All posts by dreamboy

ইয়েমেনে রকেট হামলায় গফরগাঁওয়ের যুবক নিহত

ইয়েমেনের দক্ষিণাঞ্চলীয় এডেন নগরীর কশর হোটেলে হুতি বিদ্রোহীদের রকেট হামলায় বাংলাদেশের আনছারুল হক চম্পা নামে এক যুবক নিহত হয়েছে। নিহতের বাড়ি ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার মহির খারুয়া গ্রামে। সে মহিরখরুয়া গ্রামের মৃত নইমুদ্দিন আহম্মেদের ছোট ছেলে। নিহতের খবরে তার পরিবারে চলছে শোকের মাতম। ঘটনাটি ঘটে গত মঙ্গলবার বাংলাদেশ সময় রাত ১২টায়। তার পরিবার সূত্রে জানা যায়, আনছারুল সারজা ন্যাশনাল টিমে চাকরি করত।
তার বড় ভাই কাঞ্চন মিয়া জানান, মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে আনছারুল হক চম্পার বন্ধু সোহেল দুবাই থেকে ফোন করে জানায়, বাংলাদেশ সময় ১২টার দিকে ইয়েমেনের ইডেন শহরে কশর হোটেল হামলার ঘটনায় চম্পা মারা গেছে। কাঞ্চন বলেন, তার ভাই তিন মাস আগে দুবাই থেকে ইথুপিয়া যায়। সেখান থেকে দেড় মাস আগে ইয়েমেনের ইডেন শহরের কশর হোটেলে সারজা ন্যাশনাল টিমের সঙ্গে চাকরি শুরু করে। রকেট হামলায় নিহত আনসুরুল হক চম্পার স্ত্রী জেসমিন (৩২) বলেন, ঈদের পরদিন আমার স্বামীর সঙ্গে কথা হয়েছিল। তখন সে জানায়, ইয়েমেনে কশর হোটেলে ন্যাশনাল টিমের সঙ্গে আছি। এই শহরে শুধু মারামারি। যদি বেঁচে থাকি তাহলে দেশে এসে নতুন ঘর তৈয়ার করব। রকেট হামলায় নিহত আনছারুল হক চম্পার দুই কন্যা সন্তানের জনক। বড় মেয়ে ঐশি গফরগাঁও খায়রুল্লাহ সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণীর ছাত্রী। ছোট মেয়ে শশী ঘাগড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। তার বড় ভাই মোস্তাক আহম্মেদ রতন বলেন, সংসারের অভাব-অনটন দূর করার জন্য জমি বিক্রি করে ও সুদে টাকা নিয়ে ৪ লাখ টাকা খরচ করে তাকে দুবাই পাঠিয়েছিলাম। সেখান থেকে সে ইয়েমেনে যায়। কিন্তু তার ভাগ্যে সুখ সইলো না। একটু সুখের আশায় সোনার হরিণ ধরতে দুবাই গিয়েছিল ছোট ভাই।

একটি অনুপম চলচ্চিত্র : ম্যালকম এক্স

ওয়ার্নার ব্রাদার্স এর একটি ছবি ‘ম্যালকম এক্স’ (Malcolm X) । এ ছায়াছবির প্রযোজক এবং পরিচালক হচ্ছেন স্পাইক লী (Spike Lee)। ম্যালকমের নামে ভূমিকায় অভিনয় করেছেন ডেনজেল ওয়াশিংটন (Denzel Washington)।

‘ম্যালকম এক্স’ বিংশ শতাব্দীর এক আলোড়ন সৃষ্টিকারী চলচ্চিত্র। অ্যালেক্স হ্যালীর ‘রুট্‌স’ (Roots) এর পরে সম্ভবত ‘ম্যালকম এক্স’ কালো আমেরিকানদের মাঝে অসাধারণ প্রেরণা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়।

ছবির শুরুতেই শোনা যায় আল্লাহর প্রশংসা আবৃত্তি। তারপরই একটি কণ্ঠস্বর জনতার উদ্দেশে প্রশ্ন রাখে, ‘কার কথা আমরা শুনতে চাই?’ জনতার স্বতঃস্ফূর্ত জবাব, ‘ম্যালকম এক্স’। এরপর পর্দায় প্রযোজক পরিচালকের নাম ভেসে ওঠার সাথে সাথে দেখা গেল আমেরিকান পতাকা। তারপর শোনা গেল ম্যালকম এক্সের কণ্ঠস্বর। জনতার উদ্দেশে তিনি বলছেন :

‘ভাই ও বোনেরা আমার! আপনাদের সামনে আমি সাদা মানুষদের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে হাজির হয়েছি। আমার অভিযোগ সাদা মানুষেরা পৃথিবীর বুকে সবচেয়ে বড় হত্যাকারী। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অপহরণকারী। পৃথিবীর এমন কোন জায়গার কথা ওরা বলতে পারবে না যে, সেখানে তারা শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। যেখানেই সাদা মানুষ গেছে সেখানেই বিশৃঙ্খলা ও ধ্বংসাত্মক পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। এই শ্বেতাঙ্গ মানুষই হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ডাকাত। সবচেয়ে বড় অপহরণকারী। সবচেয়ে বেশি শুকরের গোশতখোর আর মদ্যপায়ী। এই শ্বেতকায়দের বিরুদ্ধে আমি অভিযোগ উত্থাপন করছি। সাদা মানুষ এ সকল অভিযোগ অস্বীকার করতে পারবে না। আপনারাও এটি অস্বীকার করতে পারবেন না। আমরাই হলাম এর জীবন্ত প্রমাণ।

আপনারা আজ আমেরিকান হিসাবে গণ্য নন। আপনারা আজ ওদের শিকার। আপনারা নিজের ইচ্ছায় এদেশে আসেননি। সাদা মানুষ আপনাদেরকে নিয়ে আসার সময় একথা বলেনি : ‘হে কালো মানুষ! এসো আমেরিকাকে গড়ে তুলতে আমাকে সাহায্য কর।’ বরং সে বলেছিল : ‘এ ব্যাটা কালুয়া! এই বোটের অন্ধকার তলায় নেমে যা। আমেরিকা গড়ায় আমার কাজ করে দেয়ার জন্য তোকে নিয়ে যাচ্ছি।’

এদেশে জন্মগ্রহণ করেও আপনি আমেরিকান হতে পারেননি। আজ আমি আমেরিকান নই, আপনি আমেরিকান নন। আপনি হলেন দুই কোটি বিশ লাখ কালো মানুষের একজন যারা আজ আমেরিকার শিকার। আপনি এবং আমি কখনও গণতন্ত্র দেখিনি। জর্জিয়ার তুলাক্ষেতে কোন গণতন্ত্র আমাদের চোখে পড়েনি। হার্লেম, ব্রুকলিন, ডেট্রয়েট এবং শিকাগোর সড়কগুলোতে গণতন্ত্রের কোন চিহ্ন আমাদের চোখে পড়েনি। কোথাও কোনখানে আমরা গণতন্ত্র দেখিনি। সবখানে আমাদের চোখে পড়েছে শুধু ভ-ামি আর কপটতা। আমরা কোন আমেরিকান স্বপ্ন দেখিনি। শুধু দেখেছি আমেরিকান দুঃস্বপ্ন।’

ম্যালকম এক্সের উপরিউক্ত বক্তৃতার সাথে সাথে পর্দায় ভেসে ওঠা মার্কিন পতাকায় আগুন ধরে যায়। ধীরে ধীরে আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়ে গিয়ে পতাকাটি একটি ঢ আকৃতিতে রূপলাভ করে।

এই পতাকা পোড়ার সময় ইনসেটে মার্কিন পুলিশ কর্তৃক রডনি কিং এর প্রহৃত হওয়ার করুণ দৃশ্য তুলে ধরা হয়।

স্পাইক লী অত্যন্ত শক্তিশালী উপস্থাপনার মাধ্যমে এ চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। চলচ্চিত্রের শুরুতে যেমন ম্যালকম এক্সের সংগ্রামী জীবনের সূচনা তুলে ধরা ঠিক তেমনি শেষের দিকেও তাঁর জীবন চিত্রের মূল্যায়ন উপস্থাপিত হয়েছে। চলচ্চিত্রের শেষাংশে জনৈক শিক্ষিকা তাঁর ক্লাসরুমে বলছেন যে, আজ ১৯ মে, তারা ম্যালকম এক্সের জন্মদিন পালন করছে; কারণ, তিনি ছিলেন একজন মহান আফ্রো-আমেরিকান। শিক্ষিকার কণ্ঠ উচ্চারিত হয়েছে এভাবে- ‘ম্যালকম এক্স ছিলেন তোমাদেরই প্রতিভূ। তোমরাই ম্যালকম এক্সের প্রতিনিধি।’ তখন সাত বছর বয়েসী একদল আফ্রো-আমেরিকান বালক উঠে দাঁড়িয়ে এক সাথে ঘোষণা করে : ‘আমি ম্যালকম এক্স’।

এরপর পর্দায় তাদের জায়গায় দেখা যায় দক্ষিণ আফ্রিকার একদল বালক। পরেই ক্লাসরুমের সামনে ভেসে ওঠে (দাশিকি) দক্ষিণ আফ্রিকার জাতীয় পোশাক পরিহিত নেলসন ম্যান্ডেলার ছবি। তিনি ছাত্রদের উদ্দেশে বলছেন : ‘ভাই ম্যালকম যেমন বলেছেন, এই পৃথিবীর বুকে একদল মানুষ হয়ে বেঁচে থাকার জন্য, একজন মানুষের মর্যাদা লাভের জন্য, এই সমাজে আজকের এই দিনে আমরা আমাদের অধিকার ঘোষণা করছি এবং এই অধিকার বাস্তবায়নের জন্য আজ আমাদের দৃঢ় শপথ…।’

এই ভাষণ শেষ করা হয় ম্যালকমের নিজের একটি বাণী দিয়ে- ‘এই অধিকার বাস্তবায়িত করব আমরা যে কোন উপায়ে…।’

তারপর পর্দাজুড়ে দেখা যায় একটি ধূসর রংয়ের X এবং সেই সাথে শোনা যায় সংগীত কণ্ঠ- ‘কোন একদিন আমরা সকলেই হব মুক্ত।…’

এ ছায়াছবির বাণী আমাদের কাছে সুস্পষ্ট, সংগ্রাম চলবে। ম্যালকম এক্সের সংগ্রামের ফলশ্রুতিতে আমরা বিজয় লাভ করবই।

আমরা বিজয় লাভ করব এজন্য যে, অন্যায় আর অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে আমরা সেই মুক্তিসংগ্রাম চালিয়ে যাব।

ছবিটির নাটকীয় উপস্থাপনা এবং সমাপ্তির মাঝখানে নির্মাতা ম্যালকম এক্সের ঘটনাবহুল জীবনের বিভিন্ন দিক চমতকারভাবে তুলে ধরেছেন। এই ঘটনাচিত্র ম্যালকমের আত্মজীবনী থেকে নেয়া।

ছোট বেলায় তাঁর নাম ছিল ম্যালকম লিটল (Malcolm Little)। ১৯২৫ সালে নেব্রাডা অঙ্গরাজ্যের ওমাহাতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি যখন ছোট তখন শ্বেতকায় সন্ত্রাসী দল কু ক্লাক্স ক্লান (K K K) তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। তাঁর পিতাকে হত্যা করে। আর তিনি ইয়াতিম খানায় লালিত পালিত হন। স্কুল জীবন থেকেই তিনি শ্বেতকায়দের বৈষম্যের শিকার হন। তিনি আইন পড়তে চেয়েছিলেন, কিন্তু তাঁকে এই বলে নিরুতসাহিত করা হয়েছিল যে, একজন কালোর জন্য এ ধরনের উচ্চাশা পোষণ করা উচিত নয়। প্রথম জীবনে রেলওয়েতে তিনি একটি চাকরি করতেন। পরে নানারকম সামাজিক অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়েন। অপরাধে লিপ্ত থাকার কারণে তাঁকে বন্দি করে কারাগারে প্রেরণ করা হয়।

কারাগারে থাকতেই এলিজা মুহাম্মাদ এর জনৈক ভক্তের সাথে ম্যালকমের পরিচয় হয়। এলিজা মুহাম্মাদ ‘ন্যাশন অব ইসলাম’ নামের একটি দলের গুরু ছিলেন। তাঁর প্রচারিত ইসলাম ধর্মে অনেক বিকৃতি থাকলেও তাঁর শিক্ষার মাধ্যমেই ম্যালকম এক্স ইসলামের পরিচয় জানতে পারেন। কারাগারেই তিনি এলিজার শিষ্যের কাছ থেকে অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে কীভাবে মাথা তুলতে হয় সে শিক্ষা লাভ করেন।

১৯৫২ সালে কারাগার থেকে ছাড়া পেয়ে ম্যালকম পুরোদস্তুর এলিজা মুহাম্মাদের শিষ্য হয়ে যান। তিনি ‘নেশন অব ইসলাম’ এর সেবায় নিজেকে উতসর্গ করেন। কিন্তু নেশন অব ইসলামের কার্যকলাপ ম্যালকমকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। তিনি এলিজা মুহাম্মাদের বিশিষ্ট শিষ্যদের ভোগবিলাসিতা দেখে অসন্তুষ্ট হন এবং স্বয়ং এলিজার বহু বিবাহ তাঁর মাঝে সন্দেহকে আরও জোরালো করে তোলে। ক্রমে তিনি এলিজা মুহাম্মাদ প্রচারিত ইসলামের বিকৃতি উপলব্ধি করতে সক্ষম হন এবং ‘নেশন অব ইসলাম’ ত্যাগ করেন। কিন্তু এতে ইসলামের মৌলিক বিশ্বাসের প্রতি তাঁর আগ্রহ আরও প্রবল হয়ে ওঠে। মক্কায় হজ করতে এসে তিনি সত্যিকার ইসলামের পরিচয় লাভ করেন। তিনি বুঝতে পারেন যে, সকল সাদা মানুষই খারাপ নয়। মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব নির্ভর করে তার গুণাবলির ওপর, বর্ণ বা বংশের ওপর নয়।

ম্যালকম ইউরোপ ও আফ্রিকায় বিভিন্ন দেশ সফর করেন। ইউরোপ থেকে স্বদেশে ফিরে তিনি দেখতে পান তাঁর বাড়ি বোমা নিক্ষেপ করে জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। ইতিমধ্যেই তাঁর অনেক শত্রু সৃষ্টি হয়েছে। মার্কিন গোয়েন্দা বাহিনীর সাথে সাথে এলিজা মুহাম্মাদের অনুসারীরাও ম্যালকমের বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লাগে। কিন্তু ইসলামের সন্ধানপ্রাপ্ত ম্যালকম এক্স নির্ভয়ে তাঁর প্রচারণা চালিয়ে যেতে থাকেন। কালো আমেরিকানদের প্রতি যে যুক্তরাষ্ট্র অমানবিক আচরণ করছে তা তিনি সুস্পষ্ট ভাষায় জাতিসংঘের কাছে তুলে ধরেন। তাঁর বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই ভীষণ ততপর হয়ে ওঠে।

নিজের শেষ দিনগুলোতে ম্যালকম এক্স গোপন জীবনযাপন করতে বাধ্য হন। কিন্তু শত্রুরা শেষ পর্যন্ত তাঁর হদিস বের করতে সক্ষম হয়। ১৯৬৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি হার্লেমের এক ক্লাব কর্তৃক আয়োজিত জনসভায় তিনি ভাষণ দিতে আসেন। ইসলামের সত্য প্রকাশের অদম্য আগ্রহ তাঁর মাঝে গুমরে মরছিল। মঞ্চে উঠে সকলকে সম্ভাষণ জানিয়ে ‘সালামুন আলাইকুম’ বলার সাথে সাথেই অসংখ্য বুলেট এসে তাঁর দেহ ঝাঁঝরা করে ফেলে। সভার মাঝেই আততায়ীরা লুকিয়ে ছিল। এভাবেই এই প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর শাহাদাত বরণ করেন।

স্পাইক লীর এই ছায়াছবিটি বিংশ শতাব্দীর এক মহান বীরের প্রতি অসাধারণ এক শ্রদ্ধাঞ্জলি। ম্যালকম এক্স ছিলেন এমন এক প্রতিবাদী পুরুষ যিনি অপরাধ জগতের গভীর অন্ধকার থেকে ঊর্ধ্বে এসে সত্য ও সুন্দরের প্রতি ধাবিত হয়েছিলেন। তাঁর এই যাত্রা ছিল অপরাধ আর পাপ থেকে ক্ষমা প্রার্থনা আর শাহাদাতের পথে অভিযাত্রা। সত্যের সন্ধানে নিজের জীবন উতসর্গ করে ম্যালকম এক্স প্রমাণ করে দিয়ে গেছেন যে, আল্লাহ সকল শক্তির মালিক এবং সত্যের জন্য আত্মোতসর্গ করাই জীবনের শ্রেষ্ঠ লক্ষ্য হওয়া উচিত।

এ সত্যটিই স্পাইক লী তাঁর নির্মিত ‘ম্যালকম এক্স’ ছায়াছবির মাধ্যমে বেশ চমতকারভাবে আমাদের কাছে তুলে ধরেছেন।

অলংকরণ বিদ্যায় আরবি লিখনশৈলী

মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম

সৃষ্টিশীল মানবজাতির ক্রমবিবর্তনের ইতিহাসে আমরা আমাদের মনের ভাব ভাষার মাধ্যমে প্রকাশ করে থাকি। শিশুরা তাদের মায়ের ভাষায় কথা বলতে শিখে এবং এ মায়ের ভাষা হতে পৃথিবীর সবকিছুকে অনায়াসে জানতে, বুঝতে কিংবা চিনতে শিখে। ভাষা শিখবার জন্য তাদের কোনো প্রকার ট্রেনিং বা প্রশিক্ষণের প্রয়োজন পড়ে না। ভাব-বাচনক্ষমতা মানুষ জন্মসূত্রে পায়। মনের ভাব প্রকাশের জন্য পৃথিবীর একেক জাতি একেক ধরনের ভাষা ব্যবহার করে এবং ভাব প্রকাশ করার জন্য নানা প্রকৃতি বা প্রতীকীর আক্ষরিক চিহ্নের সৃষ্টি হয়েছে হাজার হাজার বছরের ব্যবধানে।

জগতে বর্ণমালা আবিষ্কার হবার অনেক পূর্বে অতি প্রাচীনকালে মানুষ নানারূপ সাংকেতিক চিহ্ন কিংবা নানা জীবজন্তুর মটিফ আকারে তা প্রকাশ করত। এ সাংকেতিক চিহ্ন ব্যবহারকে লিপি বিজ্ঞানীরা হায়ারোগ্লিফ্‌স (Hieroglyphs) নামে আখ্যা দিতেন। সে সময় এ পদ্ধতি এশিয়া মাইনর, সিরিয়া ও সিনাই দ্বীপে প্রচলিত ছিল। ব্যাবিলন হতে প্রাপ্ত পাথর এবং ইটের ওপর একপ্রকার কীলকাকার প্রতীক চিহ্নের ব্যবহার করা হতো। এ পদ্ধতিকে লিপিবিজ্ঞানীরা কিউনিফরম (Cuneform) বলতেন।

আধুনিক লিপিবিজ্ঞানী বা পণ্ডিতগণের মতে ফিনিসিয়ার অধিবাসীরা মিশরের হায়ারোগ্লিফ্‌স লিখন পদ্ধতির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বর্ণমালাভিত্তিক লিখন পদ্ধতির সূচনা করেছিল। তবে ফিনিসীয় বর্ণমালাভিত্তিক লিখন পদ্ধতি ও হায়ারোগ্লিফ্‌স পদ্ধতির মধ্যে বিরাট পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। সম্ভবত সিনাই উপদ্বীপে খ্রিস্টপূর্ব দুই সহস্র বছর আগে সিনাই তীরস্থ বর্ণমালা মিসরীয় হায়ারোগ্লিফ্‌স এবং ফিনিসীয় বর্ণমালাভিত্তিক লিখন পদ্ধতির মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করেছিল। যেমন : হায়ারোগ্লিফ্‌স পদ্ধতিতে ষাঁড়ের মাথা ফিনিসীয় ভাষায় ‘আলিফ’ অক্ষরের প্রতীক চিহ্নের মতো পরিলক্ষিত হতো।

আরবি লিপির উতপত্তি

ইতিহাসের বিভিন্ন তথ্য হতে জানা যায় যে, প্রথম বর্ণমালা সেমিটিক জাতির হাতে আবিষ্কৃত হয়েছিল। খ্রিস্টপূর্ব আঠারো শতকের শিলালিপিতে সেমিটিক আদিরূপ লক্ষ্য করা যায়। পরবর্তীকালে এ সেমিটিক লিপি উত্তর ও দক্ষিণ এ দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। উত্তর সেমিটিক লিপি হতে আবার আর্মায়িক, ক্যানানাই এবং গ্রীক লিপি এ তিনটি ভাগে ভাগ হয়ে যায়। এ আর্মায়িক লিপি হতে আরবি লিপির উতপত্তি।৩  অপরদিকে অনেক ঐতিহাসিকের মতে, আরবি লিপির উদ্ভাবনে ফিনিকীদের স্থান ছিল শীর্ষে। আরবরা বেদুঈন থাকার কারণে তারা এই আরবি লিপি সম্পর্কে মোটেই ওয়াকেফহাল ছিল না। ফিনিকীদের লিখন পদ্ধতি আবিষ্কারের ফলে আরামিগণ এ পদ্ধতি ক্রমান্বয়ে আয়ত্তে নিয়ে নতুন ‘আল-মুসুনদুল আরামি’ নাম দিল এবং পরবর্তীকালে ‘হুরানে আল-খাত্তুন্নাবাতী’ ও ইরাকে ‘আস্‌সতরূন্নাহিলী আস্‌সুরইয়ানী’ নামক দুই ভাগে ভাগ হলে এই দ্বিতীয় ধারাই আরবি লিপির মূল উতস বলে জানা যায়।

ইসলামের আবির্ভাবের কিছুকাল আগে হিরার অধিবাসীরা নাসাই ধর্মের অনুসারী ছিল। সেখানে সুরইয়ানী সংস্কৃতির ছিল জয়-জয়কার। নাবাতি লিপির প্রচলন তাদের মধ্যে ছিল খুবই কম। এতে সহজে অনুমেয় যে, হিরার অধিবাসীরা তা থেকে আরবি লিপির উদ্ভাবন করেছে। হিজাজসহ বিভিন্ন স্থানে প্রাপ্ত লিপি নিদর্শন থেকে এ তথ্য জানা যায় যে, আরামি লিপি (আর্মায়িক লিপি) নাবাতি লিপি, আরবি লিপির আকৃতি ধারণ করেছে। মুসলিম ঐতিহাসিকগণের মতে, পৃথিবীর আদি মানব হযরত আদম (আ.) সর্বপ্রথম কাদা-মাটি দিয়ে আরবি সুরইয়ানী এবং অন্যান্য ভাষার বর্ণমালা তৈরি করে রোদে শুকিয়ে আগুনে পুড়ে শক্ত করেন। কথিত আছে যে, হযরত নূহ (আ.)-এর মহাপ্লাবনের সময় আরবি ছাড়া সকল ভাষা হারিয়ে যায়। পরবর্তীকালে এ বর্ণমালা হযরত ইসমাঈল (আ.) কর্তৃক কিছুটা মার্জিত হয়। অতঃপর তাঁর সন্তানরা তাঁর এই আরবি বর্ণমালা শিক্ষা লাভ করেন। অপরদিকে ঐতিহাসিক মাসউদির মতে, মাদায়েনের বনু মুহসিন প্রথম আরবি লিপি ব্যবহার করে। উল্লেখ্য যে, ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, আরবি বর্ণমালা এক মূল শামী বর্ণমালা হতে উদ্ভূত।

আরবি লিপির সঠিক মত এই যে, আরবি লিপি হিজাজেই উন্নতি লাভ করে এবং বাণিজ্যের প্রয়োজনে হিজাজের অধিবাসীরা মাঈনি লিপি গ্রহণ করে। পরবর্তীকালে লেহয়্যানি, সামুদি এবং সফুরি নামক লিপিতে পরিবর্তিত হতে থাকে। নাবাতিদের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর আরামি বা আর্মায়িক লিপি গ্রহণ এবং সংস্কারের পর আরবি লিপির উতপত্তি হয়।

আরবি লিখনপদ্ধতির ইতিহাস

আরবি লিখনপদ্ধতি সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট উতস বা মত পাওয়া না গেলেও বর্ণিত তথ্যের আলোকে এটুকু বলা যায় যে, পৃথিবীর আদি পুরুষ হযরত আদম (আ.) আরবি, সিরীয় এবং অন্যান্য ভাষার বর্ণমালা উদ্ভাবন করে এই সবের মধ্যে ভাব আদানপ্রদান করেন। সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ তাআলা আদি পুরুষ হযরত আদম (আ.)-কে একে একে বিশ্বের সকল প্রাণী ও বস্তুর নাম এবং সেসবের প্রকৃতি সম্পর্কে অবহিত করান। অতঃপর আদম (আ.)-এর পুত্র হযরত শীষ (আ.) আরবি বর্ণ ও অক্ষরের কিছুটা উতকর্ষ সাধন করেন। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস বর্ণনা করেন যে, হযরত ইসমাঈল (আ.) মাত্র ১৪ বছর বয়সের সময় আরবি বর্ণমালায় লিখনপদ্ধতি চালু করেন। উপরিউক্ত দুটি মতের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে বলা যায়, অনেক পরে হযরত আদম (আ.)-এর আরবি বর্ণমালা হযরত ইবরাহীম (আ.) সংস্কার করেন। অতঃপর আবারো হযরত ইবরাহীম (আ.) কর্তৃক প্রবর্তিত আরবি লিপির প্রকৃত রূপদান করেন হযরত ইসমাঈল (আ.)। হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর অপর পুত্র হযরত ইসহাক (আ.) ও তাঁর বংশধরগণ সিরীয় বর্ণমালা ও আরবি ভাষার বিকাশ সাধন করেন। কারো কারো মতে আরবি লিপির উদ্ভব হয়েছে হযরত ইদরীস (আ.)-এর সময়, যিনি মাকালি বৈশিষ্ট্যের লিখনপদ্ধতিতে লিপির পূর্ণরূপ দান করেছেন।১০

আরবি বর্ণমালা তার পূর্ণরূপ পাবার পর প্রয়োজন অনুসারে সংকোচন ও সম্প্রসারণ করে ত্বরিত লেখার কাজ সমাধা ও অলংকরণের মাঝে ব্যবহার করার প্রেক্ষিতে সুন্দর হস্তলিখন পদ্ধতির উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ সাধিত হয়েছে। আরবি লিখনশৈলীর দ্রুত উন্নয়ন সাধনে লিপিকারদের অনেক বেশি ভূমিকা ছিল।

ইসলামের প্রাথমিক যুগ হতে কালক্রমে সুন্দর হস্তলিপি প্রশংসিত শিল্প হিসেবে ইসলামী আইনে অনুমোদনে সবার কাছে সমাদৃত হচ্ছে। হুসনে খাত বা সুন্দর হস্তলিখনের অধিকারী ব্যক্তি সমভাবে সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় পদমর্যাদাও লাভ করতেন। ক্যালিগ্রাফি বা অলংকৃত হস্তলিপির লিখনশিল্প উদ্ভবের প্রত্যক্ষ কারণ হিসেবে লিপিকার কর্তৃক লেখার মাধ্যমে কুরআন সংরক্ষণ পদ্ধতিকে উপস্থাপন করা যায়। মহানবী (সা.)-এর কাছে আল্লাহপ্রদত্ত ঐশীবাণীসমূহকে লিপিকার দ্বারা সুন্দর হস্তলিপির মাধ্যমে লিখে রাখা হতো। আর এ লিখনের সমষ্টিই হলো আল-কুরআন। সে সময় এ সুন্দর হস্তলিপিকারকে সামাজিক উচ্চতর মর্যাদা প্রদান করা হতো। মহানবী (সা.) উল্লেখ করেছেন : ‘ঐ ব্যক্তি বেশি উপার্জন করতে পারে যার হস্তাক্ষর সুন্দর।’১১ কুরআন মজীদে উল্লেখ আছে : ‘হে মুহাম্মাদ! তুমি তোমার প্রতিপালকের নামে পাঠ কর, যিনি তোমাকে কলমের সাহায্যে শিক্ষা দান করেছেন।’১২ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে : ‘আল্লাহ পাক সর্বপ্রথম যে বস্তুটি সৃষ্টি করেন তা হলো কলম।’১৩ কুরআনের ভাষা আরবি হবার কারণে প্রাক-ইসলামী যুগের লিপিকারদের দ্বারা কুরআনের ঐশীবাণীসমূহ লিখে রাখা শুরু হয়। অতঃপর মুসলিম শাসকগণ হস্তলিখন শিল্পীদেরকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দান করেছেন। ততকালীন রাষ্ট্রীয় শাসকগণ তাঁদের উচ্চতর বেতন, সামাজিক মর্যাদা, পদমর্যাদা এবং অত্যুতকৃষ্ট লেখনির জন্য অতি সম্মানজনক উপাধিতে ভূষিত করেছেন অর্থাত ততকালীন যুগে যাঁর হস্তাক্ষর তুলনামূলকভাবে ভালো ছিল তাঁকেই অধিক সম্মানের চোখে দেখা হতো।

এ সুন্দর হস্তলিখনশৈলী দিয়ে মহানবী (সা.)-এর সময় হুদায়বিয়ার সন্ধিপত্র লিখা হয়েছিল। শুদ্ধ ও সাবলীল আরবি ভাষায় এবং স্পষ্ট হস্তাক্ষরে পারস্যের সম্রাট খসরু পারভিজ, রোমান সম্রাট হিরাক্লিয়াস এবং মিশরের শাসক মুকাওকাসের নিকট দূত মারফত মহানবী (সা.) ইসলাম গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে পত্র প্রেরণ করেছিলেন।১৪ সম্ভবত মহানবী (সা.)-এর আমলে কুরআনের অবতীর্ণ অহীকে কুফী লিখনপদ্ধতিতে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছিল।

আরবি লিখনপদ্ধতি

পৃথিবীতে যুগে যুগে যত ভাষা সৃষ্টি হয়েছে তার ক্রমবিকাশও হয়েছে সাথে সাথে। তেমনি আরবি ভাষায় বিভিন্ন পদ্ধতিতে এর কোনো ব্যতিক্রম ঘটেনি কোনো কালে। কালের বিবর্তনে সৃষ্টি হয়েছে আরবি লিখনের নানা পদ্ধতি। সংক্ষিপ্তভাবে কয়েকটির ওপর আলোকপাত করা হলো।

প্রাথমিক পর্যায়ে তিন প্রকারের লিখনপদ্ধতি প্রচলিত ছিল। যেমন মুদাওয়ার (গোলাকার), মুসাল্লাস (ত্রিকোণাকৃতি) এবং তাইম (গোলাকার ও ত্রিকোণাকৃতির সংমিশ্রণ)। মুদাওয়ার এবং মাবসুত বা কৌণিক লিখন পদ্ধতি আরবি লিপিমালার প্রধান বৈশিষ্ট্য হিসাবে বিবেচিত হয়েছে।

খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতাব্দীতে আর্মেনীয় লিখনশৈলী হতে গোলাকার নাবাতীয় লিখনপদ্ধতির সৃষ্টি হয় যা পরবর্তীকালে উত্তর আরবে সাবলীল আরবি লিখনশৈলীতে পরিবর্তিত হয়। উল্লেখ্য যে, খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীর প্রারম্ভে নাবাতীয় বর্ণমালা হতে আরবি বর্ণমালার উদ্ভব হয়েছে।১৫ অপর সূত্র অনুযায়ী সিরীয় লিখনপদ্ধতি আরবি লিখনপদ্ধতির উতপত্তি হিসাবে বিবেচিত হয়েছে।১৬

এই গোলাকার লিখনপদ্ধতি অনেক সময় নাস্‌খ নামেও অভিহিত হতো। প্রাথমিক পর্যায়ে আরবি লিপিকৌশল নাবাতীয়দের গোলাকার এবং কৌণিক লিখনশৈলী হতে উদ্ভূত হয়েছে। তবে আরবি লিপি কোনোভাবে তার স্বকীয়তা হারায়নি। গোলাকার আরবি লিখনপদ্ধতির বিকাশে ইবনে মুকলাকে১৭ আকলামুসসিত্তা বা ছয়টি পদ্ধতির উদ্ভাবক হিসাবে গণ্য করা হয়। তাঁর উদ্ভাবিত লিখনপদ্ধতি চরম বিকাশ লাভ করেছিল। ক্রমান্বয়ে লেখার পরিধি বেড়ে গেলে দ্রুতি ও সহজ গতিতে লেখার অত্যধিক প্রয়োজনীয়তার কারণে সম্ভবত ৩১০ হিজরিতে বৃত্ত ও বিন্দুকে সামনে রেখে সুল্‌স, নাস্‌খ, মুহাক্‌কাক, রায়হান, তাহকী এবং রিকা নামক ছয়টি আরবি লিখনপদ্ধতির আবিষ্কার করে ফেলেন।১৮ আধুনিক পণ্ডিতগণের অনেকে নাস্‌খ ব্যতীত অপর পাঁচটি পদ্ধতিকে নাস্‌খের ভিন্নরূপ এবং লিখনশিল্পের অলংকরণ পদ্ধতি হিসেবে গণ্য করেন।১৯

নাবাতীয় লিখনপদ্ধতিতে ব্যবহৃত বর্ণ ও অক্ষরের প্রকৃতি সাধারণত গোলাকার এবং সিরীয় লিখনপদ্ধতিতে স্বরচিহ্ন অক্ষরের পৃথক্‌করণের জন্য নোকতা বা বিন্দু এবং শব্দ বিন্যাসের পদ্ধতি পরিলক্ষিত হয়। মাকালী পদ্ধতির লিখন বৈশিষ্ট্যের মধ্যে গোলাকার অক্ষরের অনুপস্থিতি এবং লম্ব ও উল্লম্ব দণ্ডের ব্যবহার বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।২০ আরবি বর্ণমালায় লম্ব দণ্ডের জন্য মাকালী পদ এবং গোলাকার আকৃতির জন্য নাবাতীয় পদ্ধতি এবং স্বরচিহ্ন ও অক্ষর প্রভৃতি পৃথক্করণের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত কৌশলে সিরীয় লিখনপদ্ধতি উতস হিসেবে গৃহীত হয়েছে বলে অনুমান করা যায়।

নাস্‌খ ও সুল্‌স লিখনপদ্ধতিতে ব্যবহৃত বর্ণের ঋজু দণ্ড এবং গোলাকার রেখার পরিমাণ সাধারণভাবে একই রূপ। উভয় পদ্ধতিতে আনুপাতিকভাবে বক্রাকৃতি ও গোলাকার বর্ণ এক তৃতীয়াংশ এবং লম্বদণ্ড ও ঋজু বর্ণ হবে দুই তৃতীয়াংশ। তবে সুল্স পদ্ধতিতে ব্যবহৃত অক্ষর হবে জলী বা স্পষ্ট প্রকৃতির এবং নাস্‌খ পদ্ধতিতে ব্যবহৃত বর্ণ হবে আনুপাতিকভাবে খদী বা ক্ষীণ ও সরু। কেউ কেউ মনে করেন যে, বক্রাকৃতি বর্ণ ও ঋজু দণ্ড সুল্‌স পদ্ধতিতে ব্যবহৃত বক্রবর্ণ ও ঋজু রেখার তিনগুণ হবে। মুহাক্কাক ও রায়হান পদ্ধতিতে ব্যবহৃত ঋজু দণ্ড এবং বক্রাকৃতি রেখা ও আনুভূমিক বাহুর আনুপাতিক ব্যবহার হবে যথাক্রমে তিন চতুর্থাংশ এবং এক চতুর্থাংশ। মুহাক্‌কাক পদ্ধতির লিপি হবে বলিষ্ঠ, স্পষ্ট এবং কলমের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করা যায়। রায়হান পদ্ধতিতে লিপি হতো সরু এবং কম কালি ব্যবহৃত হতো। তাও ও রিকা লিখনপদ্ধতিতে আনুপাতিক হারে সরল ও ঋজু দণ্ডের ব্যবহার হবে শব্দসমষ্টির এক চতুর্থাংশ এবং গোলাকার বর্ণ ও আনুভূমিক বাহুর ব্যবহার হবে তিন চতুর্থাংশ, তবে তাওকী হবে বলিষ্ঠ ও স্পষ্ট এবং রিকা হবে খদী বা ক্ষীণ ও সরু।২১ ইবনে মুকলার উদ্ভাবিত এই ছয়টি পদ্ধতি ভালোভাবে সমাদৃত হয়। পরবর্তীকালে শিলালিপি ও মুদ্রালিপি হিসেবে এই ছয়টি পদ্ধতি কুফী লিপি পদ্ধতির স্থলাভিষিক্ত হয়।২২

নাসতালিক পদ্ধতিতে ব্যবহৃত বর্ণের গোলাকার পরিসরকে বিস্তৃত করা হয় ও বাকসমূহকে চালু করা হয় এবং তা বিশেষভাবে শব্দ ও বর্ণের শেষ প্রান্তে লক্ষ্য করা যায়। লিপিমালাকে উত্তাল তরঙ্গের মধ্যভাগের ঢালু পরিসরের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। উপরন্তু সরলীকরণের মাধ্যমে কোনো কোনো বর্ণের দাঁত লোপ করে কলম এমনভাবে ব্যবহার করা হয় যে, তার ক্রমশ চালুরূপ লেখার ত্বরিত গতিতে সহায়তা করে। আরবি লিখনপদ্ধতিতে কুফী এবং নাস্‌খ ও তার স্বগোত্রীয় সুল্‌স, মুহাক্‌কাক ও রায়হান, তাওকী ও রিয়া এবং ফারসি লিখন পদ্ধতিসমূহের মধ্যে এই নাসতালিক পদ্ধতি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

খ্রিস্টীয় চতুর্থ ও পঞ্চম শতাব্দীর দিকে নাবাতীয় লিখনপদ্ধতি হতে সম্ভবত পেটরা এবং হিজয় শহরে আরবি লিখনপদ্ধতি জন্ম লাভ করে।২৩ উপরন্তু বলা হয়ে থাকে যে, প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার অন্তর্গত হীরা শহরে আরবি লিখনপদ্ধতির জন্ম। আবার কেউ কেউ মনে করেন যে, হিজায প্রদেশে আরবি লিখনপদ্ধতির ব্যবহার শুরু হয়েছে। অনেকের মতে নাবাতীয় বর্ণমালা হতে পাশাপাশি কৌণিক লিখনপদ্ধতি কুফী এবং গোলাকার লিখনপদ্ধতিতে নির্গত হয়েছে। তারপর লিখনপদ্ধতি উত্তর হিজাযের মক্কা ও মদীনায় প্রসার লাভ করে এবং কুফী লিখনপদ্ধতি মেসোপটেমিয়ায়, কুফা ও বসরা শহরে বিস্তার লাভ করে।

স্থূলভাবে বলা যায় যে, কৌণিক বক্রাকৃতি ও গোলাকার নাবাতীয় লিখনপদ্ধতি, সিরীয় পদ্ধতির বিন্দু ও স্বরচিহ্ন এবং মাকালী লিখনপদ্ধতির লম্ব দণ্ড সমীকরণের মাধ্যমে আররি লিখনপদ্ধতির একটি পূর্ণ কাঠামো সৃষ্টি হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে কৌণিক ও গোলাকার বর্ণ বৈশিষ্ট্যের সংমিশ্রণে কুফী লিখনপদ্ধতির উদ্ভব হয়। অনেক পণ্ডিত মনে করেন কুফা শহরে কৌণিক লিখনপদ্ধতি  প্রথমে ব্যবহার হবার কারণে তা কুফী নামধারণ করে। তুমার লিখনপদ্ধতিতে ব্যবহৃত বর্ণমালার লম্বদণ্ড ও আনুভূমিক বাহু আনুপাতিক হারে খর্বাকৃতি এবং কলমে পরিপূর্ণ কালি ব্যবহার করে ও তার মোটা অগ্রভাগ দিয়ে লেখার কাজ সম্পন্ন করা হয়। ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষার্ধে সিরিয়ায় নির্মিত একটি পিতলের দস্তানায় তুমার পদ্ধতির লেখা দেখতে পাওয়া যায়। গুবায় লিখনপদ্ধতিতে ব্যবহৃত বর্ণমালার উল্লম্ব দণ্ড ও আনুভূমিক বাহু অতি ক্ষীণ ও সরু। অক্ষরগুলোকে অনেকটা ভাসমান ধূলিকণার মতো প্রতীয়মান হয়। বিহার লিখনপদ্ধতিতে ব্যবহৃত বর্ণমালার দণ্ড ও সমান্তরাল রেখা আনুপাতিক হারে যথাক্রমে খর্বাকৃতি ও হ্রস্ব। অক্ষরের বাঁক কিছুটা কোণ সৃষ্টি করলেও ঢালু গতিতে রূপান্তর করা যায়। লিপির অন্তর্ভুক্ত অক্ষরের উল্লম্ব দণ্ড অথবা সমান্তরাল বাহু অন্য অক্ষরের অনুরূপ দণ্ড অথবা বাহুর মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দিয়ে কিংবা লিপির সারির উপরাংশে, মধ্যাংশে ও নিম্নাংশে অথবা অক্ষর সমষ্টির উতকীর্ণের দ্বারা লিখন শিল্পিগণ যে প্রাণবন্ত, গতিময় লিখনশৈলীর সৃষ্টি করেন তা লিখনশিল্পীর পরিভাষায় তোগরা পদ্ধতি হিসেবে পরিচিত হয়। এটি কোনো স্বতন্ত্র লিখনপদ্ধতি নয়; বরং লিখনশৈলীর অলংকরণ হিসেবে মনে করা হয়।২৪

আরবি লিখনশৈলীর অলংকরণের জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি পরিলক্ষিত হয়, যেমন- গুলযার, প্রথমে সীমানা নির্ধারণ করে ফুল-ফল, লতাপাতা এবং মাছ জাতীয় হলে মাহী আর ময়ূর জাতীয় হলে তাউস পদ্ধতি মনে করা হয়। বর্ণমালার বক্রাকৃতি রেখা কুঞ্চিত হয়ে ছোট গিরা সৃষ্টি করলে এবং কলমের আঁচড় প্রশস্ততার দিকে ক্ষীণ ও সূঁচালো আকারে ধারণ করলে তাকে যুলফী আরূস লিখনপদ্ধতি বলে। লারযা পদ্ধতির অক্ষরগুলো আঁকাবাঁকা গাছের শাখাপ্রশাখার মতো অর্থাত উত্তেজনাবশত কল্পিত হাতে লিখলে যেমন হয়। মানশুর বর্ণমালাকে মনে হয় যেন রেশমি ফিতাকে ভাঁজ করে প্রতিটি অক্ষর সৃষ্টি করা হয়েছে এবং অক্ষরের শেষাংশ মোড়ানো এবং দেখতে অনেকটা ঝালরের ভাঁজরূপ। আরবি লিখনশৈলিতে আরো অনেক ধরনের পদ্ধতি রয়েছে। সেগুলো হলো শিকাসতা, শাফিয়া হিলানী ইত্যাদি।

মুঘল সম্রাটগণের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতার ফলে ভারতীয় উপমহাদেশে হস্তলিখনশিল্পের প্রভূত উন্নতি হয়েছিল। তাঁদের সহযোগিতায় লিখনশৈলীর উন্নতি হলে প্রখ্যাত লিপিবিশারদগণ বিভিন্ন উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন। এসব উপাধির মধ্যে যাররীন কলম, বাদশা কলম, শিরীন কলম, আলবারীন কল, রওশন কলম এবং মুশকীন কলম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

সামাজিক মর্যাদায় লিখনশিল্পী

মহানবী (সা.)-এর যুগ থেকে শুরু করে উমাইয়্যা যুগ পর্যন্ত হস্তলিখন শিল্প সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে শিল্পীদের হাতে অপ্রতিরোধ্যভাবে বিকাশ লাভ করেছে। আব্বাসী আমলে লেখার উপকরণ হিসেবে কাগজের উদ্ভাবন হলে আরবি লিখনশৈলিতে প্রভূত পরিবর্তন সাধিত হয়। ফলে লিখনশৈলিকে অনেকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করে। আগেই বলা হয়েছে যে, যাঁর হস্তলিপি যত সুন্দর তিনি সমাজে তত অধিক মর্যাদাশালী এবং ধনবান ব্যক্তি হতেন। এমনকি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় তাঁদেরকে জায়গীর এবং ইকতা বরাদ্দ করা হতো। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, সেই আমলে বিক্রয়যোগ্য পুস্তকের অনুলিপি প্রস্তুত করে একজন হস্তলিপিকার দৈনিক তিন থেকে চার টাকা সমপরিমাণ প্রচলিত মুদ্রা অর্জন করতে পারতেন।২৫

এভাবে শিল্পীদের লেখনি দ্বারা রাজকীয় ফরমান, সনদ, সন্ধি, পাট্টা, দান, উপদেশ, ধর্মীয় বাণী, গুরুত্বপূর্ণ সরকারি তথ্য, রাজকীয় যোগাযোগের চিঠিপত্র, নিমন্ত্রণ পত্র, দলিল-দস্তাবেজসহ যে কোনো ধরনের পাণ্ডুলিপি ইত্যাদি লেখা হতো। লিখনশিল্পীদের সুহস্তলিপিসমৃদ্ধ না হলে সে যুগের জ্ঞানভাণ্ডার আমাদের কাছে আজও হয়তো অবরুদ্ধ থেকে যেত। বাহাউদ্দৌলার মন্ত্রী শাপুর বিন আরদাশীরের গ্রন্থাগারে এসব পুরানো হস্তলিপির প্রায় দশ হাজার এবং ত্রিপোলিতে বানু আম্মার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ফাতেমী গ্রন্থাগারে প্রায় ত্রিশ লক্ষ গ্রন্থ এবং স্পেনের গ্রানাডা নগর গ্রন্থাগারে চার লক্ষাধিক গ্রন্থ ও পাণ্ডুলিপি সংরক্ষিত ছিল।২৬ মিশরের আযীযবিল্লাহ তাঁর গ্রন্থাগারে ব্যবহারের জন্য প্রায় ষোল লক্ষ গ্রন্থ সংগ্রহ করেন।২৭ স্পেনের শাসক দ্বিতীয় হাকাম শিক্ষা সংস্কৃতির সাথে সম্পৃক্ত বিভিন্ন ধরনের মূল্যবান গ্রন্থ সংগ্রহের জন্য কায়রো, বাগদাদ, দামেস্ক এবং আলেকজান্দ্রিয়াতে লোক প্রেরণ করে তাঁর গ্রন্থাগারের সংগ্রহকে সমৃদ্ধশালী করে তুলেছিলেন।

দিল্লীর মামলুক সুলতান নাসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহ একজন উঁচু দরের হস্তলিখন শিল্পী ছিলেন। তিনি নিজ হাতে কুরআন শরীফ নকল ও টুপি সেলাই করে এবং বাজারে বিক্রি করে যা পেতেন তা দিয়ে কোনো রকমে সংসার চালাতেন। রাজপ্রাসাদ হতে কোনো কিছুই নিজের জন্য গ্রহণ করতেন না।

বিশ্ববিখ্যাত পরিব্রাজক ইবনে বতুতা ভ্রমণের এক সময়ে দিল্লিতে আসলে তিনি তাঁকে হস্তলিখিত কুরআন শরীফ দেখিয়েছিলেন।২৮ সুলতান ফিরুয শাহ একজন বিদ্বান এবং দক্ষ লিপিকার হিসাবে পরিচিত ছিলেন। তিনি বিহার লিখন পদ্ধতিতে কুরআনের অনুলিপি প্রস্তুত করতেন। তাঁর হস্তলিখিত একটি কপি বর্তমানে দিল্লির প্রত্নতাত্ত্বিক যাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে।২৯

সম্রাট শাহজাহানের জ্যেষ্ঠ পুত্র দারাশিকো এবং সম্রাট আলমগীরের কন্যা, আবদুর রশীদ দায়লামী (আ কা রশীদ)-এর নিকট থেকে হস্তলিখনশিল্পের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে দক্ষতা অর্জন করেন। মুঘল আমলে সম্রাট পরিবারের সদস্যগণ মোটামুটিভাবে দক্ষ ওস্তাদের কাছে বিভিন্ন ধরনের অলংকৃত ও সমৃদ্ধ আরবি লিখনশৈলী শিখতেন। শিক্ষক বা ওস্তাদদেরকে রাষ্ট্রীয়ভাবে অধিক সম্মানের চোখে দেখা হতো। এ কারণে বোধ করি লিখনশিল্পে মুঘল বাদশাদের কৃতিত্ব ছিল তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। স্বর্ণকার, কর্মকার, মৃতশিল্পী, বয়নশিল্পী, মুদ্রাকর এবং কাঠ ও পাথরে উতকীর্ণ শিল্পীর জন্য সুহস্ত লিখনের প্রশিক্ষণ গ্রহণ ছিল অত্যাবশ্যক। নানা শিল্পকর্মে শিল্পীরা একান্ত আপন চেষ্টার সাথে হস্তলিখনে সুস্পষ্ট দক্ষতার ছাপ রেখেছেন।

সম্রাট জহিরউদ্দিন মুহাম্মাদ বাবর হতে শুরু করে মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ পর্যন্ত সকল সম্রাটই হস্তলিখন শিল্পে পারদর্শিতা অর্জন করেন। সম্রাট আকবর, সম্রাট শাহজাহান এবং সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে আরবি লিখনশৈলীর বিভিন্ন পদ্ধতি এবং বিশেষ করে নাসতালিক লিখনপদ্ধতির পূর্ণ বিকাশ সাধিত হয়। সম্রাট আলমগীর একজন উঁচুমানের লিখনশিল্পী ছিলেন। তিনি নিজ হাতে সুন্দর লিখনশৈলী দিয়ে কুরআনের অনুলিপি করতেন এবং বিক্রয়লব্ধ অর্থ দিয়ে সংসার চালাতেন। প্রতি বছর রাজদরবারের কাজের অবসরে সুন্দর হস্তাক্ষরে নিজের হাতে কুরআনের অনুলিপি প্রস্তুত করে এবং মনোরম বাঁধাই করে দুটি কপি তিনি মদীনায় পাঠিয়ে দিতেন। যার প্রতিটি কপির মূল্য ছিল পাঁচ হাজার টাকার সমমানের।

ক্যালিগ্রাফি বা সুন্দর হস্তলিখন শিল্পের সৌন্দর্যে বিমুগ্ধ হয়ে মুসলমানদের বিশ্বাস সংক্রান্ত আরবি বাক্য, খ্রিস্টান শাসকদের নির্দেশ তাদের মুদ্রা ও স্থাপত্যে অনায়াসে উপস্থাপিত হয়েছে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, অষ্টম শতাব্দীর মারসিয়ার খ্রিস্টান শাসক অফফা তাঁর মুদ্রায় কুফী লিখনপদ্ধতির অলংকরণ বৈশিষ্ট্যের সাথে মিল রেখে কালিমা উতকীর্ণ করেন। অনুরূপভাবে নবম শতাব্দীর ব্রোঞ্জ নির্মিত একটি আইরিশ চিত্রের মধ্যস্থলে কুফী লিখনপদ্ধতিতে ‘বিসমিল্লাহ’ উতকীর্ণ হয়েছে। আরবি বর্ণমালার লিখনশৈলীর অলংকরণ বৈশিষ্ট্য খ্রিস্টান লিখনশিল্পীদের ওপর যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছিল। ফলশ্রুতি হিসাবে মধ্যযুগের ইতালী, স্পেন এবং ফ্রান্সের খ্রিস্টান গির্জা এবং সমাধি সৌধের স্থাপত্য অলংকরণে এরাবেক্স মটিফ এবং আরবি অলংকৃত লিখনপদ্ধতির সুকুমার ধারা উপস্থাপিত হয়েছে।

সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো যে, খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের লিখনশিল্পিগণ আরবি লিখনশৈলীর প্রতি অনুরক্ত কিংবা বিমোহিত হয়ে গির্জার প্রাচীরগাত্রে কুফী লিখনপদ্ধতিতে কুরআনের আয়াত উতকীর্ণ করতেন।৩০ সেন্ট পিটারের গির্জার সুউচ্চ প্রবেশ পথের প্রাচীর গাত্রে মুসলমানদের ধর্মীয় বিশ্বাস সম্বলিত বক্তব্য সুহস্ত লিখনে উতকীর্ণ রয়েছে। আরবি হস্তলিখন শিল্পের গতিশীল এবং আলংকারিক বৈশিষ্ট্য তাদের তুলনায় উতকৃষ্ট কিংবা শোভায় নয়নাভিরাম বিবেচিত না হলে খ্রিস্টান গির্জায় ও সমাধি সৌধে তা হয়তো কখনই স্থান পেত না।৩১

এম. এস. ব্রীগ্‌স মন্তব্য করেন যে, নবম শতাব্দীর কায়রোর ইবনে তুলুনের মসজিদের আরবি লিখনশিল্পের অলংকরণ বৈশিষ্ট্যের প্রভাব পরবর্তী গোত্রীয় স্থাপত্যের অলংকরণে লক্ষ্য করা যায়।৩২ ফ্রান্স, ইংল্যান্ড ও ইউরোপের আরো কয়েকটি দেশে স্থাপত্য অলংকরণ প্রক্রিয়ায় সুন্দর আরবি হস্তলিখন শিল্প প্রভৃতি বিস্তার লাভ করেছে। ওয়েস্ট মিনিস্টার অ্যাবের ক্যালিগ্রাফির কোন কোন অংশের অলংকরণ প্রক্রিয়ায় মুসলিম হস্তলিখন শিল্পের অলংকরণ বৈশিষ্ট্যের সুস্পষ্ট ছাপ রয়েছে বলে প্রফেসর লেঘারী মনে করেন। সিরিয়া, মুসেল, মিশর এবং পারস্যের রাই, ইসফাহান এবং বিভিন্ন স্থানে প্রাপ্ত স্বর্ণ, রৌপ্য, ব্রোঞ্জ ও পিতল ধাতবে নির্মিত আহার পাত্র, প্রদীপ, ফুলদানি, দোয়াত, ঝুড়ি, যুদ্ধের অস্ত্র, তলোয়ার, গদা-গুরুজ, কোচা এবং যুদ্ধের হেলমেট ইত্যাদির অবয়বের অলংকরণে সুন্দর সুন্দর হস্তলিখন পদ্ধতির অবয়ব লক্ষ্য করা যায়।৩৩ বিশ্বের বিভিন্ন যাদুঘরে সংরক্ষিত বিভিন্ন দ্রব্যাদির ওপর সুন্দর হস্তলিখন শিল্পের আরো উদাহরণ লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, অলংকরণ এবং সাজ-সজ্জার উপকরণ হিসাবে লিখনশিল্পকে কাজে লাগাতে শিল্পিগণ কখনো কোন শৈথিল্য প্রদর্শন করেননি। বিশেষভাবে আরবি বর্ণমালার লম্বদণ্ড ও বক্রাকৃতি রেখার সম্প্রসারণ ও সরলীকরণের সম্ভাবনা তাঁদের অলংকরণের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করার সুযোগ বৃদ্ধি করেছে।

বর্তমান যুগে ইসলামী ক্যালিগ্রাফি ইতিহাসের নিদর্শনের দিকে তাকালে পৃথিবীর বিভিন্ন যাদুঘরে এর সাক্ষ্য পাওয়া যায়। বিশেষ করে মুসলিম দেশসমূহের যাদুঘরগুলোতে কিছু কিছু নিদর্শন সংরক্ষিত রয়েছে। সেভাবে আমাদের জাতীয় যাদুঘরের কথা এসে যায়। বাংলাদেশ জাতীয় যাদুঘরে মহাকবি ফেরদৌসী রচিত শাহনামা, নিযামী কর্তৃক ৯৯৯ হিজরিতে লিখিত ‘মাখজানুল আসরার’ রয়েছে। মুঘল সম্রাট আলমগীরের আমলে ইসলাম ধর্মের বিধান সংক্রান্ত গ্রন্থ ‘ফতোয়া-ই-আলমগীরী’ সহ অনেক সুন্দর সুন্দর হস্তলিখিত অলংকৃত লিপি দেখতে পাওয়া যায়। অপরদিকে বিভিন্ন ধাতব পাত্রে নির্মিত শোভাযাত্রায় ব্যবহৃত কুঠার, ফিরাংগী, জম্বির, শামশির, আরাগুপ্তা কিরীচ, সুখেলা এবং গদা প্রভৃতিতে আরবি ক্যালিগ্রাফি দেখা যায়। অপরদিকে চীনামাটির থালা-বাসন, গ্লাস, কাপ-পিরিচ ইত্যাদিতে আরবিতে বিভিন্ন সূরার আয়াত লেখা হয়েছে এবং সেসব নিদর্শন অত্যন্ত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে থরে থরে সুন্দরভাবে গ্যালারিতে দর্শকদের জন্য প্রদর্শিত হয়েছে।

আরবি অলংকৃত লিপিশৈলীর ইতিহাসে কাগজ অনেকখানি স্থান জুড়ে রয়েছে। এ কারণে আলোচ্য নিবন্ধে কাগজের উদ্ভবের ক্রমবিকাশ ধারা একটু আলোকপাত করা হচ্ছে। ‘কাগজ’ ফারসি শব্দ। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কাগজের নাম রয়েছে। যেমন, আরবরা কিরতাস, ইংরেজরা পেপার, জার্মান কিংবা ফ্রেঞ্চরা পেপিয়ার, ল্যাটিনরা প্যাপিরাস৩৪, গ্রীকরা প্যাপুরস বলে। শব্দটি আসলে মিশরের। মিশরীয়রা তাকে প্যাপিরাস বলত।৩৫ সাইলুন (Ts’ai Lun) তন্তুজ মণ্ড থেকে কাগজ প্রস্তুত করে। অতঃপর মণ্ড থেকে উন্নত হয়ে ৬১০ খ্রিস্টাব্দে জাপানে, ৭১৫ খ্রিস্টাব্দে সমরকন্দে, ৯০০ খ্রিস্টাব্দে মিশরে, ১১৫০ খ্রিস্টাব্দে স্পেনে, ১২৭৬ খ্রিস্টাব্দে ইটালিতে, ১৩৪৮ খ্রিস্টাব্দে জার্মানিতে, ১৪৯৫ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডে ক্রমাগতভাবে উন্নততর হতে হতে অবশেষে ১৬৯০ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকায় প্রথম আধুনিক কাগজের কল স্থাপিত হয়।৩৬

চীনদেশে ৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে প্রথম কাঠের ওপর খোদাই করে টাইপ বানিয়ে ছাপ নেয়া হতো। ১৪৪০ খ্রিস্টাব্দে জার্মানির গুটেনবার্গ স্থানান্তর উপযোগী টাইপ উদ্ভাবন করেন। ১৪৪৫ খ্রিস্টাব্দে প্রথম ম্যাজারিন বাইবেল মুদ্রিত হয়। ছাপাখানার দ্রুত প্রসারে ১৪৬৫ খ্রিস্টাব্দে ইটালিতে, ১৪৬৮ খ্রিস্টাব্দে সুইজারল্যান্ডে, ১৪৭০ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সে, ১৪৭৩ খ্রিস্টাব্দে হল্যান্ডে, ১৪৭৪ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডে ছাপাখানা স্থাপিত হয়। ভারতবর্ষে সর্বপ্রথম ছাপাখানা প্রবর্তন করে পর্তুগীজরা। ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে ৭ সেপ্টেম্বর পোলায়েত মুদ্রণ যন্ত্র আনার পর ১৫৫৭ খ্রিস্টাব্দে প্রথম পুস্তক ছাপা হয়। ১৪৪৩ খ্রিস্টাব্দে লিসবনে ব্রাহ্মণ-রোমান ক্যাথলিক, ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে মাদ্রাজে, ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে হুগলিতে ‘গ্রামার অব দি বেংগল ল্যাংগুয়েজ’ নামক গ্রন্থটি মুদ্রিত হয়। ছাপাখানায় গ্রন্থ, দলিলপত্র ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র মুদ্রিত হতে লাগল।

মুদ্রণযন্ত্র ও লিথোটাইপ পদ্ধতির আবির্ভাবের ফলে হস্তলিখনে লিপিকলার প্রয়োগ ও কার্যকারিতা হ্রাস পেতে শুরু করে এবং এই শিল্পের তাতপর্য কিংবা গুরুত্ব ক্রমশ লোপ পায়। এসব আরবি হস্তলিপি আজ দেশের বিভিন্ন যাদুঘরে ঠাঁই নিয়েছে নিভৃতে শো-কেসের বাক্সে। এই আরবি অলংকৃত লিপি (Calligraphy) আজ আমাদের কাছে সত্যিই এক ইতিহাস হয়ে রয়েছে। তবুও বলতে হয় এক সময় আরবি ক্যালিগ্রাফির ইতিহাস জগদ্বিখ্যাত ছিল। অতএব, ডেকোরেটিভ বা অলংকৃত হস্তলিখন শিল্পের অবদান ঐতিহাসিক পর্যালোচনার মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ।

টীকাসমূহ

১. এ. কে. এম. ইয়াকুব আলী : মুসলিম মুদ্রা ও হস্তলিখন শিল্প, বাংলা একাডেমী, ১৯৮৯ ইং, পৃ. ২৯৭-২৯৮

২.  P.K. Hitti, History of the Arabs, London, McMillan & Co. LTD. 9th edition, 1968. Page 71

৩. মোহাম্মদ আব্দুল কাইউম : পাণ্ডুলিপি পাঠ ও পাঠ সমালোচনা, বাংলা একাডেমী, ১৯৭৬, পৃ. ১৬৫

৪. মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম : পাণ্ডুলিপি : সচিত্র বাংলাদেশ, ১১ বর্ষ, ১০ সংখ্যা, ৩০ এপ্রিল, ১৯৯০, পৃ. ২৪

৫. মোহাম্মদ রবিউল ইসলাম : আরবি লিপির উতপত্তি ও ক্রমবিকাশ : দৈনিক ইনকিলাব, ১৯ জুলাই, ১৯৮৭, পৃ. ৬, কলাম নং ৫-৮

৬. আল-কুরতুবী আল-কাস্‌দ : মাকতাবা আল-কুদ্‌সী, কায়রো, ১৩৫০ হিজরি, পৃ. ১১, ১৯-২০

৭. আল-কুরআন : সূরা আল-বাকারা, আয়াত নং ৩০

৮. Qadi Ahmed : Gulistan-i-Hunr, Tr. By: T. Minorsky, Calligraphers and painters. Page 52

৯. আল-কুরতুবী, আল-কাস্‌দ : প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা নং ১৭

১০. Abdul Fadi Allami : Ain-i-Akbari; Vol-1, Tr. By: H. Blochmann. Calcutta. Asiatic Society of Bengal: 1973. Page 99

১১. T.W. Arnold : Painting in Islam, New York; 1965, Page-2

১২. আল-কুরআন : সূরা আল-আলাক : আয়াত ১-৪

১৩. Qadi Ahmed : Ibid. Page 49

১৪. এ. কে. এম. ইয়াকুব আলী : প্রাগুক্ত, পৃ. ৩০২

১৫. K.S.M. Zafar Hasan: Specimen of Calligraphy in the Delhi Museum of Archaeology, No 29:1926: Page 1.

১৬. তালাতবে : তারীখ সুয়াল-ই-আরব, এলাহাবাদ, ১৩১৫ হিজরি, পৃ. ৫৮

১৭. Qadi Ahmed: Ain-i-Akbari, Vol. 1, Page 99

১৮. Al Nadim: Kitab-at-Phirist, Page 91, 125 & 130

১৯. Qadi Ahmed: Ibid, Page 56

২০. M. Ziauddin: Moslem Calligraphy, Calcutta, 1936, Page 60

২১. Qadi Ahmed: Ain-i-Akbari, Vol. 8, Page 57

২২. এ. কে. এম. ইয়াকুব আলী : প্রাগুক্ত, পৃ. ৩১৪

২৩.  D. Diringer: The Alphabet, London, 1947, Page 271

২৪. Douglass Barret: Islamic Metal Work in the British Museum: London; The Trustees of the Museum, 1949, Page 22

২৫. M. Ziauddin: Ibid, Page 31

২৬. M. Ziauddin: Ibid, Page 35

২৭. ইবনে খালদুন : তারীখ, কায়রো, ১২৮৪ হিজরি, ভলিউম ৪, পৃ. ৮১

২৮. Ibn Batuta: Rihla: Tr. By Agha Mahdi Husain: Baroda, 1983. Page 35

২৯. Memoirs of Archaeological Survey of India, No. 29, Specimen No. 3

৩০. এ. কে.এম. ইয়াকুব আলী : প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা নং ৩৪০

৩১. S.P. Scott: History of the Moorish Empire in Europe. Vol No. 111, Ch. 29

৩২. The Legacy of Islam. 1931, Page 178

৩৩. Douglass Barret: Ibid: Plate No’s 14, 22, 24, 28, 30, 31.

৩৪. The Compact Edition of the Oxford English Dictionary: Vol. 11, 1972.

৩৫. Encyclopaedia Britannica, Vol. 13, 15th Edition. Page 968

৩৬. The New Columbia Encyclopaedia, 4th Edition. Page 2062

ইরান ও ইসলামের মহান ব্যক্তিত্ব

এ. কে. এম. মাহবুবুর রহমান

ইরানে আম্বিয়ায়ে কেরাম

যেসব নবী ইরানে জন্মগ্রহণ করেছেন বা শুয়ে আছেন তাঁদের সংখ্যা অনেক। কয়েকজনের নাম নিম্নে উপস্থাপন করা হলো :

১. হযরত ইবরাহীম (আ.)

২. হযরত ইসহাক (আ.)

৩. হযরত ইয়াকুব (আ.)

৪. হযরত শোআইব (আ.)

৫. হযরত শাম বিন নূহ (আ.)

৬. হযরত হাম বিন নূহ (আ.)

৭. হযরত রুবিল বিন ইয়াকুব (আ.)

৮. হযরত বেলাভী বিন ইয়াকুব (আ.)

৯. হযরত সালেহ (আ.)

১০. হযরত আইয়ুব (আ.)

১১. হযরত দানিয়াল (আ.)

১২. হযরত জুলকাফ্‌ল (আ.)

১৩. হযরত হায্‌কীল (আ.)

১৪. হযরত ইসমাইল বিন হায্‌কীল (আ.)

১৫. হযরত খেজের (আ.)

১৬. হযরত জারজীস (আ.)

১৭. হযরত হায়াকুক (আ.)

১৮. হযরত সালাম (আ.)

১৯. হযরত সালুম (আ.)

২০. হযরত সাহুলী (আ.)

২১. হযরত আলকিয়া (আ.)

২২. হযরত শামউন (আ.)

 হযরত ইবরাহীম (আ.)

তিনি ততকালীন ব্যাবিলন বা বাবেলে জন্মগ্রহণ করেন। এই বাবেল বর্তমান ইরাক, ইরান ও তুরস্কের বিরাট অঞ্চল নিয়ে গঠিত ছিল। হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর জন্মস্থান নিয়ে মতভেদ আছে। তবে ইবনে জারীর তাবারী লিখেন, কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে তাঁর জন্মস্থান ছিল আহওয়াজ এলাকার শুশে।

আহওয়াজ পশ্চিম ইরানের খুজিস্তান প্রদেশের কেন্দ্রীয় শহর। শুশ তারই একটু উত্তরে অবস্থিত। ইবনুল আসীর লিখেছেন : হযরত ইবরাহীম (আ.) আহওয়াজ এলাকার নিকটবর্তী শুশে জন্মগ্রহণ করেন।

হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর মাযার বর্তমানে ফিলিস্তিনের আল খলিল শহরে। ইসরাইলি বাহিনী এ পবিত্র মাযারের বিরাট অংশ উড়িয়ে দিয়েছে। তবে নমরুদ যে চরকা দিয়ে হযরত ইবরাহীম (আ.)-কে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করেছিল তা এখনো তুরস্কে বিদ্যমান রয়েছে।

হযরত ইসহাক (আ.)

হযরত ইসহাক (আ.) হলেন হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর দ্বিতীয় পুত্র। অনেকের মতে তাঁর মাযার বাইতুল মোকাদ্দাসে অবস্থিত। তবে ইরানের পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর দেযফুলের পাশে অবস্থিত হযরত ইসহাক (আ.)-এর পবিত্র মাযার সম্পর্কে ‘তাজকিরাতুল আখইয়ার’ গ্রন্থে এরূপ লিপিবদ্ধ রয়েছে : এ অঞ্চলের পবিত্র স্থানের মধ্যে দেযফুল থেকে প্রায় ১৭ কিলোমিটার দূরে রয়েছে হযরত ইসহাক বিন ইবরাহীম (আ.)-এর পবিত্র মাযার।

হযরত ইয়াকুব (আ.)

ইরানের শুশতার শহরের অদূরে দেযফুল নদীর পাড়ে রয়েছে হযরত ইয়াকুব (আ.)-এর পবিত্র মাযার। তিনি ছিলেন হযরত ইসহাক (আ.)-এর দ্বিতীয় পুত্র। যাঁর অপর নাম ইসরাইল। এ নাম থেকেই বনি ইসরাইল বংশের উতপত্তি হয়।

হযরত শোআইব (আ.)

তাঁর মাযার শুশতার শহরের পার্শ্ববর্তী হুচ্ছামাবাদ এলাকায় অবস্থিত।

হযরত সাম বিন নূহ (আ.) এবং হযরত হাম বিন নূহ (আ.)

তাঁদের মাযার ইরানের সেমনান শহরের পাশে অবস্থিত। সে এলাকা বোকআয়ে দো’পয়গাম্বর হিসেবে প্রসিদ্ধ। হযরত নূহ (আ.)-এর মহাপ্লাবনের পর গোটা অঞ্চলের নবী ছিলেন এ দু’ভাই।

হযরত রুবিল (আ.)

তাঁর মাযার দেযফুল নদীর পাড়ে শুশতার শহরের অদূরে অবস্থিত। তিনি ছিলেন হযরত ইউসুফ (আ.)-এর ভাই।

হযরত বেলাভী (আ.)

তাঁর মাযারও দেযফুল নদীর পাড়ে শুশতার শহরের অদূরে হযরত শামউন ও ইসহাক (আ.)-এর মাযারের পার্শ্বেই অবস্থিত।

হযরত সালেহ (আ.)

তাঁর পবিত্র মাযার শুশতার শহরে অবস্থিত। একটি ছোট টিলার ওপর এ মাযার রয়েছে। একটি মাটির ঘরের উত্তর-পশ্চিম কোণে শুয়ে আছেন এ মহান পয়গাম্বর।

হযরত আইয়ুব (আ.)

দীর্ঘ আঠারো বছর পর্যন্ত অসুস্থ থাকার পর আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁকে আরোগ্য দান করেন। তাঁর ও তাঁর স্ত্রী বিবি রহিমার পবিত্র মাযার ইরানের শিরাজের অদূরে একটি পল্লিতে অবস্থিত। তবে আল্লাহ তাআলার নির্দেশে যে কূপে গোসল করে তিনি আরোগ্য লাভ করেন সে কূপটি এখনো তুরস্কে রয়েছে। এখনো হাজার হাজার মানুষ রোগমুক্তির জন্য সেখানে গোসল করতে যায়।

হযরত দানিয়াল (আ.)

তাঁর জন্ম বাইতুল মোকাদ্দাসে। তাঁর মাযার রয়েছে পশ্চিম ইরানের শুশ দানিয়াল শহরে।

হযরত জুলকাফ্‌ল

জুলকাফ্‌ল ও হযরত হাযকীল (আ.) একই ব্যক্তি না দু’ব্যক্তি এ নিয়ে মতভেদ আছে। তবে অধিকাংশ ঐতিহাসিক মতে কুরআনে বর্ণিত জুলকাফ্ল আর ইতিহাসের হাযকীল একই ব্যক্তি। ‘জুলকাফ্‌ল’ অর্থ ‘জামিনদার’। আর ‘হাযকীল’ অর্থ ‘আল্লাহ কর্তৃক শক্তিপ্রাপ্ত’। তাঁর মাযার সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে। তবে কোন কোন বর্ণনায় বলা হয়েছে যে, ইরানের দেযফুলের পার্শ্ববর্তী একটি গ্রামে তাঁর মাযার রয়েছে।

হযরত ইসমাইল বিন হাযকীল (আ.)

তিনিও বনি ইসরাইলের নবী ছিলেন। যখন বখতে নাসর বাইতুল মোকাদ্দাসে আক্রমণ করে তখন হযরত ইসমাইলের পিতা ইরানের শুশতারে আগমন করেন। সে সময় হযরত ইসমাইল (আ.) জন্মগ্রহণ করেন।

হযরত খেজের (আ.)

ইরানের শুশতারে জন্মগ্রহণ করেন। এখানো তাঁর স্মৃতিকে স্মরণ করার জন্য শুশতার-আহওয়াজ সড়কের পাশে একটি গম্বুজ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।

হযরত হায়াকুক (আ.)

হযরত দানিয়াল (আ.)-এর সমসাময়িক। ইরানের হামাদান প্রদেশের তুসেরকান শহরে তাঁর মাযার অবস্থিত।

হযরত সালাম, সালুম, সাহুলী ও আলকিয়া (আ.)

তাঁরা ছিলেন বনি ইসরাইলের নবী। তাঁদের চারজনের মাযার ইরানের কাযভীন শহরে একই স্থানে অবস্থিত।

হযরত শামউন (আ.)

তিনি ছিলেন হযরত হাযকীলের সময়কার নবী। শুশতারে তাঁর মাযার অবস্থিত।

ইমাম, আরেফ ও অলিগণ

১. হযরত আলী ইবনে মূসা আর রেযা (আ.)

তিনি ছিলেন হযরত ইমাম হোসাইন (আ.)-এর বংশধর। তিনি খলিফা মামুনুর রশিদের আমলে মুসলিম উম্মাহর ইমামতের দায়িত্ব পালন করেন। ইরানের খোরাসান প্রদেশের মাশহাদ শহরে তাঁর মাযার অবস্থিত।

২. হযরত ওয়াইস আল-কারনী (রা.)

তিনি ছিলেন ইয়েমেনের লোক। ইরানের পশ্চিমাঞ্চলীয় বাখতারান-সানান্দাজ সড়কের অদূরে একটি টিলার ওপরে তাঁর মাযার অবস্থিত।

৩. হযরত বায়েজীদ বোস্তামী (রহ.)

ইরানের সেমনান প্রদেশের শাহরোদ থেকে অল্প দূরে বোস্তাম (বাস্তাম) শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জীবনের প্রায় ত্রিশ বছর সফরে অতিবাহিত করেন। ধারণা করা হয় যে, এ সফরে তিনি বাংলাদেশের চট্টগ্রামে কিছুদিন অবস্থান করেছিলেন। বর্তমানে চট্টগ্রামে অবস্থিত মাযার সেই স্মৃতি বহন করছে। তবে তিনি শেষ জীবনে নিজ জন্মভূমি বোস্তামে ফিরে যান। ২৬১ হিজরিতে তিনি ইন্তেকাল করেন। বোস্তাম শহরে এখনো হাজার হাজার লোক তাঁর মাযার যিয়ারত করে থাকেন।

৪. হযরত ফুজাইল বিন আয়াজ (রহ.)

ইরানের মারভে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৮৭ হিজরিতে ইন্তেকাল করেন।

৫. হযরত সাহল বিন আবদুল্লাহ তাসতরী (রহ.)

ইরানের শুশতারে জন্মগ্রহণ করেন। ২৮৭ হিজরি মতান্তরে ২৯৩ হিজরিতে তিনি ইন্তেকাল করেন।

৬. হযরত হোসাইন বিন মানসুর হাল্লাজ (রহ.)

ইরানের র্ফাস প্রদেশের অন্তর্গত বায়জা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। ফানাফিল্লাহর সর্বোচ্চ মাকামে পৌঁছে ‘আনাল হক’ (আমিই খোদা)- এ কথা বলায় ৩০৬ হিজরিতে তাঁকে ফাঁসি দেয়া হয়।

৭. হযরত আবু বকর শিবলী (রহ.)

তিনি ছিলেন ইরানের খোরাসানের লোক। তবে বাগদাদেই তাঁর জীবন অতিবাহিত হয়। তিনি ৩৩৪ থেকে ৩৪৪ হিজরির মধ্যবর্তী সময়ে ইন্তেকাল করেন।

৮. হযরত আবু আলী রোদবারী

ইরানের মাযানদারান প্রদেশের রোদবার শহরে জন্মগ্রহণ করেন। ৩২২ হিজরিতে তিনি ইন্তেকাল করেন।

৯. হযরত আবু নাস্‌র সিরাজ তূসী (রহ.)

তিনি ইরানের তূসে জন্মগ্রহণ করেন। মাশহাদ শহরের অদূরে পীরে পালান্দোজ নামে খ্যাত তাঁর মাযার রয়েছে। তিনি ৩৭৮ হিজরিতে ইন্তেকাল করেন।

১০. হযরত আবুল ফজল সারাখ্‌সী (রহ.)

তিনি খোরাসানের অধিবাসী ছিলেন। তিনি ছিলেন আবু নাস্‌র সিরাজীর মুরীদ এবং বিশ্ববিখ্যাত আরেফ আবু সাঈদ আবুল খায়ের (রহ.)-এর শিক্ষক। ৪০০ হিজরিতে তিনি ইন্তেকাল করেন।

১১. আবু তালিব মাক্কী (রহ.)

তিনি ইরানের জাবাল শহরের লোক ছিলেন। বহু বছর মক্কায় অবস্থান করায় মাক্কী হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। তাঁর বিরচিত ‘কুউওয়াতুল কুলূব’ অধ্যাত্মিক জগতের গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হিসেবে প্রসিদ্ধ। তিনি ৩৮৫ হিজরিতে ইন্তেকাল করেন।

১২. শেখ আবুল হাসান খারাকানী (রহ.)

তিনি ছিলেন বিশ্ববিখ্যাত অলি। ইরানের সেমনান প্রদেশের শাহরোদ শহরের অদূরে খারাকান নামক স্থানে তাঁর জন্ম এবং সেই শহরেই তাঁর পবিত্র মাযার অবস্থিত। বিশ্ববিখ্যাত আলেম দুনিয়ার প্রথম শাইখুল ইসলাম হযরত খাজা আবদুল্লাহ আনসারী (রহ.) এবং বিজ্ঞানী ইবনে সীনা (রহ.) ছিলেন তাঁর মুরীদ। ৪২৫ হিজরিতে তিনি ইন্তেকাল করেন।

১৩. হযরত আবু সাঈদ আবুল খায়ের নিশাপুরী (রহ.)

তিনি ছিলেন নিশাপুরের অধিবাসী। এ বিশ্ববিখ্যাত অলি ৪৪০ হিজরিতে ইন্তেকাল করেন।

১৪. ইমাম আবু হামেদ মুহাম্মাদ গাজ্জালী তূসী (রহ.)

খোরাসান প্রদেশের তূস নগরে জন্মগ্রহণ করেন। ৫০৫ হিজরি সনে তিনি তূসে ইন্তেকাল করেন। তূস নগরীতে তাঁর মাযার অবস্থিত।

১৫. হযরত আহমদ গাজ্জালী (রহ.)

তিনি ছিলেন উঁচু পর্যায়ের অলি। তিনি ছিলেন হযরত ইমাম গাজ্জালীর ভাই। তাঁর চেষ্টাতেই ইমাম গাজ্জালী মহাসত্যের সন্ধান পেয়ে ‘এহইয়ায়ে উলুমিদ্দীন’ গ্রন্থ রচনা করেন। ইরানের কাজবীন শহরের আহমদিয়া মসজিদের পাশেই তাঁর মাযার রয়েছে।

১৬. হযরত আইনুল কোজাত হামেদানী (রহ.)

তিনি ছিলেন ইরানের হামেদান প্রদেশের লোক। তিনি ছিলেন হযরত আহমদ গাজ্জালী (রহ.)-এর মুরীদ। আল্লাহপ্রেমে মগ্ন হয়ে বাহ্যিকভাবে শরীয়তের বরখেলাফ কথা বলায় ৫২৫ হিজরিতে তাঁকে হত্যা করে তাঁর পবিত্র শরীর জ্বালিয়ে দেয়া হয়।

১৭. হযরত আহমদ জামী যিন্দেপীল (রহ.)

তিনি ছিলেন তুরবতে জামের অধিবাসী। ইরানের আফগান সীমান্তবর্তী তুরবতে জামেতে এ মহান অলির পবিত্র মাযার অবস্থিত। তিনি ৫৩৬ হিজরিতে ইন্তেকাল করেন।

১৮. হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহ.)

ইরানের গিলান প্রদেশের রাশ্ত শহরের অদূরে সূমে সারা নামক অঞ্চলে ৪৭০ হিজরিতে জন্মগ্রহণ করেন। ঐ শহরে তাঁর মহীয়সী মাতা উম্মুল খায়ের ফাতেমা (রহ.)-এর মাযার রয়েছে। তিনি সে এলাকায় ‘সাইয়্যেদা নেসা’ হিসেবে পরিচিত। বড় পীর (রহ.) ৫৬১ হিজরিতে বাগদাদে ইন্তেকাল করেন। বাগদাদে তাঁর মাযার অবস্থিত।

১৯. হযরত শেখ নাজমুদ্দিন কোবরা (রহ.)

তিনি ইরানের খোরাসান প্রদেশের খারযেম শহরের অধিবাসী ছিলেন। হালাকু খান যখন মুসলিম সভ্যতার কেন্দ্র ধ্বংস করছিল তখন তাঁর প্রভাব-প্রতিপত্তি দেখে এ মর্মে সংবাদ পাঠাল যে, শেখ আপনি এলাকা ছেড়ে বাইরে চলে যান। তিনি উত্তর দিলেন- ‘আমি সুখের দিনগুলোতে জনগণের পাশে ছিলাম আর এ বিপদের দিনে তাদেরকে ছেড়ে যেতে পারব না।’

এ কথা বলে বীর বেশে জেহাদের পোশাক পরিধান করে জেহাদ করে মুসলিম জনগোষ্ঠীর সাথে ৬১৬ হিজরিতে শাহাদাত বরণ করেন।

২০. শেখ ফরিদ উদ্দিন আত্তার নিশাপুরী (রহ.)

তিনি ছিলেন বিশ্ববিখ্যাত আরেফ কবি। তিনি খোরাসান প্রদেশের নিশাপুরের অধিবাসী ছিলেন। তিনি কত বড় আল্লাহর অলি ছিলেন তা বিশ্ববিখ্যাত আরেফ মাওলানা রুমী (রহ.)-এর একটি শ্লোক হতে সহজেই অনুমেয়।

هفت شهر عشق را عطار گشت

ما هنوز اندر خم یک کوچه ایم

‘আত্তার এশকের ৭টি শহরে পরিভ্রমণ করেছেন, কিন্তু আমরা এখনো (ঐ শহরের) একটি গলিতে দাঁড়িয়ে আছি।’

৬২৬ হিজরিতে তিনি মঙ্গলদের হাতে শাহাদাত বরণ করেন।

২১. শেখ শিহাবুদ্দীন সোহরাওয়ার্দী (রহ.)

তিনি ছিলেন ইরানের জানজানের অধিবাসী। তিনি ছিলেন বড় পীর (রহ.)-এর মুরীদ। আর তাঁর মুরীদ ছিলেন শেখ সাদী (রহ.)। ৬৩২ হিজরিতে তিনি ইন্তেকাল করেন। তাঁর রচিত ‘আওয়ারেফুল মাআরেফ’ আধ্যাত্মিক জগতে একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হিসেবে পরিগণিত।

২২. মাওলানা জালাল উদ্দিন মুহাম্মাদ বাল্‌খী রুমী (রহ.)

তিনি তৎকালীন ইরানের খোরাসানের বাল্‌খে ৬০৪ হিজরিতে জন্মগ্রহণ করেন। বর্তমানে এ স্থানটি রাশিয়ায় অবস্থিত। তিনি ছিলেন শেখ শাম্‌সে তাবরিযী (রহ.)-এর মুরীদ। তাঁর অমর কাব্য ‘মসনবী’ শরীফ। ৬৭২ হিজরিতে তিনি বর্তমান তুরস্কের কৌনিয়া শহরে ইন্তেকাল করেন। এখনো সেখানে তাঁর মাযার রয়েছে।

২৩. হযরত আলাউদ্দৌলা সেমনানী (রহ.)

তিনি ছিলেন ইরানের সেমনানের অধিবাসী। তাঁর রচিত ‘আল উরওয়াতুল লি আহলিল খালওয়াতি ওয়াল জালওয়াহ’ একটি বিশ্ববিখ্যাত আধ্যাত্মিক গ্রন্থ। তিনি ৭৩৪ হিজরিতে ইন্তেকাল করেন। সেমনানে তাঁর মাযার অবস্থিত।

২৪. হযরত আবদুর রাযযাক কাশানী

তিনি ছিলেন ইরানের কাশানের অধিবাসী। তিনি হযরত ইবনুল আরাবী (রহ.)-এর ‘ফুসুলুল হিকাম’ ও খাজা আবদুল্লাহ আনসারী (রহ.)-এর ‘মানাযিলুস সায়েরীন’ গ্রন্থের ব্যাখ্যা লিখেন। তিনি ৭৩৫ হিজরিতে ইন্তেকাল করেন।

২৫. হযরত খাজা হাফেয শিরাজী (রহ.)

তিনি বিশ্ববিখ্যাত আরেফ কবি হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। তাঁর ‘দিওয়ানে হাফেয’ বিশ্ব সাহিত্যের অমর নিদর্শন হিসেবে সমাদৃত। হাফেয ৭৯১ হিজরিতে ইন্তেকাল করেন। ইরানের শিরাজ নগরে তাঁর মাযার অবস্থিত।

২৬. শাহ নেয়ামত উল্লাহ অলি (রহ.)

তিনি আলেপ্পোতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন কেরমানের অধিবাসী। বিশ্ববিখ্যাত অলিদের তালিকায় তাঁর নাম শীর্ষভাগে রয়েছে। ৮২০ হিজরিতে তিনি ইন্তেকাল করেন। ইরানে কেরমান প্রদেশের মাহানে তাঁর মাযার অবস্থিত।

২৭. শামসুদ্দিন মুহাম্মাদ লাহিজী নূর বাখ্‌শী (রহ.)

তিনি ছিলেন শিরাজের অধিবাসী। তিনি মাহমুদ শবাস্তরীর ‘গুলশানে রায়’ এর ব্যাখ্যা লিখেন। নবম হিজরি শতকের শেষ দিকে তিনি ইন্তেকাল করেন।

২৮. নুরুদ্দিন আবদুর রহমান জামী (রহ.)

তিনি ইরানের খোরাসান প্রদেশের তুরবতে জাম শহরে জন্মগ্রহণ করেন এবং আহমদ জাম যিন্দেপীল (রহ.)-এর মুরীদ ছিলেন। এজন্য তিনি জামী হিসেবে প্রসিদ্ধ। তিনি ৮৯৮ হিজরিতে ইন্তেকাল করেন।

২৯. ইয়াহইয়া মায়াজ রাযী (রহ.)

তিনি ছিলেন ইরানের রেই শহরের অধিবাসী। শেখ ফরিদ উদ্দিন আত্তার (রহ.) তাঁকে প্রথম শ্রেণির অলি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। নিশাপুরে মা’মার গোরস্তানে তাঁর মাযার অবস্থিত।

৩০. হযরত তাহের বিন যায়নুল আবেদীন (রহ.)

তিনি ছিলেন হযরত ইমাম বাকেরের ভাই। ইরানের রাজধানী তেহরানের দক্ষিণ পার্শ্বস্থ শাহ আবদুল আযীমে তাঁর মাযার অবস্থিত।

৩১. হযরত বাবা তাহের উরইয়ান (রহ.)

তিনি ছিলেন হামেদানের অধিবাসী। হামেদানের উপকণ্ঠে তাঁর মাযার অবস্থিত।

৩২. শেখ আলাউদ্দিন (রহ.)

তিনি ছিলেন আবদুল কাদের জিলানী (রহ.)-এর নানার পিতা। তাঁর মাযার তেহরানের মৌলভী নামক স্থানে অবস্থিত।

৩৩. শাহ চেরাগ (রহ.)

তিনি ছিলেন হযরত ইমাম রেযা (আ.)-এর ভাই। তাঁর মাযার ইরানের শিরাজে অবস্থিত।

৩৪. শেখ সাদী (রহ.)

তিনি ছিলেন আরেফ কবি। তাঁর বিশ্ববিখ্যাত ‘গুলিস্তান’ গ্রন্থ বিশ্ব সাহিত্যে অমর কীর্তি হিসেবে সমাদৃত। ইরানের শিরাজ নগরীতে তাঁর মাযার অবস্থিত।

৩৫. শেখ আহমদ নাজ্জার আস্তারাবাদী (রহ.)

তিনি ছিলেন খোরাসানের আস্তারাবাদ এলাকার বাসিন্দা।

৩৬. শেখ আবু যোরআ আরদাবেলী (রহ.)

তিনি আরদাবেল শহরে জন্মগ্রহণ করেন। ৪১৫ হিজরিতে ইন্তেকাল করেন। ইরানের শিরাজে তাঁর মাযার অবস্থিত।

৩৭. খাজা ইউসুফ হামেদানী (রহ.)

তিনি ছিলেন ইরানের হামেদানের বাসিন্দা। শেখ মহিউদ্দীন ইবনুল আরাবী তাঁর ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।

৩৮. শেখ হাসান সাককাক সেমনানী (রহ.)

তিনি সেমনানের অধিবাসী ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন উঁচু স্তরের অলি।

৩৯. শেখ জিয়াউদ্দিন আবুন্নাজিব আবদুল কাহের সোহরাওয়ার্দী (রহ.)

তিনি ছিলেন বিখ্যাত অলি। তাঁর রচিত গ্রন্থ ‘আদাবুল মুরীদিন’ আধ্যাত্মিক জগতের মশালস্বরূপ। ৫৩৬ হিজরিতে ইন্তেকাল করেন।

৪০. শেখ নাজিমুদ্দিন রাযী (রহ.)

তিনি ইরানের রেই শহরে জন্মগ্রহণ করেন। ৬৫৪ হিজরিতে তিনি ইন্তেকাল করেন। বাগদাদে শেখ জুনাইদ বাগদাদী (রহ.)-এর মাযারের পাশেই তাঁর মাযার অবস্থিত।

৪১. শেখ আবু আবদুল্লাহ আসসাওমেয়ী (রহ.)

তিনি ছিলেন গিলান প্রদেশের সুমেসারা অঞ্চলের অধিবাসী। তিনি ছিলেন আবদুল কাদের জিলানী (রহ.)-এর নানা।

৪২. খাজা কুতুবুদ্দিন ইয়াহইয়া জামী নিশাপুরী

তিনি নিশাপুরে জন্মগ্রহণ করেন। ৭৪০ হিজরির ২১ জমাদিউল আখেরে তিনি ইন্তেকাল করেন। আফগানিস্তানের হেরাতের ফিরোজাবাদ গেটে তাঁর মাযার অবস্থিত।

৪৩. শেখ আওহাদ উদ্দীন হামেদ কেরমানী (রহ.)

তিনি ছিলেন ইরানের কেরমানের অধিবাসী। তিনি আরেফ কবি হিসেবে প্রসিদ্ধ।

৪৪. হযরত ইবরাহীম আদহাম (রহ.)

তিনি ছিলেন বালখের বাদশাহ। বাল্খ ছিল ততকালীন ইরানের খোরাসান এলাকারই একটি অংশ। তিনি ১৬১ হিজরিতে বাগদাদে ইন্তেকাল করেন এবং বাগদাদের চোকাইন কিল্লায় তাঁর মাযার অবস্থিত।

৪৫. হযরত আবুল কাসেম কোশাইরী (রহ.)

তিনি ছিলেন নিশাপুরের অধিবাসী। তিনি ৩৭৬ হিজরিতে নিশাপুরে ইন্তেকাল করেন। তাঁর ‘রেসালায়ে কুশাইরিয়া’ আধ্যাত্মিক জগতের অনন্য গ্রন্থ হিসেবে প্রসিদ্ধ।

৪৬. হযরত আবু আবদুল্লাহ দাস্তানী (রহ.)

‘শাইখুল মাশায়েখ’ হিসেবে প্রসিদ্ধ। তিনি ছিলেন খোরাসানের অধিবাসী। ৪১৭ হিজরিতে ইন্তেকাল করেন।

৪৭. হযরত আবু আবদুর রহমান সালামী (রহ.)

তিনি ৩২৫ হিজরির ১০ জমাদিউল আখের নিশাপুরে জন্মগ্রহণ করেন। ৪১২ হিজরির ৩ শাবান নিশাপুরেই ইন্তেকাল করেন। তাঁর রচিত ‘তাবাকাতুস সুফিয়া ওয়া তারিখুস সুফিয়া’ একটি প্রসিদ্ধ গ্রন্থ।

৪৮. হযরত খাজা আবদুল্লাহ আনসারী (রহ.)

তিনি ছিলেন দুনিয়ার সর্বপ্রথম শাইখুল ইসলাম। তিনি ৩১৬ হিজরি মতান্তরে ৩৯৫ হিজরির ২ শাবান জন্মগ্রহণ করেন। ৪৮১ হিজরির যিলহজ মাসে তিনি আফগানিস্তানের হেরাতে ইন্তেকাল করেন। তিনি ছিলেন হযরত আবু আইউব আনসারী (রা.)-এর বংশধর। ‘পীরে হেরাত’ নামে তিনি খ্যাত। তাঁর রচিত ‘মানাযিলুস সায়েরীন’ এবং ‘তাফসীরে কাশফুল আসরার’ আধ্যাত্মিক জগতের অনন্য গ্রন্থ হিসেবে পরিগণিত। তিনি ছিলেন হযরত আবুল হাসান খারাকানী (রহ.)-এর মুরিদ।

৪৯. হযরত মুহাম্মাদ বিন কেরাম (রহ.)

তিনি ছিলেন সুলতান মাহমুদ গজনভীর সময়ের সিসতানের অধিবাসী। কিছুদিন আহমাদ বিন হার্‌ব (১৭৬-২৩৪ হি.) এর কাছে প্রশিক্ষণ লাভের পর নিশাপুরে গমন করেন। ফিলিস্তিনের জেহাদে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে তিনি মুরিদদের বিরাট বাহিনী নিয়ে জেরুজালেম গমন করেন। ২৫৫ হিজরিতে সেখানেই ইন্তেকাল করেন।

তাঁর রচিত ‘আযাবুল কাব্‌র’ গ্রন্থখানি গবেষকদের দৃষ্টি আকৃষ্ট করেছে।

৫০. হযরত হাকিম তিরমিযী (রহ.)

তিনি খোরাসানের তিরমিয এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন। ২৮৫ হিজরিতে মতান্তরে ২৯৬ হিজরিতে তিনি তিরমিযেই ইন্তেকাল করেন। তাঁর রচিত গ্রন্থ ‘খাতামুল বেলায়াতে ওয়া এলালুশ শারায়ে’ ততকালে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।

৫১. হযরত আবুল হাসান আল-হাজবিরী (রহ.)

তিনি ‘দাতা গাঞ্জে বাখ্‌স’ হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। তিনি ছিলেন গজনীর হাজবীরের অধিবাসী। ৪৫৬ হিজরিতে লাহোরে (পাকিস্তান) ইন্তেকাল করেন। লাহোরেই তাঁর মাযার অবস্থিত। তাঁর রচিত ‘কাশফুল  মাহজুব’ বিশ্ববিখ্যাত গ্রন্থ হিসেবে সমাদৃত।

৫২. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মোবারক (রহ.)

তিনি ছিলেন ততকালীন খোরাসানের মার্‌ভের অধিবাসী। তিনি যেমন ছিলেন উচ্চ পর্যায়ের ফকিহ ও মুহাদ্দিস তেমনই ছিলেন উচ্চ পর্যায়ের একজন অলি। জীবনের বেশিরভাগ সময়ই বাগদাদ ও মক্কা মোকাররমায় কাটিয়েছেন। তাঁর জীবনপদ্ধতি সম্পর্কে বলা হয়েছে : ‘এক বছর হজ করতেন, এক বছর বাতিলের বিরুদ্ধে জিহাদ ও এক বছর ব্যবসা করতেন। আর নিজের (ব্যবসালব্ধ) আয় তাঁর অনুসারীদের মাঝে বণ্টন করতেন।’ ১৮১ হিজরিতে ইরাক ও সিরিয়ার মধ্যবর্তী ‘হেইত’ নামক স্থানে তিনি ইন্তেকাল করেন।

৫৩. হযরত আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মাদ বিন খাফিফ বিন ইসফাকশাদ আদ্দাবরী (রহ.)

২৬৮ হিজরিতে ইরানের শিরাজে জন্মগ্রহণ করেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলায় জীবনের ত্রিশ বছর তাঁকে কারাগারে থাকতে হয়। কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তিনি আলেমে রাব্বানী হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেন।

এ মহান ব্যক্তির প্রতিষ্ঠিত পন্থাকে তরীকায়ে খাফিফিয়া বলা হয়। তিনি পঁচিশটিরও অধিক গ্রন্থ রচনা করেন। তার মধ্যে ‘শারফুল ফোকারা’, ‘আওসাফুল কুলুব’, ‘কিতাবুল একতেসাদ’ সমধিক প্রসিদ্ধ। তিনি ৩৭১ হিজরির ২৩ রমযান ইরানের শিরাজে ইন্তেকাল করেন। তাঁর মাযারে অসংখ্য লোকের সমাগম হয়ে থাকে।

৫৪. হযরত আবু আলী শাকীক বিন ইবরাহীম বাল্‌খী (রহ.)

তিনি ছিলেন ততকালীন খোরাসান প্রদেশের বাল্‌খের অধিবাসী। ১৭৪ হিজরিতে বাল্‌খের খাতলাল অঞ্চলে শাহাদাত বরণ করেন। খাতলাল শহরে এখনো তাঁর মাযার বিদ্যমান।

৫৫. হযরত দাউদ বাল্‌খী (রহ.)

তিনি ছিলেন বাল্‌খের অধিবাসী। ১৭৪ হিজরিতে বাল্‌খেই তিনি ইন্তেকাল করেন।

৫৬. হযরত খাজা মাঈনুদ্দিন চিশতী আজমিরী (রহ.)

তিনি ইরানের সিসতান প্রদেশের সিন্‌জ নামক শহরে ৫৩৬ হিজরির ৬ রজব জন্মগ্রহণ করেন। ৬৩৩ হিজরির ৬ রজব ভারতের আজমীরে তিনি ইন্তেকাল করেন। তিনি ‘খাজায়ে হিন্দ’, ‘খাজা গরীব নওয়াজ’ হিসেবে প্রসিদ্ধ। তিনি ছিলেন চিশতীয়া তরিকার প্রতিষ্ঠাতা।

৫৭. হযরত আবু নাস্‌র শিরাজ তূসী (রহ.)

তিনি ছিলেন ইরানের খোরাসান প্রদেশের তূসের অধিবাসী। তিনি ‘তাউসুল ফোকারা’ হিসেবে খ্যাত ছিলেন। ৭৮ হিজরিতে তিনি ইন্তেকাল করেন।

৫৮. হযরত আবু নাস্‌র বেশর বিন আল-হারেস আবুদর রহমান হাফি (রহ.)

তিনি তৎকালীন খোরাসানের মার্‌ভ অঞ্চলের অধিবাসী। ২২৭ হিজরির ১০ই মুহররম তিনি বাগদাদে ইন্তেকাল করেন।

৫৯. হযরত আবুল হাসান আহমদ বিন মুহাম্মাদ নূরী (রহ.)

তাঁর পূর্বপুরুষগণ ছিলেন খোরাসানের লোক। তাঁর পিতা খোরাসান থেকে বাগদাদে হিজরত করেন। তিনি ছিলেন নূরিয়া তরীকার প্রতিষ্ঠাতা। ২৮৮ হিজরিতে তিনি ইন্তেকাল করেন।

৬০. হযরত আবু ইসহাক নিশাপুরী (রহ.)

তিনি ছিলেন ইরানের নিশাপুরের অধিবাসী। ২৬৯ হিজরিতে তিনি নিশাপুরেই ইন্তেকাল করেন।

৬১. আবু বকর মুহাম্মাদ বিন মূসা ওয়াসেতী খোরাসানী (রহ.)

তিনি ছিলেন খোরাসানের অধিবাসী। তিনি ৩২০ হিজরিতে ইন্তেকাল করেন।

৬২. আবুল কাসেম ইবরাহীম বিন মুহাম্মাদ নাস্‌রবাদী (রহ.)

তিনি ছিলেন নিশাপুরের নাস্‌রাবাদ এলাকার অধিবাসী। তাঁকে ‘শেইখে খোরাসান’ বলা হতো। তিনি ৩৬৯ হিজরিতে ইন্তেকাল করেন।

৬৩. হযরত আবু আলী হাসান বিন দাককাক নিশাপুরী (রহ.)

তিনি ৪০৫ হিজরিতে ইন্তেকাল করেন।

৬৪. হযরত হাফেজ আবু নাঈম ইসফাহানী (রহ.)

তিনি ইসফাহানের লোক। ৪৩০ হিজরিতে তিনি ইন্তেকাল করেন। তাঁর রচিত ‘হুলইয়াতুল আউলিয়া’ গ্রন্থখানিতে তিনি ৪র্থ হিজরি শতকের পূর্বেকার ৬৮৯ জন বিশ্ববিখ্যাত অলির জীবনী তুলে ধরেছেন।

৬৫. হযরত সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ রাযাভী (রহ.)

তিনি ইরানের নিশাবুরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি হাজী বোকতাশ অলি হিসেবে খ্যাত ছিলেন। তিনি ছিলেন বোকতাশিয়া তরীকার প্রতিষ্ঠাতা। ৭৩০, মতান্তরে ৭৩৮ হিজরিতে তিনি ইন্তেকাল করেন।

৬৬. হযরত জামাল উদ্দিন আরসিস্তানী (রহ.)

তিনি ইরানের ইসফাহান প্রদেশের আরদিস্তানে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন ‘কাশফুল আরওয়াহ’, ‘রুহুল কুদ্‌স’, ‘মিশকাতুল মুহিব্বীন’ সহ বহু মূল্যবান গ্রন্থের রচয়িতা। ৮৭৯ হিজরিতে তিনি ইন্তেকাল করেন। তিনি ছিলেন জামালিয়া তরীকার প্রতিষ্ঠাতা।

৬৭. হযরত শামসুদ্দিন মুহাম্মাদ বিন মালেকদাদ তাবরিযী (রহ.)

তিনি ‘শামছে তাবরিযী’ হিসাবে খ্যাত। মাওলানা রুমী তাঁর সান্নিধ্যে থেকে আধ্যাত্মিকতা অর্জন করেন। তিনি ৬৪৫ হিজরিতে ইন্তেকাল করেন।

৬৮. হযরত মুহাম্মাদ মাসুম শিরাজী (রহ.)

তিনি ছিলেন শিরাজের অধিবাসী। এছাড়া তিনি ছিলেন মাসুম আলী শাহ তরীকার প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর উপাধি ছিল ‘নায়েবুস সাদ্‌র’। তাঁর রচিত বিশ্ববিখ্যাত গ্রন্থ ‘তারায়েকুল হাকায়েক’ আধ্যাত্মিক জগতের এক অমূল্য গ্রন্থ।

৬৯. হযরত আবু আবদুর রহমান হাতেম বিন হালওয়ান আসাম বাল্‌খী (রহ.)

তিনি ছিলেন খোরাসান প্রদেশের বাল্‌খের অধিবাসী। ২৩৭ হিজরিতে তিনি ইন্তেকাল করেন।

৭০. হযরত আবু আহমদ বিন খাজরোবী বাল্‌খী (রহ.)

তিনি ছিলেন বাল্‌খের লোক। ২৭০ হিজরিতে তিনি ইন্তেকাল করেন।

৭১. হযরত আবু মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ বিন মুহাম্মাদ মারতাআশ নিশাপুরী (রহ.)

তিনি ছিলেন ইরানের নিশাপুরের অধিবাসী। ৩২৮ হিজরিতে তিনি ইন্তেকাল করেন।

৭২. হযরত আবু ওমর মুহাম্মাদ বিন ইবরাহীম যুজাজী (রহ.)

তিনি ছিলেন উচ্চ পর্যায়ের অলি। ৩৪৮ হিজরিতে তিনি ইন্তেকাল করেন।

৭৪. হযরত আবু মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ বিন মুহাম্মাদ বিন আবদুর রহমান রাযী শারানী নিশাপুরী (রহ.)

তিনি ছিলেন ইরানের নিশাপুরের অধিবাসী। ৩৫৩ হিজরিতে তিনি ইন্তেকাল করেন।

৭৫. হযরত আবু আহমদ আবদাল চিশতী (রহ.)

তিনি ইরানের সিসতান প্রদেশে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ৩৫০ হিজরিতে ইন্তেকাল করেন।

৭৬. হযরত আবু ইসহাক ইবরাহীম কাযরুনী (রহ.)

তিনি ইরানের ফার্স প্রদেশের কাযরুনে জন্মগ্রহণ করেন। ৪২৫ হিজরিতে তিনি ইন্তেকাল করেন।

৭৭. হযরত আবু আবদুল্লাহ শিরাজী বাবাকুহী (রহ.)

তিনি ছিলেন শিরাজের লোক। তিনি ‘বাবাকুহী’ হিসেবে প্রসিদ্ধ। শিরাজের একটি পাহাড়ের ওপর তাঁর মাযার। ৪২ হিজরিতে তিনি ইন্তেকাল করেন।

৭৮. হযরত আবু বকর নাসসাজ তূসী (রহ.)

তিনি ছিলেন খোরাসান প্রদেশের তূস শহরের অধিবাসী। ৪৮৭ হিজরিতে তিনি ইন্তেকাল করেন।

৭৯. হযরত আবুল মাজ্‌দ মাজদুদ বিন আদম সানায়ী গজনভী (রহ.)

তিনি ছিলেন বিশ্ববিখ্যাত আরেফ কবি। ৫৩৫ হিজরিতে তিনি ইন্তেকাল করেন।

৮০. সাইয়্যেদ বোরহান উদ্দিন মুহাক্কেক তিরমিযী (রহ.)

তিনি ছিলেন খোরাসান প্রদেশের তিরমিয নামক স্থানের অধিবাসী। তিনি ৬৩৮ হিজরিতে ইন্তেকাল করেন।

৮১. হযরত সা’দ উদ্দিন হামাভী (রহ.)

তিনি ছিলেন খোরাসানের অধিবাসী। ৬৫০ হিজরিতে তিনি ইন্তেকাল করেন।

৮২. হযরত আমীর সাইয়্যেদ আলী বিন শিহাবুদ্দিন হামেদানী (রহ.)

তিনি ছিলেন ইরানের হামেদান প্রদেশের অধিবাসী। ৭৮৪ হিজরিতে তিনি ইন্তেকাল করেন।

৮৩. হযরত আবু সালেহ হামদুন বিন আহমদ বিন আম্মারেহ কাসসার নিশাপুরী (রহ.)

তিনি ছিলেন কাসসারিয়া তরীকার প্রতিষ্ঠাতা। ২৭১  হিজরিতে তিনি ইন্তেকাল করেন।

৮৪. হযরত আবুল আব্বাস কাসেম বিন আবিল কাসেম বিন আবদুল্লাহ বিন আল-মাহদী (রহ.)

তিনি ছিলেন ইরানের ততকালীন খোরাসানের মার্‌ভ নামক স্থানের অধিবাসী। তিনি ছিলেন সাইয়ারিয়া তরীকার প্রতিষ্ঠাতা। ৩৪২ হিজরিতে তিনি ইন্তেকাল করেন।

(অসমাপ্ত)

‘মুহাম্মদ (স)’ ছায়াছবি দর্শকদের কাছে ব্যাপক সমাদৃত

ইরানের খ্যাতনামা চলচ্চিত্র পরিচালক মাজিদ মাজিদির নির্মিত মহানবীর জীবনআলেখ্যভিত্তিক ছায়াছবি ‘মুহাম্মদ রাসূলুল্লাহ (স)’ বিশ্বের দর্শকদের কাছে ব্যাপক সমাদৃত হয়েছে। প্রদর্শনী শুরু হওয়ার এক সপ্তাহের কম সময়ের মধ্যে ছবিটি ১০ এর মধ্যে ৮.৯ রেটিং অর্জন করেছে। চলচ্চিত্র বিষয়ক ওয়েবসাইটগুলো এ হিসাব দিয়েছে।

গত ২৭ আগস্ট ইরানের রাজধানী তেহরানসহ ১১ শহরের ১৪৩টি প্রেক্ষাগ্রহে এই ছায়াছবির প্রথম পর্বের প্রদর্শন শুরু হয়। একই সময়ে কানাডার মন্ট্রিল চলচ্চিত্র উৎসবের আওতায় সেখানকার দু’টি সিনেমা হলে দেখানো হয়েছে ইরানের ইতিহাসের সবচেয়ে ব্যয়বহুল এই ছায়াছবি।

চলচ্চিত্র ও টিভি অনুষ্ঠান সংক্রান্ত জনপ্রিয় ও নির্ভরযোগ্য উৎস ইন্টারন্যাশনাল মুভি ডাটাবেজ বা আইএমডিবি’র হিসাব অনুযায়ী- বিশাল বাজেটের এ চলচ্চিত্রটি দর্শকরা ব্যাপকভাবে গ্রহণ করেছেন। আইএমডিবি’র ওয়েবসাইটে এ ছবি নিয়ে নিজেদের আনন্দ অনভূতি তুলে ধরতে দ্বিধা করেন নি পরিতৃপ্ত দর্শকরা।

এক দর্শক লিখেছেন, শেষ ছবি নির্মাণের আট বছর পর আবারও চমক দেখালেন মাজিদ মাজিদি। এবারে তাকে ছবি নির্মাণে সহায়তা করেছেন চলচ্চিত্র জগতের খ্যাতিমান অনেকেই; ক্যামেরার পেছনে ছিলেন তারা। তাদের নিয়েই মহানবীর শিশুকালের ছবি তৈরি করেছেন মাজিদ মাজিদি।

ছবিটির এ দর্শক আরো লিখেছেন, এ পর্যন্ত যে সব ছবি দেখেছি তার মধ্যে সিনেমাটোগ্রাফির দিক থেকে এটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ। চলচ্চিত্রটিতে কম বয়সী নায়কের সঙ্গে সঙ্গে ক্যামেরা যেন উড়ে বেড়িয়েছে।  ছবিটি দেখতে যেয়ে গ্যালারিতে অনবদ্য চিত্রকলা দেখার অনুভূতি হয় বলে মন্তব্য করেন এ দর্শক।

কানাডার অপর এক দর্শক আইএমডিবি’তে লিখেছেন, ‘আর্ট ফিল্মের জগতের রাজাধিরাজ হলেন মাজিদ মাজিদি। ইরানের অনেক বড়মাপের এ সিনেমা প্রকল্প বাস্তবায়নে নানা চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করতে হয়েছে তাকে। এ ছবি দর্শককে বিচিত্র রঙের লহরীতে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। আর মহিমান্বিত সুর লহরী নির্মাণই মাজিদ মাজিদির বৈশিষ্ট্য। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, সিনেমাটোগ্রাফার ভিত্তেরিও স্তোরারোর কুশলী তৎপরতা। তবে কোথাও কোথাও তার কাজ মাত্রা অতিক্রম করেছে বলেও মনে হতে পারে। সব মিলিয়ে যে চিত্রকল্প তৈরি করতে চেয়েছিলেন তা নান্দনিকভাবেই শীর্ষে নিয়ে যাওয়ার সক্ষমতা দেখিয়েছেন মাজিদ মাজিদি।’

এ ছবিটি নির্মাণ প্রসঙ্গে পরিচালক মাজিদ মাজিদি বলেছেন, ইসলামের সঠিক ভাবমর্যাদা বিশ্বে তুলে ধরার লক্ষ্যেই তৈরি করা হয়েছে ছায়াছবি ‘মুহাম্মদ (স)’। ইসলাম নিয়ে বিশ্বজুড়ে সচেতনতা সৃষ্টি এবং ইসলামের ভাবমর্যাদা পুণরুদ্ধার করাও ছবিটির উদ্দেশ্য বলেও জানান তিনি।

মন্ট্রিলে এ ছবির প্রিমিয়ারে তিনি বলেন, “দুভার্গ্যক্রমে এখন ইসলামের নামে উগ্র এবং সহিংস রূপ তুলে ধরা হচ্ছে অথচ এটি ইসলামেরই পরিচয় নয়। ইসলামের ছদ্মাবরণের আড়ালে সন্ত্রাসীগোষ্ঠীরা যে বর্বরোচিত সন্ত্রাসী তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে তার সঙ্গে ইসলাম ধর্মের কোনো সম্পর্কই নেই।”

সিরিয়া ও ইরাকে তাকফিরি সন্ত্রাসীগোষ্ঠী আইএসআইএল’র মানুষ হত্যা এবং সাংস্কৃতিক সম্পদ ধ্বংসের কথাই পরোক্ষভাবে বলেন তিনি।

তিনি বলেন, “শান্তি, বন্ধুত্ব এবং ভালোবাসার ধর্ম ইসলাম। এ ছবিতে আমি তাই তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। ইসলাম সম্পর্কে যারা জানেন না, তাদের গবেষণার সূচনা করতে পারে এ ছবি।”

মহানবী (স) কে নিয়ে নির্মিত ট্রিলজি বা তিনখণ্ডের ছায়াছবির এই প্রথম খণ্ডে তাঁর মক্কার জীবনআলেখ্য তুলে ধরা হয়েছে। ১৭১ মিনিটের এ ছায়াছবি নির্মাণে সাত বছর সময় লেগেছে। ইরানের সবচেয়ে ব্যয়বহুল এ ছবি নির্মাণে তিন কোটি ৫০ লাখ ডলার ব্যয় হয়েছে। মোহাম্মদ মাহদি হায়দারিয়ান প্রযোজিত এ ছবির চিত্র ধারণ করা হয়েছে ইরান এবং দক্ষিণ আফ্রিকার শহর বেলা-বেলা’তে।

ছবিটি নির্মাণে চলচ্চিত্র জগতের আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে খ্যাতিমান ব্যক্তিত্বরা সহযোগিতা করেছেন। এতে কাজ করেছেন ইতালির তিনবারের অস্কারজয়ী সিনেমাটোগ্রাফার ভিত্তোরিও স্তোরারো, ইতালির ফিল্ম এডিটর রোবাতো পেরপিগানি, মার্কিন স্পেশাল এফেক্ট শিল্পী স্কট ই অ্যান্ডারসন, ইতালির মেকআপ আর্টিস্ট গিয়ানেত্তো ডি রোসি এবং ভারতীয় প্রখ্যাত সুরকার আল্লা রাখা রহমান (এ আর রহমান)।

সূত্র: রেডিও তেহরান, ৩১ আগস্ট, ২০১৫

শহীদের এক সন্তানের আর্তি

মুহাম্মাদ ফরিদ উদ্দীন খান

মাগো কিচ্ছা বলো

মাগো ঘুম আসে না কেন?

রাত কাটে না আর?

মাগো কিচ্ছা বলো-

বালিশে আর মুখ রেখো না গুঁজে-

তুমিও যে জেগে আছো

কাঁপছো ক্ষণে ক্ষণে!

দিয়ো না আর ফাঁকি মোরে

আছো বলে ঘুমে,

বালিশ তোমার ভেজা কেনো

এত গরম রাতে?

বলো বলো কিচ্ছা বলো

রাত পোহাবার তরে-

কেমন করে বর্গী এলো নৌবহরে চড়ে

কেমন করে দেও-দানব মানবরূপ ধরে

কেমন করে ইয়াঙ্কীরা রক্ত পান করে

কেমন করে ফিরিঙ্গীরা সোনা চুরি করে

কেমন করে মানবপুরী ঘুমে ঢলে পড়ে

মাগো কিচ্ছা বলো-

ঘুম আসে না যে

চারদিকেতে কোলাহল কুরআন শুধু বাজে,

রাত পোহাবে করে মা ঘুম আসে না যে।

রেডিওটা এত রাতে অন্ কেন আজ,

শুধু শুধু কুরআন কেনো বারে বারে বাজে।

ওমা ও জননী!

কাঁপছো কেন এত?

ঘুমের মাঝে দেখছো নাকি খোয়াব

কি হলো মা! মুখ রেখ না গুঁজে-

বুঝছি মাগো, বুঝছি চাতুরী-

বুঝাতে চাও আছো ঘুমের পুরী।

আজ রাতে কি বাবা এসেছিল

রক্তজবা মালাখানি ছিলো কি তার গলে-

ওমা আজ এমন কেন হলে?

সত্যি কি আজ ঘুমের ঘোরে?

বাবা তোমায় ডাকছে কাছে যেতে?

বাবার হাতে এখনও কি লাল নিশান উড়ে?

সেই আজদাহা এখনো কি আসছে হা করে

বাবার হাতের বর্শা কি বিঁধছে ওর বুকে

মা আমার!

ওগো মা তাকাও মোর দিকে-

আমার যে বড্ড ভয় লাগে

দেও-দানব যে আজদাহার পিঠে পড়ে হাকে

যাদুর বান ছুঁড়ে ওরা মারছে মানুষেরে-

বাগদাদী ওই আজদাহাটা গোগ্রাসে গিলে-

ওমা সইতে আমি পারি না যে আর-

পিলে আমার আঁতকে আঁতকে ওঠে-

ঘুম পাড়ানী কিচ্ছা ফের বলো নতুন করে

কেমন করে নূরানী পীর আসমান বেয়ে আসে

কেমন করে মানবপুরে ঈসায়ী দম মারে

গভীর ঘুমের মানুষগুলো একে একে জাগে

বলো বলো নূরানী পীর পরশ কেমন বুলায়-

মুর্দা মানুষ কেমন করে খাড়া হয়ে ওঠে

ছুটে কেমন ভীম বেগে দানব দলের পিছু

কেমন করে দেশ থেকে তাড়ায় লাখো ভূত

ওমা কাঁদছো কেন জোরে

নড়ছে কেনো দেহ তোমার থেকে থেকে আজ

তুমিও কি পাচ্ছ এখন ভয়-

আজদাহা আর দেও-দানব আসছে নাকি ধেয়ে-

ভয় করো না মা, ডাকো বাবাকে

বাবারা সব ছুটবে দেখো তেড়ে-

ডাকো তোমার নূরানী পীর-

বলো তারে গিয়ে-

মারুক জোরে মুছার লাঠি-

দেও-দানব আর আজদাহাদের পরে

মুছার লাঠি গিলবে ওদের ধরে

তখন দেখো ভয় বিপদ কেমন কাটে জোরে

ওমা কাঁদছো কেন এমন?

নূরানী পীর নেই কি মানবপুরে?

নাকি রাতে আসমানে গায়েব হয়ে গেছে-

সে কি আজ বাবাদের দলে মিশে গেছে-

ওই যে দূরের সেতারায় বিলীন হয়ে গেছে,

না না মা ওকথা এনো না আর মুখে-

এই দেখো মা কানে দিলাম তুলা

এমন কিচ্ছা শুনবো নাকো মোরা

নূরানী পীর চলে গেলে বাঁচবো কেমন করে-

বাবাকে যে ভুলে আছি কিচ্ছা তারই শুনে

বাবার আদর পাই যে তারই কোলে,

এই মা এসো আমার কাছে,

কেঁদো না আর মোটে,

বাবার হাতের বর্শাটা দাও আমার হাতে তুলে

পীরের দেয়া তসবিহ তাবীজ বেঁধে দাও গলে,

ছুটবো দেখো কেমন তেড়ে

দিগবিদিক জুড়ে

ভয় করো না মা, সাজবো মহাবীর-

বাবার খুন গাযে আমার-

দেখ কেমন লড়ি

নূরানী পীর আয়াত গেছেন ফুঁকি

সব শাহেদের* কানে

উম্মতের অন্তরে

খোদার নিশান এ আকাশে উড়বে চিরন্তন

নতুন নতুন কিচ্ছা তখন বলবো তোমার কানে।

 

*শাহেদ- শহীদদের সন্তানদের শাহেদ নামে অভিহিত করা হয়।

মালিক আশতার

মালিক আশতার হচ্ছেন ইসলামের ঐসব মহান ব্যক্তির অন্তর্ভুক্ত যাঁরা সত্য ও মিথ্যা, ন্যায় ও অন্যায়ের সংগ্রামে বেছে নিয়েছিলেন সত্য ও ন্যায়ের পথ। তাঁর জীবনের এতগুলো যুদ্ধে তিনি এত বীরত্ব ও সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন যে, হযরত আলী (আ.) তাঁকে ইসলামী বাহিনীর সেনাপতি নিয়োগ করেছিলেন।

সাহসী মুজাহিদ হওয়া ছাড়াও মালিক আশতার ছিলেন একজন ধর্মভীরু আলেম। কর্মজীবনের মধ্যগগনে যখন তিনি হযরত আলী (আ.)-এর সেনাপতি তখন তিনি সমাজের সবচেয়ে বিনয়ী ব্যক্তি হিসাবে পরিগণিত হন। এই খোদাভীরু লোকটি ছিলেন হযরত আলী (আ.)-এর একজন বিশিষ্ট শিষ্য। এই মহান ব্যক্তি সম্পর্কে আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.) কী বলেছিলেন তা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। মালিক আশতারকে তিনি যতগুলো কঠিন কাজের দায়িত্ব দিয়েছিলেন তার সবই তিনি সাফল্যের সাথে সম্পন্ন করেছিলেন।

বেশ কয়েকবার গভর্নর বদলের পর হযরত আলী (আ.) মুহাম্মাদ ইবনে আবু বকরের হাতে মিশরের শাসনভার দিয়ে পাঠান। সিরিয়ার বিদ্রোহী গভর্নর মুআবিয়া এ সময় হযরত আলীর অধীনে থাকা এই বৃহত্তম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশটিতে ব্যাপক অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা শুরু করে। যদিও সেনাবাহিনীতে মালিক আশতারের বিশেষ প্রয়োজন ছিল, কিন্তু ইসলামের বৃহত্তম স্বার্থে তিনি তাঁকে মিশর প্রেরণ করেন এবং মালিক আশতারের পরিচয় দিয়ে মিশরবাসীর কাছে এক গুরুত্বপূর্ণ পত্র প্রেরণ করেন :

‘আল্লাহর সৃষ্টি আলী ইবনে আবি তালিবের পক্ষ হতে মিশরবাসীর প্রতি, যাদের ক্রোধ আল্লাহর স্বার্থে। তারা ক্রুদ্ধ হয়ে পড়েছিল যখন তারা দেখল যে, তাদের জমিন আল্লাহর অবাধ্য লোকদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে; যখন দলিত হচ্ছিল অধিকার আর অরাজকতাই হয়ে পড়েছিল আইন এবং ভালোমন্দ, মিশরীয়-অমিশরীয় সবাই তার শিকারে পরিণত হয়েছিল, যখন ধর্মভীরুতা ও সৎকর্মের মুখে নির্মিত হয়েছিল প্রাচীর; আর কেউই যখন নাফরমানি আর পাপ করতে এতটুকু দ্বিধা করত না।

আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের প্রশংসা এবং রাসূল (সা.)-এর প্রতি দরুদ ও সালামের পর তোমরা জেনে রাখ যে, আমি তোমাদের কাছে এমন একজন আল্লাহর বান্দাকে পাঠাচ্ছি যিনি যুদ্ধের চরম সন্ধিক্ষণেও শত্রুকে বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা করেন না এবং যিনি কাফের ও অবাধ্যদের প্রতি জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের চেয়েও ভীষণ।

তিনি হচ্ছেন মাহাজ গোত্রের মালিক ইবনে হারিস। তাঁর কথা শোন এবং মেনে চল তাঁর আদেশগুলো, যেগুলো তোমরা সঠিক ও ইসলামের খাঁটি বিধানগুলোর সাথে পূর্ণ সংগতিপূর্ণ দেখতে পাবে। তিনি আল্লাহর তরবারিগুলোর মধ্যে এমন সুতীক্ষ্ণ তরবারি যার ধার কখনই ভোঁতা হবে না এবং যার আঘাত একটিবারও লক্ষ্যচ্যুত হবে না। যদি তিনি তোমাদের আদেশ করেন শত্রুর বিরুদ্ধে এগুতে, তাহলে এগোও, তিনি যদি তোমাদের থামতে বলেন, থাম, কারণ, তিনি আমার আদেশ ছাড়া কখনই কাউকে সম্মুখে নেন না বা পেছনে ফেলেন না। তোমাদের কাছে তাঁকে পাঠানোর ক্ষেত্রে আমি আমার চেয়ে তোমাদের প্রয়োজনকেই বেশি অগ্রাধিকার দিয়েছি, যাতে তোমরা বিশ্বস্তভাবে দায়িত্ব পালন করতে পার এবং সাহস ও দৃঢ়তার সাথে শত্রুদের মোকাবিলা করতে সক্ষম হও।’- নাহজুল বালাগা, পত্র নং ৩

এ ছিল ইসলামের একজন একনিষ্ঠ সেবক সম্পর্কে হযরত আলী (আ.)-এর সংক্ষিপ্ত বিবরণ।

সেনাবাহিনীর দুই অধিনায়কের কাছে প্রেরিত আর এক পত্রে মালিক সম্পর্কে হযরত আলী (আ.) নিম্নরূপ বর্ণনা দিয়েছেন : ‘যারা তোমাদের ওপরে এবং তোমাদের অধীনস্থ আছে তাদের সবার ওপর আমি মালিক আশতারকে নিয়োগ করছি। সুতরাং তাঁর আদেশ মেনে চল এবং তাঁকে গ্রহণ কর তোমাদের ঢাল ও বর্ম হিসেবে। কেননা, তিনি এমন এক  ব্যক্তি যাঁর পক্ষ হতে আমি কোনো দুর্বলতা বা ত্রুটির আশঙ্কা করি না; যেখানে দ্রুততা প্রয়োজন সেখানে আলস্য কিংবা যেখানে সিদ্ধান্ত প্রয়োজন সেখানে তাড়াহুড়া করার সম্ভাবনা যার মধ্যে নেই।’

অপর পক্ষে জালিম উমাইয়্যা শাসকগোষ্ঠী তাঁর সম্পর্কে ভিন্ন মত পোষণ করত। ঐতিহাসিক ইবনে আসির লিখেন যে, মুআবিয়া ইবনে আবি সুফিয়ান সবসময়েই নামাযের পর আলী (আ.), হাসান (আ.) ও হোসাইন (আ.)-এর ওপর অভিশাপ দিতেন। কপটতার প্রতীক, ইতিহাসের নিষ্পেষক ও বিদ্রোহীদের সর্দার মুআবিয়া তাঁর গুপ্তচরদের মাধ্যমে মালিক আশতারকে হত্যা করার পর এই অশেষ রহমতের (!) জন্য খোদার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার পর বলেন : ‘আলী ইবনে আবি তালিবের দুটি হাত ছিল : একটি আম্মার ইয়াসির, যা কাটা পড়েছে সিফফিনে; আর একটি ছিল মালিক আশতার যা এইমাত্র কাটা পড়েছে।’

স্বপক্ষীয় ও বিরোধী উভয় পক্ষের কাছেই মালিক আশতার একজন মহান ব্যক্তিত্ব হিসাবে স্বীকৃত ছিলেন।

তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন আইয়্যামে জাহেলিয়াতে। আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (সা.)-এর হাতে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ওফাতের পর সাসানীয় রাষ্ট্র ও বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে মুসলমানদের যুদ্ধে তিনি অংশ নিয়েছিলেন। হযরত আলী (আ.)-এর খেলাফতের সময় তিনি ছিলেন একজন অত্যন্ত উঁচুমানের সেনাপতি। বিদ্রোহী নাকেসিন, নাহরাওয়ানের খাওয়ারিজ এবং কাসেতিন ও সিরিয়ার বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তিনি ন্যায়ের সৈনিকদের পক্ষে বিজয়ের মুকুট বয়ে এনেছিলেন।

হযরত উসমানের খেলাফতের সময় মালিক আশতার খলিফার বিরাগভাজন হয়ে নির্বাসনে প্রেরিত হন, রাসূল (সা.)-এর সাহাবা হওয়ার গৌরবে তিনি গৌরবান্বিত ছিলেন এবং হযরত আলীর ঘনিষ্ঠ সহচরদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। উমাইয়্যা গুপ্তচরদের অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতার কারণে মিশরে যখন বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল তখন হযরত আলী (আ.) মুহাম্মাদ বিন আবি বকরের পরিবর্তে মালিক আশতারকে মিশরের গভর্নর নিয়োগ করেন। কিন্তু গন্তব্যস্থলে পৌঁছার আগেই মিশরের নিকটবর্তী বুলজম গ্রামে উমাইয়্যা ঘাতকদের হাতে তিনি শাহাদাতবরণ করেন।

হযরত আলী (আ.) যখন মালিক আশতারের শাহাদাতের সংবাদ পেলেন তখন তিনি বলে ওঠেন : ‘হায় মালিক! কত বড় মানুষ ছিল সে! আল্লাহর শপথ, যদি সে পর্বত হতো, তাহলে হতো এক মহাপর্বত, সে যদি পাথর হতো, তাহলে সে এতটা কঠিন আর এতটা বিশাল হতো যে, কোনো অশ্বচালক উঠতে পারত না তার ওপর, কোনো পাখি উড়তে পারত না তার ওপর দিয়ে।’-নাহজুল বালাগা, উক্তি নং ৪৪১

১ ফেব্রুয়ারি ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস

১ ফেব্রুয়ারি ইরানে ইসলামী বিপ্লবের নেতা ও ইসলামী প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। সুদীর্ঘ প্রায় ১৫ বছর নির্বাসিত জীবন যাপনের পর ১৯৭৯ সালের এই দিনে তিনি বিজয়ীর বেশে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। তদানীন্তন স্বৈরশাসক ইরানের শাহানশাহ রেযা শাহ পাহলভীর রাজনৈতিক নিপীড়নের শিকার হয়ে মহান ইমামকে ১৯৬৪ সালের ৪ নভেম্বর থেকে ১৯৬৫ সালের অক্টোবর পর্যন্ত তুরস্কে, ১৯৬৫ সালের অক্টোবর থেকে ১৯৭৮ সালের ৪ অক্টোবর পর্যন্ত ইরাকে এবং ১৯৭৮ সালের অক্টোবর থেকে ১৯৭৯ সালের ঐ দিন পর্যন্ত ফ্রান্সে নির্বাচিত জীবন যাপন করতে হয়। ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর এই স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ইরানে ইসলামী বিপ্লবের সাফল্যকে ত্বরান্বিত ও নিশ্চিত করে তোলে।

ইমামকে নির্বাসনে পাঠিয়ে শাহ ভেবেছিল তার বিরুদ্ধে ইমামসৃষ্ট বিপ্লবী গণ-আন্দোলন বন্ধ করা যাবে। কিন্তু না, তা হিতে বিপরীত হয়। ইসলামী আদর্শে বিশ্বাসী জনগণ তাদের সম্মানিত ও নন্দিত ইমাম খোমেইনীকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য ব্যাপক গণ-আন্দোলন শুরু করে। পর্যায়ক্রমে তা বিক্ষোভ ও বিদ্রোহে রূপ নেয়। অবস্থা বেগতিক দেখে রেযা শাহ শাপুর বখতিয়ারকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন এবং দেশের প্রচলিত সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী, সেনাবাহিনী প্রধান ও প্রধান বিচারপতির সমন্বয়ে একটি রাজকীয় পরিষদ গঠন করে ১৯৭৯ সালের ১৬ জানুয়ারি কাপুরুষের মতো দেশ ত্যাগ করেন। বিদায় বেলায় ইরানের শাহানশাহ অত্যন্ত হাস্যাস্পদ একটি উক্তি করেছিলেন : ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কয়েকদিন বেড়িয়ে আসি।’ কিন্তু দোর্দণ্ড প্রতাপশালী ও দাম্ভিক শাহ আর কোনোদিন ইরানের মাটিতে পদার্পণ করতে পারেনি। ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর নেতৃত্বে ইরানের মুক্তিকামী তাওহিদী জনতা শাহের ক্ষমতার দর্প চূর্ণ করে দেয়।

বিদায়ের সময় শাহ যে রাজকীয় পরিষদ গঠন করে গিয়েছিলেন, সেই পরিষদের সভাপতি প্রধান বিচারপতি দেশব্যাপী প্রচণ্ড গণজোয়ারের মধ্যে একদিন প্যারিসে গিয়ে হাজির হন এবং ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর নিকট আনুগত্য ঘোষণা করেন। এদিকে, ইমামকে সসম্মানে দেশে ফিরিয়ে আনার দাবিতে জনগণের বিক্ষোভ অব্যাহত থাকে। কিন্তু ক্ষমতাসীন বখতিয়ার সরকার অব্যাহতভাবে ঐ দাবি উপেক্ষা করতে থাকে। অবশেষে দৃঢ়চেতা ইমাম বখতিয়ার সরকারের অনুমতি ছাড়াই দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। ইমামের আগমনের কথা জানতে পেরে ষড়যন্ত্রকারীরা বিমান বন্দরেই তাঁকে হত্যার চক্রান্ত করেছিল। ইমামের অনুসারীরা বিমান বাহিনীর কতিপয় সদস্য পূর্বাহ্নেই এ কথা জানতে পেরে ইমামকে তা অবহিত করে। কিন্তু নির্ভীক ইমাম নির্দিষ্ট দিনে এবং নির্দিষ্ট ফ্লাইটেই দেশে ফেরার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন।

পরিস্থিতি মোকাবিলায় শাপুর বখতিয়ার তেহরান বিমান বন্দর বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন। কিন্তু বিমানের কর্মচারীরা ঐ নির্দেশ উপেক্ষা করে ইমামের বিমানকে নির্বিঘ্নে ইরানে অবতরণের সুযোগ করে দেয়। নির্ধারিত দিনে অর্থাত ১৯৭৯ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ইমাম খোমেইনী (রহ.) তাঁর ৫০ জন উপদেষ্টা ও ১৫০ জন সাংবাদিকসহ বিজয়ীর বেশে ইরানের মাটিতে পদার্পণ করেন। ইমামের পদার্পণে ইরানের আকাশ, বাতাস, মাটি  আর মানুষ যেন তাদের পালহীন তরীর কাণ্ডারি খুঁজে পায়।

বিপুল উতসাহ আর উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে ইমাম খোমেইনীকে সেদিন প্রাণঢালা সম্বর্ধনা দেয়া হয়। এজন্য মেহেরাবাদ বিমান বন্দরে সমবেত হয় লক্ষ লক্ষ মানুষ। বিমান বন্দর এবং তার আশেপাশের এলাকায় কোথাও তিল ধারণের জায়গা ছিল না। দীর্ঘদিন পর প্রাণপ্রিয় নেতাকে নিজেদের মাঝে পেয়ে ইরানী জাতি আনন্দ সাগরে অবগাহন করে। পর্যবেক্ষক মহলের মতে, ১৯৭৯ সালের ১ ফেব্রুয়ারি তেহরানের মেহেরাবাদ বিমান বন্দরে ইমাম খোমেইনীকে অভ্যর্থনা জানাতে প্রায় ৬০ লক্ষ নারী-পুরুষ সমবেত হয়েছিল। বিশ্ব ইতিহাসে অন্য কোনো নেতা এত বড় অভ্যর্থনা পাননি।