All posts by dreamboy

সভা-সমাবেশ

ইরানের ইসলামি বিপ্লবের ৩৯তম বিজয় বার্ষিকী উপলক্ষে সেমিনার

গত ০৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় জাতীয় জাদুঘরের প্রধান মিলনায়তনে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের ৩৯তম বিজয় বার্ষিকী উপলক্ষে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ও জাতীয় জাদুঘরের যৌথ উদ্যোগে ‘স্বাধীনতা, জাতীয় অগ্রগতি ও সক্ষমতা’ শীর্ষক এক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। এ উপলক্ষে ডকুমেন্টারি ফিল্ম প্রদর্শিত হয় ও ছয় দিনব্যাপী ইরানি চলচিত্র প্রদর্শণীর উদ্বোধন করা হয়। ইরানের ইসলামি বিপ্লবের ৩৯ তম বিজয় বার্ষিকী উপলক্ষে জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক জনাব ফয়জুল লতিফ চৌধুরীর সভাপতিত্বে আয়োজিত উক্ত সেমিনার ও চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান ও সাবেক মন্ত্রী ড. মো. আবদুর রাজ্জাক এমপি। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের রাষ্ট্রদূত ড. আব্বাস ভায়েজী দেহনাভী, প্রখ্যাত অভিনেতা ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. এনামুল হক ও ডেফোডিল আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যন্সেলর প্রফেসর ড. ইউসুফ মাহবুবুল ইসলাম। বাংলাদেশে সফররত ইরানি ক্বারী মুহাম্মদ জাওয়াদ হোসাইনীর সুললিত কণ্ঠে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু হয়। সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ সিদ্দিকুর রহমান খান। স্বাগত ভাষণ দেন ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের কালচারাল কাউন্সেলর জনাব সাইয়্যেদ মূসা হোসেইনী।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, আমাদের ভ্রাতৃপ্রতিম দেশ ইরানের রয়েছে হাজার বছরের সমৃদ্ধ ইতিহাস। ইরান এক প্রাচীন সভ্যতার দেশ। ইরানি জাতির ত্যাগ-তিতিক্ষা, সংগ্রাম, সহিষ্ণুতা, অধ্যবসায়, ইরানের আধ্যাত্মিক নেতৃত্বের দূরদর্শিতা ও দেশপ্রেম এবং তাঁদের প্রতি ইরানি জনগণের আস্থার ফলেই আন্তর্জাতিক বিশ্বের অসহযোগিতা সত্ত্বেও ইরান বহুদূর এগিয়ে গেছে। ইরানের রয়েছে আধ্যাত্মিক শক্তি, প্রকৃত ইসলামের সৌন্দর্য ও শিক্ষা, গোঁড়ামিমুক্ত ধর্মবিশ্বাস, মানবিক মূল্যবোধ, সমৃদ্ধ ইতিহাস, উন্নত সংস্কৃতি, শিল্প-বিজ্ঞানে সাফল্য ও প্রাকৃতিক সম্পদ। ইরানের ইসলামি বিপ্লব সবকিছুকেই ধারণ করেছে। সেখানে রয়েছে গণতন্ত্র, অর্থনৈতিক সুবিচার ও সাম্য, ন্যায়বিচারভিত্তিক সমাজ ও পরধর্ম সহিষ্ণুতা। একই সাথে ধর্ম-নৈতিকতা ও আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের শিক্ষায় শিক্ষিত ইরানের আলেমগণ সত্যিকার অর্থেই একেকজন আধুনিক ও প্রজ্ঞাবান দার্শনিক ও চিন্তাবিদ। ইসলাম অন্ধ ধর্মানুসারীদের কোন ধর্ম নয়। ইসলামে রয়েছে আত্মশুদ্ধি বা আত্মার মুক্তিবিধান এবং সেইসাথে বুদ্ধির মুক্তিবিধান। উগ্র গোঁড়া বা সংকীর্ণ চিন্তার ধর্ম সেটি নয়। তাই ইরানে যে সমাজ কায়েম হয়েছে তাকে বলতে পারি ধর্মবিশ্বাস ও নৈতিকতাযুক্ত আধুনিক বা প্রগতিশীল সমাজ। ইরানের প্রজ্ঞাবান নেতৃত্ব শত বাধার পরও যেভাবে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন তাতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সবকটি বিভাগেই সফলতা অর্জিত হচ্ছে। আমরা একে সাধুবাদ জানাই।
ইরান একটি সুসভ্য দেশ। হাজার হাজার বছরের সভ্যতার নিদর্শন রয়েছে ইরানে। ইতিহাসখ্যাত পারস্য সভ্যতার কথা কে না জানে! ইরানি জনগণ আজ থেকে প্রায় চৌদ্দ শতাব্দী আগে ইসলাম গ্রহণ করেছে। এরপর বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে এসে পুনরায় করেছে ইসলামি সাংস্কৃতিক বিপ্লব। কিন্তু ইসলাম-পূর্ব যুগের হাজার হাজার বছর আগের অতীত ইতিহাস-ঐতিহ্যকে তারা ধরে রেখেছে। ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলোকে তারা ধ্বংস করে নি। ইতিহাসের পাঠোদ্ধারের জন্য এ সবগুলোকে তারা অক্ষত রেখেছে। ইরানের জাদুঘরগুলো সমৃদ্ধ। সেখানে ইসলামি যুগের নিদর্শন যেমন স্থান পেয়েছে তেমনি প্রাক ইসলামি যুগের নিদর্শনগুলোও সযতেœ সংরক্ষিত রয়েছে। অটুট রয়েছে হাজার হাজার বছর আগের পুরাকীর্তি ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো। পারস্য সংস্কৃতির সাথে ইসলামি জীবনবোধের সংমিশ্রণে সেখানে গড়ে উঠেছে স্বতন্ত্র পারস্য সভ্যতা ও সংস্কৃতি। এই শাশ্বত বোধ বিশ্বাসকেও তারা ধরে রেখেছে। ইরানের ইসলামি বিপ্লব নামের এক গণবিপ্লবের মাধ্যমে আড়াই হাজার বছরের রাজতন্ত্র উচ্ছেদ হয়ে গেছে। আমরা ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছি। আর ইরানের বিপ্লবটি ছিল রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে। ইরান রাজতান্ত্রিক শাসনের যাঁতাকলে পিষ্ট স্বাধীনতা ও স্বনির্ভরতাকে উদ্ধার করেছে রাজতন্ত্র উৎখাতের মাধ্যমে এবং তাকে টিকিয়ে রাখার জন্য যুদ্ধ করেছে। আর এখনো তাদেরকে নানামুখি আগ্রাসন ও অপকৌশলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যেতে হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বিশ্ব ক্রমাগত ইরানকে অসহযোগিতা করে যাচ্ছে। এত অসহযোগিতা, প্রতিবন্ধকতা, শত্রুতা ও ষড়যন্ত্রের পরও ইরান যেভাবে এগিয়েছে ও এগিয়ে যাচ্ছে, যদি বহির্বিশ্বের অসহযোগিতা না থাকত তবে ইরান আরো অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারত।
স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত অধিকার। স্বাধীনতা সব মানুষকে সামনে নিয়ে যেতে সহায়তা করে। রাজতান্ত্রিক সমাজে একটি রাজবংশ তাদের আত্মীয়-স্বজন ও গুটি কয়েক কায়েমী স্বার্থবাদী রাজানুগত ব্যক্তি মিলে-মিশে দেশটাকে শোষণ করে। দেশের সম্পদ এরা মিলে-মিশে ভোগ করে। আবার স্বৈরতন্ত্র বা কোন গোত্র বা গোষ্ঠীর শাসনও জনগণকে শোষণ করে। মার্কিন তাঁবেদার রেযা শাহ পাহলভীর রাজতান্ত্রিক শাসনের শৃঙ্খল ভাঙতে তাদেরকে অনেক নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। অনেক প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছে।
পৃথিবীর ইতিহাসে যতগুলো বিপ্লব হয়েছে, যেমন ফরাসী বিপ্লব, রুশ বলসেভিক বিপ্লব, চৈনিক বিপ্লব তন্মধ্যে ইরানের ইসলামি বিপ্লবের বৈশিষ্ট্য ছিল একটু ভিন্ন। প্রত্যেকটি বিপ্লবই গণমানুষের মুক্তিবিধানে সচেষ্ট হয়েছে। কিছুটা সফল হয়েছে, কিছুটা ব্যর্থ হয়েছে। তবে ইরানের বিপ্লবকে অনেকাংশেই সফল বলা যায়। দেশপ্রেমিক ইরানি জনতা ইরানকে সকল প্রতিকূলতার ভেতর দিয়েও বিশ্বে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। ইরানে বিপ্লব শুধু শহরের মানুষের জীবনকেই বদলায় নি; বরং ইরানি জনতার উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রাম-গ্রামান্তরকেও স্পর্শ করেছে। আসলে গ্রামের মানুষের উন্নয়নই প্রকৃত উন্নয়ন- যা ইরানে হয়েছে। শত অবরোধ-অসহযোগিতার পরও ইরানের মাথাপিছু আয় ১৬০০০ ডলার এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বার্ষিক জাতীয় প্রবৃদ্ধির হার শতকরা ১২ ভাগ। এটা বিস্ময়কর অগ্রগতি।
ইরানি চলচিত্র ও সংস্কৃতি সম্পর্কে বলেন, ইরানি সিনেমা বিশ্বব্যাপী সমাদৃত ও অভিনন্দিত। ইরানি সিনেমা জীবনবোধে উদ্দীপ্ত ও নানা বিষয়ে গণসচেতনতামূলক। সমাজ ও মানবজীবনের ছোট ছোট ঘটনাগুলোকে ইরান সিনেমার মাধ্যমে শিল্পসম্মতভাবে ফুটিয়ে তোলে। এসব সিনেমার মানবিক আবেদন ও অভিনয়ের মান এতই উন্নত যে, অস্কারসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পুরস্কার প্রতি বছরই ইরান ঘরে তুলছে। ইরানি সিনেমা প্রমাণ করেছে মারদাঙ্গা, উত্তেজনা. অশ্লীলতা ও যৌনাবেদন ছাড়াও বিশ্বসেরা চলচিত্র নির্মাণ করা সম্ভব। দেশপ্রেম, মানবতা, সততা, ইসলামের শিক্ষা, চরিত্র গঠনমূলক ও ইতিহাসভিত্তিক নানা সিনেমা ইরানে নির্মিত হচ্ছে।
ইরানের সাথে রয়েছে বাংলাদেশের হাজার বছরের পুরোনো সম্পর্ক এবং এখনো তা অটুট রয়েছে। একসময় এদেশের দাপ্তরিক ভাষা ছিল ফারসি। বাংলা ভাষায় সাত হাজারেরও অধিক শব্দ রয়েছে ফারসি। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর কবিতায় ও সাহিত্যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অনেক ফারসি শব্দ ব্যবহার করেছেন। নজরুল ফারসি জানতেন। আমাদের দেশের আরো অনেক জ্ঞানী-গুণী ফারসি জানতেন। ইরানের কবি রুমী, জামি, ওমর খৈয়াম, ফেরদৌসী, শেখ সা’দী আমাদের দেশেও সমাদৃত। আমরা বাংলাদেশী বাঙ্গালীরা শতকার ৯০ ভাগ মুসলমান। কাজেই ধর্মের দিক দিয়েও আমাদের সাথে ইরানের মিল রয়েছে। ইরান ও বাংলাদেশের বন্ধুত্ব উভয় দেশের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ। এ বন্ধুত্ব সব সময় অটুট থাকবে বলে আমি মনে করি।
সভাপতির বক্তব্যে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের পরিচালক জনাব ফয়জুল লতিফ চৌধুরী বলেন, উন্নত সংস্কৃতি, সমৃদ্ধ ইতিহাস, বিশ্বসেরা সাহিত্য, খনিজ সম্পদ ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দেশ ইরান ১৯৭৯ সালের বিপ্লবের পর আরো উন্নত হয়েছে ও উজ্জ্বল হয়েছে তাদের কুটনৈতিক সফলতা। আমাদের দেশের সাথে ইরানের সম্পর্ক আগেও ছিল, তবে তা বিপ্লবের পর আরো বেড়েছে। ইরানের জনতা ইসলাম ধর্ম যেমন বোঝে তেমনি বোঝে দেশজ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও গ্রহণযোগ্য মূল্যবোধগুলোকে। আমাদের দেশের সাথে যেমন ইরানের সম্পর্ক আছে বহির্বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাথে সম্পর্কোন্নয়নেও ইরানি নেতৃত্ব অত্যন্ত সফলতার সাথে কাজ করে যাচ্ছে। ইরানের সবচেয়ে প্রশংসনীয় ও বুদ্ধিদীপ্ত কাজ হচ্ছে বিভিন্ন দেশের সাথে তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বিনিময়ের কাজটি। তারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উত্তম সাংস্কৃতিক বিষয়গুলো গ্রহণ করছে এবাং তাদের উত্তমগুলোও বিভিন্ন দেশে পৌঁছে দিচ্ছে। আমাদের জাতীয় জাদুঘরে আন্তর্জাতিক গ্যালারিতে বিভিন্ন দেশের মতো ইরানেরও একটি সমৃদ্ধ কর্নার রয়েছে। সেখানে ফেরদৌসীর ‘শাহনামা’র পুরোনো কপি রয়েছে। সঠিক উদ্যোগ গ্রহণ করলে আমরা সেই কর্নারকে আরো সমৃদ্ধ করতে পারি।
ড. আব্বাস ভায়েজী দেহনাভী বলেন, সাম্রাজ্যবাদ নিয়ন্ত্রিত পাপেট রেযা শাহ পাহলভী ইরানের জাতীয় সম্পদ অপব্যবহার ও অপচয় করত এবং তা আমেরিকার নির্দেশে ও নিয়ন্ত্রণে তাদের স্বার্থেই তা ব্যবহৃত হতো। তাই বিপ্লবের আগে আমরা অনেক পিছিয়ে ছিলাম। সাম্রাজ্যবাদীরা পাপেট শাসকদের মাধ্যমে আমাদের তেলসম্পদসহ জাতীয় সম্পদ শুষে নিত ও লুটে-পুটে খেত । বিনিময়ে তাদেরকে দিত নিরাপদে দেশের জনগণকে শোষণ করে তাদের ভোগবিলাসের মসনদকে টিকিয়ে রাখার নিশ্চয়তা। সেইসব ক্রীড়নক শাসককে তারা টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করত তাদেরই সা¤্রাজ্যবাদী স্বার্থে। কিন্তু ইমাম খোমেইনী (র)-এর নেতৃত্বে বিপ্লবের পর ইরানি জনগণ দেশকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে এবং দেশের সম্পদ ও সকল সুযোগ জনগণের উন্নয়নে ব্যবহৃত হয়। মূলত এ বিপ্লবের মাধ্যমে আমরা প্রকৃতরূপে স্বাধীন হই ও আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারপ্রাপ্ত হই। আমাদের এই জাগরণ ছিল সা¤্রাজ্যবাদীদের স্বার্থের বিপরীত তাই সা¤্রাজ্যবাদীদের তা সহ্য হচ্ছিল না। তারা আমাদের বিরুদ্ধে আট বছর মেয়াদী যুদ্ধ চাপিয়ে দেয় তাদের আরেক পাপেট পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ইরাকের সাদ্দামকে দিয়ে। এছাড়াও ইরানের ভেতর তৈরি করেছিল গুপ্ত ঘাতক। তারা আমাদের অনেক জনগণকে হত্যা করেছে। এছাড়া চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধেও অনেক লোক নিহত হয়। বিপ্লবের আগে আমাদের দেশ যেভাবে উন্নত থাকার কথা ছিল সেভাবে ছিল না, তদুপরি আমাদের ওপর যুদ্ধাঘাতে অনেক লোক নিহত হয় ও ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় শহর লোকালয় শিল্পকারখানা। শিক্ষার হারও কম ছিল। আপনারা জানেন যে, বাংলাদেশ থেকে অনেক ডাক্তার ইরানে গিয়েছিল। তারা সেখানে চিকিৎসাসেবাসহ পেশাগত দায়িত্ব পালন করেছে। কিন্তু আজ আমরা উন্নত চিকিৎসা সেবা দানে সক্ষম। তৈরি হয়েছে হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ। ঔষধ শিল্পেও আমরা এগিয়েছি। বর্তমানে আমাদের জনগণের শতকরা ৯৮ ভাগ শিক্ষিত। সাম্রাজ্যবাদী অবারোধ সত্ত্বেও আমরা অনেক দূর এগিয়েছি। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী শক্তি শুধু অবরোধ আরোপ করেই বসে থাকে নি। তারা ইরানকে বিপর্যস্ত করার জন্য ও আমাদের অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করার জন্য, আমাদের শান্তিপূর্ণ মানবিক বিকাশের কার্যক্রমকে রুদ্ধ করার জন্য, উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে রহিত করার জন্য আমাদের চারপাশে আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্রসীমানায় দায়েশসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী গ্রুপকে তৈরি করেছে। আমরা ধৈর্যের সাথে সকল ষড়যন্ত্র ও অপপ্রয়াসের মোকাবেলা করার চেষ্টা করেছি। আমরা পরমাণু কর্মসূচিকে জ্বালানি শক্তি হিসেবে ও শান্তিপূর্ণ কাজে ব্যবহার করতে চাই। এই সব কথা বারবার বলার পরও তারা আমাদের পরমাণু কর্মসূচির বিরুদ্ধে আমাদেরকে কটাক্ষ করে নানা অপপ্রচার ও অপকথা ছড়াতে লাগল। অবশেষে তারা নিউক্লিয়ার ইস্যুতে আমাদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হলো। আমাদের বিরুদ্ধে তাদের অপপ্রচারগুলো ভুল প্রমাণিত হলো।
বিপ্লবের আগে তারা আমাদের যুবসমাজের চরিত্রকে ধ্বংস করার জন্য সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চালায়। সমাজে মাদকের প্রসার ঘটায়। ইসলামের পবিত্র জীবনবিধান, ঈমানী চিন্তাচেতনা ও আমাদের নিজস্ব ইরানি জাতীয় সংস্কৃতির বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র করে। হলিউডের চলচ্চিত্রের প্রসার ঘটিয়ে সন্ত্রাস, মাদক ও নৈতিকতাহীন চালচলনকে উৎসাহিত করে। ইসলামি ও ইরানি সাংস্কৃতিক মূল্যবোধকে অবদমিত করার চেষ্টা করে। কিন্তু আমরা তা হতে দেই নি। তিনি বলেন, অবরোধ আমাদের কোন ক্ষতি করে নি; বরং আমাদেরকে সংযমী, আত্মপ্রত্যয়ী, পরিশ্রমী, আত্মশক্তিতে বলিয়ান ও দেশপ্রেমের পথে অটল করেছে।
আমরা সব সময় ন্যায় ও মানবাধিকারের পক্ষে। নির্যাতিত জাতিসমূহের পক্ষে। ফিলিস্তিনসহ বিশ্বের অপরাপর স্থানের নির্যাতিত মানুষের পক্ষে। আমরা সকল দেশের বন্ধুত্ব চাই, কিন্তু কোন শক্তির প্রভুত্ব নয়। ইহুদীবাদী ইসরাইল ও সা¤্রাজ্যবাদীদের ষড়যন্ত্র ও অপপ্রচার সত্ত্বেও আমরা ইসলামের মানবতাবাদী চেতনা নিয়ে আমাদের সঠিক অবস্থানকে বিশ্ববাসী ও বিশ্বমিডিয়ার কাছে তুলে ধরার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছি যে, ইরান বিশ্বশান্তির পক্ষে। আমরা সকল প্রকার সন্ত্রাসের বিপক্ষে। স্বাধীনতা, সক্ষমতা ও অগ্রগতির পক্ষে।
স্বাগত বক্তব্যে সম্মানিত মেহমানবৃন্দ ও সুধিম-লীকে অভিবাদন জানিয়ে ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের কালাচারাল কাউন্সেলর জনাব সাইয়্যেদ মূসা হোসাইনী উপস্থিত সবাইকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, প্রত্যেক জাতির নিজস্ব দিবস থাকে। আপনাদের মহান ভাষা দিবস ও বিজয় দিবসের মতো আমাদের কাছে ১১ ফেব্রুয়ারি বা ২২ বাহমান দিবসটি তাৎপর্যপূর্ণ। ১৯৭৯ সালের ১১ ফেব্রুয়ারিসহ দুনিয়াকাঁপানো ইরানের ইসলামি বিপ্লবের ১০টি প্রভাত ছিল ইরানের জাতীয় জীবনে দশটি গুরুত্বপূর্ণ সময়। এ দশ দিনে পর্যায়ক্রমে আমরা চূড়ান্ত সাফল্যের দিকে এগিয়ে গেছি। বিপ্লবের উক্ত দিবসগুলো ছিল ইরানের জন্য স্মৃতিবহ সময়। যে সময়ে এসে ইরানি জাতি চূড়ান্তভাবে অপসারণ করেছে আড়াই হাজার বছরের রাজতান্ত্রিক স্বৈরশাসন ব্যবস্থাকে। আমরা পেয়েছি স্বাধীনতা, জাতীয় সক্ষমতা ও অগ্রগতির প্রকৃত সোপান। এই বিপ্লবের মাধ্যমে বিজাতীয়দের কর্তৃত্ব খর্ব হয়েছে। জনগণের চাওয়া-পাওয়ার প্রতিফলন ঘটেছে। আমরা জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছি। ঈমানী চেতনা, ইরানি স্বার্থ ও দেশপ্রেমকে কেন্দ্র করে ইরানের বৃহত্তর জনসাধারণের ঐক্যই আমাদেরকে সকল ষড়যন্ত্র ও অপকৌশল থেকে মুক্ত রেখেছে। বলদর্পী শক্তি কখনো একতাবদ্ধ জাতির কোন ক্ষতি করতে পারে না।
বিশিষ্ট নাট্যকার, বুদ্ধিজীবী, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. এনামূল হক বলেন, ইরান একটি শক্তিশালী দেশ। আমরা যেমন যুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করেছি, তারাও বিভিন্ন বাধা অতিক্রম করে এগিয়েছে। হাজার বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ পারস্য সভ্যতা-সংস্কৃতির দেশ ইরান শিল্প-সংস্কৃতিতে পিছিয়ে নেই। ইরান শুধু ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক বিপ্লব এবং রাজনৈতিক বিপ্লবই করে নি, সাংস্কৃতিক বিপ্লবও করেছে। পারস্য সাহিত্য যেমন সমৃদ্ধ এবং বিশ্ব আসরে সমাদৃত, তেমনি ইরান বিশ্বসেরা চলচ্চিত্রও নির্মাণ করেছে। চলচ্চিত্র হচ্ছে একটি সৃজনশীল ও শক্তিশালী গণমাধ্যম। এর মাধ্যমে ফুটে ওঠে কোন দেশ ও জাতীর মানুষ ও সমাজ, ইতিহাস-ঐতিহ্য, আচার-আচরণ, জীবনবোধ। ইরানের ইসলামি বিপ্লব মূলত একটি সাংস্কৃতিক বিপ্লব। ইরানের জাতীয় জীবনের সবচেয়ে কঠিনতম সময়েও তারা শিল্প-সংস্কৃতির কার্যক্রমে অবহেলা করে নি। স্বতন্ত্র ঐতিহ্য তৈরি করেছে ইরানি চলচ্চিত্র এবং বিশ্বময় স্থান করে নিয়েছে। পেয়েছে অস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার। ফরাসি চলচ্চিত্র উৎসব, ইতালির ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসব, কান চলচ্চিত্র উৎসবসহ অনেক উৎসবে অংশগ্রহণ করেছে ইরানি সিনেমা এবং পুরস্কার লাভ করেছে। আমাদের বাংলাদেশে এসেও ইরানি সিনেমা পুরস্কার বিজয় করেছে। প্রতি বছর দুই শতাধিক চলচ্চিত্র নির্মিত হয় তা প্রবন্ধকার উল্লেখ করেছেন। এসব সিনেমার অভিনয়, সংলাপ, চিত্রধারণ অসাধারণ। শিল্পনৈপুণ্য প্রশংসার দাবিদার। ইরানি চলচিত্রের রয়েছে নানা ডাইমেনশন। বিভিন্ন বিষয়কে শক্তিশালী চিত্রনাট্যের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়। ইরানি নির্মাতা আসগার ফারহাদির সিনেমা ‘সেল্সম্যান’ এবং ‘সেপারেশন’ দুটি বিখ্যাত চলচ্চিত্র। এছাড়া ‘দোখতার’ বা ‘কন্যা’ সিনেমাটিও ভালো একটি সিনেমা। আসগার ফারহাদি ছাড়াও মজিদ মাজিদী, মরহুম আব্বাস কিয়োরোস্তমী সহ আরো অনেক সেরা চলচ্চিত্র নির্মাতা জন্মগ্রহণ করেছেন ইরানে।
ইরান ভ্রমণের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে ডেফোডিল আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর ইউসুফ মাহবুবুল ইসলাম বলেন, ইরানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ, যেমন : কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় অত্যন্ত সমৃদ্ধ। ইরানের পাঠাগার ও জাদুঘর দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। পাঠাগারগুলোতে রয়েছে মিলিয়ন মিলিয়ন বই। আর জাদুঘরগুলোতে রয়েছে সাত হাজার বছরেরও পুরোনো ইতিহাসের নানা স্মৃতি। ইরানি জাতি শিক্ষা-সংস্কৃতিতে কত অগ্রসর এটা তার একটি ক্ষুদ্র নমুনা মাত্র।
তিনি বলেন, গণমানুষের স্বাধীনতা যেমন ব্যক্তিজীবনকে উন্নত করে তেমনি জাতীয় জীবনকে সমৃদ্ধ করে। ইরানের পথের ধারের একজন মুচিরও শো-রুম আছে এবং সে কম্পিটার প্রযুক্তি ব্যবহার করে। এর মাধ্যমেই বোঝা যায় বিপ্লব ইরানি জনগণকে কোথায় নিয়ে গেছে!
প্রবন্ধকার ড. মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান তাঁর প্রবন্ধে উল্লেখ করেন, ইমাম আলী (আ.)-এর বংশে জন্মগ্রহণকারী অর্থাৎ মূসা কাযেম (আ.)-এর বংশে জন্মগ্রহণকারী আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ রুহুল্লাহ খোমেইনী (র.)-এর নেতৃত্বে ইরান সা¤্রাজ্যবাদী পরাশক্তির তাঁবেদারি থেকে মুক্ত হয়ে কৃষি, শিল্প-বাণিজ্য, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে অনেক দূর এগিয়েছে। বিপ্লবের পর ৩৮ বছরে চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধ, অবরোধ, স্বজাতি-বিজাতি ষড়যন্ত্রের পর দেশের অভ্যন্তরে নগর ও গ্রামগুলো উত্তরোত্তর উন্নতি সাধন করেছে। নির্মিত হয়েছে রাস্তা ঘাট, রেলপথ। কৃষিকাজের জন্য উন্নত বাঁধ নির্মিত হয়েছে। শিক্ষার হার শতকরা সাতান্নব্বই ভাগ। ইরান এগিয়েছে পরমাণু বিজ্ঞানে, জেনেটিক সাইন্স, সাইবার সাইন্স ও ন্যানো টেকনোলজিতে। ইরান থেকে আমাদেরও অনেক কিছু শেখার আছে।

আমিন আল আসাদ

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশে ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের অগ্রগতি শীর্ষক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত

গত ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ বৃহস্পতিবার ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের ৩৯তম বিপ্লব বার্ষিকী উপলক্ষে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের উদ্যোগে ‘বাংলাদেশে ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের অগ্রগতি’ শীর্ষক এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের ডীন প্রফেসর ড. এফ এম এ এইচ তাকী। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন রাবি ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের ইরানি ভিজিটিং প্রফেসর ড. রেযা সামিযাদে এবং ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রফেসর ড. মুহিবুল্লাহ সিদ্দিকী, এতে বক্তব্য রাখেন রাবি ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের প্রফেসর ড. মো. শামীম খান, প্রফেসর ড. মো. নূরুল হুদা এবং প্রফেসর ড. মো. কামাল উদ্দিন। অনুষ্ঠানের সঞ্চালকের দায়িত্ব পালন করেন প্রফেসর ড. মো. শফিউল্লাহ, সভাপতিত্ব করেন বিভাগীয় সভাপতি প্রফেসর ড. মো. আতাউল্যাহ।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রফেসর ড. এফ এম এ এইচ তাকী বলেন, এতদঞ্চলে ফারসি ভাষার আগমন ঘটেছে তুর্কিদের মুসলিম বিজয়ের পরেই। যদিও ইখতিয়ার উদ্দিন বখতিয়ার খিলজীর ভারত বর্ষে আগমনের মাধ্যমে ফারসি চর্চা শুরু হয়েছে বলা হয়ে থাকে। কিন্তু ঐতিহাসিক বিশ্লেষণে প্রতীয়মান হয় যে, কিছু কিছু সুফি সাধক এর পূর্বেই ইসলাম প্রচারের জন্য এতদঞ্চলে আগমন করেছিলেন। যাদের মাধ্যমে ফারসি চর্চা অব্যাহত ছিল। এরই ধারাবাহিকতায় সুলতানি ও মোগল আমলে ফারসি ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করে। এমনকি প্রায় ছয়শ’ বছরের অধিককাল ফারসি উপমহাদেশের রাষ্ট্রভাষার আসনে সমাসীন ছিল। এ সময় আপামর জনগণ ফারসি ভাষা ব্যবহার করতেন। অফিস-আদালতসহ সকল দাপ্তরিক কাজে ফারসির প্রভাব ছিল। এদেশের মানুষ ফারসি ভাষা, সাহিত্য, ইরানি কবি-সাহিত্যিকের সাথে পরিচিত। বাংলাদেশে ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর হতে ফারসি চর্চার আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। আমাদের দীর্ঘদিনের একটি প্রত্যাশা ছিল বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও স্বতন্ত্র মর্যাদায় ফারসি চর্চা শুরু হোক। অবশেষে ২০১৬-২০১৭ শিক্ষাবর্ষ থেকে ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ নামে স্বতন্ত্র বিভাগের মাধ্যমে ফারসি চর্চার ধারা সূচিত হয়েছে। তৎকালীন মাননীয় উপাচার্য মহোদয়ের আন্তরিক প্রচেষ্টায় এটি সম্ভবপর হয়েছে। অনুষদের ডীন হিসেবে আমি এর আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলাম।
তিনি বলেন, ইরানের ইসলামি বিপ্লবের পর এদেশে ফারসি ভাষা ও সাহিত্য চর্চায় এক নব দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফারসি বিভাগ প্রতিষ্ঠা এক্ষেত্রে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করছে। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে বলেন, এ বিভাগের অগ্রগতি অত্যন্ত ইতিবাচক। তিনি ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্দেশে বলেন, বিভাগ প্রতিষ্ঠার পর থেকেই একজন বিদেশি শিক্ষক নিয়ে আসার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। কোনো ভাষা শিখতে হলে সেই ভাষাভাষীদের কাছ থেকে শিখলে যতটা ফলপ্রসূ হয় তা অন্য কোনোভাবে হয় না। তাই প্রফেসর ড. রেযা সামিযাদের-এর আগমনের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫৭টি বিভাগের মধ্যে ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ একটি শ্রেষ্ঠ বিভাগ, কারণ অন্য কোনো বিভাগে বিদেশি ভিজিটিং প্রফেসর নেই। এ জন্য আমি ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান সরকারের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। তিনি ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের প্রচেষ্টায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইরানিয়ান স্টাডিজ রুম প্রতিষ্ঠা, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ প্রতিষ্ঠা, ইরানি শিক্ষক দ্বারা ফারসি ভাষা ও সাহিত্য প্রমোশন কোর্স পরিচালনা এবং একজন ভিজিটিং প্রফেসর আনার কার্যক্রমের সফলতায় সন্তোষ প্রকাশ করেন। আগামী দিনে এ বিভাগ পঠন-পাঠন ও গবেষণায় আরো উত্তরোত্তর উন্নতি ও সমৃদ্ধি লাভ করবে বলে তিনি দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করেন। তিনি বিভাগীয় ছাত্র-ছাত্রীদের ইরান ভ্রমণের সুযোগ প্রদান ও বিভাগের পক্ষ থেকে গবেষণা পত্রিকা প্রকাশের আশাবাদ ব্যক্ত করে তাঁর বক্তব্য শেষ করেন।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে ইরানি ভিজিটিং প্রফেসর ড. রেযা সামিযাদে বলেন, ইরানের ইসলামি বিপ্লবে বিশ্বজুড়ে ফারসি ভাষা ও সাহিত্য নব উদ্যমে বিস্তৃতি লাভ করেছে। উপমহাদেশে, এমনকি বাংলাদেশেও এর প্রভাব অপরিসীম। অনুবাদ, গবেষণা, পঠন-পাঠন প্রভৃতি ক্ষেত্রে এর ভূমিকা প্রসংশনীয়। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক ড. কলিম সাহসারামী ‘খেদমানগোযারানে ফারসি দার বাংলাদেশ’ ফারসি ভাষায় রচনা করেছেন, যা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ একটি গ্রন্থ। বাংলাদেশে ফারসি চর্চার একটি পরিচিতি একসাথে অবহিত হওয়ার একটি সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে বলে তিনি মনে করেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রফেসর ড. মুহিবুল্লাহ সিদ্দিকী বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বলেন, ফারসি এতদঞ্চলের রাষ্ট্রভাষা ছিল। মুসলমানদের পাশাপাশি হিন্দুরাও এ ভাষা চর্চা করত। আমাদের শিয়া ও সুন্নি পার্থক্য করা উচিত নয়। মুসলমান শাসনামলে কোথাও শিয়া-সুন্নি মতভেদ ছিল না। এটা মূলত ইহুদি-খিস্টানদের চক্রান্ত ছাড়া আর কিছুই নয়। ইমাম খোমেইনীও সর্বদা মুসলমানদের ঐক্যের কথা বলেছেন। এমনকি তিনি বলেছেন, যারা শিয়া-সুন্নির মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করে তারা মুসলমান নয়; বরং সা¤্রাজ্যবাদের দালাল। তিনি সম্প্রতি ইরান সফরের অভিজ্ঞতা তুলে ধরতে গিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্যেশে বলেন, ইসলামি বিপ্লবের পর ইরান শিক্ষা, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান ও টেকনোলজিতে বর্তমান বিশ্বে গৌরবময় স্থানে উন্নীত হয়েছে। আমি ইরানে আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণ করে স্বচক্ষে তা অবলোকন করেছি। যখনই আমি ইরানে পৌঁছলাম তখন মাশহাদ ফেরদৌসী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর নিজে আমাকে সম্বর্ধনা জানান, যা উন্নত সভ্যতা, সংস্কৃতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ইরানের বর্তমান অবস্থা তুলে ধরতে গিয়ে উদাহরণস্বরূপ তিনি বলেন, একজন ইরানি মহিলা আমার গাইডের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। যে অনুবাদ সাহিত্যে অনার্স ডিগ্রিধারী এবং এই আন্তর্জাতিক সেমিনারে অতিথিদের অনুবাদ গাইড হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগের পক্ষ থেকে বিনা সম্মানীতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিয়োজিত হয়েছে। তা থেকেই বুঝা যায়, যে জাতি নিজের দেশের উন্নতি ও সমৃদ্ধির জন্য এতটুকু উৎসর্গ করতে পারে সে জাতিকে কোনো স্বড়যন্ত্র, প্রতিবন্ধকতা দাবিয়ে রাখতে পারবে না, তারা উন্নতির শিখরে আরোহণ করবেই।
আলোচকের বক্তব্যে প্রফেসর ড. শামীম খান বলেন, বাংলাদেশে ফারসি ভাষা ও সাহিত্য চর্চার অগ্রগতির ক্ষেত্রে ইরানি ভিজিটিং প্রফেসরগণের ভূমিকা অপরিসীম। প্রফেসর ড. নূরুল হুদা বলেন, ফারসি চর্চায় ইরানি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করে আসছে। ফারসি ভাষা কোর্স, আন্তর্জাতিক সেমিনার, গ্রন্থ প্রকাশ প্রভৃতি ক্ষেত্রে গৌরবময় দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। প্রফেসর ড. মো. কামাল উদ্দিন বলেন, ইসলামি বিপ্লবোত্তরকালে ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়েছে। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের গবেষণাও তাৎপর্যপূর্ণ। শিক্ষকগণের পিএইচডি অভিসন্দর্ভ প্রণয়ন, গবেষণামূলক গ্রন্থ, প্রবন্ধ রচনা ও আন্তর্জাতিক সেমিনারে অংশগ্রহণ এ কার্যক্রমকে গতিশীল করেছে। বাংলা একাডেমিও অনুবাদ, গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে এক্ষেত্রে যুগোপযোগী ভূমিকা পালন করছে।
পরিশেষে অনুষ্ঠানের সভাপতি প্রফেসর ড. মো. আতাউল্যাহ উপস্থিত প্রধান অতিথি, বিশেষ অতিথি, শিক্ষকম-লী, সুধিম-লী ও ছাত্র-ছাত্রীদেরকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। আগামী দিনে ভিজিটিং প্রফেসর, ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র এবং সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বিভাগ উত্তরোত্তর উন্নতির দিকে ধাবিত হবে ইনশাল্লাহ।

খুলনায় ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের ৩৯তম বিপ্লব বার্ষিকী পালিত

আঞ্জুমান-এ-পাঞ্জাতানী ও ইসলামী শিক্ষা কেন্দ্রের যৌথ উদ্যোগে নগরীর ১২, আলতাপোল লেনস্থ মসজিদ-এ-ওয়ালী আসরে গত ৮ ফেব্রুয়ারি ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের ৩৯তম বিপ্লব বার্ষিকী পালিত হয়। বিপ্লব বার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত ‘ইসলামী বিপ্লব এবং মুসলিম বিশ্বে এর প্রভাব’ শীর্ষক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আল-মোস্তফা (সা.) আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ঢাকাস্থ সম্মানিত প্রতিনিধি বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমীন ড. শাহাবুদ্দীন মাশায়েখী।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন খুলনা সরকারী পাবলিক লাইব্রেরীর উপ-পরিচালক ড. মোঃ আহসান উল্লাহ ও খুলনা জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট মোল্লা মশিউর রহমান নান্নু।
ইসলামী শিক্ষা কেন্দ্রের অধ্যক্ষ হুজ্জাতুল ইসলাম সৈয়দ ইব্রাহীম খলীল রাজাভীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় মুখ্য আলোচক হিসেবে বক্তব্য রাখেন বিশিষ্ট আইনজীবী ও সাংবাদিক ড. মোঃ জাকির হোসেন। এছাড়া সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন এ্যাডভোকেট মোঃ আব্দুর রাজ্জাক। উপস্থিত মেহমানদের উদ্দেশ্যে স্বাগত ভাষণ দেন ইসলামী শিক্ষা কেন্দ্রের শিক্ষা বিভাগের প্রধান হুজ্জাতুল ইসলাম ড. মোঃ আলী মোর্তজা।
প্রধান অতিথি ড. মাশায়েখী তাঁর বক্তব্যে বাংলাদেশের জনগণকে বিপ্লব বার্ষিকীর অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন যে, ইসলামি বিপ্লবের প্রতিষ্ঠাকাল থেকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান বিশ্বময় নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের পাশে থেকেছে। ফিলিস্তিনসহ অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রের জনগণকে বিভিন্নভাবে সাহায্য-সহযোগিতা দিয়ে আসছে। বিপ্লবের প্রতি পাশ্চাত্য বিশ্বের বৈরী মনোভাব এবং নানা রকম নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ইরান বিশ্বের নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর জন্য তার দায়িত্ব পালন করে যাবে ইনশাআল্লাহ। আর এটাই হচ্ছে ইসলামি বিপ্লবের মূল প্রেরণা।
অনুষ্ঠানে ইসলামি সংগীত পরিবেশন করে ইসলামী শিক্ষা কেন্দ্রের ছাত্রবৃন্দ।

বগুড়ায় ইরানে ইসলামি বিপ্লবের ৩৯তম বিজয় বার্ষিকী উদ্যাপন

বগুড়া শেখ সাদী কালচারাল সেন্টারের উদ্যোগে গত ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ইরানে ইসলামি বিপ্লবের ৩৯তম বিজয় বার্ষিকী অনুষ্ঠিত হয়।
ইমামিয়া জনকল্যাণ ফাউন্ডেশনের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ আবু জাফর মন্ডলের সভাপতিত্বে এবং শেখ সাদী কালচারাল সেন্টারের পরিচালক প্রভাষক মো. শাহীনুর রহমানের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানের শুরুতেই পবিত্র কোরআন থেকে তেলাওয়াত করেন জনাব মো. নুরুল ইসলাম খান। বক্তব্য রাখেন বগুড়া আল-মাহদী শিক্ষা কেন্দ্রের অধ্যক্ষ হুজ্জাতুল ইসলাম মো. মোজাফফর হোসেন, অধ্যক্ষ, জনাব টিপু সুলতান, সহকারী অধ্যাপক, সরকারি আজিজুল হক কলেজ, আলহাজ আ. জ.ম মনিরুল ইসলাম সহযোগী অধ্যাপক, সরকারি এ্যাডওয়াড কলেজ, পাবনা ও রাজশাহী সুগার মিলস্ লিঃ এর সাবেক জিএম এবং কৃষিবিদ আলহাজ মীর সিদ্দিকুর রহমান।
হুজ্জাতুল ইসলাম মো. মোজাফফর হোসেন বলেন, ইরানে ইসলামি বিপ্লব একটি ঐশী বিপ্লব। যে বিপ্লবের মূলে রয়েছেন একজন বিশেষজ্ঞ আলেম।
জনাব আ.জ.ম মনিরুল ইসলাম বলেন, ইমাম খোমেইনী (র.) ইরানে এমন এক ইসলামি বিপ্লব প্রতিষ্ঠিত করলেন যা বিশ্বের সকল পরাশক্তি শত চেষ্টা করেও ধ্বংস করতে পারছে না। এর পিছনে কী কারণ রয়েছে? এক দিকে খোদায়ী শক্তি অন্য দিকে শয়তানি শক্তি। শয়তানি শক্তির ওপর খোদায়ী শক্তির বিজয় হয়েছে। এটি ইমাম মাহদী (আ.)-এর বিপ্লবের সাথে মিলিত হবে ইনশাআল্লাহ। তিনি রেযা শাহ পাহলভী সম্পর্কে বলেন, রেযা শাহ নিজেকে মুসলমান দাবি করলেও তার কর্মকা- ছিল ইসলামবিরোধী। ইসলামি বিপ্লবের মাধ্যমে সেই অপশক্তি পরাজিত হয়েছে। ইরানে ইসলামি বিধিবিধান বলবৎ হয়েছে, নারীরা তাদের অধিকার ফিরে পেয়েছে এবং আলেমরা সম্মানের স্থানে অধিষ্ঠিত হয়েছেন।
জনাব মীর সিদ্দিকুর রহমান বলেন, মুত্তাকী লোকের এই পৃথিবী পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। কিন্তু বিপ্লবের পূর্বে রেযা শাহ পাহলভী ও সেক্যুলাররা আলেমদেরকে বিভিন্নভাবে অপমানিত-লাঞ্ছিত করত, এমনকি হত্যা করতেও দ্বিধা করত না। ইমাম খোমেইনী নির্বাসনে থেকেও বিপ্লবকে পরিচালিত করতে থাকেন। শাহের বাহিনীর গুলির বিপরীতে বিপ্লবীরা তাদেরকে ফুল দিয়ে স্বাগত জানায়। সরকারি বাহিনী জনগণের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করতে শুরু করে। এক পর্যায়ে শাহ দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়। ইমাম খোমেইনী দেশে ফিরে আসেন এবং বিপ্লব চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে।
সভাপতি জনাব আবু জাফর ম-ল বলেন, ইমাম খোমেইনী (র.) সম্পর্কে তৎকালীন কয়েকজন রাষ্ট্রপ্রধান মন্তব্য করেছিলেন যে, ইমাম খোমেইনী এমন একজন মানুষ যিনি পৃথিবীর কোন আইনই মানেন না, তিনি আরশের আইন মানেন। ইমাম খোমেইনী যেমনিভাবে যুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন আমাদেরকেও তেমনিভাবে সোচ্চার হতে হবে।

সাতক্ষীরায় ইরানের ইসলামি বিপ্লবের বিজয় বার্ষিকী উদযাপন

ইরানের ইসলামি বিল্পবের ৩৯তম বিজয় বার্ষিকী উপলক্ষে শহরের আল রাজী পাঠাগারের হল রুমে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। আল রাজী পাঠাগারের পরিচালক জনাব আতাহার আলী খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশনের (অব.) উপ পরিচালক ডা. মাসুদুর রহমান। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট আবদুর রাজ্জাক এবং সাতক্ষীরা জেলা হাসপাতালের চিকিৎসক ড. আব্দুল লতিফ।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে ডা. মাসুদুর রহমান বলেন, ইমাম খোমেইনীর সুযোগ্য নেতৃত্বে সংঘটিত ইসলামি বিপ্লবের বৈশ্বিক বড় অবদান হলো ইসলামি উম্মাহর ঐক্যের চেতনাকে শাণিত করা। ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উপলক্ষে ‘ইসলামি ঐক্য সপ্তাহ’ পালন এর একটি কার্যকরী প্রক্রিয়া।
ডা. আব্দুল লতিফ বলেন, ইমাম খোমেইনী সুদীর্ঘ ১৩ বছর ইরাক, তুরস্ক ও ফ্রান্সে নির্বাসনে থেকেই এই বিরাট বিপ্লবের নেতৃত্ব দিয়েছেন ও শাহের পতনের পর ইরানের জনগণকে নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শক্তি যুগিয়েছেন। তিনি বিপ্লবের বিগত ৩৮ বছরে ইরানে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও টেকনোলজির অভূতপূর্ব সাফল্যের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন।
অ্যাডভোকেট আবদুর রাজ্জাক তাঁর বক্তৃতায় বলেন, ইরানের ইসলামি বিপ্লবে জনগণের সর্বস্তরের সম্পৃক্ততা ছিল এ বিপ্লবের অনন্য বৈশিষ্ট্য। ধনী-দরিদ্র, নারী-পুরুষ, বুদ্ধিজীবী, সাধারণ শিক্ষিত সকলেই অংশগ্রহণ করেছেন। বিপ্লবের সময় মিছিলের অগ্রভাগে দেখা যেত শিশুদের কোলে নিয়ে মায়েদের ব্যাপক অংশগ্রহণ। তিনি বলেন, এ বিপ্লব ছিল মহানবী (সা.) ও তাঁর আহলে বাইতের আধ্যাত্মিক শিক্ষায় সিঞ্চিত, যে আহলে বাইতের শানে নামাযের শেষ বৈঠকে আমরা দরুদ পড়ে থাকি।

ফিলিস্তিনের সংগ্রাম শুধু মুসলিমদের নয়, বরং এটি সকলের অধিকারের সংগ্রাম- ড. সলিমুল্লাহ খান
যে কোন মূল্যে জেরুজালেমের অখ-তা রক্ষা করতে হবে। কারণ, এটি সকলের জন্য পবিত্র শহর। জেরুজালেম নিয়ে ফিলিস্তিনের সংগ্রাম শুধু মুসলিমদের নয়; বরং এটি সকলের অধিকারের সংগ্রাম; এটা মনে রাখতে হবে। গত ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় মডেল ওআইসি ক্লাব আয়োজিত ‘জেরুজালেম সংকট; সম্ভাব্য রাজনৈতিক সমাধান’ শীর্ষক এক অ্যাকাডেমিক সেমিনারে কী নোট ¯িপকার হিসেবে এসব কথা বলেন ‘সেন্টার ফর অ্যাডভান্স থিওরি’র পরিচালক ও ইউল্যাব বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সলিমুল্লাহ খান।
মডেল ওআইসি ক্লাবের সভাপতি এস এইচ এম মিনহাজ উদ্দীনের সভাপতিত্বে সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের কালচারাল কাউন্সেলর সাইয়্যেদ মূসা হোসেইনী। এতে আরো উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. এ টি এম শামসুজ্জোহা, সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনিস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুল ইসলাম।
সেমিনারে ড. সলিমুল্লাহ খান বলেন, জেরুজালেমের কোন অর্থনৈতিক গুরুত্ব না থাকলেও এর ধর্মীয় গুরুত্ব তাকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। এটি শুধু মুসলমানদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভাবলে ভুল হবে। বরং এটি হযরত ইবরাহীমের ধর্মের অনুসারী মুসলিম, খ্রিস্টান ও ইহুদি সকলের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি আরো বলেন, যায়নবাদীদের হাত থেকে জেরুজালেমকে দখলমুক্ত করার জন্য মুসলিম শক্তিসহ ওআইসি এবং আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোকে এক হতে হবে। আমি মনে করি, আন্তর্জাতিক খ্রিস্টান সম্প্রদায় সবসময় ফিলিস্তিনিদের সাথে আছে। তারাও চায় জেরুজালেমের ওপর যায়নবাদী কর্তৃত্বের অবসান ঘটুক। প্রসঙ্গক্রমে তিনি বলেন, ফিলিস্তিন হাতছাড়া হওয়ার ব্যাপারে আরব সুলতানদের ও ফিলিস্তিনের রাজনৈতিক নেতাদের ভূমিকাও কম নয়। তিনি বলেন, ওআইসিভুক্ত অধিকাংশ দেশেই রাজতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও সামরিকতন্ত্র বিদ্যমান, এ অবস্থায় তারা ফিলিস্তিন মুক্তিতে কতটুকু কার্যকর ভূমিকা রাখবেন! এসময় তিনি বলেন, তবে আশার কথা হলো ইসরাইল এখনো বিশ^জনমতকে গায়ের জোড়ে পাল্টাতে পারে নি। শুধু আরেকটি যুদ্ধ কখনোই জেরুজালেমের জন্য মঙ্গল ডেকে আনবে না; বরং শান্তির জন্য সমাধানে আসতে হবে।
তিনি জেরুজালেমের এক কিলোমিটার পবিত্র ভূমিকে আন্তর্জাতিক প্রতিনিধিদের হাতে হস্তান্তর করার প্রস্তাব করেন যেখানে ইহুদি, খ্রিস্টান ও মুসলিম সবার অংশীদারিত্ব থাকবে। এসময় জেরুজালেম সঙ্কটের জন্য তিনি ফিলিস্তিনি নেতাদের অদূরদর্শিতার কথাও উল্লেখ করেন।
প্রধান অতিথি হিসেবে সাইয়্যেদ মূসা হোসেইনী বলেন, ১৯৯৩ সালে ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠনের মধ্যে অসলো চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল এবং এই চুক্তির মাধ্যমে ইসরাইল ও ফিলিস্তিন দ্বন্দ্বের অবসান হওয়ার কথা ছিল। কথা ছিল এর মাধ্যমে জেরুজালেম বা বায়তুল মোকাদ্দাস পরিস্থিতি, ফিলিস্তিনের শরণার্থী সমস্যা, ইসরাইলি বসতি, নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও সীমানা নির্ধারণের মতো বিষয়ের একটা স্থায়ী সমাধান হওয়ার। কিন্তু ঐ চুক্তি স্বাক্ষরের ২৫ বছর পর বিশ্ব আজ ফিলিস্তিনের মাটিতে ইসরাইলের আগ্রাসন ও ইহুদিদের জন্য অতীতের চেয়ে আরো বেশি বসতি নির্মাণকেই প্রত্যক্ষ করছে। এবং পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, যে আমেরিকা ঐ চুক্তির প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিল সেই আমেরিকাই এখন জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী ঘোষণা করেছে এবং তাদের দূতাবাসকে তেলআবিব থেকে জেরুজালেমে স্থানান্তর করতে যাচ্ছে। অতএব, অসলো চুক্তির মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের যে আশার আলো দেখা দিয়েছিল তার পুরোটাই এখন ভেস্তে যেতে চলেছে।
ইস্তাম্বুল ফাউন্ডেশন ফর সায়েন্স অ্যান্ড কালচার এর প্রতিনিধি জনাব সালাউদ্দিন সায়েদী বলেন, ফিলিস্তিন মুক্ত করতে মুসলমানদের আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সামনে কার্যকরী পক্ষ হতে হলে জ্ঞানগত দীনতা, অর্থনৈতিক অক্ষমতা ও অনৈক্যের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

ঢাকায় আন্তর্জাতিক সুফি উৎসব

‘সম্প্রীতির জন্য সঙ্গীত’ প্রতিপাদ্যে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সুফি উৎসব সমাপ্ত হয় গত ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮। আল্লামা রুমি সোসাইটি ও হাটখোলা ফাউন্ডেশনের যৌথ এ আয়োজনের সহযোগিতায় ছিল সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়। রাজধানীর শিল্পকলা একাডেমির নন্দন মঞ্চে আয়োজিত তিন দিনব্যাপী এ উৎসবে অংশ নেয় বাংলাদেশ, ভারত, ইরান ও তুরস্কের শিল্পীরা। ১১৯ জন সুফি, লোকসঙ্গীত শিল্পী ও সাধক এ উৎসবে অংশ নেন। দেশের বাইরের অংশগ্রহণকারী দল ছিল পাঁচটি। ২৩ ফেব্রুয়ারি বিকেলে নন্দন মঞ্চে শুরু হয় উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। প্রতিদিন মূল অনুষ্ঠান শুরু হয় বিকেল ৫টায় ও শেষ হয় রাত ১০টায়।
সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ইব্রাহীম হোসেন খানের সভাপতিত্বে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। তিনি বলেন, হাজার বছর ধরে বিভিন্ন ধর্ম ও গোত্রের মানুষ মিলে আমরা এখানে বসবাস করছি। এই সম্প্রীতির বলে দেয় জাতি হিসেবে আমরা অসাম্প্রদায়িক। লালন, হাসন, রাধা রমণেরা সারা জীবন গানে গানে এই সম্প্রীতির বাণীই প্রচার করেছেন। এই সম্প্রীতিই সুফিবাদের মূল কথা। এরকম উদার চিন্তা ও আদর্শকে আমরা পৃথিবীর সামনে তুলে ধরতে চাই।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন ইরানের রাষ্ট্রদূত ড. আব্বাস ভায়েজী দেহনাভী ও তুরস্কের রাষ্ট্রদূত দেবরিম ওজতার্ক। স্বাগত বক্তব্য দেন শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী ও আল্লামা রুমি সোসাইটি বাংলাদেশের সভাপতি মো. আবদুল করিম।
প্রথম সন্ধ্যায় সঙ্গীত পরিবেশন করে মাইজভা-ারী মরমি গোষ্ঠী, পারভেজ, শফি ম-ল, সামির কাওয়াল, রাফাত সুফি ও এসআই টুটুল। রাফাত গেয়ে শোনান ‘মুসাফির মন’, ‘ধন্য ধন্য মেরা সিলসিলা’, পারভেজ শোনান ‘বারে বারে আর আসা হবে না’, ‘কেন বান্ধ দালান ঘর’, হাজী শাহ মো. সমীর হোসেনের দল গেয়ে শোনায় ‘চল রে চল কাফেলা বেঁধে’, ‘আলী আলী মওলা আলী’সহ আরও কিছু গান। বাউল শফি ম-ল ‘মন মন্দিরে পূজা দেব, নামায পড়ব দিল কাবায়’, ও ‘ঘরে কে বা জাগে কে বা ঘুমায়’ গান গেয়ে শোনান।
দ্বিতীয় দিন বেলা ৩টায় সুফিবিষয়ক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। এদিন সঙ্গীত পরিবেশন করেন শিল্পী পুলক, শিরিন, রাজ্জাক, কিরণ চন্দ্র রায়, চন্দনা মজুমদার, সুফি বাউরা, তুর্কি সুফি দল, টুনটুন বাউল ও হানিফ বাউল। উৎসবের শেষ সন্ধ্যায় আধ্যাত্মিক গান পরিবেশন করেন শিল্পী হায়দার, হারুন, ইকবাল হায়দার, দীপংকর, সুনীল কারাকার, সিরাজ বাউল, ইরানি সুফি দল যেরইয়ব, ভারতীয় রোহিনি সিস্টার্স ও জলের গান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের নবীন বরণ

গত ৭ ফেব্রুয়ারি বুধবার সকাল ১০টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের উদ্যোগে ২০১৭-২০১৮ শিক্ষাবর্ষে ভর্তিকৃত শিক্ষার্থীদের নবীনবরণ এবং ২০১৬-২০১৭ শিক্ষাবর্ষের এম.এ. (৭ম ব্যাচ)-এর শিক্ষার্থীদের বিদায় সংবর্ধনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকাস্থ ইরান দূতাবাসের মাননীয় রাষ্ট্রদূত ড. আব্বাস ভায়েজী দেহনাভী। ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আবুল কালাম সরকারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন ঢাকাস্থ ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের কালচারাল কাউন্সেলর সাইয়্যেদ মূসা হোসেইনী, বিভাগের অধ্যাপক ও এফ রহমান হলের প্রাধ্যক্ষ ড. কে. এম. সাইফুল ইসলাম খান, অধ্যাপক ড. কুলসুম আবুল বাশার মজুমদার। সভায় নবীন ও বিদায়ী শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে প্রতিনিধিত্বমূলক বক্তব্য প্রদান করেন যথাক্রমে লাবনী আক্তার ও জামিউল হাসান এবং সুমাইয়া সুলতানা। আলোচনা অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে বিদায়ী শিক্ষার্থীদের স্মারক ক্রেস্ট প্রদান করা হয় এবং নবীন ও বিদায়ী শিক্ষার্থীরা গ্রুপ ফটোসেশনে অংশ নেন।
প্রধান অতিথির বক্তৃতায় ড. আব্বাস ভায়েজী সমাজজীবনে ভাষা শিক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরে বলেন। তিনি বলেন, মাওলানা রুমীর মসনভী ফেরদৌসী। শাহরিয়ার, নিমাইউশিজ এর কবিতায় ও দিওয়ানে ইমাম খোমেইনীতে কবিতার মূল ভাষা হচ্ছে প্রেম। তিনি বলেন, ফারসি আধ্যাত্মিকতার ভাষা, প্রেম ও আত্মিক সমৃদ্ধির ভাষা। জীবনের সবক্ষেত্রে প্রেমের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রেম মানুষের অস্তিত্ব ও অবস্থানকে শক্তিশালী করে। প্রেমিক খোদার নেয়ামতের অস্তিত্বকে বুঝতে পারে, তাঁর শক্তিকে দেখতে পায় এবং তা থেকে সে উপকৃত হয়। তিনি কবি হাফিযের ‘লিসানুল গায়েব’ থেকে উদ্ধৃত করে বলেন, হাফিয বলেছেন, যার মধ্যে প্রেম নেই সে মৃত। তার নামাযও মৃত নামায। তিনি নবীন শিক্ষার্থীদের আগামী দিনের ফারসির সৈনিক হিসেবে আখ্যায়িত করে অভিনন্দন জানান।
স্বাগত বক্তব্যে অধ্যাপক ড. কে. এম. সাইফুল ইসলাম খান বলেন, ফারসি হলো মানবিকতা, দর্শন ও সংস্কৃতির ভাষা। তিনি বলেন, সাম্রাজ্যবাদী অপশক্তি জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির এই উন্নত ভাষার সম্প্রসারণে বাধার সৃষ্টি করে। তিনি বলেন, সমকালীন পৃথিবীতে সংস্কৃতির দ্রুত পরিবর্তনের মুখে আমাদের এই ভাষা ও সংস্কৃতির শক্তিশালী অবস্থান নিয়ে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে হবে।
জনাব সাইয়্যেদ মুসা হোসেইনী নবীন ও বিদায়ী শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলেন, সাহিত্য, দর্শন ও বিজ্ঞানের ইতিহাসে শীর্ষ ব্যক্তিদের পাঠ ও সংযোগ গড়ে তুলতে হলে ফারসি ভাষা একটি সমৃদ্ধ মাধ্যম। তিনি এ ক্ষেত্রে ইরানের পক্ষ থেকে সম্ভাব্য সবধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দেন। এক্ষেত্রে তিনি সুন্দর পরিকল্পনা নিয়ে ইরান সরকারের সহযোগিতায় কলা ভবনের হাফিয প্রাঙ্গনে নবগঠিত ল্যাঙ্গুয়েজ ল্যাব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাফিয প্রাঙ্গন লাইব্রেরী, ইরান স্টাডিজ রুম ও ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের লাইব্রেরির সদ্ব্যবহার করার আহ্বান জানান।
অধ্যাপক ড. কুলসুম আবুল বাশার বলেন, ফেব্রুয়ারি মাস ইরানে ইমাম খোমেইনীর নেতৃত্বে সংঘটিত ইসলামি বিপ্লব বিজয়ের মাস, আড়াই হাজার বছরের স্বৈরাচারী পাহলভী রাজবংশের পতনের মাস, আর বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে অর্জিত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মাস। তিনি বাংলাদেশের সর্বত্র ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার প্রশংসা করেন।
সভাপতির বক্তৃতায় অধ্যাপক ড. আবুল কালাম সরকার নবীন ও বিদায়ী শিক্ষার্থীদের দুটি গুরুত্বপূর্ণ পরিচয় নিয়ে স্ব স্ব ক্ষেত্রে উন্নত ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান। একটি হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো ঐতিহ্যবাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিত্ব ও অপরটি হলো ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের সমৃদ্ধ সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব।

স্মরণীয় দিবস

১ জানুয়ারি : ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ.) ১৯৮৯ সালের এ দিনে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচেভের কাছে এক ঐতিহাসিক চিঠি প্রদান করেন।
১০ জানুয়ারি : মীর্যা তাকী খান আমীর কাবীর এর শাহাদাত বার্ষিকী।
১২ জানুয়ারি : ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর নির্দেশে ইসলামি বিপ্লবী পরিষদ গঠন দিবস এর বার্ষিকী।
১৬ জানুয়ারি : ১৯৭৯ সালের এ দিনে ইরান থেকে রেযা শাহ পাহলভী পলায়ন করেন।
* নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহর ৯২তম মৃত্যুবার্ষিকী।
২৩ জানুয়ারি : হযরত ফাতেমা ও আলী (আ.)-এর কন্যা হযরত যায়নাব সালামুল্লাহ আলাইহার জন্মবার্ষিকী।
২৬ জানুয়ারি : বাংলা ভাষার সনেট কাব্যের জনক ও ‘মেঘনাদবধ’ মহাকাব্যের রচয়িতা মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্মবার্ষিকী।
২৯ জানুয়ারি : আততায়ীর গুলিতে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা মহাত্মা গান্ধী নিহত হন।
৩১ জানুয়ারি : নবীকন্যা হযরত ফাতেমা (আ.) এর ওফাত বার্ষিকী (একটি রেওয়ায়াত অনুযায়ী)
১ ফেব্রুয়ারি : দীর্ঘ ১৫ বছর নির্বাসনে থাকার পর ইসলামি বিপ্লব বিজয়ের প্রাক্কালে এ দিনে বিপ্লবের নেতা ইমাম খোমেইনী স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন।
৮ ফেব্রুয়ারি : ইরানে বিমান বাহিনী দিবস।
১১ ফেব্রুয়ারি : ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের বিপ্লবের বিজয়বার্ষিকী। ইরানে আড়াই হাজার বছরের রাজতন্ত্রের পতন।
১৪ ফেব্রুয়ারি : মহানবী (সা.), অন্যান্য নবী (আ.) এবং পবিত্র ধর্মগ্রন্থ সম্পর্কে অবমাননাকর উক্তি করার দায়ে ১৯৮৯ সালের এ দিনে ইমাম খোমেইনী সালমান রুশদীর মৃত্যুদণ্ডের ফতোয়া প্রদান করেন।
২০ ফেব্রুয়ারি : নবীকন্যা হযরত ফাতিমা (আ.)-এর শাহাদাত দিবস (একটি রেওয়ায়াত অনুযায়ী)।
২১ ফেব্রুয়ারি : আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ১৯৫২ সালের এ দিনে বাংলা ভাষা আন্দোলনে শহীদ হন সালাম, বরকত, রফিক, জাব্বার, শফিকসহ বেশ কয়েকজন বাঙালি তরুণ।
২৪ ফেব্রুয়ারি : খাজা নাসিরউদ্দিন তূসী স্মরণে দিবস। এটি ইরানে প্রকৌশল দিবস হিসেবেও উদযাপিত  হয়।

স্মরণীয় বাণী

 

মহানবী (সা.) বলেন : যে ব্যক্তি মানুষের সাথে লেনদেন করে এবং তাদের প্রতি অন্যায় করে না, তাদের সাথে কথা বলে এবং মিথ্যাচার করে না আর তাদের সাথে অঙ্গীকার করে এবং তা ভঙ্গ করে না সে হলো এমন ব্যক্তি যার পৌরুষত্ব পূর্ণতাপ্রাপ্ত এবং তার ন্যায়পরায়ণতা প্রকাশ পেয়েছে এবং তার প্রতিদান অপরিহার্য হয়েছে আর তার গীবত নিষিদ্ধ হয়েছে।
মহানবী (সা.) হযরত আলী (আ.)-কে বলেন : হে আলী! কথার রোগ হলো মিথ্যা আর জ্ঞানের রোগ বিস্মৃতি, ইবাদতের রোগ অলসতা, দানের রোগ করুণা দেখানো ও এজন্য গর্ব করা, সাহসিকতার রোগ অত্যাচার, সৌন্দর্যের রোগ অহঙ্কার আর বংশের রোগ বড়াই।
মহানবী (সা.) বলেন : বিপদগ্রস্তদের বিচ্যুতিসমূহকে মার্জনা কর।
মহানবী (সা.) বলেন : তোমাদের আত্মীয়তার সম্পর্ককে জোড়া লাগাও, এমনকি যদি সালাম প্রদানের মাধ্যমেও হয়।
মহানবী (সা.) বলেন : নিশ্চয় আল্লাহ্ যখন তাঁর বান্দাকে নেয়ামত দান করেন তখন তার ওপর সে নেয়ামতের প্রভাব দেখতে পছন্দ করেন। আর জীবনের মন্দত্ব ও মন্দভাবে জীবনযাপন করাকে ঘৃণা করেন।
মহানবী (সা.) বলেন : আল্লাহ্ তাঁর বান্দাদের মধ্যে কিছু বান্দাকে সৃষ্টি করেছেন মানুষের উপকারের জন্য। তারা পরোপকারে তৃপ্তি লাভ করে এবং দানশীলতাকে মহত্ত্বের কাজ বলে মনে করে। আর আল্লাহ্ উত্তম চরিত্রকে পছন্দ করেন।
মহানবী (সা.) বলেন : মুমিন যে কোনো বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হতে পারে তবে কখনই মিথ্যা এবং বিশ্বাসঘাতকতার বৈশিষ্ট্য তার মধ্যে থাকতে পারে না।
মহানবী (সা.) বলেন : সেই ব্যক্তি কোরআনের প্রতি ঈমান আনে নি যে তার হারামকে হালাল গণ্য করে।
ইমাম আলী (আ.) বলেন : সকল কল্যাণ নিহিত রয়েছে তিনটি জিনিসের মধ্যে : দৃষ্টিপাত করা, নীরব থাকা এবং কথা বলা। যে দৃষ্টিপাতের মধ্যে শিক্ষা নেই তা ভ্রান্ত। আর যে নীরবতার মধ্যে অনুধ্যান নেই তা উদাসীনতা। আর যে কথার মধ্যে যিকির (আল্লাহ্্র স্মরণ) নেই তা অনর্থক। ধন্য সেই ব্যক্তি যার দৃষ্টিপাত শিক্ষার হয়, যার নীরবতা অনুধ্যানের হয় আর যার কথা যিকির হয়। আর যে স্বীয় ভুলের জন্য ক্রন্দন করে এবং মানুষ যার অনিষ্ট থেকে নিরাপদ থাকে।
ইমাম আলী (আ.) বলেন : গোনাহের মধ্যে ডুবে থেকে ইস্তিগফার করা নিজেই আরেকটি নতুন গোনাহের কাজ।
ইমাম আলী (আ.) বলেন : সবচেয়ে বড় অপরাধ হলো মুসলমানের সম্পদ অন্যায়ভাবে হস্তগত করা।
ইমাম জাফর সাদিক (আ.) বলেন : কর্ম ও আচরণ দুই ধরনের। একটি নিয়ত থেকে উৎসারিত এবং অপরটি স্বভাববশত। বলা হলো : কোনটি উত্তম? তিনি বললেন : যেটি নিয়ত থেকে উৎসারিত। কারণ, যে স্বভাববশত ভালো কাজ করে সে তাতে প্রকৃিতস্থ হয়েছে, তা ভিন্ন অন্য কাজ করতে পারে না। আর যে নিয়তের অধিকারী সে আনুগত্যে ধৈর্যধারণ করে। আর এটা হলো শ্রেয়তর।
ইমাম জাফর সাদিক (আ.)-কে বলা হলো : পৌরুষ কী? উত্তরে তিনি বলেন : আল্লাহ্ যেখানে তোমাকে নিষেধ করেছেন সেখানে যেন না দেখেন আর যেখানে তোমাকে আদেশ দিয়েছেন সেখানে যেন অনুপস্থিত না দেখেন।
ইমাম আলী ইবনে মূসা আর রেযা (আ.) বলেন : কোনো বান্দাই প্রকৃতপক্ষে ঈমানের পূর্ণতায় পৌঁছতে পারবে না যতক্ষণ না তিনটি গুণের অধিকারী হবে : দীনে গভীর জ্ঞান, জীবন-জীবিকায় পরিমিতি এবং বিপদে ধৈর্যধারণ।

(তুহাফুল উকূল থেকে সংকলিত)
অনুবাদ : আব্দুল কুদ্দুস বাদশা

সংবাদ বিচিত্রা

‘জনগণের এই বিশাল উপস্থিতি শত্রুদের জন্য কঠোর জবাব’ : রাহবার

ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী বলেছেন, ইসলামি বিপ্লবের ৩৯তম বিজয় বার্ষিকীর সমাবেশে জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণ বিদেশি শত্রুদের জন্য চরম জবাব।
বিপ্লব বার্ষিকীর সমাবেশে জনগণের ব্যাপক উপস্থিতি ও অংশগ্রহণকে মহান এবং চোখ ধাঁধাঁনো ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করে গত ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ তিনি বলেন, ‘আপনাদের এই বিশাল মহিমান্বিত উপস্থিতি যা আগের বছরগুলোর তুলনায় অনেক বেশি তা বিদেশি শত্রু ও যারা দুর্বল বিশ্বাস নিয়ে ছিল তাদের জন্য কঠোর এবং নিশ্চিত জবাব।’
সর্বোচ্চ নেতা বলেন, ‘আপনারা এই বিশাল উপস্থিতির মাধ্যমে শত্রুদেরকে বাস্তবেই বিপ্লবের উজ্জ্বলতা ও গতিশীলতা দেখিয়ে দিয়েছেন এবং আপনারা নানা স্লোগানের মাধ্যমে মরহুম ইমামের আদর্শের ওপর অটল থাকার প্রতিশ্রুতির কথা জানিয়ে দিয়েছেন।’
ইরানের জনগণের এই অনন্য বিষয়টিকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করার জন্য সরকারি কর্মকর্তাদের প্রতি সর্বোচ্চ নেতা আহ্বান জানান। তিনি বলেন, পূর্ণ দৃঢ়তা ও বিপ্লবী চেতনা নিয়ে ইরানের জনগণের সেবা দিতে হবে। পাশাপাশি বিপ্লবের আদর্শকে রক্ষা করতে হবে। সর্বোচ্চ নেতা  সুস্পষ্ট করে বলেন, ‘সতর্কতা ও দূরদৃষ্টিতার ওপর নির্ভর করছে আমাদের ভবিষ্যৎ।’

ইরানের সহযোগিতায় গোটা মধ্যপ্রাচ্য সন্ত্রাসবাদ থেকে মুক্তি পেয়েছে : ড. রুহানি

ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রেসিডেন্ট ড. হাসান রুহানি বলেছেন, ইরানের সহযোগিতায় মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য জাতিও সন্ত্রাসীদের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। ইরানের রাজধানী তেহরানে ইসলামি বিপ্লব বার্ষিকীর বিশাল সমাবেশে তিনি এ কথা বলেন।
ড. রুহানি আরও বলেন, ইরান সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে বিজয় অর্জন করেছে। আমাদের আশেপাশের দেশগুলোতে সন্ত্রাসীরা যেখানে ইচ্ছা প্রবেশ করে মানুষ হত্যা করেছে। কিন্তু তারা ইরানের সীমান্তে এসে গোয়েন্দা মন্ত্রণালয়ের লোকজন এবং ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী আইআরজিসি’র কাছে ধরাশায়ী হয়েছে।
ইরানের প্রেসিডেন্ট বলেন, ইরাক ও সিরিয়ার মানুষের প্রতি ইরানিরা সহযোগিতার যে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল তা সাফল্য ছিনিয়ে এনেছে। মধ্যপ্রাচ্যের মানুষেরা সন্ত্রাসবাদের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে।
বিপ্লব বার্ষিকীর সমাবেশে তিনি আরও বলেন, ‘আমরা বিশ্বকে এটা জানিয়ে দিয়েছি যে, আমরা শক্তিশালী। আমরা নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছি এবং সঠিক পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছি।’
ফিলিস্তিন ও বায়তুল মুকাদ্দাসের বিরুদ্ধে মার্কিন ষড়যন্ত্রের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, গোটা বিশ্ব আমেরিকার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। শুধু মুসলিম দেশ নয়, জাতিসংঘের গুটি কয়েক দেশ ছাড়া আর সবাই সাধারণ পরিষদে ওই ষড়যন্ত্রের বিরোধিতা করেছে।
ইরানের প্রেসিডেন্ট বলেন, ষড়যন্ত্রকারীরা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে খণ্ড-বিখণ্ড- করতে চায়। ইরাকি জাতির সচেতনতা ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সহযোগিতার কারণে ইরানের বন্ধুপ্রতিম দেশগুলোর অখ-তা নিশ্চিত হয়েছে। লেবানন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, জনগণের সচেতনতা ও মিত্র দেশগুলোর সহযোগিতার কারণে লেবাননেও আমেরিকা ও ইহুদিবাদী ইসরাইলের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার বিষয়ে বহুপক্ষীয় আলোচনায় ইরানের সাফল্য তুলে ধরে তিনি বলেন, মধ্যপ্রাচ্য সমস্যার সমাধান করতে হবে রাজনৈতিক উপায়ে এবং অন্যান্য দেশের সহযোগিতায় গোটা মধ্যপ্রাচ্যে নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।
ইরানের প্রেসিডেন্ট বলেন, আমেরিকা ইরানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে চায়। কিন্তু ইরানের জনগণ ঐক্য, সংহতি ও দৃঢ়তার মাধ্যমে তাদের ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দিয়েছে। ইরানের পরমাণু সমঝোতার বিরুদ্ধে মার্কিন ষড়যন্ত্র প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমেরিকা এ পর্যন্ত কয়েক বার আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক এ সমঝোতাকে ধ্বংসের চেষ্টা করেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সফল হয় নি।
তারা যদি পরমাণু সমঝোতা থেকে বেরিয়ে যেতে চায় তাহলে স্বল্প সময়ের মধ্যেই ক্ষতির শিকার হবে।

ইরানে ইসলামি বিপ্লবের ৩৯তম বার্ষিকী উদযাপিত

ইসলামি বিপ্লবের ৩৯তম বার্ষিকী উপলক্ষে তেহরানের ঐতিহাসিক আজাদি চত্বরে জনসমাবেশ এবং শোভাযাত্রা হয়েছে। প্রতি বছরের মতো গত ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ এতে ব্যাপক জনসমাগম হয়। ইরানের ইসলামি বিপ্লবের শত্রুদের বিরুদ্ধে এখান থেকে বজ্র কণ্ঠে স্লোগান উচ্চারিত হয়েছে।
এ চত্বরে ভাষণ দেন ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি। তাঁর ভাষণের আগে আজাদি চত্বরে হেলিকপ্টার থেকে অবতরণ করেন ইরানি প্যারাট্রুপারের একটি দল। নামার সময় এক ছত্রী সেনার সাথে ছিল অতি বিশাল এক ইরানি পতাকা। কেউ কেউ নেমে আসতে আসতে উড়িয়েছেন রঙ্গিন ধূম্রজাল। ছত্রী সেনারা নিপুণ দক্ষতায় অবতরণের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ প্রাণঢালা করতালি দিয়ে তাঁদেরকে বরণ করেন। এ ছাড়া, তাঁদের সাথে সেলফি তুলতে ভিড় জমাতে দেখা গেছে। মানুষের এ ভালবাসার আবদারে হাসিমুখেই সাড়া দিয়েছেন ছত্রীসেনারা।
ইরানের জনগণ আবারো জানিয়ে দিল ৩৯ বছর পরেও বিপ্লবের চেতনা এখনো সতেজ আছে। মানুষ এখনো বিপ্লবের পথেই হাঁটছে।

পশ্চিমা বিপজ্জনক অপপ্রচার রুখে দিন : ইরানের সর্বোচ্চ নেতা

ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী বলেছেন, ইহুদিবাদীদের নেতৃত্বে পশ্চিমা শক্তিগুলো বিপজ্জনক প্রচারণাযুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে। তাদের এই অপপ্রচারকে রুখে দিতে তিনি মুসলিম বিশ্বের প্রতি আহ্বান জানান।
ইরানের রাজধানী তেহরানে অনুষ্ঠিত ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা বা ওআইসিভুক্ত দেশগুলোর ১৩তম আন্তঃসংসদীয় সম্মেলনে অংশ নেয়া প্রতিনিধিদের উদ্দেশে সর্বোচ্চ নেতা গত ১৬ জানুয়ারি একথা বলেন। এ সম্মেলনে বিশ্বের বহু মুসলিম দেশের স্পিকার ও গুরুত্বপূর্ণ শীর্ষ পর্যায়ের সংসদ সদস্য যোগ দেন।
সর্বোচ্চ নেতা প্রতিনিধিদের উদ্দেশে বলেন, ‘চুপ থাকার ষড়যন্ত্র’ মোকাবেলা করতে হবে। তিনি বলেন, নীরবতার আরেক নাম হচ্ছে মুসলিম বিশ্বের প্রধান সমস্যা ফিলিস্তিন ইস্যু চেপে রাখা। তিনি সতর্ক করে বলেন, ফিলিস্তিনি ইস্যুকে আন্তর্জাতিক সমাজ প্রায় একেবারেই উপেক্ষা করছে।
ইয়েমেন ও বাহরাইন সমস্যা সমাধানের জন্য ইরানের সর্বোচ্চ নেতা মুসলিম দেশগুলোর সহযোগিতা চান। তিনি বলেন, মুসলিম বিশ্বের জন্য এ দুটি ইস্যুও গুরুত্বপূর্ণ। মৌলিক ইস্যুগুলোতে মুসলিম বিশ্বের ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নেয়া জরুরি বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করুন : ওআইসি’র সংসদীয় সম্মেলনের আহ্বান
ইহুদিবাদী ইসরাইলের সঙ্গে কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার আহ্বানের মধ্য দিয়ে ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা বা ওআইসি’র ১৩তম আন্তঃসংসদীয় সম্মেলন গত ১৮ জানুয়ারি ২০১৮ শেষ হয়েছে। ইরানের রাজধানী তেহরানে অনুষ্ঠিত এ সম্মেলনে বিশ্বের ৪০ মুসলিম দেশের স্পিকার ও শীর্ষ পর্যায়ের আইনপ্রণেতারা অংশ নেন।
সম্মেলনের চূড়ান্ত ঘোষণায় ন্যায়বিচার, গণতন্ত্র ও সবার কল্যাণ সাধনের মতো উচ্চতর মূল্যবোধের ভিত্তিতে মুসলমান এবং সমস্ত মানবজাতির অভিন্ন ইস্যুগুলোকে সমাধানের প্রচেষ্টা চালানোর আহ্বান জানানো হয়েছে। চূড়ান্ত ঘোষণা পড়ে শোনান ইরানের জাতীয় নিরাপত্তা ও পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক সংসদীয় কমিটির প্রধান আলাউদ্দিন বোরুজেরদি।
ঘোষণায় আরো বলা হয়েছে, একদিকে ন্যায়বিচার, শান্তি ও নিরাপত্তা এবং অন্যদিকে টেকসই উন্নয়ন- এগুলো পর¯পরের খুঁটি। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর উচিত এ দুটি বিষয়কে এজেন্ডার শীর্ষে রাখা।
চূড়ান্ত ঘোষণায় সন্ত্রাসবাদের নিন্দা জানিয়ে এ সমস্যা দূর করার জন্য সরকারগুলোর মধ্যে সহযোগিতা বাড়ানোর আহ্বান জানানো হয়েছে। পাশাপাশি ইরাক ও সিরিয়ায় উগ্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠী দায়েশের পতনকে স্বাগত জানানো হয়। দায়েশবিরোধী লড়াইয়ে অংশগ্রহণকারী মুসলিম দেশগুলো বিশেষ করে ইরানের প্রশংসা করা হয়েছে।
বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সংলাপ অনুষ্ঠানের আহ্বান জানানোর পাশাপাশি সন্ত্রাসবাদ, চরমপন্থার বিরুদ্ধে লড়াই, ইসলাম স¤পর্কে সত্যিকার ধারণা সৃষ্টি এবং সহিংসতাকে প্রত্যাখ্যান করারও আহ্বান জানানো হয়। এছাড়া, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিভিন্ন সময় যেসব বর্ণবাদী বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন তারও তীব্র নিন্দা জানিয়েছে এ সম্মেলন।
ফিলিস্তিনের পবিত্র বায়তুল মুকাদ্দাসকে ইহুদিবাদী ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার মার্কিন ঘোষণারও প্রতিবাদ ও নিন্দা জানানো হয়েছে। মার্কিন এ পদেক্ষপকে আন্তর্জাতিক শান্তি এবং নিরাপত্তার জন্য চরম হুমকি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বিশেষ করে ওআইসিভুক্ত দেশগুলোর বিরুদ্ধে মার্কিন একতরফা পদক্ষেপকে প্রত্যাখ্যান করেছে এ সম্মেলন।

তেহরানে প্রথম এশীয় সাংস্কৃতিক সংলাপ সম্মেলনের অভিমত : সাংস্কৃতিক সহযোগিতায় নৈতিক ও আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ গুরুত্বপূর্ণ প্রেক্ষিত

এশিয়া মহাদেশের শীর্ষস্থানীয় শিক্ষাবিদ, চিন্তাবিদ সাংস্কৃতিক বিশেষজ্ঞগণ অভিমত ব্যক্ত করেন যে, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে যোগাযোগ ও সহযোগিতার ক্ষেত্রে নৈতিক ও আধ্যাত্মিক মূল্যবোধসমূহ গুরুত্বপূর্ণ প্রেক্ষিত। গত ১৩ থেকে ১৫ জানুয়ারি (২০১৮) তেহরানের আল্-যাহ্রা হোসেনীয়ায় ‘সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য : আন্তঃক্রিয়া, সমচিন্তা ও সহযোগিতার অবকাশ ও ধারক’ স্লোগান সহকারে অনুষ্ঠিত প্রথম এশীয় সাংস্কৃতিক সংলাপ সম্মেলনে এ অভিমত ব্যক্ত করা হয়।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের ইসলামি সংস্কৃতি ও যোগাযোগ সংস্থা (আইসিআরও)-এর প্রধান আবূ ইবরাহীমী র্তোকামানের উদ্বোধনী ভাষণের মধ্য দিয়ে সূচিত ‘এশীয় সাংস্কৃতিক সংলাপ, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও সহযোগিতা’ শীর্ষক এ সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী অন্যান্য শীর্ষস্থানীয় ইরানি কর্মকর্তার মধ্যে ছিলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রী মোহাম্মাদ জাওয়াদ্ যারীফ্, সংস্কৃতি ও ইসলামি নির্দেশনা বিষয়ক মন্ত্রী সাইয়্যেদ আব্বাস ছালেহী এবং বিজ্ঞান, গবেষণা ও প্রযুক্তি বিষয়ক মন্ত্রী মানছূর গোলামী।
এশিয়া মহাদেশের বিশটিরও বেশি দেশের প্রতিনিধিগণ এ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। এতে অংশগ্রহণকারী বিশিষ্ট বিদেশি মেহমানদের অন্যতম ছিলেন ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা দ্বীন্ শামসুদ্দীন- যিনি উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন। এছাড়া ইস্তাম্বুল বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের প্রধান মুস্তাফা আয়দীন্, তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর মাহ্মূদ নীলী, ঢাকার সাউথ-ইস্ট ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর মেশকাত উদ্দিন প্রমুখ বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, চিন্তাবিদ ও সাংস্কৃতিক বিশেষজ্ঞগণ এতে অংশগ্রহণ করেন।
ইসলামি সংস্কৃতি ও যোগাযোগ সংস্থা (আইসিআরও)-এর উদ্যোগে এবং তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়, মাশ্হাদের ফেরদৌসী বিশ্ববিদ্যালয়, বাবুলর্সা-এর মাযেন্দারান বিশ্ববিদ্যালয়, অর্থনৈতিক যোগাযোগ সংস্থা (ইসিও)-র কালচারাল ইনস্টিটিউট ও এশিয়ান কোঅপারেশন ডায়লগ সেন্টার-এর সহযোগিতায় এ সম্মেলন আয়োজিত ও পরিচালিত হয়।
উল্লেখ্য, গত বছর মালয়েশিয়া, ভারত ও কাযাকিস্তানে অনুষ্ঠিত যথাক্রমে পূর্ব এশিয়া, ভারত উপমহাদেশ এবং মধ্য এশিয়া ও ককেসাস অঞ্চলের সাংস্কৃতিক সংলাপ সম্মেলনের ধারাবাহিকতায় ঐ সব সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের উদ্দেশ্যে তেহরানে এ তিন দিনব্যাপী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট তিনটি কমিশন তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়, মাশহাদ বিশ্ববিদ্যালয় ও মাযেন্দারান বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈঠকে মিলিত হয়।
এ সম্মেলনে অভিমত ব্যক্ত করা হয় যে, এশিয়া মহাদেশের দেশসমূহের মধ্যে সাংস্কৃতিক সহযোগিতা এ মহাদেশে শান্তি ও সহযোগিতার পথ উন্মুক্ত করে দেবে এবং সেই সাথে জাতিসমূহের মধ্যে একটি শান্তি ও বন্ধুত্বের সংস্কৃতি গড়ে তোলার জন্যও ক্ষেত্র প্রস্তুত করবে। এতে আরো অভিমত ব্যক্ত করা হয় যে, সমাজের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের ও চিন্তাবিদগণের মধ্যে সাংস্কৃতিক সংলাপের জন্য অব্যাহত প্রচেষ্টা চালানো সন্দেহাতীতভাবেই অভিন্ন সমঝোতা গড়ে তোলার ও আঞ্চলিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিরাজমান চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবিলার ক্ষেত্রে সঠিক পন্থা উদ্ভাবনের অন্যতম উপায়।
সম্মেলনের কমিশনসমূহের এবং অংশগ্রহণকারী শিক্ষাবিদ ও চিন্তাবিদগণের পক্ষ থেকে আরো যেসব বিষয়ের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয় তার মধ্যে নিম্নলিখিত বিষয়সমূহ অন্যতম : শীর্ষস্থানীয় সাংস্কৃতিক ব্যক্তিদের (cultural elites) মধ্যে সংলাপ ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে সংযোগ ও অভিন্ন উত্তরাধিকার অন্যতম ভিত্তি। এশিয়া মহাদেশে বিরাজমান সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের মধ্যে আন্তঃক্রিয়া ও সহযোগিতার সম্ভাবনা নিহিত। নৈতিক ও আধ্যাত্মিক মূল্যবোধসমূহ যোগাযোগ ও সহযোগিতার ক্ষেত্রে একটি যথোপযোগী ভিত্তি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। সাংস্কৃতিক বন্ধন শক্তিশালীকরণে ভাষার ক্ষেত্রে অভিন্ন উপাদানসমূহের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। সহিংসতা ও চরম পন্থা মোকাবিলার ক্ষেত্রে অভিন্ন মূল্যবোধসমূহ, আধ্যাত্মিকতা ও মরমীবাদের প্রতি মনোযোগ একটি যথোপযোগী পন্থা হতে পারে। সাংস্কৃতিক সম্পর্ক শক্তিশালী করণে ও উন্নয়নে জ্ঞান-বিজ্ঞানের ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানাদির সামর্থ্যকে কাজে লাগানো জরুরি।
উল্লেখ্য, ইতিপূর্বে ২০১১ সালে ‘এশিয়া মহাদেশের ধর্মসমূহ ও সংস্কৃতিসমূর্হে মধ্যে সংলাপ’ শীর্ষক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবার পর এশিয়া মহাদেশের বিভিন্ন অংশে এতদসংশ্লিষ্ট বেশ কয়েকটি সভা ও সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এগুলোর মধ্যে ছিল মালয়েশিয়া, ভারত, কাযাকিস্তÍান, চীন ও তুরস্কে অনুষ্ঠিত সংলাপ সম্মেলন। এসব সভা ও সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহ চূড়ান্তকরণ ও বাস্তবায়নই ছিল এবার তেহরানে অনুষ্ঠিত সম্মেলনের মূল লক্ষ্য।

ইরানের সর্বোচ্চ নেতার কাছে হামাসের চিঠি

ফিলিস্তিনের ইসলামি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসের শীর্ষ নেতা ইসমাইল হানিয়া ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ীর কাছে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন। ফিলিস্তিনের পবিত্র বায়তুল মুকাদ্দাস ইস্যুতে ইরানের অবস্থানের প্রশংসা করে তিনি এ চিঠি লেখেন বলে রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা ইরনা গত ১৮ জানুয়ারি জানায়।
বায়তুল মুকাদ্দাস ইস্যুতে ‘দৃঢ় ও মূল্যবান’ অবস্থান নেয়ার কারণে ইসমাইল হানিয়া ফিলিস্তিনি জনগণের পক্ষ থেকে ইরানের প্রশংসা করেন। পাশাপাশি হামাসের প্রতি ইরানি জনগণের সমর্থন ও সর্বোচ্চ নেতার দিক নির্দেশনার জন্য ধন্যবাদ জানান তিনি।
বায়তুল মুকাদ্দাসের বিরুদ্ধে বলদর্পী শক্তিগুলোর বড় রকমের ষড়যন্ত্রের কথা উল্লেখ করে ইসমাইল হানিয়া বলেন, গাজা উপত্যকাকে যুদ্ধে জড়িয়ে দেয়ার জন্য এই ষড়যন্ত্র করা হয় যাতে ইহুদিবাদী ইসরাইল-বিরোধী প্রতিরোধ আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়ে এবং তেল আবিবের সঙ্গে আঞ্চলিক পুতুল সরকারগুলোর স¤পর্ক স্বাভাবিক হয়।
রিয়াদ সম্মেলনে হামাস, হিজবুল্লাহ ও ইরানকে শত্রু হিসেবে উল্লেখ করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যে বক্তব্য দিয়েছিলেন তার উল্লেখ করে ইসমাইল হানিয়া বলেন, সাম্প্রতিক ঘটনাবলিতে ট্রাম্পের অসদুদ্দেশ্য আরো পরিষ্কার হয়ে গেছে।

শিক্ষা ক্ষেত্রে ইরানের সঙ্গে সহযোগিতা বাড়াতে চায় সাউথ ইস্ট ইউনিভার্সিটি

ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সঙ্গে শিক্ষা ক্ষেত্রে সহযোগিতা আরও জোরদারের আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশের সাউথ ইস্ট ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর ড. এ এন এম মেশকাত উদ্দিন। তিনি বলেছেন, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিক্ষা ক্ষেত্রে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা আরও বৃদ্ধি করা উচিত।
ড. মেশকাত উদ্দিন সাংবাদিকদের আরও বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ইরানের সঙ্গে বাংলাদেশের সহযোগিতামূলক স¤পর্ক রয়েছে। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ইরানের স¤পর্ক সন্তোষজনক পর্যায়ে।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে অবস্থিত ইরানের দূতাবাস ও কালচারাল সেন্টার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে খুবই ভালো সম্পর্ক ও সহযোগিতা গড়ে তুলেছে। সেখানে ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ চালু রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও বাংলাদেশের আরও কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ চালু রয়েছে।

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য ১৪ সদস্যের চিকিৎসক টিম পাঠাল ইরান

ইরানের ইসফাহান প্রদেশের রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি নির্যাতিত রোহিঙ্গা মুসলমানদের চিকিৎসা সুবিধা দিতে ১৪ সদস্যের একটি চিকিৎসক টিমকে বাংলাদেশে পাঠিয়েছে। ইসফাহান রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহসেন মোমেনি গত ১৫ জানুয়ারি এ তথ্য জানান।
তিনি আরো বলেন, ইরানের এ টিমে চিকিৎসক ও নার্সের পাশাপাশি স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, পুষ্টি বিশেষজ্ঞ, মনোবিজ্ঞানী এবং শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ রয়েছেন।
মোমেনি জানান, বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা মুসলমানদের চিকিৎসা সুবিধা দেয়ার জন্য আন্তর্জাতিক রেডক্রস যে আহ্বান জানিয়েছে তাতে সাড়া দিয়ে ১৪ সদস্যের এ টিম পাঠিয়েছে ইরান। এই টিম ৪৫ দিন বাংলাদেশে অবস্থান করবে বলেও তিনি জানান।
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর পাশবিক গণহত্যা থেকে রক্ষা পেতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য ইরান এ পর্যন্ত ১৩০ টন সাহায্যসামগ্রী পাঠিয়েছে।
মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যে দেশটির সেনাবাহিনী ও উগ্র বৌদ্ধদের ভয়াবহ দমন অভিযানে হাজার হাজার রোহিঙ্গা মুসলমান নিহত ও আট লাখের বেশি মানুষ পালিয়ে প্রতিবেশী বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। এসব শরণার্থীর বেশিরভাগ অপুষ্টিতে ভোগার পাশাপাশি বিপর্যয়কর স্বাস্থ্য পরিস্থিতিতে বসবাস করছেন।

ইরানের জলবিদ্যুত খাতে বিদেশি বিনিয়োগ ৮.২ বিলিয়ন ডলার

ইরানের জলবিদ্যুত খাত ৮ দশমিক ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করেছে। ইরানের ছয় বিশ্বশক্তির সঙ্গে স্বাক্ষরিত পারমাণবিক চুক্তি বাস্তবায়নের ফলশ্রুতিতে দেশটির জলবিদ্যুত খাতে এই বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট হয়েছে। দেশটির জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের এক পরিসংখ্যানে এই চিত্র উঠে এসেছে।
বিশ্ব শক্তিগুলোর সঙ্গে ইরানের পারমাণবিক চুক্তি স্বাক্ষরের পর দেশটির ওপর থেকে অবরোধ প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়, যা ইরানের অর্থনীতিতে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্টের পথ প্রশস্ত করে। এরই ধারাবাহিকতায় দেশটির পানি ও বিদ্যুত খাতে ৮ বিলিয়ন ডলারের অধিক বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট হয়েছে।
ইরানের জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের এই পরিসংখ্যানে আরও দেখা যায়, গত গ্রীষ্মকালের শেষে মন্ত্রণালয়ের ১১তম প্রশাসনের শুরু থেকে ৪ বিলিয়ন ডলারের অধিক মূল্যের বিভিন্ন প্রকল্প কর্মক্ষম হয়েছে। এতে ৫ হাজার ১৩৮ মেগাওয়াট বিদ্যুত দেশটির জাতীয় গ্রিডে যোগ হয়েছে।
এছাড়াও এ খাতে ১৩ দশমিক ৭২ বিলিয়ন ডলারের দেশীয় ও বিদেশি বিনিয়োগের জন্য আলোচনা চলছে এবং এ সংক্রান্ত চুক্তিগুলো চূড়ান্ত হওয়ার পথে। এসব চুক্তি বাস্তবায়িত হলে দেশটির বিদ্যুত কেন্দ্রগুলোতে নতুন করে ৩ হাজারের অধিক মেগাওয়াট বিদ্যুত যুক্ত হবে।

খনিজ সম্পদে বিশ্বের দশ শীর্ষস্থানীয় দেশের অন্যতম ইরান

ইরানের খনিজ শিল্প এবং খনি নবায়ন ও উন্নয়ন সংস্থার প্রধান মাহদি কারবাসিয়ান বলেছেন, তাঁর দেশ খনিজ সম্পদের রিজার্ভের দিক থেকে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় দশটি দেশের অন্যতম। ইরানের ইস্পাহানে খনি ও খনিজ শিল্প বিভাগের এক সমাবেশে তিনি গত ২৫ জানুয়ারি এ তথ্য জানান।
তামা, সোনা, ক্রোমাইট ও পাথুরে কয়লাসহ নানা ধরনের খনিজ সম্পদের ইরানি রিজার্ভ বা মজুদের পরিমাণ প্রায় পাঁচ হাজার কোটি ডলার মূল্যের সমান বলে কারবাসিয়ান জানান।
ইরানে ৬৮ ধরনের খনিজ সম্পদ রয়েছে এবং ইসলামী এই দেশটিতে এ পর্যন্ত প্রায় ছয় হাজার কোটি টন পরিমাণের খনিজ সম্পদ চিহ্নিত করা হয়েছে। বিশ্বের প্রায় সাত শতাংশ খনিজ সসম্পদ রয়েছে ইরানে।

ইরানের নয়নাভিরাম কেশম দ্বীপে ভিসা ছাড়াই ভ্রমণ

ইরানের দক্ষিণাঞ্চলীয় হরমুযগান প্রদেশের সবচেয়ে বড় দ্বীপ কেশমে এখন থেকে ভিসামুক্ত ভ্রমণ করতে পারবেন বিশ্বের ১৮০ দেশের পর্যটকরা। বিদেশি কোনো পর্যটক নীলাভ সাগরের কোলে জেগে ওঠা দ্বীপটিতে ঘুরতে চাইলে ভ্রমণের আগে ভিসার আবেদন করার প্রয়োজন নেই। ইরানের উপপররাষ্ট্র মন্ত্রী হাসান ঘাশঘাভি এই তথ্য জানান।
তিনি বলেন, কেশম এয়ারপোর্টে ইলেকট্রিক ভিসা ইস্যুর অফিস খোলা হয়েছে। বিশ্বের ১৮০ দেশের নাগরিকরা ইরানে পৌঁছার পর কেশম এয়ারপোর্টে তাঁরা তাঁদের পাসপোর্ট জমা দেবেন। পাসপোর্ট জমা দেওয়ার ২০ মিনিটের মধ্যেই তাঁদের ভিসা দেওয়া হবে।
গত ১০ জানুয়ারি ২০১৮ বিমানবন্দরে ভিসা ইস্যু অফিস উদ্বোনের অনুষ্ঠানে ইরানের সিনিয়র এই কূটনীতিক এই তথ্য জানান। তিনি আরও জানান, বিদেশি পর্যটকরা ভিসার অতিরিক্ত সময় ইরানে অবস্থান করতে চাইলে একই অফিসে ভিসার মেয়াদ বাড়িয়ে নিতে পারবেন। এক্ষেত্রে তাঁদের দূতাবাস বা কনস্যুলেট অফিস যাওয়ার কোনো প্রয়োজন হবে না।
তিনি বলেন, বিদেশি নাগরিকরা ইরানি মিশনে সশরীরে উপস্থিত হওয়া ছাড়াই ইন্টারনেটে পর্যটন ভিসার আবেদন করতে পারবেন। প্রক্রিয়া সম্পন্নের পর তাঁদের নিজ নিজ সেল ফোনে কোড পাঠানো হবে।
কেশম দ্বীপটি কেবল হরমুযগান প্রদেশেরই নয়, বরং সমগ্র পারস্য উপসাগরীয় দ্বীপগুলোর অন্যতম বিশাল দ্বীপ। হরমুয প্রণালীর উৎসমুখে এই দ্বীপটির অবস্থান। দ্বীপের আয়তন দেড় হাজার বর্গ কিলোমিটারেরও বেশি। এই দ্বীপের প্রস্তরময় উপকূল প্রায় দুইশ’ দুই কিলোমিটার দীর্ঘ। কেশম দ্বীপের আয়তন সিঙ্গাপুর বা বাহরাইনের তুলনায় আড়াই গুণ বড়। দৈর্ঘ্যে ১২০ কিলোমিটার আর প্রস্থে স্থানবিশেষে ১০ থেকে পঁয়ত্রিশ কিলোমিটার। এই দ্বীপে বেশ কয়েটি টিলাও আছে। তবে এসব টিলার উচ্চতা বেশি নয়। সবচেয়ে উঁচু টিলাটির উচ্চতা হলো সাড়ে তিনশ’ মিটার। এখানে প্রায় পঞ্চান্ন হাজার মানুষ বসবাস করে। তারা ফারসি ভাষার পাশাপাশি তাদের আঞ্চলিক ভাষাতেও কথা বলে।
গত বছরের মে মাসে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কোর বিশ্ব জিওপার্ক ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান পেয়েছে দ্বীপটি। চার বছর মেয়াদের জন্য দ্বীপটিকে ইউনেস্কো গ্লোবাল জিওপার্ক তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।

গত বছর ইরানে এসেছে ৬০ লাখ বিদেশি : মূল আকর্ষণ ইমাম রেযা (আ.)-এর মাযার

গত ফারসি বছরে ৬০ লাখেরও বেশি বিদেশি পর্যটক ইরান ভ্রমণে এসেছেন এবং তাদের বেশিরভাগই ছিলেন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর পবিত্র আহলে বাইতের অষ্টম ইমাম হযরত ইমাম রেযা (আ.)-এর মাযার যিয়ারতকারী।
গত ১ ফেব্রুয়ারি পবিত্র মাশহাদ শহরে এই তথ্য দিয়েছেন ইরানের পর্যটন বিভাগের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা মোহাম্মাদ মুহিব্বে খোদায়ি। ফারসি নতুন বছর শুরু হয় মার্চ মাসের শেষের দিকে।
মোহাম্মাদ মুহিব্বে খোদায়ি জানান, ইরানের প্রদেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিদেশি পর্যটক সফর করেছেন বৃহত্তর মাশহাদের খোরাসানে রাজাভি প্রদেশ। এ প্রদেশের মাশহাদ শহরে ইমাম রেযা (আ.)-এর পবিত্র মাযার থাকার কারণে ইরানের অন্য প্রদেশগুলোর তুলনায় প্রতি বছর এখানেই সবচেয়ে বেশি বিদেশি পর্যটকরা আসেন বলে তিনি জানান।
ইসলামি ইরানে ধর্মীয় পবিত্র স্থান ও স্থাপনাগুলো ছাড়াও হাজার হাজার প্রাকৃতিক ও ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থান এবং নিদর্শন রয়েছে। এছাড়াও ইরান চিকিৎসা ক্ষেত্রেও উন্নত দেশগুলোর অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় প্রতি বছর হাজার হাজার বিদেশি রোগী চিকিৎসার জন্য ইসলামি এই দেশটিতে সফর করেন।

নয় মাসে ৫ লাখ বিদেশি পর্যটক টেনেছে ইসফাহান

অনেকে বলে থাকেন, ইরানের ইসফাহান শহর দেখলেই যেন পৃথিবীর অর্ধেক সৌন্দর্য দেখা হয়ে যায়। ফারসিতে যাকে বলা হয়ে থাকে ‘শাহরে ইসফাহান, নেসফে জাহান’। প্রাকৃতিক মহুয়া বন, জনশূন্য বিরান মরুভূমি আর এবড়ো-থেবড়ো সুউচ্চ পাহাড়ের কোল ঘেঁষে অবস্থান করছে ইরানের এই প্রদেশটি। প্রাকৃতিক অপার সৌন্দর্যের কারণে প্রতিনিয়তই মধ্য অঞ্চলীয় এই প্রদেশটিতে বেড়েই চলেছে বিদেশি পর্যটকদের আনাগোনা।
এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, চলতি ইরানি বছরের প্রথম নয় মাসে ইসফাহান প্রদেশ ভ্রমণ করেছেন অন্তত পাঁচ লাখ বিদেশি পর্যটক। ইরানের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, হস্তশিল্প ও পর্যটন সংস্থার (আইসিএইচএইচটিও) প্রাদেশিক কার্যালয়ের সর্বশেষ প্রতিবেদনে এই চিত্র উঠে এসেছে।
এতে দেখা যায়, ইসফাহান প্রদেশের সবচেয়ে বেশি ভ্রমণ করা এলাকাগুলোর মধ্যে রয়েছে ইমাম মসজিদ (মাসজিদ-ই-জামে নামে পরিচত), আলি কাপু প্যালেস ও শেখ লুতফুল্লাহ মসজিদ। এছাড়াও বেশি ভ্রমণ করা হয়েছে চেহেল সোতুন ও ফিন গার্ডেনে।
আইসিএইচএইচটিও এর ইসফাহান অফিসের প্রধান ফেরেইদুন আল্লাহায়ারি বলেন, গত বছরের একই সময়ের চেয়ে এ বছর ফ্রান্সের পর্যটকরা সবচেয়ে বেশি ইসফাহান ভ্রমণ করেছেন। গত বছর একই সময়ে এ প্রদেশে জার্মানি থেকে সবচেয়ে বেশি পর্যটক এসেছেন। এই প্রতিবেদন মতে, ফ্রান্স ও জার্মানির পর সবচেয়ে বেশি পর্যটক এসেছেন ইতালি,  স্পেন ও চীন থেকে।
ইসফাহান প্রদেশে ২২ হাজার ঐতিহাসিক এলাকা ও স্মৃতিবিজড়িত স্থান রয়েছে। এর মধ্যে জাতীয়ভাবে নিবন্ধনপ্রাপ্ত ঐতিহাসিক এলাকা রয়েছে ৮৫০টি আর জাতিসংঘের বিজ্ঞান ও ঐতিহ্য বিষয়ক সংস্থা ইউনেসকোতে নিবন্ধন পেয়েছে চারটি এলাকা। ইউনেসকোর ঐতিহ্য তালিকায় স্থান পাওয়া জায়গাগুলো হলো নাকশ-ই জাহান স্কোয়ার, ইমাম মসজিদ, চেহেল সোতুন ও ফিন গার্ডেন। এসব ঐতিহ্যবাহী এলাকা ঘিরে রয়েছে ৯০টি হোটেল ও ৬৫টি গেস্ট হাউজ।
ইসফাহানের উঁচু পাহাড়গুলোর মধ্যে রয়েছে বিদকান এবং সিমানসাফে। সাফাভি শাসনামলের ইরানের রাজধানী ইসফাহানের সৌন্দর্যের নয়নাভিরাম দৃশ্যাবলি আর ইমাম স্কয়ারে ইমাম মসজিদের কারুকার্যময় দেয়ালচিত্র ও চোখধাঁধানো রং-বেরঙের হাজারও বাতির আলোর নাচন কিংবা ‘নাকশে জাহান’-এর স্ফটিকশুভ্র আলোগুলো যেকোন পর্যটককে মুগ্ধ করবে।

মহাকাশ বিজ্ঞানে মধ্যপ্রাচ্যে শীর্ষে ইরান

ইরানের মহাকাশ গবেষণা সংস্থার প্রধান জানিয়েছেন, এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে মহাকাশ বিজ্ঞানে র‌্যাঙ্কিংয়ে শীর্ষে রয়েছে ইরান। এছাড়া এক্ষেত্রে বিশ্ব র‌্যাঙ্কিংয়ে ১১তম স্থান অর্জন করেছে দেশটি।
ইরানের উপ আইসিটি মন্ত্রী মোরতেজা বারারি গত ১৪ জানুয়ারি এই তথ্য জানান। তিনি বলেন, এ অঞ্চলে মহাকাশ বিজ্ঞানে ইরান প্রথম স্থানে রয়েছে। মহাকাশে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণে সক্ষম দেশের মধ্যে ইরানের অবস্থান নবম।
মহাকাশ অর্থনীতির বিকাশের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব দিয়ে উপ আইসিটি মন্ত্রী বলেন, নিজ মহাকাশ কর্তৃপক্ষের ওপর নির্ভর করে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করা একটি অত্যন্ত কার্যকর পদক্ষেপ। যদিও বর্তমানে মহাকাশ অর্থনীতিতে আমাদের পরিবর্তন আনা প্রয়োজন।
তিনি বলেন, আমরা গবেষণা উপগ্রহের নকশা প্রণয়ন, উৎপাদন ও তা উৎক্ষেপণ করতে সক্ষম হয়েছি। কিন্তু আমরা এসবের সঠিক ব্যবহার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সক্ষম হই নি। আমরা বর্তমানে এ অঞ্চলে মহাকাশ বিজ্ঞানে প্রথম স্থানে রয়েছি। তবে যখন মহাকাশ প্রযুক্তি কর্মক্ষম হবে তখন আমাদের রূপান্তর ও পরিবর্তন আনা প্রয়োজন হবে। কেননা, মহাকাশ বিজ্ঞান কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেবে।

ভবনের জন্য শব্দ নিরোধক আবরণ উৎপাদন করছে ইরান

ইরানের একটি জ্ঞানভিত্তিক কোম্পানির গবেষকরা শব্দ নিরোধক ইনসুলেশন তথা আবরণ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। ভবনের মধ্যে শব্দের প্রতিফলন প্রতিরোধে এই আবরণ মেঝেতে বা দেয়ালে স্থাপন করা হবে। ফলে কমবে শব্দের প্রতিফলন।
জ্ঞানভিত্তিক ওই কো¤পানিটির মহাপরিচালক মোহাম্মাদ রেযা মোন্তাজেরি বলেন, তাঁদের কো¤পানি শব্দের প্রতিধ্বনি প্রতিরোধের আবরণ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। এই আবরণ ভবনের বিভিন্ন লেভেলের মধ্যে উৎপাদিত শব্দের ট্রান্সমিশন কমাতে ব্যবহার করা হবে।
তিনি বলেন, তাদের উৎপাদিত এই ইনসুলেশনটি নমনীয় এবং এটি দীর্ঘস্থায়ী স¤পন্ন ও অতি প্রতিরোধ সহায়ক। মেঝেগুলোর মাঝে উৎপাদিত অতিরিক্ত শব্দের গতি প্রতিরোধে সহায়ক এই পদার্থটি।
মোন্তাজেরি বলেন, কো¤পানিটি ভবনে শব্দ দূষণের সমাধান খুঁজতে গবেষণা পরিচালনা করে। এলক্ষ্যে তারা শব্দ নিরোধক আবরণটি তৈরি করেছেন। যা তৈরির পর প্রাচীর, মেঝে, দরজা, জানালাসহ ভবনের বিভিন্ন স্তরে স্থাপন করে পরীক্ষা চালানো হয়েছে।

হিমোডায়ালাইসিস মেশিন উৎপাদনে বিশ্বে ৫ম ইরান

রোগীর কিডনির হিমোডায়ালাইসিস করার মেশিনের নকশা ও উৎপাদনের প্রযুক্তি আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছেন ইরানের বিজ্ঞানীরা। বর্তমানে বিশ্বে এসব মেশিন উৎপাদনে পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে ইরান। গত ১৫ জানুয়ারি ২০১৮ সালাম গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) এই তথ্য জানান।
ইরানের একজন কর্মকর্তা জানান, নতুন এই প্রযুক্তি আবিষ্কার করা দেশগুলোর মধ্যে জার্মানি, সুইডেন, ইতালি ও জাপানের পরেই পঞ্চম স্থানে রয়েছে ইরান। তিনি বলেন, বর্তমানে আমাদের দেশীয় জ্ঞানের ওপর নির্ভর করে ইরানি হাসপাতাল ও মেডিকেল সেন্টারগুলোতে ডায়ালাইসিস প্রক্রিয়ার সকল ধাপ পরিচালনা করা যাবে।
তিনি ইরানের ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় ডায়ালাইসিস মেশিনের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। ইতোমধ্যে পশ্চিম ইরানের হাসপাতালগুলোতে এসব মেশিন পাঠানো হয়েছে।
ইরানি এই কর্মকর্তা আরও জানান, ইরানি এই ডায়ালাইসিস মেশিনটির মূল্য বিদেশি মেশিনের চেয়ে অন্তত ২০ শতাংশ কম। বিদেশি ডায়ালাইসিস মেশিনের চেয়ে এই মেশিনটির মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় অনেক কম বলে জানান তিনি।

সিঁড়িতে ওঠার বৈদ্যুতিক হুইলচেয়ার বানালো ইরান

সিঁড়িতে ওঠার বৈদ্যুতিক হুইলচেয়ার ও হাতে বহনযোগ্য বৈদ্যুতিক সাইকেল উৎপাদনের প্রযুক্তি আবিষ্কার করেছেন ইরানের একদল প্রকৌশলী। প্রতিবন্ধী মানুষদের দৈনন্দিন কাজ স¤পন্নে সহায়তায় এই বিশেষ হুইলচেয়ার ও সাইকেলটি তৈরি করেছেন তাঁরা।
ফারসি সংবাদ সংস্থা ইসনার প্রতিবেদনে সম্প্রতি এই তথ্য জানানো হয়। প্রকল্প ব্যবস্থাপক ফারহাদ ফোতুরেহচি বলেন, হুইলচেয়ার ব্যবহারকারীদের দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ-সুবিধা করে দিতে এই প্রযুক্তিটি উদ্ভাবন করা হয়েছে।
তিনি জানান, এসব বৈদ্যুতিক হুইলচেয়ার ও সাইকেল রিচার্জযোগ্য ব্যাটারি ও সিট বেল্ট দিয়ে সুসজ্জিত করা হয়েছে। সিঁড়িতে ওঠার বৈদ্যুতিক হুইলচেয়ারটির ১০০ কেজি ওজন বহনের সক্ষমতা রয়েছে।
গুণাগুণ স¤পর্কে ফোতুরেহচি জানান, পরিপূর্ণভাবে চার্জ দেওয়া একটি বৈদ্যুতিক হুইলচেয়ার দিয়ে সিঁড়ির ৭২০টি ধাপ আরোহণ করা যাবে, এতে গড়ে ৭৫ কেজি ওজন বহন করা যাবে। এ হুইলচেয়ারটি ইরানের মেডিকেল সরঞ্জাম দপ্তর কর্তৃক নির্ধারিত আন্তর্জাতিক মানদ- পূরণ করেছে বলেও জানান তিনি।
সদ্যনির্মিত এই পাওয়ার হুইলচেয়ার দিয়ে সর্বোচ্চ ২২ সেন্টিমিটার উচ্চতাস¤পন্ন সিঁড়িতে ওঠা-নামা করা যাবে। মিনিটে অতিক্রম করা যাবে সিঁড়ির ১৫টি ধাপ।
বৈদ্যুতিক হুইলচেয়ারের সঙ্গে বৈদ্যুতিক হ্যান্ড-সাইকেলের তুলনা করে তিনি বলেন, হ্যান্ড-সাইকেলটির ওজন খুবই হালকা। এটা ভাঁজ করে ম্যানুয়াল হুইলচেয়ারের মতো করা যাবে। এটি ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৩০ কিলোমিটার পাড়ি দিতে পারবে। খুব সহজেই এই সাইকেল কারে করেও বহন করা যাবে।

বিকল্প উপায়ে নয়া কৃত্রিম পা বানাল ইরান

হাঁটুর নিচের অংশে জটিলতা বা সমস্যায় ভোগা মানুষদের সহায়তায় নতুন এক কৃত্রিম পা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে ইরান। দেশটির ইসফাহান ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির গবেষকরা অঙ্গটি তৈরি করেছেন। তবে যুক্তরাষ্ট্রের বিকল্প উপায়ে পাটি তৈরি করতে হয়েছে ইরানি গবেষকদের।
ইসফাহান ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির মেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অনুষদ সদস্য ও গবেষণা দলটির নেতা নিমা জমশিদি এই সফলতা অর্জনে সক্ষম হয়েছেন। মেহর নিউজ এজেন্সিকে তিনি জানিয়েছেন, তাঁর গবেষণা দল নতুন কৃত্রিম পা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। তিনি বলেন, কৃত্রিম পা সাধারণত যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি করা হয় এবং এটা তৈরি করা হয় কার্বন দিয়ে।
এই গবেষক আরও জানান, ইরানের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা মতে ইরানে সামরিকভাবে কার্বন ব্যবহারের সম্ভাবনা রয়েছে। আন্তর্জাতিক এই নিষেধাজ্ঞার কারণে এই পদার্থটি ইরানে আমদানি করা যায় না। তাই আমাদের তৈরিকৃত কৃত্রিম পায়ে অন্যান্য পদার্থ ব্যবহার করার চেষ্টা করেছি।
তিনি বলেন, নিষেধাজ্ঞা সমস্যার কারণে আমরা ফাইবার পদার্থ ব্যবহার করেছি। যা সাধারণত কৃত্রিম পা তৈরি করতে ব্যবহার করা হয় না। তবে তিনি জানান, তাদের তৈরিকৃত কৃত্রিম পা গুণাগুণের দিক দিয়ে আমেরিকার তৈরি পায়ের মতোই।
নিমা জমশিদি আরও জানান, অমেরিকার তৈরি যন্ত্রটির আয়ুষ্কাল ৩ বছরের চেয়ে কম। অন্যদিকে তাদের তৈরিকৃত পণ্যটির আয়ুষ্কাল ৫ বছরের ওপরে। প্রতিদিন এই পা দিয়ে ৬ হাজার ধাপ হাঁটা যাবে। তিনি জানান, তারা ৪০ জন ব্যক্তির ওপর কৃত্রিম পায়ের পরীক্ষা চালিয়েছেন। ইরানের বাজারে এর দাম কমবে বলেও আশা ব্যক্ত করেন তিনি।

ঢাকায় আন্তর্জাতিক কিরাত সম্মেলন অনুষ্ঠিত

ঢাকায় ১৮তম আন্তর্জাতিক কিরাত সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। দেশ-বিদেশের আন্তর্জাতিক ক্বারী ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিস¤পন্ন আলেমরা অতিথি হিসেবে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। গত ২৯ জানুয়ারি জুমআ নামাযের পর জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম চত্বরে এই কিরাত সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনের আয়োজক ছিল আন্তর্জাতিক কুরআন তিলাওয়াত সংস্থা (ইক্বরা)।
মুহাম্মদ ইউসুফ হাফিজাহুল্লাহর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বাংলাদেশসহ মিসর, ইরান, সিরিয়া, আলজেরিয়া, ভারত, ফিলিস্তিন ও ব্রুনাইয়ের শীর্ষস্থানীয় ক্বারীরা অংশ নেন। ইক্বরার সহসভাপতি মা’হাদুল কিরাত বাংলাদেশের পরিচালক শাইখ ক্বারী আহমাদ বিন ইউসুফ আল আযহারীসহ দেশবরেণ্য ক্বারীরা এতে কিরাত পরিবেশন করবেন।

ফজর আন্তর্জাতিক সংগীত উৎসব অনুষ্ঠিত

ইরানের রাজধানী তেহরানে দশ দিনব্যাপী ফজর আন্তর্জাতিক সংগীত উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে। তেহরানের বিভিন্ন ভেন্যুতে ১০টি ভিন্ন ভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে ইরানের সর্বাপেক্ষা মর্যাদাপূর্ণ এই সংগীত উৎসব শুরু হয় গত ১০ জানুয়ারি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সংগীত শিল্পী ও ব্যান্ডের অংশগ্রহণে উৎসবের এবারের ৩৩তম আসর চলে ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত।
সংগীত উৎসবের প্রথম রাতে ভাহদাত হলে অনুষ্ঠানের আয়োজকরা সংগীত উপভোগ করেন। এসময় চাকাভাক অরকেস্ট্রা ও সঙ্গীতজ্ঞ আব্দোলহোসেইন মোখতাবাদ তার নোবাং ইনসেম্বল নিয়ে পারফরম করেন। এছাড়া আজাদি টাওয়ারে মাজান্দারান প্রদেশের নিমা ইনসেম্বল ও কোরদেস্তান প্রদেশ থেকে জি ইনসেম্বল পারফরমেন্স করে। অন্যদিকে, মিলাদ টাওয়ারে তরুণ গায়ক আলি জান্দ ভাকিলি তাঁর কিছু হিট গান পরিবেশন করে দর্শকদের মুগ্ধ করেন।
তেহরানের ছয়টি ভেন্যুতে ৯০টি সংগীত অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ভেন্যুগুলো হলো আজাদি ও মিলাদ টাওয়ার্স, নিয়াভারান কালচারাল সেন্টার, ইরানিয়ান হল, রোদাকি হল ও ভাহদাত হল। সর্বশেষ ভাহদাত হলে সংগীত উৎসবের সমাপনী অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়।
বাৎসরিক দশ দিনের এই জাতীয় সংগীত উৎসবে গান পরিবেশন করেন গায়ক মেহদি ইয়ারাহি, হামেদ হোমায়ুন,মোহাম্মাদ আলিজাদেহ, জ্যানিয়ার ও সিরভান খোসরাভি, বেহনাম বানি, আলিরেজা তালিসচি, ওমিদ হাজিলি ও আলি জান্দ-ভাকিল।
৩৩তম ফাজর আন্তর্জাতিক সঙ্গীত উৎসবে তুরস্ক, পর্তুগাল, আফগানিস্তান, ফ্রান্স, ইতালি, ভারত, মঙ্গোলিয়া,সারবিয়া, অস্ট্রিয়া, সেনেগাল,  স্লোভেনিয়া, জার্মানি, জাপান এবং স্পেন থেকে বিদেশি শিল্পীরা অংশ নেন।

তেহরানে আন্তর্জাতিক গল্পবলার উৎসব

ইরানের রাজধানী তেহরানে অনুষ্ঠিত হয় আন্তর্জাতিক গল্প বলার উৎসব। এবার উৎসবটির ২০তম পর্ব ২১ জানুয়ারি শুরু হয়ে চলে ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত।
আন্তর্জাতিক এই গল্প বলার উৎসব আয়োজন করা হয় তেহরানের ইনস্টিটিউট ফর ইনটেকচুয়াল ডেভেলপমেন্ট অব চিলড্রেন অ্যান্ড ইয়ং অ্যাডাল্টসে (আইআইডিসিওয়াইএ)।
আইআইডিসিওয়াইএ এর উপপ্রধান রেজা গামারজাদেহর তথ্য মতে, বাৎসরিক আন্তর্জাতিক এই উৎসবে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ১৮ হাজার অংশগ্রহণকারী যোগ দেন।
তিনি জানান, প্রাদেশিক, আঞ্চলিক ও জাতীয় পর্যায়ে সর্বমোট ৬ হাজার ৭৩৭টি গল্প পর্যালোচনা করা হয়। এর মধ্য থেকে সবচেয়ে মানসম্মত গল্পটি অনুষ্ঠানে পাঠ করে শোনানো হয়।
রেজা গামারজাদেহ বলেন, উৎসবের লক্ষ্য তরুণ প্রজন্মের মধ্যে গল্প বলার ঐতিহ্য ছড়িয়ে দেওয়া এবং ইরানের এই সংস্কৃতি ও প্রাচীন রীতি সর্বদা জীবিত রাখা।
২২ তেহরানে বাংলাদেশী শিল্পীর জলরং চিত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত
গত ৫ থেকে ১৫ জানুয়ারি (২০১৮) তেহরানে বাংলাদেশী চিত্রশিল্পী হাসান মোরশেদের জলরং চিত্রের প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। তেহরানের হেপ্তা গ্যালারিতে ‘বাস্তবতাই কৃত্রিম এবং কৃত্রিমই বাস্তবতা’ শিরোনামে অনুষ্ঠিত এ প্রদর্শনীতে হাতে তৈরি কাগজে অঙ্কিত হাসান মোরশেদের চৌদ্দটি জলরং চিত্র প্রদর্শিত হয়।
উল্লেখ্য, ইতিপূর্বে ২০১৬ সালের জুলাই মাসে তেহরানের মোহ্সেন্ গ্যালারিতে আয়োজিত ওপেন স্টুডিও অব্ ইরান-বাংলাদেশ এক্স্চেঞ্জ-এ হাসান মোরশেদের অঙ্কিত কয়েকটি চিত্র প্রদর্শিত হয়েছিল।

ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব অনুষ্ঠিত

চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, পুরস্কার প্রদান ও বর্ণিল আয়োজনের মধ্য দিয়ে গত ২০ জানুয়ারি শেষ হয়েছে নয় দিনব্যাপী ‘ষোড়শ ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব-২০১৮’। ‘ভালো ছবি, ভালো দর্শক, সমৃদ্ধ সমাজ’- প্রতিপাদ্যে এ উৎসবের আয়োজন করে রেইনবো ফিল্ম সোসাইটি। নয় দিনের এ উৎসবে বাংলাদেশসহ ৬৪ দেশের ২১৬টি চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়।
রাজধানীর জাতীয় জাদুঘরের প্রধান মিলনায়তনে আয়োজন করা হয় সমাপনী অনুষ্ঠানের। এতে বিভিন্ন বিভাগে পুরস্কারপ্রাপ্তদের হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। তিনি বলেন, ‘চলচ্চিত্রের নিজস্ব ভাষা রয়েছে। এটি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষকে কাছে টানতে পারে, ঐক্যবদ্ধ করতে পারে। ধর্মের নামে, রাজনীতির নামে আজ সারাবিশ্বে চলছে হত্যাযজ্ঞ, হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি আর রাহাজানি। আমরা নিজেদের দাবি করছি সভ্য হিসেবে। আসলে কি আমরা সভ্য? চলচ্চিত্র এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। চলচ্চিত্র পারে বিশ্বে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে।’
তাঁর সঙ্গে একমত হয়ে দেশ-বিদেশের চলচ্চিত্রকাররা মানবিক বিশ্ব নির্মাণের শপথ নেন।
এবারের উৎসবে শিশু চলচ্চিত্র বিভাগে সেরা চলচ্চিত্র হিসেবে বাদল রহমান পুরস্কার পেয়েছে ইরানের ‘হোয়াইট ব্রিজ’, দর্শক বিবেচনায় সেরা চলচ্চিত্র নির্বাচিত হয়েছে ভারতের ‘টোপি’।
নারী চলচ্চিত্র নির্মাতা বিভাগে সেরা পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্বাচিত হয়েছে রাশিয়ার ‘সোফিস্কা’, স্বল্পদৈর্ঘ্যে বিশেষ পুরস্কার পেয়েছে নরওয়ে ও যুক্তরাজ্যের যৌথ প্রযোজনার চলচ্চিত্র ‘থ্যাঙ্ক ইউ ফর দ্য রেইন’।
সেরা স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র আফগানিস্তানের ‘পারলিকা’, কাহিনীচিত্রে বিশেষ পুরস্কার পেয়েছে ফ্রান্সের ‘লেস বিগোরনিয়াক্স’ শ্রেষ্ঠ কাহিনীচিত্র চেক প্রজাতন্ত্র ও যুক্তরাজ্যের যৌথ প্রযোজনার চলচ্চিত্র ‘আনা’।
শর্ট অ্যান্ড ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফিল্ম বিভাগে কাহিনীচিত্রে বিশেষ পুরস্কার পেয়েছে বাংলাদেশের ‘পুনঃপৌনিক’, শ্রেষ্ঠ কাহিনীচিত্র হয়েছে ইরাকের ‘দ্য ভায়োলেট’, প্রামাণ্যচিত্রে বিশেষ পুরস্কার পেয়েছে নেপালের ‘এ সঙ ফর বারপাক’ ও শ্রেষ্ঠ প্রামাণ্যচিত্র হয়েছে যুক্তরাজ্যের ‘কন্টিনেন্টাল ড্রিফ্ট’।
বাংলাদেশ প্যানোরোমা বিভাগে চলচ্চিত্র বিষয়ক সংগঠন ফিপরেসির সৌজন্যে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হয়েছে লতা আহমেদের ‘সোহাগীর গয়না’ ও তৌকির আহমেদ ‘হালদা’ চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ নির্মাতা হয়েছেন।
অস্ট্রেলিয়া-এশিয়া  কম্পিটিশন বিভাগে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হয়েছে তুরস্কের ‘জার’। শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র পরিচালক হয়েছেন তুরস্কের অনুর সায়লাক, শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হয়েছেন ফিলিপাইনের অ্যানের ডিজোন, শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হয়েছেন ইরানের পারিনাস ইজাডায়ার ও মিনা সাদাতি, শ্রেষ্ঠ চিত্রগ্রাহক হয়েছেন ইরানের মাসুদ সালামি ও শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার হয়েছেন তুরস্কের অনুর সায়লাক, ডগু ইয়াসার আকাল ও হাকান গান্ডে।
স্পিরিচুয়াল ফিল্মস বিভাগে সেরা পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র হয়েছে রাশিয়ার ‘আমুন’, পূর্ণদৈর্ঘ্যে বিশেষ পুরস্কার পেয়েছে তাজিকস্তানের ‘ব্রেক থ্রু’, শ্রেষ্ঠ প্রামাণ্যচিত্র অস্ট্রেলিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার যৌথ প্রযোজনার ‘এখ : বিয়োন্ড দ্য সুনামি’ এবং সেরা কাহিনীচিত্র ইরানের ‘স্টিল ইয়েট’।
নয় দিনের এ উৎসবে প্রথমবারের মতো আয়োজন করা হয় এশিয়ান ফিল্ম ক্রিটিকস অ্যাসেম্বলি কনফারেন্স, যাতে এশীয় অঞ্চলের ১২টি দেশের আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন চলচ্চিত্রকাররা অংশ নেন।
এছাড়াও উৎসবের অংশ হিসেবে রাজধানীর পাঠশালায় ছিল অষ্টম ঢাকা আন্তর্জাতিক সিনে ওয়ার্কশপ। ফরাসি নারী নির্মাতা জুলি বার্টুসেলি এবং সিলিনি সিএমার ৭টি ছবি দিয়ে সাজানো ছিল রেটোস্পেকটিভ বিভাগটি। এই বিভাগের সবগুলো চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয় আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ মিলনায়তনে।

ঢাকায় আন্তর্জাতিক শিশু চলচ্চিত্র উৎসবে ইরানের ৪টি ছায়াছবি প্রদর্শিত

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় ‘১১তম আন্তর্জাতিক শিশু চলচ্চিত্র উৎসব’ এ চারটি ইরানি ছবি প্রদর্শিত হয়। এ উৎসবে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানসহ বিশ্বের ৫৮টি দেশের শিশুদের জমা দেয়া ১০০০টি চলচ্চিত্র থেকে প্রদর্শিত হয় প্রায় ২২০টি। ২৮ জানুয়ারি শুরু হয়ে উৎসব চলে ২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।
‘ফ্রেমে ফ্রেমে আগামী স্বপ্ন’  স্লোগান নিয়ে রাজধানীর পাবলিক লাইব্রেরি চত্বরে অনুষ্ঠিত প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন উৎসব উপদেষ্টা পরিষদের চেয়ারম্যান মুস্তাফা মনোয়ার।
এবারের উৎসবের উদ্বোধনী চলচ্চিত্র হিসেবে মারিয়া নভারো পরিচালিত মেক্সিকান চলচ্চিত্র ‘টেসোরস’ দেখানো হয়। পরদিন অর্থাৎ ২৮ জানুয়ারি প্রদর্শিত হয় ১৯টি চলচ্চিত্র। এর মধ্যে ছিল ইরানি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘ইট্স রেইন্স স্লোলি’।
২৯ জানুয়ারি প্রদর্শিত হয় ইরানি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘স্কুল মাস্টার’। ৩০, ৩১ জানুয়ারি এবং ১ ফেব্রুয়ারি প্রদর্শিত হয় ইরানি চলচ্চিত্র ‘দ্য চকোলেট’। উৎসবের শেষ দিন দেখানো হবে ইরানি চলচ্চিত্র ‘গ্লাসেস’।
এবার উৎসবে বাংলাদেশি শিশুদের নির্মিত প্রতিযোগিতা বিভাগে নির্বাচিত ২১টি চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়। এর মধ্যে ৫টি চলচ্চিত্র পুরস্কার পায়। পুরস্কার হিসেবে ছিল ক্রেস্ট, সার্টিফিকেট ও আর্থিক প্রণোদনা। এ বছরও ‘ইয়ং বাংলাদেশি ফিল্ম মেকার সেকশন’ শীর্ষক বিভাগটি ছিল যেখানে ১৯ থেকে ২৫ বছর বয়সী তরুণ নির্মাতারা অংশ নিয়েছেন। উৎসবের মূল ভেন্যু ছিল পাবলিক লাইব্রেরির শওকত ওসমান মিলনায়তন। এছাড়াও ব্রিটিশ কাউন্সিল, গ্যাটে ইনস্টিটিউট, অলিয়ঁস ফ্রঁসেজ, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি ও ডেফোডিল স্কুলে প্রদর্শিত হয় চলচ্চিত্রগুলো।
শিল্পের শক্তিশালী মাধ্যম চলচ্চিত্রকে শিশুদের শিক্ষা ও বিনোদনের অন্যতম অনুষঙ্গ হিসেবে গড়ে তুলতে ২০০৬ সালের ১৭ আগস্ট প্রতিষ্ঠিত হয় চিলড্রেন ফিল্ম সোসাইটিজ বাংলাদেশ। সংগঠনটির উদ্যোগে প্রতিবছর শিশু চলচ্চিত্রের এ মিলনমেলা বসে।

আবারও এএফসি ফুটসল চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জিতল ইরান

এএফসি ফুটসল চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জিতেছে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান। গত ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ তাইওয়ানে অনুষ্ঠিত এ প্রতিযোগিতার ফাইনালে ইরান ৪-০ গোলে জাপানকে হারায়। এ নিয়ে ইরান ১২ বার এএফসি ফুটসল চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জিতল। ২০১৮ এএফসি ফুটসল চ্যাম্পিয়নশিপে এশিয়ার ১৬টি টিম অংশ নেয়।
১৯৯৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত এ নিয়ে ১৫ বার এশিয়ার দেশগুলোকে নিয়ে ফুটসল চ্যাম্পিয়নশিপের আয়োজন করা হয়েছে। এর মধ্যে ১২ বারই চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ইরান। অন্য তিনটি আসরের শিরোপা জিতেছে জাপান।
আন্তর্জাতিক ফুটবল ফেডারেশন বা ফিফা’র সর্বশেষ র‌্যাঙ্কিং অনুযায়ী ফুটসলে বিশ্বে ৫ম সেরা দল হচ্ছে ইরানের জাতীয় ফুটসল টিম। এছাড়া গত কয়েক বছর ধরেই এশিয়ায় প্রথম স্থান ধরে রেখেছে দেশটির জাতীয় টিম। ফিফা র‌্যাঙ্কিংয়ে বিশ্বে শীর্ষে রয়েছে ব্রাজিল। তারপরেই রয়েছে  স্পেন, রাশিয়া ও আর্জেন্টিনা। তালিকায় ইরানের পরে ষষ্ঠ ও সপ্তম অবস্থানে রয়েছে ইতালি ও পর্তুগাল।

ইরানের ইসলামি বিপ্লব – ‘অনিবার্য’ হবার আগে যা ছিল ‘অসম্ভব’*

ইরানের ইসলামি বিপ্লব – ‘অনিবার্য’ হবার আগে যা ছিল ‘অসম্ভব’*
ব্যারি কে. গ্রোস্ম্যান**
বস্তুত মানবজাতির ইতিহাসে অন্য কোনো বিপ্লবই এতো বেশি ব্যাপক জনসমর্থন লাভ করে নি, বা অন্য কথায়, সুনির্দিষ্ট সর্বজনীন নৈতিক মূল্যবোধসমূহের প্রতি এমন সুস্পষ্টভাবে অঙ্গীকার লাভ করে নি।

এখন থেকে ঊনচল্লিশ বছর আগে হযরত আয়াতুল্লাহ্ উযমা ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর আন্তরিক নিষ্ঠা ও পবিত্র অন্তর্দৃষ্টি এমন কতগুলো ধারাবাহিক অপ্রতিরোধ্য ঘটনার দরজা উন্মোচন করে দেয় যা ইরানের ইসলামি বিপ্লব হিসেবে সুপরিচিত। এ ঘটনাবলির অন্তর্ভুক্ত ছিল খোদাদ্রোহী শক্তির প্রভাবের বিরুদ্ধে এবং সেই সাথে প্রকৃত ইসলামের নৈতিকতা ও বিধি-বিধান প্রবর্তনের লক্ষ্যে ও বর্তমান জাতি-রাষ্ট্রের এ যুগে একমাত্র যে ধরনের ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা যৌক্তিকভাবে সম্ভব তথা বেলায়াতে ফকীহ্ (মুজতাহিদের শাসন) প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ইসলামি বিপ্লব। আর এর পর পরই হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর অভিভাবকত্ব ও পথনির্দেশ এমন একটি সুদৃঢ় ও অবিচল ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে যার ওপরে আজকের ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান প্রতিষ্ঠিত হয়।
হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর হিজরত ও অতঃপর বিজয়ীর বেশে মক্কায় প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে সংঘটিত মূল ইসলামি বিপ্লবের পরে দীর্ঘ প্রায় চৌদ্দ শতাব্দী কালে আর কখনোই প্রকৃত অর্থে সাধারণ জনগণ কর্তৃক কুফ্রের প্রভাব প্রত্যাখ্যানের ক্ষেত্রে ইরানের ইসলামি বিপ্লবের তুলনায় অধিকতর উত্তম দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় না। শুধু তা-ই নয়, নিঃসন্দেহে ইতিহাসে এমন আর কোনো দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় না যে, কোনো গণবিপ্লব- তা যে কোনো আদর্শিক লক্ষ্যেই সংঘটিত হয়ে থাকুক না কেন- এমন ব্যাপক ও সর্বাত্মক জনসমর্থন লাভ করে। স্বৈরাচারী পাহ্লাভী সরকার কর্তৃক হাজার হাজার মানুষকে শহীদ করা ও অনবরত উস্কানি সৃষ্টি করা সত্ত্বেও এ বিপ্লব প্রধানত শান্তিপূর্ণভাবে সংঘটিত হয় এবং তা এতটাই শান্তিপূর্ণ ছিল যে, বিংশ শতাব্দীতে অন্য কোথাও কোনো আদর্শভিত্তিক বিপ্লব এতটা শান্তিপূর্ণভাবে সংঘটিত হবার দৃষ্টান্ত মেলে না।
বস্তুত মানবজাতির ইতিহাসে অন্য কোনো বিপ্লবই এত ব্যাপক জনসমর্থন লাভ করে নি বা কতগুলো সুনির্দিষ্ট সর্বজনীন নৈতিক মূল্যবোধের প্রতি সুস্পষ্টভাবে অঙ্গীকারাবদ্ধ ছিল না। এমনকি এ বিপ্লøবের সমালোচকরাও স্বীকার করেছেন যে, ইরানের মোট জনসংখ্যার অন্তত শতকরা দশ ভাগ ইরানের ইসলামি বিপ্লবে সরাসরি ও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন, অথচ, বলা হয়ে থাকে যে, ১৭৭৬ সালের আমেরিকান বিপ্লবে, ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লবে ও ১৯১৮ সালে রাশিয়ার বলশেভিক বিপ্লবে সংশ্লিষ্ট দেশসমূহের জনগণের শতকরা এক ভাগের সামান্য বেশি সরাসরি ও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিল।
সমালোচকগণ আরো স্বীকারোক্তি করেছেন যে, ‘… বিপ্লবের চেতনাকে ইরানের মধ্যে সীমিত করে রাখার যেমন কোনো উপায় ছিল না, তেমনি বৈপ্লবিক পরিবর্তনের লক্ষ্যে জনগণের মধ্যে বিরাজমান আগ্রহকে নিষ্প্রভ বা স্তিমিত করে দেয়াও সম্ভবপর ছিল না।’
সংক্ষেপে বলা যেতে পারে যে, এ বিপ্লব হচ্ছে এমন একটি সুউচ্চ মিনার তুল্য অর্জন যা গোটা বিশ্বের মুসলমানদের দ্বারা উদ্যাপিত হওয়া উচিত।
অবশ্য সব সময়ই এমন লোকদের অস্তিত্ব থাকবেই যারা গোষ্ঠীগত ভাবাবেগ, বৈদেশিকতা সংক্রান্ত সংবেদনশীলতা বা পার্থিব স্বার্থপরতা দ্বারা চালিত হয়ে থাকে এবং এ কারণে তারা বিপ্লবের সাফল্য অর্জন ও তার হেফাযতের লক্ষ্যে ব্যবহৃত ‘পন্থাসমূহ’ প্রসঙ্গে বিতর্কিত বিস্তারিত ঐতিহাসিক বিবরণের সমালোচনার ওপর বেশি গুরুত্ব আরোপ করে থাকে, অথচ একই সময় তারা এ বিপ্লবের মূল বিষয়বস্তুর অনস্বীকার্য বাস্তবতা এবং এ বিপ্লবের বিরুদ্ধে ইরান ও ইসলামের দুশমনদের অনবরত হুমকির বিষয়টিকে দেখেও না দেখার ভান করে থাকে।
সুতরাং এটা কী করে সম্ভব যে, আমরা ইরানের ইসলামি বিপ্লবের মূল বিষয়বস্তু বা মূল বক্তব্য এবং যে পরিস্থিতি এ বিপ্লবকে অনিবার্য করে তুলেছিল সে সম্পর্কে পরিপূর্ণ দৃঢ়তা সহকারে কিছু বলব, অথচ সে ব্যাপারে প্রশ্ন তোলা হবে না?
আলোচনার শুরুতেই আমরা যখন যে প্রেক্ষাপট সংঘটিত হবার পূর্বে ‘অসম্ভব’ হিসেবে পরিগণিত এ বিপ্লবকে ‘অনিবার্য’ করে তুলেছিল তার প্রতি দৃষ্টি দেই তখন দেখতে পাই যে, ইতিহাস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত মোহাম্মাদ রেযা পাহ্লাভীর একনায়কতান্ত্রিক শাসনকে-যা ইরানকে কুফ্রী শক্তির হাতে তুলে দেয়ার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে ছিল-সকলের দৃষ্টির সামনে নগ্ন করে তুলে ধরেছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকাধীন শাহের লুটেরা সরকার যে কী পরিমাণে পৈশাচিক নিপীড়ক, দুর্নীতিপরায়ণ ও বলদর্পী ছিল সে ব্যাপারে যারা সংশয় সৃষ্টি করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে তাদেরকে শুধু এই একটি বিষয় নিয়ে ভেবে দেখতে বলব যে, ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন কার্টার প্রশাসন, ন্যাটো, এমনকি ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের মুখপাত্র ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন (বিবিসি) পর্যন্ত প্রকাশ্যে শাহের সরকারের সমালোচনা করত। হয়তোবা এ কারণেই বিপ্লবের গড়ে ওঠার পর্যায়ে সামরিক শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে এ বিপ্লবকে গলা টিপে মারার জন্য শাহের সরকার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তার প্রতি সমর্থন দানে মার্কিন প্রশাসন অস্বীকৃতি জানায়- যা কার্যত ছিল এ বিপ্লবের সপক্ষে ঐশী সুকৌশলেরই প্রতিফলন।
অবশ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এ সিদ্ধান্ত ছিল তার এ অগভীর ও বলদর্পীমূলক ধারণার ওপরে ভিত্তিশীল। কারণ, মার্কিন প্রশাসন মনে করেছিল যে, শাহের সরকারকে সামরিক হস্তক্ষেপ তথা ব্যাপক রক্তপাত থেকে বিরত রাখার ফলে বিপ্লব সংঘটিত হয়ে গেলেও পরে কোনো না কোনোভাবে আয়াতুল্লাহ্ খোমেইনীকে পাশে সরিয়ে দেয়া যাবে এবং একজন আধ্যূাত্মিক নেতা হিসেবে তাঁকে গান্ধীর ন্যায় মার্কিন ধাঁচের গণতন্ত্রকে আলিঙ্গন করতে বাধ্য করা যাবে, আর স্বয়ং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরানে একটি ‘গণতান্ত্রিক’ ও আদর্শিকভাবে ‘যথাযথ’ সরকার গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সংখ্যক টেকনোক্র্যট্ ও আদর্শিকভাবে ‘যথাযথ’ উপকরণাদি সরবরাহ করতে সক্ষম হবে।
কিন্তু ইরানের ইসলামি বিপ্লব অত্যন্ত দ্রুত গতিতে ইরানের বুক থেকে স্বৈরাচারী স্বঘোষিত ‘বাদশাহ্দের বাদশাহ্’ (শাহানশাহ্)-এর দুর্নীতিপরায়ণ সরকারের সকল বাড়াবাড়ির ও ইসলামের প্রতি সরকারি দুশমনীর অবসান ঘটায় এবং ইসলামি বিধি-বিধানকে পাশ্চাত্য ধাঁচের বাহ্যিক প্রদর্শনী ও কৃত্রিমতার স্থলাভিষিক্ত করে। বিশেষ করে শাহের গড়ে তোলা গোপন পুলিশ বাহিনী আতঙ্ক সৃষ্টিকারী সাভাক্-কে সাথে সাথেই বিলুপ্ত করা হয় এবং সকল রাজনৈতিক বন্দিকে মুক্তি দেয়া হয়। এরপর ইরানি জাতির নৈতিক ও চারিত্রিক উন্নয়নের পাশাপাশি পার্থিব দিক থেকেও অবিশ্বাস্য উন্নতি সাধিত হয়।
মার্কিন প্রশাসনের ধারণার বিপরীতে হযরত ইমাম খোমেইনীর নেতৃত্বে ইরানের ইসলামি বিপ্লব স্বীয় ইসলামি ও স্বাধীন বৈশিষ্ট্য সহকারে টিকে যাওয়ায় স্বয়ং আমেরিকার পক্ষ থেকে এবং তার নির্দেশ অনুযায়ী তার আটলান্টিক জোটের মিত্র দেশগুলোর ও মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলস্থ তার তাঁবেদার দেশগুলোর পক্ষ হতে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানকে ভিতর ও বাইরে থেকে বার বার আক্রমণ চালানো হয়। কিন্তু এতদসত্ত্বেও মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (জিডিপি), স্বাক্ষরতার হার, শিক্ষা ও এ ধরনের অন্যান্য সূচক- সোজা কথায়, স্রেফ পার্থিব পরিভাষায় সাধারণত যেসব মানদ-দণ্ডে সাফল্য বিচার করা হয়, সেসব মানদ-দণ্ডে পরিমাপ করলেও ইরানের ইসলামি বিপ্লব দৃষ্টিগ্রাহ্যভাবে খুবই সফল হয়েছে।
ইরানে বিপ্লবের পর থেকে বিশেষ করে নারীদের মধ্যে সাক্ষরতা ও শিক্ষার হার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, অন্যদিকে প্রসূতি ও শিশু মৃত্যুর হার অনেক বেশি হ্রাস পেয়েছে। ইসলামি বিপ্লবোত্তর ইরানে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে সাক্ষরতার হার বিপ্লব-পূর্ব সময়ের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সারা দেশে স্কুলগুলোতে ছাত্র-ছাত্রী ভর্তির হার বহু গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
১৯৭৯ সালে ২৫ বছরের ঊর্ধ্ব বয়সী ইরানিদের মধ্যে মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্তকারীদের হার ছিল মাত্র শতকরা ৩৫ ভাগ, আর ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠিত হবার ২১ বছর পর ২০০০ সাল নাগাদ মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্তকারী ২৫ বছরের ঊর্ধ্ব বয়সী ইরানিদের সংখ্যা শতকরা ৮৫ ভাগে উন্নীত হয়।
১৯৭৯ সালে ২৫ বছরের ঊর্ধ্ব বয়সী ইরানিদের মধ্যে মাত্র শতকরা ১০ ভাগ উচ্চতর ডিগ্রির অধিকারী ছিল, আর ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠিত হবার ২১ বছর পর ২০০০ সালে এ হার দাঁড়ায় শতকরা ৩০ ভাগে। অন্যদিকে ১৯৭৯ সালে যেখানে ৬ বছরের বেশি বয়সী ইরানিদের মধ্যে সাক্ষরতার হার ছিল শতকরা ৫২ ভাগ, সেখানে ২০০০ সালে এ হার দাঁড়ায় শতকরা ৮৫ ভাগে। (বর্তমানে প্রায় শতভাগ।)
শুধু তা-ই নয়, ইসলামি বিপ্লব সংঘটিত হবার পর থেকে ইসলামি ইরানের বিরুদ্ধে প্রায় সব সময়ই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন আটলান্টিক বিশ্বের পক্ষ থেকে অব্যাহতভাবে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকা সত্ত্বেও ইরানের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (জিডিপি) উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে- যার ফলে ৪৩ হাজার কোটি ডলারের ইরানি অর্থনীতি উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধির অধিকারী হয়েছে এবং অনুকূল বাণিজ্যিক ভারসাম্য সহ মধ্যপ্রাচ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে। আর অধিকতর বহুমুখীকৃত ইরানি অর্থনীতির ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধি হারের ব্যাপারে যে আগাম ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে তা বিশ্বের অন্যান্য দেশের অর্থনীতির ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধি সম্পর্কে আগাম ভবিষ্যদ্বাণীকৃত হারের তুলনায় অনেক বেশি।
ক্রয় ক্ষমতা সংক্রান্ত সমতা বিধানের লক্ষ্যে সমন্বয় সাধন, এমনকি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর ক্যালক্যুলেশন ব্যবহার করা সত্ত্বেও ইরানের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (জিডিপি) দাঁড়িয়েছে এক লক্ষ ৩০ হাজার কোটি ডলারে- যা কানাডা-র জিডিপি (এক লক্ষ ৬০ হাজার কোটি ডলার)-এর সামান্য নিচে। এ ক্ষেত্রে স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, কানাডা হচ্ছে বিশ্বের সাতটি বড় দেশ (জি-৭)-এর অন্যতম অর্থাৎ আইএমএফ যে সাতটি দেশকে উন্নত অর্থনীতি ও সর্বাধিক জাতীয় সম্পদের অধিকারী সবচেয়ে বড় দেশ হিসেবে গণ্য করে সে দেশগুলোর অন্যতম এবং ইরানের অবস্থান তার খুবই কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছে।
যদিও ইরানের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ১৯৭৯ সালের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশিতে দাঁড়িয়েছে তথাপি, ক্রয় ক্ষমতার সাথে সমন্বয়কৃত সমতার ভিত্তিতে ইরানের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (জিডিপি) যেখানে বিপ্লবোত্তর দ্বিতীয় বছরে অর্থাৎ ১৯৮০ সালে ছিল মাথাপিছু ৪ হাজার ২৬৭ ডলার সেখানে ২০১৬ সালে তা শতকরা ৩০০ ভাগেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়ে মাথাপিছু ১৭ হাজার ১১৪ ডলারে দাঁড়ায়।
যে অবস্থায় ইরানের এ অর্থনৈতিক অগ্রগতি সাধিত হয়েছে সে সম্পর্কে স্মর্তব্য যে, বিপ্লবের পর ইরানের অর্থনীতিতে বার বার অস্থিরতার সৃষ্টি হয়- যে দুর্ভাগ্যজনক বাস্তবতা ছিল কেবলই ইরানের বৈদেশিক শত্রুদের অপচেষ্টার প্রতিফলন; ইরানের শত্রুরা অনবরত দেশটিকে অস্থিতিশীল করার অপচেষ্টা চালায়। এসব অপচেষ্টার মধ্যে ছিল দেশটির বিরুদ্ধে অন্যায়ভাবে, বিশেষত উৎপাদন রোধক নিষেধাজ্ঞা আরোপ, সরাসরি যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া এবং সেই সাথে বিশেষ করে সৌদি আরবের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থকে এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে তেল রপ্তানিকারক দেশসমূহের সংস্থা (ওপেক)-এর পলিসি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে তেলের মূল্যের ক্ষেত্রে অস্থিরতা সৃষ্টি।
আমেরিকার নেতৃত্বাধীন আটলান্টিক বিশ্ব কর্তৃক সত্য, ন্যায় ও মুক্তির পতাকাবাহী ইসলামি বিপ্লবের আলো নিভিয়ে দিয়ে এবং ঘড়ির কাঁটাকে উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দিয়ে ইরানকে সেই ‘অন্ধকার যুগে’-অমুসলিম দেশসমূহ এখনো যে যুগে পড়ে আছে-ফিরিয়ে নেয়ার বিরতিহীন অপচেষ্টা সত্ত্বেও ইসলামি প্রশাসনের পরিচালনাধীনে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান বস্তুগত দিক থেকে যে ব্যাপক অগ্রগতি সাধন করেছে তা একদম সাদা চেখেই খুব সহজেই ধরা পড়ে।
তবে আজকের দিনে এবং প্রতিটি বড় ধরনের ঘটনার প্রতিটি বার্ষিকী উদ্যাপন কালে প্রকৃতই যে সাফল্যটির জন্য সর্বাধিক আনন্দ উদ্যাপন করা উচিত সেটি হচ্ছে তা-ই যা ইরানকে কুফ্রের জোয়াল থেকে মুক্তি দিয়েছে, আর তা নিহিত রয়েছে কুফ্রের প্রভাবকে ও ইরানের স্বার্থ জলাঞ্জলী দেয়ার বিনিময়ে পার্থিব সুবিধা হাসিলের লোলুপ প্রস্তাবকে নির্দ্বিধায প্রত্যাখ্যানের চেতনা, লক্ষ্য ও নৈতিক বৈধতা এবং সেই সাথে হযরত ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আত্মপ্রকাশের জন্য উম্মাহ্কে প্রস্তুত করার লক্ষ্যে যথার্থ ইসলামি সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠা।
বস্তুত ইসলামের বৈপ্লবিক সামাজিক সুবিচারকে কিছুতেই প্রতারিত বিশ্ববাসীর সামনে জাতিসংঘের ‘সর্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণা’, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘বিল্ অব্ রাইট্স্’, ফ্রান্সের ‘মানুষের অধিকারের ঘোষণা’ ও ‘নাগরিক অধিকারের ঘোষণা’ অথবা ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)-এর ‘মৌলিক অধিকারের চার্টার’ প্রভৃতি কর্তৃক ঝুলিয়ে দেয়া অন্তঃসারশূন্য ও বাকসর্বস্ব মিথ্যা প্রতিশ্রুতিসমূহের সাথে তুলনা করা চলে না। এসবের বিপরীতে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের বিপ্লবী সামাজিক সুবিচার হচ্ছে চেতনা ও কথা উভয় দিক থেকেই কোরআন, হাদিস ও সুন্নায় বিধৃত ইসলামের বিশ্বজনীন বাণী অনুযায়ী শাসনকার্য পরিচালনার একটি প্রকৃত অংশ।
আটলান্টিক বিশ্বের ‘সুবিচার’ যেখানে জনগণের নিকট কিছুই জিজ্ঞেস করে না, বরং তাদেরকে বিশ্বজোড়া ও গালভরা হাওয়াই প্রতিশ্রুতি প্রদান করে মাত্র, সেখানে ইসলামি সুবিচার যেমন দায়িত্ব ও কর্তব্য হিসেবে পরিগণিত তেমনি সে দায়িত্ব ও কর্তব্য পুরোপুরি পালন করাও অপরিহার্য। অন্যদিকে ইসলামি সুবিচার যেখানে এই দুনিয়ায় যা কিছু প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তা প্রদানের নিশ্চয়তা বিধান করে এবং সেই সাথে পরজগতের জন্যও প্রতিশ্রুতি প্রদান করে- যা অবশ্যই পালিত হবে, সেখানে আটলান্টিক বিশ্বের প্রতিশ্রুত ‘সুবিচার’ হচ্ছে এমন কিছু যারা তা ‘ক্রয় করা’র ক্ষমতা ও সামর্থ্য রাখে না তা তাদের আওতার বাইরে থেকে যায় এবং এর ফলে এ ‘সুবিচার’ তাদেরকে কিছুই প্রদান করে না। তেমনি আটলান্টিক বিশ্বের ‘সুবিচার’ যেখানে কেবল ব্যক্তির প্রতি দৃষ্টি রাখে, সেখানে ইসলামি সুবিচার সামষ্টিক স্বার্থের সাথে ব্যক্তিক অধিকার ও কর্তব্যের ভারসাম্য বিধান করে।
ইসলামি সুবিচার ও আটলান্টিক বিশ্ব্রে ‘সুবিচার’-এর মধ্যে এই যে অলঙ্ঘনীয় ব্যবধান – এর প্রতি দৃষ্টি রাখলে আর এতে বিস্ময়ের কোনো কারণ পাওয়া যাবে না যে, যেসব লোক ‘মানবাধিকার’ সম্পর্কে আটলান্টিক বিশ্বের অনবরত পরিবর্তনশীল সংবেদনশীলতাকে গ্রহণ করে নেয়ার কথা ঘোষণা করেন তাঁরা কেবল একটি অপসৃয়মাণ রাজনৈতিক ফ্যাশন হিসেবেই তা গ্রহণ করেছেন, নচেৎ তাঁরা এটা অনুধাবনে পুরোপুরি অক্ষম যে, সুবিচারের বিষয়টি ইসলামি শারীয়ায় যেভাবে বিবৃত হয়েছে অর্থাৎ একই সাথে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির ক্ষতি পূরণ করে দেয়া ও অপরাধীকে শাস্তি প্রদান- তা থেকে ব্যক্তিদেরকে বঞ্চিত করা মানে যৌক্তিক দৃষ্টিতেই নিকৃষ্টতম ধরনের সুস্পষ্ট ‘মানবাধিকার লঙ্ঘন’।
অনৈসলামিক শাসনাধীন দেশসমূহে অনবরত প্রচার করা হয় যে, ইরানের ইসলামি শাসনের বৈপ্লবিক ব্যবস্থা ‘মানবাধিকার’ লঙ্ঘনের কারণ হয়েছে। কিন্তু তাদের এ অভিযোগ যে নিছক রাজনৈতিক বাগাড়ম্বর, বিভ্রান্তিকর অপপ্রচার ও সত্য বিকৃতকরণ মাত্র-যার পিছনে কোনোরূপ সাক্ষ্য-প্রমাণ বা বাস্তব দৃষ্টান্তের ভিত্তি নেই-সে কথা বাদ দিলেও এতে কোনোই সন্দেহ নেই যে, প্রকৃতপক্ষে তাঁরা ‘অধিকার’ বলতে এমন কিছুকে বুঝিয়ে থাকেন যা ইসলামের অধিকারের ধারণা থেকে ভিন্ন এবং তাঁরা তাঁদের ধারণাকৃত সে ‘অধিকার’কে উন্নততর হিসেবে গণ্য করে থাকেন, যদিও তা পুরোপুরিভাবে কেবল কতক অপসৃয়মাণ সংবেদনশীলতা থেকে উৎসারিত; কর্পোরেটিস্ট ‘তথ্যবিনোদন’ শিল্প কর্তৃক-যা এখনো অশিক্ষিত সাধারণ লোকদের কাছে আরো বেশি ‘ব্রান্ডেড্’ সাবান, ফাস্ট্ ফুড ও সোডা পপ্ বিক্রির লক্ষ্যে এবং সেই সাথে কর্পোরেট মহল যে আমেরিকা-নিয়ন্ত্রিত নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখছে সে ফ্যান্টাসিকে এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে- আমেরিকানদের মন-মগযে ‘অধিকার’ সংক্রান্ত এ ধারণা বপন করে দেয়া হয়েছে।
ধর্মসম্পর্কহীন (সেক্যুলারিস্ট) লোকেরা অধিকন্তু ইরানের ইসলামি বিপ্লবকে, তাদের ধারণা অনুযায়ী, রাষ্ট্র ও সরকার ব্যবস্থাকে ধর্মীয় নির্দেশনার অধীন করার জন্য সমালোচনা করছে। যদিও স্বাভাবিক অবস্থায় সেই সব মুসলিম জনসংখ্যা অধ্যুষিত ভূখ-খণ্ডে এটা খুব একটা মন্দ নয় যে সব ভূখ-খণ্ডে জনগণ এখনো ইসলামি শাসন ব্যবস্থার আস্বাদন করতে সক্ষম হয় নি। তাছাড়া ঐ সব ভূখ-খণ্ডে এমন ‘পরহেযগার’ মুসলমানের অভাব নেই যারা নিজ নিজ দেশের ধর্মসম্পর্কহীন (সেক্যুলার) সরকারের ওপর প্রভাব বিস্তার করে গল্পের নায়কদের ন্যায় রাতারাতি প্রচুর ধনসম্পদের মালিক হয়েছে, তেমনি তাদের পাশাপাশি রয়েছেন এমন একদল আলেম যাঁরা আলে সউদের অর্থের প্রতি আনুগত্য পোষণ করে থাকেন- এ দুই গোষ্ঠী মিলে তাদের বাতিল ও বিভ্রান্তিকর চিন্তার সাহায্যে আটলান্টিক বিশ্বের ধৃষ্টতাকে আরো বেশি শক্তিশালী করে তোলার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। এ দু’টি গোষ্ঠী জোর দিয়ে অপপ্রচার চালাচ্ছে যে, ইরানের ইসলামি বিপ্লব রাজনীতি ও শাসন ব্যবস্থার ক্ষেত্রে দিকনির্দেশ প্রদানের মাধ্যমে ইসলামের ওপর বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে।
তবে আমেরিকানদের জন্য তাদের এতো সব সন্দেহাতীত ভুল-ত্রুটির কারণে, এখন চূড়ান্ত উপসংহারে উপনীত হতে না পারলেও অন্ততঃ নিজেদের ভুলগুলো সংশোধেনের সময় এসেছে বলে মনে করি।
সে যা-ই হোক, কতক মুসলমানের পক্ষে হয়তো এটা অনুধাবন করা সম্ভব হয়ে থাকবে যে, বেলায়াতে ফকীহ্ [একজন পথনির্দেশক বা অভিভাবক মুজতাহিদ কর্তৃক শারীয়ার ভিত্তিতে শাসন কর্তৃত্ব পরিচালনা] তত্ত্ব কোনোভাবেই ‘ইমামের আগে আসবে ঈমান’ ধারণার সাথে সাংঘর্ষিক নয়। অবশ্য এ বিষয়টি ভালোভাবে বুঝার জন্য বেলায়াতে ফকীহ্ তত্ত্ব সম্পর্কে এবং তা কীভাবে প্রয়োগ বা বাস্তবায়ন করা হয়েছে সে সম্পর্কে অধ্যয়ন ও গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু এ হচ্ছে এমন একটি কাজ, দুর্ভাগ্যজনকভাবে, অধিকাংশ র্ফিকাবায মুসলমান হয় তা করতে প্রস্তুত নয়, অথবা তা করার মতো যোগ্যতার অধিকারী নয়, তাই তারা এর পরিবর্তে ‘অনুসন্ধানের আগেই নিন্দা করা’র নীতি অনুসরণকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছেন।
প্রকৃতপক্ষে বেলায়াতে ফকীহ্ হচ্ছে এমন একটি শাসন ব্যবস্থা যাতে জনগণের সচেতনতার একটি ভূমিকা রয়েছে; বিশেষ করে জনগণ তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপারে নিজেরাই উপসংহারে উপনীত হয়ে থাকে, অন্যদিকে বাস্তবতার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে এটা সুস্পষ্ট যে, একজন সর্বোচ্চ মুজতাািহদ নেতৃত্ব ব্যতীত কেবল চেষ্টা-সাধনা ও ত্যাগ স্বীকারের ফলেই ইরানের ইসলামি বিপ্লব সংঘটিত হওয়া সম্ভবপর ছিল না- যে বিপ্লব সংঘটনের লক্ষ্য ছিল : (১) ‘নিপীড়ক শাসক শ্রেণি কর্তৃক দুর্বল করে রাখা জনগোষ্ঠীর অধিকারের সীমারেখা লঙ্ঘন’কে এবং ‘তাদের (শাসকগোষ্ঠী ও তাদের বশংবদ শ্রেণির) ভোগ-বিলাসিতা ও পার্থিব স্বার্থের জন্য জনগণের সম্পদ লুণ্ঠন ও তাদেরকে অনাচারে নিমজ্জিতকরণ’ প্রতিহত করা, (২) ‘তাঁবেদার পুতুল পার্লামেন্ট কর্তৃক অনৈসলামিক আইন অনুমোদন ও ইসলামি বিধি-বিধানে বিদ্‘আত্ প্রবেশ করানো’ রোধ করা, (৩) ইসলামি ব্যবস্থার হেফাযত করা ও সকল ব্যক্তিকে গোমরাহী থেকে রক্ষা করে ইসলামের সঠিক পথে ধরে রাখা, এবং (৪) ইসলামি ভূখ-সমূহে বিজাতীয় প্রভাবের বিলুপ্তি সাধন করা।
যেসব মুসলমান বেলায়াতে ফকীহ্ তত্ত্বের কারণে ইরানের ইসলামি শাসন ব্যবস্থার ব্যাপারে আপত্তি তুলছেন তাঁদের উচিত তাঁদের নিজেদেরকে আন্তরিকভাবে প্রশ্ন করা যে, তাঁদের কাছে অগ্রাধিকারের বিষয় কোনটি এবং তাঁদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কি প্রকৃত ইসলামি আশা-আকাক্সক্ষা, নাকি তাঁদের মাযহাবী বা ধর্মসম্পর্কহীন (সেক্যুলার) লক্ষ্য-উদ্দেশ্যসমূহ?
এ আলোচনার উপসংহারে বলতে হয় যে, ইরানের ইসলামি বিপ্লব-প্রকৃতপক্ষে স্বয়ং ইসলামের বিশ্বজনীন বাণী-ভারসাম্যপূর্ণ কল্যাণকর লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের ওপর ভিত্তিশীল, পার্থিব দৃষ্টিকোণ থেকে পুরুষদের ও নারীদের আশা-আকাক্সক্ষার ভিত্তিতে সজ্ঞায়িত নয়, বরং তা স্বয়ং আল্লাহ্ তা‘আলার পছন্দের দ্বারা সংজ্ঞায়িত। সুতরাং আমরা দ্বীনী দৃষ্টিকোণ থেকে মনে করি যে, ইসলাম ও ইরানের ইসলামি বিপ্লব উভয়ই চিরদিন টিকে থাকবে এবং যেসব চক্রান্তকারী ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সাফল্য ও অর্জনসমূহকে নিষ্ফল করে দেয়ার ও যা লিপিবদ্ধ হয়ে গিয়েছে তা মুছে ফেলার জন্য অক্লান্তভাবে কাজ করে যাচ্ছে, এসব অর্জন তাদের হস্তক্ষেপ ক্ষমতার আওতার বাইরেই থেকে যাবে। প্রকৃত ব্যাপার এই যে, এক সময় যা অসম্ভব বলে পরিগণিত হতো ইরানে তা-ই সম্ভব হয়েছে এবং এরপর তা টিকে গিয়েছে, আর এটাই আমাদেরকে এর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জানিয়ে দিচ্ছে।
সুতরাং, আল্লাহ্ তা‘আলার নামে আমরা ইরানের ইসলামি বিপ্লবকে অভিবাদন জানাচ্ছি। তেমনি আমরা ইরানি জনগণের দৃঢ় ইচ্ছার প্রতি এবং ইসলামি বিপ্লবে নেতৃত্ব দান ও প্রায় দীর্ঘ চার দশক যাবত যে কোনো পন্থায় ও যে কোনো মূল্যে ঘড়ির কাঁটা উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দেয়ার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের তাঁবেদার সরকারগুলোর পক্ষ থেকে বিরামহীন অপচেষ্টা চালানো সত্ত্বেও ইসলামি শাসন ব্যবস্থা পরিচালনার মাধ্যমে উত্তরোত্তর সাফল্য সহকারে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ অভিমুখে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের দৃপ্ত অভিযাত্রা নিশ্চিতকরণে সক্ষমতার কারণে আয়াতুল্লাহ্ উযমা হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ.) ও হযরত আয়াতুল্লাহ্ উযমা সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ীর প্রজ্ঞাপূর্ণ, আপোসহীন, দৃঢ় ও প্রগতিশীল নেতৃত্বের প্রতি অভিবাদন জানাচ্ছি।
অনুবাদ : নূর হোসেন মজিদী
*অত্র নিবন্ধে লেখক ব্যারি কে. গ্রোস্ম্যান্ যেসব মতামত ব্যক্ত করেছেন তা একান্তভাবেই তাঁর নিজস্ব মতামত; তাঁর প্রতিটি বক্তব্যে নিউজলেটার কর্তৃপক্ষের, বা ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান সরকারের, বা হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর বা রাহ্বার হযরত আয়াতুল্লাহ্ উযমা সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী-র মতের হুবহু প্রতিফলন ঘটে থাকবে- এটা অপরিহার্য নয়।
* ব্যারি কে. গ্রোস্ম্যান্ ১৯৮৪ সালে ক্যানাডার ইউনিভার্সিটি অব্ ক্যাল্গারী থেকে বি.কম. ডিগ্রি এবং এরপর ১৯৮৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি থেকে এল্.এল্.বি ডিগ্রি লাভ করেন। অতঃপর তিনি টরোন্টোর একটি শীর্ষস্থানীয় বাণিজ্যিক ল ফার্মে আইনজীবী হিসেবে কাজ করেন এবং এরপর ১৯৮৮ সালে অস্ট্রেলিয়া গমন করেন ও সেখানকার ইউনিভার্সিটি অব্ মেল্বোর্ন-এর ল ফ্যাকাল্টিতে শিক্ষকতা করেন। এরপর তিনি কয়েক বছর দ্য ন্যাশনাল্ অস্ট্রেলিয়ান্ ফার্ম অব্ ফ্রীউইল্, হোলিংডেল্ এন্ড্ পেজ-এ আইন উপদেষ্টা হিসেবে কর্মরত ছিলেন। অতঃপর তিনি মোনাশ ইউনিভার্সিটির ল ফ্যাকাল্টিতে সার্বক্ষণিক প্রভাষক হিসেবে চাকরি নেন। তিনি আইন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে প্রচুর লেখালেখি করেছেন এবং রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক বিষয়াদিতে ফ্রীল্যান্স ভাষ্যকার হিসেবে লিখে থাকেন। তিনি একজন মুসলমান এবং ১৯৯৯ সাল থেকে ইন্দোনেশিয়ায় বসবাস করে আসছেন।

প্রবাদ

سر و دست شکستن برای چیزی.
উচ্চারণ : সার ও দাস্ত শেকাস্তান বারা’য়ে চীযী
অর্থ : কোনো কিছুর জন্য মাথা ও হাত ভেঙে ফেলা।
মর্মার্থ : কোনো পছন্দের জিনিস হস্তগত করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালানো বুঝাতে এই প্রবাদের প্রয়োগ ব্যাপক।
سر و صدای چیزی را در آوردن.
উচ্চারণ : সার ও সেদা’য়ে চীযী রা’ দার অ’ওয়ার্দান
অর্থ : কোনো জিনিস নিয়ে হৈচৈ বাঁধানো।
মর্মার্থ : কোনো গোপন বা অজানা বিষয় বা সংবাদ প্রকাশ করে দেয়া বুঝাতে এই প্রবাদ ব্যবহৃত হয়।
سرو کله زدن.
উচ্চারণ : সার ও কাল্লে যাদান
অর্থ : মাথা ও মু-ু মারতে থাকা।
মর্মার্থ : দরকষাকষি করা, উচ্চবাচ্য করা, মুখেমুখে তর্ক করা বুঝাতে এই প্রবাদের প্রচলন ব্যাপক।
سر و گوش آب دادن.
উচ্চারণ : সার ও গূশ অ’ব দা’দান
অর্থ : মাথা ও কানে পানি দেয়া।
মর্মার্থ : কোথাও থেকে কোনো খবর উদ্ধার করা বা কমবেশি কোনো তথ্য উদ্ধার করা অর্থে প্রবাদটি ব্যবহৃত হয়।
سر و گوشش می جنبد.
উচ্চারণ : সার ও গুশাশ মী জুম্বাদ
অর্থ : তার মাথা ও কান লাফাচ্ছে।
মর্মার্থ : বয়োপ্রাপ্ত হয়েছে, বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি হয়েছে বা সাবালক হয়েছে মর্মে এই প্রবাদ ব্যবহৃত হয়। কথায় বলে সেয়ানা হয়ে গেছে।
سری درمیان سرهادرآوردن.
উচ্চারণ : সারী দারমেয়া’নে সারহা’ দার অ’ওয়ার্দান
অর্থ : মাথাসমূহের মাঝে একটি মাথা বের করা।
মর্মার্থ : নিজের চেয়ে বয়স্ক লোকদের মাঝে গণ্য হওয়ার অবস্থায় উপনীত হওয়া, সর্বমহলে গণ্য হওয়ার অবস্থায় পৌঁছা, বেশ মানমর্যাদার অধিকারী হওয়া।
سری که درد نمی کند دستمال نمی بندند.
উচ্চারণ : সারী কে দর্দ নেমী কুনাদ দাস্তমা’ল নেমী বান্দান্দ
অর্থ : যে মাথায় ব্যথা নাই তাতে রুমাল বাঁধে না।
মর্মার্থ : খামখা কেন নিজের জন্য মাথাব্যথা সৃষ্টি করতে হবে, ভাবার্থ প্রকাশের জন্য এই প্রবাদটি প্রচলিত।
سری که عشق ندارد کدوی بی بار است.
উচ্চারণ : সারী কে এশ্ক নাদা’রাদ কদুয়ে বী বা’র আস্ত
অর্থ : যে মাথায় প্রেম নাই নিষ্ফল কদু তা
মর্মার্থ : যার মধ্যে কোনো উৎসাহ-উদ্দীপনা নাই, কোনো কিছুর প্রতি আগ্রহ দেখা যায় না, কোনো কিছুই সে অর্জন করতে পারে না।বাদ

তাঁর বিদেহী আত্মার প্রতি

তাঁর বিদেহী আত্মার প্রতি
[মুহাম্মদ ফরিদউদ্দীন খান স্মরণে। (মৃত্যু: জুলাই, ২০১৭)]
সিরাজুল হক

যে মানুষ চলে যায় এই পৃথিবী ছেড়ে আসবে কি সে
কভু এই ধূলির ধরায় আর কোনো দিন?
কত প্রিয়জন বন্ধু স্বজন কেউ নাই তাঁর পাশে,
শুধু গভীর মৃত্তিকা গর্ভে অন্ধকার কবরে একা একা,
রহমতের পরশ পেয়ে হয়তো রয়েছে আচ্ছন্ন গভীর নিদ্রায়-
থাকতে হবে কত কাল কত দিন এইভাবে কে জানে?
পাব না কভু ইহজগতে তাঁর দেখা, তাই হারাবার বেদনা
আজ সবার মনে;
সে ব্যথার নাই উপশম কস্মিনকালে
কত ভালোবাসা প্রীতিসম্ভাষণ হাসিমাখা মুখ,
আচমকা হলো তিরোহিত আমাদের মাঝ থেকে।
ছিল যেজন সেবার মূর্তপ্রতীক দেশে ও বিদেশে,
রেডিও তেহরানে তাঁর দীর্ঘ সেবা আজও রয়েছে স্মরণীয় হয়ে।
সে মানুষটির কথা ভুলি কী করে, মনে হয়-
এখনও তাঁর চেহারা চোখে ভাসে মুহূর্তে মুহূর্তে।
ভাবি, দেশ-বিদেশ থেকে সংগৃহীত তাঁর গ্রন্থমালা-
হয়তো পরে থাকবে অযত্ন আর অবহেলায়
কালের পর কাল, কে দেখবে?
আজ তাঁর বিদেহী আত্মার প্রতি জানাই সালাম
আর মাগফেরাত করি কামনা দয়াময় প্রভুর কাছে।

১৮/১০/২০১৭

প্রেমের গল্প বলা রহস্যজ্ঞানী কবি নিযামী

প্রেমের গল্প বলা রহস্যজ্ঞানী কবি নিযামী
ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী
শেখ সাদী, হাফেয শিরাযী, মওলানা রূমী, মওলানা আব্দুর রহমান জামী, হাকিম আবুল কাসেম ফেরদৌসী প্রমুখের সাথে অপর যে ফারসি কবি বিশ^জয় করেছেন, তিনি হলেন প্রেমের গল্প বলা রহস্যজ্ঞানী কবি নিযামী। হিজরি ষষ্ঠ শতকে ফারসি ভাষার অসাধারণ কবি হিসেবে তিনি গণমানুষের বুলি, কথ্য ভাষা ও গল্পধারাকে কবিতায় রূপায়িত করে প্রেমের সৌধমালা রচনা করেন। ফারসি ভাষা ও কবিতাকে বিশ্ব দরবারে অমরত্ব দানে যেসব কবির অবদান চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে তাঁদের আসরে নিযামীর আসন সোনায় মোড়ানো অলঙ্কৃত। দুঃখজনক হলেও সত্য, মহাকবি হাফিযের মতো নিযামীর জীবন প্রণালী সম্পর্কেও বিস্তারিত জানার সুযোগ একেবারে সীমিত। তাঁর বর্ণাঢ্য জীবন সম্পর্কে যেটুকু জানা যায় তার সূত্র তাঁর সাহিত্যকর্ম। তাঁর কবিতা বিশ্লেষণ করে গবেষকগণ তাঁর একটি জীবনচিত্র উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন।
শৈশব
কবি নিযামীর পুরো নাম জামাল উদ্দীন আবু মুহাম্মদ ইলিয়াস ইবনে ইউসুফ ইবনে যাকি। আনুমানিক ৫৩৭ হিজরি/ ১১৪১ খ্রিস্টাব্দে তাঁর জন্ম এবং ৬০৮ হিজরি/১২০৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইন্তিকাল করেন। তাঁর পিতার নাম ইউসুফ। পরপর একেক স্ত্রীর ইন্তিকালে তাঁর স্ত্রীর সংখ্যা জানা যায় তিনজন। তাঁর একমাত্র সন্তানের নাম মুহাম্মদ।
নিজামীর জন্মস্থান ‘গাঞ্জে’। এটি বর্তমানে আযারবাইজান প্রজাতন্ত্রে অবস্থিত। তাঁর পিতৃপুরুষ তাফাররুশ এর অধিবাসী ছিলেন বলে অনুমান করা হয়। তাঁর মায়ের নাম রাঈসা এবং তিনি কুর্দি বংশোদ্ভূত। নিযামী অল্প বয়সে এতিম হয়ে যান। তখন থেকে তাঁর মামা ‘খাজা উমর’ তাঁকে লালন পালন ও শিক্ষা-দীক্ষা দিয়ে বড় করেন।
দাম্পত্য জীবন
নিযামী তিনবার বিয়ের পিঁড়িতে বসেন। প্রথম স্ত্রীর নাম আফাক। দারবান্দ এর শাসক বাহরাম শাহ এই ক্রীতদাসী বালিকাকে নিযামীর জন্য উপহার হিসেবে পাঠিয়েছিলেন। তিনি তাঁকে বিবাহ বন্ধনে নিয়ে নেন। তাঁর সবচেয়ে প্রিয়তমা এই স্ত্রীর ঘরেই একমাত্র সন্তান মুহাম্মাদ জন্মলাভ করে। নিযামী যখন তাঁর ‘খসরু শিরীন’ কাব্য রচনা সমাপ্ত করেন তখন আফাক তাঁর কাছ থেকে চিরবিদায় গ্রহণ করেন। সে সময় মুহাম্মাদের বয়স সাত বছরের বেশি ছিল না। আশ্চর্যের বিষয় হলো, নিযামীর আরো দু’জন স্ত্রী যৌবনকালেই মৃত্যুবরণ করেন। আর উভয়ের মৃত্যু হয় তাঁর একটি করে কাব্য রচনা সমাপ্ত হওয়ার পরে।
শিক্ষাদীক্ষা
নিযামী প্রাচীনকালের অধিকাংশ জ্ঞানী-মনীষীর মতোই প্রচলিত বৃদ্ধিবৃত্তিক ও পুঁথিগত জ্ঞানে পারদর্শী ছিলেন। সাহিত্য ও আরবি ভাষা বিষয়ক জ্ঞানে ব্যুৎপত্তি, আধ্যাত্মিকতা, চিন্তা-দর্শন, চরিত্রবিজ্ঞান, কোরআন, হাদিস, ফিকাহ্ ও ইতিহাসশাস্ত্রে যুগের শ্রেষ্ঠ জ্ঞানীদের প্রথম কাতারে ছিলেন এবং মানবসভ্যতায় যাঁরা যুগে যুগে অবদান রেখেছেন তাঁদের মধ্যে শামিল হয়েছেন। আধ্যাত্মিক জ্ঞান ছাড়াও গণিত, পদার্থবিজ্ঞান ও জ্যোতির্বিজ্ঞানে তাঁর পারদর্শিতা তাঁর কবিতার মধ্যে পরিস্ফুট হয়ে আছে। যার ফলে তিনি হাকীম নিযামী বা তত্ত্বজ্ঞানী কবি নিযামী হিসেবেও সমধিক পরিচিত। নিযামীর জীবনকাল ছিল আযারবাইজান ও মূসেল এ আতাবাক বংশীয় শাসকদের এবং শিরওয়ান শাহদের সমসাময়িক। আধ্যাত্মিকতার প্রতি বিশেষ আকর্ষণ কবি নিযামীকে নির্জনতা অবলম্বন এবং জাগতিক ভোগ-বিলাসের প্রতি উদাসীন করেছিল বলে প্রতীয়মান হয়। ফলে তিনি রাজা-বাদশাহদের দরবার ও আনুকূল্য গ্রহণ থেকে দূরে থাকতেন।
রচনাবলি
নিযামীর সবচেয়ে বড় কাব্যকীর্তি ‘খামসায়ে নিযামী’, যা পাঞ্জগাঞ্জে নিযামী বলেও পরিচিত। আরবিতে খামসা অর্থ পাঁচ আর ফারসিতে বলা হয় পাঞ্জ। গাঞ্জ এর অর্থ ধনভা-ার। একে পাঁচ ধনভা-ার হিসেবে আমরা বাংলায় অনুবাদ করতে পারি। উল্লেখ্য যে, বাংলা পাঁচ শব্দটি এসেছে ফারসি পাঞ্জ থেকে। নানা উপাখ্যান নিয়ে গীতি কবিতার এই বিশাল ভা-ারে বয়েতের সংখ্যা ২০ হাজার ছাড়িয়ে যাবে। এই অনন্য সৃষ্টিই নিযামীকে বিশ^সাহিত্যে অমর করে রেখেছে। ‘খামসা’ রচনার জন্য নিযামী তাঁর জীবনের ত্রিশটি বছর অতিবাহিত করেন। ‘খামসা’র অন্তর্ভুক্ত পাঁচ কাব্যগ্রন্থ হচ্ছে :
১. মাখযানুল আসরার (রহস্যসমূহের ভাণ্ডার)
এটি ফারসি ভাষায় শিক্ষামূলক সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নমুনা। এতে রয়েছে আনুমানিক ২২৬০ বয়েত বা দ্বিপদী শ্লোক এবং তা ২০টি অধ্যায়ে বিন্যস্ত। এর মূূল বিষয়বস্তু চরিত্র, উপদেশ ও হিকমত বা তত্ত্বজ্ঞান। ৫৭০ হিজরিতে তাঁর বয়স যখন চল্লিশের কোটায় তখন আধ্যাত্মিক ভাবধারার এই কাব্যগ্রন্থটির রচনা তিনি সমাপ্ত করেন। গ্রন্থটি তিনি ফখরুদ্দীন বাহর শাহ দাউদ (মৃত ৬২২) এর নামে উৎসর্গ করেন।
২. খসরু ও শিরীন
আর্মেনিয়ার রাজকুমারী শিরীন শাহদুখতের প্রতি সাসানি বাদশাহ খসরু পারভেজের প্রেমের আলেখ্য নিয়ে রচিত। ৫৭৬ হিজরিতে গ্রন্থটির রচনা সমাপ্ত করেন এবং তা আতাবক শামসুদ্দীন মুহাম্মদ জাহান পাহলোয়ান ইবনে ইল্দ্গেয (৫৬৭-৫৮১ হিজরি) এর নামে উৎসর্গ করেন। এই কাব্যগ্রন্থের বয়েত বা দ্বিপদী শ্লোকের সংখ্যা ৬৫০০।
৩. লাইলী ও মজনূন
নিযামীর আগেও ফারসি কবিতা ও সাহিত্যে লাইলী মজনুন এর চর্চা ছিল। কিন্তু নিযামীই প্রথমবারের মতো লাইলী ও মজনুন এর প্রেমকাহিনীকে একটিমাত্র কাব্যগ্রন্থে গ্রন্থিত করেন, যার কলেবর ৪৫০০ বয়েত। এই কাব্যগ্রন্থ কবি নিযামী শেরওয়ানশাহ আবুল মুজাফফর আখেস্তান এর নামে রচনা করেন।
আরবের জাহেলি যুগে সাদ এর মেয়ে লাইলীর সাথে আমেরী গোত্রের কায়স আমেরী বা মজনুন এর মর্মস্পর্শী বেদনাময় প্রেমের আলেখ্য নিয়ে এই কাব্যগ্রন্থটি রচিত। তিনি মাত্র চার মাসে এই কাব্যগ্রন্থটি রচনা করেন। এই কাব্যগ্রন্থের ছন্দরীতি অভিনব। এ কারণে নিযামীর পরে বহু ফারসি কবি তাঁর অনুকরণে প্রেমকাব্য রচনার উদ্যোগ নিয়েছেন। অনেকে লাইলী ও মজনুন এর প্রেমকাহিনী গিয়ে নিযামীর গ্রন্থে বহু সংযোজন করেছেন কিংবা সেখান থেকে উপাদান নিয়ে নিজের মতো করে কাব্যকীর্তি নির্মাণের চেষ্টা করেছেন। নিযামীর লাইলী ও মজনুন রচনা সমাপ্ত হয় ৫৮৪ হিজরিতে।
৪. হাফ্ত পায়কর
এটি মূলত বাহরাম গুরের রূপকথার ইতিকথা। এই গ্রন্থ ‘বাহরামনামা’ ও ‘হাফ্ত গোম্বাদ’ নামেও খ্যাত। কবি এটি মারাগে এর বাদশাহ আলাউদ্দীন কারাপ আরসালানের নামে ৫৯৩ হিজরিতে উৎসর্গ করেন। এই কাহিনীকাব্যের অন্তর্ভুক্ত রয়েছে সাসানি যুগ সম্পর্কিত সাতটি ইরানি গল্প। তাতে হাফ্ত একলিম এর বাদশাহদের সাত কুমারীর সাথে বাহরামগূর (৩৪৮-৪২০) এর সম্পর্কের ইতিকথা বিবৃত হয়েছে। বাহরাম তাঁদের প্রত্যেকের জন্য ভিন্ন ভিন্ন বিশেষ রঙের গম্বুজ নির্মাণ করেন এবং সপ্তাহের প্রত্যেকদিন একেক জনের মেহমান হন। এভাবে প্রত্যেককে নিয়ে একেক গল্পের অবতারণা হয়।
৫. ইস্কান্দারনামা
এটি ‘কারাপনামা’ ও ‘ইকবালনামা’ নামে দুই খণ্ডে বিভক্ত। ৬০০ হিজরির দিকে এই কাব্যগ্রন্থ রচনা করেন। এতে বয়েতের সংখ্যা দশ হাজার পাঁচ শত।
‘খামসা’র অন্তর্ভুক্ত প্রতিটি গ্রন্থ কাব্যকলা, অলংকারশাস্ত্র ও মিষ্ট ভাষায় উজ্জ্বল নক্ষত্রের ন্যায় দেদীপ্যমান। এর মধ্যে ‘মাখজানুল আসরার’ হচ্ছে রচনার দিক থেকে সবচেয়ে পুরনো আর রচনাশৈলির বিচারে সর্বোত্তম হলো খসরু ও শিরীন। এর বাইরে আছে ‘দীওয়ান’ বা কাব্যগ্রন্থ। ‘দীওয়ান’ এ রয়েছে কাসিদা, গজল, কিতআ ও রূবাইয়্যাত ধরনের কবিতার সমষ্টি।
ফারসি মরমি কবিতার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, অনেক কবি প্রথমে শ্রোতা বা পাঠকমনকে দুনিয়ার প্রেম, প্রেয়সী, কোঁকড়ানো চুল, বেণির সুগন্ধ, কপোলের তিল, থুতনির কূপ, চোখের ভ্রুর মায়াজাল, বাঁকা চোখের চাহনির জাদু প্রভৃতির জন্য পাগল করেন, তারপর জাগতিক প্রেম বা দেহসর্বস্বতার অসারতা প্রমাণ করে পরম বন্ধু আল্লাহর সন্নিধানে নিয়ে যান। নিযামীর প্রেমকাব্যও এর ব্যতিক্রম নয়।
নিযামীর ‘মাখজানুল আসরার’ এর সূচনার কবিতাটিতে বর্ণিত হয়েছে আল্লাহর একত্ববাদের কথা। তার কয়েকটি ছত্র নিম্নরুপ।
ای همه هستی زتو پیدا شده
خاک ضعیف از تو توانا شده
ওহে গোটা সৃষ্টি পয়দা হয়েছে তোমার থেকে
দুর্বল মাটি শক্তিমান হয়েছে তোমার পরশে।
زیر نشین علمت کائنات
ما به تو قائم چو تو قائم به ذات
সৃষ্টিরাজি সবকিছু তোমার জ্ঞানের নখদর্পণে
আমরা স্থিত তোমাতে, তুমি স্থিত তোমার সত্তায়।
هستی تو صورت و پیوند نه
تو به کس و کس به تو مانند نه
তোমার অস্তিত্বের অবয়ব নাই, যোগ বিয়োগহীন
তুমি নও কারো আর তোমার নয় কেউ সদৃশ।

آنچه تغیر نپذیرد توئی
آنچه نمرده است و نمیرد توئی
যার পরিবর্তন নাই সেই সত্তা তুমিই
যা মরে নি ও মরবে না সে তুমিই।
ما همه فانی و بقابس تر است
ملک تعالی و تقدس تر است
আমরা সবাই ক্ষণিকের স্থায়িত্ব কেবল তোমার
সমুন্নত অক্ষয় পবিত্র পরম সত্তা তোমারই।
নিযামীর কবিতার বৈশিষ্ট্য
দৃশ্যপটের রূপকল্প অঙ্কণ আর মজলিসের জৌলুস সাজানোর কথাশিল্পে নিযামী ফারসি সাহিত্যের অনন্য কবি। আনন্দঘন মুহূর্তের মধুর চিত্রায়নে তাঁর সমকক্ষ দ্বিতীয়জন নেই। তাঁর ভাষা মধুর, শব্দমালা নরম নাজুক চিত্তাকর্ষক। বাচনভঙ্গি হৃদয়গ্রাহী। গবেষকরা বলেছেন, তিনি কোনো বীরত্বগাথা রচনা করতে গিয়েও রসের অবতারণা করে বসেন। এককথায় ফারসি গীতিকবিতা ও গল্প রচনায় নিযামী অপ্রতিদ্বন্দ্বি। তাঁর উপমা উৎপ্রেক্ষাগুলো মনোজ্ঞ, শৈল্পিক ও রূপকল্পে আকীর্ণ। নিসর্গের আবহ ও সরেজমিন চিত্রায়নে তাঁর পারঙ্গমতা ঈর্ষণীয়। তবে জ্ঞান-বিজ্ঞান, ধর্মীয় বা আরবি ভাষা ও সাহিত্যের বর্ণনায় গিয়ে তাঁর ভাষা অনেক গভীর। কারো কারো কাছে জটিল ও কঠিন বলেও প্রতীয়মান হতে পারে।
নিযামী তাঁর আগেকার মহাকবি ফেরদৌসীর নামোল্লেখ করেছেন তাঁর কয়েকটি কাব্যগ্রন্থে। ‘শাহনামা’র কয়েকটি গল্পও নিযামীর কবিতায় পাওয়া যায়। ফেরদৌসীর ‘শাহনামা’র সাথে কোনো কোনো কবিতায় নিযামীর কবিতার চমৎকার মিল রয়েছে। যেমন-
دو گوهر بود در یک انگشتری
چنان دان که شاهی و پیغمبری
দুই রত্ন ছিল একটি আংটির ওপর
এমন জান যে, এক বাদশাহ ও এক পয়গাম্বর।
-ফেরদৌসী
چو دو نگین است در انگشتری
نزد خرد شاهی و پیغمبری
দুটি পাথরের মতো শোভিত এক আংটির ওপর
জ্ঞানীর দৃষ্টিতে এক বাদশাহ ও এক পয়গাম্বর।
-নিযামী
ندانم چه ای هرچه هستی تویی
جهان را بلندی و پستی تویی
জানি না তুমি কী? যাকিছু হও তুমিই
জগতের উচ্চতা ও নিচুতা সব তুমিই।
-ফেরদৌস
پناه بلندی و پستی تویی
همه نیستند آنچه هستی تویی
উচ্চতা ও নিচুতার আশ্রয় তুমিই
সবাই অস্তিত্বহীন যাকিছু আছ, তুমিই।
-নিযামী
নিযামীর কাব্যশৈলীর কারণে তাঁর পরের অনেক শ্রেষ্ঠ কবি তাঁর অনুকরণে প্রেমকাব্য রচনার প্রয়াস পেয়েছেন। যেসব শক্তিমান কবি তাঁর অনুকীর্তিতে কাব্য রচনা করেছেন আবদুর রহমান জামী ও আমীর খসরু দেহলবী তাঁদের অন্যতম। উভয়ের রচিত ‘লাইলী ও মজনুন’ কাব্যগ্রন্থ বিশ্বসাহিত্যের অনবদ্য অলঙ্কার। বাংলা পুঁথিসাহিত্যে দৌলত উজির বাহরাম খান রচিত ‘লায়লী মজনুন’ কাব্য মূলত কবি নিজামী বা কবি মওলানা আবদুর রহমান জামীর ‘লাইলী ও মজনুন’ নামক কাব্যের ভাবানুবাদ।
ইন্তিকাল
নিযামী নিজের নিবাস গাঞ্জের বাইরে কোথাও সফর করেন নি। শুধু বাদশাহ কাযাল আরসালান (৫৮১-৫৮৭) এর আমন্ত্রণে গাঞ্জের অন্তর্গত একটি এলাকায় একবার মাত্র সফর করেছিলেন। তিনি তেষট্টি বছর বয়সে নিজ জন্মস্থান গাঞ্জে ৬০২ হিজরিতে ইন্তিকাল করেন। সেখানেই তাঁর সমাধি অবস্থিত।

সিনেমাকে কিভাবে দেখব

অধ্যাপক মাসউদ সোফলায়ীর কর্মশালা-
সিনেমাকে কিভাবে দেখব
সাইয়্যিদ শাহজাদা আল কারীম*

খ্রিস্টের জন্মের বহু বছর পূর্ব থেকে পৃথিবীতে শিল্প-সাহিত্যসমৃদ্ধ যে জাতির অস্তিত্ব সেই পারস্য জাতিই আজকের ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান। যুগে যুগে বহু জাতি অন্য জাতির করায়ত্ত হয়েছে, কিন্তু এ ভূখণ্ডের জনগণ অনেক ক্রান্তি কালেও কারো কাছে মাথা নত করে নি। সেই পারস্য জাতি ইসলামি বিপ্লবের পরে বর্তমানে বিশ্বের কাছে এক নতুন আঙ্গিকে পরিচিত। নানা দিকে স্বকীয়তা বজায় রাখার সাথে সাথে চলচ্চিত্র জগতেও ইরান করেছে নিজস্ব ধাঁচের প্রকাশ।
ইরানি নাটক, সিরিয়াল, আর্টফিল্ম, সিনেমা আজ একটি স্বতন্ত্র ধারা হিসেবে বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠিত। পৃথিবীর সকল ফিল্ম ফেস্টিভালে দাপটের সাথে বিচরণকারী ইরানি চলচ্চিত্রকে অস্ট্রেলিয়ান ফিল্মমেকার মিশেল হেনেক ও জার্মান ফিল্মমেকার ওয়ার্নার হারজক One of the world most important artistic Cinema হিসেবে অভিহিত করেছেন। ১৯৯২ সালে চীনে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয়েছিল ইরানি চলচ্চিত্র। বাংলাদেশের সকল ফেস্টিভালে ইরানি চলচ্চিত্রের সাবলীল বিচরণ এবং বাংলায় ডাবিংকৃত ইরানি চলচ্চিত্র মানেই টিভি সেটের সামনে পুরো পরিবারের উপস্থিতি যা সুস্থ সংস্কৃতির প্রতি সমর্থনেরই পরিচায়ক। এসব কিছু কিন্তু বিপ্লবের দর্শনে বিশেষ কোড মেনেই হচ্ছে। এতে সিনেমার শিল্পমান, অ্যাকশন ও ইমোশান ক্ষুণ্ণ হয়নি। নৈতিকতা, মানবিকতা, প্রকৃতি ও শিশুদের ব্যাপক উপস্থিতি ইরানি চলচ্চিত্রে লক্ষ করা যায়। আরেকটি দিক এখানে বলতেই হবে, এসব চলচ্চিত্রে আক্ষরিকভাবে ধর্মীয় কোন নির্দেশনা বা ডায়ালগ সাধারণত দেখা যায় না। তবে উপন্যাস ও চরিত্রনির্ভর প্রতিটি ফিল্ম থেকে মানুষ কিছু না কিছু শিক্ষা গ্রহণ করে যা পৃথিবীর অনেক বড় বড় ইন্ডাস্ট্রি বিশ্বকে দিতে পারে নি।
ইরানের চলচ্চিত্রের কথা বললেই আমাদের মনে আসে আব্বাস কিয়ারোস্তামি, মাজিদ মাজিদি, জাফর পানাহী, আসগর ফরহাদিসহ আরো কিছু বিশ্বনন্দিত নাম। সুশীল ও নৈতিক কোড মেনেই কীভাবে মনোগ্রাহী দৃশ্য নির্মাণ করা যায়, মরুভূমিতে কীভাবে ফুল ফোটানো যায় তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ যেন ইরানের চলচ্চিত্র। যে কোন বিষয়েই উচ্চ অবস্থানে পৌঁছতে হলে ব্যবহারিক জ্ঞানের পাশাপাশি তাত্ত্বিক জ্ঞানের সমন্বয় প্রয়োজন। ঠিক সেকথার সার্থকতা প্রমাণ করতেই যেন আজ থেকে প্রায় তিপ্পান্ন বছর পূর্বে ১৯৬৪ সালে তেহরান ইউনিভার্সিটি অব আর্ট এ সিনেমা ও থিয়েটার বিভাগ চালু হয় যা পরবর্তীকালে দুটি আলাদা বিভাগে বিভক্ত হয়।
বাংলাদেশে চলচ্চিত্রের শুরু অনেক পূর্বে হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক পড়াশোনার চলনটা একেবারে নতুন বললেই চলে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সর্বপ্রথম ২০১২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে টেলিভিশন ও চলচ্চিত্র অধ্যয়ন নামে একটি বিভাগ চালু হয় যা বর্তমানে টেলিভিশন, ফিল্ম ও ফটোগ্রাফি বিভাগ নামে পরিচিত।
চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটের সাথে অনেকাংশেই সঙ্গতিসম্পন্ন ইরানের মাধ্যমে বৈশ্বিক চলচ্চিত্রের সাথে দেশীয় চলচ্চিত্রের তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক বিষয়গুলোর সমন্বয় সাধনের প্রয়াসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টেলিভিশন, ফিল্ম ও ফটোগ্রাফি বিভাগ আমন্ত্রণ জানায় তেহরান আর্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেমা বিভাগের বর্তমান চেয়ারপার্সন প্রফেসর মাসউদ সোফলায়ীকে।
ইরান কালচারাল সেন্টারের যোগাযোগ ও সমন্বয়ের ধারাবাহিকতায় ৮ জানুয়ারি বাংলাদেশে আসেন তিনি। উদ্দেশ্য তাঁকে নিয়ে বিভাগের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর দুটি ব্যাচের সাথে পাঁচ দিন করে দশদিনের কর্মশালার আয়োজন করা। স্যারকে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে আনতে যাই আমরা তিনজন- আশিক, মমিনুল ভাই আর আমি।
মজার একটা ঘটনাও ঘটে তখন। এয়ারপোর্টে আমরা তিনজন তিন জায়গায় স্যারের নাম লিখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। একটু পরে আশিক এসে বলল : ‘স্যার চলে এসেছেন, দেখা হয়েছে, ভেতরে আছেন।’ মমিনুল ভাই সামনে এক ইরানি ভদ্রলোককে দেখিয়ে বললেন : ‘ইনিই স্যার।’ আমার একটু খটকা লাগলো। কারণ, নেটে সার্চ দিয়ে স্যারের ঝকঝকে কোন ছবি না পেলেও যা পেয়েছিলাম সেই ছবির সাথে এই ভদ্রলোকের কোন মিল নেই। যাই হোক, কিছুক্ষণ পর ইরান কালচারাল সেন্টার থেকে ফোন পেয়ে জানতে পারলাম স্যারকে শুভেচ্ছা জানাতে ইরান কালচারাল সেন্টারের পক্ষ থেকে এসেছেন সাংস্কৃতিক কর্মকর্তা জনাব জাওয়াদি। বুঝলাম সামনের ভদ্রলোকটিই জনাব জাওয়াদি। আমাদের বুঝতে ভুল হয়েছিল। একটু পর স্যার ইমিগ্রেশন পেরিয়ে আসলেন আর আমরা তাঁকে নিয়ে চললাম ঢাকা ক্লাবের উদ্দেশে। যাবার পথেই স্যারের সাথে অনেক বিষয় আলোচনা হলো। জানলাম তিনি বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নিয়ে অনেক আশাবাদী। জানতে চান এখানকার বর্তমান অবস্থার কথা, শিক্ষার্থীদের সাথে আলোচনা করতে চান বিশ্বের নানা প্রান্তের চলচ্চিত্র নিয়ে।
স্যার যে কদিন ছিলেন, স্যারের গাইড হিসেবে দায়িত্ব ছিল আমার ওপর। প্রতিদিন ক্লাসের আগে স্যারকে ঢাকা ক্লাবের গেস্ট হাউস থেকে নিয়ে আসা, ক্লাসের পর পৌঁছে দেয়া, এছাড়া ঢাকার ঐতিহ্যবাহী কিছু জায়গায় স্যারকে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো ইত্যাদি ছিল আমার কাজ, যে কারণে স্যারকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ ঘটেছিল।
স্যারের সম্পর্কে বলতে গেলে, প্রথমত স্যার খুব সুন্দর মনের একজন মানুষ। শিক্ষার্থীদের সাথে তাঁর আচরণ যেন বন্ধুত্বের পর্যায়ের। যেমন সিনেমার শিক্ষক, তেমনি তিনি নিজেও সিনেমা বানান। এপর্যন্ত তিনি সবমিলিয়ে প্রায় ২০০ সিনেমা সম্পাদনার কাজ করেছেন। এছাড়া নিজের পরিচালনায় তাঁর আছে বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র। স্যারের ভাষ্যমতে একজন শিল্পীর প্রথম যে বিষয়টা থাকা দরকার সেটা হচ্ছে তার মানবীয় গুণ, বিবেকবোধ; নিজের মনের মধ্য দিয়ে অন্যের অবস্থাকে পর্যবেক্ষণ করে নিজেকে ঐ পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারার ক্ষমতা। তারপর তা নিজের শিল্পবোধের মাধ্যমে প্রকাশ করা। দেখলাম স্যারকে নিয়ে যখনই শাহবাগের ওভারব্রিজের উপর দিয়ে রাস্তা পার হচ্ছি তখনই তিনি ওভারব্রিজে বাস করা ঘরহীন মানুষদের দেখে অস্বস্তি বোধ করছেন, বলছিলেন ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় যেখানে তিনি হোটেল রুমে বসে ঠা-ায় কাঁপছেন সেখানে খোলা জায়গায় ঠান্ডা বাতাসে এরা কীভাবে বেঁচে আছে! শেষ পর্যন্ত একদিন তিনি বলেই ফেললেন : ‘আমরা ওভারব্রিজ দিয়ে না গিয়ে অন্য কোনো ভাবে যেতে পারি?’
ক্লাসে স্যার দেখালেন কীভাবে একটি সিনেমার প্রতিটি ফ্রেম ধরে বিশ্লেষণ করা যায়, কীভাবে একটি আইডিয়া থেকে ধীরে ধীরে একটি চমৎকার চলচ্চিত্র তৈরি হয়, কীভাবে চলচ্চিত্রে ফিল্ম লুক দেয়া যায়, মোড ক্রিয়েট করা যায়, সম্পাদনার টেবিলে কী করে ধারণকৃত চিত্রগুলোকে নতুন রূপ দেয়া যায় ইত্যাদি নানা বিষয়। তিনি বলছিলেন : ‘সিনেমার জন্ম পাশ্চাত্যে এবং তাদের সিনেমার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে। আমাদের প্রাচ্যের মানুষ যখন সিনেমা তৈরি করব, তখন আমরা পাশ্চাত্যের কাছ থেকে শিক্ষা নেব ঠিকই, কিন্তু আমাদেরকে আমাদের গল্প নিজেদের ভাষায় বলতে পারতে হবে আর তখনই সেটা আমাদের সিনেমা হয়ে উঠবে।’
ইরানের সিনেমা যেহেতু ইতোমধ্যেই নিজেদের ধারা তৈরি করেছে সেকারণে স্যার দেখাচ্ছিলেন কোন কোন দিক দিয়ে ইরানের সিনেমা পশ্চিমের সিনেমা থেকে আলাদা। ইরানের সিনেমার গল্প বলার ধরনে মূলত পরিবর্তন এনেছে চারটি বিষয়। স্থান, চরিত্র, ভাষা আর দৃশ্য পরিকল্পনা। স্থান বা লোকেশনের দিকে ইরানের চলচ্চিত্রে বিশেষ করে অ্যাকচুয়াল লোকেশন এর ব্যবহার, চরিত্রের ক্ষেত্রে ভিন্ন ধারার চরিত্র বা ভিন্ন বৈশিষ্ট্যস¤পন্ন চরিত্র যাকে বলা হয় ত্রিমাত্রিক চরিত্র এবং চরিত্রের চিত্রায়নে সহজ ভাষা ব্যবহার বেশি লক্ষ্য করা যায়। ভাষার ক্ষেত্রে আঞ্চলিকতা পরিহার এবং দর্শকদের বোঝার সুবিধার্থে সহজ শব্দের ব্যবহার এবং সংলাপের বিশেষায়ন ইত্যাদি লক্ষণীয়। দৃশ্য পরিকল্পনায় নিজেদের সংস্কৃতির বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরাসহ নিজেদের চিত্রকর্ম, আলোকচিত্র থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে চিত্র পরিকল্পনা প্রাধান্য পেয়েছে। এছাড়া মুসলিম দেশ হিসেবে সেন্সরশিপের নিয়ম অনুযায়ী সিনেমা বানাতে গিয়ে পরিচালকরা এমনভাবে গল্প বলেছেন যেখানে নারী পুরুষের অন্তরঙ্গ দৃশ্য দেখানোর প্রয়োজনীয়তা বোধ হয় না। আর এটা করতে গিয়ে তাদের হতে হয়েছে আরো বেশি সৃজনশীল যা ঐ চলচ্চিত্রগুলোকে বিশ্ব চলচ্চিত্রের আসরে অনন্য স্থানে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
সার্জিও লিওনির চলচ্চিত্র ‘দ্য গুড, দ্য ব্যাড অ্যান্ড দ্য আগলি’ (১৯৬৬) এর শেষ সিকোয়েন্সে কীভাবে ক¤েপাজিশন, কালার আর ক্যামেরার কাজের মাধ্যমে ক্লাইমেক্স ফুটিয়ে তোলা হয়েছে তার ফ্রেম ধরে ধরে স্যার বুঝিয়ে বললেন। এছাড়া দ্যামিয়েন শ্যাজেলের চলচ্চিত্র ‘হুইপল্যাশ’ (২০১৪) এর স¤পূর্ণ ছবিতে ফ্লেচার আর অ্যন্ড্রু এর মধ্যকার দ্বন্দ্ব, চিন্তা আর স¤পর্ককে কীভাবে আলো, ফ্রেমিং আর সংগীত এর সাহায্যে স¤পাদনার দক্ষতায় অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে সেটাও ব্যাখ্যা করলেন স্যার দীর্ঘ সময় ধরে। এছাড়াও ‘এ সেপারেশন’ (২০১১), ‘দ্য সেল্সম্যান’ (২০১৬), সেভিং প্রাইভেট রায়ান’ (১৯৯৮) সহ বেশ কয়েকটি সিনেমা নিয়েও আলোচনা করলেন।
চলচ্চিত্রের এরূপ ব্যবচ্ছেদ এর মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারলাম ভালো সিনেমার কোন কিছুই বিনা কারণে করা হয় না। কোন একটি ফ্রেম কেন নেয়া হবে তার পেছনে থাকতে যথার্থতার বিবেচনাটা করতেই হবে।
শেষদিনে স্যার বোঝালেন কালার কারেকশন আর কালার গ্রেডিং এর পার্থক্য আর সিনেমায় এর প্রয়োজনীয়তা, হাই ডায়নামিক রেঞ্জ (এইচডিআর) এর বিশেষত্ব আর ক্যামেরাভেদে এর পার্থক্য। এছড়াও এলইউটি বা লুক আপ টেবিল প্লাগইনের সাহায্যে স¤পাদনায় ফিল্ম লুক পরিবর্তনের খুঁটিনাটিও তুলে ধরলেন।
কর্মশালার ফাঁকে ফাঁকে কেমন কী চলছে তার নিয়মিত খোঁজ রেখেছেন বিভাগের খণ্ডকালীন শিক্ষক হায়দার রিজভী স্যার। যিনি আমাদের সবসময় বলেন চলচ্চিত্র নির্মাণে সবার আগে দরকার মাথা। চিন্তার প্রাচুর্য না থাকলে চলচ্চিত্র হয় না।
ভালো চলচ্চিত্র নির্মাণে যেমন প্রয়োজন মেধা তেমনি প্রয়োজন শ্রমের। মাসউদ স্যার বলছিলেন বিভিন্ন সিনেমার উদাহরণগুলো একারণে দেয়া যেন সেগুলো আমাদের বাংলা চলচ্চিত্র তৈরির সময়ে আমরা আমাদের মতো করে ব্যবহার করতে পারি।
¯স্নাতক চতুর্থ বর্ষের ২৫ জন শিক্ষার্থীর আমরা প্রায় ২৩ জন নিয়মিত উপস্থিত ছিলাম। স্যার সম্পর্কে বন্ধু আশিক বলছিল স্যারের বৈশিষ্ট্য এখানে অতুলনীয় যে, স্যার আমাদের যা বলছেন সেগুলো জানতে স্যারের হয়তো অনেক সাধনা করতে হয়েছে, কিন্তু আমাদের এমনভাবে তিনি বিষয়গুলো বোঝাচ্ছেন, মনে হচ্ছে এগুলো খুবই সহজ আর সেকারণেই বিষয়গুলো মাথায় গেঁথে যাচ্ছে।
স্নাতকোত্তর পর্যায়ের ৩২ জন শিক্ষার্থীর প্রায় ২৮ জন ছিলেন নিয়মিত উপস্থিত। তাঁদের মধ্যে ফারজানা সায়মা আপু বললেন স্যারের চিন্তার গভীরতার কথা, যার মাধ্যমে তিনি নিজে ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত।
কর্মশালার মধ্যের এক শুক্রবারে ছুটি থাকায় স্যারকে নিয়ে ঘুরতে গিয়েছিলাম ঢাকেশ্বরী মন্দির, লালবাগ কিল্লা আর হোসেনী দালানে। বল্লাল সেনের নির্মিত যে মন্দিরের নামে ঢাকার নামকরণ হয়েছে সেখানে গিয়ে স্যার চারপাশ ঘুরে মন্দিরের ইতিহাস ঐতিহ্য আর প্রথা নিয়ে জানলেন, ক্যামেরায় হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন আচার করলেন ফ্রেমবন্দি। মুঘল সুবাদার আজম শাহ এর সময়কার অসম্পূর্ণ লালবাগ কিল্লা আর মীর মুরাদের নির্মিত শিয়া মুসলমানদের ইমামবাড়াও ঘুরে দেখলেন। কথা বললেন সেখানকার বর্তমান খতিব ও দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে। স্যার ইরান থেকে এসেছেন শুনে ইমামবাড়ার লোকজনও স্যারকে আনন্দের সাথে গ্রহণ করলেন। স্যারের সাথে নিয়ে আমরা শিক্ষার্থীরা মিলে একদিন সম্পূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসও ঘুরে দেখালাম। চলার ফাঁকে ফাঁকে হলো সিনেমা নিয়ে আলোচনা আর মতবিনিময়। বুঝলাম একজন ভালো শিক্ষক কীভাবে চলার পথেও শিক্ষা দিতে পারেন। জাতীয় জাদুঘরে গিয়ে স্যার জানালেন বাংলাদেশে যেমন দেশের পাখি, প্রাণী, উদ্ভিদ, প্রত্নতত্ত্ব ইত্যাদির সবকিছু একই জাদুঘরে বিন্যস্ত করা হয়েছে, ইরানে তেমন নয়; বরং প্রত্যেক বিষয়ের জন্য রয়েছে আলাদা জাদুঘর। শিল্প-সংস্কৃতিসমৃদ্ধ সুপ্রাচীন জাতির জন্য সেটাই তো স্বাভাবিক।
স্যার বাংলাদেশে ছিলেন প্রায় ১২ দিনের মতো। যাবার বেলায় স্যার জানালেন এদেশের প্রতি তাঁর ভালোলাগার কথা, বললেন সম্ভব হলে তিনি আবার আসবেন, মতবিনিময় করবেন সিনেমার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। সিনেমা নিয়ে বাংলাদেশ আর ইরানের এই উদ্যোগ সামনেও বজায় থাকবে এই আশা নিয়ে তিনি এদেশের শিক্ষার্থীদের আমন্ত্রণ জানালেন নিজের দেশে।
এমন একজন শিক্ষকের সংস্পর্শে আসতে পারাটা আমাদের শিক্ষার্থীদের কাছে স্মরণীয় বিষয়গুলোর একটি হয়ে থাকবে। এমন উদ্যোগ নেয়ায় কৃতজ্ঞতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় টেলিভিশন, ফিল্ম ও ফটোগ্রাফি বিভাগকে, প্রিয় শিক্ষক অধ্যাপক ড. এ জে এম শফিউল আলম ভূইয়া, হায়দার রিজভী স্যারসহ অন্যদের। কৃতজ্ঞতা ইরান কালচারাল সেন্টারকে। কোন কোন পাখি উড়ে চলে গেলেও ফেলে যাওয়া পালকে তার স্মৃতি রেখে যায়। মাসউদ সোফলায়ী স্যারের সাথে কাটানো সময়, তাঁর শিক্ষা যেন আমাদের কাছে তেমনই। ভবিষ্যতে আরো এমন সুন্দর আয়োজন আমাদের চিন্তার পরিধিকে বৃদ্ধি করবে, দেশের চলচ্চিত্রে ভূমিকা রাখতে সাহায্য করবে এমনটাই প্রত্যাশা।

শিক্ষার্থী (সম্মান ৪র্থ বর্ষ)
টেলিভিশন, ফিল্ম অ্যান্ড ফটোগ্রাফি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান : প্রসঙ্গ স্বাধীনতা, জাতীয় সক্ষমতা ও উন্নয়ন

ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান : প্রসঙ্গ স্বাধীনতা, জাতীয় সক্ষমতা ও উন্নয়ন
ড. মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান খান
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ায় পারস্য উপসাগরের তীরে অবস্থিত একটি রাষ্ট্র। এটি মধ্যপ্রাচ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ। ১১ ফেব্রুয়ারি ইরানের ইসলামি বিপ্লবের ৩৯তম বিজয় বার্ষিকী। আজ থেকে ৩৯ বছর আগে ১৯৭৯ সালের এদিনে প্রখ্যাত মার্জায়ে তাকলিদ (উচ্চ প্রজ্ঞাসপন্ন ফকিহ বা আলেম), বিশ্বব্যাপী ইমাম খোমেইনী নামে সুপরিচিত হযরত আয়াতুল্লাহ আল-উযমা রুহুল্লাহ আল-মুসাভী (রহ.)-এর প্রাজ্ঞ ও দূরদর্শী নেতৃত্বে ইরানের দ্বীনদার সংগ্রামী জনগণ ইসলামি আদর্শে উজ্জীবিত এক অভূতপূর্ব বিপ্লবের মাধ্যমে স্বৈরাচারী খোদাদ্রোহী রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা এবং বিজাতীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তির তাঁবেদার মুহাম্মদ রেযা শাহ ও তাঁর সরকারকে উৎখাত করে। ফলে কেবল পাহলভী রাজবংশ নয়; বরং আড়াই হাজার বছরের রাজতন্ত্রের বিলুপ্তি ঘটে। বিপ্লবের অব্যবহিত পরেই ইরানি জনগণ প্রায় সর্বসম্মত রায়ে ইরানে ইসলামি প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে। উল্লেখ্য যে, ইরানের ইসলামি বিপ্লবের মূল স্লোগান ছিল ‘স্বাধীনতা, মুক্তি ও ইসলামি প্রজাতন্ত্র’। এ স্লোগানে বিধৃত বিপ্লবের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যসমূহ ছিল- অভ্যন্তরীণ স্বৈরতন্ত্র থেকে মুক্তি, বহিঃশক্তির তাঁবেদারি থেকে স্বাধীনতা, নিজেদের ভাগ্যনিয়ন্ত্রণকে নিজেদের হাতে গ্রহণ, জনপ্রতিনিধিত্বমূলক ও ইসলামি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা; অর্থনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে স্বনির্ভরতা অর্জন এবং নিজস্ব স্বকীয় সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশ ইত্যাদি। বিগত ৩৯ বছর ধরে ইরানের সরকার ও জনগণ এ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যাবলি অর্জনে আন্তরিক ও নিষ্ঠার সাথে কাজ করে যাচ্ছে। বিপ্লবের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক শত্রুদের সর্বাত্মক অপপ্রচেষ্টা ও ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে ইতোমধ্যে ইরানের জনগণ বহিঃশক্তির নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান ও নিজেদের ভাগ্যনিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা নিজেদের হাতে গ্রহণের লক্ষ্য পরিপূর্ণভাবে অর্জন করেছে। আট বছরব্যাপী যুদ্ধ (ইরান-ইরাক যুদ্ধ) চাপিয়ে দিয়ে ও একযুগেরও বেশি সময় ধরে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা ও অবরোধ আরোপ করে ইরানকে সামরিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে পঙ্গু করে সাম্রাজ্যবাদীদের  কাছে নতজানু ও আত্মসমর্পণে বাধ্য করার অপচেষ্টা ইরানি নেতৃত্ব সম্পূর্ণভাবে অকার্যকর করে দিয়েছেন। ফলে বিপ্লব-পরবর্তী গত ৩৯ বছরে ইরানে অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, পারমাণবিক বিজ্ঞান, তথ্যপ্রযুক্তি ও ন্যানোটেকনোলজিসহ সকল ধরনের জ্ঞান-গবেষণা, সুস্থ সংস্কৃতি ও শিল্পকলা চর্চা ইত্যাদিসহ জনজীবনের সকল ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি-অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। গত প্রায় চার দশকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের স্বাধীনতা সুরক্ষা এবং জনজীবনের সর্বক্ষেত্রে তাদের অভাবনীয় উন্নতি ও অগ্রগতি সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনার উদ্দেশ্যেই আলোচ্য নিবন্ধটির অবতারণা।
সাম্রাজ্যবিরোধী অবস্থান ও স্বাধীনতা
‘এস্তেগলাল ও আযাদী’ তথা স্বাধীনতা ও মুক্তি ছিল ইসলামি বিপ্লবের অন্যতম মূল লক্ষ্য। ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান তার সুদীর্ঘ প্রায় চার দশকের পথ চলায় এ লক্ষ্য অর্জনে সর্বাত্মকভাবে সচেষ্ট থেকেছে। তবে এ কাজটি মোটেই সহজ ছিল না। ইসলামি বিপ্লবের পর সুদীর্ঘ সময় ধরে রক্ষিত কায়েমী স্বার্থ বঞ্চিত হওয়ায় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসহ পশ্চিমা শক্তি ইরানকে পদানত ও তাদের তাঁবেদারে পরিণত করার জন্য নানাভাবে চেষ্টা ও কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়েছে। ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানকে একটি অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করার লক্ষ্য সর্বাত্মক অপচেষ্টা চালিয়ে আসছে। বিলিয়ন বিলয়ন ডলার ব্যয়ে বিপ্লব ও ইরানি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও বিভ্রান্তি ছড়াবার উদ্দেশ্যে প্রচারযুদ্ধ চালিয়েছে। ইরানকে অর্থনৈতিক ও সামরিকভাবে দুর্বল করার জন্য সবধরনের অপচেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু তাদের কোনো অপকৌশলই কাজে আসে নি। ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের জ্ঞাননির্ভর নেতৃত্ব তার মেধা ও ধীশক্তি দিয়ে সফলভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছে। হযরত ইমাম খোমেইনী ও তাঁর উত্তরসূরি ধর্মীয় নেতা ও শাসকগণ ইরানের মযলুম জনতাকে সত্যিকারের প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের মেধা ও মননকে এমনভাবে গড়ে তুলেছেন যে, তারা নিঃশঙ্কচিত্ত হয়ে উঠেছে। ফলে আগ্রাসী শক্তির কাছে নতজানু না হয়ে তারা নিজেদের স্বাধীনতা ও মুক্তির উপলব্ধিতে অটুট থাকে। বর্তমান সময়ে মুসলিম দেশগুলোর বেশিরভাগ যখন পরাশক্তি ও তাদের দোসর পশ্চিমা এবং অন্য বৃহৎশক্তির তাঁবেদারে পরিণত হয়েছে সেখানে ইরান স্বাধীনভাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। বর্তমান পুঁজিবাদী বিশ্বে পশ্চিমা দেশগুলোকে যারা বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে চলাফেরা করছে ইরান তাদের অন্যতম। বস্তুত ঈমানী শক্তি, সুযোগ্য নেতৃত্ব, মেধার অনুশীলন ও দৃঢ় মনোবল নিয়ে ইসলামি বিপ্লবের অনুসারীরা একের পর এক বাধা অতিক্রম করে নিজেদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অটুট রাখতে সক্ষম হয়েছে।
সংবিধান ও সরকার ব্যবস্থা
ইসলামি বিপ্লবের অন্যতম লক্ষ্য ছিল রাজতন্ত্রের পরিবর্তে একটি ইসলামি গণভিত্তিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা- যেখানে সবাই স্বাধীনভাবে মর্যাদাপূর্ণ জীবন যাপন করতে পারবে। ১৯৭৯ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ইসলামি বিপ্লবের মাত্র দুই মাস পর ৩০ মার্চ এক ঐতিহাসিক গণভোটের (শতকরা ৯৮.২ ভাগ ভোটে) মাধ্যমে ইরানের জনগণ ইসলামি প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে রায় দেয়। ১ এপ্রিল (১২ ফারভারদিন) ইরানকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়। বর্তমানে এ দিনটি ইরানে ‘ইসলামি প্রজাতন্ত্র দিবস’ (রুজ-ই-জমহুরি ইয়ে এসলামি) হিসাবে গণ্য করা হয়। এ দিনটি এখন তাদের স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস হিসেবে পালিত হয়। এ বছরই বিপ্লবী সরকার একটি সংবিধান প্রণয়ন করে এবং ১৯৮৯ সালের ২৮ জুলাই ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সংবিধান সংশোধন করা হয়। ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সংবিধানে ইরানি সমাজের অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাঠামোগুলোর ব্যাখ্যা ইসলামের মূলনীতি এবং আদর্শের ভিত্তিতে উপস্থাপিত হয়েছে, যা ইরানিদের প্রাণের দাবির বহিঃপ্রকাশ। এ সংবিধান ইরানে তাগুতি রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার পরিবর্তে ইসলামি গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করে। এর ফলে শাসনব্যবস্থায় জনগণের অংশীদারিত্বের পথ সুগম হয়- যা রাজতান্ত্রিক যুগে অসম্ভব ছিল। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগসহ সব ধরনের ওহভৎধংঃৎঁপঃঁৎব-ই ইসলামি প্রজাতন্ত্রে বিদ্যমান। তবে একথা স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং পাশ্চাত্যের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এক নয়। ১৯৭৯ সালের সংবিধানের মাধ্যমে ইরানে এমন একটি সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয় যে সরকার ব্যবস্থায় একজন ন্যায়পরায়ণ মুজতাহিদ বা ইসলামি ধর্মতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ ‘রাহবার’ বা সর্বোচ্চ নেতা সরকার ও প্রশাসনের পথ-নির্দেশক হিসেবে কাজ করেন। একটি নির্বাচিত বিশেষজ্ঞ পরিষদ রাহবার নির্বাচন করে। ইসলামি আইনজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত একটি অভিভাবক পরিষদ ইসলামি মানদণ্ডের ভিত্তিতে এবং পার্লামেন্টের অনুমোদিত আইন অনুযায়ী তাঁদের দায়িত্ব পালন করেন। ইরানের সরকার ব্যবস্থা প্রেসিডেন্ট শাসিত। জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে চার বছরের জন্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচনের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। কিন্তু পৃথিবীর অনেক গণতান্ত্রিক দেশ দীর্ঘদিন চেষ্টা করেও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করতে পারে নি। তবে ইরান তা করতে পেরেছে। সেখানকার নির্বাচন ব্যবস্থায় সাধারণ মানুষের আস্থা রয়েছে। শাসন কাজের সুবিধার জন্য সমগ্র ইরানকে ৩১টি প্রদেশে (ওস্তা’ন) ভাগ করা হয়েছে। ইরানের আইন পরিষদ ‘মজলিশ শুরায়ে-এসলামি’ এক কক্ষবিশিষ্ট এবং এর সদস্য সংখ্যা ২৯০। ইরানের সরকার পরিচালিত হয় ইসলামি আইনের বিধিবিধান ও এর সাথে সঙ্গতি রেখে সমকালীন পেক্ষাপট অনুযায়ী পার্লামেন্টে প্রণীত আইন দ্বারা।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান তার নাগরিকদের মৌলিক মানবিক অধিকার সুরক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। গ্লোবালাইজেশনের এ যুগে সামাজিক নিরাপত্তা একটি বড় ইস্যু। যে কোনো দেশের উন্নতি ও সমৃদ্ধির বিষয়টি অনেকাংশেই নির্ভর করে সেই দেশের সামাজিক নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলার ওপর। ইরানে ইসলামি বিপ্লবের পর দেশটির সামাজিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। এক্ষেত্রে ইরানের অর্জন অন্য অনেক দেশের জন্য অনুকরণীয়। যেখানে ইউরোপ ও আমেরিকার মতো উন্নত দেশের মানুষ সারাক্ষণ নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে, আত্মরক্ষার জন্য বাধ্য হয় অস্ত্র বহন করতে, বর্ণবৈষম্য, সামাজিক বৈষম্য, সংখ্যালঘুদের অধিকার হরণ, খুন, ধর্ষণ, সন্ত্রাস, চরম নৈতিক অবক্ষয়, গভীর পারিবারিক সংকট প্রভৃতি যেখানে নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার সেখানে ইরানে বিরাজ করছে উল্টো চিত্র। শিশু ও নারী নির্যাতন, লুটপাট, খুন-খারাবি ও সাইবার ক্রাইম থেকে ইরান অনেকটা মুক্ত। ইরানে বর্তমানে সামাজিক অপরাধ প্রবণতার হারও অনেক কম।
বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ বর্তমান বিশ্বের এক মূর্তিমান আতংক। একসময় ইরানকে সন্ত্রাসের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হতো। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় তা ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়েছে। বর্তমানে ধর্মের নামে যে সন্ত্রাস মুসলিম বিশ্বসহ সমগ্র সভ্যতাকে গ্রাস করতে চাচ্ছে তার সাথে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বিশ্বের শান্তিপ্রয়াসী জাতিসমূহকে জাগ্রত করতে ইরান সক্রিয় ভূমিকা রাখছে।
অর্থনৈতিক অগ্রগতি
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান উদীয়মান অর্থনীতির এক সম্ভাবনাময় দেশ। ১৯৭৯ সালের বিপ্লবের পর থেকে ইরান সরকারের দীর্ঘমেয়াদি উদ্দেশ্য ছিল অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, পূর্ণ কর্মসংস্থান এবং নাগরিকদের জীবনযাত্রা আরামদায়ক ও মানস¤পন্ন করা। বিপ্লবী সরকার মনে করতো অর্থনৈতিক বুনিয়াদগুলো মজবুত করাই অর্থনীতির লক্ষ্য নয়; মূল লক্ষ্য হবে প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের গতিপথে মানুষের প্রয়োজন মেটানো। সকলের জন্য কর্ম সংস্থান করা এবং উপযুক্ত ও সমান সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা। তবে ইসলামি বিপ্লবের পর থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা  বিশ্ব, এমনকি মধ্যপ্রাচ্যের কতিপয় মুসলিম রাষ্ট্র ইরানের ওপর নানা রকমের বিধি-নিষেধ ও বাধা-বিপত্তি আরোপ করতে থাকায় অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ ও লক্ষ্য অর্জন মোটেই সহজ কাজ ছিল না। এতদসত্ত্বেও ইরান চার দশকের মধ্যে অর্থনৈতিক উন্নতির ক্ষেত্রে ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে। ইতোমধ্যে দেশটি মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা অঞ্চলে দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশে উন্নীত হয়েছে।
ইরান মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ একটি দেশ। তেল ও গ্যাসের বিপুল মজুদ ও মালিকানার কারণে ইরানকে energy superpower হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এক সময় তেল ও খনিজ গ্যাস ছিল ইরানের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি। ইরান সরকার বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতা এবং সময়ের দাবি মোতাবেক তেলনির্ভর অর্থনীতির পরিবর্তে নতুন নতুন খাত নির্ধারণ করে এগিয়ে যাচ্ছে। এতে ইরানি অর্থনীতিতে ক্রমশ শিল্প, কৃষি ও সেবা খাতের বিকাশ ঘটছে। ফলে দেশটির অর্থনীতির মৌলিক কাঠামো অনেকটাই বদলে গেছে।
জেনেভায় ইরানের সঙ্গে ৫+১ (জাতিসংঘের ৫ সদস্য রাষ্ট্র ও জার্মানি) বিশ্বশক্তির ব্যাপকভিত্তিক পরমাণু চুক্তি স্বাক্ষরের ফলে ইরানের ওপর থেকে একযুগের বেশি সময় ধরে আরোপিত অর্থনৈতিক অবরোধ সম্প্রতি প্রত্যাহার করা হয়। এতে ইরানের অর্থনীতিতে সমৃদ্ধির নতুন ধারা সূচিত হয় এবং অল্প সময়ের মধ্যে ইরান মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা অঞ্চলে অর্থনৈতিক পরাশক্তিতে রূপান্তরিত হওয়ার সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। ২০২৫ সালের মধ্যে ইরান এধরনের অর্থনৈতিক সক্ষমতা অর্জন করবে বলে গ্লোবাল রিস্ক ইনসাইটস আভাস দিচ্ছে। অবরোধ প্রত্যাহার হওয়ায় ইরানের জিডিপি খুব স্বাভাবিকভাবেই বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে। গত অর্থ বছরে ১২ দশমিক ৫ শতাংশ আর্থিক প্রবৃদ্ধি ঘটেছে। আইএমএফের ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক আউটলুক ডেটাবেজের পরিসংখ্যান মতে, ২০১৭ সালের এপ্রিলে ইরানের মোট দেশীয় উৎপাদন (জিডিপি) দাঁড়ায় ১ দশমিক ৫৩৫ ট্রিলিয়ন ডলারে। মাথাপিছু গড় আয় প্রায় ২০ হাজার মার্কিন ডলার। বেকারত্ব দূরীকরণ ও কর্মসংস্থানেও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে ইরান অন্যতম সফল দেশ।
ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও ইরান বর্তমানে একটি সফল দেশ। ২০১৬ সালে মোট বৈদেশিক বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ১০৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। জাতিসংঘের অধীনস্থ বাণিজ্য ও উন্নয়নবিষয়ক কর্তৃপক্ষ আঙ্কটাডের প্রতিবেদন মতে, ২০১৬ সালে বৈশ্বিকভাবে সর্বমোট বাণিজ্য হয়েছে ৩২ দশমিক ১৩৬ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের। যার দশমিক ৩৪ শতাংশ অবদান ইরানের। ২০১৬ সালে বিশ্বের সেরা বাণিজ্য সম্পাদনকারী দেশগুলোর তালিকায় ইরানকে ৪৪তম স্থান দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। আঙ্কটাডের প্রতিবেদন মতে, ইরানের ওপর থেকে অবরোধ তুলে নেয়ার পর দেশটির তেল উৎপাদন ব্যাপকভাবে বেড়েছে এবং অভ্যন্তরীণ আয়, ভোগ ও বিনিয়োগে এর প্রভাব পড়েছে।
একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি হলো রপ্তানি খাত। এ খাতের সাফল্য একটি দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিরও ইঙ্গিত দেয়। রপ্তানি খাতে ইরানের অর্জন উল্লেখ করার মতো। বর্তমানে ইরানের বার্ষিক রপ্তানির পরিমাণ ৪৬ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। এ রপ্তানির শতকরা প্রায় ৯৭ ভাগ অর্জিত হয় ১০টি রপ্তানি পণ্য থেকে। ইরানের শীর্ষ দশ শ্রেণির রপ্তানি পণ্যসামগ্রীর তালিকায় প্রথমেই রয়েছে তেলসহ খনিজ জ্বালানি। মোট রপ্তানি আয়ের ৭৫ ভাগই অর্জিত হয় এ খাত থেকে। তেলবহির্ভূত যেসব পণ্য ইরান রপ্তানি করে থাকে তার মধ্যে রেয়েছে পেট্রোকেমিক্যাল, প্লাস্টিক ও প্লাস্টিকজাত পণ্য, আয়রন ও স্টিল, কপার, রাসায়নিক ও জৈব সার, বিভিন্ন রকমের কৃষি ও খাদ্যপণ্য (গত বছরে ইরান ৪ দশমিক ৪৫ মিলিয়ন টন কৃষিপণ্য রপ্তানি করে), খনিজ, অটোশিল্প পণ্য, গালিচা ও ওষধি পণ্য ইত্যাদি। ইরানি পণ্যদ্রব্যের রপ্তানি গন্তব্যের শীর্ষে রয়েছে চীন। এ ছাড়াও ইরানি পণ্য আমদানিকারক দেশগুলোর মধ্যে ভারত, তুরস্ক, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান উল্লেখযোগ্য। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আফ্রিকার দেশগুলোতে ইরানের রপ্তানি বেড়েছে শতভাগ। অর্থনৈতিক অবরোধ প্রত্যাহারের পর ইউরোপের বাজারেও ইরানের পণ্য রপ্তানি বৃদ্ধি পেয়েছে। ইরানের শুল্ক প্রশাসনের তথ্যমতে, ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে ইউরোপের সঙ্গে ইরানের বাণিজ্য দাঁড়ায় ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারে। আগের বছরের তুলনায় বাণিজ্য বৃদ্ধির পরিমাণ ১৭১ শতাংশ।
অভ্যন্তরীণ ও বিদেশি বিনিয়োগে ইরানের বৈচিত্র্য আনার ক্ষমতাও রয়েছে যথেষ্ট। গত বছর ২২টি বিদেশি বিনিয়োগ চুক্তি করতে সমর্থ হয় ইরান। অর্থনৈতিক অবরোধ প্রত্যাহারের পর বিভিন্ন খাতে ইরানের বিনিয়োগ বৃদ্ধির পরিমাণ পূর্বের তুলনায় ৬০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ইতোমধ্যে দেশটির পানি ও বিদ্যুত খাতে ৮ বিলিয়ন ডলারের অধিক বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট হয়েছে। দেশটির অভ্যন্তরীণ সুশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি যথেষ্ট স্থিতিশীল বলে ইউরোপ, চীন, আমেরিকা, আফ্রিকা, ভারতসহ লাতিন আমেরিকার দেশগুলো দেশটিতে বিনিয়োগে ছুটছে। অর্থনৈতিক অবরোধের সময় বিভিন্ন দেশে ইরানের আটক অর্থসম্পদের মূল্য দেড়শ’ বিলিয়ন ডলার। অবরোধ প্রত্যারের পর ইতোমধ্যে ইরান ৫০ বিলিয়ন ডলার ফেরত পেয়েছে। সম্পূর্ণ অর্থ ফেরত পেলে তা ইরানের বিনিয়োগ থেকে শুরু করে সার্বিক অর্থনৈতিক কার্যক্রম আরো গতিশীল হবে এবং তা দেশটিকে মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনৈতিক পরাশক্তির আসল গন্তব্যে নিয়ে যেতে সাহায্য করবে।
শিক্ষা ক্ষেত্রে অগ্রগতি
১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লবের বিজয়ের পর থেকেই জ্ঞান-বিজ্ঞানে ধাপে ধাপে এগিয়ে চলেছে ইরান। শিক্ষা এক সময় এলিটদের ভূষণ থাকলেও বিপ্লবোত্তর ইরানে সাধারণ ও প্রান্তিক জনমানুষকে এর আওতায় নিয়ে আসা হয়। শুধু তাই নয়, ইসলামপূর্ব সেক্যুলার শিক্ষাব্যবস্থা পরিবর্তিত হয়ে ইসলামের চেতনায় ঐশী আলোয় আলোকিত হয়। পশ্চিমা বস্তুবাদী শিক্ষার দাপটে প্রায় হারিয়ে যেতে বসা ইবনে সিনা, আল-তুসী, জামী, ওমর খাইয়্যাম ও হাফিজের মতো ক্ষণজন্মা বুদ্ধিজীবীদের সৃষ্টিকর্ম ইসলামি বিপ্লবের পর পুনরুদ্ধারের সর্বাত্মক চেষ্টা গৃহীত হয়। বিপ্লবী সরকারের গঠিত সাংস্কৃতিক বিপ্লব ও শিক্ষা সংস্কার কমিটি রাহবার আয়াতুল্লাহর পরামর্শে এমন এক শিক্ষাধারা চালু করে যা ইরানকে তো বটেই, সারা পৃথিবীর সচেতন ও আলো প্রত্যাশিত মানুষকে আরো সত্য ও সুন্দরের দিকে নিয়ে যায়। এভাবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে শিক্ষা ক্ষেত্রে ইরান এক বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে উন্নীত হয়।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের শিক্ষাব্যবস্থার কিছু মৌলিক দর্শন রয়েছে। যেমন : (ক) ইসলামি শিক্ষা-দর্শনের ভিত্তিতে দেশের প্রয়োজনের প্রতি দৃষ্টি রেখে এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে অগ্রগতির সাথে তাল মিলিয়ে শিক্ষার বিষয়বস্তু নির্ধারণ করা, (খ) জনশক্তির ভিতরে চিন্তা, অনুসন্ধান, সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবন ক্ষমতার উন্নয়ন, (গ) ইসলামি সংস্কৃতি ও আদর্শের এবং কোরআনিক শিক্ষার বিকাশ সাধন এবং কোরআন মজীদ, হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) ও তাঁর আহলে বাইতের সাথে শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ততাকে কাজে লাগানো। (ঘ) শিক্ষার্থীদের মধ্যে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনের সংস্কৃতি গড়ে তোলা এবং (ঙ) ইরানের ঐতিহ্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ সাংস্কৃতিক ও শিক্ষামূলক কারিকুলাম ও পাঠ-পরিকল্পনা অনুসরণ ইত্যাদি।
উপর্যুক্ত লক্ষ্যসমূহকে সামনে রেখে বর্তমানে ইরানে যে শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে তা সরকারের নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীভূত এবং এটি ক-১২ এবং উচ্চ শিক্ষা- এ দু’ভাগে বিভক্ত। ক-১২ ধাপের শিক্ষা Primary school, (Dabestân), Middle school I High school (Dabirestân) এ ৩টি লেভেলে বিভক্ত এবং এগুলো পরিচালিত হয় Ministry of Education এর তত্ত্বাবধানে। বিশ্ববিদ্যালয়, প্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের শিক্ষা কার্যক্রম, চিকিৎসা শিক্ষা ও কমিউনিটি কলেজ শিক্ষার সমন্বয়ে ইরানের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা এবং উচ্চশিক্ষা পরিচালিত হয় Ministry of Science and Technology I Ministry of Health and Medical Education  এর তদারকিতে।

বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে নানা প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও ইরান শিক্ষা ক্ষেত্রে অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করে। বর্তমানে ইরানে শিক্ষার হার ৯৭ শতাংশেরও বেশি। বিভিন্ন তথ্যসূত্র মতে, শিক্ষা ইরান সরকারের অন্যতম প্রাগ্রাধিকার তালিকাভুক্ত। ইরান সরকার তার জিডিপির ৫ শতাংশ এবং বার্ষিক সরকারি ব্যয়ের প্রায় ২০ শতাংশ এ খাতে ব্যয় করে।
ইরান সরকার শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়ন ও সুরক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আর এ কারণেই ইরানের শিক্ষাব্যবস্থা বিশ^দরবারে স্বীকৃতি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। ইনফরমেশন সাইন্স ইনস্টিটিউটের (আইএসআই) এক জরিপ মতে বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে কার্যকর শিক্ষা কেন্দ্র ও প্রতিষ্ঠানের তালিকায় ইরানের ২৪টি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। ইরানের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে ৬১টি দেশের ৫৭ হাজার বিদেশি ছাত্রছাত্রী পড়াশুনা করছে। প্রতিবছর দেশটিতে লেখাপড়া করতে আসে ১০ হাজার বিদেশি শিক্ষার্থীছাত্রছাত্রী। অন্যদিকে ইরানের অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতের উন্নয়ন
টেকনোলজির উদ্ভাবন, ব্যবহার ও এর যৌক্তিক মাত্রা নির্ণয়ে বর্তমান বিশে^ মুসলিম দেশসমূহের পশ্চাদপদতা মোটা দাগে চোখে পড়ার মতো। যদিও মুসিলম দেশসমূহের বহু প্রতিভা পাশ্চাত্যের গবেষণাগারসমূহে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছেন। তবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গবেষণায় বিপ্লবোত্তর ইরানের অগ্রগতি এককথায় বিস্ময়কর। বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে নানা রকমের বাধা-বিপত্তি, পাশ্চাত্যের অসহযোগিতা ও বিশেষ অর্থনৈতিক অবরোধ সত্ত্বেও দেশপ্রেমে উজ্জীবিত ইরানি বিজ্ঞানীরা চরম আত্মত্যাগ ও সাধনার পরিচয় দেয়ায় দেশটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে বৈপ্লবিক উন্নতি ও সাফল্য অর্জন করেছে। ফারসি সংবাদ সংস্থা মেহর নিউজ এজেন্সির খবর অনুযায়ী, বিজ্ঞানবিষয়ক নিবন্ধ তৈরিতে ইরানের অবস্থান আঞ্চলিক প্রর্যায়ে শীর্ষতম, বিশ্বে ১৭তম এবং বৈজ্ঞানিক স্বীকৃতির মানপত্র অর্জনের ক্ষেত্রে বিশে^ অবস্থান ১৮তম। বিশ্বের সর্বাপেক্ষা প্রভাবশালী বৈজ্ঞানিক গবেষকদের তালিকায় নাম রয়েছে ইরানের ৭ বিজ্ঞানীর। ২০১৭ ‘হাইলি সাইটেড রিসারচারস’ শীর্ষক তালিকায় জায়গা করে নিয়েছেন এসব ইরানি বিজ্ঞানী। এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে মহাকাশ বিজ্ঞান গবেষণা র‌্যাঙ্কিংয়ে শীর্ষে রয়েছে ইরান। এছাড়া এক্ষেত্রে বিশ্ব র‌্যাঙ্কিংয়ে ১১তম স্থান অর্জন করেছে দেশটি। মহাশূন্যে নিজস্ব প্রযুক্তিতে নির্মিত স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণে সক্ষম দেশের মধ্যে ইরানের অবস্থান নবম এবং মহাকাশযানে প্রাণী পাঠানোর ক্ষেত্রে ইরানের অবস্থান ষষ্ঠ। ২০১৭ সালে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান মহাকাশে মানুষ পাঠানোর প্রস্তুতি হিসেবে ২০১৭ সালে সাফল্যের সঙ্গে মহাকাশে দু’বার বানর পাঠিয়েছে। গত বছর গত ২৮ জানুয়ারি ‘পিশগাম’ নামের বায়ো-ক্যাপসুলে করে এবং সম্প্রতি ‘ফারগাম’ নামের আরেকটি বানর মহাকাশে পাঠানো হয়। বানরটি মাত্র ১৫ মিনিটে পূর্ব-নির্ধারিত গতিতে নির্দিষ্ট উচ্চতায় (১২০ কিলোমিটার) পৌঁছার পর জীবন্ত অবস্থায় আবার ভূ-পৃষ্ঠে ফিরে এসেছে।
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এবং এর সাথে সম্পৃক্ত  অন্যান্য কৌশল উদ্ভাবনের মাধ্যমে ইরানে বিগত দু’দশকে বায়োটেকনোলজি বিষয়ে লক্ষণীয় উন্নতি সাধিত হয়েছে। ইরানে আধুনিক বায়োটেকনোলজি গবেষণার সূচনা ১৯৯০ সালে। বর্তমানে ইরানে ১৬০টি সরকারি গবেষণা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং ২১৮টি বেসরকারি সেন্টার ও কো¤পানি বায়োটেকনোলজি গবেষণা এবং উৎপাদন খাতে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বায়োটেকনোলজি গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশনার সংখ্যার দিক থেকে ইরান মধ্যপ্রাচ্যে ১ম স্থানে, এশিয়ায় ১ম সারির পাঁচটি দেশের অন্যতম এবং বিশ^ অবস্থান ১৪তম। বায়োটেকনোলজি ব্যবহার করে পণ্য উৎপাদন মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহের মধ্যে ইরানের অবস্থান প্রথম এবং এশিয়ায় ১ম সারির ৫টি দেশের অন্যতম। ভ্যাকসিন উৎপাদনে মধ্যপ্রাচ্যে ১ম। স্টেমসেল গবেষণার ক্ষেত্রে ইরান প্রথম সারির ১০টি দেশের মাঝে অবস্থান করছে। স্টেমসেল রিপ্লেস করার ক্ষেত্রে বিশ্বে ইরানের অবস্থান দ্বিতীয়। হাড়, হার্টভালভ ও ট্যানডন রিপ্লেস করা ও Bio-tech drug উৎপাদনের ক্ষেত্রে ইরান প্রথম ১২টি দেশের মাঝে অবস্থান করছে।

ন্যানোটেকনোলজি খাতে ইরানের প্রবৃদ্ধি বিস্ময়কর। ২০০০ সালে ইরান বিজ্ঞান গবেষণা পত্র প্রকাশনার দিক থেকে বিশ্বে ৫৯তম স্থান দখল করে। মাত্র এক দশকে ইরান ন্যানোটেকনোলজি খাতে প্রকাশনার দিক থেকে বিশ্বে ৮ম স্থান দখল করতে সক্ষম হয়। ন্যানো প্রযুক্তিতে বর্তমানে ইরানের অবস্থান বিশ্বে ষষ্ঠতম। বর্তমানে ইরানে ৩৭০টিরও অধিক কো¤পানি স্বাস্থ্য, নির্মাণ, কৃষি ও প্যাকেজিং, পেট্রোলিয়াম, বস্ত্র এবং যানবাহন নির্মাণ শিল্পে ন্যানোটেকনোলজির প্রয়োগ নিয়ে কাজ করছে। স্বল্প সময়ে ন্যানোটেকনোলজির যে সকল খাতে ইরান তাৎপর্যপূর্ণ সাফল্য অর্জন করেছে তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো : ক্যান্সার নিরোধক ঔষধ; স্ক্যানিং টানেলিং মাইক্রোস্কোপ; ডিপ রিঅ্যাক্টিং আয়ন এচিং; ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইলেকট্রোরিস মেশিন; হাই রেসুলিউশন এনিম্যাল ঝচঊঈঞ ইমেজিং সিস্টেম; আয়ন মোবিলিটি  স্পেক্ট্রোস্কোপি (IMS); প্লাজমা এনহেন্সড কেমিক্যাল ভেপার ডিপোজিশন (PECVD); স্পাটারিং অ্যান্ড এচিং সিস্টেম; প্লাজমা অ্যাসিসটেড কেমিক্যাল ভেপার ডিপোজিশন (PECVD) এবং বহনযোগ্য ন্যানোফিলট্রেশন যন্ত্র ইত্যাদি। বর্তমানে বিশ্বের ৩৫টি দেশে ন্যানো গ্লাস ও ন্যানো আয়না রপ্তানি করছে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান। দেশটির মাত্র একটি শিল্প গ্রুপ এসব ন্যানো গ্লাস রপ্তানি করছে।

কম্পিউটার সায়েন্স ও রোবোটিক্স খাতেও ইরানের সাফল্য উল্লেখ করার মতো। ২০১০ সালে তেহরান বিশ্ববিদ্যালয় নিজস্ব প্রযুক্তিতে Sorena-2 নামক রোবট তৈরি করে যা IEEE কর্তৃক বিশ্বের ৫টি সর্বোচ্চ প্রযুক্তির রোবটের মাঝে স্থান পায়। একই ধারাবাহিকতায় ইরানের automotive industry দশটি রোবট তৈরি করে। ২০১৫ সালে ইরানের বিজ্ঞানীরা নিজস্ব প্রযুক্তিতে রিমোট বা টেলি সার্জারির কাজে ব্যবহৃত রোবট উন্মোচন করেছেন।

ইবনে সিনা নামের এ রোবট দিয়ে রোগীর সংস্পর্শে  না এসেই একজন সার্জন সুনিপূণভাবে রোগীর দেহে অপারেশন করতে পারবেন। তেহরানের আমির কবীর প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ২০০৭ সালে একটি সুপার কম্পিউটার তৈরি করে যার প্রতি সেকেন্ডের কর্মক্ষমতা ৮৬০ বিলিয়ন, যদিও ইরান ২০০১ সালেই প্রথম সুপার কম্পিউটার তৈরি করে। পরবর্তীকালে ইরান তৈরি করেছে জঅঐণঅই-৩০০ যার সক্ষমতা 40 Gbit/s। ২০১১ সালে আমির কাবীর ও ইসফাহান বিশ্ববিদ্যালয় ২টি সুপার কম্পিউটার তৈরি করে যার প্রসেসিং ক্ষমতা প্রতি সেকেন্ডে ৩৪০০০ বিলিয়ন – যা বিশ্বের প্রথম সারির ৫০০টি কম্পিউটারের মাঝে রয়েছে।
মোটর গাড়ি শিল্প আধুনিক বিশ্বে অর্থনৈতিক অগ্রগতির অন্যতম বড় মাধ্যম। অনেক বিশেষজ্ঞ এ শিল্পকে শিল্প-উন্নয়নের রেল ইঞ্জিন বলে অভিহিত করে থাকেন। মোটরগাড়ি শিল্প সচল হয়ে উঠলে অন্য অনেক শিল্পও রমরমা হয়ে ওঠে। কারণ, অটোমোবাইল বা মোটরগাড়ি শিল্পের ওপর অন্তত ৮০টি শিল্প নির্ভরশীল বা   সম্পর্কি ত । ১৯৯২ সালে ইরান জাতীয় মোটরগাড়ি নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেয় এবং সংযোজন শিল্পের গণ্ডি থেকে বের হয়ে গাড়ির মূল ইঞ্জিন ও সব ধরনের যন্ত্রাংশ নির্মাণ শুরু করে। এখন ইরানে নির্মিত গাড়ি ইউরোপ ও এশিয়ার নানা দেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে বিক্রি হচ্ছে।

বিদ্যুৎ ও  জ্বালানি খাত

একটি দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও জনগণের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে বিদ্যুৎ অপরিহার্য। শিল্প, কলকারখানা, কৃষিকাজ, মানব স¤পদ উন্নয়ন, আধুনিক জীবনযাত্রা, চিকিৎসা, যোগাযোগ, কম্পিউটার  প্রযুক্তির ব্যবহার থেকে শুরু করে উন্নয়নের প্রায় সকল ক্ষেত্রেই প্রয়োজন বিদ্যুৎ। একথায় বলতে গেলে বিদ্যুৎ সভ্যতা ও আধুনিকতার প্রধান নিয়ামক। দারিদ্র বিমোচন করে একটি দেশকে শিল্পোন্নত দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে বিদ্যুতের গুণগত মান ও প্রাপ্যতা নিশ্চিত করার বিকল্প নেই। এ কারণেই বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের কাক্সিক্ষত উন্নয়ন ও পরিচালনা দক্ষতা বৃদ্ধিও উন্নত গ্রাহক সেবা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান সবিশেষ গুরুত্ব দেয় এবং এরই মধ্যে এ খাতেও ব্যাপক সফলতা লাভ করেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতার দিক থেকে আঞ্চলিক গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোর অন্যতম ইরান। বর্তমানে ইরানের বিদ্যুৎ উৎপাদন ৭৭ হাজার ৬৮ মেগাওয়াট। শীঘ্রই দেশটির বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ৮০ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। ইরানের বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৭৫ ভাগের বেশি হয় গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে। বাকি বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে ইরানে কম্বাইন্ড সাইকেল পাওয়ার প্লান্ট, হাইড্রো-ইলেকট্রিক পাওয়ার প্লান্ট, জেনারেশন পাওয়ার প্লান্ট ও রিনিউয়েবল অ্যানার্জি পাওয়ার প্লান্ট থেকে। ইরানের ভৌগোলিক বৈচিত্র্যের কারণে নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎস ব্যাপক এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ। ভূ-তাপ, সৌর ও বায়ু শক্তিসহ নানা নবায়নযোগ্য জ্বালানি শক্তি রয়েছে ইরানের। পরিবেশ সংরক্ষণের স্বার্থে পর্যায়ক্রমে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার বাড়ানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে দেশটি। নবায়নযোগ্য জ্বালানির অন্যতম উল্লেখযোগ্য উৎস ফুয়েল সেল বা জ্বালানি কোষের প্রোটন বিনিময় ঝিল্লি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন একদল ইরানি বিজ্ঞানী। ইরান সরকার আশা করছে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার করে ২০১৮ সালের মধ্যে সরকার আরো ৫০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম হবে। উল্লেখ্য যে, দেশটি বর্তমানে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ খাতে কেবল পুরোপুরি  স্বয়ংসম্পূর্ণতা  অর্জন করেছে তাই নয়, একই সাথে দেশটিতে উৎপাদিত বিদ্যুৎ এখন অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে।

জ্বালানি খাতে ইরানের সাফল্য ঈর্ষণীয়। জ্বালানি খাতে ইরান এখন সম্পূর্ণ স্বনির্ভর। ইরানে কয়েকটি পেট্রোকেমিক্যাল ও শোধনালয় উন্নয়ন প্রকল্প আছে। এসব প্রকল্পে উৎপাদিত পরিশোধিত পেট্রোল এখন বিদেশে রপ্তানি করছে। ইরান বিশ্বের প্রথম সারির চারটি দেশের মধ্যে রয়েছে যারা ঠ ৯৪.২ গ্যাস টারবাইন তৈরি করার সক্ষমতা অর্জন করেছে। গ্যাস রিফাইনারির সব পার্টসই ইরান নিজেই তৈরি করছে। তরল গ্যাস তৈরির (GTL) প্রযুক্তি অর্জনে ইরান প্রথম তিনটি দেশের মাঝে রয়েছে। ইরান দেশীয়ভাবে রিফাইনারি, তেল-ট্যাংকার, তেলকূপ খনন, Offshore platform এবং তেল উত্তোলনের ৭০ ভাগ সক্ষমতা অর্জন করেছে। গভীর পানিতে তেলকূপ খনন প্রযুক্তিতে ইরান বিশ্বের অল্প কয়েকটি দেশের মাঝে রয়েছে। ২০১৬ সালে দেশীয় প্রযুুক্তিতে ডিজাইনকৃত ইরানের Darkhovin Nuclear Power Plant চালু করা হয়।।

চিকিৎসা বিজ্ঞানে সাফল্য

গত প্রায় চার দশকে চিকিৎসা বিজ্ঞানে ইরানের অগ্রগতি চোখে পড়ার মতো। বিপ্লবের আগে যে দেশটির অনেক শহরে ইরানি ডাক্তার খুঁজে পাওয়া দুরূহ ব্যাপার ছিল, সে ইরানের নাম এখন চিকিৎসা বিজ্ঞানে বিশ্বের শীর্ষ দেশগুলোর তালিকায়। ২০১৬ সালে জানুয়ারিতে প্রকাশিত থমসন রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের প্রথম সারির চিকিৎসা গবেষকদের মধ্যে অন্তত ৩৬ জন ইরানি গবেষক স্থান করে নিয়েছেন। বার্তা সংস্থা ইরনার এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, ইরান বিশ্বের শীর্ষ ১০টি ওষুধ উৎপাদনকারী দেশের একটি। দেশটি বর্তমানে জার্মানি ও ইতালিসহ বিশ্বের ৪৪টি দেশে চিকিৎসা সরঞ্জাম রপ্তানি করছে। বিশ্বে ওষুধ শিল্পের বৃহত্তম প্রযুক্তি রপ্তানিকারক দেশে পরিণত হতে যাচ্ছে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান।
চিকিৎসা ক্ষেত্রে পরমাণু প্রযুক্তির ব্যবহার অত্যাধুনিক ও জটিল। ইরানি বিজ্ঞানীরা অত্যন্ত জরুরি এ ক্ষেত্রে দর্শনীয় সাফল্য অর্জন করেছেন। ইরানি বিজ্ঞানীরা শক্তিশালী মৌলিক কোষ তৈরি করতে সক্ষম হওয়ায় ইরান এ ক্ষেত্রে বিশ্বের ৫টি দেশের মধ্যে স্থান করে নিয়েছে। ক্যান্সার চিকিৎসায়ও ইরানি বিজ্ঞানীরা উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছেন। তেহরানের কে এন তূসি প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা ন্যানো প্রযুক্তি ব্যবহার করে এমন একটি যৌগ আবিষ্কার করেছেন যার সাহায্যে মানবদেহে ক্যান্সার চিহ্নিত করা যাবে। এ আবিষ্কার ক্যান্সার চিকিৎসাকে বেশ কয়েক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে বলে আশা করছেন ইরানের বিজ্ঞানীরা। ইরানের ইসলামিক আজাদ ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞান ও গবেষণা শাখার গবেষকরা সমন্বিত থেরাপি পদ্ধতির মাধ্যমে ক্যান্সার মোকাবেলা করার নতুন একটি পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে হৃদযন্ত্র প্রতিস্থাপন ও হৃদরোগ চিকিৎসায় শীর্ষে অবস্থান করছে ইরান। ইরান বছরে প্রায় ১০০ হৃদযন্ত্র প্রতিস্থাপন অস্ত্রোপচার করে থাকে। পঞ্চম আন্তর্জাতিক ইরানি হার্ট ফেইলিউর সামিট থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে। অঙ্গ প্রতিস্থাপন ও কিডনি প্রতিস্থাপনেও ইরানি চিকিৎসকদের দক্ষতা প্রশংসনীয় পর্যায়ের। ইরানে বর্তমানে ২৯টি কিডনি প্রতিস্থাপন কেন্দ্র, যকৃত প্রতিস্থাপনে ৭টি কেন্দ্র, ৮টি হৃদযন্ত্র ও ২টি ফুসফুস প্রতিস্থাপন কেন্দ্র চালু আছে। নিঃসন্তান দ¤পতিদের চিকিৎসার ক্ষেত্রেও ইরানি চিকিৎসকগণ বেশ সফলতা দেখিয়েছেন। স্বল্প খরচে বিশ্বের আধুনিক ইনফার্টিলিটি ট্রিটমেন্ট মেথড অনুসরণ করায় পারস্য উপসাগরের দেশগুলো থেকে অনেক নিঃসন্তান দ¤পত্তি ইরানে চিকিৎসা নিতে আসছেন। বর্তমানে এশিয়ার দেশগুলোর মাঝে মেডিক্যাল ট্যুরিজম ক্ষেত্রে কঠোর প্রতিযোগিতা চলছে। এই প্রতিযোগিতায় ইরানের অবস্থান বিশ্বের শীর্ষ দশটি দেশের মধ্যে রয়েছে।

শিল্প ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে অগ্রগতি

সংস্কৃতি মানুষের জীবনবোধ বিনির্মাণের কলাকৌশল। এটি মানুষের জীবনের একটি শৈল্পিক প্রকাশ। ইসলাম সুস্থ ও মানবিক চিন্তার বিকাশের পথে সাংস্কৃতিক চর্চার বিরোধী তো নয়ই, বরং সংস্কৃতির উন্নত সংস্করণ উপহার দিতে সক্ষম- এটাই প্রমাণ করেছে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান। ইরানে বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে নওরোজসহ সকল স্থানীয় সংস্কৃতির পরিচ্ছন্ন ও জোরালো উদ্যাপন বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
মানুষের সুকৃতি আচরণকে বিকশিত করার জন্য ইরান সকল শিল্পমাধ্যমকেই ব্যবহার করছে। এর মধ্যে ইরানি চলচ্চিত্র অন্যতম। চলচ্চিত্র একটি সৃজনশীল গণমাধ্যম। চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট দেশের জাতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতিনিধিত্ব করে। শিল্পকলার প্রভাবশালী মাধ্যম চলচ্চিত্র কেবল শক্তিশালী বিনোদন মাধ্যমই নয়, শিক্ষার অন্যতম সেরা উপকরণ হিসেবেও চলচ্চিত্রের ভূমিকা সুবিদিত। গণযোগাযোগ এবং সৃষ্টিশীল মানুষ ও আলোকিত সমাজ উপহার দেয়ার ক্ষেত্রেও এর রয়েছে জাদুকরি প্রভাব।
ইরানি চলচ্চিত্র আজ বিশে^ একটি স্বতন্ত্র ধারা হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত। পৃথিবীর সকল ফিল্ম ফেস্টিভালে দাপটের সাথে বিচরণকারী ইরানি চলচ্চিত্রকে অস্ট্রেলিয়ান ফিল্মমেকার মিশেল হেনেক ও জার্মান ফিল্মমেকার ওয়ার্নার হারজক ‘One of the world most important artist Cinema’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। বাংলাদেশের সকল ফেস্টিভালে ইরানি চলচ্চিত্রের সাবলীল বিচরণ দেখা যায়। বাংলায় ডাবিংকৃত ইরানি চলচ্চিত্র বাংলাদেশে বেশ জনপ্রিয়। ইরানি চলচ্চিত্রে সচরাচর ধর্মীয় কোন নির্দেশনা বা ডায়ালগ থাকে না। তবে উপন্যাস ও চরিত্রনির্ভর প্রতিটি ফিল্ম থেকে মানুষ কিছু না কিছু শিক্ষা গ্রহণ করে যা পৃথিবীর অনেক বড় বড় ইন্ডাস্ট্রি বিশ্বকে দিতে পারে নি। শক্তিশালী চিত্রনাট্য, অসাধারণ ও অভূতপূর্ব অভিনয়, কলাকুশলির মনকাড়া আবেদন ছাড়াও বিশ্বমানের কারিগরি কৌশলের কারণে বিশ্বের সর্বত্র আজ ইরানি সিনেমা ব্যাপকভাবে দর্শক সমাদৃত হচ্ছে। সেইসাথে পুরস্কৃত হচ্ছে শীর্ষ আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবগুলোতে। আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র অঙ্গনে সবচেয়ে আলোচিত ও সম্মানজনক পুরস্কার অস্কার থেকে শুরু করে অনেক গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক পুরস্কার ঘরে তুলে নিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের এ দেশটি। গত বছরেই অস্কারের ৮৯তম আসরে সেরা বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র হিসেবে পুরস্কার জিতে নেয় ইরানি ছবি ‘দ্য সেল্সম্যান’। পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন এবং প্রভাবশালী চলচ্চিত্র উৎসব কান চলচ্চিত্র উৎসবেও ইরানের সরব উপস্থিতি দেখা যায়। এই উৎসবের ৭০তম আসরে বিভিন্ন শাখায় ইরানি সিনেমা অ্যাওয়ার্ড জিতেছে। পঞ্চদশ ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে তিন বিভাগে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার পেয়েছে ইরান। বিশ^ব্যাপী আরো অনেক আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় ইরানি সিনেমা বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে।
শুধু চলচ্চিত্র নয়, পেইন্টিংস, কালিগ্রাফি, ফটোগ্রাফি, মিউজিক ইত্যাদি ক্ষেত্রকেও ইরানি বিপ্লব ধারণ করেছে এবং লালন করছে। মুসলিম বিশ্বে আর্ট ও পেইন্টিং-এর যে স্বতন্ত্র ধারা চালু হয়, এর অনেকটার কৃতিত্ব ইরান দাবি করতেই পারে।
মানুষের সুস্থ বিনোদনের অন্যতম প্রধান মাধ্যম খেলাধুলা। ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান জ্ঞানচর্চার পাশাপাশি মানুষের সুস্থ বিনোদনের অন্যতম প্রধান মাধ্যম হিসেবে খেলাধুলাকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়ে থাকে। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি জনগণের ব্যাপক আগ্রহের কারণে খেলাধুলায় ইরানের খ্যাতি আজ বিশ্বজোড়া। ফুটবল থেকে শুরু করে খেলাধুলার প্রায় সকল ক্ষেত্রেই অসাধারণ নৈপুণ্য দেখিয়ে চলেছেন ইরানি খেলোয়াড়রা। ২০১৮ সালের ফুটবল বিশ্বকাপের চূড়ান্ত আসরে সম্প্রতি এশিয়ার প্রথম দেশ হিসেবে খেলা নিশ্চিত করেছে ইরান। আধুনিক ও বিশেষায়িত পার্র্ক ও দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যকীর্তি ইত্যাদির কারণে ইরান এখন পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণস্থল। দেশটি এখন বিভিন্ন ফেস্টিভাল, সেমিনার, সি¤েপাজিয়াম, এক্সপো ও আন্তর্জাতিক কার্নিভালের কেন্দ্র হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে।

প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা

ইসলামি বিপ্লবের আগে ইরানের প্রতিরক্ষা বা সমর শিল্প ছিল পুরোপুরি পাশ্চাত্যনির্ভর। ইসলামি বিপ্লবের প্রায় দেড় বছর পর পাশ্চাত্যের ইশারায় ইরানের ওপর চাপিয়ে দেয়া দীর্ঘ ৮ বছরের যুদ্ধের সময় বিকশিত হয় ইরানের প্রতিরক্ষা বা সমর শিল্প। দেশটি এখন প্রচলিত সামরিক সাজ-সরঞ্জাম ও অস্ত্র-শস্ত্রে পুরোপুরি স্বনির্ভর, এমনকি অপ্রচলিত বা অত্যাধুনিক অনেক সমর-সম্ভারেও প্রায় স্বনির্ভর হয়ে উঠেছে। ইরানের রয়েছে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপক নৌযান ও রাডারসহ আরো অনেক অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র। প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় সফ্ট প্রযুক্তির অধিকারী ইরান। ইরান বিমান প্রতিরক্ষা তথা বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা ও রাডার সিস্টেম খাতেও ব্যাপক অগ্রগতি অর্জন করেছে। ইতোমধ্যে ইরান সুপারফাস্ট এন্টি সাবমেরিন তৈরি করেছে যা পানির তলদেশ দিয়ে প্রতি সেকেন্ডে ১০০ মিটার গতিতে চলে। লেজার টার্গেটিং প্রযুক্তিতে অস্ত্রের ক্ষেত্রে ইরান বিশ্বের পাঁচটি দেশের অন্যতম- যাদের চালকবিহীন বিমান (ড্রোন) নির্মাণ সক্ষমতা রয়েছে। ১৯৯২ সাল থেকেই ইরান নিজস্ব প্রযুক্তিতে ট্যাংক, মিসাইল, সাবমেরিন, ফাইটার প্লেন ও যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহার্য সামরিক যান তৈরি করছে। ইরান হালকা এবং রাডার ফাঁকি দিতে সক্ষম দূরপাল্লার নতুন একটি ড্রোন তৈরি করেছে। ড্রোনটির সর্বোচ্চ ১০ হাজার ফুট উঁচু দিয়ে ওড়ার সক্ষমতা রয়েছে। এ ড্রোন রাডার ফাঁকি দিয়ে তিন হাজার কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে আঘাত হানতে সক্ষম বলে জানিয়েছেন ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর এক সিনিয়র কমান্ডার। ইরানের মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র (আইএসআরসি) পার্সেলবাহী ড্রোন তৈরি করেছেন। ইরান রাডার ফাঁকি দিতে সক্ষম স্টিল্্থ ধরনের অত্যাধুনিক জঙ্গি বিমান ‘কাহের-৩১৩’ তৈরি করেছে। ইরানের প্রতিরক্ষা ও সামরিক সক্ষমতা সম্পর্কে পশ্চিমা শক্তির অনেকটা ধারণা রয়েছে। এ কারণেই বিগত ৩৯ বছরে শতবার হুমকি দিয়েও তারা ইরানকে আক্রমণ করতে সাহস করে নি।

ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি

ইরান বর্তমান বিশে^র একটি পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র। গত শতাব্দীর ষাটের দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির যাত্রা শুরু হয়। তবে ইসলামি বিপ্লবের পর মার্কিন সহায়তা প্রত্যাহার করে নেয়া হলেও প্রজাতন্ত্রী সরকার এ কর্মসূচি অব্যাহত রাখে। ইরানের ইসলামি সরকারের পারমাণবিক কর্মসূচি সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ। তাদের পারমাণবিক শক্তি সম্পর্কে স্লোগান হলো : ‘Nuclear energy for all, Nuclear weapon for none.’ ইরান শুরু থেকেই দাবি করে আসছে যে, ক্রমবর্ধমান বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণই তাদের পারমাণবিক কর্মসূচির প্রধান লক্ষ্য। ইরান পরমাণু শক্তি সংস্থা বা আইএই এর সদস্য এবং এনপিটি বা পরমাণু অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশ। আর এ হিসেবে তার পরিপূর্ণ অধিকার ও স্বাধীনতা আছে জ্বালানি তৈরি থেকে নিয়ে অন্য যে কোনো কাজে পারমাণবিক গবেষণা চালানো এবং প্রয়োজনীয় বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণের। এই অধিকার ও স্বাধীনতার ভিত্তিতেই ইরান তার পারমাণবিক কর্মসূচি কার্যকর করেছে। ইতোমধ্যে ইরান পারমাণবিক কর্মসূচির অংশ হিসেবে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণসহ পরমাণু রশ্মি বা শক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে উন্নত জাতের বীজ উদ্ভাবন ও সংস্কারের মাধ্যমে কৃষি-উৎপাদন বৃদ্ধি; খাদ্য সামগ্রীর স্টেরিয়ালাইজেশন ও স্বাস্থ্যসম্মত করা; পশু টিকা তৈরি, সংকোচনযোগ্য পলিমারের পাইপ নির্মাণ; বিভিন্ন ধরনের লেজার রশ্মি ব্যবহার এবং হাত-পায়ের ছাপ নির্ণয়ের মতো প্রযুক্তি আয়ত্ত করেছে। এ ছাড়াও আলোক-রশ্মি বা তেজস্ক্রিয় রশ্মির মতো বিভিন্ন রশ্মির মাধ্যমে চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারি, দেশকে বাইরের সীমান্ত থেকে আসা পারমাণবিক রশ্মির নিঃসরণ বা হামলা থেকে রক্ষা ইত্যাদি কাজে পরমাণু শক্তিকে কাজে লাগাতে সক্ষম হয়েছে।
পরমাণু ক্ষেত্রে ইরানি বিজ্ঞানীদের একের পর এক নতুন সাফল্যে দিশাহারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের দোসর ইউরোপীয় শক্তিবর্গ দেশটির বিরুদ্ধে নানা ভিত্তিহীন প্রচারণা জোরদার করে এবং জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে প্রভাব খাটিয়ে তেহরানের ওপর নানা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। বিশে^র স্বঘোষিত মোড়লদের বাড়াবাড়ি সত্ত্বেও ইরান তার পারমাণবিক কর্মসূচি থেকে এক চুলও সরে আসে নি; বরং ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ অব্যাহত রাখে এবং ২০ সালা পরিকল্পনায় ২০টির বেশি নতুন পরমাণু চুল্লি নির্মাণ এবং অন্তত ২০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের টার্গেট নেয়। ইরান ইতোমধ্যে পারমাণবিক গলনযন্ত্র নির্মাণে সফল হয়েছে। পারমাণবিক কর্মসূচি থেকে ইরানকে নিবৃত করতে ব্যর্থ হয়ে পশ্চিমা মোড়লেরা শেষ পর্যন্ত তার সাথে একটি চুক্তিতে আসতে বাধ্য হয়। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্য ও জার্মানিকে নিয়ে গঠিত হয় ৫+১ গ্রুপ ২০১৫ সালে জেনেভায় ইরানের সাথে এক চুক্তি স্বাক্ষরে বাধ্য হয়। এ চুক্তিকে বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তার জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এ চুক্তির ফলে একটি  বৈশ্বিক সংকটের সমাধান হয়। মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের একটি বড় শক্তি হিসেবে ইরানের সাথে বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলোর বিরোধ নি®পত্তির ফলে মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের সমস্ত সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। এ চুক্তির মাধ্যমে পারমাণবিক কর্মসূচি পরিচালনায় আগামী ৮ বছর ইরানকে কিছু বিধি নিষেধ মেনে চলতে হবে সত্য, তবে এর ফলে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের ওপর আরোপিত নিরাপত্তা পরিষদের নিষেধাজ্ঞা ইতোমধ্যেই তুলে নেয়ায় এবং ইরানের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য, ব্যাঙ্কিং তৎপরতা ও পুঁজি বিনিয়োগসহ সকল রকম অর্থনৈতিক স¤পর্কের ওপর ইতঃপূর্বে আরোপিত নিষেধাজ্ঞাসমূহ প্রত্যাহৃত হওয়ায় ইরানের অর্থনৈতিক সাফল্য অর্জনের ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্তের দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে।

উপসংহার

ওপরের আলোচনায় দেখা যায় যে, বর্তমান বিশে^ ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান স্বাধীনতা সুরক্ষা, সুসংবদ্ধ রাষ্ট্র ও সরকার ব্যবস্থা গঠনে কেবল সফল নয়, ৩৯ বছরের পথপরিক্রমায় স্বনির্ভর অর্থনীতির বিকাশ, শিক্ষা-সংস্কৃতি এবং পরমাণু, মহাকাশ গবেষণা, চিকিৎসা, বায়োটেকনোলজি, ন্যানোটেকনোলজি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সকল শাখায় ঈর্ষণীয় উন্নতি ও সাফল্য অর্জন করেছে। শুধু তাই নয়, ফিলিস্তিনসহ বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে, বিশ্বমানবতা ও বিশ্ব-মুসলিমকে ঐক্যবদ্ধ করার অব্যাহত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এসব বর্তমান অর্জনের মাধ্যমে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান আজ বিশ^ দরবারে উন্নয়নের অনন্য মডেল রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।
অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
(প্রবন্ধটি গত ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ইরানের ৩৯তম বিপ্লব বার্ষিকী উপলক্ষে
বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের প্রধান মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত সেমিনারে পঠিত হয়।)