All posts by dreamboy

শরৎ তোমায় লিখছি

মোঃ আনোয়ারুল আজম মিঠু

তোমার কথা ভাবতে ভাবতে
যায় দিন যায় চলে,
এক্ষুণি কি ফুটলে ফুল হয়ে তুমি
হেমন্ত শেষে এই শরতে?

তোমার অবয়ব দেখে হৃদয় জুড়ালো
হারিয়েছি তোমাতে আমি,
তুমি ছাড়া চলে না একটি দিনও
এতটুকু বৃষ্টির জলে হৃদয় জুড়ালো
আজ শরতের এই মিষ্টি আহ্বানে।

কাশফুল, ঘাসফুল ফুটে আছে থরে থরে
তোমার আমার মিলন হলো বুঝি
শরতের এই শান্ত বিকেলে,
এসো! এসো! ভালোবেসে হে শরৎ
আমার হৃদয়ের আঙ্গিনায়।

ফারসি পাণ্ডুলিপি সংক্রান্ত তথ্য আহ্বান

বিসমিল্লাহির রহমানির রাহীম

‘আনজুমানে ফারসি বাংলাদেশ’ এর পক্ষ হতে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও মোবারকবাদ গ্রহণ করুন। একটি বিষয় প্রিয় দেশবাসীর খেদমতে আরজ করতে চাই যে, অতীতে বাংলাদেশসহ পুরো ভারতবর্ষে দীর্ঘ ৬০০ বছর সরকারি অফিস-আদালত ও সাহিত্য-সংস্কৃতির ভাষা ছিল মিষ্টি মধুর ভাষা ফারসি। আমাদের পূর্বপুরুষরা তখন ফারসি ভাষার সাথে পরিচিত ছিলেন। তাঁরা অনায়াসে শেখ সাদী, হাফেয শিরাজী, মওলানা রূমী ও উমর খৈয়ামের বয়েত পড়তেন ও বলতেন। তাঁরা ফারসি ভাষায় বহু কিতাব লিখে গেছেন, যা আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির স্মারক। এখনও মানব জাতির জন্য প্রেম ও আধ্যাত্মিকতার বাহন এই ফারসি ভাষা আমাদের দেশে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নিজস্ব উপস্থিতি বজায় রেখেছে।
উল্লেখ্য যে, বর্তমানে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ে ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের উপর লেখাপড়া অনার্স থেকে মাস্টার্স ও পিএইচডি পর্যন্ত এবং খুলনা বিশ^বিদ্যালয়ে ভাষা শিক্ষাকোর্স পর্যায়ে চালু আছে। সারা দেশে হাজারো ছাত্রছাত্রী ফারসি ভাষা ও সাহিত্য অধ্যয়ন করছে এবং তাদের সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। পাশাপাশি আলিয়া ও কওমী নেসাবের মাদ্রাসাসমূহে ফারসি ভাষা ও সাহিত্য অধ্যয়ন সীমিত আকারে হলেও অব্যাহত রয়েছে। অনুরূপভাবে ধর্মীয় মহল, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক ফোরাম এবং জ্ঞানীগুণীদের মহলেও ফারসির প্রতি ভালোবাসা ও আসক্তি বলবৎ রয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে ‘আনজুমানে ফারসি বাংলাদেশ’ দেশ ও জাতির সমৃদ্ধ অতীত ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাথে সংযোগ স্থাপন এবং অতীত ও বর্তমানের মাঝে সমন্বয়ের লক্ষ্যে প্রাচীন গ্রন্থাগারসমূহ বা প্রবীণ গুণী ব্যক্তিদের বাড়িঘরে বিচ্ছিন্নভাবে সংরক্ষিত কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে নষ্ট হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে এমন ফারসি ভাষায় লিখিত পা-ুলিপি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করার চিন্তা করেছে।
এ লক্ষ্যে এই বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতি অনুরাগী প্রিয় ভাইবোনদের কাছে জাতির গৌরবদীপ্ত ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংরক্ষণের নিমিত্তে প্রাথমিক পর্যায়ে এ সম্পর্কিত তথ্য ই-মেইল বা ফোনের মাধ্যমে আমাদেরকে অবহিত করার অনুরোধ জানাচ্ছি।
১. পা-ুলিপির নাম, লেখকের নাম এবং সম্ভব হলে রচনার তারিখ
২. পা-ুলিপির শুরু ও শেষের পাতা এবং মাঝখানের দু একটি পাতার ফটোকপি বা স্ক্রীনশট।
৩. প্রেরকের বিস্তারিত ঠিকানা (মোবাইল নং, ই-মেইল নং)।
অনুগ্রহ করে যে কোনো ধরনের তথ্যের জন্য নিম্ন ঠিকানায় যোগাযোগ করার অনুরোধ জানাচ্ছি।
আনজুমানে ফারসি বাংলাদেশ
রুম নং ২০৯, ২য় তলা
আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট
ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়
ফোন : ০১৩১৯৩৪৯২১৩
ই-মেইল :[email protected]

পবিত্র আহলে বাইত ও চিরকালের কান্না

আবদুল মুকীত চৌধুরী
১. আহলে বাইত
‘আহলে বাইত’ সম্পর্কে আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীনের কালাম : “…হে নবী পরিবার! আল্লাহ তো কেবল চান তোমাদের হইতে অপবিত্রতা দূর করিতে এবং তোমাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করিতে।”- আল-কুরআনুল করীম, সূরা আহযাব ৩৩: আয়াত ৩৩) ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ঢাকা।

Ô…And God only wishes / To remove all abomination / From you, ye Members / Of the Family, and to make / You pure and spotless.’- The Holy Quran: Translation and Commentary, A. Yusuf Ali, Page 1115-16.

‘আহলে বাইত’ সম্পর্কে ব্যাখ্যা-ভাষ্যে আল্লামা ইউসুফ আলী বলেন,

“Notice the transition in this clause to the masculine gender, while before this the verbs and pronouns were in the feminine gender as referring to the consorts. The statement in this clause is now more general, including (besides the consorts) the whole family, namely, Hazrat Fatima the daughter, Hazrat ‘Ali the son-in-law, and their sons Hasan and Husain, the beloved grandsons of the Prophet. The masculine gender is used generally in speaking of a mixed assembly of men and women.” – Ibid, P.1116

দশম হিজরিতে নাজরানের এক খ্রিস্টান প্রতিনিধিদল প্রধান ধর্মযাজক আবু হারিসা ইবনে আলকামাহ এর নেতৃত্বে মদীনায় হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সাথে মুবাহালার মানসে আসেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) আহলে বাইতের সদস্য ‘আলী (রা.), ফাতেমা (রা.), হাসান (রা.) ও হুসাইন (রা)-কে তাঁর চাদরের মধ্যে নিয়ে প্রতিনিধিদের বিপরীতে দাঁড়িয়ে উল্লেখিত আয়াত তিলাওয়াত করেছিলেন।
মহানবী (সা.)-এর পরিবার-পরিজনের পবিত্র চেহারার প্রভাবে যাজক মুগ্ধ হয়ে মুবাহালা থেকে বিরত হন এবং এই পবিত্রতা সকল শক্তির বিরুদ্ধে জয়ী হবে বলে ঘোষণা করেন।
আল্লামা যামাখশারী মুবাহালার আয়াত সম্পর্কিত ব্যাখ্যার শেষে বলেন, “মুবাহালার মহা ঘটনা এবং এ আয়াতের বিষয়বস্তু ও মর্মার্থ ‘আসহাবে কিসা’ অর্থাৎ মহানবী (সা.) যাঁদেরকে তাঁর চাদরের নিচে স্থান দিয়েছিলেন, তাঁদের মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের সবচেয়ে বড় দলিল এবং ইসলাম ধর্মের সত্যতারও এক জীবন্ত সনদ।”- চিরভাস্বর মহানবী (সা.), দ্বিতীয় খ-, আয়াতুল্লাহ জাফর সুবহানী, অনুবাদ : মোহাম্মদ মুনীর হোসেন খান, পৃ. ৩৭১
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সাথে ধর্মযাজকের কথাবার্তা হয়। ‘ঈসা (আ.) আল্লাহর পুত্র’ এই বিশ্বাসের অবস্থানে যাজক। এ সময় সূরা আলে ইমরানের ৫৯ নং ক্রমিকের আয়াত নাযিল হয় : “আল্লাহর নিকট নিশ্চয়ই ঈসার দৃষ্টান্ত আদমের দৃষ্টান্ত সদৃশ। তিনি তাহাকে মৃত্তিকা হইতে সৃষ্টি করিয়াছেন; অতঃপর উহাকে বলিলেন, ‘হও’; ফলে সে হইয়া গেল।”
আলে ইমরানের ৬১তম আয়াত মিথ্যায় বিশ্বাসীদের মুবাহালায় যাওয়া এবং নিজেদের উপর ¯্রষ্টার লানত (অভিশম্পাৎ) চাওয়া সংক্রান্ত। এর টীকায় বলা হয়েছে, ‘নাজরান অঞ্চলের খৃষ্টানগণ ঈসা (আ.) সম্পর্কে কুরআনের বর্ণনা স্বীকার না করিলে আল্লাহর নির্দেশে হযরত (সা.) তাহাদিগকে মুবাহালার (দুই পক্ষের পরস্পরের জন্য বদ দু‘আ করা) জন্য আহ্বান জানান। কিন্তু খৃষ্টান পাদ্রীগণ ভীত হইয়া ইহা হইতে বিরত থাকনে ও জিযয়া দিতে স্বীকার করিয়া সন্ধি করেন।’ -জালালাইন; আল কুরআনুল করীম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, পৃ. ৮৬
ইমামুল মুমিনীন আলী (রা.) এই বিশেষ বিজয়ের সন্ধি চুক্তিপত্র লিখেন।
বিশিষ্ট সাহাবী আবূ যর গিফারী (রা) থেকে বর্ণিত : তিনি বলেন, “আমি রাসূল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, আমার আহলে বাইতের সদস্যগণ আমার উম্মতের জন্য তেমনি নাজাতের তরী, যেমনি আল্লাহর নবী নূহ (আ.)-এর তরী বিধ্বংসী বন্যার সময় তাঁর জন্য আশ্রয় ও নাজাতের তরী ছিল।”
ইমাম শাফি‘ঈ (রহ.) বলেন, ‘ইয়া আহলে বাইতে রাসূল। আপনাদের মুয়াদ্দাত (আনুগত্যপূর্ণ ভালবাসা) পবিত্র কুরআনে ফরয করা হয়েছে। যে ব্যক্তি নামাযে আপনাদের উপর দরুদ না পড়বে, তার নামাযই কবুল হবে না।’- সাওয়ায়েকে মোহরেকা, ইবনে হাজার মক্কী, পৃ. ৮৮, ৭৭১
২. আমীরুল মু‘মিনীন ‘আলী (রা.)
রাহমাতুল্লিল ‘আলামীন সায়্যিদুল মুরসালীন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সাথে ‘আলী (রা.)-এর পারিবারিক নৈকট্য ও ¯েœহের সম্পর্ক ছিল অনন্য। ‘আলী (রা.)-এর পিতা আবূ তালিব মুহাম্মদ (সা.)-কে পিতৃ¯েœহে ও মাতা ফাতেমা বিনতে আসাদ মাতৃ¯েœহে লালনপালন করেন। পিতা ‘আবদুল্লাহ-র মৃত্যু ও পরবর্তীতে মাতা আমেনার মৃত্যুর পর বিশেষভাবে তাঁর জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করেন তাঁরা। সেই পরম শ্রদ্ধেয় চাচা-চাচীর সন্তান ‘আলী (রা.)। তিনিই প্রথম তাঁর কাছে ইসলাম গ্রহণ করেন। সর্বোত্তম ফয়সালাকারী (কাযী) তিনি।
গাদীরে খুমে উপস্থিত সাহাবিগণের অঙ্গীকার গ্রহণের পর রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, “আমি যার মাওলা, ‘আলীও তার মাওলা। হে আল্লাহ, তুমি তাকে বন্ধু গণ্য করো, যে একে (‘আলীকে) বন্ধু গণ্য করে এবং যে একে (‘আলীকে) শত্রু গণ্য করে, তাকে শত্রু গণ্য করো এবং রাগান্বিত হও তার প্রতি যে একে রাগান্বিত করে।”
খায়বারে হযরত ‘আলীর মহাবিজয় সম্পর্কে রাসূল (সা.) আগেই বলেন, “আগামীকাল এ পতাকা এমন এক ব্যক্তির হাতে দেব, যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালবাসে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলও তাকে ভালবাসেন। সে এমন ব্যক্তি, যে শত্রুর প্রতি পৃষ্ঠপ্রদর্শন করেনি এবং কখনই যুদ্ধ হতে পলায়ন করেনি।”- চিরভাস্বর মহানবী (সা.) দ্বিতীয় খ-, পৃ. ২০৮। সূত্র : মাজমাউল বায়ান, ৯ম খ-, পৃ. ১২০; সীরাতে হালাবী, ২য় খ-, পৃ.৩৭; সীরাতে ইবনে হিশাম ৩য় খ-, পৃ. ৩৩৪।
খায়বারের দরজা উপড়ানোর শক্তিমত্তার অলৌকিকতার দিকটিতে জিজ্ঞাসার জবাবে ‘আলী (রা) বলেন, ‘আমি কখনো মানবীয় শক্তিতে তা উপড়াইনি; বরং আল্লাহর শক্তি ও মহান আল্লাহর সাক্ষাতের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাসের বলে তা করেছি।”- চিরভাস্বর মহানবী (সা.), দ্বিতীয় খ-, পৃ. ২১২। সূত্র : বিহারুল আনওয়ার, ২১তম খ-, পৃ. ২১।
আমীরুল মুমিনীন ‘আলী (রা.) তাঁর এক ভাষণে স্পষ্ট করে বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সা.) আমার বুকে মাথা রেখে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন।… আমি তাঁকে গোসল দিয়েছি এবং ঐ অবস্থায় ফেরেশতারা আমাকে সাহায্য করেছেন।”- চিরভাস্বর মহানবী (সা.), দ্বিতীয় খ-, পৃ. ৪২৯। সূত্র : নাহজুল বালাগাহ।
হযরত ‘আলী (রা.) খারিজী ইবনে মুলজিমের আঘাতে গুরুতর আহত ও ওফাতশয্যায় থাকা অবস্থায় হাসান (রা)-কে খিলাফতের উত্তরাধিকারী মনোনয়ন করেন।
৩. খাতুনে জান্নাত ফাতেমা যাহরা (রা)
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর চির বিশ্বস্ত নারীশ্রেষ্ঠ খাদিজা তাহেরা (রা.)-এর কন্যা ফাতেমা (রা.)। রাসূল (সা.) বলেন, “ফাতেমা আমার দেহের টুকরা। যা তাকে সন্তুষ্ট করে, তা আমাকেও সন্তুষ্ট করে; আর তার ক্রোধ ও অসন্তুষ্টি আমারই ক্রোধ ও অসন্তুষ্টি।”- সহীহ বুখারী, ৫ম খ-, পৃ. ২১
কন্যার কাছ থেকে বিদায় না নিয়ে সফরে বেরোতেন না তিনি এবং ফিরেও প্রথমেই তাঁর সাথে দেখা করতে যেতেন। যে কয়েক দিন রাসূল (সা.) ওফাত-শয্যায় শায়িত ছিলেন, সে দিনগুলোতে ফাতেমা (রা.) পিতার শয্যাপাশে বসে থাকতেন। এ সময়ে পিতার কাছ থেকে তাঁর আসন্ন ওফাতের কথা শুনে তিনি কেঁদে ফেলেন। আবার রাসূল (সা.)-এর সাথে তিনিই প্রথম মিলিত হবেন, এ ভবিষ্যদ্বাণী শুনে হাসেন তিনি। রাসূল (সা.) তাঁকে বলেছিলেন, “আমার আহলে বাইতের মধ্য থেকে তুমিই প্রথম আমার সাথে মিলিত হবে।”- আত তাবাকাতুল কুবরা, ২য় খ-, পৃ. ২১৯
মহানবী (সা.)-এর এখতিয়ারে ছিল বিনা যুদ্ধে প্রাপ্ত সম্পদ একটি উর্বর অঞ্চল ফাদাক। এটি ছিল খায়বারের কাছে। নিকটাত্মীয়গণের বৈধ প্রয়োজনাদি সম্মানজনকভাবে মেটাতে আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশ রয়েছে সূরা শূরার ষষ্ঠ ও সপ্তম আয়াতে। সূরা ইসরার ২৬তম আয়াত নাযিলের প্রেক্ষিতে কন্যা ফাতেমাকে ডেকে ফাদাকের স্বত্ব হস্তান্তর করেন নবীজী। আবূ সাঈদ খুদরী (রা.) বর্ণিত এ হাদীস।- চিরভাস্বর মহানবী (সা.), দ্বিতীয় খ-। সূত্র : মাজমাউল বায়ান, ৩য় খ-, পৃ. ৪১১; শরহু নাহজুল বালাগাহ, ১৬তম খ-, পৃ. ২৪৮
খিলাফত প্রশাসন প্রাথমিক পর্যায়ে ফাতেমা (রা.)-এর এ দাবির স্বীকৃতি দেন নি।- চিরভাস্বর মহানবী (সা.), দ্বিতীয় খ-। সূত্র : ইবনে আবীল হাদীদ প্রণীত শারহু নাহজুল বালাগাহ, ১৬তম খ-, পৃ. ৩৭৪; সীরাতে হালাবী ৩য় খ-, পৃ. ৪০০
মালে গণীমতের এক পঞ্চমাংশ থেকেও আহলে বাইত কিছু পেতেন না।- ঐ, সূত্র শারহু নাহজুল বালাগাহ, ১৬তম খ-, ২৩৬
শেরে খোদা হযরত ‘আলী (রা.)-এর শাহাদাতের পর মুয়াবিয়ার শাসনকালে তিনি মারওয়ান, আমর ইবনে উসমান ও পুত্র ইয়াযীনের মধ্যে ফাদাক বণ্টন করে দেন। মারওয়ানের দায়িত্বকালে সকল অংশ তার পুত্র আবদুল আযীযকে হিবা করে দেয়। এ ধারা চলতে থাকে। বনী উমাইয়্যা শাসকদের মধ্যে ‘উমর ইবনে আবদুল আযীয (রহ.) ফাদাক ভূখ- হযরত ফাতেমা (রা.)-এর বংশধরদের কাছে ফিরিয়ে দেন। কিন্তু তাঁকে বুঝিয়ে মূল মালিকানা হাতে রেখে সম্পত্তির ব্যয় ফাতেমা (রা.)-এর বংশধরদের মধ্যে বণ্টনে তাঁকে রাজি করা হয়েছিল।”- চিরভাস্বর মহানবী (সা.), দ্বিতীয় খ-। সূত্র : ইবনে আবীল হাদীদ প্রণীত শারহু নাহজুল বালাগাহ, ১৬তম খ-, পৃ. ২৭৮
তাঁর ইন্তেকালের পর পরবর্তীরা ফাদাক সরকারে ফিরিয়ে নেয়। বনী উমাইয়্যা শেষ দিন পর্যন্ত কর্তৃত্বে ছিল।
হযরত ‘আলী (রা.) বসরার গভর্নর ‘উসমান ইবনে হুনাইনের কাছে লেখা এক পত্রে ফাদাক প্রসঙ্গে বলেন, “হ্যাঁ, যেসব কিছুর উপর আকাশ ছায়া প্রদান করেছে, সে সবের মধ্যে ফাদাক গ্রামের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ভূ-সম্পত্তিও অন্তর্ভুক্ত, যা আমাদের হাতে (কর্তৃত্বে) ছিল। কিন্তু কোনো কোনো গোষ্ঠী এ ব্যাপারে কার্পণ্য করল। আর একদল উদার ও মহানুভব ব্যক্তি বিশেষ কতিপয় বৃহত্তর কল্যাণের স্বার্থে তা থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেন। তবে মহান আল্লাহই হচ্ছেন সর্বশ্রেষ্ঠ ফয়সালাকারী।”- নাহজুল বালাগাহ, পত্র ৪৫
৪. ইমাম হাসান বিন ‘আলী (রা.) : সায়্যিদু শাবাবি আহলিল জান্নাহ
বারা বিন আযীব (রা) থেকে বর্ণিত : “আমি হাসানকে রাসূল (সা.)-এর কাঁধ মুবারকে দেখলাম। আল্লাহর নবী বলেন, “হে আল্লাহ! আমি তাকে ভালবাসি। সুতরাং আপনিও তাকে ভালবাসুন।”- বুখারী শরীফ; মুসলিম শরীফ, বাবু ফাযাইলিল হাসানী ওয়াল হুসাইনী।
হযরত আবূ হুরায়রা থেকে বর্ণিত : “মদীনায় বাজার থেকে ফিরে এসে রাসূল (সা.) বললেন, ‘ছোট শিশুটি কোথায়?’ এ কথা তিন বার বললেন। অতঃপর বললেন, ‘হাসান ইবনু ‘আলীকে ডাকো।’ দেখা গেল হাসান ইবনু ‘আলী হেঁটে আসছেন। তাঁর গলায় ছিল মালা। নবী (সা.) এভাবে তার হাত উঠালেন। হাসানও এভাবে তাঁর হাত উঠালেন। তারপর রাসূল (সা) তাঁকে জড়িয়ে ধরলেন এবং বললেন, ‘হে আল্লাহ! আমি একে ভালবাসি; আপনিও তাকে ভালবাসুন এবং যে ব্যক্তি তাকে ভালবাসে, তাকেও আপনি ভালবাসুন।’- বুখারী শরীফ
হযরত আলী (রা.)-এর শাহাদাতের পর ইমাম হাসান (রা.) খলীফা হন। আমীরে মুয়াবিয়া তাঁর খিলাফত মেনে নিতে অস্বীকার করলে ইমাম হাসান তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। ষড়যন্ত্রকারীদের কারণে ইমাম হাসান (আ.) মুয়াবিয়ার সাথে সন্ধি করতে বাধ্য হন। অতঃপর ৫০ হিজরিতে ইমাম হাসানকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়।
৫. ইমাম হুসাইন বিন ‘আলী (রা.): সায়্যিদু শাবাবি আহলিল জান্নাহ
ইমাম হাসান (রা.)-এর পর পবিত্র আহলে বাইতের কনিষ্ঠ সদস্য ইমাম হুসাইন (রা.)। তাঁর প্রতি মুসলিম জনগণের ‘ভালবাসা ও আনুগত্য’ সর্বোচ্চ থাকবে, এটাই প্রত্যাশিত। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনচেতনায় তা ছিলও। কিন্তু পিতৃসূত্রে ক্ষমতাধর খিলাফতের পদলোভী ইয়াযীদের পক্ষ থেকে বিস্ময়করভাবে ইমাম হুসাইন (রা.)-এর কাছে ‘আনুগত্য’ তথা বায়‘আতের দাবি করা হয়। তাতে আত্মসমর্পণ না করলে ভয়ঙ্কর পরিণতির কথাও জানিয়ে দেওয়া হয়। আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীনের পক্ষ থেকে প্রেরিত মানবজাতি তথা সৃষ্টিজগতের প্রতি কল্যাণ ও শান্তির বার্তাবাহী রাসূল রাহমাতুল্লিল ‘আলামীন হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর পরম আদরের দৌহিত্র ইমাম হুসাইন (রা.) মাথা নত করলেন না। ফলে কারবালায় ইয়াযীদের নির্দেশিতদের আক্রমণে অবাঞ্ছিত অসম যুদ্ধে পানিবিহীন অবস্থায় ইমাম পরিবারের সদস্যসহ ৭২জন ফোরাত তীরে শহীদ হন। পিতা খলীফাতুল মুসলিমীন হযরত ‘আলী (রা.)-এর শাহাদাত এবং বড় ভাই ইমাম হাসান (রা.)-এর বিষপ্রয়োগে শাহাদাতের পর এ শাহাদাত মুসলিম উম্মাহর ইতিহাসে তো বটেই, গোটা মানবেতিহাসেও অনন্য করুণ। ইয়াযীদ ও তার দোসরদের পাশবিকতার প্রতি উম্মাহর তথা বিশ্বমানবতার ধিক্কার। এর বিপরীতে রাসূল (সা.) ও ইমাম প্রেমিকরা চিরকাল শ্রদ্ধা জানাবে মূলত অপরাজেয় ‘মৃত্যুহীন’ কালোত্তীর্ণ ইমামকে।
ইমাম হুসাইন (রা.)-এর কাছ থেকে জোরপূর্বক বায়‘আত গ্রহণের জন্য মদীনার গভর্নর ওয়ালিদের কাছে ইয়াযীদ এক পত্রে নির্দেশ দিয়েছিল। তাতে বলা হয়েছিল, তিনি তা করতে অস্বীকৃতি জানালে তাঁর শির কেটে তার কাছে পাঠানোর জন্য।
ইবনে যিয়াদ বলে, ‘আমি আল-হুসাইনকে হত্যা করেছি; কারণ, তিনি আমাদের ইমাম (ইয়াযীদ)-এর বিরুদ্ধে বিপ্লব করেছিলেন এবং এই ইমামই (ইয়াযীদ) হুসাইনকে হত্যার জন্য আমার কাছে বার্তা পাঠিয়েছিলেন। হুসাইনের হত্যা যদি পাপ হয়ে থাকে, তা হলে এ জন্য ইয়াযীদ দায়ী।’
বিষয়টি শুধু এ হত্যায় সীমাবদ্ধ থাকেনি। পরবর্তীতে পবিত্র মক্কা ও মদীনা আক্রান্ত হয়েছে। বহু জীবন হানি ও ক্ষয়ক্ষতি ঘটেছে। সত্য-মিথ্যার যুদ্ধে কারবালার অনন্য শোকাবহ হত্যাকা-ের পর আল্লাহর ঘর কা‘বা ও রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর স্মৃতিবাহী মদীনা আক্রমণের দুঃসহ ব্যথা নিয়ে মুসলিম উম্মাহ হাজার ও শত শত বছর পাড়ি দিচ্ছে। আল্লাহর খিলাফত- মানবকল্যাণ ও বিশ্বশান্তির শাসন ব্যবস্থা স্তব্ধ করে দিয়েছে অবৈধ রাজতান্ত্রিক ক্ষমতালোভী ও পরবর্তীতে তাদের দোসররা।
কুরআন মজীদের ৩৭তম সূরা সাফ্ফাত-এর ক্রমিক ১০৭তম আয়াত ‘মিল্লাতের পিতা’ নবী ইবরাহীম (আ.) কর্তৃক তাঁর সন্তান ইসমাঈল-এর কুরবানির মুহূর্তে আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছায় বিকল্প কুরবানি বিষয়ক : “আর আমি তাকে মুক্ত করলাম বিরাট কুরবানীর বিনিময়ে।”- আল কুরআনের বিষয়ভিত্তিক আয়াত, ৩য় খ-, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ঢাকা, বাংলাদেশ।
আল্লামা ইউসুফ আলী কৃত তাঁর ‘ঞযব ঐড়ষু ছঁৎধহ: ঞৎধহংষধঃরড়হ ্ ঈড়সসবহঃধৎু’-তে এ আয়াতের অনুবাদ: ‘অহফ বি ৎধহংড়সবফ যরস রিঃয ধ সড়সবহঃড়ঁং ংধপৎরভরপব.’ ঝধভভধঃ ৩৭ : অুধঃ ১০৭, চ. ১২০৬
এ আয়াতে ‘সড়সবহঃড়ঁং ংধপৎরভরপব’ সম্পর্কে টীকায় বিশ্লেষণাত্মক মন্তব্যে এই অনুবাদক-ভাষ্যকার ইমাম হুসাইন (রা.)-এর আত্মদানকে সর্বোচ্চ ভাবনায় উত্তীর্ণ করে বলেন- ‘ঞযব ধফলবপঃরাব য়ঁধষরভুরহম ‘ংধপৎরভরপব’ যবৎব, ‘ধুরস’ (মৎবধঃ, সড়সবহঃড়ঁং) সধু নব ঁহফবৎংঃড়ড়ফ নড়ঃয রহ ধ ষরঃবৎধষ ধহফ ধ ভরমঁৎধঃরাব ংবহংব. ওহ ধ ষরঃবৎধষ ংবহংব রঃ রসঢ়ষরবং ঃযধঃ ধ ভরহব ংযববঢ় ড়ৎ ৎধস ধিং ংঁনংঃরঃঁঃবফ ংুসনড়ষরপধষষু. ঞযব ভরমঁৎধঃরাব ংবহংব রং বাবহ সড়ৎব রসঢ়ড়ৎঃধহঃ. ওঃ ধিং রহফববফ ধ মৎবধঃ ধহফ সড়সবহঃড়ঁং ড়পপধংরড়হ, যিবহ ঃড়ি সবহ, রিঃয পড়হপবৎঃবফ রিষষ, ‘ৎধহমবফ ঃযবসংবষাবং রহ ঃযব ৎধহশং’ ড়ভ ঃযড়ংব ঃড় যিড়স ংবষভ-ংধপৎরভরপব রহ ঃযব ংবৎারপব ড়ভ এড়ফ ধিং ঃযব ংঁঢ়ৎবসব ঃযরহম রহ ষরভব.
ঞযরং ধিং ধ ঃুঢ়ব ড়ভ ঃযব ংবৎারপব যিরপয ওসধস ঐঁংধরহ ঢ়বৎভড়ৎসবফ, সধহু ধমবং ষধঃবৎ, রহ ৬০ অ. ঐ. ধং ও যধাব বীঢ়ষধরহবফ রহ ধ ংবঢ়ধৎধঃব ঢ়ধসঢ়যষবঃ…..’
৬. নজরুল কাব্য ও সংগীতে আহলে বাইত
বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। বিশ্বের সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি তিনি। বিশিষ্ট লেখক, গবেষক ও শিক্ষাবিদ মুহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন খান (মরহুম) কাজী নজরুল ইসলামের মূল্যায়নে বলেন, ‘…নজরুল আমাদের জাতীয় পরিচয়ের প্রতীক।… সাথে সাথে সাদী-হাফেজ-আত্তার-রুমী-জামী-নিজামী-সানাঈ-ফেরদৌসীর বাংলা সংস্করণ ও প্রতীক নজরুল ইসলামের সাহিত্যকর্মকে বিশ্বদরবারে তুলে ধরার জন্য সকল মহলের সাগ্রহ প্রচেষ্টা আরজ করছি।’ তাঁর দৃষ্টিতে বিশ্বখ্যাত কালোত্তীর্ণ এই কবিদের ‘বাংলা সংস্করণ ও প্রতীক নজরুল ইসলাম’। তাঁর সংগীত ও কবিতা থেকে আহলে বাইতের শানে কিছু উদ্ধৃতি পেশ করছি :
“খয়বর জয়ী আলী হায়দার
জাগো জাগো আরবার।
দাও দুশমন দুর্গ-বিদারী
দু’ধারী জুলফিকার ॥
এস শেরে খোদা ফিরিয়া আরবে-
ডাকে মুসলিম ‘ইয়া আলী’ রবে-
হায়দরী-হাঁকে তন্দ্রা-মগনে
কর কর হুঁশিয়ার ॥
আল-বোর্জের চূড়া গুঁড়া করা
গোর্জ আবার হানো,
বেহেশতী সাকী, মৃত এ জাতিরে
আবে কওসর দানো ॥
আজি বিশ্ববিজয়ী জাতি যে বেহোঁশ,
দাও তারে নব কুওত ও জোশ;
এস নিরাশার মরুধূলি উড়ায়ে
দুলদুল আসওয়ার ॥”

“ওগো মা- ফাতেমা- ছুটে আয়,
তোর দুলালের বুকে হানে ছুরি।
দীনের শেষ বাতি নিভিয়া যায় মাগো
(বুঝি) আঁধার হ’ল মদিনা-পুরী ॥

কোথায় শেরে-খোদা; জুলফিকার কোথা
কবর ফেড়ে’ এস কারবালা যেথা-
তোমার আওলাদ বিরাণ হ’ল আজি
নিখিল শোকে মরে ঝুরি’ ॥”

কোথা আখেরী নবী, চুমা খেতে তুমি
যে গলে হোসেনের,
সহিছ কেমনে? সে গলে দুশমন
হানিছে শমসের;”

“খাতুনে-জান্নাত ফাতেমা জননী
বিশ্ব-দুলালী নবী-নন্দিনী।
মদিনা-বাসিনী পাপ-তাপ নাশিনী
উম্মত-তারিণী আনন্দিনী ॥
সাহারার বুকে মাগো তুমি মেঘ-মায়া
তপ্ত মরুর প্রাণে ¯েœহ-তরু-ছায়া;
মুক্তি লভিল মাগো এর শুভ পরশে
বিশ্বের যত নারী বন্দিনী ॥”

“নবী-নন্দিনী ফাতেমা মোদের সতী নারীদের রাণী,
যাঁর ত্যাগ, সেবা, ¯েœহ ছিল মরুভূমে কওসর পানি,
যাঁর গুণগাথা ঘরে ঘরে প্রতি নর-নারী আজো গায় ॥”

“মোহররমের চাঁদ এল ঐ কাঁদাতে ফের দুনিয়ায়।
ওয়া হোসেনা; ওয়া হোসেনা তারি মাতম শোনা যায় ॥
কাঁদিয়া জয়নাল আবেদীন বেহোঁশ হল কারবালায়।
বেহেশতে লুটিয়া কাঁদে আলী ও মা ফাতেমায় ॥”

“কাঁদে বিশ্বের মুসলিম আজি, গাহে তারি মর্সিয়া
ঝরে হাজার বছর ধরে অশ্রু তারি শোকে হায় ॥”

“মনে পড়ে আসগরে আজ পিয়াসা দুধের বাচ্চায়
পানি চাহিয়া পেল শাহাদৎ হোসেনের বক্ষে রয়ে ॥
এক হাতে বিবাহের কাঙন এক হাতে কাশেমের লাশ
বেহোঁশ খিমাতে সকিনা অসহ বেদনা স’য়ে ॥”

‘শূন্য পিঠে কাঁদে দুলদুল হজরত হোসেন শহীদ,
আসমানে শোকের বারেষ, ঝরে আজি খুন হয়ে ॥”

“ফোরাতের পানিতে নেমে ফাতেমা দুলাল কাঁদে
অঝোর নয়নে রে।
দু’হাতে তুলিয়া পানি ফেলিয়া দিলেন অমনি
পড়িল কি মনে রে॥”


নব জীবনের “ফোরাত”-কূলে গো কাঁদে “কারবালা” তৃষ্ণাতুর,
ঊর্ধ্বে শোষণ-সূর্য, নি¤েœ তপ্ত বালুকা ব্যথা-মরুর।
ঘিরিয়া য়ুরোপ এজিদের সেনা এপার, ওপার, নিকট, দূর,
এরি মাঝে মোরা “আব্বাস” সম পানি আনি প্রাণ পণ করি।”
(তরুণের গান)

“বহিছে সাহারায় শোকের ‘লু’ হাওয়া
দুলে অসীম আকাশ আকুল রোদনে।
নূহের প্লাবন আসিল ফিরে যেন
ঘোরে অশ্রু শ্রাবণ-ধারা ঝরে সঘনে ॥”

ফাল্গুধারা-সম সেই কাঁদন-নদী
কুল-মুসলিম-চিতে বহে গো নিরবধি,
আসমান ও জমীন রহিবে যতদিন
সবে কাঁদিবে এমনি আকুল কাঁদনে ॥”

লেখক: সাবেক সিনিয়র সহকারী সম্পাদক ও সাহিত্য সম্পাদক, নিউ নেশন, ঢাকা

তথ্যপ্রযুক্তি খাতে অসামান্য অবদানের জন্য দিদারুল আলমকে ‘টেক উদ্যোক্তা এক্সেলেন্স অ্যাওয়ার্ড’ প্রদান

বিজনেস আমেরিকা ম্যাগাজিন-এর উদ্যোগে আয়োজিত Business Excellence Awards 2021-এ বেসিস (BASIS)-এর পরিচালক এবং Shooting Star Limited-এর প্রতিষ্ঠাতা দিদারুল আলম-কে Tech Entrepreneur Excellence Award of the Year-এ ভূষিত করা হয়েছে।
এই পুরস্কারটি দিদারুল আলমের বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের বিকাশে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে প্রদান করা হয়। তার সুদূরদর্শী নেতৃত্ব, উদ্ভাবনী দৃষ্টিভঙ্গি ও সৃজনশীল কর্মকাণ্ড বাংলাদেশের আইটি খাতকে একটি নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে। তিনি শুধুমাত্র একজন সফল উদ্যোক্তাই নন, বরং ডিজিটাল বাংলাদেশের নির্মাণে অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী একজন পথপ্রদর্শক।
পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে বিজনেস আমেরিকা ম্যাগাজিন-এর প্রেসিডেন্ট ও সিইও আলিফ রায়ান বলেন,
“দিদারুল আলম যে নিষ্ঠা ও উদ্ভাবনের সঙ্গে প্রযুক্তি খাতকে এগিয়ে নিচ্ছেন, তা অনুকরণীয়। আমরা তার এই অসাধারণ অবদানকে স্বীকৃতি দিতে পেরে গর্বিত।”
শুধু প্রযুক্তিগত অগ্রগতি নয়, দিদারুল আলম তার নেতৃত্বে সমাজ ও অর্থনীতিতেও প্রভাব ফেলেছেন। Shooting Star Limited-এর মাধ্যমে তিনি নতুন প্রজন্মকে প্রযুক্তি খাতে অনুপ্রাণিত ও ক্ষমতায়ন করছেন। তার এই অর্জন আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের অবস্থানকে আরও সুদৃঢ় করেছে।
বিজনেস আমেরিকা ম্যাগাজিন বিশ্বজুড়ে এমন নেতাদের স্বীকৃতি দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, যারা উদ্ভাবন, নেতৃত্ব এবং সামাজিক পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছেন।

ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের জাতীয় সংগীত

ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের জাতীয় সংগীত
سر زد از افق مهر خاوران
فروغ دیده‌ ی حق‌ باوران
بهمن فر ایمان ماست
پیامت ای امام، استقلال، آزادی، نقش جان ماست
شهیدان، پیچیده در گوش زمان فریادتان
پاینده مانی و جاودان
جمهوری اسلامی ایران
উদিত হলো দিগন্তে প্রাচ্যের সুরুজ
সত্যে বিশ^াসীদের নয়নের দ্যুতি
বাহ্মান্ আমাদের ঈমানের রওনক্ব
হে ইমাম! বাণী তব স্বাধীনতা-মুক্তি মোদের জীবনের ছবি
হে শহীদান! তোমাদের আহ্বান বাজিতেছে যমানার কর্ণকুহরে
হও স্থায়ী ও অমর, হে
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান!
অনুবাদ : শেখ মোহাম্মাদ নাজমুল ইসলাম

বিপ্লবের প্রতীক নিউজলেটার
সিরাজুল হক
[সাবেক সম্পাদক, নিউজলেটার।]

কালকালান্তরে চলেছ তুমি বহন করে হাজারো স্মৃতি
চলেছ তুমি হে নিউজলেটার! বহন করে মানুষের প্রীতি।
তোমার রঙিন পাতায় পাতায় রয়েছে কত সুপ্ত ইতিহাস
জীবন্ত হয়ে উঠেছে কত মহাবিপ্লবের ¯িœগ্ধ সুবাতাস।

ইমামের দানের ফসল তুমি আজ ঘরে ঘরে শোভা পাও
বিচিত্র পুষ্পের সৌরভ যেন চারিদিকে ছড়িয়ে দাও।
জ্ঞান-মনীষা-ধর্ম-সংস্কৃতি শিল্পকলার অপূর্ব সমাহার
প্রতিটি পত্রে হচ্ছে রচিত যেন সুশোভিত মুক্তার হার।

হাফেজ সা‘দী রুমী জামী খৈয়াম নিশাপুরী
ঘরে ঘরে বাঙলার বিলায়েছে যাঁরা প্রেমের গান ভূরিভূরি;
মহাবিপ্লবের মহাগাথা তুমি বিলায়েছ বাঙলার ঘরে ঘরে
ভুলবে না তোমার এই মহাদান রেখেছে সবাই স্বীয় অন্তরে।

তুমি কালোত্তীর্ণ কালের সাক্ষী মহাবিপ্লবের জাগরণী বাণী
তোমার কথা কী করে ভুলবে বাঙলার সুধী আর আছে যত জ্ঞানী।
নিউজলেটার! তুমি ঐক্যের প্রতীক, তুমি ‘ফারভারদিনের’ মিষ্টি মধুর বায়ু
¯্রষ্টার কাছে এই প্রার্থনা দীর্ঘজীবী হোক তব আয়ু।

তুমি লক্ষ শহীদের পুণ্য ভূমি ইসলামী ইরানের প্রতীক
ছড়িয়ে দিবে আলোর মশাল বিশে^র চারিদিক।
দু’টি দশক করেছি সেবা দিবস বিভাবরী এক ঠাঁই
নিরবচ্ছিন্ন সেই ক্লেশের তুলনা কিছুই যেনো নাই।
তবু ছিল মনে প্রগাঢ় শান্তি উৎফুল্ল নিশি-দিন
এমন দিন কি আসবে ফিরে
জীবনে এ অধমের আর কোনো দিন।

 

দিওয়ানে উবায়দি, গযল নম্বর ৩০
অনুবাদ : শেখ মোহাম্মদ নাজমুল ইসলাম

দেখো চেয়ে কীভাবে ফুলে ফুলে প্রস্ফুটিত হয়েছে এই বুস্তান
প্রতিটি পাতায় সমীরণ করেছে তার রহস্য স্থাপন
সকল কপটতা পরিবর্তিত হয়েছে নতুন বাহারে
এই সকল কপটতা তারই দ্বারা হয়েছে দূরীভূত
ইতিপূর্বে ফুলের এই মুখের হাসি কখনো লাগেনি জোড়া
সমীরণ তার কর্ণকুহরে এমনি কি বলেছে অমরতœ
শিশির দ্বারা মাকড়শার জালগুলো
মুক্তার ছিদ্রের ন্যায় কতই না সুন্দর বন্ধনী
পতিত হও হে মেঘ বাঁশবনেরই খুশির অশ্রু হয়ে
ফুলের শাহের দোলনা যেন করেছে বাগানে প্রস্থান
ধরণীতে নব আইনের ঘটেছে উত্থান এবং বুস্তান
পাখির সুমিষ্ট স্বরে ফুর্তিতে হয়েছে মাতোয়ারা
এই নতুন বাহারে হে উবায়দি
কেউ কি এইভাবে শুনেছে কি কোন দাস্তান?

পারভিন এতেসামির কাব্যে আধুনিকতা ও বিষয়বৈচিত্র্য

-ড. তাহমিনা বেগম
ইরানের সাহিত্য আধুনিকতায় সম্প্রসারিত এবং সমাদৃত হতে দেখা যায় মূলত বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে। সাংবিধানিক অধিকার আন্দোলন এই আধুনিক ধারাবাহিকতার একটি নতুন দিগন্তের দ্বার উন্মোচন করে। ইরানি তথা ফারসি কাব্য সাহিত্যকে দুটি ধারায় বিন্যাস করে, তা হলো ক্ল্যাসিক ও আধুনিক। এ সময় পাশ্চাত্যের প্রভাবে নতুন নতুন বিষয় ফারসি সাহিত্যে অন্তর্ভুক্ত হয়। এগুলো হচ্ছে : স্বাধীনতার চেতনা, সামাজিক ও রাজনৈতিক বিশ্বাস, রাজনৈতিক সমঅধিকার চিন্তা, স্বাধীনতা চেতনার সমস্যা এবং সংবাদপত্র ও প্রকাশনার স্বাধীনতা, স্বদেশপ্রেম এবং অবৈধ বিদেশিদের অনুপ্রবেশের প্রতি ঘৃণা। এসব বিষয় গদ্য এবং পদ্য উভয় শাখায় ফারসি সাহিত্যকে উজ্জ্বল করেছে। পূর্ববর্তী সাহিত্য সাধারণ মানুষের জীবনবোধ ও রুচিবোধ থেকে যতটা দূরে ছিল ক্রমান্বয়ে সামাজিক প্রয়োজন ও মানুষের সচেতনতায় সেখানে নতুনত্বের নানাবিধ বিষয়ের উপস্থাপনায় ফারসি সাহিত্য আধুনিকতার এক উদাহরণ হয়ে ওঠে। উপযুক্ত শব্দ ও বাক্যের বিন্যাস একে সর্বজনীন করে তোলে। এ সময়ের একজন শক্তিমান কবি যিনি একই সাথে পুরাতন ও আধুনিকতাকে সাথে নিয়ে বিশ্বকে ফারসি সাহিত্যের নতুন দিগন্ত দিয়েছেন তিনি হলেন পারভিন এতেসামি। সাহিত্যে আধুনিকতায় বিষয় ও বৈচিত্র্যের সমন্বয় তাঁর কবিতাকে অনন্য করেছে, মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছে। হয়ে উঠেছেন তিনি সাধারণ মানুষের কবি।
১৯০৭ সালে ইরানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় তাবরিজ শহরে পারভিন এতেসামির জন্ম। বংশপরম্পরায় পারভিন মায়ের দিক থেকে আজারবাইজানি এবং বাবার দিক থেকে আশতিয়ানি ছিলেন। তাঁর পিতা ইউসুফ এতেসামি সমকালীন একজন বিখ্যাত জ্ঞানী, অনুবাদক ও লেখক হবার পাশাপাশি প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ ছিলেন। মূলত বাবার সাহচর্যই পারভিনকে শৈশব থেকে আরম্ভ করে ফারসি পদ্য ও গদ্যবিষয়ক সম্যক জ্ঞানলাভে সহযোগিতা করে। পরবর্তীকালে তিনি আমেরিকান গার্লস কলেজ থেকে ইংরেজি ও আধুনিক শিক্ষালাভ করেন। কলেজের বিদায় বেলায় প্রকাশিত স্মারকে পারভিনের প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়Ñ যা সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এ কবিতার প্রথম দুটি লাইন ছিল ,
ای نهال آرزو خوش زی که بار آورده ای
غنچه بی باد صبا گل بی بهار آورده ای
‘ফল বয়ে আনা এ আশার চারা গাছ সুখে থেক
হিমেল হাওয়া ছাড়াই কুঁড়িতে বিনা বসন্তেই এনেছ ফুল।’
আধুনিকতাকে বুকে ধারণ করা পারভিন ছিলেন স্বাধীনচেতা একজন কবি। ছাত্রজীবন হতেই পারভিনের ঝোঁক ছিল কবিতার প্রতি। ফলে যৌবনকাল কবিকে এক অনাড়ম্বর জীবন উপহার দেয়। সাহিত্য আসরে স্বরচিত কবিতাপাঠ, বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় কবিতা প্রকাশ তাঁকে নতুন বলয়ের দিকে টেনে নিয়ে যায়। তারুণ্যের উদ্দীপনায় সাহিত্য জীবন শুরু হলেও মাত্র ৩৫ বছরেই এই সুন্দর পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতে হয়েছিল এই কবিকে। স্বল্প বয়সেই এই কবি পাঁচ হাজার ছয়শ বেইত সম্বলিত দিওয়ান রচনা করে সাহিত্যে জায়গা করে নিয়েছেন।
শিল্পকে ধারণ করা কবি-জীবনের সাথে মিলেনি তাঁর চলার পথের সঙ্গীর মননশীলতা। ২৮ বছর সয়সে ১৯৩৪ সালে পেশায় সৈনিক আপন চাচাত ভাইয়ের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েও সংসারের শিল্পকলায় নিজেকে বাঁধতে পারেননি পারভিন। মাত্র তিন মাসেই বিচ্ছেদের মাধ্যমে একাকীত্বের পথ ধরেন এই কবি। ভালোবাসাময় যে সস্পর্ক বিয়ে তা কবিকে যন্ত্রণা, বঞ্চনা এবং বন্দিত্ব ব্যতীত কিছুই দিতে পারেনি। যা তাঁর কবিতায় প্রকাশ পেয়েছে প্রাণবন্তভাবে। কবি বলেন,
جز سرزنش و بد سری خار چه ديدی؟ ای گل! تو ز جمعيت گلزار چه ديدی؟
جز مشتری سفله به بازار چه ديدی؟ ای لعل دل افروز!تو با اين همه پرتو
غير از قفس،ای مرغ گرفتارچه ، چه ديدی؟ رفتی به چمن ، ليک قفس گشت نصيبت
হে পুষ্প, তুমি ফুলের আসরে কী দেখেছ?
কাঁটার রুক্ষতা আর ভর্ৎসনা ছাড়া কী দেখেছ?
বাগানে গমন করেছিলে কিন্তু ভাগ্যে জুটেছে খাঁচা
ওহে বন্দিনী পাখি! ফুলবনে ঢুকে কী দেখেছ?
পারভিনের দিওয়ানে কাসিদা, মসনবি ও কেতআসহ বিভিন্ন ধরনের কবিতা স্থান পেয়েছে। সমাজ ও সমাজের মানুষের বিভিন্ন চিত্র, যেমন : নারী, শিশু, বঞ্চিত, নির্যাতিত ও নিপীড়িত মানুষের অধিকার আদায়ের দাবি স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। একই সাথে নৈতিক শিক্ষার বিষয় ও সৎকর্মের অনুপ্রেরণাও তাঁর কবিতাকে অলংকৃত করেছে। আধুনিক বিষয়ের সাথে ইত্যকার বিষয়াবলি মানুষের মনের খোরাক জুগিয়েছে।
ইরানের সমস্যাসঙ্কুল গোলযোগপূর্ণ রাজনৈতিক অবস্থার ভেতরেই বেড়ে ওঠা একজন কবি পারভিন। সমকালীন অন্যান্য কবির মতো তাঁর কবিতাতেও শ্বাসরুদ্ধকর রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং সামাজিক নানা অসঙ্গতির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় সহজেই। পারভিন এতেসামি আত্মিক সৌন্দর্য এবং চিন্তার দৃঢ়তার মাধ্যমে এসব ঘটনা বর্ণনার ক্ষেত্রে স্বাতন্ত্র্য সৃষ্টিতে সাফল্যের পরিচয় দিয়েছেন।
পারভিনের কবিতার বিষয়বস্তু এবং কাব্যভাবনা যদিও আধুনিক ভাবধারায় রচিত তবুও তাঁর কাব্যসাহিত্যে চিরায়ত ধারার অনুসরণই দৃশ্যমান। তাঁর কবিতায় অনেক নামকরা কবিদের অনুকরণ দেখতে পাওয়া যায় যার মধ্যে নাসের খসরু, শেখ সাদি অন্যতম। অপরদিকে তাঁর কবিতায় অন্তর্নিহিত অর্থের দিক থেকে আরেফ ও সাধকগণের চিন্তারও সমন্বয় খুঁজে পাওয়া যায়। যা কবির আধুনিক কবিতায় একটি স্বতন্ত্র ভাব এনে দিয়েছে।
পারভিন যেমন নিপীড়ন, বঞ্চনা, দারিদ্র্য ও অসহায়ত্বের বিরুদ্ধে সোচ্চার তেমনি নির্দয় অর্থশালী, বিত্তবান অভিজাত শ্রেণির বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ। স্বৈরাচারী অত্যাচারী রাজার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ এবং মানবতার পক্ষে তাঁর দৃঢ় অবস্থান। তাই পারভিনের চোখ নিপীড়িত মানুষের রক্তে গড়া রাজার রাজমুকুট ও সিংহাসনে মূলত বঞ্চিত মানুষের ঘামই চিকচিক করে জ্বলতে দেখে,

فرياد شوق ز هر کوی و بام خاست روزی گذشت پادشهی از گذرگهی
کاين تابناک چيست که بر تاج پادشاست؟ پرسيد زان ميانه يکی کودک يتيم:
پيداست آن قدر که متاعی گرانبهاست آن يک جواب داد:چه دانيم ماکه چيست؟
اين اشک ديدۀ من و خون دل شماست نزديک رفت پير زنی کوژ پشت و گفت
اين گرگ سال هاست که با گله آشناس ما را به رخت و چوب شبانی فريفته است
একদা রাস্তা দিয়ে রাজা চলে যায়,
প্রতিটি অলি-গলি ও ছাদ থেকে ভেসে আসে ফরিয়াদ।
একটি অনাথ শিশু বলে ওঠে,
‘রাজার মাথায় অমন মুক্তোর মতো কী সে চমকায়?’
অন্যজন স্বর তোলে, ‘বলতে পারি নাÑ
তবে জানি মূল্যবান বস্তু এক, তাই জ্বলে কি না!’
বৃদ্ধা এক ছুটে এসে বলে,
‘ওটাতো আমার অশ্রু, তোমাদের রক্তের কণিকা
সমস্ত জমাট হয়ে রাজার পাগড়ি মাঝে জ্বলে।’
যেমন ভেড়ার দলে বাঘ এসে ভেড়া শেষ করে।
নারী জাগরণের অগ্রদূত বলা হয় আধুনিক কবি পারভিনকে। যিনি সমাজে নারীর অবস্থা এবং মর্যাদা সম্পর্কে দৃঢ়তার সাথে কলম ধরেছেন। ফেরেশতায়ে উনস বা মায়ের ফেরেশতা নামের কবিতায় কবি মাকে একজন ফেরেশতার সাথে তুলনা করেছেন। অক্সিজেনবিহীন মানুষ যেমন নি®প্রাণ তেমনি নারীবিহীন একটি পরিবার। দৈহিক দিক থেকে নারীরা পুরুষদের অপেক্ষা দুর্বল এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে পুরুষের উপর নির্ভরশীল। এরপরও পারিবারিক জীবনে মায়ের ভূমিকা মূল্যায়ন করতে গিয়ে তিনি বলেন,
در آن وجود که دل مرد مرده است روان در آن سرای که زن نيست ، انس و شفقت نيست
برای مرد کمال و برای زن نقصان به هيچ مبحث و ديباچه ای، قضا ننوشت
যে ঘরে নারী¬ নেই, সেখানে প্রেম-মায়ার চিহ্ন নেই
যে দেহে মনের মৃত্যু হয়েছে, সেতো নিসাড় নি®প্রাণ।
কোথাও, কোন ভূমিকায় ভাগ্যলিপি এমন কথা লিখেনি
পুরুষের জন্য পূর্ণতা আর নারীর ভাগ্যে ত্রুটি-অপূর্ণতা।
শিক্ষা একটি জাতিকে উন্নত করে তোলে। এরপরও সমাজব্যবস্থায় এর অসঙ্গতি লক্ষ্য করা যায় প্রবলভাবে। নারী-পুরুষ সকলের জন্যই শিক্ষা অপরিহার্য তবুও পুরুষশাসিত সমাজে নারীদের শিক্ষা থেকে পিছিয়ে থাকার দৃশ্য খুব সহজেই দৃষ্টি কাড়ে। যেখানে সমাজের গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে নারী সেখানে নারীদের এহেন দুরবস্থা সত্যিই ভাবার মতো। সমাজে বসবাসরত প্রতিটি মানুষের উচিত স্বশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া। একজন নারী যতদিন পর্যন্ত শিক্ষার আলো থেকে দূরে থাকবে ততদিন পর্যন্ত সমাজের উন্নতি কোনভাবেই সম্ভব নয়। পারভিন এতেসামি নারীদের শিক্ষা থেকে দূরে থাকার ঘোর বিরোধী ছিলেন। তাঁর মতে, একটি জাতি, রাষ্ট্র ও সমাজের উন্নয়ন তখনই সম্ভব যখন পুরুষের পাশাপাশি নারীও শিক্ষার আলোয় উদ্ভাসিত হবে। তিনি নারীদেরকে যার যার অবস্থানে থেকে শিক্ষা বা জ্ঞান আহরণের প্রতি উৎসাহিত করেন। শিক্ষার আলো ব্যতীত মানুষের জীবন অন্ধ। কবির ভাষায় উচ্চারিত হয়,
پستی نسوان ايران جمله از بی دانشی است
مرديازن برتری و رتبت از دانستن است
به که هر دختر بداند قدر علم آموختن
تا نگويد کس پسر هشيار و دختر کودن است.
ইরানের নারীদের হীনমন্যতা, সম্পূর্ণ জ্ঞানহীনতার কারণ
পুরুষ অথবা নারীর শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা জ্ঞানেরই অবদান
যদি প্রতিটি মেয়ে জ্ঞান শিক্ষার মর্যাদা জানত
তবে কেউ বলত না যে, পুরুষ বুদ্ধিমান ও নারী বোকা।
‘শিশু’ মানব জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশের নাম। শিশুরা কোমলমতি স্বভাবের। ছোট্ট মনের পৃথিবীতে তাদের রয়েছে আলাদা এক ভূবন, যেটা খুব সহজ-সরল, হৃদ্যতা আর কল্পনা, কৌতুহল আর অনুভূতিতে ভরা। সকল শিশুই ভালবাসাপ্রিয়, তারা একদিকে যেমন বাবা-মার ভালবাসার প্রত্যাশী, অন্যদিকে তাদের আকাক্সক্ষা যেন মাঠে-ঘাটে, স্কুলে সকলেই তাদের স্নেহ করে। কিন্তু পিতৃহীন এক শিশুর রোনাজারি তার মায়ের মনকে বেদনায় নীল করে দেয়। বাবা না থাকাটা যেন এক অপরাধ। কবির ব্যথিত মন এই শিশুর কষ্টে প্রশ্ন রাখে, পৃথিবীর বুকে শিশুর অপরাধ কোথায়? কেন সে অন্য বাচ্চাদের মতো নয়? এমনি এক অশ্রুভরা শিশুর কাহিনী কবি পারভিন এভাবেই বর্ণনা করেন,
کز کودکان کوی به من کس نظر نداشت دی، کودکی به دامن مادر گريست
آن تير طعنه، زخم کم از نيشتر نداشت طفلی مرا ز پهلوی خود بيگانه راند
کودک مگر نبود، کسی کاو پدر نداشت اطفال را به صحبت من، از چه ميل نيست
مانا که رنج و سعی فقيران، ثمر نداشت امروز، اوستاد به درسم نگه نکرد
آن شاه شد که جامهء خلقان به بر نداشت ديروز، در ميانهء بازی، ز کودکان
اين اشک و آرزو، ز چه هر گز اثر نداشت؟ من در خيال موزه، بسی اشک ريختم
کو موزه ای به پا و کلاهی به سر نداشت جز من، ميان اين گل و باران کسی نبود
آيين کودکی، ره و رسم دگر نداشت؟ آخر تفاوت من و طفلان شهر چيست؟
وين شمع، روشنايی ازاين بيشتر نداشت هرگز درون مطبخ ما هيزمی نسوخت
کس جز من و تو، قوت ز خون جگر نداشت همسايگان ما بره و مرغ می خورند
دينار و درهمی، پدر من مگر نداشت؟ بر وصله های پيرهنم خنده می کنند
গতরাতে এক ছেলে মায়ের আঁচলে মুখ লুকিয়ে
কেঁদে কেঁদে নালিশ করল, ‘মা!
পাড়ার ছেলেরা আমার দিকে তাকায়নি কেউ
আমাকে করেনি তাদের খেলার সাথি।
সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে একটি ছেলে আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছে
তার পাশে থেকে। তার ভর্ৎসনা
তীর-বর্শার চেয়েও তীক্ষè বিষাক্ত ছিল।
ছেলেরা আমার সাথে কথা বলতে চায় না কেন মা?
তাহলে কি যার বাবা বেঁচে নেই, ছেলে হিসেবে
গণ্য হওয়ার অধিকার তার নেই?
আজ ওস্তাদজি ক্লাসে আমার পড়া দেখেননি।
গরীব হওয়াতে পরিশ্রমের যেন কোন মূল্য নেই।
গতকালের খেলায় ছেলেদের মাঝে সেই ‘রাজা’ হলো
যার পরনে পুরনো কাপড় ছিল না।
আমি জুতার চিন্তায় অনেক অশ্রু ঝরালাম,
এই অশ্রু ও আকাক্সক্ষা কখনো কি প্রভাব ফেলবে না?
কাদা ও বৃষ্টির দিনে আমি ছাড়া এমন কেউ ছিল না,
যার পায়ে জুতা আর মাথায় টুপি ছিল না।
অবশেষে শহরের ছেলেদের সাথে আমার পার্থক্য কোথায়?
ছোট ছেলেদের নিয়মনীতির কি কোন বালাই নাই?
পাশের বাড়ির লোকেরা মুরগি-ভেড়া প্রতিদিন খায়
কলিজার রক্ত চুষে বাঁচি আমি আর তুমি ছাড়া এমন তো কেউ নেই।
আমার জামার সেলাই দেখে তারা হাসাহাসি করে
দিনার-দিরহাম বলতে আমার বাবার কি কিছুই ছিল না?’
সমাজে ধনী-গরীবের বৈষম্য যত বেশি হয় সামাজিক অস্থিরতাও তত বেড়ে যায়। একদিকে ধনীদের বিত্ত-বৈভব ও বিলাসিতাপূর্ণ জীবন অন্যদিকে হত-দরিদ্রদের ছিন্নবস্ত্র-অনাহারক্লিষ্ট জীবন। একদিকে ধনীদের প্রাসাদ-অট্টালিকা, অন্যদিকে গরীবদের কুঁড়ে ঘর অথবা গাছের নিচে কিংবা পথে প্রান্তরে ঠিকানাবিহীন জীবন। একদিকে বহু মূল্য সুদৃশ্য বেশভূষার চমক এবং রকমারি খাদ্যের বাহারি আয়োজন অপরদিকে অন্নহীন, বস্ত্রহীন, ক্ষুধিত মানুষের অশ্রুসজল মলিনমুখ। একদিকে জীবনকে সুন্দর করার স্বপ্ন এবং অন্যদিকে জীবনকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য অনাহারী মানুষদের এক মুঠো অন্নের সন্ধানে আমৃত্যু সংগ্রাম। পারভিন এতেসামি মানুষকে পুঁজিবাদী মনোবৃত্তি পরিহার করে সমাজের এতিম, অন্নহীন, বস্ত্রহীন, ক্ষুধিত মানুষদের দিকে দয়ার দৃষ্টিতে তাকানোর জন্য উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। কবির ভাষায়,
صورت و سينه به ناخن می خست به سر خاک پدر، دخترکی
کاش روحم به پدر می پيوست که نه پيوند و نه مادر دارم
مرد و از رنج تهيدستی رست گريه ام بهر پدر نيست که او
دام بر هر طرف انداخت گسست زان کنم گريه که اندر يم بخت
هيچ ماهيش نيافتاد به شست شصت سال آفت اين دريا ديد
و اندرين کوی، سه داروگر هست پدرم مرد ز بی دارويی
که طبيبیش به بالين ننشست دل مسکينم از اين غم بگداخت
تا مرا ديد، در خانه ببست سوی همسايه پی نان رفتم
ليک روزی نگرفتندش دست همه ديدند که افتاده ز پای
ديشب از ديدهء من آتش جست آب دادم به پدر چون نان خواست
دل من بود که ايام شکست هم قبا داشت ثريا هم کفش
من چه می خواستم از گيتی پست؟ اين همه بخل چرا کرد، مگر
آه از اين آدمی ديو پرست! سيم و زر بود، خدايی گر بود
পিতার কবরের পাশে এক ছোট্ট বালিকা
নখের আঁচড়ে বুক আর মুখ বিক্ষত করছিল।
‘নেই কোনো আত্মীয়, নেই আমার মা
হায় আমার প্রাণ যদি বাবার কাছে উড়ে যেত।
আমার কান্না বাবার জন্য নয়। কারণ, তিনি তো
মরে বেঁচে গেছেন অভাবের যন্ত্রণা হতে।
কাঁদছি- কারণ, ভাগ্যের বিশাল সাগরে
যতদিন জাল ফেলেছি ছিঁড়ে গেছে বারে বাবে।
তিনি (পিতা) ষাট বছর এ (ভাগ্যের) সাগরের দুর্বিপাক দেখেছেন,
এর (সাগরের) কোনো মাছই ধরা পড়েনি বড়শিতে।
বাবা আমার মারা গেছেন বিনা ঔষধে, বিনা চিকিৎসায়
অথচ তিনজন চিকিৎসক আমাদের পাড়ায় ছিল বিদ্যমান
জানেন কি? আমার হতভাগা হৃদয় কাঁদছে কেন?
অসুস্থ বাবার শিয়রে আসেনি ডাক্তার কোনো
পড়শির কাছে গিয়েছিলাম আমি রুটির খোঁজে
আমাকে দেখে দুয়ার আটকে দিল অবজ্ঞা করে,
সবাই দেখেছে, তিনি পড়ে আছেন, অসহায় নিরুপায়
আসেনি কেউ দু’হাত বাড়িয়ে, হয়নি তাঁর সহায়।
রুটি চেয়েছিলেন বাবা, আমি দিয়েছিলাম পানি
গত রাত ভর জ্বলেছে সেই দুঃখের অগ্নি।
সুরাইয়ার তো জামাও ছিল তার পায়ে জুতাও ছিল
এই জগতে বঞ্চিত কেবল আমিই, আমার কপাল মন্দ ছিল।
এই সকল কার্পণ্য কেন করল? তবে
আমি হীন ধরণির কাছে কি চেয়েছি?
খোদার কর্ম যদি করত স্বর্ণ-রৌপ্যের তো কমতি নেই
হায়! (যদি) এ দৈত্য স্বভাবের মানুষ হতে রেহাই পেতাম।’

আধুনিকায়ন বিশ্বসাহিত্যে মানুষের হৃদয়কে বিশেষভাবে পরিবর্তনের দিকে নিয়ে যায়। এমনকি মানুষের যাপিত জীবনকে খুব কাছ থেকে মূল্যায়নের সুযোগ করে দেয়। পারভিন ছিলেন পাশ্চাত্য দর্শনের সাথে সমধিক পরিচিত। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিক্ষা-দীক্ষার প্রভাবে বেড়ে ওঠা এই কবির কবিতায় তৎকালীন বিশ্বব্যাপী সাহিত্যিক বিপ্লবের ধারার নিদর্শন দেখা যায়। এ জাতীয় কবিতার মাধ্যমে তিনি মানুষকে তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করেন,
بزرگ بوده پرستار خردیِ ايشان اگر فلاطن و سقراط، بوده اند بزرگ
سپس به مکتب حکمت، حکيم شد لقمان به گهوارهء مادر، به کودکی بس خفت
يکی ست کشتی و آن ديگری کشتيبان وظيفهء زن و مرد، ای حکيم دانی چيست
دگر چه باک ز امواج و رطبه و طوفان چو نا خداست خردمند و کشتی اش محکم

প্লেটো-সক্রেটিস যদি মহান ছিলেন, শৈশবে তাঁদের
লালন পালন করেছে যে সেই তো মহান নির্দ্বিধায়
মায়ের দোলনায় ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে একটি শিশু
জ্ঞান-মনীষার পাঠশালায় পড়ে হয়েছেন লোকমান হাকিম।
ওহে জ্ঞানী, জান কি নারী ও পুরুষের দায়িত্ব কী?
একজন হলো জাহাজ আর একজন কাপ্তান।
কাপ্তান যদি বিজ্ঞ হয় আর জাহাজ মজবুত
তুফান, তরঙ্গের শঙ্কা কিসের? তুমি নির্ভয়।
পারভিনের কাব্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় দেহ ও আত্মা। তাঁর দৃষ্টিতে, মানুষের আত্মাই হচ্ছে মৌলিক বস্তু। মানুষের রূহ বা আত্মাকে মুখ্য বিষয় এবং দেহকে আনুষাঙ্গিক বিষয় হিসেবে অভিহিত করেন। হিংসা-বিদ্বেষ ও লোভ-লালসা প্রভৃতি অসৎ গুণাবলি মানুষের হৃদয়কে কলুষিত করে। কেননা, সুখ ও দুঃখ সবই আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে আসে, তাই সবই একমাত্র তাঁরই উপর নির্ভরশীল। দেহ ও প্রাণের আবেদনের সমন্বয়ে তিনি উপমা ও রূপকের মাধ্যমে কবিতাতে সংযোজন করেন।
পরকালীন জবাবদিহিতার ভয় মানুষকে অপকর্ম থেকে বিরত রাখে। পারভিনের দৃষ্টিতে, পার্থিব জীবন হচ্ছে ব্যবসার মতো লাভ-ক্ষতি নিয়েই একটি জীবন। দুনিয়ার এই ক্ষণস্থায়ী জীবনে কেউ ক্ষতির সম্মুখীন হয় আবার কেউ লাভ নিয়ে এগিয়ে থাকে। বস্তুবাদী এ পার্থিব জীবনের ভোগবিলাস পরিত্যাগ ও হিংসা-বিদ্বেষ থেকে অন্তরকে পবিত্র রাখার উপদেশ দিয়েছেন তিনি। কুরআনে কারিমের বিভিন্ন কাহিনী কাব্যাকারে উপস্থাপনের মাধ্যমেও কিছু শিক্ষণীয় বিষয় উপস্থাপিত হয়েছে। এমনকি তাঁর দিওয়ানে হজরত মূসা (আ.) ও ফেরআউনের কাহিনীও অতি চমৎকারভাবে বর্ণিত হয়েছে। নিম্নে এর কিয়দংশ তুলে ধরা হলো :
در فکند، از گفتهء رب جليل مادر موسی، چو موسی را به نيل
گفت کای فرزند خرد بی گناه! خودزساحل کرد با حسرت نگاه
چون رهی زين کشتی بی نا خدای؟ گر فراموشت کند لطف خدای
آب ، خاکت را دهد ناگه به باد گر نيارد ايزد پاکت به ياد
رهرو ما اينک اندر منزل است وحی آمد کاين چه فکر باطل است؟
تا ببينی سود کردی يا زيان پردهء شک را بر انداز از ميان
دست حق را ديدی و نشناختی ما گرفتيم آنچه را انداختی
شيوهء ما، عدل و بنده پر و ری ست در تو،تنها عشق و مهر مادری ست
آنچه برديم از تو، باز آريم باز نيست بازی، کار حق، خودرا مباز
মূসার মা যখন আল্লাহর হুকুমে
মূসাকে ফেলে দিলেন নীল নদে।
নদীর তীরে দাঁড়িয়ে ভীষণ মর্মপীড়ায়
বলল: ‘হে আমার নিষ্পাপ শিশু!
আল্লাহর দয়া যদি ভুলে যায় তোমার কথা
মাঝি-মাল্লাহীন এ ডিঙি থেকে কীভাবে রক্ষা পাবে?
মহান রব যদি তোমাকে রহমতের ছায়া না দেন
পানি তোমার সর্বনাশ ঘটাবে, অস্তিত্ব করবে বিপন্ন।’
অহি আসল, ‘এ কেমন বাজে কল্পনা তোমার
আমার পথিক তো এখন পৌঁছেছে তার গন্তব্য।
সংশয়ের পর্দা তুলে নাও সম্মুখ হতে এবার
তাহলেই দেখতে পাবে মুনাফা করেছ না লোকসান।
তুমি ফেলেছ যা, আমি তা তুলে নিয়েছি
আল্লাহর হাত দেখেছ কিন্তু চেননি তা।
তোমার মাঝে রয়েছে শুধু মায়ের স্নেহ ও মমতা
আমার নীতি ইনসাফ ও বান্দার প্রতিপালন।
আল্লাহর কাজ খেল তামাশা নয়, প্রতারিত হয়ো না নিজে
তোমার কাছ থেকে যা নিয়েছি, ফিরিয়ে দেব তোমার কাছে।’
নৈতিক অধঃপতন একটি সমাজকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যায়। ক্ষণস্থায়ী এই পার্থিব জগৎ হিংসা-বিদ্বেষ ও লোভ-লালসায় পরিপূর্ণ। একমাত্র সঠিক জ্ঞানই পারে ভুল হতে দূরে সরিয়ে আখেরাতের পাথেয় সংগ্রহের দিকে ধাবিত করতে। মানবজীবন পুনর্গঠনে নৈতিক ও প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয়সমূহের অবতারণা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পারভিন এতেসামি তাঁর কবিতায় সুখী ও সুন্দর সমাজ গঠনের শিক্ষণীয় বিষয় তুলে ধরে বলেন,
نخستين فرض بوده ست اغنيارا مشو خود بين، که نيکی با فقيران
چراغ دولت و گنج غنا را زمحتاجان خبر گير، ای که داری
نبايد داشت در دل جز خدارا به وقت بخشش و انفاق، پروين
আত্মঅহংকারী হয়ো না, দরিদ্রদের প্রতি কল্যাণকামী হও
ধনীদের এটাই প্রধান করণীয় তাদের প্রতি।
অভাবীদের খবর নাও, হে সম্পদশালী!
ধনীর ধনভা-ার এতে নিয়োজিত কর।
বদান্যতা ও দানের ক্ষেত্রে হে পারভিন!
আল্লাহর ভয় ছাড়া কোনো কিছু স্থান দিও না হৃদয়ে।
মানুষের আকাক্সক্ষা ও প্রাপ্তির চাহিদার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। যে যত পায় সে তত বেশি পেতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। প্রাপ্তির পাহাড়ও মানুষকে সুখ-শান্তি দিতে সক্ষম নয়। প্রকৃত সুখ নির্ভর করে অল্পে তুষ্টির উপর। এমনকি পার্থিব বিষয়ে মানুষ যদি অপেক্ষাকৃত কম বিত্তবানদের প্রতি মনোনিবেশ করে এবং নিজের প্রাপ্ত সম্পদের ব্যাপারে সস্তুষ্ট থাকে সেই প্রকৃত ধনী, সেই সুখী। আধুনিক এই কবি পারভিন এ জাতীয় লোভ থেকে দূরে থেকে সন্তুষ্টচিত্তে জীবন অতিবাহিত করার শিক্ষা দিয়েছেন তাঁর লেখনীতে। তিনি বলেন,
کار مده نفس تبه کار را در صف گل جا مده اين خار را
جرخ و زمين بندهء تدبير توست بنده مشو درهم و دينار را
همسر پرهيز نگردد طمع باهنر انباز مکن عار را
বিনাশী প্রবৃত্তির উপর দায়িত্ব অর্পণ করো না
পুষ্পের সারিতে এ কাঁটাকে স্থান দিও না।
পৃথিবী ও গতিশীল জীবন সবই তোমার অধীনে
তুমি দিরহাম ও দিনারের গোলামে পরিণত হয়ো না।
পরহেজগারের স্ত্রী কখনো লোভী হয় না
শিল্পের সাহচর্য লাভে সঙ্কোচ করো না।
ফারসি কাব্যচর্চায় সমকালীন এই মহিলা কবি মাত্র চৌত্রিশ বছর বয়সে ১৯৪১ সালে টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। আধুনিকতার সমন্বয়ে বৈচিত্র্যময় অনুভূতি খুবই হৃদয়গ্রাহীভাবে তিনি সাহিত্যপ্রেমী মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। পিতার কবরের পাশে কোম শহরে তাঁকে সমহিত করা হয়। তাঁর কবরের ওপর খোদাই করে লিপিবদ্ধ রয়েছেÑ
اختر چرخ ادب، پروين است اين که خاک سيهش بالين است
هر چه خواهی، سخنش شيرين است گر چه جز تلخی از ايام نديد
سائل فاتحه و ياسين است صاحب آن همه گفتار، امروز
دل بی دوست، دلی غمگين است دوستان به که ز وی ياد کنند
سنگ بر سينه، بسی سنگين است خاک در ديده، بسی جانفرساست
هر که را چشم حقيقت بين است بيند اين بستر و عبرت گيرد
آخرين منزل هستی اين است هر که باشی و ز هر جا برسی
چون بدين نقطه رسد، مسکين است آدمی هر چه توانگر باشد
چاره، تسليم و ادب، تمکين است اندر آنجا که قضا حمله کند
دهررا رسد و ره ديرين است زادن و کشتن و پنهان کردن
خاطری را سبب تسکين است خرم آن کس که دراين محنت گاه
কালো মৃত্তিকা আজ যার শিয়রের ঠিকানা
সাহিত্যাকাশের নক্ষত্র সে সপ্তর্ষি।
জীবনকালে যদিও জোটেনি তিক্ততা ছাড়া কিছু
যতই চাইবে তার কথায় পাবে মধু অপার।
এতসব কথার শিল্পী যিনি, তিনি তো আজ
সূরা ফাতেহা ও ইয়াসিনের কাঙ্গাল।
বন্ধুদের জন্য উত্তম হবে, যদি তাকে স্মরণ করেন কবরে
বন্ধুহীন অন্তর সে তো চিন্তাক্লিষ্ট হৃদয়।
চোখের ওপরে চাপা মাটি বড় হৃদয়বিদারক
বুকের ওপর চাপা এ পাষাণ অসহনীয় সংহারক।
দেখুক এ বিছানা, উপদেশ নিয়ে যাক
সত্যকে দেখার চোখ যার আছে, উপলব্ধি করুক।
যে-ই হও, আর যেখানেই যাও বা আস
জীবন-জগতের শেষ মনযিল এইতো ঠিকানা।
মানুষ যতই সম্পদশালী আর হোক ধনী
এখানে যখন আসে সে তো দরিদ্র ও মিসকীন।
নিয়তির বিধান হামলা করে সেখানে যখন
একমাত্র উপায় বিনয়, আনুগত্য, আল্লাহতে সমর্পণ।
জন্মদান, গুম করা আর প্রাণ হরণ
জগতের এ যে চিরায়ত নিয়ম, বিধির বাঁধন।
কষ্ট-ক্লেশের এই নিবাসে আনন্দিত শুধু সেই লোক
যার আছে প্রশান্তচিত্ত, হৃদয়ে আলোক।
কবিরা মানুষের হৃদয়ের অভিব্যক্তি প্রকাশে দক্ষ শিল্পী। শিল্প বলতে মূলত কল্পনা ও রহস্যের সমন্বয়ে সৌন্দর্যতত্ত্বের আকৃতিতে সুশৃঙ্খল বর্ণনাকে বুঝায়। কবিতায় শিল্প হচ্ছে কল্পনা, রহস্য এবং ভাষার সমন্বয় সাধন। শিল্পের অভ্যন্তরীণ সেই নির্দিষ্ট ভাষা ঐ শিল্পীর বিশেষ ভাষা হিসেবে পরিগণিত। পারভিনের কাব্যের মধ্যেও দেখা যায় কল্পনা, রহস্য এবং ভাষার সমন্বয়ে মূল বক্তব্য বিভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করে গভীর থেকে গভীরতার দিকে ধাবিত হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে তাঁর কাব্যের সাবলীল ভাষা ও গতিশীলতা হৃদয়ে অনাবিল আনন্দ ও ঝংকার সৃষ্টি করে পাঠককুলে। মানবতাবাদী এই মহান কবি সর্বান্তকরণে মানুষের তরে সাহিত্যচর্চা করেছেন যেখানে আধুনিকতায় বৈচিত্র্যময় আবেগ-অনুভূতি ও কল্পনার গাঁথুনী তাঁর কাব্যমানকে উন্নত ও সমৃদ্ধ করেছে। তাঁর কবিতা শুধু ইরানেই নয়; বর্তমান বিশ্বের নির্যাতিত ও অধিকার বঞ্চিত মানুষের আকাক্সক্ষা পূরণে যুগান্তকারী ভূমিকায় অবতীর্ণ। পারভিন এতেসামি স^ীয় রচনার মাধ্যমে পাঠককুলের হৃদয়ে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন অনন্তকাল।

লেখক : অধ্যাপক, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

পারভিন এতেসামির কাব্যে আধুনিকতা ও বিষয়বৈচিত্র্য

পারভিন এতেসামির কাব্যে আধুনিকতা ও বিষয়বৈচিত্র্য
ড. তাহমিনা বেগম

ইরানের সাহিত্য আধুনিকতায় সম্প্রসারিত এবং সমাদৃত হতে দেখা যায় মূলত বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে। সাংবিধানিক অধিকার আন্দোলন এই আধুনিক ধারাবাহিকতার একটি নতুন দিগন্তের দ্বার উন্মোচন করে। ইরানি তথা ফারসি কাব্য সাহিত্যকে দুটি ধারায় বিন্যাস করে, তা হলো ক্ল্যাসিক ও আধুনিক। এ সময় পাশ্চাত্যের প্রভাবে নতুন নতুন বিষয় ফারসি সাহিত্যে অন্তর্ভুক্ত হয়। এগুলো হচ্ছে : স্বাধীনতার চেতনা, সামাজিক ও রাজনৈতিক বিশ্বাস, রাজনৈতিক সমঅধিকার চিন্তা, স্বাধীনতা চেতনার সমস্যা এবং সংবাদপত্র ও প্রকাশনার স্বাধীনতা, স্বদেশপ্রেম এবং অবৈধ বিদেশিদের অনুপ্রবেশের প্রতি ঘৃণা। এসব বিষয় গদ্য এবং পদ্য উভয় শাখায় ফারসি সাহিত্যকে উজ্জ্বল করেছে। পূর্ববর্তী সাহিত্য সাধারণ মানুষের জীবনবোধ ও রুচিবোধ থেকে যতটা দূরে ছিল ক্রমান্বয়ে সামাজিক প্রয়োজন ও মানুষের সচেতনতায় সেখানে নতুনত্বের নানাবিধ বিষয়ের উপস্থাপনায় ফারসি সাহিত্য আধুনিকতার এক উদাহরণ হয়ে ওঠে। উপযুক্ত শব্দ ও বাক্যের বিন্যাস একে সর্বজনীন করে তোলে। এ সময়ের একজন শক্তিমান কবি যিনি একই সাথে পুরাতন ও আধুনিকতাকে সাথে নিয়ে বিশ্বকে ফারসি সাহিত্যের নতুন দিগন্ত দিয়েছেন তিনি হলেন পারভিন এতেসামি। সাহিত্যে আধুনিকতায় বিষয় ও বৈচিত্র্যের সমন্বয় তাঁর কবিতাকে অনন্য করেছে, মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছে। হয়ে উঠেছেন তিনি সাধারণ মানুষের কবি।
১৯০৭ সালে ইরানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় তাবরিজ শহরে পারভিন এতেসামির জন্ম। বংশপরম্পরায় পারভিন মায়ের দিক থেকে আজারবাইজানি এবং বাবার দিক থেকে আশতিয়ানি ছিলেন। তাঁর পিতা ইউসুফ এতেসামি সমকালীন একজন বিখ্যাত জ্ঞানী, অনুবাদক ও লেখক হবার পাশাপাশি প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ ছিলেন। মূলত বাবার সাহচর্যই পারভিনকে শৈশব থেকে আরম্ভ করে ফারসি পদ্য ও গদ্যবিষয়ক সম্যক জ্ঞানলাভে সহযোগিতা করে। পরবর্তীকালে তিনি আমেরিকান গার্লস কলেজ থেকে ইংরেজি ও আধুনিক শিক্ষালাভ করেন। কলেজের বিদায় বেলায় প্রকাশিত স্মারকে পারভিনের প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়Ñ যা সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এ কবিতার প্রথম দুটি লাইন ছিল ,
ای نهال آرزو خوش زی که بار آورده ای
غنچه بی باد صبا گل بی بهار آورده ای
‘ফল বয়ে আনা এ আশার চারা গাছ সুখে থেক
হিমেল হাওয়া ছাড়াই কুঁড়িতে বিনা বসন্তেই এনেছ ফুল।’
আধুনিকতাকে বুকে ধারণ করা পারভিন ছিলেন স্বাধীনচেতা একজন কবি। ছাত্রজীবন হতেই পারভিনের ঝোঁক ছিল কবিতার প্রতি। ফলে যৌবনকাল কবিকে এক অনাড়ম্বর জীবন উপহার দেয়। সাহিত্য আসরে স্বরচিত কবিতাপাঠ, বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় কবিতা প্রকাশ তাঁকে নতুন বলয়ের দিকে টেনে নিয়ে যায়। তারুণ্যের উদ্দীপনায় সাহিত্য জীবন শুরু হলেও মাত্র ৩৫ বছরেই এই সুন্দর পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতে হয়েছিল এই কবিকে। স্বল্প বয়সেই এই কবি পাঁচ হাজার ছয়শ বেইত সম্বলিত দিওয়ান রচনা করে সাহিত্যে জায়গা করে নিয়েছেন।
শিল্পকে ধারণ করা কবি-জীবনের সাথে মিলেনি তাঁর চলার পথের সঙ্গীর মননশীলতা। ২৮ বছর সয়সে ১৯৩৪ সালে পেশায় সৈনিক আপন চাচাত ভাইয়ের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েও সংসারের শিল্পকলায় নিজেকে বাঁধতে পারেননি পারভিন। মাত্র তিন মাসেই বিচ্ছেদের মাধ্যমে একাকীত্বের পথ ধরেন এই কবি। ভালোবাসাময় যে সস্পর্ক বিয়ে তা কবিকে যন্ত্রণা, বঞ্চনা এবং বন্দিত্ব ব্যতীত কিছুই দিতে পারেনি। যা তাঁর কবিতায় প্রকাশ পেয়েছে প্রাণবন্তভাবে। কবি বলেন,
جز سرزنش و بد سری خار چه ديدی؟ ای گل! تو ز جمعيت گلزار چه ديدی؟
جز مشتری سفله به بازار چه ديدی؟ ای لعل دل افروز!تو با اين همه پرتو
غير از قفس،ای مرغ گرفتارچه ، چه ديدی؟ رفتی به چمن ، ليک قفس گشت نصيبت
হে পুষ্প, তুমি ফুলের আসরে কী দেখেছ?
কাঁটার রুক্ষতা আর ভর্ৎসনা ছাড়া কী দেখেছ?
বাগানে গমন করেছিলে কিন্তু ভাগ্যে জুটেছে খাঁচা
ওহে বন্দিনী পাখি! ফুলবনে ঢুকে কী দেখেছ?
পারভিনের দিওয়ানে কাসিদা, মসনবি ও কেতআসহ বিভিন্ন ধরনের কবিতা স্থান পেয়েছে। সমাজ ও সমাজের মানুষের বিভিন্ন চিত্র, যেমন : নারী, শিশু, বঞ্চিত, নির্যাতিত ও নিপীড়িত মানুষের অধিকার আদায়ের দাবি স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। একই সাথে নৈতিক শিক্ষার বিষয় ও সৎকর্মের অনুপ্রেরণাও তাঁর কবিতাকে অলংকৃত করেছে। আধুনিক বিষয়ের সাথে ইত্যকার বিষয়াবলি মানুষের মনের খোরাক জুগিয়েছে।
ইরানের সমস্যাসঙ্কুল গোলযোগপূর্ণ রাজনৈতিক অবস্থার ভেতরেই বেড়ে ওঠা একজন কবি পারভিন। সমকালীন অন্যান্য কবির মতো তাঁর কবিতাতেও শ্বাসরুদ্ধকর রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং সামাজিক নানা অসঙ্গতির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় সহজেই। পারভিন এতেসামি আত্মিক সৌন্দর্য এবং চিন্তার দৃঢ়তার মাধ্যমে এসব ঘটনা বর্ণনার ক্ষেত্রে স্বাতন্ত্র্য সৃষ্টিতে সাফল্যের পরিচয় দিয়েছেন।
পারভিনের কবিতার বিষয়বস্তু এবং কাব্যভাবনা যদিও আধুনিক ভাবধারায় রচিত তবুও তাঁর কাব্যসাহিত্যে চিরায়ত ধারার অনুসরণই দৃশ্যমান। তাঁর কবিতায় অনেক নামকরা কবিদের অনুকরণ দেখতে পাওয়া যায় যার মধ্যে নাসের খসরু, শেখ সাদি অন্যতম। অপরদিকে তাঁর কবিতায় অন্তর্নিহিত অর্থের দিক থেকে আরেফ ও সাধকগণের চিন্তারও সমন্বয় খুঁজে পাওয়া যায়। যা কবির আধুনিক কবিতায় একটি স্বতন্ত্র ভাব এনে দিয়েছে।
পারভিন যেমন নিপীড়ন, বঞ্চনা, দারিদ্র্য ও অসহায়ত্বের বিরুদ্ধে সোচ্চার তেমনি নির্দয় অর্থশালী, বিত্তবান অভিজাত শ্রেণির বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ। স্বৈরাচারী অত্যাচারী রাজার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ এবং মানবতার পক্ষে তাঁর দৃঢ় অবস্থান। তাই পারভিনের চোখ নিপীড়িত মানুষের রক্তে গড়া রাজার রাজমুকুট ও সিংহাসনে মূলত বঞ্চিত মানুষের ঘামই চিকচিক করে জ্বলতে দেখে,

فرياد شوق ز هر کوی و بام خاست روزی گذشت پادشهی از گذرگهی
کاين تابناک چيست که بر تاج پادشاست؟ پرسيد زان ميانه يکی کودک يتيم:
پيداست آن قدر که متاعی گرانبهاست آن يک جواب داد:چه دانيم ماکه چيست؟
اين اشک ديدۀ من و خون دل شماست نزديک رفت پير زنی کوژ پشت و گفت
اين گرگ سال هاست که با گله آشناس ما را به رخت و چوب شبانی فريفته است
একদা রাস্তা দিয়ে রাজা চলে যায়,
প্রতিটি অলি-গলি ও ছাদ থেকে ভেসে আসে ফরিয়াদ।
একটি অনাথ শিশু বলে ওঠে,
‘রাজার মাথায় অমন মুক্তোর মতো কী সে চমকায়?’
অন্যজন স্বর তোলে, ‘বলতে পারি নাÑ
তবে জানি মূল্যবান বস্তু এক, তাই জ্বলে কি না!’
বৃদ্ধা এক ছুটে এসে বলে,
‘ওটাতো আমার অশ্রু, তোমাদের রক্তের কণিকা
সমস্ত জমাট হয়ে রাজার পাগড়ি মাঝে জ্বলে।’
যেমন ভেড়ার দলে বাঘ এসে ভেড়া শেষ করে।
নারী জাগরণের অগ্রদূত বলা হয় আধুনিক কবি পারভিনকে। যিনি সমাজে নারীর অবস্থা এবং মর্যাদা সম্পর্কে দৃঢ়তার সাথে কলম ধরেছেন। ফেরেশতায়ে উনস বা মায়ের ফেরেশতা নামের কবিতায় কবি মাকে একজন ফেরেশতার সাথে তুলনা করেছেন। অক্সিজেনবিহীন মানুষ যেমন নি®প্রাণ তেমনি নারীবিহীন একটি পরিবার। দৈহিক দিক থেকে নারীরা পুরুষদের অপেক্ষা দুর্বল এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে পুরুষের উপর নির্ভরশীল। এরপরও পারিবারিক জীবনে মায়ের ভূমিকা মূল্যায়ন করতে গিয়ে তিনি বলেন,
در آن وجود که دل مرد مرده است روان در آن سرای که زن نيست ، انس و شفقت نيست
برای مرد کمال و برای زن نقصان به هيچ مبحث و ديباچه ای، قضا ننوشت
যে ঘরে নারী¬ নেই, সেখানে প্রেম-মায়ার চিহ্ন নেই
যে দেহে মনের মৃত্যু হয়েছে, সেতো নিসাড় নি®প্রাণ।
কোথাও, কোন ভূমিকায় ভাগ্যলিপি এমন কথা লিখেনি
পুরুষের জন্য পূর্ণতা আর নারীর ভাগ্যে ত্রুটি-অপূর্ণতা।
শিক্ষা একটি জাতিকে উন্নত করে তোলে। এরপরও সমাজব্যবস্থায় এর অসঙ্গতি লক্ষ্য করা যায় প্রবলভাবে। নারী-পুরুষ সকলের জন্যই শিক্ষা অপরিহার্য তবুও পুরুষশাসিত সমাজে নারীদের শিক্ষা থেকে পিছিয়ে থাকার দৃশ্য খুব সহজেই দৃষ্টি কাড়ে। যেখানে সমাজের গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে নারী সেখানে নারীদের এহেন দুরবস্থা সত্যিই ভাবার মতো। সমাজে বসবাসরত প্রতিটি মানুষের উচিত স্বশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া। একজন নারী যতদিন পর্যন্ত শিক্ষার আলো থেকে দূরে থাকবে ততদিন পর্যন্ত সমাজের উন্নতি কোনভাবেই সম্ভব নয়। পারভিন এতেসামি নারীদের শিক্ষা থেকে দূরে থাকার ঘোর বিরোধী ছিলেন। তাঁর মতে, একটি জাতি, রাষ্ট্র ও সমাজের উন্নয়ন তখনই সম্ভব যখন পুরুষের পাশাপাশি নারীও শিক্ষার আলোয় উদ্ভাসিত হবে। তিনি নারীদেরকে যার যার অবস্থানে থেকে শিক্ষা বা জ্ঞান আহরণের প্রতি উৎসাহিত করেন। শিক্ষার আলো ব্যতীত মানুষের জীবন অন্ধ। কবির ভাষায় উচ্চারিত হয়,
پستی نسوان ايران جمله از بی دانشی است
مرديازن برتری و رتبت از دانستن است
به که هر دختر بداند قدر علم آموختن
تا نگويد کس پسر هشيار و دختر کودن است.
ইরানের নারীদের হীনমন্যতা, সম্পূর্ণ জ্ঞানহীনতার কারণ
পুরুষ অথবা নারীর শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা জ্ঞানেরই অবদান
যদি প্রতিটি মেয়ে জ্ঞান শিক্ষার মর্যাদা জানত
তবে কেউ বলত না যে, পুরুষ বুদ্ধিমান ও নারী বোকা।
‘শিশু’ মানব জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশের নাম। শিশুরা কোমলমতি স্বভাবের। ছোট্ট মনের পৃথিবীতে তাদের রয়েছে আলাদা এক ভূবন, যেটা খুব সহজ-সরল, হৃদ্যতা আর কল্পনা, কৌতুহল আর অনুভূতিতে ভরা। সকল শিশুই ভালবাসাপ্রিয়, তারা একদিকে যেমন বাবা-মার ভালবাসার প্রত্যাশী, অন্যদিকে তাদের আকাক্সক্ষা যেন মাঠে-ঘাটে, স্কুলে সকলেই তাদের স্নেহ করে। কিন্তু পিতৃহীন এক শিশুর রোনাজারি তার মায়ের মনকে বেদনায় নীল করে দেয়। বাবা না থাকাটা যেন এক অপরাধ। কবির ব্যথিত মন এই শিশুর কষ্টে প্রশ্ন রাখে, পৃথিবীর বুকে শিশুর অপরাধ কোথায়? কেন সে অন্য বাচ্চাদের মতো নয়? এমনি এক অশ্রুভরা শিশুর কাহিনী কবি পারভিন এভাবেই বর্ণনা করেন,
کز کودکان کوی به من کس نظر نداشت دی، کودکی به دامن مادر گريست
آن تير طعنه، زخم کم از نيشتر نداشت طفلی مرا ز پهلوی خود بيگانه راند
کودک مگر نبود، کسی کاو پدر نداشت اطفال را به صحبت من، از چه ميل نيست
مانا که رنج و سعی فقيران، ثمر نداشت امروز، اوستاد به درسم نگه نکرد
آن شاه شد که جامهء خلقان به بر نداشت ديروز، در ميانهء بازی، ز کودکان
اين اشک و آرزو، ز چه هر گز اثر نداشت؟ من در خيال موزه، بسی اشک ريختم
کو موزه ای به پا و کلاهی به سر نداشت جز من، ميان اين گل و باران کسی نبود
آيين کودکی، ره و رسم دگر نداشت؟ آخر تفاوت من و طفلان شهر چيست؟
وين شمع، روشنايی ازاين بيشتر نداشت هرگز درون مطبخ ما هيزمی نسوخت
کس جز من و تو، قوت ز خون جگر نداشت همسايگان ما بره و مرغ می خورند
دينار و درهمی، پدر من مگر نداشت؟ بر وصله های پيرهنم خنده می کنند
গতরাতে এক ছেলে মায়ের আঁচলে মুখ লুকিয়ে
কেঁদে কেঁদে নালিশ করল, ‘মা!
পাড়ার ছেলেরা আমার দিকে তাকায়নি কেউ
আমাকে করেনি তাদের খেলার সাথি।
সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে একটি ছেলে আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছে
তার পাশে থেকে। তার ভর্ৎসনা
তীর-বর্শার চেয়েও তীক্ষè বিষাক্ত ছিল।
ছেলেরা আমার সাথে কথা বলতে চায় না কেন মা?
তাহলে কি যার বাবা বেঁচে নেই, ছেলে হিসেবে
গণ্য হওয়ার অধিকার তার নেই?
আজ ওস্তাদজি ক্লাসে আমার পড়া দেখেননি।
গরীব হওয়াতে পরিশ্রমের যেন কোন মূল্য নেই।
গতকালের খেলায় ছেলেদের মাঝে সেই ‘রাজা’ হলো
যার পরনে পুরনো কাপড় ছিল না।
আমি জুতার চিন্তায় অনেক অশ্রু ঝরালাম,
এই অশ্রু ও আকাক্সক্ষা কখনো কি প্রভাব ফেলবে না?
কাদা ও বৃষ্টির দিনে আমি ছাড়া এমন কেউ ছিল না,
যার পায়ে জুতা আর মাথায় টুপি ছিল না।
অবশেষে শহরের ছেলেদের সাথে আমার পার্থক্য কোথায়?
ছোট ছেলেদের নিয়মনীতির কি কোন বালাই নাই?
পাশের বাড়ির লোকেরা মুরগি-ভেড়া প্রতিদিন খায়
কলিজার রক্ত চুষে বাঁচি আমি আর তুমি ছাড়া এমন তো কেউ নেই।
আমার জামার সেলাই দেখে তারা হাসাহাসি করে
দিনার-দিরহাম বলতে আমার বাবার কি কিছুই ছিল না?’
সমাজে ধনী-গরীবের বৈষম্য যত বেশি হয় সামাজিক অস্থিরতাও তত বেড়ে যায়। একদিকে ধনীদের বিত্ত-বৈভব ও বিলাসিতাপূর্ণ জীবন অন্যদিকে হত-দরিদ্রদের ছিন্নবস্ত্র-অনাহারক্লিষ্ট জীবন। একদিকে ধনীদের প্রাসাদ-অট্টালিকা, অন্যদিকে গরীবদের কুঁড়ে ঘর অথবা গাছের নিচে কিংবা পথে প্রান্তরে ঠিকানাবিহীন জীবন। একদিকে বহু মূল্য সুদৃশ্য বেশভূষার চমক এবং রকমারি খাদ্যের বাহারি আয়োজন অপরদিকে অন্নহীন, বস্ত্রহীন, ক্ষুধিত মানুষের অশ্রুসজল মলিনমুখ। একদিকে জীবনকে সুন্দর করার স্বপ্ন এবং অন্যদিকে জীবনকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য অনাহারী মানুষদের এক মুঠো অন্নের সন্ধানে আমৃত্যু সংগ্রাম। পারভিন এতেসামি মানুষকে পুঁজিবাদী মনোবৃত্তি পরিহার করে সমাজের এতিম, অন্নহীন, বস্ত্রহীন, ক্ষুধিত মানুষদের দিকে দয়ার দৃষ্টিতে তাকানোর জন্য উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। কবির ভাষায়,
صورت و سينه به ناخن می خست به سر خاک پدر، دخترکی
کاش روحم به پدر می پيوست که نه پيوند و نه مادر دارم
مرد و از رنج تهيدستی رست گريه ام بهر پدر نيست که او
دام بر هر طرف انداخت گسست زان کنم گريه که اندر يم بخت
هيچ ماهيش نيافتاد به شست شصت سال آفت اين دريا ديد
و اندرين کوی، سه داروگر هست پدرم مرد ز بی دارويی
که طبيبیش به بالين ننشست دل مسکينم از اين غم بگداخت
تا مرا ديد، در خانه ببست سوی همسايه پی نان رفتم
ليک روزی نگرفتندش دست همه ديدند که افتاده ز پای
ديشب از ديدهء من آتش جست آب دادم به پدر چون نان خواست
دل من بود که ايام شکست هم قبا داشت ثريا هم کفش
من چه می خواستم از گيتی پست؟ اين همه بخل چرا کرد، مگر
آه از اين آدمی ديو پرست! سيم و زر بود، خدايی گر بود
পিতার কবরের পাশে এক ছোট্ট বালিকা
নখের আঁচড়ে বুক আর মুখ বিক্ষত করছিল।
‘নেই কোনো আত্মীয়, নেই আমার মা
হায় আমার প্রাণ যদি বাবার কাছে উড়ে যেত।
আমার কান্না বাবার জন্য নয়। কারণ, তিনি তো
মরে বেঁচে গেছেন অভাবের যন্ত্রণা হতে।
কাঁদছি- কারণ, ভাগ্যের বিশাল সাগরে
যতদিন জাল ফেলেছি ছিঁড়ে গেছে বারে বাবে।
তিনি (পিতা) ষাট বছর এ (ভাগ্যের) সাগরের দুর্বিপাক দেখেছেন,
এর (সাগরের) কোনো মাছই ধরা পড়েনি বড়শিতে।
বাবা আমার মারা গেছেন বিনা ঔষধে, বিনা চিকিৎসায়
অথচ তিনজন চিকিৎসক আমাদের পাড়ায় ছিল বিদ্যমান
জানেন কি? আমার হতভাগা হৃদয় কাঁদছে কেন?
অসুস্থ বাবার শিয়রে আসেনি ডাক্তার কোনো
পড়শির কাছে গিয়েছিলাম আমি রুটির খোঁজে
আমাকে দেখে দুয়ার আটকে দিল অবজ্ঞা করে,
সবাই দেখেছে, তিনি পড়ে আছেন, অসহায় নিরুপায়
আসেনি কেউ দু’হাত বাড়িয়ে, হয়নি তাঁর সহায়।
রুটি চেয়েছিলেন বাবা, আমি দিয়েছিলাম পানি
গত রাত ভর জ্বলেছে সেই দুঃখের অগ্নি।
সুরাইয়ার তো জামাও ছিল তার পায়ে জুতাও ছিল
এই জগতে বঞ্চিত কেবল আমিই, আমার কপাল মন্দ ছিল।
এই সকল কার্পণ্য কেন করল? তবে
আমি হীন ধরণির কাছে কি চেয়েছি?
খোদার কর্ম যদি করত স্বর্ণ-রৌপ্যের তো কমতি নেই
হায়! (যদি) এ দৈত্য স্বভাবের মানুষ হতে রেহাই পেতাম।’

আধুনিকায়ন বিশ্বসাহিত্যে মানুষের হৃদয়কে বিশেষভাবে পরিবর্তনের দিকে নিয়ে যায়। এমনকি মানুষের যাপিত জীবনকে খুব কাছ থেকে মূল্যায়নের সুযোগ করে দেয়। পারভিন ছিলেন পাশ্চাত্য দর্শনের সাথে সমধিক পরিচিত। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিক্ষা-দীক্ষার প্রভাবে বেড়ে ওঠা এই কবির কবিতায় তৎকালীন বিশ্বব্যাপী সাহিত্যিক বিপ্লবের ধারার নিদর্শন দেখা যায়। এ জাতীয় কবিতার মাধ্যমে তিনি মানুষকে তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করেন,
بزرگ بوده پرستار خردیِ ايشان اگر فلاطن و سقراط، بوده اند بزرگ
سپس به مکتب حکمت، حکيم شد لقمان به گهوارهء مادر، به کودکی بس خفت
يکی ست کشتی و آن ديگری کشتيبان وظيفهء زن و مرد، ای حکيم دانی چيست
دگر چه باک ز امواج و رطبه و طوفان چو نا خداست خردمند و کشتی اش محکم

প্লেটো-সক্রেটিস যদি মহান ছিলেন, শৈশবে তাঁদের
লালন পালন করেছে যে সেই তো মহান নির্দ্বিধায়
মায়ের দোলনায় ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে একটি শিশু
জ্ঞান-মনীষার পাঠশালায় পড়ে হয়েছেন লোকমান হাকিম।
ওহে জ্ঞানী, জান কি নারী ও পুরুষের দায়িত্ব কী?
একজন হলো জাহাজ আর একজন কাপ্তান।
কাপ্তান যদি বিজ্ঞ হয় আর জাহাজ মজবুত
তুফান, তরঙ্গের শঙ্কা কিসের? তুমি নির্ভয়।
পারভিনের কাব্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় দেহ ও আত্মা। তাঁর দৃষ্টিতে, মানুষের আত্মাই হচ্ছে মৌলিক বস্তু। মানুষের রূহ বা আত্মাকে মুখ্য বিষয় এবং দেহকে আনুষাঙ্গিক বিষয় হিসেবে অভিহিত করেন। হিংসা-বিদ্বেষ ও লোভ-লালসা প্রভৃতি অসৎ গুণাবলি মানুষের হৃদয়কে কলুষিত করে। কেননা, সুখ ও দুঃখ সবই আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে আসে, তাই সবই একমাত্র তাঁরই উপর নির্ভরশীল। দেহ ও প্রাণের আবেদনের সমন্বয়ে তিনি উপমা ও রূপকের মাধ্যমে কবিতাতে সংযোজন করেন।
পরকালীন জবাবদিহিতার ভয় মানুষকে অপকর্ম থেকে বিরত রাখে। পারভিনের দৃষ্টিতে, পার্থিব জীবন হচ্ছে ব্যবসার মতো লাভ-ক্ষতি নিয়েই একটি জীবন। দুনিয়ার এই ক্ষণস্থায়ী জীবনে কেউ ক্ষতির সম্মুখীন হয় আবার কেউ লাভ নিয়ে এগিয়ে থাকে। বস্তুবাদী এ পার্থিব জীবনের ভোগবিলাস পরিত্যাগ ও হিংসা-বিদ্বেষ থেকে অন্তরকে পবিত্র রাখার উপদেশ দিয়েছেন তিনি। কুরআনে কারিমের বিভিন্ন কাহিনী কাব্যাকারে উপস্থাপনের মাধ্যমেও কিছু শিক্ষণীয় বিষয় উপস্থাপিত হয়েছে। এমনকি তাঁর দিওয়ানে হজরত মূসা (আ.) ও ফেরআউনের কাহিনীও অতি চমৎকারভাবে বর্ণিত হয়েছে। নিম্নে এর কিয়দংশ তুলে ধরা হলো :
در فکند، از گفتهء رب جليل مادر موسی، چو موسی را به نيل
گفت کای فرزند خرد بی گناه! خودزساحل کرد با حسرت نگاه
چون رهی زين کشتی بی نا خدای؟ گر فراموشت کند لطف خدای
آب ، خاکت را دهد ناگه به باد گر نيارد ايزد پاکت به ياد
رهرو ما اينک اندر منزل است وحی آمد کاين چه فکر باطل است؟
تا ببينی سود کردی يا زيان پردهء شک را بر انداز از ميان
دست حق را ديدی و نشناختی ما گرفتيم آنچه را انداختی
شيوهء ما، عدل و بنده پر و ری ست در تو،تنها عشق و مهر مادری ست
آنچه برديم از تو، باز آريم باز نيست بازی، کار حق، خودرا مباز
মূসার মা যখন আল্লাহর হুকুমে
মূসাকে ফেলে দিলেন নীল নদে।
নদীর তীরে দাঁড়িয়ে ভীষণ মর্মপীড়ায়
বলল: ‘হে আমার নিষ্পাপ শিশু!
আল্লাহর দয়া যদি ভুলে যায় তোমার কথা
মাঝি-মাল্লাহীন এ ডিঙি থেকে কীভাবে রক্ষা পাবে?
মহান রব যদি তোমাকে রহমতের ছায়া না দেন
পানি তোমার সর্বনাশ ঘটাবে, অস্তিত্ব করবে বিপন্ন।’
অহি আসল, ‘এ কেমন বাজে কল্পনা তোমার
আমার পথিক তো এখন পৌঁছেছে তার গন্তব্য।
সংশয়ের পর্দা তুলে নাও সম্মুখ হতে এবার
তাহলেই দেখতে পাবে মুনাফা করেছ না লোকসান।
তুমি ফেলেছ যা, আমি তা তুলে নিয়েছি
আল্লাহর হাত দেখেছ কিন্তু চেননি তা।
তোমার মাঝে রয়েছে শুধু মায়ের স্নেহ ও মমতা
আমার নীতি ইনসাফ ও বান্দার প্রতিপালন।
আল্লাহর কাজ খেল তামাশা নয়, প্রতারিত হয়ো না নিজে
তোমার কাছ থেকে যা নিয়েছি, ফিরিয়ে দেব তোমার কাছে।’
নৈতিক অধঃপতন একটি সমাজকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যায়। ক্ষণস্থায়ী এই পার্থিব জগৎ হিংসা-বিদ্বেষ ও লোভ-লালসায় পরিপূর্ণ। একমাত্র সঠিক জ্ঞানই পারে ভুল হতে দূরে সরিয়ে আখেরাতের পাথেয় সংগ্রহের দিকে ধাবিত করতে। মানবজীবন পুনর্গঠনে নৈতিক ও প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয়সমূহের অবতারণা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পারভিন এতেসামি তাঁর কবিতায় সুখী ও সুন্দর সমাজ গঠনের শিক্ষণীয় বিষয় তুলে ধরে বলেন,
نخستين فرض بوده ست اغنيارا مشو خود بين، که نيکی با فقيران
چراغ دولت و گنج غنا را زمحتاجان خبر گير، ای که داری
نبايد داشت در دل جز خدارا به وقت بخشش و انفاق، پروين
আত্মঅহংকারী হয়ো না, দরিদ্রদের প্রতি কল্যাণকামী হও
ধনীদের এটাই প্রধান করণীয় তাদের প্রতি।
অভাবীদের খবর নাও, হে সম্পদশালী!
ধনীর ধনভা-ার এতে নিয়োজিত কর।
বদান্যতা ও দানের ক্ষেত্রে হে পারভিন!
আল্লাহর ভয় ছাড়া কোনো কিছু স্থান দিও না হৃদয়ে।
মানুষের আকাক্সক্ষা ও প্রাপ্তির চাহিদার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। যে যত পায় সে তত বেশি পেতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। প্রাপ্তির পাহাড়ও মানুষকে সুখ-শান্তি দিতে সক্ষম নয়। প্রকৃত সুখ নির্ভর করে অল্পে তুষ্টির উপর। এমনকি পার্থিব বিষয়ে মানুষ যদি অপেক্ষাকৃত কম বিত্তবানদের প্রতি মনোনিবেশ করে এবং নিজের প্রাপ্ত সম্পদের ব্যাপারে সস্তুষ্ট থাকে সেই প্রকৃত ধনী, সেই সুখী। আধুনিক এই কবি পারভিন এ জাতীয় লোভ থেকে দূরে থেকে সন্তুষ্টচিত্তে জীবন অতিবাহিত করার শিক্ষা দিয়েছেন তাঁর লেখনীতে। তিনি বলেন,
کار مده نفس تبه کار را در صف گل جا مده اين خار را
جرخ و زمين بندهء تدبير توست بنده مشو درهم و دينار را
همسر پرهيز نگردد طمع باهنر انباز مکن عار را
বিনাশী প্রবৃত্তির উপর দায়িত্ব অর্পণ করো না
পুষ্পের সারিতে এ কাঁটাকে স্থান দিও না।
পৃথিবী ও গতিশীল জীবন সবই তোমার অধীনে
তুমি দিরহাম ও দিনারের গোলামে পরিণত হয়ো না।
পরহেজগারের স্ত্রী কখনো লোভী হয় না
শিল্পের সাহচর্য লাভে সঙ্কোচ করো না।
ফারসি কাব্যচর্চায় সমকালীন এই মহিলা কবি মাত্র চৌত্রিশ বছর বয়সে ১৯৪১ সালে টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। আধুনিকতার সমন্বয়ে বৈচিত্র্যময় অনুভূতি খুবই হৃদয়গ্রাহীভাবে তিনি সাহিত্যপ্রেমী মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। পিতার কবরের পাশে কোম শহরে তাঁকে সমহিত করা হয়। তাঁর কবরের ওপর খোদাই করে লিপিবদ্ধ রয়েছেÑ
اختر چرخ ادب، پروين است اين که خاک سيهش بالين است
هر چه خواهی، سخنش شيرين است گر چه جز تلخی از ايام نديد
سائل فاتحه و ياسين است صاحب آن همه گفتار، امروز
دل بی دوست، دلی غمگين است دوستان به که ز وی ياد کنند
سنگ بر سينه، بسی سنگين است خاک در ديده، بسی جانفرساست
هر که را چشم حقيقت بين است بيند اين بستر و عبرت گيرد
آخرين منزل هستی اين است هر که باشی و ز هر جا برسی
چون بدين نقطه رسد، مسکين است آدمی هر چه توانگر باشد
چاره، تسليم و ادب، تمکين است اندر آنجا که قضا حمله کند
دهررا رسد و ره ديرين است زادن و کشتن و پنهان کردن
خاطری را سبب تسکين است خرم آن کس که دراين محنت گاه
কালো মৃত্তিকা আজ যার শিয়রের ঠিকানা
সাহিত্যাকাশের নক্ষত্র সে সপ্তর্ষি।
জীবনকালে যদিও জোটেনি তিক্ততা ছাড়া কিছু
যতই চাইবে তার কথায় পাবে মধু অপার।
এতসব কথার শিল্পী যিনি, তিনি তো আজ
সূরা ফাতেহা ও ইয়াসিনের কাঙ্গাল।
বন্ধুদের জন্য উত্তম হবে, যদি তাকে স্মরণ করেন কবরে
বন্ধুহীন অন্তর সে তো চিন্তাক্লিষ্ট হৃদয়।
চোখের ওপরে চাপা মাটি বড় হৃদয়বিদারক
বুকের ওপর চাপা এ পাষাণ অসহনীয় সংহারক।
দেখুক এ বিছানা, উপদেশ নিয়ে যাক
সত্যকে দেখার চোখ যার আছে, উপলব্ধি করুক।
যে-ই হও, আর যেখানেই যাও বা আস
জীবন-জগতের শেষ মনযিল এইতো ঠিকানা।
মানুষ যতই সম্পদশালী আর হোক ধনী
এখানে যখন আসে সে তো দরিদ্র ও মিসকীন।
নিয়তির বিধান হামলা করে সেখানে যখন
একমাত্র উপায় বিনয়, আনুগত্য, আল্লাহতে সমর্পণ।
জন্মদান, গুম করা আর প্রাণ হরণ
জগতের এ যে চিরায়ত নিয়ম, বিধির বাঁধন।
কষ্ট-ক্লেশের এই নিবাসে আনন্দিত শুধু সেই লোক
যার আছে প্রশান্তচিত্ত, হৃদয়ে আলোক।
কবিরা মানুষের হৃদয়ের অভিব্যক্তি প্রকাশে দক্ষ শিল্পী। শিল্প বলতে মূলত কল্পনা ও রহস্যের সমন্বয়ে সৌন্দর্যতত্ত্বের আকৃতিতে সুশৃঙ্খল বর্ণনাকে বুঝায়। কবিতায় শিল্প হচ্ছে কল্পনা, রহস্য এবং ভাষার সমন্বয় সাধন। শিল্পের অভ্যন্তরীণ সেই নির্দিষ্ট ভাষা ঐ শিল্পীর বিশেষ ভাষা হিসেবে পরিগণিত। পারভিনের কাব্যের মধ্যেও দেখা যায় কল্পনা, রহস্য এবং ভাষার সমন্বয়ে মূল বক্তব্য বিভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করে গভীর থেকে গভীরতার দিকে ধাবিত হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে তাঁর কাব্যের সাবলীল ভাষা ও গতিশীলতা হৃদয়ে অনাবিল আনন্দ ও ঝংকার সৃষ্টি করে পাঠককুলে। মানবতাবাদী এই মহান কবি সর্বান্তকরণে মানুষের তরে সাহিত্যচর্চা করেছেন যেখানে আধুনিকতায় বৈচিত্র্যময় আবেগ-অনুভূতি ও কল্পনার গাঁথুনী তাঁর কাব্যমানকে উন্নত ও সমৃদ্ধ করেছে। তাঁর কবিতা শুধু ইরানেই নয়; বর্তমান বিশ্বের নির্যাতিত ও অধিকার বঞ্চিত মানুষের আকাক্সক্ষা পূরণে যুগান্তকারী ভূমিকায় অবতীর্ণ। পারভিন এতেসামি স^ীয় রচনার মাধ্যমে পাঠককুলের হৃদয়ে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন অনন্তকাল।

লেখক : অধ্যাপক, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

মাইকেল মধুসূদনের আত্মবিলাপ

মাইকেল মধুসূদনের আত্মবিলাপ
সৌম্য সালেক

সামাজিক-রাষ্ট্রিক জীবনে যেমন ক্রান্তিকাল আসে তেমনি ভাষা-সাহিত্যের ক্ষেত্রেও ক্রান্তিকাল রয়েছে। বাংলা সাহিত্যে এমন এক পর্যায়ে মাইকেল মধুসূদনের আবির্ভাব ঘটে যখন বাংলা সাহিত্যের ক্রান্তিকাল। মধ্যযুগীয় সাহিত্যধারা থেকে বের হবার চেষ্টা চলেছে তখন। যাঁরা মধ্যযুগীয় বিষয়বস্তু, বাক্য ও ছন্দপ্রবণতা থেকে বের হবার চেষ্টায় ছিলেন তাঁদের একজন ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত (১৮১২-১৮৫৯)। আধুনিক কবিতা বা সাহিত্য বিষয়সীমা বর্জিত, সেখানে মানুষ এমনকি পরিপার্শ্বের প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় বিষয়বস্তুও সাহিত্যের অনুষঙ্গ বলে বিবেচিত হয়ে থাকে। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত আধুনিকতায় উত্তরণে কাজ করেছেন, তার ‘পাঁঠা’, ‘আনারস’, ‘তাপসে মাছ’ কবিতায় এবং কিছু বিদ্রƒপাত্মক লেখায় সে স্বাক্ষাৎ পাওয়া যায়। স্বদেশ ও সমাজের প্রতি তাঁর অনুরাগ ছিল। কিন্তু তাঁর ভাষা, ছন্দ-অলংকার ছিল মধ্যযুগীয়- যার ফলে আধুনিকতার উত্তরণে তখনও পথ বাকি ছিল। মধ্যযুগের সাহিত্যের বিষয় ছিল প্রধানত ধর্মকাহিনী, ঐতিহাসিক বিজয়গাথা, পুরাণ, রাজা-বাদশার আখ্যান এবং স্তুতি-বন্দনা কেন্দ্রিক। মাইকেল মধুসূদন দত্ত সেই সাহিত্য ব্যক্তিত্ব যিনি বিষয়, ভাষা ও প্রকরণগতভাবে বাংলা সাহিত্য বিশেষত বাংলা কবিতাকে আধুনিকতার সাথে পরিচয় ঘটান। মধুসূদনকে বাংলা সাহিত্যের প্রথম বিদ্রোহী বলা হয়, তাঁর এই বিদ্রোহ ছিল যেমন ভাষাবিদ্রোহ, তেমনি সাহিত্যের আঙ্গিক ও বিষয়-নিরীক্ষার দিক থেকেও।
মধুসূদনের ভাষা-বিদ্রোহ এবং অগ্রগামী সৃজন প্রক্রিয়ার বিষয়টিকে চমৎকার ব্যাখ্যা করেছেন লেখক গবেষক আহমদ রফিক, তাঁর ‘নজরুলের বিদ্রোহ : বিদ্রোহের স্বরূপ-অন্বেষ’ শীর্ষক রচনা থেকে কিছু অংশ তুলে ধরছি। ‘বিষয়গত ও প্রকরণগত উভয় দিকেই মধুসূদন তার বিদ্রোহী ভূমিকাটির সমাপন ঘটিয়েছেন এমন এক আবেগে, যার পেছন ছিল প্রচলিত মূল্যবোধ থেকে আধুনিকতায় উত্তরণের সৎসাহস। এই বলিষ্ঠ মননশীলতাই মধুসূদনের কাব্যচেতনায় লক্ষ্যণীয় বৈশিষ্ট্য যা প্রতীকী বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে বাংলা সাহিত্যের জন্য নতুন এক দিকদর্শন প্রতিষ্ঠা করেছিল।’
আমরা মধুসূদনের কবিতায় বিচিত্র বিষয়ের স্বাক্ষাৎ পাই, যা আধুনিক সাহিত্যের প্রবণতা বলে বিবেচিত। ‘ময়ুর ও গৌরি’; ‘অশ্ব ও কুরঙ্গ’; ‘সূর্য্য ও মৈনাক গিরি’; ‘মেঘ ও চাতক’; ‘সিংহ ও মশক’; ‘পীড়িত সিংহ’ ও অন্যান্য পশু এবং রসলা ও স্বর্ণ-লতিকা কবিতাগুলো যেমন মধুসূনের বিষয় নির্বাচনের সর্বমুখীতাকে প্রকাশ করে তেমনি এসবে প্রকাশিত ভাবনা-প্রবাহ, ভাষা ও আঙ্গিকগত নিরীক্ষা একজন আধুনিক শব্দ-শিল্পী হিসেবে তাঁকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে।
মধুসুদন দত্ত বাংলা সনেট ও অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তক, বাংলা ভাষার প্রথম সার্থক নাটক (শর্মিষ্ঠা-১৮৫৯) ও প্রথম সার্থক প্রহসন রচিয়তা এবং বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ মহাকাব্য ‘মেঘনাদবধ’ কাব্য রচনার মাধ্যমে একজন সার্বিক ও সম্পন্ন সাহিত্যকার- শিল্পকার হিসেবে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন। কবিতা ও নাটকের আঙ্গিকগত এসব উৎকর্ষের অন্তরালে ছিল তাঁর উৎসুক-অভিসন্ধিৎসা এবং বিষয়ের নিরীক্ষা, যা সেসময়ে বাংলা সাহিত্যের জন্য ছিল অভিনব ব্যাপার। মধুসূদনের সেই অগ্রবর্তী ভাবনা ও নিরীক্ষার ধারাবাহিক চর্চার ফল আজকের বাংলা কবিতা। মধুসূদন হোমেরিক স্টাইলে লেখার প্রবর্তন করেন- ‘মেঘনাদবধ’ কাব্যে। তিনি হোমারের ‘ইলিয়াড’কে জগতের শ্রেষ্ঠ মহাকাব্য বলে মনে করতেন। ‘হেকটর বধ’ কাব্যে তিনি ইলিয়াড এর কাহিনী বিবৃত করতে আরম্ভ করেও শেষে করতে পারেন নি। অসমাপ্ত আকারে যা ১৮৭১ সালে গ্রন্থাকারে বের হয়, সেখানে উপহারপত্রে ভূদেব মুখোপাধ্যায়কে তিনি লেখেন, ‘আমাদিগের রামায়ন, মহাভারত রামচন্দ্রের পঞ্চপা-বের জীবন-চরিত্র মাত্র… কিন্তু ঈলিয়াসের নিকট এসকল কাব্য কোথায়?’
মধুসূদন ইংরেজ কবি লর্ড বায়রনের জীবন ও কর্ম দ্বারা ব্যাপকভাবে অনুপ্রাণিত ছিলেন। তাঁর কবিতায় আমরা বায়রনের বেশ কিছু উদ্ধৃতির প্রয়োগ লক্ষ্য করি। ‘বঙ্গভূমির প্রতি’ কবিতায় রয়েছে বায়রনের বিখ্যাত উক্তি, ‘গু ঘধঃরাব খধহফ, মড়ড়ফ ঘরমযঃ’- এর ব্যবহার। একটি অবাক বিষয় হলো বায়রন মারা যান ১৮২৪ সালে এবং সে বছরের ২৫ জানুয়ারি মধুসূদনের জন্ম হয়। মধুসূদনের বিপুল প্রতিভার আরেক পরিচায়ক তাঁর ভাষা দক্ষতা। বাংলা ছাড়া তিনি আরও বারোটি ভাষা জানতেন। ইংরেজি ভাষার বিশ্বব্যাপী প্রভাব এবং সে ভাষার কবি-সাহিত্যিকদের শ্রেষ্ঠত্ব লক্ষ্য করে তিনি ইংরেজিতে সাহিত্য চর্চা আরম্ভ করেন। মাদ্রাজ থেকে প্রকাশিত তাঁর প্রথম কাব্য ছিল ইংরেজিতে লেখা- ‘ঞযব ঈধঢ়ঃরাব খধফু-১৮৪৯’ । নিজ ভাষার প্রতি তাঁর এ বিরাগ-অনুরাগের কারণ মূলত বিভিন্ন ভাষা সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান এবং সে ভাষার বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে অবহিতি। কিন্তু তিনি পরবর্তীকালে বুঝতে সক্ষম হন যে, মাতৃভাষাই শেষ্ঠ এবং মূল্যবান। তিনি ফিরে আসেন। তাঁর এই প্রত্যাবর্তন ছিল বাংলা সাহিত্যের বাঁক বদলের অন্যতম ঘটনা। মধুসূদনের কবিতায় আমরা শুনতে পাই ভাষাবন্দনার অনুপম উক্তি, ‘মাতৃভাষা রূপখানি পূর্ণ মণিজালে।’ তিনি নিজেকে ‘বাঙ্গাল’ পরিচয় দিতে পছন্দ করতেন। ঢাকায় প্রদত্ত তাঁর একটি বক্তৃতার কিছু অংশ এখানে প্রকাশ করছি :
‘আমার সম্বন্দের আপনাদের আর যে কোন ভ্রমই হইক আমি সাহেব হইয়াছি এ ভ্রমটি হওয়া ভারি অন্যায়। আমার সাহেব হইবার পথ বিধাতা রোধ করিয়া রাখিয়াছেন। আমি আমার বসিবার ও শয়ন করিবার ঘরে এক একখানি আর্শি রাখিয়া দিয়াছি এবং আমার মনে সাহেব হইবার ইচ্ছা… বলবৎ হয় অমনি আর্শিতে মুখ দেখি। আরো, আমি সুদ্ধ বাঙালি নহি, আমি বাঙ্গাল, আমার বাটি যশোহর।’
মধুসুদনের কাব্যভাষা ঋজু, সংহত এবং আভিজাত্যপূর্ণ। পরবর্তী সময়ে বাংলা কবিতায় গীতি-কবিতার ব্যাপক চর্চা পরিলক্ষিত হয়, মধুসূদনীয় ভাষাভঙ্গিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও কাব্যচর্চা করেন নি। রবীন্দ্রনাথ বিহারীলাল ও অন্য গীতিকবিদের ভঙ্গিকেই নিজের কাব্যচর্চার জন্য বেছে নিয়েছিলেন। গীতি-কবিতার অন্তর্মুখী নতবাক্ কাব্যভাষার বাইরে পরবর্তী সময়ে আমরা কাজী নজরুল ইসলাম, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ও মোহিতলাল মজুমদারের কিছু কবিতায় মধুসূদনীয় ছন্দ, শব্দ ও বাক্রীতির স্বাক্ষাৎ পাই। উল্লেখ্য, ‘মেঘনাদবধ’ কাব্যের অনুপ্রেরণায় অনেক কবি মহাকাব্য রচনায় ব্রতী হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে রঙ্গলাল বন্দোপাধ্যায়, নবীনচন্দ্র সেন, হেমচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়, কায়কোবাদ, সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী, গোলাম মোস্তফা এবং ফররুখ আহমাদের নাম বিশেষভাবে স্মরণযোগ্য। মধুসূদনের কাব্যভাষার শক্তি, স্বাতন্ত্র্য এবং অভিনবত্ব সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের একটি মন্তব্য এখানে তুলে ধরছি : ‘আপন শক্তির পরে শ্রদ্ধা ছিল বলেই বাংলাভাষার পরে কবি শ্রদ্ধা প্রকাশ করলেন। বাংলা ভাষাকে নির্ভীকভাবে এমন আধুনিকতার দীক্ষা দিলেন, যা তার পূর্বানুবৃত্তি থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। বঙ্গবাণীকে গম্ভীর স্বরনির্ঘোষে মন্ত্রিত করে তোলার জন্য সংস্কৃত ভা-ার থেকে মধুসূদন নিঃসঙ্কোচে যেসব শব্দ আহরণ করতে লাগলেন সেও নতুন, বাংলা পয়ারের সনাতন সমবিভক্ত আল ভেঙ্গে দিয়ে তার ওপরে অমিত্রাক্ষরের যে-বন্যা বইয়ে দিলেন সে-ও নতুন। আর মহাকাব্য, খ–কাব্য রচনার যে রীতি অবলম্বন করলেন, তাও বাংলা ভাষায় নতুন।’
(দুই)
কিশোরকাল থেকেই মধুসূদন ছিলেন দৃঢ়চেতা ও আত্মবিশ্বাসী। তাঁর সর্বগ্রাসী প্রতিভা সর্বজনবিদিত। মধুসূদনের ব্যক্তিত্ব গঠনে হিন্দু কলেজের শিক্ষাপর্ব এবং এ কলেজের বহিষ্কৃত শিক্ষক ডিরোজিও’র চিন্তা-ভাবনার প্রভাব অত্যন্ত গভীর। বড় কবি হবার জন্য তাঁর যে বাসনা তা কিংবদন্তিতুল্য, বিশেষত ভারতবর্ষে কেউ কবি হবার জন্যে এতটা উচ্চাকাক্সক্ষা দেখান নি এবং এতদূর ত্যাগ স্বীকারও কেউ করেনি। বিশ্বখ্যাত কবি হবার জন্য ইংল্যান্ড যাবার আকাক্সক্ষায় তিনি যে কতটা প্রবল ছিলেন, তা প্রকাশ পেয়েছে বন্ধু গৌরদাশকে লেখা চিঠিতে, তখন তিনি হিন্দু কলেজের ছাত্র।
‘সূর্য উঠতে ভুলে যেতে পারে, কিন্তু আমি- আমি ইংল্যান্ডে যাওয়ার কথা ভুলব না, ভুলতে পারব না। আর একবার ইংল্যান্ডে যেতে পারলে শ্রেষ্ঠ কবি আমি হবই।’ এতটাই প্রবল ছিল কবিতার প্রতি তাঁর অনুরাগ। তিনি আইন পড়ার উদ্দেশ্যে ইংল্যান্ড গিয়েছিলেনও, সেটা ১৮৬২ সাল। সেখানে গিয়ে তিনি সহসা বুঝতে সক্ষম হন যে, ইউরোপীয় সমাজ কোন বহিরাগতকে সাদরে গ্রহণের জন্য বসে নেই। তাঁর জীবন ছিল বাধাহীন, অমিতব্যয়ী, উশৃঙ্খল ও দ্বন্দ্বমুখর যার ফলে মাত্র ৪৯ বছরের জীবনের মধ্যে দেখা যায় ভাঙ্গা-গড়া, উত্থান-পতনের অনেক ঘটনা। আসলে অধিকাংশ শিল্পী-কবির জীবনই এমন বিশৃঙ্খলা ও দ্বন্দ্বে ভরা। এ বিষয়ে কার্ল গুস্তাভ ইয়ুং এর বহুশ্রুত মন্তব্যটি স্মরণ করছি : ‘শিল্পীর জীবন দ্বন্দ্বপূর্ণ না হয়ে পারে না, কারণ, দুটি বিপরীতমুখী শক্তি তাঁর ভিতর সংঘাতে লিপ্ত, একদিকে আনন্দ, তৃপ্তি ও সুরক্ষার জন্য সাধারণ মানবীয় বাসনা; অপরদিকে সৃষ্টির জন্য অদম্য আকাক্সক্ষা, যার বাস্তবায়নের জন্য মানবীয় বাসনাগুলোকে অগ্রাহ্য করা আবশ্যক।’ মধুসূদনের জীবনে দ্বী-মুখী সংকটের এই খেলা আমৃত্যু চলেছে, সে গল্প আমাদের অজানা নয়।
মাইকেল মধুসূদন তাঁর সাহিত্যকর্মে পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যধারার শিল্পরীতির সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন। চতুর্দশপদী কবিতাবলির মধ্যে তাঁর আধুনিক সাহিত্যভাবনার প্রকাশ ঘটেছে সবচেয়ে নিবিড়ভাবে। বিষয় বৈচিত্র্যের পাশাপাশি তাঁর মানস-ভ্রমণের নানা অনুভব ও অভিব্যক্তির প্রকাশ কবিতাগুলোর অন্তর্নিহিত সুর, যা সহজেই চোখে পড়ে। সনেটের বাইরে মধুসূদন বিভিন্ন বিষয়ে আরও বেশ কিছু কবিতা রচনা করেছেন যা সেসময় গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় নি, পরবর্তীকালে মধুসূদন রচনাবলিতে ‘নানা কবিতা’ শিরোনামে পত্রস্থ হয়েছে।
মধুসূদন রচিত গীতিকবিতাগুলোর মধ্যে সর্বাগ্রে উল্লেখযোগ্য কবিতার নাম, ‘আত্ম-বিলাপ’। এটিকে আধুনিক বাংলা কবিতার সূচনা-স্মারক বিবেচনা করলে অত্যুক্তি হবে না। আধুনিক জীবন বোধের সাথে ছন্দে- প্রকরণে- বিশ্লেষণে, শব্দপ্রয়োগে, উপমা-উৎপ্রেক্ষার যথার্থ ব্যবহারে আত্ম-বিলাপ আধুনিক বাংলা কবিতার এক অনন্য পাঠ। জীবনব্যাপী অপচয় ও আকাশ-কুসুম কল্পনার পিছে ধেয়ে চলার অভিঘাত এবং অনুতাপ এই কবিতার মর্মভাষ হলেও যুগযন্ত্রণায় দগ্ধ নাগরিক মানুষের বিষণœতাও এই কবিতার বিভিন্ন স্তবকে প্রতিভাত। কবির ‘বঙ্গভাষা’, ‘বঙ্গভূমির প্রতি’- এসব কবিতার মর্মার্থের সাথে এ কবিতার ভাবের মিল থাকলেও এখানে ভাষা বা দেশাত্মবোধের চেয়ে মুখ্য হয়েছে ব্যক্তির অন্তরগত অভিঘাত, যা ব্যক্তি হয়ে সমষ্টির একান্ত মানসকে স্পর্শ করেছে।
‘প্রেমের নিগড় গড়ি পরিলি চরণে সাধে কি ফল লাভিলি?
জ্বলন্ত-পাবক-শিখা লোভে তুই কাল-ফাঁদে
উড়িয়া পড়িলি?
পতঙ্গ যে রঙ্গে ধায়, ধাইলি, অবোধ হায়!
না দেখিলি, না শুনিলি- এবে রে পরাণ কাঁদে!
সাত স্তবকের কবিতায় আশার ছলনা, প্রমত্ত মনের তৃষ্ণা, স্বপ্নের কুহক, প্রেমের ফাঁদ, অর্থ-অন্বেষণ, যশোলাভের বাসনা এবং শতমুক্তাধিক আয়ুর অপচয়- এসব শব্দভাষ্যে কবি অনিশ্চিত-অচিহ্নিত জীবনের হাহাকার এবং আধুনিক অবিমৃষ্য জীবনের সারাৎসারকে তুলে এনেছেন অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায়। সুচিন্তা ও সুপরিকল্পনা ব্যতিরেকে কেবল ধোঁয়াসার মতো স্বপ্নের পথে ছুটে যে প্রাপ্তির পাল্লা শূন্য থেকে যায় এবং মাঝখানে মূল্যবান সময় নষ্ট হয়, এই চৈতন্য-‘আত্ম-বিলাপ’ কবিতায় অনুপম পরিভাষা পেয়েছে। কবিতাটির শেষ স্তবক এমন :
‘মুকতা ফলের লোভে ডুবে রে অতল জলে
যতনে ধীবর,
শতমুক্তাধিক আয়ু কালসিন্ধু জলতলে
ফেলিস্ পামর!
ফিরি দিবে হারাধন, কে তোরে, অবোধ মন
হায় রে, ভুলিবি কত আশার কুহক-ছলে!’
নানা ঘাত-প্রতিঘাতে, ভাঙ্গনে-বিভ্রমে পর্যুদস্ত হলেও মাইকেল মধুসূদন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশে যা করেছেন, তা অতুলনীয় এবং ঐশ্বর্যম-িত। অত্যধিক বাসনার ফলে একসময় তাঁর কাছে অন্য ভাষার সাহিত্য মহান বলে গণ্য হলেও তিনি সাহিত্যজীবনের প্রায় সর্বাংশ-জুড়ে বাংলা সাহিত্য নিয়েই খেটেছেন এবং সুকোমল বাংলা ভাষাকে অনুভব করেছেন হৃদয় দিয়ে এবং তা প্রকাশ পেয়েছে তাঁর বিভিন্ন লেখার ছত্রে ছত্রে। এখানে বাংলাভাষার প্রতি তাঁর অনুরাগের কিঞ্চিৎ কথকতা তুলে ধরছি: ‘যদি আমি মেঘ রূপে এ চন্দ্রিমার বিভারাশি স্থানে স্থানে ও সময়ে সময়ে অজ্ঞাত তিমিরে গ্রাস করি, তবুও আমার মার্জনার্থে এই একমাত্র কারণ রহিল, যে সুকোমল মাতৃভাষার প্রতি আমার এতদূর অনুরাগ যে তাহাকে এ অলঙ্কারখানি না দিয়া থাকিতে পারি না।’
বাংলা সাহিত্যের নবজাগরণের অন্যতম প্রতিভূ মাইকেল মধুসূদন দত্তের স্বর্ণছোঁয়ায় আধুনিকতার পথে অগ্রবর্তী হয়েছে বাংলা কবিতা তথা বাংলা সাহিত্য। এটি সম্ভব হয়েছিল প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যসাহিত্য সম্পর্কে তাঁর নিবিড় পরিচয়ের সুবাদে। সাহিত্যের বিষয়বস্তু, ভাষা ও প্রকরণ কেমন হওয়া উচিত তা যথার্থরূপে তিনি অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছিলেন যার ফলে পাল্টে গিয়েছিল বাংলা সাহিত্যের দৃশ্যপট। সাহিত্যের আঙ্গিক ও বিষয় নিয়ে পরবর্তীকালে বিভিন্ন কবি-লেখকের বিভিন্ন নিরীক্ষা সত্ত্বেও মধুসূদনের হাতে বাংলা সাহিত্যের যে বাঁকবদল ঘটেছে, বোধ করি অন্য কারও দ্বারা সাহিত্যের এতটা পরিবর্তন সূচিত হয় নি। বাংলা সাহিত্যের ধারাবাহিকতায় তিনি যেমন অনিবার্য তেমনি বাংলা সাহিত্য অনুধাবনেও তাঁর কাব্য ও নাটক অবশ্য পাঠ্য। ভাষার আবর্তন-বিবর্তন প্রক্রিয়া অনুধাবনে একজন কবির জন্য যেমন মধুসূদন পাঠ জরুরি, তেমনি তাঁর সৃজন-কৌশল, জীবন ও সাহিত্য-কীর্তির নতুন নতুন তথ্য ও বিবৃতি উদ্ভাবনের মাঝে আজও সাহিত্যমোদীদের কাক্সিক্ষত রসদ রয়েছে।
মধুসূদনের জন্মের দুইশত বছর পূর্তি হতে আর বেশিদিন বাকি নেই। চর্চা-পরিচর্যার মাধ্যমে এই মহান কবির সৃজন প্রতিভা ও সম্পন্নতার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হলেই তাঁর প্রতি আমাদের ভালোবাসা প্রকাশ পাবে। আর এই চর্চা প্রয়োজন আমাদের নিজের জন্য, প্রয়োজন সমাজ ও সাহিত্যের প্রগতির জন্য।
কবি মধুসূদন রচিত একটি ইংরেজি কবিতার প্রথম স্তবক উপস্থাপনপূর্বক রচনা শেষ করছি।
ঞযরং যবধৎঃ, ফবধৎ সধরফ ! ঃযধঃ ঃযড়ংব ংবিবঃ বুবং
ঐধাব ঈড়হয়ঁবৎবফ ষড়হম ধমড়,
ঝধু, ঐড়ি পধহ রহ ৎবনবষষরড়হ ৎরংব
অমধরহংঃ রঃ’ং ংড়াবৎবরমহ হড়?ি

 

 

ফরিদ উদ্দিন আত্তার : ফারসি সাহিত্যে অধ্যাত্মচিন্তার আত্মা

ফরিদ উদ্দিন আত্তার : ফারসি সাহিত্যে অধ্যাত্মচিন্তার আত্মা
ড. আবদুস সবুর খান

ফারসি সাহিত্যে আধ্যাত্মিক চিন্তার উন্মেষ ঘটে একাদশ শতকের গোড়ার দিকে, সালজুকি রাজবংশের (শাসনকাল ১০৩৭১১৫৭ খ্রিস্টাব্দ) শাসনামলে। ইতঃপূর্বে ফারসি সাহিত্যে যা ছিল অনুপস্থিত। পারস্যে সালজুকদের পৃষ্ঠপোষকতায় রাজনৈতিক, সামরিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সাহিত্যে তদানীন্তন মুসলিমবিশ্বের ইতিহাসে এক নতুন যুগের সূচনা হয়। মূলত তাঁরা ইসলামের চারশ বছরের সভ্যতা-সংস্কৃতির বিকাশের গুরুত্বপূর্ণ উত্তরসূরির ভূমিকা পালন করেন। সালজুকি স¤্রাটদের প্রায় সবাই, বিশেষ করে মালিক শাহ্ এবং সানজার নিজেদের পৃষ্ঠপোষকতা দ্বারা ফারসি সাহিত্যের যথেষ্ট উন্নয়ন সাধন করেন। এরই ধারাবাহিকতায় বলা যায়, একাদশ শতাব্দী থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত সময়কালে ইসলামি সভ্যতা এক নতুন যুগে পদার্পণ করে। কারণ, সালজুকি স¤্রাটগণের সহযোগিতায় এক দিকে যেমন এই যুগে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ব্যাপক বৃদ্ধি পায় অপর দিকে এই যুগে মুসলিমবিশ্বে সুফিবাদ বা অধ্যাত্মবাদের মতো বেশ কিছু চিন্তাধারার উদ্ভব ঘটে। বিশেষ করে ফারসি কাব্যসাহিত্যে সুফি বা আধ্যাত্মিক ধারার প্রবর্তন ঘটে; সালজুকি যুগের পূর্বে, অর্থাৎ সামানি (শাসনকাল ৮৭৪১০০৪) এবং গাজনাভি (শাসনকাল ৯৭৫১১৮৭) যুগে ফারসি কাব্যে যে ধারা ছিল সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। সামানি ও গাজনাভি শাসনামলের কবিগণ ছিলেন স¤্রাট-শাহজাদা, উজির-আমির-পারিষদের স্তুতি এবং প্রকৃতি বন্দনায় নিমগ্ন। তাঁদের প্রেমাস্পদ প্রকৃত প্রেমাস্পদ ছিল না, ছিল পার্থিব প্রেমাস্পদ। কিন্তু সালজুকি যুগে ফারসিকাব্যে সুফিবাদী ধারার আবির্ভাব ঘটে, যার মূল ভিত্তি হচ্ছে প্রকৃত পেমাস্পদ একক ¯্রষ্টার প্রেম ও করুণা উপলব্ধি এবং তাঁরই বন্দনা করা। তাই এই যুগের সুফি কবিগণ সামানি ও গাজনভি যুুগের কবিদের মতো বাদশা-শাহজাদা, উজির-ওমারা এবং দরবারিদের ন্যায় পার্থিব প্রেমাস্পদের বন্দনা না করে আত্মোন্মোচন, আত্মশুদ্ধি ও আত্ম-অধ্যয়নের মতো সঠিক পন্থার মাধ্যমে কাশ্ফ এবং শুহুদে পৌঁছতে সচেষ্ট হন। এই সাধনার মাধ্যমে তাঁরা স্বীয় আত্মাকে নশ্বর এই পৃথিবীর পঙ্কিলতা মুক্ত করে অপার্থিব ¯্রষ্টার একত্বের সান্নিধ্যে পৌঁছে স্বীয় সত্তা ও কালব-আয়নাকে এতটাই পরিষ্কার করে তুলেন যে, তাতে ¯্রষ্টার প্রতিবিম্ব প্রত্যক্ষ করতে পারা যায় এবং মারেফাতের সন্ধান পাওয়া যায়। তাঁদের চিন্তা, কথা এবং আচরণ হয়ে ওঠে প্রকৃত সত্য ও সত্তার প্রকাশস্থল। আর তাঁদের এই আলোকোজ্জ্বল দৃষ্টিতে মানবজগৎও প্রকৃত একক প্রেমাস্পদকে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়। বাবা তাহের হামেদানি (১০০০১০৮৫) আবু সাইদ আবিল খায়ের (৯৬৭১০৪৮), খাজা আব্দুল্লাহ্ আনসারি (১০০৬১০৮৮), সানায়ি (১০৭৯১১৫১), ফরিদ উদ্দিন আত্তার (১১৪৩১২৩০) প্রমুখ ছিলেন এই যুগের বিখ্যাত সুফি কবি, যাঁরা অধ্যাত্মবাদের এই চিন্তা-দর্শনকে কবিতার শ্রেষ্ঠতর সৌন্দর্যের আভরণে সাজিয়ে সরল ও সাবলীল বক্তব্যে সাধারণের জন্য সহজভাবে উপস্থাপন করেছেন।
যদিও বাবা তাহের হামেদানি এবং আবু সাইদ আবিল খায়েরের মাধ্যমেই ফারসি কাব্যে আধ্যাত্মিক দর্শনের আগমন ঘটে তবে ফারসি সাহিত্যে অধ্যাত্মচিন্তার আত্মা খ্যাত ফরিদ উদ্দিন আত্তারের মাধ্যমেই এই দর্শন পূর্ণমাত্রায় বিকশিত হয়। ফরিদ উদ্দিন আবু হামেদ মোহাম্মদ আত্তার নিশাপুরি ইরানিদের কাছে শেখ আত্তার নিশাপুরি নামেই সমধিক খ্যাত। ভারতবর্ষে তিনি শেখ ফরিদ উদ্দিন আত্তার নামে পরিচিত। আত্তারের প্রাথমিক জীবন সম্পর্কে সবিস্তার তথ্যাবলি তেমন পাওয়া যায় না। তাঁর জীবন-ইতিহাস সম্পর্কেও এই যুগের অধিকাংশ সুফি কবি এবং সাধকদের জীবনের ন্যায় নানা কিংবদন্তি ও কাহিনী প্রচলিত। এমনকি তাঁর জন্ম ও মৃত্যু তারিখ নিয়েও জীবনীকারদের মধ্যে যথেষ্ঠ মতপার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। ইরানের বিখ্যাত প-িত মরহুম ফোরুযানফারের গবেষণায় তিনি উল্লেখ করেছেন, আত্তার ১১৫২ খ্রিস্টাব্দে নিশাপুরের কাদকান শহরে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১২৮২ খ্রিস্টাব্দে মোঙ্গল সৈনিকের হাতে নিহত হন। অপর দিকে ইরানের খ্যাতিমান সাহিত্য-ইতিহাসবিদ সাইদ নাফিসির বর্ণনা মতে, তিনি ৫৩৭ হিজরি মোতাবেক ১১৪৩ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন।
আত্তারের শৈশব কাটে ইরানে তাতারদের নৃশংসতম হত্যাযজ্ঞের সময়ে। তাতারদের হত্যাযজ্ঞে যখন সমগ্র পারস্য এক বধ্যভূমিতে পরিণত হয়েছে সে সময়ে আত্তারের বয়স মাত্র ৬ কিংবা ৭ বছর। এই হত্যাযজ্ঞ এতটাই নৃশংস এবং ভীতিকর ছিল যে, আত্তারের জীবনের শেষদিন পর্যন্ত এই দুঃসহ স্মৃতির প্রভাব লক্ষ করা যায়। শৈশবে আত্তার তাঁর চারপাশে যে নির্যাতন, আগ্রাসন, ধ্বংস, মৃত্যু এবং নৃশংসতা প্রত্যক্ষ করেছিলেন তাই-ই তাঁকে পরবর্তীতে মৃত্যুচিন্তা এবং যন্ত্রণা-ভাবনায় বেদনাকাতর করে তোলে। এই নৃশংসতা কিছুটা স্তিমিত হওয়ার ক’বছর পর আত্তার স্থানীয় মক্তবে লেখাপড়ায় নিমগ্ন হন। এ সময় তিনি আব্বাস তুসি, মোজাফ্ফার এবাদি, রুকনুদ্দিন আকাফ, মোহাম্মদ বিন ইয়াহইয়া প্রমুখ ওলি ও সাধকের জীবনের নানা ঘটনাবলি সম্পর্কে অবহিত হন, যেগুলো তাঁকে দারুণভাবে আকৃষ্ট করে। তাঁদের এসব ঘটনা পরবর্তীতে আত্তার তাঁর তাযকেরাতুল আওলিয়া গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছেন।
আত্তারের দিওয়ানের ভাষ্যমতে জানা যায়, তাঁর পিতার নাম ছিল মাহমুদ। প্রাচীনতম চরিতগ্রন্থগুলোতে আত্তারের পিতার নাম উল্লেখ হয়েছে ইবরাহিম বিন ইসহাক। কোনো কোনো গ্রন্থে তাঁর পিতার নাম ইউসুফ বলেও উল্লেখ পাওয়া যায়। কাদকানে ‘পিরে জিরানভান্দ’ নামে একটি মাজার রয়েছে, যে মাজারকে স্থানীয় জনসাধারণ অত্যন্ত শ্রদ্ধা করেন। এরা বিশ্বাস করেন এটি আত্তারের পিতা ‘শেখ ইবরাহিম’-এর মাজার।
আত্তার শৈশব এবং তারুণ্যেই পবিত্র কুরআন, হাদিস, ফিক্হ, তাফসির, চিকিৎসাবিজ্ঞান ও জ্যোতির্বিজ্ঞান প্রভৃতি বিদ্যায় ব্যুৎপত্তি লাভ করেন এবং পৈত্রিক পেশা হিসেবে ‘আত্তারি’ অর্থাৎ ভেষজ চিকিৎসা এবং সুগন্ধি বিক্রয়ের পেশাকেই স্বীয় পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। সে কারণেই তিনি স্বীয় নামের চেয়ে তাঁর পেশাগত উপাধি ‘আত্তার’ (ভেষজ চিকিৎসক বা সুগন্ধি বিক্রেতা) নামেই সমধিক পরিচিত। ১৭ বছর বয়স পর্যন্ত তাঁর জীবনের প্রথম অংশ নিশাপুরের প্রাচীন শহরেই কাটে এবং মৃত্যুর আগের বাকি জীবন তিনি নিশাপুরের নতুন শহর ‘শাদইয়াখ’-এ অতিহাবিত করেন। এখানেই তিনি পৈত্রিক পেশা ভেষজ চিকিৎসায় আত্মনিয়োগ করেন। এ পেশায় তিনি এতটাই সুনাম অর্জন করেন যে, বহু দূর দূরান্ত থেকে তার বাড়ি তথা চিকিৎসাকেন্দ্রে রোগীরা এসে ভিড় করত। যে সম্পর্কে আত্তার স্বীয় গ্রন্থ আসরার নামে এবং মসিবাত নামেতে উল্লেখ করেছেন, প্রতিদিন অন্তত পাঁচশ রোগী তাঁর কাছে চিকিৎসা নিতে আসত :
بداروخانه پانصد شخص بودند
که در هر روز نبضم می نمودند
[চিকিৎসালয়ে ছিল পাঁচশ লোক
যারা প্রতিদিন আমার চিকিৎসা নিতে আসত]
আত্তার তাঁর পিতার কাছ থেকেই ভেষজ ঔষধ প্রস্তুতকরণ এবং ভেষজ চিকিৎসার যাবতীয় জ্ঞান আয়ত্ত করেছিলেন। তবে আধ্যাত্মিক সাধনার ক্ষেত্রে তিনি কার কাছ থেকে দীক্ষা গ্রহণ করেছিলেন তা সুস্পষ্ট করে না জানা গেলেও একথা জানা যায় যে, স্বীয় চিকিৎসাকেন্দ্রেই রোগীদের চিকিৎসা সেবা দেওয়ার পাশাপাশি তিনি নিয়মিত আধ্যাত্মিক দর্শন সম্বলিত কাব্যচর্চায়ও করতেন। মাদ্রাসা-খানকার প্রতি তাঁর তেমন আগ্রহ ছিল না এবং রাজ-রাজাদের স্তুতি করেও তিনি কোনো কাব্য রচনা করতেন না। এই অবস্থায়ই তাঁর জীবনে বড় ধরনের এক পরিবর্তন ঘটে। নিয়মিত রোগীর সেবা ও চিকিৎসা দেওয়া পরিত্যাগ করে আত্তার সম্পূর্ণরূপে আধ্যাত্মিক সাধনায় আত্মনিয়োগ করেন। তাঁর এই পরিবর্তন বিষয়েও নানা কিংবদন্তি প্রচলিত আছে। এগুলোর মধ্যে আব্দুর রহমান জামীর বর্ণনাই সবচেয়ে প্রসিদ্ধ। জামী তাঁর নাফাহাতুল উন্স্ গ্রন্থে বর্ণনা করেন : আত্তার প্রতিদিনের মতো স্বীয় চিকিৎসাকেন্দ্রে রোগী দেখায় ব্যস্ত ছিলেন এমন সময় সেখান দিয়ে এক আগুন্তক দরবেশ যাচ্ছিল। দরবেশ বেশ ক’বার ‘শাইউল্লাহ’ ‘শাইউল্লাহ’ বলে আত্তারের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করলেও আত্তার সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপই করছিলেন না। তখন দরবেশ বললেন, ‘হে খাজা, তুমি কীভাবে মৃত্যু কামনা কর?’ জবাবে আত্তার বললেন, ‘যেভাবে তুমি মৃত্যু কামনা কর।’ দরবেশ বললেন, ‘তুমিও আমার মতো করে মৃত্যু কামনা কর?’ আত্তার বললেন, ‘হ্যাঁ।’ একথা শুনেই দরবেশ তাঁর সাথে থাকা কাঠের পাত্রটি স্বীয় মাথার নিচে দিয়ে দোকানের সামনে সটান শুয়ে পড়ে বললেন, ‘আল্লাহ।’ এবং সঙ্গে সঙ্গেই তিনি মৃত্যুবরণ করলেন। এই দৃশ্য অবলোকন করে আত্তারের মনের অবস্থা সম্পূর্ণ বদলে যায়। তৎক্ষণাৎ তিনি স্বীয় চিকিৎসাকেন্দ্র বন্ধ করে দিয়ে এবং জগৎসংসারের সাথে সব রকমের সম্পর্ক ছিন্ন করে সম্পূর্ণরূপে নিজেকে আধ্যাত্মিক সাধনায় নিয়োগ করেন।
অবশ্য ফারসি সাহিত্যের অনেক গবেষকই জামীর এই বক্তব্যের সাথে দ্বিমত পোষণ করেছেন। কারণ, আত্তারের তাজকেরাতুল আওলিয়া গ্রন্থের তথ্য মতে দেখা যায়, শৈশবকাল থেকেই আত্তার আধ্যাত্মিকতার প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন। তাই পার্থিব জীবন তথা সংসার জীবনের প্রতি তাঁর তেমন মায়া ছিল না। তিনি ছিলেন স্বীয় পিতার শিষ্য কুতুব উদ্দিন হায়দারের শিষ্য। বাল্যকালেই আত্তার কুতুব উদ্দিনের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে সুফি সাধনায় দীক্ষা লাভ করেন। তবে ইসলামে বৈরাগ্যবাদের স্থান নেই বিধায় তিনি চিকৎসা পেশা এবং আধ্যাত্মিক সাধনা সমানতালে চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তাঁর আসরার নামে এবং এলাহি নামে গ্রন্থ দুটিও তিনি চিকিৎসা পেশায় নিয়োজিত অবস্থায়ই রচনা করেন। কালক্রমে একপর্যায়ে যখন তিনি সংসার জীবন তথা পার্থিব জীবনের মায়ামুক্ত হয়ে পার্থিব সব সম্পর্ক ছিন্ন করে সম্পূর্ণরূপে আধ্যাত্মিক সাধনায় আত্মনিয়োগ করেন, সম্ভবত এই সময়েই জামীর গ্রন্থে বর্ণিত পূর্বোক্ত দরবেশের ঘটনাটি চার দিকে ছড়িয়ে পড়ে।
যদিও অধিকাংশ গবেষকের মতে আত্তার দির্নিষ্ট কোনো মুর্শিদের কাছ থেকে সুফিতত্ত্বে দীক্ষা লাভ করেন নি, তবে কোনো কোনো গবেষক এই মতের সাথে একমত নন। আত্তারের সবচেয়ে প্রাচীনতম জীবনীকার কবি ও সুফি নূরুদ্দিন আব্দুর রহমান জামী আত্তারকে শেখ নাজমুদ্দিন কোবরার শিষ্য শেখ মাজদুদ্দিন বাগদাদীর শিষ্য বলে উল্লেখ করেছেন। অবশ্য আত্তার তাঁর তাজকেরাতুল আওলিয়া গ্রন্থের শুরুর দিকে মাজদুদ্দিন বাগদাদীর সাথে স্বীয় সম্পর্কের কথা উল্লেখ করেছেন, তবে তিনি যে মাজদুদ্দিনের শিষ্য ছিলেন সে বিষয়ে এখানে তিনি বিস্তারিত কিছু উল্লেখ করেন নি। সারকথা হচ্ছে, আত্তার জীবনের একটি বৃহৎ অংশ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের খ্যাতিমান আরেফ তথা সুফি সাধকদের সান্নিধ্যে কাটান এবং এসব সাধকের সান্নিধ্যের উদ্দেশ্যে তিনি পবিত্র ভূমি মক্কা থেকে মাওয়ারাউন্নাহার পর্যন্ত নানা দেশ ভ্রমণ করেন। এমনি এক সফরের এক পর্যায়ে মাজদুদ্দিন বাগদাদির খেদমতে উপস্থিত হন। বলা হয়ে থাকে ভূবনবিখ্যাত সুফি কবি মাওলানা জালাল উদ্দিনের পিতা বাহাউদ্দিন মোহাম্মদ, রুমির বয়স যখন পাঁচ বছর তখন সপরিবারে কুনিয়ার উদ্দেশে বাল্্খ ত্যাগ করেন। বাহাউদ্দিন পথে ওয়াখশ এবং সমরকান্দে কিছুদিন কাটিয়ে নিশাপুরে আসেন। এখানে কবি ও আধ্যাত্মিক সাধক শেখ ফরিদুদ্দিন আত্তারের সাথে তাঁর সাক্ষাৎ ঘটে। আত্তার বালক রুমির জন্য বিশেষ দোয়া করেন এবং তাঁকে তাঁর রচিত আসরার নামে গ্রন্থের একটি কপি উপহার দেন। ভবিষ্যতে রুমি একজন কামিল ব্যক্তি বা আধ্যাত্মিক সাধক হবেন বলে তিনি ভবিষ্যদ্বাণীও করেন।
সুফিদর্শন মতে, আধ্যাত্মিকতা হচ্ছে ইসলামি শরিয়াতের এমন স্তর যার মাধ্যমে বান্দা পার্থিব বিষয়াদি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিতান্তই ¯্রষ্টার সান্নিধ্য লাভের আশায় ধ্যানে মগ্ন হয়ে থাকে। জ্ঞানের মাধ্যমে সঠিক পথ উপলব্ধি করে একজন সুফি-সাধক সাধনার সাতটি স্তর পার হয়ে আল্লাহ্র সান্নিধ্যে তথা ‘বাকা’র স্তরে উপনীত হয়। নিরন্তর এই সাধনার নামই অধ্যাত্মবাদ। এশ্ক বা প্রেম হচ্ছে সৃষ্টির গূঢ় রহস্য এবং জীবনের স্ফুরক (ফবঃড়হধঃড়ৎ) আর তাসাওউফ বা অধ্যাত্মবাদের উৎসের কাঁচামাল, জগতের মহান কর্মসমূহের উৎসস্থলের গোপন ভেদ এবং সাধক পুরুষের উচ্ছ্বাস-উদ্দীপনার চূড়ান্ত অবস্থার মূল ভিত্তি। সুফিতত্ত্বের ভাষায় ‘মোহাব্বত’ বা ভালোবাসা যখন পূর্ণতায় পৌঁছে তখন তাকে বলা হয় ‘এশ্ক’ বা প্রেম এবং প্রেম যখন পূর্ণতায় পৌঁছে তখন ‘আশেক’ বা প্রেমিক ‘মাশুক’ বা প্রেমাস্পদের সত্তায় ‘ফানা’ বা বিলীন হয়ে যায়। পরম প্রেমাস্পদের প্রেমে প্রেমিকের বিলীন হওয়াই এশ্ক বা প্রেমের চূড়ান্ত পরিণতি। প্রেম আধ্যাত্মিক সাধনার গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। এই মাক্বাম বা পর্যায় কেবল ইনসানে কামেল বা একজন পরিপূর্ণ মানুষই, যে উন্নতি এবং পূর্ণতা প্রাপ্তির সবগুলো স্তর অতিক্রম করেছে, উপলব্ধি করতে পারেন।
আত্তার নিজে অধ্যাত্মবাদের এই মহান সাধনায় আত্মনিয়োগের পাশাপাশি সুফি দর্শনের এই জটিল তত্ত্বকে সর্বসাধারণের বোধগম্য করে তোলার লক্ষ্যে সাবলীল ও সরল ভাষায় গদ্যে-পদ্যে বেশ কিছু গ্রন্থ রচনা করেন। আত্তারের রচিত গ্রন্থাবলির সংখ্যা নিয়েও ফারসি সাহিত্যের গবেষক-সমালোকদের মধ্যে যথেষ্ট মতপার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। রেজাকুলি খান হেদায়াতের মতে, আত্তারের সম্পৃক্ত গ্রন্থাবলির সংখ্যা ১৯০টি। কাজি নূরুল্লাহ শোশতারির মতে এ সংখ্যা ১১৪টি এবং দৌলতশাহ্র মতানুসারে ৪০টি। আত্তারের রচনাবলি সম্পর্কে দৌলতশাহ্ বলেন : আত্তারের মানসাভি কাব্য ছাড়াও তাঁর দিওয়ানে চল্লিশ হাজার বেইত বা শ্লোক রয়েছে। এছাড়া তিনি বার হাজার রুবায়ি রচনা করেছেন এবং সুফি সাধকদের জীবনীভিত্তিক তাযকিরাতুল আওলিয়া গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হচ্ছে : আসরার নামে, এলাহি নামে, মসিবাত নামে, জাওয়াহেরুজ্জাত, ওসিয়াত নামে, মানতেকুত তেইর, বুলবুল নামে, হায়দার নামে, শুতুর নামে, মুখতার নামে, শাহনামে প্রভৃতি। এর বাইরে তিনি আরও কিছু কাব্য রচনা করেছিলেন, যেগুলো কালের পরিক্রমায় হারিয়ে গেছে। কাসিদা, গজল, মোকাত্তায়াত, রুবায়ি এবং মাসনাভি মিলে এখনো আত্তার রচিত একলক্ষ বেইত বা শ্লোকের অধিক রচনা বিদ্যমান।
অবশ্য ইরানের খ্যাতিমান ফারসি সাহিত্য সমালোচক ও গবেষক সাইদ নাফিসি বলেন, যে ৬৬টি গ্রন্থ ফরিদ উদ্দিন আত্তার রচিত বলে প্রচলিত মত বিদ্যমান তন্মধ্যে মাত্র ১২টি গ্রন্থ তিনি নিজে রচনা করেছেন। এগুলোর মধ্যে সর্বজনস্বীকৃত গ্রন্থ হচ্ছে নয়টি। যথা : মানতেকুত তেইর, আসরার নামে, এলাহি নামে, পান্দ নামে, খসরু নামে, মুখতার নামে, মসিবাত নামে, তাযকিরাতুল আওলিয়া এবং দিওয়ানে আত্তার।
দিওয়ানে আত্তার মূলত তাঁর কাসিদা এবং রুবায়ির সংকলন। এর বেইত সংখ্যা প্রায় দশ হাজার। আত্তারের দিওয়ান তাঁর আবেগময় আধ্যাত্মিক কবিতাসমূহের ধারক। যেগুলোতে আত্তার স্বীয় প্রেমাস্পদ পরম ¯্রষ্টার রহস্যাবলি কাব্যের ভাষায় ব্যক্ত করেছেন। আত্তারের গজল আবেগ ও উদ্দীপনাপূর্ণ। তাঁর কাসিদার বেশিরভাগই উপদেশ ও নসিহতে পূর্ণ। এসব কাব্যে আত্তার শ্রোতা এবং পাঠকদের পার্থিব জগতের মোহ ত্যাগ করে পরকাল তথা আখেরাতের প্রতি আগ্রহী হওয়ার আহ্বান করেছেন এবং পার্থিব জীবনের অসারতা ও নশ্বরতার কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন। আত্তারের গজলের বেইতগুলো পরস্পর সন্নিবেশিত। সাধারণত এগুলোর সমন্বয়ে একটি সম্পূর্ণ চিন্তা-দর্শনের পূর্ণ প্রকাশ ঘটেছে। তাঁর ভাষা সহজ-সহল ও সাবলীল। তবে বিশুদ্ধ শব্দসম্ভার ও অলঙ্কারপূর্ণ কাব্যবিন্যাস তাঁর কাব্যমানকে উন্নত শৈলীতে পৌঁছে দিয়েছে।
আত্তারের মাসনাভিগুলো নানা কাহিনী ও হেকায়াতে পূর্ণ। আধ্যাত্মিকতা বিষয়ে স্বীয় বক্তব্য উপস্থানের উদ্দেশ্যেই মূলত আত্তার এসব কাহিনীর অবতারণা করেছেন। এসব কাহিনীর চরিত্রগুলোও সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ের। যার ফলে এসব চরিত্রের মাধ্যমে তদানীন্তন সমাজের বাস্তব অবস্থা সম্পর্কেও অবহিত হওয়া যায়।
গল্প বলার ক্ষমতা ছিল আত্তারের সত্তাগত প্রতিভা। তাঁর এই প্রতিভা প্রথমবার পরিলক্ষিত হয় তাঁর খসরু নামে মাসনাভিতে, যেটি তিনি যৌবন বয়সেই রচনা করেছিলেন। যদিও এই কাহিনীকাব্যে তুর্কি স¤্রাটের পুত্র খসরু এবং খুজিস্তানের রাজকুমারী গুলরোখের ভালোবাসা এবং রোমাঞ্চের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে তবে আত্তার এতে এতসব রূপকথা ও কাহিনীর সমাবেশ ঘটিয়েছেন যার ফলে এ কাহিনীকাব্যকে লোকসংস্কৃতি ও তুলনামূলক ইতিহাসের আধার হিসেবে অবিহিত করা যায়। গল্প বলার ক্ষেত্রে আত্তার ছিলেন সানায়ির চেয়েও সিদ্ধহস্ত।
আমরা যদি আত্তারের কবি-জীবনের প্রথম দিকের রচনা খসরু নামে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে তাঁর অন্যসব সাহিত্যকর্মের দিকে দৃষ্টি ফেলি তাহলে তাঁর সমগ্র সৃষ্টিকর্মকে তিনটি যুগে বিভক্ত করতে পারি। প্রথম যুগের রচনাগুলোতে অধ্যাত্মবাদ ও গল্পবলার শৈলী, এ দুইয়ের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ ভারসাম্য লক্ষ করা যায়, যেগুলোতে শৈলীগত সব ধারাই অনুসরণ করা হয়েছে। দ্বিতীয় যুগের রচনাগুলোতে দেখি সৃষ্টি-কাঠামো ও সাহিত্য-শৈলীর চেয়ে আবেগ, উদ্দীপনা ও ¯্রষ্টার একত্বের প্রতিই আত্তারের অধিক মনোযোগ। তৃতীয় যুগের রচনাগুলোতে কবি বয়োবৃদ্ধ। এসব রচনায় তাঁকে হজরত আলী (রা.)-এর আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব বর্ণনার ক্ষেত্রে অতিমাত্রায় আকৃষ্ট দেখা যায়, তাঁর চৈন্তিক শৃঙ্খলা এবং বর্ণন-দক্ষতা তেমন একটা চোখে পড়ে না।
সাম্প্রতিক গবেষণায় এই তিন শ্রেণির মধ্যে শুধু প্রথম শ্রেণির রচনাগুলোকে (অর্থাৎ মানতেকুত তেইর, এলাহি নামে, মসিবাত নামে এই শ্রেণির অন্যান্য রচনা) দ্বিধাহীনভাবে আত্তারের রচনা বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। মনে করা হয়, তৃতীয় যুগের রচনাগুলোতে হয় বিকৃতি ঘটেছে অথবা এগুলো সুস্পষ্টভাবেই অন্য কারো রচনা। যেমন : মাজহারুল আজায়েব, খাইয়াত নামে, প্রভৃতি। সর্বশেষ গবেষণায় প্রতীয়মান হয়েছে যে, তৃতীয় যুগের রচনাগুলো নিশ্চয় ভিন্ন এক আত্তার কর্তৃক রচিত।
আত্তারের মাসনাভিগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি মাসনাভি হচ্ছে এলাহি নামে। প্রকৃতপক্ষে এই কাহিনীকাব্য এমন কিছু ছোট ছোট গল্প ও কাহিনীর সমাহার, যেগুলো মূলত পিতা-পুত্রের কথোপকথনকে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। পুত্র বেশকিছু অমূলক বিষয় সম্পর্কে পিতার কাছে জানতে চাচ্ছে। পিতা সেসব বিষয়ের বাস্তবতা পুত্রের কাছে সুস্পষ্ট করছেন। আত্তার এসব কথোপকথনের ফাঁকে ফাঁকে আধ্যাত্মিক, চারিত্রিক ও সামাজিক অনেক বিষয়ই বর্ণনা করছেন।
তাঁর আর একটি উল্লেখযোগ্য কাহিনীকাব্য হচ্ছে মসিবাত নামে। যেটিতে আত্তার আধ্যাত্মিক সাধকের নানা আত্মিক সমস্যা ও দুর্যোগ বর্ণনার পাশাপাশি বহু কাহিনীর সমাবেশ ঘটিয়েছেন। মূলত এটি আত্মার পরিক্রমণের গল্প, যাতে সাধক অদৃশ্য জগৎ থেকে স্বীয় ভ্রমণ-পথ অনুধ্যান করে এবং মুর্শিদের পথনির্দেশনায় পথের নানা স্তর অতিক্রম করে।
সুফিদের নিকট আধ্যাত্মিক সাধনার সাতটি স্তর বিদ্যমান। আত্তার তাঁর আধ্যাত্মিক বক্তব্য সম্বলিত বিভিন্ন রচনাবলিতে এই সাতটি স্তরকে প্রেমের শহর তথা অভীষ্ট গন্তব্যে পৌঁছার পথ-পরিক্রমার সাতটি উপত্যকার সাথে তুলনা করেছেন। প্রথম উপত্যকা বা স্তর হচ্ছে ‘তালব’ বা অনুসন্ধান। যার মাধ্যমে সাধক বা বান্দা তার অভীষ্ট গন্তব্যে পৌঁছার পথ অনুসন্ধান করবে। দ্বিতীয় উপত্যকা বা স্তর হচ্ছে ‘এশক’ বা প্রেম। যে এশকের তাড়নায় সাধক তার গন্তব্যে পৌঁছতে দ্রুত পদক্ষেপ ফেলবে। তৃতীয় স্তর ‘মারেফাত’ বা অন্তর্দৃষ্টি, যার মাধ্যমে সাধক তার সাধ্যানুযায়ী স্বীয় গন্তব্যে পৌঁছার পথ খুঁজে পাবে। চতুর্থ স্তর হচ্ছে ‘এস্তেগনা’ বা স্বয়ম্ভরতা। সাধক বান্দা তার সাধনার এই স্তরে পৌঁছে স্বীয় প্রেমাস্পদ মহান আল্লাহ্র প্রতি এতটাই আস্থাশীল হয়ে উঠবে যে, জাগতিক কোনো কিছুর প্রতিই সে আর কোনো পিছুটান বা মুখাপেক্ষিতা অনুভব করবে না। এই সাধনার পঞ্চম স্তর হচ্ছে ‘তাওহিদ’ বা একত্ববাদ। আধ্যাত্মিক সাধক তার সাধনার এই স্তরে পৌঁছে যে দিকেই দৃষ্টি দেবে সর্বত্রই মহিমাময় ¯্রষ্টার একত্বের অস্তিত্বই প্রত্যক্ষ করবে। ষষ্ঠ স্তর হচ্ছে ‘হায়রাত’ বা বিস্ময়, বিহ্বলতা। বান্দা এই স্তরে পৌঁছে মহান ¯্রষ্টার প্রেম-ভালোবাসা ও ক্ষমতার অসীমতার বিপরীতে স্বীয় জ্ঞান ও ক্ষমতার সসীমতা, অপ্রতুলতা এবং সীমাবদ্ধতা অনুধাবন করে বিস্ময়ে বিহ্বল হয়ে পড়বে। এই সাধনার সপ্তম বা সর্বশেষ স্তর হচ্ছে ‘ফানা’ বা বিলয়, বিলুপ্তি, নিশ্চিহ্নতা, অনস্তিত্ব। এই স্তরে পৌঁছে বান্দা বা সাধকের যাবতীয় মানবীয় কামনা-বাসনা বিলুপ্ত হয়ে যায়। সে আত্মপরিচয় ও আত্মসত্তাকে বিলীন করে দিয়ে প্রকৃত প্রেমাস্পদ মহান ¯্রষ্টার সত্তায় একাকার হয়ে মিলিয়ে যায়। বস্তুতপক্ষে সে ‘ফানা’ বা অনস্তিত্ব পার হয়ে ‘বাকা’ বা অস্তিত্বে পৌঁছে। নদী যেমন মোহনায় নিজেকে বিলুপ্ত করে সাগরে গিয়ে পৌঁছে।
সুফিতত্ত্বের এই জটিল দর্শনকে রূপক গল্পের মাধ্যমে আত্তার তাঁর মাসনাভি বা দ্বিপদী কাব্য মানতেকুত তেইর-এ অত্যন্ত সরল ও সাবলীলভাবে উপস্থাপন করেছেন। এটি আত্তারের আধ্যাত্মিক মাসনাভিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য, যেটিকে আত্তারের শ্রেষ্ঠকর্ম হিসেবেও আখ্যায়িত করা যায়। শুধু তাই নয়, এটি বিশ্বসাহিত্যেরও এক অমূল্য সম্পদ। আত্তার পবিত্র কুরআনুল কারিমের সূরা আন-নামলের ১৬ নং আয়াত থেকে এ গ্রন্থের নামকরণ করেছেন। যেখানে বলা হয়েছে :
“وورث سلیمن داود وقال یایها الناس علمنا منطق الطیر”
[সোলায়মান দাউদের উত্তরাধিকারী হলেন এবং তিনি বললেন, হে লোকসকল, আমাকে ‘মানতেকুত তেইর’ বা পাখির ভাষা শিক্ষা দেওয়া হয়েছে]
৪২০০-এর অধিক বেইত সম্বলিত এই মাসনাভিটি মূলত একটি রূপক কাহিনীকাব্য। ‘সিমোরগ’ নামের এক কিংবদন্তি পাখিকে কেন্দ্র করে পাখিদের আলোচনা বা সমাবেশ এ গ্রন্থের বিষয়বস্তু। এসব পাখি দ্বারা আত্তার সত্যপথের সাধক পথিক এবং ‘সিমোরগ’ দ্বারা মহান ¯্রষ্টার অস্তিত্বকেই বোঝাতে চেয়েছেন। আত্তার তাঁর এ গ্রন্থে অধ্যাত্মবাদের সূক্ষ্ম বিষয়গুলোকে মনোরম-মধুর গল্প-সূত্রে বর্ণনা করেছেন। গল্পের মূল পরিকল্পনা এরকম :
একদিন পক্ষিকুল তাদের বাদশাহ্ বা শাসক নির্বাচন ও অনুসন্ধানের জন্য একত্রিত হলো। তাদের সবার বক্তব্য হচ্ছে, এমন কোনো শহর নেই যে শহরের কোনো শাসক নেই। আমাদেরও আমাদের শাসক কে, তা অনুসন্ধান করা উচিত। সমবেত পাখিদের মধ্য থেকে হুদহুদ (কাঠঠোকরা)পখিদের গুরুত্বপূর্ণ বার্তাবাহকবলে উঠল : আমি সেই বাদশাহ্র নাম জানি। তাঁর নাম ‘সিমোরগ’। ‘সিমোরগের’ পাখিদের বাদশাহ্ হওয়ার উপযুক্ততাও বর্ণনা করল সে এবং এও বলল যে, ‘সিমোরগ’-এর আবাস সাত উপত্যকার ওপারে। তার সান্নিধ্যে যেতে হলে অবশ্যই আমাদের এই সাত উপত্যকা পাড়ি দিয়েই যেতে হবে। উল্লেখ্য, আত্তার এখানে পাখিদের দ্বারা সত্যপথের অনুসন্ধানী সাধকদের, হুদহুদ বা কাঠঠোকরা পাখি দ্বারা সেই পথের পথনির্দেশক মুর্শিদকে এবং ‘সিমোরগ’ দ্বারা চিরসত্য মহান ¯্রষ্টাকে বুঝিয়েছেন। আর সাত উপত্যকা দ্বারা উপরোল্লিখিত আধ্যাত্মিক সাধনার পথপরিক্রমার সাতটি স্তরকে বুঝিয়েছেন।
হুদহুদের কথা মতো নানা উজর-আপত্তি (পার্থিব জগতের প্রতি মানুষের ব্যাপক আসক্তি ও আগ্রহ, যেগুলোর প্রত্যেকটি ¯্রষ্টার সান্নিধ্য লাভের অভিযাত্রার সাধনার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়) সত্ত্বেও পাখিরা ‘সিমোরগ’র সান্নিধ্য লাভের যাত্রায় যুক্ত হয়। এই অভিযাত্রার প্রাক্কালে আত্তার এ পথের বিপদসঙ্কুলতা এবং দৃষ্টান্ত হিসেবে শেখ সানায়ানের কাহিনীরও অবতারণা করেছেন। হুদহুদ পথের বিপদাপদ সম্পর্কে পাখিদের অবহিত করে এবং তাদেরকে এই প্রতিশ্রুতিও দেয় যে, ‘সিমোরগ’র আবাস পর্যন্ত সে তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে। তবে শর্ত হচ্ছে তাদের পরিক্রমণ-আগ্রহ থাকতে হবে এবং দূর-পথ পরিক্রমণে যে নানা রকম কষ্টক্লেশ আসবে তাও সহ্য করতে হবে। কিন্তু পথিমধ্যে অধিকাংশ পাখিই নানা উজর-আপত্তি ও বাহানা উপস্থাপন করে এই কষ্টযাত্রা থেকে পালিয়ে যায়। যেমন : ফুলপ্রেমিক বুলবুল এই বলে অজুুহাত পেশ করে :
درسرمازعشقگل،سودابساست
زانکهمطلوبم،گلرعنابساست
طاقتسيمرغ،ناردبلبلي
بلبليرابسبود،عشقگلي
[আমার মাথায় ফুলের প্রেম, এই লেনদেনই যথেষ্ট
আমার উদ্দিষ্ট দৃষ্টিনন্দন ফুল এইতো যথেষ্ট
‘সিমোরগ’-এর সান্নিধ্য-ক্ষমতা বুলবুলের নেই
বুলবুলের জন্য ফুলের ভালোবাসাই ছিল যথেষ্ট]
এর জবাবে হুদহুদ তাকে বলে :
گل اگرچه هست بس صاحب جمال
حسن او در هفته اي گيرد زوال
عشق چيزي کان زوال آرد پديد
کاملا را زان ملال آرد پديد
خنده گل گرچه در کارت فکند
روز و شب، در ناله زارت فکند
در گذار از گل، که گل هر نوبهار
بر تو مي خندد، نه در تو، شرم دار
[যদিও ফুল যথেষ্ট সৌন্দর্যের অধিকারী
তবে তার সৌন্দর্য এক সপ্তাহেই হয় বিলীন
ভালোবাসা এমন বস্তু যা সৃষ্টি করে অবক্ষয়
সেই অবসাদ থেকেই সৃষ্টি করে পূর্ণতাকে
ফুলের হাসি যদিও তোমার কাজে নিক্ষিপ্ত
দিবানিশি, তোমার ক্রন্দনরোলে নিক্ষিপ্ত
ছাড় ফুলের কথা, ফুলতো প্রতি নববসন্তে
তোমার ওপর হাসে, তোমার ভেতরে নয়, লজ্জা কর (এমন অজুহাতে)]
ময়ূর এই বলে অজুহাত দেখায় :
کي بود سيمرغ را، پرواي من
بس بود فردوس اعلي، جاي من
من ندارم در جهان کاري دگر
تا بهشتم ره دهد، باري دگر
[কিসের পরোয়া ছিল আমার ‘সিমোরগ’-অন্বিষ্ট
সুউচ্চ ফেরদৌসই আমার স্থান, এইতো ছিল যথেষ্ট
জগতে আমার আরতো নেই কোনো কারবার
যেন আমায় বেহেশতে স্থান দেয় পুনর্বার]
হুদহুদ তাকে উপদেশ দিয়ে বলে :
چون به دريا مي تواني راه يافت
سوي يک شبنم، چرا بايد شتافت

گر تو هستي مرد کلي، کل ببين
کل طلب، کل باش، کل شو، کل ببين

[যখন তুমি সমুদ্র-মুখে পথ পেতে পার
কেন তবে শিশির বিন্দু-মুখে ছোটাছুটি কর
যেহেতু তুমি পূর্ণতার অস্তিত্ব, তাই পূর্ণতাকেই দেখ
পূর্ণ অনুসন্ধান কর, পূর্ণ থাক, পূর্ণ হও, পূর্ণতাকেই দেখ]
কিন্তু যেসব পাখি নানা অজুহাত উপস্থাপন করছিল তাদের কেউই হুদহুদের জবাব এবং উপদেশে সন্তুষ্ট হতে পারে না। এক এক করে তারা সবাই এই অভিযাত্রা থেকে সরে পড়ে। অবশিষ্ট পাখিদের মধ্য থেকে মাত্র ত্রিশটি পাখি (সি মোরগ) বিপদসঙ্কুল সাতটি উপত্যকা পার হয়ে ‘সিমোরগ’র আবাসে গিয়ে পৌঁছে এবং সেখানে তারা নিজেদের অক্ষমতা ও সীমাবদ্ধতা উপলব্ধি করে বিস্মিত-বিহ্বল হয়ে পড়ে। মহাশক্তিধর ‘সিমোরগ’-এর কাছে নিজেদের অস্তিত্বকে বিলীন (ফানা) করে দেয়। এভাবে বেশ ক’বছর কেটে যায়। তারপর তারা ফানা থেকে ‘বাকা’ বা অবিনশ্বরতার আভরণ পরে তাদের বাদশাহ্র দরবারে গৃহীত হয়। এখানে তাদের কাছে মনে হয় তারা যেন স্বচ্ছ পানিবেষ্টিত একটি উপত্যকা অথবা একটি আয়নাঘরে দাঁড়িয়ে আছে। যখন তারা ‘সিমোরগ’কে চাক্ষুস করতে চায় তখন তারা যে সি মোরগ বা ত্রিশ পাখি ছিল তাদেরকেই দেখতে পায়। যে দৃশ্যের বর্ণনা আত্তার তাঁর মানতেকুত তেইরে এভাবে দিয়েছেন :
چون نگه کردند آن سي مرغ زود
بي شک آن سيمرغ آن سي مرغ بود
در تحير جمله سرگردان شدند
مي ندانستند اين يا آن شدند
خويش را ديدند سيمرغ تمام
بود خود سي مرغ، سيمرغ مدام
[যখন সহসাই ওই ত্রিশ পাখি (সি মোরগ) তাকাল
(দেখে) সন্দেহাতীত ওই ‘সিমোরগ’ সেই ত্রিশ পাখিই (সি মোরগ) ছিল
বিহ্বলতায় সবাই বিস্ময়-বিমূঢ় হলো
তারা জানত যে, এ-ই অথবা সে-ই হয়েছে
নিজেদের দেখল তারা পূর্ণ ‘সিমোরগ’
ছিল স্বয়ং ত্রিশ পাখি (সি মোরগ) অবিনশ্বর ‘সিমোরগ’]
বস্তুতপক্ষে তারা এটা উপলব্ধি করতে পারল যে, এই ‘সিমোরগ’ আসলে ওই ত্রিশ পাখিই। অর্থাৎ তারা অজ্ঞাতসারে বাইরের জগতে যে সত্তাকে অনুসন্ধান করছিল সেই সত্তাকে তারা স্বীয় অন্তরেই খুঁজে পেয়েছে।
এই গ্রন্থের চমৎকারিত্ব হচ্ছে, পাখিদের বাদশাহ্ কিংবদন্তি পাখি ‘সিমোরগ’ এবং অভীষ্ট গন্তব্যে পৌঁছা ত্রিশ পাখি, ফারসিতে ‘সি মোরগ’, এই দুইয়ের চমৎকার অনুপ্রাস। যার দৃষ্টান্ত শুধু ফারসি সাহিত্যেই নয়, বিশ্বসাহিত্যেও বিরল। এই বিরল কাহিনীকাব্য, যা কবির উন্নত সৃজনদক্ষতা ও কবিকল্পনার ধারক এবং অধ্যাত্মবাদের নিগূঢ় রহস্যাবলির সহজ-সরল ও সাবলীল বর্ণনা এবং আধ্যাত্মিক শিক্ষার আধার, ফারসি সাহিত্যের কালজয়ী শ্রেষ্ঠকর্মগুলোর অন্যতম। আত্তারের মানতেকুত তেইর-এর মূল শিক্ষা হিসেবে আমরা দেখি, শুধু আধ্যাত্মিক সাধনার ক্ষেত্রেই নয়; বরং পার্থিব জীবনের নানারূপ সাফল্যে পৌঁছার ক্ষেত্রেও ব্যক্তির কঠিন সাধনা বাঞ্ছনীয়। আর সেই সাফল্যে পৌঁছার আগে লক্ষ্য স্থির করা অবশ্যম্ভাবী। আর লক্ষ স্থির করার পূর্বেই আসে ইপ্সিত লক্ষ্যের শুভাশুভ অনুসন্ধান। অধ্যাত্মবাদের ভাষায় যাকে বলা হয় ‘তালব’। সুতরাং একথা দৃঢ়চিত্তেই বলা যায় যে, আত্তারের মানতেকুত তেইর শুধু আধ্যাত্মিক সাধনার পথের অভিযাত্রীদের জন্যই নয়; বরং জগতের সকল সাফল্যকামী মানুষের জন্যই অবশ্যপাঠ্য এবং অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। আর সেকারণেই হয়তো পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় মানতেকুত তেইর অনূদিত হয়ে পঠিত এবং সমাদৃত হচ্ছে।
নিঃসন্দেহে ফারসি সাহিত্যের ইতিহাসে সুফিকবিদের মধ্যে আত্তারের নাম উজ্জ্বলতর। তাঁর ভালোবাসা ও আকুলতাপূর্ণ চিত্তাকর্ষক সরল বক্তব্য, একই সাথে যেগুলো চিরন্তন সত্য মহান প্রভুর সান্নিধ্যান্বেষী অভিযাত্রীদের জন্য পথনির্দেশক, অভীষ্ট গন্তব্যের পথ দেখিয়ে দেয়। তিনি অধ্যাত্মবাদের অমিয় বাণীগুলো সাধারণ্যে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে নিরাভরণ গতিশীল, সাবলীল ভাষাকেই নির্বাচন করেছেন। এক্ষেত্রে তাঁর বিশেষ পারঙ্গমতার দৃষ্টান্ত অন্যান্য কবির মধ্যে বিরল। আত্তারই প্রথম সহজ-সরল ভাষা এবং প্রচলিত কেচ্ছা-কাহিনীর মাধ্যমে অধ্যাত্মবাদের জটিল তত্ত্বকে সর্বসাধারণ্যে সহজবোধ্য করে তোলেন। সম্ভবত এ কারণেই আত্তারের অনুজ কবি ও তাঁর একনিষ্ঠ ভক্ত-অনুরক্ত, অধ্যাত্মবাদের স¤্রাট মওলানা জালাল উদ্দিন রুমি বলেছেন :
عطار روح بود سنائي دوچشم او
ما از پي سنائي و عطار آمديم
[আত্তার ছিলেন (অধ্যাত্মবাদের) আত্মা আর সানায়ি তাঁর দুচোখ
আমরা সানায়ি আর আত্তারের অনুগমন করেছি]
আত্তারের মৃত্যুতারিখ নিয়েও জীবনীকার ও ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতপার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। তবে তাঁর মৃত্যুসাল ১২৩০ খ্রিস্টাব্দ বলেই সর্বাধিক মত পাওয়া যায়। ইবনুল ফাওতির বর্ণনা মতে, আত্তারের স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটেনি, তিনি মোঙ্গল সৈনিকের হাতে শাহাদাত বরণ করেন এবং তাঁকে নিশাপুরেই সমাহিত করা হয়। ঐতিহাসিক ইবনুল আসিরের বর্ণনায় পাওয়া যায়, সে সময়ে মোঙ্গলদের অত্যাচারে নিশাপুর এমন ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত হয়েছিলো যে, সেখানে বসবাসের উপযোগী দুটি বাড়িও অবশিষ্ট ছিলো না। এ সময় আত্তার নিশাপুরেই অবস্থান করছিলেন। নিশাপুর ধ্বংসযজ্ঞের কালে একজন মোঙ্গল সৈনিক আত্তারকে হত্যা করতে চাইলে অপর একজন মোঙ্গল সৈনিক তাঁকে এক হাজার মুদ্রায় ক্রয় করার ইচ্ছা পোষণ করে। আত্তার তাকে লক্ষ্য করে বলেন, তাঁর মূল্য এর চেয়ে অধিক। কিছুক্ষণ পর অপর এক মোঙ্গল সৈনিক এসে তাঁকে একভার ঘাসের বিনিময়ে ক্রয় করতে চাইলো। এ কথা শুনে আত্তার বললেন, আমার মূল্য এরে চেয়ে কম। এর নিকটই আমাকে বিক্রি কর। এ কথা শুনে যে মোঙ্গল সৈনিক আত্তারকে বন্দি করেছিল সে ভাবল, আত্তার তার সাথে পরিহাস করছেন। ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে তৎক্ষণাৎ সে তলোয়ারের আঘাতে আত্তারকে হত্যা করে ফেলল। কিন্তু পরবর্তীতে যখন সে জানতে পারল যে, সে মূলত সমকালের শ্রেষ্ঠ সুফি সাধককে হত্যা করেছে, তখন তার ভেতর অনুশোচনাবোধ তৈরি হয় এবং সে দরবেশী পন্থা গ্রহণ করে আত্তারের মাজারের খেদমতে আত্মনিয়োগ করে। বাকি জীবন সে এখানেই অতিবাহিত করে।
ইরানের খোরাসান প্রদেশের রাজধানী মাশহাদ শহর থেকে মাত্র ছয় কিলোমিটার দূরে, নিশাপুওে ওমর খৈয়্যামের সমাধির কাছাকাছি আত্তারের মাজার অবস্থিত। দৌলতশাহ্র বর্ণনা মতে, কাজী ইয়াহইয়া বিন সাইদ সর্বপ্রথম আত্তারের কবরের ওপর সৌধের ভিত্তি স্থাপন করেন। পরবর্তীতে ১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দে নিজাম উদ্দিন আমীর আলী শের এর উপরিস্থ স্থাপনাটি নির্মাণ করেন। যেটি হযরত সাইয়্যেদ আরেফ কাসেম আনোয়ার এবং শেখ ফরিদ উদ্দিন আত্তারের রওজা হিসেবে খ্যাতি লাভ করে। দৌলতশাহ্র বর্ণনা মতে, কাজী ইয়াহইয়া বিন সাইদ আত্তারের মৃত্যুর পর ১২৩০ খ্রিস্টাব্দে সৌধটি নির্মাণ করলেও কালক্রমে তা দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে আমির আলী শের ১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দে এটি পুনঃনির্মাণ করেন। কাচার স¤্রাট মোহাম্মদ আলী শাহ্র শাসনামলের শেষ দিকে নিরুদ্দৌলা খোরাসানের প্রাদেশিক গভর্নর নিযুক্ত হলে আত্তারের কবরের ওপর একটি জাঁকজমকপূর্ণ সৌধ নির্মাণের নির্দেশ দেন। কিন্তু এরই মধ্যে তিনি তেহরানে চলে আসায় এ কাজটি অসম্পূর্ণই থেকে যায়।
বর্তমানে আত্তারের কবরের ওপর যে সৌকর্যম-িত স্থাপনাটি লক্ষ করা যায় তা নির্মিত হয় আন্জুমানে আসারে মিল্লিয়ে ইরান-এর উদ্যোগে। ১৯৫৩ এবং ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে পরপর দু’বার পূর্বের আকৃতি ও নকশাকে ঠিক রেখে এই সমাধিসৌধটি দৃষ্টিনন্দন কারুকাজে সুসজ্জিত করা হয়। প্রতিবছর ইরানি বর্ষপঞ্জিকার প্রথম মাস ফারভারদিনের ২৫ তারিখ (১৪ এপ্রিল) জাতীয়ভাবে আত্তার দিবস পালিত হয়। এ উপলক্ষ্যে নিশাপুরে তাঁর মাজার প্রাঙ্গণে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অসংখ্য ভক্ত-অনুরাগী পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ফারসি সাহিত্যের অধ্যাত্মচিন্তার আত্মা শেখ ফরিদ উদ্দিন আত্তারের পবিত্র মাজার জিয়ারতের উদ্দেশ্যে নিশাপুরে আগমন করে।

ইরানের খোরাসান প্রদেশের নিশাপুরে অবস্থিত আত্তারের সমাধিসৌধ

শেখ সাদির কবিতার চিরন্তন আবেদন

 

ফারসি সাহিত্যগগণের প্রোজ্জ্বল দিকপাল কবি শেখ সাদি। তার গুলিস্তান ও বুস্তান বিশ^সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্ম। শাসকশ্রেণি থেকে সাধারণ মানুষের যাপিত জীবনের বাস্তব রূপ চিত্রায়িত হয় তার কবিতায়। কাব্যরস উপভোগের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের পরিশীলিত ও উন্নত জীবনের বার্তাবহ। কুরআন, হাদিস, ইসলামি ঐতিহ্য, সমাজবিজ্ঞান, নৈতিক মূল্যবোধ ইত্যাকার বিষয় তাঁর সাহিত্যমানকে করে মহিমান্বিত। মানবিকতার মর্মবাণী ঝংকৃত হয় কবিতার পরতে পরতে। মনন ও বাস্তব জীবনে মানুষের কাক্সিক্ষত বাসনার প্রতিফলিত রূপ সাদির কবিতা। দৈশিক, ভাষিক ও কালিক সীমা-পরিসীমার ঊর্ধ্বে উঠে মানবতার মৌলিক ভাবসম্মিলনে সাদির কবিতার আবেদন চিরন্তন ও অমর। মহাকালের উজ্জ্বল শিল্পনিদর্শন। অমর নান্দনিক রত্মভা-ার সৃষ্টির মাধ্যমে কবি বেঁচে আছেন মানবমনে যুগ যুগান্তরে।
সাহিত্যাকাশের এই মহান জ্যোতিষ্কের পূর্ণ নাম মোশাররাফ উদ্দিন মোসলেহ বিন সাদি শিরাজি। ১২০৯ সালে ইরানের ফারস প্রদেশের শিরাজ নগরে তাঁর জন্ম। সম্ভ্রান্ত পারিবারিক পরিবেশেই লেখাপড়ার হাতেখড়ি। শিরাজেই প্রাথমিক শিক্ষার পরিসমাপ্তি। সমকালীন শ্রেষ্ঠ জ্ঞানচর্চাকেন্দ্র বাগদাদের নিজামিয়া মাদ্রাসা থেকে তাফসির, হাদিস, ফিকহ, আকাইদ, যুক্তিবিদ্যা, গ্রীকদর্শনে হয়ে ওঠেন পারঙ্গম। তাঁর বিখ্যাত শিক্ষাগুরু হলেন জামাল উদ্দিন আবুল ফারাজ আবদুর রহমান জাওজি ও শেখ শিহাব উদ্দিন সোহরাওয়ার্দি। শৈশবকাল থেকে প্রখর ধীশক্তির অধিকারী ছিলেন কবি শেখ সাদি। সাহিত্যকর্মে যার নিদর্শন দীপ্যমান।
ভ্রমণপিপাসু এই মহান কবি পৃথিবীর নানা জনপদে বৈচিত্র্যময় মানুষের সান্নিধ্যে উপনীত হন। সমকালীন যুগজিজ্ঞাসার কৌতুহল নিবৃত হয় কাব্যরসের আস্বাদনের মাধ্যমে। এমনকি রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, জুলুম-নির্যাতন, মানবাধিকারের প্রতিফলন ঘটে কবিতায়। মূলত শেখ সাদির জীবন তিন ভাগে বিভাজ্যÑ অধ্যয়নকাল, ভ্রমণকাল ও শিরাজে প্রত্যাবর্তন। ১২২৬ থেকে ১২৫৬ সাল পর্যন্ত ব্যাপৃত তার বর্ণাঢ্য ভ্রমণজীবন। এশিয়া, তুরস্ক, বলখ, আরব, সিরিয়া, আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চল, ভারতবর্ষের পাঞ্জাব ও গুজরাট ভ্রমণ করেন। বিভিন্ন দেশ ও জাতির কৃষ্টি-কালচার, সভ্যতা, উত্থান-পতন, সমাজ, ধর্ম, রীতিনীতিসমৃক্ত অভিজ্ঞতার ঝুলি সমৃদ্ধ করে ১২৫৬ সালে প্রিয় স্বদেশভূমি ইরানের শিরাজে প্রত্যাবর্তন করেন। মধ্যযুগের বিশ্বপর্যটকের মধ্যে ইবনে বতুতার পরই তাঁর স্থান। সমকালীন ইরানের শাসক আবু বকর বিন সাদ জাঙ্গি ছিলেন বিদ্যোৎসাহী সম্রাট। সাদি সাহিত্যচর্চায় তাঁর পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন। তাঁরই প্রশংসায় রচিত হয় অসংখ্য কাসিদা বা প্রশস্তিমূলক কবিতা। ১২৯১ সালে তিনি এই ধরণীর মায়া ত্যাগ করে মহান ¯্রষ্টার সান্নিধ্যে উপনীত হন। শিরাজ শহরের সাদিয়া নামক স্থানে খানকার পাশেই তিনি সমাহিত হন।
যেসব মনীষীর প্রদীপ্ত আলোচ্ছটায় ফারসি সাহিত্যাকাশ উদ্ভাসিত কবি শেখ সাদি তাঁদের শীর্ষে। পদ্য ও গদ্য উভয় শাখায় তাঁর সফল চাষবাষ। প্রকৃতপক্ষে সুন্দর, পরিশীলিত, শান্তিময় পৃথিবী গড়ার গভীর প্রত্যয় ব্যক্ত হয়েছে তাঁর কবিতায়। ক্লাসিক সাহিত্যে বিশেষ শ্রেণির প্রাধান্য থাকলেও শেখ সাদির কবিতায় রাজা-বাদশাহ থেকে সাধারণের মনোলোকের সুপ্ত অনুভূতির চিত্রায়ণ ঘটে। কবিতার আবেদন সর্বজনীন। ‘বুস্তান’ ও ‘গুলিস্তান’ তাঁর অনবদ্য শিল্পকর্ম। ‘বুস্তান’ বা সাদিনামা কাব্যগ্রন্থটি দশটি অধ্যায়ে বিন্যস্ত। রাষ্ট্রপরিচালনা পদ্ধতি ও ন্যায়বিচার, দয়া-অনুগ্রহ, প্রেম-ভালোবাসা, বিনয়-নম্রতা, সম্মতি, সন্তোষ বা তৃপ্তি, প্রশিক্ষণ, সুস্থতায় কৃতজ্ঞতা, অনুতাপ ও সঠিক পথ এবং আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা। ১২৫৭ সালে রচিত গ্রন্থটি সমকালীন শাসক সাদ বিন আবি বকর বিন সাদ জাঙ্গির নামে উৎসর্গীকৃত। রাষ্ট্রপরিচালনাবিধি, ন্যায়বিচার, দয়া-দাক্ষিণ্য, প্রেম-ভালোবাসা, বিনয়-নম্রতা, সন্তোষলাভ, প্রশিক্ষণ, কৃতজ্ঞতা এবং আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা এর প্রতিপাদ্য। রূপক, উপমা-উৎপ্রেক্ষা, শিল্পরূপের সমাহারে এক প্রাতিস্বিক সৃষ্টিকর্ম ‘বুস্তানে সাদি’। সহজ, সরল ভাষায় রচিত এ গ্রন্থের আবেদন সর্বজনীন। ইতিহাস-ঐতিহ্য, জীবনগাথা, দর্শন, কাব্যরস, মূল্যবোধের এ অপরূপ সৃষ্টি। শেখ সাদির ‘বুস্তান’ মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধের ভাবসম্মিলনে এক অপরূপ সৃষ্টি। প্রখ্যাত সাহিত্যসমালোচক ই জি ব্রাউনের মতে,
ডযবহ ঝধ‘ফর রং ফবংপৎরনবফ (ধং যব ড়ভঃবহ রং) ধং বংংবহঃরধষষু ধহ বঃযরপধষ ঢ়ড়বঃ, রঃ সঁংঃ নব নড়ৎহব রহ সরহফ ঃযধঃ, পড়ৎৎবপঃ ধং ঃযরং ারবি রহ ধ পবৎঃধরহ ংবহংব ঁহফড়ঁনঃবফষু রং, যরং বঃযরপং ধৎব ংড়সবযিধঃ ফরভভবৎবহঃ ভৎড়স ঃযব ঃযবড়ৎরবং পড়সসড়হষু ঢ়ৎড়ভবংংবফ রহ ডবংঃবৎহ ঊঁৎড়ঢ়ব.
শেখ সাদির অপর এক বিখ্যাত গ্রন্থ ‘গুলিস্তান’ রচিত হয় ১২৫৮ সালে। গদ্য ও পদ্যে রচিত গুলিস্তানে রাজচরিত্র, সন্তোষের মূল্য, নীরবতার উপকারিতা, প্রেম ও যৌবন, দুর্বলতা ও বার্ধক্য, শিক্ষার গুণ ও কথাবার্তার শিষ্টাচারিতা ইত্যাকার বিষয় স্থান লাভ করেছে। ‘গুলিস্তান’-এর স^াতন্ত্র্য হলো এর প্রতিটি অধ্যায়ে রয়েছে কাহিনী বা গল্পের অবতারণা এবং পরিসমাপ্তি ঘটেছে কবিতার মাধ্যমে। সাহিত্যচর্চায় গদ্য ও পদ্যের অপরূপ সম্মিলন ফারসি সাহিত্যে দুর্লভ।
‘কুল্লিয়াতে সাদি’ তাঁর বহুমাত্রিক কবিতাসংকলন। কাসিদা, গজল, কেতআ, তারজিবান্দ, রুবাই, মাকালাত ও আরবি কাসিদার সমাহার। জ্ঞান ও প্রজ্ঞা, হাস্যরস ও কৌতুকপ্রিয়তা, সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ, আবেগময় অভিব্যক্তি ও মানবপ্রেম তাকে পাঠকপ্রিয় করে তোলে। আল্লাহর প্রশংসা, রাসূল (সা.)-এর শানে নাত, বিজ্ঞ ব্যক্তিবর্গের উপদেশ বাণী, শোকগাথা, শাসকশ্রেণির প্রশংসা এবং হালাকু খানের নৃশংস হত্যাযজ্ঞ, আরবি ছন্দের আলোকে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়ের অবতারণা তাঁর কবিতাকে করেছে ঋদ্ধ। ফারসি ও আরবি ভাষার সম্মিলন কবিতার এক বিশেষ স্বাতন্ত্র্য।
কবিরা সত্য, সুন্দর, ন্যায়ের প্রতীক। নান্দনিক রসাস্বদনের সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা জীবনবোধের নিপুণ শিল্পী। এ ধারায় শেখ সাদি বিশ^সাহিত্যের এক শ্রেষ্ঠ শিল্পীসত্তা। তিনি রাজা-বাদশাহ থেকে সর্বস্তরের মানুষের জীবনকে সুন্দরের দিক অনুপ্রাণিত করেন। রাষ্ট্র, সমাজ, মূল্যবোধসহ নান্দনিকতার অপূর্ব সম্মিলন তাঁর কবিতা। মানুষের যাপিত জীবনের চিত্রায়ণ, সামাজিক ত্রুটি-বিচ্যুতি নিরূপণ, রাজা-প্রজার মৌল শিক্ষণীয় দিকগুলোর স্বরূপ উন্মোচিত হয় তাঁর কবিতায়। ‘বুস্তানে সাদি’র সূচনা হয় মহান আল্লাহর প্রশংসাবাণীর মধ্য দিয়েÑ
حکيم سخن در زبان آفرين بنام خداوند جان آفرين
کريم خطا بخش پوزش پذير خداوند بخشندهء دستگير
‘প্রাণের স্রষ্টা আল্লাহর নামে শুরু
তিনি মহাজ্ঞানী, মুখে ভাষা সৃষ্টিকারী।
আল্লাহ তাআলা ক্ষমাশীল ও সাহায্যকারী
দয়ালু এবং অপরাধীর গুণাহ মার্জনাকারী।’

রাসূলের (সা.) প্রশস্তিগাথা ইরানি কবিদের অনন্য বৈশিষ্ট্য। শেখ সাদিও এর ব্যতিক্রম নন। রাসূলের জীবনাদর্শনের শ্রেষ্ঠতম নমুনার পরিচয় মেলে তাঁর কবিতায়। রাসূলের শানে তাঁর রচিত নাত যুগ যুগ ধরে ইসলামি ঐতিহ্য, সভ্যতা-সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে সমাদৃত হয়ে এসেছেÑ
کشف الدجی بجماله بلغ العلی بکماله
صلوا عليه و آله حسنت جميع خصاله
‘চারিত্রিক মাধুর্যে সম্মানের উঁচুতে আসীন তিনি
স্বভাব ও সৌন্দর্যের দ্যুতিতে বিদূরিত হয় অন্ধকার।
তাঁর উন্নত গুণাবলি শ্রেষ্ঠত্বের সর্বোচ্চ শিখরে
তাঁর প্রতি দরুদ পড় এবং পরিবারের জন্য রহমত কামনা কর।’

মানবিক মূল্যবোধের নির্যাসে পূর্ণ শেখ সাদির কবিতা। সমাজ সংশোধনের ক্ষমতা যাঁদের হাতে নিবদ্ধ সেই শাসকেরা যেন মানুষের কল্যাণ সাধনে প্রবৃত্ত হন। অন্যায়কে প্রতিারোধ করেন। তাতেই নিহিত ধরণীর অধিবাসীদের সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি। তাঁর কবিতা শাসকশ্রেণিকে দায়িত্বানুগ হওয়ার প্রেরণা জোগায়। বিশ^চরাচরে মানবিকতা ও সভ্যতার উৎকর্ষে শেখ সাদির কবিতাÑ
ره پارسايان اميد ست و بيم اگر جادهء بايدت مستقيم
باميد نيکی و بيم بدی طبيعت شود مرد را بخردی
در اقليم و ملکش پنه يافتی گرين هردو در پادشاه يافتی
باميد بخشايش کردگار که بخشايش آرد بر اميدوار
‘যদি সরল সঠিক পথ নিশ্চিত করতে চাও
পরহেজগারগণের পথেই রয়েছে প্রত্যাশা ও ভয়।
জ্ঞানীদের জন্য এটাই স্বাভাবিক
কল্যাণের প্রত্যাশা ও মন্দের ভয়।
এ দুটি মহৎ গুণ বাদশাহের মধ্যে প্রত্যক্ষ হলে
দেশে-মহাদেশে কল্যাণের আধার হবে।
কেননা, আশাবাদীর জন্য রয়েছে তাঁর ক্ষমা
মহান স্রষ্টার ক্ষমার প্রত্যাশী হওয়ার তরে।’

এ পৃথিবীর সব মানুষের সৃষ্টিমূল একই উপাদান। আবার প্রত্যাবর্তনস্থলও একই। গর্ব ও অহংকার প্রদর্শনের মৌলিক কোনো উপাদান তার নেই। ওপারে সবাই সম্মুখীন হবে এপারের হিসেবে-নিকেশে। তাই শেখ সাদি জীবনকে পরিশীলিত ও বিনয়ী হতে উদ্বুদ্ধ করেনÑ
پس ای بنده افتادگی کن چو خاک زخاک آفريدت خداوند پاک
چو گردن کشيد آتش هولناک حريص و جهان سوز و سرکش مباش
‘মাটি থেকে মহান আল্লাহ তোমাকে তৈরি করেন
বিনয়ী হও তুমি মাটির এ ধরণীতে।
লোভী, বিধ্বংসী ও অত্যাচারী হয়ো না তুমি
যেন ভয়াবহ আগুন মাথা গুটিয়ে নেয়।’

মানুষে মানুষে নেই কোনো ভেদাভেদ। সৃষ্টিমূলে সবাই একই উপাদান থেকে তৈরি। রাজা-প্রজার স্থায়ী বাসস্থান একই মাটির নিচে। ক্ষণস্থায়ী এ ধরণীতলে গৌরব-অংহারের কিছু নেই। প্রকৃতপক্ষে জ্ঞানী সেই যে নিজেকে পরম¯্রষ্টার সাথে সম্পৃক্ত করে তোলেন। এ পার্থিব জীবনযাত্রা সম্পর্কে শেখ সাদি বলেনÑ
دل اندر جهان آفرين بند و بس جهان، ای برادر، نماند به کس
که بسيار کس چون تو پرورد و کشت مکن تکيه بر ملک دنيا و پشت
چه بر تخت مردن، چه بر روی خاک چو آهنگ رفتن کند جان پاک
‘পৃথিবী কারো চরস্থায়ী আবাস নয়
স্রষ্টার সাথে হৃদয়কে আবদ্ধ করো।
পৃথিবী রাজত্বের লোভে হীন আচরণ করো না
তোমার মতো অনেকেই লালিত ও নিঃশেষ হয়ে গেছে
যখন পবিত্র প্রাণপাখি চলে যাবার সুর তোলে
সিংহাসনে অথবা মাটির ধূলিতে মৃত্যুতে কিইবা যায় আসে।’

মানুষের দৈনন্দিন কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে তাদের সংস্কৃতির প্রকাশ ঘটে। সৌজন্য-শিষ্টাচার পরিশীলিত মনসিকতার পরিচায়ক। সংস্কৃতিবান মানুষের কথা-বার্তা, আচার-আচরণ সবই উন্নত হয়। সমাজের বহুমাত্রিক দিকগুলো উন্নত হয়। পারস্পরিক সৌজন্যপূর্ণ ব্যবহারের বিভিন্ন দিকও ফুটে ওঠে শেখ সাদির কবিতায়Ñ
سخن ر سر است اى خردمند و بن میاور سخن در میان سخن
خداوند تدبیر و فرهنگ و هوش نگوید سخن تا نبیند خموش
‘বক্তব্য রহস্যময় হে জ্ঞানী, প্রাজ্ঞ
অপরের কথার মাঝে বলো না কোনো কথা।
সভ্য, সংস্কৃতিবান ও জ্ঞানবান ব্যক্তি
নীরবতা না দেখলে কথা বলে না কখনো।’
মানবতার মূলমন্ত্র সাম্য, মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধন। জাতি, বর্ণ নির্বিশেষে সবাই এক আদমসন্তান। বিশে^র যে কোনো প্রান্তে একজন মানুুষ ব্যথিত হলে তার দুঃখে সবার পীড়িত হওয়া উচিত। এতেই নিহিত মানবতার মহান পরিচয়। যদি অপরের ব্যথায় হৃদয় কেঁপে না ওঠে তাহলে মনুষত্বের মর্যাদা হীন হয়ে যায়। পৃথিবী সব মানুষকে একই বন্ধনে বেঁেধ কবি সাম্য, শান্তি ও সুখের পৃথিবী গড়ার মন্ত্রে উজ্জীবিত করেনÑ
بنی آدم اعضای یکدیگرند که در آفرینش ز یک گوهرند
چو عضوی به درد آورد روزگار دگر عضوها را نماند قرار
تو کز محنت دیگران بی غمی نشاید که نامت نهند آدمی
‘আদমসন্তান একে অপরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ
সৃষ্টি হয়েছে মূলত একই মূল উৎস থেকে।
যদি একটি অঙ্গ কালের ঘূর্ণিতে হয় ব্যথিত
অপর অঙ্গের থাকে না কোনো প্রশস্তি।
তুমি যে অপরের দুঃখ-কষ্টে নির্বিকার
মানুষ নামের ভূষণ থাকতে পারে না তোমার।’

মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধ মানবজীবনকে উন্নত করে। লোভ-লালসা, ধনসম্পদের আকাক্সক্ষা মানুষকে বিপথে নিয়ে যায়। পৃথিবীতে মানুষ যা অর্জন করে তার যৎসামান্যই ভোগ করতে পারে। তবু বৈষয়িক প্রভাব-প্রতিপত্তির চাহিদা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। এমনকি মানুষ পার্থিব প্রভাব, কর্তৃত্ব, সম্পদের পাহাড় গড়তে অন্যায় পথ বেছে নিতেও কুণ্ঠিত হয় না। প্রকৃতপক্ষে আত্মিক প্রশান্তি ও উন্নত জীবন প্রাপ্তসম্পদে সন্তুষ্ট থাকার ওপরই নির্ভরশীল। অসম, অন্যায় প্রতিযোগিতা মানুষকে মৃত্যু অবধি ঊধ্বশ^াসে এগিয়ে নিয়ে চলে। অথচ নিঃশ^াস বন্ধ হয়ে গেলে এসবই মূল্যহীন হয়ে যায়। কোনোকিছুই তার বিন্দুমাত্র কাজে আসে না। অল্পে তুষ্টি ও প্রতিকূলতায় ধৈর্য মানুষের জীবনকে সুন্দর, সত্য, কল্যাণের পথে ধাবিত করে। কবির ভাষায়Ñ
که ورائ تو هیچ نعمت نیست ای قناعت توانگرم گردان
هرکرا صبر نیست حکمت نیست. کنجِ صبر اختیار لقمان است
‘ওহে অল্পে তুষ্ট অবলম্বনকারী গতিশীল প্রাণ
তোমার মতো নেয়ামতের ধারক কেউ নেই এ ধরণীতে।
ধৈর্য অবলম্বন লোকমানেরই (আ.) শিক্ষার প্রতিফলন
ধৈর্য নেই যার; প্রজ্ঞার সন্ধানও মিলবে না তার।’
জীবনের এক আনন্দময় রূপ প্রেম। এ সৃষ্টিজগতের মূলে রয়েছে প্রেমেরই অনুভূতি। প্রেমেই ভাঙা, প্রেমেই গড়া। ঐশী প্রেমের বহ্নিশিখা মানবমনে এক অপরূপ সৌন্দর্য সৃষ্টি করে। প্রতিনিয়ত তাকে পরমাত্মার সান্নিধ্যে উপনীত হবার দিকে তাড়িত করে। বৈষয়িক প্রেম-ভালোবাসাও জীবনকে মহিমান্বিত করে। নর-নারীর পূতঃপবিত্র প্রেম ¯্রষ্টারই এক বিশেষ নিদর্শন। ভালোবাসার পরশে মানুষ অসাধ্যকে সহজ করে তোলে। কাঁটাযুক্ত পথপরিক্রমাও পুষ্পকাননে পরিণত হয়। যুগে যুগের ভালোবাসার পরীক্ষায় মানুষ জীবন বিসর্জন দিতেও এতটুকু পিছপা হয়নি। সৃষ্টির প্রেরণামূলে রয়েছে প্রেম। প্রেম-ভালোবাসাহীন জীবন যেন মরীচিকায় বিচরণ। কোনো নান্দনিক দিকও তার কাছে সুন্দর রূপে ধরা দেয় না। শেখ সাদিও তাঁর কবিতায় প্রেমের ঐশ^র্য তুলে ধরেন এভাবেÑ
نشان صورت یوسف دهد بناخوبی کسی بدیدهءانکار گر نگاه کند
فرشته اش بنماید بچشم محبوبی. و گر بچشم ارادت نگه کند در دیو
‘কেউ যদি ভালোবাসাহীন হৃদয়ে কারো পানে তাকায়
ইউসুফের সৌন্দর্যময় অবয়বও তার কাছে অনুজ্জ্বল মনে হবে।
আর যদি কেউ প্রেমের মননে দৈত্য-দানবের প্রতি দৃষ্টি দেয়
প্রেমিকের চোখে তাকেও ফেরেশতার মতো মনে হবে।’

মানুষ সর্বশ্রেষ্ঠ জীব। এদের মাঝেও শ্রেষ্ঠত্ব নির্ণিত হয় জ্ঞানের মানদ-ে। যে যত বেশি জ্ঞানী তার মর্যাদাও তত উন্নত। জ্ঞানই শক্তির মূল। জ্ঞান রাজা-বাদশাদের অলংকার। জ্ঞানই প্রকৃতপক্ষে সমৃদ্ধির মূল হাতিয়ার। সাধারণ মানুষ জ্ঞান-বিজ্ঞানের বলে নেতৃত্বের মর্যাদায় আসীন। আবার রাজপুত্রও জ্ঞানের শক্তির অভাবে পরিণত হয় সাধারণ মানুষে। ইরানের জাতীয় কবি ফেরদৌসি থেকে শুরু করে প্রায় সব ফারসি কবিই জ্ঞানকে সবকিছুর চেয়ে মূল্যবান হিসেবে আখ্যা দেন। বর্তমান বিশে^ও তথ্য-প্রযুক্তি ও জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ জাতির হাতের মুঠোয় সমগ্র পৃথিবী। যুগে যুগে জ্ঞানই মানুষের মর্যাদার নির্ণায়ক। শেখ সাদির কবিতায় রয়েছে সর্বজনীন সত্যের মূল প্রেরণা। জীবনকে গতিশীল, প্রাণময়, মর্যাদাবান করতে তাঁর কবিতা এক বিশেষ ভাবরসে পূর্ণ। কবির ভাষায়Ñ

بوزیری پادشاه رفتند روستازادگان دانشمند
بگدائی بروستا رفتند. پسران وزیر ناقس عقل
‘গ্রাম থেকে আসা জ্ঞানীরা
বাদশাহর মন্ত্রীর মর্যাদায় আসীন।
মন্ত্রীর জ্ঞানহীন সন্তানেরা
গ্রামের সাধারণ মানুষে পরিণত।’

মানবজীবনে প্রকৃত শিক্ষা ও উপযুক্ত পরিবেশের প্রভাব অপরিসীম। প্রতিটি মানুষ স্বাভাবিকভাবেই স্বীয় প্রতিভা নিয়ে এই পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়। সঠিক শিক্ষা ও পরিচর্যায় কেউ হয় উন্নত চরিত্রবান আবার কেউ বিপথগামী। মৌলিক মানবিক গুণাবলির সমাহার জীবনকে পরিশীলিত ও সুন্দর করে তোলে। সঠিক শিক্ষা ও পরিবেশের অভাবে বেড়ে ওঠা সন্তান সমাজকেও করে কলুষিত। তাই শিশুর যথাযথ প্রতিপালন পিতামাতাসহ সংশ্লিষ্ট সবারই অপরিহার্য কর্তব্য। যথাসময়ে পরিচর্যার অভাবে এই প্রতিভাময় মানুষগুলোও কালের বিবর্তনে হারিয়ে যায় গহীন অন্ধকারে। আলোকিত জীবনের পথ থেকে তারা হয় বঞ্চিত। কবি শিশুকাল থেকেই তাদের পরিচর্যা ও যথাযথ শিক্ষার প্রতি গুরুত্বারোপ করে বলেনÑ
نشود خشک جز بآتش راست چوبِ تر را چنانکه خواهی پیچ
‘কাঁচা কাঠকে যেভাবে খুশি করতে পারবে বাঁকা
শুকিয়ে গেলে তা আগুনের তাপ ছাড়া হবে না কখনো সোজা।’

ফারসি কবি শেখ সাদির কবিতা মানুষের মননকে পরিশীলিত ও নৈতিক মূল্যবোধে উদ্বুদ্ধ করে। দৈশিক, কালিক ও ভৌগোলিক সীমাপরিসীমা পেরিয়ে জীবনকে সভ্য, উন্নত করে তোলে। জীবনবোধ, দর্শন, মূল্যবোধ, নান্দনিকতার অপূর্ব সম্মিলনে তাঁর কবিতা জীবনকে সত্য ও নান্দনিকতায় পূর্ণ করে দেয়। মানবজীবনে তাঁর কবিতার বাহ্যিক ও অন্তর্লোকের প্রেরণা সুদূরপ্রসারী। কবিতার ভাব-বিষয় ও শৈল্পিক নান্দনিকতা সভ্যতার উপজীব্য হিসেবে বিবেচিত হয়ে এসেছে যুগ যুগ ধরে। শেখ সাদিও স্বীয় শিল্পকর্মের মধ্য দিয়ে স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে থাকবেন মহাকালের ঘূর্ণিপাকে।