All posts by dreamboy

ইমাম আলী ইবনুল হোসাইন যায়নুল আবেদীন (আ.)

মূল : ইমাম আলী ইবনুল হোসাইন যায়নুল আবেদীন (আ.)
অনুবাদ : আব্দুল কুদ্দুস বাদশা
প্রকাশনায় : মনির হোসেন পিন্টু
অন্যধারা
৩৮/২-ক, বাংলাবাজার।
ফোন : ০১৯২০২১৬৯৬৮
দাম : ৪০০/-

‘ইমাম যায়নুল আবেদীন’ নামে সুপ্রসিদ্ধ ইমাম আলী ইবনুল হুসাইন (তাঁর ওপর শান্তি বর্ষিত হোক) ৩৮ হিজরির ৩ শা’বান পবিত্র মদীনা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর প্রপৌত্র। তাঁর পিতা ছিলেন ইমাম হুসাইন (তাঁর ওপর শান্তি বর্ষিত হোক)। তাঁর মাতার নাম ছিল শাহ্রবানু। জীবনের প্রথম দুটি বছর তিনি আমীরুল মুমিনীন হযরত আলীর (তাঁর ওপর শান্তি বর্ষিত হোক) কোলে প্রতিপালিত হন। হযরত আলীর শাহাদাতের পর তিনি বেহেশতে যুবকদের সর্দারদ্বয় তাঁর চাচা ইমাম হাসান ও পিতা ইমাম হুসাইনের সযতœ তত্ত্বাবধানে ঐশী শিক্ষা-প্রশিক্ষণ পেয়ে বড় হয়ে ওঠেন। যুবক বয়সে কারবালার প্রান্তরে সংঘটিত হৃদয়বিদারক ঘটনায় নিজের পরিজন, নিকটাত্মীয় ও বন্ধুদের শাহাদাতের স্মৃতিকে বুকে ধারণ করে তিনি প্রকৃত ইসলামের শিক্ষায় মানুষকে শিক্ষিত করার জন্য নিজেকে নিয়োগ করেন। মহান আল্লাহর প্রতি আত্মনিবেদিত থাকা ও একনিষ্ঠভাবে তাঁর ইবাদত-বন্দেগি করার মাধ্যমে তিনি হয়ে ওঠেন সকলের কাছে অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় এক মহান ব্যক্তিত্ব। তিনি মানুষের কাছে ‘যায়নুল আবেদীন’ (ইবাদতকারীদের সৌন্দর্য) ও ‘সাজ্জাদ’ (অধিক অধিক সিজদাকারী) নামে সুপরিচিত হয়ে ওঠেন। ইসলামের এই মহান ব্যক্তিত্ব ৯৫ হিজরির ২৫ মুহররম তৎকালীন উমাইয়্যা শাসক কর্তৃক বিষপ্রয়োগের ফলে শাহাদাত বরণ করেন। মদীনা নগরীর ‘জান্নাতুল বাকী’তে তাঁর পবিত্র রওযা মুবারক অবস্থিত।
‘সহীফায়ে সাজ্জাদিয়া’ একটি দোয়ার গ্রন্থ। ইমাম যায়নুল আবেদীন (তাঁর ওপর শান্তি বর্ষিত হোক) কারবালার বিষাদময় ঘটনার পর থেকে জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত মহান আল্লাহর কাছে যেসকল দোয়া ও মোনাজাত করেছেন তার একটি সংকলন এই ‘সহীফায়ে সাজ্জাদিয়া’। এটি ‘যাবুরে আলে মুহাম্মাদ’ তথা ‘মহানবী (সা.)-এর বংশধরের যাবুর’ নামেও খ্যাত। এতে বর্ণিত মোট দোয়ার সংখ্যা ৫৪টি। একই সাথে এটি ইসলামি জ্ঞান-বিজ্ঞানের অমূল্য ভা-ারও বটে। এই গ্রন্থে যেমন ইসলামি চিন্তা-বিশ্বাস ও নীতি-নৈতিকতাকে দোয়ার মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়েছে, তেমনি ইসলামের সাংস্কৃতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক বিষয়াবলিসহ কিছু কিছু প্রাকৃতিক নিয়ম ও শরীয়তের বিধানও দোয়ার মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়েছে। দোয়া ও মোনাজাতগুলো মহান আল্লাহর সাথে মানুষের সম্পর্ককে অভিনব উপায়ে উপস্থাপন করে। আল্লাহ্র সাথে সম্পর্ক অংশে দোয়াগুলো বর্ণিত হয়েছে বিভিন্ন যুগ ও বিভিন্ন পরিস্থিতির উপযোগী করে। এই গ্রন্থ মহান আল্লাহ্র কাছে অনুনয়-বিনয় এবং তাঁর দরবারে মনোস্কামনা প্রার্থনার পদ্ধতি ও মানুষকে পার্থিব জীবন থেকে বিমুক্ত হয়ে আল্লাহমুখী হওয়ার শিক্ষা দেয়।
‘সহীফা’র সর্বমোট ৫৪টি দোয়ার মধ্যে কিছু কিছু দোয়া বছরে একবার পাঠ করা হয়, যেমন : ‘দোয়ায়ে আরাফাহ’ এবং রমযান মাসের বিদায়ের দোয়া। আবার কিছু কিছু দোয়া মাসে একবার পড়তে হয়, যেমন চাঁদ দেখার দোয়া। আর কিছু কিছু দোয়া রয়েছে যেগুলো সপ্তাহে একবার এবং কিছু কিছু দোয়া প্রত্যেক দিবানিশিতে একবার করে পড়তে হয়।
১৩ শতাব্দীর অধিককাল যাবত এ গ্রন্থটি সকল ধর্মভীরু, সংযমব্রতী সাধক পুরুষ এবং প-িত ও লেখকের কাছে বিশেষভাবে সমাদৃত হয়ে এসেছে। এক কথায় বলা যায়, এটি ইহলৌকিক ও পারলৌকিক জীবনের একটি পরম আধ্যাত্মিক গুপ্তধনের ভা-ার।

চির সংগ্রামী

লেখক : মুহাম্মদ জাফর উল্লাহ্
প্রকাশনায় : দ্বীন দুনিয়া প্রকাশন
বায়তুশ শরফ কমপ্লেক্স
ধনিয়ালাপাড়া, চট্টগ্রাম-৪১০০।
০১৮২২-৫৩৫৯৯৫
দাম : ২০০/-

মুহাম্মদ জাফর উল্লাহ একজন ফররুখ অনুরাগী চিন্তাশীল লেখক। সম্প্রতি তাঁর উপরিউক্ত শিরোনামের গ্রন্থটির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ভাইস-চ্যান্সেলর ডক্টর আবদুল করিম ফররুখের কাব্যস্বরূপ সম্পর্কে বলেন, মুসলিম জাগরণের অগ্রদূত কবি আল্লামা ইকবাল ও নজরুল পরবর্তী যুগে যাঁরা ইসলামি আদর্শ ও ঐতিহ্য-চেতনাকে পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্যে সাহিত্য-সাধনা করেন, ফররুখ আহমদ ছিলেন তাঁদের মধ্যে অগ্রণী এবং স্বকীয় সত্তার অধিকারী। ধর্মীয় আদর্শের মাধ্যমে এ দেশ শাসিত হোক এবং এ দেশের প্রতি ঘরে মদীনার সুখ-সৌরভ ছড়িয়ে পড়–ক তা-ই ছিল তাঁর সমগ্র কাব্য-সম্ভারের মূলকথা।
গ্রন্থটি সম্পর্কে আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি আল মাহমুদ লিখেছেন, ‘লেখকের ভাষা আধুনিক, বিষয়বস্তু ঐতিহ্যবাহী এবং আমাদের তরুণ পাঠকদের পাঠোপযোগী।’
এ গ্রন্থে লেখক অত্যন্ত আন্তরিকতা ও দরদের সাথে বাংলা সাহিত্যের অমর কবি ফররুখ আহমদের জীবন ও তাঁর সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে আলোচনা করার প্রয়াস পেয়েছেন। এতে কবি সম্পর্কে অনেক অজানা বিষয় ও তথ্য তুলে ধরার আন্তরিক প্রয়াস বিদ্যমান। কবির ধারাবাহিক জীবন, সাহিত্য সাধনা ও সংগ্রামমুখর কর্মময় জীবনের কাহিনী অত্যন্ত আন্তরিক ও মর্মস্পর্শী ভাষায় বিবৃত হয়েছে। কবির ব্যক্তিজীবন, সাহিত্যজীবন ও কর্মজীবনের নানা দিক এতে সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। কবিকে যাঁরা জানতে চান, এ বইটি তাঁদের সে প্রত্যাশা পূরণ করতে সক্ষম হবে।
কবি সত্য, সুন্দর ও কল্যাণের প্রয়াসী। তাঁর কাব্যের মাধ্যমে তিনি একদিকে যেমন সত্য-ন্যায়, সুন্দর ও কল্যাণের পথে চলার অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন, অন্যদিকে তেমনি অসত্য, অন্যায়, অসুন্দর ও অকল্যাণের বিরুদ্ধে কলমের তীব্র আঘাত হেনেছেন। তাঁর জীবনের স্বপ্ন ছিল মানবতার মুক্তি ও শাশ্বত সত্যের প্রতিষ্ঠা।
গ্রন্থের ভাষা সহজ, সরল ও প্রাঞ্জল। বইটির মনোরম প্রচ্ছদ, বিদেশি অফসেট পেপারে ঝকঝকে ছাপা ও মজবুত বাঁধাই বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আমি এ গ্রন্থের বহুল প্রচার কামনা করি।

-অধ্যাপক মুহম্মদ মতিউর রহমান
প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, ফররুখ গবেষণা ফাউন্ডেশন, ঢাক

পবিত্র আশুরার চেতনা

আবদুল মুকীত চৌধুরী
‘পবিত্র আশুরার চেতনা’ সম্পর্কে যে কোন আলোচনার সূচনা ইলাহী কালাম ও মহানবী (সা)-এর বাণীর আলোকেই হবে এবং তা হবে নবী-পরিবার তথা আহলে বাইত প্রসংগে। আহলে বাইতের ক্ষেত্রে আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছায় নবী-পরিবারের মাসুমত্ব ঘোষিত হয়েছে কুরআন মজীদে :
‘…. হে নবী পরিবার। আল্লাহ তো কেবল চান তোমাদের হইতে অপবিত্রতা দূর করিতে এবং তোমাদের সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করিতে।’ -সূরা আল-আহযাব ৩৩ : আয়াত ৩৩, আল-কুরআনুল করীম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ঢাকা।
“ ..….and God only wishes/To remove all abomination/From you, ye Members/Of the Family, and to make/You pure and spotless.- (Sura Ahyab 33 : Verse 33, The Holy QurÕan Translation and Commentary by A. Yusuf Ali)

হয়রত ইবরাহীম (আ.) – এর সন্তান হযরত ইসমাঈল (আ.) এর কারবানি প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্ট সেই আয়াত উল্লেখ করছি, যেখানে আল্লাহ তা’আলা বলেন:  “ আমি তাহাকে মুক্ত করিলাম এক বড় ও মহান কুরবানীর বিনিময়ে।’’ ( সূরা সাফফাত ৩৭: ১০৭, আল কুরআনুল করীম, ই.ফা. ঢাকা।)

‘‘ And we ransomed him with a momentous sacrifice.’’ (Sura Saffat 37: Verse 107, The Holy Quran Translation and Commentary by A. Yusuf Ali)

অনুবাদক, ভাষ্যকার আল্লামা ইফসুফ আলী হযরত ইবরাহীম (আ.) ও হযরত ইসমাঈল (আ)-এর কুরবানী তথা চিরস্মরণীয় ত্যাগ সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন এবং পরবর্তীকালে বিশ্বনবী (সা)-এর দৌহিত্র ইমাম হোসেনের শাহাদতে সেই কুরবানীর সাযুজ্য বর্ণনা করেছেন :

‘‘ The adjective qualifying ÔsacrificeÕ here ÔayimÕ (great, momentous) may be understood both in a literal and figurative sense. In a literal sense it implies that a fine sheep or ram was substituted symbolically. The figurative sense is more important. It was indeed a great and momentous occasion, when two men, with concerted will, Ôranged themselves in the ranksÕ of those to whom self sacrifice in the service of God was the supreme thing in life. This was a type of the service, which Imam Husain performed, maû years later….’’ (The Holy Quran Translation and Commentary)

ধৈর্য ধারণ, ইহজীবনে পরকালীন নাজাত ও চিরশান্তির জন্য নিবেদিত ও সচেষ্ট থাকার জন্য ইমাম হোসেনকে উপদেশ হযরত আলী (রা)-র এবং অবৈধ অত্যাচারী খোদা-দ্রোহী শক্তির সাথে চূড়ান্ত মুকাবেলায় আধ্যাত্মিক পর্যায়ে দৃশ্যমান ভাবী শাহাদতের ইঙ্গিত সম্বলিত কাব্যকথা :
“ধৈর্যের চাদর পরো সঙ্কটের কালে
শুভ ফল পাবে পূর্ণ ধৈর্যের তা হলে।
সর্বত্র ধৈর্য ধরো–করবে সবর
কারণ ধৈর্য ভাল বন্ধু সহচর।”

-হুসায়ন (রা.)-কে উপদেশ : ঐ

“পরিজনসহ যেন আমি কারবালায়
কারবালার যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হয়ে গেছি (হায়!)
যেভাবে বিয়ের কনে পরিধেয় বসন রাঙায়
তেমনি আমার দাড়ি রক্তে রাঙা করা হচ্ছে (হায়!)”

“এই দৃশ্যাবলী দেখি : চাক্ষুষ তা নয় যে আমার
আমাকে প্রদত্ত হলো সে সকল চাবি দরজার।
এমন বিপদ কিন্তু তোমার উপর আসবেই,
প্রস্তুতি নিয়ে নাও, সেজন্য আসার আগেই।”

“হে হুসায়ন-
আমার, তোমারও হন্তা তাঁর হাতে হবে গ্রেফতার
কাজেই তাদের দেয়া কষ্টে করো সবর এখতিয়ার।”
-নয়নমণি হুসায়ন (রা)-কে উপদেশ, ঐ

আশুরার চেতনা সর্বব্যাপী। বাতিলের উত্থানের বিপরীতে হক ইনসাফের সুরক্ষা ও সুদৃঢ় প্রতিষ্ঠা এবং কুরআন সুন্নাহ ঘোষিত সে রাষ্ট্রব্যবস্থার পতাকা সমুন্নত রাখার সংগ্রাম প্রতি মুহূর্তে প্রতিটি ক্ষেত্রে। এ প্রেক্ষিতে সামগ্রিক ও চিরন্তন শপথতুল্য উচ্চারণ :
“প্রতিটি দিনই আশুরা
প্রতিটি ময়দানই কারবালা।”
-ইমাম জাফর সাদেক (র)
আহলে বাইতকে নাজাতের ওসিলা বলেন মুসলিম উম্মাহ্র অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফিক্্হবিদ ইমাম শাফিঈ (র)। তাঁর কাব্য পংক্তিমালা :
“নবী পরিবার মাধ্যম আমার,
তাঁরা ওসিলা দরবারে আল্লাহ্র।
তাঁদের কারণে আশা কেয়ামতে
আমল আমার পাবো ডান হাতে।”
-ইমাম শাফি‘ঈ (র)
ভাবানুবাদ : হাফিদ কলন্দর
এজিদের আনুগত্য গ্রহণ না করে ইমাম হোসেন (রা) শাহাদত কবুল করে কলেমায়ে শাহাদতের নব-ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করলেন-সুলাতানুল হিন্দ খাজা মঈন উদ্দীন চিশতী (র)-এর সাক্ষ্য :
‘শাহ আস্ত হোসাইন, বাদশাহ আস্ত হোসাইন
দ্বীন আস্ত হোসাইন, দ্বীন পানাহ আস্ত হোসাইন।
সার দা’দ নাদা’দ দাস্ত দার দাস্তে ইয়াযীদ
হাক্কাকে বেনায়ে লা ইলাহা আস্ত হোসাইন।’

“বাদশাহ বলো আর শাহ্ বলো
হুসাইনকেই মানায় তা;
দীন ও দীনের আশ্রয় হলো
হুসাইনের কোলেই তা।

হাত না দিয়ে মাথা দিলেন
হাতে বর্বর এযীদের,
নবভিত্তি এতে হলো
কালেমায়ে শাহাদাতের।”
-খাজা মঈন উদ্দীন চিশতী (রহ)
ভাবানুবাদ : হাফিদ কলন্দর
হোসাইনী কাফেলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ পতাকাবাহী ইরানের বিশ্ববিখ্যাত মর্সিয়াখানির কবি শামসুস্ শোয়ারা মুহতাশেম কাশানী (র)। তাঁর কাব্যের মাতম রোনাজারি মর্সিয়া সাহিত্য ও আশুরার অন্যতম প্রতিপাদ্য। এজিদী অত্যাচার ও ইমাম হোসেনের শাহাদতে গোটা সৃষ্টিজগতের কান্না ও আকুতি বাক্সক্ষয় হয়েছে মুহতাশেম কাশানীর কাব্য-পংক্তিমালায় :
“গোটা দুনিয়ার সৃষ্টিলোকে এ কোন্ ফরিয়াদ জাগলো ফের
এ কোন্ শোক মাতম ওঠে, হায়, নওহায় করুণ রবের!

“যদি বলি রোজ কিয়ামত পৃথিবীতে, নয় রঞ্জন
সর্বব্যাপী উত্থান পুন, এর নাম যে মুহররম।”

“আকাশ-মাটির সূর্য তিনি, পুব ও পশ্চিমের আলো
রাসূলেরই কোল থেকে সেই হুসাইনী নূর ছড়ালো।”

“নওহার করুণ সুরধ্বনি ষড় দিক পানে ছড়িয়ে যায়
সাত আকাশের ফেরেশতাকুল তাঁদের কাঁদনে সুর মেলায়।”

-আরশে আযীম ছুঁয়ে যায়, শামসুশ্ শোয়ারা মুহ্তাশেম কাশানী
(মুহরররম উপলক্ষে মুহতাশিমের বারো স্তবক)
ভাষান্তর : মুহাম্মদ আব্দুল কুদ্দুস বাদশা, কাব্যরূপ ও সম্পাদনা : আবদুল মুকীত চৌধুরী

ইসলামী ন্যায় ইনসাফ, সাম্য, মানবতার পতাকা সমুন্নত রাখতে ইমাম হোসেনের শাহাদত সম্পর্কে বিশ্ব বিখ্যাত লেখক চার্লস ডিকেন্স লিখেছেন :

-“If Husain had fought to quench his worldly desire then I do not understand why his sister, wife and children accompanied him. It stands for reason therefore, that he sacrificed purely for Islam.”  –Charles Dickens

“তওহীদ কি আমানত সিনোঁ মে হ্যায় হামারা
আঁসা নেহি মিটানা নাম ও নিশাঁ হামারা”
পবিত্র কালামে ইলাহী “তোমরা হীনবল হইও না এবং দুঃখিত হইও না ; তোমরাই বিজয়ী যদি তোমরা মুমিন হও।” (সূরা আলে ইমরান ৩ : আয়াত ১৩৯, আল কুরআনুল করীম) এ আয়াতের প্রতিফলন-দীপ্ত এই উজ্জীবনী কাব্যের মহাকবি আল্লামা ইকবালের কাব্যে ইমাম হোসেন (রা)-এর অনন্য আত্মদান ও তাঁর সাথী শাহীদানের মাহাত্ম্যকথা :

“জিস্ তারাহ মুজকো শাহীদে কারবালা সে প্যায়ার হায়
হক তা‘আলা কো ইয়াতিমুঁ কী দুআ সে প্যায়ার হ্যায়।”
-“যেভাবে শহীদে কারবালার প্রতি আমার ভালবাসা রয়েছে,
(অনুরূপ) এতিমের দুআর প্রতিও আল্লাহতা‘আলার ভালবাসা রয়েছে।”
-মহাকবি আল্লামা ইশবাল
ভারতের ‘জাতির জনক’ মহাত্মা গান্ধী ইমাম হুসাইনকে মূল্যায়ন করেছেন ‘মহান শহীদ’ রূপে। খিলাফতের ন্যায় ইনসাফ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তাঁর ইমামতী আত্মদানকে তিনি ভারতের ‘বিজয়ী রাষ্ট্র’ হওয়ার জন্য ‘আদর্শ’ মনে করেন এবং ‘অনুসরণ করতে হবে’ বলেছেন।
“আমি ইমাম হুসাইন তথা ইসলামের এ মহান শহীদের জীবনী মনোযোগ সহকারে পাঠ করেছি এবং কারবালার পৃষ্ঠাগুলোর প্রতি অধিক মনোনিবেশ করেছি। আমার কাছে প্রতীয়মান হয়েছে যে, ভারত যদি একটি বিজয়ী রাষ্ট্র হতে চায়, তা হলে ইমাম হুসাইনের আদর্শ অনুসরণ করতে হবে।” -মহাত্মা গান্ধী

কারবালার শাহাদতের উজ্জীবনী ও বিজয়ী চেতনার মূল্যায়নে কবি মুহাম্মদ আলী জওহরের বহুল উচ্চারিত কাব্য পংক্তিদ্বয় :

“কাত্লে হুসাইন আসল মেঁ মরগে ইয়াযীদ হ্যায়
ইসলাম যিন্দা হোতা হ্যায় হর কারবালা কে বা‘দ”,

“হুসাইনের হত্যাকান্ডের মধ্যেই ইয়াযীদের মৃত্যু ;
(আর) প্রতিটি কারবালার পরই ইসলাম জীবিত হয়।”
-মুহাম্মদ আলী জওহর

মযলুমের সাহায্যকারীর প্রতি কবি ফয়েয আহমদ ফয়েযের সালাম। আমাদের স্মরণে পবিত্র কুরআনের আয়াত : “তোমাদের কী হইলো যে তোমরা যুদ্ধ করিবে না আল্লাহ্র পথে এবং অসহায় নরনারী এবং শিশুগনের জন্য, যাহারা বলে হে আমাদের প্রতিপালক ! এই জনপদ যাহার অধিবাসী জালিম, উহা হইতে আমাদেরকে অন্যত্র লইয়া যাও, তোমার নিকট হইতে কাহাকেও আমাদের অভিভাবক কর এবং তোমার নিকট হইতে কাহাকেও আমাদের সহায় কর।” (সূরা নিসা ৪: আয়াত ৭৫, আল-কুরআনুল করীম)” যে অত্যাচারের বিপরীতে ভূমিকা রাখে না, কবি তাকে ‘দীন অস্বীকারকারী’ বলছেন :

“ইনসাফ কে নেকী কে মুরাওয়াত কে তারাফদার
জালেম কে মুখালেফ হেঁ তু বেকাস কে মাদাদগার
জো জুলুম পার লানত না কারে আপ লায়ি হ্যায়
জো জাবার কা মুনকির নাহিঁ ওহ মুনকিরে দীন হ্যায়”।

– “ইনসাফের নেকী চরিত্রের অধিকারী,
জালেমের বিরুদ্ধে তুমি অসহায়ের সাহায্যকারী;
যে জুলুমকে আভিশাপ দেয় না, সে নিজেই অভিশপ্ত ;
যে অত্যাচারকে অস্বীকার করে না, সে দীনকে অস্বীকারকারী।”
-কবি ফয়েজ আহমদ ফয়েজ

বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি ও বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁর সাহিত্যের একাংশ ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহ ভিত্তিক ও প্রাসংগিক। এরই অংশবিশেষ আহলে বাইত ও শানে জেহাদে কারবালা। হযরত মঈন উদ্দীন চিশতীর ‘সর দাদ’-এর মতোই তাঁর কাব্যে ‘হাঁকে বীর শির দেগা, নেহি দেগা আমামা।’ দ্রষ্টব্য : ‘আমামা’ অর্থ ‘পাগড়ি’, ‘শিরস্ত্রাণ’। এখানে অত্যাচারী এজিদের আনুগত্যে আত্মসমর্পণ না করা এবং ইসলাম তথা কুরআন সুন্নাহ্র রাষ্ট্রব্যবস্থা সমুন্নত রাখার প্রতীক স্বরূপ এই ‘আমামা’র উচ্চারণ। এর অর্থ ইমাম শির দিচ্ছেন ; কিন্তু ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থার আদর্শ বিসর্জন দেবেন না। মহানবী পরিবারের সবার প্রতি নজরুলের কাব্য ও সংগীতের শ্রেষ্ঠ ও অনন্য নযরানা। ‘এজিদী মুসলমানে’র বিপরীতে ‘শহীদী ঈদগাহে’ তাঁর ‘জমায়েত ভারী’ ও ‘ইসলামী ফরমান জারি’র আহবান। আহলে বাইতের পদধূলি-ধন্য মাটি সুর্মা করে তাঁর চোখে মাখার আকুতি :
“দ্রিম দ্রিম বাজে ঘন দুন্দুভি দামামা,
হাঁকে বীর, ‘শির দেগা, নেহি দেগা আমামা’।”

“কত মোর্হরম এলো, গেল চলে বহু কালÑ
ভুলিনি তো আজো সেই শহীদের লোহু লাল!
মুসলিম তোরা আজ ‘জয়নাল আবেদীন,’
‘ওয়া হোসেনা–ওয়া হোসেনা’ কেঁদে তাই যাবে দিন।”

“হাসানের মত পিব পিয়ালা সে জহরের,
হোসেনের মত নিব বুকে ছুরি কহরের;
আসগর সম দিব বাচ্চারে কোরবান,
জালিমের দাদ নেবো, দেবো আজ গোর জান!”
-মোর্হরম, নজরুল ইসলাম : ইসলামী কবিতা,
সম্পাদক : আবদুল মুকীত চৌধুরী

“ঐক্য যে ইসলামের লক্ষ্য, এরা তাহা দেয় ভেঙে।
ফোরাত নদীর কূল যুগে যুগে রক্তে উঠেছে রেঙে
এই ভোগীদের জুলুমে। ইহারা এজিদী মুসলমান,
এরা ইসলামী সাম্যবাদেরে করিয়াছে খানখান।”
-মোর্হরম, ঐ

“আঁজলা ভ’রে আনল কি প্রাণ
কারবালাতে বীর শহীদান,
আজকে রওশন জমীন-আসমান
নওজোয়ানীর র্সুখ্ নূরে।”
-ভোরের সানাই, সন্ধ্যা, নজরুল ইসলাম : ইসলামী গান

“নব জীবনের ‘ফোরাত’ কূলে গো কাঁদে ‘কারবালা’ তৃষ্ণাতুর,
ঊর্ধ্বে শোষণ-সূর্য, নিম্নে তপ্ত বালুকা ব্যথা মরুর।
ঘিরিয়া যুরোপ-এজিদের সেনা এপার, ওপার, নিকট, দূর,
এরি মাঝে মোরা ‘আব্বাস’ সম পানি আনি প্রাণপণ করি।”

“আজো নম্রুদ ইব্রাহীমেরে মারিতে চাহিছে সর্বদাই
আনন্দ-দূত মোরা সে আগুনে ফোটাই পুষ্প-মঞ্জরী।”
-তরুণের গান, ঐ

“খাতুনে জান্নাত আমার মা,
হাসান-হোসেন চোখের জল;
ভয় করি না রোজ-কেয়ামত
পুল-সিরাতের কঠিন পুল।”
-বক্ষে আমার কাবার ছবি, ঐ

“আন মহিমা হযরতের
শক্তি আন শেরে খোদার,
কোরবাণী আন কারবালার,
আন্ রহম মা ফাতেমার।”
-খুশী লয়ে খোশরোজের, ঐ

“হাসান হোসেন সে কোথায়, কোথায় বীর শহীদান
কোরবাণী দিতে আপনায় আল্লার মুখ চাহি”।

-কোথায় তখ্ত তাউস, জুলফিকার, ঐ

“এস শেরে খোদা ফিরিয়া আরবে
ডাকে মুসলিম ‘ইয়া আলী’ রবে
হয়দারী-হাঁকে তন্দ্রা-মগনে
কর কর হুঁশিয়ার”।।
-খয়বর-জয়ী আলী হাইদার, ঐ

“শহীদী ঈদগাহে দেখ্ আজ জমায়ত্ ভারি।
হবে দুনিয়াতে আবার ইসলামী ফরমান জারি।।
তুরান ইরান হেজাজ মেসের হিন্দ্ মোরোক্কা ইরাক,
হাতে হাত মিলিয়ে আজ দাঁড়ায়েছে সারি সারি।।
-শহীদী ঈদ্গাহে দেখ্, জুলফিকার, ঐ

“তোর হৃদয়ের কারবালাতে বইবে ফোরাত নদী,
শহীদের র্দজা তোরে দেবেন আল্লা হাদী,
দুনিয়াদারী করেই পাবি বেহেশতেরি স্বাদ।”
-আল্লা ব’লে কাঁদ্, ঐ

“কত ছেলে মোর শহীদ হয়েছে মরুতে কারবালার।
আমি নন্দিনী মা ফাতেমার”
-মুসলিম যুবা মুসলিম নারী (ডুয়েট), ঐ


“হাসান হোসেনে তব উম্মত তরে, মাগো
কারবালা প্রান্তরে দিলে বলিদান,
বদলাতে তার রোজ হাশরের দিনে
চাহিবে মা মোর মত পাপীদের ত্রাণ।”
-খাতুনে জান্নাত, ঐ

বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি, ইসলামী মানবিকতার কবি ফররুখ আহমদ। আহলে বাইতের প্রতি শ্রদ্ধা ভালবাসার নযরানা-ঋদ্ধ তাঁর কাব্য ‘সিরাজাম মুনীরা’। ইসলাম প্রেম, মানবপ্রেম, মানুষের প্রতি একাত্মতার অনন্য কবিকণ্ঠ ফাররুখ। ‘আলী হায়দর’, ‘জেহাদে কারবালা’ কবিতায় হযরত আলীর শৌর্য-বীর্য ও ইমাম হোসেনের করুণ শাহাদত-গাথা ও উজ্জীবলী কাব্য পংক্তিমালা :

“আট কেল্লার রুদ্ধ প্রাকার আজিকে হয়েছে গুঁড়া,
কুল মখলুক হতে দেখা যায় আল হেলালের চূড়া,
তার তকবীর শোনা যায় পিছে ওঠে জনতার স্বর;
আলী হায়দর! আলী হায়দর! আসে আলী হায়দর!”

-আলী হায়দর, সিরাজাম মুনীরা, ফররুখ আহমদ

“ঝাঁজরা সিনা, তবুও সিংহ জয় করে নিল ফোরাত তীর,
আঁজলা ভরিয়া মুখে তুলে নিল ফোরাত নদীর শীতল নীর।
লাগলো আবার তীরের আঘাত পানি ফেলে দিয়ে দাঁড়ালো বীর;
হাহাকার করে উঠলো সভয়ে ফোরাত নদীর মুক্ত তীর।
জাগে রণবাজা এজিদের দলে তলোয়ার তীর নেজার ছায়,
জাগে শংকার কাঁপন আকাশে, লাগে মৃত্যুর রঙ ধুলায়,
সে রণভূমিতে ক্লান্ত সিংহ চলে একা বীর মরণাহত;
ক্ষত তনু তাঁর তীরের আঘাতে লুটালো বিশাল শিলার মত।
জীবন দিয়ে যে রাখলো বাঁচায়ে দীনী ইজ্জত বীর জাতির
দিনশেষে হায় কাটলো শত্রু সীমার সে মৃত বাঘের শির।
তীব্র ব্যথায় ঢেকে ফেলে মুখ দিনের সূর্য অস্তাচলে,
ডুবে ইসলাম রবি এজিদের আঘাতে অটল তিমিরতলে,
কলিজা কাঁপায়ে কারবালা মাঠে ওঠে ক্রন্দন লোহু সফেন
ওঠে আসমান জমিনে মাতম কাঁদে মানবতা হায় হোসেন।”

-জেহাদে কারবালা, সিরাজাম মুনীরা, ফররুখ আহমদ

[সংকলনটি গত ৬ অক্টোবর ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে ‘আশুরার বার্তা বহনে কবিদের ভূমিকা’ শীর্ষক আলোচনা ও কবিতা পাঠের আসরে উপস্থাপিত হয়।]

(লেখাটি প্রবন্ধ-আংগিকে নয় ; বলা যেতে পারে উদ্ধৃত কথা-কাব্য-গীতি-নকশা। কথা, কাব্য বা গানের কোন কোনটির উৎসে রয়েছে পবিত্র কুরআন-সুন্নাহ্র সূত্র।

চলচ্চিত্র শিল্পে ইরানের সাফল্য

সাইদুল ইসলাম :

চলচ্চিত্র একটি সৃজনশীল গণমাধ্যম। এর সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে সাংস্কৃতিক উপাদানসমূহ। যে দেশে তা নির্মিত হয় সে দেশেরই জাতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতিনিধিত্ব করে চলচ্চিত্রটি। শিল্পকলার প্রভাবশালী মাধ্যম, শক্তিশালী বিনোদন মাধ্যম এবং শিক্ষার অন্যতম সেরা উপকরণ হিসেবেও খ্যাতি রয়েছে চলচ্চিত্রের। গণযোগাযোগ বা সাধারণ মানুষের কাছাকাছি খুব সহজে পৌঁছার ক্ষেত্রেও চলচ্চিত্রের ভূমিকা অপরিসীম। আবার সৃষ্টিশীল মানুষ ও আলোকিত সমাজ উপহার দেয়ার ক্ষেত্রেও এর রয়েছে জাদুকরি প্রভাব।
চলচ্চিত্রের মূল ধারক হচ্ছে এর গল্প বা চিত্রনাট্য। একটি সহজ, বাস্তবসম্মত এবং শিক্ষামূলক গল্প একটি ভাল চলচ্চিত্রের প্রাণ। এছাড়াও থাকে অভিনয়, চিত্রায়ন, সংগীত, প্রেক্ষাপট এবং সম্পাদনা। এই প্রতিটি অনুষঙ্গ যখন যথোপযুক্তভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব হয় তখনই সেই চলচ্চিত্রটি হয়ে ওঠে একটি সফল ও পূর্ণাঙ্গ শিল্প। আর সফল চলচ্চিত্র নির্মাণে যে দেশ যত উন্নত সেই দেশের সংস্কৃতিও তত সমৃদ্ধ। আর এক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই ইতিহাস, ঐতিহ্য ও শিল্প-সাহিত্যে সমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান। গত ১২ সেপ্টেম্বর নানা আয়োজনে দেশটিতে পালিত হলো জাতীয় চলচ্চিত্র দিবস। এ উপলক্ষে ইরানের বিশাল চলচ্চিত্র পরিবারের প্রতি অভিনন্দন বার্তা দিয়েছেন দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বাহরাম কাশেমি। এ বার্তায় কাশেমি বলেন, ‘পথচলার একশ’ বছরে ইরানি সিনেমা নজিরবিহীন, প্রশংসনীয় ও চিরস্থায়ী চলচ্চিত্র কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। যারা এই ভূখণ্ডের সংস্কৃতি ও শিল্পের জন্য আবেগ-অনুভূতি ভাগাভাগি করে নেয় তাদের স্মৃতিতে দিনটি চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে।’
তিনি বলেন, অসংখ্য আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ইরানি সিনেমার হৃদয়স্পর্শী ও প্রভাবশালী উপস্থিতি বিশ্বে ইরানি সংস্কৃতি ও শিল্পের স্বচ্ছ ও অগাধ ভাবমূর্তিকে তুলে ধরেছে।
উল্লেখ্য, ইরান ২০০০ সাল থেকে ১২ সেপ্টেম্বর জাতীয় চলচ্চিত্র দিবস হিসেবে উদ্যাপন করে আসছে। এ বছর ইরানি চলচ্চিত্রের শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে একটি উৎসবের আয়োজন করা হয়। ১৯০০ সালে শুরু হয় ইরানি চলচ্চিত্রের পথচলা।
বর্তমানে দেশটিতে প্রতি বছর প্রায় ২০০টি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। ইসলামি বিপ্লবের পর থেকে এ পর্যন্ত গত ৩৮ বছরে দেশটিতে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ধারাবাহিকভাবে ৩৫টি চলচ্চিত্র উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে। ইরানের অভ্যন্তরীণ চলচ্চিত্রের মানোন্নয়ন ও এর পরিচিতি বিশ্বময় ছড়িয়ে দেওয়ার পাশাপাশি বিশ্বের অত্যাধুনিক চলচ্চিত্র নির্মাণকৌশল এবং নতুন নতুন চলচ্চিত্রের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়াই এই চলচ্চিত্র উৎসব উদ্যাপনের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য।
ইসলামি বিপ্লবের বিজয়ের পর থেকে বিগত বছরগুলোতে ইরানের চলচ্চিত্র শিল্প বিশ্বের চলচ্চিত্র জগতে দর্শক ও বোদ্ধাদের কাছে একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে। বিশ্বের অধিকাংশ চলচ্চিত্র নির্মাতা যখন জৈবিক আকর্ষণকে তাঁদের বাণিজ্যিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে অতি সহজে দর্শকের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছেন তখন ইরানের চলচ্চিত্র নির্মাতারা তাঁদের পেশাগত দক্ষতা ও নান্দনিক শিল্পকর্মকে কাজে লাগিয়ে এবং সামাজিক, চারিত্রিক ও মানবিক মূল্যবোধগুলোকে ব্যবহার করে চলচ্চিত্র জগতে দর্শকের কাছে একটি ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছেন। তাই তো বিশ্বব্যাপী আজ ইরানি চলচ্চিত্রের এমন জয়জয়কার।
শক্তিশালী চিত্রনাট্য, অসাধারণ ও অভূতপূর্ব অভিনয়, কলাকুশলির মনকাড়া আবেদন ছাড়াও বিশ্বমানের কারিগরি কৌশলের কারণে বিশ্বের সর্বত্র আজ ইরানি সিনেমা ব্যাপকভাবে দর্শক সমাদৃত হচ্ছে। সেইসাথে পুরস্কৃত হচ্ছে শীর্ষ আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবগুলোতে।
আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র অঙ্গনে সবচেয়ে আলোচিত ও সম্মানজনক পুরস্কার অস্কার থেকে শুরু করে অনেক গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক পুরস্কার ঘরে তুলে নিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের এ দেশটি। চলতি বছরেই অস্কারের ৮৯তম আসরে সেরা বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র হিসেবে পুরস্কার জিতে নেয় ইরানি ছবি ‘দ্য সেল্সম্যান’। এ নিয়ে দ্বিতীয়বার অস্কার জিতলেন ছবিটির পরিচালক আসগর ফারহাদি। এর আগে ‘অ্যা সেপারেশন’ তাঁকে এনে দেয় এই সম্মাননা। তবে আগেরবারের মতো এবারের ট্রফি নিজের হাতে গ্রহণ করতে অস্কার আসরে উপস্থিত ছিলেন না আসগর ফারহাদি। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ সাতটি দেশের নাগরিকদের আমেরিকায় প্রবেশে ট্রাম্পের নিষেধাজ্ঞা জারির প্রতিবাদে আগেই অস্কার অনুষ্ঠান বর্জনের ঘোষণা দিয়েছিলেন ফারহাদি ও তাঁর চলচ্চিত্রের অভিনেত্রী তারানেহ আলীদুস্তি।


দেশটি অস্কারের আগামী প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে এরই মধ্যে ১০টি চলচ্চিত্র চূড়ান্ত করেছে। ইরানের ৯ জন চলচ্চিত্র তারকার সমন্বয়ে একটি মূল্যায়ন কমিটি বাছাই করে এসব চলচ্চিত্র। বিদেশি ভাষার ক্যাটাগরিতে চলচ্চিত্রগুলো প্রতিযোগিতায় অংশ নেবে। ইরানের ওই ১০টি চলচ্চিত্র হচ্ছে, ‘দি মিডডে ইভেন্ট’, ‘দি ভিলা টেন্যান্টস’, ‘টুয়েন্টি-ওয়ান ডেজ লেটার’, ‘সাবডিউয়েড’, ‘রেড নেইল পলিশ’, ‘মাই ব্রাদার খসরু’, ‘এ হাউস অন ফোরটি ওয়ান স্ট্রিট’, ‘ম্যালেরিয়া’, ‘ব্রেথ’ ও ‘ইনভারসন’। এই ছবিগুলোর মধ্যে এবার এক ইরানি নারী চলচ্চিত্রকারের ছবিও স্থান পেয়েছে। নারগেস আবিয়ার পরিচালিত যুদ্ধবিরোধী ছবিটির নাম ‘ব্রেথ’। প্রশংসিত চলচ্চিত্রটি প্রযোজনা করেছেন নারগেসের স্বামী মোহাম্মাদ হোসেইন কাশেমি। এ ছবিতে চারটি শিশুর কাহিনি তুলে ধরা হয়েছে, যাদের মা কয়েক বছর আগে মারা যায়। ১৯৮০ সালের সেপ্টেম্বরে ইরান-ইরাক যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে তৈরি করা হয়েছে ছবিটি। মায়ের মৃত্যুর পর তাদের বাবা যুদ্ধে নিয়োজিত ইরানি স্বেচ্ছাসেবীদের সঙ্গে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ছবিটি এর আগে বেশ কয়েকটি ইরানি ও আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবেও প্রশংসিত হয়েছে।
৯০তম অ্যাকাডেমি অ্যাওয়াড্র্স অনুষ্ঠান আগামী বছর ৪ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসে শুরু হবে। অস্কার আয়োজনে চলচ্চিত্র জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ছিল ২ অক্টোবর।
পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন এবং প্রভাবশালী চলচ্চিত্র উৎসব কান চলচ্চিত্র উৎসবেও ইরানের সরব উপস্থিতির কথা নিশ্চয়ই কারো অজানা নয়। এই উৎসবের ৭০তম আসরে সিনেফন্ডেশন পুরস্কার জিতেছে ইরানি স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি ‘অ্যানিম্ল’। বাহরাম ও বাহমান আর্ক পরিচালিত ছবিটি এবারের আয়োজনের ২০তম সিনেফন্ডেশন বিভাগে দ্বিতীয় পুরস্কার জিতেছে। ‘সিনেফন্ডেশন’ মূলত শিক্ষার্থী নির্মাতাদের বিভাগ।
কান চলচ্চিত্র উৎসবের সিনেফন্ডেশন বিভাগের ২০তম আসরে জমা পড়েছিল বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের ৬২৬টি ফিল্ম স্কুলের ২ হাজার ৬০০টি ছবি।
উৎসবে ‘অ্যানিমেশন দ্যাট ম্যার্টাস অ্যাওয়ার্ড’ জিতেছে ইরানের অপর ছবি ‘রিলিজ ফ্রম হেভেন’। ২৩ মে ইরানের অ্যানিমেশন নির্মাতাদের সঙ্গে জাপানের শিনিচিরো কিমুরা, ফ্রান্সের মিখায়েল ফুজেলিয়ার ও ইতালির বাবাব পায়ামির হাতে তুলে দেওয়া হয় এ অ্যাওয়ার্ড। ইরানের ৭৬ মিনিটের এ অ্যানিমেশন ছবির চিত্রনাট্য করেছেন বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক মাজিদ আসোদেগান, পরিচালনা করেছেন অ্যানিমেটর আলী নুরি অস্কুরি এবং সহপ্রযোজনা করেছেন সাইয়্যেদ ভাহিদ ওলিয়াই।
ইরানি অ্যানিমেশন চিত্রটির বাস্তব্য মূল্য ও বার্তা বিবেচনা করে অ্যাওয়ার্ড দেয়া হয়েছে, যেখানে মানুষ হিসেবে দুনিয়ায় জন্মের সার্থকতা তুলে ধরা হয়েছে। অ্যানিমেশন চিত্রটিতে দেখা যাচ্ছে, যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশে একজন শিক্ষক যাঁর নাম সারেহ, তাঁর দুই ছাত্রকে এমন পথ বাৎলে দেন যাতে তাদের জীবন পাল্টে যায়। চিন্তাশক্তি, গল্পের শক্তিশালী কাহিনী ও বাস্তবতা এবং বিস্ময়কর অ্যানিমেশন প্রযুক্তি ও কারিগরি শৈলী মিলে ‘রিলিজ ফ্রম হেভেন’ জিতে নেয় এবারের কান চলচ্চিত্র উৎসবে ‘অ্যানিমেশন দ্যাট ম্যার্টাস অ্যাওয়ার্ড’।
উৎসবে ‘উন সার্টেন রিগার্ড’ ক্যাটাগরিতে সেরা ছবির পুরস্কার জিতেছে ইরানের আরো একটি চলচ্চিত্র। মোহাম্মাদ রাসুলফ পরিচালিত ছবিটির নাম ‘এ ম্যান অব ইন্টেগ্রিটি’। ‘উন সার্টেন রিগার্ড’ ক্যাটাগরিতে তরুণ প্রতিভা ও সৃজনশীল চলচ্চিত্র তৈরির স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
২০১৭ সালের কান চলচ্চিত্র উৎসবের ‘উন সার্টেন রিগার্ড’ বিভাগে ২২টি দেশের ১৮টি চলচ্চিত্র প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিল।
সিনেমা জগতের আরেক মর্যাদাপূর্ণ উৎসবের নাম ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসব। এই উৎসবের ৭৪তম আসরে দুই অ্যাওয়ার্ড জয় করে ইরানি চলচ্চিত্র ‘নো ডেট, নো সিগনেচার’। ছবিটির জন্য সেরা পরিচালকের অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন এর পরিচালক চলচ্চিত্রকার ভাহিদ জলিলভান্দ এবং সেরা অভিনেতার অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন নাভিদ মোহাম্মাদজাদেহ।
‘নো ডেট, নো সিগনেচার’ ছবিটি এর আগে ৩৫তম ফজর আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা পরিচালক ও সেরা সহায়ক অভিনেতার পুরস্কার পেয়েছিল।
ছবিটিতে দারুণ ও ব্যতিক্রমীভাবে বৈচিত্র্য তুলে ধরা হয়েছে। জুরিবোর্ড ছবিটিতে নাভিদ মোহাম্মাদজাদেহর পারফরমেন্সের প্রশংসা করেছেন। পাশাপাশি তাঁরা ছবিটির শীর্ষ চরিত্রে অভিনয় করা চার ব্যক্তির পরফরমেন্সেরও প্রশংসা করেছেন।
ইরানি জনগণের জন্য এ সম্মাননা উৎসর্গ করে উৎসবের সমাপনী অনুষ্ঠানে পরিচালক ভাহিদ বলেন, ‘আমি একজন ইরানি হওয়ায় গর্বিত এবং ইরানের সিনেমার ইতিহাসে অন্যতম সেরা চলচ্চিত্রকার রাখশান বানিইতেমাদ ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবের জুরি বোর্ডের সদস্য হিসেবে থাকায় আনন্দিত।’ ৭৪তম ভেনিস আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব ইতালির ভেনিস নগরীতে ৩০ আগস্ট শুরু হয়ে চলে ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত।
ভারতে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় কার্গিল আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে অ্যাওয়ার্ড জেতে ইরানের চারটি ছবি। ২৩ আগস্ট কার্গিল শহরে অনুষ্ঠিত উৎসবের সমাপনী অনুষ্ঠানে এ অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়। ইরানি চলচ্চিত্রকার ইউসেফ জাফরি তাঁর ডকুমেন্টারি ‘চকোলেট স্টোরির’ জন্য সেরা পরিচালকের অ্যাওয়ার্ড জেতেন। অন্যদিকে, মিলাদ জারমুজ স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি ‘নাম্বনেসের’ জন্য সেরা পরিচালকের অ্যাওয়ার্ড পান।
এছাড়া এ উৎসবে ইরানের সাইয়্যেদ মোসলেম তাবাতাবায়ি পরিচালিত ‘লাইট সাইট’ সেরা অ্যানিমেশন ছবি হিসেবে নির্বাচিত হয় এবং অ্যানিমেশন ছবি ‘ইন দ্যা ক্রসহেয়ার্স’ এর জন্য মারজিয়েহ খেইরখাহ সেরা পরিচালকের পুরস্কার পান।
পঞ্চদশ ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে তিন বিভাগে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার পেয়েছে ইরান। সেরা ছায়াছবি, সেরা অভিনয় ও শ্রেষ্ঠ পরিচালনা বিভাগে পুরস্কার জিতে নেয় ইসলামি প্রজাতন্ত্রের এই দেশটি।
ইরানের বার্তা সংস্থা ইসনা জানায়, ঢাকা চলচ্চিত্র উৎসবের সমাপনী অনুষ্ঠানে রেজা মির কারিমি’র পরিচালনায় নির্মিত ‘দোখতার’ বা ‘কন্যা’ শীর্ষক ছবিটি শ্রেষ্ঠ ছায়াছবি হওয়ার গৌরব অর্জন করে। একই ছায়াছবিতে অভিনয়কারী ফরহাদ আসলানি পান সেরা অভিনয়ের পুরস্কার।
অন্যদিকে ‘ম্যালেরিয়া’ শীর্ষক ছায়াছবি পরিচালনার জন্য সেরা পরিচালক হওয়ার গৌরব অর্জন করেন ইরানের পারভিজ শাহবাজি। ঢাকার আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব গত ১২ জানুয়ারি শুরু হয়ে শেষ হয় ২০ জানুয়ারি।
স্পেনে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা অ্যানিমেশন ছবি হওয়ার গৌরব অর্জন করে ইরানি স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি ‘দ্য সারভেন্ট’। ৪০তম এলচি আন্তর্জাতিক স্বতন্ত্র চলচ্চিত্র উৎসবের অ্যানিমেশন বিভাগে সেরা ছবির অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে ছবিটি।
এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব ‘২০১৭ সিলভার স্ক্রিম ফেস্টিভ্যালে’ সেরা স্বল্পদৈর্ঘ্য অ্যানিমেশন ছবির অ্যাওয়ার্ড, ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত ১৩তম আন্তর্জাতিক ফ্যান্টাস্টিক ফেস্টিভ্যাল অব পোর্তো’তে দর্শক অ্যাওয়ার্ড, মেক্সিকোর আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবির অ্যাওয়ার্ড এবং যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকোতে সেরা অ্যানিমেশন ছবি হিসেবে দ্বিতীয় পুরস্কার লাভ করে এই চলচ্চিত্রটি।
ফারনুশ আবেদির তথ্যমতে ‘সারভেন্ট’ চলচ্চিত্রটি প্রভু ও তার দাসের কাহিনীকে ঘিরে নির্মিত। এখানে দাসের ভূমিকায় দেখা যাবে রাক্ষুসে পোকা তেলাপোকাকে। কিন্তু ধীরে ধীরে সে বুঝতে পারবে যে, সে আরও ভালো কিছু পাওয়ার যোগ্য। সুতরাং তেলাপোকা টেবিল উল্টে দেয়ার চেষ্টা করবে এবং শেষ পর্যন্ত খেলা নিজের অনুকূলে ঘুরিয়ে দিতে পারবে। ইলচি আন্তর্জাতিক স্বতন্ত্র চলচ্চিত্র উৎসবের এবারের ৪০তম আসর ১৪ জুলাই শুরু হয়ে চলে ২১ জুলাই পর্যন্ত।
পর্তুগালে অনুষ্ঠিত ২১তম অ্যাভানকা চলচ্চিত্র উৎসব থেকে তিনটি অ্যাওয়ার্ড ঘরে তোলে ইরান। দেশটির তিনটি ছবি উৎসবের কয়েকটি বিভাগ থেকে অ্যাওয়ার্ডগুলো জয় করে। এর মধ্যে বাহমান ও বাহমান আর্ক পরিচালিত ইরানি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘অ্যানিম্যাল’ উৎসবের সেরা স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবির অ্যাওয়ার্ড পায়।
১৫ মিনিটের চলচ্চিত্রটিতে এক ব্যক্তির কাহিনী তুলে ধরা হয়েছে, যে শিকারের উদ্দেশ্যে অবৈধভাবে সীমানা পাড়ি দিতে চায়। অতঃপর সে একটি ভেড়া শিকার করে এবং সেখান থেকে ছদ্মবেশে পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
অন্যদিকে, মজিদ ইসমায়েলি-পার্সা পরিচালিত ‘কাশতিবান’ সেরা ফিচার চলচ্চিত্র হিসেবে সিনেমা প্রাইজ পেয়েছে। ছবিটির চিত্র ধারণের জন্য মোহাম্মাদ ফাকুরি উৎসবে সেরা সিনেমা চিত্রশিল্পীর অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন।
এছাড়া, পর্তুগীজ চলচ্চিত্র উৎসবে মোসলেম তাবাতাবাইয়ির ‘লাইট সাইট’ প্রতিযোগিতা করেছে। এবারের উৎসবে ১০টি দেশের ৩৭ জনের সমন্বয়ে গঠিত জুরিবোর্ড ১৮টি অ্যাওয়ার্ড ও ৭টি সম্মাননা দিয়েছেন। ইউরোপীয় এ চলচ্চিত্র উৎসবটি গত ২৬ জুলাই শুরু হয়ে চলে ৩০ জুলাই পর্যন্ত।
হলিউডের বিখ্যাত তথ্যচিত্র পরিচালক ও অ্যাক্টিভিস্ট মাইকেল মুরের চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা ছবির খেতাব কুড়িয়েছে ইরানি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘রিটাচ’। যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান অঙ্গরাজ্যে অনুষ্ঠিত ‘ট্রাভার্স সিটি ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে’ ছবিটি সেরা স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবির অ্যাওয়ার্ড জিতে নেয়। ছবিটি পোলান্ডে অনুষ্ঠিত ৫৭তম ক্রাকো চলচ্চিত্র উৎসবেও দুটি পুরস্কার লাভ করে। সেরা কথাসাহিত্য বিষয়ক চলচ্চিত্র পরিচালনার জন্য পোলিশ উৎসবে ছবিটির পরিচালক কাভেহ মাজাহেরিকে সিলভার ড্রাগন অ্যাওয়ার্ড দেয়া হয়।
ইরান ডেইলির খবরে বলা হয়, ছবিটিতে এক তরুণীর মর্মান্তিক অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে। পৃথিবীর যেখানে অধিকার বলে কিছু অবশিষ্ট নেই এমন এক জায়গায় ওই নারীকে জীবন অথবা মৃত্যু এবং স্বাধীনতা অথবা বন্দিদশার মধ্যে যে কোনো একটি বেছে নেয়ার মতো পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়।
এর আগে ‘রিটাচ’ ফজর আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবির জন্য ‘ক্রিস্টাল সিমোর্ঘ’ পুরস্কার পেয়েছে। সেই সাথে এটি ইরানের চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা সংক্ষিপ্ত শিরোনামের জন্য খেতাব কুড়িয়েছে।
ছবিটি পরিচালনা করেছেন ইরানি চলচ্চিত্র নির্মাতা কাভেহ মাজাহেরি এবং এটি প্রযোজনা করেছেন ইরানিয়ান ইয়ং সিনেমা সোসাইটি। মিশিগানে অডিয়েন্স ও সেরা ফিকশন শর্ট ফিল্মে অ্যাওয়ার্ডের জন্য ছবিটি দাখিল করা হয়। এই উৎসবের প্রতিষ্ঠাতা অস্কার বিজয়ী চলচ্চিত্র নির্মাতা মাইকেল মুর। বাৎসরিক চলচ্চিত্র উৎসব ‘ট্রাভার্স সিটি ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’ মিশিগানের ট্রাভার্স সিটিতে জুলাইয়ের শেষ নাগাদ অনুষ্ঠিত হয়।
ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত চলচ্চিত্র উৎসব দ্য পোর্তো অ্যালেগ্রি স্ক্রিন রাইটিং ফেস্টিভ্যালে (এফআরএপিএ) তিনটি অ্যাওয়ার্ড জিতেছে ইরানি স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি ‘লাঞ্চ টাইম’। চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেছেন আলী রেজা কাশেমি। উৎসবের এবারের ৫ম আসর ৪ জুলাই শুরু হয়ে শেষ হয় ৭ জুলাই।
‘লাঞ্চ টাইম’ ১৬ বছর বয়সী এক কিশোরীর কাহিনী অবলম্বনে নির্মিত। যেখানে মায়ের মৃত্যুর পর তার মরদেহ শনাক্ত করতে হাসপাতালে আসে কিশোরী মেয়েটি। কিন্তু অল্প বয়সের কারণে হাসপাতালের দায়িত্বপ্রাপ্তরা মেয়েটিকে মর্গে ঢুকতে দেয় না। এ কারণে মরদেহ শনাক্ত করতে ঝামেলায় পড়তে হয় তাকে।
এর আগে যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবির আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা স্টুডেন্ট শর্ট ফিল্মের খেতাব কুড়ায় ইরানি চলচ্চিত্রটি। ‘স্নেক অ্যালি ফেস্টিভ্যাল অব ফিল্ম’ নামে ওই চলচ্চিত্র উৎসবের ৬ষ্ঠ আসরে ছবিটি সেরা ছবির অ্যাওয়ার্ড জেতে।
চলচ্চিত্রটিতে খোরশিদ চেরাঘিপুর, রুইয়া বখতিয়ারি, আমির তাঘদিরি, পেইম্যান নাইমি, সিয়াভাশ চেরাঘিপুর, বাহরাম ইমরানি, পুরিয়া আখাভান, মোহাম্মাদ হাদাদি, আলিরেজা কাসেমি, মাহদি ইয়েগানি ও আরাশ কাসেমি অভিনয় করেছেন।
ভিয়েনা স্বতন্ত্র চলচ্চিত্র উৎসবে তিনটি অ্যাওয়ার্ড জিতেছে ইরানি চলচ্চিত্র নির্মাতা ইবরাহিম হাতামিকিয়া পরিচালিত রাজনৈতিক ছবি ‘দ্য বডিগার্ড’।
হাতামিকিয়ার চলচ্চিত্রটি সেরা পরিচালক, সেরা শিল্প নির্দেশনার পুরস্কার জিতেছে। এছাড়া ছবিটির তারকা বাবাক হামিদিয়ান সেরা পার্শ্ব অভিনেতা হিসেবে অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। উৎসবের সমাপনী অনুষ্ঠান থেকে এ তিনটি পুরস্কার ঘরে তোলে ‘দ্য বডিগার্ড’।
চলচ্চিত্রটিতে এক মাঝ-বয়সী দেহরক্ষীর কাহিনী তুলে ধরা হয়েছে, যিনি একজন রাজনীতিবিদকে আত্মঘাতী বোমা হামলাকারীর হাত থেকে রক্ষা করেন। এরপর পেশাগত জীবনে তাঁর আত্মত্যাগ নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন শুরু হয়।
এছাড়াও উৎসব থেকে সেরা পুরস্কার কুড়িয়েছে হংকংয়ের স্যাম্পসন ইয়ুন পরিচালিত ‘মিলিয়ন লাভস ইন মি’। অন্যদিকে, জার্মান পরিচালিত অ্যান্দ্রিজ মোরেলের ‘প্লাটনভ’ সেরা চলচ্চিত্রের অ্যাওয়ার্ড জিতেছে।
ইরানের ইসফাহানে অনুষ্ঠিত ৩০তম আন্তর্জাতিক শিশু-কিশোর চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা ছবির খেতাব অর্জনের পাশাপাশি চলচ্চিত্র প্রতিযোগিতার বিভিন্ন বিভাগে ছয়টি অ্যাওয়ার্ড জেতে ইরানি চলচ্চিত্র নির্মাতা ফেরেইদিন নাজাফি পরিচালিত ‘দ্য স্কেটার’।
‘দ্য স্কেটার’ চলচ্চিত্রটি উৎসবের আন্তর্জাতিক ও জাতীয় প্রতিযোগিতা বিভাগে প্রদর্শিত হয়। সেরা পরিচালকের জন্য ছবিটি গোল্ডেন বাটারফ্লাই অ্যাওয়ার্ডও পায়। ছবিটিতে কেন্দ্রীয় চরিত্রের এক বালকের কাহিনী দারুণভাবে তুলে ধরার জন্য সেরা অভিনেতার অ্যাওয়ার্ড জিতেছে আমির-রেজা ফারামরিজি। প্রতিযোগিতার আন্তর্জাতিক বিভাগ থেকে সে এই পুরস্কার লাভ করে। এছাড়া জাতীয় বিভাগেও সেরা অভিনেতার অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে সে।
জাতীয় বিভাগে ছবিটি সেরা চলচ্চিত্র ও সেরা পরিচালকের অ্যাওয়ার্ডসহ কয়েকটি অ্যাওয়ার্ড জেতে। সব মিলিয়ে নিজেদের ঝুড়িতে ছয়টি অ্যাওয়ার্ড ভরে ‘দ্য স্কেটার’।
বিশেষ অনুষ্ঠানে ইরানের সংস্কৃতি ও ইসলামি নীতিমালা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী রেজা সালেহি-আমিরির উপস্থিতিতে বিজয়ীদের সম্মাননা জানানো হয়। এতে বিপুল সংখ্যক সিনেমা ব্যক্তিত্ব ও শিশু-কিশোর উপস্থিত ছিল।
ইরানি চলচ্চিত্র নির্মাতা সাইদ মোসলেম তাবাতাবাঈ পরিচালিত স্বল্পদৈর্ঘ্য অ্যানিমেশন ছবি ‘লাইট সাইট’ সেরা ছাত্র বিষয়ক ছবির পুরস্কার জেতে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যে অনুষ্ঠিত ‘ফাইন আর্ট্স্ ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে’ (এফএএফএফ) ছবিটি সেরা ছাত্র বিষয়ক চলচ্চিত্র হিসেবে নির্বাচিত হয়।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে কয়েক ডজন ছবি উৎসবে প্রদর্শিত হয়। ক্যালিফোর্নিয়ায় গত ১২ মে উৎসব শুরু হয়ে চলে ১৩ মে পর্যন্ত।
‘লাইট সাইট’ ছবিটি এম. ই নামের এক জীবকে ঘিরে নির্মিত। যে তার কক্ষের বাইরে একটি সাদা আলো দেখে মুগ্ধ হয়ে পড়ে। পরে সে ওই আলোর কাছে পৌঁছার চেষ্টা করে। কিন্তু পথে নানা প্রতিবন্ধকতায় পড়ে।
উৎসবে গ্রিসের ডিমিত্রিস কুতসিয়াবাসাকোস তাঁর ‘ইয়ান্নিস কাস্ত্রিটসিস: এ ম্যান অ্যান্ড হিজ শ্যাডো’ চলচ্চিত্রের জন্য সেরা পরিচালকের পুরস্কার পেয়েছেন। অন্যদিকে, ফিনল্যান্ডের সারা ল্যাম্বার্গ পরিচালিত ‘ইন্নুয়েন্ডো’ উৎসবের সেরা চলচ্চিত্র হিসেবে মনোনীত হয়েছে।
ভারতের জয়পুরে অনুষ্ঠিত ষোড়শ আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব (১৬-আইএফএফ) জয় করেছে ইরানের স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘দ্য গাই কেম অন হর্সব্যাক‘ ও ‘বর্ন ইন মরড্যাড’। সদ্য পর্দা নামা ১৬-আইএফএফ এর দ্বিতীয় আসরে সেরা ছবির পুরস্কার জিতে নিয়েছে চলচ্চিত্র দুটি।
এ উসবের আয়োজন করে জয়পুর আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব- জেআইএফএফ। জয়পুরের কোচা সিনেমা হলে গত ১৭ মে উৎসব শুরু হয়ে চলে ২১ মে পর্যন্ত। এতে ১২ দেশের ১৩টি ভাষার ২৩টি চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়।
১৬টি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে এই চলচ্চিত্র উৎসবের আয়োজন করা হয়। তা হলো গণতন্ত্র, রাজনীতি, দুর্নীতি, ভয়ঙ্কর চলচ্চিত্র, রোমান্টিক ছায়াছবি, নারী বিষয়ক চলচ্চিত্র, শিশু বিষয়ক চলচ্চিত্র, অ্যানিমেশন ছবি, বিজ্ঞাপন চলচ্চিত্র ইত্যাদি।
ইরানি চলচ্চিত্র নির্মাতা হোসেইন রাবিয়েই দাসরজারদি পরিচালিত ‘দ্য গাই কেম অন হর্সব্যাক’ উৎসবের সেরা ভালোবাসা ও রোমান্টিক স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবির পুরস্কার জিতেছে। অন্যদিকে, ফারজাদ রহমানি পরিচালিত ‘বর্ন ইন মরড্যাড’ সেরা নারী ও শিশু বিষয়ক স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবির খেতাব কুড়িয়েছে।
এর আগে আইএফএফের প্রথম আসরে ইরানের পাঁচটি চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছিল।
পর্তুগালের দশম পর্তো সেভেন ইন্টারন্যাশনাল শর্ট ফিল্ম ফেস্টিভালে ইরানি চলচ্চিত্র ‘ইউ জাস্ট বি মাই মাদার’ এর অভিনেত্রী সারা বাহরামি সেরা অভিনেত্রীর অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। এর আগে এ চলচ্চিত্রটি দিল্লি ইন্টারন্যাশনাল ডিজিটাল ফিল্ম ফেস্টিভাল ও এথেন্স ইন্টারন্যাশনাল ডিজিটাল ফিল্ম ফেস্টিভালে প্রশংসা কুড়ায়। স্বামী পরিত্যক্তা একজন নারী হিসেবে সারা এ চলচ্চিত্রে আরেক ব্যক্তির সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন যেখানে ওই ব্যক্তিটির পুত্র তাকে সহজে নিতে পারে নি। শেষ পর্যন্ত সারা ওই ছেলে ও তার প্রেমের মধ্যে যে কোনো একটিকে বেছে নিতে বাধ্য হন। এ চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেছেন রকিহ তাভাকোলি।
উৎসবে সেরা চলচ্চিত্রের মর্যাদা পায় জার্মানির চলচ্চিত্র ‘সেলফি’। স্পেনের ‘দি ফোর্থ কিংডম’ চলচ্চিত্রটি একই মর্যাদা পায়। এছাড়া সেরা অ্যানিমেশনের জন্য স্পেনের ‘মেকানিজ্ম ডায়াবলিকো’ চলচ্চিত্রটি অ্যাওয়ার্ড পায়। উৎসবে ইরানি পরিচালক সাইদ নাকাভিয়ান পরিচালিত ‘রিফিউজি ক্যাম্প’ প্রদর্শিত হয়।
২০তম ব্রুকলিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা শৈল্পিক পুরস্কার পেয়েছেন ইরানি অভিনেত্রী গোলাব আদিনেহ। চলচ্চিত্র নির্মাতা মারজান আশরাফিজাদেহ পরিচালিত ‘দ্য সিস’ চলচ্চিত্রে সেরা অভিনয়ের জন্য তিনি এই পুরস্কার লাভ করেন।
এবারের ব্রুকলিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে ‘দ্য সিস’ ছবিটি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের প্রতিযোগিতা বিভাগে নবমবারের মতো অংশগ্রহণ করলো। ব্রুকলিনে ছবিটি দুইবার দেখানো হয়েছে। এতে গোলাব আদিনেহের অভিনয় দেখে অভিভূত হয়েছেন আন্তর্জাতিক জুরিবোর্ড।
এর আগে সপ্তম বেইজিং আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে (বিজেআইএফএফ) ‘দ্য সিস’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য সেরা অভিনেত্রীর অ্যাওয়ার্ড পান তিনি।
ইরানি এই চলচ্চিত্রটি দুই নারীর চরিত্রকে ঘিরে নির্মিত। যেখানে তাঁরা ৫০ বছরের অধিক সময় ধরে একত্রে বসবাস করেন। যে সম্পর্ক চিরতরে শেষ হওয়ার নয়। তবুও শেষ পর্যন্ত তাঁদের মধ্যে বিচ্ছেদের দিন এসে হাজির হয়।
স্পেনে অনুষ্ঠিতব্য মাদ্রিদ আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের চারটি ক্যাটাগরিতে প্রধান পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছে ইরানি চলচ্চিত্র নির্মাতা ইব্রাহিম হাতামিকিয়ার ফিচার ফিল্ম ‘বডিগার্ড’।
‘বডিগার্ড’ ছবিটি প্রথম ইরানের ৩৪তম আন্তর্জাতিক ফজর চলচ্চিত্র উৎসবে দেখানো হয়েছে। এই উৎসবে শীর্ষ চরিত্রে সেরা অভিনয় ও সেরা ভিজুয়াল ইফেক্টের জন্য ছবিটি দু’টি ক্রিস্টাল সিমোর্ঘ সেরা পুরস্কার) জয় করেছে।
মাদ্রিদ চলচ্চিত্র উৎসবের চারটি বিভাগ তথা সেরা অভিনেতা হিসেবে পারভিজ প্যারাস্তোয়ি, সেরা সহকারী অভিনেতা হিসেবে বাবাক হামিদিয়ান, সেরা বিদেশি চলচ্চিত্র বিভাগে এহসান মোহাম্মাদ হাসানি ও সেরা এডিটিং-এ প্রধান পুরস্কারের জন্য মেহদি হুসেইনভান্দ মনোনীত হয়েছেন।
এছাড়া চলচ্চিত্রের আরও অনেক ক্ষেত্রেই ইরান সাফল্যের স্বাক্ষর রেখে চলেছে যা এই সীমিত পরিসরে তুলে ধরা প্রায় অসম্ভব। তবে একথা বলা যায়, চলচ্চিত্রে ইরানের সফলতার এই ধারা অব্যাহত থাকলে দেশটি একদিন বিশ্বের সিনেমা জগতে নেতৃত্বের আসন গ্রহণ করবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।

ইতিহাসের সাক্ষী তাখতে জামশীদ

ইরানের দর্শনীয় ঐতিহাসিক স্থানগুলোর অন্যতম হলো ‘তাখতে জামশীদ’। পাশ্চাত্যে একে ‘পার্সেপোলিশ’ নামেও অভিহিত করা হয়।

‘তাখতে জামশীদ’ একটি প্রাচীন রাজপ্রাসাদ। ইরানের হাখামানশী বংশের বাদশাদের এই নগরী প্রাচ্য সভ্যতার এক উজ্জ্বল নিদর্শন হিসাবে আজো টিকে রয়েছে। কালের বিবর্তনে এই নগরীর জৌলুশ আর নেই। তবে এর অবশিষ্ট ধ্বংসাবশেষ আজো বিশ্ববাসীকে প্রাচীন পারস্য সভ্যতার শৌর্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। প্রতি বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের হাজার হাজার পর্যটক এই তাখতে জামশীদের ধ্বংসাবশেষ দেখার জন্য ইরানে এসে ভীড় করে থাকেন।

63739505569014036238ইরানের শিরাজ নগরীর উত্তর-পূর্বে ৭৫ কিলোমিটার দূরে বিশাল এক সমভূমির মাঝে প্রায় আড়াই হাজার বছরের প্রাচীন ইতিহাসের সাক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তাখতে জামশীদের স্তম্ভশ্রেণি। ইসফাহান সড়কের পাশেই এটি অবস্থিত।

প্রাচীন ইরানের হাখামানশী রাজবংশ ছিল খুবই বিখ্যাত। এই বংশের বিখ্যাত রাজা ছিলেন প্রথম দারিয়ুস। রাজা প্রথম দারিয়ুসের আমলে হাখামানশী সাম্রাজ্য সমৃদ্ধির সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ করে। তিনি ৫২২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৪৮৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত শাসন করেন। দারিয়ুসই প্রথম তাখতে জামশীদ নির্মাণ শুরু করেন।

1426273174884639_0রাজা দারিয়ুস তাঁর প্রাসাদের জন্য প্রথমে একটি বিশাল সোপান শ্রেণি তৈরি করেন। তাঁর রাজধানীর পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন পাহাড় কেটে এনে এটি তৈরি করা হয়। তাঁর প্রাসাদের চারপাশে পাথরের উঁচু প্রাচীরও গড়ে তোলা হয়। ৫০ ফুট উঁচু এই প্রাচীর এত বেশি মজবুত ছিল যে, তাখতে জামশীদ একটি দুর্ভেদ্য দুর্গে পরিণত হয়। প্রাসাদের সিঁড়ির পশ্চিম পাশে দারিয়ুস তাঁর রাজধানী শহর গড়ে তোলেন।

তাখতে জামশীদের নির্মাণ কাজ সম্রাট দারিয়ুসের দ্বারা শুরু হলেও তাঁর আমলে এর কাজ শেষ হয়নি। পরবর্তী সম্রাটদের আমলেও এর নির্মাণ কাজ অব্যাহত থাকে। দারিয়ুস এই নগরীর নির্মাণ কাজ শুরু করলেও এর নাম হয়েছে ‘তাখতে জামশীদ’ বা ‘জামশীদের তাখত’। জামশীদ ছিলেন পৌরাণিক কাহিনীর কল্পনায়ক। বিভিন্ন রাজার আমলে নির্মিত হওয়ায় হয়তো এ নগরী তাখতে জামশীদ হিসাবে পরিচিতি পেয়েছে। গ্রীকরা এ নগরীর নাম দিয়েছিল পার্সেপোলিশ। আধুনিক ইংরেজি ভাষাতেও এ নামটিই রয়ে গেছে।

22272499901350544039৫১৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে দারিয়ুস তাখতে জামশীদ নির্মাণ শুরু করেন। তাঁর পরে তাঁর পুত্র প্রথম খোশিয়ার শাহ (৪৮৬-৪৬৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি পাশ্চাত্যে জেরেক্সস নামে পরিচিত। খোশিয়ার শাহ এর আমলে এই রাজধানীর নির্মাণ কাজ চলে এবং তাঁর পরে তাঁর পুত্র প্রথম আরদেশির (৪৬৬-৪২৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) এর আমলে নির্মাণ কাজ অব্যাহত থাকে। আরদেশির পাশ্চাত্যে আরটাজেরেক্স নামে পরিচিত। এসব আসলে গ্রীকদের দেয়া নাম। প্রাচীন পারস্য সভ্যতার সাথে গ্রীক সভ্যতার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল।

প্রথম আরদেশিরের আমলে তাখতে জামশীদের নির্মাণ কাজ সম্পূর্ণ হয়। এই শহর ছিল প্রাচীনকালের বিখ্যাত রাজধানী শহরগুলোর অন্যতম। বিভিন্ন সম্রাটের রাজত্বকালে দীর্ঘ প্রায় ১০০ বছর ধরে এ নগরীর নির্মাণ কাজ চলে। হাখামানশী সম্রাটরা নিজেদের সাম্রাজ্যের কেন্দ্রবিন্দু এবং নিজেদের রাজকীয় বাসস্থান হিসাবে তাখতে জামশীদকে মনের মতো করে গড়ে তোলেন।

তাখতে জামশীদের গোটা আঙ্গিনার মোট দৈর্ঘ্য ৪৫০ মিটার, প্রস্থ ৩০০ মিটার এবং উচ্চতা ১৮ মিটার। এর চারপাশ দুর্ভেদ্য প্রাচীর দিয়ে ঘেরা।

downloadতাখতে জামশীদের উত্তর-পশ্চিম কোনে দাঁড়ালে চোখে পড়বে সুবিশাল সোপান শ্রেণি। ১১০টি ধাপ রয়েছে এতে। জেরেক্সেস (খোশিয়ার শাহ) তোরণ দিয়ে এই সোপানে আরোহণ করতে হয়। এই তোরণে তিনটি প্রবেশদ্বার। প্রতিটি ১১ মিটার উঁচু। এই তিনটি প্রবেশদ্বার যথাক্রমে পূর্ব, পশ্চিম এবং দক্ষিণমুখী। দক্ষিণদ্বার দিয়ে গেলে আপনি আপাদানা হল ঘরে পৌঁছবেন। এটি একটি বিশাল হল ঘর। আয়তাকার এই হল ঘরকে সিংহাসন মহলও বলা হতো। এখানে সিংহাসনে বসে রাজার প্রজাদের সাক্ষাৎ দান করতেন। এ ঘরের ছাদ ছিল অনেক উঁচু। প্রায় ৬০ ফুট উঁচু স্তম্ভ শ্রেণি হলঘরের গৌরব ও মহিমা প্রকাশ করত। মোট ৩৬টি স্তম্ভ সুদৃশ্য কারুকাজে শোভিত বিশাল ছাদকে ধরে রাখত। এই হলঘরের ধ্বংসাবশেষের ওপর দাঁড়িয়ে চারিদিকে চোখ বুলালেই কল্পনায় ভেসে উঠে প্রাচীন ইরানী সভ্যতার গৌরব ও মর্যাদা। এই প্রাসাদ এক সময় আলোকোজ্জ্বল ও কোলাহলমুখর ছিল। বাদশাহি জাঁকজমক এর শোভা বর্ধন করত। হাখামানশী সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রজারা দলে দলে এসে এখানে ভীড় করত। বাদশাকে সম্মান জানাতে, উপহার দিতে এবং খাজনা পরিশোধ করতে ওরা আসত। সুউচ্চ আসনে বসে বাদশা প্রজাদের দর্শন দিতেন।

আপাদানা প্রাসাদের দক্ষিণ-পূর্ব পাশে রয়েছে আরেকটি হলঘর। এর নাম ‘তালারে শোরা’। এর সোপান শ্রেণি সুন্দর সুন্দর নকশা ও কারুকাজ শোভিত।

71073571তাখতে জামশীদের আরেকটি আকর্ষণীয় অংশ হলো বাদশাহ দারিয়ুসের প্রাসাদ। এর নাম তাসার। এই প্রাসাদে অপরূপ কারুকাজমণ্ডিত সুদৃশ্য প্রবেশদ্বার সম্বলিত অনেকগুলো কামরা রয়েছে। এগুলোর মধ্যে ‘আয়না ঘর’ অন্যতম।

শাহ আরদেশিরের প্রাসাদ তাখতে জামশীদের দক্ষিণ পাশে। এটি দেখতে তাসার প্রাসাদের অনুরূপ। এই প্রাসাদে ছিল সুদৃশ্য ব্যালকনি, যেখান থেকে দূরে সমভূমির দৃশ্য অবলোকন করা যেত। তাছাড়া একটি বৃহৎ  জেনানা মহলও (হারাম) এর শোভা বর্ধন করত।

তাখতে জামশীদের উত্তর-পূর্ব পাশে অবস্থিত খোশিয়ার শাহ এর ‘সাদ সতুন’ (১০০ স্তম্ভ) প্রাসাদ। ১০০টি সুদৃশ্য স্তম্ভ দ্বারা নির্মিত হয়েছিল এই প্রাসাদ। এখানেও ছিল অনেক কারুকাজ ও নকশা। কিন্তু কালের করালগ্রাসে সেই জৌলুশ লোপ পেয়েছে। এখন কিছু স্তম্ভসহ সেই প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ অবশিষ্ট আছে। তাখতে জামশীদের দক্ষিণ পাশেই রয়েছে সম্রাট তৃতীয় দারিয়ুসের সমাধি।

pe29p0v5i4kkl95pou6w৩৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গ্রীক সম্রাট আলেকজান্ডার পারস্যে এক অভিযান চালাবার সময় তাখতে জামশীদ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। কথিত আছে, তাঁর রাণী থায়িস এর প্ররোচনায় আলেকজান্ডার তাখতে জামশীদে অগ্নিসংযোগ করেন।

তারপরেও তাখতে জামশীদ কালের সাক্ষী হয়ে আজো দাঁড়িয়ে আছে। তাখতে জামশীদের প্রতিটি কোনায় কোনায় দৃষ্টি বুলালে আপনি দেখতে পাবেন বিভিন্ন প্রকার উৎকীর্ণ শিলালিপি। প্রাচীন পারসিক, ব্যাবিলনীয় এবং ইসলামী ভাষায় এসব শিলালিপি উৎকীর্ণ করা হয়েছে।

এসব লেখায় যরথুস্ত্র ধর্মের আহুর মাজদার প্রতি প্রশংসা, সৃষ্টিতত্ত্ব, পৃথিবী, স্বর্গ, নরক, মানুষ, যশঃ, খ্যাতি, হাখামানশী রাজা-বাদশাদের গৌরবগাথা প্রভৃতির বর্ণনা আছে। বিভিন্ন ভাষার ব্যবহার দেখে মনে হয় তখন ইরানের সাথে আন্তর্জাতিক সভ্যতাসমূহের যোগাযোগ ছিল।

 

 

 

 

মহাকবি ফেরদৌসি ও তাঁর প্রজ্ঞা

ড. তারিক সিরাজী: প্রাচ্যের ‘হোমার’ খ্যাত ফারসি সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবি আবুল কাসেম ফেরদৌসি ছিলেন ইরানের প্রাচীন ইতিহাস, ঐতিহ্য ও গৌরবগাথার সার্থক রূপকার। যে কারণে তাঁর জীবনকাহিনী রূপকথার ন্যায় ছড়িয়ে পড়েছে। বিশ্ববিখ্যাত বীরত্বগাথা শাহনামা রচনার মাধ্যমে তিনি ইরানিদের জাতিসত্তা ও ফারসি ভাষার মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্যকে সংরক্ষণ করেছেন। তাঁর এ কালোত্তীর্ণ বীরত্বগাথা শাহনামা গ্রন্থটি পৃথিবীর প্রসিদ্ধ ভাষাগুলোতে অনূদিত হয়েছে এবং অসংখ্য সাহিত্যামোদীর মনের খোরাক যুগিয়েছে।

আবুল কাসেম ফেরদৌসি ৯৪০ খ্রিস্টাব্দে খোরাসানের তুস নগরীর অন্তর্গত তাবরানের বায নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আর্থিক অবস্থা যাই ছিল না কেনো বস্তুত ত্রিশ বছর ধরে শাহনামা রচনার কারণে তাঁর ধনসম্পদ হাতছাড়া হয়ে যায় এবং বার্ধক্যে এসে তিনি দরিদ্র হয়ে পড়েন। আর এ ত্রিশ বছর অক্লান্ত পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে তিনি গোটা পারস্যকে পুনরুজ্জীবিত করেন। তিনি নিজেই বলেন:

بسي رنج بردم در اين سال سي عجم زنده كردم بدين پارسي

আমি বহু কষ্ট ভোগ করেছি এই দীর্ঘ ত্রিশটি বছর ধরে

আর এ পারসির (ফারসি) মাধ্যমে পারস্যকে জীবন্ত করেছি।

6-1024x682কবি ফেরদৌসির গুরুত্ব ও আবেদন কেবল তাঁর ভাষার লালিত্য, মাধুর্য, ইতিহাস-ঐতিহ্য ও বীরদের কাহিনী বর্ণনার মধ্যেই নিহিত নয়, বরং তাঁর জাতীয়তাবাদ ও ধর্মীয় চেতনার মাঝেও বিদ্যমান। তাঁর রচিত শাহনামা গ্রন্থের পরতে পরতে গল্পের কাহিনীগুলো এমনিভাবে বিধৃত রয়েছে যে প্রতিটি চরিত্রই যেন একেক জন পর্যবেক্ষক হিসাবে কাজ করছে। যে কারণে এ মহাকাব্য সাহিত্যের একটি উচ্চমার্গে পৌঁছেছে। তিনি প্রচলিত সাহিত্যরীতির বিপরীতে অন্তর্নিহিত বর্ণনার দিকে অগ্রসর হয়েছেন আর এটি ছিল তাঁর নিজস্ব উদ্ভাবিত শৈলী। এ ধরনের সাহিত্যশৈলী ফারসি সাহিত্যে বিরল। তিনি তাঁর শাহনামা কাব্যগ্রন্থকে ধ্বনি, শব্দ চয়ন, এমনকি ব্যাকরণসহ সকল স্তরে একটি সুশৃঙ্খল গঠন কাঠামোর মাধ্যমে বিন্যস্ত করেছেন। যার ফলে এটি ভাষাতত্ত্বের দৃষ্টিকোণ থেকেও সর্বোচ্চ ও চূড়ান্ত অবস্থানে রয়েছে।

প্রাচীনকালে তথা শাহনামার রচয়িতা আবুল কাসেম ফেরদৌসির যুগে আনুষ্ঠানিকভাবে গল্প বলা ও শোনার একটা প্রচলন ছিল। কারণ, সে সময় বেশিরভাগ লোকই পড়তে ও লিখতে জানতো না। এ ধরনের গল্প পাঠের আসরে পরিবেশন করা হতো ধর্মীয় ও পৌরাণিক কাহিনী। পুরাণপাঠের এ কাজটিকে বলা হয় নাক্কালি আর যিনি কাহিনীগুলো পাঠ করে শোনান বা উপস্থাপন করেন তাঁকে বলা হয় নাক্কাল বা পুরাণপাঠকারী। তাঁর হাতে থাকত একটি লাঠি যা দিয়ে তিনি চরিত্র চিত্রায়ণ করতেন। বলা যায় ঠিক আমাদের দেশের পুথি পাঠের ন্যায়। পুরাণপাঠকারীর অথবা গল্প বলার কাজটিকে সহজতর ও প্রাণবন্ত করার লক্ষ্যেই ফেরদৌসি সহজ-সরল ও প্রাঞ্জল ভাষায় পৌরাণিক কাহিনীগুলো রচনা করে তা শাহানামা কাব্যগ্রন্থে তুলে ধরেছেন।

আমরা জানি যে, পৌরাণিক কাহিনীগুলোর বিশ্লেষণ, মহান বীর যোদ্ধাদের গুণ, বৈশিষ্ট্য ও কীর্তি বর্ণনা এবং বিভিন্ন জাতির ভাগ্য নির্মাণে সংঘটিত যুদ্ধ-বিগ্রহের ইতিহাস তুলে ধরাই হলো মহাকাব্যের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। পাশাপাশি সমকালীন রাজনৈতিক ও আত্মউদ্দীপক বিষয়গুলোও এতে অনুরণিত হয়ে থাকে। এছাড়া ফেলা আসা অতীত যুগের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস, একটি জাতি প্রতিষ্ঠার ঘটনা ও নিজের প্রসিদ্ধ বীরত্বগাথা মাহাকাব্যে বিধৃত থাকে। মহাকাব্যের রচয়িতাগণ এ ধরনের সাহিত্যকর্মে নিজ জাতি ও মানব সভ্যতার আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়ে থাকেন এবং তাঁদের ভিতরের রহস্যকে নিজদের সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে উন্মোচিত করেন। তাঁরা মনে করেন জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য ও বীরত্ব জানার মধ্য দিয়ে আত্মপরিচয় লাভ করা যায় এবং উৎসাহ-উদ্দীপনা ও জাতীয় আত্মবিশ্বাস প্রতিষ্ঠায় উজ্জীবিত হওয়া যায়। মহাকাব্যে বিধৃত বীরদের কাহিনী থেকে শিক্ষা নিয়ে অত্যাচার ও নীপিড়নের বিরুদ্ধে জাতি ও দেশকে ধ্বংস থেকে রক্ষার উপায় ও অবলম্বন অন্বেষণ করা যায়।

বিশ্বে যে কয়টি নির্ভরযোগ্য মহাকাব্য রয়েছে সেগুলোর মূল বক্তব্য ও বিষয় অনেকটা একই বলে প্রতিভাত হয়। সমৃদ্ধ ও গ্রহণযোগ্য মহাকাব্যগুলোর মধ্যে রয়েছে:

১. গিলগামেশ (এরষমধসবংয) : এটি প্রায় খ্রিস্টপূর্ব দুই হাজার সালে ব্যাবিলনীয় ভাষায় রচিত হয়েছে এবং যার বিষয়বস্তু ছিল বীরদের জন্য এমন এক মৃতসঞ্জীবনী উদ্ভিদ অন্বেষণ এবং পরাজিত সৈনিকদের কাহিনী বর্ণনা করা। ২. ইলিয়াড (ওষরধফ): এটি খ্রিস্টপূর্ব ৮ম শতকের মধ্যভাগে হোমার কর্তৃক গ্রিক ভাষায় রচিত হয়েছেÑ যার বিষয়বস্তু ছিল ট্রয় নগরীর দশ বছরব্যাপী যুদ্ধকাহিনী। ৩. ইনেইড (অবহবরফ): এটি ভার্জিল কর্তৃক ল্যাটিন ভাষায় রচিত মহাকাব্য। এটি রচনা করতে ভার্জিলের খ্রিস্টর্পূব ২৯ থেকে ১৯ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ সময় লেগেছিল। এ মহাকাব্যের বিষয়বস্তু ছিল ট্রয় নগরীর ধ্বংস এবং রোম জাতির প্রতিষ্ঠার পর বন্ধুদের সাথে ইনের ভ্রমণ-বৃত্তান্ত বর্ননা করা। এছাড়া এতে উল্লেখ রয়েছে শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রতীক হিসাবে খ্যাত ট্রয়ের জনগণ এবং শক্তিমত্তার প্রতীক হিসাবে প্রসিদ্ধ ল্যাটিন জনগণের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার বিষয়াবলি। ৪. মহাভারত (গধযধনযধৎধঃধ) খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে সংস্কৃত ভাষায় রচিত হয়েছে। ৫. রামায়ণ (জধসধুধহধ): খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় অথবা চতুর্থ খ্রিস্টাব্দে বাল্মীকি কর্তৃক রামচন্দ্রের জীবনকাহিনী নিয়ে রচিত হয়েছে। ৬. ফেরদৌসির শাহনামা হিজরি চতুর্থ শতকে ফারসি ভাষায় রচিত হয়েছে।

ফেরদৌসি ৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে শাহনামা রচনা শুরু করেন এবং ১০১০ খ্রিস্টাব্দে ৭৫ বছর বয়সে তা সমাপ্ত করেন। বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ফেরদৌসির শাহনামায় যে বিষয়গুলো রয়েছে তা হচ্ছে, বীরদের মানসিকতা, প্রচেষ্টা, জ্ঞান ও বিদ্যা, খোদার আনুগত্য, ন্যায়পরায়ণতা, রাজনীতি, জাতীয় ঐক্য ও সংহতি। এতে শিক্ষণীয় অনেক বিষয়ের উল্লেখের পাশাপাশি রয়েছে বিশ্বদর্শন।

হিজরি ষষ্ঠ শতকে শাহনামা মূলত দু’টি ভাষায় অনূদিত হয়েছিল। একটি জর্জিয়ান ভাষায় আর অপরটি হয়েছিল আরবি ভাষায়। কিন্তু পরিতাপের সাথে বলতে হয় যে, উভয়টিই কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। প্রথম আরবি ভাষায় শাহনামা অনুবাদ করেন আসিরুল মামালিক নিশাবুরিÑ যিনি হিজরি পঞ্চম শতকের শেষভাগে এবং ষষ্ঠ শতকের গোড়ার দিক পর্যন্ত জীবিত ছিলেন।

কাওয়াম উদ্দিন ফাতেহ বিন আলি বিন মুহাম্মাদ বুন্দারি ই¯পাহানি কর্তৃক আরবি ভাষায় অনূদিত কপিটিই হচ্ছে শাহনামার সবচেয়ে পুরাতন অনূদিত কপি যা এখনো সংরক্ষিত আছে। অনুবাদক বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক তথ্যগুলোই তুলে ধরেছেন এবং বর্ণনাধর্মী বিষয়গুলো পরিহার করেছেন।

১০৩০ খ্রিস্টাব্দে তৃতীয় যে ভাষায় শাহনামা অনূদিত হয়েছিল তা ছিল ওসমানি তুর্কি ভাষায়। শাহানামা কাব্যগ্রন্থটি ২৭টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। যেমন, আরবি, জার্মানি, উর্দু, ইংরেজি, বাংলা, ইতালি, পশতু, তুর্কি, রুশ, জাপানি, হিন্দি, কুর্দি ইত্যাদি।

উল্লেখ্য যে, শাহানামার প্রথম অনুবাদটি সুলতান ঈসা বিন মুলকে কামেল আবু বকর এর নির্দেশে বুন্দারি সম্পন্ন করেছেন যা ছিল ইতিহাসনির্ভর। সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার হলো এই যে, জার্মানি ভাষায় যখন শাহানামা অনূদিত হয় তখন চলছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। আবার মনিরউদ্দিন ইউসুফ ১৯৭১ সালে বাংলা ভাষায় যখন শাহনামা অনুবাদ করছিলেন তখন ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়। মহাকাব্য শাহনামা অনুবাদের এ প্রেক্ষাপট পর্যালোচনার দাবি রাখে। তাই বলা যায় যে, মনিরউদ্দিন ইউসুফ বাংলা ভাষায় শাহনামা শীর্ষক মহাকাব্য অনুবাদের মধ্য দিয়ে মূলত কবি ফেরদৌসির আত্মরহস্য উদ্ঘাটন করতে চেয়েছেন।

ফেরদৌসি তাঁর শাহানামা কাব্যগ্রন্থে প্রাচীন পারস্যের ইতিহাস-ঐতিহ্য বর্ণনার মাধ্যমে চরিত্র গঠন, বীরত্ব, পা-িত্য, বিচক্ষণতা ও জ্ঞানের সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেন। জ্ঞানের যে বিশাল শক্তি রয়েছে সে বিষয়ে তিনি বলেন:

توانا بود هر که دانا بود ز دانش دل پير برنا بود

যে জ্ঞানী সেই শক্তিশালী ও সামর্থ্যবান,

আর জ্ঞানসমৃদ্ধ বৃদ্ধের হৃদয় চির যৌবন থাকে।

ফেরদৌসি শাহনামা রচনা করে ফারসি ভাষাকে নিশ্চিহ্ন হওয়া থেকে রক্ষা করেন। এ গ্রন্থের মাধ্যমে তিনি প্রতিরোধের মানসিকতা, খোদার আনুগত্য, স্বদেশপ্রেম ও স্বাধীনতার শিক্ষা দিয়েছেন। কিন্তু শাহনামার বড় পরিচয় হচ্ছে ফারসি ভাষার অস্তিত্বের সনদ হিসাবে।

ফেরদৌসি শাহনামা কাব্যগ্রন্থে যুদ্ধ ও বীরত্বপূর্ণ কাহিনী বর্ণনার পাশাপাশি তথ্যপূর্ণ উপদেশাদি ও নৈতিক কর্তব্যাদি সম্পর্কে বক্তব্য দিতেও সচেষ্ট ছিলেন। শাহনামায় বিধৃত এমনি উপদেশ সম্পর্কিত কয়েকটি পঙ্ক্তি নিচে তুলে ধরা হলো:

بيا تا جهان را به بد نسپريم به کوشش، همه دست نيکي بريم

نماند همي نيک و بد پايدار همان بِه، که نيکي بود يادگار

نه گنج و نه ديهيم و کاخ بلند نخواهد بدن مر ترا سودمند

فريدون فرخ فرشته نبود ز مُشک و ز عنبر سرشته نبود

بِه داد و دهش يافت اين نيکويي تو داد و دهش کن فريدون تويي

এসো, এ পৃথিবীকে আমরা যেন অকল্যাণের দিকে ঠেলে না দেই,

প্রচেষ্টার মাধ্যমে একে সামগ্রিক কল্যাণে পরিণত করব।

ভালো-মন্দ কিছুই স্থায়ী রবে না,

তবে কল্যাণকর স্মৃতি ধরে রাখাই উত্তম।

সুউচ্চ প্রাসাদ, ধন-সম্পদ, ঐশ্বর্য

তোমার কোনো কল্যাণেই আসবে না।

ফরিদুন কোনো ফেরেশতা ছিল না,

কিংবা কোনো মৃগনাভি বা কস্তুরি দ্বারাও সৃষ্ট নয় সে।

সেতো ন্যায়পরায়ণতা ও বদান্যতা দিয়ে এ মহত্ত্বের অধিকারী হয়েছে,

তুমিও ন্যায়পরায়ণতা ও বদান্যতা অর্জন কর, তবেই তুমি ফরিদুন হবে।

শাহনামা কাব্যগ্রন্থে ফেরদৌসির জ্ঞানের গভীরতার পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি মনে করেন এ ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীতে মনুষত্বই শ্রেষ্ঠ আর জ্ঞান ছাড়া সে মনুষত্ব অজির্ত হয় না। সৎ ও সততার দ্বারাই কেবল সকলের মাঝে সাম্য ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়। কবি বলেন:

دگر گفت روشن روان آن کسي که کوتاه گويد به معني بسي

چو گفتار بيهوده بسيار گشت سخنگوي در مردمي خوار گشت

هنر جوي و تيمار بيشي مخور که گيتي سپنج است و ما برگذر

ز دانش چو جان ترا مايه نيست بِه از خاموشي هيچ پيرايه نيست

 

সে (বুজুর্গ মেহের নুশিরওয়ানকে) বলল: সে-ই আলোকিত আত্মার অধিকারী

যে সংক্ষেপে অধিক অর্থপূর্ণ কথা বলে।

যদি বক্তব্য হয়ে ওঠে অনর্থক

তবে লোকদের কাছে বক্তা তুচ্ছে পরিণত হয়।

জ্ঞান অন্বেষণ করো আর দুঃখকে প্রশ্রয় দিও না

এ পৃথিবী ক্ষণিকের, আমাদের চলে যেতেই হবে।

যদি জ্ঞানসমৃদ্ধ আত্মা তোমার নাই বা থাকে

তবে মৌনতা ছাড়া তোমার আর কোনো ভূষণ নেই।

মোট কথা, গোটা শাহনামাই চিত্রকল্পে ভরপুর। যুদ্ধ-বিগ্রহের চিত্র এবং এর চরিত্রগুলো এতোটাই প্রাণবন্তভাবে এ গ্রন্থে অনুরণিত হয়েছে যে, পাঠক সহসাই তা উপলব্ধি করতে সক্ষম হবেন।

ফেরদৌসির শাহনামা কাব্যগ্রন্থ ও এতে বর্ণিত কাহিনীগুলো যুগ যুগ ধরে কাব্যরসিকদের হৃদয় ও মননে এমনি জায়গা করে নিয়েছে যে তা অম্লান হয়ে থাকবে, কখনোই বিনষ্ট হবে না।

 

তথ্যসূত্র:

১. আহমাদ তামীমদারী (২০০৭ খ্রি.): ফার্সী সাহিত্যের ইতিহাস, আলহুদা আন্তর্জাতিক প্রকাশনা সংস্থা, ইরান।

২. হরেন্দ্র চন্দ্র পাল (১৩৬০ বঙ্গাব্দ): পারস্য সাহিত্যের ইতিহাস, প্রকাশক অজিত চন্দ্র ঘোষ, শ্রী জগদীশ প্রেস, কলকাতা।

৩. আবুল কাসেম ফেরদৌসি (১৩৭৪ সৌরবর্ষ): শাহনামেয়ে ফেরদৌসি, এনতেশারাতে তুস, তেহরান, ইরান।

৪. আবুল কাসেম ফেরদৌসি, শাহনামেয়ে ফেরদৌসি, এনতেশারাতে ফ্রাঙ্কলিন, ইরান।

৫. সাদেক রেযা যাদে শাফাক (১৩৫২ সৌরবর্ষ): তারিখে আদাবিয়্যাতে ইরান, এনতেশারাতে দানেশগাহে পাহলাভি, ইরান।

৬. নিউজ লেটার (ঢাকাস্থ ইরানি সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের মুখপত্র), ৩য় সংখ্যা, মে-জুন, ২০১৩।

দি গ্রেট ইসলামিক এনসাইক্লোপেডিয়ার ৫ম খণ্ড প্রকাশিত

দি গ্রেট ইসলামিক এনসাইক্লোপেডিয়ার পঞ্চম খণ্ড প্রকাশিত হয়েছে। ইংরেজিতে প্রকাশিত এ এনসাইক্লোপেডিয়ার নামকরণ করা হয়েছে এনসাইক্লোপেডিয়া ইসলামিকা  । এর আগের খণ্ডগুলো একই নামে পরিচিতি পেয়েছে। নেদারল্যান্ডের লিডেনে ব্রিল একাডেমি এনসাইক্লোপেডিয়াটি প্রকাশ করেছে।

ফারসি ভাষায় ইরানে এ এনসাইক্লোপেডিয়াটি ২১ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে যা ইংরেজিতে প্রকাশের কাজ শুরু হয় ২০০৮ সালে। ইংরেজিতে ১৬ খণ্ডে প্রকাশিত হবে এটি। প্রকল্পের কাজ শেষ হবে ২০২৩ সালে।  ইংরেজিতে প্রকাশিত এ এনসাইক্লোপেডিয়ার প্রধান সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন উইলফ্রাড মেডলাং। তিনি  অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির আরবি বিভাগের অধ্যাপক। তার বয়স ৮৫ এবং ১৯৭৮ সাল থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত তিনি অক্সফোর্ডে অধ্যাপনা করেছেন। ইসলামের ওপর তার রয়েছে অগাধ পাণ্ডিত্য ও প্রাক ইসলামের ওপর অনেক বই তিনি লিখেছেন। এছাড়া আরবি ও ইসলামি স্টাডিজের ওপরও তার রয়েছে অনেক গবেষণামূলক প্রবন্ধ।

দি গ্রেট ইসলামিক এনসাইক্লোপেডিয়া ইতিমধ্যে আরবি ভাষায় ২১ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। ইসলাম ও সমসাময়িক মুসলিম বিশ্ব সম্পর্কে এ এনসাইক্লোপেডিয়ায় বিভিন্ন তথ্য ছাড়াও ইসলামি সংস্কৃতির বিস্তারিত পরিচিতি রয়েছে। ইরানে ১৯৮৩ সালে ফারসি ভাষায় এনসাইক্লোপেডিয়াটি প্রকাশের উদ্যোগ নেয়া হয়। এটি পশ্চিমা দেশগুলোর জ্ঞানপিপাসুদের জন্যে ইসলাম সম্পর্কে জানার এক মহাসুযোগ সৃষ্টি করেছে।

সূত্র: ফিনান্সিয়াল ট্রিবিউন

মাথায় কাপড় না দিলে ১ হাজার রিয়েল জরিমানা

সৌদি আরবে নারীরা অফিসে মাথায় কাপড় না দিলে ১ হাজার রিয়েল জরিমানা করা হবে এবং কোন কোম্পানি এ নির্দেশনা অমান্য করলে তাকে জরিমানা করা হবে ৫ হাজার রিয়েল। সদ্য চালু হওয়া নতুন শ্রম আইনে এ জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে।

সোমবার সৌদি আরবের আল হায়াত নামে একটি স্থানীয় পত্রিকা শ্রম মন্ত্রণালয়ের উদ্ধৃতি দিয়ে এ তথ্য জানিয়েছে।

কোন কোম্পানি যদি মহিলা শ্রমিকদের মাঝে এ আইন কার্যকর না করে এবং এ সংক্রান্ত কোন লিখিত নির্দেশনা না দেয় তাহলে ওই কোম্পানিকে ৫ হাজার রিয়েল জরিমানা করা হবে বলে জানানো হয়েছে।

শ্রম মন্ত্রণালয় আরও জানায়, প্রত্যেক কোম্পানিকে অবশ্যই তার নারী শ্রমিকদের অফিসে মাথা ঢেকে কাজ করার লিখিত নির্দেশ দিতে হবে। এ নির্দেশ অমান্য করলে কোম্পানিকে ৫ হাজার রিয়েল জরিমানা করা হবে।

এছাড়া কোন কোম্পানি যদি তার নারী শ্রমিকদের রাতের বেলায় কাজ করতে বাধ্য করে তাহলে ৫ হাজার রিয়েল এবং নারী শ্রমিকদের পৃথক কর্মক্ষেত্র না থাকলে ১০হাজার রিয়েল জরিমানা করা হবে।

সূত্র: আরব নিউজ।

ইরানে সৌদি তরুণীর অভিজ্ঞতা

সৌদি আরবের তরুণী সারাহ মিশরি ১০ মাস ধরে ইরানে বসবাস করছে। পড়াশোনা করার জন্যই মূলত ইরানে আসা। ইরানে নিজের অভিজ্ঞতার কথা সামাজিক মাধ্যমে লিখে জানান সারাহ।

তিনি লিখেছেন, সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে বৈরী সম্পর্ক রয়েছে এই বিষয়টি গোপনীয় নয়। হজের সময় সৌদিতে ক্রেন দুর্ঘটনা ও মিনায় পদপৃষ্ট হয়ে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তা স্পষ্ট হয়ে উঠে। ইরানের অনেক সাহিত্য ও কাহিনী পড়েছি।

ইরানের প্রতি দুর্বলতার জন্যই লন্ডন থেকে ইরানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। আমার এই সিদ্ধান্ত পরিবারের কোন সদস্য মেনে নেয়নি। তারা আমাকে সবাই বাধা দেয় ইরানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করার জন্য।

আমি ইরানে আসার পরে একজন জিজ্ঞেস করেন ইরানে আপনার নেতিবাচক অভিজ্ঞতা কি? উত্তরে আমি তাদের বলি এখনো কোন নেতিবাচক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হইনি।

হজ করতে গিয়ে সৌদিতে শতশত ইরানি নাগরিকের প্রাণহানির জন্য সৌদি নাগরিক হিসেবে ইরানের কোন নাগরিক আমাকে বিন্দুমাত্র বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলেনি। আমি সুন্নি নাগরিক হলেও ইরানের নাগরিকরা আমার প্রতি যতেœর কোন হেরফের করেনি।

ইরানিরা অনেক দয়ালু ও আন্তরিক। তারা মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশ থেকে সত্যিই ভিন্ন। ভিন্ন ভিন্ন মানুষের রাজনৈতিক আদর্শ ভিন্নরকম। আমি যখন কথা বলি ইরানিরা আমাকে ভারতীয় নাগরিক মনে করে। আমার ফার্সি উচ্চারণের জন্যই আমাকে ভারতীয় নাগরিক মনে করেন তারা।

যখন জানতে পারে আমি সৌদির নাগরিক তখন আরো বেশি আগ্রহ নিয়ে আমার কাছে আসে তারা। জানতে চায় সৌদির নাগরিক হয়েও কেন ইরানে থাকছি। আমি ইরান পছন্দ করি কি না এসব বিষয় জানতে চায় তারা। আমি ইরানের অনেক অঞ্চল ভ্রমণ করেছি। ইরানে দেখার মতো অনেক সুন্দর সুন্দর শহর রয়েছে। ইরানিদের আন্তরিকতা আমাকে মুগ্ধ করে।

একবার ব্যাগ হারিয়ে গিয়েছিল। ব্যাগে ড্রাইভিং লাইসেন্স, আইডিসহ গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র ছিল। আমার বন্ধু ও পুলিশ বলছিল এটি পাওয়া যাবে না। আমার মন ভিষণ খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তার কিছুদিন পরেই এক মহিলা আমাকে ফোন দিয়ে জানায় সে একজন ট্যাক্সি চালকের স্ত্রী। তার স্বামীর ট্যাক্সি থেকে একটি ব্যাগ পেয়েছেন। পরে ব্যাগটি আমাকে ফেরত দেয়।

সারা পৃথিবীতে উগ্রবাদী রয়েছে শুনেছি তবে ইরানে একজনও উগ্রবাদী দেখিনি। মিনা দুর্ঘটনার পরে আমার সঙ্গে কেউ খারাপ ব্যবহার করেনি। আগে তারা আমার সঙ্গে যে ব্যবহার করত মিনা দুর্ঘটনার পরেও একই ব্যবহার করছে কোন ব্যতিক্রম ব্যবহার করেনি।

মিনা ট্রাজেডির পরে একদিন আমি একটি ক্যাফেটেরিয়ায় দুপুরের খাবার খেতে যাই। সেখানে আমার ইরানের এক বন্ধু দুষ্টুমী করে রেষ্টুরেন্টের ক্যাশিয়ারকে বলে আমার কাছে কোন খাবার বিক্রি না করে কারণ আমি সৌদির নাগরিক। সঙ্গে সঙ্গে ইরানের কয়েকজন এসে তাদের দেশের নাগরিকের এমন বিরুপ আচরণের জন্য আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে। পরে আমি তাদের বলি আমরা মজা করছি, আমরা দুই জন বন্ধু।

সূত্র: তেহরান টাইমস