All posts by dreamboy

ইরানে মসজিদের সংস্কৃতি : একটি শিক্ষণীয় বাস্তবতা

সিরাজুল ইসলাম

মসজিদ হচ্ছে ইসলামি সংস্কৃতির প্রতীক এবং প্রার্থনাস্থল। এটি সমস্ত মুসলমানের জন্য আধ্যাত্মিক স্থান। মসজিদ সম্পর্কে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আল্লাহর সবচেয়ে নিকটতম স্থান হলো মসজিদ।’ মসজিদেই নামাজ আদায় করা হয় আর নামাজ হচ্ছে ইসলামের অন্যতম প্রধান রুকন বা স্তম্ভ, নামাজ হচ্ছে ‘ইসলামের নির্যাস’। ফলে শুধু সাধারণ লোকজনের জন্য মসজিদে গিয়ে জামায়াতে নামাজ পড়া বা সংঘবদ্ধভাবে ইবাদত করার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয় নি; বরং খ্যাতিমান ইসলামি প-িত ব্যক্তিরাও জামায়াতে নামাজ পড়ার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকেন।
মসজিদ হলো ইবাদাতের স্থান। কোরআন তেলাওয়াত করা, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দেওয়া, নামাজ আদায় করা ইত্যাদি বিভিন্ন রকমের ইবাদাতের স্থান হলো মসজিদ। এইসব কাজের সুবিধার্থে সময়ের পরিক্রমায় মসজিদকে ঘিরে গড়ে ওঠে গ্রন্থাগার, সরাইখানা, চিকিৎসাকেন্দ্র, মাদ্রাসা ও রান্নাঘর। মুসলমানরা তাদের বস্তুগত ও আধ্যাত্মিক বিচিত্র চাহিদা মেটানোর জন্য মসজিদ কমপ্লেক্সে প্রবেশ করত। সাধারণত এই মসজিদ কমপ্লেক্স গড়ে উঠত শহরকে কেন্দ্র করে। সেজন্য এর গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।
ইসলামের আবির্ভাব থেকে এখন পর্যন্ত মুসলিম উম্মাহর কাছে মসজিদ সমানভাবে গুরুত্বপূর্র্ণ ও মর্যাদার অধিকারী। কেননা, মসজিদ হচ্ছে তাদের ইবাদাতের মূল কেন্দ্র। ইবাদাত-বন্দেগির মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের স্থান মসজিদে এক সময় রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার পাশাপাশি সামরিক অভিযান সম্পর্কেও পরামর্শ করা হতো। মসজিদ ছিল মুসলিম সমাজের সকল কর্মকা-ের প্রাণকেন্দ্র।
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর আমলে মসজিদ বিচিত্র কাজে ব্যবহৃত হতো। যেমন নিঃস্বদের আবাসন, মুসাফিরদের যাত্রাবিরতি, সামাজিক কাজকর্মের কেন্দ্র এবং কোরআনসহ ধর্মীয় জ্ঞান শিক্ষা। পরবর্তীকালে জ্ঞানের ‘আদর্শ নমুনা’ এই মসজিদ থেকেই শুরু হয়ে বিস্তৃতি ও বিকাশ লাভ করেছে। তবে ইতিহাসের সকল পর্যায়েই মসজিদ ছিল আল্লাহর সাথে যোগাযোগ স্থাপন এবং তাঁর সাথে নিজেদের চাওয়া-পাওয়া-প্রয়োজনীয়তার কথা বলার পবিত্র স্থান। কিন্তু বর্তমানে নামাজ আদায় ও ওয়াজ মাহফিল ছাড়া মসজিদ তার অবশিষ্ট ভূমিকাগুলো খুব একটা পালন করতে পারছে না। প্রায় সারা বিশ্বেই একই অবস্থা। এ অবস্থার পরিবর্তন হওয়া একান্তই জরুরি। তাতে দেশ, সমাজ ও সমাজের মানুষেরই উপকার হবে।
১৯৭৯ সালে ইরানে মহান ইসলামি বিপ্লব বিজয় লাভের পর রাষ্ট্রীয়ভাবে মসজিদকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়। এ সময় ইরানের পাড়া-মহল্লা থেকে শুরু করে শহরের বড় বড় মসজিদগুলোকে বিশেষ শিক্ষা, সাহিত্য, শিল্প-সংস্কৃতি, রাজনীতি, সমাজসেবা ইত্যাদির প্রাণকেন্দ্রে পরিণত করা হয়। মসজিদের ইমামদেরকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। ইমামরা শুধু ‘নামাজ পড়ানো লোক’ হিসেবে বিবেচিত না হয়ে সমাজের নেতা হিসেবে গণ্য হতে শুরু করেন। মসজিদ হয়ে ওঠে প্রান্ত থেকে কেন্দ্রের মধ্যে যোগাযোগের বিরাট সেতুবন্ধন। বিপ্লবের পর মসজিদ আর শুধু নামাজের স্থান থাকল না; বরং এর নানামুখী ব্যবহার শুরু হলো। গড়ে উঠতে থাকল নতুন নতুন মসজিদ ও মসজিদ কমপ্লেক্স। এসব মসজিদ কমপ্লেক্সে রাজনীতির সর্বোচ্চ পর্যায়ের কর্মকা- নির্বাচনের ভোট গ্রহণও করা হয়ে থাকে।
মসজিদ তথা ইবাদাত-কেন্দ্রের নানামুখী ব্যবহারের বিষয়ে উদাহরণ হিসেবে রাজধানী তেহরানে নির্মিত ইমাম খোমেইনী মুসাল্লার কথা বলতে পারি। আগে ইরানের রাজধানী তেহরানের কেন্দ্রীয় জুমার নামাজের জামায়াত অনুষ্ঠিত হতো তেহরান বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদে। ইসলামি বিপ্লব বিজয়ের পর ১৯৮২ সালে তেহরান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জুমার নামাজের জামায়াত অনুষ্ঠানের জন্য তেহরানের আব্বাস আবাদ এলাকায় মুসাল্লা গড়ে তোলার প্রস্তাব দেওয়া হয়। নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং আলোচনা-পর্যালোচনার পর ১৯৯০ সালে এর চূড়ান্ত নকশা গ্রহণ করা হয় যাতে ইরান, তাজিকিস্তান, আজারবাইজান এবং জর্জিয়ার ইসলামি নির্মাণশৈলী ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত হয়। তাজিকিস্তান, আজারবাইজান এবং জর্জিয়া প্রাচীনকালে ইরানের অংশ ছিল।
যাহোক, তেহরানে নির্মিত এই মুসাল্লার নাম দেওয়া হয়েছে ইমাম খোমেইনী মুসাল্লা। এখানে শুধু জুমার নামাজ অনুষ্ঠিত হয় না; বরং ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আজহার নামাজের জামায়াতও অনুষ্ঠিত হয়। ইমাম খোমেইনী মুসাল্লায় গড়ে তোলা হয়েছে সুবিশাল কমপ্লেক্স। এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় মসজিদ কমপ্লেক্স। এখানে ২৩০ মিটার উচ্চতার দুটি মিনার নির্মাণ করা হয়েছে।
ইমাম খোমেইনী মুসাল্লায় জুমা এবং ঈদের নামাজ অনুষ্ঠান ছাড়া আরো যেসব কার্যক্রমে এটি ব্যবহৃত হয় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি তুলে ধরা হলো। ইমাম খোমেইনী মুসাল্লায় বহু গুরুত্বপূর্ণ প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। যেমন-
১. আন্তর্জাতিক কোরআন প্রদর্শনী
২. তেহরান ইন্টারন্যাশনাল বুক ফেয়ার
৩. ইরানের খনি এবং খনিজ শিল্পে বিনিয়োগের সুযোগ বিষয়ক আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী এবং
৪. আন্তর্জাতিক হস্তশিল্প প্রদর্শনী।
এবার আমরা ইরানের মাশহাদ শহরে ইমাম রেযা আলাইহিস সালামের পবিত্র মাজার কমপ্লেক্সের দিকে নজর দিতে পারি।
মাশহাদ শহরটি তুর্কমেনিস্তান ও আফগানিস্তানের সীমান্তবর্তী একটি শহর। পবিত্র এই শহরেই রয়েছে নবী-বংশের অষ্টম ইমাম হযরত ইমাম রেযা আলাইহিস সালামের মাজার। এই মাজার কমপ্লেক্সে যে মসজিদ রয়েছে সেটি আয়তনের দিক দিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মসজিদ। এছাড়া, মসজিদ কমপ্লেক্সে রয়েছে একটি জাদুঘর, একটি বিশাল লাইব্রেরি এবং চারটি মাদ্রাসা, একটি কবরস্থান, রাজাভি ইউনিভার্সিটি অব ইসলামিক সায়েন্সেস, পর্যটকদের জন্য নির্মিত একটি বিশাল ডাইনিং হল, সুবিশাল নামাজের স্থান এবং আরো কয়েকটি ভবন।
ইরানে ঐতিহাসিক ও আকর্ষণীয় যেসব দর্শনীয় স্থান রয়েছে ইমাম রেযার মাজার কমপ্লেক্স তার অন্যতম প্রধান। কানাডার বিশিষ্ট লেখক বেনি রাল্ফ ইমাম রেযা (আ.)-এর মাজার কমপ্লেক্সের কাঠামোগত বৈশিষ্ট্য নিয়ে কথা বলেছেন। তিনি ‘ইরান, ফিরোযা ব্রিজ’ নামক গ্রন্থে লিখেছেন, ‘মাশহাদে ইমাম রেযা (আ.)-এর মাজারের বিস্তৃত শাবেস্তান আর কবরের পাশের কারুকার্র্যময় খোলা আঙ্গিনা দেখতে খুবই সুন্দর। সেখানে সবাই একধরনের প্রশান্তি ও নিরাপত্তা বোধ করেন। গম্বুজের ভেতরের রং-বেরঙের দেয়াল চমৎকার সব টাইলসের কারুকাজে এমনভাবে সাজানো হয়েছে যে, অন্যরকম এক ভালো লাগার সাথে সেখানে বিরাজ করে এক ঐশী গুঞ্জরণ। মানুষ এখানে অলৌকিক মাহাত্ম্য অনুভব করেন এবং মানুষকে যেন বেহেশতের পথ দেখায়। মানুষ সর্বশক্তিমান আল্লাহর সামনে নিজেকে খুব তুচ্ছ মনে করেন এবং মারেফাতের নূর তাঁর অন্তরে আলো বিকিরণ করে। এই মাজার দেখার যে অনুভূতি তা বর্ণনা করার মতো কোনো ভাষা নেই।’
২০০৭ সালের তথ্য অনুযায়ী ইরান এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রতিবছর প্রায় আড়াই কোটি মানুষ ইমাম রেযার মাজার জিয়ারত করে থাকেন।
এই মাজার কমপ্লেক্সের ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে রয়েছে আস্তান কুদস রাজাভি ফাউন্ডেশন যার নেতৃত্বে থাকেন ইরানের একজন প্রখ্যাত আলেম। ইরানের বর্তমান প্রেসিডেন্ট সাইয়্যেদ ইবরাহিম রায়িসি একসময় এই আস্তান কুদস রাজাভি ফাউন্ডেশনের প্রধান ছিলেন।
ইমাম রেযা (আ.)-এর মাজার কমপ্লেক্সের মোট আয়তন ৫ লাখ ৯৮ হাজার ৬৫৭ বর্গমিটার। এর মধ্যে শুধু মাজার এলাকার আয়তন ২ লাখ ৫৭ হাজার ৭৯ বর্গমিটার।
ইমাম রেযার মূল কবরের বেষ্টনীর ভেতরে সোনা ও রূপার যে বিচিত্র কারুকাজ, তার পাশাপাশি কাচের শিল্পকর্মে সজ্জিত ক্যানভাসে মৃদু আলোর নয়নাভিরাম সৌন্দর্য যিনি একবার দেখেন, তিনি আর ফিরে আসতে চান না। বিখ্যাত ৭ জন ইরানি শিল্পী আড়াই বছর ধরে এসব কারুকাজ সম্পন্ন করেছেন। আধ্যাত্মিকতা ও শৈল্পিক সৌন্দর্যের গুণে একটি মাজার ও মসজিদ কমপ্লেক্স ইরানের মতো একটি দেশের অন্যতম প্রধান পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে, কেবল ইবাদাতের স্থান হয়ে থাকে নি।
শুধু ইসলামি বিপ্লবের পরে নয়, বরং বিপ্লব সফল হওয়ার আগেও মহান ইমাম আয়াতুল্লাহ খোমেইনী তাঁর আন্দোলনের প্রধান কেন্দ্র বানিয়েছিলেন মসজিদকে। ১৯৭৮ সালে যখন মোহাম্মদ রেযা শাহের স্বৈরতান্ত্রিক সরকার দেশে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করল তখন ফ্রান্সের প্যারিস থেকে পাঠানো রেকর্ড একজন মসজিদের ইমাম রমজানের জুমার নামাজের খুতবা হিসেবে ব্যবহার করেন। এতে মানুষের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। ১৯৭৮ সালের ৮ সেপ্টেম্বর রাজধানী তেহরানে অন্তত ১৫ হাজার মানুষ বিক্ষোভে নামেন। তাঁদের ওপর সেনাবাহিনী গুলি চালালে ৮৭ জন শহীদ এবং ২০৫ জন আহত হন। ইরানের ইতিহাসে এ ঘটনাকে ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’ হিসেবে পালন করা হয়ে থাকে। প্যারিস থেকে ইমাম খোমেইনী (রহ) নতুন রেকর্ড পাঠিয়ে জনগণের প্রতি বিশেষ করে মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ও আলেমদের প্রতি আহ্বান জানান এই কথা প্রচার করার জন্য যে, মসজিদ থেকেই ইসলামি বিপ্লবের শুরু। এর পরিণতিতে ১৯৭৮ সালের ডিসেম্বর মাসে তেহরানের রাজপথে কোটি মানুষের বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয় এবং সেখান থেকে এই প্রস্তাব গৃহীত হয়- ‘আয়াতুল্লাহ খোমেইনী দেশের নেতা এবং রাজতন্ত্র প্রত্যাখ্যান করা হলো, পরিবর্তে দেশে ইসলামি সরকার গঠিত হবে।’ এই বিক্ষোভের পরে (১৬ জানুয়ারি ১৯৭৯) মোহাম্মদ রেযা শাহ দেশ থেকে পালিয়ে যান এবং ১১ ফেব্রুয়ারি দীর্ঘ নির্বাসনের অবসান ঘটিয়ে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস থেকে ইমাম খোমেইনী ইরানে ফিরে আসেন। এভাবে ইরানের বিপ্লব চূড়ান্ত সফলতার মুখ দেখে।
বলা যেতে পারে, ইরানের আলেমদের মসজিদভিত্তিক নেটওয়ার্ক বিপ্লব গড়ে তোলা ও মোহাম্মদ রেযা শাহের স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের পতনের ক্ষেত্রে মৌলিক ভূমিকা পালন করেছে। ইরানের শহর নগর ও গ্রামে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হাজার হাজার মসজিদ দেশব্যাপী মানুষের মধ্যে অনানুষ্ঠানিক এবং প্রাকৃতিক যোগাযোগের একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছিল।
ইসলামি বিপ্লব সফল হওয়ার ব্যাপারে ইরানের মসজিদগুলো ইমাম খোমেইনী (রহ.)-কে বিরাটভাবে সাহায্য করেছিল। বিপ্লবের পর তিনি মসজিদগুলোর গুরুত্ব অনুধাবন করে সেগুলোকে বিপ্লবের অর্জন সমাজে বাস্তবায়নের জন্য কাজে লাগাতে শুরু করলেন।
তিনি দেশে ফিরেই জুমার নামাজের বৃহৎ জামায়াত অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিলেন এবং ইরানের সমস্ত শহর-নগরের মসজিদগুলোতে জুমার নামাজের ইমাম নিয়োগ করলেন। বিপ্লবের নেতার প্রতিনিধি হিসেবে এসমস্ত ইমামের ওপর জুমার নামাজের খুতবা ও সমাজের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি নিয়ে বক্তব্য রাখার দায়িত্ব দেওয়া হয়।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে ইরানে যে তামাকবিরোধী আন্দোলন হয়েছিল এবং ১৯০৫ সালে যে সাংবিধানিক বিপ্লব হয়েছিল মসজিদ তাতে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে।
মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি ধরে রাখার প্রাণকেন্দ্র হিসেবে মসজিদের ভূমিকা অপরিসীম। একটি সমাজ ও রাষ্ট্রের টিকে থাকার জন্য এই ঐক্য ও সংহতির কোনো বিকল্প নেই। ইসলামি বিপ্লব বিজয়ের পর ইরানের যেসব শহরে শিয়া ও সুন্নি মুসলমান বসবাস করেন সেসব শহরে ঐক্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অভূতপূর্ব উদ্যোগ নেওয়া হয়। দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় যাহেদান শহরের মুসলমানরা এক শুক্রবার একজন শিয়া আলেমের ইমামতিতে জুমার নামাজ আদায় করতেন এবং পরবর্তী শুক্রবার একজন সুন্নি আলেমের ইমামতিতে এই সাপ্তাহিক নামাজ আদায় করতেন। প্রথমদিকে এই নামাজের ইমামতি করেছেন মরহুম আয়াতুল্লাহ কাফআমি ও মরহুম মৌলভি আবদুল আজিজ। শিয়া ও সুন্নি মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সেটি ছিল একটি চমৎকার উদ্যোগ। পরস্পরের মসজিদে এবং ইমামতিতে নামাজ আদায় করার সময় তাঁরা ফিকাহ সংক্রান্ত মতপার্থক্য নিয়ে মাথা ঘামাতেন না।
সমাজে ঐক্য প্রতিষ্ঠায় মসজিদ কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে তার আরেকটি উদাহরণ ইরানের সিস্তান ও বালুচিস্তান প্রদেশের ‘খাশ’ মসজিদ। প্রদেশের খাশ শহরে অবস্থিত এই মসজিদ শিয়া ও সুন্নি মুসলমানদের মধ্যে ঐক্যের প্রতীক হিসেবে পরিচিত। শহরের বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তিরা বলেন, এখানে শুরু থেকেই দুই মাজহাবের মুসল্লিরা একত্রে নামাজ আদায় করতেন। খাশ শহরের জুমার নামাজের খতিব হুজ্জাতুল ইসলাম মোহাম্মাদ হোসেইন মিরি বলেছেন, মসজিদটিতে এখনো শিয়া ও সুন্নি মুসলমানরা একসঙ্গে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করেন।
এতক্ষণ রাষ্ট্র ও সমাজে বিশেষ করে ইরানে মসজিদের নানামুখী গঠনমূলক কর্মকা- এবং সামাজিক ঐক্য প্রতিষ্ঠায় মসজিদের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করা হলো। নিবন্ধের শেষ পর্যায়ে এসে আমরা বলতে পারি- মানুষের ব্যক্তিগত ও সামাজিক আচরণ নিয়ন্ত্রণে মসজিদের রয়েছে অনন্য ভূমিকা। মুসল্লিরা যখন জামায়াতে সারিবদ্ধভাবে নামাজ আদায় করেন তখন সমাজের এই মানুষগুলোর সামষ্টিক আচরণ প্রকাশ পায়। ধনী-গরীব, উঁচু-নিচু নির্বিশেষে সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নামাজে দাঁড়ালে এক অপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হয়। পাশাপাশি অন্য সময়ে যখন মুসল্লিরা আলাদাভাবে মসজিদে উপস্থিত হন তখনও তাঁরা সতর্কতার সঙ্গে নিজেদের ব্যক্তিগত আচরণ ও কথাবার্তা নিয়ন্ত্রণ করেন। মসজিদে কেউ কোনো অবস্থায় স্বেচ্ছাচারী আচরণ করেন না এবং এখানকার এই প্রশিক্ষণটি মানুষের জন্য সমাজে চলার উত্তম পাথেয় হয়ে দাঁড়ায়। অর্থাৎ মসজিদে নিয়মিত নামাজ আদায়কারী একজন মানুষ নিজেই তার স্বভাব-চরিত্রের খারাপ দিকগুলো বর্জন করে উন্নত গুণাবলি অর্জন করতে থাকেন। এটি একটি দীর্ঘ ও চলমান প্রক্রিয়া এবং দীর্ঘদিন ধরে নিয়মিত মসজিদে যাতায়াতকারী ব্যক্তি সমাজের আদর্শস্থানীয় মানুষে পরিণত হয়ে যান। ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্মের উপাসনালয়ের এরকম কোনো বৈশিষ্ট্য নেই।
নিয়মিত মসজিদে যাতায়াতকারী একজন মানুষ প্রতিনিয়ত ঈমানদার, নামাজি, মুত্তাকি ও ধার্মিক ব্যক্তিদের সাক্ষাৎ পান। এসব ধর্মপ্রাণ মানুষের ঈমান ও আমল সবার সামনে উন্মুক্ত। ধর্মভীরু এসব মানুষ সাধারণভাবে সমাজে সবার শ্রদ্ধাভাজন হন। পারিবারিক ও সামাজিক কাজেকর্মে এমনকি অর্থনৈতিক লেনদেনের ক্ষেত্রেও এই মানুষগুলোর কথা ও দিক-নির্দেশনাকে সবাই সম্মান জানান। পক্ষান্তরে মসজিদের সঙ্গে সম্পর্কহীন মানুষেরা ইসলামি সমাজে কোনো অবস্থাতেই এরকম শ্রদ্ধা অর্জন করতে পারে না। তাই একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, শুধু ইরান নয়- সব মুসলিম দেশেই মসজিদকে নানামুখী সমাজসেবামূলক কর্মকা-ের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করা দরকার। তাতে উন্নত চারিত্রিক মাধুর্যের মানুষে ভরে উঠবে প্রতিটি সমাজ, দেখা দেবে বৈষয়িক উন্নতি। সমাজে ছড়িয়ে পড়বে শান্তি ও আধ্যাত্মিকতার ছোঁয়া।
লেখক : রেডিও তেহরানের সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট

ইবনে সিনা : মধ্যযুগের বিশ্বসেরা চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও দার্শনিক

আবদুস সবুর খান

সর্ববিদ্যায় পারদর্শী চিকিৎসাবিজ্ঞানী, রসায়নবিদ, গণিতজ্ঞ, জ্যোতির্বিদ, ভূগোলবিদ, মৃত্তিকাবিজ্ঞানী, তর্কশাস্ত্রবিদ, দার্শনিক, সংগীতজ্ঞ, কবি এবং ইরান ও বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী দার্শনিক ও প-িত আবু আলী হোসাইন বিন আবদুল্লাহ বিন হাসান বিন আলী বিন সিনা ৩৭০ হিজরির সফর মাসে (৯৮০ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাস) তদানীন্তন পারস্যের বোখারায় জন্মগ্রহণ করেন। প্রাচ্যে তিনি আবু আলী সিনা, ইবনে সিনা, পুর সিনা প্রভৃতি নামে সুপ্রসিদ্ধ। দর্শন ও চিকিৎসাশাস্ত্রে বিশেষ অবদানের জন্য তাঁর খ্যাতি বিশ্বজোড়া। তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি বিজ্ঞান ও দর্শনের জ্ঞানকোষ ‘কিতাবে শেফা’ এবং ‘দানেশ নামেয়ে এলমি’। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘কানুন ফিত তিব্ব’কে ‘চিকিৎসাশাস্ত্রের বাইবেল’ বলে আখ্যায়িত করা হয়।
ইবনে সিনার পিতা আবদুল্লাহ ছিলেন বালখের অধিবাসী। সামানিদের পতন ও সুলতান মাহমুদের উত্থান এই সন্ধিক্ষণে তিনি মাওয়ারাউন্ নাহর-এর সামানি শাসক আমির নূহ বিন মানসুর (শাসনকাল ৯৭৬৯৯৭ খ্রিস্টাব্দ)-এর শাসনকালে জন্মভূমি বালখ ত্যাগ করে বোখারা চলে আসেন এবং এক উচ্চপদে নিযুক্ত হন। কিছুদিন পর রাজস্ব বিভাগের একটি পদে নিযুক্ত করে তাঁকে খারামশীন-এ প্রেরণ করা হয়। এরই নিকটবর্তী আফশানে নামক গ্রামের সেতারে নাম্মী এক মেয়ের সাথে তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। এখানেই তাঁদের প্রথম সন্তান ভুবনবিজয়ী প-িত ও চিকিৎসাশাস্ত্রবিদ ইবনে সিনার জন্ম হয়।
ইবনে সিনা ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী এবং প্রখর স্মৃতিশক্তির অধিকারী। ছয় বছর বয়সে তিনি পিতার সাথে বোখারায় চলে আসেন এবং এখানে তাঁর শিক্ষা শুরু হয়। দশ বছর বয়সে তিনি পবিত্র কুরআন মুখস্ত করেন। অতঃপর সাহিত্য অধ্যয়ন করেন এবং বিভিন্ন শিক্ষকের নিকট ফিক্হ বা মুসলিম আইনশাস্ত্র ও কালাম বা অলংকারশাস্ত্র শিক্ষা করেন। এ সময় তাঁর পিতার নিকট ইসমাঈলিগণের যাতায়াত ছিল। ইসমাঈলিগণের সাথে মেলামেশার ফলে ইবনে সিনার বিভিন্ন বিদ্যার প্রতি অনুরাগ সৃষ্টি হয়। অনেকের মতে তিনি আত্মা ও বুদ্ধি সম্বন্ধে তাদের আলোচনা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন।
ইবনে সিনা আবদুল্লাহ নাতিলির নিকট নীতি-দর্শন, জ্যামিতি, জ্যোতিষ্ক বিজ্ঞান এবং মানতেক বা তর্কশাস্ত্রশিক্ষা করেন। নাতিলি ইবনে সিনার জ্ঞানান্বেষায় মুগ্ধ হয়ে তাঁর পিতাকে স্বীয় পুত্রকে জ্ঞান শিক্ষা দান ছাড়া অন্য কোনো কাজে নিযুক্ত না করার পরামর্শ দেন এবং ইবনে সিনাকেও বিদ্যার্জন ছাড়া অন্য কোনো কাজে যুক্ত না হবার উপদেশ দেন। ইবনে সিনাও ওস্তাদের উপদেশ মতো জ্ঞান শিক্ষায় নিজেকে সম্পূর্ণরূপে নিযুক্ত করেন এবং মানতেক বা তর্কশাস্ত্রে ওস্তাদের চেয়েও অধিকতর ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। অল্প দিনেই তিনি, মাত্র ১৪ বছর বয়সে, শিক্ষককে ছাড়িয়ে যান। নাতিলি বোখারা ছেড়ে চলে যাওয়ার পর ইবনে সিনা ধর্মতত্ত্ব ও প্রকৃতিবিজ্ঞান অধ্যয়নে মনোনিবেশ করেন। এর কিছুদিন পর তাঁর ভেতর চিকিৎসাবিজ্ঞান অধ্যয়নের আগ্রহ সৃষ্টি হয়। ইতঃপূর্বের চিকিৎসাবিজ্ঞানিগণ যা কিছু লিখেছিলেন তার সবই তিনি পড়ে শেষ করেন। চিকিৎসাবিজ্ঞান তাঁর কাছে তেমন কোনো জটিল শাস্ত্র ছিল না, তাই দ্রুততম সময়েই তিনি এই বিষয়ে ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন এবং চিকিৎসাকার্যে অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে লব্ধ জ্ঞানের পরিপূর্ণতা সাধন করেন। যার ফলে তাঁর সমসাময়িক অন্যান্য চিকিৎসাবিজ্ঞানী এই বিদ্যা আয়ত্ত করার উদ্দেশ্যে তাঁর নিকট আগমন করেন। বলা হয়ে থাকে, ‘যখন চিকিৎসাবিদ্যার অস্তিত্ব ছিল না তখন হিপোক্রেটিস এর সৃষ্টি করেন; যখন এটি প্রায় মরে গিয়েছিল তখন গ্যালেন একে পুনরুজ্জীবিত করেন; যখন এটি বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে তখন আর-রাজি একে সুসংবদ্ধ করেন; তবে এটি ছিল অসম্পূর্ণ, ইবনে সিনা একে পরিপূর্ণতা দান করেন।’ এসময় তিনি রুগীদের চিকিৎসার পাশাপাশি অন্যান্য শাস্ত্র যথা পদার্থবিদ্যা ও অধিবিদ্যা অধ্যয়ন করছিলেন। এ সময় তিনি খুব কম রাতই ঘুমিয়ে কাটিয়েছেন এবং খুব কম দিনই কাটে যাতে তিনি অধ্যয়ন ব্যাতীত অন্য কোনো কাজ করেছেন। আঠারো বছর বয়স পর্যন্ত দিনরাত তিনি লেখাপড়ায়ই ব্যাপৃত থাকতেন। নিদ্রাকর্ষণ যাতে অধ্যয়নে ব্যাঘাত না ঘটায় সে জন্য তিনি নিদ্রা-প্রতিরোধক কিছু পান করতেন। নিদ্রিত অবস্থায়ও তাঁর মনে নানা প্রশ্নের উদয় হতো, এমনকি কোনো কোনো প্রশ্নের সমাধান নিদ্রার মাধ্যমেই হয়ে যেত।
এ সময় তিনি ধর্মতত্ত্ব, বিশেষ করে ¯্রষ্টার পরিচয় বিষয়ে অধ্যয়নে অত্যন্ত আগ্রহী হয়ে পড়েন এবং অ্যারিস্টোটলের ‘মা বাদাত্ তাবিয়ি’ গ্রন্থ অধ্যয়ন করতে শুরু করেন। কিন্তু অ্যারিস্টোটলের ম্যাটাফিজিক্স-এর কিছুই তিনি বুঝতে পারেন না এবং এসব বক্তব্যের মাধ্যমে লেখক কী বলতে চাচ্ছেন তাও তাঁর নিকট সুস্পষ্ট হয় না। ফলে তিনি গ্রন্থটি আবার শুরু থেকে পাঠ করতে আরম্ভ করেন। এভাবে তিনি চল্লিশ বার গ্রন্থটি পাঠ করেন। যার ফলে গ্রন্থটি তাঁর মুখস্ত হয়ে যায়। তথাপি এর বক্তব্য তাঁর নিকট অস্পষ্টই থেকে যায়। অবশেষে একদিন বিকেলে তিনি বইয়ের বাজারের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলেন এমন সময় দেখেন ভ্রাম্যমাণ এক বই বিক্রেতা একটা বই হাতে করে ক্রেতা খুঁজছে। বিক্রেতা বইটি তাঁকে কেনার জন্য অনুরোধ করে। তিনিও বইটি কিনে নিয়ে আসেন। এটি ছিল আবু নাসর আল-ফারাবির ‘এগরাজে মা বাদাত্ তাবিয়ি’। বাড়ি পৌঁছেই তিনি বইটি নিয়ে পড়তে বসে পড়েন এবং এটি পড়তে পড়তেই অ্যারিস্টোটলের ‘মা বাদাত্ তাবিয়ি’র সব বক্তব্য তাঁর নিকট পরিষ্কার হয়ে যায়। কারণ, ‘মা বাদাত্ তাবিয়ি’র প্রতিটি শব্দই হুবহু তাঁর মুখস্ত ছিল। এই ঘটনায় তিনি এতটাই আনন্দিত হন যে, পরদিন তিনি বহু অভাবী লোকদের দান-সদকা করেন। ঘটনাটি ঘটেছিল ৩৮৭ হিজরিতে। এসময় ইবনে সিনার বয়স ছিল ১৭ বছর।
ইবনে সিনার বয়স যখন ১৮ বছর তখন বোখারার শাসনকর্তা নূহ বিন মানসুর এক জটিল রোগে আক্রান্ত হন। বহু চিকিৎসক চিকিৎসা করে তাঁর রোগ নিরাময়ে ব্যর্থ হলে ইবনে সিনার ডাক পড়ে। কারণ, এরই মধ্যে ইবনে সিনার চিকিৎসার খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। তাঁর চিকিৎসায় নূহ বিন মানসুর সুস্থ হয়ে ওঠেন। এতে খুশি হয়ে ইবনে সিনাকে তিনি তাঁর রাজকীয় গ্রন্থাগার ব্যবহারের সুযোগ দেন। এটি ছিল খুব সমৃদ্ধ একটি গ্রন্থাগার এবং শুধু শাহজাদাগণেরই এ গ্রন্থাগারে প্রবেশের অনুমতি ছিল। ইবনে সিনা এই গ্রন্থাগারে এমনসব দুর্লভ গ্রন্থাদি অধ্যয়নের সুযোগ পান সাধারণ মানুষ যেগুলোর নামই জানত না এবং ইবনে সিনারও ইতঃপূর্বে এগুলো দেখার সুযোগ ঘটেনি। এসব গ্রন্থ অধ্যয়নে ইবনে সিনার জ্ঞান-সাধনার প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়।
সময় ভালোই যাচ্ছিল। কিন্তু এরই মধ্যে ইবনে সিনার পিতার ইন্তেকাল ঘটে। এর কিছুদিন পর বোখারার শাসক নূহ বিন মানসুরেরও মৃত্যু হয়। বোখারায় রাজনৈতিক গোলযোগ শুরু হয়। ফলে তিনি খাওয়ারিজমের গোরগাঞ্জ-এর উদ্দেশে বোখারা ত্যাগ করেন। ১০০১ খ্রিস্টাব্দে তিনি খাওয়ারিজম পৌঁছেন। খাওয়ারিজমের শাসনকর্তা আলী ইবনে মামুন তাঁকে সসম্মানে রাজ দরবারে বরণ করেন। এখানে তিনি বেশ কিছুদিন অবস্থান করেন। এখানে তাঁর আবু রায়হান আল বিরুনি, আবু নাসর আল ইরাকি, আবু সাঈদ আবুল খায়ের প্রমুখ প-িত ও সুফির সাথে সাক্ষাৎ ঘটে। আলী ইবনে মামুনের আনুকূল্যে খাওয়ারিজমে অবস্থানকালে তিনি বেশ ক’টি গ্রন্থ রচনা করেন। ইতঃপূর্বে বোখারায় অবস্থানকালেও তিনি বেশ ক’টি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন।
এরই মধ্যে বিশ্বপরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটে। ফলে ইবনে সিনা ১০১৩ খ্রিস্টাব্দে জুরজানের উদ্দেশ্যে গোরগাঞ্জ ত্যাগ করতে বাধ্য হন। উদ্দেশ্য ছিল বন্ধু কাবুস বিন ওয়াশামগিরের সাথে সাক্ষাৎ করা। তিনি খোরাসানের পথে যাত্রা করেছিলেন। বেশ কিছুদিন এ-শহর, ও-শহর ঘোরাঘুরির পর অবশেষে জুরজানে পৌঁছেন। তবে এরই মধ্যে কাবুস বিন ওয়াশামগিরের মৃত্যু ঘটে। জুরজানে তিনি তাঁর এক বন্ধুর আতিথেয়তায় বেশ কিছুদিন অবস্থান করেন। জুরজানে অবস্থানকালে তিনি বেশ ক’টি গ্রন্থ রচনা করেন। এসময় আবু ওবায়েদ জুরজানি তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। জীবনের শেষ পর্যন্ত আবু ওবায়েদ জুরজানি তাঁর সহচর ছিলেন।
১০১৫ খ্রিস্টাব্দে ইবনে সিনা জুরজান থেকে রেই গমন করেন। এখানে তিনি দিলমি বংশীয় শাসনকর্তা মাজদুদ্দৌলার খেদমতে উপস্থিত হন এবং চিকিৎসার মাধ্যমে তাঁকে বিষণœতার জটিল রোগ থেকে সারিয়ে তোলেন। ইবনে সিনা রেই-এ অবস্থানকালেই ১০১৫ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে মাজদুদ্দৌলার ভাই আলে বুইয়ার শাসনকর্তা শামসুদ্দৌলা রেই আক্রমণ করে। এ সময় ইবনে সিনা কাজভিন গমন করেন এবং কাজভিন থেকে হামেদানে চলে যান। হামেদানে তিনি দীর্ঘদিন অবস্থান করেন। এখানে তিনি হামেদানের শাসনকর্তা শামসুদ্দৌলা দিলমির চিকিৎসা করেন এবং তাঁর অনুরোধে মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করেন। ১০২১ খ্রিস্টাব্দে শামসুদ্দৌলার মৃত্যু পর্যন্ত তিনি এই পদে হবাল ছিলেন।এই সময়েই তিনি তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘কানুন’ রচনা করেন এবং ‘শিফা’ গ্রন্থের রচনা শুরু করেন। ইবনে সিনার সুযোগ্য মন্ত্রিত্বের কারণে শামসুদ্দৌলার শাসনকাল ইতিহাসে প্রশংসিত স্থান লাভ করেছে।
শামসুদ্দৌলার মৃত্যুর পর স্বীয় পুত্র সামাউদ্দৌলা তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন এবং তিনি ইবনে সিনাকে তাঁর মন্ত্রিত্বের পদ অব্যাহত রাখার অনুরোধ করেন। কিন্তু ইবনে সিনা রাজকার্যে পূর্ব থেকেই সন্তুষ্টি বোধ করছিলেন না, এই পদ থেকে মুক্তির বাহানা অনুসন্ধান করছিলেন। তাই তিনি গোপনে ইসফাহানের শাসনকর্তা আলাউদ্দৌলা আলে কাকুইয়ার সাথে পত্রযোগাযোগ করেন।
ইবনে সিনা সামাউদ্দৌলার মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করতে অসম্মতি জানালে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় যে, ইসফাহানের শাসনকর্তার সাথে তাঁর পত্রযোগাযোগ রয়েছে এবং এই অভিযোগে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। ৪ মাস তিনি কারারুদ্ধ অবস্থায় কাটান এবং এ সময় তিনি ৩টি গ্রন্থ রচনা করেন। কারামুক্তির পর ইবনে সিনা কিছুদিন হামেদানে অবস্থান করেন। অতঃপর একদল দরবেশের সাথে গোপনে হামেদান থেকে বেরিয়ে পড়েন এবং ইসফাহান অভিমুখে যাত্রা করেন। এ সময় তাঁর ভাই, শিষ্য ওবায়েদ জুরজানি এবং আরো দুজন ব্যক্তি তাঁর সফরসঙ্গী ছিলেন। বহু বন্ধুর পথ পারি দিয়ে অবশেষে তাঁরা ইসফাহান গিয়ে পৌঁছেন। ইসফাহানের শাসনকর্তা আলাউদ্দৌলা তাঁকে উষ্ণ অভ্যর্থনার মাধ্যমে গ্রহণ করেন। আলাউদ্দৌলা ছিলেন মুক্ত চিন্তা ও জ্ঞানী প-িতদের পৃষ্ঠপোষক। যুদ্ধ কিংবা শান্তিকালে, সফর কিংবা রাজধানীতে অবস্থানকালে সর্বদাই তিনি ইবনে সিনাকে তাঁর সাথে রাখতেন। এই শহরে অবস্থানকালেই ইবনে সিনা তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘কিতাবুশ্ শেফা’ রচনা সমাপ্ত করেন। ১০৩৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি যখন আলাউদ্দৌলার সাথে হামেদান সফরে যান এসময় তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। ৪২৮ হিজরির ৪ রমজান মোতাবেক ১০৩৭ খ্রিস্টাব্দের ২১ জুন এই শহরেই তিনি ইন্তেকাল করেন এবং এখানেই তাঁকে সমাহিত করা হয়।
যদিও অল্প বয়সেই ইবনে সিনা জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে গ্রন্থ রচনা শুরু করেছিলেন তবে জুরজান, হামেদান এবং ইসফাহানের শাহী দরবারের পৃষ্ঠপোষকতায়ই তাঁর রচনাশক্তি পূর্ণ পরিণতি পায়। রাজ-মন্ত্রিত্ব গ্রহণের পর যখন তাঁর কর্মব্যস্ত জীবন শুরু হয় তখনো তিনি ভ্রমণ ও প্রবাস অবস্থায়ও নিজের বৃহৎ গ্রন্থসমূহের সারসংক্ষেপ ও বিভিন্ন প্রবন্ধ রচনায় নিবিষ্ট থাকতেন। ফলে তাঁর বিশাল এক রচনাসম্ভার তৈরি হয়। জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে রচিত তাঁর এসব গ্রন্ধের সংখ্যা ৪৫০-এরও অধিক। তবে এগুলোর বেশিরভাগই চিকিৎসা ও দর্শনবিষয়ক। জর্জ সার্টন তাঁর ঐরংঃড়ৎু ড়ভ ঝপরবহপব-গ্রন্থে ইবনে সিনাকে চিকিকৎসাশাস্ত্রের একজন প-িত বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি তাঁকে তাঁর সমসাময়িককালের ইরানের শ্রেষ্ঠ প-িত হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। একই সাথে তাঁকে সর্বযুগের, সর্বস্থানের এবং সর্বজাতির শ্রেষ্ঠ প-িতদের একজন বলে আখ্যায়িত করেছেন।
ইবনে সিনার সমকালে ইরানের প-িতদের বেশিরভাগই তাঁদের মাতৃভাষা ফারসি হওয়া সত্ত্বেও আরবি ভাষায়ই জ্ঞানচর্চা ও গ্রন্থ রচনা করতেন। ইবনে সিনাও তাঁর বেশিরভাগ গ্রন্থই আরবি ভাষায়ই রচনা করেছেন। পরবর্তীকালে কেউ কেউ এগুলো ফারসি ও অন্যান্য ভাষায় অনুবাদ করেছেন। দর্শন, ন্যায়শাস্ত্র ও অধিবিদ্যাবিষয়ক তাঁর গ্রন্থ ‘আশ-শিফা’ অল্প বয়সের রচনা হলেও বেশ ব্যাপক। এটি কয়েকটি খ-ে মুদ্রিত হয়েছে। চিকিৎসাবিজ্ঞান বিষয়ে তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ‘আল-কানুন ফিত্ তিব’ বা সংক্ষেপে ‘আল কানুন’। ‘কানুন’ চিকিৎসাবজ্ঞানের একটি বৃহৎ, ব্যাপক ও উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন রচনা। আবদুর রহমান শারাফকান্দি ‘কানুন ফিত তিব্ব’ ফারসি ভাষায় অনুবাদ করেন। এটি ইউরোপেরও বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়। এ গ্রন্থে ইবনে সিনা প্রাচীনকাল ও তাঁর সমসাময়িককালের চিকিৎসাবিজ্ঞান বিষয়ে লব্ধজ্ঞান অত্যন্ত পরিশ্রমের সাথে সুবিন্যস্ত আকারে লিপিবদ্ধ করেছেন। এ কারণেই এ গ্রন্থ প্রকাশের পর চিকিৎসাবিজ্ঞান বিষয়ে গ্যালেন, রাজি ও আলী ইবনে আব্বাসের রচনাবলির ব্যবহার পরিত্যাক্ত হয়।
ইবনে সিনার সমকালেই জ্ঞান-বিজ্ঞানে তাঁর খ্যাতি এশিয়া থেকে ইউরোপেও পৌঁছে গিয়েছিল। চিকিৎসাবিজ্ঞান বিষয়ক ইবনে সিনার দুটি মৌলিক গ্রন্থ ‘শেফা’ এবং ‘কানুন’ দ্বাদশ শতকেই ইউরোপে চিকিৎসাশাস্ত্রের মৌলিক বিদ্যা হিসেবে অধীত হতো। দ্বাদশ শতক থেকে ষোড়শ শতক পর্যন্ত প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সর্বত্রই চিকিৎসাবিজ্ঞানের তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক অধ্যাপনার বিষয়গুলো মূলত ইবনে সিনার ‘শেফা’ এবং ‘কানুন’-এর ভিত্তিতেই পরিচালিত হতো। অবশ্য ইউরোপীয়রা আবুবকর মোহাম্মদ বিন যাকারিয়া রাজির চিকিৎসাবিষয়ক তত্ত্ব সম্পর্কেও অবহিত ছিল। তবে ইউরোপে তিনি চিকিৎসা-তাত্ত্বিকের চেয়ে চিকিৎসক হিসেবেই অধিকতর গণ্য হতেন। কিন্তু চিকিৎসাবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের কাছে ইবনে সিনার ‘কানুন’ বিকল্পহীন গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হতো। যদিও গ্যালেনের মাধ্যমে প্রাচীন চিকিৎসা পদ্ধতির চরম উন্নতি হয়েছিল তবে ইবনে সিনা গ্যালেনকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন। ‘কানুন’ গ্রন্থে খুঁটিনাটি বিষয়ের আলোচনায় ইবনে সিনা যে সূক্ষ্ম দৃষ্টির পরিচয় দিয়েছেন তার অনুমান এ থেকেই করা যায় যে, তিনি বেদনার পনেরোটি কারণ বর্ণনা করেছেন। চোখের আবরণের প্রদাহ বর্ণনায় তিনি মধ্যস্থিত এবং পার্শ্বস্থ আবরণের মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করেছেন। এ গ্রন্থে তিনি বলেন, ক্ষয়রোগ একটি সংক্রামক ব্যাধি এবং এই রোগের বিস্তারে বাতাস ও পানির প্রভাব অনেক বেশি। চর্মরোগের যথাযথ বর্ণনা দেওয়া ছাড়াও তিনি ধাতুগত পীড়া ও ধাতুগত বিকৃতি, ¯œায়বিক উপসর্গ, এমনকি প্রেমজনিত পীড়া সম্পর্কেও বিশদ আলোচনা করেছেন। তিনি মানসিক ও পীড়াগত তথ্যের নিদান নিরূপণ ও এর বিশ্লেষণও করেছেন। এখান থেকেই মনোবিশ্লেষণ (চংুপযড়-ধহধষুংরং) শুরু হয়। ভেষজ দ্রব্যগুণ বিষয়ে তিনি অষুধসমূহের যথার্থ তত্ত্ব ও ভেষজবিদ্যায় অনুসরণীয় পদ্ধতিসমূহের একটা নক্সাও প্রস্তুত করেছেন।
১১৫০ থেকে ১১৮৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে জারারদ কারমুনায়ি ‘কানুন’-এর সম্পূর্ণ অনুবাদ করেন। ইউরোপে এটি ঈধহহড়হ সবফরপরহধ নামে প্রসিদ্ধ। এ পর্যন্ত এটি প্রায় ৮৭টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এসব অনুবাদের বেশিরভাগই ল্যাটিন ভাষায়। তবে স্পেনিস, ইতালীয় এবং দক্ষিণ ফরাসি ভাষায়ও কিছু অনুবাদ হয়েছে। ইউরোপের প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়েই চিকিৎসাবিজ্ঞান শিক্ষার মূল ভিত্তিই ছিল ইবনে সিনার ‘কানুন ফিত্ তিব’। এ পর্যন্ত ইউরোপের চিকিৎসা বিদ্যালয়গুলোর সবচেয়ে পুরোনো যে পাঠ্যক্রমের সন্ধান পাওয়া গেছে, যেটি ১৩০৯ খ্রিস্টাব্দে পঞ্চম পোপ কালমান্ট-এর মাধ্যমে মনোপলিয়ে চিকিৎসা বিদ্যালয়ের জন্য প্রণীত হয়েছিলো, তাতে ইবনে সিনার ‘কানুন’ গ্রন্থের নাম উল্লেখ পাওয়া যায়। পরবর্তীতে ১৫৫৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সব পাঠ্যক্রমেই এ গ্রন্থের উল্লেখ পাওয়া যায়। এর দশ বছর পর অর্থাৎ ১৫৬৭ খ্রিস্টাব্দে বিখ্যাত গ্রীক চিকিৎসাশাস্ত্রবিদ গ্যালেনাস-এর নাম ইবনে সিনার চেয়ে অধিক প্রাধান্য পায়। তবে সপ্তদশ শতক পর্যন্তই ইবনে সিনার ‘কানুন’ ইউরোপে পাঠ্যভুক্ত ছিল।
জর্জ সার্টন-এর মতে, ইবনে সিনা ছিলেন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ দার্শনিকদের একজন। তেনসি বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিশ্বকোষে ইবনে সিনাকে প্রাক-আধুনিক যুগের সবচেয়ে প্রভাবশালী দার্শনিক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁর দর্শনবিষয়ক বক্তব্যসমূহ পরবর্তী যুগের বিখ্যাত দার্শনিকবৃন্দ, যথা : মোল্লা সাদরা, টমাস অকুইয়ুনাস, ডেকার্ট প্রমুখের ওপর প্রভাব ফেলেছিল। যদিও ইবনে সিনা অ্যারিস্টোটলীয় দর্শনের অনুসারী ছিলেন এবং এ দিক থেকে আল ফারাবি ছিলেন তাঁর এই চিন্তার গুরু। দর্শন বিষয়ে তাঁর আলোচনা-পর্যালোচনার বেশিরভাগই অ্যারিস্টোটলীয় ব্যাখ্যাকারদের মতামতের ভিত্তিতেই লক্ষ করা যায়। অ্যারিস্টোটলের ন্যায় তাঁর সমুদয় রচনার প্রারম্ভও হয়েছে ন্যায়শাস্ত্র হতেই। তবে যতই দিন গড়াতে থাকে তিনি অ্যারিস্টোটলীয় দর্শন-চিন্তা থেকে দূরে সরে যেতে থাকেন এবং প্লেটনিক ও ইসলামের আধ্যাত্মিক দর্শন-চিন্তায় প্রভাবিত হতে থাকেন। তাঁর বিশাল আকারের গ্রন্থ ‘মান্তেকুল মাশরেক্বিন’-এর বক্তব্যসমূহ এর প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত, যেটি তিনি জীবনের শেষ দিকে রচনা করেছিলেন। কিন্তু আফসোসের বিষয় হচ্ছে বর্তমানে এই গ্রন্থটির ভূমিকা অংশ ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।
ইবরাহিম মাকদুর মনে করেন, দর্শনে ইবনে সিনা অ্যারিস্টোটল অপেক্ষা অধিকতর অগ্রসর হয়েছেন। তাঁর দর্শন এক হিসেবে নতুন ন্যায়ের অগ্রদূত। সে কারণেই মুসলিম বিশ্বে ‘সিনুভি দর্শনতত্ত্ব’ বা ‘ইবনে সিনার দর্শনতত্ত্ব’ নামে পৃথক দর্শনতত্ত্বের সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে ইউরোপীয় দর্শনশাস্ত্রেও ইবনে সিনার দর্শনতত্ত্ব স্বীকৃতি পায়। খাজা নাসির উদ্দিন তুসির ‘বিমূর্তন বিশ্বাসতত্ত্ব’ মূলত ইবনে সিনার দর্শনতত্ত্ব থেকেই উদ্ভুত। ইবনে সিনার মতে, মানতিক বা ন্যায়শাস্ত্র হচ্ছে একটি চিন্তামূলক শিল্প। এর কাজ হচ্ছে দার্শনিককে সঠিক সীমা ও সঠিক ধারণা পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া। কারণ, যে কোনো প্রকারের জ্ঞানই হোক না কেন, হয় তা হবে ‘তাসাব্বুর’ বা নিছক ধারণা অথবা হবে ‘তাসদিক্ব’ বা সত্যতা প্রতিপাদন। ‘তাসদিক্ব’-এর মাধ্যম হলো ‘ক্বিয়াস’ বা অনুমান। এটি সঠিকও হতে পারে, আবার বেঠিকও হতে পারে। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় বিষয় হচ্ছে শব্দসমূহের তাৎপর্য নির্ণয়। এ কারণে তিনি সম্বোধনমূলক, বিতর্কমূলক, বিভ্রান্তিমূলক ও কুতর্কমূলক প্রমাণ প্রয়োগ পদ্ধতিসমূহরে ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে শব্দসমূহকে ‘মুফরাদ’ বা মৌল এবং ‘মুরাক্কাব’ বা যৌগ এই দুই শ্রেণিতে বিভক্ত করেছেন।
সত্তা (ইবরহম) ও অস্তিত্ব (ঊীরংঃবহপব) প্রশ্নে ইবনে সিনার অনুরাগ বিশেষ প্রকট। তাঁর মতে সত্তার মৌলিক পরিচয় এর নিজ অস্তিত্ব হতেই প্রতিষ্ঠিত। সত্তার বর্ণনায় কেবল এইটুকু বলাই যথেষ্ট নয় যে, এর নিজ অস্তিত্ব থেকে এটি ভিন্ন নয় অথবা এর অস্তিত্বের সাথে সম্পর্কহীন নয়। এই সম্পর্কহীনতা কল্পনাই করা যায় না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ত্রিভুজের তিনটি কোণের সমষ্টি দুই সমকোণের সমান, এই কথাটি বাস্তবেও সত্য এবং কল্পনাতেও সত্য। সুতরাং ত্রিভুজ হতে এ কথাটিকে বিচ্ছিন্ন করা হলে ত্রিভুজ সম্পর্কে এটি বলা সম্ভব হবে যে, এটি সত্তাজ্ঞাপক ও অস্তিত্বজ্ঞাপক উভয়ই।
ইবনে সিনা বিজ্ঞান ও দর্শনচর্চার পাশাপাশি সাহিত্যচর্চাও করেছেন। আরবি ও ফারসি ভাষায় তাঁর বেশ কিছু কবিতা রয়েছে। বিভিন্ন জীবনীগ্রন্থে ৭২টি ফারসি শের (শ্লোক) ইবনে সিনার রচনা হিসেবে উদ্ধৃত করা হয়েছে। এসব কবিতায় সৃষ্টিজগতের নশ্বরতা ও মানব জাতির অক্ষমতা সম্পর্কে ইবনে সিনার তীর্যক ব্যঙ্গ লক্ষ করা যায়। নমুনা হিসেবে কয়েকটি পঙ্্ক্তির উদ্ধৃতি করা যায় :
بر سرِ خاک باد پیمودم روزکی چند در جهان بودم
جانِ پاکیزه را بیالودم ساعتی لطف و لحظه‌ای در قهر
بی‌خرد را به طمع بستودم باخرد را به طبع، کردم هَجو
و آبِ دیده ازو بیالودم آتشی برافروختم از دل
[বাতাসের ধূলির মাথায় করেছি ভ্রমণ যতদিন ছিলাম এই ভুবন
পরিচ্ছন্ন জীবনকে করেছি দূষণ ক্রোধের ভেতর করুণার সময়-ক্ষণ
লিপ্সায় করেছি মূর্খের তোষণ জ্ঞানীকে করেছি দুর্নামে মুদ্রণ
আর তার অশ্রুজলে করেছি মিশ্রণ হৃদয়ে জ্বেলেছি অগ্নি-দহন]

ইবনে সিনা জ্ঞানচর্চা ও গ্রন্থ রচনার পাশাপাশি আবু ওবায়েদ জুরজানি, আবুল হাসান বাহামানিয়ার, আবু মানসুর তাহের ইসফাহানি, আবু আবদুল্লাহ মোহাম্মদ বিন আহমাদ আল মাসুমি প্রমুখের ন্যায় বেশ কিছু যোগ্য চৈন্তিক উত্তরসূরিও তৈরি করেছিলেন। যাঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন বিজ্ঞ প-িত এবং নিজ নিজ ক্ষেত্রে পা-িত্বের কারণে সমকালেই খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।
ইবনে সিনাকে স্মরণীয় করে রাখার উদ্দেশ্যে ইরানে ইবনে সিনার জন্মদিন ২৩ আগস্ট ‘চিকিৎসক দিবস’ হিসেবে পালিত হয়। এ ছাড়া বিজ্ঞান, দর্শন ও জ্যোতির্বিজ্ঞানে তাঁর অনবদ্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ইবনে সিনার নামে নানা প্রতিষ্ঠান এবং সংগঠনের নামকরণ করা হয়েছে। ‘ইবনে সিনা মুখ’ নামে চাঁদের লুক্কায়িত দিকের একটি মুখের নামকরণ করা হয়েছে। তেহরান, শিরাজ, মাশহাদ, ইসফাহান, ইস্তাম্বুল, হারারে, ফ্রান্সের বুবিনি এবং বাংলাদেশের ঢাকায় ইবনে সিনার নামে হাসপাতাল ও মেডিক্যাল কলেজের নামকরণ করা হয়েছে। নিউইয়র্কে ইবনে সিনার নামে একটি অপারেশন থিয়েটারের নামকরণ করা হয়েছে। পূর্ব ব্রিটেনের সাসেক্সে ইবনে সিনার নামে একটি চাইনিজ মেডিক্যাল কলেজের নামকরণ করা হয়েছে। পাকিস্তানেও ইবনে সিনার নামে একটি মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। হাঙ্গেরীতে ইবনে সিনার নামে একটি ইন্টারন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ রয়েছে। তেহরানে ইবনে সিনার নামে আন্তর্জাতিক বায়োটেকনোলজি জার্নাল প্রকাশিত হচ্ছে। তেহরানে ইবনে সিনা নামে একটি গবেষণাকেন্দ্রও রয়েছে। এ ছাড়া ইবনে সিনা নামে বেশ কটি স্কুল এবং শিক্ষাকেন্দ্রও কাজ করছে।
জার্মানিতে ইবনে সিনার নামে একটি পুরস্কারও প্রবর্তিত হয়েছে। ২০০৫ খ্রিস্টাব্দে ড. ইয়াশার বিলগিন আরো কজন বিজ্ঞজনকে সাথে নিয়ে ফ্রাঙ্কফ্রুট শহরে ‘অভিসিনা প্রেইজ’ (আরপবহহধ-চৎবরং ব. ঠ) নামে একটি জনহিতকর সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংগঠন প্রতিবছর বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর মধ্যে পারস্পরিক সাংস্কৃতিক সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় বিশেষ অবদানের জন্য মূল্যায়নের ভিত্তিতে কোনো ব্যক্তি বা সংস্থাকে ‘ইবনে সিনা পুরস্কার’ প্রদান করে। এই পুরস্কারের মূল্যমান এক লক্ষ ইউরো।
২০০৯ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান বিজ্ঞানের শান্তিপূর্ণ অগ্রগতির নিদর্শনস্বরূপ ভিয়েনায় অবস্থিত জাতিসংঘের দপ্তরে হাখামানশি যুগের স্থাপত্যধারা এবং ইসলামি স্থাপত্যধারার মিশেলে প্রস্তুত একটি চমৎকার ভাস্কর্য উপহার দেন, যেটি এই দপ্তরের মূল প্রবেশদ্বারের ডানপাশে স্থাপন করা হয়েছে। চারদিক-সম্মুখবিশিষ্ট এই ভাস্কর্যে ইরানের বিখ্যাত চার দার্শনিক ওমর খাইয়াম, আবু রায়হান বিরুনি, যাকারিয়া রাজি এবং ইবনে সিনার প্রতিকৃতি বিদ্যমান।

 

 

সম্পাদকীয়

নূরের জন্মোৎসব
يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ إِنَّا أَرْسَلْنَاكَ شَاهِدًا وَمُبَشِّرًا وَنَذِيرًا ﴿٤٥﴾ وَدَاعِيًا إِلَى اللهِ بِإِذْنِهِ وَسِرَاجًا مُّنِيرًا ﴿٤٦﴾
‘হে নবী! অবশ্যই আমি আপনাকে (লোকদের জন্য) সাক্ষী, সুসংবাদদাতা, সতর্ককারী ও আল্লাহ্র অনুমতিক্রমে তাঁর দিকে আহ্বানকারী হিসেবে এবং জ্যোতির্ময় প্রদীপরূপে প্রেরণ করেছি।’ (সূরা আল-আহযাব : ৪৫-৪৬)
এতে সন্দেহের কোনোই অবকাশ নেই যে, কোনো মানুষের পক্ষেই হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর সমুন্নত ব্যক্তিত্বের সকল দিক বর্ণনা করা সম্ভব নয়। কারণ, এ মহান রাসূলের ব্যক্তিত্বের দিকসমূহ বুঝার জন্য মানুষের সক্ষমতা খুবই সীমিত। তাই আমরা আল্লাহ্ রাব্বুল্ ‘আলামীনের নির্বাচিত এ শ্রেষ্ঠতম নবী ও রাসূল সম্পর্কে ইতিহাস থেকে যা জানতে পেরেছি তা কেবলই এ মহান ব্যক্তিত্বের অভ্যন্তরীণ ও প্রকৃত সত্তার একটি ছায়া মাত্র। তবে আমাদের জন্য তাঁর এ পরিচয়টুকুই যথেষ্ট। কারণ, প্রথমত, এ থেকেই আমরা তাঁকে আমাদের জন্য পরিপূর্ণ অনুসরণীয় আদর্শ হিসেবে পাচ্ছি। দ্বিতীয়ত, এর ফলে আমরা রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে কেন্দ্র করে ইসলামি ঐক্যে উপনীত হতে সক্ষম। সুতরাং আমাদের মুসলমানদের জন্য রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ব্যক্তিত্বের বিভিন্ন দিক এবং তাঁর জীবন, সীরাত, চরিত্র ও আচরণ এবং সমুন্নত শিক্ষাসমূহের সাথে গভীরভাবে পরিচিত হওয়া অপরিহার্য।
বস্তুত ইসলামের সবচেয়ে বড় প্রচার এটাই যে, আমরা বিশ^বাসীর সামনে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রকৃত পরিচয় তুলে ধরব, আর এটাই প্রকৃত রাসূলপ্রেমের দাবি। কারণ, তাহলে মানুষের মন রাসূলুল্লাহ্র প্রতি আকৃষ্ট হতে বাধ্য। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই যে, সাম্প্রতিক কালে ইসলামি জাহানে এমন কতক ইফরাতী (উগ্রপন্থী) ফিরকা ও ধারা আত্মপ্রকাশ করেছে যারা আল্লাহর দ্বীন ইসলাম ও রাহ্মাতুল্লিল ‘আলামীন রাসূলুল্লাহ (সা.) সম্পর্কে ভুল পরিচয় তুলে ধরছে এবং ইসলামকে সন্ত্রাসবাদের সমার্থকে পর্যবসিত করেছে; বস্তুত এটাই আজ ইসলাম ও রাসূলুল্লাহর মযলূম হওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ মূলগতভাবেই ইসলাম ও রাসূলুল্লাহর সমুন্নত শিক্ষা ও চারিত্রিক বিধানে ইফরাত (উগ্রপন্থা) ও সন্ত্রাসের, যেমন : আত্মঘাতী হামলা, নিরপরাধ মানুষ হত্যা, শিরñেদ ইত্যাদির ন্যায় নিষ্ঠুরতার কোনো স্থান নেই।
আজকের দিনে মানব প্রজাতি মুক্তি ও সফলতার তীরে উপনীত হওয়ার জন্য ইসলামি সচেতনতা এবং রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ব্যক্তিসত্তার বিভিন্ন দিক, তাঁর চারিত্রিক শিক্ষা, রাষ্ট্রপরিচালনা পদ্ধতি, রাষ্ট্রীয় নীতিমালা, জনকল্যাণ, ইবাদত-বন্দেগি, জিহাদ ও বিশেষ শিক্ষার সাথে পরিচিত হওয়ার জন্য অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি মুখাপেক্ষী। কারণ, বর্তমানে দু’টি পক্ষ থেকে রাসূলুল্লাহ্র প্রতি হামলা চালানো হচ্ছে :
প্রথমত, মাযহাবী উগ্রপন্থার অনুসরণকারীরা – যারা দ্বীন ইসলাম সম্পর্কে অসম্পূর্ণ ও ভ্রান্ত তাৎপর্য গ্রহণ করেছে। দ্বিতীয়ত, বৈশি^ক দাম্ভিক বৃহৎ শক্তিবর্গ – যারা ইসলামি সচেতনতা ও জাগরণ এবং মুসলমানদের ঐক্যকে ভয় পাচ্ছে।
ইসলামি ঐক্য
বস্তুত ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ব হচ্ছে সুন্দরতম পরিভাষাসমূহের অন্যতম। পূর্ববর্তী সমস্ত নবী-রাসূলের (আ.) আদর্শের ধারাবাহিকতায় হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) মানবসমাজকে ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের শিক্ষা উপহার দিয়েছেন। আর এটা অনস্বীকার্য যে, মুসলমানদের জন্য ঐক্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। কারণ, ইসলামের দুশমনরা তাদের বিখ্যাত সর্বজনজ্ঞাত ‘ভাগ কর ও শাসন কর’ ঔপনিবেশিক নীতির ভিত্তিতে সব সময়ই মুসলমানদের মধ্যে অনৈক্য ও বিভক্তি সৃষ্টি করে তা থেকে সুবিধা হাসিল করে আসছে।
বিগত এক শতাব্দী কাল যাবৎ সারা বিশে^র ওলামায়ে ইসলাম ও ইসলামি চিন্তাবিদগণ ইসলামি ঐক্যের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে আসছেন। এটা অনস্বীকার্য যে, মুসলমানদের বিভিন্ন মাযহাব ও ফিরকার মধ্যে আকায়েদের কতক শাখা-প্রশাখা ও কতক ফিকহী বিষয়ে মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও তারা আকায়েদের অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক বিষয়গুলোতে এবং অনেক বেশি ফিকহী বিষয়ে অভিন্নতার অধিকারী। তাই তাঁরা ইসলামের বিপজ্জনক দুশমনদের মোকাবিলায় পরস্পরের প্রতি ভ্রাতৃত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়ে ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপ গ্রহণের চেষ্টা করে আসছেন। আল্লাহ্ তা‘আলা কোরআন মজীদে মুসলমানদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন : وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلا تَفَرَّقُوا – ‘তোমরা দৃঢ়তার সাথে আল্লাহ্র রশি আঁকড়ে ধর এবং বিভক্ত হয়ো না।’ সুতরাং অনস্বীকার্য যে, ইসলামের ঘোরতর দুশমনদের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দেয়ার চাবিকাঠি মুসলমানদের ঐক্য ও দূরদর্শিতার মধ্যে নিহিত। এ বিষয়টি সামনে রেখেই, যেহেতু ১২ ও ১৭ই রবিউল আউয়াল যথাক্রমে সুন্নি ও শিয়া মতে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জন্মদিন সেহেতু ইরানের ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা হযরত ইমাম খোমেইনী (র.) বিপ্লবের বিজয়ের পর পরই যথার্থভাবেই ঈদে মীলাদুন্নবী (সা.) উপলক্ষ্যে ১২ থেকে ১৭ই রবিউল আউয়ালকে ‘ইসলামি ঐক্য সপ্তাহ’ হিসেবে ঘোষণা করেন এবং তখন থেকেই প্রতি বছর বিশে^র মুসলমানরা এ সপ্তাহটি উদ্যাপন করে ইসলামের অন্তর্দৃষ্টির আলোকে নিজেদের মধ্যকার অনৈক্য ও বিভক্তিকে পাশে সরিয়ে রেখে ইসলামের দুশমনদের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দেয়ার চেষ্টা চালিয়ে আসছে।
সবশেষে এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে চাই যে, ইসলামি জাহানের ঐক্যের আহ্বায়নকারী হিসেবে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান মাজ্মা‘এ জাহানীয়ে তাক্বরীবে মাযাহেবে ইসলামি (ইসলামি মাযহাবসমূহের ঘনিষ্ঠতা সৃষ্টিকারী বৈশি^ক সংস্থা)-এর মাধ্যমে প্রতি বছর তেহরানে আন্তর্জাতিক ইসলামি ঐক্য সম্মেলনের আয়োজন করে আসছে – যা সারা বিশে^ ইসলামি মাযহাবসমূহের ওলামা ও চিন্তাবিদগণের বৃহত্তম সমাবেশ।
আমরা হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর মহান জন্মদিন কেন্দ্রিক ঈদে মীলাদুন্নবী ও ইসলামি ঐক্য সপ্তাহ উপলক্ষ্যে এবং একই সাথে আহ্লে বাইতের ধারাবাহিকতার ষষ্ঠ ইমাম হযরত জা‘ফর সাদেক (আ.)-এর জন্মদিন উপলক্ষ্যে বিশে^র মুসলমানদের প্রতি ও বিশেষভাবে নিউজলেটারের পাঠক-পাঠিকাদের প্রতি মোবারকবাদ জানাচ্ছি। আমাদের প্রত্যাশা এই যে, এ মহান সপ্তাহে ইসলামি জাহানের ঐক্য অতীতের চেয়েও অধিকতর সুদৃঢ় হবে এবং আমরা সকলেই যথাযথভাবে আমাদের দ্বীনী দায়িত্ব পালনে সক্ষম হব, ইন শাআল্লাহ।
মোহাম্মাদ রেযা নাফার
বাংলাদেশে নিয়োজিত ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের রাষ্ট্রদূত
সাইয়্যেদ হাসান সেহাত
বাংলাদেশে নিয়োজিত ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের কালচারাল কাউন্সেলর

স্মরণীয় দিবস

 

১ জুলাই : বিশ্ব হস্তশিল্প দিবস।
৩ জুলাই : ১৯৮৮ সালের এ দিনে পারস্য উপসাগরে মার্কিন রণতরী থেকে পরিচালিত ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইরানি এয়ারবাসের তিন শতাধিক যাত্রী শহীদ হন।
৫ জুলাই : বিশ্ব কলম দিবস।
৯ জুলাই : ইরানে শিশু-কিশোর সাহিত্য দিবস হিসেবে পালিত হয়।
১২ জুলাই : ইরানে হিযাব ও সতীত্ব দিবস।
১০ জুলাই : ইমাম তাকী (আ.)-এর শাহাদাত দিবস।
২১ জুলাই : আহলে বাইতের প্রথম ইমাম আলী (আ.) এবং নবীকন্যা হযরত ফাতিমা (আ.)-এর বিবাহ বার্ষিকী। ইরানে দিবসটি বিবাহ দিবস হিসেবে উদযাপিত হয়।
১৭ জুলাই : আহলে বাইতের পঞ্চম ইমাম বাকের (আ.)-এর শাহাদাত দিবস।
১৯ জুলাই : আরাফাত দিবস (৯ যিলহজ)।
*বিশ্ব স্বেচ্ছায় রক্তদান দিবস।
২০ জুলাই : ঈদুল আযহা বা কোরবানির ঈদ।
২৮ জুলাই : ঈদ-ই গাদীর দিবস। বিদায় হজ থেকে ফেরার সময় মহানবী (সা.) ১৮ যিলহজ হাজীদের সমাবেশে ইমাম আলীকে মহানবীর ওফাত পরবর্তীকালে উম্মতের মাওলা ঘোষণা করেন।
৩ আগস্ট : মহানবী (সা.)-এর সাথে খ্রিস্টান পাদ্রিদের মুবাহিলা দিবস।
৫ আগস্ট : ইসলামি মানবাধিকার ও মানবতা দিবস।
৬ আগস্ট : বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুবার্ষিকী।
৮ আগস্ট : ইরানে সাংবাদিক দিবস।
১১ আগস্ট : হিজরি ১৪৪৩ সাল শুরু।
*১৯৮১ সালের ৩০ আগস্ট প্রেসিডেন্ট ভবনে গুপ্তঘাতকের পাতা বোমা বিস্ফোরণে শহীদ হন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মুহাম্মাদ আলী রাজাই ও প্রধানমন্ত্রী হুজ্জাতুল ইসলাম ড. জাভাদ বাহোনার। দিবসটি সন্ত্রাসবিরোধী দিবস হিসেবে পালিত হয়।
১৫ আগস্ট : বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান সপরিবারে নিহত হন।
২০ আগস্ট : পবিত্র আশুরা। ইমাম হোসাইন (আ.)-এর শাহাদাত দিবস।
২১ আগস্ট : ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান কর্তৃক ঘোষিত বিশ্ব মসজিদ দিবস।
*আল্লামা মাজলিসী স্মরণে দিবস।
২৩ আগস্ট : বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক ও বিজ্ঞানী বু-আলী সীনা স্মরণে দিবস; ইরানে এ দিনটি চিকিৎসক দিবস হিসেবে পালিত হয়।
২৭ আগস্ট : বিশ্ববিখ্যাত চিকিৎসাবিজ্ঞানী যাকারিয়া রাযী স্মরণে দিবস; ইরানে এ দিনটি ওষুধ শিল্প দিবস হিসেবে পালিত হয়।
২৯ আগস্ট : বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যুবার্ষিকী।
৪ সেপ্টেম্বর : নবীবংশের চতুর্থ ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.)-এর শাহাদাত দিবস। *বিজ্ঞানী ও দার্শনিক আবু রায়হান বিরুনী স্মরণে দিবস।
১০ সেপ্টেম্বর : আয়াতুল্লাহ তালেকানী (রহ.)-এর ওফাত দিবস।
১৮ সেপ্টেম্বর : ইরানে কবিতা ও ফারসি সাহিত্য দিবস হিসেবে পালিত হয়। কবি সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ হোসাইন শাহরিয়ার স্মরণে দিবস।
২০ সেপ্টেম্বর : বাংলা ভাষার প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক আবুল খায়ের মুসলেহ উদ্দিনের মৃত্যুবার্ষিকী।
২২ সেপ্টেম্বর : ইরাকের সাদ্দাম সরকার এদিনে ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। ইরানের পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধের শুরু।
২৭ সেপ্টেম্বর : বিশ্ব পর্যটন দিবস।
৩০ সেপ্টেম্বর : বিশ্ববিখ্যাত মরমি কবি মওলানা জালালউদ্দিন রূমির জন্মবার্ষিকী।
*ফিলিস্তিনের শিশু-কিশোরদের সাথে সংহতি প্রকাশের জন্য দিবসটি পালিত হয়।

মানবাধিকার : ইসলামি ও পাশ্চাত্যের নিরিখ

মুজতাহিদ ফারুকী

মানবাধিকার নিয়ে কথা বলতে গেলে আমাদেরকে অধিকার কাকে বলে তা বুঝে নিতে হবে। বুঝতে হবে মৌলিক অধিকার এবং মানবাধিকারের মধ্যে পার্থক্য। এরপর আসবে মানবাধিকার ও ইসলামে মানবাধিকারের প্রসঙ্গ। সাধারণভাবে ‘অধিকার’ বলতে কোনো কিছুর উপর একজন মানুষের নৈতিক বা আইনগত দাবি বোঝায়। একজন মানুষ জন্ম নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার খাবারের চাহিদা জন্মায়। এই দাবি বা চাহিদা তার বাবা-মার কাছে, পরিবারের কাছে, সমাজের কাছে এবং রাষ্ট্রের কাছে। এই দাবিটি একেবারেই প্রাথমিক। এটা তার লাগবেই। এমনই আরও কিছু দাবি তার থাকে। সে কোথায় থাকবে, কী পরবে, কী শিখবে ইত্যাদি যৌক্তিক বিষয়গুলো তার পরিবার যেমন মেনে নেয়, তেমনই সমাজ ও রাষ্ট্রও স্বীকার করে। সুতরাং মৌলিক অধিকার হলো নাগরিকদের প্রাথমিক অধিকার যা সংবিধানে লিখিত। এটি হলো মানুষের মৌলিক চাহিদা, যা রাষ্ট্র নিশ্চিত করে।
অন্যদিকে মানবাধিকার হলো সেই সব অধিকার যা সব মানুষের ক্ষেত্রে সর্বজনীনভাবে প্রযোজ্য। যেমন, পৃথিবীর যে প্রান্তেই একজন মানুষ জন্মগ্রহণ করে থাকুক না কেন, তার মর্যাদা হবে অন্য যে কোনও মানুষের সমান। ওই মানুষটি যে ধর্মের, যে জাতির, যে বর্ণের বা লিঙ্গের হোক না কেন তাকে পৃথিবীর সবচেয়ে সমৃদ্ধ, সবচেয়ে শক্তিশালী, সবচেয়ে উন্নত জাতির একজন মানুষেরই সমান মর্যাদা, সম্মান ও সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। এটাই মানবাধিকার এবং এটিও মৌলিক অধিকারের মধ্যেই পড়ে। তবে এই অধিকার নিশ্চিত করে বিশ্বের সব দেশের অংশীদারিত্বে গড়ে ওঠা সবার অভিন্ন প্লাটফর্ম জাতিসংঘ। বুঝতে হবে, মৌলিক অধিকার দেশে দেশে ভিন্ন হতে পারে। কিন্তু মানবাধিকার বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত, সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নীতিমালা যা বিশ্বের প্রতিটি মানুষের জন্য সম মর্যাদার নিশ্চয়তা দেয়। এটি মানব সমাজের সব সদস্যের জন্য সর্বজনীন, সহজাত, হস্তান্তরের অযোগ্য এবং অলঙ্ঘনীয়। বলা হয়, মানবাধিকার প্রতিটি মানুষের এমন এক ধরনের অধিকার যেটা তার জন্মগত ও অবিচ্ছেদ্য। মানুষ এ অধিকার ভোগ করবে এবং চর্চা করবে। এ চর্চার মধ্য দিয়ে অন্যের মানবাধিকার নিশ্চিত হলেই বিশ্বশান্তি নিশ্চিত ও মানবতার কল্যাণ হওয়া সম্ভব। উল্লেখ্য, সদস্য দেশগুলোর নাগরিকদের মানবাধিকার নিশ্চিত করার জন্য জাতিসংঘ কোনও দেশকে নির্দেশ দিতে, এমনকি চাপ প্রয়োগও করতে পারে।
সম্প্রতি বিশ্বজুড়ে মানবাধিকারের বিষয়টি নানা কারণে বহুল আলোচিত। ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার সনদ ঘোষিত হয় এবং এ সনদ কার্যকর করার জন্য মানবাধিকার কমিশন গঠন করা হয়। এই সর্বজনীন ঘোষণাপত্রে যে ৩০টি ধারা সংযোজিত রয়েছে তাতে মানুষের মৌলিক ও আইনগত অধিকার সংরক্ষিত থাকার কথা। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। বরং দেখা গেছে, বিভিন্ন দেশের ক্ষেত্রে ওই নীতিমালার বাস্তবায়ন ভিন্নতর হচ্ছে। ভিন্ন দেশ বা জাতিগোষ্ঠী বা ধর্মীয় জনসমষ্টির ক্ষেত্রে মানবাধিকারের ভিন্ন ব্যাখ্যা দাঁড় করানো হচ্ছে। আর এটি করছে কারা? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে পরে পাশ্চাত্যের যেসব দেশ বিশ্বের মোড়ল হয়ে বসেছে তারাই। তারা নিজেদের স্বার্থে অর্থাৎ রাজনৈতিক সুবিধা লাভের হাতিয়ার হিসাবে মানবাধিকারের প্রসঙ্গটি সামনে আনছে বা ক্ষেত্রবিশেষে পেছনে ঠেলে দিচ্ছে। তার অর্থ হলো বিশ্বের সব মানুষ, সব দেশ, সব ধর্ম, সব জনগোষ্ঠীর মানবাধিকার সমভাবে রক্ষা করা হচ্ছে না বা করতে দেওয়া হচ্ছে না। সমস্যাটা এখানেই।
এ প্রসঙ্গে সাধারণভাবে একজন মুসলমানের মনে আসবে কীভাবে ফিলিস্তিনের মুসলমানদের ওপর অত্যাচার নির্যাতন চলে আসছে গত ৭০ বছর ধরে। তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া তো দূরের কথা, সামান্য নিন্দাটুকুও জানাতে পারেনি জাতিসংঘ। বরং কোনো কোনো পরাশক্তি বিপুল পরিমাণ অর্থনৈতিক, সামরিক এবং কূটনৈতিক সহায়তার মাধ্যমে দেশটিকে তার মানবতাবিরোধী অপরাধ চালিয়ে যেতে সাহায্য করে চলেছে। ধর্ম পালনের অধিকার মানবাধিকার সনদে অন্যতম অধিকার হিসাবে স্বীকৃত, কিন্তু এক্ষেত্রেও বৈষম্য দিন দিন প্রকট হয়ে উঠছে।
জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার সনদকে যেন নির্দিষ্ট কোনো জনগোষ্ঠীর বলে গণ্য করা হচ্ছে। যেমন আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গদের মানবধিকার শত শত বছর ধরে পদে পদে লঙ্ঘিত হয়েছে, এখনও হচ্ছে। কৃষ্ণাঙ্গদেরও জীবনের মূল্য- আমেরিকার সমাজে সেটিই অস্বীকৃত। আর সেজন্যেই এই ২০২০ সালে এসেও তাদেরকে ‘ব্ল্যাক লাইভ ম্যাটারস’ নামে আন্দোলন সংগ্রামে রাজপথে নামতে হয়। মানুষ হিসাবে ন্যূনতম অধিকার লাভের জন্য চিৎকার করে গলায় রক্ত তুলতে হয়। এখন মোটামুটি সবাই জানেন যে, পশ্চিমা দুনিয়ার অন্যায়, একদেশদর্শী ও স্বার্থবাদী আচরণের কারণেই বিশ্বে প্রতিনিয়ত মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, জাতিসংঘের এই মানবাধিকার সনদ নিয়ে বিকল্প ভাবনা-চিন্তা করা জরুরি। সেই ভাবনা-চিন্তারই বাস্তব প্রতিফলন হলো ইসলামি মানবাধিকারের সনদ। ১৯৯০ সালের ৫ আগস্ট ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা বা ওআইসির পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে ইসলামি মানবাধিকার ঘোষণা পাস হয়। এরপর থেকেই প্রতি বছর ৫ আগস্ট মুসলিম দেশগুলোতে ইসলামি মানবাধিকার ও মানবীয় মর্যাদা দিবস হিসেবে পালন করা হচ্ছে। পাশ্চাত্যের বাইরের (অ-পশ্চিমা) দেশগুলোর সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিতে ব্যর্থতার জন্য বিভিন্ন মুসলিম দেশ জাতিসংঘের মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণার (ইউডিএইচআর) সমালোচনা করেছিল। বিশেষ করে ইরানে ইসলামি বিপ্লবের পর ১৯৮১ সালে, জাতিসংঘে ইরানি প্রতিনিধি সাইয়্যেদ রাজাই-খোরাসানি ইউডিএইচআর সম্পর্কে তাঁর দেশের অবস্থান তুলে ধরে বলেন, এটি একটি আপেক্ষিক ‘ইহুদি-খ্রিস্টান ঐতিহ্যের ধর্মনিরপেক্ষ বোঝাপড়ামাত্র’, যা মুসলমানদের পক্ষে ইসলামি আইন লঙ্ঘন না করে নিজেদের সমাজে বাস্তবায়ন করা সম্ভবই না।
মুসলিম দেশগুলোর এই উপলব্ধি থেকেই জাতিসংঘ ঘোষিত সর্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণা ও নির্দিষ্ট দিবস থাকার পরও ইসলামি মানবাধিকার দিবস পালনের যৌক্তিকতা স্পষ্ট হয়ে যায়। এইসব সমালোচনা ও উপলব্ধির বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে ওআইসির সম্মেলনে মানবাধিকারের কায়রো ঘোষণা (সিডিএইচআরআই) প্রণয়ন ও ঘোষণা করা হয় যা পরে ওআইসিভুক্ত মুসলিম দেশগুলো অনুস্বাক্ষর করে।
এ পর্যায়ে আমরা জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার সঙ্গে ইসলামি মানবাধিকার ঘোষণার পার্থক্যটা এক নজরে দেখে নিতে পারি।
জাতিসংঘে নিজেদের কর্তৃত্ব ও আধিপত্য ব্যবহার করে পাশ্চাত্যের দেশগুলো সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণায় নিজেদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করেছে। ৩০ ধারাবিশিষ্ট জাতিসংঘের মানবাধিকার ঘোষণার মূল ভিত্তি হলো পশ্চিমা লিবারেলিজম বা উদার নৈতিকতাবাদ। এ ঘোষণায় মুসলমানসহ অনেক জনগোষ্ঠীর ধর্মবিশ্বাস, সংস্কৃতি ও বাস্তবতা উপেক্ষিত হয়েছে। জাতিসংঘ মানবাধিকার ঘোষণার বেশ কিছু দিক গ্রহণযোগ্য হলেও এর অনেক ধারাই ইসলামি বিশ্বাস ও মূল্যবোধের সঙ্গে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক।
অন্যদিকে ইসলামে মানবাধিকারের বিষয়টি অত্যন্ত কঠোরভাবে ধর্মীয় বাধ্যবাধকতার আওতাভুক্ত। এর অর্থ হলো, কেউ যদি মানবাধিকার লঙ্ঘন করে তাহলে তার ঈমান রক্ষা করাই কঠিন হয়ে যায়। ঈমানদারি ঠিক রাখতে হলে মানবাধিকারের নীতি সমুন্নত রাখতে হবে। সুতরাং ইসলামে মানবাধিকারের ধারণা নিছক একটি ঘোষণার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং তা প্রতিপালন করা প্রতিটি মুসলমানের ঈমানী দায়িত্ব।
জাতিসংঘের মানবাধিকার ঘোষণায় যে বিষয়গুলো উপেক্ষিত হয়েছে, ইসলামি মানবাধিকার ঘোষণার ২৫টি ধারায় সেগুলো গুরুত্বের সঙ্গে স্থান পেয়েছে। মানবীয় মর্যাদা, নীতি-নৈতিকতা ও মানুষের আধ্যাত্মিক চাহিদার বিষয়গুলো ইসলামি মানবাধিকার ঘোষণায় গুরুত্ব পেয়েছে। এতে গোটা মানবজাতিকে একটি পরিবারের অংশ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ, সব মানুষই আল্লাহর দাস ও আদমের সন্তান। তাই ধর্ম,বর্ণ, গোত্র, জাতি ও সমাজের ভিত্তিতে মানুষের মধ্যে বৈষম্যের কোনো অবকাশ নেই। সেই মানুষই শ্রেষ্ঠত্বের দাবি করতে পারে যে সবচেয়ে বেশি ন্যায়নিষ্ঠ বা তাকওয়াসম্পন্ন। ইসলামি মানবাধিকার ঘোষণায় আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো দাসত্ব করতে নিষেধ করা হয়েছে। এটিই হলো মানুষের প্রকৃত স্বাধীনতার ভিত্তি। ইসলামি মানবাধিকার ঘোষণায় আধ্যাত্মিকতা ও পার্থিব বিষয়গুলো পরস্পরের সাথে সম্পর্কিত বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
ইসলাম মানবাধিকারের সীমা এত প্রশস্ত করেছে যে, মানুষের পুরো জীবন এর আওতায় পড়ে। পিতা-মাতার হক, সন্তানের হক, স্বামী-স্ত্রীর হক, নারীর অধিকার, বন্ধু-বান্ধবের হক, শ্রমিক-মালিক এবং শাসক ও জনগণের হক, সরকারের হক, শ্রমজীবী মানুষদের হক, দুর্বল ও অসহায়দের হক, এতিম-মিসকিনের হক, সাধারণ মুসলমানের হক, সাধারণ মানুষের হক ইত্যাদি ব্যক্তি, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীক ও আন্তর্জাতিক যাবতীয় বিষয় ইসলামের মানবাধিকারের অনুষঙ্গ।
ইসলামি মানবাধিকার ঘোষণার ষষ্ঠ ধারায় নারী-পুরুষের সাম্যের কথা স্থান পেয়েছে। নারী ও পুরুষের যেমন আলাদা আলাদা কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে, তেমনি আলাদা আলাদা কিছু অধিকারও রয়েছে। নাগরিক অধিকার ছাড়াও তাদের রয়েছে স্বাধীনভাবে সম্পদ অর্জনের অধিকার। নারী ও পুরুষের শারীরিক ও চাহিদাগত পার্থক্যের কারণে তাদের দায়িত্ব ও অধিকারেও কিছু পার্থক্য রয়েছে বলে ইসলাম মনে করে, কিন্তু এসব পার্থক্যের অর্থ বৈষম্য নয়। সামাজিক অগ্রগতি ও সুষ্ঠুতার স্বার্থে প্রয়োজনীয় বিবেচনায় ঐশী নির্দেশনার (কুরআন ও সুন্নাহ) প্রেক্ষিতেই এটা করা হয়েছে।
ইসলামি মানবাধিকার ঘোষণার ২২ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, প্রত্যেক ব্যক্তিই তার মতামত প্রকাশের ব্যাপারে স্বাধীন, তবে তা ধর্মবিরোধী হওয়া চলবে না। ইসলামের দৃষ্টিতে বাক-স্বাধীনতা লাগামহীন নয়। বাক-স্বাধীনতার নামে অন্যদের ধর্মীয় চিন্তাধারা ও পবিত্র বিষয়গুলোর অবমাননা করার কোনো অধিকার কারো নেই। দুঃখজনকভাবে পশ্চিমা সরকার ও গণমাধ্যমগুলো এক্ষেত্রে স্বাধীনতার অপব্যবহার করছে এবং তারা এ পর্যন্ত ইসলামের পবিত্র বিষয়গুলোর যারপরনাই অবমাননা করেছে। তাই ইসলামি মানবাধিকার ঘোষণায় বলা হয়েছে, ‘ধর্মীয় পবিত্র বিষয় এবং নবী-রাসূলদের মর্যাদার প্রতি আঘাত কিংবা মূল্যবোধের ক্ষেত্রে ব্যাঘাত ও সমাজে বিভেদ সৃষ্টিকারী বা ঐশী বিশ্বাসের প্রতি অবমাননাকর যে কোনো ধরনের পদক্ষেপ নিষিদ্ধ।’
ইসলামি মানবাধিকার ঘোষণায় উপনিবেশবাদ ও সা¤্রাজ্যবাদ নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে লড়াইকে ন্যায্য অধিকার বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। পাশ্চাত্যের দেশগুলো সা¤্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইকে সন্ত্রাসবাদ হিসেবে অভিহিত করে। ইসলামি মানবাধিকার ঘোষণায় স্বৈরাচার ও ক্ষমতার অপব্যবহারকেও কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ইসলাম অমুসলিমদেরকে যথাযথ নিরাপত্তা ও অধিকার, শিক্ষার অধিকার, মান-সম্মানের অধিকার, পরিবার গঠনের অধিকারসহ সব রকমের অধিকার নিশ্চিত করেছে।
পাশ্চাত্য ও ইসলামের মানবাধিকার সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা নেওয়ার পর এখন আমরা বাস্তব উপলব্ধির সঙ্গে বিশ্ব বাস্তবতার প্রেক্ষিত বিবেচনায় বিষয়টি বিশ্লেষণ করতে পারি। বিষয়টি আমরা দেখতে পারি ইরানি চিন্তাবিদ হুজ্জাতুল ইসলাম মুহাম্মাদ জাভাদ হুজ্জাতি কিরমানির চিন্তাধারার আলোকে। তাঁর ‘ইসলাম ও পাশ্চাত্যের মানবাধিকারের ধারণায় মিল-অমিল’ শীর্ষক প্রবন্ধে এ বিষয়ে একটি সুনিশ্চিত নির্দেশনা পাওয়া যায় যা আমাদের বিবেচনায় অত্যন্ত সময়োপযোগী এবং বাস্তবানুগ।
‘তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই সর্বোত্তম যে সবচেয়ে ন্যায়নিষ্ঠ।’ পবিত্র কুরআনের এই বাণী উদ্ধৃত করে কিরমানি বলছেন, সর্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণার মুখবন্ধে প্রতিটি মানুষের সহজাত গুণাবলির স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। আমাদের মনে হয় যে, এই ঘোষণা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কুরআনের মাধ্যমে প্রভাবিত অথবা অন্ততপক্ষে উভয়টিই পরম কার্যকারণ এবং মানবিক প্রজ্ঞার ধারণার সঙ্গে সাজুয্যপূর্ণ। উভয়ের মধ্যে সবচেয়ে বড় পার্থক্য শুধু এটুকু যে, একটির উদ্ভব সরাসরি ঐশ্বরিক প্রত্যাদেশ থেকে আরেকটি কিছু মধ্যবর্তী উপাদানের ভেতর দিয়ে প্রত্যাদেশের সঙ্গে সম্পর্কিত।
ইসলামে মানবাধিকার বা ইনসানিয়াত এবং পাশ্চাত্যের মানবাধিকারের ঘোষণা পাশাপাশি রেখে বিচার বিবেচনা করার সুযোগ আছে। সেটা যে কেউ করতে পারেন। তবে আমরা এ বিষয়ে ইরানি স্কলার হুজ্জাতুল ইসলাম মুহাম্মাদ জাভাদ কিরমানির দৃষ্টিভঙ্গি বিশেষভাবে অনুধাবনযোগ্য মনে করি। ইসলামি বিপ্লবের পর ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেইনীর নির্দেশনা অনুযায়ী দেশটি বিভিন্ন ধর্ম বিশেষ করে ইসলাম, ইহুদি ও খ্রিস্টধর্মের প-িতদের নিয়ে আন্তঃধর্ম সংলাপ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আসছে। কিরমানির মানবাধিকার বিষয়ক এক প্রবন্ধে সেই পরিপ্রেক্ষিতটি ধরা পড়ে। তিনি সর্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণা এবং ইসলামি মানবাধিকারের তুলনা করতে গিয়ে বলছেন, ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ অবসানের পর গৃহীত সর্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণায় পরিবারকে একক সত্তা হিসাবে গ্রহণের বিষয়টি ওই সময়ের জনমানস এবং একটি আদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন। মানুষের অস্তিত্বের বাস্তবতার ভিত্তিতেই তার ঐক্যের বিষয়টি স্বীকার করে নেওয়া হয়। এক্ষেত্রে আমরা ইসলামি ও পাশ্চাত্যের মানবাধিকার ব্যবস্থার মধ্যে সাজুয্য খুঁজে পাই। ইসলামেও পরিবারকে অভিন্ন লাভ-ক্ষতির শরিক একটি একক সত্তা হিসাবে দেখা হয়। ইসলাম ও পাশ্চাত্যের মানবাধিকারের ধারণার আরেকটি অভিন্ন উপাদান হলো মানুষের প্রকৃতিগত মূল্য ও তার প্রতি শ্রদ্ধা।’
জাভাদ কিরমানি উভয় ঘোষণার মধ্যে যেসব সামঞ্জস্য রয়েছে সেগুলোর উল্লেখ করে বলেন, ‘স্বাধীনতা বলতে আমরা সাধারণভাবে মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণায় বর্ণিত স্বাধীনতাই বুঝি যেখানে মানুষকে জন্মগতভাবে স্বাধীন বলা হয়েছে এবং সব ধরনের দাসত্ব নিষিদ্ধ করা হয়েছে। প্রতিটি মানুষের স্বাধীন ও নিরাপত্তার সঙ্গে বাঁচার অধিকার দেওয়া হয়েছে।… মানুষের দায়িত্ববোধের জন্ম হয় তার স্বাধীনতার চেতনা থেকে। মানুষ স্বভাবগতভাবেই মুক্ত সত্তা। বিজ্ঞ বলেই সে তার ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে সংযম রক্ষা করে চলার বিষয়টিকে বুদ্ধি ও প্রজ্ঞার পরিচায়ক বলে মনে করে। সংযমের এই যৌক্তিক প্রয়াস আরও বিশুদ্ধ ও প্রকৃত রূপ লাভ করে অধ্যাত্মবাদ ও ঐশী প্রত্যাদেশের আলোকধারায়।’
ইসলামি ও পাশ্চাত্যের মানবাধিকারের ধারণার মধ্যে কোনও পার্থক্য থাকলে সেটা আছে স্বাধীনতার মাত্রা নির্ধারণের ক্ষেত্রে। সেটা স্বাধীনতার যৌক্তিকতা ও মৌলিক ভিত্তির কোনও ব্যত্যয় ঘটায় না।
অন্য কথায়, মানবাধিকারের উভয় ধারণাই মানুষের জন্মগত স্বাধীনতার ওপর কিছু সীমারেখা টেনে দেয়। খোদায়ী বিধানে যৌন স্বাধীনতার ওপর যে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়, ভোগবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে তেমন নিয়ন্ত্রণ অনেক কম। তার পরও পাশ্চাত্যের ভোগবাদী আদর্শেও যৌন স্বাধীনতা সীমিত করা হয়েছে, যেমন ধর্ষণ এবং প্রকাশ্য যৌনাচার নিষিদ্ধ। তার মানে হলো, সবচেয়ে মুক্ত সমাজের ক্ষেত্রেও মানুষের যুক্তিশীলতা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েনি, সেখানেও খুব সামান্য হলেও স্বাধীনতার ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে।
জাভাদ কিরমানি তাঁর প্রবন্ধে বলেন, বস্তুতপক্ষে ন্যায়বিচার বলবৎ করা এবং অবিচার দূর করার আকাক্সক্ষার উদাহরণ যা ইসলামি ও পাশ্চাত্যের মানবাধিকারের ধারণায় খুবই জোরালো এবং সংহতরূপে রয়েছে, সেটি উভয়ের মধ্যে আরেকটি সংযোগসূত্র। প্রকৃতপক্ষে ন্যায়বিচারের ধারণাই গোটা বিশ্বকে স্থিতিশীল করেছে। তিনি উভয় ঘোষণার মধ্যে বিদ্যমান অসামঞ্জস্যগুলোও চিহ্নিত করেন। তবে আহ্বান জানান, সবাইকে নিজ নিজ আদর্শে অবিচল থেকেও একটি সমঝোতার জায়গায় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়ানো যায় কিনা সেই বিষয়ে প্রয়াসী হওয়ার। কারণ, বিশ্ববাসী এখনও বিভিন্ন ধর্ম তথা মানবজাতির বিভিন্ন আদর্শের কাছেই শান্তির প্রত্যাশা করে।

আশুরা কোরবানির মরমি ব্যাখ্যা

সংকলন : ড. এম আব্দুল কুদ্দুস বাদশা

মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর প্রিয় দৌহিত্র, মা ফাতিমাতুয যাহরা ও শেরে খোদা হযরত আলী (আ.)-এর কলিজার টুকরা, বেহেশতের সর্দার হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) ৬১ হিজরির দশই মুহররম কারবালার প্রান্তরে নির্মমভাবে শাহাদাতবরণ করেন। অভিশপ্ত ইয়াযিদ ইবনে মুয়াবিয়ার হুকুমে নামধারী মুসলমানদের হাতে তিনদিনের দানাপানিবিহীন ক্ষুধার্ত ও পিপাসার্ত অবস্থায় ইমাম হোসাইন (আ.)-এর সপরিবারে কোরবানি হওয়ার বেদনায় যে কোনো মানুষের হৃদয় কেঁদে ওঠে। কিন্তু এ ক্রন্দন কি শুধুই একটি মানবিক অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ যা অন্য সব মানুষের ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হয়? নাকি আশুরা কোরবানির আলাদা কোনো মহিমা রয়েছে, যা জাগতিক ও মানবিক স্তরকে অতিক্রম করে যায় এবং আধ্যাত্মিক ও ঐশ্বরিক স্তরে গিয়ে পৌঁছে? আল-কোরআনে যাকে ‘যিব্হ-ই আযীম’ তথা মহাকোরবানি হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। নিশ্চয় যারা আশুরার শোকাবহ অনুভূতিকে অস্বীকার করতে চায় তারা নিজেদের চিন্তা ও বিশ্বাসকে জাগতিকতার ঊর্ধ্বে উত্তরণ ঘটাতে সক্ষম হয়নি। যে ইমাম হোসাইন (আ.) তাঁর বিখ্যাত দোয়া-ই আরাফা’র মধ্যে ঘোষণা করেছেন : ‘হে আমার রব! যে তোমাকে পেয়েছে সে কী হারিয়েছে? আর যে তোমাকে হারিয়েছে সে কী পেয়েছে?’ সেই ইমামের এই মহান কোরবানি যে জাগতিক ও মানবিকতাকে ছাড়িয়ে যাবে এটাই স্বাভাবিক। তাই এ প্রবন্ধে আশুরার দিনে সাইয়্যেদুশ শুহাদা ইমাম হোসাইন (আ.)-এর মহান কোরবানির একটি মরমি তথা আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা উপস্থাপনের প্রয়াস চালানো হয়েছে।
মরমিবাদী আরেফগণ ইমাম হোসাইন (আ.)-কে একজন ইনসানে কামেল তথা পূর্ণাত্মা মানবের উৎকৃষ্ট উদাহরণ হিসাবে মনে করে থাকেন। একারণে তাঁদের নিকট ইমাম হোসাইন (আ.)-এর মর্যাদা নিছক একজন ইমাম তথা সমাজের নেতার পর্যায় থেকে অতিক্রম করে অনেক ঊর্ধ্বে চলে যায়। কেননা, একজন ইমাম যদি রাজনৈতিক প্রেক্ষিত থেকে মুসলমানদের বিষয়াদি পরিচালনা করার দায়িত্ব পালন করে থাকেন, তবে একজন ইনসানে কামেল এর দায়বদ্ধতা গোটা বিশ্বজাহানের কাছে। অন্যভাষায় বলা যায়, ইনসানে কামেল হচ্ছেন জমিনে আল্লাহর খলীফা তথা প্রতিনিধি। তিনি যদি নিশ্চিহ্ন হয়ে যান, তার অর্থ হলো গোটা বিশ্ব জাহান ও জীবনের শৃঙ্খলা ভেঙ্গে পড়া। একারণে মরমিবাদী আরেফগণ আশুরার ঘটনাকে এমন একটি ঘটনা হিসাবে বিবেচনা করেন যেখানে একজন ইনসানে কামেল উপস্থিত ছিলেন। আরেফগণের শুহুদী দৃষ্টিতে নিশ্চয় এ কোরবানির চেহারা ধরা পড়বে এক অনবদ্য আধ্যাত্মিক পরিমাত্রায়, ঐশ্বরিক সুবাসে।
আশুরার প্রতি ইরফানি দৃষ্টিভঙ্গিতে ইরফানের মাকাম তথা স্তরসমূহও বিবেচনায় নেওয়া হয়। এই দৃশ্যপটে আশুরার প্রত্যেক শহীদ একদিকে যেমন এক একটি ইরফানি উপাদান, আবার একই সাথে এক একটি ইরফানি সিম্বল তথা প্রতীকও বটে। এভাবে আশুরায় যে ইরফানি সেইর ও সুলুক সংঘটিত হয়েছে তার কোনোটাই দৃষ্টি থেকে বাদ পড়ে না। স্বয়ং ইমাম হোসাইন (আ.) ছিলেন ইরফানের কুতুব তথা মূল অক্ষ। আর অবশিষ্ট মহান শহীদগণও অন্যান্য ভূমিকায় আবির্ভূত হয়েছেন। উল্লেখ্য, সব মরমি সাধকই যে এ ব্যাপারে একই দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন, সেটা বলা যায় না। কিংবা সে বিষয়ে আলোচনা করাও এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। বরং বিখ্যাত মরমি কবি হাকিম সানায়ী গাযনাভী’র কাব্যের আলোকে শীর্ষ আরেফগণের দৃষ্টিভঙ্গিই তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।
হাকিম আবদুল মাজদ মাজদুদ বিন আদাম সানায়ী গাযনাভী (১০৮০-১১৪১ খ্রি.) রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর আহলে বাইতের প্রতি আন্তরিক ভালোবাসা পোষণ করতেন। তিনি আহলে বাইতের প্রতি এই ভালোবাসা আর বনি উমাইয়্যার প্রতি ঘৃণার মাধ্যমে নাজাতের আশা রাখতেন। আলী (আ.)-এর প্রতি ও তাঁর দুই পুত্র ইমাম হাসান ও ইমাম হোসাইনের প্রতি ভক্তি এবং ভালোবাসার মাধ্যমে তিনি বেহেশতে প্রবেশ করার তাওফিক কামনা করতেন :
আমি দুইটা কারণকে আশায় রাখি
যদিও আমি গোনাহগার পাপী
এই দুই কারণে পেতে পারি নাজাত
যা থেকে বে-খবর সবে ইয়া রব!
একটি হলো আলে রাসূলের ভালোবাসা
ঐ সিংহপুরুষের, যিনি বাতুলের জোড়া
অপরটি হলো আলে বু-সুফিয়ানের ঘৃণা
যারা ছিল আলে মুহাম্মাদের শত্রু সর্বদা
আশা, এই দুই উসিলাই দেবে নাজাত আমায়
আর জাহান্নাম থেকে আমাকে দেবে রেহাই
রোজ হাশরের দিনে এটুকুই সম্বল আমার
আশা করা যায় এটাই হবে দ্বীনের বিচার।
উপরিউক্ত বয়েতগুলোতে ‘তাওয়াল্লা’ এবং ‘তাবাররা’- এই দুইটি মূলনীতির কথা বলা হয়েছে। তাওয়াল্লা হচ্ছে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর প্রতি। আর তাবাররা হচ্ছ ইয়াযিদ ও সমস্ত বনি উমাইয়্যা হতে। উপরন্তু ইমাম হাসান ও ইমাম হোসাইনের প্রতি ভালোবাসা নাজাতের কারণ এবং খোদায়ী বেহেশতে প্রবেশের উসিলা হবে বলে আশা প্রকাশ।
আট বেহেশতকে কখনো কি সন্ধান পাবে কোথাও
যদি না থাকে মহব্বত আলীর, শাব্বিরের ও শুবাইরের।
সানায়ী গাযনাভী বিশ্বাস করতেন যে, হাসানাইন (আ.)-এর সম্পর্কে কথা বলতে গেলে আগে হোসাইনী হাল, চরিত্র ও স্বভাবের অধিকারী হতে হবে। একারণে তিনি মনে করতেন, যে ব্যক্তি আহলে বাইতের অনুসারী বলে দাবি করে, তাকে সবদিক থেকে পুণ্যময় চরিত্র দ্বারা চরিত্রবান হওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে :
তুমি ঈমানের দাবি করবে আর নাফ্্সের নির্দেশ মেনে চলবে?
বাইয়াত করবে আলীর সাথে আর হাসানকে বিষ পান করাবে?
সানায়ী ইয়াযিদ ও তার লোক-লস্করের প্রতি এতটাই ঘৃণা পোষণ করতেন যে, ইয়াযিদের হাতে বাইয়াতকারীদেরকে আরেক ইয়াযিদ বলে আখ্যায়িত করেন। নতুবা কোনো সুস্থ-বিবেকের মানুষ ইয়াযিদের সাথে বাইয়াত করতে রাজি হতে পারে না, আর মুমিন মানুষের তো প্রশ্নই আসে না। ইয়াযিদ ও শিমারের প্রতি তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীতে ইমাম হোসাইন (আ.)-কে তিনি ‘শহীদদের স¤্রাট’ বলে মনে করেন।
গোটা দুনিয়ার সবখানে ভরা কত শহীদে
কিন্তু কারবালার হোসাইনের ন্যায় শহীদ তুমি পাবে কোথায়?
সানায়ী’র দৃষ্টিকোণ থেকে আশুরা বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার কারণ ছিল এটা যে, একদল দুনিয়ালিপ্সু লোকের ইমাম হোসাইন (আ.)-এর ন্যায় অপার্থিব ব্যক্তিত্বকে সহ্য করার সামর্থ্য ছিল না। বাদুড় যেমন দিনের আলোয় চলতে পারে না বলে সূর্যের আলোকে এড়িয়ে রাতের আঁধারে বের হয়, জুলুমপূজারী জালেমরাও তদ্রƒপ তাদের চলার পথে বাধা হিসাবে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর সূর্যের ন্যায় আলোকোজ্জ্বল অস্তিত্বকে সরিয়ে ফেলতে তৎপর হয়ে ওঠে। এই অন্ধকারে বিচরণকারী দলটি শুধু যে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর সাথে এরূপ আচরণ করেছে, তা নয়; বরং এর আগে তাঁর মহান পিতার সাথেও একই আচরণ করেছে। আমিরুল মুমিনীন আলী (আ.)-এর সাথে তাদের বিরোধিতার পেছনেও মূল দর্শন ছিল এটাই। আর আলী (আ.)ও যে তাদের বিরুদ্ধে তলোয়ার ধরতেন, সেটাও ছিল এই কারণে। কেননা, শেরে খোদার প্রত্যেকটি তলোয়ার আঘাত যা নিশাচরীদের মস্তকের উপর নেমে আসত, উদ্দেশ্য ছিল যাতে খোদায়ী নূরের পরিধি আরও বিস্তৃত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে এবং মানুষ সে আলো থেকে উপকৃত হতে সক্ষম হয়।
তারা যেহেতু জাহেলি যুগে এবং হযরত আলী (আ.)-এর খেলাফতের আমলে তাঁর থেকে বিষাক্ত আঘাতে জর্জরিত হয়েছিল, একারণে ৬১ হিজরিতে এর বদলা গ্রহণে উদ্যত হয়, যাতে ঐসমস্ত পরাজয়ের আংশিক উসূল করতে পারে। আর হোসাইন (আ.) ও তাঁর পরিবার-পরিজনদের প্রতি গালি ও অভিসম্পাত বর্ষণের মাধ্যমে মাওলা আলীকে খাটো করতে পারে। সুতরাং ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কতলের রহস্য খুঁজতে হবে ইয়াযিদী জাহেল ও জুলুমপূজারীদের সেই সব পরাজয়ের মধ্যে যেগুলো তারা শেরে খোদার জুলফিকারের মাধ্যমে পরাজিত হয়েছিল। সানায়ী এরূপ ইরফানি দৃষ্টিকোণ থেকেই ইয়াযিদ ও তার লোক-লস্করকে লানতের ও অভিসম্পাতের পাত্র হিসাবে গণ্য করেন এবং তাদেরকে নিন্দা ও সমালোচনা করা মানুষের জন্য ইহকাল ও পরকালে সম্মান ও মুক্তির উসিলা বলে মনে করেন :
যে কেউ ঐ কুকুরগুলোর নিন্দাবাদ জানাবে
জেনে রাখ, সে বাদশাহি পাবে পরলোকে।
মরমি আরেফ সানাযী প্রকাশ্যে ও নির্দ্বিধায় ইয়াযিদ ও শিমারের প্রতি লানত বর্ষণ করেন এবং তাদেরকে চিরকালীন অভিশপ্ত হিসাবে গণ্য করেন। তিনি তাঁর ‘লোগাতনামা’র মধ্যে জল্লাদদের একজন একজন করে নাম উল্লেখ করেছেন এবং তাদের উপর লানত বর্ষণ করেছেন। তাদের কৃতকর্মকে অত্যন্ত লজ্জাজনক আখ্যায়িত করে তাদেরকে নিন্দাবাদ জানিয়েছেন এবং প্রত্যাখ্যাত বলে ঘোষণা দিয়েছেন :
কারবালা যখন করল মাকাম ও মঞ্জিল নির্মাণ
সহসাই ইবনে যিয়াদ সেথা হানল আক্রমণ
দেহ থেকে মস্তকগুলো কাটল খঞ্জরে
বড় ফায়দার লোভ ছিল তাদের এই কর্মে
পিপাসিত আলী আসগর তাকেও করে না রহম
আর ঐ কুকুরেরা মেনে নেয় এই নিদারুন জুলুম।
সানায়ী গাযনাভী কোথাও কোথাও ইয়াযিদ ও তার লোক-লস্করকে সামুদ গোত্রের সাথে তুলনা করেছেন। তিনি ব্যাখ্যা দিয়েছেন যে, তারাও ঠিক সেই কাজগুলোই করেছে যা সামুদ গোত্র করেছিল :
আমর বিন আস ও ইয়াযিদ ও ইবনে যিয়াদ
ঠিক যেন সেই গোত্র সামুদ, সালেহ ও আদ।
সত্য থেকে বিচ্যুত হয়ে অস্বীকার আর অস্বীকার
জুলুম আর অন্যায় করাই তাদের যত অঙ্গীকার।
অবিচার করায় একবারও করল না বিবেচন
মুস্তাফা ও মূর্তজার কথা করল না স্মরণ।
বুল-হাকামকে গ্রহণ করল, না আহমদ
নিজের কৃতকর্মে করল দোযখকে খরিদ।
অবশ্য মানুষের মধ্যে এমনও অনেকে রয়েছে যাদের অন্তর নিরেট কালো হওয়ার কারণে এবং আল্লাহর মারেফত না থাকার কারণে ইরফানের স্বাদই আস্বাদন করতে পারেনি। এরা দুনিয়ার মূল্যে নিজেকে বিক্রি করে দেয় এবং ইয়াযিদদের কাতারে দাঁড়ায়। যে কেউ ইমাম হোসাইন (আ.)-এর রক্ত ঝরাবার কাজে রাজি থাকবে, অবশ সে পুণ্যবানদের ও আরেফগণের পক্ষ থেকে লানত ও অভিসম্পাত পাওয়ার যোগ্য হবে। অতএব, যে ব্যক্তি ইয়াযিদ ও আমর বিন আসের ন্যায় পাপিষ্ঠ লোকদের অনুসরণ করবে এবং এ নিয়ে গর্ব করবে, নিশ্চিতভাবে সে কেবল দুনিয়াতেই যে শুধু পুণ্যবানদের দোয়া-খায়ের থেকে বঞ্চিত হবে, তা নয়; বরং দুনিয়া এবং আখেরাতে তাদের বদদোয়া ও লানতের ভাগীদার হবে :
তুমি যে বল ইয়াযিদ আমার আমীর
আর পাপিষ্ঠ আমরে আস আমার পীর
তবে জেন পাপিষ্ঠ ইয়াযিদ হয় যার আমীর
কিংবা আমর বিন আস হয় যার পীর
আযাব ও লানত পাওনা হবে তার
সে তো নরাধম এক পাপিষ্ঠ বে-দ্বীন।
শুধু যে ইয়াযিদ ও তার দোসররা দুনিয়া ও আখেরাতে আল্লাহর আযাব ও আউলিয়াগণের লানতের পাত্র হবে, তা নয়; বরং যারা অন্যায়ভাবে এসব দুরাচারীকে পুণ্যভরে স্মরণ করবে, তারাও তাদের দলভুক্ত হবে :
ন্যায়বিচারীর লানত হোক তাদের উপর
যারা শ্রদ্ধায় স্মরণ করে এই জালেমদের।
তবে অবশ্য ওলি-আউলিয়াগণ এবং তরিকতের সাধকবৃন্দ ইমাম হোসাইন (আ.) ও আত্মোৎসর্গী সঙ্গী-সাথিদের প্রতি দরুদ ও সানা প্রেরণ পাঠ করাকে নিজেদের কর্তব্য বলে মনে করে থাকে। আর এ কারণেই তাঁরা নিজেদেরকে সেই কাফেলার সহযাত্রী হিসাবে ঘেষেণা করেন যে কাফেলায় বর্শার মাথায় কাটা শির মোবারক থেকে কোরআন তেলাওয়াত করা হয়।
প্রকৃতপক্ষে ইমাম হোসাইন (আ.) ও তাঁর সঙ্গী-সাথিদের প্রতি দরুদ ও সালাম পাঠ আর ইয়াযিদ ও তার দোসরদের প্রতি লানত প্রেরণ করা হচ্ছে হক ও বাতিল এই দুই বিপরীত পক্ষের মধ্যে সংগ্রামের অব্যাহত ধারাবাহিকতা। যা হযরত আদম সৃষ্টির শুরু থেকে অদ্যাবধি চলমান রয়েছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত চলতে থাকবে। একারণে ইমাম হোসাইন (আ.) সম্পর্কে কিংবা ইয়াযিদ সম্পর্কে একজন মানুষ কোন্্ অবস্থান গ্রহণ করবে তার উপর নির্ভর করবে সে হক পথে সাইর করছে নাকি বাতিল পথে। আর একারণেই ইরফানি দৃষ্টিকোণ থেকে ইয়াযিদ, শিমার ও তাদের দোসরদের প্রতি লানত বর্ষণ করা অর্থপূর্ণ হয়ে ওঠে ও ভিত্তি খুঁজে পায়। সানায়ী’র ভাষায় :
আশুরা কোরবানির স্মরণ
সে তো সাইরকারীদের কল্বের শক্তির কারণ
সানায়ী দ্বীনি আমলসমূহ পরিপালনে কষ্ট ও মুসিবত সহ্য করার উপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি তরিকতের বিভিন্ন স্তরে কঠিন শোকতাপগুলোকে বরণ করে নেওয়ার ক্ষেত্রে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর নিকট থেকে মদদ কামনা করেন। ইরফানের অঙ্গনে ইমাম হোসাইন ও তাঁর সঙ্গী-সাথিদের ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতাকে তিনি এমন এক মডেল হিসাবে উপস্থাপন করেন যা আর পুনরাবৃত্তি ঘটবে না। আর এ কারণেই আশুরার কোরবানি সম্পর্কে অধ্যয়ন করাকে নিজের উপরে এবং হাকিকত অন্বেষী মরমি সাধকদের জন্য ফরয বলে মনে করেন।
সানায়ী ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কোরবানিকে শুধু একটি আত্মত্যাগের মডেল হিসাবে উপস্থাপন করেই ক্ষান্ত হননি; বরং মরমিবাদের যে ‘মৃত্যুর পূর্বে মৃত্যুকে আস্বাদন করার চর্চা রয়েছে’- সেদিক থেকে তিনি ইমাম (আ.) ও তাঁর সঙ্গী-সাথিদেরকে স্বাভাবিক মৃত্যুর পূর্বে মৃত্যুকে আস্বাদন করার উত্তম নজির হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। এই দৃষ্টিকোণ থেকে মহান ওলি-আউলিয়াগণ ও খোদায়ী পুরুষগণ হচ্ছে তাঁরাই যাঁরা ইহজগতে তাঁদের নাফসের মৃত্যুকে অবলোকন করেছেন। পরিশেষে সানায়ী দাবি করেন যে, ইমাম হোসাইন (আ.) এই পরীক্ষাটি অত্যন্ত নিখুঁতভাবে আঞ্জাম দিয়েছেন।
সানায়ী গাযনাভী আশুরা বিপ্লবের প্রকৃত স্বরূপ আর ইমাম হোসাইন (আ.)-এর চির অম্লান ব্যক্তিত্বের সঠিক অনুধাবন তখনই সম্ভব বলে মনে করেন যখন মানুষ গায়রুল্লাহ থেকে বিচ্ছিন্নতার অভিজ্ঞতা লাভ করবে। অন্যথায় হোসাইন (আ.)-এর কাহিনী পাঠ করে তার কোনো উপকারে আসবে না। কারণ, ইমাম হোসাইন (আ.) এমন এক অগ্নিপরীক্ষার অভিজ্ঞতায় নেমেছেন যা মৃত্যুর পূর্বে মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদনকারীরা ছাড়া তা আস্বাদন করতে সক্ষম হবে না এবং তা অনুধাবন ও স্পর্শ করতে পারবে না।
হাকিম সানায়ী বিশ্বাস করেন, হক সবসময় বিজয়ী। যদিও ক্ষণিকের জন্য কালো মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়ে। তাই ইমাম হোসাইন (আ.) এমন এক আন্দোলনের সূচনা করেন যার মূল শিকড় প্রোথিত রয়েছে আল্লাহর হাক্কানি সত্তার মধ্যে। এই কারণে তা কখনই বিস্মৃতির কবলে পড়বে না। পরাজয়ের ধুলোর আস্তরণও এর গায়ে বসবে না। হাকিম সানায়ী মনে করেন, যদিও পাপিষ্ঠ জালেমরা জাহেলিয়াতের বশবর্তী হয়ে খোদার দ্বীনের সম্মানকে ভূলুণ্ঠিত করেছে এবং রেসালাতের খান্দানের পবিত্র দরজা, যা ছিল জগতের শুদ্ধ পুরুষদের পছন্দনীয়, সেটাকে তারা পদদলিত করেছে, আর আলে ইয়াসীনের কর্তিত মস্তকগুলোকে বর্শার উপরে তুলেছে এবং তাদের শিরকাটা দেহগুলোর উপর দিয়ে ঘোড়া চালিয়েছে, কিন্তু আসলে তারা তাদের এসব কৃতকর্ম দ্বারা অনন্তকালীন লানত ও অভিসম্পাতে আক্রান্ত করেছে। আমি সানায়ী বনি উমাইয়্যা খান্দানের এসব অপকর্মের প্রতি অসন্তুষ্টি ঘোষণা করছি। কিন্তু কারবালার ¯িœগ্ধ সমীরণ বেহেশতের বারতা বয়ে আনে যা অনুসরণ ও অনুকরণযোগ্য বটে। তাই আমি সেই নারীর গোলাম যিনি কারবালার ¯িœগ্ধ সমীরণের সুবাস গ্রহণের জন্য প্রতিদিন শহরের বাইরে চলে আসতেন এবং পিশাচ দুশমনের কোনো পরোয়া করতেন না। ইমাম হোসাইন (আ.) ও তাঁর সঙ্গী-সাথিদের অমরত্ব ও চিরন্তনতার পেছনে যে রহস্য নিহিত, সেটা হলো এই যে, তাঁরা হক (আল্লাহ) ও তাঁর সিফাতসমূহের তাজাল্লীকারী ছিলেন। এই দৃষ্টিকোণ থেকে খোদায়ী জামালের দর্পণসমূহ কখনই ভেঙ্গে যাবে না। বরং প্রত্যেক যুগ ও জামানায় আরও স্থায়ী ও টেকসই হবে। হাকিম সানায়ীর দৃষ্টিতে কারবালা হচ্ছে আল্লাহর বেহেশতেরই একটি টুকরা, যা জমিনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আর কারবালার শহীদগণ হচ্ছেন সেই পবিত্র ফুলসমূহ, যা কারবালার মাটিতে ফুটেছে এবং গোটা জাহানকে সুরভিময় করে তুলেছে।

 

‘পয়গাম্বরে রহমত’ শীর্ষক বই প্রকাশ

পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) ও ইসলামি ঐক্য সপ্তাহ উপলক্ষ্যে গত ২৪ অক্টোবর রোববার ‘পয়গাম্বরে রহমত’ শীর্ষক একটি বই প্রকাশিত হয়েছে। এটি মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা হযরত আয়াতুল্লাহ আল উজমা খামেনেয়ী (মুদ্দাযিল্লুহু)-এর বয়ান সংকলন।
এটি বঙ্গানুবাদ করেছেন ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী। ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান দূতাবাসের কালচারাল কাউন্সেলর ড. সাইয়্যেদ হাসান সেহাতের তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত বইটির সম্পাদনায় ছিলেন ড. এম আব্দুল কুদ্দুস বাদশা। এটি প্রকাশ করেছে সূচীপত্র প্রকাশনী।
বিশ্ববাসীর জন্য রহমতের বার্তা নিয়ে আগমন করেন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)। মানবের জাগতিক ও আধ্যাত্মিক মুক্তির জন্য তিনি যে ঐশী জীবন-দর্শন উপস্থাপন করেন, আজকের বিশ্বমানব তা থেকে বহু ক্রোশ দূরে। ফলশ্রুতিতে জাতিতে জাতিতে হানাহানি, যুদ্ধ-বিগ্রহ, অশান্তি আর রক্তপাত যেন থামছেই না। প্রমাণ হয়েছে বিশ্বমানবকে ফিরে যেতে হবে বিশ্বশান্তির দূত হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর আনীত সেই শান্তিময় জীবন ধারায়। তাই সময়ের চাহিদা ও পরিস্থিতিকে সামনে রেখে মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে গোটা মানবজাতির কাছে ইসলামের মহান পয়গাম্বরের জীবনদর্শনকে নতুন বিশ্লেষণে উপস্থাপন করা খুবই অত্যাবশ্যক। ইরানের ইসলামি বিপ্লবের বিদগ্ধ নেতা আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী (হাফা.) তাঁর গভীর প্রজ্ঞা এবং মুসলিম জাতির নেতৃত্ব প্রদানের সুদীর্ঘ অভিজ্ঞতার আলোকে বিভিন্ন বয়ানে মহানবী (সা.) সম্পর্কে বিশ্লেষণ তুলে ধরেছেন, যেগুলো স্থান পেয়েছে এই সংকলনে। বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম এই বইয়ের মধ্যে খুঁজে পাবে তাদের মনের খোরাক।
উল্লেখ্য, হযরত আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী ইউরোপ ও আমেরিকার তরুণদের উদ্দেশে লেখা পত্রে কুরাআন ও পয়গাম্বরে ইসলামকে চেনার ব্যাপারে যে গুরুত্বারোপ ও সুপারিশ করেছেন তার পরিপ্রেক্ষিতে ইসলামি বিপ্লবের সাংস্কৃতিক গবেষণা ফাউন্ডেশনের আন্তর্জাতিক অধিদপ্তর মহামান্য রাহবারের লেখা, বক্তব্য ও ভাষণসমূহ সংগ্রহ এবং শিরোনাম ও অধ্যায় আকারে সাজানোর কাজ হাতে নেয়। উক্ত ফাউন্ডেশনের মূল দায়িত্ব হচ্ছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতার বক্তব্য, রচনা ও চিন্তাধারার প্রচার প্রসার করা।
এ ক্ষেত্রে ১৩৮৫ ফারসি সালে তরুণ সমাজের পক্ষ হতে ‘নাইয়েরে আজম’ শিরোনামে যে বইটি ফাউন্ডেশনের তত্ত্বাবধানে রচিত ও মুদ্রিত হয়েছে তা থেকে বিরাটভাবে সাহায্য নেওয়া হয়েছে। তবে নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে এবং সময়ের চাহিদা ও পরিস্থিতিকে সামনে রেখে অমুসলিমদের, বিশেষ করে ইউরোপ ও আমেরিকা মহাদেশের জনগণের উদ্দেশে ইসলামের মহান পয়গাম্বরের জীবনের ঘটনাপ্রবাহ ও ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার আলোকে সর্বশেষ তথ্যগুলোও সন্নিবেশিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এমনকি ১৪৪২ হিজরি সালের ২৭ রজব মোতাবেক ২১ ইসফান্দ ১৩৯৯ ফারসি সালে (২০২০খ্রি) রাসূলে আকরামের নবুওয়াত লাভের যে বার্ষিকী পালিত হয় তাতে মহামান্য রাহবার যে বয়ান পেশ করেন সেটিকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এখন বইটি নতুন ও পরিবর্তিত বিন্যাসে ও কলেবরে মুদ্রিত হলো।

 

বিশ্বের শীর্ষ দশ পর্যটন গন্তব্যের দেশ ইরান

সাইদুল ইসলাম

আগামী ২৭ সেপ্টেম্বর বিশ্ব পর্যটন দিবস। এ উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করছে ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্বের শীর্ষ দশ পর্যটন গন্তব্যের দেশ ইরান। এজন্য ইরানের ৫টি প্রদেশকে নির্বাচন করা হয়েছে। সমৃদ্ধ ও ঐতিহ্যবাহী ভ্রমণ গন্তব্যের প্রতিনিধিত্ব করায় এসব প্রদেশকে বাছাই করা হয়েছে। বিশ্ব পর্যটন দিবসের ছয়দিনের অনুষ্ঠানমালা আরদেবিল, কোরদেস্তান, কেরমানশাহ, কেরমান ও ফার্স প্রদেশে অনুষ্ঠিত হবে। এই প্রদেশগুলো দেশের নতুন ও ঐতিহ্যবাহী ভ্রমণ রুটের প্রতিনিধিত্ব করে। বিগত দুই বছর ধরে ইরানের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, পর্যটন ও হস্তশিল্প মন্ত্রণালয় দেশের কম পরিচিত পর্যটন গন্তব্যগুলোকে পরিচয় করাতে এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ও মানুষকে পর্যটনের গুরুত্বের প্রতি মনোযোগ আকৃষ্ট করতে বিশ্ব পর্যটন দিবসের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইভেন্টকে কাজে লাগাতে বিশেষভাবে উদ্যোগী হয়েছে।
মানব সভ্যতার সুপ্রাচীন ঐতিহ্য ও সৌন্দর্যের অন্যতম লীলাভূমি আজকের ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান। বিচিত্র প্রকৃৃতির বিপুল সম্ভারে পরিপূর্ণ এই দেশটি স্মরণাতীতকাল ধরে পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আসছে। প্রায় সব ধরনের পর্যটককে কোনো না কোনোভাবে আকৃষ্ট করতে সক্ষম ইরান। আপনি যদি সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহী হয়ে থাকেন তাহলে ইরান আপনার জন্য হবে স্বর্গ। আপনি যদি শিল্পে আগ্রহী হন তাহলে এখানকার মনোমুগ্ধকর স্থাপত্য ও জাদুঘর আপনাকে দেবে পরমানন্দ। আর প্রকৃতিপ্রেমী হলে তো কথাই নেই। আপনি উপভোগ করবেন সেরা সব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য।
সুপ্রাচীনকাল থেকে আজকের আধুনিক বিশ্ব; ইতিহাসের প্রতিটি বাঁকে ইরানের নাম অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। দেশটির ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থান, পৌরাণিক কাহিনী, আখ্যান যেকোনো পর্যটককে মুগ্ধ করে। ফলে ইরানকে সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্যটনগন্তব্য হিসেবে বেছে নেয়াটা একেবারেই যৌক্তিক একটা সিদ্ধান্ত হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। উত্তর-পূর্ব শিরাজ প্রদেশের অসাধারণ প্রাচীন শহর পারসেপোলিস থেকে শুরু করে প্রাচীন মানব-বসতিসহ ইরানের সব দর্শনীয় স্থান দেখে বিস্মিত হবেন আপনি। ইসফাহানে দেখবেন অর্ধ-জাহানের সৌন্দর্য! বিস্ময়ের সে ঘোর হয়তো কাটবে প্রকৃতির উজাড় করে দেওয়া ভালোবাসায়। প্রকৃতির এমন ভালোবাসা পাবেন গিলান কিংবা মাযান্দারান প্রদেশে।
প্রাকৃতিক পরিবেশের দিক থেকে বলতে গেলে ইরানে যেমন রয়েছে পাহাড় আর সাগর, তেমনি রয়েছে বিশাল মরুভূমি, কোথাও নদ-নদী, আবার কোথাও সুবিস্তৃত সমতলভূমি। ইরানের দুই পাশে রয়েছে দুই সাগর অর্থাৎ পারস্য উপসাগর ও কাস্পিয়ান সাগর। ভূমি-বৈচিত্র্যের মতো এখানকার আবহাওয়াতেও রয়েছে বেশ বৈচিত্র্য। সারা ইরানে বসন্ত, গ্রীষ্ম, শরৎ ও শীতÑ এই চারটি ঋতু রয়েছে। রাজধানী তেহরানসহ বিশাল এলাকাজুড়ে যখন প্রচ- শীত কিংবা তুষারাবৃত তখন দক্ষিণে (পারস্য উপসাগর সংলগ্ন) দিব্যি বসন্তের হাওয়া। আপনি কম খরচে অভ্যন্তরীণ বিমানের কোনো ফ্লাইট ধরে সেখান থেকে সহজেই একটু উষ্ণতা নিতে পারেন। পাহাড়, সাগর, নদ-নদী আর জঙ্গলাকীর্ণ বৈচিত্র্যময় ভূমি এবং আবহাওয়ার কারণে ইরানে পর্যটকের ভিড়ও লেগে থাকে সারা বছর। এশিয়ার বহু দেশ, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা থেকেই আসেন বেশি পর্যটক।
ইউনেস্কোর হিসাব মতে, ইরান বিশ্বের ১০ম প্রধান পর্যটনের দেশ। কেবল ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত স্থান রয়েছে ২৬টি। এই তালিকা ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে। গত ২৭ জুলাই ইরানের উরামানাত সাংস্কৃতিক ভূদৃশ্যকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানসমূহের তালিকায় যুক্ত করেছে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংষ্কৃতি সংস্থা ইউনেসকো। ১ লাখ ৬ হাজার হেক্টর ভূখ-ের উরামানাতে কয়েকশ গ্রাম রয়েছে। এর চারপাশ ঘিরে রয়েছে আরও ৩ লাখ ৩ হাজার হেক্টরের দৃষ্টিনন্দন সম্পত্তি। চীনের ফুঝুতে ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির ৪৪তম অধিবেশনে স্থানটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
সারভাবাদ কাউন্টির ঢালে ছড়িয়ে থাকা উরামানাত ভূদৃশ্যের কিছু অংশ কোরদেস্তান ও কিছু অংশ কেরমানশাহ প্রদেশে পড়েছে। এখানকার সারি সারি ঘরগুলো এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যার নিচের ঘরের ছাদ উপরের ঘরের আঙ্গিনা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বসতিটির অসাধারণ এই বৈশিষ্ট্য দারুণ আকর্ষণ তৈরি করেছে। একই মাসে এক হাজার চারশ কিলোমিটার দীর্ঘ ট্রান্স-ইরানিয়ান রেলপথকেও জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থার (ইউনেসকো) বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির ৪৪তম অধিবেশনে রেলপথটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। চীনের ফুঝুতে এই অধিবেশন চলে ৩১ জুলাই পর্যন্ত।
রেলপথটি ইরানের ব্যাপক উন্নয়নের ক্ষেত্রে একটি টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে। এসব উন্নয়নের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক উন্নয়ন। এমনকি সমসাময়িক বিশ্ব ইতিহাসের স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ সময়ের রাজনৈতিক দিকও এর অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ১৩৯৪ কিলোমিটার দীর্ঘ ট্রান্স-ইরানি রেলপথের চওড়া ১৪৩৫ মি.মিটার। রুটটিতে মোট ৯০টি ওয়ার্কিং স্টেশন আছে। কাস্পিয়ান সাগরের দক্ষিণপূর্বে অবস্থিত তোরকামান বন্দরের উত্তর পয়েন্ট থেকে রেলপথটি শুরু হয়েছে। সারি ও কায়েম-শাহর শহর হয়ে রেলপথটি আলবোর্জ অঞ্চলের পর্বত এলাকায় প্রবেশ করেছে। অনেকগুলো সেতু ও সুড়ঙ্গ বেয়ে তেহরান ও ভারামিন প্লেইনকে সংযুক্ত করেছে ঐতিহাসিক এই রেলপথটি।
দেশটিতে রয়েছে অসংখ্য বাগান। যেগুলো পরিদর্শনে যেকোনো পর্যটকের মন সত্যি ছুঁয়ে যাবে। এ পর্যন্ত দেশটির ৯টি বাগান বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ইউনেস্কোর প্রতিবেদনে ইরানের বাগিচাগুলো সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘এই বাগিচাগুলোর ডিজাইন চারটি আলাদা আলাদা ভাগে বিভক্ত। এগুলোর মাঝখানে রয়েছে পানির ব্যবস্থা যা একদিকে দৃশ্য নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে অপরদিকে বাগানের সজ্জাকৌশল ও স্থাপত্যশৈলীর দিক থেকেও এই পানির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।’ ওই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, ইরানের বাগিচাগুলো কাল্পনিকভাবে বেহেশতের বাগানের অনুসরণে তৈরি করা হয়েছে। এই বিষয়টির প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে, ইরানের বাগিচা নির্মাণ পদ্ধতি ও সজ্জা কৌশলের প্রভাব সুস্পষ্টভাবে ভারত এবং স্পেনের মতো দেশগুলোর বাগিচা তৈরির স্টাইলের ওপর ব্যাপকভাবে পড়েছে। ইউনেস্কো তালিকাভুক্ত ইরানের নয়টি বাগিচা হলো : বাগে পাসারগাড, বাগে এরাম, বাগে চেহেল সুতুন, বাগে ফিন, বাগে আব্বাসাবাদ, বাগে শাযদেহ মহন, বাগে দৌলাতাবাদ, বাগে পাহলাভনপুর এবং বাগে আকবারিয়া। মজার ব্যাপার হলো, এইসব বাগিচা ইরানের বিভিন্ন অঞ্চলে বিচিত্র আবহাওয়াময় পরিবেশে নির্মাণ করা হয়েছে।
তবে ইউনেস্কোর বিশেষজ্ঞগণ স্বীকার করেছেন, অঞ্চলগত বৈচিত্র্য, পরিকল্পনা ও ডিজাইন এবং ইরানের ঐতিহাসিক রীতি ও সাংস্কৃতিক শেকড়গুলো এই মনোনয়নের ক্ষেত্রে যে কাজ করেনি তা নয়। এই বাগিচাগুলো ইতিহাসের বিভিন্ন যুগে গড়ে উঠেছে। সেই হাখামানশী যুগ অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দী থেকে দুই শতাব্দী আগের কাজার শাসনামল পর্যন্ত সময়কালের মধ্যে বাগিচাগুলো তৈরি করা হয়েছে। ইরানিদের বিশ্বাস ও মূল্যবোধের মাঝে বাগিচা সবসময়ই একটি পবিত্র স্থান হিসেবে সম্মানিত ও মর্যাদাময়।
২০১৮ সালে বিশ্বের দ্বিতীয় দ্রুত বর্ধনশীল পর্যটন গন্তব্য হিসেবে ইরানকে স্বীকৃতি দিয়েছে বিশ্ব পর্যটন সংস্থা ইউনাইটেড নেশনস ওয়ার্ল্ড ট্যুরিজম অর্গানাইজেশন (ইউএনডব্লিউটিও)। ২০১৮ সালের ইউএনডব্লিউটিও-এর বার্ষিক প্রতিবেদন মতে, মিসর, নেপাল, জর্জিয়া এবং দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশকে পেছনে ফেলে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করে ইরান। অন্যদিকে, দ্রুত বর্ধনশীল পর্যটন গন্তব্য হিসেবে প্রথম স্থান অর্জন করেছে ইকুয়েডর। প্রতিবেদনে বিশ্বের যেসব দেশের পর্যটন প্রবৃদ্ধি সর্বাপেক্ষা বেশি সেসব দেশের পর্যটন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় তুলে আনা হয়। র‌্যাঙ্কিংয়ে ইরানের পরে রয়েছে মিসরের অবস্থান।
ইরানে বাজার, জাদুঘর, মসজিদ, সেতু, বাথহাউস, মাদ্রাসা, মাজার, গির্জা, টাওয়ার এবং ম্যানসিসের মতো শত শত ঐতিহাসিক স্থান রয়েছে যা বিদেশী পর্যটকদের নিকট বেশ প্রিয়। ২০১৯ সালের ট্র্যাভেল রিস্ক ম্যাপে ‘ইনসিগনিফিকেন্ট’ ক্যাটাগরিতে স্থান পায় ইরান। এই বিভাগের দেশটির সাথে আরও রয়েছে যুক্তরাজ্য, ডেনমার্ক, সুইজারল্যান্ড, নরওয়ে এবং ফিনল্যান্ড। ট্র্যাভেল রিস্ক ম্যাপে পর্যটন গন্তব্যের দিক দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর ঝুঁকির মাত্রা বিশ্লেষণ করে র‌্যাঙ্কিং প্রকাশ করা হয়।
মেডিক্যাল ট্যুরিজমেও ইরান ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে। এখন সারা বছরই বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বহু মানুষ ইরানে আসছেন চিকিৎসার জন্য। বেশিরভাগ রোগী হলেন ব্রিটেন, সুইডেনসহ পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলোর। ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য নীতিতে চিকিৎসা ব্যয় কমানোর ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এ কারণে ইরানে যেকোনো অপারেশনের ব্যয় তুরস্ক, ব্রিটেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক চতুর্থাংশের মতো। তবে গুণগত দিক থেকে এখানকার চিকিৎসা বিশ্বমানের। সেজন্যই বিদেশী রোগীরা ইরানের চিকিৎসার মানের ব্যাপারে সন্তুষ্ট। এছাড়া ইরানি অস্ত্রোপচারকারী চিকিৎসক এবং সাধারণ চিকিৎসকগণ বেশ দক্ষ। বিদেশি সহযোগীরা সবসময়ই তাঁদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। এশিয়ার দেশগুলোর মাঝে মেডিক্যাল ট্যুরিজমের ক্ষেত্রে কঠোর প্রতিযোগিতা চলছে। এই প্রতিযোগিতায় ইরানের অবস্থান বিশ্বের শ্রেষ্ঠ দশটি দেশের মধ্যে রয়েছে। ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় মেডিক্যাল ট্যুরিজমের ক্ষেত্রে এশীয় দেশগুলোর সাথে সহযোগিতা বৃদ্ধি সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষরও করেছে। ইরানে বর্তমানে অন্তত ষাটটি হার্ট অপারেশন কেন্দ্রে ওপেন হার্ট সার্জারি হচ্ছে। ইরানের এই চিকিৎসা সেবা বিশ্বের চিকিৎসকগণকে আকৃষ্ট করছে। কেবল ওপেন হার্ট সার্জারিই নয়, আরো বহু জটিল ও মারাত্মক রোগের চিকিৎসা এখন বেশ উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে করা হচ্ছে। ইরানের স্বাস্থ্যসেবা খাতে প্রায় ৪শ হাসপাতাল চিকিৎসা সেবা দিচ্ছে। যে বিষয়গুলো দেশটিতে পর্যটকদের বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে তা হলো ইরানিদের আতিথেয়তা, থাকা-খাওয়ায় স্বল্প ব্যয়, সহজ ও উন্নত যাতায়াত ব্যবস্থা, অভিজাত ও ঐতিহ্যবাহী হোটেল, এক ভ্রমণে সব মৌসুমের অভিজ্ঞতা লাভের সুযোগ ও লোভনীয় বিভিন্ন খাবারের স্বাদ। সব মিলিয়ে ইরান ভ্রমণপিপাসুদের জন্য হয়ে উঠেছে অন্যরকম এক আকর্ষণের স্থান। ‘২০২৫ ট্যুরিজম ভিশন প্ল্যান’ অনুযায়ী, ইরান ২০২৫ সাল নাগাদ ২ কোটি বিদেশী পর্যটক আকৃষ্টের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। ২০১৪ সালে যেখানে দেশটিতে বিদেশী পর্যটক আগমনের সংখ্যা ছিল ৪৮ লাখ।

 

ইরানে চিকিৎসাবিজ্ঞানের পথিকৃৎ আল-রাজি ও আজকের বাস্তবতা

রাশিদ রিয়াজ

ইরানের চিকিৎসাবিজ্ঞানী আবু বকর মুহাম্মাদ বিন জাকারিয়া আল-রাজি ৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে (২৫১ হিজরি) পারস্যের ‘রেই’ নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। আলবোর্জ পর্বতমালার দক্ষিণের ঢালে বিখ্যাত সিল্ক রোডের পাশে এই নগরীটি অবস্থিত। বর্তমানে এটি বৃহত্তর তেহরানের অংশ। আল-রাজি ইউরোপে ‘রাজেশ’ নামে পরিচিত।
রাজি ছিলেন দরিদ্র পরিবারের সন্তান। জীবনের শুরুতে সাধারণ শিক্ষা গ্রহণ করেন। তরুণ বয়সে উদ্দেশ্যহীন জীবনযাপন করতেন। বিভিন্ন আসর, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডাবাজি ইত্যাদি অনর্থক কাজে সময় কাটিয়ে দিতেন। (সও আজিম মুসলিম সাইন্সদা : ১৪৭)। পরবর্তী সময়ে রসায়নবিদ্যার প্রতি তাঁর প্রবল আগ্রহ সৃষ্টি হয়। ‘কিমিয়াগিরির’ (লোহা ও পিতল ইত্যাদিকে স্বর্ণে রূপান্তর করার একটি কৌশল) পেছনে সময় ও মেধা ব্যয় করতে থাকেন। কিমিয়াগিরির জন্য বাড়িতে আগুনের চুল্লি স্থাপন করেছিলেন। তাঁর বাড়ি সর্বদা ধোঁয়ায় পরিপূর্ণ থাকত। অতিরিক্ত ধোঁয়ার কারণে চোখ রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে। চিকিৎসার জন্য ডাক্তারের শরণাপন্ন হলে ডাক্তার ৫০০ আশরাফি মুদ্রার বিনিময়ে চোখের চিকিৎসা করেন। বিদায়কালে বলেন, রসায়নবিদ্যার আকর্ষণে তুমি যে কিমিয়াগিরি করছ সেটি আসল কিমিয়াগিরি নয়, আসল কিমিয়া হলো আমি যেটা করছি সেটা! (তারিখুল হুকামা : ৬)
চক্ষু ডাক্তারের ওই মন্তব্য মুহাম্মাদ রাজির জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। চিকিৎসাশাস্ত্রে পারদর্শী হতে তিনি স্ত্রী-সন্তান ও বন্ধুদের বিদায় জানিয়ে বাগদাদের পথে যাত্রা করেন। বাগদাদের তৎকালীন শীর্ষ চিকিৎসক আলী ইবনে সাহলের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। ইবনে সাহলের তত্ত্বাবধানে কঠিন অধ্যবসায় ও অধ্যয়নের ফলে চিকিৎসাশাস্ত্রে ব্যুৎপত্তি অর্জনে সক্ষম হন। দীর্ঘকাল চিকিৎসাশাস্ত্রের পাঠদান ও রোগীদের সেবা করার ফলে তাঁর নাম চিকিৎসাশাস্ত্রের ইমাম ও নতুন তত্ত্ব উদ্ভাবনকারীদের শীর্ষ তালিকায় উচ্চারিত হতে থাকে। বিখ্যাত মনীষী ইবনে খাল্লিকান বলেন, মুহাম্মাদ আল-রাজি চিকিৎসাবিজ্ঞানের প-িত ছিলেন। তাঁর যুগে তাঁকেই সেরা বলা হতো। তিনি চিকিৎসাশাস্ত্রের অসংখ্য মৌল তত্ত্বের আবিষ্কারক। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ চিকিৎসাশাস্ত্রের দীক্ষা নিতে তাঁর কাছে আগমন করত। (হুকামায়ে ইসলাম : ১/২০১)
চিকিৎসাবিজ্ঞানে মুহাম্মাদ রাজির অবদান স¤পর্কে ইতিহাসবিদরা বলেন, ‘চিকিৎসাাস্ত্রের মৃত্যু ঘটেছিল, হাকিম জালিনুস আবার প্রাণ দান করেছেন। এ শাস্ত্রের নীতিমালা বিক্ষিপ্ত ও দুর্বল ছিল, ইমাম রাজি সেসব নীতিকে পরিমার্জন, পরিবর্ধন ও সুবিন্যস্ত করে কিতাবের আকৃতি দান করেছেন। চিকিৎসাশাস্ত্র অস¤পূর্ণ ছিল, ইবনে সিনা তার পূর্ণতা দান করেছেন।’ (ইবনে খাল্লিকান : ২/৭৮)
ইমাম রাজি একজন প্রাজ্ঞ চিকিৎসক ছিলেন। রেই শহরের প্রধান হাসপাতালের প্রধান পরিচালকের পদে তাঁকে আসীন করা হয়। এ সময়েই তাঁর অসাধারণ যোগ্যতা ও কর্মদক্ষতার সুখ্যাতি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। খলিফা মুকতাফির (১৭তম আব্বাসি খলিফা) রাজত্বকালে ইমাম রাজিকে বাগদাদে বদলি করা হয়। ৯০৩ খ্রিস্টাব্দে রেইয়ের শাসক মানসুর ইবনে ইসহাকের অনুরোধে তিনি আবার রেইয়ের সরকারি হাসপাতালে আগের পদে যোগদান করেন।
ইমাম রাজিই সর্বপ্রথম ‘ফার্স্ট এইড’ পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। এ পদ্ধতির নীতিমালাও তিনি প্রণয়ন করেন। ‘মিজানে তিববি’ নামক ওষুধের ওজন পরিমাপক যন্ত্র তাঁর হাত ধরেই আবিষ্কৃত হয়। এ নিক্তির মাধ্যমে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জিনিসের সঠিক পরিমাপ জানা যায়। অ্যালকোহল আবিষ্কারকের নাম হিসেবেও মুহাম্মাদ রাজির নাম উচ্চারিত হয়। ‘বংশপরা¤পরায় রোগের সৃষ্টি’ তত্ত্বের ধারণা তিনিই সর্বপ্রথম প্রদান করেন। ‘নশতার’ নামক এক ধরনের অস্ত্রোপচার যন্ত্র আবিষ্কার করেন। (সও আজিম মুসলিম সাইন্সদা : ১৪৭)
শল্যচিকিৎসার প্রাণপুরুষ আল-রাজিই প্রথম চিকিৎসক যিনি হাম ও গুটি বসন্তকে আলাদা রোগ হিসাবে চি‎হ্নিত করেছিলেন। তিনি সালফিউরিক এসিড, ইথানল উৎপাদন ও পরিশোধন এবং চিকিৎসায় এর ব্যবহার পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন।
আল-রাজি কেবল চিকিৎসাবিজ্ঞানীই ছিলেন না; বরং একাধারে দার্শনিক, গণিতবিদ ও রসায়নবিদ ছিলেন। ৯২৫ খ্রিস্টাব্দে একটি সফল জীবন শেষ করে জন্মশহর রেইতে ইন্তেকাল করেন এ জগদ্বিখ্যাত মনীষী। তাঁর নামে ইরানে রাজি ইন্সটিটিউট ও ইরানের কেরমানশাহ শহরে রাজি বিশ্ববিদ্যালয় অবস্থিত। ইরানে প্রতি বছর ২৭ আগস্ট আল-রাজিকে স্মরণ করে রাজি দিবস পালন করা হয়।
মুহাম্মাদ রাজির রচনাবলি
আল-রাজি রসায়নবিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান, চিকিৎসাবিজ্ঞান ও অন্যান্য বিষয়ে প্রায় ২০০টির অধিক গ্রন্থ লিখেছেন। তাঁর গবেষণাকর্মের মধ্যে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ হলো চিকিৎসাবিজ্ঞানের শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ ‘আল হাভি’ এবং ‘রসায়নশাস্ত্রের রহস্যাবলির রহস্য’ শীর্ষক গ্রন্থ। দিনরাত পড়াশুনা ও গবেষণার এক পর্যায়ে তিনি অন্ধ হয়ে যান। এরপর তিনি বলতেন আর তাঁর ছাত্ররা তা লিখে রাখতেন। যখন তিনি মারা গেলেন তখন তাঁর ছাত্ররাই ‘আল হাভি’র কাজ সমাপ্ত করেছিলেন। নিচে তাঁর কয়েকটি বইয়ের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরা হলো :
ক. আল-হাভি : ‘আল-হাভি’ হলো চিকিৎসাশাস্ত্রে লিখিত তাঁর জগদ্বিখ্যাত কিতাব। এটাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের আরবি ভাষার এনসাইক্লোপিডিয়া বলা হয়। এ বইতে চিকিৎসাশাস্ত্রের সূক্ষ¥ সূক্ষ্ম সমস্যার সমাধান ও আরব বিশ্বের চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের মতামত লিপিবদ্ধ করেছেন। ইউনান, হিন্দুস্তান ও ইরানের চিকিৎসাবিজ্ঞানের সারনির্যাসকে নীতিমালার আলোকে একত্রিত করেছেন। শতাব্দীকাল ধরে এ বই পশ্চিমা বিশ্বের বিভিন্ন বিশ^বিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১২৭৯ খ্রিস্টাব্দে একজন ইহুদি চিকিৎসক এ বইয়ের ল্যাটিন অনুবাদ করেন। বইটির গ্রহণযোগ্যতা বোঝাতে এতটুকুই যথেষ্ট যে, ১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দে সর্বপ্রথম অনুবাদ প্রকাশের পর ১৫৪২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত পনেরোর অধিক সংস্করণ ছাপা হয়!
খ. কিতাবুল মানসুরি : ইমাম রাজির বিখ্যাত রচনা। দশ খ-ে লিখিত বইটি শাসক মানসুরের নামে নামকরণ করেন। ইতালির মিলান শহরে পনেরো শতাব্দীর শেষের দিকে এর অনুবাদ প্রকাশিত হয়। অধুনা এর কিছু অংশ ফ্রেঞ্চ ও জার্মান ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
গ. কিতাবুল জাদারি ওয়াল হাসাবা : আরেকটি জনপ্রিয় কিতাব। ইতিহাসে সর্বপ্রথম এই কিতাবে বসন্ত, জলবসন্ত ও হাম রোগের চিকিৎসা স¤পর্কে বিস্তারিত সমাধান দেওয়া হয়। রাজির আগে অন্য কেউ এ বিষয়ে কলম ধরেনি। বসন্তের ধরন নির্ণয়ের ভিত্তিতে তিনি প্রতিষেধক উদ্ভাবন করেন। ১৫৬৫ খ্রিস্টাব্দে প্রথমে ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ প্রকাশিত হয়। পরবর্তী সময়ে ইউরোপের বিভিন্ন ভাষায় কিতাবটির অনুবাদ হয়। এ বইটিই ইমাম রাজিকে মধ্যযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ চিকিৎসা বিজ্ঞানীরূপে প্রতিষ্ঠিত করে। ইংরেজি অনুবাদ হয় ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে। ফ্রেঞ্চ, ইউনান ও জার্মান ভাষায়ও এটির অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জাতীয় পাঠ্যক্রমে কিতাবটি অন্তর্ভুক্ত ছিল।
ঘ. আল-ফুসুল ফিত-তিব : রাজির বিখ্যাত কিতাব। সর্বপ্রথম ইবরানি ভাষায় তরজমা প্রকাশিত হয়। লন্ডনে এর অনুবাদ বিদ্যমান আছে। ল্যাটিন ভাষায়ও অনূদিত হয়েছে।
ঙ. কিতাবুত তিববিল মুলুকি : আরেকটি প্রসিদ্ধ কিতাব। তবারিস্তানের (ইরানের বিখ্যাত নগরী) শাসক আলি ইবনে উমসুজানের নামে বইটির নামকরণ করেন। এটির হাতেলেখা পা-ুলিপি লন্ডন লাইব্রেরিতে বিদ্যমান আছে। (ইসলামি এনসাইক্লোপিডিয়া : ৮১৯, উলুম ওয়া ফুনুন আহদে আব্বাসি : ১২৬)
চ. কিতাবুল আসরার : গুরুত্বপূর্ণ ও সুপরিচিত কিতাব। প্রসূতিবিদ্যা, চক্ষুরোগ ও মহিলা রোগের চিকিৎসা বিষয়ে এ কিতাবের গ্রহণযোগ্যতার কথা পশ্চিমা বিশ্ব নির্দ্বিধায় স্বীকার করে নিয়েছে। (আরবু কে ইলমি কারনামে : ৭০)।
লেখালেখিতে ইমাম রাজির স্বভাবজাত আগ্রহ ও যোগ্যতা ছিল। সর্বদা লেখার কাজে নিমগ্ন থাকতেন। চিকিৎসাবিজ্ঞান ছাড়াও আকিদা, যুক্তিবিদ্যা, দর্শন, মহাকাশ ইত্যাদি বিষয়ে লেখা তাঁর রচনাবলি বিশেষ মর্যাদায় আসীন। পশ্চিমা বিশ্বের চিকিৎসা, দর্শন ইত্যাদির ওপর ইমাম রাজির রচনাবলির ব্যাপক প্রভাব রয়েছে।
১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটেন কংগ্রেস আয়োজিত আন্তর্জাতিক সেমিনারে ইমাম রাজির জীবন ও অবদানের ওপর আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। বক্তারা কৃতজ্ঞতা ও প্রশংসা জ্ঞাপনসূচক বাক্যে ইমামকে উল্লেখ করেন। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে ইমাম রাজির মৃত্যুর হাজার বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে অতিথিদের সবাই তাঁকে ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ চিকিৎসাবিজ্ঞানী হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেন।
ইরানের বর্তমান চিকিৎসাব্যবস্থা
আজকের দিনে ইরান যখন নিজেদের ওষুধ চাহিদার ৯৮ শতাংশ নিজেরাই তৈরি করে তখন বোঝা যায় চিকিৎসাবিজ্ঞানে আল-রাজির মতো বিদগ্ধ প-িতরা দেশটির এ শাখায় প্রাচীনকালেই ভিত গড়ে দিয়ে গেছেন। অভ্যন্তরীণ চাহিদার শতকরা ১০০ ভাগ ওষুধ উৎপাদনের লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ইরান। গত বছর ৯৭০টি লাইসেন্স ইস্যু করা হয়েছে, এর মধ্যে ৮০টি লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে এমন সব ওষুধ তৈরির জন্য যা দেশে এই প্রথমবারের মতো তৈরি হচ্ছে।
একটি দেশের বিরুদ্ধে ৪ দশকেরও বেশি সময় ধরে যখন অন্যায়ভাবে অবরোধ ও ওষুধ আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা চলে আসছে তখনো ইরান করোনাভাইরাস মোকাবেলায় এমনভাবে লড়ছে যেখানে জাতীয় জাগরণের আভাস পাওয়া যায়। ইরানই একমাত্র মুসলিম দেশ যারা অন্তত তিনটি দেশের সঙ্গে করোনাভাইরাসের টিকা যৌথভাবে ও নিজেদের উদ্ভাবিত তিনটি টিকা উৎপাদনে যাচ্ছে। এর বাইরে আরো কয়েকটি টিকার ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চলছে। ইতিমধ্যে ইরান জার্মানি ও তুরস্কসহ কয়েকেটি দেশে করোনাভাইরাস শনাক্তকরণ কিট রপ্তানি শুরু করার পর দক্ষিণ আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইরানের কিটের চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী ইরানের নিজস্ব টিকা ‘কোভিড বারাকাত’ গ্রহণ করেছেন। লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে নির্বাচিত হওয়ার পর ইরানের নতুন প্রেসিডেন্ট ড. রায়িসি ইরানের তৈরি করোনা ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ নিয়েছেন। তাঁর নেওয়া ‘কোভ-ইরান বারাকাত’ নামের ওই ভ্যাকসিন ইরানের তরুণ গবেষক ও বিজ্ঞানীদের নিরলস প্রচেষ্টার ফসল। সকল প্রকার ট্রায়াল শেষে এই ভ্যাকসিন প্রদানের অনুমতি মিলেছে। প্রেসিডেন্ট রায়িসি এ টিকা নিয়ে ‘কোভ-ইরান বারাকাত’ তৈরির ক্ষেত্রে নিয়োজিত তরুণ বিজ্ঞানী ও গবেষকদের শ্রম ও মেধাকে স্বীকৃতি দিয়েছেন ও তাঁদেরকে সম্মানিত করেছেন। ‘কোভ-ইরান বারাকাত’ ভ্যাকসিন ব্যবহারের লাইসেন্স পাবার মধ্য দিয়ে ইরান করোনার টিকা প্রস্তুতকারী বিশ্বের ছয়টি দেশের মধ্যে নিজেদের স্থান করে নিয়েছে। আগামী বছরে মুখে নেওয়ার মতো কোভিড ওরাল ভ্যাকসিন তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে ইরান। ইরানের মোট ৯টি স্থানীয় ফার্ম করোনাভাইরাস ভ্যাকসিন উৎপাদন নিয়ে কাজ করছে। দুটি ভ্যাকসিন ক্লিনিক্যাল লাইসেন্স লাভের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে।
এসব গবেষণা নিরন্তর চলার পেছনে উৎসাহ যুগিয়েছে তাদের উত্তরসূরি চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা। তাঁদের মতো আরো অনেক চিকিৎসাবিজ্ঞানীর অশেষ পরিশ্রম ও ধারাবাহিক প্রচেষ্টায় আজকে ইরানে ৬শ’র বেশি কো¤পানি মেডিক্যাল যন্ত্রপাতি তৈরি করে যা ইরানের মোট চাহিদার শতকরা ৩৫ ভাগ। বিভিন্ন দেশে যখন কোভিড মহামারিতে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জাম, আইসিইউ, ভেন্টিলেটরসহ বিভিন্ন উপকরণের সংকট চলছে তখন ইরান এসব উপকরণ অনেক দেশে রফতানি করছে।
পশ্চিম এশিয়ায় বৃহত্তম ওষুধ উৎপাদকে পরিণত হবে ইরান এমন লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে দেশটি। আর এধরনের লক্ষ্যমাত্র নিয়ে আগানো সম্ভব হচ্ছে ইরানের বিজ্ঞানীদের উচ্চ বৈজ্ঞানিক সক্ষমতা ও সামর্থ্য এবং ওষুধ উৎপাদনের প্রয়োজনীয় উপাদান নিজেরাই তৈরি করতে পেরেছে বলে।
এমনিতে বিশ্বখ্যাত ৩৫ জন স্টেম সেল প্রতিস্থাপন ডাক্তারের তালিকায় রয়েছেন ইরানি চিকিৎসক আমির আলি হামিদিয়ে। ‘দেড় মিলিয়ন হেমাটোপয়েটিক স্টেম সেল ট্রান্সপ্লান্ট’ শীর্ষক এক নিবন্ধে তিনি সেরা ৩৫ জনের মধ্যে স্থান পান। তাঁর মতো অনেক চিকিৎসাবিজ্ঞানী তাঁদের উত্তরসূরির গবেষণার ভিত্তিকেই অনুসরণ করে নিত্যনতুন আবিষ্কার করছেন।
এরই মধ্যে ইরান ইন্দোনেশিয়ায় আধুনিক টেলিসার্জারি কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। রোবটের সাহায্যে দূরবর্তী স্থানে অস্ত্রোপচারের জন্য ইন্দোনেশিয়ায় দুটি আধুনিক টেলিসার্জারি কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করবে ইরান। এছাড়া পশ্চিম এশিয়ায় প্রথম আয়ন থেরাপি কেন্দ্র চালু করেছে ইরান। আগামী বছরে থেকে কেন্দ্রটিতে সব ধরনের ক্যান্সারের জন্য সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হবে। বিশ্বে এই ধরনের প্রযুক্তি মাত্র ছয়টি দেশের হাতে আছে।
একই সঙ্গে ইরানে নিয়মিত আন্তর্জাতিক সেমিনার অনুষ্ঠিত হচ্ছে। তেহরানে পঞ্চম ইন্টারন্যাশনাল হেলথ কংগ্রেস শুরু হওয়ার পর আশা করা হচ্ছে এ আয়োজন মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে পর্যটন উন্নয়ন ও সহযোগিতা বাড়াতে ভূমিকা রাখবে, একই সঙ্গে মেডিকেল টুরিজ্যম, ¯েপার্টস টুরিজ্যম, পুষ্টি ও স্বাস্থ্যকর খাবার ও ল্যাবরেটরি ইকুয়েপমেন্ট নিয়েও এ কংগ্রেসে আলোচনায় উপকৃত হয়েছে দেশগুলো।
সম্প্রতি রাশিয়া, জার্মানি এবং ইকুয়েডরে ‘ব্রেন সার্জারি নেভিগেশন সিস্টেম’ রফতানি শুরু করছে ইরান। মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচারের এসব জটিল উপকরণ বর্তমানে ইরানের ৮০টি হাসপাতালে ব্যবহৃত হচ্ছে। উপকরণগুলো কৌশলগত পণ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মস্তিষ্কের বিভিন্ন ধরনের জটিল অস্ত্রোপচারে এধরনের উপকরণ ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এধরনের ডিভাইস সার্জনকে অস্ত্রোপচারের সময় প্রয়োজনীয় সঠিক দিক নির্দেশনা দিতে সক্ষম। টিউমার, সাইনাস ও মাথার খুলি, এমনকি ¯পাইনাল কর্ড বা মেরুদ- অপারেশনে এসব ডিভাইস খুবই উপযোগী। ফলে চিকিৎসকরা এধরনের অস্ত্রোপচারের সময় বাড়তি সাহস পেয়ে থাকেন। সঠিক সময়ের মধ্যে অস্ত্রোপচারে আস্থাও পান। তুরস্কে এধরনের ডিভাইস রপ্তানির কথা চলছে। ইরানের দেড়শ চিকিৎসক অন্তত ৬ হাজার রোগীর মস্তিষ্কের অস্ত্রোপচারে এসব ডিভাইস ব্যবহার করেছেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের পরিচালক আহমেদ আল-মানদারি বলেছেন, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য ইরান হচ্ছে রোল মডেল। ইরান জুড়ে ৬৯৬টি প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দেওয়া এক বার্তায় তিনি এই মন্তব্য করেন। মানদারি বলেন, বিগত চার দশক ধরে ইরানের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নেটওয়ার্ক জনগণের সময়মতো সাশ্রয়ী মূল্যে, গ্রহণযোগ্য প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য পরিষেবা নিশ্চিতের লক্ষে কাজ করছে। তিনি বলেন, এসব নতুন স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের আওতা বাড়াতে সাহায্য করবে এবং শতভাগ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
উল্লেখ্য, বর্তমানে প্রায় সব ইরানিই রাষ্ট্র সমর্থিত স্বাস্থ্যবিমা পরিষেবা পান।

স্মরণীয় বাণী

 

হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) এরশাদ করেন : যে কেউ জ্ঞানার্জনের জন্য কিছু সময় বিনীতভাবে ধৈর্যধারণ করে থাকতে পারে না সে সবসময়ই মূর্খতার লাঞ্ছনার মধ্যে পড়ে থাকবে।
তিনি আরো এরশাদ করেন : আল্লাহ্্ তা‘আলা আমাকে সহজভাবে শিক্ষাদানকারী শিক্ষক হিসেবে উত্থিত করেছেন।
হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) এরশাদ করেন : আমি কি তোমাদেরকে আচরণের বিচারে দুনিয়া ও আখিরাতের জন্য সর্বোত্তম ব্যক্তি কারা বলে দেব? (সাহাবিগণ) বললেন : জ্বী। তিনি এরশাদ করলেন : যে ব্যক্তি তার সাথে সম্পর্ক ছিন্নকারীর সাথে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে।
মহানবী (সা.) আরো এরশাদ করেন : ব্যক্তি যদি তার কাঁধে করে লাকড়ি বহন করে এবং তা দ্বারা স্বীয় প্রয়োজন পূরণ করে, আর স্বীয় প্রয়োজনের অতিরিক্ত যা তা সাদাকাহ্ দেয়, এটা অন্যদের কাছে হাতপাতার চেয়ে উত্তম। কারণ, দাতার হাত গ্রহীতার হাতের চেয়ে উত্তম।
তিনি আরো বলেন : পাকস্থলী হচ্ছে শরীরের হাউযস্বরূপ এবং রগসমূহ এর সাথে সংযুক্ত। তাই পাকস্থলী যখন সুস্থ থাকে তখন রগসমূহ সুস্থতা সরবরাহ করে এবং পাকস্থলী যখন অসুস্থ হয়ে পড়ে তখন রগসমূহ অসুস্থতা সরবরাহ করে।
আমীরুল মু‘মিনীন হযরত আলী (আ.) এরশাদ করেন : কাজ যদিও কঠিন ও কষ্টকর, কিন্তু স্থায়ী কর্মহীনতা পাপাচার নিয়ে আসে।
হযরত আলী (আ.) এরশাদ করেন : যে কেউ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন খাবার খায়, ভালো করে চিবিয়ে খায়, পুরোপুরি তৃপ্ত হবার আগেই খাওয়া বন্ধ করে এবং পায়খানা-প্রস্রাবের বেগ হলে বিলম্ব করে না, মৃত্যু ছাড়া সে অসুস্থ হবে না।
হযরত ইমাম সাজ্জাদ (আ.) এরশাদ করেন : তোমার সন্তানের অধিকার এই যে, তুমি মনে রাখবে সে তোমার থেকেই এবং এ দুনিয়ায় তার ভালোমন্দ তোমার সাথে সম্পর্কযুক্ত।
হযরত ইমাম সাজ্জাদ্ (আ.) এরশাদ করেন : যে কেউ এমন অবস্থায় ভরাপেটে নিদ্রা যায় যে, তার কাছাকাছি কোনো মু‘মিন ক্ষুধার্ত থাকে তখন আল্লাহ্ বলেন : হে আমার ফেরেশতারা! আমি তোমাদেরকে আমার এই বান্দার ব্যাপারে সাক্ষী করছি যে, আমি তাকে আদেশ দিয়েছিলাম কিন্তু সে নাফরমানী করেছে ও অন্য কারো ফরমাবরদারী করেছে, তাই আমি তাকে তার আমলের ওপর রেখে দিলাম। আমার ইজ্জত ও প্রতাপের শপথ, আমি কখনোই তাকে ক্ষমা করব না।
হযরত ইমাম বাকের (আ.) এরশাদ করেন : চারটি গুণ যে কোনো মু‘মিনের মধ্যে থাকবে আল্লাহ্্ তাকে বেহেশতের সমুন্নততম স্তরে সর্বোত্তম কক্ষসমূহের একটিতে ও সমুন্নততম স্থানে জায়গা দেবেন, … : যে ব্যক্তি তার পিতা ও মাতাকে দান করবে, উভয়ের সাথে খাপ খাইয়ে চলবে, তাদের কল্যাণ করবে এবং তাদেরকে মনঃকষ্ট দেবে না।
হযরত ইমাম বাকের (আ.) এরশাদ করেন : বিভিন্ন ধরনের জুয়া খেলাকে কোরআন মজীদে মাইসির বলে গণ্য করা হয়েছে এবং এগুলোকে শয়তানের কাজ বলে গণ্য করা হয়েছে।
হযরত ইমাম জাফর সাদেক (আ.)-এরশাদ করেন : তোমরা আত্মীয়-স্বজনের খোঁজখবর নাও, কেবল সালাম করার মাধ্যমে হলেও।
হযরত ইমাম মূসা কাযেম্ (আ.) এরশাদ করেন : যে কেউ তার ভাইদের ও স্বীয় পরিবারের কল্যাণ সাধন করে তার হায়াত দীর্ঘ হয়।
(মাফাতীহুল্ হায়াত্ গ্রন্থ থেকে সংকলিত)
অনুবাদ : নূর হোসেন মজিদী