All posts by dreamboy

ইসলাম ও পাশ্চাত্যের মানবাধিকারের ধারণায় মিল-অমিল

হুজ্জাতুল ইসলাম মুহাম্মাদ জাভেদ হুজ্জাতি কিরমানি: ‘ইসলামে মানবাধিকার’ বা ‘পাশ্চাত্যে ১ মানবাধিকার’ এই দুটি পরিভাষার পার্থক্য বিবেচনায় না নিয়ে এই নিবন্ধে বরং ইসলামে মানবাধিকারের যে ধারণা দেওয়া হয়েছে তার সঙ্গে পাশ্চাত্যের সর্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণা ও পরবর্তী বিভিন্ন সম্মেলনে গৃহীত সংযুক্তিতে মানবাধিকারের যে ধারণা তুলে ধরা হয়েছে সেই দুটির মধ্যে বিদ্যমান সামঞ্জস্য এবং অসামঞ্জস্যগুলোর বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। সর্বোপরি এই নিবন্ধে ওই সামঞ্জস্য ও অসামঞ্জস্যের বিষয়টি সংক্ষেপে তুলে ধরার দিকেই মনোযোগ কেন্দ্রীভূত থাকবে।
ইসলাম ও পাশ্চাত্যের মানবাধিকারের ধারণার মধ্যে যেসব পার্থক্য রয়েছে সেগুলোর পরিবর্তে উভয়ের মিলগুলোর ওপর মনোযোগ দেবার ক্ষেত্রে যে বিষয়টি আমাদের আকৃষ্ট করেছে সেটি হলো এই যে, অতীতের যে কোনও সময়ের মত বর্তমান যুগেও বিভিন্ন ধর্ম ও জাতিসমূহের কাছ থেকে মানুষ শান্তির বার্তা পেতে চায়। মানুষ যে শান্তি চায় তার বড় প্রমাণ হলো সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আন্তঃধর্ম সংলাপ বিশেষ করে ইসলাম ও খ্রিস্টবাদের মধ্যে সংলাপ অনুষ্ঠানের ধারার প্রচলন। আর এসব সংলাপ মুসলিম ও খ্রিস্টানদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা সৃষ্টি এবং মুসলিম ও খ্রিস্টান দার্শনিক ও পণ্ডিতদের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সন্দেহাতীতভাবে ভূমিকা রেখেছে।
যারা সব মানুষের সুখ-সাচ্ছন্দ্য কামনা করে, যারা বিশ্বশান্তি ও বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতা ও আন্তঃসভ্যতা সংলাপের সত্যিকারের প্রবক্তা সেই সত্যসন্ধানীদের জন্য এটি এক অবশ্য পালনীয় কর্তব্য যে, তারা বিশ্বের বিভিন্ন ধর্ম, সভ্যতা ও সংস্কৃতির মধ্যকার সম্পর্কের বন্ধনগুলো চিহ্নিত করবেন, সারা বিশ্বের সব মানুষের মধ্যে বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করবেন এবং জাতিসমূহের মধ্যে বিভক্তি ও বৈরিতা জিইয়ে রাখার মধ্যেই যারা নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করে সেই সাম্রাজ্যবাদী চক্রের মানবতাবিরোধী ও বৈরী প্রচারণার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলবেন।
বিষয়টিকে যেভাবে দেখা হয়েছে
ইসলামের মানবাধিকার এবং পাশ্চাত্যের মানবাধিকারের তুলনামূলক বিশ্লেষণ দীর্ঘকাল ধরেই বিদ্যমান রয়েছে। এই বিষয়ের ওপর বহু গ্রন্থ ও প্রবন্ধ রচনা করা হয়েছে। পাশ্চাত্যের এবং ইসলামি বিশ্বের পণ্ডিতরা এ বিষয়ে সাধারণভাবে তিন ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছেন :
১. প্রাথমিকভাবে পণ্ডিতদের দৃষ্টিভঙ্গি হলো বিষয়টিকে পুরোপুরি গ্রহণ বা পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করা; অন্য কথায়, তাঁরা কোনরকম ওজর-আপত্তি ছাড়াই হয় একটিকে গ্রহণ করেছেন বা অন্যটিকে নাকচ করে দিয়েছেন। কিছু কিছু মুসলিম চিন্তাবিদ সর্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণায় উল্লিখিত নীতিগুলোকে প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং কেবল ইসলাম ধর্মেই এধরনের অধিকারের অনুসন্ধান করেছেন। তাঁরা ধারণা করেন যে, ওই ঘোষণায় যেসব নীতি গ্রহণ করা হয়েছে সেগুলো নেওয়া হয়েছে মানবিক আশা-আকাঙ্ক্ষা, এমনকি নিরীশ্বরবাদ থেকে। এদের এই অবস্থানের বিপরীতে পাশ্চাত্যের মানবাধিকারের কিছু প্রবক্তা ধারণা করেন যে, ইসলামে যেসব নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে সেগুলো মোটেও যথেষ্ট নয়, এমনকি কোনও কোনও ক্ষেত্রে অন্যায্য। তাঁরা ইসলামের উদ্ভবের বিষয়টি নিয়েও প্রশ্ন তোলেন এবং বিশ্বাস করেন যে, ইসলামে মানবাধিকারের যেসব বিষয় রয়েছে সেগুলো স্থান-কালের প্রেক্ষাপটের সঙ্গে সম্পর্কিত।
২. এ বিষয়ে দ্বিতীয় যে দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে তা পাশ্চাত্য সভ্যতার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তৈরি হয়েছে। তারা সর্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণা ছাড়া অন্য কিছুই গ্রাহ্য বলে মনে করে না। মানবাধিকারের বিষয়টিকে তারা দেখে ধর্মের আওতাবহির্ভূত একটি বিষয় হিসাবে। জাগতিক বিষয়ে ধর্মের কোনও ভূমিকা থাকলে সেটিকে তারা ধর্মের উদ্ভবকালের জন্য যতটা প্রাসঙ্গিক মনে করে বর্তমান সময়ের জন্য সেভাবে প্রাসঙ্গিক মনে করে না। সুতরাং ঐশী জ্ঞানের বাহক হওয়ার দাবিদার ধর্মে যদি এ বিষয়ে কোনও কিছু বলা হয়ে থাকে তাহলে সেটি কেবল ওই সময়ের জন্যই প্রযোজ্য এবং তা কখনই বর্তমান যুগসহ সর্বকালের জন্য সাধারণভাবে প্রযোজ্য হতে পারে না। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব খোদার পক্ষ থেকেই মানুষের ওপর ন্যস্ত হয়েছে।
আমরা যখন রাজনীতির বিষয়ে কথা বলি তখন এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বলা হয় যে, ধর্মকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে হবে। এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী, ধর্ম ও রাজনীতির এই পৃথকীকরণ কোনও বিচ্যুতি নয়, বরং তা ধর্মের ঔৎকর্ষের লক্ষণ। তারা মনে করে যে, অনেক দিক থেকেই ধর্মের অবস্থান জাগতিক বিষয়ের অনেক ঊর্ধ্বে। যাই হোক, সমস্যা দেখা দেয় তখনই যখন সর্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণা এবং পবিত্র কুরআন বা অন্য কোনও ধর্মের নির্দেশনার মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। এই নিবন্ধের উপসংহারে এই বিষয়ে সংক্ষেপে ব্যাখ্যা দেওয়া হবে।
৩. তৃতীয় দৃষ্টিভঙ্গিটা মাঝামাঝি অবস্থানের যা ইসলামি ও পাশ্চাত্যের মানবাধিকারের ধারণার উৎস, ভিত্তি এবং উপকরণের মধ্যে অনেক মিল ও সম্পর্ক খুঁজে পায়। এই নিবন্ধে এটাই দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে যে, মানবাধিকারের উভয় ধারণার মধ্যে অমিলের চেয়ে মিলই বেশি।
এই নিবন্ধে যে দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরা হয়েছে
এই নিবন্ধে একই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটেছে এবং দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে যে, উল্লিখিত উভয় ধারণায় অধিকারগুলো, এমনকি উৎসের দিক থেকেও অর্থাৎ আদর্শিক এবং সাধারণ কাঠামোগত তত্ত্বের দিক থেকে অভিন্ন। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, আয়াতুল্লাহ জাভাদি আমুলি মনে করেন, প্রথমে উৎসগুলো চিহ্নিত করে তারপর সেইসব সূত্র থেকে আইনগত ভিত্তিসমূহ বাছাই করতে হবে এবং সবশেষে আইনগত বিধিবিধানগুলো বাছাই করার লক্ষ্যে এ বিষয়ক আইনী নির্দেশনা (legal texts) তুলে আনতে হবে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, সর্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণার একটি অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, আইনের চোখে সব মানুষ সমান। এই অনুচ্ছেদের ভিত্তি হলো ন্যায়বিচার। ন্যায়বিচারের ধারণারও সৃষ্টি হয় জনমানস এবং আদর্শিক (public and ideological approaches) দৃষ্টিভঙ্গি থেকে।
৪. ইসলামি ও পশ্চিমা অধিকারের জনমানসগত ও অভিন্ন উৎস
বস্তুবাদী ও ধর্মীয় চিন্তাধারায় অধিকারের উৎস ভিন্ন। যাঁরা অধিকারের ধর্মীয় উৎস স্বীকার করেন না সেই আইনজীবীরা বিশ্বাস করেন যে, অধিকারের জন্ম মানুষের বিবেক এবং প্রজ্ঞা থেকে যা ব্যক্তি ও সামাজিক জীবনে শুভ ও অশুভের মধ্যে পার্থক্য অনুধাবনে সক্ষম। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, জাঁ জ্যাক রুশো তাঁর ‘এমিল’ (Emile) গ্রন্থে বিবেককে বর্ণনা করছেন ঐশী অমর প্রেরণা, স্বর্গীয় কণ্ঠস্বর এবং শুভ ও অশুভর কল্যাণকামী ও সত্যনিষ্ঠ বিচারক হিসাবে। অন্যদিকে নবী-রাসূলের শিষ্যরা বিশ্বাস করেন যে, নবীরা মানুষকে ওইসব অধিকার সম্পর্কে অবহিত করেছিলেন খোদার নির্দেশেই। মনে হয়, এই দুটি পর্যবেক্ষণ পরস্পরবিরোধী নয়, বরং বাস্তবে একে অপরের পরিপূরক। মানুষের প্রকৃতি সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে :
‘শপথ মানুষের এবং তার, যিনি তাকে সুঠাম করেছেন, অতঃপর তাকে তার অসৎকর্ম ও তার সৎকর্মের জ্ঞান দান করেছেন।’ (সূরা আস-শামস : ৭-৮)
এই আয়াতে স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে যে, খোদায়ী অনুপ্রেরণা প্রতিটি মানুষকেই দেওয়া হয়েছে এবং সবাইকেই শুভ ও অশুভ পথ দেখানো হয়েছে। সুতরাং কুরআনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বলা যায়, মানুষের প্রকৃতি, বিবেক ও প্রজ্ঞা ঐশী প্রেরণার ভিত্তিতেই ভালো ও মন্দের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে। অন্যদিকে, প্রত্যাদেশ হলো এক অতীব মহিমাময় গুণ যা বিকশিত হয় কেবল সমুন্নত চেতনা ও প্রজ্ঞার মধ্যে। অন্য কথায়, প্রত্যাদেশ হলো মানবিক প্রজ্ঞার সর্বোচ্চ শিখর এবং তা কেবল তাঁদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য যাঁদের মধ্যে সমুন্নত চেতনা ও শ্রেষ্ঠ প্রজ্ঞা রয়েছে। এজন্যই আমাদের পণ্ডিতরা মহান নবী (সা.)-কে পরম প্রজ্ঞার অধিকারী বলে মনে করেন।
সুতরাং এই দুটি ধারণার বিরোধিতা করার পরিবর্তে বরং এদের ভেতরকার সম্পর্কের বন্ধন খুঁজে বের করাই উত্তম। কারণ, বস্তুত এই দুটি ধারণাই মানবিক প্রজ্ঞা ও চেতনার ওপর আলোকপাত করে। এদের মধ্যে পার্থক্য শুধু এটুকু যে, ঐশী চিন্তাধারা অনুযায়ী এই মানবিক চেতনা ও প্রজ্ঞার স্ফূরণ ঘটে ব্যতিক্রমধর্মী উত্তম মানুষের মধ্যে যাঁরা নবী এবং যাঁদেরকে খোদায়ী প্রত্যাদেশ গ্রহণ করার মতো সক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, ধর্মতাত্ত্বিক পণ্ডিতেরা মানুষের প্রজ্ঞার ওপর আস্থাশীল, কিন্তু সেটা হলো সেই প্রজ্ঞা যা তাঁদেরকে ঐশী প্রত্যাদেশের সাহায্য নিয়েই সত্যের পরিপূর্ণ উপলব্ধিতে পৌঁছার সক্ষমতা দান করে। এদিকে অন্য পণ্ডিতদের, এমনকি দার্শনিক, আইনজ্ঞ এবং চিন্তাবিদ যাঁরা নতুন চিন্তাধারার জন্ম দিতে সহায়তা করেছেন তাঁদের ভাবনায় সব সময়ই ভুল-ভ্রান্তি থেকে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।
এটা বেশ কৌতুহলোদ্দীপক বিষয় যে, এই দৃষ্টিভঙ্গির ভুলগুলোর দৃষ্টান্ত পাশ্চাত্যের অগ্রনায়কদের কাজের মধ্যেই দৃশ্যমান। যেমন, রুশো তাঁর লেখার এক জায়গায় বলেছেন : ‘জনগণের জন্য শ্রেষ্ঠ বিধি-বিধান ও আইন উদ্ভাবনের জন্য মানুষের সব আশা-আকাক্সক্ষা উপলব্ধি করার মতো এমন পরিপূর্ণ প্রজ্ঞাসম্পন্ন ব্যক্তির প্রয়োজন রয়েছে, প্রকৃতির সঙ্গে যাঁর কোনও ধরনের সম্পর্ক আছে এবং একে পুরোপুরি জানেন, যাঁর সুখ আমাদের সুখের সঙ্গে সম্পর্কিত বা নির্ভরশীল নয়, কিন্তু আমাদের সুখ নিশ্চিত করতে যিনি প্রস্তুত। কিন্তু তেমন প্রজ্ঞাসম্পন্ন কোনও মানুষের ধারণা আমাদের নেই।’২
বলতেই হবে যে, এই পরিপূর্ণ প্রজ্ঞা খোদার নবীদের মধ্যে সুস্পষ্টরূপে প্রকাশ পেয়েছে, যদিও রুশোর ইঙ্গিত থেকে বোঝা যায় তিনি ঈশ্বরকেই বুঝিয়েছেন।
অভিন্ন ভিত্তি
মানব জাতির ঐক্য
প্রথম সর্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণার মূল কাঠামোটি হলো মানব জাতির ঐক্য। এই পর্যবেক্ষণ কেবল যে ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ তাই নয়, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এটির উদ্ভব হয়েছে ধর্ম থেকেই। মানব জাতিকে সাধারণভাবে যখন ‘হে জনগণ!, ‘হে মানবসকল!, ‘হে মানব জাতি! বলে সম্বোধন করা হচ্ছে তখন স্পষ্টতই কুরআনের ‘সকল মানুষ সমান’ এই সূক্ষ্মদৃষ্টিই প্রকাশ পাচ্ছে।
‘হে মানুষ! আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী থেকে, পরে তোমাদেরকে বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা একে অন্যের সঙ্গে পরিচিত হতে পরো।’ (সূরা আল-হুজারাত : ১৩)
কুরআনের পবিত্র এই বাণী ওই ধারণার যথার্থতা প্রমাণ করে।
এ প্রসঙ্গে নবী করিম (সা.) বলেছেন : ‘তোমরা সবাই আদমের সন্তান আর আদম মাটির তৈরি।’
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ অবসানের পর গৃহীত সর্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণায় পরিবারকে একক সত্তা হিসাবে গ্রহণের বিষয়টিও ওই সময়ের জনমানস এবং একটি আদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন। মানুষের অস্তিত্বের বাস্তবতার ভিত্তিতেই তার ঐক্যের বিষয়টি স্বীকার করে নেওয়া হয়। এক্ষেত্রেও আমরা ইসলামি ও পাশ্চাত্যের মানবাধিকার ব্যবস্থার মধ্যে সাজুয্য খুঁজে পাই। ইসলামেও পরিবারকে অভিন্ন লাভ-ক্ষতির শরিক একটি একক সত্তা হিসাবে দেখা হয়।
ইরানের বিশিষ্ট কবি শেখ সাদী যেমনটা বলেন :
‘আদম সন্তান পরস্পরে এক দেহের অঙ্গ
সৃষ্টির উৎসে তাদের উপাদান যে অভিন্ন
কালের দুর্বিপাকে ব্যথিত হয় যদি একটি অঙ্গ
স্বস্তিতে থাকতে পারে না, বাকি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ
অন্যদের দুঃখ-কষ্টে তুমি যে নির্বিকার
তোমাকে মানুষ বলা অনুচিত, অবিচার।’ (গুলিস্তান, ১ম অধ্যায়, হেকায়ত নং ১০)

মানুষের প্রকৃতিগত মূল্য
ইসলাম ও পাশ্চাত্যের মানবাধিকারের ধারণার আরেকটি অভিন্ন উপাদান হলো মানুষের প্রকৃতিগত মূল্য ও তার প্রতি শ্রদ্ধা।
পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই সর্বোত্তম যে সবচেয়ে ন্যায়নিষ্ঠ।’ আর সর্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণার মুখবন্ধে মানব পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের সহজাত গুণাবলির স্বীকৃতির কথা বলা হয়েছে। আমাদের মনে হয় যে, এই ঘোষণা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কুরআনের মাধ্যমে প্রভাবিত অথবা অন্ততপক্ষে উভয়টিই পরম কার্যকারণ এবং মানবিক প্রজ্ঞার ধারণার সঙ্গে সাজুয্যপূর্ণ। উভয়ের মধ্যে সবচেয়ে বড় পার্থক্য শুধু এটুকু যে, একটির উদ্ভব সরাসরি ঐশী প্রত্যাদেশ থেকে আরেকটি কিছু মধ্যবর্তী উপাদানের ভেতর দিয়ে প্রত্যাদেশের সঙ্গে সম্পর্কিত।
ব্যক্তি ও সমাজ
ইসলামি ও পাশ্চাত্যের মানবাধিকারের ধারণার মধ্যে আরেকটি যোগবন্ধন হলো ব্যক্তি ও সমাজের বিষয়টি এবং মানুষের ব্যক্তিগত ও সামাজিক মর্যাদার স্বীকৃতি। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ এবং সমাজবাদ সম্পর্কিত তাত্ত্বিক ও দার্শনিক আলোচনার দিকটি বিবেচনায় না নিয়েও বলা যায় যে, আইনী ব্যবস্থায় উভয় ক্ষেত্রেই সমাজের স্বার্থকে ব্যক্তির ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে। ব্যক্তির অধিকার রক্ষায় প্রয়োজনীয় সব উপায়-উপকরণের সমাবেশ ঘটানো হয়েছে।
মজার ব্যাপার হলো, ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তি বা সমাজের স্বার্থের দ্বন্দ্ব দেখা দিলে কেবল সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই ব্যক্তিকে সরিয়ে দেওয়া যেতে পারে। এই গভীর অভিজ্ঞতা থেকেই মানব জাতি ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির এবং সমাজের সম্পর্ক নিয়মিত করার লক্ষ্যে রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তুলেছে এবং একে ক্ষমতা ও বৈধতা দিয়েছে। এই ক্ষেত্রে মানুষের তৈরি সংবিধিবদ্ধ আইন এবং পবিত্র কুরআন ও রাসূলের বিধি-বিধানের মধ্যে অনেক মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
অভিন্ন বিধানসমূহ
মানবাধিকারের মৌল ধারণা ও উৎস সম্পর্কিত যেসব বিষয়ে আমরা আলোচনা করেছি তার বাইরে এর বিভিন্ন অনুচ্ছেদ এবং নীতির মধ্যেও মিল খুঁজে পাওয়া যায়। এখানে আমরা কিছু উদাহরণ তুলে ধরব :
ক. জীবন
খ. স্বাধীনতা
গ. ন্যায়বিচার

জীবন
কোন কোন মুসলিম বিজ্ঞানী জীবনকে দুভাগে ভাগ করছেন : বস্তুগত ও আধ্যাত্মিক। ইসলামে আধ্যাত্মিক দিকের ওপর বিশেষ মনোযোগ দেওয়া হয়েছে অন্যদিকে সর্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণা থেকে এই বিষয়টি মুছে ফেলা হয়েছে। পাশ্চাত্যের চেয়ে এখানেই ইসলামের প্রাধিকার।৩ ইসলামি ও পাশ্চাত্যের মানবাধিকার ব্যবস্থায় আমরা বস্তুগত জীবন বলতে বুঝি মানুষ একদিন জন্ম গ্রহণ করে আরেক দিন মৃত্যুবরণ করে এবং এই জীবনের (বস্তুগত) প্রতিই থাকে তার সমস্ত মনোযোগ। এটি উভয় ধারণার আরও একটি মিল এবং সম্পর্কের বন্ধন। ‘রক্তক্ষয় এবং হত্যার’ ব্যাপারে ইসলাম এতটাই কঠোর এবং এই কাজটি এতটাই নিন্দনীয় যে, একজন ব্যক্তিকে হত্যা করাও সমগ্র মানব জাতিকে হত্যার সমান বলা হয়েছে। এ সম্পর্কিত কুরআনের আয়াত- ‘যে বিনা কারণে একজন ব্যক্তিকে হত্যা করল সে যেন সমগ্র মানব জাতিকেই হত্যা করল।’ (সূরা আল-মায়িদা : ৩২)
নিশ্চিতভাবেই ‘হত্যা’ সম্পর্কে আমাদের মনোগত ধারণার অভিন্ন অর্থ।
স্বাধীনতা
স্বাধীনতার মূল্য সর্বোচ্চ এবং এটি হলো দুই আইনী ব্যবস্থার মধ্যে সম্পর্কসূত্রের আরেকটি ক্ষেত্র। এ সম্পর্কে বলা যায় যে, অধ্যাত্মবাদ ও ধর্মীয় দিক থেকে স্বাধীনতার অর্থ হলো কেবল ঈশ্বর ছাড়া অন্য সব জাগতিক আকাঙ্ক্ষার গোলামি থেকে মুক্তি। এটিকে কোনভাবেই পাশ্চাত্যের মানবাধিকারের ধারণার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা যাবে না।
স্বাধীনতা বলতে আমরা সাধারণভাবে মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণায় বর্ণিত স্বাধীনতাই বুঝি যেখানে মানুষকে জন্মগতভাবে স্বাধীন বলা হয়েছে এবং সব ধরনের দাসত্ব নিষিদ্ধ করা হয়েছে। প্রতিটি মানুষের স্বাধীন ও নিরাপত্তার সঙ্গে বাঁচার অধিকার দেওয়া হয়েছে।
এখানে উল্লেখ করা যুক্তিযুক্ত হবে যে, মানুষের দায়িত্ববোধের জন্ম হয় তার স্বাধীনতার চেতনা থেকে। মানুষ স্বভাবগতভাবেই মুক্ত সত্তা। বিজ্ঞ বলেই সে তার ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে সংযম রক্ষা করে চলার বিষয়টিকে বুদ্ধি ও প্রজ্ঞার পরিচায়ক বলে মনে করে। সংযমের এই যৌক্তিক প্রয়াস আরও বিশুদ্ধ ও প্রকৃত রূপ লাভ করে অধ্যাত্মবাদ ও ঐশী প্রত্যাদেশের আলোকধারায়।
ইসলামি ও পাশ্চাত্যের মানবাধিকারের ধারণার মধ্যে কোনও পার্থক্য থাকলে সেটা আছে স্বাধীনতার মাত্রা নির্ধারণের ক্ষেত্রে। সেটা স্বাধীনতার যৌক্তিকতা ও মৌলিক ভিত্তির কোন ব্যত্যয় ঘটায় না।
অন্য কথায়, মানবাধিকারের উভয় ধারণাই মানুষের জন্মগত স্বাধীনতার ওপর কিছু সীমারেখা টেনে দেয়। খোদায়ী বিধানে যৌন স্বাধীনতার ওপর যে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়, ভোগবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে তেমন নিয়ন্ত্রণ অনেক কম। তার পরও পাশ্চাত্যের ভোগবাদী আদর্শেও যৌন স্বাধীনতা সীমিত করা হয়েছে, যেমন ধর্ষণ এবং প্রকাশ্য যৌনাচার নিষিদ্ধ। তার মানে হলো, সবচেয়ে মুক্ত সমাজের ক্ষেত্রেও মানুষের যুক্তিশীলতা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে নি, সেখানেও খুব সামান্য হলেও স্বাধীনতার ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে।
ন্যায়বিচার
সর্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণার মুখবন্ধে বলা হয়েছে যে, মানবাধিকারের স্বীকৃতি না থাকলে বর্বরতার সৃষ্টি হয় যা মানুষকে বিদ্রোহী করে তোলে এবং সাধারণভাবে আইন প্রয়োগের মাধ্যমে মানুষের অধিকার রক্ষা করতে হবে যাতে মানুষ অবিচার ও নির্মমতার বিরুদ্ধে শেষ উপায় হিসাব বিদ্রোহের পথ বেছে নিতে বাধ্য না হয়। মুখবন্ধের বিভিন্ন অনুচ্ছেদে এসব বিষয়ে সবিস্তার বর্ণনা রয়েছে।
এসব উপকরণ বস্তুতপক্ষে ন্যায়বিচার বলবৎ করা এবং অবিচার দূর করার আকাক্সক্ষার উদাহরণ যা ইসলামি ও পাশ্চাত্যের মানবাধিকারের ধারণায় খুবই জোরালো এবং সংহতরূপে রয়েছে এবং এটি উভয়ের মধ্যে আরেকটি সংযোগসূত্র। প্রকৃতপক্ষে ন্যায়বিচারের ধারণাই গোটা বিশ্বকে স্থিতিশীল করেছে। আমরা সর্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণায় যা দেখতে পাই তা হলো মানুষের ইচ্ছার যথাযথ প্রতিফলন। আসলে মানুষ একটি সত্যিকারের অভীষ্ট থেকে উৎসারিত মূল্যবোধের ভিত্তিতে বিশ্বজগতে বিরাজমান ন্যায়বিচারের একটি প্রকৃত বৈশ্বিক নমুনাকে নিজেদের জন্য আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করার চেষ্টা করেছে।৪
পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘হে বিশ্বাসিগণ! আল্লাহর উদ্দেশ্যে ন্যায় সাক্ষ্যদানে তোমরা অবিচল থাকবে; কোন সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ তোমাদেরকে যেন কখনও সুবিচার বর্জনে প্ররোচিত না করে, সুবিচার করবে, এটা খোদাভীতির নিকটতর।’ (সূরা আল-মায়িদা : ৮)
এবং
‘যখন তোমরা কথা বলবে তখন ন্যায্য কথা বল সেটা তোমার আত্মীয়-স্বজনের সম্পর্কে হলেও।’ (সূরা আল-আন’আম : ১৫২)
এছাড়াও এধরনের অনেক আয়াত রয়েছে যা থেকে কুরআনের নির্দেশনায় ন্যায়বিচারকে কতটা সমুন্নত করা হয়েছে তা বোঝা যায়। এ বিষয়ে সর্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণায় যা কিছুই বলা হয়ে থাকুক না কেন সেগুলো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ইসলাম ও অন্যান্য ধর্মের পবিত্র শিক্ষারই প্রতিফলন।
উভয় ধারণার মধ্যে যেসব পার্থক্য রয়েছে
আসুন এখন আমরা সর্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণার এমন কিছু অংশ নিয়ে আলোচনা করি যা ইসলামের ধারণা থেকে পৃথক। আমরা এসব বিষয় নিয়ে পাশ্চাত্য ও ইসলামি চিন্তাবিদদের মধ্যে সংলাপ ও আলোচনার আহবান জানাই
১. মানব পরিবারের সব সদস্যের সমান অধিকার রয়েছে (ভূমিকা)। এতে মনে হয়, ইসলামে অমুসলিমদের বিষয়ে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে।
২. মর্যাদা ও অধিকারের দিক থেকে সব মানুষ সমান ( অনুচ্ছেদ-১)
৩. ঘোষণাপত্র অনুযায়ী যে কোন ধর্মের অনুসারীরা সব অধিকার ও স্বাধীনতা লাভের অধিকারী হবেন (অনুচ্ছেদ-২)
৪. জাতিগোষ্ঠী, জাতীয়তা বা ধর্মের কারণে কোনরকম সীমাবদ্ধতা ছাড়াই প্রাপ্তবয়স্ক নারী ও পুরুষ বিয়ে করার এবং পরিবার গঠনের অধিকারী হবেন (অনুচ্ছেদ-৬)
৫. প্রতিটি মানুষেরই স্বাধীনভাবে চিন্তা, বিবেক ও ধর্ম পালনের অধিকার আছে; এই অধিকারের মধ্যে ধর্ম বা বিশ্বাস পরিবর্তন এবং এককভাবে বা সমাজের অন্যদের সঙ্গে মিলে প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে নিজের ধর্ম বা বিশ্বাসের শিক্ষাদান, চর্চা করা, ইবাদত-বন্দেগি করা বা পরিপালনের স্বাধীনতাও অন্তর্ভুক্ত (অনুচ্ছেদ-১৮)
৬. প্রত্যেকেরই স্বাধীনভাবে নিজের মতামত প্রকাশের অধিকার রয়েছে (অনুচ্ছেদ-১৯)
৭. বিবাহিত দম্পতি বা বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কের মাধ্যমে জন্ম গ্রহণকারী যে কোন শিশুই একই রকম সামাজিক সুরক্ষা লাভ করবে (অনুচ্ছেদ-২৫, ২য় প্যারা)
এই বিষয়গুলো ইসলাম প্রদত্ত অধিকারের সঙ্গে তুলনামূলক পর্যালোচনা করতে হবে।
সব শেষে আমরা ইসলামের মহান শিক্ষা থেকে উৎসারিত কিছু জোরালো ও মহত্তর বিষয় নিয়ে আলোচনা করব। যদিও কিছু দার্শনিক, আইনবিদ ও রাজনীতিকের মতে এই বিষয়টি সম্ভবত আমাদের পর্যালোচনার এখতিয়ার বহির্ভূত, আমরা মনে করি যেহেতু এই নিবন্ধে পাশ্চাত্য ও ইসলামি অধিকারের মিল ও অমিল সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে সেজন্য এখানে ওই বিষয়গুলোর উপস্থাপন যথাযথ।
বিষয়টি সৃষ্টিকর্তার অধিকার এবং তাঁর ইচ্ছার সঙ্গে সম্পর্কিত। ইসলামের দৃষ্টিতে এই অধিকার হলো সব মানবাধিকারের ভিত্তি। আগে যেমনটা বলা হয়েছে, মানুষের বুদ্ধি ও প্রজ্ঞা হলো আল্লাহ প্রদত্ত উপহার আর বিষয়টি হলো এই যে, ঐশী জ্ঞান হলো শুধুই তার পবিত্র প্রকৃতি। এ বিষয়ে চলুন আমরা ইমাম যায়নুল আবেদীন আলী ইবনে হুসাইন (রা.)-এর একটি বক্তব্য বিবেচনা করে দেখি। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, মানুষের প্রতিটি কর্মকা- ঐশী অধিকার দিয়েই নিয়ন্ত্রিত এবং এই অধিকার পূরণ করার দায়িত্ব প্রতিটি মানুষের ওপর আরোপিত। তিনি বলেন : ‘আল্লাহর সবচেয়ে বড় অধিকার হলো সেটি যেটি তিনি নিজের জন্য নির্ধারণ করেছেন। এটি হলো সেই অধিকার যা সব অধিকারের উৎস এবং যত রকমের অধিকার আছে তার সবই এটি থেকে উদ্ভূত। আর আল্লাহর সবচেয়ে বড় অধিকার হলো তাঁর উপাসনা করা এবং কাউকেই তাঁর সঙ্গে শরিক না করা।’
টীকা
১. এই ভ্রান্তিটা ঘটেছে এজন্য যে, সর্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণায় অন্তর্ভুক্ত অনেক নিবন্ধই একদিকে সব ধর্ম ও গোষ্ঠীর নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত, যেমন সম্পত্তি, নিরাপত্তা, মালিকানা ইত্যাদির অধিকার সম্পর্কিত নিবন্ধ; অন্যদিকে ইসলামের মানবাধিকার বলতে বোঝানো হয় কায়রো ঘোষণায় গৃহীত ইসলামের অভিন্ন শিক্ষাভিত্তিক অধিকারগুলোকে যেখানে বিকৃতি গ্রহণযোগ্য নয়। এটা বলাই নিরাপদ যে, আমরা মুসলমানরা আমাদের ব্যক্তিগত পঠন-পাঠন এবং ব্যাখ্যাকে ইসলামের প্রতি আরোপ করব না।
২. জাঁ জ্যাক রুশো, সোশিয়াল কন্ট্যাক্ট, পৃষ্ঠা ৮১।
৩. দেহজ জীবনের ধারণা ভ্রান্তিমুক্ত নয়। কারণ, জীবন আত্মার ওপর নির্ভরশীল আর আত্মা হলো বিমূর্ত।
৪. আয়াতুল্লাহ জাভাদি আমুলির ব্যবহৃত শব্দই ব্যবহার করা হয়েছে।

হজ : ভালোবাসার সফর

‘এবং মানুষের মধ্যে হজের ঘোষণা করে দাও, যেন তারা তোমার নিকট পায়ে হেঁটে এবং সব রকমের শীর্ণকায় বাহনে করে দূর-দূরান্ত হতে (গভীর উপত্যকা অতিক্রম করে) আসে।’- সূরা হজ : ২৭
সেই মহিমান্বিত মৌসুম আরো একবার ফিরে এসেছে। চান্দ্রবর্ষের শেষের দিকে এসে ঐশ্বর্যম-মণ্ডিত দস্তরখান খোলা হয়েছে। হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর ঐশী আহ্বান-যা কেবল জড় পাহাড়গুলো শুনেছিল-হাজার বছর পর সেই ঊষর উপত্যকায় লাখো-কোটি মানুষকে টেনে এনেছে।
আমরা এবছর হজ পালন করি বা না-করি, আসুন হজ থেকে আমাদের যা কিছু শিক্ষা লাভ করা উচিত তা থেকে কয়েকটি বিষয়ের দিকে আমরা মনোযোগ নিবদ্ধ করি।
১. পবিত্র কাবার চারিদিকে তাওয়াফ
তাওয়াফ হলো এ বিষয়টির স্মরণ যে, প্রত্যেক মানুষের সমস্ত অস্তিত্ব কেবল আল্লাহকেন্দ্রিক হবে। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে : ‘তুমি কি তাকে লক্ষ্য করেছ যে তার প্রবৃত্তিকে নিজের উপাস্য করেছে?’- সূরা যাসিয়া : ২৩
ইসলাম ধর্মে মানুষের ইচ্ছা বা চাওয়াকে পবিত্র বলে বিবেচনা করা হয়েছে। আর হজের বাণী কুফ্রের সংস্কৃতির পুরোপুরি বিপরীত- আমাদের সময়কালে যা আধিপত্য বিস্তার করে আছে।
২. সাফা-মারওয়ায় দৌড়ানো
সাঈ বা সাফা-মারওয়ায় দৌড়ানো হলো শিশুসন্তানের তৃষ্ণা নিবারণের জন্য হযরত হাজেরার প্রাণপন চেষ্টার স্মরণ। নীরব পাহাড়গুলো ছাড়া প্রকৃতিগতভাবে মাতৃসুলভ এই আত্মত্যাগের অন্য কোন সাক্ষী ছিল না। কিন্তু মাতৃসুলভ এই প্রবল ভালোবাসা মহান আল্লাহকে এতটাই সন্তুষ্ট করে যে, তিনি মানুষকে কিয়ামত দিবস পর্যন্ত সেই মহীয়সী নারীর পদাঙ্ক অনুসরণ করে দৌড়ানোর আদেশ দিয়েছেন। কোথায় সেই মিথ্যুকরা যারা নারীবাদী স্লোগানের যিকির তুলে নারীকে অশালীন করে উপস্থাপন করে নারীকে সম্মান প্রদর্শনের দাবি তোলে? তারা এই মহান বিষয়টির প্রতি লক্ষ্য করুক যে, ইসলাম একজন নিঃসঙ্গ নারীকে কেবল মা হওয়ার কারণে এবং মাতৃসুলভ ভালোবাসা প্রদর্শনের কারণে কীভাবে পুরস্কৃত করেছে!
হাদিস শরীফে বলা হয়েছে : ‘মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত।’
৩. মাকামে ইবরাহীমে নামায আদায়
মাকামে ইবরাহীম বা যেখানে ইবরাহীম (আ.)-এর পদচিহ্ন রয়েছে সেখানে নামায আদায় হলো পার্থিব জগতে নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তার স্মরণিকা। কাবা শরীফের তাওয়াফ শেষে হাজীদেরকে ইবরাহীম (আ.)-এর পদচিহ্নের পেছনে দুই রাকআত নামায আদায়ের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কোরআন মজীদে এরশাদ হয়েছে : ‘… ইবরাহীমের দাঁড়ানোর (এ) স্থানকে নামাযের স্থানরূপে গ্রহণ কর…।’- সূরা বাকারা : ১২৫
কেন একজন মুসলমান তার ইচ্ছামতো যে কোন দিক ফিরে নামায পড়তে পারে না, যতক্ষণ না সে কাবার দিকে মুখ করে? হজ পালনকারী এবং তার প্রভুর ঘরের মধ্যে ইবরাহীম (আ.)-এর পদচিহ্নকে-যিনি মানবজাতির জন্য একজন মনোনীত ইমাম [‘আমি তোমাকে মানবজাতির নেতা (ইমাম) মনোনীত করলাম’- সূরা বাকারা : ১২৪]-রেখে হাজীকে স্মরণ করিয়ে দেয়া হয় যে, তার রবের নিকট পৌঁছানোর একমাত্র পথ-যা সৃষ্টির লক্ষ্য-উদ্দেশ্য-হলো তাঁদেরকে অনুসরণ করা যাঁদেরকে আল্লাহ মানবজাতির নেতৃত্ব দেয়ার জন্য পাঠিয়েছেন। কোন যুগই উম্মতের অনুসরণের জন্য ঐশী মনোনীত নেতাবিহীন ছিল না। তাই আমাদের ওপর অবশ্য কর্তব্য হলো আমাদের জন্য মনোনীত নেতাকে খুঁজে বের করা ও তাঁকে অনুসরণ করা।
৪. উম্মাহর এককেন্দ্রিক চিন্তা
হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর স্বর্গীয় কণ্ঠস্বর বর্ণ, ভাষা ও ভৌগোলিক সীমাকে অতিক্রম করে অন্তরসমূহকে আলোড়িত করে। নারী-পুরুষ, যুব-বৃদ্ধ, সাদা-কালো সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠে হাজার হাজার ছাউনিতে অবস্থানকারী সকলেই একক স্রষ্টার অনুগত হয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়ায়, একটি দিকে মুখ করে ও একই ধর্মীয় আচার পালন করে।
‘নিশ্চয় এটা (একত্ববাদী ধর্ম) তোমাদেরও ধর্ম যা একই ধর্ম এবং আমি তোমাদের প্রতিপালক, সুতরাং আমারই উপাসনা কর।’- সূরা আম্বিয়া : ৯২
চিন্তা করুন, যাঁরা হজে এসেছেন তাঁরা সকলে যদি একই বাণী শুনতেন এবং এরপর যে লক্ষ্যকে অনুধাবন করা উচিত সেই লক্ষ্যমাফিক একটিমাত্র দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তাঁদের ভূখ-সমূহে প্রত্যাবর্তন করতেন! কল্পনা করুন, যদি কাবার হাজীরা বিশ্বের নানা অংশ থেকে আগত তাঁদের ভাই-বোনদের সাথে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনা করার এই অনন্য সুযোগ গ্রহণ করেন এবং তাঁদের বিষয়াদিতে সচেতন হন, তাঁদের সমস্যাগুলো নিয়ে মত বিনিময় করেন এবং একে অপরকে নিশ্চয়তা দেন যে, ‘আমরা সকলেই মহান আল্লাহর দুশমনদের বিরুদ্ধে একটি ঐক্যবদ্ধ জাতি’, তাহলে অবস্থা কিরূপ হতে পারত!
কিন্তু আফসোস! এ ধরনের ঘটনা সংঘটিত হওয়া বর্তমান প্রেক্ষাপটে সম্ভব নয়। ঐশী বাণী নাযিলের স্থানে এমন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যার ফলে হাজীরা মহিমান্বিত হজের সময়কালে কেবল একথাগুলো শোনে যে, মৃত মানুষের কবরে কান্নাকাটি করা যায়েজ নয়, মৃত ব্যক্তির প্রতি সম্মান প্রদর্শন ও তাদের কবরে গিয়ে যে কোন আহ্বান করা হলো ধর্মহীন বিশ্বাস এবং এ কাজের মাধ্যমে তাদেরকে সর্বশক্তিমান আল্লাহর অংশী বলে বিবেচনা করা হয় যা কুফ্রের নামান্তর; এগুলো এমন সব বিষয় যেগুলোর সাথে মুসলিম উম্মাহর বর্তমান অবস্থার কোন সম্পর্কই নেই এবং যেগুলো আমাদেরকে সামনের দিকে অগ্রসর হতে মোটেও সাহায্য করে না।
অবশ্য সত্য পথ প্রদর্শনের কণ্ঠকে নিস্তব্ধ করার যত চেষ্টাই করা হোক না কেন আল্লাহর অশেষ রহমতে সবসময় তা বিরাজমান।
‘তারা আল্লাহর জ্যোতিকে ফুৎকারে নির্বাপিত করতে চায়, কিন্তু আল্লাহ তাঁর জ্যোতি পূর্ণ করবেনই যদিও অবিশ্বাসীরা তা অপছন্দ করে।’-সূরা সফ : ৮
৫. আরাফাতের ময়দানে অবস্থান
মক্কায় ওমরা পালনের পর হাজীরা তাদের প্রতিপালকের সেই পবিত্র স্থান ত্যাগ করে হারামের সবচেয়ে দূরবর্তী স্থান থেকে হজের আচার শুরু করে। ‘আরাফ’ নামে পরিচিত মরুময় জায়গায় অবস্থান (উকুফ) হলো হজের প্রথম আচার। পর্যায়ক্রমে হাজীদেরকে আবার মহাপ্রভুর পবিত্র স্থানের নিকটে আনা হয়। অর্থাৎ আরাফাতের ময়দান থেকে মুজদালিফা, মুজদালিফা থেকে মীনা; এর পরে হাজীরা আরো একবার পবিত্র স্থানে প্রবেশ করতে পারেন। এই সফর যেন মানুষের অস্তিত্বের সফরের মতোই যেখানে সে তার প্রভুর নৈকট্যজনক অবস্থা থেকে সফর শুরু করে, এরপর নিম্নতম স্থানে বা জগতের সবচেয়ে দূরতম স্থানে (অর্থাৎ দুনিয়ায়) উপস্থিত হয়, এরপর সে আবার ধীরে ধীরে ঐশী নৈকট্যের দিকে ফিরে যায়। যেমনটি কোরআন মজীদে এরশাদ হয়েছে : ‘… এবং (সকলের) প্রত্যাগমন তো আল্লাহর দিকেই।’- সূরা ফাতির : ১৮
যা হোক, এই সফর মহামূল্যবান। এই সফরে পার্থিব সাগরের অন্ধকারে মানুষ তার হৃদয়ের গুহায় সংরক্ষণ করার জন্য মণি-মুক্তা আহরণ করে যাতে মহাসাক্ষাতের দিনে উপস্থাপন করতে পারে। আরাফাতের ময়দানই হলো সেই স্থান যেখানে মানুষ মারেফাত (অন্তর্জ্ঞান ও পরিচিতি) অর্জন করে; এই মারেফাতই হলো সেই গুপ্তধন যা তাকে ঐশী খলিফার মর্যাদায় অধিষ্টিত করে। একটি হাদিসে বলা হয়েছে : ‘যে নিজেকে চিনেছে, সে তার রবকে চিনেছে।’
এটি হলো সেই মারেফাত যার মাধ্যমে মানুষ বুঝতে পারে যে, সে সৃষ্ট হয়েছে। আর এটিও বুঝতে পারে যে, যদিও পৃথিবী হলো সর্বনিম্ন জগৎ, তারপরও এর সর্বোচ্চ গুরুত্ব রয়েছে। কারণ, এটিই হলো সেই জগৎ যেখানে মানুষ তার অস্তিত্বের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য উপলব্ধি করতে পারে। দুনিয়া হলো মহান আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের একটি মাধ্যম। পরবর্তী জগতে সে কেবল সেই ফসলই তুলবে দুনিয়ার জীবনে সে যেমন বীজ বপন করেছিল।
মনে করি, দুনিয়া হলো আমাদের ‘আরাফাত’। এটি ঐশী নৈকট্যের অবস্থান থেকে অনেক দূরে। মহানবী (সা.)-কে অনুসরণের মাধ্যমে আমাদেরকে আবিষ্কার করতে হবে যে, প্রকৃতপক্ষে আমরা কারা এবং আমাদের দায়িত্ব-কর্তব্য কী। আর যদি আমরা তা করতে পারি, তাহলে আমরা এই দুনিয়ায় আমাদের লক্ষ্য অর্জন করেছি। এই দুনিয়া আমাদের জন্য সর্বশক্তিমান ও প্রশংসিত আল্লাহর নৈকট্যে অর্জনের একটি উপায় বা মাধ্যম হিসেবে পরিগণিত হয়েছে।
আরাফাতের ময়দানে অবস্থান (উকুফ) হজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আচার, এমনকি বর্ণনা করা হয়েছে যে, আল্লাহর প্রিয় নবী (সা.) বলেছেন, ‘আরাফাতই (আরাফাতে অবস্থান) হজ।’
৬. শয়তানরূপ স্তম্ভে পাথর নিক্ষেপ
যে তিনটি স্তম্ভে পাথর নিক্ষেপ করা হয় সেগুলো শয়তানের প্রতিনিধিত্ব করে- যা শত্রুর উপস্থিতির প্রগাঢ় স্মরণিকা। মানুষ এই দুনিয়াতে আসার আগে থেকেই তার শত্রু তাকে ধ্বংস করার পরিকল্পনা করেছিল। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে :
‘হে আদম-সন্তানরা! (সাবধান!) শয়তান যেন তোমাদের প্রতারিত না করে যেমনভাবে সে তোমাদের পিতা-মাতাকে জান্নাত থেকে বের করে দিয়েছে…।- সূরা আরাফ : ২৭
তিনটি স্তম্ভ সম্ভবত মানুষের তিনটি শত্রুর প্রতিনিধিত্ব করে। সবচেয়ে বড় শত্রু হলো তার নিজের সত্তা, দ্বিতীয় শত্রু হলো জিনদের মধ্য থেকে শয়তানরা এবং সবশেষে হলো মানুষের মধ্য থেকে শয়তানরা। শত্রুর হাতে অন্যতম প্রধান যে হাতিয়ার রয়েছে সেটা হলো উদাসীনতা। এটি যেন একটি তন্দ্রাযুক্ত অবস্থা যেখানে মানুষ তার প্রবল শত্রুর উপস্থিতি সম্পর্কে উদাসীন। কোরআন মজীদ প্রতিনিয়ত চায় যেন আমরা তাদের মতো হই যারা সবসময় বাস্তবতাকে স্মরণে রাখে। কেবল স্মরণের (যিকির) আলোই আমাদেরকে অন্ধকার (উদাসীনতা) থেকে রক্ষা করতে পারে। এরশাদ হয়েছে : ‘এবং তাদের মতো হয়ো না যারা আল্লাহকে বিস্মৃত হয়েছে; ফলে আল্লাহ তাদের আত্মবিস্মৃত করেছেন…।’- সূরা হাশর : ১৯
৭. পশু কোরবানি
ঈদের দিন পশু কোরবানি হলো মহান আল্লাহর প্রতি ভালোবাসার কারণে ইবরাহীম (আ.)-এর প্রিয়পাত্রের কোরবানি করার ইচ্ছার প্রতিচ্ছবি। মহান আল্লাহর হযরত ইসমাঈল (আ.)-এর রক্তের কোন প্রয়োজন ছিল না; বরং যা কাক্সিক্ষত ছিল তা হলো এই ঐশী পরীক্ষার মাধ্যমে ইবরাহীম (আ.)-এর মর্যাদার উন্নতি এবং ইবাদতের যোগ্য একক ও অদ্বিতীয় সত্তার প্রতি তাঁর পরম আনুগত্য ও নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ। আমরা ঈদুল আযহায় এ বিষয়টিকেই স্মরণ করি।
কোরআনের বক্তব্য অনুসারে ইবরাহীম (আ.) আমাদের অনুসরণীয় আদর্শ। এরশাদ হয়েছে : ‘নিঃসন্দেহে তোমাদের জন্য ইবরাহীম ও তার সাথিদের মধ্যে উত্তম আদর্শ রয়েছে…’- সূরা মুমতাহিনা : ৪
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা তাঁর প্রতি আমাদের ভালোবাসা প্রদর্শনের জন্য কোন্ জিনিসটি উৎসর্গ করব?
পশু কোরবানি আমাদেরকে নিন্ম পাশবিক প্রবৃত্তিকে স্মরণ করিয়ে দেয়; এই প্রবৃত্তিকে কোরবানি করার পরই কেউ চুল কামিয়ে ফেলতে বা ছোট করতে পারে, সে ইহরামের অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসে এবং আরো একবার মহাপ্রভুর পবিত্র স্থানে প্রত্যাবর্তন করে। কেবল নিম্ন পাশবিক সত্তাকে জয় করার মাধ্যমেই মানুষ তার প্রিয়তমের নৈকট্যের মাকাম অর্জন করতে পারে।
একজন মানুষের নিকট নিজের সত্তার চেয়ে অধিকতর প্রিয় কিছু নেই। আর এটাই হলো তার ‘ইসমাঈল’- যা তার ভালোবাসার পবিত্র সংগ্রামে অবশ্যই তাকে উৎসর্গ করতে হবে। মহান আধ্যাত্মিক শিক্ষক আয়াতুল্লাহ আল-উযমা সাইয়্যেদ আলী আল-কাযী বলেন : ‘তোমার ও বেহেশতের মধ্যে একটি মাত্র ধাপ ব্যতীত কোন দূরত্ব নেই, আর সেই ধাপ হলো তোমার নিজের (নিম্ন) সত্তা।’
হজের আধ্যাত্মিক, দৈহিক, সামাজিক, রাজনৈতিক প্রভৃতি দিক নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করলে কেউ ইসলাম সম্পর্কে বিস্মিত না হয়ে পারে না। অন্যান্য ধর্ম পথনির্দেশের বিষয়টিকে মানুষের সত্তার একটি দিকের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে, পক্ষান্তরে ইসলাম মানুষকে সবদিক থেকে পথনির্দেশনা দিতে চায়। ইসলাম আধ্যাত্মিকতাকে রাজনৈতিক ও সামাজিক বিষয়াদি থেকে বিচ্ছিন্ন মনে করে না; বরং অবিচ্ছেদ্য মনে করে। উপরন্তু ইসলামের বক্তব্য হচ্ছে, এই দুনিয়ার মাধ্যমেই বেহেশতের পথ অর্জিত হয়। হজ পালনকারী যেন হজের যাবতীয় আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যেই তাঁর প্রভুকে অন্বেষণ করেন। এই বিক্ষিপ্ত ও উন্মত্ত দুনিয়াতেই মানুষকে তার প্রেমাস্পদকে খুঁজে নিতে হবে।
ইমাম জাফর সাদিক (আ.) বলেন : ‘কল্ব (অন্তর) হলো আল্লাহর আরশ, আল্লাহর আরশে আল্লাহ ছাড়া কাউকে সমাসীন করো না।’
অনুবাদ : মো. আশিফুর রহমান

বাংলা ভাষায় ফারসি শব্দের ব্যবহার

বাংলা রূপ –      ফারসি রূপ –    আধুনিক ফারসি উচ্চারণ
কানুন                     قانون               গ-নুন্
কানুনী                  قانونى             গ-নূ-নী
কায়েম                     قائم               গয়েম
কবলা                     قباله               গা-বলেহ্
কবর                       قبر                গাবর
কবরস্তান            قبرستان            গাবরেস্ত-ন
কবজ                     قبض                   গাব্জ
কব্জা                     قبضه                 গাবযে
কেবলা                  قبله                     গেবলে
কবুল                   قبول                      গ্বাবুল্
কবুলিয়ত          قبوليت                গ্বাবুলিয়্যাত
গাহ (স্থান)            ﮔاه                         গহ্
ঈদগাহ                   عيد ﮔاه            য়্যেইদ গ্বহ্
গর্দান                    ﮔردن                র্গাদান
গুরদা (কিডনি)      ﮔرده              গ্বোরদে
গ্রেফতার            ﮔرفتار                গেরেফ-তর
গ্রেফতারি          ﮔرفتارى              গেরেফ-তরী
গরম                      ﮔرم                     গারম্
গিরা                      ﮔره                     গেরেহ্
গোস্তাখী           ﮔستاخى                   গোস্তখী
গোলাপ               ﮔلاب                    গো-লব
গোলাপি            ﮔلابى                      গো-লবী
গোলাপদান     ﮔلاب دان                গো-লব দন
গুলিস্তান           ﮔلستان                    গোলেস্তন্
গুলশান            ﮔلشن                      গোলশান্
গুম                    ﮔم                              গুম
গোমরা              ﮔمراه                    গোম-রহ্
গোমরাহি             ﮔمراهى             গোম্-রহী
গোনাহ             ﮔناه                        গো-নহ্
গোনাহগার         ﮔناه كار            গো-নহ্কর্-
গম্বুজ                   ﮔنبد                 গোম্বাদ
গঞ্জ                       ﮔنج                    গাঞ্জ
গান্দা (পচা)         ﮔنده                  গান্দে

সম্পাদকীয়

হজ্ব : মুসলিম উম্মাহ্র ঐক্য-সংহতি ও শক্তির প্রতীক
ইসলামি উম্মাহ্র সর্বসম্মত মত অনুযায়ী হজ্ব ইসলামের মূল স্তম্ভসমূহের অন্যতম। কোরআন মজীদে উল্লেখ করা হয়েছে, কা‘বা গৃহে পৌঁছার মতো সামর্থ্যরে অধিকারী প্রতিটি মুসলমান যেন জীবনে অন্তত একবার হজ্বে গমন করে।
কা‘বা গৃহ হচ্ছে আল্লাহ্ তা‘আলার ইবাদতের উদ্দেশ্যে প্রথম মানুষ হযরত আদম (আ.) কর্তৃক নির্মিত সর্বপ্রথম গৃহÑ যা কালের প্রবাহে বিধ্বস্ত হয়ে যাবার পর আল্লাহ্ তা‘আলার আদেশে হযরত ইবরাহীম (আ.) তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র হযরত ইসমাঈল (আ.)-এর সহায়তায় পুনঃনির্মাণ করেন এবং আল্লাহ্ তা‘আলার আদেশে হজ্বের প্রচলন করেন। তখন থেকেই এ পবিত্র গৃহকে কেন্দ্র করে প্রতি বছর হজ্ব অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।
কা‘বা গৃহের তাওয়াফ, হজরত হাজেরা (আ)-এর স্মৃতি পুনরুজ্জীবনে ছ্বাফা’ ও মারওয়া পাহাড়ের মাঝে সা‘ঈ করা, হযরত আদম (আ.)-এর স্মৃতিবিজড়িত ‘আরাফায় সমাবেশ, হযরত ইসমা‘ঈলের স্মৃতিবিজড়িত মিনায় শয়তানের প্রতীকের ওপর কঙ্কর নিক্ষেপ ও কোরবানিসহ হজ্বের প্রতিটি আনুষ্ঠানিকতাই দুনিয়ার বুকে আল্লাহর খলীফা হিসেবে বিশেষভাবে নবী-রাসূলগণের (আ.) আগমন ও দায়িত্ব পালনের কথা গভীরভাবে স্মরণ করিয়ে দেয়। এভাবে একজন হজ্বযাত্রী নিজেকে তাঁর প্রভু আল্লাহ্ তা‘আলার ঘনিষ্ঠতম নৈকট্যে অনুভব করেন। এ হচ্ছে ইসলামের আধ্যাত্মিক শিক্ষার সবচেয়ে বড় বাস্তব চর্চা।
তবে হজ্ব কেবল আনুষ্ঠানিক ইবাদত হিসেবেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং এর রাজনৈতিক গুরুত্বও অপরিসীম। বস্তত হজ্ব হচ্ছে আল্লাহ্ তা‘আলার কাছে আত্মসমর্পিত বান্দাদের- হযরত ইবরাহীম (আ.) যাদের নামকরণ করেছিলেন ‘মুসলিম’ (আত্মসমর্পিত)- ঐক্য-সংহতি ও শক্তির প্রতীক। জাহেলিয়াতের যুগে হজ্বের এ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যটি হারিয়ে যাবার পর আল্লাহ্ তা‘আলার নির্দেশে রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (সা.) হজ্বকে এ মর্যাদায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন; নবম হিজরির হজ্বের অব্যবহিত পূর্বে মুশরিকদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ (বারাআত্)-এর আয়াত নাযিল হলে তিনি হযরত আলী (আ.)-কে স্বীয় প্রতিনিধি হিসেবে এ আয়াত সহ মক্কায় পাঠিয়ে দেন এবং আলী (আ.) তা হজ্বের সমাবেশে পাঠ করে শোনান। বারাআাতের এ ঘোষণা ছিল হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনাবলির অন্যতম এবং হজ্বের রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য নির্দেশক।
পরবর্তীকালে ইসলামি উম্মাহ্র ওপর জাহেলী রাজতান্ত্রিক শাসন চেপে বসলে হজ্বের এ রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য পুনরায় হারিয়ে যায় এবং হজ¦ কেবল আনুষ্ঠানিকতাসর্বস্ব হয়ে দাঁড়ায়। অতঃপর হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর ওফাতের প্রায় চৌদ্দশ’ বছর পরে ইরানে ইসলামি বিপ্লবের বিজয় ও ইসলামি হুকুমত প্রতিষ্ঠিত হলে এ বিপ্লবের নেতা হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্.) হজ্বের এ বিরাট রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য পুনঃপ্রতিষ্ঠার এবং পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে বারাআাতের প্রয়োগের উদ্যোগ নেন। তিনি হাজ্বীদের প্রতি ইসলামি উম্মাহ্র সবচেয়ে বড় দুশমন যায়নবাদী অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাঈলের বিরুদ্ধে ও ফিলিস্তিনি জনগণের হৃত অধিকার পুনরুদ্ধারের সপক্ষে সোচ্চার হতে আহ্বান জানান। ইসলামি উম্মাহ্ তাঁর এ আহ্বানে সাড়া দেয় এবং তখন থেকে প্রতি বছর হজ্বের সময় বিশ্বের  সর্বত্র থেকে আগত সচেতন হাজ্বিগণ বারাআতের সমাবেশে অংশগ্রহণ করছেন।
হজ্বের সমাবেশে বর্ণ-গোত্র-ভাষা-ভূখণ্ড দেশ নির্বিশেষে সারা দুনিয়ার মুসলমানরা একত্রিত হন, পরস্পর পরিচিত হন, দ্বীনী ও সাংস্কৃতিক বিষয়াদিতে মতবিনিময় করেন এবং তাদের প্রতিটি জাতি ও গোষ্ঠীর সমস্যাবলি সহ গোটা উম্মাহ্র অভিন্ন সমস্যাবলির সমাধান উদ্ভাবনে পরামর্শ ও মতবিনিময় করেন। এভাবে হজ্বের সমাবেশ সারা দুনিয়ার মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য ও সংহতির চেতনা দৃঢ়তর করছে এবং প্রতিনিধিত্বমূলকভাবে মুসলিম উম্মাহ্র বিশ্ব সম্মেলনের রূপ পরিগ্রহ করছে। আশা করা যায় যে, এতদসহ বারাআতের কর্মসূচি থেকে হাজ্বিগণ যে প্রেরণা ও বাণী নিয়ে স্বদেশে ফিরে যাচ্ছেন তার ধারাবাহিকতায় এক সময় সমগ্র মুসলিম উম্মাহ্ সীসাঢালা প্রাচীরের ন্যায় সুদৃঢ় ঐক্য-সংহতি ও শক্তির অধিকারী হবে এবং এর ফলে রোহিঙ্গা মুসলমানদের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও যায়নবাদীদের কবল থেকে ফিলিস্তিন পুনরুদ্ধার সহ উম্মাহ্র সকল গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সমাধানে যথাযথ ভূমিকা পালনে সক্ষম হবে। তাই হজে¦র এ রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্যটি পুরোপুরিভাবে পুনঃপ্রতিষ্ঠায় মায্হাব্ ও র্ফিক্বাহ্ নির্বিশেষে ওলামায়ে কেরাম ও ইসলামি চিন্তাবিদগণের জন্য এগিয়ে আসা অপরিহার্য।
হজে¦র গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ ত্যাগের মহিমায় সমুজ্জ্বল কোরবানি ও পবিত্র ঈদুল আয্হা উপলক্ষে সমগ্র মুসলিম উম্মাহ্র প্রতি, বিশেষ করে নিউজলেটারের পাঠক-পাঠিকাগণ সহ ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের ও বাংলাদেশের মুসলিম জনগণের প্রতি মোবারকবাদ। ঈদের আনন্দে ভরে উঠুক ইসলামি উম্মাহ্র প্রতিটি পরিবারের গৃহ।

বই পরিচিতি

কুহেলী
রচনা : আকবর মোহাম্মদ
প্রকাশক : মোজাম্মেল প্রধান
সাহিত্যকাল
পুরানা পল্টন ঢাকা
প্রচ্ছদ : মোজাম্মেল প্রধান
প্রকাশকাল : একুশে বইমেলা-২০১৩
পবিবেশক : আবাবিল, ফকিরের পুল
মূল্য : ১৩০ টাকা।

লেখক সংগঠক আকবর মোহাম্মদ-এর নামটি শিশু-সাহিত্যের সাথে যেভাবে জড়িয়ে আছে তেমনি শিশু-কিশোর সংগঠন আবাবিলের নামের সাথেও তাঁর নামটি অভিন্ন ভাবে জড়িয়ে আছে। তিনি একজন নিবেদিতপ্রাণ সংগঠক। শিশু-সাহিত্য আর ক্রীড়া-সাহিত্য নিয়েই তাঁর পদচারণা। দৈনিক ইনকিলাবের শিশু-কিশোর পাতা ‘সোনালী আসর’-এর বিভাগীয় সম্পাদক ছিলেন। সংগঠক আকবর মোহাম্মদ নিজেও লিখেছেন অনেক লেখা। তাঁর প্রথম বইটি ছড়ার। নাম ‘ছড়াটিং’। প্রকাশিত হয় ২০০২ সালে। এরপর একই সালে বের হয় ‘মহানবী (সা.)-কে নিবেদিত কবিতাগুচ্ছ’। তাঁর সম্পাদিত গল্পগ্রন্থ ‘অতি লোভে ক্ষতি খুব’ ও বিজ্ঞান গ্রন্থ ‘আলোয় ভুবন ভরা’ প্রকাশিত হয় ২০০৯ সালে।
আলোচ্য এই গল্পের বইটি একটি রহস্য গল্পের সংকলন। এক ডজন গল্প আছে এতে। গল্পগুলোর কোনটা ভৌতিক, কোনটা আদিভৌতিক, কোনটা অজানা আতঙ্কে ভরা বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা সম্পর্কিত। রহস্যে ঘেরা গল্প শুনতে কে না ভালবাসে! ভূতের গল্প না শুনলে নাকি শৈশবই বৃথা। আকবর মোহাম্মদ তাঁর নিজের জীবনে দেখা কয়েকটি রহস্যে ঘেরা ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন বইটিতে। তৃতীয় গল্প ‘কুহেলী’র নামে বইটি নামকরণ করা হয়েছে। ‘গণিত’, ‘ভয়’, ‘সেদিন রাতে’, ‘নোট বইটি’ এই গল্প চারটি খুবই আকর্ষণীয় ও রহস্যময়। কাল্পনিকও মনে হতে পারে। তবে ‘চামচা জীন’ গল্পটি কাল্পনিক গল্পই মনে হয়েছে। অফসেট কাগজে ছাপা ৪৮ পৃষ্ঠার এই বইটির প্রচ্ছদেও রয়েছে রহস্যের ছাপ। বইটি পড়ে শিশু-কিশোর, এমনকি বড়রাও পাবেন রহস্যে ঘেরা রোমাঞ্চকর আনন্দ।
□ আমিন আল আসাদ

ছড়ার সাথে সঙ্গী হলাম
রচনা : ওমর বিশ্বাস
প্রকাশক : কালো বুক
২২ ফ্রি স্কুল স্ট্রিট. কাঠাল বাগান, ঢাকা
প্রচ্ছদ : তানভীর এনায়েত
অলংকরণ : নাজমুল হুসাইন রাসেল
প্রকাশকাল : একুশে বইমেলা-২০১৮
মূল্য : ১০০ টাকা।

কবি ওমর বিশ্বাস বিংশ শতাব্দীর নব্বই দশকের একজন অন্যতম সাহসী ছড়াকার ও কবি। তাঁর কবিতা ও ছড়া নিজের অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে সাহিত্যে। ফলে তিনি একজন স্বতন্ত্র সফল কবি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন। গল্পও লিখেছেন তিনি। শিশু-সাহিত্যেও তাঁর অবস্থান বেশ মজবুত। নানা বিষয়ে তিনি ছড়া ও কবিতা লেখেন। আর শিশু-কিশোরদের জন্য লেখেন নিজের শৈশবের অনভূতির সাথে বর্তমান সময়ের শিশু-কিশোরদের চাওয়া পাওয়াগুলোর তুল্য মূল্য বিচার করে। দেশপ্রেম, প্রকৃতিপ্রেম অথবা আনন্দ-অনুভূতি তো আছেই। সেই সাথে তাঁর ছড়া ও কবিতায় থাকে মূল্যবোধের গান। শিশু-কিশোরদের ভেতরের শক্তিকে নৈতিকতার আলোয় পুষ্ট করার প্রেরণা সংগীত হয়ে ওঠে তাঁর এক একটি কবিতা।
যেমন তাঁর আলোচ্য ছড়ার বইটিতে রয়েছে ‘আমার ডানা কে দেখেছে’ শীর্ষক একটি ছড়া। ‘আমারও তো ডানা আছে/ পাখির মতো জানা আছে/ কেমন করে উড়তে হয়/ কেমন করে আকাশ জুড়ে/ জগতময় দেখতে হলে / উড়তে হবে পাতাল ফুড়ে// আমারও তো জানা আছে/ কেমন করে ঘুরতে হয়/ আমারও তো ভাষা আছে/ দু-চোখে যার স্বপ্ন আছে/ কোন ভাষাতে বললে কথা / করতে পারি বিশ্বজয়।’ যা শিশু-কিশোরদের ভেতরের স্বপ্নডানাকে নিঃসীম আকাশে মেলে ধরবার প্রেরণা যোগায়।
সময় কারো জন্য বসে থাকে না। গতিশীল সময়ের বাস্তবতা তুলে ধরেছেন বইয়ের প্রথম ছড়া ‘সময়গুলো নদীর মতো’ ছড়াটিতে। ‘যাচ্ছে চলে সময়গুলো নদীর মতো/ কোথায় থেকে যাচ্ছে কোথায় অবিরত/ কেউ জানে না কোথায় গিয়ে ধরবে তাকে/ সময় কি আর কারো জন্য আটকা থাকে?’
মহাকাশ, নভোমণ্ডল, চাঁদ-তারকা মহান আল্লাহর অপূর্ব ও অসাধারণ সৃষ্টি। ‘চাঁদের নায়ে’ ছড়াটিতে পাই সেই কথার বাস্তবতা। ‘ডাক পড়েছে আকাশ গাঁয়ে/ যাচ্ছি সেথা চাঁদের নায়ে/ চাঁদ তারাদের জগৎ ঘুড়ে দেখব আজি/ কে বানালো কার-ইশারা’-র কারসাজি’। বইটির নামছড়া ‘ছড়ার সাথে সঙ্গী হলাম’ জেগে ওঠা শিশু-কিশোরদের স্বভাব বা বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করে। ‘‘আমরা দেখি স্বপ্ন অনেক দু-চোখে ওই তারার মতো/ তাইতো সবাই ছুটে চলি সামনে আসে বাধা যত// আমরা খুঁজি কেমনে আসে আকাশ থেকে আলো/ রাত্রি এলে প্রশ্ন মনে ঢাললো কে ওই কালো?// আমরা খুঁজি সাগর নদী মেঘের বসতবাড়ি/হাজার ফুলের ঘ্রাণ ছড়ানো ফুল বাগানের সারি।’
এছাড়া ‘সাহসটাকে জড়িয়ে নাও’, ‘সূর্য’, ‘বৃষ্টি’, ‘দুপুর’, ‘কাল বোশেখির ঝড়’, ‘অংকের ঠ্যাং’, ‘ভূত’, ‘মেঘের বাসা’ ‘আমাদের গাঁয়ে’, ‘ছোটখুকু’, ‘ঈদ’, ‘চলো বনে যাই’, ‘ছড়ার গুপ্তধন’, ‘দেখে আসি অজানার দেশ’, ‘একটি ছেলে’, এই সব ছড়া কবিতাগুলো সুপাঠ্য।
বইটি শিশু-কিশোরদের ভালো লাগবে আশা করি।
□ আমিন আল আসাদ

যুক্তরাষ্ট্রকে ইউরোপের ‘না’ বলতে হবে জেফরি ডি স্যাক্স

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রা¤প। ইরান চুক্তি থেকে ডোনাল্ড ট্রা¤েপর বেরিয়ে যাওয়া এবং ইরানের ওপর নতুন করে অবরোধ চাপিয়ে দেওয়া বিশ্বশান্তির জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এই চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরও চুক্তিটিকে সমর্থন করার ওপর ইউরোপের নিরাপত্তা নির্ভর করছে। রাশিয়া, চীন এবং জাতিসংঘভুক্ত অন্যান্য দেশের সঙ্গে এক হয়ে ইউরোপেরও এখন বলার সময় এসেছে যে ইরানের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যের স¤পর্ক গড়ে তোলা সম্ভব।
এই লক্ষ্য অর্জন করতে গেলে ইউরোপকে অবশ্যই ইরানের ওপর যুক্তরাষ্ট্রবহির্ভূত অবরোধের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে; অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের বাইরের দেশগুলোর কো¤পানিগুলোকেও ইরানের সঙ্গে বাণিজ্য করতে না দেওয়া বা তাদের বাণিজ্য সীমিত করে দেওয়ার মার্কিন প্রচেষ্টাকে মোকাবিলা করতে হবে।
ট্রা¤েপর এই চুক্তি ছাড়ার উদ্দেশ্য স্বচ্ছ ও পরিষ্কার। ¯পষ্টতই তিনি এর মাধ্যমে ইরানের সরকারকে ফেলে দিতে চান। ট্রা¤েপর এই সিদ্ধান্তকে ইউরোপীয় নাগরিকেরা বোকামি হিসেবেই গ্রহণ করেছে এবং তারা বুঝতে পারছে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা ইস্যুর সঙ্গে এখন আর ইউরোপের নিরাপত্তা ইস্যুর সংশ্লিষ্টতা খুব একটা নেই।
ইরানের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ভীতি-প্রদর্শনমূলক পদক্ষেপকে সর্বান্তঃকরণে সমর্থন করেছে মধ্যপ্রাচ্যের দুই দেশ। একটি ইসরায়েল, অন্যটি সৌদি আরব। ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রকে কোনোভাবেই ফিলিস্তিনিদের একচুলও ছাড় না দিতে বলে আসছে। অন্যদিকে, সৌদি আরবের প্রধান চাওয়া যুক্তরাষ্ট্র যেন ইরানের ওপর চাপ অব্যাহত রাখে। যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র হিসেবে পরিচিত এই দুটি দেশই এখন চায় যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি ইরানের ওপর হামলা চালাক।
এর আগে মধ্যপ্রাচ্যে শাসন বদল করতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যা করেছে তার খেসারত যুক্তরাষ্ট্রকে একা দিতে হয় নি। ইউরোপকেও এর যন্ত্রণা বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যে সরকার পরিবর্তনের মতলবে যুদ্ধ শুরু করার পর মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা থেকে অভিবাসীদের ঢল ইউরোপের দিকে ধেয়ে আসতে শুরু করে। আফগানিস্তান, ইরাক ও লিবিয়ার মতো দেশে যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছামতো সরকার পরিবর্তন হলেও সেখানে এখনো অস্থিতিশীল অবস্থা রয়ে গেছে। আর সিরিয়ার মতো যেখানে সরকার ফেলে দেওয়ার চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে, সেখানে পুরোদমে যুদ্ধ চলছে।
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে এবং জার্মানির চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল অনেক চেষ্টা করেও ট্রা¤পকে চুক্তিতে ধরে রাখতে পারলেন না। তাঁরা যে লজ্জাজনকভাবে ব্যর্থ হবেন, তা আগেভাগেই বলা হচ্ছিল।
মনে হচ্ছে দুটি বিষয়ের কারণে ট্রা¤প এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। প্রথমত, মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য আরও বিস্তার করার জন্য ট্রা¤প প্রশাসন আগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছে এবং দ্বিতীয়ত, ট্রা¤েপর মতিচ্ছন্ন মনস্তত্ত্ব। ইউরোপীয় নেতাদের অপ্রস্তুত করে ট্রা¤প যে আনন্দ পান, তা তিনি বারবার বুঝিয়ে দিয়েছেন।
তবে ইউরোপীয় দেশগুলোর হাতে যে একেবারেই কোনো ক্ষমতা নেই তা নয়। যুক্তরাষ্ট্র বেরিয়ে গেলেও ইরান চুক্তি এখনো বহাল রয়েছে। কেননা, এটি শুধু ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তি নয়। জাতিসংঘের সনদ অনুযায়ী সদস্যদেশগুলোর অনুমোদনে এই চুক্তি হয়েছে। বরং ট্রা¤প একতরফাভাবে এই চুক্তি থেকে বেরিয়ে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করেছেন।
এই চুক্তিতে সই করার পর থেকেই ইরান তার পরমাণু কার্যক্রম স্থগিত রেখেছে এবং এই চুক্তির সুবাদেই তার আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক স¤পর্ক আস্তে আস্তে স্বাভাবিকতার দিকে যাচ্ছিল। যুক্তরাষ্ট্র বেরিয়ে গেলেও এখনো এই চুক্তি বাকি বিশ্বের সমঝোতার দলিল হিসেবেই টিকে আছে। এখন বাকি বিশ্বকে যদি যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ওপর অবরোধ চাপাতে বাধ্য করতে পারে (যেটিকে বলা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রবহির্ভূত অবরোধ), তাহলে ইরান চুক্তি কার্যত ভেঙে যাবে। যুক্তরাষ্ট্র সেটিই চাইছে।
কিন্তু বিশ্বশান্তির দিকে চেয়ে হলেও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও চীনকে এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। তাদের বলতে হবে, যুক্তরাষ্ট্র না চাইলে ইরানের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করবে না, কিন্তু সে কাউকে ইরানের সঙ্গে স¤পর্ক রাখার বিষয়ে বাধা দিতে পারবে না।
সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের যেসব কো¤পানি ইরানের সঙ্গে ব্যবসা করে, যুক্তরাষ্ট্র তাদের সেখানে ব্যবসা করতে নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে। ইরানের কো¤পানিগুলোকে যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে পারে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এখানেই থেমে থাকতে চায় না। অন্য দেশগুলোও যাতে ইরানকে নিষিদ্ধ করে যুক্তরাষ্ট্র সেই চেষ্টা করছে। ইউরোপের দেশগুলোকেও সে এর আওতায় রাখার চেষ্টা করবে। এ ক্ষেত্রে ইউরোপকে রুখে দাঁড়াতে হবে। তাদের যুক্তরাষ্ট্রকে বুঝিয়ে দিতে হবে, ট্রা¤েপর হঠকারী সিদ্ধান্তের চেয়ে তাদের প্রতিশ্রুতির দাম অনেক বেশি। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রবহির্ভূত অবরোধে তাদের ¯পষ্ট করে যুক্তরাষ্ট্রের মুখের ওপর ‘না’ বলে দিতে হবে। তাদের বলতে হবে এ ধরনের অবরোধ আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। তাদের বুঝতে হবে, এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ নিলে ট্রা¤পকে যুদ্ধ ও শান্তির একক ইজারা দিয়ে দেওয়া হবে; জাতিসংঘের হাতে কোনো ক্ষমতা থাকবে না। বৈশ্বিক বাণিজ্যের রীতিনীতি বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার হাত থেকে ট্রা¤েপর হাতেই চলে যাবে। তাই যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে ইউরোপ বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা এবং জাতিসংঘের সহায়তা চাইতে পারে। যেসব স্থানে ইরানের সঙ্গে ব্যবসা করতে ইউরোপের অসুবিধা আছে, সেখানে সহজেই চীন ব্যবসা করতে পারে। আইনগতভাবে চীনের সে অধিকার রয়েছেও।
ইউরোপের সামনে এখন কোনো আইনগত কিংবা ভূরাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ নেই। যেটি আছে সেটি হলো মনস্তাত্ত্বিক চ্যালেঞ্জ। ইউরোপের নেতারা এমন আচরণ করছেন যা দেখে মনে হচ্ছে, তাঁরা এখনো ভাবেন তাঁদের ভালো-মন্দ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র মাথা ঘামায়। কিন্তু দুঃখের বিষয় যুক্তরাষ্ট্র এখন আর সে জায়গায় নেই। তাই এখনই ইউরোপকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলতে হবে, জাতিসংঘ সনদ ও বিশ্ববাণিজ্য নীতি রক্ষায় ইউরোপের ভূমিকার ওপর বিশ্বশান্তি নির্ভর করছে; ট্রা¤েপর একগুঁয়েমির ওপর নয়।
ইংরেজি থেকে অনূদিত।
জেফরি ডি স্যাক্স কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক
সূত্র: প্রথম আলো, ১ জুন, ২০১৮

ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা ইমাম খোমেইনী (র.)-এর ২৯তম মৃত্যুবাষিকী উপলক্ষে সেমিনার অনুষ্ঠিত

‘ইমাম খোমেইনী (র.) একজন প্রজ্ঞাবান দার্শনিক ও দূরদর্শী ইসলামি নেতা ছিলেন’- প্রফেসর ড. এম শমসের আলী

গত ১ জুন ঢাকাস্থ ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের উদ্যোগে রাজধানীর ডেফোডিল বিশ্ববিদ্যালয় মিলনায়তনে ইরানের ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা ইমাম খোমেইনী (র.)-এর ২৯তম মৃত্যুবাষিকী উপলক্ষে ‘মুসলিম উম্মাহর জাগরণে ইমাম খোমেইনী (র.)-এর চিন্তাধারার প্রভাব’ শীর্ষক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক ড. কে এম সাইফুল ইসলাম খানের সভাপতিত্বে উক্ত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন দেশের বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী ও ইসলামি চিন্তাবিদ, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ভিসি এবং সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যলয়ের প্রফেসর এমিরিটাস প্রফেসর ড. এম শমসের আলী। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের রাষ্ট্রদূত ড. আব্বাস ভায়েজী দেহনাভী। স্বাগত ভাষণ দেন ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের কালচারাল কাউন্সেলর সাইয়্যেদ মূসা হোসেইনী। সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন দৈনিক নিউনেশনের সাবেক সম্পাদক ও গ্রীনওয়াচ ঢাকার সম্পাদক জনাব মোস্তফা কামাল মজুমদার। আলোচনায় অংশ নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মুহাম্মদ রাশেদ আলম ভূঁইয়া এবং বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ হুজ্জাতুল ইসলাম মোহাম্মদ আশরাফ উদ্দিন খান।
সভায় ইমাম খোমেইনীর জীবনীর ওপর একটি ঐতিহাসিক ডকুমেন্টারি প্রদর্শিত হয়।
সভাপতির বক্তব্যে ড. কে এম সাইফুল ইসলাম খান বলেন, ইরানের ইসলামি বিপ্লব একই সাথে পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, রাজতন্ত্র, সমাজবাদ ও ইহুদি যায়নবাদকে ভ্রুকুটি করে স্বতন্ত্র স্বাধীন মেজাজে ইরানের মাটি থেকে অঙ্কুরিত হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে সারা দুনিয়ায়। ইরানের ইসলামি বিপ্লব দুনিয়ার মুসলমানের কাছে, মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সমগ্র মানবতার কাছে এক নুতন দিগন্ত উন্মোচন করে। কোনো প্রকার পার্থিব স্বার্থের পথে নয়, কেবল খোদায়ী স্বার্থে একটি সামাজিক জাগরণ ঘটেছিল ইরানে যার ফলাফল কেবল ইরানি জাতিই নয়, নানা দেশের জনগণ জাতীয়ভাবে, এমনকি ব্যক্তি-মানুষের বিকাশেও এ বিপ্লবের আলো কার্যকরি ভূমিকা রেখেছে। বিভিন্ন দেশে ইসলামের সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষ সাধনে বিপ্লবের পর ফারসি ভাষা ও সাহিত্য, এর ইসলামি জীবনদর্শনের বিকাশে সাংস্কৃতিক কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা আর বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে স্বতন্ত্র ফারসি বিভাগ চালু ও সেসব বিভাগে গবেষক ছাত্র-শিক্ষক তৈরি করে দিয়ে অনেক দিনের পুরোনো ঐতিহ্যের পুনরুজ্জীবন ঘটাতে ইরানি কর্তৃপক্ষ সদা সচেষ্ট থেকেছে। ইমাম খোমেইনী (র.)-এর সুযোগ্য নেতৃত্বে ইরানের ইসলামি বিপ্লব ইসলাম সম্পর্কে অনেক প্রচলিত সংকীর্ণ ধ্যানধারণাকে বদলে দিয়েছে। দলপূজা, গোষ্ঠীতন্ত্র, খণ্ডিত চিন্তাধারার বেষ্টনীতে সীমাবদ্ধ চিন্তাধারাকে নিয়ে গেছে নিঃসীম নীলাকাশের কাছে অথবা বিস্তীর্ণ সমুদ্রের কাছাকাছি।
ইমাম খোমেইনী (র.) তথাকথিত কোনো আলেম ছিলেন না। তিনি ছিলেন একাধারে আলেম, আরেফ, আবেদ, দার্শনিক ও রাজনৈতিক নেতা। ইরফানি শিক্ষার আলোয় তিনি আত্মশুদ্ধির মহান দরজায় প্রবেশ করতে পেরেছেন বলেই তাঁকে আমরা দেখি একজন ইনসানে কামেল আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবে। কেবল বস্তুবাদী চিন্তাধারার বিশ্লেষণের কোনো খণ্ডিত ইসলামি ধ্যন-ধারণা তাঁর মাঝে ছিল না। তাঁর ইসলামি চিন্তা-চেতনার গভীরতার ভেতর আমরা প্রকৃত ইসলামের গভীরতা টের পাই। প্রকৃত বাস্তবতাকে উপলব্ধি করেই মিখাইল গর্বাচেভের কাছে তাঁকে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে এবং সত্যের আহ্বান জানিয়ে তিনি যে ঐতিহাসিক পত্র লিখেছিলেন এতে রয়েছে এই মহান নেতার অপরিসীম দূরদর্শিতার পরিচয় ও তুখর অনুমান শক্তির বাস্তব নমুনা। তিনি বলেছিলেন, কমিউনিজমের ঠাঁই হবে বিশ্বের রাজনৈতিক ইতিহাসের জাদুঘরে। সত্যি সত্যি তাই হয়েছে। বিশাল সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে খান খান হয়ে গিয়েছে। ইমাম খোমেইনী (র.) পুঁজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্র, বিষাক্ত ইসরাইলী নির্মমতা, সমাজতন্ত্রের অসারতার প্রতি যেমন সচেতন ছিলেন তেমনি সচেতন ছিলেন লরেন্স অব অ্যারাবিয়া ও হামফ্রের ষড়যন্ত্রের ফসল ইহুদি ও ব্রিটিশের চক্রান্তে মুসলিম সমাজে ছড়ানো ওয়াহাবি ইজমের কুফল সম্পর্কেও। যা মুসলিম দুনিয়া থেকে মুসলমানদের ইতিহাস-ঐতিহ্য বিলীন করে দেয়াসহ আধ্যাত্মিক ও তাকওয়াভিত্তিক আত্মশক্তিকে দুর্বল করে দিয়েছিল।
ইসলাম যে কেবল কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর সম্পদ নয় তা ইমাম খোমেইনী (র.)-এর চিন্তাধারা ও ইরানের ইসলামি বিপ্লব থেকে বোঝা যায়। আজকে আমরা বিভিন্ন দল-গোত্র নাম দিয়ে ইসলামের বিশালত্বের ক্ষতি করে ফেলেছি। কেবল ইসলামের নামকরণের নামে নিজেরাই খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে এবং বিভিন্ন বিষয়কে খণ্ড-বিখণ্ড করে কোনো বিষয়কে আত্মীকরণের মাধ্যমে আত্মস্থ ও পরিশোধিত করার পরিবর্তে দূরে সরিয়ে দিয়েছি। ফলে আমাদের এই পরিণতি হয়েছে যে বলিষ্ঠ শক্তিতে দাঁড়িয়ে থেকে ইয়াযিদি ব্যবস্থা ও স্বৈরতন্ত্র-রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে সাহসী চিত্তে দাঁড়াতে পারছি না। আত্মশুদ্ধির জায়গা থেকে আমরা সরে গেছি। আর আত্মশুদ্ধির পথ পরিক্রমা অতিক্রম প্রচেষ্টার অভাবযুক্ত নেতৃত্ব থেকে সুবিচার আশা করা যায় না।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে অধ্যাপক ড. এম শমসের আলী বলেন, বিপ্লবের পূর্বে ও বিপ্লবোত্তর ইরানে যাওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। কাজেই দুই সময়ের পার্থক্য নিরূপণ করা আমার পক্ষে সহজ হয়েছে। বিপ্লবের ঠিক পরপর আমি যখন ইরানে গিয়েছিলাম তখন ইরানি জনগণের সমন্বিত ঐক্য সংহতির চিত্র দেখে আমি আশান্বিত হয়েছিলাম। তাদের ঐক্যের যে শক্তি তারা আত্মার ভেতর অর্জন করেছিল তা হচ্ছে সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি অগাধ আস্থা। ইরানের রাজধানী তেহরান একটি বড় শহর। আমি দেখলাম ও শুনলাম প্রতিটি বাড়ির ছাদের শীর্ষে উঠে নারী-পুরুষ শিশু-কিশোর স্লোগান দিচ্ছে ‘আল্লাহু আকবার’। সারা তেহরান প্রকম্পিত করে সেই ‘আল্লাহু আকবার’ স্লোগানটি ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হলো। এই একতা ও বিশ্বাসের শক্তিকে দমন করার সাধ্য ছিল না শাহ বা আমেরিকা অথবা ইসরাইলের।
বিপ্লবের আগে ইরানের বৃহত্তর জনগণ সুবিধাবঞ্চিত ছিল। সাধারণ জনগণের সাধ্যের ভেতর ছিল না ভালো খাবার খাওয়ার অথবা উত্তম কাপড় পড়ার। কিন্তু বিপ্লবের পর ইরানি জনগণের মৌলিক চাহিদাসমূহ পূরণ হয়েছে। তারা আজ বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। বিপ্লবের পর ইরানের শিক্ষার অনেক প্রসার ঘটেছে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের সকল শাখায় তারা উন্নতি লাভ করেছে। ইরানি সাহিত্য বিশ্বসাহিত্যের দরবারে উজ্জ্বল আসন দখল করে রেখেছে ঐতিহাসিকভাবে। শেখ সাদী, রুমী, জামি, ওমর খৈয়াম, ফেরদৌসীকে কে না জানে! ইরান বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছে। অস্কারসহ বিভিন্ন পুরস্কার জিতে নিচ্ছে। ইরানের পরমাণু বিজ্ঞান আজ আলোচিত। পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও সামাজিক কাজে ব্যাপক অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়েছে। এক্ষেত্রে ইরানের ইসলামি নেতৃবৃন্দ কোনো সংকীর্ণতা দেখায় নি। কারণ, সেটা ইসলামসম্মত নয়। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর যুগে নারীরাও পুরুষের পাশাপাশি তাদের রান্নাঘর ছাড়াও আরো দায়িত্ব পালন করেছে। ইরানেও আমরা তাই দেখি সকল ক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ রয়েছে। তারা স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, অফিস, আদালত, স্টেশন, বিমানবন্দর, শপিং মলে সব জায়গাই রয়েছে। তাদেরকে চার দেয়ালের মধ্যে আটকে রাখা হয় নি। তারা গাড়িও চালাচ্ছে। তবে তা ইসলামের হিজাবের ভেতর দিয়ে। ইরানি জাতির এই যে ভেতরে বাহিরে অসাধারণ এক পরিবর্তন এলো সেটা এই ক্ষণজন্মা মানুষটির জন্য যিনি ছিলেন হযরত আলীর বংশধর। তিনি তাঁর পূর্বপুরুষদের ব্যক্তিত্বের বিশালতা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। হযরত আলী ইসলামের ইতিহাসে একজন বুদ্ধিদীপ্ত ও প্রজ্ঞাবান রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন। তিনি মালিক আশতারের কাছে যে প্রশাসনিক পত্র দিয়েছিলেন সেই পত্র ছিল দূরদর্শী তাৎপর্যপূর্ণ যা ইসলামের ইতিহাসে অমূল্য সম্পদ হিসেবে অক্ষয় হয়ে রয়েছে।
আমরা খণ্ডিত ইসলামের অনুশীলন করে যাচ্ছি। আমরা নামায, রোযা, হজ, ওমরা পালন করে যাচ্ছি, কিন্তু আমাদের দেশ ও সমাজকে আল্লাহর হুকুমমতো পরিচালিত করছি না। ইরান থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে যা আমরা গ্রহণ করতে পারি নি। আজকে পাশ্চাত্য দুনিয়া ইরানের সাথে শত্রুতা করে চলেছে। অথচ আমরা যে নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার বা নয়া বিশ্বব্যবস্থার কথা শুনি, ইরানের সাথে শত্রুতা নিরসন করে নয়া বিশ্ব ব্যবস্থার সাথে ইরানের অর্জনসমূহ ও ইসলামি নৈতিকতা ও মানুষের সত্যিকার অধিকার প্রদানের বিষয়টি যুক্ত হলে পৃথিবী শান্তির রাজ্যে প্রবেশ করতে পারত।
তিনি আরো বলেন, ইমাম খোমেইনী (র.) একজন প্রজ্ঞাবান দার্শনিক ও দূরদর্শী ইসলামি নেতা ছিলেন। তিনি ছিলেন সর্বপ্রকার গোঁড়ামিমুক্ত। তাঁর একটি অসাধারণ উক্তি আমার হৃদয়ে বাজে। তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা যখন ইসলামিক সাইন্স বা ইসলামিক জিউমেট্রির কথা বলি আসলে ইসলামিক সাইন্স বা ইসলামিক জিউমেট্রি বলতে কিছু নেই। বিজ্ঞান বিজ্ঞানই। জিওমেট্রি জিওমেট্রিই। আমরা ইসলামিক সাইন্স বলতে সেটাই বোঝাতে চাই যে, বিজ্ঞানের সাথে নৈতিকতার বিষয়টি জড়িত থাকতে হবে। বিজ্ঞানকে অনৈতিক কাজে ব্যবহার করা যাবে না।’ তিনি তাঁর চিন্তাধারাকে সমাজে বাস্তবায়িত করেছিলেন জনগণকে সাথে নিয়ে। জনগণের ওপর চাপিয়ে দিয়ে নয়।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে ড. আব্বাস ভায়েজী দেহনাভী বলেন, আমেকিার পুতুল সরকার রেজা শাহ পাহলভীর স্বৈরশাসন থেকে আমরা যখন স্বাধীনতা লাভ করলাম তখন আমাদের অনেক কিছুই ছিল না। আমরা জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায়, শিক্ষা ব্যবস্থাপনায়, চিকিৎসা ক্ষেত্রে অনেক পেছনে ছিলাম। আপনাদের বাংলাদেশ থেকে ডাক্তারদের নিয়োগ দিয়েও আমাদের চিকিৎসাকর্ম চালাতে হয়েছে। আমাদের আত্মনিয়ন্ত্রণ ও জাতীয় বিপ্লবকে মেনে নিতে পারে নি পরাশক্তি আমেরিকা, ইহুদিবাদী ইসরাইলসহ পাশ্চাত্য বিশ্ব। কঠিন যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়ে ধ্বংস করা হয় নগর, গ্রাম, ধ্বংস করা হয় আমাদের জাতীয় অর্থনীতি। কিন্তু ইমাম খোমেইনী (র.)-এর মহান নেতৃত্বে আমাদের এই পরিবর্তনকে আমরা পুনর্গঠনের সংগ্রামের মাধ্যমে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকলাম শত্রুদের চতুর্মুখী ষড়যন্ত্রের পরেও। ইমাম খোমেইনী (র.)-এর অবর্তমানে তাঁর সুযোগ্য ছাত্র রাহবার সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ীর নেতৃত্বে আমরা ক্রমশ এগিয়ে চলেছি। আল্লাহর রহমতে আমরা এখন পরমাণু শক্তিসম্পন্ন জাতি। আলহামদুলিল্লাহ আমরা আল্লাহর রহমাতে একটা দৃঢ় অবস্থানে নিজেদেরকে দাঁড় করিয়েছি।
আমরা যখন ইমাম খোমেইনী (র.)-এর নেতৃত্বে মহান ইসলামি বিপ্লব সফল করি তখন সমসাময়িক মুসলিম বিশ্বে, যেমন : মিশর, তুরস্ক, তিউনিশিয়া, মালয়েশিয়া, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, এমনকি সৌদি আরবেও একটি পরিবর্তনের হাওয়া প্রবাহিত হচ্ছিল। কিন্তু সেই আলোকোজ্জ্বল পবিবর্তনের হাওয়াকে সব দেশের জনসাধারণ দুঃখজনকভাবে তাদের অনুকূলে ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু আমরা সফল হয়েছি এবং সফলতার পথে এগিয়ে চলেছি।
রাষ্ট্রদূত আরো বলেন, বিশ্বের অনেক দেশে খণ্ডিত ইসলামচর্চা হয়। ইসলামের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও আইনগত দিকগুলো চর্চা হয় না। রাসূলুল্লাহ (সা.) মদীনায় যে ইসলামি সমাজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সেই সমাজের মতো একটি সমাজ প্রতিষ্ঠা করার জন্যই ইমাম খোমেইনী (র.) আন্দোলন করেছিলেন। ইরানের ইসলামি বিপ্লবের আওয়াজ অনেকে শুনতে পেয়েছেন, অনেকে একে গ্রহণ করেছেন। প্রভাবিত হয়েছেন এর আলোকে। ফিলিস্তিন ও লেবাননের জনগণকে উৎসাহিত করেছে আমাদের জাগরণ। ইমাম খোমেইনী (র.)-এর ব্যক্তিত্বের বিশালতা, তাঁর তাকওয়া এবং আল্লাহর তরফ থেকে সহযোগিতা প্রাপ্তির ফলে পরাশক্তিসমূহের সকল চক্রান্ত ভেদ করে আমরা দাঁড়িয়েছি। ইনশাল্লাহ আপনাদেরকে নিয়ে ইসলামি বিপ্লবের সফলতার ৪০তম বার্ষিকী উদ্যাপন করতে সক্ষম হব।
কালচারাল কাউন্সেলর জনাব সাইয়্যেদ মূসা হোসেইনী বলেন, ইমাম খোমেইনী (র.) ছিলেন একজন মুজাহিদ, বিশিষ্ট আলেম, মুজতাহিদ, চিন্তাবিদ, দার্শনিক, ফকিহ, আরেফ, ধর্মীয় নেতা ও ইসলামি বিপ্লবের রূপকার। ইসলামি জাগরণে তাঁর প্রচেষ্টা ও চিন্তা-দর্শনের জন্য তিনি অমর হয়ে আছেন। তাঁর চিন্তাধারা ছিল বিশুদ্ধ ইসলামি চিন্তাধারার বহিঃপ্রকাশ। তিনি মহান আল্লাহর ওপর নির্ভর করে ইরানের জনগণকে সচেতন করার পাশাপাশি যোগ্য নেতৃত্বের মাধ্যমে বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বড় বিপ্লবের বিজয় ছিনিয়ে এনেছেন এবং ইরানে ইসলামি প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছেন। ইমাম খোমেইনী (র.)-এর ইসলামি চিন্তার পুনর্জাগরণী দর্শন, অনুপ্রেরণা এবং দূরদর্শী নেতৃত্বই ইরানের জনগণকে সচেতন ও জাগ্রত করতে সক্ষম হয়েছে। এই বিপ্লবের বড় অর্জন হলো স্বাধীনতা ও মুক্তি এবং ইসলামের ওপর ভিত্তি করে ইরানে একটি সরকার প্রতিষ্ঠা। যার ফলে ইরানে আড়াই হাজার বছরের রাজতন্ত্র উচ্ছেদ হয়েছে এবং অবসান হয়েছে ইরানি জাতির ওপর থেকে বিদেশী ও সা¤্রাজ্যবাদীদের খবরদারি। ইমাম খোমেইনী (র.) তাঁর চিন্তাধারার মাধ্যমে আজো আমাদের কাছে অমর হয়ে আছেন। ইসলামি বিপ্লবের শত্রুরা এই মহান বিপ্লবকে ধ্বংস ও ইমামের চিন্তা-দর্শনের ওপর কালিমা লেপনের জন্য সব ধরনের অপচেষ্টা করলেও ইমাম খোমেইনী (র.)-এর চিন্তা-দর্শন এখনও জীবন্ত ও প্রগতিশীল দর্শন হিসেবেই বিস্তৃত হচ্ছে। ইসলামি বিপ্লবের পর বিশেষ করে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিভিন্ন ইসলামি দেশের জনগণের মধ্যকার জাগরণ, বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন ও রাজনৈতিক পরিবর্তন, বিভিন্ন স্থানে স্বাধীন, ইসলামি পরিচয় ও রীতিনীতির পুনঃপ্রতিষ্ঠা, ইসলামি চিন্তাচেতনার প্রতি যুবপ্রজন্মের আগ্রহ, জাতীয় ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ইসলামপন্থীদের ক্রমবর্ধমান সফলতা, মুসলমানদের নিজস্ব সংস্কৃতিতে ফিরে যাওয়ার প্রচেষ্টা এবং নিজের ভাগ্যের ওপর সাম্রাজ্যবাদীদের কর্তৃত্ব খর্ব করার জন্য ইসলামি উম্মাহর এই জাগরণ ইমাম খোমেইনী (র.)-এর বৈপ্লবিক চিন্তার প্রভাব থেকেই হয়েছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই।
প্রবন্ধকার তাঁর প্রবন্ধে বলেন, ইমাম খোমেইনী (র.)-এর চিন্তাধারার প্রভাবের ব্যাপারে আলোচনা করতে হলে তাঁর সময়, পারিপার্শ্বিকতা ও প্রেক্ষিতকে বিবেচনায় আনতে হবে। দুনিয়ার এক প্রাচীন সভ্যতার দেশ ইরানে রয়েছে হাজার বছরের ইসলামি ঐতিহ্য। শেখ সাদী ও জালালউদ্দীন রুমীর মতো কবি-দার্শনিক মধ্যাপ্রাচ্য থেকে পূর্ব ইউরোপ এবং দক্ষিণ এশিয়াকে আালোকিত করে রেখেছেন শত শত বছর ধরে। ইরানেই জন্ম হয়েছে হাফিজ সিরাজী, ফেরদৌসী, ওমর খৈয়ামের মতো মহাকবি-চিন্তাবিদ। উপমহাদেশের আলেম সমাজ এখনো বিখ্যাত ইরানি কবিদের উদ্ধৃতি তাঁদের বয়ানে ব্যবহার করেন। ইমাম খোমেইনী সেই ঐতিহ্যেরই ধারক।
প্রবন্ধকার আরো বলেন, ইমাম খোমেইনী (র.) ইরানের মাটিতে বিপ্লব সফল করার পর দল, মত, মাজহাব, তরীকা নির্বিশেষে সকল মুসলমান ও সকল মানবতার কল্যাণচিন্তায় বিশ্বের নির্যাতিত জাতিসমূহের প্রতি তাঁর সমর্থন ব্যক্ত করেন। তিনি মুসলমানদের মধ্যে মাজহাবী ঐক্যের নিমিত্তে মহানবী (সা.)-এর জন্মমাস পবিত্র মাহে রবিউল আওয়ালের ১২ থেকে ১৭ তারিখ পর্যন্ত ঐক্য সপ্তাহ ঘোষণা করেন। মুসলমানদের প্রথম কিবলা বায়তুল মোকাদ্দাস বা আল-কুদসকে যায়নবাদী ইহুদি গোষ্ঠীর থাবা থেকে মুক্ত করার জন্য পবিত্র মাহে রমজানের বিদায়ী জুমা বা জুমাতুল বিদাকে আল-কুদস দিবস ঘোষণা করে সারা দুনিয়ার মুসলমানদের মধ্যে আল-কুদস মুক্তির চেতনার আগুন ছড়িয়ে দেন।
হুজ্জাতুল ইসলাম মোহাম্মদ আশরাফ উদ্দিন খান বলেন, ইরানের ইসলামি বিপ্লব নির্যাতিত মুসলমানদের মনে আশা সঞ্চার করেছে। ইমাম খোমেইনী (র.) মাহে রমজানের শেষ শুক্রবারকে আল কুদস দিবস ঘোষণা করে সারা দুনিয়ার মুসলমানদের মধ্যে ও বিশ্ব মানবতার মধ্যে আল কুদস মুক্তি চেতনার প্রেরণা ছড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি ফিলিস্তিনে হামাস ও লেবাননে হিজবুল্লাহ নামের এমন দুটি বাহিনী তৈরি করে দিয়েছেন যে, আক্রমণকারী জালিম যায়নবাদী ইসরাইলের ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছে।
ইরানে ইমাম খোমেইনী বিপ্লবের মাধ্যমে রাষ্ট্রগঠন করেছেন ইরানের জনগণকে সাথে নিয়ে। তিনি জোর করে কোনো কিছু চাপিয়ে দেন নি। যা কিছু করেছেন জনগণকে সাথে নিয়ে এবং তাদের সাথে পরামর্শ করেই। তিনি ইসলামি প্রজাতন্ত্র করেছেন এবং অভিভাবক হিসেবে বেলায়াতে ফকীহর নেতৃত্ব কায়েম করেছেন। ‘বেলায়াত’ শব্দের অর্থ অভিভাবকত্ব। ‘বেলায়াতে ফকীহ’ অর্থ ফিকাহশাস্ত্রবিদ আলেমদের অভিভাবকত্ব। কিন্তু ইরানে সংসদ রয়েছ্। জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকার রয়েছে। সেখানে ভোটের মাধ্যমে সরকার নির্বাচন হয় ও পরিবর্তন হয়। রাষ্ট্রের কার্যক্রম সংসদ পরিচালনা করে। জাতীয় পর্যায়ে কোনো সমস্যা দেখা দিলে রাহবার সেটির সমাধানে পরামর্শ দান করেন বা ইসলামি বিধানমতে ফতোয়া দেন। ইমাম খোমেইনী অপূর্ব একটি সমন্বয় ঘটিয়েছেন ইসলামের আধ্যাত্মিকতার সাথে প্রজাতন্ত্রের। ইমাম খোমেইনী (র.)-এর সুযোগ্য উত্তরসূরি রাহবার সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী ইমামের পথ ধরেই বিশ্ব মুসলিমের নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন।
জনাব রাশেদ আলম ভূঁইয়া বলেন, ইমাম খোমেইনী (র.) ছিলেন একজন প্রজ্ঞাবান ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ। যাঁর অন্তর ছিল আধ্যাত্মিক শক্তির আলোয় আলোকিত। তাঁর চিন্তা-চেতনা ও স্বপ্নকে তিনি সফল করে দেখিয়েছেন। ইরানের ইসলামি বিপ্লব ছিল এক স্বতন্ত্র বিপ্লব যা কোনো পরাশক্তির ইন্ধনে প্রতিষ্ঠিত হয় নি। কোনো জাগতিক শক্তির চিন্তাধারাকে বাস্তবায়নের দায়িত্ব নিয়ে তা আবির্ভূত হয় নি; বরং এটা খোদায়ী ইচ্ছার ফসল ছিল। ইমাম পাশ্চাত্য গণতন্ত্র কিংবা সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের চিন্তাধারায় কোনো পরিবর্তন সাধন করেন নি; বরং খোদায়ী ইচ্ছার বাস্তবায়ন ঘটিয়েছেন এবং খোদায়ী বিধানের আওতায় মানুষের জাগতিক সমস্যার সামাধানে সচেষ্ট হয়েছেন। তিনি মানুষের ওপর ইসলামকে জোর করে চাপিয়ে দেননি। জনগণকে সাথে নিয়েই ইসলামি সমাজ প্রতিষ্ঠা করেছেন। অনেকের কাছে ইসলাম মসজিদ, মাদ্রাসা বা খানকায় সীমাবদ্ধ একটি ধর্ম মাত্র। তাঁরা মনে করেন ইসলামে রাজনীতি, অর্থনীতি বা সংস্কৃতি নেই। রাজনীতি থেকে ধর্মকে আলাদা করার যে প্রবণতা স্যেকুলার গণতান্ত্রিকদের মাঝে দেখা যায় অথবা যা দেখা যায় সমাজতান্ত্রিকদের মাঝে তাদের চিন্তাচেতনাকে ভুল প্রমাণ করে ইমাম দেখিয়ে দিয়েছেন যে, ইসলাম কেবল ধর্মকেন্দ্রে আবদ্ধ থাকা নিছক কিছু আচার-আচরণ নয়। এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা।
সেমিনারে ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী অনূদিত ও ড কে. এম. সাইফুল ইসলাম খান সম্পাদিত ইমাম খোমেইনী (র.)-এর একটি বৃহৎ কাব্য সংকলন ‘দিওয়ানে ইমাম খোমেইনী (র.)’ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয়। সভায় ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের পক্ষ থেকে ইসলামি চিন্তাবিদ ও কবি ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদীকে বিশেষ সম্মাননা পত্র প্রদান করা হয়।
মোড়ক উন্মোচনের প্রাক্কালে ড. ঈসা শাহেদী তাঁর বক্তৃতায় বলেন, বস্তুত সমকালীন ইতিহাসের সর্বাধিক আলোচিত ইসলামি বিপ্লবের সফল নেতা হিসেবে বিশ্বব্যাপী ইমাম খোমেইনীর পরিচয় তিনি একজন রাজনৈতিক ও বিপ্লবী নেতা। তবে এটিই তাঁর একমাত্র পরিচয় নয়, প্রকৃতপক্ষে তিনি একজন ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক নেতা। কিন্তু ইমাম খোমেইনীর ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বাইরের দুনিয়া খুব কমই জানে। এর কারণ, তাঁর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিই সাধারণত ফারসি থেকে অনূদিত হয়ে বাইরে এসেছে। তদুপরি ইমাম খোমেইনীর আরেকটি পরিচয় ১৯৮৯ সালে ৮৮ বছর বয়সে তাঁর ইন্তিকালের আগ পর্যন্ত খোদ ইরানের মানুষও জানত না। সেটি হলো, তাঁর কবিত্ব। এই বইয়ের ভূমিকা ও তৎসঙ্গে তাঁর পুত্রবধূ ফাতেমার একটি পত্র পাঠ করলে বুঝা যাবে, কীভাবে এই রহস্যটি এতদিন গোপন ছিল এবং কীভাবে কবিত্ব ও কবিতা ইমাম খোমেইনীর নিত্যসঙ্গী ছিল। সুফিবাদের অতলান্তের এই ভাবধারাকে বাংলায় রূপান্তরিত করার দুরূহ কাজটি করতে পেরে আমি সত্যিই আনন্দিত।
কবিতার আসরে ইমাম খোমেইনীর পরিচয় তিনি একজন কবি। রাজনীতি, বিপ্লব ও যুদ্ধ এখানে অনুপস্থিত। তাঁর কবিতা পড়ে কেউ আঁচ করতে পারবে না, তিনি দুনিয়া কাঁপানো একটি সর্বাত্মক বিপ্লবের নেতা বা তিনি যখন কবিতা চর্চা করছেন তখন এক সর্বাত্মক প্রতিরোধ যুদ্ধের সর্বাধিনায়কের দায়িত্ব পালন করে চলেছেন।

◊ আমিন আল আসাদ

খুলনায় ইমাম খোমেইনী (র.)-এর মৃত্যুবার্ষিকী পালন

গত ০৪ জুন ইসলামী শিক্ষা কেন্দ্র ও আহলে বাইত (আ.) ফাউন্ডেশনের যৌথ আয়োজনে ইসলামী শিক্ষা কেন্দ্রের আল কাউছার সেমিনার কক্ষে ইসলামি বিপ্লবের মহান স্থপতি হযরত আয়াতুল্লাহ উজমা ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর ২৯তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে একটি আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন ইসলামি শিক্ষা কেন্দ্রের অধ্যক্ষ হুজ্জাতুল ইসলাম সৈয়দ ইব্রাহীম খলিল রাজাভী। অনুষ্ঠানে আলোচক হিসাবে উপস্থিত ছিলেন হুজ্জাতুল ইসলাম মোঃ আলী মোর্তজা, হুজ্জাতুল ইসলাম মোঃ আব্দুল লতিফ প্রমুখ।
অনুষ্ঠানে ‘একটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের সফল বিস্ফোরণ’ শিরোনামে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন হুজ্জাতুল ইসলাম মোঃ শহীদুল হক। তিনি তাঁর প্রবন্ধে ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর শৈশব, শিক্ষা ও ধর্মীয়-রাজনৈতিক জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো তুলে ধরেন।
হুজ্জাতুল ইসলাম মোঃ আব্দুল লতিফ বলেন, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বাক্যের দর্শনে আলোকিত ছিল হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর জীবন। ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর ধর্মীয় তথা রাজনৈতিক জীবনের প্রতিটি পদে পদে আমরা এই বাক্যটির বাস্তবায়ন দেখতে পাই। একমাত্র আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে তিনি ভয় পেতেন না যা ইসলামি বিপ্লবের প্রতিষ্ঠার পর থেকে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত তিনি দেখিয়ে গেছেন।
হুজ্জাতুল ইসলাম আলী মোর্তজা বলেন, ইমাম খোমেইনী (রহ.) ছিলেন যুগ-সচেতন ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। সমাজের ওপরে তাঁর প্রভাব কতখানি তিনি তাঁর বিপ্লবের মাধ্যমে তা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন।
হুজ্জাতুল ইসলাম সৈয়দ ইব্রাহীম খলীল রাজাভী ইমাম খোমেইনীকে আল্লাহর একজন ওলী হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেন, ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর বেলায়েতে ফকীহ অর্থাৎ ফকীহর নিরঙ্কুশ ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকার সম্পর্কিত ধারণাটি একটি অনন্যসাধারণ ঘটনা। কারণ, ইসলামি শাসনব্যবস্থায় ফকীহ বা সর্বোচ্চ আলেমের ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকার ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই। আর সে কারণেই হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ.) ইরানের বুকে একটি ইসলামি বিপ্লব প্রতিষ্ঠায় সফল হয়েছিলেন। বর্তমান বিশ্বে ওলীয়ে ফকীহ ও মারজাগণ ইসলামকে পৃথিবীর বুকে টিকিয়ে রেখেছেন।

আল কুদ্স দিবস উপলক্ষে সেমিরার ও মানব বন্ধন অনুষ্ঠিত
‘ফিলিস্তিনের সমস্য কেবল ফিলিস্তিনি বা মুসলমানদেরই নয়, বিশ্বমানবতার সমস্যা’- ইরানি রাষ্ট্রদূত

গত ৮ জুন ঢাকার বিএমএ মিলনায়তনে বিশ্ব আল-কুদ্স দিবস উপলক্ষে মুসলমানদের প্রথম কিবলা বায়তুল মুকাদ্দাস পুনরুদ্ধার ও ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রতি সমর্থন ও সংহতি প্রকাশ করে আল-কুদ্স কমিটি বাংলাদেশ-এর উদ্যোগে কমিটির সভাপতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহ কাউসার মুস্তাফা আবুল উলায়ীর সভাপতিত্বে এক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টি থেকে সাতক্ষীরা এক আসনে নির্বাচিত জাতীয় সংসদ সদস্য জনাব অ্যাডভোকেট লুৎফুল্লাহ এমপি। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের মাননীয় রাষ্ট্রদূত ড. আব্বাস ভায়েজী দেহনাভী এবং সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ ন ম মেশকাত উদ্দিন। স্বাগত ভাষণ দেন আল-কুদ্স কমিটি বাংলাদেশের সহ-সভাপতি বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী জনাব এ কে এম বদরুদ্দোজা। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিশিষ্ট সাংবাদিক ও দৈনিক আজকের ভোলার সম্পাদক অধ্যক্ষ মুহাম্মদ শওকাত হোসেন। আলোচনায় অংশ নেন মাসিক মদীনার সম্পাদক মাওলানা আহমদ বদরুদ্দীন খান ও বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ হুজ্জাতুল ইসলাম সাইয়্যেদ আফতাব হোসেন নাকাভী।
উল্লেখ্য যে, ১৯৭৯ সালে ইরানের ইসলামি বিপ্লবের পর বিপ্লবের মহান নেতা ইমাম খোমেইনী (র.) মুসলমানদের প্রথম কিবলা বাইতুল মুকাদ্দাস ইহুদিবাদী ইসরাইলের কবল থেকে পুনরুদ্ধার ও ফিলিস্তিনের মুসলিম গণমানুষের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সংহতি ও অকুণ্ঠ সমর্থন জ্ঞাপন করে বিশ্বমুসলমানদের মাঝে সচেতনতা জাগ্রত করার লক্ষ্যে রমযান মাসের শেষ শুক্রবার তথা পবিত্র জুমআতুল বিদাকে মহান আল-কুদ্স দিবস হিসেবে ঘোষণা করে দিবসটি একযোগে পালনের জন্যে সব দেশের মুসলমানদের প্রতি আহ্বান জানান। সেই থেকে আজ অবধি দিবসটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পালিত হয়ে আসছে। পালিত হয়ে আসছে বাংলাদেশেও।
সেমিনারের প্রধান অতিথির ভাষণে অ্যাডভোকেট লুৎফুল্লাহ এমপি ফিলিস্তিনি সংগ্রামীদের প্রতি সংহতি প্রকাশ ও লাল সালাম জানিয়ে বলেন, যেখানেই জুলুম-নির্যাতন, যেখানেই সাম্রাজ্যবাদের হিংস্র থাবা, যেখানেই মানবতার পতন সেখানেই আমরা আছি এবং আমরা থাকব। আজকে সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা আরব মুসলমান ও গণমানুষের ওপর জুলুম করছে। মানবিক ঐক্যের মাঝে ফাটল ধরিয়ে আরব ও মুসলিম সমাজকে বিভক্ত করে শোষণের রাজত্ব কায়েম করতে চায়। সেজন্যই তারা ইসরাইল নামের কঠিন অপশক্তির বীজ বপণ করেছে। ইহুদি-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী চেতনা যারা লালন করেন দল-মত নির্বিশেষে আমরা যদি ঐক্যবদ্ধ হতাম তবে পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদীরা দুনিয়ার কোথাও বিপর্যয় ঘটাতে পারত না। আমরা যদি ঐক্যবদ্ধভাবে এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হই তবেই আমাদের ভূখণ্ড, আমাদের অধিকার, আমাদের ধর্ম, সংস্কৃতি, আমাদের যা কিছু আছে সবই আমরা পুনরুদ্ধার করতে পারব।
সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক ড. শাহ কাউসার মুস্তাফা আবুল উলায়ী বলেন, ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা মুসলমানদের প্রথম কিবলা বায়তুল মুকাদ্দাসকে পুনরুদ্ধারের জন্য পবিত্র জুমআতুল বিদাকে আল-কুদ্স দিবস ঘোষণা করে দল-মত-মাজহাব-তরিকা নির্বিশেষে সকল মুসলমানকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। সেই প্রচেষ্টা তাঁর আহ্বানে সাড়া দেয়া মুসলমানরা এখনো অব্যাহত রেখেছে। আজকে প্রতি বছর মাহে রমযানের শেষ শুক্রবার সারা বিশ্বে দিবসটি একযোগে পালিত হচ্ছে। কিন্ত্র মুসলিম ঐক্য বিনষ্টকারীরা শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব তৈরির জন্য ষড়যন্ত্রমূলক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। আমাদেরকে যে কোনো মূল্যে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই। ফিলিস্তিনসহ যে কোনো দেশের মুসলমানই আমাদের ভাই-বোন। তাদের ওপর নির্মম নির্যাতন হচ্ছে, অথচ ফিলিস্তিনের পাশেরই কোনো কোনো দেশ ইসরাইলের সাথে সখ্য স্থাপন করে চলেছে। ন্যূনতম ইমান থাকলেও তো কোনো মুসলমান এটা করতে পারে না। তিনি আরো বলেন, বিশ্ব আল-কুদ্স দিবস পালনের মধ্য দিয়ে আল-কুদ্স মুক্তির বিপ্লবী আওয়াজ সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ছে।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে ড. আব্বাস ভায়েজী দেহনাভী বলেন, ৭০ বছর আগে একটি শয়তানি রাষ্ট্র ইসরাইল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। যায়নবাদী ইসরাইলের স্বপ্ন ছিল নীল থেকে ফোরাত পর্যন্ত বিস্তৃত এক ইহুদি রাজ কায়েম করা। কিন্তু প্রকৃত মুসলমানদের আত্মজাগৃতি ও হামাস ও হিজবুল্লাহর প্রতিরোধ সংগ্রামের ফলেই সেটা সম্ভব হয় নি। ফিলিস্তিনের মানুষ বছরের পর বছর ধরে নির্যাতিত। রাষ্ট্রদূত বলেন, ইসরাইল রাষ্ট্রটি মুসলিম বিশ্বে একটি ক্যান্সার সদৃশ্য। এর বিস্তৃতি ঘটেছে সাম্রাজ্যবাদীদের সহায়তায় যায়নবাদী ইহুদিদের দ্বারা। এ সমস্যা শুধু ফিলিস্তিনিদের সমস্যা নয়, গোটা মুসলিম উম্মাহর সমস্যা, বরং সমগ্র বিশ্ব মানবতার সমস্যা। এখানে মুসলিম গণমানুষের ওপর অমানবিক নির্যাতন হচ্ছে। কাজেই এটি কেবল ইসলামি ইস্যুই নয়, মানবিক ইস্যুও বটে। খ্রিস্ট সমাজের অনেক মানবতাবাদীও এর প্রতিবাদ করছে, এমনকি ইহুদিরাও যায়নবাদীদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। সেখানে নিষ্পাপ নারী, শিশু, যুবক, বৃদ্ধকে নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে। কিন্তু তাওরাত বা ইঞ্জিলের কোথাও নেই নির্দোষ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করতে হবে। এই নির্যাতনের বিরুদ্ধে গণসচেতনতা ও বিশ্বব্যাপী গণজোয়ার সৃষ্টির জন্যই ইমাম খোমেইনী (র.) মাহে রমযানের শেষ শুক্রবারকে কুদ্স দিবস ঘোষণা করেন। অনেক দেশ এটাকে স্বাগত জানায়। অনেক দেশের সরকার স্বাগত না জানালেও জনগণ এর সাথে একাত্ম হয়েছে। আবার অনেক মুসলিম দেশের শাসক কুদ্স দিবসের চেতনার সাথে একাত্ম না হয়ে আমেরিকা ও ইসরাইলকে সহযোগিতা করছে। সাম্রাজ্যবাদীরা ও তাদের সহযোগী এসব শাসক শিয়া-সুন্নি ইস্যু তুলে মুসলিম বিশ্বকে বিভক্ত করেছে ও করছে। তারা দায়েশ, আল-কায়দা ও তালেবান নামের সন্ত্রাসী তৈরি করে মুসলমানদের দিয়ে মুসলমানদের ধ্বংস করছে। এই বিভক্তির ফলে ইহুদিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদীরই লাভবান হচ্ছে। ইরানের ইসলামি বিপ্লবের পর ইমাম খোমেইনী (র.) শিয়া-সুন্নি সহ মুসলিম ঐক্যের জন্য নানাভাবে আহ্বান জানিয়েছেন। ইরানিরা জাতীয়-আন্তর্জাতিকভাবে সেসব চেষ্টা করে গেছে। অনেক সেমিনার, সিম্পোজিয়াম করেছে।
প্রকৃত অর্থেই মুসলমানরা যদি তাদের ঐক্যের প্রতীক কোরআনের পথে থাকত তবে নিজেদের মধ্যে এই হানাহানি বা বিভক্তি থাকত না। মাহে রমযান হচ্ছে কোরআনের মাস। আমাদেরকে কোরআনের পথে আসতে হবে। এ মাসে আমাদের রোযা, নামায, কিয়ামুল লাইল, তাসবিহ-তাহলিল, যিয়ারত ইত্যাদি সব ইবাদতের মাধ্যমে আত্মিক শক্তি অর্জন করতে হবে। আর নিজেরা ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। তবেই বাতিল, শয়তান ও শয়তানি শক্তি পরাজিত হবে।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে অধ্যাপক ড. আ ন ম মেশকাত উদ্দিন বলেন, ফিলিস্তিনের মুসলমানদের ওপর যে অত্যাচার চলছে একমাত্র মানবিক ঐক্যের জোয়ার দ্বারাই একে প্রতিহত করা সম্ভব। মুসলিম হোক, অমুসলিম হোক কোনো মানুষের প্রতিই কোনো প্রকার অত্যাচার মেনে নেয়া যায় না। ইসরাইলের প্রধান মদদদাতা হচ্ছে আমেরিকা। এর পর রয়েছে ব্রিটেন ও ফ্রান্স। শুধু ফিলিস্তিনেই নয়, মিয়ামনার, ইয়ামেন, ইরাক, আফগানিস্তান, কাশ্মিব, চেচনিয়া, সিরিয়া সবখানেই মুসলমানরা নানা বিপর্যয়ের সম্মুখীন। একসময় বসনিয়ায় নির্যাতন হয়েছে। ফিলিস্তিনে সত্তর বছর যাবৎ হত্যা-নির্যাতন চলছে। বিরতিহীনভাবে চলছে এই নির্যাতন। ইমাম খোমেইনী (র.) বিশ্ব আল-কুদ্স দিবস ঘোষণা করে মুসলমানদের জন্য একটি ঐক্যের প্লাটফর্ম তৈরি করে দিয়েছেন। দুনিয়ার মুসলমানদের কাছে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। মুসলিম দেশসমূহকে তিনি ঐক্যের আহ্বান জানিয়ে গেছেন। সেই আহ্বানকে স্বাগত জানিয়ে আমাদেরকে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে দাঁড়াতে হবে। আর ইসলামি ঐক্যের সাথে সাথে প্রকৃত সমস্যাকে চিহ্নিত করতে হবে। আমাদেরকে বৈজ্ঞানিক ও সামরিক শক্তিতে যেমন বলিয়ান হয়ে তাদেরকে প্রতিহত করতে হবে তেমনি বুদ্ধিবৃত্তিকভাবেও প্রতিহত করার যোগ্যতা অর্জন করতে হবে।
মাসিক মদীনা সম্পাদক আরবের কবি আহমদ শাওকির একটি লাইন উদ্ধৃত করে এর অর্থ করেন যে, ‘আল-কুদ্স মুসলমানের কেবল রাষ্ট্রীয় সম্পদই শুধু নয়, আল-কুদ্স হচ্ছে মুসলমানদের ঈমানের স্তম্ভ। মুসলমানের ঈমান এবং অস্তিত্বের জন্য মক্কা, মদীনা এবং আল-কুদ্স অবিনাশী অংশরূপে অপরিহার্য। এর কোনো একটি মুসলমানের হাতছাড়া হয়ে গেলে মুসলমানদের বিপর্যয়ের সীমা থাকবে না।’
তিনি বলেন, ইহুদিরা হচ্ছে সেই অভিশপ্ত জাতি যারা তাদের নবীদেরকে হত্যা করেছে। যারা আল্লাহকে গালি দেয়। আর যারা তাদের ধর্মগ্রন্থকে বিকৃত করেছে। তারা বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে পৃথিবীতে বড় বড় বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। একথা কোরআনেও রয়েছে। এই সব ইহুদির অনেক দিনের স্বপ্ন যে বায়তুল মুকাদ্দাস ভেঙে তারা হায়কলে সোলায়মানী বানাবে। তাই তারা এখন আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স-এর সহযোগিতা প্রাপ্তির সাথে সাথে মুসলিম বিশ্বের কিছু ভোগবাদীর রাজা-বাদশাদেরকেও হাত করে ফেলেছে। এই গণবিচ্ছিন রাজা-বাদশাহরা তাদের ক্ষমতার স্বার্থে ইহুদিদের সাথে হাত মিলিয়েছে। ইহুদিদের ব্যাপারে ইসলামের অনেক মনীষী মুসলমানদেরকে সাবধান করে দিয়েছেন। কোরআনেও বলা হয়েছে, তোমরা ইহুদি-নাসারাদেরকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করো না। মোজাদ্দেদে আলফেসানী (র.) তাঁর লেখায় ও শাহ নেয়ামতউল্লাহ কাশ্মিরি (র.) তাঁর ভবিষ্যদ্বাণীতে উল্লেখ করেছেন ইহুদিদের নৃশংসতা ও বর্বরতার কথা। তাঁরা বলেছেন যে, মুসলমানরা যদি নিজেদেরকে ইহুদিতে পরিণতও করে তবু তারা ইহুদি ষড়যন্ত্র থেকে বাঁচতে পারবে না।
হুজ্জাতুল ইসলাম সাইয়্যেদ আফতাব হোসেন নাকাভী বলেন, সত্তর বছর যাবৎ ফিলিস্তিনিরা নির্যাতিত হলেও ইনশাআল্লাহ এই নির্যাতনের দিন অচিরেই শেষ হয়ে যাবে। সারা দুনিয়ায় একটি জাগরণ সৃষ্টি হয়েছে। ইমাম খোমেইনী (র.)-এর নেতৃত্বে আল-কুদ্সের ঘোষণার পর সেটি বিশ্বের মুসলমানরা গ্রহণ করেছে। এখন আমাদের শুধু দরকার কয়েকটি বিষয়ে মনোযোগ দেয়ার। মুসলমানদের মধ্যে ঐক্যের প্রতিবন্ধক সকল বিষয় দূর করতে হবে। মুসলমানদের মাঝে সঠিক দ্বীনী চেতনা যা আহলে বাইতের মাঝে ছিল সেটার প্রচার ও প্রসার ঘটাতে হবে। তরুণদেরকে সজাগ করতে হবে ও তাদেরকে দ্বীনী বিষয়ে আগ্রহী করতে হবে যাতে অপসংস্কৃতি তাদেরকে গ্রাস করতে না পারে। তাদেরকে মুসলমানদের প্রকৃত ইতিহাস শেখাতে হবে ও তাদের ভৌগোলিক, ঐতিহ্যিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয় তাদের সামনে তুলে ধরতে হবে। ফিলিস্তিন, মিয়ামনারসহ যে কোনো জায়গায় মুসলমানরা নির্যাতিত হলে তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে ও তাদের প্রতি অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকে বুলন্দ করতে হবে।
স্বাগত ভাষণে জনাব এ কে এম বদরুদ্দোজা বলেন, ইসরাইল কর্তৃক ফিলিস্তিনি গণহত্যা যেন আজ সেখানকার জনগণের নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিদিন সেখানে কোনো না কোনো স্থানে মুসলমানদের হত্যা করা হচ্ছে। যেমনিভাবে বিশ্বের নানা স্থানে মুসলমানদেরকে হত্যা করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, ইমাম খোমেইনী (র.)-কর্তৃক আল-কুদ্স দিবসের যুগান্তকারী ঘোষণা বিশ্বে সত্যিকার অর্থেই একটা প্রভাব ফেলেছে। যত নির্যাতনই চালাক না কেন ইহুদি যায়নবাদী ইসরাইল নৈতিকভাবে পরাজিতই হচ্ছে। এর বাস্তব প্রমাণ হলো সাম্প্রতিক সময়ে আর্জেন্টিনা ফুটবল টিম কর্তৃক ইসরাইলি টিমের সাথে প্রীতি ফুটবল ম্যাচকে বয়কট করে দেয়া। শুধু মুসলমানই নয়, ফিলিস্তিনি মানবতার ওপর ইসরাইলি বর্বরতা সকল মানবতাবাদী মানুষেরই ঘৃণা কুড়িয়েছে। আর ইমামের ঘোষিত আল-কুদ্স দিবস সারা বিশ্বে সত্যিকার অর্থেই একটা জাগরণ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। তাই নেতানিয়াহুর টেলিফোনে অনুরোধ সত্ত্বেও আর্জেন্টিনা টিম লিডার মেসি সহ পুরো দলের মন গলানো যায় নি। কারণ, এর ভেতর এক ইসরাইলি রাজনৈতিক প্রতারণা লুক্কায়িত ছিল, তা তারা বুঝতে পেরেছে।
তিনি বলেন, আজকে ট্রাম্প-এর প্রচেষ্টায় জেরুজালেমে ইসরাইলের রাজধানী স্থাপনের চেষ্টায় একটা ধাক্কা খেয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের কেউ জেরুজালেমে তাদের দূতাবাস স্থানান্তর করে নি। পৃথিবীর মানবতাবাদীরা বিবেকের বিচারের ডাকে সাড়া দিয়েছে। সেটি এই আল-কুদ্সের চেতনা সম্প্রসারণেরই ফল।
অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন লেখক গবেষক অধ্যাপক ড মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান। পবিত্র কালামে পাক থেকে তেলাওয়াত করেন ক্বারী সাইয়্যেদ মোহাম্মদ রেজা রাজাভী। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘আল্লাতে যার পূর্ণ ঈমান কোথা সে মুসলমান’ শীর্ষক ঈমানী চেতনা জাগানিয়া গানটি গেয়ে শোনান রেডিও তেহরানের সাবেক সংবাদ পাঠক, কবি ছড়াকার ও মর্সিয়া লেখক জনাব শাহনেওয়াজ তাবিব।
সেমিনারের আগে জুমআর নামাযের পর জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে আল-কুদ্স দিবস উপলক্ষে মানবতার দুশমন ইহুদিবাদী ইসরাইলি বর্বরতার প্রতিবাদ করে ও ফিলিস্তিনি জনতার সংগ্রামের প্রতি সংহতি প্রকাশ করে এক মানব বন্ধন কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন আজকের ভোলা সম্পাদক অধ্যক্ষ মুহাম্মদ শওকাত হোসাইন। মানববন্ধনে বক্তৃতা দেন আল-কুদ্স কমিটি বাংলাদেশের সেক্রেটারি জেনারেল মোস্তফা তারেকুল হাসান, মাওলানা শাখাওয়াত হোসেন, জনাব আবু বকর সিদ্দিক, কবি আমিন আল আসাদ ও মাওলানা মুহিবুল্লাহ প্রমুখ।

আমিন আল আসাদ

খুলনায় আল-কুদস দিবস পালিত

আন্তর্জাতিক আল-কুদ্স দিবস উপলক্ষে আঞ্জুমান-এ-পাঞ্জাতানী ও আহলে বাইত (আ.) ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে গত ৮ জুন বাদ জুমা’ নগরীর আঞ্জুমান-এ-পাঞ্জাতানী ইমামবাড়ী হতে এক বিক্ষোভ র‌্যালী বের হয়ে নগরীর আলতাপোল লেন ও সাউথ সেন্ট্রাল রোড প্রদক্ষিণ করে কেন্দ্রে এসে শেষ হয়। র‌্যালীতে ইসরাইলের পতাকা পুড়িয়ে ইহুদিবাদী অত্যাচারী রাষ্ট্রের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করা হয়।
র‌্যালী শেষে সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে ইসলামী শিক্ষা কেন্দ্রের অধ্যক্ষ হুজ্জাতুল ইসলাম সৈয়দ ইব্রাহীম খলিল রাজাভী বলেন, বিশ্বজুড়ে মুসলমানদের ওপরে যে বর্বর অত্যাচার জুলুম নেমে এসেছে সে প্রেক্ষাপটে আজ মুসলমানদের মধ্যে সকল বিভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধভাবে ইসলামের শত্রুদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। বিশ্ব আল-কুদস দিবস পালন করার উদ্দেশ্য হল ফিলিস্তিনিদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করা এবং এটা বোঝানো যে আমরাও তাদের সাথে আছি। সেখানে যে ষড়যন্ত্র চলছে তার স্বরূপটি হলো সিরিয়া ও ইরাকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে মুসলমানদেরকে উস্কানি দিয়ে বিরোধ সৃষ্টি করে তাদেরকে ব্যস্ত রেখে ফিলিস্তিনিদের ওপর হামলা চালানো।

স্মরণীয় দিবস

 

১ মে : আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস।
২ মে : আধুনিক বিশ্বে ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ের অন্যতম প্রধান তাত্ত্বিক ও বিশ্লেষক অধ্যাপক আয়াতুল্লাহ মোর্তজা মোতাহ্্হারীর শাহাদাত দিবস। এটি ইরানে শিক্ষক দিবস হিসেবে পালিত হয়।
৮ মে : আন্তর্জাতিক রেডক্রস ও রেডক্রিসেন্ট দিবস। ইরানে ১৯৪৯ সালের এ দিনে আজকের রেডক্রিসেন্টের ভিত্তি স্থাপন করা হয়।
১৫ মে : মহাকবি ফেরদৌসি স্মরণে দিবস। আবুল কাসেম ফেরদৌসি ৩২৯ হিজরিতে ইরানের তূস নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। ইরানে ফারসি ভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়।
১৭ মে : দার্শনিক ও কবি ওমর খৈয়াম স্মরণে দিবস। হাকিম আবুল ফাতাহ ওমর বিন ইবরাহীম খৈয়াম নিশাবুরী ছিলেন পঞ্চম শতাব্দীর শেষ ও ষষ্ঠ শতাব্দীর প্রথম দিকের দার্শনিক, গণিতবিদ ও কবি।
২২ মে : প্রখ্যাত দার্শনিক মোল্লা সাদরা স্মরণে দিবস।
২৫ মে : (১১ জ্যৈষ্ঠ) বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মবার্ষিকী।
৩১ মে : ইমাম হাসান (আ.)-এর জন্মদিবস।
৪ জুন : ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা ও ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রতিষ্ঠাতা হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর মৃত্যুবার্ষিকী এবং আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ীর নেতৃত্ব (রাহবারি) শুরু হয়।
৬ জুন : আমীরুল মুমিনীন ইমাম আলী (আ.)-এর শাহাদাত দিবস।
৮ জুন : আন্তর্জাতিক আল-কুদ্্স দিবস।
১০ জুন : ইরানে হস্তশিল্প দিবস হিসেবে পালিত হয়।
১৬ জুন : ঈদুল ফিত্র।
১৯ জুন : আধুনিক ইরানের প্রখ্যাত চিন্তাবিদ ড. আলী শরীয়তী ১৩১২ ফারসি সালে খোরাসান শহরে জন্মগ্রহণ করেন।
২১ জুন : ইরানের প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ড. মোস্তফা চামরানের শাহাদাত দিবস।
২৬ জুন : আন্তর্জাতিক মাদক নিয়ন্ত্রণ ও মাদক চোরাচালান প্রতিরোধ দিবস।
* উম্মুল মুমিনীন হযরত খাদীজাতুল কুবরা (আ.)-এর ওফাত দিবস।
২৮ জুন : আয়াতুল্লাহ বেহেশতীসহ ইসলামি বিপ্লবের নেতৃস্থানীয় আরো ৭২ ব্যক্তির শাহাদাত দিবস। বিপ্লববিরোধী মুজাহেদীনে খাল্্ক কর্তৃক বোমা হামলায় তাঁরা শহীদ হন।
২৯ জুন : রাসায়নিক অস্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম দিবস।

স্মরণীয় বাণী

 

মহানবী (সা.) বলেন : আমার উম্মতের মধ্যে যে দিনাতিপাত করে আর তার উদ্দেশ্য থাকে আল্লাহ্ ভিন্ন অন্য কিছু, সে আল্লাহ্র থেকে (রহমত ও সাহায্যপ্রাপ্ত) নয়। আর যে মুসলমানদের সমস্যার ব্যাপারে গুরুত্ব দেয় না সে তাদের অন্তর্ভুক্ত নয়। আর যে সাগ্রহে অপমান মাথা পেতে নেয় সে আমাদের আহলে বাইত থেকে (আহলে বাইতের অনুসারীদের মধ্যে গণ্য) নয়।
মহানবী (সা.) বলেন : জেনে রাখ, আমার উম্মতের মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট হলো তারা যাদেরকে অনিষ্টতার ভয়ে (অনিষ্টতা থেকে বাঁচার জন্য) সম্মান করা হয়। আর সাবধান! যে মানুষের অনিষ্টতার ভয়ে তাকে সম্মান করে সে আমার থেকে নয়।
মহানবী (সা.) বলেন : কোনো উত্তম কাজকেই লোকদেখানোর উদ্দেশ্যে করো না আর লজ্জার বশে তা পরিত্যাগ করো না।
মহানবী (সা.) বলেন : মুমিনের আপাদমস্তক সম্মানীয় : তার সম্ভ্রম, তার ধন-সম্পদ এবং তার রক্ত।
মহানবী (সা.) বলেন : পরস্পর করমর্দন কর। কারণ, করমর্দন (পারস্পরিক) বিদ্বেষ দূর করে।
ইমাম আলী (আ.) বলেন : নামায হলো প্রত্যেক পরহেজগারের জন্য নৈকট্যের উপকরণ। হজ হলো প্রত্যেক অসামর্থ্যরে জন্য জিহাদস্বরূপ। সবকিছুরই যাকাত রয়েছে, আর শরীরের যাকাত হলো রোযা। ব্যক্তির জন্য সর্বোত্তম কাজ হলো আল্লাহ্্র উদ্দেশ্যে মুক্তি কামনায় অপেক্ষা করা। যে ব্যক্তি দোয়া করে কিন্তু আমল করে না, সে হলো সেই ব্যক্তির ন্যায়, যে ধনুকের ছিলা ছাড়া তীর নিক্ষেপ করে। যে ব্যক্তি নিশ্চিত বিশ্বাস রাখে যে, প্রতিদান লাভ করবে, সে দান করে। সাদাকাহ প্রদানের মাধ্যমে জীবিকা কামনা কর। যাকাত পরিশোধের মাধ্যমে স্বীয় ধনকে বীমা কর।
ইমাম আলী (আ.) বলেন : যে আল্লাহ্্র ইবাদাত কর তাঁর মারেফাত (পরিচয় জ্ঞান)-কে মনের মধ্যে স্থান দিবে যাতে তোমাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের দ্বারা ইবাদত তোমাদের জন্য ফলদায়ক হয়।
এক ব্যক্তি যে দুনিয়াবিমুখতা ও কৃচ্ছ্রতার সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল তাকে ইমাম (আ.) বলেন : হে অমুক! তুমি কি আল্লাহ্্র এ কথা শোননি যে, তিনি বলেন : ‘আর তোমার প্রতিপালকের নেয়ামতের ব্যাপারে আলোচনা কর।’ (সূরা দুহা : ১১) আল্লাহ্্র শপথ! আল্লাহ্্র নেয়ামতকে কাজের মাধ্যমে প্রচার করা জিহ্বা দ্বারা প্রচারের চেয়ে শ্রেয়তর।
ইমাম আলী (আ.) বলেন : যে বান্দা আশাকে দীর্ঘায়িত করে সে পরকালকে ভুলে যায়।
ইমাম আলী (আ.) বলেন : মৃত্যুবরণ, তবুও লাঞ্ছনা নয় এবং আত্মসংযম, তবুও আত্মপরাজয় ও নতজানুতা নয়। আর জীবন দুই দিনের : সুখের আর দুঃখের। সুতরাং তোমার সুখের দিনে উন্মাদনা কর না আর দুঃখের দিনে মন খারাপ কর না। কারণ, এ উভয় অবস্থাতেই তুমি পরীক্ষার মধ্যে রয়েছ।
ইমাম হাসান (আ.) বলেন : হাতের চেয়ে কোনো কিছুই দেহের নিকটবর্তী নয়। আর নিশ্চয় এ হাতই কখনও কখনও ভেঙে যায় এবং পচে নষ্ট হয়ে যায় ফলে তা কেটে ফেলতে এবং বিচ্ছিন্ন করতে হয়।
ইমাম হাসান (আ.) বলেন : যে ব্যক্তি আস্থা রাখে যে, আল্লাহ্্ তার জন্য যা কিছু করেন সেটা ভালো, সে আল্লাহ্্ তার জন্য যা নির্বাচিত করেছেন সে অবস্থার বাইরে থাকার আশা করে না।
ইমাম হোসাইন (আ.) বলেন : নিশ্চয় মুমিন ব্যক্তি আল্লাহ্্কে নিজের সংরক্ষক গণ্য করে আর তার কথাবার্তাকে নিজের দর্পণ হিসাবে। একবার মুমিনদের গুণ বিশেষণের দিকে তাকায়, আরেকবার স্বেচ্ছাচারীদের বিশেষণের দিকে তাকায়। সুতরাং সে এ দিক থেকে (কোরআনের) সূক্ষ্ম ও আকর্ষণীয় এক বৈশিষ্ট্যের অন্তর্ভুক্ত এবং নিজেকে চেনার ক্ষেত্রে সফল হয়েছে এবং স্বীয় বিচক্ষণতার দ্বারা নিশ্চিত বিশ্বাসের পর্যায়ে পৌঁছেছে এবং নিজের পবিত্রতার মাধ্যমে আস্থা অর্জন করেছে।
ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.) বলেন : আল্লাহ্্র এমন বিচার যা বান্দার নিকট অপছন্দনীয়, বান্দা তাতে সন্তুষ্ট থাকা হলো ইয়াকীনের সর্বোচ্চ স্তর।
(তুহাফুল উকূল থেকে সংকলিত)
অনুবাদ : আব্দুল কুদ্দুস বাদশা