All posts by dreamboy

জ্ঞান-বিজ্ঞানে ইরানের সাফল্য

সাইদুল ইসলাম
‘তাভনা’ বুভাদ, হার কি দনা’, বুভাদ’ অর্থাৎ ‘সেই শক্তিশালী যে জ্ঞানী’। ১০০০ বছরেরও বেশি সময় আগে বিখ্যাত এই উক্তিটি করেছিলেন বিশ্বখ্যাত ইরানি কবি ও সাহিত্যিক ফেরদৌসি। যাঁরা এই উক্তিটি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেছেন এবং সেই অনুযায়ী কাজ করেছেন তাঁরাই সফলকাম হয়েছেন। আর যাঁরা মনে করেছেন জোর যার মল্লুক তার বা যে বিত্তশালী সেই শক্তিশালী তাদের অনেকেই ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন। আর সেকারণেই আজ যাঁরা বিশ্বে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে চান তাঁদের সবাই ছুটছেন জ্ঞানের সন্ধানে। কারণ, জ্ঞান-বিজ্ঞান ছাড়া আজকের বিশ্বে নেতৃত্ব তো দূরের কথা সবার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলাও অসম্ভব।
একটি দেশ তথা জাতির উন্নয়নের প্রধান চালিকাশক্তি হচ্ছে জ্ঞান-বিজ্ঞান। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে যে জাতি যত বেশি এগিয়ে সে জাতি তত উন্নত। বলা হয়ে থাকে, জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ কোন জাতি যেকোন সময় যে কোন কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে সক্ষম। আর এ বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব দিয়েই ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতার নির্দেশে দেশটির বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদরা চরম আত্মত্যাগ ও সাধনার মাধ্যমে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অভাবনীয় সাফল্যের স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। বিশেষ করে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে ইরানের অগ্রগতি আজ সবার নজরে এসেছে। বিজ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রে ইরানের বিজ্ঞানীদের অগ্রগতি সমগ্র বিশ্বের বিজ্ঞানীদের গড় অগ্রগতির চেয়ে ১১ গুণ দ্রুততর (ঋধংঃবংঃ)। ইরানের বিজ্ঞান, গবেষণা ও প্রযুক্তি বিষয়ক মন্ত্রী বলেছেন, সর্ব-সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিশ্বে বৈজ্ঞানিক গবেষণার দ্রুত অগ্রগতি বা প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে ইরান শীর্ষ স্থানে রয়েছে। মন্ত্রী বলেন, বৈজ্ঞানিক প্রবৃদ্ধির ধারা বজায় রেখেছে এমন ২৫টি দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ইরান ১৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের মাধ্যমে এক্ষেত্রে শীর্ষ স্থানে রয়েছে। আর এক্ষেত্রে রাশিয়া দ্বিতীয় ও চীন রয়েছে তৃতীয় স্থানে। বিগত এক বছরে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে ইরান যেসব সাফল্য অর্জন করেছে তা নিয়ে সম্প্রতি একটি বই প্রকাশিত হয়েছে। ইরানের প্রেসিডেন্ট কার্যালয়ের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দপ্তর বইটি প্রকাশ করে। এতে গত এক বছরে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইরান যেসব অর্জন করেছে তা বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
বইটির নাম ‘সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ইন ইরান: এ ব্রিফ রিভিউ’। এতে ২০১৭ সালে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইরানের অর্জনগুলো পাঠকদের জন্য বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়।
বইটি শুরু করা হয়েছে ইরানের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ইতিহাস দিয়ে। এরপরেই বইটিতে বর্ণনা করা হয়েছে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনে ইরানের জাতীয় নীতি। প্রথম অধ্যায়ে বৈজ্ঞানিক প্রকাশনার দিক দিয়ে বিশ্বে ইরানের অবস্থান উল্লেখ করা হয়। পাশাপাশি দেশটির সর্বশেষ বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত পরিসংখ্যানের ওপর একটি পর্যালোচনা তুলে ধরা হয়।
বইয়ের দ্বিতীয় অধ্যায়ে ন্যানো প্রযুক্তি, জৈবপ্রযুক্তি, স্টেম সেল প্রযুক্তি, জ্ঞানীয় বিজ্ঞান, ওষুধি উদ্ভিদ এবং ঐতিহ্যগত ওষুধ এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিসহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ১৩টি ক্ষেত্রের সুনির্দিষ্ট তথ্য, উপাত্ত ও পরিসংখ্যান উল্লেখ করা হয়েছে।
এছাড়া ‘সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ইন ইরান : এ ব্রিফ রিভিউ’তে সাংস্কৃতিক ও সৃজনশীল শিল্প, মহাকাশ, বিমানচালনা প্রযুক্তি, সামুদ্রিক শিল্প, পানি, খরা, ক্ষয় এবং পরিবেশগত প্রযুক্তি, প্রচলিত জ্বালানি (তেল ও গ্যাস) এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির মতো বিজ্ঞানের অন্যান্য ক্ষেত্রগুলোও তুলে ধরা হয়েছে। বইটির প্রতিটি অধ্যায় পাঁচটি অংশে বিভক্ত করা হয়েছে। তা হলো ইতিহাস ও পটভূমি, লক্ষ্য উদ্দেশ্য ও কলাকৌশল, ধারণ ক্ষমতা ও সক্ষমতা, অথোরিটিজ এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা।
বইটির শুরুতে এক নজরে ইরানের বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনে অর্জনগুলো তুলে ধরা হয়েছে। এতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দেশটিতে অধ্যয়নরত ছাত্রছাত্রী, স্নাতক ও পিএইচডি ডিগ্রিধারীদের তালিকা উল্লেখ করা হয়েছে। এতে দেখা যায়, ২০০৫-৬ শিক্ষাবর্ষে ইরানে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ছাত্রছাত্রী ছিল ২৩ লাখ ৮৯ হাজার ৮৬৭ জন। ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে এটা বেড়ে দাঁড়ায় ৮৪ লাখ ১১ হাজার ৫৮১ জনে। ২০০৫-৬ শিক্ষাবর্ষে স্নাতকধারীর সংখ্যা ছিল ৩ লাখ ৪০ হাজার ২৪৬ জন, ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৭ লাখ ৩৮ হাজার ২৬০ জনে। এসময়ে পিএইচডি ছাত্রছাত্রী ১৯ হাজার ২৩৭ জন থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৬৬ হাজার ৩২৪ জনে।
২০০৫ সালে মধ্যপ্রাচ্যে বৈজ্ঞানিক প্রকাশনায় ইরানের অবদান ছিল ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ। ২০১৪-১৫ সালে অবদান বেড়ে দাঁড়ায় ২৮ দশমিক ৬ শতাংশ। ২০০৫ সালে বৈজ্ঞানিক প্রকাশনায় মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের অবস্থান ছিল তৃতীয়তম, সেখানে ২০১৪-১৫ সালে একেবারে শীর্ষ স্থান দখল করেছে দেশটি।
ইরানের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে ১৫৪টি, পাবলিক মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে ৫৮টি, বেসরকারি ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় ৫৬৭টি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে ৩৫৪টি। এরমধ্যে বিশ্ব সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তালিকায় রয়েছে ইরানের ২৪টি বিশ্ববিদ্যালয়। ইনফরমেশন সায়েন্স ইনস্টিটিউটের (আইএসআই) এক জরিপে এ তথ্য জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বিশ্বের সবচেয়ে কার্যকর শিক্ষা কেন্দ্র ও প্রতিষ্ঠানের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে ইরানের ২৪টি বিশ্ববিদ্যালয়। এর মধ্যে তেহরান মেডিকেল সায়েন্স ইউনিভার্সিটি, ইরান পলিমার অ্যান্ড পেট্রোকেমিকেল ইনস্টিটিউট, তেহরান বিশ্ববিদ্যালয় ও আমির কবির ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি অন্যতম।
ইরানে ২০১৪ সালে জ্ঞানভিত্তিক ফার্ম ছিল ৫২টি, ২০১৭ সালের মে পর্যন্ত তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩০৩২টিতে। এসব কোম্পানিতে ৯০ হাজার ব্যক্তির কর্মসংস্থান হয়েছে, রাজস্ব আদায় হয়েছে ৯ দশমিক ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
ইরানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি পার্কের সংখ্যাও উল্লেযোগ্যভাবে বেড়েছে। ২০০২ সালে যেখানে মাত্র ১টি পার্ক ছিল এখন সেখানে রয়েছে ৩৯টি।
ইরানের প্রযুক্তিভিত্তিক রপ্তানিও বেড়েছে। ২০০৪ সালে দেড় বিলিয়ন ডলার প্রযুক্তিভিত্তিক রপ্তানি হয়েছে দেশটির, ২০০৯ সালে সেখানে হয়েছে ৭ বিলিয়ন ডলার ও ২০১৪ সালে হয়েছে ১২ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি পার্কের মাধ্যমে জ্ঞানভিত্তিক পণ্য সামগ্রীর রপ্তানি বেড়েছে। ২০১৩ সালে যেখানে ৪৯ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারের এসব পণ্য রপ্তানি হয়েছে, ২০১৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫০ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারে।
এদিকে, তেহরান টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বে ন্যানো প্রযুক্তিতে দক্ষিণ কোরিয়া, জার্মানি, জাপান ও ফ্রান্সের মতো দেশকে টপকিয়ে ৪র্থ স্থান দখল করেছে ইরান। এই খাতে ৮ হাজার ৭৯১টি আর্টিকেল প্রকাশ করে দেশটি এই অবস্থান অর্জন করে। এই র‌্যাঙ্কিং প্রকাশ করেছে ওয়েব সায়েন্স। এই তালিকায় চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত যথাক্রমে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে।
বৈজ্ঞানিক উৎপাদনে সম্প্রতি ১৮ ধাপ উপরে উঠে এসেছে ইরান। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক র‌্যাঙ্কিংয়ে ইরানের অবস্থান যেখানে ছিল ৩৪, সেখান থেকে উন্নতি লাভ করে বর্তমানে ১৬তম অবস্থানে উঠে এসেছে দেশটি। ইরান-ইউরোপ সহযোগিতা বিষয়ক দ্বিতীয় কনফারেন্সে এ কথা জানান ইরানের প্রযুক্তি বিষয়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট সোরেনা সাত্তারি।
ব্রাসেলসে অনুষ্ঠিত সেকেন্ড ইন্টারন্যাশনাল ইরান-ইউরোপ ইকোনোমিক অ্যান্ড টেকনোলজি কনফারেন্সে বক্তৃতাকালে সাত্তারি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইরানের বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত অর্জনগুলো তুলে ধরেন।
গত ২১ জুন শুরু হওয়া দু’দিনব্যাপী এই কনফারেন্সের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন ইরানের প্রযুক্তি বিষয়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট। এসময় তিনি জানান, পশ্চিম এশিয়ায় বৈজ্ঞানিক উৎপাদনে ইরান প্রথম স্থানে রয়েছে।
সাত্তারি বলেন, ইরান জৈবপ্রযুক্তি, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, ন্যানোপ্রযুক্তি এবং স্টেম কোষ সম্পর্কিত গবেষণায় বিশাল অগ্রগতি লাভ করেছে। অন্যদিকে জৈব ওষুধ উৎপাদনে মধ্যপ্রাচ্যে ইরান সবার শীর্ষে রয়েছে বলে জানান তিনি।
সাত্তারি আরও বলেন, বিশ্বের সর্বাপেক্ষা সফল জৈবপ্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর মধ্যে ইরানের জৈবপ্রযুক্তি কোম্পানি অন্যতম। কোম্পানিটির রয়েছে তরুণ ও দক্ষ কর্মকর্তা-কর্মচারী, যাঁদের গড় বয়স ৩৩ বছর। বিশ্বের দশটি দেশে কোম্পানিটি জৈব ওষুধ রপ্তানি করে বলে জানান তিনি।
মুসলিম বিশ্বে বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্রের মানের দিক দিয়ে শীর্ষে রয়েছে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান। গত দশ বছরে দেশটির বিভিন্ন গবেষণাপত্র আন্তর্জাতিকভাবে ১৭ লাখ ৭০ হাজারের অধিক বার উদ্ধৃত করা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র উদ্ধৃতের তালিকায় শীর্ষে উঠে এসেছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশটি।
বিশ্বব্যাপী বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্রের গুণাগুণ বিচার ও জরিপ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান এসেনশিয়াল সায়েন্স ইনডিকেটরসের (ইএসআই) র‌্যাঙ্কিংয়ে এই চিত্র দেখা গেছে। এ তথ্য জানিয়েছেন আইএসসির পরিচালক মোহাম্মাদ জাভেদ দেহকানি।
বিজ্ঞান ও প্রকৌশল গ্রাজুয়েটদের তালিকায় ইরান বিশ্বে দ্বিতীয়। গ্লোবাল ইনোভেশন ইনডেক্স ২০১৬ অনুযায়ী ইরান ১২৮টি দেশের মধ্যে বিজ্ঞান ও প্রকৌশল গ্রাজুয়েটদের তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। আর মেধা বিকাশে ইরান রয়েছে ২৬তম স্থানে।
তেহরানে অবস্থিত জাতিসংঘের তথ্য কেন্দ্র জানিয়েছে, করনেল ইউনিভার্সিটি, আইএনএসইএডি বিজনেস স্কুল এবং দি ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি অর্গানাইজেশন সম্প্রতি এ গ্লোবাল ইনোভেশন ইনডেক্স ২০১৬ প্রকাশ করেছে।
বিজ্ঞানের আরো যেসব শাখায় ইরান উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে তার কিছু দিক নিচে তুলে ধরা হলো।

মহাকাশবিজ্ঞানে মধ্যপ্রাচ্যে শীর্ষে ইরান

ইরানের মহাকাশ গবেষণা সংস্থার প্রধান জানিয়েছেন, এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে মহাকাশবিজ্ঞানে র‌্যাঙ্কিংয়ে শীর্ষে রয়েছে ইরান। এছাড়া এক্ষেত্রে বিশ্ব র‌্যাঙ্কিংয়ে ১১তম স্থান অর্জন করেছে দেশটি। ইরানের উপ আইসিটি মন্ত্রী মোরতেজা বারারি এই তথ্য জানান। তিনি বলেন, এ অঞ্চলে মহাকাশবিজ্ঞানে ইরান প্রথম স্থানে রয়েছে। মহাকাশে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণে সক্ষম দেশের মধ্যে ইরানের অবস্থান নবম।
মহাকাশ অর্থনীতির বিকাশের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব দিয়ে উপ আইসিটি মন্ত্রী বলেন, নিজেদের মহাকাশ কর্তৃপক্ষের ওপর নির্ভর করে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করা একটি অত্যন্ত কার্যকর পদক্ষেপ। যদিও বর্তমানে মহাকাশ অর্থনীতিতে আমাদের পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। তিনি বলেন, আমরা গবেষণা উপগ্রহের নকশা প্রণয়ন, উৎপাদন ও তা উৎক্ষেপণ করতে সক্ষম হয়েছি। তবে এসবের সঠিক ব্যবহার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে ক্ষেত্রে আমাদের আরো কাজ করতে হবে। আমরা বর্তমানে এ অঞ্চলে মহাকাশ বিজ্ঞানে প্রথম স্থানে রয়েছি। তবে যখন মহাকাশ প্রযুক্তি কর্মক্ষম হবে তখন আমাদের রূপান্তর ও পরিবর্তন আনার প্রয়োজন হবে। কেননা, মহাকাশবিজ্ঞান কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেবে।

বিমানের টারবোজেট ইঞ্জিন তৈরিতে ইরানের সাফল্য

সম্পূর্ণ নিজস্ব প্রযুক্তিতে বিমানের টার্বোজেট ইঞ্জিন তৈরি করেছে ইরান। ইঞ্জিনটির নকশা ও কারিগরি দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন ইরানি প্রকৌশলীরা। দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী হোসেইন দেহকান এ তথ্য জানিয়েছেন। এধরনের টার্বোজেট ইঞ্জিন বিমানে সংযোজন করা হলে তা ৫০ হাজার ফুট উচ্চতায় উড্ডয়ন করতে পারবে। এমন বিমানের বহন ক্ষমতা থাকবে ১০ টন। প্রতিরক্ষামন্ত্রী আরো জানান, আটটি দেশ যারা বিমানের ইঞ্জিন বানাতে পারে ইরান তাদের অন্তর্ভুক্ত হলো। ইরানের প্রতিরক্ষা ও নিজস্ব সক্ষমতার দিক থেকেও এধরনের কৃতিত্ব উল্লেখযোগ্য হয়ে থাকবে।
সামরিক ট্যাঙ্ক তৈরি করতে সক্ষম এ দেশটি ১৯৯২ সাল থেকে আর্মার্ড পারসোনেল ক্যারিয়ার, ক্ষেপণাস্ত্র, রাডার, যুদ্ধ জাহাজ, সাবমেরিন ও জঙ্গি বিমান ছাড়াও দূরপাল্লার ড্রোন তৈরি করে থাকে।
পার্সেল ডেলিভারির ড্রোন তৈরিতে ইরানের সাফল্য
কেবল স্থলপথ নয়, এবার আকাশপথেও খুব সহজেই এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পৌঁছে যাবে পার্সেল। আর সে কাজটি করবে ড্রোন। ইরানের মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র (আইএসআরসি) ড্রোনটি তৈরি করেছে। পার্সেল ডেলিভারির কাজে ব্যবহারের লক্ষ্যে তৈরি এ ড্রোনটি ইতোমধ্যে উন্মোচন করা হয়েছে ইরানে।

রাডার ফাঁকি দিতে সক্ষম দূর পাল্লার ড্রোন তৈরিতে সাফল্য
ইরান হালকা এবং রাডার ফাঁকি দিতে সক্ষম দূরপাল্লার নতুন একটি ড্রোন তৈরি করেছে। ড্রোনটির সর্বোচ্চ ১০ হাজার ফুট উঁচু দিয়ে ওড়ার সক্ষমতা রয়েছে। সম্প্রতি ইরানের বিমান এবং মহাকাশ শিল্প সংস্থার সর্বশেষ সাফল্য প্রদর্শনের অংশ হিসেবে নতুন এ ড্রোন উন্মোচন করা হয়।
সমুদ্রের পানি লবণমুক্ত করার মেশিন তৈরি
ইরানের একদল গবেষক নতুন এমন এক ধরনের যন্ত্র তৈরি করেছেন, যা দিয়ে সমুদ্রের পানি লবণমুক্ত করে পানযোগ্য করা যাবে। পানির মেমব্রেন ব্যবহার করে এই যন্ত্র দিয়ে সমুদ্রের লবণাক্ত পানিকে মিষ্টি পানিতে পরিণত করা যাবে। যন্ত্রটি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন ইরানের আমির কবির ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির একদল গবেষক।

পানির মান পরীক্ষায় টেস্টিং কিট তৈরি
পানির গুণগত মান পরীক্ষার জন্য বহুমুখী প্র্যাকটিক্যাল টেস্টিং কিট তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন ইরানি গবেষকরা। ন্যানো-টেক স্টার্টআপের অংশ হিসেবে তারা টেস্টিং কিটটি বানাতে সক্ষম হয়েছেন।

ন্যানো জ্বালানি কোষ তৈরি
নবায়নযোগ্য জ্বালানির অন্যতম উল্লেখযোগ্য উৎস ফুয়েল সেল বা জ্বালানি কোষের প্রোটন বিনিময় ঝিল্লি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন একদল ইরানি বিজ্ঞানী। এর ফলে ঝিল্লিতে প্রোটনের রূপান্তর প্রক্রিয়ায় অগ্রগতি ঘটবে বলে আশা করা হচ্ছে। আর প্রোটন রূপান্তর প্রক্রিয়ায় অগ্রগতির মাধ্যমে জ্বালানি ও পরিবেশগত সঙ্কটের সমাধান হবে বলে আশা গবেষকদের।
ন্যানো-প্রযুক্তিতে কীটনাশক তৈরিতে সাফল্য
ইরানি এক গবেষক ন্যানোপ্রযুক্তি ব্যবহার করে কীটনাশক তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। এ প্রকল্পের পরিচালক ড. নার্গিস মেমারিজাদেহ জানিয়েছেন, ন্যানো প্রযুক্তিতে তৈরি এ কীটনাশক দিয়ে ক্ষতিকারক পোকামাকড় মারা যাবে, কিন্তু পরিবেশে তার কোনো বিরূপ প্রভাব পড়বে না।

ন্যানো-প্রযুক্তি খাতে ইরানি অধ্যাপিকার ইউনেস্কোর পদক লাভ
ইরানের তাবরীয বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা-রসায়ন বিজ্ঞানের অধ্যাপিকা ডক্টর সুদাবেহ দবারান ন্যানো-প্রযুক্তি খাতে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কোর পদক পেয়েছেন।

ক্যান্সারের চিকিৎসায় নতুন সমন্বিত থেরাপি পদ্ধতির উদ্ভাবন
ইরানের ইসলামিক আজাদ ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞান ও গবেষণা শাখার গবেষকরা সমন্বিত থেরাপি পদ্ধতির মাধ্যমে ক্যান্সার মোকাবিলা করার নতুন একটি পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন। ফটো ডাইনামিক থেরাপি (পিডিটি) ও ঠাণ্ডা বায়ুম-লীয় প্লাজমার (সিএপি) সমন্বয়ে নতুন এ পদ্ধতি উদ্ভাবন করা হয়েছে। যা ক্যান্সার মোকাবিলায় অধিক কার্যকর বলে জানাচ্ছেন এসব গবেষক।

ক্ষতস্থানে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ওষুধ লাগানোর স্মার্ট ব্যান্ডেজ তৈরি
সম্প্রতি একদল গবেষক এমন একটি স্মার্ট ব্যান্ডেজ তৈরি করেছেন যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে ক্ষতস্থানে ওষুধ লাগাবে। ইউনিভার্সিটি অফ নেবরাস্কা-লিংকন, হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি এবং এমআইটি’র একদল ইরানি গবেষক ব্যান্ডেজটি তৈরি করেছেন। ত্বকের ক্ষত দ্রুত সারাতে স্মার্ট ব্যান্ডেজটি তৈরি করার পর এটির পরীক্ষা চালাচ্ছেন তাঁরা।

বেদনানাশক ক্রিম তৈরিতে ইরানের সাফল্য
বেদনানাশক ক্রিম তৈরি করেছেন ইরানের একদল গবেষক। দেশটির জ্ঞানভিত্তিক একটি কোম্পানির গবেষকরা জীবাণুবিরোধী উপাদান সংবলিত এই ক্রিম উৎপাদন করেছেন। এটা বাতগ্রস্ত রোগীরা ব্যবহার করতে পারবেন।

নিরাপদ কোয়ান্টাম যোগাযোগ প্রযুক্তি অর্জনে ইরানের সাফল্য
বর্তমানে বিজ্ঞানীদের কাছে আকর্ষণীয় বিষয় হচ্ছে নিরাপদ কোয়ান্টাম যোগাযোগ প্রযুক্তি। এই নতুন ধরনের প্রযুক্তি নিয়ে নিরলসভাবে কাজ করে চলেছে উন্নত বিশ্বের দেশগুলো। আর এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইরান। সম্প্রতি দেশটির বিজ্ঞানীরা এই অত্যাধুনিক প্রযুুক্তি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন বলে জানিয়েছে দেশটির সংবাদ মাধ্যম।
শিশুদের জন্য আকর্ষণীয় রোবটের খেলাঘর তৈরি
খেলার ছলে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে শিশুদের পরিচয় করিয়ে দিতে রোবটের খেলনাঘর তৈরি করেছেন গবেষকরা। যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘রোবোকিড্স’। সম্প্রতি ইরানের আমির কবির ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (এইউটি) গবেষকরা রোবটের এই খেলনাঘর তৈরি করেছেন।
আমির মোগুয়েই নামে প্রকল্পটির এক ব্যবস্থাপক সংবাদ সংস্থা মেহর নিউজ এজেন্সিকে জানিয়েছেন, সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তি দিয়ে রোবটের খেলনাঘর ‘রোবোকিড্স’ নকশা ও নির্মাণ করা হয়েছে। এই খেলাঘরটি নির্মাণের উদ্দেশ্য হলো শিশুদের বিনোদন দেওয়ার পাশাপাশি রোবট প্রযুক্তি সম্পর্কে আকর্ষণীয় পন্থায় পরিচয় করিয়ে দেওয়া।
অগ্নি নির্বাপক ড্রোন তৈরিতে ইরানের সাফল্য
ইরানের শরীফ প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত একটি কোম্পানি অগ্নিনির্বাপণে ব্যবহাযোগ্য ড্রোন তৈরি করেছে। কোনো রকম বিদেশি প্রযুক্তি ছাড়াই সম্পূর্ণ নিজস্ব প্রযুক্তি দিয়ে কোম্পানিটি এধরনের ড্রোন তৈরি করে। এ ড্রোনের নাম দেওয়া হয়েছে হুদহুদ থ্রি। একাধিক বা মাল্টিরোটর সংযুক্ত এ ড্রোনটি উল্লম্বভাবে চলতে পারে। একটি সহজ যন্ত্রের সাহায্যে ড্রোনটিকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

ওষুধশিল্পের প্রযুক্তি রপ্তানিতে সাফল্য
বিশ্বে ওষুধ শিল্পের বৃহত্তম প্রযুক্তি রপ্তানিকারক দেশে পরিণত হতে যাচ্ছে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান। সেদেশের সবচেয়ে বড় ওষুধ কোম্পানি সিন্নাজেন ফার্মাসিউটিক্যাল গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ড. হালেহ হামেদিফার এই তথ্য জানিয়েছেন।
তেহরান চেম্বার অব কমার্স, ইন্ডাস্ট্রিজ, মাইনস অ্যান্ড এগ্রিকালচার (টিসিসিআইএমএ) এর রিপ্রেজেনটেটিভ বোর্ডের ৩৪তম বৈঠকে তিনি এসব কথা বলেন।
তিনি জানান, ইরানে প্রথম বারের মতো সিন্নাজেন ফার্মাসিউটিক্যাল গ্রুপ ওষুধ শিল্পের নেতৃস্থানীয় রপ্তানিকারক ফার্ম হিসেবে পরিচিত হতে যাচ্ছে। প্রথম বারের মতো এই ফার্মাসিউটিক্যাল গ্রুপটির প্রযুক্তি মালয়েশিয়া ও আর্জেন্টিনায় রপ্তানি করা হচ্ছে বলেও জানান এই কর্মকর্তা।

ইরানের প্রযুক্তিগত ও প্রকৌশলসেবা রপ্তানিতে সাফল্য
চলতি ইরানি বছরের প্রথম আট মাসে ইরানের প্রযুক্তি ও প্রকৌশল সেবা রপ্তানির পরিমাণ বেড়েছে ৮০ শতাংশ। ইরানের বাণিজ্য উন্নয়ন সংস্থার (টিপিও) এক ব্যবস্থাপনা পরিচালক এই তথ্য জানিয়েছেন।
টিপিও এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহমুদ এসকান্দারি বলেন, বছরের প্রথম ৮ মাসে ইরান থেকে ৫৫৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের প্রযুক্তি ও প্রকৌশল সেবা রপ্তানি হয়েছে। অর্থাৎ আগের বছরের একই সময়ে তুলনায় এ সময়ে রপ্তানি বেড়েছে ৮০ শতাংশ। আগের বছরের প্রথম ৮ মাসে এ রপ্তানির পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল ৩০৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।

ভবন নকশায় ইরানি স্থপতির স্বর্ণপদক জয়
ইরানি স্থপতি মোহাম্মদ রেজা কানেই’এর নকশায় তৈরি ভবন মিলানে নকশা প্রতিযোগিতায় স্বর্ণপদক জিতেছে। কানেই’এর ভবনটি আবাসিক। ইরানের ইসফাহানে পলশির আর্কিটেক্ট প্রতিষ্ঠান ওই ভবনটি নির্মাণ করে। যা ইতালিতে আর্কিটেকচার, বিল্ডিং অ্যান্ড স্ট্রাকচার ডিজাইন ক্যাটাগরিতে পুরস্কার লাভ করে।

মধ্যপ্রাচ্যে শীর্ষ ৫ ইরানি প্রকৌশলী
মিডিল ইস্ট প্রিমিয়ার ওয়েবসাইট ফর আর্কিটেকচার অ্যান্ড ইন্টেরিওর ডিজাইন যে প্রভাবশালী ৫০ জন প্রকৌশলীর নাম ঘোষণা করেছে তার মধ্যে ৫ শীর্ষ প্রকৌশলীই ইরানি। লেবানন থেকে ইরান পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্য ও উপসাগরীয় দেশগুলোতে এ ৫০ জন প্রকৌশলীর নির্মাণ স্থাপত্য উন্নয়নে এক নতুন বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি করেছে।

বিশ্বের সর্বাপেক্ষা প্রভাবশালী বিজ্ঞানীদের তালিকায় ৭ ইরানি
বিশ্বের সর্বাপেক্ষা প্রভাবশালী বৈজ্ঞানিক গবেষকদের তালিকায় নাম রয়েছে ইরানের সাত বিজ্ঞানীর। ‘২০১৭ হাইলি সাইটেড রিসারচারস’ শীর্ষক তালিকায় জায়গা করে নিয়েছেন এসব ইরানি বিজ্ঞানী। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক ও অ্যাকাডেমিক গবেষণাবিষয়ক কোম্পানি ক্লারিভেট অ্যানালিটিক্স প্রকাশিত তালিকায় এই চিত্র উঠে এসেছে।

আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত ইরানি বিজ্ঞানী
ইরানের বিজ্ঞানি ও স্ট্রিং তত্ত্ববিদ কারমান ভাফা আরো তিন বিজ্ঞানীর সঙ্গে মৌলিক পদার্থ বিদ্যায় ব্রেকথ্রু প্রাইজ ২০১৭ পেয়েছেন। এসব বিজ্ঞানী স্ট্রিং তত্ত্ব ব্যবহার করে বিশ্বের চার মৌলিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করে আসছেন। এ চারটি মৌলিক শক্তি হচ্ছে বিদ্যুৎ-চৌম্বকীয় শক্তি, সবল পারমাণবিক শক্তি, দুর্বল পারমাণবিক শক্তি ও মহাকর্ষ। বিজ্ঞানীদের মধ্যে অ্যান্ড্রু স্ট্রমিঙ্গার ও কারমান ভাফা হার্ভার্ড ভার্সিটি এবং জোসেপ পোলসিনিস্কি ক্যালিফোর্নিয়া ভার্সিটি থেকে যৌথভাবে এ পুরস্কার লাভ করেন। জ্ঞান-বিজ্ঞানের আরো অনেক শাখায় ইরান একের পর এক সাফল্যের স্বাক্ষর রেখে চলেছে। একটিমাত্র লেখার মধ্যে এসব সাফল্যের সম্পূর্ণ তথ্য তুলে ধরা সম্ভব নয়। তবে এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, জ্ঞান-বিজ্ঞানে ইরানের সফলতার এই ধারা অব্যাহত থাকলে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে দেশটি বিশ্বের প্রথম ৫টি দেশের মাঝে স্থান করে নেবে এতে কোন সন্দেহ নেই।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হযরত আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী এক গবেষণা কেন্দ্র পরিদর্শন করে বলেছিলেন, বিজ্ঞান ও গবেষণাই অগ্রগতি অর্জনের চাবিকাঠি। এক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের অর্জিত জ্ঞান-বিজ্ঞান আয়ত্ত করাকে তিনি বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে প্রাথমিক যাত্রা হিসেবে অভিহিত করেন এবং এ যাত্রাকে প্রাথমিক পর্যায়েই সীমিত না রাখার আহ্বান জানান। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আরও বলেন, কোনো কোনো বৃহৎ শক্তি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে একচেটিয়া কর্তৃত্বাধীনে রাখতে চাইছে এবং বিশ্বকে উন্নত ও পশ্চাদপদ এ দুই অংশে চিরকালের জন্য বিভক্ত করে রাখতে আগ্রহী। জাতিগুলোর জাগরণ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে অগ্রগতি অর্জনের মাধ্যমে বর্তমান বিশ্বের ওপর চাপিয়ে রাখা এই আধিপত্যকামী ব্যবস্থা পরিবর্তন করা সম্ভব। আর এক্ষেত্রে সমৃদ্ধ ইতিহাস-ঐতিহ্য, প্রতিভা ও উন্নত সংস্কৃতির অধিকারী ইরানের মুসলিম জাতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বলে তিনি স্মরণ করিয়ে দেন। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা বলেন, জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইরানি গবেষকদের বিস্ময়কর সব সাফল্য ওই কাঙিক্ষত আত্মবিশ্বাস, প্রতিভা ও শক্তিমত্তারই প্রমাণ।

রাহবার সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী ও বই পাঠ

মাহদী মাহমুদ: শায়খ জামালুদ্দিন আফগানী থেকে শায়খ মোহাম্মদ আবদুহ, সাইয়্যেদ কুতুব থেকে সাইয়্যেদ বাকের আল সাদর, আল্লামা তাবাতাবেয়ী প্রত্যেকেই মহান আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছেন। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে রক্ত দিয়েছেন হাসান আল বান্নাহ, রাগিব হারব প্রমুখ। চলে গিয়েছেন আহলে বাইতের অনুসারীদের এক কাণ্ডারি, ইসলামি বিপ্লবের নেতা ইমাম খোমেইনী। আর তাঁর রত্নসভার রত্নগণ- আয়াতুল্লাহ মুরতাজা মুতাহহারী, বেহেশতী আর বাহোনারসহ অনেক আলোকোজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব একে একে শত্রুর কালো হাতের থাবায় শহীদ হয়েছেন। সাম্রাজ্যবাদ, উগ্রবাদ তথা বৈশ্বিক হেজিমনি (hegemony) আজ শক্তিশালী ভিত্তির ওপর আবারো উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে।
আর এমনি এক ক্রান্তিলগ্নে মুসলিম উম্মাহর কাণ্ডারি রূপে বিরাজমান রয়েছেন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে কঠোরহস্ত, অগ্নিঝড়া কণ্ঠস্বর ইসলামি বিপ্লবের বর্তমান নেতা সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী। সাম্রাজ্যবাদ এবং বৈশ্বিক হেজিমনির বিরুদ্ধে যুদ্ধে তাঁর প্রবলতম অস্ত্র হচ্ছে একটি সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিপ্লব যা কর্মগত দিক দিয়ে বৈশ্বিক আর প্রকৃতিগত দিক থেকে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর বিপ্লবের সাথে সংযুক্ত।
এই বিদগ্ধ পণ্ডিত এবং বিপ্লবী নেতার ‘বইপোকা’ স্বভাবের কথা আমাদের অনেকের নিকটেই অবিদিত নয়।
আজ আমরা আলোচনা করব বই পড়ার গুরুত্ব ও আবশ্যিকতার ব্যাপারে সাইয়্যেদের উৎসাহ প্রদান এবং দিকনির্দেশনামূলক ভাষণ ও বক্তৃতাসমূহে তিনি তরুণ সমাজের নিকট প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের যে সকল বিপ্লবী সাহিত্যিকের রচনা তুলে ধরেছেন এবং সেগুলো অনুধ্যান করার তাগিদ দিয়েছেন সে সম্পর্কে।
সরাসরি চলে যাচ্ছি সাইয়্যেদের বক্তৃতামালায়।
“বইয়ের সাথে সম্পর্কহীনতা যেকোনো জাতির জন্যই অপূরণীয় ক্ষতিস্বরূপ। অন্যদিকে বইয়ের সাথে সখ্য, সেগুলো থেকে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন কিছু শেখা এবং উপকৃত হওয়া যেকোন ব্যক্তির জন্যই একটি বিরাট অর্জন। এ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে ঐতিহাসিক একটি ঘটনার পেছনের মূল্য এবং অন্তর্নিহিত তাৎপর্য সঠিকভাবে উপলব্ধি করা সম্ভব হবে। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট নাযিল হওয়া প্রথম আয়াতের প্রথম শব্দেই আল্লাহ বলছেন : ‘পড়’। আর প্রথম আয়াতটিতেই ‘কলম’ শব্দটিকে বিশেষ মর্যাদা এবং প্রশংসার সাথে উল্লেখ করা হয়। ‘পড় এবং তোমার রব বড় মেহেরবান, যিনি কলমের সাহায্যে জ্ঞান শিখিয়েছেন।” (আল কোরআন, সূরা ৯৬, আয়াত ৩ ও ৪), ডিসেম্বর ২৫, ১৯৯৩
বই সভ্যতার নির্যাস স্বরূপ
‘বই হচ্ছে যেকোনো সভ্যতার মা স্বরূপ।’ সেপ্টেম্বর ১২, ১৯৯৫
বই পড়া একটি ধর্মীয় দায়িত্ব
‘বর্তমানে বই পড়া কেবল জাতীয় কর্তব্য নয়; বরং একটি ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা।’- ডিসেম্বর ২৫, ১৯৯৩
এখন সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ীর পছন্দের কয়েকজন লেখক-ঔপন্যাসিক ও সাহ্যিতিকের ব্যাপারে তিনি কী মন্তব্য করেছেন তাই দেখব।
টমাস কার্লাইল
‘টমাস কার্লাইল, যিনি একজন অমুসলমান কিংবা আরো নির্দিষ্টভাবে বললে একজন খ্রিস্টান পণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন, তিনি কোরআন এর সত্যতা খুঁজে পেয়েছিলেন এবং এর আয়াতগুলোর শক্তিশালী গাঁথুনি থেকে উপলব্ধি করেছিলেন যে, সেগুলো সীমাবদ্ধতাসম্পন্ন সত্তা মানুষের তৈরি নয় এবং ফলশ্রুতিতে অখণ্ডনীয়।’- ৬ই মে, ১৯৯২
জওহরলাল নেহেরু
‘আপনাদের উচিত জওহরলাল এর ‘বিশ্ব ইতিহাস প্রসঙ্গ’ (Glances at World History) বইটা পড়া। ‘ভারতবর্ষে ইংরেজ আগ্রাসন’ শীর্ষক অধ্যায়ে লেখক বলেছেন যে, ভারতে যেসকল শিল্প এবং বিজ্ঞান প্রচলিত ছিল সেগুলো কোন অংশেই ইউরোপ, ব্রিটিশ কিংবা পাশ্চাত্যের তুলনায় কম ছিল না… সে সময়ের মানদণ্ডে।’
‘একই কথা অন্যান্য দেশের ব্যাপারেও বলা চলে। আর ইংরেজরা যখন ভারতে প্রবেশ করল তখন তারা সেখানকার প্রচলিত শিল্পগুলো বন্ধ করে দিল… তারা ভারতের কুটিরশিল্প বন্ধ করে দিল। স্থবিরতা সৃষ্টি করল এবং অবনতির দিকে নিয়ে গেল যাতে ভারতীয়রা ইংরেজদের থেকে পণ্য আমদানি করতে বাধ্য হয়। সুপরিকল্পিতভাবে তারা এগুলো করেছিল এবং একই পন্থা অন্যান্য দেশেও তারা ব্যবহার করেছিল। এমনকি ইরানেও।’- জুন ৭, ২০১৭
এছাড়াও ২০১৬ সালের ৫ মে, ২০১৫ সালের ১১ নভেম্বর এবং তারও পূর্বে ২০১৩ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর আরো তিনটি ভাষণে সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী জওহরলাল নেহেরু এবং তাঁর উপরিউক্ত গ্রন্থটির ভূয়সী প্রশংসা করেন এবং তরুণ সমাজকে এই গ্রন্থটি পড়ার তাগিদ দেন।
তিনি বলেন যে, জওহরলাল নেহেরু একই সাথে একজন বিশ্বস্ত এবং বিদগ্ধ জ্ঞানী লেখক। এরপর তিনি আবারো আমাদের দৃষ্টি নিয়ে যান নেহেরু লিখিত গ্রন্থে ভারতবর্ষে ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদ বিষয়ক বর্ণনায়। রাহবারের বরাতে, ‘নেহেরুর মতে ইউরোপীয় সভ্যতার তুলনায় ভারতবর্ষের জ্ঞান-বিজ্ঞানের অবস্থা আরো উন্নত ছিল। ইংরেজরা ভারতে আধিপত্য বিস্তারের পর তারা তাদের নীলনকশা অনুযায়ী ভারতের কুটির ও ক্ষুদ্র শিল্পগুলো ধ্বংস করে দেয়। ফলশ্রুতিতে ভারতবর্ষ ক্ষুধা ও দারিদ্রের স্বরূপ আক্ষরিক অর্থে অবলোকন করল। একই কথা আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকার ক্ষেত্রেও সত্য। তাই দিনশেষে বৈশ্বিক আধিপত্যবাদী পাশ্চাত্য শক্তি যুদ্ধের পর যুদ্ধই বাধায় নি কেবল, বরং এসব দেশ-জাতি ও সভ্যতার জন্য দারিদ্র্য ডেকে এনেছিল। সভ্যতাগুলোকে শুষে খেয়ে যে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছে এই ধনিক শ্রেণিটি সেটা আমাদেরকে ইমাম আলী ইবনে আবি তালিবের একটি উক্তির কথা মনে করিয়ে দেয়, ‘আমি স¤পদ পুঞ্জিভূত করার এমন কোন নজির দেখি নি, যেক্ষেত্রে অন্য কারো অধিকার ভূলুণ্ঠিত করা হয় নি।’- দেরাছাত ফি নাহজুল বালাগা, পৃষ্ঠা ৪০।
যখন তারা অন্য দেশের তেলসম্পদ, কৃষি কিংবা চা সম্পদ লুট করে, যখন তারা দেশগুলোর অর্থনীতিকে করায়ত্ত করে যাতে সেই দেশের মানুষদের নিজের দেশের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আর কোন নিয়ন্ত্রণ থাকে না, আর যখন তারা দেশের ন্যায়সংগত জনগণকে দেশজ উৎপাদন, শিল্প এবং জাতীয় উন্নয়নের অন্য ক্ষেত্রসমূহে নিয়ন্ত্রণ নিতে দেয় না, তখন স্বাভাবিকভাবেই এই জাতি ও রাষ্ট্রগুলো দুর্দশায় পতিত হয়। তারা যুদ্ধ, দারিদ্র এবং অবক্ষয়ের জন্য দায়ী। তারা মূল্যবোধের অবক্ষয়ের জন্য দায়ী এবং মানুষের মাঝের কামনা-বাসনাকে স্থূলভাবে জাগিয়ে তোলে।- সেপ্টেম্বর ১৭ ২০১৩ তারিখে সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী প্রদত্ত ভাষণ অবলম্বনে।
জন স্টেইনবেক
‘জন স্টেইনবেক যিনি ‘দ্য গ্রেপস অফ রেথ’ এবং একই ঘরানার অন্য যেসকল বিখ্যাত উপন্যাস লিখেছিলেন সেগুলোতে মার্কিন প্রশাসনের চাপে ফেলার নীতির ওপর লিখিত। আমেরিকায় যে কেউ এমন কোন শব্দ ব্যবহার করে যাতে সমাজতন্ত্রের নাম-গন্ধ পাওয়া যায়, সেটা প্রকৃতপক্ষে সমাজতন্ত্র না হোক, কেবল সমাজতন্ত্রের হালকা ঘ্রাণ পাওয়া যায় সে ব্যক্তি সকল প্রকার প্রশাসনিক চাপ-শারীরিক ক্ষতি থেকে চারিত্রিক কালিমার শিকার হয়। আর গণতন্ত্রের তথাকথিত আতুরঘরের হর্তাকর্তারা মানুষের সাথে এভাবেই আচরণ করে।’- ২ মে, ১৯৯৬
তবে পরবর্তীকালে ২০০৩ সালের অপর একটি বক্তৃতায় রাহবার আলী খামেনেয়ী জন স্টেইনবেকের পরবর্তী অবস্থানের সমালোচনা করে বলেন যে, কতিপয় কর্পোরেশন তাঁকে প্রলুব্ধ করেছে এবং বড় অংকের উৎকোচ দিয়েছে, যার ফলে তিনি ভিন্নভাবে লিখছেন।- মে ২৬, ২০০৩
পুনরায় ২০১৬ সালের ১৮ জুন বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক, ব্যবস্থাপক এবং সরকারি চাকুরেদের একটি অনুষ্ঠানে ভাষণে তিনি জন স্টেইনবেকের পূর্ব অবস্থানের প্রশংসা করেন এবং তাঁর কালোত্তীর্ণ লেখাগুলো পড়ার উপদেশ দেন।
আইজ্যাক আসিমভ
‘দ্য বাইসেনটেনিয়াল ম্যান’ গল্পটি বর্তমানের বৈজ্ঞানিক বাস্তবতা সমর্থিত নয়। তার মানে এই না যে, এটা অনর্থক উপভোগ করতে হবে; বরং বইটি চিন্তার জগতে নতুন এক দিগন্ত খুলে দেয়, আর সেটি একটি ইতিবাচক দিক। এধরনের বই সবসময়ই ছিল। যখন সেগুলো লেখা হতো সে যুগে কেবল কল্পনা হিসেবে সেগুলো বাস্তবতা পেলেও বর্তমানে সেগুলো বাস্তবতার খুবই নিকটে।’- ৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৯২
জর্জ সার্টন
‘জর্জ সার্টন, যিনি Introduction to the History of Science নামে বিজ্ঞানের ইতিহাস নিয়ে একটি বই লেখেন যেটা আপনাদের সকলেই হয়তো পড়ে থাকবেন, সেখানে একটি বাক্য লেখা আছে, ‘ইরানি পণ্ডিতগণ সভ্যতার পথে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছেন।’- ১১ নভেম্বর, ২০১৫
হাওয়ার্ড ফাস্ট
‘প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক হাওয়ার্ড ফাস্ট লিখিত ‘দ্য আমেরিকান’ উপন্যাসটি পড়লে একজন উপলব্ধি করতে পারবেন নির্বাচন (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে) কাকে বলে! নির্বাচনে যাঁদের ন্যূনতম ভূমিকা নেই তারা হচ্ছে জনগণ! যাঁরা ব্যালটে ভোট দিয়ে আসেন! যাঁরা ব্যালট বাক্সে ভোট দিতে আসেন, তাঁদেরই বিন্দুমাত্র ভূমিকা নেই মার্কিন নেতা নির্বাচনে।’- ২৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৯
ভিক্টর হুগো
‘আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, অন্য সব উপন্যাসের চেয়ে ‘লা মিজারেবল’ উপন্যাসটি অন্যরকম-বিস্ময়কর। আমি বার বার তরুণদেরকে এই উপন্যাসটি পড়ার জন্য তাগিদ দেই। এটাকে সমাজবিজ্ঞানের একটি শৈল্পিক প্রদর্শন হিসেবে বলা যায়, এটি একটি ঐতিহাসিক দলিল। এটি একটি তাৎপর্যবহ বই। ঐশ্বরিকতা, দয়া-মায়া এবং ভালোবাসার বিষয়ে একটি বই। এটি ভিক্টর হুগোর একটি অনবদ্য সৃষ্টি- যেখানে নেপোলিয়ানের যুদ্ধের একটা অংশ উঠে এসেছে। আমার মতে, ভিক্টর হুগো সবচেয়ে মুনশীয়ানার সাথে চিত্রগুলো তুলে ধরেছেন। ভিক্টর হুগো একজন প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি, নেহায়েত একজন লেখকই নন। আমরা মুসলমানরা যে শব্দটা ব্যবহার করি সেই অর্থেই ভিক্টর হুগো একজন হাকিম। আর ‘লা মিজারেবল’ হলো তাঁর হেকমতের নিদর্শন।’- ২০ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৩
রজার মারটিন দ্য গার্ড
তেহরান আন্তর্জাতিক বইমেলা সফরকালে নিলুফার প্রকাশনীর স্ট্যান্ড পরিদর্শনে আসেন রাহবার আলী খামেনেয়ী। তিনি বিক্রেতাদের অভিবাদন জানান এবং নতুন প্রকাশিত বইগুলোর ব্যাপারে জানতে চান। এর মধ্যে একটি বই তাঁর কাছে আকর্ষণীয় লাগে। তিনি জিজ্ঞেস করেন, ‘এটা কি সেই পুরানো চার খণ্ডের বইটিই এক মলাটে বের করা হয়েছে?’ বিক্রেতা হ্যা-সূচক জবাব দিলেন। তিনি অনুবাদকের নাম জানতে চাইলেন। তারা জানালো, ‘আবুল হাসান নাজাফি’।
রাহবার খামেনেয়ী স্মৃতিচারণ করলেন, “আহ! আবুল হাসান নাজাফি। আবুল হাসান নাজাফি, মরহুম হাবিবি এবং আরো কয়েকজন সাহিত্যবোদ্ধা আমাদের সাথে দেখা করতে আসেন একবার। আমি নাজাফিকে জিজ্ঞাস করলাম, ‘আপনি কি থিবল্টের (Thibaults) অনুবাদক?’ আমি এই উপন্যাসের নাম জানি দেখে জনাব নাজাফি যার পর নাই অবাক হলেন। আমি উপন্যাসটি পছন্দ করেছিলাম এবং এর একটি ক্রিটিক জানালাম অনুবাদক নাজাফিকে। জনাব নাজাফি আরো বেশি অবাক হয়ে গেলেন। তিনি বললেন, ‘আপনি আসলেই পুরো চার খ- পড়েছেন? আমি ভাবতেই পারি নি যে, আপনি এমনকি এটার নাম জানবেন’!”
রাহবার হাসি হাসি মুখে তাঁর স্মৃতিচারণ অব্যাহত রাখলেন, ‘আমি তাঁকে জানালাম, আমি সেটি পড়েছি। মরহুম নাজাফির রুহের মাগফিরাত কামনা করছি। ‘থিবল্ট’ আসলেই একটি চমৎকার উপন্যাস, কিন্তু দুঃখের বিষয় এটি এর যোগ্য মূল্যায়ন পায় নি।’ – ১১ মে, ২০১৮
‘দ্য থিবল্ট’ (লাস থিবল্ট) ফরাসী লেখক রজার মারটিন দ্য গাডর্ রচিত একটি সুদীর্ঘ উপন্যাস। এটিতে ইউরোপের বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিককার ইতিহাস আলোচিত হয়েছে এবং একই সাথে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসও উঠে এসেছে। এতে একটি ফরাসি উচ্চবিত্ত বুর্জোয়া পরিবার-দ্য থিবল্ট-এর কাহিনী চিত্রায়িত হয়।
আনাতোলি রাইবাকভ (‘চিল্ড্রেন অফ দ্য আরব্যাট’ এর লেখক)
(লেখকের নিজের মত অনুসারে) এটি একটি স্তালিনবিরোধী উপন্যাস। রাহবার আলী খামেনেয়ীর বর্ণনায়, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের আগে সোভিয়েত দেশের ভেতরকার তিক্ত ঘটনাবলির কিছু কিছু বাইরে বের হতো, আর সেগুলোর কোন কোনটা আবার ফারসিতে প্রকাশ হতো। সেগুলো রাহবার পড়তেন। তেমনই একটি উপন্যাস এটি। সোভিয়েত ইউনিয়নের কম্যুনিস্ট বাহিনী দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রবলতম নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। নিজের নাগরিকদের ওপর প্রবল চাপ প্রয়োগ করে। সীমাবদ্ধতা আরোপ করে। জনগণের জীবন দুর্বিষহ হয়ে যায়। বিপ্লব প্রথম থেকেই ধীরে ধীরে ভিন্ন পথে চলে যায়। বিপ্লবের মুল উদ্দেশ্য কখনই সফল হয় নি।- ২০ অক্টোবর ১৯৯১ এবং ১০ আগস্ট ২০১১ সালের বক্তৃতা অবলম্বনে
লিও তলস্তয়
‘কোন জাতির কঠিন সময় যেমন যুদ্ধ, অর্থনৈতিক মন্দা কিংবা রাজনৈতিক চাপের সময় তাদের সত্যিকার শক্তি এবং সক্ষমতা উপলব্ধি করা যায়। এতে একটি জাতির টিকে থাকার যোগ্যতাও অনুধাবন করা যায়। আর তাই দেখা যায়, এরকম কঠিন সময়েই শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্মগুলো আত্মপ্রকাশ করে। লক্ষ্য করে দেখুন সবচেয়ে মিষ্টি এবং একই সাথে সবচেয়ে সৃষ্টিশীল শিল্পকর্মগুলো তখনি প্রকাশ পায় যখন একটি জাতি একটি বড় দায়িত্ব হাতে তুলে নেয়। তলস্তয়ের ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’ তেমনি একটি রচনা। নেপোলিয়ানের বিরুদ্ধে রুশ জাতির অভূতপূর্ব প্রতিরোধ সংগ্রামের ইতিহাস উঠে এসেছে।’
‘তলস্তয় আরো অনেকগুলো প্রন্থ রচনা করেছেন, তবে আমার কাছে এটিই তাঁর শ্রেষ্ট সৃষ্টি; কেননা, এতে রুশ জাতির প্রতিরোধের উদ্দীপনার প্রকাশ পাওয়া গিয়েছে।’
মাইকেল জিভাকো
‘মাইকেল জিভাকো একজন বিখ্যাত ফরাসি লেখক যিনি বহু গ্রন্থ রচনা করেছেন। আমি অতীতে তাঁর প্রায় সকল উপন্যাস পড়েছি। আমি সবসময় বই পড়তে ভালোবাসতাম। আমাদের ঘরে অনেক বই ছিল। আমার বাবার একটি বড় ব্যক্তিগত গ্রন্থাগার ছিল, যেখানের বইগুলোর অনেকগুলোই আমার জন্য ছিল চমৎকার। অবশ্য আমার নিজেরও ব্যক্তিগত বইয়ের সংগ্রহ ছিল। এছাড়াও আমি মানুষের থেকে বই ধার নিতাম। আমাদের বাড়ির পাশেই একটি ছোট বইয়ের দোকান ছিল- যারা বই ধার দিত। মূলত উপন্যাস আর অন্য বইও আমি সেখান থেকে ধার নিতাম। পরবর্তীকালে আমি মাশহাদে অবস্থিত অস্তানে-কুদ্স রাযাভি লাইব্রেরিতে যেতাম। সেটি ছিল অত্যন্ত চমৎকার! আর তখন আমি হাওযার প্রথম বর্ষে অধ্যয়ন করছিলাম এবং আমার বয়স ছিলো পনের কি ষোল। মাঝে মাঝে আমি পুরো দিন সেখানে কাটাতাম। যেহেতু সেটা হেডকোয়ার্টারের খুব নিকটে ছিল তাই আজানের ধ্বনি সেখানে প্রবেশ করত। কিন্তু আমি বইয়ের মধ্যে এতটাই বুঁদ হয়ে থাকতাম যে, সেটা শুনতে পেতাম না। আরেকজন ঘোষক নিকট থেকেই নামাযের জন্য ডাক দিতেন যেটি লাইব্রেরির দেয়ালে প্রতিধবনিত হতো গমগম করে। সময়টা তখন দুপুরআমি বই ভালোবাসতাম। আর এখন যখন আমার বয়স প্রায় ষাট বছর,যখন আমি তোমাদের অনেকের পিতা কিংবা দাদা-নানার বয়সী, তখনো আমি যে পরিমাণ বই পড়ি তত বই তোমাদের পরিচিত খুব কম কিশোরও পড়ে থাকে। আমি তরুণদের নিকট অতিরিক্ত বই এবং উপন্যাসের পরিচয় করাতে চাই না, তবে কয়েক জন লেখকের কথা বলতে পারি। যেমন, প্রখ্যাত ফরাসি লেখক মাইকেল জিভাকো, যিনি বহু গ্রন্থ রচনা করেছেন। এছাড়া আমি ভিক্টর হুগোর কথা বলতে পারি। আমি তরুণ বয়সে তাঁর ‘লা মিজারেবল’ এর কিছুটা পড়েছিলাম,পরবর্তীকালে সেটা পুরোটা কয়েকবার করে পড়েছি।’-৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৮, শিশু-কিশোরদের সাথে একটি আন্তরিক মিলনমেলায়।
রাহবার সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ীর বইয়ের তালিকা সুদীর্ঘ। মাত্র একটি পর্বে এবং এতটা ছোট কলেবরে সেগুলো স¤পর্কে তাঁর মতামত তুলে ধরা এক কথায় অসম্ভব। তাই এবারের মতো শেষ করতে চাই মুসলিম উম্মাহর ও মানবতার ঐক্যের সুউচ্চ কণ্ঠস্বর ইমাম সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ীর আরো দুটি মুল্যবান বাণী উদ্ধৃত করে।
‘মানবজাতির দুনিয়াবি এবং পরকালীন উভয় জীবন-এই দেহ এবং আত্মা-বইয়ের মাধ্যমে পুষ্টি লাভ করে এবং সুষ্ঠুভাবে বেড়ে ওঠে। মানবীয় পূর্ণতা অর্জিত হয় বই পড়ার মধ্য দিয়েই।’-১২ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৫
‘আমরা যত উন্নতির দিকে এগিয়ে যাব বইয়ের প্রয়োজনীয়তা ততই বৃদ্ধি পাবে। যেরকম ধারণা করা হয় যে, নতুন নতুন যোগাযোগের প্রযুক্তি মাধ্যম গড়ে ওঠার সাথে সাথে বইয়ের প্রয়োজনীয়তা সীমাবদ্ধ হয়ে যাবে, এটা একেবারেই ভুল। বই মানব সমাজে ক্রমান্বয়ে আরো কেন্দ্রীয় অবস্থান দখল করবে। নতুন নতুন প্রযুক্তির আগমন, খুব বেশি হলে বইয়ের বণ্টনকে সহজতর করবে।’- জুলাই ২০, ২০১১।
আল্লাহ আমাদেরকে ভালো বইয়ের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে দিন।

ফিলিস্তিন ও আল কুদস-এ ইসারাইলি দখলদারিত্বের ৭০ বছর : বিশ্ব মুসলিম এর করণীয়

অধ্যক্ষ মুহাম্মদ শওকাত হোসেন*

অসংখ্য নবী আ.-এর পবিত্র স্মৃতি বিজরিত পবিত্র কুরআন বর্ণিত দুটি পবিত্র মসজিদের একটি এবং ইসলামের প্রথম কিবলা ও তিনটি বিশেষ গুরুত্ব সম্পন্ন মসিজদের একটি বায়তুল মাকদিস আল কুদস আল শরীফ। দীর্ঘ ৭০ বছর যাবৎ বিশ্বের নিকৃষ্টতম বর্ণবাদী সাম্প্রদায়িক মতবাদ ‘যায়নবাদ’ (ইহুদিবাদ) এর বিষাক্ত ছোবলে প্রতিনিয়ত নির্যাতিত ও নিষ্পেষিত হচ্ছে। ৭০ বছর যাবৎ বহিরাগত ইহুদিবাদের সন্ত্রাসী দখলদাররা পবিত্রভূমি ফিলিস্তিনের নিরপরাধ মুসলিমদের ওপর উৎখাত, হত্যা, নির্যাতন, নৃশংসতার স্টিম-রোলার চালিয়ে যাচ্ছে। লক্ষ লক্ষ মুসলিমকে নিজ বাসগৃহ থেকে উৎখাত করে সেখানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে তুলে এনে ইহুদিদের বসতি স্থাপন করছে। সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ আমেরিকার ষড়যন্ত্রে ফিলিস্তিনের বুকের ওপর অবৈধ কৃত্তিম রাষ্ট্র অভিশপ্ত ইসরাইল এর জন্ম দিয়েছে। সাম্রাজ্যবাদীরা সব মারণাস্ত্র আর পারমাণবিক অস্ত্রে সজ্জিত করেছে তাদের সৃষ্ট বিষবৃক্ষ ইসরাইলকে। ইসরাইলের ইতিহাস হত্যা, নির্যাতন, দখলদারিত্ব আর নির্মমতা ও নৃশংসতার ইতিহাস। শুধু ফিলিস্তিন নয়, তাদের আক্রমণ আর নৃশংসতার শিকার হয়ে প্রাণ হারিয়েছে লেবানন, জর্দান, মিশর, সিরিয়ার অসংখ্য মুসলিম জনগণ। ১৯৪৮ সালের আগ থেকে যে নির্যাতন, নির্মমতা শুরু হয়েছে তা আজ মানবতার দুশমন ইসলাম ফোবিয়ায় আক্রান্ত, সাইকিক ডোনাল্ড ট্রাম্প এর প্রত্যক্ষ মদদে তা নৃশংসতার সকল সীমা অতিক্রম করেছে। আজ সময় এসেছে ৭০ বছরের নির্যাতন, নির্মমতা, হত্যাযজ্ঞ তথা মানবতার বিরুদ্ধে পাহাড় সম অপরাধের হিসাব নেয়ার। বিশ্ব মুসলিমের ঐক্য সংগ্রাম তথা জিহাদের মাধ্যমে অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইলের বিলুপ্তি এবং স্বাধীন ফিলিস্তিন ও মুক্ত বায়তুল মাকদিস প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই তা সম্ভব হবে।
সাম্প্রতিক ঘটনা
১৪ মে ২০১৮। ইসরাইল এর প্রতিষ্ঠা দিবস উপলক্ষে এবার আল কুদস তথা জেরুসালেমে তেল আবিব থেকে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস স্থানান্তর উপলক্ষে আনন্দানুষ্ঠানে অতিথি হয়ে এসেছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এর কন্যা ইভানক ও জামাতা জেরাল্ড কুশনার। ১৫ মে আল নাকবা- ‘মহা বিপর্যয়’ দিবস সামনে রেখে হামাস এর আহ্বানে চলছে ফিলিস্তিনিদের বিক্ষোভ। হাজার হাজার বিক্ষোভকারীকে ঠেকাতে ট্যাংক সহ মারণাস্ত্র নিয়ে রাস্তায় নেমেছে ইসরাইলি সেনাবাহিনী। বিক্ষোভকারীদের একমাত্র অস্ত্র ‘পাথর’। পাথরের জবাবে ইসরাইলি হানাদার বাহিনীর ব্রাশফায়ারে শহীদ হলো ৬০ জন ফিলিস্তিনি, আহত হলো ২ হাজার ৭শ’র বেশি ফিলিস্তিনি। যার মধ্যে শিশু, নারী, বৃদ্ধও রয়েছে। গত ২০ দিনে ১শ’র বেশি ফিলিস্তিনি প্রাণ দিয়েছে ইসরাইলি হানাদারদের হাতে। এটা ১ দিনের ঘটনা নয়, এভাবেই চলছে প্রতিদিন, প্রতি মাস, প্রতি বছর দীর্ঘ ৭০ বছর কিংবা তারও বেশি সময় ধরে।
ঘরহারা, বাড়িহারা, প্রিয়জনহারা উদ্বাস্তু শিবিরে জন্ম নেয়া মানুষগুলো তাদের মাতৃভূমি উদ্ধারের আকাক্সক্ষায় প্রতিনিয়ত অস্ত্র-গোলাবারুদ নয়, হাতে পাথর আর অন্তরের তীব্র ক্ষোভ নিয়ে এভাবেই মুক্তি সংগ্রামে লিপ্ত রয়েছে। এর বিনিময়ে সকল রকম মারণাস্ত্র ও পারমাণবিক অস্ত্র সম্বলিত ইসরাইলি বাহিনীর ব্রাশফায়ারে প্রাণ দিচ্ছে অহরহ। নারী শিশু বৃদ্ধ কেউ রেহাই পাচ্ছে না এ হায়েনাদের হাত থেকে।
বায়তুল মাকদিস বা আল কুদস সম্পর্কিত তথ্য
মসজিদে আকসা সম্পর্কে পবিত্র কুরআন মজিদে দুবার উল্লিখিত হয়েছে। মক্কার ১৩ বছর এবং মদীনায় ১৭ মাস মুসলমানদের ক্বিবলা ছিল মসজিদে আকসা। বিভিন্ন বর্ণনায় এ মসজিদ ফেরেশতাদের তৈরি, হযরত আদম আ. কর্তৃক নির্মিত, হযরত শিশ (আ.), হযরত নূহ আ., হযরত ইবরাহীম (আ.)-কে নির্মাতা হিসেবে বলা হয়েছে। বোখারী শরীফের ৩১৮৬ নং হাদিস অনুযায়ী হযরত আবুজার গিফারী (রা.) বর্ণিত হাদীসে কাবা গৃহের ৪০ বছর পর মসজিদে আকসা নির্মিত হয়েছে বলে বলা হয়েছে। ১ লক্ষ চুয়াল্লিশ হাজার বর্গমিটার এরিয়ার ওপর বায়তুল মুকাদ্দাস বা আল কুদস শহর অবস্থিত। এখানে মসজিদ আকারে ২টি স্থাপনা রয়েছে। প্রধান মসজিদ মসজিদে কিবালী ও মসজিদে কুব্বাতছু ছাখরা ও মুছাল্লা (মসজিদ) হিসেবে রয়েছে আরো ৫টি স্থাপনা। ছোট-বড় মিলিয়ে ১৫টি গম্বুজ, ১২টি মাদরাসা, ২৫টি কূপ, ২৩টি মাসতাবা (খালি মাঠে বর্গাকৃতির উঁচু জায়গা) ৮টি বায়েকা (গেটসদৃশ একাধিক স্তম্ভের স্থাপনা) ৪টি আযানখানা সহ বিভিন্ন ধরনের ১৯০টি স্থাপনা রয়েছে। মসজিদে আকসার ১৫টি দরজার ১০টি ব্যবহৃত হচ্ছে। এর ওপরে রয়েছে সীসার গম্বুজ, এটি ১৫ হিজরিতে খলিফা হযরত ওমর (রা.) নির্মাণের নির্দেশ দেন। এখানে দাঁড়িয়ে খতিব ইমামতি করেন। কুব্বাতুছ ছাখরা (পাথর গম্বুজ মসজিদ) ইসলামি স্থাপত্যের প্রাচীন ও অন্যতম নির্দশন। খলিফা আবদুল মালেক বিন মারওয়ান ৬৬ থেকে ৭২ হিজরীতে এর নির্মাণ সম্পন্ন করেন। এর অভ্যন্তরে বৃত্তের মাঝখানে পাথর রয়েছে। যার ওপর দাঁড়িয়ে বোরাকে আরোহণ করে মহানবী (সা.) মেরাজে গিয়েছিলেন।
ঐতিহাসিক তথ্যসমূহ
আল কুদস এর মূল অধিবাসীরা কেনান থেকে এসে এখানে প্রথম বসতি স্থাপন করে। হযরত মূসা আ. বনি ইসরাইলকে এখানে নিয়ে আসলেও তারা পরবর্তীকালে বিতাড়িত হয়। ৯১৫ খ্রিস্ট পূর্বে জালেম বাদশা জালুতের বিরুদ্ধে ন্যায়পরায়ণ বাদশা তালুতের পক্ষে যুদ্ধে করে দাউদ আ. জালুতকে হত্যা করে। হিব্রু ভাষায় ‘উরে সালিম’ ইংরেজিতে জেরুসালেম বা আল কুদসের বাদশা হন। সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হাদিস (১৪০৮) অনুযায়ী দাউদ আ. এর পুত্র হযরত সুলাইমান বাদশা মসজিদে আকসা ও জেরুসালেম (আল কুদস) শহর পুনঃনির্মাণ করেন। ৫৮৭ খ্রি. পূর্বে সম্রাট বখতে নছর জেরুসালেম দখল করে মসজিদে আকসা ধ্বংস করেন এবং বনি ইসরাইলে অধিকাংশকে হত্যা করে বাকিদের ব্যাবিলনে নিয়ে যান। এর ৫০ বছর পর পারস্য সম্রাট সাইরাস বনি ইসরাইলকে জেরুসালেমে প্রবেশের অনুমতি দেন। ৩৩০ খ্রি. পূর্বে মহাবীর আলেকাজান্ডার জেরুসালেম দখল করেন। খ্রি. পূর্ব ১৫২ অব্দে ইহুদি মুকাবি বিদ্রোহীরা জেরুসালেম দখল করে রাজধানী স্থাপন করেন, এরা সম্রাট এবং পম্পেওর অনুগামী রোমানরা মিলে হযরত ঈসা আ. এর বিরোধিতা করেন। এসময় রোমানদের অত্যাচারে কিছু ইহুদি মদীনায় চলে গিয়েছিল। শেষ নবী সা.-কে এস্তেকবাল জানানোর জন্য। কিন্তু তাদের উত্তরসূরি ইহুদিরা বেশির ভাগই মহানবী (সা.)-এর বিরুদ্ধাচরণ করেছেন। বর্তমান যায়নযাদীরা তাদেরই উত্তরসূরি। মহানবী (সা.)-এর সময় জেরুসালেম খ্রিস্টানদের দখলে ছিল। ১৫ হিজরিতে ইয়ারমুকের যুদ্ধের পর জেরুসালেমে ইসলামের পতাকা উড্ডীন হয়। ১১৯৯ সালে খ্রিস্টান ক্রুসেডাররা জেরুসালেম দখল করে। তারা কুব্বাতুছ ছাখরাকে গির্জায় পরিণত করে। আল আকসা মসজিদকে রাজকীয় প্রাসাদ বানায়। ৮৮ বছর পর গাজী সালাহ উদ্দিন আইউবী জেরুসালেম পুনরুদ্ধার করে কুব্বাতুছ ছাখরা থেকে ক্রুসেড চিহ্ন সরিয়ে চাঁদ স্থাপন করেন। ১ম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে ব্রিটিশরা ফিলিস্তিন দখলের ম্যান্ডেট নিয়ে সেখানে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়।

মহাদুর্যোগ ও দখলদারিত্বের ৭০ বছর
তারও আগে ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার জেমস বেলফোর ইহুদিদের জন্য ফিলিস্তিনে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। এরপরই যায়নবাদী ইহুদিরা ব্রিটিশ সহযোগিতায় ফিলিস্তিনে জমি ক্রয় করে অনুপ্রবেশ শুরু করে। তাদের চক্রান্তের নীল নকশা অনুযায়ী ১৯৪৮ সালকে টার্গেট করা হয়। ১৯৪৫ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান ফিলিস্তিনে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন। ব্রিটিশ সেনাদের সহায়তা নিয়ে ১৯৪৭ সালে বোমা ও মাইন বিস্ফোরণ করে ফিলিস্তিনের অনেকগুলো গ্রাম সমূলে ধ্বংস করে মুসলমানদের হত্যা অথবা বহিষ্কার করে সেখানে বিভিন্ন দেশ থেকে এনে ইহুদিদের পুনবার্সন শুরু করা হয়। অবৈধ ইসরাইলের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জল্লাদ বেন গুরিয়ান তার ডায়রিতে ১৯৪৮ সালের ১২ মে তারিখে লিখেছেন ‘আজ দারাস গ্রামে মর্টার হামলায় ৫০ জন আরব নিহত হয়েছে। বাকিরাও গ্রাম ছেড়ে পালিয়েছে। একই দিনে বাসিত ও সাত্তয়াদী নামে আরো দুটি গ্রাম দখল করেছে।’ (যুদ্ধের দিনগুলো ১৯৪৭-৪৯ খ্রি.) ১৯৪৮ সালের ১৪ মে তেল আবিবকে রাজধানী করে বেন গুরিয়ানকে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করে ফিলিস্তিনের বুকের ওপর অবৈধ রাষ্ট্র ‘ইসরাইল’ এর জন্ম দেয়া হয়। ঘোষণার মাত্র ১০ মিনিটের মধ্যে ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট টারভিন ইসরাইলের স্বীকৃতি দিয়ে পাশে দাঁড়ায়। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ফ্রান্স ও রাশিয়া স্বীকৃতি দেয়। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র, গোলাবারুদ ও অর্থ দিয়ে ইসরাইলকে ভয়াবহ, আগ্রাসী পারমাণবিক রাষ্ট্রে পরিণত করা হয়। উদ্দেশ্য একটাই আরব ও মুসলিমদেরকে আজীবনের জন্য পর্যদুস্ত করে রাখা। শুরু হয়ে যায় অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইলের গণহত্যা, রাহাজানি, দখল, লুটপাট, মানবতার বিরুদ্ধে জঘন্যতম সব অপরাধ, যা দীর্ঘ ৭০ বছর যাবৎ সমানে চলছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ মোড়লরা একদিকে অস্ত্র ও অর্থ দিয়েছে অন্যদিকে বারবার ভেটো প্রয়োগ করে জাতিসংঘের সব প্রস্তাব ও উদ্যোগকে ভণ্ডুল করে দিয়েছে।
নির্যাতন, নির্মমতার কিছু উদাহরণ
রাষ্ট্র ঘোষণার দিনই ইয়ামিন গ্রামের ৪০০ অধিবাসীর ২৫০ জনকে হত্যা করে। অনেকের অঙ্গ-প্রতঙ্গ কেটে নেয়। আগুনে পুড়িয়ে মারে, চোখ তুলে নেয়, নারীদের স্তন কেটে নিয়ে নির্যাতনের অশুভ সূচনা করে। ৪৮ সালে হাল্লাদ ও রামাল্লার কয়েকশ’ মানুষকে হত্যা করে। ১৯৪৮ সালে নাসিরুদ্দিন গ্রামের ৪০ জন বাদে সবাইকে, কাবু গ্রামের ২০ জন বাদে সবাইকে, দারোস গ্রামের সবাইকে ইসরাইলি জল্লাদ বাহিনী মসজিদে এনে গ্রেনেড নিক্ষেপ করে হত্যা করে।
এভাবে শুরুতেই তারা পশ্চিম জেরুসালেম দখল করে নেয়। ৩ বছরে ১০ লক্ষাধিক ফিলিস্তিনি মুসলিম নিজেদের বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ হয়ে জর্ডান, লেবানন, সিরিয়া কিংবা অন্য কোথায়ও উদ্বাস্তু শিবিরে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। গৃহহীন ফিলিস্তিনিদের সংখ্যা পরবর্তীকালে ৫০ লক্ষ ছাড়িয়ে যায়। ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ফিলিস্তিনের জনগণকে নিজ এলাকায় ফিরে যাওয়ার অধিকারের স্বীকৃতি দেয়া হলেও দীর্ঘ ৭০ বছরে সে প্রস্তাব বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় নি।
৭০ বছরে ইসরাইলি জল্লাদদের অপরাধের ইতিহাস এ সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধে উপস্থাপন সম্ভব নয়। এরা ১৯৮২ সালে লেবানন দখল করে ২৫ হাজার মানুষকে হত্যা করেছে। ইন্তিফাদার ৫ বছরে ১৬ শ’র বেশি শিশু-কিশোরকে হত্যা করেছে। ৬০ থেকে ৭৫ হাজারকে আহত ও বিকলাঙ্গ করেছে। হত্যা, গ্রেফতার, কারাগারে নির্যাতন করে হত্যা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কাঁদানে গ্যাস, বোমা ইত্যাদি নিক্ষেপ তাদের নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। তারা ১৯৮৩ সালে ‘সাবরা’ ‘শাতিলা’ রিফিউজি ক্যাম্পে আক্রমণ করে শত-সহস্ত্র নিরপরাধ উদ্বাস্তু ফিলিস্তিনিকে হত্যা করে। ১৯৬৫ সালে ৫ বার জর্ডানে বোমা হামলা করে ২ শতাধিক মানুষ হত্যা করে। ১৯৯৪ সালে আল খলিলে হযরত ইবরাহীম আ. এর মাজার সংলগ্ন মসজিদে হামলা করে শতাধিক লোককে হত্যা করে। ১৯৯৬ সালে লেবাননের কুনা শহরে হামলা করে ১৭০ জনকে হত্যা করে। ২০০০ সালে সূচিত দ্বিতীয় ইন্তিফাদায় ২০০৯ সাল পর্যন্ত ৬৩৪৮ জন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে। ২০০৬ সালের ১২ জুলাই থেকে ১৪ আগস্ট পর্যন্ত সাড়ে ১১শ’ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে। ১৯৬৭ সালে তারা ফিলিস্তিনের বাকি অংশসহ মিশরের সিনাই ও গাজা, সিরিয়ার বেকা, জর্ডানের অধীনস্থ পশ্চিম তীর সহ বিশাল আরব ভূমি অনেক রক্ত ও লাশের ওপরে দখল করে নেয়। ১৯৬৯ সালের ২২ আগস্ট বর্ণবাদী ইহুদি ঘাতক ‘রোহান’ মসজিদে আকসায় আগুন লাগিয়ে দেয়। এতে মসজিদে কিবালী (মূল মসিজদ) ও সালাউদ্দিন নির্মিত মিম্বর পুড়ে যায়। বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদ বিক্ষোভ হয়। এরই প্রেক্ষিতে ১ মাস পর ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৬৯ সালে মরোক্কোর রাবাতে মুসলিম দেশসমূহের শীর্ষ নেতারা সম্মেলন করে ফিলিস্তিন ও মুসলিম স্বার্থ রক্ষার লক্ষে ওআইসি গঠন করে। এর প্রথম মহাসচিব ছিলেন মালয়েশিয়ার নেতা টেংকু আবদুর রহমান। ১৯৭২ সালে জর্ডান পুড়ে যাওয়া মসজিদের সংস্কার কার্যক্রম সম্পন্ন করে।
ইসরাইল ১৯৮২ সালে লেবাননের বৈরুত সহ বিশাল এলাকা দখল করে নেয়। ২০০৭ সালে হিজবুল্লাহর সঙ্গে ৩৪ দিন ব্যাপী যুদ্ধ হয়। ২০১৪ সালে ৯ জুলাই থেকে শুরু হয় নতুন করে ফিলিস্তিনিদের ওপর হামলা ও হত্যাযজ্ঞ। এতে ২২ জুলাই পর্যন্ত ৬০০ এর বেশি ফিলিস্তিনি শাহাদাত বরণ করে। ২০১২ সালেও একই ভাবে ৮ দিনের যুদ্ধে ১৭০ ফিলিস্তিনি শহীদ হয়।
১৯৮০ সালের ৩০ জুলাই ইসরাইলি পালার্মেন্ট ‘নেসেট’ জেরুসালেম তথা আল কুদসকে ইসরাইলের ‘চীরকালীন’ রাজধানী ঘোষণা করে। ১৯৯০ সালে মার্কিন সিনেট বায়তুল মোকাদ্দাসকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেয় (৩৭৮/৩৪ ভোটে)। তারও ২৮ বছর পর ইসলাম ও মানবতার শত্রু ডোনাল্ড ট্রাম্প এর নেৃতত্বে যুক্তরাষ্ট্র গত ১৫ মে ইসরাইলের ৭০তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে দূতাবাস তেল আবিব থেকে আল কুদস এ স্থানান্তর করলো যার মূল্য দিল শতাধিক শহীদ ফিলিস্তিনি জীবন দিয়ে আর প্রায় ৩ হাজার আহত হয়ে।
শুরু থেকেই চাপিয়ে দেয়া রাষ্ট্র ইসরাইলের সীমানা, লক্ষ্য, কার্যক্রম নিয়ে এক ধরনের ধোঁয়াশা রয়েছে। ইসরাইলের জন্মদাতা ব্রিটেন ও আমেরিকার বক্তব্য ও বাস্তবতার মধ্যে রয়েছে আকাশ-পাতাল ফারাক। বেলফোর ঘোষণার অনেক পরে ১৯৩৯ সালে ১৭ মে ব্রিটিশ সরকার ফিলিস্তিনে একটি মুসলিম ও ইহুদিদের যৌথ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়। ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ জেরুসালেম বা আল কুদসকে আন্তর্জাতিক শহর তথা ইহুদি ও মুসলিমদের সম্মিলিত শহর হিসেবে ঘোষণা দেয়। ৪৮ সালে ইসরাইল প্রতিষ্ঠার ঘোষণায় কোন সীমানা উল্লেখ নেই। ব্রিটিশ, আমেরিকা, তাদের সহযোগীরা ও জাতিসংঘ ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইলের পাশাপাশি ফিলিস্তিনের জনগণের অধিকারের কথাও বলে আসছে। অথচ আমরা বাস্তবে কী দেখি? রাষ্ট্র ঘোষণার ১ বছর আগ থেকেই ব্রিটিশ সেনাদের সহায়তায় ইহুদিরা ফিলিস্তিনের বিভিন্ন গ্রামে হামলা করে গ্রামবাসীদের হত্যা করে গ্রাম দখলে নিয়ে ইহুদিদের বসতি স্থাপন শুরু করে। তারা ‘তেল আবিবে’ রাজধানী স্থাপন করে। ৫৬ সালের যুদ্ধে তারা মিশরের কাছ থেকে ‘সিনাই’ দখল করে নেয়। ৬৭ সালের আরব ইসরাইল যুদ্ধে তারা মিশরের গাজা, সিরিয়ার বেক্কা, জর্ডানের পশ্চিম তীর, পূর্বে জেরুসালেম ও ওল্ডসিটি (প্রাচীন নগরী) দখল করে নেয়। ৭৩ সালের যুদ্ধে তারা সিরিয়ার গোলান মালভূমি দখল করে নেয়। তাদের এই দখল, উৎখাত ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা কতটুকু বিস্তৃত হবে তার কোন সীমারেখা নেই।
আমরা লক্ষ করেছি শুরু থেকেই যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও তাদের সহযোগীরা কখনো সরাসরি, কখনো জাতিসংঘের মাধ্যমে ফিলিস্তিন ইস্যুতে ‘শান্তি শান্তি’ খেলা খেলছে। কখনো ফিলিস্তিনি জনগণের পক্ষে জাতিসংঘের প্রস্তাব এনে মুসলিম উম্মাহ ও বিশ্ব জনমতকে ধোঁকা দিচ্ছে। ১৯৬৭ সাল থেকে ২০১৬ পর্যন্ত জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ অন্তত ১০ বার বায়তুল মোকাদ্দাস এর পবিত্রতা ও মুসলিম অধিকারের স্বীকৃতি দিয়ে প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। প্রথমদিন থেকেই ২ রাষ্ট্রের ধারণা দিয়ে ফিলিস্তিনিদের শান্ত করার চেষ্টা করছে। শান্তি শান্তি খেলায় ১৯৭৭ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট কার্টারের মধ্যস্থতায় ইসরাইল ও মিশরের মধ্যে ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি হয়। ‘শান্তির কলা’ দেখিয়ে পিএলওকে আজীবনের জন্য ‘বশ’ করে রাখা হয়েছে। এই শান্তি শান্তি খেলায় সর্বোচ্চ পাওয়া হচ্ছে একটি আলাদা ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের নামে একটি ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের ঘোষণা। গাজায় কঠোর নিয়ন্ত্রণে যা আজ শুধু অবরুদ্ধই নয়, প্রায় অকেজো। ইসরাইলি অবরোধ ও নির্যাতনে সেখানকার অধিবাসীরা আজ মানবেতর জীবন যাপন করছে। ত্রান সংস্থাও সেখানে ঔষধ কিংবা ত্রান সামগ্রী নিয়ে যেতে পারছে না। সেই আলাদা রাষ্ট্রের রাজধানী হচ্ছে পশ্চিম জেরুসালেম তথা আল কুদস। এ কারণেই ১৯৮০ সালে রাজধানী ঘোষণা দেয়া সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র তাদের দূতাবাস স্থানান্তর করেনি। কিন্তু ইসলাম ফোবিয়ায় আক্রান্ত ট্রাম্প গত ১৪ মের অঘটন ঘটিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে শালিসের ভূমিকা দূরে থাক, পর্যবেক্ষকের ভূমিকার জন্যও অনুপযুক্ত প্রমাণ করলেন। কথা হচ্ছে ইসরাইল তথা যায়নাবাদীরা কারো সমঝোতা কিংবা সালিশ মানে না। তারা তাদের নৃশংসতা, নির্মমতা দিয়ে হত্যা, দখল, নির্যাতন-নিপীড়নের মাধ্যমে তাদের মূল গোপন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজে এগিয়ে যাচ্ছে। আগে ব্রিটেন যুক্তরাষ্ট্রের কথায় তারা চলেছে, এখন শুধু যুক্তরাষ্ট্র আর ব্রিটেনই নয়, আশপাশের আরব ও মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের রাজা-উজিরদের কেউ কেউ ইসরাইলের কথায় উঠ-বস করে। প্রশ্ন আসে ইসরাইলি পরিকল্পনাটি কী? বিভিন্ন দেশে ইহুদি নিধনের প্রেক্ষিতে ১৮৯৬ সালে ইহুদি পণ্ডিত থিউডর হার্জল ইহুদিদের জন্য ইহুদি ধর্মগ্রন্থের নির্দেশনা মাফিক একটি সূদুরপ্রসারী পরিকল্পনা বা নীল নকশা প্রণয়ন করে। তখন থেকেই বিশ্বের ইহুদি নেতৃস্থানীয়দের সমন্বয়ে তার প্রণীত ‘ইহুদি চক্রান্ত’ বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেন। ১৮৯৭ সালে সুইজারল্যান্ড এর বার্সনে ইহুদিদের প্রথম বিশ্ব কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। এখান থেকেই শুরু, ১৯৪৮ সালে ‘ইসরাইল’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে প্রথম ধাপ সফল হলে পরবর্তী ধাপগুলো একের পর এক বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। এ পরিকল্পনা অনুযায়ী ইসরাইল রাষ্ট্রের সীমানা হবে নীল নদ থেকে ফোরাত নদী পর্যন্ত। পশ্চিমে সিরিয়া, দক্ষিণে তুরস্ক। লেবানন, জর্ডান, মিশর, সিরিয়ার বিশাল ভূমি নিয়ে তাদের পরিকল্পিত বৃহত্তর ‘ইসরাইল’ প্রতিষ্ঠা করবে। এ পরিকল্পনায় ইসরাইল হবে সারা বিশ্বের নিয়ন্ত্রক শক্তি। বিশ্বের রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করবে ইহুদিবাদীরা।
সে পরিকল্পনায় তারা অনেকাংশে সফল। ২০০০ সাল থেকে এ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের মাধ্যমে ৬টি মুসলিম দেশ (ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া, সিরিয়া, দক্ষিণ সুদান, ইয়ামেন) প্রায় ধ্বংস করতে সফল হয়েছে। সে পরিকল্পনায় তাদের এখন একমাত্র টার্গেট ইরান। ইরানকে হটিয়ে তাদের বৃহত্তর পরাশক্তি ইসরাইল প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বিভোর তারা। ইহুদিবাদী রাষ্ট্র ইসরাইলের জন্মের আলামত পেয়েই তা প্রতিরোধের লক্ষে আরব জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে আরব লীগ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৪৫ সালে। ইসরাইল প্রতিষ্ঠার পর ১৯৪৮, ১৯৫৬, ১৯৬৭, ১৯৭৩ সালে চার চারটি যুদ্ধে সব আরব রাষ্ট্র মিলেও যুক্তরাষ্ট্রের মদদপুষ্ট ইসরাইলের কাছে হেরে যায়। ১৯৬৯ সালে মসজিদুল আকসায় আগুন দেওয়াকে কেন্দ্র করে ওআইসি (ইসলামি সম্মেলন সংস্থা) প্রতিষ্ঠিত হয়। ফিলিস্তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামী সংগঠনগুলো মিলে পিএলও এর নেতৃত্বে কখনো সশস্ত্র কখনো সংগ্রাম, কখনো সংলাপের মাধ্যমে অনেক চেষ্টা করেও পেয়েছে কেবল নির্যাতন, নির্মমতা, আশ্বাস, আর প্রতারণা। ১৯৭৯ সালে ইরানের ইসলামি বিপ্লবের পরপরই বিপ্লবের নেতা ইমাম খোমেইনী (র.) বিশ্ব মুসলিমকে আল কুদস এর মুক্তির লক্ষে ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে এগিয়ে আসার আহব্বান জানান। তিনি বিশ্বব্যাপী রমজানের শেষ শুক্রবারকে আল কুদস দিবস পালনের মাধ্যমে ফিলিস্তিনীদের সংগ্রামের প্রতি সমর্থন ও সংহতি প্রকাশের ডাক দেন। এরই ফলশ্রুতিতে নব্বই এর দশকে ফিলিস্তিনীদের মুক্তি সংগ্রামে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়। সৃষ্টি হয় ফিলিস্তিনের আপোসহীন সংগ্রামী কাফেলা ‘হামাস’। ১৯৮৭ সালে শিশু-কিশোরদের ইট-পাথর নিক্ষেপের মাধ্যমে প্রতিরোধ সংগ্রাম ‘ইন্তিফাদা’। পাশাপাশি লেবাননে সংগঠিত হয় ইসরাইলবিরোধী নতুন ইসলামি কাফেলা হিজবুল্লাহ। যাদের আপোসহীন বিপ্লবী প্রতিরোধে ইসরাইলের বেশ ক‘টি আক্রমণ আগ্রাসন ব্যর্থ হয়েছে। তাইতো চক্রান্তকারী ইহুদিবাদীরা নতুন নতুন নীল নকশা নিয়ে মাঠে নেমেছে। তারা বিশ্বব্যাপী শিয়া-সুন্নি সংঘাত ছড়িয়ে দিয়ে ইরানকে এক ঘরে করার চেষ্টা চালাচ্ছে। অন্যদিকে আফগানিস্তান, ইরাক ও লিবিয়াকে ধ্বংসস্তূপ বানিয়ে এবার ইয়ামেন ও সিরিয়াকে টার্গেট করে নতুন যুদ্ধ ক্ষেত্র তৈরি করেছে। এ ছাড়া আল কায়দা, আইএস ও কুর্দিদের সশস্ত্র বাহিনী তৈরি করে গোটা মুসলিম বিশ্বকে দোযখের দারপ্রান্তে এনে দাঁড় করিয়েছে। উদ্দেশ্যে একটাই মধ্যপ্রাচ্যের ভৌগোলিক মানচিত্রের পরির্বতন করে দেওয়া। অনেকগুলো ছোট ছোট দুর্বল রাষ্ট্র তৈরি করে ইসরাইলের মানচিত্র বৃহত্তর করে ইসরাইলকে বিশ্বের নিয়ন্ত্রক শক্তি বানানোর মাধ্যমে যায়নবাদী নীল নকশার বাস্তবায়ন। এ ক্ষেত্রে তাদের বর্তমান প্রধান প্রতিবন্ধক হচ্ছে ইরান ও তুরস্ক। তাইতো পারমাণবিক চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্র সরে গিয়ে ইরানকে একঘরে করার চেষ্টা চালাচ্ছে। প্রয়োজনে ইরানের ওপর সামরিক আগ্রাসনের পথে হাঁটবে বলে হুমকি দিচ্ছে ইহুদিবাদী ইসরাইল ও তার চিরসাথি যুক্তরাষ্ট্র। আজ সময় এসেছে বিশ্ব মুসলিমের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার। লেবানন ও ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়ে ইহুদিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বের সকল মুসলিম ও মানবতাবাদী মানুষকে এ সংগ্রামের পক্ষে সর্বাত্মক সমর্থন জানাতে হবে। হারামাইন শারিফাইন এর নিরাপত্তার নামে মূলত রাজতন্ত্রের প্রতিরক্ষার জন্য তাদের নেতা ডোনাল্ড ট্রাম্পের উপস্থিতিতে মুসলিম বিশ্বের যৌথ বাহিনী গঠনের উদ্যোগ হয়েছে। অথচ আজ প্রয়োজন ইহুদিবাদের দখলকৃত আমাদের প্রথম কিবলা পবিত্র মসজিদুর আকসা মুক্ত করার লক্ষে মুসলিম বিশ্বের যৌথ বাহিনী গঠন। আমরা আশা করব, মুসলিম উম্মাহ ঐক্যবদ্ধ হয়ে যায়নবাদের বিরুদ্ধে আল কুদসকে মুক্ত করার লক্ষে যৌথ প্রতিরোধ আন্দোলনের উদ্যোগ গ্রহণ করবে। বিশ্ব মুসলিমদের সর্বাত্মক সমর্থন ও অংশগ্রহণের মাধ্যমে বিশ্বের অশুভ শক্তির সৃষ্ট অবৈধ কৃত্রিম রাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যের বিষফোঁড়া ইসরাইলের বিলুপ্তি ঘটানোর মাধ্যমেই ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা, আল কুদস এর মুক্তি এবং বিশ্ব শান্তি নিশ্চিত করা সম্ভব।
সম্পাদক, দৈনিক আজকের ভোলা।
[প্রবন্ধটি গত ৮ জুন, ২০১৮ ঢাকাস্থ বিএমএ অডিটোরিয়ামে আয়োজিত
আল-কুদ্স দিবস উপলক্ষে আয়োজিত সেমিনারে পঠিত হয়।]

ইরানি প্রবাদ বাক্য

سگ صاحبش را نمی شناخت
উচ্চারণ : সাগ্ সা’হেবাশ রা’ নেমী শেনা’খ্ত
অর্থ : কুকুর তার মালিককে চিনছিল না।
মর্মার্থ : প্রচণ্ড ভীড় ও গোলযোগ বুঝাতে এই প্রবাদ প্রচলিত। যেমন বলা হয়, সুঁই রাখার জায়গা ছিল না।
سگ هارم نگرفته است
উচ্চারণ : সাগ্ হা’রেম নাগেরেফতে আস্ত
মর্মার্থ : এই প্রবাদ দ্বারা এ কথা বুঝানো হয় যে, অকারণে আমি ক্রদ্ধ হই নি। নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে, যার জন্যে আমি বেসামাল হয়ে গেছি।
سگی به بامی جسته گردش به او نشسته
উচ্চারণ : সাগী বে বা’মী জাস্তে গেরদাশ্ বে উ নেশাস্তে
অর্থ : একটি কুকুর ছাদে লাফ দিয়েছে আর তার ধুলোবালি তার উপর বসে আছে।
মর্মার্থ : ঐসব লোককে বুঝাতে এই প্রবাদ ব্যবহৃত হয়, যারা কোনো নামী-দামি পরিবারের সাথে পরিচয়ের সূত্রে গর্ব করে বেড়ায়। সবার চোখে ধুলো দিতে চায়।
سلام روستائی بی طمع نیست
উচ্চারণ : সালা’মে রুস্তা’য়ী বী তামা‘ নীস্ত
অর্থ : গ্রাম্য লোকের সালাম কোনো লোভ ছাড়া নয়।
মর্মার্থ : কেউ যখন নিজেকে খুব ছোট ও অনুগত হিসেবে উপস্থাপন করে তখন বুঝতে হবে যে, এর পেছনে কোনো স্বার্থ বা মতলব আছে।
سلانه سلانه راه رفتن
উচ্চারণ : সেলানে সেলানে রাহ রাফতান
অর্থ : ঠমকে ঠমকে পথ চলা।
মর্মার্থ : ঠমকে ভারিক্কি চালে পথচলা বোঝাতে এর ব্যবহার। হেলে দুলে পথ চলা, ঠমক দেখানো।
سماق مکیدن
উচ্চারণ : সোমা’ক মাকীদান
অর্থ : সোমাক চূষতে থাকা। সোমাক টকজাতীয় ফলবিশেষ।
মর্মার্থ : এই প্রবাদের মর্মার্থ হলো অপেক্ষায় বেসে থাকা। অলীক কল্পনা মাথায় নিয়ে চলা। কোনো কিছু নিয়ে মনখোশ করে বসে থাকা।
অনুবাদ : আবু আব্দুল্লাহ

নজরুলের কবিতায় কোরবানি ও ঈদ-উল-আযহা

আমিন আল আসাদ : আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সমগ্র সাহিত্যকর্ম আমাদের জাতীয় জীবনের নানাবিধ অধ্যায় ও বৈশিষ্ট্যকে পূর্ণরূপে ধারণ করে আছে। কবি নজরুল ইসলাম এমন এক বিস্ময়কর কাব্যমেধার নাম যাঁকে কোন দেশ-কাল-পাত্রের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ করা যায় না। তিনি সর্বজনীন ও বিশ্বজনীন। তাঁর কবিতা ও গান প্রথমত স্পর্শ করেছে মানবতাকে। দেশাত্মবোধ, স্বজাত্যবোধ, অসাম্প্রদায়িকতাবোধ সহ সামাজিক ও মানবিক জীবনের বিভিন্ন দিক ও বিভাগকে তিনি প্রাধান্য দিয়েছেন তাঁর লেখনিতে। নজরুল জীবনের বহুমাত্রিকতাই তাঁকে জাতীয় পর্যায়ে যেমন করেছে মহিমান্বিত, তেমনি আন্তর্জাতিকতা প্রাপ্তও হয়েছেন তিনি। নজরুলের কবিতা ইংরেজি, হিন্দি, উর্দু, ফারসি, ফরাসি, রুশ ও চৈনিক ভাষাতে অনূদিত হয়েছে। বিশ্বজন কর্র্তৃক তিনি সমাদৃত হয়েছেন বলেই বিগত ২০০৪ সালের সেপ্টেম্বরে পারস্যের কবিদের গুল বাগিচায় ইরান-বাংলাদেশ যৌথ উদ্যোগে আন্তর্জাতিক নজরুল সম্মেলনে ইরানের সাংস্কৃতিক মন্ত্রী বলতে বাধ্য হয়েছেন, ‘নজরুল আমাদেরই সম্পদ। প্রচণ্ড ঝড়ো হাওয়া নজরুলকে আমাদের মাঝখান থেকে বাংলাদেশের কাদামটিতে ফেলে দিয়েছে।’ জাতীয় জীবনের মতো আন্তর্জাতিকতা তাঁর সাহিত্যে স্থান পেয়েছে বলেই ভিন্ন দেশের সংস্কৃতি মন্ত্রীর কাছে নজরুলকে নিজের মনে হয়। নজরুল ইসলাম হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়কে নিয়েই ভেবেছেন এবং তাঁর সে ভাবনা তাঁর রচনায় ফুটে উঠেছে। এদিক দিয়ে তিনি ছিলেন সাম্প্রাদায়িক সম্প্রীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
তিনি অসাম্প্রদায়িক ছিলেন মানে এই নয় যে, তিনি নিজের ধর্ম সম্প্রাদায়কে উপেক্ষা করেছেন। অসাম্প্রদায়িকতা মানে এই নয় যে, নিজের ধর্মীয় জীবন-দর্শন, বোধ-বিশ্বাস, ধর্মীয় নৈতিকতা, আচার-আচরণ ও ধর্মের মূল দর্শনের অন্তর্নিহিত সত্যকে অস্বীকার করতে হবে বা পাশ কাটিয়ে চলতে হবে। তাই নজরুল নিজের দ্বীন-দর্শনকে সম্মান করেছেন এবং অন্যকেও মর্যাদার সাথে পাশে অবস্থান দিয়েছেন।
নজরুল ধর্মের অন্তর্নিহিত সৌন্দর্যকে মানবতার সৌন্দর্যরূপে পেশ করেছেন। ধর্মের ভেতরের মানবিক মূল্যবোধকে বের করে এনেছেন। ধর্মের তথাকথিত ধ্বজা নয় এবং আচারস্বর্বস্ব বক-ধার্মিকতা নয় বরং ধর্মের সঙ্গে যে নৈতিকতার প্রসঙ্গটি জড়িত সেই নৈতিকতাকে সকল অন্যায়-অবিচার, জুলুমের বিপক্ষে সংগ্রামে অসি ও ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছেন নজরুল। বাজিয়েছেন পরাধীনতা থেকে জাতির মুক্তির রণবাদ্য।
ধর্মীয় উপলক্ষসমূহের ভেতর যে দর্শন কাজ করে বা কোন ঐতিহাসিক ঘটনা যা ধর্মের উপলক্ষ হিসেবে স্মরণীয় বা চর্চিত হয়ে এসেছে এর ভেতরের চেতনাকে গণমুক্তির চেতনা হিসেবে নজরুল তাঁর ভাষায় প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছেন। আর যেহেতু ইসলাম শুধু কতিপয় আচারসর্বস্ব ধর্ম নয়, এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান যার রয়েছে একটি সামাজিক অবকাঠামো যা বিশৃঙ্খল আরব জাতিকে করেছিল শৃঙ্খলাবদ্ধ ও সারিবদ্ধ করেছিল ঐক্যের মন্ত্রে। পরাধীনতার নাগপাশ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য সে ঐক্যের বিকল্প নেই।
নজরুলের যুগটি ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সূর্যাস্থ না যাওয়ার যুগ। নজরুল নানাভাবে বাংলার হিন্দু-মুসলমানকে যুগপৎভাবে জাগিয়ে দিতে চেয়েছেন পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে বেড়িয়ে আসার জন্য। মুসলমানদেরকে জাগানোর জন্য তিনি লিখেছেন, ‘মোহররম’, ‘কোরবানী’, ‘বকরিদ’, ‘শহীদী ঈদ’ সহ অনেক কবিতা।
ইসলামের অনন্য উৎসব ঈদ-উল-আযহা। বিশ্বের মুসলমানরা যে মুসলিম পরিচয় বহন করে, সেই পরিচয়ের প্রতিষ্ঠাতা হলেন হযরত ইবরাহীম (আ.)। তাই মুসলিম জাতিকে বলা হয় ‘মিল্লাতে ইবরাহীম’ বা ইবরাহীমের জাতি। ইবরাহীম (আ.) হচ্ছেন মুসলিম জাতির পিতা। ত্যাগের পরীক্ষায় বহুবার তিনি হয়েছিলেন পরীক্ষিত। প্রাণের চেয়ে প্রিয় পুত্রকে আল্লাহর রাহে কোরবানি করতে একটুও ছিল না দ্বিধা-সংকোচ। মানবতাকে বধ করা ছিল নার উদ্দেশ্য। উদ্দেশ্য ছিল ইবরাহীমের হৃদয় পরখ। উত্তীর্ণ হলেন ইবরাহীম (আ.) সেই পরীক্ষায়। আল্লাহ পাঠিয়ে দিলেন দুম্বা। ইসমাইল (আ)-এর পরিবর্তে সেই দুম্বা জবাই হয়ে গেল। সেই থেকে অদ্যাবধি চলছে ঈদুল আযহায় পশু কোরবানি। কিন্তু এ ঘটনায় অন্তর্নিহিত শিক্ষা যে ত্যাগ, তা ভুলে গিয়ে আমরাও কি আচারস্বর্বস্ব হয়ে যাই নি? আমাদের আচরণের ভেতর যে দর্শন বিচরণের কথা ছিল তা কোথায়? নজরুল তো সেই কথাই বলেছেন তাঁর ‘কোরবানী’ কবিতায়-
‘ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যগ্রহ’ শক্তির উদ্বোধন
দুর্বল ভীরু চুপ রহো ওহো খামখা ক্ষুব্ধ মন
ধ্বনী ওঠে রণি দুরবানীর
আজিকার এ খুন কোরবানীর
দুম্বাশির-রুমবাসীর
শহীদের শির সেরা আজি।’ [কোরবানী]
পরাধীনতার নাগপাশ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য যে জীবন দানের প্রয়োজন। সে জন্য ইবরাহীমের মতো পুত্র কোরবানি প্রয়োজন। জাতির জন্য হাজেরা মায়েদের পড়াতে হবে বলির বসন তাদের প্রিয় পুত্রকে। তবেই স্বাধীনতা আসতে পারে।
‘আস্তানা সিধা রাস্তা নয়
আযাদি মেলে না পস্তানোয়
দস্তা নয় সে সস্তা নয়।’’ [কোরবানী]
সেজন্য দরকার আলীর জুলফিকার-
“চরেছে খুন আজ খুনিয়ারার
মুসলিমে সারা দুনিয়াটার
জুলফিকার’ খুলবে তার
দুধারী ধার, শেরে খোদার
রক্তে পুত-বদন
ওরে শক্তি হস্তে মুক্তি, শক্তি রক্তে সুপ্ত শোন
ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যগ্রহ’ শক্তির উদ্বোধন।”
[ কোরবানী]
নজরুল তাঁর সংগ্রামী চেতনার ভেতরেই ঈদ-উল-আযহা বা কোরবানির ঈদের তাৎপর্য খুঁজে পেয়েছেন। সেটাই তিনি তাঁর ‘বকরীদ’ কবিতায় বলতে চেয়েছেন।
‘শহীদানদের ঈদ এলো বকরীদ
অন্তরে চির নৌ-জোয়ান যে তারি তরে এই ঈদ
আল্লার রাহে দিতে পারে যারা আপনারে কোরবান
নির্লোভ নিরহংকার যারা যাহারা নিরভিমান
দানব দৈত্যে কতল করিতে আসে তলোয়ার লয়ে
ফিরদাউস হতে এসেছে যাহারা ধরায় মানুষ হয়ে
অসুন্দর ও অত্যাচারীরে বিনাস করিতে যারা
জন্ম লয়েছে চির-নির্ভীক, যৌবন মাতোয়ারা
তাহাদেরি শুধু আছে অধিকার ঈদগাহে ময়দানে
তাহারাই শুধু বকরীদ করে জান-মাল কোরবানে।”
[বকরীদ/কাব্যগ্রন্থ জাগরণ]
আবার বলেছেন-
“ইব্রাহিমের মতো পুত্রেরে আল্লার রাহে দাও
নৈলে কখনো মুসলিম নও মিছে শাফায়াত চাও
নির্যাতিতের লাগি’ পুত্রেরে দাও না শহীদ হতে
চাকুরীতে দিয়া মিছে কথা কও- ‘যাও আল্লার পথে’?
বকরীদি চাঁদ করে ফরিয়াদ দাও দাও কোরবানী
আল্লারে পাওয়া যায় না করিয়া তাহার না-ফরমানী
——————————————–
ওমরে, খালেদে, মুসা ও তারেকে বকরীদে মনে কর
শুধু সালওয়ার পরিও না, ধর হাতে তলোয়ার ধরো।’’
[বকরীদ]
এভাবে নজরুল কোরবানি বা ত্যাগের মর্মকে উপলব্ধি করেছেন এবং মুসলিম বীরদেরকে জাতীয় জাগরণের প্রতীক ও প্রেরণা হিসেবে তুলে ধরেছেন। মহান বীরদের ও তাঁদের কোরবানি ও প্রচেষ্টাসমূহকে স্মরণ করেছেন যে প্রচেষ্টার মধ্যে দিয়েই জুলুম-জালিম উৎখাত হবে।
সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ্ব, জালিম-মজলুমের সংঘাত, শোষক-শোষিতের লড়াই, নিপীড়ক-নিপীড়িতের যুদ্ধ, ধর্ম-অধর্মের জিহাদ হচ্ছে মানব জাতির ইতিহাস। সত্যের সুরে অসুরকে বিদূরিত করতে আলোর গানে অন্ধকারকে বিদূরিত করতে জমায়েত হতে হবে শহীদের ঈদগাহে। উৎসর্গ করতে হবে আল্লার রাহে অর্থাৎ ন্যায়ের পথে সংগ্রামে জীবনের সবচেয়ে প্রিয় বস্তুকে।
‘‘শহীদের ঈদ এসেছে আজ
শিরোপরি খুন লোহিত তাজ
আল্লার রাহে চাহে সে ভিখ
জিয়ারার চেয়ে পিয়ারা যে
আল্লার রাহে তাহারে দে
চাহি না ফাঁকির মণি মানিক ।।

চাহিনা ক’ গাভী দুম্বা উট
কতটুকু দান? সে দান ঝুট
চাই কোরবানী চাই না দান
রাখিতে ইজ্জত ইসলামের
শির চাই তোর তোর ছেলের
দেবে কি? কে আছো মুসলমান?’’ [শহীদি ঈদ]
সা¤্রাজ্যবাদী শোষণের অক্টোপাশ থেকে মুক্ত হতে হলে প্রয়োজন জীবনের চেয়ে দীপ্ত মৃত্যু। কোন এক দেশের বিপ্লবী নেতা বলেছিলেন, ‘আদর্শ বাস্তবায়ন বা স্বদেশেকে মুক্ত করা অথবা রক্ষা করা আমার কাজ নয়। আমার দায়িত্ব হচ্ছে আমার মাটিতে দুশমন পা রাখার আগে তাকে প্রতিরোধে দেশ ও আদর্শের জন্য আমার জীবন দিয়ে দেয়া’,’ যেমনিভাবে করি ফররুখ বলেছিলেন :
‘জীবনের চেয়ে দীপ্ত মৃত্যু তখনি জানি
শহীদী রক্তে হেসে ওঠে যবে জিন্দেগানী।’
কেননা, বাঁচার জন্য প্রয়োজন মৃত্যু। যারা বাঁচার জন্য ছোটে তারা বাঁচতে পারে না। যারা মৃত্যুভয় তুচ্ছ করে মরার জন্য ছোটে তারাই বেঁচে থাকে। তারাই মৃত্যঞ্জয়। নজরুল ইসলামও তাই বলেন–
‘শুধু আপনারে বাঁচায় যে
মুসলিম নহে ভ- সে
ইসলাম বলে বাঁচ সবাই
দাও কোরবানী জান ও মাল
বেহেশত তোমার কর হালাল
স্বার্থপরের বেহেশত নাই।’ [শহীদী ঈদ]
নজরুল আহ্বান করেছেন- ‘শির দে, খুন দে, বৎস শোন’
কেননা- ‘গোলামীর চেয়ে শহীদী দরজা অনেক উর্ধে জেনো
চাপরাশীর ওই তকমার চেয়ে তরবারী বড়ো মেনো।’
কবিগুরু রবীন্দ্র নাথ ঠাকুরও তাই বলেছেন :
‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী ভয় নাই ওরে ভয় নাই
নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।’
আর যারা অকাতরে প্রাণ বিলিয়ে শহীদ হতে পারে তারাই লাভ করতে পারে মুক্তি। উত্তর পুরুষের জন্য রেখে যায় স্বাধীনতা ও মুক্ত আবাসভূমি আর নিজেরা লাভ করে জান্নাত। ঈদের জামাত তো তাদেরি—-
‘আমাদের নয় তাদের ঈদ
বীর-সুত যারা হল শহীদ
অমর যাদের বীরবাণী।’ [শহীদী ঈদ]
নজরুল বলেছেন যখন পূর্ণ-আজাদ হবে স্বদেশভূমি, তখন পশু কোরবানি করো। আর পশু যদি জবাই করতেই হয় তবে মনের পশুকে আগে জবাই করো। তারপর প্রতীকি পশু জবাই করো আর গোশত খাও তাতে আপত্তি নাই।
‘মনের পশুরে কর জবাই
পশুরাও বাঁচে বাঁচে সবাই।’
একই ভাবাদর্শে আরেক কবি লিখেছেন-
‘আত্মত্যগের ঈদ হলো ভাই
ঈদুল আযহা কোরবানীর ঈদ
আত্মত্যাগের আদর্শে আজ
জাগিয়ে দাও ভাঙ্গিয়ে নিদ

শুধু পশু কোরবানী নয়
তারই সাথে করবো জবাই
মনের ভেতর পুষে রাখা
পশুটাকে আজকে সবাই।’
নজরুল বলেছেন। পশু কোরবানি দাও ভালো কথা। কিন্তু পশু কোরবানি স্বার্থক হবে তখন যখন দেশ মুক্ত হবে। দেশকে শত্রুর শৃঙ্খলে আবদ্ধ রেখে আযাদীর পায়ে ডাণ্ডা বেড়ি রেখে কেবল পশু কোরবানির আনুষ্ঠানিকতার দরকার কী?
পশু কোরবানি তখন দিও যখন দেশ ও সমাজ মুক্ত হবে সা¤্রাজ্যবাদী জুলুম থেকে।
‘পশু কোরবানী দিস তখন
আজাদ মুক্ত হবি যখন
জুলুম মুক্ত হবে রে দ্বীন
কোরবানীর আজ এই যে খুন
শিখা হয়ে যেন জ্বালে আগুন
জালিমের যেনো রাখে না চিন
আমিন রাব্বিল আলামিন।
আমিন রাব্বিল আলামিন ।।’’
যে পৃথিবীতে আজ আমাদের বসবাস। সে পৃথিবীতে রয়েছে বিভিন্ন দেশ, জাতি, ভাষা, ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী, গোত্র, দল, মত, মাজহাব, তরীকা ও অঞ্চলভেদে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের মানুষ। কিন্তু জালিমের কোন ধর্ম, মত, দল ও রাজনৈতিক পরিচয় নাই। তদ্রƒপ নিপীড়িতেরও নেই কোন দল-মত-গোষ্ঠী। সৃষ্টির আদিকাল থেকে এ পর্যন্ত প্রেক্ষাপট বদল হয়েছে, পরিবর্তন এসেছে পৃথিবীতে, কিন্তু জালিম-মজলুমের লড়াই আজো অব্যাহত আছে। বিভিন্ন ধর্ম, গোত্র, মাজহাব, তরীকা, বর্ণ, দল ও রাজনৈতিক মতাদর্শের নামে চলেছে মানুষের মুক্তির প্রচেষ্টা, তেমনি বিভিন্ন ধর্ম, গোত্র, মাজহাব, তরীকা, বর্ণ, দল ও রাজনৈতিক মতাদর্শের নামে চলছে জুলুমও। একমতের মানুষ কর্র্তৃক অন্য মতের মানুষকে দাবিয়ে রাখার চেষ্টা অতীতেও ছিল, আজো আছে। পৃথিবীর ইতিহাস হচ্ছে যখনি কোন মতের মানুষ শক্তিশালী হয়ে উঠেছে ও ক্ষমতার শীর্ষে উঠেছে তখনি ভিন্নমতের মানুষকে নিষ্পেষণ করার চেষ্টা করেছে। আজকের বিশ্বের মুসলিম-অমুসলিম দেশসমূহে যা দৃশ্যমান তা কোন ভিন্ন চিত্র নয়। আবার একপেশে নির্যাতিত মানুষরাও যখন উল্টোভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে এবং ক্ষমতাসীনকে হটিয়ে দিয়ে দখল করে নিয়েছে সেই শীর্ষ ক্ষমতা তখন তারাও মানবতা ও ন্যায়নীতি দেখায় নি পতিত শ্রেনিগোষ্ঠীর প্রতি। এটাই বিশ্বের নির্মম ইতিহাস। একমাত্র মহানবী (সা.) কর্তৃক মক্কা বিজয়ের ঘটনা ব্যতীত। সেদিন মহানবী (সা.)-এর নেতৃত্বে মক্কার বিজয়ী মুসলিম শক্তি বিজিত শক্তির ওপর কোন জুলুম তো করেই নি; বরং ক্ষমা করে দিয়েছেন সবাইকে। এটা কেবল তাঁর পক্ষেই সম্ভব। কারণ, তিনি আল্লাহর নবী। কিন্তু আমাদেরকেও শিখতে হবে আল্লাহর নবীর কাছ থেকেই। সামগ্রিক মানবতাকে রক্ষা করতে হলে দরকার যে ত্যাগের, দরকার যে কোরবানির, সে কোরবানির নাম স্বার্থত্যাগ। সে কোরবানির নাম শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। সে কোরবানির নাম ন্যায়নীতির প্রতিষ্ঠা। আমাদের ঈদ-উল-আযহা বা বকরীদ তবেই স্বার্থক হবে ইনশাআল্লাহ।

যাকারিয়া রাযি- একজন ইরানি অগ্রণী পণ্ডিত ব্যক্তিত্ব

Houchang D. Modanlou MD*

আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া আল-রাযি ছিলেন বহু বিষয়ে একজন পণ্ডিত ব্যক্তিত্ব এবং সেই সাথে একজন দার্শনিক ও চিকিৎসক। তিনি ৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে সামানি রাজবংশের তৎকালীন প্রাদেশিক রাজধানী ও বর্তমান ইরানের তেহরান শহরের নিকটস্থ ঐতিহাসিক রেই শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ৯২৫ খ্রিস্টাব্দে ইন্তেকাল করেন, যদিও কেউ কেউ ধারণা করে থাকেন যে, তিনি ৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ ও ৯৩০ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। রসায়ন, চিকিৎসা, দর্শন ও চিকিৎসাবিদ্যার নীতিশাস্ত্র ও অধিবিদ্যা বিষয়ে অবদানের জন্য তিনি সমধিক প্রসিদ্ধ। তিনি উল্লিখিত বিষয়সমূহে ১৮৪টি গ্রন্থ ও প্রবন্ধ-নিবন্ধ রচনা করেন।
যাকারিয়া রাযি প্রাচীন গ্রিক ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন এবং গ্রিক চিকিৎসক ও দার্শনিক গ্যালেনের একজন প্রশংসাকারী ও সমালোচকও ছিলেন। রাযির প্রাথমিক জীবন সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানা যায় না, তবে এটি লিখিত রয়েছে যে, তিনি যুবক বয়সে বীণাজাতীয় যন্ত্র বাজাতেন এবং গানের একটি বিশ্বকোষ রচনা করেছিলেন। গানের মাধ্যমে স্বচ্ছন্দ জীবন যাপনের পথ রচনায় ব্যর্থ হন। এরপর তিনি তাঁর মনোযোগ রসায়নবিদ্যার দিকে নিবদ্ধ করেন।
একজন প্রকৃত রসায়নবিদ ও পদার্থবিদ হওয়ার কারণে তিনি এ দুই বিষয়ে গবেষণায় অতুলনীয় অবদান রাখেন এবং রসায়নবিদ্যার ওপরে বেশ কিছু গ্রন্থ ও প্রবন্ধের মাধ্যমে মধ্যযুগীয় রসায়নবিদ্যার স্থলে আধুনিক রসায়নবিদ্যার ভিত্তি স্থাপন করেন। তিনি অ্যালকোহল (ইথানল) আবিষ্কার ও পরিশুদ্ধ করেন এবং ঔষধশাস্ত্রে এর ব্যবহারের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অগ্রপথিক। এছাড়াও আধুনিক রসায়ন ও রসায়ন প্রকৌশলের চালিকাশক্তি সালফিউরিক এসিড আবিষ্কারের কৃতিত্বও তাঁর বলে উল্লেখ করা হয়। অ্যামোনিয়াম ক্লোরাইড ও অন্যান্য এসিডের আবিষ্কারের কৃতিত্বও রাযির। রাসায়নিক উপাদানসমূহের নিয়মানুগ শ্রেণিবিন্যাস, রাসায়নিক বিক্রিয়া ও পরীক্ষাগারে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির ক্ষেত্রে তাঁর অর্জনসমূহ বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
‘কিতাব আল-আসরার (রহস্যসমূহের বই) এবং সির আল-আসরার (রহস্যসমূহের রহস্য) নামক দুটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থে তিনি বস্তুকে তিনটি ভাগে ভাগ করেছেন। সেগুলো হলো : উদ্ভিদ, প্রাণী ও খনিজ মূল। যখন তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয় যে, তিনি লোহা এবং তামাকে স্বর্ণে রূপান্তরিত করার পদ্ধতি আবিষ্কার করতে পেরেছেন কিনা, তখন তিনি রসায়নের সীমাবদ্ধতার উপলব্ধি থেকে বলেন : ‘আমি রসায়ন বুঝি এবং আমি দীর্ঘ সময় ধরে ধাতুর স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। কিন্তু এটি আমার কাছে এখনো স্পষ্ট হয় নি যে, কীভাবে একজন তামাকে স্বর্ণে রূপান্তরিত করবে। গত কয়েক শতকে প্রাচীন বৈজ্ঞানিকগণের গবেষণা সত্ত্বেও সেখানে কোন উত্তর পাওয়া যায় নি। আমার খুবই সন্দেহ আছে, এটি আদৌ সম্ভব কিনা।’
তবে তিনি সংকর ধাতু তৈরির কৌশল বর্ণনা করেন। ফারসি ভাষায় রসায়ন বিষয়ে বিশটি গ্রন্থ ও প্রবন্ধ যাকারিয়া রাযির রচনা হিসেবে প্রসিদ্ধ।
আল-বিরুনির সূত্রে নায়েরনাওরী উল্লেখ করেছেন যে, রাসায়নিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার কারণে রাযির চক্ষুরোগ হয়েছিল। আর একারণেই তিনি রসায়নচর্চা বন্ধ করে দেন।
ত্রিশ বছর বয়সে রাযি পশ্চিম ইরানের মার্ভ শহরের আলি ইবনে রব্বান আল-তাবারী নামক একজন দার্শনিক ও চিকিৎসকের অধীনে দর্শন ও ঔষধ সম্পর্কিত পড়াশোনা শুরু করেন। আল তাবারী যে ঔষধশাস্ত্রে রাযির শিক্ষক ছিলেন নায়েরনাওরী এই তথ্যের সঠিকতা অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, রাযি সম্ভবত তাবারীর ঔষধশাস্ত্রের ওপর লিখিত তথ্যকে কাজে লাগিয়েছেন, কেননা, রাযির জন্মের পূর্বেই তিনি মৃত্যুবরণ করেছিলেন।
রেই শহরের রয়েল হাসপাতালের পরিচালক হিসেবে কাজ করার সময় যাকারিয়া রাযি বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। তাঁর ঔষধশাস্ত্রের শিক্ষকদের মধ্যে আরেকজন হলেন প্রসিদ্ধ চিকিৎসক আলি ইবনে সাহল (একজন ইহুদি, যিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন এবং হায়েরকানিয়া বা তাবারিস্তানের বিখ্যাত মেডিকেল স্কুলে কর্মরত ছিলেন।) অচিরেই তিনি চিকিৎসাবিদ্যা ও বাস্তব অভিজ্ঞতার দিক থেকে তাঁর শিক্ষকদেরকে অতিক্রম করে যান। পরবর্তীকালে তৎকালীন মুসলিম শাসকের আহ্বানে সাড়া দিয়ে তিনি মুক্তাদারি হাসপাতালের প্রধান হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেন। বর্ণিত হয়েছে যে, খলিফা তাঁর নিকট একটি হাসপাতাল তৈরি করার প্রস্তাব দেন। রাযি হাসপাতালের স্থান নির্বাচনে অভিনব পদ্ধতির আশ্রয় নেন। তিনি কিছু তরতাজা মাংসের টুকরা ইরাকের বাগদাদ শহরের বিভিন্ন স্থানে রেখে আসেন। কিছু দিন পর তিনি মাংসের টুকরাগুলো পরিদর্শন করেন। অবশেষে সবচেয়ে কম নষ্ট হওয়া মাংসটি যে স্থানে রেখে এসেছিলেন সেই স্থানটিকে হাসপাতালের স্থান হিসেবে নির্বাচন করেন।
একজন দার্শনিক, চিকিৎসক ও শিক্ষক হিসেবে উচ্চ মর্যাদার কারণে মুসলিম অঞ্চলগুলো থেকে ছাত্ররা তাঁর কাছে ভীড় জমাতো।
‘শুকুক আলা গ্যালেনাস’ (গ্যালেন সম্পর্কে সন্দেহ) নামক পুস্তকে তিনি ঔষধশাস্ত্রে প্রশংসনীয় অবদানের জন্য গ্যালেনের প্রশংসা করেছেন। কিন্তু তিনি গ্যালেনের গ্রিক ভাষার শ্রেষ্ঠত্বের দাবি এবং তাঁর বেশ কিছু চিকিৎসাগত দৃষ্টিভঙ্গিকে গ্রহণ করেন নি। কারণ, গ্যালেনের কিছু কিছু রোগের বর্ণনা স্বয়ং রাযির রোগসংক্রান্ত পর্যবেক্ষণ থেকে আলাদা ছিল, যেমন : জ্বর ছেড়ে যাওয়ার বিষয়টি। কোন কোন ক্ষেত্রে রাযি বিশ্বাস করতেন, তাঁর রোগ সম্পর্কিত অভিজ্ঞতা গ্যালেনকেও অতিক্রম করেছে। এছাড়াও তিনি সক্রেটিস ও অ্যারিস্টোটলের মন ও শরীরের বৈপরীত্য সংক্রান্ত চিন্তাধারাকে প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি রোগীর কল্যাণের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য ও আত্মমর্যাদার মতবাদের চিন্তার অগ্রপথিক ছিলেন।
‘সুস্থ মন ও সুস্বাস্থ্য ’ বিষয়টি তাঁকে তাৎক্ষণিকভাবে তাঁর রোগীদের সাথে অনায়াসে যোগাযোগের ক্ষেত্রে সহযোগিতা করে। তিনি আরোগ্য লাভের উপায় হিসেবে রোগীদেরকে তাঁর নির্দেশনা মেনে চলার জন্য বলতেন এবং রোগ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে তাদের মানসিক শক্তিকে উজ্জীবিত করতেন যা দ্রুত আরোগ্য লাভের ক্ষেত্রে সহায়ক হতো। আত্মিক বা আধ্যাত্মিক ঔষধ সম্পর্কিত গ্রন্থে রাযি চিকিৎসক-বিজ্ঞানীদের নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করেছেন। তিনি রোগীর আধ্যাত্মিক গুণের উৎকর্ষের গুরুত্বের বিষয়ে আলোচনা করেন। ক্যাসিমভ বলেন যে, রাযির আধ্যাত্মিক ঔষধকে ‘চিকিৎসা নীতিবিজ্ঞান’ এর ধারণার সমার্থক হিসেবে দেখা হয়।
রাযির চিকিৎসা দৃষ্টিভঙ্গি হিপোক্রিটাস ও গ্যালেন দ্বারা প্রভাবিত ছিল। তাত্ত্বিকভাবে রাযি একজন গ্যালেনিস্ট, কিন্তু ব্যবহারিক ক্ষেত্রে তিনি স্পষ্টতই হিপোক্রিটাসের নীতি দ্বারা অধিকতর পরিচালিত, কিন্তু রাযির পাণ্ডিত্য ছিল আরো ব্যাপক ও গভীর এবং তাঁর যথেষ্ট পরিমাণে স্বকীয়তাও ছিল।
রাযি মনস্তাত্ত্বিক পদ্ধতি ও শরীরবৃত্তীয় ব্যাখ্যার মধ্যে সমন্বয় সাধন করেছিলেন। তিনি সাইকোথেরাপিকে প্রাথমিক পর্যায়ে, কিন্তু গতিশীল উপায়ে ব্যবহার করেছিলেন। তিনি চিকিৎসকদের পেশাগত প্র্যাকটিসের একটি স্পষ্ট মানদ- স্থাপন করেছিলেন। তিনি ঔষধ বিষয়ক একজন শ্রান্তিহীন লেখক ছিলেন। চিকিৎসা সংক্রান্ত তাঁর প্রায় ৪০টি গ্রন্থ ও প্রবন্ধ-নিবন্ধ ইরান, ব্রিটেন, ফ্রান্স, ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লাইব্রেরি ও জাদুঘরগুলোতে সংরক্ষিত আছে।
জর্জ সার্টন তাঁর ‘Introduction to the History of Science’ গ্রন্থে লিখেছেন : ‘রাযি ছিলেন ইসলাম ও মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ চিকিৎসক।’ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ১৯৭০ সালের মে মাসের বুলেটিনটি রাযিকে উৎসর্গ করা হয়। এতে বলা হয়, গুটিবসন্ত ও হামের ওপর তাঁর লেখাগুলো তাঁর মৌলিকতা ও সঠিকতার বিষয় নির্দেশ করে এবং সংক্রামক ব্যাধির ওপর তাঁর রচনা এ বিষয়ের ওপর লিখিত সর্বপ্রথম বৈজ্ঞানিক রচনা। রাযিকে ঔষধবিজ্ঞানের অনেক ক্ষেত্রের অগ্রপথিক বলা হয়, বিশেষ করে শিশুরোগবিদ্যা ও সংক্রামক ব্যাধির ক্ষেত্রে।
তিনি ঔষধের ওপর ২৩ খণ্ডের বিশাল মেডিকেল এনসাইক্লোপিডিয়া রচনা করেন; গ্রন্থটির নাম ‘কিতাব আল-হাওয়ী ফীত তিব’। এতে গ্রিক ও ভারতীয় লেখকদের লেখা ও তাঁর নিজের গবেষণালব্ধ বিষয়াদি রয়েছে।
অন্যান্য চিকিৎসাগত অবদান
রাযি ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি চোখের পিউপিলারী রিফ্লেক্স সম্পর্কে আলোচনা করেন। তিনি ছানির অপারেশনের বর্ণনা দিয়ে বলেন : ‘আমি অক্ষিগোলকের নিম্ন অংশকে উন্মুক্ত করেছি এবং ছানিকে বহির্মুখ করে দিয়েছি।’ তিনি হলেন প্রথম চিকিৎসক যিনি সম্পূর্ণরূপে সুনির্দিষ্ট করে গনোরিয়ার লক্ষণগুলো বর্ণনা করেন। তিনি প্রথম ব্যক্তি যিনি মায়ের গর্ভে শিশুর মেরুদণ্ডের গঠন সংক্রান্ত রোগ নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি তাঁর গ্রন্থে মৃগীরোগের ব্যাপারে আলোচনা করেন। তিনি বংশগত বা জন্মের পরপরই নবজাতকের মস্তিষ্কের অসুস্থতা hydrocephalus সম্পর্কে বর্ণনার পাশাপাশি microcephalyসম্পর্কেও বর্ণনা দেন এবং পরবর্তী অসুখটিকে তিনি নিরাময়ের অযোগ্য বলে মনে করেন। বসন্তকালে গোলাপের ঘ্রাণ নেয়ার পর যুবরাজ আবু যায়েদ বালখীর নাকের অ্যালার্জিতে আক্রান্ত হওয়ার কারণ নিয়ে তিনি একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন যেখানে তিনি allergic rhinitis সম্পর্কে বর্ণনা দিয়েছেন।
রাযিই ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি প্রথম উপলব্ধি করেছিলেন যে, জ্বরের ক্ষেত্রে একটি প্রকৃতিগত প্রতিরোধ পদ্ধতি রয়েছে, যেটি রোগের মোকাবিলায় শরীরের নিজস্ব পদ্ধতি। তাঁর লেখায় রাযি বাতজ্বরকে গেঁটেবাত থেকে আলাদা করেন। তিনি তাঁর রোগীদের ওপর নতুন ঔষধ প্রয়োগের পূর্বে পশুর ওপর নতুন ঔষধের পরীক্ষা চালাতেন এবং সেগুলোর ফলাফল ও প্রতিক্রিয়া লিপিবদ্ধ করতেন। তাঁর ‘কিতাব আল-হাওয়ী ফীত তিব’ গ্রন্থের একটি খ- ফার্মাকোলজি নিয়ে লেখা। নিশ্চিতভাবেই ফার্মেসী এর ঐতিহাসিক ভিত্তির অনেক বিষয়ের জন্য এককভাবে যাকারিয়া রাযির ওপর নির্ভরশীল। ২৭ আগস্ট রাযির জন্মদিনটিকে ইরানে ফার্মাকোলজি দিবস হিসেবে পালন করা হয়ে থাকে।
উপসংহার
খ্রিস্টীয় ৭ম শতাব্দীতে ইসলামের উত্থান এবং ৮ম শতাব্দীতে বাগদাদে আব্বাসী খেলাফত প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সাথে সাথে পারস্যের গান্দীশাপুর অ্যাকাডেমি থেকে চিকিৎসক-দার্শনিকদের একটি মাইগ্রেশন হয় বাগদাদে; যাতে ইসলামের স্বর্ণযুগের সূচনা হয়। ইসলামি চিকিৎসাবিজ্ঞানের স্বর্ণযুগের ভিত্তিস্থাপনকারীদের অন্যতম ছিলেন পারস্যের রসায়নবিদ-চিকিৎসক-দার্শনিক যাকারিয়া রাযি। যে কোন ব্যক্তি পত্র-পত্রিকায় ছাপানো চিকিৎসা বিষয়ক নানা সূত্র থেকে যাকারিয়া রাযির যে অবদানসমূহ খুঁজে পাবেন তা হলো- তিনি সর্বপ্রথম শিশুরোগবিদ্যা বিষয়ক নীতিমালা (The Practica Puerorum) রচনা করেন। তিনি একজন যুক্তিবাদী ব্যক্তি ছিলেন এবং যুক্তির ওপর ভীষণভাবে আস্থাশীল ছিলেন। তিনি ছিলেন সকল প্রকার কুসংস্কার থেকে মুক্ত এবং নিজের চিন্তাধারা প্রকাশে অকুতোভয়। মহানুভবতায় তিনি ছিলেন অসাধারণ এবং সর্বদা দরিদ্রদের সাহায্যের ব্যাপারে আকাঙক্ষী। তিনি ছিলেন তাঁর সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় চিকিৎসক। যেহেতু তিনি একজন পণ্ডিত ব্যক্তি ও ধীসম্পন্ন শিক্ষক ছিলেন সেহেতু শিক্ষার্থী ও চিকিৎসাশাস্ত্রের চর্চাকারীরা তাঁর বক্তব্য শোনার জন্য ভীড় জমাতেন। তিনি ছিলেন এমন এক ব্যক্তি যিনি শিক্ষা ও জ্ঞান অর্জনকে সম্মান করতেন। তাঁর জ্ঞান পূর্ববর্তী লেখকদের গ্রহণযোগ্য ও স্বনামধন্য গ্রন্থসমূহের ওপর ভিত্তিশীল হলেও তিনি স্বাধীন চিন্তাধারার অধিকারী ছিলেন এবং যখন তাঁর নিজের পর্যবেক্ষণকৃত বিষয় পূর্ববর্তীদের বক্তব্যের বিপরীত প্রতিপন্ন হতো তখন তিনি নিজের পর্যবেক্ষণলব্ধ বিষয়ের ওপর অটল থাকার ব্যাপারে কখনই ভীত হতেন না। তিনি অন্যদেরকে এই বলে পরামর্শ দিতেন যে, একটি গ্রন্থে যা লিপিবদ্ধ রয়েছে, তা একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসকের অভিজ্ঞতার তুলনায় কম মূল্য রাখে।
অসুস্থতার কারণ সংক্রান্ত সুস্পষ্ট বিবরণ দান, মৌলিক পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা এবং চিকিৎসাক্ষেত্রে গতিশীল ও বাস্তবধর্মী পদ্ধতি ব্যবহারের কারণে রাযি বিখ্যাত হয়ে রয়েছেন। তিনিই সর্বপ্রথম গুটি বসন্ত ও হাম সম্পর্কে নিখুঁত বর্ণনা দেন; তিনি চিকিৎসার ক্ষেত্রে ওষুধের তুলনায় যথাযথ খাদ্য গ্রহণের বিষয়ে অগ্রাধিকার দান করেন এবং অপেক্ষাকৃত জটিল ব্যবস্থাপত্রের পরিবর্তে সহজ সরল ব্যবস্থাপত্র দেন। বিপুল পরিমাণ সম্মানি পাওয়ার পরও হতদরিদ্রদের প্রতি মহানুভবতার কারণে তিনি সম্পদহীন অবস্থায় মারা যান। কয়েক শতাব্দী যাবত ইবনে সীনার চিকিৎসা বিষয়ক গ্রন্থ ‘কানুন’ এর পাশাপাশি তাঁর বইও ইউরোপের প্রধান প্রধান মেডিকেল কলেজে প্রাথমিক পাঠ্য হিসেবে পড়ানো হতো। বিশ্বের অনেক দেশ তাঁর স্মরণে স্মারক ডাকটিকেট প্রকাশ করেছে। যাকারিয়া রাযির একটি পোট্রেট প্যারিসের স্কুল অব মেডিসিন-এর দেয়ালে টাঙানো রয়েছে।
লেখক :

: Department of Pediatrics

University of California, U.S.A.

অনুবাদ : সরকার ওয়াসি আহম্মেদ

তেহরান আন্তর্জাতিক বইমেলায় বাংলাদেশ দিবস

ড. আবদুস সবুর খান
গত ২ মে থেকে ১২ মে ২০১৮ তারিখ পর্যন্ত ইরানের তেহরানে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ৩১তম তেহরান আন্তর্জাতিক বইমেলা। এ বছর মেলার পঞ্চম দিন অর্থাৎ ৬ মে মেলার বিশেষ আকর্ষণ ছিল ‘বাংলাদেশ দিবস’। বাংলাদেশ দিবসের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের জন্য ইরানের সাদি ফাউন্ডেশন (বুনিয়াদে সাদি)-এর আমন্ত্রণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমি এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. তাহমিনা বেগম ইরানে গিয়েছিলাম। তুর্কি এয়ার লাইন্সের বিমানযোগে ইস্তাম্বুল হয়ে ৩ মে রাত দেড়টায় ইরানের ইমাম খোমেইনী ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে পৌঁছি আমরা। সেখানে আমাদের রিসিভ করার জন্য সাদি ফাউন্ডেশনের প্রতিনিধি জনাব কাসেমী আগে থেকেই অপেক্ষা করছিলেন। তাই আমাদের আর কোনো কিছুতেই বেগ পেতে হয় নি। ইমিগ্রেশন পার হয়ে বেল্ট থেকে লাগেজ নিয়ে সামনে আসতেই আগা কাসেমী আমাদের দেখে চিনে ফেলে ইশারা করেন।
আগা কাসেমীর সাথে করমর্দন করে আমরা বাইরে বেরিয়ে এলাম। বাইরে আমাদের জন্য গাড়ি অপেক্ষা করছিল। ইমাম খোমেইনী এয়ারপোর্ট থেকে উত্তর তেহরানের ভেলেঞ্জাকে অবস্থিত সাদি ফাউন্ডেশনের গেস্ট হাউজ প্রায় ৪০ কিলোমিটার পথ। রাতের তেহরান বলে বেশ ফাঁকা। আমরা এক ঘণ্টারও কম সময়ে পৌঁছে গেলাম গেস্ট হাউজে। আমাদের পৌঁছে দিয়ে আগা কাসেমী বিদায় নিলেন।
সাদি ফাউন্ডেশনের মূল কার্যালয়ের অষ্টম তলায় এই প্রতিষ্ঠানের গেস্ট হাউজ। এখানেই আমাদের থাকার ব্যবস্থা। এখানে বিদেশীদের মাঝে ৩ জন বসনীয় ও ১ জন পাকিস্তানি অতিথিও অবস্থান করছিলেন। সুন্দর পরিপাটি করে সাজানো চারটি পৃথক পৃথক ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাট। প্রতিটির নিচ তলায় ডাইনিং-ড্রয়িং, কিচেন, টয়লেট এবং কাঠের সিঁড়ি বেয়ে ওপর তলায় টয়লেট আর ৩টি করে বেড রুম। প্রতি রুমে দুটি করে খাট, ইরানি কার্পেটে মেঝে মোড়া। ফ্ল্যাটে পৌঁছেই কাপড়-চোপড় ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়লাম। রাতের খাবার প্লেনেই সেরে এসেছি। দীর্ঘ পথযাত্রায় ক্লান্ত শরীর। ভেবেছিলাম বিছানায় গা এলিয়ে দিলেই ঘুমিয়ে পড়ব। কিন্তু হলো তার উল্টোটা। অনেক রাত অবধি এপাশ-ওপাশ করলাম। কিন্তু কিছুতেই ঘুম এলো না।
শেষ রাতের দিকে সামান্য ঘুম এলেও খুব ভোরে ঘুম ভেঙ্গে গেল। ফজরের নামায পড়েই হাঁটতে বের হলাম। এই অঞ্চলে মূলত অভিজাত শ্রেণির বাস। সুন্দর পরিপাটি একটি আবাসিক এলাকা। উঁচু উঁচু অভিজাত সব ইমারত ঝক ঝক করছে। রাস্তার দু’ধারে সারিবদ্ধভাবে অসংখ্য গাড়ি পার্ক করা। ঝকঝকে তকতকে ফুট পাথে একটু পর পরই নানা ধরনের সবুজ গাছ আর ফুলের কেয়ারি। এখন বসন্তকাল বলে গাছে গাছে সবুজের সমারোহ আর নানা বর্ণের ফুলে আচ্ছাদিত কেয়ারিগুলো। বেশিরভাগই গোলাপ। নানা বর্ণের, নানা আকারের। ইতঃপূর্বেও আমি উত্তর তেহরানে থেকেছি। তাই এলাকাটা আমার বেশ পরিচিত। একেবারে পাহাড়ের ওপরে। পাশের রাস্তা ধরে আমি হাঁটতে হাঁটতে আরও ওপরের দিকে উঠতে লাগলাম। শেষ মাথায় পাহাড়ের চূড়ায় একটা কুঞ্জের মতো। বেশ কিছু ছোট ছোট ঝাউ আর চেনার গাছ। গাছে গাছে চড়–ই আর বুলবুলির কলকাকলিতে চারদিক বেশ মুখরিত।
সকালের রোদ একটু পরিণত হতেই গেস্ট হাউজের দিকে ফিরলাম। শুক্রবার বলে রাস্তাঘাটে লোকজন তেমন নেই। গেস্ট হাউজেও দারোয়ান ছাড়া আর কোনো কর্মচারী নেই। ফ্ল্যাটে পৌঁছেই কাপড় ছেড়ে শাওয়ার নিয়ে নাস্তা সেরে নিলাম। ফ্রিজে ইরানি রুটি নানে লাবাশ, জেলি আর মধু রাখা ছিল। দুধও ছিল। কিচেন ক্যাবিনেটে চা পাতা, চিনি, ইলেক্ট্রিক টি মেকার সাজানো। নিজেই তাতে পানি চাপিয়ে চা করে নিলাম।
কিছুক্ষণ পরই মুমিত এলো। মুমিত আল রশিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের সহকারী অধ্যাপক, আমার ছাত্র। বর্তমানে তেহরানের টিচার্স ট্রেনিং ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি করছে। ইরান এলেই আমাকে সময় দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সে। তার সাথে কুশলাদি বিনিময় করে ড. তাহমিনাসহ আমরা বেরিয়ে পড়লাম তাজরিশের উদ্দেশ্যে। তাজরিশ উত্তর তেহরানের বড় শপিং কমপ্লেক্স, সবকিছুই পাওয়া যায় সেখানে।
তাজরিশ সাজানো গুছানো, ঝকঝকে তকতকে বাজার। বসন্তকাল বলে স্থায়ী দোকানপাটের সামনের খোলা জায়গায় প্রচুর টাটকা ফলের পসরা সাজিয়ে বসেছে মৌসুমী ফলব্যবসায়ী এবং ফলচাষীরা। আলবালু, গিলাস (চেরি), গোলাবি, খরবুজে (মরু এলাকার বাঙ্গি) আরও কত কী! নানা সবজি এবং নানা রকমের সবুজ বিন। আমি ৭০০ তুমানে একটা খরবুজে কিনলাম। ড. তাহমিনা কিছু ড্রাই ফ্রুটস কিনলো। বাদাম, কিশমিস এসব। মুমিত আমাদের কিছু ডলার ভাঙ্গিয়ে দিল। মোবাইলে ইরানি সিমও সেট করে দিল। তারপর সে আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিতে চাইল, তার অন্য একটি অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। তাকে সানন্দে বিদায় দিয়ে গেস্ট হাউজে ফিরে এলাম।
গেস্ট হাউজে ফেরার কিছুক্ষণ পরই ড. দরুদগারিয়ানের ফোন পেলাম। ড. দরুদগারিয়ান আমার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মাত্র বছর খানেক হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে ইরানি ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে দায়িত্ব সমাপ্ত করে ইরান ফিরেছেন। ইরানে পায়ামে নূর ইউনিভার্সিটির শিক্ষক তিনি। তাঁর স্ত্রী ড. এলহাম হাদ্দাদি ইরানের সাদি ফাউন্ডেশনে বাংলাদেশ ও ভারতের ডেস্ক প্রধান। তিনিও ড. দরুদের বাংলাদেশে দায়িত্ব পালনকালীন তাঁর সাথে ছিলেন। সেই সুবাদে তাঁর সাথেও হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক আমার। আমাদের দুই পরিবারের মধ্যে একটি চমৎকার সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। ড. এলহামের আমন্ত্রণে এই সফরে আমার স্ত্রীরও আমার সাথে আসার কথা ছিল। কিন্তু সাংসারিক নানা সমস্যার কারণে তাঁর আসার সম্ভব হয় নি।
ড. দরুদ ফোনে বললেন, ‘আমরা বইমেলায় আছি। তোমরা আসতে চাও কি-না। চাইলে আমি গাড়ি নিয়ে আসছি তোমাদের গেস্ট হাউজ থেকে পিক করব।’
আমি বললাম, ‘আমাদের প্রোগ্রাম তো ৬ তারিখ, মানে আগামী পরশু?’
‘হ্যাঁ, আজ আসলে মেলায় ঘুরেফিরে দেখলে। সেদিন তো মেলা ভালো করে দেখতে পারবে না।’
‘তা তুমি ঠিকই বলেছ। ওকে। আমরা লাঞ্চ করে নেই। তুমি চলে আস।’
দুইটার দিকে ড. দরুদগারিয়ান নিচে এসে ফোন দিলেন। আমি তাঁকে ওপরে আসতে বললাম। তিনি বললেন, ‘তোমরা তৈরি হয়ে চলে এসো। আমি নিচে অপেক্ষা করছি।’ দশ মিনিটের মাথায় আমরা নিচে নেমে এলাম। নিচে সাদি ফাউন্ডেশনের অলিন্দে ড. দরুদের হাস্যোজ্জ্বল মুখ দেখে দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলাম। তারপর আমাদের কুশল বিনিময় হলো। দুজনেই উচ্ছ্বসিত। প্রায় বছর খানেক পর দেখা। আমি ড. দরুদের জন্য বাংলাদেশ থেকে বোতলে করে ডাবের পানি নিয়ে এসেছি। গাড়িতে বসে ডাবের পানিতে চুমুক দিয়ে ভারি তৃপ্তি বোধ করলেন তিনি, সেই সাথে কৃতজ্ঞতাও জানালেন। গাড়ি ছুটল আমাদের নিয়ে বইমেলার উদ্দেশে। গাড়ি দক্ষিণমুখো চলছে। পাহাড়ি ঢাল বেয়ে নিচের দিকে। রাস্তার দুইধারে অসংখ্য চেনার গাছের সারি। ভরা বসন্তের পত্রপল্লবে সবুজে সবুজ হয়ে আছে গাছের সব শাখা-প্রশাখা। দক্ষিণা বাতাসে ভরা যৌবনা সবুজ পত্রপল্লবের নাচন আর ঝকঝকে তকতকে পথ- রিক্সা কিংবা সিএনজির উৎপাতহীন। কী যে চমৎকার সেই শহুরে পথ! চলতে চলতে ইরান-বাংলাদেশের নানা বিষয় নিয়ে কথা হলো আমাদের। এক সময় আমরা একটি খোলা উদ্যানের মতো জায়গায় এসে থামলাম। দরুদ বললেন, ‘এটি পার্কিং জোন। আমরা এখানে গাড়ি রেখে কিছুটা পথ হেঁটে যাব।’ আমরা গাড়ি থেকে নামলাম। রাস্তার পাশেই খোলা আকাশে ওভাবেই গাড়ি রেখে চললাম আমরা। কোনো গার্ড নেই। গাড়ি চুরি হবার কোনো ভ্রুক্ষেপও নেই। মিনিট দশেক হেঁটে সামনে যেতেই মেলার প্রবেশ পথ। ড. দরুদ বললেন, ‘এখান থেকে মূল মেলা প্রাঙ্গণে যেতে আরও মিনিট দশেক লাগবে। চাইলে শাটল মাইক্রোবাস আছে, ওগুলোতে যেতে পার।’ সামনের দিকে ইশারা করলেন। আমরা সেদিকে তাকাতেই দেখি লোকজন লাইন করে দাঁড়িয়ে আছে। দুটি মাইক্রোবাস এলে তাতে পালা করে উঠে পড়ল অনেকেই। বাস রওয়ানা হলো তাদের নিয়ে। আমি বললাম, ‘আমরা হেঁটেই যাব। তাতে চারপাশটা ভালো করে দেখা যাবে, মেলাফেরত মানুষও দেখা হবে।’
আমরা হাঁটছি মেলামুখো। ওদিক থেকে মেলাফেরত মানুষ ফিরছে। দলে দলে, ছেলে, বুড়ো, নারী, পুরুষ। নানা বয়েসী। অধিকাংশের হাতেই বইয়ের ব্যাগ। দেখে ভালই লাগল। আমাদের বাংলা অ্যাকাডেমির বইমেলায় প্রথম ১৫ দিন সাধারণত মেলাফেরত মানুষের হাতে বই দেখাই যায় না। এখানে তার ব্যতিক্রম। মূল মেলায় প্রবেশ করতেই ড. এলহাম হাদ্দাদি আমাদের স্বাগত জানালেন। আগে থেকেই তিনি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। মেলায় প্রবেশ করে আমার বিস্ময়ের আর অবধি রইল না। এতবড়, এত পরিপাটি মেলা! এবারের মেলা আয়োজন করা হয়েছে মোসাল্লায়ে ইমামে, যেখানে তেহরানের কেন্দ্রীয় জুমআর নামায অনুষ্ঠিত হয়। বিশাল বড় জায়গা নিয়ে চারপাশ খোলা এক ছাদের স্থাপনা। পূর্বপাশের অংশ দোতলা। নিচতলায় অজুখানা আর টয়লেট। এর ওপরে বিদেশী স্টল আর বিভিন্ন মিডিয়া। নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন এবং আলোচনার জন্য চারটি সুসজ্জিত সেমিনার কক্ষ। খোলা স্থানগুলোতে ইরানের বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিকদের নানা ভঙ্গিমার আলোকচিত্রের ডিসপ্লে। পশ্চিম পাশের অংশে দেশীয় সব স্টল। মোট আশিটি বিদেশী স্টল আর দেশীয় প্রায় তিন হাজার স্টলে এবারের মেলার পরিসর। মেলার এই বিশালতা আর পরিপাট্য দেখে আমার কাছে মনে হলো এটি জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলার তুলনায় আয়োজন আর পরিসরের দিক থেকে কোনো অংশেই ছোট নয়। প্রেস টিভি, ইরনা এবং বুনিয়াদে সাদিসহ বেশ কটি মিডিয়া আমার সাক্ষাৎকার নিল। মেলা সম্পর্কে আমার মতামত জানতে চাইল। আমি তাদেরকে গুরুত্বের সাথেই এ কথাটা বললাম।
প্রায় ঘণ্টা তিনেক সময় কাটালাম মেলায়। ঘুরে ঘুরে সব স্টল দেখলাম। আফগানিস্তানের স্টল থেকে একটি আফগানি ফারসি ছোটগল্পের সংকলন কিনলাম। সন্ধ্যার দিকে গেস্ট হাউজের দিকে রওনা হলাম। ফেরার ফেরার পথে দেখি বাইরের প্রাঙ্গণে বড় বড় বইয়ের রেপ্লিকায় বেশ উঁচু করে একটি বইয়ের স্তূপ করা হয়েছে। চমৎকার লাগছে সেই বইয়ের স্তূপ। আমরা যখন গেস্ট হাউজে পৌছলাম তখন সন্ধ্যা মিলিয়ে রাত হয়ে গেছে।
৫ মে শনিবার সকাল নয়টায় ড. এলহাম হাদ্দাদির ফোন পেলাম, ‘আমি অফিসে আছি। তোমরা আধা ঘণ্টার মধ্যে তৈরি হয়ে নিচে এসো।’ সাদি ফাউন্ডেশনের ষষ্ঠ তলায় ড. এলহামের অফিস। আর আমাদের গেস্ট হাউজ অষ্টম তলায়। আমরা তৈরি হয়ে ড. এলহামের অফিসে চলে এলাম। বাংলাদেশ থেকে ড. এলহাম এবং তাঁর সহকর্মীদের জন্য কিছু সুভ্যেনীর উপহার নিয়ে এসেছি সেগুলোও নিয়ে এলাম সাথে করে। ড. এলহামের সাথে কুশল বিনিময়ের পর তিনি আমাদের নিয়ে গেলেন সাদি ফাউন্ডেশনের দাপ্তরিক ও অর্থনৈতিক বিষয়ক প্রধান জনাব সাখায়ির কাছে। ছিমছাম গড়নের চমৎকার মানুষ জনাব সাখায়ি। ইতঃপূর্বে কাতারসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে কালচারাল কাউন্সেলরের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। প্রায় ঘণ্টা খানেক স্থায়ী হলো আমাদের এই সাক্ষাৎ। বাংলাদেশের নানান বিষয় আলোচনায় এলো। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কূটনৈতিক প্রজ্ঞা সম্পর্কেও নানান বিষয়ে কথা বললেন তিনি। সম্প্রতি কানাডা থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশী এক লেখকের রাসূল (সা.)-এর কূটনীতি বিষয়ে লেখা একটি বইয়ের ফারসি অনুবাদের কপিও উপহার দিলেন আমাকে। আমি বাংলাদেশের স্মারক উপহার পিতলের নৌকা শোপিস নিয়ে এসেছি কয়েকটি। তার একটি জনাব সাখায়িকে উপহার দিলাম। তিনি খুশি হলেন।
আমরা তাঁর রুম থেকে বের হয়ে আবারও ড. এলহামের রুমে গিয়ে বসলাম। এরই মধ্যে যাকারিয়া এসে উপস্থিত হলো। অতি সম্প্রতি ২০১৭ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে মাস্টার্স শেষ করেছে। মাস্টার্সে ভালো ফলাফল এবং ফারসিতে তার দক্ষতার কারণে ইরান সরকার তাকে ইরানে মাস্টার্স এবং পিএইচডি অধ্যয়নের জন্য বৃত্তি প্রদান করেছে। সেই সুবাদে বর্তমানে সে তেহরানের খাওয়ারিজমি বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স করছে।
খানিক পর ড. এলহাম আমাদের নিয়ে গেলেন সাদি ফাউন্ডেশনের দাপ্তরিক ও আন্তর্জাতিক বিষয়ক প্রধান জনাব পালিজদারের সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করাতে। জনাব পালিজদার খুবই দিলখোলা মানুষ। নানান বিষয়ে খুবই হৃদ্যতাপূর্ণ আলাপ হলো আমাদের। তাঁকেও একটা পিতলের নৌকা-শোপিস উপহার দিলাম।
মধ্যাহ্ন ভোজের পর ড. দরুদগারিয়ান আমাদের নিয়ে রওয়ানা হলেন গ্রামের বাড়িতে তাঁর অবকাশ ভিলা দেখানোর জন্য। তেহরান থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে আলবোর্জের পাদদেশে লালন গ্রামে তাঁর পৈত্রিক নিবাস। ড. দরুদ এখানেই মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে একটি পাহাড়ের ঢালে নদীর তীরে জায়গা কিনে তাঁর অবকাশ ভিলা তৈরি করছেন। লালনের অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে আমরা যার পর নাই বিস্মিত হলাম। বন্ধু দরুদকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এই জায়গার নাম লালন হলো কীভাবে। লালন তো আমাদের বিখ্যাত বাউল সাধক।’
দরুদ হেসে বললেন, ‘তোমাদের লালনকে আমি চিনি। আসলে ইরানে একটি ফুল আছে লালে, টিউলিপ। যেটি বর্তমানে ইরানের জাতীয় ফুল। এই লালের বহুবচন হচ্ছে লালান। যেটি কথ্যভাষায় লালন রূপ পেয়েছে। এই অঞ্চলে প্রচুর লালে ফুল হতো এবং এখানে এক জাতীয় বুনো লালে আছে যার আকৃতি বেশ ছোট এবং রঙ হলুদ। লালের প্রাচুর্যের কারণেই হয়তো এই গ্রামের নাম লালন হয়েছে।’
আমরা লালন থেকে ফিরলাম সন্ধ্যারও পরে। যাকারিয়া পথে তার ইউনিভার্সিটির কাছাকাছি কোথাও নেমে গেল। ড. দরুদগারিয়ান আমাদের গেস্ট হাউজের গেটে নামিয়ে দিয়ে বাসায় চলে গেলেন। যাবার সময় বলে গেলেন আমরা যেন আগামীকালের ‘বাংলাদেশ দিবস’-এর অনুষ্ঠানের জন্য ভালো করে প্রস্তুতি নেই।
পরদিন ৬ মে রোববার। বইমেলার ‘বাংলাদেশ দিবস’ অনুষ্ঠান। মূলত এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের জন্যই আমরা বাংলাদেশ থেকে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছি। এদিনের অনুষ্ঠানমালায় রয়েছে বেলা একটায় ড. ফরহাদ দরুদগারিয়ান ও তাঁর সহধর্মিণী ড. এলহাম হাদ্দাদি রচিত ‘শুরে ক্বান্দে পারসি দার বাংলাদেশ’ (বাংলাদেশে ফারসি ভাষার উচ্ছ্বাস) শীর্ষক গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন ও গ্রন্থের ওপর আলোচনা অনুষ্ঠান এবং বিকেল তিনটায় সাম্প্রতিক ইরানের সবচেয়ে আলোচিত কথাসাহিত্যিক মুস্তাফা মাস্তুর এর উপন্যাস ‘রুয়ে মাহে খোদাভান্দ রা বেবুস’- খোদার চাঁদমুখে চুমু খাও) উপন্যাসের বাংলা, তুর্কি এবং আযারবাইজানীয় ভাষার অনুবাদগ্রন্থের পরিচিতি ও পর্যালোচনা অনুষ্ঠান।
ড. দরুদগারিয়ান ও ড. এলহাম বাংলাদেশ অবস্থানকালে বাংলাদেশে ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের অতীত ঐতিহ্য, বিকাশ ও বিস্তার সম্পর্কে যেসব তথ্যউপাত্য সংগ্রহ করেছিলেন ইরানে ফিরে এসে এগুলোর সমন্বয়েই একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। সাদি ফাউন্ডেশনের প্রধান ইরানের বিশিষ্ট্য পণ্ডিত ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, সাবেক স্পিকার ড. গোলাম আলী হাদ্দাদ আদেল প্রধান অতিথি হিসেবে এই গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন করবেন। ইরানে নিযুক্ত বাংলাদেশের মাননীয় রাষ্ট্রদূত জনাব মজিবুর রহমান এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকার কথা। আমি মূল আলোচক এবং ড. তাহমিনা বেগম সহ-আলোচক।
বেলা এগারোটার দিকেই সাদি ফাউন্ডেশনের দাপ্তরিক ও আন্তর্জাতিক বিষয়ক প্রধান জনাব পালিজদার আমাদের নিয়ে মেলা অভিমুখে রওয়ানা হলেন। এবার গাড়ি আমাদের মেলা প্রাঙ্গণের মূল প্রবেশদ্বার পর্যন্ত নিয়ে গেল। ভিআইপি বলে এই সুবিধা। আমরা অনুষ্ঠানের জন্য নির্ধারিত কক্ষে প্রবেশ করলাম। এখানে আর একটা বইয়ের ওপর আলোচনা চলছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই অনুষ্ঠান শেষ হলো। ড. হাদ্দাদি এসে পৌঁছলেন। খানিক পর তেহরান রেডিওর বাংলা বিভাগের পরিচালক জনাব ইব্রাহিমী তাঁর সাংবাদিকদের নিয়ে উপস্থিত হলেন। তাঁদের অনেকেই আমার পরিচিত। তাঁরা এসে আমার সাথে করমর্দন করে কুশল বিনিময় করলেন। মিনিট পাঁচেক পর এসে উপস্থিত হলেন মাননীয় রাষ্ট্রদূত মজিবুর রহমান সাহেব। তাঁর সাথে তাঁর ফার্স্ট সেক্রেটারি জনাব হুমায়ুন কবির এবং কমার্শিয়াল সেক্রেটারি জনাব সবুর আহমেদ। মুমিতও তাঁদের সাথে রয়েছে।
যথাসময়ে অনুষ্ঠান শুরু হলো। ড. হাদ্দাদী তাঁর সূচনা বক্তব্য শেষ করে আমাদের সবাইকে নিয়ে বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করলেন। বেশ চমৎকার মোড়ক উন্মোচন পদ্ধতি! আমাদের দেশের মতো র‌্যাপিং পেপারে মোড়া বই মোড়ক ছিড়ে বের করলেন না। মূল মঞ্চে একটা সাইড টেবিলে স্ট্যান্ডের ওপর সুন্দর একটা কাপড় দিয়ে বেশ কটি বই ঢাকা ছিল। ড. হাদ্দাদী আমাদের নিয়ে সেই কাপড় সরালেন। অবগুন্ঠণ মুক্ত হলো বই ‘শুরে ক্বানেদ পারসি দার বাংলাদেশ’। পাঁচটি অধ্যায়ে বিভক্ত এই গ্রন্থে বাংলাদেশের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি, ভৌগলিক অবস্থা, ভূপ্রকৃতি, আবহাওয়া, জলবায়ু ইত্যাদির আলোচনা যেমন এসেছে। তেমনি বাংলাদেশের সাহিত্যে বিশেষ করে পুঁথি সহিত্যে ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের প্রভাব, বাংলাদেশে ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের আগমন-ইতিহাস ও তার বিকাশ ও বিস্তার, বর্তমান বাংলাদেশে ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের পুনর্জাগরণ, বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের বর্তমান অবস্থা, বাংলাদেশের ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক ও গবেষকগণের গবেষণাকর্মের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি, বর্তমান বাংলাদেশের কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে ফারসি সাহিত্য সম্পর্কে আগ্রহ ও অবগতি ইত্যাকার নানা বিষয় স্থান পেয়েছে ‘শুরে ক্বান্দে পারসি দার বাংলাদেশ’ গ্রন্থে।
আমি আর মজিবুর রহমান সাহেব পাশাপাশি বসেছি। তাঁর সাথে আমার বহুদিনের সখ্যতা। সেই ১৯৯৮ সালে আমি যখন প্রথম ইরানে আসি তখন তিনি ছিলেন তেহরানে বাংলাদেশ দূতাবাসে ফার্স্ট সেক্রেটারি। সেই সময়ের তাঁর আতিথিয়তা আজও আমি ভুলতে পারিনি। সেই থেকেই আমাদের হৃদ্যতা। গতবছর জানুয়ারিতে যখন ইরান এসেছিলাম তখন তিনি ইরানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত। মাত্র সাত দিনের সেই সফরে তাঁর বাসায় আমাদের দুই রাত আড্ডা এবং ডিনার হয়েছে। এখানেও বক্তৃতার ফাঁকে ফাঁকে আমরা কথা বলছিলাম। তিনি প্রস্তুতি নিয়ে এসেছিলেন ইংরেজিতে বক্তৃতা করবেন। আমি বললাম, বাংলায়ই বলেন। বাংলাদেশে ইরানি ডিপ্লোমেটরা সাধারণত ফারসিতে বক্তৃতা করে, সেগুলো বাংলায় অনুবাদ করা হয়। আপনি বাংলায় বলেন। মুমিত ফারসিতে অনুবাদ করবে। তিনি আমার প্রস্তাবে রাজি হয়ে বাংলায়ই তাঁর বক্তৃতা শুরু করলেন। মুমিত অনুবাদ করতে লাগলো। আমি দেখলাম উপস্থিত শ্রোতা-দর্শক বেশ উপভোগ করছে তাঁর বক্তৃতা। বিশেষ করে বাংলা ভাষা। তিনি তাঁর বক্তৃতায় বাংলাদেশে ফারসি ভাষার অতীত-ঐতিহ্যের প্রতি ইঙ্গিত করে বললেন, বাংলাদেশে ফারসি ভাষার এতটাই প্রশার ঘটেছিল যে বর্তমানেও আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের বাংলাভাষায় প্রায় সাড়ে ছয় হাজার ফারসি শব্দ ব্যবহার করি। তিনি রশিকতাছলে বললেন, ফারসি শব্দাবলি আমাদের কাছে খুবই পরিচিত। সুতরাং ইরানি বন্ধুরা আমাদের সামনে সতর্কতার সাথে ফারসি বলবেন। কারণ আমরা কিন্তু অনেক শব্দই বুঝতে পারি। তাঁর এ কথায় দর্শক-শ্রোতাদের মধ্যে হাসির রোল পড়ে গেল।
আমি ফারসিতেই আমার বক্তৃতা শুরু করলাম। বাংলাদেশীদের জন্য ফাঁকে ফাঁকে তা নিজেই বাংলায় অনুবাদ করতে থাকলাম। আমি আমার বক্তৃতায় বাংলাদেশ ও ইরানের মধ্যেকার সুদূর অতীতকাল থেকেই যে খুবই ঘনিষ্ট ভাষিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল এবং অতীতে যে বাংলাদেশে ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের ব্যাপক চর্চা হতো সেদিকে ইঙ্গিত করে বললাম, বর্তমানে ইরান ও বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও সাহিত্যিক সম্পর্ক এতটাই নিবিড় ও হৃদ্যতাপূর্ণ যে আমরা এখন আর কেউ কাউকে ভিনদেশী বলে অনুভব করি না। ইতঃপূর্বে আমি ইরানে আরও অনেক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছি এবং আমার অনেক সহকর্মী ও বাংলাদেশী স্কলাররা ইরানে যেসব অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছেন সেসব অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের কোনো রাষ্ট্রদূত অংশগ্রহণ করেছেন বলে আমার জানা নেই। সেদিক বিবেচনায় এই অনুষ্ঠান অত্যন্ত গুরুত্বের দাবিদার এবং আমি আশাকরি এর মাধ্যমে দুইদেশের শিল্পী-সাহিত্যিকদের মধ্যকার সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় ও হৃদ্যতাপূর্ণ হবে।
ড. তাহমিনাও ফারসি ও বাংলা উভয় ভাষায় তাঁর বক্তৃতা উপস্থাপন করলেন। তাঁর বক্তৃতায় ড. দরুদগারিয়ান ও ড. এলহাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের প্রশিক্ষণ কোর্সে গিয়ে যে আন্তরিকতাপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন এবং তাঁদের উপস্থিতিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা যে অনুপ্রেরণা লাভ করেছে সেদিকে ইঙ্গিত করলেন।
এরপর গ্রন্থকারদের বক্তৃতায় ড. দরুদগারিয়ান বাংলাদেশে অবস্থানকালে ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের যে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং বাংলাদেশের সাধারণ পাঠক ও কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি যে আগ্রহ সে বিষয়ে আলোকপাত করলেন।
জনাব পালিজদার তাঁর সভাপতির বক্তৃতায় উল্লেখ করলেন, এখন থেকে সাদি ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে আমরা প্রতিবছর বইমেলায় বাংলাদেশ বিষয়ক একটি করে গ্রন্থ প্রকাশের চেষ্টা করবো।
মধ্যাহ্ন ভোজের সময়ও পার হয়ে যাচ্ছে। জনাব পালিজদার অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করলেন। আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো মেলা আয়োজন কর্তৃপক্ষের অফিসে, মধ্যাহ্ন ভোজের জন্য। ইরানি কাবাব, কোরমা সাবজি, মাস্ত (টকদই) আর ইরানি বেরেঞ্জ (ইরানি ভাত) দিয়ে আমরা মধ্যাহ্ন ভোজ শেষ করলাম। এরই মধ্যে ড. এলহাম আমাকে তাড়া দিতে শুরু করলো, মুস্তাফা মাস্তুর চলে এসেছে। আমার জন্য অপেক্ষা করছে। মুস্তাফা মাস্তুর রুয়ে মাহে খোদাভান্দ রা বেবুস উপন্যাসের মূল লেখক। তাঁর এই উপন্যাস ২০০০-২০০১ সালে ইরানের শ্রেষ্ঠগ্রন্থ নির্বাচিত হয়েছে। আমি এটি ‘খোদার চাঁদমুখে চুমু খাও’ শিরোনাম বাংলাভাষায় অনুবাদ করেছি। ২০১৪ সালের একুশের গ্রন্থমেলায় রোদেলা প্রকাশনি এটি গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেছে। আরও বেশ কটি ভাষায় উপন্যাসটি অনূদিত হয়েছে। পরবর্তী অধিবেশনে বাংলা, তুর্কী এবং আজারবাইযানি অনুবাদের পরিচিতি ও পর্যালোচনা অনুষ্ঠান। এই অধিবেশনেও আমিই মূল আলোচক।
আমি খাওয়া শেষ করেই রাষ্ট্রদূত মহোদয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ড. এলহামের সাথে অনুষ্ঠানস্থলে চলে এলাম। মুস্তাফা মাস্তুরকে দেখে দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলাম তাঁকে। দুই ভাষার দুই লেখক শুধু লেখালেখির সূত্রে মুহূর্তে একাকার হয়ে গেলাম। মনে হলো দুজন দুজনার কতকালের পরিচিত।
যথাসময়ে অনুষ্ঠান শুরু হলো। এরই মাঝে মাননীয় রাষ্ট্রদূতকে বিদায় জানিয়ে অন্যরা সবাই সভাস্থলে এসে উপস্থিত হয়েছে। আমি আমার বক্তৃতায় বাংলাদেশে রুয়ে মাহে খোদাভান্দরা বেবুস-এর অনুবাদ পাঠকদের প্রতিক্রিয়া বিষয়ে উল্লেখ করে বললাম, পাঠকদের মধ্যে আমি দুই ধরণের প্রতিক্রিয়া দেখেছি। বিশেষ করে রক্ষণশীল পাঠকদের কেউ কেউ বইয়ের শিরোনাম দেখেই নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেছেন, এটিতো শিরকি শিরোনাম। খোদার আবার মুখ হতে পারে নাকি?
জবাবে আমি বিনয়ের সাথে তাদের বলেছি, এটি আক্ষরিক অর্থে নয়। রূপক অর্থে, কুদরতি মুখ। আপানারা দয়া করে বইটি পড়ুন। তারপর যদি মনে হয় এটি র্শেক-এর পর্যায়ে পড়ে তাহলে আপনাদের বক্তব্যের সাথে আমিও সহমত পোষণ করবো। বইটি পড়ার পর তাদের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ পাল্টে যেতে দেখেছি আমি। বরং তাঁরা বলেছেন, উপন্যাসের বিষয়বস্তু এমনই হওয়া উচিত। আমাদের দেশের বেশিরভাগ উপন্যাসের বিষয়বস্তুই তো হালকা, চটুল।
পরদিন ৭মে সোমবার বিকেল ৪টায় বুক সিটিতে (শাহরে কেতাব) ‘সমকালীন বাংলাদেশ ও ইরানের সাহিত্যের তূলনামূলক পর্যালোচনা এবং বাংলাদেশে ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশে নারী শিক্ষকদের ভূমিকা শীর্ষক’ সাহিত্য সভা। আমার আর ড. তাহমিনা বেগমের দুজনেরই এই সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করার কথা। আমি বলবো সমকালীন বাংলাদেশ ও ইরানের সাহিত্য বিষয়ে আর ড. তাহমিনা বলবেন বাংলাদেশে ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশে নারী শিক্ষকদের ভূমিকা। আমরা দুজনই সেভাবে প্রবন্ধ লিখে নিয়ে এসেছি। ড. দরুদগারিয়ান ও ড. এলহাম হাদ্দাদিও এতে বক্তব্য রাখবেন। জনাব মুস্তাফা মাস্তুরও উপস্থিত হবেন বক্তা হিসেবে।
মধ্যাহ্ন ভোজ সেড়ে আড়াইটার দিকে আমরা রওনা হলাম বুকসিটির উদ্দেশ্যে। বুক সিটি দক্ষিণ তেহরানে। তাই আমাদের পৌঁছতে একটু সময় লাগলো। প্রবেশ মুখে বোর্ডে টাঙ্গানো অনুষ্ঠানের পোস্টারে আমাদের নাম দেখে ভালই লাগলো। দোতলায় বুক সিটির অফিসে ঢুকতেই দেখা হলো বুকসিটির প্রধান মোহাম্মদখানীর সাথে। আমার বহুদিনের পরিচিত তিনি। একটু পরই এলো শাহ হোসাইনি, যিনি ২০০২ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত ঢাকাস্থ ইরানি সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের ডেপুটি কালচারাল কাউন্সেলরের দায়িত্ব পালন করেছেন। খুবই ভাল মানুষ। আরও একটু পরে এলো লেখক মুস্তাফা মাস্তুর। চা-চকলেটের আপ্যায়নের পর আমরা মূল মিলনায়তনে প্রবেশ করলাম। অনুষ্ঠান শুরু হলো। যথারীতি মোহাম্মদখানী সভাপতি। আমি আমার প্রবন্ধের আলোকে বক্তব্য উপস্থাপন করলাম। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক ইরানি সাহিত্যের অনুবাদ, সাম্প্রতিক বাংলাসাহিত্যের ফারসি অনুবাদ, বাংলাদেশে সমকালীন ফারসি সাহিত্যের পিএইচটি ও এমফিল পর্যায়ে গবেষণা, বিভিন্ন গবেষক ও শিক্ষকদের সাম্প্রডুশ ফারসি সাহিত্য সম্পর্কে গবেষণা প্রবন্ধ ও গ্রন্থ প্রকাশ, বাংলাদেশে সমকালীন ফারসি সাহিত্যের প্রচার ও বিকাশে বাংলাদেশে নিযুক্ত ইরানি ভিজিটিং প্রফেসরবৃন্দের ভূমিকা, ঢাকাস্থ ইরানি সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের ভূমিকা, ইত্যাকার নানা বিষয়। ড. তাহমিনা বেগম তাঁর প্রবন্ধে বাংলাদেশে ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশে নারী শিক্ষকগণের ভূমিকা বিষয়ে নানা তথ্য উপাত্য উপস্থাপন করলেন। ড. দরুদগারিয়ান বাংলাসাহিত্যের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি এবং বাংলাসাহিত্যে ফারসি সাহিত্যের প্রভাব, সমকালীন বাংলা সাহিত্যের সাথে সমকালীন ফারসি সাহিত্যের সাদৃশ্য ও দূরত্ব ইত্যাকার বিষয়ে আলোকপাত করলেন। তাঁর বক্তব্যে হুমায়ূন আহমাদ ও তাঁর সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য ও বিষয় খুব গুরুত্বের সাথে স্থান পেল। মুস্তাফা মাস্তুর তাঁর বক্তৃতায় সাম্প্রতিককালের ফারসি সাহিত্যের বিশেষ করে কবিতায় কায়সার আমিনপুর এবং কথাসাহিত্যে সিমিন দানেশভার, গুলি তারাক্বি প্রমুখের শ্রেষ্ঠকর্মসমূহ আরও অধিক অনুবাদ হওয়া উচিৎ বলে উল্লেখ করলেন। জনাব মোহাম্মদখানী তাঁর বক্তব্যে ঘোষণা করলেন, শাহরে কেতাব হুমায়ূন আহমেদের গৌরিপুর জংশন সম্পাদনা করে ইরান থেকে প্রকাশ করবে এবং এখন থেকে প্রতিবছর শাহরে কেতাব একটি করে ফারসি সাহিত্যের কোনো গ্রন্থ বাংলা ভাষায় এবং বাংলা সাহিত্যের কোনো একটি গ্রন্থ ফারসি ভাষায় অনুবাদ করে প্রকাশ করবে। তিনি ইরান-বাংলাদেশ সাহিত্য সংসদ-এরও ঘোষণা করলেন। সভাশেষে আনুষ্ঠানিকভাবে আমি রুয়ে মাহে খোদাভান্দ রা বেবুস-এর বাংলা অনুবাদের একটি কপি মূল লেখককে উপহার দিলাম।
বুকসিটির অনুষ্ঠান শেষ করে সবাই চলে গেলেও আমরা যেতে পারলাম না। আমাদের বসে থাকতে হলো, রেডিও তেহরান থেকে সাংবাদিক মুসা রেজা আসছেন আমাদের সাক্ষাৎকার নিতে। বিকেলেই পরিচালক ইব্রাহিমী ফোন করেছিল, আমরা কবে ফ্রি আছি। আমি বলেছি, আজ ছাড়া আর আমাদের অবসর নেই। আগামীকাল এবং পরশু আমাদের সারাদিন ব্যস্ততা। তাই এখানেই সময় নিয়েছেন আমাদের।
আমরা মোহাম্মদখানীর অফিসে অপেক্ষা করতে লাগলাম। প্রায় ঘণ্টাখানিক পর মুসা রেজা এসে পৌঁছলেন। সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ ও ইরানের নানা বিষয় উঠে এলো আলাপক্রমে। সাক্ষাৎকার শেষ করে বুক সিটি থেকে আমরা বের হলাম রাত আটটার দিকে। মুসা রেজা আমাদের ভেলেঞ্জাকে গেস্ট হাউজের কাছাকাছি কোনো এক জায়গায় নামিয়ে দিয়ে চলে গেলেন।
৮ তারিখ বেলা এগারোটায় আমাদের ইসলামি সম্পর্ক ও সংস্কৃতি সংস্থা (সাজেমানে ফারহাঙ্গ ভা এরতেবাতাতে ইসলামি)-এর এশিয়া মহাসাগরীয় অঞ্চল প্রধানের সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ ছিল। মূলত এই সংস্থাই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ইরানি সাংস্কৃতিক কেন্দ্রগুলো পরিচালনা করে। ঢাকাস্থ ইরানি সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের সাবেক ডেপুটি জনাব আসগর খসরুআবাদি বর্তমানে এই দপ্তরের ডেস্কপ্রধান। তাঁর আমন্ত্রণেই মূলত এই সাক্ষাৎ। ওদিকে ড. এলহাম অপেক্ষা করছেন হওজে হুনারিতে। হওজে হুনারি প্রধান আলী রেজা ক্বাজভে আমাদের মধ্যাহ্ন ভোজের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। দু জায়গাতেই আমরা বাংলাদেশ ইরানের নানা সম্পর্ক, বাংলাদেশে ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশে আরও কী কী করণীয়, বাংলাদেশের ফারসি গ্র্যাজুয়েটদের কর্মসংস্থানে কার্যকর কী কী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত, ইত্যাকার বিষয়ে আলোচনা হলো।
৯ মে সকালেই আমাদের কেনাকাটায় যাবার কথা ছিল। রাতে মাননীয় রাষ্ট্রদূত আমাদের জন্য নৈশভোজের আয়োজন করেছেন। তাই অন্য কোনো প্রগ্রাম আর রাখিনি। কিন্তু সকাল নয়টার দিকে ড. এলহাম ফোন করে তাঁর অফিসে যাবার জন্য অনুরোধ করলেন। বললেন, সাদি ফাউন্ডেশনের শিক্ষা ও গবেষণা বিষয়ক প্রধান ড. সাহরায়ী তোমাদের সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে চাচ্ছেন।
আমি বললাম, আমরাতো আজ কেনাকাটা করতে যাবার কথা।
তিনি অনুরোধ করে বললেন, বিষয়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তোমরা ঘণ্টাখানিক সময় দিয়ে তারপর কেনাকাটায় চলে যাও।
আমি রাজি হয়ে গেলাম। তৈরি হয়ে এলহামের দপ্তর হয়ে ড. সাহরায়ীর সাথে আমাদের বসতে বসতে দশটা বেজে গেল। আসলেই বৈঠকটা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মূলত ইরানের বাইরে ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের প্রচার ও বিকাশ নিয়ে কাজ করে সাদি ফাউন্ডেশন। জার্মানির গ্যাটে ফাউন্ডেশন এবং ফ্রান্সের আঁলিয়াস ফ্রাঁসোর মতো। তাই শিক্ষা ও গবেষণাই এই প্রতিষ্ঠানের মূল কাজ। ড. সাহরায়ী ভাষাতত্ত্বের এবং ফারসি ভাষা শিক্ষার বিশেষজ্ঞ। সম্প্রতি তাঁর নেতৃত্বে আইএলটিএস-এর আদলে অইরানিদের জন্য ফারসি ভাষা শিক্ষাপদ্ধতি প্রবর্তিত হয়েছে এবং তাঁর আলোকে এই প্রতিষ্ঠান বেশ কটি পাঠ্যপুস্তক প্রবর্তন করেছে। এগুলো হচ্ছে প্রাথমিক ফারসি ভাষা শিক্ষা বিষয়ক গ্রন্থ গামে আওয়াল, দ্রুত পঠন এবং আনন্দ পাঠ গ্রন্থ মিনা এবং ইরান পরিচিতি বিষয়ক গ্রন্থ ইরান শেনাসি। ড. সাহরায়ী এই বইগুলোর বৈশিষ্ট্য এবং সুবিধা অসুবিধা নিয়ে কথা বলছিলেন। এই পদ্ধতি এবং বইগুলো আমারকাছে খুবই কার্যকরী বলে মনে হলো। আমি বললাম, সবই ঠিক আছে, তবে এই পদ্ধতি কার্যকর ও ফলপ্রসূ করতে হলে আমরা যারা বিভিন্নি বিশ্ববিদ্যালয়ে অইরানিদের ফারসি ভাষা শিক্ষাদিচ্ছি সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষা শিক্ষার জন্য অভিন্ন পাঠ্যপুস্তক সিলেবাস ভুক্ত করতে হবে। এবং যারা এগুলো পাঠ দান করবেন তাদেরও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
ড. সাহরায়ী আমার বক্তব্যের সাথে একমত পোষণ করলেন। সাহরায়ীর দপ্তর থেকে বের হতে হতে সাড়ে বারটার মতো বেজে গেলো। বের হয়েই সোজা ট্যাক্সি নিয়ে তাজরিশ। সেখান থেকে ম্যাট্রোতে বড় বাজার। বড় বাজারে কেনাকাটা সেরে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা। দৌড়ে রুমে গিয়ে কোনো রকমে পোশাক পরিবর্তন করে রাষ্ট্রদূত মহোদয়ের নৈশভোজে রওনা হলাম। সেখান থেকে ফিরতে ফিরতে রাত সাড়ে বারটা বেজে গেল। পরদিন ১০মে বেশকিছু সুন্দর স্মৃতি সাথে নিয়ে স্বদেশের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।

* অধ্যাপক, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ইমাম রেযা (আ.)-এর ইবাদত-বন্দেগি ও মহানুভবতা

ইমাম রেযা (আ.)-এর ইবাদত-বন্দেগি
ইমাম রেযা (আ.) তাঁর সময়ের শ্রেষ্ঠ ইবাদত গুজার ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর শত্রুরাও এই বাস্তবতাকে স্বীকার করত এবং তাঁর চরিত্রের এই বিশেষ দিকটিকে তারা অস্বীকার করতে পারত না। এমনকি আব্বাসী খলিফা মামুনুর রশিদও তাঁর ‘আনুগত্যের অঙ্গীকারনামা’য় ইমাম রেযা (আ.)-এর এই ধর্মনিষ্ঠতার প্রশংসা করেছিলেন-যে অঙ্গীকারনামার মাধ্যমে তিনি ইমাম রেযা (আ.)-কে তাঁর উত্তরাধিকারী বলে ঘোষণা করেন।
রেযা বিন যাহহাক, যে ব্যক্তি ইমাম রেযা (আ.)-কে আব্বাসী খলিফা মামুনুর রশিদের নির্দেশে মদীনা থেকে মার্ভে (খোরাসানে) নির্বাসনে বাধ্য করেছিল সেই ব্যক্তি রেযা (আ.)-এর ধর্মপরায়ণতা ও তাঁর ইবাদত-বন্দেগি সম্পর্কে বর্ণনা করেছে : ‘আমি মদীনা থেকে মার্ভ পর্যন্ত তাঁর সাথে ছিলাম। আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি, আমি এমন কোন ব্যক্তিকে দেখিনি যে তাঁর মতো আল্লাহকে সবসময় স্মরণ করে এবং এমন কোন ব্যক্তিকেও দেখিনি যে তাঁর মতো সর্বশক্তিমান ও সুমহান আল্লাহকে ভয় করে। দিনের শুরুতে তিনি ফজর নামায আদায় করতেন। নামায আদায় শেষ হলে তিনি সেই স্থানেই সূর্যোদয় পর্যন্ত আল্লাহ তা‘আলার প্রশংসায় রত থাকতেন এবং এই সকল তাসবিহ বারবার পাঠ করতেন-‘আলহামদুলিল্লাহ’(সকল প্রশংসা আল্লাহর), ‘আল্লাহু আকবার’ (আল্লাহ সুমহান),‘লাইলাহা ইল্লাল্লাহ’ (আল্লাহ ব্যতীত কোন মাবুদ নেই), ‘আল্লাহুম্মা সাল্লিআলা মুহাম্মাদ ওয়াআলে মুহাম্মাদ’ (হে আল্লাহ! মহানবী (সা.) ও তাঁর বংশধরদের ওপর দরুদ প্রেরণ করুন)। এরপর তিনি পূর্বাহ্ন পর্যন্ত সিজদা রত থাকতেন। অতঃপর তিনি জনসাধারণের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করতেন, তাদের বিষয়াদি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতেন এবং তাদেরকে সৎকর্মে উদ্বুদ্ধ করতেন। এ সমস্ত কাজ তিনি দুপুর পর্যন্ত অব্যাহত রাখতেন।
মামুনুর রশিদের শাসনামলের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ইবরাহীম ইবনে আব্বাস ইমাম রেযা (আ.)-এর ইবাদত-বন্দেগি সম্পর্কে বলেন : ‘ইমাম রেযা (আ.) রাতের অধিকাংশ সময় জেগে থাকতেন ও খুব অল্প সময় ঘুমাতেন। বেশির ভাগ সময়ই তিনি সকাল পর্যন্ত জাগ্রত থাকতেন। তিনি প্রায়শ রোযা রাখতেন, বিশেষ করে প্রতিমাসেই তিন বিশেষ দিনের রোযা রাখতেন। তিনি এই রোযাকে ‘সারা জীবনের রোযা’ নামে অভিহিত করতেন। তিনি অত্যন্ত দানশীল ছিলেন এবং গোপনে এবং প্রায়শই রাতের বেলা অভাবীদেরকে দান করতেন। ’
ইবরাহীম আরো বলেন : ‘কেউ যদি দাবিকরে যে, সে ইমাম রেযা (আ.)-এর মতো ধার্মিক কোন ব্যক্তিকে দেখেছে তাহলে তা বিশ্বাস করোনা।’
দান-সাদাকাহ
ইমাম রেযা (আ.) খোরাসানে অবস্থান কালে একবার আরাফাত দিবসে তাঁর সকল সম্পদ গরীবদের মাঝে দান করে দেন। তখনতৎকালীনখলিফামামুনুররশিদের গভর্নরফযলইবনেসাহ্লতাঁকেবলেন : ‘আপনি তোএখন দেউলিয়া ও নিঃস্ব হয়ে গেছেন।’ইমাম রেযা (আ.) জবাবেবলেন : ‘বরংএরবিপরীত। আমিএখনঅতীতেরসকলসময়ের চেয়েওসম্পদশালী। আল্লাহরপুরস্কারও সন্তুষ্টিরজন্য আমি যেসম্পদের বাণিজ্য করেছিতাকেতুমিদেউলিয়াবলে গণ্য করোনা।’
ইমাম রেযা (আ.) অন্যদের ভালোবাসাঅর্জনবাতাদের সাথে বন্ধুত্ব গড়ারজন্য ধন-সম্পদ দানকরতেননা; বরং  তিনি দান-সাদাকাহ করাকে মহান স্রষ্টার নৈকট্য লাভের একটি উপায় মনে করতেন, যে সৃষ্টিকর্তা অনুগ্রহ করে তাঁর বান্দাকে ধন-সম্পদ দিয়ে ধন্য করেছেন।

গীরব-দুঃখীদের খাদ্য দান

মুআম্মার ইবনে খাল্লাদ বর্ণনা করেন, ইমাম রেযা (আ.) যখনই খাবার খেতে বসতেন তখন তিনি একটি বড় পাত্র আনতেন এবং সবচেয়ে উৎকৃষ্ট খাবারগুলো ওইপাত্রে তুলতেন এবং সেইখাবার গুলো গরীবদের মাঝে বিলিয়ে দেওয়ার আদেশ দিতেন। এরপর তিনি এই আয়াত পাঠ করতেন : ‘অতঃপর সে ধর্মের ঘাঁটিতে প্রবেশ করেনি।’ (সূরা বালাদ : ১১) অতঃপর বলতেন : ‘আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতা‘আলা জানেন যে, সকলেরই দাস মুক্ত করার সামর্থ্য নেই, তা সত্তে¡ও তিনি তাদের জন্য জান্নাত লাভের পথ করে দিয়েছেন (অপরকে খাদ্য দানের মাধ্যমে)।’

মানবতার প্রতিশ্রদ্ধা

গরীব-দুঃখী, দাস-দাসী, চাকর-চাকরাণী এবং নিঃস্বদের প্রতি ইমাম রেযা (আ.) সবচেয়ে বেশি মানবিকতাপূর্ণ আচরণ প্রদর্শন করতেন। ইমাম রেযা (আ.) তাদেরকে সমধর্মী এবং মানবতার দৃষ্টিকোণ থেকে ভাই হিসেবে দেখতেন। তাঁর একজন অনুসারী নিম্নোক্ত ঘটনাটি উল্লেখ করেন :
ইমাম রেযা (আ.)-এর খোরাসানে ভ্রমণের সময় আমি তাঁর সাথে ছিলাম। একদিন তিনি তাঁর খাবারের দস্তরখানা বিছালেন এবং তাঁর সকল কর্মচারীকে একত্রিত করলেন। আমি বললাম : ‘আমি আপনার জন্য উৎসর্গিত হই। তাদের জন্য আলাদা দস্তরখানাবিছানোহলে সেটা কি উত্তম হতো না?’ ইমাম রেযা (আ.) বলেন : ‘এটি বলনা।’ এরপর তিনি বলেন : ‘মহিমান্বিত ও সুমহান আল্লাহ এক এবং সকল মানুষই আদম ও হাওয়ার সন্তান এবং প্রত্যেকেই তাদের কর্ম অনুযায়ী পুরস্কার বা শাস্তি পাবে।’
ইমাম রেযা (আ.)-এর একজন কর্মচারী নাদির বলেন : ‘ইমাম রেযা (আ.) আমাদের কোন কর্মচারীকে খাওয়ার সময় কোন কাজের দায়িত্ব অর্র্পণ করতেন না, যতক্ষণ আমাদের খাওয়া শেষ নাহয়।’
ইমাম রেযা (আ.)-এর অপর একজন কর্মচারী ইয়াসিনও একই কথা বলেন। তিনি বলেন : ইমাম রেযা (আ.) আমাদেরকে বলেছিলেন : ‘আমি যদি তোমাদেরকে কোন কিছু করতে বলি আর তোমরা খাবার খাওয়ারত অবস্থায় থাক, তাহলে তোমাদের খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত উঠবেনা।’ কোন কোন সময় তিনি আমাদের কাউকে ডাকতেন, কিন্তু যখন তাঁকে বলা হতো যে, সে খাবার গ্রহণ করছে তখন তিনি বলতেন : ‘তাদের খাবার শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা কর।’
অবসর সময়ে ইমাম রেযা (আ.) তাঁর সকল কর্মচারীকে একত্রিত করতেন এবং তাদের সাথে কথা বলতেন। ইমাম রেযা (আ.) তাদেরকে আনন্দিত করার জন্য তাদের প্রতি তাঁর সন্তুষ্টির কথা ব্যক্ত করতেন। রাতের খাবার খাওয়ার সময় তাঁর আশপাশে যারা আছে তাদের সকলকে তাঁর সাথে খাওয়ার জন্য আহবান জানাতেন।

অনুবাদ :সরকার ওয়াসি আহম্মেদ

ইমাম রেযা (আ.)-এর ইবাদত-বন্দেগি ও মহানুভবতা

 

ইমাম রেযা (আ.)-এর ইবাদত-বন্দেগি
ইমাম রেযা (আ.) তাঁর সময়ের শ্রেষ্ঠ ইবাদত গুজার ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর শত্রুরাও এই বাস্তবতাকে স্বীকার করত এবং তাঁর চরিত্রের এই বিশেষ দিকটিকে তারা অস্বীকার করতে পারত না। এমনকি আব্বাসী খলিফা মামুনুর রশিদও তাঁর ‘আনুগত্যের অঙ্গীকারনামা’য় ইমাম রেযা (আ.)-এর এই ধর্মনিষ্ঠতার প্রশংসা করেছিলেন-যে অঙ্গীকারনামার মাধ্যমে তিনি ইমাম রেযা (আ.)-কে তাঁর উত্তরাধিকারী বলে ঘোষণা করেন।
রেযা বিন যাহহাক, যে ব্যক্তি ইমাম রেযা (আ.)-কে আব্বাসী খলিফা মামুনুর রশিদের নির্দেশে মদীনা থেকে মার্ভে (খোরাসানে) নির্বাসনে বাধ্য করেছিল সেই ব্যক্তি রেযা (আ.)-এর ধর্মপরায়ণতা ও তাঁর ইবাদত-বন্দেগি সম্পর্কে বর্ণনা করেছে : ‘আমি মদীনা থেকে মার্ভ পর্যন্ত তাঁর সাথে ছিলাম। আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি, আমি এমন কোন ব্যক্তিকে দেখিনি যে তাঁর মতো আল্লাহকে সবসময় স্মরণ করে এবং এমন কোন ব্যক্তিকেও দেখিনি যে তাঁর মতো সর্বশক্তিমান ও সুমহান আল্লাহকে ভয় করে। দিনের শুরুতে তিনি ফজর নামায আদায় করতেন। নামায আদায় শেষ হলে তিনি সেই স্থানেই সূর্যোদয় পর্যন্ত আল্লাহ তা‘আলার প্রশংসায় রত থাকতেন এবং এই সকল তাসবিহ বারবার পাঠ করতেন-‘আলহামদুলিল্লাহ’(সকল প্রশংসা আল্লাহর), ‘আল্লাহু আকবার’ (আল্লাহ সুমহান),‘লাইলাহা ইল্লাল্লাহ’ (আল্লাহ ব্যতীত কোন মাবুদ নেই), ‘আল্লাহুম্মা সাল্লিআলা মুহাম্মাদ ওয়াআলে মুহাম্মাদ’ (হে আল্লাহ! মহানবী (সা.) ও তাঁর বংশধরদের ওপর দরুদ প্রেরণ করুন)। এরপর তিনি পূর্বাহ্ন পর্যন্ত সিজদা রত থাকতেন। অতঃপর তিনি জনসাধারণের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করতেন, তাদের বিষয়াদি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতেন এবং তাদেরকে সৎকর্মে উদ্বুদ্ধ করতেন। এ সমস্ত কাজ তিনি দুপুর পর্যন্ত অব্যাহত রাখতেন।
মামুনুর রশিদের শাসনামলের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ইবরাহীম ইবনে আব্বাস ইমাম রেযা (আ.)-এর ইবাদত-বন্দেগি সম্পর্কে বলেন : ‘ইমাম রেযা (আ.) রাতের অধিকাংশ সময় জেগে থাকতেন ও খুব অল্প সময় ঘুমাতেন। বেশির ভাগ সময়ই তিনি সকাল পর্যন্ত জাগ্রত থাকতেন। তিনি প্রায়শ রোযা রাখতেন, বিশেষ করে প্রতিমাসেই তিন বিশেষ দিনের রোযা রাখতেন। তিনি এই রোযাকে ‘সারা জীবনের রোযা’ নামে অভিহিত করতেন। তিনি অত্যন্ত দানশীল ছিলেন এবং গোপনে এবং প্রায়শই রাতের বেলা অভাবীদেরকে দান করতেন। ’
ইবরাহীম আরো বলেন : ‘কেউ যদি দাবিকরে যে, সে ইমাম রেযা (আ.)-এর মতো ধার্মিক কোন ব্যক্তিকে দেখেছে তাহলে তা বিশ্বাস করোনা।’
দান-সাদাকাহ
ইমাম রেযা (আ.) খোরাসানে অবস্থান কালে একবার আরাফাত দিবসে তাঁর সকল সম্পদ গরীবদের মাঝে দান করে দেন। তখনতৎকালীনখলিফামামুনুররশিদের গভর্নরফযলইবনেসাহ্লতাঁকেবলেন : ‘আপনি তোএখন দেউলিয়া ও নিঃস্ব হয়ে গেছেন।’ইমাম রেযা (আ.) জবাবেবলেন : ‘বরংএরবিপরীত। আমিএখনঅতীতেরসকলসময়ের চেয়েওসম্পদশালী। আল্লাহরপুরস্কারও সন্তুষ্টিরজন্য আমি যেসম্পদের বাণিজ্য করেছিতাকেতুমিদেউলিয়াবলে গণ্য করোনা।’
ইমাম রেযা (আ.) অন্যদের ভালোবাসাঅর্জনবাতাদের সাথে বন্ধুত্ব গড়ারজন্য ধন-সম্পদ দানকরতেননা; বরংতিনি দান-সাদাকাহকরাকেমহান¯্রষ্টারনৈকট্য লাভেরএকটিউপায়মনেকরতেন, যে সৃষ্টিকর্তাঅনুগ্রহকরেতাঁরবান্দাকেধন-সম্পদ দিয়েধন্য করেছেন।
গীরব-দুঃখীদের খাদ্য দান
মুআম্মার ইবনে খাল্লাদ বর্ণনা করেন, ইমাম রেযা (আ.) যখনই খাবার খেতে বসতেন তখন তিনি একটি বড় পাত্র আনতেন এবং সবচেয়ে উৎকৃষ্ট খাবারগুলো ওইপাত্রে তুলতেন এবং সেইখাবার গুলো গরীবদের মাঝে বিলিয়ে দেওয়ার আদেশ দিতেন। এরপর তিনি এই আয়াত পাঠ করতেন : ‘অতঃপর সে ধর্মের ঘাঁটিতে প্রবেশ করেনি।’ (সূরা বালাদ : ১১) অতঃপর বলতেন : ‘আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতা‘আলা জানেন যে, সকলেরই দাস মুক্ত করার সামর্থ্য নেই, তা সত্ত্বেও তিনি তাদের জন্য জান্নাত লাভের পথ করে দিয়েছেন (অপরকে খাদ্য দানের মাধ্যমে)।’
মানবতার প্রতিশ্রদ্ধা
গরীব-দুঃখী, দাস-দাসী, চাকর-চাকরাণী এবং নিঃস্বদের প্রতি ইমাম রেযা (আ.) সবচেয়ে বেশি মানবিকতাপূর্ণ আচরণ প্রদর্শন করতেন। ইমাম রেযা (আ.) তাদেরকে সমধর্মী এবং মানবতার দৃষ্টিকোণ থেকে ভাই হিসেবে দেখতেন। তাঁর একজন অনুসারী নি¤েœাক্ত ঘটনাটি উল্লেখ করেন :
ইমাম রেযা (আ.)-এর খোরাসানে ভ্রমণের সময় আমি তাঁর সাথে ছিলাম। একদিন তিনি তাঁর খাবারের দস্তরখানা বিছালেন এবং তাঁর সকল কর্মচারীকে একত্রিত করলেন। আমি বললাম : ‘আমি আপনার জন্য উৎসর্গিত হই। তাদের জন্য আলাদা দস্তরখানাবিছানোহলে সেটা কি উত্তম হতো না?’ ইমাম রেযা (আ.) বলেন : ‘এটি বলনা।’ এরপর তিনি বলেন : ‘মহিমান্বিত ও সুমহান আল্লাহ এক এবং সকল মানুষই আদম ও হাওয়ার সন্তান এবং প্রত্যেকেই তাদের কর্ম অনুযায়ী পুরস্কার বা শাস্তি পাবে।’
ইমাম রেযা (আ.)-এর একজন কর্মচারী নাদির বলেন : ‘ইমাম রেযা (আ.) আমাদের কোন কর্মচারীকে খাওয়ার সময় কোন কাজের দায়িত্ব অর্র্পণ করতেন না, যতক্ষণ আমাদের খাওয়া শেষ নাহয়।’
ইমাম রেযা (আ.)-এর অপর একজন কর্মচারী ইয়াসিনও একই কথা বলেন। তিনি বলেন : ইমাম রেযা (আ.) আমাদেরকে বলেছিলেন : ‘আমি যদি তোমাদেরকে কোন কিছু করতে বলি আর তোমরা খাবার খাওয়ারত অবস্থায় থাক, তাহলে তোমাদের খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত উঠবেনা।’ কোন কোন সময় তিনি আমাদের কাউকে ডাকতেন, কিন্তু যখন তাঁকে বলা হতো যে, সে খাবার গ্রহণ করছে তখন তিনি বলতেন : ‘তাদের খাবার শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা কর।’
অবসর সময়ে ইমাম রেযা (আ.) তাঁর সকল কর্মচারীকে একত্রিত করতেন এবং তাদের সাথে কথা বলতেন। ইমাম রেযা (আ.) তাদেরকে আনন্দিত করার জন্য তাদের প্রতি তাঁর সন্তুষ্টির কথা ব্যক্ত করতেন। রাতের খাবার খাওয়ার সময় তাঁর আশপাশে যারা আছে তাদের সকলকে তাঁর সাথে খাওয়ার জন্য আহ্বান জানাতেন।

অনুবাদ :সরকার ওয়াসি আহম্মেদ

জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসারে ইমাম জাফর সাদিক (আ.)-এর ভূমিকা

মো. মাঈনউদ্দিন: ইমাম জাফর সাদিক (আ.) ছিলেন ইমামতের আকাশের ষষ্ঠ তারকা। তিনি ৮৩ হিজরির ১৭ রবিউল আউয়াল মদিনায় জন্মগ্রহণ করেন ও ৬৫ বছর বয়সে ১৪৮ হিজরিতে শাহাদাত বরণ করেন। তিনি জান্নাতুল বাকীতে প্রিয় পিতার পাশে সমাধিস্থ হন। একদা সেখানে সমাধি সৌধ ছিল, কিন্তু ৮ শাওয়ালের ওয়াহাবী তাণ্ডব ও পরবর্তী ঘটনা প্রবাহে তা আর আলাদা করে চিহ্নিত করার উপায় নেই।
তাঁর কুনিয়াহ ছিল আবু আব্দুল্লাহ ও উপাধি হলো সাদিক। তাঁর মহান পিতা ছিলেন ইমাম বাকির (আ.) ও মাতা ছিলেন উম্মে ফারভাহ।
ইমাম সাদিক (আ.) ইতিহাসের এমন এক অধ্যায় অতিক্রম করছিলেন, যখন বিশৃঙ্খলা, বিরোধ ও রাজনৈতিক বিবাদ ইসলামি সমাজে এমন আকারে বিস্তৃতি লাভ করেছিল যে, তদানিন্তন সমাজ ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়েছিল। ঠিক এমন এক জটিল পরিস্থিতিতে ইমাম জাফর সাদিক (আ.)-এর প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার কারণে জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসার ঘটানোর জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছিল। তিনি তাঁর তীক্ষ্ম চিন্তার আলোকে জ্ঞানের অবগুণ্ঠন বিদীর্ণ করে বিশ্বমানবতাকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের উপত্যকার সন্ধান দিয়েছেন।
ইমাম সাদিক (আ.)-এর অভূতপূর্ব বিশ্ববিদ্যালয়ে তাফসীর, কোরআন তত্ত্ব, হাদীস, ফিকাহ, ধর্মীয় জ্ঞানের পাশাপাশি অন্যান্য জ্ঞান, যেমন : গণিত, চিকিৎসাবিদ্যা, রসায়ন, জ্যোতির্বিদ্যা, প্রাণিবিদ্যা ও আরও শতাধিক বিদ্যার পাঠ দান করা হতো, যেগুলো ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মানুষের জ্ঞানের উৎস হয়েছিল।
ইতিহাস সাক্ষী হয়ে আছে যে, প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর ইন্তিকালের পর ইমামগণ নিজ নিজ সময়ের শাসকদের দ্বারা চাপের মধ্যে জীবন কাটিয়েছিলেন। তথাপি ইমাম সাদিক (আ.) কিরূপে সক্ষম হয়েছিলেন জ্ঞান-বিজ্ঞানের একাধিক শাখায় ভূমিকা রাখতে?
এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য ইমাম (আ.)-এর ইমামত কালে রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রতি আলোকপাত করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। ইমাম সাদিক (আ.) ১১৪ হিজরিতে ইমামত লাভ করেছিলেন। তাঁর ইমামত-কাল ছিল উমাইয়্যা শাসনের শেষ দিকের সমসাময়িক। ১৩২ হিজরিতে উমাইয়্যা শাসনের অবসান ঘটে ও আবাসীরা ক্ষমতার মসনদে আরোহণ করে। সুতরাং উমাইয়্যা যুগের অবসান ও আব্বাসী যুগের সূচনা এমনই এক সময়ে ইমাম এক অপূর্ব সুযোগ হাতে পান। ইমাম এ সুযোগ জ্ঞান-বিজ্ঞান বিস্তারের জন্য কাজে লাগান। এ সময় উমাইয়্যা ও আব্বাসীরা ক্ষমতা রক্ষা করা ও ক্ষমতার মসনদে আরোহণ করার জন্য দ্বন্দ্বে লিপ্ত ছিল। সুতরাং শাসকশ্রেণি নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় ব্যস্ত ছিল। আর শিক্ষা ও সংস্কৃতির উন্নয়নের এক সোনালি যুগ ইমাম সাদিক (আ.)-এর সময়ে রচিত হয়েছিল। এ সময়ই বিভিন্ন শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন রূপ পরিগ্রহ করেছিল। এর ধারাবাহিকতায় ইলমে ক্বারাআতে কোরআন, ইলমে তাফসীর, ইলমে হাদীস, ইলমে ফিক্হ, ইলমে কালাম, অপরদিকে চিকিৎসাবিদ্যা, দর্শন, জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত ও রসায়ন ইত্যাদি বিদ্যা অস্তিত্ব লাভ করেছিল। জ্ঞানচর্চা এতটা প্রসার লাভ করেছিল যে, যার কাছে যা-ই চিন্তার খোরাক ছিল, তা-ই বাজারে বিকাতো। ফলে এক অদ্ভুত জ্ঞানপিপাসা সমাজে বিরাজ করছিল, তাই বিভিন্ন ধরনের চিন্তাগত দ্বিধা-দ্বন্দ্বেরও উদ্ভব হয়েছিল। আর এগুলোর জবাব দেয়া জরুরি হয়ে পড়েছিল।
যা হোক বিভিন্ন জ্ঞানগত ধারার উৎপত্তির কারণ হিসেবে নিম্নলিখিত কারণগুলোকে উল্লেখ করা যায় :
(১) ইসলামে চিন্তা ও বিশ্বাসগত স্বাধীনতা : এ স্বাধীনতার মূল উৎস ইসলামের শিক্ষায়ই নিহিত। ফলে আব্বাসী খলিফারা চাইলেও তা রোধ করতে পারতেন না।
(২) তদানিন্তন ইসলামি সমাজ ছিল পরিপূর্ণরূপে মাযহাবী। ফলে জনগণ মাযহাবী প্রবণতার প্রভাব বলয়ে বিদ্যমান ছিল। জ্ঞানার্জনের ব্যাপারে মহানবী (সা.)-এর উৎসাহ এবং জ্ঞান, বিজ্ঞান ও চিন্তার পথে পবিত্র কোরআনের শিক্ষা এ জ্ঞানগত ধারাসমূহের উৎপত্তির পথে প্রধান উদ্দীপক ছিল।
(৩) বিভিন্ন ক্ষেত্র ও গোষ্ঠী, যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিল প্রকারান্তরে তারা পূর্ব থেকেই কিছু নিজস্ব ধ্যান-ধারণার অধিকারী ছিল। এগুলোর মধ্যে পারসিক, মিশরীয় ও সিরিয় সভ্যতা ছিল তদানিন্তন সভ্যতাসমূহের কেন্দ্রবিন্দু। তাঁরা ইসলামের শিক্ষাকে গভীরভাবে অনুধাবনের জন্য গবেষণা, অনুসন্ধান ও মতবিনিময় করতেন।
(৪) অন্যান্য ধর্মের মানুষের সাথে মুসলমানদের শান্তিপূর্ণ অবস্থান বা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রেখে বসবাস, বিশেষ করে আহলে কিতাবের সাথে অবস্থান। মুসলমানরা আহলে কিতাবের সাথে বসবাসকে নিজেদের দ্বীনের মূলনীতি বিরুদ্ধ বলে মনে করতেন না। তদানিন্তন আহলে কিতাবের মধ্যেও অনেক জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তি ছিলেন। মুসলমানরা তাঁদের সাথে তাত্ত্বিক আলোচনা ও বিতর্ক করতেন।
এবার মূল শিরোনামের দিকে আলোকপাত করা যাক।
ইমাম সাদিক (আ.) বিদ্যমান পরিস্থিতিকে পূর্ণরূপে কাজে লাগালেন এবং স্বীয় পিতা পঞ্চম ইমাম বাকির (আ.)-এর কর্মসূচির ধারাবাহিকতায় এক বিশাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করলেন। সেখানে তিনি আক্বলী (বুদ্ধিবৃত্তিক) ও নাক্বলী (কোরআন, হাদীস…) বিষয়ে অনেক খ্যাতিমান শিষ্য ও ছাত্র লালন করেছিলেন। শেখ মুফিদ ‘আল ইরশাদ’-এর ২৭১ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন, ইমাম জাফর সাদিক (আ.)-এর ছাত্র সংখ্যা ছিল চার হাজারেরও বেশি। এদের মধ্যে হিশাম ইবনে হাকাম, মোহাম্মদ ইবনে মুসলিম আবান ইবনে তাগলিব, হিশাম ইবনে সালিম, মুমিন তাক্ব, মোফাজ্জাল ইবনে ওমর, জাবির ইবনে হাইয়্যান প্রমুখের কথা উল্লেখ করা যায়। আমরা এখানে জ্ঞান ও বিজ্ঞানের প্রসারে ইমাম জাফর সাদিক (আ.)-এর ভূমিকার উত্তম উদাহরণ হিসাবে তাঁর শিষ্যদের মধ্যে কারো কারো অমর কীর্তির দিকে আলোকপাত করব। আশা করি শিষ্যদের কর্ম তাঁদের গুরুর দৃষ্টান্তমূলক পরিচয় পাঠকের কাছে তুলে ধরবে।
হিশাম ইবনে হাকাম
হিশাম ইবনে হাকাম ৩১টি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি একজন বিখ্যাত মুতাকাল্লিম ও বাগ্মী তার্কিক। তিনি ছিলেন ইমাম জাফর সাদিক (আ.)-এর প্রথম সারির ছাত্র। তাঁর উল্লেখযোগ্য লিখনির মধ্যে রয়েছে, ইলমে কালামে ‘আল ইমামাহ’, ‘জাবর ওয়া এখতিয়ার’, উসূলে ফেকহ-এ ‘আলফায’।
মুমিন তাক্ব
মোহাম্মদ ইবনে নো’মান কুফী আবু জাফর মুমিন তাক্ব নামে খ্যাত। তিনি একাধিক কিতাব লিখেছেন এবং খাওয়ারেজের সাথে বিতর্ক করেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হলো : ‘আল ইহতিজায ফীল ইমামাতু আলী (আ.)’, ‘আফয়ালু লা তাফয়াল’, ‘আররাদ্দু আলাল মু’তাযিলা’।
মোফাজ্জাল ইবনে ওমর কুফী
ইমাম সাদিক (আ.) প্রাকৃতিক বিজ্ঞান বিষয়ে জ্ঞান শিক্ষা দিয়েছিলেন, যেখানে প্রকৃতির নিগূঢ় রহস্য উন্মোচিত হয়েছিল; যা আধুনিক যুগের বিজ্ঞানীদেরকে আজও বিস্মিত করে। ইমাম চার দিন ধরে মোফাজ্জালকে লিখিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে তা ‘তাওহীদে মোফাজ্জাল’ হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছিল।
প্রসঙ্গক্রমে ইমাম সাদিক (আ.) মোফাজ্জাল ইবনে ওমর কুফীকে বললেন : ‘আমি তোমার নিকট জগৎ সৃষ্টি, প্রাণিকুল, হিংস্র পশুসমূহ, পোকা-মাকড়, পাখিদের সৃষ্টি এবং যে কোন প্রাণী, মানুষ, চতুষ্পদ, বৃক্ষ-লতা, ফলজ ও ফলহীন বৃক্ষ, খাওয়ার যোগ্য ও খাওয়ার অযোগ্য বৃক্ষ-লতার সৃষ্টিতে মহান আল্লাহর প্রজ্ঞা সম্পর্কে বর্ণনা করব, যাতে উপদেশ গ্রহণকারীরা তা থেকে উপদেশ গ্রহণ করতে পারে আর মুমিনদের মা’রেফাত বৃদ্ধি পায়, আর নাস্তিক ও কাফেররা তাতে পেরেশানিতে থাকে। আগামীকাল প্রভাতে আমার কাছে আস।’
ইমাম এরপর ধারাবাহিকভাবে চারদিন ধরে সৃষ্টির সূচনা থেকে মানুষের সৃষ্টি, অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক শক্তি, তার ফেতরাতগত গুণাবলি, মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সৃষ্টি, বিভিন্ন প্রকার পশু-পাখি সৃষ্টি, অনুরূপ আসমান ও পৃথিবী সৃষ্টি, বিপদ-আপদ ও মৃত্যুর দর্শন ইত্যাদি বিষয়ে বর্ণনা দেন। আর তা পরবর্তীকালে তাওহীদে মোফাজ্জাল হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছিল।
জাবির ইবনে হাইয়্যান
ইমাম জাফর সাদিক (আ.)-এর একজন অন্যতম ছাত্র ছিলেন জাবির ইবনে হাইয়্যান। তিনি রসায়নবিদ্যার ওপর একাধিক বই লিখেছেন। তাঁর ভাষ্য অনুযায়ী তিনি ইমাম (আ.)-এর শিক্ষা থেকে এ বইগুলো লিখেছেন। কারণ, তাঁর বইতে উল্লিখিত হয়েছে :
قال لی جعفر علیه‌ السّلام القی علی ‌جعفر علیه ‌‌السّلام، حدّثنی مولای جعفر علیه ‌السّلام، اخذت هذا العلم من جعفر ابن‌ محمّد سید أهل زمانه علیهما السّلام
জাবির তাঁর থিওরিগুলো প্রমাণের জন্য তদানিন্তন সময়ের উপযোগী করে একটি পরীক্ষাগারও তৈরি করছিলেন। তিনি তেজাব পানি ও সালফিউরিক এসিডের আবিষ্কারক। তাঁর লিখিত পুস্তক সংখ্যা পাঁচশ’।
আবু হামযা সুমালী
ইমাম জাফর সাদিক (আ.)-এর অন্যতম ছাত্র। তিনি ছিলেন কুফার অধিবাসী, অন্যতম বিশ্বস্ত ও জ্ঞানী ব্যক্তি। তিনি কোরআনের তাফসীর লিখেছিলেন। তিনি ইমাম সাজ্জাদ (আ.), ইমাম বাকির (আ.), ইমাম জাফর সাদিক (আ.) ও ইমাম মূসা কাজিম (আ.), এ চারজন ইমাম থেকেই কল্যাণ লাভ করেছিলেন।
ইমাম আবু হানিফা
ইমাম জাফর সাদিক (আ.)-এর বিশ্ববিদ্যালয় কেবল মাত্র তাঁর একান্ত অনুসারীদের জন্যই সীমাবদ্ধ ছিল না; বরং আহলে সুন্নাতের বিশিষ্ট ব্যক্তিগণও তাঁর এ বিদ্যানিকেতনে আশ্রয় পেয়েছিলেন। তাঁদের অন্যতম ছিলেন ইমাম আবু হানিফা যাঁর নামে হানাফী মাযহাব প্রচার লাভ করেছিল। তিনি দুই বছর ইমাম থেকে শিক্ষা নেয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। আর এ দুই বছরকে তিনি জ্ঞান ও বিদ্যার ভিত্তি হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন : لو لا السنتان لهلك نُعمان ‘যদি ঐ দুই বছর না থাকত, তবে নোমান ধ্বংস হয়ে যেত।’
উল্লেখ্য, ইমাম আবু হানিফার নাম নো’মান ইবনে সাবেত।
ইমাম জাফর সাদিক (আ.) নিজ সময়ের সমস্ত চিন্তা ও বিশ্বাসগত ধারার সম্মুখীন হয়েছিলেন এবং তাদের মোকাবেলায় ইসলাম এ আহলে বাইতের মতাদর্শগত অবস্থানকে পরিষ্কার করেছিলেন এবং ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছিলেন। আর তাই তাবৎ জ্ঞান-বিদ্যা ইমামতের আকাশের এ ষষ্ঠ তারকার নিকট ঋণী।
তথ্যসূত্র
১. সিরায়ে পিশবুয়গ সাহদী পিশাভারী
২. উইকিপিডিয়া