All posts by dreamboy

মারইয়াম মির্যাখানির দেশে ইনফরমেটিক্স অলি¤িপয়াড

মোহাম্মদ কায়কোবাদ*

প্রাক-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ছাত্রদের নিয়ে আন্তর্জাতিক ইনফরমেটিক্স অলি¤িপয়াডের আসর এবার বসেছিল তেহরান শহরে। ইরান এর আগেও পদার্থবিজ্ঞানের অলি¤িপয়াড আয়োজন করেছে ২০০৭ সালে, আবার ২০২৩ সালেও আয়োজন করবে। ইনফরমেটিক্স অলি¤িপয়াডে বাংলাদেশের তিনজন স্কুল ছাত্র তাসমীম রেজা, রুহান হাবিব এবং রুবাব রেদওয়ান এবং নটরডেম কলেজের যুবায়ের রহমানের যাত্রা মারইয়াম মির্যাখানির দেশ ইরানে। ইরান জ্ঞানভিত্তিক প্রতিযোগিতায় তার অবস্থান সুদৃঢ় করেছে বেশ আগেই। প্রতিটি অলি¤িপয়াডে স্বর্ণপদক প্রাপ্তি ঘটছে অহরহ। আন্তর্জাতিক গণিত অলি¤িপয়াড থেকে ইরানের প্রাপ্তি ৪৩টি স্বর্ণ, ৯২টি রৌপ্য এবং ৩৯টি ব্রোঞ্জপদক। দেশভিত্তিক অর্জনে জাপান, তাইওয়ান কিংবা কানাডার থেকে ঢের এগিয়ে। ইনফরমেটিক্স অমি¤িপয়াডে ২২টি স্বর্ণ, ৫২টি রৌপ্য এবং ২২টি ব্রোঞ্জ। পদকের ভিত্তিতে র‌্যাংক করা হলে অষ্টম স্থানে ইরান। পদার্থবিজ্ঞানের অলি¤িপয়াড থেকে ইরানের অর্জন ৩৬টি স্বর্ণ, ৫৪ট রৌপ্য এবং ৩৩টি ব্রোঞ্জ। রসায়নশাস্ত্রের অলি¤িপয়াড থেকে এবার তিনটি স্বর্ণ পেয়েছে ইরান, গতবার পেয়েছিল দুইটি, বায়োলজির অলি¤িপয়াড থেকেও ইরান স্বর্ণপদক পাচ্ছে। জ্ঞানভিত্তিক প্রতিযোগিতায় ইরানের সমকক্ষ কোন মুসলিম দেশ নেইÑ ইরান ঢের এগিয়ে। আন্তর্জাতিক গণিত অলি¤িপয়াড থেকে মারইয়াম মির্যাখানি দুইবার স্বর্ণপদক পেয়েছিলেন যার মধ্যে ১৯৯৫ সালে পূর্ণ নম্বর পেয়ে। ১৯৯৮ সালে দেশভিত্তিক র‌্যাংকিং এ ইরান হয়েছিল প্রথম। প্রথম দশে ইরান অসংখ্যবার স্থান পেয়েছে।
এবারের আয়োজন আমার দেখা সকল ইনফরমেটিক্স অলি¤িপয়াডের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। দলনেতাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে পার্সিয়ান আজাদি হোটেলে, প্রতিযোগীদের জন্য অদূরে অবস্থিত এভিন হোটেল। দুটিই তেহরান শহরের উত্তরে পাহাড় ঘেঁষে দামি জায়গায়। অনেক দর্শনীয় স্থানে যাওয়ার সুযোগ ছিল, যার মধ্যে মিলাদ টাওয়ারÑ যা ইরানিদের দৃঢ়তার প্রতীক, দৃষ্টিনন্দন ওয়াটার অ্যান্ড ফায়ার পার্ক, আজাদী টাওয়ার, আজাদী স্কয়ার, ইরানের এমআইটি খ্যাত শরীফ ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি, তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়।
পারস্যের সভ্যতা প্রাচীনতম, ইতিহাস ও ঐতিহ্যসমৃদ্ধ। তাই কখনো পারস্যের ওপর আধিপত্য বিস্তার করা যায় নি। এমনকি ইসলাম ধর্মের স্বর্ণযুগেও আরব সভ্যতা পারস্যে বিস্তৃতি পায় নি। ইরানের জনগন আত্মমর্যাদাবোধে অতুলনীয়; বরং তাদের সভ্যতার বিস্তৃতি ঘটেছে ইতালি, গ্রীস, রাশিয়া এবং পূর্ব এশিয়াতে। মানব সভ্যতায় ইরানের শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি একটি সমৃদ্ধ ঐতিহ্য ধারণ করে আছে। মিলাদ টাওয়ারের একাধিক তলায় ইরানের কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী এবং জ্ঞানতাপসদের জীবন্তসদৃশ ভাস্কর্য রয়েছে, তাও নানা শতাব্দীর। ইরানের প্রধান ভাষা পার্সিয়ান হলেও উত্তর পশ্চিমে আযারবাইজানের ভাষা, পশ্চিমে কুর্দি, উপসাগরীয় এলাকায় আরবি এবং কিছু এলাকায় বালুচ, আর্মেনিয়ান এবং জর্জিয়ান ভাষা অল্প পরিসরে চালু আছে। পার্সিয়ান সাহিত্য গ্যেটেসহ অনেক ইউরোপীয় বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিককে অনুপ্রাণিত করেছিল। ভারতবর্ষেও পারস্যের সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রভাব কম নয়। এখানে কুলীন সমাজে ফারসি ভাষায় কথা বলা কিংবা ফারসি সংস্কৃতির চর্চা করার ঐতিহ্য ছিল। ইরানের সিনেমা গত দশ বছরে তিন শতটি আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছে; আব্বাস কিয়ারোস্তামি, মাজিদ মাজিদি কিংবা জাফর পানাহির নাম আন্তর্জাতিক সিনেমাজগতের সকলেই জানে। ইরানের সুস্বাদু সুগন্ধযুক্ত খাবারের কথা কে না জানে! আমার মনে হলো বাজারের এক তৃতীয়াংশ দোকানই নানা জাতীয় মসলায় ভরা। রুটির মধ্যে নান, হামির খুব জনপ্রিয়। চেলো হরেশ, শিশ কাবাব, চেলো কাবাব এবং মিষ্টির মধ্যে বাদাম দিয়ে বাক্লাভা, পানীয়ের মধ্যে শরবাতে পোর্তেকাল বেশ জনপ্রিয়।
ইরানের অনেক ঠিকানাÑ শেখ সাদীর দেশ ইরান, ওমর খৈয়ামের দেশ ইরান, হাফিযের দেশ ইরান, জালালুদ্দিন রুমির দেশ ইরান। ক¤িপউটার বিজ্ঞানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ধারণা হলো এলগরিদমÑ এই নামের সূচনাও কিন্তু পারস্যের গণিতবেত্তা ও জ্যোতির্বিদ আল খারিজমির নাম থেকে এসেছে, যেমন হয়েছে ‘এলজেবরা’ শব্দের উৎপত্তি আলখারিজমির বই ‘ইল্ম আল জাব্র ওয়াল মুকাবালা’ থেকে। ‘ফাজি লজিক’ এর জনক লতফি জাদেহর নাম কে না জানে? সুতরাং জ্ঞান-বিজ্ঞানে ইরানের অবদান প্রাচীন কাল থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। পৃথিবীর ব্যাসার্ধ হিসাব করে বের করেছেন আল বিরুনী, ইবনে সীনা এবং ওমর খৈয়ামও বিজ্ঞানে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। এরপরও আমার শিরোনাম কিছুটা ভিন্ন, কিন্তু বর্তমানের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা জানি, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়নশাস্ত্র কিংবা জীববিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার থাকলেও গণিত কিংবা ক¤িপউটার বিজ্ঞানে এই পুরস্কার নেই। কানাডিয়ান গণিতজ্ঞ জন চার্লস ফিল্ড্সের অর্থায়নে ১৯৩৬ সালে গণিতের নোবেল পুরস্কার খ্যাত এই পুরস্কারটির সূচনা । এখন প্রতি চার বছরে দুই, তিন কিংবা চারজন অনূর্ধ্ব চল্লিশ বছর বয়সী বিজ্ঞানীকে এই পুরস্কার দেয়া হয় । ২০১৪ সালে পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম বারের মত এই পুরস্কার একজন ইরানি মহিলা গণিতজ্ঞ পান, যাঁর নাম মারইয়াম মির্যাখানি। তাঁর গবেষণার বিষয়বস্তু এতটাই জটিল ছিল যে, সেক্ষেত্রটি শক্তিশালী গণিতবেত্তারাও এড়িয়ে গেছেন। তাঁর ফিল্ড্স মেডেল প্রাপ্তির সংবাদটি তিনি এমনকি তাঁর পিতামাতাকেও জানান নি। তবে তাঁরা যখন জিজ্ঞাসা করলেন না জানানোর কারণ কী তখন মারইয়াম বলেছিলেন, ‘এটা এমন বড় কিছু নয়।’ প্রচার সব সময়ই তিনি এড়িয়ে চলেছেন। ফিল্ড্স মেডেল গ্রহণের ক্ষেত্রে বলেছিলেন, এই পুরস্কারটি যাতে মহিলাদের অনুপ্রাণিত করে এজন্যই তিনি পুরস্কারটি গ্রহণ করেছেন। অবশ্যই প্রথম মহিলা ফিল্ড্স মেডেল বিজয়ী হিসেবে তিনি বহুবার শিরোনাম হতেই পারেন। কিন্তু এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে স্ট্যানফোর্ডের এই অধ্যাপকের গত ১৪ জুলাইতে মহাপ্রয়াণের ঘটনা। প্রযুক্তির বিশ্ববিদ্যালয় হওয়া সত্ত্বেও গণিতসহ টেকনোলজির বাইরে অন্যান্য বিষয়ও সেখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ। অতি সম্প্রতি সিদ্ধান্ত হয়েছে শরীফ ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি এর গণিত ফ্যাকাল্টির নাম মির্যাখানির নামে করা হবে। ইরান তার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের উপযুক্ত স্বীকৃতি দিচ্ছে, গুণী মানুষের কদর করছে। স্বতঃস্ফূর্ত গণশোক হয়েছে নানা পার্কে এবং গুরুত্বপূর্ণ অডিটোরিয়ামে সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ে। তাঁর নামে রাস্তার নামকরণ করা হবে, তাঁর মেয়েকে কীভাবে ইরানি নাগরিকত্ব দেয়া যায় তা নিয়ে আইন পাশ হবে পার্লামেন্টে।
বিজ্ঞানের প্রতি ইরানিদের যে ভালোবাসা, তা টের পেলাম ইনফরমেটিক্স অলি¤িপয়াডে এসে। তাঁদের গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞানীদের ছবিসহ আবিষ্কারের নানা তথ্য দিয়ে সাজানো হয়েছে তোরণ যাতে কোন বিদেশির দৃষ্টি না এড়ায়। এক মেয়ে স্বেচ্ছাসেবককে জিজ্ঞাসা করলাম মির্যাখানিকে চেনে কিনা। অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে উচ্চারণ করলো আমরা একই বিভাগের ছাত্রী। এমনকি এই অলি¤িপয়াডেও আমাদের সঙ্গে দীর্ঘদিন প্রোগামিং প্রতিযোগিতা করা স্বাস্থ্যগত কারণে হুইল চেয়ারের বাসিন্দা অধ্যাপক ঘোদসীকে যে সম্মান জানানো হলো তাতে অভিভূত হয়ে গেলাম।
আমার বদভ্যাস তরুণ-তরুণী, কিশোর-কিশোরীকে দেখলেই সমস্যা দেয়া। বিদেশ বিভুঁইয়ে এর ব্যতিক্রম হলো না। শরীফ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবয়বে ছোটোখাটো এক ছাত্রী স্বেচ্ছাসেবককে এরকম একটি সমস্যা দিলাম। প্রথমে একটু ইতস্তত করলেও শেষাবধি সমাধান বের করে ফেললো। তারপর আবার আরেকটি সমস্যা চাইল। আরেকটি সমস্যা দিলাম। সেটাও সে কিছুক্ষণ পরে করে নিয়ে আসলো আবার আরেকটি সমস্যা চাইতে। আমি তাকে বললাম আনন্দ-ফূর্তি কর, সমস্যা সমাধানের এত দরকার কী! জানালো সমস্যা সমাধান করতে তার বেশ ভালো লাগে। ভাবলাম হয়তো বা ইরানের সবচেয়ে বুদ্ধিমতী মেয়েটির সামনে আমি দাঁড়িয়ে আছি। তাই একজন লম্বা ছেলেকেও একটি সমস্যা দিলাম। দেখলাম সেও পারে। আমি এই ছেলেমেয়েদের বিশ্লেষণী ক্ষমতা দেখে অভিভূত হয়ে গেলাম। জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতি ইরানীদের অন্যরকম আকর্ষণ, অন্যরকম শ্রদ্ধাবোধ। নানারকম অলি¤িপয়াড প্রতিযোগিতায় ইরানের যে সাফল্য তার থেকে এই সিদ্ধান্তে আসা কঠিন নয় যে, আগামীতে ইরান জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তির বিশ্বে তার অবস্থান আরো শক্তিশালী করবে, পারস্যের হৃত সোনালি দিন আবার ফিরে আসবে। আমার নিজের নাম পারস্যের একটি রাজবংশের এক রাজার নাম থেকে ধার করা বলে নিজেও ইরানের জ্ঞানভিত্তিক প্রতিযোগিতার সাফল্যে বেশ একটু গর্ববোধ করছি।

*অধ্যাপক, ক¤িপউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়

কারবালা

আমিন আল আসাদ

শহীদের স্মৃতি কারবালা
তোমায় নিয়ে লেখা হলো
অনেক কাব্য গান পালা।
শহীদের ভূমি কারবালা
তুমি ক্ষুধা পিপাসার বুক জ্বালা
রক্তসাক্ষী কারবালা
ব্যথার করুণ শোকমালা।
এইখানে এসে হেরে গেছে সব
মসৃণ বীর তরবারির
বিজয় হয়েছে তাঁর রুধির
কার রুধির?
প্রাণপ্রিয় নাতি নূরনবীর (সা.)
¯েœহের পুত্র বীর আলীর
নয়নের মণি ফাতেমার
নির্ভিক বীর মদিনার,
তাঁর রুধির।
ওরে কারবালা
নিলি ইমামের খুন শুষি
পিপাসা মিটালি আজগরে
এজিদী সেনার বিষ তীরে।
ঘাতক জালিম শোষক শোন
রব উঠেছে ইয়া হোসেন
ঘটে ঘটনা কারবালার
আসবে বিজয় ইসলামের।
কারবালা ফোরাত ত্যাগের মহিমা
রবে উচ্চে চিরদিন
শহীদী ঈদের সেনারা সাজ
জেগে ওঠ মুসলেমিন।

হায় হোসেন ওভা আলমাস

 

এসেছে মুহররম
কাঁদাতে এ জাহান
সকরুণ মাতম আজ
হায় হোসেন, হায় হোসেন।
সত্যের দিশা দিতে
নিজের জীবন দিয়ে
দেখালেন পৃথিবীকে
সত্যের জয় নিশান্
হৃদয়ের অতলে তোলপাড় আজো
বুক ভেঙে যায়
কোন অজানা ব্যথায়
সত্য-মিথ্যার অসম দামামায়
হোসেনের মাথা ঐ সীমারের বর্শায়!
রক্ত স্নানে তুমি হে প্রিয় ধরণী
নুইয়েছো মাথা আজ
ব্যথাভরা লজ্জায়?
কারবালা প্রান্তরে হত্যাযজ্ঞে
এজিদের চক্রান্ত নস্যাত করে দিয়ে
ইসলাম জেগে আছে রবে কেয়ামত পর্যন্ত।
ভাস্বর মুহররম ত্যাগের মহিমায়
চারদিকে আজো আহাজারি
মর্সিয়া তাজিয়ায়
সকরুণ সুরে গাই
হায় হোসেন, হায় হোসেন!

জীবনের দাম
শেখ হিজারুল ইসলাম

তোমরা কি ভুলে গেছো, ইমাম হুসাইনের নাম?
জীবনের চেয়ে বেশি কিছু দিয়ে দিলেন জীবনের দাম।
মনে নেই শহীদ আলী আসগরের কথা?
ছয় মাসের ছোট্ট মাসুম ছেলে, চলে গেছে নিয়ে ব্যথা।
বোঝে না আঘাত বোঝে না সংঘাত।
তবু তার কচি বুক, বিদীর্ণ করে পাষাণ তীরের আঘাত!
পিতার কোল ভিজে ওঠে প্রিয় সন্তানের খুনে!
এমন পিতার ত্যাগের গৌরব ছড়াক প্রতিটি প্রাণে।

ভুলে কি গেছো সেদিনের সব কথা
বাহাত্তর জন মযলুম শু’হাদার নিষ্পাপ চেহারা
বাঁচতে দেয়নি যাঁদের কাউকে,
পাপিষ্ঠ ইয়াযিদ সেনা।

আজো আছে সেই যিন্দানখানা শুষ্ক মরুর চর।
রক্তের দাগ বুকে আজো কাঁদে কারবালা প্রান্তর।

সেদিন, শান্তি রক্ষায় কুফার পথে ইমাম বীর
চারদিক থেকে ঘিরে ফেললো ফোরাত নদীর তীর।

শর্ত দিয়েছে,
যুদ্ধ কিংবা বাই‘আত হতে হবে ইয়াযীদের হাতে।
আচ্ছা তোমরাই বলো!
নারী, শিশু, পরিবার নিয়ে কেউ কি আসে লড়াইয়ের ময়দানে?
হযরত বললেন,
স্বৈরাচারের কাছে বাই‘আত নয়।
বরং ফিরে যাই মদীনায়
নয় তো ইয়াযীদের কাছে নিয়ে চলো আমাকে
কথা হোক চোখে চোখ রেখে।
শোনেনি সে কথা যালিমরা,
তাই তো শুরু হলো এ যুদ্ধ।

ত্রিশ হাজার সৈন্যকে রুখে দাঁড়াল ইমামের তরবারী
জীবন দিয়েও সত্যকে তিনি করলেন বিজয়ী।
অসম যুদ্ধে লাল হলো অবরুদ্ধ দরিয়ার তীর।
অন্যায়ের কাছে নত হবেন না অনন্য সাহসী বীর।
জীবন দিলেন সবাই প্রায় কাফেলায় ছিলেন যাঁরা।
প্রাণ দিয়েছেন, মিথ্যার কাছে পরাজিত নন তারা।

তোমরা কী ভেবেছো?
ভেবেছো, যুদ্ধ থেমে গেছে, শহীদরা দিলেন শির।
চেয়ে দেখো, যুগে যুগে আরো ইয়াযীদ সীমারের ভীড়।

ভেবেছো,
হুসাইন চলে গেছেন, ফিরবেন না আর ঘরে
শহীদরা ‘জীবিত’, ফিরে আসেন বারে বারে।
জাগরূক থাকেন মুমিনের হৃদিভরে
চেয়ে দেখো ইমাম হুসাইন, বেঁচে আছেন মানুষের অন্তরে।

শহীদ ইমাম ও নব্য এজিদী
মামুন সারওয়ার

কি পড়ব কথার মালা
অশ্রুমাখা চোখে?
ভাবছি বসে একলা একা
সেই আশুরার শোকে।

কারবালায় শহীদ ইমাম
হৃদয়ে রক্ত ঝরে
মুসলমান হও বলীয়ান
কুরআনী অক্ষরে।

নব্য এজিদ অং সুচি আজ
খুনে মত্ত তারা
বিরান হলো সেই আরাকান
কাঁদছে রোহিঙ্গারা।

সত্য ন্যায়ের প্রতীক হয়ে
ইমাম হাসান হোসেন
তাঁদের নামে মযলুমান
অশ্রু কেবল মোছেন।

প্রেরণার সেই বাতিঘরের
আলো জ্বলে মনে
মুসলমান আজ ঐক্য গড়ো
এই আশুরার খণে।

নব্য এজিদ সব দিকে আজ,
কে দেবে পাহারা ?
বিশ্ব জুড়ে মরছে স্বজন
কাঁদছে রোহিঙ্গারা।

হায় হোসেন! হায় হোসেন!
পৃথিবীতে সবচে করুণ আহাজারি
ক্ষণে ক্ষণে বাতাসও হয় মহাভারি
হৃদয়টাতে মহা বিক্ষোভ নিত্য পোষেন
হায় হোসেন! হায় হোসেন!

সীমার এজিদ কারবালাতে রাঙায় হাত
রাঙায় আরো এই আশুরার সেই প্রভাত
সেই ঘটনায় বিশ্ববাসী আজও ফোঁসেন
হায় হোসেন! হায় হোসেন!

মুসলমানের মনটা আজও ডুকরে কাঁদে
অস্থির হয় কারবালার সে আর্তনাদে
বিক্ষুব্ধ তারা দারুণ রোষে ফুঁসে
হায় হোসেন! হায় হোসেন!

হায় হোসেন! হায় হেসেন!
আবু সালেহ

পৃথিবীতে সবচে’ করুণ আহাজারী
ক্ষণে ক্ষণে বাতাসও হয় মহাভারী
হৃদয়টাতে মহা বিক্ষোভ নিত্য পোষেন
হায় হোসেন! হায় হোসেন!

সীমার এজিদ কারবালাতে রাঙায় হাত
রাঙায় আরো এই আশুরার সেই প্রভাত
সেই ঘটনায় বিশ্ববাসী আজও ফোঁসেন
হায় হোসেন! হায় হোসেন!

মুসলমানের মনটা আজও দারুণ কাঁদে
অস্থির হয় কারবালার সেই আর্তনাদে
বিক্ষুব্ধ হয়ে তারা দারুণ রোষে রোষেণ
হায় হোসেন! হায় হোসেন!

কারবালার রক্তকথা
এডভোকেট শামীমা আক্তার শিউলী

মোহররমের মাতম শুনি চারদিকে আজ
দুখের স্মৃতি জেগে উঠার চোখের জলের সাজ
হায় হোসেন প্রায় হায় হোসেন বলি হৃদয় সুরে
আজকে প্রলয়স্মৃতির হৃদয় কারবালাতে ঘুরে।

কারবালারই মাটির বুকে রক্তঝরা পাঠ
কষ্টের বাণী সুর তুলেছে দু:খে গড়া হাট
হাজার বছর পার হয়েছে আরো কত হবে
কারবালারই রক্তকথা স্মৃতির দুখে রবে।

ইমাম হোসেন ইমান হোসেন গীতি গাঁথি মনে
ভুলবো না তো সেই শাহাদত কারবালার রণে
কারবালারই রক্তকথা পেয়ে রাখি কবি
জীবন মাঝে চির আলোর চিরকালের ছবি।

জগলুল হায়দার
দুটি ছড়া

১. শোকের শোণিতে হোসেন লিখেছি
পিপাসার বুকে জল,
আশুরা এসেছে ন্যায়ের নামতা
পাঠ করি ফের চল।

২. এযিদ মরে বারে বারে
হোসেন মরেও মরে না,
ইতিহাসে বিপ্লবীদের
রক্ত বৃথা ঝরে না।

হৃদয়ে মাতম
আমির সোহেল

হৃদয়ে মাতম উঠে।
করুণতর প্রিয়জন বিয়োগে।
ইতিহাসের রক্তক্ষরা দিনে ফোরাতের নীল জলে
লাল স্রোত বয়!
এ কী বেদনা, এ কী লেলিহান বিষাদ!
মুনাফিকের হিংস্র কর্মে
শহীদি লোহুতে ভরে যায় কারবালার শুষ্ক প্রান্তর!

প্রিয় নবীজির আদরের দৌহিত্র ও স্বজনদের উপর
জঘন্য আক্রমণ আর নৃশংসতার সাথে হত্যা…..
ভাবতেই হৃদয় মোচড় দিয়ে উঠে!

কী করে মানুষ হন্তা হয়?
কী পাষাণ সীমার কোমল গলায় ছুরি চালায়,
খন্ডিত করে ইমামের শির!

ওরে বেহুশ, ওরে হায়েনা, এ কী করলি!
হৃদয়ে মাতম উঠে বারেবার,
অশ্রুসিক্ত হয় আঁখিপল্লব,
ভাবনার গতি স্তব্ধ হয়ে পড়ে,
মাতমের তীব্র শব্দে আকাশ ভারি হয়ে উঠে…
বেহেশতের যুবকদের সর্দার ইমাম হুসাইনকে করলি শহীদ
হায় এজিদ, হায় সীমার, হায় মুনাফিকের দল,
বেদনায় নীল ইতিহাস ভাসে
অন্তরে জ্বলে উঠে অনল!

আজও রক্তের নিশান ওড়ে কারবালায়
আহমেদ উল্লাহ

আজও রক্তের নিশান ওড়েÑ মরু-কারবালায়
আকাশে-বাতাসে গোধুলির গগন কিনারায়!
তৃষ্ণার হাহাকার ফোরাতের সফেদ ফেনিলে
যালেমের নিন্দিত জিঘাংসার ঝড় বহে অনিলে

দুরন্ত লু হাওয়ায় ভেসে ওঠে আজওÑ
কান্নাভেজা হায় হোসেন হায় হোসেন ধ্বনি
চারধারে আজও যেন বাজে শুনি ওইÑ
এজিদ-সীমারের নৃশংস হুঙ্কার কাপাঁনো অবনি

হোসেনের খণ্ডিত মস্তক কাঁদিয়েছে স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল
অনন্ত-বেদনা দিয়ে গেছে দান এজিদ পিশাচের পাল
কেঁদেছিল তলোয়ার, কেঁদেছিল জগতের যত মুসলমান
কাঁদেনি তো ক্ষণিকের তরে নির্বোধ অসুর সীমারের প্রাণ
আজও গুমরে কেঁদে ওঠেÑ উষাÑনিশি মরুর কুয়াশা
কেঁদে ওঠে ফোরাতের জল, অশ্রুসিক্ত বাষ্প ধোঁয়াশা

ঝরেছিল জীবন যতই মোহাম্মদী গোলামের প্রাণ
গৌরবে ওড়েছিল সেদিন ইসলামের বিজয় নিশান
চিরতরে পরাভূত মুখোশধারী যালেম-বেঈমান যত
অনন্ত-গৌরবে ইসলামের তরী মহাবেগবান অবিরত

মুহরম এলে পরে লেলিহান শিখা জ্বলে রক্তের প্লাবনে
অনন্ত আঁখিজল মন জুড়ে টলমল ঝরে আজ সঘনে
শোকের ক্রন্দনরোল উন্মাতাল বুক জুড়ে বাজে অনুখন
দিশেহারা মন মগ্ন রোদনে খুঁজে-স্বর্গবাসী রসূল-নন্দন!

শোকাবহ কারবালা
সালাম তাসির

১০ই মহররম
বিষাদ ছুঁয়েছে মন
রৌদ্রে ঝলমল এই তো সকাল হঠাৎ অগ্নিদহন
কারবালার আকাশে সূর্য দহন নিভে যায় আলোর জ্যোতি
কে জানে কখন ফোরাত নদীতে বইবে উজান স্রোত
বাতাসের বিষণœ মন, দুঃখের মেঘ থমকে দাঁড়ায় সত্যের পাহাড় চূড়ায়,
অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়, অসত্যের বিরুদ্ধে সত্য প্রতিষ্ঠার অসম যুদ্ধ,
ইমাম হোসেনের দৃঢ় প্রত্যয়, সাহসী সম্মুখযুদ্ধ কারবালায়
শ্রেষ্ঠ মানব ইমাম হোসেন সত্য প্রতিষ্ঠায়
নিজেকে উৎসর্গ করার দৃঢ় প্রত্যয় মনে ধারণ
পরাধীনতার শিকলে বন্দী নয়; বরং মৃত্যুই শ্রেয়।

যুদ্ধে নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও অন্যায়ের কাছে আত্মসমর্পণ নয়,
আত্মোৎস্বর্গ খোদার কাছে
হযরত ইমাম হোসেন ইসলাম রক্ষায় প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর
চেতনায় নিজেকে প্রস্তুত করেন দ্বিধাহীন চিত্তে।

কারবালার পবিত্র মাটিতে অসম যুদ্ধে অবতীর্ণ হন
শক্রসেনার গোত্রতন্ত্র আর কায়েমী স্বার্থ রুখে দিতে,
এদিন অবরুদ্ধ শিবির, অবরুদ্ধ ফোরাত নদীর তীর,
পানিশূন্য শিবির তৃষ্ণার্ত হোসেন পরিবার,
শিশুর ওষ্ঠাগত প্রাণ
অথচ শত্রুসেনার পাষাণ হৃদয় জুড়ে মানবতার দুর্ভিক্ষ।

জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে ইমাম হুসাইন
দিগন্তে যুদ্ধের দামামা
এযিদী সেনার আক্রমণে ভ্রাতুষ্পুত্র শহীদ হন
শিবিরে তৃষ্ণার্ত পুত্রের আর্ত চিৎকার
পুত্রকে কোলে নিয়ে ইমাম হোসেন ছুটলেন
ফোরাত নদীর তীরে
শত্রুসেনার তীরের আঘাতে শিশুপুত্র শহীদ বাহুবন্ধনে পিতার।

শিবিরে ফেরার পথে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর
আদরের দৌহিত্র ইমাম হুসাইন তীরবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়েন
কারবালা প্রান্তরে দ্বীনের আলো নিভু নিভু প্রায়
দীন রক্ষায় ইমাম হুসাইন শহীদ হলেন,
বাতাসে ধ্বনিত হলো হায় হোসেন! হায় হোসেন!

কে ডাকে ঐ প্রান্তরে
রওশন রুবী

কে ডাকে ঐ কে ডাকে ঐ কারবালারই প্রান্তরে
কার ডকে ঐ ফোরাত হৃদয় কাঁপে ঢেউ যে মন্থরে
কাদের চোখে জলের ধারা বিষাদ বিছায় অন্তরে।
কে ডাকে ঐ কে ডাকে ঐ কারবালারই প্রান্তরে।

রক্তনদীর স্রোতের মাতম আরব বুকে আর্তনাদ
জলের ছলা জলের কলা ভাঙবে সবই সীমার ফাঁদ।
জিহ্বা চুষে তিয়াস মিটে, সীমার করে জুলুমবাদ।
রক্তনদীর স্রোতের মাতম কারবালাতে আর্তনাদ।

রাসূল পাকের পাগড়ি পরে কে ছুটেন ঐ কারবালার ?
কার হাতে ঐ শোভা পেল শেরে আলীর জুলফিকার?
কার চোখেতে চুমুর পরশ নবীকরীম একাকার?
রাসূল পাকের পাগড়ি পরে কে ছুটেন ঐ কারবালার?

মা ফাতেমার চোখের মনির জখম শরীর মোবারক
ছিন্ন মাথা লুটিয়ে কাঁদে, জান্নাতে মা লুটান Ñশোক,
হাসান হোসেন ডেকে কাঁদে তপ্তধুলি বিশ্বলোক
মা ফাতেমার চোখের মনির জখম শরীর মোবারক।

কে ডাকে ঐ আজো দেখ জুলুমকারীর ভাঙতে স্বর
ঘোড়ার খুরে উড়ছে ধূলো রক্ত ফুটে দেহের ’পর
ছড়িয়ে পড়ে রক্ত তারই ধূলি এবং জলের ’পর।
সে ডাকে ঐ সুদূর থেকে জুলুমকারীর ভাঙতে স্বর?

শোকার্ত মুহররম
নূরে জান্নাত নাছরিন

এসেছে মুহররম বছর ঘুরে
কর রে বরণ হে মুসলমান!
কারবারলার স্মৃতি ভারাক্রান্ত হৃদয়
হোসাইনি রক্তে রঞ্জিত কারবালার ময়দান।

ক্ষমতার লোভে হিংসার বশে
এজিদ ক্ষেপেছিল সেদিন,
কলা-কৌশলে দাওয়াত দিয়ে
বাজালো মরণ বীণ।

কাঁদেনি তো বুক তিল পরিমাণ
সীমার ছুরিতে রক্তাক্ত ময়দান,
মুখে সবার আহাজারি
ইয়া হোসাইন ইয়া হোসাইন।

নবী নন্দিনী খোদা-বান্দির
হোসাইন জানের জান,
দ্বীনের তরে অকাতরে
জীবন করেন দান।

মা ফাতেমার করুণ ক্রন্দন
সেদিন শুনেনি কেউ
কেঁদেছে আকাশ কেঁদেছে ধরণী
হোসাইনী শোকে ঢেউ।

এজিদ বাহিনী করেছে দখল
ফোরাত নদীর পার,
তৃষ্ণা-কাতর হোসাইনি দল
তস্ত মরুর হাহাকার।

এক ফোঁটা পানি দিতে সেদিন
হয়নি তাদের মায়া,
কেমন নিষ্ঠুর জালিম পশু
নরাধমের কায়া।

কারবালার করুণ কাহিনী
ভুলতে পারি না কভু!
হোসাইনি শোকে শোকার্ত মুহররম
কবুল কর প্রভু।

মুহররম
অধ্যাপক ডা. হাসিনা বানু

কোথা থেকে আওয়াজ শোনা যায়
পিপাসা পিপাসা
মাগো পানি দাও কলিজা ফেটে যায়।
কাঁদে আকাশ কাঁদে বাতাস
ভেসে বেড়ায় করুণ আওয়াজ
হায় হসেইন, হায় হুসেইন।
রাসূলের (সা) কলিজার টুকরা
এক ফোঁটা পানি তুলে দিতে মুখে
ছুটে যান শিশুপুত্র আসগর (রা) নিয়ে
ফোরাত নদীর দিকে
কিন্তু কী কঠিন হৃদয় ইয়াযীদ সৈন্যের
তীরের আঘাতে বক্ষ বিদীর্ণ করে শিশু আসগরের!
পানির অভাবে প্রচন্ড তৃষ্ণার্ত সবাই এক সাথ
তবু ছাড়ে নাই তারা আল্লাহর নির্দেশিত পথ।
হায় হুসাইন হায় হুসেইন
করে আল্লার বান্দা
ইয়া মুহাম্মদ ইয়া মুহাম্মদ (সা)
বাতাসে ভাসে ক্রন্দনরত শ্বাস
উত্তাল করে আকাশ বাতাস।
পিপাসার্ত শিশু, মা, আরো অনেকের
পিপাসা বেড়ে যায়
যখন সেজদারত অবস্থায় তৃষ্ণার্ত ইমাম হুসাইনের
শির গর্দান থেকে গড়িয়ে পড়ে মাটিতে
সীমারের তরবারির আঘাতে
আর সওয়ার বিহীন দুলদুল ছুটে যায় পাগলপারা
সেই তখন থেকে আজও জমিন সাগর আকাশ বাতাস
ক্রন্দনরত একটু পানির জন্য
তাদের জন্য
যেখানে রসূলের (সা) বংশধর
শহীদ হয়েছেন ইয়াযীদের নিষ্ঠুরতায়
পিপাসায় কাতর হয়ে পানি পানি করে।

এখনো কাঁদছে ফোরাত
এম. এ. হাশেম আকাশ

থামবে না আর রোনাজারি
মানবের এই ধরাতে,
উঠল যে শোকের মাতম
কারবালা আর ফোরাতে।

ক্ষমতালোভী প্রতারকদের
কু-চক্রান্তের ফন্দিতে,
এজিদ, সিমার যা ঘটাল
ভাষা নেই তার নিন্দিতে।
কেয়ামত তক জ্বিন ও মানব
থাকবে সবাই কান্দিতে।

কৌশলে করে দখল
ফোরাত নদীর জল,
নায়ের পথের সংগ্রামীদের
ভাঙতে মনোবল
মৃত্যুতেও মানে না ভাই
সত্যাশ্রয়ীর দল।

চোখ মুদিলে ঐ দেখা যায়
আলীযাদা যান ছুটে,
সত্য ন্যায়ের অসি হাতে
শপথে দৃপ্ত পথে
অপরাধীর ভীরু হৃদয়
কাঁপে তার হুংকারেতে।

বীরযাদা বীর হোসেন
শিশু কাঁধে ঘোষেন
শুন রে ওরে বলি,
এ যে মানবকলি,
ওষ্ঠাগত প্রাণের মুখে
দাও, ক’ফোঁটা জল ঢালি।

মানব রূপের দানবরা সব
মানবতা ভুলি
তীরের বৃষ্টি দিয়ে শিশুর
বুকটা করে ফালি।
কচি শিশুর রক্তে লেখা
সেই কলঙ্কের কালি।

সুযোগ সন্ধানী কুফার
বিশ্বাসঘাতক সীমার
খঞ্জর হাতে হাসে
পুরস্কারের উল্লাসে
বীররাহু হোসেনের
ছিন্ন মস্তক হাতে ছোটে সোল্লাসে।

মস্তক নয়, ছিন্ন মানবতা
মন্দ মলয়ে মিশে তপোবনে,
এখানো কাঁদছে ফোরাত
বুকে জ্বালা হতাশনে,
বুকভরা তৃষ্ণা তার
শহীদি খুনের তপ্ত প্রস্রবনে।

থামবে না তার রোনাজারি
মানবের এ ধরাতে
এদিন যে শোকের মাতম
কারবালা আর ফোরাতে

ঘুরে দাঁড়াও ওহে মানব
হোসেনের সেই অসি হাতে
ফিরিয়ে এনে দৃপ্ত শপথ
তৃপ্ত মনের জনস্রোতে।
বুকে জ্বালা আগুন করো সব ছারখার
নিপাত থাক, ধ্বংস হোক বিশ্বের সকল সীমার।

ইমাম হোসাইন (আ.)-এর আন্দোলন ও এর শিক্ষা সংকলন : মো. আশিফুর রহমান

 

ইমাম হোসাইন (আ.)-এর জীবন সম্পর্কে যাঁরা পরিচিত তাঁরা নিশ্চয়ই অনুধাবন করেন যে, ইসলামের প্রতি খেদমত তাঁর জীবনের প্রাথমিক কালেই শুরু হয়ে যায়। বাল্যকালেই তিনি ইসলামি কর্মকা-ে আত্মনিয়োগ এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি তাঁর পিতা আমীরুল মুমিনীন আলী ইবনে আবি তালিব (আ.)-এর খেলাফতকালে তিনটি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ইমাম হাসান (আ.)-এর নেতৃত্বকালে তিনি সর্বাবস্থায় তাঁকে মান্য করেন ও তাঁর অনুসরণ করেন। ইমাম হাসানের শাহাদাতের পর ইমাম হোসাইনের ভূমিকা একটি নতুন পর্যায়ে উপনীত হয়। যেহেতু আহলে বাইতের ইমামগণের ভূমিকা তাঁদের সময়ের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করত সেভাবে ইমাম হোসাইনও তাঁর সময়ের পরিস্থিতি অনুযায়ী ইসলামি আন্দোলনের রূপরেখা প্রণয়ন করেন।
ইমাম হোসাইন (আ.)-এর আন্দোলন
ইমাম হোসাইন (আ.)-এর এ পরিমাণ সামরিক শক্তি ছিল না যার মাধ্যমে তিনি যুদ্ধ করে জয় লাভ করতে পারতেন, এমনকি তিনি তাদের ওপরও আস্থাশীল ছিলেন না যারা কুফা থেকে চিঠি লিখে তাঁকে সেখানে গিয়ে তাদেরকে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছিল। উপরন্তু তিনি তাদের চিঠি প্রাপ্তি ও তাদের পক্ষ থেকে প্রতিনিধিদল তাঁর নিকট আসার পূর্বেই তাঁর আন্দোলনের ঘোষণা দেন। তিনি পবিত্র মক্কা নগরীতে রক্তপাত ঘটানোকে পরিহার করার জন্য মক্কা ত্যাগ করেন। তিনি জানতেন যে, তিনি মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন, তারপরও তিনি সেদিকেই অগ্রসর হন।
এখানে যে প্রশ্নটি এসে যায় তা হলো, এত প্রতিকূলতার মাঝেও কেন তিনি মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন এবং তাঁর আন্দোলনের ঘোষণা দেন? এই প্রশ্নের জবাব দেয়ার জন্য নিচের বাস্তবতাগুলোর ব্যাপারে আমাদেরকে সচেতন হতে হবেÑ
প্রথমত, ইয়াযীদ মুসলিম উম্মাহর জন্য একজন বিপজ্জনক ব্যক্তি ছিল। ইতিহাসবিদদের অভিমত অনুযায়ী বলা যায়, সে ইসলামের কোন শিক্ষাই তার মধ্যে ছিল না। সে মদপান করত, জুয়া খেলত এবং সকল ধরনের অপকর্মে লিপ্ত হত। ঐতিহাসিক গ্রন্থসমূহে সংকলিত ইসলাম, ওহী, মহানবী (সা.) সম্পর্কে ইয়াযীদের বিভিন্ন মন্তব্য থেকে বোঝা যায় যে, তার কাছে মহানবী (সা.)-এর নবুওয়াত ছিল ক্ষমতা দখলের অজুহাত; প্রকৃতপক্ষে মহানবী (সা.)-এর কাছে কোন ওহী আসে নি। মুসলিম উম্মাহর পরিচালনার বিষয়ে এমন ধরনের লোকের ওপর কিভাবে বিশ্বাস স্থাপন করা সম্ভব? অন্যদিকে সত্যপন্থীদের জন্য এমন ধরনের ভ্রষ্ট নেতার বিপক্ষে ইমাম হোসাইনকে নেতা হিসেবে গ্রহণ ও তাঁর আনুগত্য করা ছিল একটি যৌক্তিক বিষয়।
কিন্তু এমন পরিস্থিতিতেও দেখা যায় তৎকালীন মুসলিম সমাজের প্রখ্যাত ব্যক্তিত্বগণও ইমাম হোসাইনকে সমর্থন ও সহযোগিতা করা বিরত থাকল। উপরন্তু ইমাম হোসাইন (আ.) ইয়াযীদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের আহ্বান জানালে তারা উল্টো তাঁকে ইয়াযীদের বিপক্ষে না দাঁড়ানোর জন্য পরামর্শ দিল, যদিও তাদের কাছে বনু উমাইয়্যার দুর্নীতি ও ইসলামবিরোধী কর্মকা- প্রমাণিত ছিল। আবদুল্লাহ ইবনে উমর এবং আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইরও ইমাম হোসাইনকে তাঁর জাগরণী কার্যক্রম থেকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেছিলেন। এসব কর্মকা- মুসলিম উম্মাহর মধ্যে জিহাদী চেতনার অনুপস্থিতিকে তুলে ধরে।
এভাবে একটি নেতিবাচক চেতনা সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ইবনে যিয়াদের ভীতি প্রদর্শনের মুখে কুফার জনগণ তাদের অঙ্গীকার ভঙ্গ করে, শুধু তা-ই নয় ইবনে যিয়াদের প্রদত্ত পদ ও ধন-সম্পদের প্রতিশ্রুতির প্রতি তারা আস্থা স্থাপন করে সত্যপথে লড়াই করা থেকে নিজেদেরকে গুটিয়ে নেয়। ইমাম হোসাইন (আ.) জনসাধারণের মৃত চেতনাকে ফিরিয়ে আনতে কিয়াম করেন।
দ্বিতীয়ত, তৎকালীন সমাজে বিদ্যমান বিচ্যুতিকে দূর করার ব্যাপারে সার্বিকভাবে উম্মাহর অবস্থান ছিল খুবই নি¤œ পর্যায়ে। সর্বস্তরের জনসাধারণের মধ্যে আল্লাহর পথে নিজেকে উৎসর্গ করার পরিবর্তে পার্থিব ভোগ-বিলাসের প্রবণতা প্রকট হয়ে দেখা দেয়। এই বিষয়টি সুযোগসন্ধানীদেরকে শাসনক্ষমতা দখল এবং মানুষকে তাদের ইচ্ছামতো পরিচালনা করার ক্ষেত্রে সক্ষম করে তোলে। ইমাম হোসাইনের সংগ্রামের লক্ষ্য ছিল সকল যুগের মানুষের চেতনাকে ক্ষণস্থায়ী বস্তুবাদী আকাক্সক্ষার বিপরীতে জাগ্রত করা। এটাই ইমাম হোসাইন বলেছেন : ‘আমি সৎকর্মের আদেশ করতে ও অসৎকর্মে নিষেধ করতে চাই।’
তৃতীয়ত, সময়ের বাস্তবতায় এটি জরুরি হয়ে পড়েছিল যে, মুসলিম উম্মাহ ইমাম, ইমামত, ইমামের সত্যিকার ভূমিকা ও অন্যান্য দিক সম্পর্কিত প্রকৃত ধারণার বিষয়ে অবহিত হবে। কারণ, ইসলামি আকীদা-বিশ্বাস, চিন্তা-চেতনা, মূল্যবোধ ও হুকুম-আহকামের অবমূল্যায়নের মতো বিপজ্জনক বিষয়গুলো কখনই তৃণমূল স্তর থেকে উত্থিত হয় নি; বরং তা উমাইয়্যা শাসনব্যবস্থার সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে হয়েছিল যারা সকল কিছুকে কুক্ষিগত করে রেখেছিল। সুতরাং ইসলামের নির্দেশনা এবং একজন মুসলমান শাসকের যেসব গুণ থাকা প্রয়োজন, ইমাম হোসাইনকে মুসলিম উম্মাহর সামনে তা ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। ইমাম হোসাইন (আ.) যখনই সুযোগ পেয়েছেন তখনই তিনি জনসাধারণের সামনে প্রদত্ত প্রতিটি বক্তৃতায় তা ব্যাখ্যা করেছেন। যেমন, তিনি বলেছেন : ‘হে জনগণ! তোমরা ধর্মপরায়ণ মুমিন হও; তোমাদেরকে সত্য ও সঠিক বিষয়সমূহ জানতে হবে। এটিই তোমাদের জন্য অধিকতর উত্তম। আর আমরা মুহাম্মাদ (সা.)-এর পরিবারবর্গ সেসব অত্যাচারী ও নির্যাতনকারীর চেয়ে শাসক হওয়ার জন্য অধিকতর দাবিদার, যারা যা তাদের নয় সে বিষয়টি দাবি করে।’
এমন অকাট্য বক্তব্যের মাধ্যমে ইমাম হোসাইন (আ.) স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেন যে, ইসলামের সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত উমাইয়্যা গোষ্ঠী মুসলিম উম্মাহর শাসক হওয়ার যোগ্য নয়। আর তিনি একই সাথে এটাও ব্যক্ত করেন যে, ইসলামে শাসক হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় বৈশিষ্ট্যাবলি তিনিই ধারণ করেন এবং তিনিই এ পদের অধিকারী। আর তাই নেতৃত্ব বা ইমামতের বিষয়ে ইসলামের ধারণা কী এবং বনু উমাইয়্যার শাসক হওয়ার দাবি যে মিথ্যা এটি প্রকাশ করে দেয়াও ইমাম হোসাইনের আন্দোলনের অন্যতম কারণ ছিল বলা যায়।
চতুর্থত, ইসলামি সমাজে একজন মানুষ কোন বিচ্ছিন্ন ও স্বতন্ত্র ব্যক্তিসত্তা নয়, বরং সে তার সমাজের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত এবং ইসলামের বিধি অনুসারে তাকে তার সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে হবে। কিন্তু ইসলামি শরীয়তের অন্যতম বিধান ‘সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ’ এর দায়িত্ব পালনের অর্থ হলো তাকে বিপ্লবের পথ অনুসরণ করতে হবে, কারণ, এটিই একমাত্র পথ ছিল যার মাধ্যমে ইমাম হোসাইন তাঁর নানার উম্মতের সংস্কার সাধন করতে পারতেন।
পঞ্চমত, অত্যাচার ও নির্যাতনের মোকাবেলায় এবং সত্য, ন্যায় এবং চিন্তা, কথা ও কর্মের স্বাধীনতার মানবিক মূল্যবোধকে উচ্চে তুলে ধরতে ইমাম হোসাইন (আ.), তাঁর পরিবার এবং বন্ধুরা তাঁদের জীবন, ধন-সম্পদ ও সম্মান অর্থাৎ যা কিছু তাঁদের ছিল সকল কিছুকে উৎসর্গ করেছিলেন।
এই কারণগুলোকে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর আন্দোলনের উদ্দেশ্য হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে যে আন্দোলন ইসলামকে অমর করেছে এবং অনাগত প্রজন্মকে ইসলামের প্রতিরক্ষায় জিহাদের চেতনাকে উজ্জীবিত করেছে।
ইমাম হোসাইনের আন্দোলনের শিক্ষা
ইমাম হোসাইন (আ.) ছয় মাসেরও অধিককাল ধরে একটি আন্দোলন পরিচালনা করে মহান আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে যান। কিন্তু এই মহান আন্দোলনে ইমাম হোসাইনের প্রতিটি পদক্ষেপ, জনসাধারণের উদ্দেশে দেয়া তাঁর প্রতিটি বাণী এবং তাঁর শাহাদাত ও শাহাদাত-পরবর্তী প্রতিটি ঘটনা থেকে মানুষ কিয়ামত অবধি পাঠ লাভ করতে থাকবে। আমরা এখানে তন্মধ্যে কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করছি মাত্রÑ
প্রথমত, ইসলাম আপোসকামী ধর্ম নয়। ইসলাম অনুসারে অত্যাচারী শাসকের অধীনে কেবল নিজে সুখে-শান্তিতে বসবাস করা অন্যায়। যদি ইমাম হোসাইন (আ.) অত্যাচারী শাসকের আনুগত্য স্বীকার করে নিতেন তাহলে হয়তো তিনি নিজেকে নিহত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে পারতেন এবং খলিফা কর্তৃক কোন উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত হতে পারতেন যে খলিফা তাকে নামায পড়া, রোযা রাখা এবং অন্যান্য বিধান পালন করার সুযোগ দিত। কিন্তু তিনি ছিলেন আল্লাহর রাসূল হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর নাতি যে রাসূল ঘোষণা করেছেন : ‘অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো এবং সত্য কথা বলা বড় জিহাদগুলোর অন্যতম।’ আর ইমাম হোসাইনও কারবালার পথে তাঁর বিভিন্ন বক্তৃতায় উল্লেখ করেন যে, অত্যাচারী শাসকের সাথে জীবন যাপন করা অসম্মানের।
ইমাম হোসাইন (আ.) পবিত্র কোরআনকে বুকে ধারণ করতেন এবং জানতেন যে, মহান আল্লাহর পথে জিহাদের পরম পুরস্কার রয়েছে। যেমন কোরআনের একটি আয়াতে বলা হয়েছে : যারা ঈমান এনেছে, দেশ ত্যাগ করেছে এবং আল্লাহর রাহে নিজেদের জান ও মাল দিয়ে জিহাদ করেছে, তাদের বড় মর্যাদা রয়েছে আল্লাহর কাছে। আর তারাই সফলকাম।Ñ সূরা তাওবা : ২০,
অপর একটি আয়াতে বলা হয়েছে : ‘যারা আমার পথে জিহাদ (সাধনায় আত্মনিয়োগ) করে, আমি অবশ্যই তাদেরকে আমার পথে পরিচালিত করব। নিশ্চয় আল্লাহ সৎকর্মপরায়ণদের সাথে আছেন।’Ñ সূরা আনকাবুত ৬৯
দ্বিতীয় শিক্ষা হলো জীবনের মালিকানা এবং মালিকের কারণে জীবন বিলিয়ে দেয়ার ধারণা। আমাদের দেহ ও জীবনের মালিক হলেন আল্লাহ তাআলা। আর এজন্যই এ জীবন তাঁর কারণেই ও তাঁর পথেই সঠিকভাবে ব্যয়িত হওয়া উচিত। যদি আমরা তা করি, তাহলে এটি হবে আমাদের জীবনকে এর প্রকৃত মালিকের কাছে ফিরিয়ে দেয়া। আল্লাহর পথে শহীদ হওয়ার মহা পুরস্কার রয়েছে। একজন শহীদ বেহেশতে নবী-রাসূলগণের পাশে অবস্থান করবেন।
পবিত্র কোরআন ঘোষণা করছে : ‘যদি তোমরা আল্লাহর পথে নিহত হও অথবা (স্বাভাবিক) মৃত্যুবরণ কর তবে নিঃসন্দেহে আল্লাহর ক্ষমা ও করুণা যা তোমরা সঞ্চয় কর (ধনদৌলত) তা থেকে উত্তম। এবং যদি তোমরা (স্বাভাবিক) মৃত্যুবরণ কর বা নিহত হও, (পরিশেষে) অবশ্যই আল্লাহরই দিকে সমবেত হবে।’- সূরা আলে ইমরান : ১৫৭-১৫৮
তৃতীয় শিক্ষা হলো যখন আমরা পরীক্ষার সম্মুখীন হব তখন সেই পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়া। এটি বেহেশতে প্রবেশের অন্যতম শর্ত। পবিত্র কোরআন ঘোষণা করছে : ‘তোমাদের কি এই ধারণা যে, তোমরা জান্নাতে চলে যাবে, অথচ সে লোকদের অবস্থা অতিক্রম কর নি যারা তোমাদের পূর্বে অতীত হয়েছে। তাদের ওপর এসেছে বিপদ ও কষ্ট। আর এমনি ভাবে শিহরিত হতে হয়েছে যাতে নবী ও তাঁর প্রতি যারা ঈমান এনেছিল তাদেরকে পর্যন্ত একথা বলতে হয়েছে যে, কখন আসবে আল্লাহর সাহায্য! তোমরা শুনে নাও, আল্লাহর সাহায্য একান্তই নিকটবর্তী।’Ñ সূরা বাকারা : ২১৪
অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে : ‘আল্লাহ ক্রয় করে নিয়েছেন মুসলমানদের থেকে তাদের জান ও মাল এই মূল্যে যে, তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত। তারা যুদ্ধ করে আল্লাহর রাহে, অতঃপর মারে ও মরে। তওরাত, ইঞ্জিল ও কোরআনে তিনি এ সত্য প্রতিশ্রুতিতে অবিচল। আর আল্লাহর চেয়ে প্রতিশ্রুতি রক্ষায় কে অধিক? সুতরাং তোমরা আনন্দিত হও সে লেন-দেনের ওপর, যা তোমরা করছ তাঁর সাথে। আর এ হল মহান সাফল্য।’Ñসূরা তওবা : ১১১
চতুর্থ যে শিক্ষা আমরা ইমাম হোসাইন (আ.)-এর আন্দোলন থেকে পাই তা হলো আত্মত্যাগের শিক্ষা। আল্লাহর কারণে জীবন দেয়া হলো চূড়ান্ত আত্মত্যাগ। কিন্তু নিজেকে প্রাধান্য না দিয়ে অপরকে প্রাধান্য দেয়া ও অন্যান্য ক্ষেত্রেও আত্মত্যাগের বিষয় রয়েছে। আমরা কি আমাদের সম্পদ-সম্পত্তি যেগুলোকে আমরা খুব ভালোবাসি তা দরিদ্রদের জন্য বিলিয়ে দিতে পারি? আমরা কি আমাদের মূল্যবান সময়গুলোকে আমাদের সন্তানদের শিক্ষা-প্রশিক্ষণ দানের ক্ষেত্রে ব্যয় করতে প্রস্তুত? আমরা কি আমাদের বংশ, রক্ত, ভাষা, জাতীয়তা ও বর্ণের মিথ্যা অহমিকা পরিত্যাগ করতে পারি এবং অন্যান্য মুসলমানকে আমাদের ভাই বা বোন হিসেবে মেনে নিতে পারি? জীবন দানের মতো চূড়ান্ত ত্যাগের শিক্ষা আমাদেরকে এই সকল ত্যাগের শিক্ষার দিকে পরিচালিত করে।
শোক পালন
আমাদের কাছে এটি স্পষ্ট থাকা প্রয়োজন যে, কেন আমরা ইমাম হোসাইন (আ.)-এর জন্য শোকানুষ্ঠান ও ক্রন্দন করি। যদি আমরা ইমাম হোসাইনের শাহাদাতের জন্য ক্রন্দন করি তাহলে কোরআন মজীদ আমাদের বলছে যে, শহীদরা মৃত ননÑ ‘আর যারা আল্লাহর রাস্তায় নিহত হয়, তাদেরকে মৃত বলো না; বরং তারা জীবিত, কিন্তু তোমরা তা বোঝ না।’Ñসূরা বাকারা : ১৫৪
আমরা কি তাঁর পরাজয়ের জন্য ক্রন্দন করি? নিশ্চয়ই নয়; বরং যদি ইমাম হোসাইন (আ.) ইয়াযীদের কাছে আত্মসমর্পণ করতেন এবং তার আনুগত্য মেনে নিতেন তাহলে তিনি পরাজিত হতেন, কিন্তু তা করেন নি। প্রকৃতপক্ষে তাঁর আত্মত্যাগ ইসলামি সমাজের জন্য রাজতন্ত্র ও রাজা-বাদশাহর শাসনব্যবস্থাকে একটি কাঠামো হিসেবে গড়ে ওঠাকে প্রতিরোধ করে। এটি ইয়াযীদের মতাদর্শের মৃত্যু। যেমনটি কবি বলেছেন, নিশ্চয়ই হোসাইনের হত্যাকা-ে ইয়াযীদের মৃত্যু নিহিত। প্রতিটি কারবালাই ইসলামকে জীবিত করে।
প্রকৃতপক্ষে শোক পালনের মাধ্যম আমরা আহলে বাইত ও ইমাম হোসাইন (আ.)-এর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করি। একই সাথে যারা আহলে বাইতের শত্রু তাদের অন্যায় আচরণের প্রতিবাদ ও তাদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করি। এই অনুষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে আমরা তাঁদের আদর্শ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে সমাজকে সুন্দর করতে এবং এক প্রজন্ম থেকে অপর প্রজন্মের মধ্যে প্রকৃত ইসলাম, কোরআন, মহানবী (সা.) ও তাঁর আহলে বাইতের আদর্শ স্থানান্তর করতে চাই।
উপসংহার
ইসলামি নববর্ষ যেভাবে উদ্যাপন করা হয় সম্ভবত অন্য কোন জাতি বা গোষ্ঠী তাদের নববর্ষকে সেভাবে উদ্যাপন করে না। অধিকাংশ সভ্যতাই এ দিনটিকে আনন্দ ও খুশির দিন হিসেবে গ্রহণ করে এবং উদ্যাপন করে। কিন্তু ইসলামে, বিশেষ করে আহলে বাইতের অনুসারীদের জন্য নতুন বর্ষটি শুরু হয় দুঃখ-বেদনা এবং দুর্নীতি, শয়তান ও পাপের মূলোৎপাটনের আহ্বানের মাধ্যমে। এই সময়টিতে আমরা কেবল বাহ্যিক অত্যাচারীকে মূলোৎপাটনের আহ্বান জানাই না; বরং আমরা আমাদের অভ্যন্তরস্থ অবাধ্য সত্তাকেও মূলোৎপাটনের আহ্বান জানাই। এই বিশ্বাসের সর্বোৎকৃষ্ট নমুনা আমরা দেখতে পাই মহানবী (সা.)-এর একটি দোয়ার মধ্যে যা তিনি মুহররমের নতুন চাঁদ উদিত হওয়ার সময় করতেন : ‘হে আল্লাহ! আপনি অনাদি প্রভু এবং এটি একটি নতুন বছর, অতঃপর এতে (এ বছরে) আমি আপনার কাছে শয়তানের কাছ থেকে আশ্রয় চাই এবং মন্দের দিকে ধাবিত করে এমন নিচু নাফ্সের বিরুদ্ধে শক্তি কামনা করি এবং আপনি আমাকে সেই কাজে ব্যস্ত রাখুন যা আপনার নৈকট্য আনয়ন করে, হে মহান… হে আমাদের প্রভু! আমাদেরকে পথপ্রদর্শন ও গ্রহণ করার পর আপনি আমাদের অন্তরকে বিভ্রান্ত করেন না, আপনার পক্ষ হতেই ক্ষমা। নিশ্চয়ই আপনি গ্রহণকারী।’
আমাদের এটি মনে রাখতে হবে যে, মুহররম কেবল দশদিনের জন্য আর এরপর সবকিছু আগের মতো হয়ে যাওয়া নয়। যখন অধিক ইবাদত-বন্দেগিতে সময় ব্যয় করার জন্য আমাদের সামনে রমযান ও মুহররম মাসের মতো মাস আসে তখন আমাদের উচিত এই মাসগুলো থেকে কতটুকু লাভবান হলাম তা মূল্যায়ন করা। শুধু ত-ই নয়, আমাদেরকে এটাও মূল্যায়ন করতে হবে যে, এই মাসগুলোর পরে আমরা কি সেই মাসগুলোর প্রাপ্তিকে ধরে রাখতে সক্ষম হই কিনা। আর কীভাবেই বা আমরা পরবর্তী মাসগুলোতে সর্বোচ্চ লাভবান হতে পারি। অনেক মানুষই এই সময়ে তার ইবাদত-বন্দেগি ও অন্যান্য কর্মকা- নিয়ে সন্তুষ্ট হয়, কিন্তু পরবর্তী সময়ে কী হবে সে সম্পর্কে তেমন চিন্তা-ভাবনা করে না। শয়তান চেষ্টা করে প্রথম সুযোগেই মুমিনরা এই মাসগুলোতে যা অর্জন করে তা ছিনিয়ে নেয়ার। এই বিষয়ে সচেতন হয়ে কর্মে নিয়োজিত হলেই কেবল আমাদের পক্ষে পার্থিব ও পরকালীন কল্যাণ লাভ করা সম্ভব।

কারবালার ঘটনাপ্রবাহের ঐতিহাসিক নির্ভরযোগ্যতা : একটি পর্যালোচনা

মাহদী মাহমুদ :

যেকোনো সচেতন এবং বিজ্ঞ শ্রোতা কিংবা পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগাটা স্বাভাবিক যে, কীভাবে এত বিস্তারিতভাবে আমাদের মাঝে কারবালার ঘটনার বিবরণ এসে পৌঁছেছে। এ সম্পর্কিত বিদ্যমান বিভিন্নমুখী বর্ণনাসমূহের সবই কি সত্যি? পাশাপাশি ভিন্ন মতাবলম্বীদের কাছ থেকেও কারবালার ইতিহাসের ব্যাপারে সত্যমিথ্যার মোড়কে সংশয় সৃষ্টির প্রয়াস চালানো হয়েছে।
প্রথম প্রশ্নের জবাবে বলতে হয়, ইতিহাসের অনেক ঘটনার বর্ণনার মতোই কারবালার ইতিহাসের নামে যা বর্ণিত হয়েছে তার সবই যে সত্য এরকম কোনো কথা নেই। সত্তরের দশকে ইরানের বিখ্যাত বিপ্লবী আলেম আয়াতুল্লাহ মোর্তাজা মোতাহহারী তাঁর এক গবেষণাধর্মী বক্তৃতামালায় কারবালার ইতিহাসের নামে মিম্বরগুলো থেকে যা বলা হয়ে থাকে সেগুলোর কতক বর্ণনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন এবং যুক্তি, বুদ্ধি ও ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ, এককথায় বলতে গেলে, হিস্টরিওগ্রাফিক আলোচনার মধ্য দিয়ে প্রমাণ করেছেন যে, কারবালার মর্ম¯পর্শী বর্ণনার নামে মিম্বরগুলো থেকে কিছু কিছু কল্পকথাও সংযুক্ত হয়েছে।
মুহররম উপলক্ষে আহলে বাইতের অনুসারীদের মধ্যে মুহররম মাসে ১০ থেকে ১৫ দিনব্যাপী শোক মজলিশের আয়োজনের রীতি আছে। সেগুলোতে ‘মাসায়েব’ নামে একটি পর্ব থাকে, যেখানে ইমাম হোসাইন (আ.) ও তাঁর সঙ্গীসাথিদের মর্ম¯পর্শী শাহাদাতের বর্ণনা এবং শাহাদাত-পরবর্তী তাঁর পরিবার-পরিজনের মজলুমিয়াত বর্ণনা করা হয়Ñ যা শুনে শ্রোতারা ক্রন্দন করে থাকেন। এই মাসায়েব পাঠ করেন একজন আলেম বা যাকের। আলেমরা ইসলামি শাস্ত্রগুলোর ব্যাপারে গভীরভাবে পড়ালেখা করেছেন, অন্যদিকে যাকেররা মূলত বিভিন্ন ধরনের বই পড়ে বা অন্য কোনো আলেমের মুখে শুনে শ্রোতাদের সামনে কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনাবলি বর্ণনা করেন।
কারবালায় ইমাম হোসাইনের শাহাদাতের কথা আগাম জানতেন মহানবী (সা.)। আর এই হৃদয়বিদারক শাহাদাতের স্মরণে স্বয়ং নবীজী ক্রন্দন করেছেন। কারবালার শহীদদের স্মরণ করে শোক প্রকাশ, ক্রন্দন করার বিরাট ফযিলত রেওয়ায়াতসমূহে বর্ণিত আছে। আর এই শোকের স্মরণ করে আল্লাহর দ্বীনের প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের প্রতি আকর্ষণ ও শক্তি সঞ্চয় একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। বিশেষজ্ঞ আলেমগণের মতে, কারবালার প্রকৃত ও মূল ঘটনাসমূহে সাধারণ বর্ণনাই অত্যন্ত মর্মান্তিক, হৃদয়বিদারক, সচেতনতা সৃষ্টিকারী ও শোক উদ্রেককারী ক্রন্দনময়। এর জন্য অতিরিক্ত কোন কাহিনী বা উপকাহিনী সংযোজন করার প্রয়োজন নেই। যদিও কারবালার শহীদদের স্মরণে শোকানুষ্ঠানকে প্রাণবন্ত করতে, মানুষের ক্রন্দনের পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য যাকেরদের একাংশ কারবালার প্রকৃত ঘটনার সাথে আরো কিছু কল্পিত অনুভূতি ও কাহিনী তুলে ধরেন। প্রাসঙ্গিকভাবে উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায় যে, প্রখ্যাত সাহিত্যিক মীর মশাররফ হোসেনের লেখা সুপাঠ্য, কিন্তু সর্বৈব আজগুবি, কাল্পনিক এবং ইমাম হোসাইনের সংগ্রামের দর্শনের প্রতি অবমাননাকর উপন্যাস ‘বিষাদসিন্ধু’র কথা। তবে অবাক হওয়ার কিছু নেই। মীর মশাররফ হোসেনের বহু আগে থেকেই বাংলার সাহিত্য, কবিতা, জারী-মর্সিয়া প্রভৃতি শোকগাথাগুলোতে কিছু কিছু উপকাহিনী উপস্থাপন করা হয়েছে।
শৃগাল যেমন ওঁত পেতে থাকে তার শিকারের এক নিমেষের অন্যমনস্কতার জন্য, তেমনিভাবে আহলে বাইতের বিরুদ্ধবাদীরাও কারবালার প্রকৃত ও সতত স্বীকৃত মূল ঘটনাপ্রবাহ ও এর ঐতিহাসিক বর্ণনা ও সেই ইতিহাসকে কেন্দ্র করে এসকল অতিরঞ্জনের সুযোগ নিয়ে, বলতে গেলে, কারবালার সমগ্র ঐতিহাসিক বাস্তবতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে চলেছে। বিশেষ করে কারবালার ইতিহাসের বিপ্লবী উপাদানগুলোকে শতভাগ অস্বীকার করার অপপ্রয়াস চালাচ্ছে।
আহলে বাইতপন্থিদের প্রতি এই গোষ্ঠীটির আরোপিত সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগ হচ্ছে যে, কারবালার সংগ্রামের যে বিপ্লবী এবং মর্ম¯পর্শী বর্ণনা আহলে বাইতপন্থিরা প্রচার করে সেগুলো নাকি প্রাথমিকভাবে কেবল ‘আবু মেখনাফ লুত বিন ইয়াহিয়া’ নামের এক ব্যক্তি থেকেই এসেছে। তাদের মতে, আবু মেখনাফ একজন অনির্ভরযোগ্য ব্যক্তি এবং তাঁর সংকলিত কারবালার ইতিহাস নাকি তাঁর ‘ঊর্বর মস্তিষ্কের ফসল’।
এবার আমরা নিবন্ধের মূলভাগে প্রবেশ করব যেখানে আমরা উপরিউক্ত অভিযোগের ব্যাপারে আলোচনা করব, কারবালার বিপ্লবী ইতিহাসের নির্ভরযোগ্যতা নিরূপণের চেষ্টা করব এবং দেখতে চেষ্টা করব কারবালার বিপ্লবী ইতিহাসের বিরুদ্ধবাদীরা তাঁদের সামাজিক এবং স্বার্থগত প্রয়োজনে কীভাবে কারবালার ইতিহাসের নতুন একটি ধারা সৃষ্টি করেছেন।
প্রথমে আমরা দেখব, কারবালার প্রান্তরে যে নৃশংস হত্যাকা- সংঘটিত হয়েছিল কীভাবে তার ইতিহাস সেই কারবালার প্রান্তর থেকে বহির্বিশ্বে ও প্রজন্মান্তরে প্রচারিত হয়েছেÑ
১. আবু মেখনাফ এবং মাকতাল : আবু মেখনাফ ছিলেন কুফার অধিবাসী ও আয্দ গোত্রের গোত্রপতি। তাঁর পিতার নাম ইয়াহিয়া। তিনি ইমাম আলী (আ.)-এর নেতৃত্বে বিশ্বস্ততার সাথে প্রায় প্রতিটি যুদ্ধ অংশগ্রহণ করেন। আবু মেখনাফের বন্ধু ছিলেন বিখ্যাত মুসলিম ঐতিহাসিক হিশাম আল কালবির পিতা মুহাম্মদ ইবনে সাইদ আল কালবি। আবু মেখনাফ বিখ্যাত ঐতিহাসিক ইবনে জারির তাবারির ইতিহাস বর্ণনার একজন মৌলিক এবং প্রধান তথ্যসূত্র। ইসলামের ইতিহাসের বিতর্কিত সময়সমূহের অত্যন্ত বিষদ বর্ণনাগ্রন্থ রচনা করেন তিনি। তিনি অকুস্থলে থাকা ব্যক্তিদের সাথে সরাসরি সাক্ষাতের মাধ্যমে তাঁর তথ্যসমূহ জোগাড় করতেন। সেসকল রচনার মধ্যে রয়েছে ‘কিতাব আল সাকিফা’, ‘কিতাব আল রিদ্দা’, ‘কিতাব আল জামাল’, ‘কিতাব আল শুরা’, ‘কিতাব আল সিফফিন’ প্রভৃতি। বালাজুরি, ইবনে আসাকির, ইবনে আল কালবি, ইবনে আসিম, আল ওয়াকিদি, আবুল ফিদা, তাবারীর মত আহলে সুন্নাহর প্রখ্যাত ঐতিহাসিকগণ পরবর্তীকালে আবু মেখনাফের রেখে যাওয়া কিতাবগুলো থেকে তাঁদের ইতিহাস গ্রন্থগুলোকে ব্যাপকভাবে সমৃদ্ধ করেছেন। যদিও অধিকাংশ সুন্নি ঐতিহাসিকের মতে আবু মেখনাফ অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য, তদুপরি যাহাবি, ইয়াহিয়া ইবনে মুইন, দারে কুতনি, ইবনে কাসির, ইবনে তাইমিয়া এবং এই শ্রেণির অপরাপর ইতিহাসবিদ ও ইতিহাসবিশারদের নিকটে আবু মেখনাফ ‘শিয়া দোষে দুষ্ট’। তাই তিনি অনির্ভরযোগ্য! এই শ্রেণিই মূলত কারবালার ইতিহাসের ভিন্নতম একটি ধারা রচনা করেছেন যার ব্যাপারে আমরা পরে আলোচনা করব। উল্লেখ্য, আধুনিককালের কথিত ‘সালাফি’ ধারাটিও ওই শ্রেণিটির বিশ্বাস ধারণ করে। যার মধ্যে ইয়াসির কাজি প্রমুখ বিজ্ঞ আলোচকও অন্তর্ভুক্ত।
কিন্তু তাঁরা ভুলে যান যে, যদি আবু মেখনাফ শিয়া হয়েও থাকেন, তবুও বলতে হয়, বুখারি ও মুসলিম শরীফসহ প্রসিদ্ধ সুন্নি হাদিস কিতাবসমূহে অন্তত ১০০ জন শিয়া রাবী থেকে হাদিস বর্ণনা করা হয়েছে এবং তাঁদেরকে রিজালশাস্ত্রে ‘নির্ভরযোগ্য’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এর বিপরীতে বলা যায়, বিখ্যাত সুন্নি হাদিসবিশারদ আল মিজ্জি তাঁর ‘তাহযিব আল কামাল’ এ উমর ইবনে সাদ, যে ছিল কারবালায় ইয়াযীদের ত্রিশ হাজার সৈন্যের সর্বাধিনায়ক এবং যার প্রত্যক্ষ আদেশে কারবালায় ইমাম হোসাইন (আ.) এবং তাঁর পরিজনকে হত্যা করা হয় এবং নারীদের পর্দার চাদর ছিনিয়ে নেয়া হয় এবং দড়িতে বেঁধে বন্দি করে নিয়ে যাওয়া হয়, তার ব্যাপারে আল ইজিলি নামক আরেকজন সুন্নি হাদিসবিশারদের মত গ্রহণ করেন, যেটি ছিল এমনÑ ‘উমর ইবনে সাদ হোসাইনের হত্যাকারী এবং একজন তাবেঈ এবং একজন নির্ভরযোগ্য হাদিস বর্ণনাকারী।’(?)
তাবারী ‘ইমাম হোসাইনের আন্দোলন’ শীর্ষক অধ্যায়টি স¤পূর্ণভাবে আবু মেখনাফের ‘মাকতাল’ গ্রন্থ থেকে গ্রহণ করেছেন। আর আবু মেখনাফ কারবালার প্রান্তরের বিস্তারিত বর্ণনা গ্রহণ করেছেন ইয়াহিয়া বিন হানি বিন উরওয়া, যুহাইর বিন আবদুর রহমান, সাবিত বিন হুবায়ের, মুহাম্মাদ ইবনে কায়েস, হারিস ইবনে আবদুল্লাহ, আবদুল্লাহ ইবনে আসিম, যাহ্হাক ইবনে আবদুল্লাহ, আবু যানাব আল কালবি, আদি বিন হুরমালা, মুহাম্মাদ ইবনে কায়েস প্রমুখ ইয়াযীদ বাহিনীর সৈন্যদের নিকট থেকে, যারা কারবালার ময়দানে থেকে সমগ্র ঘটনাপ্রবাহ প্রত্যক্ষ করেছিল।
আবু মেখনাফের ‘মাকতাল’ প্রখ্যাত ঐতিহাসিক হিশাম আল কালবি তাঁর লেখনির মধ্যে সংরক্ষণ করেন। হতে পারে, সেখান থেকেই পরে তাবারী ইমাম হোসাইনের শাহাদাতের আবু মেখনাফ রচিত অধ্যায়টি গ্রহণ করেন।
উল্লেখ্য, আবু মেখনাফ ছিলেন ইমাম যাইনুল আবেদীন (আ.), তাঁর পুত্র ইমাম বাকের (আ.) ও তাঁর পুত্র ইমাম জাফর সাদেক (আ.)-এর সমসাময়িক। যদি আবু মেখনাফ কারবালার ইতিহাস রচনায় কোন অতিরঞ্জন করতেন, তবে অবশ্যই নবীবংশের ইমামগণ তাঁর প্রতি কঠোর হতেন, তাঁকে সংশোধন করে দিতেন। অন্যদিকে এই তিনজন ইমাম এবং তাঁদের বংশের নারিগণ নিয়মিতভাবে শোক মজলিশের আয়োজন করতেন এবং কারবালার ঘটনা বিবৃত করতেন (উল্লেখ্য, ইমাম যাইনুল আবেদীন কারবালায় উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া ইমাম পরিবারের নারীরা প্রায় সকলেই কারবালা থেকে মদিনায় ফিরে এসেছিলেন)। যদি আবু মেখনাফ ইয়াযীদ বাহিনীর সৈন্যদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের সাথে ইমামদের বর্ণনার গরমিল দেখতেন তবে অবশ্যই তিনি ইমামদের মতটাই গ্রহণ করতেন।
আমরা এ প্রবন্ধে বার বার ‘মাকতাল’ শব্দটি উল্লেখ করেছি। ‘মাকতাল’ শব্দের প্রচলিত অর্থ ‘কতল করার স্থান’, কিন্তু হোসাইনি আন্দোলনের ক্ষেত্রে এই শব্দটি ‘শাহাদাতের ঘটনাবলি’ অর্থে ব্যবহৃত হয়।Ñ অুড়ঁন, গ. (১৯৮৭), জবফবসঢ়ঃরাব ংঁভভবৎরহম রহ ওংষধস: অ ংঃঁফু ড়ভ ঃযব ফবাড়ঃরড়হধষ ধংঢ়বপঃং ড়ভ অংযঁৎধ রহ ঞবিষাবৎ ঝযর’রংস (ঞযব ঐধমঁব: গড়ঁঃড়হ)
উল্লেখ্য,বিরুদ্ধবাদীরা যেরূপ বলে থাকে যে, আবু মেখনাফের ‘মাকতালু ইমাম হোসাইন’ কারবালার ইতিহাসের বিপ্লবী ও মর্ম¯পর্শী বর্ণনার সর্বপ্রথম রচনা, কথাটি সত্য নয়; বরং ইতঃপূর্বে ইমাম আলী (আ.)-এর বিশ্বস্ত ও বিখ্যাত সাহাবি আসবাগ বিন নুবাতা এবং আবু মেখনাফের প্রায় সমসাময়িক সময়ে যাবের বিন ইয়াযীদ আল জুফি ইমাম হোসাইনের ‘মাকতাল’ কিতাব রচনা করেন। আবু মেখনাফের ‘মাকতাল’ আমাদের হাতে আজ অবধি আংশিক ভাবে থাকলেও অপর দুজনেরটা নেই। কিন্তু তাঁদের ঠিক পরের যুগের ‘মাকতাল’ লেখকগণ ঐসকল ‘মাকতাল’ থেকেও সাহায্য গ্রহণ
করেছেন।
পরবর্তী সময়ে আরো অনেক ঐতিহাসিক অনেক ‘মাকতাল’ লিখেছেন, যাঁদের মধ্যে শিয়া এবং সুন্নি উভয় মতাবলম্বীই রয়েছেন। যেমন, ইবনে সাদ এর ‘মাকতাল’ (মৃত্যু ২৩০ হিজরি), বালাজুরির ‘মাকতাল’ (২৮৩ হিজরি), দিনাওয়ারির ‘মাকতাল’, ইবনে আসামের (৩১৪ হিজরি) ‘মাকতাল’, ইবনে তাউসের ‘মাকতাল’। এছাড়াও প্রাথমিক যুগেই ওয়াকিদি, মুয়াম্মার আল মুসান্না, নাস্র বিন মুযাহাম, ইয়াকুবি প্রমুখ ইমাম হোসাইনের মাকতাল রচনা করেন। তবে তাঁদের মাকতালসমূহ প্রথমোক্তগণের মত আজ আর অস্তিত্বশীল নয়।
তবে সবচেয়ে বিখ্যাত ‘মাকতাল’টির সংকলকের নাম শেখ সাদুক (মৃত্যু ৩৩১ হিজরি)। যদিও আজ আর তাঁর ‘মাকতাল’টি সরাসরি পাওয়া যায় না। তবে তাঁর ‘মাকতাল’ থেকে বিভিন্ন কিতাবে কারবালার ইতিহাস এত বেশি উদ্ধৃত হয়েছে যে, সেগুলো কেটে কেটে নিয়ে ‘মাকতালু শেখ সাদুক’ এর বিরাটাংশ পুনরুদ্ধার করা গিয়েছে। এই ‘মাকতাল’টির বিশেষ বৈশিষ্ট্য এই যে, শেখ সাদুক সরাসরি মাসুম ইমামগণ তথা রাসূল (সা.)-এর আহলে বাইত-বংশধরগণের মুখনিঃসৃত বর্ণনা থেকে তাঁর ‘মাকতাল’টি রচনা করেন। (ঞযব গধয়ঃধষ এবহৎব: অ চৎবষরসরহধৎু ওহয়ঁরৎু ধহফ ঞুঢ়ড়ষড়মু; চৎড়ভ. উৎ. গঁযধসসধফ-জবুধ ঋধশযৎ-জড়যধহর উবঢ়ধৎঃসবহঃ ড়ভ ঊহমষরংয, টহরাবৎংরঃু ড়ভ ছড়স, ছড়স, ওৎধহ)
এভাবে প্রমাণিত হয় যে, আহলে বাইতের অনুসারীরা ইমাম হোসাইনের সংগ্রামের বিপ্লবী বর্ণনা কেবল আবু মেখনাফ থেকে বর্ননা করেন নি; বরং প্রত্যেক যুগের আহলে বাইতপন্থি ঐতিহাসিকগণ আগের যুগের ‘মাকতাল’ এর বর্ণনা রাসূল (সা.)-এর সুযোগ্য বংশধর এবং তাঁদের শুভাকাক্সক্ষীদের মতামতের ভিত্তিতে রচনা করেছেন।
২. পরবর্তী যুগের মাকতাল লেখক, ইতিহাসবিদগণ সরাসরি আহলে বাইতের নারীদের কাছ থেকে ও কারবালায় নবীপরিবারের বাইরেরও যাঁরা শহীদ হয়েছেন তাঁদের পরিবারের নারী সদস্যগণ, যাঁরা কারবালায় উপস্থিত ছিলেন তাঁদের কাছ থেকে বর্ণনার বরাত দিয়ে কারবালার ঘটনা উল্লেখ করছেন। যেমন, যুহাইর বিন কাইনের স্ত্রী দাইলামের কাছ থেকে ইতিহাস গ্রন্থগুলোতে ইমামের শাহাদাতের পরে কারবালার ময়দানে ইমাম-পরিবারের দুর্দশা এবং সামগ্রিক পরিবেশ-পরিস্থিতির মর্মন্তুদ বর্ণনা পাওয়া যায়। অন্যদিকে ইমাম হোসাইনের বোন যায়নাব এর নিকট থেকে ঠিক ইমাম হোসাইনের শাহাদাতের সময়ের বর্ণনা পাওয়া যায়। ইমাম আলীর কন্যা হযরত যায়নাবই সেই নারী, যিনি কারবালার ময়দানে ইমাম হোসাইন ও তাঁর সঙ্গীদের শাহাদাত কিংবা তার পরের মহামুসিবতের সমগ্রটা নিকটতম দূরত্ব থেকে প্রত্যক্ষ করেন। কারবালার ঘটনার পর হযরত যায়নাব যতদিন বেঁচে ছিলেন তিনি প্রতিনিয়ত কারবালার ঘটনা স্মরণ করে শোক মজলিশের আয়োজন করতেন এবং কারবালার ময়দানের ঘটনাবলি বিবৃত করতেন।
অনুরূপভাবে কারবালার ময়দানে বেঁচে থাকা ইমাম হোসাইনের পুত্র ইমাম যাইনুল আবেদীন (আ.) থেকে সরাসরি মাকতাল লেখকদের নিকট, আবার ইমাম যাইনুল আবেদীন থেকে নবীবংশের পরবর্তী ইমামদের নিকট কারবালার ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে।
কারবালায় ইমাম হাসানের ছয়জন সন্তান শহীদ হন, অপর একজন হাসান আল মুসান্না আহত অবস্থায় বেঁচে যান এবং কারবালার ঘটনার পর বেঁচে ছিলেন। তাঁর থেকেও কারবালার ইতিহাস জনসাধারণের নিকট প্রকাশিত হয়।
৩. কারবালার ময়দানে উপস্থিত ছিল ইয়াযীদের নিয়োজিত বেতনভুক্ত প্রতিবেদক হামিদ বিন মুসলিম। কারবালার প্রতিটি ঘটনা, প্রত্যেকজন শহীদের যুদ্ধের ধরন এবং যুদ্ধ-পরবর্তী নির্মম অবস্থা সে অত্যন্ত ঠা-া মাথায় তাৎক্ষণিকভাবে লিপিবদ্ধ করে ফেলে। যেমন,ইমামের শরীরে ঠিক কতটি তীর বিদ্ধ হয়েছিল কিংবা কে ইমাম হোসাইনকে হত্যা করেছিল। ইমাম হোসাইনকে কে হত্যা করেছিলÑ শিমর বিন জিল জাওশান নাকি সিনান বিন আনাস, এই নিয়ে বিতর্ক দেখা যায়। হামিদ বিন মুসলিম এই বিতর্কের কারণটিও ব্যাখ্যা করে। সে বলে, ইমাম হোসাইনের জীবনের শেষ মুহূর্তে যখন তিনি ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে গেলেন তখন তাঁর শরীরে এত বেশি তীর বিদ্ধ হয়েছিল যে, তাঁকে দেখে সজারুর কথা মনে হবে। এমতাবস্থায়, ইয়াযীদ বাহিনীর সব সৈন্য সম্ভ্রমে দূরে সরে গেল। কেউই ইমাম হোসাইনকে হত্যা করার অপরাধের ভাগী হতে চাচ্ছিল না। কিন্তু এই অবস্থায় শিমর এবং সিনান মিলে হোসাইনের দেহকে আঘাত করতে লাগলো। এমনকি তারা ইমামের পবিত্র দেহ মোবারকের বা পাঁজরের ওপরে উঠে লাফাতে লাগল। এরই মধ্যে এবং মরুভূমির ধুলা-ঝাপসা বাতাসে দু’জনের মধ্যে কে শেষ আঘাতটা হেনে ইমাম হোসাইনের শরীর থেকে তাঁর পবিত্র মাথা বিচ্ছিন্ন করলো তা আর বোঝা সম্ভব হলো না।
কারবালার ঘটনার পর কিছুদিনের মধ্যেই হামিদ বিন মুসলিম প্রচ- অনুতপ্ত হলো, কিন্তু কারবালার বিভীষিকা তার মন-মস্তিষ্ক থেকে গেল না, ধীরে ধীরে স্মৃতিলুপ্ত, অপ্রকৃতস্থ হয়ে পড়ল সে।
৪. কারবালার ঘটনার কিছুদিন পর কুফার অধিবাসী মুখতার বিন সাকাফির নেতৃত্বে আহলে বাইতপন্থিরা বিদ্রোহ করেন। এই বিদ্রোহীরা সাময়িকভাবে সরকার গঠন করে মুখতারের নেতৃত্বে। অতঃপর কারবালার ঘটনায় সরাসরি জড়িত প্রত্যেক জালেমকে ধরে এনে তাদের মুখ থেকে প্রকাশ্য জনসমাবেশে কারবালায় তাদের জুলুমের কাহিনী শোনেন এবং তাদেরকে হত্যা করেন। মুখতারের এই কর্মকা-ের মাধ্যমেও কারবালার ইতিহাসের ব্যাপারে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায়।
৫. আহলে বাইত তথা রাসূল (সা.)-এর অষ্টম বংশধর ইমাম রেযা (আ.)-এর মজলিশে দেবেল বিন আলী আল খুযায়ী থেকে অনেকগুলো কবিতা পাওয়া যায়, যেগুলোতে কারবালার বিভীষিকা ও মাজলুমিয়াত ফুটে উঠেছে। এই কবিতাগুলো দেবেল ইমাম রেযার সামনে পাঠ করে শুনাতেন, ইমাম রেযা যেহেতু তাতে আপত্তি করতেন না, তাই ধরে নেয়া যায়, মাকতালের সাথে স¤পূর্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ এই কবিতাগুলো প্রকারান্তরে নির্ভরযোগ্যভাবে কারবালার মজলুমিয়াতের সাক্ষ্য বহন করছে।
আমরা দেখতে পাচ্ছি, কারবালার ইতিহাসের ব্যাপারে কেবল আবু মেখনাফ নয়; বরং আরো বহু সূত্র থেকে নির্ভরযোগ্য তথ্যাদি ও বিবরণ পাওয়া গিয়েছে যেগুলো একত্র করে নিরীক্ষণ এবং পুনঃনিরীক্ষণের (পযবপশ ধহফ পৎড়ংং পযবপশ) এর মাধ্যমে আধুনিক লেখকগণ কারবালার ইতিহাসকে বৈজ্ঞানিক রূপ দান করেছেন। এ প্রসঙ্গে শেখ আব্বাস কুম্মি রচিত ‘নাফাসুল মাহমুম’ গ্রন্থটির কথা বলা যায়। এই গ্রন্থটিতে বলতে গেলে লেখক আবু মেখনাফের থেকে কারবালার ঘটনা ততটা বর্ণনা করেন নি; বরং শেখ মুফিদের ‘আল ইরশাদ’, ইবনে তাউসের ‘লুহুফ’, ইবনে আসিরের ‘তারিখে কামিল’, আবুল ফারায ইসফাহানি যায়েদির ‘মাকবাতিলুল তালিবিঈন’, মাসউদির ‘মুরুজুয যাহাব’, সিবতে ইবনে জাওযির ‘তাযকিরাতুল খাওয়াস’, মুহাম্মাদ বিন তালহার ‘মাতালিবুস সাউল’, ইবনে সাব্বাগ মালিকির ‘ফুসুলুল মুহিম্মাহ’, ঈসা ইরবিলির ‘কাশফুল গুম্মাহ’, ইবনে আব্দ রাব্বাহ এর ‘ইকদুল ফারিদ’, তাবারসির ‘আল ইহতিজাজ’, ইবনে শাহর আশোবের ‘মানাকিবে আলে আবি তালিব’ প্রমুখ গ্রন্থ থেকে কারবালার প্রায় সবচেয়ে প্রাঞ্জল, নির্ভরযোগ্য, যুক্তিভিত্তিক এবং পরিষ্কার ঘটনাপ্রবাহ রচনা করেছেন। অর্থাৎ আহলে বাইতপন্থিরা কখনোই কারবালার ইতিহাসের ক্ষেত্রে আবু মেখনাফের ওপর এককভাবে নির্ভরশীল নন।
এখন সংক্ষিপ্তভাবে আলোচনা করতে চাই যে, আহলে বাইপন্থিদের বিরুদ্ধবাদীরা ইমাম হোসাইনের আন্দোলনের বিপ্লবী ও মর্ম¯পর্শী ইতিহাসের বিপরীতে নতুন ধারার ইতিহাসের মাধ্যমে কোন্ স্বার্থসিদ্ধি করতে চাচ্ছেন?
এই ধারার ইতিহাসের রচয়িতা মূলত ইবনে কাসির এবং তাঁর গুরু এবং শিষ্যগণ। হালের ইয়াসির কাজিও একই মতবাদ প্রচারের প্রয়াস চালাচ্ছেন। তাঁরা বলতে চান, ইমাম হোসাইনের ‘আবেগ তাঁর যুক্তিবোধ’কে তমসাচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। তাঁদের মতে, ইমাম হোসাইন (আ.) সেই যুগে যিনি তাঁর চেয়েও জ্ঞানী ছিলেন সেই আবদুল্লাহ ইবনে উমরসহ প্রত্যেক জ্ঞানী-গুণী সাহাবির কথা অমান্য করে কুফাবাসীদের মাধ্যমে মুসলিম-জাহানের ক্ষমতার মসনদে আরোহণের চেষ্টা করেন এবং ব্যর্থ হন। অন্যদিকে জ্ঞানী সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনে উমর এই সময়ে ‘না ইয়াযীদ, না হোসাইন’ এইরকম মধ্যপন্থা অবলম্বন করে তাঁর ধীশক্তির প্রমাণ দেন। মুসলিম উম্মাহ ইতিমধ্যেই যথেষ্ট রক্ত ঝরিয়েছে। ইমাম হোসাইনের উচিত ছিল রাজনীতির অঙ্গনে না ঢুকে বরং ইবাদত-বন্দেগিতে নিয়োজি থাকা। এইসব দুনিয়াবি হানাহানি, ঝগড়া-বিবাদের চেয়ে আল্লাহর যিক্র করা শ্রেয়তর। আর ইমাম হোসাইনকে হত্যার পেছনে সিংহভাগ দায় কুফাবাসীদের, যার জন্য অনুতপ্ত হয়ে ইমাম হোসাইনের শাহাদাতের পর তারা তাঁর খুনের বদলা নিতে বিদ্রোহ করে এবং তাদের নাম ছিল ‘তাওওয়াবুন’Ñ যারা আজ অবধি প্রতি মুহররমে ক্রন্দন আর মাতমের মাধ্যমে নিজেদের অনুতাপ প্রকাশ করে। (ইউটিউবে দেখুন :ঞযব গধংংধপৎব ড়ভ কধৎনধষধ:অ ঐরংঃড়ৎরপধষ অহধষুংরং-উৎ. ণধংরৎ ছধফযর)
অর্থাৎ তাঁদের কথার সারকথা এটাই যে, ১. সমাজে জুলুম-নির্যাতন, অশ্লীলতা, অনাচার, পুঁজিবাদ প্রকট আকার ধারণ করুক কিংবা ফাসেক শাসক হালালকে হারাম আর হারামকে হালাল করুক তবুও এর প্রতিবাদ জানানো যাবে না। সেটা করলে রাজনীতি করা হবে। উল্লেখ্য, ইমাম হোসাইন (আ.) মদীনা থেকে মক্কায়, মক্কা থেকে কুফায় যাত্রাপথে বিভিন্ন মঞ্জিলে বক্তব্যে বার বার সু¯পষ্টভাবে বলেছেন যে, তিনি ক্ষমতার লোভে নয়; বরং ‘সৎ কাজের নির্দেশ এবং অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করা’র জন্য আন্দোলনে নামছেন। তিনি তাঁর নানার দ্বীনকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য সংগ্রাম করছেন। (২) তাঁদের মতে, হক আর বাতিলের লড়াইয়ের সময় মধ্যপন্থা অবলম্বন করাটা অধিক জ্ঞানের লক্ষণ। এমনকি মুসলিম জাহানের শাসক যদি রাসূল (সা.)-এর মিম্বরে বসে তাঁর রেসালাতে অবিশ্বাস করে, ব্যাঙ্গ-বিদ্রƒপ করে, তাও সেটার বিরুদ্ধে রুখে না দাঁড়িয়ে মধ্যপন্থা অবলম্বন করতে হবে! উল্লেখ্য, ইয়াযীদ বলেছিল, ‘বনি হাশেম ক্ষমতা নিয়ে খেলছে। না কোন নির্দেশ এসেছে আল্লাহ থেকে, আর না কোন ওহি নাযিল হয়েছে।’ (তারিখে তাবারী, আরবি খ- ১৩, পৃষ্ঠা ২১৭৪।
তাজকিরাতুল খাওয়াস সিবতে ইবনে আল জাওযি, পৃষ্ঠা ২৬১) (৩) আহলে বাইত এর মর্যাদা কেবল বংশীয়। তাঁদের আর কোন বিশেষ দায়িত্ব নেই। সমাজের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোটা তাঁদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। আহলে বাইতের শান আগের পারস্য কিংবা গ্রিক বংশীয় অভিজাততন্ত্রের মত কিংবা বর্তমানের নখদন্তহীন ব্রিটিশ রাজপরিবারের মত। এমনকি রাসূল (সা.)-এর বংশধর হিসেবে তাঁর আনীত দ্বীনের হেফাযতে কিয়াম করাও তাঁদের ভুল, অনভিজ্ঞতা এবং বোকামি। (৪) কুফাবাসী আহলে বাইতপন্থিদেরকে তাঁরা সামগ্রিকভাবে দায়ী করেছেন। তাঁরা যেন ভুলেই গিয়েছেন যে, এই কুফাবাসীদের মধ্যে থেকেই হানি বিন উরওয়া, মাইসাম বিন তাম্মারসহ আরো অনেকেই ইমাম হোসাইন ও আহলে বাইতের সম্মান রক্ষার জন্য শাহাদাত বরণ করেন। মুসলিম বিন আওসাজা, হাবিব ইবনে মাজাহের, বুরায়র ইবনে খুজায়ের আল হামেদানি প্রমুখ কুফাবাসী ইমামের জন্য কারবালার ময়দানে শাহাদাত বরণ করেন। কুফাবাসী আহলে বাইতপন্থি মুখতার বিন সাকাফি এবং তাঁর দল শাহাদাত-পরবর্তীকালে কারবালার ময়দানের জালেমদের একজন একজন করে ধরে বিচার করে এবং তাদের হত্যা করেন। অবশেষে জালিম সরকারের হাতে প্রাণ ত্যাগ করেন। (৫) তাঁরা ভুলে যান ‘তাওওয়াবুন’ বা অনুতাপকারীদের মানসিকতার সাথে অতীত কিংবা বর্তমানের আহলে বাইতপন্থিদের শোক পালনের দর্শনের বিন্দুমাত্র মিল নেই। যেমন, তাওয়াবুনরা ইমাম হোসাইনকে সাহায্য না করার ফলে ইমাম অসহায় অবস্থায় শহীদ হন, এই বেদনায় ক্রন্দন করতো। আর প্রকৃত আহলে বাইতপন্থিরা ক্রন্দন করে হযরত যায়নাব আর ইমাম যাইনুল আবেদীনের ক্রন্দন, আহাজারি, মর্সিয়া-মাতমের বিপ্লবী সংস্কৃতিকে অনুসরণ করেন। পবিত্র কোরআনের সূরা শুরার ২৩ নং আয়াতে মহান আল্লাহ রাসূলকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘(হে রাসূল!) তুমি বলে দাওÑ আমি এর জন্য (আল্লাহর বার্তা মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া) তোমাদের নিকট হতে আমার পরমাত্মীয়দের প্রতি ভালোবাসা ব্যতীত অন্য কোন প্রতিদান চাই না।’ রাসূলের কুরবা (পরমাত্মীয়, রক্তজ বংশধর) হচ্ছেন হযরত ফাতেমা, আলী, হাসান, হোসাইন। আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী ইমাম হোসাইনের প্রতি ভালোবাসা থেকেই আহলে বাইতপন্থিরা ক্রন্দন করেন। মাতম করেন। কারবালার মাজলুমিয়াত এর ইতিহাসকে অজ্ঞ ও মৃত আত্মা জনসাধারণের মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার জন্যই শোকমিছিল করেন এবং শোককে শক্তিতে রূপান্তর করে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। আহলে বাইতপন্থিদের বিপ্লবী ও মর্ম¯পর্শী ‘মাকতালে ইমাম হোসাইন’ তাদেরকে এই শিক্ষাই দেয়।

হজ-বাণীতে রাহবার হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী

ফিলিস্তিনের মুক্তির লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ করা সমগ্র মুসলিম উম্মাহ্র অপরিহার্য কর্তব্য
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হযরত আয়াতুল্লাহিল উযমা সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী এবারের পবিত্র হজে সমবেত হাজিদের উদ্দেশে প্রদত্ত বাণীতে বলেন, ফিলিস্তিনের মুক্তির লক্ষ্যে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা সমগ্র মুসলিম উম্মাহ্র অপরিহার্য কর্তব্য। এছাড়া তিনি তাঁর বাণীতে মুসলিম দেশগুলোতে চলমান যুদ্ধগুলো দ্রুত বন্ধের জন্য আহ্বান জানান।
রাহ্বার তাঁর বাণীর শুরুতে মহান আল্লাহ্ তা‘আলার প্রশংসা করেন এবং রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (সা.), তাঁর নি®পাপ আহ্লে বাইত (আ.) ও তাঁর পছন্দনীয় সাহাবীদের ওপর সালাম ও দরুদ পেশ করেন।
এরপর ইরানের ইসলামি বিপ্লবের রাহ্বার বলেন, মহান আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি এ কারণে যে, তিনি অতীতের বছরগুলোর মত এ বছরও বিশ্বের বিপুল সংখ্যক মুমিন মুসলমানকে হজ পালনের সৌভাগ্য দান করেছেন এবং তাঁদেরকে মহাকল্যাণময় ও স্বচ্ছ-সুপেয় রহমতের ঝর্নাধারা থেকে উপকৃত হবার এবং এ মূল্যবান পবিত্র সময়ের দিন-রাতে আল্লাহর মহিমান্বিত ঘরের চারপাশে ইবাদত, বিনম্র-বিহ্বলতা, যিক্র ও নৈকট্য অর্জনের সাধনায় মশগুল হবার ও এভাবে হৃদয়গুলোকে বদলে ফেলার, আর প্রাণগুলোকে পবিত্র ও সুসজ্জিত-সুশোভিত করার সুযোগ দিয়েছেন।
হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী বলেন, হজ রহস্যে ভরপুর এমন এক ইবাদত ও এমন এক পবিত্র স্থানে অবস্থানের সুযোগÑ যা ঐশী বরকতে পরিপূর্ণ ও মহান আল্লাহর নানা নিদর্শনের বহিঃপ্রকাশ। হজ আল্লাহর প্রতি ঈমান পোষণকারী বান্দাদেরকে, বিশেষত বিনম্র ও চিন্তাশীল-জ্ঞানী ব্যক্তিদের আধ্যাত্মিক মর্যাদা এনে দিতে পারে এবং তাঁদেরকে আলোকিত হৃদয়ের অধিকারী ও উচ্চতর ব্যক্তিতে পরিণত করতে পারে। হজ এ ধরনের ব্যক্তিদেরকে অন্তর্দৃষ্টি ও সাহসিকতার মত নানা গুণে গুণান্বিত করতে পারে এবং তাঁদেরকে কাজের উদ্যম ও আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সংগ্রাম করার গুণ প্রদান করতে পারে।
ইসলামি বিপ্লবের রাহ্বার বলেন, হজের রাজনৈতিক, আধ্যাত্মিক এবং ব্যক্তিগত ও সামাজিক দিকগুলো নজিরবিহীন, অত্যন্ত উচ্চমানের ও দৃশ্যমান। আজ মুসলিম সমাজের জন্য হজের এই আধ্যাত্মিক ও সামাজিক-রাজনৈতিক উভয় দিকই খুবই জরুরি। তিনি বলেন, আজ একদিকে বস্তুবাদের সম্মোহনী শক্তি নানা ধরনের উন্নত উপকরণের মাধ্যমে মানুষকে বিভ্রান্ত করছে ও তাদেরকে ধ্বংস করছে, অন্যদিকে আধিপত্যকামী শক্তিগুলোর নীতি ও কর্মসূচি মুসলমানদের মধ্যে ফেতনা ও বিভেদের আগুন ছড়িয়ে দিচ্ছে। তারা মুসলিম দেশগুলোকে নিরাপত্তাহীনতা ও মতবিরোধের জাহান্নামে পরিণত করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে।
হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী বলেন, হজ মুসলিম উম্মাহকে এই দুই বিরাট ব্যাধি থেকে নিরাময় করতে পারে। মনগুলোকে পবিত্রতায় উজ্জীবিত করে তোলার এবং তাকওয়া ও আধ্যাত্মিকতার আলোয় আলোকিত করে তোলার সুযোগ সৃষ্টি হয় এই হজের মাধ্যমে। একইভাবে হজে মুসলিম বিশ্বের তিক্ত ঘটনাবলির ওপর দৃষ্টিপাত করারও পরিবেশ তৈরি হয় এবং এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য দৃঢ়সংকল্পে আবদ্ধ হওয়ার চেতনায় উজ্জীবিত হবার পাশাপাশি বাস্তবে কাজে লাগানোরও ¯পৃহা সৃষ্টি হয়।
ইসলামি বিপ্লবের রাহ্বার বলেন, মুসলিম বিশ্ব আজ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। এই নিরাপত্তাহীনতা একদিকে নৈতিক, অপরদিকে আধ্যাত্মিক। রাজনৈতিক নিরাপত্তাহীনতাও মুসলিম বিশ্বকে গ্রাস করে আছে। এইসব নিরাপত্তাহীনতার অন্যতম কারণ হলো আমাদের উদাসীনতা এবং শত্রুদের নির্দয় আক্রমণ। তিনি বলেন, আমরা দুর্নীতিবাজ শত্রুদের আক্রমণ মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে আমাদের দ্বীনি দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করি নি এবং বিচারবুদ্ধিগুলোকেও সঠিকভাবে কাজে লাগাই নি। আমরা কাফেরদের বিরুদ্ধে আপোষহীন হবার নীতিও ভুলে গিয়েছি, তেমনি নিজেদের মধ্যে পর¯পরে দয়াপরবশ হবার শিক্ষাও ভুলে গিয়েছি। এর পরিণতিতে শত্রুরা মুসলিম বিশ্বের মূল ভূখ-ের কেন্দ্রস্থলে ফেতনা-ফাসাদ সৃষ্টি করে চলেছে।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতা বলেন, আমরা ফিলিস্তিনীদের মুক্তির ব্যাপারে আমাদের অবশ্য করণীয় দায়িত্ব পালনে উদাসীন রয়েছি। বর্তমানে সিরিয়ায়, ইরাকে, ইয়েমেনে, লিবিয়ায় ও বাহরাইনে গৃহযুদ্ধ চলছে, আবার পাকিস্তানে ও আফগানিস্তানে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে মোকাবেলা করতে হচ্ছে। এ ব্যাপারে মুসলিম দেশগুলোর নেতৃবৃন্দ এবং মুসলিম বিশ্বের সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের ব্যাপক দায়দায়িত্ব রয়েছে। তিনি বলেন, এ দায়িত্বগুলোর মধ্যে রয়েছে ঐক্য প্রতিষ্ঠা, ধর্মীয় ও গোত্রীয় সামগ্রিক নির্যাতন পরিহার, সব মুসলিম দেশ ও জাতিকে তাদের শত্রুদের শত্রুতার ধরন ও কৌশলগুলোর ব্যাপারে এবং যায়নবাদ ও বলদর্পী শক্তিগুলোর বিশ্বাসঘাতকতার ব্যাপারে সচেতন করা। সর্বোপরি নরম যুদ্ধের ও সশস্ত্র যুদ্ধের ময়দানে শত্রুদের মোকাবেলা করার জন্য যথাযথ উপকরণে ও অস্ত্রেশস্ত্রে সুসজ্জিত হওয়া এবং দ্রুততার সঙ্গে মুসলিম দেশগুলোতে চলমান বিপর্যয়কর ঘটনাগুলো বন্ধ করা অপরিহার্য। এসব তিক্ত ঘটনার মধ্যে ইয়েমেন পরিস্থিতি আজ গোটা বিশ্বের দুঃখ-কষ্ট ও প্রতিবাদের উৎস হয়ে আছে। এছাড়া মিয়ানমার ও অন্যান্য স্থানের মযলুমদের মতো নির্যাতিত মুসলিম সংখ্যালঘুদের প্রতি দৃঢ় সমর্থন ঘোষণা করা অপরিহার্য।
রাহ্বার বলেন, মুসলিম উম্মাহ্র সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ফিলিস্তিনিদের সমর্থন দেয়া। এটি হবে এমন এক জাতির প্রতি নিঃশর্ত সমর্থন ও সহযোগিতা, যে জাতি তাদের দখল হয়ে যাওয়া মাতৃভূমির জন্য প্রায় ৭০ বছর ধরে সংগ্রাম করছে।
তিনি বলেন, এর সবই আমাদের ওপর অর্পিত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। বিশ্বের জাতিগুলোর উচিত তাদের সরকারগুলোর কাছে এসব দাবি তুলে ধরা এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বদের উচিত দৃঢ় মনোবল ও অকৃত্রিম ইচ্ছার আলোকে এসব দাবি বাস্তবায়নে চেষ্টা করা। এসব কাজের অর্থ হচ্ছে নিশ্চিতভাবে ঐশী ধর্মকে সাহায্য করা। নিঃসন্দেহে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী এসব কাজে সাহায্য করবেন।
হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী বলেন, এগুলো হজের শিক্ষার অংশ এবং আমি আশা করি আমরা এসব শিক্ষা গ্রহণ করে সে অনুযায়ী কাজ করব। পরিশেষে, আমি দোয়া করি আপনাদের হজ কবুল হোক। আমি মিনা ও মসজিদুল হারামের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। আমি দোয়া করছি, মহানুভব ও দয়ালু আল্লাহ তা‘আলা যেন তাঁদেরকে উচ্চ মর্যাদা দান করেন।

বাংলা রূপ ফারসি রূপ আধুনিক ফারসি উচ্চারণ

বাংলা রূপ ফারসি রূপ আধুনিক ফারসি উচ্চারণ
শুরু شروع শুরু
শরিয়ত (ধর্মীয় নিয়মকানুন) شريعت শারিয়াত্
শরীফ (মর্যাদাবান / অভিজাত) شريف শারীফ
শরীক (অংশীদার) شريك শারীক
শতর (দাবা) شطرنبح শাত-রাঞ্জ
শের (কবিতা) شعر শে’র
শৃগাল شغال শো-গল
শেফা/শাফা (সুস্থ হওয়া) شفا শে–ফ
শেফাখানা
(ক্লিনিক) شفاخانه শে–ফ-খনেহ্
শিকার شكار শে-র্ক
শিকারী شكارى শে-করী
শোকর (কৃতজ্ঞতা) شكر শোক্র
শালগম شلغم শালগাম্
শেলোয়ার (ঢিলা পেক্ট/ পাজামা) شلوار শাল্ভর
শুমারী (গননা) شمارى শো-মরী
আদম শুমারী آدم شمارى অ-দাম শো-মরী
শমশের (তরবারী) شمشير শামর্শী
শনাক্ত شناخت শে-নখ্ত
শোননো شنو শে-নো
শাহাদাত (সাক্ষ্য/ শহীদ হওয়া) شهادت শা-হদাত্
শহর شهر শাহ্র্
শহুরে شهرى শাহ্রী
সনদ سند সানাদ্
সঙ্গীন (কঠিন/ভারী) سنگين সাঙ্গীন
সওয়ার سوار সা-র্ভ
সওয়াল سؤال সো-আল
সুদ (মুনাফা) سود সূদ
সুদখোর سود خور সূদ-র্খো
সওদা سودا সাও-দ
সওদাগর سوداگر সাও-দ-র্গা
সওগাত سوغات সৌগ¦ত
শোক سوگ সুগ¦
সের سير র্সী
সয়লাব سیلاب সেইলব্

শোকাবহ আশুরা ও আজকের প্রেক্ষাপটে আমাদের করণীয়

সম্পাদকীয়
শোকাবহ আশুরা ও আজকের প্রেক্ষাপটে আমাদের করণীয়
দশই মহররম শোকাবহ আশুরা; হিজরি ৬১ সালের এ দিনে সাইয়্যেদুশ্ শুহাদা বেহেশতে যুবকদের নেতা হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) কারবালায় তাঁর স্বজন ও সহচরগণসহ ইয়াযীদী বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে শাহাদাত বরণ করেন। এ ঘটনা মানব জাতির ইতিহাসের করুণতম ঘটনাÑ প্রেক্ষাপটসহ যে ঘটনা ইতিহাসের বিতর্কাতীত বিষয়াবলির অন্যতম।
আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.)-এর শাহাদাতের পরে হযরত ইমাম হাসান (আ.) খেলাফতের দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হন। কিন্তু মুসলিম উম্মাহ্কে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ও সম্ভাব্য রোমান হামলা থেকে রক্ষার লক্ষ্যে তিনি তাঁর বৈধ খেলাফতকে মুআবিয়ার হাতে ছেড়ে দেন। মুআবিয়া হযরত ইমাম হাসান (আ.)-এর সাথে কৃত সন্ধির শর্ত ভঙ্গ করে মৃত্যুকালে হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-এর হাতে খেলাফতের দায়িত্ব হস্তান্তরের পরিবর্তে স্বীয় চরিত্রহীন পাপাচারী পুত্র ইয়াযীদকে খেলাফতে অধিষ্ঠিত করে গেলে ইয়াযীদ ইমাম হুসাইনের কাছ থেকে শক্তিপ্রয়োগে বাই‘আত্ আদায়ের জন্য মদীনার প্রশাসককে নির্দেশ দেয়। কিন্তু হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-এর ন্যায় ব্যক্তি ইসলামের সমস্ত সীমারেখা অমান্যকারী ইয়াযীদের আনুগত্য করলে যে কারো জন্য তা ইসলামি মূল্যবোধ বিসর্জনের সপক্ষে দলিল হিসেবে গণ্য হতো। এ কারণে তিনি ইয়াযীদের অনুকূলে বাই‘আত্ করা থেকে বিরত থাকেন এবং রক্তপাত এড়াবার লক্ষ্যে রাতের বেলা মদীনা ত্যাগ করে মক্কায় চলে যান।
মক্কায় তিনি লোকদের মধ্যে মুসলমানদের হুকূমাতের অবস্থা সম্বন্ধে সচেতনতা সৃষ্টির কাজে আত্মনিয়োগ করেন। কিন্তু ইয়াযীদ সেখানে তাঁকে হজের ভীড়ে হত্যার জন্য গুপ্তঘাতক পাঠালে হযরত ইমাম (আ.) পবিত্র স্থানে রক্তপাত এড়াবার লক্ষ্যে মক্কা ত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন এবং কূফার জনগণের দাও‘আতে সাড়া দিয়ে সেখানে পৌঁছার উদ্দেশ্যে কারবালায় উপনীত হন। সেখানে ইয়াযীদী বাহিনী দ্বারা অবরুদ্ধ হয়ে তিনি মদীনায় ফিরে যাবেন বা মুসলমানদের রাজ্যের সীমান্তের ওপারে হিজরত করবেন বলে প্রস্তাব দেনÑ যা আবারো প্রমাণ করে যে, তিনি ক্ষমতালোভী ছিলেন না এবং রক্তপাত এড়াবার জন্য শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা করেছিলেন। তা সত্ত্বেও ইয়াযীদের নির্দেশে তার বাহিনী ইমামের ওপরে ইয়াযীদের অনুকূলে বাই‘আত্ করার জন্য কঠোরভাবে চাপ সৃষ্টি করে। কিন্তু ইমাম হুসাইন কোনো অবস্থায়ই ফাসেক্ব ইয়াযীদের অনুকূলে বাই‘আত্ করাকে জায়েয গণ্য করেন নি বিধায় তাদের এ চাপের কাছে নতি স্বীকার করতে অস্বীকৃতি জানান। এমতাবস্থায় ইয়াযীদী বাহিনী তাঁকে তাঁর সকল পুরুষ স্বজন ও সহচরসহ, এমনকি দুগ্ধপোষ্য শিশুকেও নির্মমভাবে হত্যা করে; কেবল আল্লাহ্ তা‘আলার বিশেষ ইচ্ছায় হযরত ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.) ঐ সময় মরণাপন্ন অসুস্থ থাকায় এ হত্যাকা- থেকে রেহাই পান।
হযরত ইমাম হুসাইনের আত্মত্যাগের এ ঘটনা মুসলমানদের জন্য বাতিলকে সহ্য করার সীমারেখাকে সুস্পষ্ট করে দেয়। এভাবে কারবালার ঘটনা যুগ যুগান্তর ধরে প্রকৃত ইসলামের অনুসারীদের জন্য প্রেরণার উৎসে পরিণত হয়।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক যে, কারবালার ঘটনা সম্পর্কে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলে আসা মতৈক্যের বরখেলাফে ইদানীং কিছুসংখ্যক লোক একদিকে কারবালার ঘটনার গুরুত্ব হ্রাস করার লক্ষ্যে অতীতের অনেক ইতিবাচক ঘটনা আশুরার দিনে ঘটেছিল বলে দাবি করছেÑযার সপক্ষে কোনো অকাট্য দলীল নেইÑএবং এর ভিত্তিতে আশুরার এ শোকের দিনকে এমনকি আনন্দের দিন বলে অভিহিত করার মতো জঘন্য মানসিকতার প্রদর্শন করতেও দ্বিধা করছে না। অন্যদিকে তারা কারবালার ঘটনাকে ইসলামের সাথে সম্পর্কহীন রাজনৈতিক সংঘাত ও ইমাম হুসাইনকে বৈধ (?!) খেলাফতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহকারী ক্ষমতাপ্রয়াসী হিসেবে চিত্রিত করার এবং নরপিশাচ ইয়াযীদকে নির্দোষ প্রমাণের ঘৃণ্য অপচেষ্টা চালাচ্ছে। তারা দাবি করছে যে, ইয়াযীদের অনুমতি ছাড়াই কারবালার ঘটনা ঘটানো হয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, তারা এ-ও প্রচার করছে যে, শিয়ারাই ইমাম হুসাইনকে হত্যা করেছিল। আমরা এ ব্যাপারে কোনো দীর্ঘ আলোচনা ও মন্তব্য না করে কেবল মুক্তবিবেক মানুষদের কাছে প্রশ্ন করব : যদি তা-ই হয়ে থাকে তাহলে যারা এ জন্য দায়ী ইয়াযীদ তাদেরকে শাস্তি দেয় নি কেন; বরং কেন তাদেরকে পুরস্কৃত করেছিল এবং ইমামের পরিবারের সদস্যদেরকে কারারুদ্ধ করে ছিল?
এটা আজ অনস্বীকার্য যে, ইরানের ইসলামি বিপ্লবের বিজয়ের মধ্য দিয়ে ইসলামের বিজয় ও ইসলামি ঐক্য অভিমুখে মুসলিম উম্মাহ্র নবযাত্রা শুরু হয়েছে। তাই ইসলামকে ছিন্নভিন্ন ও নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যে ইসলামের দুশমনদের পক্ষ থেকে বিলিয়ন-বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে বহুমুখী হামলা শুরু হয়েছে এবং আশুরাসহ ইসলামের বিতর্কাতীত বিষয়গুলোকে বিতর্কিত করার অপচেষ্টা এ ষড়যন্ত্রমূলক হামলার প্রধান কর্মসূচি। এমতাবস্থায় সমগ্র মুসলিম উম্মাহ্র জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে ইসলামের দুশমনদের এ ষড়যন্ত্র ও হামলাকে জ্ঞানের অস্ত্র দ্বারা শক্তভাবে মোকাবিলা করা অপরিহার্য।
আমরা আশুরা উপলক্ষে সমগ্র মুসলিম উম্মাহ্র প্রতি, বিশেষ করে নিউজ লেটারের পাঠক-পাঠিকাদের প্রতি গভীর শোক ও সমবেদনা জানাচ্ছি।

বাংলা রূপ ফারসি রূপ আধুনিক ফারসি উচ্চারণ

evsjv iƒc dviwm iƒc AvaywbK dviwm D”PviY
ïiæ شروع ïiæ
kwiqZ (agx©q wbqgKvbyb) شريعت kvwiqvZ&
kixd (gh©v`vevb / AwfRvZ) شريف kvixd
kixK (Askx`vi) شريك kvixK
kZi (`vev) شطرنبح kvZ-ivÄ
†ki (KweZv) شعر  †kÕi
k„Mvj شغال †kv-Mj
†kdv/kvdv (my¯’ nIqv) شفا  †k–d
†kdvLvbv

(wK¬wbK)

شفاخانه  †k–d-L‡bn&
wkKvi شكار †k-Ki&
wkKvix شكارى †k-Kix
†kvKi (K…ZÁZv) شكر  †kvK&i
kvjMg شلغم kvjMvg&
†k‡jvqvi (wXjv †c±/ cvRvgv) شلوار kvj&fi
ïgvix (Mbbv) شمارى  †kv-gix
Av`g ïgvix آدم شمارى A-`vg †kv-gix
kg‡ki (Zievix) شمشير kvgkxi&
kbv³ شناخت †k-bL&Z
†kvb‡bv شنو †k-†bv
kvnv`vZ (mvÿ¨/ knx` nIqv) شهادت kv-n`vZ&
kni شهر kvn&i&
kû‡i شهرى kvn&ix
mb` سند mvbv`&
m½xb (KwVb/fvix) سنگين mv½xb
mIqvi سوار mv-fi&
mIqvj سؤال  †mv-Avj
my` (gybvdv) سود m~`
my`‡Lvi سود خور m~`-‡Lvi&
mI`v سودا mvI-`
mI`vMi سوداگر mvI-`-Mvi&
mIMvZ سوغات ‡mŠM¦Z
‡kvK سوگ myM¦
 †mi سير mxi&
mqjve سیلاب †mBje&

 

সম্পাদকীয়

শোকাবহ আশুরা ও আজকের প্রেক্ষাপটে আমাদের করণীয়
দশই মহররম শোকাবহ আশুরা; হিজরি ৬১ সালের এ দিনে সাইয়্যেদুশ্ শুহাদা বেহেশতে যুবকদের নেতা হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) কারবালায় তাঁর স্বজন ও সহচরগণসহ ইয়াযীদী বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে শাহাদাত বরণ করেন। এ ঘটনা মানব জাতির ইতিহাসের করুণতম ঘটনাÑ প্রেক্ষাপটসহ যে ঘটনা ইতিহাসের বিতর্কাতীত বিষয়াবলির অন্যতম।
আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.)-এর শাহাদাতের পরে হযরত ইমাম হাসান (আ.) খেলাফতের দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হন। কিন্তু মুসলিম উম্মাহ্কে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ও সম্ভাব্য রোমান হামলা থেকে রক্ষার লক্ষ্যে তিনি তাঁর বৈধ খেলাফতকে মুআবিয়ার হাতে ছেড়ে দেন। মুআবিয়া হযরত ইমাম হাসান (আ.)-এর সাথে কৃত সন্ধির শর্ত ভঙ্গ করে মৃত্যুকালে হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-এর হাতে খেলাফতের দায়িত্ব হস্তান্তরের পরিবর্তে স্বীয় চরিত্রহীন পাপাচারী পুত্র ইয়াযীদকে খেলাফতে অধিষ্ঠিত করে গেলে ইয়াযীদ ইমাম হুসাইনের কাছ থেকে শক্তিপ্রয়োগে বাই‘আত্ আদায়ের জন্য মদীনার প্রশাসককে নির্দেশ দেয়। কিন্তু হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-এর ন্যায় ব্যক্তি ইসলামের সমস্ত সীমারেখা অমান্যকারী ইয়াযীদের আনুগত্য করলে যে কারো জন্য তা ইসলামি মূল্যবোধ বিসর্জনের সপক্ষে দলিল হিসেবে গণ্য হতো। এ কারণে তিনি ইয়াযীদের অনুকূলে বাই‘আত্ করা থেকে বিরত থাকেন এবং রক্তপাত এড়াবার লক্ষ্যে রাতের বেলা মদীনা ত্যাগ করে মক্কায় চলে যান।
মক্কায় তিনি লোকদের মধ্যে মুসলমানদের হুকূমাতের অবস্থা সম্বন্ধে সচেতনতা সৃষ্টির কাজে আত্মনিয়োগ করেন। কিন্তু ইয়াযীদ সেখানে তাঁকে হজের ভীড়ে হত্যার জন্য গুপ্তঘাতক পাঠালে হযরত ইমাম (আ.) পবিত্র স্থানে রক্তপাত এড়াবার লক্ষ্যে মক্কা ত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন এবং কূফার জনগণের দাও‘আতে সাড়া দিয়ে সেখানে পৌঁছার উদ্দেশ্যে কারবালায় উপনীত হন। সেখানে ইয়াযীদী বাহিনী দ্বারা অবরুদ্ধ হয়ে তিনি মদীনায় ফিরে যাবেন বা মুসলমানদের রাজ্যের সীমান্তের ওপারে হিজরত করবেন বলে প্রস্তাব দেনÑ যা আবারো প্রমাণ করে যে, তিনি ক্ষমতালোভী ছিলেন না এবং রক্তপাত এড়াবার জন্য শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা করেছিলেন। তা সত্ত্বেও ইয়াযীদের নির্দেশে তার বাহিনী ইমামের ওপরে ইয়াযীদের অনুকূলে বাই‘আত্ করার জন্য কঠোরভাবে চাপ সৃষ্টি করে। কিন্তু ইমাম হুসাইন কোনো অবস্থায়ই ফাসেক্ব ইয়াযীদের অনুকূলে বাই‘আত্ করাকে জায়েয গণ্য করেন নি বিধায় তাদের এ চাপের কাছে নতি স্বীকার করতে অস্বীকৃতি জানান। এমতাবস্থায় ইয়াযীদী বাহিনী তাঁকে তাঁর সকল পুরুষ স্বজন ও সহচরসহ, এমনকি দুগ্ধপোষ্য শিশুকেও নির্মমভাবে হত্যা করে; কেবল আল্লাহ্ তা‘আলার বিশেষ ইচ্ছায় হযরত ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.) ঐ সময় মরণাপন্ন অসুস্থ থাকায় এ হত্যাকা- থেকে রেহাই পান।
হযরত ইমাম হুসাইনের আত্মত্যাগের এ ঘটনা মুসলমানদের জন্য বাতিলকে সহ্য করার সীমারেখাকে সুস্পষ্ট করে দেয়। এভাবে কারবালার ঘটনা যুগ যুগান্তর ধরে প্রকৃত ইসলামের অনুসারীদের জন্য প্রেরণার উৎসে পরিণত হয়।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক যে, কারবালার ঘটনা সম্পর্কে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলে আসা মতৈক্যের বরখেলাফে ইদানীং কিছুসংখ্যক লোক একদিকে কারবালার ঘটনার গুরুত্ব হ্রাস করার লক্ষ্যে অতীতের অনেক ইতিবাচক ঘটনা আশুরার দিনে ঘটেছিল বলে দাবি করছেÑযার সপক্ষে কোনো অকাট্য দলীল নেইÑএবং এর ভিত্তিতে আশুরার এ শোকের দিনকে এমনকি আনন্দের দিন বলে অভিহিত করার মতো জঘন্য মানসিকতার প্রদর্শন করতেও দ্বিধা করছে না। অন্যদিকে তারা কারবালার ঘটনাকে ইসলামের সাথে সম্পর্কহীন রাজনৈতিক সংঘাত ও ইমাম হুসাইনকে বৈধ (?!) খেলাফতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহকারী ক্ষমতাপ্রয়াসী হিসেবে চিত্রিত করার এবং নরপিশাচ ইয়াযীদকে নির্দোষ প্রমাণের ঘৃণ্য অপচেষ্টা চালাচ্ছে। তারা দাবি করছে যে, ইয়াযীদের অনুমতি ছাড়াই কারবালার ঘটনা ঘটানো হয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, তারা এ-ও প্রচার করছে যে, শিয়ারাই ইমাম হুসাইনকে হত্যা করেছিল। আমরা এ ব্যাপারে কোনো দীর্ঘ আলোচনা ও মন্তব্য না করে কেবল মুক্তবিবেক মানুষদের কাছে প্রশ্ন করব : যদি তা-ই হয়ে থাকে তাহলে যারা এ জন্য দায়ী ইয়াযীদ তাদেরকে শাস্তি দেয় নি কেন; বরং কেন তাদেরকে পুরস্কৃত করেছিল এবং ইমামের পরিবারের সদস্যদেরকে কারারুদ্ধ করে ছিল?
এটা আজ অনস্বীকার্য যে, ইরানের ইসলামি বিপ্লবের বিজয়ের মধ্য দিয়ে ইসলামের বিজয় ও ইসলামি ঐক্য অভিমুখে মুসলিম উম্মাহ্র নবযাত্রা শুরু হয়েছে। তাই ইসলামকে ছিন্নভিন্ন ও নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যে ইসলামের দুশমনদের পক্ষ থেকে বিলিয়ন-বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে বহুমুখী হামলা শুরু হয়েছে এবং আশুরাসহ ইসলামের বিতর্কাতীত বিষয়গুলোকে বিতর্কিত করার অপচেষ্টা এ ষড়যন্ত্রমূলক হামলার প্রধান কর্মসূচি। এমতাবস্থায় সমগ্র মুসলিম উম্মাহ্র জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে ইসলামের দুশমনদের এ ষড়যন্ত্র ও হামলাকে জ্ঞানের অস্ত্র দ্বারা শক্তভাবে মোকাবিলা করা অপরিহার্য।
আমরা আশুরা উপলক্ষে সমগ্র মুসলিম উম্মাহ্র প্রতি, বিশেষ করে নিউজ লেটারের পাঠক-পাঠিকাদের প্রতি গভীর শোক ও সমবেদনা জানাচ্ছি।