All posts by dreamboy

নওরোযের উৎপত্তির ইতিহাস

nowrojতিন হাজার বছর পূর্বে আযারবাইজানের শাসক তাহমুরসের ভাই জামশীদ্ নিজ জাতির জন্য একটি ঈদ বা আনন্দের দিন নির্ধারণ করতে চাইলেন। সূর্য নতুন বর্ষে প্রবেশ করার সময় তিনি এক বিরাট মিলনায়তনে মণি-মুক্তাখচিত সিংহাসনে আসন গ্রহণ করলেন। রং-বেরংয়ের হীরা-জহরতে অলংকৃত তাজ মাথায় ধারণ করলেন এবং সাধারণ জনগণকে সাক্ষাৎ প্রদান করলেন।

সূর্য যখন মাথার উপরে এল তখন এর কিরণ নানা ধরনের মণি-মুক্তার ওপর পতিত হলে ঝলমল করছিল আর উপস্থিত সকলের চোখে বিস্ময়ের ছোঁয়া দিয়ে যাচ্ছিল। কারণ, এর আগে তারা এমন জাঁকজমক আর দেখে নি। তাই তারা ঐ দিনটিকে ‘নতুন দিন’ (রুযে নোও) বলে আখ্যায়িত করে পরস্পর পরস্পরকে অভিনন্দন জানালো। ‘জামশীদকে ঐ দিন পর্যন্ত ‘জাম্’ বলা হত। ঐ দিন তার নামের সাথে ‘শীদ্’ (অর্থাৎ সূর্যকিরণ) সংযুক্ত হল।

জামশীদ্ জনগণকে সুদপদেশ দিলেন এবং তাদেরকে উত্তম অনুষ্ঠানাদি পালনের জন্য আহবান জানালেন ও ঐ দিনকে জাতীয় উৎসবের দিন হিসাবে নির্ধারণ করে দিলেন।

আভেস্তা-য় নওরোয

‘জাম্‌’ (উৎসব) কথাটির উৎপত্তি ‘ইয়াসনে’ অথবা ‘ইয়াসনা’ শব্দ থেকে, যার অর্থ ইবাদত, দোয়া ও আনন্দ। কারণ, নওরোযের অনুষ্ঠানে আনন্দসহকারে ইবাদত করা হয়।

যরথুস্ত্রীদের ধর্মগ্রন্থ ‘আভেস্তা’য় বলা হয়েছে যে, আহুরমায্দা বিশ্ব ও সৃষ্টিকুলকে কালের ছয় পর্যায়ে সৃষ্টি করেছেন :

১. বছরের পঁয়তাল্লিশতম দিনে (১৫ই ওর্দিবেহেশ্ত্) আকাশ সৃষ্টি করা হয়; এটাই সৃষ্টির শুরু।

২. বছরের একশ পঞ্চাশতম দিনে (১৫ই তীর্) পানি সৃষ্টি করা হয়।

৩. বছরের একশ আশিতম দিনে (৩০শে শাহরীভার্) ভূমি সৃষ্টি করা হয়।

৪. বছরের দুইশ দশম দিনে (৩০শে মেহ্‌র) বৃক্ষ-লতা সৃষ্টি করা হয়।

৫. বছরের দুইশ নববইতম দিনে (২০শে দেই) প্রাণিকুল সৃষ্টি করা হয়।

৬. বছরের তিনশ পঁয়ষট্টিতম দিনে (১লা ফারভারদিন্; নতুন বছরের শুরু) মানুষ সৃষ্টি করা হয় ও বিশ্বসৃষ্টির সমাপ্তি ঘটে।

আসমানী কিতাব তাওরাত ও কুরআনেও ছয় ধাপে বিশ্বসৃষ্টির কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর দৃষ্টিতে বসন্ত

মহানবী (সা.) বলেছেন : ‘বসন্তের মৃদু সুবাতাসকে গনিমত মনে করো। কারণ, যেরূপে তা বৃক্ষরাজিকে দোলা দেয়, ঠিক সেরূপ তা তোমাদেরকেও ছুঁয়ে যায়।’

দার্শনিক ওমর খৈয়াম, আবু রায়হান আল-বিরুনী, তাবারী ও ফেরদৌসীও নওরোয সম্পর্কে আলোচনা করেছেন।

ইসলামে নওরোয

ইসলাম সমস্ত গোত্রীয় রং ও রীতিকে মুছে ও পাল্টে দিলেও নওরোযকে করেছে আরও বেশি উদ্ভাসিত। ইসলামী যুগ এতে নতুন অধ্যায় যোগ করে, একে বিস্মৃতিতে হারিয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করে যে নওরোয ইরানী জাতির প্রাণে বেঁচে ছিল তা ধর্মীয় ‘আত্মা’ লাভ করে। জাতীয় ও গোত্রীয় রীতি, ধর্মীয় বিশ্বাস ও জনগণের অন্তরে জাগ্রত শক্তিশালী নবপ্রেমের সাথে মিশে গিয়ে দৃঢ় ও পবিত্র হয় এবং বিশেষ দোয়ার সাথে নিষ্ঠা ও ঈমানে পরিপূর্ণ হয়ে যায়।

নওরোয ছিল যরথুস্ত্রীদের ধর্মীয় সঙ্গীত ও ‘আভেস্তা’র বাণীগুলোর সাথে সংমিশ্রিত; ইসলামের আগমনের সাথে সাথে তা নতুন জীবন লাভ করল।

ইমাম সাদেকের দৃষ্টিতে নওরোয

ইমাম সাদেক (আ.) মু’আল্লা বিন খুনাইসকে বলেন : ‘হে মু‘আল্লা! নওরোয এমন এক দিবস যেদিন মহান আল্লাহ্ তাঁর বান্দাদের নিকট থেকে প্রতিশ্রুতি নিয়েছেন যে, তারা তাঁর উপাসনা করবে, তাঁর সাথে শরীক করবে না এবং ধর্মের ধারক ও বাহকদের সাথী হবে। এটি এমন এক দিবস যেদিন নূহের তরী পাহাড়ের ওপর এসে স্থির হয়।’

‘এদিন সূর্য কিরণ ছড়িয়ে দেয়, বাতাস প্রবাহিত হয় এবং ভূ-পৃষ্ঠ বিকশিত হয়।’

‘এটি এমন এক দিবস যেদিন মহানবী (সা.) হযরত আলী (আ.)-কে কাঁধে তুলে নেন যাতে তিনি কাবার মূর্তিগুলো ভাঙতে পারেন। এদিন মহানবী নিজের সাহাবীদেরকে হযরত আলীর হাতে বাই‘আত হলে বলেন (গাদীর দিবসে)। এদিন লোকেরা হযরত আলীকে খলিফা নির্বাচন করেছিল।’

‘এটি এমন এক দিবস যেদিন মুহাম্মাদ (সা.)-এর বংশের কায়েম ইমাম মাহ্দী (আল্লাহ্ তাঁর আত্মপ্রকাশ ত্বরান্বিত করুন) আত্মপ্রকাশ করবেন এবং দাজ্জালের বিরুদ্ধে জয়ী হবেন ও তাকে হত্যা করবেন। এ দিন মুসলমানদের মুক্তি ও নিশ্চিন্ততার দিন।’

প্রকৃতির নবায়নের দিন

নওরোয এক মহান স্মৃতির স্মরণ, প্রকৃতির সাথে মানুষের আত্মীয়তার স্মৃতিচারণ। মানুষ নামক প্রকৃতির আত্মভোলা সন্তানেরা নিজ নিজ কাজে ডুবে থাকে আর প্রকৃতি-মাতাকে ভুলে যায়। মধুময় বসন্তের আগমনে তারা মাতৃক্রোড়ে ফিরে আসে এবং তাদের ফিরে আসা ও পুনর্মিলন উপলক্ষে উৎসবে মেতে ওঠে।

সন্তান নিজ মায়ের আঁচলে পুনরায় স্থান পায়। মা তার সন্তানদের কাছে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয় আর আনন্দাশ্রু (বৃষ্টি) বর্ষণ করে, যৌবন ফিরে পায় আর নবজীবন লাভ করে, নব কিশলয়ের আগমনে ঘটে, বৃক্ষে সবুজের ছোঁয়া লাগে। তারা প্রিয়জনের সাক্ষাতে দৃষ্টিমান ও জাগ্রত হয়। দিন হয় নির্মল, আকাশ হয় মেঘমুক্ত।

অনুবাদ: মাঈন উদ্দিন

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম

শামীমা আফরোজ
বাংলা সাহিত্য জগতে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। এঁরা দু’জনেই বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে শুধু উন্নত ও সমৃদ্ধই করেননি, বিশ্ব দরবারে পরিচিত ও প্রতিষ্ঠিতও করেছেন। দু’জনেই যে যার ক্ষেত্রে প্রজ্জ্বলমান নক্ষত্রসম। এদের একজনকে ছাড়া অন্যজনকে ভাবা যায় না, এরা উভয়ে বাংলা সাহিত্যের একই বৃন্তে দু’টি ফুল। বয়সের বেশ পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও পরস্পরের মাঝে আন্তরিকতা, শ্রদ্ধা, স্নেহ-ভালোবাসার কমতি ছিল না। একজন অপরজনের কবিতা, গান, সাহিত্যের ভক্ত হলেও কেউ কারও দ্বারা প্রভাবিত হননি। বরং, আপন স্বকীয়তায় রেল লাইনের দু’লাইনের মতই সমান্তরালভাবে সদাবহমান। আমরা বাংলা সাহিত্যের এই দুই দিকপালকে সম্মান করি, শ্রদ্ধা করি, ভালোবাসি। আদর্শ কবিগণ স্থান-কাল-পাত্রের গণ্ডি ছাড়িয়ে স্থায়ী আসন পেতে নেন ভক্তের অন্তরের অন্তঃস্থলে। প্রিয় কবির দু’লাইন কবিতার ছত্রে ভক্ত যেন খুঁজে পান হৃদয়ের কথা, শাণিত চেতনা। এখানেই কবির স্বার্থকতা।

বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন ও ১৯৭১’র মুক্তিযুদ্ধে নজরুলের গান যুদ্ধের ময়দানে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে, দেশকে স্বাধীন করতে যে অবদান রেখেছে, উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছে তার নজির বিরল। নিঃসন্দেহে প্রিয় কবির স্বভাব-চরিত্র, চিন্তা-চেতনার প্রচণ্ড প্রভাব পরে ভক্তদের হৃদয়ে। মুসলিম জাতীয় কবি হিসেবে কাজী নজরুলের মাঝে আমরা খুঁজে পাই বাঙালি মুসলিম জাতির জাতিসত্ত্বা ও ধর্মীয় চেতনার বহিঃপ্রকাশ। যদিও তিনি হিন্দু জাতির জন্যও অনেকগুলো শ্যামা সঙ্গীত, কির্তন ইত্যাদি লিখে গেছেন। তাঁর বিখ্যাত বিদ্রোহী কবিতায়ও হিন্দু ধর্মের অনেক দেব-দেবীর নাম উল্লেখ করেছেন। তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িকের মাঝে ইসলামী জাগরণের কবি। নজরুল যেমন অসংখ্য ইসলামী গান,  হামদ, নাত রচনা করেছেন রবীন্দ্রনাথও পূজার গান রচনা করেছেন ৬১৭টি। অনেক হিন্দু তাদের পূজায় রবীন্দ্রনাথের গান গেয়ে থাকেন, অনেকে তাকে দেবতা বানিয়ে পূজাও করছেন। এতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই, আপত্তি থাকার কথাও নয়। আপত্তি হলো যখন বাংলাদেশের কিছু মুসলমান  অতিভক্তির আতিশয্যে রবীন্ত্রনাথকে হিন্দুদের মতো দেবতা বানিয়ে পূজার অনুরূপ করে থাকেন তখন, তাঁকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করে, আর স্বধর্মের জাতীয় কবিকে সঠিক মর্যাদা দেয় না, অবহেলা করে, তখন বড় কষ্ট হয়! সহজ সরল সাধরণ মুসলমানের ঈমানের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে নষ্ট করার ষড়যন্ত্র করা হয়। জাতীয় চেতনাকে বিনষ্ট করা হয় তখন সইতে পারি না!

১লা বৈশাখে রবীন্দ্র বন্দনা ও চর্চা নিয়ে এত বাড়াবাড়ি করা হয় দেখে মনে হয় বাংলার মাটিতে রবীন্দ্রনাথের পূর্বে বৈশাখ মাস আসেনি, সমাজের কেউ ১লা বৈশাখ উদযাপন ও হালখাতাও করেননি। বাংলাদেশে রবীন্দনাথকে নিয়ে যে ধরনের বাড়াবাড়ি করা হয় ইন্ডিয়া, কলকাতা খোদ কবির বাড়ি জোড়াসাঁকোতেও তার সিকিখানিও করা হয় না। এসব দেখে রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকলে তিনি হয়তো স্বয়ং লজ্জা পেতেন ও আপত্তি জানাতেন। রবীন্দ্রানুষ্ঠানের আয়োজকরাই নজরুলের ব্যাপারে এত কার্পণ্য কেন করে থাকেন, বুঝে আসে না। ইদানীং একটি বিষয় লক্ষ্যণীয় তাহলো মিডিয়াগুলোতে রবীন্দ্রসঙ্গীতের বিস্তৃতির জন্য যতটুকু চেষ্টা করা হয় নজরুল গীতির জন্য ততটুকু করা হয় না। রবীন্দ্রসঙ্গীতের জন্য নামকরা ও ভালোমানের শিল্পীদের সিলেক্ট করা হয়। অথচ নজরুল গীতির জন্য সমমানের শিল্পীদের সিলেক্ট করা হয় না বলেই মনে হয়। নজরুলের গানের শব্দ, সুর, উচ্চারণে প্রচুর ভুলভ্রান্তি পরিলক্ষিত হয়। অনেক গানে আন্তরিকতা, যোগ্যতা, প্রশিক্ষণেরও প্রচণ্ড অভাব পরিলক্ষিত হয় যা শ্রুতিকটু ঠেকে। কিন্তু ঐ গানগুলোই বিখ্যাত নজরুল শিল্পীদের দিয়ে পরিবেশন করলে গানের তাল, লয়, সুর, উচ্চারণে আন্তরিকতা ফুটে ওঠে, ফলে অনেক শ্রুতিমধুর হয়, গানের আবেদন ও স্বাভাবিকতার ফলে সর্বজন গ্রাহ্যতাও বেড়ে যায়।  নজরুল মাত্র ২২/২৩ বছর লিখতে পেরেছেন তাও আবার শান্তিতে বসে নয়। বাল্যঅবধি দারিদ্র্যের কষাঘাতে, যুদ্ধের ডামাডোলে, জেলখানার জিঞ্জিরায়, রাজনৈতিক অস্থিরতায়, পারিবারিক সমস্যায়, বিভিন্ন ষড়যন্ত্রের শিকারে থাকা অবস্থায়! ধীরস্থিরভাবে তিনি লিখতেও পারেননি গবেষণাও করতে পারেননি। তদুপরি যা লিখেছেন, সঠিক সংরক্ষণের অভাবে সে সময় থেকে শুরু করে অদ্যবধি সেসবের অনেক কিছুই হারিয়ে গেছে, চুরি হয়েছে, নষ্ট হয়েছে। এখনও অজানাই রয়ে গেছে তার অনেক গান, কবিতা রচনাবলি! গত ক’দিনপূর্বে নজরুলের ইসলামী গানের সম্রাট ও সহচর মরহুম আব্বাসউদ্দিন এর সুযোগ্য সন্তান নজরুল গীতির শিল্পী মোস্তফা জামান আব্বাসী জানিয়েছেন, নজরুল অসুস্থ হয়ে নয় বরং কাঁধে প্রচণ্ড আঘাত করায় নির্বাক হয়ে গেছেন! এ সম্পর্কিত বা চিকিৎসা সংক্রান্ত ১৫টি প্রেসক্রিপশন ও ওনার কাছে মওজুদ আছে বলে তিনি জানান। নজরুলের সরলতার সুযোগে তাঁকে দিয়ে চলচ্চিত্রে শ্রী-কৃষ্ণের অভিনয় থেকে শুরু করে পূজা অর্চনাও করানো হয়েছে। এতেও নিস্তার মেলেনি কবির, অবশেষে আঘাতে আঘাতে জর্জরিত করে নির্বাক-নিস্তব্ধ করে দেয়া হয়েছে। অবহেলা, দ্রুত ও উন্নত চিকিৎসার অভাবে বাংলার গানের বুলবুলি চিরতরে স্তব্ধ হয়ে গেছেন। গুটিকয়েক ভক্ত ও কল্যাণকামী ছাড়া কবির প্রতি কেউ সত্যিকারার্থে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করে দেননি। হিন্দু-মুসলিম-বৃটিশ রাজ প্রত্যেক সম্প্রদায়ের লোকই কবিকে শারীরিক ও মানসিক কষ্ট দিয়েছেন। একথাও প্রচলিত আছে যে, কবিকে স্লো পয়জনিং করা হয়েছিল। অত্যাধিক শারীরিক ও মানসিক কষ্ঠে মাত্র ৪৩ বছর বয়সে কবি নির্বাক অসুস্থ হয়ে যান। কবি আরও ৩৪ বছর বেঁচে ছিলেন, যদি ষড়যন্ত্রমূলক অসুস্থ না হয়ে ঐ ৩৪ বছর অর্থাৎ পরিণত বয়স পর্যন্ত অনুকূল পরিবেশে ধীরে সুস্থে লিখতে পারতেন, তাহলে নজরুলের গান, কবিতা ও রচনাবলির নিকট পৃথিবীর কোনো কবি-সাহিত্যিক দাঁড়াতে পারতেন বলে মনে হয় না। এদিক থেকে রবীন্দ্রনাথ ভাগ্যবান ছিলেন। তিনি সোনার চামচ মুখে নিয়ে সহিত্যিক জমিদার পরিবারে জন্মেছিলেন। ৮০ বছরের জীবনে ৬৪ বছর লিখে গেছেন নিশ্চিন্ত মনে, কোনো পারিবারিক, সামাজিক জেল-জুলুম ব্যতিরেকে।

অসুস্থ কবির জীবন সায়াহ্নে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর শেখ মুজিবুর রহমান সাহেব কবিকে সম্মানের সাথে কলকাতা থেকে ঢাকায় আনানোর ব্যবস্থা করেন। পিজি হাসপাতালে চিকিৎসা করানো হয়, ধানমন্ডিতে কবিকে বাসা ও গাড়ি দেয়া হয়। পিজি হাসপাতালের সম্মুখস্থ ফুলবাগানে কবি পায়চারি করতেন, বিকেলে গাড়িতে করে ঘুরে বেড়াতেন, কথা বলার চেষ্টা করতেন, কবিকে বেশ উৎফুল্ল মনে হতো, ওনার সেন্সও অনেকটা সচল হচ্ছিল। কিন্তু এতবড় একজন রোগী জাতীয় কবির সাথে পূর্বেকার ষড়যন্ত্রের দোসররা ষড়যন্ত্র করতে এবারও দ্বিধা করেনি। বিকেলে কবি পাজামা-পাঞ্জবি পরিধান করে তৈরি থাকতেন বেড়াতে যাওয়ার জন্য। গাড়ি নষ্ট, তেল নাই, ড্রাইভার আসেনি এ সকল কথা বলে কবিকে বেড়াতে নেয়া হতো না। কবি মন খারাপ করে বসে থাকতেন। কবি ক্ষীর খেতে পছন্দ করতেন বলে কবির ভক্ত এক অধ্যাপিকা প্রতিদিন ক্ষীর বা পায়েস  রান্না করে নিয়ে আসতেন, কবি আগ্রহ ভরে খেতেন। অধ্যাপিকাকেও ক্ষীর আনতে নিষেধ করে দেয়া হয়। আরও জেনেছি কবির সম্মুখে কবির রচিত প্রিয় গানগুলো উল্টাপাল্টা করে বা বেসুরা করে শুনানো হতো। এতে কবি খুবই কষ্ট পেতেন। তিনি ক্ষীপ্ত হয়ে এটা ওঠা ছুঁড়ে ফেলতেন, রাগান্বিত অবস্থায় পায়চারি করতেন। জীবনের শেষপ্রান্তেও কবিকে এ ধরনের মানসিক বা মেন্টাল টর্চার করা হয়েছে। একটি কুচক্রি মহল উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবেই কবির পেছনে লেগে থাকতো। এরা কবির সুস্থ-স্বাভাবিক জীবন সহ্য করতে পারতো না। এদের উত্তরাধিকারীরা আজও কবির জীবনী, গান কবিতা রচনাবলী সকলে জানুক তা চায় না, এসব দিয়ে বাংলার মুসলিম জনগণ উজ্জীবিত হোক তাও চায় না।

যারা নজরুলের ভক্ত, জাতির প্রতি যাদের দায়বদ্ধতা আছে তাদের উচিত কবির রচনাবলী মন থেকে মনে, ঘর হতে ঘরে, দেশ হতে দেশান্তরে ছড়িয়ে দেয়া, তাঁর গানের মান বজায় রাখার ব্যবস্থা করা। ইসলামী জাগরণের কবি, বিদ্রোহী কবি, প্রেমের কবি, চেতনার কবি, জাতীয় কবিকে আর অবমূল্যায়ন বা স্বল্পমূল্যায়ন নয়।

নজরুলের লিখনী দিয়ে এ দেশের মুসলমানদের ঈমান-একতা, সম্মান-মর্যাদা, সাহস-হিম্মত, দায়িত্ব-কর্তব্য, দেশপ্রেম-ধর্মপ্রেম জাগ্রত করতে হবে। মুসলিম জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য, সভ্যতা-সংস্কৃতি ফিরে পেতে হলে জাতীয় ঐক্য ধরে রাখতে হলে, নজরুলকে জানতে হবে, তাঁর সাহিত্য ছড়িয়ে দিতে হবে বেশি বেশি করে। নতুন প্রজন্মকে সচেতন করতে হলে সচেতন কবি ভক্তদেরই এগিয়ে আসতে হবে। তবেই কবির সঠিক মূল্যায়ন হবে, কবির প্রতি দায়িত্ব পালন করা হবে, হয়তো এভাবে কবির বিদেহী আত্মা শান্তি পাবে।  জাতি জাতীয় কবির সঠিক মূল্যায়ন করবে এ আশা ব্যক্ত করছি। ওমা তৌফিকী ইল্লাবিল্লাহ।

সূত্র: সাপ্তাহিক সোনার বাংলা

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় মুসলিম অবদান

মনসুর আহমদ
সৃষ্টি জগতের সমস্ত সৃষ্টির নিজ নিজ ভাষা আছে, কিন্তু সে সব ভাষায় নেই কোনো পরিবর্তন বিবর্তন। কিন্তু আল্লাহ প্রদত্ত মানুষের ভাষায় রয়েছে বৈচিত্র্য ও পরিবর্তন বিবর্তনের গতি। মানুষের ভাষা আল্লাহ তায়ালার পবিত্র কুদরতের নিদর্শন। পবিত্র কুরআনে এরশাদ হচ্ছে, ‘তার নিদর্শনাবলীর অন্যতম নিদর্শন হল আকাশ মণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণ বৈচিত্র্য; নিশ্চয়ই এতে জ্ঞানীদের জন্য রয়েছে নিদর্শন।’

পৃথিবীতে রয়েছে কয়েক হাজার ভাষা। সময়ের স্রোতে প্রতিটি ভাষা কম বেশি তার রূপ বদলায়। আমাদের মাতৃভাষা বাংলাও বিভিন্ন সময় তার রূপ পাল্টিয়েছে। প্রতিটি ভাষার রূপের কারিগর ঐ ভাষাভাষী মানুষ। আমাদের মাতৃভাষা বাংলার যে সুন্দর রূপ বর্তমানে আমরা দেখতে পাই তার পেছনে রয়েছে বাঙালির বহু শতাব্দীর সাধনা।

ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে বাংলা ভাষার উৎপত্তিকাল খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতাব্দী। অনূন্য হাজার বছরের পুরানো বাংলা ভাষা উৎপত্তির পর থেকে নানা পর্যায়ে পরিবর্তনের মাধ্যমে আধুনিক পর্যায়ে উপনীত হয়েছে।  বাংলাদেশের অধিবাসীরা প্রথম থেকেই বাংলা ভাষায় কথা বলত না। বর্তমান বাংলা ভাষা প্রচলনের আগে গৌড় ও পুন্ড্রের লোকেরা অসুর ভাষাভাষী ছিল। এই অসুর ভাষাই ছিল আমাদের দেশের ভাষা। বাংলাদেশে আর্যদের আসার আগে এ দেশবাসীরা যে ভাষা ব্যবহার করতেন, তার কোনো নিদর্শন আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।

ঐতিহাসিকরা মনে করেন, বাংলা ভাষার প্রাথমিক স্তর পঞ্চম থেকে দশম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় উদ্ভূত হয়েছিল। সেন রাজগণ বিদেশী ছিলেন বলে বাংলা সম্বন্ধে বিশেষ কৌতুহলী ছিলেন না। তাদের সভায় সংস্কৃতজ্ঞ ব্রাহ্মণ -পণ্ডিতদের প্রধান্য ছিল বেশী। বাংলাদেশে বাংলা ভাষা ও বাংলা সাহিত্যের উদ্ভব ও প্রসার লাভ ঘটেছে বৌদ্ধ আমলে; বিশেষ করে স্বাধীন পাল রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায়। পাল এবং সেন বংশীয় রাজাদের আমলে বাঙালি জনগণ ও তাদের ভাষাও অন্যতম মুখ্য বিশিষ্টতা প্রাপ্ত হয়। নতুন ভাষা বাঙলার রূপ গ্রহণের সাথে সাথে বাঙালির মানসিক সংস্কৃতি এই ভাষার মাধ্যমে আত্ম প্রকাশের কাজে লেগে গেল- আনুমানিক দশম শতক হতে প্রাচীন বাঙলায় রচিত বৌদ্ধ চর্যাপদকে অবলম্বন করে বাংলা ভাষার সাহিত্যিক ইতিহাস শুরু হয়।

বাংলা সাহিত্যের প্রথম মুসলমান কবি হিসেবে শাহ মুহম্মদ সগীর বিশেষ গৌরবের অধিকারী। তিনি গৌড়ের সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের রাজত্ব কালে [ ১৩৯৩-১৪০৯ খ্রিঃ] ইউসুফ জোলেখা কাব্য রচনা করেন। এর পরে যাদের নাম করতে হয় তারা হলেন দৌলত উজির বাহরাম খান,  মুহম্মদ কবির, সাবিরিদ খান ও দোনাগাজী চৌধুরীর।

মধ্যযুগে [ ১২০০- ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দ] আরকান রাজ সভায় বাংলা সাহিত্যের চর্চা হয় এবং সেখানকার মুসলমান কবিগণ ধর্ম সংস্কার মুক্ত মানবীয় প্রণয়কাহিনী অবলম্বনে কাব্য রচনা করে এক নতুনতর বৈশিষ্ট্য দেখান। আরকানের বৌদ্ধ রাজাদের আনুকূল্যে বাংলা সাহিত্যের চর্চা করে যে সমস্ত মুসলিম কবি খ্যাতি অর্জন করেছেন, তাঁদের মধ্যে দৌলত কাজীর নাম সর্বাগ্রে স্মরণীয়। তাঁর রচিত কাব্যগ্রন্থের মধ্যে ‘ সতী ময়না ও লোর চন্দ্রানী’ নামে একটি মাত্র কাব্যের সন্ধান পাওয়া যায়।

আরকান রাজসভার বাংলা সাহিত্যের আর একজন নামকরা কবি মহাকবি আলাওল। কবি আলাওলের সাহিত্য সম্পদের প্রাচুর্য সহজেই চোখে পড়ার মতো। ফারসী সাহিত্য ভাণ্ডার থেকে তিনি ‘সেকান্দার নামা’, ‘সয়ফুল মুলক বদিউজ্জামাল’, ‘হপ্ত পয়কর’ প্রভৃতি কাব্য ও ধর্ম বিষয়ক ‘তোহফা’ গ্রন্থটি অনুবাদ করেন। এছাড়াও সতের শতকের বিখ্যাত মুসলমান কবি হলেন আবদুল হাকিম, নওয়াজিস খান, সৈয়দ মুহম্মদ আকবর প্রমুখ।

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের যে রূপ নিয়ে আমরা গর্ব করি তা প্রকৃত প্রস্তাবে শুরু হয়েছিল বাংলাদেশে মুসলিম শাসনামল থেকে। গুপ্তদের শাসনামলে সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের যে চর্চা শুরু হয়, পাল ও সেন আমলে সে ধারা অব্যাহত থাকে। তবে বাংলা দেশের স্বাধীন শাসক পালদের আমলে দেশীয় ভাষা হিসেবে প্রথম বাংলার চর্চা শুরু হয়। বাংলা দেশে বাংলা ভাষা ও বাংলা সাহিত্যের উদ্ভব ও প্রসার ঘটেছে বৌদ্ধ আমলে; বিশেষ করে স্বাধীন পাল রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায়। হিন্দু সেন রাজাদের আমলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য পৃষ্ঠ- পোষকতা থেকে বঞ্চিত হয়। সেন আমলে বাংলা ভাষার চর্চা না হলেও এ ভাষার নিজস্ব সত্তা একেবারে লোপ পায়নি। স্বাভাবিক ভাবে মুসলমানদের আগমনের পর মুক্ত পরিবেশে সাধারণের মুখের ভাষা বাংলার ব্যাপক চর্চার সুযোগ ঘটে।

বাংলা ভাষা মুসলমান প্রভাবের পূর্বে অতীব অনাদর ও উপোয় আত্ম প্রকাশ করছিল। ইতরের ভাষা বলে বাংলা ভাষা পণ্ডিত সমাজে অপাংক্তেয় ও উপোর পাত্র ছিল। মুসলমান বিজয় বাংলা ভাষার জন্য শুভ দিন বয়ে আনল। বাংলা ভাষা- সাহিত্য তথা বাঙালির জন্য ১২০৫ খ্রিষ্টাব্দ এক মহা ঐতিহাসিকক্ষণ। তুর্কি মুসলিম সেনাপতি মুহম্মদ বখতিয়ার খিলজি বাংলা দেশে মুসলিম রাজত্ব কায়েমের ফলে বাংলাভাষা ও সাহিত্যের নবজন্ম ঘটে। মুসলমান শাসক হুসেন শাহ, গৌড়ের সামসুদ্দিন ইউসুফ শাহ এবং অপরাপর মুসলমান সম্রাটেরা বাংলাদেশে বাংলা ভাষাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে আমাদের সাহিত্যে এক নতুন যুগ সৃষ্টি করেছিলেন। এ সব ইতিহাস সামনে রেখে শ্রী দিনেশ চন্দ্র সেন মন্তব্য করেন, ‘মুসলমান সম্রাটগণ বর্তমান বঙ্গ – সাহিত্যের এইরূপ জন্মদাতা বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। … বঙ্গ সাহিত্য মুসলমানদেরই সৃষ্ট, বঙ্গভাষা বাঙ্গালী মুসলমানের মাতৃভাষা।’

বাংলা সাহিত্যে মুসলমান শাসকগণের উদার পৃষ্ঠপোষকতায় যে নবজীবনের সূচনা হয়েছিল সে সম্পর্কে ড. মুহম্মদ এনামুল হক মন্তব্য করেছেন, ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশে বাংলার মুসলমানদের যতখানি হাত রহিয়াছে হিন্দুদের ততখানি নহে।  এদেশের হিন্দুগণ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জন্মদাতা বটে; কিন্তু তাহার আশৈশব লালন পালন ও রাকর্তা বাংলার মুসলমান । স্বীকার করি, মুসলমান না হইলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য মনোরম বনফুলের ন্যায় পল্লীর কৃষককন্ঠেই ফুটিয়া উঠিত ও বিলীন হইত, কিন্তু তাহা জগতকে মুগ্ধ করিবার জন্য উপবনের মুখ দেখিতে পাইত না বা ভদ্র সমাজে সমাদৃত হইত না।’

মধ্য যুগে মুসলিম সুলতান ও আমাত্য গণের অকৃপণ পৃষ্ঠপোষকতায় হিন্দু মুসলিম উভয় কবিদের মিলিত প্রচেষ্টায় সুসমৃদ্ধ সাহিত্য গড়ে ওঠে। মধ্যযুগে আরবি- ফারসি- তুর্কি- উর্দু শব্দের সংমিশ্রণে বাংলা যেমন সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে, বাঙালি মুসলিম হিন্দু নির্বিশেষে সে ভাষায় কাব্যচর্চা করে বাংলা সাহিত্য ভাণ্ডারকে পূর্ণ করে তোলেন।

মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে ধর্মীয় বিষয় বস্তু ব্যাপক ভাবে স্থান লাভ করেছিল। মর্সিয়া কাব্যের উপাদান বিবেচনা করলে এগুলোকেও ধর্মীয় সাহিত্য হিসেবে বিবেচনা করা যায়। মোগল আমলে বাংলায় মর্সিয়া সাহিত্য রচনা করেছিলেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন : দৌলত উজির বাহরাম খান, মুহম্মদ খান, হায়াৎ মামুদ, জাফর, হামিদ প্রমুখ। দৌলত উজির বাহরাম খান ‘জঙ্গনামা’ কাব্য রচনা করেছিলেন। মুহম্মদ খান ‘মক্তুল হোসেন’ কাব্য রচনা করে যথেষ্ট খ্যাতি লাভ করেছিলেন । ইসলামী বিষয় অবলম্বনে বাংলা সাহিত্য সৃষ্টির যে সব নিদর্শন মধ্য যুগে ল করা যায় তার মধ্যে সুফি সাহিত্য বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী। বাংলা সুফি সাহিত্যের ধারায় সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য কবি সৈয়দ সুলতান।

১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে বাংলার স্বাধীন সূর্য অস্তমিত হবার পর বাংলা সাহিত্যে আবার পালা বদল হলো। পরিবর্তন ঘটল মুসলিম শাসনের। সনাতন শিা ব্যবস্থা ভেঙ্গে গড়ে উঠতে লাগল ইংরাজ সৃষ্ট নতুন ইঙ্গ- হিন্দু মার্কা শিা ব্যবস্থা। ফারসীর বদলে নতুন রাষ্ট্র ভাষা হল ইংরাজি। ইংরাজি ভাষা- সাহিত্যের প্রভাবে ইংরাজি পড়া বাঙালির হাতে আধুনিক বাংলা সাহিত্যের গোড়া পত্তন হল।

ফোর্ড উইলিয়মের সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতেরা বাংলাভাষায় পণ্ডিতী রীতির জন্ম দান করেন এবং বিদ্যাসাগর (১৮২০Ñ১৮৯১) তার প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেন। তাদের আমলে বাংলা ভাষা এক রকম বাঙালিত্ব বর্জন করে খাঁটি আর্য ভাষায় (সংস্কৃত ) রূপান্তরিত হয়েছে। উল্লেখ করা যেতে পারে, আধুনিক বাংলার জনক নামে পরিচিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ভাষা এত খাঁটি ছিল যে, তার ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’ ও ‘সীতার বনবাস’ গ্রন্থদ্বয়ের শব্দ সম্ভারের শতকরা ৯০ থেকে ৯৯ ভাগ পর্যন্ত সংস্কৃত হয়ে উঠেছিল।  ফোর্ড উইলিয়ম কলেজকে কেন্দ্র করে যে বাংলা গদ্যের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয় বাঙালি হিন্দু সমাজ ছিল তার প্রধান রূপকার। বাঙালি মুসলমানদের তরফ থেকে এই প্রয়াসের বিরূদ্ধে যে প্রতিবাদ জ্ঞাপন করা হয়েছিল, দুর্ভাগ্যক্রমে তা বিশেষ আমলে আনা হয়নি।

ফোর্ট উইলিয়মের পণ্ডিতেরা নির্মীয়মান বাংলা থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে আরবি- ফার্সি শব্দ বর্জন করে ছিলেন। তারা বাংলা ভাষার বিশুদ্ধতা রার জন্য এই শব্দ বর্জনের পরামর্শ দিয়েছিলেন। হিন্দু পণ্ডিতগণ এ আদেশ অরে অরে পালন করে ছিলেন কিন্তু মুসলমান কবিরা আরবি- ফার্সি শব্দাবলীকে বাংলা ভাষার নিজস্ব সম্পদ মনে করে তা বর্জন করতে রাজী হননি।

ফোর্ট উইলিয়মের পণ্ডিতগণ ও তার পরবর্তী হিন্দু সাহিত্যিকগণ যাই করুন না কেন, বাঙালি মুসলমান লেখকগণ কিন্তু এই অভিনব গদ্য-পদ্যের ধারাকে কোনোদিনই মনে প্রাণে গ্রহণ করতে পারেনি। ফলে, তথাকথিত আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ধারা থেকে তাঁরা বহু দিন ধরে দূরে অবস্থান করেছেন। উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে মীর মোশাররফ হোসেন [ ১৮৪৭- ১৯১২] মুসলমানদের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় বিষয় বস্তু নিয়ে সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন। তার পরে কায়কোবাদ থেকে শুরু করে শেখ আবদুর রহীম, মুনশী রিয়াজুদ্দীন, মোজাম্মেল হক প্রমুখ সাহিত্যিকগণ ইসলামি সাহিত্যের ধারা সৃাষ্টি করলেন তাদের সাহিত্য কর্মে। এ সব মুসলিম সাহিত্যিক বিদ্যাসাগর, বঙ্কিম, ও মধুসূদনের অনুপ্রেরণায় পাশ্চাত্য প্রভাবান্বিত আধুনিক বাংলা গদ্য সাহিত্য সৃষ্টির পথ তৈরির প্রয়াস চালিয়েছেন।

প্রকৃত পে প্যারীচাঁদের ‘আলালের ঘরের দুলাল’ রচনা কাল থেকে আধুনিক বাংলা গদ্য রীতির একটি শক্তিশালী ধারার উদ্ভব ঘটে। বঙ্কিমচন্দ্র (১৮৩৮Ñ১৮৯৪) আলালের ঘরের দুলালের ভাষা- রীতির দ্বারা আকৃষ্ট হয়ে বাংলা গদ্য পুনঃনির্মানের গরজ অনুভব করেছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্রের সমসাময়িক কালে মধুসূদনের আবির্ভাব। বিশাল প্রতিভার অধিকারী মধুসূদন বাংলায় প্রথম সার্থক মহাকাব্য, সনেট, গীতিকাব্য, নাটক ও প্রহসন রচনা করেন।

মধুসূদনের পরে বাংলা সাহিত্যে যে যুগান্তকারী প্রতিভার আবির্ভাব ঘটে তিনি হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১Ñ১৯৪১)। তিনি নানা বৈচিত্রে ও অভূতপূর্ব অবদানে বাংলা সাহিত্যকে এক নতুন দিগন্তে পৌঁছে দেন। রবীন্দ্রনাথের পরে বাংলা কাব্যের সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য কবি হলেন কাজী নজরুল ইসলাম(১৮৯৯-১৯৭৬)। রবীন্দ্রনাথের প্রভাব বলয় অতিক্রম করে তিনি বাংলা কাব্যে এক নতুন ধারার যুগান্তকারী বৈশিষ্ট্য নিয়ে আসেন। বাংলার যে একটি মুসলমানী রূপ আছে নজরুল ইসলাম তাঁর কাব্যে সেটা সার্থক ভাবে তুলে ধরেছেন। নজরুল ইসলাম বাংলা কাব্যে যে তেজস্বিতা, প্রাণময় উদ্দীপনা ও নতুন বৈশিষ্ট্য নিয়ে এলেন, তাঁর সমকালে অনেক কবি তাতে অনুপ্রাণিত হয়ে বাংলা কাব্যকে নানা ভাবে সমৃদ্ধ করে তোলেন।

বাংলা গদ্যের সমৃদ্ধিতে মুসলিম সাহিত্যিকদের অবদান ঈর্ষণীয়। এদের মধ্যে যারা শীর্ষে ছিলেন তাঁরা হলেন নওশের আলী খান ইউসুফ জায়ী, আবদুল করীম সাহিত্য বিশারদ, মোহাম্মদ রওশন আলী চৌধুরী, সৈয়দ ইসমাইল হেসেন সিরাজী, বেগম রোকেয়া, কাজী ইমাদুল হক, লুৎফর রহমান, এস. ওয়াজেদ আলী, শাহাদৎ হোসেন, ইবরাহিম খাঁ, শেখ ফজলুল করিম, আবুল মনসুর আহমদ, কাজী আবদুল ওয়াদুদ, মোহাম্মাদ নজিবর রহমান, মোম্মদ বরকতুল্লাহ, মোহাম্মাদ ওয়াজেদ আলী, শেখ হাবিবর রহমান ও মোতাহের হোসেন চৌধুরী প্রমুখ।

এ ভাবে আমরা দেখতে পাই, মধ্যযুগের বাংলাভাষা ও সাহিত্যের উন্নতি ও শ্রীবৃদ্ধির মূলে রয়েছে মুসলমান আমির-উমরাহ থেকে শুরু করে বিভিন্ন মুসলিম কবি সাহিত্যিক।

বাংলা ভাষার শ্রী বৃদ্ধির পরে আলোচনা করতে হয় বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় মুসলমানদের অবদান নিয়ে। ভারতে বৃটিশ রাজের শেষের দিকে গৃহীত লাহোর প্রস্তাব থেকে শুরু করে ১৯৪৭ সনে উপমহাদেশের মুসলমানদের জন্য স্বাধীন রাষ্ট্র পাকিস্তানের অভ্যূদয়ের প্রোপটে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য এক নতুন আবহ সৃষ্টি হয়। ১৯৪০ সালের ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব পাশের, তথা সাবেক পাকিস্তান আন্দোলনের সময় থেকে, ১৯৫২ সালের ঐতিহাসিক ভাষা আন্দেলনের সময় পর্যন্ত যদি ইতিহাস পর্যালোচনা করা যায়, তা হলে বিভিন্ন মুসলিম ব্যক্তিদের ঐতিহাসিক ভূমিকার পরিচয় দীপ্ত হয়ে উঠবে।

মাতৃভাষা বাংলার সাথে উর্দুর একটি প্রতিযোগিতা গড়ে উঠেছিল দেশ বিভাগের বেশ আগ থেকেই। এক শ্রেণীর বাঙালি মুসলমানের মনে উর্দু প্রীতির উদ্ভব ঘটেছিল বিভিন্ন কারণে। যেমন, ‘যখন বাঙ্গলা সাহিত্য চর্চায় বাঙ্গলার মুসলমান গণের একটা ঘৃণা জন্মিয়া গেল, তখন তাহারা কোথাকার উর্দু ভাষাকে মাতৃভাষা বলিয়া বরণ করিয়া লইতে বৃথা চেষ্টা করিতে লাগিলেন।’

দেশ বিভাগের অনেক আগে, ১৯৪২ সালেরও আগে,‘ পূর্ব পাকিস্তান কথাটি‘ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের ভবিষ্যত সম্ভাবনা ও প্রতীক হিসেবে চালু হয়ে গিয়েছিল এবং বুদ্ধিজীবীদের মনোরাজ্যেও ঠাই করে নিয়েছিল। বস্তুত এ কারণেই সাবেক পাকিস্তান প্রতিষ্ঠারও বহু কাল আগে ১৯৪২ সালেই কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ‘পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটি এবং ঢাকায়‘ পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ।’ দেশ বিভাগ ও (সাবেক) পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হবার পর ‘পূর্ব পাকিস্তান’- এর রাষ্ট্র ভাষা কি হবে, এ নিয়ে রেনেসাঁ আন্দোলনের নায়করা চিন্তা ভাবনা করেছিলেন দেশ বিভাগের বহু আগে, ১৯৪২- ৪৩ সালেই। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগেই বাংলা ভাষাকে নতুন রাষ্ট্রের, রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দানের দাবি উঠে ছিল। বস্তুতঃ সেকালেই ‘দৈনিক আজাদ’,‘ মাসিক মোহাম্মদী’, ‘সওগাত’ প্রভৃতি পত্রিকায় প্রবন্ধ ও অন্যান্য রচনার মাধ্যমে মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা নিয়ে আন্দোলন শুরু করেন। ‘আজাদ’- এর প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা মোহাম্মাদ আকরাম খাঁ ছিলেন বাংলা ভাষার সুপণ্ডিত শক্তিমান লেখক, মাতৃভাষার প্রতি গভীর অনুরাগী ও শ্রদ্ধাশীল।‘ বাংলা ভাষা বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা কিনা’ এই হটকারী ও বিভ্রান্তিমূলক প্রশ্নের উত্তরে ১৩২৫ সালেই মাওলানা মোহাম্মদ আকরাম খাঁ বলেছিলেন, ‘দুনিয়ায় অনেক রকম অদ্ভুত প্রশ্ন আছে, বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা কি? উর্দু না বাংলা? এই প্রশ্নটা তাহার মধ্যে সর্বাপো অদ্ভূত। নারিকেল গাছে নারিকেল ফলিবে না বেল?… বঙ্গে মোছলেম ইতিহাসের সূচনা হইতে আজ পর্যন্ত বাংলা ভাষাই তাহাদের লেখ্য ও কথ্য মাতৃভাষা রূপে ব্যবহৃত হইয়া আসিয়াছে। এবং ভবিষ্যতেও মাতৃভাষা রূপে ব্যবহৃত হইবে।’

উর্দুকে মাতৃভাষা রূপে গ্রহণ করার মানসিকতা কিছু মুসলমানের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছিল এক বিশেষ প্রোপটে। ইতিহাসের প্রোপট বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় হিন্দু নেতারা বার বার মুসলমানদের ভাষা উর্দুকে দূরে ঠেলে দিয়ে হিন্দিকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা চালিয়েছে।‘As early as 1867, Hindu leaders in Benares began a movement to replace Urdu- the chief language of the Muslims- by Hindi.’ ১৯১৮ সালে বিশ্ব ভারতীতে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভারতবর্ষে বাংলার পরিবর্তে হিন্দিকে রাষ্ট্র ভাষা করার প্রস্তাব করেছিলেন। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হিন্দির পরিবর্তে বাংলার পক্ষে যুক্তি তর্ক উপস্থাপনা পেশ করেন এবং বলেন, ‘শুধু ভারত কেন, সমগ্র এশিয়া মহাদেশেই বাংলা ভাষার স্থান হবে সর্বোচ্চ। ভাব সম্পদ ও সাহিত্যের গুণে বংলাভাষা এশিয়ার ভাষা গোষ্ঠীর মধ্যে অদ্বিতীয়।’ হিন্দুরা সেদিন এটি মেনে নিতে পারেনি। উর্দু- হিন্দি – বাংলা বিতর্কে কংগ্রেসের সব নেতাই হিন্দির পক্ষে রায় দেন। শুধু রায়ই নয়, সমগ্র ভারতকে এক রাষ্ট্রে পরিণত এবং এক জাতীয়তায় আবদ্ধ করার জন্য কংগ্রেসের সব নেতাই এক বাক্যে হিন্দির পক্ষে রায় দেন। এ ঘটনার প্রায় ৩০ বছর পরে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রাক্কালে ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ড. জিয়াউদ্দীন আহমদ স্বাধীন ভারতে হিন্দিকে রাষ্ট্র ভাষা করার মোকাবেলায় পাকিস্তানে উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ইতিহাসের এই গতি ধারায় মুহম্মদ আলী জিন্নাহ পাকিস্তান সৃষ্টির পরে ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ ঢাকায় গোটা পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে উর্দু উপযুক্ত হবে বলে বিবেচনা করে ঘোষণা প্রদান করেন যে উর্দু হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা। জিন্নাহর এই ঘোষণাকে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ মাতৃভাষা বাংলা ও সংস্কৃতির ওপর হামলা বিবেচনা করে সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়। এই ভাষা সংগ্রামে যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তারা সবাই ছিলেন মুসলমান। ভাষা আন্দেলনের ইতিহাসে একজনও অমুসলমান ছাত্র- যুবকের নাম খোঁজ করে পাওয়া যায় না । ১৯৪৮ সালের রাজপথে শুরু হওয়া ভাষা আন্দোলন- যা’ ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্র“য়ারিতে কতগুলো মুসলমান শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জন করে অমর মহিমা। ঢাকার রাজপথ কিছু মুসলিম তরুণ তাদের বুকের তাজা রক্ত ঢেলে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করল।

বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য ৫২-এর ভাষা আন্দোলন রাজনৈতিক আন্দোলনের রূপ ধারণ করে। ’৪৮ পূর্ব আন্দোলন ছিল বুদ্ধি বৃত্তিক আন্দোলন। স্বাধীনতা পুর্বকালে ১৮৯৯ সালে বাংলা দেশের মুসলিম পুনর্জাগরণের অগ্রদুত সৈয়দ নওয়াব আলীর নেতৃত্বে ‘বঙ্গীয় সাহিত্য বিষয়ক মুসলিম সমিতি’ গড়ে ওঠে এবং ১৯১১ সালে ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’ যে উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে যাত্রা শুরু করেছিল সেই একই উদ্দেশ্যে স্বাধীনতা উত্তরকালে জন্ম লাভ করে ‘তমদ্দুন মজলিস’। এই তমদ্দুন মজলিসই সর্ব প্রথম ভাষা আন্দোলনকে সাংগঠনিক রূপ দান করে। এ ভাবেই তুর্কি আগমনের পর থেকে শুরু করে বাংলা ভাষার উন্নতি ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে মুসলমানগণ সক্রিয় অংশ গ্রহণ করে ’৫২ সালে শাহাদতের মধ্য দিয়ে বিশ্বের দরবারে মাতৃভাষাকে মর্যাদার আসনে স্থান দিতে সম হয়।

১৯৬১ সালে বাংলার উন্নতি ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার ল্ক্ষ কায়েম হয় ‘পাক সাহিত্য সংঘ’, ১৯৬৯ সালে ‘মুক্তবুদ্ধি সাহিত্য সংঘ’, স্বাধীনতা উত্তরকালে ১৯৭২ সাল থেকে ‘স্বদেশ সংস্কৃতি সংসদ, সোনার বাংলা সাহিত্য সভা, ঢাকা সাহিত্য সংস্কৃতি কেন্দ্র ইত্যাদি কাজ করে যাচ্ছে। এ ধারাবাহিকতা থেকেই ১৯৮৩ সালে বাংলা সাহিত্য পরিষদ প্রতিষ্ঠিত হয়। এসব সাহিত্য সংস্কৃতি সংসদগুলো মাতৃভাষার উন্নতি এবং নিজস্ব কৃষ্টি সংস্কৃতি লালনে যে ভূমিকা পালন করে আসছে তা ওজনের দিক থেকে বিশাল।

সূত্র: সাপ্তাহিক সোনার বাংলা

ইচ্ছেমতো ওষুধ নয়

অসুখ হলে ওষুধ খেতে হয়—সবাই জানি, কিন্তু সঠিক নিয়মে ওষুধ খাওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনেকেই অনুভব করি না। ওষুধ খেতে আমরা যতটা ত ৎপর, ওষুধ খাওয়ার নিয়ম মানতে ততটাই উদাসীন। আমাদের এ অবহেলা জীবনরক্ষাকারী ওষুধকে করে তুলতে পারে জীবনবিনাশী বিষ।

ওষুধ গ্রহণের ক্ষেত্রে আমরা প্রথমেই যে অনিয়মটা করি তা হলো চিকি ৎসকের পরামর্শ না নেওয়া। আমরা নিজেরাই নিজেদের চিকি ৎসা করি, কখনো আত্মীয়, কখনো বন্ধুর পরামর্শ নিই, কখনো চিকি ৎসকের চেয়ে ওষুধ বিক্রেতার ওপর বেশি নির্ভর করি। ‘অমুক ওষুধে তমুক ভালো হয়েছিল, তাই আমিও ভালো হব’—এমন চিন্তাই আমাদের মধ্যে কাজ করে। অথচ লক্ষণ এক হলেই অসুখ এক হবে, এমন কোনো কথা নেই। আবার একই রোগে একই ওষুধের মাত্রা রোগীভেদে ভিন্ন হতে পারে। শুধু অসুখে নয়, ওষুধ সহজলভ্য হওয়ায় সুখেও আমরা অন্যের পরামর্শে ওষুধ খাই। মোটা হওয়ার জন্য স্টেরয়েড বা শক্তি বাড়ানোর জন্য ভিটামিন খাই যেন ভাতের চেয়ে বেশি। এসবের মারাত্মক, কখনো জীবনবিনাশী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে আমরা সম্পূর্ণ অজ্ঞ।

যদিও বা কখনো (বাধ্য হয়ে) চিকি ৎসকের পরামর্শ নিই, ওষুধ ব্যবহারের ক্ষেত্রে চিকি ৎসকের বেঁধে দেওয়া বিধিনিষেধ মানি কম। সময়মতো ওষুধ খাওয়া, খাওয়ার আগে না পরে তা বুঝে খাওয়া, পর্যাপ্ত পানি পান করা—এসব আমরা খেয়াল রাখি না। বিশেষ করে অ্যান্টিবায়োটিকের ডোজের ক্ষেত্রে আমরা পুরোপুরি উদাসীন থাকি। সবচেয়ে ভয়াবহ হলো ওষুধ বন্ধ করে দেওয়া। ‘জ্বর ভালো হয়ে গেছে, অ্যান্টিবায়োটিক আর কী দরকার’ ভেবে নিজেরাই ওষুধ বন্ধ করে দিই। আবার অন্যদিকে কয়েক দিনে জ্বর ভালো না হলে ‘ওষুধ ঠিক নাই’ ভেবে তা বন্ধ করে দিই এবং অন্য চিকি ৎসকের কাছে নতুন ওষুধের প্রত্যাশায় যাই। যেসব অসুখে দীর্ঘদিন বা আজীবন ওষুধ খেতে হয়, সেখানে আমরা অসুখ নিয়ন্ত্রণে এলেই তা বন্ধ করে দিই, বুঝতে চাই না যে রোগ ভালো হয়নি, নিয়ন্ত্রণে আছে কেবল। একসময় লোকমুখে ‘ক্যানসারের ওষুধ’ শুনে বাতের ওষুধ বন্ধ করার ঘটনা প্রচুর হয়েছে। ওষুধ শুরুর মতো বন্ধ করার সময়ও আমরা নিয়ম মানি না। যেসব ওষুধ হঠা ৎ বন্ধ করা যায় না, তা নিজেরাই হঠাৎ বন্ধ করে দিই।

ওষুধ নিয়ে এ অনাচারে কী ক্ষতি হতে পারে? প্রথম কথা, যে রোগের জন্য ওষুধ সেবন করা তার উপশম হবে না, বরং খারাপ হতে পারে। ওষুধ প্রতিরোধী জীবাণুর আবির্ভাব এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে মারাত্মক হুমকি। অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার জীবাণুর বিরুদ্ধে এদের অকার্যকর করে দিচ্ছে। সঠিক অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে যে রোগ শুরুতেই ভালো করা যেত, ভুল ব্যবহারের কারণে তা আর সম্ভব হচ্ছে না, নতুন দামি ওষুধ দরকার হচ্ছে, কখনো তাতেও কাজ হচ্ছে না। বিশেষভাবে বলা যায় যক্ষ্মার কথা, যেখানে কমপক্ষে ছয় মাস ওষুধ খেতে হয়, অথচ অনেকেই কয়েক মাস খেয়ে ‘ভালো হয়ে গেছি’ মনে করে তা বন্ধ করে দেয়। ফলে তা মারাত্মক মাল্টি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট টিবিতে পরিণত হয়, যা নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত কঠিন। আর্থিক দিকটাও বিবেচনা করা জরুরি। যে চিকি ৎসা এখন সুলভে হচ্ছে, অবিবেচকের মতো ওষুধ খেলে বা না খেলে পরে ব্যয়বহুল হয়ে যেতে পারে।

শুধু জীবাণু সংক্রমণ নয়, হাই ব্লাড প্রেশার, ডায়াবেটিস ইত্যাদি অসুখেও ‘মাঝেমধ্যে ওষুধের ব্যবহার’ উপকারের চেয়ে অপকারই বেশি করে।

নিয়মিত ওষুধ খেলেও যদি সেবনবিধি না মানা হয়, তবে অনেক ওষুধই অকার্যকর হয়ে যায়। খালিপেটে খাওয়ার ওষুধ ভরা পেটে খেলে তা না খাওয়ার মতোই হবে। এ ছাড়া অনেক ক্ষেত্রেই এক ওষুধ অন্য ওষুধের উপস্থিতিতে কাজ করে না। অজ্ঞ ব্যক্তির পরামর্শে এসব ওষুধ একত্রে খেলে লাভ তো হবেই না, বরং ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা আছে।

মনের মতো ওষুধ খাওয়ার আরেক সমস্যা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। একজন চিকি ৎসক ভালোমতোই জানেন কোন ওষুধের কী সমস্যা, আর তাই তা কাকে দেওয়া যাবে, কাকে যাবে না। নিজে থেকে ওষুধ খেলে এসব বিবেচনা সম্ভব না, তাই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার আশঙ্কা বেশি। ব্যথার ওষুধ খেয়ে পেট ফুটো হওয়ার ঘটনা প্রায়ই ঘটে। মোটা হওয়ার জন্য স্টেরয়েড খেয়ে অনেকেই মারাত্মক কুশিং সিনড্রোমে আক্রান্ত হন, যা সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হয়। বলে রাখা ভালো, চিকি ৎসকের পরামর্শ ছাড়া হঠা ৎ ওষুধ বন্ধ করেও অনেকে বিপদে পড়েন, বিশেষ করে স্টেরয়েড হঠা ৎ বন্ধ করলে এডিসনিয়ান ক্রাইসিস হতে পারে, যা থেকে রোগী মারাও যেতে পারে।
সাধারণ ওষুধ, যার অনেকগুলো প্রেসক্রিপশন ছাড়াই পাওয়া যায়, বিশেষ অবস্থায় তাও হতে পারে ক্ষতিকর। আমরা অনেকেই জানি না যে ভিটামিন ‘এ’ বা কৃমির ওষুধের মতো সাধারণ ওষুধ গর্ভের শিশুর মারাত্মক ক্ষতি করে। লিভারের রোগীর জন্য প্যারাসিটামলের মতো ওষুধ হতে পারে ক্ষতির কারণ।
এ অবস্থার জন্য দায়ী আমরা সবাই। রোগী যেমন চিকি ৎসকের পরামর্শ নেওয়া বাহুল্য ভাবছেন, চিকি ৎসকও তেমনি রোগীকে সঠিক পরামর্শ দিচ্ছেন না, আর কর্তৃপক্ষ হয়ে আছে উদাসীন।

এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য রোগীদের যা মেনে চলা উচিত তা হলো—
 শুধু চিকি ৎসক পরামর্শ দিলেই ওষুধ সেবন করা যাবে।
 বিশেষ অবস্থায় (যেমন গর্ভাবস্থা, লিভারের রোগ ইত্যাদি) সাধারণ ওষুধ, যা প্রেসক্রিপশন ছাড়া পাওয়া যায়, তাও চিকি ৎসকের পরামর্শেই ব্যবহার করতে হবে।
 শুধু ফার্মাসিস্টের কাছ থেকে ওষুধ কেনা উচিত। কেনার সময় তার মেয়াদ দেখে নিতে হবে।
 চিকি ৎসক ওষুধ খাওয়ার যে নিয়ম বলে দেবেন (কতটুকু ওষুধ, কতক্ষণ পরপর, কত দিন, খাবার আগে না পরে ইত্যাদি), সে অনুযায়ী তা সেবন করতে হবে। প্রয়োজনে তা লিখে রাখুন বা মনে রাখতে অন্যের সাহায্য নিন। নিজে থেকে ওষুধের মাত্রা পরিবর্তন করা যাবে না।
 নিজে নিজে ওষুধ খাওয়া বন্ধ করা যাবে না। সুস্থতা বোধ করলেও কোর্স সম্পূর্ণ করতে হবে। কোনো সমস্যা হলে চিকি ৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
 একই সঙ্গে অ্যালোপ্যাথিক ও অন্যান্য পদ্ধতির চিকি ৎসা চালালে তা চিকি ৎসককে জানানো উচিত।
 ওষুধ সব সময় আলো থেকে দূরে, ঠান্ডা, শুষ্ক স্থানে, শিশুদের নাগালের বাইরে রাখুন।
 ব্যবহারের সময় ওষুধ ভালো আছে কি না দেখে নিন। নাম ও মাত্রাটা আবার খেয়াল করুন।
 অনেক সময় দোকানিরা প্রেসক্রিপশনে লেখা ওষুধ না দিয়ে শুধু বিক্রি করার জন্য অন্য কোম্পানির অন্য ওষুধ দিয়ে থাকেন, বলেন, ‘একই ওষুধ।’ এ ক্ষেত্রে রোগীদের সতর্ক থাকা উচিত এবং প্রেসক্রিপশনে যে ওষুধ লেখা, তা-ই কেনা উচিত।

এ ছাড়া চিকি ৎসকেরও এ ব্যাপারে দায়িত্ব রয়েছে। তাঁদের কর্তব্য—
 রোগীকে রোগ এবং ওষুধ সম্পর্কে জানান।
 ওষুধের সম্ভাব্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে জানান।
 নিজে থেকে বন্ধ করলে কী ক্ষতি হতে পারে জানান। কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলে দ্রুত চিকি ৎসককে জানানোর পরামর্শ দিন।
 কখন ও কীভাবে ওষুধ বন্ধ করা যাবে জানান।
 নিয়মিত ও নিয়মমতো ওষুধ খেতে উ ৎসাহিত করুন।
 রোগীর খরচের দিকটা মাথায় রাখুন। অযথা অতিরিক্ত দামি ওষুধ নেহাত প্রয়োজন না হলে বা জীবন রক্ষাকারী না হলে না লেখাই ভালো।
 প্রেসক্রিপশনে অসুখের পূর্ণ নাম, ওষুধের নাম, মাত্রা, খাওয়ার নিয়ম, কত দিন খেতে হবে ইত্যাদি স্পষ্টাক্ষরে সুন্দরভাবে লেখা উচিত।

এর সঙ্গে সঙ্গে ওষুধ বিক্রেতার কর্তব্য প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ওষুধ বিক্রি করা, শুধ ব্যবসায়িক স্বার্থে যেনতেনভাবে যেকোনো ওষুধ বিক্রি না করা। কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব সরকারি হাসপাতালে প্রয়োজনীয় ওষুধের সরবরাহ নিশ্চিত করা, দোকানে ওষুধ বিক্রির ক্ষেত্রে নিয়ম মানা হচ্ছে কি না তা পর্যবেক্ষণ এবং সার্বিক তত্ত্বাবধান করা।

ওষুধের অপব্যবহার, বিশেষ করে অ্যান্টিবায়োটিকের রেজিস্ট্যান্স থেকে নিজেদের এবং ভবিষ্য ৎ প্রজন্মকে বাঁচাতে এখনই পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।

এ বি এম আবদুল্লাহ
ডিন, মেডিসিন অনুষদ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, নভেম্বর ৩০, ২০১১

ডায়াবেটিস ঝুঁকি কমাবেন কী করে

ডায়াবেটিস একটি বড় সমস্যা পৃথিবীজুড়ে, আর একে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হচ্ছে বলে মনে হয় না। আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশনের (আইডিএফ) একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ৫৫২ মিলিয়ন লোক, অর্থাৎ ১০ জন প্রাপ্তবয়স্ক লোকের একজন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবে ২০৩০ সালের মধ্যে। তা-ই যদি সত্যি হয়, তাহলে দুই দশকের মধ্যে টাইপ-২ ডায়াবেটিস নিয়ে ২০০ মিলিয়ন বা এরও বেশি লোক আসবে নতুন স্বাস্থ্য-সমস্যা হিসেবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমান, বর্তমানে এ রোগে ভুগছে ৩৪৬ মিলিয়ন লোক। ডায়াবেটিস বেড়ে যাওয়ার মূলে অন্তর্গত কারণ জীবনযাপনে পরিবর্তন, মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি, অধিক হারে রোগনির্ণয় ও তরুণদের মধ্যে স্থূলতা বেড়ে যাওয়া।
ডায়াবেটিস ফেডারেশনের বক্তব্য, ইদানীং ডায়াবেটিস বাড়ছে শিশু ও তরুণদের মধ্যে। ২০ বছর আগে তরুণদের মধ্যে ডায়াবেটিস ছিল অত্যন্ত নগণ্য। তবে কথা হলো, টাইপ-২ ডায়াবেটিস পুরোপুরি প্রতিরোধযোগ্য; প্রয়োজন লাইফ স্টাইলে সামান্য পরিবর্তন। এ ক্ষেত্রে ব্যায়াম ও খাদ্যবিধি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আর একটি গবেষণায় দেখা গেছে, মাত্র পাঁচটি সহজ অভ্যাস চর্চা করলে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমানো যায় ৮০ শতাংশ।

কী করা উচিত
 স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া: প্রচুর ফল ও শাকসবজি।
 সপ্তাহে অন্তত তিন দিন ২০ মিনিট করে ব্যায়াম।
 স্বাভাবিক দেহ ওজন বজায় রাখা (বিএমআই ১৮.৫-২৪.৯-এর মধ্যে রাখা)।
 ধূমপান করে থাকলে বর্জন করা।
 মদ্যপান করলে সামান্য করা। আমার পরামর্শ, মদ্যপান না করা।
এই পাঁচটি গাইডলাইন মেনে চললে ডায়াবেটিস প্রতিরোধ বেশ ফলপ্রসূ হয়। বিজ্ঞানীরা বলেন, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো দেহের স্বাভাবিক ওজন বজায় রাখা। স্বাভাবিক ওজনের পুরুষের ভারী ওজন বা স্থূল পুরুষের তুলনায় ডায়াবেটিস হওয়ার আশঙ্কা ৭০ শতাংশ কম। স্বাভাবিক ওজনের নারীদের ডায়াবেটিস হওয়ার আশঙ্কা ৭৮ শতাংশ কম।
আবার ভারী ওজনের লোক যদি একটি অভ্যাস চর্চা করে, যেমন—সপ্তাহে তিন দিন ব্যায়াম করে, তাতেও ডায়াবেটিসের ঝুঁকি তাদের অনেক কমে।

অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরীর কলম থেকে
পরিচালক, ল্যাবরেটরি সার্ভিসেস, বারডেম হাসপাতাল, সাম্মানিক অধ্যাপক ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ, ঢাকা।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ০৭, ২০১২

কেমন চাই গরমে পুষ্টি

মানবদেহের পুষ্টি চাহিদা সম্পর্কে প্রতিটি মৌসুমে সজাগ দৃষ্টি রাখা একান্ত কর্তব্য। আর গ্রীষ্মের গরমে এ কর্তব্য আরো বেড়ে যায়। উচ্চ তাপমাত্রায় আমাদের খাবার গ্রহণের ব্যাপারে সচেতনতা বাড়াতে হবে। আমাদের পরিষ্কার ধারণা নিতে হবে যে, কোন খাবার গরমে খাদ্য তালিকা থেকে কমিয়ে দিতে হবে অথবা কোন খাবার একেবারেই খাদ্যতালিকা থেকে বাদ দিতে হবে। আমাদের অসচেতনতা বহু রোগের কারণ। কিছু রোগ বা শারীরিক পরিস্থিতি জন্ম থেকে নিয়ে আসে না। শুধুমাত্র অসচেতনতার কারণে শরীরে স্থান পায় ও শরীরে এদের আধিপত্য বিস্তার করে অথ্যাৎ কোন কোন রোগী রোগগুলোর উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। মানুষের অসচেতনতার দরুণ খাদ্য সম্পর্কিত দীর্ঘমেয়াদী রোগ গুলো হলো: (১) শরীরের অতিরিক্ত ওজন (২) ডায়াবেটিস (৩) ইনসুলিন রেসিসাটেন্স (৪) উচ্চ রক্তচাপ (৫) হৃদরোগ।

কোন ব্যক্তি যদি উপরোক্ত যে কোন ১টি বা সবগুলোতে ইতিমধ্যে আক্রান্ত হয় তবে তাদের এই গরমে কিছুটা স্বসি-র জন্য অত্যন- সজাগ হতে হবে কেন না প্রচণ্ড গরমে শরীরের মধ্যে বিভিন্ন পরিবর্তন দেখা যায়। যেমন: ১। দেহে সোডিয়াম কমে যাওয়া ২। পটাসিয়াম কমে যাওয়া ৩। বমি হওয়া ৪। খাদ্য হজম না হওয়া ও পেট ফাপা ৫। ডায়রিয়া ৬। আমশায় ৭। জ্বর।

গরমে এ শারীরিক পরিবর্তন গুলোকে প্রতিরোধ করতে খাবারের গুরুত্ব অপরীসিম। গরমে সঠিক পুষ্টির লক্ষে সুস্বাস্থ্য রক্ষায় সে দিকগুলো খেয়াল রাখতে হবে তা হলো:
১। প্রথম ও প্রধান সাবধানতা হলো বাহিরের খোলা জায়গার পানি, শরবত, আখের রস, পরিহার করা, এগুলো গ্রহণের ফলে সৃষ্ট ডায়রিয়া, আমাশয়, আপনার আর্থিক ব্যায় বৃদ্ধির সাথে সাথে মৃত্যু ঝুঁকিও বহন করে।
২। নিরাপদ বিশুদ্ধ পানি পান করা, ঘরের তৈরী শরবত, পানি জাতিয় শাক সবজি ও ফল বেশী খাওয়া।
৩। উল্লেখ যে, গরমে ডাব, তরমুজ, বাঙ্গি, বেলের শরবত এগুলো পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ভাবে হাত ধুয়ে খাবারের উপযোগী করা।
৪। গরমে মাছ, মাংস, ভূণা, ভাজি, খিচুরী, পোলাও, ফাস্টফুড কমিয়ে পাতলা আম ডাল, পাতলা দুধ, টকদই, করলার বোল তরকারী, লেবু চিনির শরবত, সালাদ, রসালো ফল খাওয়া যেতে পারে।
৫। গরমে সাদা ভাত, পোলাও, বিরানী, খিচুরী পরটা থেকে অনেক বেশী উপযোগী।
৬। যারা নিয়মিত হাঁটেন, তারা শুধুমাত্র সময় পরিবর্তন করলেই চলবে। যেমন সকালে না হেঁটে বিকাল/সন্ধ্যার পর হাঁটা খুব বেশী আরাম দায়ক।
৭। গরমে খুব বেশী হাঁটা, ব্যায়াম অত্যাধিক পরিশ্রম, অত্যাধিক খাদ্য গ্রহণ পরিহার করুন।
৮। পোষাক পরুন আরাম দায়ক। হালকা রং বেছে নিন পোষাকে।
৯। নিজস্ব পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখুন।
১০। মনে রাখবেন গরমে আপনার নিজস্ব পরিচর্যা ও যত্ন আপনাকে সুস্থ্য রাখতে সহায়ক হবে। গরমে থাকা যাবে স্বস্তিতে। প্রতিরোধ করা যাবে ডায়রিয়া, কলেরা ও আমশায়ের মত পানি বাহীত ও খাদ্য বাহীত বিভিন্ন রোগ এমন কি মৃত্যু ঝুঁকিও।

গরমে পুষ্টি: গরমে কিছুটা স্বস্থির জন্য পুষ্টি সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-১। যারা অতিরিক্ত ওজনে ভূগছেন তারা এই গরমে অন্তত: সজাগ হোন পথ্য ও পুষ্টির ব্যাপারে। ওজন কমানোর জন্য গরমকাল সহায়ক। কেন না আপনি যদি উচ্চ ক্যালরি পরিহার করে নিম্ন ক্যালরির খাদ্য গ্রহণ করেন তবে ওজন কমবে। নিম্ন ক্যালরি খাবারের মধ্যে রয়েছে ফল (যেমন: তরমুজ, বাঙ্গি, জাম, জামরুল, ডাব ইত্যাদি) ও সবজি (যেমন- লাউ, পেঁপে, ঝিংগা, কুমড়া ইত্যাদি)। ২। গরমে খাদ্য তালিকায় তেল ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্ক হোন। গরমে তেলের ব্যাবহার একেবারেই কমিয়ে দিন। কেন না ১ গ্রাম তেল শরীরের ভেতর ৯ কিলো ক্যালোরী তাপ উৎপন্ন করে। উচ্চ তাপমাত্রায় ও আদ্রতায় শরীরের তাপ বাইরে বেরোতে পারে না। ফলে শরীরের তাপমাত্রা বাড়ে। এই গরমে বয়স্ক ও অতিরিক্ত ওজন ব্যক্তিদের হিট স্ট্রোকের সম্ভাবনা বাড়ে। তাই অন-ত: এই গরমে তেলের ব্যবহার কমিয়ে দেখুন আপনার ৩টি উপকার নিশ্চিত হবে।
(ক) কম তেলে খাবার খেয়ে আপনি স্বসি- বোধ করবেন, হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমবে
(খ) আপনার অতিরিক্ত ওজন কমবে,
(গ) দ্রব্যমূল্য উর্ধগতির সাথে তাল মিলানো যাবে অর্থাৎ তেল কেনার খরচ কমবে।
ইদানিং “কোলেস্টেরল ফ্রি” তেলের প্রচারণা বেড়েছে। এক্ষেত্রে আপনার নিজস্ব বৃদ্ধি যাচাই করুন। উদ্ভিদ উৎস হতে আসা তেলে প্রাকৃতি গত ভাবেই কোন কোলেস্টেরল থাকে না। এটি তেলের নিজস্ব বৈশিষ্ট। বিশেষ ভাবে উদ্ভিজ তেলকে কোন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মাধ্যমে কোলেস্টেরল ফ্রি করা হয়নি। কোলেস্টেরল ফ্রি তেলের প্রচারনায় সাধারণ মানুষ মনে করে তেল খেলে কোন ক্ষতি নেই কিন্তু এ কথা পরিষ্কার ভাবে বুঝতে হবে। ১ চা চামচ (৫ এম. এল) তেল = ৪৫ ক্যালরি, ১ চা চামচ (৫ এম. এল) ঘি = ৪৫ ক্যালরি, ১ চা চামচ (৫ এম. এল) সরিষা তেল = ৪৫ ক্যালরি, ১ চা-চামচ (৫ এম. এল) সয়াবিন তেল = ৪৫ ক্যালরি, কোলেস্টেরল ফ্রি হোক বা না হোক ৫ এম. এল তেল বা ঘি এর ক্যালরি মূল্য কিন্তু একই। অতিরিক্ত গ্রহনের ফলে আপনার শরীরের ওজন বৃদ্ধি পাবে যা আপনার হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়াবে। ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকিতো রয়েছেই। তাই নিদিষ্ট পরিমাণের বেশি কোন ভাবেই যে তোলই হোক না কেন তা গ্রহণ করা যাবে না। আমরা আসলে জানি কি প্রতিদিন প্রাপ্তবয়স্ক একজন মানুষের কতটুকু তেলের প্রয়োজন। প্রাপ্তবয়স্ক = ২০ গ্রাম ভিজিটেবল ফ্যাট, গর্ভবতী মা ৩০ গ্রাম ভিজিটেবল ফ্যাট, দুগ্ধদানকারী মা ৪৫ গ্রাম ভিজিটেবল ফ্যাট, [উৎস: আই.সি.এম.আর]

এই গরমে এখনই নিয়ন্ত্রণ করুন:
১. অতিরিক্ত তেল গ্রহণ
২. ডুবো তেলে ভাজা খাবার
৩. ঘি, মাখন, পনির, মেয়নেজ, ফাস্টফুড
৪. কোল্ডড্রিংক্স
৫. পোলাও, কাচ্চি, গরু ও খাশীর মাংস
৬. ভূনা খাবার
৭. অতিরিক্ত মিষ্টি খাবার
৮. অতিরিক্ত গরম ও ঠান্ডা খাবার।

গ্রহণ করুন:
তেল ১। অল্প তেলে রান্না খাবার। প্রতিদিন ৩টির বেশ তরকারী গ্রহণ করবেন না। কারণ খাদ্য তালিকায় রান্না করা খাবার যত বাড়াবেন তত বেশী তেল খাওয়া হবে তত বেশী পেট ভরে খাওয়া হবে, তাই সাদা ভাতের সাথে করলা ভাজি, পাতলা আম ডাল ও মাছ/মুরগীর ঝোল তরকারী যথেষ্ট। সাথে সালাদ লেবু, রসালো ফল ও টকদই রাখতে পারেন। তাজা খাবার গ্রহণ করুন, বাসী খাবার পরিহার করুন। উদাহরণ: ৪ সদস্য বিশিষ্ট প্রতিটি পরিবার এই গরমে দিনে ৩-৪ টেবিল চাচম অর্থাৎ ৬০ এম এল তেল ব্যবহার করুন। খাবারের বৈচিত্র যাই হোক না কেন তেলের ব্যবহার ৬০ এম এল অতিক্রম করবেন না। কারণ শুধু তেল থেকে ক্যালরি পাচ্ছে ৬০x৯ = ৫৪০। গরমে এটিই যথেষ্ট নয় কি? মাসের তেলের মোট ব্যবহার হওয়া উচিত ১৮০০ এম এল. প্রায় ২ লিটার। পাশাপাশি তেল খরচও কমে গেল। অবশ্য শিশু ও গর্ভবতী মা, দুগ্ধদানকারী মায়েদের জন্য পরিমান কিছুটা বাড়াতে হবে। আমাদের দেশে অনেক পরিবার মাসে ১০ লিটার থেকে ১৫ লিটার পর্যন্ত তেল গ্রহণ করে থাকে। এতে আপনার পরিবারের সদস্যদের গরমে অস্বসি-র পাশাপাশি শরীরে ওজন বেড়ে যাওয়া, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ সবশেষে কিডনি পর্যন্ত অকেজো হবার ঝুঁকি থাকে। এই গরম থেকেই কম তেলের ব্যবহার শুরু করলে আস্তে আস্তে অভ্যস্ত হবে, লাভবান হবেন:- গরমে স্বস্থি, রোগ প্রতিরোধ, চিকিৎসা ব্যয় কমানো।
২। কোমল পানীয়ের পরিবর্তে ডাবের পানি গ্রহণ করুন।
৩। ফ্রিজ ঠান্ডা তরল খাবেন না। এতে গরমে অস্বসি- আরো বাড়বে। ৪। তরমুজের শরবত বাঙ্গির শরবত, টকদইয়ের শরবত, বেলের শরবত পান করুন।

প্রেটিন: ৫। মনে রাখবেন শরীরে প্রোটিনের চাহিদা অত্যন- গুরুত্বপূর্ণ। সুস্থ্য প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির প্রতি কেজি শরীরের ওজনের জন্য ১ গ্রাম প্রোটিন ধার্য্য করা হয়েছে। অর্থাৎ ৬০ কেজি শরীরের ওজনের জন্য ৬০ গ্রাম প্রোটিন প্রয়োজন। [কিডনি রোগ ব্যতিত] গরমে মাংস (গরু, খাসী) পরিহার করে এর পরিবর্তে ছোট মাছ, পাতলা ডাল, টক দই, পাতলা দুধ, খাদ্যতালিকায় অনর্-ভূক্ত করে দৈনিক চাহিদা পূরণ করতে হবে।

শর্করা: ৬। শর্করা জাতীয় খাবারের দিকে একটু লক্ষ করুন। আপনি জানেন কি? আপনার শরীরে শর্করা জাতীয় খাবারের চাহিদা কতটুকু। এটি হচেছ মোট ক্যালরির ৬০%। অর্থাৎ আপনার ওজন উচ্চতা, বয়স, শারীরিক পরিশ্রম লিঙ্গ ভেদে শক্তি চাহিদা যদি হয় ২০০০ ক্যালরি তবে তার ৬০ % নিতে হবে শর্করা জাতীয় খাবার থেকে। অর্থাৎ ১২০০ ক্যালরি। ১২০০ গু ৪ = ৩০০ গ্রাম শর্করা, এটি আপনি পাবেন ভাত, রুটি, চিড়া, মুড়ি, সুজি, সাগু, চিনি, আলু ও ফল থেকে। দুধ থেকেও আপনি শর্করা পাবেন। অনেকে ফল ও দুধ নিয়ে চিনি-ত হবেন, চিন্তা মুক্ত হতে জেনে নিন:- ফলে গড়ে ১৫% শর্করা থাকে, দুধে ১২% শর্করা থাকে। মনে রাখতে হবে, পাকা আমে ক্যালরি প্রতি ১০০ গ্রাম পাকা আমে ৭৪ ক্যালরি পাওয়া যায়। আমে কোন প্রোটিন বা ফ্যাট নেই। পুরোটাই শর্করা। হ্যাঁ তবে ভিটামিন ‘এ’ পাবেন প্রচুর। প্রতি ১০০ গ্রাম পাকা আমে ২৭৪৩ মাইক্রোগ্রাম ক্যারটিন পাওয়া যায়। গরমে শর্করার চাহিদা মিটাতে ভাত, রুটি, চিনির পরিমান কমিয়ে ফল, সবজি, দুধ, দই খাদ্য তালিকায় স্থান দিন।

ভিটামিন ও খনিজ উপাদান: ৭। গরমে ভিটামিন ও খনিজ উপাদানের চাহিদা মেটাতে টক ফল ও মিষ্টি ফল দুটোই খাদ্যতালিকায় রাখতে হবে। এছাড়া রঙ্গিন শাক সবজি, তো রয়েছেই। সুষম খাদ্যতালিকা থেকে (ইধষধহপব উরবঃ) আপনার খাদ্যের ৬টি পুষ্টি উপাদানের চাহিদাই পুরণ হবে।

পানি: ৮। বিশুদ্ধ পানি গ্রহণের কথা ভূলে গেলে চলবে না। প্রতিদিন ২.৫ লিটার পানি গ্রহণ যথেষ্ট। ৩ লিটার পর্যন্ত গ্রহণ করা যেতে পারে। তবে কিডনি রোগী ও ফ্লুয়িড রিটেনশন সিনড্রমের রোগীরা পানি গ্রহণের ব্যাপারে সতর্ক হোন ও আপনার ডাক্তার এর পরামর্শ নিন।
৯। অত্যাধিক পরিশ্রম নিয়ন্ত্রণ করুন। প্রয়োজন অনুযায়ী বিশ্রাম করুন।
১০। নিজের প্রতি স্বাস্থ্য সচেতনতাই আপনাকে করবে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী, সজীব ও কর্মক্ষম।

এস এন সম্পা
পুষ্টিবিদ, শমরিতা হাসপাতাল
পান্থপথ, ঢাকা।
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, মে ০৮, ২০১০

কিডনি রোগীর পথ্য ও পুষ্টি

আমাদের দেশে দিনে দিনে কিডনি রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। এর মধ্যে ক্রনিক কিডনি রোগী ও শিশু কিডনি রোগী সর্বাধিক। এর কিছু সাধারণ কারণ হলো: ১. খাদ্যে ভেজাল ও বিষাক্ত খাদ্য ২. বাহিরের খাবারের প্রতি আগ্রহ ও খাদ্য গ্রহণ বৃদ্ধি ৩. প্রত্যেক স্কুলের সামনে অস্বাস্থ্যকর খোলা খাবার বিক্রয় ৪. ডায়াবেটিস ৫. উচ্চ রক্তচাপ ৬. শরীরে অতিরিক্ত ওজন ৭. প্রস্রাবে এলবুমিন নির্গত হওয়া ৮. কিছু কিছু ক্ষেত্রে জেনেটিক ও বংশগত কারণও দায়ী করা হয়। এর মধ্যে অনেক রোগের অন্যতম কারণ হলো নিজের প্রতি নিজের অসচেতনতা, অযত্ন। নিজেকেই নিজের যত্ন নিতে হবে। এক জন মানুষের প্রথম চিকিৎসক সে নিজেই নিজের একটুখানি সচেতনতা। তাকে অনেক রোগ প্রতিরোধ করতে সাহায্য করবে। “কথায় বলে” ঢ়ৎবৎবহ ভরফৎ রং নবঃবৎ ঃযবহ পবৎবব অর্থাৎ নিরাময়ের চেয়ে প্রতিকার ভালো। ব্যাক্তি সচেতনতা দিতে পারে নিরোগ শরীর। আর নিরোগ শরীরের জন্য চিকিৎসার কোন প্রয়োজন নেই। আমরা প্রত্যেকে যদি নিজে কেবলমাত্র নিজের দায়িত্ব নেই তবে রোগ প্রতিরোধ সম্ভব। কিছু নিয়ম-নীতি মেনে চললে অর্জন হবে সুস্বাস্থ্য, বেচে যাবে বিপুল পরিমাণ চিকিৎসা খাতের খরচ।

সাধারণ নিয়ম-নীতিগুলো হলো: ১. নিয়মিত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা, প্রতিদিন গোসল করা ও খাবার আগে সাবান দিয়ে হাত ধোয়া। ২. স্বাস্থ্যকর সুষম খাবার গ্রহণ করতে হবে। বাসী, পচাঁ খাবার ত্যাগ, অসচেতনতার দরুন বাসী পচাঁ খাবার থেকে ডায়রিয়া, আমাশয় এমনকি দির্ঘদিনের অভ্যাস থেকে কিডনি অকেজো হতে পারে। ৩. শরীরের আদর্শ ওজন বজায় রাখা। স্থূল শরীর বা অতিরিক্ত ওজন সমস- রোগের সম্ভাবনাকে বাড়ায়, যেমন: ডায়াবেটিস, উচ্চরক্ত চাপ এরা উভয়ে মিলে আক্রমণ করে কিডনির উপর। ৪.শুয়ে বসে দিন পার না করে স্বাভাবিক হাঁটাচলা, কাজকর্ম বজায় রাখা, নিয়মিত স্বাভাবিক ব্যায়াম করুন অথবা হাটুন। ৫. রক্তে চিনির স্বাভাবিক মাত্রার উপর নিয়ন্ত্রণ রাখা এবং নিয়মিত পরীক্ষা করা। ৬. নিয়মিত রক্তচাপ (ব্লাডপ্রেসার) পরীক্ষা করা। স্বাভাবিক রক্তচাপ ১২০/৮০। ৭. খাদ্যাভ্যাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ, প্রত্যেককে জানতে হবে সুস্থ্য নিরোগ আদর্শ ওজনের শরীরের জন্য কোন খাবার খাবো, কোন খাবার কম খাবো, কোন খাবার পরিহার করবো। কোন খাবার কি পরিমাণে খাবো। উদাহরণ: একজন কিডনি রোগী যার সিরাম ক্রিয়েটিনিন ৪০০ এর উপরে এবং সিরাম পটাসিয়াম ৫.৩ সে শারীরিক দুর্বলতার কারণে পর পর দুই দিন ইচ্ছামত মুরগীর স্যুপ এবং প্রচুর ফল খায়, ৩য় দিন তার অবস্থা গুরুতর হওয়ায় সে হাসপাতালে ভর্তি হয়। তার ধারণা ছিল উক্ত খাবার তার দুর্বলতা কাটাবে, সে স্বাভাবিক সুস্থ্যতা ফিরে পাবে। অথচ উক্ত খাবার উক্ত রোগীর জন্য বর্জনীয়। সে পরিমিত প্রোটিন (অর্থাৎ মুরগী), ফল (পটাসিয়াম সমৃদ্ধ) একে বারেই বর্জনীয়। প্রত্যেককে খাদ্য সমন্ধে সচেতন হতে হবে, পুষ্টিজ্ঞান অত্যন- প্রয়োজন।

বিশেষ কিছু রোগের খাদ্য নির্বাচন যেমন: (ক) ডায়াবেটিক (খ) উচ্চরক্ত চাপ (গ) কিডনী রোগ (ঘ) হৃদরোগ (ঙ) অতিরিক্ত ওজন কিডনী রোগীর বেলায়। ৮. প্রচুর পানি পান করুন। এ কথাটি মোটেও প্রযোজ্য নয়। বিশেষ করে কিডনি রোগের বেলায়। কারণ মূত্রত্যাগ এর পরিমানের উপর নির্ভর করে কতটুকু পানি পান করবেন। প্রচুর কথাটির নিদির্ষ্ট কোন মাপ নেই। তাই কিডনি রোগীকে বিশেষ সতর্ক হতে হবে পানি গ্রহনের ব্যাপারে। এ ব্যাপারে আপনার ডাক্তার অথবা ডাইটিশিয়ান অথবা স্বাস্থ্যকর্মির পরামর্শ নিন। উদাহরণ: কোন কোন কিডনি রোগীকে ৫০০ সষ পানি (২৪ ঘন্টায়) পান করার উপদেশ দেয়া হয়। তার শারীরিক অবস্থার কথা বিবেচনা করে। ৯. লবণ গ্রহণ: অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ কিডনি রোগকে তরান্বিত করে। প্রতিদিন রান্নায় ১ চা চামচ লবণ গ্রহণ করুন, এতে আপনার রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকবে। সংযত থাকুন: আচার, পনির, চিপস, লোনামাছ, শুটকি এবং সালাদ ও টকফল এর সাথে লবণ খাওয়া থেকে। ১০. ধূমপান ছেড়ে দিন। নতুবা এটি আপনাকে ছাড়বে না। উদাহারণ: একজন ৮০ বছর বয়স্ক বৃদ্ধা ফুসফুসের ক্যান্সার নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি। তার বিবরণী থেকে জানা গেল সে ২০ বছর বয়স থেকে সিগারেট টানা শুরু করছে, ৩০ বছর ক্রমাগত সিগারেট খেয়েছেন এবং ৩০ বছর ধরে খাচ্ছেন না = ৮০ বছর বয়সের হিসাব। বর্তমানে ৮০ বছর বয়সে ফুসফুসের ক্যান্সার। চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এখনই আপনি সিদ্ধান- নিন এখনই সচেতন হোন। ১১. খুব বেশী ওষুধ গ্রহণ থেকে বিরত থাকুন। একটুতেই ওষুধ মুখে নেবেন না। আপনার কিডনি ক্রমাগত উপকারী পুষ্টি ছেকে শরীরে ধরে রাখছে এবং অপ্রয়োজনীয় বর্জপদার্থ বের করে দিচ্ছে। আর স্বাভাবিক কাজে তাকে সাহায্য করুন। ১২. শক্তিবর্ধক ভিটামিন টেবলেট খাওয়া থেকে বিরত থাকুন। এটি ধীরে ধীরে আপনার কিডনি অকেজো করে দেয়। মনে রাখবেন আপনি যদি নিয়মিত সুষম খাবার (ইধষধহপব উরবঃ) গ্রহণ করেন তবে কোন কৃত্রিম ভিটামিনের প্রয়োজন নেই। সাময়িক স্বসি-র কাছে স্থায়ী কিডনি অকেজো সীমাহীন দুর্ভোগ নিজেই নিজের কিডনি অকেজো করবেন না। কিডনি রোগ অত্যন- যন্ত্রনাদায়ক, অত্যন- ব্যায়বহুল এবং বছরে ৪০ হাজার রোগী মারা যায়। আক্রান-দের মধ্যে ৯০ ভাগের পক্ষে এই ব্যায়বহুল চিকিৎসা করা সম্ভব হয় না। ১৩. ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপ হতে দুরে থাকুন। আমাদের দেশে ৫১ ভাগ লোকই জানে না তাদের ডায়াবেটিস এবং ৩৫ ভাগ লোকই জানে না তাদের উচ্চ রক্তচাপ। এই অজানা একত্রিত হয়ে জন্ম দেয় নতুন বন্ধু- সেটি হলো কিডনি অকেজো, উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না থাকার দরুন তাদের এই ভয়াবহ ফলাফল। একটু ব্যক্তিগত সচেতনতা এনে দিতে পারে অপরিসীম স্বস্থি, সাচ্ছন্দ্য। নিম্নে একজন কিডনি রোগের পথ্য ও অনে-র ব্যাপারে সাধারণ ধারণা দেয়া হলো: কিডনি রোগ সনাক্ত হবার সাথে সাথে ৩০ মস প্রোটিন প্রগণ করতে হবে এ ধারনা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীণ। প্রোটিন গ্রহনের পরিমাপ নির্ভর করবে তার রক্তের ক্রিয়েটিনিনের মাত্রার উপর। একজন প্রাপ্ত বয়স্ক সুস্থ ব্যাক্তির প্রতি কেজি দৈহিক ওজনের জন্য ১ গ্রাম প্রোটিন নির্ধারণ করা হয়। কিডনী রোগে আক্রান- ব্যাক্তির জন্য (০.৫ গ্রাম থেকে ০.৮ গ্রাম) প্রতি কেজি দৈহিক ওজনের জন্য নির্ধারণ করা হয়। সবচেয়ে গুরুতর অবস্থায় ৩০ কেজি ওজনের একজন রোগীর ০.৫ গ্রাম/কেজি প্রোটিন নির্ধারণ হয়। সেই হিসাবে (৩০ ী ০.৫) = ৩০ গ্রাম প্রোটিন। মনে রাখতে হবে কিডনি রোগীকে উচ্চ জৈব মূল্যের প্রানিজ প্রোটিন দিতে হবে। যেমন-মাছ, মাংস, ডিম, দই ইত্যাদি। এবং সঠিক হিসেব রাখতে হবে। ৩০ গ্রাম মাছ/মাংসের টুকরা মানে ৩০ গ্রাম প্রোটিন নয়, ৩০ গ্রাম টুকরা থেকে মাত্র ৭ গ্রাম প্রোটিন পাওয়া যাবে। অনেকে ১ টুকরার বেশী মাছ/মাংস খেতে চান না। ৩০ গ্রাম প্রোটিন পূরনের জন্য : ১ টুকরা মাছ (৩০ মস) = ৭ মস প্রোটিন, ১ টুকরা মুরগী (৩০ মস)= ৭ গ্রাম প্রোটিন, ১টি ডিমের সাদাঅংশ = ৪ গ্রাম প্রোটিন, ১ কাপ টক দই = ৬ গ্রাম প্রোটিন মোট= ২৪ গ্রাম প্রোটিন। বাকীটুকু ভাত, রুটি ও সবজি থেকে পাওয়া যায়। কিডনি রোগীর দিনে দিনে ওজন কমতে থাকে। এদিকে খেয়াল রেখে খাদ্য তালিকা তৈরী করতে হবে। তার খাবার সীমিত প্রোটিন ও যথাযথ ক্যালরী সমৃদ্ধ হবে বিশেষ ভাবে খেয়াল রাখতে হবে:

(১) কিডনি রোগী মাছ, মাংস, দুধ, ডিম সিমীত পরিমানে খাবেন। এগুলো প্রাণিজ প্রোটিন। (২) উদ্ভিজ প্রোটিন বা দ্বিতীয় শ্রেণীর প্রোটিন যেমন-ডাল, মটরশুটি, সিমেরবীচি যে কোন বীচি জবহধষ উরবঃ-এ থাকবে না। (৩) যে সমস- সবজি খাবেননা: ফুলকপি, বাধাকপি, গাজর, ঢেঁড়শ, শীম বরবার্ট, কাঠালের বীচি, শীমের বীচি, মিষ্টি কুমড়ার বীচি, কচু, মূলা এবং পালং, পুই ও মূলা শাক খাওয়া যাবে না। (৪) যে সমস- সবজি খাবেন: লাউ, জিংগা, চিচিঙ্গা, ডাটা, করলা, পটল, পেঁপে, ধূন্ধল, শশা (বীচি ছাড়া) সাজনা ইত্যাদি, সাকের মধ্যে ডাটা, লালশাক, কমলি, হেলেঞ্চা, কচু শাক খাওয়া যাবে। (৫) ডাল এবং ডাব একেবারেই খাওয়া চলবে না। কারণ কিডনি রোগীদের রক্তে পটাশিয়াম এর মাত্রা বাড়তে থাকে। কম পটাশিয়াম সমৃদ্ধ সবজি বেছে নিন। পটাশিয়ামের মাত্রা স্বাভাবিক হলো (৩.৫-৫.২) সড়ষ/ষ এর বেশী হলে খাদ্য তালিকায় ফল রাখা যাবে না। পটাশিয়ামের মাত্রা স্বাভাবিকের মধ্যে থাকলেও কিডনী রোগীরা কম পটাশিয়াম যুক্ত ফল বেছে নিন যেমন:- আপেল, পেয়ারা, পাকা পেঁপে, নাসপাতি, সবজির পটাশিয়ামের মাত্রা কমানোর জন্য সবজি রান্নার পূর্বে ভালো করে ধুয়ে নিন। ভারি করে কাটুন। প্রথমে সবজি সেদ্ধ করে পানি ফেলে দিন। তারপর রান্না করুন। (৬) অন্যান্য যে সমস- খাবার বাদ দিতে হবে তা হলো, টিনের খাবার, শুটকী মাছ, বাদাম, আচার, চাটঁনী, সস ইত্যাদি।

রক্তে ক্রিয়েটিনিন সম্পর্কে ধারনা: রক্তে ক্রিয়েটিনিনের স্বাভাবিক পরিমাপ হলো ৫৩-১২৩ মাইক্রোমোল/লিটার এর বেশী হলে আপনাকে সতর্ক হতে হবে। অনতি বিলম্বে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করুন। ক্রিয়েটিনিন ও প্রোটিন গ্রহন: রক্তে ক্রিয়েটিনিনের পরিমাপ: ৩০০ মাইক্রোমোল/লিটার হলে ৩০ গ্রাম প্রোটিন, ২৫০-৬০০ মাইক্রোমোল/লিটার হলে ৪০ গ্রাম প্রোটিন, ১৪০-২৫০ মাইক্রোমোল/লিটার হলে ৫০ গ্রাম প্রোটিন এর কিছুটা কম বা বেশী হতে পারে। এটি নির্ধারন করবে আপনার পুষ্টিবিদ।

একজন কিডনি রোগীর নিম্নের অবস্থার উপর নির্ভর করবে সে কি ধরনের পথ্য গ্রহণ করবে: (১) কিডনি রোগের প্রকার (২) কিডনি রোগের ধাপ (৩) রোগী ডায়ালাইসিস শুরু করেছেন কি না (৪) ডায়াবেটিস আছে কিনা (৫) রোগীর ওজন উচ্চতর কি না ও বয়স বিশ্লেষণে (৬) শারীরিক পরিশ্রম (৭) প্রস্রাব নির্গমনের পরিমাপ (৮) রক্ত পরীক্ষার ফলাফল, কিডনি রোগীকে বিশেষ ভাবে মনে রাখতে হবে, প্রত্যেক রোগীর পথ্য তালিকা ভিন্ন হবে, উপরোক্ত অবস্থার বিশ্লেষনে এবং পথ্য ব্যাবস্থাপনা আপনার চিকিৎসার অত্যন- গুরুত্বপূর্ণ অংশ। পথ্য আপনার কিডনি রোগ নিরাময় করবে না। পথ্য কিডনি রোগ নিয়ন্ত্রণে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে। এতে আপনি হয়তো যন্ত্রণার পরিবর্তে স্বসি- বোধ করবেন।

এস এন সম্পা
পুষ্টিবিদ, সমরিতা হাসপাতাল, পান্থপথ, ঢাকা।
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, মার্চ ০৬, ২০১০

ডায়রিয়া ও আমাশয়ে কাঁচকলা উপকারী

সবুজ কলা, যা সাধারণের কাছে কাঁচকলা নামে পরিচিত, সেই কাঁচকলা ডায়ারিয়া ও রক্ত আমাশায় বা ব্লাড ডিসেন্ট্রিতে উপকারী বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। আমেরিকান গ্যাস্ট্রো অ্যান্ট্রলজি অ্যাসোসিয়েশনের গ্যাস্ট্রো অ্যান্ট্রোলজি জার্নালে প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানিয়েছেন আইসিডিডিআরবির গবেষক, ডা. জিএইচ রব্বানী। ১-২ বছর বয়সের ২০০ শিশুর ওপর পরিচালিত এই গবেষণায় দেখা গেছে, শতকরা ৭০-৮৫ ভাগ ক্ষেত্রে ২-৪ দিনের মধ্যে ডায়ারিয়া ও রক্ত আমাশয়ে আক্রান্ত শিশুরা সেরে উঠছে। গবেষণায় বলা হয়েছে কাঁচকলায় রয়েছে বিশেষ ধরনের স্টার্চ বা শকরা জাতীয় উপাদান, যা মানুষের হজমযোগ্য নয়। এই উপাদানটি পরিপাকনালী পৌঁছার পর সেখানে অবস্থিত ব্যাকটেরিয়ার দ্বারা ভেঙে ফ্যাটি এসিডে পরিণত হয়। এ ফ্যাটি অ্যাসিড পরিপাকনালী থেকে লবণ ও পানিকে শোষণ করে ধরে রাখার মাধ্যমে ডায়রিয়া রোধ করে। এ গবেষনার সময় ২৫০ গ্রাম সিদ্ধ করা কাঁচকলার সঙ্গে ১০ গ্রাম চালের গুঁড়া এক সঙ্গে রান্না করে ধকধকে জাউ হিসেবে চামচ দিয়ে শিশুদের খাওয়ানো হয়, যেহেতু চার মাস বয়সের আগে শিশুদের হজমক্ষমতা পূর্ণতা পায় না; তাই এই বয়সের আগে কাঁচকলার এই জাউ খাইয়ে কোনো লাভ হবে না। কিন্তু সব বয়সের ক্ষেত্রে কাঁচকলা ডায়রিয়া কমাতে কতটুকু সাহায্য করবে তা নিয়ে এখনো গবেষণা হয়নি। তা ছাড়া এ গবেষণা ডায়রিয়া আক্রান্ত হাসপাতালে ভর্তি শিশুদের ওপর পরিচালিত হওয়ায় ডায়রিয়ার শুধু কাঁচকলার জাউ খেলেই চলবে কি না, সে সম্পর্কে এখনো কোনো গবেষণা হয়নি। গবেষণায় আরো বলা হয়, যেকোনো জাতের কাঁচকলা দিয়েই এটি তৈরি করা যেতে পারে। তবে পাকা কলায় এই উপকরণ পাওয়া যাবে না। কারণ পেকে যাওয়ার সঙ্গে বিশেষ ধরনের সেই স্টার্চ চিনিতে রূপান্তরিত হয়ে যায়।

সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, আগস্ট ০১, ২০০৯

অগ্রগতির পথে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান ও বিশ্বব্যাপী ইসলামী জাগরণ

ড. জহির উদ্দিন মাহমুদ

ইতিহাসের এক চরম সন্ধিক্ষণে আইয়ামে জাহেলিয়াতের শত দেবতার নিষ্পেষণ থেকে মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) নিপীড়িত মানবতাকে মুক্তি দিয়েছিলেন। মানবজাতি প্রত্যক্ষ করেছিল এক অকৃত্রিম শাশ্বত ভারসাম্যপূর্ণ জীবনব্যবস্থা। কিন্তু দীর্ঘ পথপরিক্রমায় ইসলামের সে অবিকৃত রূপ থেকে মানুষ দূরে সরে গিয়েছিল। বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষের পাশাপাশি নৈতিক চরিত্রের চরম অধঃপতন, সাম্রাজ্যবাদী শোষক শ্রেণীর হিংস্র আগ্রাসন, দেশে দেশে মুক্তিকামী মজলুম জনতার করুণ আহাজারি যখন পৃথিবীকে ভারাক্রান্ত করে তুলেছিল তখনই পারস্যের শাহী লৌহপ্রাচীর ভেদ করে মহান নেতা ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর নেতৃত্বে সংঘটিত ইসলামী বিপ্লব মানবজাতির সামনে আবারো সেই চিরন্তন সত্যবাণী ঘোষণা করল – ‘সত্য এসেছে, মিথ্যা বিলুপ্ত হয়েছে, মিথ্যা তো বিলুপ্ত হবারই’। (সূরা বনি ইসরাইল : ৮১)

বিশ্ব-যায়নবাদী চক্রের হাতে বনিদ পৃথিবীর মানুষগুলো আবার নতুন করে ভাবতে শিখল। অভ্যন্তরীণ শত্রুদের অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা ও বহিঃশত্রুর কুটনৈতিক, রাজনৈতিক, সামরিক আগ্রাসন আর অব্যাহত অপপ্রচারের প্রবল লড়াই মোকাবিলা করে বিগত ৩৩ বছর ধরে ইসলামী বিপ্লব বিশ্ব-মুসলমানের জন্য এক অনুকরণীয় আদর্শ রূপে অটল থেকে ৩৪তম বছরে প্রবেশ করেছে।

সমকালীন বিশ্বে সংঘটিত এত বড় ঘটনার পরবর্তী তিন দশক খুব একটা দীর্ঘ সময় নয়। এ অল্প সময়েই সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব-শয়তানি চক্র এ ইসলামী বিপ্লবের প্রতি নানাভাবে তাদের মাত্রাতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। এর কারণ হিসেবে অনেকে মনে করেন, শত শত বছর ধরে এই শোষক পুঁজিবাদী গোষ্ঠী বিশ্বের তাবৎ জনগোষ্ঠীর চোখে ধুলা দিয়ে বিশ্বকে একচেটিয়াভাবে শোষণ করে আসছিল; ইরানের ইসলামী বিপ্লবের বিজয়ের কারণে যেন তাতে ছেদ পড়ল। বিশেষ করে বিপ্লবের নেতা ইমাম খোমেইনী (রহ্.)-এর সময়োপযোগী, জাগরণী ও সুনির্দিষ্ট তথ্যবহুল বাণীসমূহ ধীরে ধীরে যখন মানুষের চোখ খুলে দিচিছল তখনই এই বিশ্বলুটেরা গোষ্ঠী এ বিপ্লব ও তার নেতার প্রতি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। বিশ্বব্যাপী তাদের নিয়ন্ত্রিত সকল মিডিয়া ও তাদের দোসরদের মাধ্যমে ইসলামী বিপ্লব ও ইসলামী প্রজাতন্ত্রকে তারা পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার প্রচেষ্টা চালালো। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদীদের সকল হিসাবকে ভুল প্রমাণ করে এ বিপ্লব স্ব মহিমায় এগিয়ে যাচেছ।

ইরানে ইসলামী বিপ্লব সংঘটনের পর থেকে যে সব বাধার সম্মুখীন হয় তার মধ্য থেকে কয়েকটি এখানে তুলে ধরা হলো :

১. অপপ্রচার : ইসলামী বিপ্লব ও তার নেতৃবৃনদ সম্পর্কে অপপ্রচার চালিয়ে বিকৃত চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। যেমন :

ক.   ইসলামী বিপ্লব ইরানকে একটি পশ্চাদপদ দেশে পরিণত করেছে;

খ.   বিপ্লবী ইরান ইসলামের উদারনীতির বিপরীত একটি উগ্র ধারা গড়ে তুলেছে;

গ.   ইরান (রাজা-বাদশাহ শাসিত তথাকথিত আধুনিক) আরব দেশগুলোতে আগ্রাসন চালিয়ে এ দেশগুলোকে দখল করবে;

ঘ. ইরানের পরমাণু সক্ষমতা অর্জন ও মিসাইল প্রযুক্তির অগ্রগতি প্রতিবেশী দেশগুলোর জন্য হুমকি (যদিও ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচী কেবল শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে নিবেদিত);

ঙ.   ইরান পুরাতন পারস্য সাম্রাজ্যের পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালাবে;

চ.   ইরানের বিপ্লব একটি শিয়া বিপ্লব যার লক্ষ্য বিশ্বব্যাপী শিয়া সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা;

ছ.   শিয়ারা মুসলমান নয়; বরং তারা একটি ভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠী, একটি বিভ্রান্ত সম্প্রদায়; শিয়ারা ইহুদিদের দোসর;

জ.   এ বিপ্লব নারী অধিকার পদদলিত করছে;

ঝ.   এ বিপলব গণতন্ত্র, মানবতা ও বাক-স্বাধীনতার বিরোধী।

২. অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা : ইরানের বিপ্লববিরোধী অভ্যন্তরীণ গোষ্ঠীকে ব্যবহার করে বিপ্লবের প্রতি নিবেদিত অসংখ্য দেশপ্রেমিক নেতাকে গুপ্তহত্যা করা হয়। গুপ্ত হামলায় ১৯৭৯ সালের ১ মে আয়াতুল্লাহ মোতাহ্হারীর শাহাদাত, ১৯৮১ সালের ২৮ জুন ড. বেহেশতী সহ ৭২ জন নেতার শাহাদাত, ১৯৮১ সালের ৩০ আগস্ট প্রেসিডেনট রাজাই ও প্রধানমন্ত্রী বাহোনারের শাহাদাত এ ষড়যন্ত্রেরই অংশবিশেষ। বিপ্লবের প্রথম দশকে বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী ড. মোস্তফা চামরান (১৯৮১) ও সাম্প্রতিককালে চারজন পরমাণু বিজ্ঞানী গুপ্তহত্যার শিকার হন। জুনদুল্লাহ বাহিনীর গুপ্তঘাতকের পেতে রাখা বোমায় শহীদ হন জেনারেল নূর আলী শুশ্তারী। ইরানের ইসলামী বিপ্লবের পূর্বে ও পরে এ বিপ্লবের সফলতার জন্য প্রাণ দেন লক্ষাধিক মানুষ।

৩. আগ্রাসন : বাথপন্থী জল্লাদ চরিত্রের সাদ্দামকে দিয়ে ইরানের ওপর আগ্রাসন চালিয়ে আট বছর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ অব্যাহত রাখা হয়। ইরানের বাইরে অনেক ইসলামী নেতাকে হত্যা ও গুম করা হয়। এ যুদ্ধে প্রায় দুই লক্ষ ইরানী দেশপ্রেমিক শহীদ হন। ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে পারস্য উপসাগরে ইরানী এয়ারবাস বিধ্বস্তকরণ (১৯৯০) – যে হামলায় ২৯২ জন যাত্রী নিহত হন, মার্কিন গুপ্তচরদের উদ্ধার করার জন্য ইরানের তাবাস মরুভূমিতে অভিযান (২৫ এপ্রিল, ১৯৮০) এবং মক্কায় হারাম এলাকায় তিন শতাধিক হাজীকে শহীদ করা (১৯৮৭) এসব আগ্রাসনেরই অংশ ছিল।

৪. বিপ্লবের নেতৃবৃনেদর মাঝে দ্বন্দ্ব সৃষ্টির প্রয়াস : ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের বিভিন্ন নেতার মাঝে কাউকে কট্টরপন্থী, কাউকে উদারপন্থী বলে প্রচার করে তাঁদের মাঝে বিরোধ সৃষ্টির চেষ্টা চালানো এবং বহির্বিশ্বে তা ফলাও করে প্রচার করা হয়।

৫. পণ্য আমদানিতে বাধা : বিজ্ঞান ও প্রকৌশলগত গবেষণার জন্য অতীব প্রয়োজনীয় সামগ্রী, বিমান ও অন্যান্য বাহন ও যন্ত্রপাতির স্পেয়ার পার্টস ইত্যাদি (যখন ইরান এসবে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয় নি) ইরানে আমদানি করতে বাধা দেয়া হয়। একইভাবে বাণিজ্যিক লেনদেনেও বাধা দেয়া হয়।

৬. শিয়া-সুন্নি বিরোধ উস্কে দেয়া : দেশে দেশে শিয়া-সুন্নি বিষয়টিকে ইস্যু বানানো হয়। এমনকি বিভিন্ন দেশে শিয়াদের ও ইরানী কুটনীতিকদের গুপ্তহত্যা করা হয়। যেসব দেশে ৭০:৩০, ৬০:৪০, ৮০:২০ অনুপাতে শিয়া-সুন্নি জনসংখ্যা বিরাজ করছে সেখানে সুন্নি জনগোষ্ঠী ও নেতৃবৃনদকে শিয়াদের সাথে শত শত বছর ধরে চলে আসা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও যৌথ ব্যবসায়ে বাধা দেয়া হয়। শিয়াদের সাথে না মিশতে ভীতি প্রদর্শন করা হয়, এমনকি শিয়াদের সাথে যৌথ সরকারে বা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করলে হুমকি দেয়া হয় এবং হত্যাকান্ডও চালানো হয় (ইরাক, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে)।

৭. বৈজ্ঞানিক কর্মকান্ডে বাধা প্রদান : পারমাণবিক ও অন্যান্য বৈজ্ঞানিক সক্ষমতা অর্জনে বাধা দেয়া হয়। এতে সফল না হওয়ায় ‘ইরান পারমাণবিক বোমা তৈরি করছে’ এই মিথ্যা অভিযোগের ধুয়া তুলে ইরানের প্রতি অব্যাহত অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করা হয় এবং ইরানে আগ্রাসন চালানোর হুমকি দেয়া হয়। ড্রোন গোয়েনদা বিমান পাঠিয়ে ইরানের প্রতিরক্ষা ও অন্যান্য সক্ষমতা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য ইরানের সীমানা অতিক্রমের চেষ্টা করা হয়। আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) পক্ষ থেকে নিয়মিত পরিদর্শনে আগত পরিদর্শকদলের কাছ থেকে ইরানের বিভিন্ন কৌশলগত স্থানের চিত্র ও তথ্য হস্তগত করার চেষ্টা করা হয় – যে সম্পর্কে ইরান অনেক বার অভিযোগ করেছে।

৮. সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের জন্য ইরান ও ইসলামপন্থীদের দায়ী করা : বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন জনপদে সামা্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী তাদের ভাড়াটে লোকদের দিয়ে বোমা হামলা চালিয়ে কাজটি ইরান করেছে বলে প্রচার করে এবং এজন্য ইরানকে অভিযুক্ত করার চেষ্টা চালায়। নাইন-ইলেভেনের ঘটনা এবং এর ধারাবাহিকতায় ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা এর সবচেয়ে বড় ঘটনা।

৯.  বিশ্বে ইসলামকে কদর্য রূপে তুলে ধরা : সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী ও তাদের বাদশাহী দোসরদের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে মুসলমানদের স্বল্পজ্ঞানী ও স্বল্প তথ্যজ্ঞানসম্পন্ন মোটা বুদ্ধির মোল্লাদের দিয়ে আল-কায়েদা, তালেবান, সিপাহে সাহাবা ইত্যাদি বিভিন্ন নাম দিয়ে বিভিন্ন জঙ্গীবাদী গ্রুপ তৈরি করা হয়। এসব গ্রুপের নামে বিভিন্ন দেশে (প্রায় সবগুলোই মুসলিম দেশে) নিরীহ মানুষদের হত্যা করা, ঐতিহাসিক নিদর্শন ধ্বংস করা, ইসলাম ও মহানবী (সা.)-এর স্মৃতি বিজড়িত স্থানসমূহের চিহ্ন ধ্বংস করা, নারীশিক্ষা বন্ধ করা, টেলিভিশন দেখা বন্ধ করা ও অনুরূপ কাজ করে ইসলাম ও মুসলমানদের সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী এক বিকৃত চিত্র প্রকাশ করা হয় এবং ভীতি সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়। এসব দুর্ঘটনার ডামাডোলে বেছে বেছে মেধাবী ইসলামী ব্যক্তিত্বদের হত্যা করা হয়।

১০. তথ্যের অবাধ প্রবাহে বাধা দান : ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের নেতৃবৃনেদর বাণী, বক্তব্য, বিভিন্ন ডকুমেনট অন্যান্য দেশে বিশেষ করে গণমাধ্যমসমূহে প্রচারে বাধা দেয়া হয়। নিতান্তই কিছুটা প্রচার করলেও তা বিকৃতভাবে প্রচার করা হয়।

১১. তথাকথিত নেতৃত্বের প্রচারণা : ইরানের ইসলামী বিপ্লবের নেতৃত্বের আবহ যেন অন্যান্য মুসলিম দেশে না পড়ে সেজন্য সাদ্দাম, গাদ্দাফী, মাহাথির মোহাম্মদ, লাদেন, মোল্লা ওমর, আইমান আল-জাওয়াহিরি প্রমুখ ব্যক্তিদের নিয়ে সারা বছর ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে মিডিয়া কভারেজ দেয়া হয় এবং তাদের কণ্ঠে সর্বদা রণহুঙ্কারের তথ্য প্রচার, অন্যান্য ধর্মের লোকদের হত্যা করার ঘোষণা, অন্যান্য দেশের স্থাপনায় হামলার ঘোষণা মিডিয়ায় ফলাও করে আসতে থাকে। অথচ আজ পর্যন্ত ঐসব ব্যক্তির কোনো কর্মসূচি, মেনিফেস্টো, ফলো-আপ বিশ্ববাসী দেখে নি। এরা সবসময়ই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের তথাকথিত ছায়াশত্রু। এদের হুমকি ও আক্রমণের ছুতা দেখিয়ে মুসলমানদের বিভিন্ন স্থান ও সম্পদ দখল করাই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের চিরাচরিত কর্মপদ্ধতি।

১২. ইরান-বিরোধী চলচিচত্র ও প্রকাশনা : ইতিমধ্যে হলিউড সহ পাশ্চাত্যের বিভিন্ন চলচিচত্রধারায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ চরিত্র চিত্রায়িত করে প্রচুর ইরান-বিরোধী চলচিচত্র নির্মাণ করা হয়েছে। একইভাবে প্রচুর পুস্তক-সাময়িকীর মাধ্যমে, এমনকি উচচতর অ্যাকাডেমিক গবেষণা (Ph.D) থিসিসের মাধ্যমেও ইরানের ইসলামী বিপ্লব ও এর নেতৃবৃনদ সম্পর্কে বিকৃত ও ভুল তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে।

ইরানের ইসলামী বিপ্লবের বিরুদ্ধে উপরিউক্ত পদ্ধতিতে বাধার প্রাচীর সৃষ্টি করা ছাড়াও আরো বহুমুখী পদ্ধতিতে ইরানের এ বিপ্লবের প্রতি নেতিবাচক আচরণ করা হয়।

এবার আমরা ইসলামী বিপ্লব সংঘটনের পর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বলয়ে যে মৌলিক সাফল্যগুলো অর্জন করেছে সেগুলো সংক্ষেপে তুলে ধরছি :

১. ইসলামী প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা : ১৯৭৯ সালে মহান আল্লাহর সার্বভৌমত্বের মূলনীতির ভিত্তিতে প্রত্যক্ষ গণভোটে ৯৮% ভোট পেয়ে ইসলামী প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় এবং গত ৩৪ বছরে বিভিন্ন পর্যায়ে ৩০টি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগ সহ সব ধরনের Infrastructure-ই আধুনিক ইসলামী প্রজাতন্ত্রে বিদ্যমান। ইরানে বিচার বিভাগ সম্পূর্ণই স্বাধীন। ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান কুরআন-সুন্নাহ ও আহ্লে বাইতের শিক্ষার ওপর প্রতিষ্ঠিত।

২. নাগরিক সুবিধা প্রদান : ইসলামী ইরানে সকল মানুষ সকল মৌলিক নাগরিক সুবিধা – খাদ্য, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, মত প্রকাশের সুবিধাদি ভোগ করছে। বর্তমানে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে প্রত্যেক নাগরিক মাসিক ৪৫,০০০ তুমান করে নিয়মিত ভাতা পাচেছ। স্বল্প আয়ের জনগণ কম খরচে ও ঋণসুবিধা পেয়ে গৃহের মালিক হচেছ। নববিবাহিতরা গৃহায়ণ ঋণ পাচেছ। বিপ্লবের পর পরই প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ, পানি, স্কুল-কলেজ ও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করে তাৎক্ষণিক নাগরিক সুবিধা পৌঁছে দেয়া হয়েছে।

৩. সামাজিক নিরাপত্তা ও ইসলামী পরিবেশ : ইরান বর্তমান বিশ্বে একটি বিরল রাষ্ট্র যেখানে জনগণ বিশেষ সামাজিক নিরাপত্তা ভোগ করছে। দিনে-রাতে সর্বক্ষণ সকল নারী-পুরুষ নিরাপদে রাস্তাঘাটে চলাচল করতে পারে। শালীন পোশাক, নারীর হিজাব মেনে চলা ও প্রচারমাধ্যমে অশ্লীলতার চিহ্ন না থাকায় অপরাধপ্রবণতা সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে।

৪. বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে অসামান্য সাফল্য : একের পর এক যুদ্ধ, অবরোধ, পাশ্চাত্যের অসহযোগিতা, হুমকি ও সর্বশেষ সাম্প্রতিক বিশেষ অর্থনৈতিক অবরোধের (যার ফলে তেল রপ্তানি এক-তৃতীয়াংশে নেমে এসেছে) মুখে দেশের সর্বোচচ ধর্মীয়-রাজনৈতিক নেতার নির্দেশে ইরানের বিজ্ঞানীরা চরম আত্মত্যাগ ও সাধনার পরিচয় দেয়ায় দেশটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে শনৈ শনৈ উন্নতি করছে (যার সংক্ষিপ্ত খতিয়ান এ নিবন্ধের শেষে সংযুক্ত করা হয়েছে)। বিজ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রে ইরানের বিজ্ঞানীদের অগ্রগতি বর্তমানে সমগ্র বিশ্বের বিজ্ঞানীদের গড় অগ্রগতির ১১ গুণ দ্রুততর (Fastest)। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে স্বল্পতম সময়ে তারা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে বিশ্বের প্রথম ৫টি দেশের মাঝে স্থান করে নেবে। (শান্তিপূর্ণ কাজে ইরানের বিজ্ঞান গবেষণা কার্যক্রম সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে Iranian Technology for Peace and Human Prosperity সংস্থার রয়েছে ওয়েবসাইট http://diplotech.isti.ir/)

৫. দ্বীনের আলোকে সাংস্কৃতিক বিপ্লব : ইরানের ইসলামী বিপ্লবের পর অনেক ইসলামপন্থী ও সেকুলার জনগণ মনে করেছিল যে, ইরান বোধ হয় ইসলামের প্রথম যুগের উমাইয়্যা ও আববাসী খলিফাদের মতো রাজ্যজয় ধরনের কর্মসূচি গ্রহণ করবে এবং একের পর এক অভিযান চালিয়ে বিভিন্ন ভূখন্ডে ইসলামী হুকুমত কায়েম করবে। কিন্তু ইরানীরা, তাদের ভাষায়, প্রকৃত মুহাম্মাদী ইসলাম – তারা মহানবী (সা.)-এর আহ্লে বাইতের ইমামদের রেওয়াইয়াত ও জীবন থেকে যার শিক্ষা নিয়েছে – সে ধারায় রাজ্যজয় ধরনের কোনো জবরদস্তিমূলক হুকুমত কায়েমের ধারায় বিশ্বাস করে না। তারা মহানবী (সা.) ও তাঁর আহ্লে বাইতের শিক্ষা ও কুরআনের সংস্কৃতির বিকাশ করতে চায় এবং প্রকৃত ইমাম ও রাহবারের নেতৃত্বে জীবনকে ঢেলে সাজাতে চায়, আর সে আলোকে একটি সমাজ যদি সত্যিই পরিপুষ্টতা (maturity) লাভ করে তাহলে স্বাভাবিক গতিতে জনগণের মাধ্যমে রাষ্ট্রব্যবস্থায় ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। আর একবার যদি সঠিক যোগ্যতাসম্পন্ন মুজতাহিদের অধীনে ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠিত হয় তাহলে অভ্যন্তরীণ শত্রু (মুনাফিক) ও বহিঃশত্রুর হাত থেকে তার প্রতিরক্ষা করা তাদের দৃষ্টিতে ফরয হয়ে দাঁড়ায়।

ক. এ ধারায় ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান সারা দেশে ও বহির্বিশ্বে সকল বয়সী ও সকল পেশার মানুষের মাঝে কুরআন শিক্ষা প্রোগ্রাম ছড়িয়ে দিয়েছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে কুরআন তেলাওয়াত ও হিফ্য প্রতিযোগিতার আয়োজন ও অংশগ্রহণ ব্যাপক করেছে। কুরআনের বিভিন্ন কাহিনী নির্ভর চলচিচত্র ও সিরিয়াল তৈরি করেছে। যেমনঃ মারইয়াম মুকাদ্দাসা, মুল্কে সুলায়মান, হযরত ইউসুফ, মারদানে আনজালোস (আসহাবে কাহাফ এর ঘটনা অবলম্বনে) ইত্যাদি। ইরান প্রতি রমযানে আন্তর্জাতিক কুরআন প্রদর্শনীর আয়োজন করে যাতে কুরআন বিষয়ক গবেষক, লেখক, ক্যালিগ্রাফি-শিল্পী ও হাফেয-ক্বারীগণের সরব উপস্থিতি থাকে। এছাড়া কুরআনিক গযল, বিষয়ভিত্তিক, কাহিনী-ভিত্তিক, শব্দভিত্তিক ইত্যাদি বিভিন্ন সফ্টওয়্যার তৈরি করেছে।

খ. সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ কার্যক্রম : রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে ও প্রতিটি প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তি পর্যায়ে এ কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এজন্য প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে বাসিজ (গণসংগঠন) রয়েছে – যারা সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রমের পাশাপাশি বিনোদন, চলচিচত্র, ডকুমেনটারী প্রদর্শন ইত্যাদির মাধ্যমে সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ কার্যক্রম চালিয়ে থাকে। জাতির ক্রান্তিকালে তারা গণসংযোগের মাধ্যমে নাগরিকদের কর্তব্য নির্ধারণে পরামর্শ দিয়ে থাকে।

গ. হিজাবের সংস্কৃতি : ইরানী নারীদের হিজাবের মডেলটি এখন বিশ্বব্যাপী মুসলিম নারীদের মাঝে ছড়িয়ে পড়েছে। এমনকি অনেক দেশে কিছুসংখ্যক অমুসলিম নারীও আজকাল এ ধরনের হিজাব পরছেন। এটি নারীদের মাঝে এক সাংস্কৃতিক বিপ্লব। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, অফিস-আদালত, খেলাধুলা – সর্বত্র হিজাব পরে নারীর স্বচছনদ গতিময় চলাফেরা বিশ্বব্যাপী নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় এক উন্নত মডেল উপস্থাপন করেছে।

ঘ ইরানী চলচিচত্র, পেইনিটং, ফটোগ্রাফি, ভাস্কর্য ইত্যাদি : মানুষের সুকৃতি আচরণকে বিকশিত করার জন্য ইরান সকল শিল্পমাধ্যমকেই ব্যবহার করছে। আর ইরানীরা এসব ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা ও প্রদর্শনীসমূহে অংশগ্রহণ করে শুধু স্বদেশের জন্য সম্মানই বয়ে আনছে না; বরং সকল মুসলমানের পক্ষ থেকে এক শক্তিশালী প্রতিনিধিত্ব করছে। ইসলাম সুস্থ ও মানবিক চিন্তার বিকাশের পথে সাংস্কৃতিক চর্চার বিরোধী তো নয়ই, বরং সংস্কৃতির উন্নত সংস্করণ উপহার দিতে সক্ষম – এটাই প্রমাণ করেছে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান। অশ্লীলতা ও উগ্রতাবর্জিত ইরানী আর্ট ফিল্ম ও অ্যাকশন ফিল্ম আজ বিশ্ববিখ্যাত।

৬. প্রতিরক্ষায় স্বনির্ভরতা ও স্বয়ংসম্পূর্ণতা : ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান অত্যাধুনিক প্রযুক্তির প্রতিরক্ষা সামগ্রী তৈরি করে তার জল, স্থল, আকাশপথের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে। ইরানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আত্মরক্ষামূলক, আক্রমণাত্মক নয়। আজ পর্যন্ত ইরান তার প্রতিবেশী বা দূরবর্তী কোনো দেশে নিজ থেকে আক্রমণ করেছে এমন কোন নজির নেই। ইরানের প্রচলিত ও অপ্রচলিত অনেক যুদ্ধকৌশল রয়েছে যা বহিঃশত্রু আক্রমণ করলেই টের পাবে। ইরানের প্রতিরক্ষা ও সামরিক সক্ষমতা সম্পর্কে পশ্চিমা শক্তির অনেকটা ধারণা রয়েছে। এ কারণেই বিগত ৩৪ বছরে শত বার হুমকি দিয়েও তারা ইরানকে আক্রমণের সাহস করে নি। পাশ্চাত্য ইরানের সাথে অর্থনৈতিক, কৌশলগত, মিডিয়াগত ইত্যাদি এককথায় একটি soft war-এ লিপ্ত রয়েছে।

৭. ইসলাম ও মানবতার বড় শত্রু চিহ্নিত করা : ইসলামী ইরান বিপ্লবের শুরু থেকেই তার নিজস্ব গণমাধ্যম, সাময়িকী ও আন্তর্জাতিক ফোরাম ও আন্তর্জাতিক সম্মেলনসমূহে ইসলাম ও মানবতার অভিন্ন শত্রুকে চিহিত করতে সক্ষম হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, সাম্রাজ্যবাদী, পুঁজিবাদী, যায়নবাদী ও বর্ণবাদী আগ্রাসী শক্তিসমূহের অপরাধের খতিয়ান ইরান জাতিসঙেঘর অধিবেশনসমূহে ও আন্তর্জাতিক আদালতে ( হেগে) লিখিতভাবে ডকুমেনেটড করেছে। ইরান কোনো আন্তর্জাতিক ফোরাম বর্জন করে নি। বরং জাতিসঙঘ, ওআইসি, জোটনিরপেক্ষ আনেদালন, ডি-৮ সম্মেলন, ওপেক ও ECO সহ সকল ফোরামে ইরান সক্রিয় ও গঠনমূলক ভূমিকা পালন করে স্বীয় ন্যায্য অধিকার আদায়ের ও মানবতার উন্নয়নের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচেছ।

৮. বিশ্বে মার্কিন নিয়ন্ত্রিত একমেরু (Unipolar) রাজনীতি রুখে দেয়া : মার্কিন-ব্রিটেন যায়নবাদী গোষ্ঠীর একমেরুভিত্তিক রাজনৈতিক হিসাবকে ইরান ভুল প্রমাণ করেছে। অবশ্য এ অবস্থাটি অর্জন করতে ইরানকে অনেক প্রচেষ্টা চালাতে হয়েছে। মৌলিক আদর্শের বিতর্কে না জড়িয়ে মানবতা, সুস্থ সংস্কৃতি, সমানাধিকার, ন্যায়বিচার ও বাণিজ্যিক লেনদেনের বিষয়গুলোকে ভিত্তি করে ভারত, চীন, রাশিয়া ও দক্ষিণ আমেরিকার বামপন্থী সরকারগুলোর সাথে ইরান ব্যাপক কৌশলগত সম্পর্ক গড়ে তুলেছে যার ফলে ঐ সব দেশ স্ব স্ব অবস্থানে ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফেরামে আমেরিকার একক পরাশক্তি হওয়ার খায়েশকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছে এবং তার Unipolar প্রভাবকে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে।

৯. অন্যান্য দেশের সাথে সম্পর্কোন্নয়ন : ইরান মধ্যপ্রাচ্যের ও আফ্রিকার আরব দেশসমূহ ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর সাথে ব্যাপক সাংস্কৃতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। এর ফলে সে সব দেশ আজ আন্তর্জাতিক কোনো ফোরামেই ইসলামী প্রজাতন্ত্রের বিরোধিতায় অবতীর্ণ  হচেছ না। এসব সম্পর্কের ব্যাপক সুফল রয়েছে। সুদান, গাম্বিয়া ও লেবানন সহ বেশ কয়েকটি দেশের সাথে ইরানের রয়েছে ব্যাপক ও দীর্ঘ মেয়াদী বাণিজ্যিক, সমাজকল্যাণমূলক ও প্রতিরক্ষা চুক্তি। সুদান ও লেবানন তো হিজাব সহ সামাজিক অনেক বিষয়ে ইসলামী প্রজাতন্ত্রকে অনুসরণ করছে।

১০. ইরাক, ফিলিস্তিন, লেবানন ও আফগানিস্তানের শরণার্থীদের আশ্রয় প্রদান ও এর সুফল : আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসন ও ইরাকে সাদ্দামের নির্যাতনে সব মিলিয়ে প্রায় ৫০ লক্ষ শরণার্থী বছরের পর বছর ধরে ইরানে অবস্থান করেছে। ইসলামের মানবিক সাহায্যের শিক্ষা অনুসরণ করে ইরান তাদের আশ্রয় দিয়েছে। আর তারা অন্যান্য দেশের শরণার্থীদের মতো কোনো শরণার্থী শিবিরে আটক ছিল না; বরং তারা সর্বত্র বিচরণ, শিক্ষা, ব্যবসা, কর্মসংস্থানেরও ব্যাপক সুযোগ পেয়েছে। আর সেই সাথে হয়েছে ইরানের বিপ্লবীদের সাথে তাদের চিন্তাগত বিনিময়। বর্তমানে এদেরই বিরাট অংশ ইরাক ও আফগানিস্তানে ব্যাপক প্রভাবশালী ভূমিকায় রয়েছে। ফিলিস্তিনি ও লেবাননি বহু নেতা দীর্ঘদিন ইরানে থাকাকালে ইরানের ইসলামী বিপ্লব থেকে অনেক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন। ইরানের ধর্মীয় আধ্যাত্মিক নেতৃবৃনেদর সাথে তাঁদের সখ্য গড়ে উঠেছে।

১১. আল্-কুদ্স ও ফিলিস্তিন প্রসঙ্গে ইরানের ভূমিকা : ইরানে ইসলামী বিপ্লব সংঘটনের পর এ বিপ্লবের নেতৃবৃনদ যে আন্তর্জাতিক ও ধর্মীয় ইস্যুতে তাঁদের চিন্তা ও প্রচেষ্টাকে সর্বাধিক পরিমাণে নিয়োজিত করেছেন তা হচেছ ফিলিস্তিন ইস্যু। বিপ্লবের পর থেকেই ফিলিস্তিনিদের মানবিক ও অন্যান্য কৌশলগত ক্ষেত্রে ইরানই সর্বাধিক সাহায্য প্রদান করেছে। ইরানের বিপ্লবী নেতাদের অনুপ্রেরণায়ই ফিলিস্তিনিদের ব্যাপক অংশ আপোসের পথ পরিহার করে শক্তিশালী ইন্তিফাদা গড়ে তোলে; গড়ে ওঠে বিপ্লবী সংগঠন হামাস। ইরানের পাশাপাশি শক্তিশালী সাহায্যে এগিয়ে আসে লেবাননের হিজবুল্লাহ ও সিরিয়ার সরকার। ফিলিস্তিনিরা শক্তি ও সাহস পুনঃসঞ্চয় করে যায়নবাদী ইসরাইলের মোকাবিলায় টিকে আছে ও শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। ২০০৬ সালে ইসরাইল দক্ষিণ লেবানন থেকে হাত গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়। পরবর্তীকালে লেবাননের হিজবুল্লাহর সাথে (২০০৬) ৩৩ দিনের যুদ্ধে, হামাসের সাথে ২২ দিনের (২০০৮-২০০৯)  যুদ্ধে ও ও সর্বশেষ গাজায় হামলা চালিয়ে ৮ দিনের (২০১২)  বেশি টিকে থাকতে পারে নি। আর এ কথা কে না জানে যে, ফিলিস্তিনি ও লেবাননিরা এক্ষেত্রে ইরান থেকে নৈতিক, আধ্যাত্মিক, মানবিক, রাজনৈতিক ও বস্ত্তগত ব্যাপক সাহায্য লাভ করে থাকে। আর এটি ফিলিস্তিন ও লেবাননের নেতারা অকপটে স্বীকার করেন। ফিলিস্তিন ও আল্-কুদ্স মুক্তির জন্য ইমাম খোমেইনী রমযানের শেষ শুক্রবারকে বিশ্ব আল্-কুদ্স দিবস ঘোষণা করেছেন এবং কুদ্স দিবসের বিশেষ কর্মসূচি দিয়েছেন। এ কথা আজ দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে, ইরানের ইসলামী বিপ্লবের সাফল্য ও ফিলিস্তিনিদের জন্য এ বিপ্লবের সর্বাত্মক সাহায্যের জন্যই এ বিপ্লবের পর ইসরাইল তার সীমানা একটুও সম্প্রসারিত করতে পারে নি। অথচ ইসরাইলের নীল থেকে ফোরাত পর্যন্ত সম্প্রসারিত ইহুদিবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা ছিল।

১২. ধর্মের মূলে ফিরে আসার জন্য ইসলামী বিপ্লবের অবদান : ইরানে ইসলামী বিপ্লবের বিজয়ের পর থেকেই বিপ্লবের মহান নেতা ইমাম খোমেইনী (রহ্.) বিশ্ববাসীকে কুরআন, সুন্নাহ ও আহ্লে বাইতের প্রদর্শিত প্রকৃত ইসলামে ফিরে আসার জন্য উদাত্ত আহবান জানান। ইমাম খোমেইনী তাঁর ইন্তেকালের আগেও তাঁর অসিয়তনামায় এ আবেদন জানান। এ প্রসঙ্গে ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ দিবস ও উপলক্ষগুলোকে বিশ্বব্যাপী উদ্যাপন কার্যক্রমের উজ্জীবন ঘটান। এ উপলক্ষে ইরানে ও বহির্বিশ্বে আন্তর্জাতিক সম্মেলন, সফর বিনিময়, স্মারক ও সাময়িকী প্রকাশনার আয়োজন করা হয়। যে সব উপলক্ষকে কেনদ্র করে ইসলামী ইরান ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণ করে তা হলো :

ক.   হজ : হজ বিশ্ব-মুসলিমের সর্ববৃহৎ আধ্যাত্মিক ও রাজনৈতিক সম্মেলন। হজের সময় কা‘বায় তাওয়াফ, আরাফাতে অবস্থান, মীনায় কুরবানী, পাথর নিক্ষেপ, মদীনায় মহানবী (সা.)-এর রওজা মুবারক যিয়ারত ইত্যাদি কার্যক্রমকে জীবন্ত করতে, নিছক যপ-তপের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রাখতে ও প্রকৃত চেতনার স্ফুরণ ঘটাতে ইসলামী বিপ্লবের সর্বোচচ ধর্মীয় নেতা হাজীদের উদ্দেশে প্রতি বছর সময়োপযোগী গুরুত্বপূর্ণ বাণী প্রদান করেন। ইরানের হজ মিশনের উদ্যোগে আন্তর্জাতিকভাবে মক্কায় বারাআত-এর (মুশরিকদের সাথে সম্পর্কোচেছদ সম্পর্কিত কুরআনের আয়াতের) চেতনা উজ্জীবনের সমাবেশ করা হয়। মহানবী (সা.) কর্তৃক মদীনায় আনসার ও মুহাজিরদের ভ্রাতৃত্ববন্ধনের স্মরণে ওয়াহ্দাত বা ঐক্য সম্মেলন আয়োজন করা হয়। বিশ্বের সব মুসলমানকে সচেতন করতে তাঁরা সুশৃঙখলভাবে এসব কার্যক্রম চালিয়ে থাকেন।

খ.   ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উদ্যাপন উপলক্ষে ১২-১৭ রবিউল আউয়াল সপ্তাহব্যাপী ইসলামী ঐক্য সপ্তাহ উদ্যাপন করে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান বিশ্বব্যাপী ইসলামী ঐক্য সুদৃঢ় করার প্রচেষ্টা চালাচেছ। এ উপলক্ষে মহানবী (সা.)কে কেনদ্র করে সকল মুসলমানের মাঝে ঐক্য গড়ে তোলার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক সম্মেলনেরও আয়োজন করা হয় এবং বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানমালার মধ্য দিয়ে ঈদে মিলাদুন্নবী উদ্যাপন করা হয়।

গ.   আশুরা উদ্যাপন : মুসলমানদের প্রকৃত ইসলামী সত্তায় ফিরে আসার চেতনা জাগ্রতকারী সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হচেছ কারবালায় নবী-দৌহিত্র হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) ও তাঁর সঙ্গীদের শাহাদাত। ইমাম খোমেইনী (রহ.) বলেন : ‘আমাদের যা কিছু অর্জন তার সবই মুহররম ও সফর থেকে।’ ইরানের ইসলামী বিপ্লবে সর্বোচচ আত্মত্যাগের চালিকাশক্তিও ছিল এই কারবালার হুসাইনী চেতনা। তাই ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান স্বদেশে ও বিদেশে সর্বত্র মুহররমের ১-১২ তারিখ পর্যন্ত আশুরার শাহাদাতের প্রেক্ষাপট, ঘটনাপ্রবাহ ও শিক্ষা সম্পর্কে আলোচনা ও শোকানুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে।

ঘ.   রমযান মাসে বিশ্বব্যাপী ইরানী ক্বারীগণ সফর করেন ও দেশে দেশে কুরআন প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়।

ঙ.   এসব দিবস ও ধর্মীয় উপলক্ষগুলোকে যথাযথ মর্যাদা সহকারে উদ্যাপনের পাশাপাশি পবিত্র কুরআন, মহানবী (সা.) ও অন্যান্য নবী-রাসূলগণের (আঃ) প্রতি ও ইসলামের ভিত্তিমূলে আঘাতকারী বইপুস্তক, চলচিচত্র ও অন্যান্য ষড়যন্ত্রমূলক তৎপরতার বিরুদ্ধে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান সর্বদাই সোচচার ভূমিকা পালন করে থাকে। সালমান রুশদীর ‘শয়তানের পদাবলী’ (Satanic Verses) উপন্যাসের জন্য ইমাম খোমেইনী কর্তৃক (১৯৮৯) তাকে মৃত্যুদন্ডের ফতোয়া বিশ্ব-মুসলিমকে জাগরিত ও ঐক্যবদ্ধ করেছিল।

১৩. ইসলামী জাগরণ বনাম আরব বসন্ত : ইসলামী বিপ্লব বিজয়ের পর থেকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান এ বিপ্লবের নেতৃবৃনদ ও বিশ্বব্যাপী এর সমর্থক ও শুভাকাঙক্ষীরা ইসলামী প্রজাতন্ত্রের আহবানে উপরিউক্ত কর্মসূচিগুলো অব্যাহত রাখেন। ধীরে ধীরে এসব চেতনা বিশ্ব-মুসলমানের চোখ খুলে দেয়, চেতনা জাগ্রত করে, দেশে দেশে গড়ে ওঠে ইসলামের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও জনকল্যাণমূলক কার্যক্রম। এরই ফলশ্রুতিতে মানুষের মাঝে মূল ইসলামে ফিরে যাওয়ার তীব্র আকাঙক্ষা এবং জালেম, ভন্ড ও পাশ্চাত্যের সেবাদাস সরকারগুলোর প্রতি ঘৃণা ছড়িয়ে পড়তে থাকে। মুসলমানরা ইসলামের চেতনায় জেগে ওঠে। কিছু কিছু আরব দেশে যে নামকাওয়াস্তে পার্লামেনট রয়েছে সে সব প্রতিকী পার্লামেনেটও ইসলামপন্থীরা ব্যাপক আসন পায়, কোথাও কোথাও স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে গণ-অভ্যুত্থান দানা বাঁধে। অবশেষে তিউনিসিয়া, মিসর, ইয়েমেন ও লিবিয়ায় স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে জনগণ মাঠে নামে। পাশ্চাত্য যায়নবাদী পক্ষ ও তাদের প্রচারমাধ্যমসমূহ আরব জনগণের এহেন ইসলামী চেতনাসমৃদ্ধ জাগরণকে তাৎক্ষণিকভাবে ‘আরব বসন্ত’ বলে অভিহিত করে প্রচার চালায় এবং পাশ্চাত্য মাধ্যমগুলো তড়িঘড়ি করে প্রচেষ্টা চালায় যাতে সে সব দেশে তাদের দোসর ব্যক্তিরাই ভোল পাল্টিয়ে বিপ্লবী সেজে নির্বাচনের মাধ্যমে বা জোট গঠনের নামে ক্ষমতা দখল করতে পারে। তবে এ প্রসঙ্গে বলা যায় যে, ভন্ড স্বৈরশাসকদের প্রতি জনগণের ঘৃণা প্রকাশ, অভ্যুত্থানকারীদের অধিকাংশেরই ইসলামপন্থী হওয়া, স্বৈরচারীদের ইতিমধ্যে অনেকেরই পতন হওয়া – এসব মিলিয়ে ইসলামী জাগরণ একটি পর্যায় অতিক্রম করেছে। আশা করা যায় যে, পরবর্তী ভন্ডরাও মুনাফিকী করে বেশিদিন পার পাবে না। তবে অনেক ভাল নেতাকেও ভন্ড আখ্যায়িত করে কলঙ্কিত করার প্রয়াস চালানো হবে বলে আশঙ্কা রয়েছে। অবশেষে অনেক ধাপ পার হয়ে প্রকৃত ইসলামী জাগরণ পরিণতি পাবে ইনশাআল্লাহ। ইসলামী জাগরণকে ছিনতাই করে আরব জাগরণ আখ্যা দিয়ে তারা বেশিদূর এগুতে পারবে না।

ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার আরব দেশগুলোতে ইসলামী জাগরণকে ইতিবাচক ধাপ হিসেবে গ্রহণ করেছে, ইসলামী বিপ্লবের রাহবার হযরত আয়াতুল্লাহ্ ওযমা সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী এসব দেশের ইসলামী নেতৃবৃনদকে ইসলামী নেযাম বা রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম করে বিপ্লব ও জাগরণকে সুসংহত রূপদান করার আহবান জানিয়েছেন। ইতিমধ্যে গত দুই বছরে রাহবারের আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. আলী আকবর বেলায়াতীর আহবানে ইরানে ইসলামী জাগরণ বিষয়ক আন্তর্জাতিক কবি সম্মেলন, নারী সম্মেলন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গবেষকদের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ( info@islamicawakening.ir ওয়েবসাইটে এসব সম্মেলনের Proceedings ও গবেষণাপত্রসমূহ পাওয়া যাচেছ।)

১৪. সফল ন্যাম সম্মেলন : গত আগস্ট ২০১২ ইরানের রাজধানী তেহরানে অনুষ্ঠিত হলো জোট নিরপেক্ষ দেশগুলোর সফল ষোড়শ শীর্ষ সম্মেলন। পাশ্চাত্যের প্রতিক্রিয়াশীল সাম্রাজ্যবাদী কতক দেশের অপপ্রচার ও বাধার মুখেও জাতিসঙেঘর মহাসচিবসহ ২৭টি দেশের প্রেসিডেনট, ২ জন বাদশাহ, ৮ জন প্রধানমন্ত্রী, ২ জন পার্লামেনট স্পীকার, ৯ জন ভাইস প্রেসিডেনট ও ১০টি আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধি এ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। এ সম্মেলনের অন্যতম বিষয় ছিল ফিলিস্তিনিদের স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবি, পরমাণুমুক্ত বিশ্বব্যবস্থা গড়ার আহবান, সন্ত্রাসবাদের শিকড় উপড়ে ফেলা ও ইরানের শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক কার্যক্রমের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন ঘোষণা। যায়নবাদী ইসরাইল ও তার দোসররা এ সম্মেলনের সফলতার বিরুদ্ধে কাজ করেও কিছুই করতে পারে নি।

১৫. ইরানের পরমাণু সক্ষমতা প্রসঙ্গে পাশ্চাত্যের ষড়যন্ত্রের মোকাবিলা : ২০০৯ সালে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান পারমাণবিক ক্ষেত্রে সক্ষমতা অর্জন করে পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হিসেবে নিজেদের অবস্থান গড়ে তোলে। এক্ষেত্রে ইরানের বিজ্ঞানীরা আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার (IAEA) সকল প্রটোকল মেনেই তাদের কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। ইসফাহান, বুশেহ্র ও কোমের পরমাণু কেনদ্রগুলোতে IAEA-এর পরিদর্শকদল তাদের রুটিন মাফিক পরিদর্শন অব্যাহত রেখেছেন এবং ইরান পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি (NPT)-তে স্বাক্ষরকারী একটি দেশ। ইরান বিদ্যুৎ উৎপাদন, চিকিৎসা ও কৃষি গবেষণার কাজে এ পারমাণবিক শক্তিকে কাজে লাগাচেছ। ইরান শুরু থেকেই বলে আসছে যে, তার এ পারমাণবিক প্রযুক্তির জ্ঞান অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে মুসলিম ও শান্তিপ্রিয় দেশগুলোর সাথে ব্যবহার করতে প্রস্ত্তত। এক্ষেত্রে ইরান পরমাণু প্রযুক্তি কাজে লাগাতে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে একটি ক্লাব গঠনেরও প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু শুরু থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কয়েকটি দেশ ইরানের এ শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক কার্যক্রমের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগেছে। তারা কল্পিত অভিযোগ এনে প্রচার চালাচেছ যে, ইরান পারমাণবিক গবেষণার অন্তরালে পারমাণবিক বোমা বানানোর লক্ষ্যে কাজ করছে। এসব চিৎকারে সবচেয়ে বেশি সোচচার হলো IAEA-তে সাক্ষর করতে অস্বীকারকারী ২ শতাধিক পারমাণবিক বোমার অধিকারী ইসরাইল ও হিরোসিমা-নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপকারী আমেরিকা।

যা-ই হোক, এ কল্পিত অভিযোগের ধুয়া তুলে আমেরিকা ইরানের ওপর একের পর এক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে এবং হামলার হুমকি দিচেছ। আমেরিকা তার মিত্র সকল দেশকে ইরানের সাথে বাণিজ্যিক লেনদেনে বাধা দিচেছ। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এ কল্পিত অভিযোগ যে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও অন্তঃসারশূন্য তা বিশ্বের অধিকাংশ পর্যবেক্ষক মহলই আজ বুঝতে পারছেন। আবার অনেক অতি উৎসাহী ইসলামপন্থীদের বলতে শোনা যায় যে, প্রতিপক্ষের সাথে শক্তির ভারসাম্য আনার জন্য ইরানের পারমাণবিক বোমা বানানো দরকার। কিন্তু তাদের জবাবে বলতে হয় যে, ইরান তো পারমাণবিক বোমার অধিকারী না হয়েও গত ৩৪ বছর দুশমনের হুমকির মুখে টিকে আছে। আর পারমাণবিক বোমার অধিকারী পাকিস্তানের জনগণ নিজ দেশেই প্রতিদিন মার্কিন ড্রোন হামলার শিকার হচেছ। তাই পারমাণবিক বোমার অধিকারী হওয়াই নিরাপত্তার গ্যারানিট নয়। সর্বোপরি ইসলামী বিপ্লবের সর্বোচচ নেতা পারমাণবিক বোমা বানানোর বিরুদ্ধে ফতোয়া দিয়েছেন। আর ইসলামী প্রজাতন্ত্রের রাহবারের ফতোয়া যে কোনো ফাঁকা বুলি নয় তা সবারই জানা আছে। আরেকটি বিষয় হলো, আমেরিকা ও তার দোসররা এ পর্যন্ত বহু বার IAEA-এর প্রধানের ওপর এ মর্মে রিপোর্ট দেয়ার জন্য চাপ প্রদান করে যে, ইরানের পারমাণবিক কার্যক্রম সনেদহজনক ও পারমাণবিক বোমা তৈরি করা যেতেও পারে ইত্যাদি। কিন্তু আজ পর্যন্ত তারা সে রকম সুনির্দিষ্ট কোনো বিৃবতি লাভ করতে পারে নি। এদিকে বিগত দুটি জোটনিরপেক্ষ আনেদালন সম্মেলন ও ওআইসি সম্মেলনে সদস্যরাষ্ট্রগুলো ইরানের শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক কার্যক্রমের প্রতি তাদের সমর্থন ব্যক্ত করেছে। ইরানের পরমাণু কার্যক্রমের স্লোগান হলো : ‘Nuclear energy for all, Nuclear weapon for none.’ (ইরানের পারমাণবিক কার্যক্রম সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য রয়েছে ইরানের পরমাণু শক্তি কমিশনের ওয়েবসাইট http://www.aeoi.org.ir/Portal/Home/)

১৬. প্রচারযুদ্ধে ইরান : দীর্ঘদিন ধরে সারা বিশ্বের প্রতিষ্ঠিত সব প্রচারমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করে আসছিল বিশ্ব-যায়নবাদী চক্র নিয়ন্ত্রিত পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদ। তাই স্বাভাবিকভাবেই এসব সংবাদমাধ্যমে ইরানের প্রকৃত সংবাদগুলো ইতিবাচক কভারেজ পায় নি। তাই বিপ্লবের পর থেকেই ইরান এ সংকটে ভুগছিল। ইরানের IRIB-এর বহির্বিশ্ব সম্প্রচার কার্যক্রমে বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় রেডিওর সম্প্রচার এর অভাব কিছুটা পূরণ করে। পরবর্তীকালে ইরানের ইংরেজি ভাষায় Press TV, স্পেনিশ ভাষায় হিসপান টিভি ও আরবি ভাষায় আল-‘আলাম টিভি চ্যানেল শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর প্রবল বাধার মুখে গত ৩০ বছরে ইরান তার নিজস্ব প্রচারমাধ্যম ও দেশে দেশে বন্ধুত্বের বিনিময়ে, এ নিবন্ধের শুরুতে ইসলামী ইরান সম্পর্কে বর্ণিত অপপ্রচারগুলো যে মিথ্যা তা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে। দিনদিন বিশ্বব্যাপী বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বে ইসলামী প্রজাতন্ত্রের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হচেছ। মাযহাব নির্বিশেষে মুসলমানগণ ইসলামী ইরানকে তাদের সহযোদ্ধা ও সত্যের পথে নিশানবরদার হিসেবে ভাবতে শুরু করেছে। এরই ফলশ্রুতিতে বিশ্বের বিভিন্ন জনপদে ইসলামী জাগরণ জোরদার হচেছ। সাম্রাজ্যবাদের জন্য এ অবস্থাটি সহ্য করা কঠিন হয়ে উঠেছে। তাই বর্তমানে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার আওতায় যায়নবাদী ইন্ধনে বহু দেশ ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান পরিচালিত প্রেস টিভিসহ অন্যান্য চ্যানেলের সম্প্রচার বন্ধ করলেও বিশ্বের অনেক গণমাধ্যম তাদের ওয়েবসাইট থেকে সংবাদ সংগ্রহ করছে। আজ ইসলামী বিপ্লব দীর্ঘ সংগ্রামের পর এমন একটি নতুন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, ইসলামী বিপ্লবের সর্বোচচ নেতা ও ইরানের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বদের কথাগুলো, উন্নয়ন ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রগতির সংবাদগুলো বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম নিজ উদ্যোগেই সংগ্রহ করছে। যেসব ওয়েবসাইট থেকে ইরানের সংবাদগুলো বেশি সংগৃহীত হচেছ সেগুলো হলো Iran Supreme Leader : http://www.leader.ir/, President : www.president.ir, Judiciary : www.judiciary.ir; Parliament: www.majlis.ir; Ministry of Culture : www.farhang.gov.ir; Foreign Ministry: www.mfa.gov.ir; Iran Broadcasting: http://www.irib.ir/, Organization of Islamic Culture and Relations: http://www.icro.ir/; Iran Tourism and International Tourism: http://www.ittic.com/; Iran News : http://www.irna.ir/, Iran Students News Agency: http://www.isna.ir/; Other News Agencies: http://www.farsnews.com/, www.presstv.com; Centre for Strategic Studies in Iran: http://www.csr.ir/, Information on Islam: http://www.itf.org.ir, [email protected], www.iqna.ir/bn, www.islamonline.com, www.tebyan.com, www. crescent-online.net, http://islamica.ir; About Imam Khomeini: www.imam-khomeini.com; Women Magazine: www.raihaneh.com; Mahjubah: [email protected]

কয়েকটি ক্ষেত্রে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের অবস্থান

  • সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার : প্রত্নতত্ত্ব, ভাস্কর্য, হস্তশিল্প ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক নিদর্শনাদির সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের দিক থেকে UNESCO-এর তালিকাভুক্তিতে ইরানের অবস্থান বিশ্বে সপ্তম।
  • কর্মসংস্থান : ২০০৭ সালের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী ইরানের কর্মক্ষম জনসংখ্যার ৯২.২৫% অর্থাৎ ২,১৭,৬৯,০০০ ব্যক্তির কর্মসংস্থান হয়েছে এবং বেকার রয়েছে ৭.৭৫%।
  • তেল ও গ্যাসসম্পদ : ভূগর্ভস্থ রিজার্ভ তেলের পরিমাণের দিক থেকে ইরানের অবস্থান বিশ্বে পঞ্চম। রিজার্ভ গ্যাসের পরিমাণের দিক থেকে ইরান বিশ্বে দ্বিতীয় (প্রথম রাশিয়া)।
  • দৈননিদন ব্যবহারের জন্য গ্যাস সরবরাহ : ১১২৯টি শহরে।
  • বিদ্যুৎ উৎপাদন (২০০৬ সাল) : ২০০ মিলিয়ন কিলোওয়াট আওয়ার।
  • বাঁধের সংখ্যা : ১৮৬টি সুবৃহৎ ও ৩২০টি ছোট আকারের বাঁধ। ৯১টি বৃহৎ বাঁধের মাধ্যমে ১০ বিলিয়ন কিউব মিটার পানি সরবরাহ হয়। বিশ্বে এর র‌্যাঙ্কিং তৃতীয় (প্রথম চীন, দ্বিতীয় তুরস্ক)।
  • রেলপথ : প্রধান রেলপথ ৮,৮৩৭ কিলোমিটার, দ্বিতীয় স্তরে ১,৮৩৩ কিলোমিটার, বাণিজ্যিক রেলপথ (স্বতন্ত্র) ১,০০০ কিলোমিটার।
  • ইনটারনেটের ব্যবহার :  ইনটারনেট ব্যবহারের দিক থেকে মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার মধ্যে ইরানের অবস্থান প্রথম।

v       কৃষি উৎপাদন (২০০৭)

  • GNP (Gross National Production) : কৃষি থেকে ১৫%।
  • তেল বহির্ভূত রফতানি সামগ্রী : কৃষি থেকে ২২%।
  • কৃষিজ দ্রব্য উৎপাদন ৮৫ মিলিয়ন টন (৬২.৫ মিলিয়ন দানাশস্য, ১৩.৫ মিলিয়ন টন ফল, ৮.৬ মিলিয়ন টন গবাদিজাত ও ৪,৫৫,০০০ টন মৎস উৎপাদন।
  • বৈচিত্র্যময় বাগানজাত উৎপাদনের দিক থেকে ইরানের অবস্থান বিশ্বে তৃতীয়।
  • পেস্তা, জাফরান, খেজুর, ডালিম ও এপ্রিকট উৎপাদনের ক্ষেত্রে ইরানের অবস্থান বিশ্বে প্রথম।

v        বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি : বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গবেষণায় ইরানের অগ্রগতি বিশ্বে দ্রুততম (Fastest) [Canadia.htmail]। বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষত মহাকাশ গবেষণা, পরমাণু চিকিৎসা ও ন্যানো টেকনোলজি গবেষণায় ইরানের অগ্রগতি ব্যাপক।  [presstv.com, ২১ অক্টোবর, ২০১১]

  • ক. ন্যানো টেকনোলজি (Nanotechnology) : পঞ্চাশের অধিক ন্যানো টেকনোলজি কোম্পানি কাজ করছে। Nanotechnology সংশ্লিষ্ট বৈজ্ঞানিক গবেষণা নিবন্ধের ক্ষেত্রে বিশ্বে ইরানের অবস্থান ২৫তম এবং মধ্যপ্রাচ্যে সর্বোচচ। সর্বশেষ রিপোর্ট প্রকাশসাপেক্ষে, ২০১২-এর মধ্যে ন্যানো টেকনোলজিতে বিশ্বে ইরানের দ্বিতীয় অবস্থানে আসার সম্ভাবনা। [En.nano.ir.retrieve, 21 Oct, 2011]
  • খ. মহাকাশ গবেষণা (Space and Aerospace) : মহাশূন্যে নিজস্ব প্রযুক্তিতে নির্মিত স্যাটেলাইট পাঠানোর ক্ষেত্রে ইরানের অবস্থান বিশ্বে নবম এবং মহাকাশ যানে প্রাণী পাঠানোর ক্ষেত্রে ইরানের অবস্থান ষষ্ঠ। ২০০৮ সালে Iranian Space Agency একটি তিন স্তরের স্যাটেলাইট ‘সাফির’ (Ambassador)-এর পরীক্ষা চালায় এবং ২০০৯ সালে Omid (আশা) নামের ক্যারিয়ার কক্ষপথে উৎক্ষেপণ করে। ২০১৫ সালের মধ্যে ইরান মহাশূন্যে মানুষবাহী স্যাটেলাইট পাঠানোর পরিকল্পনা করেছে।

ইসলামী বিপ্লব বিজয়ের পর ইরানের ধর্মীয় নেতৃবৃনদ গবেষকদের প্রতি ইসলাম ও আধুনিক বিজ্ঞানের সমন্বয়ের মাধ্যমে জাতীয় অগ্রগতির ও স্বয়ংসম্পূর্ণতার আহবান জানান। এরই ফলে সাম্প্রতিককালে ইরানে বিজ্ঞান গবেষণায় প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়েছে।

[1. Quarks and the Koran : Iran’s Islamic Embrace of Science- The Daily Beast, 22 May, 2009

2. Science and Technology and the Future Development of Soceities: International Workshop Proceedings. Nap.edu. 11 February, 2007, retrieved 21 Oct, 2011]

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গবেষণায় ইরানের দ্রুততম অগ্রগতির রিপোর্ট : এ সম্পর্কে ইরানের সর্বোচচ দ্রুত অগ্রগতির স্বীকৃতি (1996-2004) দিয়েছে ISI (Institute of Scientific Information), Canadian Research Firm Science-Matrix and Engineering Indicators: 2010, 2012’, Science Watch Report (2008), International Comperative Performance of UK Research Base (2009), এবং ‘Knowledge, networks and nations’ by Britain Leading Academic Institution, the Royal Society in Collaboration with Elsevier.

ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান ৫১,০০০ পৃষ্ঠাসমৃদ্ধ ব্যাপক বিজ্ঞানগবেষণা সংক্রান্ত প্রকল্পপত্রে বর্ণিত ২২৪টি প্রকল্প ২০২৫ সালের মধ্যে সম্পন্ন করতে বদ্ধপরিকর। [Iran Unveils Comprehensive Scientific Plan. payvand.com. 4 Jan, 2011, retrieved 21 Oct, 2011] UNESCO-এর রিপোর্ট অনুযায়ী (২০১০) ইরানের বিজ্ঞান গবেষণার ৭৫% বাজেটই সরকার বহন করে।

  • চিকিৎসাবিজ্ঞান গবেষণা : চিকিৎসাবিজ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রে ইরানের অবস্থান বিশ্বে ১৯তম এবং সর্বশেষ রিপোর্ট প্রকাশসাপেক্ষে, ২০১২ সালের মধ্যে ১০ম অবস্থানে আসার কথা। [presstv.ir, 20 Jan, 2012]
  • বায়ো টেকনোলজি : স্টেমসেল গবেষণার ক্ষেত্রে ইরান প্রথম সারির ১০টি দেশের মাঝে অবস্থান করছে। স্টেমসেল রিপেলস করার ক্ষেত্রে বিশ্বে ইরানের অবস্থান দ্বিতীয়। হাড়, হার্টভাল্ভ ও ট্যানডন রিপেলস করা ও Bio-tech drug উৎপাদনের ক্ষেত্রে ইরান প্রথম ১২টি দেশের মাঝে অবস্থান করছে।
  • কম্পিউটার সায়েন্স ও রোবোটিক্স : ২০১০ সালে তেহরান বিশ্ববিদ্যালয় নিজস্ব প্রযুক্তিতে Sorena-2 নামক রোবট তৈরি করে যা IEEE কর্তৃক বিশ্বের ৫টি সর্বোচচ প্রযুক্তির রোবটের মাঝে স্থান পায়। একই ধারাবাহিকতায় ইরানের automotive industry দশটি রোবট তৈরি করে। তেহরানের আমির কাবীর প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ২০০৭ সালে একটি সুপার কম্পিউটার তৈরি করে যার প্রতি সেকেন্ডের কর্মক্ষমতা ৮৬০ বিলিয়ন, যদিও ইরান ২০০১ সালেই প্রথম সুপার কম্পিউটার তৈরি করে। পরবর্তীকালে ইরান তৈরি করেছে RAHYAB-300 যার সক্ষমতা 40 Gbit/s। ২০১১ সালে আমির কাবীর ও ইসফাহান বিশ্ববিদ্যালয় ২টি সুপার কম্পিউটার তৈরি করে যার প্রসেসিং ক্ষমতা প্রতি সেকেন্ডে ৩৪০০০ বিলিয়ন – যা বিশ্বের প্রথম সারির ৫০০টি কম্পিউটারের মাঝে রয়েছে।
  • এনার্জি (Energy) : ইরান বিশ্বের প্রথম সারির চারটি দেশের মধ্যে রয়েছে যারা V 94.2 গ্যাস টারবাইন তৈরি করার সক্ষমতা অর্জন করেছে। গ্যাস রিফাইনারির সব পার্টসই ইরান নিজেই তৈরি করছে। তরল গ্যাস তৈরির (GTL) প্রযুক্তি অর্জনে ইরান প্রথম তিনটি দেশের মাঝে রয়েছে। ইরান দেশীয়ভাবে রিফাইনারি, তেল-ট্যাংকার, তেলকূপ খনন, Offshore platform এবং তেল উত্তোলনের ৭০ ভাগ সক্ষমতা অর্জন করেছে। গভীর পানিতে তেলকূপ খনন প্রযুক্তিতে ইরান বিশ্বের অল্প কয়েকটি দেশের মাঝে রয়েছে। দেশীয় প্রযুক্তিতে ডিজাইনকৃত ইরানের Darkhovin Nuclear Power Plant কার্যক্ষম হবে ২০১৬ সালে।
  • সমরবিজ্ঞান : ইরান সুপারফাস্ট এনিট সাবমেরিন তৈরি করেছে যা পানির তলদেশ দিয়ে প্রতি সেকেন্ডে ১০০ মিটার গতিতে চলে; আর এ প্রযুক্তিটি বিশ্বে রয়েছে একমাত্র রাশিযার হাতে। লেজার টার্গেটিং প্রযুক্তিতে অস্ত্রের ক্ষেত্রে ইরান বিশ্বের পাঁচটি দেশের অন্যতম – যাদের চালকবিহীন বিমান (ড্রোন) নির্মাণ সক্ষমতা রয়েছে। ১৯৯২ সাল থেকেই ইরান নিজস্ব প্রযুক্তিতে ট্যাংক, মিসাইল, সাবমেরিন, ফাইটার প্লেন ও যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহার্য সামরিক যান তৈরি করছে।
  • ইরানের বিজ্ঞান গবেষণার আরো কতক সাফল্য
  • কয়েক ধরনের অত্যাধুনিক চালকবিহীন বিমান (ড্রোন) তৈরি;
  • সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে সমুদ্রগামী তেল-ট্যাঙ্কার তৈরি;
  • মহাশূন্যে ‘পিশগাম’ বা ‘অভিযাত্রী’ নামের বায়ো-ক্যাপসুল প্রেরণ;
  • রাডার ফাঁকি দিতে সক্ষম স্টিল্থ ধরনের অত্যাধুনিক জঙ্গী বিমান ‘কাহের-৩১৩’ তৈরি।
  • সৌরশক্তিচালিত মোটরগাড়ি তৈরি।

পরিশেষে বলা যায় যে, শক্তিশালী মুজতাহিদ নেতৃত্বের অধীন ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান পুরো জাতির বিভিন্ন পর্যায়ে জ্ঞান-বিজ্ঞানে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিত্বদের পরিচালনায় সুসংবদ্ধ রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠন করেছে; বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে চরম অগ্রগতি অর্জন করেছে, স্বনির্ভর অর্থনীতির একটি শক্তিশালী ভিত তৈরি করেছে, সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে, স্বীয় ভূখন্ডের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে, ফিলিস্তিন সহ মুক্তিকামী মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে, বিশ্ব-সাম্রাজ্যবাদী শক্তির মুখোশ উন্মোচন করে দিয়েছে, বিশ্বমানবতা ও বিশ্ব-মুসলিমকে ঐক্যের ও উন্নত সংস্কৃতি গ্রহণের আহবান জানিয়েছে। এসবই ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানকে একটি অনন্য মডেল হিসেবে উপস্থাপন করেছে। বিশ্বব্যাপী ইসলামী জাগরণে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান আরো সুদূরপ্রসারী প্রভাব রাখবে এমে সনেদহ নেই।