All posts by dreamboy

সংবাদ বিচিত্রা

১। বিশ্বনবী (সা.)-এর অবমাননার প্রতি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ন্যক্কারজনক : ইরানের সর্বোচ্চ নেতা
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উপলক্ষে গত ৩ নভেম্বর ২০২০ ইরানি জনগণের পাশাপাশি গোটা মুসলিম উম্মাহর উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছেন। এতে তিনি আবারো ফ্রান্সে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর ব্যাঙ্গাত্মক কার্টুন পুনঃপ্রকাশ এবং এর প্রতি দেশটির সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার তীব্র নিন্দা জানান।
তিনি বলেন, একজন কার্টুনিস্ট যখন এ ধরনের অবমাননাকর কাজ করে কিংবা একটি পত্রিকা যখন তা প্রকাশ করে তখন বিষয়টি একরকম থাকে আর যখন সেই দেশের সরকারের পক্ষ থেকে এই কুকর্মকে পৃষ্ঠপোষকতা করা হয় তখন সেটি অনেক বেশি জঘন্য চরিত্র ধারণ করে। ফ্রান্সের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে এই ন্যক্কারজনক অপকর্মকে সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া হয়েছে।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা বলেন, তবে আশার কথা মুসলিম বিশ্ব নীরব থাকেনি। প্রাচ্য থেকে পাশ্চাত্যের সর্বত্র মুসলমানরা তাদের ঈমানি শক্তির পরিচয় দিয়েছেন। তারা তাদের প্রাণপ্রিয় নবীর অবমাননার বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন।
আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী বলেন, ফ্রান্স দাবি করে, মানবাধিকার ও বাক-স্বাধীনতার কারণে তারা এ কাজ করছে। অথচ এই ফ্রান্স উগ্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়। ফ্রান্স ইরানের সন্ত্রাসী মোনাফেকিন গোষ্ঠীকে সব রকম সহযোগিতা করেছে এবং এই গোষ্ঠী আমাদের দেশের প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতিসহ ১৭ হাজার ইরানিকে হত্যা করেছে।
তিনি বলেন, এই ফ্রান্স বন্য জন্তুতুল্য ও রক্তপিপাসু (ইরাকের সাবেক শাসক) সাদ্দামকে ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অত্যাধুনিক অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেছে। প্যারিস প্রকাশ্যে এই সহযোগিতা দিয়েছে এবং ঘোষণা করেছে। সেই নির্লজ্জ ফ্রান্স এখন বাক স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের বুলি আওড়ায়।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা বলেন, বিগত বছরগুলোতে আমেরিকা ও ইউরোপীয় দেশগুলোতে বিশ্বনবীর (সা.) অবমাননা বারবার করা হয়েছে। কিন্তু এসবের মাধ্যমে তারা মহানবীর মর্যাদার বিন্দুমাত্র ক্ষতি করতে পারেনি। যেভাবে মক্কা ও তায়েফের কাফেররা একদিন তাদের অপতৎপরতার মাধ্যমে বিশ্বনবী কিংবা ইসলামের ক্ষতি করতে পারেনি বর্তমানেও পশ্চিমা বিশ্ব এই মহান নবী (সা.) বা ইসলামের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।
আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী বলেন, এখান থেকে পশ্চিমাদের কথিত সভ্যতার কদার্য দিকটি ফুটে উঠেছে। তাদের কাছে উন্নত প্রযুক্তি থাকায় তাদের এই পাশবিক ও বর্বর চেহারা ঢেকে রাখলেও মাঝেমধ্যে তাদের প্রকৃত চেহারা বিশ্ববাসীর সামনে প্রকাশ হয়ে পড়ছে। কয়েক শতাব্দী ধরে তারা এই কথিত সভ্যতার দাবি করে আসলেও তাদের অসভ্যতা ও বর্বরতা বিশ্ববাসীর কাছে দিনদিন ¯পষ্ট হয়ে পড়ছে।
ইসলামি ঐক্য সপ্তাহ
আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী তাঁর ঈদে মিলাদুন্নবীর ভাষণে আরো বলেন, ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম খোমেইনী (রহ.) বর্তমানে ইমামের আহ্বান অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি প্রয়োজন। ইমাম যখন এই ঐক্যের আহ্বান জানিয়েছিলেন, সেদিন মুসলিম বিশ্বের বহু নেতা এই আহ্বানের গুরুত্ব উপলব্ধি করেননি। আবার অনেকে উপলব্ধি করেও শুধু বিদ্বেষের কারণে তাতে সাড়া দেননি।
কিন্তু আজ মুসলিম বিশ্বে যেসব ঘটনা ঘটছে তাতে উপলব্ধি করা যায়, মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য কতটা জরুরি ছিল। আজ ফিলিস্তিন সংকটকে ইহুদিবাদী ইসরাইলকে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়ার মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা চলছে। ফিলিস্তিন মুসলিম বিশ্বের প্রধান সংকট হলেও সেটি থেকে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি সরিয়ে রাখার চেষ্টা চলছে। কিন্তু এসব অপচেষ্টায় কোনো কাজ হবে না। ফিলিস্তিন একদিন মুক্ত হবেই।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা বলেন, যে ইহুদিবাদী ইসরাইল ফিলিস্তিনি জাতির ভূমি দখল ও হাজার হাজার ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে সেই ইসরাইলের সঙ্গে স¤পর্ক স্থাপন করা এবং স¤পর্ক স্থাপন করে তৃপ্তির হাসি হাসা চরম ন্যক্কারজনক ঘটনা। এর চেয়ে অপমান আর হতে পারে না।
তিনি বলেন, ইমামের আহবানের গুরুত্ব মুসলমানরা উপলব্ধি না করলেও ইসলামের শত্রুরা বুঝতে পেরেছে। এ কারণে তারা ইসলামের বিভিন্ন মাজহাবের মধ্যে যাতে ঐক্য প্রতিষ্ঠা না হয় সেজন্য থিংক ট্যাংক প্রতিষ্ঠা করে সেখান থেকে বিভেদ সৃষ্টির সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছে। কীভাবে মুসলমানদের মধ্যে মতপার্থক্য আরো বেশি উসকে দেয়া যায় তারা সারাক্ষণ সে চেষ্টা চালাচ্ছে। পশ্চিমা বিশ্ব এই বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টার অংশ হিসেবে দায়েশ (আইএস) সৃষ্টি করেছে।
কিন্তু এই দায়েশকে মধ্যপ্রাচ্যের যেসব আরব দেশ অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সমর্থন দিয়েছে তাদের অপরাধ অনেক বেশি। যেসব সন্ত্রাসী মানবতাবিরোধী অপরাধ চালিয়েছে তাদের চেয়ে যারা তাদেরকে সব ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে তাদের অপরাধ বহুগুণ বেশি।
কাশ্মির থেকে লিবিয়া পর্যন্ত মুসলিম বিশ্বের যত সংকট আছে তার সব সংকটের সমাধান মুসলিম বিশ্বের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সম্ভব বলে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা মন্তব্য করেন।
ভাষণে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়েও কথা বলেন আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী। মার্কিন গণতন্ত্রকে যারা মডেল হিসেবে তুলে ধরে তাদের সমালোচনা করে তিনি বলেন, যে ব্যক্তি এখন প্রেসিডেন্টের দায়িত্বে আছেন তিনি বলছেন, আমেরিকার ইতিহাসে এর চেয়ে বেশি কারচুপির ফাঁদ আর কখনো তৈরি করা হয়নি। নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি হবে বলে তিনি সংশয় প্রকাশ করেছেন।
আর নির্বাচনের অপর প্রার্থী বলছেন, ট্রা¤প বড় ধরনের কারচুপির চেষ্টা করছেন। এই হচ্ছে, মার্কিন গণতন্ত্রের উদাহরণ। আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী বলেন, যে ব্যক্তিই নির্বাচিত হোক না কেন তাতে আমেরিকা পতন ঠেকানো সম্ভব হবে না। আজ না হোক কাল আমেরিকার পতন হবেই।
ইরানের সঙ্গে আমেরিকার শত্রুতা
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা বলেন, তাঁর দেশের সঙ্গে সঙ্গে আমেরিকার শত্রুতা থেমে নেই। আমেরিকার কোনো সরকার আমাদেরকে সহযোগিতা করবে না। আমাদেরকে অভ্যন্তরীণভাবে শক্তিশালী হতে হবে।
আমেরিকাকে হতাশ করে দিতে হবে। ইরানের জনগণ নিষেধাজ্ঞার ক্ষতিকর প্রভাবের বিরুদ্ধে কঠোরভাবে রুখে দাঁড়িয়েছে। এজন্য তিনি ইরানি জনগণকে ধন্যবাদ জানান।
আর্মেনিয়া-আজারবাইজান যুদ্ধ
ভাষণের শেষাংশে তিনি নাগরনো-কারাবাখের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যকার চলমান যুদ্ধের ব্যাপারে দুঃখ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, এর অবসান দরকার। আজারবাইজানের যেসব ভূখ- আর্মেনিয়া দখল করে নিয়েছে তা ছেড়ে দিতে হবে। এটি আজারবাইজানের অধিকার।
সেইসঙ্গে এই ভূখ-ে যেসব আর্মেনীয় জনগোষ্ঠী বসবাস করেন তাদের অধিকারও সমুন্নত রাখতে হবে। এ ছাড়া, এই যুদ্ধের সুযোগে কেউ যদি ইরান সীমান্তে সন্ত্রাসীদের জড়ো করার চেষ্টা করে তাহলে সেসব সন্ত্রাসীকে কঠোর হাতে দমন করা হবে।
সর্বোচ্চ নেতার ভাষণ রেডিও ও টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারিত হয়।

২। রাসূল (সা.)-এর অবমাননা মানবীয় মূল্যবোধ ও নৈতিকতার অবমাননার শামিল : ইরান
ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি বলেছেন, ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর যেকোনো ধরনের অবমাননা করা প্রকারান্তরে মানবীয় মূল্যবোধ, নৈতিকতা ও স্বাধীনতাকে অপমান করার শামিল। তিনি বিশ্বনবী (সা.)-এর পবিত্র জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে মুসলিম দেশগুলোর নেতাদের কাছে পাঠানো এক শুভেচ্ছা বার্তায় এ মন্তব্য করেন।
গত অক্টোবর মাসে ফরাসি পত্রিকা ‘শালি এবদো’ মানবতার মুক্তির দূত বিশ্বনবী (সা.)-এর ব্যাঙ্গাত্মক কার্টুন পুনঃপ্রকাশ করার পর বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদের যে ঝড় উঠেছে সেদিকে ইঙ্গিত করে প্রেসিডেন্ট রুহানি এ মন্তব্য করেন। এসব অবমাননাকর কার্টুন ২০০৫ সালে একটি ড্যানিশ পত্রিকা প্রথম প্রকাশ করে এবং ২০০৬ সালে এই ‘শার্লি এবদো’ পত্রিকাই এগুলো একবার পুনঃপ্রকাশ করেছিল।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতাসহ দেশের শীর্ষস্থানীয় প্রায় সব কর্মকর্তা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর অবমাননার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। এছাড়া, ইরানের সাধারণ জনগণ গত বেশ কয়েকদিন ধরে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে রাজপথে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন।
প্রেসিডেন্ট রুহানি তাঁর বার্তায় আরো বলেন, মহনবী (সা.) ছিলেন সর্বোত্তম পুরুষ এবং গোটা বিশ্বের জন্য রহমত। এমন একজন আদর্শ পুরুষের অবমাননা সব ধরনের নীতি-নৈতিকতার অবমাননার শামিল। তিনি বলেন, ‘ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান এই ঘৃণিত পদক্ষেপের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে এবং একই কাজ করার জন্য সব মুসলিম দেশের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে।’
আহলে সুন্নাতের বর্ণনা অনুযায়ী বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা (সা.) ১২ রবিউল আউয়াল ধূলির ধরায় আগমন করেন। তবে শিয়া মাজহাবের বর্ণনায় বলা হয়েছে, মানবতার মুক্তির দূত ১৭ রবিউল আউয়াল জন্মগ্রহণ করেন।
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জন্মদিবস নিয়ে এই মতপার্থক্য যাতে শিয়া ও সুন্নি মুসলমানদের মধ্যে প্রবল মতবিরোধ তৈরি করতে না পারে সেজন্য ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম খোমেইনী (রহ.) প্রতি বছর ১২ রবিউল আউয়াল থেকে ১৭ রবিউল আউয়াল পর্যন্ত সময়কে ঐক্য সপ্তাহ পালন করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে গত চার দশক ধরে ইরানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঐক্য সপ্তাহ পালিত হয়ে আসছে।

৩। বিশ্বনবীকে অবমাননার নিন্দা ও ফ্রান্সের যুবকদেরকে ইরানের সর্বোচ্চ নেতার কিছু প্রশ্ন
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী ফরাসি তরুণদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, ‘আপনারা আপনাদের প্রেসিডেন্টকে জিজ্ঞেস করুন কেন তিনি একজন আল্লাহর রাসূলকে অবমাননা করার পক্ষে অবস্থান নিলেন? এবং কেন এটাকে তিনি বাকস্বাধীনতা বলছেন?
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা ফরাসি যুবকদের উদ্দেশ্যে দেয়া বাণীতে প্রশ্ন করেছেন, পবিত্র ও ঐশী ব্যক্তিত্বদেরকে অপমান অপদস্থ করাই কি বাকস্বাধীনতা? তিনি আরো বলে, ফ্রান্সের যেসব মানুষ ম্যাক্রনকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করেছেন ম্যাক্রন সেই সব মানুষকে তাঁর এই বোকামিপূর্ণ কর্মকা-ের মাধ্যমে মূলত তাদেরকে কি অপমান করেননি? ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আরো প্রশ্ন করেন, তথাকথিত ইহুদি নিধনযজ্ঞের কল্পকাহিনী বা হলোকাস্টের বিরুদ্ধে কথা বলাকে কেন অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়? যদি কেউ হলোকাস্টের বিষয়ে প্রশ্ন তোলে কিংবা সন্দেহ করে অথবা অস্বীকার করে তাহলে কেন তাদেরকে শাস্তি দেয়া হয়? অথচ বিশ্বনবীকে অবমাননার ঘটনাকে বাকস্বাধীনতা বলে দাবি করা হচ্ছে!
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রন সম্প্রতি বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-কে অবমাননা করে ব্যাঙ্গচিত্র প্রকাশের বিষয়টিকে সমর্থন করে বক্তব্য দেয়ার পর বিশ্বজুড়ে মুসলমানদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। এরপরও ওই দেশটির সরকার এটাকে বাকস্বাধীনতা বলে দাবি করছে। এমনকি পাশ্চাত্যের আরো অনেক দেশও এটাকে বাকস্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক অধিকার বলে দাবি করছে। ফ্রান্সসহ পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে ইসলাম ভীতি ছড়ানোর মাত্রা বহুগুণে বেড়েছে, অথচ এ ধর্ম রহমত, শান্তি ও বন্ধুত্বের বার্তা বয়ে এনেছে।
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) হচ্ছেন মুসলমানদের মধ্যে ঐক্যের কেন্দ্রবিন্দু এবং এমনকি এ ধর্ম অন্যান্য ঐশী ধর্মের প্রতিও সম্মান দেখাতে বলে। সব ধর্মেই উগ্রপন্থাকে ঘৃণা ও নিন্দা জানানো হয়। তাই কারোরই উচিত নয় রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য উগ্রন্থীদেরকে হাতিয়ার বা অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করা। কিন্তু ফরাসি কর্মকর্তারা এ অপকর্মটিই করছেন। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রন বাকস্বাধীনতার দোয়াই দিয়ে বিশ্বনবীকে অবমাননা করার যে ধৃষ্টতা দেখিয়েছেন তার কোনো ব্যাখ্যা থাকতে পারে না এবং তাঁর এ আচরণ সব ধর্মের মধ্যে গঠনমূলক সহযোগিতা, সহাবস্থান ও শান্তির জন্য সহায়ক নয়।
ইরাকের খ্রিস্টান পাদ্রি কার্ডিনাল মার লুইস রাফায়েল সাকু এক বিবৃতিতে বলেছেন, সব ধর্মের লক্ষ্য হওয়া উচিত ঘৃণা ও সহিংসতার পরিবর্তে পার¯পরিক ভালোবাসা, শান্তি, সহযোগিতা ও জনগণের মধ্যে আস্থার পরিবেশ তৈরি করা।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, মুসলমানদের ব্যাপারে ফরাসি প্রেসিডেন্টের আচরণ কোনো ধর্মেরই নীতি আদর্শের মধ্যে পড়ে না এবং তিনি সারা বিশ্বের জন্য চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছেন। প্রেসিডেন্টের পদে বসে বাকস্বাধীনতার ব্যাপারে ম্যাক্রণের দ্বিমুখী নীতি সেদেশের জনগণের প্রতি অবমাননা যারা কিনা তাঁকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় এনেছে। কারণ, বাকস্বাধীনতার অর্থ অন্য ধর্মের প্রতি অবমাননা করা নয়।
বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, ফরাসি প্রেসিডেন্ট খুব সহজে বিশ্বনবীকে অবমাননার ঘটনাকে সমর্থন করেছেন। অথচ ওই দেশটিতেই হলোকাস্টের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলা যায় না এবং এটাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়।

৪। সারা দেশে পালিত হয়েছে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)
যথাযথ মর্যাদায় গত ৩০ অক্টোবর বাংলাদেশে উদ্যাপিত হয়েছে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব ও শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) ৫৭০ খ্রিস্টাব্দের ১২ রবিউল আউয়াল মাসে মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন। সমগ্র বিশ্বে মুসলমানদের কাছে ১২ রবিউল আউয়াল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণময় দিন।
বাংলাদেশে দিনটি সরকারি ছুটির দিন এবং দেশের মুসলিমরা এ দিন বিশেষ ইবাদত করেন। দিনটি উপলক্ষে মিলাদ মাহফিল, আলোচনা ও কোরআন খতমসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজন করে ইসলামিক ফাউন্ডেশনসহ বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক দল, মসজিদ ও মাদরাসা।
এক তথ্য বিবরণীতে পিআইডি জানায়, বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে জাতীয়ভাবে ঈদে মিলাদুন্নবী পালন শুরু করেন।
ঈদে মিলাদুন্নবী পালন উপলক্ষে ২৯ অক্টোবর থেকে ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত ১৪ দিনব্যাপী বিশেষ কর্মসূচি হাতে নেয় ইসলামিক ফাউন্ডেশন।

৫। ‘শত্রুরা কখনোই ইসলামের নূরকে নিভিয়ে দিতে পারবে না’
বাংলাদেশে নিযুক্ত ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মাদ রেজা নাফার বলেছেন, শুত্রুরা যত চেষ্টাই করুক না কেন তারা কখনোই ইসলামের নূরকে নিভিয়ে দিতে পারবে না। বরং দিন দিন তা আরও প্রজ¦লিত হবে। গত ২ নভেম্বর ২০২০ পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) ও ইসলামি ঐক্য সপ্তাহ উপলক্ষে আয়োজিত সেমিনারে প্রধান অতিথির ভাষণে তিনি এসব কথা বলেন। ঢাকাস্থ ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের উদ্যোগে আয়োজিত এই ওয়েবিনারে রাষ্ট্রদূত বলেন, পবিত্র রবিউল আউয়াল মাস এজন্য গুরুত্বপূর্ণ যে, এমাসে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানব হযরত মুহাম্মাদ (সা.) সমগ্র মানবজাতির রহমতস্বরূপ পৃথিবীতে আগমন করেন। তাঁর সৃষ্টি গোটা সৃষ্টিজগৎ ও মানবজাতির জন্য সবচেয়ে বড় ঘটনা।
হাদিসে কুদসীতে বর্ণিত হয়েছে যে, মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘হে নবী! আপনাকে যদি সৃষ্টি না করতাম তাহলে পৃথিবীর কোনো কিছুই সৃষ্টি হতো না।’ তাই আমাদের কাছে এই প্রিয় নবীর জন্মদিনের চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে?
পৃথিবীতে তাঁর শুভাগমন আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় ঈদ। যদিও ইসলামের বিভিন্ন মাজহাবের মধ্যে তাঁর জন্মদিন নিয়ে কিছুটা মতপার্থক্য রয়েছে। কোনো কোনো মাজহাবের মতে ১২ই রবিউল আউয়াল রাসূলের জন্মদিন আবার কোনো কোনো মাজহাবের মতে ১৭ই রবিউল আউয়াল হলো রাসূলের জন্মদিন। সুতরাং এ ধরনের বিষয় মুসলমানদের মধ্যে যাতে কোনো বিভেদ সৃষ্টি করতে না পারে সেজন্য ইরানের ইসলামি বিপ্লবের রূপকার ইমাম খোমেইনী (রহ.) ১২ই রবিউল আউয়াল থেকে ১৭ই রবিউল আউয়ালকে ইসলামি ঐক্য সপ্তাহ হিসেবে ঘোষণা করেছেন যাতে মুসলমানরা ঐক্যবদ্ধ হতে পারে।
মোহাম্মাদ রেজা নাফার বলেন, মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য যখন অত্যন্ত জরুরি তখন তাদের একটি অংশ ইহুদি-নাসারাদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। ফিলিস্তিনের মুসলমানরা যখন ইহুদিবাদী ইসরাইল কর্তৃক চরম নির্যাতনের শিকার হচ্ছে তখন সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন ও সুদানের মতো মুসলিম দেশ এই অবৈধ রাষ্ট্রের সাথে সরাসরি স¤পর্ক স্থাপনের ঘোষণা দিয়ে ফিলিস্তিনের মুসলিম ভাইদের যন্ত্রণাকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। তিনি বলেন, বর্তমান বিশ্ব দুটি ভয়াবহ ভাইরাসে আক্রান্ত। একটি প্রাণঘাতি করোনাভাইরাস এবং আরেকটি ইসলাম আতঙ্ক। পশ্চিমারা গত দুই দশক ধরে ইসলামের সাথে দ্বন্দ্বের পথ বেছে নিয়েছে। ফ্রান্সে রাসূল (সা.)-কে নিয়ে অবমাননাকর কার্টুন প্রকাশ করাই তার প্রমাণ।
কেন ফ্রান্স আজ ইসলামের দুশমনের পতাকাবাহী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে? কারণ, তারা ইসলামকে ভয় পায়। ফ্রান্সের একজন খ্রিস্টান ধর্মজাজক সম্প্রতি বলেছেন, ফ্রান্স আগামী দিনে মুসলিম দেশে পরিণত হবে। আমাদের সকল শিশু ভবিষ্যতে মুসলমান হয়ে যাবে। ইসলাম সকল জায়গায় বিস্তৃত হবে। দুনিয়ার প্রায় ৫০ শতাংশ শিশুর নাম মুহাম্মাদ। যদি আমরা এ ব্যাপারে এখনই পদক্ষেপ না নেই তাহলে ইসলাম ইউরোপেও বিজয়ী হবে।
আইরিশ নাট্যকার ও রাজনীতিবিদ জর্জ বার্নার্ড শ যিনি ৭০ বছর আগে মৃত্যুবরণ করেছেন তাঁর দুটি বইয়ে লিখেছেন, আমি ভাবিষ্যদ্ববাণী করছি যে, আগামী দিনে ইউরোপ মুহাম্মাদ (সা.)- এর ধর্মের দিকে ফিরে যাবে। মুহাম্মাদ (সা.) ব্যতীত আর
কেউই বিশ্বের সমস্যার সমাধান দিতে পারবে না। সুতরাং আমরা বুঝতে পারছি রাসূল (সা.)-এর অবমাননার পিছনে মূল কারণ কী। তিনি বলেন, ইসলামের বিরুদ্ধে শত্রুতার বিষয়টি আজ আর কোনো মুসলমানের কাছেই গোপন নয়। ইসলামের শত্রুরা আজ প্রকাশ্যে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ময়দানে নেমেছে। কারণ, ইসলামি বিশ্বের শক্তি আগের চেয়ে আরো দুর্বল হয়ে পড়েছে। ফলে মুসলমানরা আজ দু-ধারবিশিষ্ট তলোয়ারের মুখে পড়ে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে পড়ছে। তাই মুসলমানদের এই সংকট থেকে মুক্তির জন্য ঐক্যের বিকল্প নেই।
ফরিদগঞ্জ মজিদিয়া কামিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ড. মাওলানা এ. কে. এম মাহবুবুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন ঢাকাস্থ ইরান দূতাবাসের কালচারাল কাউন্সেলর ড. সাইয়্যেদ হাসান সেহাত।
অনুষ্ঠানে আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক ড. কে এম সাইফুল ইসলাম খান, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সাবেক পরিচালক ডা. খিজির হায়াত খান, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মো. মুহিবুল্লাহ সিদ্দিকী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের সাবেক চেয়ারমান ড. মোঃ আতাউল্ল্যাহ এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের চেয়ারম্যান আব্দুল করিম।
অনুষ্ঠানে পবিত্র কুরআন থেকে তেলাওয়াত করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক আবু আব্দুল্লাহ। অনুষ্ঠানে নাতে রাসুল পাঠ করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিদ্যা বিভাগের ছাত্র হাসান কিবরিয়া। অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক ড. কামাল উদ্দিন।

৬। পরমাণু বিজ্ঞানী হত্যার পর যে বার্তা দিলেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের পরমাণু বিজ্ঞানীকে হত্যার সঙ্গে জড়িত সবার শাস্তি নিশ্চিত করতে বলেছেন সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী।
তিনি বলেছেন, এ ক্ষেত্রে কোনো দ্বিধা-সন্দেহের অবকাশ নেই। পরমাণু বিজ্ঞানী মোহসেন ফাখরিজাদেহর শাহাদাত উপলক্ষে এক বার্তায় তিনি গত ২৮ নভেম্বর ২০২০ এ কথা বলেন।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আরও বলেন, এই হত্যাকা- যারা ঘটিয়েছে এবং যারা এর পেছনে রয়েছে তাদের সবার শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে তিনি বিজ্ঞান, গবেষণা ও কারিগরি ক্ষেত্রে এই বিজ্ঞানীর পরিকল্পনা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।
আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী বলেন, জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে চেষ্টা-প্রচেষ্টা ও অবদানের কারণে এই মহান বিজ্ঞানীকে হত্যা করা হয়েছে। আল্লাহ তাঁকে কবুল করেছেন। তিনি শাহাদাতের উচ্চ মর্যাদা অর্জন করেছেন। এটা তাঁর জন্য ঐশী পুরস্কার। উল্লেখ্য, গত ২৭ নভেম্বর ইরানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের রিসার্চ ও ইনোভেশন সংস্থার প্রধান মোহসেন ফাখরিজাদেহ সন্ত্রাসী হামলায় শহীদ হন।

৭। মরণোত্তর সামরিক পদক পেলেন শহীদ পরমাণুবিজ্ঞানী ফাখরিজাদে
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতা ও সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী সম্প্রতি সন্ত্রাসী হামলায় শহীদ শীর্ষ পরমাণুবিজ্ঞানী মোহসেন ফাখরিজাদেকে মরণোত্তর সামরিক পদকে ভূষিত করেছেন।
গতমাসের শেষদিকে ইরানের রাজধানী তেহরানের অদূরে এক সন্ত্রাসী হামলায় ফাখরিজাদে নিহত হন। এই পাশবিক হত্যাকা-ের জন্য ইহুদিবাদী ইসরাইলকে দায়ী করেছে তেহরান।
ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর চিফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল মোহাম্মাদ বাকেরি গত ১৩ ডিসেম্বর ফাখরিজাদের বাসভবনে গিয়ে তাঁর পরিবারের কাছে সর্বোচ্চ নেতার স্বাক্ষরিত ‘ফার্স্ট ক্লাস অর্ডার অব নাস্র [বিজয়]’ পদক হস্তান্তর করেন।
এ সময় জেনারেল বাকেরি বলেন, ইসলামি বিপ্লব এবং ইরানের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় অবদান রাখার স্বীকৃতি হিসেবে এই পদক প্রদান করা হলো। পদক প্রদানের সময় ইরানের শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন সামরিক কমান্ডার জেনারেল বাকেরিকে সঙ্গ দিচ্ছিলেন।
তিনি আরও বলেন, সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা এবং লজিস্টিক অবদানের স্বীকৃতি হিসাবে এটি সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে প্রদত্ত সর্বোচ্চ পদক। ফাখরিজাদে শহীদ হওয়ার পর ইরানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী আমির হাতামি তাঁকে উপ প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে অভিহিত করেছিলেন।
জেনারেল বাকেরি আরো বলেন, উপযুক্ত সময় ও স্থানে এই শীর্ষ পরমাণুবিজ্ঞানী হত্যার প্রতিশোধ নেয়া হবে।

৮। আইআরজিসিতে যুক্ত হলো নতুন যুদ্ধজাহাজ
ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসি’র নৌ ইউনিটে গত ১৯ নভেম্বর ২০২০ যুক্ত হয়েছে নতুন যুদ্ধজাহাজ ‘শহীদ রুদাকি’। ইরানের নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি বিশাল আকৃতির এই জাহাজকে হঠাৎ দেখলে মনে হয় সাগরে ভাসমান এক ছোট্ট শহর। জাহাজটির ভিডিও প্রকাশ করেছে আইআরজিসি।
ইরানের দক্ষিণাঞ্চলীয় বন্দর আব্বাসে বিশাল এই যুদ্ধজাহাজ সংযোজনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন আইআরজিসি’র প্রধান মেজর জেনারেল হোসেইন সালামিসহ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা।
বিশাল এই যুদ্ধজাহাজ বিভিন্ন ধরনের হেলিকপ্টার, ড্রোন, ক্ষেপণাস্ত্র, রাডার এবং আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বহন করতে সক্ষম। এতে রয়েছে থ্রিডি রাডার, জাহাজ থেকে জাহাজে এবং আকাশে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র। এছাড়া রয়েছে অত্যাধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা।
এই যুদ্ধজাহাজ দূরবর্তী মহাসাগরে গিয়েও অভিযান চালাতে সক্ষম। বিশাল আকারের হওয়ার কারণে ইরানের এই জাহাজকে সাগরে ভাসমান শহর হিসেবেও অভিহিত করা হচ্ছে।
এই যুদ্ধজাহাজ সাগরে ইরানসহ বিভিন্ন দেশের বাণিজ্যিক জাহাজকে নিরাপত্তা দেওয়ার পাশাপাশি মানবিক সহযোগিতা দেওয়ার কাজও করবে। ইরানের রয়েছে বিশাল পানিসীমা। এ কারণে দেশটি ইসলামি বিপ্লবের পর থেকেই সামরিক বাহিনীর অন্যান্য ইউনিটের পাশাপাশি নৌবাহিনীকে শক্তিশালী করার কাজে মনোনিবেশ করেছে।

৯। মালবাহী ওয়াগন নির্মাণে স¤পূর্ণ স্বনির্ভর ইরান
মালবাহী ওয়াগন উৎপাদনে স¤পূর্ণ স্বনির্ভরশীলতা অর্জন করেছে ইরানের রেলওয়ে শিল্প। ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের রেলওয়ে (যা আরএআই নামে পরিচিত) প্রধান সাইদ রাসুলি এই তথ্য জানান।
গত ৮ ডিসেম্বর ২০২০ দেশীয়ভাবে তৈরি ওয়াগন ব্রেক সিস্টেম এবং রেল চাকার উন্মোচন অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, আরএআই মালবাহী ওয়াগনের জন্য ৫০০টি মনোব্লক চাকা ও ৫০০টি ব্রেক সিস্টেম ক্রয়ের জন্য দেশীয় উৎপাদনকারীদের সাথে একটি চুক্তি সই করতে যাচ্ছে।
ইরানি এই কর্মকর্তা বলেন, এবছর প্রথমবারের মতো দেশীয়ভাবে তৈরি চাকা জাতীয় রেলে যুক্ত হচ্ছে।

১০। আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যেই কেবল ইরান থেকে অস্ত্র ক্রয় করা যাবে : আলী রাবিয়ি
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান বলেছে, যেসব দেশ ইরান থেকে অস্ত্র কিনতে চায় তারা শুধু আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যেই তা কিনতে পারবে। কোনো দেশ যুদ্ধকামী নীতি থেকে ইরানি অস্ত্র কিনতে পারবে না।
ইরান সরকারের মুখপাত্র আলী রাবিয়ি গত ২৩ অক্টোবর ইরানের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা আইআরবি-কে এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, যেসব দেশ ইরান থেকে অস্ত্র কিনতে চায় তাদেরকে ইরানের শর্ত মেনেই তা করতে হবে, কোনো দেশ তাদের নিজেদের শর্ত ইরানের ওপর চাপিয়ে দিতে পারবে না। অস্ত্র ক্রেতাদের দেশগুলোকে অবশ্যই অস্ত্র কেনার যৌক্তিক এবং নৈতিক অবস্থান তুলে ধরতে হবে, তারা কেউ যুদ্ধংদেহী মনোভাব নিয়ে ইরানের অস্ত্র কিনতে পারবে না।
আলী রাবিয়ি সু¯পষ্টভাবে বলেন, আন্তর্জাতিক নিয়ম নীতি এবং কাঠামোর ভেতরে থেকেই ইরান অস্ত্র বিক্রি করবে। তিনি বলেন, ‘আমরা প্রকৃতপক্ষে অস্ত্রের ভক্ত নই, আমরা শান্তি চাই এবং মধ্যপ্রাচ্যকে অস্ত্র-গুদামে পরিণত করতে চাই না।’
ইরান সরকারের মুখপাত্র আরো বলেন, আমেরিকা মধ্যপ্রাচ্যকে অস্ত্রের গুদামে পরিণত করেছে এবং এর মাধ্যমে মূলত মার্কিন অস্ত্র ব্যবসায়ীরা লাভবান হচ্ছেন। তাঁদের কাছে সবসময় মানুষের জীবনের চেয়ে অর্থগত লাভটাই বেশি পছন্দের।

১১। ইরানে বিশালায়তনের ভূগর্ভস্থ শহরের সন্ধান
মধ্য ইরানের তাফতেশে বিশালায়তনের একটি ভূগর্ভস্থ শহরের সন্ধান পাওয়া গেছে। দেশটির প্রতœতাত্ত্বিকরা বলছেন, সম্প্রতি তাঁরা যে একটি প্রবেশপথ আবিষ্কার করেছেন সেটি বিশাল একটি ভূগর্ভস্থ শহরের প্রবেশদ্বার হতে পারে। গত ৮ ডিসেম্বর তাফরেশের গভর্নর আব্দোলরেজা হাজালিবেইগি এই তথ্য জানান।
ওই কর্মকর্তা জানান, সম্প্রতি এক সপ্তাহে খনন কাজ পরিচালনা করা হয়। এসময় তাফরেশের ভূগর্ভস্থ ওই শহরটির প্রধান এলাকায় প্রবেশের প্রথম চিহ্ন প্রকাশিত হয়। হাতে খোদাই করা ভূগর্ভস্থ শহরটি তাফরেশ আধুনিক শহরের নি¤œদেশে অবস্থিত। যার আয়তন তিন হেক্টর। ইরান এমনকি পশ্চিম এশিয়ার অন্যতম বৃহত্তম ভূগর্ভস্থ এলাকা এটি।
গভর্নর আরও জানান, ভূগর্ভস্থ শহরটিতে প্রথম প্রতœতাত্বিক অনুসন্ধান চালানো হয় গত গ্রীষ্মকালে এবং বর্তমানে স্থানটিতে দ্বিতীয় পর্বের অনুসন্ধান চলছে।

১২। ইরানে প্রথম পর্যটন ফার্মের উদ্বোধন
ইরানে পাঁচ হেক্টর জায়গার ওপর দেশটির প্রথম পর্যটন ফার্ম চালু করা হয়েছে। উত্তরাঞ্চলীয় গোলেস্তান প্রদেশে ঘনবন সংলগ্ন একটি প্রাকৃতিক উর্বর জমিতে ফার্মটি তৈরি করা হয়েছে।
গত ৯ নভেম্বর ২০২০ প্রাদেশিক পর্যটন বিভাগের উপপ্রধান বলেন, গোলেস্তান প্রদেশে পর্যটন উন্নয়নের ক্ষেত্রে কৃষি পর্যটন অন্যতম অবহেলিত দিক। অথচ এই পর্যটনের ৯২টি কৃষি পণ্য উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে এবং গোলেস্তান কাসপিয়ান সাগরের নিকটে একটি অনুকূল আবহাওয়া ও উর্বর জমিসমৃদ্ধ এলাকা।
এই কর্মকর্তা আরও জানান, গত মাসে (২০ সেপ্টেম্বর থেকে ২১ অক্টোবর) তাসকেস্তানে পর্যটন ফার্মটি উদ্বোধন করা হয়েছে। প্রদেশ জুড়ে কৃষি পর্যটনে বিনিয়োগের নতুন অধ্যায় উন্মুক্ত করবে এই ফার্মটি।

১৩। ইউরোপীয় ইউনিয়নে ইরানের রপ্তানি বেড়েছে ১৩ শতাংশ
চলতি বছরের প্রথম নয় মাসে (জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর) ইউরোপীয় ইউনিয়নে ইরানের তেল-বহির্ভূত রপ্তানি বেড়েছে ১৩ শতাংশ।
২০২০ সালের প্রথম নয় মাসে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে ইরানের বাণিজ্যের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩ দশমিক ৩৪৫ বিলিয়ন ইউরো। আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় এই বাণিজ্যর পরিমাণ ১১ শতাংশ কম। তবে একই সময়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নে ইরানের তেল-বহির্ভূত পণ্য সামগ্রীর রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৩ শতাংশ।

১৪। বিশ্বসেরা গবেষকদের তালিকায় ১২ ইরানি অধ্যাপক
বিশ্বে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ গবেষকদের তালিকায় স্থান পেয়েছেন ইরানের ১২ জন অধ্যাপক। ক্লারিভেট (ডাব্লিউওএস) প্রকাশিত ‘হাইলি সাইটেড রিসার্চার্স ২০২০’-এর সদ্য-উন্মোচিত তালিকায় এই চিত্র উঠে এসেছে।
মুসলিম বিশ্বের বিজ্ঞান সাইটেশন ডাটাবেজ আইএসসি এর প্রধান মোহাম্মাদ জাভাদ দেহকানি জানান, ক্লারিভেট অ্যানালিটিকসে (আইএসআই) প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী যেসব গবেষকের নিবন্ধ সর্বাধিক উদ্ধৃত হয়েছে তাদেরকে পরিচয় করানো হয়।
২০২০ সালের শীর্ষ গবেষক হিসেবে প্রায় ৬ হাজার ৩৮৯ জন গবেষককে বাছাই করা হয়। ২০২০ সালে বিশ্বের সর্বাধিক প্রসিদ্ধ গবেষকদের এই তালিকায় ইরানের ১২ গবেষক স্থান পেয়েছেন বলে জানান দেহকানি।

১৫। বিজ্ঞান গবেষণায় ৫ম স্থানে ইরান
আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রে ৫ম স্থানে রয়েছে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান। এছাড়া, বৈজ্ঞানিক উৎপাদন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে দেশটি বর্তমানে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। ১৫ ডিসেম্বর ইরানের বিজ্ঞান, গবেষণা ও প্রযুক্তিমন্ত্রী মানসুর গোলামি এ তথ্য জানান।
নির্বাচিত কয়েকজন বিজ্ঞান গবেষক ও প্রযুক্তিবিদকে দেয়া সম্মাননা অনুষ্ঠানে একথা বলেন তিনি। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে ইরানের অবস্থানেরও প্রশংসা করেন মন্ত্রী।
মানসুর গোলামি বলেন, বিশ্বে যেসব দেশ বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বহু বছর ধরে নেতৃত্ব দিচ্ছে ইরান তাদের মধ্যে রয়েছে। তবে এই অবস্থান ধরে রাখতে হলে বিজ্ঞান, গবেষণা ও প্রযুক্তি খাতকে সর্বাত্মক সমর্থন দিতে হবে।
ইরানের এ মন্ত্রী বলেন, ‘আজকে দেশে যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি পার্ক গড়ে উঠেছে তা এখন গর্ব ও আশার উৎস। এই পার্ক দেশের নানাবিধ সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এখন আমরা গর্বের সঙ্গে দাবি করতে পারি যে, জ্ঞানের ধারা তৈরি, সেগুলোকে প্রযুক্তি খাতে ব্যবহার ও স¤পদ অর্জনের জন্য বিজ্ঞানকে কাজে লাগাতে সক্ষম হচ্ছি আমরা।’

১৬। কমসটেক অ্যাওয়ার্ড পেলেন ইরানি অধ্যাপক জাফরি
গণিতে মুসলিম দেশগুলোর সংগঠন ওআইসির অঙ্গপ্রতিষ্ঠান কমসটেক অ্যাওয়ার্ড ২০১৯ লাভ করলেন ইরানি অধ্যাপক। ইরানের আমিরকবির ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির অনুষদ সদস্য সাজ্জাদ জাফরি এই পুরস্কার লাভ করেন।
কমসটেক ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা ওআইসির বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা বিষয়ক কার্যনির্বাহী স্থায়ী কমিটি। ইরানি অধ্যাপক পুরস্কার হিসেবে ৫ হাজার মার্কিন ডলার লাভ করেন।
জাফরি ১৯৮৩ সালে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি আমিরকবির ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে পড়াশোনা করেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ২০০৫ সালে বিএসসি, ২০০৮ সালে এমএসসি ও ২০১৩ সালে পিএইচডি করেন। ২০১৩ সাল থেকে তিনি এখানে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন।

১৭। অ্যাস্ট্রোনমি অলি¤িপয়াডে ইরানি শিক্ষার্থীদের ৮ মেডেল
ইন্টারন্যাশনাল অলি¤িপয়াড অন অ্যাস্ট্রোনমি এবং অ্যাস্ট্রোফিজিক্স (আইওএএ) এ আটটি রঙিন মেডেল জিতেছে ইরানি শিক্ষার্থীরা। ন্যাশনাল অরগানাইজেশন ফর ডেভেলপমেন্ট অব এক্সসেপশনাল ট্যালেন্টস গত ৪ নভেম্বর এই তথ্য জানায়।
আইওএএ এর এবারের পর্বের আয়োজন করে স্লোভাকিয়া। করোনা ভাইরাস মহামারির কারণে এবছর ভারচুয়ালি এই প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়।
ইরানি শিক্ষার্থীরা দুটি স্বর্ণ, দুটি রৌপ্য ও চারটি ব্রোঞ্জপদক লাভ করে। এছাড়া দুটি সম্মানজনক ডিপ্লোমা লাভ করে দেশটির শিক্ষার্থীরা। এ নিয়ে বিশ্বে পঞ্চম অবস্থান দখল করে তারা।
স্বর্ণজয়ী ইরানি দুই শিক্ষার্থী হলো কাসরা হাজিয়ান ও পারশান জাভানরুদ। রুপা জিতেছে আলি রাজ কান্দি ও মতিন মোহাম্মাদি সারাই। আর ব্রোঞ্জপদক লাভ করে আমির হোসাইন হাজী মোহাম্মদ রেজায়ে, ফাতেমেহ আলী মুরাদী, হোসেইন মোহাম্মদী, এবং মোহাম্মদ মেহেদী ওয়াহেদী।

১৮। ইরানের তৈরি হলো সেরা ইসলামি ক¤িপউটার গেম
‘অ্যাম্বাসেডর অব লাভ’ তথা ভালোবাসার দূত নামে একটি অ্যাকশন-অ্যাডভেঞ্চার গেম তৈরি করল ইরানের ইসলামিক রেভ্যুলুশন সেন্টার ফর ডিজিটাল প্রোডাক্ট অ্যান্ড পাবলিকেশন মাটনা। গেমটির প্রযোজকরা এটিকে সবচেয়ে বড় ইরানি-ইসলামি ক¤িপউটার গেম প্রকল্প হিসেবে অভিহিত করেছেন।
গত ১৫ ডিসেম্বর মাটনা প্রকাশিত একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে মেহদি জাফরি জোজানি বলেন, গেমারদের চাহিদা পূরণ করতে দেশের তরুণ দক্ষ গেম নির্মাতারা বৃহত্তম এই ইরানি-ইসলামি ক¤িপউটার গেম প্রকল্পটির কাজ স¤পন্ন করেছে।
থার্ড পারসন অ্যাকশন-অ্যাডভেঞ্চার গেম ‘অ্যাম্বাসেডর অব লাভ’ শুরু হয়েছে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর দূত মুসলিম ইবনে আকিল আল হাশিমির (আ.) কুফায় আগমন দিয়ে। আশুরা বিদ্রোহের কয়েক দিন আগে তিনি কুফায় আগমন করেন। ৬৮০ খ্রিস্টাব্দের এই ঘটনায় ইমাম ও তাঁর সঙ্গী-সাথিরা শাহাদাত বরণ করেন।

১৯। অস্কারে ইরানের প্রতিনিধিত্ব করবে মাজিদির ‘দ্যা সান’
২০২১ অস্কার অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডসে সেরা আন্তর্জাতিক বিদেশি ভাষার ছবি হিসেবে ইরানের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করবে প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার মজিদ মাজিদির ‘দ্যা সান’। অস্কারের জন্য ইরানের সিনেমা বাছাই কমিটির মুখপাত্র রাইদ ফরিদজাদেহ এই ঘোষণা দিয়েছেন।
তিনি জানান, এবছর অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডের জন্য প্রাথমিকভাবে ১২টি ছবির সংক্ষিপ্ত তালিকা করা হয়। এসব চলচ্চিত্রের মধ্য থেকে বাছাই কমিটি ‘দ্যা সান’কে এ বছর ইরান থেকে অস্কারে পাঠানোর জন্য চূড়ান্তভাবে মনোনীত করেন।
‘দ্যা সান’ ছবিটিতে ১২ বছর বয়সী বারক আলি ও তার তিন বন্ধুর গল্প তুলে ধরা হয়েছে। বেঁচে থাকার লড়াইয়ে ও পরিবারের সহায়তায় তারা একত্রে কঠোর পরিশ্রম করে। তারা একটি গ্যারেজে ছোটখাটো কাজ নেয়। দ্রুত টাকা আয় করতে গিয়ে তারা ছোট অপরাধে জড়িয়ে পড়ে।
এর আগে ৭৭তম ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে অংশ নিয়ে প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার মজিদ মাজিদির ছবিটি অ্যাওয়ার্ড জিতে।

২০। তিন আন্তর্জাতিক উৎসবে পুরস্কার জিতলো ইরানি ছবি ‘উইকেন্ড’
তিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কার জিতলো ইরানি স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি ‘উইকেন্ড’। চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেছেন চলচ্চিত্রকার আরিয়ো মোতেভাকেহ।
‘উইকেন্ড’ আমেরিকার ৫১তম নাশভিল্লে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব, ১৭তম সেডিকিকোরতোত উৎসবের ইরানি চলচ্চিত্র বিভাগ ও ট্রিয়ন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের প্রতিদ্বন্দ্বিতা বিভাগে দেখানো হয়।
স্বল্পদৈর্ঘ্যটি নাশভিল্লে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে গ্রেভইয়ার্ড শিফট অ্যাওয়ার্ড এবং সেডিকিকোরটোট ও ট্রিয়নে আর্টিস্টিক ইভেন্টে সেরা ফিকশন স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমা অ্যাওয়ার্ড লাভ করে।
এছাড়া আর্মেনিয়ায় ওয়ান শট এর আন্তর্জাতিক উৎসবে বিশেষ অ্যাওয়ার্ড লাভ করেছে চলচ্চিত্রটি।

২১। তেহরান অ্যানিমেশন উৎসবে ৮৫ দেশের সহস্রাধিক ছবি
দ্বাদশ তেহরান আন্তর্জাতিক অ্যানিমেশন উৎসবের আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা বিভাগে দেখানো হবে ৮৫টি দেশের সহ¯্রাধিক ছবি। বেশিরভাগ অ্যানিমেশন জমা পড়েছে জাপান, চীন, ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া, জার্মানি, নরওয়ে, সুইডেন, ইতালি ও ব্রাজিল থেকে। আর বাকি দেশগুলো থেকে কয়েক ডজন ছবি দেখানো হবে।
উৎসবের জাতীয় বিভাগে প্রায় ৪৬০টি ইরানি অ্যানিমেশন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। উৎসবের এবারের দ্বাদশ আসর আগামী বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি শুরু হয়ে চলবে ৪ মার্চ পর্যন্ত।
তেহরান আন্তর্জাতিক অ্যানিমেশন উৎসবের আয়োজক শিশু ও তরুণদের মেধা বিকাশ বিষয়ক ইন্সটিটিউট আইআইডিসিওয়াইএ।

২২। ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে আসছে ৩৫টি ইরানি ছবি
ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব ২০২০ এ দেখানো হবে ৩৫টি ইরানি ছবি। আসছে বছরের জানুয়ারিতে উৎসবের ১৯তম আসর বসবে। ঢাকা উৎসবের বিভিন্ন বিভাগে ছবিগুলো দেখানো হবে।
এশিয়ান ফিল্ম প্রতিযোগিতা বিভাগে ইরানি চলচ্চিত্রকার আব্বাস আমিনির ‘দ্যা স্লটার হাউজ’, শাহরাম মোকরির ‘কেয়ারলেস ক্রাইম’ ও সাফি ইয়াজদানিয়ানের ‘সাডেনলি এ ট্রি’ দেখানো হবে।
সিনেমা অব দ্য ওয়ার্ল্ড এ দেখানো হবে মাহমুদ রেজা সানির ‘কিয়ারোস্তামি অ্যান্ড হিজ মিসিং কেইন’, কেইভান আলি মোহাম্মাদির সিনেমা ‘শাহর-ই কেসসেহ’, কারিম মোহাম্মাদ আমিনির ‘দ্যা ব্ল্যাক ক্যাট’, বোরজু নিকনেজাদের ‘অ্যাম্ফিবিয়াস’ ও কাজেম মোল্লায়ির ‘দ্যা বাদগার’। এছাড়াও এই বিভাগে ইরান ও জাপানের যৌথ প্রযোজনার ছবি ‘হোটেল নিউ মুন’ দেখানো হবে।
উইমেন্স ফিল্ম মেকার বিভাগে দেখানো হবে ফেরেসতেহ তাভাক্কোলির ‘সিকিং লস্ট’, শাকিবা খালেকির ‘টিরিশকো’, মাসুমেহ নূরমোহাম্মাদি কোমির ‘ফুকুশিমা ট্রাভেলর’, আজাদেহ মুসাভির ‘দ্যা ভিজিট’, নিলুফার জামানের ‘দ্যা ডার্ক ডেজ’, মানিজেহ হেকমাতের ‘বন্দর ব্যান্ড’ ও হান্না জালালির ‘ইন্টারভিউ’।
স্পিরিচুয়াল বিভাগে দেখানো হবো আব্বাস আমিনির ‘আই অ্যাম হেয়ার’, হামেদ তেহরানির ‘ডায়াপ্যাসন’, সাইয়িদ নেজাতির ‘ডাবুর’, আবোদ কাজেমির ‘আরসু’ ও মেহরদাদ ওসকুয়ির ‘সানলেস শ্যাডোস’।
চিলড্রেন ফিল্মস বিভাগে দেখানো হবে কেইভান মাজিদির ‘দ্যা ব্লু গার্ল’, হামিদ রেজা কোতবির ‘দ্যাট নাইটস ট্রেইন’, মোজগান বায়াতের ‘বর্ন অব দ্যা আর্থ’, তেইমুর কাদেরির গান্দো’ ও বাবাক নাবিজাদেহর ‘দ্যা ওসান বিহাইন্ড দ্যা উইন্ডো’। এছাড়া শর্ট অ্যান্ড ইন্ডিপেনডেন্ট ফিল্ম বিভাগে দেখানো হবে আলি আসগারির ‘উইটনেস’, হুমান ফাখতেহর ‘টেল অব ইবি’, মেহরান হেম্মাতজাদেহর ‘দ্যা ড্রিমার’ ও মাহশাদ ভালির ‘আই’।

২৩। মিউনিখে ইরানি আলোকচিত্রীর প্রথম পুরস্কার জয়
কোভিড-১৯ মহামারিকালীন সাংস্কৃতিক শাটডাউনের ওপর আয়োজিত ফটো প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার লাভ করেছে ইরানি আলোকচিত্রী আলি হাদ্দাদি ও জোহরেহ সালিমি। তাঁদের সংগৃহীত ১২টি ফটো প্রতিযোগিতায় শীর্ষ স্থান দখল করে।
এই আলোকচিত্র প্রতিযোগিতার আয়োজন করে জার্মানির বাভারিয়ার মিউনিখের সাবেক ফ্যাক্টরি প্যাসিঞ্জার ফ্যাবরিক।
স্থানটি এখন সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ও ইভেন্ট ভেন্যু হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য জমা পড়া ছবিগুলো থেকে বাছাইকৃত সব ফটো ২৩ অক্টোবর থেকে সাংস্কৃতিক কেন্দ্রটিতে প্রদর্শন শুরু হয়। প্রদর্শনী চলে ২৯ নভেম্বর পর্যন্ত।
ফটো প্রদর্শনীর কিউরেটর হচ্ছেন থোমাস লিনসমায়ার ও স্টেফ্যান-মারিয়া মিটেনডোরফ।

 

‘শাবে ইয়ালদা’ ঐতিহ্যবাহী ইরানি উৎসব

সাইদুল ইসলাম –

‘শাবে ইয়ালদা’ বা ইয়ালদার রাত ইরানের অন্যতম প্রাচীন ও জনপ্রিয় একটি উৎসব। ইয়ালদা শব্দের অর্থ সূচনা বা জন্ম। শাবে ইয়ালদা, ‘জন্মের রাত’। ‘সূর্যের জন্মোৎসব রাত’ বা শাবে চেল্লেহ হলো ইরানিদের শীতকালীন উৎসব যা প্রাচীন কাল থেকেই বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে পালিত হয়ে আসছে। শীত মওসুমে নিরক্ষ রেখা থেকে সূর্যের দূরতম অবস্থানকালে উত্তর গোলার্ধের দীর্ঘতম রাতে উদ্যাপিত হয় শাবে ইয়ালদা। ইরানি ক্যালেন্ডার অনুসারে প্রতি বছর ডিসেম্বরের ২০ বা ২১ তারিখ রাতে উদ্যাপিত হয় এই উৎসব। ইরান ছাড়াও আফগানিস্তান, তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান এবং কিছু ককেশীয় অঞ্চলের দেশ, যেমন- আজারবাইজান এবং আর্মেনিয়ায় বছরের একই সময় এই শাবে ইয়ালদা উদ্যাপিত হয়। এসব অঞ্চলের মানুষ যেসব কারণে শাবে ইয়ালদা উদ্যাপন করে থাকে তার মধ্যে শীতের আগমন এবং অন্ধকারের উপর আলোর বিজয় অন্যতম। তারা মনে করে অন্ধকার মন্দের প্রতীক। আর শাবে ইয়ালদার পরে প্রথম সকাল অন্ধকার ও অশুভ শক্তির উপর সূর্য এবং আলোর বিজয়ের সূচনা। অর্থাৎ এ রাতেই আলোর কাছে আঁধার পরাজিত হয় এবং এ রাত থেকেই মানবজাতির জন্য সুদিনের পালা বইতে শুরু করে।
বিশ্বখ্যাত ইরানি কবি জালালুদ্দিন রুমি রাতকে অবকাশকালে আগ্রাসনকারী ও নৈশকালে আকস্মিক হানাদার বাহিনী হিসেবে উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ রাত হলো অশুভ বা মন্দের প্রতীক এবং দিন হলো ঔজ্জ্বল্য, শুভ্রতা, সচ্ছলতা, নির্মলতা ও পবিত্রতার প্রতীক। শাবে ইয়ালদা নিয়ে মহাকবি শেখ সাদি লিখেছেন,
ব্যথাতুর অন্তরে প্রশান্তির হাওয়া নাহি বয়
ইয়ালদার রজনী না পোহালে হয় না ভোরের উদয়
কবি শেখ সাদি অপর এক কবিতায় বলেছেন,
তোমার রূপ দেখা প্রতিটি সকাল যেন শুভ নববর্ষ
তোমার বিচ্ছেদের প্রতিটি রাত যেন অতি দীর্ঘ

কবি শেখ ফরিদ উদ্দীন আত্তার বলেন,
নেই যদি জানা শেষ কোথায় আমার এ ব্যথাবেদনার
নেই কোন উৎসব তবে কাল শবে ইয়ালদার
কবি আল্লামা ইকবাল বলেছেন,
প্রাণচক্ষুকে যেমন অন্ধ করে দেয় তারই সুরমায়
আলোকিত দিনকে রাত পরিণত করে ইয়ালদায়
আল বিরুনী তাঁর ‘আল-বাকিয়াহ গ্রন্থে’ ইয়ালদাকে ‘মিলাদে আকবর’ বা ‘শ্রেষ্ঠতম জন্মদিন’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। যার উদ্দেশ্য সূর্যের জন্মদিন হিসেবে অধিক পরিচিত।
রাতটি যেন পরিবার ও বন্ধুদের একত্র হয়ে আনন্দময় মুহূর্ত উদ্যাপনের এক সোনালি রাত। সবাই মিলে ধুমধাম করে উদ্যাপন করা হয় বছরের এই দীর্ঘতম রাত। ‘শাবে ইয়ালদা’ ঘিরে ইরানে রয়েছে বেশ কিছু ঐতিহ্য। শীতের দীর্ঘতম এই রাতে পরিবারগুলো একত্রিত হয়ে কবিতা এবং উৎসবে মেতে ওঠে। সঙ্গে ঐতিহ্যবাহী তরতাজা ফলমূলের সমাহার তো আছেই। করুণাময় এই রাতে ইরানিদের কাছে শীতকালীন শীতলতা যেন পরাস্ত হয়। ভালোবাসার উষ্ণতা পুরো পরিবারকে আলিঙ্গন করে। আত্মাগুলো একে অপরের আরও বেশি ঘনিষ্ঠ হয়ে ভালোবাসা বিনিময়ে মেতে ওঠে। ২১ই ডিসেম্বরের এই রাতে বিদেশে বসবাসরত ইরানিদের জন্য রয়েছে চমৎকার কিছু সুযোগ। তাঁরা এদিন বিভিন্ন জাতি ও সংস্কৃতির মানুষদের কাছে নিজেদের অসাধারণ এই ঐতিহ্য তুলে ধরতে পারেন। প্রথা ও রীতিনীতি ভাগাভাগি করার মাধ্যমে দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্ক গড়ে তোলার সুযোগ পান। যা আন্তঃসংযুক্তির এই বিশ্বে পারস্পরিক উত্তম বোঝাপড়ার পথ প্রশস্ত করে।
ইরানের ব্যস্ততম রাস্তায় উঁকি দিলে দেখা যায় মুদি ও কনফেকশনারি দোকানগুলো যেন মহাউৎসবে মেতে উঠেছে। সব শ্রেণি-পেশার মানুষ প্রয়োজনীয় খাবার-দাবার কিনে আনন্দ উপভোগের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
ইয়ালদা রাতে সাধারণত পুষ্পশোভিত বাটিতে করে তরতাজা ফলমূল ও রঙিন আজিল (শুকনো ফল, বীজ ও বাদামের সংমিশ্রণ) পরিবেশন করা হয়। ইরানিদের কাছে গ্রীষ্মকালে ফলমূল হলো প্রাচুর্যের স্মারক। এই রাতের ঐতিহ্যবাহী টাটকা ফল হচ্ছে তরমুজ এবং ডালিম। এ দু’টি ফলকে অনুগ্রহের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিশ্বাস করা হয়, শীতের আগমনের আগে তরমুজ খেলে অসুস্থতার বিরুদ্ধে শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে।
রাতে উষ্ণ খাবার শেষে অনেকে কবিতা, গল্প ও বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে অসাধারণ মুহূর্ত কাটান। মধ্যরাত পর্যন্ত চলতে থাকে এই উৎসব।
লোকজন নিজেদের ভাগ্যগণনাও এই রাতেই করে থাকেন। মহাকবি হাফিজ শিরাজির কাব্য সংকলনের প্রতিটি গজলের রয়েছে আলাদা আলাদা তাৎপর্য। তাঁর কাব্য সংকলনটি সামনে রেখে পরিবারের বয়স্ক ব্যক্তি শুরু করেন ভাগ্যগণনা। যার ভাগ্যগণনা করা হবে তিনি পবিত্র হয়ে চোখ বন্ধ করে ৩ বার সূরা এখলাস পড়ে মনে মনে কিছু একটা চাইবেন। অতঃপর বয়স্ক ব্যক্তি কাব্য সংকলনটি তাঁর সামনে খুলে ধরে বলবেন, ‘ডান পৃষ্ঠা নাকি বাম পৃষ্ঠা?’ চোখ বন্ধ রেখেই লোকটি কোনো এক পৃষ্ঠায় নিজের ডান হাতটি রাখবেন এবং বয়স্ক ব্যক্তি ওই পৃষ্ঠার কবিতা ও তার তাৎপর্য ব্যাখ্যা করবেন। এভাবেই দীর্ঘ এই রাতটি গল্পগুজবে পার করে দেন ইরানের জনগণ। তবে ইরানের কোন কোন অংশে মহাকবি ফেরদৌসীর ‘শাহনামা’ থেকে সুরে সুরে আবৃত্তি করা হয়। কোথাও কোথাও সারা রাত কবিতার লড়াই অনুষ্ঠিত হয়।
শাবে ইয়ালদার ভোজ ‘শাবে চেল্লেহ’ নামেও পরিচিত। আক্ষরিক ভাবে যার অর্থ চল্লিশের রাত। অর্থাৎ ‘শাবে চেল্লেহ’ বলতে শীতকালের প্রথম চল্লিশ দিনকে বোঝায়। শীতের এই দিনগুলো সাধারণত সবচেয়ে শীতল ও কঠিন হয়ে থাকে।
প্রাচীন ইরানি ক্যালেন্ডারে শীতকাল দুভাগে বিভক্ত। ‘চেল্লেহ বোজোর্গ’ ২২ ডিসেম্বর থেকে ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত। যার আক্ষরিক অর্থ বড় চল্লিশ। আর ‘চেল্লেহ কুচাক’ ৩০ জানুয়ারি থেকে শুরু হয়ে ১০ মার্চ পর্যন্ত। যার অর্থ ছোট চল্লিশ।
ইয়ালদার রাতে মূলত শীতের সূচনা উদ্যাপন করা হয়। একইসাথে দিন বাড়তে থাকায় সূর্যের আধিপত্য বিস্তার হতে থাকে। ইয়ালদা সরকারি কোনো ছুটির দিন না হলেও এখনও প্রাচীন কিছু ঐতিহ্যকে ছাপিয়ে যায় উৎসবটি।

মহাকবি হাফিজের কাব্যে পবিত্র কুরআনের প্রতিফলন

ড. মোঃ মুহসীন উদ্দীন মিয়া –

পবিত্র কুরআন সমগ্র বিশ্বের প্রতিপালক মহান আল্লাহর বাণী। এর ভাষা ও বক্তব্য শাশ্বত, চিরন্তন। এটি মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর নবুওয়াতি জীবনের সবচাইতে বড় মুজিযা। ইসলাম তথা আসমানি জীবন ব্যবস্থার প্রজ্ঞাময় অবিকৃত সর্বশেষ গ্রন্থও এটি। এর সাহিত্যশৈলি ও মুজিযার কথা সর্বজনবিদিত।
কুরআনে বর্ণনার বিভিন্ন ঢং, হেকমত, উপমা-উৎপ্রেক্ষা, প্রবাদ-প্রবচন, বাগধারাসহ অতি উঁচু মানের সাহিত্যালংকারের সমাবেশ ঘটেছে। এর অভ্রভেদী বাণী অনিন্দ্য সুন্দর ও বাক্সময় বর্ণনাশৈলীর কাছে মাথানত করেছেন বড় বড় কবি ও সাহিত্যিক। ‘আমরা আল্লাহর রং গ্রহণ করেছি। আল্লাহর রং এর চাইতে উত্তম রং আর কার হতে পারে?’ [২/১৩৮, অনুবাদ মারেফুল কুরআন] আল কুরআনের এই অমোঘ বাণীর প্রতি অনুরক্ত হয়ে মহান আল্লাহর রহমত ও বরকত হাসিলের উদ্দেশ্যে মুসলিম বিশ্বের অসংখ্য কবি-সাহিত্যিক তাঁদের সাহিত্যকর্মে কুরআনশৈলী গ্রহণ করেছেন।
ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের অসংখ্য কবি-সাহিত্যিকও কুরআনের অলংকরণ অনুসরণ করে তাঁদের সাহিত্যকর্ম সাজিয়েছেন। এ ভাষার যে সকল সাহিত্যিক পবিত্র কুরআনকে মন ও মননে ধারণ করে নিজ অভিব্যক্তি বর্ণনায় এর শৈলীবিদ্যার সংযোগ ও সংমিশ্রণে সফল হয়েছেন তাঁদের পুরোধা পুরুষ হিসেবে হাফিজের নাম সবিশেষে উল্লেখযোগ্য।
পরিচিতি : তাঁর প্রকৃত নাম খাজা শামসুদ্দিন মোহাম্মদ বিন বাহাউদ্দিন সুলগারি মোহাম্মাদ হাফিজ শিরাজী। জন্মের সময় তাঁর চেহারা সূর্যের ন্যায় উদ্ভাসিত ছিল বলে বাবা-মা তাঁর নাম রাখেন শামসুদ্দিন বা দ্বীনের সূর্য। শিরাজ নগরে জন্ম নেন বিধায় শিরাজী। শৈশবে পবিত্র কুরআন হেফ্য বা মুখস্ত করেছিলেন বলে তিনি হাফিজ নামে সর্বাধিক পরিচিতি পান।
তাঁর জন্মসাল জানা যায় নি। তবে গবেষকগণের ধারণা মতে তিনি অষ্টম হিজরি মোতাবেক খ্রিস্টিয় চর্তুদশ শতাব্দীতে (১৩১০ থেকে ১৩৩০ সালের ভিতর) ইরানের শিরাজ নগরীর রুকনাবাদের মোসাল্লা নামক স্থানের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বিশিষ্ট গবেষক এ. জে. আর বারীসহ অনেক গবেষক তাঁর জন্মসাল ১৩২৬ খ্রিস্টাব্দ বলে উল্লেখ করেছেন। [শাহনেওয়াজ, ইনকিলাব, ২৬ জুন ২০২০]
হাফিজের মৃত্যুসন নিয়েও মতভেদ বিদ্যমান। ‘শারহে গাযালহায়ে হাফেজ’ প্রণেতা হোসাইন আলি হারুভি তাঁর মৃত্যুসাল ৭৯২ হিজরি মোতাবেক ১৩৯০ সাল এবং বয়স ৭২ বছর ছিল বলে উল্লেখ করেছেন [হারুভি : ১৩৯২ : ১৮] দৌলত শাহের মতে তিনি ৭৯৪ হিজরি মোতাবেক ১৩৯১ সাল এবং হাফিজের বন্ধু ও তাঁর কবিতার সর্বপ্রথম সংগ্রাহক ‘গুল আন্দাম’ বলেন, তাঁর মৃত্যুসাল ছিল ৭৯১ হিজরি মোতাবেক ১৩৮৯ খ্রিস্টাব্দ।
আবার গৌড়ের সুলতান গিয়াসউদ্দিন আযম শাহের (রাজত্বকাল ১৩৮৯-১৪০৯ খ্রি.) সাথে হাফিজের পত্র বিনিময় হয়েছিল। এর থেকে অনুমিত হয় হাফিজ অন্তত ১৩৯০ সাল পর্যন্ত বেচেছিলেন। তাই দৌলত শাহের মতামতই তাঁর মৃত্যুসালের যথার্থ কাছাকাছি মতামত বলে বলে বিবেচিত হয়। [বরকত উল্লাহ : ২০১০ : ২৩৬]
পিতা বাহাউদ্দিন সুলগারির কাছেই তাঁর প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি হয়। বাবার মুখে পবিত্র কুরআনের বাণী শুনেই তিনি কুরআনের প্রতি অনুরক্ত হন। কিন্তু পিতৃবিয়োগ ঘটলে এ সময়ে তাঁর জীবনের ছন্দপতন ঘটে। সংসারের সকল দায়িত্ব তাঁর কাঁধে এসে পড়লেও বিদ্যার্জনে তা বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। ‘মেইযানে’ গ্রন্থ প্রণেতা আবদুন্নবির বর্ণনা মতে তখন তিনি একটি রুটির দোকানে কাজ নেন। কাজের ফাঁকে ফাঁকে নিকটস্থ বিদ্যালয়ের বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন কাওয়ামুদ্দিন আবদুল্লাহর (মৃত্যু ৭৭২ হি.) কাছে প্রাথমিক শিক্ষা লাভের সাথে সাথে পবিত্র কুরআন মুখস্ত করতে শুরু করেন। তাঁর কাছে থেকেই হাফিজ ইলমে কালাম, ইলমে তাফসির, ইলমে কিরআত ও দর্শনশাস্ত্রে বুৎপত্তি অর্জন করেন।
এছাড়াও তিনি যুগের খ্যাতিমান শিক্ষাবিদ শামসুদ্দিন আবদুল্লাহ শিরাজী, কাজী এযদুদ্দিন আবদুর রহমানসহ নাম না-জানা আরো অনেকের কাছে তাফসির, হাদিস, কালামশাস্ত্র, আরবি ও ফারসি সাহিত্য এবং ধর্মতত্ত্বে অসাধারণ পা-িত্য অর্জনে সমর্থ হন। (তারিক, ২০১৮ পৃ.) পবিত্র কুরআন বিশ্লেষণ বিদ্যায় তিনি তখন এতটাই পারদর্শী হয়ে ওঠেন যে, আল্লামা জামখসারি প্রণীত ‘তাফসিরে কাশশাফ’ গ্রন্থের একটি গুরুত্বপূর্ণ হাশিয়া গ্রন্থও লিখেছিলেন। একই সাথে ইলমে কিরআত তথা পবিত্র কুরআনের পঠন রীতির ভিন্ন ভিন্ন চৌদ্দটি পদ্ধতি করায়ত্ব করতে সমর্থ হন। (হুমায়ী : ১৩৭৩ : ১১৩)
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন :
عشقت رسد به فرياد ارخود به سان حافظ
قران زبر بخوانى درچها رده روايت
(গজল ৯৪ গানজুর)
তোমার প্রেম চিৎকার দিয়ে উঠবে যদি হাফিযের মতো
কুরআন মুখস্ত পড় চৌদ্দ প্রকার রেওয়ায়েত সহকারে।
(সেহাত, অক্টোবর-নভেম্বর : ২০১৮)
তাঁর অসাধারণ প্রতিভা ও অসামান্য কৃতিত্বের কারণে স্বদেশবাসীরা তাঁকে অসংখ্য উপাধিতে বিভূষিত করেন। যেমন : ‘লিসানুল গায়েব’ বা অজ্ঞাতের বাণী এবং ‘তরজুমানুল আসরার’ বা রহস্যের মর্মসন্ধানী ছিল তাঁর প্রসিদ্ধ উপাধি। এছাড়াও ‘মুলুকুল ফুজালা’, ‘কাশেফুল হাকায়েক’, ‘মাযদুবে সালেক’, ‘বুলবুলে শিরাজ’, ‘খাজা হাফিজ’, ‘ফাখরুল মুতাকাল্লেমিন’ তাঁর উল্লেখযোগ্য উপাধি ছিল।
সাহিত্য সাধনা : হাফিজ যৌবনে প্রায় ২১ বছর বয়সেই কাব্যসাধনায় আত্মনিয়োগ করেন। মরমি ধারার সাহিত্য রচনায় তখন তাঁর একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল। অতি অল্প সময়ে তাঁর দর্শন ও কাব্যখ্যাতি দেশের গ-ি পেরিয়ে বহিঃবিশ্বেও ছড়িয়ে পড়ে। এ সময়ে মুযাফফারীয় রাজবংশের আবু ইসহাক ইনযু, আমির মুবারেযুদ্দিন মুহাম্মদ এবং তাঁর পুত্র শাহশুজা ও শাহ মনসুরের পৃষ্ঠপোষকতা পেলে তাঁর সাহিত্যকর্মে গতির সঞ্চার হয়। হাফিজ তাঁর কোন কোন গজলে এই বাদশাদের প্রশংসা করেছেন।
‘দিভান’ বা কাব্য সমগ্র হলো তাঁর অন্যতম সাহিত্য নিদর্শন। এতে রয়েছে প্রেম ও মরমি ভাবধারাসম্বলিত অসংখ্য (৪৯৫) গজল। সমসাময়িক বাদশাগণের প্রশংসায় রচিত কয়েকটি কাসিদা। কিছু রুবায়ী ও দুটি মাসনাভী, যার একটি ‘সাকীনামে’ খ্যাত; অপরটি হলো প্রেম বিষয়ক। [হোমায়ী : ১৩৭৩ : ১১৩]
কুরআনের প্রতিফলন : বহুমুখি জ্ঞানের অতুলনীয় রত্মভা-ার হিসেবে বিবেচিত হাফিজ-কাব্যে ফুটে উঠেছে বিশ্বপ্রকৃতি ও মানব জীবনের গভীর রহস্য। শেখ সাদির পরে হাফিজকেই শ্রেষ্ঠ ফারসি গজল বা গীতিকাব্য রচয়িতা বলে ভাবা হয়। প্রগাঢ় প্রেম ও গভীর আধ্যাত্মিকতায় সিক্ত তাঁর কবিতায় মুগ্ধ হয়েছেন বিশ্ববাসী। শরাব-সাকী, প্রেম-মদিরা, বসন্ত গোলাপ, প্রেমাস্পদের রূপমুগ্ধতা তাঁর মরমি সাধনার রূপক বর্ণনা হিসেবে ধরা দিয়েছে তাঁর কবিতায়। আত্তার ও রুমির অধ্যাত্মবাদ, সাদির মানবতাবোধ, সানায়ীর আত্মসমালোচনা ও সামাজিক মূল্যবোধের নির্যাসকে ধারণ করে আছে হাফিজের গজল।
হাফিজ-গবেষকগণের ভাষ্যমতে তিনি তাঁর জীবনের প্রায় চল্লিশ বছর কাটিয়েছেন মহাগ্রন্থ আল কুরআনের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণে। হাফিজ বলেন :
علم وفضلى كه به چهل سال دلم جمع آورد
ترسم آن نرگس مستانه به يغما ببرد.
(গজল ১২৮, গানজুর)
দীর্ঘ চল্লিশ বছরের সাধনায় আমার অন্তরে যে জ্ঞানবৈশিষ্ট্য সঞ্চিত হয়েছে,
ভয় হয়, না জানি প্রেয়সীর চোখের চাহনি তা হরণ করে নিয়ে যায়। (তারিক)
পবিত্র কুরআনে তাঁর এই অগাধ পা-িত্বের প্রতিফলন ঘটেছে তাঁর কাব্যের প্রতিটি ছত্রে। কুরআনের জ্ঞানে সমৃদ্ধ হওয়ার কারণেই তিনি ‘খাজা হাফিজ’ অভিধায় বিভূষিত হয়েছিলেন। তাঁর কাব্যসৌধের প্রতিটি ছত্রেই ঝংকৃত হয়েছে পবিত্র কুরআনের প্রতিধ্বনি। কবি বলেন :
نديدم خوشتر از شعر تو حافظ
كه قرانى كه اندر سينه دارى
(গজল ১৭৮ গানজুর)
হে হাফিজ! তোমার বক্ষে সংরক্ষিত কুরআনের আভায় রচিত
কবিতার চাইতে সুন্দর বাণী আর কিছু দেখিনি।
কুরআন সাধনার মাধ্যম হিসেবে তিনি বেছে নিয়েছিলেন প্রেমকে। তাঁর মতে প্রেম একটি ঐশী ও এরফানি চেতনা, যা মানুষকে তার প্রেমাস্পদ মহান আল্লাহর সান্নিধ্য লাভে উদ্বুদ্ধ করে, অন্তর্দৃষ্টি খুলে দেয়, সৃষ্টি রহস্যের নিগুঢ় তত্ত্ব অনুধাবনে সহায়তা করে। হৃদয়মন তখন মহাপ্রভুর রং-এ রঞ্জিত হতে ব্যাকুল হয়। এই ব্যাকুল মন নিয়েই হাফিজ তাঁর কাব্যের অবকাঠামো নির্মাণ, সৌন্দর্যবর্ধক আলংকারিক দিকনির্দেশনা গ্রহণ এবং কবিতার ভাব-রস, তাল-লয় নির্ধারণের প্রতিটি ক্ষেত্রেই মহাগ্রন্থ আল কুরআনের দ্বারস্থ হয়েছেন। কুরআনের সৌন্দর্য সুষমায় তিনি তাঁর কবিতার ক্যানভাস সাজিয়েছেন নিপুণ শিল্পীর মতো।
পবিত্র কুরআনের ছন্দরীতি অনুসরণ : সাধারণত ছন্দবদ্ধ কবিতার অন্ত্যমিলকে উচ্চারণের সুবিধার্থে বিভিন্ন অংশে বিভক্ত করে পড়ার নিয়ম-নীতিকে সাহিত্যের পরিভাষায় বাহার (بحر) বলেÑ যা ‘এলমে আরুয’ নামে পরিচিত। ফারসি ছন্দ বিশারদগণের মতেÑ পবিত্র কুরআনের আয়াতসমূহে এই ছন্দরীতি বিদ্যমান রয়েছে। বলা যায়, পবিত্র কুরআনের সেই ছন্দ ও শব্দ ব্যঞ্জনা থেকেই এই অলংকারশাস্ত্রের উৎপত্তি। ফারসি ভাষা ও সাহিত্যে প্রচলিত সেই বাহার ছন্দরীতিগুলো হলোÑ رمل রামাল, مضارع মোযারে, هزز হাযায, متقارب মোতাকারের প্রভৃতি। হাফিজ কুরআনের সেই অনিন্দ্যসুন্দর بحر ছন্দরীতি অবলম্বন করেই তাঁর কবিতার কাঠামো নির্মাণ করেছেন।
যেমন বাহারে রামাল : فاعلاتن – فاعلاتى – فاعلاتن- فاعلن এ ওজনটি পবিত্র কুরআনের যে আয়াতগুচ্ছ থেকে নেয়া হয়েছে তার একটি হচ্ছেÑ ف اذكرو الله قياما و قعودا وعلى جنوبكم (অর্থ : অতঃপর যখন তোমরা নামায সম্পন্ন কর, তখন দ-ায়মান, উপবিষ্ট ও শায়িত অবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ কর।) (অনুবাদ : মারেফুল কুরআন)
এ ওজনে রচিত হাফিজের কবিতা-
شاهدان گردلبرى زين سان كنند
زاهدان را رخنه در ايمان كنند
[হাফেজ : ১৩৮৬ : ১১৬]
হৃদয়হারী প্রিয়া যদি করতে থাকে ছলচাতুরী
ক্ষণকালেই যাহেদগণের ফুটো হবে ঈমান তরী।
হাফিজের সবচাইতে প্রিয় ছন্দরীতিও এটি। তাঁর ৪৯৫টি গজলের ১৮০টিই এ রীতিতে রচিত। (সিরাজ : ১৩৬৮ : ৫৭) (জাহরা জামশিদী)
বাহারে হাযায : مفاعيل – مفاعيلن – فعولن
কুরআনের আয়াত : فان كان لكم كيد فكيدون
(অতএব, তোমাদের কোন অপকৌশল থাকলে তা প্রয়োগ কর আমার কাছে।) (অনুবাদ : মারেফুল কুরআন)
এ ওজনে হাফিজের কবিতা :
شب تاريك و بيم موز گردابى چنين هایل
كجا دانند حال ما سبكباران ساحلها .
ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ উত্তাল ঢেউয়ে আঁধার রাতে মাঝ সমুদ্রে থাকা
আমাদের অবস্থা তারা কিভাবে বুঝবে, যারা সমুদ্রতটে নিরাপদে অবস্থান করছে। [হাফিজ : ১৩৮৬ : ১]

বাহারে মোতাকারেব : فعولن – فعولن – فعولن – فعولن
পবিত্র কুরআনের বাণী : اقيمو الصلوة واتوالزكاة
(অর্থ : নামাজ প্রতিষ্ঠা কর এবং যাকাত আদায় কর)
হাফিজের কবিতা :
سلامی چوبوى خوش آشنايى
بدان مردم ديده روشنايى
(হাফিজ : ১৩৮৬; ২৯৪)
অর্থ : প্রিয় পরিচিত সেই সুগন্ধকে সালাম
যাতে মানুষ আলোর সন্ধান পায়। (জামশিদী : ১৩৯৯ : ৪৫, ৪৬, ৪৭)
কুরআনের আয়াত ও বিষয় অবতারণার পদ্ধতি অনুসরণ : তাঁর গযল গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় তিনি কবিতার চরণ বা শ্লোক উপস্থাপনার ক্ষেত্রেও পবিত্র কুরআনের বর্ণনারীতির অনুকরণ করেছেন। আমরা পবিত্র কুরআনের কোন সূরা বা অধ্যায় পড়ার সময় দেখতে পাই যে, কুরআন বর্ণনা বিন্যাসে আয়াতগুলো পারস্পরিকভাবে সম্পর্কিত হলেও মাঝে মধ্যে ভিন্ন ও স্বাধীন অর্থবোধক কোন কোন আয়াত চলে আসে যেগুলোর অর্থ বিচারে সূরা বা অধ্যায়ের অংশ বলে মনে না হলেও সম্পূর্ণ অধ্যায় পাঠান্তে আয়াতগুলো যে সে অধ্যায় বা সূরার অবিচ্ছেদ্য অংশ তা সহজেই অনুমিত হয়। অর্থাৎ প্রতিটি আয়াতের একটি স্বাধীন অর্থ থাকলেও তা অধ্যায় বিন্যাসের অধীন থাকে। এ আয়াত বা আয়াতাংশের আংশিক অর্থ, সামষ্টিক সূরা অধ্যায়ের সার্বিক অর্থ হিসেবে পরিগণিত হয়।
হাফিজের গজলের শ্লোকগুলোর পারস্পরিক গঠন প্রক্রিয়াও তেমনি। কখনো কখনো কবিতার শ্লোক বর্ণনার ধারাবাহিকতায় একটি শ্লোকের সাথে অপর ছত্রের বিষয়বস্তুগত বাহ্যিক কোন মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে পূর্ণ গজল পাঠ করলেই চরণসমূহের অর্থগত অভ্যন্তরীণ সম্পর্কের সেই মিল পরিষ্কার বোঝা যায়। অর্থাৎ প্রতিটি শ্লোকের একটি স্বাধীন অর্থ থাকলেও সামষ্টিকভাবে একটি গজলেরই অরিচ্ছেদ অংশ বলে প্রতীয়মান হয়। (সায়েদী : ১৩৬৯; ১৮৬-৮৭)
এ কারণেই হাফিজ দাবি করেছেনÑ
صبح خيزى و سلامت طلبى چون حافظ
هرچه كردم همه از دولت قران كردم
হে হাফিজ! যদি সুস্থতা কামনা কর তবে প্রভাতে জেগে ওঠ
যা কিছুই করেছি তা সবই পবিত্র কুরআনের সম্পদের মাধ্যমেই করেছি।

কবিতায় পবিত্র কুরআনের আয়াত ও আয়াতাংশ সংযোগ : হাফিজ ত্ার গজলে শব্দ চয়ন, বাক্য বিন্যাস মমার্থ বর্ণনা ও পরিভাষা ব্যবহারেও কুরআনশৈলি দ্বারা উপকৃত হয়েছেন। পবিত্র কুরআনের শব্দ ও বাক্য বিন্যাস, উপমা-উৎপ্রেক্ষা, প্রবাদ-প্রবচন, এর শৈল্পিক ও নান্দনিক সংমিশ্রণ ঘটিয়ে তাঁর কাব্যসৌন্দর্য বাড়িয়েছেন। এতে যেমন বেড়েছে তার কাব্যশোভা, অর্থে এসেছে গভীরতা, কবিতা হয়েছে শ্রুতিমধুর, পাঠক মহলে এসেছে মুগ্ধতা। অবশ্য কুরআনের জ্ঞানে আলোকিত ব্যক্তিবর্গ ভিন্ন সাধারণের পক্ষে তাঁর কাব্যের এই রসবোধ আস্বাদন করা মোটেই সম্ভব নয়।
হাফিজ বলেন :
زحافظ جهان كس چو بنده جمع نكرد
لطائف حكمى با نكات قرانى
(কাছিদে : ২ গানজুর)
জগতের মাঝে এমন হাফেজ পাবে নাকো খুঁজে
আমার মত যে কুরআনের তত্ত্বে, দর্শন বুঝে। (শাহ নেওয়াজ : ০৩ জুন, ২০২০)
কুরআনের অলংকরণে সজ্জিত তাঁর গজলের কয়েকটি নমুনা নি¤েœ তুলে ধরছি যাতে তিনি কুরআনের কোনো আয়াত বা আয়াতাংশ আত্মীকরণ করেছেন শৈল্পিকভাবে।
مده خاطر نازك ملامت ازمن زود
كه حافظ تو خود اين لحظه گفت بسم الله
(গজল : ২১৬, গানজুর)
সামান্য বিরক্তিতে দ্রুতই করো না তিরস্কার আমায়
হাফিজ! শুরু কর তোমার বক্তব্য বিসমিল্লায়।
سرم به دنيى وعقبى فرونمى آيد
تبارك الله از اين فطنه¬ها كه در سرماست
(গজল : ২২, সাঞ্জুর)

দুনিয়ার কুটকৌশল যত, শক্তিপূজা ও পরকালীন ভয়,
নত করেনি আমারে কভু, মুক্তিদাতা এ ফেতনায়
তাবারাকাল্লাহ আল্লাহ বরকতময়।
شب قدر است و طى شد نامه هجر
سلام فيه حتى مطلع الفجر
[গযল ২৫১, গাঞ্জুর]
কেটে গিয়েছে যন্ত্রণা যত, কদরের মহিমায়,
ফজরেও তা রইবে বহমান রজনী প্রশান্তিময়।
عيشم مدام است از لعل دلخواه
كارم بكام است الحمد لله
চিরন্তন হয়েছে আরাম আয়েশ মোর প্রিয়ার সান্নিধ্য কামনায়,
স্বার্থক হয়েছে সকল প্রত্যাশা মোর পড় আলহামদুলিল্লাহ।
حضور خلوت انس است و دوستان جمعند
و ان يكاد بخوانيد و در فراز كنيد
(গজল ২৪৪, গাঞ্জুর)
উপস্থিতি তো সান্নিধ্যের নির্জনতা আর বন্ধুদের সমাগম,
‘ওয়া ইন ইয়াকাদু’ তেলাওয়াত কর এবং দরজা খুলে দাও।

কুরআনের আয়াতের ভাবার্থ প্রয়োগ : হাফিজ পবিত্র কুরআনের আয়াত বা আয়াতাংশের ভাবার্থ নিয়েও কবিতা রচনা করেছেন। যেমন : মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআনের সূরা আহযাবের ৭৩ নং আয়াতে শরীয়াতের বিধান সম্পর্কে বলেন :
‘আমি আকাশ, পৃথিবী ও পর্বতমালার সামনে এই আমানত পেশ করেছিলাম, অতঃপর তারা একে বহন করতে অস্বীকার করল এবং এতে ভীত হলো, কিন্তু মানুষ তা বহন করা। নিশ্চয় সে জালিম ও অজ্ঞ।’ (আহযাব : ৭৩)
হাফিজ বলেন :
آسمان بارامانت نتوانست كشيد
قرعه فال به نام من ديوانه زدند .
(গজল : ১৮৪, গানজুর)
আসমান পারেনি বহন করতে এই আমানত ভার
অবশেষে আমি পাগলের নামে এল ভাগ্যফল তার। (সেহাত : ২০১৮)
একইভাবে সূরা আহযাবের ৫৬ নং আয়াতের ভাবার্থও তিনি এনেছেন তাঁর কবিতায়।
আল্লাহ তায়ালা বলেন : ‘নিশ্চয় আল্লাহ ও তাঁর সকল ফেরেশতা তাঁর নবীর উপর দরুদ, সালাম (রহমত) প্রেরণ করেন। হে ঈমানদারগণ! তোমরাও তাঁর প্রতি দরুদ সালাম পাঠ কর।’ এই আয়াতের ভাবার্থকে উপজীব্য করে হাফিজ বলেন :
گفتم سخن توگفت حافظ گفتا
شادى لطيفه گويان صلوات ـ
(রুবায়ী-৩, গানজুর)
বললাম, হাফিজ, তোমার যা বলার ছিল সবই বলা হয়ে গেছে।
আনন্দ কর! মনোহারী কথা যারা বলেন তাদের প্রতি দরুদ সালাম।
একইভাবে সূরা আনআমের ১০৩ নং আয়াতের ভাবার্থ : ‘দৃষ্টিসমূহ তাঁকে পেতে পারে না, অবশ্য তিনি দৃষ্টিসমূহকে পেতে পারেন। তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও সুবিজ্ঞ’ ধারণ করে হাফিজ বলেন :
ديدن روى تو را ديده جان بين بايد
وين كجا مرتبۀ چشم جهان بين من است
(গজল ৩৯৪)
তোমার (কুদরতি) মুখ দেখতে, ঐ চোখ প্রয়োজন যা রুহানি জগৎ দেখতে পায়,
আমার এ চোখ দুনিয়া দেখে যে, তোমায় দেখায় যোগ্য নয়।
কুরআনে বর্ণিত কাহিনীকেও তিনি তুলে এনেছেন তাঁর কবিতায়। হারিয়ে যাওয়া হযরত ইউসুফ (আ.) পুনরায় কেনানে ফিরে আসার গল্প বর্ণনা করে হতাশার দোলাচল থেকে মুক্তি কামনা করে তিনি বলেন :
يوسف گم گشته باز ايد به كنعان غم مخور
كلبه احزان شود روزى گلستان غم مخور
(গজল ২৫৫, গানজুর)

দুঃখ করোনা হারানো য়ুসুফ
কানানে আবার আসিবে ফিরে।
দলিত শুষ্ক এমরু পুন
হয়ে গুলিস্তাঁ হাসিবে ধীরে। (নজরুল)

তাই বলা যায়, হাফিজের দিভানে অগণিত গজল ও অন্যান্য কবিতা রয়েছে যার ছত্রসমূহ পবিত্র কুরআনের আয়াত, আয়াতাংশ, ভাবধারা প্রয়োগে সমৃদ্ধ করেছেন। এটা সম্ভব হয়েছে তাঁর জীবনের চল্লিশটি বসন্তকাল এ মহাগ্রন্থের অনুশীলন ও প্রশিক্ষণে কাটিয়েছিলেন বলে। দীর্ঘদিনের সেই লব্ধ অভিজ্ঞতার স্বার্থক প্রয়োগ করেছেন তাঁর কাব্যে। এতে তাঁর কবিতা হয়েছে আরো অর্থবহ, বেড়েছে আংগিক শোভা, ছন্দের মাত্রায় যোগ হয়েছে অভিনব রসবোধ। তাই তাঁর কাব্যের আবেদন এখনো চিরন্তন। ‘লিসানুল গায়েব’ খ্যাত হাফিজ যথার্থই বলেন :
اى چنگ فروبرده به خون دل حافظ
فكرت مگر ازغيرت قران وخدا نیست
হাফিজের হৃদয় উতালা হয়েছে, সর্বগ্রাসী থাবায়,
চিন্তা-চেতনার বিকাশ ঘটেছে কুরআন ও আল্লাহর ভাবনায়।

তথ্যসূত্র
১. কুরআনুল কারিম।
২. হাফেজ, শামসুদ্দিন মোহাম্মদ, (১৩৮৬) অসিম প্রকাশনা, তেহরান।
৩. হুমায়ী, আল্লামা জালালউদ্দিন, (১৩৭৩) তারিখে মোখতাসারে আদাবি, কোম, ইরান।
৪. হারুভী, হোসাইন আলি, (১৩৯২) শারহে গাযালহায়ে, তেহরান।
৫. সায়েদী, আব্দুল আজিজ, (১৩৬৯) বা’ হাফেজ তা কাহকেশানে এরফার ভা আখলাক, শিরাজ।
৬. খানলরী, পারভেজ নাতেল, (১৩৬৮) ভাযনে শেরে ফারসি, তেহরান।
৭. শরিফ, বাবাক, বাহমানী, ফাতেমে, (১৩৯৫) এযাযে মুসেকিহায়ে কুরআন দার আয়নেয়ে এবরাতহায়ে মাওযুনে আরুযী। ফাসল নামে পাঝুহেশহায়ে আদাবি, চতুর্থ বর্ষ, ৩য় সংখ্যা।
৮. হাসান আনওয়ারী, (১৩৯২) সেদায়ে সোখানে এশক, তেহরান।
৯. জাহরা জামশিদী, (১৩৯৯) শেফায়ে দেল, ৩য় বর্ষ ৫ম সংখ্যা (৩৭-৫০)
১০. বাহাউদ্দিন খোররামশাহী, (১৩৭৩) বারগোযিদেয়ে শারহে হাফেজ, তেহরান।
১১. মোহাম্মদ বরকত উল্লাহ, (২০১০) পারশ্যপ্রতিভা, সাহিত্য প্রকাশনী, ঢাকা।
১২. অধ্যাপক মনুসর উদ্দীন, (১৯৭৮) ইরানের কবি, ঢাকা।
১৩. ড. হাসান সেহাত, (২০১৮) নিউজলেটার, ‘মানবতার উৎকর্ষ সাধনে সাধক কবি হাফিজ শিরাজী ও রবীন্দ্রনাথ’, (অক্টোবর-নভেম্বর)
১৪. ড. তারিক সিরাজী, (২০১৮) নিউজলেটার, ‘আধ্যাত্মিক কবি হাফিজ ও তাঁর কবিতা’। (অক্টোবর-নভেম্বর)
১৫. কাদের শাহনেওয়াজ, (২০২০) দৈনিক ইনকিলাব, ‘মহাকবি শামসুদ্দিন হাফিজ : জীবন ও কর্ম’, ৩রা জুলাই।
লেখক : অধ্যাপক, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

কোরআন মজীদের দৃষ্টিতে মানবতার ঐক্য ও ইসলামি ঐক্য

নূর হোসেন মজিদী –
আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেন :
كَانَ النَّاسُ أُمَّةً وَاحِدَةً فَبَعَثَ اللَّهُ النَّبِيِّينَ مُبَشِّرِينَ وَمُنْذِرِينَ وَأَنْزَلَ مَعَهُمُ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ لِيَحْكُمَ بَيْنَ النَّاسِ فِيمَا اخْتَلَفُوا فِيهِ وَمَا اخْتَلَفَ فِيهِ إِلا الَّذِينَ أُوتُوهُ مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَتْهُمُ الْبَيِّنَاتُ بَغْيًا بَيْنَهُمْ فَهَدَى اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا لِمَا اخْتَلَفُوا فِيهِ مِنَ الْحَقِّ بِإِذْنِهِ وَاللَّهُ يَهْدِي مَنْ يَشَاءُ إِلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ
‘(আদিতে) মানবম-লী একটিমাত্র উম্মাহ্ (আদর্শিক জনগোষ্ঠী) ছিল। অতঃপর আল্লাহ্ সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী হিসেবে নবীদেরকে উত্থিত করলেন এবং তাদের সাথে সত্যতা সহকারে কিতাব নাযিল করলেন যাতে তারা লোকদের মধ্যে তাদের মতপার্থক্যের বিষয়ে ফয়সালাহ্ করে দেয়, আর যাদের কাছে অকাট্য নিদর্শনাদি এসে যাওয়ার পরে তা দেয়া হয়, তারা নিজেদের মধ্যে বিদ্রোহাত্মকভাবে ব্যতীত সে ব্যাপারে মতপার্থক্য করে নি। অতঃপর আল্লাহ্ ঈমানদারদেরকে তাদের মতপার্থক্যের বিষয়ে সত্যতা সহকারে পথপ্রদর্শন করেন। আর আল্লাহ্ যাকে চান সরল-সঠিক-সুদৃঢ় পথে পরিচালিত করেন।’ (সূরা আল্-বাক্বারাহ্ : ২১৩)
এ আয়াতের ভাষা থেকে সুস্পষ্ট যে, আল্লাহ্ তা‘আলার এটাই পছন্দ যে, সমস্ত মানুষ একটি অভিন্ন উম্মাহ্ হিসেবে থাকবে, কিন্তু সীমালঙ্ঘনকারীরা তথা আল্লাহ্ তা‘আলার বিরুদ্ধে বিদ্রোহকারীরা মতপার্থক্য করে এবং এর ফলে সেই আদি উম্মাহ্ ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। অবশ্য পরবর্তীকালে মানব প্রজাতির ব্যাপক বিস্তারের ফলে অনেক ক্ষেত্রে এমনও হয়েছে যে, কোনো কোনো জনগোষ্ঠীর কাছ থেকে অতীতের নবী-রাসূলগণের (আ.) পরিচয় ও শিক্ষা হারিয়ে যায়, বা বিকৃত হয়ে যায়, বা তাদের কাছে যা ছিল তা পরিবর্তিত কালের দাবি পূরণের জন্য যথেষ্ট ছিল না, কিন্তু এ অবস্থায় নতুন আগত নবী-রাসূলগণের (আ.) নবী-রাসূল হওয়ার ব্যাপারে তাদের অনেকের জন্য ইতমামে হুজ্জাত হয় অর্থাৎ তারা নতুন আগত নবী-রাসূলগণের (আ.) নবী-রাসূল হওয়ার ব্যাপারে ইয়াক্বীনের অধিকারী হয়, কিন্তু অপর অনেকের কাছে, বিভিন্ন বাধার কারণে, যেমন : নতুন আগত নবী-রাসূলগণের পরিচয় সঠিকভাবে না পৌঁছা বা বিকৃতভাবে পৌঁছার কারণে, তাঁদের ব্যাপারে ইতমামে হুজ্জাত হয় নি। এমতাবস্থায় প্রথম ধরনের লোকদের মধ্যে যারা ইখলাসের অধিকারী তারা নতুন আগত নবী-রাসূলগণের ওপর ঈমান এনেছে এবং দ্বিতীয় ধরনের লোকদের মধ্যে যারা ইখলাসের অধিকারী তারা সহজাত প্রবণতা ও সর্বজনীন বিচারবুদ্ধি (عقل)-এর রায় অনুসরণ করেছে।
এ কারণে আল্লাহ্ তা‘আলা কোরআন মজীদের শুরুতে দুই ধরনের লোককে মুত্তাক্বী তথা আহ্লে নাজাত বলে উল্লেখ করেছেন এবং তাদের পক্ষে কোরআন মজীদ থেকে হেদায়াত লাভ করা সম্ভব বলে উল্লেখ করেছেন।
এরশাদ হয়েছে :
ذَلِكَ الْكِتَابُ لا رَيْبَ فِيهِ هُدًى لِلْمُتَّقِينَ الَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِالْغَيْبِ وَيُقِيمُونَ الصَّلاةَ وَمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنْفِقُونَ وَالَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ وَمَا أُنْزِلَ مِنْ قَبْلِكَ وَبِالآخِرَةِ هُمْ يُوقِنُونَ أُولَئِكَ عَلَى هُدًى مِنْ رَبِّهِمْ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ
‘এই কিতাব্- যাতে কোনো রকমের সন্দেহ-সংশয় নেই; এটি মুত্তাক্বীদের (সাবধানী লোকদের) জন্য পথপ্রদর্শনকারী- যারা ঈমান পোষণ করে ইন্দ্রিয়াতীত সত্তায়, সালাত্ কায়েম রাখে এবং আমি তাদেরকে যে রিয্ক্ব্ দিয়েছি তা থেকে ব্যয় করে। আর (তারাও মুত্তাক্বী/ সাবধানী হিসেবে এ কিতাব থেকে পথনির্দেশ পাবে) যারা (হে রাসূল!) আমি আপনার প্রতি যা নাযিল করেছি এবং আপনার পূর্বে যা কিছু নাযিল করেছি তাতে ঈমান পোষণ করে। আর তারা (সকলেই) আখেরাতের অস্তিত্বে ঈমান পোষণ করে। এরাই স্বীয় রবের হেদায়াতের ওপর রয়েছে এবং এরাই সফলকাম।’ (সূরা আল্-বাক্বারাহ্ : ২-৫)
এছাড়া কোরআন মজীদে বিচারবুদ্ধি (‘আক্বল্) ব্যবহারের ওপর বার বার তাকিদ করা হয়েছে এবং সর্বজনীন সুস্থ বিচারবুদ্ধি (عقل سليم عمومی)-এর দলিলের সাহায্যে তাওহীদ, আখেরাত ও নবুওয়াতে মুহাম্মাদী (সা.)-এর দাও‘আত পেশ করা হয়েছে। যেমন, বলা হয়েছে : তারা কি কোনো সৃষ্টি-উৎস ছাড়াই সৃষ্ট হয়েছে, নাকি তারা নিজেরাই স্রষ্টা? তিনিই পুনঃসৃষ্টি করবেন যিনি প্রথম বার সৃষ্টি করেছেন। মুহাম্মাদ (সা.) তো (নবুওয়াত-দাবির) পূর্বে গোটা জীবনই মক্কাবাসীদের মধ্যে কাটিয়েছিলেন। (তো তারা কি তাঁর পক্ষে কোরআনের মতো গ্রন্থ রচনা করা সম্ভবপর বলে মনে করে?) তারা যদি কোরআনকে গ¦ায়রুল্লাহ্র রচিত বলে মনে করে তাহলে এর সমমান সম্পন্ন একটি সূরা রচনা করে আনুক। এগুলোর সবই সর্বজনীন বিচারবুদ্ধির দলিল বা অকাট্য যুক্তি।
মোট কথা, আল্লাহ্ তা‘আলা মানুষের জন্য নাজাতের ভিত্তি করেছেন তাওহীদ ও আখেরাতে ঈমান এবং যথাযথ কর্ম (‘আমালে সালেহ্) সম্পাদনকে। যেহেতু আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর বান্দাদের ওপর সাধ্যাতীত দায়িত্ব প্রদান করেন না এবং তিনি জানেন যে, বিভিন্ন বাধার কারণে অনেক লোকের জন্য নবুওয়াতের ব্যাপারে ইতমামে হুজ্জাত না-ও হতে পারে। অবশ্য কারো জন্য নবুওয়াতের ব্যাপারে ইতমামে হুজ্জাত হওয়া সত্ত্বেও সে নবুওয়াতে ঈমান না আনলে তা হবে নেফাক্বের পরিচায়ক এবং সে ধরনের লোকেরা নাজাত লাভ করবে না। অন্যদিকে কোনো মুখলিস লোকের কাছে কোনো নবী-রাসূলের ব্যাপারে ইতমামে হুজ্জাত না হলেও তাঁদের ব্যাপারে সে সতর্কতার (তাক্বওয়ার) নীতি অনুযায়ী সসম্মান আচরণ করবে এবং এ সম্ভাবনা পোষণ করবে যে, হয়তো তিনি নবী ছিলেন, কিন্তু তাঁর পরিচিতি ও শিক্ষা বিকৃত হয়ে গিয়ে থাকবে।
আল্লাহ্ তা‘আলা মুসলমানদেরকে তাওহীদের ভিত্তিতে আহ্লে কিতাবের সাথে ভদ্রজনোচিত ও সসম্মান সহাবস্থানের জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। এরশাদ হয়েছে :
قُلْ يَا أَهْلَ الْكِتَابِ تَعَالَوْا إِلَى كَلِمَةٍ سَوَاءٍ بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمْ أَلا نَعْبُدَ إِلا اللَّهَ وَلا نُشْرِكَ بِهِ شَيْئًا وَلا يَتَّخِذَ بَعْضُنَا بَعْضًا أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللَّهِ فَإِنْ تَوَلَّوْا فَقُولُوا اشْهَدُوا بِأَنَّا مُسْلِمُونَ
‘(হে রাসূল!) বলুন : হে আহ্লে কিতাব! তোমরা এসো এমন একটি কথার দিকে যা আমাদের ও তোমাদের মধ্যে সমান, তা হচ্ছে : আমরা আল্লাহ্ ব্যতীত কারো দাসত্ব-উপাসনা করব না এবং তাঁর সাথে কোনো কিছুকে শরীক করব না, আর আল্লাহ্ ব্যতীত আমাদের কতক অপর কতককে রব হিসেবে গ্রহণ করব না। অতঃপর তারা যদি পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে তো (হে ঈমানদারগণ!) তোমরা বল : তোমরা সাক্ষী থাক যে, আমরা মুসলিম (আল্লাহ্র কাছে আত্মসমর্পিত)।’ (সূরা আলে ‘ইম্রান্ : ৬৪)
নিঃসন্দেহে যাদের সাথে এ ধরনের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য চেষ্টা করতে হবে তাদেরকে কাফের, মুশরিক, গোমরাহ্ ইত্যাদি মন্দ অভিধায় অভিহিত করা জায়েয হতে পারে না। এছাড়াও, যেহেতু মুসলমানদের দায়িত্ব অন্যদের কাছে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর মাধ্যমে নাযিলকৃত আল্লাহ্র দ্বীনের পরিপূর্ণ ও সর্বশেষ সংস্করণ পৌঁছানো ও এর প্রতি আহ্বান জানানো সেহেতু তাদেরকে মন্দ অভিধায় অভিহিত করা হলে তাদের দ্বারা এ দ্বীন গ্রহণযোগ্য হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। তাই তাদের অনুসৃত ধর্মের ভুলত্রুটি নির্দেশও ভদ্রজনোচিত পন্থায় করতে হবে; এমনকি বিতর্কের ক্ষেত্রেও তারা যে ভাষায় কথা বলে তার চেয়ে উত্তম ভাষায় জবাব দেয়ার জন্য কোরআন মজীদে সুস্পষ্ট নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
এই যেখানে অবস্থা সেখানে হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর খাতমে নবুওয়াত ও কোরআন মজীদের পূর্ণাঙ্গ ও সংরক্ষিত ঐশী কিতাব হওয়ার ওপরে ঈমান পোষণকারী মুসলমানদের জন্য অন্য কোনো কোনো ব্যাপারে মতপার্থক্যের কারণে পরস্পর বহুধাবিভক্ত হওয়া এবং পরস্পরকে কাফের, মুশরিক, মুরতাদ, গোমরাহ্ ইত্যাদি মন্দ অভিধায় অভিহিত করা কোনোভাবেই জায়েয হতে পারে না। কারণ, যে সব বিষয়ে মতপার্থক্য রয়েছে সে সব বিষয়ে সঠিক মতের ব্যাপারে বিভিন্ন বাধার কারণে কারো কারো জন্য ইতমামে হুজ্জাত না-ও হয়ে থাকতে পারে। সুতরাং নবুওয়াতে মুহাম্মাদী (সা.)-এর প্রতি ঈমান পোষণ না করা সত্ত্বেও আহ্লে কিতাবের সাথে যে ধরনের ভদ্রজনোচিত ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য যখন আল্লাহ্ তা‘আলা মুসলমানদের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন তখন মুসলমানদের পরস্পরের ক্ষেত্রে তার বরখেলাফ আচরণ জায়েয হতে পারে না।
আল্লাহ্ তা‘আলা কোরআন মজীদে বলেছেন যে, আল্লাহর কাছে দ্বীন একমাত্র ইসলাম এবং ইসলাম ব্যতীত অন্য কোনো দ্বীন কবুল করা হবে না। বস্তুত আল্লাহ্ তা‘আলার দৃষ্টিতে যা ইসলাম তা রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর মাধ্যমে প্রেরিত কোনো নতুন দ্বীন নয়, বরং হযরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে সকল নবী-রাসূলের দ্বীন এবং রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর মাধ্যমে তাকে পূর্ণতা দেয়া হয়েছে। ইসলাম তা-ই যা স্বয়ং আল্লাহ্ তা‘আলা কোরআন মজীদে উপস্থাপন করেছেন।
মানুষের গড়া ধর্মসমূহ ও আল্লাহ্র দ্বীনের মানুষের কৃত বিকৃত রূপসমূহ থেকে কোরআন মজীদে উপস্থাপিত আল্লাহ্র দ্বীনের পার্থক্য নির্দেশক অন্যতম বিশেষ বৈশিষ্ট্য এই যে, যেহেতু আল্লাহ্ তা‘আলা সকল প্রকার পক্ষপাতিত্ব ও গোষ্ঠীগত সঙ্কীর্ণতা থেকে প্রমুক্ত, সেহেতু মানুষের গড়া ধর্মসমূহের বিপরীতে এ দ্বীনে মানুষের সীমাবদ্ধতাকে বিবেচনায় রাখা হয়েছে।
এখানে আরো উল্লেখ্য যে, কোরআন মজীদে মুসলমানদেরকে একটি একক উম্মাহ্ (আদর্শিক জনগোষ্ঠী) হিসেবে গণ্য করা হয়েছে এবং তাদের জন্য অনৈক্য ও বিভেদ-বিভক্তিকে হারাম করা হয়েছে। এরশাদ হয়েছে :
إِنَّ هَذِهِ أُمَّتُكُمْ أُمَّةً وَاحِدَةً وَأَنَا رَبُّكُمْ فَاعْبُدُونِ
‘নিঃসন্দেহে তোমাদের এ উম্মাহ্ হচ্ছে এক উম্মাহ্ এবং আমি তোমাদের রব, সুতরাং তোমরা আমারই দাসত্ব কর।’ (সূরা আল্-আম্বিয়া’ : ৯২)
অন্যদিকে কোরআন মজীদে বিভিন্ন দল ও গোষ্ঠীতে বিভক্ত হওয়াকে মুশরিকদের বৈশিষ্ট্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে এবং মু’মিনদেরকে এ থেকে নিষেধ করা হয়েছে। এরশাদ হয়েছে :
وَلا تَكُونُوا مِنَ الْمُشْرِكِينَ مِنَ الَّذِينَ فَرَّقُوا دِينَهُمْ وَكَانُوا شِيَعًا كُلُّ حِزْبٍ بِمَا لَدَيْهِمْ فَرِحُونَ
‘আর তোমরা মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না – যারা তাদের দ্বীনকে বিভক্ত করেছে ও নিজেরা বিভিন্ন দল হয়ে গিয়েছে এবং প্রতিটি দলই তাদের কাছে যা আছে তা নিয়ে আনন্দিত।’ (সূরা র্আ-রূম্ : ৩১-৩২)
অন্য এক আয়াতে এরশাদ হয়েছে :
وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلا تَفَرَّقُوا
‘আর তোমরা সকলে মিলে আল্লাহ্র রশি দৃঢ়তার সাথে আঁকড়ে ধর এবং বিভক্ত হয়ো না।’ (সূরা আলে ‘ইমরান্ : ১০৩)
এছাড়া বিভক্তির অন্যতম প্রধান কারণ যে ঝগড়া-বিবাদ তা থেকেও নিষেধ করা হয়েছে; এরশাদ হয়েছে :
وَأَطِيعُوا اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَلا تَنَازَعُوا فَتَفْشَلُوا وَتَذْهَبَ رِيحُكُمْ
‘আর তোমরা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর এবং পরস্পর ঝগড়া-বিবাদ করো না, তাহলে তোমরা হীনবল হয়ে পড়বে এবং তোমাদের প্রাণবায়ু (শক্তি ও প্রাভাব) হারিয়ে যাবে।’ (সূরা আল্-আন্ফাল্ : ৪৬)
এ থেকে সুস্পষ্ট যে, কোরআন মজীদে তাওহীদ ও আখেরাতে ঈমান পোষণকারী এবং যথাযথ কর্ম (‘আমালে সালেহ্) সম্পাদনকারী জনগোষ্ঠীসমূহের সাথে উম্মাতে মুহাম্মাদীকে যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে তা হচ্ছে বহুর মধ্যে সমঝোতা (اتحاد), কিন্তু নবুওয়াতে মুহাম্মাদীতে ঈমান পোষণকারীদের জন্য সে ধরনের সমঝোতার নির্দেশ দেয়া হয় নি, বরং তাদেরকে একটি উম্মাহ্ – একটি অবিভাজ্য সত্তা হিসেবে গণ্য করা হয়েছে এবং বিভক্ত হওয়ার বিরুদ্ধে সতর্ক করা হয়েছে। অর্থাৎ কোরআন মজীদ উম্মাতে মুহাম্মাদীর জন্য এককত্বের (وحدة) প্রবক্তা।
সুতরাং সুস্পষ্ট যে, উম্মাতে মুহাম্মাদীর জন্য বহুধাবিভক্ত হওয়া কোনোমতেই জায়েয হয় নি। কিন্তু অবাঞ্ছিত বাস্তবতা হচ্ছে এই যে, তা সত্ত্বেও তারা বহুধাবিভক্ত হয়েছে। 
বাস্তবে আমরা মুসলমানদের এই বিভেদ ও অনৈক্যের বিষময় পরিণতি দেখতে পাচ্ছি। 
বর্তমানে বিশ্বে মুসলমানের সংখ্যা পৌনে দু’শ’ কোটি, কিন্তু তা সত্ত্বেও বৈশ্বিক অঙ্গনে তাদের তেমন কোনো প্রভাব নেই। এ কারণেই, তারা যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে পিছিয়ে আছে শুধু তা-ই নয়, ইসলাম ও মুসলমান আজ আদর্শিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক তথা সার্বিক দিক থেকে দুশমনদের হামলার শিকার। বিশেষত ইসলামের প্রথম ক্বিবলা বাইতুল মুক্বাদ্দাসসহ পবিত্র ভূমি ফিলিস্তিন দীর্ঘ সাত দশকেরও বেশি কাল যাবত যায়নবাদীদের অবৈধ দখলে, কিন্তু পৌনে দু’শ’ কোটি মুসলমান তা উদ্ধারের জন্য কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারে নি। ইরানের ইসলামি বিপ্লবের বিজয়ের পর বিপ্লবের নেতা হযরত ইমাম খোমেইনী (র.) মুসলিম উম্মাহ্কে ঐক্যবদ্ধ করার লক্ষ্যে মাহে রামাযানের শেষ শুক্রবারকে বিশ্ব ক্বুদস্ দিবস এবং হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ১২ই থেকে ১৭ই রাবী‘উল আউয়ালকে ইসলামি ঐক্য সপ্তাহ হিসেবে ঘোষণা করেন। কিন্তু তাতে দ্বীনদার মুসলমানদের অনেকে সাড়া দিলেও বিশ্বের মোট মুসলিম জনশক্তি অনুপাতে তা মোটেই যথেষ্ট নয় এবং তা চৈন্তিক অনৈক্যের কারণেই।  
মুসলমানদের এই বিভেদ-অনৈক্যের কারণেই ইসলামের আদর্শিক সীমান্ত বার বার দুশমনদের গুরুতর আগ্রাসনের সম্মুখীন হচ্ছে। এমনকি তাদের দুঃসাহস এতোই বেড়ে গিয়েছে যে, তারা হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-কে অবমাননা করতেও দ্বিধা করছে না। এর সর্বসাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত হচ্ছে ফরাসি সাময়িকী ‘শার্লি এবদো’তে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-কে অবমাননা করে ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশ। কেবল যে সাময়িকীটি তার পাঁচ বছর আগে প্রকাশিত এ ব্যঙ্গচিত্রটি পুনঃপ্রকাশ করেছে তা নয়, এটি ফ্রান্সের বিভিন্ন সরকারি ভবনেও প্রদর্শিত হয়েছে। এমনকি স্বয়ং ফরাসি প্রেসিডেন্ট মত প্রকাশের স্বাধীনতার নামে এটি নিষিদ্ধ করতেই কেবল অস্বীকৃতি জানান নি, সরকারি ভবনে প্রদর্শন বন্ধ করতেও অস্বীকৃতি জানিয়ে ইসলামবিদ্বেষী জঘন্য মানসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। অথচ ফ্রান্সসহ সমগ্র পাশ্চাত্যে তথাকথিত হলোকস্ট সম্পর্কে অনুসন্ধানী তথ্যাদি প্রকাশ নিষিদ্ধ; এ নিষেধাজ্ঞা আরোপের ক্ষেত্রে তারা মত প্রকাশের স্বাধীনতার কথা ভুলে যায়। অধিকন্তু কোনো পবিত্র ব্যক্তিকে ব্যঙ্গ তথা অবমাননা করা কখনোই মত প্রকাশের স্বাধীনতার অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য হতে পারে না। শুধু তা-ই নয়, ফ্রান্সে মুসলিম নারীদের হিজাব পরিধানকে নিষিদ্ধ করার সময়ও তাদের ব্যক্তিস্বাধীনতার কথা মনে ছিল না।
সর্বপ্রথম ইসলামি বিপ্লবের বর্তমান রাহবার হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী এ ব্যঙ্গটিত্র পুনঃপ্রকাশ ও প্রদর্শনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও নিন্দা জ্ঞাপন করেন। এরপর সমগ্র মুসলিম উম্মাহ্র মধ্যে ফরাসি সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও নিন্দা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং অনেকে ফরাসি পণ্য বর্জন করছেন। এটা আশার কথা। কিন্তু সার্বিকভাবে বিশে^র মুসলিম জনগণ ও সরকারগুলোর পক্ষ থেকে যে ধরনের সমন্বিত পদক্ষেপ প্রয়োজন ছিল তা এখনো গৃহীত হয় নি।
আসলে উম্মাহ্র মূল সমস্যা যে চৈন্তিক ক্ষেত্রে বিভেদ-অনৈক্য তার নিরসন হলে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর অবমাননাসহ ইসলামের আদর্শিক সীমান্তে আগ্রাসন চালানোর মতো দুঃসাহস ইসলামের দুশমনদের হতো না। তাই এ সমস্যার সমাধানকেই সব কিছুর ওপরে অগ্রাধিকার দেয়া অপরিহার্য।
প্রশ্ন হচ্ছে, এ সমস্যার নিরসনের জন্য করণীয় কী?
সর্বপ্রথম করণীয় হচ্ছে আল্লাহ্র দ্বীনকে ঠিক সেভাবে দেখার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হতে হবে যেভাবে স্বয়ং আল্লাহ্ তা‘আলা কোরআন মজীদে উপস্থাপন করেছেন। এর ভিত্তিতে নিজেদের জন্য উগ্রপন্থা (ইফ্রাত্ব) ও শিথিলপন্থা (তাফ্রীত্ব) হতে মুক্ত একটি মধ্যমপন্থী উম্মায় তথা ভ্রাতৃসম্প্রদায়ে পরিণত হওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে Ñ ঠিক যেমনটি আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেছেন :
وَكَذَلِكَ جَعَلْنَاكُمْ أُمَّةً وَسَطًا لِتَكُونُوا شُهَدَاءَ عَلَى النَّاسِ وَيَكُونَ الرَّسُولُ عَلَيْكُمْ شَهِيدًا
‘আর এভাবেই আমি তোমাদেরকে একটি মধ্যমপন্থী উম্মাহ্ বানিয়েছি যাতে তোমরা মানব জাতির জন্য শাহীদ (সত্যের সাক্ষী/ দ্বীনের মূর্ত প্রতীক) হও এবং রাসূল তোমাদের জন্য শাহীদ (সত্যের সাক্ষী/ দ্বীনের মূর্ত প্রতীক) হন।’ (সূরা আল্-বাক্বারাহ্ : ১৪৩)
এর ভিত্তিতে, ‘আক্বায়েদের ক্ষেত্রে শাখা-প্রশাখাগত বিষয়াদিতে মতপার্থক্য সত্ত্বেও খোদাদ্রোহী ব্যতীত উম্মাতে মুহাম্মাদীর সদস্যদেরকে আন্তরিকভাবেই আহ্লে নাজাত গণ্য করতে হবে এবং তাদের কাউকে ও অন্য কোনো আহ্লে নাজাতকে কাফের, মুশরিক, মুরতাদ, মুনাফিক্ব ইত্যাদি গণ্যকরণ ও অভিহিতকরণ পরিহার করতে হবে।
উম্মাতে মুহাম্মাদীর মধ্যে একক উম্মাহ্র অনুভূতি গড়ে তোলার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালাতে হবে। বিশেষ করে সকল ক্ষেত্রে সত্য ও ন্যায়ের সপক্ষে দাঁড়াতে হবে এবং খোদাদ্রোহীদের (তাদের জন্মগত ধর্মীয় পরিচয় যা-ই হোক না কেন), বিশেষত আল্লাহ্র বান্দাদেরকে স্বীয় দাসে পরিণতকারী বলদর্পী ও আধিপত্যবাদীদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
বিভক্তি দূরীভূত করে উম্মাতে মুহাম্মাদীকে কোরআন মজীদে কাক্সিক্ষত একক ও অবিভাজ্য উম্মায় পরিণত করার বিষয়টি জোর করে চাপিয়ে দেয়ার বিষয় নয় এবং সেভাবে তা অর্জন করা সম্ভবও নয়, বরং সে জন্য এমন প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে যাতে স্বাভাবিক পন্থায় স্বয়ংক্রিয়ভাবেই ফাটল ও বিভক্তি দূরীভূত হয়ে উম্মাতে মুহাম্মাদী পুনরায় সুসংহত একক অবিভাজ্য সত্তায় পরিণত হতে পারে। আর বলাই বাহুল্য যে, তা হতে হবে চৈন্তিক ও মনস্তাত্ত্বিক এককত্বের মাধ্যমে- যা কেবল ‘ইল্মী পন্থায় অর্জিত হতে পারে।
ইরানের ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্.) ইসলামি উম্মাহ্কে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য তাঁর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত চেষ্টা করেছেন। বিশেষত তিনি সব সময়ই ইসলামের প্রথম ক্বিবলা বায়তুল্ মুক্বাদ্দাসসহ ফিলিস্তিন ভূমিকে মুক্ত করার জন্য উম্মাহ্র ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন; ইতিপূর্বে যেমন উল্লেখ করেছি, তিনি উম্মাহ্র মধ্যে ঐক্য সৃষ্টির লক্ষ্যে বিশ্ব ক্বুদ্স্ দিবস ও ইসলামি ঐক্য সপ্তাহ্ ঘোষণা করেন। 
বস্তুত ইসলামের অকাট্য জ্ঞানসূত্রসমূহের আলোকে ‘আক্বায়েদের শাখা-প্রশাখাসমূহ এবং মৌলিক ফরয/ ওয়াজিব্ ও হারামের ক্ষেত্রে বিরাজমান মতপার্থক্যসমূহ নিরসন করা সম্ভব হলে প্রায়োগিক (ফরয/ ওয়াজিব্ ও হারাম সংক্রান্ত বিধান বাস্তবায়নের শর্তাবলি) এবং গৌণ বিষয়াদির (মুস্তাহাব্ ও মাক্রূহ্র) ক্ষেত্রে বিরাজমান মতপার্থক্যসমূহ কোনো সমস্যা নয়।
অত্র নিবন্ধকারের দৃষ্টিতে, ইসলামের অকাট্য জ্ঞানসূত্র চারটি যার সাহায্যে ‘আক্বায়েদ ও তার শাখা-প্রশাখাসমূহ এবং মৌলিক ফরয/ ওয়াজিব্ ও হারামসমূহ প্রমাণিত হতে পারে। তা হচ্ছে : (১) সর্বজনীন সুস্থ বিচারবুদ্ধি, (২) কোরআন মজীদ, (৩) মুতাওয়ার্তি হাদীস ও (৪) শিয়া-সুন্নি নির্বিশেষে উম্মাহ্র মধ্যে শুরু থেকে ধারাবাহিকভাবে চলে আসা অভিন্ন মত ও আমলসমূহ (ইজ্মা‘এ উম্মাহ্)।
এ জ্ঞানসূত্রগুলো এমন যা সকল মুসলমানের নিকট সমভাবে গ্রহণযোগ্য হওয়া অপরিহার্য। কোরআন মজীদে সকল মুসলমানই ঈমান পোষণ করে, অন্যদিকে শেষোক্ত দু’টি জ্ঞানসূত্র নিঃসন্দেহে সুন্নাতে রাসূল (সা.)-এর উদ্ঘাটনকারী। তবে সর্বজনীন সুস্থ বিচারবুদ্ধিকে ইসলামের অন্যতম অকাট্য জ্ঞানসূত্র হিসেবে গ্রহণ করা, বিশেষত ক্রমের দিক থেকে প্রথমে স্থান দেয়ার ব্যাপারে অনেকের আপত্তি থাকতে পারে।
এ প্রসঙ্গে কেবল এতোটুকু উল্লেখ করাই যথেষ্ট যে, কোরআন মজীদ বিচারবুদ্ধি (‘আক্বল্) ব্যবহারের ওপর বার বার গুরুত্ব আরোপ করেছে এবং ‘আক্বলী দলিলের ভিত্তিতে লোকদেরকে তাওহীদ, আখেরাত, নবুওয়াতে মুহাম্মাদী (সা.) ও কোরআন মজীদের প্রতি ঈমানের আহ্বান জানিয়েছে, আর একজন অমুসলিম – যে নবুওয়াতে মুহাম্মাদীর ও কোরআন মজীদের প্রতি ঈমান পোষণ করে না – সর্বজনীন সুস্থ বিচারবুদ্ধির ভিত্তিতে পর্যালোচনা করে ইসলামের সত্যতায় উপনীত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করে। সুতরাং সর্বজনীন সুস্থ বিচারবুদ্ধি ইসলাম-গৃহে প্রবেশের দরজাস্বরূপ। তাই সর্বজনীন সুস্থ বিচারবুদ্ধির আলোকে যা কিছুকে সত্য জেনে একজন অমুসলিম ইসলামে ঈমান এনেছে অতঃপর ইসলামের অন্য কোনো জ্ঞানসূত্র থেকে, এমনকি কোরআন মজীদ থেকেও এর বরখেলাফ কোনো তাৎপর্য গ্রহণ করা যেতে পারে না।

ইরানি প্রবাদ

شش دانگ غرق کاری بودن
উচ্চারণ : শিশ দা’ঙ্গ গারকে কা’রী বূদান
অর্থ : ছয় আনা কোনো কাজে ডুবে যাওয়া।
মর্মার্থ : ধ্যানমন একাগ্র করে কোনো কাজে ডুবে যাওয়া বুঝাতে সাধারণ কথাবার্তায় প্রবাদটি সর্বত্র ব্যবহৃত হয়।
شش ماهه به دنیا آمده
উচ্চারণ : শিশ মা’হে বে দুনয়া’ আ’মাদে
অর্থ : ছয় মাস হলো দুনিয়ায় এসেছে।
মর্মার্থ : কেউ কাজকর্ম খুব তাড়াহুড়ায় আঞ্জাম দিচ্ছে, এখনো বাচ্চা মানুষ, এ কথা বুঝাতে এই প্রবাদের প্রচলন ব্যাপক।
شق القمر کردن
উচ্চারণ : শাক্কুল কামার কার্দান
অর্থ : চাঁদ দ্বিখ-িত করা।
মর্মার্থ : খুবই কষ্টকর কোনো কাজ সম্পাদন করা, বিস্ময়কর কোনো কাজ আঞ্জাম দেয়া অর্থে এই প্রবাদের প্রচলন ব্যাপক।
شکراب میان دو نفر شدن
উচ্চারণ : শেকারা’ব মিয়া’নে দো নাফার শোদান
অর্থ : দু জনের মাঝে চিনির পানি হওয়া।
মর্মার্থ : দুই বন্ধুর মাঝখানে মনোমালিন্য হয়েছে বা দু জনের সম্পর্কের মাঝে সন্দেহ সংশয় সৃষ্টি হয়েছে এমনটি বুঝাতে এই প্রবাদটি ব্যবহৃত হয়।
شکسته نفسی کردن
উচ্চারণ : শেকাস্তে নাফসী কার্দান
অর্থ : নফস ভেঙে গেছে এমন দেখানো।
মর্মার্থ : বিনয় প্রকাশ, নিজেকে প্রকাশ না করার ভাবার্থ বুঝানোর জন্য এই প্রবাদ ব্যবহৃত হয়। যেমন বলা হয়, লোকটি শেকাস্তা নফসী করছে। নিজের যোগ্যতা গোপন করে বিনয় প্রকাশ করছে।
شکم خود را صابون زدن
উচ্চারণ : শেকামে খোদ রা’ সা’বূন যাদান
অর্থ : নিজের পেটে সাবান দেয়া
মর্মার্থ : কিছুদিন ক্ষুধার ঘানি টানার পর খাওয়ার জন্য নিজকে প্রস্তুত করেছে। খাওয়ার রুচি ঠিক করে নিয়েছেÑ এই ভাবার্থটি প্রকাশ করার জন্য প্রবাদটি ব্যবহৃত হয়।
شکمش گوشت نو بالا آورده
উচ্চারণ : শেকামাশ গূশতে নূ বা’লা’ আ’ওয়ার্দে
অর্থ : তার পেটে নতুন গোশত ফুলে উঠেছে।
মর্মার্থ : তার কায়কারবার বেশ জমে উঠেছে, নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে, অতীতের কথা ভুলে গেছে, নিজেকে নিয়ে বেসামালÑ এ ভাবটি ফুটিয়ে তোলার জন্য উপরোক্ত প্রবাদটি ব্যবহৃত হয়।

অনুবাদ : ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী

ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের নতুন ইন্সটাগ্রাম পেইজ ও ইউটিউব চ্যানেল চালু

ঢাকাস্থ ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের নতুন ইন্সটাগ্রাম পেইজ ও ইউটিউব চ্যানেল চালু করা হয়েছে। ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাহিত্য ও সংস্কৃতি স¤পর্কে জানতে এবং দেশটির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ও আকর্ষণীয় তথ্য পেতে পেইজটি আজই ভিজিট করুন।
ইন্সটাগ্রাম পেইজের ঠিকানা  https://www.instagram.com/iran_cultural_center_dhaka?r=nametag
নিয়মিত তথ্য পেতে পেইজটির ফলোয়ার হোন এবং চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব করুন।
আমাদের ইউটিউব চ্যানেলের নাম: iran-culture-bd
ইউটিউব চ্যানেলের ঠিকানা:
https://www.youtube.com/channel/UCqpd3vaK56AK2yRpfR124kwhttps://www.youtube.com/channel/UCqpd3vaK56AK2yRpfR124kw

ইমাম জাফর সাদিক (আ.)

সংকলন ও অনুবাদ : মো. আশিফুর রহমান –

ভূমিকা : আহলে বাইতের ষষ্ঠ ইমাম জাফর সাদিক (আ.) ১৪৮ হিজরিতে পবিত্র মদীনায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ৩৪ বছর ইমামতের দায়িত্ব পালন করেন।
পিতামাতা : ইমাম জাফর সাদিক (আ.)-এর পিতার নাম ছিল ইমাম মুহাম্মাদ আল বাকের (আ.) ও মাতার নাম ছিল হযরত ফারওয়া।
কুনিয়া ও উপাধি : ইমামের কুনিয়া ছিল আবু আবদুল্লাহ। কোনো কোনো সূত্রে তাঁর কুনিয়া আবু ইসমাইল (যেহেতু তাঁর বড় ছেলের নাম ছিল ইসমাইল) ও আবু মূসা (তাঁর জীবিত পুত্র মূসা কাযিম) হিসেবেও বর্ণিত হয়েছে।
তাঁর প্রসিদ্ধ উপাধি হচ্ছে আস-সাদিক যার অর্থ সত্যবাদী। একটি হাদিস অনুসারে, মহানবী (সা.) স্বয়ং তাঁর এই উপাধি বলে গিয়েছিলেন যাতে ‘জাফর আলকায্যাব’ থেকে পৃথক করা যায়।- সাদুক, কামালুদ্দীন, পৃ. ৩১৯
যাহোক, ইতিহাসের বিশ্লেষণ অনুযায়ী ইমাম সাদিক (আ.) এই উপাধি পেয়েছিলেন এজন্য যে, তিনি তাঁর সময়ের যে কোনো বিদ্রোহ থেকে নিজেকে দূরে রেখেছিলেন। ওই সময়ে যে কেউ শাসকদের বিরুদ্ধে লোকদেরকে জমায়েত করত ও বিদ্রোহে প্ররোচনা দিত তাদেরকে ‘কায্যাব’ বলা হতো। 
এই উপাধি কেবল তাঁর জন্যই ব্যবহৃত হতো। কয়েকজন সুন্নি পণ্ডিত, যেমন মালিক বিন আনাস, আহমাদ বিন হাম্বাল এবং আল জাহিয ইমাম জাফর সাদিককে এই উপাধি দ্বারাই উল্লেখ করেছেন।
ইমাম সাদিকের অন্যান্য উপাধির মধ্যে রয়েছে আস-সাবির, আত-তাহির এবং আল-ফাযিল।
জীবনকাল
ইমাম সাদিক (আ.) তাঁর জীবনের বারো বছর তাঁর দাদা ও ত্রিশ বছর তাঁর পিতার সান্নিধ্যে কাটান। ইমাম জাফর সাদিক (আ.) দশ জন উমাইয়্যা খলিফা ও দুই জন আব্বাসী খলিফার সমসাময়িক ছিলেন।
ইমাম সাদিক (আ.) তাঁর পিতার সাথে সিরিয়ায় গমন করেন যখন হিশাম ইবনে আবদুল মালিক ইমাম বাকের (আ.)-কে সিরিয়া ডেকে পাঠায়।
ইমাম সাদিক (আ.)-এর ইমামতকালে উমাইয়্যা খেলাফত পতনোন্মুখ হয়েছিল এবং অবশেষে পতনও ঘটে আর আব্বাসীরা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। শাসকবর্গের দুর্বলতা ইমামের শিক্ষা বিস্তারে সুযোগ সৃষ্টি করে। তুলনামূলকভাবে এই উন্মুক্ত অবস্থা দ্বিতীয় শতাব্দীর একটি অংশে বিস্তৃত ছিল। কিন্তু এর আগে ইমাম ও তাঁর অনুসারীরা উমাইয়্যাদের পক্ষ থেকে ভীষণ চাপের মধ্যে ছিলেন। মুহাম্মাদ আন-নাফসে যাকীয়াহ এবং তাঁর ভাই ইবরাহীমের বিদ্রোহের পরও ইমাম প্রচণ্ড চাপের মধ্যে ছিলেন।
ইমাম জাফর সাদিকের ইমামতকাল ৩৪ বছর স্থায়ী হয়েছিল। মানসুর দাওয়ানিকির শাসনকালের দশ বছর পর ইমাম শহীদ হন। ইমাম সাদিক খলিফা মানসূর কর্তৃক ইরাকে নীত হন এবং সেখানে কিছুকাল বসবাস করতে বাধ্য হন।
ইমামতের প্রমাণ
কয়েক ব্যক্তি ইমাম বাকের (আ.)-এর নিকট থেকে তাঁর সন্তান ইমাম জাফর সাদিক (আ.)-এর জন্য ইমামতের বিষয়টি সুনির্দিষ্ট করে বর্ণনা করেছেনÑ যাঁদের মধ্যে রয়েছেন হিশাম বিন সালিম, আবুল সাবাহ আল কানানী, জাবির ইবনে ইয়াযীদ আল জুফী এবং আবদুল আলা মাওলা আল শাম।
শেখ মুফীদ বলেন, ইমাম বাকের (আ.) কর্তৃক ইমাম জাফর সাদিক (আ.)-এর ইমামতের বিষয়টি বলে যাওয়া ছাড়াও তাঁর ভাইদের, তাঁর চাচাতো ভাইদের ও অন্য মানুষদের ওপর তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব এবং তাঁর জ্ঞানগত প্রতিভা, ধার্মিকতা এবং ধর্মপরায়ণতা ইত্যাদি তাঁর ইমামতের প্রমাণ বহন করে।
প্রতিনিধি নিয়োগ
যেহেতু আহলে বইতের অনুসারী মুসলমানরা মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাস করতো এবং ইমামের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করাটা তাদের জন্য খুব কষ্টকর ছিল তাই ইমাম সাদিক (আ.) বিভিন্ন অঞ্চলের জন্য প্রতিনিধি নিয়োগের পদ্ধতি চালু করেন যারা খুম্স, যাকাত ও অন্যান্য অনুদান ও উপঢৌকন ইমামের কাছে পৌঁছে দিতেন। তারা বিভিন্ন বিষয়ে জনসাধারণের প্রশ্নসমূহ ইমামদের কাছে নিয়ে আসতেন এবং সেগুলোর জবাবও জনগণের কাছে পৌঁছে দিতেন।- জাব্বারী, সাজমান-ই ওয়াকালাত-ই আইম্মা, ১ম খ-, পৃ. ২৮০, ৩২০, ৩২২
পরবর্তীকালে এই প্রতিনিধি নিয়োগের ধারা আলী বিন মুহাম্মাদ আল সামারীর মৃত্যু পর্যন্ত অব্যাহত থাকে যিনি ইমাম মাহদী (আ.)-এর চতুর্থ সরাসরি প্রতিনিধি ছিলেন।- জাব্বারী, বাররাসীয়ে সাজমানে দাওয়াতি আব্বাসীয়ান, পৃ. ৭৫-১০৪
গুলাতের বিরোধিতা
ইমাম বাকের (আ.) ও ইমাম জাফর সাদিক (আ.)-এর সময় গুলাতরা তাদের কর্মকা- বিস্তৃত করে ফেলে। তারা বিশ্বাস করত ইমামরা খোদা অথবা নবী। ইমাম সাদিক (আ.) শক্তভাবে এই মতবাদের বিরোধিতা করেন। তিনি তাঁর অনুসারীদেরকে গুলাতদের সাথে মিশতে নিষেধ করতেন এবং তাদেরকে কাফির হিসেবে ঘোষণা করেন। তাদের সম্পর্কে ইমাম বলেন, ‘তাদের সাথে সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করো না, তাদের সাথে খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ করো না এবং তাদের সাথে মুসাফাহা করো না।’ ইমাম হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন : ‘সতর্ক থেক, গুলাতরা যেন তোমাদের যুবকদেরকে বিপথে না নিতে পারে। তারা আল্লাহর সবচেয়ে নিকৃষ্ট শত্রু। তারা আল্লাহকে তুচ্ছ গণ্য করে, কিন্তু আল্লাহর বান্দাদের ওপর প্রভুত্বের বৈশিষ্ট্য আরোপ করে।’- তূসী, আল আমালী, পৃ. ৬৫০
জ্ঞানগত আন্দোলন
উমাইয়্যাদের দুর্বলতার কারণে ইমাম জাফর সাদিক (আ.) শিক্ষাদান ও সামাজিক কর্মকা- করার জন্য অপেক্ষাকৃত অধিক সুযোগ লাভ করেন। ইমামদের সময়ে এমনটি খুবই দুর্লভ বিষয় ছিল। আর তাই আহলে বাইতের অধিকাংশ হাদিস ইমাম জাফর সাদিক (আ.) হতে বর্ণিত হয়েছে।
ইবনে হাজার হাইসামীর অভিমত অনুযায়ী, মানুষ তাঁর নিকট থেকে বিপুল পরিমাণ জ্ঞান অর্জন করে ও প্রচার করে এবং তাঁর সুখ্যাতি বহু দূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে পড়ে। আল-জাহিয বলেন যে, তাঁর জ্ঞান এবং ফিকাহ্শাস্ত্র বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। আল হাসান বিন আলী আল ওয়াসসা বর্ণনা করেন যে, কুফার মসজিদে নয় শত লোক ইমাম জাফর সাদিক (আ.) থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন।- নাজাশী, রিজাল আল নাজাশী, পৃ. ১২
আহলে বাইতের মাযহাব
আহলে বাইতের অধিকাংশ হাদিস, তা ফিকাহ বিষয়ে হোক, অথবা ধর্মতত্ত্ব সম্পর্কিত, ইমাম সাদিক (আ.) থেকে বর্ণিত হয়েছে এবং তাঁর নিকট থেকে হাদিস বর্ণনাকারীদের সংখ্যা চার হাজার পর্যন্ত বলা হয়েছে (ইরবিলির অভিমত)- যা অন্য যে কোনো ইমাম থেকে বর্ণিত হাদীসের চেয়ে অনেক বেশি। আবান ইবনে তাগলিবের মতে, আহলে বাইতের অনুসারীরা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কোনো বাণীর বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করলে সেক্ষেত্রে আলী (আ.)-এর বাণী দেখত, তেমনিভাবে যখন ইমাম আলী (আ.)-এর বাণীর বিষয়ে মতানৈক্য করত তখন তারা ইমাম সাদিক (আ.)-এর বাণীর দিকে লক্ষ্য করত।
ইসলামি শিক্ষার ব্যাপক বিস্তারে ইমাম জাফর সাদিক (আ.)-এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার জন্য আহলে বাইতের অনুসারীদেরকে জাফরী মাযহাবের অনুসারী বলা হয়।
বুদ্ধিবৃত্তিক সংলাপ ও বিতর্ক
আহলে বাইতের হাদিস সংকলনে কিছু সংখ্যক পারস্পরিক সংলাপ ও বিতর্কের বিষয় লিপিবদ্ধ হয়েছে যা ইমাম সাদিক (আ.) এবং অন্যান্য মাযহাবের পণ্ডিত এবং কতিপয় নাস্তিকের সাথে সংঘটিত হয়েছিল। কিছুসংখ্যক বিতর্কে ইমামের শিষ্যগণ অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং ইমাম তা অবলোকন করেছিলেন। কখনও কখনও ইমাম নিজেই বিতর্কে অংশ নিতেন।- কুলাইনী, আল-কাফী, ১ম খ-, পৃ. ৭৯, ৮০, ১৭১-১৭৩ 
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, দামেশকের একজন পণ্ডিতের সাথে ইমামের শিষ্যদের বিতর্কের অুনরোধ করা হলে ইমাম জাফর সাদিক (আ.) হিশাম বিন সালিমকে ধর্মতত্ত্বের বিষয়ে তার সাথে বিতর্কে লিপ্ত হওয়ার নির্দেশ দেন।৪৯ প্রাগুক্ত
অন্য একটি ঘটনায় দেখা যায়, এক ব্যক্তি তাঁকে বিতর্কের আহ্বান জানালে ইমাম প্রথমে তাঁর শিষ্যের সাথে তাকে বিতর্ক করার জন্য বলেন। সেই ব্যক্তি হুমরান বিন আয়ানের সাথে কোরআনের বিষয়ে, আবান বিন তাগলিবের সাথে আরবি সাহিত্যের বিষয়ে, যুরারাহর সাথে ফিকাহ বিষয়ে এবং মুমিন তাক ও হিশাম বিন সালিমের সাথে ধর্মতত্ত্ব বিষয়ে বিতর্ক করে এবং তাদের সকলের কাছে পরাজিত হয়।- কাশশী, রিজাল, পৃ. ২৭৫-২৭৭
আহমাদ বিন আলী আল তাবরিযী ইমাম সাদিক (আ.)-এর কিছুসংখ্যক বিতর্কের সংকলন করেন যেগুলো নিচে উল্লেখ করা হলো :
১. আল্লাহর অস্তিত্বের বিষয়ে একজন নাস্তিকের সাথে বিতর্ক,
২. আবু শাকির আল দায়সানির সাথে আল্লাহর অস্তিত্বের বিষয়ে বিতর্ক;
৩. ইবনে আবিল আওযার সাথে আল্লাহর অস্তিত্বের বিষয়ে বিতর্ক;
৪. ইবনে আবিল আওযার সাথে বিশ্বের সৃষ্টি নিয়ে বিতর্ক;
৫. একজন নাস্তিকের সাথে ধর্মীয় বিভিন্ন বিষয়ে দীর্ঘ বিতর্ক;
৬. ইমাম আবু হানিফার সাথে উসূলে ফিকহ্ নিয়ে বিতর্ক;
৭. কয়েকজন মুতাযিলী প-িতের সাথে শাসককে বেছে নেয়া ও কিছু ধর্মীয় নিয়ম-কানুন নিয়ে বিতর্ক।
এই বিতর্কগুলোর অধিকাংশই আল্লামা তাবারসীর ‘আল-ইহতিজাজ’ গ্রন্থের ২য় খ-ে ৩৩১ পৃষ্ঠা থেকে ৩৬৪ পৃষ্ঠা পর্যন্ত বর্ণিত হয়েছে।
রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড
ইমাম সাদিক (আ.)-এর জীবনী পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই যে, তিনি রাজনীতি থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতেন এবং এই অবস্থান উমাইয়্যা ও আব্বাসী উভয় শাসনামলে একই রকম ছিল। যদিও তিনি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে দূরে থাকতেন, কিন্তু সমাজের প্রতি এবং এর গন্তব্য সম্পর্কে খুবই মনোযোগী ছিলেন। তিনি শাসকদেরকে শাসনকার্যে ন্যায়নীতি বজায় রাখার উপদেশ দিতেন, মানুষের সাথে পরামর্শ এবং তাদের অনুরোধ রক্ষার জন্য উপদেশ দিতেন।
সেই সময়ে উমাইয়্যা শাসকদের দুর্বলতা সত্ত্বেও তিনি বিদ্রোহ ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব থেকে দূরে থাকতেন। শাহরেস্তানীর মতে, আবু মুসলিম খোরাসানী ইবরাহীম আল ইমামের মৃত্যুর পর ইমাম সাদিকের কাছে একটি চিঠি প্রেরণ করেন এই কথা বলে যে, তিনিই খেলাফতের সবচেয়ে যোগ্য এবং তিনি যেন খেলাফতের পদ গ্রহণ করেন। ইমাম এর জবাবে লিখেন : ‘তুমি আমার অন্যতম সাহায্যকারী নও, আর এই সময়টিও আমার নয়।’- শাহরিস্তানী, আল মিলাল ওয়ান নিহাল, ১ম খ-, পৃ. ১৭৯
আবু সালামাও ইমামের নিকট এই রকম পত্র প্রেরণ করেন আর ইমাম তা পুড়িয়ে ফেলেন।- মাসউদী, মুরুযুয যাহাব, ৩য় খ-, পৃ. ২৫৪
ইমাম সাদিক (আ.) তাঁর চাচা যায়েদ বিন আলীর সাথে বিদ্রোহে যোগ দেন নি। একটি হাদিস থেকে জানা যায়, যথেষ্ট সংখ্যক বিশ্বস্ত সমর্থক না থাকায় ইমাম বিদ্রোহগুলোতে যোগ দেন নি।- ইবনে শাহরাশুব, মানাকিব আল আবি তালিব, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ২৩৭
আবদুল্লাহ আল মাহাযের সাথে মতানৈক্য
উমাইয়্যা শাসনের শেষের দিকে বনু হাশিমের কতিপয় ব্যক্তি-যাদের মধ্যে আবদুল্লাহ আল মাহায ও তার সন্তানও ছিল-এবং আস সাফফাহ এবং আল মানসূর আবওয়া নামক স্থানে জমায়েত হয়েছিল নিজেদের মধ্যে কারো হাতে বাইয়াত করার জন্য। সেই সমাবেশে আবদুল্লাহ তার সন্তানকে ‘আল মাহদী’ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয় এবং অন্যদেরকে তার হাতে বাইয়াত গ্রহণের আহ্বান জানায়। যখন ইমাম সাদিক (আ.) তাদের মনোভাব সম্পর্কে অবহিত হন তখন তিনি আবদুল্লাহকে বলেন, ‘যদি তুমি তোমার সন্তানকে মাহদী মনে কর (তাহলে তুমি ভুল করেছ, আসলে) সে আল মাহদী নয় এবং আল মাহদীর আগমনের সময় এখনও হয় নি।’ আবদুল্লাহ একথা শুনে রাগান্বিত হয় এবং ইমামকে হিংসার অভিযোগে অভিযুক্ত করে। ইমাম সাদিক (আ.) কসম করে বলেন, তাঁর কথা হিংসাপ্রসূত নয় এবং তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেন যে, আল সাফফাহ ও আল মানসূর শাসক হবে এবং আবদুল্লাহ ও তার সন্তানকে হত্যা করা হবে।- আবুল ফারায আল-ইসফাহানী, মাকতালুত তালিবিয়্যীন, পৃ. ১৮৫-১৮৬
খলিফাদের সাথে সম্পর্ক
যদিও ইমাম সাদিক (আ.) তাঁর সময়ের খলিফাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে অস্বীকার করেন, কিন্তু খলিফাদের সাথে তাঁর সম্পর্ক মোটেও ভালো ছিল না। একবার হজের মৌসুমে তিনি আহলে বাইতকে আল্লাহর মনোনীত হিসেবে ঘোষণা করেন এবং খলিফা হিশাম বিন আবদুল মালিকের আহলে বাইতের প্রতি শত্রুতার কথা উল্লেখ করেন।- মাজলিসী, বিহারুল আনওয়ার, ৪৬তম খ-, পৃ. ৩০৬
একবার আব্বাসী খলিফা মানসূর দাওয়ানিকি অন্য লোকেরা যেমন তার সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য যায় ইমামকেও তেমন তার সাথে সাক্ষাৎ করা জন্য যাওয়ার আহ্বান জানালে ইমাম লিখে পাঠান- তোমাকে ভয় করার জন্য আমাদের তেমন কিছু নেই, পরকালে তোমার কিছু নেই যার জন্য তোমার কাছে আমাদের কিছু আশা থাকতে পারে, আর তুমি নেয়ামতের মধ্যেও নও যার জন্য তোমাকে অভিনন্দন জানানো যায়…- মাজলিসী, বিহারুল আনওয়ার, ৪৭তম খ-, পৃ. ১৮৪
ইমাম সাদিক (আ.)-এর বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া
একটি বর্ণনায় পাওয়া যায় যে, যখন হাসান বিন যায়েদ মক্কা ও মদীনার গভর্নর ছিল সেসময় একবার ইমাম সাদিক (আ.)-এর বাড়ি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। আগুনে বাড়ির দরজা ও করিডোর পুড়ে যায়। ইমাম সাদিক (আ.) আগুনের ভেতর দিয়ে এ কথা বলতে বলতে বের হয়ে আসেন : ‘আমি পৃথিবীর মূলের সন্তান (অর্থাৎ ইসমাইল আ.-এর সন্তান); আমি আল্লাহর বন্ধু ইবরাহীমের সন্তান।’- কুলাইনী, আল-কাফী, ১ম খ-, পৃ. ৪৭৩
দ্বিতীয় হিজরি শতাব্দীর তৃতীয় দশকের কিছুটা সময় বাদে পুরো সময়টি ইমাম উমাইয়্যা ও আব্বাসী খলিফাদের কঠোর নজরদারির মধ্যে ছিলেন। ইমামের ওপর রাজনৈতিক চাপ চরমে পৌঁছেছিল।- জাফারীয়ান, হায়াতি ফিকরী সিয়াসীয়ে ইমামানে শিয়া, পৃ. ৪৩৫
কিছু কিছু বর্ণনায় পাওয়া যায় যে, মানসুরের গুপ্তচররা ইমামের সাথে যেসব ব্যক্তি যোগাযোগ রাখত তাদেরকে নির্যাতন করত, এমনকি অনেককে হত্যাও করত। এতে ইমাম ও তাঁর অনুসারীদেরকে খুব সতর্ক হয়ে চলতে হতো।
চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য
ইমাম জাফর সাদিক (আ.)-এর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে অনেক কিছু বর্ণিত হয়েছে, যেমন তাঁর বদান্যতা, ইবাদত-বন্দেগি, কোরআন তেলাওয়াত ইত্যাদি। মালিকি মাযহাবের প্রতিষ্ঠাতা মালিক বিন আনাস বর্ণনা করেন যে, যখনই তিনি ইমাম জাফর সাদিক (আ.)-এর সাথে দেখা করতে যেতেন তখন তাঁকে তিনটি অবস্থার যে কোনো একটি অবস্থায় পেতেনÑ নামায পড়া, রোযা রাখা অথবা আল্লাহর যিকির করা।- মাজলিসী, বিহারুল আনওয়ার, ৪৭তম খ-, পৃ. ১৬
বর্ণিত হয়েছে যে, একবার ইমাম একজন ভিক্ষুককে চারশ’ দিরহাম ভিক্ষা দেন। ভিক্ষুকটি ইমামের প্রশংসা করলে ইমাম তাঁর হাতের আংটি সেই ভিক্ষুককে দিয়ে দেন যার মূল্য ছিল দশ হাজার দিরহাম।- মাজলিসী, বিহারুল আনওয়ার ৪৭তম খ-, পৃ. ৬১
বর্ণিত হয়েছে যে, ইমাম সবসময় কিছু রুটি ও মাংস এবং টাকা-পয়সা একটি থলেতে নিয়ে বিভিন্ন বাড়িতে যেতেন এবং তাদের মধ্যে সেগুলো বণ্টন করতেন। এসময় তিনি নিজের পরিচয় গোপন রাখতেন।- কুলাইনী, আল-কাফী, ৪র্থ খ-, পৃ. ৮
ইরাক সফর
আব্বাসী খলিফা সাফফাহ ও আল মানসূরের শাসনকালে ইমামকে কয়েকবার বাগদাদে নিয়ে যাওয়া হয়। এই সময়ে তিনি কারবালা, নাজাফ, কুফা ও হিরাও সফর করেন। মুহাম্মাদ বিন মারুফ আল হিলালির বর্ণনা অনুযায়ী, যখন ইমাম হিরা সফর করেন তখন বিপুল সংখ্যক লোকজন তাঁকে দেখার জন্য আসেন যে, তিনি কয়েকদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করেও ইমামের সাথে দেখা করতে পারেননি।- মাজলিসী, বিহারুল আনওয়ার, ৪৭তম খ-, পৃ. ৯৩-৯৪
ইমাম জাফর সাদিক (আ.) কারবালায় ইমাম হোসাইন (আ.)-এর মাযার যিয়ারত করেন। কারবালায় হোসাইনিয়া নদীর তীরে একটি স্থাপনা রয়েছে যার মধ্যে ইমাম সাদিক (আ.)-এর একটি মেহরাব রয়েছে।- মুজাফফার, আল-ইমাম আস-সাদিক, ১ম খ-, পৃ. ১৩০
ইমাম আলী (আ.)-এর মাযার চিহ্নিত করা 
ইমাম জাফর সাদিক (আ.) ইমাম আলী (আ.)-এর মাযার যিয়ারত করেন এবং এই স্থানটি চিহ্নিত করেন যা পূর্বে অনুদ্ঘাটিত ছিল। আল্লামা কুলাইনির বক্তব্য অনুযায়ী, ইমাম সাদিক (আ.) ইয়াযীদ বিন আমর ইবনে তালহাকে নাজাফ ও হিরার মধ্যবর্তী একটি স্থানে নিয়ে যান এবং ইমাম আলী (আ.)-এর কবর দেখিয়ে দেন। শেইখ আত তূসীও বর্ণনা করেন যে, ইমাম জাফর আস সাদিক (আ.) ইমাম আলী (আ.)-এর মাযার যিয়ারত করেন, এর পাশে নামায আদায় করেন এবং ইউনুস বিন জাবইয়ানকে বলেন যে, সেটি আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.)-এর মাযার।- তূসী, তাযহীবুল আহকাম, ৬ষ্ঠ খ-, পৃ. ৩৫
একান্ত অনুসারী, ছাত্র এবং হাদিসের বর্ণনাকারী
শেইখ আত তূসী তাঁর ‘রিজাল’ গ্রন্থে ইমাম সাদিক (আ.) থেকে ৩২০০ হাদিস বর্ণনাকারীর নাম উল্লেখ করেছেন।- তূসী, ইখতিয়ার মাআরিফাতুর রিজাল, ২য় খ-, পৃ. ৪১৯-৬৭৯
শেইখ মুফীদ তাঁর ‘ইরশাদ’ গ্রন্থে এই সংখ্যা ৪০০০ বলে উল্লেখ করেছেন। ৮৫ মুফীদ, আল-ইরশাদ, ২য় খ-, পৃ. ২৫৪
বলা হয়েছে যে, ইবনে উকদা ইমাম জাফর সাদিক (আ.) থেকে ৪০০০ হাদিস বর্ণনাকারীর নাম একটি গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।- কুম্মী, আল-কিনা ওয়াল আলকাব, ১ম খ-, পৃ. ৩৫৮
ইমাম জাফর সাদিক (আ.)-এর কয়েকজন প্রসিদ্ধ ছাত্রের নাম এখানে উল্লেখ করা হলো : ১. যুরারাহ বিন আয়ান, ২. বুরাইদ বিন মুয়াবিয়া, ৩. জামিল বিল দাররাজ, ৪. আবদুল্লাহ বিন মুসকান, ৫. আবদুল্লাহ বিন বুকাইর, ৬. হাম্মাদ বিন উসমান, ৭. হাম্মাদ বিন ঈসা, ৮. আবান বিন উসমান, ৯. আবদুল্লাহ বিন সিনান, ১০. আবু বাসীর, ১১. হিশাম বিন সালীম, ১২. হিশাম বিন আল-হাকাম।
ইমামের কয়েকজন একান্ত অনুসারী কিছু কিছু বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ছিলেন। যেমন- হামরান বিন আয়ান কোরআনভিত্তিক বিজ্ঞানে বিশেষজ্ঞ ছিলেন। আবান বিন তাগলিব আরবি সাহিত্যে, যুরারাহ বিন আয়ান ফিকাহ্্শাস্ত্রে, মুমিন আল তাক ও হিশাম বিন সালীম ধর্মতত্ত্বে বিশেষজ্ঞ ছিলেন। ধর্মতত্ত্বে আরো বিশেষজ্ঞ ছিলেন হামরান বিন আয়ান, কায়েস আল মাসির এবং হিশাম বিন হাকাম।- পাকাচী, ইমাম জাফর সাদিক (আ.), পৃ. ১৯৯
কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ সুন্নি পণ্ডিতও ইমাম সাদিক (আ.)-এর ছাত্র ছিলেন। শেইখ আস সাদুকের মতে, মালিক বিন আনাস বলেন, তিনি ইমাম সাদিক (আ.)-এর কাছে যেতেন এবং ইমাম থেকে হাদিস শুনতেন।- সাদুক, আল-খিসাল, পৃ. ১৬৮
মুয়াত্তা ইমাম মালিকের মধ্যে তিনি ইমাম সাদিক (আ.)-এর নিকট থেকে কয়েকটি হাদিস বর্ণনা করেছেন।- মালিক বিন আনাস, আল-মুয়াত্তা, পৃ. ১০
ইবনে হাজার হায়সামী বলেন, সুন্নি পণ্ডিত, যেমন : ইয়াহইয়া বিন সাইদ, ইবনে যুরাইহ, মালিক বিন আনাস, সুফইয়ান বিন উইয়াইনা, সুফইয়ান সাওরী, আবু হানিফা, শুবা বিন আল-হাজ্জাজ এবং আইয়্যুব আল সাখতিয়ানী ইমাম জাফর সাদিক (আ.) থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন।- ইবনে হাজার আল-হাইসামী, আল-সাওয়ায়েকুল মুহরিকাহ, ২য় খ-, পৃ. ৫৮৬
বিখ্যাত হাদিসসমূহ
১. তাওহীদে মুফাজ্জাল : এই দীর্ঘ হাদিসটি চারটি বৈঠকে ইমাম কর্তৃক মুফাজ্জাল বিন উমরকে প্রদত্ত বিভিন্ন শিক্ষামূলক বিষয়ের সমষ্টি। এতে রয়েছে বিশ্বের সৃষ্টি, মানব সৃষ্টি, জীবজগতের অপূর্ব বর্ণনা, বেহেশত ও দোযখের বর্ণনা, মৃত্যুর বাস্তবতা, মানুষ সৃষ্টির পেছনের প্রজ্ঞা ইত্যাদি। যেহেতু এতে ‘ফাক্কির ইয়া মুফাজ্জাল’ অর্থাৎ চিন্তা কর, মুফাজ্জল বাক্যটি পুনঃপুন ব্যবহৃত হয়েছে সেজন্য এটি ‘কিতাবে ফাক্কির’ নামেও প্রসিদ্ধ হয়েছে।
২. হাদিসে ইনওয়ান আল বাসরী : এই হাদিসে ইমাম সাদিক (আ.) ইনওয়ান আল বাসরী নামের এক ব্যক্তিকে আত্মপরিশুদ্ধি, ধৈর্য এবং জ্ঞান সম্পর্কে নির্দেশনা দিয়েছেন।- মাজলিসী, বিহারুল আনওয়ার, ১ম খ-, পৃ. ২২৪-২২৬
৩. উমাম বিন হানযালার মাকবূলা : এই হাদিস বিচারকার্য ও হাদিসের মধ্যকার বৈপরীত্য নিয়ে আলোচনা করেছে। ৯৫ এই হাদিসকে বেলায়াতে ফকীহর সমর্থক হিসেবে গণ্য করা হয়।- খোমেইনী, আল হুকুমা আল-ইসলামিয়াহ, পৃ. ১১৫-১২১
লিখিত কর্ম
কোনো কোনো সূত্রে কিছুসংখ্যক পত্র ও অসিয়তনামাকে ইমাম জাফর সাদিক (আ.)-এর সাথে সম্পৃক্ত বলে বর্ণনা করা হয়েছে। এসবের মধ্য থেকে কয়েকটির নির্ভরযোগ্যতা যাচাই করা সম্ভব নয়, তবে কিছু কিছু বর্ণনা ‘আল-কাফি’র মতো সূত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। আর তাই এগুলোর নির্ভরযোগ্যতাকে উচ্চ সম্ভাবনাযুক্ত বলে বিবেচনা করা যেতে পারে। নিচে এমন কিছু কর্মের উল্লেখ করা হলো :
১. নিজ সাথিদের কাছে ইমাম সাদিক (আ.)-এর চিঠি। ‘আল-কাফি’তে উল্লিখিত এ পত্রে বিভিন্ন বিষয়ে ইমামের নির্দেশনা বর্ণিত হয়েছে।
২. রিসালাত শারাই আদ দীন, আমাশের সূত্রে বর্ণিত। এটি ধর্মতত্ত্ব ও ইসলামের ব্যবহারিক শিক্ষা সংক্রান্ত- যা ইবনে বাবাওয়াই কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে।
৩. আর-রিসালাহ আল-আহওয়াযিয়া। এই পত্রটি আহওয়াযের গভর্নর নাজাশীর কাছে লেখা হয়েছিল। এটি শহীদে সানী’র ‘কাশ্্ফ আর-রিবা’ গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে।
৪. রিসালা আল-ইহলিলাযা। এটি ভারতীয় একজন পদার্থবিজ্ঞানীর সাথে ¯্রষ্টার অস্তিত্ব নিয়ে জাফর সাদিক (আ.)-এর আলোচনা। নাজাশী এটি ‘বাদ আল খাল্্ক ওয়াল হাস্্ আলাল ইতিবার’ শিরোনামে উল্লেখ করেছেন।
৫. তাফসীরে নুমানী।
ইমাম সাদিক (আ.)-এর বাণীসমূহের সংকলনও রয়েছে যা তাঁর ছাত্রদের দ্বারা সংকলিত হয়েছিল। এর মধ্য থেকে প্রকাশিত কয়েকটি হলো :
১. আল-জাফারিয়াত; মুহাম্মাদ ইবনে মুহাম্মাদ আল-আশআস কর্তৃক সংকলিত।
২. নাস্র আদদুরার; এর বর্ণনাগুলো তুহাফুল উকূল গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে।
৩. আল-হিকাম আল জাফারিয়া
৪. সালমান বিন আইয়ুব কর্তৃক বর্ণিত কিছুসংখ্যক সংক্ষিপ্ত বাণী যেগুলো ‘ফারায়েদুস সিমতাইন’ গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে।
সুন্নি আলেমদের দৃষ্টিতে ইমাম সাদিক (আ.)
সুন্নি পণ্ডিতদের কাছেও ইমাম সাদিক (আ.) উচ্চ মর্যাদার অধিকারী। হযরত আবু হানিফা ইমাম জাফর সাদিককে সবচেয়ে জ্ঞানী এবং শ্রেষ্ঠ ফকীহ বলে বিবেচনা করতেন।- যাহাবী, তাযকিরাতুল হুফ্ফায, ১ম খ-, পৃ. ১২৬
প্রখ্যাত সুন্নি পণ্ডিত ইবনে আবিল হাদীদের মতে, আবু হানিফা, আহমদ বিন হাম্বাল এবং আশ শাফেয়ী প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ইমাম সাদিক (আ.)-এর ছাত্র ছিলেন।
শাহাদাত
১৪৮ হিজরিতে তৎকালীন খলিফার নির্দেশে ইমাম জাফর সাদিক (আ.)-কে বিষ প্রয়োগ করা হয় এবং ইমাম শাহাদাত বরণ করেন।- মুফীদ, আল-ইরশাদ, ২য় খ-, পৃ. ১৮০
তাঁকে মদীনার জান্নাতুল বাকী কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।
উত্তরসূরি
শাহাদাতের পূর্বে ইমাম জাফর সাদিক (আ.) তাঁর সন্তান ইমাম মূসা আল কাযিম (আ.)-কে তাঁর উত্তরাধিকারী ও পরবর্তী ইমাম হিসেবে ঘোষণা করেন।- কাশশী, রিজাল, পৃ. ২৮২-২৮৩

জেনারেল সোলাইমানি: অন্তহীন এক বীরের স্মৃতিকথা

সিরাজুল ইসলাম –

কালের গর্ভে চলে গেল একটি বছর। স্মৃতির পাতায় জমা হয়েছে অনেক কথা, অনেক দুঃখ-ব্যথা। তিনি চলে গেছেন নশ্বর এ পৃথিবী ছেড়ে। কিন্তু স্মৃতির মণিকোঠায় উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে আছেন এখনো। এই উজ্জ্বল নক্ষত্র আর কেউ নন, তিনি ইরানের মহাবীর কাসেম সোলাইমানিÑ বহু বিপ্লবী মানুষের প্রাণপুরুষ।
বছর ঘুরে আবার এসেছে সেই অভিশপ্ত ৩রা জানুয়ারি। ২০২০ সালের এই দিনে খুব ভোরে মার্কিন সন্ত্রাসী বাহিনী ইরাকের বাগদাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছে ড্রোন থেকে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় জেনারেল কাসেম সোলাইমানির গাড়িবহরে। এতে শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করেন তিনি। তাঁর সঙ্গে আরো শহীদ হন ইরাকের জনপ্রিয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন হাশদ আশ-শাবির সেকেন্ড ইন-কমান্ড আবু মাহদি আল-মুহান্দিস এবং আট সঙ্গী। মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় নিভে যায় বিশ্বের এক নম্বর সমর নায়কের প্রাণপ্রদীপ। তবে তিনি রেখে যান অজস্র কর্ম। তাঁর দেখানো পথই আলোকবর্তিকা হয়ে আছে মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিরোধকামীদের জন্য। কর্মের মাঝেই বেঁচে আছেন; মহৎ কর্মের মাঝেই বেঁচে থাকবেন ইরানের এ কমান্ডার।
আমেরিকা কেন হত্যা করল জেনারেল সোলাইমানিকে?
একথা আজও বড় হয়ে দেখা দেয় যে, আমেরিকা কেন এই মহান সমরবিদকে নির্মম ও বর্বরভাবে হত্যা করল? এ আলোচনার হাত ধরে গভীরে প্রবেশ করলে বেরিয়ে আসবে আমেরিকার ভয়াবহ এক কুৎসিত চোহারা। উন্মোচিত হবে মানবতার ছদ্মাবরণে মার্কিনিদের ভয়ঙ্কর মানবতাবিরোধী তৎপরতার কথা।
কুদস ফোর্সের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল কাসেম সোলাইমানি ইরানের হয়ে সিরিয়া ও ইরাকের মাটিতে তৎপর উগ্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে জটিল ও কঠিন সব অভিযান পরিচালিত হয়েছে। এসব অভিযানে সন্ত্রাসীরা সব চোখে সর্ষের ফুল দেখেছে। দিন দিন ফুরিয়ে আসছিল সন্ত্রাসীদের প্রাণবায়ু। এ অবস্থায় আমেরিকা জেনারেল সোলাইমানিকে বর্বরভাবে হত্যার পথ বেছে নেয়। কারণ, যে লক্ষ্য নিয়ে উগ্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে মধ্যপ্রাচ্যে ছেড়ে দেয়া হয়েছে, জেনারেল সোলাইমানি বেঁচে থাকলে সেসব লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হবে না। তাতে আমেরিকার ভা-ার শূন্য থেকে যায়। শূন্যেরে তাই পূর্ণ করতেই আমেরিকা নিষ্ঠুরতার পথ বেছে নেয়; শহীদ করে জেনারেল সোলাইমানিকে।
ইসলামের শত্রুরা আইএস বা দায়েশ সন্ত্রাসী গোষ্ঠী সৃষ্টি করেছে যাতে ইসলাম ও মুসলিম জাতিগুলো সম্পর্কে সারা বিশ্বে নেতিবাচক ধারণা তৈরি করা যায়। অন্যদিকে তারা আইএস-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে ইরাক ও সিরিয়ায় তাদের অবৈধ উপস্থিতি জোরদার করার চেষ্টা করছে। এভাবে তাদের প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে ইরাক ও সিরিয়াসহ পশ্চিম এশিয়ার তেল সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা।
সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর মূলোৎপাটন সম্ভব হলে মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি ভিন্ন হবেÑ একথা ভেবে আমেরিকা, ইহুদিবাদী ইসরাইল ও তাদের পশ্চিমা এবং আঞ্চলিক মিত্ররা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। রাজনৈতিক সমাধান কিংবা কূটনীতির পথ কোনটাতেই তারা নিরাপদ বোধ করে নি। তারা বেছে নেয় সন্ত্রাসের পথ। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে, সমস্ত আন্তর্জাতিক আইন-কানুন উপেক্ষা করে মার্কিন সরকার ও তাদের সন্ত্রাসী বাহিনী নির্জন ভোরে বাগদাদের রাজপথ রক্তে রঞ্জিত করে। শাহাদাতবরণ করেন ইরানের শীর্ষস্থানীয় সেনা কর্মকর্তা জেনারেল কাসেম সোলাইমানি। যেন শাহাদাতের সাক্ষী হয়ে বাগদাদের রাজপথে পড়ে থাকে হাতের আংটিটি।
এমন নির্মম, বেআইনি ও বর্বর হত্যাকা-ের দায় স্বীকার করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দম্ভভরে ঘোষণা করেন যে, তাঁর সরাসরি নির্দেশে জেনারেল কাসেম সোলাইমানিকে হত্যা করা হয়েছে। যে ইহুদিবাদী ইসরাইলের জন্য মূর্তিমান আতঙ্ক ছিলেন জেনারেল সোলাইমানি, সেই ইসরাইল মোটা মাথার ট্রাম্পকে ক্ষমতায় থাকার কার্ড হিসেবে সোলাইমানি হত্যাকা-কে ব্যবহারের উসকানি দেয়। শুধু ইরান-বিরোধিতা নয় বরং ইরানের শীর্ষ সমর নায়কককে হত্যা করার মধ্য দিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট টানার ঘৃণ্য কৌশল গ্রহণের প্ররোচনা দেয় তাঁর বুদ্ধিদাতারা। ক্ষমতার স্বাদ পাওয়া ট্রাম্প সহজ পথ ভেবেই তা গ্রহণ করেন এবং জেনারেল সোলাইমানিকে হত্যা করে বসেন। কিন্তু যে পথ তিনি বেছে নিয়েছিলেন তা যে কণ্টকাকীর্ণ তা তিনি হয়ত বুঝতে পারেন নি।
শহীদ হয়ে গেছেন জেনারেল সোলাইমানি, কিন্তু ট্রাম্পের ক্ষমতার মসনদ স্থায়ী হয় নি। অজস্র প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তিনি দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় বসার সুযোগ পান নি। ট্রাম্পের বিদায় ঘণ্টা বেজে গেছে, তিনি এই জানুয়ারিতেই বিদায় নেবেন। তাঁকে বিদায় নিতে হবে কোটি কোটি মানুষের অভিশাপ আর ঘৃণা মাথায় নিয়ে। ট্রাম্প যেসব কারণে বিশ্ববাসীর কাছে অতিমাত্রায় ঘৃণিত, নিশ্চয় জেনারেল সোলাইমানির হত্যাকা- তার প্রধান। ইরানি জেনারেলের শাহাদাতের পর বহু বীর সেনানি তৈরি হবেন তাঁর পথ ও কর্মকে এগিয়ে নিতে। কিন্তু ট্রাম্পের এই ঘৃণিত কাজ এগিয়ে নিতে আমেরিকায় কেউ আগুয়ান হবেন কিনাÑ সে এক মস্ত প্রশ্ন।
এর মানে হচ্ছে জেনারেল সোলাইমানি হত্যাকা-ের বিষয়টি আমেরিকার জন্য ভালো ফল বয়ে আনবে না, বরং ভুল ও ঘৃণিত কাজ বলেই চিহ্নিত হবে। জেনারেল সোলাইমানিকে হত্যার পর খোদ আমেরিকাতেই এর বিরোধিতা করতে দেখা গেছে। গত নির্বাচনের ডেমোক্র্যাট দলের মনোনয়ন প্রত্যাশী বার্নি স্যান্ডার্স থেকে শুরু করে অনেক মার্কিন রাজনীতিকই হত্যাকা-টিকে মন্দ কাজ বলেছেন। অন্যদিকে, জেনারেল সোলাইমানির যে দাফন অনুষ্ঠান হয়েছিল তা ছিল স্মরণকালের অন্যতম বৃহত্তম জনউপস্থিতির ঘটনা।
দুঃসাহসিক অভিযানের অনন্য স্মৃতি
২০১৫ সালের ২৪ নভেম্বর। তুরস্কের সীমান্ত থেকে এক কিলোমিটার দূরে তাঁদের শেষ অভিযান। অন্য দিনগুলোর মতো সেদিনও সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিমান অভিযান পরিচালনার কথা ছিল। সুখোই-২৪ বোমারু বিমান নিয়ে আকাশে উড়লেন এবং ঠিকঠাক মতো সন্ত্রাসী অবস্থানে বোমাবর্ষণ শেষে রাশিয়ার পাইলট লেফটেন্যান্ট কর্নেল ওলেগ পেশকভ এবং কো-পাইলট ক্যাপ্টেন কনস্টানটাইন মুরাখতিন সিরিয়ার হেমেইমিম ঘাঁটিতে ফিরছিলেন। কিন্তু বাধ সাধলো তুরস্কের এফ-১৬ জঙ্গিবিমান। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তুর্কি এফ-১৬ থেকে ছোঁড়া ক্ষেপণাস্ত্র এসে আঘাত হানে সুখোই-২৪’র পেছনের অংশে। উপায়হীন হয়ে প্যারাস্যুটের সাহায্যে বিমান থেকে বেরিয়ে পড়েন দুই পাইলট।
কিন্তু ভাগ্য খারাপ; আকাশে থাকা অবস্থাতেই সিরিয়ার তুর্কমেন ১০ ব্রিগেডের সন্ত্রাসীদের গুলিতে পাইলট ওলেগ পেশকভ মারা যান। আর কোনো রকমে প্রাণে বাঁচেন কো-পাইলট মুরাখতিন। পাইলট পেশকভের দেহ মাটিতে পড়ার পর সন্ত্রাসীরা উল্লাস প্রকাশ করে এবং আক্ষেপ করতে থাকে যে, ‘জীবিত পেলে পুড়িয়ে মারা যেত’! পরে লেগে যায় কো-পাইলট মুরাখতিনের খোঁজে। এরই মধ্যে রাশিয়ার এমআই-৮ হেলিকপ্টার নেমে যায় দুই পাইলটের সন্ধানে। সে অভিযানেও সন্ত্রাসীদের ছোঁড়া গোলার আঘাতে হেলিকপ্টার ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং একজন উদ্ধারকারী মেরিন সেনা নিহত হন। প্রথমে খবর বের হয় যে, দুই পাইলটই নিহত হয়েছেন। পরে ফ্রান্সে নিযুক্ত রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আলেকজান্ডার ওরলভের মাধ্যমে খবর বের হয় যে, একজন পাইলট আহত অবস্থায় বেঁচে আছেন। এ অবস্থায় রাশিয়া সিদ্ধান্ত নেয়Ñ যে এলাকায় বিমানটি ভূপাতিত হয়েছে সে এলাকায় উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করা হবে। শুরু হয় দুঃসাহসিক অভিযান; পরের ঘটনাপ্রবাহ বড়ই রোমাঞ্চকর।
ইরানের আধা সরকারি বার্তা সংস্থা ‘ফার্স নিউজ’ জানায় ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর আল-কুদস ফোর্সের বিশ্ববিখ্যাত কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল কাসেম সোলাইমানি ওই অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং মজার বিষয় হলো কোনো রকমের ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই সফলভাবে উদ্ধার অভিযান শেষ করতে সক্ষম হয়েছেন। সে গল্প জানিয়েছেন রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা স্পুৎনিকের সাংবাদিক ইমাদ আবশেনাস।
কেমন ছিল সেই অভিযান : সিরিয়ার লাতাকিয়া এলাকায় কর্মরত সিরিয় একজন সিনিয়র সেনা কর্মকর্তার কাছে ইমাদ আবশেনাস জানতে চেয়েছিলেন উদ্ধার অভিযানের কাহিনী। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিরিয়ার সেনা কর্মকর্তা জানালেন সে গল্পÑ
‘কো-পাইলট ক্যাপ্টেন মুরাখতিন প্যারাস্যুটের সাহায্যে যে এলাকায় নামেন তা ছিল বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে। কিলোমিটারের পর কিলোমিটার এলাকা অচেনা; শুধুই শত্রুর বসবাস! সিদ্ধান্ত হলো ক্যাপ্টেন মুরাখতিনকে উদ্ধার করতে হবে। বিমানটি ভূপাতিত হওয়ার পরপরই রাশিয়ার দুটি হেলিকপ্টার রওয়ানা দিল সেদিকে। কিন্তু পশ্চিমা সমর্থিত কথিত ফ্রি সিরিয়ান আর্মি বা এফএসএ এবং তুরস্ক সমর্থিত তুর্কমেন সন্ত্রাসীরা রকেট ও উন্নত অস্ত্র দিয়ে হেলিকপ্টারগুলোর বিরুদ্ধে হামলা চালাতে থাকল। এসব অস্ত্র তারা খুব সম্প্রতি পেয়েছে। অভিযানে রাশিয়ার একজন সাহায্য কর্মী (কেউ কেউ বলছেন মেরিন সেনা) মারা গেলেন।
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গিয়েছিলÑ বিমান ভূপাতিত হওয়ার পর ওই এলাকায় তুরস্ক স্পেশাল ইউনিটের সেনাদেরকে পাঠায় যাতে আটক রুশ পাইলটকে তারা নিয়ে যেতে পারে এবং পরে রাশিয়াকে ব্ল্যাকমেইল করতে পারে। অন্যদিকে, রাশিয়া শিগগিরি আরেকটি অপারেশন পরিচালনার পরিকল্পনা করছিল যার মাধ্যমে নিখোঁজ পাইলটকে উদ্ধার করা যায়। এ অবস্থায় ইরানের জেনারেল সোলাইমানি রুশ সেনা কমান্ডের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং তিনি একটি বিশেষ টাস্কফোর্স ইউনিট গঠনের প্রস্তাব দেন যাতে থাকবে হিজবুল্লাহর স্পেশাল ফোর্স এবং সিরিয়ার কমান্ডো সেনা যাঁদেরকে ইরান প্রশিক্ষণ দিয়েছে। এসব সেনার কাছে ওই এলাকা ছিল সম্পূর্ণ পরিচিত। এদের নিয়েই জেনারেল সোলাইমানি পাইলট উদ্ধারের অভিযান পরিচালনা করবেন। আর আকাশ থেকে রুশ বাহিনী বিমান ও স্যাটেলাইট তথ্য দিয়ে সহায়তা করবে। জেনারেল সোলাইমানি রুশ সেনা কর্মকর্তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিলেন, আল্লাহ চান তো তিনি নিরাপদে এবং অক্ষত অবস্থায় পাইলটকে উদ্ধার করবেন।
রুশ পাইলটের ব্যবহার করা জিপিএস শনাক্ত করে তাঁর অবস্থান জানা গেল যে, তিনি যেখানে অবস্থান করছেন সেখান থেকে মাত্র ছয় কিলোমিটার দূরে সিরিয়ার সেনা ও সন্ত্রাসীদের ফ্রন্টলাইন। সেখানে বার বার সংঘর্ষ হয়েছে।
হিজবুল্লাহর স্পেশাল অপারেশন ইউনিটের ছয় যোদ্ধা এবং সিরিয়ার ১৮ কমান্ডোকে নিয়ে উদ্ধার অভিযানে রওয়ানা দিলেন জেনারেল সোলাইমানি। এরই মধ্যে রুশ বিমান ও হেলিকপ্টার ওই এলাকায় এমনভাবে হামলা শুরু করল যেন সন্ত্রাসীদের জন্য তা দোজখে পরিণত হলো। বিমান ও হেলিকপ্টার হামলায় সন্ত্রাসীদের সদরদপ্তর ধ্বংস হয়ে গেল এবং মোতায়েন করা শত্রুরা যারা বেঁচে আছে তারা পালিয়ে যেতে থাকল। এ পর্যায়ে শুরু হলো স্পেশাল ইউনিটের স্থল অভিযান।’
গল্পের মাঝে সিরিয়ার ওই সেনা কর্মকর্তা জানালেন, ‘অভিযানের পুরো সময় স্পেশাল ইউনিট রাশিয়ার স্যাটেলাইট নেটওয়ার্কের আওতায় কাজ করেছে। পাইলটের অবস্থানের ১০০ মিটারের কাছাকাছি পৌঁছলে তাদেরকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়া হয় এবং সে সময় ক্রেমলিনের একজন অত্যন্ত উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে প্রতি মুহূর্তের অভিযানের রিপোর্ট জানানো হচ্ছিল (বলা হয়েছিল রুশ উচ্চ পদস্থ এ কর্মকর্তা আর কেউ নন স্বয়ং প্রেসিডেন্ট পুতিন) এবং এটা পরিষ্কার যে, মস্কো থেকে তিনি পুরো অভিযান স্যাটেলাইটের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করছিলেন।’
গল্পের কথক সিরিয়ার ওই সেনা কর্মকর্তার বর্ণনা অনুসারে- ‘অভিযানের এক পর্যায়ে তা সন্ত্রাসী ধরার অভিযানে পরিণত হয় যা আকাশ থেকে পরিচালনা করছিল রুশ বাহিনী আর স্থলভাগ থেকে জেনারেল সোলাইমানি। অভিযানের সময় রুশ বাহিনী শক্তিশালী ইলেক্ট্রনিক ওয়ারফেয়ার শুরু করে এবং শত্রুদের সব ধরনের স্যাটেলাইট ও যোগাযোগ যন্ত্র অকেজো হয়ে যায়। এ যুদ্ধ শুরু হয় অভিযানের মূল এলাকায় পৌঁছানোর কয়েক কিলোমিটার আগে থেকেই। যখন শত্রুরা বুঝতে পারল ইলেক্ট্রনিক ওয়ারফেয়ারের মতো কিছু একটা ঘটছে ততক্ষণে অপারেশন শেষ। রুশ বাহিনীর উদ্বেগ ছিল যে, পশ্চিমা স্যাটেলাইটগুলো সন্ত্রাসীদের কাছে এ অভিযানের কথা ফাঁস করে দিতে পারে। যাহোক, শেষ পর্যন্ত স্পেশাল ইউনিট শত্রু লাইনের ছয় কিলোমিটার ভেতরে ঢুকে পাইলটকে নিরাপদে উদ্ধার করে। এ সময় শত্রুপক্ষের উন্নত প্রযুক্তির সরঞ্জমাদি ধ্বংস করা হয় এবং এগুলো যারা পরিচালনা করছিল তারাও নিহত হয়। সবচেয়ে মজার বিষয় ছিল- যে ২৪ জনকে নিয়ে স্পেশাল ইউনিট গঠন করা হয়েছিল তাদের সবাই পাইলট মুরাখতিনকে নিয়ে নিরাপদে ঘাঁটিতে ফিরে আসেন। বিপজ্জনক এ মিশনে ২৪ জনের কেউই সামান্য একটু আহতও হন নি।’
হত্যাকা-ে যেসব ভুল করেছে আমেরিকা
জেনারেল কাসেম সোলাইমানিকে হত্যার মধ্য দিয়ে সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে নিজের ভূমিকা বিতর্কিত করেছে আমেরিকা। সিরিয়া ইস্যুসহ বিভিন্ন ঘটনায় আমেরিকা দাবি করে আসছে তারা উগ্রবাদ এবং সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। যদিও সিরিয়ায় তৎপর উগ্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠী দায়েশের প্রতিষ্ঠা, প্রশিক্ষণ, অস্ত্র এবং অর্থ যোগানের সবকিছুর সাথেই আমেরিকার সম্পৃক্ততা ছিল তারপরও তারা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের দাবি করে আসছিল। অন্যদিকে মাঠে-ময়দানে লড়াইয়ে জেনারেল কাসেম সোলাইমানি উগ্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। ইরানের কোনো শত্রুদেশও বলতে পারবে না যে, জেনারেল কাসেম সোলাইমানি সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেন নি। এরকম একটা পেক্ষাপটে জেনারেল সোলাইমানিকে হত্যা করে আমেরিকা প্রকৃতপক্ষে সন্ত্রাসবাদবিরোধী লড়াইয়ের বিপরীতে অবস্থান নিয়েছে। অর্থাৎ আমেরিকার এই ভূমিকা সন্ত্রাসীদের পক্ষে গেছে এবং সেক্ষেত্রে বলাই যায় যে, আমেরিকা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে নি; বরং সন্ত্রাসীদের পক্ষে লড়াই করছে। জেনারেল কাসেম সোলাইমানিকে হত্যার ক্ষেত্রে এটি ছিল আমেরিকার সবচেয়ে বড় ভুল।
জেনারেল কাসেম সোলাইমানিকে ৩ জানুয়ারি হত্যার পর ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনেয়ী এক জরুরি বৈঠকে বসেন। সামরিক কমান্ডারদের সঙ্গে বৈঠকে তিনি সরাসরি নির্দেশনা দেন যে, আমেরিকা যেভাবে জেনারেল সোলাইমানি হত্যা করেছে ঠিক একইভাবে আমেরিকার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে পাল্টা হামলা চালাতে হবে। সর্বোচ্চ নেতাসহ ইরানের প্রেসিডেন্ট, পররাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে শুরু করে অন্যান্য বহু কর্মকর্তা এই হত্যাকা-ের প্রতিশোধের ঘোষণা দেন। জেনারেল সোলাইমানি হত্যাকা-ের পর ৮ জানুয়ারি ইরাকে অবস্থিত দুটি মার্কিন ঘাঁটিতে ব্যাপকভাবে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইরান। ওই হামলায় আইন আল আসাদ ঘাঁটি চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো- ইরান যেসব ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হামলা চালিয়েছে তার একটিও ভূপাতিত করতে পারে নি আমেরিকা বরং আমেরিকার ঘাঁটি ও সেনারা অসহায়ের মতো আর্তনাদ করেছে এবং তারা মৃত্যুর প্রমাদ গুনেছে সেদিন। আমেরিকার এত সামরিক শক্তি, এত উন্নত প্রযুক্তি রয়েছে বলে দাবি করে অথচ ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা তারা প্রতিহত করতে পারে নি। সেক্ষেত্রে ইরান এখন তাদরে জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে। আমেরিকার এই ভুলের কারণে তাদের সামরিক শক্তি, কৌশল, অস্ত্রের ব্যর্থতা এবং প্রযুক্তির দুর্বলতা মারাত্মকভাবে জনসমক্ষে প্রকাশ হয়ে পড়েছে। সবার মনে একই প্রশ্ন ছিল বিশ্বের এক নম্বর সামরিক শক্তির দাবিদার আমেরিকা ইরানের হামলা ঠেকাতে পারে নি। তাহলে কি আমেরিকার সামরিক প্রযুক্তি ইরানের কাছে অসহায় হয়ে গেল?
জেনারেল সোলাইমানি ছিলেন ইরানের সর্বোচ্চ পর্যায়ের একজন সামরিক কর্মকর্তা। এ পর্যায়ের কোনো কর্মকর্তাকে এরকম বর্বরতার আশ্রয় নিয়ে হত্যা করা আন্তর্জাতিক আইনের প্রকাশ্য লঙ্ঘন। কিন্তু আমেরিকা তাই করেছে। সেক্ষেত্রে আবারও পরিষ্কার হয়েছেÑ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমেরিকা আইনের মোটেই তোয়াক্কা করে না বরং তার স্বার্থের জন্য আইন লঙ্ঘন করতে দ্বিধা করে না।
আমেরিকা হচ্ছে বিশ্বের মানবতা রক্ষার কথিত ধ্বজাধারী একটি দেশ, কথায় কথায় তারা মানবতার বুলি আওড়ায়। প্রতিবছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে তারা রিপোর্ট তৈরি করে। সেই আমেরিকা অত্যন্ত নির্মমভাবে যুদ্ধক্ষেত্রের বাইরে একজন জেনারেলকে হত্যা করেছে। এর মধ্য দিয়ে আমেরিকা যেমন মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে, তেমনি কূটনীতির পথকে কঠোরভাবে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করেছে। যদিও আমেরিকার জন্য এই ধরনের হত্যাকা- নতুন কিছু নয় তবে জেনারেল সোলাইমানি হত্যাকা-ের ঘটনায় আমেরিকা মানবতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় অভিযুক্ত। বিশ্ববাসীর কাছে আরেকবার পরিষ্কার হয়েছেÑ আমেরিকার কাছে শিশুদের যেমন অধিকার নেই তেমনি একজন জেনারেলেরও অধিকার আমেরিকার কাছে নেই। অর্থাৎ তারা মানুষের অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রেই আন্তরিক নয়। জেনারেল সোলাইমানিকে হত্যার মধ্য দিয়ে আমেরিকা সুদীর্ঘকালের কর্মকা- নতুন করে চিনিয়ে দিয়েছে।
যেকোনো সমস্যার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক সমাধান সেরা বলে বিবেচিত। কিন্তু আমেরিকা এসবের ধারে কাছে না গিয়ে বরং জেনারেল সোলাইমানিকে হত্যা করে পেশী শক্তির পরিচয় দিয়েছে। তারাই একথা দিবালোকের মতো স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, আমেরিকার কাছে কূটনীতি নয় বরং পেশিশক্তিই বড়।
জেনারেল সোলাইমানি হত্যার কারণে ইরান আমেরিকার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে সামরিকভাবে প্রতিশোধ নেয়ার সুযোগ পেয়েছে, তেমনি আমেরিকার সামরিক ও প্রযুক্তিগত দুর্বলতাও ইরানের কাছে পরিষ্কার হয়েছে। সেক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্যে ইরান তার প্রভাব প্রতিপত্তি আরো বেশি বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যে ইরানকে বাদ দিয়ে কেউ এখন কোনো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে পারবে না। ইরানের সামরিক ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতার পাশাপাশি তার কূটনৈতিক সৌন্দর্য পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের বেশকিছু দেশকে আকৃষ্ট করবে যা আমেরিকা ও তার মিত্রদের জন্য কূটনৈতিকভাবে বড় ধরনের বিপর্যয় হিসেবে দেখা হবে।
১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামি বিপ্লব সফল হওয়ার পর থেকে ইরান ও আমেরিকার মধ্যে মারাত্মক রকমের শত্রুতাপূর্ণ সম্পর্ক চলে আসছে। ইরানের ভেতরে নানা রকমের নাশকতার পাশাপাশি যাত্রীবাহী বিমান ভূপাতিত করার মতো চরম অমানবিক ঘটনাও আমেরিকার ঘটিয়েছে। এবারে শীর্ষ পর্যায়ের একজন সেনা কমান্ডারকে হত্যার পর মার্কিন প্রশাসন ইরানের সঙ্গে তাদের শত্রুতার মাত্রা ভিন্ন পর্যায়ে নিয়ে গেল। ইরান এতদিন মার্কিন শত্রুতা উপেক্ষা করে নিজের মতো করে পথ চলার চেষ্টা করেছে। কিন্তু এবার মার্কিন সামরিক ঘাঁটির ওপর সফল হামলার মাধ্যমে আরো বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠবে এবং আমেরিকার বিরুদ্ধে আরো শক্ত অবস্থান গ্রহণ করতে সুযোগ পাবে। মূলত আমেরিকা জেনারেল সোলাইমানি হত্যার মাধ্যমে ইরানকে আরও বেশি শক্ত অবস্থানে চলে যাওয়ার পথ করে দিল।
ইরানের কুদস ফোর্সের কমান্ডার জেনারেল কাসেম সোলাইমানি যে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন তাতে মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিরোধকারী সংগঠনগুলোর নেতা হিসেবে মূলত তিনি কাজ করছিলেন। কাসেম সোলাইমানিকে হত্যা করা মানেই হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিরোধকামী সংগঠনগুলোর নেতাকে হত্যা করা। ফলে আমেরিকার বিরুদ্ধে শুধু ইরানই শক্ত অবস্থান গ্রহণ করবে না বরং ইরাক, সিরিয়া, লেবানন ও ফিলিস্তিনসহ মধ্যপ্রাচ্যের যেসব দেশে প্রতিরোধকামী সংগঠন রয়েছে সেসব দেশে ইরানের অবস্থান অনেক বেশি সম্মানজনক ও মর্যাদাপূর্ণ হয়ে উঠবে। ইরান তাদের নেতা হয়ে উঠবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। ইরানকে এই সম্মানজনক অবস্থানে পৌঁছে দিয়েছে জেনারেল কাসেম সোলেইমানির শাহাদাত। শাহাদাতের এই গৌরব ও মর্যাদা প্রতিরোধকামী সংগঠনগুলোর নেতারা অর্জন করতে উদগ্রীব হয়ে উঠবেন। এতে প্রতিরোধকামী সংগঠনগুলো এবং মার্কিন ও ইসরাইল-বিরোধী প্রতিরোধ প্রবল হয়ে উঠবে। স্মরণ রাখা দরকার, যে জাতি রক্ত দিতে জানে সে জাতিকে দমিয়ে রাখা যায় না। বিজয় তাদের কাছে ধরা দিতে বাধ্য। জেনারেল কাসেম সোলাইমানির শাহাদাত মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিরোধকামী সংগঠনগুলোর কাছে এই বার্তাটিই পৌঁছে দেবে। ফলে শাহাদাতবরণের মধ্য দিয়ে জেনারেল সোলাইমানি যে মশাল প্রজ¦লন করে গেলেন সে মশাল বহন করার লোকের অভাব হবে না কোনো দিন। সে মশাল প্রজ¦লিত থাকবে যুগ-যুগান্তর ধরে। এটিই হবে অন্তহীন এই বীরের মহান কীর্তি।
লেখকÑ সাংবাদিক ও কলামিস্ট

 

ইসলামের দৃষ্টিতে পরিবার ও পারিবারিক জীবনের তাৎপর্য

শাহনাজ আরফিন –

মানব জীবনের সূচনালগ্ন থেকেই জগতে কোন না কোনভাবে পারিবারিক ব্যবস্থা চালু ছিল। পৃথিবীর প্রথম পরিবার গড়ে ওঠে হযরত আদম (আ.) ও তাঁর স্ত্রী হাওয়ার মাধ্যমে। পরিবারের সদস্য প্রথমত তাঁরা স্বামী-স্ত্রী দুজন ছিলেন। সৃষ্টির পর মহান আল্লাহ এ পরিবারকে জান্নাতে বসবাস করতে দেন।
আল্লাহ পাক সূরা বাকারার ৩৫ নং আয়াতে বলেন : ‘হে আদম! তুমি আর তোমার স্ত্রী দুজনে জান্নাতে বসবাস কর।’ পরবর্তীকালে তাঁরা পৃথিবীতে আগমন করলেন এবং তাঁদের থেকে জন্ম নেয় তাঁদের সন্তান-সন্ততি। এভাবে পৃথিবীতে পরিবার ও পারিবারিক ব্যবস্থার সূচনা হয়।
অতীতের সব নবী ও রাসূলের জীবনে ও সময়কালে পরিবারের সন্ধান পাওয়া যায়। যেমন হযরত ইবরাহীম (আ.) তাঁর পরিবারের জন্য দোয়া করেছিলেন। সূরা বাকারার ১২৮ নং আয়াতে এসেছে : ‘হে পরওয়ারদিগার! আমাদের উভয়কে তোমার আজ্ঞাবহ করো এবং আমাদের বংশধরদের থেকেও একটি অনুগত দল সৃষ্টি করো। নিশ্চয়ই তুমি তওবা কবুলকারী, দয়ালু।’
নিঃসন্দেহে, পরিবার হচ্ছে মানুষের বেড়ে ওঠার অন্যতম কেন্দ্র। মানুষের উন্নতি কিংবা তার অধঃপতন পরিবারের সুস্থতা ও পরিশুদ্ধতার ওপর নির্ভরশীল। আর সমাজের সুস্থতার জন্য পরিবারের বিকল্প নেই। কোরআনে সূরা নাহলের ৭২ নং আয়াতে এসেছে : ‘তিনিই আল্লাহ, যিনি তোমাদের জন্য তোমাদের স্বজাতীয় জোড়া বানিয়ে দিয়েছেন আর তোমাদের জোড়া থেকে তোমাদের দান করেছেন পুত্র ও পৌত্র।’
কোরআন মজীদে ‘বাইত’ শব্দটি পরিবার অর্থে বহুবার ব্যবহৃত হয়েছে। কোরআনের এ আয়াতগুলো পর্যালোচনা করলে বোঝা যায়, মানবতার ধর্ম ইসলাম পরিবার ও পারিবারিক জীবনের ওপর যথেষ্ট তাগিদ দিয়েছে। পবিত্র কোরআনে পরিবারের অপরিহার্যতার দিকে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে।
এখন আমরা পবিত্র কোরআনে পরিবারের গুরুত্ব নিয়ে খানিকটা আলোচনা করব।
প্রশান্তির স্থান : পরিবার তথা গৃহের অন্যতম কাজ হচ্ছে পরিবারের সদস্যদের মানসিক প্রশান্তি নিশ্চিত করা। পরিবারের ক্ষুদ্র গণ্ডি ও নিরাপদ আলয়ে মানুষ তার আবেগ ও অনুভূতি প্রকাশ করতে পারে এবং তার সহজাত কামনা-বাসনা এবং দৈহিক ও আত্মিক চাহিদাগুলোর নির্বৃিত্ত করতে সক্ষম হয়। মহান স্রষ্টা নিজেকে এই প্রশান্তি ও নিরাপত্তার উৎস হিসেবে উল্লেখ করে বলেন :  
وَاللّهُ جَعَلَ لَكُم مِّن بُيُوتِكُمْ سَكَنًا
অর্থাৎ ‘আল্লাহ করে দিয়েছেন তোমাদের গৃহকে অবস্থানের জায়গা’। (সূরা নাহল : ৮০)
আরবি ‘সাকানা’ শব্দটির অর্থ হচ্ছে যার মাধ্যমে মানুষ প্রশান্তি ও তৃপ্তি লাভ করে।
(১) মানুষ গৃহে তার শান্তি ও নিরাপত্তার প্রয়োজন মেটাবার পাশাপাশি আত্মিক ও মানসিক উপশমের জন্য সামাজিক বিধিনিষেধের গণ্ডি এড়িয়ে একান্তে নিজ আলয়ে বিশ্রাম এবং নিজ স্রষ্টার সাথে ভাব বিনিময় তথা প্রার্থনার প্রয়োজন অনুভব করে। পরিবার যদি তার এ চাহিদা মেটাতে না পারে তাহলে তা শান্তির নীড় হতে পারে না।
স্রষ্টার স্মরণ ও যিকিরের স্থান : সূরা আহযাবের ৩৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন :
وَاذْكُرْنَ مَا يُتْلَى فِي بُيُوتِكُنَّ مِنْ آيَاتِ اللَّهِ وَالْحِكْمَةِ

অর্থ : আল্লাহর আয়াত ও জ্ঞানগর্ভ কথা, যা তোমাদের গৃহে পঠিত হয় তোমরা সেগুলো স্মরণ করবে।
এ আয়াতটি নবী করিম (সা.)-এর স্ত্রীদের প্রতি সম্বোধন করে নাযিল করা হয়েছে। এ আয়াতে লক্ষণীয় বিষয়গুলো হচ্ছে :
প্রথমত, গৃহ বা পরিবার থেকে মানুষ যে মূল্যবোধ অর্জন করে তা অতীব গুরুত্বপূর্ণ এবং একে পুরো জীবনের জন্য সংরক্ষণ করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, আমাদের বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর পরিবার হচ্ছে বিশ্বের সব পরিবারের জন্য উত্তম আদর্শ। কাজেই আল্লাহর নির্দেশ পালনের ক্ষেত্রে তাঁদেরকে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
তৃতীয়ত, গৃহের নিবিড় ও শান্ত পরিবেশ যদি স্রষ্টার আনুগত্য ও তাঁর স্মরণের স্থানে পরিণত হয় তখন স্রষ্টা নিজেই সেই গৃহের মর্যাদা অনেক বাড়িয়ে দেন। সূরা নূরের ৩৬ নং আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন :
فِي بُيُوتٍ أَذِنَ اللَّهُ أَن تُرْفَعَ وَيُذْكَرَ فِيهَا اسْمُهُ يُسَبِّحُ لَهُ فِيهَا بِالْغُدُوِّ وَالْآصَالِ
অর্থ : আল্লাহ যেসব গৃহকে মর্যাদায় উন্নীত করার এবং সেগুলোতে তাঁর নাম উচ্চারণ করার আদেশ দিয়েছেন সেখানে সকাল ও সন্ধ্যায় তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে।
আল্লামা তাবাতাবায়ী তাঁর ‘তাফসীরে আল মীযান’ গ্রন্থে এ আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেছেন, যে আবাস পাক-পবিত্র ও নিষ্কলুষ সেটি স্রষ্টার ইবাদত ও স্মরণের স্থানে পরিণত হবে। তখন তা আর নি®প্রাণ চার দেয়ালের সাধারণ গৃহ থাকবে না; বরং ঐশী রং এ রঙিন হয়ে আধ্যাত্মিক এক বিশেষ মর্যাদা লাভ করবে। এর ঐশী দিক যতটা জোরালো ও গাঢ় হবে গৃহের মর্যাদা ততই বাড়বে।
‘বায়তুল্লাহ’ বা কাবা ঘর হচ্ছে এর বাস্তব নিদর্শন।(১)
ঐশী বন্ধনের স্থান : সূরা নূরের ৬১ নং আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন :
فَإِذَا دَخَلْتُم بُيُوتًا فَسَلِّمُ طَ وا عَلَى أَنفُسِكُمْ تَحِيَّةً مِّنْ عِندِ اللَّهِ مُبَارَكَةً يِّبَةً
অর্থ : অতঃপর যখন তোমরা গৃহে প্রবেশ কর তখন তোমাদের স্বজনদের প্রতি সালাম বলবে। এটা আল্লাহর কাছ থেকে কল্যাণময় ও পবিত্র দোয়া। 
এ আয়াতের মাধ্যমে বোঝা যায়, পরিবারের সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হবে ‘সালাম’ ও শুভ কামনার মাধ্যমে এবং আল্লাহর স্মরণ ও খোদাভীতি তাদের মধ্যে থাকতে হবে। পরিবারে এ ধরনের পবিত্র আবহ বিরাজ করলে নিঃসন্দেহে তা সমাজেও ছড়িয়ে পড়বে। কাজেই সালামের তাৎপর্য হচ্ছে পরস্পরের মধ্যে সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি, আস্থা ও ভালোবাসা ছড়িয়ে দেয়া।
গৃহের মান ও সম্ভ্রম রক্ষা : পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ পরিবারের মর্যাদার ওপর যথেষ্ট গুরুত্বারোপ করেছেন। আর তাই এ ঐশী গ্রন্থের একাধিক আয়াতে পরিবার সুরক্ষার নানা দিকনির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সূরা নূরের ২৭ নং আয়াতে রয়েছে :
أَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ لَا تَدْخُلُوا۟ بُيُوتًا غَيْرَ بُيُوتِكُمْ حَتَّىٰ تَسْتَأْنِسُوا۟ وَتُسَلِّمُوا۟ عَلَىٰٓ أَهْلِهَا ذَٰلِكُمْ خَيْرٌ لَّكُمْ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُون

অর্থ : হে মুমিনগণ! তোমরা নিজেদের গৃহ ব্যতীত অন্য গৃহে প্রবেশ করো না, যে পর্যন্ত আলাপ-পরিচয় না কর এবং গৃহবাসীদেরকে সালাম না কর। এটাই তোমাদের জন্য উত্তম, যাতে তোমরা স্মরণ রাখ।’
এ আয়াতে আল্লাহ পাক অনুমতি ও সালাম ব্যতীত অন্যের গৃহে প্রবেশ নিষিধ করেছেন এবং পরিবারের মান ও সম্ভ্রম রক্ষার জন্য এ ধরনের বিধি-নিষেধ মেনে চলাকে জরুরি বলে উল্লেখ করেছেন।
‘সালাম’ শব্দটির মধ্যে রয়েছে পরিবারের সদস্যদের প্রতি শান্তি ও নিরাপত্তা কামনা এবং তাদের প্রতি আন্তরিকতা ও শান্তির ঘোষণা দেয়া।
আদী ইবনে সেবাত থেকে বর্ণিত হয়েছে, একবার আনসার গোত্রের এক মহিলা রাসূলে খোদা (সা.)-এর নিকট আগমন করে বলেন, ‘আমি নিজ গৃহে অনেক সময় একান্তে থাকতে চাই এবং পরিবারের অপরাপর সদস্যদের কেউ-আমার পিতা, সন্তান কিংবা অন্য কোন পুরুষ আত্মীয়-যদি গৃহে প্রবেশ করেন, তখন কী করব?’ মহিলার এ প্রশ্নের প্রেক্ষাপটে এ আয়াত অবতীর্ণ হয়। এ আয়াতের আলোকে বলা যায়, অপরের গৃহে প্রবেশের ক্ষেত্রে গৃহকর্তার অনুমতি ছাড়া গৃহের ভেতরে প্রবেশ করা যাবে না।
এ ছাড়া সূরা আহযাবের ৫৩ নং আয়াতে নবী করিম (সা.)-এর গৃহে প্রবেশের ক্ষেত্রেও অনুমতি নেবার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
কোরআনের দৃষ্টিতে পরিবারের সংজ্ঞা : পবিত্র কোরআনের আলোকে ‘পরিবার’ হচ্ছে এমন একটি সংগঠন যার অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে এর সদস্যদের, যেমন : স্বামী-স্ত্রী, পিতা-মাতা ও সন্তানদের আত্মিক ও মানসিক সুস্থতা নিশ্চিত করা এবং তাদেরকে সামাজিক বিভিন্ন সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত করা।
সূরা ফোরকানের ৭৪ নং আয়াতে এসেছে :
وَالَّذِينَ يَقُولُونَ رَبَّنَا هَبْ لَنَا مِنْ أَزْوَاجِنَا وَذُرِّيَّاتِنَا قُرَّةَ أَعْيُنٍ وَاجْعَلْنَا لِلْمُتَّقِينَ إِمَامًا
অর্থ : এবং যারা বলে, হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদের স্ত্রীদের পক্ষ থেকে এবং আমাদের সন্তানের পক্ষ থেকে আমাদের জন্য চোখের শীতলতা দান কর এবং আমাদেরকে মুত্তাকীদের জন্য আদর্শস্বরূপ কর।
এ আয়াতে একটি আদর্শ সমাজ গঠনের জন্য পরিবারের গুরুত্ব তুলে ধরার পাশাপাশি একটি সুস্থ ও আদর্শ পারিবারিক আবহ যে ঈমানদারদের পরম কাঙ্ক্ষিত তা উল্লেখ করা হয়েছে।
একটি আদর্শ পরিবারের ভিত্তি গৃহের সদস্যদের মধ্যকার আন্তরিক ও নিবিড় সম্পর্কের ওপর নির্ভরশীল। পরস্পরের প্রতি দায়িত্বানুভূতি পরিবারের বন্ধনকে দৃঢ় ও অটুট রাখে। পরিবারের সদস্যরা যদি স্বার্থপরতা ও আত্মকেন্দ্রিকতা পরিহার করে নিজেদের মধ্যকার বন্ধনকে ধরে রাখতে পারে তবে মানবীয় উৎকর্ষতা ও পূর্ণতা অর্জন সহজতর হয়।  
সূরা রূমের ২১ নং আয়াতে আল্লাহ পাক বলেছেন :
وَمِنْ آَيَاتِهِ أَنْ خَلَقَ لَكُمْ مِنْ أَنْفُسِكُمْ أَزْوَاجًا لِتَسْكُنُوا إِلَيْهَا وَجَعَلَ بَيْنَكُمْ مَوَدَّةً وَرَحْمَةً إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآَيَاتٍ لِقَوْمٍ
يَتَفَكَّرُون
অর্থ : এবং তাঁর নিদর্শনাবলির মধ্যে আর এক নিদর্শন (হচ্ছে) : তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য হতে তোমাদের সঙ্গিনীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের নিকট শান্তি পাও এবং তিনি তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা ও সহানুভূতি সৃষ্টি করেছেন; নিশ্চয় চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য এতে নিদর্শন আছে।
এ আয়াতের লক্ষণীয় বিষয়গুলো হচ্ছে :
প্রথমত, (مِنْ أَنْفُسِكُمْ أَزْوَاجًا) ‘তোমাদের মধ্য হতে তোমাদের সঙ্গিনীদের সৃষ্টি করেছেন’ 
পরিবারের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, গৃহে পরিবারের সদস্যদের প্রকৃত রূপ ফুটে ওঠে। প্রত্যেকের চরিত্রের ভালো ও মন্দ দিক, চারিত্রিক গুণ বা দুর্বলতা সবই প্রকাশিত হয়ে পড়ে। ফলে পরিবারই হচ্ছে নিজেকে গড়ার তথা সংশোধনের অন্যতম পীঠস্থান। সন্তানের প্রতি মা-বাবার স্নেহ, দয়া-মমতা এবং মা-বাবার প্রতি সন্তানের শ্রদ্ধা-ভালোবাসা আর স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার প্রেম-প্রীতি, ভালোবাসা, আস্থা-বিশ্বাস ও ত্যাগের মাধ্যমে প্রত্যেকেই নিজেদের চারিত্রিক ত্রুটিগুলো কাটিয়ে উঠতে পারে।
ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষের বাহ্যিক পরিশীলতার চেয়ে আত্মিক শুদ্ধতা ও পবিত্রতা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আর গৃহের আন্তরিক ও নিবিড় পরিবেশে ভালোবাসা ও মমতার ছোঁয়ায় মানুষের আত্মগঠন ও সংশোধনের প্রক্রিয়া সহজ হয়ে ওঠে।
দ্বিতীয়ত, (وَجَعَلَ بَيْنَكُمْ مَوَدَّة ) ‘তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা ও সহানুভূতি সৃষ্টি করেছেন’
মহান আল্লাহ স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার প্রেম-প্রীতি, ভালোবাসা মানুষের চিরন্তন প্রকৃতিজাত করে দিয়েছেন।
এসব গুণ ও অনুভূতির মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রী আত্মিক পরিশুদ্ধতার পাশাপাশি নিজ স্রষ্টার সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলার মাধ্যমে অপার সুখ ও প্রশান্তি অর্জন করতে পারে। 
তৃতীয়ত, (لِتَسْكُنُوا إِلَيْهَا ) ‘যাতে তোমরা তাদের নিকট শান্তি পাও’
প্রশান্তি ও নিরাপত্তা অর্জন পারিবারিক জীবনের অপর একটি অন্যতম লক্ষ্য। পবিত্র কোরআনের দৃষ্টিতে পরিবারে স্বামী-স্ত্রী এবং পরবর্তীকালে সন্তানদের দায়িত্ব হচ্ছে এ লক্ষ্যপানে এগিয়ে যাওয়া।
চতুর্থত, ( وَرَحْمَةً ) ‘তিনি তোমাদের মধ্যে রহমত ও সহানুভূতি সৃষ্টি করেছেন’
স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, মায়া, মমতা ও সহানুভূতি পরিবারে শান্তি ও নিরাপত্তার অনুভূতি ছড়িয়ে দিতে পারে। শান্তিপূর্ণ ও সুস্থ পারিবারিক আবহে পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের মধ্যে তৈরি হয় ভালোবাসা ও হৃদ্যতা।এ ধরনের পরিবেশে প্রতিপালিত ও বেড়ে ওঠা সন্তানরাই একটি সুস্থ ও সুন্দর সমাজের ভিত্তি নির্মাণ করতে পারে।
ইসলামের দৃষ্টিতে পরিবার হলো একটি শিশুর জীবন গড়ার প্রাথমিক পাঠশালা ও প্রধান পাঠাগার। এ পাঠশালার ওপর শিশুর জীবনের ভিত রচিত হয়। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বসবাসের মধ্য দিয়েই শিশুরা মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক রচনার গুণাগুণের পরিচয় লাভ করতে শুরু করে। এ জন্য পরিবারের প্রধান দুজন সদস্য বাবা-মায়ের ভূমিকা অপরিসীম। মাতা-পিতার কারণে শিশু পৃথিবীর মুখ দেখতে পেরেছে। মমতাময়ী মায়ের কারণেই সন্তানের পৃথিবীর আলো দেখার সৌভাগ্য হয় এবং নিরাপদে বেড়ে ওঠে। সন্তান গর্ভে ধারণ, প্রসববেদনার কষ্ট এবং দুধপান করানো প্রভৃতি মা একাই বহন করে
থাকেন। এরপর বাবা লালন-পালনের কাজে মায়ের সঙ্গে অংশীদার হয়ে থাকেন। এর বাহ্যিক প্রতিদান হিসেবে আল্লাহ তাআলা সন্তানের প্রতি তার মাতা-পিতার সঙ্গে সদয় ও সদ্ব্যবহারকে অবশ্য পালনীয় কর্তব্য এবং ইবাদত হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। 
সূরা বনী ইসরাইলের ২৩ নং আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন :
وَقَضَى رَبُّكَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا إِمَّا يَبْلُغَنَّ عِنْدَكَ الْكِبَرَ أَحَدُهُمَا أَوْ كِلَاهُمَا فَلَا تَقُلْ لَهُمَا أُفٍّ وَلَا
تَنْهَرْهُمَا وَقُلْ لَهُمَا قَوْلًا كَرِيمًا
অর্থ তোমার রব ফায়সালা করে দিয়েছেন : তোমরা তাঁর ইবাদত ছাড়া অন্য কারোর ইবাদত কর না, পিতা-মাতার সাথে ভালো ব্যবহার কর। যদি তোমাদের কাছে তাদের কোনো একজন বা উভয় বৃদ্ধ অবস্থায় থাকে, তাহলে তাদেরকে ‘উহ্’ পর্যন্তও বল না এবং তাদেরকে ধমকের সুরে জবাব দিও না; বরং তাদের সাথে সম্মান ও মর্যাদার সাথে কথা বল।
পিতা-মাতার দায়িত্ব হচ্ছে সন্তানদের লালন-পালন করা, তাদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করা। রাসূলে খোদা (সা.) থেকে বর্ণিত হাদীস অনুযায়ী, সন্তান হচ্ছে পিতা-মাতার কাছে আল্লার আমানতস্বরূপ। তাই তাদেরকে সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি অবশ্যই নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও উন্নত চারিত্রিক গুণাবলি শিক্ষা দিতে হবে। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘যখন তোমাদের সন্তানদের বয়স সাত বছর হয় তখন তাদের নামাজের প্রশিক্ষণ দাও।’ অন্য এক হাদিসে বলা হয়েছে : ‘সুন্দর নৈতিক চরিত্র ও শিষ্টাচার শিক্ষা দেওয়ার চেয়ে উত্তম আর কিছুই পিতা-মাতা সন্তানদের দান করতে পারে না।’
বিশ্বনবী(সা.) পারিবারিক জীবনের সুস্থতার ওপরে ভীষণ গুরুত্ব প্রদান করেছেন, যা আমাদের অনুসরণযোগ্য। হাদিসে এসেছে যে, রাসূলে খোদা (সা.) একবার তাঁর মেয়ে ফাতেমা (সা. আ.), তাঁর স্বামী হযরত আলী ও হাসান-হোসাইনকে এক চাদরের নিচে রেখে আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন : ‘হে আল্লাহ! এরা হচ্ছে আমার আহলে বাইত (পরিবার)।’
পরিবারের সদস্যদের সাথে উত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষ মর্যাদায় উচ্চ স্তরে পৌঁছে। অপর একটি হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : ‘মুমিনের মধ্যে ঐ ব্যক্তির ঈমান সবচেয়ে পরিপূর্ণ, যে চরিত্রের সৌন্দর্যে উন্নত এবং নিজের পরিবার-পরিজনের প্রতি সর্বাপেক্ষা সদয় ও নম্র ব্যবহার করে।’
স্বামী-স্ত্রী, বাবা-মা, ভাই-বোন প্রভৃতি নিয়ে গঠিত হয় পরিবার। তাই সুস্থ পরিবার গঠনে পুরুষের পাশাপাশি নারীদেরকে যথোপযুক্ত মর্যাদা দিতে হবে। 

কাজেই দেখা যাচ্ছে, জীবনের অন্য সকল দিকের মতো পরিবার ও পারিবারিক জীবন সম্পর্কেও ইসলামের রয়েছে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি। একটি পুরুষ ও নারী কিভাবে দাম্পত্য জীবন শুরু করবে, তাদের একের প্রতি অন্যের দায়িত্ব ও কর্তব্য কী হবে, তাদের পরস্পরের মধ্যে বিরোধ ও বিসম্বাদ দেখা দিলে কীভাবে তার সমাধান করবে সব বিষয়েই ইসলাম দিয়েছে সুস্পষ্ট নির্দেশনা। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, ইসলামের সেসব নির্দেশনা যথাযথভাবে অনুসৃত না হওয়ার আজ বিশ্বের মুসলিম সমাজ ভুগছে নানা দুরারোগ্য ব্যাধিতে।
জাতিসংঘ প্রতি বছর ১৫ মে ‘আন্তর্জাতিক পরিবার দিবস’ পালন করে। তারা পরিবার বিষয়ে সচেতনতা ও দায়িত্ববোধ জাগ্রত করা এবং শান্তিময় জীবন লাভের স্বপ্ন নিয়ে এ দিবসের নানা আয়োজন করে।
অথচ আমাদের প্রাণের ধর্ম ইসলাম শান্তিময় জীবন ও পারস্পরিক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য শেখানোর জন্য দিয়েছে ‘পরিবার ব্যবস্থা’। কোরআনের দিকনির্দেশনা অনুসরণ করলেই কেবল আদর্শ পরিবার গঠন করা সম্ভব। মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে তাঁর নির্দেশিত পথে আমাদের পরিবারগুলো গঠন করার তওফিক দিন। 

শাহনাজ আরফিন : লেখক ও গবেষক

পরমাণুবিজ্ঞানী ফাখরিজাদে হত্যাকান্ড- ইতিহাসের এক কালো অধ্যায়

 

মোহাম্মদ আতিক –

ইরানের বিশিষ্ট পদার্থবিজ্ঞানী এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের গবেষণা ও উদ্ভাবন বিষয়ক সংস্থার চেয়ারম্যান মোহসেন ফাখরিজাদে গত ২৭ নভেম্বর শুক্রবার সন্ধ্যায় সন্ত্রাসীদের বর্বরোচিত হামলায় শহীদ হয়েছেন। সন্ত্রাসীরা সুপরিকল্পিতভাবে তাঁকে হত্যা করে। তেহরানের অদূরে দামাভান্দ কাউন্টির আবসার্দ শহরের একটি সড়কে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা ফাখরিজাদেকে বহনকারী গাড়িতে হামলা চালায়। ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী আইআরজিসি জানিয়েছে, ইরানের শীর্ষ পরমাণুবিজ্ঞানী মোহসেন ফাখরিজাদেকে হত্যা করার কাজে সাটেলাইট নিয়ন্ত্রিত অত্যাধুনিক ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার ব্যবহার করা হয়েছে।
ইরানের এই পরমাণুবিজ্ঞানী হত্যার পর পরই দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মাদ জাওয়াদ জারিফ বলেছেন, এই হত্যাকা-ের পেছনে ইসরাইলের জড়িত থাকার মারাত্মক ইঙ্গিত রয়ে়ছে। অপরদিকে আমেরিকার দুইজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা ‘নিউইয়়র্ক টাইমস’কে নিশ্চিত করেছেন যে, এই হত্যার পেছনে ইসরাইল জড়িত। আমেরিকার একজন বেসামরিক কর্মকর্তা একই কথা বলেছেন ‘নিউইয়র্ক টাইমস’কে। একজন পদস্থ মার্কিন কর্মকর্তার বরাত দিয়ে ‘দৈনিক ওয়াশিংটন পোস্ট’ জানিয়েছে, এই হত্যাকা-ে ইসরাইলের হাত থাকার ব্যাপারে কোনো সংশয় নেই। কয়েক বছর আগে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ইরানকে পরমাণু অস্ত্র তৈরির প্রচেষ্টার দায়ে অভিযুক্ত করতে গিয়ে তাঁর ভাষায় মোহসেন ফাখরিজাদেকে ইরানের ‘পরমাণু অস্ত্র তৈরির জনক’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘নামটি মনে রাখবেনÑ মোহসেন ফাখরিজাদে।’
ইরানের সর্বোচ্চ জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের সচিব আলী শামখানি বলেছেন, শত্রুরা গত ২০ বছর ধরে ইরানের এই বিজ্ঞানীকে হত্যা করার চেষ্টা করে আসছিল। এই হত্যাকা-ের পর ঢাকাস্থ ইরান দূতাবাসের এক বিবৃতিতে বলা হয়, এটা ১৯৪৮ সালে বৈশ্বিকভাবে গৃহীত মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্রের অনুচ্ছেদ ৩, নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক চুক্তির অনুচ্ছেদ ৬, জাতিসংঘ সনদের অনুচ্ছেদ ১, ১২ ও ৫১ এবং জেনেভা কনভেনশনসমূহের দ্বিতীয় অতিরিক্ত প্রোটোকলের অনুচ্ছেদ ১৩’র সাথে সাংঘর্ষিক। একইসাথে এটা আন্তর্জাতিক অপরাধমূলক তৎপরতার বিষয়ে রাষ্ট্রসমূহের যে দায়িত্ব রয়েছে তার লঙ্ঘন এবং এটা প্রকৃতপক্ষে ‘আন্তর্জাতিক টার্গেট কিলিংয়ের’ নিখুঁত উদাহরণ।
ইরান এই ন্যক্কারজনক কাজের জবাব দেয়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে। ইরানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও বর্তমান স্ট্র্যাটেজিক কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্সের প্রধান কামাল খাররাজি বলেছেন, দেশের শীর্ষ পরমাণুবিজ্ঞানী মোহসেন ফাখরিজাদে হত্যার বিষয়ে যথেষ্ট হিসাব-নিকাশ করে জবাব দেবে তেহরান।
জাতিসংঘে ইরানের স্থায়ী প্রতিনিধি মজিদ তাখতে রাভানচি জাতিসংঘ মহাসচিব এবং নিরাপত্তা পরিষদের প্রধানের কাছে লেখা চিঠিতে ইরানি পরমাণুবিজ্ঞানীকে হত্যার নিন্দা জানানোর আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, এ হত্যাকা-ে ইসরাইলের জড়িত থাকার প্রমাণ রয়েছে। তিনি এ ধরনের অপরাধের বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিক্রিয়া দেখানোর আহ্বান জানান।
বিজ্ঞানী ফাখরিজাদে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা খাতেও গুরুত্বপূর্র্ণ অবদান রেখেছেন। ইরানে প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্তকরণ কিট তৈরির পাশাপাশি করোনাভাইরাসের টিকা তৈরির চলমান প্রকল্পে তাঁর সম্পৃক্ততা ছিল। শহীদ ফাখরিজাদে করোনাভাইরাসের টিকা তৈরির প্রকল্প পরিচালনা করছিলেন। ইরানের পরমাণু গবেষণায় তিনিই ছিলেন মুখ্য ব্যক্তিত্ব। কয়েকবছর আগে যুক্তরাষ্ট্র পরমাণু চুক্তি থেকে একতরফাভাবে বেরিয়ে যাওয়ার পর ইরানের আণবিক গবেষণাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। যার ফলে তাঁকে ইসরাইলের বিষ নজরে পড়তে হয়েছিল বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এই পাশবিক হত্যাকা-ের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দার ঝড় ওঠে। রাশিয়া, তুরস্ক, কাতার, সিরিয়া, ভেনিজুয়েলা ও দক্ষিণ আফ্রিকা, ওমান, সংযুক্ত আর আমিরাত, ইরাক, আফগানিস্তান এবং কুয়েতসহ আরো বহু দেশ এবং জাতিসংঘের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থা এ হত্যাকা-ের নিন্দা জানায়।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক প্রধান কর্মকর্তা জোসেফ বোরেল ইরানের শীর্ষস্থানীয় পরমাণু ও প্রতিরক্ষাশিল্প বিজ্ঞানী মোহসেন ফাখরিজাদের হত্যাকা-কে ‘অপরাধমূলক তৎপরতা’ বলে মন্তব্য করেছেন।
তিনি ব্রাসেলসে এক বক্তব্যে ইরানি বিজ্ঞানী হত্যাকা-ের নিন্দা জানান। তবে এ হামলার পেছনে কারা জড়িত সে সম্পর্কে তিনি কোনো ইঙ্গিত করেন নি।
জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিবেদক অগান্স ক্লামন্ড ওই সন্ত্রাসী হামলার পরপরই এক টুইট বার্তায় প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন, এই হত্যাকা- বাইরে থেকে পরিচালিত হয়েছে এবং টার্গেট করে এ হত্যাকা- ঘটানো হয়েছে। এ পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন এবং জাতিসংঘ নীতিমালার পরিপন্থী। জাতিসংঘের এ কর্মকর্তা ইরানের বিজ্ঞানী হত্যার এ পদক্ষেপকে বেআইনি বলেও অভিহিত করেছেন।
রুশ সংসদের নি¤œকক্ষ দুমা’র পররাষ্ট্র বিষয়ক স্থায়ী কমিটির চেয়ার‌্যমান লিওনিদ স্লাতেস্কি ইরানের বিশিষ্ট পরমাণুবিজ্ঞানী মোহসেন ফাখরিজাদের হত্যাকা-কে সন্ত্রাসী হামলা বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘ইরানকে নতুন করে উসকানি দিতেই এ হত্যাকা- চালানো হয়েছে। এ অবস্থায় মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা যাতে আর বাড়তে না পারে সে পদক্ষেপ নেয়া জরুরি।’
আমেরিকার শীর্ষস্থানীয় প্রভাবশালী সিনেটর এবং গত নির্বাচনের ডেমোক্র্যাট দল থেকে প্রেসিডেন্ট পদের মনোনয়ন প্রত্যাশী বার্নি স্যান্ডার্স ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের খ্যাতিমান পদার্থবিজ্ঞানী মোহসেন ফাখরিজাদে হত্যাকা-ের কঠোর নিন্দা জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এই হত্যাকা- অবৈধ এবং নতুন মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে ইরানের সমঝোতা বা আলোচনার সম্ভাবনা বানচাল করার প্রচষ্টা।
স্যান্ডার্স তাঁর টুইটার অ্যাকাউন্টে বলেন, মোহসেন ফাখরিজাদে হত্যার ঘটনা অবৈধ ও উসকানিমূলক। আমেরিকার নতুন একটি প্রশাসন যখন ক্ষমতা নেবে তার আগ মুহূর্তে এই হত্যাকা- একথা পরিষ্কার করে দেয় যে, ইরান ও আমেরিকার মধ্যকার সম্ভাব্য কূটনৈতিক প্রক্রিয়া বানচাল করার পদক্ষেপ এটি। তবে আমাদের এ ধরনের ঘটনা ঘটতে দেয়া মোটেই উচিত হবে না। খুন নয়, বরং কূটনৈতিক পথ হচ্ছে সামনে এগিয়ে যাওয়ার শ্রেষ্ঠ পথ।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের আণবিক শক্তি সংস্থা বা এইওআই’র সাবেক প্রধান ও পরমাণুবিজ্ঞানী ফেরেইদুন আব্বাসি বলেছেন, দেশের কৌশলগত গবেষণাকর্ম বাধাগ্রস্ত করতে খ্যাতিমান বিজ্ঞানী মোহসেন ফাখরিযাদেকে শত্রুরা হত্যা করেছে। তবে শত্রুদের সমস্ত চাপ ইরান মোকাবেলা করবে।
ইরানের নিউজ চ্যানেল ‘প্রেসটিভি’কে দেয়া সাক্ষাৎকারে ফেরেইদুন আব্বাসি বলেন, ১০ বছর আগে তিনি নিজেও হামলার শিকার হয়েছিলেন। এ ধরনের হামলার একটি অভিন্ন লক্ষ্য হচ্ছে ইরানের বৈজ্ঞানিক সমাজে ভীতি ছড়িয়ে দেয়া যাতে দেশের কৌশলগত গবেষণা বন্ধ হয়ে যায় এবং ইরান এসব ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করতে না পারে।
তিনি বলেন, “শত্রুরা গুরুত্বপূর্ণ কিছু ব্যক্তিকে হত্যা করে আমাদের সমাজে ভীতি ছড়িয়ে দিতে চায় যাতে ইরানের কর্মকর্তারা তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে বাধ্য হন। শত্রুরা অতীতে একই কাজ করেছে। তবে আমরা সমস্ত চাপ মোকাবেলা করে যাচ্ছি এবং আমাদের দেশ কোনো একজন ব্যক্তির ওপর নির্ভরশীল নয়।”
আব্বাসি জোর দিয়ে বলেন, সমস্ত কষ্ট-ক্লেশ সত্ত্বেও আমরা পথচলা অব্যাহত রাখব।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের জাতীয় সম্প্রচার সংস্থা আইআরআইবি’র প্রধান আবদুল আলী আসকারি বলেছেন, বিশ্বের আধিপত্যবাদী শক্তিগুলোর জেনে রাখা উচিত, ফাখরিজাদের শাহাদাতের কারণে জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা ক্ষেত্রে ইরানের উন্নতি থেমে থাকবে না বরং এর ফলে উল্টো আধিপত্যকামী শক্তিগুলোর মোকাবিলায় ইরানের বিপ্লবী তরুণ বিজ্ঞানীরা তাদের দেশকে আরো এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে আরো সংকল্পবদ্ধ হবে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইরানের একাধিক পরমাণুবিজ্ঞানী রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদের শিকার হয়েছেন। কিন্তু এ ধরনের অপরাধ প্রতিহত করার জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে কোনো ধরনের পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় নি। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর নিষ্ক্রিয় ভূমিকার কারণে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্দেশে চলতি বছরের জানুয়ারিতে ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসি’র কুদস ব্রিগেডের কমান্ডার জেনারেল কাসেম সোলাইমানিকে ড্রোন হামলা চালিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায়ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো ট্রাম্পের পদক্ষেপের বিরুদ্ধে মৌখিক নিন্দা জ্ঞাপন করা ছাড়া বাস্তবে কোন পদক্ষেপ নেয় নি।
ইরানের অন্যতম শীর্ষ পরমাণুবিজ্ঞানী হত্যার ঘটনায় এক প্রতিক্রিয়ায় জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস ইসরাইলি এই অপরাধযজ্ঞের ব্যাপারে কঠোর নিন্দা ও স্পষ্ট অবস্থান নেয়ার পরিবর্তে সব পক্ষকে সংযত হওয়ার এবং যেকোন উত্তেজনা এড়িয়ে চলার আহ্বান জানিয়েছেন।
ইরানি পরমাণুবিজ্ঞানী হত্যাকা-ের প্রতিক্রিয়ায় ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসাদ আবু খালিল এক টুইট বার্তায় লিখেছেন, ‘ধরুন ইরান কিংবা মার্কিন সরকারের বিরোধী কোন দেশের সরকার যদি ইসরাইলের কোন পরমাণুবিজ্ঞানীকে হত্যা করত তাহলে আমরা দেখতে পেতাম পাশ্চাত্যের সরকারগুলো ও গণমাধ্যম থেকে শুরু করে মানবাধিকার সংগঠনগুলো একযোগে এর বিরুদ্ধে কঠোর ও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখাতো।’
ইরানের বিচারবিভাগের মানবাধিকার বিষয়ক দফতরের প্রধান আলী বাকেরি কানি জাতিসংঘ মহাসচিব এবং এ সংস্থার মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনারের কাছে লেখা আলাদা চিঠিতে ওই হত্যাকা-ের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর নিষ্ক্রিয় ভূমিকার কথা উল্লেখ করে বলেছেন, এ নীরবতা সন্ত্রাসবাদী কর্মকা-কে বৈধতা দান করবে এবং উগ্রপন্থা ও সন্ত্রাসবাদের বিস্তার ঘটাবে।
ইরানের বিচারবিভাগের মানবাধিকার বিষয়ক দফতরের প্রধান আলী বাকেরি কানি তাঁর ওই চিঠিতে সন্ত্রাসবাদ বিষয়ে পাশ্চাত্যের দ্বিমুখী, বৈষম্যমূলক ও রাজনৈতিক পক্ষপাতমূলক আচরণের কথা উল্লেখ করে বলেছেন, এর ফলে বিশ্বের শান্তি ও নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এ ধরনের হত্যাকা-ের বিষয়ে নীরবতা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এর ফলে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদ স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হবে এবং বিশ্বের নানা প্রান্তে এ ধরনের হত্যাকা- ঘটার আশঙ্কা বাড়বে।
সূত্র: প্রেসটিভি, পার্সটুডে, মেহর নিউজ, ইরনা।