سوزن همه را می پوشاند اما خودش لخت است
উচ্চারণ : সূযান হামে রা’ মী পূশা’নাদ আম্মা’ খোদাশ লোখ্ত আস্ত
অর্থ : সূঁই সবাইকে ঢেকে দেয়; (সিলাইয়ের মাধ্যমে মানুষের কাপড় তৈরি করে লজ্জা নিবারণের ব্যবস্থা করে) কিন্তু সে নিজেই নাঙ্গা।
মর্মার্থ : লোকটি মানুষের উপকার সাধন করে, কিন্তু নিজের প্রতি নিজে উদাসীন বুঝাতে এই প্রবাদটি ব্যবহার করা হয়।
سوسه¬ای در کار بودن
উচ্চারণ : সূসেঈ দার কা’র বূদান
অর্থ : ভেতরে কোনো কিন্তু থাকা
মর্মার্থ : কারো কাজ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, তার কারণ পেছনে কারো শয়তানি লুক্কায়িত আছে। নিশ্চয়ই ভেতর থেকে কেউ গোলমাল পাকিয়ে দিচ্ছে।
سیاهی به سیاهی کسی رفتن
উচ্চারণ : সিয়া’হী বে সিয়া’হীয়ে কাসী রাফতান
অর্থ : এক লেজুড় আরেক লেজুড়ের পেছনে যাওয়া
মর্মার্থ : গোপনে কাউকে ফলো করা। কারো তথ্য উদ্ধারের জন্য গোপনে পেছনে লাগা।
سیاهی لشکر بودن
উচ্চারণ : সিয়া’হী লাশকার বূদান
অর্থ : কোনো সেনাদলের লেজুড় হওয়া
মর্মার্থ : সবসময় সেনাদলের পেছনে দৌঁড়ায় ও সুযোগের সন্ধানে থাকে এবং লোকজন যোগাড় করে ধুমধাম করার প্রবণতা আছে এমন লোক বুঝাতে এই প্রবাদটি ব্যবহার করা হয়।
سیاهی لشکر نیاید بکار
یکی مرد جنگی به از صد هزار
উচ্চারণ : সিয়া’হীয়ে লাশকার নয়া’য়াদ বেকা’র
য়্যকী মার্দে জাঙ্গী বে আয সাদ হেযা’র
অর্থ : সেনাদলের লেজুড় দিয়ে কোনো কাজ হবে না
একজন যুদ্ধবাজ হাজার জনের চেয়ে উত্তম।
মর্মার্থ : বিরাট জনসমষ্টির চাইতে একজন গুণী ব্যক্তির মূল্যমান অনেক বেশি বুঝাতে এই প্রবাদটি ব্যবহৃত হয়।
অনুবাদ : আবু আব্দুল্লাহ
All posts by dreamboy

ইরানের জাতীয় সনদ ফেরদৌসির ‘শাহনামা’
ড. মো. কামাল উদ্দিন: মহাকবি আবুল কাসেম ফেরদৌসি ইরানের জাতীয় কবি। ইরানের ঐতিহ্যম-িত জাতীয় ঘটনাবলি ও ইতিহাসকে পুনরুজ্জীবন দান এবং ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের নবদিগন্ত উন্মোচনে ফেরদৌসি ইরানের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি। ফারসি ভাষা ও সাহিত্য যখন আরবি ভাষা ও সাহিত্যের প্রভাবে পশ্চাৎগামী হয়ে পড়ছিল এবং ইরানের জাতীয় ইতিহাস ঐতিহ্য মাত্র কয়েকটি যুগের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে মানব জাতির ইতিহাস থেকে হারিয়ে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই ফেরদৌসি শাহ্নামা রচনার মাধ্যমে মাতৃভাষাকে পুনরুজ্জীবন দান করেন এবং জাতীয় ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে বিশ্বপরিম-লে গৌরবময় আসনে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। শাহ্নামা শুধু কলেবর ও অনন্য বৈশিষ্ট্যের জন্য ফারসি সাহিত্যের সর্ববৃহৎ কাব্যগ্রন্থ নয়; বরং তা বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্ম। শাহ্নামার ভাষা ও সাহিত্য অতি উন্নত প্রকাশভঙ্গী ও মননশীলতার অধিকারী। এ ধারা অনুসরণে পরবর্তীকালে ইরানের বিখ্যাত কবি ওমর খৈয়াম রচনা করেন কালজয়ী রুবাঈয়াত, নিজামি সিকান্দার নামা ও ইউসুফ-জোলেখা, শেখ সাদি গুলিস্তান ও বুস্তান এবং জালাল উদ্দিন রুমি বিশ্ববিখ্যাত মসনবি। বিশ্বের অন্যতম অমর মহাকাব্য ফেরদৌসির শাহ্নামা ইরানের জাতীয় সনদ।
ফেরদৌসি (৯৪০-১০২০) সুলতান মাহমুদের নির্দেশে শাহ্নামা রচনায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন বলে অনেকে মনে করেন। প্রকৃতপক্ষে শাহ্নামা রচনার পরিসমাপ্তি ঘটে ১০১০ সালে। ত্রিশ বছর আগে শাহ্নামা রচনার সূচনা হলে তা এসে দাঁড়ায় ৯৮০ সালের কোনো এক সময়ে। অথচ সুলতান মাহমুদ সিংহাসনে আরোহণ করেন ৯৯৮ সালে, তাই তাঁর নির্দেশে ৯৮০ সালে শাহ্নামা রচনার কোন অবকাশ নেই। যদিও কোনো কোনো ক্ষেত্রে শাহ্নামা রচনার সময়কাল পঁয়ত্রিশ বছর বলে উল্লিখিত হয়েছে। কালজয়ী এ মহান কবি ১০২০ সালে স্বীয় জন্মভূমি তুস নগরীতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
মহাকাব্য শাহ্নামার সূচনা হয় আল্লাহ তাআলার প্রশংসাবাণীর মাধ্যমে। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) ও আসহাবে রাসূলের প্রশংসা, জ্ঞান ও প্রজ্ঞার গুরুত্ব, মানুষ ও মহাবিশ্বের সৃষ্টি রহস্য, শাহ্নামা রচনার প্রেক্ষাপট এবং ইরানের পঞ্চাশ জন বাদশাহর গৌরবময় ইতিহাস ইত্যাকার বিষয়ের সমাহার ঘটে এতে। শাহ্নামার শুরুতেই মহান আল্লাহর প্রশংসায় ফেরদৌসি বলেন,
প্রাণ ও প্রজ্ঞার প্রভুর নামে শুরু করি,
কল্পনা অতিক্রম করতে পারে না তাঁর নামের সীমা।
প্রভু তিনি নামের, প্রভু তিনি স্থানের,
তিনিই আহার্য দান করেন, তিনিই পথ দেখান।
তিনি প্রভু পৃথিবীর ও ঘূর্ণমান আকাশের,
চন্দ্র-সূর্য ও শুকতারা আলো পায় তাঁর থেকে।
বর্ণনা, ইঙ্গিত ও ধারণার ঊর্ধ্বে তাঁর অবস্থান,
চিত্রকরের সৃষ্টির তিনি মূলতত্ত্ব।
জ্ঞানের গুণ বর্ণনা প্রসঙ্গে কবি বলেন,
জ্ঞান যে আহরণ করেছে সেই হয়েছে ক্ষমতাবান
জ্ঞানের দ্বারা জরাগ্রস্ত প্রাণ ফিরে পেয়েছে তার যৌবন।
বিশ্ব-প্রভুর দানের মধ্যে জ্ঞান সবচাইতে মূল্যবান,
জ্ঞানের গুণ-কীর্তন বদান্যতার পথে শ্রেষ্ঠ উপায়ন।
জ্ঞান স¤্রাটদেরও স¤্রাট,
জ্ঞান সম্মানিতগণের অলঙ্কার।
জেনে রাখ, জ্ঞান জীবন্ত ও চিরঞ্জীব,
জেনে রাখ, জ্ঞান জীবনের পুঁজি।
জ্ঞান পথের দিশারী ও হৃদয়-মুক্তকারী,
জ্ঞান হস্তধারণকারী বর্তমানে ও ভবিষ্যতে।
জ্ঞান অন্ধকার ও জড়ত্বকে দান করে আলো ও চলমানতা,
কাল প্রফুল্ল হয় না জ্ঞানের স্পর্শ না পেলে।
শাহ্নামার ঘটনা পরিক্রমা পৌরাণিক কাহিনীর মাধ্যমে শুরু হয় এবং ঐতিহাসিক ঘটনা পরম্পরায় এসে এর পরিসমাপ্তি ঘটে। গবেষকগণ শাহ্নামার ঘটনা প্রবাহকে তিনটি যুগে বিভক্ত করেন। পৌরাণিক বা রূপকথার যুগ: ইরানের প্রথম সম্রাট কিউমারস থেকে এ যুগের সূচনা। তারপর হোশাঙ্গ, তাহমুরস, জামশিদ এবং জোহাকের বর্ণনার পর ফারীদুনের সিংহাসনে আরোহণের মধ্য দিয়ে এ যুগ সমাপ্ত হয়। এ সময়কালে মানুষ খাদ্য ও বস্ত্র অনুসন্ধান, অগ্নি উদ্ভাবন এবং কৃষিকাজ সহ অন্যান্য পেশা উদ্ঘাটনের মাধ্যমে সাফল্যের দ্বার উন্মোচিত করেন। বীরত্বপূর্ণ যুগ: ভাল-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, কল্যাণ-অকল্যাণের দ্বন্দ্ব-সংঘাতের মধ্য দিয়ে এ যুগের সূত্রপাত হয়। সম্রাট কাভের সিংহাসনে আরোহণের সময় থেকে এর সূচনা হয় এবং ইতিহাসের মহাবীর রুস্তমের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এ যুগের পরিসমাপ্তি ঘটে। শাহ্নামার এ অংশটুকুই ইরানিদের শ্রেষ্ঠ সম্পদ, জাতীয় ইতিহাস ঐতিহ্যের বীরত্বগাথা কাহিনীসমূহ অতি চমৎকারভাবে এতে বর্ণিত হয়েছে। ঐতিহাসিক যুগ: সম্রাট বাহমানের সিংহাসনে আরোহণের মাধ্যমে এ যুগের সূচনা হয় এবং সর্বশেষ সাসানী সম্রাট তৃতীয় ‘ইয়াযদেগারদ’ এর পতনের মধ্য দিয়ে শাহ্নামা মহাকাব্যের ঘটনা প্রবাহ সমাপ্ত হয়। এ যুগে এসে বীরত্বপূর্ণ কল্পকাহিনী, অলৌকিক ব্যক্তিবর্গ এবং অস্বাভাবিক কার্যাবলির পরিবর্তে ঐতিহাসিক ও বাস্তব ঘটনাবলি শাহ্নামায় স্থান দখল করে নেয়।
ফেরদৌসি তাঁর শাহ্নামায় ইরানের জাতীয় ইতিহাস ঐতিহ্যকে ধারাবাহিকভাবে কাব্যাকারে সন্নিবেশিত করেন। পাহলভি ভাষার সাথে সাথে ইরানিদের ইতিহাস যখন কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই মহাকবি ফেরদৌসি শাহ্নামা রচনার মাধ্যমে মাতৃভাষা এবং ইতিহাস-ঐতিহ্যকে সুসংহত ও যুগপদভাবে সংরক্ষিত করেন।
শাহ্নামা পৃথিবীর শেষ্ঠ মহাকাব্যগুলোর অন্যতম। প্রাচীন ঐতিহাসিক যুগ থেকে শুরু করে আরবদের ইরান বিজয়ের পূর্ব পর্যন্ত ইরানের গৌরবময় ইতিহাস এতে কাব্যাকারে বর্ণিত হয়েছে। এ কাব্যগ্রন্থ শুধু কল্পকাহিনীতে পরিপূর্ণ নয়, বরং এর অর্থের বৈচিত্র্যময় মানবীয় আবেদন হৃদয়কে আন্দোলিত করে। ইরানের বীরত্বগাথা কাহিনীসমূহ সাহসিকতা, সৌজন্য, স্বদেশ প্রেম এবং আত্মোৎসর্গ করার মানসিকতায় পরিপূর্ণ। শাহ্নামায় ইরানের প্রাচীন সম্রাটদের কীর্তি-কলাপ, আচার-ব্যবহার, সমাজ-সভ্যতা, সমর-কৌশল, শাসন প্রণালি, বিদ্যা-বদান্যতা এবং তৎকালীন লোক-চরিত্র, খেলাধুলা, শিল্প-বিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয় বিশদভাবে আলোচিত হয়েছে। এ ছাড়া তাওহিদ, দর্শন, মানব সভ্যতার ইতিহাস, সামাজিক বিবর্তন ও নৈতিকতার সাথে সম্পৃক্ত বিষয়াবলিও এতে স্থান পেয়েছে। এ সম্পর্কে অ. ঔ. অৎনবৎৎু বলেন: “ঋরৎফধঁংর’ং ঝযধযহধসধয, পড়হংরফবৎবফ নড়ঃয য়ঁধহঃরঃধঃরাবষু ধহফ য়ঁধষরঃধঃরাবষু, রং ঃযব মৎবধঃবংঃ ড়িৎশ রহ চবৎংরধহ ষরঃবৎধঃঁৎব ধহফ ঢ়ড়বঃৎু; রহফববফ, ড়হব পধহ ংধু ঃযধঃ রঃ’ং ড়হব ড়ভ ঃযব ড়িৎষফ’ং ষরঃবৎধৎু সধংঃবৎঢ়রবপবং.”
সোহরাব ও রুস্তমের কাহিনী শাহ্নামার সর্বাপেক্ষা আবেগময় অনুভূতির চিত্র, যা দেশ কাল ও ভৌগোলিক সীমা পরিসীমা অতিক্রম করে মানুষের হৃদয়ে গভীর সহানুভূতির সঞ্চার করে। এমন হৃদয় বিদারক বিয়োগান্ত দৃশ্য বিশ্বসাহিত্যে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। শাহ্নামার মহানায়ক রুস্তম। কবি তাঁকে শৌর্যে-বীর্যে, শক্তিমত্তায়, সুবিবেচনায় ও আড়ম্বরে মহিমান্বিত করে চিত্রিত করেছেন। কিন্তু যুবক বীর সোহরাবের শৌর্যের সামনে তিনি আতঙ্কিত হয়েছেন, অহংকারে জ্বলে উঠে গোপন করেছেন আত্মপরিচয়। এ পাপের শাস্তি বড় নির্মম, বড় হৃদয় বিদারক; রুস্তম পুত্রহন্তা ও আত্মনীপিড়ক হয়ে তাঁর দায়ভার চিরদিন নিজের শিরে বহন করেছেন। সোহরাব রুস্তমের কাহিনী বাংলাদেশে খুবই জনপ্রিয়। বাংলা সাহিত্যে ডি.এল. রায় তাঁর ‘সোহরাব-রুস্তম’ নাটকে হৃদয় বিদারক কাহিনী বেশ চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। নিয়তির উপকরণ হিসেবে এখানে যা ব্যবহৃত হয়েছে তা হচ্ছে রুস্তমের আত্মমর্যাদাবোধ ও সোহরাবের অনুসন্ধিৎসা।
ফেরদৌসি বহুমুখী চরিত্র চিত্রণে ছিলেন দক্ষশিল্পী। পৃথিবীর যে কোন মহাকবির সৃষ্ট চরিত্রের চেয়ে তা সংখ্যায় কম নয়; মানবিক দোষে-গুণে হীন নয়, শৌর্য-বীর্যে খাটো নয় এবং প্রেমে ও সহানুভূতিতে অনুজ্জ্বল নয়। ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়ের পতন এই মূল্যবোধের ভিত্তিতে তিনি এসব চরিত্রের গতিতে মানব জীবনকে সম্পর্ণরূপে আবর্তিত করেছেন। কোন চরিত্রের প্রতিই কবির কোন পক্ষপাতিত্ব নেই; স্রষ্টার মমত্ববোধ ও সহানুভূতি নিয়েই তিনি তাদের অনুসরণ করেছেন। এই অমর সৃষ্টিই ফেরদৌসিকে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ কবিদের সমমর্যাদা দান করেছে। বিশেষত তিনি শাহ্নামার অন্যতম চরিত্র তাহমিনার জন্য পাঠক হৃদয়ে সহানুভুতির অনির্বাণ শিখা প্রজ্বলিত করেছেন।
বীরত্বগাথা কাহিনীতে ভরপুর শাহ্নামার রণক্ষেত্রগুলো বিপুল প্রসার। বড় ভয়াবহ সেই রণক্ষেত্র, সেখানে রক্তের স্রোত প্রবাহিত হয়। সৈন্যদের পদতাড়িত ধুলায় আকাশে মেঘ জমে যায়, তরবারি বিদ্যুতের ন্যায় চমকাতে থাকে, তীর ও বর্শার বারি বর্ষণ শুরু হয়ে যায়। শাহ্নামার প্রাকৃতিক দৃশ্য খুবই মনোরম। সেখানে উপত্যকায় ও উপবনে হরিণদল বিচরণ করে। কোথাও কোথাও স্রোতস্বিনী প্রবাহিত হয়, যা হৃদয় মনকে উচ্ছ্বাসে নাচিয়ে তোলে। অবসানকালে সেনাপতিগণ বিশেষত রুস্তম সেখানে শিকারে মত্ত হয়ে যায়। প্রকৃতপক্ষে মহাকবি ফেরদৌসি স্বীয় সৃজনী প্রতিভা দিয়ে তাঁর মহাকাব্যকে কাব্যরসের সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছে দিয়েছেন।
সাহিত্যের এক বিস্তৃত অংশ জুড়ে রয়েছে নারীর সৌন্দর্য, প্রেমময় অনুভূতি, বৈশিষ্ট্য প্রভৃতি। শাহ্নামায় বর্ণিত নারী চরিত্র খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি নারীর মর্যাদাকে সমুন্নত রেখেছেন তাঁর মহাকাব্যে। ইরানের রাজকন্যা ও অভিজাত কন্যাগণ প্রায়শই প্রেমময়ী ও পবিত্র হতেন। কুটিল ও দুশ্চরিত্রা নারীরা অবশ্যই তাদের পাপের প্রায়শ্চিত্ত ভোগ করত। কুমারী কন্যাগণ গৃহের অভ্যন্তরে অবস্থান করতেন। লজ্জাশীলতা ও ধর্মভীরুতা ছিল তাদের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য।
ফেরদৌসির শাহ্নামা চিরায়ত ফারসি সাহিত্যের এক অনুপম দৃষ্টান্ত। কোরআন, হাদিস ও ইসলামি সাহিত্যের প্রভাব বিশেষভাবে প্রতিফলিত হয়। রূপক উপমা-উৎপ্রেক্ষার সার্থক প্রয়োগ কাব্যশৈলীকে করেছে উন্নত। তিনি দুর্বোধ্য ফারসি শব্দাবলি পরিহার করে সহজ সরল ভাষার প্রয়োগে কাব্যকে আকর্ষণীয় ও সর্বজনীন করে তোলেন। ফলে অন্যান্য কাব্যের তুলনায় শাহ্নামা অধ্যয়নকালে খুব বেশি অভিধানের মুখাপেক্ষী হতে হয় না। আল্লামা ইবনুল আসির তাঁর মাসালুশ শা‘য়ের গ্রন্থের শেষাংশে উল্লেখ করেন, ‘আরবি ভাষা শাহ্নামার ন্যায় ভাবের বিশালতা ও প্রচুর শাব্দিক বিন্যাস উপস্থাপন করতে পারবে না।’ ফেরদৌসি ছিলেন উন্নত নৈতিক চিন্তাচেতনার অধিকারী। বলা যায় ফারসি কাব্যসাহিত্যে ফেরদৌসি হচ্ছেন প্রথম কবি যিনি কাব্য চর্চায় অশালীন শব্দাবলি পরিহার করে একান্ত প্রয়োজনে মার্জিত ভাষার প্রয়োগে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন। তিনি স্বদেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে ফারসি ভাষা ব্যতীত অন্যান্য ভাষা অনেকাংশে বর্জন করেন। ফেরদৌসির শাহ্নামা গবেষণায় প্রতীয়মান হয় যে, তিনি সম্পূর্ণ শাহ্নামায় মাত্র শতকরা চার কিংবা পাঁচ ভাগ আরবি শব্দের প্রয়োগ করেছেন। এমনকি শতকরা দু’ভাগের অধিক আরবি শব্দের সমাহার তাঁর শাহ্নামার ভূমিকায় পরিলক্ষিত হয় না। ফেরদৌসি শাহ্নামা রচনার মাধ্যমে ইরানের ইতিহাস ঐতিহ্যকে পুনরুজ্জীবিত করেন। কবি নিজেই বলেন,
দীর্ঘ ত্রিশ বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে
এ ফারসিগ্রন্থ দ্বারা ইরানকে পুনরুজ্জীবিত করে গেলাম।
শাহ্নামা এক বিশ্ববিশ্রুত মহাকাব্য। শাহ্নামার শব্দ ও ছন্দ মাধুর্য্য সাহিত্যানুরাগী মানুষের হৃদয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে। তিনি ফারসি ভাষায় চমৎকার শব্দ সম্ভার প্রয়োগের মাধ্যমে কাব্য রচনা করে সাহিত্য জগতে এক নবদিগন্ত উন্মোচিত করেন। শাহ্নামার ভাষা ও সাহিত্য মান এত উন্নত যে, পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় তা অনূদিত হয়েছে। বিশেষ করে ইউরোপ ও এশিয়াতে ফেরদৌসির শাহ্নামা খুবই জনপ্রিয়। পাশ্চাত্য গবেষকদের কাছে আজো মহাকাব্য শাহনামা এক বিস্ময়কর শিল্পকর্ম। এ অনবদ্য মহাকীর্তি শাহ্নামার জন্য তাঁকে হোমারের সাথে তুলনা করা হয়ে থাকে। ঝরৎ ডরষষরধস ঔড়হবং এর মতে, “(ঝযধযহধসধ) ধ মষড়ৎরড়ঁং সড়হঁসবহঃ ড়ভ ঊধংঃবৎহ মবহরঁং ধহফ ষবধৎহরহম যিরপয রভ বাবৎ রঃ ংযড়ঁষফ নব মবহবৎধষষু ঁহফবৎংঃড়ড়ফ রহ রঃং ড়ৎরমরহধষ ষধহমঁধমব, রিষষ পড়হঃবংঃ ঃযব সবৎরঃ ড়ভ রহাবহঃরড়হ রিঃয ঐড়সবৎ যরসংবষভ.”
ইরানের ইতিহাস-ঐতিহ্য, ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশে মহাকবি ফেরদৌসির অবদান অপরিসীম। সুনিপুণ শব্দচয়ন, বক্তব্যের গাঁথুনি, প্রবাদ প্রবচন এবং অন্তর্নিহিত অর্থের সমন্বয়ে শাহ্নামা উঁচুমানের সাহিত্যিক বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। ফারসি ভাষাকে সহজ, গতিশীল ও অবিমিশ্র ভাষারূপে উপস্থাপন করে ভাবীকালের কাব্য সাধকগণের জন্য কাব্যচর্চার একটি বিশাল রাজপথ নির্মাণ করেন গিয়েছেন। ঘটনার চিত্র উপস্থাপনায়, দৃশ্য বর্ণনায় এবং অনুভূতি-কল্পণা প্রকাশের ক্ষেত্রে তিনি যে অনবদ্য অবদান রেখেছেন তা পরবর্তীকালের কবিসাহিত্যিকদের জন্য অনুসরণীয়। এ ধারা অনুসরণে পরবর্তীকালে ইরানের বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিক নিজেদেরকে বিশ্বসাহিত্যের গৌরবময় আসনে সমাসীন করতে সক্ষম হন। পৃথিবীতে যতদিন ভাষা, সাহিত্য, সমাজ, সভ্যতা ও সংস্কৃতি টিকে থাকবে ফেরদৌসির শাহ্নামাও ততদিন বিশ্ববাসীর নিকট এক অমূল্য রতœ হিসেবে বিবেচিত হবে। শাহ্নামা পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ মহাকাব্য, ইরানের জাতীয় সনদ।
স্মরণীয় দিবস
১ জুলাই : বিশ্ব হস্তশিল্প দিবস।
৩ জুলাই : ১৯৮৮ সালের এ দিনে পারস্য উপসাগরে মার্কিন রণতরী থেকে পরিচালিত ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইরানি এয়ারবাসের তিন শতাধিক যাত্রী শহীদ হন।
৪ জুলাই : হযরত মাসুমা (আ.)-এর জন্মদিবস। ইরানে কন্যাদিবস।
৫ জুলাই : বিশ্ব কলম দিবস।
৯ জুলাই : ইরানে শিশু-কিশোর সাহিত্য দিবস হিসেবে পালিত হয়।
১২ জুলাই : ইরানে হিযাব ও সতীত্ব দিবস।
১৪ জুলাই : আহলে বাইতের অষ্টম ইমাম রেযা (আ.)-এর জন্মদিবস।
৩১ জুলাই : বিশ্ব স্বেচ্ছায় রক্তদান দিবস।
৩ আগস্ট : আহলে বাইতের প্রথম ইমাম আলী (আ.) এবং নবীকন্যা হযরত ফাতিমা (আ.)-এর বিবাহ বার্ষিকী। ইরানে দিবসটি বিবাহ দিবস হিসেবে উদ্যাপিত হয়।
৫ আগস্ট : ইসলামি মানবাধিকার ও মানবতা দিবস।
৬ আগস্ট : বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুবার্ষিকী।
৮ আগস্ট : ইরানে সাংবাদিক দিবস।
৯ আগস্ট : আহলে বাইতের পঞ্চম ইমাম বাকের (আ.)-এর শাহাদাত দিবস।
১১ আগস্ট : আরাফাত দিবস (৯ যিলহজ)।
*১৯৮১ সালের ৩০ আগস্ট প্রেসিডেন্ট ভবনে গুপ্তঘাতকের পাতা বোমা বিস্ফোরণে শহীদ হন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মুহাম্মাদ আলী রাজাই ও প্রধানমন্ত্রী হুজ্জাতুল ইসলাম ড. জাভাদ বাহোনার। দিবসটি সন্ত্রাসবিরোধী দিবস হিসেবে পালিত হয়।
১২ আগস্ট : ঈদুল আযহা বা কোরবানির ঈদ।
১৭ আগস্ট : নবীবংশের দশম ইমাম আলী নাকী (আ.)-এর জন্মদিবস।
২০ আগস্ট : ঈদ-ই গাদীর দিবস। বিদায় হজ থেকে ফেরার সময় মহানবী (সা.) ১৮ যিলহজ হাজীদের সমাবেশে ইমাম আলীকে মহানবীর ওফাত পরবর্তীকালে উম্মতের মাওলা ঘোষণা করেন।
২১ আগস্ট : ইমাম তাকী (আ.)-এর শাহাদাত দিবস।
*ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান কর্তৃক ঘোষিত বিশ্ব মসজিদ দিবস। *আল্লামা মাজলিসী স্মরণে দিবস।
২২ আগস্ট : নবীবংশের সপ্তম ইমাম মূসা কাযেম (আ.)-এর জন্মদিবস।
২৩ আগস্ট : বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক ও বিজ্ঞানী বু-আলী সীনা স্মরণে দিবস; ইরানে এ দিনটি চিকিৎসক দিবস হিসেবে পালিত হয়।
২৬ আগস্ট : মহানবী (সা.)-এর সাথে খ্রিস্টান পাদ্রিদের মুবাহিলা দিবস।
২৭ আগস্ট : বিশ্ববিখ্যাত চিকিৎসাবিজ্ঞানী যাকারিয়া রাযী স্মরণে দিবস; ইরানে এ দিনটি ওষুধ শিল্প দিবস হিসেবে পালিত হয়। *বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যুবার্ষিকী।
৩১ আগস্ট : ৯ জিলহজ্ব আরাফাত দিবস অর্থাৎ হজ্ব।
১ সেপ্টেম্বর : হিজরি ১৪৪১ সাল শুরু।
৪ সেপ্টেম্বর : বিজ্ঞানী ও দার্শনিক আবু রায়হান বিরুনী স্মরণে দিবস।
১০ সেপ্টেম্বর : পবিত্র আশুরা। ইমাম হোসাইন (আ.)-এর শাহাদাত দিবস। *আয়াতুল্লাহ তালেকানী (রহ.)-এর ওফাত দিবস।
১২ সেপ্টেম্বর : নবীবংশের চতুর্থ ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.)-এর শাহাদাত দিবস।
১৮ সেপ্টেম্বর : ইরানে কবিতা ও ফারসি সাহিত্য দিবস হিসেবে পালিত হয়। কবি সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ হোসাইন শাহরিয়ার স্মরণে দিবস।
২০ সেপ্টেম্বর : বাংলা ভাষার প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক আবুল খায়ের মুসলেহ উদ্দিনের মৃত্যুবার্ষিকী।
২২ সেপ্টেম্বর : ইরাকের সাদ্দাম সরকার এদিনে ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। ইরানের পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধের শুরু।
২৭ সেপ্টেম্বর : বিশ্ব পর্যটন দিবস।
৩০ সেপ্টেম্বর : বিশ্ববিখ্যাত মরমি কবি মওলানা জালালউদ্দিন রূমির (মৌলভী রূমি) জন্মবার্ষিকী।
*ফিলিস্তিনের শিশু-কিশোরদের সাথে সংহতি প্রকাশের জন্য দিবসটি পালিত হয়।

মহাকাশ বিজ্ঞানে ইরানের সাফল্য
সাইদুল ইসলাম : একটি দেশ তথা জাতির উন্নয়নের প্রধান চালিকাশক্তি হচ্ছে জ্ঞান-বিজ্ঞান। এক্ষত্রে যে জাতি যত বেশি এগিয়ে সে জাতি তত উন্নত। বলা হয়ে থাকে, জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ কোন জাতি যেকোন সময় যে কোন কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে সক্ষম। আর এ বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব দিয়েই ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতার নির্দেশে দেশটির বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদরা চরম আত্মত্যাগ ও সাধনার মাধ্যমে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অভাবনীয় সাফল্যের স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। বিশেষ করে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে ইরানের অগ্রগতি আজ সবার নজরে এসেছে। বিজ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রে ইরানের বিজ্ঞানীদের অগ্রগতি সমগ্র বিশ্বের বিজ্ঞানীদের গড় অগ্রগতির চেয়ে ১১ গুণ দ্রুততর (ঋধংঃবংঃ)। ইরানের বিজ্ঞান, গবেষণা ও প্রযুক্তিবিষয়ক মন্ত্রী বলেছেন, সর্ব-সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিশ্বে বৈজ্ঞানিক গবেষণার দ্রুত অগ্রগতি বা প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে ইরান শীর্ষ স্থানে রয়েছে। দেশটির বিজ্ঞানীরা এখন পৃথিবীর গ-ি পেরিয়ে মহাকাশ গবেষণার ক্ষেত্রেও একের পর এক সাফল্যের স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। বর্তমানে মহাকাশ শক্তিতে মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশটি পশ্চিম এশিয়ায় শীর্ষে এবং বিশ্বের শীর্ষ ১১টি দেশের তালিকায় রয়েছে। আর স্যটেলাইট নির্মাণে বিশ্বের শীর্ষ নয় দেশের মধ্যে রয়েছে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান। এক্ষেত্রে আমেরিকা, রাশিয়া, কানাডা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের কয়েকটি দেশের পরেই রয়েছে দেশটির অবস্থান। ইরানের মহাকাশ গবেষণা সংস্থার প্রধান মোরতেজা বারারি এই তথ্য জানিয়েছেন। মধ্যপ্রাচ্যে বৈজ্ঞানিক কর্তৃপক্ষে ইরান প্রথম অবস্থানে রয়েছে উল্লেখ করে বারারি বলেন, ২০১৬ সালে মহাকাশ প্রকৌশলে তাঁর দেশ বিশ্বে ১৪তম অবস্থানে ছিল। অবস্থার উন্নতি হয়ে ২০১৭ সালে র্যাঙ্কিংয়ে ১১তম অবস্থানে উঠে আসে দেশটি। একদিন এই বৈজ্ঞানিক অগ্রগতিতে একই সাথে প্রযুক্তিগত, শিল্প ও অর্থনৈতিক কর্তৃপক্ষ হিসেবেও পরিগণিত হতে পারে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। ওই কর্মকর্তার তথ্য মতে, ২০০৬ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে বিশ্বে পরিপূর্ণ মহাকাশ প্রযুক্তিচক্র সম্পন্ন করা প্রথম নয় দেশের তালিকায় স্থান করে নেয় ইরান।
বারারি জানান, তাঁর দেশের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা পরিচালিত প্রকল্পগুলোর মধ্যে আমির কবির ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (এইউটি) স্যাটেলাইট প্রকল্পটি বর্তমানে উদ্বোধনী পর্যায়ে রয়েছে। বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যে এইউটির স্যাটেলাইটটি চারটি ক্যামেরায় সুসজ্জিত করা হয়েছে। এর রয়েছে তথ্য জমা করার ক্ষমতা। এক সাথে এতে ৪৫ জন ব্যবহারকারীর মধ্যে যোগাযোগ বজায় রাখার সুবিধা রয়েছে। এদিকে, আমির কবির ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির প্রেসিডেন্ট সৈয়দ আহমাদ মোতামেদি জানিয়েছেন, ইরান পৃথিবীর কক্ষপথে ৫শ’ কিলোমিটার পর্যন্ত উচ্চতায় উচ্চ মানসম্পন্ন স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণে সক্ষম। রাজধানী তেহরানে অনুষ্ঠিত একটি বৈঠকে তিনি বলেন, ‘আমরা ৫শ’ কিলোমিটার উচ্চতায় স্যাটেলাইট পাঠাতে সক্ষম এবং আমরা আন্তর্জাতিক মানদ-ের ভিত্তিতে স্যাটেলাইট তৈরি করতে পারি।’
ইরানের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা আইএসএ-এর প্রধান মোরতেজা বারারি গত ডিসেম্বরের মাঝামাঝি জানিয়েছিলেন, তাঁর দেশ আগামী কয়েক বছরের মধ্যে দেশীয় প্রযুক্তিতে একটি টেলিযোগাযোগ স্যাটেলাইট তৈরির পরিকল্পনা করছে। তিনি জানান, আইএসএ-এর পরিকল্পনার তালিকায় এটি একেবারে উপরে রয়েছে। টেলিযোগাযোগ স্যাটেলাইটটি নির্মাণে ইরান ইতোমধ্যে প্রাথমিক পদক্ষেপ নিয়েছে বলেও জানান তিনি।
ইরানের জাতীয় মহাকাশ কেন্দ্রের প্রধান মানুচেহর মানতেকি বলেছেন, অত্যাধুনিক মহাকাশ প্রযুক্তিতে ইরানি বিজ্ঞানীদের সাফল্য প্রশংসনীয়। মার্কিন নিষেধাজ্ঞা এ ক্ষেত্রে কোন প্রভাব ফেলতে পারে নি। কেননা, ১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লবের বিজয়ের পর থেকেই ইরানের মহাকাশ শিল্প ও কেন্দ্রসমূহ নিষেধাজ্ঞা মোকাবিলা করে আসছে। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইরানি এসব প্রতিষ্ঠানের অগ্রগতি ঠেকাতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। তবুও অগ্রগতি থামাতে পারে নি। তবে এই সময়ে একই ধরনের সমস্যা দেশকে শতভাগ স্বনির্ভর হতে আরও সাহায্য করেছে। নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরান দেশীয়ভাবে স্যাটেলাইট নির্মাণে সক্ষমতা অর্জন করেছে বলে তিনি জানান। সম্প্রতি ইরানের মহাকাশ সংস্থা আইএসএর প্রধান মোরতেজা বারারি জানান, তাঁর দেশ শিগগিরই কক্ষপথে নতুন তিনটি স্যালেটাইট পাঠাবে। পূর্ণাঙ্গ মহাকাশ প্রযুক্তি বলয়ে তেহরানের প্রবেশ ঠেকাতে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ব্যর্থ হয়েছে বলেও জানান তিনি। মহাকাশ গবেষণাভিত্তিক এন্টারপ্রেনিউরশিপের ওপর একটি বৈঠকে বারারি তাঁর দেশের মহাকাশ ও মহাকাশ প্রযুক্তিতে অর্জনগুলো তুলে ধরেন। এই কর্মকর্তা স্মরণ করিয়ে দেন, ইরান গত বছর দুটি স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করেছে। চলতি ইরানি বছরের শেষ নাগাদ কক্ষপথে নতুন আরও তিনটি স্যাটেলাইট পাঠাতে তেহরান প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এরই মধ্যে দেশটি একটি কৃত্রিম উপগ্রহ নির্মাণের কাজ শেষ করেছে এবং আরো দুটি কৃত্রিম উপগ্রহ মহাকাশে পাঠানোর চূড়ান্ত প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। ইরানে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব সংঘটিত হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, তেহরান মহাকাশ সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তির ওপর ভিত্তি করে নতুন ৫ লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য যা যা করার তার সব প্রচেষ্টাই চালাচ্ছে।
গত মাসে বিশ্বব্যাপী বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণাকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহের বিজ্ঞানভিত্তিক মূল্যায়ন প্রতিষ্ঠান স্কিমাগো ইনস্টিটিউশন র্যাঙ্কিং একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, ২০১৮ সালে মহাকাশ প্রকৌশল উন্নয়নে মধ্যপ্রাচ্যে প্রথম স্থানে রয়েছে ইরান। মহাকাশ প্রকৌশল হচ্ছে বিমান ও মহাকাশ যান নির্মাণ সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলের প্রাথমিক ক্ষেত্র। এর দুটি বড় শাখা রয়েছে- বিমান প্রকৌশল ও মহাকাশ প্রকৌশল। প্রতিবেদন মতে, মহাকাশ প্রকৌশলে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে ইরান শীর্ষ স্থানে। আন্তর্জাতিক পেপারে দেশটির ৪৮৬টি নথি, ৪৪১টি উল্লেখযোগ্য দলিল ও ৫১৬টি উদ্ধৃতি স্থান পেয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ইরান ২০১৮ সালে মহাকাশ প্রকৌশলে তুরস্ক, ইসরাইল, সৌদি আরব, মিসর, ইরাক, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও জর্ডানকে পেছনে ফেলেছে।
২০০৯ সালে ইরান প্রথম উমিদ বা আশা নামের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠিয়েছিল। ইরানের নিজস্ব প্রযুক্তি দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল ‘উমিদ’। এ ছাড়া দেশটি প্রাণীবাহী মহাকাশযান প্রথম পাঠিয়েছিল ২০১০ সালে। এ মহাকাশযান পাঠানোর জন্য কাভোশগার (অভিযাত্রী)-৩ নামের রকেট ব্যবহার করা হয়েছিল।
২০১৫ সালে ‘ফজর’ বা উষা নামে কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠায় মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশটি। এটি উঁচুমানের ছবি ধারণ করতে এবং তা পৃথিবীর উপগ্রহ কেন্দ্র পাঠাতে পারে। ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইরান নিজ দেশে তৈরি ‘নাহিদ-১’ ও ‘আমির কবির’ নামে দুটি স্যাটেলাইট উন্মোচন করে। সেই সাথে প্রথমবারের মতো দেশে তৈরি স্পেস টাগ উৎক্ষেপণ করে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান।
‘নাহিদ-১’ হচ্ছে টেলিযোগাযোগ স্যাটেলাইট। এটি নির্মাণ করা হয় ইরানের মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রে। আর ‘পায়াম-ইয়ে আমির কবির’ স্যাটেলাইটের নকশা ও নির্মাণ কাজ করা হয় আমির কবির ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজিতে। এটি নিখুঁতভাবে ছবি তুলতে সক্ষম। উল্লিখিত সময়ে ইরানে প্রথমবারের মতো ‘সামান-১’ নামে স্পেস টাগ নির্মাণ করা হয় যেটি স্যাটেলাইটকে লো আর্থ অর্বিট (এলইও) থেকে হায়ার-এনার্জি অর্বিটে রূপান্তরিত করতে ব্যবহার করা হয়।
ইরানের জাতীয় মহাকাশ কেন্দ্রের প্রধান মানুচেহর মানতেকি গত অক্টোবরে ঘোষণা দিয়েছিলেন, মহাকাশে প্রথমবারের মতো মানুষ পাঠাতে রাশিয়াকে সহযোগিতা করার পরিকল্পনা করছে ইরান। তেহরানে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, মহাকাশে মানুষ পাঠাতে প্রচুর অর্থ ব্যয়ের প্রয়োজন হয় এবং বিভিন্ন দেশ এক্ষেত্রে একে অপরের সম্ভাবনাকে ব্যবহার করে থাকে। বর্তমানে রাশিয়ার মানুষ পাঠানোর প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি এই মিশনে রাশিয়াকে আমরা সহযোগিতা করব। ইরান এর আগে কক্ষপথে ‘সিমোর্ঘ’ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করে।
এদিকে, ইরানের যোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী মোহাম্মাদ জাভেদ আজারি জাহরোমি বলেছেন, দেশের মহাকাশ কর্মসূচি আরও জোরদার করতে ইরানের উত্তরাঞ্চলে মহাকাশ প্রযুক্তি পার্ক প্রতিষ্ঠা করা হবে। জাহরোমি জানান, ইরানের যে স্যাটেলাইটটি বর্তমানে উদ্বোধনী পর্যায়ে রয়েছে তার নকশা ও নির্মাণ কাজ করেছে আমির কবির ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি (এইউটি)। আর ‘জাফর’ স্যাটেলাইটের নকশা ও নির্মাণ কাজ করেছে ইরান ইউনিভার্সিটি অব সাইন্স অ্যান্ড টেকনোলজি। ‘জাফর’ স্যাটেলাইট ২৩ আগস্ট সরবরাহ করা হবে। তিনি আরও ঘোষণা দেন, ইরানের প্রথম মহাকাশ প্রযুক্তি পার্ক মাজান্দারান প্রদেশে নির্মাণ করা হবে। তিনি বলেন, মহাকাশ ব্যবসার বিকাশে দেশে প্রথম স্পেস টেকনোলজি পার্ক নির্মাণ করা হচ্ছে। মহাকাশ প্রযুক্তিতে সক্রিয় সব কোম্পানি এই পার্কে অংশ নেবে। এরই মধ্যে ইরান একটি ইলেকট্রো-ম্যাগনেটিক কম্প্যাটিবিলিটি (ইএমসি) টেস্টিং ল্যাবসহ মহাকাশ প্রযুক্তিতে দেশীয়ভাবে তিনটি অর্জন উন্মোচন করেছে। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে এগুলো উন্মোচন করা হয়।
ইরান মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান হোসেইন সামিমি বলেন, মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান মিশন হচ্ছে গবেষণা করা। এজন্য সবার আগে প্রয়োজন বিশেষায়িত ইএমসি ল্যাব। যা ইতোমধ্যে উন্মোচন করা হয়েছে এবং সেই সাথে একটি রেডিও টেলিস্কোপ সিস্টেম ও একটি স্যাটেলাইট সিমুলেশন সফ্টওয়্যার (এসআরআই) উন্মোচন করা হয়েছে। সামিমি ব্যাখ্যা করে বলেন, স্যাটেলাইট ডিজাইনের ক্ষেত্রে এসআরআই একটি কার্যকর হাতিয়ার। ইরানের মহাকাশ সেক্টরের সকল বিশেষজ্ঞ এটি ব্যবহার করবেন।
এদিকে, সাইবারস্পেস প্রযুক্তিতে বিশ্বে সক্রিয় শীর্ষ দশ দেশের তালিকায় রয়েছে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান। মিউজিয়াম অব ইসলামিক রেভুলিউশন অ্যান্ড হলি ডিফেন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলি আসকার জাফরি এই তথ্য জানিয়েছেন। ‘হলি ডিফেন্স অ্যান্ড রেজিস্টেন্স ইন সাইবারস্পেস’ অ্যাক্টিভিস্টদের এক সেমিনারে তিনি এই তথ্য জানান। আসকার বলেন, সম্প্রতি শহীদদের জানাযায় জনগণ আবারও দেখিয়ে দিয়েছে শহীদদের মানুষ কখনও ভুলে যায় না, তাঁরা সবসময়ই মানুষের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করেন। তিনি তরুণ প্রজন্মের পবিত্র প্রতিরক্ষার মূল্যবোধ সুরক্ষা ও সংরক্ষণের গুরুত্ব তুলে ধরে বলেন, ইসলামি বিপ্লব ও পবিত্র প্রতিরক্ষার মহিমান্বিত মূল্যবোধের সুরক্ষায় সাইবারস্পেস একটি যুৎসই সুযোগ।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ইসলামি ইরানের বিজ্ঞানীরা মহাকাশ প্রযুক্তিতে এতটা অগ্রসর হয়েছেন যে, তাঁদের দৃঢ় ইচ্ছা ও সংকল্পের সুবাদে ইসলামি এই দেশ মহাকাশে কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠাতে সক্ষম হয়েছে। মহাকাশে কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠানোর ক্ষেত্রে ইরান বিশ্বের নবম দেশ হওয়ার গৌরবের অধিকারী। ইরানের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা দশ বছরের প্রচেষ্টা ও গবেষণার পর এই সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হয়। বর্তমানে ইসলামি ইরান মহাশূন্য গবেষণায় মধ্যপ্রাচ্যে প্রথম স্থানে এবং বিশ্বে একাদশতম অবস্থানে রয়েছে। ইসলামি ইরান মহাশূন্যে বানরসহ জীবন্ত নানা প্রাণী পাঠানোর পরীক্ষায় সফল হয়েছে। দেশটি অদূর ভবিষ্যতে মহাশূন্যে মানুষ পাঠানোর কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য জোর তৎপরতা শুরু করেছে। যা দেশটির মহাকাশ গবেষণায় অভাবনীয় সাফল্যেরই স্বাক্ষর বহন করে। ইরানের বর্তমান সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ীর মতে ইসলামি বিপ্লবের ফলে সৃষ্ট পরিবেশে ইরানি বিজ্ঞানীদের আত্মবিশ্বাস জোরদার হওয়ার কারণেই তাঁরা এমন সাফল্য পাচ্ছেন।
সূত্র: মেহর নিউজ, ফার্স নিউজ, পার্সটুডে, প্রেসটিভি, তেহরান টাইমস, ইরনা
ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের তালিকাভুক্ত ইরানের ২৪টি স্থান
জাতিসংঘ শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা বা ইউনেস্কো ইরানের মোট ২৪টি স্থানকে বিশ^ ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে তালিকাভুক্ত করে যেগুলোর ২২টি সাংস্কৃতিক ও ২টি প্রাকৃতিক স্থান। নিচে এই স্থানগুলো সম্পর্কে সংক্ষেপে বর্ণনা করা হলো।
আর্মেনিয়ান আশ্রম বা চার্চ (২০০৮)
ইরানের পশ্চিম আযারবাইজান প্রদেশে এর অবস্থান। এটি ইরানের বিশ^ ঐতিহ্য তালিকার অন্যতম স্থান। ইউনেস্কো কর্তৃক স্বীকৃত এই অঞ্চলের মোট আয়তন হলো ১২৯ হেক্টর। আর্মেনিয়ান আশ্রম হলো সপ্তম এবং চতুর্দশ শতকে নির্মিত তিনটি আশ্রম বা চার্চের সমষ্টি। এ তিনটি চার্চের নাম হলো সেইন্ট থাডুয়েস চার্চ, চ্যাপেল অব যার্ডযার এবং সেইন্ট স্টেপানোস চার্চ।
এই চার্চগুলোর সংস্কার কাজ করায় এগুলো উত্তমরূপে সংরক্ষিত হয়েছে। এগুলো আর্মেনিয়ান স্থাপত্যশৈলীর শক্তিশালী গুণমান এবং সাজসজ্জাগত ঐতিহ্যকে উপস্থাপন করে। উপরন্তু এটি ইরানের এই অংশে আর্মেনিয়ান সংস্কৃতির বিস্তারকেও প্রকাশ করে।
বাম নগরীর সাংস্কৃতিক ভূদৃশ্য (২০০৪)
২০০৪ সালে ইউনেস্কোর বিশ^ ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয় বাম নগরীর রোদে পোড়া মাটি দ্বারা তৈরি বিশে^র সর্ববৃহৎ দালান। এই দালানটি প্রাচীন সিল্ক রোড বা রেশম পথের সন্নিকটে প্রকা- দুর্গ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। ইতিহাসবিদদের অভিমত অনুসারে এটি হাখামানেশী সা¤্রাজ্যের সময়ে নির্মিত হয়ে থাকতে পারে। সপ্তম থেকে একাদশ শতাব্দীতে এই দুর্গটি রেশম পথের বাণিজ্য রুটে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাম নগরীর পুরো এলাকাটি একটি বৃহদাকার দুর্গের মতো যার অন্তর্ভুক্ত ছিল এই দালানটি।
২০০৩ সালে ইরানে সংঘটিত ভূমিকম্পে এই দালানটি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়। পরে ইরান সরকার তা পুনঃনির্মাণ করে।
বিসোতুন (২০০৬)
বিসোতুন হলো ইরানের আরেকটি সাংস্কৃতিক স্থান যা ইউনেস্কোর বিশ^ ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত হয়েছে। এটি কেরমানশাহ প্রদেশে অবস্থিত। এটি ২০০৬ সালে ইউনেস্কোর তালিকাভুক্ত হয়।
বিসোতুন বহুভাষী শিলালিপি এবং বেহিসতুন পাহাড়ের ঢালে বড় বড় পাথরের ওপর উৎকীর্ণ খোদাই কাজের জন্য সর্বাধিক প্রসিদ্ধ। বিশেষজ্ঞগণ পাথরের গায়ে খোদাই করা কুনোফর্ম স্ক্রিপ্টের পাঠোদ্ধারকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন। এসব শিলালিপির উচ্চতা ১৫ মিটার এবং প্রস্থ ২৫ মিটার। আর এগুলো চুনাপাথরের পাহাড়ি ঢালে ১০০ মিটার পর্যন্ত উঁচুতে অবস্থিত।
গোলেস্তান প্রাসাদ (২০১৩)
ইরানের রাজধানী তেহরানে গোলেস্তান প্যালেসের অবস্থান। এটিও ইউনেস্কোর তালিকাভুক্ত ইরানের অন্যতম ঐতিহ্য নিদর্শন যা ২০১৩ সালে ইউনেস্কোর বিশ^ ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান লাভ করে। গোলেস্তান প্রাসাদ ছিল প্রাচীন কাযার রাজার বাসভবন। এটি তেহরান শহরের অন্যতম প্রাচীন ঐতিহাসিক নিদর্শন। এটি প্রাচীর দ্বারা পরিবেষ্টিত কয়েকটি গুচ্ছ দালানের সমন্বয়ে দুর্গের আকারে নির্মিত। প্রাচীরের অভ্যন্তরে রাজপ্রাসাদ ও অন্যান্য অবকাঠামো রয়েছে, আর রয়েছে ইরান ও ইউরোপের নানা ধরনের কারুশিল্পের সংগ্রহ (যেগুলোর কয়েকটি ১৮ থেকে ১৯ শতকের) এবং অনেকগুলো বাগান।
কাবুস মিনার (২০১২)
ইরানের এই ঐতিহাসিক নিদর্শনটি ২০১২ সালে ইউনেস্কোর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়। এই নিদর্শনটি ৭২ মিটার উঁচু যা কাবুস মিনারের কেন্দ্রীয় অংশে অবস্থিত। মিনারটি পাকা ইটের তৈরি এবং দশকোণী আকৃতির। তবে মিনারটির ছাদ মোচাকৃতির এবং স্বর্ণালি অনুপাত ‘ফি’ (গোল্ডেন র্যাশিও ফি) অনুযায়ী ডিজাইনকৃত। এই মিনারের অভ্যন্তরভাগের নকশা মুকারনা অলংকারশৈলীর সর্বোৎকৃষ্ট নমুনা। স্থাপত্যটি ৩ মিটার পুরু দেয়াল ও দশ কোণবিশিষ্ট। এই মিনারটি এমনভাবে স্থাপত্য ও বৈজ্ঞানিক ডিজাইনের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছে যে, এর সামনের দিক থেকে আপনি আপনার কণ্ঠস্বরের প্রতিধ্বনি শুনতে পাবেন। এই মিনারটি ১০০৬ খ্রিস্টাব্দে নির্মাণ করা হয়েছে। উজবেক আমীর শামস-উল মা’লী কাবুস ইবনে ওয়াশ্মগীরের নির্দেশে এটি নির্মাণ করা হয়।
লূত মরুভূমি (২০১৬)
২০১৬ সালে এটি ইউনেস্কোর বিশ^ ঐতিহ্যবাহী স্থানের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়। লূত মরুভূমি ইউনেস্কোর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত ইরানের দুটি প্রাকৃতিক নিদর্শনের অন্যতম। এই মরুভূমির সংরক্ষিত এলাকার আয়তন ২.২ মিলিয়ন হেক্টর। এটি দাশ্তে লূত নামেও পরিচিত। এই লবণ মরুভূমি আয়তনের দিক থেকে বিশে^ ২৫তম। এটি বিশে^র সবচেয়ে উত্তপ্ত ও শুষ্ক বালুময় স্থানগুলোর একটি, যার গড় তাপমাত্রা ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
ইসফাহানের জামে মসজিদ (২০১২)
৭৭১ খ্রিস্টাব্দে ইসফাহানের জামে মসজিদ নির্মিত হয় এবং বিংশ শতাব্দীর শেষভাগ পর্যন্ত অনেকবার এর পুনঃনির্মাণ, সংস্কার ও সম্প্রসারণের কাজ সম্পন্ন হয়। এটি ২০১২ সালে ইউনেস্কোর বিশ^ ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত হয়। ইরানের দীর্ঘস্থায়ী ও প্রাচীনতম মসজিদগুলোর অন্যতম হওয়ায় এটি বিশ^ ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান লাভ করে। এটি মসজিদ নির্মাণের ক্ষেত্রে ইরানে ব্যাপকভাবে প্রচলিত চুতষ্কোণীয় আইভান স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত।
ম্যায়মান্দ সাংস্কৃতিক ভূদৃশ্য (২০১৫)
এই সাংস্কৃতিক গ্রাম হলো ইরানের আরেকটি বিশ^ ঐতিহ্যবাহী সম্পত্তি যা ম্যায়মান্দ পল্লি জেলার একটি অংশ। ২০০৬ সালে এই গ্রামের জনসংখ্যা ছিল সাতশ’ এর চেয়েও কম (যা ১৮১টি পরিবারের সমান বলে হিসেব করা হয়)। এটি ইরানের কেরমান প্রদেশের একটি প্রাচীন গ্রাম এবং এ অঞ্চলকে ইরানের প্রাচীনতম মানব বসতির স্থান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ইতিহাসবিদগণ মনে করেন, মানুষজন ১২০০০ বছর আগে থেকে এই গ্রামে বসবাস করে আসছে। গ্রামটির বাড়ি-ঘরগুলো হাত দিয়ে পাথর কেটে কেটে নির্মাণ করা হয়েছে। এখানে ১০০০০ বছর পূর্বেকার খোদাই করা পাথরও রয়েছে।
ইমাম ময়দান, ইসফাহান (১৯৭৯)
ইমাম ময়দান হলো ১৯৭৯ সালে ইউনেস্কো কর্তৃক তালিকাভুক্ত ইরানের প্রথম কয়েকটি বিশ^ ঐতিহ্যবাহী স্থানের অন্যতম। এটি সপ্তদশ শতকের সূচনালগ্নে প্রথম শাহ আব্বাসর নির্দেশে নির্মাণ করা হয়। এর কাঠামোটি ভবন দ্বারা বেষ্টিত যা দুই তলাবিশিষ্ট খিলান দ্বারা সংযুক্ত। এই ভূসম্পত্তির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নিদর্শনগুলো হলো শেখ লুতফুল্লাহ মসজিদ, কায়সারিয়েহ চত্বর এবং রাজকীয় মসজিদ। এ নিদর্শনগুলো ইরানের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্তস্বরূপ।
পাসারগাদ (২০০৪)
এই প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান ইউনেস্কোর বিশ^ ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত ইরানের অন্যতম স্থান। এটি হাখামানশী সা¤্রাজ্যের রাজধানী হিসেবে ব্যবহৃত হতো- যা সাইরাস দ্য গ্রেটের নির্দেশে তৈরি করা হয়েছিল। ৫৪৬ খ্রিস্টাব্দে এই রাজধানী গড়ে ওঠে, কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে সাইরাস দ্য গ্রেটের নিহত হওয়া পর্যন্ত এর নির্মাণকাজ অসমাপ্ত অবস্থায় রয়ে যায়। বর্তমানে পাসারগাদের সাইরাস দ্য গ্রেটের সমাধিক্ষেত্র এই অঞ্চলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন। এই সমাধিক্ষেত্র পাথর ও মাটি দিয়ে নির্মিত।
পারসেপোলিশ (১৯৭৯)
পারসেপোলিশ ছিল খ্রিস্টপূর্ব ৫৫০ থেকে ৩৩০ অব্দ পর্যন্ত পারস্যের হাখামানশী সা¤্রাজ্যের রাজধানী। এটি ইরানের শিরাজ প্রদেশের উত্তর-পূর্ব দিকে অবস্থিত। বর্তমানে যেসব পর্যটক এই প্রাচীন নগরী পরিদর্শনে আসবেন তাঁরা হাখামানশী স্থাপত্যের রয়ে যাওয়া নিদর্শন দেখবেন যা রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠার সমসাময়িককালেই গড়ে উঠেছিল। যেহেতু এই ধ্বংসপ্রাপ্ত স্থাপনা ইরানের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অংশ সেহেতু সাংস্কৃতিক গুরুত্বের কারণে ইউনেস্কো কর্তৃক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত হয়।
পার্সিয়ান গার্ডেন অব ইরান (২০১১)
পার্সিয়ান গার্ডেন অব ইরান ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ^ ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত ইরানের একটি সাংস্কৃতিক স্থান যা ২০১১ সালে তালিকাভুক্ত হয়। পারস্যের ঐতিহ্যগত বাগান ডিজাইন ও স্টাইল ব্যবহারের কারণে বাগানটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ভারতীয় বাগান ডিজাইন থেকে শুরু করে স্পেনের আন্দালুসিয়ার বাগান ডিজাইন দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে এই বাগানের ডিজাইন তৈরি করা হয়। প্রকৃতপক্ষে স্পেনের আলহামরার বাগানগুলোর সাথে পার্সিয়ান গার্ডেনের ব্যাপক সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়।
পার্সিয়ান কানাত অব ইরান (২০১৬)
এই সাংস্কৃতিক নিদর্শন ইউনেস্কোর তালিকাভুক্ত ইরানের আরেকটি নিদর্শন। এই নিদর্শনটি হলো একটি স্বল্প ঢালবিশিষ্ট খাল যা একটি কূপ থেকে পানি সরবরাহের জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এখান থেকে প্রাপ্ত পানি পানীয় হিসেবে এবং চাষাবাদের জন্য ব্যবহার করা হয়। এটি পানি সরবরাহের জন্য ইরানের একটি প্রাচীন পদ্ধতি যা পারসিকদের দ্বারা খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ অব্দে আবিষ্কার করা হয়েছিল। বর্তমানেও এই অঞ্চলের লোকদের পানি সরবরাহের জন্য এই পদ্ধতি চালু রয়েছে।
শাহর-ই সোখতেহ (২০১৪)
এটি ইরানের ইউনেস্কো বিশ^ ঐতিহ্য তালিকার আরেকটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান। এ শহরের নামের আভিধানিক অর্থ হলো পুড়ে যাওয়া শহর। শহরটি তা¤্র যুগে এ অঞ্চলে জনমানুষের বসতি স্থাপনের চিহ্ন বহন করছে- যা তা¤্র সংস্কৃতির সাথে সম্পর্কযুক্ত। এটি ২০১৪ সালে ইউনেস্কোর তালিকায় স্থান পায় যা ইরানের সিস্তান-বালুচিস্তান প্রদেশে অবস্থিত। এই পুড়ে যাওয়া শহরটির উত্থান-পতন সম্পর্কে বেশি কিছু জানা সম্ভব হয় নি।
শেখ সাফিউদ্দিন খানেগাহ এবং আরদাবিলের সমাধি (২০১০)
সমাধিক্ষেত্র ও গম্বুজের সমাহারে গড়ে ওঠা এই স্থানটি মুসলিম সুফিসাধক শেখ সাফিউদ্দিনের সাথে সম্পর্কিত। শেখ সাফিউদ্দিন আরদাবিলে জন্মগ্রহণ করেন এবং তাঁর জন্মস্থানটি এই সমাধিক্ষেত্র ও পুরো কমপ্লেক্সের মাঝেই অবস্থিত। ২০১০ সালে স্থানটি ইউনেস্কোর তালিকাভুক্ত হয়। এ সমাধিক্ষেত্রটি একটি বিশাল কমপ্লেক্সে অবস্থিত যার মধ্যে রয়েছে কমপ্লেক্সটির মূল স্থাপনা, গম্বুজ, দরগা এবং নামাযের স্থান। সাফাভী শাসনামলে বেশিরভাগ অংশ মূল স্থাপনার সাথে সংযুক্ত হয়। চালদিরান যুদ্ধের সময় যারা নিহত হয়েছিল তাদের অনেককে এই স্থানে সমাহিত করা হয়।
শুসতারের ঐতিহাসিক হাইড্রোলিক সিস্টেম (২০০৯)
২০০৯ সালে তালিকাভুক্ত শুসতারের ঐতিহাসিক হাইড্রোলিক সিস্টেম হলো একটি সমন্বিত সেচ ব্যবস্থা যা ইরানের খুজেস্তান প্রদেশের দ্বীপ শহরে অবস্থিত। এটি ইউনেস্কোর তালিকাভুক্ত ইরানের ১০ম স্থান। এই বিশাল অবকাঠামো গড়ে উঠেছে ওয়াটার মিল, খাল, বাধ এবং সুড়ঙ্গ নিয়ে। এই সেচ ব্যবস্থার মূল অবকাঠামো হলো কায়সার বাধ। এর আয়তন ৫০০ মিটার, যা নদী থেকে খালে পানি সরবরাহ করার জন্য ব্যবহার করা হয়। তৃতীয় শতাব্দীতে রোমান কারিগরদের দ্বারা এটি তৈরি করা হয়।
সোলতানিয়াহ (২০০৫)
ইরানের যানযান প্রদেশে অবস্থিত সোলতানিয়াহ ইউনেস্কোর বিশ^ ঐতিহ্যবাহী স্থানের তালিকাভুক্ত আরেকটি স্থান। এটি তেহরানের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত এবং চতুর্দশ শতকে মোঙ্গল ইলখানী শাসকদের রাজধানী হিসেবে একে গড়ে তোলা হয়েছিল। নামটি একজন মুসলিম শাসকের উপাধি থেকে নেয়া হয়েছিল যার অর্থ ‘রাজকীয়’। এই প্রাচীন শহরের বেশ কয়েকটি স্থাপনা শহরটিতে ইলখানী শাসনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। স্থাপনাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো ওলযাইতুর সমাধিক্ষেত্র। এই সমাধিক্ষেত্রটি চতুর্দশ শতকের গোড়ার দিকে তৈরি করা হয়।
শুশা (২০১৫)
এই সাংস্কৃতিক স্থানটি খুজেস্তান প্রদেশে অবস্থিত যা ২০১৫ সালে ইউনেস্কো কর্তৃক তালিকাভুক্ত হয়। এটি হলো আরেকটি প্রাচীন শহর যে শহরকে নিকট-প্রাচ্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রাচীন শহরগুলোর অন্যতম বলে গণ্য করা হয়। বর্তমানে এই প্রাচীন শহরের নাম হলো শুশ যার জনসংখ্যা ৬৫ হাজার।
প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণের ভিত্তিতে বলা যায় যে, খ্রিস্টপূর্ব ৭০০০ অব্দে শুশা শহরে জনমানুষের বসতি গড়ে উঠেছিল। নব্যপ্রস্তরযুগীর গ্রাম হিসেবে গড়ে ওঠা এই প্রাচীন শহরটি অঙ্কিত মৃৎশিল্প সভ্যতার সাথে সম্পর্কিত ছিল। এই স্থানে প্রাপ্ত নিদর্শনসমূহের মধ্যে আঁকা মৃৎশিল্প ছাড়াও আঁকা সিরামিকের পাত্রও রয়েছে।
তাবরীযের ঐতিহাসিক বাজার কমপ্লেক্স (২০১০)
২০১০ সালে তাবরীযের ঐতিহাসিক বাজার কমপ্লেক্স ইউনেস্কোর বিশ^ ঐতিহ্যবাহী স্থানের তালিকাভুক্ত হয়। ইরানের তাবরীয প্রদেশের কেন্দ্রে এই ঐতিহাসিক বাজারটি অবস্থিত। এটি কেবল ইরানের নয়; বরং মধ্যপ্রাচ্যের প্রাচীন ও বৃহৎ বাজারসমূহের অন্যতম। এই ঐতিহাসিক বাজার নির্মাণের আগে প্রাচীনত্বের কারণে তাবরীয শহরটি ইরানের সাংস্কৃতিক বিনিময়ের কেন্দ্ররূপে পরিগণিত হতো। তাবরীয বাজার কমপ্লেক্স ঐতিহাসিক রেশমপথের একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবেও প্রসিদ্ধ ছিল।
তাখতে সোলায়মান (২০০৩)
ইরানের পশ্চিম আযারবাইজান প্রদেশে অবস্থিত এই সাংস্কৃতিক স্থানটি ভূতাত্ত্বিক গুরুত্বের জন্য প্রসিদ্ধ। এই সাংস্কৃতিক স্থান একটি আগ্নেয়গিরির মুখে অবস্থিত এবং একটি সুরক্ষিত স্থানও বটে। দুর্গটি এই স্থানের অধিকাংশ এলাকাজুড়ে অবস্থিত। এখানে রয়েছে সাসানি শাসনামলে নির্মিত জরাথ্রুস্টদের অগ্নিমন্দির। ইলখানীদের শাসনামলে মন্দিরটি পুনর্নিমিত হয়।
চোঘা যানবিল (১৯৭৯)
এই প্রাচীন ইলামী কমপ্লেক্স ইউনেস্কোর বিশ^ ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত ইরানের অন্যতম স্থান। এটি ইরানের খুজেস্তান প্রদেশে অবস্থিত। মেসোপোটেমিয়া অঞ্চলের বাইরে হাতে গোনা যে কয়েকটি প্রাচীন ও বিশাল স্থাপত্য নিদর্শন রয়েছে সেগুলোর অন্যতম হলো এই চোঘা যানবিল। এই সাংস্কৃতিক স্থান খ্রিস্টপূর্ব ১২৫০ অব্দে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, কিন্তু খ্রিস্টপূর্ব ৬৫০ অব্দে তা পরিত্যক্ত হয়। এটি পোড়ামাটি এবং কাদামাটি দিয়ে নির্মিত হয়েছিল। বর্তমানে এ স্থানে প্রাচীন বিশাল স্থাপনার ধ্বংসাবশেষ দেখতে পাওয়া যায়- যা ইউনেস্কো কর্তৃক সংরক্ষিত।
ইয়াযদের ঐতিহাসিক নগরী (২০১৭)
ইয়াযদের ঐতিহাসিক নগরী ইউনেস্কোর বিশ^ ঐতিহ্যবাহী স্থানের তালিকার অন্যতম ইরানি নিদর্শন। এই শহুরে ভূদৃশ্য ঐতিহ্যবাহী মাটিনির্মিত শহর অবকাঠামোর জন্য ইউনেস্কো কমিটির কাছ থেকে স্বীকৃতি অর্জন করে। বিশেষত মরু এলাকার সাথে খাপ খাইয়ে নেয়ার সক্ষমতার জন্য স্থানটি স্বীকৃত। শহরটির অবস্থান প্রাচীন রেশমপথের পাশে। আর তাই বাণিজ্যিক কর্মকা-ের মাধ্যমে এলাকাটি সমৃদ্ধি লাভ করেছিল। এই প্রাচীন নগরীর একটি দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে- যা হাখামানশী সা¤্রাজ্যের সাথে সম্পৃক্ত।
ফার্স অঞ্চলের সাসানি আমলের ভূতাত্ত্বিক স্থান (২০১৮)
ইরানের ফার্স প্রদেশের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত তিনটি ভৌগোলিক এলাকা, যথা: ফিরুযাবাদ, বিশাপুর ও সারভেস্তানে আটটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান রয়েছে। এর সুরক্ষিত অবকাঠামো, রাজপ্রাসাদ এবং নগর পরিকল্পনায় সাসানি শাসনামলের প্রাচীনতম ও নবীনতম স্থাপত্যের নিদর্শন বিদ্যমান যা ২২৪ থেকে ৬৫৮ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত বলে মনে করা হয়। এই স্থানগুলোর মধ্যে রয়েছে সাসানি সা¤্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা আরদেশীর বাবাকানের রাজধানী এবং তাঁর উত্তরসূরি প্রথম শাপুরের সময়ে নির্মিত একটি শহর ও স্থাপত্য কাঠামো। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনসমূহ প্রাকৃতিক ভূসংস্থানের যথাযথ ব্যবহারকে প্রতিফলিত করে এবং ওই সময়ে ইসলামি স্থাপত্যের ওপর উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাব বিস্তারকারী হাখামানশী ও পার্থিয়ান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও রোমান শিল্পকলার প্রভাবের সাক্ষ্য বহন করে।
আক্কাডিয়ান বনভূমি (২০১৯)
আক্কাডিয়ান বনভূমি একটি অনন্য বনভূমি যা কাস্পিয়ান সাগরের উপকূল বরাবর ৮৫০ কিলোমিটার ব্যাপী বিস্তৃত। এই বিস্তৃত বনভূমির ইতিহাস ২৫ থেকে ৫০ মিলিয়ন বছরের পুরানো- যা উত্তরের নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের অধিকাংশ এলাকাজুড়ে বিস্তৃত ছিল। এই প্রাচীন বনভূমি হিমবাহ দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এরপর যখন আবহাওয়া পুনরায় নাতিশীতোষ্ণ হয় তখন আবারোও এই বনভূমি বিস্তৃত হতে শুরু করে। এ বনভূমির জীববৈচিত্র লক্ষণীয়। সংবহনতান্ত্রিক উদ্ভিদের শতকরা ৪৪ ভাগ এই বনভূমিতে রয়েছে। বর্তমানে এই নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে পার্সিয়ান চিতাসহ ১৮০ প্রজাতির পাখি এবং ৫৮ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণীর সন্ধান পাওয়া গেছে।
সংকলন ও অনুবাদ : মো. আশিফুর রহমান
হাজ্বীদের উদ্দেশে রাহ্বার আয়াতুল্লাহ্ সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ীর বাণী
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতা হযরত আয়াতুল্লাহিল উযমা সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ীর হজ্ব-বাণী গত ১০ই আগস্ট (২০১৯) সকালে সর্বোচ্চ নেতার হজ্ব বিষয়ক প্রতিনিধি হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন নাভাব্ ‘আরাফাতের ময়দানে সমবেত হাজ্বীদের উদ্দেশে পাঠ করে শোনান। এখানে রাহ্বারের হজ্ব-বাণীর পূর্ণাঙ্গ বিবরণ তুলে ধরা হলো :
বিসমিল্লাহির রাহ্মার্নি রাহীম।
ওয়াল-হামদু লিল্লাহি রাব্বিল ‘আলামীন ওয়া ছ¡াল্লাল্লাহু ‘আলা রাসূলিহিল্ কারীম্ আল-আমীন্ মুহাম্মাদ খাতামুন্নাবীয়্যীন ওয়া ‘আলা আালিহিল মুতাহ্হিরিন সিয়ামা বাক্বীয়াতুল্লাহি ফীল র্আদিন্ ওয়া ‘আলা আছ¡হাবিহিল মুনতাজাবীন ও মান্ তাবে‘আহুম্ বি-ইহসান ইলা ইয়াওমিদ্দীন্।
প্রতি বছর মুসলিম উম্মাহর প্রতি পরওয়ারদেগার আল্লাহ তা‘আলার রহমতের ফল্গুধারা হয়ে হজ্বের মওসুম আগমন করে। কোরআন মজীদ্ ‘ওয়া আয্যিন ফিন্নাসি বিল-হাজ্ব’ (লোকদের মধ্যে হজ্বে¡র ঘোষণা প্রদান করুন) বলে ইতিহাসের দীর্ঘ পরিক্রমায় এ রহমতের দস্তরখানে আসন গ্রহণ করার জন্য সকলের প্রতি আমন্ত্রণ জানিয়েছে। খোদাপ্রেমিকদের অন্তর এবং চিন্তাশীলদের দৃষ্টি ও চিন্তাশক্তি এ আহ্বানে সাড়া দেয়। প্রতি বছর হজ্ব পালনকারী ব্যক্তিদের মাধ্যমে হজ্বে¡র শিক্ষাগুলো সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।
হজ্বে¡ আল্লাহ্র যিকির ও ইবাদত হলো ব্যক্তি ও সমাজের আধ্যাত্মিক উন্নতির প্রধান উপকরণ, এক সঙ্গে মুসলমানদের সমাবেশ ঐক্যবদ্ধ মুসলিম উম্মাহর প্রমাণ বহনকারী এবং একত্ববাদের কেন্দ্রবিন্দুকে ঘিরে সব বর্ণের মানুষের তাওয়াফ্ ইসলামে বর্ণবৈষম্য না থাকার সুস্পষ্ট প্রমাণ তুলে ধরে। এর ফলে বোঝা যায় যে, ইসলামে বর্ণবৈষম্যের কোনো স্থান নেই এবং এখানে সকলের জন্য সমান সুযোগ অবারিত রয়েছে। আর হজ্বে¡র এ আনুষ্ঠানিকতা বিশাল মুসলিম সমাজের একটি ছোট্ট নমুনা বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরে। ইসলাম বিশ্ববাসীর সামনে আদর্শ মুসলিম সমাজের যে চিত্র তুলে ধরতে চায় ইহরাম, তাওয়াফ, সাঈ, উকূফ, রামী ইত্যাদি হচ্ছে সেগুলোর কিছু খ-চিত্র।
বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে অবস্থিত দেশ ও অঞ্চলসমূহের মানুষের মধ্যে জ্ঞান ও সম্পদের আদান-প্রদান, পরস্পরের খোঁজ-খবর নেয়া, ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটানো এবং অভিন্ন শত্রুর মোকাবিলা করার লক্ষ্যে সকলের সক্ষমতা একত্র করা হচ্ছে হজ্বের অন্যতম বিশাল অর্জন- যা অন্যান্য জমায়েত বা সমাবেশ শত শত বার অনুষ্ঠিত করেও অর্জন করা সম্ভব নয়।
হজ্বে¡র বারাআত (সম্পর্কচ্ছেদ) অনুষ্ঠানটি হচ্ছে নির্যাতিত মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর বলদর্পী ও আধিপত্যকামী শক্তিগুলোর সব ধরনের যুুলুম, নিষ্ঠুরতা, অন্যায় ও অপকর্মের প্রতি ঘৃণা প্রদর্শন এবং সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর বলপ্রয়োগ ও ছাড় আদায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলারই নামান্তর।
আজ র্শিক ও কুফ্রের আস্তানা হিসেবে পরিচিত সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো এবং তাদের নেতা আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্নকরণ নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর ঘাতক ও যুদ্ধবাজদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করারই সমতুল্য। আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার অর্থ হচ্ছে দায়েশ ও মার্কিন ব্ল্যাকওয়াটারের মতো উগ্র সন্ত্রাসবাদীদের নিন্দা জানানো, শিশু হত্যাকারী যায়নবাদী সরকার ও তাকে সাহায্যকারী ও পৃষ্ঠপোষকতা প্রদানকারীদের প্রতি মুসলিম উম্মাহর ঘৃণা প্রকাশ এবং স্পর্শকাতর পশ্চিম এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকা অঞ্চলে আমেরিকা ও তার সহযোগীদের যুদ্ধ বাঁধানোর অপতৎপরতার নিন্দা জানানো। এসব অপশক্তি বিভিন্ন নির্যাতিত জাতির দুঃখ-দুর্দশা ও কষ্টকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে গেছে এবং প্রতিদিনই নানাভাবে তাদের ওপর নির্যাতন ও দমন অভিযান পরিচালনা করছে।
বারাআত অর্থ হচ্ছে ভৌগোলিক সীমানা, বর্ণ ও বংশগত পরিচয়ের ভিত্তিতে সৃষ্ট বৈষম্য ও বর্ণবাদী আচরণের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্নকরণ। সেই সঙ্গে বারাআতের আরেকটি লক্ষ্য হচ্ছে ন্যায়বিচার, সমতা ও সম্মানজনক আচরণের বিপরীতে সাম্রাজ্যবাদী ও মতভেদ সৃষ্টিকারীদের জঘন্য আচরণের প্রতি ঘৃণা প্রদর্শন; কারণ, ইসলাম সকলকে ন্যায়বিচার, সমতা ও সম্মানজনক আচরণের দিকে আহ্বান জানিয়েছে।
এগুলো হচ্ছে হজ্বে ইবরাহীমীর বিশাল বরকতের কিছু ক্ষুদ্র নমুনা যেগুলোর প্রতি প্রকৃত ইসলাম আমাদেরকে আহ্বান জানায়। আর প্রতি বছর বিশ্বের মুসলমানদের অনেকে হজ্বের আনুষ্ঠানিকতা পালন করে যে বিশাল ও অর্থপূর্ণ ইবাদতে শামিল হন তার মাধ্যমে কার্যত তাঁরা সুস্পষ্টভাবে সবাইকে জানিয়ে দেন যে, মুসলিম উম্মাহ্ ঠিক এ রকম একটি সমাজ গঠনের জন্যই যুগ যুগ ধরে অপেক্ষার প্রহর গুণছে।
এ ক্ষেত্রে মুসলিম বিশ্বের দেশসমূহের চিন্তাবিদগণ- যাঁদের একটা অংশ এই মুহূর্তে হজ্বের আনুষ্ঠানিকতায় অংশগ্রহণ করছেন, তাঁদের কাঁধে একটি বিশাল ও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব রয়েছে। হজ্বের এ শিক্ষাগুলো তাঁদের মাধ্যমে মুসলিম বিশে^র আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়া উচিত এবং সাধারণ মুসলমানদেরকে তাঁদের মাধ্যমে আধ্যাত্মিকতার আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠতে হবে।
বর্তমানে মুসলিম বিশ্বের অন্যতম প্রধান সমস্যা হচ্ছে ফিলিস্তিন সংকট। ভাষা, বর্ণ ও মাযহাব নির্বিশেষে এ সংকট সকল মুসলমানের সব ধরনের রাজনৈতিক সমস্যার শীর্ষে স্থান পাওয়া উচিত। সাম্প্রতিক শতাব্দীগুলোর সবচেয়ে ভয়ানক যুলুম ফিলিস্তিনে সংঘটিত হয়েছে। এ বেদনাদায়নক ঘটনায় একটি জাতির ভূমি, ঘরবাড়ি, কৃষিক্ষেত, সহায়-সম্বল, সম্মান-সম্ভ্রম ও আত্মপরিচিতি সহ সব কিছু জবরদখল করা হয়েছে। কিন্তু আল্লাহর রহমতে এ জাতি এখনো পরাজয় মেনে নেয় নি ও নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে নি, বরং প্রতিদিন নতুন উদ্যোমে জিহাদের ময়দানে অবতীর্ণ হচ্ছে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, ফিলিস্তিনী জাতির এ প্রচেষ্টার সাফল্য নির্ভর করছে তাদের প্রতি সকল মুসলমানের সম্মিলিত পৃষ্ঠপোষকতার ওপর। যালেম আমেরিকা ও তার সহযোগী বিশ্বাসঘাতক শাসকেরা ‘ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি’ নামের যে ধোঁকাবাজির ক্ষেত্র প্রস্তুত করছে তা শুধু ফিলিস্তিনী জাতির বিরুদ্ধে নয়, বরং সমগ্র মানব জাতির বিরুদ্ধে একটি অপরাধ। আমরা শত্রুর এ প্রতারণা ও অপকৌশলকে ব্যর্থ করে দেয়ার লক্ষ্যে সকলের সক্রিয় উপস্থিতি কামনা করছি এবং আশা করছি, ইনশা আল্লাহ্, ইসলামি প্রতিরোধ ফ্রন্টের ঈমান ও প্রচেষ্টার সামনে সাম্রাজ্যবাদীদের এ অপকৌশল সহ অন্যান্য ধোঁকাবাজি প- হয়ে যাবে।
আল্লাহ তা‘আলা যেমন বলেছেন : ‘না; তারা ষড়যন্ত্র করতে চায়? অতএব, যারা কাফের, তারাই ষড়যন্ত্রের শিকার হবে।’ ছ¡াদাক্বাল্লাহুল ‘আলীয়্যুল ‘আযীম্।
মহান আল্লাহর দরবারে সকল সম্মানিত হাজ্বীর জন্য সুস্বাস্থ্য, রহমত ও সাফল্য কামনার পাশাপাশি তাঁদের সকলের ইবাদত যাতে কবুল হয় সে জন্য দো‘আ করছি।
সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী
১৪ই মোরদাদ ১৩৯৮ ইরানি সাল
মোতাবেক ৩রা যিলহাজ্ব, ১৪৪০ হিজরি।
আলেম, বুদ্ধিজীবী ও নাগরিকদের উদ্দেশে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর নসিহত
মাহদি মাহমুদ –
ইমাম হোসাইন (আ.) তাঁর বিপ্লব ও সংগ্রামের উদ্দেশ্য সুবিস্তরে তুলে ধরেছেন মিনায় প্রদত্ত ভাষণটিতে যা অনাগত কালের মানুষের জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। আজ আমরা ওই ভাষণেরই একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা করব।
ইমাম হোসাইন মক্কায় অবস্থানকালে এই ভাষণটি দিয়েছিলেন। আমীর মুয়াবিয়ার মৃত্যুর পর যখন ইয়াযীদের পক্ষে বাইআত করার জন্য তাঁর ওপর জোর-জবরদস্তি শুরু হয় তখন তিনি মদিনা ত্যাগ করেন এবং মক্কার উদ্দেশে রওয়ানা হন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল একাধারে হজ করা এবং হজের জন্য আগত মুসলিম বিশ্বের মানুষের উদ্দেশে সতর্কবাণী পৌঁছে দেয়া, বনি উমাইয়ার মাত্রাছাড়া জাহেলিয়াত, সুন্নাহবিরোধী ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে তাদেরকে সচেতন করা। সেই লক্ষ্যেই ৬০ হিজরির জিলহজ মাসে মিনায় ইমাম হোসাইন এই ভাষণটি প্রদান করেন।
ভাষণে তিনি ‘হে লোকসকল বা জনগণ’ সম্বোধনে শুরু করেন। অতঃপর তিনি কুরআনের আয়াত পাঠ করেন, ‘কেন ধার্মিক ব্যক্তিরা (আল্লাহওয়ালা আলেমগণ) এবং প-িতগণ তাদের পাপের কথা ও নিষিদ্ধ বস্তু ভক্ষণ হতে নিষেধ করে না? নিশ্চয় তারা যা করছে তা অত্যন্ত জঘন্য।’ (সূরা মায়িদা : ৬৪)
অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে যে, ইমাম হোসাইনের ভষণটি সামগ্রিকভাবে তৎকালীন এবং অনাগত যুগের সচেতন জনগণের উদ্দেশে এবং নির্দিষ্ট করে বললে, মুসলিম আলেমসমাজ এবং বুদ্ধিজীবীদের উদ্দেশেই ছিল। এভাষণে তিনি আলেমসমাজ এবং বুদ্ধিজীবীদেরকে ‘হে শক্তিমান সম্প্রদায়! যারা জ্ঞানে বিখ্যাত’ বলেও সম্বোধন করেছেন। আলেমসমাজ এবং বুদ্ধিজীবীদেরকে তিনি শক্তিমান মনে করেন। কেননা, তাঁদের আছে প্রজ্ঞা। জনগণ তাঁদেরকে ভরসা এবং সম্মান করে। তিনি বলছেন, ‘মর্যাদাবান ব্যক্তি তোমাদেরকে (আলেম এবং বুদ্ধিজীবী) মূল্যায়ন করে এবং দুর্বল ব্যক্তি তোমাদেরকে শ্রদ্ধা করে।… তোমরা সম্রাটদের শান সহকারে এবং বুজুর্গদের সম্মান সহকারে রাস্তায় পথ চল।’ কিন্তু কেন? তিনি নিজেই উত্তর দিচ্ছেন, ‘এসব কি এজন্যই নয় যে, জনগণ তোমাদের প্রতি আশা রাখে যে, তোমরা আল্লাহর অধিকার প্রতিষ্ঠায় আন্দোলন করবে?’
আলেমগণের শ্রদ্ধার মাপকাঠি জনগণের নিকটে এজন্য হওয়া উচিত যে, তাঁরা আল্লাহর অধিকার প্রতিষ্ঠার জ্য আন্দোলন করেন। জনগণকে সংগঠিত করেন। দুনিয়ার প্রান্তে প্রান্তে যেখানেই নিপীড়িত মানুষ রয়েছে, যেখানেই যালেমরা মযলুমের রক্ত ঝরাচ্ছে সেখানেই প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠবে আলেম এবং বুদ্ধিজীবী সমাজ।
ইমাম তাঁর ভাষণের এই পর্যায়ে আবারো হুশিয়ার করে দিচ্ছেন যে, আলেম ও বুদ্ধিজীবীদের প্রতি মানুষের ইতিবাচক মূল্যায়ন এবং আল্লাহপ্রদত্ত অধিকার ও ক্ষমতা এজন্য নয় যে, তাঁরা বেশি বেশি নামায পড়েন কিংবা ব্যক্তিজীবনে ঈমানদারির পরিচয় দেন।
ইমাম বলছেন, ‘আল্লাহর প্রতি ঈমানদার বান্দা সংখ্যায় অনেক, কিন্তু জনগণ তাদের শ্রদ্ধা করে না। আর তোমরা আল্লাহর কারণে জনগণের মাঝে সম্মানের পাত্র। এখন তোমরা স্বচক্ষে আল্লাহর নির্দেশ-আল্লাহর প্রতি কৃত অঙ্গীকারসমূহকে ভঙ্গ হতে দেখেও কেন ভয় করছ না?’
ইমাম হোসাইন তৎকালীন এবং অনাগত যুগের আলেম এবং বুদ্ধিজীবীদের প্রতি হুশিয়ারি উচ্চারণ করছেন- ‘তোমাদের ব্যাপারে আমার আশংকা হয় যে, ঐশী কোনো প্রতিশোধ তোমাদের ওপর নেমে আসবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘তোমাদের ওপর দুর্দশা অন্যদের চেয়েও বড়। কারণ, তোমরা যারা আলেম এবং প-িত, তোমরা তোমাদের জ্ঞান এবং মর্যাদাকে রক্ষার দায়িত্বে ব্যর্থ হয়েছ।’
কী এমন অপরাধ যার কারণে ইমাম হোসাইন এভাবে হুশিয়ার করে আশংকা করছেন যে, তাঁদের ওপর আল্লাহর গজব নাযিল হবে? কি ছিল আল্লাহর প্রতি কৃত অঙ্গীকার এবং আল্লাহর অধিকার- যা প্রতিনিয়ত ভঙ্গ হচ্ছিল এবং আজকের যুগেও হয়ে চলেছে?
ইমাম হোসাইন নিজেই কোরআন মজীদের দুটি আয়াত দিয়ে বিষয়টি পরিষ্কার করে দিচ্ছেন। আল্লাহর বাণী মনে করিয়ে দিচ্ছেন।
ঈমাম হোসাইন বলছেন, “মহান আল্লাহ বলেন, ‘মানুষকে ভয় করো না। ভয় করো আমাকে।’ (সূরা মায়িদা : ৪৪)। মহান আল্লাহ আরো বলেন, ‘মুমিন নরনারীরা একে অপরের বন্ধু। তারা সৎকাজে আদেশ করে এবং অসৎকাজ থেকে নিষেধ করে। (সূরা তওবা : ৭১)।”
ইমাম হোসাইন এরপর বলছেন, ‘আল্লাহ সৎকাজের নির্দেশ এবং অসৎকাজ থেকে নিষেধ করাকে ফরজ করেছেন। কারণ, তিনি জানতেন, যদি এই ফরজটি পালন করা হয় বা প্রতিষ্ঠিত হয় তাহলে সহজ-কঠিন সব ফরজই পালন করা হবে।’
এই ‘আম্্র বিল মারুফ ওয়া নাহি আনিল মুনকার’ আসলে কোন্গুলো? মানুষকে জোর করে নামাযে ধরে নিয়ে যাওয়া? জবরদস্তি করে ইসলামের পথে আনা? ধরে-বেঁধে জোর করে ধর্মীয় মজলিশে নিয়ে যাওয়া? না।
অতঃপর তিনি ব্যাখ্যা করলেন, এসকল ‘আম্র বিল মারুফ ওয়া নাহি আনিল মুনকার’ বলতে আল্লাহ তাআলা কোন্গুলো বুঝিয়েছেন।
‘সৎকাজের নির্দেশ এবং অসৎকাজ থেকে নিষেধ হলো অন্যায়ভাবে কেড়ে নেয়া অধিকার ফিরিয়ে দেয়া (এর জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করা), যালিমের বিরোধিতা, বাইতুল মাল ও গনিমত বণ্টন, যাকাতের নিসাব থেকে যাকাত গ্রহণ এবং তা যথার্থ খাতে ব্যয় করা।’
তিনি ভাষণেরই আরেক স্থানে বলছেন, ‘সকল জনপদে অন্ধ, বোবা আর দুর্বলেরা অভিভাবকহীন হয়ে পড়ছে এবং তাদের ওপর দয়া করা হচ্ছে না। এক্ষেত্রে তোমরাও তোমাদের (আলেম ও বুদ্ধিজীবী) পদ অনুযায়ী এবং দায়িত্ব মোতাবেক কাজ করছ না। আর যে ঐ কাজ করছে তাকেও সাহায্য করছনা। যালিমদের সাথে আঁতাত ও আপোস করে নিজেদেরকে ঝামেলামুক্ত রাখছ। এসবই হলো সেই সকল জিনিস যেগুলোকে সংঘবদ্ধভাবে প্রতিরোধের জন্য আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দিয়েছেন।’
এরপর ইমাম হোসাইন আলেম সমাজের নখদন্তহীন দুর্বল এবং সম্মানহানীর কারণ তুলে ধরেন।
‘নির্দেশাবলি ও বিধি-বিধানের বাস্তবায়ন আল্লাহর জ্ঞানে প-িত ও বিদ্বানের ওপর ন্যস্ত যারা তাঁর হালাল ও হারামের বিশ্বস্ত রক্ষক এবং শাসনকর্তৃত্ব তাদের হাতেই থাকতে হবে। সুতরাং তোমরা হলে তারাই যাদের থেকে সেই পদ ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। এর কারণ হচ্ছে, তোমরা সত্যপথ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছ এবং যথেষ্ট প্রমাণ বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নীতিপন্থা স¤পর্কে মতবিরোধ করেছ।’
তিনি আরো বলেন, ‘তোমরা নিজেরাই অন্যায়কে প্রশ্রয় দিয়েছ এবং খোদায়ী শাসনকর্তৃত্বকে তাদের (যালিমদের) হাতে সোপর্দ করেছ যাতে তারা সংশয়প্রণোদিত কাজ করে এবং স্বীয় কামনার বশীভূত হয়ে চলে।’
তিনি আরো বলেন, ‘তোমাদের মৃত্যুভয় এবং দুনিয়ার জীবন- যা তোমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হবে তা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকাই তাদেরকে এই পদে আসীন করেছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘তারা (আলেম এবং বুদ্ধিজীবী) তাদের সময়ে যারা যালিম ছিল তাদের নোংরা ও জঘন্য কাজ প্রত্যক্ষ করত, কিন্তু তাদেরকে তা থেকে নিষেধ করত না- তাদের হাতে যা ছিল তার লোভে এবং কোণঠাসা হয়ে পড়ার ভয়ে।’
এর ফলশ্রুতিতে মুসলিম সমাজের পরিণতি কী হলো?
‘তোমাদের (আলেম ও বুদ্ধিজীবীদের) এরূপ মানসিকতা (উদাসীনতা) এবং জীবনপদ্ধতি অবলম্বনের মাধ্যমেই তোমরা অক্ষমদেরকে তাদের (যালিমদের) অধীন করেছ। ফলে অক্ষমদের একদল এখন তাদের গোলামি শুরু করেছে। আরেকদল এক লোকমা খাবারের সন্ধানে নিরুপায় হয়ে পড়েছে। এবং এসকল শাসক তাদের মতো করে রাষ্ট্রকে ওলট-পালট করে এবং পরাক্রমশালী আল্লাহর প্রতি ধৃষ্টতা প্রদর্শন করে।’
অতঃপর ইমাম হোসাইন যুগের আলেম ও বুদ্ধিজীবীদেরকে তাঁদের হৃত সম্মান ও ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার পথ বাতলে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন : ‘তোমরা যদি (যালেমদের) নিপীড়নে ধৈর্যধারণ করো এবং আল্লাহর পথে সহনশীল হও তাহলে শাসনকর্তৃত্ব তোমাদের হাতে ফিরে আসবে এবং তোমাদের পক্ষ থেকেই বাস্তবায়ন হবে এবং তোমরাই জনগণের বিষয়াদির সমাধানস্থলে পরিণত হবে।’
পরিশেষে ইমাম হোসাইন বলেন, ‘হে আল্লাহ! তুমি জান যে, আমার থেকে যা কিছু প্রকাশ পেয়েছে তা শাসনকর্তৃত্বের প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য নয় এবং দুনিয়ার পণ্যের লোভেও নয়। এজন্য যে, তোমার দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত দেখব এবং তোমার রাজ্যে সংস্কার করব আর তোমার নিপীড়িত বান্দাদেরকে চিন্তামুক্ত করব এবং তোমার ওয়াজিব এবং (নবীর) সুন্নাত এবং বিধিবিধান পালন করব।’
এই ভাষণে জনগণের উদ্দেশে তাঁর শেষ কথা ছিল- ‘তোমাদের উচিত আমাদের সহায়তা করা। আমাদের প্রতি ন্যায়বিচার করা। যালিমদের শক্তি তোমাদের ওপর রয়েছে। তারা তোমাদের নবীর নূরকে নিভিয়ে দিতে চেষ্টা করছে। আর আল্লাহ আমাদের জন্য যথেষ্ট। তাঁর ওপরেই ভরসা করি, তাঁর দরবারেই প্রত্যাবর্তন করব। শেষ পরিণতি তাঁরই অভিমুখে।’

কারবালার চিরন্তন আহ্বান
মো. মাঈনউদ্দীন : ৬১ হিজরির যে ঘটনাটি মানবেতিহাসের পাতায় সুস্পষ্টরূপে দৃশ্যমান তা হলো কারবালা প্রান্তরে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর শাহাদাতের ঘটনা। যুগযুগ ধরে ফোরাত কূলে সংঘটিত এ ঘটনা একদিকে যেমন মানুষের হৃদয়কে ভারাক্রান্ত করে, নবী-পরিবারের বিয়োগান্তক বেদনায় মানুষ অশ্রু বিসর্জন দেয়, অপরদিকে এ আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় মানবতার জন্য অসংখ্য অভিজ্ঞতা, শিক্ষা ও পরতে পরতে সফলতার পাথেয় সঞ্চিত হয়েছে। কারবালার ইতিহাস ও ঘটনা প্রবাহ আলোচনা করা বক্ষ্যমান প্রবন্ধের লক্ষ্য নয়; বরং সমসাময়িক বিশ্ব ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে এ ঘটনা থেকে আমরা কী দিকনির্দেশনা নিতে পারি তাই আলোচ্য বিষয়। কারণ, আজকের সমাজ, রাজনীতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক মুসলমানদের জন্য যে চিত্র অঙ্কন করছে তা অনেকটা ইয়াযিদী যুগের পুনরাবৃত্তি ঘটাচ্ছে। প্রারম্ভেই ইমাম হোসাইন (আ.)-এর সে উক্তি যেখানে তিনি তাঁর আন্দোলনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে বর্ণনা দিয়েছেন, তা উল্লেখ করতে চাই।
إِنّى لَمْ أَخْرُجْ أَشِرًا وَلا بَطَرًا ، وَلا مُفْسِدًا وَلا ظالِمًا ، وَإِنَّما خَرَجْتُ لِطَلَبِ الإصْلاحِ في أُمَّةِ جَدّي ، أُريدُ أَنْ آمُرَ بِالْمَعْرُوفِ وَأَنْهى عَنِ الْمُنْكَرِ ـ
আমি না ভ্রমণের জন্য বের হয়েছি, না পৃথিবীতে ফেসাদ ছড়িয়ে দেয়ার জন্য কিংবা না জুলুম করার জন্য বের হয়েছি। আমি কেবল আমার নানার উম্মতের সংস্কারের জন্য বের হয়েছি। আমি সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করতে চাই।
ইমাম হোসাইন (আ.)-এর এ উক্তিতে তাঁর আন্দোলনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সামগ্রিক চিত্র ফুটে উঠেছে। এখানে আমরা কারবালা থেকে নেয়া কয়েকটি শিক্ষা যা ব্যক্তি ও সমাজ সংস্কারে ভূমিকা রাখতে পারে তা নিয়ে আলোচনা করব।
১. মানবিক ও নৈতিক নীতির ওপর দৃঢ় থাকা : খোদায়ী মানুষ চরম প্রতিকূল পরিবেশেও কখনো মানবিকতা ও নৈতিকতাকে বিসর্জন দিয়ে সুযোগের সদ্ব্যবহার করেন না। এ প্রসঙ্গে আমরা কারবালার ঘটনা বর্ণনা করতে পারি। যখন হোর ইবনে ইয়াযীদ রিয়াহী ইমাম হোসাইন (আ.)-এর পথরোধ করে দাঁড়ালেন তখন ইমামের সঙ্গিগণ হোর ও তার বাহিনীকে তাৎক্ষণিক নির্মূল করার পরমার্শ দিলেন। এ যুক্তিতে যে, হোরের বাহিনীকে ধ্বংস করার মতো সামর্থ্য তাঁদের ছিল। কিন্তু ইমাম সেখানে ধৈর্যধারণ করলেন ও এ কাজে সমর্থন দেন নি।
২. সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ : কারবালার ঘটনার শিক্ষাসমূহের অন্যতম হলো : দুটি গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্যের প্রতি গুরুত্বারোপ করাÑ সৎকাজে আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ। ইমাম হোসাইন (আ.) মদিনা থেকে বিদায়বেলায় তাঁর ভাই মুহাম্মদ ইবনে হানাফিয়ার উদ্দেশে লিখেছিলেন : ‘…আমি চাই সৎকাজের আদেশ দিতে এবং অসৎকাজে নিষেধ করতে।’
ইমামের এ বক্তব্যটি পবিত্র কোরআনের সূরা আলে ইমরানের ১১০ নং আয়াতের প্রতিস্মৃতি যেখানে মহান আল্লাহ উম্মত হিসেবে আমাদের শ্রেষ্ঠত্বের কারণ উল্লেখ করেছেন : كُنتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنكَرِ وَتُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ ۗ অর্থাৎ তোমরাই হলে সর্বোত্তম উম্মত, মানবজাতির কল্যাণের জন্যই তোমাদের উদ্ভব ঘটনো হয়েছে, তোমরা সৎকাজের নির্দেশ দান করবে ও অন্যায় কাজে বাধা দেবে।
৩. আপোসহীনতা : ইমাম হোসাইন (আ.) ইয়াযীদের পক্ষ থেকে বাইয়াতের প্রস্তাবে বলেছিলেন : مثلى لا يبايع مثله ‘আমার মতো কেউ তার (ইয়াযীদের) মতো কারো হাতে বাইয়াত করবে না।’ বিষয়টি হলো ন্যায়-অন্যায়ের, আলো-আঁধারের। ইমাম হোসাইন (আ.) ন্যায় ও আলোর প্রতীক হিসেবে অন্যায় ও অন্ধকারে নিমজ্জিত কারো হাতে বাইয়াত করতে পারেন না।
৪. আত্মসম্মানবোধ : ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কাছে অন্যায়ের নিকট মাথা নত করাটা ছিল অপমানজনক। তিনি সুস্পষ্টরূপে ঘোষণা করেন موت فی غز خیر من حیاة فی ذل ‘সম্মানজনক মৃত্যু অপমানজনক জীবন থেকে উত্তম।’ আজকের যুগে যাঁরা মুসলিম উম্মাহর নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাঁদের মধ্যে যাঁরা ইমাম হোসাইন (আ.)-এর এ বাণী থেকে শিক্ষা নিচ্ছেন তাঁরা শত কষ্টক্লেশের মধ্যেও অন্যায়ের সাথে আপোস করেন নি। এমনকি জীবন বিপন্ন হলেও। আত্মসম্মানবোধহীন নেতৃত্বের কারণেই একটি জাতি লাঞ্ছিত ও বঞ্চিত হয়।
৫. মহান আল্লাহর ওপর ভরসা (তাওয়াক্কুল) : ইমাম হোসাইন (আ.) কুফা অভিমুখে যাওয়ার পথেই কুফার জনগণের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ ও হযরত মুসলিম ইবনে আকীলের শাহাদাতের সংবাদ পেয়েছিলেন, কিন্তু তিনি তাঁর সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন নি; বরং কর্তব্যপরায়ণতার জন্য তিনি তাঁর যাত্রা অব্যাহত রেখেছিলেন এবং মহান আল্লাহর ওপর নির্ভর করেছিলেন। তিনি মহান আল্লাহর প্রতি হাত তুলে বলেছিলেন : ‘প্রভু হে! সব দুঃখ-কষ্টে আপনিই আমার ভরসাস্থল; আপনিই আমার আশার স্থল সব ক্লেশে।
৬. আল্লাহর নিকট সমর্পণ ও মহান আল্লাহর সন্তুষ্টিতে সন্তুষ্ট : কারবালার অন্যতম শিক্ষার মধ্যে রয়েছে আল্লাহর সন্তুষ্টিতে সন্তুষ্ট থাকা। ইমাম হোসাইন (আ.) কারবালার প্রান্তরে তাঁর অতি প্রিয়জনকে হারিয়েছেন, নিজ পরিবার বন্দিদশায় পতিত হয়েছিল। ছয় মাসের শিশুকে পিপাসার্ত অবস্থায় নিজ হাতের ওপর শহীদ হতে দেখেছেন; সব কষ্টই তিনি সহ্য করেছিলেন একমাত্র মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। নিজেকে সম্পূর্ণরূপে মহান প্রভুর দরবারে সমর্পণ করেছিলেন। নিজ কলিজার টুকরা আলী আসগরের রক্ত আকাশের দিকে ছুড়ে দিয়ে বলেছিলেন : ربّنا تقبل هذا القليل ‘প্রভু হে! এ সামান্যটুকু আপনি কবুল করুন।’
ইমাম হোসাইন (আ.) যখন মক্কা থেকে কুফার দিকে রওয়ানা হলেন তখন স্বয়ং এ বিষয়টির প্রতি ইশারা করেছিলেন : ‘আমরা নবীর আহলে বাইত, মহান আল্লাহ যা কিছুতে সন্তুষ্ট থাকেন তাতেই সন্তুষ্ট থাকি। তাঁর পরীক্ষা ও বালার বিপরীতে ধৈর্য ও দৃঢ়তা অবলম্বন করি। তিনি ধৈর্যধারণকারীদের পুরস্কার আমাদেরকে দান করবেন।’
৭. স্বাধীনচেতা : কারবালার ঘটনা হলো স্বাধীন চেতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ইয়াযীদের পক্ষ থেকে বাইয়াতের প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল ইমামকে নিরাপদ থাকার শর্তস্বরূপ। ইমাম (আ.) বললেন : ‘জেনে রাখ! নাপাকের জন্ম নাপাক, আমাকে অপমান আর মৃত্যুÑ এ দুয়ের মাঝে থাকতে বাধ্য করেছে। কিন্তু هيهات من الذلة ধিক্! অপমানের জীবন আমাদের থেকে দূরে থাক। মহান আল্লাহ অপমানের জীবন মেনে নেয়া আমাদের জন্য, নবিগণের জন্য ও মুমিনদের জন্য সমীচীন করেন নি।’
৮. ইখলাস বা একনিষ্ঠতা : ইমাম হোসাইন (আ.)-এর সঙ্গীদের কারবালায় তাঁর সাথে থাকার কারণ কী ছিল? হয়ত কারবালায় আসা পর্যন্ত ইমামের সঙ্গী হয়েছিলেন অনেকেই, কিন্তু যখন মৃত্যু অবধারিত, বেঁচে থাকার কোন আশা নেই, তখনও ইমামকে যাঁরা ছেড়ে যান নি তাঁরা কিসের আশায় ছিলেন? গণিমত, ধন-সম্পদ লাভের তো কোন আশাই ছিল না। একমাত্র ইখলাস বা একনিষ্ঠতা ছাড়া এর কোন কারণ নেই। ইমাম স্পষ্ট ভাষায় তাঁর সঙ্গীদেরকে বলেছিলেন : ‘তারা শুধু আমাকে হত্যা করতে চায়, তোমাদের ওপর থেকে বাইয়াত তুলে নিলাম। বাতি নিভিয়ে দিলাম, তোমরা রাতের অন্ধকারে চলে যাও।’ কিন্তু কেউই ইমামকে ফেলে যান নি। সুতরাং ইখলাসের চরম পরাকাষ্ঠার চিত্রায়ন হয়েছিল কারবালায়।
৯. ত্যাগ : কারবালার দৃশ্যপট ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত। যখন ইমাম যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তাঁর সঙ্গীরা সংকল্পবদ্ধ হয়েছিলেন যে, তাঁরা যতক্ষণ জীবিত আছেন ততক্ষণ নবী-পরিবারের কোন সদস্যের গায়ে আঁচর লাগতে দিবেন না। আবার যখন নবী-পরিবারের পালা আসল তখন ইমাম তাঁর কলিজার টুকরা আলী আকবরকে প্রথম যুদ্ধে পাঠালেন। অনুরূপ হযরত আব্বাস যখন শত্রুর বুহ্য ভেদ করে ফোরাতের পানি হাতে তুলে নিলেন, মুহূর্তেই তাঁর মনে পড়ে গেল ইমাম ও তাঁবুতে থাকা নারী-শিশুদের তৃষ্ণার্ত চেহারাগুলো। তাদের আগে পানি পান করবেন না বলে মশক নিয়ে ছুটে চলেছিলেন তাঁবুর দিকে। কিন্তু পথেই তৃষ্ণার্ত অবস্থায় শত্রুর তীরের আঘাতে শাহাদাতের পিয়ালা পান করলেন।
১০. কীর্তিকে অমর করে রাখা : ইমাম হোসাইন (আ.) জানতেন শাহাদাত তাঁর জন্য লিখা হয়ে গিয়েছে। কারণ, তিনি যেখানেই থাকতেন সেখানেই তাঁকে হত্যা করা হতো। যদি মদিনা বা মক্কায় তাঁকে গুপ্তহত্যা করা হতো তবে তাঁর শাহাদাতের ফল খুব ¤্রয়িমাণ হতো। হয়তোবা কয়েক দশক পরেই সব কিছু ম্লান হয়ে যেত। কিন্তু ইমাম মদিনা থেকে বের হয়ে মক্কায় চলে আসলেন; যখন দেখলেন গুপ্তঘাতকরা তাঁকে সেখানেই শহীদ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে তখন তিনি হজ শেষ না করেই মক্কা থেকে বের হয়ে আসলেন। মদিনা থেকে মক্কা, মক্কা থেকে কারবালা এ সুদীর্ঘ পথ পরিক্রমায় তিনি একাধিক সমাবেশে বক্তব্য দিয়েছিলেন। তাঁর আন্দোলনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পর্কে মানুষকে অবহিত করেছিলেন। এমনকি যুদ্ধ করতে করতে যখন ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত হয়ে গিয়েছিলেন তখন একটি চিরন্তন আহ্বান জানিয়ে তাঁর মিশন শেষ করেছিলেন : هل من ناصر ینصرنی ‘এমন কোন সাহায্যকারী কি আছ যে আমাকে সাহায্য করবে?’ ইমামের এ আহ্বানের ধ্বনি আজও ভক্তদের কানে ধ্বনিত হয়। যতদিন পৃথিবী থাকবে, যতদিন বিশ্বের মানবতার অস্তিত্ব থাকবে, ইমামের এ আহ্বান সবার জন্য, সর্বযুগে সর্বস্থানে প্রতিধ্বনিত হতে থাকবে।
হয়তো সৌভাগ্যবানরা তাঁর আহ্বানে সাড়া দিবে। আর হতভাগারা চিরকাল হতভাগাই থেকে যাবে।
তথ্যসূত্র : ১. সিরায়ে পিশভায়ন ২. লুহুফ
ইমাম জাফর আস-সাদিক (আ.)-এর বাণী
সংকলন ও অনুবাদ : মুহাম্মদ মুনীর হোসেইন খান –
২৫ শাওয়াল মহানবী (সা.)-এর আহলে বাইতের ষষ্ঠ ইমাম জাফর ইবনে মুহাম্মাদ আস-সাদিক (আ.)-এর শাহাদাত দিবস। তিনি ৪র্থ ইমাম হযরত আলী ইবনুল হুসাইন যায়নুল আবেদীনের পৌত্র। তাঁর পিতা ছিলেন আহলে বাইতের পঞ্চম ইমাম মুহাম্মাদ আল বাকির (আ.)। ইমাম জাফর ইবনে মুহাম্মাদকে ‘সাদিক’ (সত্যবাদী) উপাধি দেয়া হয়েছে এ কারণে যে, তাঁর যুগে বনী উমাইয়্যা ও বনী আব্বাস শাসকচক্রের প্রতিপালিত ও পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত মিথ্যাবাদী রাবীরা (বর্ণনাকারীরা) মহানবী (সা.)-এর নামে মিথ্যা ও জাল হাদীস বর্ণনা ও প্রচার করত, আর এ রকম এক যুগসন্ধিক্ষণে ইমাম জাফর (আ.) মহানবীর দিশাহারা উম্মতের সামনে মহানবীর সত্য ও বিশুদ্ধ (সহীহ) হাদীস ও সুন্নাহ উপস্থাপন করেছিলেন এবং ইসলামি জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় ৪০০০ শিষ্য, মুহাদ্দিস (হাদীসশাস্ত্রবিদ), মুফাসসির, মুতাকাল্লিম (কালামশাস্ত্রবিদ), রাবী (হাদীস বর্ণনাকারী) ফকীহ-মুজতাহিদকে শিক্ষা দিয়েছিলেন ও প্রশিক্ষিত করেছিলেন। তাই মহানবীর সত্য হাদীস ও সুন্নাহ বর্ণনা করার জন্য তাঁকে ‘সাদিক’ বা ‘সাদিকু আলে মুহাম্মাদ’ (হযরত মুহাম্মাদ সা.-এর আহলে বাইতের সত্যবাদী) বলা হয়, যদিও মহানবী (সা.) এবং তাঁর আহলে বাইতের সকল ইমাম সত্যবাদী ছিলেন। ইমাম জাফর আস-সাদিকের অক্লান্ত চেষ্টা-প্রচেষ্টার কারণে মহানবী (সা.)-এর হাদীস ও সুন্নাহ এবং তাঁর আহলে বাইতের অমিয় বাণী তথা খাঁটি ইসলামি জ্ঞান-বিজ্ঞান সংরক্ষিত হয়েছে। তাই এ মহান ইমামের শাহাদাত দিবসে তাঁর কিছু অমিয় বাণীর অনুবাদ উপস্থাপন করছি যা আমাদের জীবনে চলার পথে হবে নিঃসন্দেহে আলোকবর্তিকাস্বরূপ। বলার আর অপেক্ষা রাখে না যে, মহানবী (সা.) এবং তাঁর আহলে বাইতের সকল বাণী ও হাদীস হচ্ছে হেদায়াতের নূর (সঠিক পথ প্রদর্শনের আলো) এবং প্রাণ-সঞ্জীবণী সুধা।
ইমাম সাদিক (আ.) বলেছেন :
১. আমি বেহেশতের সন্ধান করলাম, অতঃপর তা পেলাম দানশীলতার মাঝে।
২. আমি সুস্থতা ও মুক্তির সন্ধান করলাম, অতঃপর তা পেলাম (গঠনমূলক ও ইতিবাচক) নির্জনবাসের মধ্যে। (গঠনমূলক ও ইতিবাচক নির্জনবাসে মানুষের চিন্তাশক্তির বিকাশ হয় এবং নিভৃতে রিয়ামুক্ত ইবাদত-বন্দেগি করার মাধ্যমে মহান আল্লাহর নৈকট্য অর্জিত হয়। তাই এ ধরনের নির্জনবাসের প্রয়োজন রয়েছে।)
৩. আমি (পরকালে) মানদণ্ডে (মীযান) আমলসমূহ যাতে ভারী হয় তার সন্ধান করলাম, অতঃপর তা পেলাম লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ- এ কলেমার সাক্ষ্যদানের মাঝে (অর্থাৎ মহান আল্লাহর তাওহীদ এবং মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর রিসালতে সাক্ষ্যদান ও বিশ্বাস স্থাপনের মধ্যে)।
৪. আমি বেহেশতে দ্রুত প্রবেশের (উপায়) সন্ধান করলাম, অতঃপর তা পেলাম মহান আল্লাহর জন্য নিষ্ঠার সাথে সৎকর্ম স¤পাদন করার মাঝে।
৫. আমি মৃত্যুর প্রতি ভালোবাসার সন্ধান করলাম, অতঃপর তা পেলাম মহান আল্লাহর (সন্তুষ্টি অর্জনের) জন্য স¤পদ ব্যয় ও উৎসর্গ (ইনফাক) করার মধ্যে।
৬. মহান আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগির মাধুর্য, স্বাদ ও মিষ্টতার সন্ধান করলাম, অতঃপর তা পেলাম পাপ ও গুনাহ বর্জন করার মধ্যে।
৭. আমি হৃদয়ের কোমলতার সন্ধান করলাম, অতঃপর তা পেলাম ক্ষুধা ও তৃষ্ণার মাঝে।
৮. আমি হৃদয়ের আলো ও ঔজ্জ্বল্যের সন্ধান করলাম, অতঃপর তা পেলাম চিন্তা (শীলতা) ও কান্নার মধ্যে।
৯. আমি (কিয়ামত দিবসে) পুল সিরাত অতিক্রমের (উপায়ের) সন্ধান করলাম, অতঃপর তা পেলাম দান করার (সাদাকা দেয়ার) মধ্যে।
১০. আমি মুখম-লের আলোকোজ্জ্বল্যের সন্ধান করলাম, অতঃপর তা পেলাম রাতের নামাযের (তাহাজ্জুদের নামায পড়ার) মধ্যে।
১১. আমি জিহাদের ফযিলতের (মর্তবা ও পুণ্যের) সন্ধান করলাম, অতঃপর তা পেলাম পরিবারের জন্য (হালাল) উপার্জন করার মধ্যে।
১২. আমি মহান আল্লাহর বন্ধুত্বের সন্ধান করলাম, অতঃপর তা পেলাম পাপীদেরকে ঘৃণা করার মধ্যে।
১৩. আমি নেতৃত্বের (নেতা হওয়ার উপায়ের) সন্ধান করলাম, অতঃপর তা পেলাম মানুষকে সদুপদেশ (নসিহত) দানের মধ্যে।
১৪. আমি চিত্তের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের সন্ধান করলাম, অতঃপর তা পেলাম ধন-স¤পদের স্বল্পতার (স্বল্প ধন-স¤পদের অধিকারী হওয়ার) মধ্যে।
১৫. আমি গুরুত্বপূর্ণ কর্মসমূহ যেগুলো স¤পাদন করার জন্য দৃঢ় সংকল্প ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রয়োজন সেগুলো (স¤পন্ন করার উপায়ের) সন্ধান করলাম, অতঃপর তা পেলাম ধৈর্য অবলম্বনের মধ্যে।
১৬. আমি বংশ মর্যাদা ও গৌরবের সন্ধান করলাম, অতঃপর তা পেলাম বিদ্যার মধ্যে।
১৭. আমি ইবাদত-বন্দেগির সন্ধান করলাম, অতঃপর তা পেলাম পাপ না করার (পরহেজগারী) মধ্যে।
১৮. আমি আরাম ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের সন্ধান করলাম, অতঃপর তা পেলাম যুহ্দ অর্থাৎ দুনিয়ার প্রতি উপেক্ষা ও ইবাদতে মনোসংযোগ করার (পার্থিবতা বর্জনের) মধ্যে।
১৯. আমি শ্রেষ্ঠত্ব ও মহানতার সন্ধান করলাম, অতঃপর তা পেলাম বিনয় ও নম্রতার মধ্যে।
২০. আমি মর্যাদা ও সম্মানের সন্ধান করলাম, অতঃপর তা পেলাম সততা ও সত্যবাদিতার মধ্যে।
২১. আমি নম্রতা ও বিনয়ের সন্ধান করলাম, অতঃপর তা পেলাম রোযার মধ্যে।
২২. আমি প্রাচুর্য ও নিরাভবতার সন্ধান করলাম, অতঃপর তা পেলাম অল্পে তুষ্টির মধ্যে।
২৩. আমি ঘনিষ্ঠতা ও সখ্যের (ঘনিষ্ঠ সঙ্গীর) সন্ধান করলাম, অতঃপর তা পেলাম পবিত্র কোরআন তিলাওয়াতের মধ্যে।
২৪. আমি মানুষের সাহচর্যের সন্ধান করলাম, অতঃপর তা পেলাম সদাচরণ ও সুমিষ্ট ব্যবহারের মধ্যে।
২৫. আমি মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির সন্ধান করলাম, অতঃপর তা পেলাম পিতামাতার প্রতি সদাচরণ ও পুণ্যের মধ্যে।
মহান আল্লাহ আমাদেরকে ইমাম সাদিক (আ.)-এর এই অমিয় বাণীগুলো আমাদের জীবনে বাস্তবায়ন করার তৌফিক দান করুন।
সম্পাদকীয়
ত্যাগের মহিমায় সমুজ্জ্বল আশুরা ও আমাদের করণীয়
দশই মহররম ত্যাগের মহিমায় সমুজ্জ্বল শোকাবহ আশুরা; হিজরি ৬১ সালের এ দিনে সাইয়্যেদুশ্ শুহাদা বেহেশতে যুবকদের নেতা হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) কারবালায় তাঁর স্বজন ও সহচরগণ সহ ইয়াযীদী বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে শাহাদাত বরণ করেন। এ ঘটনা মানব জাতির ইতিহাসের করুণতম ঘটনা।
আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.)-এর শাহাদাতের পরে হযরত ইমাম হাসান (আ.) খেলাফতের দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হন। কিন্তু মুসলিম উম্মাহ্কে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ও সম্ভাব্য রোমান হামলা থেকে রক্ষার লক্ষ্যে তিনি তাঁর বৈধ খেলাফতকে মু‘আবিয়ার হাতে ছেড়ে দেন। মুআবিয়া হযরত ইমাম হাসান (আ.)-এর সাথে কৃত সন্ধির শর্ত ভঙ্গ করে মৃত্যুকালে হযরত ইমাম হোসাইন (আ.)-এর হাতে খেলাফতের দায়িত্ব হস্তান্তরের পরিবর্তে স্বীয় চরিত্রহীন পাপাচারী পুত্র ইয়াযীদকে খেলাফতে অধিষ্ঠিত করে গেলে ইয়াযীদ হযরত ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কাছ থেকে শক্তিপ্রয়োগে বাই‘আত আদায়ের জন্য মদীনার প্রশাসককে নির্দেশ দেয়। কিন্তু ইমাম হোসাইনের ন্যায় ব্যক্তি ইসলামের সমস্ত সীমারেখা অমান্যকারী ইয়াযীদের আনুগত্য করলে যে কারো জন্য তা ইসলামি মূল্যবোধ বিসর্জনের সপক্ষে দলিল হিসেবে গণ্য হতো। এ কারণে তিনি ইয়াযীদের অনুকূলে বাই‘আত করা থেকে বিরত থাকেন এবং রক্তপাত এড়াবার লক্ষ্যে মদীনা ত্যাগ করে মক্কায় চলে যান।
মক্কায় তিনি লোকদের মধ্যে মুসলমানদের হুকূমাতের অবস্থা সম্বন্ধে সচেতনতা সৃষ্টির কাজে আত্মনিয়োগ করেন। কিন্তু ইয়াযীদ সেখানে তাঁকে হজ্বের ভীড়ে হত্যার জন্য গুপ্তঘাতক পাঠালে হযরত ইমাম (আ.) পবিত্র স্থানে রক্তপাত এড়াবার লক্ষ্যে মক্কা ত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন এবং কূফার জনগণের দাও‘আতে সাড়া দিয়ে সেখানে পৌঁছার উদ্দেশ্যে কারবালায় উপনীত হন। সেখানে তিনি পরিবার-পরিজন ও সঙ্গী-সাথিসহ ইয়াযীদী বাহিনী দ্বারা অবরুদ্ধ হন। ইয়াযীদের নির্দেশে তার বাহিনী ইমামের ওপরে ইয়াযীদের অনুকূলে বাই‘আত করার জন্য কঠোরভাবে চাপ সৃষ্টি করে। কিন্তু ইমাম হোসাইন (আ.) কোনো অবস্থায়ই ফাসেক ইয়াযীদের অনুকূলে বাই‘আত করাকে জায়েয গণ্য করেন নি বিধায় তাদের এ চাপের কাছে নতি স্বীকার করতে অস্বীকৃতি জানান। এমতাবস্থায় ইয়াযীদী বাহিনী তাঁকে তাঁর সকল পুরুষ স্বজন ও সহচর সহ, এমনকি দুগ্ধপোষ্য শিশুকেও, নির্মমভাবে হত্যা করে; কেবল আল্লাহ্ তা‘আলার বিশেষ ইচ্ছায় হযরত ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.) ঐ সময় মরণাপন্ন অসুস্থ থাকায় এ হত্যাকাণ্ড থেকে রেহাই পান।
হযরত ইমাম হোসাইন (আ.)-এর আত্মত্যাগের এ ঘটনা মুসলমানদের জন্য বাতিলকে সহ্য করার সীমারেখাকে সুস্পষ্ট করে দেয়। এভাবে কারবালার ঘটনা যুগ যুগান্তর ধরে প্রকৃত ইসলামের অনুসারীদের জন্য প্রেরণার উৎসে পরিণত হয়।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক যে, ইতিহাসের সমস্ত সাক্ষ্য-প্রমাণের বিপরীতে কতক লোক কারবালার হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে ইয়াযীদকে নির্দোষ প্রমাণের অপচেষ্টা চালাচ্ছে। তারা দাবি করছে যে, ইয়াযীদের অনুমতি ছাড়াই কারবালার ঘটনা ঘটানো হয়েছিল। আমরা এ ব্যাপারে কোনো দীর্ঘ আলোচনা ও মন্তব্য না করে কেবল মুক্তবিবেক মানুষদের কাছে প্রশ্ন করব : যদি তা-ই হয়ে থাকে তাহলে যারা এ জন্য দায়ী ইয়াযীদ তাদেরকে শাস্তি দেয় নি কেন, বরং কেন তাদেরকে পুরষ্কৃত করেছিল এবং হযরত ইমামের পরিবারের সদস্যদেরকে কারারুদ্ধ করে রেখেছিল?
এটা আজ অনস্বীকার্য যে, ইরানের ইসলামি বিপ্লবের বিজয়ের মধ্য দিয়ে ইসলামের বিজয় ও ইসলামি ঐক্য অভিমুখে মুসলিম উম্মাহ্র নবযাত্রা শুরু হয়েছে। তাই ইসলামের দুশমনদের পক্ষ থেকে একদিকে যেমন ইসলামের বিরুদ্ধে বহুমুখী হামলা চালানো হচ্ছে, অন্যদিকে আশুরাসহ ইসলামের ইতিহাসের বিতর্কাতীত বিষয়গুলোকে বিতর্কিত করার অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে। এমতাবস্থায় সমগ্র মুসলিম উম্মাহ্র জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে ইসলামের দুশমনদের এ ষড়যন্ত্র ও হামলাকে জ্ঞানের অস্ত্র দ্বারা শক্তভাবে মোকাবিলা করা এবং ইসলামের অভিন্ন মৌলিক বিষয়গুলোর ভিত্তিতে উম্মাহ্র মধ্যে সুদৃঢ় ঐক্য গড়ে তোলার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো অপরিহার্য ।
আমরা আশুরা উপলক্ষে সমগ্র মুসলিম উম্মাহ্র প্রতি, বিশেষ করে নিউজলেটারের পাঠক-পাঠিকাদের প্রতি গভীর শোক ও সমবেদনা জানাচ্ছি।
ঈদুল আয্হার মোবারকবাদ
ত্যাগের মহিমায় সমুজ্জ্বল পবিত্র ঈদুল আয্হা উপলক্ষে সমগ্র মুসলিম উম্মাহ্র প্রতি, বিশেষ করে নিউজলেটারের পাঠক-পাঠিকাগণসহ ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের ও বাংলাদেশের মুসলিম জনগণের প্রতি মোবারকবাদ। ঈদের আনন্দে প্রতিদিনই ভরে উঠুক ইসলামি উম্মাহ্র প্রতিটি পরিবারের গৃহ।