All posts by dreamboy

ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা সংগ্রাম ইন্তিফাদা

মুজতাহিদ ফারুকী:  ১৫ মে, ১৯৪৮ সাল। একদিনে লাখো ফিলিস্তিনিকে তাদের হাজার বছরের আবাসভূমি থেকে ঘরবাড়ি ভেঙ্গে দিয়ে, সীমাহীন অত্যাচার-নিপীড়ন চালিয়ে উৎখাত করা হয়। সেই ভূমিতে বহিরাগত ইহুদিদের জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয় আজকের ইসরাইল। দিনটিকে ফিলিস্তিনিরা ‘বিপর্যয়’ বা ‘নাকবা’ দিবস হিসাবে বিবেচনা করে। এরও আগে ১৯১৭ সালে ব্রিটেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বেলফোর ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিলে শুরু হয় ফিলিস্তিনিদের প্রতিবাদ-বিক্ষোভ। তাদের সেই জীবনপণ প্রতিরোধ আন্দোলনের মধ্যেই ব্রিটিশ ষড়যন্ত্রে ইসরাইলের প্রতিষ্ঠা। সেই থেকে শুরু প্রতারিত, ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত, ভাগ্যবিড়ম্বিত ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতার সংগ্রাম। গত ৭০ বছর ধরে এই সংগ্রাম বিরতিহীনভাবে চলছে। আরও কত বছর ধরে তাদেরকে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে তা কেউ বলতে পারে না।
বেলফোর ঘোষণার বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিরা লড়াই শুরু করলে যুক্তরাষ্ট্র তাদের প্রতিশ্রুতি দেয় ন্যায্য অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার। ফিলিস্তিনিদের জন্যও পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার। ১৯৪৭ সালেই জাতিসংঘ দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু ওই পর্যন্তই। যুক্তরাষ্ট্র ফিলিস্তিনিদের দেওয়া নিজের প্রতিশ্রুতি ভুলে যায়। শুধু তাই নয়, আজ ৭০ বছর পরে এসে চক্ষুলজ্জা ভুলে, সব আন্তর্জাতিক রীতি-নীতি, ন্যায়বিচার, মানবাধিকার, এমনকি জাতিসংঘের ১৯৪৭ সালের ১৮১ নম্বর প্রস্তাবের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ইসরাইলের পক্ষে অবস্থান নেয়।
জাতিসংঘের ১৮১ নম্বর প্রস্তাব অনুসারে জেরুসালেম একটি আন্তর্জাতিক জোন। জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত এলাকা। আর পূর্ব জেরুসালেম হলো ইসরাইলের অবৈধভাবে দখল করা ভূমি। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র সেখানেই মার্কিন দূতাবাস সরিয়ে এনেছে। আর সেটা করেছে সেই ফিলিস্তিনিদের বিপর্যয় বা ‘নাকবা’ দিবসে। এর তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে ফিলিস্তিনিদের মধ্যে। ১৫ মে’র পর ইসরাইলের বিরুদ্ধে গাজার বিক্ষোভগুলো ইতিহাসের সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে ভয়াবহ। ইসরাইলের তারকাঁটা দিয়ে ঘেরা সীমানা প্রাচীরের বাইরে বিক্ষোভ সমাবেশে হাজির হয় লক্ষাধিক ফিলিস্তিনি। প্রতি বছরের মতো চলতি বছরের ৩০ মার্চ নিজেদের ভূমিতে ফেরার ‘মহান প্রত্যাবর্তন মিছিল’ নামে বিক্ষোভ সমাবেশ শুরু হয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয় ১৫ মে ‘নাকবা’ বা বিপর্যয় দিবসের বিক্ষোভ। বিক্ষুব্ধ ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরাইলি সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণে এদিন গাজায় ৬০ জন নিহত এবং আড়াই হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি আহত হন।
নতুন করে শুরু হওয়া এই বিক্ষোভ একটি প্রচণ্ড গণঅভ্যুত্থান বা ‘ইন্তিফাদা’য় পরিণত হতে যাচ্ছে কিনা অনেকে সেই প্রশ্ন তুলছেন।
আরবি শব্দ ‘ইন্তিফাদা’র অর্থ হলো গণঅভ্যুত্থান। ইসরাইলের সব রকম জুলুম-নিপীড়ন, গুলি, টিয়ার গ্যাস, জেল-জরিমানা উপেক্ষা করে এর আগে দু’বার দেশটির অবৈধ অস্তিত্বের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড বিক্ষোভে ফেটে পড়ে নিরস্ত্র-নীরিহ ফিলিস্তিনিরা। সে বিক্ষোভ ব্যাপকতার দিক থেকে এতটাই তীব্র ছিল যে সেটি কার্যত গণঅভ্যুত্থানের রূপ পেয়েছে।
প্রথম ইন্তিফাদা শুরু হয় ১৯৮৭ সালের ৮ ডিসেম্বর। ওই দিন গাজার জাবালে শরণার্থী শিবিরের বাইরে ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর একটি লরি একটি বেসামরিক গাড়িকে চাপা দিয়ে কয়েকশ’ মানুষের চোখের সামনে চারজন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করলে মানুষের চাপা ক্ষোভ জ্বলে ওঠে ক্রোধের আগুনে। যে চারজন শাহাদাত বরণ করেন, তাঁদের নামাজে জানাযায় ১০ হাজারের মতো শোকার্ত মানুষ উপস্থিতি হন। সেই জানাযার জামাতে আবার ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইসরাইলি সেনাবাহিনী। এতে নিহত হয় ১৭ বছরের যুবক হাতেম আবু সিসি, আর মারাত্মকভাবে আহত হয় আরো ১৬ জন।
এই ঘটনায় উত্তপ্ত অবস্থা আগ্নেয়গিরির মতো বিস্ফোরিত হয়। প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধের জ্বলন্ত লাভা ছড়িয়ে পড়ে ফিলিস্তিনি শরণার্থী ক্যাম্প থেকে গাজা, পশ্চিম তীর এবং পূর্ব জেরুজালেমের সমস্ত অঞ্চল জুড়ে। ক্রুদ্ধ ও বেপরোয়া ফিলিস্তিনিরা খুব দ্রুতই বিভিন্ন এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়, শুরু করে রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড স্থাপন, যাতে ইসরাইলি সেনাদের ভারি যানবাহনগুলো ঢুকতে না পারে। কোনো রকম অস্ত্রশস্ত্র ছাড়াই কেবল প্রতিশোধ আর প্রতিরোধের আগুনে ঝলসে ওঠা ফিলিস্তিনি নারী-পুরুষ-তরুণ-তরুণীরা পাথরের টুকরোকে হাতিয়ারে পরিণত করে। তারা ইসরাইলি সেনা এবং ট্যাংকগুলোর দিকে পাথর ছুড়ে নিজেদের প্রতিরোধ সংগ্রাম চালিয়ে যেতে থাকে। ব্যবসায়ীরা ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করে দেয়, আর শ্রমিকরা প্রত্যাখ্যান করে ইসরাইলের ভেতরে কারখানায় কাজ করতে।
ইসরাইলি সেনাবাহিনী ফিলিস্তিনিদের পুরো প্রতিরোধ আন্দোলনকে ‘দাঙ্গা’ হিসেবে ঘোষণা দিয়ে প্রতিরোধকারীদের শায়েস্তা করতে উত্তাল জনতার মিছিলে রাবার বুলেট, তাজা গুলি ও টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ শুরু করে। তার পরও আপামর জনতার অংশগ্রহণে প্রতিরোধ আন্দোলন আরো তীব্র এবং বৃহৎ আকার ধারণ করে। ডিসেম্বরের ১২ তারিখের মধ্যে সহিংসতায় শাহাদাত বরণ করেন আরো ৬ জন, গুরুতর আহত হন ৩০ জনের মতো।
দিনের পর দিন পেরিয়ে গেলেও আন্দোলন স্তিমিত হওয়ার কোনো লক্ষণই যখন দেখা গেল না, তখন দখলদাররা শুরু করে গণগ্রেফতার কর্মসূচি। পশ্চিম তীরের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়। প্রথম বছরেই ইসরাইলি সরকার ১৬০০ বার কারফিউ জারি করে। বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় ফিলিস্তিনিদের খামার ও বসতবাড়ি, উপড়ে ফেলা হয় গাছপালা। প্রতিবাদী যেসব ফিলিস্তিনি ট্যাক্স দিতে অস্বীকার করে তাদের সম্পত্তি ও আবাসনের লাইসেন্স বাতিল করা হয়। সৈন্যদের পাশাপাশি অবৈধ বসতি স্থাপনকারী ইহুদিরা পর্যন্ত ফিলিস্তিনিদের ওপর হিংস্র আক্রমণ চালাতে থাকে।
ইউএন রিলিফ এবং ওয়ার্ক এজেন্সি ফর প্যালেস্টাইন রিফিউজির তথ্যমতে, ইন্তিফাদা সূচনার প্রথম বছরেই ৩০০ ফিলিস্তিনি শহীদ হন, গুরুতর আহত হন ২০ হাজার এবং সাড়ে ৫ হাজারের মতে ফিলিস্তিনি কারাবরণ করেন ইসরাইলি দখলদারদের হাতে।
১৯৮৮ থেকে ফিলিস্তিনি নেতারা বাড়তে থাকা এই সহিংস পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা চালাতে থাকেন। ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাতের দল প্যালেস্টাইন লিবারেশন অরগানাইজেশন (পিএলও) সহিংসতার লাগাম টেনে ধরতে এবং জাতিসংঘের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করার চেষ্টা করে। এই প্রচেষ্টা খুব কমই সফলতার মুখ দেখে। বিপরীতে গাজা উপত্যকায় জন্ম হয় ইসলামিক প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস-এর, যারা নিজেদেরকে পিএলও’র বিকল্প শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়।
আপসকামিতার পথে না গিয়ে হামাস তার প্রধান লক্ষ্য হিসেবে যে কোনো কিছুর বিনিময়ে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার ঘোষণা করে। এই ঘোষণা আন্দোলনরত যোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করে এবং সাহস যোগায় ইসরাইলি দখলদারদের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার।
১৯৮৮ সালে জর্দানের সুলতান হোসেন পশ্চিম তীরের সঙ্গে সব প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করলে ফিলিস্তিনিদের স্বাধিকার আন্দোলন হুমকির মুখে পড়ে। তবে জনগণের মুক্তিকামী মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের উপর্যুপরি তরঙ্গাভিঘাত অব্যাহত থাকে, সেই সঙ্গে স্বাধীন ফিলিস্তিন প্রতিষ্ঠার ডাকও জোরদার হয়। একই বছরে দ্যা প্যালেস্টাইন ন্যাশনাল কাউন্সিল নামের প্রবাসী সরকার ১৯৪৭ সালের জাতিসংঘের নেওয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান গ্রহণ করে।
এতকিছুর মধ্যেও অবিরত চলতে থাকে ফিলিস্তিনিদের আন্দোলন এবং ইহুদিদের সহিংসতা। ১৯ জনের মতো ইসরাইলি সাধারণ নাগরিক এবং ইসরাইলি ডিফেন্স ফোর্সের ৬ জন সদস্য নিহত হয়। ১৯৮৯ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট কাউন্সিল ইসরাইলের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং ৪র্থ জেনেভা কনভেনশন অগ্রাহ্য করার অভিযোগে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাবিত নিন্দা জানানোর খসড়া সিদ্ধান্তে একের পর এক ভেটো প্রয়োগ করে। ইন্তিফাদা অব্যাহত থাকার প্রেক্ষাপটে ১৯৯১ সালে যুক্তরাষ্ট্র পিএলও’কে ফিলিস্তিনের সর্বস্তরের জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে স্বীকার করে নেয়। নরওয়ের আগ্রহে পিএলও এবং ইসরাইলের মধ্যে আলাপ-আলোচনা চলতে থাকে, যা পরের বছর অসলো চুক্তির মাধ্যমে পরিণতি লাভ করে। ১৯৯৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টনের উপস্থিতিতে হোয়াইট হাউসের লনে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী আইজ্যাক রবিন এবং পিএলওর চেয়ারম্যান ইয়াসির আরাফাতের মধ্যে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

চুক্তিতে পাঁচ বছর মেয়াদি একটি অন্তর্বর্তীকালীন সময় নির্ধারণ করা হয়, যে সময়ের মধ্যে ইসরাইলি সেনাবাহিনী দখলিকৃত এলাকা থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নেবে এবং ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ফিলিস্তিনকে সচল করার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করবে।
এই শান্তি প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকার পরও ইন্তিফাদা চলতে থাকে। ১৯৯৩ সালে যখন ইন্তিফাদা স্তিমিত হয়ে আসছে ততদিনে ১৫০০ ফিলিস্তিনি এবং ১৮৫ ইসরাইলি নাগরিক নিহত হয়েছে; ১ লাখ ২০ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি করেছে কারাবরণ।
প্রথম সেই ইন্তিফাদা ফিলিস্তিনিদের প্রতি ইহুদিবাদী ইসরাইলের ভয়াবহ সহিংসতার ঘটনা দুনিয়াজুড়ে স্পষ্ট করে তোলে। আন্তর্জাতিক মহলে ইসরাইলের প্রতি প্রচণ্ড অনাস্থা তৈরি করে। ইন্তিফাদার কারণেই পরে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে ইসরাইলের প্রতি ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে  চলমান সহিসংতা বন্ধের দাবি জানিয়ে ৬০৭ এবং ৬০৮ ধারার প্রস্তাব উত্থাপন সম্ভব হয়।
ঐতিহাসিকদের চোখে যদিও ইন্তিফাদা ফিলিস্তিন-ইসরাইল শান্তি প্রক্রিয়া সূচনার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে আলোচিত হয়ে আসছে, কিন্তু গত তিন দশকেও ফিলিস্তিনিদের জন্য শান্তির সেই কপোত ডানা মেলে নি। অসলো চুক্তি একটি ব্যর্থ অধ্যায়ে পর্যবসিত হয়েছে। ইসরাইলি অবৈধ দখলদারিত্বে ফিলিস্তিনিদের নাগরিক, ভৌগোলিক ও মানবাধিকার আগের থেকে আরো বেশি হুমকির মুখে পড়েছে।ফলে একথা বলাই যায় যে, প্রথম ইন্তিফাদা আসলে কখনও শেষ হয় নি; বরং ফিলিস্তিনিরা সর্বাংশে ও সব সময়ই ইসরাইলের দখলদারিত্ব, নিপীড়ন এবং আগ্রাসনের বিরুদ্ধে চালিয়ে যাচ্ছে এক অন্তহীন সংগ্রাম।

প্রথম ইন্তিফাদায় ইসরাইলি বাহিনীর আধুনিক সব সমরাস্ত্রের মোকাবিলায় পাথর ব্যবহার করে ফিলিস্তিনিরা বিশ্বে আলোড়ন তুলেছিল। সেই ইন্তিফাদার কারণে গোটা বিশ্বের মানুষ আরও বেশি সচেতন হয়ে ওঠে এবং ইসরাইলের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী জনমত জোরদার হয়। বৈরী আরব রাষ্ট্রগুলোর পাশে একটি ‘নাজুক ইহুদি রাষ্ট্র’ হিসেবে বিশ্বে ইসরাইলের যে ভাবমূর্তি ছিল তা যে সঠিক নয়, বরং ইসরাইলই একটি হিংস্র রাষ্ট্রশক্তি এই সত্য বিশ্ববাসীর সামনে প্রকাশিত হয়।
ফিলিস্তিনিদের দ্বিতীয় ইন্তিফাদা শুরু হয় ২০০০ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর থেকে। এটি ‘আল আকসা’ নামে পরিচিতি লাভ করে। দখলদার ইসরাইলের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এরিয়েল শ্যারন বেশ কিছু সৈন্য সঙ্গে নিয়ে আল আকসা মসজিদে প্রবেশ করলে ফিলিস্তিনিরা দ্বিতীয় ইন্তিফাদা শুরু করে। সেই ইন্তিফাদার মাধ্যমে ফিলিস্তিনিরা জানিয়ে দেয়, বিশ্ব মুসলিমের তৃতীয় পবিত্রতম স্থান আল আকসা মসজিদের বিষয়ে তারা কোনো ছাড় দেবে না।
আল-আকসা মসজিদ খ্যাত বায়তুল মুকাদ্দাস ইস্যুতে এবার শুরু হয়েছে তৃতীয় ইন্তিফাদা। অবশ্য চলমান ইন্তিফাদা শুরুর ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল ২০১৫ সালেই। আল-আকসা মসজিদসহ অন্যান্য মুসলিম ঐতিহ্য ধ্বংস করে বায়তুল মুকাদ্দাসকে ইহুদিবাদীদের শহর হিসেবে চিহ্নিত করার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে ২০১৫ সালের অক্টোবর থেকে জোরালো প্রতিবাদ শুরু করে ফিলিস্তিনিরা। এরই মধ্যে ২০১৭ সালে জেরুসালেমে মার্কিন দূতাবাস সরিয়ে নেওয়ার ট্রাম্পের ঘোষণা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে এবং ফিলিস্তিনিরা তৃতীয় ইন্তিফাদা শুরু করতে বাধ্য হয়।
এটিও বিগত দু’টি ইন্তিফাদা এবং অতীতের অন্যান্য আন্দোলনেরই ধারাবাহিকতা। ফিলিস্তিনিরা যে তাদের মাতৃভূমি মুক্ত করার আন্দোলন থেকে পিছু হটে নি এবং প্রতিবাদের শক্তি হারিয়ে ফেলে নি এর মধ্য দিয়ে আবারও তা স্পষ্ট হয়েছে।
এদিকে ফিলিস্তিন মুক্তি সংগ্রামের অব্যাহত গতিধারায় একটি নতুন আশার আলো দেখা দিয়েছে। তা হচ্ছে ১৯৭৯ সালে ইমাম খোমেনী (রহ্.)-এর নেতৃত্বে সংঘটিত ইরানের ইসলামি বিপ্লব। বিপ্লবের পর ফিলিস্তিন ও আল্-কুদ্স্-এর মুক্তির লক্ষ্যে সমগ্র মুসলিম উম্মাহ্কে ঐক্যবদ্ধ করতে ইমাম খোমেইনী (র.) মাহে রমজানের শেষ শুক্রবারকে আল্-কুদ্স্ দিবস ঘোষণা করেন। তখন থেকে বিশ্ব মুসলিম এ দিবসটি পালন করে আসছে।
আল-কুদস দিবসের মর্মকথা হলো কুদ্সের মুক্তি, পবিত্র শহর জেরুসালেমের মুক্তি। বর্তমান ফিলিস্তিনে আপসকামিতাকে বুড়া আঙ্গুল দেখিয়ে হামাসের নেতৃত্বের জেগে উঠেছে ফিলিস্তিনের অযুত মানুষ। আর দক্ষিণ লেবাননে বিপুল শক্তি অর্জন করেছে অকুতোভয় এক লড়াকু সংগঠন হিজবুল্লাহ। তাদের হাতে পর্যুদস্ত হয়ে ২০০৬ সালে ইসরাইলি সেনাবাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিল।
২০০৮ থেকে এ পর্যন্ত ইসরাইল হামাস শাসিত গাজা দখলের জন্য তিন তিন বার সর্বাত্মক যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়। কিন্তু হামাস কঠিন প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ফলে প্রতিবারই গাজার ব্যাপক মানবিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতি হলেও ইসরাইল গাজা দখল ও হামাসের পতন ঘটাতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়। অন্যদিকে হিযবুল্লাহ্ অপরাজেয় হিসেবে পরিগণিত ইসরাইলের ওপর তিন তিন বার শোচনীয় পরাজয়ের গ্লানি চাপিয়ে দেয়।
হামাস ও হিযবুল্লাহ্র সাফল্য প্রমাণ করে, অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইলের বিলুপ্তি ও সমগ্র ফিলিস্তিন ভূখণ্ড জুড়ে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা কেবল স্বপ্নমাত্র নয়; বরং আগামী দিনের বাস্তবতা।
তবে এজন্য সব রকম বিভেদের ঊর্ধ্বে উঠে মুসলিম উম্মাহর বৃহত্তর স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপ নিতে হবে। তাহলে আশা করা যায়, হামাস ও হিযবুল্লাহ্র সাফল্যের ধারায় এগিয়ে গেলে চূড়ান্ত সাফল্য ও বিজয় অবশ্যম্ভাবী।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক তত্ত্বের দৃষ্টিতে ইসলামি বিপ্লব ও ইমাম খোমেইনী (রহ্.)-এর প্রভাব

ড. মোহাম্মাদ মাহ্দী মাযাহেরী
হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্.)-এর নেতৃত্বে ১৯৭৯ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ইরানে ইসলামি বিপ্লব বিজয়ী হবার পর থেকে এ বিপ্লবের পিছনে নিহিত কারণ সমূহ ও এ বিপ্লবের বিজয়ের প্রভাব ও ফলাফল সমূহ সম্পর্কে প্রচুর গ্রন্থ ও প্রবন্ধ রচনা করা হয়েছে। এসব গ্রন্থ ও প্রবন্ধ রচনা করতে গিয়ে যে ব্যাপকভিত্তিক গবেষণা করা হয়েছে তাতে হয় ইসলামি বিপ্লবের প্রতি এর অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক মূল্যের দৃষ্টিকোণ থেকে দৃষ্টিপাত করা হয়েছে অথবা এ বিপ্লব ও বিশ্বের অন্যান্য বিপ্লব সম্পর্কে তুলনা মূলক আলোচনা করা হয়েছে।
প্রকৃতপক্ষে এসব গবেষণায় প্রধানত রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক, সমাজতাত্ত্বিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের দৃষ্টিতে এবং তুলনামূলক গবেষণার দৃষ্টিকোণ থেকে ইসলামি বিপ্লবের প্রতি দৃষ্টিপাত করা হয়েছে। তবে ইসলামি বিপ্লব সম্পর্কিত সাহিত্যের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে দেখা যাবে যে, এতে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক তত্ত্বের প্রেক্ষাপটে আলোচনা একান্তই বিরল। অবশ্য এটা অনস্বীকার্য যে, এসব আলোচনার মূল মর্মে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক তত্ত্বের ছাপ পাওয়া যায়। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইসলামি বিপ্লবের প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া সম্পর্কিত আলোচনায় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক তত্ত্ব সমূহের, বিশেষত সিস্টেম্যাটিক তত্ত্ব সমূহের কতগুলো দিকের ভিত্তিতে আলোচনা দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা কাঠামোর ওপরে ইসলামি বিপ্লবের প্রভাবের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক তত্ত্ব সমূহ ও তথাকথিত ‘গঠনরোধক’ (deconstructive) ) তত্ত্ব সমূহের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকলেও এ পর্যন্ত ইসলামি বিপ্লব সম্পর্কে যেসব গবেষণা মূলক আলোচনা করা হয়েছে সেসবে ঐ সব তত্ত্বকে যথাযথ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয় নি। তাই আমরা এখানে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক তত্ত্বের দৃষ্টিকোণ থেকে ইরানের অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে ও বিশ্ব পরিস্থিতিতে হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্.) ও ইসলামি বিপ্লবের প্রভাবের ওপর সংক্ষেপে ও সুবিন্যস্তভাবে আলোকপাত করার চেষ্টা করব।
আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা কাঠামো বলতে আমরা বুঝি বিশ্বব্যাপী শক্তি ও ক্ষমতার বণ্টন এবং প্রভাবকে; এ হচ্ছে ঠিক সেই ধারণা যা দ্বিমেরু বিশ্ব, একমেরু বিশ্ব, বহুমেরু বিশ্ব ইত্যাদির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। বস্তুত এগুলো দ্বারা সেই সব বিতর্কিত ও সমালোচিত তত্ত্বকে বুঝানো হয় যেগুলো বিশ্বের বুকে বর্তমানে বিদ্যমান ব্যবস্থার ভিত্তিমূলকে অগ্রহণযোগ্য বলে এবং একে জংলি আইনের সমতুল্য বলে গণ্য করে থাকে। এ তত্ত্ব সমূহ বিদ্যমান স্থিতাবস্থার সমালোচনার, এ থেকে উদ্ধারের এবং এমন একটি ভবিষ্যতের চিত্র অঙ্কন করার চেষ্টা করে থাকে- যাতে কাঠামোগত বৈষম্যকে সুবিচারের দ্বারা ও সহিংসতাকে শান্তির দ্বারা প্রতিস্থাপন করা হবে।
প্রকৃতপক্ষে ইরানের ইসলামি বিপ্লবের প্রকৃতি হচ্ছে বিদ্যমান স্থিতাবস্থার বিরুদ্ধে সমালোচনামূলক প্রকৃতি। এ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা লাভ করতে হলে তৎকালীন ইরানের অবস্থার প্রতি দৃষ্টি দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে আমাদেরকে একই বিষয়ের-যাকে আমরা ইরানি সমাজের কাঠামোগত বৈষম্য বলে অভিহিত করতে পারি-চারটি দিকের প্রতি দৃষ্টি দিতে হবে।
ইসলামি বিপ্লব-পূর্ব ইরানি সমাজের কাঠামোগত বৈশিষ্ট্যের প্রথম দিকটি ছিল এই যে, তৎকালীন ইরানি সমাজ বেশ কয়েকটি উপবিভাগে বিভক্ত ছিল। যদিও পাহ্লাভী রাজবংশের শাসনাধীন ইরান অর্থনৈতিক মানদণ্ডের বিবেচনায় তৎকালীন তৃতীয় বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় উন্নততর ছিল, তবে সেই সাথে এ দেশটি ছিল সেই সব দেশের অন্তর্ভুক্ত যেসব দেশের জনগণের ওপর একজন রাজা বা বাদশাহ্র সার্বভৌমত্ব চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল। বিশেষ করে, ১৯৫১ থেকে ১৯৫৩-র মাঝামাঝি পর্যন্ত স্বল্পকালীন সময়টির কথা বাদ দিলে দীর্ঘ তিন দশকেরও বেশিকাল যাবত ইরানের সমস্ত কিছুর নিয়ন্ত্রণ ছিল তৎকালীন শাহ মোহাম্মাদ রেযা পাহ্লাভীর হাতে।
যদিও বিপ্লব-পূর্ব ইরানে একটি সংবিধান ছিল এবং সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী ছিলেন প্রশাসনিক বিভাগের প্রধান, কিন্তু কার্যত পুরো প্রশাসনিক ক্ষমতা শাহের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে ছিল; সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় মন্ত্রী পরিষদের ভূমিকা ছিল খুবই গৌণ। অন্যদিকে সশস্ত্র বাহিনী নীতিগতভাবে অরাজনৈতিক জাতীয় প্রতিষ্ঠান হলেও এবং প্রশাসনিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিষয়াদিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভূমিকা পালন থেকে তার দূরে থাকার কথা থাকলেও কার্যত সব সময়ই সশস্ত্র বাহিনী শাহের স্বৈরাচারী কর্তৃত্ব কার্যকর করার ও ব্যক্তিগত লক্ষ্য-উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতো।
তৎকালীন সংবিধান অনুযায়ী ইরানে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে মজলিস (পার্লামেন্ট)-এর সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার কথা থাকলেও কেবল ১৯৫১ থেকে ১৯৫৩-র মাঝামাঝি পর্যন্ত মজলিস এ ভূমিকা পালন করতে পেরেছিল; অতঃপর ১৯৫৩-র ১৯ আগস্ট ব্রিটিশ-মার্কিন যৌথ ষড়যন্ত্রে সংঘটিত সামরিক অভ্যুত্থানের ফলে মজলিস পুনরায় একটি গুরুত্বহীন ‘রাবার স্ট্যাম্প’ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়।
সংক্ষেপে বলা যেতে পারে যে, ইসলামি বিপ্লবের বিজয়ের পূর্বে ইরানে কোনো কার্যকর আইনগত প্রতিষ্ঠান অথবা আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক সামাজিক গোষ্ঠীর দ্বারা নয়, বরং কেবল শাহের ইচ্ছানুযায়ীই রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত সমূহ গ্রহণ করা হতো। তখন সমস্ত আইনগত ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের ওপরে এবং গোটা রাজনৈতিক ব্যবস্থার ওপরে, এমনকি সংবিধানের ওপরে, শাহের ইচ্ছা অগ্রাধিকার লাভ করতো। তখন প্রকারান্তরে শাহের ইচ্ছাই ছিল ইরানের আইন ও সংবিধান এবং শাহের প্রতি আনুগত্যই আইন ও সংবিধানের প্রতি আনুগত্য হিসেবে বিবেচিত হতো। এ প্রবণতাকে আমরা ‘অভ্যন্তরীণ কাঠামোগত সহিংসতা’ হিসেবে ব্যাখ্যা করতে পারি। এর মানে হচ্ছে, ইরানে সরকার এবং সমাজ ও জনগণের মধ্যকার সম্পর্ক ছিল কোনো রকমের নাগরিক সমাজের উপস্থিতিবিহীন একটি স্বৈরতান্ত্রিক সম্পর্ক।
ইসলামি বিপ্লব-পূর্ব ইরানের কাঠামোগত সহিংসতার দ্বিতীয় দিকটি প্রতিফলিত হয় ইরান ও পাশ্চাত্য জোটের মধ্যকার সম্পর্কে। এ প্রসঙ্গে আমরা স্মরণ করতে পারি যে, তৎকালীন বিশ্ব ও বৈশ্বিক রাজনৈতিক শক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পাশ্চাত্য শিবির ও অধুনালুপ্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বাধীন প্রাচ্য শিবিরের মধ্যে বিভক্ত ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে শুরু করে ইরানে ইসলামি বিপ্লবের বিজয় কাল পর্যন্ত এটাই ছিল বিশ্বের অবস্থা; এ সময়টিতে এ দুই শিবিরের বাইরে কোনো দেশের স্বতন্ত্র স্বকীয় অবস্থান চিন্তনীয় ছিল না।
এ সময় ভৌগোলিক কৌশলগত অবস্থানের কারণে উভয় শিবিরের কাছেই ইরান বিশেষ গুরুত্বের অধিকারী ছিল। কিন্তু শাহ্শাসিত তৎকালীন ইরান বিভিন্ন কারণে পাশ্চাত্য শিবিরকে অগ্রাধিকার প্রদান করে এবং এ শিবিরভুক্ত দেশগুলোর সাথে, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আত্মসমর্পণ মূলক সম্পর্ক, অন্য কথায়, অধীনতামূলক মৈত্রীর সম্পর্ক গড়ে তোলে। এ কারণেই দেখা যায় যে, যেহেতু শাহ্ মোহাম্মাদ রেযা পাহ্লাভীর শাসনামলে ইরান সরকারের জন্য দেশের সাধারণ জনগণের মধ্যে কোনো সামাজিক ভিত্তি ছিল না, সেহেতু শাহের সরকার তৎকালীন দুই প্রধান বৃহৎ শক্তির অন্যতম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগী হয়ে নিজের জন্য বৈধতা ক্রয়ের চেষ্টা করে।
বস্তুত একদিকে সরকারের প্রশাসনিক বিভাগের অস্থিতিস্থাপক বৈশিষ্ট্য এবং ধনিক ও তথাকথিত অভিজাত শ্রেণির ওপর ভিত্তিশীল কাঠামো, অন্যদিকে জনগণের অংশগ্রহণমূলক আইনগত প্রতিষ্ঠান সমূহের অনুপস্থিতি পাহ্লাভী সরকার ও ইরানি জনগণের মধ্যে দুস্তর ব্যবধান গড়ে তুলেছিল। এ কারণেই শাহের সরকারের জন্য স্বীয় অস্তিত্ব বজায় রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পুরোপুরিভাবে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়া এবং এর অনিবার্য দাবি হিসেবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে, বিশেষ করে রাজনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে পাশ্চাত্যের সাথে, বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সর্বাত্মক সম্পর্ক গড়ে তোলা ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। আর এর ফলাফল ছিল ইরান ও পাশ্চাত্য শিবিরের মধ্যে বিশেষত ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে আধিপত্য মূলক মৈত্রীর সম্পর্ক গড়ে ওঠা- যাকে আমরা ‘ইরান ও আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার মধ্যকার কাঠামোগত সহিংসতা’ বলে অভিহিত করতে চাই, কারণ, এ সম্পর্কের ফলে পাশ্চাত্য, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র সব সময়ই শাহের সরকারে ওপর স্বীয় ইচ্ছা ও সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিত। আর শাহের সরকারের পক্ষে তা মেনে নেয়া ছাড়া গত্যন্তর ছিল না, কারণ, গণভভিত্তিহীন শাহের সরকারের জন্য টিকে থাকার নিশ্চয়তা বিধানের জন্য এটাই ছিল একমাত্র পথ।
কাঠামোগত সহিংসতার তৃতীয় দিকটি ছিল সামগ্রিকভাবে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকে ঘিরে গড়ে ওঠা চক্র সমূহ। এ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে আমরা দেখতে পাই যে, তৎকালে সমগ্র আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা দু’টি শিবিরে বিভক্ত ছিল এবং উভয় শিবিরের প্রতিটিই তিনটি অংশের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছিল, তা হচ্ছে : (১) কেন্দ্রীয় অংশ তথা পরাশক্তি বা কেন্দ্রীয় শক্তি, (২) অর্ধ-গৌণ বা প্রায় গৌণ অংশ সমূহ তথা ইউরোপের শক্তিশালী দেশ সমূহ ও (৩) গৌণ অংশ সমূহ অর্থাৎ তৃতীয় বিশ্বের দেশ সমূহ।
আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার এ কাঠামো বিভাগে প্রকৃত ক্ষমতা মূলত কেন্দ্রীয় অংশের হাতে নিহিত ছিল এবং সব সময়ই যে কোনো বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত পরাশক্তি কর্তৃক গৃহীত হতো। ফলত সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী প্রকৃত শক্তি তথা ক্ষমতাকেন্দ্র ও সিদ্ধান্ত সমূহ বাস্তবায়ন পর্যায়ের মধ্যকার বিরাট ব্যবধানের কারণে সব সময়ই দেখা যেতো যে, নীতি নির্ধারণের কাজ যেখানে পাশ্চাত্য ও প্রাচ্য শিবিরের পরাশক্তি কর্তৃক সম্পাদিত হতো সেখানে দুই পরাশক্তির অর্থাৎ ওয়াশিংটন ও মস্কোর পরস্পরবিরোধী স্বার্থের কারণে সৃষ্ট দ্বন্দ্বের খেসারত দিতে হতো গৌণ দেশ সমূহকে তথা ঐ সব দেশের জনগণকে।
এ কাঠামোগত সহিংসতার চতুর্থ দিক ছিল উত্তর ও দক্ষিণের মধ্যকার সম্পর্ক। কাঠামোগত সহিংসতার এ দিকটি প্রধানত অর্থনৈতিক বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তিশীল। এ ক্ষেত্রে উত্তরের স্বল্প সংখ্যক দেশের একটি গোষ্ঠী বিরাট সংখ্যক দেশের অপর গোষ্ঠীটিকে শোষণ করে ও দুর্বল করে রাখে। বস্তত এটা এখনো আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। উত্তর ও দক্ষিণের মধ্যকার সম্পর্কটি এমন ধরনের যে, এ সম্পর্ক সব সময়ই অর্থনৈতিক দিক থেকে দক্ষিণকে অনুন্নত ও উত্তরকে উন্নত করে রাখছে। ভারসাম্যহীন বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক হচ্ছে উত্তর-দক্ষিণ সম্পর্কের প্রধান বৈশিষ্ট্য। আর তৃতীয় বিশ্বের অর্থাৎ দক্ষিণের দেশগুলোকে সব সময়ই উত্তরের পক্ষ থেকে নির্ধারিত নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কাঠামোর সাথে খাপ খাইয়ে অর্থনৈতিক ভারসাম্য সৃষ্টির জন্য নির্দেশ দেয়া হয়ে থাকে।
ইরানের ইসলামি বিপ্লব স্বীয় বিজয়ের পূর্বে সংগ্রামের যুগ থেকেই সব সময়ই ওপরে বর্ণিত বৈষম্য মূলক ও শোষণকারী তথা সহিংস অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির প্রতি সমালোচনা মুখর ছিল। ইসলামি বিপ্লবের মহান নায়ক হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্.)-এর অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল কাঠামোগত সহিংসতাজাত এসব পরিবেশগত বৈশিষ্ট্য সমূহকে দূরীভূত করা। অন্য কথায়, ইরানের ইসলামি বিপ্লবের প্রধান লক্ষ্য ছিল একটি পরিবর্তন সৃষ্টি করা এবং সে পরিবর্তন সৃষ্টি কেবল জনগণের মন-মানসিকতায় পরিবর্তন সৃষ্টির মাধ্যমেই সম্ভব ছিল। হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্.) কখনোই জবরদস্তি করে তথা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে অথবা ভূখ- দখলের মাধ্যমে এ পরিবর্তন সাধন করতে চান নি। তিনি সব সময়ই সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে জনমনে পরিবর্তন সৃষ্টি ও জনগণের মনের উন্নয়ন সাধন করতে চেয়েছেন।
ইসলামি বিপ্লবের বিজয়ের পরে ইরানে কাঠামোগত বৈষম্য ও সহিংসতার অবসান ঘটে। শুধু তা-ই নয়, বরং এ বিপ্লব সামগ্রিকভাবে কাঠামোগত সহিংসতাকে, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের উপ-ব্যবস্থাকে প্রকম্পিত করে তোলে। অবশ্য দ্বিমেরুভিত্তিক বৈশ্বিক ব্যবস্থা তার টলটলায়মান কাঠামো সহকারে আরো এক দশকের সামান্য বেশি কালের জন্য টিকে থাকে, তবে তার ধসে পড়া ছিল অনিবার্য। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ধসে পড়ার পরে আর দ্বিমেরু বিশ্ব বলতে কিছু অবশিষ্ট থাকে নি, কিন্তু তা সত্ত্বেও কাঠামোগত সহিংসতা অন্যভাবে অব্যাহত থাকে।
ইরানে ইসলামি বিপ্লবের বিজয়ের পর হযরত ইমাম খোমেইনী শাসন ব্যবস্থার একটি নতুন মডেল উপস্থাপন করেন – যার সর্বপ্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মুক্তি, স্বাধীনতা ও স্বনির্ভরতা। হযরত ইমাম খোমেইনী জনগণের চিন্তায় ও চেতনায় যেসব প্রভাব বিস্তার করেন সেসবের মধ্যকার ক্ষুদ্রতম প্রভাব হচ্ছে এই যে, তারা দেশ সমূহের অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে বিরাজমান কাঠামোগত বৈষম্য ও সহিংসতার এবং পরাশক্তি সমূহের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের আকারে বিদ্যমান আন্তর্জাতিক কাঠামোগত সহিংসতার প্রকৃতি সম্পর্কে সচেতন হয়েছে। আর বিভিন্ন দেশে জনগণের এ সচেতনতা সম্ভাবনার পর্যায় তথা চৈন্তিক পর্যায় থেকে বাস্তব চর্চাগত পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে।
আজকের বিশ্বের হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্.)-এর চিন্তা ও কর্মের যে সবচেয়ে বড় প্রভাব দেখতে পাওয়া যায় তা হচ্ছে এই যে, তিনি জনমনে চৈন্তিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক পরিবর্তন সাধনের মাধ্যমে পরাশক্তিবর্গের অবৈধ স্বার্থ নস্যাৎ করে দিয়েছেন। অবশ্য পরাশক্তিবর্গও হযরত ইমাম খোমেইনীর চিন্তাধারার ও ইসলামি বিপ্লবের এ বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে শুরু থেকেই সচেতন ছিল এবং এ কারণেই ইসলামি বিপ্লবের বিজয়ের পর থেকে সব সময়ই এ শক্তিগুলো হযরত ইমামের চিন্তাধারা ও ইসলামি বিপ্লবের প্রভাব ইরানের বাইরে ছড়িয়ে পড়া প্রতিহত করার জন্য সম্ভব সব রকমের চেষ্টা চালায়। এ লক্ষ্যে তারা ইসলামি ইরানের বিরুদ্ধে যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করে তার মধ্যে বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি এবং দীর্ঘমেয়াদি ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া ছিল অন্যতম।
বস্তুত বর্তমান বিশ্বের বিদ্যমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে এবং দেশ সমূহের অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থা সমূহকে বিভিন্ন মুখরোচক পরিভাষা সহকারে যতভাবেই ব্যাখ্যা করা হোক না কেন, প্রকৃত অবস্থা হচ্ছে এই যে, একমাত্র ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান ব্যতীত বর্তমান বিশ্বের দেশগুলো আধিপত্যকারী ও আধিপত্যাধীন এই দুই ভাগে বিভক্ত। আধিপত্যকারী শক্তিগুলোর আধিপত্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে আত্মমর্যাদা সহকারে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে চলার জন্য আগ্রহী আধিপত্যাধীন দেশ সমূহের জনগণের সামনে ইরানের ইসলামি বিপ্লব একটি প্রোজ্জ্বল চৈন্তিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও আধ্যাত্মিক দৃষ্টান্ত।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ : নূর হোসেন মজিদী

মহীয়সী নারী হযরত খাদীজাতুল কুবরা (আ.)

মহীয়সী নারী হযরত খাদীজাতুল কুবরা (আ.)
মো. আশিফুর রহমান

হযরত খাদীজার জন্ম ও বংশপরিচয়

যখন সমগ্র আরব জাহেলীয়াতের অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল- নারীদের কোন সম্মান ছিল না- তাদেরকে মানুষের মর্যাদা দেয়া হতো না, নারীদেরকে পুরুষের ভোগের উপকরণ মনে করা হতো, পিতার মৃত্যুর পর সন্তানদের মধ্যে পিতার স্ত্রীদের বণ্টন করে দেয়া হতো সেই সময় আরবের সম্ভ্রান্ত কুরাইশ বংশে জন্ম নেন হযরত খাদীজাতুল কুবরা (আ.)। তিনি আবরাহার হাতি বাহিনীর মক্কা আক্রমণের পনের বছর আগে পবিত্র মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ছিল খুওয়াইলিদ ইবনে আসাদ ইবনে আবদুল উয্যা ইবনে কুসাই ইবনে কিলাব। অন্যদিকে মহানবী (সা.)-এর বংশগত পরিচয় হচ্ছে তিনি হলেন মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে আবদুল মুত্তালিব ইবনে হাশিম ইবনে আব্দে মানাফ ইবনে কুসাই ইবনে কিলাব। অর্থাৎ মহানবী (সা.)-এর সাথে হযরত খাদীজার বংশধারা ঊর্ধ্বতন ষষ্ঠ পুরুষে গিয়ে মিলিত হয়। হযরত খাদীজার মাতার নাম ছিল ফাতিমা বিনতে যায়েদা।
হযরত খাদীজার পিতা খুওয়াইলিদ ছিলেন আরবের ধনাঢ্য ব্যক্তি এবং প্রসিদ্ধ ব্যবসায়ী। খুওয়াইলিদ দম্পত্তি দীর্ঘদিন সন্তানহীন ছিলেন। অঢেল সম্পত্তির অধিপতি হওয়ার পরও তাঁদের মনে সন্তানহীনতার বেদনা পীড়া দিত। অবশেষে তাঁরা আল্লাহ্তায়ালার কৃপায় হযরত খাদীজা (আ.)-এর গর্বিত পিতা-মাতা হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেন।
তাঁদের কন্যাসন্তান ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠতে লাগলেন। খুওয়াইলিদ কন্যাকে সব দিক দিয়ে সহযোগিতা করতেন। জাহেলীয়াতের যুগে কন্যাসন্তানকে শিক্ষা দান করার কথা কল্পনাই করা যেত না। কিন্তু খুওয়াইলিদ তাঁর কন্যাকে শিক্ষিত করে তোলেন।

হযরত খাদীজার উপাধি

হযরত খাদীজা যেমনি শিক্ষিত ছিলেন তেমনি ব্যক্তি-জীবনেও তিনি ছিলেন নির্মল চরিত্রের অধিকারিণী। হযরত খাদীজা তাঁর অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ও পুণ্যময় চরিত্রের কারণে ‘আত তাহেরা’ অর্থাৎ পবিত্রা বলে প্রসিদ্ধা ছিলেন। তাঁকে ‘খাদীজাতুল কুবরা’ অর্থাৎ মহতী খাদীজাও বলা হতো।

ব্যবসায়ের দায়িত্ব গ্রহণ

হযরত খাদীজার মাতা ৬৭৫ খ্রিস্টাব্দে এবং পিতা ৬৮৫ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। মাত্র দশ বছরের ব্যবধানে বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর তাঁদের সম্পদ তাদের সন্তানদের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়, কিন্তু পারিবারিক ব্যবসায়ের দায়িত্ব গ্রহণ করেন খাদীজা এবং তিনি একে সম্প্রসারিত করেন। বলা হয় যে, যখন কুরাইশরা গ্রীষ্মের সময় সিরিয়ায় অথবা শীতের মওসুমে ইয়েমেনে বাণিজ্য সফরে বের হতো তখন তাদের সকলের সম্মিলিত সম্পদের সমান হতো কেবল খাদীজার বাণিজ্য কাফেলার সম্পদ।

হযরত খাদীজার বদান্যতা

হযরত খাদীজা দানশীলতার জন্য প্রসিদ্ধ ছিলেন। তিনি সব সময় দরিদ্রদের সহযোগিতা করতেন। তাঁর দরজা দুঃখী ও অসহায় মানুষের জন্য খোলা থাকত। তাঁর বাড়িকে দরিদ্ররা ‘আশা ও নিরাপত্তার বাড়ি’ বলে জানত। তিনি অনাথদের এত আপন করে নিতেন যে, সবাই তাঁকে ‘ইয়াতীমের মা’ বলে ডাকত।
হযরত খাদীজা তাঁর ব্যবসায়ের মাধ্যমে যে লাভ অর্জন করতেন তা দিয়ে গরীব, বিধবা, ইয়াতীম, অসুস্থ এবং মক্কার প্রতিবন্ধীদের সাহায্য করতেন। তিনি দরিদ্রদের খাদ্য ও বস্ত্র প্রদান করতেন, তাঁর দরিদ্র স্বজনদের অর্থনৈতিকভাবে সাহায্য করতেন, এমনকি তাঁর নিকটআত্মীয়দের মধ্যে যারা বিবাহের খরচ বহন করার সামর্থ্য রাখত না তাদের বিবাহের খরচ তিনি বহন করতেন। তিনি প্রতিদিন দরিদ্র ও নিরাশ্রয় অতিথিদের সাথে কথা বলতেন, তাদের অসহায়ত্ব ও সমস্যার কথা শুনতেন। তিনি অসহায় নারীদের প্রতি ভীষণভাবে যত্নশীল ছিলেন। তাদের মধ্যে তিনি টাকা-পয়সা বিতরণ করতেন। তিনি ইয়াতীমদের খাওয়াতেন এবং তাদের সাথে নিজে খাদ্য গ্রহণ করতেন। হযরত খাদীজা কন্যাদের জীবন্ত কবর দেয়ার বিরোধিতা করতেন এবং সাধ্যমতো কন্যাসন্তানদেরকে নিজ গৃহে আশ্রয় দিতেন।

রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সাথে বিবাহ

পিতার মৃত্যুর পর হযরত খাদীজাহ্ নিজেই তাঁর ব্যবসা পরিচালনা করতে লাগলেন। ৫৯৫ খ্রিস্টাব্দে হযরত খাদীজা তাঁর ব্যবসায়ের দায়িত্ব গ্রহণের জন্য একজন যোগ্য ও বিশ্বস্ত ব্যক্তির সন্ধান করছিলেন। হযরত আবু তালিব হযরত খাদীজার ব্যবসায়ের দায়িত্বভার নেয়ার জন্য রাসূলকে উপদেশ দেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) হযরত খাদীজার পণ্য-সামগ্রী নিয়ে সিরিয়ায় গমন করেন এবং বিপুল পরিমাণ মুনাফা অর্জন করে মক্কায় ফিরে আসেন। তবে রাসূলুল্লাহ (সা.) হযরত খাদীজার কর্মচারী হিসাবে নাকি ব্যবসায়ের অংশীদার হিসাবে শামে গিয়েছিলেন এ বিষয়টিতে মতপার্থক্য রয়েছে। ইয়াকুবী তাঁর ইতিহাস গ্রন্থে লিখেছেন : ‘মহানবী (সা.) তাঁর জীবনে কারো বেতনভুক কর্মচারী হন নি।’
খাদীজার দাস মাইসারাহ্ এ সফরে রাসূলের চরিত্র সম্পর্কে যা কিছু প্রত্যক্ষ করেছিল তা হযরত খাদীজাকে অবহিত করে। রাসূলের উন্নত চরিত্র, সততা, আমানতদারীর কারণে হযরত খাদীজা তাঁর প্রতি অভিভূত হয়ে তাঁর কাছে বিবাহের প্রস্তাব পাঠান।
মহানবী (সা.) হযরত আবু তালিবের সাথে বিবাহের ব্যাপারে আলোচনা করলেন। কুরাইশ বংশীয় শীর্ষস্থানীয় ও সম্মানিত ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতিতে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। হযরত আবু তালিব রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর বিবাহের খুতবা পাঠ করেন। এ বিবাহের পরপরই মক্কার অজ্ঞ নারীরা মহানবী (সা.)-কে বিয়ে করার জন্য খাদীজার নিন্দা করতে থাকে যে, মহানবী (সা.) কোনভাবেই তাঁর উপযুক্ত নন।
বস্তুবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে হযরত খাদীজার বিবাহ করার কারণ হিসাবে মনে হতে পারে যে, যেহেতু তিনি তাঁর ব্যবসা পরিচালনার জন্য একজন বিশ্বস্ত ও দক্ষ লোক খুঁজছিলেন, আর রাসূলও তেমনি ছিলেন সেজন্য তিনি রাসূলের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এমন চিন্তা নিঃসন্দেহে অমূলক। ইতিহাস থেকে প্রতীয়মান হয় যে, হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে তাঁকে যেসব বিষয় উদ্বুদ্ধ করেছিল তা ছিল কতগুলো আধ্যাত্মিক ও নৈতিক বিষয়। ব্যবসায়ের উত্তরোত্তর প্রবৃদ্ধি অর্জন আর ধন-সম্পদ বৃদ্ধি যে তাঁর বিবাহে কোন ভূমিকাই রাখেনি সেটা আমরা বুঝতে পারি ইসলামের জন্য তাঁর সমুদয় সম্পদ বিলিয়ে দেয়া থেকে। বিবাহের পর হযরত খাদীজা তাঁর সমুদয় সম্পদ রাসূলের হাতে তুলে দেন। আর রাসূলুলুল্লাহ (সা.) এ সম্পদ অসহায়, এতীম ও গরীব-দুঃখীদের মধ্যে বণ্টন করেন এবং পরবর্তীকালে ইসলাম প্রচার কাজে ব্যয় করেন।
রাসূলের সাথে হযরত খাদীজাহ্ দীর্ঘ পঁচিশ বছর বৈবাহিক জীবন অতিবাহিত করেন। এ সময়ে হযরত খাদীজার গর্ভে রাসূলের দুই পুত্রসন্তান ও চার কন্যাসন্তানের জন্ম হয়। পুত্রসন্তানরা রাসূলের নবুওয়াতের ঘোষণার পূর্বেই মারা যান। তাঁর চারজন কন্যাসন্তানও ছিল। তবে হযরত ফাতিমা (আ.) ছাড়া অন্যরা হযরত খাদীজার কন্যা ছিলেন কিনা এ নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে।

রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি ঈমান

রাসূলুল্লাহ (সা.) ত্রিশ বছর বয়স থেকে মক্কার হেরা গুহায় আল্লাহর ধ্যানে মশগুল থাকতে শুরু করেন। তিনি হেরা গুহাতে একাধারে কয়েকদিন অবস্থান করতে আরম্ভ করেন। এমতাবস্থায় খাদীজা নিজে গিয়ে তাঁর খাবার পৌঁছে দিতেন। মহান আল্লাহ্র পক্ষ থেকে চল্লিশ বছর বয়সে মহানবী (সা.)-এর নবুওয়াতের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা প্রদান করা হয়। হেরা পর্বতের গুহায় রাসূলের ওপর সূরা আলাকের প্রথম পাঁচটি আয়াত নাযিল হয়। মহানবী (সা.) বাড়িতে ফিরে এসে হযরত খাদীজার কাছে এ কথা ব্যক্ত করেন। ইসলামের ইতিহাসের অকাট্য বিষয়াদির অন্যতম হচ্ছে এই যে, হযরত খাদীজাহ্ (আ.) ছিলেন প্রথম নারী যিনি মহানবী (সা.)-এর প্রতি ঈমান এনেছিলেন। আর এ ব্যাপারে কোন মতপার্থক্যও নেই।
হযরত আলী (আ.) মহানবীর নবুওয়াতের সূচনালগ্নে ইসলাম ধর্মের নিঃসঙ্গতার দিকে ইঙ্গিত করে একটি ভাষণে বলেছেন : ‘সে দিন রাসূলুল্লাহ্ ও খাদীজার গৃহ ব্যতীত ইসলামে বিশ্বাসী আর কোন ঘর ছিল না; আমি ছিলাম তাঁদের পর ইসলামে বিশ্বাসী তৃতীয় ব্যক্তি।’ হযরত খাদীজা রাসূলের সাথে সর্বপ্রথম নামায আদায় করেন।

ইসলাম প্রচারে হযরত খাদীজার অবদান

বিবাহিত জীবনের ১৫ বছর অতিবাহিত হওয়ার পর এ সময়ে হযরত খাদীজা অত্যন্ত কষ্টকর এক জীবনের মধ্যে প্রবেশ করেন। কেননা, এ সময়ের মধ্যেই তাঁর স্বামী মহান আল্লাহর নবী হিসাবে তাঁর ধর্ম প্রচারের কাজ শুরু করেন। আর ইসলামের প্রাথমিক যুগের দুর্যোগময় পরিস্থিতিতে তিনিই ছিলেন রাসূলের সান্ত¡নার উৎস। রাসূলের ইসলাম প্রচারের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক পৃষ্ঠপোষক ছিলেন হযরত খাদীজা।
শেবে আবু তালিবে
হযরত খাদীজা প্রচণ্ড চাপের মুখেও তাঁর স্বামীর সাথে থেকে কুরাইশদের মোকাবিলা করেন। যখন কাফিররা বনি হাশিম ও বনি আবদুল মুত্তালিবকে বয়কট করার ঘোষণা দেয় তখন হযরত আবু তালিব নিজেদের নিরাপত্তার জন্য শেবে আবু তালিবে চলে যান। সেখানে তাঁরা প্রায় তিন বছর অবস্থান করেন।
হযরত খাদীজা জন্মগ্রহণ করেছিলেন একটি অভিজাত পরিবারে এবং জীবনের বেশিরভাগ সময় কষ্টহীন একটি জীবন যাপন করেছিলেন। যদিও রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সাথে বিবাহ বন্ধনের আবদ্ধ হওয়ার পর তিনি তাঁর ধনসম্পদ মুসলিম জনসাধারণের জন্য খরচ করেন। কিন্তু শেবে আবু তালিবের কষ্টকর জীবন তাঁর কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত একটি বিষয় ছিল। বৃদ্ধ বয়সেও হযরত খাদীজা শেবে আবু তালিবে উপস্থিত ছিলেন।
হযরত খাদীজার ইন্তেকাল
যা হোক রাসূলের সাথে দীর্ঘ পঁচিশ বছরের জীবন ইসলামের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময় ছিল। এ সময় তিনি রাসূলকে সব দিক দিয়েই সহযোগিতা করেছেন। রাসূলের সাথে সব কষ্ট তিনি সমানভাবে বহন করেছেন। অবরোধের সময় হযরত খাদীজাহ্ যে কষ্ট সহ্য করেন তাতে তাঁর শরীর ভেঙ্গে পড়ে। তাঁর অসুস্থাবস্থায় রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁর সেবা-শুশ্রুষা করতে থাকেন। অবশেষে পঁয়ষট্টি বছর বয়সে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নবুওয়াতের ১০ম বর্ষে (৬১৯ খ্রিস্টাব্দ) ১০ রমযান হযরত খাদীজা মহান আল্লাহর সান্নিধ্যে গমন করেন।
তাবারসী ‘ই’লামুল ওয়ারা’ গ্রন্থে ইবনে মান্দাহর ‘কিতাবুল মারিফাহ’ থেকে ওয়াকিদীর বক্তব্যটি বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেন : তাঁরা হিজরতের তিন বছর পূর্বে শে’ব থেকে বের হন। আর এ বছরেই আবু তালিব ও খাদীজা ত্রিশ দিনের ব্যবধানে ইন্তেকাল করেন। একারণে রাসূলুল্লাহ (সা.) ঐ বছরটিকে ‘আমুল হুয্ন’ বা ‘শোকের বছর’ নাম দেন।
হযরত খাদীজা শেবে আবু তালিবে অবস্থানকালের তিনটি বছরে তাঁর ধনসম্পদের সবকিছুই ব্যয় করে ফেলেন। এমনকি যখন তিনি মারা যান তখন তাঁকে দাফন করার মতো একটি কাপড়ও তাঁর ঘরে ছিল না। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর একটি চাদর দিয়ে তাঁকে দাফন করা হয়। তাঁকে দাফন করা হয় হুজুন নামক স্থানে। রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁর কবরে নেমে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকেন। এরপর তিনি তাঁকে সেখানে দাফন করেন।

হযরত খাদীজার মর্যাদা

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : ‘সারা বিশ্বের নারীদের মধ্যে মরিয়ম বিনতে ইমরান, খাদীজা বিনতে খুওয়াইলিদ, ফাতিমা বিনতে মুহাম্মাদ এবং ফিরআউনের স্ত্রী আসিয়াই তোমাদের জন্য যথেষ্ট।’
ইসলামের ইতিহাসে হযরত খাদীজা অনেক দিক থেকে অগ্রবর্তী ছিলেন। তিনি অনেক বিষয়েই প্রথম ব্যক্তি হিসাবে বিবেচিত হন। যেমন তিনি শেষ নবী (সা.)-এর প্রথম স্ত্রী। তিনিই প্রথম সাক্ষ্য দেন যে, আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই এবং মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহর রাসূল ও শেষ নবী। মহানবী (সা.)-এর পর তিনিই প্রথম ওহীর বাণী শ্রবণকারী। তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি মহানবী (সা.)-এর সাথে মহান আল্লাহর উদ্দেশে নামায আদায় করেন। তিনি একমাত্র নারী যাঁর বর্তমানে রাসূল (সা.) দ্বিতীয় বিবাহ করেন নি। তাঁর গর্ভে রাসূলের সন্তানরা জন্মগ্রহণ করেন এবং তাঁর কন্যা হযরত ফাতেমার মাধ্যমে রাসূলের বংশধারা কিয়ামত পর্যন্ত বজায় থাকবে এবং পৃথিবীতে শেষ ইমাম হযরত মাহ্দী (আ.)-এর আগমন ঘটবে।

হযরত খাদীজার প্রতি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ভালোবাসা

রাসূলুল্লাহ (সা.) হযরত খাদীজার মৃত্যুর পর প্রায়শ তাঁর সম্পর্কে আলোচনা করতেন এবং তাঁর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করতেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলতেন : ‘আমাকে (আল্লাহর তরফ থেকে) তাঁর ভালোবাসা দান করা হয়েছে।’

শাহনামায় বর্ণিত ফেরদৌসির চিন্তাদর্শন

তারিক সিরাজী :ফারসি সাহিত্যের বিশ্ববিশ্রুত ও বরেণ্য কবি আবুল কাসেম ফেরদৌসি [৯৪০-১০২০/১০২৫ খ্রি. (আনুমানিক)] ছিলেন ইরানের প্রাচীন ইতিহাস, ঐতিহ্য ও গৌরবগাথার সার্থক রূপকার। বিশ্ববিখ্যাত বীরত্বগাথা শাহনামা রচনার মধ্য দিয়ে তিনি মূলত ইরানিদের জাতিসত্তা ও ফারসি ভাষার মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্যকে সংরক্ষণ করেছেন। জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ হওয়ার প্রেরণা ও গুরুত্ব অনুধাবন করে তাঁর এ কালজয়ী বীরত্বগাথা গ্রন্থটি পৃথিবীর প্রসিদ্ধ ভাষাগুলোতে অনূদিত হয়েছে এবং অনেক জাতির কাছেই তা হয়েছে সমাদৃত।ফেরদৌসি তাঁর লেখার মাধ্যমে লুপ্তপ্রায় পারস্যের প্রাচীন সভ্যতা-সংস্কৃতি ও ফারসি ভাষা পুনরুদ্ধারে এগিয়ে আসেন। অক্লান্ত পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে তিনি গোটা পারস্যকে পুনরুজ্জীবিত করেন। তিনি তাঁর শাহনামার শ্লোকে শ্লোকে জাতীয় অনুভূতি, উপলব্ধি ও চেতনার এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলেন-যার দ্বারা ইরানি জনগণ ব্যাপকভাবে জাতীয় মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে শাহনামা হলো ভিনদেশি শাসনশৃঙ্খলের বিরুদ্ধে বহুকালের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ এবং জাতীয়তার মূর্ত প্রতীক। এ কাব্যগ্রন্থটি যারতুশ্তের (জরাথ্রুস্ট-Zoroater) সময় থেকে আরব সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাকাল পর্যন্ত ইরানে যে রাজন্যবর্গ ছিলেন তাঁদের চরিত্র অবলম্বনে রচিত হয়েছে।
আমরা জানি যে, মহাকাব্যের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে পৌরাণিক কাহিনীগুলোর বিশ্লেষণ, মহান বীরযোদ্ধাদের গুণ, বৈশিষ্ট্য ও কীর্তি বর্ণনা এবং বিভিন্ন জাতির ভাগ্য নির্মাণে সংঘটিত যুদ্ধ-বিগ্রহের ইতিহাস তুলে ধরা। পাশাপাশি সমকালীন রাজনৈতিক, সামাজিক ও আত্মউদ্দীপক বিষয়গুলোও এতে সমভাবে অনুরণিত হয়ে থাকে। এছাড়া মাহাকাব্যে ফেলে আসা অতীত যুগের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস, একটি জাতি প্রতিষ্ঠার ঘটনা ও নিজের প্রসিদ্ধ বীরত্বগাথা বিধৃত থাকে।
মহাকাব্যের রচয়িতাগণ এ ধরনের সাহিত্যকর্মে নিজ জাতি ও মানব সভ্যতার আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়ে থাকেন এবং তাঁদের ভিতরের রহস্যকে নিজদের সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে উন্মোচিত করেন। তাঁরা মনে করেন জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য ও বীরত্ব জানার মধ্য দিয়ে আত্মপরিচয় লাভ করা যায় এবং উৎসাহ-উদ্দীপনা ও জাতীয় আত্মবিশ্বাস প্রতিষ্ঠায় উজ্জীবিত হওয়া যায়। মহাকাব্যে বিধৃত বীরদের কাহিনী থেকে শিক্ষা নিয়ে অত্যাচার ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে জাতি ও দেশকে ধ্বংস থেকে রক্ষার উপায় ও অবলম্বন অন্বেষণ করা যায়। বিশ্বে যে কয়টি নির্ভরযোগ্য মহাকাব্য রয়েছে সেগুলোর মূল বক্তব্য ও বিষয় অনেকটা একই বলে প্রতিভাত হয়। সমৃদ্ধ ও গ্রহণযোগ্য মহাকাব্যগুলোর মধ্যে রয়েছে :
১. গিলগামেশ (Gilgamesh) প্রায় খ্রিস্টপূর্ব দুই হাজার সালে ব্যবিলনীয় ভাষায় রচিত হয়েছে এবং এর বিষয়বস্তু ছিল বীরদের জন্য এক ধরনের মৃতসঞ্জীবনী উদ্ভিদ অন্বেষণ এবং পরাজিত সৈনিকদের কাহিনী বর্ণনা করা। ২. ইলিয়াড (Iliad) খ্রিস্টপূর্ব ৮ম শতকের মধ্যভাগে হোমার কর্তৃক গ্রিক ভাষায় রচিত হয়েছে-যার বিষয়বস্তু ছিল ট্রয় নগরীর দশ বছরব্যাপী যুদ্ধ কাহিনী। ৩. ইনেইড (Aeneid) শীর্ষক মহাকাব্যটি ভার্জিল কর্তৃক ল্যাটিন ভাষায় রচিত হয়েছে। এটি রচনা করতে ভার্জিলের খ্রিস্টর্পূব ২৯ থেকে ১৯ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ দশ বছর সময় লেগেছিল। এ মহাকাব্যের বিষয়বস্তু ছিল ট্রয় নগরীর ধ্বংস এবং রোম জাতির প্রতিষ্ঠার পর বন্ধুদের সাথে ইনের ভ্রমণ বৃত্তান্ত বর্ণনা করা। এছাড়া এতে উল্লেখ রয়েছে শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রতীক হিসাবে খ্যাত ট্রয়ের জনগণ এবং শক্তিমত্তার প্রতীক হিসাবে প্রসিদ্ধ ল্যাটিন জনগণের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার বিষয়াবলি। ৪. মহাভারত (Mahabharata) খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে সংস্কৃত ভাষায় রচিত হয়েছে। ৫. রামায়ণ (Ramayana) খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় অথবা চতুর্থ খ্রিস্টাব্দে বাল্মীকি কর্তৃক রামচন্দ্রের জীবন কাহিনী নিয়ে রচিত হয়েছে। ৬. ফেরদৌসির শাহনামা খ্রিস্টীয় দশম শতকে ফারসি ভাষায় রচিত হয়েছে।
ফেরদৌসি ৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে শাহনামা রচনা শুরু করেন এবং ১০১০ খ্রিস্টাব্দে ৭৫ বছর বয়সে তা সমাপ্ত করেন। বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ফেরদৌসির শাহনামায় যে বিষয়গুলোর উল্লেখ রয়েছে তা হচ্ছে, বীরদের মানসিকতা, প্রচেষ্টা, জ্ঞান ও বিদ্যা, আল্লাহর আনুগত্য, ন্যায়পরায়ণতা, রাজনীতি, জাতীয় ঐক্য ও সংহতি। এতে শিক্ষণীয় অনেক বিষয়ের উল্লেখের পাশাপাশি রয়েছে বিশ্বদর্শন।
হিজরি ষষ্ঠ শতকে শাহনামা মূলত দু’টি ভাষায় অনূদিত হয়েছিল একটি জর্জিয়ান ভাষায় আর অপরটি আরবি ভাষায়। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হচ্ছে এ দুইটি অনূদিত গ্রন্থ কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। আসিরুল মামালিক নিশাবুরি প্রথম আরবি ভাষায় শাহনামা অনুবাদ করেন। তিনি হিজরি পঞ্চম শতকের শেষভাগে এবং ষষ্ঠ শতকের গোড়ার দিক পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন। তবে কাওয়াম উদ্দিন ফাতেহ বিন আলি বিন মুহাম্মাদ বুন্দারি ইস্পাহানি কর্তৃক আরবি ভাষায় অনূদিত কপিটিই হচ্ছে শাহনামার সবচেয়ে পুরাতন অনূদিত কপি যা এখনো সংরক্ষিত আছে। অনুবাদক বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক তথ্যগুলোই তুলে ধরেছেন এবং বর্ণনাধর্মী বিষয়গুলো পরিহার করেছেন।
১০৩০ খ্রিস্টাব্দে তৃতীয় যে ভাষায় শাহনামা অনূদিত হয়েছিল তা ছিল ওসমানি তুর্কি ভাষায়। শাহানামা কাব্যগ্রন্থটি যেসকল ভাষায় অনূদিত হয়েছে এর অন্যতম হলো আরবি, জার্মানি, উর্দু, ইংরেজি, বাংলা, ইতালি, পশতু, তুর্কি, রুশ, জাপানি, হিন্দি, কুর্দি ইত্যাদি। ধারণা করা হয় যে, শাহনামা কাব্যগ্রন্থটি প্রায় ২৮টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
উল্লেখ্য যে, শাহানামার প্রথম অনুবাদটি সুলতান ঈসা বিন মুলকে কামেল আবু বকর এর নির্দেশে বুন্দারি সম্পন্ন করেছেন যা ছিল ইতিহাসনির্ভর। অত্যন্ত বিস্ময়ের ব্যাপার হলো এই যে, জার্মান ভাষায় যখন শাহানামা অনূদিত হয় তখন চলছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। আবার মনিরউদ্দিন ইউসুফ ১৯৭১ সালে যখন বাংলা ভাষায় শাহনামা অনুবাদ করছিলেন তখন ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়। মহাকাব্য শাহনামা অনুবাদের এ প্রেক্ষাপট পর্যালোচনার দাবি রাখে। তাই বলা যায় যে, মনিরউদ্দিন ইউসুফ বাংলা ভাষায় শাহনামা শীর্ষক মহাকাব্য অনুবাদের মধ্য দিয়ে মূলত কবি ফেরদৌসির আত্মরহস্য উদঘাটন করতে চেয়েছেন।
ফেরদৌসির যুগে আনুষ্ঠানিকভাবে গল্প বলা ও শোনার একটা প্রচলন ছিল। কারণ, সে সময় বেশিরভাগ লোকই পড়তে ও লিখতে জানতো না। এ ধরনের গল্প পাঠের আসরে পরিবেশন করা হতো ধর্মীয় ও পৌরাণিক কাহিনী। পুরাণপাঠের এ কাজটিকে বলা হয় নাক্কালি আর যিনি কাহিনীগুলো পাঠ করে শোনান বা উপস্থাপন করেন তাকে বলা হয় নাক্কাল বা পুরাণপাঠকারী। তাঁর হাতে থাকত একটি লাঠি যা দিয়ে তিনি চরিত্র চিত্রায়ণ করতেন। বলা যায় ঠিক আমাদের দেশের পুঁথি পাঠের ন্যায়। অনেকের অভিমত পুরাণপাঠকারীর গল্প বলার কাজটিকে সহজতর ও প্রাণবন্ত করার লক্ষ্যেই ফেরদৌসি সহজ-সরল ও প্রাঞ্জল ভাষায় পৌরাণিক কাহিনীগুলো রচনা করে তা শাহানামা কাব্যগ্রন্থে তুলে ধরেছেন। কবি নিজেই শাহনামা গ্রন্থ রচনার প্রেক্ষাপট তুলে ধরে বলেন :
‘আমি উড়ন্ত ঝলধর, কিন্তু পদযুগ বিন্যস্ত করেছি
সেই ছায়াচ্ছন্ন দেবদারুর উন্নত শাখায়।
কারণ, যশস্বী নরপতিগণের এই ইতিকথা
দুনিয়ায় আমার স্মারক হয়ে থাকবে।
তুমি একে অলীক কাহিনী বলে মনে করো না,
গণ্য করো না তাকে যুগ-চিত্তের উৎসার মাত্র বলে।
এর কিছু কাহিনীতে রয়েছে বুদ্ধি ও জ্ঞানের দীপ্তি,
অন্যরা নিজেদের মধ্যে বহন করছে রহস্যময় তাৎপর্য।
অতীত কালে ছিল পূরাকীর্তি সম্বলিত এক গাথা,
তার মধ্যে সন্নিবেশিত ছিল অনেক উপাখ্যান।
প্রত্যেক জ্ঞানী ব্যক্তির মুখে মুখে তা ছড়িয়েছিল,
সেগুলো থেকে তারা সংগ্রহ করত প্রজ্ঞা ও তত্ত্বের সম্পদ।
কোন নিভৃত গ্রামাঞ্চলের এক বীর সন্তান
বর্ষীয়ান সাহসী জ্ঞানী ও দানশীল-
আদিম যুগের সেই ইতিকথার খোঁজে তৎপর হোল,
কাহিনীগুলোর উদ্ধার মানসে সে ঘুরে বেড়ালো বহুদিন।
ফিরলো সে বহু নগরীর পথে পথে,
ফলে সংগৃহীত হোল এই গাথা।
সেই বীর-জ্ঞানী তাঁদের কাছ থেকে জেনেছে অতীতের সব কীর্তি,
তারপর সেই সংগ্রহ থেকে রচিত হয়েছে এক মহান পুরাণ কথা।
জগতে সেই গাথাই হয়ে আছে অতীতের স্মৃতি,
সর্বত্র জ্ঞানী ও ধর্মবেত্তা জানিয়েছে তাকে স্বাগতম।’ (মনিরউদ্দীন ইউসুফ অনূদিত)
সাহিত্যামোদিদের নিকট কবি ফেরদৌসির গুরুত্ব ও আবেদন কেবল তাঁর ভাষার লালিত্য ও মাধুর্যের মধ্যেই নিহিত নয়, বরং তাঁর জাতীয়তাবাদ ও ধর্মীয় চেতনার মাঝেও বিদ্যমান রয়েছে। তাঁর রচিত শাহনামা গ্রন্থের পরতে পরতে গল্পের কাহিনীগুলো এমনিভাবে বিধৃত রয়েছে যে প্রতিটি চরিত্রই যেন একেক জন পর্যবেক্ষক হিসাবে কাজ করছে। যে কারণে এ মহাকাব্য সাহিত্যের একটি উচ্চমার্গে পৌঁছেছে। তিনি প্রচলিত সাহিত্যরীতির বিপরীতে অন্তর্নিহিত বর্ণনার দিকে অগ্রসর হয়েছেন আর এটি ছিল তাঁর নিজস্ব উদ্ভাবিত শৈলী। এ ধরনের সাহিত্যশৈলী ফারসি সাহিত্যে বিরল। তিনি তাঁর শাহনামা কাব্যগ্রন্থকে ধ্বনি, শব্দ চয়ন, এমনকি ব্যাকরণসহ সকল স্তরে একটি সুশৃঙ্খল গঠন কাঠামোর মাধ্যমে বিন্যস্ত করেছেন। যার ফলে এটি ভাষাতত্ত্বের দৃষ্টিকোণ থেকেও সর্বোচ্চ ও চূড়ান্ত অবস্থানে রয়েছে।
ফেরদৌসি তাঁর শাহনামা কাব্যগ্রন্থে প্রাচীন পারস্যের ইতিহাস-ঐতিহ্য বর্ণনার মাধ্যমে চরিত্র গঠন, বীরত্ব,পাণ্ডিত্য, বিচক্ষণতা ও জ্ঞানের সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেন। জ্ঞানের যে বিশাল শক্তি রয়েছে সে বিষয়ে তিনি বলেন :
توانا بود هر که دانا بود ز دانش دل پير برنا بود
যে জ্ঞানী সেই শক্তিশালী ও সামর্থ্যবান,
আর জ্ঞানসমৃদ্ধ বৃদ্ধের হৃদয় চির যৌবন থাকে।

জ্ঞান ও প্রজ্ঞা যে অমূল্য সম্পদ সে সম্পর্কে কবি ফেরদৌসি অন্যত্র বলেন :
‘বিশ্ব-প্রভুর দানের মধ্যে জ্ঞান সব চাইতে বেশী মূল্যবান,
জ্ঞানের গুণকীর্তন বদান্যতার পথে শ্রেষ্ঠ উপায়ন।
জ্ঞান সম্রাটদেরও সম্রাট,
জ্ঞান সম্মানিতগণের অলঙ্কার।
জ্ঞান অন্ধকার ও জড়ত্বকে দান করে আলো ও চলমানতা
কাল উৎফুল্ল হয় না জ্ঞানের স্পর্শ না পেলে।’ (মনিরউদ্দীন ইউসুফ অনূদিত)
ফেরদৌসি শাহনামা রচনা করে ফারসি ভাষাকে নিশ্চিহ্ন হওয়া থেকে রক্ষা করেন। এ গ্রন্থের মাধ্যমে তিনি প্রতিরোধের মানসিকতা, আল্লাহর আনুগত্য, স্বদেশপ্রেম ও স্বাধীনতার শিক্ষা দিয়েছেন। কিন্তু শাহনামার বড় পরিচয় হচ্ছে ফারসি ভাষার অস্তিত্বের সনদ হিসাবে।
কবি ফেরদৌসি জাতীয়তাবাদের চেতনায় উজ্জীবিত ছিলেন। তিনি ছিলেন ভৌগোলিক ও ভাষাগত জাতীয়তায় বিশ্বাসী। যে কারণে তাঁর কাব্যগ্রন্থে আরবি ভাষার আধিক্য দেখা যায় না। তাঁর বর্ণিত দেশের জন্য আত্মত্যাগের বীরত্বপূর্ণ কাহিনী সকল জাতির কাছে সমভাবে সমাদৃত হয়েছে। তিনি বলেন :
چون ايران نباشد تنِ من مباد بدين بوم و بَر زنده يک تن مباد
همه سربسر تن به کشتن دهيم از آن به که کشور به دشمن دهيم
যখন ইরান থাকবে না, তখন আমার এ দেহ থাকবে না,
এই দেশ, মাটি এমনকি একটি দেহও বেঁচে থাকবে না।
দেশকে শত্রুর হাতে তুলে দেয়ার চেয়ে
আমাদের সকলের দেহ শত্রুর কাছে বিলিয়ে দেয়াই উত্তম।
ফেরদৌসি শাহনামা কাব্যগ্রন্থে যুদ্ধ ও বীরত্বপূর্ণ কাহিনী বর্ণনার পাশাপাশি তথ্যপূর্ণ উপদেশাদি, ন্যায়পরায়ণতা, বদান্যতা, মহত্ত্ব ও নৈতিক কর্তব্যাদি সম্পর্কে বক্তব্য দিতেও সচেষ্ট ছিলেন। শাহনামায় বর্ণিত এমনি উপদেশ সম্পর্কিত কয়েকটি পঙ্ক্তি নিচে তুলে ধরা হলো :
بيا تا جهان را به بد نسپريم به کوشش، همه دست نيکي بريم
نماند همي نيک و بد پايدار همان بِه، که نيکي بود يادگار
نه گنج و نه ديهيم و کاخ بلند نخواهد بدن مر ترا سودمند
فريدون فرخ فرشته نبود ز مُشک و ز عنبر سرشته نبود
بِه داد و دهش يافت اين نيکويي تو داد و دهش کن فريدون تويي
এসো, এ পৃথিবীকে যেনো আমরা অকল্যাণের দিকে ঠেলে না দেই,
প্রচেষ্টার মাধ্যমে একে সামগ্রিক কল্যাণে পরিণত করবো।
ভালো-মন্দ কিছুই স্থায়ী রবে না,
তবে কল্যাণকর স্মৃতি ধরে রাখাই উত্তম।
সুউচ্চ প্রাসাদ, ধন-সম্পদ ও ঐশ্বর্য
তোমার কোনো কল্যাণেই আসবে না
ফরিদুন কোনো ফেরেশতা ছিলো না,
কিংবা কোনো মৃগনাভি বা কস্তুরী দ্বারাও সৃষ্ট নয় সে।
সেতো ন্যায়পরায়ণতা ও বদান্যতা দিয়ে এ মহত্ত্বের অধিকারী হয়েছে,
তুমিও ন্যায়পরায়ণতা ও বদান্যতা অর্জন কর, তবেই তুমি ফরিদুন হবে।
ফেরদৌসির শাহনামা কাব্যগ্রন্থে তাঁর জ্ঞানের গভীরতার পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি মনে করেন এ ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীতে মনুষ্যত্বই শ্রেষ্ঠ আর জ্ঞান ছাড়া সে মনুষ্যত্ব অজির্ত হয় না। সৎ ও সততার দ্বারাই কেবল সকলের মাঝে সাম্য ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়। কবি বলেন :
دگر گفت روشن روان آن کسي که کوتاه گويد به معني بسي
چو گفتار بيهوده بسيار گشت سخنگوي در مردمي خوار گشت
هنر جوي و تيمار بيشي مخور که گيتي سپنج است و ما برگذر
ز دانش چو جان ترا مايه نيست بِه از خاموشي هيچ پيرايه نيست

সে (বুজুর্গ মেহের নুশিরওয়ানকে) বললো: সে-ই আলোকিত আত্মার অধিকারী
যে সংক্ষেপে অধিক অর্থপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ কথা বলে।
যদি বক্তব্য বহুলাংশে অনর্থক হয়ে ওঠে
তবে লোকদের কাছে বক্তা তুচ্ছে পরিণত হয়।
জ্ঞান অন্বেষণ কর আর দুঃখকে প্রশ্রয় দিও না
এ পৃথিবী ক্ষণিকের, আর আমাদের চলে যেতেই হবে।
যদি জ্ঞানসমৃদ্ধ আত্মা তোমার নাই বা থাকে
তবে মৌনতা ছাড়া তোমার আর কোনো ভূষণ নেই।

পুরো শাহনামাই চিত্রকল্পে ভরপুর। যুদ্ধ-বিগ্রহের চিত্র এবং এর চরিত্রগুলো প্রাণবন্তভাবে এ গ্রন্থে চিত্রায়িত হয়েছে এবং পাশাপাশি এতে জীবনঘনিষ্ঠ নানা উপদেশ ও বাণী এমনিভাবে বিধৃত রয়েছে যে, পাঠক সহসাই তা উপলব্ধি করতে সক্ষম হবেন। আর এতেই শাহনামার বিশ^জনীনতার প্রমাণ মেলে। এ গ্রন্থের আবেদন পাঠক হৃদয়ে যুগ যুগ ধরে অক্ষুণ্ণ থাকবে। পরিশেষে ফেরদৌসির জ্ঞানসঞ্জাত একটি বাণী তুলে ধরা হলো।

‘কি হবে, যদি পৃথিবী তোমাকে প্রতিপালিত করে মধু ও পানীয় দ্বারা
আর তোমার কানে না শোনায় জ্ঞানের বাণী?
কিন্তু জেনে রাখ, একদিন যখন ছড়িয়ে পড়বে বাণীর সম্পদ-
তখন আমাদের উপর উদিত হবে সফলতার সূর্য।
তোমরা সবাই তখন সুখী হয়ো, ও আনন্দ লাভ করো এই বাণী থেকে,
উন্মুক্ত করো, তোমাদের হৃদয় জ্ঞানের দ্বারা।
অমূল্য এক অবদান বলে মনে করো সেই বস্তুকে-
যা তোমার হৃদয় থেকে ঝরায় রক্ত।
এই দুনিয়া বড় অস্থায়ী,
এখানে তুমি সৎকর্মের বীজ ছাড়া আর কিছুই বপন করো না।’ (মনিরউদ্দীন ইউসুফ অনূদিত)

তথ্যসূত্র
১. আবদুল মওদুদ (১৯৮০ খ্রি.): মুসলিম মনীষা, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ঢাকা।
২. আহমাদ তামিমদারি (২০০৭ খ্রি.): ফার্সী সাহিত্যের ইতিহাস, আলহুদা আন্তর্জাতিক প্রকাশনা সংস্থা, ইরান।
৩. তারিক জিয়াউর রহমান সিরাজী (২০১৪ খ্রি.): ফারসি সাহিত্যের ইতিবৃত্ত, বাড পাবলিকেশন্স, ঢাকা।
৪. ফেরদৌসী (১৯৭৭ খ্রি.) : শাহনামা (মনিরউদ্দীন ইউসুফ অনূদিত), বাংলা একাডেমী, ঢাকা।
৫. সাদেক রেযা যাদে শাফাক (১৩৫২ সৌরবর্ষ): তারিখে আদাবিয়্যাতে ইরান (ইরানি সাহিত্যের ইতিহাস), এনতেশারাতে দানেশগাহে পাহলাভি, ইরান।
৬. হরেন্দ্র চন্দ্র পাল (১৩৬০ বঙ্গাব্দ): পারস্য সাহিত্যের ইতিহাস, প্রকাশক অজিত চট্ট ঘোষ, শ্রী জগদীশ প্রেস, কলকাতা।
৭. নিউজ লেটার, (ঢাকাস্থ ইরানি সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের মুখপত্র), ৩য় সংখ্যা, মে-জুন, ২০১৩।
লেখক : ড. তারিক জিয়াউর রহমান সিরাজী
অধ্যাপক, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

বাংলা ভাষায় ফারসি শব্দের ব্যবহার

বাংলা রূপ ফারসি রূপ আধুনিক ফারসি উচ্চারণ
এলেম (জ্ঞান, বিজ্ঞান) علم এল্ম্
ওলামা علما ও-লা-ম
আলাদা عليحده আলা-হাদ্দে
ইমারত (প্রাসাদ) عمارت এ-ম-রাত্
আমামা (পাগড়ি) عمامه আম্মমেহ্
আমল (কাজ) عمل আমাল্
আমলনামা عمل نامه আমল-নমেহ্
ঈদ عيد এইদ
ঈদী عيدى এইদী
ঈদে মিলাদুন্নবী عيد ميلادالنبى এইদে মিলাদুন্নাবী
আইনী عينى এঈনী
ফেরারী فرارى ফা-র-রী
ফেরাক فراق ফে-রগ
ফরযন্দ (সন্তান) فرزند ফার্ যান্দ
ফরাশ (কার্পেট) فرش  ফার্ শ
ফেরেশতা فرشته ফেরেশ্ তে
ফুরসত فرصت ফোরসাত্
ফরয فرض ফারয্
ফারাক فرق  ফারক্
ফরমান فرمان ফারমন
ফরমাইশ فرمايش ফার-ময়েশ
ফরমায়েশী فرمايشى ফার-ময়েশী
কাজী قاضى গযী
কাফেলা قافله গফেলেহ্
গালিচা قاليـﭼـه গ্বলিচেহ্

ইমাম খোমেইনী (র.)-এর কবিতার সংকলন

দিওয়ানে ইমাম
ইমাম খোমেইনী (র.)-এর কবিতার সংকলন
অনুবাদ : ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী
বাংলা অনুবাদ সম্পাদনা : ড. কে এম সাইফুল ইসলাম খান
প্রকাশক : রিয়াজ খান
রোদেলা প্রকাশনী
রুমি মার্কেট (২য় তলা) ৬৮-৬৯, প্যারিদাস রোড
(বাংলাবাজার), ঢাকা-১১০০
প্রকাশকাল : জানুয়ারি ২০১৮
মূল্য : ৬০০ টাকা।
হযরত আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ আল-মুসাভী আল-খোমেইনী ইরানের রাজধানী তেহরান থেকে ২২৫ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত খোমেইন শহরে ১৩২০ হিজরির ২০ জমাদিউস সানী মোতাবেক ১৯০১ সালের ২৩ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন। এ মহান ব্যক্তিত্বের পিতার নাম আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ মোস্তফা মুসাভী এবং মাতার নাম হাজেরা। তাঁর পিতা খুবই উঁচু স্তরের আলেম ছিলেন। ইমাম খোমেইনীর প্রপিতামহের নাম সাইয়্যেদ দ্বীন আলী শাহ। তিনি কাশ্মীরের অধিবাসী ছিলেন এবং সেখানেই শাহাদাত বরণ করেন। ইমাম খোমেইনীর মাতা হাজেরাও ছিলেন আলেম পরিবারের সন্তান।
ইমাম রুহুল্লাহ মুসাভী খোমেইনী ইরানের ইসলামি বিপ্লবের অবিসংবাদিত নেতা। তিনি বিশ^সভ্যতার অন্যতম লালনভুমি ইরানে আড়াই হাজার বছরের প্রাচীন রাজতন্ত্রের উত্তরাধিকারী পাহলভী বংশকে উৎখাত করেন।
১৯৪১ থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত ইমাম খোমেইনী ইরানের তৎকালীন শাসক রেযা শাহ পাহলভীর স্বৈরাচারী শাসননীতি ও ধর্মবিরোধী কর্মকাকাণ্ডের তীব্র সমালোচনা করেন। ফলশ্রুতিতে ১৯৬৩ সালের ৫ জুন থেকে তাঁকে কয়েক দফা গ্রেফতার করা হয় ও পরবর্তীকালে ১৯৬৪ সালের ৪ নভেম্বর তুরস্কে নির্বাসনে পাঠানো হয়। ইমাম খোমেইনী তুরস্ক, ইরাক ও সবশেষে ফ্রান্সে প্রায় ১৫ বছর নির্বাসনে থাকা অবস্থায়ই ইরানে বিপ্লবের নেতৃত্ব দেন। তাঁর নেতৃত্বে জনগণের অব্যাহত সংগ্রামের ক্রান্তিকাল অতিক্রম করে ১৯৭৯ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ইমাম খোমেইনী দেশে ফিরে আসেন ও ১১ ফেব্রুয়ারি ইরানে ইসলামি বিপ্লব বিজয় লাভ করে। ১৯৮৯ সালের ৩ জুন ইমাম খোমেইনী ইন্তেকাল করেন।
বস্তুত সমকালীন ইতিহাসের সর্বাধিক আলোচিত ইসলামি বিপ্লবের সফল নেতা হিসেবে বিশ^ব্যাপী ইমাম খোমেইনীর পরিচয় তিনি একজন রাজনৈতিক ও বিপ্লবী নেতা। কিন্তু এটিই কি তাঁর আসল পরিচয়? প্রকৃতপক্ষে ইমাম খোমেইনী শুধু একজন সংগ্রামী ব্যক্তিত্বই ছিলেন না; বরং সুফিতত্ত্ব ও নীতিশাস্ত্রের বিশেষজ্ঞ হিসেবেও তিনি ছিলেন এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। মানবজীবনে শিল্প-সংস্কৃতি ও সাহিত্যের ভূমিকা সম্পর্কেও ইমাম খোমেইনী সচেতন ছিলেন। এক্ষেত্রেও তিনি রেখে গেছেন মূল্যবান নির্দেশনা। ইমাম খোমেইনীর ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বাইরের দুনিয়া খুব কমই জানে। এর কারণ, তাঁর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিই সাধারণত ফারসি থেকে অনূদিত হয়ে বাইরে এসেছে। তদুপরি ইমাম খোমেইনীর আরেকটি পরিচয় ১৯৮৯ সালে ৮৮ বছর বয়সে তাঁর ইন্তিকালের আগ পর্যন্ত খোদ ইরানের সমাজও জানত না। সেটি হলো তাঁর কবিত্ব। এই বইয়ের ভূমিকা ও তৎসঙ্গে তাঁর পুত্রবধূ ফাতেমার একটি পত্র পাঠ করলে বুঝা যাবে, কীভাবে এই রহস্যটি এতদিন গোপন ছিল এবং কীভাবে ইমাম খোমেইনী কবি ও কবিতা তাঁর নিত্যসঙ্গী ছিল! ইমাম খোমেইনীর ইন্তেকালের পর ১৩ জুন, ১৯৮৯ তাঁর পুত্র আহমাদ খোমেইনী প্রথমবারের মতো তাঁর কবিপ্রতিভার কথা প্রকাশ করেন। ইমাম খোমেইনী (র.) বিভিন্ন সময়ে এ জাতীয় মরমি কবিতা রচনা করেছেন যা তাঁর জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয় নি; তিনি এসব কাব্যকীর্তি তাঁর জীবদ্দশায় প্রকাশের অনুমতি দেন নি। তাঁর রচিত কবিতা ও রুবাই সব মিলিয়ে প্রায় তিনশ’। এই গ্রন্থে ইমামের লেখা ১৪৭টি গযল, ১১৮টি রূবাই, ২টি মুসাম্মাত, ১টি তারজী’ বান্দ, কয়েকটি কিতআ ও কতিপয় বিক্ষিপ্ত বয়েত সংকলিত হয়েছে। এতে অন্তর্ভুক্ত কবিতাসমূহের আধ্যাত্মিক ও রূপক শব্দসমূহের টীকা লিখেছেন আলী আকবার রাশাদ।
আমরা আশা করি এই কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে ইমাম খোমেইনীর বিশাল ব্যক্তিত্বের একটি অনুদ্ঘাটিত দিগন্ত উন্মোচিত হবে। ইমাম খোমেইনীকে সুফিতাত্মিক দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়নের বাতায়ন খুলে যাবে। তাতে আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা বাংলার কবি ও কবিতা এবং সাহিত্যের যোদ্ধা ও বোদ্ধারা একটি নতুন দিক দর্শন লাভ করতে সক্ষম হবেন।

বই পরিচিতি

বাংলার রুমী সৈয়দ আহমদুল হক
সম্পাদনা : সবিহ-উল আলম
প্রকাশক : আল্লামা রুমী সোসাইটি
রুহ আফজা কুটির, ১২৮ লালখান বাজার, চট্টগ্রাম
প্রকাশকাল : সেপ্টেম্বর ২০১৩
মূল্য : ৫০০ টাকা।

আলোচ্য গ্রন্থটি ‘বাংলার রুমী’ নামে খ্যাত মরহুম সৈয়দ আহমদুল হকের স্মারক জীবনী গ্রন্থ। সুফি মিজানুর রহমান, সৈয়দ রেজাউল করীম, সৈয়দ মাহমুদুল হক, ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ, নাজমাতুল আলম, ড. কে এম সাইফুল ইসলাম খান, ড মোহাম্মদ বাহাউদ্দিন প্রমুখ সাত সদস্য বিশিষ্ট সম্পাদনা পরিষদ সমন্বয়ে শিল্পী সবিহ-উল আলমের সুযোগ্য সম্পাদনায় গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। সৈয়দ আহমদুল হক ছিলেন একজন অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন সুফি-সাধক, লেখক, গবেষক ও প্রজ্ঞাবান মহামনীষী। ইরানের কবি মাওলানা জালালউদ্দীন রুমী (র.)-এর ভাবশিষ্য হিসেবে তিনি আজীবন রুমী সাধনা করেছেন। রুমীকে আত্মস্থ করেছেন। স্বজাতির মাঝে রুমীর মানবতাবাদী প্রেমদর্শন প্রচার করেছেন। সে লক্ষ্যে গঠন করেছেন আল্লামা রুমী সোসাইটি। তাঁর রুহ আফজা কুটির ছিল মরমি বৃক্ষ পরিচর্যার গ্রীন হাউসস্বরূপ। দূরদর্শী চিন্তাবিদ ও দার্শনিক হিসেবে তিনি বাংলা ভাষায় জালালউদ্দীন রুমী ও তাঁর কালজয়ী সৃষ্টি ‘মসনভী’ চর্চার মাধ্যমে এক প্রতিকৃত ও কিংবদন্তি মনীষী হিসেবে সুপরিচিত হয়ে ওঠেন। বিস্ময়কর প্রতিভাসম্পন্ন মরমি সাধক এই মহান ব্যক্তি স্বীয় যোগ্যতা, অপূর্ব দক্ষতা, অতুলনীয় ধীশক্তি ও মেধায় এবং বস্তুনিষ্ঠ গবেষণা আর অকৃত্রিম সাহিত্য সেবার মাধ্যমে একটি নিজস্ব ভূবন সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন। সেকারণেই তাঁকে ‘বাংলার রুমী’ বলা হয়। ‘মসনভী’র প্রতিটি কবিতার ছত্রের বিশ্লেষণ করতে গিয়ে যে তুলনামূলক আলোচনা ও গবেষণা তিনি চালিয়েছেন তাতে নিঃসন্দেহে তাঁর বহুমুখী প্রতিভা, অগাধ পাণ্ডিত্য আর অধ্যয়নের গভীরতার পরিচয় পাওয়া যায়। আজীবন সাধক সৈয়দ আহমদুল হক তাঁর সাধনার পাশাপাশি সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন দায়িত্বপূর্ণ পদ সফলতার সাথে পরিচালনা করেন।
উক্ত স্মারক জীবনী গ্রন্থে সৈয়দ আহমদুল হক এর সংক্ষিপ্ত জীবনালেখ্য, তাঁর রচিত সাতটি প্রবন্ধের সাথে আরো ৪০ জন লেখকের লেখা প্রকাশিত হয়েছে।
বইটি বাংলার রুমী সৈয়দ আহমদুল হককে জানতে বুঝতে ও বাংলা ভাষায় রুমী গবেষণায় সহায়ক হবে বলে আশা রাখি।
□ আমিন আল আসাদ

আর্থ-সামাজিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইরানি নারীদের সাফল্য

সাইদুল ইসলাম : নারী সমাজ জাতীয় জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সমাজ ও সভ্যতার উন্নয়নের পাশাপাশি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে নারীর ভূমিকা অগ্রগণ্য। পারিবারিক জীবনে, বিশেষ করে সন্তানের প্রতিপালন ও জীবন গঠনে নারীর প্রধান ভূমিকার বাইরেও জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর করণীয় অনেক কিছুই রয়েছে। অতীতের মতো নারী সমাজ আজ পিছিয়ে নেই। যুগের বিবর্তনে জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রসারিত হয়েছে নারীর ভূমিকা। সেইসাথে প্রসারিত হয়েছে মানুষের জীবনের গতি, বেড়েছে কাজ আর পরিবর্তিত অবস্থার প্রেক্ষিতে নারীর দায়িত্বও বেড়েছে। তাই তো বিদ্রোহী কবি অকুণ্ঠ চিত্তে ঘোষণা করেছেন :
‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’
বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বারবারই দেখা গেছে, সেই সমাজ উন্নত হয়, যেখানে নারীরা এগিয়ে আসেন বিভিন্ন পেশায়, তৎপর হন সর্বক্ষেত্রে। নারীর উন্নয়নে বিশ্বের যে দেশগুলো এগিয়ে রয়েছে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান তাদের অন্যতম। জ্ঞান-বিজ্ঞান, রাজনীতি, অর্থনীতি, খেলাধুলাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইরানের নারীদের সাফল্য চোখে পড়ার মতো।

জ্ঞান-বিজ্ঞান
ফারসি ১৩৯৫ সালের হিসাব অনুযায়ী ৮ কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত ইরানে সাক্ষরতার হার ৯৪.৭ শতাংশ। এর মধ্যে ৪৬ শতাংশ নারী। দেশটিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারী মানুষের সংখা ১১ মিলিয়ন। যার ৫০ শতাংশই নারী। এদিকে,
বিশ্বে সর্বোচ্চ সংখ্যক নারী বিজ্ঞানীর তালিকার শীর্ষে রয়েছে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে পশ্চিমা বিশ্বের প্রতিপক্ষদের বহুদূর ছাড়িয়ে গেছেন দেশটির নারীরা। এক হিসাব মতে, বিজ্ঞানে ডিপ্লোমা সম্পন্ন করেন ইরানের অর্ধেকেরও বেশি নারী। ইরানের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল এবং গণিত (সংক্ষেপে এসটিইএম) বিষয়ে স্নাতক সম্পন্ন করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশই নারী। যা বিশ্বের যে কোনো দেশের তুলনায় শতাংশে অনেক বেশি। লেখিকা সাদিয়া জাহিদি তাঁর নতুন বই ‘ফিফটি মিলিয়ন রাইজিং’-এ এসব তথ্য তুলে ধরেন। বইটিতে মূলত মুসলিম দেশগুলোতে কর্মক্ষেত্রে নারীদের অর্জন, অগ্রগতি ও কৃতিত্ব নিয়ে একটি বিশ্লেষণ তুলে ধরেছেন তিনি।

কর্মক্ষেত্র
এয়ারলাইনস : কর্মক্ষেত্রে ইরানি নারীদের সাফল্য চোখে পড়ার মতো। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, প্রশাসন, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও চিকিৎসা কেন্দ্র থেকে শুরু করে প্রায় সব ধরনের কর্মক্ষেত্রে ইরানি নারীদের রয়েছে সরব উপস্থিতি। বর্তমানে ইরানের রাষ্ঠ্রীয় এয়ারলাইন্স ইরান এয়ারের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন একজন নারী। ফারজানেহ শারাফবাফি সর্বপ্রথম মহিলা যাঁকে গত বছর ইরান এয়ারের সিইও পদে নিয়োগ করা হয়। এমনকি তিনিই প্রথম মহিলা যিনি এরোস্পেসে পিএইচডি করেছেন।
এদিকে, প্রথমবারের মতো নারী পাইলট চেয়ে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে ইরানের এই বিমান সংস্থাটি।
ইরান এয়ার ‘হোমা’ নামেও পরিচিত। ফারজানেহ জানান, প্রতি বছরের মতো এবারও শূন্য পদে নতুন পাইলট নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে। এবারের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির মূল আকর্ষণ হচ্ছে নারী পাইলটরা আবেদন করতে পারবেন।
তিনি আরও জানান, বর্তমানে ইরান এয়ারের পাঁচজন শীর্ষ ব্যবস্থাপক হলেন নারী। দাপ্তরিক তথ্য তুলে ধরে ফারজানেহ জানান, হোমাতে বর্তমানে ১ হাজার ৭৮০ জন নারী কর্মরত রয়েছেন। এছাড়া আরও প্রায় ৪ হাজার নারী ইরান এয়ারের অধিভুক্ত বিভিন্ন কোম্পানি এবং এয়ার ট্রাভেল এজেন্সিতে কর্মরত রয়েছেন।
ইরান এয়ারের সিইও বলেন, হোমাতে কর্মরত নারীদের ১৬ শতাংশ মধ্যম পর্যায়ের কর্মকর্তা। ‘আমাদের কর্মকর্তাদের মধ্যে নারী পাইলট যুক্ত হওয়ার বিষয়টি আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ’, বলেন এই নারী কর্মকর্তা।
ফারজানেহ বলেন, ইরানে বিপুল সংখ্যক নারী পাইলট রয়েছেন। ইরান এয়ারের দক্ষতার ভিত্তিতে প্রশাসনিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নতুন এসব পাইলটের নিয়োগ সম্পন্ন করা হবে।
তিনি বলেন, নারীরা সামাজিক উন্নয়ন ও সামাজিক ন্যায়বিচারের উপলব্ধি সৃষ্টিতে শীর্ষ ভূমিকা রাখতে পারে।

বছরের সেরা নাবিক ইরানের রাহেলে
জাহাজ চালানো একটি পেশীশক্তির ব্যবহার্য কাজ। অথচ এক্ষেত্রেও পিছিয়ে নেই ইরানের নারীরা। সম্প্রতি দেশটির হোরমোজগান প্রদেশের নারী রাহেলে থামাসেবি সারভেস্তানি বছরের সেরা নাবিক হওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন।
ফারসি বার্তা সংস্থা ইসনাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে রাহেলে বলেন, জাহাজ চালানোর প্রতি তাঁর ভালোবাসা দীর্ঘদিনের। ১৯৮৪ সালে জন্ম রাহেলের। ৫০০ থেকে ৩ হাজার টনের যুদ্ধ জাহাজ চালিয়ে বেশ পারদর্শিতা দেখিয়েছেন সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট রাহেলে। প্রশিক্ষণের সময় ‘সাগর’ নামে একটি বাণিজ্যিক জাহাজ চালিয়েছেন তিনি। এরপর একের পর এক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়েছে তাঁকে সামরিক জাহাজ পরিচালনার ক্ষেত্রে।

চাকরির বাজার
কর্মক্ষেত্রে নারীর এমন সফলতার কারণে চাকরির বাজারে দেশটির নারীদের চাহিদা বাড়ছে। ইরানের চাকরির বাজারে বিগত তিন বছরে নারীদের উপস্থিতির সংখ্যা বেড়েছে ৪০ ভাগ। ইরান ট্যালেন্ট ডটকমের এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ফারসি বছরে আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলোর বিভিন্ন শাখায় নারী কর্মচারীদের সংখ্যা বেড়েছে ২৯ ভাগ। অন্যদিকে, বেসরকারি মালিকানাধীন কোম্পানিগুলোতে বেড়েছে ৩২ শতাংশ এবং রাষ্ট্রীয় পরিচালিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে নারীর সংখ্যা বেড়েছে ২০ শতাংশ। প্রতিবেদন মতে, ইরানে মধ্যম সারির ব্যবস্থাপক পর্যায়ে ২৫ শতাংশ নারী কর্মরত রয়েছেন এবং উচ্চ পর্যায়ের ব্যবস্থাপনা পদে রয়েছেন ১৯ শতাংশ নারী। এছাড়া দেশটিতে প্রায় ৬০ শতাংশ নারী কার্যনির্বাহী ও প্রশাসনিক কর্মী হিসেবে সক্রিয় রয়েছেন। বিদেশি ভাষা থেকে অনুবাদের কাজে কর্মরত রয়েছেন ৫০ শতাংশ নারী।
ইরান ট্যালেন্ট ডটকমের অপর আরেকটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, প্রায় ৫০ শতাংশ ইরানি নারী শিল্প ক্ষেত্রে কাজ করছেন। দেশজুড়ে ২৮টি ভিন্ন ভিন্ন চাকরি ক্ষেত্রের ১ লাখ কর্মচারীর ওপর জরিপ পরিচালনা করে এই তথ্য দেয়া হয়।

গ্রামীণ অর্থনীতি

ইরানের নারী ও পরিবার বিষয়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট বলেছেন, গ্রামীণ নারীরা আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন যদিও তা অনেকের অজানা। পরিবার ও সামাজিক দিক থেকে নারীর এ ভূমিকা অসামান্য। তবে নারীর এ ভূমিকা অজানা থাকায় তা অনেক সময় স্বীকৃত হয়ে ওঠে না। তিনি বলেন, ৩২ মিলিয়ন গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে ১২ মিলিয়ন হচ্ছে নারী। এসব নারী কৃষি ও কুটির শিল্পসহ অনেক ক্ষেত্রে ব্যাপক অবদান রেখে চলেছেন।

রাজনীতি

রাজনীতিতেও সক্রিয় উপস্থিতি রয়েছে ইরানের নারীদের। দেশটির ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন দুজন নারী। এদের একজনের নাম মাসুমেহ এবতেকার। ইরানের এই নারীর আরেক নাম নিলোওফার এবতেকার। তিনি প্রথমবারের মত ইরানে নারী ও পরিবার বিষয়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগ পান ৯ আগস্ট ২০১৭। তিনি একাধারে রাজনীতিবিদ, বিজ্ঞানী ও সাংবাদিক। পরিবেশ ও সমাজসংস্কারক হিসেবেও তাঁকে চেনে বিশ্বের মানুষ। মাসুমেহ এবতেকার দেশটির পরিবেশ বিষয়ক মন্ত্রী হিসেবে ১৯৯৭ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন।
ইরানের অপর নারী ভাইস প্রেসিডেন্টের নাম লয়া জনিদি। তিনি আইন বিষয়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এদিকে ইরানের প্রেসিডেন্টের বিশেষ উপদেষ্টা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন একজন নারী। যাঁর নাম শাহীন দোখত মৌলাভারদি।

নারী মেয়র
ইরানি নারীদের ক্রমবর্ধমান সফলতার ক্ষেত্রে আরেকটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত দেখালেন সামানেহ শাদ-দেল। সম্প্রতি দেশটির উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় জানযান পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন এই নারী। বিজয়ের পর জানযান শহরের জেলা দুই-এর মেয়র হিসেবে দায়িত্বও গ্রহণ করেছেন তিনি।
এর আগে সামানেহ জানযান পৌরসভার ট্রাফিক ও পরিবহন বিষয়ক পরিচালক হিসেবে চার বছর দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া তিনি জানযানের সংস্কৃতি বিষয়ক ডেপুটি মেয়র হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
মূলত ইরানি এই নারীর কর্মদক্ষতা ও অভিজ্ঞতা মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হতে সাহায্য করেছে।

বিবাহিত নারী সামানেহ মাস্টার ডিগ্রি সম্পন্ন করেছেন।
ইরানে একজন নারী হিসেবে শীর্ষ কোনো পদে তিনিই প্রথম অধিষ্ঠিত হন নি। দেশটির যোগ্যতাসম্পন্ন নারীরা ইতোমধ্যে ডেপুটি প্রাদেশিক গভর্নর, গভর্নর ও মেয়র পদে অধিষ্ঠিত রয়েছেন। আর ইরানের ব্যবস্থাপনা পদে নারীদের উপস্থিতি দিনদিনই বাড়ছে।

তেহরান সিটি কাউন্সিলে নারীদের রেকর্ড জয়
ইরানের রাজধানী তেহরানের সিটি কাউন্সিল নির্বাচনে রেকর্ড সংখ্যক জয় পেয়েছেন নারী প্রার্থীরা। এবারের ৫ম সিটি কাউন্সিল নির্বাচনে ছয় জনই নারী প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছেন।
তেহরান টাইমসের খবরে বলা হয়, আগের বারের তুলনায় ৫ম সিটি কাউন্সিল নির্বাচনে নারী কাউন্সিলরদের সংখ্যা দ্বিগুণ। নির্বাচিতারা হলেন শাহারবানু আমানি আঙ্গানেহ, বাহারেহ আরভিন, যাহরা সাদরাজম নুরি, নাহিদ খোদাকারামি, যাহরা নেজাদবাহরাম ও ইলহাম।

খেলাধুলা

ডার্ট যুব বিশ্বকাপে রানার্স-আপ ইরান
জাপানে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড ডার্ট ফেডারেশন (ডব্লিউডিএফ) যুব বিশ্বকাপ ২০১৭-তে রানার্স-আপ হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে ইরান। এবারের আসরে দু’টি সোনার ও একটি ব্রোঞ্জ মেডেল জয়লাভের মধ্য দিয়ে টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেছে ইরানি ডার্ট স্কোয়াড। ৩ অক্টোবর জাপানি শহর কোবেতে ওয়ার্ল্ড ডার্ট ফেডারেশন (ডব্লিউডিএফ) যুব বিশ্বকাপ-২০১৭ শুরু হয়। প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে ইরানি নারীরা দারুণ পারফরমেন্স করেন, সংগ্রহ করেন দুটি স্বর্ণপদকসহ তিনটি মেডেল।

বিশ্ব শ্যুটিংয়ে ইরানি নারীর সোনা জয়
ওয়ার্ল্ড শ্যুটিং প্যারাস্পোর্ট ওয়ার্ল্ড কাপ ২০১৮০-তে দ্বিতীয় সোনার মেডেল জয় করেন ইরানের নারী প্যারালিম্পিক শ্যুটার সারেহ জাভানমারদি। সংযুক্ত আরব আমিরাতে নারীদের পি-৪ ৫০-মিটার পিস্তল এসএইচ-১ প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে প্রথম স্থান দখল করেন ৩৩ বছর বয়সী এই প্যারালিম্পিক চ্যাম্পিয়ন।

ইরানের দুই নারীর কারাতে মেডেল জয়
স্পেনে ২০১৭ ওয়ার্ল্ড জুনিয়র, ক্যাডেট ও অনূর্ধ্ব ২১ চ্যাম্পিয়নশিপে একটি সোনার ও একটি রুপার মেডেল জয় করেছেন ইরানি দুই নারী কারাতে খেলোয়াড়।
কারাতে প্রতিযোগিতায় সোনাজয়ী ইরানি নারী হলেন অভিশান বাকেরি। রুপাজয়ী কারাতের নাম সারা বাহমানিয়ার। পদকজয়ী এই দুই নারী ইরানের গিলান থেকে প্রতিযোগিতায় অংশ নেন এবং দেশের জন্য সুনাম বয়ে আনেন।

বিশ্ব যুব দাবা প্রতিযোগিতায় ইরানি কিশোরীর সাফল্য
রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত বিশ্ব যুব দাবা প্রতিযোগিতায় ইরানি কিশোরী মোবিনা আলী নাসাব রৌপ্যপদক লাভ করেছেন। রাশিয়ার মধ্যাঞ্চলীয় খানতি-মানসিস্ক শহরে অনুষ্ঠিত এ প্রতিযোগিতায় অনূর্ধ্ব ১৬ বছর বয়সীদের প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে এ পদক লাভ করেন তিনি। এ ছাড়া, ইরানের অপর প্রতিযোগী শাহিন লোরপারি জাঙ্গানে অনূর্ধ্ব ১৮ গ্রুপের প্রতিযোগিতায় তৃতীয় স্থান অধিকার করে ব্রোঞ্জপদক পেয়েছেন।
প্রতিযোগিতায় অনূর্ধ্ব ১৬ গ্রুপে সারা বিশ্ব থেকে ৫৮ জন এবং অনূর্ধ্ব ১৮ গ্রুপে ৬৫ জন প্রতিযোগী অংশগ্রহণ করেন। এর আগে মঙ্গোলিয়ায় অনুষ্ঠিত এশীয় যুব দাবা প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান লাভ করে স্বর্ণপদক পেয়েছিলেন মোবিনা আলী নাসাব।

রিও অলিম্পিকে ইতিহাস গড়লেন ইরানি তরুণী
রিও ডি জেনেইরো অলিম্পিকের ১৩তম দিনটি ইরানের জন্য একটি ঐতিহাসিক দিন। কারণ, ওইদিন তায়কোয়ান্দো প্রতিযোগিতায় মেয়েদের ৫৭ কেজি ওজনশ্রেণিতে ব্রোঞ্জপদক জেতেন ইরানি তরুণী কিমিয়া আলীজাদেহ জিনোরিন। এর মাধ্যমে তিনি অলিম্পিকে প্রথম কোনো ইরানি নারী হিসেবে পদক জেতার গৌরব অর্জন করেন।
অলিম্পিকের ইতিহাসে প্রথম কোনো ইরানি একজন নারী ক্রীড়াবিদ হিসেবে পদক জয়ের পর অভিনন্দন জানান ইরানের প্রেসিডেন্ট ড. হাসান রুহানি।
এর আগে ২০১৪ সালে যুব অলিম্পিক দুটি পদক জিতেছিলেন আলীজাদেহ। গত বছরের এপ্রিলের মাঝামাঝিতে ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলায় রিও অলিম্পিকের এশীয় অঞ্চলের বাছাই পর্বে অসাধারণ পারফরমেন্স দেখিয়ে স্বর্ণপদক জেতেন কিমিয়া আলীজাদেহ।

এশিয়ান মহিলা ভলিবলে ৯ম ইরান
এশিয়ান সিনিয়র মহিলা ভলিবল চ্যাম্পিয়নশিপে অস্ট্রেলিয়াকে পরাজিত করে ইরান। এ জয়ের মাধ্যমে টুর্নামেন্টের এবারের ১৯তম আসরে ৯ম স্থান অর্জন করে দেশটির মহিলা জাতীয় ভলিবল টিম।
ফিলিপাইনের মুন্তিনলুপা স্পোর্ট কমপ্লেক্সে ম্যাচটি অনুষ্ঠিত হয়। ইরানি স্কোয়াড পাঁচ সেটের ম্যাচে ৩-২ সেটের ব্যবধানে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে জয় ঘরে তুলে নিজেদের ক্যাম্পেইন শেষ করে।

এশিয়ান নৌকাবাইচ চ্যাম্পিয়নশিপে ইরানের পাঁচ মেডেল

২০১৭ এশিয়ান নৌকাবাইচ চ্যাম্পিয়নশিপে প্রশংসনীয় দক্ষতা দেখিয়েছেন ইরানের পুরুষ ও নারী খেলোয়াড়রা। থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠিত মহাদেশীয় এই টুর্নামেন্টে তিনটি সোনার মেডেলসহ মোট পাঁচটি মেডেল জিতেছে দেশটি।
ইরানের নারী মাল্লা নাজানিন মোলায়ি মেয়েদের লাইটওয়েট বিভাগের প্রতিযোগিতার ফাইনালে অংশ নেন। ম্যাচটি অনুষ্ঠিত হয় থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংকক থেকে ১০০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে পাতায়ায়।

ইরানের প্রথম নারী ‘স্কাই ডাইভার’ ফাতেমা

২৪ বছরের ইরানি নারী ফাতেমা আকরামি প্রথম স্কাইডাইভার হিসেবে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। প্রফেশনাল স্কাই ডাইভার হিসেবেও তিনি প্রথম ইরানি নারী। আকরামি একজন চ্যাম্পিয়ন জিমন্যাস্ট। অন্যান্য খেলাধুলায় নিয়মিত অংশ নেন তিনি।
ফাতেমার এক বন্ধু তাঁকে স্কাই ডাইভার হওয়ার প্রেরণা যোগান। যুক্তরাষ্ট্রের প্যারাস্যুট অ্যাসোসিয়েশন থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে রীতিমত লাইসেন্স গ্রহণ করেছেন ফাতেমা। বিমান থেকে লাফিয়ে পড়ে নিরাপদে ভূমিতে অবতরণ করা চাট্টিখানি কথা নয়। কঠিন মনোবল ও সাহস প্রয়োজন পড়ে। ধৈর্যের সঙ্গে সঙ্গে গভীর মনোসংযোগের দরকার হয়। সামরিক প্রশিক্ষণের বাইরে একজন বেসামরিক নাগরিক হিসেবে এধরনের প্রশিক্ষণ খুবই কঠিন হয়ে থাকে। এসব বাধা ডিঙ্গিয়ে ফাতেমা তাঁর ইচ্ছা পূরণ করেছেন।
আকরামির ইন্সট্রাগ্রামে আকাশে তাঁর লাফিয়ে পড়ার ছবি রয়েছে। হাসিমুখে আকাশ থেকে নেমে আসছেন মাটিতে, পাখির মতো ডানা মেলে বাতাসে ভাসতে ভাসতে। এধরনের প্রশিক্ষণের বিভিন্ন ছবি তিনি শেয়ার করেছেন।
চলচ্চিত্র
আজীবন সম্মাননা পেলেন কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকার বানি-এতেমাদ। ইরানের কিংবদন্তি চলচ্চিত্র নির্মাতা রাখশান বানি-এতেমাদ চলচ্চিত্রে সুদীর্ঘ অবদান রাখার জন্য পাচ্ছেন আজীবন সম্মাননা। তুরস্কে অনুষ্ঠিত সপ্তম মালাতিয়া আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব প্রখ্যাত এই নারী চলচ্চিত্রকারের কর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ এ সম্মাননা দেয়।
আন্তর্জাতিক শাহর চলচ্চিত্র উৎসবে ইরানের ১৮০ নারী চলচ্চিত্রকার
আন্তর্জাতিক শাহর চলচ্চিত্র উৎসবের বিভিন্ন বিভাগে এবার অংশ নেবেন ইরানের রেকর্ড সংখ্যক নারী চলচ্চিত্র নির্মাতা। আইএফপিনিউজ ডটকমের তথ্যমতে, চলচ্চিত্র উৎসবটিতে অংশ নেওয়ার জন্য আবেদন করেন ইরানের ১৮০ জনের অধিক নারী চলচ্চিত্র নির্মাতা। তাঁরা এবারের আসরের ফিচার, পূর্ণদৈর্ঘ্য ফিচার, মাঝারি-দৈর্ঘ্য ফিচার, স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি, ডকুমেন্টারি, মাঝারি-দৈর্ঘ্য ডকুমেন্টারি, স্বল্পদৈর্ঘ্য ডকুমেন্টারি, অ্যানিমেশন ও নেইবারহুড বিভাগে অংশ নেবেন।
আন্তর্জাতিক কোনো চলচ্চিত্র উৎসবে এবারই রেকর্ড সংখ্যক ইরানি নারী চলচ্চিত্র নির্মাতা অংশ নিচ্ছেন। বিশেষ করে চলচ্চিত্র উৎসবের মাঝারি-দৈর্ঘ্য ফিচার বিভাগে ইরানি নারী চলচ্চিত্র নির্মাতাদের অংশগ্রহণকে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
জানানো হয়, প্রায় ৫০ জন ইরানি নারী চলচ্চিত্র নির্মাতা মাঝারি-দৈর্ঘ্য ফিচার ও স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বিভাগে অংশ নেওয়ার জন্য আবেদন করেছেন। অন্যদিকে, অ্যানিমেশন ও নেইবারহুড বিভাগে অংশ নিতে ইতোমধ্যে ৩৯ জন করে আবেদন করেছেন। এছাড়া স্বল্পদৈর্ঘ্য ও মাঝারি-দৈর্ঘ্য ডকুমেন্টারি বিভাগে ইরানের ৩৬ জন নারী চলচ্চিত্র নির্মাতা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ফিচার বিভাগে ১০ জন এবং পূর্ণদৈর্ঘ্য ফিচার ও ডকুমেন্টারি বিভাগে অংশ নেবেন ৭ জন।
ষষ্ঠ আন্তর্জাতিক শাহর চলচ্চিত্র উৎসব ইরানের রাজধানী তেহরানে ৩১ জুলাই শুরু হয়ে চলবে ৫ আগস্ট পর্যন্ত।

দশ বছরের ইরানি বালিকার কোরআনের সিডি

মাত্র দশ বছরের ইরানি বালিকা হান্নাহ খালাফি তার সুমধুর কণ্ঠে কোরাআন শরীফ অডিও রেকর্ডিং করেছে। তার অডিও সিডি তেহরানে অনুষ্ঠিত ২৪তম ইন্টারন্যাশনাল হলি কোরআন এক্সিবিশনে দর্শকদের কাছে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে। ইরানের সংস্কৃতি ও ইসলামি গাইডেন্স মন্ত্রী আলী জান্নাতির উপস্থিতিতে একটি অনুষ্ঠানে হান্নাহ কোরআন তেলাওয়াত করেন।
এছাড়া আরও অনেক ক্ষেত্রেই ইরানের নারীরা সাফল্যের স্বাক্ষর রেখে চলেছেন যা এই সীমিত পরিসরে তুলে ধরা প্রায় অসম্ভব। তবে একথা বলা যায়, ইরানের নারীদের সফলতার এই ধারা অব্যাহত থাকলে দেশটি একদিন উন্নয়নের রোলমডেল হবে তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

সূত্র: ইরান ডেইলি, মেহর নিউজ, প্রেসটিভি, তেহরান টাইমস, আইএফপি, ফিন্যান্সিয়াল ট্রিবিউন।

ইসলামি পর্যটনের রাজধানী ইরানের তাবরিজ

সাইদুল ইসলাম : ইরানের পূর্ব আযারবাইজান প্রদেশের কেন্দ্রীয় শহর তাবরিজ। ২০১৮ সালের জন্য ইসলামি পর্যটনের রাজধানী হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে ঐতিহাসিক এ শহরটি। এ উপলক্ষে অনানুষ্ঠানিকভাবে গত জানুয়ারিতে ‘তাবরিজ ২০১৮’ নামের একটি ইভেন্টের উদ্বোধন করেছে দেশটি। আর ২৫ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন হয় এই ইভেন্টের। এতে যোগ দেন ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি ও কয়েকটি মুসলিম দেশের শীর্ষ কর্মকর্তারা।
‘তাবরিজ ২০১৮’ নামের ইভেন্টের উদ্বোধনীতে ইরানের সংস্কৃতি মন্ত্রী আব্বাস সালেহি, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, হস্তশিল্প ও পর্যটন সংস্থার (আইসিএইচএইচটিও) প্রধান আলি আসগর মুনেসান, ইরানের পার্লামেন্ট ‘মজলিস’ এর প্রথম ডিপুটি স্পিকার মাসুদ পেজেশকিন, পূর্ব আযারবাইজানের গভর্নর জেনারেল মজিদ খোদাবাখ্স ও কয়েকটি মুসলিম দেশের রাষ্ট্রদূত যোগ দেন। এতে তাবরিজের ঐতিহাসিক গুরুত্ব তুলে ধরে লোকসংগীত ও নৃত্যও পরিবেশন করা হয়।
অনুষ্ঠানে বক্তৃতাকালে ইরানের সংস্কৃতিমন্ত্রী তাবরিজ শহরের নানা গুরুত্ব তুলে ধরেন। মূলত যেসব যোগ্যতা শহরটিকে ইসলামি পর্যটনের রাজধানীর মর্যাদা এনে দিয়েছে সেসব বিষয় তুলে ধরেন তিনি। একই সাথে অন্যান্য শহরের জন্য তাবরিজ একটি মডেল শহর হতে পারে বলেও উল্লেখ করেন মন্ত্রী।
সালেহি আরও জানান, তাবরিজ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একটি শৈল্পিক ও সাংস্কৃতিক কূটনীতির প্রতীক হিসেবে ইরানের প্রতিনিধিত্ব করবে। ২০১৮ সালের শেষে এই অঞ্চলের সংস্কৃতি অমরত্ব লাভের জন্য সীমান্ত ছাড়িয়ে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়বে এবং বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া ইরানের সংস্কৃতির সঙ্গে এটি সেতুবন্ধন করবে।
আইসিএইচএইচটিও প্রধান আলি আসগর মুনেসানও তাঁর বক্তব্যে ‘তাবরিজ ২০১৮’ ইভেন্টের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, ‘২০১৮ ইভেন্ট’ চূড়ান্ত লক্ষ্য নয়। তবে তাবরিজ শহরের অধিকতর উন্নয়নের জন্য এটি একটি শুরুর স্থান মাত্র। আমাদের বিস্তৃত লক্ষ্য উদ্দেশ্য অর্জনে এই সুযোগকে কাজে লাগাতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে হবে। তিনি জানান, ইরানের পাঁচটি সেরা পর্যটন গন্তব্যের মধ্যে পূর্ব আযারবাইজান অন্যতম। চলতি ইরানি বছরের প্রথমার্ধে সেখানে তিন লাখ বিদেশি পর্যটক ভ্রমণ করেছেন। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় যা ৬ শতাংশ বেশি। তিনি বলেন, তাবরিজে ১৮শ’ জাতীয় ঐতিহ্যবাহী দর্শনীয় এলাকা রয়েছে। যেসব জায়গায় ইরানে বেড়াতে আসা পর্যটকদের অধিকাংশই ভ্রমণ করেছেন।
মুনেসান আরও জানান, তাবরিজ শহরের সাড়ে তিন হাজার বছরের ইতিহাসের মূল্যবান সম্ভাবনা রয়েছে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং প্রকৃতি পর্যটনের জন্য এর ব্যাপক সক্ষমতা রয়েছে। জাতীয় লক্ষ্য পূরণের পাশাপাশি ইসলামি সম্মেলন সংস্থা ওআইসি যেসব লক্ষ্য-উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে বিভিন্ন শহরকে ইসলামি পর্যটনের রাজধানী হিসেবে নির্বাচিত করে ইরান সেসব সাধারণ লক্ষ্যও পূরণ করবে। তিনি বলেন, ওআইসি সুনির্দিষ্টভাবে ইসলামি পর্যটনের প্রচারণা চালাচ্ছে। তাই ইসলামি পর্যটকদের কাছে তাবরিজকে একটি আদর্শ গন্তব্য প্রমাণিত করতে অতীতে যেসব শহরকে ইসলামি পর্যটনের রাজধানী হিসেবে নির্বাচিত করা হয়েছে সেসব শহরের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে হবে।
এক ঝলকে তাবরিজ
ভৌগোলিক অবস্থান
তাবরিজ শহর ৩৮ ০২ উত্তর অক্ষাংশ ও ৪৬ ২৫ পূর্ব দ্রাঘিমাংশের মধ্যে অবস্থিত একটি বৃহৎ শিল্প, ব্যবসা ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র। শহরটি সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে ১,৩৪০ মিটার উঁচুতে অবস্থিত। এটি নিম্ন আর্দ্রতাসম্পন্ন মহাদেশীয় জলবায়ু এলাকায় অবস্থিত। এখানকার বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত ২৮৫ মিলিমিটার। সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে অনেক উঁচুতে অবস্থিত বিধায় একদিকে এ শহরের শীতকাল দীর্ঘ এবং শীতে প্রচণ্ড ঠান্ডা বিরাজ করে, অন্যদিকে গ্রীষ্মকালে প্রচণ্ড গরম অনুভূত হয়।
যোগাযোগ
ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক গুরুত্বসম্পন্ন ও শিল্পসমৃদ্ধ শহর হওয়ায় তাবরিজের সড়ক যোগাযোগ অত্যন্ত উন্নত। শহরটি ইরানের রাজধানীর সাথে ৬১৯ কিলোমিটার দীর্ঘ মহাসড়ক দ্বারা যুক্ত যা ইরান ও আযারবাইজানের সীমান্ত সংলগ্ন সুদূর জুলফা এবং ইরান ও তুরস্কের মধ্যে সংযোগ সাধন করেছে। অন্য আরও কয়েকটি মহাসড়কের মাধ্যমে তাবরিজের প্রতিবেশী প্রদেশ, যেমন আরদেবিল, কুর্দিস্তান ও পশ্চিম আযারবাইজনের রাজধানীর সাথে সংযুক্ত। এছাড়া তেহরান-আঙ্কারা ও তেহরান-মস্কো রেলপথটি তাবরিজ শহরের ওপর দিয়ে গিয়েছে। রেলপথটি কাজভীন, যানজন ও তাবরিজ অতিক্রমের পর সুফিয়ান নামক স্থানে বিভক্ত হয়ে একটি অংশ জুলফা হয়ে মস্কো এবং অন্য অংশ তুরস্কের মধ্য দিয়ে ইউরোপীয় রেল নেটওয়ার্কের সাথে সংযুক্ত। ইসলামি প্রজাতন্ত্রের বিমান সংস্থা ‘হোমা’ তেহরান-তাবরিজ রুটে দৈনিক ফ্লাইট পরিচালনা করে এবং আকাশপথে তেহরান থেকে মাত্র আধ ঘণ্টায় তাবরিজ পৌঁছা যায়।
ভাষা ও ধর্ম
পূর্ব আযারবাইজানের অন্যান্য অংশের ন্যায় তাবরিজের অধিবাসীরা আজারী ভাষায় কথা বলে। ১৯৫০ সালে সাফাভী বংশের রাজত্ব শুরু হলে তুর্কি ভাষা আজারী ভাষার স্থান দখল করে। সাংস্কৃতিক বিনিময়ের ফলে তুর্কি ভাষা ফারসি, আরবি, আর্মেনীয় ও জর্জিয়ান ভাষা দ্বারা প্রভাবিত হয় এবং তাবরিজীরা বর্তমানে নব্য আজারী ভাষায় কথা বলে। তাবরিজের সংখ্যাগুরু অধিবাসী মুসলিম, আর সামান্য সংখ্যক খ্রিস্টান রয়েছে, যারা মূলত আর্মেনীয় বংশোদ্ভূত।
শহরের নামকরণ
এ শহরের নামকরণ সম্পর্কে ঐতিহাসিকগণ নানা মতে বিভক্ত। কোনো কোনো ইতিহাস গ্রন্থে এ শহরের আদি নাম ‘তাওরী’, আবার অন্য ইতিহাস গ্রন্থে ‘তাওরিজ’ নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। এ শহরের মধ্যযুগীয় ও আজারী নাম ‘তাওরী’ যার মূল ‘তাও’ অর্থাৎ তাপ বা গরম এবং ‘রি’ অর্থ নদী বা ঝরনা। এতে এ শহরে যে অনেক উষ্ণ প্রস্রবণের অস্তিত্ব ছিল এটার প্রমাণ পাওয়া যায়। কেউ কেউ আর্মেনীয় রাজা খসরু- যিনি পার্সিয়ান রাজা চতুর্থ আরদাভান-এর সময় রাজত্ব করেন, তিনি এ শহরের পত্তন করেছেন বলে অভিমত ব্যক্ত করেন। ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, তিনি আর্মেনিয়ার নিকটবর্তী এট্রোপাটেন (আযারবাইজান) রাজ্যে দাভরেজ শহর নির্মাণ করেন যা কালের বিবর্তনে ‘তাভরিজ’, ‘তাওরিজ’ ও ‘তাবরিজ’ নাম ধারণ করে।
স্থাপত্য নিদর্শন
সমৃদ্ধ অতীতের অধিকারী তাবরিজ শহরে অনেক স্থাপত্য নিদর্শন রয়েছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে উপর্যুপরি বৈদেশিক আক্রমণ ও দখলদারিত্ব, তৎকালীন সরকারের উদাসীনতা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যেমন : ভূমিকম্প ও বন্যার কারণে বহু নিদর্শন ধ্বংস হয়ে গেছে। কালের বিবর্তনে এখনও যেগুলো টিকে আছে সেগুলো ইলখানী, সাফাভী ও ক্বাজার রাজত্বকালে নির্মিত হয়। কোনো কোনো স্থাপত্য অতুলনীয় নির্মাণশৈলীর নিদর্শন। প্রধান কয়েকটি স্থাপত্য নিদর্শন সম্পর্কে নিচে বর্ণনা করা হলো :
মসজিদ : কাবুদ (নীল) মসজিদ : কাবুদ মসজিদ তাবরিজের একটি উল্লেখযোগ্য স্থাপনা। এ মসজিদ বাইর ও ভিতরের অপূর্ব নীল-সবুজ কারুকার্যময় টাইলস-এর জন্য প্রসিদ্ধ এবং এটি ‘টারকুইজ অব ইসলাম’ নামে পরিচিত। দৃষ্টিনন্দন টাইল্স ও ক্যালিগ্রাফি আচ্ছাদিত মসজিদটি একটি অনন্য অট্টালিকা। এটি ১৪৬৫ খ্রিস্টাব্দে রাণী জেহান বেগমের নির্দেশে জাহানশাহ কারা কউনলুর সময় নির্মিত হয়। এ অট্টালিকায় রয়েছে সুউচ্চ প্রবেশপথ যার চৌকাঠ সুদৃশ্য কারুকার্য খচিত, রয়েছে টাইল্স ও ক্যালিগ্রাফিসমৃদ্ধ দু’টি মিনার ও গম্বুজ যা প্রবেশ পথ ও নামাযের হলঘরের সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ। আলী শাহ মসজিদ : তাবরিজ শহরের অন্যতম প্রাচীন এবং উল্লেখযোগ্য স্থাপনা যা ইসলামি স্থাপত্যের অনন্য নিদর্শন। জামে মসজিদ : এ মসজিদটি ইলখানী শাসনামলে নির্মিত তাবরিজ শহরের একটি অত্যন্ত প্রাচীন নজরকাড়া অট্টালিকা। মসজিদটির উঁচু চত্বর এ সময়েই নির্মিত হয়। ওস্তাদ ও শগের্দ (শিক্ষক ও ছাত্র) মসজিদ : যেহেতু এ মসজিদের ভিতর ও বাইরের ক্যালিগ্রাফি বিখ্যাত ক্যালিগ্রাফার আবদুল্লাহ সিরাজী এবং তাঁর এক ছাত্রের তৈরি সেজন্য এটি ‘ওস্তাদ ও শগের্দ’ মসজিদ নামে খ্যাত। এ মসজিদের গম্বুজটি গোটা নামায ঘর আচ্ছাদিত করে রেখেছে যার ডিজাইন একে বাড়তি সৌন্দর্য দান করেছে। এ শহরে আরও অনেক প্রসিদ্ধ মসজিদ রয়েছে যার মধ্যে শাহজাদা মসজিদ, মাক্ববারহ (মাযার) মসজিদ ও যাহিরিয়া মসজিদ উল্লেখযোগ্য।
শু’আরা গোরস্তান : এ কবরস্থানে অনেক ইরানি কবি, সুফি, বিজ্ঞানী ও দ্বীনী আলেম শায়িত আছেন। আসাদী তূসি, খাকানী শেরভানী, জাহির ফারিয়াবী, কাতরান তাবরিজী, মুহাম্মাদ শিরিন মাগরেবী, হোমাম তাবরিজী, সালমান সাফাভী, ফালাকী শেরভানী, কাজী বেইজাভী ও সমকালীন প্রসিদ্ধ কবি মুহাম্মাদ হোসাইন শাহরিয়ারকে এখানে দাফন করা হয়েছে।
চার্চ : এ শহরে ছয়টি গির্জা রয়েছে যার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো সাধু সেরকির চার্চ, যা তাবরিজের আর্মেনীয়ান এলাকা বারন আভাক্-এ অবস্থিত। এটি ১৮৪৫ সালে সংস্কার করা হয়। এরপর সেন্ট মেরী চার্চ যার নির্মাণকাজ ১৭৪৫ সালে সম্পন্ন হয়। এটি সবচেয়ে প্রাচীন চার্চ। আর আছে আবল মেরী চার্চ যা ১৯১০ সালে নির্মিত হয়।
গোলেস্তান উদ্যান : এটি তাবরিজ শহরের অন্যতম প্রধান বিনোদন কেন্দ্র যা ৫৩ হাজার বর্গমিটার জায়গা জুড়ে বিস্তৃত। এ উদ্যানটি প্রায় ৬০ বছর আগে একটি পুরনো সমাধিস্থলে নির্মিত হয়েছিল। এ উদ্যানে রয়েছে সবুজ বৃক্ষরাজিতে ঘেরা অনেকগুলো বড় বড় পুকুর।
আযারবাইজান যাদুঘর : ১৯৬২ সালে নীল মসজিদের পার্শ্ববর্তী এলাকায় এ জাদুঘর উদ্বোধন করা হয়। এটি ৩০০ বর্গমিটার জায়গা জুড়ে বিস্তৃত। এতে তিনটি প্রধান হল রয়েছে যেগুলোতে ঐতিহাসিক নিদর্শনাবলি, ইরানের বিভিন্ন উপজাতির পোশাক, প্রসিদ্ধ ইরানি ক্যালিগ্রাফারদের ক্যালিগ্রাফি, চিত্রকর্ম, ঘোষণাপত্র, দলিলাদি ও শাসনতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের ব্যক্তিগত ব্যবহার্য দ্রব্যাদি প্রদর্শনের জন্য রাখা হয়েছে। এ শহরের অন্যান্য উল্লেখযোগ্য ভবনের মধ্যে রয়েছে তাবরিজ লাইব্রেরি, তুমানিয়ান স্কুল, রেল স্টেশন ও পৌরভবন।
বাজার
প্রাচীন সৌন্দর্য, বাণিজ্যিক গুরুত্ব ও বিশালাকারের জন্য তাবরিজ বাজার ইরানের অন্যতম বৃহৎ ও সুন্দর বাজারগুলোর অন্যতম। স্থাপত্যশৈলী, অসংখ্য সরাইখানা, প্রশস্ত চত্বর, মসজিদ ও স্কুল এর সৌন্দর্য এবং গুরুত্ব আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। এ বাজারের প্রকৃত ইতিহাস ও উৎপত্তি সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় নি। তথাপি এর ঐতিহাসিক স্থাপনাসমূহ, যেমন জামে মসজিদ, তালেবিয়াহ স্কুল ও সাদেক্বিয়াহ স্কুলের নির্মাণশৈলী এগুলোর প্রাচীনত্বের ইঙ্গিতবহ।
কুটিরশিল্প
ইরানের প্রসিদ্ধ কার্পেট (গালিচা) প্রস্তুতকারী শহরগুলোর মধ্যে তাবরিজ অন্যতম। গালিচা থেকে তাবরিজের শত বছরের ঐতিহ্যবাহী কুটিরশিল্পের পরিচয় মেলে। ইরানের রফতানিকৃত গালিচার সিংহভাগই তাবরিজের তৈরি।

সভা-সমাবেশ

ঢাকায় ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস এবং ইসলামে নারীর মর্যাদা ও অধিকার’ শীর্ষক আলোচনা সভা

নবীকন্যা হযরত ফাতিমা যাহরা (সালামুল্লাহি আলাইহা)-এর জন্মদিবস ও আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে গত ৯ মার্চ ২০১৮ রাজধানী ঢাকায় ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস এবং ইসলামে নারীর মর্যাদা ও অধিকার’ শীর্ষক এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকাস্থ ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ও যাহরা এসোসিয়েশন এর যৌথ উদ্যোগে ডেফোডিল ইন্টারন্যাশনার ইউনিভার্সিটির কনভেনশন হলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ও জাতীয় মহিলা সংস্থার নির্বাহী পরিচালক মিসেস জাহানারা পারভীন। বিশেষ অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ইরানের রাষ্ট্রদূতের পত্নী যায়নাব ভায়েজী ও ডেফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের প্রধান প্রফেসর ড. ফারহানা হেলাল মেহতাব। সম্মানিত অতিথি হিসেবে ছিলেন আল মোস্তফা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বাংলাদেশ শাখার প্রধান হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলেমীন শাহাবুদ্দীন মাশায়েখী রাদ। অনুষ্ঠানে সভানেত্রী হিসেবে উপস্থিত ছিলেন যাহরা এসোসিয়েশনের চেয়ারপার্সন মিসেস সেলিনা পারভীন।
মিসেস জাহানারা পারভীন তাঁর বক্তৃতায় বলেন, নারীকে তার অবদানের স্বীকৃতি প্রদান ও তাকে সমাজ গঠনে উদ্বুদ্ধ করা নারী দিবস পালনের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। বর্তমান সরকার নারীর কল্যাণে নানারকম পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। বিধবা ভাতা, সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ, ক্ষুদ্রঋণ প্রদান ইত্যাদি। তিনি বলেন, ইসলামে নারীকে যে মর্যাদা দেয়া হয়েছে সেই মর্যাদায় নারীকে অধিষ্ঠিত করা আমাদের সকলের দায়িত্ব।
হুজ্জাতুল ইসলাম শাহাবুদ্দীন মাশায়েখি রাদ বলেন, আমরা এই দিবসটি নারী দিবসের পাশাপাশি মা দিবস হিসেবেও পালন করি। আমরা নারীর প্রতি ও মায়ের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য দিবস পালন করি। নারীর কাজ ও তাঁর দায়িত্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও মহান। মায়ের জায়গা থেকে নারীকে সমাজে প্রভাব ফেলতে হবে। নারী জাতির আদর্শ হযরত ফাতিমা নারীত্বের জায়গা ও মাতৃত্বের জায়গা থেকেই এই দায়িত্ব পালন করেছেন। এই অবস্থান থেকে যদি সে সরে যায় তবে তার মর্যাদার অবনমন হয়।
মিসেস যেইনাব ভায়েজী বলেন, ইসলাম নারী-পুরুষকে লিঙ্গের ভিত্তিতে মর্যাদা প্রদান করে নি। বরং নারী-পুরুষের কর্মকা-ই তার মর্যাদার কারণ। পবিত্র কুরআনে মুমিনদের উদাহরণ দিতে গিয়ে বিবি আছিয়া ও হযরত মারইয়ামের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে নারী-পুরুষ সকলের জন্য তাঁদেরকে দৃষ্টান্ত হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। অন্যদিকে কাফিরদের উদাহরণ দিতে গিয়ে হযরত নূহ (আ.) ও লূত (আ.)-এর স্ত্রীদের কথা বলা হয়েছে। কোরআনে ঐশী ও মানবীয় গুণ অর্জনের ক্ষেত্রেও লিঙ্গের পার্থক্য করা হয় নি। ইসলাম সমাজ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীকে অংশগ্রহণের অধিকার দিয়েছে। এদিক থেকে পাশ্চাত্য বিশ্ব ১৩০০ বছর পিছিয়ে রয়েছে। ইউরোপ নারীকে পর্দা থেকে বের করে এনে এর নাম দিয়েছে স্বাধীনতা আর শালীনতাকে নাম দিয়েছে বন্দিত্ব। অথচ প্রকৃতপক্ষে পর্দা ও শালীনতাই হলো মর্যাদা। আর পর্দার মধ্যে থেকেই প্রতিটি কাজ করার ক্ষেত্রে নারী স্বাধীন।
প্রফেসর ড. ফারহানা হেলাল মেহতাব বলেন, ইসলাম-পূর্ব সভ্যতায় নারী অত্যাচারিত অবস্থায় জীবন অতিবাহিত করত। ইউরোপীয় সভ্যতায় নারীকে ক্রীতদাসের চেয়েও নিকৃষ্ট মনে করা হতো। ভারতীয় সভ্যতায় নারীকে স্বামীর মৃত্যুর পর একইসাথে চিতায় পুড়িয়ে মারা হতো। আরবে নারীকে জীবন্ত কবর দেয়া হতো। তাদের কোনো ধরনের অধিকারের স্বীকৃতি দেয়া হতো না। কিন্তু ইসলাম নারীকে স্বীয় মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে। ইসলাম নারীকে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অংশগ্রহণের অধিকার দিয়েছে। ইসলামের সুনির্দিষ্ট বিধিবিধান, পবিত্রতা ও শালীনতা বজায় রাখার মধ্য দিয়ে তারা এসব ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারে।
জনাব সাইয়্যেদ মূসা হোসেইনী বলেন, ইসলামি শিক্ষার বিপরীতে পশ্চিমা বস্তুবাদীদের পক্ষ থেকে নারীদের স্বাধীনতা ও অধিকার নিয়ে সর্বদা ব্যাপক প্রচারণা চলছে। তারা নারীর হারানো অধিকারকে ফিরিয়ে দিতে চায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত অবাধ স্বাধীনতার নামে নারীকে কেবল এক ধরনের পণ্যে পরিণত করা হচ্ছে। তারা নারীকে আধুনিক দাসত্বের দিকে নিয়ে আসছে। তাই অত্যাধুনিক এই যুগে নারীর প্রকৃত ব্যক্তিত্ব ও অবস্থান তুলে ধরা ইসলামের মহান লক্ষ্য বাস্তবায়নে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বলে আমরা মনে করি।
তিনি আরো বলেন, ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান গত ৪ দশকে নারীর অধিকার ও সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ইরানের নারীরা আজ পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করার পাশাপাশি বিশেষ করে জ্ঞান-বিজ্ঞান, সংস্কৃতি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য, সমাজ ও রাজনীতি, খেলাধুলা, শিল্পকর্মসহ সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে।

উল্লেখ্য, ইরানে ইসলামি বিপ্লবের বিজয়ের পর ২০ জামাদিউস সানী মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর কন্যা ও মহাবিশ্বের নারীদের সর্বোত্তম আদর্শ হযরত ফাতিমা যাহরা (সা. আ.)-এর জন্মের দিনটিকে ‘নারী দিবস’ হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয় এবং এরপর থেকে নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দেশটিতে নারী দিবস উদ্যাপিত হয়ে আসছে।
অনুষ্ঠানে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘নারী’ কবিতা থেকে আবৃত্তি করেন আমেনা বেগম লাবনী ও হযরত ফাতিমার শানে নজরুল সংগীত পরিবেশন করেন জনাব শাহ নওয়াজ তাবীব।

ইমাম হোসাইন (আ.)-এর পবিত্র জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন

২০ এপ্রিল ২০১৮ (৩রা শাবান) ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে বেহেশতে যুবকদের নেতা ইমাম হোসাইন (আ.)-এর পবিত্র জন্মদিবস উপলক্ষে আঞ্জুমানে মুমিনীনে বাংলাদেশ ও ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের যৌথ উদ্যোগে একটি আনন্দ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এতে বক্তব্য রাখেন ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের কালচারাল কাউন্সেলর জনাব সাইয়্যেদ মূসা হোসেইনী, হুজ্জাতুল ইসলাম মোহাম্মদ মাঈন উদ্দিন ও হুজ্জাতুল ইসলাম আব্দুল কুদ্দুস বাদশা। অনুষ্ঠানে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর শানে কবিতা আবৃত্তি ও গযল পরিবেশন করা হয়।

যশোরে হযরত ফাতেমাতুয্ যাহরা (সা. আ.)-এর পবিত্র জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন
গত ৯ মার্চ ২০১৮ যশোর জেলা স্কুল অডিটোরিয়ামে ২০শে জমাদিউস্সানী জান্নাত নেত্রী হযরত ফাতেমাতুয্ যাহ্রা (সা. আ.)-এর পবিত্র জন্মবার্ষিকী এবং ১৯০১ সালের ঐ একই দিনে ইরানে ইসলামি বিপ্লবের মহান সাধক ইমাম খোমেইনী (র.)-এর জন্মবাষির্কীকে কেন্দ্র করে ইনকিলাব-এ-মাহ্দী মিশন এর ২৫তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উদ্যাপিত হয়েছে।
ইনকিলাব-এ-মাহ্দী মিশনের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক জনাব মল্লিক আব্দুর রউফের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসাবে বক্তব্য রাখেন ইসলামী শিক্ষা কেন্দ্র, খুলনার অধ্যক্ষ হুজ্জাতুল ইসলাম মাওলানা সাইয়্যেদ ইব্রাহীম খালীল রাজাভী, আঞ্জুমানে রূহানীর সেক্রেটারী হুজ্জাতুল ইসলাম মাওলানা সাইয়্যেদ হাবীব রেজা হুসাইনী, পাক্ষিক ফজর পত্রিকার সম্পাদক জনাব ইকবাল হোসেন, ঐতিহাসিক মুড়লী ইমাম বাড়ীর পেশ ইমাম জনাব ইকবাল হুসাইন প্রমুখ।
‘বিশ্ব ইসলামি নারী দিবস’-কে স্বাগত ও স্বীকৃতি জানিয়ে ইনকিলাব-এ-মাহ্দী মিশনের উদ্যোগে অনুষ্ঠানে উপস্থিত নারীদের সমন্বয়ে একটি র‌্যালি বের করা হয়। অনুষ্ঠানের প্রথম অধিবেশনে ছোটদের কোরআন তেলাওয়াত, হাম্দ-নাত, ইসলামিক গজল ও কবিতা পরিবেশন করা হয়।

যশোরের শার্শায় ইসলামি নারী দিবস উদ্যাপন

গত ১৪ মার্চ ২০১৮ মোতাবেক ২০ জমাদিউস সানি হযরত ফাতেমা যাহরা (সা. আ.) এবং তাঁরই বংশধর ইরানের ইসলামি বিপ্লবের রূপকার আয়াতুল্লাহ ইমাম খোমেইনী (র.)-এর পবিত্র জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে শার্শা ইমাম মাহদী আ. ফাউন্ডেশন আয়োজিত শার্শা কমিউনিটি সেন্টারে এক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়।
এতে সভাপতিত্ব করেন ইমাম মাহদী আ. ফাউন্ডেশনের সভাপতি জনাব মোঃ আলাউদ্দিন সর্দার। প্রধান আলোচক ছিলেন বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ জনাব মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন শান্তি। অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য রাখেন প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক মোঃ আনোয়ারুল ইসলাম, মোহাম্মদ মুরাদ হোসেন, মোঃ আতিয়ার রহমান। অনুষ্ঠানটির পরিচালনা করেন আলি আকবর আ. যুব সংঘের প্রচার সম্পাদক জনাব বেলাল হোসেন। অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর শার্শা অডিটোরিয়াম থেকে একটি দৃষ্টিনন্দন র‌্যালি বের করা হয়।

হযরত আলী ইবনে আবি তালিব (আ.)-এর পবিত্র জন্মদিবস উদ্যাপন (ক্যাপশান নিউজ)

গত ৩১ মার্চ ২০১৮ হযরত আলী ইবনে আবি তালিব (আ.)-এর পবিত্র জন্মদিবস উপলক্ষে আঞ্জুমানে মুমিনীনে বাংলাদেশ ও ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের যৌথ উদ্যোগে ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে এক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে বক্তব্য উপস্থাপন করেন হুজ্জাতুল ইসলাম আব্দুল কুদ্দুস বাদশা ৷

শার্শায় হযরত আলী ইবনে আবি তালিব (আ.)-এর পবিত্র জন্মদিবস উদ্যাপন

গত ১ এপ্রিল ২০১৮ হযরত আলী ইবনে আবি তালিব (আ.)-এর পবিত্র জন্মদিবস উপলক্ষে যশোরের শার্শা থানার ফাতিমাতুজ্জাহরা (সাঃ আঃ) পাঠাগারের উদ্যোগে শার্শা অডিটোরিয়ামে এক আলোচনা সভা ও দোয়া অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে মূল্যবান বক্তব্য রাখেন হুজ্জাতুল ইসলাম আলী মোরতাজা ৷

অনৈক্যই মুসলিম বিশ্বের বর্তমান সংকটের প্রধান কারণ : আয়াতুল্লাহ আরাফি

ঢাকা সফররত ইরানের আল-মোস্তফা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির চ্যান্সেলর এবং ইরানের জাতীয় মাদ্রাসা বোর্ডের চেয়ারম্যান আয়াতুল্লাহ আলি রেজা আরাফি বলেছেন, অনৈক্য, অসচেতনতা ও জ্ঞানচর্চার অভাব ইসলামি বিশ্বের বর্তমান সংকটের প্রধান কারণ। গত ২৭ মার্চ ঢাকাস্থ ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সাথে এক মতবিনিময় সভায় তিনি একথা বলেন। ইরানের এই শিক্ষাবিদ বলেন, মুসলমানরা দীর্ঘদিন ইসলামের ছায়াতলে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করলেও এই মুসলিম সভ্যতা আজ হুমকির মুখে রয়েছে। তিনি এজন্য অভ্যন্তরীণ সমস্যার পাশাপাশি বিদেশী শক্তির চক্রান্তকেও দায়ী করেন।
আয়াতুল্লাহ আরাফি বলেন, বিশ্বের ৫৪টি মুসলিম দেশের হাতে ৬০ শতাংশেরও বেশি খনিজ সম্পদ থাকা সত্ত্বেও অর্থনৈতিকভাবে মুসলমানরা আজ দুর্বল এবং শক্তিশালী অর্থনীতি পশ্চিমাদের হাতে। তারা সুকৌশলে চিন্তাগত বিভিন্ন বিষয় মুসলমানদের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে আর আমরা অজ্ঞতার কারণে তাদের এসব চিন্তাগত বিভ্রান্তির ফাঁদে পা দিয়ে অনৈক্যের বেড়াজালে আটকা পড়ছি। তাদের অব্যাহত অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনে মুসলমানরা আজ দিশেহারা। মুসলিম বিশ্বের এই সংকট নিরসনে শিক্ষিত সমাজকে আরো বেশি করে জ্ঞানচর্চায় মনোনিবেশ করতে হবে এবং পশ্চিমাদের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন মোকাবেলায় আমাদেরকে আরো বেশি সচেতন হতে হবে।
তিনি বলেন, একটি শ্রেণি ইসলামি সমাজে উগ্রবাদের প্রসার ঘটাতে চায় এবং একে কেন্দ্র করে বিভ্রান্তি ও অনৈক্য সৃষ্টির প্রয়াস চালাচ্ছে। আমাদেরকে এ বিষয়ে অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে।
তিনি বাংলাদেশ ও ইরানের মধ্যে শিক্ষা, সংস্কৃতি, শিল্পকলা এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতার পরিধি আরও বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, ইরান এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে সব ধরনের সহযোগিতা করতে প্রস্তুত রয়েছে।
আল-মোস্তফা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি সম্পর্কে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়টিতে বর্তমানে ১৩০টি দেশের ৩৫ হাজার ছাত্রছাত্রী লেখাপড়া করছে এবং এ পর্যন্ত ৪৫ হাজার ছাত্রছাত্রী বিভিন্ন স্তরে ডিগ্রি গ্রহণ করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ১০০টি বিষয়ে পাঠ দান করা হয়। ইরান ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিশ্ববিদ্যালয়টির শাখা থাকার পাশাপাশি বিশ্বের অনেক স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে এর এমওইউ রয়েছে। যার ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়টি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে জ্ঞানের আদান প্রদান করে থাকে।
সভায় আল-মোস্তফা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বাংলাদেশ প্রতিনিধি হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমীন শাহাবুদ্দীন মাশায়েখী রাদ মুসলমানদের উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে জ্ঞানচর্চার বিকল্প নেই উল্লেখ করে বাংলাদেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ইন্সটিটিউটের সাথে জ্ঞানচর্চা ও গবেষণামূলক যে কোনো ধরনের সহযোগিতায় তাঁদের প্রস্তুতির কথা ঘোষণা করেন।
সভায় ঢাকাস্থ ইরানের রাষ্ট্রদূত ড. আব্বাস ভায়েজী দেহনাভী বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা দিবসে দেশটির জনগণকে শুভেচ্ছা এবং স্বাধীনতার জন্য যাঁরা শহীদ হয়েছেন তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, বাংলাদেশের মানুষের সাথে ইরানের জনগণের আত্মার সম্পর্ক রয়েছে এবং দুদেশের সরকার ও জনগণের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আরো জোরদার হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। ড. ভায়েজী বলেন, পশ্চিমাদের মতে ধর্মে সমাজ গঠনের কোনো স্থান নেই। অথচ ইরানের ইসলামি বিপ্লব প্রমাণ করেছে ইসলামই হলো পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান।
ঢাকাস্থ ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের কালচারাল কাউন্সেলর সাইয়্যেদ মূসা হোসেইনী আল-মোস্তফা আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর আলি রেজা আরাফিসহ অনুষ্ঠানে উপস্থিত সম্মানিত অতিথিদের স্বাগত জানিয়ে বলেন, আমরা দীর্ঘদিন আয়াতুল্লাহ আরাফির বাংলাদেশে আগমনের প্রত্যাশায় ছিলাম। আবশেষ তাঁর আগমন আমাদেরকে ধন্য করেছে। জনাব আরাফির সৌজন্যে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সাথে আজকের এই মতবিনিময় সভা জ্ঞানের আদান প্রদানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আমার বিশ্বাস। তিনি এসময় ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের বিভিন্ন কার্যক্রম তুলে ধরেন। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ ও ইরানের মধ্যে শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সহযোগিতা আরো জোরদারের ওপর গুরুত্বারোপ করে এক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রস্তাব তুলে ধরা হয়।
অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. আতাউর রহমান মিয়াজী বলেন, ইরান ইতিহাস ও ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ একটি দেশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের পাঠ্যক্রমে ইরানের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে এবং আমরা বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে ছাত্রছাত্রীদের পড়িয়ে থাকি। তিনি ইরান সম্পর্কে আরো বেশি অধ্যয়ন ও গবেষণার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ইরান স্টাডিস নামে একটি গবেষণা কেন্দ্র চালু করারও আহ্বান জানান। সভায় আলোচনায় আরো অংশগ্রহণ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহ কাওসার মোস্তফা আবুলউলায়ী, আরবি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ আল মারুফ ও মাদ্রাসা আলিয়া, ঢাকার অধ্যক্ষ ড. সিরাজউদ্দিন। অনুষ্ঠানের আলোচনা পর্বের শেষে মোনাজাত পরিচালনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আব্দুর রশীদ।

ইরানি নওরোজ ও বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে অনুষ্ঠান

‘ইরানের সাথে বাংলাদেশের পুরোনো সম্পর্ক নবরূপে আরো জোরদার হয়েছে’- প্রফেসর ড. গওহর রিজভী
গত ৬ এপ্রিল ২০১৮ বিকাল চারটায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সঙ্গীত ও নাট্যকলা মিলনায়তনে ঢাকাস্থ ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি যৌথ উদ্যেগে ‘নওরোজের ঐতিহ্য ও নিদর্শন’ শীর্ষক এক আলোচনা সভা ও মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির নাট্য ও চলচ্চিত্র বিজ্ঞান বিভাগের পরিচালক জনাব মোঃ বদরুল আলম-এর সভাপতিত্বে উক্ত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা প্রফেসর ড. গওহর রিজভী। বিশেষ অতিথি হিসেবে ছিলেন বাংলাদেশ টেলিভিশনের সাবেক মহাপরিচালক ও বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব জনাব ম হামিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের চেয়ারম্যান জনাব প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আবুল কালাম সরকার। স্বাগত ভাষণ দেন ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের কালচারাল কাউন্সেলর জনাব মূসা হোসেইনী।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে ড. গওহর রিজভী সুদূর অতীত কাল থেকে ইরানের সাথে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক ঐক্যের কথা উল্লেখ করে ঢাকাস্থ ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রকে ধন্যবাদ জানান এই ধরনের একটি অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য। তিনি বলেন, এসব অনুষ্ঠানই আমাদেরকে পুরোনো সম্পর্কের কথা নুতনভাবে মনে করিয়ে দেয়। পারস্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর কবিতা ও সাহিত্যে বহু ফারসি শব্দ প্রয়োগ করেছেন। ফারসি ভাষা বহুদিন রাজভাষা থাকার ফলে আমাদের দাপ্তরিক অনেক শব্দ এখনো ফারসি রয়ে গেছে। যেমন, আইন-আদালত ও জমিজমা সংক্রান্ত প্রায় শব্দ ফারসি।
নওরোজ এবং নববর্ষ সম্পর্কে তিনি বলেন, আমাদের দেশে নববর্ষ উদ্যাপন নওরোজেরই নবসংস্করণ। ইরানের সাথে গভীর সম্পর্ক ও বন্ধুত্বের প্রভাবেই তা এদেশে এসেছে। নওরোজ প্রায় পাঁচ হাজার বছরের একটি পুরোনো উৎসব। এটি ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের উৎসব। তবে আনন্দঘন আমেজে এটি পালিত হতো শীতের শেষে বসন্তকে স্বাগত জানিয়ে। এটি প্রথমে কোন ধর্মীয় উৎসব ছিল না, তবে ধর্মীয় আবহ যুক্ত হয়ে পরবর্তীকালে পরস্পরের মঙ্গল কামনার জন্য স্রষ্টার কাছে প্রার্থনার বিষয়টি একে বরং প্রাণবন্ত করেছে। এই নওরোজ শুধু ইরানেই সীমাবদ্ধ থাকে নি। ইন্দো পারস্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রভাবে এটি ইরানের বাইরে দক্ষিণ এশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে গিয়েছে। আমাদের দেশে মোঘল আমলে এটি প্রচলিত হয়। মোঘল শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায়ও তখন বেশ ঘটা করে নওরোজ উৎসব পালিত হতো। তিনি তাঁর শৈশব স্মৃতি উল্লেখ করে বলেন, শৈশবে আমরা দেখেছি পুরোনো ঢাকার হোসেইনী দালান এলাকা, ইসলামপুর, সিদ্দিকবাজার, তাঁতিবাজারের অলিতে গলিতে নওরোজ উদ্যাপিত হতো। নওরোজের দিন ঢাকার লোকজন একে অপরের সাথে দেখা হলে বলতো ‘শুভ নওরোজ’। প্রতি বছর নওরোজের একটা রং দেয়া হতো। যেমন লাল, সবুজ, নীল, বেগুনি ইত্যাদি। যে বছর যে রং দেয়া হতো সেই রঙের কাপড় পরতো সবাই। খাদ্য-মিষ্টান্নতেও সেই রং দেয়া হতো অনেক সময়। জনাব রিজভী সবাইকে নওরোজের শুভেচ্ছা এবং একই সাথে পহেলা বৈশাখের শুভেচ্ছা জানান।
স্বাগত ভাষণে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের কালাচারাল কাউন্সেলর জনাব মূসা হোসেইনী ইরানি নওরোজ ও বাংলা নববর্ষ পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে সবাইকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বন্ধু ও ভ্রাতৃপ্রতিম দুই দেশ ইরান ও বাংলাদেশের জনগণের সম্মান, মর্যাদা, উন্নতি-অগ্রগতি ও সফলতা প্রার্থনা করে বলেন, নওরোজ ইরানিদের সবচেয়ে প্রাচীন ও গুরুত্বপূর্ণ উৎসবগুলোর অন্যতম যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে উদ্যাপিত হয়ে এসেছে। নওরোজ শব্দের অর্থ নুতন দিন যা প্রকৃতির পুনর্জাগরণ ও নুতন শপথে নুতন বছরের পরিকল্পনাসমূহ হাতে নিয়ে নব উদ্দমে যাত্রার প্রারম্ভস্বরূপ। নওরোজ মানে শীতের জরাজীর্ণতার অবসান, বসন্তের শুরু এবং সবুজ শ্যামল রূপে পুনরায় নব যৌবনে পদার্পণ। ইরানি জনগণের সংস্কৃতিতে নওরোজ বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান ও নিদর্শনে পরিপূর্ণ যা একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় ও জাতীয় উৎসব রূপেও বিবেচিত। নওরোজ ইরানি জাতির নিজস্ব উৎসব হলেও আজ তা গুরুত্বপূর্ণ সংস্কৃতি হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করেছে। ইরানের পাশাপাশি এই উৎসব আজ মধ্য এশিয়া থেকে শুরু করে তুরস্ক, ইরাক, ভারত উপমহাদেশ হয়ে উত্তর আফ্রিকাসহ বিশ্বের আরো অনেক অঞ্চলে তাদের নিজস্ব আচার পদ্ধতিতে পালিত হচ্ছে। নওরোজ নিছক কিছু আচার অনুষ্ঠান নয়; বরং কিছু অর্থবোধক নিদর্শন, অনুপ্রেরণা ও মানবিক মূল্যবোধেও পরিপূর্ণ। নতুন বছরের আগমনের সাথে সাথে ইরানে বাড়ি-ঘর, আঙ্গিনা, অলি-গলি, রাস্তা-ঘাট পরিষ্কার করা হয়। নতুন জামা-কাপড় কেনা ও আসবাবপত্র ঝেড়ে মুছে পরিষ্কার করা, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের দেখতে যাওয়া, মুরব্বিদের সাথে কুশল বিনিময় করা, তাঁদেরকে সম্মান জানানো ও তাঁদের দোয়া চাওয়া, মৃতদের স্মরণ করে তাঁদের কবর যিয়ারত করা, বন্ধুত্ব ও ভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত করা, একে অপরকে উপহার প্রদান, প্রকৃতির সাথে সম্পর্ক স্থাপন এবং নতুন বছরের দিনগুলো যাতে ভালোভাবে অতিবাহিত হয় সে লক্ষ্যে নিজের ও অপরের সুখ-সমৃদ্ধির জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করা ইত্যাদি সবই ইতিবাচক ও উন্নত মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন আচার-আচরণ। ইরানি নওরোজের একটি প্রতীকী বিষয় হচ্ছে ‘হাফ্ত সীন’ বা ফারসি সীন অক্ষর দিয়ে শুরু সাতটি দ্রব্যের সুসজ্জিত টেবিল যা সাতটি অর্থ প্রকাশ করে। বস্তুত এসব ধর্মীয় ও বিভিন্ন দেশের জাতীয় উৎসবের ভেতর দিয়ে ব্যক্তির নিজের, তার সমাজের, তার রাষ্ট্রের, এমনকি রাষ্ট্রের বাইরে আন্তর্জাতিক পরিম-লে সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা বিশ্বসমাজ ও মানবতার জন্য অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি জরুরি। তাই তো ২০০১ সালে জাতিসংঘে বসন্তের প্রথম দিন ২১ মার্চ বিশ্ব নওরোজ দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পায় এবং ২০০৯ সালে এটি মানবতার সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক নিদর্শন হিসেবে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে জনাব ম হামিদ বলেন, ইরান ও বাংলাদেশের এই দুই জাতির মধ্যে অনেক বিষয়ে মিল রয়েছে। উভয় দেশেই যেমন পবিত্র দুই ঈদ উদ্যাপিত হয় তেমনি উভয় দেশের জাতীয় দিবস রয়েছে বছরান্তে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যসম্পন্ন নববর্ষ উৎসব। ইরানে নওরোজের আনন্দ ও আমেজ থাকে সপ্তাহব্যাপী। আমাদের দেশেও পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে গ্রামে-গঞ্জে মেলা হয়ে থাকে। মেলায় ওঠে নানা রকম জিনিসপত্র ও খাদ্যসামগ্রী। বিভিন্ন রকম খেলাধুলা সহ আনন্দ উল্লাস হয়ে থাকে। বিগত কয়েক দশক যাবৎ এটা নগর জীবনেও প্রভাব ফেলেছে। ইরানের মানুষ একদিকে যেমন জাতিয় চেতনা ও সংস্কৃতিবোধসম্পন্ন তেমনি ধর্মীয় সংস্কৃতি দ্বারাও উৎসাহিত। কিন্তু এই দুই বিষয়ে তাদের চেতনার গভীরে কখনো অন্তর্দ্বন্দ্ব হয় না। তারা সমুন্নত চিন্তায় উদ্দীপ্ত। কিন্তু খুব আফসোসের বিষয় আমাদের দেশে আমাদের নৃতাত্ত্বিক সংস্কৃতি যা আমাদের জাতীয় বিষয়আশয় ও আমাদের প্রকৃতির সাথে সংশ্লিষ্ট, আমাদের নিজস্ব জাতীয়তার প্রয়োজনেই এখানকার মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে পালন করে সেসব উৎসবে হুমকি দেয়া হয়। বিগত দশকে নববর্ষ অনুষ্ঠানে জঙ্গি হামলাও হয়েছে, যা অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় ও নিন্দনীয়। আমাদের যেখানে বড় বেশি প্রয়োজন বিভিন্ন বিষয়ে ঐক্য স্থাপন ও সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করা, উদার ও মানবিক হওয়া এবং আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রসারিত করা সেখানে আমরা নিজেরই আত্মঘাতী হচ্ছি ও একে অপরকে উৎখাত করে দেয়ার জন্য নানা বিষয়কে কেন্দ্র করে উগ্রতা ও বিদ্বেষের সম্প্রসারণ ঘটাচ্ছি। এই হিংসা-বিদ্বেষ জাতির জন্য শুভ বার্তা বয়ে আনে না।
তিনি বলেন, ইরান শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে একটি সমৃদ্ধ জাতি। মহাকবি ফেরদৌসী, হাফিজ, রুমি, জামি, ওমর খৈয়াম, ইবনে সীনা, আত্তার সহ অনেক বিদ্বান হাজার বছরে ইরানি সংস্কৃতিকে আরো সাবলিল ও সমৃদ্ধ করেছেন। আমরাও জাতি হিসেবে পেয়েছি কালিদাস, অতীশ দিপঙ্কর, আলাওল, শাহ সগীর, সৈয়দ সুলতান, রবীন্দ্র, নজরুল, জীবনানন্দের মতো সাংস্কৃতিক মহাপুরুষ।
জনাব ম হামিদ দুই দেশের ভ্রাতৃত্ব ও বন্ধুত্ব আরো সমৃদ্ধ করার লক্ষ্যে চলমান সাংস্কৃতিক কর্মকা-কে আরো বৃদ্ধি করার পরামর্শ দেন এবং সর্বোপরি দুই দেশসহ সারা বিশ্বের মানুষে মানুষে সৌহার্দ কামনা করেন, মানুষের মুক্তি ও বিজয় কামনা করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আবুল কালাম সরকার বলেন, ইরানের নওরোজ আজ বিভিন্ন বিষয়ের সমন্বয়ে স্বতন্ত্র রূপ পেয়েছে। এখানে রয়েছে জাতীয় চেতনা, ধর্মীয় শিক্ষা, সাংস্কৃতিক চিন্তা, প্রকৃতিপ্রেম, আনন্দঘন মানবতাবোধ। এখানে ধর্মগ্রন্থ আল কোরআনের শিক্ষা ও চেতনা যেমন যুক্ত হয়েছে, তেমনি রয়েছে ‘শাহনামা’, সাদীর কবিতা, রুমীর ‘মসনভী’ও। হাফ্ত সীনের সাথে এগুলোও যুক্ত। নওরোজে ইরানি জনগণ প্রত্যাশা করে ইহ-পরকালীন মুক্তি এবং বৈধ জাগতিক সুখ-সমৃদ্ধি ও শান্তিময় জীবন যাপন। নওরোজে আনন্দের সাথে যুক্ত হয় প্রার্থনার ভাষাও।
সভাপতির বক্তব্যে জনাব মোঃ বদরুল আনাম ভূঁইয়া বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীকে সাথে নিয়ে এ ধরনের একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করায় ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রকে ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, এ ধরনের আন্তঃদেশীয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেশসমূহের মধ্যে সম্পর্ক বৃদ্ধিতে সহয়তা করে।
আলোচনা পর্বের পর ছিল আকর্ষণীয় সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের সহকারী অধ্যাপক জনাব আহসানুল হাদীর নির্দেশনায় বাংলা ও ফারসি কবিতা ও দলীয় সংগীত পরিবেশন করে বিভাগের ছাত্র-ছাত্রীবৃন্দ। এতে ফারসি বিভাগের শিক্ষক ও কণ্ঠশিল্পী মেহেদী হাসানের নেতৃত্বে তাঁর দল মহাকবি হাফিজের ‘তুতিয়ানে হিন্দ’ ও বিশ্বকবি রবিন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘এসো হে বৈশাখ’ গানটি গেয়ে শোনান। বাংলা ও ইরানি নববর্ষের প্রেক্ষাপটে বিশেষ নাটিকাও প্রদর্শিত হয়। অনুষ্ঠানের বিশেষ আকর্ষণ ছিল সামির বাউলের হৃদয়গাহী বাউল গান। অনুষ্ঠানে ঢাকাস্থ ইরানিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা একটি প্রাণসঞ্জিবনী ফারসি গান পরিবেশন করে।

বগুড়া শেখ সা’দী কালচারাল সেন্টারে ফারসি নববর্ষ উদ্যাপন ১৩৯৭

গত ২১ মার্চ ২০১৮ বগুড়া শেখ সা’দী কালচারাল সেন্টারের উদ্যোগে সেন্টারের হলরুমে ফারসি নববর্ষ ১৩৯৭ উদ্যাপিত হয়। পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু হয়। ফারসি নববর্ষের শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন শেখ সা’দী কালচারাল সেন্টারের পরিচালক জনাব মোঃ শাহীনুর রহমান।
এ উপলক্ষে আলোচনা রাখেন জনাব মোঃ আতিফুর রহমান, হুজ্জাতুল ইসলাম মোঃ আনিসুর রহমান, হুজ্জাতুল ইসলাম মোঃ মোজাফ্ফর হোসেন, মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ্জ্ব আবু জাফর মন্ডল, অধ্যাপক টিপু সুলতান।
আলোচকবৃন্দ বলেন, প্রত্যেকটি জাতির নিজস্ব সংস্কৃতি রয়েছে, নিজস্ব ভাষা রয়েছে। ইরানি জাতিরও নিজস্ব সংস্কৃতি রয়েছে, তাদের নববর্ষ উদ্যাপনে রয়েছে ধর্মীয় মূল্যবোধ। ধর্মীয় মূল্যবোধের মাধ্যমে তাদের প্রত্যেকটি সংস্কৃতি, সাহিত্য, সিনেমা ইত্যাদি পরিচালিত হয়। অতএব, এখান থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে অপসংস্কৃতিকে বর্জন করা দরকার।

বগুড়ায় বাংলা নববর্ষ ও শেখ সা’দী (রহ.)-এর জন্মবার্ষিকী উদযাপন

গত ২০ এপ্রিল ২০১৮ বগুড়া শেখ সা’দী কালচারাল সেন্টারের উদ্যোগে বাংলা নববর্ষ ও পারস্যের মানবতাবাদী কবি শেখ সা’দী (রহ.)-এর জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।
রাজশাহী সুগার মিলস লিঃ এর সাবেক জি.এম. কৃষিবিদ মীর সিদ্দিকুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির আসন অলংকৃত করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক ড. মোঃ কামাল উদ্দিন। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বগুড়া সরকারী আজিজুল হক কলেজের অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক জনাব আতিকুল আলম।
শেখ সা’দী কালচারাল সেন্টারের পরিচালক প্রভাষক শাহীনুর রহমানের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানের স্বাগত বক্তব্য রাখেন বগুড়া ইমামিয়া জনকল্যাণ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা জনাব আলহাজ্জ্ব আবু জাফর মন্ডল। সংক্ষিপ্ত আলোচনা রাখেন বগুড়া আল্-মাহদী শিক্ষা কেন্দ্রের অধ্যক্ষ হুজ্জাতুল ইসলাম জনাব মোজাফ্্ফর হোসেন।
প্রফেসর ড. কামাল সবাইকে বাংলা নববর্ষের প্রাণঢালা অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, নববর্ষ আমাদের প্রাণের ঐতিহ্য যার সাথে জড়িয়ে আছে অনেক স্মৃতি বিজড়িত ঘটনা। আমাদের প্রত্যেকের উচিত এই নববর্ষকে যথাযথ মর্যাদা সহকারে শালীনতা বজায় রেখে পালন করা।
শেখ সা’দী (রহ.)-এর জীবনী আলোচনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, পারস্য কবি শেখ সা’দী (রহ.) তাঁর রচিত প্রতিটি কাব্যগ্রন্থই আল্লাহর প্রশংসামূলক কথা দিয়ে শুরু করেছেন এবং তাঁর রচনাবলি দ্বারা তিনি মানুষকে বিশেষ করে যুবসমাজকে আল্লাহ ও কোরআনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। বিশ্ব মানবতায় তিনি এতটাই অবদান রেখেছেন যে, তাঁর রচিত মানবাধিকার সম্বলিত কবিতার চরণ জাতিসংঘের মূল ফটকে জায়গা করে নিয়েছে।
জনাব আতিকুল আলম বিভিন্ন ঘটনা উল্লেখ করে বলেন, শেখ সা’দী (রহ.) শুধু একজন কবি-ই ছিলেন না; বরং তিনি একজন উচ্চ পর্যায়ের আলেম, দার্শনিক এবং আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্বসম্পন্ন আল্লাহর অলি ছিলেন। তিনি বলেন, শেখ সা’দী (রহ.) একদিন খালি পায়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন আর ভাবছিলেন আমার যদি একজোড়া জুতা থাকত তাহলে কতই-না ভালো হতো! এ কথা ভাবতে ভাবতে তিনি মসজিদে নামায আদায়ের জন্য প্রবেশ করলেন এবং হঠাৎ তাঁর চোখে পড়ল মসজিদে একজন লোক শুয়ে আছে যার পা ছিল না। ঐ লোককে দেখে তিনি জুতার কথা মন থেকে মুছে ফেললেন।
জনাব মোজাফ্ফর হোসেন বলেন, আমাদের আলেম সমাজ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, মিলাদ মাহফিলে এবং দোয়ার অনুষ্ঠানে শেখ সা’দী (রহ.)-এর লেখা ‘বালাগাল উলা বিকামালিহি, কাশাফাদ্দোজা বিজামালিহি, হাসুনাত জামিউ খিসালিহি সাল্লু আলাইহি ওয়া আলিহি’ পড়ে থাকেন যা না পড়লে সেই অনুষ্ঠানগুলো যেন অপূর্ণ থেকে যায়।
স্বাগত বক্তব্যে জনাব আবু জাফর মন্ডল উপস্থিত অতিথিবৃন্দকে ধন্যবাদ জানানোর পাশাপাশি বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময় এবং মানবতার কবি শেখ সা’দী (রহ.)-এর জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে সকলকে মোবারকবাদ জানান।
সভাপতির বক্তৃতায় জনাব মীর সিদ্দিকুর রহমান বাংলা নববর্ষ উদ্যাপন সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেন। বিশ্ব মানবতায় শেখ সা’দী (রহ.) যে বিশেষ অবদান রেখেছেন তার কিছু বিষয় তিনি তুলে ধরেন।