All posts by dreamboy

‘বাংলাদেশে ফারসি শিক্ষায় করোনা মহামারির প্রভাব’

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বাহাউদ্দিন-

[গত ১৫-১৬ ডিসেম্বর ২০২০ ইরানের তেহরানে অনুষ্ঠিত ‘বিশ্বে ফারসি ভাষার শিক্ষা ও প্রসার : করোনা মহামারির প্রভাব’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বাহাউদ্দিন আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে যে বক্তব্য তুলে ধরেন নিউজলেটারের পাঠকবর্গের জন্য তা বাংলায় অনুবাদ করে নি¤েœ উপস্থাপিত হলো।]
বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর এদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। আজ আমাদের সেই বিজয় দিবস; এ উপলক্ষে আমি আপনাদের সকলকে আমার দেশের পক্ষ থেকে অভিনন্দন জানাই।
আপনারা জেনে খুশি হবেন, বাংলাদেশ ফারসি শিক্ষার জন্য এক উর্বর ভূমি। বাংলা ভাষা বহু ফারসি শব্দ ধারণ করে শক্তিশালী ও গতিশীল হয়েছে। অনুরূপভাবে এতদঞ্চলের কবি-সাহিত্যিকদের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্য ফারসি সাহিত্যের অনেক উপাদান গ্রহণ করে সমৃদ্ধ ও উপকৃত হয়েছে। প্রায় দশ থেকে বার হাজার ফারসি শব্দ বাংলা ভাষার সাথে ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে। একইভাবে বাঙালি কবিদের উপর ফারসি কবিদের অবিশ্বাস্য প্রভাব রয়েছে। তাই আমরা বলি, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের রয়েছে ব্যাপক অবদান। এতদ্ব্যতীত বাংলা ও ফারসির পার¯পরিক ঘনিষ্ঠ মেলবন্ধন বঙ্গীয় অঞ্চলে হাজার বছর ধরে অব্যাহত রয়েছে।
বাংলাদেশে মোটাদাগে দুই ধরনের শিক্ষা-ব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে। একটি সাধারণ শিক্ষা-ব্যবস্থা আর অন্যটি ধর্মীয় শিক্ষা-ব্যবস্থা। ফারসি ভাষা ও সাহিত্য এতদুভয় পদ্ধতির শিক্ষা-ব্যবস্থাতেই পড়ানো হয়ে থাকে। অর্থাৎ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, যেমন দ্বীনি মাদ্রাসাসমূহ এবং দ্বিতীয়ত, দেশের সরকারি শিক্ষা-ব্যবস্থায়; যেমন, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ। আমরা বলতে পারি, উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশে ফারসির রয়েছে এক অনবদ্য ঐতিহ্য; যা আমাদের জন্য খুবই গৌরবের। সেটি হলো, দেশের সর্বপ্রাচীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফারসি ভাষা ও সাহিত্য অধ্যয়ন ও চর্চা; বর্তমানে এ বিশ্ববিদ্যালয় তার শতবর্ষ উদ্যাপন করছে। ১৯২১ সালের ১ জুলাই যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার ঐতিহাসিক যাত্রা শুরু করে তখন থেকেই ফারসি বিভাগ ছিল; যাতে অনার্স ও মাস্টার্স পর্যায়ে ফারসি পড়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়। পরবর্তীকালে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তানের এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ও উর্দু বিভাগে উর্দুর প্রাধান্য চলে আসে। কিন্তু বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হলে আবারো ফারসির পুরনো ঐতিহ্য ফিরে আসতে থাকে এবং ১৯৭৯ সালে ইরানের ইসলামি বিপ্লব বিজয়ের পর থেকে ইরানের ঢাকাস্থ দূতাবাস ও কালচারাল সেন্টারের সর্বাত্মক সহযোগিতায় সর্বতোভাবে ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা, শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে এক নবজোয়ার বইতে থাকে। উল্লেখ্য যে, ১৯৩৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়; যা ফারসি ভাষার মাতৃপ্রতিম দেশ ইরানের সর্বপ্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়। সেদিক বিবেচনায় বলতে পারি, এটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ যে, উচ্চশিক্ষায় ফারসির যাত্রা ইরানের আগেই আমাদের এই বাংলায় শুরু হয়েছিল!
বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর পর্যায়ে শিক্ষা ও গবেষণার জন্য ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় তিনটি হলো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। এ বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে বিএ, এমএ, এমফিল ও পিএইচডি পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা অর্জনের ব্যবস্থা রয়েছে। দেশের তিনটি সরকারি আলিয়া মাদ্রাসা, যথাক্রমে মাদ্রাসা-ই আলিয়া, ঢাকা, সিলেট সরকারি আলিয়া মাদ্রাসা ও বগুড়া সরকারি মুস্তাফাবিয়া আলিয়া মাদ্রাসার সিলেবাসে ফারসি ভাষা ও সাহিত্য রয়েছে এবং বেসরকারি কওমি মাদ্রাসায়ও ফারসি অধ্যয়নের সুযোগ রয়েছে। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটেও ফারসি ভাষা কোর্স চালু আছে। এসব শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে হাজার হাজার শিক্ষার্থী ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে পড়াশোনায় নিয়োজিত রয়েছে। কিন্তু করোনা মহামারির কবলে পড়ে সমগ্র দেশের গোটা শিক্ষাব্যবস্থাই এক ভয়াবহ অনিশ্চয়তার মধ্যে পতিত হয়েছে।
আপনাদের সদয় অবগতির জন্য জানাই, গত ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। ১৭ মার্চ ২০২০ হতে দেশের সমস্ত শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান সরকারিভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হয়; আজ পর্যন্ত সেগুলো খোলার পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি। প্রাথমিক পর্যায়ে কিছুদিন আমরা করোনা পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছি। এসময় প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সকল ক্লাস ও পরীক্ষা কার্যক্রম বন্ধ থাকে। পরবর্তীতে মে এবং জুন মাস হতে আমরা অনলাইন ক্লাস কার্যক্রম শুরু করি আর এভাবেই করোনা মহামারিতে দেশের ফারসি পরিবারও যথারীতি তাদের শিক্ষা কার্যক্রমে নিজেদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে। দেশব্যাপী চলমান মহামারিতে ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক, শিক্ষার্থীরা তাদের অ্যাকাডেমিক জীবন সচল রাখতে আন্তরিকভাবে সচেষ্ট থাকেন। এক্ষেত্রে আমাদের ছাত্র-শিক্ষকদের সামনে অনেক সমস্যা এসে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। আমরা সেগুলোর সমাধানে সাধ্যমতো আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখি।
বাংলাদেশে ফারসি শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে গত মার্চ থেকে ডিসেম্বরের প্রথম দশক পর্যন্ত শুধু জুম ও অনলাইনে নানা মাধ্যমে ক্লাসসমূহ চালু ছিল। কিন্তু সমস্ত পরীক্ষা কার্যক্রম বন্ধ ছিল। গত এক সপ্তাহে দেশের প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্তৃপক্ষ পরিকল্পিত উপায়ে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে স্থগিত পরীক্ষাগুলো অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এক্ষেত্রেও নানা প্রতিবন্ধকতা ও চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এর মধ্যে প্রথমেই ভাববার বিষয় হলো, দেশের নানা প্রান্ত হতে শিক্ষার্থীরা
বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিতে এসে কোথায় অবস্থান করবে এবং দ্বিতীয়ত, করোনা মহামারির এই দুঃসময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলসমূহ খোলা ঠিক হবে কি-না। এসব বিষয় খুব ভেবে-চিন্তে সিদ্ধান্ত নেয়া অতি জরুরি। কেননা, আমাদের দেশে করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের হার এখনো কমছে না, বরং শীতের প্রকোপে তা আরো বেড়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে পরীক্ষা নেয়াও জরুরি, কেননা, শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা ও রেজাল্ট শেষে তাদের পেশাগত কর্মজীবনে প্রবেশ করবে। এসব অত্যাবশ্যকীয় বিষয়ে সময়োচিত সমাধানকল্পেই এখন আমরা সাবধানে কাজ করে যাচ্ছি।
একটি বিষয় আপনাদের সদয় অবগতির জন্য উল্লেখ করতে চাই যে, হঠাৎ করে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে আমাদের অনেক শিক্ষার্থীই আর্থিকভাবে সমস্যায় পড়ে যায়। আমরা শুরুতেই বিপদাপন্ন শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছি এবং তাদেরকে সাধ্যমতো আর্থিক সহায়তা প্রদান করেছি।
অতঃপর অনলাইন ক্লাসে অংশগ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করেছি। আমাদের দেশের শিক্ষা মন্ত্রণালয়, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন ও বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ অভাবী ও দরিদ্র শিক্ষার্থীদের সহায়তায় এগিয়ে এসেছে এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এতে করে শিক্ষার্থীদের পরিবারের উপর আর্থিক চাপ অনেকটাই কমে যায় এবং এরকম প্রতিকূল পরিবেশেও তারা শিক্ষা কার্যক্রমে নিজেদের সংযুক্ত রাখতে সক্ষম হয়; যদিও আমরা আমাদের শিক্ষার্থীদের চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় শিক্ষা-সামগ্রী সরবরাহ করতে পারিনি, কেননা, আমাদেরও নানা সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান ফারসি ভাষা ও সাহিত্য পরিবারের জন্য মাতৃপ্রতিম দেশ। একইভাবে জ্ঞানচর্চা, মেধার বিকাশ ও সংস্কৃতির লালনের ক্ষেত্রেও ইরান আমাদের সুযোগ্য অভিভাবক ও পৃষ্ঠপোষক। আমাদের দেশে যে কোনো কারণে ফারসি ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির শিক্ষা বিপদাপন্ন হলে ইরান আমাদের পাশে থাকবে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা। অতীতে সবসময়ই আমরা ইরানের কাছ থেকে গবেষণা ও শিক্ষা-বিষয়ক সহযোগিতা পেয়েছি, এজন্য আমরা গভীর কৃতজ্ঞ। বর্তমানে
করোনা মহামারিতে আমাদের ফারসি শিক্ষার্থীরা অনেকটাই বিপদগ্রস্ত, এক্ষেত্রেও ইরানি জাতি আমাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়াবে; এটা আমাদের বিশ্বাস। আমাদের দেশে ইরানি কালচারাল সেন্টার ও দূতাবাস রয়েছে এবং যোগ্য ও পদস্থ ব্যক্তিবর্গ সেখানে তাঁদের পেশাগত দায়িত্ব অত্যন্ত দক্ষতার সাথে পালন করে যাচ্ছেন। তাঁদের প্রতিও আমাদের দৃঢ় আস্থা রয়েছে, বিপদসঙ্কুল এ পরিস্থিতিতে মহান ইরানি জাতির পক্ষ থেকে তাঁরা বরাবরের মতোই আমাদের প্রিয় শিক্ষার্থীদের পাশে
থাকবেন।
সমগ্র বিশ্ব করোনা ভাইরাস থেকে মুক্ত হোক। বিশ্বমানবতা পরিত্রাণ লাভ করুক। মর্যাদাপূর্ণ এ আন্তর্জাতিক সেমিনারে আমাকে দাওয়াত দেয়ায় সম্মানিত আয়োজকদের প্রতি জানাই অজস্র ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা। বাংলাদেশ ও ইরানের বন্ধুত্ব ও স¤পর্ক দীর্ঘস্থায়ী হোক। সবাইকে ধন্যবাদ। খোদা হাফেজ!

সুবর্ণজয়ন্তীর দ্বারপ্রান্তে আমরা : এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ

সিরাজুল ইসলাম –

আর ক’দিন পরেই বাংলাদেশ তার স্বাধীনতার ৫০ বছরে পা রাখবে। আমরা এমন একটি ধাপে পৌঁছাব যার নাম ‘সুবর্ণজয়ন্তী’। বড় কাক্সিক্ষত সময় বটে। স্বাধীনতার ৫০তম বার্ষিকী! এ এক ইতিহাস, একটি মাইল ফলক। সুবর্ণজয়ন্তীতে জেগে উঠবে পুরো দেশ। উদ্যাপিত হবে নানা কর্মসূচি। বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন বছরব্যাপী নানা আয়োজনে উদ্যাপন করবে আমাদের এ সুবর্ণজয়ন্তী।
৫০ বছর মানে বেশ একটা লম্বা সময়। আমরা যখন সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপন করব তার মানে হবে বাংলাদেশ পেছনে ফেলে এসেছে ৫০টি বছর। অর্থাৎ তখন আমরা স্বাধীনতার ৫০ বছরে। স্বাধীনতার এই ৫০ বছরে পদার্পণ করার মধ্য দিয়ে আমরা একটি বিশেষ মাইল ফলক পার করব। স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশ আরো পরিপক্ব হয়ে উঠবে। আমরা জাতি হিসেবে নিজেদেরকে আরো গুছিয়ে নেব। আমাদের হিসাবের খাতায় কত যোগ-বিয়োগ হবে। কত কাটাকাটি হবে।
স্বাধীন বাংলাদেশের হাত ধরে আমরা এই যে দীর্ঘ সময় পার করে এলাম, এ সময়ে আমরা কী পেয়েছি আর কী পাই নি, সঙ্গত কারণেই সে হিসাবও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। আমাকে যদি কেউ প্রশ্ন করেন স্বাধীনতার সবচেয়ে বড় অর্জন কী? নির্দ্বিধায়, নিঃশঙ্কচিত্তে আমি বলব স্বাধীনতা প্রাপ্তিই আমার সবচেয়ে বড় অর্জন। এই অর্জনের মধ্য দিয়ে আজ আমি ও আমরা স্বাধীন অস্তিত্ব নিয়ে বেড়ে উঠেছি, আমরা স্বাধীন ভূখ- পেয়েছি, পেয়েছি লাল-সুবজের প্রিয় পতাকা। এর চেয়ে আর কী চাই? তবু প্রাপ্তির হিসাব আসবেই। বেশ, তবে আসুন স্বাধীনতার প্রাপ্তির খাতগুলোতে নজর বুলাই।
যে পাকিস্তানের বৈষ্যমের অসহায় শিকার হয়ে আমরা স্বাধীনতার পথ বেছে নিয়েছিলাম সেই পাকিস্তান এখন প্রায় সমস্ত উন্নয়ন সূচকে আমাদের পেছনে। বাংলাদেশের গড় আয়ু (৭৩.৪) ছাড়াও অন্যান্য সামাজিক খাতে দক্ষিণ এশিয়ার এ দেশটির অর্জন রীতিমত ঈর্ষণীয়। শুধু কী তাই? দেখুন না আমাদের বিজ্ঞানী মেয়ে তনিমা তাসনিম অনন্যা এখন বিশ্বের সেরা ১০ বিজ্ঞানীর একজন। এটা কী কম পাওয়া? স্বাধীনতা না এলে এই অর্জনে কী আমরা এতটা বুক ফুলিয়ে বলতে পারতামÑ তনিমা আমাদের গর্বের ধন? তনিমার কথা যখন চলেই এলো তাহলে একটু সামান্য বিস্তারিত জানা যাক তার সম্পর্কে।
কৃষ্ণগহ্বর নিয়ে গবেষণা করছেন তিনি। কৃষ্ণগহ্বরগুলো কীভাবে বেড়ে ওঠে এবং পরিবেশে কী প্রভাব রাখে তার পূর্ণাঙ্গ চিত্র এঁকে দেখিয়েছেন তিনি। ইতোমধ্যে এ কাজের জন্য বিশ্বের সেরা ১০ বিজ্ঞানীর তালিকায় তাঁর নাম উঠেছে। তিনি একজন বাংলাদেশি তরুণী। নাম তনিমা তাসনিম অনন্যা।
২৯ বছর বয়সী এই তরুণী আমেরিকার ডার্টমাউথ কলেজের সঙ্গে যুক্ত। ওয়াশিংটনভিত্তিক সায়েন্স নিউজ নামের একটি গণমাধ্যম সম্প্রতি তনিমা তাসনিমের এ সফলতার কথা জানায়। গত ৩০ সেপ্টেম্বর ‘এসএন টেন : সায়েন্টিস্ট টু ওয়াচ’ নামের একটি তালিকা প্রকাশ করে গণমাধ্যমটি। যেখানে তাসনিমের কাজকে ‘অসাধারণ গবেষণা’ বলে উল্লেখ করা হয়।
এ তো গেল একজন তনিমার কথা। এবার জানা যাক আমাদের উন্নয়ন পরিকল্পনার কথা। দেশের সামগ্রিক উন্নতির জন্য আমাদের সামনে রয়েছে এলএনজি টার্মিনাল, স্পেশাল ইকোনমিক জোন, মাতারবাড়ি এনার্জি হাব, গভীর সমুদ্রবন্দরের মতো মেগা প্রকল্পের পাশাপাশি ঢাকা-চট্টগ্রাম ইকোনমিক করিডোরের জন্য হাইস্পিড রেল, ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের জন্য চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইন, উপকূলীয় মহাসড়ক নির্মাণ, আইসিটি সেক্টরে উচ্চতর পড়াশোনার সুযোগ সৃষ্টির পরিকল্পনা। কক্সবাজার-চট্টগ্রাম-পার্বত্য চট্টগ্রামে পর্যটন হাব গড়ে তোলার মাধ্যমে অন্যরকম এক বাংলাদেশ উপহার দিতেও কাজ করছে সরকার। এরই মধ্যে অনেক স্বপ্নের পদ্মাসেতু দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। ঢাকার বুকে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে মেট্রোরেল।
উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ : স্বল্পোন্নত বা এলডিসি থেকে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশের কাতারে। জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন নীতি সংক্রান্ত কমিটি (সিডিপি) এলডিসি থেকে বাংলাদেশের উত্তরণের যোগ্যতা অর্জনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছে। এলডিসি ক্যাটাগরি থেকে উত্তরণের জন্য মাথাপিছু আয়, মানব সম্পদ সূচক এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচক এ তিনটি সূচকের যে কোন দুটি অর্জনের শর্ত থাকলেও বাংলাদেশ তিনটি সূচকের মানদ-েই উন্নীত হয়েছে।
জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিলের (ইকোসক) মানদ- অনুযায়ী এক্ষেত্রে একটি দেশের মাথাপিছু আয় হতে হবে কমপক্ষে ১২৩০ মার্কিন ডলার, বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় এখন ২০৬৪ মার্কিন ডলার। অর্থাৎ প্রয়োজনের চেয়ে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় অনেক বেশি। মানবসম্পদ সূচকে ৬৬ প্রয়োজন হলেও বাংলাদেশ অর্জন করেছে ৭২ দমমিক ৯। অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচক হতে হবে ৩২ ভাগ বা এর কম যেখানে বাংলাদেশের রয়েছে ২৪ দশমিক ৮ ভাগ।
‘যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ থেকে আজকের এই উত্তরণÑ যেখানে রয়েছে এক বন্ধুর পথ পাড়ি দেয়ার ইতিহাস’। সরকারের রূপকল্প ২০২১ বাস্তবায়নের এটি একটি বড় অর্জন।
বাংলাদেশ ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় যোগ হয়েছে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণের সফলতাও। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্ব, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, এমডিজি অর্জন, এসডিজি বাস্তবায়নসহ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, লিঙ্গ সমতা, কৃষি, দারিদ্র্যসীমা হ্রাস, গড় আয়ু বৃদ্ধি, রপ্তানিমুখী শিল্পায়ন, ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, পোশাক শিল্প, ওষুধ শিল্প, রপ্তানি আয় বৃদ্ধিসহ নানা অর্থনৈতিক সূচক। পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দর, ঢাকা মেট্রোরেলসহ দেশের মেগা প্রকল্পগুলো।
দারিদ্র দূরীকরণ : ক্ষুদ্র আয়তনের একটি উন্নয়নশীল দেশ হয়েও বাংলাদেশ ইতোমধ্যে সারা বিশ্বের কাছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের নিবিড় সমন্বিত ব্যবস্থাপনা, ক্ষুদ্র ঋণের ব্যবহার এবং দারিদ্র দূরীকরণে তার ভূমিকা, বৃক্ষরোপণ, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সূচকের ইতিবাচক পরিবর্তন প্রভৃতি ক্ষেত্রে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে জন্ম নেয়া এই বাংলাদেশকে আজকের অবস্থানে আসতে অতিক্রম করতে হয়েছে হাজারো প্রতিবন্ধকতা। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ৮টি লক্ষ্যের মধ্যে শিক্ষা, শিশুমৃত্যুহার কমানো এবং দারিদ্র হ্রাসকরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য উন্নতি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। নোবেল বিজয়ী ভারতীয় অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের করা মন্তব্য এক্ষেত্রে উল্লেখ করা যায়। তাঁর মতে কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিশ্বকে চমকে দেয়ার মতো সাফল্য আছে বাংলাদেশের। বিশেষত শিক্ষা সুবিধা, নারীর ক্ষমতায়ন, মাতৃ ও শিশু মৃত্যুহার ও জন্মহার কমানো, গরিব মানুষের জন্য শৌচাগার ও স্বাস্থ্য সুবিধা প্রদান এবং শিশুদের টিকাদান কার্যক্রম অন্যতম।
শিক্ষাখাতে অর্জন : শিক্ষাকে সর্বস্তরে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপগুলোর অন্যতম হলো শতভাগ ছাত্রছাত্রীর মাঝে বিনামূল্যে বই বিতরণ কার্যক্রম। নারী শিক্ষাকে এগিয়ে নেয়ার জন্য প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত চালু করা হয়েছে উপবৃত্তি ব্যবস্থা। বর্তমান ২৬ হাজার ১৯৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে নতুন করে জাতীয়করণ করেছে। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষকের চাকরি সরকারিকরণ করা হয়েছে। ১৯৯০ সালে বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া শিশুর শতকরা হার ছিল ৬১, বর্তমানে তা উন্নীত হয়েছে শতকরা ৯৭.৭ ভাগে। শিক্ষার সুবিধাবঞ্চিত গরিব ও মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট আইন প্রণয়ন করা হয়েছে; গঠন করা হয়েছে ‘শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট’।
স্বাস্থ্যসেবায় সাফল্য : শিশুদের টিকাদান কর্মসূচির সাফল্যের জন্য এক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বে অন্যতম আদর্শ দেশ হিসেবে তার স্থান করে নিয়েছে। স্বাস্থ্যখাতকে যুগোপযোগী করতে প্রণয়ন করা হয়েছে ‘জাতীয় স্বাস্থ্য নীতিমালা-২০১১’। তৃণমূল পর্যায়ের দরিদ্র মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে গড়ে তোলা হয়েছে ১২ হাজার ৭৭৯টি কমিউনিটি ক্লিনিক। ৩১২টি উপজেলা হাসপাতালকে উন্নীত করা হয়েছে ৫০ শয্যায়। মেডিক্যাল কলেজ ও জেলা হাসপাতালগুলোতে ২ হাজার শয্যা সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়েছে। মাতৃ ও শিশু মৃত্যুহার এবং জন্মহার হ্রাস করা সম্ভব হয়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। ১৯৯০ সালে নবজাতক মৃত্যুর হার ১৪৯ থেকে নেমে বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ৫৩-তে। স্বাস্থ্যসেবাকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যকে সামনে রেখে নির্মাণ করা হয়েছে নতুন ১২টি মেডিক্যাল কলেজ, নিয়োগ দেয়া হয়েছে ৪৭ হাজারেও বেশি জনশক্তি।
নারী ও শিশু উন্নয়ন : নারীর সার্বিক উন্নয়নের জন্য প্রণয়ন করা হয়েছে ‘জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা-২০১১’। নারী শিক্ষাকে উৎসাহিত করতে প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত চালু করা হয়েছে উপবৃত্তি কার্যক্রম। সমাজের প্রতিটি স্তরে নারী অংশগ্রহণকে নিশ্চিত করতে নেয়া হয়েছে নানামুখী পদক্ষেপ। প্রযুক্তি জগতে নারীদের প্রবেশকে সহজ করতে ইউনিয়ন ডিজিটাল কেন্দ্রের মতো ইউনিয়নভিত্তিক তথ্যসেবায় উদ্যোক্তা হিসেবে একজন পুরুষের পাশাপাশি নিয়োগ দেয়া হয়েছে একজন নারী উদ্যোক্তাকেও। ‘জাতীয় শিশু নীতি-২০১১’ প্রণয়নের মাধ্যমে সুরক্ষিত করা হয়েছে শিশুদের সার্বিক অধিকারকে। দেশের ৪০টি জেলার সদর হাসপাতাল এবং ২০টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে স্থাপন করা হয়েছে ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেল। দুঃস্থ্, এতিম, অসহায় পথ-শিশুদের সার্বিক বিকাশের জন্য স্থাপন করা হয়েছে ১৫টি শিশু বিকাশ কেন্দ্র। তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে দেশের নারী ও শিশুর উন্নয়নে ভূমিকা রাখার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভূষিত করা হয়েছে জাতিসংঘের ‘সাউথ-সাউথ অ্যাওয়ার্ডে’।
নারীর ক্ষমতায়ন : নারী বঞ্চনার তিক্ত অতীত পেরিয়েছে বাংলাদেশ। নারীর ক্ষমতায়নে দেশ এখন অনেক দূর এগিয়েছে। পোশাকশিল্পে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ দেশ। আর এই শিল্পের সিংহভাগ কর্মী হচ্ছে নারী। ক্ষুদ্রঋণ বাংলাদেশে গ্রামীণ উন্নয়নে ও নারীর ক্ষমতায়নে অভূতপূর্ব অবদান রেখেছে। আর ক্ষুদ্রঋণ গ্রহীতাদের মধ্যে ৮০% এর ওপর নারী। শুধু কী তাই? এনজিওগুলো যে ঋণ বিতরণ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে তার অগ্রভাগে রয়েছেন নারী কর্মী; ঋণ বিতরণকারীদের বড় অংশই নারী। মোট কথা বাংলাদেশ সরকার নানাভাবে নারী উদ্যোক্তাদের অনুপ্রেরণা দিয়ে এসেছে।
ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠন : ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্নকে বাস্তবতায় রূপ দিতে বাংলাদেশ সরকার নিয়েছে গুরুত্বপূর্ণ সব পদক্ষেপ। দেশের তৃণমূল পর্যায়ে প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে সরকারি সেবা পৌঁছে দেয়ার অভিপ্রায়ে দেশের ৪,৫৫০টি ইউনিয়ন পরিষদে স্থাপন করা হয়েছে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার। তৈরি করা হয়েছে বিশ্বের অন্যতম বিশাল ন্যাশনাল ওয়েব পোর্টাল। কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত এ পোর্টালের সংখ্যা প্রায় ২৫,০০০। দেশের সবক’টি উপজেলাকে আনা হয়েছে ইন্টারনেটের আওতায়। টেলিযোগাযোগের ক্ষেত্রে নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে বর্তমানে বাংলাদেশে মোবাইল গ্রাহকের সংখ্যা ১২ কোটি ৩৭ লাখ এবং ইন্টারনেট গ্রাহকের সংখ্যা ৪ কোটি ৪৬ লাখে উন্নীত হয়েছে। সেবাপ্রদান প্রক্রিয়া সহজ ও স্বচ্ছ করতে চালু করা হয়েছে ই-পেমেন্ট ও মোবাইল ব্যাংকিং। সরকারি ক্রয় প্রক্রিয়া অনলাইনে সম্পাদন করার বিষয়টিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া হয়েছে। ৪-জি প্রযুক্তির মোবাইল নেটওয়ার্কের বাণিজ্যিক কার্যক্রম চলছে; দেশ এখন ৫-জি’র নেটওয়ার্ক গ্রহণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। যদিও ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের সব প্রক্রিয়া এখনো শেষ হয় নি তবে দেশ সে পথে এগিয়ে যাচ্ছে বেশ ভালোভাবেই।
খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা : কৃষিখাতে অভূতপূর্ব কিছু সাফল্যের জন্য বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশ বারবার আলোচিত হয়েছে। প্রায় ১৮ কোটি জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশ বর্তমানে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশে ধানের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৫০ লাখ মেট্রিক টন। প্রধানমন্ত্রী ও কৃষিমন্ত্রীর সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশের বিজ্ঞানী ড. মাকসুদুল আলম আবিষ্কার করেছেন পাটের জিনোম সিকুয়েন্সিং। সারা বিশ্বে আজ পর্যন্ত মাত্র ১৭টি উদ্ভিদের জিনোম সিকুয়েন্সিং হয়েছে, তার মধ্যে ড. মাকসুদ করেছেন ৩টা। তাঁর এই অনন্য অর্জন বাংলাদেশের মানুষকে করেছে গর্বিত।
জনশক্তি রপ্তানি খাতে উন্নয়নে অর্জন : বর্তমানে বিশ্বের ১৫৭টি দেশে বাংলাদেশের ৮৬ লাখেরও অধিক শ্রমিক কর্মরত আছে। বিদেশে শ্রমিক প্রেরণ প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ স্থাপন করেছে অনন্য দৃষ্টান্ত। স্বল্প সুদে অভিবাসন ঋণ প্রদানের লক্ষ্যে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক স্থাপন করে দেশের ৭টি বিভাগীয় শহরে এর শাখা স্থাপন করা হয়েছে। এই ব্যাংকের মাধ্যমে এপ্রিল ২০১৪ পর্যন্ত ২০ কোটি ৫০ লক্ষ টাকা অভিবাসন ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে সারাদেশে তৃণমূল পর্যায় থেকে বিদেশ গমনেচ্ছু জনগণকে রেজিস্ট্রেশন করা হয়েছে। ফলে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনগণকেও এ সেবা গ্রহণের আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের হয়রানি উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে।
জাতিসংঘ শান্তি মিশনে বাংলাদেশ : ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশ জাতিসংঘ শান্তি মিশনে যোগদানের পর থেকে এ পর্যন্ত বিশ্বের ৩৯টি দেশের ৬৪টি শান্তি মিশনে খ্যাতি ও সফলতার সাথে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। এ যাবৎকালে জাতিসংঘ শান্তি মিশনে বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণকারী ১১৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সর্বাগ্রে। এ অর্জন বাংলাদেশকে বিরাটভাবে সম্মানিত করেছে।
বিদ্যুৎখাতে সাফল্য : বিদ্যুৎখাতে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অর্জনের মধ্যে রয়েছে জাতীয় গ্রিডে অতিরিক্ত ৬ হাজার ৩২৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সংযোজন যার ফলে বিদ্যুতের সুবিধাভোগীর সংখ্যা ৪৭ শতাংশ থেকে ৬২ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। একই সাথে মাথাপিছু বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ২২০ কিলোওয়াট ঘণ্টা থেকে বেড়ে ৩৪৮ কিলোওয়াট ঘণ্টায় দাঁড়িয়েছে। নতুন বিদ্যুৎ সংযোগ প্রদান করা হয়েছে ৩৫ লাখ গ্রাহককে। নির্মাণ করা হয়েছে নতুন ৬৫টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র। বিশাল জনগোষ্ঠীর বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণে যদিও এখনো পুরোপুরি সম্ভব হয় নি তবে দেশ এ খাতে অনেক এগিয়েছে। সাফল্যের এই ধারা অব্যাহত থাকলে শিগগিরিই দেশ বিদ্যুতের অভাবমুক্ত হবে।
শিল্প ও বাণিজ্য খাতে অর্জন : বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের পাশাপাশি প্রসার ঘটেছে আবাসন, জাহাজ, ওষুধ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ খাদ্য শিল্পের। বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের তালিকায় যোগ হয়েছে জাহাজ, ওষুধ এবং বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাত খাদ্যসামগ্রী। বাংলাদেশের আইটি শিল্প বহির্বিশ্বে বেশ সুনাম কুড়িয়েছে। বাংলাদেশের আইটি শিল্প এখন বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছে।
সামাজিক নিরাপত্তা খাতে অর্জন : হতদরিদ্রদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনি তৈরি করা হয়েছে। এজন্য বয়স্ক, বিধবা, স্বামী পরিত্যক্ত ও দুঃস্থ মহিলা ভাতা, অস্বচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতা, মাতৃকালীন ভাতার ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং সময়ের ব্যবধানে এসব ভাতার হার ও আওতা ব্যাপকভাবে বাড়ানো হয়েছে। ২০০৮-২০০৯ সালে এই খাতে মোট বরাদ্দ ছিল ১৩ হাজার ৮৪৫ কোটি টাকা। ২০২০-২০২১ অর্থবছরের বাজেটে এ খাতে ৯৫ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। এটি বাজেটের ১৬ দশমিক ৮৩ শতাংশ। আগের অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৮১ হাজার ৮৬৫ কোটি টাকা। খানা আয়-ব্যয় জরিপের সমীক্ষায় দেখা যায় মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩০ ভাগের কাছাকাছি সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনির আওতাভুক্ত হয়েছে।
ভূমি ব্যবস্থাপনায় অর্জন : ভূমি ব্যবস্থাপনাকে আধুনিকায়ন করতে ৫৫টি জেলায় বিদ্যমান মৌজা ম্যাপ ও খতিয়ান কম্পিউটারাইজেশনের কাজ সম্পন্ন করার কাজ হাতে নেয়া হয়েছে। ভূমির পরিকল্পিত ও সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করতে মোট ২১টি জেলার ১৫২টি উপজেলায় ডিজিটাল ল্যান্ড জোনিং ম্যাপ সম্বলিত প্রতিবেদন প্রণয়ন করা হয়েছে। প্রণীত হয়েছে ‘কৃষি জমি সুরক্ষা ও ভূমি ব্যবহার আইন, ২০১২ এর খসড়া’। এখন ইচ্ছা করলেই আর ভূমির যথেচ্ছ ব্যবহার করতে পারবে না।
মন্দা মোকাবেলায় সাফল্য : মন্দার প্রকোপে বৈশ্বিক অর্থনীতি যখন বিপর্যস্ত ছিল বাংলাদেশ তখন বিভিন্ন উপয্ক্তু প্রণোদনা প্যাকেজ ও নীতি সহায়তার মাধ্যমে মন্দা মোকাবেলায় শুধু সক্ষমই হয় নি; বরং জাতীয় প্রবৃদ্ধির হার গড়ে ৬ শতাংশের বেশি বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। বিশ্ব অর্থনীতির শ্লথ ধারার বিপরীতে আমদানি-রপ্তানি খাতে প্রবৃদ্ধি বাড়ার পাশাপাশি বেড়েছে রেমিট্যান্সের পরিমাণ। ঋণ পরিশোধে সক্ষমতার মানদ-ে ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতনামের সমকক্ষতা অর্জিত হয়েছে। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের মহামারিতে বিশ্ব যখন দারুনভাবে বিপর্যন্ত তখনো আমাদের গার্মেন্টস খাত লাভজনক অবস্থানে রয়েছে। করোনা মহামারির মধ্যেও বাংলাদেশে খাদ্য উৎপাদনের ধারা অব্যাহত রয়েছে। এ বছরই বাংলাদেশ বিশ্বে মৎস্য উৎপাদনে দ্বিতীয় অবস্থানে উন্নীত হয়েছে।
শেষ কথা : স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাদেশ ধীরে ধীরে যেসব সাফল্য অর্জন করেছে তার পেছনে সরকারের যেমন অবদান রয়েছে তেমনি অবদান আছে সাধারণ মানুষেরও। দেশের উন্নতির বিরাট অংশেই রয়েছে বেসরকারি ও ব্যক্তিগত উদ্যোগ। সেক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগ যদি আরো বেশি কার্যকর করা যায় তবে দেশের উন্নয়ন কাক্সিক্ষত মাত্রা স্পর্শ করবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। নানা ক্ষেত্রে দুর্নীতি, অনিয়ম ও সম্পদের অপব্যবহার রোধ করা গেলে উন্নয়নের গতি যেমন বাড়বে তেমনি টেকসই উন্নয়নও নিশ্চিত হবে। সুশাসন ও গণতন্ত্রায়নে যেসব সংকট আছে সেগুলো দূর করারও উদ্যোগ অনেক বেশি জরুরি। এতে দেশ ও দেশের মানুষ লাভবান হবে; তাতে সরকারের নেয়া নানা প্রকল্প ও রূপকল্প বাস্তবায়নের পথ সুগম হবে আর আমরা বিশ্ব দরবারে আরো শক্তভাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারব।

আরবাইন : ইমাম হোসাইন (আ.)-এর শাহাদাতের স্মরণ

রাশিদ রিয়াজ – 
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রতিবছর মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর দৌহিত্র ইমাম হোসাইন (আ.)-এর শাহাদাত থেকে চল্লিশ দিন পর তাঁর কারবালার মাজারে ভক্ত অনুসারীরা ছুটে যান। কিন্তু কেন? ছকে বাঁধা জীবনের মোহ থেকে মুক্তি পেতে সত্যের পথে ধাবিত হয়ে চিরন্তন অনুসারী হিসেবেই তাঁরা সেখানে যান। মিশে যান সমাবেশে। এ দিবসটি পালনই হলো আরবাইন। ‘আরবাইন’ আরবি শব্দ ও এর মানে হচ্ছে চল্লিশ। ফারসি শব্দ ‘চেহলুম’ বা উর্দু ‘চেহলাম’ শব্দের অর্থও চল্লিশ যা বাংলায় চল্লিশা হিসেবে সুপরিচিত। এ দিন কারবালায় ইমাম হোসাইনের মাজারটি ইসলামের অনুসারীদের অংশগ্রহণে এক সংগ্রামী কাফেলায় পরিণত হয়। তাঁরা আসেন বিশে^র বিভিন্ন দেশ থেকে। সত্য প্রতিষ্ঠায় আরো বেগবান হওয়ার শপথ নিয়ে তাঁরা ছড়িয়ে পড়েন নিজেদের গন্তব্যে। প্রখর খরতাপ, কখনো বালু ঝড়, অজানা শঙ্কা কোনো কিছুই তাঁদের পথ আটকে রাখতে পারে না। পায়ে হেঁটে তাঁরা অবিরাম গন্তব্যে ছোটেন। পিপাসা, ক্ষুধা, পায়ে ফোস্কা পড়ে গেলেও তাঁরা ক্ষণিক বিশ্রাম নেন তারপর ফের রওয়ানা দেন। ৬৮০ খ্রিস্টাব্দের ১০ অক্টোবর কারবালার প্রান্তরে সেই বিয়োগান্তক ঘটনার পর মানুষ হক ও বাতিলের পার্থক্য ধরে রেখে হকের পক্ষেই অবস্থান বুঝাতে এই কাফেলায় যোগ দেন। বরং তাঁদের মনে থাকে এ গর্ব যে, তাঁরা হকের পথ অনুসরণ করেই যাঁর যাঁর দেশ থেকে এসে মানব¯স্রোতে মিশে গেছেন। ইরান, লেবানন, আজারবাইজান, পাকিস্তান, ভারত, তুরস্ক, সিরিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও ইউরোপের কোনো কোনো দেশ থেকে তাঁরা আসেন এবং অনিবার্য এক আদর্শিক শপথে বলীয়ান হয়ে ওঠেন। ইরাকের নাজাফ থেকে কারবালা ৫০ মাইলের এ পথযাত্রা নির্ধারিত হয়ে থাকে ১৪শ’ পোলের মাধ্যমে। এধরনের পোলকে গন্তব্য ধরে শত সহস্র মানুষ আগাতে থাকেন এক মিলন মেলায়। প্রায় দুই দিন ও দুই রাত্রির যাত্রা পথে থেমে থেমে ইবাদতে মশগুল হয়ে পড়েন, ফের যাত্রা শুরু করেন ধীর স্থির এক লক্ষ্যপানে। 
আরবাইনের এক সপ্তাহ আগে থেকেই মূলত এসব নারী ও পুরুষ বা তাঁদের সঙ্গে শিশুরা, এমনকি বয়স্করা পথ চলতে শুরু করেন প্রস্তুতি পর্বের অংশ হিসেবে। ইমামের অতুলনীয় বীরত্ব, সাহসিকতা ও আপোসহীনতাই তাঁদের কাছে পার্থিব প্রস্তুতির অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে, যা তাঁদের প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে ধাবিত করে আরবাইনে। অসাধারণ সংকল্প নিয়ে তাঁরা দিন রাত অবিরাম এক শহর থেকে অন্য শহরে নির্বিঘেœ ও নিরবচ্ছিন্ন পথে হাঁটেন, সংকল্পগুলো ধরে রাখেন। এদেরই একজন পাকিস্তানের গিলগিট থেকে আসা রাগিব হুসেইন বলেন আরবাইনে তাঁর জীবন পাল্টে যাওয়া অভিজ্ঞতার কথা। তুরস্কের ‘আনাদোলু এজেন্সি’কে বলেন, ‘ভিন্ন জাতি, সংস্কৃতি, ভাষাভাষির মানুষ এক মোহনায় এসে মিলিত হচ্ছে এবং কি এক ঐক্য আমাদের একীভূত করছে যা সব ধরনের শয়তানি কার্যক্রম থেকে মানবতাকে রক্ষা ছাড়া আর কিছুই নয়। এদৃশ্য আমি কখনোই ভুলব না। এ এক আবেগময় অভিজ্ঞতা।’ আজারবাইজান থেকে এসেছিলেন আন্না ফাতেমেহ। তিনি বলেন, ‘ধর্মীয় সমাবেশের চেয়ে আরবাইন অতিরিক্ত কিছু। গত তিন বছর ধরে আমি আরবাইনে যোগ দিচ্ছি। প্রতিবারই নিজেকে চেতনাগত দিক থেকে সমৃদ্ধ করছি এবং তা বিস্ময়কর। এই পদযাত্রা প্রত্যেককে সত্য, ন্যায় বিচার ও স্বাধীনতা চিনে নিতে সাহায্য করে। মানবতার জন্যই আমরা এতে যোগ দেই।’
অনেক অমুসলিম আরবাইনে যোগ দেন। ২০১৯ সালে ব্রিটেনের এক বিশ^বিদ্যালয় ছাত্র ৩০ বছরের জেমস বলেন, ‘দুই বছর ধরে পরিকল্পনার পর আমি আরবাইনে যোগ দিয়েছি।’ একই বছর যুক্তরাষ্ট্রের হিউস্টন থেকে আলী মেহেদি আরবাইনে এসে বলেন, ‘কারবালা সত্য সম্পর্কে বলতে শিক্ষা দেয় এবং যারা নির্বাক তাদের কণ্ঠস্বর তুলে ধরতে ও সোচ্চার হতে সাহায্য করে। দুর্বল, শক্তিহীন ও নিপীড়িতদের সমর্থনে এই পদযাত্রা এক চিৎকার।’ জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর হুমকি সত্ত্বেও আরবাইনে যোগ দেয়া মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। ‘আনাদোলু’কে ইরানের ইসলামি চিন্তাবিদ শেখ জারিয়ে খোরমিজি আরবাইনের পদযাত্রায় হাঁটতে হাঁটতে বলেন, ‘কারবালার উত্তরাধিকার হলো সত্য বনাম মিথ্যা, সঠিক বনাম পেশীশক্তি, ন্যায়বিচার বনাম নিপীড়ন ও গৌরব বনাম ঘৃণার।’
নাজাফ থেকে আরবাইনের পথচলা শুরু হওয়ার সপ্তাহ খানেক আগে রাস্তায় নেমে আসেন বিভিন্ন দেশ থেকে আগত মানুষ। স্থানীয়রা তাঁদের প্রয়োজনে স্টল খোলেন, পানীয়, মিস্টি ও খাবার নিয়ে অতিথিদের আমন্ত্রণ জানান। নাজাফ থেকে কারবালা পর্যন্ত পথের মোড়ে মোড়ে স্থানীয় বাসিন্দারা একইভাবে স্বাগত জানান, মসজিদগুলোতে তৃষ্ণার্ত ও ক্ষুধার্ত পথযাত্রীদের খোঁজ নেন। প্রচুর পরিমাণে অতিথিদের জন্য খাবার তৈরি করেন তাঁরা। ভেড়ার মাংস, গ্রিল করা মাছ, সবজি, রুটি, ভাত আরবাইনে অংশ নেয়াদের খাওয়াতে পেরে স্থানীয়রা পরম তৃপ্তি লাভ করেন। তাঁরা তাঁবু গেড়ে অপেক্ষায় থাকেন মানুষের, কালো ইরাকি চা, উলের কম্বল নিয়ে আগ্রহ নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকেন। কারো প্রয়োজন মেটাতে পারলে তাঁরা যারপর নাই খুশি হন। মোবাইল বাথরুম, টয়লেটের ব্যবস্থা থাকে যাতে দ্রুত গোসল সেরে নেয়া যায়। থাকে অ্যাম্বুলেন্স জরুরি চিকিৎসার জন্য। মরুভূমির এই পদযাত্রায় দিনে প্রখর খরতাপ আর রাতে কঠিন ঠাণ্ডা। লেবানন থেকে আসা হুসেইন আল-হাদি বলেন, অপরিচিত মেহমানদের সেবা করে তাঁরা মেহমানদারির এক নতুন সংজ্ঞা তৈরি করেন। আতিথেয়তার ধারণা পাল্টে যায়। অতিথিদের জন্য প্রয়োজন মেটাতে পেরে নিজে সম্মানিত হন। পথের বাঁকে দেখা যায় কোনো দম্পতি খেঁজুর নিয়ে অপেক্ষা করছেন যদি অতিথিকে আপ্যায়ন করার সুযোগ মেলে। এমনি এক দম্পতি জানান, ‘প্রতিটি মাসে অল্প অল্প করে সাধ্যমত কিছু সঞ্চয় করেছি যাতে তা আরবাইনে আগতদের জন্য খরচ করতে পারি। অতিথিরা যেন কোনো অভিযোগ করার সুযোগ না পান।’ যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ হলেও, তাঁদের আয়ের উৎস স্বাভাবিক হয়ে না এলেও তাঁরা এমন আতিথেয়তা থেকে বিরত থাকতে পারেন না। অন্তত দশটি দিন ইরাকি নাগরিকরা আরবাইনে আগতদের জন্য সেবা দিতে তাঁদের হৃদয়ের দরজা খুলে দেন। 
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আরবাইনে মানুষের যোগ দেয়ার বিষয়টি উল্লেখযোগ্য হয়ে উঠলেও আন্তর্জাতিক মূলধারার মিডিয়ার কাছে তা উপযুক্ত মনোযোগ পাচ্ছে না। কিন্তু কেন? এবং এটি বিশ্লেষণের দাবি রাখে। এক সময় ইরাকে আহলে বাইতের অনুসারীরা খালি পায়ে আরবাইনে যোগ দিতেন। ইতিহাসের কোনো এক সন্ধিক্ষণে তা বাদ যায়। ১শ’ বছর আগে তা ফের চালু হয়। কিন্তু ইরাকে সাদ্দাম হোসেনের শাসনামলে (১৯৭৯-২০০৩) আরবাইন নিষিদ্ধ ছিল। যাঁরা লুকিয়ে আরবাইনে অংশ নিতেন তাঁদেরকে হিংস্র প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হতে হয়েছে। সাদ্দাম সরকারের আমলে কারবালা অভিমুখে এধরনের পদযাত্রায় সামিল হওয়া কারো কারো পা কেটে নেয়ার মতো নিষ্ঠুর ঘটনা ঘটেছে। এরপর রাতের অন্ধকারে কিংবা বিকল্প পথে খেঁজুর বাগানের মধ্য দিয়ে সন্তপর্ণে আরবাইনে যোগ দিতেন অনেকে। সাদ্দামের পতনের পর ফের লোকজন দেশটির বিভিন্ন অঞ্চল থেকে খালি পায়ে কারবালা অভিমুখে আরবাইনে যোগ দিতে শুরু করেন। আরবাইনের দিনে বা এ ধর্মীয় যাত্রার শেষ দিনে তাঁরা কারবালায় পৌঁছে যান। আরবাইনের সময় এলেই ইরাকের সকল রাস্তার গন্তব্য যেন আরবাইনমুখী হয়ে পড়ে। এখন বছরে ২০ মিলিয়ন মানুষ আরবাইনে যোগ দিচ্ছেন। গত তিরিশ বছর ধরে ইরাকের জনগণ অবরোধ, স্বৈরাচারী সারকার, যুদ্ধ, বিদেশি দখলদারিত্ব ও আইএস জঙ্গি গোষ্ঠীর সন্ত্রাস মোকাবেলা করে আসছে। ইরাকের দক্ষিণ অঞ্চলে সিংহভাগ শিয়ারা বাস করেন। ওই অঞ্চলের আল-ফাও এলাকা থেকে ৬৬৭ কিলোমিটার হেঁটে শিয়ারা আরবাইনে যোগ দিতেন। ২৪ মুহররম থেকে তাঁরা যাত্রা শুরু করতেন এবং ২৬ দিন তাঁরা একটানা হেঁটে আরবাইনের আগেই কারবালায় পৌঁছতেন। বিভিন্ন শহরের মানুষ তখন হিল্লাহ শহর দিয়েই আরবাইনে যোগ দিতেন। তবে ইরাকের বাইরে অন্য যেসব দেশ থেকে যাঁরা আরবাইনে যোগ দিতে আসেন তাঁরা তা শুরু করেন নাজাফ থেকে। এখানেই হযরত আলী (আ.)-এর মাজার। নাজাফ থেকে কারবালার দূরত্ব ৮০ কিলোমিটার। আরবাইনের দিন যাঁরা কারবালায় পৌঁছতে চান তাঁদের জন্য সফর মাসের ১৬ তারিখে যাত্রা শুরু করা ভালো। যাত্রাপথে বিশ্রাম ও খাবার গ্রহণের সময় ‘মওকেব’ হিসেবে পরিচিত। এসময় অনেকে নামাজ আদায় করে নেন। ইরাকি নাগরিকরা ‘মওকেব’-এর আয়োজন করে থাকেন। ধর্মীয় দিক থেকে মূল্যবান হওয়া ছাড়াও আরবাইনের বিভিন্ন উদ্দেশ্য রয়েছে। 
প্রথমত, আরবাইন বিদ্যমান বিশ্বব্যবস্থার বিপরীতে একটি প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা তৈরি করে। ধর্ম এবং এর মূল্যবোধ ও চিহ্নগুলো রক্ষায় বিপুল সংখ্যক ধর্মীয় ও অনুপ্রাণিত লোকÑ যাঁরা অনুসারী হিসেবে অস্তিত্বের জানান দেন। এ এক নতুন বিকল্প শক্তির উৎস যা অন্য কোনো উপায়ে অনুকরণ করা যায় না এবং ফলাফলগুলো ইসলামি বিশে^র স্বার্থ ও নীতিগুলোর অগ্রগতির জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। আরবাইন যাত্রায় অংশ যাঁরা নেন তাঁদের মধ্যে অপ্রতিদ্বন্দ্বী এক সুবিধা ও সীমাহীন সম্ভাব্য শক্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটে যা তাঁকে যে কোনো বিপদ থেকে রক্ষা করার ও প্রতিরোধের সক্ষমতা তৈরি করে।
দ্বিতীয়ত, আরবাইন বিশ^মানবের কাছে একটি কাক্সিক্ষত জীবন যাত্রার আদর্শ উপস্থাপন করে। ক্ষণিকের এই জীবনে কয়েক দিন মানুষ তার সমস্ত পার্থিব সম্পদ ত্যাগ করে ক্ষতিকর প্রতিদ্বন্দ্বিতার পরিবর্তে ভ্রাতৃত্ব, সহানুভূতি এবং একে অপরকে সাহায্য করার জন্য সময়কে মূল্যবান করে তোলে। মানুষ পার্থিব সম্পদ জমানোর সন্ধানে নয় বরং প্রত্যেকে আরো আধ্যাত্মিকতা অর্জনের চেষ্টা করে। মানুষ একে অপরের সেবা করতে পছন্দ করে এবং অন্যকে সহায়তা করার জন্য প্রতিযোগিতা করে। আসলে এটি বলা যেতে পারে যে, আরবাইন মানুষকে এক নতুন জীবন দান করে।
তৃতীয়ত, আরবাইন মানুষের সামাজিক-রাজনৈতিক জ্ঞান এবং মননশীলতার বৃদ্ধি ঘটায়। আরবাইন চলাকালে মানুষের মাঝে রাজনীতি, সংস্কৃতি, সামাজিক নানা ইস্যুতে তথ্য ও ভাবের বিনিময় হয়। এতে সবাই ধর্মীয় জ্ঞান ও সচেতনতা বৃদ্ধির সুযোগ পায়। আরবাইন পদযাত্রায় এ দিকটি ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কারবালায় যাত্রার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ যেমনটি তিনি তাঁর অনুসারীদের নিয়ে নামাজে মহান আল্লাহর কাছে দোয়া চাইতেন, ‘হে আল্লাহ! তুমি আমাদের অজ্ঞতা ও পথভ্রষ্টতা থেকে মুক্তি দাও।’
চতুর্থত, আরবাইন যাত্রা আধ্যাত্মিকতাকে আরো গভীর করে। এবং তা অর্জনের উপায় হিসেবে ইসলামি শিক্ষাগুলোর সম্মিলিত আচার-আচরণ ও ইবাদতের ওপর অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়। ব্যক্তিগত ইবাদতের পাশাপাশি সম্মিলিতভাবে ইবাদতের মাধ্যমে আধ্যাত্মিক মিলনকে আরো বাড়িয়ে দেয়। সম্মিলিত এ আন্দোলনে নির্জন প্রার্থনায় নিজেকে সঁপে দেয়া ও শোক করা, দান করা, তাপ-তৃষ্ণা এড়িয়ে এগিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে আরবাইন যাত্রীরা আধ্যাত্মিকতার স্পর্শ লাভ করেন। ইমাম হোসাইন (আ.) তাঁর অনুসারীদের নিয়ে কারবালায় যে যাত্রা শুরু করেছিলেন তার স্মরণে লাখো মানুষ এখন আরবাইনে যোগ দেন। ইমাম হোসাইন অসত্য ও জুলুমের বিরুদ্ধে সংগ্রামে তাদের কাছে এক আদর্শিক প্রতীক হয়ে উঠেছে। ন্যায়বিচার ও আত্মমর্যাদাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে তাঁরা এক অনুপ্রেরণার উৎস সন্ধানে কারবালার প্রান্তরে ধাবিত হন। কারবালার যুদ্ধ, ইমাম হোসাইন (আ.), তাঁর জীবন ও উত্তরাধিকার সম্পর্কে স্পষ্ট এক ধারণা নিয়ে ফেরেন তাঁরা।

 

আত্মগঠন ও মানবীয় গুণাবলি অর্জনে ইমাম হাসান (আ.)-এর কর্মপন্থা

আব্দুল কুদ্দুস বাদশা –
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রিয় দৌহিত্র হযরত ইমাম হাসান ইবনে আলী (আ.) হলেন আহলে বাইতের সিলসিলায় মুসলমানদের দ্বিতীয় ইমাম। নবীদুহিতা মা ফাতেমা আর শেরে খোদা হযরত আলী (আ.)- এর পবিত্র দাম্পত্য জীবনের সর্বপ্রথম ফল। বেহেশতের বাদশা এ মহান ইমামের জন্ম পবিত্র মদিনা মুনাওয়ারায়, তৃতীয় হিজরি সনের মধ্য রমজানে। নানা হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ইন্তেকালের সময় তিনি ছিলেন সাত বছরের বালক। অতঃপর দীর্ঘ ত্রিশ বছর স্বীয় পিতা হযরত আলী ইবনে আবি তালিবের সাহচর্যে অতিবাহিত করেন। ৪০ হিজরিতে স্বীয় পিতার শাহাদাতের পর তিনি ইমামতের মাকামে অধিষ্ঠিত হন। কিন্তু আমীর মুয়াবিয়ার নিরন্তর চক্রান্তের মধ্যে তিনি মাত্র ১০ বছর ইমামতি দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম হন। হিজরি পঞ্চাশ সনের ২৮শে সফর তারিখে (প্রসিদ্ধ মতানুসারে) মাত্র ৪৮ বছর বয়সে তাঁকে বিষ প্রয়োগে শহীদ করা হয়। মদীনার ‘জান্নাতুল বাকী’ গোরস্থানে তাঁর পবিত্র সমাধি অবস্থিত। (বিহারুল আনওয়ার, ৪৪ : ১৩৪) আল্লামা সুয়ূতী লিখেছেন : ‘হাসান (রা.) অশেষ চারিত্রিক ও মানবীয় গুণাবলির অধিকারী ছিলেন। তিনি একজন মহৎপ্রাণ, অধ্যবসায়ী, স্থিরচিত্ত, ব্যক্তিত্ববান, উদার এবং প্রশংসনীয় ব্যক্তি।’ (তারিখুল খুলাফা : ১৮৯)। অবশ্য এটাই স্বাভাবিক যে বিশ্বনবীর জ্যেষ্ঠ দৌহিত্র এমনই গুণের অধিকারী হবেন।
মুসলমানদের মধ্যে একটি চিরায়ত নিয়ম হচ্ছে কোন ব্যক্তির শান-মানকে পরিমাপ করা হয় রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট তার স্থান কী ছিল তার উপর বিচার করে। এদিক থেকে বলা যায় যে, নিঃসন্দেহে ইমাম হাসান রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট প্রাণাধিক প্রিয় ছিলেন। তিনি প্রকাশ্যে শত-সহ¯্রবার ইমাম হাসানের প্রতি তাঁর সে গভীর ভালবাসার প্রমাণ রেখেছেন। ইমাম বুখারী হযরত আবু বকর (রা.) হতে বর্ণনা করেছেন যে তিনি বলেন, ‘আমি নবীজীকে মিম্বারের উপরে বসা অবস্থায় দেখেছি যখন হাসান ইবনে আলী তাঁর সাথে ছিলেন। তিনি একবার সমাগত লোকদের দিকে মুখ ফেরাচ্ছিলেন এবং আরেকবার তার দিকে তাকাচ্ছিলেন আর বলছিলেন : আমার এই পুত্র হচ্ছে সাইয়্যেদ তথা নেতা। (সহীহ্ বুখারী, বৈরুত প্রিন্ট, ৩ : ৩১) তিনি আরও বলছিলেন : ‘যে হাসান ও হোসাইনকে ভালবাসলো সে আমাকে ভালবাসলো। আর যে এ দুজনকে রাগন্বিত করলো সে আমাকে রাগন্বিত করলো।’ (বিহারুল আনওয়ার, ৪৩ : ২৬৪)। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর আপন হাতে প্রতিপালিত ইমাম হাসান ও ইমাম হোসাইন তাই নিঃসন্দেহে প্রতিটি মুসলমান ঘরের সন্তানদের প্রতিপালন পন্থার ক্ষেত্রে উত্তম আদর্শ। এ প্রবন্ধে ইমাম হাসান মুজতবা (আ.)-এর জীবনচরিত থেকে মুসলমানদের ব্যক্তি চরিত্র গড়ার সেই রীতিপন্থাকেই তুলে ধরার চেষ্টা করা হল।
মানব সন্তান এক তার জাগতিক ও আধ্যাত্মিক জীবনে এক অমিয় সম্ভাবনা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে থাকে। তার মধ্যে নিহিত শক্তি ও সম্ভাবনাসমূহ বাস্তবরূপ লাভ করে সঠিক প্রতিপালনের মাধ্যমে। যোগ্যতম প্রতিপালকের তত্ত্বাবধানে মানবের অন্তর্নিহিত সুপ্ত প্রতিভাসমূহ বিকশিত হয় যা তাকে পূর্ণতার পাণে পরিচালিত করে, মানবিক গুণাবলির অধিকারী করে তোলে এবং আত্মিক পরিশুদ্ধি দান করে। মহাপুরুষদের সীরাত তথা জীবনচরিত এক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। এখানে সীরাত বলতে মাসুমগণের সেই জীবনাচারকে বুঝানো হয়েছে যা অপেক্ষাকৃত স্থিতিশীল, নিয়মানুবর্তী এবং রীতি তথা পদ্ধতিগত। ইমাম হাসান (আ.)-এর জীবনাচারে এ বৈশিষ্ট্যগুলো এতটাই উজ্জ্বল হয়ে আলো ছড়িয়েছে যে, প্রতিটি মুসলমানের ব্যক্তি চরিত্র গঠনে তা অনুকরণীয় আদর্শ হতে পারে।
ইমাম হাসান (আ.) মানবের সঠিক প্রতিপালনের জন্য তার বিচক্ষণতা ও অন্তর্দৃষ্টির (بصیرت) সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রতি বিশেষ জোরারোপ করেছেন। এটা মানুষের অন্তর্নিহিত শক্তি যা হাকিকতকে জানার ক্ষেত্রে অস্তিত্বসত্তার গভীর থেকে আরও গভীরে অনুপ্রবেশ করতে পারে। তখন অন্তর্দৃষ্টিবান ব্যক্তি বস্তুনিচয়ের প্রকৃত স্বরূপকে অনুধাবন করতে সক্ষম হয়। ইমাম হাসান (আ.) মানুষের মধ্যে অন্য সবকিছুর আগে এ অর্থটিকেই শক্তিশালী করার প্রয়াস  চালাতেন। যাতে তারা আপাতঃদৃষ্টির পথ পরিহার করে এবং সত্যে উপনীত হতে সক্ষম হয়। কেননা, অন্তর্দৃষ্টিই হচ্ছে সঠিক কর্মকাণ্ডের ভিত্তি। পক্ষান্তরে আপাতঃদৃষ্টির উপর নির্ভর করে চললে ভ্রান্তির সম্ভাবনা যেমন বৃদ্ধি পায়, তদ্রুপ পদে পদে বিপথগামী হওয়ার ঝুঁকিও থাকে অনেক বেশি। মাসুম ইমামগণের বিশেষ করে ইমাম আলী ইবনে আবি তালিব (আ.) এবং ইমাম হাসান মুজতবা (আ.) তৎকালীন জনগণের এই অর্ন্তদৃষ্টির অভাবহেতু সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। কেননা, এমনকি তাঁদের সমর্থনকারীরও শত্রুর প্রচারণার প্রভাবে প্রতারণার কবলে পড়ে। ধুরন্ধর মুয়াবিয়ার কুটচালের মোকাবিলায় তারা অবিচল থাকতে পারে নি। ফলশ্রুতিতে আমিরুল মুমিনীন আলী (আ.) সিফফীনের ময়দানে সালিশ মানতে বাধ্য হন এবং ইমাম হাসান মুয়াবিয়ার সাথে সন্ধি করতে বাধ্য হন। (দ্র: শেইখ মুফিদ, আল-জামাল : ৬৯)
একারণে ইমাম হাসান (আ.) স্বীয় কথা ও কর্মের মাধ্যমে জনগণকে বিচক্ষণ করে গড়ে তোলা ও সচেতন করার যথাসাধ্য প্রয়াস চালান। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন : ‘সর্বাপেক্ষা দৃষ্টিবান চক্ষু হচ্ছে সেই চক্ষু যা কল্যাণের পথে অনুপ্রবেশ করে, আর সর্বাপেক্ষা শ্রবণশক্তিসম্পন্ন কান হচ্ছে সেই কান যা নিজের মধ্যে উপদেশকে শিক্ষা করে এবং তা থেকে উপকার গ্রহণ করে। আর সর্বাপেক্ষা সুস্থতম অন্তর হচ্ছে সেই অন্তর যা সংশয়-সন্দেহ থেকে মুক্ত থাকে।’ (তুহাফুল উকুল আন আলে রাসূল : ১৭০) মানুষ যদি এই তিনটি উপকরণ ও মাধ্যমকে যথাযথভাবে কাজে লাগায় তাহলে নির্দ্ধিধায় বলা যায় যে, সে প্রকৃত অন্তর্দৃষ্টি অর্জন করতে সক্ষম হবে। দৃষ্টিশক্তি এবং শ্রবণশক্তি হচ্ছে এমন দুটি মাধ্যম যা তথ্যাবালকে চিন্তা ও বুদ্ধির কেন্দ্রস্থল অর্থাৎ অন্তরে প্রবেশ করায়। যদি এই আমদানিকৃত কাঁচামালসমূহ পরিশোধনকৃত হয়ে থাকে, আর অন্তরও যদি সংশয় ও সন্দেহের দোলাচল থেকে মুক্ত থাকতে পারে, তাহলে নিখাঁদ তথ্যাবলি প্রবেশের মাধ্যমে অন্তর সুচি ও স্বচ্ছতার মধ্য দিয়ে অন্তদৃষ্টির কেন্দ্রে পরিণত হয়।
ইমাম হাসান অন্তর্দৃষ্টি অর্জনের উপায় হিসাবে মানুষের আত্মপরিচিতি এবং আত্মগঠনের দিকে মনোযোগী হওয়ার উপদেশ দেন। স্বীয় পুত্রের উদ্দেশ্যে এক অসিয়তে ইমাম বলেন : ‘পুত্র আমার! কারও সাথে ভ্রাতৃত্বের (বন্ধুত্বের) বন্ধনে আবদ্ধ হয়ো না, যতক্ষণ না তাকে সর্বদিক থেকে চিনবে এবং নিশ্চিত হতে পারবে! অতঃপর যখন এরূপ ব্যক্তিকে খুঁজে পাবে তখন সর্ববিষয়ে তার সাথে থাকবে।’ (তুহাফুল উকুল আন আলে রাসূল : ১৬৮) অর্থাৎ ইমাম বন্ধুত্ব স্থাপনের পূর্বে ঐ ব্যক্তির সম্পর্কে বিচক্ষণতার পন্থা অবলম্বন করার উপদেশ দিয়েছেন। যদি সর্বদিক দিয়ে তাকে চেনা হয় এবং আস্থা আসে কেবল তখনই তার সহচর হওয়া যাবে। কারণ, মানুষের প্রতিপালনে এবং ব্যক্তিত্ব ও পরিচয়সত্তা গঠনে বন্ধুর ভূমিকা অত্যধিক। একারণেই যারা ইমাম হাসানকে যথাযথভাবে চিনতো না তাদের নিকট নিজের পরিচয় তুলে ধরতেন এবং বলতেন : ‘আমি হলাম হাসান, রাসূলুল্লাহর পুত্র, আমি হলাম সুসংবাদ দানকারী ও সতর্ককারীর পুত্র, আমি তাঁর পুত্র যিনি রিসালাতের জন্য নির্বাচিত হয়েছেন…।’ (তুহাফুল উকুল আন আলে রাসূল : ১৬৭) এ বাক্যগুলোর মধ্যে ইমাম প্রকৃতপক্ষে শ্রোতাদের কাছে নিজের পরিচয় তুলে ধরেছেন। যাতে কেউ যদি তাকে না চিনে, সে যেন তাঁর পরিচয় জানতে পারে এবং জেনেশুনে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে। তাই তো তিনি বক্তব্য শুরুই করেছেন এভাবে : ‘যে আমাকে চিনে সে তো চিনেই। আর যে আমাকে চিনে না তার জন্য আমি আমার পরিচয় বলছি…।’
এরপর মানুষের আত্মগঠনের বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, মানুষ তাকওয়া ও নফসের তাহযীব তথা পরিশীলনের ক্ষেত্রে যতটা এগিয়ে যেতে পারবে, তদনুপাতে তার অন্তর্দৃষ্টির শক্তিও বৃদ্ধি লাভ করবে। এ প্রসঙ্গে ইমাম হাসান এক উপদেশবাণীতে সকল আত্মগঠনে ব্রতী মুসলমানদের উদ্দেশে বলেন : ‘আমি তোমাদেরকে আল্লাহর প্রতি তাকওয়া বজায় রাখার এবং নিরন্তর চিন্তা-অনুধ্যাানের আহ্বান জানাচ্ছি। কেননা, চিন্তা-অনুধ্যান হচ্ছে সকল কল্যাণের জনক এবং তার জননী।’ (মাজমুআতু ওয়ারাম, ১ : ৫৩) ইমামের এ উপদেশ বাণী থেকে প্রতিপন্ন হয় যে, সঠিক চিন্তা-অনুধ্যান এবং অন্তর্দৃষ্টি অর্জন হচ্ছে তাকওয়া ও আত্মশুদ্ধির ফসলস্বরূপ। ইমামের অপর এক উপদেশ বাণীতে এসেছে যে, তিনি বলেন, ‘আল্লাহ তোমাদেরকে তাকওয়ার প্রতি উপদেশ দিয়েছেন। এ তাকওয়াকে তিনি নিজের পরম সন্তষ্টির কারণ হিসাবে নির্ধারণ করেছেন। তাকওয়া হচ্ছে সকল তওবার দরজাস্বরূপ এবং সকল প্রজ্ঞাশীলতার মূল। মুত্তাকীদের মধ্যে যাঁরা সফলকাম হয়েছেন তাঁরা এ তাকওয়ার মাধ্যমেই সফলকাম হয়েছেন।’ (তুহাফুল উকুল : ১৬৭)
সুতরাং ইমাম হাসান (আ.)-এর দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষের বিচক্ষণতা ও অন্তর্দৃষ্টি অর্জনে তার আত্মপরিচিতির জ্ঞানের ভূমিকা যেমন গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন, অনুরূপভাবে তার তাকওয়া এবং আত্মশুদ্ধির ভূমিকাও অতীব গুরুত্বপূর্ণ বলে গণ্য করেন। এ অন্তর্দৃষ্টিকে কোরআনে ‘ফুরকান’ তথা সত্য ও মিথ্যার পার্থক্যকারী নামে অভিহিত করা হয়েছে। ইমাম হাসান (আ.) জীবনের সর্ব অঙ্গনে এ বিষয়টির প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। তিনি মুয়াবিয়ার সাথে সম্পাদিত সন্ধিচুক্তির প্রভাব এবং মুসলমানদের জন্য এর সুফল ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন : ‘যে অধিকার নিতান্তই ছিল আমার প্রাপ্য, মুয়াবিয়া তা নিয়ে আমার সাথে বিবাদে লিপ্ত হল। আর আমি উম্মতের মঙ্গলার্থে এবং তাদের রক্তপাত এড়াবার লক্ষ্যে সে অধিকার তার হাতে তুলে দিলাম।’ (বিহারুল আনওয়ার, ৪৪ : ২৩) অন্যত্র ইমাম বলেন, ‘আমি এ কাজ করেছি ¯্রফে রক্তপাত এড়াবার জন্য এবং নিজের, পরিবারের এবং একনিষ্ঠ সহচরবৃন্দের প্রাণভয়ে।’ (প্রাগুক্ত : ৫৫) যারা উগ্রতা প্রদর্শন করতো এবং ইমামের প্রতি অসৌজন্যমূলক আচরণ করতো তারা আসলে অজ্ঞ ছিল এবং সন্ধিচুক্তির দর্শন সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিল না। মুয়াবিয়া ক্ষমতার মোহে অন্ধ হয়ে এবং বনি হাশিমের প্রতি চরম বিদ্বেষের বশবর্তী হয়ে যেভাবে হত্যা ও ধ্বংসলীলায় মেতে উঠেছিল এবং ইসলামে সীমাহীন বিকৃতি ও কু-সংস্কৃতির প্রচলন ঘটিয়ে চলেছিল তার বিপরীতে যুগের নিষ্পাপ ইমাম হিসাবে একদিকে দ্বীনকে সুরক্ষা এবং অপরদিকে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদেরকে নিধনের হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখার গুরুদায়িত্ব অনুভব করেন। আর তখনই তিনি মুয়াবিয়ার অন্যায্য সন্ধির প্রস্তাবে সাড়া দেন। ইমাম যখন স্বীয় সহচরবৃন্দের কাছে এই নির্মম বাস্তবতার ব্যাখ্যা তুলে ধরেন তখন তাদের অনেকেই এ সত্যকে অনুধাবন করতে সক্ষম হয় এবং সরল সিরাতুল মুস্তাকীমের উপর অটল থাকে।
অন্তর্দৃষ্টি ও বিচক্ষণতা অর্জনের পর একজন মুসলমানের জন্য তার দ্বীনি বিশ্বাসসমূহকে লালন করা একান্তভাবে আবশ্যক। কেননা, অন্তর্দৃষ্টির সাথে সঠিক আকিদা-বিশ্বাসের সংযোগ থাকলেই কেবল মানুষ সন্দেহ-সংশয় ও ভ্রষ্ট চিন্তাধারার বিপরীতে অটল থাকতে পারে। জীবনের উৎপত্তি এবং এর পরিসমাপ্তি, যা কোরআনের ‘নিশ্চয় আমরা আল্লাহর জন্য এবং তাঁরই নিকট প্রত্যাবর্তন করব’- এ আয়াতের মধ্যে প্রতিধ্বনিত হয়েছে, এ বিশ্বাস একজন মুমিনকে সঠিক পরিচয়সত্তা দান করে। এ বিশ্বাস যতই যুক্তিসিদ্ধ ও প্রমাণসাপেক্ষ হবে, জীবনে তার প্রভাব ততই অধিক হবে। সত্য ও সঠিক বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে যে ব্যক্তিত্ব ও পরিচয়সত্তা জন্ম লাভ করবে তা ব্যক্তির জন্য ততই মর্যাদা ও সম্মান বয়ে আনবে। এ মর্মে মহামহিম আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘যারা শাশ্বত বাণীতে বিশ্বাসী, তাদের ইহজীবনে ও পরজীবনে আল্লাহ্ সুপ্রতিষ্ঠিত রাখবেন।’ (ইবরাহীম : ২৭)
ইমাম হাসান (আ.) মুয়াবিয়া কর্তৃক সৃষ্ট চরম রাজনৈতিক ও সামাজিক সংকটময় পরিস্থিতির মধ্যেও কীভাবে দ্বীনি বিশ্বাস ও মূল্যবোধসমূহের উপর সুদৃঢ় থাকতে হয় তা জনগণকে দেখিয়ে গেছেন। পরম ধৈর্য, অবিচল অধ্যাবসায় এবং পরম তিতিক্ষার মাধ্যমে তিনি শান্তভাবে সেসব সংকট ও সমস্যার মোকাবিলা করেন। যদিও তাঁর অজ্ঞ ও অসহিষ্ণু সহচরবৃন্দ এপথে তাঁকে কোন সহযোগিতা তো করেইনি, বরং মুয়াবিয়ার প্ররোচনায় নিজেরাই একাধিকবার ইমামের বিরুদ্ধে ঘাতকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, তাঁর তাঁবুতে আক্রমণ চালায় এবং তাঁর মাল-সামান লুট করে নিয়ে যায়। এমনকি তারা ইমামের পবিত্র শরীরে আঘাত করে জখম করে ছাড়ে। আহত দেহ নিয়ে তিনি কিছুদিন মাদায়েনে অবস্থান করেন। এহেন অবস্থায়ও তিনি ধৈর্যের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শনে কুণ্ঠিত হননি এবং লোকদের দ্বীনি বিশ্বাসকে মজবুত করণের প্রচেষ্টা থেকে বিমুখ হননি। একত্ববাদী দীক্ষার বিকাশ সাধনে তিনি নিরলস প্রয়াস চালিয়ে যান। এপ্রসঙ্গে এক ভাষণে ইমাম বলেন : ‘মহান আল্লাহ তোমরাÑ মানুষদেরকে অযথা এবং বিনা উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেননি। তিনি তোমাদেরকে স্বাধীনভাবে ছেড়ে দেননি। তোমাদের আয়ুষ্কালের নির্ধারিত সময় তিনি লিখে দিয়েছেন। তোমাদের মাঝে তোমাদের জীবিকাকে তিনি বণ্ট করে দিয়েছেন। যাতে প্রত্যেক ধীসম্পন্ন ব্যক্তি তার অবস্থানকে জানতে পারে এবং যা তার জন্য নির্ধারিত হয়েছে তা সে পেয়েছে আর যা তার থেকে ফিরিয়ে রাখা হয়েছে তা সে কখনও পাবে না।’ (তুহাফুল উকুল : ২৩২)
অনেক মানুষ রয়েছে যারা নিজেদের মূল্য ও মর্যাদাকে উপলব্ধি করে না। আর একারণেই অনায়াসে অপমান ও হীনতাকে বরণ করে নেয়। কিন্তু যদি সে তার মূল্য ও মর্যাদায় বিশ্বাস করতো তাহলে স্বীয় জাগতিক ও আধ্যাত্মিক জীবনকে সুশৃঙ্খলাবদ্ধ করে ফেলতো। সে কখনও চিন্তা ও আচরণগত সমস্যার সম্মুখীন হতো না, পথভ্রষ্টতার কবলেও পড়তো না। তাই দ্বীনি বিশ্বাসসমূহকে মজবুত করা মানুষের প্রতিপালন ব্যবস্থায় এবং তার আচরণের সংশোধনে একটি কার্যকরী পদ্ধতি যার উপর ইমাম হাসান (আ.) কথা ও কর্মের মাধ্যমে তাগিদ দিয়েছেন আজীবন।
অন্তর্দৃষ্টি অর্জন এবং দ্বীনি বিশ্বাসসমূহ লালনের পর যে গুণটি মানব জীবনকে আলোকিত করে তোলে সেটা হল বন্দেগি। ইসলাম ও কোরআনের দৃষ্টিতে ইবাদত-বন্দেগি হচ্ছে মানব জীবনের স্পন্দনস্বরূপ। ইবাদতের উদ্দেশ্যেই তার সৃষ্টি। সময়মত ও সঠিক পন্থায় ইবাদত-বন্দেগি সম্পাদনের মাধ্যমে মানুষ তার চলার পথে অত্যাবশ্যকীয় ক্ষেত্রসমূহ যেমন সুশৃঙ্খলা, সুপরিকল্পনা, অপরের অধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন, আত্মিক পরিতৃপ্তি ইত্যাদি বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। ইমাম হাসান মুজতবা (আ.) সর্বদা ইবাদতকে তার পূর্ণাঙ্গ ও পরিপূর্ণরূপেই আঞ্জাম দিতেন। বর্ণিত হয়েছে যে তিনি জীবদ্দশায় ২৫ বার পায়ে হেঁটে হজ্জব্রত পালন করেন। (বিহারুল আনওয়ার, ৪৩ : ৩৩১) অনুরূপভাবে তাঁর নামায আদায় সম্পর্কেও বর্ণিত হয়েছে যে, যখন নামাযের সময় সমাগত হতো এবং তিনি ওযু করতেন, তখন তাঁর হাঁড়ের জোড়াগুলো কেঁপে কেঁপে উঠতো এবং মুখম-ল ফ্যাকাশে হয়ে যেত। এর কারণ জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি উত্তর দেন, ‘যে কেউ মহান প্রতিপালকের সম্মুখে দ-ায়মান হয়, তার এমনটাই হওয়া উচিত।’ (সিবতে আকবার : ৪১) তিনি যখন মসজিদের দরজায় পৌঁছতেন, মাথা আকাশের দিকে উঠিয়ে বলতেন, ‘হে আল্লাহ! তোমার অতিথি তোমার দরজায় উপস্থিত। হে মহীয়ান! অধম এসেছে তোমার ঘরের দরজায়। অতএব, আমার নিকট যে মন্দ রয়েছে তা তোমার নিকট যে সুন্দরতম জিনিস রয়েছে তা দিয়ে ক্ষমা করে দাও, হে দয়াময়।’ (মানাকিব-ই আলে আবি তালিব, ৪ : ৭)
তিনি মুসলমানদেরকে মসজিদে গিয়ে জামাআত সহকারে নামায আদায়ে উৎসাহী করার নিমিত্তে বলতেন, ‘যে ব্যক্তি নিয়মিত মসজিদে যাতায়াত করবে সে আটটি জিনিসের যে কোন একটি লাভ করবে : (১) শক্তিশালী খোদায়ী নিদর্শন (২) উপকারী বন্ধুত্ব (৩) নতুন জ্ঞান (৪) প্রতীক্ষিত করুণা (৫) বক্তব্য, যা তাকে সত্য পথে টেনে আনবে (৬) বক্তব্য, যা তাকে হীনতা থেকে রক্ষা করবে (৭) আল্লাহর থেকে লজ্জাবশত পাপ বর্জন অথবা (৮) আল্লাহর ভয়বশত পাপ বর্জন। (তুহাফুল উকুল : ১৬৯) ইমাম মসজিদে গমনাগমনের এই যে সুফলগুলো উল্লেখ করেছেন তা ব্যবহারিক জীবনে উপকারী বটে। অন্যত্র তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর ইবাদত করে, আল্লাহ সবকিছুকে তার প্রতি আনুগত্যশীল করে দেন।’ (মুস্তাদরাক আল-ওসায়িল, ৩ : ৩৫৯, হাদিস ৩৭৭৮) তিনি ইবাদতকে আত্মশুদ্ধির উপায় হিসাবে গণ্য করেছেন এবং বলেছেন, ‘নিশ্চয় যে ব্যক্তি ইবাদতকে ইবাদতের জন্যই অন্বেষণ করবে তার আত্মশুদ্ধি অর্জিত হবে।’ (তুহাফুল উকুল : ১৭০) ইমাম স্বয়ং যেমন ইবাদতের আশেক ছিলেন এবং আল্লাহর আনুগত্যকে মানুষের আত্মবিকাশ ও পূর্ণতা লাভের কারণ বলে মনে করতেন, তদ্রƒপ অন্যদেরকেও এ ব্যাপারে আহ্বান জানাতেন। এভাবে তিনি তাদের মাঝে বন্দেগির প্রাণশক্তি লালন করতেন।
মায়া-মমতা এবং ভালবাসা হচ্ছে আরেকটি অন্যতম মানবীয় গুণ যা ইমাম হাসান (আ.)-এর কর্মপন্থায় গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে ছিল। কেননা, অন্যদের প্রতি সদয় হওয়া এবং সম্মান প্রদর্শন করা মানব প্রকৃতির একটি স্বভাবজাত চাহিদা, যা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত দরকার হয়। মানুষের এই সহজাত চাহিদাটি তার ব্যবহার ও অন্যদের সাথে তার আচরণে প্রকাশ পায়। মহান আল্লাহ হযরত মূসা (আ.)-কে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘আমি আমার নিকট হতে মানুষের মনে তোমার প্রতি ভালবাসা সঞ্চারিত করেছিলাম, যাতে তুমি আমার তত্ত্বাবধানে প্রতিপালিত হও।’ (ত্বা-হা : ৩৯) এ খোদায়ী বাণী থেকে স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয় যে, মানবের আত্মগঠন তথা সঠিক প্রতিপালনে তার ভাবাবেগ ও ভালবাসার মনোবৃত্তিকে বিশেষভাবে পরিচর্যা করার আবশ্যকতা রয়েছে। কেননা, এই মানবিক গুণটি তার জীবনের মহৎ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে পৌঁছতে অত্যধিক প্রভাব রাখে। মহানবী (সা.)-কে প্রশ্ন করা হলো যে, পুরুষ ও নারিগণের মধ্য থেকে কারা আপনার নিকট অধিকতর প্রিয়? তিনি উত্তর দিলেন, ‘ফাতেমা ও তার স্বামী।’ তদ্রুপ হযরত আয়েশা থেকে বর্ণিত হয়েছে যে ইমাম আলী (আ.) রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-কে প্রশ্ন করেন, ‘আমাদের মধ্যে কে আপনার অধিক প্রিয়, আমি নাকি সে?’ তিনি (সা.) উত্তর দিলেন, ‘সে আমার অধিকতর প্রিয় আর তুমি আমার নিকট অধিকতর সম্মানিত।’ (বিহারুল আনওয়ার, ৪৩ : ৩৮) রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁর দুই দৌহিত্র হাসান ও হোসাইনের প্রতিও একইরূপ ভালবাসা পোষণ করতেন এবং অন্যদেরকেও তাঁদের প্রতি ভালবাসা রাখার আহ্বান জানাতেন। তিনি বলতেন, ‘যে কেউ হাসান ও হোসাইনকে ভালবাসবে সে আমাকে ভালবাসলো আর যে তাদের প্রতি শত্রুতা করবে সে আমার সাথে শত্রুতা করলো।’ (বিহারুল আনওয়ার, ৪৩ : ৩০৪) গুরুজনদের মমতা ও ভালবাসা সন্তানদের সঠিক প্রতিপালনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখে। একারণে মাসুমগণের জীবনচরিতে এ মানবীয় গুণটি সবকিছুকে ছাড়িয়ে যেতে দেখা যায়। তাঁরা এমনকি শত্রুদেরকেও আকৃষ্ট করতে এবং তাদেরকে সঠিক পথে দীক্ষা প্রদানের জন্য এটাকে কাজে লাগাতেন। ইমাম হাসান (আ.) নানা রাসূলুল্লাহ (সা.) এবং পিতা আলী (আ.)-এর জীবন থেকে এ গুণটি উত্তমভাবেই রপ্ত করেছিলেন এবং অন্যদের প্রতিপালনে তা যথাযথভাবে কাজে লাগিয়েছিলেন। হযরত আনাস ইবনে মালেক বলেন, ইমাম হাসান (আ.)-এর জনৈকা কানিজ তাঁকে একটি ফুল উপহার দিল। ইমাম সাগ্রহে ফুলটি গ্রহণ করলেন এবং তাকে বললেন, ‘তোমাকে আমি আল্লাহর রাহে মুক্ত করে দিলাম।’ তখন আমি প্রতিবাদের স্বরে বলে উঠলাম, ‘একটি মাত্র ফুলের বিনিময়ে তাকে আপনি মুক্ত করে দিলেন?’ ইমাম বললেন, ‘আল্লাহ্ কোরআনের মধ্যে আমাদেরকে এমনটাই শিক্ষা দিয়েছেন। ইরশাদ হচ্ছে, ‘আর যখন তোমাদের কোন সৌজন্যতার মাধ্যমে অভিবাদন করা হয় তখন তোমরাও তা অপেক্ষা উত্তম অভিবাদন করবে।’ ( নিসা : ৮৫) অতঃপর তিনি বললেন, ‘এক্ষেত্রে তাকে মুক্ত করে দেওয়াই হচ্ছে অপেক্ষকৃত উত্তম অভিবাদন। ’ (জালওয়াহায়ি আয নূরে কোরআন : ২৭)
একদিন ইমাম হাসান (আ.) এক যুবককে দেখলেন তার সামনে একটি খাবারের পাত্র। আর সে তা থেকে এক লোকমা নিজে খাচ্ছে এবং আরেক লোকমা একটি কুকুরকে খেতে দিচ্ছে। ইমাম যুবককে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এরূপ করছো কেন?’ যুবকটি বলল, ‘আমার শরম হচ্ছে যে, নিজে খাবার খাব অথচ এ কুকুরটি ক্ষুধার্ত থাকবে।’ ইমাম হাসান যুবকের এ বদান্যতায় মুগ্ধ হয়ে তাকে পুরস্কৃত করতে চাইলেন। তার ভাল কাজের জন্য ইমাম তাকে তার মনিবের নিকট থেকে খরিদ করে মুক্ত করে দিলেন। আর যে বাগিচায় সে কাজ করছিল, সে বাগিচাটি খরিদ করে তাকে দান করলেন। (আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৮ : ৩৮) এভাবেই বিশেষ করে কিশোর ও যুবকদের সঠিক প্রতিপালনে ইমাম হাসান (আ.) মানুষের প্রতি দয়া ও ভালবাসাকে অন্যতম উপকরণ হিসাবে কাজে লাগান। তিনি বলতেন, ‘আপন হচ্ছে সেই ব্যক্তি বন্ধুত্ব ও ভালবাসা যাকে নিকটবর্তী করেছে, যদিও বংশের দিক থেকে সে দূরের হয়ও। আর পর হচ্ছে সেই ব্যক্তি যে বন্ধুত্ব ও ভালবাসা বিবর্জিত, যদিও বংশের দিক থেকে সে কাছের হয়ও।’ (তুহাফুল উকুল : ১৬৮)
পরিশেষে বলা যায়, অধুনা যুগের যান্ত্রিক জীবন থেকে যে জিনিসটি হারিয়ে যেতে বসেছে সেটা হচ্ছে মানুষের আত্মগঠনের চিন্তা আর মানবীয় গুণাবলির প্রতি মনোযোগ। আজ জীবন হয়ে উঠেছে নিরস আর বিষময়। নতুন নতুন আবিষ্কার আর গগণচুম্বী অট্টালিকা গড়া এ যুগের মানুষের জন্য যতটা না সহজ তার চেয়ে ঢের বেশি কঠিন হচ্ছে তার আত্মগঠন। ইসলাম মানুষের সঠিক প্রতিপালন ও তার মানবিক গুণাবলিকে বিকশিত করার উপর জোর দেয় সবচেয়ে বেশি। স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সা.) হচ্ছেন মুসলমানদের জন্য উত্তম আদর্শ। সেই রাসূলের ক্রোড়ে লালিতপালিত হয়েছেন ইমাম হাসান (আ.)। কিশোর ও যুবকদের আত্মগঠনে তিনি যে কর্মপন্থা নিজ জীবনে রেখে গেছেন তা এই ইট পাথরের নগর জীবনের মানুষকেও সোনার মানুষে পরিণত করতে সক্ষম। মানুষকে তার আত্মসত্তায় ফিরতেই হবে। তাকে তার জৈবিক খোলস ভেদ করে আত্মায় পৌঁছতে হবে। আত্মার চাহিদাগুলোকে মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করে আত্মগঠনে ব্রতী হতেই হবে। নতুবা বৃথা পর্যবসিত হবে তার এ জীবন। ইমাম হাসান (আ.) দুনিয়াবি বাদশাহীকে নির্দ্ধিধায় ত্যাগ করে বেহেশতের সর্দার হয়ে প্রমাণ করেছেন যে, পার্থিব জগৎ আর দেহবিলাসই মানুষের প্রকৃত মর্যাদা নয়। তার স্থান পরাপ্রাকৃতিক, ঊর্ধ্বজাগতিক। তাই তাকে সেভাবেই গড়ে তুলতে হবে নিজেকে। চলতে হবে মানবিক পথে, মানবীয় গুণাবলির শক্তিতে।

হাজি কাসেম সোলাইমানির শাহাদাত বার্ষিকী ও বিশ্ব প্রতিরোধদিবস

সম্পাদকীয় –

বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম
আমরা বিশ্বের মজলুম ও নিপীড়িতদের জন্য নিবেদিত, সাহসী ও আত্মত্যাগী অনন্য সেনানায়ক জেনারেল কাসেম সোলাইমানির কাপুরুষোচিত হাত্যাকা-ের এক বছর পূর্তির (৩ জানুয়ারি) দ্বারপ্রান্তে এসে উপস্থিত হয়েছিÑ যিনি ইসলাম ও মুসলমানদের রক্ষায় এবং সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে জীবন অতিবাহিত করেছেন এবং অবশেষে সন্ত্রাসীদের পৃষ্ঠপোষকদের হাতে শাহাদাত বরণ করেছেন।
বিশ^বাসী সাক্ষী যে, জেনারেল কাসেম সোলাইমানি আইএস-এর বিরুদ্ধে সংগ্রামে এবং এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর মূলোৎপাটনের জন্য তাঁর সারাটা জীবন ব্যয় করেছেন। মুসলিম দেশ ইরাক ও সিরিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল Ñ যা দখল করে আইএস ঐ দেশ দু’টিকে তাদের তথাকথিত ইসলামি সরকারের ভূমি বলে ঘোষণা করেছিল Ñ তিনি শাহাদতের সূধা পান না করা পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন।
জেনারেল সোলাইমানি এমন এক সময় ইরাকে ইসলামি ঐক্যের দুশমনদের হামলার শিকার হন যখন তিনি ইরাকের প্রধানমন্ত্রীর আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণে ইরাক সরকারের মেহমান হিসেবে বাগদাদে গিয়েছিলেন। কিন্তু বলদর্পী মার্কিন সরকারের নীতি হচ্ছে তাদের প্রতিপক্ষের লোকদেরকে যেখানে ও যেভাবে সম্ভব হত্যা করা; এ ক্ষেত্রে তাদের কাছে না মেহমানের মর্যাদা আছে, না কোনো দেশের রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের মর্যাদা আছে, না আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি তাদের কোন শ্রদ্ধাবোধ আছে।
গোটা দুনিয়া প্রত্যক্ষ করেছে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের বিজ্ঞানী ও বুদ্ধিজীবীদেরকে কী রকম নির্মমভাবে হত্যা করা হচ্ছে। সে সব বিজ্ঞানী ও বুদ্ধিজীবী কেবল ইরানি জাতির সম্পদ ছিলেন না, বরং তাঁরা ছিলেন সমগ্র ইসলামী বিশ্বের সম্পদ। কিছুদিন পর পরই তাঁদের একেক জন ইরানের মুসলিম জাতির ও ইসলামের শত্রুদের হাতে হামলার শিকার হয়ে শাহাদাত বরণ করছেন। তাদের সর্বশেষ ও সর্বসাম্প্রতিক কাপুরুষোচিত হত্যাকা-ের শিকার হয়েছেন ইরানের শীর্ষ পরমাণুবিজ্ঞানী ও দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের গবেষণা ও উদ্ভাবন বিষয়ক সংস্থার চেয়ারম্যান ড. মোহসেন ফাখরিজাদে। আমরা এখন এই প্রিয় শহীদের শাহাদাতের চেহ্লামের সময় অতিক্রম করছি।
কিন্তু যারা একটি জাতির বিজ্ঞানীদের হত্যা করে তাদের আসল উদ্দেশ্য কী? কেন তারা চিন্তার স্বাধীনতা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশ-বিস্তারের বিরোধী? কেন তারা জ্ঞান-বিজ্ঞানের মোকাবিলায় অস্ত্র ব্যবহার করে?! কেন চিন্তা ও কলমের মোকাবিলায় অস্ত্র ব্যবহার করে? আর কেনই বা তারা মুসলিম দেশগুলোর বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে? তাদের লক্ষ্য কি মুসলিম উম্মাহ্কে ও মুসলিম দেশগুলোকে দুর্বল ও অক্ষম করা ছাড়া আর কিছু?
প্রশ্ন হচ্ছে, ইসলামের শত্রুদের এ দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে মসলিম উম্মাহ্ ও ইসলামি দেশগুলোর কর্তব্য কী? ইসলামী উম্মাহ্ ও মুসলিম বিশ্বের ঐক্য এবং ইসলামের শত্রুদের মোকাবেলায় প্রতিরোধের কৌশল অবলম্বনই কি এই ইসলামবিরোধী ও জ্ঞানবিজ্ঞানবিরোধী স্রোতকে মোকাবিলা করার সেরা কর্মকৌশল নয়?
আমরা ইসলামের ইতিহাসের শুরু থেকে এ পর্যন্তকার সকল শহীদের বিদেহী নাফ্সের প্রতি, বিশেষত ইসলামি ইরানের সকল শহীদ, আরো বিশেষ করে জেনারেল কাসেম সোলাইমানি ও তাঁর শহীদ সঙ্গীদের এবং শহীদ ফাখরিজাদে ও অন্যান্য শহীদ বিজ্ঞানী ও বুদ্ধিজীবীর মহান বিদেহী নাফ্সের প্রতিÑযাঁরা জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নয়ন ও বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদের পথে শাহাদাতের উচ্চ মর্যাদা লাভ করেছেনÑসালাম পৌঁছে দিচ্ছি।
আমরা একই সাথে সালাম পৌঁছে দিচ্ছি ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রতিষ্ঠাতা হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর মহান ও পবিত্র বিদেহী নাফ্সের প্রতিÑ যাঁর চিন্তাদর্শে ও পবিত্র প্রতিরক্ষাকালীন সময়ে এমন সাহসী ও নির্ভীক সন্তানরা গড়ে উঠেছিলেন এবং যাঁর বুদ্ধিদীপ্ত নেতৃত্ব ও হেদায়াতের ছায়ায় ইসলামি বিপ্লবের বর্তমান নেতা হযরত আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী এমন বিচক্ষণ দিকনির্দেশনার মাধ্যমে ইসলামের মাহাত্ম্য ও মর্যাদা সমুন্নত রেখে বলদর্পিতাবিরোধী কর্মকৌশল এবং মুসলিম উম্মাহ্র শত্রুদের মোকাবিলায় প্রতিরোধের ধারা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছেন। মুসলমানদের স্বাধীনতা ও ইসলামকে সমুন্নত রাখতে বলদর্পিতার বিরুদ্ধে লড়াই করে যাঁরা শহীদ হয়েছেন সেই সব মহান শহীদের রক্তের সাথে আমরা অঙ্গীকারাবদ্ধ হচ্ছি যে, প্রতি বছর ৩ জানুয়ারি হাজি কাসেম সোলাইমানির শাহাদাত বার্ষিকীকে বিশ্ব প্রতিরোধদিবস হিসেবে উদ্যাপন করতে ভুলব না।

ড. সাইয়্যেদ হাসান সেহাত
সম্পাদক, নিউজলেটার

স্মরণীয় বাণী

 

এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর কাছে এলো এবং বলল : ‘হে আল্লাহ্্র রাসূল! আমাকে নসীহত্ করুন।’ রাসূলুল্লাহ্ (সা.) তাকে তিনবার জিজ্ঞেস করলেন : ‘আমি যদি তোমাকে নসিহত্ করি তা মেনে চলবে তো?’ লোকটি তিনবারই জবাব দিল: ‘জ্বী, হে আল্লাহ্র রাসূল!’ তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা.) এরশাদ করলেন : তোমাকে নসিহত করছি যে, যখনই তুমি কোনো কাজ আঞ্জাম দেয়ার সিদ্ধান্ত নেবে তখনি কাজটির পরিণতি সম্বন্ধে চিন্তা ও পর্যালোচনা করবে; কাজটা যদি উন্নতি ও হেদায়াতের উৎস হয়ে থাকে তাহলে তা আঞ্জাম দাও, আর তা যদি গোমরাহীর উৎস হয়ে থাকে তাহলে তা বর্জন করো।’
রাসূলে আকরাম (সা.) এরশাদ করেন : ‘যে কেউ কিছু জ্ঞান শিক্ষা করল এবং আল্লাহ্র সন্তুষ্টি লাভের জন্য তা লোকদেরকে শিক্ষা দিল আল্লাহ্্ তা‘আলা তাকে সত্তর জন নবীর পুরস্কারের সমতুল্য পুরস্কার প্রদান করবেন।’
হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) এরশাদ করেন : ‘পিতার ওপর কন্যার অধিকার হচ্ছে এই যে, তাকে সূরা আন্-র্নূ শিক্ষা দেবে।’
হযরত রাসূলে আকরাম এরশাদ করেন : : ‘তোমার মেহমানকে এমন কিছু করতে বাধ্য করো না যা সম্পাদন করা তার জন্য কঠিন।’
স্বীয় পুত্র মুহাম্মাদ বিন হানাফীয়ার উদ্দেশে কৃত অসিয়তে ইমাম আলী (আ.) এরশাদ করেন : ‘যে কেউ স্বীয় কাজের পরিণতি সম্বন্ধে চিন্তা-ভাবনা না করে কোনো কাজে হাত দেয় সে নিজেকে অত্যন্ত নোংরা ও অপছন্দনীয় ঘটনাবলির মুখোমুখি করে। আর কাজের আগে চিন্তা-ভাবনা ও পর্যালোচনা তোমাকে লজ্জিত হওয়া থেকে রক্ষা করবে।’
আমীরুল্ মু‘মিনীন্ হযরত আলী (আ.) এরশাদ করেন : ‘তোষামোদ ও ঈর্ষা মু‘মিনদের বৈশিষ্ট্য নয়, তবে জ্ঞানার্জনের লক্ষ্যে হলে তা ব্যতিক্রম।’
হযরত আলী (আ.) এরশাদ করেন : ‘নাফ্সের পবিত্রতাসহ কোনো পেশায় নিয়োজিত থাকা অপবিত্রতা মিশ্রিত ধন-সম্পদের তুলনায় উত্তম।’
হযরত ইমাম সাজ্জাদ্ (আ.) এরশাদ করেন : ‘তোমার পিতার অধিকার হচ্ছে এই যে, তুমি মনে রাখবে, সে হচ্ছে তোমার মূল আর তুমি হচ্ছ তার শাখা এবং মনে রাখবে, সে না হলে তোমারও অস্তিত্ব হতো না। অতএব, যখনই তোমার নিজের মধ্যে এমন কোনো নে‘আমত পাবে যা তোমাকে আনন্দিত করে তখন মনে করবে যে, তোমার পিতাই তোমার এ নে‘আমতের মূল। তাই আল্লাহ্র প্রশংসা করো এবং ঐ নে‘আমতের পরিপ্রেক্ষিতে তার প্রতি কৃতজ্ঞ হও।’
হযরত ইমাম বাকের (আ.) এরশাদ করেন : হযরত মূসা (আ.) একদিন আল্লাহ্র কাছে মুনাজাত করার সময় এক ব্যক্তিকে আল্লাহ্র ‘আরশের ছায়াতলে দেখতে পেলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন : ‘হে আমার রব! এই ব্যক্তি কে, যে, তোমার ‘আরশ তার ওপরে ছায়া ফেলেছে?’ আল্লাহ্্ বললেন : ‘এ হচ্ছে এমন এক ব্যক্তি যে তার পিতা ও মাতার কল্যাণ করেছে এবং সে চোগলখুরি করে নি।’
হযরত ইমাম বাকের (আ.) এরশাদ করেন : ‘কেউ যদি পিতা-মাতার জীবদ্দশায় তাদের উভয়ের প্রতি কল্যাণ সাধন করে থাকে, কিন্তু তাদের মৃত্যুর পর তাদের ঋণ পরিশোধ না করে এবং তাদের জন্য ইস্তিগর্ফা না করে, আল্লাহ্্ তাকে পিতামাতার অবাধ্য হিসেবে গণ্য করবেন।’
হযরত ইমাম জা‘ফর সাদেক (আ.) তাঁর সন্তানদের কয়েক জনের উদ্দেশে এরশাদ করেন : ‘আলসেমি ও অধৈর্য (অস্থিরতা) এই দু’টি স্বভাব পরিহার করো। কারণ, এ দু’টি তোমার জন্য দুনিয়া ও আখিরাতে কল্যাণ লাভের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে।’
আবূ ‘আম্র্ শায়বানী বলেন : হযরত ইমাম সাদেক (আ.)-কে দেখলাম একটি কাপড় গায়ে জড়িয়ে নিয়ে বেলচা হাতে তাঁর বাগানে কাজ করছেন এবং তাঁর শরীর থেকে ঘাম বেয়ে পড়ছে। আরয করলাম : ‘আপনার জন্য উৎসর্গ হই! বেলচাটা আমাকে দিন; আপনার পরিবর্তে আমি কাজ করব।’ তিনি এরশাদ করলেন : ‘আমি পছন্দ করি যে, ব্যক্তি কষ্টদায়ক রোদের গরমে স্বীয় যিন্দেগীর প্রয়োজন পূরণের জন্য কষ্ট করবে।’
হযরত ইমাম মূসা কাযেম্ (আ.) এরশাদ করেন : ‘পাকস্থলী হচ্ছে রোগব্যাধিসমূহের গৃহ ও কেন্দ্র।’
হযরত ইমাম রেযা (আ.) এরশাদ করেন : ‘আল্লাহ্্ তাকওয়ায়ে ইলাহীকে আত্মীয়-স্বজনের খোঁজখবর নেয়ার সাথে একত্রে উল্লেখ করেছেন। অতএব, যে কেউ আত্মীয়-স্বজনের খোঁজখবর নেয় না সে তাকওয়ায়ে ইলাহীর অধিকারী নয়।’

 

 

বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরামের পক্ষ থেকে দিদারুল আলমকে সম্মাননা প্রদান

মহামারির সময় অসাধারণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ, বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরাম “এসো সবাই” ক্যাম্পেইনের নেতৃত্ব ও কার্যকর পরিকল্পনার জন্য দিদারুল আলম-কে কৃতজ্ঞতা ও সম্মাননা প্রদান করেছে।
প্রযুক্তি প্ল্যাটফর্মের উদ্ভাবনী ব্যবহারের মাধ্যমে তিনি ব্যবসা, গণমাধ্যম ও শিল্পকলার বিভিন্ন ক্ষেত্রের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের একত্রিত করে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছেন, যা সহযোগিতা ও সহমর্মিতার এক উজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে ওঠে। এই ক্যাম্পেইন দেশের সবচেয়ে বিপন্ন জনগোষ্ঠীর জন্য খাদ্য ও সহায়তা নিশ্চিত করেছে।
তার এই প্রচেষ্টা প্রমাণ করেছে যে, সঠিকভাবে ব্যবহৃত হলে প্রযুক্তি এবং কমিউনিটি মোবিলাইজেশন অসাধারণ ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সক্ষম।
৪র্থ ডিজিটাল মার্কেটিং অ্যাওয়ার্ড ২০২০-তে এই স্বীকৃতি প্রদান করা হয়, যা দিদারুল আলমের নেতৃত্বে এক আশার আলো হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।
শরিফুল ইসলাম, প্রতিষ্ঠাতা ও ম্যানেজিং ডিরেক্টর, বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরাম বলেন, “এই সম্মাননা দিদারুল আলমের প্রতি কৃতজ্ঞতার এক প্রতীক এবং সংকটকালে তার অবদানের স্বীকৃতি।”

আমার বাবা

– মুহাম্মদ ইসমাঈল

বাবা আমার বটের ছায়া
মাথার উপর ছাতা
বাবার কথা পড়লে মনে
ভেজে চোখের পাতা

বাবা ছিলেন শিক্ষার কারিগর
মানুষ গড়তেন যিনি
জন্ম থেকে এই পর্যন্ত
বাবাকে আমি চিনি

বাবা ছিলেন বিশাল মনের
উদার নীল আকাশ
বাবার মুখে দেখলে হাসি
দুঃখ হতো নাশ।

বাবা ছিলেন বিশ্ব আমার
নিঃস্ব ভরা ভয়
বাবার বুকে মাথা রেখে
পেতাম সুখ আশ্রয়

বাবা ছিলেন সরল মানুষ
এন ভুলানো হাসি
দেখি না আর এই জগতে
দুঃখ ¯্রােতে ভাসি।

বাবা ছিলেন আদর্শ
আর দুঃখভরা জীবন
বাবা আমার চিন্তা করেন
তোমরা আছো কেমন।

বাবা ছিলেন অনেক দামী
যায় না তারে কেনা
দূর থেকে আমার বাবাকে
যায় না তারে চেনা।

বাবা ছিলেন রুপালি চাঁদ
জোসনামাখা রাতে
সুরের যাদু ছড়িয়ে দিতেন
বাঁশের বাঁশি হাতে।

বাবা ছিলেন অনেক গুণের
এখন কোথায় বাস
ভাবনা মনে যায় ছড়িয়ে
বুকে দীর্ঘশ্বাস।

বাবার জন্য দুহাত তুলে
করছি মুনাজাত
বাবা আমার ভালো থাকুন
দূর আকাশের চাঁদ।

কত কষ্ট দিয়েছি বাবা
করে দাও মাফ
আমার জন্য দোয়া কর
মন থেকে ছাপ।