All posts by dreamboy

ইরানের ইসলামি বিপ্লবের প্রেক্ষাপট এবং প্রভাব

সিরাজুল ইসলাম
বিংশ শতাব্দীর শেষ প্রান্তে এসে বিশ্বে যে মহাবিস্ময়কর ঘটনাটি ঘটেছিল তার নাম ইরানের ইলামি বিপ্লব। যখন সারা বিশ্ব রুশ-মার্কিন দুই শিবিরে বিভক্ত, বিশ্ববাসী যখন মার্কিন পুঁজিবাদ ও সোভিয়েত কমিউনিজমের যাঁতাকলে পিষ্ট, তখন ‘না পশ্চিম, না পূর্ব’ এই স্লোগানকে বুকে ধারণ করে একদল ‘জানবাজ যোদ্ধা’ ইরানে এই অত্যাশ্চর্যজনক ঘটনার জন্ম দেন। আধুনিক বিশ্বের সেই নজিরবিহীন বিপ্লবের নেতৃত্বে ছিলেন ইরানের সিংহপুরুষ সর্বজন শ্রদ্ধেয় আলেম হযরত আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ মুসাভি খোমেইনী। কী এক ঐশী ক্ষমতা দিয়ে তিনি পুরো ইরানি জাতিকে উন্মত্ত সাগরের ন্যায় জাগিয়ে তুললেন যার ফল হিসেবে ফেনিল তটে গোড়াপত্তন হলো ইসলামি বিপ্লবের। বহু জীবন আর রক্তের বিনিময়ে ইতিহাসের ইরান পেল সত্যিকারের স্বাধীনতা, সাম্রাজ্যবাদকে ‘না’ বলে দেওয়ার দুর্দমনীয় সাহস। যে শুভক্ষণে পাহাড়, সাগর আর জঙ্গলাকীর্ণ ইরানের ভূখ- বিপ্লবের সোনালি আভায় উদ্ভাসিত হলো সেই শুভক্ষণটি হলো ১৯৭৯ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি। আড়াই হাজার বছরের রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে, পতন ঘটে পাহলভি রাজবংশের শেষ শাসক মোহাম্মাদ রেজা খানের। ইরানে প্রতিষ্ঠা হয় জনগণের অংশগ্রহণে ইসলামি সরকার ব্যবস্থা।
রেজা শাহ ইরানের শাসন ক্ষমতায় বসেছিলেন ১৯৪১ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর। ক্ষমতায় থাকাকালে তিনি ১৯৬৭ সালের ২৬ অক্টোবর জন্মদিনে নিজেকে ‘শাহানশাহ’ বা ‘রাজাদের রাজা’ বলে ঘোষণা দেন। রেজা শাহ ছিলেন একজন সেক্যুলার ব্যক্তি। ক্ষমতায় বসে তিনি বিদেশি শাসক বিশেষ করে আমেরিকা, ব্রিটেন ও ইসরাইলকে খুশি করার কাজে ব্যস্ত ছিলেন। এর কারণ মূলত তাদের কৃপায় তিনি নিজ পিতার স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন। দেশ শাসনের যোগ্যতা না যতটা ছিল, তার চেয়ে বেশি ছিল পরাশক্তির আনুকূল্য। ফলে দেশের মান্ুেষর সুবিধা-অসুবিধাগুলো নিয়ে তার কোনো মাথা ব্যথা ছিল না। নিজের গদি ঠিক রেখে যা খুশি তাই করার চিন্তাই ছিল প্রখর। এ কারণে ধীরে ধীরে তিনি জনপ্রিয়তা হারাতে থাকেন বিশেষ করে ইরানের শিয়া আলেমদের কাছ থেকে তিনি একেবারেই ছিটকে পড়েন। এছাড়া, শ্রমিক ও কর্মজীবী মানুষও তাকে পছন্দ করতেন না। তার বিরুদ্ধে লাগামহীন দুর্নীতির অভিযোগ ছিল। দুর্নীতিতে তার আশপাশের লোকজন জড়িত ছিলেন; জড়িত ছিলেন তার পরিবারের লোকজন। প্রশাসনের এলিটরাও একইভাবে দুর্নীতিতে জড়িত ছিলেন। ফলে তার সরকার ইসলামি গণবিপ্লব সফল হওয়ার বেশ আগেই জনপ্রিয়তা হারিয়েছিল। এছাড়া, রাজনৈতিক কিছু কর্মকা- যেমন কমিউনিস্ট ‘তুদেহ পার্টি’কে নিষিদ্ধ করা, ইসরাইলের সঙ্গে অতিমাত্রায় ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, বিরোধী রাজনীতিকদেরকে গুপ্ত পুলিশ বাহিনী সাভাক দিয়ে নির্যাতন তার পতনের জন্য অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে কাজ করেছে। সরকারি হিসাব মতে ১৯৭৮ সালে ইরানে রাজনৈতিক বন্দির সংখ্যা ছিল ২,২০০ এর মতো, কিন্তু গণবিপ্লবের সময় সেই সংখ্যা বহুগুণ বেড়ে যায়। ফলে ১৯৭৯ সালে দেশে গণ-অশান্তি বিপ্লবে রূপ নেয় এবং চূড়ান্তভাবে রেজা শাহের পতন ঘটে। ১১ ফেব্রুয়ারি বিপ্লব সফল হওয়ার আগে ১৭ জানুয়ারি তিনি দেশ থেকে পালিয়ে যান। জনশ্রুতি রয়েছে, রেজা শাহ নারীর বেশে দেশ থেকে পালিয়ে যান। দেশে ফিরে এলে মৃত্যুদ-ের আশংকা ছিল। সে ভয়ে রেজা শাহ দেশে ফিরে আসেন নি; অনেকটা নিঃসঙ্গ অবস্থায় মিশরে তার মৃত্যু হয় এবং রাজধানী কায়রোয় তাকে দাফন করা হয়। সেখানেই দাফন করা হয়েছিল তার বাবাকেও।
ইরানের এই ভয়াবহ ক্ষমতাধর রেজা শাহের জীবন ছিল ভোগ বিলাসে ভরা। এর ছোট্ট নমুনা পাওয়া যাবে একটি ঘটনা উল্লেখ করলে। ১৯৭১ সালে দেশে ইরানি রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আড়াই হাজার বছর পূর্তি পালন করেন রেজা খান। সে সময় মার্কিন প্রভাবশালী দৈনিক ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ রিপোর্ট করেছিল ইরানি রাজতন্ত্রের আড়াই হাজার বছর পূর্তিতে রেজা শাহ পাহলভি তখনকার দিনে ১০০ মিলিয়ন বা ১০ কোটি ডলার খরচ করেছিলেন। ইরানের প্রাচীন ও সুবিখ্যাত পার্সেপোলিস গেইটের কাছে ১৬০ একর জমিতে ‘তাঁবুর শহর’ প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দেন। তার নির্দেশমতো বিশালাকারের তিনটি রাজকীয় তাঁবু এবং ৫৯টি লেজার দিয়ে তাঁবুর শহর প্রতিষ্ঠা করা হয়। তারার আকৃতিতে সাজানো হয় তাঁবুর শহরকে। ফ্রান্সের বিখ্যাত ম্যাক্সিম থেকে বাবুর্চি আনা হয় এবং এসব বাবুর্চি রাজ পরিবারের সদস্য ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা রাজকীয় মেহমানদের জন্য খাবার তৈরি করে। তাঁবুর শহর সাজানোর কাজ করে মাইসন জ্যানসেন কোম্পানি যারা জ্যাকুইলিন কেনেডির জন্য হোয়াইট হাউজের ডেকোরেশনের কাজ করেছিল। মেহমানদের খাবার-দাবার পরিবেশন করা হয়েছিল ফ্রান্সে তৈরি অভিজাত বাসনকোসনে। এছাড়া মদপানের আয়োজন করা হয়েছিল বাকারা ক্রিস্টাল গ্লাসে।
যেখানে এই মহাসাড়ম্বরের সঙ্গে উৎসব আয়োজন করা হয়েছিল তার পাশেই ছিল ইরানের অংসখ্য গরিব লোকের বসবাস। তাদেরকে অভুক্ত রেখে রাজপরিবারের সদস্য আর বিদেশী মেহমান নিয়ে বিশাল রাজকীয় ভোজ উৎসবের আয়োজন মারাত্মক কেলেংকারির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কেউ রেজা শাহের এই রাজকীয় ভোজ উৎসবকে পছন্দ করেন নি। এর প্রতিবাদে ইরানের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ধর্মঘট করেছিল।
রেজা শাহের ব্যক্তিগত জীবন যেমন ছিল ভোগবিলাসে পূর্ণ, তেমনি যৌন-উন্মত্ততাও ছিল লাগামহীন। তার চরিত্রের এসব অন্ধকার দিকই ইসলামি বিপ্লবের ক্ষেত্র প্রস্তুতে সাহায্য করে, বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করে। জনগণকে বঞ্চিত রেখে নিজের ও পরিবারের কিংবা কাছের লোকজনের ভোগবিলাস আর সম্পদ লুণ্ঠন এবং আমেরিকা, ইসরাইল ও ব্রিটেনের মতো বিদেশী শক্তির তোষণনীতি বিপ্লবের বারুদে পেট্রোল ঢালার মতো ঘটনা হিসেবে কাজ করেছে। বিপ্লবের অবিসংবাদিত নেতা ইমাম খোমেইনীকে বার বার নির্বাসনে পাঠিয়েও শেষ রক্ষা হয় নি। রেজা শাহরে পতন হয়েছে ঠিকই এবং ইরানের জনগণ তাদের অধিকার ফিরে পেয়েছে। একাজে বীর ইরানি জাতি লক্ষাধিক প্রাণ কুরবানি দিয়েছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পরই ইরানে ব্যাপক আকারে তেলক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয় যার মালিক ছিল ব্রিটিশ কোম্পানিগুলো। ঠিক এই সময়টিতে ১৯৫১ সালে ইরানে গণতান্ত্রিকভাবে প্রথম নির্বাচিত হয় মোহাম্মাদ মোসাদ্দেকের ন্যাশনাল ফ্রন্টের সরকার। ইরানিরা কেবল লাভের ২০ শতাংশই পেতো। ফলে প্রধানমন্ত্রী মোসাদ্দেক দেশের সব তেল সম্পদ জাতীয়করণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে পার্লামেন্ট নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন। ব্রিটেনে তখন উইনস্টন চার্চিল ক্ষমতায় আর আমেরিকায় হেনরি ট্রুম্যান। মোসাদ্দেকের জয়লাভের ফলে দুই ক্ষমতাশালীর মাথায় বাজ পড়ল। শুরু হলো মোসাদ্দেককে ক্ষমতাচ্যুত করার নীল নকশা। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা ‘সিআইএ’ এবং ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা ‘এসআইএস’ লন্ডনে বসে যৌথ পরিকল্পনা করল। প্রেসিডেন্ট থিউডর রুজভেল্টের নাতি কার্মিট রুজভেল্ট তখন সিআইএ প্রধান। তিনি উড়ে এলেন লন্ডনে। প্রণীত হলো অপারেশন ‘অ্যাজাক্স’ এর নীল নকশা। পরিকল্পনা মতে- ইরানি সেনাবাহিনীতে ঘটানো হলো অভ্যুত্থান। প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মাদ মোসাদ্দেক ক্ষমতাচ্যুত হলেন। তার স্থানে আজ্ঞাবহ জেনারেল ফজলুল্লাহ জাহেদিকে নিয়োগ দেয়া হলো। কিন্তু মূল ক্ষমতা রাখা হলো ইঙ্গো-মার্কিন সাম্রাজ্যের অনুগত মোহাম্মদ রেজা শাহের হাতে। এই ঘটনার একদিনের মাথায় সেনাবাহিনীতে একটি কাউন্টার অভ্যুত্থান হলো। অভ্যুত্থানকারীরা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর প্রধানমন্ত্রী মোসাদ্দেককে উদ্ধার করলেন। অন্যদিকে শাহ পালিয়ে গেলেন বাগদাদে এবং তারপর ইতালিতে। কিন্তু এর দুই দিন পর আরো একটি রক্তাক্ত পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটানো হয় সেনাবাহিনীতে। ফলে মার্কিন-ব্রিটেনের নীল-নকশায় অপারেশন অ্যাজাক্স সফল হয় শতভাগ। পরবর্তীতে শাহ ইরানে ফিরে আসে চটজলদি।
এসব ঘটনা ঘটে ১৯৫৩ সালে। পতনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অর্থাৎ ১৯৭৯ সালের ১৬ই জানুয়ারি পর্যন্ত দেশের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ছিল শাহের হাতে। তার ইঙ্গো-মার্কিন মদদদাতারা অনবরত সমর্থন দিয়ে যাচ্ছিল তাকে। ফলে তার পুলিশ ও সেনাবাহিনী প্রতিদিন রাজপথে শত শত মানুষকে গুলি করে হত্যা করছিল।
১৯৫৩ সালের হস্তক্ষেপটি শুধু ইরানিদেরই তিক্ত অপমান, বিশ্বাসঘাতকতা এবং নিপীড়নের আঘাত দেয় নি; বরং সমগ্র মুসলিম বিশ্বে এর ব্যাপক প্রভাব রেখেছে।
১৯৫৩ সালের পর থেকে ইরানে বড় রকমের উন্নতি হয়েছিল এবং তাতে জনগণের খুশি বা সন্তুষ্ট থাকার কথা ছিল কিন্তু তারা তা ছিল না। শাহের কতিপয় ব্যক্তিগত আচরণ, অভ্যাস আর পশ্চিমা সংস্কৃতির অবাধ প্রচলন দেশের সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষকে ধীরে ধীরে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। এই বিক্ষোভই অগ্নিগর্ভে রূপ নেয় ১৯৭৭ সালের শেষ দিকে। তেহরান শহরে কোনো পাবলিক বাসে কোনো ধর্মীয় লেবাসধারী মানুষ উঠলেই কন্ট্রাক্টর টিটকারি করে বলতÑ ‘আমরা আলেম আর পতিতাদের বাসে চড়াই না।’ রাস্তায় রাস্তায় গড়ে উঠেছিল মদের দোকান। শহর ও শহরতলীতে শত শত নাইটক্লাবে চলত সারারাত ধরে ডিস্কো পার্টির নামে মদপান, জুয়া আর অবাধ যৌনাচার।
রেজা শাহ নিজেও ছিলেন পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত। তার স্ত্রী, সন্তানরাও পশ্চিমা ধাঁচে চলতেন। শাহ এবং তার স্ত্রী সকল রাজকীয় অনুষ্ঠান এবং দেশী-বিদেশী সরকারি অনুষ্ঠানসমূহে পশ্চিমাদের পোশাক পরতেন। এসব কারণে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা দিনকে দিন ফুঁসে উঠতে থাকে।
১৯৫৩ সাল থেকে ১৯৭৭, এই সময়ে ইরানের বিকাশের দিকে তাকালে দেখতে পাওয়া যাবেÑ- কী সাংঘাতিকভাবে রেজা শাহ মার্কিনদের ওপর নির্ভর করেছিলেন। মার্কিনীদের প্রচেষ্টানুযায়ী এই সময়কালে ইরানি সেনাবাহিনীর আধুনিকীকরণ, ইরানি সমাজব্যবস্থা ও অর্থনীতিকে নির্মাণ করেন শাহ, যাকে তিনি ‘শ্বেত বিপ্লব’ বলে আখ্যায়িত করেন। যদিও তার অর্থনৈতিক কর্মসূচি ইরানে সমৃদ্ধি ও শিল্পায়ন এনেছিল এবং শিক্ষাগত উদ্যোগের ফলে সাক্ষরতার হার বেড়েছিল, কিন্তু এসবই ছিল বিশাল ব্যয়বহুল কর্মকা-। সম্পদ সমানভাবে বণ্টন করা হয় নি, কৃষকদের মধ্যে নগরায়নের প্রভাব লক্ষণীয় ছিল, এমনকি ভিন্নমত পোষণকারীদের রাজনৈতিকভাবে ব্যাপক দমনপীড়ন করা হয়েছিল। ধর্মীয় আলেমরা পশ্চিমা জীবনধারা তাদের ওপর চাপানো হচ্ছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। তারা বুঝতে ও বিশ্বাস করতে শুরু করলেন যে, ইসলামকে সমাজ থেকে সম্পূর্ণভাবে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
১৯৬৩ সালের ১৫ খোরদার যে বিক্ষোভ হয় তাতে ইমাম খোমেইনী সুস্পষ্ট ভূমিকা পালন করেন। ফলস্বরূপ তিনি দেশ থেকে নির্বাসিত হন। নির্বাসিত জীবনে ইমাম খোমেইনী বিপ্লবের জন্য আরো বেশি কাজের সুযোগ পেলেন। শাহকে খোলাখুলিভাবে সমালোচনা করে রেকর্ডকৃত বক্তব্য পাঠাতে লাগলেন দেশে এবং সেসব রেকর্ড ইরানে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হতে থাকে।
ঔপনিবেশিক পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের অবসান ঘটিয়ে ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ইসলামকে সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করা যেতে পারে বলে ইমাম খোমেইনী যুক্তি দেন। কুরআনের ওপর ভিত্তি করে ইসলামি সরকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব এবং উদাহরণস্বরূপ তিনি মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা)-এর কর্মকা-ের বর্ণনা দেন।
ইমাম খোমেইনীর বক্তব্য দিন দিন ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠল এবং পরিস্থিতি ক্রমেই শাহ সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে থাকে। এ অবস্থায় রেজা শাহ বিপ্লবের নেতা ইমাম খোমেইনীকে ইরাক থেকে ফ্রান্সে নির্বাসনে পাঠান। সেখানে গিয়েও ইমাম খোমেইনী তার তৎপরতা অব্যাহত রাখলেন। তার রেকর্ডকৃত বক্তৃতার ক্যাসেটগুলো জনগণের মাঝে এতটাই প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হলো যে, ইমাম খোমেইনীর অনুসারীরা চূড়ান্ত মাত্রায় উদ্দীপিত হয়ে উঠলেন এবং বিক্ষোভগুলো ইরানের প্রধান প্রধান শহরে ছড়িয়ে পড়ল। ব্যাপক হত্যা, গুম ও ধরপাকড়ের পরেও জনগণকে ঠেকিয়ে রাখা গেল না।
১৯৭৮ সালের ৮ সেপ্টেম্বর। শাহের বাহিনী তেহরানের বিশাল জনসমাবেশের ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে অসংখ্য মানুষকে হত্যা করে। আপাতত লোকজন ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় কিন্তু দিবসটি ইরানের ইতিহাসে কুখ্যাত ‘ব্লাক ফ্রাইডে’ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যায়। ব্লাক ফ্রাইডের পর তেহরানে মার্কিন দূতাবাসে কর্মরত সিআইএ এজেন্ট ওয়াশিংটন ডিসিতে সিআইএ হেড কোয়াটারে রিপোর্ট করেনÑ ৮ই সেপ্টেম্বরের ঘটনার পর শাহের শাসন ক্ষমতা এতটাই সূদৃঢ় হয়েছে যে আগামি ১০ বছরে বিরোধী পক্ষ মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। অথচ এর মাত্র ৩ মাসের কিছু সময় পর অর্থাৎ ১৬ জানুয়ারি ১৯৭৯ সালে মাত্র একদিনের গণ অভ্যুত্থানে শাহের পতন হয়। অবশষে ১৯৭৯ সালের পহেলা ফেব্রুয়ারি ফ্রান্স থেকে নির্বাসিত জীবনের অবসান ঘটিয়ে ইমাম খোমেইনী বিজয়ীর বেশে ইরানে ফিরে আসেন এবং বিপ্লব চূড়ান্তভাবে সফল হয়।
বিপ্লবের প্রভাব: ইরানের ইসলামি বিপ্লব প্রায় ১৪০০ বছর ধরে চলে আসা খাঁটি মুহাম্মাদি ইসলামের ধারায় সূচিত সংগ্রামগুলোরই অনন্য ধারাবাহিকতার ফসল। আর যে বিপ্লবের ভিত্তিগুলো যত বেশি মজবুত সেই বিপ্লবের স্থায়িত্বও হয় তত বেশি। আল্লাহু আকবার ও লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ-ভিত্তিক আদর্শের পুনরুজ্জীবন যে বিপ্লবের লক্ষ্য, সেই বিপ্লব মাত্র ৪০ বছরেই বুড়িয়ে যায় না, ঝিমিয়ে পড়ে না; বরং ৪০ বছর তার প্রাণবন্ত যৌবনের সূচনা মাত্র।
রাজনৈতিক ইসলামের পুনরুত্থানের মাধ্যমে মুসলিম বিশ্বে ইরানি বিপ্লবের প্রভাব দেখা যায়। ইরানের সফলতা দেখায় যে, ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা শুধু একটি স্বপ্ন নয়। পশ্চিমা ও তাদের সহযোগী সম্রাট ও স্বৈরশাসকদের ওপর জয় লাভ করা যে সম্ভব তাও ইরান প্রমাণ করেছে। ১৯৮০ ও ৯০’র দশকে পুরো মুসলিম বিশ্বেই ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলো ইরানের ইসলামি বিপ্লবের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েছিল। ধর্মনিরপেক্ষতার মডেল অগ্রগতি এবং সম্পূর্ণ স্বাধীনতা প্রদানে ব্যর্থ হয়েছে, এক্ষেত্রে ইসলামি মডেল একমাত্র বিকল্প। দেশে দেশে রাজনৈতিক দলগুলো উদাহরণ হিসেবে ইরানের বিপ্লবের কথাই তুলে ধরত।
সা¤্রাজ্যবাদী বিশ্বে ইউরোপের পরে মার্কিন সরকারগুলোর সঙ্গে শত্রুতা করে কোনো দেশই শক্তভাবে টিকে থাকতে পারে নি কিন্তু ইরান এ ক্ষেত্রে ভিন্ন উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। বিপ্লবের মাধ্যমে ইরান এমন এক মুসলিম রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে যারা বিগত ৪০ বছর ধরে মার্কিন আগ্রাসনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে টিকে আছে।
গণবিপ্লব সংঘটিত হওয়ার পর তা ব্যর্থ করার জন্য ইসলামি এই দেশটির বিরুদ্ধে ইরাকের সাদ্দামকে ব্যবহার করেছে মার্কিন সরকার। ইরানের বিরুদ্ধে আরব দেশগুলোর সামরিক শক্তি ব্যবহারের নীতি গ্রহণ করেছিল ওয়াশিংটন। আর এজন্য ইরাক ও সৌদি আরবকে উসকে দিয়েছিল হোয়াইট হাউজ। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের সাবেক নিরাপত্তা উপদেষ্টা ব্রেজনস্কি এ কথা স্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘মার্কিন সরকারের উৎসাহ পেয়েই রাজতান্ত্রিক আরব দেশগুলো ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে ইরাকের সাদ্দাম সরকারকে অর্থ সাহায্য দিত। মার্কিন সরকারের উস্কানি বা উৎসাহ পেয়েই সৌদি সরকার তেলের দাম কমিয়ে দিত যাতে ইরানের তেলের দামও কমে যায়। এর ফলে তেহরান যুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হয়।’ ব্রেজনস্কি আরো বলেছেন, ‘বর্তমানে ইরানের তেল ও গ্যাস বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে আমেরিকা সেই একই নীতি অনুসরণ করছে।’
ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইরাকের প্রতি মার্কিন ও আরব দেশগুলোর, এমনকি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের প্রায় সব শক্তির সর্বাত্মক সহায়তা সত্ত্বেও বিপ্লবী ইরানি জাতির প্রতিরোধের ফলে ইরানের ইসলামি বিপ্লবকে ধ্বংস করা বা দুর্বল করার মার্কিন ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়। এই যে ইরানি জাতির টিকে থাকার অদম্য শক্তি, এই শক্তির মূলমন্ত্র হলো ইসলামি বিপ্লব।
ইসলামি বিপ্লবের মাধ্যমে ইরান যেমন সা¤্রাজ্যবাদী শক্তিকে সরাসরি ‘না’ বলে দিতে শিখেছে তেমনি ইরানকে দেখে বিশ্বের বহু দেশ পশ্চিমা শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। বিপ্লবের পর মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদী শক্তিকে যেমন ইরান ‘বড় শয়তান’ বলে আখ্যা দিয়েছে তেমনি ব্রিটেন ও ইসরাইলকেও ইরান শত্রুর তালিকায় ফেলেছে। ইরানে বিপ্লব সফল হওয়ার পর ইসরাইল যেভাবে প্রতিরোধ ও সংগ্রামী চেতনার মুখে পড়ছে, এই অবৈধ শক্তিটি আগে কখনই তা দেখে নি।
প্রতিরোধ ও প্রতিশোধের দুর্বার শক্তি হয়ে উঠেছে লেবাননের হিজবুল্লাহ, ফিলিস্তিনের হামাস ও ইসলামি জিহাদ আন্দোলন। যে উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদ বা জিসিসি-কে ইরানের বিপ্লব ধ্বংস করার জন্য জোট শক্তি হিসেবে গঠন করা হয়েছিল সেই জিসিসির অন্যতম প্রধান সদস্য কাতার তারই মিত্রদের বিরুদ্ধে ঘুরে দাঁড়াল, কুয়েত এবং ওমানের মতো দেশ আমেরিকার প্রধান মিত্র সৌদির একান্ত অনুগত আর নেই। তারা নিজেদের মতো করে অনেক ক্ষেত্রেই সিদ্ধান্ত নিতে পারে। যে দারিদ্রপীড়িত ইয়েমেনকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে চেয়েছিল মার্কিন মদদপুষ্ট সৌদি জোট সেই ইয়েমেন এখন সিংহবিক্রমে লড়ছে মার্কিন অস্ত্র ও প্রযুক্তির বিরুদ্ধে। পারস্য উপসাগর ছিল ইঙ্গো-মার্কিন মিত্রদের স্বর্গরাজ্য। সেই পারস্য উপসাগরে এখন ইরানের সদর্প পদচারণা। অনেকটা ইরানি অনুকম্পা নিয়ে সেখানে থাকতে হচ্ছে মার্কিন বাহিনীকে। মধ্যপ্রাচ্য থেকে ধীরে ধীরে বিদায় নেওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে মর্কিন সেনাদের। বিপ্লবের আগে যেখান ইরানের সরকার ছিল নিতান্তই নতজানু ও পরনির্ভরশীল সরকার, সেখানে ইরান এখন সামরিক, কূটনৈতিক ও প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে দিব্যি বিশ্বের বড় বড় শক্তির সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে। ইরানি ক্ষুরধার কূটনীতির কাছে প্রতিনিয়ত নাকানি-চুবানি খাচ্ছে পশ্চিমা শক্তি বিশেষ করে আমেরিকা। ইসলামি বিপ্লব ইরানকে কতটা শক্তি ও সাহস যুগিয়েছে তার চূড়ান্ত নজির হচ্ছে ইরাকে মার্কিন ঘঁটিতে ঘোষণা দিয়ে ইরানি সামরিক বাহিনীর ক্ষেপণাস্ত্র হামলা যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর একমাত্র ইরানের পক্ষেই সম্ভব হয়েছে। ইরানের এই সক্ষমতায় বহু বন্ধুদেশ নিজের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে চায়, তারাও বুঝতে শিখেছে কীভাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হয়। এই প্রচেষ্টা মোটেই অসম্ভব নয় বরং এখন বাস্তবতা। এর সবই সম্ভব হয়েছে ইরানের মহান ইসলামি বিপ্লবের কারণে।
লেখক : সাংবাদিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক

‘শাবে ইয়ালদা’ ইরানের শীতকালীন জনপ্রিয় উৎসব

সাইদুল ইসলাম

‘শাবে ইয়ালদা’ ইরানের শীতকালীন একটি জনপ্রিয় উৎসব। যা প্রাচীন কাল থেকেই ব্যাপক জাঁকজমকপূর্ণভাবে পালিত হয়ে আসছে। এ উৎসবকে কেন্দ্র করে দেশটির বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। ইরানের ইনস্টিটিউট ফর ইন্টেলেকচুয়াল ডেভেলপমেন্ট অব চিলড্রেন অ্যান্ড ইয়াং অ্যাডাল্ট্্স (আইআইডিসিওয়াইএ-কানুন) ‘শাবে ইয়ালদা’ উপলক্ষ্যে কুড়ি বছরেরও বেশি সময় ধরে আন্তর্জাতিক গল্প বলার উৎসবের আয়োজন করে আসছে। করোনা পরিস্থিতির কারণে এ বছর অনলাইনে অনুষ্ঠিত হয় আন্তর্জাতিক গল্প বলার ২৩তম উৎসব। এবারের উৎসবে সারা বিশ্ব থেকে ২০জনের অধিক গল্পকার এবং বিপুল সংখ্যক ইরানি কথক অংশগ্রহণ করেন। গল্প বলার পারফরম্যান্সগুলো কানুন-এর ওয়েবসাইট, ইন্সটাগ্রাম এবং ইরানের ভিডিও শেয়ারিং পরিষেবা অ্যাপারাতে অনলাইনে সম্প্রচার করা হয়। শাবে ইয়ালদার রাতে অনুষ্ঠিত হয় উৎসবের চূড়ান্ত পর্ব।
কানুন এর উপ-পরিচালক মাহমুদ মোরাভভেজ উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বলেন, ‘গল্প বলার ঐতিহ্য মানুষের অস্তিত্বের শুরুর ইতিহাসের সাথে জড়িত এবং ইতিহাসের বিভিন্ন সময়কালে মানুষের মধ্যে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের একটি প্রধান মাধ্যম ছিল এটি।’ ‘শাবে ইয়ালদা’ এখন আন্তর্জাতিক পরিম-লে বহুল পরিচত এক উৎসবের নাম। শীঘ্রই জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থার (ইউনেসকো) অধরা ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান পেতে যাচ্ছে এটি। তেহরান টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, সিল্ক রোডের পাশাপাশি সম্প্রতি অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় নিবন্ধিত হয়েছে ইরানের ঐতিহ্যবাহী উৎসব ‘শাবে ইয়ালদা’। যা ভবিষ্যতে ইউনেস্কোর তালিকাভুক্ত হওয়ার পথ উল্লেখযোগ্যভাবে প্রশস্ত করে।
দক্ষিণ কোরিয়ায় ইউনেস্কো (আইসিএইচসিএপি) এর পৃষ্ঠপোষকতায় ও ইন্টারন্যাশনাল ইনফরমেশন অ্যান্ড নেটওয়াার্কিং সেন্টার আয়োজিত এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের অন্তর্মুখী সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি অনলাইন আন্তর্জাতিক সম্মেলন এবং ১০ ডিসেম্বর সমরকন্দে ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর সেন্ট্রাল এশিয়ান স্টাডিজে (আইআইসিএএস) উৎসবটি নিবন্ধন লাভ করে।
ইয়ালদা শব্দের অর্থ সূচনা বা জন্ম। শীত মওসুমে নিরক্ষ রেখা থেকে সূর্যের দূরতম অবস্থানকালে উত্তর গোলার্ধের দীর্ঘতম রাতে উদ্যাপিত হয় শাবে ইয়ালদা। ইরানি ক্যালেন্ডার অনুসারে প্রতি বছর ডিসেম্বরের ২০ বা ২১ তারিখ রাতে উদ্যাপিত হয় এই উৎসব। এটি ইরানি পরিবার ও বন্ধুদের একত্র হয়ে মূল্যবান সময় কাটানোর একটি সোনালি রাত। এদিন সবাই মিলে ধুমধাম করে বছরের দীর্ঘতম রাত উদ্যাপন করেন। ‘শাবে ইয়ালদা’ ঘিরে ইরানে রয়েছে বেশ কিছু ঐতিহ্য। শীতের দীর্ঘতম এই রাতে পরিবারগুলো একত্রিত হয়ে কবিতা এবং উৎসবে মেতে ওঠে। সঙ্গে ঐতিহ্যবাহী তরতাজা ফলমূলের সমাহার তো রয়েছেই। করুণাময় এই রাতে ইরানিদের কাছে শীতকালীন শীতলতা যেন পরাজিত হয়। ভালোবাসার উষ্ণতা পুরো পরিবারকে আলিঙ্গন করে। আত্মাগুলো একে অপরের আরও বেশি ঘনিষ্ঠ হয়ে ভালোবাসা বিনিময়ে মেতে ওঠে।
ইরান ছাড়াও আফগানিস্তান, তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান এবং কিছু ককেশীয় অঞ্চলের দেশ, যেমন- আজারবাইজান এবং আর্মেনিয়ায় বছরের একই সময় এই শাবে ইয়ালদা উদ্যাপিত হয়। এসব অঞ্চলের মানুষ যেসব কারণে শাবে ইয়ালদা উদ্যাপন করে থাকেন তার মধ্যে শীতের আগমন এবং অন্ধকারের উপর আলোর বিজয় অন্যতম। তারা মনে করেন অন্ধকার মন্দের প্রতীক। আর শাবে ইয়ালদার পরে প্রথম সকাল অন্ধকার ও অশুভ শক্তির উপর সূর্য এবং আলোর বিজয়ের সূচনা। অর্থাৎ এ রাতেই আলোর কাছে আঁধার পরাজিত হয় এবং এ রাত থেকেই মানবজাতির জন্য সুদিনের পালা বইতে শুরু করে।
কোনো কোনো ইরানি কবি-সাহিত্যিকের মতে, রাত হলো অশুভ বা মন্দের প্রতীক এবং দিন হলো ঔজ্জ্বল্য, শুভ্রতা, স্বচ্ছলতা, নির্মলতা ও পবিত্রতার প্রতীক। শাবে ইয়ালদা নিয়ে মহাকবি শেখ সাদি লিখেছেন,
ব্যথাতুর অন্তরে প্রশান্তির হাওয়া নাহি বয়
ইয়ালদার রজনী না পোহালে হয় না ভোরের উদয়।
কবি শেখ সাদি অপর এক কবিতায় বলেছেন,
তোমার রূপ দেখা প্রতিটি সকাল যেন শুভ নববর্ষ
তোমার বিচ্ছেদের প্রতিটি রাত যেন অতি দীর্ঘ
কবি শেখ ফরিদ উদ্দীন আত্তার বলেন,
নেই যদি জানা শেষ কোথায় আমার এ ব্যথাবেদনার
নেই কোনো উৎসব তবে কাল শাবে ইয়ালদার
কবি আল্লামা ইকবাল বলেছেন,
প্রাণচক্ষুকে যেমন অন্ধ করে দেয় তারই সুরমায়
আলোকিত দিনকে রাত পরিণত করে ইয়ালদায়
আল বিরুনী তাঁর ‘আল-বাকিয়াহ’ গ্রন্থে ইয়ালদাকে ‘মিলাদে আকবর’ বা ‘শ্রেষ্ঠতম জন্মদিন’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। যার উদ্দেশ্য সূর্যের জন্মদিন হিসেবে অধিক পরিচিত।
২১ ডিসেম্বরের এই রাতে বিদেশে বসবাসরত ইরানিদের জন্য রয়েছে চমৎকার কিছু সুযোগ। তাঁরা এদিন বিভিন্ন জাতি ও সংস্কৃতির মানুষদের কাছে নিজেদের অসাধারণ এই ঐতিহ্য তুলে ধরতে পারেন। প্রথা ও রীতিনীতি ভাগাভাগি করার মাধ্যমে দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্ক গড়ে তোলার সুযোগ পান। যা আন্তঃসংযুক্তির এই বিশ্বে পারস্পরিক উত্তম বোঝাপড়ার পথ প্রশস্ত করে। শাবে ইয়ালদার পূর্ব মুহূর্তে ইরানের ব্যস্ততম রাস্তায় উঁকি দিলে দেখা যায় মুদি ও কনফেকশনারি দোকানগুলো যেন মহাউৎসবে মেতে উঠেছে। সব শ্রেণি-পেশার মানুষ প্রয়োজনীয় খাবার-দাবার কিনে আনন্দ উপভোগের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
ইয়ালদা রাতে সাধারণত পুষ্পশোভিত বাটিতে করে তরতাজা ফলমূল ও রঙিন আজিল (শুকনো ফল, বীজ ও বাদামের সংমিশ্রণ) পরিবেশন করা হয়। ইরানিদের কাছে গ্রীষ্মকালে ফলমূল হলো প্রাচুর্যের স্মারক। এই রাতের ঐতিহ্যবাহী টাটকা ফল হচ্ছে তরমুজ ও ডালিম। এ দু’টি ফলকে অনুগ্রহের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিশ্বাস করা হয়, শীতের আগমনের আগে তরমুজ খেলে অসুস্থতার বিরুদ্ধে শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে।
রাতে উষ্ণ খাবার শেষে অনেকে কবিতা, গল্প ও বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে অসাধারণ মুহূর্ত কাটান। মধ্যরাত পর্যন্ত চলতে থাকে এই উৎসব।
লোকজন নিজেদের ভাগ্যগণনাও এই রাতেই করে থাকেন। মহাকবি হাফিজ শিরাজির কাব্য সংকলনের প্রতিটি গজলের রয়েছে আলাদা আলাদা তাৎপর্য। তাঁর কাব্য সংকলনটি সামনে রেখে পরিবারের বয়স্ক ব্যক্তি শুরু করেন ভাগ্যগণনা। যার ভাগ্যগণনা করা হবে তিনি পবিত্র হয়ে চোখ বন্ধ করে ৩ বার সূরা ইখলাস পড়ে মনে মনে কিছু একটা চাইবেন। অতঃপর বয়স্ক ব্যক্তি কাব্য সংকলনটি তাঁর সামনে খুলে ধরে বলবেন, ‘ডান পৃষ্ঠা নাকি বাম পৃষ্ঠা?’ চোখ বন্ধ রেখেই লোকটি কোনো এক পৃষ্ঠায় নিজের ডান হাতটি রাখবেন এবং বয়স্ক ব্যক্তি ওই পৃষ্ঠার কবিতা ও তার তাৎপর্য ব্যাখ্যা করবেন। এভাবেই দীর্ঘ এই রাতটি গল্পগুজবে পার করে দেন ইরানের জনগণ। তবে ইরানের কোনো কোনো অংশে মহাকবি ফেরদৌসির ‘শাহনামা’ থেকে সুরে সুরে আবৃত্তি করা হয়। কোথাও কোথাও সারা রাত কবিতার লড়াই অনুষ্ঠিত হয়।

স্মরণীয় দিবস

 

৬ নভেম্বর : বাংলাদেশের বিশিষ্ট কথা সাহিত্যিক শাহেদ আলীর মৃত্যুবার্ষিকী।
১১ নভেম্বর : ইতিহাসখ্যাত সাহিত্যিক ‘বিষাদ সিন্ধু’র রচয়িতা মীর মশাররফ হোসেনের জন্মদিবস।
১৪ নভেম্বর : বিশ্ব ডায়াবেটিক রোগীদের সহায়তা দিবস।
১৫ নভেম্বর : বিশ্ব পুস্তক ও পুস্তক পাঠ দিবস, বিশ্ব গণমাধ্যম দিবস।
১৭ নভেম্বর : বাংলাদেশের মযলুম জননেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মৃত্যুবার্ষিকী।
১৯ নভেম্বর : অবিভক্ত ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অমর শহীদ মীর নিসার আলী তিতুমীরের শাহাদাত বার্ষিকী।
* আন্তর্জাতিক পরিবার দিবস।
২০ নভেম্বর : বাংলাদেশের প্রখ্যাত মহিলা কবি সুফিয়া কামালের মৃত্যুবার্ষিকী।
২৩ নভেম্বর : ইমাম হাসান আসকারী (আ.)-এর জন্মদিবস।
৩০ নভেম্বর : শেখ মুফিদ (র.) স্মরণে দিবস।
১ ডিসেম্বর : বিশ্ব এইড্্স প্রতিরোধ দিবস।
২ ডিসেম্বর : শিল্পী কামরুল হাসানের জন্মদিন।
৩ ডিসেম্বর : বাংলাদেশের কচিকাঁচার আসরের প্রতিষ্ঠাতা রোকনুজ্জামান খান দাদা ভাইয়ের মৃত্যুবার্ষিকী।
*বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস।
৫ ডিসেম্বর : অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকী।
১৬ ডিসেম্বর : বাংলাদেশের মহান বিজয় দিবস। দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধের পর এই দিনে বাংলাদেশ বিজয় লাভ করে।
* বিশ্ব গবেষণা দিবস।
১৮ ডিসেম্বর : ড. মুহাম্মাদ মুফাত্তেহর শাহাদাত দিবস। এ দিবসটি ইরানে ‘ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (হাওযা) ও বিশ্ববিদ্যালয় এর মধ্যে ঐক্য দিবস’ হিসাবে পালিত হয়।
২১ ডিসেম্বর : ইরানে বছরের সবচেয়ে দীর্ঘতম রাত (শাবে ইয়ালদা)
২৫ ডিসেম্বর : হযরত ঈসা (আ.)-এর পবিত্র জন্মদিবস।
২৭ ডিসেম্বর : প্রলয়ংকরী সুনামীর বার্ষিকী। এ দিনে ভয়াবহ সুনামীতে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ভারত, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপসহ এ অঞ্চলের দেশগুলোর কয়েক লাখ লোক মৃত্যুবরণ করে।
১ জানুয়ারি : ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ.) ১৯৮৯ সালের এ দিনে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচেভের কাছে এক ঐতিহাসিক চিঠি প্রদান করেন।
৩ জানুয়ারি : জেনারেল কাসেম সোলাইমানির শাহাদাত বার্ষিকী।
১০ জানুয়ারি : মীর্যা তাকী খান আমীর কাবীর এর শাহাদাত বার্ষিকী।
১২ জানুয়ারি : ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর নির্দেশে ইসলামি বিপ্লবী পরিষদ গঠন দিবস এর বার্ষিকী।
১৭ জানুয়ারি : নবীকন্যা হযরত ফাতেমা (আ.) এর ওফাত বার্ষিকী (একটি রেওয়ায়াত অনুযায়ী)
*১৯৭৯ সালের এ দিনে ইরান থেকে রেযা শাহ পাহলভী পলায়ন করেন।
* নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহর ৯২তম মৃত্যুবার্ষিকী।
২৬ জানুয়ারি : বাংলা ভাষার সনেট কাব্যের জনক ও ‘মেঘনাদবধ’ মহাকাব্যের রচয়িতা মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্মবার্ষিকী।
২৯ জানুয়ারি : আততায়ীর গুলিতে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা মহাত্মা গান্ধী নিহত হন।
১ ফেব্রুয়ারি : দীর্ঘ ১৫ বছর নির্বাসনে থাকার পর ইসলামি বিপ্লব বিজয়ের প্রাক্কালে এ দিনে বিপ্লবের নেতা ইমাম খোমেইনী স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন।
৩ ফেব্রুয়ারি : নবীকন্যা হযরত ফাতেমা (আ.)-এর পবিত্র জন্মদিবস। বিশ্ব নারী ও মা দিবস।
*ইরানে বিমান বাহিনী দিবস।
১১ ফেব্রুয়ারি : ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের বিপ্লবের বিজয়বার্ষিকী। ইরানে আড়াই হাজার বছরের রাজতন্ত্রের পতন।
১৪ ফেব্রুয়ারি : মহানবী (সা.), অন্যান্য নবী (আ.) এবং পবিত্র ধর্মগ্রন্থ স¤পর্কে অবমাননাকর উক্তি করার দায়ে ১৯৮৯ সালের এ দিনে ইমাম খোমেইনী সালমান রুশদীর মৃত্যুদ-ের ফতোয়া প্রদান করেন।
১৫ ফেব্রুয়ারি : হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর জন্মদিবস।
১৬ ফেব্রুয়ারি : নবীবংশের ১০ম ইমাম আলী নাকী (আ.)-এর শাহাদাত দিবস।
২১ ফেব্রুয়ারি : আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ১৯৫২ সালের এ দিনে বাংলা ভাষা আন্দোলনে শহীদ হন সালাম, বরকত, রফিক, জাব্বার, শফিকসহ বেশ কয়েকজন বাঙালি তরুণ।
২২ ফেব্রুয়ারি : নবীবংশের নবম ইমাম তাকী (আ.)-এর পবিত্র জন্মদিবস।
২৪ ফেব্রুয়ারি : খাজা নাসিরউদ্দিন তূসী স্মরণে দিবস। এটি ইরানে প্রকৌশল দিবস হিসেবেও উদযাপিত হয়।
২৬ ফেব্রুয়ারি : আমীরুল মুমিনীন ইমাম আলী (আ.)-এর পবিত্র জন্মদিবস।
২৮ ফেব্রুয়ারি : মহানবী (সা.)-এর নাতনী হযরত যায়নাব (আ.)-এর ওফাতবার্ষিকী।

ইমাম খোমেইনী (র.) ও ইরানের ইসলামি বিপ্লব

মো. আশিফুর রহমান

আজ থেকে প্রায় ১২০ বছর আগে ১৯০১ সালের ২৩ অক্টোবর (১৩২০ হিজরির ২০ জমাদিউস সানি) ইরানের রাজধানী তেহরান থেকে ২২৫ কি.মি. দক্ষিণে খোমেইন শহরে জন্মগ্রহণ করেন এক ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ, যাঁর নাম রুহুল্লাহ মুসাভী খোমেইনী, যিনি পরবর্তীকালে ইমাম খোমেইনী হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। তিনি জন্মগ্রহণ করেন এক সম্ভ্রান্ত আলেম পরিবারে। তিনি ছিলেন পিতা-মাতার কনিষ্ঠ সন্তান। তাঁর পিতা আয়াতুল্লাহ্ সাইয়্যেদ মুস্তাফা মুসাভী একজন বিশিষ্ট মুজতাহিদ আলেম ছিলেন। ইমামের শিশুকালেই তাঁর পিতা শাহাদাতবরণ করেন। ভূ-স্বামীদের নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার কারণে ইমাম খোমেইনীর পিতাকে মাত্র ৪৭ বছর বয়সে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এরপর থেকে ইমাম খোমেইনী তাঁর ফুফু ও বড় ভাইয়ের তত্ত্বাবধানে বড় হতে থাকেন। তাঁর বড় ভাই আয়াতুল্লাহ্ সাইয়্যেদ মুর্তাজাও একজন প্রাজ্ঞ ধর্মতত্ত্ববিদ ছিলেন।
ইমাম খোমেইনী ছিলেন প্রচ- ধীসম্পন্ন। মাত্র সাত বছর বয়সে সম্পূর্ণ কোরআন পড়া শেষ করে আরবি সাহিত্য অধ্যয়ন করেন। এরপর বড় ভাইয়ের কাছে তিনি যুক্তিবিদ্যা, আরবি ব্যাকরণ শিক্ষালাভ করেন। ১৯ বছর বয়সে তিনি উচ্চ শিক্ষার জন্য আরাকে গমন করেন। সেখানে স্বনামধন্য আলেমদের কাছে শিক্ষা লাভ করেন। এক বছর পর ইরানের ধর্মীয় নগরী কোমে চলে আসেন। সেখানে ১৫ বছর তিনি আয়াতুল্লাহ্ হায়েরীর দারসে খারেযে (মুজতাহিদ হওয়ার পড়াশুনা) যোগ দেন। এরপর তিনি আয়াতুল্লাহ্ বোরুজেরদীর ক্লাসে যোগ দেন। তিনি আয়াতুল্লাহ্ আলী আকবর ইয়াযদীর কাছে জ্যোতির্বিদ্যা এবং মরহুম শায়খ মুহাম্মদ আলী শাহবাদীর কাছে দর্শন ও রহস্যজ্ঞান বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষালাভ করেন।
এভাবে অল্প সময়েই মধ্যেই তিনি ধর্মতত্ত্ব, ইসলামি আইন, হাদীস ও তাফসীর শাস্ত্র, রহস্যজ্ঞান, জ্যোতির্বিদ্যা, দর্শন ইত্যাদি বিষয়ে একজন আসামান্য প-িত হয়ে ওঠেন। বিশ্বে প্রচলিত অন্যান্য জ্ঞান-বিজ্ঞানেও তিনি বেশ পারদর্শিতা অর্জন করেন। তিনি এসবের পাশাপাশি আধ্যাত্মিকতার চর্চা করেন। এসময়কালে তিনি নিজেও বিভিন্ন বিষয়, যেমন আইনশাস্ত্র, ইরফান, দর্শন ইত্যাদি শিক্ষাদান করতেন। মাত্র ২৭ বছর বয়সে ইমাম খোমেইনী দর্শনের অধ্যাপক হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন।
তৎকালীন ইরানের অবস্থা
ইমাম খোমেইনী যখন জ্ঞান অন্বেষণে ব্যস্ত সেসময়ে ইরানের সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থান ছিল পুরোপুরি ইসলামি আদর্শের বিপরীতে। মদপানের জন্য বার, নাইটক্লাব ইত্যাদি সবখানে ছড়িয়ে পড়েছিল। নারীদেরকে বেপর্দায় চলাফেরায় বাধ্য করা হতো। সমাজের সর্বত্র ইসলামি মূল্যবোধের পরিবর্তে পাশ্চাত্য মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা চলছিল। অর্থনীতি ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে আমেরিকা-ব্রিটেনের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। তেলসম্পদের বিরাট লভ্যাংশ ব্রিটেন ও মার্কিন তেল কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল। ইরানের সশস্ত্র বাহিনী মার্কিন সামরিক বিশেষজ্ঞদের দ্বারাই পরিচালিত হতো।
এসব কর্মকা-ের ফলে শাহের রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে নানা আন্দোলনও গড়ে ওঠে। ১৮৯২ সালে আলেমদের নেতৃত্বে তামাকবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। মীর্যা হাসান সিরাজী তামাক বর্জনের ফতোয়া দেন। ১৯০৩ সালে কোরআন ভিত্তিক সংবিধান রচনার দাবিতে শুরু হয় শাসনতান্ত্রিক আন্দোলন। ১৯৫২-৫৩ সালে তেলসম্পদ জাতীয়করণের আন্দোলন হয়। এ আন্দোলনের এক পর্যায়ে মোহাম্মদ রেজা ইরান থেকে পলায়ন করে। ব্রিটিশরা এ অবস্থায় ইরানের উপর পুনরায় নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করা সম্ভব হবে না জেনে ইরানের ভার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতে ছেড়ে দেয়। সিআইএ দ্বারা পরিচালিত সামরিক অভ্যুত্থানে মোসাদ্দেক সরকারের পতন ঘটে এবং মোহাম্মদ রেজা আবার ইরানে ফিরে এসে ক্ষমতা গ্রহণ করে।
এ সময়কালের মধ্যে মীর্যা হাসান সিরাজী, সাইয়্যেদ মুহাম্মদ বিহবিহানী, সাইয়্যেদ তাবতাবায়ী, শেখ ফাজলুল্লাহ্ নূরী, আয়াতুল্লাহ্ কাশানী, আয়াতুল্লাহ্ বোরুজেরদী প্রমুখ খ্যাতনামা আলেম এসব আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন।
ইমাম খোমেইনীর আন্দোলন
১৯৪১ সালে কাশফুল আসরার (রহস্য উন্মোচন) নামক গ্রন্থ রচনার মধ্য দিয়ে ইমাম খোমেইনী নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামের যাত্রা শুরু করেন। এতে তিনি বলেন, ‘একমাত্র ধর্মই মানুষকে বিশ্বাসঘাতকতা ও অপরাধের হাত থেকে বাঁচাতে পারে। দুর্ভাগ্যবশত যারা ইরানের রাষ্ট্রীয় কর্ণধার, তারা মেকী ধর্মে বিশ্বাস করেন অথবা তাদের আদৌ কোনো ধর্মবিশ্বাস নেই।’
ইমাম খোমেইনী তাঁর ছাত্রদের আত্মিক পরিশুদ্ধি এবং রূহানি শক্তি ও নৈতিকতা অর্জনের উপর গুরুত্ব দিতেন। পরবর্তীতে তিনি নীতিশাস্ত্র এবং আত্মিক জ্ঞানের ক্লাস চালু করেন। তাঁর ক্লাসে শত শত ছাত্র, এমনকি মুজতাহিদরাও যোগ দিতেন। তাঁর জনপ্রিয়তা এবং তাঁর ক্লাসে বিপুল সংখ্যক ছাত্রের উপস্থিতি রেজা খানের নিরাপত্তা পুলিশকে আতঙ্কিত করে এবং তারা লোকদেরকে এ থেকে নিবৃত্ত প্রয়াস চালায়। এমনকি ক্লাসটি বন্ধ করার জন্য হুমকি দেওয়া হয়।
কোমের ফায়জিয়া মাদ্রাসা থেকে কোমের প্রত্যন্ত অঞ্চলে হাজী মোল্লা সাদিক মাদ্রাসায় নীতিশাস্ত্রের ক্লাসগুলো স্থানান্তরের পূর্ব পর্যন্ত পুলিশ এ চাপ অব্যাহত রাখে। রেজা শাহের পতন ও নির্বাসনের আগ পর্যন্ত এ অবস্থা চলতে থাকে। এরপর আবার ফায়জিয়া মাদ্রাসায় ক্লাস চালু হয়। এসব ক্লাসের বক্তৃতা পরবর্তীতে ‘নফসের বিরুদ্ধে সংগ্রাম’ ও ‘আল জিহাদুল আকবার’ নামে সংকলিত হয়।
ইমাম খোমেইনী শাহের ধর্মবিরোধী ও দেশবিরোধী কর্মকা-ের প্রতিবাদ জানান এবং আলেমরাও তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করা শুরু করেন। ১৯৬৩ সালে ৯ জানুয়ারি শাহের সরকার ছয় দফা সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ করে এবং এ কর্মসূচি অনুমোদনের জন্য গণভোটের আয়োজন করে। একে ‘শ্বেত বিপ্লব’ বা ‘শাহ ও জনতার বিপ্লব’ নাম দেওয়া হয়। বিপ্লবীরা একে শ্বেত বিপ্লব বলতেন এ অর্থে যে, তা হোয়াইট হাউসে জন্মলাভ করেছিল।
ইমাম খোমেইনী ভোট বর্জনের ডাক দেন। জনগণ ভোটদান হতে বিরত থাকে। সে বছরই ঈদুল ফিত্র উপলক্ষে ইমাম শাসকগোষ্ঠীর বেআইনি ও ইসলামবিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার আহ্বান জানান। ইমামের নেতৃত্বে ইরানের ইসলামি উম্মাহ্র প্রতিরোধে শাহ অসহিষ্ণু হয়ে পড়ে।
১৯৬৩ সালের পূর্বে রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রত্যক্ষ ভূমিকায় অবতীর্ণ না হওয়ার পেছনে প্রকৃত কারণ ছিল এ সময় তিনি আলেম সমাজের মধ্যে এক চিন্তাগত নীরব বিপ্লব সাধন করছিলেন। তিনি বৈপ্লবিক চিন্তাধারায় বিপুল সংখ্যক ছাত্র ও শিক্ষক গড়ে তুলেছিলেন।
১৯৬৩ সালে আলেমরা ঘোষণা করেন যে, এ বছর সপ্তাহব্যাপী নওরোজ পালন করা উচিত নয়। কারণ, নববর্ষের ২য় দিন ইমাম জাফর সাদিক (আ.)-এর শাহাদাত বার্ষিকী। জনগণ এর প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করে।
১৯৬৩ সালের ২২ মার্চ নওরোজের দ্বিতীয় দিন ফায়জিয়া মাদ্রাসায় ইমাম জাফর সাদিক (আ.)-এর শাহাদাত বার্ষিকীর অনুষ্ঠানে হাজার হাজার লোক অংশগ্রহণ করে। শাহের লোকেরা এ অনুষ্ঠানে আক্রমণ করে অনেককে হত্যা ও আহত করে। শুধু তাই নয় কয়েকদিন পর যারা আহত হয়ে হাসপাতালে ছিল তাদেরকে হাসপাতাল থেকে বের করে দেয়।
এ ঘটনার চল্লিশতম দিনে সারা দেশে প্রচ- বিক্ষোভ হয়। জনতা ও নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এর পরপরই আশুরা সমাগত হয়। সাভাক বাহিনী হুকুম দেয় যে, ফায়জিয়া মাদ্রাসায় ইমামের বক্তৃতা দেওয়া চলবে না। ইমাম এ অন্যায় আদেশ উপেক্ষা করে আশুরার বিকেলেই মাদ্রাসা ফায়জিয়ায় পৌঁছান। ইমাম তাঁর বক্তৃতায় বলেন, ‘আমরা এ সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেছি যে, তারা ইসলাম ও ধর্মীয় নেতৃত্বের বিরোধী। ইসরাইল আমাদের পবিত্র ঐশী গ্রন্থ আল কোরআনকে হেয় করতে চায় এবং ধর্মীয় নেতৃত্বকে নির্মূল করতে চায়। ইসরাইল আমাদের অর্থনীতি, ব্যবসা ও কৃষিকে পাকাপোক্তভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়।’
ইমামের ভাষণে জনগণ ক্রোধে ফেটে পড়ে। রাতে ইমামকে গ্রেফতার করা হয়। মুহূর্তে খবর সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। জনতা স্লোগান তোলে : ‘হয় খোমেইনী, না হয় মৃত্যু।’ তেহরানে বিশাল মিছিল হয়। বিশ্ববিদ্যালয়, দোকানপাট বন্ধ থাকে। সারা দেশে ধর্মঘট পালিত হয়।
১৯৬৩ সালের ৫ জুন গণবিক্ষোভে গুলি বর্ষণ করলে তেহরানে ১৫০০০ ও কোম শহরে ৪০০ লোক শাহাদাতবরণ করে। জনগণের দাবির মুখে ১৯৬৪ সালের ৭ এপ্রিল শাহ ইমামকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।
ক্যাপিটিউলেশন আইন
১৯৬৪ সালের ১৩ অক্টোবর ইরানি পার্লামেন্টে ইরানে বসবাসরত মার্কিন নাগরিকদের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে আইন পাশ করা হয়। এ আইনে মার্কিন নাগরিকদের বিচার করার কোনো ক্ষমতা ইরান সরকারের থাকবে না এবং তাদের বিচার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হবে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়।
ইমাম এর বিরোধিতা করে বক্তৃতা রাখেন। তিনি বলেন, ‘এহেন অপমানের প্রতিবাদ করার ভার এখন ইসলাম প্রচারক ও বক্তাদের উপরই ন্যস্ত। সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে দেশের স্বাধীনতার জন্য কলম ধরতে হবে, সংগ্রাম করতে হবে। রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্রনায়কদের উচিত পার্লামেন্টে গৃহীত সিদ্ধান্তের পেছনে কী রহস্য নিহিত রয়েছে, সে সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করা। এ সম্পর্কে রাজনৈতিক দলগুলোকে একটি সর্বসম্মত নীতি গ্রহণ করতে হবে। ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের ইসলাম ও কোরআনের গৌরব বৃদ্ধির জন্য সচেষ্ট হওয়া এবং একই সাথে মুসলমানদের সমর্থনে কাজ করে যাওয়া উচিত।’
ইমাম সেনাবাহিনীকে জেগে উঠে শাহকে ক্ষমতাচ্যুত করার আহ্বান জানান। শাহ বুঝতে পরল যতদিন ইমাম দেশে আছেন ততদিন জনগণের স্বার্থের প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন করা যাবে না। তাই আন্দোলনকে দুর্বল করার জন্য ইমামকে নির্বাসনে পাঠানোর কথা ভাবল। ১৯৬৪ সালের ৪ নভেম্বর ইমামকে কোম থেকে গ্রেফতার করে তুরস্কে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সৈন্যরা ধর্মীয় নেতাদের বাড়ি ঘেরাও করে। ইমাম খোমেইনীর জ্যেষ্ঠপুত্র মোস্তফা খোমেইনীও গ্রেফতার হলেন। দু’মাস পর তাঁকেও তুরস্কে নির্বাসন দেয়া হয়।
১৯৬৫ সালের অক্টোবরে তুরস্ক সরকার তাঁকে ইরাকের নাজাফে প্রেরণ করে। সেখানে তিনি ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত অবস্থান করেন। তিনি সেখান থেকে তাঁর বাণী ইরানে প্রেরণ করতেন এবং আলেমরা তা জনসাধারণের কাছে পৌঁছে দিতেন।
ইমাম খোমেইনীকে মানসিকভাবে দুর্বল করার জন্য তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র মোস্তফা খোমেইনীকে ১৯৭৭ সালের ২৩ অক্টোবর বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়।
১৯৭৮ সালের ৭ জানুয়ারী ইমাম খোমেইনীর মর্যাদা নষ্ট করে পত্রিকায় নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। ইমামকে ভারতীয় বংশোদ্ভূত এবং তিনি ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থার দালাল বলে উল্লেখ করা হয়।
এর প্রতিবাদে কোমে বিক্ষোভ হয় এবং ২০০ লোক শাহাদাতবরণ করেন। কোমের শহীদদের স্মরণে তাবরীজে বিক্ষোভ হয়। এতে ৫০০ জন শহীদ হন। এরপর ইরানের প্রতিটি শহরে বিক্ষোভ শুরু হয়। শত শত লোক শহীদ হয়।
১৯৭৮ সালের মুহররম মাসে লাখ লাখ মানুষ তেহরানের রাস্তায় নেমে আসে। নিরস্ত্র জনতা কাফনের কাপড় পড়ে মেশিনগান সজ্জিত সেনাবাহিনীর সামনে ছুটে যেতে থাকে। ৮ সেপ্টেম্বর ৫০০০ লোক শাহাদাতবরণ করে।
অক্টোবর মাসে ইমামকে ইরাক থেকে বহিষ্কার করা হয়। যদিও ইমাম কোনো মুসলিম দেশে যেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু কোনো মুসলিম দেশ ইমামকে গ্রহণ করতে রাজি হয়নি। তাই তিনি ফ্রান্সের প্যারিসে চলে যান।
সেখান থেকে ইমামের বাণী রেকর্ড করে ইরানে প্রেরণ করা হতো। তেহরানের বহু লোক ফোনে সরাসরি তাঁর কথা রেকর্ড করে রাখতেন। ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ তাঁদের ছাত্রদের মাধ্যমে গ্রাম-গ্রামান্তরে তা পৌঁছে দিতেন।
১৯৭৮ সালের ৪ নভেম্বর তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ইমামকে দেশে ফিরিয়ে আনার দাবিতে মিছিল করে। শাহের বাহিনী এ মিছিলের উপর গুলি করলে ৬৫ জন ছাত্র শহীদ হয়। এরপর মুহররম ৯ ও ১০ তারিখ (১৯৭৯) পুনরায় বিক্ষোভ হয়। ইমাম তাঁর প্রেরিত বাণীতে বলেন : ‘মুহররম হলো তরবারির উপর রক্তের বিজয়ের মাস’।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সারা দেশে কার্ফু ঘোষণা করা হয়। কিন্তু শাসকগোষ্ঠী বুঝতে পারে যে, কার্ফু মানা হবে না। তাই তা প্রত্যাহার করা হয়। প্রায় ৫০ লক্ষ লোক মিছিল করে উত্তর তেহরানের দিকে ধাবিত হয়। তারা শাসকদের ভবনগুলোতে তালা লাগিয়ে দেয়। শাহ বুঝতে পারে আর টিকে থাকা সম্ভব নয়। সে কট্টর ধর্মবিরোধী নেতা শাপুর বখতিয়ারকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করে। সে শাহকে নিরাপদে দেশ থেকে পালিয়ে যাবার ব্যবস্থা করে দেয়। শাহ পালিয়ে যাবার সময় বলে : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কিছু দিন বেড়িয়ে আসি। শাহ আমেরিকায় কিছুদিন অবস্থান করে। আমেরিকার সরকার তার নিরাপত্তার ব্যাপারে অপারগতা প্রকাশ করে। সে মিশরে আনোয়ার সাদাতের আশ্রয় নেয় এবং সেখানেই মারা যায়।
ইমামকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য জনগণ বিক্ষোভ অব্যাহত রাখে। কিন্তু শাপুর বখতিয়ার এ দাবিকে উপেক্ষা করে। ইমাম বখতিয়ারের অনুমতি ছাড়াই দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নেন। বিমান বন্দরে তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র করা হয়। ইমামকে এ ব্যাপারে অবহিত করার পরও তিনি নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট ফ্লাইটে দেশে ফেরার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন।
শাপুর বখতিয়ার বিমান বন্দর বন্ধ রাখার নির্দেশ দিলেও বিমান বন্দরের কর্মচারীরা তা উপেক্ষা করে ইমামের বিমান অবতরণের ব্যবস্থা করে দেয়। এভাবে ১৯৭৯ সালের ১ ফেব্রুয়ারী ইমাম বিজয়ীর বেশে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। প্রায় ৬০ লক্ষ লোক তাঁকে অভ্যর্থনা জানায়।
ইমাম প্রথমেই বিপ্লবের শহীদদের কবরস্থান বেহেশতে যাহ্রায় যান এবং সেখানে বক্তব্য রাখেন। তিনি রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ও মজলিশকে অবৈধ ঘোষণা করেন। তিনি সেনাবাহিনীকে জনগণের সাথে একাত্মতা ঘোণার আহ্বান জানান। তাঁদেরকে স্বাধীনতার দিকে উৎসাহিত করেন। তিনি মেহেদী বজারগানকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন। বাজারগান অস্থায়ী মন্ত্রিসভা গঠন করেন। দেশে দু’টি সরকার অস্তিত্ব লাভ করে।
সেনাবাহিনীর সদস্যদের দলত্যাগের সংখ্যা বাড়তে থাকে। ১০ ফেব্রুয়ারী বিমান বাহিনীর ক্যাডেটরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে। সেনাবাহিনীর প্রধান দেশে সামরিক আইন জারির চিন্তা করে। ইমাম সামরিক আইন উপেক্ষা করে জনগণকে রাস্তায় নেমে আসার আহ্বান জানান। প্রধানমন্ত্রীর অফিস, রেডিও স্টেশন, টেলিভিশন স্টেশন, সংসদ ভবন, সাভাব বাহিনীর সদর দফতর ও নির্যাতন কেন্দ্রগুলোতে গোলযোগ ছড়িয়ে পড়ে। এতে প্রায় ৮০০ লোক নিহত হয়। জনগণের প্রবল চাপে শাপুর বখতিয়ার রাতের আঁধারে পালিয়ে যায় এবং ১১ ফেব্রুয়ারি বিপ্লব পূর্ণ সফলতা লাভ করে। ১৯৭৯ সালের ৩০ মার্চ গণভোট হয় এবং দেশের ৯৮.২% জনগণ ইসলামি প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে ভোটদান করে। ১ এপ্রিল ইরানকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করা হয়।
বিপ্লবের পরপরই খুব কম সময়েই মধ্যে আয়াতুল্লাহ্ মুর্তাজা মোতাহ্হারী, আয়াতুল্লাহ্ তালেকানী, আয়াতুল্লাহ্ বেহেশতীসহ বিপ্লবের প্রথম কাতারের ৭৩ জন শ্রেষ্ঠ সন্তানকে শহীদ করা হয়। বোমা বিস্ফোরণে শহীদ করা হয় প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আলী রাজাই ও প্রধানমন্ত্রী ড. জাওয়াদ বাহোনারকে। বর্তমান রাহবার আয়াতুল্লাহ্ সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ীকেও হত্যার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু যে বিপ্লব ধ্বংসের জন্য এত প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছিল মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের অশেষ মেহেরবাণীতে আজও তা স্বমহিমায় টিকে আছে। শুধু তা-ই নয়, ইরান দিন দিন জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিক্ষা, চিকিৎসা, প্রযুক্তি, উদ্ভাবন, ব্যবসা-বাণিজ্য, খেলাধুলা প্রভৃতি ক্ষেত্রে শনৈঃশনৈ উন্নতি মাধ্যমে বিশে^র প্রথম শ্রেণির দেশগুলোর মাঝে নিজেদের স্থান করে নিতে নিজেকে সক্ষম করে তুলছে।

নবীকন্যা হযরত ফাতেমা (সা. আ.) এর পবিত্র জন্মদিন এবং বিশ্ব নারী দিবস

ড. সামিউল হক
সারা বিশে^র মুসলমানদের জন্য হযরত ফাতেমা (সা.আ.) অনুকরণীয় আদর্শ। আর তাই তাঁর জন্মদিনটি সকল মুসলমানই অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে পালন করে থাকেন। যদিও প্রতি বছর মার্চ মাসের ৮ তারিখে বিশ^ব্যাপী নারী দিবস পালিত হয়, তবে নবীর আহলে বাইতের অনুসারিগণ হযরত ফাতেমার(সা.আ.) জন্মদিনকে কেন্দ্র করেই নারী দিবস বা মাতৃ দিবস পালন করে থাকেন এবং আরবি মাসের সাথে সৌর মাসের মিল না থাকার কারণে প্রতিবছর এ দিবসটি আরবি মাসের তারিখের উপর ভিত্তি করেই পালিত হয়। আর যেহেতু এবছর ২০শে জমাদিউস সানি দিনটি পড়েছে ২৪শে জানুয়ারি সোমবার তাই এ দিনটি উপলক্ষ্যে আমরা বিশ^ নারী দিবস হিসেবে প্রত্যেক ধর্মপ্রাণ মুসলমানকে জানাই শীতকালীন উষ্ণ শুভেচ্ছা।
জন্মদিন পালনের কারণ
জন্মদিন পালন করা মানুষের সহজাত প্রবণতাই অংশ; ঠিক যেভাবে মানুষ তার বাবা, মা, স্ত্রী ও সন্তানের জন্মদিনকে স্মরণ করে আনন্দানুষ্ঠান পালন করে থাকে একইভাবে তার প্রিয়জন ও আদর্শবান ব্যক্তিত্বের জন্মদিনকে স্মরণ করেও আনন্দানুষ্ঠানের আয়োজন করে। মহান আল্লাহ কয়েকজন মানুষকে সবধরনের পূর্ণতা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন যাতে তাঁরা হন মানুষের জন্য উন্নতির আদর্শ। নবীকন্যা হযরত ফাতেমা (সা.আ.) এমনই একজন অসাধারণ ব্যক্তিত্ব যাঁর জন্মদিনকে কেন্দ্র করে মুসলিম বিশে^ তাঁর অনুসারী ও ভক্তবৃন্দ পালন করে থাকেন নারী দিবস বা মাতৃদিবস। গবেষণা করে পাওয়া যায় যে, যাঁরা জন্মদিন পালন করাকে ‘বেদআত’ বলে ফতোয়া দেন তাঁদের মূল যুক্তি হলো: জন্মদিনের অনুষ্ঠানে নাচ, গান ও শরিয়তবিরোধী কাজ করা হয়ে থাকে। কিন্তু আমরা তাঁদের সেই যুক্তির মোকাবেলায় বলতে চাই: যদি তাতে শরিয়তবিরোধী কোনো কাজ না করা হয় এবং মহান ব্যক্তিবর্গকে স্মরণ করে শিক্ষা গ্রহণের উদ্যোগ নেওয়া হয় তবে কোনোভাবেই তাকে ‘বেদআত’ বলা যাবে না।
এক নজরে ফাতেমা (সা. আ.)
নবীকন্যা ফাতেমা (সা.আ.) এমন এক ব্যক্তিত্ব যাঁর সম্পর্কে শতাধিক পৃষ্ঠার বই লিখলেও তাঁর পরিপূর্ণ পরিচয় বর্ণনা করা সম্ভব হবে না। তাই এ পর্যায়ে একনজরে তাঁর সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরছি:
নাম: ফাতেমা, সিদ্দীকা, মুবারেকাহ, তাহিরাহ, যাকিয়্যাহ, রাযিয়্যাহ, মারযিয়্যাহ, মুহাদ্দিসাহ এবং যাহরা (আমালি সাদুক/৬৮৮)।
ডাক নাম: উম্মুল হাসান, উম্মুল হোসাইন, উম্মুল মুহসিন, উম্মুল আইম্মাহ এবং উম্মে আবিহা (কাশফুল গুম্মাহ, ২/১৮)।
উপাধিসমূহ: বাতুল, সিদ্দিকা, কুবরা, আযরা, তাহিরা এবং সাইয়্যেদাতুন নিসা (মানাকিবে ইবনে শাহরে আশুব, ৩/১৩৩)।
পিতা: নবী করিম হযরত মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল্লাহ (স.)।
মাতা: ইসলাম গ্রহণকারী সর্বপ্রথম নারী ও নবীপতœী খাদিজাতুল কুবরা।
জন্মস্থান: মক্কা নগরী ও জন্ম তারিখ: নবুওয়াতের পঞ্চম বছর (প্রাগুক্ত: ৩/১৩২)। আরবি জমাদিউস সানি মাসের ২০ তারিখ শুক্রবার, মক্কার প্রস্তরময় পর্বতের পাদদেশে কাবার সন্নিকটে, ওহী নাযিলের গৃহে মা খাদিজার গর্ভ থেকে নবীনন্দিনী ফাতেমা যাহরা জন্মগ্রহণ করেন।
হযরত ফাতেমা (সা.আ.) এর জন্মের ফলে নবীর গৃহ আগের চেয়ে আরো অধিক দয়া ও ¯েœহ-মমতার আধারে পরিণত হয়। তিনি তাঁর পিতার কষ্টের দিনগুলোতে প্রশান্তি যোগাতেন। এবিষয়ে নবী করিম(স.) বলেন,
‘ফাতেমা আমার প্রাণের সমতুল্য, তার কাছ থেকে আমি বেহেশতের সুঘ্রাণ পাই।’ (কাশফুল গুম্মাহ, ২/২৪)।
নবীকন্যা হযরত ফাতেমার সঙ্গে ইমাম আলীর বিবাহ
যখন নবীকন্যা বিবাহের বয়সে উপনীত হলেন, নবী করিম(স.) এর একাধিক সাহাবি তাঁর পবিত্র কন্যাকে বিবাহ করে সম্মানিত হবার জন্য নবীকে তাগাদা দিতে থাকেন। কিন্তু তিনি তাদের প্রস্তাবে তেমন কোনো সাড়া দিচ্ছিলেন না। নবী করিম (স.) ঘোষণা দিলেন যে, ফাতেমার বিয়ে সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর হাতে এবং তিনি এ ব্যাপারে কিছুই করবেন না। এ ঘোষণা শোনার পর তাঁরা ফাতেমাকে বিয়ের প্রস্তাব থেকে নিবৃত হলেন এবং অনুধাবন করছিলেন যে, নবীর সাথে ইমাম আলীর যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এবং দ্বীনের পথে তাঁর যে কঠোর সংগ্রামের ভূমিকা রয়েছে তাতে আলীই হবেন ফাতেমার উপযুক্ত পাত্র।
অবশেষে নবী করিম (স.) সাহাবিদেরকে বললেন, আল্লাহ তাঁর কন্যাকে ইমাম আলীর সাথে বিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। অতঃপর বললেন, “আল্লাহর ফেরেশতা আমার কাছে এসে বললেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! আল্লাহ আপনাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন এবং বলেছেন, মা ফাতেমা এবং আলীকে আমি জান্নাতে বিয়ে দিয়েছি। সুতরাং আপনি তাদেরকে দুনিয়াতে বিয়ে দিন।’ ” (মোস্তফা কামাল অনূদিত, মা ফাতিমা/৬৭)
জান্নাতের নেত্রী নবীকন্যা হযরত ফাতেমা (সা. আ.)
নবীকন্যা ফাতেমা(সা.আ.) নবী করিম(স.) এর বংশধারার কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব, কারণ, তাঁর মাধ্যমেই নবী(স.) এর বংশধারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছে। আহলে সুন্নাতের বর্ণনায় চারজন নারীকে বেহেশতের সর্দার হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে:
أفضَلُ نساءِ الجنَّةِ أربعٌ: مريمُ بنتُ عمرانَ، وخديجةُ بنتُ خوَيْلدٍ، وفاطمةُ بنتُ محمَّدٍ، وآسيةُ
নবী (স.) এর কাছ থেকে বর্ণিত হয়েছে: ‘বেহেশতের নারীদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ নারী চারজন: মারিয়াম বিনতে ইমরান, খাদিজা বিনতে খোয়াইলাদ, ফাতেমা বিনতে মুহাম্মাদ ও আছিয়া।’ (মুত্তাকি হিন্দি, কানজুল উম্মাল, ১২/১৪৪) অন্যদিকে আহলে বাইতের বর্ণনায় বলা হয়েছে: নবীকন্যা ফাতেমা(সা.আ.) শুধু জান্নাতি নারীদের নেত্রীই নন; বরং তিনি বিশ^জাহানের নারীদের নেত্রী। আর নবীকন্যা ফাতেমার দুই সন্তান ইমাম হাসান ও হোসাইন(আ.) যে জান্নাতের যুবকদের নেতা তাতে সকলেই ঐকমত্য পোষণ করেছেন। তাই বলা যায় যে, পরকালের কা-ারি নবী করিম(স.) যখন কেয়ামতের দিন শাফায়াত করবেন তখন তাঁর পাশে থাকবেন তাঁরই কন্যা, সন্তানদ্বয় ও ইমাম আলী(আ.)। কারণ, সুনানে ইবনে মাজাহতে বর্ণিত হয়েছে:
قال رسول الله صلى الله عليه وسلم “الحسن والحسين سيدا شباب أهل الجنة. وأبوهما خير منهما “.
নবী করিম(স.) বলেছেন : হাসান ও হোসাইন(আ.) বেহেশতী যুবকদের সর্দার। আর তাদের পিতা তাদের চেয়েও উত্তম।
এই মহীয়সী নারীর গুণ বলে শেষ করা যাবে না। সহীহ হাদিসের পাশাপাশি পবিত্র কোরআনে তাঁর শানে যেসব আয়াত নাযিল হয়েছে তার তাফসির করলে, এমনকি শুধু তার অনুবাদ অধ্যয়ন করলেই ফাতেমা যাহরার শান ও মর্যাদা সকল মুসলমানের কাছে সুস্পষ্ট হবে। উদাহরণস্বরূপ মুবাহেলার আয়াতটির (কোরআন ৩/৬১) উপর চিন্তা করলে অনুধাবন করা যাবে যে, নবওুয়তের কেন্দ্রীয় চাবিকাঠি হলেন নবীকন্যা হযরত ফাতেমা(সা.আ.) যে বিষয়ে লেখকের স্বতন্ত্র একটি প্রবন্ধ রয়েছে। দৈনিক যুগান্তরের এক প্রাবন্ধিক, ‘জান্নাতের নেত্রী হযরত ফাতেমা যাহরা’ শিরোনামে একটি প্রন্ধের শুরুতে এভাবে লিখেছেন, ‘যে নুরের আকর্ষণে সারা জাহান মাতোয়ারা, যে নুরের আলোতে আলোকিত আশি হাজার মাখলুক, সিরাজুম মুনিরা হিসেবে যে নুর উদ্ভাসিত, সে নুরের সরাসরি অংশ ফাতেমাতুয যাহরা(রা.)।’ (দৈনিক যুগান্তর, ২৮/২/২০২০)
নবীকন্যা হযরত ফাতেমার বিশেষত্ব, চরিত্র ও কর্ম-পদ্ধতি
নবীকন্যা হযরত ফাতেমা(সা.আ.) এর চরিত্র ও কর্ম-পদ্ধতির বর্ণনায় অসংখ্য বিশেষত্ব পরিলক্ষিত হয়, আলোচনার কলেবর সীমাবদ্ধ রাখার লক্ষ্যে এসব বিশেষত্বের শুধু সংক্ষিপ্ত নাম উল্লেখ করব: ১- যুহদ তথা দুনিয়াবিমুখতা, ২-বাড়ির কাজ নিজের হাতে সম্পাদন, ৩-অত্যধিক ইবাদাত ও অপরের জন্য দোয়া, ৪- নিজ হিজাবের সুরক্ষা, ৫- সতীত্ব ও বেগানা পুরুষ থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখা, ৬- নিজের সম্পদ ও অলংকার আল্লাহর রাস্তায় দান করার স্পৃহা, ৭- পোশাকাদি ও বিশেষত বিয়ের পোশাক ভিক্ষুককে দান, ৮- তাকওয়া অর্জনে উদ্গ্রীব, ৯- আল্লাহর পক্ষ থেকে তিনি ছিলেন নবীর জন্য কাউসারের ঝরনাধারা যার মাধ্যমে নবীর বংশধারা আজো বিশে^ বিরাজমান, ১০- আদর্শ গৃহিনী বা স্ত্রী, ১১- আদর্শ জননী, ১২- আদর্শ সমাজ সেবিকা ও ১৩- সর্বাপেক্ষা সত্যবাদী রমণী, ১৪- অগণিত কোরআনের আয়াত নাযিলের শান ও মর্যাদার অধিকারিণী, ১৫- উম্মে আবিহা: ¯েœহময়ী জননীর মতো নবী করিমের (স.) সেবা-যতœ করা এবং বিপদের সময় তাঁর সহায়তায় এগিয়ে আসার জন্য মহীয়সী নারী ফাতেমা(সা.আ.) এর অন্যতম নাম উম্মে আবিহা অর্থাৎ তাঁর পিতার জননী। অনুরূপ অগণিত বিশেষত্ব নবীকন্যা হযরত ফাতেমা (সা. আ.) এর শানে বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহর দরবারে তাঁর বিশেষ মর্যাদার কারণে নবী (স.) তাঁকে দেখলে দাঁড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন করতেন এবং তিনি বলেছেন, ‘ফাতেমা আমার দেহের অংশ, যা কিছু তাকে সন্তুষ্ট করে তা আমাকে সন্তুষ্ট করে এবং যা কিছু ফাতেমাকে কষ্ট দেয় তা আমাকে কষ্ট দেয়, আর যা আমাকে কষ্ট দেয় তা আল্লাহকেও কষ্ট দেয়।’ (বুখারি/৩৭১৪, মুসলিম ২৪৪৯)। এ পর্যায়ে একটি ঘটনা বর্ণনা করব যাতে বুঝা যাবে যে, ফাতেমার (সা.আ.) অন্তর ছিল আল্লাহর প্রতি ইমান ও ইয়াকিনে পূর্ণ:
হযরত আবুযর গিফারি(রা.) বলেন: একবার রাসূল (স.) আলীকে ডাকার জন্য আমাকে পাঠান। আলীর গৃহে এসে তাঁকে ডাকলে কেউ আমার ডাকে সাড়া দিল না। কিন্তু লক্ষ্য করলাম তার বাড়ির হস্তচালিত যাঁতাকলটি নিজে নিজেই ঘুরছে অথচ এর পাশে কেউ ছিল না। তখন আবার তাঁকে ডাকলাম। আলী ঘর থেকে বেড়িয়ে এলেন। আমি তাঁকে নবীর কথা বললে তিনি নবীর সাথে দেখা করার জন্য যাত্রা করলেন। নবী (স.) এর কাছে পৌঁছলে তাঁর সাথে নবী(স.) কথোপকথন করলেন এবং এমন কিছু বললেন যা আমি বুঝতে পারলাম না। তখন আমি নবী(স.) এর কাছে প্রশ্ন করলাম: ‘হে নবী, আলীর গৃহে হস্তচালিত যাঁতাকলটি দেখে আমি অবাক হয়ে গিয়েছি। যাঁতাকলটি কীভাবে নিজে নিজেই ঘুরছিল অথচ এর পাশে কেউ ছিল না?!
নবী(স.) বলেন, ‘আমার কন্যা ফাতেমা এমন একজন রমণী যার অন্তর ও সর্বাঙ্গকে ইমান ও ইয়াকিনে পূর্ণ করেছেন। আল্লাহ ফাতেমার অক্ষমতা ও দৈহিক দুর্বলতার ব্যাপারে অবহিত। তাই তিনি তার জীবন পরিচালনার ক্ষেত্রে গায়েবিভাবে সাহায্য করে থাকেন। তুমি কি জান না আল্লাহর এমন অনেক ফেরেশতা আছেন যাঁরা মুহাম্মাদের বংশকে সাহায্য করার জন্যে দায়িত্বপ্রাপ্ত?’ (চৌদ্দ মাসুম আ. এর জীবনী/১৪৫)
ফাতেমা (সা.আ.) ও নারী স্বাধীনতা
জাহেলিয়াতের যুগে আরব নারীরা সকল প্রকার জুলুম ও নির্যাতনের শিকার হতো। অধিকার থেকে তাদেরকে বঞ্চিত করা হতো। নি¤েœ কিছু উদাহরণ তুলে ধরা হলো:
জাহেলিয়াতের যুগে নারীদের সঙ্গে করা সবচেয়ে নিষ্ঠুরতম নির্যাতনটি ছিল জীবন্ত কন্যাসন্তানকে কবর দেওয়া। কিছু আরব গোত্র তাদের ঘরে কন্যাসন্তান জন্মগ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গেই তাকে কবর দিয়ে দিত। তাদের মধ্যে বহুল প্রচলিত একটি প্রথা ছিল যে, কন্যাকে কবর দেওয়া মহত্ত্বের অংশ। এ বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা আয়াত নাযিল করে বলেন:
আর যখন জীবন্ত কবরস্থ কন্যাকে জিজ্ঞেস করা হবেÑ কী অপরাধে তাকে হত্যা করা হয়েছে? (সূরা তাকভীর/৮-৯)
কিন্তু ইসলাম আগমনের পর বিশেষত মদীনায় ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হবার পর এ প্রথা চিরতরে রহিত হয়। এমনকি ইতিহাসে বর্ণিত আছে যে, ইসলাম প্রতিষ্ঠার পর মেয়েরা এতই সম্মানিত হয়েছিল যে, কোনো নারীকে দেখলেই পুরুষরা তাকে মা বলে সম্বোধন করতেন এবং তাকে মায়ের মতোই সম্মান করতেন। এই আচরণের শিক্ষা মুসলমানরা নবী(স.) এর কাছ থেকেই পেয়েছিলেন। কারণ, ফাতেমা(সা.আ.) কে তিনি মা বলে সম্বোধন করতেন এবং বাস্তবে তাঁকে মায়ের মতোই সম্মান করতেন। আর তাই ফাতেমার অন্যতম উপাধি হলো: উম্মে আবিহা অর্থাৎ তাঁর পিতার জননী।
নবী করিম (স.) এর কাছে ফাতেমার সম্মান
নবীপতœী হযরত আয়েশা থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, ‘যখনি হযরত ফাতেমা(সা.আ.) নবীর (স.) কাছে আসতেন তখনি তিনি ফাতেমার সম্মানে উঠে দাঁড়াতেন এবং ফাতেমার মাথায় চুমু খেতেন, অতঃপর তাকে নিজের স্থানে বসাতেন। আবার যখন নবী (স.) ফাতেমার সাক্ষাতে গমন করতেন তখন তাঁরা পরস্পরের মুখে চুম্বন করতেন এবং পাশাপাশি বসতেন।’ (মানাকিবে ইবনে শাহরে আশুব, ৩/১১৩)।
সর্বোপরি ফাতেমা(সা.আ.) এটা প্রমাণ করেছেন যে, পরিপূর্ণতার শিখরে ওঠার জন্য পুরুষ হওয়া জরুরি কোনো শর্ত নয়। তিনি এমন এক যুগে জন্মগ্রহণ করেছেন যখন আরবরা নারীকে মনে করত কেবল ভোগের সামগ্রী এবং কিছু আরব গোত্র তাদের ঘরে কন্যাসন্তান জন্মগ্রহণ করলে অমর্যাদার ভয়ে তাদেরকে জীবন্ত কবর দিত বা গোপনে মেরে ফেলত। কিন্তু মহান আল্লাহ তাঁর সর্বশেষ রাসূল ও সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানবের ঘরে একজন কন্যাসন্তান পাঠিয়ে নারী জাতির জন্য অশেষ সম্মান ও মুক্তির ব্যবস্থা করেছেন।
উপসংহার: যদিও প্রতি বছর ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হয়ে থাকে, যার ইতিহাসে নিবন্ধিত রয়েছে যে, ১৯০৮ সালে নিজেদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে নিউইয়র্কের রাস্তায় নেমে আসে প্রায় ১৫ হাজার নারী। আন্দোলনের প্রেক্ষাপট ছিল নারীর মজুরি বৈষম্য, কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করা এবং কাজের অমানবিক পরিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো। কিন্তু আরবিয় জাহেলী যুগের নারীদের প্রতি যে অবমাননা এবং জুলুম হয়েছে সেই পরিবেশে আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রিয় নবীর ঘরে ফাতেমা (সা.আ.) কে প্রেরণ করে তাঁর মাধ্যমেই নবীর বংশ বিস্তার করে তাঁকে সম্মান প্রদর্শন করতঃ যে দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেছেন সে বিষয়ের প্রতি যদি আমরা মনোনিবেশ করি তবে ফাতেমা (সা.আ.) এর জন্মদিনটাই নারী দিবস ঘোষণা দেবার দাবি রাখে।
কী ওয়ার্ড: নবীকন্যা, নবী করিম, ফাতেমা, জন্মদিন ও নারী দিবস।

স্মরণীয় বাণী

স্মরণীয় বাণী

এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর কাছে এলো এবং বলল : ‘হে আল্লাহ্্র রাসূল! আমাকে নসীহত্ করুন।’ রাসূলুল্লাহ্ (সা.) তাকে তিনবার জিজ্ঞেস করলেন : ‘আমি যদি তোমাকে নসিহত্ করি তা মেনে চলবে তো?’ লোকটি তিনবারই জবাব দিল: ‘জ্বী, হে আল্লাহ্র রাসূল!’ তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা.) এরশাদ করলেন : তোমাকে নসিহত করছি যে, যখনই তুমি কোনো কাজ আঞ্জাম দেয়ার সিদ্ধান্ত নেবে তখনি কাজটির পরিণতি সম্বন্ধে চিন্তা ও পর্যালোচনা করবে; কাজটা যদি উন্নতি ও হেদায়াতের উৎস হয়ে থাকে তাহলে তা আঞ্জাম দাও, আর তা যদি গোমরাহীর উৎস হয়ে থাকে তাহলে তা বর্জন করো।’
হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) এরশাদ করেন : ‘হয় আলেম হও, নয়তো ‘ইল্ম্ অর্জনে রত হও; কিন্তু স্বীয় সময়কে অযথা কাজে ও ভোগ-আনন্দে ব্যয় করো না।’
হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) এরশাদ করেন : ‘তোমাদের শিশুদেরকে সর্বপ্রথম যে শব্দাবলি শিক্ষা দেবে তা হচ্ছে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্।’
হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) এরশাদ করেন : ‘হে আলী! তোমার খাবারের শুরু ও শেষ যেন হয় লবণ। কারণ, লবণ সত্তরটি রোগ নিরাময় করে, যার মধ্যে ন্যূনতম হচ্ছে মস্তিষ্ক বিকৃতি, কুষ্ঠ ও দাদ।’
আমীরুল মু‘মিনীন হযরত আলী (আ.) এরশাদ করেন : ‘জেনে রেখ, কোরআনের তেলাওয়াতে যদি চিন্তা-ভাবনা ও পর্যালোচনা না থাকে তাহলে তাতে কোনোই লাভ নেই।’
হযরত আলী (আ.) এরশাদ করেন : ‘তোমরা যদি সাফল্য কামনা করো তাহলে দৃঢ়তার সাথে কর্মপ্রচেষ্টা অবলম্বন করো।’
আমীরুল্ মু‘মিনীন্ হযরত আলী (আ.) এরশাদ করেন : ‘যে কেউ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন খাবার খায়, ভালো করে চিবিয়ে খায়, পুরোপুরি তৃপ্ত হবার আগেই খাওয়া বন্ধ করে এবং পায়খানা-প্রস্রাবের বেগ হলে বিলম্ব করে না, মৃত্যু ছাড়া সে অসুস্থ হবে না।’
এক ব্যক্তি হযরত ইমাম জা‘ফর সাদেক (আ.)-এর কাছে আরয করল : ‘আমি হাতের কাজ (শিল্পকর্ম) পারি না এবং ব্যবসায়ের কাজও ভালো জানি না। তাই আমি এখন মাহ্রূম ও মুখাপেক্ষী।’ তখন হযরত ইমাম এরশাদ করেন : লোকদের কাছ থেকে অমুখাপেক্ষী হওয়ার জন্য তুমি শ্রমিকের কাজ করো এবং নিজের মাথায় করে বোঝা বহন করো। রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-ও কাঁধে করে একটি পাথর বহন করেন এবং তা তাঁর বাগানের একটি দেয়াল তৈরির কাজে ব্যবহার করেন; সে পাথরটি এখনো সেখানে আছে।’
হযরত ইমাম মূসা কাযেম্ (আ.) এরশাদ করেন : ‘এমন কোনো ওষুধ নেই যা কোনো না কোনো ব্যথাকে উস্কে না দেয়। তাই যতক্ষণ সম্ভব ওষুধ সেবন পরিহার করো, কারণ, এটাই শরীরের জন্য অধিকতর কল্যাণকর।’
হযরত ইমাম রেযা (আ.) এরশাদ করেন : ‘মঙ্গলবার নখ কাট, বুধবার হাম্মাম করো এবং হাজামতের প্রয়োজন হলে তা বৃহস্পতিবারে আঞ্জাম দাও। আর জুমুআর দিন সর্বোত্তম খুশবু দ্বারা নিজেকে খুশবু করো।
হযরত ইমাম রেযা (আ.) এরশাদ করেন : ‘নিঃসন্দেহে আল্লাহ্্ মদকে এ কারণে হারাম করেছেন যে, তা পানকারীদের বিচারবুদ্ধিকে ধ্বংস করে দেয়।’
(মাফাতীহুল্ হায়াত্ গ্রন্থ থেকে সংকলিত)
অনুবাদ : নূর হোসেন মজিদী

ফারসি পাণ্ডুলিপি  সংক্রান্ত তথ্য আহ্বান

বিসমিল্লাহির রহমানির রাহীম
ফারসি পাণ্ডুলিপি  সংক্রান্ত তথ্য আহ্বান
‘আনজুমানে ফারসি বাংলাদেশ’ এর পক্ষ হতে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও মোবারকবাদ গ্রহণ করুন। একটি বিষয় প্রিয় দেশবাসীর খেদমতে আরজ করতে চাই যে, অতীতে বাংলাদেশসহ পুরো ভারতবর্ষে দীর্ঘ ৬০০ বছর সরকারি অফিস-আদালত ও সাহিত্য-সংস্কৃতির ভাষা ছিল মিষ্টি মধুর ভাষা ফারসি। আমাদের পূর্বপুরুষরা তখন ফারসি ভাষার সাথে পরিচিত ছিলেন। তাঁরা অনায়াসে শেখ সাদী, হাফেয শিরাজী, মওলানা রূমী ও উমর খৈয়ামের বয়েত পড়তেন ও বলতেন। তাঁরা ফারসি ভাষায় বহু কিতাব লিখে গেছেন, যা আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির স্মারক। এখনও মানব জাতির জন্য প্রেম ও আধ্যাত্মিকতার বাহন এই ফারসি ভাষা আমাদের দেশে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নিজস্ব উপস্থিতি বজায় রেখেছে।
উল্লেখ্য যে, বর্তমানে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ে ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের উপর লেখাপড়া অনার্স থেকে মাস্টার্স ও পিএইচডি পর্যন্ত এবং খুলনা বিশ^বিদ্যালয়ে ভাষা শিক্ষাকোর্স পর্যায়ে চালু আছে। সারা দেশে হাজারো ছাত্রছাত্রী ফারসি ভাষা ও সাহিত্য অধ্যয়ন করছে এবং তাদের সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। পাশাপাশি আলিয়া ও কওমী নেসাবের মাদ্রাসাসমূহে ফারসি ভাষা ও সাহিত্য অধ্যয়ন সীমিত আকারে হলেও অব্যাহত রয়েছে। অনুরূপভাবে ধর্মীয় মহল, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক ফোরাম এবং জ্ঞানীগুণীদের মহলেও ফারসির প্রতি ভালোবাসা ও আসক্তি বলবৎ রয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে ‘আনজুমানে ফারসি বাংলাদেশ’ দেশ ও জাতির সমৃদ্ধ অতীত ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাথে সংযোগ স্থাপন এবং অতীত ও বর্তমানের মাঝে সমন্বয়ের লক্ষ্যে প্রাচীন গ্রন্থাগারসমূহ বা প্রবীণ গুণী ব্যক্তিদের বাড়িঘরে বিচ্ছিন্নভাবে সংরক্ষিত কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে নষ্ট হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে এমন ফারসি ভাষায় লিখিত পা-ুলিপি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করার চিন্তা করেছে।
এ লক্ষ্যে এই বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতি অনুরাগী প্রিয় ভাইবোনদের কাছে জাতির গৌরবদীপ্ত ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংরক্ষণের নিমিত্তে প্রাথমিক পর্যায়ে এ সম্পর্কিত তথ্য ই-মেইল বা ফোনের মাধ্যমে আমাদেরকে অবহিত করার অনুরোধ জানাচ্ছি।
১. পা-ুলিপির নাম, লেখকের নাম এবং সম্ভব হলে রচনার তারিখ
২. পা-ুলিপির শুরু ও শেষের পাতা এবং মাঝখানের দু একটি পাতার ফটোকপি বা স্ক্রীনশট।
৩. প্রেরকের বিস্তারিত ঠিকানা (মোবাইল নং, ই-মেইল নং)।
অনুগ্রহ করে যে কোনো ধরনের তথ্যের জন্য নি¤œ ঠিকানায় যোগাযোগ করার অনুরোধ জানাচ্ছি।
আনজুমানে ফারসি বাংলাদেশ
রুম নং ২০৯, ২য় তলা
আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট
ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়
ফোন : ০১৩১৯৩৪৯২১৩
ই-মেইল : [email protected]

ইরানের আধুনিক কবি ওস্তাদ শাহরিয়ার

ড. মোঃ মুহসীন উদ্দীন মিয়া

ইরানের সমকালীন কাব্য জগতে যে কয়জন কবির বহুমুখী কাব্য প্রতিভার উন্মেষ ঘটেছিল, তাঁদের মধ্যে ওস্তাদ মুহাম্মাদ হুসাইন শাহরিয়ার ছিলেন অন্যতম। তিনি ছিলেন ইরানের রীতিসিদ্ধ ও আধুনিক ধারার যুগসন্ধিক্ষণের কবি । সনাতনী ধারায় কবিতা রচনায় যেমনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত তেমনি মুক্ত কবিতা রচনায় ছিলেন পারঙ্গম। তুর্কি ভাষায় ‘হেইদার বাবায়ে সালাম’ শিরোনামের কবিতা রচনার মধ্য দিয়ে ঈর্ষণীয় খ্যাতি অর্জন করেছেন। এ ছাড়া যেনদানে ‘যেন্দেগী’ (জীবনের কারাগার), ‘দাসতাম বে দামানাত (তোমার আঁচলের উপর আমার হাত), ‘হালা চেরা?’ (এখন কেন?) ‘কারগাহে অদামসাযি’ (মানুষ তৈরির কারখানা), ‘হাতেম ভা দারভিশান’ (হাতেম ও দরবেশগণ) ইত্যাদির ন্যায় অসংখ্য ফারসি কবিতা লিখে সমভাবে সুনাম অর্জন করেছেন।
তাঁর পুরো নাম হল সাইয়্যেদ মুহম্মাদ হুসাইন বেহজাত তাবরিযী। তাঁর প্রথম দিককার কবি বা ছদ্মনাম হলো বেহজাত। পরবর্তী সময়ে তিনি মহাকবি হাফিজের দিভান (কাব্যসমগ্র) থেকে ফাল (ভাগ্য গণনা) গ্রহণ করে কাব্যনাম শাহরিয়ার ধারণ করেন। আজও তিনি এই শাহরিয়ার নামেই পরিচিত। জনশ্রুতি আছে যে, তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু সাইয়্যেদ আবুল কাশেম তাঁকে একটি নতুন কাব্যনাম গ্রহণের জন্য অনুরোধ করলে হাফিজের অনুরক্ত শাহরিয়ার হাফিজের দিভান থেকে ফাল গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। ওজু করে মনোবাসনা পূরণের নিয়তে চোখ বন্ধ করে হাফিজের দিভান খুললেন। অতঃপর কবিতার ইঙ্গিতবহ দুটি চরণ তাঁর জন্য বেরিয়ে এলো। যেমন:
دوام عمر و ملک او بخواه از لطف حق ای دل
که چرخ سکه ی دولت به نام شهر باران زد
হে হৃদয়, চলমান জীবন আর রাজত্বের তরে দয়াময় প্রভুর কাছে প্রার্থনা কর,
কেননা সবসময় সৌভাগ্যের মুদ্রা বাদশাহদের নামে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।
‘শাহরিয়ার’ নামটি পাবার পর তিনি এ নামটি গ্রহণ করবেন কী করবেন না এ নিয়ে দোদুল্যমান হয়ে পড়েন। আবারও চোখ বন্ধ করে হাফিজের দীভান খুললেন, এবারও তাঁর জন্য সেই ইঙ্গিতবহ নাম সম্বলিত কবিতাই বের হয়ে এল। যেমন:
غم غریبی و غربت چو بر نمی تایم
به شهر خود روم شهریار خود باشم
অচেনা ও অজানার দুশ্চিন্তা যেহেতু আমাকে উজ্জীবিত করেনি
তাই নিজ শহরে যাবো এবং নিজের বাদশাহ হবো।
উল্লিখিত পঙক্তি থেকেই তিনি শাহরিয়ার’ নামটি ভণিতা হিসেবে গ্রহণ করেন। উল্লেখ্য যে, শাহরিয়ার শব্দের অর্থ হলো বাদশা।
শাহরিয়ার ১৯০৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইরানের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর ও পূর্ব আজারবাইজানে প্রাদেশিক রাজধানী তাব্রিজের খোশনাব অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা পীর আগা সাইয়্যেদ ইসমাঈল মুসাভি খোশগুনাবি ছিলেন তাব্রিজের একজন আইনজ্ঞ ও উঁচুমাপের শিক্ষাবিদ। এ ছাড়া তিনি কাজার বংশীয় যুবরাজদের সহপাঠী ছিলেন।
শাহরিয়ার তাঁর শৈশব ও কৈশোর জীবনের প্রাথমিক ১৪ বছর নিজ মাতৃভূমি তাব্রিজ শহরে অতিবাহিত করেন এবং সেখানেই তিনি তাঁর প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা সমাপ্ত করেন।
সময় তিনি তাঁর প্রাইভেট শিক্ষকদের কাছে ও মাদ্রাসাতে তালাবিয়ায় ও ফেরদৌসিতে ফারসি, আরবি ভাষা ও সাহিত্য এবং হস্তলিপি বিদ্যা অর্জন করেন।
১৯৯১ সালে ১৬ বছর বয়সে তিনি উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য তেহরান গমন করেন এবং চাচার বাসায় থেকে পড়াশুনা চালিয়ে যান। তেহরানের তৎকালীন বিখ্যাত বিদ্যাপীঠ দারুল ফুনুনে ভর্তি হয়ে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা সম্পন্ন করেন।
১৯৯২ সালে ১৯ বছর বয়সে তিনি একই বিদ্যাপীঠের চিকিৎসা বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। এখানে ৫ বৎসর অধ্যয়ন শেষে চিকিৎসা বিজ্ঞানে উচ্চতর ডিগ্রি নেয়ার জন্য ১৯২৭ সালে চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ে ভর্তি হন। কিন্তু একদিকে অর্থ কষ্ট এবং অন্যদিকে সুরাইয়া নামের এক তরুণীর প্রতি প্রেমাসক্ত হওয়ার কারণে মেডিকেলের উচ্চতর ডিগ্রি নেয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি; এমনকি সুরাইয়ার সাথেও তাঁর পরিণয় ঘটেনি। প্রেমে ব্যর্থ হওয়ার গ্লানি তাঁর উজ্জ্বল জীবনকে অন্ধকারে ঢেকে দেয়। তিনি বলতেন, ‘আমি যখন ডাক্তাদের সাথে অস্ত্রোপাচারে অংশ নিতাম, মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে সেলাই করে জোড়া দিতাম, তখন আমার হৃদয়-মন দুর্বল হয়ে যেত।’
দারুল ফুনুনে অধ্যয়নকালে তিনি মালেকুশ শোয়ারা বাহার, লুৎফুল্লাহ যাহেদি, আবুল হাসান সাথী, হাবিব সেফারি, ওস্তাদ ওয়ায়েযি, কারখি ইয়াজদি, আমিরি, ফিরোজ কুহি, আরেফ কাযবিনি, মিরযাদে এশকি, ইরাজ মীর্জা প্রমুখ বিখ্যাত কবির সাথে পরিচিত হন। এ সকল কবির দ্বারা পরিচালিত কবিতার আসর ও প্রতিযোগিতাসমূহে তিনি নিয়মিত অংশ নিতেন। রেজা খানের শাসন আমলে সাইয়্যেদ হাসান মুদাররেসের সাহচর্যের প্রভাবে তাঁর মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ ঘটে। লেখাপড়া ছেড়ে দেয়ার পর তিনি ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে তেহরানের সরকারি দলিল রেজিস্ট্রি অফিসে চাকুরিতে যোগদান করেন। কিছুদিন পর নিশাপুরে বদলি হয়ে তিনি মাশহাদে চলে আসেন। ১৯৩৫ সালে পুনরায় তেহরানে প্রত্যাবর্তন করে পৌরসভার জনস্বাস্থ্য পরিদর্শক পদে নিয়োজিত হন। এরপর ১৯৩৬ সালে কৃষি ব্যাংকে যোগদান করেন। ১৯৩৭ সালে তাঁর পিতা এবং পনের বছর পর ১৯৫২ সালে তাঁর মা ইন্তেকাল করেন। মাতৃবিয়োগের পর তিনি প্রচ-ভাবে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন এবং ১৯৫৩ সালের দিকে তাব্রিজে ফিরে আসেন। অবসর গ্রহণের পর কৃষি ব্যাংক থেকে যে সামান্য পেনশন পেতেন তা দিয়ে অতি কষ্টে জীবিকা নির্বাহ করতেন। এই কষ্টের জীবনের কথা তিনি তার দিনের সূচনাতে ‘মুমিয়ায়ী’ (মমি) নামক কবিতায় চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন।
১৯৬৭ সালে আজারবাইজান বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য হুশাঙ্গ আনছারি দেশ ও সাহিত্যে তার অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে তাঁকে ওস্তাদ (শিক্ষক) উপাধি দেন। একই সাথে পূর্ব আজারবাইজানের প্রাদেশিক শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়ের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ইরানের কেন্দ্রীয় সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ঐ দিনটিকে ‘শাহরিয়ার দিবস’ ঘোষণা করা হয়। ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে বার্ধক্যজনিত রোগে অসুস্থ হয়ে পড়লে শাহরিয়ারকে তেহরানে চিকিৎসার জন্য আনা হয় এবং চিকিৎসারত অবস্থায় ৮২ বৎসর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন। তাঁর লাশ তাব্রিজ শহরে এনে মাকবারাতুশ শোয়ারা তথা কবিদের গোরস্তানে দাফন করা হয়।
শাহরিয়ারের কাব্য প্রতিভা
শাহরিয়ার চার বছর বয়স থেকে কবিতা রচনা শুরু করেন। রুহে পিরভানে’ (প্রজাপতির আত্মা) শিরোনামে তার প্রথম দ্বিপদি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমেই কাব্যপ্রেমীদের কাছে তিনি সমাদৃত হন। তার সমসাময়িক কালের খ্যাতিমান কবি মালেকুশ শোয়ারা বাহার ও সায়ীদ নাফিসির ভুমিকা সম্বলিত এ কাব্যগ্রন্থটি ১৯৩১ সালে প্রকাশ পায়। এ প্রসংগে মালেকুশ শোহারা বাহার ‘সেদায়ে খোদা (খোদার আহ্বান) কাব্যগ্রন্থে শাহরিয়ারকে প্রাচ্যের গৌরব বলে অভিহিত করেন।
শাহরিয়ার মাতৃভাষা তুর্কি ও ফারসিতে অসংখ্য কবিতা লিখেছেন। ১৯৯৮ সালে কাসিদা, গজল, মাসনাভি এবং কেতয়া সম্বলিত প্রায় ত্রিশ হাজার শ্লোক সম্বলিত তাঁর কাব্যসমগ্র ‘দিভানে শাহরিয়ার’ নামে প্রকাশিত হয়। ত্রিশ হাজার শ্লোকবিশিষ্ট এ কাব্যসমগ্রটি চার খ-ে প্রকাশিত হয় এবং এর তিন হাজার শ্লোক ছিল তার মাতৃভাষা তুর্কিতে আর অবশিষ্ট সবই ছিল ফারসিতে রচিত।
তাঁর কাব্যসমগ্র পর্যালোচনা করলে এতে কবিতা রচনার বেশ কয়েকটি ধারা বা বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। পূর্বেই বলা হয়েছে যে, তিনি ছিলেন ইরানের সাহিত্যাঙ্গনের ক্লাসিক ধারা হতে আধুনিক ধারায় প্রত্যাবর্তনের যুগ সন্ধিক্ষণের কবি। প্রাথমিক পর্যায়ে তিনি ক্লাসিক ধারার কবিতা রচনা করতেন। বলা হয়ে থাকে, তাঁর মাধ্যমেই এ ধারার কবিতা রচনার পরিসমাপ্তি ঘটেছিল। সমসাময়িক কালে তাঁর সমকক্ষ কাব্য প্রতিভা খুঁজে পাওয়া নিতান্তই কঠিন ছিল। সনাতন ধারায় কাব্যচর্চার প্রতি তাঁর এ আসক্তি মূলত মহাকবি হাফিজের প্রতি প্রগাঢ় অনুরাগ থেকেই জন্মেছে। শৈশবে দিনে হাফিজ পড়তে পড়তেই হাফিজের প্রতি তাঁর অনুরাগের সৃষ্টি হয়। এ প্রসংগে তিনি নিজেই বলেন, ‘আমি ছোট বেলায় একদিকে যেমন প্রতিদিন পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত করতাম অন্যদিকে হাফিজের দিভানও পড়তাম। আমি পবিত্র কুরআনের পাশেই হাফিজের দিভান রাখতাম। হাফিজ যেমন তাঁর কবিতার প্রেরণা প্রসংগে বলেছেন,
هرجه كردم از دولت قرآن كردم
অর্থাৎ আমি যা কিছু করেছি, সবই পবিত্র কুরআন থেকেই করেছি। শাহরিয়ার তাঁরই কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বলেন।
هرجه دارم از دولت حافظ دارم
অর্থাৎ আমার যা কিছু অর্জন সবই হাফিজ থেকে।’
তিনি ‘বারগাহে হাফে’ (হাফিজের দরবার), ‘হাফেযে জাভেদান’ (চিরন্তন হাফিজ), ‘ভেসালে হাফেয’ (হাফিজের মিলন) নামক কবিতা লিখে হাফিজের প্রতি তাঁর ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে। এ কারণেই তিনি হাফিজ শিরাযির পাচশ গজলের অনুকরণে নিজস্ব কল্পনা ও অভিব্যক্তির সম্মিলনে শত গজল রচনা করেছেন-যা পাঠ করলে মনে হবে এ যুগে বসেও হাফিজের সাথেই ভাবের আদান-প্রদান করা হচ্ছে। আরো মনে হবে হাফিজের গজলেরই প্রতিউত্তরে এ গজলগুলো রচিত হয়েছে। ‘হাতেম ভা দারভিশান’ (হাতেম ও দরবেশগণ), ‘বাদে ভাহাদাত’ (একত্ববাদের সমীরণ), ‘কারগাহে অদামসাযি (মানুষ তৈরির কারখানা) শিরোনামের কবিতাগুলোর উপজীব্য বিষয়, অভিব্যক্তি, মরমি ভাবধারা এবং । শিল্পগুণ- এ সবই হাফিজের গজলের অনুসৃত বলে প্রতীয়মান হয়। যেমন:
آسمان خود خبر از عالم درویشان است
که کمر بسته به خدمت خم درویشان است
نیست جز بی خبری در همه عالم خبری
که خبرها همه در عالم درویشان است
দরবেশ জগতের খবর হয় নিজস্ব আকাশে উদ্ভাসিত,
ন্যুব্জ দরবেশগণ সেবায় কোমর বেঁধেছে।
সারা দুনিয়ার সংবাদে খবরহীনতা ভিন্ন নেই কিছু
কেবল দরবেশগণের সংবাদেই হয় জগত পূর্ণ।
এমনকি কবিতা সম্মেলন উপলক্ষ্যে শিরায নগরীতে অবস্থানকালে শাহরিয়ারের রাতগুলো কেটেছিল হাফিজের মাজারে। সেখানে হাফিজের সামাধি থেকে তিনি আত্মিক প্রেরণা লাভ করেছেন। বিদায় বেলায় একটি আবেগময়ী গজল লিখে হাফিজের কাছ থেকে বিদায় নেন। সেই গজলের দু’টি চরণ ছিল এই রূপ:
به تودیع تو جان می خواهد از تن شد جدا حافظ
به جان کندن وداعت می کنم حافظ، خدا حافظ
তোমাকে বিদায় দিতে আমার প্রাণ ছিন্ন হতে চায় দেহ থেকে
হে হাফিজ! প্রাণটা ছিন্ন করেই তোমাকে জানাই বিদায়, খোদা হাফেজ।
শাহরিয়ার শৈশব থেকেই জীবনের পূর্ণতা ও সঠিক দিকনির্দেশনা লাভে পবিত্র কুরআনের সাথে গভীরভাবে আত্মিক সম্পর্ক গড়ে তোলেন। নিজেকে সর্বদা পবিত্র কুরআনের কাছে ঋণী মনে করতেন। তিনি বলেন: ‘আমি যে সামান্য সাহিত্য সেবা করার সুযোগ পেয়েছি তার অন্যতম কারণ হচ্ছে আমি ৬ বছর বয়স হতেই পবিত্র কুরআন পাঠের অভ্যাস গড়ে তুলি। সে বয়সেই আমি দেখে দেখে পবিত্র কুরআন পড়তে শিখি। আমার ঘরে একটি তাক ছিল যাতে সর্বদাই রাখা হত এক খ- কুরআন ও হাফিজের দিভান। বাহির থেকে ঘরে ফিরে এসে একবার পবিত্র কুরআনের আয়াত তিলাওয়াত করতাম আরেকবার পড়তাম দিভানে হাফেজ। ঐশী বাণীর কাব্য ঝংকারের সাথে হাফিজের কবিতার ছন্দোবদ্ধ সুর আমার চিন্তা জগতে দারুণভাবে নাড়া দিত। যেমন তিনি বলেন:
به شمع صبحدم شهریار و قرآنش
کزین ترانه به مرغان صبح خوان مانم
হে শাহরিয়ার! প্রভাতের প্রদীপ আর পবিত্র কুরআনের শপথ
এই সুর ও ছন্দের দ্যোতনায় ভোরের গায়ক পাখির সাথে তুলনীয় আমি।
পরবর্তী সময় ১৯৪১ সালে রেজাশাহ পাহলভী ও তার সন্তান মুহাম্মদ রেজা শাহ পাহলভীর ক্ষমতার পটপরিবর্তনের ঘটনা শাহরিয়ারের মনে গভীর রেখাপাত করে। এ সময় থেকেই তিনি বৈষয়িক সকল বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে মহান আল্লাহ ও তাঁর প্রদর্শিত জীবনবিধানের সাথে আত্মার বন্ধন গড়ে তোলেন। এমনকি তাঁর ধর্মানুরাগ তাঁকে সেতার বাজানো থেকেও বিরত রাখে। তিনি বলেন, ‘আসলেই মানুষের আল্লাহ হতে বিচ্ছন্ন হওয়া উচিত নয়। মানুষ যদি আল্লাহর সান্নিধ্য হতে বিচ্ছিন্ন না হয় তবে আল্লাহ নিজেই মানুষের হৃদয়ে ভাবের সঞ্চার করেন।’
তাঁর মতে কবিরা হলেন পয়গাম্বরদের চাইতে একস্তরের নিচের মর্যাদায় আসীন। নবিগণের কাছে আল্লাহর ওহী (প্রত্যাদেশ) অবতীর্ণ হয় আর কবিগণের কাছে আসে ইলহাম (ভাবসঞ্চার)। তবে শর্ত হচ্ছে কবিতার পুরোটাই হতে হবে তাওহীদভিত্তিক বা আল্লাহর একত্বের অভিব্যক্তি।
এ প্রসংগে তিনি বলেন:
غلام همت آن قهرمان کون و مکان
که بی رضای الهی نمی زند تفسی
(শাহরিয়ার) সৃষ্টি জগতের সেই অদম্য সাহসী বীরের গোলাম
যে কখনো আল্লাহর সন্তুষ্টি ছাড়া একটি নিঃশ্বাসও নেয় না।
এরপর থেকে তাঁর দিনে স্থান পেতে থাকে আধ্যাত্মিকতা সঞ্জাত ধর্মীয় কবিতাসমূহ।
যেমন: মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের প্রশংসা, মহানবী (সা.)-এর প্রশস্তি, খোদার কাছে প্রার্থনা ও আহলে বাইতের গুণগান। মহান আল্লাহকে উদ্দেশ্য করে শাহরিয়ার তাঁর মোনাজাত’ কবিতায় বলেন:
دلم جواب بلی می دهد صدای تو را
صلا بزن که به جان می خرم بلای ترا
شبانیم هوس است و طواف کعبه ی طور
مگر به گوش دلی بشنوم صدای تو را
তোমার ডাকে হৃদয় মোর ‘হ্যা’ বলে দেয় সাড়া।
ডাকো মোরে বার বার প্রাণের বিনিময়ে ক্রয় করবো যত দুর্দশা
রাখালের ন্যায় কামনা মোর কাবার তুর তাওয়াফের তরে
কিন্তু হৃদয়ে বার বার শুনি তোমার ধ্বনি।
মহানবী (সা.)-এর প্রশস্তি রচনায় ‘কেয়ামে মুহাম্মাদ’ নামক কবিতায় বলেন:
ستون عرش خدا قايم از قیام محمد (ص)
ببین که سر به کجا می کشد مقام محمد (ص)
به کارنامه ي منشور آسماني قرآن
که نقش مهر نبوت بود به نام محمد (ص)
আল্লাহর আরশের খুঁটি দাঁড়িয়ে আছে মুহাম্মাদের আবিভাবে
তাকিয়ে দেখ, কোথায় পৌঁছেছে মুহাম্মাদের মর্যাদা
আসমানে প্রকাশিত কুরআন নামের আমল নামায়
মুহাম্মাদের নামই ছিল নবুয়্যতের মোহারাংকিত।
আহলে বাইত বা নবী-পরিবারকে নিয়ে লিখতে গিয়ে তিনি হযরত আলী (আ.)-এর সম্পর্কে অপর এক কবিতায় বলেন :
علي اي هماي رحمت تو چه آیتی خدارا
که به ماسر افکندی همه سایه ی همارا
হে আলী তুমি রহমতের পাখিতুল্য, কি অপূর্ব নিদর্শন তুমি খোদার
আল্লাহ ছাড়া সবকিছুকে ছুড়ে ফেলেছো তুমি, এমনকি সৌভাগ্যের ছায়াকেও।
তিনি অন্যত্র বলেন:
أي مظهر جمال و جلال خدا علي
یا مظهر العجايب و يا مرتضي على
از شهریار پیر زمینگیر دست گیر
اي رتگیر مردم بی دست و پا علی
হে আল্লাহর সৌন্দর্য ও মহিমার প্রকাশ আলী,
হে বিস্ময়ের প্রকাশস্থল মুরতাজা আলী।
ভূলুষ্ঠিত বৃদ্ধ শাহরিয়ারের হাত ধরে তরিয়ে নাও,
ওহে হাত-পা-শুন্য অসহায় মানুষের দরদী বন্ধু আলী।
তাঁর কবিতা দর্শন, নৈতিকতা ও মানবতার জয়গানে পরিপূর্ণ। তাই তাঁর চিরায়ত সাহিত্যকর্ম কালোত্তীর্ণ হতে পেরেছে। মহাকবি সাদি, হাফিজ ও রুমির প্রেমগীতির আধুনিক স্লোগান হিসেবে ধরা দিয়েছে শাহরিয়ারের কবিতাবলি। মানবতা ও সভ্যতার সকল সৌকর্যে পরিপূর্ণ শাহরিয়ারের কবিতা। তাঁর অসংখ্য জীবনঘনিষ্ঠ প্রেমময় গজল ভাষার দুর্বোদ্ধতা এড়িয়ে সাধারণ মানুষের কাছে অতি সহজে উপস্থাপিত হয়েছে। ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবোধ, নিজস্ব চিন্তা-কল্পনা ও ভাবধারা তাঁর কবিতায় নতুনত্বের স্বাদ এনে দিয়েছে। শাহরিয়ার সংগীত খুব পছন্দ করতেন। তিনি নিজে ইরানি মিউজিক সম্পর্কে অভিজ্ঞ ছিলেন এবং সেতার বাজাতে পারঙ্গম ছিলেন। এ প্রসংগে তিনি বলেন:
آنچه دیدم از نواي زندگي نامبتذل
ناله سیم سه تارم بود و دیوان غزل
জীবনের নিষ্কলুষ হৃদয় নিঃসৃত সুরে যা কিছু দেখেছি,
তা ছিল আমার সেতারের ক্রন্দন আর গজলের দিন।
আরেকটি গজলে তিনি সেতারকে ব্যথিত হৃদয়ের সাথি ও শান্তিদায়ক বলে বর্ণনা করেন:
نالد به حال زار من امشب سه تار من
این مایه تسلي شبهاي تار من
ভারাক্রান্ত হৃদয়ের কথা ব্যক্ত করতে আজ কাঁদছে আমার সিতার খানি
আমার নিকষ কালো রাতগুলোতে সান্ত¡নার মূলে ছিলো এটি।
মহাকবি হাফিজের প্রেম মদিরার ফলগুধারা শাহরিয়ারের কাব্যেও প্রবহমান ছিল। কেননা, প্রেমই বিশ্বলোকের প্রাণশক্তি। শাহরিয়ার নারীপ্রেম দিয়েই তাঁর কাব্য শুরু করে পরিশেষে সত্যিকারের প্রেমের সন্ধান লাভ করেন।
যেমন তিনি বলেন:
نقش مزار من کشید این دو سخن که شهریار
با غم عشق زاده و با غم عشق داده جان
মোর মাযারে লিখে রেখো বন্ধু এ দু’কথার স্লোগান
প্রেমের ধ্যানে জন্মেছে শাহরিয়ার, প্রেমেই দিয়েছে প্রাণ।
অন্যত্র তিনি বলেন :
عشق ای همسایه آوارگی
عشق ای سرمایه بیچارگی
راحت از بار غم دل کن مرا
یا بکش یکباره با ول کن مرا
প্রেম: হে ভবঘুরে প্রতিবেশী আমার
প্রেম হে অসহায়ত্বের পুঁজি আমার
অন্তরের চিন্তার বোঝা থেকে আমায় মুক্তি দাও
একবারে হত্যা কর অথবা ছেড়ে দাও আমায়।
তাঁর আধ্যাত্মিক প্রেমের গজলগুলো হচ্ছে ‘এন্তেজার’ (অপেক্ষা) ‘জাম ভা তাফরীক’ (সমম্বিত ও বিচ্ছিন্নতা), ‘ভাহশী শেকার’ (হিংস্র পশু শিকার), ‘ইউসুফ গোমগাশতে’ (হারানো ইউসুফ), ‘মোসাফিরে হামেদান’ (হামেদানের পথিক), ‘হারাজে এশক’ (প্রেমের নিলাম) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। শাহরিয়ার রীতিসিদ্ধ কবিতার পাশাপাশি মুক্ত কবিতা বা শেরে আযাদ রচনা করেছেন সাবলীলভাবে। তাঁর মুক্ত কবিতাগুলো অধিকাংশই ইরানের আধুনিক কাব্যের জনক নিমা ইউসিজের আফসানে’-এর (রূপকথা) আদলেই রচিত। বলা যায়, এক্ষেত্রে তিনি নিমায়ী ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। নিমা আধুনিক কবিতার আঙ্গিক বিনির্মাণের লক্ষ্যে তাঁর সংক্ষিপ্ত কবি জীবনের আকাক্সক্ষা ও বেদনার দীর্ঘ কঠিন পথের চিত্র তুলে ধরেছেন তাঁর বিখ্যাত ‘আফসানে’ শীর্ষক কবিতায়। এ কবিতা রচনার মধ্য দিয়েই মূলত আধুনিক একটি ধারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শাহরিয়ার যদিও তাঁর কবি জীবনের সূচনা করেছেন ক্লাসিক ধারার কবিতা রচনার মাধ্যমে। যদিও মাঝ পথে এসে তিনি অর্ধ রীতিসিদ্ধ। কবিতা রচনা শুরু করেন- ফারসিতে যাকে বলে ‘নিমে সুন্নাতি’। এ ধরনের কবিতার মধ্যে উল্লেখযােগ্য হলো ‘হাযিয়ানে দেল’ (অন্তরের অর্থহীন প্রলাপ), ‘দো মোরগে বেহেশতি’ (স্বর্গের দুই পাখি), ‘সারনেভেশতে এশক’ (প্রেমের ভাগ্যলিপি), ‘রায ভানিয়ায (রহস্য ও প্রয়োজন) ইত্যাদি। তার আধুনিক কবিতার ভাবধারা নিমায়ী ভাবধারার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ হলেও রং ও ভঙ্গিমা ছিল একান্ত নিজস্ব। কেননা, এ কবিতাগুলোর বিষয় নির্বাচন ও কল্পচিত্র তৈরিতে তিনি সৃজনশীলতার পরিচয় দিয়েছেন অত্যন্ত দক্ষতার সাথে। তাঁর আধুনিক ধারার উল্লেখযোগ্য কবিতাগুলো হচ্ছে ‘এই ভায়াইয়ে মাদারাম’ (হায়রে আমার মা), ‘অফসানেয়ে শাব’ (রাতের রূপকথা), ‘হাযিয়ানে দেল’ (অন্তরের অর্থহীন প্রলাপ), ‘মুমিয়ায়ী’ (মমি) ইত্যাদি। উদাহরণস্বরূপ তাঁর রচিত একটি আধুনিক কবিতার অংশ বিশেষ তুলে ধরা হলো:
در شبستان خود پای شمعی
شاعر مات و محزون نشسته
دیرگاهی است کاین کلیه را در
بر رخ یار و اغيار بسته
گرد اندوه باریده اینجا
می نماید همه چیز خسته
دفتری پیشش است و سه تاری
নিজ কক্ষে মৃদু আলোর মোমবাতির সন্নিকটে
বিষণœমনা ও চিন্তাক্লিষ্ট কোনো এক কবি একাকী বসে আছে
বহুকাল হতে ছোট সে কুটিরের দরজা
বন্ধুর মুখের উপর হয়েছে বন্ধ
দুশ্চিন্তার ধূলোরাশি প্রতিনিয়ত বর্ষিত হয় এখানে
সব কিছুই ক্লান্তিকর করে তোলে, আর
তার কাছে রয়েছে একটি খাতা ও একটি সেতার।
নিজ মাতৃভাষা তুর্কি অযারি ভাষায় তাঁর বিস্ময়কর সৃষ্টি হচ্ছে ‘হেইদার বাবায়ে সালাম’ (সালাম হায়দারবাবা)। হায়দরবাবা তাঁর গ্রামের অদূরে পাহাড়ের একটি নাম। কবি শৈশবের স্বপ্নের দিনগুলোতে তাঁর গ্রামের পাহাড়ঘেরা প্রকৃতির সাথে আত্মার যে কথোপকথন বা ভাব বিনিময় করেছেন তা-ই কবিতায় সালাম হায়দার বাবা নামে মূর্ত হয়ে উঠেছে। কবিতাটি কেবল তুর্কি ভাষাতেই নয়, বিশ্ব সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ হিসেবে প্রায় সত্তরের অধিক ভাষাতে অনূদিত হয়েছে। পয়ার ছন্দে লেখা এই কবিতার ভাষা অত্যন্ত সহজ-সরল ও প্রাঞ্জল। তুর্কি ভাষায় তাঁর দক্ষতার জ্বলন্ত সাক্ষ বহন করে এ কবিতাটি। তুর্কি ভাষাভাষী এমন কোন শিক্ষিত লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না যিনি তুর্কি জানেন অথচ এ কবিতা পড়ে ভাষার লালিত্যে মোহিত হননি।
قارى كه ﮔتچه تاغيل دلينده
كولك قالخوب قاب يجائى توينذه
قورد ﮔچنين ستگيلين يثيتده
من قابلدوب بيرده لوشاق لولبديم
হেইদার বাবা মনে পড়ে কি আজি সেই রাতের কথা
যে রাতে বৃদ্ধ দাদীমা নানা কাহিনী বলতেন
ঝড়ো বাতাস জানালা-দরজাকে ঝাঁকুনি দিত
ক্ষুধার্ত নেকড়ে দল ছাগল দলের ওপর হানা দিত
আফসোস যদি আমি এক মুহূর্তের তরে ফিরে যেতে পারতাম সেই শৈশবে ….
শাহরিয়ারের স্বদেশপ্রেমের কবিতাগুলো পাঠক মহলে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়েছে। স্বদেশ ও স্বজাতির প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিল সীমাহীন। ‘শিভানে শাহরিভার’ (শাহরিভার মাসের শোকগাথা), ‘মেহমানে শাহরিভার’ (শাহরিভার মাসের অতিথি), ‘শাবিখুন’ (রক্তাক্ত রজনী) প্রভৃতি কবিতা তাঁর স্বদেশপ্রেমের অন্যতম নিদর্শন। তিনি ইসলামি বিপ্লবের একজন খাঁটি সমর্থক ছিলেন। শোষকের বিরুদ্ধে মজলুম ও বঞ্চিতদের প্রতিরোধ আন্দোলনই ছিল তাঁর কবিতার প্রাণশক্তি। যে কারণে কবি শাহরিয়ারের নাম ফারসি সাহিত্যাঙ্গনে চির অম্লান হয়ে থাকবে।
লেখক : অধ্যাপক, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

ইরানে চিকিৎসাবিজ্ঞানের পথিকৃৎ আল-রাজি ও আজকের বাস্তবতা

রাশিদ রিয়াজ

ইরানের চিকিৎসাবিজ্ঞানী আবু বকর মুহাম্মাদ বিন জাকারিয়া আল-রাজি ৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে (২৫১ হিজরি) পারস্যের ‘রেই’ নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। আলবোর্জ পর্বতমালার দক্ষিণের ঢালে বিখ্যাত সিল্ক রোডের পাশে এই নগরীটি অবস্থিত। বর্তমানে এটি বৃহত্তর তেহরানের অংশ। আল-রাজি ইউরোপে ‘রাজেশ’ নামে পরিচিত।
রাজি ছিলেন দরিদ্র পরিবারের সন্তান। জীবনের শুরুতে সাধারণ শিক্ষা গ্রহণ করেন। তরুণ বয়সে উদ্দেশ্যহীন জীবনযাপন করতেন। বিভিন্ন আসর, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডাবাজি ইত্যাদি অনর্থক কাজে সময় কাটিয়ে দিতেন। (সও আজিম মুসলিম সাইন্সদা : ১৪৭)। পরবর্তী সময়ে রসায়নবিদ্যার প্রতি তাঁর প্রবল আগ্রহ সৃষ্টি হয়। ‘কিমিয়াগিরির’ (লোহা ও পিতল ইত্যাদিকে স্বর্ণে রূপান্তর করার একটি কৌশল) পেছনে সময় ও মেধা ব্যয় করতে থাকেন। কিমিয়াগিরির জন্য বাড়িতে আগুনের চুল্লি স্থাপন করেছিলেন। তাঁর বাড়ি সর্বদা ধোঁয়ায় পরিপূর্ণ থাকত। অতিরিক্ত ধোঁয়ার কারণে চোখ রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে। চিকিৎসার জন্য ডাক্তারের শরণাপন্ন হলে ডাক্তার ৫০০ আশরাফি মুদ্রার বিনিময়ে চোখের চিকিৎসা করেন। বিদায়কালে বলেন, রসায়নবিদ্যার আকর্ষণে তুমি যে কিমিয়াগিরি করছ সেটি আসল কিমিয়াগিরি নয়, আসল কিমিয়া হলো আমি যেটা করছি সেটা! (তারিখুল হুকামা : ৬)
চক্ষু ডাক্তারের ওই মন্তব্য মুহাম্মাদ রাজির জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। চিকিৎসাশাস্ত্রে পারদর্শী হতে তিনি স্ত্রী-সন্তান ও বন্ধুদের বিদায় জানিয়ে বাগদাদের পথে যাত্রা করেন। বাগদাদের তৎকালীন শীর্ষ চিকিৎসক আলী ইবনে সাহলের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। ইবনে সাহলের তত্ত্বাবধানে কঠিন অধ্যবসায় ও অধ্যয়নের ফলে চিকিৎসাশাস্ত্রে ব্যুৎপত্তি অর্জনে সক্ষম হন। দীর্ঘকাল চিকিৎসাশাস্ত্রের পাঠদান ও রোগীদের সেবা করার ফলে তাঁর নাম চিকিৎসাশাস্ত্রের ইমাম ও নতুন তত্ত্ব উদ্ভাবনকারীদের শীর্ষ তালিকায় উচ্চারিত হতে থাকে। বিখ্যাত মনীষী ইবনে খাল্লিকান বলেন, মুহাম্মাদ আল-রাজি চিকিৎসাবিজ্ঞানের প-িত ছিলেন। তাঁর যুগে তাঁকেই সেরা বলা হতো। তিনি চিকিৎসাশাস্ত্রের অসংখ্য মৌল তত্ত্বের আবিষ্কারক। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ চিকিৎসাশাস্ত্রের দীক্ষা নিতে তাঁর কাছে আগমন করত। (হুকামায়ে ইসলাম : ১/২০১)
চিকিৎসাবিজ্ঞানে মুহাম্মাদ রাজির অবদান স¤পর্কে ইতিহাসবিদরা বলেন, ‘চিকিৎসাাস্ত্রের মৃত্যু ঘটেছিল, হাকিম জালিনুস আবার প্রাণ দান করেছেন। এ শাস্ত্রের নীতিমালা বিক্ষিপ্ত ও দুর্বল ছিল, ইমাম রাজি সেসব নীতিকে পরিমার্জন, পরিবর্ধন ও সুবিন্যস্ত করে কিতাবের আকৃতি দান করেছেন। চিকিৎসাশাস্ত্র অস¤পূর্ণ ছিল, ইবনে সিনা তার পূর্ণতা দান করেছেন।’ (ইবনে খাল্লিকান : ২/৭৮)
ইমাম রাজি একজন প্রাজ্ঞ চিকিৎসক ছিলেন। রেই শহরের প্রধান হাসপাতালের প্রধান পরিচালকের পদে তাঁকে আসীন করা হয়। এ সময়েই তাঁর অসাধারণ যোগ্যতা ও কর্মদক্ষতার সুখ্যাতি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। খলিফা মুকতাফির (১৭তম আব্বাসি খলিফা) রাজত্বকালে ইমাম রাজিকে বাগদাদে বদলি করা হয়। ৯০৩ খ্রিস্টাব্দে রেইয়ের শাসক মানসুর ইবনে ইসহাকের অনুরোধে তিনি আবার রেইয়ের সরকারি হাসপাতালে আগের পদে যোগদান করেন।
ইমাম রাজিই সর্বপ্রথম ‘ফার্স্ট এইড’ পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। এ পদ্ধতির নীতিমালাও তিনি প্রণয়ন করেন। ‘মিজানে তিববি’ নামক ওষুধের ওজন পরিমাপক যন্ত্র তাঁর হাত ধরেই আবিষ্কৃত হয়। এ নিক্তির মাধ্যমে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জিনিসের সঠিক পরিমাপ জানা যায়। অ্যালকোহল আবিষ্কারকের নাম হিসেবেও মুহাম্মাদ রাজির নাম উচ্চারিত হয়। ‘বংশপরা¤পরায় রোগের সৃষ্টি’ তত্ত্বের ধারণা তিনিই সর্বপ্রথম প্রদান করেন। ‘নশতার’ নামক এক ধরনের অস্ত্রোপচার যন্ত্র আবিষ্কার করেন। (সও আজিম মুসলিম সাইন্সদা : ১৪৭)
শল্যচিকিৎসার প্রাণপুরুষ আল-রাজিই প্রথম চিকিৎসক যিনি হাম ও গুটি বসন্তকে আলাদা রোগ হিসাবে চি‎হ্নিত করেছিলেন। তিনি সালফিউরিক এসিড, ইথানল উৎপাদন ও পরিশোধন এবং চিকিৎসায় এর ব্যবহার পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন।
আল-রাজি কেবল চিকিৎসাবিজ্ঞানীই ছিলেন না; বরং একাধারে দার্শনিক, গণিতবিদ ও রসায়নবিদ ছিলেন। ৯২৫ খ্রিস্টাব্দে একটি সফল জীবন শেষ করে জন্মশহর রেইতে ইন্তেকাল করেন এ জগদ্বিখ্যাত মনীষী। তাঁর নামে ইরানে রাজি ইন্সটিটিউট ও ইরানের কেরমানশাহ শহরে রাজি বিশ্ববিদ্যালয় অবস্থিত। ইরানে প্রতি বছর ২৭ আগস্ট আল-রাজিকে স্মরণ করে রাজি দিবস পালন করা হয়।
মুহাম্মাদ রাজির রচনাবলি
আল-রাজি রসায়নবিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান, চিকিৎসাবিজ্ঞান ও অন্যান্য বিষয়ে প্রায় ২০০টির অধিক গ্রন্থ লিখেছেন। তাঁর গবেষণাকর্মের মধ্যে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ হলো চিকিৎসাবিজ্ঞানের শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ ‘আল হাভি’ এবং ‘রসায়নশাস্ত্রের রহস্যাবলির রহস্য’ শীর্ষক গ্রন্থ। দিনরাত পড়াশুনা ও গবেষণার এক পর্যায়ে তিনি অন্ধ হয়ে যান। এরপর তিনি বলতেন আর তাঁর ছাত্ররা তা লিখে রাখতেন। যখন তিনি মারা গেলেন তখন তাঁর ছাত্ররাই ‘আল হাভি’র কাজ সমাপ্ত করেছিলেন। নিচে তাঁর কয়েকটি বইয়ের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরা হলো :
ক. আল-হাভি : ‘আল-হাভি’ হলো চিকিৎসাশাস্ত্রে লিখিত তাঁর জগদ্বিখ্যাত কিতাব। এটাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের আরবি ভাষার এনসাইক্লোপিডিয়া বলা হয়। এ বইতে চিকিৎসাশাস্ত্রের সূক্ষ¥ সূক্ষ্ম সমস্যার সমাধান ও আরব বিশ্বের চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের মতামত লিপিবদ্ধ করেছেন। ইউনান, হিন্দুস্তান ও ইরানের চিকিৎসাবিজ্ঞানের সারনির্যাসকে নীতিমালার আলোকে একত্রিত করেছেন। শতাব্দীকাল ধরে এ বই পশ্চিমা বিশ্বের বিভিন্ন বিশ^বিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১২৭৯ খ্রিস্টাব্দে একজন ইহুদি চিকিৎসক এ বইয়ের ল্যাটিন অনুবাদ করেন। বইটির গ্রহণযোগ্যতা বোঝাতে এতটুকুই যথেষ্ট যে, ১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দে সর্বপ্রথম অনুবাদ প্রকাশের পর ১৫৪২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত পনেরোর অধিক সংস্করণ ছাপা হয়!
খ. কিতাবুল মানসুরি : ইমাম রাজির বিখ্যাত রচনা। দশ খ-ে লিখিত বইটি শাসক মানসুরের নামে নামকরণ করেন। ইতালির মিলান শহরে পনেরো শতাব্দীর শেষের দিকে এর অনুবাদ প্রকাশিত হয়। অধুনা এর কিছু অংশ ফ্রেঞ্চ ও জার্মান ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
গ. কিতাবুল জাদারি ওয়াল হাসাবা : আরেকটি জনপ্রিয় কিতাব। ইতিহাসে সর্বপ্রথম এই কিতাবে বসন্ত, জলবসন্ত ও হাম রোগের চিকিৎসা স¤পর্কে বিস্তারিত সমাধান দেওয়া হয়। রাজির আগে অন্য কেউ এ বিষয়ে কলম ধরেনি। বসন্তের ধরন নির্ণয়ের ভিত্তিতে তিনি প্রতিষেধক উদ্ভাবন করেন। ১৫৬৫ খ্রিস্টাব্দে প্রথমে ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ প্রকাশিত হয়। পরবর্তী সময়ে ইউরোপের বিভিন্ন ভাষায় কিতাবটির অনুবাদ হয়। এ বইটিই ইমাম রাজিকে মধ্যযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ চিকিৎসা বিজ্ঞানীরূপে প্রতিষ্ঠিত করে। ইংরেজি অনুবাদ হয় ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে। ফ্রেঞ্চ, ইউনান ও জার্মান ভাষায়ও এটির অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জাতীয় পাঠ্যক্রমে কিতাবটি অন্তর্ভুক্ত ছিল।
ঘ. আল-ফুসুল ফিত-তিব : রাজির বিখ্যাত কিতাব। সর্বপ্রথম ইবরানি ভাষায় তরজমা প্রকাশিত হয়। লন্ডনে এর অনুবাদ বিদ্যমান আছে। ল্যাটিন ভাষায়ও অনূদিত হয়েছে।
ঙ. কিতাবুত তিববিল মুলুকি : আরেকটি প্রসিদ্ধ কিতাব। তবারিস্তানের (ইরানের বিখ্যাত নগরী) শাসক আলি ইবনে উমসুজানের নামে বইটির নামকরণ করেন। এটির হাতেলেখা পা-ুলিপি লন্ডন লাইব্রেরিতে বিদ্যমান আছে। (ইসলামি এনসাইক্লোপিডিয়া : ৮১৯, উলুম ওয়া ফুনুন আহদে আব্বাসি : ১২৬)
চ. কিতাবুল আসরার : গুরুত্বপূর্ণ ও সুপরিচিত কিতাব। প্রসূতিবিদ্যা, চক্ষুরোগ ও মহিলা রোগের চিকিৎসা বিষয়ে এ কিতাবের গ্রহণযোগ্যতার কথা পশ্চিমা বিশ্ব নির্দ্বিধায় স্বীকার করে নিয়েছে। (আরবু কে ইলমি কারনামে : ৭০)।
লেখালেখিতে ইমাম রাজির স্বভাবজাত আগ্রহ ও যোগ্যতা ছিল। সর্বদা লেখার কাজে নিমগ্ন থাকতেন। চিকিৎসাবিজ্ঞান ছাড়াও আকিদা, যুক্তিবিদ্যা, দর্শন, মহাকাশ ইত্যাদি বিষয়ে লেখা তাঁর রচনাবলি বিশেষ মর্যাদায় আসীন। পশ্চিমা বিশ্বের চিকিৎসা, দর্শন ইত্যাদির ওপর ইমাম রাজির রচনাবলির ব্যাপক প্রভাব রয়েছে।
১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটেন কংগ্রেস আয়োজিত আন্তর্জাতিক সেমিনারে ইমাম রাজির জীবন ও অবদানের ওপর আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। বক্তারা কৃতজ্ঞতা ও প্রশংসা জ্ঞাপনসূচক বাক্যে ইমামকে উল্লেখ করেন। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে ইমাম রাজির মৃত্যুর হাজার বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে অতিথিদের সবাই তাঁকে ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ চিকিৎসাবিজ্ঞানী হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেন।
ইরানের বর্তমান চিকিৎসাব্যবস্থা
আজকের দিনে ইরান যখন নিজেদের ওষুধ চাহিদার ৯৮ শতাংশ নিজেরাই তৈরি করে তখন বোঝা যায় চিকিৎসাবিজ্ঞানে আল-রাজির মতো বিদগ্ধ প-িতরা দেশটির এ শাখায় প্রাচীনকালেই ভিত গড়ে দিয়ে গেছেন। অভ্যন্তরীণ চাহিদার শতকরা ১০০ ভাগ ওষুধ উৎপাদনের লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ইরান। গত বছর ৯৭০টি লাইসেন্স ইস্যু করা হয়েছে, এর মধ্যে ৮০টি লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে এমন সব ওষুধ তৈরির জন্য যা দেশে এই প্রথমবারের মতো তৈরি হচ্ছে।
একটি দেশের বিরুদ্ধে ৪ দশকেরও বেশি সময় ধরে যখন অন্যায়ভাবে অবরোধ ও ওষুধ আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা চলে আসছে তখনো ইরান করোনাভাইরাস মোকাবেলায় এমনভাবে লড়ছে যেখানে জাতীয় জাগরণের আভাস পাওয়া যায়। ইরানই একমাত্র মুসলিম দেশ যারা অন্তত তিনটি দেশের সঙ্গে করোনাভাইরাসের টিকা যৌথভাবে ও নিজেদের উদ্ভাবিত তিনটি টিকা উৎপাদনে যাচ্ছে। এর বাইরে আরো কয়েকটি টিকার ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চলছে। ইতিমধ্যে ইরান জার্মানি ও তুরস্কসহ কয়েকেটি দেশে করোনাভাইরাস শনাক্তকরণ কিট রপ্তানি শুরু করার পর দক্ষিণ আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইরানের কিটের চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী ইরানের নিজস্ব টিকা ‘কোভিড বারাকাত’ গ্রহণ করেছেন। লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে নির্বাচিত হওয়ার পর ইরানের নতুন প্রেসিডেন্ট ড. রায়িসি ইরানের তৈরি করোনা ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ নিয়েছেন। তাঁর নেওয়া ‘কোভ-ইরান বারাকাত’ নামের ওই ভ্যাকসিন ইরানের তরুণ গবেষক ও বিজ্ঞানীদের নিরলস প্রচেষ্টার ফসল। সকল প্রকার ট্রায়াল শেষে এই ভ্যাকসিন প্রদানের অনুমতি মিলেছে। প্রেসিডেন্ট রায়িসি এ টিকা নিয়ে ‘কোভ-ইরান বারাকাত’ তৈরির ক্ষেত্রে নিয়োজিত তরুণ বিজ্ঞানী ও গবেষকদের শ্রম ও মেধাকে স্বীকৃতি দিয়েছেন ও তাঁদেরকে সম্মানিত করেছেন। ‘কোভ-ইরান বারাকাত’ ভ্যাকসিন ব্যবহারের লাইসেন্স পাবার মধ্য দিয়ে ইরান করোনার টিকা প্রস্তুতকারী বিশ্বের ছয়টি দেশের মধ্যে নিজেদের স্থান করে নিয়েছে। আগামী বছরে মুখে নেওয়ার মতো কোভিড ওরাল ভ্যাকসিন তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে ইরান। ইরানের মোট ৯টি স্থানীয় ফার্ম করোনাভাইরাস ভ্যাকসিন উৎপাদন নিয়ে কাজ করছে। দুটি ভ্যাকসিন ক্লিনিক্যাল লাইসেন্স লাভের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে।
এসব গবেষণা নিরন্তর চলার পেছনে উৎসাহ যুগিয়েছে তাদের উত্তরসূরি চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা। তাঁদের মতো আরো অনেক চিকিৎসাবিজ্ঞানীর অশেষ পরিশ্রম ও ধারাবাহিক প্রচেষ্টায় আজকে ইরানে ৬শ’র বেশি কো¤পানি মেডিক্যাল যন্ত্রপাতি তৈরি করে যা ইরানের মোট চাহিদার শতকরা ৩৫ ভাগ। বিভিন্ন দেশে যখন কোভিড মহামারিতে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জাম, আইসিইউ, ভেন্টিলেটরসহ বিভিন্ন উপকরণের সংকট চলছে তখন ইরান এসব উপকরণ অনেক দেশে রফতানি করছে।
পশ্চিম এশিয়ায় বৃহত্তম ওষুধ উৎপাদকে পরিণত হবে ইরান এমন লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে দেশটি। আর এধরনের লক্ষ্যমাত্র নিয়ে আগানো সম্ভব হচ্ছে ইরানের বিজ্ঞানীদের উচ্চ বৈজ্ঞানিক সক্ষমতা ও সামর্থ্য এবং ওষুধ উৎপাদনের প্রয়োজনীয় উপাদান নিজেরাই তৈরি করতে পেরেছে বলে।
এমনিতে বিশ্বখ্যাত ৩৫ জন স্টেম সেল প্রতিস্থাপন ডাক্তারের তালিকায় রয়েছেন ইরানি চিকিৎসক আমির আলি হামিদিয়ে। ‘দেড় মিলিয়ন হেমাটোপয়েটিক স্টেম সেল ট্রান্সপ্লান্ট’ শীর্ষক এক নিবন্ধে তিনি সেরা ৩৫ জনের মধ্যে স্থান পান। তাঁর মতো অনেক চিকিৎসাবিজ্ঞানী তাঁদের উত্তরসূরির গবেষণার ভিত্তিকেই অনুসরণ করে নিত্যনতুন আবিষ্কার করছেন।
এরই মধ্যে ইরান ইন্দোনেশিয়ায় আধুনিক টেলিসার্জারি কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। রোবটের সাহায্যে দূরবর্তী স্থানে অস্ত্রোপচারের জন্য ইন্দোনেশিয়ায় দুটি আধুনিক টেলিসার্জারি কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করবে ইরান। এছাড়া পশ্চিম এশিয়ায় প্রথম আয়ন থেরাপি কেন্দ্র চালু করেছে ইরান। আগামী বছরে থেকে কেন্দ্রটিতে সব ধরনের ক্যান্সারের জন্য সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হবে। বিশ্বে এই ধরনের প্রযুক্তি মাত্র ছয়টি দেশের হাতে আছে।
একই সঙ্গে ইরানে নিয়মিত আন্তর্জাতিক সেমিনার অনুষ্ঠিত হচ্ছে। তেহরানে পঞ্চম ইন্টারন্যাশনাল হেলথ কংগ্রেস শুরু হওয়ার পর আশা করা হচ্ছে এ আয়োজন মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে পর্যটন উন্নয়ন ও সহযোগিতা বাড়াতে ভূমিকা রাখবে, একই সঙ্গে মেডিকেল টুরিজ্যম, ¯েপার্টস টুরিজ্যম, পুষ্টি ও স্বাস্থ্যকর খাবার ও ল্যাবরেটরি ইকুয়েপমেন্ট নিয়েও এ কংগ্রেসে আলোচনায় উপকৃত হয়েছে দেশগুলো।
সম্প্রতি রাশিয়া, জার্মানি এবং ইকুয়েডরে ‘ব্রেন সার্জারি নেভিগেশন সিস্টেম’ রফতানি শুরু করছে ইরান। মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচারের এসব জটিল উপকরণ বর্তমানে ইরানের ৮০টি হাসপাতালে ব্যবহৃত হচ্ছে। উপকরণগুলো কৌশলগত পণ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মস্তিষ্কের বিভিন্ন ধরনের জটিল অস্ত্রোপচারে এধরনের উপকরণ ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এধরনের ডিভাইস সার্জনকে অস্ত্রোপচারের সময় প্রয়োজনীয় সঠিক দিক নির্দেশনা দিতে সক্ষম। টিউমার, সাইনাস ও মাথার খুলি, এমনকি ¯পাইনাল কর্ড বা মেরুদ- অপারেশনে এসব ডিভাইস খুবই উপযোগী। ফলে চিকিৎসকরা এধরনের অস্ত্রোপচারের সময় বাড়তি সাহস পেয়ে থাকেন। সঠিক সময়ের মধ্যে অস্ত্রোপচারে আস্থাও পান। তুরস্কে এধরনের ডিভাইস রপ্তানির কথা চলছে। ইরানের দেড়শ চিকিৎসক অন্তত ৬ হাজার রোগীর মস্তিষ্কের অস্ত্রোপচারে এসব ডিভাইস ব্যবহার করেছেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের পরিচালক আহমেদ আল-মানদারি বলেছেন, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য ইরান হচ্ছে রোল মডেল। ইরান জুড়ে ৬৯৬টি প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দেওয়া এক বার্তায় তিনি এই মন্তব্য করেন। মানদারি বলেন, বিগত চার দশক ধরে ইরানের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নেটওয়ার্ক জনগণের সময়মতো সাশ্রয়ী মূল্যে, গ্রহণযোগ্য প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য পরিষেবা নিশ্চিতের লক্ষে কাজ করছে। তিনি বলেন, এসব নতুন স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের আওতা বাড়াতে সাহায্য করবে এবং শতভাগ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
উল্লেখ্য, বর্তমানে প্রায় সব ইরানিই রাষ্ট্র সমর্থিত স্বাস্থ্যবিমা পরিষেবা পান।

বিশ্বের শীর্ষ দশ পর্যটন গন্তব্যের দেশ ইরান

সাইদুল ইসলাম : গত ২৭ সেপ্টেম্বর ছিল বিশ্ব পর্যটন দিবস। এ উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করে ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্বের শীর্ষ দশ পর্যটন গন্তব্যের দেশ ইরান। এজন্য ইরানের ৫টি প্রদেশকে নির্বাচন করা হয়। সমৃদ্ধ ও ঐতিহ্যবাহী ভ্রমণ গন্তব্যের প্রতিনিধিত্ব করায় এসব প্রদেশকে বাছাই করা হয়। প্রদেশগুলো হলো আরদেবিল, কোরদেস্তান, কেরমানশাহ, কেরমান ও ফার্স প্রদেশ। এসব প্রদেশে ছয় দিনব্যাপী চলে বিশ্ব পর্যটন দিবসের অনুষ্ঠান। বিগত দুই বছর ধরে ইরানের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, পর্যটন ও হস্তশিল্প মন্ত্রণালয় দেশের কম পরিচিত পর্যটন গন্তব্যগুলোকে পরিচয় করাতে এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ও মানুষকে পর্যটনের গুরুত্বের প্রতি মনোযোগ আকৃষ্ট করতে বিশ্ব পর্যটন দিবসের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইভেন্টকে কাজে লাগাতে বিশেষভাবে উদ্যোগী হয়েছে।

মানব সভ্যতার সুপ্রাচীন ঐতিহ্য ও সৌন্দর্যের অন্যতম লীলাভূমি আজকের ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান। বিচিত্র প্রকৃৃতির বিপুল সম্ভারে পরিপূর্ণ এই দেশটি স্মরণাতীতকাল ধরে পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আসছে। প্রায় সব ধরনের পর্যটককে কোনো না কোনোভাবে আকৃষ্ট করতে সক্ষম ইরান। আপনি যদি সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহী হয়ে থাকেন তাহলে ইরান আপনার জন্য হবে স্বর্গ। আপনি যদি শিল্পে আগ্রহী হন তাহলে এখানকার মনোমুগ্ধকর স্থাপত্য ও জাদুঘর আপনাকে দেবে পরমানন্দ। আর প্রকৃতিপ্রেমী হলে তো কথাই নেই। আপনি উপভোগ করবেন সেরা সব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য।
সুপ্রাচীনকাল থেকে আজকের আধুনিক বিশ্ব; ইতিহাসের প্রতিটি বাঁকে ইরানের নাম অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। দেশটির ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থান, পৌরাণিক কাহিনী, আখ্যান যেকোনো পর্যটককে মুগ্ধ করে। ফলে ইরানকে সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্যটনগন্তব্য হিসেবে বেছে নেয়াটা একেবারেই যৌক্তিক একটা সিদ্ধান্ত হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। উত্তর-পূর্ব শিরাজ প্রদেশের অসাধারণ প্রাচীন শহর পারসেপোলিস থেকে শুরু করে প্রাচীন মানব-বসতিসহ ইরানের সব দর্শনীয় স্থান দেখে বিস্মিত হবেন আপনি। ইসফাহানে দেখবেন অর্ধ-জাহানের সৌন্দর্য! বিস্ময়ের সে ঘোর হয়তো কাটবে প্রকৃতির উজাড় করে দেওয়া ভালোবাসায়। প্রকৃতির এমন ভালোবাসা পাবেন গিলান কিংবা মাযান্দারান প্রদেশে।
প্রাকৃতিক পরিবেশের দিক থেকে বলতে গেলে ইরানে যেমন রয়েছে পাহাড় আর সাগর, তেমনি রয়েছে বিশাল মরুভূমি, কোথাও নদ-নদী, আবার কোথাও সুবিস্তৃত সমতলভূমি। ইরানের দুই পাশে রয়েছে দুই সাগর অর্থাৎ পারস্য উপসাগর ও কাস্পিয়ান সাগর। ভূমি-বৈচিত্র্যের মতো এখানকার আবহাওয়াতেও রয়েছে বেশ বৈচিত্র্য। সারা ইরানে বসন্ত, গ্রীষ্ম, শরৎ ও শীতÑ এই চারটি ঋতু রয়েছে। রাজধানী তেহরানসহ বিশাল এলাকাজুড়ে যখন প্রচ- শীত কিংবা তুষারাবৃত তখন দক্ষিণে (পারস্য উপসাগর সংলগ্ন) দিব্যি বসন্তের হাওয়া। আপনি কম খরচে অভ্যন্তরীণ বিমানের কোনো ফ্লাইট ধরে সেখান থেকে সহজেই একটু উষ্ণতা নিতে পারেন। পাহাড়, সাগর, নদ-নদী আর জঙ্গলাকীর্ণ বৈচিত্র্যময় ভূমি এবং আবহাওয়ার কারণে ইরানে পর্যটকের ভিড়ও লেগে থাকে সারা বছর। এশিয়ার বহু দেশ, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা থেকেই আসেন বেশি পর্যটক।
ইউনেস্কোর হিসাব মতে, ইরান বিশ্বের ১০ম প্রধান পর্যটনের দেশ। কেবল ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত স্থান রয়েছে ২৬টি। এই তালিকা ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে। গত ২৭ জুলাই ইরানের উরামানাত সাংস্কৃতিক ভূদৃশ্যকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানসমূহের তালিকায় যুক্ত করেছে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংষ্কৃতি সংস্থা ইউনেসকো। ১ লাখ ৬ হাজার হেক্টর ভূখ-ের উরামানাতে কয়েকশ গ্রাম রয়েছে। এর চারপাশ ঘিরে রয়েছে আরও ৩ লাখ ৩ হাজার হেক্টরের দৃষ্টিনন্দন সম্পত্তি। চীনের ফুঝুতে ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির ৪৪তম অধিবেশনে স্থানটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
সারভাবাদ কাউন্টির ঢালে ছড়িয়ে থাকা উরামানাত ভূদৃশ্যের কিছু অংশ কোরদেস্তান ও কিছু অংশ কেরমানশাহ প্রদেশে পড়েছে। এখানকার সারি সারি ঘরগুলো এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যার নিচের ঘরের ছাদ উপরের ঘরের আঙ্গিনা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বসতিটির অসাধারণ এই বৈশিষ্ট্য দারুণ আকর্ষণ তৈরি করেছে। একই মাসে এক হাজার চারশ কিলোমিটার দীর্ঘ ট্রান্স-ইরানিয়ান রেলপথকেও জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থার (ইউনেসকো) বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির ৪৪তম অধিবেশনে রেলপথটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। চীনের ফুঝুতে এই অধিবেশন চলে ৩১ জুলাই পর্যন্ত।
রেলপথটি ইরানের ব্যাপক উন্নয়নের ক্ষেত্রে একটি টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে। এসব উন্নয়নের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক উন্নয়ন। এমনকি সমসাময়িক বিশ্ব ইতিহাসের স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ সময়ের রাজনৈতিক দিকও এর অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ১৩৯৪ কিলোমিটার দীর্ঘ ট্রান্স-ইরানি রেলপথের চওড়া ১৪৩৫ মি.মিটার। রুটটিতে মোট ৯০টি ওয়ার্কিং স্টেশন আছে। কাস্পিয়ান সাগরের দক্ষিণপূর্বে অবস্থিত তোরকামান বন্দরের উত্তর পয়েন্ট থেকে রেলপথটি শুরু হয়েছে। সারি ও কায়েম-শাহর শহর হয়ে রেলপথটি আলবোর্জ অঞ্চলের পর্বত এলাকায় প্রবেশ করেছে। অনেকগুলো সেতু ও সুড়ঙ্গ বেয়ে তেহরান ও ভারামিন প্লেইনকে সংযুক্ত করেছে ঐতিহাসিক এই রেলপথটি।
দেশটিতে রয়েছে অসংখ্য বাগান। যেগুলো পরিদর্শনে যেকোনো পর্যটকের মন সত্যি ছুঁয়ে যাবে। এ পর্যন্ত দেশটির ৯টি বাগান বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ইউনেস্কোর প্রতিবেদনে ইরানের বাগিচাগুলো সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘এই বাগিচাগুলোর ডিজাইন চারটি আলাদা আলাদা ভাগে বিভক্ত। এগুলোর মাঝখানে রয়েছে পানির ব্যবস্থা যা একদিকে দৃশ্য নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে অপরদিকে বাগানের সজ্জাকৌশল ও স্থাপত্যশৈলীর দিক থেকেও এই পানির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।’ ওই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, ইরানের বাগিচাগুলো কাল্পনিকভাবে বেহেশতের বাগানের অনুসরণে তৈরি করা হয়েছে। এই বিষয়টির প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে, ইরানের বাগিচা নির্মাণ পদ্ধতি ও সজ্জা কৌশলের প্রভাব সুস্পষ্টভাবে ভারত এবং স্পেনের মতো দেশগুলোর বাগিচা তৈরির স্টাইলের ওপর ব্যাপকভাবে পড়েছে। ইউনেস্কো তালিকাভুক্ত ইরানের নয়টি বাগিচা হলো : বাগে পাসারগাড, বাগে এরাম, বাগে চেহেল সুতুন, বাগে ফিন, বাগে আব্বাসাবাদ, বাগে শাযদেহ মহন, বাগে দৌলাতাবাদ, বাগে পাহলাভনপুর এবং বাগে আকবারিয়া। মজার ব্যাপার হলো, এইসব বাগিচা ইরানের বিভিন্ন অঞ্চলে বিচিত্র আবহাওয়াময় পরিবেশে নির্মাণ করা হয়েছে।
তবে ইউনেস্কোর বিশেষজ্ঞগণ স্বীকার করেছেন, অঞ্চলগত বৈচিত্র্য, পরিকল্পনা ও ডিজাইন এবং ইরানের ঐতিহাসিক রীতি ও সাংস্কৃতিক শেকড়গুলো এই মনোনয়নের ক্ষেত্রে যে কাজ করেনি তা নয়। এই বাগিচাগুলো ইতিহাসের বিভিন্ন যুগে গড়ে উঠেছে। সেই হাখামানশী যুগ অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দী থেকে দুই শতাব্দী আগের কাজার শাসনামল পর্যন্ত সময়কালের মধ্যে বাগিচাগুলো তৈরি করা হয়েছে। ইরানিদের বিশ্বাস ও মূল্যবোধের মাঝে বাগিচা সবসময়ই একটি পবিত্র স্থান হিসেবে সম্মানিত ও মর্যাদাময়।
২০১৮ সালে বিশ্বের দ্বিতীয় দ্রুত বর্ধনশীল পর্যটন গন্তব্য হিসেবে ইরানকে স্বীকৃতি দিয়েছে বিশ্ব পর্যটন সংস্থা ইউনাইটেড নেশনস ওয়ার্ল্ড ট্যুরিজম অর্গানাইজেশন (ইউএনডব্লিউটিও)। ২০১৮ সালের ইউএনডব্লিউটিও-এর বার্ষিক প্রতিবেদন মতে, মিসর, নেপাল, জর্জিয়া এবং দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশকে পেছনে ফেলে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করে ইরান। অন্যদিকে, দ্রুত বর্ধনশীল পর্যটন গন্তব্য হিসেবে প্রথম স্থান অর্জন করেছে ইকুয়েডর। প্রতিবেদনে বিশ্বের যেসব দেশের পর্যটন প্রবৃদ্ধি সর্বাপেক্ষা বেশি সেসব দেশের পর্যটন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় তুলে আনা হয়। র‌্যাঙ্কিংয়ে ইরানের পরে রয়েছে মিসরের অবস্থান।
ইরানে বাজার, জাদুঘর, মসজিদ, সেতু, বাথহাউস, মাদ্রাসা, মাজার, গির্জা, টাওয়ার এবং ম্যানসিসের মতো শত শত ঐতিহাসিক স্থান রয়েছে যা বিদেশী পর্যটকদের নিকট বেশ প্রিয়। ২০১৯ সালের ট্র্যাভেল রিস্ক ম্যাপে ‘ইনসিগনিফিকেন্ট’ ক্যাটাগরিতে স্থান পায় ইরান। এই বিভাগের দেশটির সাথে আরও রয়েছে যুক্তরাজ্য, ডেনমার্ক, সুইজারল্যান্ড, নরওয়ে এবং ফিনল্যান্ড। ট্র্যাভেল রিস্ক ম্যাপে পর্যটন গন্তব্যের দিক দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর ঝুঁকির মাত্রা বিশ্লেষণ করে র‌্যাঙ্কিং প্রকাশ করা হয়।
মেডিক্যাল ট্যুরিজমেও ইরান ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে। এখন সারা বছরই বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বহু মানুষ ইরানে আসছেন চিকিৎসার জন্য। বেশিরভাগ রোগী হলেন ব্রিটেন, সুইডেনসহ পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলোর। ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য নীতিতে চিকিৎসা ব্যয় কমানোর ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এ কারণে ইরানে যেকোনো অপারেশনের ব্যয় তুরস্ক, ব্রিটেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক চতুর্থাংশের মতো। তবে গুণগত দিক থেকে এখানকার চিকিৎসা বিশ্বমানের। সেজন্যই বিদেশী রোগীরা ইরানের চিকিৎসার মানের ব্যাপারে সন্তুষ্ট। এছাড়া ইরানি অস্ত্রোপচারকারী চিকিৎসক এবং সাধারণ চিকিৎসকগণ বেশ দক্ষ। বিদেশি সহযোগীরা সবসময়ই তাঁদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। এশিয়ার দেশগুলোর মাঝে মেডিক্যাল ট্যুরিজমের ক্ষেত্রে কঠোর প্রতিযোগিতা চলছে। এই প্রতিযোগিতায় ইরানের অবস্থান বিশ্বের শ্রেষ্ঠ দশটি দেশের মধ্যে রয়েছে। ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় মেডিক্যাল ট্যুরিজমের ক্ষেত্রে এশীয় দেশগুলোর সাথে সহযোগিতা বৃদ্ধি সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষরও করেছে। ইরানে বর্তমানে অন্তত ষাটটি হার্ট অপারেশন কেন্দ্রে ওপেন হার্ট সার্জারি হচ্ছে। ইরানের এই চিকিৎসা সেবা বিশ্বের চিকিৎসকগণকে আকৃষ্ট করছে। কেবল ওপেন হার্ট সার্জারিই নয়, আরো বহু জটিল ও মারাত্মক রোগের চিকিৎসা এখন বেশ উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে করা হচ্ছে। ইরানের স্বাস্থ্যসেবা খাতে প্রায় ৪শ হাসপাতাল চিকিৎসা সেবা দিচ্ছে। যে বিষয়গুলো দেশটিতে পর্যটকদের বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে তা হলো ইরানিদের আতিথেয়তা, থাকা-খাওয়ায় স্বল্প ব্যয়, সহজ ও উন্নত যাতায়াত ব্যবস্থা, অভিজাত ও ঐতিহ্যবাহী হোটেল, এক ভ্রমণে সব মৌসুমের অভিজ্ঞতা লাভের সুযোগ ও লোভনীয় বিভিন্ন খাবারের স্বাদ। সব মিলিয়ে ইরান ভ্রমণপিপাসুদের জন্য হয়ে উঠেছে অন্যরকম এক আকর্ষণের স্থান। ‘২০২৫ ট্যুরিজম ভিশন প্ল্যান’ অনুযায়ী, ইরান ২০২৫ সাল নাগাদ ২ কোটি বিদেশী পর্যটক আকৃষ্টের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। ২০১৪ সালে যেখানে দেশটিতে বিদেশী পর্যটক আগমনের সংখ্যা ছিল ৪৮ লাখ।