All posts by dreamboy

মানবাধিকার : ইসলামি ও পাশ্চাত্যের নিরিখ

মুজতাহিদ ফারুকী

মানবাধিকার নিয়ে কথা বলতে গেলে আমাদেরকে অধিকার কাকে বলে তা বুঝে নিতে হবে। বুঝতে হবে মৌলিক অধিকার এবং মানবাধিকারের মধ্যে পার্থক্য। এরপর আসবে মানবাধিকার ও ইসলামে মানবাধিকারের প্রসঙ্গ। সাধারণভাবে ‘অধিকার’ বলতে কোনো কিছুর উপর একজন মানুষের নৈতিক বা আইনগত দাবি বোঝায়। একজন মানুষ জন্ম নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার খাবারের চাহিদা জন্মায়। এই দাবি বা চাহিদা তার বাবা-মার কাছে, পরিবারের কাছে, সমাজের কাছে এবং রাষ্ট্রের কাছে। এই দাবিটি একেবারেই প্রাথমিক। এটা তার লাগবেই। এমনই আরও কিছু দাবি তার থাকে। সে কোথায় থাকবে, কী পরবে, কী শিখবে ইত্যাদি যৌক্তিক বিষয়গুলো তার পরিবার যেমন মেনে নেয়, তেমনই সমাজ ও রাষ্ট্রও স্বীকার করে। সুতরাং মৌলিক অধিকার হলো নাগরিকদের প্রাথমিক অধিকার যা সংবিধানে লিখিত। এটি হলো মানুষের মৌলিক চাহিদা, যা রাষ্ট্র নিশ্চিত করে।
অন্যদিকে মানবাধিকার হলো সেই সব অধিকার যা সব মানুষের ক্ষেত্রে সর্বজনীনভাবে প্রযোজ্য। যেমন, পৃথিবীর যে প্রান্তেই একজন মানুষ জন্মগ্রহণ করে থাকুক না কেন, তার মর্যাদা হবে অন্য যে কোনও মানুষের সমান। ওই মানুষটি যে ধর্মের, যে জাতির, যে বর্ণের বা লিঙ্গের হোক না কেন তাকে পৃথিবীর সবচেয়ে সমৃদ্ধ, সবচেয়ে শক্তিশালী, সবচেয়ে উন্নত জাতির একজন মানুষেরই সমান মর্যাদা, সম্মান ও সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। এটাই মানবাধিকার এবং এটিও মৌলিক অধিকারের মধ্যেই পড়ে। তবে এই অধিকার নিশ্চিত করে বিশ্বের সব দেশের অংশীদারিত্বে গড়ে ওঠা সবার অভিন্ন প্লাটফর্ম জাতিসংঘ। বুঝতে হবে, মৌলিক অধিকার দেশে দেশে ভিন্ন হতে পারে। কিন্তু মানবাধিকার বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত, সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নীতিমালা যা বিশ্বের প্রতিটি মানুষের জন্য সম মর্যাদার নিশ্চয়তা দেয়। এটি মানব সমাজের সব সদস্যের জন্য সর্বজনীন, সহজাত, হস্তান্তরের অযোগ্য এবং অলঙ্ঘনীয়। বলা হয়, মানবাধিকার প্রতিটি মানুষের এমন এক ধরনের অধিকার যেটা তার জন্মগত ও অবিচ্ছেদ্য। মানুষ এ অধিকার ভোগ করবে এবং চর্চা করবে। এ চর্চার মধ্য দিয়ে অন্যের মানবাধিকার নিশ্চিত হলেই বিশ্বশান্তি নিশ্চিত ও মানবতার কল্যাণ হওয়া সম্ভব। উল্লেখ্য, সদস্য দেশগুলোর নাগরিকদের মানবাধিকার নিশ্চিত করার জন্য জাতিসংঘ কোনও দেশকে নির্দেশ দিতে, এমনকি চাপ প্রয়োগও করতে পারে।
সম্প্রতি বিশ্বজুড়ে মানবাধিকারের বিষয়টি নানা কারণে বহুল আলোচিত। ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার সনদ ঘোষিত হয় এবং এ সনদ কার্যকর করার জন্য মানবাধিকার কমিশন গঠন করা হয়। এই সর্বজনীন ঘোষণাপত্রে যে ৩০টি ধারা সংযোজিত রয়েছে তাতে মানুষের মৌলিক ও আইনগত অধিকার সংরক্ষিত থাকার কথা। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। বরং দেখা গেছে, বিভিন্ন দেশের ক্ষেত্রে ওই নীতিমালার বাস্তবায়ন ভিন্নতর হচ্ছে। ভিন্ন দেশ বা জাতিগোষ্ঠী বা ধর্মীয় জনসমষ্টির ক্ষেত্রে মানবাধিকারের ভিন্ন ব্যাখ্যা দাঁড় করানো হচ্ছে। আর এটি করছে কারা? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে পরে পাশ্চাত্যের যেসব দেশ বিশ্বের মোড়ল হয়ে বসেছে তারাই। তারা নিজেদের স্বার্থে অর্থাৎ রাজনৈতিক সুবিধা লাভের হাতিয়ার হিসাবে মানবাধিকারের প্রসঙ্গটি সামনে আনছে বা ক্ষেত্রবিশেষে পেছনে ঠেলে দিচ্ছে। তার অর্থ হলো বিশ্বের সব মানুষ, সব দেশ, সব ধর্ম, সব জনগোষ্ঠীর মানবাধিকার সমভাবে রক্ষা করা হচ্ছে না বা করতে দেওয়া হচ্ছে না। সমস্যাটা এখানেই।
এ প্রসঙ্গে সাধারণভাবে একজন মুসলমানের মনে আসবে কীভাবে ফিলিস্তিনের মুসলমানদের ওপর অত্যাচার নির্যাতন চলে আসছে গত ৭০ বছর ধরে। তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া তো দূরের কথা, সামান্য নিন্দাটুকুও জানাতে পারেনি জাতিসংঘ। বরং কোনো কোনো পরাশক্তি বিপুল পরিমাণ অর্থনৈতিক, সামরিক এবং কূটনৈতিক সহায়তার মাধ্যমে দেশটিকে তার মানবতাবিরোধী অপরাধ চালিয়ে যেতে সাহায্য করে চলেছে। ধর্ম পালনের অধিকার মানবাধিকার সনদে অন্যতম অধিকার হিসাবে স্বীকৃত, কিন্তু এক্ষেত্রেও বৈষম্য দিন দিন প্রকট হয়ে উঠছে।
জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার সনদকে যেন নির্দিষ্ট কোনো জনগোষ্ঠীর বলে গণ্য করা হচ্ছে। যেমন আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গদের মানবধিকার শত শত বছর ধরে পদে পদে লঙ্ঘিত হয়েছে, এখনও হচ্ছে। কৃষ্ণাঙ্গদেরও জীবনের মূল্য- আমেরিকার সমাজে সেটিই অস্বীকৃত। আর সেজন্যেই এই ২০২০ সালে এসেও তাদেরকে ‘ব্ল্যাক লাইভ ম্যাটারস’ নামে আন্দোলন সংগ্রামে রাজপথে নামতে হয়। মানুষ হিসাবে ন্যূনতম অধিকার লাভের জন্য চিৎকার করে গলায় রক্ত তুলতে হয়। এখন মোটামুটি সবাই জানেন যে, পশ্চিমা দুনিয়ার অন্যায়, একদেশদর্শী ও স্বার্থবাদী আচরণের কারণেই বিশ্বে প্রতিনিয়ত মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, জাতিসংঘের এই মানবাধিকার সনদ নিয়ে বিকল্প ভাবনা-চিন্তা করা জরুরি। সেই ভাবনা-চিন্তারই বাস্তব প্রতিফলন হলো ইসলামি মানবাধিকারের সনদ। ১৯৯০ সালের ৫ আগস্ট ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা বা ওআইসির পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে ইসলামি মানবাধিকার ঘোষণা পাস হয়। এরপর থেকেই প্রতি বছর ৫ আগস্ট মুসলিম দেশগুলোতে ইসলামি মানবাধিকার ও মানবীয় মর্যাদা দিবস হিসেবে পালন করা হচ্ছে। পাশ্চাত্যের বাইরের (অ-পশ্চিমা) দেশগুলোর সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিতে ব্যর্থতার জন্য বিভিন্ন মুসলিম দেশ জাতিসংঘের মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণার (ইউডিএইচআর) সমালোচনা করেছিল। বিশেষ করে ইরানে ইসলামি বিপ্লবের পর ১৯৮১ সালে, জাতিসংঘে ইরানি প্রতিনিধি সাইয়্যেদ রাজাই-খোরাসানি ইউডিএইচআর সম্পর্কে তাঁর দেশের অবস্থান তুলে ধরে বলেন, এটি একটি আপেক্ষিক ‘ইহুদি-খ্রিস্টান ঐতিহ্যের ধর্মনিরপেক্ষ বোঝাপড়ামাত্র’, যা মুসলমানদের পক্ষে ইসলামি আইন লঙ্ঘন না করে নিজেদের সমাজে বাস্তবায়ন করা সম্ভবই না।
মুসলিম দেশগুলোর এই উপলব্ধি থেকেই জাতিসংঘ ঘোষিত সর্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণা ও নির্দিষ্ট দিবস থাকার পরও ইসলামি মানবাধিকার দিবস পালনের যৌক্তিকতা স্পষ্ট হয়ে যায়। এইসব সমালোচনা ও উপলব্ধির বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে ওআইসির সম্মেলনে মানবাধিকারের কায়রো ঘোষণা (সিডিএইচআরআই) প্রণয়ন ও ঘোষণা করা হয় যা পরে ওআইসিভুক্ত মুসলিম দেশগুলো অনুস্বাক্ষর করে।
এ পর্যায়ে আমরা জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার সঙ্গে ইসলামি মানবাধিকার ঘোষণার পার্থক্যটা এক নজরে দেখে নিতে পারি।
জাতিসংঘে নিজেদের কর্তৃত্ব ও আধিপত্য ব্যবহার করে পাশ্চাত্যের দেশগুলো সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণায় নিজেদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করেছে। ৩০ ধারাবিশিষ্ট জাতিসংঘের মানবাধিকার ঘোষণার মূল ভিত্তি হলো পশ্চিমা লিবারেলিজম বা উদার নৈতিকতাবাদ। এ ঘোষণায় মুসলমানসহ অনেক জনগোষ্ঠীর ধর্মবিশ্বাস, সংস্কৃতি ও বাস্তবতা উপেক্ষিত হয়েছে। জাতিসংঘ মানবাধিকার ঘোষণার বেশ কিছু দিক গ্রহণযোগ্য হলেও এর অনেক ধারাই ইসলামি বিশ্বাস ও মূল্যবোধের সঙ্গে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক।
অন্যদিকে ইসলামে মানবাধিকারের বিষয়টি অত্যন্ত কঠোরভাবে ধর্মীয় বাধ্যবাধকতার আওতাভুক্ত। এর অর্থ হলো, কেউ যদি মানবাধিকার লঙ্ঘন করে তাহলে তার ঈমান রক্ষা করাই কঠিন হয়ে যায়। ঈমানদারি ঠিক রাখতে হলে মানবাধিকারের নীতি সমুন্নত রাখতে হবে। সুতরাং ইসলামে মানবাধিকারের ধারণা নিছক একটি ঘোষণার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং তা প্রতিপালন করা প্রতিটি মুসলমানের ঈমানী দায়িত্ব।
জাতিসংঘের মানবাধিকার ঘোষণায় যে বিষয়গুলো উপেক্ষিত হয়েছে, ইসলামি মানবাধিকার ঘোষণার ২৫টি ধারায় সেগুলো গুরুত্বের সঙ্গে স্থান পেয়েছে। মানবীয় মর্যাদা, নীতি-নৈতিকতা ও মানুষের আধ্যাত্মিক চাহিদার বিষয়গুলো ইসলামি মানবাধিকার ঘোষণায় গুরুত্ব পেয়েছে। এতে গোটা মানবজাতিকে একটি পরিবারের অংশ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ, সব মানুষই আল্লাহর দাস ও আদমের সন্তান। তাই ধর্ম,বর্ণ, গোত্র, জাতি ও সমাজের ভিত্তিতে মানুষের মধ্যে বৈষম্যের কোনো অবকাশ নেই। সেই মানুষই শ্রেষ্ঠত্বের দাবি করতে পারে যে সবচেয়ে বেশি ন্যায়নিষ্ঠ বা তাকওয়াসম্পন্ন। ইসলামি মানবাধিকার ঘোষণায় আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো দাসত্ব করতে নিষেধ করা হয়েছে। এটিই হলো মানুষের প্রকৃত স্বাধীনতার ভিত্তি। ইসলামি মানবাধিকার ঘোষণায় আধ্যাত্মিকতা ও পার্থিব বিষয়গুলো পরস্পরের সাথে সম্পর্কিত বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
ইসলাম মানবাধিকারের সীমা এত প্রশস্ত করেছে যে, মানুষের পুরো জীবন এর আওতায় পড়ে। পিতা-মাতার হক, সন্তানের হক, স্বামী-স্ত্রীর হক, নারীর অধিকার, বন্ধু-বান্ধবের হক, শ্রমিক-মালিক এবং শাসক ও জনগণের হক, সরকারের হক, শ্রমজীবী মানুষদের হক, দুর্বল ও অসহায়দের হক, এতিম-মিসকিনের হক, সাধারণ মুসলমানের হক, সাধারণ মানুষের হক ইত্যাদি ব্যক্তি, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীক ও আন্তর্জাতিক যাবতীয় বিষয় ইসলামের মানবাধিকারের অনুষঙ্গ।
ইসলামি মানবাধিকার ঘোষণার ষষ্ঠ ধারায় নারী-পুরুষের সাম্যের কথা স্থান পেয়েছে। নারী ও পুরুষের যেমন আলাদা আলাদা কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে, তেমনি আলাদা আলাদা কিছু অধিকারও রয়েছে। নাগরিক অধিকার ছাড়াও তাদের রয়েছে স্বাধীনভাবে সম্পদ অর্জনের অধিকার। নারী ও পুরুষের শারীরিক ও চাহিদাগত পার্থক্যের কারণে তাদের দায়িত্ব ও অধিকারেও কিছু পার্থক্য রয়েছে বলে ইসলাম মনে করে, কিন্তু এসব পার্থক্যের অর্থ বৈষম্য নয়। সামাজিক অগ্রগতি ও সুষ্ঠুতার স্বার্থে প্রয়োজনীয় বিবেচনায় ঐশী নির্দেশনার (কুরআন ও সুন্নাহ) প্রেক্ষিতেই এটা করা হয়েছে।
ইসলামি মানবাধিকার ঘোষণার ২২ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, প্রত্যেক ব্যক্তিই তার মতামত প্রকাশের ব্যাপারে স্বাধীন, তবে তা ধর্মবিরোধী হওয়া চলবে না। ইসলামের দৃষ্টিতে বাক-স্বাধীনতা লাগামহীন নয়। বাক-স্বাধীনতার নামে অন্যদের ধর্মীয় চিন্তাধারা ও পবিত্র বিষয়গুলোর অবমাননা করার কোনো অধিকার কারো নেই। দুঃখজনকভাবে পশ্চিমা সরকার ও গণমাধ্যমগুলো এক্ষেত্রে স্বাধীনতার অপব্যবহার করছে এবং তারা এ পর্যন্ত ইসলামের পবিত্র বিষয়গুলোর যারপরনাই অবমাননা করেছে। তাই ইসলামি মানবাধিকার ঘোষণায় বলা হয়েছে, ‘ধর্মীয় পবিত্র বিষয় এবং নবী-রাসূলদের মর্যাদার প্রতি আঘাত কিংবা মূল্যবোধের ক্ষেত্রে ব্যাঘাত ও সমাজে বিভেদ সৃষ্টিকারী বা ঐশী বিশ্বাসের প্রতি অবমাননাকর যে কোনো ধরনের পদক্ষেপ নিষিদ্ধ।’
ইসলামি মানবাধিকার ঘোষণায় উপনিবেশবাদ ও সা¤্রাজ্যবাদ নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে লড়াইকে ন্যায্য অধিকার বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। পাশ্চাত্যের দেশগুলো সা¤্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইকে সন্ত্রাসবাদ হিসেবে অভিহিত করে। ইসলামি মানবাধিকার ঘোষণায় স্বৈরাচার ও ক্ষমতার অপব্যবহারকেও কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ইসলাম অমুসলিমদেরকে যথাযথ নিরাপত্তা ও অধিকার, শিক্ষার অধিকার, মান-সম্মানের অধিকার, পরিবার গঠনের অধিকারসহ সব রকমের অধিকার নিশ্চিত করেছে।
পাশ্চাত্য ও ইসলামের মানবাধিকার সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা নেওয়ার পর এখন আমরা বাস্তব উপলব্ধির সঙ্গে বিশ্ব বাস্তবতার প্রেক্ষিত বিবেচনায় বিষয়টি বিশ্লেষণ করতে পারি। বিষয়টি আমরা দেখতে পারি ইরানি চিন্তাবিদ হুজ্জাতুল ইসলাম মুহাম্মাদ জাভাদ হুজ্জাতি কিরমানির চিন্তাধারার আলোকে। তাঁর ‘ইসলাম ও পাশ্চাত্যের মানবাধিকারের ধারণায় মিল-অমিল’ শীর্ষক প্রবন্ধে এ বিষয়ে একটি সুনিশ্চিত নির্দেশনা পাওয়া যায় যা আমাদের বিবেচনায় অত্যন্ত সময়োপযোগী এবং বাস্তবানুগ।
‘তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই সর্বোত্তম যে সবচেয়ে ন্যায়নিষ্ঠ।’ পবিত্র কুরআনের এই বাণী উদ্ধৃত করে কিরমানি বলছেন, সর্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণার মুখবন্ধে প্রতিটি মানুষের সহজাত গুণাবলির স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। আমাদের মনে হয় যে, এই ঘোষণা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কুরআনের মাধ্যমে প্রভাবিত অথবা অন্ততপক্ষে উভয়টিই পরম কার্যকারণ এবং মানবিক প্রজ্ঞার ধারণার সঙ্গে সাজুয্যপূর্ণ। উভয়ের মধ্যে সবচেয়ে বড় পার্থক্য শুধু এটুকু যে, একটির উদ্ভব সরাসরি ঐশ্বরিক প্রত্যাদেশ থেকে আরেকটি কিছু মধ্যবর্তী উপাদানের ভেতর দিয়ে প্রত্যাদেশের সঙ্গে সম্পর্কিত।
ইসলামে মানবাধিকার বা ইনসানিয়াত এবং পাশ্চাত্যের মানবাধিকারের ঘোষণা পাশাপাশি রেখে বিচার বিবেচনা করার সুযোগ আছে। সেটা যে কেউ করতে পারেন। তবে আমরা এ বিষয়ে ইরানি স্কলার হুজ্জাতুল ইসলাম মুহাম্মাদ জাভাদ কিরমানির দৃষ্টিভঙ্গি বিশেষভাবে অনুধাবনযোগ্য মনে করি। ইসলামি বিপ্লবের পর ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেইনীর নির্দেশনা অনুযায়ী দেশটি বিভিন্ন ধর্ম বিশেষ করে ইসলাম, ইহুদি ও খ্রিস্টধর্মের প-িতদের নিয়ে আন্তঃধর্ম সংলাপ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আসছে। কিরমানির মানবাধিকার বিষয়ক এক প্রবন্ধে সেই পরিপ্রেক্ষিতটি ধরা পড়ে। তিনি সর্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণা এবং ইসলামি মানবাধিকারের তুলনা করতে গিয়ে বলছেন, ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ অবসানের পর গৃহীত সর্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণায় পরিবারকে একক সত্তা হিসাবে গ্রহণের বিষয়টি ওই সময়ের জনমানস এবং একটি আদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন। মানুষের অস্তিত্বের বাস্তবতার ভিত্তিতেই তার ঐক্যের বিষয়টি স্বীকার করে নেওয়া হয়। এক্ষেত্রে আমরা ইসলামি ও পাশ্চাত্যের মানবাধিকার ব্যবস্থার মধ্যে সাজুয্য খুঁজে পাই। ইসলামেও পরিবারকে অভিন্ন লাভ-ক্ষতির শরিক একটি একক সত্তা হিসাবে দেখা হয়। ইসলাম ও পাশ্চাত্যের মানবাধিকারের ধারণার আরেকটি অভিন্ন উপাদান হলো মানুষের প্রকৃতিগত মূল্য ও তার প্রতি শ্রদ্ধা।’
জাভাদ কিরমানি উভয় ঘোষণার মধ্যে যেসব সামঞ্জস্য রয়েছে সেগুলোর উল্লেখ করে বলেন, ‘স্বাধীনতা বলতে আমরা সাধারণভাবে মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণায় বর্ণিত স্বাধীনতাই বুঝি যেখানে মানুষকে জন্মগতভাবে স্বাধীন বলা হয়েছে এবং সব ধরনের দাসত্ব নিষিদ্ধ করা হয়েছে। প্রতিটি মানুষের স্বাধীন ও নিরাপত্তার সঙ্গে বাঁচার অধিকার দেওয়া হয়েছে।… মানুষের দায়িত্ববোধের জন্ম হয় তার স্বাধীনতার চেতনা থেকে। মানুষ স্বভাবগতভাবেই মুক্ত সত্তা। বিজ্ঞ বলেই সে তার ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে সংযম রক্ষা করে চলার বিষয়টিকে বুদ্ধি ও প্রজ্ঞার পরিচায়ক বলে মনে করে। সংযমের এই যৌক্তিক প্রয়াস আরও বিশুদ্ধ ও প্রকৃত রূপ লাভ করে অধ্যাত্মবাদ ও ঐশী প্রত্যাদেশের আলোকধারায়।’
ইসলামি ও পাশ্চাত্যের মানবাধিকারের ধারণার মধ্যে কোনও পার্থক্য থাকলে সেটা আছে স্বাধীনতার মাত্রা নির্ধারণের ক্ষেত্রে। সেটা স্বাধীনতার যৌক্তিকতা ও মৌলিক ভিত্তির কোনও ব্যত্যয় ঘটায় না।
অন্য কথায়, মানবাধিকারের উভয় ধারণাই মানুষের জন্মগত স্বাধীনতার ওপর কিছু সীমারেখা টেনে দেয়। খোদায়ী বিধানে যৌন স্বাধীনতার ওপর যে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়, ভোগবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে তেমন নিয়ন্ত্রণ অনেক কম। তার পরও পাশ্চাত্যের ভোগবাদী আদর্শেও যৌন স্বাধীনতা সীমিত করা হয়েছে, যেমন ধর্ষণ এবং প্রকাশ্য যৌনাচার নিষিদ্ধ। তার মানে হলো, সবচেয়ে মুক্ত সমাজের ক্ষেত্রেও মানুষের যুক্তিশীলতা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েনি, সেখানেও খুব সামান্য হলেও স্বাধীনতার ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে।
জাভাদ কিরমানি তাঁর প্রবন্ধে বলেন, বস্তুতপক্ষে ন্যায়বিচার বলবৎ করা এবং অবিচার দূর করার আকাক্সক্ষার উদাহরণ যা ইসলামি ও পাশ্চাত্যের মানবাধিকারের ধারণায় খুবই জোরালো এবং সংহতরূপে রয়েছে, সেটি উভয়ের মধ্যে আরেকটি সংযোগসূত্র। প্রকৃতপক্ষে ন্যায়বিচারের ধারণাই গোটা বিশ্বকে স্থিতিশীল করেছে। তিনি উভয় ঘোষণার মধ্যে বিদ্যমান অসামঞ্জস্যগুলোও চিহ্নিত করেন। তবে আহ্বান জানান, সবাইকে নিজ নিজ আদর্শে অবিচল থেকেও একটি সমঝোতার জায়গায় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়ানো যায় কিনা সেই বিষয়ে প্রয়াসী হওয়ার। কারণ, বিশ্ববাসী এখনও বিভিন্ন ধর্ম তথা মানবজাতির বিভিন্ন আদর্শের কাছেই শান্তির প্রত্যাশা করে।

পবিত্র আহলে বাইত ও চিরকালের কান্না

আবদুল মুকীত চৌধুরী
১. আহলে বাইত
‘আহলে বাইত’ সম্পর্কে আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীনের কালাম : “…হে নবী পরিবার! আল্লাহ তো কেবল চান তোমাদের হইতে অপবিত্রতা দূর করিতে এবং তোমাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করিতে।”- আল-কুরআনুল করীম, সূরা আহযাব ৩৩: আয়াত ৩৩) ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ঢাকা।
‘…অহফ এড়ফ ড়হষু রিংযবং / ঞড় ৎবসড়াব ধষষ ধনড়সরহধঃরড়হ / ঋৎড়স ুড়ঁ, ুব গবসনবৎং / ঙভ ঃযব ঋধসরষু, ধহফ ঃড় সধশব / ণড়ঁ ঢ়ঁৎব ধহফ ংঢ়ড়ঃষবংং.’- ঞযব ঐড়ষু ছঁৎধহ: ঞৎধহংষধঃরড়হ ধহফ ঈড়সসবহঃধৎু, অ. ণঁংঁভ অষর, চধমব ১১১৫-১৬.
‘আহলে বাইত’ সম্পর্কে ব্যাখ্যা-ভাষ্যে আল্লামা ইউসুফ আলী বলেন,
“ঘড়ঃরপব ঃযব ঃৎধহংরঃরড়হ রহ ঃযরং পষধঁংব ঃড় ঃযব সধংপঁষরহব মবহফবৎ, যিরষব নবভড়ৎব ঃযরং ঃযব াবৎনং ধহফ ঢ়ৎড়হড়ঁহং বিৎব রহ ঃযব ভবসরহরহব মবহফবৎ ধং ৎবভবৎৎরহম ঃড় ঃযব পড়হংড়ৎঃং. ঞযব ংঃধঃবসবহঃ রহ ঃযরং পষধঁংব রং হড়ি সড়ৎব মবহবৎধষ, রহপষঁফরহম (নবংরফবং ঃযব পড়হংড়ৎঃং) ঃযব যিড়ষব ভধসরষু, হধসবষু, ঐধুৎধঃ ঋধঃরসধ ঃযব ফধঁমযঃবৎ, ঐধুৎধঃ ‘অষর ঃযব ংড়হ-রহ-ষধ,ি ধহফ ঃযবরৎ ংড়হং ঐধংধহ ধহফ ঐঁংধরহ, ঃযব নবষড়াবফ মৎধহফংড়হং ড়ভ ঃযব চৎড়ঢ়যবঃ. ঞযব সধংপঁষরহব মবহফবৎ রং ঁংবফ মবহবৎধষষু রহ ংঢ়বধশরহম ড়ভ ধ সরীবফ ধংংবসনষু ড়ভ সবহ ধহফ ড়িসবহ.” – ওনরফ, চ.১১১৬
দশম হিজরিতে নাজরানের এক খ্রিস্টান প্রতিনিধিদল প্রধান ধর্মযাজক আবু হারিসা ইবনে আলকামাহ এর নেতৃত্বে মদীনায় হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সাথে মুবাহালার মানসে আসেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) আহলে বাইতের সদস্য ‘আলী (রা.), ফাতেমা (রা.), হাসান (রা.) ও হুসাইন (রা)-কে তাঁর চাদরের মধ্যে নিয়ে প্রতিনিধিদের বিপরীতে দাঁড়িয়ে উল্লেখিত আয়াত তিলাওয়াত করেছিলেন।
মহানবী (সা.)-এর পরিবার-পরিজনের পবিত্র চেহারার প্রভাবে যাজক মুগ্ধ হয়ে মুবাহালা থেকে বিরত হন এবং এই পবিত্রতা সকল শক্তির বিরুদ্ধে জয়ী হবে বলে ঘোষণা করেন।
আল্লামা যামাখশারী মুবাহালার আয়াত সম্পর্কিত ব্যাখ্যার শেষে বলেন, “মুবাহালার মহা ঘটনা এবং এ আয়াতের বিষয়বস্তু ও মর্মার্থ ‘আসহাবে কিসা’ অর্থাৎ মহানবী (সা.) যাঁদেরকে তাঁর চাদরের নিচে স্থান দিয়েছিলেন, তাঁদের মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের সবচেয়ে বড় দলিল এবং ইসলাম ধর্মের সত্যতারও এক জীবন্ত সনদ।”- চিরভাস্বর মহানবী (সা.), দ্বিতীয় খ-, আয়াতুল্লাহ জাফর সুবহানী, অনুবাদ : মোহাম্মদ মুনীর হোসেন খান, পৃ. ৩৭১
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সাথে ধর্মযাজকের কথাবার্তা হয়। ‘ঈসা (আ.) আল্লাহর পুত্র’ এই বিশ্বাসের অবস্থানে যাজক। এ সময় সূরা আলে ইমরানের ৫৯ নং ক্রমিকের আয়াত নাযিল হয় : “আল্লাহর নিকট নিশ্চয়ই ঈসার দৃষ্টান্ত আদমের দৃষ্টান্ত সদৃশ। তিনি তাহাকে মৃত্তিকা হইতে সৃষ্টি করিয়াছেন; অতঃপর উহাকে বলিলেন, ‘হও’; ফলে সে হইয়া গেল।”
আলে ইমরানের ৬১তম আয়াত মিথ্যায় বিশ্বাসীদের মুবাহালায় যাওয়া এবং নিজেদের উপর ¯্রষ্টার লানত (অভিশম্পাৎ) চাওয়া সংক্রান্ত। এর টীকায় বলা হয়েছে, ‘নাজরান অঞ্চলের খৃষ্টানগণ ঈসা (আ.) সম্পর্কে কুরআনের বর্ণনা স্বীকার না করিলে আল্লাহর নির্দেশে হযরত (সা.) তাহাদিগকে মুবাহালার (দুই পক্ষের পরস্পরের জন্য বদ দু‘আ করা) জন্য আহ্বান জানান। কিন্তু খৃষ্টান পাদ্রীগণ ভীত হইয়া ইহা হইতে বিরত থাকনে ও জিযয়া দিতে স্বীকার করিয়া সন্ধি করেন।’ -জালালাইন; আল কুরআনুল করীম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, পৃ. ৮৬
ইমামুল মুমিনীন আলী (রা.) এই বিশেষ বিজয়ের সন্ধি চুক্তিপত্র লিখেন।
বিশিষ্ট সাহাবী আবূ যর গিফারী (রা) থেকে বর্ণিত : তিনি বলেন, “আমি রাসূল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, আমার আহলে বাইতের সদস্যগণ আমার উম্মতের জন্য তেমনি নাজাতের তরী, যেমনি আল্লাহর নবী নূহ (আ.)-এর তরী বিধ্বংসী বন্যার সময় তাঁর জন্য আশ্রয় ও নাজাতের তরী ছিল।”
ইমাম শাফি‘ঈ (রহ.) বলেন, ‘ইয়া আহলে বাইতে রাসূল। আপনাদের মুয়াদ্দাত (আনুগত্যপূর্ণ ভালবাসা) পবিত্র কুরআনে ফরয করা হয়েছে। যে ব্যক্তি নামাযে আপনাদের উপর দরুদ না পড়বে, তার নামাযই কবুল হবে না।’- সাওয়ায়েকে মোহরেকা, ইবনে হাজার মক্কী, পৃ. ৮৮, ৭৭১
২. আমীরুল মু‘মিনীন ‘আলী (রা.)
রাহমাতুল্লিল ‘আলামীন সায়্যিদুল মুরসালীন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সাথে ‘আলী (রা.)-এর পারিবারিক নৈকট্য ও ¯েœহের সম্পর্ক ছিল অনন্য। ‘আলী (রা.)-এর পিতা আবূ তালিব মুহাম্মদ (সা.)-কে পিতৃ¯েœহে ও মাতা ফাতেমা বিনতে আসাদ মাতৃ¯েœহে লালনপালন করেন। পিতা ‘আবদুল্লাহ-র মৃত্যু ও পরবর্তীতে মাতা আমেনার মৃত্যুর পর বিশেষভাবে তাঁর জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করেন তাঁরা। সেই পরম শ্রদ্ধেয় চাচা-চাচীর সন্তান ‘আলী (রা.)। তিনিই প্রথম তাঁর কাছে ইসলাম গ্রহণ করেন। সর্বোত্তম ফয়সালাকারী (কাযী) তিনি।
গাদীরে খুমে উপস্থিত সাহাবিগণের অঙ্গীকার গ্রহণের পর রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, “আমি যার মাওলা, ‘আলীও তার মাওলা। হে আল্লাহ, তুমি তাকে বন্ধু গণ্য করো, যে একে (‘আলীকে) বন্ধু গণ্য করে এবং যে একে (‘আলীকে) শত্রু গণ্য করে, তাকে শত্রু গণ্য করো এবং রাগান্বিত হও তার প্রতি যে একে রাগান্বিত করে।”
খায়বারে হযরত ‘আলীর মহাবিজয় সম্পর্কে রাসূল (সা.) আগেই বলেন, “আগামীকাল এ পতাকা এমন এক ব্যক্তির হাতে দেব, যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালবাসে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলও তাকে ভালবাসেন। সে এমন ব্যক্তি, যে শত্রুর প্রতি পৃষ্ঠপ্রদর্শন করেনি এবং কখনই যুদ্ধ হতে পলায়ন করেনি।”- চিরভাস্বর মহানবী (সা.) দ্বিতীয় খ-, পৃ. ২০৮। সূত্র : মাজমাউল বায়ান, ৯ম খ-, পৃ. ১২০; সীরাতে হালাবী, ২য় খ-, পৃ.৩৭; সীরাতে ইবনে হিশাম ৩য় খ-, পৃ. ৩৩৪।
খায়বারের দরজা উপড়ানোর শক্তিমত্তার অলৌকিকতার দিকটিতে জিজ্ঞাসার জবাবে ‘আলী (রা) বলেন, ‘আমি কখনো মানবীয় শক্তিতে তা উপড়াইনি; বরং আল্লাহর শক্তি ও মহান আল্লাহর সাক্ষাতের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাসের বলে তা করেছি।”- চিরভাস্বর মহানবী (সা.), দ্বিতীয় খ-, পৃ. ২১২। সূত্র : বিহারুল আনওয়ার, ২১তম খ-, পৃ. ২১।
আমীরুল মুমিনীন ‘আলী (রা.) তাঁর এক ভাষণে স্পষ্ট করে বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সা.) আমার বুকে মাথা রেখে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন।… আমি তাঁকে গোসল দিয়েছি এবং ঐ অবস্থায় ফেরেশতারা আমাকে সাহায্য করেছেন।”- চিরভাস্বর মহানবী (সা.), দ্বিতীয় খ-, পৃ. ৪২৯। সূত্র : নাহজুল বালাগাহ।
হযরত ‘আলী (রা.) খারিজী ইবনে মুলজিমের আঘাতে গুরুতর আহত ও ওফাতশয্যায় থাকা অবস্থায় হাসান (রা)-কে খিলাফতের উত্তরাধিকারী মনোনয়ন করেন।
৩. খাতুনে জান্নাত ফাতেমা যাহরা (রা)
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর চির বিশ্বস্ত নারীশ্রেষ্ঠ খাদিজা তাহেরা (রা.)-এর কন্যা ফাতেমা (রা.)। রাসূল (সা.) বলেন, “ফাতেমা আমার দেহের টুকরা। যা তাকে সন্তুষ্ট করে, তা আমাকেও সন্তুষ্ট করে; আর তার ক্রোধ ও অসন্তুষ্টি আমারই ক্রোধ ও অসন্তুষ্টি।”- সহীহ বুখারী, ৫ম খ-, পৃ. ২১
কন্যার কাছ থেকে বিদায় না নিয়ে সফরে বেরোতেন না তিনি এবং ফিরেও প্রথমেই তাঁর সাথে দেখা করতে যেতেন। যে কয়েক দিন রাসূল (সা.) ওফাত-শয্যায় শায়িত ছিলেন, সে দিনগুলোতে ফাতেমা (রা.) পিতার শয্যাপাশে বসে থাকতেন। এ সময়ে পিতার কাছ থেকে তাঁর আসন্ন ওফাতের কথা শুনে তিনি কেঁদে ফেলেন। আবার রাসূল (সা.)-এর সাথে তিনিই প্রথম মিলিত হবেন, এ ভবিষ্যদ্বাণী শুনে হাসেন তিনি। রাসূল (সা.) তাঁকে বলেছিলেন, “আমার আহলে বাইতের মধ্য থেকে তুমিই প্রথম আমার সাথে মিলিত হবে।”- আত তাবাকাতুল কুবরা, ২য় খ-, পৃ. ২১৯
মহানবী (সা.)-এর এখতিয়ারে ছিল বিনা যুদ্ধে প্রাপ্ত সম্পদ একটি উর্বর অঞ্চল ফাদাক। এটি ছিল খায়বারের কাছে। নিকটাত্মীয়গণের বৈধ প্রয়োজনাদি সম্মানজনকভাবে মেটাতে আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশ রয়েছে সূরা শূরার ষষ্ঠ ও সপ্তম আয়াতে। সূরা ইসরার ২৬তম আয়াত নাযিলের প্রেক্ষিতে কন্যা ফাতেমাকে ডেকে ফাদাকের স্বত্ব হস্তান্তর করেন নবীজী। আবূ সাঈদ খুদরী (রা.) বর্ণিত এ হাদীস।- চিরভাস্বর মহানবী (সা.), দ্বিতীয় খ-। সূত্র : মাজমাউল বায়ান, ৩য় খ-, পৃ. ৪১১; শরহু নাহজুল বালাগাহ, ১৬তম খ-, পৃ. ২৪৮
খিলাফত প্রশাসন প্রাথমিক পর্যায়ে ফাতেমা (রা.)-এর এ দাবির স্বীকৃতি দেন নি।- চিরভাস্বর মহানবী (সা.), দ্বিতীয় খ-। সূত্র : ইবনে আবীল হাদীদ প্রণীত শারহু নাহজুল বালাগাহ, ১৬তম খ-, পৃ. ৩৭৪; সীরাতে হালাবী ৩য় খ-, পৃ. ৪০০
মালে গণীমতের এক পঞ্চমাংশ থেকেও আহলে বাইত কিছু পেতেন না।- ঐ, সূত্র শারহু নাহজুল বালাগাহ, ১৬তম খ-, ২৩৬
শেরে খোদা হযরত ‘আলী (রা.)-এর শাহাদাতের পর মুয়াবিয়ার শাসনকালে তিনি মারওয়ান, আমর ইবনে উসমান ও পুত্র ইয়াযীনের মধ্যে ফাদাক বণ্টন করে দেন। মারওয়ানের দায়িত্বকালে সকল অংশ তার পুত্র আবদুল আযীযকে হিবা করে দেয়। এ ধারা চলতে থাকে। বনী উমাইয়্যা শাসকদের মধ্যে ‘উমর ইবনে আবদুল আযীয (রহ.) ফাদাক ভূখ- হযরত ফাতেমা (রা.)-এর বংশধরদের কাছে ফিরিয়ে দেন। কিন্তু তাঁকে বুঝিয়ে মূল মালিকানা হাতে রেখে সম্পত্তির ব্যয় ফাতেমা (রা.)-এর বংশধরদের মধ্যে বণ্টনে তাঁকে রাজি করা হয়েছিল।”- চিরভাস্বর মহানবী (সা.), দ্বিতীয় খ-। সূত্র : ইবনে আবীল হাদীদ প্রণীত শারহু নাহজুল বালাগাহ, ১৬তম খ-, পৃ. ২৭৮
তাঁর ইন্তেকালের পর পরবর্তীরা ফাদাক সরকারে ফিরিয়ে নেয়। বনী উমাইয়্যা শেষ দিন পর্যন্ত কর্তৃত্বে ছিল।
হযরত ‘আলী (রা.) বসরার গভর্নর ‘উসমান ইবনে হুনাইনের কাছে লেখা এক পত্রে ফাদাক প্রসঙ্গে বলেন, “হ্যাঁ, যেসব কিছুর উপর আকাশ ছায়া প্রদান করেছে, সে সবের মধ্যে ফাদাক গ্রামের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ভূ-সম্পত্তিও অন্তর্ভুক্ত, যা আমাদের হাতে (কর্তৃত্বে) ছিল। কিন্তু কোনো কোনো গোষ্ঠী এ ব্যাপারে কার্পণ্য করল। আর একদল উদার ও মহানুভব ব্যক্তি বিশেষ কতিপয় বৃহত্তর কল্যাণের স্বার্থে তা থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেন। তবে মহান আল্লাহই হচ্ছেন সর্বশ্রেষ্ঠ ফয়সালাকারী।”- নাহজুল বালাগাহ, পত্র ৪৫
৪. ইমাম হাসান বিন ‘আলী (রা.) : সায়্যিদু শাবাবি আহলিল জান্নাহ
বারা বিন আযীব (রা) থেকে বর্ণিত : “আমি হাসানকে রাসূল (সা.)-এর কাঁধ মুবারকে দেখলাম। আল্লাহর নবী বলেন, “হে আল্লাহ! আমি তাকে ভালবাসি। সুতরাং আপনিও তাকে ভালবাসুন।”- বুখারী শরীফ; মুসলিম শরীফ, বাবু ফাযাইলিল হাসানী ওয়াল হুসাইনী।
হযরত আবূ হুরায়রা থেকে বর্ণিত : “মদীনায় বাজার থেকে ফিরে এসে রাসূল (সা.) বললেন, ‘ছোট শিশুটি কোথায়?’ এ কথা তিন বার বললেন। অতঃপর বললেন, ‘হাসান ইবনু ‘আলীকে ডাকো।’ দেখা গেল হাসান ইবনু ‘আলী হেঁটে আসছেন। তাঁর গলায় ছিল মালা। নবী (সা.) এভাবে তার হাত উঠালেন। হাসানও এভাবে তাঁর হাত উঠালেন। তারপর রাসূল (সা) তাঁকে জড়িয়ে ধরলেন এবং বললেন, ‘হে আল্লাহ! আমি একে ভালবাসি; আপনিও তাকে ভালবাসুন এবং যে ব্যক্তি তাকে ভালবাসে, তাকেও আপনি ভালবাসুন।’- বুখারী শরীফ
হযরত আলী (রা.)-এর শাহাদাতের পর ইমাম হাসান (রা.) খলীফা হন। আমীরে মুয়াবিয়া তাঁর খিলাফত মেনে নিতে অস্বীকার করলে ইমাম হাসান তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। ষড়যন্ত্রকারীদের কারণে ইমাম হাসান (আ.) মুয়াবিয়ার সাথে সন্ধি করতে বাধ্য হন। অতঃপর ৫০ হিজরিতে ইমাম হাসানকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়।
৫. ইমাম হুসাইন বিন ‘আলী (রা.): সায়্যিদু শাবাবি আহলিল জান্নাহ
ইমাম হাসান (রা.)-এর পর পবিত্র আহলে বাইতের কনিষ্ঠ সদস্য ইমাম হুসাইন (রা.)। তাঁর প্রতি মুসলিম জনগণের ‘ভালবাসা ও আনুগত্য’ সর্বোচ্চ থাকবে, এটাই প্রত্যাশিত। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনচেতনায় তা ছিলও। কিন্তু পিতৃসূত্রে ক্ষমতাধর খিলাফতের পদলোভী ইয়াযীদের পক্ষ থেকে বিস্ময়করভাবে ইমাম হুসাইন (রা.)-এর কাছে ‘আনুগত্য’ তথা বায়‘আতের দাবি করা হয়। তাতে আত্মসমর্পণ না করলে ভয়ঙ্কর পরিণতির কথাও জানিয়ে দেওয়া হয়। আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীনের পক্ষ থেকে প্রেরিত মানবজাতি তথা সৃষ্টিজগতের প্রতি কল্যাণ ও শান্তির বার্তাবাহী রাসূল রাহমাতুল্লিল ‘আলামীন হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর পরম আদরের দৌহিত্র ইমাম হুসাইন (রা.) মাথা নত করলেন না। ফলে কারবালায় ইয়াযীদের নির্দেশিতদের আক্রমণে অবাঞ্ছিত অসম যুদ্ধে পানিবিহীন অবস্থায় ইমাম পরিবারের সদস্যসহ ৭২জন ফোরাত তীরে শহীদ হন। পিতা খলীফাতুল মুসলিমীন হযরত ‘আলী (রা.)-এর শাহাদাত এবং বড় ভাই ইমাম হাসান (রা.)-এর বিষপ্রয়োগে শাহাদাতের পর এ শাহাদাত মুসলিম উম্মাহর ইতিহাসে তো বটেই, গোটা মানবেতিহাসেও অনন্য করুণ। ইয়াযীদ ও তার দোসরদের পাশবিকতার প্রতি উম্মাহর তথা বিশ্বমানবতার ধিক্কার। এর বিপরীতে রাসূল (সা.) ও ইমাম প্রেমিকরা চিরকাল শ্রদ্ধা জানাবে মূলত অপরাজেয় ‘মৃত্যুহীন’ কালোত্তীর্ণ ইমামকে।
ইমাম হুসাইন (রা.)-এর কাছ থেকে জোরপূর্বক বায়‘আত গ্রহণের জন্য মদীনার গভর্নর ওয়ালিদের কাছে ইয়াযীদ এক পত্রে নির্দেশ দিয়েছিল। তাতে বলা হয়েছিল, তিনি তা করতে অস্বীকৃতি জানালে তাঁর শির কেটে তার কাছে পাঠানোর জন্য।
ইবনে যিয়াদ বলে, ‘আমি আল-হুসাইনকে হত্যা করেছি; কারণ, তিনি আমাদের ইমাম (ইয়াযীদ)-এর বিরুদ্ধে বিপ্লব করেছিলেন এবং এই ইমামই (ইয়াযীদ) হুসাইনকে হত্যার জন্য আমার কাছে বার্তা পাঠিয়েছিলেন। হুসাইনের হত্যা যদি পাপ হয়ে থাকে, তা হলে এ জন্য ইয়াযীদ দায়ী।’
বিষয়টি শুধু এ হত্যায় সীমাবদ্ধ থাকেনি। পরবর্তীতে পবিত্র মক্কা ও মদীনা আক্রান্ত হয়েছে। বহু জীবন হানি ও ক্ষয়ক্ষতি ঘটেছে। সত্য-মিথ্যার যুদ্ধে কারবালার অনন্য শোকাবহ হত্যাকা-ের পর আল্লাহর ঘর কা‘বা ও রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর স্মৃতিবাহী মদীনা আক্রমণের দুঃসহ ব্যথা নিয়ে মুসলিম উম্মাহ হাজার ও শত শত বছর পাড়ি দিচ্ছে। আল্লাহর খিলাফত- মানবকল্যাণ ও বিশ্বশান্তির শাসন ব্যবস্থা স্তব্ধ করে দিয়েছে অবৈধ রাজতান্ত্রিক ক্ষমতালোভী ও পরবর্তীতে তাদের দোসররা।
কুরআন মজীদের ৩৭তম সূরা সাফ্ফাত-এর ক্রমিক ১০৭তম আয়াত ‘মিল্লাতের পিতা’ নবী ইবরাহীম (আ.) কর্তৃক তাঁর সন্তান ইসমাঈল-এর কুরবানির মুহূর্তে আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছায় বিকল্প কুরবানি বিষয়ক : “আর আমি তাকে মুক্ত করলাম বিরাট কুরবানীর বিনিময়ে।”- আল কুরআনের বিষয়ভিত্তিক আয়াত, ৩য় খ-, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ঢাকা, বাংলাদেশ।
আল্লামা ইউসুফ আলী কৃত তাঁর ‘ঞযব ঐড়ষু ছঁৎধহ: ঞৎধহংষধঃরড়হ ্ ঈড়সসবহঃধৎু’-তে এ আয়াতের অনুবাদ: ‘অহফ বি ৎধহংড়সবফ যরস রিঃয ধ সড়সবহঃড়ঁং ংধপৎরভরপব.’ ঝধভভধঃ ৩৭ : অুধঃ ১০৭, চ. ১২০৬
এ আয়াতে ‘সড়সবহঃড়ঁং ংধপৎরভরপব’ সম্পর্কে টীকায় বিশ্লেষণাত্মক মন্তব্যে এই অনুবাদক-ভাষ্যকার ইমাম হুসাইন (রা.)-এর আত্মদানকে সর্বোচ্চ ভাবনায় উত্তীর্ণ করে বলেন- ‘ঞযব ধফলবপঃরাব য়ঁধষরভুরহম ‘ংধপৎরভরপব’ যবৎব, ‘ধুরস’ (মৎবধঃ, সড়সবহঃড়ঁং) সধু নব ঁহফবৎংঃড়ড়ফ নড়ঃয রহ ধ ষরঃবৎধষ ধহফ ধ ভরমঁৎধঃরাব ংবহংব. ওহ ধ ষরঃবৎধষ ংবহংব রঃ রসঢ়ষরবং ঃযধঃ ধ ভরহব ংযববঢ় ড়ৎ ৎধস ধিং ংঁনংঃরঃঁঃবফ ংুসনড়ষরপধষষু. ঞযব ভরমঁৎধঃরাব ংবহংব রং বাবহ সড়ৎব রসঢ়ড়ৎঃধহঃ. ওঃ ধিং রহফববফ ধ মৎবধঃ ধহফ সড়সবহঃড়ঁং ড়পপধংরড়হ, যিবহ ঃড়ি সবহ, রিঃয পড়হপবৎঃবফ রিষষ, ‘ৎধহমবফ ঃযবসংবষাবং রহ ঃযব ৎধহশং’ ড়ভ ঃযড়ংব ঃড় যিড়স ংবষভ-ংধপৎরভরপব রহ ঃযব ংবৎারপব ড়ভ এড়ফ ধিং ঃযব ংঁঢ়ৎবসব ঃযরহম রহ ষরভব.
ঞযরং ধিং ধ ঃুঢ়ব ড়ভ ঃযব ংবৎারপব যিরপয ওসধস ঐঁংধরহ ঢ়বৎভড়ৎসবফ, সধহু ধমবং ষধঃবৎ, রহ ৬০ অ. ঐ. ধং ও যধাব বীঢ়ষধরহবফ রহ ধ ংবঢ়ধৎধঃব ঢ়ধসঢ়যষবঃ…..’
৬. নজরুল কাব্য ও সংগীতে আহলে বাইত
বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। বিশ্বের সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি তিনি। বিশিষ্ট লেখক, গবেষক ও শিক্ষাবিদ মুহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন খান (মরহুম) কাজী নজরুল ইসলামের মূল্যায়নে বলেন, ‘…নজরুল আমাদের জাতীয় পরিচয়ের প্রতীক।… সাথে সাথে সাদী-হাফেজ-আত্তার-রুমী-জামী-নিজামী-সানাঈ-ফেরদৌসীর বাংলা সংস্করণ ও প্রতীক নজরুল ইসলামের সাহিত্যকর্মকে বিশ্বদরবারে তুলে ধরার জন্য সকল মহলের সাগ্রহ প্রচেষ্টা আরজ করছি।’ তাঁর দৃষ্টিতে বিশ্বখ্যাত কালোত্তীর্ণ এই কবিদের ‘বাংলা সংস্করণ ও প্রতীক নজরুল ইসলাম’। তাঁর সংগীত ও কবিতা থেকে আহলে বাইতের শানে কিছু উদ্ধৃতি পেশ করছি :
“খয়বর জয়ী আলী হায়দার
জাগো জাগো আরবার।
দাও দুশমন দুর্গ-বিদারী
দু’ধারী জুলফিকার ॥
এস শেরে খোদা ফিরিয়া আরবে-
ডাকে মুসলিম ‘ইয়া আলী’ রবে-
হায়দরী-হাঁকে তন্দ্রা-মগনে
কর কর হুঁশিয়ার ॥
আল-বোর্জের চূড়া গুঁড়া করা
গোর্জ আবার হানো,
বেহেশতী সাকী, মৃত এ জাতিরে
আবে কওসর দানো ॥
আজি বিশ্ববিজয়ী জাতি যে বেহোঁশ,
দাও তারে নব কুওত ও জোশ;
এস নিরাশার মরুধূলি উড়ায়ে
দুলদুল আসওয়ার ॥”

“ওগো মা- ফাতেমা- ছুটে আয়,
তোর দুলালের বুকে হানে ছুরি।
দীনের শেষ বাতি নিভিয়া যায় মাগো
(বুঝি) আঁধার হ’ল মদিনা-পুরী ॥

কোথায় শেরে-খোদা; জুলফিকার কোথা
কবর ফেড়ে’ এস কারবালা যেথা-
তোমার আওলাদ বিরাণ হ’ল আজি
নিখিল শোকে মরে ঝুরি’ ॥”

কোথা আখেরী নবী, চুমা খেতে তুমি
যে গলে হোসেনের,
সহিছ কেমনে? সে গলে দুশমন
হানিছে শমসের;”

“খাতুনে-জান্নাত ফাতেমা জননী
বিশ্ব-দুলালী নবী-নন্দিনী।
মদিনা-বাসিনী পাপ-তাপ নাশিনী
উম্মত-তারিণী আনন্দিনী ॥
সাহারার বুকে মাগো তুমি মেঘ-মায়া
তপ্ত মরুর প্রাণে ¯েœহ-তরু-ছায়া;
মুক্তি লভিল মাগো এর শুভ পরশে
বিশ্বের যত নারী বন্দিনী ॥”

“নবী-নন্দিনী ফাতেমা মোদের সতী নারীদের রাণী,
যাঁর ত্যাগ, সেবা, ¯েœহ ছিল মরুভূমে কওসর পানি,
যাঁর গুণগাথা ঘরে ঘরে প্রতি নর-নারী আজো গায় ॥”

“মোহররমের চাঁদ এল ঐ কাঁদাতে ফের দুনিয়ায়।
ওয়া হোসেনা; ওয়া হোসেনা তারি মাতম শোনা যায় ॥
কাঁদিয়া জয়নাল আবেদীন বেহোঁশ হল কারবালায়।
বেহেশতে লুটিয়া কাঁদে আলী ও মা ফাতেমায় ॥”

“কাঁদে বিশ্বের মুসলিম আজি, গাহে তারি মর্সিয়া
ঝরে হাজার বছর ধরে অশ্রু তারি শোকে হায় ॥”

“মনে পড়ে আসগরে আজ পিয়াসা দুধের বাচ্চায়
পানি চাহিয়া পেল শাহাদৎ হোসেনের বক্ষে রয়ে ॥
এক হাতে বিবাহের কাঙন এক হাতে কাশেমের লাশ
বেহোঁশ খিমাতে সকিনা অসহ বেদনা স’য়ে ॥”

‘শূন্য পিঠে কাঁদে দুলদুল হজরত হোসেন শহীদ,
আসমানে শোকের বারেষ, ঝরে আজি খুন হয়ে ॥”

“ফোরাতের পানিতে নেমে ফাতেমা দুলাল কাঁদে
অঝোর নয়নে রে।
দু’হাতে তুলিয়া পানি ফেলিয়া দিলেন অমনি
পড়িল কি মনে রে॥”


নব জীবনের “ফোরাত”-কূলে গো কাঁদে “কারবালা” তৃষ্ণাতুর,
ঊর্ধ্বে শোষণ-সূর্য, নি¤েœ তপ্ত বালুকা ব্যথা-মরুর।
ঘিরিয়া য়ুরোপ এজিদের সেনা এপার, ওপার, নিকট, দূর,
এরি মাঝে মোরা “আব্বাস” সম পানি আনি প্রাণ পণ করি।”
(তরুণের গান)

“বহিছে সাহারায় শোকের ‘লু’ হাওয়া
দুলে অসীম আকাশ আকুল রোদনে।
নূহের প্লাবন আসিল ফিরে যেন
ঘোরে অশ্রু শ্রাবণ-ধারা ঝরে সঘনে ॥”

ফাল্গুধারা-সম সেই কাঁদন-নদী
কুল-মুসলিম-চিতে বহে গো নিরবধি,
আসমান ও জমীন রহিবে যতদিন
সবে কাঁদিবে এমনি আকুল কাঁদনে ॥”

লেখক: সাবেক সিনিয়র সহকারী সম্পাদক ও সাহিত্য সম্পাদক, নিউ নেশন, ঢাকা

আশুরা কোরবানির মরমি ব্যাখ্যা

সংকলন : ড. এম আব্দুল কুদ্দুস বাদশা

মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর প্রিয় দৌহিত্র, মা ফাতিমাতুয যাহরা ও শেরে খোদা হযরত আলী (আ.)-এর কলিজার টুকরা, বেহেশতের সর্দার হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) ৬১ হিজরির দশই মুহররম কারবালার প্রান্তরে নির্মমভাবে শাহাদাতবরণ করেন। অভিশপ্ত ইয়াযিদ ইবনে মুয়াবিয়ার হুকুমে নামধারী মুসলমানদের হাতে তিনদিনের দানাপানিবিহীন ক্ষুধার্ত ও পিপাসার্ত অবস্থায় ইমাম হোসাইন (আ.)-এর সপরিবারে কোরবানি হওয়ার বেদনায় যে কোনো মানুষের হৃদয় কেঁদে ওঠে। কিন্তু এ ক্রন্দন কি শুধুই একটি মানবিক অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ যা অন্য সব মানুষের ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হয়? নাকি আশুরা কোরবানির আলাদা কোনো মহিমা রয়েছে, যা জাগতিক ও মানবিক স্তরকে অতিক্রম করে যায় এবং আধ্যাত্মিক ও ঐশ্বরিক স্তরে গিয়ে পৌঁছে? আল-কোরআনে যাকে ‘যিব্হ-ই আযীম’ তথা মহাকোরবানি হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। নিশ্চয় যারা আশুরার শোকাবহ অনুভূতিকে অস্বীকার করতে চায় তারা নিজেদের চিন্তা ও বিশ্বাসকে জাগতিকতার ঊর্ধ্বে উত্তরণ ঘটাতে সক্ষম হয়নি। যে ইমাম হোসাইন (আ.) তাঁর বিখ্যাত দোয়া-ই আরাফা’র মধ্যে ঘোষণা করেছেন : ‘হে আমার রব! যে তোমাকে পেয়েছে সে কী হারিয়েছে? আর যে তোমাকে হারিয়েছে সে কী পেয়েছে?’ সেই ইমামের এই মহান কোরবানি যে জাগতিক ও মানবিকতাকে ছাড়িয়ে যাবে এটাই স্বাভাবিক। তাই এ প্রবন্ধে আশুরার দিনে সাইয়্যেদুশ শুহাদা ইমাম হোসাইন (আ.)-এর মহান কোরবানির একটি মরমি তথা আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা উপস্থাপনের প্রয়াস চালানো হয়েছে।
মরমিবাদী আরেফগণ ইমাম হোসাইন (আ.)-কে একজন ইনসানে কামেল তথা পূর্ণাত্মা মানবের উৎকৃষ্ট উদাহরণ হিসাবে মনে করে থাকেন। একারণে তাঁদের নিকট ইমাম হোসাইন (আ.)-এর মর্যাদা নিছক একজন ইমাম তথা সমাজের নেতার পর্যায় থেকে অতিক্রম করে অনেক ঊর্ধ্বে চলে যায়। কেননা, একজন ইমাম যদি রাজনৈতিক প্রেক্ষিত থেকে মুসলমানদের বিষয়াদি পরিচালনা করার দায়িত্ব পালন করে থাকেন, তবে একজন ইনসানে কামেল এর দায়বদ্ধতা গোটা বিশ্বজাহানের কাছে। অন্যভাষায় বলা যায়, ইনসানে কামেল হচ্ছেন জমিনে আল্লাহর খলীফা তথা প্রতিনিধি। তিনি যদি নিশ্চিহ্ন হয়ে যান, তার অর্থ হলো গোটা বিশ্ব জাহান ও জীবনের শৃঙ্খলা ভেঙ্গে পড়া। একারণে মরমিবাদী আরেফগণ আশুরার ঘটনাকে এমন একটি ঘটনা হিসাবে বিবেচনা করেন যেখানে একজন ইনসানে কামেল উপস্থিত ছিলেন। আরেফগণের শুহুদী দৃষ্টিতে নিশ্চয় এ কোরবানির চেহারা ধরা পড়বে এক অনবদ্য আধ্যাত্মিক পরিমাত্রায়, ঐশ্বরিক সুবাসে।
আশুরার প্রতি ইরফানি দৃষ্টিভঙ্গিতে ইরফানের মাকাম তথা স্তরসমূহও বিবেচনায় নেওয়া হয়। এই দৃশ্যপটে আশুরার প্রত্যেক শহীদ একদিকে যেমন এক একটি ইরফানি উপাদান, আবার একই সাথে এক একটি ইরফানি সিম্বল তথা প্রতীকও বটে। এভাবে আশুরায় যে ইরফানি সেইর ও সুলুক সংঘটিত হয়েছে তার কোনোটাই দৃষ্টি থেকে বাদ পড়ে না। স্বয়ং ইমাম হোসাইন (আ.) ছিলেন ইরফানের কুতুব তথা মূল অক্ষ। আর অবশিষ্ট মহান শহীদগণও অন্যান্য ভূমিকায় আবির্ভূত হয়েছেন। উল্লেখ্য, সব মরমি সাধকই যে এ ব্যাপারে একই দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন, সেটা বলা যায় না। কিংবা সে বিষয়ে আলোচনা করাও এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। বরং বিখ্যাত মরমি কবি হাকিম সানায়ী গাযনাভী’র কাব্যের আলোকে শীর্ষ আরেফগণের দৃষ্টিভঙ্গিই তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।
হাকিম আবদুল মাজদ মাজদুদ বিন আদাম সানায়ী গাযনাভী (১০৮০-১১৪১ খ্রি.) রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর আহলে বাইতের প্রতি আন্তরিক ভালোবাসা পোষণ করতেন। তিনি আহলে বাইতের প্রতি এই ভালোবাসা আর বনি উমাইয়্যার প্রতি ঘৃণার মাধ্যমে নাজাতের আশা রাখতেন। আলী (আ.)-এর প্রতি ও তাঁর দুই পুত্র ইমাম হাসান ও ইমাম হোসাইনের প্রতি ভক্তি এবং ভালোবাসার মাধ্যমে তিনি বেহেশতে প্রবেশ করার তাওফিক কামনা করতেন :
আমি দুইটা কারণকে আশায় রাখি
যদিও আমি গোনাহগার পাপী
এই দুই কারণে পেতে পারি নাজাত
যা থেকে বে-খবর সবে ইয়া রব!
একটি হলো আলে রাসূলের ভালোবাসা
ঐ সিংহপুরুষের, যিনি বাতুলের জোড়া
অপরটি হলো আলে বু-সুফিয়ানের ঘৃণা
যারা ছিল আলে মুহাম্মাদের শত্রু সর্বদা
আশা, এই দুই উসিলাই দেবে নাজাত আমায়
আর জাহান্নাম থেকে আমাকে দেবে রেহাই
রোজ হাশরের দিনে এটুকুই সম্বল আমার
আশা করা যায় এটাই হবে দ্বীনের বিচার।
উপরিউক্ত বয়েতগুলোতে ‘তাওয়াল্লা’ এবং ‘তাবাররা’- এই দুইটি মূলনীতির কথা বলা হয়েছে। তাওয়াল্লা হচ্ছে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর প্রতি। আর তাবাররা হচ্ছ ইয়াযিদ ও সমস্ত বনি উমাইয়্যা হতে। উপরন্তু ইমাম হাসান ও ইমাম হোসাইনের প্রতি ভালোবাসা নাজাতের কারণ এবং খোদায়ী বেহেশতে প্রবেশের উসিলা হবে বলে আশা প্রকাশ।
আট বেহেশতকে কখনো কি সন্ধান পাবে কোথাও
যদি না থাকে মহব্বত আলীর, শাব্বিরের ও শুবাইরের।
সানায়ী গাযনাভী বিশ্বাস করতেন যে, হাসানাইন (আ.)-এর সম্পর্কে কথা বলতে গেলে আগে হোসাইনী হাল, চরিত্র ও স্বভাবের অধিকারী হতে হবে। একারণে তিনি মনে করতেন, যে ব্যক্তি আহলে বাইতের অনুসারী বলে দাবি করে, তাকে সবদিক থেকে পুণ্যময় চরিত্র দ্বারা চরিত্রবান হওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে :
তুমি ঈমানের দাবি করবে আর নাফ্্সের নির্দেশ মেনে চলবে?
বাইয়াত করবে আলীর সাথে আর হাসানকে বিষ পান করাবে?
সানায়ী ইয়াযিদ ও তার লোক-লস্করের প্রতি এতটাই ঘৃণা পোষণ করতেন যে, ইয়াযিদের হাতে বাইয়াতকারীদেরকে আরেক ইয়াযিদ বলে আখ্যায়িত করেন। নতুবা কোনো সুস্থ-বিবেকের মানুষ ইয়াযিদের সাথে বাইয়াত করতে রাজি হতে পারে না, আর মুমিন মানুষের তো প্রশ্নই আসে না। ইয়াযিদ ও শিমারের প্রতি তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীতে ইমাম হোসাইন (আ.)-কে তিনি ‘শহীদদের স¤্রাট’ বলে মনে করেন।
গোটা দুনিয়ার সবখানে ভরা কত শহীদে
কিন্তু কারবালার হোসাইনের ন্যায় শহীদ তুমি পাবে কোথায়?
সানায়ী’র দৃষ্টিকোণ থেকে আশুরা বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার কারণ ছিল এটা যে, একদল দুনিয়ালিপ্সু লোকের ইমাম হোসাইন (আ.)-এর ন্যায় অপার্থিব ব্যক্তিত্বকে সহ্য করার সামর্থ্য ছিল না। বাদুড় যেমন দিনের আলোয় চলতে পারে না বলে সূর্যের আলোকে এড়িয়ে রাতের আঁধারে বের হয়, জুলুমপূজারী জালেমরাও তদ্রƒপ তাদের চলার পথে বাধা হিসাবে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর সূর্যের ন্যায় আলোকোজ্জ্বল অস্তিত্বকে সরিয়ে ফেলতে তৎপর হয়ে ওঠে। এই অন্ধকারে বিচরণকারী দলটি শুধু যে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর সাথে এরূপ আচরণ করেছে, তা নয়; বরং এর আগে তাঁর মহান পিতার সাথেও একই আচরণ করেছে। আমিরুল মুমিনীন আলী (আ.)-এর সাথে তাদের বিরোধিতার পেছনেও মূল দর্শন ছিল এটাই। আর আলী (আ.)ও যে তাদের বিরুদ্ধে তলোয়ার ধরতেন, সেটাও ছিল এই কারণে। কেননা, শেরে খোদার প্রত্যেকটি তলোয়ার আঘাত যা নিশাচরীদের মস্তকের উপর নেমে আসত, উদ্দেশ্য ছিল যাতে খোদায়ী নূরের পরিধি আরও বিস্তৃত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে এবং মানুষ সে আলো থেকে উপকৃত হতে সক্ষম হয়।
তারা যেহেতু জাহেলি যুগে এবং হযরত আলী (আ.)-এর খেলাফতের আমলে তাঁর থেকে বিষাক্ত আঘাতে জর্জরিত হয়েছিল, একারণে ৬১ হিজরিতে এর বদলা গ্রহণে উদ্যত হয়, যাতে ঐসমস্ত পরাজয়ের আংশিক উসূল করতে পারে। আর হোসাইন (আ.) ও তাঁর পরিবার-পরিজনদের প্রতি গালি ও অভিসম্পাত বর্ষণের মাধ্যমে মাওলা আলীকে খাটো করতে পারে। সুতরাং ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কতলের রহস্য খুঁজতে হবে ইয়াযিদী জাহেল ও জুলুমপূজারীদের সেই সব পরাজয়ের মধ্যে যেগুলো তারা শেরে খোদার জুলফিকারের মাধ্যমে পরাজিত হয়েছিল। সানায়ী এরূপ ইরফানি দৃষ্টিকোণ থেকেই ইয়াযিদ ও তার লোক-লস্করকে লানতের ও অভিসম্পাতের পাত্র হিসাবে গণ্য করেন এবং তাদেরকে নিন্দা ও সমালোচনা করা মানুষের জন্য ইহকাল ও পরকালে সম্মান ও মুক্তির উসিলা বলে মনে করেন :
যে কেউ ঐ কুকুরগুলোর নিন্দাবাদ জানাবে
জেনে রাখ, সে বাদশাহি পাবে পরলোকে।
মরমি আরেফ সানাযী প্রকাশ্যে ও নির্দ্বিধায় ইয়াযিদ ও শিমারের প্রতি লানত বর্ষণ করেন এবং তাদেরকে চিরকালীন অভিশপ্ত হিসাবে গণ্য করেন। তিনি তাঁর ‘লোগাতনামা’র মধ্যে জল্লাদদের একজন একজন করে নাম উল্লেখ করেছেন এবং তাদের উপর লানত বর্ষণ করেছেন। তাদের কৃতকর্মকে অত্যন্ত লজ্জাজনক আখ্যায়িত করে তাদেরকে নিন্দাবাদ জানিয়েছেন এবং প্রত্যাখ্যাত বলে ঘোষণা দিয়েছেন :
কারবালা যখন করল মাকাম ও মঞ্জিল নির্মাণ
সহসাই ইবনে যিয়াদ সেথা হানল আক্রমণ
দেহ থেকে মস্তকগুলো কাটল খঞ্জরে
বড় ফায়দার লোভ ছিল তাদের এই কর্মে
পিপাসিত আলী আসগর তাকেও করে না রহম
আর ঐ কুকুরেরা মেনে নেয় এই নিদারুন জুলুম।
সানায়ী গাযনাভী কোথাও কোথাও ইয়াযিদ ও তার লোক-লস্করকে সামুদ গোত্রের সাথে তুলনা করেছেন। তিনি ব্যাখ্যা দিয়েছেন যে, তারাও ঠিক সেই কাজগুলোই করেছে যা সামুদ গোত্র করেছিল :
আমর বিন আস ও ইয়াযিদ ও ইবনে যিয়াদ
ঠিক যেন সেই গোত্র সামুদ, সালেহ ও আদ।
সত্য থেকে বিচ্যুত হয়ে অস্বীকার আর অস্বীকার
জুলুম আর অন্যায় করাই তাদের যত অঙ্গীকার।
অবিচার করায় একবারও করল না বিবেচন
মুস্তাফা ও মূর্তজার কথা করল না স্মরণ।
বুল-হাকামকে গ্রহণ করল, না আহমদ
নিজের কৃতকর্মে করল দোযখকে খরিদ।
অবশ্য মানুষের মধ্যে এমনও অনেকে রয়েছে যাদের অন্তর নিরেট কালো হওয়ার কারণে এবং আল্লাহর মারেফত না থাকার কারণে ইরফানের স্বাদই আস্বাদন করতে পারেনি। এরা দুনিয়ার মূল্যে নিজেকে বিক্রি করে দেয় এবং ইয়াযিদদের কাতারে দাঁড়ায়। যে কেউ ইমাম হোসাইন (আ.)-এর রক্ত ঝরাবার কাজে রাজি থাকবে, অবশ সে পুণ্যবানদের ও আরেফগণের পক্ষ থেকে লানত ও অভিসম্পাত পাওয়ার যোগ্য হবে। অতএব, যে ব্যক্তি ইয়াযিদ ও আমর বিন আসের ন্যায় পাপিষ্ঠ লোকদের অনুসরণ করবে এবং এ নিয়ে গর্ব করবে, নিশ্চিতভাবে সে কেবল দুনিয়াতেই যে শুধু পুণ্যবানদের দোয়া-খায়ের থেকে বঞ্চিত হবে, তা নয়; বরং দুনিয়া এবং আখেরাতে তাদের বদদোয়া ও লানতের ভাগীদার হবে :
তুমি যে বল ইয়াযিদ আমার আমীর
আর পাপিষ্ঠ আমরে আস আমার পীর
তবে জেন পাপিষ্ঠ ইয়াযিদ হয় যার আমীর
কিংবা আমর বিন আস হয় যার পীর
আযাব ও লানত পাওনা হবে তার
সে তো নরাধম এক পাপিষ্ঠ বে-দ্বীন।
শুধু যে ইয়াযিদ ও তার দোসররা দুনিয়া ও আখেরাতে আল্লাহর আযাব ও আউলিয়াগণের লানতের পাত্র হবে, তা নয়; বরং যারা অন্যায়ভাবে এসব দুরাচারীকে পুণ্যভরে স্মরণ করবে, তারাও তাদের দলভুক্ত হবে :
ন্যায়বিচারীর লানত হোক তাদের উপর
যারা শ্রদ্ধায় স্মরণ করে এই জালেমদের।
তবে অবশ্য ওলি-আউলিয়াগণ এবং তরিকতের সাধকবৃন্দ ইমাম হোসাইন (আ.) ও আত্মোৎসর্গী সঙ্গী-সাথিদের প্রতি দরুদ ও সানা প্রেরণ পাঠ করাকে নিজেদের কর্তব্য বলে মনে করে থাকে। আর এ কারণেই তাঁরা নিজেদেরকে সেই কাফেলার সহযাত্রী হিসাবে ঘেষেণা করেন যে কাফেলায় বর্শার মাথায় কাটা শির মোবারক থেকে কোরআন তেলাওয়াত করা হয়।
প্রকৃতপক্ষে ইমাম হোসাইন (আ.) ও তাঁর সঙ্গী-সাথিদের প্রতি দরুদ ও সালাম পাঠ আর ইয়াযিদ ও তার দোসরদের প্রতি লানত প্রেরণ করা হচ্ছে হক ও বাতিল এই দুই বিপরীত পক্ষের মধ্যে সংগ্রামের অব্যাহত ধারাবাহিকতা। যা হযরত আদম সৃষ্টির শুরু থেকে অদ্যাবধি চলমান রয়েছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত চলতে থাকবে। একারণে ইমাম হোসাইন (আ.) সম্পর্কে কিংবা ইয়াযিদ সম্পর্কে একজন মানুষ কোন্্ অবস্থান গ্রহণ করবে তার উপর নির্ভর করবে সে হক পথে সাইর করছে নাকি বাতিল পথে। আর একারণেই ইরফানি দৃষ্টিকোণ থেকে ইয়াযিদ, শিমার ও তাদের দোসরদের প্রতি লানত বর্ষণ করা অর্থপূর্ণ হয়ে ওঠে ও ভিত্তি খুঁজে পায়। সানায়ী’র ভাষায় :
আশুরা কোরবানির স্মরণ
সে তো সাইরকারীদের কল্বের শক্তির কারণ
সানায়ী দ্বীনি আমলসমূহ পরিপালনে কষ্ট ও মুসিবত সহ্য করার উপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি তরিকতের বিভিন্ন স্তরে কঠিন শোকতাপগুলোকে বরণ করে নেওয়ার ক্ষেত্রে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর নিকট থেকে মদদ কামনা করেন। ইরফানের অঙ্গনে ইমাম হোসাইন ও তাঁর সঙ্গী-সাথিদের ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতাকে তিনি এমন এক মডেল হিসাবে উপস্থাপন করেন যা আর পুনরাবৃত্তি ঘটবে না। আর এ কারণেই আশুরার কোরবানি সম্পর্কে অধ্যয়ন করাকে নিজের উপরে এবং হাকিকত অন্বেষী মরমি সাধকদের জন্য ফরয বলে মনে করেন।
সানায়ী ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কোরবানিকে শুধু একটি আত্মত্যাগের মডেল হিসাবে উপস্থাপন করেই ক্ষান্ত হননি; বরং মরমিবাদের যে ‘মৃত্যুর পূর্বে মৃত্যুকে আস্বাদন করার চর্চা রয়েছে’- সেদিক থেকে তিনি ইমাম (আ.) ও তাঁর সঙ্গী-সাথিদেরকে স্বাভাবিক মৃত্যুর পূর্বে মৃত্যুকে আস্বাদন করার উত্তম নজির হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। এই দৃষ্টিকোণ থেকে মহান ওলি-আউলিয়াগণ ও খোদায়ী পুরুষগণ হচ্ছে তাঁরাই যাঁরা ইহজগতে তাঁদের নাফসের মৃত্যুকে অবলোকন করেছেন। পরিশেষে সানায়ী দাবি করেন যে, ইমাম হোসাইন (আ.) এই পরীক্ষাটি অত্যন্ত নিখুঁতভাবে আঞ্জাম দিয়েছেন।
সানায়ী গাযনাভী আশুরা বিপ্লবের প্রকৃত স্বরূপ আর ইমাম হোসাইন (আ.)-এর চির অম্লান ব্যক্তিত্বের সঠিক অনুধাবন তখনই সম্ভব বলে মনে করেন যখন মানুষ গায়রুল্লাহ থেকে বিচ্ছিন্নতার অভিজ্ঞতা লাভ করবে। অন্যথায় হোসাইন (আ.)-এর কাহিনী পাঠ করে তার কোনো উপকারে আসবে না। কারণ, ইমাম হোসাইন (আ.) এমন এক অগ্নিপরীক্ষার অভিজ্ঞতায় নেমেছেন যা মৃত্যুর পূর্বে মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদনকারীরা ছাড়া তা আস্বাদন করতে সক্ষম হবে না এবং তা অনুধাবন ও স্পর্শ করতে পারবে না।
হাকিম সানায়ী বিশ্বাস করেন, হক সবসময় বিজয়ী। যদিও ক্ষণিকের জন্য কালো মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়ে। তাই ইমাম হোসাইন (আ.) এমন এক আন্দোলনের সূচনা করেন যার মূল শিকড় প্রোথিত রয়েছে আল্লাহর হাক্কানি সত্তার মধ্যে। এই কারণে তা কখনই বিস্মৃতির কবলে পড়বে না। পরাজয়ের ধুলোর আস্তরণও এর গায়ে বসবে না। হাকিম সানায়ী মনে করেন, যদিও পাপিষ্ঠ জালেমরা জাহেলিয়াতের বশবর্তী হয়ে খোদার দ্বীনের সম্মানকে ভূলুণ্ঠিত করেছে এবং রেসালাতের খান্দানের পবিত্র দরজা, যা ছিল জগতের শুদ্ধ পুরুষদের পছন্দনীয়, সেটাকে তারা পদদলিত করেছে, আর আলে ইয়াসীনের কর্তিত মস্তকগুলোকে বর্শার উপরে তুলেছে এবং তাদের শিরকাটা দেহগুলোর উপর দিয়ে ঘোড়া চালিয়েছে, কিন্তু আসলে তারা তাদের এসব কৃতকর্ম দ্বারা অনন্তকালীন লানত ও অভিসম্পাতে আক্রান্ত করেছে। আমি সানায়ী বনি উমাইয়্যা খান্দানের এসব অপকর্মের প্রতি অসন্তুষ্টি ঘোষণা করছি। কিন্তু কারবালার ¯িœগ্ধ সমীরণ বেহেশতের বারতা বয়ে আনে যা অনুসরণ ও অনুকরণযোগ্য বটে। তাই আমি সেই নারীর গোলাম যিনি কারবালার ¯িœগ্ধ সমীরণের সুবাস গ্রহণের জন্য প্রতিদিন শহরের বাইরে চলে আসতেন এবং পিশাচ দুশমনের কোনো পরোয়া করতেন না। ইমাম হোসাইন (আ.) ও তাঁর সঙ্গী-সাথিদের অমরত্ব ও চিরন্তনতার পেছনে যে রহস্য নিহিত, সেটা হলো এই যে, তাঁরা হক (আল্লাহ) ও তাঁর সিফাতসমূহের তাজাল্লীকারী ছিলেন। এই দৃষ্টিকোণ থেকে খোদায়ী জামালের দর্পণসমূহ কখনই ভেঙ্গে যাবে না। বরং প্রত্যেক যুগ ও জামানায় আরও স্থায়ী ও টেকসই হবে। হাকিম সানায়ীর দৃষ্টিতে কারবালা হচ্ছে আল্লাহর বেহেশতেরই একটি টুকরা, যা জমিনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আর কারবালার শহীদগণ হচ্ছেন সেই পবিত্র ফুলসমূহ, যা কারবালার মাটিতে ফুটেছে এবং গোটা জাহানকে সুরভিময় করে তুলেছে।

 

একটি স্বর্গীয় বিয়ে এবং বিয়ে বার্ষিকী উদযাপন

শাহনাজ আরফীন

আরবি যিলহজ মাসের প্রথম দিন মুসলমানদের জন্য অনাবিল আনন্দ আর উৎসবমুখর একটি দিন। এদিনে এ ধরাপৃষ্ঠে এমন দুজন স্বর্গীয় মানব ও মানবীর শুভ বিবাহ হয়েছিল যার খুশি আর আনন্দে মেতে উঠেছিলেন খোদ আসমানের ফেরেশতারাও।
হ্যাঁ, ঐতিহাসিক ওই বিয়ের বর ছিলেন আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.) আর কনে ছিলেন নবীনন্দিনী হযরত ফাতিমাতুয যাহরা (সা. আ.)। পবিত্র যিলহজ মাসের এক তারিখে রোজ শুক্রবার নবীনন্দিনী ফাতেমা যাহরার সাথে শেরে খোদা আলী (আ.)-এর ভালোবাসার নিবিড় বন্ধন ও শুভ বিবাহ স¤পন্ন হয়। মহান স্রষ্টা নিজ মনোনীত বান্দা রাসূলে পাক (সা.)-কে এ অভিনব ও স্বর্গীয় বিয়ের সাক্ষী হিসেবে স্থির করেন। এ ঐশী বিয়ের আনন্দ ও সুখময় স্মৃতি সূর্যের আলোকরশ্মির মতোই আলো বিকিরণ করবে ও প্রেরণা যোগাবে প্রতিটি খোদাপ্রেমী মানুষকে।
মা ফাতেমা ও আলী (আ.)-এর বিবাহ বার্ষিকী ইরানে ‘বিয়ে দিবস’ হিসেবে নামকরণ করা হয়েছে। স্বর্গীয় এ দুজন মহামানবের প্রেম-প্রীতির অপূর্ব এ বন্ধনকে চির অম্লান রাখা এবং তাঁদের শুভ পরিণয়ের আদর্শ অনুসরণের জন্য এ দিবস উদ্যাপনের উদ্যোগ সত্যিই বেশ তাৎপর্যপূর্ণ।
হযরত ফাতেমা (সা.) আরবি ২০শে জমাদিউস সানী হযরত খাদিজাতুল কোবরার গৃহ আলোকিত করে এ ধরার বুকে আগমন করেন। জন্মের পর রাসূল (সা.) তাঁর নাম রাখেন ‘ফাতেমা’। ‘ফাতেমা’ নামটির অর্থ হলো সকল প্রকার অপবিত্রতা থেকে মুক্ত। এ মহীয়সী নারী বহু মানবীয় গুণের অধিকারী ছিলেন বলে তাঁকে সিদ্দিকাহ বা সত্যবাদিনী, মুবারাকাহ বা বরকতময়ী, তাহেরাহ বা পবিত্রা, যাকিয়াহ বা পরিশুদ্ধতার অধিকারী, রাজীয়া বা সন্তুষ্ট, মার্জিয়া বা সন্তোষপ্রাপ্ত মুহাদ্দিসাহ বা হাদিস বর্ণনাকারী এবং যাহরা বা দীপ্তিময় উপাধিতে ডাকা হতো। এছাড়া তিনি উম্মুল হাসান, উম্মুল হুসাইন, উম্মুল মুহসিন, উম্মুল আয়েম্মা এবং উম্মে আবিহা নামেও পরিচিত ছিলেন। হযরত ফাতেমা ছিলেন রাসূলে খোদা (সা.)-এর অতি আদরের কন্যা। ফাতেমা স¤পর্কে বিশ্বনবী (সা.) বলেন : ‘ফাতেমা আমার দেহের অঙ্গ, চোখের জ্যোতি, অন্তরের ফল এবং আমার রুহস্বরূপ। সে হচ্ছে মানুষরূপী স্বর্গীয় হুর।’
অন্যদিকে, হযরত আলী (আ.) ছিলেন রাসূলে খোদার চাচা আবু তালিবের পুত্র। ৬০০ খ্রিস্টাব্দের ১৩ই রজব তিনি পবিত্র কাবাগৃহে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের তিনদিন পর বালকটির মা ফাতিমা বিনতে আসাদ তার নাম রাখেন আলী। চাচা আবু তালিবের দুর্দিনে রাসূল (সা.) ছোট্ট বালক আলীর ভরণপোষণের দায়িত্ব নেন। রাসূল খোদা যখন নবুওয়াত পান, তখন কিশোর আলীই তাঁর প্রতি প্রথম ইমান আনেন। শুধু তাই নয়, নবীজিকে তিনি সবসময় ছায়ার মতো অনুসরণ করতেন। তাঁর বীরত্ব, জ্ঞান-গরিমা, ত্যাগ, প্রজ্ঞা ও সাহসিকতায় রাসূল (সা.) ছিলেন মুগ্ধ। খোদ রাসূল (সা.) আলী স¤পর্কে বলেন : ‘আমি জ্ঞানের শহর আর আলী হচ্ছে তার দরজা।’
রাসূলে খোদা মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করার দুবছর পর অনেকেই তাঁর কাছে ফাতিমার জন্য বিয়ের প্রস্তাব পাঠান। তাঁদের মধ্যে আরবের বহু স্বনামনধন্য প্রথিতযশা ও ধনাঢ্য ব্যক্তিও ছিলেন। কিন্তু সবার ক্ষেত্রেই রাসূলে খোদা (সা.) জানান যে, তিনি এ ব্যাপারে আল্লাহর ওহীর দিকনির্দেশনার প্রত্যাশা করছেন। প্রাচীন আরবে বিয়ের ক্ষেত্রে স্বামীর ধনস¤পদ, প্রভাব-প্রতিপত্তি ও মোটা অংকের দেনমোহরকে নারীর জন্য সম্মানের মাপকাঠি এবং স্বামীর মর্যাদা ও ব্যক্তিত্বের পরিচায়ক হিসেবে ধরা হতো। কিন্তু হযরত ফাতেমা যাহরা (সা.)-এর বিয়ের ঘটনা তো ইসলামের মহান শিক্ষা ও আদর্শকে তুলে ধরবে এবং সেই সাথে অন্ধকার ও জাহেলী যুগের রীতি-নীতি ও প্রথাগুলোর মূলোৎপাটন করে ইসলামি মূল্যবোধকে প্রতিষ্ঠিত ও বাস্তবায়িত করবে। তাই বিশ্বনবী (সা.) সমাজের এসব বৈশিষ্ট্য ও মাপকাঠিকে অগ্রাহ্য করে প্রচলিত প্রথায় আঘাত হানেন। আরবের বিশিষ্ট ধনী ব্যক্তি আবদুর রহমান ইবনে আওফ যখন ফাতেমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন এবং দেনমোহর হিসেবে মোটা অংকের অর্থ প্রদানের কথা ঘোষণা করেন, রাসূলে খোদা (সা.) ভীষণ রাগান্বিত হন।
যখন আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.) হযরত ফাতেমা (সা.)-এর বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসেন তখন লজ্জায় তাঁর চেহারা মোবারক গোলাপি বর্ণ ধারণ করেছিল। রাসূল (সা.) আলীর অবস্থা দেখে মুচকি হেসে বলেন : ‘আমার কাছে কি কোনো কাজে এসেছ?’ কিন্তু আলী (আ.) লজ্জা ও সংকোচের কারণে নিজের মনের কথা ব্যক্ত করতে পারলেন না, বরং নীরব থাকলেন। মহানবী (সা.) আলীকে বলেন : ‘ফাতেমার প্রস্তাব নিয়ে এসেছ।’ আলী (আ.) বলেন, ‘জী, এ উদ্দেশ্য নিয়েই এসেছি।’ আলী (আ.)-এর কোনো ধনস¤পদ ছিল না এবং আরবের জাহেলী প্রথানুযায়ী ঐশ্বর্যের প্রাচুর্যও তাঁর ছিল না। তারপরও মহানবী এ প্রস্তাবে খুব খুশি হলেন। তিনি বলেন : ‘হে আলী! তোমার আগেও অনেকে ফাতেমার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে। কিন্তু যখনই আমি তাদের প্রস্তাব ফাতেমার কাছে উপস্থাপন করেছি সে না-সূচক জবাব দিয়েছে। এখন তোমার বিষয়টিও তার কাছে তুলে ধরব।’
হযরত আলীর প্রস্তাব নিয়ে মহানবী কন্যা ফাতেমার কাছে এলেন। তিনি আলীর অসাধারণ চারিত্রিক গুণ ও মর্যাদা উল্লেখ করে জিজ্ঞেস করলেন : ‘মা, তুমি কি আলীকে বিয়ে করতে রাজি আছ? আল্লাহ আমাকে এ নির্দেশ দিয়েছেন।’ হযরত ফাতেমা একথা শুনে খুশি হলেন। কিন্তু লজ্জায় মুখ ফুটে কিছু বলতে পারলেন না। কেবল মাথা নিচু করে সম্মতি জানালেন। মহানবী মেয়ের সম্মতি জানতে পেরে খুশিতে ‘আল্লাহু আকবার’ বলে উঠলেন।
এটা সত্য যে, এ বিবাহটি ছিল একটি ঐশী সিদ্ধান্ত। কিন্তু সাধারণভাবে সহধর্মী নির্বাচনে নারীদের মতামতের গুরুত্ব প্রমাণের জন্য রাসূল (সা.) হযরত ফাতেমার সাথে পরামর্শ ছাড়া কোনো সিদ্ধান্ত কিংবা পদক্ষেপ নেননি।
এরপর দ্বিতীয় হিজরির পহেলা যিলহজ, শুক্রবার হযরত আলীর সাথে হযরত ফাতেমার শুভ বিবাহের দিন ধার্য করা হয়। এ বিবাহ অনুষ্ঠানে বহু আনসার ও মুহাজির উপস্থিত ছিলেন। আলীর সাথে বিয়ের প্রস্তাবে রাজি হওয়ায় মুহাজিরদের অনেকেই এতে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। বিয়ের অনুষ্ঠানে ভাষণ দিতে গিয়ে মহানবী (সা.) সাহাবীদের উদ্দেশে বলেন : ‘আল্লাহর আদেশে আমি ফাতেমার সাথে আলীর বিয়ে দিচ্ছি।’ এরপর মহানবী (সা.) হযরত আলীকে জিজ্ঞেস করলেন : ‘এমন কিছু কি আছে যা দ্বারা তোমার স্ত্রীর দেনমোহর প্রদান করবে?’ আলী (আ.) বলেন : ‘আপনি আমার জীবন-যাপন স¤পর্কে ভালোভাবেই অবগত আছেন। আমার নিকট একটি তরবারি, একটি ঢাল ও একটি উট ছাড়া আর কিছুই নেই।’
রাসূল (সা.) বলেন : ‘ঠিক আছে, ইসলামের শত্রুদের সাথে যুদ্ধের সময় তোমার তরবারি প্রয়োজন হবে। আর খেজুর বাগানে পানি দেবার জন্য এবং সফরের সময় তোমার উটের প্রয়োজন হবে। অতএব, অবশিষ্ট থাকে শুধু ঢালটি, আর তা দিয়েই তোমার স্ত্রীর দেনমোহর প্রদান করবে। আমি আমার কন্যা ফাতেমাকে কেবল উক্ত ঢালের বিনিময়ে তোমার সাথে বিয়ে দিলাম। হে আলী, তুমি কি এতে রাজি আছ?’ হযরত আলী সম্মতি জানিয়ে বললেন : ‘জী, আমি রাজি।’
তখন নবীজী দুহাত তুলে তাঁদের জন্য এবং তাঁদের অনাগত বংশধরদের সার্বিক কল্যাণের জন্য দোয়া করলেন।
এ দুজন মহামানবের বিয়ের অনুষ্ঠানটি ছিল খুবই সাদামাটা। তাই হযরত উম্মে আইমান এসে মহানবীর কাছে দুঃখ করে বললেন : ‘সেদিনও তো আনসারদের এক মেয়ের বিয়ে হলো। সে অনুষ্ঠানে কত জাঁকজমক ও আনন্দ ফুর্তি হলো! অথচ বিশ্ববাসীর নেতা মহানবীর মেয়ের বিয়ে কিনা এত সাধারণ ও সাদাসিধেভাবে হচ্ছে!’ উম্মে আইমানের কথা শুনে রাসূল (সা.) বললেন : ‘এ বিয়ের সাথে পৃথিবীর কোনো বিয়ের তুলনা হয় না। পৃথিবীতে এ বিয়ের কোনো জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান না হলেও আল্লাহর আদেশে আসমানে এ বিয়ে উপলক্ষে ব্যাপক উৎসব হচ্ছে। বেহেশতকে অপূর্ব সাজে সাজানো হয়েছে। ফেরেশতারা, হুর-গেলমান সবাই আনন্দ করছে। বেহেশতের গাছপালা থেকে মণি-মুক্তা ঝরছে!’ একথা শুনে বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত সকলের মুখ খুশিতে ভরে উঠল।
হযরত আলী ও হযরত ফাতেমার স্বর্গীয় বিয়ের শিক্ষাগুলো হচ্ছে নিম্নরূপ :
১. বিয়ের ক্ষেত্রে সমাজের রীতিনীতি ও মানুষের মতামতের চেয়ে স্রষ্টার মতামত ও সন্তুষ্টিকেই প্রাধান্য দেওয়া।
২. সঠিক ও উপযুক্ত পাত্র ও পাত্রী নির্বাচন।
৩. বিয়ের আচার-অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে বাহুল্য ও অপচয় থেকে দূরে থাকা।
৪. বিয়ের মোহরানা যথাসম্ভব সহনীয় ও সাধ্যের মধ্যে নির্ধারণ করা, নারীদের মোহরানা উচ্চ হারে না ধরা।
৫. বিয়ের আনুষাজ্ঞিক বিষয়গুলো সহজ ও স্বাভাবিক রাখা।
৬. পাত্র ও পাত্রী নির্বাচনের ক্ষেত্রে খোদাভীতি, সদাচরণ ও মানবীয় গুণাবলিকে প্রাধান্য দেওয়া।
কিন্তু দুঃখজনক ব্যপার হলো আমাদের বর্তমান সমাজের দিকে তাকালে দেখা যায়, বিয়ের অনুষ্ঠানমালায় পবিত্রতা ও ধার্মিকতা অনেকাংশে লোপ পেয়েছে। বর্তমানে বিয়ের অনুষ্ঠান যেন মর্যাদার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিয়েতে কে কত বেশি জমকালো আয়োজন করতে পারে, অর্থ ব্যয় করতে পারে তার যেন প্রতিযোগিতা চলে সবার মধ্যে। বিয়ের অনুষ্ঠান লৌকিকতা এবং নিছক আনন্দ-উল্লাসের অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। আর অপর দিকে বিয়ের শর্তাবলি কঠিন ও ব্যয়বহুল হবার কারণে বিয়ের ব্যাপারে যুবক-যুবতীদের অনীহা তৈরি হচ্ছে এবং নানা কারণে বিবাহ বিচ্ছেদের হার ক্রমশ বাড়ছে।
অথচ বিবাহ একটি শুভ ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান, যা পালনের মধ্য দিয়ে নারী-পুরুষের ভবিষ্যৎ জীবনের সূচনা হয়। বিয়ে হচ্ছে রাসূলে খোদা (সা.)-এর পবিত্র একটি সুন্নত। মানবতার ধর্ম ইসলাম নারী-পুরুষের মধ্যে সুন্দর ও পুতঃপবিত্র জীবন যাপনের জন্য বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার ব্যবস্থা করেছে। উচ্ছৃঙ্খলতা ও অশালীনতার অভিশাপ থেকে সুরক্ষা পেতেই ইসলাম বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে জোর তাগিদ প্রদান করেছে। কাজেই বিয়ের মতো শুভ ও পবিত্র একটি ঐশী বিধানকে নির্মল, সুন্দর ও সার্থক করার জন্য নবী করিম (সা.)-এর আদর্শ অনুসরণ একান্ত জরুরি। বিশ্বনবী (সা.) ঐশী নির্দেশে এবং নিজ তত্ত্বাবধানে কন্যা ফাতেমার সাথে আলীর বিয়ে দিয়েছেন। তাই বিয়ের ক্ষেত্রে মুসলমানদের জন্য এর চেয়ে উত্তম আদর্শ আর কি হতে পারে? তাই মা ফাতেমা ও হযরত আলীর বিবাহ বার্ষিকীকে ‘বিয়ে দিবস’ হিসেবে উদ্যাপন সত্যিই প্রশংসনীয়। যাঁরা নিজেদের দা¤পত্য জীবনকে ঐশী দিকনির্দেশনা অনুযায়ী পরিচালিত করতে চান এবং নিজেদের পারিবারিক জীবনকে বরকতময় ও স্বর্গীয় সুষমা দিয়ে ভরে তুলতে চান তাঁদের জন্য ফাতেমা ও আলীর বিয়ে বার্ষিকী হতে পারে সর্বোত্তম ও শুভ দিন।

পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) ও ইসলামি ঐক্য সপ্তাহ

ড. মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান খান

হযরত মুহাম্মাদ (সা.) হলেন সর্বশেষ ও বিশ্বনবী। একজন মানুষ হিসেবেও তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ। তিনি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মহামানব- রাহমাতুল্লিল ‘আলামীন। তাঁর পবিত্র পয়গাম কোনো বিশেষ জাতি বা ভৌগোলিক পরিসীমার মধ্যে আবদ্ধ ছিল না বা নয়। পৃথিবীতে তাঁর আগমন হয়েছিল বিশ্বব্যাপী সকল মানুষের কল্যাণের জন্য। শ্রেষ্ঠতম মানব মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর স্বীকৃতি কেবল পবিত্র মহাগ্রন্থ আল কুরআন, হাদিস বা মুসলিম মনীষীদের ভাষ্য দ্বারাই স্বীকৃত নয়; বরং বিশ^বরেণ্য অমুসলিম প-িত ও মহান ব্যক্তিরাও তাঁকে মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছেন। কেবল একজন ধর্ম প্রচারক হিসেবে নয়, একজন ব্যক্তি মানুষ হিসেবে অনুপম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, শিষ্টাচার, সত্যনিষ্ঠা, তাঁর জ্ঞান ও প্রজ্ঞা, রাষ্ট্র পরিচালনায় অনন্য দক্ষতা, মানবতাবাদী চিন্তা দর্শন এবং পরধর্ম সহিষ্ণুতা ইত্যাদি মানবীয় গুণাবলির অনুপুঙ্খ পর্যালোচনা ও বিচার-বিশ্লেষণ করে ফরাসি লেখক আলফ্রেড দ্য ল্যামারটাইন, বীরযোদ্ধা নেপোলিয়ন বোনাপার্ট, পাদ্রি বচওয়ার্থ স্মিথ, স্টিফেন, আলফ্রেড টয়েনবী, ঐতিহাসিক এইচ আর গিবন, থমাস কার্লাইল, জর্জ বার্নার্ড শ, আলবার্ট জনসন প্রমুখ অমুসলিম পাশ্চাত্য মনীষিগণও মহানবী (সা.)-এর প্রশংসা করতে বাধ্য হয়েছেন। মহানবীর শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে সহমত পোষণকারী ভারতীয় প-িতদের মধ্যে মহাত্মা গান্ধী, প-িত জওহরলাল নেহেরু, স্যার পিসি রাম, স্বামী বিবেকানন্দ, সরোজনী নাইডু, এনি এ বোসান্তÍ, এম এন রায়, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখের নামও প্রসঙ্গত স্মরণযোগ্য। বিশিষ্ট ঐতিহাসিক লেখক মাইকেল এইচ হার্ট তাঁর সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টিকারী গ্রন্থ দি হান্ড্রেড-এ পৃথিবীর সর্বকালের শ্রেষ্ঠ যে ১০০ জন মনীষীর জীবনী সংযুক্ত করেছেন সেখানে তিনি হযরত মুহাম্মাদ (সা.) কে শীর্ষতম স্থান দিয়েছেন।
মুসলিম জাতির কাছে ১২ রবিউল আউয়াল দিনটি অত্যন্ত পবিত্র ও বরকতময় দিন। কারণ, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের প্রসিদ্ধ মতে, মহিমান্বিত এই দিনেই (৫৭০ খ্রিস্টাব্দের ২৯ আগস্ট) হযরত মুহাম্মাদ (সা.) জন্মগ্রহণ করেন। বলা বাহুল্য যে, পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর জন্ম মানব ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। তাঁর জন্মদিনটি মুসলিম জাতির জীবনে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তাই এ মহিমান্বিত দিনে গোটা পৃথিবীর মুসলিম সমাজ যে ধর্মীয় উৎসব ও আচারের মাধ্যমে বিশেষভাবে আনন্দ প্রকাশ ও মহানবী (সা.)-এর প্রতি তাঁদের সালাম ও শ্রদ্ধা প্রকাশ করে থাকেন- যা ‘ঈদে মিলাদুন্নবী’ নামে পরিচিত। আভিধানিক অর্থে এই ঈদ অর্থ হুজুর পাক (সা.)-এর পবিত্র ‘বেলাদত শরিফ’ উপলক্ষে খুশি প্রকাশ করা।
বর্তমানে বাংলাদেশসহ মুসলিম বিশে^র প্রায় সর্বত্রই যথাযোগ্য ধর্মীয় মর্যাদা এবং ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উদ্যাপিত হচ্ছে। এইদিন ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণ মসজিদে মসজিদে, নিজ নিজ বাড়িতে কুরআন খতম ও জিকির আজগারের মাধ্যমে মহান রাব্বুল ‘আলামীনের বিশেষ রহমত কামনা করেন। এইদিনে বিশেষ আলোচনা সভা ও সেমিনার আয়োজনের মাধ্যমে মহানবীর জীবনচরিত আলোচনা করে ও এর আলোকে নিজেদের জীবন গঠনের অঙ্গিকার করা হয়। ঈদে মিলাদুন্নবী উদ্যাপন কর্মসূচিতে জশনে জুলুস, বিশেষ দোয়া ও মিলাদ মাহফিল ইত্যাদির আয়োজনও থাকে। মহানবী (সা.)-এর প্রতি সম্মান প্রদর্শনার্থে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন মুসলিম দেশে সরকারি ছুটি প্রদান করা হয়। ঈদে মিলাদুন্নবী উপলক্ষ্যে বাংলাদেশের প্রিন্ট মিডিয়ায় ক্রোড়পত্র প্রকাশসহ প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রকাশ করা হয়ে থাকে। ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ায় দিবসটির গুরুত্ব তুলে ধরে বিশেষ অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হয়।

বর্তমান বিশে^ মুসলমান সমাজ নানামুখী বিপদ ও দুরবস্থার মধ্যে আছে। মুসলিম বিশ্ব আজ ক্ষতবিক্ষত। তাদের এ দুরবস্থার অন্যতম কারণ হলো নিজেদের মধ্যকার বিভেদ ও অনৈক্য। মুসলমানদের মাঝে আজ নানা বিভক্তি বিরাজমান। অথচ সমগ্র মুসলমান এক জাতি। তাদের লক্ষ্য এক। ঈমানের পর ঐক্য ও একতাকে মুসলিম জাতির উপর আল্লাহ তায়ালার সবচেয়ে বড় নিয়ামত বলে গণ্য করা হয়। আর বিভেদ ও বিচ্ছিন্নতা হলো তাদের জন্য সবচেয়ে বড় শাস্তি। আর এ কারণেই মহাপবিত্র আল কুরআনে আল্লাহ মুসলিমদের বিভিন্ন দল-উপদলে বিভক্ত হওয়ার পরিবর্তে আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে ঐক্যবদ্ধ থাকতে এবং নিজেদের মধ্যে বিভেদ না করতে নির্দেশ দিয়েছেন। (সূরা আল ইমরান, আয়াত : ১০৩)। মুসলিমগণ যেন বিভেদ সৃষ্টি না করে রাসূলের আনুগত্য করেন পবিত্র কুরআনে সে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। নতুবা মুসলমানদের শক্তি নিঃশেষ হয়ে যাবে এবং প্রভাব-প্রতিপত্তি হারিয়ে তারা শত্রুদের চোখে হেয় প্রতিপন্ন হবে বলেও আল্লাহ পাক সতর্ক করে দিয়েছেন। (সূরা আল আনফাল, আয়াত : ৪৬)। বিশ্বনবী (সা.) নিজেও এ বিষয়ে তাঁর উম্মতদের করণীয় নির্দেশ করে গেছেন। মহানবী (সা.) বলেছেন, আল্লাহ এক এবং তিনি ঐক্য বা একতা পছন্দ করেন। (অষষধয রং ঁহরঃু, ধহফ ষরশবং ঁহরঃু.) এরূপ আরো অনেক হাদিস রয়েছে যেখানে মানব জাতি তথা মুসলমানদের মধ্যকার ঐক্যের কথা বলা হয়েছে এবং জাতিগত বৈষম্য কঠোরভাবে ইসলামে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অনৈক্যের ক্ষতি এবং ঐক্যের গুরুত্ব ও কল্যাণ সম্পর্কে বলতে গিয়ে রাসূলে করিম (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা অনৈক্য থেকে দূরে থাকবে। একাকী থাকা অবস্থায় ভেড়া যেভাবে বাঘের শিকার হয়, তেমনি একাকী অবস্থানরত ব্যক্তিকে শয়তান ঘেরাও করে ফেলে।’
কিন্তু মুসলিম সমাজ কুরআন-হাদিসের শিক্ষা থেকে দূরে সরে গিয়ে নিজেদের মধ্যে অনৈক্য ও বিভেদের দেয়াল তৈরি করেছে। মুসলমানদেরকে ভেতর থেকে দুর্বল করে দেওয়ার জন্য মুসলমানদের শত্রুরাও মুসলমানদেরকে একে অপরের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে। শিয়া-সুন্নি ভেদাভেদ ও মাজহাবি বিতর্কের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে তাদের মাঝে বিদ্বেষ উস্কে দিয়ে অনৈক্যকে দৃঢ়মূল করে তুলছে। ছোট-খাট বিষয় নিয়েও মুসলিম সমাজ অহেতুক বিতর্ক ও বিরোধে জড়িয়ে পড়ছে। মুসলিম সমাজের এ অনৈক্যের সুযোগ নিচ্ছে অমুসলিম বিশেষ করে পশ্চিমা দুনিয়া।
বিশ্বনবী (সা.)-এর পর ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে মুসলিম উম্মাহর সর্বজনমান্য অন্য মহাপুরুষ বা ধর্মীয় নেতারাও মুসলিম বিশে^ বিরাজমান এহেন মত-বিরোধ, বিভেদ-বিভক্তি, তিক্ততা-রেষারেষি, হানাহানি, হিংসা-বিদ্বেষ, শত্রুতা-ঘৃণা প্রভৃতি দূরীভূত করে তাদেরকে সুসম্পর্ক ও সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ করার লক্ষ্যে নানাভাবে ভূমিকা রেখেছেন। তাঁরা ইসলামি ঐক্য ও সহিষ্ণুতার দিকে মানুষকে আহ্বান করেছেন। মুসলিম বিশে^র ঐক্য ও সংহতি বিনির্মাণে যেসব মহৎপ্রাণ ব্যক্তি অবদান চিরস্মরণীয় তাঁদের মধ্যে হযরত আয়াতুল্লাহ্ আল্-উয্মা রুহুল্লাহ্ আল্-মুসাভী ইমাম খোমেইনী (রহ.) ছিলেন অন্যতম। তিনি ছিলেন ইরানের সফল ইসলামি বিপ্লবের মহান নায়ক ও ইসলামি প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা। একজন প্রাজ্ঞ দার্শনিক, রাষ্ট্রচিন্তক ও রাজনীতিজ্ঞ, আপোসহীন বিপ্লবী, একজন উঁচুমানের শিক্ষক, হৃদয়স্পর্শী বক্তা এবং সর্বোপরি একজন অনন্যসাধারণ আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবে তিনি বিশ^ময় স্বীকৃত। জগৎ বিখ্যাত দ্যা টাইমস ম্যাগাজিন ১৯৭৯ সালে তাঁকে ‘গধহ ড়ভ ঃযব ুবধৎ’ নির্বাচন করেছিল।
মুসলমানদের মধ্যকার ঐক্য, শান্তি ও সংহতি প্রতিষ্ঠার জন্য ইমাম খোমেইনী (রহ.) যেসব উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন এর অন্যতম ছিল পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী উপলক্ষ্যে ১২-১৭ রবিউল আউয়াল পর্যন্ত প্রতিবছর মুসলমানদের জন্য ‘ঐক্য সপ্তাহ’ পালনের ঘোষণা প্রদান। মহান ইসলামি বিপ্লব সফল হওয়ার বিপ্লবের প্রাণপুরুষ মহান ইমামের নির্দেশে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানে ‘ঐক্য সপ্তাহ’ শুরু হয়। ইমাম খোমেইনী (রহ.) ঐক্য, শান্তি ও সংহতি প্রতিষ্ঠার জন্য মুসলমানদের বিভিন্ন মাজহাব ও সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংলাপে বিশ^াসী ছিলেন। মাজহাবী বিতর্ক তথা শিয়া-সুন্নি বিরোধ মুসলিম বিশে^র ঐক্য ও প্রগতির পথে একটি শক্ত প্রাচীর হিসেবে কাজ করছে। এ বিরোধকে জিইয়ে রেখে সা¤্রাজ্যবাদী শক্তি ও তাদের দোসররা নানাভাবে তাদের স্বার্থ হাসিলের চেষ্টারত। মুসলিম উম্মাহর জন্য এ ক্ষতিকর দিক উপলব্ধি করে ইমাম খোমেইনী (রহ.) শিয়া-সুন্নি ও অন্যান্য মাজহাবগত ফেরকা বা বিভেদের ঊর্ধ্বে গোটা মুসলিম জনসমাজকে ঐক্যবদ্ধকরণে আত্মনিয়োগ করেন। মাজহাবী মতপার্থক্য সত্ত্বেও মুসলিম উম্মাহ যেন ইসলাম ও মুসলমানদের স্বার্থ সুরক্ষার জন্য পরস্পরকে সমর্থন, সাহায্য ও সহযোগিতা করে এবং পারস্পরিক মতপার্থক্যকে এতদূর নিয়ে না যায়- যা থেকে ইসলাম ও মুসলমানদের শত্রুরা লাভবান হবে- সে লক্ষ্যে মহান ইমাম সর্বাত্মকভাবে চেষ্টা করেন। ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উপলক্ষ্যে ইসলামি ঐক্য সপ্তাহের আয়োজনের পিছনেও এই উদ্দেশ্য ছিল।
ইসলামি বিপ্লবোত্তর ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানে ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উপলক্ষ্যে প্রতিবছর ইসলামি ঐক্য সপ্তাহ পালিত হয়। এতদউপলক্ষে আয়োজিত সেমিনারে প্রতিবছর মুসলিম বিশে^র প্রায় প্রতিটি দেশ এবং এর বাইরেও ইউরোপ ও আমেরিকাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে প্রতিনিধিগণ অংশ নেন। ২০১৮ সালে তেহরানে অনুষ্ঠিত ৩২তম ঐক্য সম্মেলনে বর্তমান নিবন্ধকার নিজেও অংশগ্রহণ করেছিলেন। সে সম্মেলনে শিয়া-সুন্নি নির্বিশেষে তিন শতাধিক প্রতিনিধি অংশ নিয়েছিলেন। এ বছর (২০২১ সালে) ১৯ থেকে ২৪ অক্টোবর তেহরানে অনুষ্ঠিত হয় ৩৫তম ইসলামি ঐক্য সম্মেলন। সম্মেলনটি উদ্বোধন করেন ইরানের নব-নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট সাইয়্যেদ ইব্রাহিম রায়িসি। প্রেসিডেন্ট তাঁর উদ্বোধনী বক্তৃতায় পারস্পরিক মতানৈক্য ও বিরোধ পরিহার করে মুসলিম বিশে^র ঐক্য ও সংহতি জোরদার করার উপর গুরুত্বারোপ করেন। এবারের ইসলামি ঐক্য সম্মেলনে মুসলিম বিশে^র প্রায় চারশ’ প্রতিনিধি অংশ নেন। ইসলামি ঐক্য সম্মেলনে একত্রিত হয়ে মুসলিম বিশ্বের প্রসিদ্ধ শিয়া ও সুন্নি, আলেম, প-িত ও চিন্তাবিদরা মুসলিম বিশ্বের সর্বশেষ ইস্যুগুলো নিয়ে আলোচনা করেন এবং মুসলিমদের মাঝে সংহতি জোরদার করার পথ প্রশস্তকরণে দিকনির্দেশনা ও পরামর্শ দেন।
আমরা বর্তমানে এক অস্থির পৃথিবীতে বাস করছি। বিশ^ায়ন এবং তথ্য প্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে সাথে বিশ^ব্যাপী চরম রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। মুসলিম বিশ^ আজ অনৈক্যের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। নব্য সা¤্রাজ্যবাদের কবলে পড়ে আফ্রিকার তিউনিসিয়া, মিশর, লিবিয়া এবং এশিয়ার সিরিয়ার, ইরাক, ইয়ামেন ও আফগানিস্তান আজ গৃহযুদ্ধের আগুনে দগ্ধিভূত হচ্ছে। সা¤্রাজ্যবাদীদের মদদপুষ্ট হয়ে একদল বিভ্রান্ত লোক ইসলামের নামে সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে বিশ^দরবারে মুসলমানদের জঙ্গি হিসেবে পরিচিত করানোর অপচেষ্টা করছে। এ থেকে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশও আজ আর মুক্ত নেই। আমরা এ অবস্থার পরিবর্তন চাই। এর জন্য প্রয়োজন কুরআনের নির্দেশনা এবং মহানবীর জীবনাদর্শ চর্চা এবং অনুসরণের মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহর ঐক্য, বিশ^ শান্তি ও সংহতির লক্ষ্যে কাজ করা।
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর প্রতি মহব্বত ও ভালোবাসা পোষণ করা ইমানের পূর্বশর্ত। এটি আল্লাহর মহব্বত ও ভালোবাসাপ্রাপ্তির একমাত্র মাধ্যম। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ ততক্ষণ ইমানদার হবে না যতক্ষণ তার পিতা-মাতা, সন্তান-সন্তুতি ও সব মানুষের চেয়ে আপন আর বেশি প্রিয় না হই।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘মহান আল্লাহ তোমাদের নিয়ামত দান করেন সেজন্য তোমরা তাঁকে ভালোবাসবে আর তাঁর মহব্বত পাওয়ার জন্য তোমরা আমাকে ভালোবাসবে।’ পবিত্র কুরআনুল কারিমের সূরা আলে ইমরানের ৩১ ও ১৩২ নং আয়াতেও এ বিষয়ে আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশনা রয়েছে। মহানবী (সা.)-কে ভালোবাসা মানে হলো তাঁর জীবনাদর্শকে অনুসরণ করা। আর মহানবী (সা.) হলেন উত্তম জীবনাদর্শের অধিকারী। এই আদর্শের যথার্থ অনুসরণ, প্রয়োগ ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে ইহ ও পারলৌকিক মুক্তি অর্জনের চেষ্টা করা আমাদের একান্ত কর্তব্য। রাসূল (সা.)-এর ভালোবাসা এবং তাঁর সুপারিশ লাভের জন্য তাঁর নির্দেশিত পথে চলার পাশাপাশি অশান্ত পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পারস্পরিক সংঘাত, বিভেদ ও অনৈক্য পরিহার করে রাসূলের আদর্শের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ একটি শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠা হোক আমাদের প্রত্যয়। আজকের বিশ^বাস্তবতায় এটিই ঈদে মিলাদুন্নবীর বড় শিক্ষা হওয়া বাঞ্ছনীয়।
লেখক : অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ
ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়।

চলতি বছরে খেলাধুলায় ইরানের সাফল্য

সাইদুল ইসলাম :

খেলাধুলা মানুষের জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশে খেলাধুলার বিকল্প নেই। এটি মানুষের সুস্থ বিনোদনের অন্যতম প্রধান মাধ্যম। বর্তমানে বিশ্বের দেশে দেশে পারস্পরিক বন্ধুত্ব ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে খেলাধুলার ভূমিকা অনস্বীকার্য হয়ে উঠেছে। সেজন্য খেলাধুলার আন্তর্জাতিক ভূমিকাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
খেলাধুলা দেহ-মনে স্বাচ্ছন্দ্য ও প্রশান্তি বয়ে আনে। পরিচ্ছন্ন বিনোদন ও খেলাধুলার মধ্য দিয়ে যে শিশু বেড়ে ওঠে তার পক্ষে সফল মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠা সম্ভব। আবার অপরিচ্ছন্ন বা কুয়াশাচ্ছন্ন বিনোদনে বেড়ে ওঠা শিশুর জীবন ধ্বংস হতে বাধ্য। এ কারণে বলা হয়, শিশু বয়সে মানুষ যা গ্রহণ করে পরবর্তী জীবনে সে তা লালন করে। তাইতো ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান জ্ঞানচর্চার পাশাপাশি মানুষের সুস্থ বিনোদনের অন্যতম প্রধান মাধ্যম হিসেবে খেলাধুলাকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়ে থাকে। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি জনগণের ব্যাপক আগ্রহের কারণে খেলাধুলায় ইরানের খ্যাতি আজ বিশ্বজোড়া। ফুটবল থেকে শুরু করে খেলাধুলার প্রায় সকল ক্ষেত্রেই অসাধারণ নৈপুণ্য দেখিয়ে চলেছেন ইরানি খেলোয়াড়রা।
এরই মধ্যে এশিয়ান পুরুষ ভলিবল চ্যাম্পিয়নশিপ ২০২১ এর শিরোপা জয় করেছে ইরানের জাতীয় পুরুষ ভলিবল দল। গত ১৯ সেপ্টেম্বর ফাইনাল ম্যাচে স্বাগতিক জাপানকে ৩-০ সেটে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে ইরানি স্কোয়াড। ইরান প্রতিপক্ষকে ২৭-২৫, ২৫-২২, ৩১-২৯ পয়েন্টের ব্যবধানে টানা তিন সেটে পরাজিত করে।

২১তম এশিয়ান সিনিয়র পুরুষ ভলিবল চ্যাম্পিয়নশিপ ১২ থেকে ১৯ সেপ্টেম্বর জাপানের চিবাতে অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিযোগিতা শেষে ইরানি কোচ বেহরুজ আতায়েই এশিয়ার সেরা কোচ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। অন্যদিকে ইরানি খেলোয়াড় সাবের কাজেমি সর্বাপেক্ষা মূল্যবান খেলোয়াড়ের উপাধি লাভ করেন।
এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে এ নিয়ে ইরান চারবার শিরোপা জিতল। অন্যদিকে স্বাগতিক জাপান এপর্যন্ত নয়বার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে। ফাইনাল লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে ইরান ও জাপান উভয়েই ২০২২ এফআইভিবি ভলিবল পুরুষ বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের টিকিট লাভ করে।

এদিকে, এশিয়ান পুরুষ ভলিবল চ্যাম্পিয়নশিপ ২০২১ এর শিরোপা জয়ের মধ্য দিয়ে এফআইভিবি বিশ্ব র‌্যাংঙ্কিংয়ে এশিয়ার সেরা ভলিবল দলের স্থান দখল করেছে ইরান। বিশ্বে ইরানের জাতীয় ভলিবল দলের স্থান দশম। এই তালিকায় জাপানের থেকে এক ধাপ এগিয়ে রয়েছে ইরানিরা। এফআইভিবি বিশ্ব র‌্যাংঙ্কিংয়ে শীর্ষে রয়েছে ব্রাজিল। এরপর রয়েছে যথাক্রমে পোল্যান্ড, রাশিয়া, ফ্রান্স ও ইতালি।

‘গ্রেটেস্ট শো অন দি আর্থ’ খ্যাত অলিম্পিকের সর্বশেষ আসরেও ইরানের সাফল্য চোখে পড়ার মতো। জাপানের টোকিওতে অনুষ্ঠিত হয় অলিম্পিকের ৩২তম আসর। এতে তিনটি স্বর্ণ, দুটি রৌপ্য ও দুটি ব্রোঞ্জসহ মোট সাতটি পদক জয় করেন ইরানের অ্যাথলেটরা। এর আগে অলিম্পিকের রিও আসরে ইরানি প্রতিনিধি দল তিনটি স্বর্ণ, একটি রৌপ্য ও চারটি ব্রোঞ্জপদক জিতেছিল।

এবারের অলিম্পিকে ইরানের হয়ে প্রথম স্বর্ণপদক জয় করেন শুটার জাভাদ ফোরুকি। তিনি পুরুষদের ১০ মিটার এয়ার পিস্তলে শীর্ষ স্থান লাভ করেন। ইরানি এই অ্যাথলেট ২৪৪ দশমিক ৮ পয়েন্টে সংগ্রহ করে অলিম্পিকে রেকর্ড করেন। রৌপ্যপদক জয়ী সারবিয়ার দামির মিকেককে ৬ দশমিক ৯ পয়েন্ট ব্যবধানে পেছনে ফেলেন। অলিম্পিক শুটিংয়ের ইতিহাসে এটি ইরানের প্রথম স্বর্ণপদক।
ইরানের গ্রেকো-রোমান কুস্তিগির মোহাম্মাদ রেজা গেরায়েই ইরানের জন্য দ্বিতীয় স্বর্ণপদক জয় করেন। তিনি ইউক্রেনের পারভিজ নাসিবভকে পুরুষদের গ্রেকো-রোমান ৬৭ কেজির ফাইনাল বাউটে ৯-১ পয়েন্টে হারিয়ে শীর্ষ স্থান লাভ করেন।
ইরানের জন্য তৃতীয় স্বর্ণপদক লাভ করেন সাজাদ গানজাদেহ। তিনি পুরুষদের কারাতে কুমিতে ৭৫ কেজি ওজন শ্রেণিতে স্বর্ণপদক জয় করেন। ফাইনাল ম্যাচে তিনি সৌদি আরবের তারেহ হামেদিকে পরাজিত করেন। এবারের টোকিও অলিম্পিকের ১৭টি স্পোর্টসে ৬৬জন অ্যাথলেটকে পাঠায় ইরান।

প্যারালিম্পিকে ইরানের ২৪টি মেডেল

টোকিও প্যারালিম্পিক গেমসে মোট ২৪টি মেডেল জেতেন ইরানি অ্যাথলেটরা। পদক তালিকায় ইরানের স্থান ১২তম । গত ৪ সেপ্টেম্বর প্রতিযোগিতার ১১তম দিনে ২০২০ প্যারালিম্পিকের ফাইনালে রুশ দলকে পরাজিত করে ইরানের জাতীয় সিটিং ভলিবল দল। এদিন স্বর্ণপদক জয় করেন প্যারাতাইকোয়ান্দো আসগার আজিজি আকদাম। অন্যদিকে শট পুট প্রতিযোগিতায় রৌপ্যপদক জেতেন সাজ্জাদ মোহাম্মাদিয়ান। এছাড়াও ইরানের সাদেক বেইত চাকতি নিক্ষেপে রুপার মেডেল লাভ করেন।


এবারের প্যারালিম্পিক গেমসে বিস্ময়কর সাফল্য দেখিয়েছেন ইরানের নারী অ্যাথলেটরা। বিশ্বের মর্যাদাপূর্ণ এই ক্রীড়া ইভেন্টের এবারের আসরে দেশটির নারীরা তিনটি ডিসিপ্লিনে অংশ নিয়ে তিনটি সোনার মেডেল ঘরে তোলেন। এর মধ্য দিয়ে প্যারালিম্পিকের ইতিহাস বইয়ে নাম তোলেন নিজেদের।
৪ সেপ্টেম্বরে প্রতিযোগিতা শেষে টোকিও প্যারালিম্পিকে ইরান ১২টি স্বর্ণ, ১১টি রৌপ্য ও ১টি ব্রোঞ্জ মেডেলসহ মোট ২৪টি মেডেল জিতে ১২তম স্থান লাভ করে। মেডেল জয়ের জন্য প্যারা অ্যাথলেটদের অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানান দেশটির ক্রীড়া ও যুব মন্ত্রণালয়।

জুনিয়র কুস্তি বিশ্বকাপে ইরানের শিরোপা জয়


জুনিয়র বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জিতেছে ইরানের ফ্রিস্টাইল কুস্তি দল। ১৮ আগস্ট আন্তর্জাতিক ইভেন্টটির ফাইনাল অনুষ্ঠিত হয়। রাশিয়ার উফায় অনুষ্ঠিত এই প্রতিযোগিতায় ইরানি কুস্তিগিররা ৫টি স্বর্ণ, একটি রৌপ্য ও একটি ব্রোঞ্জপদকসহ মোট সাতটি পদক জয় করে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে।

ইরানি যুব অ্যাথলেটরা এই জয়ের জন্য ছয় বছর ধরে অপেক্ষা করছিল। অবশেষে সেই অপেক্ষার অবসান ঘটে শিরোপা ঘরে তোলার মধ্য দিয়ে। ২০১৫ সালের পর এই প্রথম ইরান জুনিয়র বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জিতল।
ফ্রিস্টাইল কুস্তির শীর্ষ অবস্থান দখল করতে ইরান মোট ১৭৮ পয়েন্ট সংগ্রহ করে। ইরানের পাঁচ স্বর্ণজয়ী কুস্তিগির হল রহমান আমুজাদ খলিলি (৬১ কেজি), ইরফান এলাহি (৭০ কেজি), মোহাম্মাদ নোখোদি (৭৯ কেজি), আমির হোসেইন ফিরুজপুর (৮৬ কেজি) ও আলি আকবারপুর (১২৫ কেজি)।
অন্যদিকে, মাহদি হাজিলুইয়েন ৯২ কেজিতে রৌপ্য ও আলিরেজা আবদুল্লাহি ৯৭ কেজিতে ব্রোঞ্জ পদক জেতে।

এশিয়ান কুস্তি চ্যাম্পিয়নশিপে ইরানের শিরোপা জয়

২০২১ এশিয়ান কুস্তি চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জিতেছে ইরান গ্রেকো-রোমান কুস্তি দল। গত ১৪ এপ্রিল কাজাখস্তানের আলমাতিতে দলটি শিরোপা নিশ্চিত করে। গত বছর ৭৭ কেজি ওজন-শ্রেণিতে রৌপ্যজয়ী পেজমান পোশতাম কোনো লড়াই ছাড়াই এবার স্বর্ণপদক লাভ করেছেন। তাজিকিস্তানের প্রতিপক্ষ দলের রিজা জাদে ইঞ্জুরির কারণে প্রতিযোগিতায় অংশ না নেওয়ায় তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সোনা ঘরে তোলেন।
আন্তর্জাতিক কুস্তি অঙ্গনে ইরানের নতুন মুখ নাসের আলিজাদেহ জয় দিয়ে পরিচিত হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেছেন। তিনি ৮৭ কেজিতে কাজাখস্তানের আতাবেক আজিসবেকোভকে ৩-১ পয়েন্টে হারিয়ে স্বর্ণপদক জয় করেন। ৯৭ কেজিতে মাহদি বালি দক্ষিণ কোরিয়ার সিউংজিউন কিমকে হারিয়ে সোনা জয় করেন।


জুনিয়র ওয়ার্ল্ডে রানার-আপ ইরানের জিআর টিম

ইরানের গ্রেকো-রোমান টিম রাশিয়ার উফায় জুনিয়র ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপে রানার-আপ হয়েছে। ১৩০ পয়েন্ট পেয়ে ইরানের এ দলটি একটি স্বর্ণপদক, একটি রৌপ্য ও পাঁচটি ব্রোঞ্জপদক পায়। স্বাগতিক দেশ রাশিয়া ১৮৩ পয়েন্ট পেয়ে চ্যাম্পিয়ন ও ১০১ পয়েন্ট পেয়ে আজারবাইজান তৃতীয় স্থান অধিকার করে। ৫৫ কেজি ফাইনাল বাউটে উজবেকিস্তানের আলিমার্দন আবদুলায়েফকে হারিয়ে ৩-১ সেটে আমিররেজা দেহবোজর্গি স্বর্ণপদক জেতে। রাশিয়ার দিনিসলাম বামাতোফের কাছে ৬০ কেজি ফাইনাল বাউটে ৭-৩ সেটে হেরে যায় সাইদ এসমায়েলি। রোমানিয়ার মানুয়েল স্টোইকাকে ৬৩ কেজিতে ৯-০ সেটে পরাস্ত করে ইমান মোহাম্মাদি। মিসরের এমাদ আবোলাট্টাকে পরাস্ত করে মোহাম্মাদহোসেইন আজারমদখত।
তুর্কি টুর্নামেন্টে ইরানের ফ্রিস্টাইল কুস্তিগিরদের ৯টি মেডেল জয়
তুরস্কের ইয়াসার দোগু কাপে ৫টি স্বর্ণ, ১টি রৌপ্য ও ৩টি ব্রোঞ্জ পদক জিতেছে ইরানের পুরুষ ফ্রিস্টাইল কুস্তি দল। গত ২৭ জুন তুরস্কের ইস্তাম্বুলে ইয়াসার দোগু কাপ রেসলিং টুর্নামেন্টের পর্দা নামে। প্রতিযোগিতা শেষে ইরানি ফ্রিস্টাইল কুস্তি দল মোট ৯টি মেডেল ঘরে তুলতে সক্ষম হয়।
মর্যাদাপূর্ণ এই তুর্কি টুর্নামেন্টে ইরানের ১৩জন খেলোয়াড় দেশের প্রতিনিধি হিসেবে অংশ নেন।
আলি গোলিজাদেগান ৫৭ কেজি ওজন-শ্রেণিতে, রহমান আমুজাদ ৬১ কেজি, মোহাম্মাদ নোখোদি ৭৯ কেজি, আমির হোসেইন ফিরুজপুর ৮৬ কেজি, আব্বাস ফোরুতান ১২৫ কেজিতে স্বর্ণপদক জয় করেন। অন্যদিকে হামিদরেজা জাররিন পেইকার ৭৯ কেজিতে রুপার মেডেল জিতেন, হাসান ইবাদি ও কিয়ান মাহমুদজানলু ৬৫ কেজিতে ব্রোঞ্জপদক ও ইরফান ইলাহি ৭০ কেজিতে ব্রোঞ্জ মেডেল জিতেন।

এশিয়ান অনূর্ধ্ব-১৯ বিচ ভলিবল চ্যাম্পিয়ন ইরান

এশিয়ান অনূর্ধ্ব-১৯ বিচ ভলিবল চ্যাম্পিয়নশিপের মুকুট জয় করেছে ইরান। চ্যাম্পিয়নশিপের এবারের তৃতীয় পর্বে থাইল্যান্ডকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে ইরানি অ্যাথলেটরা। ইরানের আবুলহাসান খাকিজাদে ও আলি গোরবানপাসান্দি থাইল্যান্ডের নেতিতোর্ন মুনিকুল ও ওয়াচিরাবিত মুয়াদফাকে ২-০ (২১-১৮, ২১-১৫) সেটে পরাজিত করে।
অন্যদিকে থাইল্যান্ড বি দলকে ২-০ সেটে হারিয়ে ব্রোঞ্জপদক লাভ করে কাজাখস্তান। ইরান কাজাখস্তান বি দলের বিরুদ্ধ ২-০ সেটে জয় দিয়ে এশিয়ান অনূর্ধ্ব-১৯ বিচ ভলিবল চ্যাম্পিয়নশিপ শুরু করে এবং দ্বিতীয় দিনে বাহরাইনকেও ২-০ সেটে পরাজিত করে।
ইরানি দল কোয়ার্টারে থাইল্যান্ড সি দলকে ২-০ সেটে হারায় এবং সেমিতে থাইল্যান্ড বি দলের বিরুদ্ধে ২-০ সেটে জয় পায়। থাইল্যান্ডের নাখোন পাথোমে ৩ থেকে ৭ জুলাই এই প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়।
এশিয়ান প্যারা তাইকোয়ান্দো চ্যাম্পিয়নশিপে ইরানের শিরোপা জয়
এশিয়ান প্যারা তাইকোয়ান্দো চ্যাম্পিয়নশিপের নারী-পুরুষ উভয় বিভাগে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে ইরানের জাতীয় প্যারা তাইকোয়ান্দো দল। গত ১৫ জুন লেবাননের বৈরুতে প্রতিযোগিতা শেষে ইরানি দল মোট ৪টি স্বর্ণ, ১টি রৌপ্য ও ২টি ব্রোঞ্জ মেডেল জয় করে। এবার নিয়ে ষষ্ঠ বছরের মতো এশিয়ান প্যারা তাইকোয়ান্দো চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জয় করল ইরান।
ইরানের মাহদী পৌরহেনামা, আসগর আজিজি, সাইদ সাদেঘিয়ানপুর এবং মাহতাব নববী স্বর্ণপদক লাভ করেন, হামেদ হাঘশেনাস রৌপ্য এবং মাহদি বাহরামি আজার ও রায়েহে শাহাব ব্রোঞ্জপদক জিতেন।
এশিয়ান ভারোত্তোলনে ইরানের মোতামেদির সোনা জয়
উজবেকিস্তানের তাশখন্দে ২০২১ এশিয়ান ভারোত্তোলন চ্যাম্পিয়নশিপে স্বর্ণপদক জিতেছেন ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের রাসুল মোতামেদি। ২৪ এপ্রিল ১০২ কেজি ওজন-শ্রেণিতে এশিয়ান ভারোত্তোলন চ্যাম্পিয়নশিপ ও অলিম্পিক বাছাই পর্বের এই প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়।
ইভেন্টে ইরানের রাসুল মোতামেদি ও রেজা দেহদার তাঁদের প্রতিদ্বন্দ্বীদের পরাজিত করে প্রথম স্থান অধিকার করেন। স্ন্যাচে রেজা প্রথম প্রচেষ্টায় ১৬৬ কেজি ওজন তোলেন এবং দ্বিতীয় প্রচেষ্টায় তোলেন ১৭২ কেজি। তৃতীয়বার ১৭৫ কেজি ওজন তুলে স্বর্ণপদক জয় করেন। মোতামেদি স্ন্যাচে একটি ব্রোঞ্জপদক ও ক্লিন অ্যান্ড জার্কে দুটি স্বর্ণপদক জিতেন।
ইন্টারন্যাশনাল শুটিং স্পোর্টস ফেডারেশন (আইএসএসএফ) বিশ্বকাপে চতুর্থ ইরান
আইএসএসএফ বিশ্বকাপে চতুর্থতম স্থান লাভ করেছে ইরান। ২১ মার্চ প্রতিযোগিতার তৃতীয় দিনে পুরুষ দলের এয়ার রাইফেল ইভেন্টে ইরানি টিম এই সাফল্য অর্জন করে।
ব্রোঞ্জ মেডেল ম্যাচে অংশ নেন দক্ষিণ কোরিয়ার (৬২১.২) তাইয়েউন নাম, বাইউংগিল চু ও জা সেং চুং এবং ইরানের পুরিয়া নরোজিয়ান, হোসেইন বাঘেরি ও আমির মোহাম্মদ নেকৌনাম।
কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইরান, ইউক্রেন, ফ্রান্স, হাঙ্গেরি, ইতালি, থাইল্যান্ড এবং তুরস্কসহ ৫৩টি দেশের মোট ২৯৪ জন শুটার টুর্নামেন্টে অংশ নেন।
রুশ লিগে বর্ষসেরা খেলোয়াড় ইরানের আজমুন
ইরানি স্ট্রাইকার সরদার আজমুন রুশ প্রিমিয়ার লিগে (আরপিএল) ২০২০-২০২১ সেশনের জন্য বর্ষসেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়েছেন। এফসি জেনিতের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদন মতে, আরপিএল এর বর্ষসেরা খেলোয়াড় নির্বাচনে ভোট দেন আরপিএল ব্যবস্থাপকরা, রুশ দলের প্রধান কোচ স্টেনিসলাভ চেরচেসোভ এবং আরপিএল টিম ক্যাপ্টেনরা।
ইরানি স্ট্রাইকার আজমুন ভোটে ৭৬ পয়েন্ট পেয়ে বছরের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হন। দ্বিতীয় সর্বাধিক ৬১ পয়েন্ট পান আরতেম দিজিউবা এবং তৃতীয় সর্বাধিক ৫১ পয়েন্ট পান সাবেক জেনিত খেলোয়াড় নোবোয়া। ২০২০-২১ সেশনে আজমুন মোট ১৯টি গোল করেন।
খেলাধুলার আরও অনেক ক্ষেত্রেই ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান সাফল্যের স্বাক্ষর রেখে চলেছে যা এই সীমিত পরিসরে তুলে ধরা সম্ভব নয়। তবে একথা বলা যায়, খেলাধুলায় ইরানের সফলতার এই ধারা অব্যাহত থাকলে দেশটি একদিন ক্রীড়াক্ষেত্রে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় দেশগুলোর মধ্যে নিজের অবস্থান করে নিতে সক্ষম হবে তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

প্রেসিডেন্ট ড. রাঈসীর কর্মবহুল বর্ণাঢ্য জীবন

 

হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমীন সাইয়্যেদ ইবরাহীম রাঈসী গত ১৮ই জুন (২০২১) অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে সর্বোচ্চ ভোট লাভ করে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের তেরোতম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন এবং সংবিধান অনুযায়ী রাহ্বার হযরত আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী কর্তৃক তাঁকে মনোনয়নপত্র প্রদানের পর তিনি মজলিসে শূরায়ে ইসলামি (পার্লামেন্ট)-এর অধিবেশনে শপথ গ্রহণের পর পূর্ববর্তী প্রেসিডেন্ট হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমীন হাসান রুহানির স্থলাভিষিক্ত হিসেবে স্বীয় দায়িত্ব পালন শুরু করেছেন।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সংবিধান অনুযায়ী দেশের প্রেসিডেন্ট জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে চার বছর মেয়াদের জন্য নির্বাচিত হন এবং এক ব্যক্তি পর পর দুই বার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে পারেন, অবশ্য এরপর অন্তত এক মেয়াদের বিরতির পর তিনি পুনরায় প্রার্থী হতে পারেন। হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমীন ইবরাহীম রাঈসী প্রেসিডেন্ট পদের মেয়াদের হিসেবে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের তেরোতম প্রেসিডেন্ট এবং এ পদে নির্বাচিত অষ্টম ব্যক্তি।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ছিলেন আবুল হাসান বানী সাদ্্র; তিনি সংবিধান লঙ্ঘন করায় মজলিসে শূরায়ে ইসলামি তাঁকে অনাস্থা প্রদান করলে সংবিধান প্রদত্ত এখতিয়ার বলে ইসলামি বিপ্লবের নেতা ও ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রথম রাহ্বার হযরত ইমাম খোমেইনী (রা.) তাঁকে অপসারণ করেন। এরপর দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন মোহাম্মাদ আলী রাজাই; তিনি ইসলামি বিপ্লবের দুশমনদের দ্বারা সংঘটিত বোমা বিস্ফোরণে শহীদ হন। এরপর তৃতীয় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন বর্তমান রাহ্বার হযরত আয়াতুল্লাহ্ সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী; তিনি পর পর দুই মেয়াদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ইমাম খোমেইনী (র.)-এর ইন্তেকালের পর তিনি নেতা নির্বাচনী বিশেষজ্ঞ পরিষদ কর্তৃক প্রার্থিতাবিহীন পদ্ধতিতে রাহ্বার হিসেবে নির্বাচিত হন। এরপর আয়াতুল্লাহ আলী আকবার হাশেমী রাফসানজানী, হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমীন সাইয়্যেদ মোহাম্মাদ খাতামী, ড. মাহমুদ আহমাদিনেজাদ ও হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমীন হাসান রুহানি প্রত্যেকে পর পর দুই মেয়াদের জন্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। অতঃপর হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমীন রাঈসী এ পদে নির্বাচিত হলেন।
হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমীন রাঈসী নির্বাচনের প্রথম দফায়ই সর্বোচ্চ ভোট লাভ করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন; তিনি মোট এক কোটি আশি লাখ ভোট লাভ করেন। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বিগণ ছিলেন মোহসেন রেযায়ী, আবদুন নাসের হিম্মাতী ও আমীর হোসেন ক্বাযীযাদেহ। ড. রাঈসী পূর্ববর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন এবং এক কোটি ষাট লাখ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছিলেন। ড. রাঈসী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে বিজয়ী হবার পর পরই তাঁর তিন প্রতিদ্বন্দ্বী তাঁকে অভিনন্দন জানান।
হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমীন রাঈসী অত্যন্ত কর্মবহুল ও বর্ণাঢ্য অতীতের অধিকারী। তিনি ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের তেরোতম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পূর্ব পর্যন্ত দেশের বিচার বিভাগের প্রধান ছিলেন।
জন্ম ও শিক্ষা জীবন
সাইয়্যেদ ইবরাহীম রাঈসী ১৯৬০ সালের ১৪ই ডিসেম্বর ইরানের অন্যতম ধর্মীয় নগরী মাশহাদ শহরের নোওগ¦ন মহল্লায় এক দ্বীনদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ও মাতা উভয়ই ছিলেন হোসেইনী সাইয়্যেদ এবং উভয়ই হযরত ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.)-এর পুত্র শহীদ হযরত যায়েদ (র.)-এর বংশধর। তাঁর পিতা ছিলেন মাশহাদের সুপরিচিত আলেমগণের অন্যতম। জনাব রাঈসীর পাঁচ বছর বয়সে তাঁর পিতা ইন্তেকাল করেন।
সাইয়্যেদ ইবরাহীম রাঈসী মাশহাদে প্রাথমিক পর্যায়ের পড়াশুনা শেষ করার পর দ্বীনী শিক্ষা গ্রহণের জন্য পর পর এ শহরেরই দু’টি দ্বীনী মাদ্রাসায় পড়াশুনা করেন। এরপর তিনি তাঁর দ্বীনী শিক্ষা অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে ১৯৭৫ সালে দ্বীনী শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে সুপরিচিত ইরানের অন্যতম ধর্মীয় নগরী কোমে চলে যান এবং সেখানকার মাদ্রাসায়ে আয়াতুল্লাহ্ বোরুজারদী-তে ভর্তি হন। এ সময় তিনি হযরত ইমাম খোমেইনী (র.)-এর ভাই হযরত আয়াতুল্লাহ্ পাসান্দিদে-র মাদ্রাসায়ও পড়াশুনা করেন।
সাইয়্যেদ ইবরাহীম রাঈসী কোমে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত দ্বীনী শিক্ষা গ্রহণ করেন। এ সময় তিনি সেখানকার বিভিন্ন সুপরিচিত মুজতাহিদ আলেমের কাছ থেকে শিক্ষালাভের সৌভাগ্য অর্জন করেন। এদের মধ্যে রয়েছেন আয়াতুল্লাহ মিশকীনী, আয়াতুল্লাহ খায আলী, শহীদ আয়াতুল্লাহ মোরতাযা মোতাহহারী, আয়াতুল্লাহ র্মা‘আশী শূশ্তারী, আয়াতুল্লাহ হাশেমী শাহ্রূদী, আয়াতুল্লাহ্ মুজতাবা তেহরানী ও বর্তমান রাহবার হযরত আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ীর ন্যায় মশহুর মুজতাহিদ ব্যক্তিত্বগণ।
ড. রাঈসী ইজতিহাদী ধারার দ্বীনী শিক্ষা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি বিশ^বিদ্যালয় শিক্ষাও অব্যাহত রাখেন এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন; এ সময় তিনি ارث بلا وارث (ওয়ারিসবিহীন মীরাছ) শীর্ষক একটি থিসিস রচনা করেন। এরপর তিনি ২০০১ সালে তেহরানের মাদ্রাসায়ে ‘আলীয়ে শাহীদ মোতাহহারীতে ডক্টরেট করার জন্য অনুমতি লাভ করেন এবং تعارض اصل و ظاهر در فقه و حقوق (ফিকাহ্ ও আইনে মূলনীতি ও বাহ্যিক তাৎপর্যের সাংঘর্ষিকতা) শিরোনামে থিসিস-এর জন্য ডক্টরেট লাভ করেন।
সংগ্রামী জীবন
সাইয়্যেদ ইবরাহীম রাঈসী কোমের মাদ্রাসায়ে আয়াতুল্লাহ্ বোরুজারদী-তে অধ্যয়নকালে তখনকার শাহ্পন্থী পত্রিকা ‘দৈনিক এত্তেলাআত’-এ হযরত ইমাম খোমেইনীর প্রতি অবমাননাকর একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হলে সারা ইরানে গণবিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। এ গণবিক্ষোভের শুরুর দিকেই মাদ্রাসায়ে আয়াতুল্লাহ্ বোরুজারদী-তে একের পর এক প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হতে থাকে এবং ড. রাঈসী এসব সভায় ও গণবিক্ষোভে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। এ সময় দ্বীনী শিক্ষাকেন্দ্রের শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেক ছোট ছোট বিপ্লবী গ্রুপ গঠিত হয় এবং রাঈসীও এ ধরনের একটি গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত হন; তিনি এ সময় প্রধানত কারাগার থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত বা নির্বাসিত আলেমগণের সাথে যোগাযোগ রক্ষার দায়িত্ব পালন করতেন।
ইসলামি বিপ্লবের বিজয়ের পর নবগঠিত ইসলামি রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কাঠামো সংক্রান্ত প্রয়োজন পূরণের লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় দায়িত্ব পালনের উপযোগী প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লোকের প্রকট অভাব লক্ষ্য করে শহীদ ড. আয়াতুল্লাহ বেহেশতী এ অভাব পূরণের উদ্দেশ্যে জনশক্তি গড়ে তোলার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। এ পরিকল্পনা অনুযায়ী তিনি কোমের দ্বীনী জ্ঞানকেন্দ্র থেকে সত্তর জন বিশেষ মেধাবী শিক্ষার্থীকে বাছাই করে প্রশিক্ষণ প্রদানের পদক্ষেপ গ্রহণ করেন; রাঈসী এই সত্তর জন ছাত্রের একজন ছিলেন। এ সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ কোর্সের বেশির ভাগ ক্লাসই তেহরানের মাদ্রাসায়ে ‘আালীয়ে মোতাহহারী-তে অনুষ্ঠিত হতো। এ প্রশিক্ষণ কোর্সে শহীদ আয়াতুল্লাহ বেহেশতী, বর্তমান রাহবার হযরত আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী, আয়াতুল্লাহ মুসাভী আরদেবিলী (যিনি পরে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের বিচার বিভাগের প্রধান মনোনীত হন) প্রমুখ শিক্ষাদান করেন।
এরপর ‘মসজিদে সোলায়মান’ শহরে মার্ক্সবাদী বিদ্রোহ সংঘটিত হলে ও এর ফলে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখা দিলে সেখানে দ্বীনী সাংস্কৃতিক তৎপরতা চালানোর লক্ষ্যে ড. রাঈসী একদল দ্বীনী শিক্ষার্থীর সাথে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অত্যন্ত সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে সেখানে গমন করেন। মসজিদে সোলায়মান শহর থেকে কোমে ফিরে আসার পর তিনি শাহ্রূদ শহরে গমন করেন এবং সেখানে একটি রাজনৈতিক ও চৈন্তিক শিক্ষামূলক ফোরাম গঠন করেন। তিনি স্বয়ং কিছুদিন সেটি পরিচালনা করেন।
বিচার বিভাগীয় কর্মজীবন
হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমীন সাইয়্যেদ ইবরাহীম রাঈসী শিক্ষাজীবন অব্যাহত থাকা অবস্থায়ই এর পাশাপাশি কর্মজীবনে প্রবেশ করেন এবং এ জন্য বিচার বিভাগীয় দায়িত্ব পালনকে বেছে নেন। তিনি ১৯৮০ সালে ২০ বছর বয়সে কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। এ সময় তিনি তেহরানের পাশর্^বর্তী জিলা শহর কারাজ-এ সহকারি প্রসিকিউটর পদে নিয়োজিত হন। কিন্তু তাঁর এ দায়িত্ব লাভের পর কয়েক মাসের মধ্যেই তাঁর বিশেষ যোগ্যতার পরিচয় লাভ করে ইসলামি বিপ্লবের প্রসিকিউটর জেনারেল শহীদ আয়াতুল্লাহ্ কুদ্দুসী তাঁকে কারাজের প্রসিকিউটর নিয়োগ করেন। অতঃপর ১৯৮২ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত তিনি হামেদান প্রদেশের প্রসিকিউটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ১৯৮৫ সালে তিনি তেহরানে ইসলামি বিপ্লবের প্রসিকিউটরের ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব লাভ করেন।
ড. রাঈসী তেহরানে দায়িত্ব পালনকালে তাঁর বিশেষ যোগ্যতা ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা হযরত ইমাম খোমেইনী (র.)-এর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তাই হযরত ইমাম (র.) রাহ্বার হিসেবে সাংবিধানিক এখতিয়ার বলে ১৯৮৮ সালে ড. রাঈসীকে বিচার বিভাগের কাঠামোর বাইরে থেকে স্বাধীনভাবে লোরেস্তান, কেরমানশাহ্ ও সেমনানসহ দেশের কয়েকটি প্রদেশের বিচার বিষয়ক সমস্যাবলি তদন্তের দায়িত্ব প্রদান করেন। এরপর হযরত ইমাম (র.) কয়েকটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ নথির বিচারিক ফয়সালার দায়িত্বও তাঁর ওপর অর্পণ করেন।
১৯৮৯ সালে ইমাম খোমেইনীর ইন্তেকালের পর হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী রাহ্বার নির্বাচিত হন। এ সময় বিচার বিভাগের প্রধান ছিলেন আয়াতুল্লাহ্ মোহাম্মাদ ইয়াযদী; তিনি হুজ্জাতুল ইসলাম রাঈসীকে তেহরানের প্রসিকিউটর হিসেবে নিয়োগ প্রদান করেন। ড. রাঈসী ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছর এ দায়িত্ব পালন করেন। এরপর তিনি জাতীয় তদন্ত সংস্থার প্রধান পদে নিয়োজিত হন এবং ২০০৪ সাল পর্যন্ত দশ বছর এ দায়িত্ব পালন করেন। অতঃপর ২০০৪ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত দশ বছর তিনি বিচার বিভাগের উপপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। অতঃপর তিনি ২০১৪ সালে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রসিকিউটর জেনারেল পদে দায়িত্ব লাভ করেন এবং ২০১৬ সাল পর্যন্ত দুই বছর এ দায়িত্ব পালন করেন।
তাঁর উপরিউক্ত দায়িত্বসমূহের পাশাপাশি অতিরিক্ত বিশেষ দায়িত্ব হিসেবে রাহ্বার হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ীর নির্দেশে তিনি ২০১২ সাল থেকে ওলামা সংক্রান্ত বিশেষ প্রসিকিউটর জেনারেল-এর দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। এছাড়া ধর্মীয় শহর মাশ্হাদের ওয়াকফ্ সংস্থা ‘অস্তানে কুদসে রাযাভী’র মুতাওয়াল্লী আয়াতুল্লাহ্ ওয়া‘এযীর ইন্তেকালের পর ২০১৪ সালের ৮ই মার্চ রাহ্বারের নির্দেশে ড. রাঈসী তাঁর স্থলাভিষিক্ত হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং ২০১৭ সালের ৭ই মার্চ পর্যন্ত তিন বছর এ দায়িত্ব পালন করেন।
রাহ্বার হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী ২০১৭ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারি হুজ্জাতুল ইসলাম সাইয়্যেদ ইবরাহীম রাঈসীকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের বিচার বিভাগের প্রধান নিয়োগ করেন এবং প্রেসিডেন্ট পদে শপথ গ্রহণের পূর্ব পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্ব পালন করেন।
দ্বীনী জ্ঞান বিস্তারে তৎপরতা
একজন মুজতাহিদ আলেম হিসেবে হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমীন সাইয়্যেদ ইবরাহীম রাঈসী বিচার বিভাগীয় ও অন্যান্য দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি দীর্ঘদিন দ্বীনী ‘ইল্মের বিভিন্ন শাখায় জ্ঞান বিস্তারের কাজ করেছেন। তিনি অস্তানে কুদসে রাযাভীর মোতাওয়াল্লী হিসেবে মাদ্রাসায়ে নাওয়াব্-এ ফিকাহ্শাস্ত্রের ওপর র্দাসে খারেজ প্রদান করতেন। এছাড়াও তিনি তেহরানের বিভিন্ন দ্বীনী মাদ্রাসায় ও বিশ^বিদ্যালয়ে বিভিন্ন বিষয়ে, বিশেষত বিচার বিষয়ক ফিকাহ্র কাওয়া‘এদ ও অর্থনৈতিক ফিকাহ্র কাওয়া‘এদ্ সম্পর্কে স্নাতকোত্তর ও ডক্টরেট পর্যায়ে শিক্ষা প্রদান করেন। তিনি একই সময় একাধিক বিশ^বিদ্যালয়ে ক্লাস নিতেন; তিনি যেসব বিশ^বিদ্যালয়ে ক্লাস নেন তার মধ্যে ইমাম সাদেক (আ.) বিশ^বিদ্যালয় ও শহীদ বেহেশতী বিশ^বিদ্যালয় অন্যতম।
এছাড়া ড. রাঈসী আইন, অর্থনীতি, ফিকাহ্, সামাজিক সুবিচার, জীবনধারা ও আরো বিভিন্ন বিষয়ে অনেকগুলো গ্রন্থ প্রণয়ন করেছেন।
পারিবারিক জীঁবন
হুজ্জাতুল ইসলাম ড. সাইয়্যেদ ইবরাহীম রাঈসীর সাথে ১৯৮৩ সালে-যখন তাঁর বয়স ২৩ বছর-স্বনামখ্যাত মুজ্তাহিদ হযরত আয়াতুল্লাহ্ সাইয়্যেদ আহ্মাদ্ ‘আলামুল্ হুদার জ্যেষ্ঠা কন্যা ড. জামিলাতুস সাদাত-এর বিবাহ হয়। ড. জামিলাতুস সাদাত তেহরানের শহীদ বেহেশতী বিশ^বিদ্যালয়ের ‘প্রশিক্ষণ দর্শন’ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। এর আগে তিনি সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সর্বোচ্চ পরিষদের মানবিক বিজ্ঞান বিষয়ক গবেষণা সংস্থার প্রধান ছিলেন।
ড. রাঈসী ও বেগম রাঈসী দু’জন কন্যাসন্তানের পিতা-মাতা। তাঁদের জ্যেষ্ঠা কন্যা বিবাহিতা; তিনি আয্-যাহ্রা (সালামুল্লাহি ‘আলাইহা) বিশ^বিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞান বিষয়ে এবং রেই শাহ্রের হাদিসবিজ্ঞান বিশ^বিদ্যালয় থেকে কোরআন ও হাদিস বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেছেন। রাঈসী দম্পতির কনিষ্ঠা কন্যাও বিবাহিতা; তিনি শারীফ বিশ^বিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক পর্যায়ে পড়াশুনা করছেন।

 

অশ্রুর অস্ত্র, শোকের শক্তি

মুহাম্মাদ আশিকুর রহমান

অশ্রু দিয়েই পেলেন ক্ষমা নবী আদম শেষে,
নূহের নামটি নূহ হয়েছে অশ্রুনদে ভেসে।

ইব্রাহীমের অশ্রুকণা নেভায় আগুন শোনো,
ইয়াকুব নবীর অশ্রু ঝরে বাঁধ মানে না কোনো।

ইউনুস নবীর মুক্তি মেলে- অশ্রু সাথে দোয়া,
ঈসা নবীর ঊর্ধ্বে গমন অশ্রু দিয়ে ছোঁয়া।

মূসার হাতে লাঠির চেয়েও অশ্রু বেশি বল,
সুলাইমানের আংটি বলে ঝরাও অশ্রুজল।

অশ্রু দিয়ে যুদ্ধ জেতেন দাউদ-তালুত সেনা,
অশ্রু দিয়ে খিজির বাঁচেন, আর তাঁকে যায় চেনা।

জরা কালে পুত্র পেলেন জাকারিয়া কেঁদে,
ইয়াহইয়া তাঁর শহীদ হলেন অশ্রুশোকের ভেদে।

ইদ্রিস নবী অশ্রু বলে মারুফ হলেন জ্ঞানে,
শীষ নবী তাঁর সহিফা পেলেন অশ্রুপ্রেমের ধ্যানে।

হূদের দোয়া, অশ্রু বলে মূর্তি ধসে পড়ে,
অশ্রু দাওয়ায় এত রাসূল ইসহাক নবীর ঘরে,

অশ্রু দিয়েই লড়েন হারুন তুর সিনিনের ধারে,
শুয়াইব নবীর কওম ধ্বংস তাঁরই অশ্রু ভারে।

অশ্রুস্রোতে ভেসে আসে ইসমাইলের নহর,
লূত নবীর অশ্রু গুণে দূর হয়ে যায় কহর।

সালেহ নবী অশ্রু দিয়ে সৃষ্টি করেন উট,
সারাহ বিবির মানকে অশ্রু দেয় নি হতে লুট।

ইলিয়াস নবী আজও বাঁচেন অশ্রু রিযিক দিয়ে,
উযাইরের রাজাত যেন অশ্রু তাঁরই পিয়ে।

শামায়ুনের অশ্রু জাহিল, বাতিল করে নাশ,
ইউশা ইবনে নুনের বিজয় অশ্রু জলোচ্ছ্বাস।

মাসীহর খবর ইমরান তাঁর অশ্রু চোখে দেন,
আইয়ুব নবী অশ্রুধারায় ধৈর্য শিক্ষা নেন।

ইউসুফের অশ্রু করে অন্ধ কুয়া জয়,
দানিয়ালের অশ্রু গুণে নাই দেহ তাঁর ক্ষয়।

আল ইয়াসা শ্রেষ্ঠ হলেন অশ্রু করে পাত,
যুলকিফলের সবর বাড়ায় অশ্রুমাখা হাত।

আসিয়ারই অশ্রু তাঁকে সাহস জোগায় চাপে,
হাজার বিবির অশ্রুনাদে পাহাড়, মরু কাঁপে।

মারইয়ামের অশ্রু জোরে শিশু কথা কহে,
আল-এ-নবীর অশ্রুপ্রেমে আজও ফোরাত বহে।

আসাদ সুতার অশ্রু ভাঙ্গে ক্বাবার দেয়াল ঘাতে,
আবুল ফজল অশ্রু ঝরান, বীর হয়েছেন তাতে।

আবদুল্লাহ আর আমিনারই অশ্রু আনে নবী,
আবু তালিবের অশ্রু যেন দ্বীন হাফেজের ছবি।

খাদিজারই আঁতুড়ঘরে অশ্রু কারামাত,
হামযা, জাফর হলেন শহীদ গেয়ে অশ্রু নাত।

সাজ্জাদেরই অশ্রু দেখে জাগে পাষাণ দিল,
নবীর দাদার অশ্রুবানে ধ্বংস হলো ফিল।

আলীর চোখের অশ্রুবানে যায় যে থেমে ঝড়।
হাসান, হুসাইন অশ্রু দিয়ে বাঁচান খোদার ঘর।

ফাতিমারই অশ্রু গড়ে কাউসারেরই ধারা,
যাইনাব তাঁর অশ্রুসহ রোপন করেন চারা।

রাসূল ঝরান অশ্রু তাঁরই হুসাইন শহীদ হবে,
অশ্রু ছাড়া দ্বীনের পথে কে জেগেছে কবে?

অশ্রু, প্রেমে হলেন সফল সকল ইমাম, নবী,
অশ্রু ছাড়া প্রেমের রাহে কেমনে সফল হবি!

অশ্রু দিয়েই তওবা কবুল, অশ্রু দিয়েই জয়,
অশ্রু ঝরান যাঁরা, তাঁদের নেই কখনও লয়।
অশ্রু দিয়েই পারে মানুষ খোদার দিকে যেতে,
অশ্রু, প্রেমে থাকেন সকল মহামানব মেতে।

অশ্রু দিয়ে হুসাইন তোমায় সালাম জানাই হে,
রক্তে ভেজা তোমায় দেখে হায় কাঁদে না কে?
নবীর আশেক অশ্রুজলে স্মরণ তোমায় করে,
তোমার বাণী পৌঁছে দিতে কাঁদেন সমস্বরে…।

 

ফারসি পাণ্ডুলিপি সংগ্রহের গুরুত্ব

ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী
হাল জামানায় দ্বিতীয় প্রজন্মের শিক্ষিত লোকেরা কাগজে লিখেন না। তাঁরা সরাসরি টাইপ করেন কম্পিউটারের স্ক্রীনে। আমরা যারা প্রথম প্রজন্মের লোক, আমাদের মধ্যে ভালো ভালো লেখকদেরও দেখা যায়, লিখতে গিয়ে তাঁদের বিড়ম্বনার শেষ নেই। কারণ হলো, দিনদিন কাগজ-কলমের চর্চা অচল হয়ে যাচ্ছে। তাঁরা আশংকায় থাকেন, কখন তাঁদের দিনকাল অচল হয়ে যায়।
প্রাইমারিতে পড়ার সময় দ্বিতীয় শ্রেণিতে ওঠার পর আমরা জামার পকেটে কালি লাগাতাম। উদ্দেশ্য বিদ্যার দৌড়ের কথা জানান দেওয়া। কারণ, এর আগে লিখতে হতো স্লেটে খড়িমাটি দিয়ে। তারও আগে দোয়াতের কালিতে বাঁশের কঞ্চি চুবিয়ে অ আ ক খ লিখতে হতো শিল্পীর দক্ষতায়। মোবাইলে কম্পিউটারে এখনকার শিশুদের নিপুণতা দেখলে অতীতকে স্মরণ করে লজ্জা হয়।
বই-পুস্তক প্রকাশনায় কম্পিউটারের চর্চা ব্যাপক হয়েছে বেশিদিন হয় নি। এর আগে কাগজের গায়ে হাতে লেখা হতো কলম কালির বিন্যাসে। সেই লেখা সীসা বা দস্তায় তৈরি অক্ষর খাঁজে বসিয়ে বসিয়ে বইয়ের পাতা আকারে সাজানো হতো। তারপর তা মেশিনে কালির ছাপ দিয়ে ছাপানো হতো। মুদ্রণ শিল্পের আগের ইতিহাস বিচিত্র হলেও মূল কথা হলো, বই-পুস্তক, দলিল-দস্তাবেজ টাইপ বা কম্পোজ করার পরিবর্তে কাগজ বা কাঠ, চামড়া কিংবা অন্য কোনো উপকরণের উপর লেখা হতো। সেই লেখা দেখে দেখে কপি বা অনুলিপি তৈরি করা হতো। এই যে প্রথম লেখা, সেটির নাম পা-ুলিপি। অর্থাৎ লেখকের হাতের মূল লেখা। অনেক সময় কপিকারের অনুলিপিও হাতের লেখা বিধায় পা-ুলিপি বলা হতো বা এখনো বলা হয়।
পঞ্চাশ বছর আগের লেখা বইয়ের কথা চিন্তা করলে ধরে নিতে হবে যে, সে বই কলম-কালি ব্যবহার করে কাগজের গায়ে লেখা হয়েছে। তারপর মুদ্রণ যন্ত্রের সাহায্যে শত শত বা ইচ্ছামত ছাপা আকারে বের করা হয়েছে। শুধু বই-পুস্তক কেন, জায়গা জমির দলিল, বিয়ের কাবিন, চুক্তিপত্র সবই এ পদ্ধতিতে লিখিত ও সংরক্ষিত হয়েছে।
এই যে বই-পুস্তক, দলিল-দস্তাবেজ, চুক্তিপত্রের কথা বললাম তার হাকিকত কী? হাকিকত হলো, আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্যের লিখিত সনদ এসব পা-ুলিপি। বর্তমানের বেলাভূমিতে দাঁড়িয়ে যদি অতীতের সাগরের রূপ দেখতে চাই তাহলে এসব পা-ুলিপির শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া উপায় নেই।
আমরা সাধারণত বাপ-দাদার ভিটেমাটিতে বসবাস করি। জমি-জিরাত অধিকাংশ পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া। এই ভিটেমাটি, জামি-জিরাত আমার, তাতে অন্যের মালিকানা নেই, এ কথার প্রমাণ কী? নিশ্চয়ই জমির দলিলপত্র। দলিলপত্র ঠিক না থাকলে জমির মালিকানা বেহাত হবে এ কথা যুক্তি প্রমাণ দিয়ে বুঝানোর প্রয়োজন হয় না। জমির মালিকানা সাব্যস্ত করতে দলিল-দস্তাবেজের যে গুরুত্ব, শিক্ষাগত যোগ্যতা প্রমাণে প্রাতিষ্ঠানিক সনদ বা সার্টিফিকেটের যে মূল্যমান, জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্যের স্মারক হিসেবে প্রাচীন পা-ুলিপির গুরুত্ব তার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।
একটি দালান টিকে থাকে তার ভিত্তিমূলের উপর। গাছ মাথা তুলে শাখা বিস্তার করে তার মূল বা শিকড়ের উপর ভর করে। একটি জাতিও বিশে^র দরবারে মাথা উঁঁচু করে দাঁড়াতে পারে তার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের দাবি নিয়ে। যে গাছের শিকড় শক্ত মাটির গভীরে প্রোথিত নয় সেটি সামান্য ঝড়ের ঝাপটায় কুপোকাত হয়ে পড়ে। যে জাতির পেছনের ইতিহাস জানা নেই, দুই একশ বছর বা পাঁচ সাতশ বছরের আগে কোথায় কী হয়েছিল জানা নেই, বিশ^সভায় মাথা উঁচু করে সভ্যতার বড়াই করার অধিকার সে জাতির নেই।
এ কারণেই বিশে^র উন্নত জাতিগুলো ইতিহাস-ঐতিহ্য সংরক্ষণের জন্য জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করে। প্রত্নতত্ত্ব গবেষণায় কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে। দেশে বিদেশে খনন কার্য চালায়। তার উপর ইতিহাসের পাঠ তৈরি করার জন্য গবেষকরা জীবন উৎসর্গ করেন। বিশ^বিদ্যালয়ে ইতিহাস বিষয়ে জ্ঞানচর্চা ও গবেষণা হয়। জাদুঘরের প্রত্নতত্ত্বের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো প্রাচীন পা-ুলিপি। এ জন্য পশ্চিমা উপনিবেশবাদীরা এর প্রতি এত লোভী।
আমেরিকার ইরাক আগ্রাসনে বাগদাদের পতন হলে জাতীয় বিশ^বিদ্যালয়ের ভিসি ইতিহাসবিদ প্রফেসর আব্দুল মুমিন এক টিভি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, বাগদাদের যে সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার লুণ্ঠিত হয়েছে, ইউরোপ আমেরিকার সংগ্রহশালায় সেগুলোর খোঁজ পাওয়া যাবে। তার মানে পা-ুলিপিগুলো চোরাই পথে ইউরোপ আমেরিকার সংগ্রহশালায় গিয়ে জমা হয়েছে। কারণ, তারা এর মাধ্যমে একটি জাতির অতীত ও ভবিষ্যতকে জিম্মি করে রাখতে পারে। ভারতবর্ষে ইংরেজদের ঔপনিবেশিক শাসনের অভিজ্ঞতাও তার চেয়ে ভিন্ন নয়। তাই বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে মৌলিক গবেষণা করতে হলে আমাদের গবেষকদের লন্ডন চলে যেতে হয়।
প্রশ্ন হলো, আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের শিকড় কোথায়? মুসলিমপ্রধান বাংলদেশ ভূখ-ে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১২০৪ সালে ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মাদ বখতিয়ার খিলজির বঙ্গবিজয়ের মধ্য দিয়ে। তবে বাংলায় ইসলাম ও মুসলমানদের আগমন তারও আগে। তখনকার দুনিয়ার সকল বাণিজ্য ছিল সাগর পথে। সমুদ্র বাণিজ্যে তখন একক রাজত্ব ছিল আরব বণিকদের। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাণিজ্য সফরে যাত্রাবিরতির ঐতিহাসিক স্থান ছিল চট্টগ্রাম বন্দর। সেখান থেকেই চট্টগ্রাম ও আরাকানে ইসলামের বিস্তার হয়। চট্টগ্রাম ‘ইসলামাবাদ’ নামে আখ্যায়িত হওয়ার প্রেক্ষাপটও তাই। আরব বণিকদের মতো বাংলাদেশে ফারসিভাষী সুফি-দরবেশদের আগমন হয়েছিল ব্যাপকভাবে। আর বখতিয়ার খলজির সামরিক বিজয়ের পর এই ভূখ- পুরোপুরি ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নেয়। বিশেষ করে হালাকু খাঁ (১২৫৬-১২৬৫ খ্রি.) বাগদাদে ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর ফলে দলে দলে আলেম, সুফি-দরবেশ ও শাসকশ্রেণির লোকজন বাংলায় আগমন করেন।
ইতিহাসের সাক্ষ্য হলো, ভারতবর্ষ ও বাংলাদেশে মুসলিম শাসনামলে অফিস-আদালত ও সাহিত্য-সংস্কৃতির ভাষা ছিল ফারসি। শাসকশ্রেণি আফগান বা তুর্কি বংশোদ্ভূত হলেও তাঁরা রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে বরাবর ফারসির পরিচর্যা করেন। এ করণে ১২০৪ খ্রিস্টাব্দ বা তারও আগে থেকে এই ভূখ-ে মুসলমানদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের সবকিছু লিপিবদ্ধ হয় ফারসি ভাষায়। এই অবস্থা অব্যাহত থাকে ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত।
১৭৫৭ সালে ইংরেজ বণিকরা নবাব সিরাজুদ্দৌলাকে পরাজিত করলে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়। কিন্তু দাফতরিক ভাষা হিসেবে ইংরেজি ভাষা চালু করতে ইংরেজদের অপেক্ষা করতে হয়েছিল প্রায় একশ বছর অর্থাৎ ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। তার মানে ছয়-সাতশ বছর পর্যন্ত এ দেশের সাহিত্য-সংস্কৃতির ভাষা ছিল ফারসি। বস্তুত ঐতিহাসিক সত্য হলো, বাঙালি বা বংলাদেশী বলতে যাদের বুঝায় এই ভূখ-ের সেই ভূমিপুত্র মুসলমানদের জাতীয় চেতনার শিকড় সন্ধান করতে হলে ফারসির মধ্যেই খুঁজতে হবে।
বিষয়টি নিয়ে যতই চিন্তা করা হবে ততই আমাদের জাতীয় জীবনে ফারসি চর্চার গুরুত্ব উজ্জ্বল হয়ে উঠবে। যদি বলেন, ফারসি চর্চা করে বৈষয়িক লাভ কী হবে, তাহলে বলব, বিশ^বিদ্যালয়ে যে ইতিহাস বিভাগ আছে, দর্শন চর্চা হয়, তার প্রয়োজন কেন? বিভিন্ন জাতির ভাষা ও সাহিত্য চর্চারও প্রয়োজন কেন হবে? আমরা জানি, মানুষ কোনো উৎপাদন যন্ত্র বা রোবট কিংবা অর্থ উপার্র্জনের হাতিয়ার নয়। তার মন আছে, মননশীলতা আছে। ঐতিহ্যবোধ আছে। নৈতিক চেতনা, যুক্তিবাদ ও ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতের সঠিক বেঠিক পথ নির্ণয়ের প্রয়োজন আছে। এই প্রয়োজনের দাবিতেই জাতীয় জীবনে ফারসির চর্চা অব্যাহত রাখতে হবে। আর এ ক্ষেত্রে ফারসি পা-ুলিপি সংগ্রহ ও সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।
পা-ুলিপি সংরক্ষণের কথা উঠলে জাতীয় জাদুঘর বা ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের পা-ুলিপি সংরক্ষণের বিষয়টি সামনে আসে। অথচ মাদ্রাসা-ই-আলিয়া ঢাকায় কতক অমূল্য পা-ুলিপি আছে। এগুলোর প্রতি অযত্ন অবহেলার শেষ নেই। মাদ্রাসা-ই-আলিয়ার মতো আরো অনেক প্রতিষ্ঠানে বিশেষ করে ঢাকার নজরুল কলেজ, চট্টগ্রামের মহসিন কলেজ যেগুলো অতীতে মাদ্রাসা ছিল, নিউস্কীমের খপ্পড়ে পড়ে কলেজে পরিণত হয়েছে, সেখানে পচনশীল প্রাচীন আরবি ফারসি কিতাবপত্র ও পা-ুলিপির খোঁজ খবর রাখার কেউ গরজ করে না। আমরা নিজেদের প্রতি এমনই উদাসীন।
এসব প্রতিষ্ঠানের বাইরে এখনো অনেক পরিবার আছে যারা পূর্বপুরুষের স্মৃতি হিসেবে বাড়িতে ফারসি-আরবি কিতাব বা পা-ুলিপি বুকে আগলে রেখেছেন। অথচ সেগুলো যথাযথ ব্যবহার করেন না, যত্ন নেন না। এই দিকটি চিন্তা করে আনজুমনে ফারসি বাংলাদেশ-এর পক্ষ হতে একটি আবেদন পেশ করা হয়েছে। এ আবেদনে সকলে ইতিবাচক সাড়া দেবেন বলে আশা করছি।

মহানবী (সা.)-এর বিদায় হজ এবং গাদীরে খুমের ঘটনা

সংকলন : মোহাম্মদ আশিফুর রহমান

ইসলামের সামষ্টিক ইবাদতসমূহের মধ্যে সবচেয়ে বড় ও আড়ম্বরপূর্ণ ইবাদত হলো হজ। প্রতি বছর সামর্থ্যবান মুসলমানরা যিলহজ মাসে তাঁদের এ ধর্মীয় দায়িত্ব পালনের জন্য পবিত্র মক্কা নগরীতে আগমন করেন। হজ এমন একটি সমাবেশ যেখানে মুসলিম উম্মাহ্র ঐক্য ও সাম্যের বাস্তব নমুনাই কেবল প্রকাশিত হয় তা নয়; বরং এর মাধ্যমে মুসলমানদের আন্তঃসম্পর্কও দৃঢ় হয়।
হযরত ইবরাহীম (আ.) পবিত্র কাবার ভিত্তি পুনঃনির্মাণ কাজ সম্পন্ন করে মহান আল্লাহ্র বান্দাদেরকে এ ঘর যিয়ারত করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। সেদিন থেকে এ অঞ্চল কাবা ও তাওয়াফের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। প্রতি বছর পৃথিবীর প্রত্যন্ত অঞ্চল এবং আরব উপদ্বীপের বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ এ ঘর যিয়ারত করার জন্য ছুটে আসে এবং যে আচার-অনুষ্ঠান হযরত ইবরাহীম (আ.) শিক্ষা দিয়েছিলেন, তা সম্পন্ন করে। কিন্তু কালক্রমে মহান নবিগণের নেতৃত্ব-ধারা থেকে হিজাযবাসী বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে কুরাইশদের স্বেচ্ছাচারিতা এবং সমগ্র আরব বিশ্বের চিন্তাজগতের ওপর প্রতিমাগুলোর আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হবার কারণে হজের আচার-অনুষ্ঠানও স্থান-কালের দৃষ্টিকোণ থেকে বিকৃত হয়ে যায় এবং সত্যিকার খোদায়ী রূপ হারিয়ে ফেলে।
এসব কারণেই মহানবী (সা.) হিজরতের দশম বর্ষে মহান আল্লাহ্র পক্ষ থেকে আদিষ্ট হন যে, তিনি নিজে ঐ বছর হজ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে মুসলিম উম্মাহ্কে ব্যবহারিকভাবে তাদের দায়িত্ব-কর্তব্যের সাথে পরিচিত করাবেন এবং উপরিউক্ত কারণসমূহের জন্য এ হজকে কেন্দ্র করে যেসব বিকৃতির উদ্ভব ঘটেছিল, সেগুলোর মূলোৎপাটন করবেন এবং জনগণকে আরাফাত ও মিনার সীমানা এবং ঐসব স্থান থেকে বের হবার সঠিক সময়ও শিখিয়ে দেবেন।
মহানবী (সা.) ইসলামি বর্ষপঞ্জির একাদশ মাস অর্থাৎ যিলকদ মাসে ঘোষণা করেন যে, তিনি ঐ বছর মহান আল্লাহ্র ঘর যিয়ারত করতে যাবেন। এ ঘোষণা মুসলমানদের এক বিরাট অংশের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার সৃষ্টি করে এবং এর ফলে হাজার হাজার মানুষ মদীনার চারপাশে তাঁবু স্থাপন করে মহানবীর হজযাত্রার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।
মহানবী (সা.) ২৬ যিলকদে আবু দুজানাকে মদীনায় নিজের স্থলবর্তী নিযুক্ত করে ৬০টি কুরবানির পশু সাথে নিয়ে পবিত্র মক্কার উদ্দেশে রওয়ানা হয়ে যান। তিনি যূল হুলাইফায় পৌঁছে দু’টি সেলাইবিহীন বস্ত্র পরে ‘মসজিদে শাজারাহ্’ থেকে ইহ্রাম করেন এবং ইহ্রাম করার সময় হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর আহ্বানে সাড়া দানস্বরূপ প্রসিদ্ধ দুআ- লাব্বাইক, আল্লাহুম্মা লাব্বাইক… পাঠ করেন। আর যখনই তিনি কোনো বহনকারী পশু (সওয়ারী) দেখতে পেয়েছেন বা উঁচু বা নিচু স্থানে উপনীত হয়েছেন, তখনই তিনি ‘লাব্বাইকা’ বলেছেন। যিলহজ মাসের ৪ তারিখে তিনি পবিত্র মক্কা নগরীতে প্রবেশ করেন এবং সরাসরি মসজিদুল হারামের পথ ধরে এগিয়ে যান। তিনি বনী শাইবার ফটক দিয়ে মসজিদুল হারামে প্রবেশ করেন। ঐ অবস্থায় তিনি মহান আল্লাহ্র প্রশংসা করছিলেন এবং হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর ওপর দরুদ পাঠ করছিলেন।
তাওয়াফের সময় তিনি হাজরে আসওয়াদের (কালো পাথর) নিকটে গিয়ে প্রথমে একে স্পর্শ করেন এবং এর উপর হাত বুলান এবং পবিত্র কাবা সাত বার তাওয়াফ করেন। এরপর তিনি মাকাম-ই ইবরাহীমের পশ্চাতে গিয়ে দু’ রাকাআত তাওয়াফের নামায আদায় করেন। তিনি নামায সমাপ্ত করে সাফা-মারওয়ার মাঝখানে সাঈ করেন। অতঃপর তিনি হাজীদের উদ্দেশে বলেন : ‘যারা নিজেদের সাথে কুরবানির পশু আনে নি, তারা ইহ্রাম ত্যাগ করবে এবং তাকসীর (অর্থাৎ চুল ছাটা বা নখ কাটা) করার মাধ্যমে তাদের জন্য ইহ্রামকালীন হারাম হয়ে যাওয়া বিষয়গুলো হালাল হয়ে যাবে। তবে আমি এবং যারা নিজেদের সাথে কুরবানির পশু এনেছে, তারা অবশ্যই ইহ্রামের অবস্থায় থাকবে ঐ সময় পর্যন্ত, যখন তাদের কুরবানির পশুগুলোকে তারা কুরবানি করবে।’
হজের আনুষ্ঠানিকতা শুরু
উমরার আমলসমূহ সমাপ্ত হয়। উমরা ও হজের আমলসমূহ শুরু হওয়ার অন্তর্বর্তীকালীন সময় কারো কাবায় (মসজিদুল হারাম ও মক্কা নগরীতে) অবস্থান করার ব্যাপারে মহানবী (সা.) সম্মত ছিলেন না। তাই তিনি মক্কার বাইরে তাঁর তাঁবু স্থাপন করার নির্দেশ দিলেন।
৮ যিলহজ বাইতুল্লাহ্ যিয়ারতকারিগণ পবিত্র মক্কা নগরী থেকে আরাফাতের ময়দানের দিকে যাত্রা শুরু করেন, যাতে তাঁরা ৯ যিলহজ দুপুর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করতে পারেন। মহানবী (সা.) ৮ যিলহজ মিনার পথে আরাফাতের ময়দানের দিকে যাত্রা করেন এবং ৯ যিলহজের সূর্যোদয় পর্যন্ত তিনি মিনায় অবস্থান করেন। এরপর তিনি নিজ উটের উপর সওয়ার হয়ে আরাফাতের পথে অগ্রসর হন এবং ‘নামিরাহ্’-এ অবতরণ করেন। উল্লেখ্য, এ স্থানেই মহানবী (সা.)-এর জন্য তাঁবু স্থাপন করা হয়েছিল। ঐ মহতী মহাসমাবেশে মহানবী (সা.) উটের পিঠে আসীন অবস্থায় তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ দান করেন। আর এ ঐতিহাসিক ভাষণই ‘বিদায় হজের ভাষণ’ নামে খ্যাতি লাভ করে।
বিদায় হজে মহানবী (সা.)-এর ঐতিহাসিক ভাষণ
মহানবী (সা.) আরাফাতের ময়দানে এক লক্ষ মানুষের সাথে যুহর ও আসরের নামায আদায় করেন। এরপর তিনি উটের পিঠে আরোহণ করে ঐ দিন তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন। অত্যন্ত বলিষ্ঠ ও উচ্চকণ্ঠের অধিকারী তাঁর সাহাবীরা তাঁর ভাষণ পুনরাবৃত্তি করে দূরবর্তী লোকদের কর্ণগোচর করেছিলেন।
মহানবী (সা.) তাঁর এ ভাষণে প্রথমেই নিজের পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়ার ইঙ্গিত দেন। এরপর তিনি মুসলমনাদেরকে বিভিন্ন বিষয়ে দিকনির্দেশনা দেন। প্রতিটি মুসলমানের ধন-সম্পদ ও জীবন সম্মানিত বলে ঘোষণা করেন। জাহেলিয়াতের যুগে যেসব রক্ত ঝরানো হয়েছে সেগুলোর প্রতিশোধ গ্রহণ থেকে বিরত থাকতে বলেন। আমানত তার প্রকৃত মালিকের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন। সুদকে হারাম করেন। অত্যাচার করা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেন। বারো মাসের মধ্যে যিলকদ, যিলহজ, মুহররম এবং রজব- এ চারটি মাসকে মহান আল্লাহ্ হারাম করেছেন বলে ঘোষণা করেন। স্ত্রীদের অধিকারের দিকে খেয়াল রাখতে বলেন। পথভ্রষ্টতা থেকে দূরে থাকার জন্য আল্লাহর কিতাব ও নিজ আহলে বাইতকে আঁকড়ে ধরার কথা বলেন।
১০ যিলহজ মহানবী মিনার উদ্দেশে রওয়ানা হলেন এবং কঙ্কর নিক্ষেপ, কুরবানি এবং তাকসীর ইত্যাদি সম্পন্ন করে হজের অন্যান্য আচার-অনুষ্ঠান ও কাজ আঞ্জাম দেয়ার জন্য পবিত্র মক্কা গমন করেন। আর এভাবে তিনি জনগণকে হজের আচার-অনুষ্ঠান এবং বিধানসমূহ শিক্ষা দেন।
হাদীসবিদগণের মধ্যে প্রসিদ্ধ অভিমত হচ্ছে এই যে, মহানবী (সা.) আরাফাতের দিবসে (৯ যিলহজ) তাঁর এ ভাষণ প্রদান করেছিলেন। তবে কতিপয় মুহাদ্দিস ও ঐতিহাসিক বিশ্বাস করেন, মহানবী (সা.) ১০ যিলহজ এ ভাষণ দিয়েছিলেন।
গাদীরে খুমের মহাঘটনা
হজের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হলো। মুসলমানরা মহানবীর কাছ থেকে হজের আমলসমূহ শিখে নেন। এ সময় মহানবী পবিত্র মদীনার উদ্দেশে পবিত্র মক্কা ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন। মদীনা অভিমুখে যাত্রার নির্দেশ দেওয়া হলো। কাফেলাসমূহ জুহ্ফার তিন মাইলের মধ্যে অবস্থিত ‘রাবুঘ’ নামক স্থানে পৌঁছলে ওহীর ফেরেশতা হযরত জিবরাইল আমীন (আ.) ‘গাদীরে খুম’ নামক স্থানে মহান আল্লাহর পক্ষ হতে একটি আয়াত নিয়ে অবতরণ করেন। আয়াতটি হলো :
                   ক্সক্স 
আপনার প্রভুর পক্ষ থেকে আপনার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে, তা প্রচার করুন; আর যদি আপনি তা না করেন, তা হলে আপনি তাঁর রিসালাতই (যেন) প্রচার করেন নি এবং মহান আল্লাহ্ আপনাকে জনগণের অনিষ্টতা থেকে রক্ষা করবেন।… (সূরা মায়েদাহ্ : ৬৭)
মহানবী (সা.) যাত্রা বিরতির নির্দেশ দিলেন। যাঁরা কাফেলার সম্মুখভাগে ছিলেন তাঁদেরকে থামানো হলো এবং যাঁরা কাফেলার পেছনে ছিলেন তাঁরা এসে তাঁদের সাথে মিলিত হলেন। সেদিন দুপুর বেলা তীব্র গরম পড়েছিল। জনতা তাদের বহিরাবরণের একটি অংশ মাথার উপর এবং আরেকটি অংশ পায়ের নিচে রেখেছিল। মহানবী (সা.)-এর জন্য একটি শামিয়ানা তৈরি করা হলো। তিনি জামাআতে যুহরের নামায আদায় করলেন। এরপর জনতা তাঁর চারপাশে সমবেত হলে তিনি একটি উঁচু জায়গার উপর গিয়ে দাঁড়ালেন যা উটের হাওদা দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল। তিনি বলিষ্ঠ কণ্ঠে ভাষণ দিলেন।
গাদীরে খুমে মহানবী (সা.)-এর ভাষণ
মহানবী (সা.) প্রথমে মহান আল্লাহ্র একত্ববাদের সাক্ষ্য দেন, তাঁর প্রশংসা করেন এবং যাবতীয় মন্দ কাজ থেকে তাঁর কাছে আশ্রয় কামনা করেন। তিনি তাঁর উপর অর্পিত রিসালাতের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেছেন কিনা সে ব্যাপারে উপস্থিত জনতা হতে সাক্ষ্য গ্রহণ করেন।
এরপর মহানবী (সা.) সকলকে জিজ্ঞাসা করেন : ‘তোমরা কি সাক্ষ্য দেবে যে, বিশ্বজগতের মাবুদ এক-অদ্বিতীয় এবং মুহাম্মাদ আল্লাহ্র বান্দা এবং তাঁর রাসূল; পরকালে বেহেশত, দোযখ এবং চিরস্থায়ী জীবনের ব্যাপারে কোনো দ্বিধা ও সন্দেহ নেই?’ তখন সবাই বললেন : ‘এসব সত্য এবং আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি।’
অতঃপর তিনি বললেন : ‘হে লোকসকল! আমি দু’টি মূল্যবান জিনিস তোমাদের মাঝে রেখে যাচ্ছি। আমরা দেখব, তোমরা আমার রেখে যাওয়া এ দু’টি স্মৃতিচিহ্নের সাথে কেমন আচরণ কর?’ ঐ সময় একজন দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করেন : ‘এ দুটি মূল্যবান জিনিস কী?’ মহানবী বললেন : ‘একটি মহান আল্লাহ্র কিতাব (পবিত্র কুরআন), যার এক প্রান্ত মহান আল্লাহ্র হাতে এবং অপর প্রান্ত তোমাদের হাতে আছে এবং অপরটি আমার বংশধর (আহ্লে বাইত)। মহান আল্লাহ আমাকে জানিয়েছেন, এ দুই স্মৃতিচিহ্ন কখনো পরস্পর বিচ্ছিন্ন হবে না।’
এরপর তিনি সমবেত লোকদেরকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন : ‘হে লোকসকল! পবিত্র কুরআন ও আমার বংশধর থেকে অগ্রগামী হয়ো না এবং কার্যত এতদুভয়ের প্রতি অবহেলা প্রদর্শন করো না; এর অন্যথা করলে তোমরা ধ্বংস হয়ে যাবে।’
এ সময় মহানবী (সা.) আলী (আ.)-এর হাত উঁচু করে ধরেন এবং আলী (আ.)-কে উপস্থিত জনতার কাছে পরিচয় করিয়ে দেন। এরপর তিনি জিজ্ঞেস করেন : ‘মুমিনদের চেয়ে তাদের নিজেদের ওপর কে সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত?’ তখন সবাই জবাব দিলেন : ‘মহান আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসূলই ভালো জানেন।’ মহানবী তখন বললেন : ‘মহান আল্লাহ্ আমার মাওলা এবং আমি মুমিনদের মাওলা; আর আমি তাদের নিজেদের ওপর তাদের চেয়ে বেশি অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত এবং সবচেয়ে যোগ্যতাসম্পন্ন। সুতরাং হে লোকসকল! আমি যার মাওলা, এই আলীও তার মাওলা।’
এরপর তিনি মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন : ‘হে আল্লাহ! যে তাকে (হযরত আলীকে) সমর্থন করবে তাকে তুমিও সমর্থন কর; যে তার সাথে শত্রুতা করবে, তার সাথে তুমিও শত্রুতা কর; যে তাকে ভালোবাসবে, তাকে তুমিও ভালোবাস; যে তাকে ঘৃণা করবে, তাকে তুমিও ঘৃণা কর; যে তাকে সাহায্য করবে, তাকে তুমিও সাহায্য কর এবং যে তাকে সাহায্য থেকে বিরত থাকবে, তাকে তুমিও সাহায্য থেকে বিরত থাক এবং সে যেদিকে ঘোরে, সত্যকেও তার সাথে সেদিকে ঘুরিয়ে দাও।’
মহানবীর ভাষণের পর গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ হযরত আলীর সাথে মুসাফাহা করে তাঁকে অভিনন্দন জানান। সবার আগে হযরত আবু বকর ও হযরত উমর হযরত আলীকে অভিনন্দন জ্ঞাপন করেন এবং শুভেচ্ছা জানান।
সাহাবী কবি হাস্সান ইবনে সাবিত মহানবী (সা.)-এর কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে তৎক্ষণাৎ একটি কবিতা রচনা করেন এবং তা তাঁর সামনে আবৃত্তি করেন। এই কবিতার দু’টি পঙ্ক্তি নিচে তুলে ধরা হলো :
فقال له: قم يا علىّ، فإنّنِى رضيتك من بعدى إماما وهاديا
فمن كنت مولاه فهذا وليّه فكونوا له أَتـبـاع صدق موالـيا
‘অতঃপর তিনি তাঁকে বললেন : হে আলী! উঠে দাঁড়াও।
কারণ, আমি তোমাকে আমার পরে ইমাম (নেতা) ও পথপ্রদর্শক মনোনীত করেছি।
অতএব, আমি যার মাওলা (অভিভাবক ও কর্তৃপক্ষ), সেও তার ওয়ালী।
তাই তোমরা সবাই তার সত্যিকার সমর্থক ও অনুসারী হয়ে যাও।’
গাদীরে খুমের ঘটনার চিরস্থায়িত্ব
গাদীরে খুমের ঐতিহাসিক ঘটনা সর্বকাল ও সর্বযুগে এক জীবন্ত ইতিহাস রূপে বিদ্যমান। মুসলিম লেখক ও গ্রন্থ রচয়িতাগণ তাঁদের প্রণীত গ্রন্থসমূহে এ ব্যাপারে আলোচনা করেছেন এবং একে ইমাম আলী (আ.)-এর অন্যতম ফযীলত ও শ্রেষ্ঠত্ব বলে গণ্য করেছেন। গাদীরে খুমের ঘটনা মুহাদ্দিস, মুফাস্সির, কালামশাস্ত্রবিদ, দার্শনিক, ঐতিহাসিক ও জীবনচরিত রচয়িতাগণের মতো বিভিন্ন শ্রেণির মনীষীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে এবং তাঁরা এ ব্যাপারে অতিশয় গুরুত্ব প্রদান করেছেন- যা অন্য কোনো ঘটনার ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যায় না।
এ ঐতিহাসিক ঘটনার গুরুত্ব তুলে ধরার ক্ষেত্রে এতটুকু উল্লেখ করাই যথেষ্ট যে, মহানবী (সা.)-এর ১১০ জন সাহাবী এই ঘটনা বর্ণনা করেছেন। হিজরি দ্বিতীয় শতকে তাবেয়িগণের যুগেও ৮৯ জন তাবেয়ী এ হাদীস বর্ণনা করেছেন। পরবর্তী শতকসমূহেও হাদীসে গাদীরের বর্ণনাকারিগণের সংখ্যা অনেক। তাঁদের মধ্য থেকে ৩৬০ জন তাঁদের নিজ নিজ গ্রন্থে এ হাদীসটি সংকলন করেছেন এবং অনেকেই এ প্রসঙ্গে বর্ণিত অনেক হাদীসের বিশুদ্ধতা ও সঠিক (সহীহ) হবার বিষয়টি স্বীকার করেছেন।
হিজরি তৃতীয় শতকে ৯২ জন আলেম, চতুর্থ শতকে ৪৩ জন, পঞ্চম শতকে ২৪ জন, ষষ্ঠ শতকে ২০ জন, সপ্তম শতকে ২১ জন, অষ্টম শতকে ১৮ জন, নবম শতকে ১৬ জন, দশম শতকে ১৪ জন, একাদশ শতকে ১২ জন, দ্বাদশ শতকে ১৩ জন, ত্রয়োদশ শতকে ১২ জন এবং চতুর্দশ শতকে ২০ জন আলেম এ হাদীস বর্ণনা করেছেন।
আলেমগণের কেউ কেউ কেবল এ হাদীস বর্ণনা করেই ক্ষান্ত হন নি; বরং এ হাদীসের সনদ এবং এর অন্তর্নিহিত অর্থ নিয়ে স্বতন্ত্র গ্রন্থও রচনা করেছেন।
প্রখ্যাত মুসলিম ঐতিহাসিক তাবারী ‘আল ওয়ালায়াহ্ ফী তুরুকি হাদীসিল গাদীর’ নামে একখানা গ্রন্থ রচনা করেছেন এবং এ হাদীস মহানবী (সা.) থেকে ৭২টি সূত্রে বর্ণনা করেছেন। ইবনে উকদাহ্ কুফী ‘বেলায়াত’ নামক সন্দর্ভে এ হাদীস ১০৫ জন রাবী থেকে বর্ণনা করেছেন। আবু বকর মুহাম্মাদ ইবনে উমর বাগদাদী এ হাদীস ২৫টি সূত্রে বর্ণনা করেছেন।
হাদীসশাস্ত্রবিদগণের মধ্য থেকে আহমাদ ইবনে হাম্বাল এ হাদীস ৪০টি সূত্রে, ইবনে হাজার আসকালানী ২৫টি সূত্রে, জাযারী শাফেঈ ২৫টি সূত্রে, আবূ সাঈদ সুজিস্তানী ১২০টি সূত্রে, আমীর মুহাম্মদ ইয়েমেনী ৪০টি সূত্রে, নাসাঈ ২৫০টি সূত্রে, আবুল আলা হামাদানী ১০০টি সূত্রে এবং আবুল ইরফান হিব্বান ৩০টি সূত্রে বর্ণনা করেছেন।
যেসব ব্যক্তি এ মহান ঐতিহাসিক ঘটনার বৈশিষ্ট্যসমূহ সংক্রান্ত বই-পুস্তক রচনা করেছেন তাঁদের সংখ্যা ২৬। আল্লামা আয়াতুল্লাহ্ আমীনী এ ঐতিহাসিক ঘটনা সম্পর্কে ‘আল গাদীর’ নামে একটি মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেছেন।