All posts by dreamboy

বই পরিচিতি – ঐতিহাসিক সোনারগাঁ

রচনা : এ কে এম মুজ্জাম্মিল হক
সম্পাদনা : রবীন্দ্র গোপ
প্রকাশক : বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন
সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়
সোনারগাঁও, নারায়ণগঞ্জ
প্রচ্ছদ : রবীন্দ্র গোপ ও এ কে এম আজাদ সরকার
আলোকচিত্র : মোঃ শফিকুর রহমান
প্রকাশকাল : ফেব্রুয়ারি ২০১৬
মুদ্রণ : জি জি অফসেট প্রেস, ৩১/এ সৈয়দ আওলাদ হোসেন লেন
নয়াবাজার, ঢাকা-১১০০
মূল্য : ৫০০ টাকা।
স্বাধীন সুলতানী বাংলার রাজধানী ‘সোনারগাঁ’ আজ রূপকথার নগরী হলেও এর ঐতিহাসিক বাস্তবতা চিরন্তন ও অবিস্মরণীয় । এর সাথে জড়িয়ে থাকা প্রতিটি ঘটনা সত্য। কথা-কাহিনী আর কিংবদন্তির ভীর সরিয়ে মৌলিক ইতিহাসের ভেতরে প্রবেশ করলেই চকচকে স্বর্ণালি সত্যের সুবাস পাওয়া যায় যা জাতি হিসেবে আমাদের কাছে অতীব গর্বের। ঐতিহাসিক ভাবে বাংলাদেশী বাঙালি জাতি চিরদিনই স্বাধীনচেতা জাতি হিসেবে স্বগৌরবে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকতে চেয়েছে এবং যতবার আক্রমণ এসেছে ততবার প্রতিহত করার চেষ্টা করেছে। সেইসব স্বর্ণালি ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আজো দাঁড়িয়ে আছে প্রত্নতাত্ত্বিক নগরী সোনারগাঁ। বাংলার স্বাধীন সুলতান গিয়াসউদ্দিন আযম শাহ কিংবা স্বাধীনচেতা বার ভূঁইয়া নেতা বাঙালি বীর ঈশা খাঁ আমাদের ইতিহাসের অবিস্মরণীয় ও অনুপ্রেরণীয় দুই মহাবীর। সোনারগাঁ আমাদের জাতীয় ঐশ্বর্য ও গৌরবের প্রতীক। জাতি হিসেবে আমরা একদা খুব সমৃদ্ধশালী ছিলাম। ভুবনমোহিনী সুবিখ্যাত মসলিনের স্মৃতিও বহন করছে এই সোনারগাঁ। আর ছিল নৌশিল্প। বিশাল বিশাল কাঠের জাহাজ তৈরি হতো বাংলাদেশে। সোনারগাঁয়ের লোকশিল্প যাদুঘরে রয়েছে মসলিনের নিদর্শন ও নানা প্রকার নৌকা ও জাহাজের মডেল। আর রয়েছে সে আমলের শীতল পাটি, জামদানি সহ নানা দেশজ ও লোকজ নিদর্শন। গর্বের কথা যে সম্প্রতি আমাদের শীতল পাটি ও জামদানি ‘ওয়াল্ড হেরিটেজ’ বা বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
আমাদের ইতিহাসের সোনালি দিবসগুলোতে ইরান, তুরস্ক, মিশর ও চীন দেশের সাথে ছিল প্রাচীন বাংলাদেশের কূটনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও বাণিজ্য সম্পর্ক। ইবনে বতুতা, হিউয়েন সাং, বার্নিয়ার প্রমুখ দূত সোনারগাঁয়ে এসেছিলেন। ইরানের কবি হাফিজকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল সোনারগাঁয়ে আসার জন্য। আহ্বান জানিয়েছিলেন সুলতান গিয়াসউদ্দীন আযম শাহ। হাফিজ আসতে পারেন নি বটে, কিন্তু সুলতানকে সম্মান জানিয়ে পত্র পাঠিয়েছিলেন দূত মারফত। আর মিলিয়ে দিয়েছিলেন সুলতানের অসমাপ্ত কবিতা। লিখেছিলেন বাংলাদেশ সম্পর্কেও।
এই সোনারগাঁয়ে মুসলিম শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় ইসলাম প্রচার করতে আসেন নূর কুতুবুল আলম, শায়খ আনোয়ার, শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা, ইয়াহিয়া মানেরী, ইব্রাহিম দানেশমান্দ, পীর বদরউদ্দিন প্রমুখ পীর আওলিয়া সাধকপুরুষগণ। শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা (র.) এখানে গড়ে তোলেন জামেয়া বা ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়। শাসক শের শাহ নির্মাণ করেন এখানে গ্রান্ড ট্রাংক রোড। সোনারগাঁয়ের নামকরণ নিয়ে রয়েছে নানা কাহিনী। সারি সারি সোনারু গাছে ঘেরা ছিল এই সোনারগাঁ। সেজন্য এর নাম হয়েছে সুবর্ণ গ্রাম বা সোনারগাঁ। কেউ বলেন, ঈশা খাঁর বীর পত্নী সোনামনীর নাম অনুসারে এর নাম হয়েছে সোনারগাঁ। যিনি ঈশা খাঁর মৃত্যুর পরও বার ভূঁইয়াদের প্রধান হিসেবে মোঘল আক্রমণকে প্রতিহত করেছিলেন। নারায়ণগঞ্জের সোনাকু-া দুর্গে যুদ্ধে জীবন দিয়েছেন, কিন্তু বেঁচে থাকতে বাংলার স্বাধীনতা বিলুপ্ত হতে দেন নি।
সোনারগাঁয়ের নানা কাহিনী ও ইতিহাস সহ ১১৯টি ঐতিহাসিক, প্রত্নতাত্ত্বিক. সাংস্কৃতিক ও লোকজ ঐতিহ্যের নানা নিদর্শনের রঙিন ছবি ও বিবরণ যুক্ত ১৫৮ পৃষ্ঠার উক্ত আলোচ্য গ্রন্থটি একটি সমৃদ্ধ গ্রন্থ। ১২০ গ্রাম গ্লসি আর্র্ট পেপারে মুদ্রিত উক্ত গ্রন্থটি কেবল ওজনেই ভারী নয়, জ্ঞানগর্ভ তথ্যেও বেশ ওজনদার। এ কেবল ইতিহাসের কোন গ্রন্থই নয় পর্যটকদের গাইড বইও বটে। জ্ঞানপিপাসু পুস্তকপ্রেমিক মানুষ উক্ত বইটি সংগ্রহ না করে পারবেন না বলে আমাদের বিশ্বাস।
□ আমিন আল্ আসাদ

বই পরিচিতি

বাংলায় ফারসি ভাষা সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিকাশের ইতিহাস
রচনা : আবদুস সবুর খান
প্রকাশক : রিয়াজ খান
রোদেলা প্রকাশনী
রুমী মার্কেট (২য় তলা) ৬৮-৬৯, প্যারিদাস রোড
৩৫ বাংলাবাজার, ঢাকা-১১০০
প্রচ্ছদ : তারিক ফেরদৌস খান
প্রকাশকাল : আগস্ট ২০১৭
মুদ্রণ : আল কাদের অফসেট প্রিন্টার্স, ৫৭ ঋষিকেশ দাস লেন,
ঢাকা-১১০০
মূল্য : ৪০০ টাকা।

ড. আবদুস সবুর খান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান। তিনি একজন কথাশিল্পী, সুপরিচিত লেখক, গবেষক ও অনুবাদক। ১৯৯৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ও উর্দু বিভাগ থেকে ফারসি ভাষা ও সাহিত্যে এম এ প্রথম শ্রেণিতে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করার পর ইরান সরকারের বৃত্তি নিয়ে তেহরানের শিক্ষক প্রশিক্ষণ কোর্সে অংশগ্রহণ করেন এবং ২০০৩ সালে ইরানের ইমাম খোমেইনী (রহ.) আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এবং পরবর্তীকালে ২০০৬-৭ সালে তেহরানের আল্লামা তাবাতাবাই বিশ্ববিদ্যালয়ে ফারসি ভাষা ও সাহিত্যে গবেষণা কোর্স সম্পন্ন করেন। ফারসি ভাষা থেকে তিনি বেশ কিছু প্রবন্ধ নিবন্ধ অনুবাদ করেন। ইরানের বিখ্যাত কথাশিল্পী জালালে আলে আহমদের ‘নির্বাচিত ছোটগল্প’ এবং ফারসি ছোট গল্পের সংকলন ‘ইয়েকি বুদ ওয়া ইয়েকি নাবুদ’ এর বাংলা অনুবাদ ‘একদা একদিন’ এবং বাংলাদেশের জনপ্রিয় কথাশিল্পী হুমায়ুন আহমেদের ‘গৌরিপুর জংসন’-এর ফারসি অনুবাদ ‘ইস্তগাহে গৌরিপুর’ দক্ষতার সাথে অনুবাদ করেন। এছাড়া বাংলা একাডেমী থেকে ২০০৯ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর পিএইডি গবেষণার অভিসন্দর্ভ ‘আধুনিক ফারসি ছোটগল্প বিষয় বৈশিষ্ট্য, শিল্পরূপ, চিত্রিত জীবন ও সমাজ’। আর তাঁর আলোচ্য বই ‘বাংলায় ফারসি ভাষা ও সাহিত্য সংস্কৃতি বিকাশের ইতিহাস’ একটি তথ্যসমৃদ্ধ গবেষণা গ্রন্থ। এখানে তিনি বাংলা বলতে শুধু স্বাধীন বাংলাদেশকেই বোঝান নি; বরং সমগ্র বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলকে বুঝিয়েছেন। বাংলা বলতে প্রাচীন ভারতের পূর্বাঞ্চল, তুর্ক-আফগান শাহী বাংলা, স্বাধীন সুলতানী বাংলা, মোগল সুবে বাংলা, ব্রিটিশ বঙ্গ, পাকিস্তান শাসনামলে বাংলা ও সর্বশেষে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। বাংলাদেশের সীমানা সব সময় এক রকম ছিল না। এক সময় বাংলাদেশকে গৌড়, পুণ্ড্র, রাঢ়, সমতট, হরিকেল এই পাঁচভাগে বিভক্ত করা হতো। শাসনামল ও সীমানা পরিবর্তন হলেও পারস্যের সাথে বাংলাদেশের এবং ফারসি ভাষার সাথে বাংলা ভাষার সম্পর্ক সব সময়ই ছিল। বাংলা ও ফারসি উভয় ভাষাই প্রাচীন ভাষা। উভয় ভাষারই রয়েছে নিজস্ব ঐতিহ্য। ভাষার ইতিহাস ও ভাষাতাত্ত্বিকদের আলোচনা পর্যালোচনায় উঠে আসে এ ব্যাপারে নানাবিধ তথ্য। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সাথে ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের সম্পর্কের কথা বহু স্থানে বহু বার উচ্চারিত এবং সর্বজনবিদিত। বাংলা ভাষায় সাড়ে সাত হাজার ফারসি শব্দ সরাসরি আত্মস্থ হয়েছে যা আজ বাংলা ভাষার শব্দ হিসেবে চিহ্নিত। এছাড়া অনেক শব্দ এসেছে পরিবর্তিত হয়ে। বাংলার আঞ্চলিক শব্দমালায় অগণিত ফারসি শব্দের স্পর্শ লেগে আছে। বাংলাদেশে ইসলাম এসেছে অলি-আউলিয়াদের মাধ্যমে। যাঁদের ভাষা ছিল ফারসি। তাসাউফের অধিকাংশ মৌলিক গ্রন্থ ফারসি ভাষায় রচিত। এছাড়া রাজভাষা হিসেবে ফারসি বজায় ছিল পলাশীর প্রান্তরে নবাবের পরাজয়ের পরও অনেক বছর। ইংরেজরাও ইংরেজি হুট করে চাপিয়ে দিতে পারে নি। কারণ, রাজকার্যের ভূমি সংক্রান্ত, খাজনা সংক্রান্ত দলিল-দস্তাবেজও ছিল ফারসিতে। মোগল শাসকদের ইতিহাসও আমরা ফারসি ভাষাতে পাই। কাজেই ফারসি ভাষা ইরানের ভাষা হলেও ঐতিহাসিক ভাবে ও ধর্মীয় কারণে এ ভাষা ও সংস্কৃতি বাংলা ভাষা ও সাহিত্য-সংস্কৃতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যায়।
ফারসি ভাষা ও সাহিত্য এর মূল ভূখ- পারস্য বা ইরানে যেমন যুগে যুগে বিকশিত হয়েছে ঠিক তেমনি ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় কারণে সুবে বাংলা, সুলতানী বাংলা কিংবা বর্তমান সময়ের বাংলাদেশেও এর চর্চা ও বিকাশের ধারা অব্যাহত রয়েছে। ইরানের সাথে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় সম্পর্ক অতীতেও ছিল বর্তমানেও আছে এবং তা ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে। কেননা, ইরানের ইসলামি বিপ্লবের পর সেই সম্বন্ধ আরো জোরদার হয়েছে।
লেখক, গবেষক, কথাশিল্পী, অনুবাদক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান, অধ্যাপক ড. আবদুস সবুর খানের উক্ত গবেষণা গ্রন্থটিতে বাংলাদেশে ফারসিচর্চা ও সংস্কৃতি বিকাশের ইতিহাসের চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। সুদূর অতীত থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত সকল কর্মকা- প্রচেষ্টাসমূহের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের ফারসিচর্চা, ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের নানা কর্মসূচি, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিকাশের নানা কর্মশালা, ক্লাস-সেমিনার ইত্যাদির কথাও তুলে ধরা হয়েছে। তবে বইটিতে মাদ্রাসাসমূহের ফারসিচর্চা প্রসঙ্গেও বলা হয়েছে।
বইটি বাংলা ও ফারসি সাহিত্য গবেষকদের, ফারসি সাহিত্যানুরাগীদের কাজে লাগবে। ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের ছাত্র-ছাত্রীদের সহায়ক গ্রন্থ হিসেবেও পাঠযোগ্য বলে বিবেচিত হতে পারে। বইটির প্রচ্ছদ চমৎকার এবং মুদ্রণও ভালো। আমরা উক্ত গ্রন্থটির ব্যাপক পঠন ও পর্যালোচনার আহ্বান জানাচ্ছি।

□ আমিন আল আসাদ

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে প্রেসিডেন্ট রুহানি

নবাগত দুর্বৃত্তরা পারমাণবিক চুক্তি নস্যাৎ করলে বিশ্বের একটি বিরাট সুযোগ হাতছাড়া হবে
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রেসিডেন্ট হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমীন ড. হাসান রুহানি সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন যে, নবাগত দুর্বৃত্তরা যদি ইরানের পারমাণবিক প্রকল্পবিষয়ক চুক্তিকে নস্যাৎ করে দেয় তাহলে বিশ্বের কাছ থেকে একটি বিরাট সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাবে। তিনি গত ২০শে সেপ্টেম্বর (২০১৭) নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দফতরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বিশ্বের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানগণ এবং শীর্ষস্থানীয় সরকারি ব্যক্তিত্ববর্গ ও কূটনীতিকদের সামনে প্রদত্ত ভাষণে এ সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন। তিনি বিশ্ববাসীকে আশ্বস্ত করেন যে, ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান কখনোই এ চুক্তি লঙ্ঘনকারী প্রথম দেশ হবে না।
প্রেসিডেন্ট রুহানির ভাষণের পূর্ণ বিবরণ নিম্নে প্রদত্ত হলো ঃ
বিসমিল্লাহির রাহ্মানির রাহীম
মাননীয় সভাপতি,
মাননীয় মহাসচিব,
মহামান্যবর্গ,
ভদ্র মহিলাগণ ও ভদ্র মহোদয়গণ!
আমি আমার ভাষণের শুরুতেই জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অত্র অধিবেশনের সভাপতিকে তাঁর এ পদে নির্বাচিত হবার জন্য অভিনন্দন জানাচ্ছি। একই সাথে আমি মহাসচিব মি. গুটেরেস্কে জাতিসংঘের সর্বোচ্চ পদে নির্বাচিত হওয়ার জন্য অভিনন্দন জানাচ্ছি এবং তাঁর ওপরে যে গুরুদায়িত্ব অর্পিত হয়েছে তা পালনের ক্ষেত্রে সর্বাঙ্গীণ সাফল্য কামরা করছি।
চার মাস আগে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের দ্বাদশ প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে চার কোটি দশ লাখ ইরানি অর্থাৎ শতকরা ৭৩ ভাগ ভোটার অংশগ্রহণ করেন এবং তাঁরা নির্বাচনী বুথে হাযির হয়ে আমার ভারসাম্যপূর্ণ কর্মসূচি, মানবাধিকার ও নাগরিক অধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শনকারী অভ্যন্তরীণ নীতি, আন্তঃক্রিয়া সৃষ্টিকারী পররাষ্ট্রনীতি ও অর্থনৈতিক বিবর্তনের ক্ষেত্রে অগ্রগতির প্রতি পুনরায় আস্থা ব্যক্ত করেন। তাঁদের এ রায় হচ্ছে এমন একটি সমাজের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিপক্বতার ফসল যা মাত্র চার দশক হলো জনগণের শাসনের রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং মুক্তি ও স্বাধীনতার অভিজ্ঞতার অধিকারী হয়েছে। বস্তুত এ নির্বাচন কেবল একজন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নয়; বরং এ হচ্ছে এমন একটি জনগণের পক্ষ থেকে বিরাট রাজনৈতিক পুঁজি বিনিয়োগ যারা ইসলামি প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার সবচেয়ে বড় পৃষ্ঠপোষক হিসেবে পরিগণিত হয়ে থাকেন।
বিগত দেড় শতাধিক বছর ধরে, বিশেষ করে ১৯৭৯ সালে সংঘটিত ইসলামি বিপ্লবে ইসলাম ও সুবিচারের দাবির পাশাপাশি মানবাধিকার ও নাগরিক অধিকারের দাবি ইরানি জনগণের গুরুত্বপূর্ণ দাবিসমূহের অন্যতম। আমার সরকার পূর্ববর্তী মেয়াদে বৈদেশিক অঙ্গনে পারমাণবিক আলোচনায় উন্নতির পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে নাগরিক অধিকার সুবিন্যস্ত করার চেষ্টা চালায় এবং এরই ধারাবাহিকতায় ‘নাগরিক অধিকারের ঘোষণাপত্র’ ঘোষণা করে ও তা কার্যকর করার জন্য জারি করে। তৎকালীন স্বৈরাচারী ও ডিক্টেটরী সরকারগুলোর বিরুদ্ধে এবং মানুষের সমুন্নত মর্যাদা ও সম্মান আদায় করা ও স্বীয় অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে এখন থেকে ১১১ বছর পূর্বে যে সাংবিধানিক বিপ্লব (মাশ্রূত্বাহ্) সংঘটিত হয় এবং এখন থেকে প্রায় ৩৯ বছর আগে যে ইসলামি বিপ্লব সংঘটিত হয় তাতে ইরানি জনগণের যেসব দাবি-দাওয়া ও আশা-আকাক্সক্ষা ছিল তারই পথ ধরে এ ঘোষণাপত্র বাস্তবায়িত হয়।
ভদ্র মহিলাগণ ও ভদ্র মহোদয়গণ!
বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এ আন্তর্জাতিক সমাবেশে আমি সুউচ্চ কণ্ঠে ঘোষণা করছি যে, মহান ইরানি জাতির মানসিকতা ও চলার পথ হচ্ছে ভারসাম্যপূর্ণ মধ্যম পন্থা। আর ভারসাম্য ও মধ্যম পন্থার মানে না একঘরে হয়ে থাকা, না আধিপত্যকামিতা, তেমনি না উদাসীনতা, না উগ্রতা।
০ ভারসাম্যের পথ হচ্ছে শান্তির পথ; কিন্তু সুবিচারপূর্ণ ও সামগ্রিক শান্তি, এমন শান্তি নয় যা হবে এক জাতির জন্য শান্তি, আর অপর এক জাতির জন্য যুদ্ধ ও সংঘাত।
০ ভারসাম্য মানে মুক্তি, স্বাধীনতা ও জনগণের শাসন, কিন্তু তা হতে হবে সামগ্রিক ও সর্বাত্মক, এমন নয় যে, এক দেশে বাহ্যত মুক্তি ও স্বাধীনতাকে সমর্থন করা হবে, অথচ আরেক দেশে ডিক্টেটরী শাসনের পৃষ্ঠপোষকতা করা হবে।
০ ভারসাম্য মানে পারস্পরিক চিন্তাসমূহের বিস্তার সাধন, তলোয়ারের ঝনঝনানি নয়।
০ সর্বোপরি, ভারসাম্যের পথ হচ্ছে সৌন্দর্য সৃষ্টিকারী; যে মারণাস্ত্র রফতানি করা হয় তা সুন্দর নয়। শান্তি সুন্দর, যুলুমমূলক বয়কট সুন্দর নয়; সুবিচার সুন্দর।
আমাদের আবেদন শান্তিকামী এবং জাতিসমূহের অধিকারের প্রতি সমর্থন। আমরা যুলুমকে পছন্দ করি না এবং আমরা মযলূমের প্রতিরক্ষা ও সমর্থন করি। আমরা হুমকি দেই না এবং কারো পক্ষ থেকে ও কোনো শক্তির পক্ষ থেকে দেয়া হুমকি মেনে নেই না। আমাদের ভাষা হচ্ছে সম্মান প্রদর্শনের ভাষা এবং আমরা হুমকির ভাষায় বিচলিত হই না। আমরা আলাচনা ও সংলাপের সমর্থক, কিন্তু তা হতে হবে সমান-সমান ও পারস্পরিক সম্মানের অবস্থান থেকে এবং তার আবেদন হবে উভয় পক্ষেরই অর্জন (উইন-উইন)-এর আবেদন।
আজকের দুনিয়ায় দেশসমূহের শান্তি, নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা ও অগ্রগতি পরস্পর অবিচ্ছেদ্যভাবে সংযুক্ত হয়ে আছে। তাই এটা হতে পারে না যে, ফিলিস্তিনের জনগণ একটি দুর্বৃত্ত ও বর্ণবাদী সরকার কর্তৃক ন্যূনতম মানবাধিকার থেকেও বঞ্চিত হবে অথচ সেই ভূখ-টি জবরদখলকারী সরকার নিরাপদ থাকবে। তেমনি এ-ও হতে পারে না যে, ইয়েমেন, সিরিয়া, ইরাক, বাহরাইন, আফগানিস্তান, মিয়ানমার ও অন্যান্য অঞ্চলের মুসলমানরা দারিদ্র্য, যুদ্ধ ও সংঘাতের মধ্যে জীবন যাপন করবে, অথচ কিছুসংখ্যক লোক মনে করবে যে, তারা তাদের নিজ নিজ দেশে নিরাপত্তা, কল্যাণ ও উন্নয়নের অধিকারী হবে।
মাননীয় সভাপতি!
ইরান অতীত কাল থেকেই ধর্মসমূহের ও জাতিগত জনগোষ্ঠীসমূহের সহাবস্থানের পতাকাবাহী। আমরা হচ্ছি সেই জাতি যারা ইহুদিদেরকে বাবেলীদের বন্দিত্বের কষ্ট থেকে মুক্তি দিয়েছি, আর্মেনীয় খ্রিস্টানদেরকে প্রশস্ত হৃদয়ে বুকে টেনে নিয়ে নিজেদের মধ্যে স্থান দিয়েছি এবং নিজেদের মধ্যে একটি ‘সাংস্কৃতিক মহাদেশ’ গড়ে তোলার আর বিভিন্ন জাতিগত জনগোষ্ঠী ও বিভিন্ন ধর্মকে নিজেদের মধ্যে স্থান দেয়ার এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছি। এ হচ্ছে সেই ইরান যে সব সময়ই মযলূমদের পাশে দাঁড়িয়েছেÑ বহু শতাব্দী আগে ইহুদিদের অধিকারের প্রতিরক্ষা করেছিল এবং আজ ফিলিস্তিনিদের অধিকারের প্রতিরক্ষা করছে। এ ইরান হচ্ছে সেই সত্যপন্থী এবং শান্তি ও স্থিতিশীলতাকামী ইরান।
আমরা আজ মধ্যপ্রাচ্যের বুকে সন্ত্রাসবাদবিরোধী ও ধর্মীয় চরমপন্থাবিরোধী সংগ্রামের প্রথম কাতারে অবস্থান করছি। আর আমাদের এ অবস্থান কোনোরূপ র্ফিক্বাগত বা জাতিগত অবস্থান নয়; বরং আমাদের এ অবস্থান হচ্ছে মানবিক ও নৈতিক অবস্থান।
ইরান না তার ঐতিহাসিক সাম্রাজ্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে চায়, না তার রাষ্ট্রীয় মাযহাবকে প্রতিষ্ঠা করতে চায়, না স্বীয় বিপ্লবকে বর্শার ডগার শক্তির মাধ্যমে রফতানি করতে চায়। আমরা আমাদের সংস্কৃতির দৃঢ়তায়, আমাদের ধর্মের সত্যতায় ও আমাদের বিপ্লবের মৌলিকত্বে এতখানি আস্থা পোষণ করি যে, আমরা কখনোই তা নব্য উপনিবেশবাদীদের উদ্দেশ্য হাসিলের পন্থার অনুসরণে সৈন্যদের হেলমেটের মধ্যে লুকিয়ে রফতানি করতে চাই না। আমরা আমাদের সংস্কৃতি, সভ্যতা, ধর্ম ও বিপ্লব প্রবর্তনের জন্য অন্তরসমূহে প্রবেশ করি এবং বিচারবুদ্ধির কাছে আবেদন করি। আমরা কবিতা আবৃত্তি করি এবং অকাট্য জ্ঞানসহকারে কথা বলি। আমাদের রাষ্ট্রদূতগণ হচ্ছেন আমাদের কবিগণ, আধ্যাত্মিক ব্যক্তিবর্গ ও দার্শনিকগণ। আমরা মাওলানা রূমীকে নিয়ে আটলান্টিক মহাসাগরের ওপার পর্যন্ত পাড়ি দিয়েছি। আমরা সা‘দীকে নিয়ে এশিয়ার গভীরে প্রবেশ করেছি। আমরা হাফেযকে নিয়ে বিশ্বকে জয় করেছি। অতএব, আমাদের জন্য নতুন বিজয়ের আর কী প্রয়োজন আছে?
মান্যবরগণ!
এখানে ভারসাম্য ও মধ্যম পন্থার আহ্বান এমন একটি জাতির পক্ষ থেকে উচ্চারিত হচ্ছে যে জাতিটি কেবল এর ঘোষণার মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখে নি; বরং কাজেও তা মেনে চলছে। ইরানের পারমাণবিক প্রকল্প সম্পর্কিত যৌথ সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা (জেসিপিওএ) আমাদের এ দাবির সত্যতার সর্বোত্তম নিদর্শন।
যৌথ সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা হচ্ছে দুই বছরব্যাপী সংক্ষিপ্ত আলোচনার ফলÑ যা জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ কর্তৃক অনুমোদিত ও বৈশ্বিক সমাজ কর্তৃক সমর্থিত হয়েছে এবং নিরাপত্তা পরিষদের ২২৩১ নং সিদ্ধান্তের অঙ্গীভূত হয়েছে। তাই যৌথ সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা কোনো একটি বা দু’টি দেশের নিজস্ব বিষয় নয়; বরং এটি হচ্ছে নিরাপত্তা পরিষদের একটি দলিল এবং তা সমগ্র আন্তর্জাতিক সমাজের সম্পদ।
জেসিপিওএ মানে নতুন বৈশ্বিক সম্পর্কে এক নতুন আন্তঃক্রিয়াÑ যে আন্তঃক্রিয়া আমাদের ও বৈশ্বিক সমাজের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক অংশীদারিত্ব ও গঠনমূলক কর্মকা-ের ওপর ভিত্তিশীল। আমরা আন্তঃক্রিয়া ও সহযোগিতার দরজাসমূহ উন্মুক্ত করে দিয়েছি; আমরা প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের উন্নত দেশসমূহের সাথে ডজন ডজন উন্নয়ন চুক্তি স্বাক্ষর করেছি। কিন্তু দুঃখজনকভাবে কোনো কোনো সরকার নিজেদেরকে এ নতুন সম্ভাবনার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করেছে। বস্তুত তারা নিজেদেরকে বয়কট করারই পদক্ষেপ নিয়েছে, আর প্রতারণা করতে পেরেছে বলে মনে করার পর এখন তারা মনে করছে যে, তারা নিজেরাই প্রতারিত হয়েছে, অথচ প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে এই যে, আমরা না প্রতারিত হয়েছি, না কাউকে প্রতারিত করেছি। আমরা আমাদের পারমণবিক কর্মসূচির স্তর নিজেরাই নির্ধারণ করেছি। আমরা পারমাণবিক অস্ত্রের সাহায্যে নয়; বরং জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাহায্যে ও আমাদের মহান জাতির প্রতিরোধ শক্তির সাহায্যে পারমাণবিক হামলানিরোধক শক্তির অধিকারী হয়েছি। এটাই হচ্ছে আমাদের সূক্ষ্ম নীতি ও কর্মকৌশল।
তারা চেয়েছিল যে, ইরান যে পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী ছিল না তা-ই তার কাছ থেকে কেড়ে নেবে। অবশ্য যে জিনিস আমাদের হাতে কখনো ছিল না এবং আমরা কখনো যার দাবিদারও ছিলাম না আমাদের কাছ থেকে তা কেড়ে নেয়াকে আমরা পরোয়া করি না। কিন্তু এটা কখনোই মেনে নেয়া চলে না যে, ফিলিস্তিন-গ্রাসী যায়নবাদী সরকার পারমাণবিক অস্ত্রের সাহায্যে মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলকে ও বিশ্বকে হুমকির সম্মুখীন করবে এবং কোনো রকমের আন্তর্জাতিক বিধি-বিধান মেনে চলবে না ও কোনো ধরনের আন্তর্জাতিক নযরদারিকে গ্রহণ করবে না, অথচ শান্তিকামী জাতিসমূহকে উপদেশ দেবে।
ভদ্র মহিলাগণ ও ভদ্র্র মহোদয়গণ!
কেবল এক মুহূর্তের জন্য ভেবে দেখুন, যৌথ সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা (জেসিপিওএ) না থাকলে মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে কী পরিস্থিতির উদ্ভব হতো। আপনারা চিন্তা করে দেখুন, পশ্চিম এশিয়ায় গৃহযুদ্ধসমূহ, তাকফিরি সন্ত্রাসবাদ, মানবিক সঙ্কটসমূহ এবং জটিল রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতির পাশাপাশি এ অঞ্চলে যদি কৃত্রিম পারমাণবিক সঙ্কটও বিরাজ করতো তাহলে অবস্থাটা কী দাঁড়াতো?
আমি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করছি যে, ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান যৌথ সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা লঙ্ঘনকারী প্রথম দেশ হবে না, কিন্তু এটি লঙ্ঘিত হলে যথাযথ ও দৃঢ় প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করবে। ‘রাজনৈতিক অঙ্গনের দুবর্ৃৃত্তদের’ দ্বারা যদি এ সমঝোতা নস্যাৎ হয়ে যায় তাহলে তা হবে খুবই দুঃখজনক ব্যাপার এবং এর ফলে বিশ্ব একটি বিরাট সুযোগ হাতছাড়া করবে। কিন্তু এ ধরনের পদক্ষেপ কোনোদিনই ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানকে তার উন্নয়ন ও অগ্রগতির সমুন্নত পথ থেকে ফিরিয়ে রাখতে পারবে না।
আমেরিকার নতুন সরকার চুক্তি ভঙ্গ করে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গীকারসমূহ লঙ্ঘন করে তাহলে কেবল স্বীয় বৈশ্বিক গ্রহণযোগ্যতাকেই বিনষ্ট করবে এবং ভবিষ্যতে যে কোনো ধরনের আলোচনা ও অঙ্গীকারের ক্ষেত্রে সরকারসমূহের ও জাতিসমূহের আস্থা হারিয়ে ফেলবে।
ভদ্র মহিলাগণ ও ভদ্র মহোদয়গণ!
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান হচ্ছে সহিংসতা ও চরমপন্থী নীতির বিরুদ্ধে মোকাবিলার লক্ষ্যে বৈশ্বিক ঐক্যের উদ্ভাবক এবং উভয় পক্ষের অর্জন (উইন-উন্) নীতির ভিত্তিতে সংলাপ ও আলোচনাকে বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক সঙ্কটসমূহের সমাধানের একমাত্র পন্থা বলে মনে করে। আমরা প্রতিবেশী ও আঞ্চলিক দেশসমূহের সাথে বন্ধনকে গভীরতরকরণ ও বন্ধু দেশসমূহের সাথে সহযোগিতার স্তর বৃদ্ধিকরণকে সচেতনভাবে বেছে নিয়েছি। আর সরকারসমূহ ও জাতিসমূহের পক্ষ থেকে পারস্পরিক যোগাযোগ ও সহমর্মিতা বৃদ্ধিকরণ এবং সংলাপকে প্রতিষ্ঠানিক রূপ প্রদান করা ব্যতীত চলমান যুগের বিপজ্জনক হুমকিসমূহ ও জটিল বিবর্তনসমূহকে অতিক্রম করা কিছুতেই সম্ভব নয়।
গতকাল এ সম্মানিত সমাবেশে ইরানি জাতির বিরুদ্ধে আমেরিকার প্রেসিডেন্টের মুখ থেকে মূর্খতাসুলভ, নোংরা, শত্রুতামূলক এবং ভুল তথ্যাদি ও বিভিন্ন ভিত্তিহীন অভিযোগে পূর্ণ বাগাড়ম্বর শোনা গিয়েছে। এ ধরনের বক্তব্য যে জাতিসংঘের মর্যাদার জন্য মানানসই ছিল না শুধু তা-ই নয়; বরং তা এ অধিবেশনের কাছে জাতিসমূহের আজকের প্রত্যাশার অর্থাৎ যুদ্ধ ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে জাতিসমূহের ঐক্যের প্রত্যাশার সাথে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক।
আমি এ অধিবেশনে ঘোষণা করছি যে, মিসাইল সক্ষমতাসহ ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের গোটা প্রতিরক্ষা সামর্থ্যরে একমাত্র লক্ষ্য প্রতিরক্ষামূলক ও নিরোধমূলক এবং তা মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতার হেফাযতের ও অদূরদর্শিতামূলক অভিযাত্রিকতা প্রতিহত করার লক্ষ্যে নিবেদিত। আট বছরব্যাপী চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধকালে আমাদের শহরসমূহের জনগণ সাদ্দাম সরকারের দূর পাল্লার মিসাইলের হামলার শিকার হয়েছিল; তাই আমরা আর কখনোই কাউকে ধ্বংসাত্মক আধিপত্যলিপ্সার পুনরাবৃত্তি করার সুযোগ দেব না।
আমাদের অঞ্চলে এ অঞ্চলের বাইরের শক্তিসমূহের সামরিক হস্তক্ষেপ এ অঞ্চলে স্থিতিহীনতা ও সহিংসতাকেই তীব্রতর করবে। আর এরা হচ্ছে সেই সব শক্তি যারা এখন আরো বেশি হস্তক্ষেপের ও মারণাস্ত্র বিক্রির লক্ষ্যে ইরানকে নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টির মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত করছে। আমি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করছি, মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে বৈদেশিক হস্তক্ষেপ ও বাইরের শক্তিগুলোর দ্বারা এ অঞ্চলের জনগণের জন্য দায়িত্ব-কর্তব্য নির্ধারণ করে দেয়ার ফল সঙ্কটের স্থায়িত্ব ও বিস্তার ব্যতীত আর কিছুই হবে না। সামরিক সমাধান সিরিয়া, ইয়েমেন ও বাহরাইনের সঙ্কটের সমাধান নয়; বরং কেবল সহিংসতা বন্ধ করা এবং জনগণের রায় ও মতামত মেনে নেয়ার মাধ্যমে এসব সঙ্কটের অবসান হওয়া সম্ভব।
আমেরিকার সরকারের তার নিজ দেশের জনগণের সামনে কৈফিয়ত দেয়া উচিত যে, কেন আমেরিকান জাতির ও মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের জাতিসমূহের সম্পদ থেকে হাজার হাজার কোটি ডলার স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তায় সহায়তা করার পরিবর্তে মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে ও বিশ্বে হত্যা, দারিদ্র্য সৃষ্টি ও ধ্বংসের কাজে এবং সন্ত্রাসবাদ ও চরমপন্থী নীতির বিস্তারে ব্যয়িত হচ্ছে?
ভদ্র মহিলাগণ ও ভদ্র মহোদয়গণ!
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের বিগত চার বছরের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি অত্যন্ত চমৎকারভাবে প্রমাণ করেছে যে, ইরানের অর্থনীতি বিকাশ ও প্রসারের বিরাট সম্ভাবনার অধিকারীÑ যার নযির খুবই বিরল।
ইরানের বিরুদ্ধে আরোপিত অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা যে ইরানের গতিরোধ করতে সক্ষম হয় নিÑ শুধু তা-ই নয়; বরং জাতীয় উৎপাদনকে শক্তিশালী করার জাতীয় প্রতিজ্ঞাকে দৃঢ়তর করেছে। গত বছর ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের অর্থনীতি বৈশ্বিক অঙ্গনে সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধির অধিকারী হয়Ñ যা থেকে সুস্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে, আগামী বিশ বছরে ইরানের অর্থনীতি এক লক্ষ কোটি ডলার প্রবৃদ্ধি সামর্থ্যরে অধিকারী হবে এবং বিশ্বের বুকে সর্বাধিক আশা সঞ্চারকারী নব উদ্ভাসিত অর্থনীতি হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করতে সক্ষম হবে। এ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে আমরা যে নীতি অনুসরণ করছি তার প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে দৃঢ়তা, ভারসাম্য ও বিশ্বের সাথে ব্যাপকভিত্তিক আন্তঃক্রিয়া। আমাদের বিশ্বাস এই যে, উন্নয়ন ও নিরাপত্তা একই সাথে বৃদ্ধি পেতে থাকবে এবং যৌথ স্বার্থ মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের ও বিশ্বের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সক্ষম হবে।
বিশ্বের সর্বাধিক পরিমাণ গ্যাস সম্পদের ও প্রচুর পরিমাণ তেল সম্পদের অধিকারী ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান এক দীর্ঘমেয়াদী সহযোগিতার মাধ্যমে বিশ্বের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে সাহায্য করবে এবং সামুদ্রিক, রেল ও সড়ক পরিবহনের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গড়ে তোলার লক্ষ্যে যৌথ পুঁজি বিনিয়োগ আন্তর্জাতিক ট্রানজিটের করিডোরসমূহের ক্ষমতা বৃদ্ধি করবে। গ্যাস লাইন, বিদ্যুৎ লাইন, রেল ও সড়ক যোগাযোগের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক অবকাঠামোসমূহকে শক্তিশালী করা হলে তার ফলে উৎপাদন ব্যয় হ্রাস পাবে এবং বিভিন্ন ধরনের শিল্প প্রকল্পসমূহের জন্য প্রয়োজনীয় পণ্য সংগ্রহের লক্ষ্যে ইরানের বিশাল বাজারে ও মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের বিরাট বিরাট বাজারে উপস্থিত হওয়া সহজতর হয়ে যাবে। আইনগত দিক থেকে যথাযথ পরিবেশ তৈরি হওয়ার ফলে বর্তমানে বিভিন্ন বিদেশি পুঁজি বিনিয়োগকারী প্রতিনিধিদল ইরানমুখী হয়েছেন এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে যৌথ পুঁজি বিনিয়োগ ও আর্থিক সরবরাহের লক্ষ্যে ক্রমবর্ধমান হারে বিরাট বিরাট চুক্তি সম্পাদন করছেন।
ইরানে সরকারের নীতি হচ্ছে ব্যবসায়ের জন্য পরিবেশের অনবরত উন্নয়ন, বুদ্ধিবৃত্তিক ও চৈন্তিক সম্পদের মালিকানাকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান, প্রশাসনিক বাধ্যবাধকতার অনবরত সংশোধন ও মানি লন্ডারিং কঠোরভাবে মোকাবিলাকরণ। এর ফলে বিজ্ঞানভিত্তিক উৎপাদনে কর্মতৎপর কোম্পানিসমূহে এবং বিভিন্ন কারিগরি, প্রযুক্তিগত ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পুঁজি বিনেয়োগের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ দিনের পর দিন অধিকতর বেশি পরিমাণে নিশ্চিত হচ্ছে।
ইরানি জাতি পরিপূর্ণ মুক্ত, স্বাধীন, স্বনির্ভর ও উন্নততর ইরান গড়ে তোলার জন্য দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ এবং নৈতিকতা ও আন্তর্জাতিক অধিকারসমূহের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের ভিত্তিতে শান্তি ও নিরাপত্তাপূর্ণ মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চল গড়ে তোলার কাজে অংশীদারিত্বে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এ কারণেই ইরানি জাতি বিশ্বের সকল পুঁজি বিনিয়োগকারীকে এবং জ্ঞানী-বিজ্ঞানী ও আবিষ্কারক-উদ্ভাবকের অংশীদারিত্ব ও সহযোগিতাকে স্বাগত জানায়। যারা জাতিসমূহের পারস্পরিক অংশীদারিত্ব ও সহযোগিতার ছায়াতলে শান্তি, নিরাপত্তা ও উন্নয়ন-অগ্রগতির সন্ধান করছেন আমি এই বৈশ্বিক মঞ্চে ইরানের অতিথিপরায়ণ জনগণের মুখপাত্র হিসেবে এ জাতির পক্ষ থেকে তাঁদের সকলকে ইরান সফরের ও এ আশাব্যঞ্জক আগামী দিনে অংশীদার হওয়ার জন্য দাওআত করছি।
ভদ্র মহিলাগণ ও ভদ্র মহোদয়গণ!
চার বছর আগে আমি জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে সহিংসতা থেকে মুক্ত হয়ে চরম পন্থা, চাপিয়ে দেয়া সংলাপ, একদেশদর্শিতা এবং মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের আতঙ্ক সৃষ্টি ও যুদ্ধের স্থলে সংলাপ, সহযোগিতা ও শান্তি প্রতিস্থাপিত করে মুক্ত বিশ্ব গঠনে সক্ষম হব বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলাম, সে আশাবাদকে আমরা সিদ্ধান্তে পরিণত করতে পারিÑ যাতে ভারসাম্য ও মধ্যম পন্থার ধ্বনি বৈশ্বিক অঙ্গনে সর্বপ্রধান ও বিজয়ী ধ্বনিতে পরিণত হয়।
আপনাদের সকলকে ধন্যবাদ।
ফারসি থেকে অনুবাদ : নূর হোসেন মজিদী

সারাদেশে পবিত্র আশুরা পালিত

গত ১ অক্টোবর ২০১৭ সারাদেশে ভাবগম্ভীর পরিবেশে ও যথাযোগ্য মর্যাদায় পবিত্র আশুরা পালিত হয়েছে। পবিত্র আশুরা উপলক্ষে বাণী প্রদান করেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদ। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও পৃথক বাণী দিয়েছেন। এসব বাণীতে তাঁরা দিবসটির গুরুত্ব ও তাৎপর্য তুলে ধরে বলেন, সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় কারবালায় শহীদদের এই আত্মত্যাগ মুসলিম উম্মাহর জন্য এক উজ্জ্বল ও অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।
আশুরা উপলক্ষে প্রদত্ত বাণীতে রাষ্ট্রপতি মোঃ আব্দুল হামিদ বলেন, ইসলামের আদর্শকে সমুন্নত রাখার জন্য হযরত ইমাম হোসাইন (রা.) ও তাঁর ঘনিষ্ঠ সহচররা যে আত্মত্যাগ করেছেন, তা ইতিহাসে সমুজ্জ্বল হয়ে আছে। কারবালার শোকাবহ ঘটনার স্মৃতিতে ভাস্বর পবিত্র আশুরার শাশ্বত বাণী আমাদের অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে উদ্বুদ্ধ করে।
অপর এক বাণীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, পবিত্র আশুরা মানব ইতিহাসে একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিন। সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য হযরত ইমাম হোসাইন (রা.) এবং তাঁর পরিবারবর্গ যে আত্মত্যাগ করেছেন, মুসলিম উম্মাহর জন্য তা অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। বাণীতে প্রধানমন্ত্রী সব অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো এবং সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় আশুরার মহান শিক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে সবার প্রতি আহ্বান জানান।
বিভিন্ন মসজিদ, মাদরাসা, সংগঠন ও খানকা আহলে বাইতে রাসূল (সা.) স্মরণে আলোচনা ও শোকসভার আয়োজন করে। আলোচনা সভায় বক্তাগণ আশুরার ত্যাগের শিক্ষা রাষ্ট্র, সমাজ ও ব্যক্তি জীবনে অনুসরণ করার আহ্বান জানান।
পবিত্র আশুরা উপলক্ষে ৩০ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে এক ওয়াজ মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। ‘আশুরার তাৎপর্য ও শিক্ষা’ শীর্ষক এই মাহফিলের আয়োজন করে ইসলামিক ফাউন্ডেশন। এতে সভাপতিত্ব করেন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের দ্বীনি দাওয়াত ও সংস্কৃতি বিভাগরে পরিচালক মোঃ মোজাহারুল মান্নান। চট্টগ্রামে আহলে বায়তে রাসূল (দ.) স্মরণে জমিয়াতুল ফালাহ মসজিদে ১০ দিনব্যাপী শাহাদাতে কারবালা মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়।
দেশের বিভিন্ন স্থানে শোক র‌্যালি ও মিছিল বের করা হয়। রেডিও ও টিভি চ্যানেলগুলোতে মুহররম উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়। সংবাদপত্রগুলো বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে।

‘আশুরার বার্তা বহনে কবিদের ভুমিকা’ শীর্ষক আলোচনা ও কবিতা পাঠ অনুষ্ঠিত
‘ন্যায় প্রতিষ্ঠায় কবিতা একটি শক্তিশালী মাধ্যম। আদর্শ বিকাশে শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির গুরুত্ব অপরিসীম’Ñ ইরানি রাষ্ট্রদূত
মহান আশুরা উপলক্ষে শোহাদায়ে কারবালা স্মরণে কবিতা পাঠ ও আলোচনা অনুষ্ঠানে ঢাকায় নিযুক্ত ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের রাষ্ট্রদূত জনাব আব্বাস ভায়েজী দেহনাভী বলেন, ‘ন্যায় প্রতিষ্ঠায় কবিতা একটি শক্তিশালী মাধ্যম। আর আদর্শ বিকাশে শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির গুরুত্ব অপরিসীম।’ প্রবীণ সাংবাদিক ও কবি এরশাদ মজুমদারের সভাপতিত্বে জাতীয় কবিতা মঞ্চ ও ঢাকাস্থ ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের যৌথ উদ্যোগে ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র মিলনায়তনে ‘আশুরার বার্তা বহনে কবিদের ভূমিকা’ শীর্ষক এক আলোচনা সভা ও কবিতা পাঠের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে ইরানি রাষ্ট্রদূত এ কথা বলেন। গত ০৬ অক্টোবর, ২০১৭ সকালে জাতীয় কবিতা মঞ্চের সভাপতি কবি মাহমুদুল হাসান নিজামীর সঞ্চালনায় উক্ত অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের কালচারাল কাউন্সেলর জনাব সাইয়্যেদ মূসা হোসেইনী, ব্রিগেডিয়ার (অবসরপ্রাপ্ত) নাসিমুল গণি, অধ্যাপক ডা. হাসিনা বানু, বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ কবি ড. ঈসা শাহেদী, প্রখ্যাত ছড়াকার কবি আবু সালেহ, কবি ও গবেষক আবদুল মুকীত চৌধুরী, উদিচি শিল্পী গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য আবৃত্তিকার বদরুল হাসান খান, নজরুল ইনস্টিটিউটের ডেপুটি ডিরেক্টর কবি রেজাউদ্দীন স্টালিন, ইরানি রাষ্ট্রদূতের পতœী মিসেস যেইনাব ভায়েজী দেহনাভী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. নাজিব ওয়াদুদ।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের রাষ্ট্রদূত ড. ভায়েজী আরো বলেন, মানুষ তার চিন্তা-চেতনা, আদর্শ, দর্শন ও অভিব্যক্তিকে বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশ করে থাকে। যেমন, পেইন্টিং, চলচ্চিত্র, কবিতা ইত্যাদি। যখন কোন ঘটনাকে শৈল্পিক শব্দমালায় প্রকাশ করা হয় তখন তা হয় কবিতা। কবিরা যখন ইতিহাসকে বিশ্লেষণ করেন তখন তাঁরা এর আবেগকে ধারণ করেন এবং কবিতা রচনা করেন। কবিরাই পারেন মহান ঘটনাকে ও এর তাৎপর্যকে শৈল্পিক শব্দমালা ও যথার্থ বাক্যাবলির মাধ্যমে হৃদয়ে গেঁথে দিতে। আশুরায় ইমাম হোসাইন (আ)-এর আত্মত্যাগের ঘটনাকে ন্যায় প্রতিষ্ঠার উজ্জ্বল পথরেখা সৃষ্টির উদাহরণ হিসেবে কবিরা তাঁদের কাব্যভাষার ভেতর দিয়ে ফুটিয়ে তুলতে পারেন। যখন কবিরা ইমাম হোসাইনের কথা চিন্তা করেন তখন যেন এটি সেই চৌদ্দ শত বছর আগের বিষয় মনে না করেন, এবং তাঁরা তা করেনও না। যেমন আজকের কবিতাগুলোতে নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের প্রসঙ্গ এসেছে। প্রকৃতপক্ষে কারবালার বাণীই এটা যে, অত্যাচারিতকে সাহায্য করতে হবে এবং অত্যাচারীর বিরোধীতা করতে হবে। নিজেদেরকে ভুলে যাবেন না, নিজেদের সক্ষমতাকে ভুলে যাবেন না; বরং সেই সক্ষমতা নিয়েই অত্যাচারিতের পক্ষে কথা বলতে হবে। এর কোন বিকল্প নেই।
সভাপতির ভাষণে জনাব এরশাদ মজুমদার কারবালার আত্মত্যাগকে ইতিহাসের এক করুণ ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করেন এবং অনুষ্ঠানে আগত কবি-সাহিত্যিক ও মেহমানবৃন্দকে ধন্যবাদ জানান।
জনাব সাইয়্যেদ মূসা হোসেইনী বলেন, ইমাম হোসাইন ও তাঁর সঙ্গীদের শাহাদাত এবং আশুরার হৃদয়বিদারক ঘটনা মানব ইতিহাসের অন্যতম করুণ ঘটনা। যে ঘটনার ১৪ শত বছর অতিবাহিত হলেও এই শোকাবহ স্মৃতি এখনও মানুষের অন্তরে জাগরুক রয়েছে এবং প্রতিবছর এই দিনটির গুরুত্ব মানুষের কছে আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রতি বছর কারবালার শহীদদের স্মরণ এবং অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানোর পাশাপাশি ইমাম হোসাইনের দেখানো পথ স¤পর্কে মানুষকে আরো বেশি করে অবহিত করতে বিভিন্ন অনুষ্ঠান যেমন, শোকানুষ্ঠান, শোক মিছিল, কবিতা ও মর্সিয়া পাঠ ও আলোচনার আয়োজন করা হয়। আর এসব আয়োজন কেবল মুসলমানদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় বরং অমুসলিমদের মধ্যেও কারবালার শহীদদের পথ অনুসরণ এবং জুলুম ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে একই কণ্ঠ ধ্বনিত হয়।
তিনি আরো বলেন, দীর্ঘ ইতিহাসে বিশিষ্ট কবি ও নবি পরিবার ভক্তরা কারবালায় ইমাম হোসানের বিপ্লবের লক্ষ্য ও আশুরার ঘটনা কবিতার মাধ্যমে বর্ণনা করে একে চির জাগরুক করে রাখার পাশাপাশি পরবর্তী প্রজন্মের কাছে এর বার্তা পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রেও মহান অবদান রেখে চলেছেন। এই অবদান কেবল ইরান ও আরবের আরবি ও ফারসি ভাষাভাষি ও এমনকি বাংলা, উর্দু ও হিন্দি ভাষাভাষী মুসলিম কবিদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় বরং অনেক অমুসলিম কবিও কারবালার ঘটনা ও আশুরার বার্তা পৌঁছে দিতে অনেক মূল্যবান কবিতা রচনা করেছেন। সুতরাং কবি, সাহিত্যিকরা তাদের আবেগ-অনুভূতি ও এর বিপ্লবী ও মানবিক বর্ণনা দিয়ে আশুরার ঐতিহাসিক ঘটনা জাগ্রত রাখার ক্ষেত্রে যে অবদান রেখে যাচ্ছেন তা ইতিহাসে চিরভাস্বর হয়ে থাকবে এতে কোন সন্দেহ নেই।
তিনি মাওলানা মুহাম্মদ আলী জওহর, প্রখ্যাত কবি ও দরবেশ খাজা মাইনুদ্দিন চিশতির কবিতা থেকে উদ্ধৃতি পেশ করেন এবং বলেন যে, জালিম ইয়াযিদের নৈতিক পরাজয় ঘটেছে এবং সে গণধীকৃত, নিন্দিত, লানতপ্রাপ্ত হয়েছে। পক্ষান্তরে ইমাম হোসাইন যুগযুগান্তর ধরে মানুষের হৃদয়ে নৈতিকতার আলো জ্বেলে দিয়েছেন।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাসিমুল গণি বলেন, কবিতা হলো এমন একটি বিষয় যা মানুষের চিন্তা, চেতনা ও মননকে প্রকাশ করে। কবিকে জ্ঞানী হতে হয়। ইতিহাসকে ধারণ করতে গেলে সেই বিষয় সম্পর্কে পূর্ণ ধারণা থাকতে হয়। অতীতের মহান ব্যক্তিরা কবি ছিলেন। তাঁরা কবিতার মাধ্যমে তাঁদের অভ্যন্তরীণ শক্তিকে তুলে প্রকাশ করেছেন। কবি নজরুল ছিলেন তেমনই এক ব্যক্তিত্ব। যিনি প্রকৃতপক্ষে ছিলেন মানবতার কবি। কাজী নজরুল ইসলাম ও অন্য কবিরা আশুরা ও কারবালাকে এই উপমহাদেশের মানুষের কাছে পরিচিত করিয়েছেন।
তিনি আরো বলেন, কারবালার মহান ঘটনা নিয়ে আমরা এক সময় পুঁথি পাঠ শুনতাম, রেডিও-টিভিতে অনুষ্ঠান হতো। এখন আর তেমন একটা শোনা যায় না। এটা আমাদের দৈন দশা। একটা আত্মত্যগের মহান দর্শনকে আমরা ভুলে যেতে বসেছি। এ অবস্থা থেকে আমাদেরকে বের হয়ে আসতে হবে।
ড. নাজিব বলেন, দশই মুহররমের ঘটনা অত্যন্ত হৃদয়বিদারক। আশুরা বা মুহররম বিষয়ক কবিতায় দশই মুহররমের মর্মন্তুদ ঘটনার বর্ণনা থাকবে এটাই স্বাভাবিক। তবে এর সাথে বর্তমান প্রেক্ষাপটকে সম্পৃক্ত করতে হবে। আর কেবল শোক প্রকাশ বা প্রচার নয়; বরং ইমাম হোসাইন (রা.) কেন শহীদ হলেন, কোন্ লক্ষ্য নিয়ে তিনি আন্দোলন করেছিলেন তা জানতে হবে ও সেই বাণী প্রচার করতে হবে। সেসবের সাথে আমাদের জীবনের সংশ্লিষ্টতা খুঁজে বের করে করণীয় উপস্থাপন করতে হবে। এখানেই কবিতার সার্থকতা।
ছড়াকার আবু সালেহ বলেন, ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র যে কবিতা পাঠের অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে এটি আমার জীবনের একটি স্মরণীয় ঘটনা হয়ে থাকবে। কারণ, মুহররমকে নিয়ে এধরনের কোন অনুষ্ঠানে আমি কখনই অংশগ্রহণ করি নি। তিনি কবিতাচর্চায় ইরানি দূতাবাস ও ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের সহযোগিতা অব্যাহত রাখার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, কারবালার মহাবিয়োগান্ত ঘটনায় কেবল ইমাম হোসাইন (রা.) শহীদ হন নি, হত্যা করা হয়েছে পিতৃ¯েœহকে, ন্যায়কে, সর্বোপরি আল্লাহর প্রেমকে খুন করা হয়েছে। তাই মুহররমের বিষয়টি আমাদের মাঝে নতুন করে আলোচিত হওয়া প্রয়োজন।
কবি আবদুল মুকীত চৌধুরী মুহররম বিষয়ে বাংলাদেশের কবিদের লেখনি সম্পর্কে ‘পবিত্র আশুরার চেতনা’ শিরোনামে একটি সংক্ষিপ্ত সংকলন উপস্থাপন করেন।
অনুষ্ঠানে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে কবিরা অংশ নেন। আশুরা ও মুহররমের চেতনা নিয়ে শোহাদায়ে কারবালা স্মরণে উক্ত অনুষ্ঠানটি ছিল এ সময়ের একটি যুগান্তকারী ঘটনা। কেননা, সাহিত্য সাংস্কৃতিক মহলের অভিমত যে, কারবালার ঘটনা নিয়ে জারি গান, পুঁথিপাঠ ও মর্সিয়া পাঠের অনুষ্ঠান হলেও অমর আশুরা উপলক্ষে নিবেদিত কবিতা পাঠের বিষয়টি আধুনিক বাংলা কবিতার ইতিহাসে এটিই সূচনা ও একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। এ ধারাকে অব্যহত রাখার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
অনুষ্ঠানে বক্তাদের আলোচনা ও কবিদের কবিতায় কারবালার বিয়োগান্ত ঘটনা, স্বপরিবারে ইমাম হোসাইন (আ)-এর হৃদয়বিদারক আত্মত্যাগের মহিমা, তরবারির ওপর রক্তের বিজয়ের চেতনা প্রকাশের সাথে সাথে বর্তমান সময়ে ফিলিস্তিন, ইয়েমেন, আরাকান, ইরাকসহ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে মুসলমানদের ওপর ঘটমান নির্মমতার কথা উল্লিখিত হয়।
অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠে ও আবৃত্তিতে অংশ নেন কথা সাহিত্যিক কাসেম বিন আবু বাকার, ‘নুতন মাত্রা’ সম্পাদক ড. ফজলুল হক তুহিন, কবি কে এম মাহফুজুল করিম, কবি এমরান খন্দকার, কবি আরিফ খান, ছড়াকার কবি জগলুল হায়দার, কবি আমিন আল আসাদ, কবি মামুন সরোয়ার, কবি আবদুল হাই ইদ্রিসী, কবি মৃধা নুরুন নবী নূর, কবি হিজারুল ইসলাম, ড. সালমা, এডভোকেট শামীমা আকতার শিউলি, এডভোকেট সাজেদা বানু হেলেন প্রমুখ। সভায় আরো উপস্থিত ছিলেন শিশু-কিশোর মাসিক ‘ফুলকুঁড়ি সম্পাদক কথাশিল্পী মাহবুবুল হক, নিউজলেটারের সম্পাদকম-লীর সদস্য ড. জহির উদ্দিন মাহমুদ, আল-কুদস কমিটি বাংলাদেশের সেক্রেটারি জেনারেল জনাব মোস্তফা তারেকুল হাসান প্রমুখ। এছাড়া বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আগত জাতীয় কবিতা মঞ্চের জেলা কমিটি সদস্যরা কবিতা পাঠে অংশ নেন। অনুষ্ঠানে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘মোহররম’ কবিতা থেকে নির্বাচিত অংশ আবৃত্তি করেন বিশিষ্ট আবৃত্তিকার সীমা ইসলাম, গযল পরিবেশন করেন জনাব এম এ মোন্নাফ, জনাব আবীদ আজম, শাহ নওয়াজ তাবীব, মর্সিয়া পাঠ করেন ড. সালমা এবং সংক্ষিপ্ত জারি পরিবেশন করেন মিসেস তাহেরা মোন্নাফ।

ঢাকাস্থ নাখালপাড়া ইমাম বাড়িতে শোকানুষ্ঠান
পবিত্র আশুরা উপলক্ষে গত ১-১৩ মুহররম নাখালপাড়াস্থ ইমামবাড়িতে আলোচনা ও শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়। ‘নিশ্চয়ই এ হচ্ছে হোসাইন। তার মারেফাত (পরিচিতি) অর্জন কর’Ñ মহানবী (সা.)-এর এই হাদিসের ওপর ধারাবাহিক বক্তব্য উপস্থাপন করেন হুজ্জাতুল ইসলাম আব্দুল কুদ্দুস বাদশা। তিনি বলেন, ইমাম হোসাইন (আ.) মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর নাতি ছিলেন। কিন্তু এটিই কি তাঁর পরিচয়? বরং তিনি ছিলেন ‘বেহেশতের যুবকদের সর্দার’, তিনি ছিলেন ‘নাজাতের তরী ও হেদায়াতের আলোকবর্তিকা’। ইমাম হোসাইনের শিশুকাল থেকেই মহানবী (সা.) তাঁর সাহাবীদের সামনে তাঁর প্রতি ভালবাসা প্রকাশ করেছেনÑ কখনো আচরণের মাধ্যমে, কখনো কথা বলার মাধ্যমে। ইমাম হোসাইন (আ.)-এর ভবিষ্যৎ ব্যক্তিত্বের দিক সম্পর্কে মহানবী (সা.) মুসলমানদেরকে বার বার অবহিত করেছেন। আহলে বাইতের অন্যতম সদস্য হিসেবে তাঁর যে মর্যাদা সেটার বাইরেও স্বতন্ত্রভাবে ইমাম হোসাইনের মর্যাদাকে মহানবী (সা.) মুসলমানদের সামনে প্রকাশ করেছেন। আর এভাবেই তিনি ইমাম হোসাইনের পরিচয় লাভ করতে বলেছেন। যেমন যখন রাসূলুল্লাহ (সা.) ইমাম হোসাইনকে ‘হেদায়াতের আলোকবর্তিকা’ বলেন তখন বুঝতে হবে মুসলমানরা যখন সত্য-মিথ্যা নির্ণয়ে সন্দেহে পতিত হবে তখন ইমাম হোসাইন (আ.) তাদেরকে সত্যপথ চিনিয়ে দেবেন। কিন্তু মুসলমানদের দুর্ভাগ্য যে, তারা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর বাণীর প্রতি মনোযোগী হয় নি, ইমাম হোসাইনের কালজয়ী আন্দোলনে তারা তাঁর সহযোগী হয় নি; বরং তারা ইমাম হোসাইনকে অনুসরণ না করে অবহেলা করেছিল। ইমাম হোসাইন কারবালায় মুষ্টিমেয় সঙ্গী-সাথি ও পরিবার-পরিজন নিয়ে ইয়াযীদের সেনাবাহিনীর চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধের মোকাবেলা করেন এবং শাহাদাত বরণের মাধ্যমে ইসলামকে পুনর্জীবিত করে যান।

খুলনায় আশুরা পালিত
পবিত্র মুহররম উপলক্ষে আঞ্জুমান-এ-পাঞ্জাতানী ট্রাস্টের উদ্যোগে খুলনায় ১০ দিনব্যাপী শোকসভা ও আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। এতে ধারাবাহিক আলোচনা উপস্থাপন করেন ইসলামী শিক্ষা কেন্দ্রের অধ্যক্ষ হুজ্জাতুল ইসলাম সৈয়দ ইব্রাহিম খলিল রাজাভী। সমাপনী দিনে নগরীর আলতাপোল লেনস্থ আঞ্জুমান-এ-পাঞ্জাতানী ট্রাষ্ট ইমাম বাড়ি হতে আশুরার শোক মিছিল বের করা হয়।
শোক মিছিলে অংশগ্রহণ করেন খুলনা সিটি কর্পোরেশনের মেয়র জনাব মনিরুজ্জামান মনি ও ২২ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর জনাব মাহবুব কায়সার।
শোক মিছিলপূর্ব বক্তৃতায় হুজ্জাতুল ইসলাম সৈয়দ ইব্রাহীম খলীল রাজাভী বলেন, দশ দিনব্যাপী শোক আলোচনা ও শোক মিছিলের মূল উদ্দেশ্য হলো বিশ্ববাসীকে এ বার্তা পৌঁছে দেওয়া যে, আহলে বাইতের অনুসারী মুসলমানরা জালিমদের পক্ষে নয়, তারা মজলুমদের পক্ষে।
তিনি বলেন, বিশ্বের মুসলমানরা আজ যদি মজলমুদের পক্ষে অবস্থান নিত তাহলে আইএস তথা ইসলামের নামে অন্যান্য জঙ্গি ও সন্ত্রাসী দল সৃষ্টি হতো না। তারা আজ ইসলামের নামে বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের মসজিদ ও ধর্মীয় স্থাপনায় আত্মঘাতী বোমা আক্রমণ চালিয়ে মুসলমান নারী-পুরুষ-শিশুকে নির্মমভাবে হত্যা করছে। তিনি কারবালার ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে নবী (সা.)-এর দৌহিত্র, বেহেশতের যুবকদের নেতা হযরত ইমাম হোসাইন (আ.)-এর আদর্শ বুকে ধারণ করে মজলুমদের পক্ষে অবস্থান নেওয়ার আহ্বান জানান।

বগুড়ায় আশুরা পালন

গত ১ মুহররম পবিত্র আশুরা উপলক্ষে বগুড়ার শিবগঞ্জ মোহাম্মদপুর (হরিপুর) ইমামিয়া জনকল্যাণ ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে এক আলোচনা সভা ও শোক র‌্যালির আয়োজন করা হয়। এতে আশুরার তাৎপর্য বিষয়ে বক্তব্য উপস্থাপন করেন হুজ্জাতুল ইসলাম এ কে এম আনোয়ারুল কবীর, ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আলহাজ আবু জাফর মন্ডল ও সেক্রেটারি হুজ্জাতুল ইসলাম মোহাম্মদ মোজাফফর হোসেন। অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য রাখেন জনাব মীর সিদ্দিকুর রহমান, মাওলানা আনিসুর রহমান, প্রভাষক শাহিনুর ইসলাম, মাওলানা শাহিনুর রহমান প্রমুখ।

চট্টগ্রামে আশুরা পালন

আশুরা উপলক্ষে গত ১ থেকে ১০ অক্টোবর, ২০১৭ সকালে হালিশহর হোসাইনিয়া ইমামবারগাহে প্রতি সন্ধ্যায় শোক মজলিস অনুষ্ঠিত হয়। কারবালায় আশুরা দিবসের মর্মস্পর্শী বর্ণনা তুলে ধরেন হুজ্জাতুল ইসলাম মাওলানা আমজাদ হোসাইন। মুসলিম উম্মাহকে সেই ইতিহাস মনে করিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে বরাবরের মতো এবারো শোক মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। মিছিলটি বিভিন্ন রাস্তা প্রদক্ষিণ করে সদরঘাট ইমামবারগাহে ফিরে আসে। পথসমাবেশে সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন মাওলানা আমজাদ হোসাইন। জোহরের নামাযের আগ পর্যন্ত ইমামবারগাহে নওহা চলে। আস্র এর নামাযের পর ‘নামাযে আশুরা’ ও ‘যিয়ারতে ইমাম হোসাইন’ পাঠ করা হয়। সন্ধ্যায় কারবালার শাহাদাত-পরবর্তী নবী পরিবারের নারী-শিশুদের বন্দিদশায় অবর্ণনীয় নির্যাতন ভোগের বর্ণনাসম্বলিত শোকানুষ্ঠান পালিত হয়।

যশোরে পবিত্র আশুরা পালন

পবিত্র আশুরা উপলক্ষে দানবীর হাজী মুহাম্মাদ মহ্সীন ইমামবাড়ী কার্যকরী সমন্বয় পরিষদের উদ্যোগে যশোর ঈদগাহ হতে ঐতিহাসিক মুড়লী ইমামবাড়ী পর্যন্ত শোক মিছিল বের করা হয়। মিছিলের শুরুতেই ঈদগাহ ময়দানে কারবালার শহীদদের স্মরণে যিয়ারতে আশুরা পাঠ করা হয়। মিছিল শেষে বক্তব্য রাখেন কমিটির সভাপতি মোঃ এহতেশাম-উল-আলম প্রতীক, সেক্রেটারি মোঃ সিরাজুল ইসলাম, ঐতিহাসিক ইমাম বাড়ীর পেশ ইমাম জনাব ইকবাল হুসাইন, হুজ্জাতুল ইসলাম মাওলানা মিজানুর রহমান প্রমুখ।
বক্তারা বলেন, ইমাম হোসাইন (আ.) ও তাঁর পরিবার এবং সঙ্গী-সাথিদেরকে ৬১ হিজরিতে কারবালার প্রান্তরে নিষ্ঠুর ও নির্মমভাবে হত্যা করেছিল আবু সুফিয়ানের বংশধর আমীরে মুয়াবিয়ার স্বৈরাচারী সন্তান ইয়াযীদের সেনাবাহিনী। ইয়াযীদের হুকুম ছিল ইমাম হোসাইন (আ.) যেন ইয়াযীদের হাতে বাইয়াত হন। হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র জান্নাতের যুবকদের স¤্রাট ইমাম হোসাইন (আ.) দেখলেন মদ্যপ ও দুঃশ্চরিত্র ইয়াযীদের হাতে বাইয়াত হওয়ার মানে এক লক্ষ চব্বিশ হাজার পয়গাম্বরের কষ্টার্জিত দ্বীন ইসলামকে ধ্বংসের মুখে নিক্ষেপ করা। বিশেষ করে হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর মাধ্যমে যে দ্বীন ইসলাম পূর্ণতা পেয়েছে, যে দ্বীনের উপরে মহান আল্লাহ রাযি ও খুশি হয়েছেন সেই দ্বীন ইসলাম তাগুতি শক্তি ইয়াযীদের হাতে ধ্বংস হতে চলেছে। তাই কারবালার ময়দানে ইমাম হোসাইন (আ.) এমন এক নজিরবিহীন আত্মত্যাগের সিন্ধান্ত গ্রহণ করলেন যার মাধ্যমে হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর রেখে যাওয়া দ্বীন ইসলাম আবারো নতুন করে জীবন ফিরে পেল। মহান কুরবানি (যিবহে আযীম)-এর মাধ্যম দ্বীন ইসলাম প্রকৃত রূপ ধারণ করল।
বক্তারা আরো বলেন, কারবালাতে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর এই আত্মত্যাগের কারণেই আমরা সত্য দ্বীন ইসলাম পেয়েছি। মসজিদের মিনার থেকে আমরা আজানের সুমধুর ধ্বনি শুনতে পাচ্ছি।

কুষ্টিয়ায় পবিত্র আশুরা উপলক্ষে আলোচনা সভা ও শোকানুষ্ঠান
গত ৫ অক্টোবর, ২০১৭ ইমাম আল মাহদী পাঠাগার, ফকিরাবাদ, কুষ্টিয়া ও ইমামীয়া জনকল্যাণ ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ এর যৌথ উদ্যোগে পবিত্র আশুরা উপলক্ষে আলোচনা সভা ও শোকানুষ্ঠান ইমাম আল মাহদী পাঠাগারে অনুষ্ঠিত হয়। ইমামীয়া জনকল্যাণ ফাউন্ডেশন এর সভাপতি জনাব মোঃ আবু জাফর মন্ডলের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন রাজশাহী সুগার মিলস লিঃ এর অবসরপ্রাপ্ত জি.এম. (কৃষি) জনাব মীর সিদ্দিকুর রহমান। প্রধান আলোচক ছিলেন বগুড়া আল মাহদী শিক্ষা কেন্দ্রের পরিচালক হুজ্জাতুল ইসলাম মোজাফফর হোসেন। স্বাগত বক্তব্য রাখেন ইমাম আল মাহদী পাঠাগার এর সভাপতি জনাব মোঃ আব্দুল ওয়াহেদ।
প্রধান অতিথি তাঁর বক্তৃতায় বলেন, আশুরার মূল শিক্ষা কারবালার ঘটনার সাথে জড়িয়ে আছে। জান্নাতের স¤্রাট ইমাম হোসাইন (আ.) এবং তাঁর সাথিরা কারবালায় মহান আত্মত্যাগের মাধ্যমে ইসলামের একটি নিখুঁত চিত্র অংকন করেন। তিনি কারবালার ঘটনার মাধ্যমে ইসলামের শত্রু-মিত্রের পরিচয়ও তুলে ধরেন।
প্রধান বক্তা তাঁর বক্তৃতায় পবিত্র আশুরার গুরুত্ব, তাৎপর্য ও শিক্ষার ওপর বিষদ আলোচনা রাখেন। তিনি কারবালায় মৃতপ্রায় ইসলামকে পুনর্জীবিত করার জন্য সাইয়্যেদুশ শুহাদা ইমাম হোসাইন (আ.) এবং তাঁর সাথিদের অবদানের কথা তুলে ধরেন। মহানবী (সা.) এর ওফাতের ৫০ বছরের মাথায় তাঁরই একদল বিপথগামী উম্মতের দ্বারা তাঁর পরিবারের ওপর এধরনের নৃশংস হত্যাকা-ের কারণ কী এবং কারা এর জন্য দায়ী তিনি তা ব্যাখ্যা করেন।
জনাব আবু জাফর মন্ডল তাঁর বক্তৃতায় পবিত্র আশুরায় ইমাম হোসাইনের আধ্যাত্মিক বিপ্লবের চিত্র তুলে ধরেন।

ভোলা জেলার বোরহান উদ্দিন থানায় ‘আশুরার তাৎপর্য ও দোয়া মাহফিল’ শীর্ষক আলোচনা সভা
গত ১ অক্টোবর ২০১৭ বোরহান উদ্দিন পিরগঞ্জ সংলগ্ন খানকায়ে দারুস্ সুন্নাত দাখিল মাদ্রাসায় ‘ইমাম মাহদী (আ.) একাডেমী’র উদ্যোগে হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর দৌহিত্র হযরত ইমাম হোসাইন (আ.)-এর শাহাদাত দিবস উপলক্ষে ‘আশুরার তাৎপর্য ও দোয়া মাহফিল’ শীর্ষক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে অনুষ্ঠান আরম্ভ হয়। সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাটামারার পীর সাহেব আলহাজ্জ হযরত মাওলানা মুহিবুল্লাহ। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, মাওলানা মোহাম্মদ মাসুম বিল্লাহ, সিনিয়র শিক্ষক, খানকায়ে বশিরিয়া দারুস্ সুন্নাত দাখিল মাদ্রাসা, সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন হাফেজ ওয়াহিদর রহমান। তাছাড়া বিভিন্ন গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গসহ উক্ত দাখিল ও হাফেজি মাদ্রাসার শিক্ষার্থিগণ উপস্থিত ছিলেন।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে আলহাজ্জ হযরত মাওলানা মুহিবুল্লাহ বলেন, আমাদের প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর অত্যন্ত প্রিয় দৌহিত্র, বেহেস্তের যুবকদের সর্দার, হযরত ফাতিমা (রা.)-এর সন্তান হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) এবং নবী পরিবারের সদস্যগণকে ইয়াযীদ বাহিনী ৬১ হিজরির এ দিনে অত্যন্ত নির্মম ও অন্যায়ভাবে শহীদ করে। হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেন নি বলেই তাঁকে শাহাদাত বরণ করতে হয়েছে। এ হত্যাকা- সংগঠিত করার জন্য ইয়াযীদ, ইয়াযীদ বাহিনী এবং তাদের নেপথ্যে যারা ইন্ধন জুগিয়েছে তারা সকলেই অপরাধী। কোন অমুসলিমের হাতে ইমাম হোসাইন শহীদ হন নি। যারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে তারা সকলেই নামে মুসলমান ছিল। ইমাম হোসাইনের এ শাহাদাতের মাধ্যমে প্রকৃত ইসলাম স্পষ্ট হয়েছে। তাই ইমাম হোসাইন (আ.)-এর আদর্শ আমাদের অনুসরণ করা সকলের কর্তব্য। কারবালার এ ঘটনা থেকে আমরা শিক্ষা অর্জন করতে পারি যে, অন্যায়ের কাছে কোন অবস্থাতেই মাথা নত করা যাবে না।
অনুষ্ঠানে অন্যান্য বক্তা বলেন, কীভাবে মহানবী (সা.)-এর উম্মতই তাঁর সন্তানকে হত্যা করলÑ এ জিজ্ঞাসা সর্ব যুগের প্রতিটি বিবেকবান মানুষের। রাসূলের ওফাতের মাত্র ৫০ বছর অতিক্রান্ত হতে না হতেই এ হত্যাকা- চালানো হয়। এ হত্যাকা- ঘটিয়েছিল রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর উম্মত, যারা রাসূল (সা.) এবং তাঁর বংশকে ভালবাসে বলে দাবি করত। কারবালায় ইমাম হোসাইনের মহান ও সর্বোচ্চ আত্মত্যাগে আমাদের কান্নাবিজড়িত শোককে শক্তিতে পরিণত করে খুঁজে নিতে হবে ইমাম হোসাইনের শাহাদাতের লক্ষ্যকে, পৌঁছতে হবে তাঁর এ সর্বব্যাপী বীরত্বপূর্ণ বিপ্লবের ময়দানে।

সাতক্ষীরা আল-রাজী পাঠাগারে পবিত্র আশুরা পালন
গত ১ অক্টোবর, ২০১৭ সাতক্ষীরা আল-রাজী পাঠাগারের উদ্যোগে পবিত্র আশুরা উপলক্ষে এক আলোচনা ও শোকানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। উক্ত আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন আল-রাজী পাঠাগারের পরিচালক মোঃ আতাহার আলী খান। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট আইনজীবী এ্যাডভোকেট মোঃ আব্দুর রাজ্জাক। বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন চিশতিয়া খানকা শরীফের পেশ ইমাম হাফেজ মাওলানা মোঃ আব্দুল হাকিম।
জনাব মোঃ আতাহার আলী বলেন, আশুরার দিনটি ছিল হক-বাতিল নির্ধারণের দিন। এ দিনে পাপিষ্ঠ ইয়াযীদ ও তার বাহিনী বেহেশতের যুবকদের সর্দার ইমাম হোসাইন ও তাঁর সাথিদেরকে কারবালার ময়দানে তিন দিনের ক্ষুধার্ত ও পিপাসার্ত অবস্থায় শহীদ করে। তাই মুসলিম জাতি এ দিনে শোক পালন করে।
প্রধান অতিথি তাঁর বক্তব্যে ইমাম হোসাইন (আ.) ১০ মুহররম রাতে তাঁর সঙ্গী-সাথিদের একত্র করে যে কথাগুলো বলেছিলেন তা তুলে ধরেন।
বিশেষ অতিথি হাফেজ মাওলানা মোঃ আব্দুল হাকিম বলেন, রাসূল (সা.) ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইতকে মানতে হবে এবং তাঁদেরকে ভালোবাসতে হবে। মহান আল্লাহই তাঁদেরকে বিশেষ মর্যাদা দান করেছেন এবং তাঁদেরকে আনুগত্য করা ও ভালোবাসাকে আমাদের জন্য কর্তব্য নির্ধারণ করেছেন। আমাদের পরকালীন মুক্তির জন্য পবিত্র আহলে বাইতকে অনুসরণ করতে হবে।

যশোরের শার্শায় আশুরা পালন

ইমাম মেহেদী (আঃ) ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে শার্শা থানার বিভিন্ন এলাকায় ১ মুহররম হতে ৯ মুহররম পর্যন্ত শোকানুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। ১০ মুহররম সকালে শোক মিছিল বের করা হয়। মিছিলটি নাভারন বাজার প্রদক্ষিণ করে উলাশী প্রাইমারি স্কুল প্রাঙ্গনে এসে শেষ হয়। আসরের নামাযের পর শোকানুষ্ঠান শুরু হয়। উক্ত অনুষ্ঠানে আলোচনা করেন জনাব আতিয়ার রহমান, জনাব মোঃ আমীর হামজা, অধ্যাপক মেহেদী হাসান মুরাদ, মাস্টর আয়ূব হোসেন, মাস্টার আনোয়ারুল ইসলাম এবং জনাব ইকবাল হোসেন (শান্তি)।

ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে গাদীর দিবস ও মোবাহিলা দিবস উদ্যাপন
১৮ যিলহজ ঈদে গাদীর ও ২৪ যিলহজ ঈদে মোবাহিলা উপলক্ষে গত ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ও আনজুমানে মুমিনীনে বাংলাদেশ এর যৌথ উদ্যোগে ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে এক আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
সুরেশ্বর দরবার শরীফের পীর আলহাজ খাজা শাহ সুফি সাইয়্যেদ নূরী আখতার হোসেন আহমাদী নূরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ সভায় বক্তব্য রাখেন বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ জনাব শাহ সারওয়ার মুস্তাফা। স্বাগত বক্তব্য রাখেন ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের কালচারাল কাউন্সেলর জনাব সাইয়্যেদ মূসা হোসেইনী।
জনাব মূসা হোসেইনী বলেন, ইসলামের ইতিহাসে যে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো রয়েছে তার মধ্যে গাদীরে খুম ও মোবাহিলার ঘটনা উল্লেখযোগ্য। আর এ দুটি ঘটনাই ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বর্ণিত হয়েছে। অর্থাৎ এগুলো মুসলমানদের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন বিদায় হজ সমাপ্ত করে মদীনায় প্রত্যাবর্তন করছিলেন সেই সময় গাদীরে খুম নামক স্থানে পৌঁছলে জীবরাইল (আ.) মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহী নিয়ে অবতরণ করেন যেখানে আল্লাহ মহানবী (সা.)-কে সম্বোধন করে বলেন : হে রাসূল! যা তোমার প্রতিপালকের পক্ষ হতে তোমার প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে তা পৌঁছে দাও, আর যদি তুমি তা না কর, তবে তুমি তার কোন বার্তাই পৌঁছাওনি; এবং আল্লাহ তোমাকে মানুষের অনিষ্ট হতে রক্ষা করবেন; এবং নিশ্চয় আল্লাহ অবিশ্বাসী সম্প্রদায়কে সঠিক পথে পরিচালিত করেন না।
মহানবী (সা.) গাদীরে খুমে যাত্রা বিরতি করে লোকদের সামনে ঐতিহাসিক বক্তব্য প্রদান করেন এবং হযরত আলী (আ.)-কে তাঁর পরে মুসলমানদের মাওলা বা অভিভাবক হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেন। এরপর মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে অপর আয়াত নাযিল হয় : ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দীনকে পূর্ণ করলাম ও তোমাদের প্রতি আমার নিয়ামত সম্পূর্ণ করলাম এবং তোমাদের জন্য ধর্ম হিসেবে ইসলামের প্রতি সন্তুষ্ট হলাম।’
গাদীরে খুমে নাযিলকৃত দুটি আয়াত থেকে আমরা এই ঘটনার অপরিসীম গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারি।
অপরদিকে যে ঘটনাটি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নবুওয়াত ও ইসলাম ধর্মের সত্যতার পরিচয় বহন করে তা হলো মোবাহিলার ঘটনা। ইসলাম গ্রহণের দাওয়াত সম্বলিত মহানবী (সা.)-এর পত্র পেয়ে মদীনার নিকটবর্তী নাজরান অঞ্চলের খ্রিস্টানদের একটি প্রতিনিধিদল তাঁর সাথে দেখা করার জন্য মদীনায় আগমন করে। খ্রিস্টান প-িতদের সাথে আলোচনার এক পর্যায়ে যখন তারা কোন যুক্তি মানতে রাজি হচ্ছিল না তখন মহানবী (সা.) তাদেরকে মোবাহিলায় আহ্বান জানান। অর্থাৎ উভয় পক্ষ একটি জায়গায় সমবেত হয়ে মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করবে যে, যারা মিথ্যাবাদী তাদের ওপর যেন আল্লাহর অভিশাপ বর্ষিত হয়। কিন্তু পরবর্তী দিনে খ্রিস্টানরা মহানবী (সা.) ও তাঁর সাথে আগত তাঁর পরিবারের লোকজনের দ্যুতিময় চেহারা এবং মোবাহিলার ব্যাপারে তাঁদের আস্থা দেখে ভয় পেয়ে যায়। তারা মোবাহিলায় অবতীর্ণ না হয়ে জিজিয়া প্রদানের শর্তে মহানবীর সাথে সন্ধি করে।
জনাব হোসেইনী বলেন, এ দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনায় মহানবী (সা.) ও তাঁর আহলে বাইতের জয় ও সত্যের পরিচয় পরিস্ফুট হয়েছে। একই সাথে ইসলাম ধর্ম পৃথিবীর অন্য সকল ধর্মের ওপর বিজয় লাভ করেছে।
জনাব শাহ সারওয়ার মুস্তাফা বলেন, ‘(হে রাসূল!) তুমি বলে দাও, ‘আমি এর (বার্তা প্রচারের) জন্য তোমাদের নিকট হতে আমার পরমাত্মীয়গণের প্রতি ভালোবাসা ব্যতীত অন্য কোন প্রতিদান চাই না,’Ñ পবিত্র কোরআনের এ আয়াত নাযিল হলে সাহাবিগণ রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞেস করেন যে, কাদেরকে ভালোবাসতে হবে। রাসূল (সা.) জবাব দেন, ‘আমার আহলে বাইতকে।’ সূরা আহযাবের ৩৩ নং আয়াতের মাধ্যমে মহানবীর আহলে বাইতকে নিষ্পাপ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। আর হাদীসে সাকালাইনের মাধ্যমে আহলে বাইতকে আঁকড়ে ধরার জন্য মহানবী (সা.) আমাদেরকে নির্দেশনা দিয়েছেন।
এই আহলে বাইতের অন্যতম ব্যক্তিত্ব হযরত আলী ইবনে আবি তালিবের মাওলা হিসেবে অভিষিক্ত হওয়ার ঘটনাই হলো গাদীরে খুমের ঘটনা। মহানবী (সা.) হযরত আলীর হাত উঁচু করে ধরে ঘোষণা করেন : ‘আমি যার মাওলা, এই আলী তার মাওলা…।’ এই ঘোষণার পর সাহাবীরা হযরত আলীকে অভিনন্দন জানান।
তিনি আরো বলেন, মোবাহিলা বিষয়ে পবিত্র কোরআনের যে আয়াত নাযিল হয় তা হলো : ‘… এস, আমরা আহ্বান করি আমাদের পুত্রদের এবং তোমাদের পুত্রদের, আমাদের নারীদের এবং তোমাদের নারীদের, এবং আমাদের সত্তাদের এবং তোমাদের সত্তাদের; অতঃপর সকলে মিলে (আল্লাহর দরবারে) নিবেদন করি এবং মিথ্যাবাদীদের ওপর আল্লাহর অভিসম্পাত বর্ষণ করি।
মহানবী (সা.) হযরত আলী, হযরত ফাতেমা, ইমাম হাসান ও ইমাম হোসাইনকে সাথে নিয়ে খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে মোবাহিলায় অংশগ্রহণের জন্য উপস্থিত হন। আয়াতের ভাষ্য অনুযায়ী সন্তান হিসেবে ইমাম হাসান ও ইমাম হোসাইনকে, নারী হিসেবে হযরত ফাতেমাকে ও নিজ সত্তা হিসেবে হযরত আলীকে সাথে নেন। এটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। এর মাধ্যমে মহানবী (সা.) আহলে বাইতের পরিচয় আমাদের সামনে সুন্দরভাবে তুলে ধরেন।
জনাব সাইয়্যেদ নূরী আখতার হোসেন বলেন, গাদীরে খুমে লক্ষাধিক সাহাবীর সামনে রাসূলুল্লাহ (সা.) হযরত আলীকে মুসলমানদের মাওলা হিসেবে ঘোষণা করেন। তিনি সবসময় আহলে বাইতকে ভালোবাসা ও তাঁদেরকে অনুসরণের নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে তাঁর সেই আদেশকে লঙ্ঘন করা হয়েছে। হযরত আলীকে শহীদ করা হয়েছে। মহানবীর প্রাণপ্রিয় নাতি বেহেশতে যুবকদের সর্দারদ্বয় ইমাম হাসান ও ইমাম হোসাইনকে শহীদ করা হয়েছে। আমাদেরকে এসব ইতিহাস সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। আমাদের উচিত মহানবী (সা.)-এর এই হাদিসটি সবসময় স্মরণ রাখাÑ ‘আমি তোমাদের মধ্যে দুটি ভারী জিনিস রেখে যাচ্ছি যা আঁকড়ে ধরলে তোমার কখনই পথভ্রষ্ট হবে না : একটি আল্লাহর কিতাব, অন্যটি আহলে বাইত’। আমাদের দায়িত্ব হলো যারা রাসূলের হাদিসসমূহকে অস্বীকার করতে চায় তাদের ষড়যন্ত্রকে নস্যাৎ করে দেয়া এবং সকলের মধ্যে আহলে বাইতের প্রতি ভালোবাসাকে ছড়িয়ে দেয়া।
অনুষ্ঠানে পবিত্র কোরআন থেকে তেলাওয়াত করেন জনাব শামীম রেযা। স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করেন কবি আমিন আল আসাদ ও কাসিদা পরিবেশন করেন জনাব মেহেদী হাসান ও নাজিম হোসাইন।

যশোরে ঈদে গাদীর উদ্যাপন
গত ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৭, (১৮ যিলহজ) যশোরে আলী আসগার স্মৃতি সংঘ পাঠাগারের উদ্যোগে যশোর জিলা স্কুল অডিটোরিয়ামে ঈদে গাদীর দিবস উদ্যাপিত হয়। ইনকিলাবে মাহদী মিশনের প্রতিষ্ঠাতা জনাব মল্লিক আব্দুর রউফে সভাপতিত্বে প্রধান বক্তা হিসেবে বক্তব্য রাখেন ইসলামী শিক্ষা কেন্দ্রের অধ্যক্ষ হুজ্জাতুল ইসলাম সৈয়দ ইব্রাহীম খালীল রাজাভী। বিশেষ বক্তাদের মধ্যে ছিলেন হুজ্জাতুল ইসলাম সৈয়্যদ হাবীব রেজা হুসাইনী, হুজ্জাতুল ইসলাম সৈয়্যদ এহসান হুসাইন হুসাইনী, মোঃ ফিরোজ খান, ঐতিহাসিক মুড়লী ইমাম বাড়ীর পেশ ইমাম জনাব ইকবাল হুসাইন ও ইনকিলাব-এ-মাহদী মিশনের পরিচালক মোঃ সিরাজুল ইসলাম প্রমুখ।
বক্তাগণ বলেন, ঈদে গাদীর মহান আল্লাহর পক্ষ হতে একটি পবিত্র ও মহিমান্বিত দিবস। এই দিনে সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) হযরত আলী (আ.)-কে বেলায়াতের স্বীকৃতি প্রদানের মাধ্যমে খতমে নবুওয়তের পর ইমামতের পরিচিতি প্রদান করেন।
হযরত মুহাম্মাদ (সা.) ইমাম আলী (আ.) থেকে শুরু করে আল্লাহর পক্ষ থেকে শেষ প্রতিনিধি হযরত ইমাম মাহদী (আ.) পর্যন্ত প্রত্যেক ইমামের নেতৃত্ব ও মর্যাদা সম্পর্কে বর্ণনা করেন। গাদীর দিবসকে গুরত্ব না দেবার কারণেই বিশ্বের মানব সম্প্রদায় আজ সাম্রাজ্যবাদী ও বিশ্ব লুটেরাদের হাতে জিম্মি এবং বিশেষ করে মুসলিম জাতির দলে দলে বিভক্তি ও অনৈক্যের কারণই হচ্ছে গাদীর দিবসকে মূল্যায়ন না করা।
অনুষ্ঠানে হাম্দ, নাত, কবিতা আবৃত্তি ও গজল পরিবেশন করা হয়।

যশোরের শার্শায় ঈদে গাদীর উদ্যাপন
১৮ই যিলহজ ঈদে গাদীর উপলক্ষে যশোরের শার্শা থানার উলাশী শিয়া মসজিদ প্রাঙ্গনে ইমাম মেহেদী (আঃ) ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে এক সেমিনারের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন ডাঃ আলতাফ হোসেন, মেহেদী হাসান মুরাদ। জনাব ইকবাল হোসেন (শান্তি) হযরত আলীর অভিষেকের ঘটনার ওপর বিস্তারিত আলোচনা করেন। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) এই দিবসে হযরত আলীর অনন্য মর্যাদা তাঁর সাহাবীদের সামনে তুলে ধরেন।

স্মরণীয় দিবস

১ জুলাই : বিশ্ব হস্তশিল্প দিবস।
৩ জুলাই : ১৯৮৮ সালের এ দিনে পারস্য উপসাগরে মার্কিন রণতরী থেকে পরিচালিত ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইরানি এয়ারবাসের তিন শতাধিক যাত্রী শহীদ হন।
৫ জুলাই : বিশ্ব কলম দিবস।
৯ জুলাই : ইরানে শিশু-কিশোর সাহিত্য দিবস হিসেবে পালিত হয়।
১২ জুলাই : * ইরানে হিযাব ও সতীত্ব দিবস।
* ইরানে খেলাধুলা ও পাহলোয়ানি (যুরখানেহ) সংস্কৃতি দিবস।
২০ জুলাই : আহলে বাইতের ষষ্ঠ ইমাম জাফর সাদিক (আ.)-এর শাহাদাত দিবস।
২৫ জুলাই : হযরত মাসুমা (আ.)-এর জন্মদিবস। ইরানে কন্যাদিবস।
৩১ জুলাই : বিশ্ব স্বেচ্ছায় রক্তদান দিবস।
৫ আগস্ট : ইসলামি মানবাধিকার ও মানবতা দিবস।
৬ আগস্ট : বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুবার্ষিকী।
৮ আগস্ট : ইরানে সাংবাদিক দিবস।
৪ আগস্ট : আহলে বাইতের অষ্টম ইমাম রেযা (আ.)-এর জন্মদিবস।
২১ আগস্ট : ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান কর্তৃক ঘোষিত বিশ্ব মসজিদ দিবস।
২২ আগস্ট : আহলে বাইতের নবম ইমাম তাকী (আ.)-এর শাহাদাত দিবস।
২৩ আগস্ট : * বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক ও বিজ্ঞানী বু-আলী সীনা স্মরণে দিবস; ইরানে এ দিনটি চিকিৎসক দিবস হিসেবে পালিত হয়।
* আমীরুল মুমিনীন ইমাম আলী (আ.) ও নবীকন্যা হযরত ফাতেমা (আ.)-এর বিবাহের দিবস।
২৭ আগস্ট : * বিশ্ববিখ্যাত চিকিৎসাবিজ্ঞানী যাকারিয়া রাযী স্মরণে দিবস; ইরানে এ দিনটি ওষুধ শিল্প দিবস হিসেবে পালিত হয়।
* বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যুবার্ষিকী।
২৯ আগস্ট : আহলে বাইতের পঞ্চম ইমাম বাকের (আ.)-এর শাহাদাত দিবস।
৩০ আগস্ট : ১৯৮১ সালের ৩০ আগস্ট প্রেসিডেন্ট ভবনে গুপ্তঘাতকের পাতা বোমা বিস্ফোরণে শহীদ হন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মুহাম্মাদ আলী রাজাই ও প্রধানমন্ত্রী হুজ্জাতুল ইসলাম ড. জাভাদ বাহোনার। দিবসটি সন্ত্রাসবিরোধী দিবস হিসেবে পালিত হয়।
৩১ আগস্ট : ৯ জিলহজ্ব আরাফাত দিবস অর্থাৎ হজ্ব।

স্মরণীয় বাণী

 

মহানবী (সা.) বলেন : আল্লাহ্র কসম! এমন কোনো কাজই নেই যা তোমাদেরকে জাহান্নামের নিকটবর্তী করে আর আমি তোমাদের সে ব্যাপারে অবগত করি নি কিংবা তোমাদের তা থেকে বারণ করি নি। অপরদিকে এমন কোনো কাজই নেই যা তোমাদেরকে বেহেশতের নিকটবর্তী করে আর আমি তোমাদের সে ব্যাপারে অবগত করি নি কিংবা তার আদেশ করি নি।
মহানবী (সা.) বলেন : আমার নিকট জ্ঞানের মর্যাদা ইবাদতের মর্যাদার চেয়ে অধিক প্রিয়। তোমাদের সবচেয়ে বড় ধর্ম হলো পরহেজগারিতা (আত্মসংযম)।
মহানবী (সা.) বলেন : যে ব্যক্তি নিজেকে নিঃস্ব হিসাবে প্রকাশ করে সে অভাবগ্রস্ত হয়।
মহানবী (সা.) বলেন : নিশ্চয় আল্লাহ্ ঘৃণা করেন বৃদ্ধ ব্যভিচারীকে এবং বিত্তবান অত্যাচারীকে এবং অহংকারী গরীবকে এবং নাছোড়বান্দা ভিক্ষুককে। আর নিষ্ফল করেন প্রচার করে বেড়ানো দানশীলদের পুরস্কারকে আর ঘৃণা করেন এমন ফূর্তিবাজকে যে বেপরোয়া ও মিথ্যাচারী।
মহানবী (সা.) মসজিদুল খিফ-এ দাঁড়ালেন এবং বললেন : আল্লাহ্ প্রফুল্ল করেন সেই বান্দাকে যে আমার কথা শ্রবণ করে অতঃপর স্মৃতিতে ধরে রাখে এবং যে শ্রবণ করে নি তার কাছে পৌঁছে দেয়। কত জ্ঞানপ্রচারকারীর চেয়ে ঐ ব্যক্তি অধিক ব্যুৎপত্তিসম্পন্ন যার নিকট সে জ্ঞানকে পেঁৗঁছায়। কত জ্ঞানের বাহক রয়েছে যে আদৌ জ্ঞানী নয়।
ইমাম আলী (আ.) বলেন : আল্লাহ্্র কিছু বান্দা রয়েছে যারা নিষ্ঠাপূর্ণ অন্তরে তাঁর সাথে আচরণ করেছে এবং আল্লাহ্্ যথাযথই তাদেরকে মূল্যায়ন করেছেন। কিয়ামতের দিনে তাদের হিসাবের খাতা নিখুঁত এবং যখন তারা তাঁর সামনে দাঁড়াবে, তখন তাদের আমলনামা পরিপূর্ণ থাকবে সেসব রহস্য দিয়ে, যা তার নিকট গোপন ছিল।
ইমাম আলী (আ.) বলেন : তোমাদের চরিত্রকে ভালোসমূহের প্রতি নত কর এবং মহত্ত্বের দিকে পরিচালিত কর এবং নিজেকে সহিষ্ণুতায় অভ্যস্ত কর এবং অন্যকে নিজের ওপর প্রাধান্য দানে স্বীয় প্রবৃত্তিকে অভ্যস্ত কর তার মাধ্যমে যা তোমাদের প্রশংসিত হওয়ার উপকরণ। আর মানুষের বেশি ছিদ্রান্বেষণ করতে যেও না। আর নীচ কাজসমূহ থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে নিজেকে ঊর্ধ্বে তুলে ধর।
ইমাম আলী (আ.) বলেন : পুরুষের পৌরুষ ও ব্যক্তিত্ব ততক্ষণ পর্যন্ত পূর্ণ হয় না যতক্ষণ না দীনকে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়, জীবনে মধ্যপন্থা অবলম্বন করে আর বিপদের সময় ধৈর্যধারণ করে এবং বন্ধুর থেকে তিতা আচরণকে মিঠা বলে জানে।
ইমাম আলী (আ.) বলেন : হে আল্লাহ্্র বান্দাগণ! জেনে রাখ, তাকওয়া হলো মজবুত দুর্গস্বরূপ। আর অনাচার হলো নাজুক দুর্গ যা তার বাসিন্দাদের বাঁচাতে পারে না এবং নিজ আশ্রিতদের রক্ষা করতে পারে না। জেনে রেখ, তাকওয়া দ্বারা বিচ্যুতিসমূহের বিষাক্ত হুল উপড়ে যায় এবং আল্লাহ্্র আনুগত্যের পথে ধৈর্য দ্বারা সওয়াব অর্জিত হয়। আর নিশ্চিত বিশ্বাস দ্বারা পরম কাক্সিক্ষতকে লাভ করা যায়।
ইমাম হোসাইন (আ.) বলেন : তোমরা সুস্থ শরীরে তোমাদের আয়ুষ্কালের মধ্যেই আমলে ধাবিত হও, যেন অকস্মাৎই মৃত্যু হানা দিবে আর তোমাদেরকে মাটির ওপর থেকে মাটির মধ্যে টেনে নিবে এবং মাটির টিলা থেকে গর্তের মধ্যে নিক্ষেপ করবে এবং সঙ্গী-সাথী ও প্রশান্তি থেকে ভয় ও নিঃসঙ্গতায় নিয়ে যাবে এবং খোলা আকাশ ও আলো থেকে অন্ধকারে নিয়ে যাবে। আর প্রশস্ত জায়গা থেকে সংকীর্ণতার মধ্যে ঠেলে দিবে যেখানে আত্মীয়-স্বজনদের দেখতে যাওয়া হয় না, অসুস্থকেও দেখতে যাওয়া হয় না আর না কোনো ফরিয়াদে সাড়া দেওয়া হয়।
ইমাম আলী ইবনুল হোসাইন যায়নুল আবেদীন (আ.) বলেন : কখনই মিথ্যাবাদীর সাথে ওঠাবসা করবে না। কারণ, সে হলো মরীচিকাসদৃশ, দূরকে করে নিকট এবং নিকটকে তোমার কাছে দূর করে দিবে। কখনই ফাসেক ও খারাপ ব্যক্তির সাথে চলাফেরা করবে না। কেননা, সে তোমাকে এক লোকমা কিংবা তার কম মূল্যে বিক্রি করে দিবে। কৃপণ লোকের সহচর হবে না। কেননা, তার প্রতি তোমার চরম প্রয়োজনের দিনে সে তোমাকে ত্যাগ করবে। কোনো বোকার বন্ধু হয়ো না। সে তোমার উপকার করতে চেয়ে ক্ষতি করে বসবে। আর আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারীর সাথেও বন্ধুত্ব কর না। কারণ, আমি তাকে কোরআনে অভিশপ্ত পেয়েছি।
ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.) বলেন : তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি আল্লাহ্্র অধিকতর প্রিয় যে অধিকতর সৎকর্মশীল। আর নিশ্চয় তোমাদের মধ্যে আল্লাহ্্র নিকট সে-ই বেশি মর্যাদাশীল যে তাঁর নিকট যা আছে তার প্রতি বেশি আগ্রহশীল। আর তাঁর আযাব থেকে সে-ই বেশি নাজাত লাভকারী যে তোমাদের মধ্য থেকে আল্লাহ্্কে বেশি ভয় করে।
(তুহাফুল উকূল থেকে সংকলিত)
অনুবাদ : আব্দুল কুদ্দুস বাদশা

সংবাদ বিচিত্রা

১ আরেকটি ইসরাইল সৃষ্টি করতে চায় আমেরিকা : সর্বোচ্চ নেতা
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী বলেছেন, আমেরিকাসহ আরো কিছু বিদেশি শক্তি মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলের মতো আরেকটি অবৈধ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়। তিনি আরো বলেছেন, আমেরিকা ও ইসরাইলের স্বার্থ রক্ষার লক্ষ্যেই সম্প্রতি ইরাকের কুর্দিস্তানে বিচ্ছিন্নতাকামী গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে।
ইরান সফররত তুর্কি প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোগানের সঙ্গে এক বৈঠকে এ মন্তব্য করেন সর্বোচ্চ নেতা। তিনি বলেন, ‘আমেরিকাসহ পশ্চিমা সরকারগুলোকে বিশ্বাস করা যায় না এবং তারা মধ্যপ্রাচ্যে নতুন একটি ইসরাইল সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে।”
আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী বলেন, কুর্দিস্তানে গণভোট অনুষ্ঠান ছিল গোটা মধ্যপ্রাচ্যের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা এবং এটি এ অঞ্চলের ভবিষ্যতের জন্য হুমকি সৃষ্টি করেছে। ইরাকের প্রতিবেশী দেশগুলোতে এই গণভোটের দীর্ঘমেয়াদী প্রতিক্রিয়ার ব্যাপারেও তিনি সতর্ক করে দেন।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, ‘ইরাক থেকে কুর্দিস্তানের বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া ঠেকাতে ইরান ও তুরস্কের উচিত সম্ভাব্য সব পদক্ষেপ নেয়া। সেইসঙ্গে ইরাক সরকারকেও এ ব্যাপারে কঠোর সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ নিতে হবে।’
তিনি সিরিয়া বিষয়ক আস্তানা বৈঠকে তেহরান-আঙ্কারা সহযোগিতায় সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, ওই সহযোগিতার কারণে সিরিয়ার পরিস্থিতি আগের তুলনায় অনেক ভালো হয়েছে। তবে দীর্ঘমেয়াদী ও বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা গ্রহণ না করলে উগ্র তাকফিরি সন্ত্রাসবাদকে নির্মূল করা যাবে না বলেও তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতার সঙ্গে সাক্ষাতে তেহরান ও আঙ্কারাকে নিয়ে একটি শক্তিশালী জোট গঠনের আগ্রহ প্রকাশ করেন রজব তাইয়্যেব এরদোগান। তিনি বলেন, ইরাক থেকে কুর্দিস্তানের বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া ঠেকাতে তেহরান, আঙ্কারা ও বাগদাদকে সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। তুর্কি প্রেসিডেন্ট বলেন, কুর্দি নেতা মাসুদ বারজানি গণভোটের আয়োজন করে ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করেছেন।

২ মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিন : মুসলিম দেশগুলোর প্রতি ইরানের সর্বোচ্চ নেতা
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর মিয়ানমার সরকারের বর্বর গণহত্যা ও ভয়াবহ দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ ব্যবস্থা নিতে মুসলিম দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানান। তিনি গত ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৭ বলেন, গণহত্যা বন্ধে মিয়ানমার সরকারকে বাধ্য করার জন্য মুসলিম দেশগুলোর উচিত অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করা। তিনি বলেন, মিয়ানমার সংকট অবসানের জন্য মুসলিম দেশগুলোকে বাস্তবধর্মী পদক্ষেপ নিতে হবে। তবে তিনি বাস্তবধর্মী পদক্ষেপ বলতে সেনা মোতায়েনের কথা বলেন নি।
সর্বোচ্চ নেতা বলেন, রোহিঙ্গা সংকট অবসানের জন্য মুসলিম দেশগুলোকে মিয়ানমারের ওপর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক চাপ বাড়াতে হবে এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোতে মুসলিম সরকারগুলোকে মিয়ানমার সরকারের অপরাধের বিরুদ্ধে জোরালোভাবে কথা বলতে হবে।
রোহিঙ্গা সংকটে আন্তর্জাতিক সংস্থা ও স্বঘোষিত মানবাধিকারের ধ্বজাধারীদের নীরবতার তীব্র সমালোচনা করেন সর্বোচ্চ নেতা। তিনি বলেন, মিয়ানমারের চলমান সংকটে যদিও ধর্মীয় রূপ থেকে থাকে তবে তাকে কোনোভাবেই বৌদ্ধ ও মুসলমানদের মধ্যকার ধর্মীয় দ্বন্দ্ব বলা যাবে না; বরং এটি হচ্ছে একটি রাজনৈতিক ইস্যু। এর কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর যারা এই বর্বর হত্যাকা- ও নির্যাতন চালাচ্ছে তারা হচ্ছে মিয়ানমারের সরকার যার শীর্ষে রয়েছেন একজন নিষ্ঠুর নারী যিনি শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। এই বর্বর ঘটনার মধ্য দিয়ে নোবেল শান্তি পুরস্কারেরও মৃত্যু ঘটেছে বলে সর্বোচ্চ নেতা মন্তব্য করেন।
আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা বা ওআইসিতে আলোচনা হওয়া উচিত। পাশাপাশি তিনি ইরান সরকারকে এ ইস্যুতে জোরালো অবস্থান নেয়ার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, আজকের বিশ্ব হচ্ছে নির্যাতনের বিশ্ব, কিন্তু ইরানকে নিপীড়িনের বিরুদ্ধে কথা বলার সম্মান ধরে রাখতে হবে এবং বিশ্বের যেখানে অন্যায় ও নিপীড়ন চলুক না কেন তার বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে।

৩ ‘বিপ্লবী আদর্শের প্রতি বিপুল সংখ্যক ইরানি যুবকের গভীর অনুরাগ মহাবিস্ময়কর’
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হযরত আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী বলেছেন, ইরানি জাতি ও এর যুব সমাজের মধ্যে জিহাদ আর শাহাদাতের আদর্শ ভুলিয়ে দেয়ার জন্য শত্রুদের ব্যাপক চেষ্টা সত্ত্বেও বিপ্লবী আদর্শের প্রতি বিপুল সংখ্যক ইরানি যুবকের গভীর অনুরাগ মহাবিস্ময়কর ব্যাপার। তিনি ৩ অক্টোবর ২০১৭ দুপুরে শহীদ মোহসেন হুজাজির পরিবারকে দেয়া এক সাক্ষাতে এই মন্তব্য করেন।
২৬ বছর বয়স্ক ইরানি যুবক মোহসেন হুজাজি সিরিয়ায় ইমাম হোসাইন (আ.) এর বোন হযরত যায়নাব সালামুল্লাহি আলাইহার পবিত্র মাযার রক্ষাকারী স্বেচ্ছাসেবী বাহিনীর একজন সিনিয়র কমান্ডার হিসেবে গত ৯ আগস্ট সিরিয়া ও ইরাক সীমান্তে তাকফিরি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী দায়েশ বা আইএসআইএল-বাহিনীর হাতে শহীদ হন।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা শহীদ হুজাজির প্রশংসা করে তাঁকে মহান আল্লাহর নিদর্শন ও সন্ত্রাসীদের হাতে মস্তক-বিচ্ছিন্ন হওয়া মজলুম শহীদদের মুখপাত্র বলে মন্তব্য করেছেন।
শহীদ হুজাজির দাফন ও শোক অনুষ্ঠানে বিপুল সংখ্যক মানুষের উপস্থিতির কথা তুলে ধরে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা বলেন, মহান আল্লাহ শহীদ হুজাজির সংগ্রামের উসিলায় ইরানি জাতিকে গৌরবান্বিত করেছেন এবং তাকে বিপ্লবী যুব প্রজন্মের আদর্শ ও ইসলামি বিপ্লবের চলমান মু’জিজা বা অলৌকিক খোদায়ী নিদর্শনে পরিণত করেছেন।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা সারা ইরানে শহীদ হুজাজির খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ার কারণ ব্যাখ্যা করে আরও বলেছেন, সব শহীদই মজলুম ও হুজাজি ছাড়াও অন্য অনেককেও দেহ থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করে শহীদ করা হয়েছে, তারা সবাইই মহান আল্লাহর কাছে প্রিয়, কিন্তু মহান আল্লাহ তাঁর হেকমত বা প্রজ্ঞার মাধ্যমে হুজাজি ও তার নানা বৈশিষ্ট্যকে এই শহীদদের প্রতিনিধি ও মুখপাত্র করেছেন।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী আরও বলেছেন, ইরান, আফগানিস্তান, ইরাক ও অন্য অনেক অঞ্চল থেকে যারা দুর্বৃত্তদের মোকাবেলায় যুদ্ধ করতে গিয়ে শহীদ হয়েছেন তাদের সবাইকেই দেখা যায় শহীদ হুজাজির মধ্যে এবং হুজাজি তাদের সবারই সারাংশ বা সংক্ষিপ্ত রূপ; আর মহান আল্লাহ তাকে সাহসী ও মজলুম শহীদের প্রতীকে পরিণত করেছেন।

৪ ৬৪ লাখ মানুষের উপস্থিতিতে কারবালায় পবিত্র আশুরা পালিত
৬৪ লাখ মানুষের উপস্থিতিতে কারবালায় পালিত হলো পবিত্র আশুরা। আল ফুরাত আলআওসাত অভিযানের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার কাইস আল মুহাম্মাদাওয়ি গত ১ অক্টোবর ২০১৭ এ তথ্য দিয়েছেন।
তিনি বলেছেন, আশুরার দিনে ৬০ লাখ ইরাকি ও চার লাখ বিদেশী নাগরিক কারবালায় হাজির হন।আশুরার শোক অনুষ্ঠান পরিপূর্ণ নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেছেন।
বিভিন্ন আরব দেশ ও ইরান থেকে বিপুল সংখ্যক ইমাম-অনুরাগী কারবালায় আশুরার শোক অনুষ্ঠানে উপস্থিত হন বলে ব্রিগেডিয়ার কাইস আল মুহাম্মাদাওয়ি জানান।
বিভিন্ন দেশ থেকে হাজার হাজার মুসলমান আশুরার শোক পালন করতে পবিত্র কারবালা শহরে এসেছেন যেখানে রয়েছে আশুরা বিপ্লবের মহানায়ক হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) ও তাঁর সৎ ভাই হযরত আবুল ফজল আব্বাস (আ.)-এর পবিত্র মাযার।

৫ মুসলিম দেশ সমূহের মধ্যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতা সম্প্রসারণের জন্য প্রেসিডেন্ট রুহানির আহ্বান
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রেসিডেন্ট হজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমীন ড. হাসান রুহানি মুসলিম-প্রধান দেশ সমূহের মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে, বিশেষ করে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অঙ্গনে পারস্পরিক সহযোগিতা সম্প্রসারণের জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি গত ১০ সেপ্টেম্বর (২০১৭) কাযাকিস্তানের আস্তানা শহরে অনুষ্ঠিত ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি)-র বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক এক বৈঠকে প্রদত্ত ভাষণে এ আহ্বান জানান।
প্রেসিডেন্ট রুহানি তাঁর ভাষণে বলেন, ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সরকার জ্ঞান-বিজ্ঞানভিত্তিক সহযোগিতাকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদানের ক্ষেত্রে যে সক্রিয় নীতি গ্রহণ করেছে তার ফলে নতুন নতুন প্রযুক্তির ক্ষেত্রে হাজার হাজার সহযোগিতা গড়ে উঠেছে ও বিস্তার লাভ করেছে। তিনি উল্লেখ করেন যে, ইরান থেকে উচ্চ ও মধ্যম স্তরের প্রযুক্তি পণ্য রফতানির পরিমাণ দেড়শ’ কোটি ডলার থেকে বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে ১২১০ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছেÑ যা ইরানের ইতিবাচক বাণিজ্যিক ভারসাম্যের ওপর বিরাট প্রভাব বিস্তার করেছে।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, গত জুলাই মাসে (২০১৭) ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান যে নতুন স্যাটেলাইট ক্যারিয়ারের সফল পরীক্ষামূলক উৎক্ষেপণ করে প্রেসিডেন্ট রুহানি তার উল্লেখ করে বলেন, এ ধরনের বৈজ্ঞানিক সাফল্য সমূহ ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের গৌরবময় অর্জন এবং এগুলো ইরানের শক্তি ও ক্ষমতারই প্রমাণ বহন করে।
প্রেসিডেন্ট রুহানি তাঁর ইন্্স্ট্যাগ্রাম অ্যাকাউন্টে লিখিত এক বাণীতে বলেন, আজকের দিনে আমাদের জন্য মহাশূন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিরাট গুরুত্বের অধিকারী এবং এ ক্ষেত্রে ও বিজ্ঞানের অন্যান্য ক্ষেত্রে আমরা যত বেশি সামনে এগিয়ে যাব ততই আমরা অধিকতর শক্তিশালী ও অধিকতর মর্যাদার অধিকারী হব।
উল্লেখ্য, মহাশূন্য যানের অধুনাতম মানের প্রতি দৃষ্টি রেখে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান তার সর্বসাম্প্রতিক মহাশূন্য রকেট ‘সির্মোগ্’-এর ডিজাইন করে ও তা নির্মাণ করেÑ যা ২৫০ কেজি ওজনের কৃত্রিম উপগ্রহকে লো আর্থ অরবিট (এলইও)-এর ভিতরে ৫০০ কিলোমিটার পর্যন্ত দূরত্বে নিয়ে যেতে সক্ষম। এটি হচ্ছে ইরানে তৈরি এ পর্যন্তকার সবচেয়ে বড় রকেট। অদূর ভবিষ্যতে এটি ইরানের অভ্যন্তরে নির্মিত আর্থ অবজারভেশন কৃত্রিম উপগ্রহ ‘ত্বূলু’ (উদয়)-কে কক্ষপথে স্থাপনের জন্য ব্যবহার করা হবে।
স্মর্তব্য, ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের অভ্যন্তরে নির্মিত প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ ‘ওমিদ্’ (আশা) ২০০৯ সালে কক্ষপথে উৎক্ষেপণ করা হয়। এছাড়া ইরান তার ‘কভের্শ্গা-৩’ (উদ্ভাবক-৩) নামক ক্যারিয়ার ব্যবহার করে ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জীবন্ত প্রাণিবাহী তার প্রথম বায়ো-ক্যাপসুল্ মহাশূন্যে উৎক্ষেপণ করে। এরপর ২০১৫ সালে ইরানের অভ্যন্তরে প্রস্তুত কৃত্রিম উপগ্রহ ‘ফাজ্র্’ (ঊষা)-কে কক্ষপথে প্রেরণ করে। এ কৃত্রিম উপগ্রহটি অত্যন্ত নিখুঁত ও উঁচু মানের চিত্র গ্রহণ করে এবং ভূপৃষ্ঠস্থ স্টেশনে প্রেরণ করে থাকে।
এ প্রসঙ্গে আরো উল্লেখ্য যে, ইরানের প্রতিরক্ষা লক্ষ্যে নিবেদিত ক্ষেপণাস্ত্র উন্নয়ন কর্মসূচির কারণে মার্কিন কংগ্রেস কর্তৃক ইরানের বিরুদ্ধে নতুন নিষেধাজ্ঞা অনুমোদনের মাত্র কয়েক দিনের মাথায়ই ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান তার সর্বসাম্প্রতিক মহাশূন্য রকেট ‘সির্মোগ্’ উৎক্ষেপণ করে। মার্কিন কংগ্রেসের একই বিলে রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধেও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। মার্কিন কংগ্রেস কর্তৃক অনুমোদিত নিষেধাজ্ঞার বিলটি অত্র সংবাদ লিপিবদ্ধ করার সময় পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের স্বাক্ষরের অপেক্ষায় ছিল।
জনাব সালেহী আরো জানান যে, ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানে বর্তমানে চার শতাধিক মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্র রয়েছে যেগুলোতে মাছ টিনজাতকরণ, মাছের পাউডার তৈরিকরণ ও প্যাকেজিং-এর কাজ করা হয়। এসব কেন্দ্রে দুই লাখ ২০ হাজার মানুষ প্রত্যক্ষভাবে কর্মরত আছে।
৬ ইরান সফরে এলেন তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগান
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোগান একটি উচ্চ প্রতিনিধি দল নিয়ে তেহরানে পৌঁছেছেন। সফরে তিনি ইরানের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হবেন। গত ৪ অক্টোবর ২০১৭, ইরান সফররত প্রেসিডেন্ট এরদোগানকে তেহরানের সা’তাদাবাদ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে স্বাগত জানান ইরানের প্রেসিডেন্ট ড. হাসান রুহানি। এরদোগানের সঙ্গে তুরস্কের অর্থ, জ্বালানি এবং
সাংস্কৃতিক বিষয়ে চার মন্ত্রীর পাশাপাশি বহু তুর্কি ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারী রয়েছেন। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এরইমধ্যে দুই দেশের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য অংশীদারিত্ব রয়েছে এবং ভবিষ্যতে বাণিজ্যিক লেনদেন ৩,০০০ কোটি ডলারে উন্নীত করার লক্ষ্যে তেহরান-আঙ্কারার পরিকল্পণা রয়েছে বলে জানা গেছে।
ইরান ও তুরস্কের প্রেসিডেন্টের মধ্যে অনুষ্ঠেয় বৈঠকে তেহরান-আঙ্কারার মধ্যে শক্তিশালী অর্থনৈতিক স¤পর্ক বজায় রাখার পাশাপাশি আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক নানা ইস্যু অগ্রাধিকার পাবে বলে মনে করা হচ্ছে।
এছাড়া, সাম্প্রতিক সময়ে দুই দেশের কর্মকর্তাদের সফরের পর ইরান ও তুরস্কের মধ্যে যেসব সমঝোতা স্মারকে সই হয়েছে সে স¤পর্কেও বৈঠকে আলোচনা করা হবে। ইরাকের কুর্দিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার গণভোট স¤পর্কে ইরানের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গেও প্রেসিডেন্ট এরদোগান বৈঠক করবেন।
সামরিকসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইরান ও তুরস্কের মধ্যে কৌশলগত সহযোগিতা নিয়ে দুই দেশের সুপ্রিম কাউন্সিল বৈঠকে বসবেন বলে জানা গেছে।

৭ ইরান-তুরস্ক আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা রক্ষার স্তম্ভ : প্রেসিডেন্ট রুহানি
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রেসিডেন্ট ড. হাসান রুহানির সঙ্গে বৈঠক করেছেন তেহরান সফররত তুরস্কের সেনাপ্রধান জেনারেল হুলুসি অকার। বৈঠকে প্রেসিডেন্ট রুহানি বলেছেন, এ অঞ্চলের সীমানায় যেকোনো পরিবর্তন নিরাপত্তাহীনতা ও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করবে।
বৈঠকে তিনি ইরাক ও সিরিয়ার ভৌগোলিক অখ-তা রক্ষার জন্য দেশ দুটির কেন্দ্রীয় সরকারকে শক্তিশালী করার ওপর গুরুত্বরোপ করেন। সোমবার এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া, সন্ত্রাস-বিরোধী যুদ্ধ এবং এ অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তন ঠেকানোর জন্য দেশ দুটির সরকারকে শক্তিশালী করা দরকার বলে প্রেসিডেন্ট রুহানি জোর দেন।
তিনি আরো বলেন, সন্ত্রাস-বিরোধী লড়াই ও আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক সীমান্ত রক্ষা করা হচ্ছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দুটি লক্ষ্য এবং দ্বিপক্ষীয় স¤পর্ক উন্নয়নের মাধ্যমে ইরান ও তুরস্ক সে লক্ষ্য অর্জন করতে চায়। প্রেসিডেন্ট রুহানি বলেন, ইরান ও তুরস্ক হচ্ছে এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতা রক্ষার দুটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ এবং দুই দেশ পর¯পরের পাশে দাঁড়ালে এ অঞ্চলের সংকট সমাধানে প্রভাবশালী ভূমিকা রাখতে পারে। তিনি বলেন, দু দেশের মধ্যে সর্বাÍক স¤পর্ক প্রতিষ্ঠা করতেই হবে।
বৈঠকে তুর্কি সেনাপ্রধান বলেন, তার দেশ ইরাক ও সিরিয়াসহ আঞ্চলিক প্রতিটি দেশের ভৌগোলিক অখ-তার প্রতি সম্মান দেখায়। তিনি বলেন, সন্ত্রাস-বিরোধী লড়াইয়ের জন্য ইরানের সঙ্গে স¤পর্ক বাড়াতে আংকারা প্রস্তুত রয়েছে।
ইরানি সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল মোহাম্মাদ বাকেরির আমন্ত্রণে তুর্কি সেনাপ্রধান রোববার শেষ বেলায় ইরান সফরে আসেন।

৮ পরমাণু সমঝোতার প্রতি বিশ্বের ১৩৪ দেশের জোরালো সমর্থন
ছয় জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে ইরানের সই হওয়া পরমাণু সমঝোতার প্রতি সমর্থন ঘোষণা করেছে বিশ্বের ১৩৪টি দেশ। এসব দেশ ইসলামি ইরানের বিরুদ্ধে আরোপিত একতরফা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারেরও আহ্বান জানায়।
নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের অবকাশে ৭৭ জাতি গ্রুপের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা গত ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭ এক বৈঠকে বসেন। ওই বৈঠকে সর্বসম্মতি ক্রমে একটি বিবৃতি পাস হয়। ওই বিবৃতিতে ছয় জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে সই হওয়া ইরানের পরমাণু সমঝোতাকে আন্তর্জাতিক সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে গঠনমূলক দৃষ্টান্ত হিসেবে অভিহিত করা হয়।
এদিকে, জাতিসংঘে ইরানের স্থায়ী প্রতিনিধি গোলাম আলী খুশরো বলেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রা¤েপর লজ্জাজনক বক্তব্যের পর বিশ্বের ১৩৪টি দেশ উচ্চ কণ্ঠে পরমাণু সমঝোতার প্রতি সমর্থন ঘোষণার পাশাপাশি অবিলম্বে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের আহ্বান জানান।
গত ৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রা¤প তাঁর ভাষণে পরমাণু সমঝোতাকে ভয়ানক সমঝোতা হিসেবে আখ্যায়িত করেন। ইরানের সঙ্গে পরমাণু সমঝোতায় যেসব দেশ সই করেছে তার অন্যতম হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ওবামা সরকার এই সমঝোতায় সই করলেও ট্রা¤প প্রথম থেকেই এর বিরোধিতা করে আসছেন। তবে ট্রা¤েপর এ অবস্থানকে মেনে নেয় নি আন্তর্জাতিক সমাজ।

৯ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মধ্যে ইরানি ত্রাণ
মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও উগ্র বৌদ্ধদের হাতে নির্যাতিত অসহায় রোহিঙ্গা মুসলিমরা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়ার পর ইরানের উপ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইব্রাহিম রহিমপুরের নেতৃত্বে সেদেশের একটি প্রতিনিধি দল গত ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭ বাংলাদেশে আসেন। ইরানের প্রতিনিধিরা শরণার্থীদের সঙ্গে দেখা করে তাঁদের খোঁজখবর নেন।
রোহিঙ্গা মুসলমানদের জন্য ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের পাঠানো প্রথম ত্রাণবাহী কার্গো বিমানও ৫০ টন ত্রাণ নিয়ে গত ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭, চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। ত্রাণ সামগ্রীর মধ্যে ছিল তাঁবু, কম্বল, চা, চিনি, তেল, কাপড়চোপড়, ওষুধসহ ৯ ধরনের পণ্য সামগ্রী।
ইরানি প্রতিনিধিদলের নেতৃত্বে থাকা ইরানের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইবরাহীম রাহিমপুর এসব ত্রাণ চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মো. জিল্লুর রহমান চৌধুরীর কাছে হস্তান্তর করেন। এ সময় সংসদ সদস্য মঈনুদ্দিন খান বাদলও উপস্থিত ছিলেন।
ত্রাণ হস্তান্তরের সময় ইরানের উপ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, ‘নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ায় আমরা বাংলাদেশের প্রশংসা করি ও কৃতজ্ঞতা জানাই। কিছু ত্রাণ সামগ্রী দিতে পেরে আমরা আনন্দিত। মিয়ানমারে যা হচ্ছে তা অমানবিক, নিষ্ঠুর এ হত্যাকা- বন্ধ করা উচিত। অতীতেও আমরা নির্যাতিত মানুষের পাশে ছিলাম, এখনও আছি, ভবিষ্যতেও থাকব।”
ইরানের রেড ক্রিসেন্ট ত্রাণ সংস্থার প্রধান মোর্তেজা সালিমি এর আগে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা মুসলমানদের মাঝে ত্রাণ বিতরণের ক্ষেত্রে কোনো সহযোগিতার আশ্বাস দেয় নি। ত্রাণগুলো বাংলাদেশে জরুরি আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা মুসলমানদের মাঝে বণ্টন করার কথাও জানান তিনি।
উল্লেখ্য, গত ২৫ আগস্ট থেকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর হত্যা নির্যাতন শুরুর পর এ পর্যন্ত হাজার হাজার মানুষ হতাহত এবং চার লাখের বেশি মানুষ শরণার্থীতে পরিণত হয়েছে।

১০ বিশ্বে বিজ্ঞান শিক্ষায় পঞ্চম ইরান
সর্বোচ্চ বিজ্ঞান শিক্ষিত দেশের তালিকায় পঞ্চম অবস্থান অর্জন করেছে মুসলিম দেশ ইরান। এ তালিকায় শীর্ষে রয়েছে চীন। এরপরে দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া। ফোর্বস এর ২০১৬ সালের পরিসংখ্যানে এই চিত্র উঠে এসেছে। এ পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১৬ সালে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল এবং গণিত বিষয়ে ৩ লাখ ৩৫ হাজার ইরানি ¯œাতক ডিগ্রি স¤পন্ন করেছেন।
একই সময়ে চীনে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল এবং গণিত বিষয়ে ¯œাতক ডিগ্রি স¤পন্ন করেছেন ৪৭ লাখ। এ সংখ্যা নিয়ে বিশ্বের সর্বোচ্চ বিজ্ঞান শিক্ষিত দেশ হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছে দেশটি। অন্যদিকে, ভারত গত বছর বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল এবং গণিত বিষয়ে ২৬ লাখ নতুন ¯œাতকধারী তৈরি করে দ্বিতীয় অবস্থান অর্জন করেছে।
এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র নতুন ৫ লাখ ৬৮ হাজার ¯œাতকধারী নিয়ে বিশ্বে তৃতীয় ও ৫ লাখ ৬১ হাজার ¯œাতকধারী নিয়ে চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে রাশিয়া।
বিজ্ঞান শিক্ষিত দেশের তালিকায় ইরানের পরেই রয়েছে মুসলিম দেশ ইন্দোনেশিয়া। তারপরে রয়েছে জাপান। দেশ দুটি যথাক্রমে ২ লাখ ৬ হাজার ও ১ লাক ৯৫ হাজার বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল এবং গণিত বিষয়ে ¯œাতকধারী নিয়ে ষষ্ঠ ও সপ্তম অবস্থানে রয়েছে।

১১ বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ গ্যাস উৎপাদনকারী দেশ ইরান
আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থার (আইইএ) সর্বশেষ প্রতিবেদন বলছে, ২০১৬ সালে বিশ্বে তৃতীয় সর্বোচ্চ পরিমাণ গ্যাস উৎপাদনকারী দেশ ছিল ইরান। বৈশ্বিক জ্বালানি বাজার পরিস্থিতির ওপর সর্বশেষ প্রতিবেদনে এই চিত্র তুলে ধরেছে আইইএ।
প্রতিবেদনে সংস্থাটি বলেছে, গত বছর ইরান ১৯০ বিলিয়ন কিউবিক মিটার (বিসিএম) গ্যাস উৎপাদন করেছে। অর্থাৎ বৈশ্বিকভাবে মোট উৎপাদিত গ্যাসের ৫ দশমিক ৩ শতাংশ উৎপাদন হয়েছে দেশটিতে।
আইইএ এর প্রতিবেদনে জানানো হয়, গত বছরে শীর্ষ গ্যাস উৎপাদনকারী দেশ ছিল যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া। ২০১৬ সালে দেশ দুটি যথাক্রমে ৭৪৯ বিসিএম (মোট গ্যাসের ২০.৭ ভাগ) ও ৬৪৪ বিসিএম (১৭.৭ ভাগ) গ্যাস উৎপাদন করেছে।
ইরানের পরে চতুর্থ ও পঞ্চম গ্যাস উৎপাদনকারী দেশ কানাডা ও কাতার। দেশ দুটি ১৭৪ বিসিএম ও ১৬৫ বিসিএম গ্যাস উৎপাদন করেছে।
আইইএ এর প্রতিবেদনে আরও জানানো হয়, ২০১৬ সালে বিশ্বে অপরিশোধিত তেল উৎপাদনে পঞ্চম ছিল ইরান। এই ক্যাটাগরিতে শীর্ষে ছিল সৌদি আরব। তারপরেই দ্বিতীয় রাশিয়া, তৃতীয় যুক্তরাষ্ট্র ও চতুর্থ কানাডা।

১২ ইরানের পর্যটন শিল্পের রমরমা অবস্থা
আমেরিকার একটি প্রভাবশালী গণমাধ্যম বলছে, পশ্চিমা পর্যটন সংস্থাগুলো যখন এই আশঙ্কায় করছে যে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রা¤প পারমাণিবক চুক্তি বানচাল করে দিতে পারেন। ঠিক সে সময় আকস্মিকভাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াচ্ছে ইরানের পর্যটন শিল্প। সরকারি তথ্যমতে, গত ইরানি বছরের শেষ নাগাদ ৬০ লক্ষাধিক পর্যটক ইরান ভ্রমণ করেছেন। অর্থাৎ আগের বছরের তুলনায় গত বছর পর্যটক বেড়েছে অর্ধেক এবং ২০০৯ সালের তুলনায় বেড়েছে তিন গুণ।
সম্প্রতি সিএনএন এর প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৫ সালে তেহরান ও বিশ্ব শক্তিগুলোর মধ্যে পারমাণবিক চুক্তি স¤পাদনের প্রেক্ষিতে পরের বছর ইরানের ওপর থেকে অধিকাংশ নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়। ফলে দেশটিতে আকস্মিকভাবে পর্যটক প্রবাহ ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। অবরোধ প্রত্যাহারের পর ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ ও লুফথানসা (ডিএলএকেওয়াই) এর মতো ইউরোপীয় এয়ারলাইন্সগুলো ইরানে পুনরায় সরাসরি ফ্লাইট চালু করে। অন্যদিকে, ইরানি কর্তপক্ষও ভিসা পদ্ধতিতে শিথিলতা নিয়ে আসেন। ফলে ব্যাপক পর্যটক আসতে শুরু করে দেশটিতে। বর্তমানে পর্যটকদের জন্য আবাসিক হোটেলের চাহিদা আকাশ ছুঁয়েছে।
অপরদিকে, ইরানের পর্যটন শিল্পের চাঙ্গাভাব স্থানীয় উদ্যোক্তা ও বিদেশি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে।
যদিও পশ্চিমা কিছু ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান প্রেসিডেন্ট ট্রা¤প পারমাণবিক চুক্তি বানচাল করে দিতে পারেন- এই আশঙ্কায় ইরানে বিনিয়োগে অনাগ্রহী। তবে আন্তর্জাতিক হোটেল ব্যবসায়ীরা পর্যটকদের অধিক পরিমাণের কক্ষের চাহিদা পূরণে দ্রুত এগিয়ে আসছে।
ফ্রান্সের হোটেল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান অ্যাকোর (এসিসিওয়াইওয়াই) প্রথম ২০১৫ সালে ইরানে তাদের শাখা চালু করে। বর্তমানে কো¤পানিটি সেখানে দুটি হোটেল পরিচালনা করছে। ¯েপনের মেলিয়া (এসএমআইজেডএফ) আগামী বছর ইরানে তাদের প্রথম হোটেল চালু করবে। এছাড়া সংযুক্ত আরব আমিরাতের রোটানা’র আগামী বছরের শুরুতে একটি হোটেল এবং ২০২০ সালের মধ্যে আরও তিনটি হোটেল চালু করার পরিকল্পনা রয়েছে ।
ইরানের রাষ্ট্রীয় পর্যটন সংস্থার তথ্যমতে, ২০২৫ সাল নাগাদ দেশটির ২ কোটি পর্যটক গ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে।

১৩ নানা আয়োজনে ইরানে জাতীয় চলচ্চিত্র দিবস উদযাপন
গত ১২ সেপ্টেম্বর নানা আয়োজনে ইরানে পালিত হয়েছে জাতীয় চলচ্চিত্র দিবস। এ উপলক্ষে ইরানের বিশাল চলচ্চিত্র পরিবারের প্রতি অভিনন্দন বার্তা দেন দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বাহরাম কাশেমি। এ বার্তায় কাশেমি বলেন, ‘পথচলার একশ’ বছরে ইরানি সিনেমা নজীরবিহীন, প্রশংসনীয় ও সদা চিরস্থায়ী চলচ্চিত্র কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। যারা এই ভূখ-ের সংস্কৃতি ও শিল্পের জন্য আবেগ-অনুভূতি ভাগাভাগি করে তাদের স্মৃতিতে দিনটি চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে।’
তিনি বলেন, অসংখ্য আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ইরানি সিনেমার হৃদয়¯পর্ষী ও প্রভাবশালী উপস্থিতি বিশ্বে ইরানি সংস্কৃতি ও শিল্পের স্বচ্ছ ও অগাধ ভাবমূর্তিকে তুলে ধরেছে। ইরানি সিনেমা পরিবারের কঠোর পরিশ্রমী সব সদস্যর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেনে কাশেমি।
উল্লেখ্য, ইরান ২০০০ সাল থেকে ১২ সেপ্টেম্বর জাতীয় চলচ্চিত্র দিবস হিসেবে উদ্যাপন করে আসছে। এ বছর ইরানি চলচ্চিত্রের শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে একটি উৎসবের আয়োজন করা হয়।
১৯০০ সালে শুরু হয় ইরানি চলচ্চিত্রের পথচলা।

১৪। ২১ দেশে ন্যানো পণ্য রপ্তানি করে ইরান
বর্তমানে বিশ্বের ২১টি দেশে ন্যানো পণ্য রপ্তানি করে ইরান। এ থেকে দেশটির আয় ৩০০ বিলিয়ন তুমান (ইরানি মুদ্রা) ছাড়িয়েছে। ইরানের ন্যানো প্রযুক্তি উন্নয়ন দপ্তরের শিল্প উন্নয়ন গ্রুপের পরিচালক আলী তাহারি গত ৯ সেপ্টেম্বর এই তথ্য জানান।
তিনি বলেন, ইরানের ন্যানো প্রযুক্তি বাজারের আকার ৩০০ বিলিয়ন তুমান ছাড়িয়েছে। বর্তমানে ইরান বিশ্বের ২১টি দেশে ন্যানো পণ্য রপ্তানি করছে।
তাহারি বলেন, ‘ন্যানো-ফ্যাব্রিক শিল্প উৎপাদন লাইনে তৎপরতা জোরদারের পর আমরা এই প্রযুক্তি দক্ষিণ কোরিয়ায় রপ্তানি করতে সক্ষম হয়েছি। একইসাথে চীনে রপ্তানির লক্ষ্যে আমরা একটি চুক্তি সই করেছি।’
ইরান ইতোমধ্যে জানিয়েছে দেশটি অস্ট্রেলিয়া, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া,তুরস্ক, রাশিয়া ও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশে ন্যানো পণ্য রপ্তানি করছে।

১৫ হারবাল ওষুধ রপ্তানি থেকে ইরানের আয় ৩৫০ মিলিয়ন ডলার
ইরান থেকে বছরে বুটি গোলাপ, জাফরান, সুগন্ধি লতাবিশেষ ও বিভিন্ন ধরনের হারবাল ওষুধ রপ্তানি হয় সাড়ে তিনশ’ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের। দেশটির কৃষি মন্ত্রণালয়ের হারবাল ওষুধ দপ্তরের পরিচালক পেইমান ইউসেফি আজার গত ৭ সেপ্টেম্বর এই তথ্য জানান।
তিনি বলেন, ইরানের কৃষি মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ নীতি সমূহের মধ্যে হারবাল ওষুধ সেবনের পরিমাণ বৃদ্ধি, এর চাষাবাদের উন্নয়ন এবং প্রযুক্তি ও প্রক্রিয়াজাতের আধুনিকায়ন করা অন্যতম।
ইরানে চলমান পানি সঙ্কটের মধ্যে কৃষি মন্ত্রণালয় হারবাল ওষুধ উৎপাদন বৃদ্ধির পরিকল্পনা করছে বলে উল্লেখ করেন এই কর্মকর্তা। বলেন, ওষুধি গাছের জন্য পানি স¤পদ কম প্রয়োজন হয়। তাই ওষুধি গাছ চাষাবাদের জন্য এটি একটি বড় সুবিধা।
আজার জানান, ওষুধি গাছের চাষাবাদ বিশ্বে একটি উদীয়মান অর্থনীতি হিসেবে দেখা দিয়েছে। এতে প্রবৃদ্ধির হার ৯ শতাংশ। দ্রুত অগ্রগতির কারণে নিকট ভবিষ্যতে কৃষি ক্ষেত্রে ওষুধি গাছ একটি গুরুত্বপূর্ণ খাতে পরিণত হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।

১৬ ইরানের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বৃদ্ধির আগ্রহ প্রকাশ করল বাংলাদেশ
ইরানের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বাড়ানোর আগ্রহ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ। তেহরানে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মজিবুর রহমান ভূঁইয়া ইরানের সেমনানে অনুষ্ঠিত অর্থনীতি বিষয়ক এক বৈঠকে এ আগ্রহ প্রকাশ করেন।
গত ১৪ সেপ্টেম্বর তেহরানের পূর্বে অবস্থিত সেমনান শহরে অনুষ্ঠিত বৈঠকে অন্যান্যের মধ্যে আফগানিস্তানের রাষ্ট্রদূত, চীনের একটি বাণিজ্যিক প্রতিনিধিদল, সেমনানের গভর্নর ও বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত অংশগ্রহণ করেন।
বৈঠকে মজিবুর রহমান ভূঁইয়া বলেন, ইরানের সঙ্গে তার দেশের বাণিজ্য বৃদ্ধির জন্য দুই দেশের এ সংক্রান্ত সম্ভাবনাময় খাতগুলো চিহ্নিত করার পাশাপাশি ইরান ও বাংলাদেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সফর ও সংলাপ বাড়াতে হবে। দুই দেশের দূতাবাসগুলো এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
বৈঠকে সেমনানের গর্ভনর মোহাম্মাদ রেজা খাব্বাজ তার প্রদেশে বিদেশি পুঁজি বিনিয়োগ বাড়ানোর উপায় নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি বলেন, এ পর্যন্ত বিশ্বের বহু দেশ সেমনান প্রদেশে পুঁজি বিনিয়োগের লক্ষ্যে চুক্তি সই করেছে। এ ছাড়া, নতুন যেকোনো পুঁজি বিনিয়োগকে স্বাগত জানানো হবে বলেও তিনি বিদেশি প্রতিনিধিদের আশ্বাস দেন।

১৭ ইরান ও হাঙ্গেরীর মধ্যে শিক্ষা ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতা সম্প্রসারণের ওপর গুরুত্ব আরোপ
সম্প্রতি হাঙ্গেরীর রাজধানী বুদাপেস্টে অনুষ্ঠিত ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান ও হাঙ্গেরীর মধ্যে গবেষণা সহযোগিতা বিষয়ক চতুর্থ গোল টেবিল বৈঠকে দু’দেশের মধ্যে শিক্ষা ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতা সম্প্রসারণের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়।
গত ৯ সেপ্টেম্বর (২০১৭) তারিখে অনুষ্ঠিত এ গোল টেবিল বৈঠকে ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আন্তর্জাতিক গবেষণা ও শিক্ষা কেন্দ্র (সিআইআরএফ)-এর প্রধান মোহাম্মাদ কাযেম সাজ্জাদপুর ও হাঙ্গেরীর ফরেন রিলেশন্স অ্যান্ড ট্রেড ইনস্টিটিউটের প্রধান মারটোন স্কোবেরল অংশগ্রহণ করেন। এছাড়া হাঙ্গেরীর উপপ্রধানমন্ত্রী যল্ট সেমজেন সম্মানিত অতিথি হিসেবে এবং বুদাপেস্টে নিয়োজিত ইরানি রাষ্ট্রদূত গোলামরেযা রাযাভী ইয়ায্দী, দু’দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিশেষজ্ঞগণ এবং সেøাভেনিয়া, পোল্যান্ড ও আর্মেনিয়াসহ আরো কয়েকটি দেশের বিশেষজ্ঞগণ এ গোল টেবিল বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
এ গোল টেবিল বৈঠকে হাঙ্গেরী ও ইরানের মধ্যকার সম্পর্ক, ইরান ও মধ্যপ্রাচ্য সম্পর্কে হাঙ্গেরীর দৃষ্টিভঙ্গি, মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে স্থিতিশীলতা আনয়নের জন্য নিরাপত্তা সহযোগিতা এবং ইরান ও হাঙ্গেরীর মধ্যে অর্থনৈতিক, জ্বালানি ও বাণিজ্য সহযোগিতাসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়।
হাঙ্গেরীর উপপ্রধানমন্ত্রী যল্ট সেমজেন বৈঠকের শুরুতে প্রদত্ত তাঁর বক্তব্যে এ মর্মে আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে, ইরান ও হাঙ্গেরীর ব্যাঙ্ক সমূহের মধ্যকার সম্পর্ক দু’দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক বিনিময় বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হবে। এছাড়া তিনি ইরান ও হাঙ্গেরীর শহরগুলোর মধ্যে সিস্টারহুড কাঠামোর আওতায় পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির জন্যও আহ্বান জানান।
বৈঠকে বুদাপেস্টে নিয়োজিত ইরানি রাষ্ট্রদূত গোলামরেযা রাযাভী ইয়ায্দী বলেন যে, দু’দেশের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার সম্প্রসারণ ঘটানো বুদাপেস্টস্থ ইরান দূতাবাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা। তিনি জানান যে, তেহরান ও বুদাপেস্টের মধ্যে সরাসরি বিমান যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার এবং দু’দেশের মধ্যে শিক্ষা ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

১৮ ইরানের মৎস্য সম্পদ রফতানি শতকরা ৬০ ভাগ বৃদ্ধি
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের মৎস্য সম্পদ রফতানি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। ইরানের ফিশারিজ অর্গানাইজেশনের প্রধান হাসান সালেহী গত ১১ সেপ্টেম্বর (২০১৭) তারিখে ঘোষণা করেন যে, পূর্ববর্তী চার মাসের ব্যবধানে ইরানের মৎস্য সম্পদ রফতানির পরিমাণ শতকরা ৬০ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে।
জনাব সালেহী উল্লেখ করেন যে, উক্ত সময়ে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মোট ৪১ কোটি ২০ লাখ ডলার মূল্যের মৎস্য সম্পদ রফতানি করেছে। তিনি আরো জানান যে, একই সময় অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধির ফলে ইরানের সামুদ্রিক সামগ্রী আমদানির পরিমাণ শতকরা ৩০ ভাগ হ্রাস পায়।
জনাব সালেহী আরো বলেন যে, বর্তমানে বিশ্বের প্রায় শতকরা এক ভাগ জনসংখ্যা ইরানে বসবাস করে, কিন্তু এ দেশে বর্তমানে বছরে ১৯ লক্ষ টন মৎস্য ও অন্যান্য জলজ সম্পদ উৎপাদিত হয়ে থাকে। তিনি আরো জানান যে, স্যামন মাছ ও খাভিয়ার (বিশেষ ধরনের বড় আকারের মাছর ডিম) উৎপাদনের ক্ষেত্রে ইরান বিশ্বের মধ্যে প্রথম স্থানের অধিকারী।
জনাব সালেহী উল্লেখ করেন যে, গত ২০ মার্চ ২০১৭ তারিখে সমাপ্ত ইরানি বছরে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান মৎস্য উৎপাদন খাতে যেসব গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করে তার ফলে ঐ বছরে ইরানে প্রায় ১১ লক্ষ টন মৎস্য সম্পদ উৎপাদিত হয়। তিনি বলেন, গত ইরানি বছরে দেশে মৎস্য শিল্পের যথেষ্ট উন্নতি হয় এবং এর ফলে দেশ থেকে মোট এক লাখ ২০ হাজার টন মৎস্য সামগ্রী রফতানি করে এ খাত থেকে মোট ৪১ কোটি ২০ লাখ ডলার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব হয়।

১৯ খোলা সাগরে টহল অভিযানে ইরানের ৪৮তম নৌবহর
গত ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭, খোলা সাগরে টহল দেয়ার জন্য ইরানের ৪৮তম নৌবহর বন্দর আব্বাস থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা করে। এ নৌবহরে আলভান্দ ডেস্ট্রয়ার এবং সহায়তাকারী যুদ্ধজাহাজ লাভান রয়েছে। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ইরানের নৌবাহিনীর কমান্ডার রিয়াল অ্যাডমিরাল হাবিবুল্লাহ্ সাইয়্যেরি।
এদিকে, আলবোর্জ ডেস্ট্রয়ার এবং সহায়তাকারী যুদ্ধজাহাজ বুশেহর সমন্বয়ে গঠিত ৪৭তম নৌবহর একইদিনে বন্দর আব্বাসে ফিরে এসেছে। নৌবহরটি খোলা সাগরে ৭৬ দিনের অভিযান শেষে ফিরে আসে।
অনুষ্ঠানে ইরানি নৌকমান্ডার হাবিবুল্লাহ্ সাইয়্যেরি বলেন, সাগরে সন্ত্রাসবাদ বিরোধী লড়াইয়ে ইরান একটি কার্যকর শক্তি হয়ে উঠেছে। এডেন উপসাগরে ইরানের নৌবাহিনী অব্যাহতভাবে অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, জলদস্যুর হুমকির বিরুদ্ধে বাণিজ্যিক এবং তেলবাহী জাহাজকে নিরাপত্তা দেয়ার জন্য এ অভিযান অব্যাহত রাখা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
এ সময়ে ৪৭তম নৌবহরের সাফল্যের কথাও তুলে ধরেন ইরানের শীর্ষস্থানীয় নৌকমান্ডার। তিনি জানান, ইরানের ৪৭তম নৌবহর ৪২০০ জাহাজকে পাহারা দিয়ে নিয়ে গেছে। খোলা সাগরে ইরানের নৌবহরের উপস্থিতি দেশটির বৈজ্ঞানিক এবং শিল্পখাতের সক্ষমতারই পরিচয় দিচ্ছে।

২০ তেহরানে ৩য় আন্তর্জাতিক ইরান ফার্মা রফতানি মেলা অনুষ্ঠিত
গত ১২ থেকে ১৪ সেপ্টেম্বর (২০১৭) তেহরানের বিখ্যাত ঈদগাহ্ মোসাল্লায়ে বোযোর্গে ৩য় আন্তর্জাতিক ইরান ফার্মা রফতানি মেলা অনুষ্ঠিত হয়। এ মেলায় ১৬৪টি গুরত্বপূর্ণ বিদেশি কোম্পানিসহ মোট ৫০২টি ওষুধ উৎপাদনকারী কোম্পানি অংশগ্রহণ করে।
গত ১২ সেপ্টেম্বর তারিখে অনুষ্ঠিত মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রী হাসান গাযীযাদে হাশেমী, ইরান সরকারের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসনের প্রধান গোলামরেযা আসগারী, ইন্দোনেশিয়ার ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং ইরানে নিয়োজিত ডেনমার্ক ও বুলগেরিয়ার রাষ্ট্রদূতদ্বয়সহ বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি অংশগ্রহণ করেন। এছাড়া মেলার ভেন্যুতে মেলার পাশাপাশি আরো কতোগুলো গরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয়; এসব কর্মসূচির মধ্যে ছিল দ্বিতীয় চিকিৎসা ও ওষুধবিষয়ক গ্রন্থমেলা, ১ম স্বাস্থ্যবিষয়ক গণমাধ্যম প্রদর্শনী এবং প্যাকেজিং, বিপণন ও রফতানিবিষয়ক বিভিন্ন কর্মশালা।
ইরান ফার্মা রফতানি মেলায় বিপুল পরিমাণে ওষুধপত্র, এপিআই, প্যাকেজিং শিল্পের উপকরণাদি, হারবাল ওষুধ ও উপকরণাদি, ওষুধ শিল্পে ব্যবহার্য যন্ত্রপাতি, হাতিয়ারপত্র ও উপকরণাদি, ওষুধ শিল্পের সাপ্লিমেন্টারি উপকরণাদি ও উপজাত, কসমেটিকস, ওষুধ বহির্ভূত স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্ট দ্রব্যাদি ইত্যাদি প্রদর্শিত হয় এবং এর পাশাপাশি হোমকেয়ার ও কন্ট্র্যাক্ট সার্ভিসেস-এরও ব্যবস্থা রাখা হয়।
বস্তুত পরিপূর্ণ সাফল্যের কারণে ৩য় আন্তর্জাতিক ইরান ফার্মা রফতানি মেলা মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের ওষুধ বাজারে একটি উল্লেখযোগ্য নতুন ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনায় পরিণত হয়।

২১ রাশিয়ায় ইরানি বায়োটেক্ ওষুধ আমেরিকান বায়োটেক্ ওষুধের স্থান দখল করলো
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানে উৎপাদিত বেশ কয়েকটি বায়োটেক্ ওষুধ রাশিয়ায় ঐসব ওষুধের বাজার শতকরা একশ’ ভাগ দখল করতে এবং রাশিয়ান বাজার থেকে ঐসব ক্যাটেগরির আমেরিকান বায়োটেক্ ওষুধকে বিতাড়িত করতে সক্ষম হয়েছে। উল্লেখ্য, ইতিপূর্বে রাশিয়ায় বায়োটেক ওষুধের বাজার পুরোপুরিভাবে আমেরিকায় উৎপাদিত ওষুধের দখলে ছিল। ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের ন্যাশনাল ট্যালেন্ট্স্ ফাউন্ডেশন গত ১০ সেপ্টেম্বর (২০১৭) এ তথ্য প্রকাশ করে।
প্রকাশিত তথ্যে আরো জানা যায় যে, বিজ্ঞান ভিত্তিক ও উদ্ভাবনমূলক অর্থনীতির ক্ষেত্রে ইতিপূর্বে ২০১৪ সালে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের অবস্থান যেখানে ছিল বিশ্বের মধ্যে ১২০তম সেখানে তা দ্রুত ঊর্ধ্বারোহী হয়ে ২০১৬ সালে ৪২তম স্থানে উন্নীত হয়েছে। অন্যদিকে এই প্রথম বারের মতো দু’টি ইরানি বায়োটেক্ ওষুধ ইউরোপে নিবন্ধিত হওয়ার প্রক্রিয়াধীন রয়েছে, যদিও রাশিয়ায় ইতিমধ্যেই পাঁচটি ইরানি বায়োটেক্ ওষুধ নিবন্ধিত হয়েছে এবং সে দেশের বাজারে ঐসব ওষুধের ক্ষেত্রে আমেরিকান ওষুধের পুরোপুরি স্থলাভিষিক্ত হতে সক্ষম হয়েছে। রাশিয়ায় রফতানিকৃত এসব ইরানি ওষুধের মধ্যে একটি ওষুধ মাল্টিপ্ল্ সেলেরোসিস্ (এম্এস্) চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এ এন্টি-ক্যান্সার ওষুধটি রাশিয়া কর্তৃক অতি সম্প্রতি অনুমোদিত হয়েছে ও বর্তমানে সে দেশে রফতানি করা হচ্ছে। এছাড়া প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া সমাপ্তির পর বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের ইরানি ওষুধ ইরাকে ও তুরস্কে রফতানি হতে যাচ্ছে।

২২ ইরানি চিকিৎসা গবেষক কম্বিনেশন ক্যান্সার থেরাপির নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের একজন চিকিৎসা গবেষক কম্বিনেশন ক্যান্সার থেরাপির একটি নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন। ইরানের ইসলামি উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান ও গবেষণা শাখার এ গবেষক কর্তৃক উদ্ভাবিত ও ব্যবহৃত এ পদ্ধতিতে ফটোডাইনামিক থেরাপি (পিডিটি) ও কোল্ড অ্যাটমোসফিয়ারিক প্লাসমা (সিএপি)-র কম্বিনেশন ঘটানো হয়েছে।
এ পদ্ধতির উদ্ভাবক ইসলামি উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান ও গবেষণা শাখার রেডিওলোজি ইঞ্জিনিয়ারিং-এর পিএইচডি-র ছাত্রী ও গবেষক লায়লা কারীমী গত ৫ সেপ্টেম্বর (২০১৭) সাংবাদিকদের প্রদত্ত সাক্ষাৎকারে জানান যে, তিনি মানুষের ফুসফুসের ক্যান্সার সেল্-এর ওপর গবেষণা চালিয়ে এ নতুন পদ্ধতিটি উদ্ভাবন করেন এবং তিনি তাঁর প্রকল্পটি নিয়ে তিন বছর কাজ করার পর তাঁর থিসিসের হাইপোথেসিস-এর যথার্থতা প্রমাণ করতে সক্ষম হন।
লায়লা কারীমী বলেন, বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার চিকিৎসার ক্ষেত্রে, বিশেষ করে চামড়ার ক্যান্সারের চিকিৎসায় ফটোডাইনামিক থেরাপি (পিডিটি) একটি কার্যকর পন্থা হিসেবে স্বীকৃত। কিন্তু এ পদ্ধতিটি অপেক্ষাকৃত কম ব্যয়সাপেক্ষ ও কম কষ্টদায়ক হলেও এর কার্যকরিতা রেডিওথেরাপির তুলনায় কম।
তিনি আরো উল্লেখ করেন যে, বর্তমানে বিশ্বেÑএবং ইসলামি উন্মুক্ত বিশ্ববদ্যালয়ের বিজ্ঞান ও গবেষণা শাখার ফিজিক্স্ রিসার্চ সেন্টারেওÑএ বিষয়ে অপক্ষোকৃত নতুন একটি পদ্ধতি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা অব্যাহত রয়েছে যেটিকে কোল্ড অ্যাটমোসফিয়ারিক প্লাসমা (সিএপি) বলা হয় এবং এটি বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সারের চিকিৎসায়, বিশেষ করে চামড়ার চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
লায়লা কারীমী বলেন, বিশ্বের বিজ্ঞানী সমাজ কর্তৃক প্রথম বারের মতো পরিচালিত এ গবেষণায় আমরা ফটোডাইনামিক থেরাপি (পিডিটি) ও কোল্ড অ্যাটমোসফিয়ারিক প্লাসমা (সিএপি)-র কম্বিনেশন ঘটাতে সক্ষম হয়েছিÑ ক্যান্সার চিকিৎসায়, বিশেষত চামড়ার ক্যান্সারের চিকিৎসায় যার কার্যকরিতা ফটোডাইনামিক থেরাপি (পিডিটি)-র তুলনায় শতকরা ৩৭ ভাগ ও কোল্ড অ্যাটমোসফিয়ারিক প্লাসমা (সিএপি)-র তুলনায় শতকরা ৪১ ভাগ বেশি।
তিনি আরো জানান যে, এ প্রকল্পের পরবর্তী পর্যায়ে চিকিৎসা নৈতিকতার মান রক্ষা করেই এটি সরাসরি মানব দেহে প্রয়োগ করা হবে।

২৩ আন্তর্জাতিক র‌্যাঙ্কিং-এ ইরানি জুনিয়র বাইসাইকেল চালকের দ্বিতীয় স্থান অধিকার
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের জুনিয়র বাইসাইকেল চালক আমীর হোসাইন জামশিদিয়ান বাইসাইকেল চালনার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক র‌্যাঙ্কিং-এ দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছে। ইউনিয়ন সাইক্লিস্ট্ ইন্টারন্যাশ্নেল্ (ইউসিআই) কর্তৃক ঘোষিত ‘মেন্ জুনিয়র পয়েন্টস্ রেস্ র‌্যাঙ্কিং’-এর তালিকায় তার এ অবস্থানের কথা ঘোষণা করা হয়।
উল্লেখ্য, ইউসিআই হচ্ছে সারা বিশ্বের স্পোর্টস্ সাইক্লিং-এর গভর্নিং বডি। জামিশিদিয়ান ইউসিআই জুনিয়র ট্র্যাক সাইক্লিং ওয়ার্লড্ চ্যাম্পিয়নশীপ্স্-এ ছেলেদের বিভাগে প্রতিযোগিতা করে বিস্ময়কর সাফল্যের অধিকারী হবার ফলে এ অবস্থানের অধিকারী হতে সক্ষম হয়।
ইউসিআই জুনিয়র ট্র্যাক সাইক্লিং ওয়ার্লড্ চ্যাম্পিয়নশীপ্স্ গত ২৩ থেকে ২৭ আগস্ট (২০১৭) ইতালির মন্টিচিয়ারিতে অনুষ্ঠিত হয় এবং এতে বিশ্বের ৪২টি দেশ থেকে মেয়েদের বিভাগে একশ’ জনেরও বেশি প্রতিযোগী ও ছেলেদের বিভাগে প্রায় দু’শ’ জন প্রতিযোগী ব্যক্তিগতভাবে ও গ্রুপ ভিত্তিতে অংশগ্রহণ করে। স্প্রিন্ট ও অ্যান্ডুর‌্যান্স রেসিং পর্যায়ে এ প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়।
জামশিদিয়ান উপরিউক্ত অবস্থানের অধিকারী হওয়া ছাড়াও ছেলেদের বিভাগে ‘জুনিয়র অম্নিয়াম র‌্যাঙ্কিং’-এ নবম স্থান লাভ করে। এ ক্ষেত্রে একই বিভাগে সুইজারল্যান্ডের অ্যালেক্স ভোগেল মোট ১৩৯০ পয়েন্ট পেয়ে সর্বোচ্চ স্থান দখল করতে সক্ষম হয় এবং দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে আয়ারল্যান্ডের জেনো ইয়ং। এছাড়া এ প্রতিযোগিতায় ছেলেদের জুনিয়র স্ক্র্যাচ র‌্যাঙ্কিং তালিকায় ইরানি টীম ১২১০ পয়েন্ট পেয়ে সপ্তম স্থান অধিকার করে।
উল্লেখ্য, ইউসিআই জুনিয়র ট্র্যাক সাইক্লিং ওয়ার্লড্ চ্যাম্পিয়নশীপ্স্ হচ্ছে জুনিয়র বাইসাইকেল চালকদের জন্য বিভিন্ন ধরনের ও বিভিন্ন দূরত্বের ট্র্যাক সাইক্লিং-এর ক্ষেত্রে কতগুলো ওয়ার্লড্ চ্যাম্পিয়নশীপ ইভেন্টের সমন্বিত প্রতিযোগিতা। এ প্রতিযোগিতাগুলো ইউনিয়ন সাইক্লিস্ট ইন্টারন্যাশনাল (ইউসিআই) কর্তৃক পরিচালিত হয়ে থাকে।

২৪ ভারোত্তোলনে ১৮ বছরের পুরনো রেকর্ড ভাঙলেন মোরাদি
ভারোত্তোলনে দীর্ঘ ১৮ বছরের পুরনো বিশ্ব রেকর্ড ভাঙতে সক্ষম হয়েছেন ইরানের অলি¤িপক চ্যা¤িপয়ন সোহরাব মোরাদি। গত ২৩ সেপ্টেম্বর এশিয়ান ইনডোর অ্যান্ড মার্শাল আর্ট্স গেমসে স্বর্ণ জয়ের পাশাপাশি এই নতুন রেকর্ড গড়েন ২৯ বছর বয়সী এই ভারোত্তোলক।
এশিয়ান ইনডোর গেমসে সমন্বিতভাবে ৪১৩ কেজি ওজন তুলে নতুন বিশ্ব রেকর্ড গড়েন ইরানি এই ভারোত্তোলক।।
সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘আমি অত্যন্ত কঠোর পরিশ্রম করেছি, ভারোত্তোলনের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছি। দিনে তিনবার টানা প্রশিক্ষণ নিয়েছি। আমি আমার সময় শুধুমাত্র ভারোত্তোলনের জন্য বরাদ্দ রেখেছি, অন্যকিছুর জন্য নয়। এটাই আমার সফলতার রহস্য।’
মোরাদি বলেন, ‘বিশ্ব রেকর্ড আমার এসব প্রচেষ্টার ফসল। একদিন আমার স্বপ্ন ছিল অলি¤িপকে সোনা জেতার, তা করেছি। কারণ এটা সব অ্যাথলেটের কাছেই খুবই গুরুত্বপূর্ণ স্বপ্ন। আমার আরেকটি লক্ষ্য ছিল বিশ্ব রেকর্ড ভাঙার, সেটিও করেছি।’
এর আগে ১৯৯৯ সালে এথেনসের ওয়ার্ল্ড চ্যা¤িপয়নশিপে সমন্বিতভাবে ৪১২ কেজি ওজন তুলে বিশ্ব রেকর্ড করেছিলেন গ্রিসের আকাকিওস কাকিয়াসভিলিস।

২৫ এশিয়ান স্টুডেন্টস্ ফুটবল প্রতিযোগিতায় ইরানি টীমের শিরোপা বিজয়
সম্প্রতি ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের শীরায নগরীতে অনুষ্ঠিত ‘এশিয়ান স্টুডেন্টস্ ফুটবল প্রতিযোগিতা ২০১৭’-তে ইরানি টীম শিরোপা অর্জন করেছে। এ প্রতিযোগিতায় ফাইন্যাল ম্যাচে ইরানি টীম ইন্দোনেশীয় টীমকে ৩-০ গোলে পরাজিত করে এ গৌরব অর্জন করে।
‘এশিয়ান স্টুডেন্টস্ ফুটবল প্রতিযোগিতা ২০১৭’ ইরানসহ বিশ্বের আটটি দেশের ৯টি টীমের ২৭০ জন খেলোয়াড়ের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হয়। ৬ থেকে ১৬ সেপ্টেম্বর (২০১৭) পর্যন্ত অনুষ্ঠিত এ প্রতিযোগিতায় দুইটি ইরানি টীম এবং দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, ভারত, মালয়েশিয়া আফগানিস্তান ও ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় টীম অংশগ্রহণ করে।
এ প্রসঙ্গে যোগ করা যেতে পারে যে, চলতি সেপ্টেম্বর (২০১৭)-এর শুরুর দিকে ইরানের ন্যাশন্যাল বীচ সকার টীম প্রথম বারের মতো বৈশ্বিক র‌্যাঙ্কিং-এ দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে। ‘বীচ সকার ওয়ার্লড্ কাপ বাহামাস্ ২০১৭’-তে ইরানি টীম তৃতীয় স্থান অধিকার করলে তার অবস্থান বৈশ্বিক র‌্যাঙ্কিং-এ দ্বিতীয় স্থানে উন্নীত হয়। বৈশ্বিক র‌্যাঙ্কিং-এর প্রথম পাঁচটি টীম হচ্ছে থাক্রমে : ব্রাজিল (৪,৫৬৩ পয়েন্ট), ইরান (৩,০৮১ পয়েন্ট), পর্তুগাল (৩,০৬৩ পয়েন্ট), তাহিতি (২,৬৩১ পয়েন্ট) ও রাশিয়া (২,৫৩৮ পয়েন্ট)।

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য ইরানের ত্রাণ সাহায্য

মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও উগ্রবাদী বৌদ্ধদের নির্যাতনের মুখে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা মুসলমানদের জন্য ইরানের রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির মানবিক ত্রাণবাহী তৃতীয় কার্গো বিমান বাংলাদেশে পৌঁছেছে। গত ১১ অক্টোবর বিকালে ৩০ টন ত্রাণসামগ্রী নিয়ে ইরানের একটি কার্গো ফ্লাইট চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দরে অবতরণ করে।
ইরান দূতাবাসের প্রথম কাউন্সিলর এবং মিশনের ডেপুটি প্রধান নেয়ামতুল্লাহ জাদেহ এসব ত্রাণসামগ্রী চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) মো. হাবিবুর রহমানের কাছে হস্তান্তর করেন। এসময় অন্যদের মধ্যে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্টের ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য শেখ শফিউল আজম ও রেড ক্রিসেন্টের চট্টগ্রাম ইউনিটের সচিব আব্দুল জব্বার উপস্থিত ছিলেন।
উল্লেখ্য, এর আগে গত ১৫ সেপ্টেম্বর রোহিঙ্গা মুসলমানদের জন্য ইরানের প্রথম ত্রাণবাহী কার্গো বিমান বাংলাদেশে পৌঁছে। ইরানের উপ পররাষ্ট্রন্ত্রী ইব্রাহিম রহিমপুরের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল ত্রাণ বিতরণের পাশাপাশি রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেছেন। প্রথম দফায় পাঠানো ৪০ টন ত্রাণ সামগ্রীর মধ্যে ছিল তাঁবু, কম্বল, চা, চিনি, তেল, কাপড়চোপড়, ওষুধসহ ৯ ধরনের পণ্য সামগ্রী।
এরপর ৩০ সেপ্টেম্বর ৩০ টন ত্রাণের দ্বিতীয় কার্গো বিমান বাংলাদেশে পৌঁছায়। এ দফায় পাঠানো ত্রাণসামগ্রীর মধ্যে ছিল ৩০০ তাঁবু, ৫ হাজার ৫০০ কম্বল, ১০ হাজার টিনজাত খাবার এবং এক টন ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম।
ইরানের রেড ক্রিসেন্টের কর্মকর্তা মোর্তেজা সালিমি এর আগে জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা মুসলমানদের জন্য মোট ১৫০ টন সাহায্য পাঠানো হবে।
ত্রাণবাহী কার্গো বিমানে রেড ক্রিসেন্টের কর্মকর্তাদের পাশাপাশি ইরানের পররাষ্ট্র ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা অন্তর্ভুক্ত ছিলেন বলে ইরানি রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির প্রধান আলী আসগর পেইভান্দি জানান। তিনি আরও জানান, বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের জন্য ইরান অস্থায়ী হাসপাতাল নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী নাসিমের সাথে ইরানের স্বাস্থ্য উপমন্ত্রী ডা. সাইয়্যেদ হাদি আইয়াজির সাক্ষাৎ
গত ১২ অক্টোবর ২০১৭ বাংলাদেশ সফররত ইরানের সামাজিক বিষয়ক স্বাস্থ্য উপমন্ত্রী ডা. সাইয়্যেদ হাদি আইয়াজি এবং ইরান রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির চেয়ারম্যান ডা. আলী আসগর পায়ভান্দির নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সচিবালয়ের দফতরে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের সাথে সাক্ষাৎ করেন। এসময় স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মোঃ সিরাজুল হক খান, স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের সচিব মোঃ সিরাজুল ইসলামসহ বাংলাদেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির ঊর্দ্ধতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
ইরানের স্বাস্থ্য উপমন্ত্রী পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সাহায্য করায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, মানবতার এই দৃষ্টান্তের ফলে বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি আরো উজ্জ্বল হয়েছে। বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের জন্য রেড ক্রিসেন্টের সহায়তায় ইরান খাদ্য, চিকিৎসা সরঞ্জাম ও ওষুধ সহায়তা দিচ্ছে। টেকনাফ ও উখিয়ায় ইরান সরকার অস্থায়ীভাবে একটি রেফারেল হাসপাতাল ও পাঁচটি মোবাইল ক্লিনিকের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। এজন্য সেই এলাকায় ভূমি বরাদ্দে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সহায়তা চেয়েছেন তিনি।
ইরানের রেড ক্রিসেন্টের চেয়ারম্যান শরাণার্থী ক্যা¤প ও তার আশেপাশে পরিবেশগত স্বাস্থ্য বিপর্যয় ও সংক্রামক রোগের বিস্তার যেন না ঘটে সেদিকে লক্ষ্য রাখার জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে ত্রাণ সহায়তা নিয়ে এগিয়ে আসায় ইরানের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে মোহাম্মদ নাসিম বলেন, এই উদ্যোগের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ও ইরানের মধ্যে বিদ্যমান দ্বিপাক্ষিক বন্ধুত্ব আরো জোরদার হবে। তিনি টেকনাফ ও উখিয়ায় হাসপাতাল ও ক্লিনিক স্থাপনে দ্রুত জমি বরাদ্দের সহযোগিতার আশ্বাস দেন।
এসময় মন্ত্রী বাংলাদেশে মেডিক্যাল কলেজগুলোতে ইরানের আরো শিক্ষার্থী পাঠানো এবং বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক মানের ওষুধ আমদানিতে পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানান।

ইরানি প্রবাদ

سر کسی را با پنبه بریدن.
উচ্চারণ : সারে কেসীরা’ বা’ পাম্বে বোরীদান
অর্থ : কারো মাথা তুলা দিয়ে কেটে ফেলা।
মর্মার্থ : কাউকে ন¤্র ও মোলায়েম ভাষায় ধোঁকা দেয়া বুঝাতে এই প্রবাদটি ব্যবহৃত হয়।
سر کسی را گرم کردن.
উচ্চারণ : সারে কেসী রা’ গার্ম কার্দান
অর্থ : কারো মাথা গরম করা।
মর্মার্থ : কাউকে দিয়ে কোনো কাজ করানো বা কোনো কথা বলানো অর্থে প্রবাদটি ব্যবহৃত হয়।
سر کسی کلاه گذاردن.
উচ্চারণ : সারে কেসী কোলা’হ গুযা’রদান
অর্থ : কারো মাথায় টুপি রাখা।
মর্মার্থ : কারো সরলতার সুযোগ নিয়ে ধোঁকা দেয়া বা অর্থিকভাবে প্রতারিত করা বুঝাতে এই প্রবাদটির ব্যবহার অত্যন্ত ব্যাপক।
سرکوفت زدن (دادن).
উচ্চারণ : সার কূফত যাদান
অর্থ : মাথায় বাড়ি দেয়া।
মর্মার্থ : এই প্রবাদের মাধ্যমে কাউকে তিরস্কার করা বা গালমন্দ করা বুঝানো হয়।
سرکه نقد به از حلوای نسیه.
উচ্চারণ : সিরকেয়ে নাকদ বে আয হালওয়ায়ে নাসিয়ে
অর্থ : নগদ সিরকা বাকিতে হালওয়ার চেয়ে উত্তম।
মর্মার্থ : ক্ষিধের সময় শুকনো রুটি পাওয়া সেই ভাল খাবারের চেয়ে উত্তম যা এখনো হাতে আসে নি।
سرکیسه را شل کردن.
উচ্চারণ : সারেকীসে রা’ শোল কার্দান
অর্থ : থলের মুখ ঢিলা করে দেয়া।
মর্মার্থ : কোনো উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করা বুঝাতে এই প্রবাদটির ব্যবহার ব্যাপক।
سرکیسه کردن.
উচ্চারণ : সার কীসে কার্দান
অর্থ : মাথা থলের মধ্যে নেয়া।
মর্মার্থ : যে কোনো পন্থায় ও কৌশলে কারো টাকাপয়সা হস্তগত করা বুঝাতে এই প্রবাদ ব্যবহৃত হয়।
سر گاو توی خمره گیر کردن.
উচ্চারণ : সারে গাও তুয়ে খোমরে গীর কার্দান
অর্থ : গরুর মাথা মটকায় আটকে যাওয়া।
মর্মার্থ : কোনো ব্যাপারে বড় ধরনের সমস্যা দেখা দিয়েছে এবং তা সমাধানের পথ বের করা প্রয়োজন বুঝাতে এই প্রবাদ ব্যবহৃত হয়।
سرگنجشک خورده است.
উচ্চারণ : সারে গুনযেশ্ক খোরদে আস্ত
অর্থ : চড়–ই পাখির মাথা খেয়েছে।
মর্মার্থ : লোকটি বকবক করছে বা বেজায় বাচাল প্রকৃতির, এ কথা বোঝাতে এই প্রবাদ ব্যবহৃত হয়।

ফারসি ভাষা ও সাহিত্য

রাশিদুল ইসলাম ঃ ব
পারসিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজ যা ফারসি ভাষা হিসেবে পরিচিত। ভারতবর্ষে মুসলিম শাসনামলে ফারসি ভাষা ছিল রাজভাষা। একারণে বাংলা ভাষায় এখনো প্রচুর ফারসি ভাষা ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যা বাংলা সাহিত্য ও কবিতায় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, ফররুখ আহমদ থেকে শুরু করে আরো অনেকে ব্যবহার করেছেন। প্রতিদিন আমাদের বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত অনেক শব্দই যে ফারসি তা অনেকের অজানা। যেমন, ‘আবহাওয়া’ শব্দটির ‘আব’ অর্থ পানি ও ‘হাওয়া’ অর্থ বাতাস। অর্থাৎ পানি ও বাতাস মিলে আবহাওয়া হয়েছে। তেমনি বাবা, পা, দরদ, পিয়াজ, দূর এমন হাজার হাজার শব্দ আমরা বাংলা হিসেবে জানি যা আদতে ফারসি শব্দ।
ফারসি ভাষা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার পরিবার থেকে জন্ম হয়েছে। ঐতিহাসিকভাবে ফারসি প্রাচীন, মধ্যকাল ও আধুনিকÑ এ তিনভাগে বিভক্ত। প্রাচীন ফারসির উৎপত্তি ধরা হয় তৃতীয় শতাব্দীতে। সেই ব্যবিলনীয় সভ্যতার সময় দানিয়ুস প্রাচীন ফারসি ভাষা আবিষ্কার করেন। এরপর এলামাইট ও একিমিনীয়রা ফারসি ভাষা ব্যবহার করে। জরথুস্ত্রদের ধর্মগ্রন্থ ‘আভেস্তা’ লিখিত ছিল প্রাচীন ফারসি ভাষায়। এরপর নবম শতাব্দী পর্যন্ত প্রাচীন ফারসি মধ্যফারসি ভাষা হিসেবে চালু থাকে এবং আধুনিক ফারসি ভাষার ক্রমবিকাশ শুরু হয়। মাঝখানে কিন্তু হাজার বছর অতিক্রান্ত হয়ে যায়। মজার ব্যাপার হচ্ছে ইরানিদের আদি ভাষা ছিল আরবি। মানে ইসলামে খলিফাদের যুগে। অভিযোগ ওঠে বিজয়ী আরবরা পারস্যের প্রাচীন সাহিত্য ধ্বংস করে, কিন্তু গীবন থেকে শুরু করে আরো অনেক ঐতিহাসিক এ অভিযোগ অমূলক প্রমাণ করেছেন। পাহলভি স্ক্রিপ্ট রেখে পারস্যবাসী তখন আরবি স্ক্রিপ্ট ব্যবহার করতে শুরু করে। কিন্তু ফারসি ভাষা হারিয়ে যায় নি। ফারসি ভাষা ইরানের আশে পাশে পারস্য শাসক ও মুসলমান শাসকদের মাধ্যমে অন্যান্য ভাষা, যেমন হিন্দি বা তুর্কি ভাষার ওপর বিশাল প্রভাব বিস্তার করে। যেমন ধীরে বাংলা শব্দটি ‘অহেস্তে’ ফারসি থেকে হিন্দিতে ‘আহিস্তি’ বা বাংলায় আস্তে পর্যন্ত রূপান্তরিত হয়েছে। ফারসি ভাষাই উর্দু ভাষার জনক।
ফেরদৌসী
ফারসি ভাষার প্রাচীন কবি হচ্ছেন রুদাকি যিনি পাহলাভি স্ক্রিপ্ট রচনা করেন। তিনি মারা যান ৯৪০ খ্রিস্টাব্দে। প্রাচীন ফারসি ভাষার পা-ুলিপির সন্ধান পাওয়া যায় নি। মুখে মুখে এ ভাষায় রচিত কবিতা যুগের পর যুগ টিকে থাকে। তবে ফারসি ভাষা শুনলে আমাদের মানসপটে ভেসে ওঠে ‘শাহনামা’র কথা। এখন পর্যন্ত ‘শাহনামা’র যতগুলো হাতে লিখিত অনুলিপি পাওয়া গিয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে পুরাতন অনুলিপি ১২৭৬ থেকে ৭৭ সালে তৈরি। তার মানে মূল রচনার সাথে এ অনুলিপিটির পার্থক্য আড়াইশ’ বছর। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, এর আগের কোনো ‘শাহনামা’ কপি এখনো পাওয়া যায় নি। ‘শাহনামা’কে বলা হয় পূর্বের ‘ইলিয়াড’।
হাজার বছর কেটে গেছে। তারপরও মর্মর সৌধের মত ‘শাহনামা’ এক অলৌকিক প্রতিভার স্বাক্ষর বহর করছে। এ কাব্যের জন্যে প্রাচ্য ও প্রতীচ্য প-িতরা ফেরদৌসীকে ‘ইরানের হোমার’ বলে অভিনন্দিত করেছেন। ‘শাহনামা’ পৃথিবীর মহাকাব্যসমূহের অন্যতম। সাতটি বড় খ-ে বিভক্ত মহাকাব্যটি ষাট হাজার শ্লোকে সমাপ্ত। ফেরদৌসী অবিমিশ্র ফারসি ভাষায় ‘শাহনামা’ রচনা করেন।
প্রাগৈতিহাসিক শাসনামল থেকে আরবদের কর্তৃক পারস্য বিজয়ের পূর্ব পর্যন্ত পারস্যের গৌরবময় পুরাবৃত্ত কাব্যের মধ্য দিয়ে ‘শাহনামা’য় বর্ণিত রয়েছে। লোকগাথা, গল্প, উপাখ্যান, কিংবদন্তি, ইতিহাস ও ধর্মগ্রন্থগুলো থেকে এর উপকরণ নেয়া হয়েছে। ‘শাহনামা’র ঘটনাবলির বিস্তৃতিকাল তিন হাজার আটশ’ চুয়াত্তর বছর এবং এতে উনচল্লিশটি রাজবংশের শাসনকালের বিস্তৃত বিবরণী রয়েছে। প্রথম তিন হাজার বছরের কাহিনী নিছক উপাখ্যানভিত্তিক। পরবর্তী নয় শতাব্দীর ঘটনাবলি ইতিহাসের সাথে সম্পর্কিত।
ফেরদৌসী ৯৪১ সালে সমরখন্দের তুস নগরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার প্রচুর জমিজমা ছিল। ভালো লেখাপড়া করেছিলেন ফেরদৌসী। ছোট বেলা থেকে কবিতা লিখতেন। যৌবনে একান্তভাবে কবিতাচর্চায় আত্মনিয়োগ করেন। তাঁর একটি মাত্র কন্যাসন্তান ছিল যাকে নিয়ে তাঁর উচ্চাভিলাষ ছিল যে তাকে তিনি উপযুক্ত যৌতুক দিয়ে বিয়ে দেবেন। যৌতুকের অর্থ সংগ্রহে তিনি ‘শাহনামা’র কবিতা রচনা শেষ করেন। তার পর সুলতান মাহমুদ গজনীর সিংহাসনে আরোহণ করেন। সুলতান এ কাব্য দেখে মুগ্ধ হয়ে ‘শাহনামা’র ষাট হাজার শ্লোকের জন্যে ষাট হাজার রৌপ্য মুদ্রা দেন। কিন্তু কবির আশা ছিল আরো বেশি, নেহাত স্বর্ণমুদ্রা হলেও তিনি হয়ত খুশি হতেন। জীবনের সেরা ৩০টি বছর এ কবিতার পেছনে ফেরদৌসীর অতিবাহিত হয়েছে। তার মূল্য রৌপ্যমুদ্রা? অভিমানে তিনি এসব মুদ্রা তাঁর শরবত বিক্রেতা, হাম্মাম খানার তত্ত্বাবধায়ক ও পুরস্কার বহনকারীদের বিতরণ করে দিয়ে তিনি গজনী ত্যাগ করেন।
ফেরদৌসীর বয়স তখন ৭০/৭১ বছর। এরপর তিনি ৮/৯ বছর বেঁচে ছিলেন। ১০২০ সালে তিনি ইন্তেকাল করেন। তুস নগরে তাঁকে সমাহিত করা হয়। ‘শাহনামা’র উপসংহারে তিনি লিখেছিলেন, এ কাব্য অনেক শৌর্যবীর্য ও বীরত্বের এক উজ্জ্বল আলেখ্য। এ কাহিনী ইরানের প্রত্যেক চিত্তকে জাগ্রত করবে এবং এর সুর তাদেরকে গৌরবজনক কাজের দিকে প্রেরণা দেবে। একজন লজ্জাবতী ললনাও যদি এ কাব্য পাঠ করে, সে একজন সাহসী যোদ্ধায় পরিণত হবে।

বৃদ্ধ বয়সে ফেরদৌসী ‘ইউসুফ জুলেখা’ নামে ১৮ হাজার পদবিশিষ্ট আরও একটি কাব্য রচনা করেন।
রোস্তম-সোহরাব কাহিনী
বীরশ্রেষ্ঠ রোস্তম ছিলেন ইরানের সেনাপতি। পারস্যের বীরত্বগাথা সাহিত্যে তাঁর প্রভাবশালী চরিত্র অনন্য নজির স্থাপন করে আছে। দাস্তানে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। মাতৃগর্ভে রোস্তমের অস্বাভাবিক আকারের জন্য তাঁর জন্ম হয় সিজারিয়ান পদ্ধতিতে। কথিত আছে, একটি অলৌকিক পাখি তাঁর পরিবারকে সবসময় সাহায্য করত। বালক বয়স থেকে তাঁর বীরত্ব ও সাহসের কথা চারপাশে ছড়িয়ে যায়। রোস্তমের বয়স যখন মাত্র ৮ বছর তখন এক ক্ষিপ্ত বন্য হাতিকে তিনি পরাস্ত করেন।
সেনাপতি রোস্তম শিকারে বের হয়ে তুরান দেশের এক অরণ্যে ঘুমিয়ে পড়েন। ঘুম থেকে উঠে তিনি দেখেন তাঁর প্রিয় ঘোড়া ‘রুখ্শ’ চুরি হয়ে গেছে। ঘোড়ার পদাঙ্ক অনুসরণ করে তিনি অরণ্য থেকে বের হয়ে এসে শামিঙ্গনের রাজধানীতে পৌঁছান। তাঁকে চিনতে পেরে দেশটির রাজা তাঁর ঘোড়া খুঁজে দেয়ার ব্যবস্থা করেন। রাজগৃহে অবস্থানের সময় রাজার পরমা সুন্দরী কন্যা তাহমিনার প্রেমে পড়েন রোস্তম। তাঁদের বিয়ে হয়। এভাবে কিছুদিন কেটে যাওয়ার পর তাঁর ইরানের কথা মনে পড়ে। তাহমিনার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দেশে ফেরেন। তাহমিনাকে একটি মোহর দিয়ে বলেন, তাঁর নামাঙ্কিত এ মোহরটি পুত্রসন্তান হলে যেন তার বাজুবন্ধে বেঁধে দেওয়া হয়Ñ যা তার পিতৃপরিচয় দেবে।
তাহমিনার পুত্রসন্তান হলে তার নাম রাখলেন সোহরাব। পুত্রকে নিয়ে যাবেন রোস্তম, এই ভয়ে তাহমিনা তাঁর স্বামীর কাছে খবর পাঠালেন যে, তাঁর কন্যাসন্তান হয়েছে। রোস্তম নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েন। এভাবে কুড়ি বছর চলে গেল। পিতৃপরিচয় নিয়ে সোহরাবের বন্ধুরা তাঁকে নানাধরনের বিদ্রƒপ করত। পিতার কীর্তি তাঁকে প্রেরণা যোগাত। পিতৃখোঁজে সোহরাব বের হন সহ¯্রাধিক সৈন্য নিয়ে। তাঁর বাসনা পিতাকে খুঁজে বের করে ইরানের সিংহাসনে বসাবেন। পথিমধ্যে বেশ কয়েকটি যুদ্ধ হল। সোহরাব একের পর এক যুদ্ধে জয়লাভ করে ইরান পৌঁছলেন। ইরানস¤্রাট কায়-কায়স সোহরাবের পরিচয় রোস্তমের কাছে গোপন করে তাঁদেরকে যুদ্ধের ময়দানে কৌশলে মুখোমুখি করে দিলেন। দিনের পর দিন পিতা ও পুত্রের মধ্যে যুদ্ধ হয়। কেউ পরাস্ত হয় না। কেউ কারো পরিচয় স্বীকার করে না। এক পর্যায়ে সোহরাব মল্লযুদ্ধে রোস্তমকে পরাস্ত করেন। কিন্তু পারস্য যুদ্ধের রীতি অনুযায়ী প্রথমবার পরাস্ত করলেও পুনরায় যুদ্ধে চূড়ান্ত ফয়সালা হওয়ার নিয়ম। তাই ফের পিতা-পুত্রের লড়াই চলতে লাগল। দিন কয়েক এভাবে চলার পর এবার পরাস্ত পুত্র পিতাকে বললেন, ‘আপনি তো বললেন, প্রথম পরাস্ত করাই চূড়ান্ত বিজয় নয়। আরেকবার লড়াই হোক।’ কিন্তু পিতা রোস্তম সে সুযোগ না দিয়ে পুত্র সোহরাবের বক্ষ খঞ্জরে বিদীর্ণ করলেন। মুত্যুর আগে দু’জনই দু’জনের পরিচয় জিজ্ঞেস করলে সোহরাব তাঁর বাজুবন্ধে বাঁধা রোস্তমের নামাঙ্কিত মোহরটি দেখালে মৃতপ্রায় পুত্রকে কোলে টেনে নেন পিতা। শেষ মুহূর্তে পিতাপুত্রের যুদ্ধের ময়দানে সম্মুখ সমরে লিপ্ত থাকার কথা শুনে তাহমিনা যখন এসে পৌঁছলেন ততক্ষণে সোহরাব তাঁদেরকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেছেন না ফেরার দেশে।
পারস্যের সাহিত্য বা ফারসি ভাষা যেমন বীরত্ব কাহিনীতে ভরপুর তেমনি ইতিহাস ঐতিহ্যে এ ভাষা মিষ্টি মধুর ও সহজবোধ্য। অলঙ্করণের জন্য ফারসির এ স্বাদ দেশ থেকে দেশান্তরে খুব সহজে ছড়িয়ে পড়েছিল। আধ্যাত্মিকতা সহজেই এ ভাষার ওপর ভর করে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে মরমি সাধকদের মনে ও প্রাণে। মাত্র একটি লাইনেই ফারসি ভাষায় জীবন ও জগতের গভীর থেকে গভীরতর মর্মবাণী বা গভীর কোনো চিন্তা সহজবোধ্য হয়ে ধরা দেয়। আবার আধুনিক ফারসি কবিতা সর্বশ্রেষ্ঠ ছন্দোময় সংগীতময়তা ও শব্দের মিশুক অর্থ মিলে অসাধারণ কাব্যময় হয়ে ওঠে। পূর্ববতী সংগীতময়তার সঙ্গে ভাষাগত কমনীয়তা মিলে এক অত্যাশ্চর্য দ্যুতির সৃষ্টি করে। ঐতিহ্যবাহী পারস্য কাব্য থেকে শুরু করে কাসিদা, মসনভি, গযল ও রুবাইয়াৎÑ কোনোটির তুলনা কোনোটির সঙ্গে চলে না। ওমর খৈয়াম, সাদি, হাফেজের মত মহাকবিরা এ ফারসি ভাষায় তাই বিশ্ব শ্রেষ্ঠ সাহিত্য, মহাকাব্য রচনা করেছেন মেধা, মনন ও প্রবল বাগ্মীতায় অনায়াসে। বিজ্ঞান সাধনা, গণিতের জটিল সূত্রের উদ্ভাবন ও বিভিন্ন সমস্যার উপমা ও ছক তৈরি করেছেন ফারসি ভাষায়।
ওমর খৈয়াম
ওমর খৈয়াম জন্মগ্রহণ করেন ১০৪৮ সালে খোরাসানের নিশাপুরে। ‘খৈয়াম’ শব্দের অর্থ তাঁবু প্রস্তুতকারক। পুরো নাম গিয়াস উদ্দিন আবুল ফাত ওমর ইবনে ইবরাহিম নিশাপুরি।
ওমর খৈয়ামের বয়স যখন ২৫ বছর তখন সংগীত ও বীজগণিতের ওপর তাঁর দুটি বই বাজারে সাড়া ফেলে দিয়েছিল। ১০৭০ সালে ওমর খৈয়াম প্রখ্যাত আইনজীবী আবু তাহেরের আমন্ত্রণে সমরখন্দে যান এবং সেখানে বীজগণিতের সমস্যা নিয়ে তাঁর বিখ্যাত বই ‘টিরেটাইজ অন ডেমোস্ট্রেশন অব প্রবলেম অব অ্যালজেব্রা’ রচনা করেন। এরপর ইসফাহানে ওমরখৈয়াম স্থাপন করেন বিজ্ঞান পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র। এরপর তিনি মার্ভে চলে যান। যা আজকে তুর্কমেনিস্তান হিসেবে পরিচিত। সেই সময় মার্ভ ইসলামি শিক্ষা ও গবেষণা জন্য বিখ্যাত ছিল। তিনি গণিতের বিভিন্ন বিভাগ, যেমন কিউবিক ফরমুলা বা জ্যামিতির বৃত্ত সম্পর্কিত নানা ধরনের জটিল সমীকরণের সমাধান করেন। অনুপাত ও সমানুপাত নিয়েও গণিতের বিভিন্ন ফয়সালা দেন খৈয়াম। কবিতার জন্য যতটা বিখ্যাত হয়ে আছেন ওমর খৈয়াম, বিজ্ঞান ও গণিত সাধনার জন্যও তিনি সমানভাবে বিখ্যাত। ওমর খৈয়াম ১১২৩ সালে নিশাপুরে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি পশ্চিমা দুনিয়ায় সাহিত্যকর্মের জন্য অসাধারণ খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘নগদ যা পাও হাত পেতে নাও, বাকির খাতায় শূন্য থাক, দূরের বাদ্য লাভ কি শুনে, মাঝখানে যে বেজায় ফাঁকা’Ñ এমন অসংখ্য চরণ ও সাহিত্যকর্ম দেশকাল অতিক্রম করে আজো মানুষের মনে অনুরণিত হচ্ছে। ওমর খৈয়াম রচিত ‘রুবাইয়াৎ’ পাশ্চাত্য জগতে দারুণ সাড়া ফেলে।
ফরিদুদ্দিন আত্তার
আবু তালেব মুহম্মদ ফরিদউদ্দিন আত্তার এক আতর ব্যবসায়ীর গৃহে ১১৩০ সালে জন্মগ্রহণ করেন। এজন্য তাঁর উপাধি আত্তার। তিনি ওষুধ বিক্রি করতেন। শৈশবেই আত্তার ছিলেন ধর্মীয় শিক্ষার অনুরাগী। কৈশোরে তিনি ইমাম রেযা (আ.)-এর মাযারে চলে যান। তারপর দেশভ্রমণে বের হন। হেকিম হিসেবে তিনি ছিলেন প্রখ্যাত। কাব্য রচনা, দার্শনিক চিন্তা, বিপুল বৈভব ও খ্যাতি নিয়ে ভালোই ছিলেন তিনি। একদিন তাঁর দোকানের সামনে কোথা থেকে এক ভিক্ষুক এসে ওষুধপত্রের দিকে তীক্ষè দৃষ্টি ফেলে। আত্তার বিরক্ত হয়ে বলেন, ‘যাও আগে বাড়ো।’ ভিক্ষুক এই অবমাননায় ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, ‘আমি তো যাচ্ছি, তুমি তোমার নিজের দিকে নজর দাও।’ সেখানেই তৎক্ষণাৎ প্রাণত্যাগ করলেন ভিক্ষুকটি। এ অপ্রত্যাশিত ঘটনায় আত্তার বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে পড়লেন। তিনি বুঝলেন যে, যা কিছু অর্জন করেছেন তা খুবই সামান্য। কি সেই শক্তি যার বলে মানুষ ইচ্ছামাত্রই নিজেই নিজের প্রাণ বিসর্জন দিতে পারে? পা-িত্যভিমান, সংসার ও অনিত্য বৈভব, সবকিছুর মায়া কাটিয়ে সেই যে ঘর থেকে শাশ্বত সত্যের অন্বেষণে আত্তার বের হলেন, অন্তত ৪০ বছর পর্যন্ত তিনি বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করলেন।
মুসলিম জগতে সফর পবিত্র বিষয়। অন্তত সেই যুগে সফর না করলে মানুষের শিক্ষা পরিপূর্ণ হত না। আত্তার রেই, কুফা, মিসর, দামেস্ক, মক্কা, জুডা, তুর্কিস্তান, ভারতবর্ষ সহ অনেক দেশ ভ্রমণ করেন। বিভিন্ন দেশ থেকে সাধু ও দরবেশদের কাছ থেকে নানা শিক্ষামূলক রচনাব সংগ্রহ করেন। দীর্ঘস্থায়ী অধ্যাবসায় ও আধ্যাত্মিক চর্চা তাঁর জীবনকে পূতস্নিগ্ধ ও উন্নত করে। এরপর তিনি লেখায় মনোনিবেশ করেন। ১১৪টি গ্রন্থ রচনা করেন তিনি। তার মধ্যে ৩০টির হদিস পাওয়া যায়। ‘তাযকিরাতুল আওলিয়া’, ‘পান্দনামা’, ‘লিসানুল গায়েব’ মত অসংখ্য বই লিখলেও জীবনে তিনি কখনো কারো স্তুতিগাথা রচনা করেন নি। মহাকবি জালালউদ্দীন রুমি যাঁকে ‘সুফি জগতের রুহ’ বলে অভিহিত করেছিলেন সেই আত্তারকেও ধর্মান্ধদের খপ্পরে পড়ে শেষ পর্যন্ত নির্বাসনে চলে যেতে হয়েছিল। ১২২১ সালে তিনি মোগলদের হাতে নিহত হন।
নেজামি
১১৪০ সালে নেজামি গাঞ্জা বা আজকের আযারবাইজানে জন্মগ্রহণ করেন। যিনি ‘লাইলি-মজনু’, ‘খসরু-শিরী’, ‘এস্কেন্দারনামা’র মত অসংখ্য অমর কাব্য গ্রন্থের রচয়িতা। তাঁর পুরো নাম নেজাম উদ্দিন আবু মুহাম্মদ ইলিয়াস। হাকিম হিসেবে তাঁর সুপরিচিতি ছিল। সাহিত্য ও ধর্মশাস্ত্রে তিনি ছিলেন সুপ-িত। সহজ-সরল জীবন যাপন করতেন নেজামি। তিনি ১২০৯ সালে মারা যান।
জালালুদ্দিন রুমি
জালালুদ্দিন মোহাম্মদ রুমি ‘মৌলানা’ হিসেবে পরিচিত, যার অর্থ হচ্ছে পথপ্রদর্শক। রুমি ছিলেন ইরানের অন্যতম মহাকবি ও সুফিসম্রাট। আজকের আফগানিস্তানের বাল্খ এলাকায় ১২০৭ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। রুমির বয়স যখন ১২ বছর বয়স তখন মঙ্গলদের আগ্রাসনের কারণে তাঁর পরিবার তুরস্কে চলে যায়। শৈশবে তিনি তাঁর পিতার বন্ধু বিখ্যাত সাধক বোরহানুদ্দিনের কাছে শিক্ষা গ্রহণ করেন। সিরিয়ার আলেপ্পো ও দামেস্কে বেশ কয়েক বছর রুমি জ্ঞান সাধনায় মগ্ন থাকেন। অধ্যাপনাই ছিল তাঁর জীবনের ব্রত। তাঁর স্ত্রী খেরা খাতুন বলেছেন, ‘পাঠগৃহে এক মানুষ উঁচু একটি দীপাধার ছিল। তার পাশে দাঁড়িয়ে রুমি সারারাত জ্ঞান সাধনা করতেন।’ রুমি মহাসাধক শাম্স তাবরীযের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন। সাধনার সৌন্দর্যে সংগীতের প্রচলনের জন্য রুমির সমালোচনা করেছিলেন অনেকে। কিন্তু রুমির ব্যবহার ছিল অত্যন্ত নম্র ও বিনয়ী। পরিচ্ছন্ন পোশাক, লাল রংয়ের আবা ও চোগা পড়তে ভালবাসতেন রুমি। ১২৭৩ সালের ১৬ ডিসেম্বর রুমি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর রচনার প্রধান বৈশিষ্ট্য হল আশাবাদ। পাপময় এ সংসারে মানুষ জীবন সংগ্রামে জয়ী হবেÑ এ সম্পর্কে তিনি কখনো তাঁর লেখায় সন্দেহ ও নৈরাজ্যের ছায়াপাত করেন নি। ‘মসনভি’ ও ‘দিওয়ান’ তাঁর সুপ্রসিদ্ধ গ্রন্থ। ‘দিওয়ান’-এ প্রায় পঞ্চাশ হাজার শ্লোক রয়েছেÑ যার সবগুলোই গযল। ইশ্ক বা প্রেম এসব গযলের বিষয়বস্তু। এসব গযল উপস্থাপনে বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার হতো।

শেখ সা’দী
ইরানের বিশ^বিখ্যাত আরেকজন কবির নাম শেখ সা’দী। শেখ সা’দী একাধারে কবি ও সাহিত্যিক। তিনি পদ্যে যেমন জগতসেরা, তেমনি গদ্যেও অতুলনীয়। তাঁর জন্ম সাল ১২০৪ বা ১২১২ খ্রিস্টাব্দ। আর মৃত্যু ১২৯১ বা ৯২ খ্রিস্টাব্দ।
শেখ সা’দীর পুরো নাম আবু মুহাম্মদ মুশররফ উদ্দীন মুসলেহ ইবনে আবদুল্লাহ। সা’দী তাঁর কবিনাম। তৎকালীন মুসলিম বিশে^র শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপিঠ বাগদাদের নিজামিয়া মাদ্রাসায় তিনি অধ্যয়ন করেন। এরপর বক্তা হিসেবে বিশে^র দিকে দিকে, যেমন হেজাজ ও সিরিয়া সফর করার পর জন্মভূমি শিরাজে ফিরে আসেন এবং আমৃত্যু শিরাজেই অবস্থান করেন। তিনি পারস্যের আতাবক বংশীয় রাজাদের বিশেষ করে সাআদ ইবনে আবু বকরের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন। তাঁর সমাধি ইরানের শিরাজ নগরীতে অবস্থিত। মহাকবি হাফেযও এই শিরাজেই চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন।
ফারসি ভাষার ওপর সা’দী যে প্রভাব বিস্তার করেন তা কালজয়ী। এ কারণে বর্তমান ইরানে প্রচলিত ভাষার সাথে সা’দীর রচনাবলির চমৎকার মিল পাওয়া যায়। ইরানে প্রচলিত অধিকাংশ প্রবাদ সা’দীর রচনাবলি হতেই মানুষের মুখে মুখে চর্চিত হয়ে আসছে। সা’দী তাঁর সমসাময়িক বা তাঁর আগের অনেক লেখকের বিপরীতে সহজ সরল ভাষায় ও ইঙ্গিতে কথা বলার শিল্পকে অনেক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। সা’দী তাঁর জীনদ্দশাতেই ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁকে ‘চিরন্তন কথাশিল্পী’ ও ‘কথা সাহিত্যের বাদশাহ’ নামে আখ্যায়িত করা হয়। তাঁর রচনাবলি ‘কুল্লিয়াতে সা’দী’ বা সা’দী রচনা সমগ্রের মধ্যে সন্নিবেশিত আছে। তবে ‘গুলিস্তান’ ও ‘বুস্তান’ কিতাব দু’টি আলাদাভাবে ছাপা হয়ে থাকে এবং এই দু’টি কিতাবের খ্যাতি বিশ^জনীন। ‘গুলিস্তান’ পদ্য ও গদ্যের মিশেলে একটি অতুলনীয় নীতিশাস্ত্রীয় সাহিত্যকর্ম। কিন্তু ‘বুস্তান’ শুধু কবিতায় লেখা। উভয় কিতাবের খ্যাতি জগতজোড়া। সা’দীর গযলকাব্যের উপজীব্য জাগতিক প্রেম। তাতে তিনি অনেকগুলো নীতিশাস্ত্রীয় ও আধ্যত্মিক গযলও রচনা করেছেন। সা’দী শরীয়তের গ-ির বাইরে যেকোনো ধরনের চিন্তাদর্শনকে গোমরাহি বলে সাব্যস্ত করেন। তাঁর মতে সর্বাবস্থায় কুরআন ও হাদিসের নির্দেশনাকে বিবেচনায় রেখে চলতে হবে। সা’দীর নীতিশাস্ত্রীয় উপদেশগুলো কাল ও স্থানের গ-ি ছাড়িয়ে মানবসভ্যতাকে সুবাসিত করে রেখেছে। সেই বিবেচনায় তাঁর দু’টি গ্রন্থের নাম ‘গুলিস্তান’ ও ‘বুস্তান’ যথার্থ ও সার্থক। উভয় নামের অর্থ যথাক্রমে ফুলের স্থান ও সুবাসের স্থান। সা’দী একদিকে তাসাওওফ ও সুফিদের প্রশংসা করেছেন, অন্যদিকে ভ-দের তীব্র সমালোচনা ও কটাক্ষ করেছেন।

মহাকবি হাফেয শিরাজি
ফারসি সাহিত্যের কিংবদন্তি কবি মহাকবি হাফেয শিরাজি। তাঁর জন্মসাল ১৩২৫ বা ১৩২৬ খ্রিস্টাব্দ। ইরানের শিরাজ নগরীতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর অন্তিম শয়ানও শিরাজে এবং ১৩৮৯ বা ১৩৯০ সালে। ঐতিহাসিক শিরাজ নগরীর মুসল্লা মহল্লায় তাঁর মাযার এখনো দুনিয়ার প্রেমিক ও কবিদের যিয়ারতগাহ বা তীর্থভূমি হিসেবে প্রসিদ্ধ। জানা যায়, তিনি কাব্যচর্চায় তাঁর পূর্ববর্তী কবি সানায়ী, আনোয়ারী, নিযামী, সা’দী, খাকানী, আত্তার প্রমূখ কবিদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। আর পরবর্তী যুগের সকল ফারসি কবি ও জার্মান কবি গ্যাটে তাঁর দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছেন।
কবি হাফেযের মূল নাম মুহাম্মদ। উপাধি শামসুদ্দীন আর কবিনাম হাফেয। হাফেযের পিতার নাম বাহাউদ্দীন বা কামাল উদ্দীন ছিল বলে ভিন্ন ভিন্ন বর্ণনা পাওয়া যায়। তবে তাঁর দাদার নাম ছিল গিয়াস উদ্দীন। বর্ণিত আছে, হাফেযের পিতা ইসফাহানের বাসিন্দা ছিলেন। পরে ব্যবসার উদ্দেশ্যে পরিবার-পরিজনসহ দেশ ছেড়ে শিরাজ চলে আসেন। তাঁর মায়ের আদি নিবাস কাযরুনে এবং তিনি শিরাজের কাযরুন মহল্লায় থাকতেন। পিতার মৃত্যুর পর হাফেয এর মা সন্তানদের নিয়ে অর্থনৈতিক দৈন্যের শিকার হন। ফলে হাফেয রুটির দোকানে চাকরি নেন এবং ফাঁকে ফাঁকে পাশর্^বর্তী মাদ্রাসায় লেখাপড়া করেন। পরবর্তীকালে শিরাজের নামকরা জ্ঞানীগুণিদের শিষ্যত্ব গ্রহণের সুযোগ হয়। অল্প বয়সে কুরআনে হেফ্য করার সুবাদে তিনি হাফেয নামে খ্যাত হন।
হাফেযের জীবনকালে ইরানে চরম রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছিল। শিরাজে সিংহাসনের দাবিতে খুনাখুনি ছিল নিত্যকার ঘটনা। এর মধ্যেই হাফেয বিস্ময়করভাবে জ্ঞানচর্চা ও কবিতাচর্চায় সিদ্ধি লাভ করেন।
হাফেয তাঁর জন্মস্থান শিরাজকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতেন । সে কথা তাঁর কবিতায় একাধিকবার ব্যক্ত হয়েছে। একই কারণে তিনি কোথাও সফর পর্যন্ত করেন নি। মাত্র দু’বার তিনি অল্প সময়ের জন্য ইয়ায্দ ও হরমুজ সফর করেন। তাঁর একটি ছেলেসন্তান অল্প বয়সে ইন্তিকাল করেছেন মর্মে তাঁর ‘দিওয়ান’ বা ‘কাব্য’ থেকে জানা যায়।
কুরআন তাফসীরের জ্ঞানে গভীর পা-িত্যের পাশাপাশি কাব্যচর্চায় হাফেযের অসধারণ দক্ষতা তাঁর সময়েই ইরানের সীমানা পেরিয়ে বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল। যে কারণে ভারতের দাক্ষিণাত্যের শাসক মাহমুদ দক্ষিণী তাঁকে দাক্ষিণাত্য সফরের আমন্ত্রণ জানান। কিন্ত হাফেয হরমুজ প্রণালি পর্যন্ত গিয়ে জাহাজে আরোহণের পর সমুদ্রে ঝড়তুফান দেখে ভয় পান এবং শিরাজে ফিরে আসেন। তৎকালীন বাংলার সুলতান গিয়াস উদ্দীন আযম শাহের সাথে হাফেযের পত্রালাপ ছিল। ‘দিওয়ানে হাফেয’ এর একটি বিখ্যাত গযলে বাঙ্গালা এবং সুলতান গিয়াস উদ্দীন আযম শাহের মজলিসে উপস্থিত হওয়ার জন্য কবির কান্নাজড়া উদ্দীপনার কথা ব্যক্ত হয়েছে।
৭৯১ হিজরিতে মহাকবি হাফেজ শিরাজী এই নশ^র জগৎ ত্যাগ করেন। কবি হাফেযের একমাত্র কাব্যের নাম ‘দিওয়ানে হাফেয’। এতে রয়েছে গযল, কাসিদা, কিতআ ও রূবায়াতের সন্নিবেশ। হাফেয নিজে তাঁর ‘দিওয়ান’ গ্রন্থিত করে যান নি, বরং তাঁর সমসাময়িক বন্ধু মুহাম্মদ গুলান্দাম ফারসি সাহিত্যের এই অমূল্য গ্রন্থটি সংকলন করেন। মুহাম্মদ গুলান্দামের বর্ণনা অনুযায়ী, হাফেয ধর্মতত্ত্ব, ফিকাহ্ ও তাফসীরশাস্ত্র ছাড়াও জ্যামিতি ও সংগীতে অভিজ্ঞ ছিলেন। তিনি তাফসীরে কাশশাফের টীকা লিখেছেন বলেও কথিত আছে।
হাফেযের কবিতার মূল প্রতিপাদ্য প্রেম। মানবজীবনের দুঃখ-বেদনা ও বিরহ-বিচ্ছেদ তাঁর কবিতায় বাঙ্ময় হয়েছে। হাফেযের প্রেম মানুষের চিন্তাকে শেষ পর্যন্ত আধ্যাত্মিক প্রেমের দিকে ধাবিত করে। জাগতিক ও আধ্যাত্মিক প্রেমের এমন জয়গান যুগপৎভাবে আর কোনো কবি গাইতে পারেন নি, এখানেই হাফেযের শ্রেষ্ঠত্ব। এ কারণে বিজ্ঞজনেরা তাঁকে ‘অদৃশ্যের কণ্ঠস্বর’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। হাফেয এখনো ইরানের সর্বস্তরের মানুষের কাছে প্রাতঃস্মরণীয়।

ইরানের সমকালীন শ্রেষ্ঠকবি শাহরিয়ার
ইরানের সমকালীন শ্রেষ্ঠ কবি শাহরিয়ার। পুরো নাম সাইয়্যেদ মুহাম্মদ হুসাইন বাহজাত তাবরিযী। কবি নাম শাহরিয়ার। তিনি ইরানের আযারবাইজান প্রদেশের অধিবাসী। ফারসি ও আযারি ভাষায় সমান দক্ষতার সাথে তিনি কাব্যচর্চা করেন।
১২৮৫ ইরানি সাল মোতাবেক ১৯০৬ সালে আযারবাইজানের কারাহচামান অঞ্চলে শাহরিয়ার জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবকাল অতিবাহিত করেন পৈত্রিক ও মাতৃনিবাস পূর্ব আযারবাইজানের বুস্তানাবাদ জেলার পল্লিগাঁয়ে। বাবার নাম ছিল মীর আগা খোশগনাভী। তাবরিযে তিনি আইন পেশায় নিয়োজিত ছিলেন।
শাহরিয়ার তাবরিযে মাধ্যমিক শিক্ষা শেষে উচ্চতর পড়ালেখার উদ্দেশ্যে ১৩০০ ইরানি সালে (১৯২১ খ্রি.) তিনি তেহরানে আসেন। ১৩১৩ সালে (১৯৩৪) খোরাসানে থাকাকালে তাঁর পিতা ইন্তিকাল করেন। ১৯৩৬ সালে কৃষি ব্যাংকে চাকরি নিয়ে তিনি তাবরিয চলে যান।
তাঁর বিখ্যাত কাব্যের শিরোনাম ‘হায়দার বাবায়া সালাম’। এটি তুর্কি আযারবাইজানি ভাষায় রচিত এবং ১৩৩৩ (১৯৫৪) সালে প্রকাশিত। হায়দার বাবা একটি পাহাড়ের নাম, যে পাহাড়ের পাদদেশে কবি শাহরিয়ারের শৈশবকাল অতিবাহিত হয়েছে। কবি এই কাব্যে গ্রামীণ জীবনের নিসর্গ আর শৈশবের স্মৃতিকে মনের মাধুরি মিশিয়ে চিত্রিত করেছেন।
তাবরিয বিশ^বিদ্যালয়ের সাহিত্য ফ্যাকাল্টির পক্ষ হতে তাঁকে সম্মানজনক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করা হয়। ১৯৫৩ সালে মায়ের ইন্তিকাল হয় এবং একই সালে আযিযা আমীদ খালেকী নামে এক নিকটাত্মীয়ার সাথে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। শাহরিয়ারের দুই মেয়ে শাহ্রযাদ, মারইয়াম এবং ছেলে হাদী। কবি শাহরিয়ার ১৯৮৮ সালে ৮৩ বছর বয়সে ইন্তিকাল করেন। তাঁর অন্তিম ইচ্ছা অনুযায়ী মৃত্যুর পর তাঁকে তাবরিযের মাকবিরাতুশ শোয়ারা বা কবিদের কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।
শাহরিয়ার কাসিদা, মসনবী, গযল, কিতআ ও নিমাঈ রীতির কবিতায় সিদ্ধহস্ত ছিলেন। তাঁর বিখ্যাত একটি গযল হযরত আলী (আ.)-কে সম্বোধন করে লেখা, যার প্রথম কলি ‘হে আলী! হে রহমতের বিহঙ্গপাখি।’
তিনি ইরানি বিপ্লবের নেতাদের প্রশংসায় কবিতা রচনা করেন। যেমন ইমাম খোমেইনী, রাহবার খামেনেয়ী ও হাশেমী রাফসানজানীর নামে তাঁর কবিতা সমধিক প্রসিদ্ধ। তিনি ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের রাহবার সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ীর উপস্থিতিতে স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করেন।
শাহরিয়ার মহাকবি হাফেযের বড় আসক্ত ও হাফেযের জন্য নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন। তিনি বলেন, নিজের কবিনাম চয়নের সময় তিনি দু’রাকাত নামায পড়ে কবি হাফিযের ‘দিওয়ান’ নিয়ে বিশেষ নিয়মে ফাল দেখেন। সে ভিত্তিতে তিনি তাঁর কবি নাম ধারণ করেন ‘শাহরিয়ার’। হাফেযের মতো শাহরিয়ারের কবিতায় বিরহ-বিচ্ছেদ, প্রেমের আকুতি ও মনের স্বচ্ছতার উদ্ভাস চিরভাস্বর। ইরানে ফারসি ২৮ মেহের কবি শাহরিয়ার স্মরণে দিবসটি কবিতা ও ফারসি সাহিত্য দিবস হিসেবে উদ্যাপিত হয়।