All posts by dreamboy

ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ওয়েবিনার

ইরানের ইসলামি বিপ্লবের রূপকার ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর ৩২তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে গত ৩ জুন, বৃহ¯পতিবার বিকাল ৩টায় ঢাকাস্থ ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের উদ্যোগে এক ওয়েবিনার অনুষ্ঠিত হয়। ওয়েবিনারে আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মাদ রেজা নাফার, সাবেক নির্বাচন কমিশনার এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. কে এম সাইফুল ইসলাম খান, খুলনায় অবস্থিত ইসলামিক শিক্ষা কেন্দ্রের অধ্যক্ষ হুজ্জাতুল ইসলাম সৈয়দ ইব্রাহীম খলিল রাজাভী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আবু মূসা মো. আরিফ বিল্লাহ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. কামাল উদ্দিন, বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ হুজ্জাতুল ইসলাম সাইয়্যেদ আফতাব হোসাইন নাকাভী এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোঃ নূরে আলম। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশে অবস্থিত ইরান দূতাবাসের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের কালচারাল কাউন্সেলর ড. সাইয়্যেদ হাসান সেহাত। অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় ছিলেন ড. আব্দুল কুদ্দুস বাদশা। পবিত্র কোরআন থেকে তেলাওয়াত করেন বিশিষ্ট ক্বারী এ কে এম ফিরোজ।
ইরানি রাষ্ট্রদূত জনাব মোহাম্মাদ রেজা নাফার বলেন, ইমাম খোমেইনী (র.) ছিলেন একজন পারফেক্ট মানুষ, যিনি ধর্ম, দর্শন, নৈতিকতা, ইরফান এবং রাজনীতির সংমিশ্রণ ঘটিয়ে এমন এক রসায়ন তৈরি করেছিলেন যার স্বাদ মানুষ এর আগে কখনই পায়নি। ইমাম খোমেইনী ছিলেন তৎকালীন সময়ের অন্যতম অনন্য ব্যক্তিত্ব, যিনি বস্তুবাদ ও ধর্মবিদ্বেষের যুগে ধর্মের পুনর্জাগরণের পতাকা উড্ডয়ন করেছিলেন এবং বিশ্বব্যাপী এতটাই আলোড়ন তৈরি করেছিলেন যে, এই শতাব্দীর সাথে তাঁর পবিত্র নামটিই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে। ইমাম খোমেইনী ছিলেন মুসলিম বিশ্বের এক অনন্য ব্যক্তিত্ব, যাঁর ব্যক্তিত্বের প্রভাব কেবল ইরানের ভৌগোলিক গ-ির মধ্যে আবদ্ধ ছিল না; বরং তিনি ছিলেন গোটা মানবজাতি এবং মুসলিম বিশ্বের অমূল্য স¤পদ।
তিনি আরো বলেন, বর্তমান সময়ে ইমাম খোমেইনীর চিন্তাদর্শ সংরক্ষণ করা আমাদের বড় সাফল্য, শত্রুরা যা বছরের পর বছর ধরে ব্যাহত করার চেষ্টা করেছে। ইমাম খোমেইনীর স্মরণসভাগুলো প্রকৃতপক্ষে এই আধ্যাত্মিক নেতার চিন্তাদর্শ ও আলোকিত পথনির্দেশনা সংরক্ষণের একটি উপায়। বর্তমান সময়ে মুসলিম যুবকদেরকে ইমাম খোমেইনীর জীবনাদর্শের সাথে পরিচিত করানো উচিত।
স্বাগত বক্তব্যে ড. হাসান সেহাত বলেন, প্রতি বছর ৪ জুন মহান ইরানি জাতিকে ও বিশে^র সমস্ত মুক্তিকামী মানুষকে একটি বিরাট দুঃখজনক ও অবিস্মরণীয় ঘটনাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। এ দুঃখজনক ঘটনা হচ্ছে এমন একজন বিরাট, মহান, সাহসী ও শক্তিশালী নেতাকে হারানোর ঘটনাÑ যিনি বিশে^র সবচেয়ে বড় বিপ্লবের নেতৃত্ব প্রদানের মাধ্যমে ইরানি জাতিকে আড়াই হাজার বছরের স্বৈরাচারী রাজতন্ত্র ও বিজাতীয় আধিপত্যের কবল থেকে মুক্ত করে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
অনুষ্ঠানের স্বাগত বক্তব্যে ড. সাইয়্যেদ হাসান সেহাত বলেন, প্রত্যেক বছর খোরদাদ মাসের মাঝের তারিখটি মহান ইরানি জাতির জন্য এবং একই সাথে বিশ্বের সকল স্বাধীনচেতা মানুষের জন্য অশেষ দুঃখ ও শোকের বার্তা নিয়ে হাজির হয়, যে শোক কখনও ভোলার নয়। এ শোক এক মহান, অবিসংবাদিত, সাহসী ও প্রতাপশালী নেতাকে হারানোর শোক, যিনি বিশ্বের সবচেয়ে বৃহত্তম গণমানুষের বিপ্লবের নেতৃত্ব দিয়ে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের গোড়াপত্তন করেন। তিনি বলেন, ইমাম খোমেইনি আত্মমনোবল এবং গভীর বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে ইরানের মহান জাতিকে তার আসল পরিচয়সত্তার প্রতি পথনির্দেশনা দান করেছেন। আর এ কারণেই ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান, ইসলামি বিপ্লবের বিজয়ের পর থেকে বিগত ৪২ বছরে অর্থনৈতিক, সামরিক, প্রযুক্তিসহ অন্যান্য খাতে যত উন্নতি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে তা ইমাম খোমেইনীর ঐ উৎসাহ ও অনুপ্রেরণার কাছে ঋণী ।
ড. আবু মূসা মো. আরিফ বিল্লাহ বলেন, ইসলামি হুকুমত প্রতিষ্ঠা একটি স্বপ্ন ছিল। তৎকালীন বিশে^ সমাজবাদ, পুঁজিবাদ ও গণতন্ত্রবাদের বাইরে একটি ইসলামি হুকুমত প্রতিষ্ঠা সহজ কোনো বিষয় ছিল না। ইরানের তৎকালীন শাসক রেযা শাহ খুবই শক্তিশালী ছিলেন। তাঁর পৃষ্ঠপোষক ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু ইমাম খোমেইনী (র.) শোহাদায়ে কারবালার চেতানায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বিপ্লব করেন। একটি বিপ্লবের জন্য তিনটি উপাদান খুবই গুরুত্বপূর্ণÑ তত্ত্ব, নেতৃত্ব ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক অবস্থা। ইমাম খোমেইনী বেলায়াতে ফকীহ তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে বিপ্লব সংগঠিত করেন; তিনি নিজে ছিলেন অসাধারণ নেতৃত্বের গুণে গুণান্বিত এবং তাঁর নেতৃত্বের অধীনে আয়াতুল্লাহ মোর্তজা মোতাহহারী, ড. আলী শরীয়তীর মতো অসংখ্য আলেম-বুদ্ধিজীবী বিপ্লবী কর্মকা-ে অংশ নিয়েছিলেন। আর ইরানের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল।
ড. মো. নূরে আলম বলেন, ইরানে ইসলামি বিপ্লবের পূর্বে যখন অত্যাচারী ও ইহুদী মার্কিনপন্থী রেযা শাহ পাহলভী ইরানের শাসন ক্ষমতায় ছিলেন, তিনি যখন দেশ থেকে ইসলামি আদর্শকে সমূলে ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন, দেশে যখন মদ, জুয়া ও অশ্লীলতা মারাত্মক আকার ধারণ করে, ইসলামের অনুসারিগণকে অমানুষিক জুলুম, নির্যাতন ও অত্যাচার করা হয়, আমেরিকানরা যখন মধ্যপ্রাচ্যকে তাদের ঘাঁটি মনে করত এবং ইরান থেকে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিল, এ করুণ পরিস্থিতিতে আত্মপ্রকাশ করেন ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা হযরত ইমাম খোমেইনী (র)। হযরত ইমাম খোমেইনী রাজনীতি ও সংগ্রামের ক্ষেত্রে কেবল একজন অনন্য বিশ্বনেতাই ছিলেন না; বরং আইনবিজ্ঞান, ফিকাহশাস্ত্র, দর্শনশাস্ত্র, সূফিতত্ত্ব ও নীতিশাস্ত্রের বিশেষজ্ঞ হিসাবেও ইসলামি বিশ্বের এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি বর্তমান মুসলিম বিশ্বের সকল নেতার চেহারা থেকে অপমান, সংকীর্ণতা ও অলসতার চিহ্ন মুছে ফেলেছেন, মুসলিম ও অমুসলিম জাতিসমূহের মধ্যে ইসলামি মূল্যবোধ পুনরুজ্জীবিত করেছেন, বিশ্বের সকল মুক্তিকামী ও নির্যাতিত মানুষের হৃদয় আলোড়ন তুলেছেন। তিনি শুধু ইরানের নন, সারা বিশ্বের মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সকল নির্যাতিত মানুষের নেতা। তিনি যে বিপ্লব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তা ছিল পৃথিবীর বুকে এক অলৌকিক ঘটনা।
হুজ্জাতুল ইসলাম সৈয়দ ইব্রাহীম খলিল রাজাভী বলেন, মুসলিম উম্মাহকে শোহাদায়ে কারবালার চেতনায় জালেমকে ঘৃণার কথা শিক্ষা দেওয়া হতো, কিন্তু বাস্তবে এর প্রয়োগ সেভাবে ছিল না। যা ইমাম খোমেইনী (রহ.) তাঁর বিপ্লবের মাধ্যমে বাস্তবে করে দেখিয়েছেন। ইমাম খোমেইনী বলেন, মুহররম ও সফর ইসলামকে জাগ্রত রেখেছে। ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর বেলায়াতে ফকীহ তত্ত্ব এমন একটি তত্ত্ব যা বিপ্লবের পর বিপ্লবকে অব্যাহত রাখতে ভূমিকা রেখে চলেছে। এ বিপ্লবকে বুঝতে হলে বেলায়াতে ফকীহকে বুঝতে হবে, কারবালার চেতনাকে বুঝতে হবে, ইমাম খোমেইনীর ব্যক্তিত্বের আধ্যাত্মিক দিককে গভীরতার সাথে অনুধাবন করতে হবে। আর যে আহলে বাইতের খাদেম হিসেবে ইমাম খোমেইনী গর্ববোধ করতেন সেই আহলে বাইতকেও বুঝতে হবে।
তিনি আরো বলেন, ইমাম খোমেইনী প্রতিষ্ঠিত এ রাষ্ট্রের নীতি হচ্ছে জালেমের বিপক্ষে আর মজলুমের পক্ষে। ফিলিস্তিনের পক্ষে ইরানের সুস্পষ্ট অবস্থান এ বিষয়টিকেই প্রমাণ করেছে।
ড. মো. কামাল উদ্দিন বলেন, ইমাম খোমেইনী এমন এক ব্যক্তি যিনি দীর্ঘদিন দেশের বাইরে থেকে ইরানের বিপ্লবের নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং বিপ্লবকে সফল করেছেন। এতে তাঁর শক্তিশালী ব্যক্তিত্বের পরিচয় ফুঠে ওঠে। ইরানের জনগণকে দীর্ঘদিন ইসলামবিরোধী শক্তির মোকাবিলা করতে হয়েছে, তারা কখনই প্রকৃত স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে নি। অবশেষে ইমাম খোমেইনী (র.) কর্তৃক সংঘটিত ইসলামি বিপ্লবের বিজয়ের মাধ্যমে তারা স্বাধীনতার প্রকৃত স্বাদ আস্বাদন করতে পেরেছে। ইমাম খোমেইনী বস্তুগত ও আধ্যাত্মিক বিপ্লব সাধন করেছিলেন। বিপ্লবের পূর্বে তেহরান বিশ^বিদ্যালয়কে এমন একটি দোকান বলা হতো যেখানে পাশ্চাত্য পণ্য বিক্রি হয়। অর্থাৎ চিন্তা-চেতনা সকল কিছু পাশ্চাত্য দ্বারা প্রভাবিত ছিল। কিন্তু বিপ্লবের পর ইমাম খোমেইনী এমন এক আধ্যাত্মিক বিপ্লব সাধন করেন এবং নৈতিক মূল্যবোধ সৃষ্টি করেন যার ফলে সকল বিরোধী শক্তির মোকাবিলায় ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান আজো মাথা উঁচু করে টিকে আছে।
অধ্যাপক ড. কে এম সাইফুল ইসলাম খান বলেন, ইমাম খোমেইনী (র.) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পুঁজিবাদী গণতন্ত্র, সোভিয়েত ইউনিয়নের ধর্মহীন শাসনব্যবস্থা ও মধ্যপ্রাচ্যের রাজতন্ত্রকে চ্যালেঞ্জ করে ইসলামি বিপ্লব সংঘটিত করেছেন। বিপ্লব সফল হওয়ার পর বিপ্লবকে নস্যাৎ করার জন্য ইরাক কর্তৃক চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধে মুসলিম রাষ্ট্রগুলো প্রতিবাদী ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে নি। কিন্তু ইসলামি বিপ্লব স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত থেকে যায়। ইমাম খোমেইনী একটি সাংস্কৃতিক বিপ্লব সাধন করেছিলেন। তিনি একটি জাতিকে আত্মমর্যাদাবোধ, শালীনতা, শিষ্টাচার ও স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করেন।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ইরানের বিপ্লব ছিল একটি নজিরবিহীন বিপ্লব, ইসলামের নামে এ ধরনের বিপ্লব আর দ্বিতীয়টি হয় নি। এ বিপ্লব সমগ্র বিশে^র জন্য ছিল একটি বিস্ময়। যদিও ইরান একটি মুসলিম প্রধান দেশ ছিল, কিন্তু এর সংস্কৃতি হয়ে গিয়েছিল ইউরোপ-আমেরিকার মতো। ইমাম খোমেইনী ইসলামি বিপ্লবের মাধ্যমে এতে আমূল পরিবর্তন সাধন করেন। আর এতে জনগণের সমর্থন ও সহযোগিতাও ছিল ব্যাপক।
বিপ্লবের পর ইরাক সরকার কর্তৃক চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধের মাধ্যমে পাশ্চাত্য শক্তি চেয়েছিল ইরানের বিপ্লবকে ধ্বংস করতে, কিন্তু ইরানিদের জাতীয় চেতনা, আত্মমর্যাদাবোধের কারণে তারা তাতে সফল হয়নি।
ইমাম খোমেইনী অত্যন্ত জ্ঞানী ব্যক্তি ছিলেন। তিনি ছিলেন উদার দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী। ইসলামি বিপ্লবের পর ইরানে ইহুদি, খ্রিস্টান ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের স্বাধীনভাবে ধর্মপালন এর প্রমাণ বহন করে। তিনি বলেছিলেন, আমরা ইহুদিদের বিরোধী নই, তবে আমরা যায়নবাদীদের বিরোধী।
বর্তমান ইরানের কথা উল্লেখ করে জনাব সাখাওয়াত বলেন, ইরান একটি আধুনিক ও শক্তিশালী রাষ্ট্র। ইরানের অবকাঠামোগত অগ্রগতি ইউরোপের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। ইরান একটি পরিচ্ছন্ন দেশ। একটি দেশের উন্নতির জন্য যা প্রয়োজন সকল কিছু ইরানে বিদ্যমান। ইরানে নারী নিরাপত্তার বিষয়টি লক্ষ্যণীয়। অনেক রাতেও নারীরা নিরাপদে চলাচল করতে পারে। ইরানে দুর্নীতি নেই বললেই চলে। ইরানিরা খুবই উন্নত সংস্কৃতির অধিকারী। বিপ্লবকে টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে প্রচ- চেতনা কাজ করে। তিনি আরো বলেন, ইরানিরা তাদের অতীত ইতিহাসকে মুছে ফেলেনি। তারা সেগুলোকে সংরক্ষণ করে রেখেছে।
হুজ্জাতুল ইসলাম সৈয়দ আফতাব হোসেন নাকাভী বলেন, ইসলামি বিপ্লব সফল হওয়া অন্যতম প্রধান কারণ ছিল যোগ্য নেতার যথাযথ অনুসরণ। ইসলামি বিপ্লব শিক্ষা দেয় যে, শুধু নামায, রোযা, হজ, যাকাত নয়; বরং অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক সকল ধরনের কর্মকা- ধর্মীয় নেতৃত্বের অধীনে হওয়া আবশ্যক। রাজনীতির সাথে ধর্মের কোন বিরোধ নেই, বরং রাজনীতি ইসলাম ধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে এ রাজনীতি মিথ্যা ওয়াদা, ধোঁকা দেয়া, অন্যায়-অবিচার করার রাজনীতি নয়; এ রাজনীতি পবিত্র বিষয়, এটি একটি ইবাদত।

ইরানের ইসলামি বিপ্লবে ইমাম খোমেইনীর (র.) অবদান

-ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী : 
ইরানে ইসলামি বিপ্লব বিজয় লাভ করে ১৯৭৯ সালে। এ বিপ্লবের প্রধান স্লোগান ছিল : ‘লা শারকী ওয়া লা গারবী, জামহুরিয়ে ইসলামি’ – ‘প্রাচ্যও নয়, পাশ্চাত্যও নয়, ইসলামি প্রজাতন্ত্র’। প্রাচ্য বলতে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং এশিয়া, ইউরোপ, এমনকি আরব ও আফ্রিকার কোনো কোনো দেশও সোভিয়েত বলয়ভুক্ত ছিল। আর পাশ্চাত্য বা আমেরিকার বলয়ভুক্ত ছিল ইউরোপ, আমেরিকা, এশিয়া, আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়ার বিশাল ভূখণ্ড। তখনকার বিশ্ব রাজনীতিতে এমন বিশ্বাস বদ্ধমূল ছিল যে, এ দুই শক্তিবলয় বা পরাশক্তির বশ্যতা না মেনে পৃথিবীর কোথাও কোনো রাষ্ট্রক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত বা পরিচালিত হতে পারে না। কিন্তু এই মিথ্যা ধারণা ও বিশ্বাসে পদাঘাত হেনে ইসলামি বিপ্লবের নেতা হযরত ইমাম খোমেইনী (র.) এমন এক বিপ্লব সংগঠিত করেন যা ইতিহাসের অনেক হিসাব-নিকাশকে ভুল প্রমাণিত করে দেয় এবং এক সর্বাত্মক গণবিপ্লবের মাধ্যমে ইসলামি বিপ্লব বিজয় লাভ করে। ইরানে ইসলামি প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এখনো তা সগৌরবে বলবৎ আছে। এ কারণে এ বিপ্লব বিশ্বের তাবত মজলুম মানুষ, বিশেষ করে বঞ্চিত নিপীড়িত মুসলমানদের মনে আশার সঞ্চার করে। কারণ, ইরানের ইসলামি বিপ্লব দুটি বৃহৎ শক্তির বলয়বৃত্তে শৃঙ্খলিত মানুষের মনে নতুন আশার সঞ্চার করে।
দীর্ঘকাল ধরে সর্বসাধারণের মাঝে বদ্ধমূল ধারণা ছিল ইসলাম একটি সুন্দর ও শ্রেষ্ঠ ধর্ম হলেও কোনো রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষমতা ইসলামের নেই। অন্য কথায়, কোনো ইসলামি রাষ্ট্র আধুনিক যুগে চলতে পারে না। কিন্তু হযরত ইমাম খোমেইনী (র.) এ ধারণা ভুল প্রমাণ করে দেন। তিনি বাস্তবে দেখিয়ে দেন যে, বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর বিরোধিতা সত্ত্বেও এবং তাদের সব ধরনের ষড়যন্ত্র প্রতিহত করে ইসলামি আদর্শের ভিত্তিতে রাষ্ট্র্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করা সম্ভব। ইরানের সরকারব্যবস্থা বা রাষ্ট্রীয় কাঠামো পর্যালোচনা করলে যে কেউ এ কথা স্বীকার করতে বাধ্য হবেন যে, এ ব্যবস্থা অত্যন্ত নিখুঁত, উন্নত, আধুনিক ইসলামি আদর্শের অনুসারী হওয়ার সাথে সাথে প্রগতিশীল। এতে সর্ব স্তরে জনগণের অংশগ্রহণ ও ইসলামি আদর্শের অনুসরণ নিশ্চিত করা হয়েছে। ইরানের মজলিসে শুরায়ে ইসলামি (পার্লামেন্ট), সাংবিধানিক অভিভাবক পরিষদ, দেশের সর্বোচ্চ নেতা নির্বাচনী বিশেষজ্ঞ পরিষদ, জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ, বিচারব্যবস্থার উপর নজরদারির জন্য সর্বোচ্চ বিচার পরিষদ প্রভৃতির বিন্যাস এতই নিখুঁত যে, এর ফলে ইসলামি বিপ্লবের মূল লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হওয়ার সুযোগ নেই।
ইরানের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ শিয়া মাজহাবের অনুসারী। কাজেই ইরানের ইসলামি বিপ্লবে শিয়া মাজহাবের প্রভাব থাকবে এটাই স্বাভাবিক। শিয়া মাজহাবের ‘আক্বীদাহ্ অনুযায়ী উম্মতের হেদায়তের জন্য ১২ জন ইমাম আল্লাহ ও রাসূলের (সা.) পক্ষ হতে নির্ধারিত। বারো ইমামের সর্বশেষ যিনি তিনি ইমাম মাহদী (‘আ.)। ইমাম মাহদী গায়েব হয়েছেন (আত্মগোপন করেছেন) অনেক আগে। ফলে বর্তমানে সামাজিক বা রাষ্ট্রব্যবস্থায় সঠিক নেতৃত্ব দেয়ার জন্য কোনো ইমাম নেই। এর ভিত্তিতে সাধারণভাবে মনে করা হতো যে, ইমামের অনুপস্থিতিতে ধর্মের ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনা সম্ভব নয়। হ্যাঁ, যখন ইমাম মাহদী (‘আ.) পুনরায় আবির্ভূত হবেন তখন তিনি এ পৃথিবীকে সুবিচার ও সুশাসনে ভরে তুলবেন, ইসলামের সত্যিকার বাস্তবায়নে সমগ্র দুনিয়ায় শান্তি সুখের রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে; কাজেই ইমাম মাহদী (‘আ.) ও ইসলামি বিশ্ববিপ্লবের জন্য অপেক্ষায় থাকাই এখনকার সময়ের দাবি। হযরত ইমাম খোমেইনী (র.) এ ধারণায় ভীষণভাবে নাড়া দেন বেলায়াতে ফকীহ তত্ত্ব উপস্থাপন করে। অর্থাৎ ইমাম মাহদীর (‘আ.) আত্মগোপন অবস্থায় থাকাকালে ইসলামি সমাজ সঠিক নেতৃত্বশূন্য থাকতে পারে না, অন্য কথায়, খোদাদ্রোহী শক্তির হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা তুলে দিয়ে কেউ নিছক ধর্মকর্ম নিয়ে দুনিয়া ও আখেরাতে কামিয়াব হওয়ার মিথ্যা দাবি করতে পারে না।
বেলায়াতে ফকীহর দৃষ্টিকোণ উপস্থাপন করে হযরত ইমাম খোমেইনী (র.) বলেন, যতদিন ইমামে যামান হযরত ইমাম মাহদী (‘আ.) আবির্ভূত হবেন ততদিন ইসলামি সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালিত হবে একজন ফকীহর নেতৃত্বে। এই কর্তৃত্ব ও নেতৃত্বের নামই বেলায়াতে ফকীহ।
হযরত ইমাম খোমেইনীর (র.) নেতৃত্বের অভাবনীয় সাফল্য হলো, তিনি এ তত্ত্বের ভিত্তিতে প্রাচীন সভ্যতা ও সংস্কৃতির লালনভূমি ইরানের গণমানুষকে একটি সর্বাত্মক আন্দোলনের জন্য উজ্জীবিত করেন এবং গোটা বিশ্বে তাক লাগানো গণবিপ্লবের মাধ্যমে আড়াই হাজার বছরের রাজতন্ত্রকে উৎখাত করে শতাব্দীর বিস্ময় ইসলামি বিপ্লবকে বিজয়ী করেন। হযরত ইমাম খোমেইনীর (র.) এ তত্ত্ব এতই বাস্তব ও দূরদর্শী যে, এর কল্যাণেই এ বিপ্লব এখনও তার সঠিক গতিধারার উপর অবিচল আছে।
ইসলামের স্বর্ণযুগের পর থেকে সমাজে আলেম সমাজের ভূমিকা নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয় ও তাঁদেরকে কোণঠাসা করে রাখা হয়। সমাজের সর্বত্র এমন ধারণার বিস্তার ঘটানো হয় যে, সমাজের নেতৃত্ব দানের যোগ্যতা আলেমদের নেই। তাঁরা কেবল কবর ও পরজগত নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন।। জন্মের সময়ে আজান দেওয়া আর মৃত্যুর সময় জানাযা পড়ানো ও নামায-কালামের বাইরে তাঁদের কাজ নেই। সমাজ বা রাষ্ট্রের কোনো দায়িত্ব পালনের যোগ্যতা তাঁদের নেই। সে ক্ষেত্রে হযরত ইমাম খোমেইনী (র.) ইরানে ইসলামি বিপ্লবের বিজয়ের মধ্য দিয়ে প্রমাণ করেন যে, আলেম সমাজ ইসলামি রাষ্ট্র পরিচলনার যোগ্যতা রাখেন। শুধু তা-ই নয়, যুগের সকল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে ইসলাম একটি বিজয়ী আদর্শ এবং আলেম সমাজই তার ঝাণ্ডাবাহী হতে পারে – তিনি এ সত্যকে বাস্তব দৃষ্টান্তের মাধ্যমে দুনিয়ার সামনে পেশ করেন।
ইসলামি জাহানের মূল সমস্যা ফিলিস্তিন এবং বায়তুল মোকাদ্দাস। দীর্ঘদিন হলো ইসলামের প্রথম কিবলাহ্ মসজিদুল আকছার স্বাধীনতা যায়নবাদী ইসরাইলের কব্জায় চলে গেছে, আর মজলুম ফিলিস্তিনি জনগণের উপর অবর্ণনীয় জুলুম নির্যাতন চালানো হচ্ছে। এ কাজে যায়নবাদী ইসরাইল সরকারকে মদদ যোগাচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা, ব্রিটেন, রাশিয়া তথা বিশ্বের সকল পরাশক্তি। তার সঙ্গে আরব দেশসমূহের সরকার-প্রধানরা ইসরাইলের মোকাবিলায় বশ্যতার নীতি গ্রহণ করায় ফিলিস্তিন ও আল-কুদ্সের মুক্তির স্বপ্ন বাস্তবায়িত হতে পারছে না। মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার প্রধান বরকন্দায ছিল ইরানের শাহানশাহ মোহাম্মাদ রেযা পাহলাভী। যায়নবাদী ইসরাইলের সাথে ছিল তার আঁতাত। ইসলামি বিপ্লবের পর হযরত ইমাম খোমেইনী (র.) প্রথম পদক্ষেপেই ইসরাইলের সাথে সর্বপ্রকার সম্পর্ক ছিন্ন করেন এবং তেহরানে অবস্থিত ইসরাইলি দূতাবাসকে ফিলিস্তিন দূতাবাসে রূপান্তরিত করেন। তাঁর এ পদক্ষেপ ফিলিস্তিনি জনগণের মধ্যে নতুন আশাবাদের সঞ্চার করে।
হযরত ইমাম খোমেইনীর (র.) দৃষ্টিতে মসলিম অধ্যুষিত দেশসমূহ যদি ঐক্যবদ্ধ হয় তাহলে ফিলিস্তিন ও আল-কুদস মুক্ত হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। এ জন্য সর্বপ্রথম মুসলিম উম্মাহর মধ্যে জাগরণ আনতে হবে এবং আল-কুদস ইস্যুকে মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ইস্যু হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। এ লক্ষ্যে তিনি পবিত্র মাহে রমজানের শেষ শুক্রবারকে বিশ্ব আল-কুদস দিবস হিসাবে পালনের ঘোষণা দেন। তাঁর এ ঘোষণা যে অত্যন্ত সময়োপযোগী ও বাস্তবধর্মী ছিল তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই।
ইরানে ইসলামি বিপ্লব বিজয় লাভের পর পরই দেশের অভ্যন্তরে অন্তর্ঘাতমূলক অনেক তৎপরতা চালানোর পাশাপাশি ইরাকের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনকে দিয়ে একটি সর্বাত্মক যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া হয়। এরপর আমেরিকা ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন সহ বিশ্বের সকল পরাশক্তি সর্বপ্রকার যুদ্ধসরঞ্জাম দিয়ে সাদ্দামকে সহায়তা করে। প্রতিক্রিয়াশীল আরব শেখরা তাদের ধনভাণ্ডার সাদ্দামের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়। এ যুদ্ধ নবপ্রতিষ্ঠিত ইসলামি বিপ্লবকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে দিতে পারত। সেই যুদ্ধ দীর্ঘ আট বছর স্থায়ী হয়। কিন্তু হযরত ইমাম খোমেইনীর (র.) বিচক্ষণতায় দুনিয়ার সকল পরাশক্তির পরিকল্পনা নস্যাৎ হয়ে যায়। যুদ্ধের অবসান হয় এবং তাতে উন্নত শিরে বিজয়ী হন হযরত ইমাম খোমেইনী (র.) ও ইরানের ইসলামি বিপ্লব।
ইসলামি বিপ্লবের আগে ইরান যুদ্ধাস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জামের ব্যাপারে সম্পূর্ণ নির্ভরশীল ছিল আমেরিকার উপর। ইরানের শাহ ছিল এতদঞ্চলে আমেরিকার প্রধান এজেন্ট। সেনাবাহিনীতে প্রাধান্য ছিল ইসরাইলি সামরিক বিশেষজ্ঞদের এবং অস্ত্রশস্ত্রের যোগান আসত আমেরিকা ও ইসরাইল থেকে।
কিন্তু ইসলামি বিপ্লবের ফলে ইরান অন্যান্য খাতের ন্যায় অস্ত্র খাতেও আত্মনির্ভরশীল হয়। তার সামরিক শক্তি এতখানি মজবুত হয় যে, ইরাকের তৎকালীন প্রেসিডেন্টে সাদ্দামের মাধ্যমে প্রক্সি যুদ্ধে বলতে গেলে সকল পরাশক্তি ইরানের কাছে পরাভব মানে। বর্তমানে ইরানের ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র শক্তি এতখানি প্রবল যে, সকল পরাশক্তি এখন ইরানের সামরিক সক্ষমতাকে সমীহ করে চলছে। ইরান নিজস্ব প্রযুক্তিতে মহাশূন্যে উপগ্রহ পাঠিয়েছে এবং ক্ষেপণাস্ত্র শক্তিতে মধ্যপ্রাচ্যে প্রধান শক্তিতে পরিণত হয়েছে।
হযরত ইমাম খোমেইনীর (র.) নেতৃত্বে ইরানের ইসলামি বিপ্লবের আরেকটি সাফল্য হলো নারীদের ক্ষমতায়ন। দীর্ঘদিন থেকে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে যে, ইসলাম পর্দার বিধান দিয়ে নারীদেরকে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ড থেকে বাধা দেয় এবং নারীর সাম্য, মুক্তি ও প্রগতির অন্তরায়। তাদের মুখরোচক স্লোগান হলো, হিজাব প্রগতির অন্তরায়। কিন্তু ইরানের ইসলামি বিপ্লব এ প্রচারণাকে মিথ্যা প্রমাণ করেছে। ইরানি মহিলারা হিজাব সহকারে সমাজের সর্বস্তরে তাঁদের উপস্থিতির মধ্য দিয়ে বিশ্ববাসীর সামনে প্রমাণ করেছেন যে, হিজাব প্রগতির অন্তরায় নয়। হিজাব সহকারে তাঁরা শিক্ষায়, গবেষণায়, অফিস-আদালতে, বিজ্ঞানচর্চায়, এমনকি ক্রীড়াঙ্গনে ও যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁদের যোগ্যতার প্রমাণ উপস্থিত করেছেন। তাঁরা বিশ্বঅলিম্পিকের বিভিন্ন ইভেন্টে বিশ্ববাসীর সামনে নিজেদের যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখেছেন। ইরানের সমাজে এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেখানে মহিলারা পুরুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যোগ্যতার সাথে দায়িত্ব পালন করছেন না।
ইরানের ইসলামি বিপ্লবের আরো একটি উজ্জ্বল দিক হলো, দেশের যুব সমাজকে ইসলাম ও জাতি গঠনের জন্য উদ্বুদ্ধ করা। ইরানি যুবকদের মাঝে আত্মত্যাগের যে প্রেরণা সৃষ্টি করা হয়েছিল এবং এখনো যা বলবৎ আছে, তা পৃথিবীর সব দেশের জন্য ঈর্ষণীয়। বিশ্বে অনেক দেশে বিপ্লব হয়, দেখা যায়, যারা বিপ্লব করেছে তারা কিছুদিন পরে বিপ্লবের গতিধারা থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ে বা ক্ষমতা তাদের হাতে থাকে না। এ ক্ষেত্রে ইরানের ইসলামি বিপ্লবের দৃষ্টান্ত সবার জন্য অনুসরণীয়। বেলায়াতে ফকীহ বা রাহবারের হাতে সর্বোচ্চ ক্ষমতা থাকার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে বিপ্লবের শুরুতে যাঁরা ছিলেন তাঁরাই এখনো এই বিপ্লবের কাণ্ডারির ভূমিকা পালন করছেন। এটাও বিপ্লবের নায়ক ইমাম খোমেইনীর দূরদর্শিতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

 

হযরত ইমাম খোমেইনী (র.)-এর চিন্তাধারায় মুস্তাক্বেরীন ও মুস্তায্‘আফীন

-নূর হোসেন মজিদী  : “ মুস্তাকবেরীন্‌” (مستکبرين) ও “মুস্তায্‘আফীন্” (مستضعفين) কোরআন মজীদে ব্যবহৃত পরিভাষাসমূহের অন্যতম। এ দু’টি পরিভাষা যথাক্রমে کبر (বড়ত্ব, অহঙ্কার) ও ضعف (দুর্বলতা) ক্রিয়ামূল (মাছদার) থেকে নিষ্পন্ন। مستکبرين ও مستضعفين ছাড়াও উভয় ক্রিয়ামূল থেকে নিষ্পন্ন আরো বিভিন্ন শব্দরূপ ও ক্রিয়ারূপ কোরআন মজীদের অনেকগুলো আয়াতে ব্যবহৃত হয়েছে। কোরআন মজীদের শুরুর দিকেই ইবলীস্ কর্তৃক হযরত আদমকে (‘আ.) সিজ্দাহ্ না করার কারণ সম্পর্কে এরশাদ হয়েছে :

أَبَى وَاسْتَكْبَرَ وَكَانَ مِنَ الْكَافِرِينَ
‘সে অস্বীকার করল ও অহঙ্কার প্রদর্শন করল; বস্তুত সে কাফেরদের অন্তর্ভুক্ত ছিল।’ (সূরা আল্-বাক্বারাহ্ : ৩৪)

এখানে যে اسْتَكْبَرَ ক্রিয়াপদ ব্যবহৃত হয়েছে যার ক্রিয়ামূল (মাছদার) হচ্ছে استکبار (ইস্তিকবাার – যা کبر থেকে নিষ্পন্ন) এবং এর কর্তাবাচক বিশেষ্য (ইসমে ফাা‘এল্) مستکبر (বহুবচনে مستکبرون ও مستکبرين) – যার ব্যবহারিক তাৎপর্য ‘দাম্ভিক’ ও ‘বলদর্পী’ (অমার্জিত ভাষায় বললে ‘মাস্তান্’)।
আর ضعف ক্রিয়ামূল থেকে নিষ্পন্ন استضعاف-এর কর্মবাচক বিশেষ্য (ইসমে মাফ্‘ঊল্) مستضعف মানে ‘দুর্বলকৃত/ যাকে দুর্বল করে রাখা হয়েছে’ (বহুবচনে مستضعفون ও مستضعفين)। যেমন, এরশাদ হয়েছে :

وَمَا لَكُمْ لا تُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَالْمُسْتَضْعَفِينَ
‘তোমাদের কী হয়েছে যে, তোমরা যুদ্ধ করছ না আল্লাহর রাস্তায় এবং মুস্তায্‘আফীনের জন্য ….?’ (সূরা আন্-নিসাা’ : ৭৫)

কোরআন মজীদে “ মুস্তাকবেরীন্‌” ও “মুস্তায্‘আফীন্” পরিভাষা এবং অভিন্ন মূল থেকে নিষ্পন্ন বিভিন্ন ক্রিয়াপদ ও বিশেষ্য অনেকগুলো আয়াতে ব্যবহৃত হলেও এ বিষয়টির গুরুত্বের প্রতি হযরত ইমাম খোমেইনী (র.) যেভাবে দৃষ্টি দিয়েছেন তাঁর পূর্বে অন্য কোনো ইসলামি মনীষী সে ধরনের দৃষ্টি দিয়েছেন বলে জানা যায় না। বস্তুত ইসলামি বিপ্লবের বিজয়ের আগে-পরে সব সময়ই ইমামের বাণী ও ভাষণে এ বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব লাভ করে এবং “ মুস্তাকবেরীন্‌” ও “মুস্তায্‘আফীন্” কা’রা, তাদের ভূমিকা কী, এ দু’টি শ্রেণির উদ্ভবের পিছনে নিহিত কারণ ও এ থেকে মানব প্রজাতির মুক্তির পন্থা কী সে সম্পর্কে তিনি বিশ্লেষণাত্মক মতামত ব্যক্ত করেছেন। এ বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ আলোচনা একটি গ্রন্থ রচনার দাবি রাখে; এখানে আমরা অত্যন্ত সংক্ষেপে এ বিষয়ের ওপর আলোকপাত করব।

সংক্ষেপে বলতে গেলে হযরত ইমামের দৃষ্টিতে জাতীয়, আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় পর্যায়ে নির্বিশেষে মুস্তাক্বেরীন্ হচ্ছে তারা যারা অন্যায়ভাবে ও জবরদস্তি করে সাধারণ জনগণের ওপর নিজেদের শাসন, নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য চাপিয়ে দেয় এবং তাদেরকে শোষণ করে, প্রাকৃতিক সম্পদ কুক্ষিগত করে রাখে ও সমস্ত রকমের সুযোগ-সুবিধা একচ্ছত্রভাবে ভোগ করে, অন্যদিকে মুস্তায্‘আফীন্ হচ্ছে শোষিত-বঞ্চিত ও আধিপত্য কবলিত জনগণ- ক্ষেত্রবিশেষে যারা জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় ন্যূনতম উপায়-উপকরণ থেকেও বঞ্চিত।

হযরত ইমামের (র.) দৃষ্টিতে মুস্তাকবের  হওয়ার মূল কারণ হচ্ছে আল্লাহ্ তা‘আলাকে ভুলে যাওয়া ও তার পরিবর্তে শয়তানের ও নাফ্সের পূজারী হওয়া। এ কারণেই তারা অন্যদের বিরুদ্ধে অন্যায়-অপরাধ ও যুলুম-শোষণের আশ্রয় নেয় এবং সমাজে বিপর্যয়-বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। এ কারণেই – আল্লাহ্ তা‘আলার কাছে জবাবদিহিতার কথা ভুলে যাবার কারণেই – তারা অহঙ্কার ও দাম্ভিকতার আশ্রয় নেয়। তারা তাদের সৃষ্ট যুলুমমূলক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার মাধ্যমে সাধারণ জনগণকে, বিশেষত তাদেরকে বিভিন্ন গোষ্ঠী ও শ্রেণিতে বিভক্ত করে, স্বীয় পদতলে দাবিয়ে রেখে মুস্তায্‘আফীনে পরিণত করেছে। অবশ্য স্বয়ং মুস্তাকবেরীন্‌-এর মধ্যে বিভিন্ন স্তর ও শ্রেণি রয়েছে, কিন্তু তাদের অভিন্ন বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যুলুম-শোষণ। অন্যদিকে মুস্তায্‘আফীন্ শ্রেণির লোকেরা সাধারণত সৎ ও খোদাভীরু। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তাদের সকলের অবস্থা এক রকম নয়, তবে সকলের অভিন্ন বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে, তাদের সকলেই কম-বেশি মযলূম, শোষিত ও বঞ্চিত।
হযরত ইমামের মতে, যদিও কোরআন মজীদের উল্লেখ অনুযায়ী মানব প্রজাতির ইতিহাসে সব সময়ই মুস্তাকবেরীন্‌  ও মুস্তায্‘আফীনের অস্তিত্ব ছিল তবে মুসলিম অধ্যুষিত দেশসমূহে উপনিবেশবাদীদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে এ ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ হয়।

ইমাম খোমেইনী (র.) তাঁর এতদবিষয়ক মতামতে বিশেষভাবে ইসলামি বিপ্লব-পূর্ব ইরানি সমাজের অবস্থাকে বিশ্লেষণ করেন – যা থেকে বিশ্বের সকল দেশের অবস্থা সম্পর্কেই কম-বেশি ধারণা মেলে। তিনি সম্পদ ও ক্ষমতাকে মুস্তাক্বেরীনের ব্যবহৃত দু’টি প্রধান হাতিয়ার হিসেবে গণ্য করেন; একদিকে সম্পদ ক্ষমতায় উপনীত হওয়ার তথা ক্ষমতা ক্রয়ের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে, অন্যদিকে ক্ষমতা সম্পদ হস্তগতকরণের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ফলে সম্পদ ও ক্ষমতা একটি শ্রেণির কুক্ষিগত হয়ে যায়, অন্যদিকে ব্যাপক জনগণ শুধু ক্ষমতাহীন ও দরিদ্রই নয়, বরং সরকারি ব্যয়ে শিক্ষা লাভ ও সরকারি চাকরি থেকে শুরু করে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত থেকে যায়; কেবল ব্যতিক্রম হিসেবে অসাধারণ প্রতিভার কারণে বা ঘটনাক্রমে সাধারণ মানুষের মধ্যকার কিছু লোক নিজেদেরকে উপরে তুলতে সক্ষম হয়।
ইসলামি বিপ্লবের বিজয়ের পূর্বে সুযোগ-সুবিধার বিচারে ইরানি জনগণ সাধারণভাবে মোটামুটি তিন শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল : (১) শাহের পারিষদবর্গ ও তাঁবেদার গোষ্ঠী, পদস্থ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাগণ, বিদেশী (প্রধানত আমেরিকান) পুঁজি বিনিয়োগকারিগণ ও দেশী পুঁজিপতিগণ, (২) সরকারি কর্মচারী, ব্যবসায়ী, ছোটখাট ভূমি-মালিক ও পেশাজীবীসহ মধ্যবিত্ত শ্রেণি, (৩) কৃষিশ্রমিক, কারখানা-শ্রমিক, ক্ষুদ্র চাষী, বস্তিবাসী ও ঝুপড়িবাসীসহ সুবিধাবঞ্চিত ব্যাপক সাধারণ জনগণ।
হযরত ইমাম (র.) এর আলোকে সেই যুগে মুসলিম জাহানের অবস্থা সম্পর্কে বলেন : ‘উপনিবেশবাদীরা জনগণের ওপর চেপে বসা তাদের রাজনৈতিক এজেন্টদের মাধ্যমে যুলুমমূলক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চাপিয়ে দিয়েছে এবং এর ফলে জনগণ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছে : যালেম ও ময্লূম। একদিকে শত শত মিলিয়ন মুসলমান ক্ষুধা ও বঞ্চনা কবলিত, অন্যদিকে ধনী ও রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী স্বল্পসংখ্যক লোক ভোগ-বিলাসিতা, অপচয় ও পাপাচারে নিমজ্জিত। ময্লূম বঞ্চিতরা সব সময়ই এই মুষ্টিমেয় সংখ্যকের আধিপত্য থেকে নিজেদেরকে মুক্ত করার জন্য চেষ্টা করছে, কিন্তু যুলুমমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা এই সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মুক্তির পথকে রুদ্ধ করে দিচ্ছে।’
শাহের তথাকথিত সংস্কার পরিকল্পনার সমালোচনায় হযরত ইমাম (র.) বলেন : ‘শাহ্ …. দেশের শিল্পায়নের বাহানায় শিল্পপ্রতিষ্ঠানসমূহে দেশী-বিদেশী পুঁজিবিনিয়োগকারীদের জন্য পথ তৈরি করে দিয়েছে, …. আর এখন দেখতে পাচ্ছি, সরকারের তাঁবেদার ইরানের সেই বড় বড় ভূমি-মালিকরা বিরাট বিরাট কারখানার মালিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে।’ তিনি আরো বলেন : ‘আমেরিকান পুঁজিপতিরা ইরানকে শোষণের উপযোগী সর্বোত্তম জায়গা হিসেবে গণ্য করে এবং বিভিন্নভাবে ইরানে তাদের পুঁজি ঢেলে দিয়েছে।’ হযরত ইমাম (র.) সেই সাথে এদের সহযোগী জমিদার, ভূমিদস্যু, সরকারের তাঁবেদার, মাস্তান ও যারা বসে বসে অন্যদের শ্রমের ফল ভোগ করে তাদের কথাও উল্লেখ করেন।

ইমাম খোমেইনী তাঁর অন্তিম বাণীতে সারা দুনিয়ার মুস্তাকবেরীন্‌  ও মুস্তায্‘আফীনের কথা স্মরণ করেন। তিনি বলেন : ‘অন্তত বিগত একশ বছরে – যখন পর্যায়ক্রমে সকল মুসলিম-অধ্যুষিত দেশে ও অন্যান্য ছোট দেশে বিশ্বভুক বৃহৎ শক্তিবর্গের প্রবেশ ঘটে – আমরা ও আপনারা প্রত্যক্ষ করেছি বা সঠিক ইতিহাস আমাদেরকে জানিয়েছে যে, এসব দেশের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত কোনো সরকারই স্বীয় জাতির মুক্তি, স্বাধীনতা ও কল্যাণের চিন্তা করে নি ও করছে না; বরং তাদের প্রায় সকলেই স্বীয় জনগণের ওপর যুলুম ও শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা চাপিয়ে দিয়েছে এবং তারা যা কিছুই করেছে ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত স্বার্থে এবং ধনিক ও বালাখানাবাসীদের জন্য করেছে; ঝুপড়িবাসী ও বস্তিবাসীরা জীবন ধারণের জন্য অপরিহার্য সমস্ত উপকরণ থেকে, এমনকি পানি, রুটি ও কোনোমতে বেঁচে থাকার উপযোগী পুষ্টি থেকেও বঞ্চিত থেকে যায়, আর এই হতভাগাদেরকে ধনিক ও বিলাসী শ্রেণির স্বার্থে কাজে খাটানো হয়।’

ইমামের দৃষ্টিতে শক্তিশালী সরকারগুলো তাদের তাঁবেদার স্বল্পসংখ্যক লোক ব্যতীত সকল জাতির সমস্ত জনগণকে মুস্তায্‘আফে পরিণত করেছে। তিনি বিশেষভাবে ইসলামি বিপ্লব-পূর্ব ইরানের অবস্থা সম্পর্কে এক কথায় বলেন যে, শাহী সরকার ওলামা, গ্রামবাসী ও অন্যান্য শ্রেণির লোক নির্বিশেষে সর্ব স্তরের জনগণকে তার হুকুমবরদার হিসেবে গণ্য করত। তিনি ব্যবসায়ীদের মধ্যে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদেরকে মুস্তায্‘আফ্ হিসেবে গণ্য করেন।

হযরত ইমাম খোমেইনী (র.) তাঁর বিভিন্ন বাণী ও ভাষণে মুস্তাকবেরীনের  যেসব বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেন তা হচ্ছে : তারা আধিপত্যবাদী, সীমালঙ্ঘনকারী, আক্রমণকারী, নিপীড়ক, আরাম-আয়েশপ্রিয়, ভোগবাদী, লোভী, মুফ্ত্খোর, পাপাচারী, সমাজে বিভেদ-অনৈক্য সৃষ্টিকারী, জনগণকে নিষ্পেষণকারী, নিষ্ঠুর, প্রতারক, চক্রান্তকারী, বর্ণবৈষম্যবাদী, সত্য ও বাস্তবতাকে অস্বীকারকারী, কাপুরুষ ইত্যাদি। এছাড়া তারা তাদের ক্ষমতা ও আধিপত্য টিকিয়ে রাখার লক্ষ্যে চেষ্টা করে যাতে মুস্তায্‘আফ্ জনগণ স্বনির্ভরতা ও আত্মবিশ্বাসের অধিকারী হতে না পারে এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিক্ষা, সংস্কৃতি, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে অগ্রসর হতে না পারে।

অন্যদিকে হযরত ইমামের দৃষ্টিতে যারা প্রকৃত মুস্তায্‘আফীন্ তারা বিপ্লবী, সংগ্রামী সাহসী, নিষ্ঠাবান মুসলমান, ইখলাছের অধিকারী, নৈতিক শক্তির অধিকারী, আত্মবিশ্বাসী, আশাবাদী, আত্মরক্ষাকারী, বাস্তবদর্শী ও পদ-পদবির লোভ থেকে মুক্ত। তিনি ইরানের ইসলামি বিপ্লবে মুস্তায্‘আফ্ জনগণের অংশগ্রহণের কথার উল্লেখ করে বলেন, এই বঞ্চিত জনগণ, গ্রামবাসী ও শহরের অনুন্নত এলাকার জনগণের সাহসী অংশগ্রহণ ব্যতীত শাহী সরকারের পতন ঘটানো সম্ভব হতো না।

কিন্তু তিনি মুস্তায্‘আফীনের দুর্বলতাকেও অস্বীকার করেন নি। তিনি বলেন যে, মুস্তাকবেরদের শাসনব্যবস্থায় মুস্তায্‘আফীনের মধ্যকার কয়েক ধরনের লোক থাকে যারা সংগ্রামের ময়দানে নামে না অথবা উদাসীনতা, মুস্তাকবেরীনের  দ্বারা প্রতারিত হওয়া, ঈমান না থাকা বা ভয়ের কারণে মুস্তাকবেরীনের  যুলুমের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যেমন : সাধারণ সরকারি কর্মচারী, সৈনিক এবং বিশ্বের সকল দেশেরই বিরাটসংখ্যক বেখবর জনগণ।

হযরত ইমাম (র.) যে কোনো সমাজের ওলামা, লেখক, বক্তা ও বুদ্ধিজীবীদেরকে সমাজের দায়িত্বশীল অংশ বলে গণ্য করেন এবং বলেন যে, তাঁদের অবশ্যই মুস্তায্‘আফীনের পাশে থাকা উচিত।

ইমাম স্মরণ করিয়ে দেন যে, এ ক্ষেত্রে ওলামায়ে কেরামের দায়িত্ব সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তা হচ্ছে লোকদেরকে গোমরাহী থেকে রক্ষা করা। এ লক্ষ্যে তিনি ‘রাজা-বাদশাহ্দের ইসলাম, পুঁজিপতিদের ইসলাম, হক্ব-বাত্বিলের সংমিশ্রিত ইসলাম ও আমেরিকান ইসলাম’-এর বিপরীতে খাঁটি মুহাম্মাদী (সা.) ইসলামকে তুলে ধরার জন্য বার বার তাকীদ করেন। তিনি স্মরণ করিয়ে দেন যে, সাধারণ মানুষের মধ্যে গুনাহ্-খাতা ও দোষ-ত্রুটি থাকতেই পারে, কিন্তু কতক আলেম নামধারী লোক মুস্তাকবেরীন্‌  সহযোগী হয়ে দ্বীনকে বিকৃত করছে; প্রবৃত্তির দাস এই সব আলেমের সহযোগিতায় মুস্তাকবেরীন্‌  গোষ্ঠী জনগণের মধ্যে দ্বীনী চিন্তা-চেতনার ক্ষেত্রে স্থবিরতা সৃষ্টি করছে। তাই যে আধিপত্যবাদীরা প্রকাশ্যে ইসলামের বিরোধিতা করছে তাদের তুলনায় ইসলামের জন্য এ ধরনের আলেমদের সৃষ্ট ক্ষতি অনেক বেশি গুরুতর। ফলত এ ধরনের আলেমরা কার্যত মুস্তাকবেরীনের  প্রশাসনের মধ্যেই শামিল। হযরত ইমাম (র.) বলেন, যেসব আলেম মুস্তাকবেরীনের  খেদমতে আত্মনিয়োজিত তাদের পক্ষে যুলুম, শির্‌ক ও কুফরের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা সম্ভব নয়।

ইমাম খোমেইনী (র.) বার বার স্মরণ করিয়ে দেন যে, নিষ্ঠাবান ওলামায়ে কেরাম, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, শ্রমিক, গ্রামবাসী, ঝুপড়িবাসী, ছাত্র ও সমাজের অন্যান্য অবহেলিত গোষ্ঠীর লোকেরা – এক কথায়, মুস্তায্‘আফীন্ ইসলামি বিপ্লবকে বিজয়ী করে। তাই তিনি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অঙ্গনসহ ইসলামি হুকূমাতের সর্ব স্তরে মুস্তায্‘আফীনের অংশগ্রহণের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি স্মরণ করিয়ে দেন যে, ইসলামি হুকূমাতের অন্যতম গুরুদায়িত্ব হচ্ছে বঞ্চিত জনগণের বঞ্চনা দূর করা, শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকসহ সকল ক্ষেত্রে জনগণের উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য চেষ্টা করা এবং পরাশক্তিবর্গকে ভয় না করে বিশ্বের মুস্তায্‘আফীনের, বিশেষত মুসলমানদের পাশে দাঁড়ানো – যাতে তারা বৈশ্বিক ইসলামি হুকূমাত প্রতিষ্ঠার দিকে অগ্রসর হতে পারে।

একই সাথে তিনি মুস্তায্‘আফীনের ঐক্যের এবং ‘ইল্ম্ ও তাক্বওয়ার অস্ত্রে তাদের সজ্জিত হওয়ার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি সতর্ক করে দেন যে, মুস্তায্‘আফ্ লোকেরা যেন পদ-পদবির অধিকারী হলে ভারসাম্য হারিয়ে না ফেলে, প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে জিহাদের কথা ভুলে না যায় এবং নিজেরা মুস্তাকবেরের  ব্যাধিতে আক্রান্ত না হয়। তিনি ইসলামি সরকারকে সতর্ক করে দেন যে, মজুদদার, জোঁকের স্বভাববিশিষ্ট পুঁজিপতি ও অন্যান্য লোক যেন অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার সুযোগ নিয়ে বা স্বীয় অবস্থানের অপব্যবহার করে বিপুল সম্পদের মালিক হতে না পারে। তিনি বলেন, ইসলামের অন্যতম অবদান হচ্ছে বঞ্চিতদের বঞ্চনার অবসান ঘটানো ও সকল ক্ষেত্রে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। সুতরাং মুসলমানদের মধ্য থেকে যারাই শাসনক্ষমতায় আসুক না কেন, তারা যেন ভুলে না যায় যে, দেশের স্বাধীনতার সংরক্ষণ, আধিপত্যের ও শোষকদের শোষণের অবসান ঘটানো, সরকারি কর্মচারী, শ্রমিক, কৃষক ও সৎ ব্যবসায়ীদের জন্য পবিত্র ও সুস্থ জীবন যাপন নিশ্চিতকরণ, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক অগ্রগতি সাধন ইসলামি হুকূমাতের মূলনীতিসমূহের অন্যতম।
এখানে যে কারো মনে একটি প্রশ্ন আসতে পারে, তা হচ্ছে, একটি সমাজে বিপ্লবের মাধ্যমে মুস্তায্‘আফীন্ শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে তারা যে, ঐ সব মূলনীতির অনুসরণ অব্যাহত রাখবেই তার কী নিশ্চয়তা আছে? এ সম্পর্কে ইমাম খোমেইনীর অভিমত এই যে, মুস্তাকবেরীনের, ধর্মসম্পর্কহীনদের ও বিকৃত ধর্মানুসারীদের শাসনকাঠামোই এমন যে, তাতে যে কেউই অংশগ্রহণ করুক তার পক্ষে অনুরূপ স্বভাব পরিগ্রহণ ব্যতীত গত্যন্তর থাকে না। তাই মুস্তায্‘আফীনের শাসনকাঠামো অবশ্যই এমন হতে হবে যাতে এতে অংশগ্রহণকারীদের জন্য মুস্তার্ক্বে স্বভাব পরিগ্রহণের আশঙ্কা না থাকে। এ কারণে সুযোগ-সুবিধা বণ্টন, দায়িত্ব অর্পণ ও নির্বাচনের ক্ষেত্রে দ্বীনী মানদ- অনুসরণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সর্বাগ্রে মূল্যবোধকে তথা তাক্বওয়া ও আল্লাহর পথে চেষ্টাসাধনাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে এবং প্রয়োজনে গতানুগতিকভাবে চলে আসা নিয়ম-কানুন ও রীতিনীতিকে বদলে ফেলতে হবে।

ওলামা ও সরকারি দায়িত্বশীলগণ যাতে পথচ্যুত না হন সে লক্ষ্যে হযরত ইমাম খোমেইনী (র.) তাঁদের সম্পর্কে কতগুলো সাধারণ দিকনির্দেশনা প্রদান করতেও ভুলে যান নি। তিনি বলেন, সবকিছুর আগে আল্লাহ্ তা‘আলার প্রতি যথাযথ ঈমানই এ ক্ষেত্রে রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করতে পারে। তিনি আরো বলেন : ওলামা ও সরকারি দায়িত্বশীলগণের পক্ষে কেবল তখনই বঞ্চিত জনগণের পৃষ্ঠপোষক হওয়া সম্ভব যখন তাঁরা সাদাসিধা জীবন যাপন করবেন, জাঁকজমক পরিহার করবেন, আরাম-আয়েম ও ভোগ-বিলাসের পিছনে ছুটবেন না, জনগণের খেদমত করবেন, সুখে-দুঃখে জনগণের পাশে গিয়ে দাঁড়াবেন, ঝুপড়িবাসী ও বস্তিবাসীদের সাথে ওঠা-বসা করবেন, প্রাসাদবাসীদের থেকে দূরে থাকবেন, মুস্তায্‘আফীনের পৃষ্ঠপোষকতা করবেন, বায়তুল মাল্ ও স্বীয় পদ-ক্ষমতার অপব্যবহার করবেন না, ইসলামের অপব্যবহার করবেন না, কারণ, ইসলাম পকেট ভর্তি করার দ্বীন নয়, ঘন ঘন জনগণকে (টেলিভিশনের মাধ্যমে) চেহারা দেখাবেন না, সাদাসিধা উপায়-উপকরণ (যেমন : কম দামী গাড়ি) ব্যবহার করবেন। তিনি বলেন, কিন্তু এগুলো সম্ভব নয় যদি না ব্যক্তি নিজেকে নাফ্সের প্রতি ভালোবাসা ও দুনিয়ার প্রতি ভালোবাসা থেকে মুক্ত করে, যদি না পদ-ক্ষমতাকে অস্থায়ী ও গুরুত্বহীন গণ্য করে এবং মনে রাখে যে, একদিন আল্লাহ্ তা‘আলার নিকট পদ-ক্ষমতার হিসাব দিতে হবে, ফলত প্রয়োজন হলে খুব সহজেই তা ছেড়ে দিতে পারে।

মুস্তাকবেরীন্‌ ও মুস্তায্‘আফীন্ সম্পর্কে ইমাম খোমেইনী (র.)-এর সমস্ত কথার নির্যাস হচ্ছে এই যে, প্রবৃত্তিপূজা ও দুনিয়া-প্রীতিই সমস্ত গোমরাহী ও পাপাচারের মূল এবং এটাই মানুষকে মুস্তাকবের  হওয়ার দিকে এগিয়ে দেয়। তাই সর্বাবস্থায় প্রবৃত্তিপূজা ও দুনিয়া-প্রীতি থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা তথা নাফ্সের বিরুদ্ধে জিহাদই ইস্তিকবার থেকে মুক্তির একমাত্র উপায়।

* * *
কৃতজ্ঞতা : হযরত ইমাম খোমেইনী (র.)-এর উদ্ধৃতিগুলো ড. আলী আছগার মুক্বাদ্দাস্-এর مستکبرین و مستضعفین از دیدگاه امام خمینی শীর্ষক প্রবন্ধ থেকে গৃহীত।
* * *

ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর ইসলামি বিপ্লব এখন অনেক বেশি শক্তিশালী : ইরানের সর্বোচ্চ নেতা

ইরানের ইসলামি বিপ্লবের রূপকার ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে গত ৪ জুন রেডিও-টিভিতে সরাসরি ভাষণে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আল উযমা সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী এ কথা বলেন।
তিনি আরও বলেন, ইসলামি প্রজাতন্ত্রের সাফল্যের চাবিকাঠি হচ্ছে এই দু’টি শব্দ : ইসলামি ও প্রজাতন্ত্র। হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ.) মহান ও বিশাল যে কাজটি করেছেন তা হলো ইসলামি প্রজাতন্ত্রের তত্ত্ব উদ্ভাবন এবং তা বাস্তবায়ন। তাঁর এই তত্ত্বের ভিত্তি হলো পবিত্র ইসলাম ধর্ম ও জনগণ সম্পর্কে গভীর জ্ঞান।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা বলেন, গত এক-দুই শতাব্দীতে যেসব রাষ্ট্র ও সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তার মধ্যে আর কোনো ব্যবস্থার পতনের বিষয়ে এত বেশি পূর্বাভাস করা হয়নি যেমনটি করা হয়েছে ইরানের ইসলামি প্রজাতন্ত্রের বিষয়ে।
তিনি বলেন, ইসলামি বিপ্লবের প্রথম দিন থেকেই এর বিরোধীরা যারা এই বিপ্লবকে সহ্য করতে পারছিল না তারা বলছিল এই বিপ্লব দু’মাস, ছয় মাস বা এক বছরের বেশি স্থায়ী হবে না। এক বা দু’বছর আগে আমেরিকার একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাও বলেছিলেন যে, ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের বিপ্লবের ৪০তম বার্ষিকী উদ্যাপনের সুযোগ হবে না। কিন্তু আল্লাহর রহমতে ইমাম খোমেইনীর বিপ্লব ও রাষ্ট্রব্যবস্থার পতন হয়নি; বরং তা ক্রমেই এগিয়ে যাচ্ছে। দিন দিন আরও বেশি শক্তিশালী হচ্ছে।
এই বিপ্লব সব বাধা অতিক্রম করে অনেক বড় বড় সাফল্য এনে দিয়েছে বলে সর্বোচ্চ নেতা মন্তব্য করেন।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আসন্ন নির্বাচনে সবাইকে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, প্রত্যেকের উচিত নির্বাচনে অংশগ্রহণকে নিজের ওপর অর্পিত একটি দায়িত্ব হিসেবে গণ্য করা এবং নিজে অংশ নেওয়ার পাশাপাশি অন্যকেও পরামর্শ দেওয়া।
একই সঙ্গে প্রার্থীদেরকে পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, প্রত্যেক প্রার্থীকে অবশ্যই সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, ধনী-দরিদ্রের মধ্যে ব্যবধান হ্রাস, দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই, দেশীয় উৎপাদন বৃদ্ধি এবং চোরাচালান ও মাত্রাতিরিক্ত আমদানি ঠেকানোর বিষয়ে নিজেকে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ মনে করতে হবে। তাদেরকে এখন প্রতিশ্রুতিগুলো সু¯পষ্ট করতে হবে যাতে নির্বাচনে বিজয়ের পর প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করলে নজরদারির দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো জবাবদিহির সম্মুখীন করতে পারে।

 

ইমাম খোমেইনী : এক অনন্য ব্যক্তিত্ব

بسم الله الرحمان الرحیم

ثم الصّلاه و السّلام علی سیّدنا و نبیّنا محمد صلی الله علیه و آله اجمعین

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পবিত্র কুরআনে বলেছেন :

و لقد کتبنا فی الزبورِ من بعد الذکر ان الارض یرثها عبادی الصالحون

অর্থাৎ আমি তাওরাতের পর যাবুরে লিখে দিয়েছি যেআমার সৎকর্মপরায়ণ বান্দারা পৃথিবীর অধিকারী হবে।

প্রথমে আমি সম্মানিত বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গবিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবুদ্ধিজীবী ও সুধীমণ্ডলীর প্রতি সালাম ও শ্রদ্ধা নিবেদন করছিযাঁরা ইসলামের গৌরব-মাহাত্ম্যইরানের ইসলামি বিপ্লব ও এর সুযোগ্য নেতা ইমাম খোমেইনী (র.)-কে হৃদয়ে ধারণ করেন।

প্রিয় বন্ধুরা! ফারসি মাসের ১৩ই খোরদাদ মোতাবেক ৩রা জুন এক অনবদ্য আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্বদৃঢ় প্রত্যয়ী আরেফমুক্তিকামী মানুষের নেতাখোদাভীরু চিন্তাবিদ অর্থাৎ ইমাম খোমেইনী (র.)-এর মৃত্যুবার্ষিকী। আজ থেকে বত্রিশ বছর আগের এমন এক দিনে শতাব্দীর বৃহত্তম বিপ্লবের নেতা-যাঁর নাম প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের দাম্ভিক শক্তিগুলোর মনে কম্পন সৃষ্টি করতো-মহান রবের ডাকে সাড়া দিয়ে এই ইহধাম ত্যাগ করেন।  

একজন আদর্শবাদী জনপ্রিয় ইমামযিনি ছিলেন সদা জাগ্রত এক মহান নেতামুক্তি ও স্বাধীনতা এবং এই শতাব্দীতে ইসলামি বিশ্বের জাগরণের অগ্রদূততাঁর সম্পর্কে কিছু লেখা বা বলা সত্যিই খুব কঠিন। আমি ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দুঃখভারাক্রান্ত মনে এই দিনটিকে স্মরণ করছি এবং এই দিন উপলক্ষে বাংলাদেশের মুসলিম ভাই-বোনদের উদ্দেশে কিছু কথা বলার প্রয়াস পাচ্ছি।

প্রিয় বন্ধুরা! মহান ব্যক্তিদের মধ্যে যাঁরা ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছেন তাঁদের স্মৃতি-আদর্শের কথা সাধারণত মানুষ বছরের বিশেষ কোনো দিনবিশেষ করে তাঁদের মৃত্যুবার্ষিকীতে স্মরণ করে থাকেন। কিন্তু ইমাম খোমেইনী (র.) ছিলেন নিজেই একটি ইতিহাস এবং কালোত্তীর্ণ ব্যক্তিত্ব।

তিনি এমন এক চরিত্র যা শাশ্বত ও চিরন্তন। সুতরাং মুক্তিকামী জাতিগুলোর চিন্তা-চেতনার জগতে ইমাম খোমেইনীর নাম সর্বদা জীবন্ত ও অম্লান হয়ে আছে। কমিউনিস্ট সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতা মিখাইল গর্বাচেভও ইমাম খোমেইনীর দূরদর্শিতা ও চিন্তার সর্বজনীনতার কথা স্বীকার করেছেন।

ইমাম খোমেইনী (র.) ছিলেন একজন পরিপূর্ণ মানুষযিনি ধর্মদর্শননৈতিকতাইরফান এবং রাজনীতির সংমিশ্রণ ঘটিয়ে এমন এক রসায়ন তৈরি করেছিলেন যার স্বাদ মানুষ এর আগে কখনই পায়নি। ইমাম খোমেইনী ছিলেন তৎকালীন সময়ের অন্যতম অনন্য ব্যক্তিত্বযিনি বস্তুবাদ ও ধর্মবিদ্বেষের যুগে ধর্মের পুনর্জাগরণের পতাকা উড্ডয়ন করেছিলেন এবং বিশ্বব্যাপী এতটাই আলোড়ন তৈরি করেছিলেন যেএই শতাব্দীর সাথে তাঁর পবিত্র নামটিই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে।

ইমাম খোমেইনী ছিলেন মুসলিম বিশ্বের এক অনন্য ব্যক্তিত্বযাঁর ব্যক্তিত্বের প্রভাব কেবল ইরানের ভৌগোলিক গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ ছিল নাবরং তিনি ছিলেন গোটা মানবজাতি এবং মুসলিম বিশ্বের অমূল্য সম্পদ

সম্মানিত উপস্থিতি! এতে কোনো সন্দেহ নেই যেইরানের ইসলামি বিপ্লব বিংশ শতাব্দীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এবং অবিস্মরণীয় একটি ঘটনা। যেই বিপ্লব ইসলামের জন্য স্বর্ণযুগ বয়ে এনেছে এবং মুসলমানদের জন্য পরিণত হয়েছে অনুকরণীয় আদর্শে। এই বিপ্লব পথহারা মুসলমানদেরকে দিয়েছে পথের দিশাএভাবে এই বিপ্লব ঠাঁই করে নিয়েছে সত্যসন্ধানীদের হৃদয়ের গভীরে। বর্তমান প্রজন্মের যারা ইমাম খোমেইনীকে চিনতে বা বুঝতে সক্ষম হয় নি তাদের জন্য ইমাম খোমেইনীর উন্নত চিন্তাদর্শের সাথে পরিচিত হওয়া খুবই দরকার। ইমাম খোমেইনী (র.) ইসলামের যে শিক্ষা এবং ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা মুহাম্মাদি ইসলামের’ পূর্ণ রূপএটি অবশ্য অন্যান্য প্রচলিত ব্যাখ্যার চেয়ে পৃথক। তিনি বিমর্ষ ও মৃতপ্রায় ইসলামকে পুনরায় বিপ্লবী ইসলামে পরিণত করেন। এই মহান ও অলৌকিক কাজটি সাধন করা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সাহায্য ও তাওফিক ছাড়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

প্রিয় ভাই ও বোনেরা! ইমাম খোমেইনী কে ছিলেনতিনি এমন একজন ব্যক্তি যিনি একটি নতুন বিশ্ব বিনির্মাণের বিষয়ে গভীরভাবে এবং নিবিড়ভাবে চিন্তা করেছিলেন। তিনি এমন এক ব্যক্তি যাঁর কর্ম ছিল নবীদের প্রয়াসেরই পুনরাবৃত্তি। যিনি ইবরাহীম (আ.)-এর মতো প্রতিমা (তাগুতিশক্তি) ভেঙ্গেছেনযিনি মসিহ রুহুল্লাহর উদ্যম নিয়ে উম্মতকে নতুন করে উজ্জীবিত করেছেন। যিনি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মতো আল্লাহর দ্বীনকে সাহায্য করতে আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি ছিলেন সাথি-সঙ্গীদের ক্ষেত্রে অত্যন্ত সদয় ও স্নেহশীল। আর আল্লাহর দ্বীনের শত্রুদের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অনমনীয় এবং অত্যন্ত কঠোর। তিনি এমন এক মহান ব্যক্তিত্ব যাঁর চিন্তা ও দিকনির্দেশনা শুধু তাঁর জীবদ্দশায় নয়বরং তাঁর মৃত্যুর পরও সমস্যার জট খুলতে সাহায্য করছে। যিনি ইমান ও ইখলাসের সাথে এবং অঙুলির ইশারায় বিশ্বের বড় একটি বিপ্লবের নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় ও ধর্মীয়   মাদ্রাসার মধ্যে পুনর্মিলন ও প্রীতির সম্পর্ক  গড়তে সক্ষম হয়েছিলেনতিনি ছিলেন বিভিন্ন ধর্ম ও মাজহাবের মধ্যে ঐক্য ও সংহতির পথিকৃৎ। তিনি সেই ব্যক্তি যিনি দর্শনশাস্ত্রের সাথে ইরফান ও নীতিশাস্ত্রেরও সম্মিলন ঘটিয়েছেন। তিনি ছিলেন জনহিতৈষী এবং মনে করতেন জনগণই সকল সম্পদের মালিক। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি জনগণকে নিজের স্বার্থে অপব্যবহার করেন নি। 

ইমাম খোমেইনী (র.)-এর বিপ্লবী চিন্তাদর্শ জীবন্ত ও অমর এবং তাঁর অনুপ্রেরণামূলক কথা ইরানের জনগণ ও বিশ্বের মুসলমানদের সতত অনুপ্রাণিত করে চলেছে। ইমাম খোমেইনী (র.)-এর জীবনাদর্শে একটি নতুন বিশ্বব্যবস্থার খোরাক রয়েছে। বিশ্বের সব অঞ্চলের মুসলিম জাতিগুলো যদি এই আধ্যাত্মিক নেতার দিকনির্দেশনা গ্রহণ করে হাতে হাত রেখে ঐক্যবদ্ধ হয়তাহলে নিঃসন্দেহে তারা বিদ্যমান বিশ্বব্যবস্থায় কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আনতে সক্ষম হবে।

প্রিয় বুদ্ধিজীবিগণ! ইমাম খোমেইনী (র.)-এর কর্ম ও চিন্তাদর্শ সংরক্ষণ করা অত্যন্ত মূল্যবান কাজতবে ইমাম খোমেইনীর মতাদর্শ গ্রন্থাগারে ফেলে রাখা গুরুত্ব বহন করতে পারে না।বর্তমান সময়ে ইমাম খোমেইনীর চিন্তাদর্শ সংরক্ষণ করা আমাদের বড় সাফল্যশত্রুরা যা বছরের পর বছর ধরে ব্যাহত করার চেষ্টা করেছে। ইমাম খোমেইনীর স্মরণসভাগুলো প্রকৃতপক্ষে এই আধ্যাত্মিক নেতার চিন্তাদর্শ ও আলোকিত পথনির্দেশনা সংরক্ষণের একটি উপায়। বর্তমান সময়ে মুসলিম যুবকদেরকে ইমাম খোমেইনীর জীবনাদর্শের সাথে পরিচিত করানো উচিত। ইসলামি বিপ্লবের ইশতেহার হিসেবে বিবেচিত ইমাম খোমেইনীর দৃষ্টিভঙ্গির সাথে পরিচিত হওয়া বর্তমান সময়ে বিশ্বের সকল বুদ্ধিজীবী ও আলেমের জন্য একটি অতি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ হতে পারে। ইমাম খোমেইনীর বহুমুখী ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে জানতে না পারলে ইসলামি বিপ্লবকে সঠিকভাবে বুঝা অসম্ভব। 

ইরানের বর্তমান সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনেয়ী যথার্থই বলেছেন, ‘ইমাম খোমেইনীর নাম ছাড়া এই বিপ্লবকে পৃথিবীর কোথাও কেউ চেনে না।

সবশেষে আমি বলতে চাইআমাদের এখন ফিরে যাওয়া দরকার ইমাম খোমেইনী (র.)-এর যুগে- যে যুগের পতাকাটি এখন উড়ছে স্বাধীনচেতাআধুনিক ইসলামি আইনবিদ (ফকিহ)নির্ভীক ও বিচক্ষণ নেতা হযরত আলী খামেনেয়ীর হাতে।

ইমাম খোমেইনী (র.) এবং মুক্তি সংগ্রাম ও ইসলামি বিপ্লবের মহান শহিদদের আত্মার উদ্দেশ্যে সালাম ও দরুদ পেশ করছি এবং ইমাম মাহদী (আ.)-এর আত্মপ্রকাশের প্রত্যাশা ব্যক্ত করে শেষ করছি।

[ইমাম খোমেইনী (র.)-এর ৩২তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে গত ৩ জুন ২০২১ ঢাকাস্থ ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র আয়োজিত ওয়েবিনারে বাংলাদেশে নিযুক্ত ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের মহামান্য রাষ্ট্রদূত জনাব মোহাম্মদ রেজা নাফারের পূর্ণাঙ্গ বক্তব্য]

 

 

ইমাম খোমেইনী (র.): যুগান্তকারী বিপ্লবের নেতা

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
প্রত্যেক বছর খোরদাদ মাসের মাঝের তারিখটি (৪ জুন) মহান ইরানি জাতিকে এবং একই সাথে বিশ্বের সকল মুক্তিকামী মানুষকে এক অশেষ দুঃখ ও শোকের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় যা ভোলার নয়। এই শোক এমন  একজন মহান, সাহসী ও শক্তিশালী নেতাকে হারানোর শোক- যিনি বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিপ্লবের নেতৃত্ব প্রদানের মাধ্যমে ইরানি জাতিকে আড়াই হাজার বছরের স্বৈরাচারী রাজতন্ত্র ও বিজাতীয় আধিপত্যের কবল থেকে মুক্ত করে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, অত্যন্ত রূঢ় বাস্তবতা ছিল এই যে, মহান ইসলামি বিপ্লবের বিজয়ের পূর্বে ইরানের বুকে এমন এক সংস্কৃতি বিরাজমান ছিল সংক্ষেপে যার চেতনা ছিল ‘আমরা পারব না- আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।’ অর্থাৎ মনে করা হতো যে, পাশ্চাত্যের ওপর নির্ভর করা ব্যতীত আমাদের পক্ষে বেঁচে থাকা- যিন্দেগী যাপন করা সম্ভব নয়। এ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে শাহী ইরানের সরকারি কর্তাব্যক্তিরা এমনকি দেশী বিশেষজ্ঞদেরকে শিল্পোৎপাদনের অনুমতি পর্যন্ত দিত না। ইসলামি বিপ্লব ইরানি সমাজে বিরাজমান সংস্কৃতির ও তার ভূমিকার ওপর বিরাট ও সুগভীর প্রভাব বিস্তার করে। ইসলামি বিপ্লব ইরানি জনমনে এ প্রত্যয় সৃষ্টি করে যে, কোনো জাতিকে যা পরিবর্তন করে তা হচ্ছে তার সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি। এ কারণে হযরত ইমাম খোমেইনী (র.) যে বিপ্লবে নেতৃত্ব প্রদান করেন তিনি সে বিপ্লবকে একটি সাংস্কৃতিক বিপ্লব হিসেবে গণ্য করতেন। তিনি আত্মবিশ্বাস ও সৃদৃঢ় ঈমানী চেতনা সহকারে মহান ইরানি জাতিকে তার স্বকীয় প্রকৃতির দিকে দিকনির্দেশ করেন।
এ কারণে ইসলামি বিপ্লবের বিজয়ের পর বিগত ৪২ বছরে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান কৃষি ও শিল্প সহ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এবং সামরিক, শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, অবকাঠামো উন্নয়ন ইত্যাদি সহ অন্য সমস্ত ক্ষেত্রে যে নজিরবিহীন উন্নতির অধিকারী হয়েছে তা হযরত ইমাম খোমেইনী (র.) কর্তৃক ইরানি জাতিকে আত্মপরিচিতি ও আত্মবিশ্বাসে উৎসাহিতকরণের নিকট ঋণী।
হযরত ইমাম খোমেইনী (র.) সাংস্কৃতিক বিবর্তনে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি একদিকে যেমন অসুস্থ সংস্কৃতি, ঔপনিবেশিক সংস্কৃতি ও পরনির্ভরশীলতার সংস্কৃতি প্রত্যাখ্যান করেন, তেমনি সঠিক সংস্কৃতিকে ঐশী সংস্কৃতি হিসেবে গণ্য করেন এবং সাংস্কৃতিক বিবর্তনের ওপরে বিরাট গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি দেশের অভ্যন্তরে উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী ব্যবহার, সাংস্কৃতিক উন্নয়ন ও সাংস্কৃতিক চিন্তার ক্ষেত্রে আত্মবিশ্বাস সৃষ্টির লক্ষ্যে পরিকল্পনা প্রণয়নের ওপর বার বার জোর গুরুত্ব আরোপ করেন।
হযরত ইমাম খোমেইনী (র.) ভাষার ক্ষেত্রেও মাতৃভাষার হেফাযত এবং নিজেদের ভাষায় বিজাতীয় পশ্চিমা শব্দ ও পরিভাষা ব্যবহার পরিহার করার জন্য তাকীদ করতেন। তিনি দেশী ভাষাসমূহে বিজাতীয় পশ্চিমা শব্দ ও পরিভাষা ব্যবহার করাকে জাতিসমূহের সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার বরখেলাফ বলে গণ্য করতেন ঠিক যেভাবে আপনারা বাংলাদেশী জনগণ মাতৃভাষার হেফাযত ও মর্যাদার লক্ষ্যে অভ্যুত্থান করেছিলেন।
হযরত ইমাম খোমেইনী (র.) সাংস্কৃতিক উপাদানসমূহকে এবং সাধারণ শিক্ষা, উচ্চ শিক্ষা ও দ্বীনী শিক্ষার প্রতিষ্ঠানসমূহ সহ সমাজের সংস্কৃতি বিনির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানসমূহকে যে কোনো সমাজের সংশোধন ও সংস্কারের পথ ও মাধ্যম হিসেবে গণ্য করতেন।
হযরত ইমাম খোমেইনীর (র.) দৃষ্টিতে স্বাধীনতা, আত্মবিশ্বাস, আধিপত্য মেনে না নেয়া, সভ্যতা সৃষ্টিকারী বস্তুগত ও আত্মিক-মানসিক উন্নয়ন ও মানুষ হিসেবে মানুষের প্রতি সম্মানবোধ- এগুলো হচ্ছে সংস্কৃতির প্রধান ও অপরিহার্য উপাদান।
হযরত ইমামের (র.) চিন্তাধারার মৌলিক ও কেন্দ্রীয় বৈশিষ্ট্য ছিল তাঁর ঐশী সাংস্কৃতিক চিন্তা। তিনি সর্বাবস্থায় এদিকে দৃষ্টি রাখতেন যে, আল্লাহ্ তা‘আলা কী পছন্দ করেন এবং আল্লাহ্ তা‘আলার দ্বীনের দাবি কী। এছাড়া তিনি সমাজের দুর্বল ও বঞ্চিত মুস্তায্‘আফ্ শ্রেণির লোকদেরকে সহায়তা ও পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করাকে অপরিহার্য কর্তব্য বলে গভীরভাবে বিশ্বাস পোষণ করতেন এবং সব সময় এর ওপর গুরুত্ব আরোপ করতেন।
হযরত ইমাম খোমেইনীর (র.) ইন্তেকালের এ দুঃখজনক উপলক্ষ্যে আমরা বাংলাদেশ সহ বিশ্বের মসলিম ও মুস্তায্‘আফ্ জনগণের প্রতি, বিশেষ করে নিউজলেটারের পাঠক-পাঠিকাদের উদ্দেশে গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি এবং এ মহান ইমামের বিদেহী নাফ্সের কল্যাণের জন্য দো‘আ করছি; আমাদের এ প্রিয় নেতাকে জান্নাতের সমুন্নত ধামে স্থান দেয়ার জন্য মহান আল্লাহর দরবারে আকুল আবেদন জানাচ্ছি। সেই সাথে আমরা আল্লাহ্ তা‘আলার নিকট শুকরিয়া জানাচ্ছি যে, ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা হযরত ইমাম খোমেইনীর (র.) ইন্তেকালের পর ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান আল্লাহ্ তা‘আলার বিশেষ অনুগ্রহে হযরত ইমামের (র.) যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে বর্তমান মহান রাহ্বার হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ীর ন্যায় নেতৃত্ব লাভ করেছে- যিনি হযরত ইমামের (র.) প্রদর্শিত পথের ধারাবাহিকতাকে যথাযথভাবে অব্যাহত রাখতে সক্ষম হয়েছেন।
ড. সাইয়্যেদ হাসান সেহাত
কালচারাল কাউন্সেলর

সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান দূতাবাস

ঢাকা, বাংলাদেশ

স্মরণীয় বাণী

 

মহানবী (সা.) এরশাদ করেন : ‘কেউ যখন কল্যাণকর জ্ঞান অর্জনের উদ্দেশ্যে অথবা অন্যদেরকে তা শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে মসজিদে যাতায়াত করে তখন সে ‘উমরাহ্র ও পূর্ণ হজ্বের প্রতিদান লাভ করবে।’
হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) উত্তরাধিকারের আহ্কাম সম্বন্ধে এরশাদ করেন : ‘তোমরা মীরাছ সংক্রান্ত বিষয়াদি শিক্ষা করো এবং তা লোকদেরকে শিক্ষা দাও। কারণ, আমি এ দুনিয়া থেকে চলে যাব…. এবং ফিতনাসমূহ এমনভাবে ছড়িয়ে পড়বে যে, দুই ব্যক্তির মধ্যে মীরাছ সম্পর্কে মতপার্থক্য ঘটবে, কিন্তু তারা এমন কাউকে পাবে না যে তাদের মধ্যকার বিরোধের ফয়সালা করে দেবে।’
রাসূলে আকরাম (সা.) এরশাদ করেন : ‘প্রতিটি মুসলমানের জন্য জ্ঞানার্জন করা ফরয। অতএব, তোমরা এজন্য উপযুক্ত এমন ব্যক্তিদের কাছ থেকে তা শিক্ষা করো।’
তিনি আরো এরশাদ করেন : ‘যুল্ কারনাইনের ওয়াসীয়াত্সমূহের অন্যতম হচ্ছে এই : যে ব্যক্তি স্বীয় জ্ঞান থেকে কল্যাণ হাসিল্ করে নি তার কাছ থেকে জ্ঞানার্জন করো না। কারণ, যার জ্ঞান তার নিজেকে কল্যাণ দান করে নি তা তোমাকেও কল্যাণ দান করবে না।’
হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) এরশাদ করেন : ‘প্রত্যুষে জাগরণ বরকতময় এবং তা সকল নে‘আমত, বিশেষ করে রুযী নিয়ে আসে।’
আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.) এরশাদ করেন : ‘হে মু‘মিন! তোমার প্রাণের মূল্য হচ্ছে ‘ইল্ম্ ও আদবে। অতএব, তা আয়ত্ত করার জন্য চেষ্টা করো। সুতরাং তোমার ‘ইল্ম্ ও আদব যত বৃদ্ধি পাবে তোমার মূল্যও ততই বৃদ্ধি পাবে। কারণ, ‘ইল্মের মাধ্যমে তুমি তোমার রবের দিকে অগ্রসর হবার পথ এবং আদবের মাধ্যমে উত্তমভাবে রবের খেদমত আঞ্জাম দিতে পারবে। আর খেদমতে এই আদবের মাধ্যমেই মানুষ বেলায়াত্ ও আল্লাহ্র নৈকট্যের অধিকারী হয়ে থাকে। অতএব, আমার নসীহত্ গ্রহণ করো, তাহলে আযাব থেকে রেহাই পাবে।’
আমীরুল্ মু‘মিনীন্ হযরত আলী (আ.) এরশাদ করেন : ‘যুবক ও কিশোরদের জন্য শিক্ষণীয় সর্বোত্তম বিষয়গুলো হচ্ছে তা-ই বয়সকালে যা তাদের প্রয়োজন হবে।’
হযরত ইমাম বাকের (আ.) এরশাদ করেন : ‘আলসেমি দ্বীন ও দুনিয়া উভয়ের জন্যই ক্ষতিকর।’
হযরত ইমাম বাকের (আ.) এরশাদ করেন : ‘আত্মীয়-স্বজনের খোঁজখবর নেয়ার ফলে আমলসমূহ পবিত্র হয়, সম্পদ বৃদ্ধি পায়, বালা-মুছীবত দূর হয়, হিসাব সহজ হয় ও মৃত্যু পিছিয়ে যায়।’
হযরত ইমাম বাকের (আ.) আরো এরশাদ করেন : ‘চারটি কাজের জন্য দ্রুত শাস্তি দেয়া হয় : … এবং আত্মীয়-স্বজনের সাথে সম্পর্ক ছিন্নকরণ।’
হযরত ইমাম বাকের (আ.) এরশাদ করেন : হযরত মূসা বিন্ ‘ইমরান্ (আ.) তিনবার আল্লাহ্র কাছে আরয করেন : ‘হে আমার রব! আমাকে নসীহত করো।’ পরম প্রমুক্ত আল্লাহ্্ তা‘আলা প্রত্যেক বারই এরশাদ করেন : ‘আমি তোমাকে আমার ব্যাপারে নসীহত করছি।’ এরপর মূসা (আ.) আবার আরয করলেন : ‘হে আমার রব! আমাকে নসীহত করো।’ আল্লাহ্্ এরশাদ করেন : ‘তোমাকে তোমার মায়ের ব্যাপারে নসীহত করছি।’ এরপর মূসা (আ.) আবার আরয করলেন : ‘হে আমার রব! আমাকে নসীহত করো।’ আল্লাহ্্ এবারও এরশাদ করেন : ‘তোমাকে তোমার মায়ের ব্যাপারে নসীহত করছি।’ এরপর মূসা (আ.) আবার আরয করলেন : ‘হে আমার রব! আমাকে নসীহত করো। এবার আল্লাহ্্ এরশাদ করেন : ‘তোমাকে তোমার পিতার ব্যাপারে নসীহত করছি।’ ইমাম বাকের (আ.) বলেন : ‘এ কারণেই বলা হয় যে, কল্যাণের অধিকার দুই তৃতীয়াংশ মাতার ও এক তৃতীয়াংশ পিতার।’
ইমাম জাফর সাদিক (আ.) এরশাদ করেন : ‘অকর্মণ্য হয়ো না যাতে তোমাকে যারা চেনে তারা তোমাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য না করে।’
হযরত ইমাম জা‘ফর সাদেক (আ.) এরশাদ করেন : ‘রোগীর জন্য সাত দিনের বেশি পরহেয (চিকিৎসা না করানো) কল্যাণকর নয়।’
হযরত ইমাম রেযা (আ.) এরশাদ করেন : ‘যে ব্যক্তি তার পাকস্থলীকে কষ্ট দিতে চায় না সে যেন খাওয়ার মাঝখানে বা পর পরই পানি পান না করে, বরং যেন খাওয়ার কিছু পরে পানি পান করে। যে তা করে (খাওয়ার মাঝে বা পর পরই পানি পান করে) তার শরীরে ঠা-া ভাব তৈরি হয় এবং তার পাকস্থলী দুর্বল হয়ে যায় এবং তার রগসমূহ খাবার থেকে (ঠিকমতো) শক্তি সংগ্রহ করতে পারে না।’
হযরত ইমাম রেযা (আ.) এরশাদ করেন : ‘লোকেরা যখন প্রথম বারের মতো কোনো গুনাহ্্র কাজ করে যা সে অতীতে করে নি তখন আল্লাহ্্ তা‘আলা তাদেরকে নতুন ও অভূতপূর্ব সমস্যার কবলে নিক্ষেপ করেন।’
হযরত ইমাম রেযা (আ.) এরশাদ করেন : ‘ফুটানো পানি সবকিছুর জন্যই উপকারী এবং তাতে কোনোই ক্ষতি নিহিত নেই।’
(মাফাতীহুল্ হায়াত্ গ্রন্থ থেকে সংকলিত)
অনুবাদ : নূর হোসেন মজিদী

ইসলামে নারী অধিকারের স্বরূপ

শাহনাজ আরফিন –

নারী ও পুরুষকে নিজ নিজ কক্ষপথে পরিভ্রমণকারী দুটি গ্রহের সাথে তুলনা করা যায়। আর নারী-পুরষের সৌভাগ্য তথা মানব সমাজের পূর্ণতা ও কল্যাণ, নারী ও পুরুষের নিজ নিজ দায়িত্ব পালন বা নিজস্ব কক্ষপথে পরিভ্রমণের মধ্যেই নিহিত রয়েছে। 
ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে, পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হিসেবে নারীকে কালের পরিক্রমায় অনেক ঘাত-প্রতিঘাত, উত্থান-পতন ও নানা বাধা-বিঘ্ন সহ্য করতে হয়েছে। আর অধিকাংশ সমাজেই নারী হয়েছে নানা বঞ্চনা ও শোষণের শিকার। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, আজকের আধুনিক ও প্রগতিশীল সমাজেও নারীর অধিকার নানাভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে এবং নারীরা বিভিন্নভাবে শোষিত ও নির্যাতিত হচ্ছে। অবশ্য এটাও ঠিক যে, মানব সমাজে বিরাজমান নানা বিষয় নারী অধিকারের ওপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এর মধ্যে সামাজিক ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা এবং বিভিন্ন সমাজে বিরাজমান প্রথা-সংস্কৃতি ও বিশ্বাসের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়।
আজকের আধুনিক সমাজে নারী অধিকারের বিষয়টি ব্যাপকভাবে গুরুত্ব পাচ্ছে। আর এ কারণে নারী-অধিকার নিয়ে নানা মতাদর্শ ও দৃষ্টিভঙ্গিরও জন্ম হয়েছে। এদের মধ্যে অনেক মতাদর্শ আবার অপর মতাদর্শের পরিপন্থী। নারীবিষয়ক নানা মতাদর্শের মধ্যে ‘নারীবাদী’ বা ‘ফেমিনিস্ট আন্দোলন’ অন্যতম। নারীবাদ (Feminism) প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থাকে ভেঙ্গে দেয়ার জন্য একটি অস্বাভাবিক, কৃত্রিম ও উদ্দেশ্যমূলক আন্দোলনের ফসল। এর লক্ষ্য হলো সকল অদৃশ্য বিশ্বাস, নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিক মূল্যবোধকে অস্বীকার করা।
এ মতাদর্শে বিশ্বাসীরা নারী অধিকারের ব্যাপারে উগ্র দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে। তারা নারীকে পুরুষের গুণাবলি ও অধিকার অর্জনে উৎসাহিত করে এবং নারী-পুরুষের মধ্যে সমতা অর্জনের জন্য সমাজ কাঠামোয় পরিবর্তন বা বিপ্লব সাধনে বিশ্বাসী। আর এক্ষেত্রে তারা ধর্ম, সহজাত প্রকৃতি, প্রথা ও পরিবারের ভূমিকাকে গুরুত্বহীন বলে মনে করে। আর এভাবে নারীবাদীরা নারী ও পুরুষের বিশেষ প্রকৃতি, চাহিদা ও অধিকারকে অগ্রাহ্য করে তাদের মধ্যে এক ধরনের কৃত্রিম সমতা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে যাচ্ছে।
অতীতে যেমন পুরুষতন্ত্র ও নারীবিদ্বেষ, মানব সমাজ বিশেষ করে নারী জাতির ব্যাপক ক্ষতি সাধন করেছে, তেমনিভাবে নারী অধিকার নিয়ে নারীবাদীদের চরমপন্থা ও বাড়াবাড়ি নারী-পুরুষ তথা মানব সমাজের জন্যই অকল্যাণ বয়ে আনবে। ঐশী গ্রন্থ পবিত্র কোরআন নারী –পুরুষের অধিকার সম্পর্কে কোন ধরনের বাড়াবাড়িকে প্রশ্রয় দেয় না। পবিত্র কোরআনের মতে, নারী-পুরুষ ভিন্ন ভিন্ন সহজাত বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও মানবিকতার দিক দিয়ে উভয়েই সমান। ইসলামের আলোকে ‘নারী ও পুরুষের সাম্য’ কথাটি গোলাপ ও বেলীর গুণাগুণ সমান বলার মতোই একটি অযৌক্তিক কথা। কারণ, এ দুটি ফুলেরই রয়েছে পৃথক পৃথক ঘ্রাণ, বর্ণ, আকৃতি ও সৌন্দর্য।
তেমনিভাবে নারী-পুরুষও এক নয়। এদের প্রত্যেকেরই রয়েছে ভিন্ন গঠন প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য। মহিলারা যেমন হতে পারে না পুরুষের সমান, তেমনি পুরুষরাও হতে পারে না মহিলাদের সমান। তাই ইসলাম এদের উভয়কে একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দাঁড় না করিয়ে একে অপরের সহযোগী হিসেবে মূল্যায়ন করেছে। নিজস্ব গঠনপ্রকৃতি অনুযায়ী এদের প্রত্যেকের জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছে পৃথক পৃথক দায়িত্ব ও কর্তব্য। 
পুরুষের যেহেতু বহু গুরুত্বপূর্ণ ও কঠিন কাজ সম্পাদন করতে হয়; তাই তাকে কর্তৃত্ব ও নেতৃত্বের মতো কিছু সামাজিক প্রাধান্য ও সুবিধা ভোগের সুযোগ দেয়া হয়।
প্রথমত, তাকে অর্থনৈতিক গুরু দায়িত্ব বহন করতে হয়। কেননা, পরিবারের সার্বিক ব্যয় নির্বাহের দায়িত্ব পুরুষের। অপরদিকে স্ত্রী যদি ধনী হন, কিংবা তিনি যদি আর্থিকভাবে স্বাধীন হয়েও থাকেন, তবুও তার ভরণ পোষণের দায়িত্ব স্বামীর ওপর। আদর্শবাদী মুসলিম সমাজে নারীকে জীবিকার জন্য কোন দুঃশ্চিন্তা করতে হয় না। 
দ্বিতীয়ত, একজন মুসলিম নারী,স্বামী খুঁজে পাওয়া কিংবা না-পাওয়ার ভয়াবহ দুঃশ্চিন্তা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। নারীর স্বাভাবিক চারিত্রিক দাবি অনুযায়ী তার পিতা-মাতা বা অভিভাবকগণ তার জন্য কোন উপযুক্ত বর খুঁজে না আনা পর্যন্ত সে গৃহেই অবস্থান করে থাকে। এ ধরনের বিবাহই হচ্ছে প্রকৃত ধর্মসম্মত বিবাহ এবং এতেই পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন স্থায়িত্ব পায়।
তৃতীয়ত, প্রয়োজন ছাড়া মুসলিম মহিলারা রক্তাক্ত যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ থেকে মুক্ত। এটাকে অনেকের কাছে একটি বঞ্চনা বলে মনে হতে পারে। কিন্তু নারী প্রকৃতির আলোকে বিচার করলে দেখা যাবে যে, অধিকাংশ নারীর পক্ষেই এ ধরনের কাজে অংশগ্রহণ খুবই ভারী ও কঠিন বলে প্রমাণিত। এমনকি আধুনিক যে সকল সমাজে ‘সাম্যবাদী’ পদ্ধতিতে নারী ও পুরুষকে সমান করার প্রক্রিয়া চলছে সে সকল সমাজেও চরম কোন অবস্থা না দেখা দেয়া পর্যন্ত মহিলাদেরকে সামরিক বাহিনী বা যুদ্ধে অংশগ্রহণ থেকে দূরে রাখা হচ্ছে।
ইসলাম নারী ও পুরুষের প্রকৃতি অনুযায়ী তাদেরকে একে অপরের পরিপূরক হিসেবে সমাজে তাদের কর্ম ও অবস্থান নির্ধারণ করে দিয়েছে। ইসলাম পুরুষকে সামাজিক ও রাজনৈতিক আধিপত্য প্রদান করেছে এ জন্য যে, পুরুষদেরকে পরিবারের সকল দায়-দায়িত্ব বহন করতে হয়। এছাড়া তাদেরকেই পারিবারিক বিভিন্ন সংকট, আর্থিক, সামাজিক ও অন্য সকল চাপ থেকে পরিবারের সদস্যদেরকে রক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হয়।
পবিত্র কোরআনে সূরা ইয়াসীনের ৪০ নম্বর আয়াতে এসেছে :

لَا الشَّمْسُ يَنْبَغِي لَهَا أَنْ تُدْرِكَ الْقَمَرَ وَلَا اللَّيْلُ سَابِقُ النَّهَارِ وَكُلٌّ فِي فَلَكٍ يَسْبَحُونَ 

অর্থাৎ সূর্য চন্দ্রের নাগাল পায় না, রাত দিনকে অতিক্রম করে না এবং প্রত্যেকে নিজ নিজ কক্ষ পথে পরিভ্রমণ করে।
নারী-পুরুষও ভিন্ন ভিন্ন গ্রহের মতো এবং তাদের উচিত নিজ নিজ গতি পথে পরিভ্রমণ করা।
স্বাধীনতা এবং সাম্য তখনই ফলপ্রসূ হবে যখন তারা নিজস্ব গতি ও প্রকৃতির উপর অটল থাকবে। এর অন্যথায় সামাজিক স্থিতি ও শৃঙ্খলা বিনষ্ট হতে বাধ্য। ইসলামে নারী অধিকারের সমালোচকদের অনেকেই প্রশ্ন করেন, যদি ইসলাম ধর্মে নারীকে পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হতো তাহলে কি এ ধর্মে নারী-পুরুষের জন্য সম অধিকার নিশ্চিত করা হতো না?
এ প্রশ্ন বা সমালোচনার জবাব দিতে গেলে প্রথমেই বলতে হয়, মানবিক ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমতা বলতে কি তাদের অধিকারের সাদৃশ্য বোঝায়, না কি সমতা ও সাদৃশ্য দুটি ভিন্ন বিষয়?
ইরানের বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ ও গবেষক মুর্তাজা মোতাহহারী এ সম্পর্কে লিখেছেন, সমতা ও সাদৃশ্য দুটি ভিন্ন জিনিস। সমতা বলতে সাম্য বা সমান ভাগ বোঝায়। আর সাদৃশ্য হচ্ছে অনুরূপতা। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কোন পিতা তার সন্তানদের মধ্যে সহায় সম্পতি বণ্টনের ক্ষেত্রে সমতা বিধান করতে পারেন। তবে এক্ষেত্রে সাদৃশ্য নাও থাকতে পারে। যেমন ধরুন, পিতা কোন সন্তানকে তাঁর কৃষি জমি দিলেন, কাউকে দিলেন তাঁর বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান আবার কাউকে দিলেন তাঁর দোকান-পাট দেখাশোনার দায়িত্ব। এ ক্ষেত্রে পিতা তাঁর সন্তানদের ক্ষমতা ও যোগ্যতার প্রতি লক্ষ্য রেখে সমভাবেই এ বণ্টনের কাজটি সমাধা করতে চেয়েছেন, কাউকে কারো ওপর প্রাধান্য দেয়া বা বৈষম্য করতে চাননি।
পবিত্র কোরআনে নারীকে কোমলতা, প্রশান্তি ও দয়ার প্রতীক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। পবিত্র কোরআনে সূরা আরাফের ১৮৯ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন,

هُوَ الَّذِي خَلَقَكُم مِّن نَّفْسٍ وَاحِدَةٍ وَجَعَلَ مِنْهَا زَوْجَهَا لِيَسْكُنَ إِلَيْهَا

‘তিনিই তোমাদের এক ব্যক্তি হতে সৃষ্টি করেছেন এবং তা থেকে তার সঙ্গিনী সৃষ্টি করেন যাতে সে তার নিকট শান্তি পায়।’
ইসলাম-পূর্ব যুগে যখন নারীরা ছিল চরম অবহেলা ও বঞ্চনার স্বীকার, কন্যাসন্তানকে জীবন্ত কবর দেয়া হতো এবং নারীর কোন মূল্যায়নই করা হতো না, তখন ইসলাম দিয়েছে নারীর মুক্তি ও নিরাপত্তা। কন্যাসন্তানের জন্মকে বলা হলো ‘সুসংবাদ’।
কোরআন মজীদের সূরা আন নাহলের ( ৫৮-৫৯) নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন :
“তাদের কাউকে যখন কন্যাসন্তানের ‘সুসংবাদ’ দেয়া হয় তখন তার চেহারা মলিন হয়ে যায় এবং সে অসহনীয় মনস্তাপে ক্লিষ্ট হয়। সে এ সুসংবাদকে খারাপ মনে করে নিজ সম্প্রদায় থেকে লুকিয়ে বেড়ায় (এবং চিন্তা করে) হীনতা স্বীকার করে তাকে নিজের কাছে রেখে দেবে, নাকি মাটিতে পুঁতে ফেলবে। কত নিকৃষ্ট ছিল তাদের সিদ্ধান্ত।”
মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে সূরা নিসা নামে পূর্ণাঙ্গ একটি সূরা নাযিল করেছেন কেবল নারীর যাবতীয় স্বাধীনতা ও অধিকারের বার্তা নিয়ে। পবিত্র কোরআনে সূরা বাকারার ২২৮ নম্বর আয়াতে নারী অধিকারের কথা উল্লেখ করে মহান আল্লাহ ঘোষণা করেছেন : ‘নারীদের (পুরুষদের উপর) তেমনি ন্যায়সঙ্গত অধিকার রয়েছে যেমনি রয়েছে নারীদের উপর পুরুষদের।’
এ আয়াতে যেমন সুস্পষ্টভাবে নারীদের অধিকারের কথা বলা হয়েছে, অন্য কোনো ধর্মে এভাবে নারীর অধিকারের কথা বলা হয়নি। 
এছাড়া হাদীসে এসেছে : ‘নারীকে সযত্নে লালন পালনকারী পিতামাতার অবস্থান হবে জান্নাতে।’
বিশ্বনবী (সা.) বিশ্ব মানবতার অনন্য আদর্শ হিসেবে নারীর মর্যাদা ও সম্মান রক্ষায় কোন ধরনের কার্পণ্য করেননি। তিনি নিজ কন্যা ফাতেমা যাহরা (সা. আ.)-এর হাতে চুমু খেতেন, তাঁর সম্মানে নিজ জায়গা ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেন।
নবীজির বিখ্যাত একটি উক্তি হচ্ছে এরকম : ‘তোমাদের মধ্যে সেই পুরুষ সবচেয়ে ভালো যে তার স্ত্রীর কাছে ভালো।’
পরিশেষে বলা যায়, ইসলাম নারীজাতীকে যে সম্মান, মর্যাদা ও অধিকার দিয়েছে অন্য কোন ধর্মে তা দেয়া হয়নি। বিশ্বের নারী সমাজ যত বেশি চিন্তা ও গবেষণা করবেন তত দ্রুত তাঁরা এ সত্যকে অনুধাবন করতে পারবেন বলে আমার বিশ্বাস।

শাহনাজ আরফিন : লেখক ও গবেষক

ইসলামে নারী অধিকারের স্বরূপ

শাহনাজ আরফিন –

নারী ও পুরুষকে নিজ নিজ কক্ষপথে পরিভ্রমণকারী দুটি গ্রহের সাথে তুলনা করা যায়। আর নারী-–পুরষের সৌভাগ্য তথা মানব সমাজের পূর্ণতা ও কল্যাণ, নারী ও পুরুষের নিজ নিজ দায়িত্ব পালন বা নিজস্ব কক্ষপথে পরিভ্রমণের মধ্যেই নিহিত রয়েছে।
ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে, পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হিসেবে নারীকে কালের পরিক্রমায় অনেক ঘাত-প্রতিঘাত, উত্থান-পতন ও নানা বাধা-বিঘœ সহ্য করতে হয়েছে। আর অধিকাংশ সমাজেই নারী হয়েছে নানা বঞ্চনা ও শোষণের শিকার। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, আজকের আধুনিক ও প্রগতিশীল সমাজেও নারীর অধিকার নানাভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে এবং নারীরা বিভিন্নভাবে শোষিত ও নির্যাতিত হচ্ছে। অবশ্য এটাও ঠিক যে, মানব সমাজে বিরাজমান নানা বিষয় নারী অধিকারের ওপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এর মধ্যে সামাজিক ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা এবং বিভিন্ন সমাজে বিরাজমান প্রথা-সংস্কৃতি ও বিশ্বাসের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়।
আজকের আধুনিক সমাজে নারী অধিকারের বিষয়টি ব্যাপকভাবে গুরুত্ব পাচ্ছে। আর এ কারণে নারী-অধিকার নিয়ে নানা মতাদর্শ ও দৃষ্টিভঙ্গিরও জন্ম হয়েছে। এদের মধ্যে অনেক মতাদর্শ আবার অপর মতাদর্শের পরিপন্থী। নারীবিষয়ক নানা মতাদর্শের মধ্যে ‘নারীবাদী’ বা ‘ফেমিনিস্ট আন্দোলন’ অন্যতম। নারীবাদ (ঋবসরহরংস) প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থাকে ভেঙ্গে দেয়ার জন্য একটি অস্বাভাবিক, কৃত্রিম ও উদ্দেশ্যমূলক আন্দোলনের ফসল। এর লক্ষ্য হলো সকল অদৃশ্য বিশ্বাস, নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিক মূল্যবোধকে অস্বীকার করা।
এ মতাদর্শে বিশ্বাসীরা নারী অধিকারের ব্যাপারে উগ্র দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে। তারা নারীকে পুরুষের গুণাবলি ও অধিকার অর্জনে উৎসাহিত করে এবং নারী-পুরুষের মধ্যে সমতা অর্জনের জন্য সমাজ কাঠামোয় পরিবর্তন বা বিপ্লব সাধনে বিশ্বাসী। আর এক্ষেত্রে তারা ধর্ম, সহজাত প্রকৃতি, প্রথা ও পরিবারের ভূমিকাকে গুরুত্বহীন বলে মনে করে। আর এভাবে নারীবাদীরা নারী ও পুরুষের বিশেষ প্রকৃতি, চাহিদা ও অধিকারকে অগ্রাহ্য করে তাদের মধ্যে এক ধরনের কৃত্রিম সমতা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা
করে যাচ্ছে।
অতীতে যেমন পুরুষতন্ত্র ও নারীবিদ্বেষ, মানব সমাজ বিশেষ করে নারী জাতির ব্যাপক ক্ষতি সাধন করেছে, তেমনিভাবে নারী অধিকার নিয়ে নারীবাদীদের চরমপন্থা ও বাড়াবাড়ি নারী-পুরুষ তথা মানব সমাজের জন্যই অকল্যাণ বয়ে আনবে। ঐশী গ্রন্থ পবিত্র কোরআন নারী –পুরুষের অধিকার সম্পর্কে কোন ধরনের বাড়াবাড়িকে প্রশ্রয় দেয় না। পবিত্র কোরআনের মতে, নারী-পুরুষ ভিন্ন ভিন্ন সহজাত বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও মানবিকতার দিক দিয়ে উভয়েই সমান। ইসলামের আলোকে ‘নারী ও পুরুষের সাম্য’ কথাটি গোলাপ ও বেলীর গুণাগুণ সমান বলার মতোই একটি অযৌক্তিক কথা। কারণ, এ দুটি ফুলেরই রয়েছে পৃথক পৃথক ঘ্রাণ, বর্ণ, আকৃতি ও সৌন্দর্য।
তেমনিভাবে নারী-পুরুষও এক নয়। এদের প্রত্যেকেরই রয়েছে ভিন্ন গঠন প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য। মহিলারা যেমন হতে পারে না পুরুষের সমান, তেমনি পুরুষরাও হতে পারে না মহিলাদের সমান। তাই ইসলাম এদের উভয়কে একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দাঁড় না করিয়ে একে অপরের সহযোগী হিসেবে মূল্যায়ন করেছে। নিজস্ব গঠনপ্রকৃতি অনুযায়ী এদের প্রত্যেকের জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছে পৃথক পৃথক দায়িত্ব ও কর্তব্য।
পুরুষের যেহেতু বহু গুরুত্বপূর্ণ ও কঠিন কাজ স¤পাদন করতে হয়; তাই তাকে কর্তৃত্ব ও নেতৃত্বের মতো কিছু সামাজিক প্রাধান্য ও সুবিধা ভোগের সুযোগ দেয়া হয়।
প্রথমত, তাকে অর্থনৈতিক গুরু দায়িত্ব বহন করতে হয়। কেননা, পরিবারের সার্বিক ব্যয় নির্বাহের দায়িত্ব পুরুষের। অপরদিকে স্ত্রী যদি ধনী হন, কিংবা তিনি যদি আর্থিকভাবে স্বাধীন হয়েও থাকেন, তবুও তার ভরণ পোষণের দায়িত্ব স্বামীর ওপর। আদর্শবাদী মুসলিম সমাজে নারীকে জীবিকার জন্য কোন দুঃশ্চিন্তা করতে হয় না।
দ্বিতীয়ত, একজন মুসলিম নারী,স্বামী খুঁজে পাওয়া কিংবা না-পাওয়ার ভয়াবহ দুঃশ্চিন্তা থেকে স¤পূর্ণ মুক্ত। নারীর স্বাভাবিক চারিত্রিক দাবি অনুযায়ী তার পিতা-মাতা বা অভিভাবকগণ তার জন্য কোন উপযুক্ত বর খুঁজে না আনা পর্যন্ত সে গৃহেই অবস্থান করে থাকে। এ ধরনের বিবাহই হচ্ছে প্রকৃত ধর্মসম্মত বিবাহ এবং এতেই পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন স্থায়িত্ব পায়।
তৃতীয়ত, প্রয়োজন ছাড়া মুসলিম মহিলারা রক্তাক্ত যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ থেকে মুক্ত। এটাকে অনেকের কাছে একটি বঞ্চনা বলে মনে হতে পারে। কিন্তু নারী প্রকৃতির আলোকে বিচার করলে দেখা যাবে যে, অধিকাংশ নারীর পক্ষেই এ ধরনের কাজে অংশগ্রহণ খুবই ভারী ও কঠিন বলে প্রমাণিত। এমনকি আধুনিক যে সকল সমাজে ‘সাম্যবাদী’ পদ্ধতিতে নারী ও পুরুষকে সমান করার প্রক্রিয়া চলছে সে সকল সমাজেও চরম কোন অবস্থা না দেখা দেয়া পর্যন্ত মহিলাদেরকে সামরিক বাহিনী বা যুদ্ধে
অংশগ্রহণ থেকে দূরে রাখা হচ্ছে।
ইসলাম নারী ও পুরুষের প্রকৃতি অনুযায়ী তাদেরকে একে অপরের পরিপূরক হিসেবে সমাজে তাদের কর্ম ও অবস্থান নির্ধারণ করে দিয়েছে। ইসলাম পুরুষকে সামাজিক ও রাজনৈতিক আধিপত্য প্রদান করেছে এ জন্য যে, পুরুষদেরকে পরিবারের সকল দায়-দায়িত্ব বহন করতে হয়। এছাড়া তাদেরকেই পারিবারিক বিভিন্ন সংকট, আর্থিক, সামাজিক ও অন্য সকল চাপ থেকে পরিবারের সদস্যদেরকে রক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হয়।
পবিত্র কোরআনে সূরা ইয়াসীনের ৪০ নম্বর আয়াতে এসেছে :
          ক্স      
অর্থাৎ সূর্য চন্দ্রের নাগাল পায় না, রাত দিনকে অতিক্রম করে না এবং প্রত্যেকে নিজ নিজ কক্ষ পথে পরিভ্রমণ করে।
নারী-পুরুষও ভিন্ন ভিন্ন গ্রহের মতো এবং তাদের উচিত নিজ নিজ গতি পথে পরিভ্রমণ করা।
স্বাধীনতা এবং সাম্য তখনই ফলপ্রসূ হবে যখন তারা নিজস্ব গতি ও প্রকৃতির উপর অটল থাকবে। এর অন্যথায় সামাজিক স্থিতি ও শৃঙ্খলা বিনষ্ট হতে বাধ্য। ইসলামে নারী অধিকারের সমালোচকদের অনেকেই প্রশ্ন করেন, যদি ইসলাম ধর্মে নারীকে পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হতো তাহলে কি এ ধর্মে নারী-পুরুষের জন্য সম অধিকার নিশ্চিত করা হতো না?
এ প্রশ্ন বা সমালোচনার জবাব দিতে গেলে প্রথমেই বলতে হয়, মানবিক ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমতা বলতে কি তাদের অধিকারের সাদৃশ্য বোঝায়, না কি সমতা ও সাদৃশ্য দুটি ভিন্ন বিষয়?
ইরানের বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ ও গবেষক মুর্তাজা মোতাহহারী এ সম্পর্কে লিখেছেন, সমতা ও সাদৃশ্য দুটি ভিন্ন জিনিস। সমতা বলতে সাম্য বা সমান ভাগ বোঝায়। আর সাদৃশ্য হচ্ছে অনুরূপতা। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কোন পিতা তার সন্তানদের মধ্যে সহায় সম্পতি বণ্টনের ক্ষেত্রে সমতা বিধান করতে পারেন। তবে এক্ষেত্রে সাদৃশ্য নাও থাকতে পারে। যেমন ধরুন, পিতা কোন সন্তানকে তাঁর কৃষি জমি দিলেন, কাউকে দিলেন তাঁর বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান আবার কাউকে দিলেন তাঁর দোকান-পাট দেখাশোনার দায়িত্ব। এ ক্ষেত্রে পিতা তাঁর সন্তানদের ক্ষমতা ও যোগ্যতার প্রতি লক্ষ্য রেখে সমভাবেই এ বণ্টনের কাজটি সমাধা করতে চেয়েছেন, কাউকে কারো ওপর প্রাধান্য দেয়া বা বৈষম্য করতে চাননি।
পবিত্র কোরআনে নারীকে কোমলতা, প্রশান্তি ও দয়ার প্রতীক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। পবিত্র কোরআনে সূরা আরাফের ১৮৯ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন,
            
‘তিনিই তোমাদের এক ব্যক্তি হতে সৃষ্টি করেছেন এবং তা থেকে তার সঙ্গিনী সৃষ্টি করেন যাতে সে তার নিকট শান্তি পায়।’
ইসলাম-পূর্ব যুগে যখন নারীরা ছিল চরম অবহেলা ও বঞ্চনার স্বীকার, কন্যাসন্তানকে জীবন্ত কবর দেয়া হতো এবং নারীর কোন মূল্যায়নই করা হতো না, তখন ইসলাম দিয়েছে নারীর মুক্তি ও নিরাপত্তা। কন্যাসন্তানের জন্মকে বলা হলো ‘সুসংবাদ’।
কোরআন মজীদের সূরা আন নাহলের ( ৫৮-৫৯) নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন :
“তাদের কাউকে যখন কন্যাসন্তানের ‘সুসংবাদ’ দেয়া হয় তখন তার চেহারা মলিন হয়ে যায় এবং সে অসহনীয় মনস্তাপে ক্লিষ্ট হয়। সে এ সুসংবাদকে খারাপ মনে করে নিজ সম্প্রদায় থেকে লুকিয়ে বেড়ায় (এবং চিন্তা করে) হীনতা স্বীকার করে তাকে নিজের কাছে রেখে দেবে, নাকি মাটিতে পুঁতে ফেলবে। কত নিকৃষ্ট ছিল তাদের সিদ্ধান্ত।”
মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে সূরা নিসা নামে পূর্ণাঙ্গ একটি সূরা নাযিল করেছেন কেবল নারীর যাবতীয় স্বাধীনতা ও অধিকারের বার্তা নিয়ে। পবিত্র কোরআনে সূরা বাকারার ২২৮ নম্বর আয়াতে নারী অধিকারের কথা উল্লেখ করে মহান আল্লাহ ঘোষণা করেছেন : ‘নারীদের (পুরুষদের উপর) তেমনি ন্যায়সঙ্গত অধিকার রয়েছে যেমনি রয়েছে নারীদের উপর পুরুষদের।’
এ আয়াতে যেমন সুস্পষ্টভাবে নারীদের অধিকারের কথা বলা হয়েছে, অন্য কোনো ধর্মে এভাবে নারীর অধিকারের কথা বলা হয়নি।
এছাড়া হাদীসে এসেছে : ‘নারীকে সযতেœ লালনপালনকারী পিতামাতার অবস্থান হবে জান্নাতে।’
বিশ্বনবী (সা.) বিশ্ব মানবতার অনন্য আদর্শ হিসেবে নারীর মর্যাদা ও সম্মান রক্ষায় কোন ধরনের কার্পণ্য করেননি। তিনি নিজ কন্যা ফাতেমা যাহরা (সা. আ.)-এর হাতে চুমু খেতেন, তাঁর সম্মানে নিজ জায়গা ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেন।
নবীজির বিখ্যাত একটি উক্তি হচ্ছে এরকম : ‘তোমাদের মধ্যে সেই পুরুষ সবচেয়ে ভালো যে তার স্ত্রীর কাছে ভালো।’
পরিশেষে বলা যায়, ইসলাম নারীজাতীকে যে সম্মান, মর্যাদা ও অধিকার দিয়েছে অন্য কোন ধর্মে তা দেয়া হয়নি। বিশ্বের নারী সমাজ যত বেশি চিন্তা ও গবেষণা করবেন তত দ্রুত তাঁরা এ সত্যকে অনুধাবন করতে পারবেন বলে আমার বিশ্বাস।
লেখক ও গবেষক

স্মরণীয় দিবস

 

১ অক্টোবর : বাংলাদেশের প্রখ্যাত ইসলামি চিন্তাবিদ ও বহু গ্রন্থ প্রণেতা মাওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম (রহ.)-এর মৃত্যুবার্ষিকী।
৫ অক্টোবর : হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ.) ইরাক থেকে ফ্রান্সে হিজরত করেন (১৯৭৮)।
৮ অক্টোবর : ইমাম হোসাইন (আ.)-এর শাহাদাতের চল্লিশতম দিবস (আরবাইন)।
১২ অক্টোবর : বিশ্ববিখ্যাত কবি হাফিজ স্মরণে দিবস।
১৫ অক্টোবর : বিশ্ব সাদাছড়ি দিবস (অন্ধদের কল্যাণে)।
১৬ অক্টোবর : সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর ওফাত দিবস।
*আহলে বাইতের ধারার দ্বিতীয় ইমাম ও বেহেশতের যুবকদের নেতৃদ্বয়ের প্রথম ব্যক্তিত্ব ইমাম হাসান (আ.)-এর শাহাদাত বার্ষিকী।
১৭ অক্টোবর : আহলে বাইতের ধারার অস্টম ইমাম আলী ইবনে মূসা আর-রেযা (আ.)-এর শাহাদাত বার্ষিকী।
*বাংলাদেশের মরমি বাউল সংগীতের জনক লালন শাহের মৃত্যুবার্ষিকী।
১৯ অক্টোবর : বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি ফররুখ আহমদের মৃত্যুবার্ষিকী।
২৪ অক্টোবর : উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেম, সাহিত্যিক, সাংবাদিক মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর মৃত্যুবার্ষিকী।
২৬ অক্টোবর : ইমাম হাসান আল-আসকারী (আ.)-এর শাহাদাত দিবস।
*অবিভক্ত বাংলার নেতা প্রজাতিহৈষী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের জন্মবার্ষিকী।
২৯ অক্টোবর : কবি বেনজীর আহমদের জন্মবার্ষিকী। *কবি তালিম হোসেনের জন্মবার্ষিকী।
*কিশোর (১৩ বছর) মুহাম্মাদ হুসাইন ফাহমিদেহ এর শাহাদাত দিবস। ইরানে এটি কিশোর স্বেচ্ছাসেবী দিবস হিসেবে পালিত হয়।
৩০ অক্টোবর : মহানবী (সা.)-এর পবিত্র জন্মদিবস (আহলে সুন্নাতের রেওয়ায়েত অনুযায়ী) ও ইসলামি ঐক্য সপ্তাহের শুরু (১২-১৭ রবিউল আউয়াল)।
৪ নভেম্বর : মহানবী (সা.)-এর পবিত্র জন্মদিবস (আহলে বাইতের ধারায় বর্ণনা অনুযায়ী) ও আহলে বাইতের ষষ্ঠ ইমাম জাফর সাদেক (আ.)-এর জন্মদিবস।
৬ নভেম্বর : বাংলাদেশের বিশিষ্ট কথা সাহিত্যিক শাহেদ আলীর মৃত্যুবার্ষিকী।
১১ নভেম্বর : ইতিহাসখ্যাত সাহিত্যিক ‘বিষাদ সিন্ধু’র রচয়িতা মীর মশাররফ হোসেনের জন্মদিবস।
১৪ নভেম্বর : বিশ্ব ডায়াবেটিক রোগীদের সহায়তা দিবস।
১৫ নভেম্বর : বিশ্ব পুস্তক ও পুস্তক পাঠ দিবস, বিশ্ব গণমাধ্যম দিবস।
১৭ নভেম্বর : বাংলাদেশের মযলুম জননেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মৃত্যুবার্ষিকী।
১৯ নভেম্বর : অবিভক্ত ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অমর শহীদ মীর নিসার আলী তিতুমীরের শাহাদাত বার্ষিকী।
* আন্তর্জাতিক পরিবার দিবস।
২০ নভেম্বর : বাংলাদেশের প্রখ্যাত মহিলা কবি সুফিয়া কামালের মৃত্যুবার্ষিকী।
২৩ নভেম্বর : ইমাম হাসান আসকারী (আ.)-এর জন্মদিবস।
৩০ নভেম্বর : শেখ মুফিদ (র.) স্মরণে দিবস।
১ ডিসেম্বর : বিশ্ব এইড্্স প্রতিরোধ দিবস।
২ ডিসেম্বর : শিল্পী কামরুল হাসানের জন্মদিন।
৩ ডিসেম্বর : বাংলাদেশের কচিকাঁচার আসরের প্রতিষ্ঠাতা রোকনুজ্জামান খান দাদা ভাইয়ের মৃত্যুবার্ষিকী।
*বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস।
৫ ডিসেম্বর : অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকী।
১৬ ডিসেম্বর : বাংলাদেশের মহান বিজয় দিবস। দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধের পর এই দিনে বাংলাদেশ বিজয় লাভ করে।
* বিশ্ব গবেষণা দিবস।
১৮ ডিসেম্বর : ড. মুহাম্মাদ মুফাত্তেহর শাহাদাত দিবস। এ দিবসটি ইরানে ‘ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (হাওযা) ও বিশ্ববিদ্যালয় এর মধ্যে ঐক্য দিবস’ হিসাবে পালিত হয়।
২১ ডিসেম্বর : ইরানে বছরের সবচেয়ে দীর্ঘতম রাত (শাবে ইয়ালদা)
২৫ ডিসেম্বর : হযরত ঈসা (আ.)-এর পবিত্র জন্মদিবস।
২৭ ডিসেম্বর : প্রলয়ংকরী সুনামীর বার্ষিকী। এ দিনে ভয়াবহ সুনামীতে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ভারত, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপসহ এ অঞ্চলের দেশগুলোর কয়েক লাখ লোক মৃত্যুবরণ করে।

যঃঃঢ়ং://িি.িরংষধসরপরঃু.ড়ৎম/৬৪২৮/ঃযব-শরহফহবংং-ড়ভ-ঢ়ৎড়ঢ়যবঃ-সঁযধসসধফ-ং/