All posts by dreamboy

আধ্যাত্মিক কবি হাফিজ ও তাঁর কবিতা

 

তারিক সিরাজী –

কবি হাফিজ (১৩২৫-১৩৮৯ খ্রিস্টাব্দ) শুধু ইরানেরই নয়; বরং সমগ্র বিশ্বের প্রথিতযশা কবিদের একজন। তিনি ইরানের শিরাজ নগরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রকৃত নাম হলো শামসুদ্দীন মুহাম্মদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে মুহাম্মদ হাফিজ শিরাজী এবং কবি নাম বা ভনিতা হলো হাফিজ। তাঁর পিতা বাহাউদ্দীন ছিলেন ইসফাহানের একজন প্রসিদ্ধ ব্যবসায়ী। পরবর্তীকালে তিনি এ ব্যবসা ব্যাপদেশে ইসফাহান ত্যাগ করে শিরাজে চলে আসেন। তাঁর মা ছিলেন কাজরুনের অধিবাসী। তাঁর দুই ভাই ছিল যারা তাঁর চেয়ে বয়সে বড় এবং বয়ঃপ্রাপ্তির পর তারা শিরাজ ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যায়। কিন্তু হাফিজ মায়ের সাথেই আর্থিক সংকটের মধ্যে শিরাজে থেকে যান এবং জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি শিরাজেই অবস্থান করেছিলেন। মৃত্যুর পর তাঁকে ‘খাকে মুসাল্লা’ নামক স্থানে দাফন করা হয়।
হাফিজের শৈশব খুব একটা সুখের ছিল না। কারণ, পিতৃহারা হাফিজকে সংসারের দায় শৈশবেই বহন করতে হয়েছিল। যে কারণে অর্থ উপার্জনের বোঝা তিনি মাথায় পেতে নিয়েছিলেন। প্রসিদ্ধ ইরানি লেখক ও সাহিত্যিক আব্দুন্নবী তাঁর মেইখানে নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, হাফিজ স্থানীয় একটি রুটির দোকানে কাজ করতেন আর এখান থেকে লব্ধ অর্থ দিয়েই দিনযাপন করতেন। এই রুটির দোকানের পাশেই একটি বিদ্যালয় ছিল যেখানে কাওয়াম উদ্দিন আবদুল্লাহ (মৃত্যু ৭৭২ হি.) নামে একজন প্রসিদ্ধ আলেম শিক্ষা দান করতেন। হাফিজ রুটির দোকানে কাজ করার ফাঁকে ফাঁকে তাঁর কাছ থেকে বিদ্যার্জন করতেন। শুধু প্রাথমিক শিক্ষাই নয়, বরং কুরআন হেফ্জ করা থেকে কুরআনের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ও দর্শনশাস্ত্রেরও জ্ঞান অর্জন করেন। এরপর ধীরে ধীরে ইসলামের বিধি-বিধান ও সাহিত্য সংক্রান্ত জ্ঞান নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করতে শুরু করেন। যেহেতু সেকালে সাহিত্যের জ্ঞান শরীয়তের জ্ঞান লাভের পটভূমি ছিল, সেহেতু তিনি ধর্মীয় জ্ঞানেও প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করেন। হাফিজের যুগে শিরাজ ছিল ধর্মীয় জ্ঞান ও কবি-সাহিত্যিকদের আবাসভূমি। এই বিষয়টি তাঁর শিক্ষা-দীক্ষা ও জ্ঞানার্জনে বিস্ময়কর প্রভাব বিস্তার করে।
হাফিজ উপরিউক্ত শিক্ষক ছাড়াও শামসুদ্দীন আবদুল্লাহ শিরাজী ও কাজী এযদুদ্দীন আবদুর রহমান ইয়াহইয়ার নিকট থেকে দর্শন ও তাসাউফের জ্ঞান অর্জন করেন। জানা যায়, হাফিজ চল্লিশ বছর পর্যন্ত বিদ্যার্জনে রত ছিলেন। কুরআন কণ্ঠস্থকরণ ও কুরআনের জ্ঞানে সমৃদ্ধ হওয়ার কারণেই অবশেষে ‘খাজা হাফিজ’ নামে তিনি অভিহিত হয়েছিলেন। তাঁর কাব্যের ছত্রে ছত্রে এই কুরআনের প্রভাব প্রতিফলিত হয়েছে। হাফিজ নিজেই এ ব্যাপারে উল্লেখ করেছেন :
ندیدم خوشتر از شعر تو حافظ به قرآنی که اندر سینه داری
[হে হাফিজ! তোমার বক্ষে ধারণকৃত এই কুরআনের চেয়ে
সুন্দর ও সুমিষ্ট বাণী আর কিছুই দেখি নি।]
ইরানিরা কবি হাফিজকে আদর করে ‘বুলবুলে শিরাজ’ অর্থাৎ শিরাজের বুলবুল বলে আখ্যায়িত করে থাকেন। তারা হাফিজকে লেসানুল গায়েব (অজ্ঞাতের বাণী), তরজমানুল আসরার (রহস্যের মর্ম সন্ধানী) প্রভৃতি অভিধায় অভিহিত করে থাকেন।
হাফিজ ছোটবেলা থেকেই কাব্যচর্চায় অনুরক্ত হয়ে পড়েন। আবদুন্নবী তাঁর মেইখানে গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন যে, শিরাজে যেখানে তিনি অবস্থান করতেন তার সন্নিকটে একটি বাজার ছিল। বাজারে একজন বড় বস্ত্র ব্যবসায়ী ছিলেন। যিনি ছিলেন কাব্যপ্রেমিক ও রসিক প্রকৃতির লোক। যেখানে রসিক কবি-সাহিত্যিকরা এসে জড়ো হতেন এবং কাব্যচর্চায় মুখরিত থাকতেন। হাফিজও এখানে যাতায়াত করতেন এবং সমকালীন কবিদের সংস্পর্শ লাভ করতেন। তাঁর কাব্যচর্চা দেখে অনেক সময় বন্ধুরা তাঁকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রƒপ করত। উল্লেখ্য যে, তাঁর জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে খোদায়ী প্রেমের নিদর্শন দেখতে পাওয়া যায়। কেননা, এ খোদায়ী প্রেমই কাব্য সাধনায় তাঁকে উজ্জীবিত করেছিল।
হাফিজের মতে প্রেম-ভালোবাসা এমন এক ঐশী চেতনা যা মানুষকে তার প্রেমের মূলে তথা প্রেমাস্পদের সান্নিধ্য লাভে উদ্বুদ্ধ করে। স্রষ্টার আকর্ষণ তার মধ্যে এমনিভাবে এক বিশাল আকার ধারণ করে যে, সৃষ্টির যে কোনো সৌন্দর্যই তাকে স্রষ্টার স্মরণে আকুল করে তোলে। কবি হাফিজ এ প্রেমকে এমন এক মূল্যবান অর্ঘ্য বলে মনে করেনÑ যার প্রাপ্তি কেবল তার প্রেমাস্পদের একান্ত অনুগ্রহেই সম্ভব। হাফিজ মনে করেন, তাঁর মাঝে যে ঐশীপ্রেম বিদ্যমান রয়েছে তা কেবল তাঁর স্রষ্টার বিশেষ অনুগ্রহ ও দান। বিশ্বলোকের অপরাপর প্রাণিকূল এ অনুগ্রহ ও দান থেকে বঞ্চিত। হাফিজের কবিতা ও গজলের ছত্রে ছত্রে সেই প্রেমের দৃষ্টান্ত ও প্রতিভাস বিলক্ষণ খুঁজে পাই। লৌকিক প্রেমের পাশাপাশি তিনি স্বর্গীয় প্রেমকে অত্যন্ত নিপুণভাবে তাঁর কাব্যে ফুটিয়ে তুলেছেন। তবে হাফিজের ভাষায় এ প্রেম কোনো সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। প্রেম সলিলে অবগাহন করতে হলে প্রেমিকের জন্য যে অফুরন্ত ও অসীম সাধনার প্রয়োজন রয়েছে তা তাঁর কাব্যে ভাস্বর হয়ে ফুটে উঠেছে। হাফিজ বলেন :
الا یا ایها الساقی ادر کأسا و ناولها که عشق آسان نمود اول ولی افتاد مشکل‌ها
به بوی نافه‌ای کاخر صبا زان طره بگشاید ز تاب جعد مشکینش چه خون افتاد در دل‌ها
“হায় বধুয়া! দাও পেয়ালা ঢালো শারাব মধুক্ষরা
সহজ ছিল পথটি প্রেমের দেখছি এখন কাঁটা ভরা।
ভেবেছিলাম ভোর বাতাসে কস্তুরী-বাস আসবে ভেসে
বধুর চিকন চিকুর হতে, কলজে হলো ঘায়েল শেষে” (হাফিজ, ১৯৮ : ১৭(
হাফিজের একটি দিভান তথা কাব্যসমগ্র রয়েছে। এতে আছে গজল ও রুবায়িসহ নানা আঙ্গিকের কবিতা। কিন্তু হাফিজ গজল রচনা করেই বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন এবং গজল রচনায় তাঁকে ফারসি সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি বলা হয়ে থাকে। হাফিজ মধুর কণ্ঠে ও সুললিত ভাষায় তাঁর গজলসমূহে সুফি তত্ত্বই বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁর কবিতার মধ্যে বসন্ত, গোলাপ, বুলবুল, মদ, যৌবন, সৌন্দর্য এবং বিশেষ করে প্রেমিকা ও প্রেমাস্পদের রূপ, গুণ ও দোষের বর্ণনা রয়েছে। কিন্তু তাঁর এ সকল বর্ণনা রূপকভাবে খোদার প্রতি ভালোবাসার অপূর্ব কাহিনী মাত্র।
হাফিজের গজল শেখ সাদির প্রেমময় বিষয়বস্তু এবং ফরিদ উদ্দিন আত্তার ও মাওলানা রুমির আধ্যাত্মিক বিষয়বস্তুকে ধারণ করে আছে। এছাড়া কবি সানায়ির সামাজিক ও সমালোচনামূলক বিষয়ও তাঁর কাব্যে ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হয়। অন্যদিকে তিনি কাসিদার ন্যায় স্তুতি বর্ণনায়ও পারদর্শী ছিলেন। তাঁর কবিতার সম্বোধিত বিষয়বস্তু হলো প্রভু, প্রেমাস্পদ ও প্রশংসিত ব্যক্তি। তাই তাঁর কবিতা সাদির গজলের ন্যায় দ্রুত বুঝা যায় না এবং মাওলানা রুমীর প্রতীকী কবিতার মতো তা বুঝতে কঠিন বলেও মনে হয় না। তাঁর অধিকাংশ কবিতাই হলো আধ্যাত্মিক সুলভ। হাফিজ তাঁর কবিতাগুলোকে এমনভাবে বিন্যস্ত করেছেন যাতে পাঠক তৎক্ষণাৎ তা থেকে একটি কল্পিত ভাব গ্রহণ করতে পারে।
হাফিজের কবিতার অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে একটি হলো কবিতার শ্লোকগুলোর সাথে পারস্পরিক সম্পর্ক। তাঁর গজলগুলোতে একটি নীরব চিন্তাধারার ধারাবাহিকতা স্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয়ে ওঠে। হাফিযের গজলে পদগুলোর ধারাবাহিকতায় একটি পঙ্্ক্তি বা ছত্রের সাথে অপর একটি পঙ্্ক্তি বা ছত্রের বিষয়বস্তুগত পারম্পর্য বাহ্যিকভাবে লক্ষ্য করা যায় না। কিন্তু যখন কোনো অনুসন্ধিৎসু পাঠক তাঁর পুরো একটি গজলের বিষয়বস্তু হৃদয়ঙ্গম করতে পারবেন তখন তিনি একটি শ্লোকের সাথে অপর শ্লোকের বিষয়বস্তুরগত যে পারস্পরিক সম্পর্ক রয়েছে তা অনায়াসে বুঝতে পারবেন।
হাফিজ তাঁর কাব্যে শুধু রূপক প্রেমের বর্ণনাই করেন নি, বরং কবিতার কাঠামো নির্মাণে বিভিন্ন প্রকারের সাহিত্যালক্সকারের এমন প্রয়োগে দেখিয়েছেন যা তুলনা রহিত। তিনি তাঁর কবিতার শ্লোকগুলোতে ইহাম (দ্ব্যর্থবোধক বক্তব্য বা পরোক্ষ ইঙ্গিত), এস্তেখ্দাম (একই শব্দের ভিন্ন ভিন্ন অর্থ), তাশ্বিহ (উপমা বা সাদৃশ্য), তাজনিস (সাদৃশ্য), কেনায়া (রূপক) অত্যন্ত দক্ষতা ও নিপুণতার সাথে ব্যবহার করেছেন। বিশেষ করে ইহাম তথা দ্ব্যর্থবোধক শব্দ তাঁর কবিতায় বারবার ব্যবহৃত হয়েছে। তিনি তাঁর কাব্যে সুন্দর-সুন্দর উপমা ও উৎপ্রেক্ষা বর্ণনার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাছাড়া আরবি ও ফারসি সাহিত্যের একটি বড় বিষয় হচ্ছে কাফিয়া তথা অন্ত্যমিল। এ অন্ত্যমিল ব্যবহারের ক্ষেত্রেও তাঁর দক্ষতার ছাপ পরিলক্ষিত হয়। যেমন :
لعل سیراب به خون تشنه لب یار من است وز پی دیدن او دادن جان کار من است
[সতেজ, রক্তবর্ণ মণি বিশেষের ন্যায় আমার বন্ধুর ঠোঁট রক্তপিপাসু
এবং আমার কর্তব্য তাকে পেয়ে আত্মোৎসর্গ করা।]
বিদ্রƒপাত্মক ও সমালোচনাধর্মী বিষয়গুলোও তাঁর দিভানে বহুল পরিমাণে পরিলক্ষিত হয় এবং সাধারণত তিনি কপট ও বকধার্মিকদেরকে শ্লেষমিশ্রিত ভাষায় সমালোচনা করেছেন।
চৈন্তিক ও মানসিক দৃষ্টিকোণ থেকে হাফিজের কবিতা হলো ‘নেযামে রেন্দি’ তথা সূক্ষ্মদর্শী তাপসের জীবন পদ্ধতি। রেন্দি হলো বাকচাতুর্যে পটু এমন একজন তাপস ব্যক্তি বা সূক্ষ্মদর্শী আরেফ, যিনি চিন্তা ও কর্মে প্রেম বা এশ্্কের ওপর নির্ভর করে থাকেন। এমনিভাবে এশ্্ক্ শব্দটি প্রায়শই তাঁর কবিতায় ব্যবহৃত হয়েছে এবং তা প্রায় ২৩৪ বার পুনরাবৃত্তি হয়েছে। হাফিজের ভাষায় মূলত রেন্দির সাথে এশ্্কের একটা পারস্পরিক সম্পর্ক রয়েছে, সাধারণত সে কারণেই এ শব্দ দুটি তাঁর কাব্যে একত্রে ব্যবহৃত হয়েছে।
উল্লেখ করা যেতে পারে যে, শরাবের বর্ণনা হাফিজের কাব্যে অসংখ্যবার এসেছে। কারণ এটাই যে, হাফিজ ‘শরাব’-কে দুঃখ-বেদনার উপশম হিসাবে মনে করেছেন। তাঁর নিকট এটিই একমাত্র বস্তু যার মাধ্যমে জীবনের যত রকমের তিক্ততা ও বিস্বাদ আছে তা বিদূরিত করা যেতে পারে। যেমন হাফিজ বলেন :
ساقیا برخیز و درده جام را خاک بر سر کن غم ایام را
[হে সাকী! ওঠ, আমাকে শরাবের পেয়ালা দাও,
আর দুঃখের দিনের শিরে ধূলি নিক্ষেপ কর।]
হাফিজের কাব্যে এই যে উন্মত্ততার বহিঃপ্রকাশ তার অন্তর্নিহিত ও গূঢ় রহস্য অত্যন্ত ব্যাপক। তাঁর এই উন্মত্ততা এই জন্য নয় যে, তিনি কিছুক্ষণের জন্য শরাব পান করে নিজেকে অসাড় ও তন্ময়গ্রস্ত করে তুলবেন, বরং তিনি চাচ্ছেন এই প্রেম মদিরা পান করে নিজেকে সতেজ-সজীব ও প্রাণবন্ত করে তাঁর প্রেমাস্পদের বা আরাধ্যের সমীপে উপস্থিত হবেন। এছাড়া তিনি চাচ্ছেন এই প্রেমের শরাব পান করে তাঁর মধ্যে এমন একটি যোগ্যতা সৃষ্টি করবেন যাতে তিনি একটি অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে নিজেকে প্রেমাস্পদের সম্মুখে হাজির করতে পারেন।
আমরা প্রবন্ধের প্রারম্ভে উল্লেখ করেছি যে, হাফিজ দীর্ঘ চল্লিশ বছর পর্যন্ত জ্ঞান সাধনা করেছেন যা তাঁর নিজের গজল থেকে উদ্ধৃত করা যেতে পারে :
علم و فضلی که به چل سال دلم جمع آورد ترسم آن نرگس مستانه به یغما ببرد
[দীর্ঘ চল্লিশ বছরের সাধনায় আমার অন্তরে
যে জ্ঞান-বৈশিষ্ট্য সঞ্চিত হয়েছে,
ভয় হয়, না জানি প্রেয়সীর চোখের চাহনি
তা হরণ করে নিয়ে যায়।]
কাব্যচর্চার পাশাপাশি তাঁর এই জ্ঞানচর্চা নিছক কোনো বৈষয়িক জ্ঞান ছিল না। অধিকন্তু ক্ষেত্রে তা ছিল অধ্যাত্ম বা পরমার্থ জ্ঞান। তবে এই আধ্যাত্মিক সাধনার ক্ষেত্রে হাফিজ মুরশিদের আবশ্যকতা উপলব্ধি করেছেন বিধায় তিনি বাহাউদ্দিন নকশেবন্দীসহ একাধিক প্রসিদ্ধ সুফির সংস্পর্শে সময় ব্যয় করেছেন। এ ব্যাপারে হাফিজের মত হচ্ছে এই মুর্শিদ ব্যতীত প্রেমের পথে পা বাড়িও না। এ পথের পথপ্রদর্শক (সালেক) বা মুর্শিদ না পেলে পথিককে পথভ্রান্ত হতে হয়। তবে এ ক্ষেত্রে সচেতনতা ও সতর্কতা অপরিহার্য। কারণ, গুরু চিনতে ভুল করলে শিষ্যের জীবনে ভ্রান্তি, ভ্রষ্টতা ও বিচ্যুতি নেমে আসা একান্তই স্বাভাবিক। হাফিজ বলেন :
به می سجاده رنگین کن گرت پیر مغان گوید که سالک بی‌خبر نبود ز راه و رسم منزل‌ها
[তোমার খাঁটি পীর যদি বলে তবে শরাব রং-এ তোমার মুসাল্লা রাঙ্গিয়ে নাও,
কেননা, সালেক মানযিলের পথ-পদ্ধতি সম্পর্কে সম্যক অবগত।]
হাফিজ তাঁর কাব্যে সুরা-সাকী প্রভৃতি শব্দ কতটা রূপক (অপ্রকৃত) বা প্রকৃত অর্থে ব্যবহার করেছেন তা নিয়ে আলোচনার অবকাশ আছে বলে অনেকে মনে করেন।
গোঁড়াপন্থীরা যাই বলুন, হাফিজ যে একজন ধর্মপ্রাণ, খোদাভক্ত মুসলমান ছিলেন, তাঁর রচিত কাব্যের বহু স্থানে সেই সত্য বিক্ষিতপ্তভাবে রয়েছে। এ প্রসঙ্গে হাফিজের ইন্তেকালের পর জানাযা নিয়ে গোঁড়াপন্থী ও উদারপন্থীদের মধ্যে যে বিরোধ উপস্থিত হয়েছিল তা উল্লেখযোগ্য। গোঁড়াপন্থীরা হাফিজকে ধর্মদ্রোহী শারাবখোর বলে তাঁর জানাযা দিতে অস্বীকার করে এবং এ নিয়ে হাফিজের উদারপন্থী ভক্তবৃন্দের সাথে তাদের বিবাধ ঘটে। কতিপয় লোকের হস্তক্ষেপের ফলে এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, হাফিজের রচিত কবিতা একত্র করে সেখান থেকে যে কোনো একটি কবিতা তুলে দেখা যাক, এ সম্বন্ধে তিনি কিছু লিখে গেছেন কি-না। তাই করা হলো এবং যে কবিতাটি প্রথম তুলে নেয়া হলো তা হলো :
قدم دریغ مدار از جنازه حافظ که گر چه غرق گناه است می‌رود به بهشت
[হাফিজের জানাযা থেকে ফিরে যেও না ভাই
যদিও সে পাপে মগ্ন রয়েছে তথাপি বেহেশতে পাবে ঠাঁই।]
এ কবিতা উদ্ঘাটনের পর হাফিজকে ‘লেসানুল গায়েব’ বা অদৃষ্টের রসনা বলে স্বীকার করে উভয় দল মহাসমারোহ ও সম্মানের সাথে তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন করেন। অনেকের বিশ্বাস এখন পর্যন্ত কেউ তাঁর দিভান খুলে দিভানের যে কবিতার ওপর প্রথম দৃষ্টি পড়ে, সে কবিতায় তার ভবিষ্যৎ ইঙ্গিত লাভ করে।
হাফিজ তাঁর গজল ও রূবাইগুলোতে বিশুদ্ধ প্রেমের মাহাত্ম্য ও খোদাপ্রাপ্তির তথা খোদার নৈকট্য লাভের উপায় বর্ণনা করেছেন। হাফিজের কাব্যে কোথাও ধর্মের ভান বা প্রতারণার অবকাশ নেই। তাঁর মতে খোদার প্রেমে অবগাহন করে যে নিজেকে বিলীন করে দিতে পারে সেই প্রকৃত খোদাপ্রেমিক। ধর্মের নামে প্রতারণা বা ভান করা সম্পর্কে হাফিজ বলেন :
آتش زهد و ریا خرمن دین خواهد سوخت حافظ این خرقه پشمینه بینداز و برو
[কপটতা ও প্রতারণার আগুন ধর্মের ভা-ারকে অবশ্যই জ্বালিয়ে ফেলবে,
হে হাফিজ! এ দরবেশি পোশাক পরিত্যাগ করে সামনে অগ্রসর হও।]
বাহারে হেজাজ (কবিতার এক প্রকার ছন্দের নাম) ছন্দে লিখিত কবি হাফিজের এই শ্লোকটি অথবা অনুরূপ আরো অনেক শ্লোকই তাঁর শব্দচয়ন, ভাষা-ছন্দ ও অলংকারের নিপুণতার স্বাক্ষর বহন করে।
তিনি আরো বলেন,
سخن عشق نه آن است که آید به زبان ساقیا می ده و کوتاه کن این گفت و شنفت
[মুখে যা কিছু উচ্চারিত সেটাই প্রেমের কথা নয়,
হে সাকী! ঢালো শরাব আর সংক্ষিপ্ত কর তোমার কথাবার্তা।]
প্রেম-বিরহ এবং মায়ামমতায় ঘেরা এই নশ্বর পৃথিবীতে যা কিছু আছে তা তুচ্ছ ও অনর্থক নয়। মানুষের জীবনে সুখ-শান্তির পাশাপাশি বিরহ-বেদন, দুঃখ-যাতনা অনিবার্য হয়ে দেখা দেয়। মানুষ এই পৃথিবীতে স্বপ্নের তাজমহল গড়তে চেষ্টা করে। সংসার গড়ে। স্ত্রী-পুত্র পরিজনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। আর এ পথ ধরে মানুষের জীবনে আসে নিরবচ্ছিন্ন প্রেমের তাগাদা। কবি হাফিজের জীবনও হয়তো এর ব্যতিক্রম ছিল না। তাই আমরা তাঁর যৌবনের শুরুতেই দেখতে পাই শাখ-ই-নাবাতের মত এক প্রেয়সীর সান্নিধ্য লাভের একান্ত বাসনা। কবির জীবনে এটা কতটা সত্য তা আমরা জানি না, তবে জীবনীকাররা এ ঘটনার উল্লেখ করেছেন।
হাফিজ সংসার ধর্ম যাপন করেছেন যে কথা আমরা উপরে উল্লেখ করেছি। তাঁর পুত্রসন্তান ‘বুলবুল’ অকালে প্রাণ হারালে হাফিজ তার জন্য ক্রন্দন করেছেন। হাফিজ বলেন :
دلا دیدی که آن فرزانه فرزند چه دید اندر خم این طاق رنگین
به جای لوح سیمین در کنارش فلک بر سر نهادش لوح سنگین
“ওরে হৃদয়” তুই দেখেছিস¬Ñ পুত্র আমার আমার কোলে
কি পেয়েছে এই সে রঙিন গগণ-চন্দ্রাতপের তলে।
সোনার তাবিজ রূপার সেলেট মানাত না বুকে রে যার,
পাথর চাপা দিল বিধি হায় কবরের সিথানে তার।” (নজরুল, ১৯৯৬: ৪৩)
কবির জীবনে প্রেমের এই যে বিচিত্র লীলাখেলা তা কতটা লৌকিক আর কতটা স্বর্গীয় তা নির্ণয়ের ভার হাফিজের বোদ্ধা পাঠক ও সমালোচকদের ওপরেই ছেড়ে দেয়া ভালো। তবে তিনি যে যৌবনের প্রারম্ভেই এই প্রেমসাগরে অবগাহন করেছেন তা তাঁর কাব্যে বিচিত্রভাবে বিধৃত হয়েছে। হাফিজ বলেন :
اگر آن ترک شیرازی به دست آرد دل ما را به خال هندویش بخشم سمرقند و بخارا را
بده ساقی می باقی که در جنت نخواهی یافت کنار آب رکن آباد و گلگشت مصلا را
[শিরাজের সেই তুর্কী তন্বী যদি আমার হৃদয় হরণ করে
তবে তার কালো তিলের তরে সমরকন্দ ও বোখারা দান করে দেব।
ওগো সাকী, অবশিষ্ট শরাবটুকু আমায় দাও, কেননা বেহেশতে
রোকনাবাদের স্রোতস্বতী ও মোছাল্লায় পুষ্প উদ্যান মিলবে না।]
হাফিজ আল্লাহর প্রেমে নিমগ্ন হলেও দেশ, দেশের মাটি ও মানুষকে গভীর অন্তর দিয়ে ভালোবাসতেন। এই ভালোবাসা ছিল যেমনি সনাতন তেমনি নির্বিশেষ। হাফিজ শিরাজের লোক। শিরাজকে তিনি কীভাবে ভালোবেসেছেন তার নির্দশন আমরা খুঁজে পাই তাঁর কবিতার পরতে পরতে। কবি হাফিজ জীবনভর শিরাজ নগরীর সঙ্গে তাঁর অন্তরকে বেঁধে রেখেছিলেন। যেমন তিনি বলেন :
اگر چه زنده رود آب حیات است ولی شیراز ما از اصفهان به
[যদিও ইসফাহান হচ্ছে সঞ্জিবনী সুধা, কিন্তু আমাদের শিরাজ হচ্ছে
ইসফাহানের তুলনায় সহস্রগুণে শ্রেষ্ঠ।]
خوشا شیراز و وضع بی‌مثالش خداوندا نگه دار از زوالش
[শিরাজ নগরী তুলনাহীন, তার প্রশংসা আর কত করব
হে খোদা! যে কোনো ধরনের পতন থেকে একে রক্ষা কর।]
তিনি সব সময়ই এ সবুজ শ্যামল ও সুখময় স্থান তথা তাঁর স্থায়ী বাসস্থানের সঙ্গে নিজের অন্তরকে বেঁধে রেখেছিলেন। জানা যায় তিনি একবার ভ্রমণের উদ্দেশ্যে বের হয়েছিলেন। কিন্তু শিরাজ থেকে ইয়ায্দ পর্যন্ত পৌঁছেই ক্লান্ত হয়ে পড়েন। তিনি তাঁর প্রিয় শিরাজ নগরীকে বার বার স্মরণ করেন এবং বলেন :
خرم آن روز کز این منزل ویران بروم راحت جان طلبم و از پی جانان بروم
دلم از وحشت زندان سکندر بگرفت رخت بربندم و تا ملک سلیمان بروم
[সেই সৌভাগ্যপূর্ণ দিনগুলো কখন ফিরে আসবে,
যখন আমি এই বিরাণ ভূমি থেকে প্রত্যাবর্তন করতে পারব?
কখন সে দুঃখ-বেদনা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে এবং প্রিয়তমার সাক্ষাৎ লাভ হবে?
আলেকজান্ডারের জেলখানার আতংকে আমার অন্তর সংকীর্ণ ও আড়ষ্ট হয়ে গেছে,
কখন সফরের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করব
কখন সোলাইমানের নগরীতে প্রত্যাবর্তন করব?]
কবি রচিত এই কবিতাগুলোতে আধ্যাত্মিকতা চিন্তা করলে কবির অন্তরের গভীর অনুধ্যান কী তা আমরা উপলব্ধি করতে পারি। এখানে উল্লিখিত দ্বিতীয় শ্লোকটির ব্যাখ্যা হচ্ছে এই যে, ইতিহাস এবং প্রাচীন উপাখ্যানসমূহে লিপিবদ্ধ আছে যে, আলেকজান্ডার যখন ইরানে পদার্পণ করেন তখন তিনি ইয়ায্্দ নগরীতে তাঁর জেলখানা স্থাপন করেন। অর্থাৎ যখনই কাউকে গ্রেফতার করা হতো তখন তাকে ইয়ায্্দের কয়েদখানায় প্রেরণ করা হতো। অন্যদিকে সে সুপ্রাচীনকাল থেকেই ‘শিরাজ’ এবং ‘তাখ্তে জামশিদ’ সোলাইমান নগরী বলে খ্যাত।
হাফিজের কাব্যের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আশাবাদ। প্রেমের ক্ষেত্রে তিনি কখনো নৈরাশ্যবাদে বিশ্বাসী ছিলেন না। তাঁর জীবনে অন্য কবিদের মতো বিরহ-বিচ্ছেদের অন্ধকার গভীর রজনী উপস্থিত হয়েছে বটে, কিন্তু তিনি বিশ্বাস করতেন এ রাত দীর্ঘস্থায়ী হবে না। প্রেম-ভালোবাসার মধ্য দিয়ে অচিরেই উজ্জ্বল প্রভাত অন্ধকারের কুহেলিকা ভেদ করে আবির্ভূত হবেÑ যা খুশির বার্তা বয়ে আনবে এবং বিষণœ কুটির একদিন আনন্দের বাগানে পরিণত হবে। যেমন তিনি বলেন :
یوسف گم گشته بازآید به کنعان غم مخور کلبه احزان شود روزی گلستان غم مخور
[হারানো ইউসুফ আসবে ফিরে আবার কেনানে, চিন্তা করো না তাই,
এই বিষণœ কুটির একদিন হবে যে গুলিস্তান, চিন্তা করো না ভাই।]
প্রেমের শক্তিমত্তার কথা তুলে ধরে হাফিজ বলেন :
دولت عشق بین که چون از سر فقر و افتخار گوشه تاج سلطنت می‌شکند گدای تو
[প্রেমের শক্তি ও মর্যাদার প্রতি দৃষ্টি দাও, কেননা, এর গৌরব এতটাই যে,
তোমার ক্রন্দন ও ফরিয়াদে সাম্রাজ্যের কোনা ধসে পড়বে।]
হাফিজের অবস্থান ছিল ভাবজগতের এতটাই ঊর্ধ্বে যে, তিনি নিজেকে কখনো কোনো সম্প্রদায়ের গ-ির মাঝে ধরে রাখতে চেষ্টা করেন নি। তাঁর মতে প্রেমের রাজ্যে কোনো গ-িভেদ নেই। কবি হাফিজের অন্যকিছু ভাবার সময় ছিল না।
বাংলার সুলতান গিয়াস উদ্দীন সেকান্দর শাহ (৭৬৮ হি.) সিংহাসনে আরোহণের পর এই গজল সম্রাটকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন এই সোনার বাংলায় তাঁর রাজধানীতে। কবি আসতে পারেন নি বটে, কিন্তু সুদূর ইরান থেকে তাঁর অন্তরের নির্যাসস্বরূপ যে মিছরি-খ- পাঠিয়েছিলেন তার অমিয় স্বাদ এখনও আমাদের রসনাকে তৃপ্ত করছে বিপুলভাবে। কবির সে বিখ্যাত কবিতার কয়েকটি শ্লোক এখানে উদ্ধৃত করা হলো :
شکرشکن شوند همه طوطیان هند زین قند پارسی که به بنگاله می‌رود
طی مکان ببین و زمان در سلوک شعر کاین طفل یک شبه ره یک ساله می‌رود
আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এ চরণ দু’টির মর্মার্থ নি¤œরূপ উল্লেখ করেছেন :
“আজকে পাঠাই বাঙ্লায় যে ইরানের এই ইক্ষু-শাখা,
এতেই হবে ভারতের সব তোতার চঞ্চু মিষ্টিমাখা।
দেখ গো আজ কল্পলোকের কাব্যদূতীর অসম সাহস,
এক বছরের পথ যাবে যে, একটি নিশি যাহার বয়স।” (নজরুল, ১৯৯৬: ৪৫)

তথ্যনির্দেশ:
১. আব্দুল হাফিজ (১৯৮৪ খ্রি.): হাফিজের গজল গুচ্ছ, বাংলাডেমী ঢাকা
২. আল্লামা শিবলী নোমানী, শেরুল আজম (পারস্যের কবি), এম ফরমান আলী এন্ড সন্স বুক সেইলারজ, লাহোর
৩. আয়াতুল্লাহ মুর্তজা মোতাহারী (১৯৮৭ খ্রি.): হিজরত ও জিহাদ, [অনুবাদ : অধ্যাপক সিরাজুল হক], সাজেমানে তাবলিগাতে ইসলামি (বাংলা বিভাগ), তেহরান
৪. আহমাদ তামীমদারী (২০০৭ খ্রি.) : ফার্সী সাহিত্যের ইতিহাস, [বাংলা ভাষায় অনূদিত],আলহুদা আন্তর্জাতিক প্রকাশনা সংস্থা, ইরান
৫. কাজী নজরুল ইসলাম (১৯৯৬) : নজরুল রচনাবলী, (২য় খ-) বাংলা একাডেমী, ঢাকা
৬. বাহাউদ্দীন খুররম শাহী (১৯৮৭ খ্রি.) : হাফেজ নামে (হাফিজের সাহিত্যকর্ম), সরুশ প্রকাশনী, তেহরান, (১ম ও ২য় খ-)
৭. মির্যা মকবুল বেগ বাদাখশানি, আদব নামে ইরান (ইরানের সাহিত্য), (২য় খ-) ইউনিভার্সিটি বুক এজেন্সী, লাহোর
৮. মুহম্মদ মনসুর উদ্দীন (১৩৭৫ বঙ্গাব্দ) : ইরানের কবি, বাংলা একাডেমী, ঢাকা
৯. মুহাম্মদ সুদি বাসনুভি (১৯৮৬ খ্রি.) : শারেহ সুদি বার হাফেজ (মুহাম্মদ সুদি বাসনুভিকৃত হাফিজের কবিতার ব্যাখ্যা) [অনুবাদ: আছমাত সেতারে যাদেহ], র্যারিন প্রকাশনী তেহরান
১০. মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ (২০০০ খ্রি.) : পারস্য প্রতিভা, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, ঢাকা
১১. রেযা যাহেদ শাফাক, তারিখে আদাবিয়্যাতে ইরান (পারস্য সাহিত্যের ইতিহাস), পাহলভী বিশ্ববিদ্যালয়, ইরান
১২. হরেন্দ্র চন্দ্র পাল (১৩৬০ বঙ্গাব্দ) : পারস্য সাহিত্যের ইতিহাস, শ্রী জগদীশ প্রেস, কলকাতা
১৩. হাফেজ শিরাজী (১৯৯৯ খ্রি.) : দিভানে গাযালিয়াতে মাওলানা শামসুদ্দীন হাফেজ শিরাজী (হাফিজের গজলসমগ্র), সাফি আলী শাহ প্রকাশনী, ইরান
১৪. ঊফধিৎফ এ. ইৎড়হিব (১৯৬৯ ঈঊ): অ ষরঃবৎধৎু ঐরংঃড়ৎু ড়ভ চবৎংরধ, ঠড়ষ.-ওওও, ঈধসনৎরফমব টহরাবৎংরঃু ঢ়ৎবংং, খড়হফড়হ,

মানবতার উৎকর্ষ সাধক কবি হাফেজ শিরাজী ও রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর

ড. সাইয়্যেদ হাসান সেহা

দূর অতীতে প্রাচীন গ্রিস পরিচিত হয়েছিল দর্শনশাস্ত্রের কারণে আর ফ্রান্সের পরিচিতি ছিল সাহিত্যের সুবাদে। একইভাবে রোম পরিচিত ছিল নয়নজুড়ানো স্থাপত্য শিল্পের কারণে, রাশিয়ার খ্যাতি ছিল টলস্টয়, দস্তায়ভস্কি ও চাখুভ প্রমুখ ঔপন্যাসিকদের খ্যাতির সুবাদে। আর প্রাচীন জার্মানির পরিচিতি ছিল তার নিজস্ব দার্শনিক বৈশিষ্ট্যের কল্যাণে। এ ক্ষেত্রে ইরান ভূখ-ের পরিচিতি ছিল কবিতা ও সাহিত্যের দেশ হিসেবে। শেখ ফরিদ উদ্দিন আত্তার, শেখ সাদী, আবুল কাসেম ফেরদৌসী, মওলানা রূমী ও হাফেয শিরাজীর মতো মহান ব্যক্তিগণ ইরানের জন্য এমনই জাতীয় ঐশ^র্য বয়ে এনেছেন।
রবিন্দ্রনাথ ঠাকুরও সাহিত্যে এশিয়ার প্রথম নোবেল বিজয়ী হিসেবে নিজের সর্বোতমুখী চেষ্টা নিয়োজিত করেছিলেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল সে সময়কার ভারতবর্ষকে ঐশ^র্যশালী করা। তবে যে কথাটি বাস্তব তা হলো, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন বাংলাভাষী, তিনি বাংলাভাষী কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেছেন এবং কলকাতা ও আজকের বাংলাদেশে জীবন অতিবাহিত করেন, বাংলা ভাষায় কবিতা চর্চা করেন এবং তাঁর কবিতাসমূহ বাংলা ভাষায় প্রকাশিত কলকাতার পত্রপত্রিকায় মুদ্রিত হয়েছে। আর তিনি বাংলার সংস্কৃতিকেই লালন করেছেন এবং শেষ পর্যন্ত কলকাতাতেই দুনিয়া থেকে বিদায় গ্রহণ করেছেন। এসব কারণে তাঁকে ভারতবর্ষের কবি বলার আগে বৃহত্তর বাংলা (বাংলাদেশ)-র কবি এবং বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জাতীয় কবি হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়।
অবশ্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বা তাঁর মতো লোকদের জন্য তাঁকে কোন্ দেশের নাগরিক বলা হবে তা মোটেও গুরুত্বপূর্ণ নয়। কেননা, কবি, সহিত্যিক, সংস্কারক, মরমিবাদী, দার্শনিক, শিল্পী ও সংগীতজ্ঞদের কাছে ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক বিভাজনের কোনো অর্থ নেই। মহাকবি হাফেয শিরাজীর কাছেও এ ধরনের ভৌগোলিক সীমারেখার মোটেও গুরুত্ব ছিল না। যেমন তিনি ইরানে বসে কবিতা রচনা করতেন আর এজন্য আনন্দিত ছিলেন যে, তিনি বাংলার জন্য পারসির কান্দ প্রেরণ করেছেন। ঠাকুরও ভারতবর্ষের প্রতি যেমন ভালোবাসা পোষণ করতেন তেমনি ইরান ও এশিয়ার সকল দেশ আর এখানকার জাতিসমূহের প্রতিও ভালোবাসা পোষণ করতেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিশ^জনীন চিন্তাধারা উপলব্ধি করার জন্য এটুকুই যথেষ্ট যে, বিশে^র প্রখ্যাত চিন্তাবিদ, যেমন আলবার্ট আইনস্টাইন, রূমান রোলান, এইচ জি ভালজ প্রমুখের সাথে ১৯৩০-এর দশকে ঠাকুরের যেসব সাক্ষাৎ ও আলোচনা হয়েছে, তা বিবেচনায় আনা হবে। এসব আলোচনার বিষয়বস্তু নিয়ে চিন্তাভাবনা করে দেখলেই উপরিউক্ত বক্তব্যের সত্যতা প্রমাণিত হবে। ঠাকুর তাঁর সময়কার প্রায় সকল জ্ঞানী-মনীষী, বুদ্ধিজীবী ও তারকা শিল্পী, যেমন হ্যানরি ব্রাগসন, জর্জ বার্নাড শ, টমাস ম্যান ও রবার্ট ফ্রস্ট প্রমুখের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। সেই তুলনায় হাফেজ শিরাজি পৃথিবীর সর্বত্র সফর, পর্যটন কিংবা তখনকার দিনের জ্ঞানী-মনীষীদের সাথে দেখা-সাক্ষাতের পক্ষপাতি ছিলেন না। হাফেজ নিজেই বিষয়টিকে বেশ শৈল্পিক আঙ্গিকে ব্যক্ত করেছেন। বলেছেন,
نمی دهند اجازت مرا به سیر و سفر
نسیم باد مصلا و آب رکنا باد
নামী দাহান্দ এজা’যত মারা’ বে সাইর ও সাফার
নাসীমে বা’দে মুসাল্লা’ ও আ’বে রোকনা’বা’দ
সফর ও পর্যটনের অনুমতি দেয় না যে আমাকে
ঈদগাহের মলয় সুবাস ও রোকনাবাদের ঝর্নাধারা।
আমাদের আফসোস লাগে, হাফেজ যদি পৃথিবীর সকল দেশকে নিকট থেকে দেখতেন, তাহলে সেসব দেশের সৌন্দর্যগুলোও তাঁর কবিতার ভাষায় মনিমুক্তা খচিত আকারে আরো সুন্দররূপে প্রস্ফুটিত হতো। ঠিক যেভাবে তিনি ইরানের শিরাজ ও শিরাজের রূপের বাহারকে বিশ^জনীনতা দিয়েছেন। আমরা দেখি যে, হাফেজের মতো ঠাকুরের মাঝেও প্রকৃতি ও নিসর্গের প্রতি প্রীতি ও ভালোবাসা প্রবল ছিল।
হাফেজ শিরাজী ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সংগীত চেতনা ও প্রতিভা
হাফেজ ও ঠাকুরের মধ্যে যেসব অভিন্ন সূত্র খুঁজে পাওয়া যায়, তার অন্যতম হলো সুর, ছন্দ, সংগীতের দ্যোতনা আর সংগীতের তাল-লয় ও বিভিন্ন সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়গুলোর প্রতি সচেতনতা ও মনোযোগ। তবে এটুকু তফাৎ যে, হাফেজ তাঁর সুরেলা গজল কাব্যে তাঁর সংগীত প্রিয়তার ছন্দ ও সুরের সর্বোচ্চ প্রকাশ ও প্রমাণ দিয়েছেন। কিন্তু ঠাকুর সংগীতের যন্ত্র বাদন ও সংগীতের সূক্ষ্ম তত্ত্ব রচনায় প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বার্লিনে আইনস্টাইনের সাথে সাক্ষাৎকালে গান ও সংগীত, হস্তলিপি ও চিত্রাঙ্কনে মেলোডির ভূমিকা এবং সৌন্দর্যের আপেক্ষিকতা সম্পর্কে এমন দক্ষতার সাথে কথা বলেন যে, বিশ^বিখ্যাত এই জার্মান বিজ্ঞানী অবাক হয়ে যান।
কুরআন মজীদ সম্পর্কে হাফেজের দক্ষতা
তবে মহাকবি হাফেজ শিরাজীর অনন্যতার একটি কারণ ছিল কুরআন মজীদের বিষয়ে তাঁর অগাধ পা-িত্য। সামগ্রিক পর্যালোচনায় আমাদের কাছে প্রতীয়মান হয় যে, হাফেজ সম্ভবত যে বিষয়টিকে সর্বাধিক প্রাধান্য দিয়েছিলেন তা ছিল, তিনি যে সময়টি ভ্রমণে কাটাতে পারতেন, সে সময়টিকে কুরআন মজীদ অনুধ্যানে বিনিয়োগ করেছেন। এ কারণেই তিনি হাফেজে কুরআন হতে পেরেছেন এবং ‘হাফেজ’ নামেই তাঁর খ্যাতি। তিনি ১৪টি ভিন্ন ভিন্ন বর্ণনা রীতিতে কুরআন পড়তে সক্ষম ছিলেন। হাফেজ বলেন,
عشقت رسد به فریاد ارخود به سان حافظ
قرآن زبر بخوانی در چارده روایت
এশকাত রসদ বে ফারয়া’দ আর খোদ বে সা’ন হাফেয
কুরআ’ন যে বর বেখা’নী দার চা’রদে রেওয়ায়াত
তোমার প্রেম চিৎকার দিয়ে উঠবে যদি হাফেজের মতো
কুরআন মুখস্ত পড় চৌদ্দ প্রকার রেওয়ায়েত সহকারে।
হাফেজের কবিতায় কুরআনের আয়াত বা আয়াতাংশের উদ্ধৃতি
১. হফেজের কবিতায় ফাঁকে ফাঁকে কুরআন মজীদের কোনো আয়াত বা আয়াতাংশের উদ্ধৃতি এসেছে অতিশয় শৈল্পিক সৌন্দর্য নিয়ে। যেমন-
حضور خلوت انس است و دوستان جمعند
و ان یکاد بخوانید و در فراز کنید
হুযুর খালওয়াতে উন্স আস্ত ওয়া দূস্তা’ন জামআন্দ
ওয়াইন য়াকা’দু বেখা’নীদ ও দার ফারা’য কুনীদ
উপস্থিতি তো সান্নিধ্যের নির্জনতা আর বন্ধুদের সমাগম
ওয়া ইন ইয়াকাদু তেলাওয়াত কর আর খুলে দাও দরজা।
২. হাফেজ কুরআন মজীদের ভাবার্থকেও কবিতার ভাষায় ফুটিয়ে তুলেছেন। েেযমন সূরা আহযাবের ৭৩ নং আয়াতের ভাবার্থ ভাস্বর হয়েছে তাঁর এ কবিতায়-
آسمان بار امانت نتوانست کشید
قرعه فال به نام من دیوانه زدند
আ’সেমা’ন বা’রে আমা’নত নাতাওয়ানেস্ত কাশীদ
কুরআয়ে ফা’ল বে না’মে মানে দীওয়ানে যাদান্দ
আসমান পারে নি বহন করতে এই আমানত ভার
অবশেষে আমি পাগলের নামে এল ভাগ্যফল তার।
৩. তিনি কুরআনে বর্র্র্র্ণিত কাহিনীকেও শিল্পিত আঙ্গিকে তুলে এনেছেন তাঁর কবিতায়। যেমন-
یوسف گم گشته باز آید به کنعان غم مخور
کلبه احزان شود روزی گلستان غم مخور
ইউসুফে গুম গাশতে বা’য আ’য়াদ বে কেনআ’ন গাম মাখূর
কুলবেয়ে আহযা’ন শাওয়াদ রূযী গুলেস্তা’ন গাম মাখূর
হারানো ইউসুফ কেনানে আবার আসবে ফিরে চিন্তা নেই
দুঃখের এ কুটির হবে একদিন ভরা ফুলবন চিন্তা নেই।
৪. কখনো গল্পের পিঠে গল্প দিয়ে সাজিয়েছেন তিনি কবিতার পসরা-
ای هدهد صبا به سبا می‌فرستمت
بنگر که از کجا به کجا می‌ فرستمت
আই হুদহুদে সাবা’ বে সাবা’ মী ফেরেস্তামেত
বিনগার কে আয কোজো’ বে কোজো’ মী ফেরেস্তামেত
ওহে প্রভাতের হুদহুদ তোমায় পাঠাচ্ছি সাবায়
দেখ প্রেরণ করছি কোত্থেকে কোথায় তোমায়?
আল্লাহর বাণী কুরআনের ব্যাপারে এমন পা-িত্যই হাফেজকে কবিতার শিল্পে অনন্যতা দিয়েছে। আমরা আবারো হাফেজ ও ঠাকুর প্রসঙ্গে ফিরে আসছি।
হাফেজ ও ঠাকুরের মনোবৈজ্ঞানিক চেতনা
হাফেজ এমনভাবে মানুষের মনস্তত্ত্ব নিয়ে কবিতা রচনা করেছেন এবং তাতে এতখানি পারদর্শিতা দেখিয়েছেন যে, প্রত্যেক যুগের মানুষ মনে করে যে, হাফেজ আমাদের নিয়েই কবিতা রচনা করেছেন। তিনি কবিতার মাধ্যমে চিকিৎসার কাজ আঞ্জাম দিয়েছেন। মানবতার সকল দুঃখ দরদ নিয়ে তিনি কবিতা লিখেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মধ্যেও আমরা তার সাক্ষাৎ পাই। তিনি বিশে^র জ্ঞানী-মনীষীদের সাথে সাক্ষাতে আলাপকালে ভারতবর্ষের জনগণ তথা এশিয়ার গণমানুষের দুঃখ-দুর্দশার কথা এমনভাবে তুলে ধরেছেন যা দুনিয়ার যে কোনো স্বাধীনচেতা মানুষকে প্রশংসামুখর করে। রোমান রোলানের সাথে সাক্ষাতের সময় তিনি ভারতীয়দের কাল্পনিক কুসংস্কার পূজা, ধর্মীয় সহনশীলতা ও বিজ্ঞানকে মানবকল্যাণে নিয়োজিত করার বিষয়গুলোর ব্যাখ্যা করেন। তাতে রোলান কবির চিন্তাধারার উচ্চতায় অভীভূত হয়ে যান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মানুষে মানুষে হানাহানির প্রতি ভীষণভাবে রুষ্ট ছিলেন। তিনি সকল মানুষকে মনে করতেন ঈশ^রের সন্তান। কাজেই ঈশ^রের সন্তানদের হত্যা করা যাবে না, অন্যায়ভাব তাদের রক্তপাত ঘটানো যাবে না; বরং মানুষের ব্যক্তিসত্তাকে মর্যাদা দিতে হবে। মানুষের ব্যক্তিসত্তার বিকাশের প্রতি তিনি অতিশয় গ্ররুত্ব আরোপ করতেন। হাফেজ শিরাজী কিন্তু ঠাকুরের এসব কথাকে একটি মাত্র বাক্যে অত্যন্ত শৈল্পিক দ্যোতনায় উপস্থাপন করে বলেছেনÑ
جانا روا نباشد خونریز را حمایت
জা’না’ রওয়া’ নাবা’শাদ খোনরীয রা’ হেমা’য়েত
প্রিয়তম মোটেও বৈধ নয় রক্তপাতে সমর্থন জ্ঞাপন
রাজনৈতিক ও সামাজিক বিচার-বিশ্লেষণে হাফেজ ও ঠাকুরের দক্ষতা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভারতের জন্য কবিতা লিখতেন, প্রবন্ধ রচনা করতেন, ব্রিটিশ নীতির সমালোচনা করতেন। তাঁর এসব রচনার অধিকাংশই উল্লিখিত বৈশিষ্ট্য ও বিষয়বস্তুর কারণে ভারতের জাতীয় রচনাবলিতে রূপান্তরিত হয়েছে। এ জাতীয় রচনার মধ্যে অন্যতম হলো ‘জাতীয় আন্দোলন’ শীর্ষক সংকলন, যা ১৯০৪ সালে প্রকাশিত হয়েছে।
হাফেজ তাঁর রচনায় যুগের প্রদর্শনেচ্ছু প্রতারকদের প্রতি কটাক্ষবান নিক্ষেপ করেছেন। তিনি তথাকথিত শরীয়তের আইন প্রয়োগকারী, সুফি, সংসারত্যাগী, মুফতি, মুহতাসিব প্রভৃতি শ্রেণিকে প্রকাশ্যে তিরস্কার করেছেন। এই দৃষ্টিকোণ থেকে হাফেজ হলেন সামাজিক বিশ্লেষক, সমালোচক ও প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। মিথ্যা, প্রতারণা ও ধোঁকাকে তিনি মনে-প্রাণে ঘৃণা করেন এবং তার থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করেন।
চরিত্র নির্মাণে হাফেজ ও ঠাকুর
ব্যক্তি-চরিত্র নির্মাণে হাফেজ ও ঠাকুরের মধ্যে চমৎকার মিল দেখা যায়। যেমন ঠাকুরের কাছে যিনি বাউল, হাফেজের দৃষ্টিতে তিনি রেন্দ। বাউলদের অধিকাংশ হিন্দু; তবে কিছুসংখ্যক মুসলমানও আছে। এরা নিজেদেরকে সব ধরনের বাধা বন্ধন থেকে মুক্ত মনে করে। অন্যকথায় ‘আয রাঙ্গে তাআ‘ল্লুক আ’যা’দেগা’ন’
از رنگ تعلق آزادگان
‘সম্পৃক্ততার রঙ হতে মুক্ত’। এই জগতের কোনো নিয়ম-কানুনের এরা ধার ধারে না এবং কোনো নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানকেও অনুসরণ করে না। কারো আনুগত্য করে না।
হাফেজ ও ঠাকুর দুজনই সংস্কারক
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তির পতাকাবাহী। বিশ^সমাজের জন্য তাঁর দরদ স্বতঃসিদ্ধ ও সর্বজনজ্ঞাত। বিশে^র বিভিন্ন দেশে তাঁর বিভিন্ন সফর ও উদ্দীপনাময় ভাষণসমূহ তাঁর এই উন্নত ও সংস্কারবাদী চিন্তা-চেতনার পরিচায়ক। ঠাকুরের সংস্কার কার্যক্রম ও উচ্চতর দৃষ্টিভঙ্গি তখনকার ভারত ও ভারতীয় সমাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি গোটা মানবসমাজের শান্তি ও সৌভাগ্যের প্রত্যাশী ছিলেন। এ কথার উত্তম প্রতিপাদ্য ছিল তাঁর রচিত ‘আফ্রিকা কাব্য’। তাতে তিনি যারা আফ্রিকার কালো মানুষকে দাসত্বে শৃঙ্খলিত করেছে তাদের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ কণ্ঠে প্রতিবাদ জানান। নাজীদের গণহত্যার প্রতিবাদেও তাঁর কবিতা বলিষ্ঠ ভাষায় প্রতিবাদ জানায়। ১৯০৭ সালে ভারতীয় কংগ্রেস যখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে অধিবেশনে মিলিত হয় তখন তিনি তাঁর রচিত একটি প্রার্থনা পাঠ করে শোনান। সেই প্রার্থনা শুধু ঈশ^রের সামনে তাঁর বিনয়, কাকুতি ও প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামে তাঁর প্রবল ইচ্ছার সাক্ষ্য বহন করে না; বরং তাতে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা এবং পছন্দনীয় কাজ ও কল্যাণধর্ম কার্য সম্পাদনে মহাপ্রভুর সমীপে দাবি ও আকুতি প্রতিধ্বনিত হয়েছে।
জাতীয় জীবনের উৎকর্ষে হাফেজ ও ঠাকুরের সাফল্যের মূল্যায়ন
উপসংহারে আমি বলতে চাই যে, হাফেজ ও ঠাকুর শুধু ইরান, ভারত বা বাংলাদেশের জন্য কবিতা রচনা করেন নি; বরং গোটা এশিয়া তথা গোটা বিশে^র মানবতার উৎকর্ষ সাধনে কবিতার শক্তিকে ব্যবহার করেছেন। মানবতার কল্যাণের শাশ^ত চেতনা উভয় কবিকে ইতিহাসের বিস্তর দূরত্ব সত্ত্বেও পরস্পরের একান্ত নিকটে নিয়ে এসেছে।
অনুবাদ : ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী

সাক্ষাৎকার

গত ১৪-১৬ নভেম্বর ২০১৯ ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের রাজধানী তেহরানে ‘আল আকসা মসজিদের প্রতিরক্ষায় মুসলিম উম্মাহর ঐক্য’ শীর্ষক ৩৩তম আন্তর্জাতিক ইসলামি ঐক্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে ৯৩টি দেশের ৩৯৭ জন অতিথি অংশগ্রহণ করেন। বাংলাদেশ থেকে এই সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন ঢাকাস্থ মদীনাতুল উলূম মডেল ইন্সটিটিউটের অধ্যক্ষ মাওলানা মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক, দৈনিক ইনকিলাবের সিনিয়র সহকারী সম্পাদক, দার্শনিক ও আলেমে দীন মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী, ইস্টার্ন প্লাস জামে মসজিদের খতিব মাওলানা মোহাম্মদ রুহুল আমীন ও ইউনাইটেড মুসলিম উম্মাহ’র চীফ কোঅর্ডিনেটর জনাব মজুমদার মোহাম্মাদ আমীন। আমরা তাঁদের সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকার গ্রহণ করি। দুটি পর্বে তাঁদের সাক্ষাৎকার উপস্থাপন করা হবে। এই পর্বে মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী ও মাওলানা মোহাম্মদ রুহুল আমীন এর সাক্ষাৎকার নিউজলেটারের পক্ষ থেকে পাঠকদের উদ্দেশে পত্রস্থ হলো।

প্রশ্ন ১ : মহানবী (সা.)-এর পবিত্র জন্মদিবসÑ ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উদ্যাপন উপলক্ষে ইসলামি ঐক্য সপ্তাহ পালন ও আন্তর্জাতিক ইসলামি ঐক্য সম্মেলনের আয়োজনকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী : মহানবী (সা.)-এর পবিত্র জন্মদিবস শুধু নয়, তাঁর পূর্ণ জীবনাদর্শের ওপর সমানভাবে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে মুসলমানদের আদর্শিক অগ্রযাত্রা চালিয়ে যেতে হবে। মহানবী (সা.)-এর কর্মধারাও এমনই ছিল। ‘ইসলামি ঐক্য সপ্তাহ’ ধারণাটি খুবই সুন্দর। তাছাড়া আন্তর্জাতিক ইসলামি ঐক্য সম্মেলন একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। আমার ধারণায় মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পর্যায়ক্রমে এর ভেন্যু বদল হতে পারে। জাকার্তা থেকে রাবাত পর্যন্ত সুবিধাজনক ৫০টিরও বেশি রাজধানীতে ক্রমান্বয়ে এ সম্মেলনের আয়োজন করা বেশি ফলপ্রদ হবে বলে মনে করি। এ পর্যন্ত ৩৩টি সম্মেলন তেহরানে হয়েছে। মুসলিম বিশ্বে এর প্রভাব আরও বাড়তে পারে, আংকারা, বাগদাদ, কায়রো, তাশখন্দ, ঢাকা, কুয়ালালামপুর, ইসলামাবাদ, দোহা, আবুধাবি ইত্যাদিতে সম্মেলন করা গেলে।
মাওলানা মোহাম্মদ রুহুল আমীন : বর্তমান সমস্যা জর্জিত বিশ্বে যে বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে টহরঃু বা ঐক্য। এই ঐক্যকে আল্লাহ তা’আলা কুরআন মজীদে ফরজ ঘোষণা দিয়েছেন। যেমন- তোমরা সবাই মিলে আল্লাহর রজ্জুকে শক্তভাবে ধারণ করো। (সূরা আলে ইমরান : ১০৩)। আজ মুসলমানদের অনৈক্যের সুযোগে পৃথিবীর দাম্ভিক শক্তি আমেরিকাসহ সমস্ত সা¤্রাজ্যবাদী শক্তি বিশ্ব মুসলিমের ওপর অবর্ণনীয় ও বর্বরতম পৈশাচিক নির্যাতন চালাতে সাহস পাচ্ছে। কোটি কোটি জনতার সামনে ফিলিস্তিন, কাশ্মীর, মায়ানমার, চীনের উইঘুর মুসলিম, সিরিয়া, ইরাক, ইয়েমেনসহ দুনিয়ার দেশে দেশে এই অমানবিক জুলুম চলছে। এমন একটি করুণ মুহূর্তে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান এতবড় একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলনের আয়োজন করে সমগ্র মুসলিম বিশ্বের কাছে কৃতজ্ঞতার দাবি করতে পারে।
৩৩তম আন্তর্জাতিক ইসলামি সম্মেলন আয়োজনের ব্যাপারে আমার মূল্যায়ন হলো ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান যখন গোটা মুসলিম উম্মাহর তথা শিয়া, সুন্নি ও মুসলিম মিল্লাতের বিভিন্ন মাযহাবগুলোর মধ্যে পারস্পরিক মতপার্থক্য সহনীয় পর্যায়ে এনে বিশ্বের জুলুমবাজ হায়েনাদের মুকাবিলা করা দরকার, ঠিক তখনই এই সম্মেলনের আয়োজন করে সারা দুনিয়ার নির্যাতিত মুসলমানদের ব্যথিত হৃদয়ের দরজায় আবেগময়ী করাঘাত করেছে। বিশ্ব মুসলিমের হিম্মত ফিরিয়ে দিয়েছে। আবেদন রাখতে পেরেছেÑ ‘হে বিশ্বমুসলিম! আজ তোমাদের রক্ষা কবজ, তোমাদের হারানো ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারের একমাত্র হাতিয়ার হলো ইসলামি ঐক্য।’ তেহরানের আন্তর্জাতিক সম্মেলন সে বার্তাই আমাদেরকে দিয়েছে।
প্রশ্ন ২ : তেহরানে আয়োজিত ৩৩তম আন্তর্জাতিক ইসলামি ঐক্য সম্মেলনের আয়োজন, ব্যবস্থাপনা, অ্যাকাডেমিক ও আনুষ্ঠানিক সেশন স¤পর্কে কিছু বলুন।
মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী : সম্মেলনটির আয়োজন ছিল যথেষ্ট সুন্দর। একটি পরিণত আয়োজনের সবদিক তেহরানের সম্মেলনে দেখা গেছে। উদ্বোধনী ও বিদায়ী অনুষ্ঠান, অভ্যর্থনা, আতিথেয়তা, নিরাপত্তা, স্বস্তি ও অ্যাকাডেমিক সেশন সবই ছিল উচ্চমানের। অল্প সময়ের সর্বোচ্চ ব্যবহার ও লক্ষ্য পূরণ সম্মেলনটিকে অর্থবহ করেছে। আমার দেখা বহু সম্মেলনের ভেতর এটি অন্যতম সফল একটি সম্মেলন।
মাওলানা মোহাম্মদ রুহুল আমীন : তেহরানের ৩৩তম আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজনটি প্রথম থেকেই খুবই সুশৃঙ্খল। আমাদের দাওয়াত নামা, তেহরান থেকে ভিসা দেয়ার নির্দেশ, অতঃপর ভিসা ও টিকিটের ব্যবস্থা এবং আমাদের প্রস্তুতি, প্রবন্ধ লেখা, বিভিন্ন বিষয় ঠিক করে দেয়ার প্রয়োজনীয় নির্দেশনা ছিল খুবই চমৎকার। ইরানি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ও দূতাবাসের টাইম টু টাইম আমাদের সাথে যোগাযোগে ছিল দারুণ আন্তরিক। অতঃপর প্রস্তুতি পর্ব শেষে শাহজালাল বিমান বন্দরে নির্ধারিত সময়ে এমিরাটস এর বিমানে প্রথমে দুবাই অতঃপর সেখান থেকে আরব সাগর পাড়ি দিয়ে যখন আমরা ইসলামি ইরানের অবিসংবাদিত নেতার নামে প্রতিষ্ঠিত এয়ারপোর্ট ইমাম খোমেইনী আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে পড়ন্ত বিকালে পৌঁছলাম, বিমান থেকে নামতেই দেখি দরজায় দাঁড়ানো ইসলামি ইরানের স্বেচ্ছাসেবকরা। তাঁদের হাতে আমাদের নাম লেখা প্লাকার্ড। তাঁরা ইংরেজিতে আমাদের পরিচয় জানতে চাইলেন। প্রত্যেকের পরিচয় জেনে আমাদেরকে ভিআইপি গেইট দিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো। গাড়িতে করে কিছু দূর গেলেই দেখি আমাদের জন্য অপেক্ষমাণ ইরানি আয়াতুল্লাহগণ। দুহাত প্রসারিত করে তাঁরা আমাদের বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলেন। আমরা সুন্নি আলেম, তাঁরা শিয়া আলেম। কিন্তু এখানে যেন সবাই একাকার হয়ে গেলাম। অতঃপর গেস্ট হাউজে বিভিন্ন দেশের ইসলামিক স্কলারগণ পারস্পরিক পরিচিতির মাধ্যমে জানতে পারলাম কেউ ইরানি, কেউ পাকিস্তানি, কেউ ইরাকি। আমরা তো বাংলাদেশী। সে অভূতপূর্ব মিলন মেলা। অতঃপর নাস্তা সেরে একটি গাড়িতে স্বেচ্ছাসেবকরা আমাদের নিয়ে একবারে ইমাম খোমেইনী (র.)-এর মাজার সংলগ্ন হলরুমে নিয়ে গেলেন। সেখানে পরিপাটি ব্যবস্থাপনা। বিভিন্ন দেশের উলামা-দ্বীনদার বুদ্ধিজীবিগণ সমবেত। সেখানে আমাদেরকে স্বাগত জানানো হলো। বক্তব্য রাখলেন আমাদের দাওয়াতদাতা এ সম্মেলনের সেক্রেটারি আয়াতুল্লাহ মোহসেন আরাকী এবং ইমাম খোমেইনী (র.)-এর নাতি আয়াতুল্লাহ হোসাইনী। বক্তব্যের পূর্বে মধুময় তেলাওয়াতে কালামে মজীদ সকলের হৃদয়কে জুড়িয়ে দিল। অতঃপর বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে সাক্ষাৎকার। তারপর আমাদের থাকার জায়গা ফুন্দুকে আবাদীতে গেলাম। হোটেলের নিচতলার সিপাহি পাসদারানের সদস্যগণ আমাদেরকে একটি ফাইল, কলম, প্রোগ্রাম সূচি দিলেন। এরপর আমাদের স্বদেশী মাশহাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সালেহকে আমাদের সংগে দিলেন। আমাদের প্রতি দুজনের জন্য একটি রুম বরাদ্দ। ২৬ তলায় খাবারের ব্যবস্থা দেখে সত্যিই অভীভূত হলাম। কঠোর নিরাপত্তা, সুশৃঙ্খল উপস্থাপনা এবং জমরুদ, আলমাস, জেরীন, ব্রিলিয়ান ইত্যাদি হলগুলোতে প্রায় ১০/১৫টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মনোমুগ্ধকর আলোচনা। যেমন ইসলামে প্রতিরোধ আন্দোলনের গুরুত্ব, আল আকসা মসজিদ উদ্ধারের উপায়, ফিলিস্তিনী মুসলমানদের মুক্তি সংগ্রাম, মায়ানমারের মুসলিমদের ওপর নির্যাতনের বীভৎস কাহিনী, ইসলামের বিচার ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে মুসলমানদের গুরুত্বারোপ ইত্যাদি। আলহামদুলিল্লাহ এ ব্যাপারে ইসলামি ইরান অনেক অগ্রসর। ইসলামের শিক্ষা নীতিসহ তামাম বিশ্বের নির্যাতিত মুসলিমদের মুক্তির উপায় সম্পর্কে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রতিদিন বিভিন্ন হলে কখনও বিরাট সম্মেলন, কখনও গ্রুপভিত্তিক আলোচনা, পর্যালোচনা সত্যিই সমগ্র বিশ্ব ইসলামি চিন্তাবিদদের হৃদয় কেড়েছে। এ সমস্ত শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান বার বার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিলÑ এ যেন সম্মেলন নয়, বরং সমগ্র বিশ্বের ইসলামি বিপ্লবের সদর দপ্তরে বসে আছি। সত্যিই এই আয়োজন, ব্যবস্থাপনা এবং বিভিন্ন শিক্ষামূলক প্রোগ্রাম উপস্থাপনা ছিল হৃদয়গ্রাহী ও আকর্ষণীয়।
প্রশ্ন ৩ : আপনার দৃষ্টিতে মুসলিম উম্মাহর বর্তমান প্রধান সমস্যাগুলো কী কী?
মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী : ইসলাম সম্পর্কে অমুসলিমদের পারসেপশন সংকট। অপপ্রচারে ইসলামের সঠিক চিত্রটি তাদের সামনে স্পষ্ট নয়। মুসলিমরাও শিক্ষা সংস্কৃতির দিক দিয়ে স্বকীয় নয়। এর ওপর আছে ঐক্য ও উদারতার সংকট। নেতৃত্ব গড়ে না উঠলেও ছোট ছোট গ্রুপিং তৃণমূল পর্যন্ত ছেয়ে আছে। এছাড়াও আদর্শ, শিক্ষা, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, শিল্প, বাণিজ্য, সংগঠন ইত্যাদি অনেক দিক দিয়েই মুসলিমরা পিছিয়ে আছে।
মাওলানা মোহাম্মদ রুহুল আমীন : আমার দৃষ্টিতে বর্তমান মুসলিম বিশ্বের প্রধান সমস্যাগুলোর অন্যতম হলো মুসলমানদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব। এরপর রয়েছে শত্রু-মিত্র নিরূপণে বা পরিচয় জানতে অর্থাৎ ইসলামের দুশমন চিনতে ভুল করা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে অনগ্রসরতা, নিজেদের অঢেল সম্পদ থাকতেও মুসলিম নামের জালিম সরকার প্রধানগুলোর কুফরী শক্তির পায়রাবী করা, দেশে দেশে অনৈসলামি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত থাকা ইত্যাদি। অর্থনৈতিক সমস্যা যা পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থার কারণে সৃষ্ট। আলেম সমাজের মধ্যে আদর্শিক নেতৃত্ব দানে ব্যর্থতা, যুব সমাজকে ইসলামের কল্যাণ সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানদানে ব্যর্থতা, ইসলামে নারীর অধিকারের ব্যাপারে সচেতনতার অভাবগুলোই মনে হয় আজকের দুনিয়ার মুসলমানদের মৌলিক সমস্যা। আজ বড় প্রয়োজন মাযহাবী দ্বন্দ্ব মিটিয়ে মুসলিম পরিচয়ে বির্কতহীন এক উম্মাহ।
প্রশ্ন ৪ : সমস্যাগুলো উত্তরণের জন্য ইতিবাচক ও কার্যকরী কর্মসূচি স¤পর্কে আপনার মত স¤পর্কে কিছু বলুন।
মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী : নিঃস্বার্থ, উদার ও নিষ্ঠাবান নেতৃত্ব যদি সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করে অগ্রসর হয়, তাহলে মুসলিমরা বিশ্বে একটি ভালো জায়গা করে নেবে। বিচ্ছিন্ন অনেক শক্তি, জনগণ, সম্পদ ও সম্ভাবনা মুসলিম উম্মাহর রয়েছে। কিন্তু মুসলিম উম্মাহ সংহত না থাকায় তারা আজ নানা চক্রান্তের শিকার। বড় মানসিকতা নিয়ে দায়িত্বশীলরা গোটা উম্মাহকে এগিয়ে নেওয়ার চিন্তা করলে নানা বিভক্তি সত্ত্বেও মৌল কিছু ইস্যুতে বিশ্ব মুসলিম এক হতে পারে। এজন্য সবারই কমবেশি দায়িত্ব আছে। বিশেষ করে এ পথে বাধাগুলো খুঁজে বের করে সেসব দূর করার আন্তরিক উদ্যোগ থাকতে হবে। সংকীর্ণতা ও ক্ষুদ্র স্বার্থ চিন্তা বাদ দিয়ে আন্তরিক প্রচেষ্টা চালালে মুসলিমরা বড় শক্তিতে পরিণত হতে পারে।
মাওলানা মোহাম্মদ রুহুল আমীন : সমস্যাগুলো উত্তরণ ও কার্যকরী কর্মসূচি হতে পারে দুনিয়ার দেশে দেশে ইসলামি আন্দোলনগুলোর মধ্যে তথা মুসলিম মিল্লাতের মধ্যে ঐক্য সৃষ্টি। এরপর আলেমদের দ্বারা মাযহাবী বিরোধের প্রাচীর ভেঙ্গে যেখানে মুসলিম পরিচিতির প্রতি গুরুত্বারোপ করা। অর্থনৈতিক উন্নতির লক্ষ্যে মুসলিম সরকার প্রধানদের স্বতন্ত্র অর্থনৈতিক ফোরাম গঠন করে মুসলিম মিল্লাতের কল্যাণের প্রতি প্রাধান্য দেয়া। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিষয়ে গভীর পা-িত্যের প্রয়োজন। উল্লেখ্য, এ কাজগুলোর জন্য ইসলামি ইরানই সর্বাধিক ভূমিকা রাখতে পারে। কারণ, তারাই পৃথিবীর একমাত্র ইসলামের সাংবিধানিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। পৃথিবীর অনৈসলামিক ও জালিম সরকারগুলোর উৎখাত সময়ের দাবি।
প্রশ্ন ৫ : ইসলামি ঐক্যের ব্যাপারে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা ও অন্য নেতৃবৃন্দের ভূমিকা এবং রাষ্ট্র হিসেবে ইরানের অবস্থান স¤পর্কে কিছু বলুন।
মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী : ইরানের নেতৃবৃন্দ তাঁদের মতো করে এ পথে দীর্ঘদিন যাবত কাজ করে যাচ্ছেন। বিপ্লব সংঘটিত করেছেন। এরপর ৪০টি বছর বহু বাধা বিপত্তি মোকাবেলা করে একটি দৃষ্টান্তকে টিকিয়ে রেখেছেন। তবে এ সময়ে স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে পারলে আরও বেশি ফল পাওয়া যেত। এরপরও তাঁরা বিশ্বব্যাপী ইরানকে কীভাবে তুলে ধরবেন, সে বিষয়ে নিরন্তন গবেষণা করে যাওয়া উচিত। এসব সম্মেলন সম্ভবত সঠিক কর্মপন্থা নির্ধারণে সহায়তা দিতে পারে। একটি শক্তি অন্যান্য রাষ্ট্র ও জাতির ওপর কীভাবে প্রভাব ও জনপ্রিয়তা লাভ করে, স্বতঃসিদ্ধ সে পথগুলো অবলম্বন করেই সবাইকে এগোতে হয়। বহু বাধা পাড়ি দিয়ে ইরান চলছে, তবে তাকে আরও অধিক গ্রহণযোগ্য কর্মপন্থা বাছাই করতে হবে।
মাওলানা মোহাম্মদ রুহুল আমীন : ইসলামি ইরানের ধর্মীয় নেতা মুহতারাম সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ীর ভূমিকা যে কত বেশি ও আন্তরিক তা তেত্রিশতম আন্তর্জাতিক ঐক্য সম্মেলনে অনুভুত হলো। ইসলামি ইরানের উলামায়ে কেরামগণ অত্যন্ত যোগ্যতার সাথে সম্মেলনের বিভিন্ন সেশনে যে ভূমিকা পালন করেছেন তা প্রমাণ করে তাঁরা ঐক্যের জন্য খুবই আন্তরিক। বিশেষ করে স্বচক্ষে দেখলাম যখন রাহবারের সঙ্গে আমাদের সাক্ষাৎ হলো। সেই বিরাট সম্মেলনে ইসলামি ইরানের রাহবার, প্রেসিডেন্ট, স্পিকার, চীফ জাস্টিসসহ অন্য ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের সরব উপস্থিতি প্রমাণ করে তাঁরা ঐক্যের জন্য গভীরভাবে আগ্রহী।
ইসলামি ইরানের রাষ্ট্র হিসাবে অবস্থানের ব্যাপারে বলব বর্তমান বিশ্বে তাবৎ কুফরী শক্তির রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে প্রচ- অর্থনৈতিক অবরোধ মুকাবিলা করে দীর্ঘ চল্লিশ বছর টিকে প্রমাণ দিল রাষ্ট্র হিসাবে ইরান এখন মুসলিম বিশ্বের ইমামতের স্থলে রয়েছে এবং সুদৃঢ় ভাবেই আছে। কতই না ভাল হতো যদি আরও কিছু দেশে ইসলামি হুকুমত প্রতিষ্ঠিত হতো!
প্রশ্ন ৬ : তেহরানের রাস্তাঘাট, অবকাঠামো, নারী-পুরুষের বিচরণ স¤পর্কে আপনার সংক্ষিপ্ত সফরে লক্ষণীয় বিষয়ে কিছু বলবেন কি?
মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী : তেহরান একটি প্রাচীন শহর। শূন্য থেকে গড়ে ওঠা নতুন নগরী নয়। সে হিসাবে তেহরান ঐতিহ্যবাহী ও সুন্দর। তবে দীর্ঘ অর্থনৈতিক অবরোধের কবলে না পড়লে হয়তো তেহরান অবকাঠামোগত দিক আরও বেশি উন্নত হতে পারত। সৌন্দর্য ও শৃংখলা ভালোই। নারী-পুরুষের জীবন সংগ্রামে শরীক হওয়ার দিকটি প্রত্যাশা অনুযায়ী রয়েছে বলে মনে হয়। কিছু স্থাপনা খুবই মনোরম। সম্মেলনের ব্যস্ততায় ও স্বল্প সময়ে তেহরান ঘুরে দেখা হয় নি। নতুন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটি সরল সৌন্দর্যে অপরূপ।
মাওলানা মোহাম্মদ রুহুল আমীন : আমি দুঃখিত যে, আমার সংক্ষিপ্ত সফরে ইসলামি ইরানের মতো এই বিরাট রাষ্ট্রের তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ স্থান আমরা পরিদর্শন করতে পারি নি। তবুও তোরানের ইমাম খোমেইনী আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর থেকে আমাদের আবাসিক হোটেল অর্থাৎ পার্সিয়ান আজাদী হোটেলের দূরত্ব ছিল আনুমানিক ৬০/৭০ কিলোমিটার। এই দীর্ঘ রাস্তা অতিক্রম কালে আমরা মসৃণ রাস্তাঘাট দেখেছি। বিশাল প্রশস্ত রাস্তা দিয়ে সাঁ সাঁ করে গাড়ি ছুটে চলেছে তাদের গন্তব্যের দিকে। কোথাও যনাজট চোখে পড়েনি। কোথাও যাত্রাপথে বিরক্তিকর কোনো বিষয় ছিল না। সবকিছু ছিমছাম সুন্দর নয়নাভিরাম।
অবকাঠামোগত অবস্থা দেখলাম। রাস্তার দুধারে সুরম্য প্রাসাদ দাঁড়িয়ে আছে। যদিও বিভিন্ন জায়গা দেখার একান্ত বাসনা থাকলেও আমার সৌভাগ্য হয় নি। তবে যা দেখেছি তাতে ইরানের বিপ্লবী জনগণ ইসলাম প্রতিষ্ঠা করে হেরে যায় নি। যদি ইরানের ওপর অন্যায় অর্থনৈতিক অবরোধ না থাকত তবে হয়তো অবকাঠামোসহ ইতিহাস অন্যরকম লিখা হতো।
নারী-পুরুষের বিচরণ সম্পর্কে বলব ইরানের নারীরা পুরুষের সাথে সাথে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করছেন। তবে নিজ নিজ আঙ্গিক থেকে আমরা বিভিন্ন মিটিং-এ দেখেছি আপাদমস্তক কালো হিজাবে আবৃত ইরানের মা-বোনেরা সমান ভাবে তাঁদের জন্য নির্ধারিত অংশে অবস্থান গ্রহণ করেছেন। সব থেকে বেশি যে জিনিসটি লক্ষণীয় ছিল তাহলো ইরানি জাতির অভূতপূর্ব মেহমানদারি, ভদ্রতা ও শালীনতাÑ যা সত্যিই ভুলবার নয়।
প্রশ্ন ৭ : নিউজলেটারের পাঠক ও বাংলাদেশের জনগণের উদ্দেশে কিছু বলুন।
মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী : সবাইকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। ইসলামই আল্লাহর নিকট মনোনীত একমাত্র জীবন ব্যবস্থা। কোরআন সুন্নাহ ও মুমিনের প্রজ্ঞা বিশ্বকে মুক্তি ও শান্তির পয়গাম দিতে পারে। মুসলিমদের উচিত অন্যসব মতাদর্শ বাদ দিয়ে ইসলামকে নিয়ে অগ্রসর হওয়া। মুসলিমদের মধ্যে যত মাইনর বিরোধ সব ইগনোর করে বৃহৎ ঐক্য গড়ে তোলা। বড় বড় বিষয়েও সংলাপ ও পরস্পর মতবিনিময়ের মাধ্যমে একটি সমঝোতায় পৌঁছা সম্ভব। মুসলিমরা পরস্পর ভাই ভাই। আর এই উম্মাহ এক ও ঐক্যবদ্ধ থাকার কথা। এ বিষয়ে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সবাইকে কাজ করতে হবে।
মাওলানা মোহাম্মদ রুহুল আমীন : নিউজলেটারের সম্মানিত পাঠক ও বাংলাদেশের বীর জনতার উদ্দেশে আমার বক্তব্য হলো আল্লাহ তা‘আলা যোগ্য জাতির কাছে ইসলামি হুকুমাত দান করছেন। লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে ইরানের সাহসী জনগণ ইসলাম প্রতিষ্ঠা করে বিশ^ব্যাপী জনগণকে দাওয়াত দিচ্ছে দিগন্তপ্লাবী এক ইসলামী বিপ্লবের। যে বিপ্লব আলেম নেতৃত্ব ও দীনদার বুদ্ধিজীবীদের সমন্বয়েই প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।

ইসলামি ঐক্য সপ্তাহ উপলক্ষে দেশী-বিদেশী মেহমানদের প্রদত্ত সাক্ষাতে রাহবার

ইসরাঈলের বিলুপ্তিই ফিলিস্তিনের প্রকৃত মালিকদের সরকার প্রতিষ্ঠার উপায়
ইসলামি বিপ্লবের রাহ্বার ও ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতা হযরত আয়াতুল্লাহ্ উয্মা সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে উদ্যাপিত ইসলামি ঐক্য সপ্তাহের কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারী দেশী-বিদেশী মেহমানগণ ও ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদেরকে প্রদত্ত এক সাক্ষাতে প্রদত্ত ভাষণে ফিলিস্তিনের মুক্তি ও ফিলিস্তিনী জনগণের ন্যায্য অধিকার পুনরুদ্ধারের ওপর জোর গুরুত্ব আরোপ করে বলেন, ইসরাঈলের অস্তিত্ব মুছে ফেলার মানেই হচ্ছে ফিলিস্তিনের প্রকৃত মালিকরা তাদের নিজেদের সরকার নির্বাচন করতে সক্ষম হবে।
রাহ্বারের ভাষণের পূর্ণ বিবরণ নিচে দেয়া হলো :
বিস্মিল্লাহির রাহ্মানির রাহীম
সমস্ত প্রশংসা বিশ^জগতের রব আল্লাহ্র জন্য এবং দরূদ ও সালাম সাইয়্যেদেনা মুহাম্মাদের, তাঁর পবিত্র বংশধরদের, তাঁর নির্বাচিত সহচরদের ও যারা উত্তমভাবে তাঁদের অনুসরণ করেছেন তাঁদের প্রতিÑ শেষ বিচারের দিন পর্যন্ত।
ইসলামের মহাসম্মানিত নবীর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া আলিহ্) ও হযরত ইমাম জা‘ফর সাদিকের (সালামুল্লাহি ‘আলাইহি) মহান জন্মদিবস উপলক্ষে সকলের উদ্দেশে মোবারকবাদ জানাচ্ছি। এ মহান দিবসের গুরুত্ব হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) যেদিন দুনিয়ায় আগমন করেন ঠিক সেই দিনটির গুরুত্বের সমান, সুতরাং এ দিবসটির এবং এ ধরনের অন্যান্য মহান দিবসের যথাযথ ক্বর্দ করা কর্তব্য।
বস্তুত হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) মহান রাব্বুল্ ‘আলামীনের সৃষ্টিকুলের মধ্যে শীর্ষতম ব্যক্তিত্ব ও শ্রেষ্ঠতম মানুষÑ যিনি ইতিহাসের সমস্ত নবী-রাসূলের (‘আ.) ও সমস্ত আউলীয়া’র তুলনায় শ্রেষ্ঠতর এবং সমগ্র সৃষ্টিকুলের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম। ইসলামের মহানবী (সা.) শ্রেষ্ঠতম, সমুন্নততম ও মহানতম।
فاق النّبیّین فی خَلق و فی خُلُق
و لم یدانوه فی علم و لا کرم
و کلّهم من رسول الله ملتمس
غرفاً من البحر او رشفاً من الدّی
কবির এ কথা আক্ষরিক অর্থেই সত্য। রাসূলুল্লাহ্র (সা.) পবিত্র অস্তিত্ব সমগ্র সৃষ্টিজগতের শীর্ষচূড়া এবং সম্ভব অস্তিত্বলোকের শ্রেষ্ঠতম অস্তিত্ব। কোরআন মজীদ নিজেকে ‘নূর’ হিসেবে উল্লেখ করেছে; কোরআন মজীদ স্বীয় যে সব বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছে তার অন্যতম হচ্ছে ‘নূর’; এরশাদ হয়েছে : قَد جٰاءَکُم مِنَ اللهِ نورٌ وَکِتٰبٌ مُبین
রাসূলুল্লাহ্র (সা.) সম্মানিতা বিবির নিকট থেকে উদ্ধৃত করা হয়েছে যে, তাঁর নিকট রাসূলুল্লাহ্ (সা.) সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে জবাবে তিনি বলেন : کان خُلقه القرآن অর্থাৎ তিনি ছিলেন কোরআন মজীদের মূর্ত প্রতীক তথা রাসূলুল্লাহ্ (সা.)ও ছিলেন নূর।
‘নূর’ (আলো/জ্যোতি) হচ্ছে ঔজ্জ্বল্যের মাধ্যম এবং মানুষের জীবনের মাধ্যম। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) ছিলেন মানব সমাজের জন্য ঔজ্জ্বল্য ও জীবনের মাধ্যম। এগুলো হচ্ছে এমন বিষয় মানুষ যেগুলোতে ধীরে ধীরে উপনীত হচ্ছে।
‘নূর’ শব্দটির প্রকৃত অর্থেই রাসূলুল্লাহ্র (সা.) পবিত্র অস্তিত্ব নূর। বস্তুত আরব কবি যথার্থই বলেছেন :
ولد الهدیٰ فالکائنات ضیاء
তেমনি তিনি এ-ও যথার্থই বলেছেন :
و فم الزّمان تبسّم و ثناء
আল্লাহ্ করুন, ইসলামি জাহান এমনটিই হোক; রাসূলুল্লাহ্র (সা.) জন্মদিনে ইসলামি জাহানের সকলের ঠোঁটে আনন্দের হাসি ফুটে উঠুক; কারো মধ্যে দুঃখ ও মনঃকষ্ট না থাকুক। কারণ, এ দিনটি আমাদের দিন।
আমি দু’তিনটি বিষয় নোট করেছি; এবার তা পেশ করছি।
একটি বিষয় হচ্ছে ইসলামি ঐক্য সপ্তাহ। আমরা ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানে এ সপ্তাহটি অর্থাৎ বারোই রাবী‘উল্ আউয়াল্ থেকে যে সপ্তাহ্ তাকে ইসলামি ঐক্য সপ্তাহ্ নামকরণ করেছি। এটি স্রেফ্ একটি নামকরণ নয় এবং একটি রাজনৈতিক ও কৌশলগত আন্দোলনও নয়, বরং এটি অন্তঃকরণ থেকে উৎসারিত একটি ‘আক্বায়েদী ও ঈমানী আন্দোলন।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান এ নামটির প্রকৃত তাৎপর্যে অর্থাৎ ইসলামি উম্মাহ্র ঐক্যের অপরিহার্যতায় বিশ^াসী। অতীত অভিজ্ঞতায়ও এর প্রমাণ রয়েছে অর্থাৎ এটি বিশেষভাবে কেবল আমাদের যুগের ও ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের যুগের সাথে সংশ্লিষ্ট নয়। ইতিপূর্বে আমাদের যৌবন কালের মহান র্মাজা‘ মরহূম আয়াতুল্লাহ্ বোরুর্জেদীÑতৎকালে যিনি ছিলেন সমগ্র শিয়া দুনিয়ার সর্বজনীন র্মাজা‘Ñইসলামি ঐক্যের দৃঢ় সমর্থক ছিলেন। তিনি ইসলামি মাযহাবসমূহের ঘনিষ্ঠতার দৃঢ় সমর্থক ছিলেন এবং আহ্লে সুন্নাতের শীর্ষস্থানীয় আলেমগণ সহ সারা বিশে^র শীর্ষস্থানীয় আলেমগণের সাথে তাঁর বন্ধুত্ব ছিল ও তাঁদের সাথে তিনি মত বিনিময় করতেন। বস্তুত এ হচ্ছে একটি ‘আক্বীদাÑ অন্তঃকরণের অন্তস্তল থেকে উৎসারিত একটি ‘আক্বীদা।
অনেকে ধারণা করেন বা এমনটি ভান করেন যে, এটি একটি রাজনৈতিক কৌশল। না, মোটেই এ রকম নয়। এটি একটি ঈমানী ও অন্তঃকরণ থেকে উৎসারিত আন্দোলন।
অবশ্য ঐক্যের বিভিন্ন স্তর আছে; ইসলামি জাহানের ঐক্যের বিভিন্ন স্তর আছে। এর নিম্নতম স্তর হচ্ছে এই যে, ইসলামি সমাজসমূহ, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশসমূহ, মুসলিম সরকারগুলো, মুসলিম জাতি-গোষ্ঠীসমূহ ও ইসলামি মাযহাবসমূহ পরস্পরের বিরুদ্ধে শত্রুতামূলক আচরণ করবে না, পরস্পরের বিরুদ্ধে সীমালঙ্ঘন করবে না, পরস্পরকে আঘাত করবে না; এটি হচ্ছে প্রথম পদক্ষেপ। তবে এর চেয়ে উচ্চতর স্তর হচ্ছে, ইসলামি জাহান কেবল যে পরস্পরের ওপর আঘাত হানবে না শুধু তা-ই নয়, বরং অভিন্ন দুশমনের বিরুদ্ধে পরস্পর হাত মিলাবে; প্রকৃত ও যথেষ্ট মাত্রায় ঐক্যের পরিচয় দেবে, পরস্পরের প্রতিরক্ষা করবে। এ-ও হচ্ছে এক ধাপ উচ্চতর ঐক্য। তবে এর চেয়েও উচ্চতর ধাপ আছে, তা হচ্ছে, মুসলিম জাতিসমূহ পরস্পরের উন্নয়ন ও বিকাশে সহায্য করবে।
মুসলিম দেশসমূহ জ্ঞান-বিজ্ঞান, ধনসম্পদ, নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক শক্তির দিক থেকে এক পর্যায়ের নয়; এ সব ক্ষেত্রে তারা পরস্পরকে সাহায্য করতে পারে, পরস্পরের সমৃদ্ধিসাধন করতে পারে। যে দেশই এ সব ক্ষেত্রের মধ্যে যে ক্ষেত্রে উচ্চতর স্তরে রয়েছে সে দেশই যে সব দেশ সে ক্ষেত্রে নিচের স্তরে রয়েছে সে দেশকে সাহায্য করতে পারে।
এ-ও হচ্ছে ঐক্যের একটি পর্যায়। এর চেয়ে উচ্চতর পর্যায় হচ্ছে এই যে, একটি নতুন ইসলামি সভ্যতা বিনির্মাণের লক্ষ্যে ইসলামি জাহানের সকলেই ঐক্যবদ্ধ হবে। আর ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান এটাকেই স্বীয় চূড়ান্ত লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করেছে। নতুন ইসলামি সভ্যতার মানে হচ্ছে, মুসলিম জাতিসমূহ বর্তমান যুগের উপযোগী একটি নতুন ইসলামি সভ্যতা বিনির্মাণ করবে।
এগুলোই হচ্ছে ইসলামি ঐক্যের বিভিন্ন স্তর।
হ্যা, এবার আপনারা লক্ষ্য করুন, এ ঐক্যের নিম্নতম স্তর কী? তা হচ্ছে, মুসলিম দেশসমূহ পরস্পরের বিরুদ্ধে সীমালঙ্ঘন ও হামলা করবে না এবং অভিন্ন দুশমনের বিরুদ্ধে পরস্পরের পাশে দাঁড়াবে। আজকের দিনে আমরা যদি এটি মেনে চলতাম তাহলে ইসলামি জাহানে এতো সব বিপদ-মুসিবতের অস্তিত্ব থাকত না।
ফিলিস্তিন সমস্যা হচ্ছে ইসলামি জাহানের সবচেয়ে বড় বিপদ, কারণ, এখানে একটি জাতিকে তাদের বাড়িঘর ও স্বদেশ থেকে বের করে দিয়েছে এবং তাদের জায়গায় অন্য লোকদেরকে নিয়ে এসে বসতি করিয়ে দিয়েছে ও শাসকে পরিণত করেছে এবং আসল মালিকদেরকে চাপের মধ্যে রেখেছে। লক্ষ্য করুন, গাযা’র এই পরিস্থিতি ও যায়নবাদীদের পৈশাচিক অপরাধসমূহ, অন্যদিকে সমগ্র ফিলিস্তিন ভূখ-ের ও পশ্চিম তীরের অবস্থা; এটি ইসলামি জাহানের জন্য ন্যূনতম এ নিম্নতম স্তরের ঐক্যের ও তার আন্তরিক অনুসরণের অপরিহার্যতা প্রমাণ করেÑ যা থাকলে এ অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটত না। এ ঐক্য থাকলে দুশমন কখনোই এ কাজ করতে সাহসী হতো না।
আপনারা লক্ষ্য করে দেখুন, ইসলামি জাহানে কী সব অবাঞ্ছিত ঘটনা সংঘটিত হয়েছে এবং বহু রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে; ইয়েমেনের ঘটনা, পশ্চিম ও উত্তর আফ্রিকা অঞ্চলের ঘটনাবলিÑ এ সব কিছুই কেবল এ কারণে সংঘটিত হয়েছে ও হচ্ছে যে, ইসলাম আমাদের নিজেদের মধ্যে যে ন্যূনতম মাত্রার ঐক্য দাবি করছে আমরা তার প্রতি দৃষ্টি দেই নি।
এটি আমাদের একটি গুরু দায়িত্ব। আমরা শীর্ষস্থানীয় সমুজ্জ্বল চিন্তাশক্তির অধিকারীদের সামনে বিষয়টি পেশ করছি। আল্লাহ্ তা‘আলার শুকরিয়া যে, বর্তমানে ইসলামি জাহানে এমন বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ রয়েছেন যাঁরা চিন্তাশীল, তাঁরা দৃঢ়তার সাথে এ লক্ষ্যে উপনীত হবার চেষ্টা করছেন। মুসিলম জাতিসমূহ, বিশেষত যুব সমাজ এ বিষয়ে খুবই আগ্রহী। কিন্তু এর পাশাপাশি অনৈক্য সৃষ্টিকারী লোকও রয়েছেÑ যাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো প্রয়োজন।
আজকের ইসলামি জাহানে উত্তর আফ্রিকা থেকে শুরু করে পূর্ব এশিয়া পর্যন্ত মুসলমানরা চাপের মধ্যে রয়েছে; ইসলামি জাহানের পূর্বাংশে ও পশ্চিমাংশে মুসলমানরা চাপের মধ্যে আছে। এ ক্ষেত্রে বিশেষ করে ফিলিস্তিনের ব্যাপারে আমি কয়েকটি কথা আরয করতে চাই।
ফিলিস্তিনের ব্যাপারে আমাদের অবস্থান একটি মূলনীতিগত অবস্থানÑ একটি অকাট্য ও সুদৃঢ় নীতিগত অবস্থান। ইসলামি বিপ্লবের বিজয়ের অনেক আগেইÑ বৈপ্লবিক আন্দোলনের শুরু থেকেই আমাদের মহান ইমাম যায়নবাদের প্রভাব, যায়নবাদের হস্তক্ষেপ ও যায়নবাদের যুলুম সম্পর্কে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বক্তব্য রাখেন; ইসলামি বিপ্লবের বিজয়ের পর শুরু থেকেই আমরা এ অবস্থান গ্রহণ করেছি।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান সর্বপ্রথম যে কাজটি করে তা ছিল, পূর্ববর্তী শাসকগোষ্ঠীর শাসনামলে তেহরানে যায়নবাদীদের যে কেন্দ্র ছিল তা তাদের কাছ থেকে নিয়ে নেয়, তাদেরকে বের করে দেয় এবং সেটি ফিলিস্তিনীদেরকে প্রদান করে; এটি ছিল একটি বাস্তব ও দৃষ্টিগ্রাহ্য মৌলিক পদক্ষেপ এবং আজ পর্যন্ত আমরা আমাদের এ অবস্থানের ওপর অটল আছি।
আমরা ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে আসছি ও ফিলিস্তিনীদেরকে সাহায্য করে আসছি; আমরা তাদেরকে আরো সাহায্য করে যাব; এ ব্যাপারে আমরা অন্য কোনো বিষয়ই বিবেচনা করব না এবং কখনোই আমরা এ থেকে সরে দাঁড়াব না। সমগ্র ইসলামি জাহানেরও উচিত ফিলিস্তিনকে সাহায্য করা।
মরহূম হযরত ইমাম (রেয্ওয়ানুল্লাহে তা‘আলা ‘আলাইহি)-এর বক্তব্য-বিবৃতিসমূহে ও ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের বক্তব্য-বিবৃতিসমূহে বার বার ইসরাঈল রাষ্ট্রের বিলুপ্তির ওপরে জোর দেয়া হয়েছে। দুশমনরা এর কদর্থ করেছে। কিন্তু ইসরাঈল রাষ্ট্রের বিলুপ্তি মানে ইয়াহূদীদের নিশ্চিহ্নকরণ নয়; তাদের বিরুদ্ধে আমাদের কোনোই কথা নেই। আমরা চাই ঐ সরকারের বিলুপ্তিÑ যায়নবাদী সরকারের বিলুপ্তি। ‘ইসরাইলের বিলুপ্তি’ মানে ফিলিস্তিনী জনগণÑযারা ঐ ভূখ-ের প্রকৃত মালিক, তা তারা মুসলমানই হোক, বা খৃস্টানই হোক, বা ইয়াহূদীই হোকÑঐ ভূখ-ের প্রকৃত মালিকরা তাদের নিজেদের সরকার নির্বাচন করবে এবং নেতানিয়াহু ও তার মতো অন্যান্য বিজাতীয় ও হীন-নীচ লোকদেরকেÑযারা প্রকৃতই হীন-নীচÑনিজেদের মধ্য থেকে উচ্ছেদ করবে, বের করে দেবে, আর নিজেদের দেশকে নিজেরাই পরিচালনা করবে; এটাই ‘ইসরাঈলের বিলুপ্তি’র তাৎপর্য এবং এটি অবশ্যই ঘটবে।
কেউ কেউ এটি অসম্ভব মনে করেন যে, কীভাবে সত্তর বছর পর ফিলিস্তিন স্বাধীন হবে। কিন্তু বলকান রাষ্ট্রগুলো ও আরো কতক দেশ অন্যদের দখলে যাবার ষাট বছর ও সত্তর বছর পর স্বাধীন হয়েছে এবং স্ব স্ব জাতির কাছে ফিরে এসেছে। এটি মোটেই দূরে নয়। وَ ما ذٰلِکَ عَلَی اللهِ بِعَزیز এ ঘটনা সংঘটিত হবেই।
আমরা ফিলিস্তিনের জনগণের সমর্থক, আমরা ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার সমর্থক, আমরা ফিলিস্তিনের মুক্তির সমর্থক। আমরা ইয়াহূদী বিতাড়ক নই; আমাদের নিজেদের দেশেও বহু ইয়াহূদী আছেনÑ যাঁরা পরিপূর্ণ নিরাপত্তা সহকারে এখানে জীবনযাপন করছেন।
এই হলো একটি বিষয়।
আরেকটি বিষয় হচ্ছে এই যে, আমরা ঐক্য চাই এবং ঐক্যের জন্য আন্তরিকভাবে আগ্রহী। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, এ চিন্তা, এ কামনা ও এ লক্ষ্যের বিরোধী পৈশাচিক ঘাতক দুশমন গোষ্ঠীও রয়েছে; বর্তমান যুগে এখন এ দুশমনদের শীর্ষে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার ও যায়নবাদী কৃত্রিম সরকার। এরা ইসলামি ঐক্যের দুশমন।
আমেরিকা কেবল ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের দুশমন নয়। কতক লোক মনে করে যে, কেবল ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান ও আমেরিকার মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ চলছে; হ্যা, যেহেতু ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান সক্রিয় রয়েছে সেহেতু তার বিরুদ্ধেই বেশি শত্রুতা করা হচ্ছে। কিন্তু আসলে তারা ইসলামি জাহানের এবং মুসলিম দেশসমূহের দুশমন, তারা ফিলিস্তিনের দুশমন, পশ্চিম এশিয়ার জাতিসমূহের দুশমন, উত্তর আফ্রিকার জাতিসমূহের দুশমন, তারা সমস্ত মুসলমানের দুশমন। আর এর কারণ হচ্ছে ইসলামের প্রকৃতি। যেহেতু ইসলাম যুলুমের বিরোধী, আধিপত্যবাদের বিরোধী, বলদর্পিতার বিরোধী, সেহেতু আধিপত্যবাদী শক্তিবলয়Ñবর্তমানে যার শীর্ষে রয়েছে আমেরিকা এবং এক সময় যার শীর্ষে ছিল ব্রিটেন বা অন্যরাÑইসলামের যুক্তির, ইসলামের প্রকৃতির ও ইসলামের তাৎপর্যের বিরোধী। অবশ্য তারা ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের বেশি বিরোধী। এরা সউদীদেরও বিরোধী। কেউ কেউ মনে করে যে, আমেরিকানরা ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের দুশমন এবং সউদীদের বন্ধু; না, আমেরিকা তাদেরও দুশমন। তারা যে সুস্পষ্ট ভাষায় বলে, সউদীদের অর্থ ছাড়া আর কিছুই নেইÑ এটা কি দুশমনী নয়? এ কথার অর্থ কী? এর মানে হচ্ছে এই : ‘যেহেতু তাদের অর্থ আছে সেহেতু যাব, তাদের অর্থ লুটে নেব।’ একটি দেশের বিরুদ্ধে, একটি জাতির বিরুদ্ধে এর চেয়ে বড় দুশমনী আর কিছু হতে পারে কি?
বেশ, তাঁরা বুঝুন; তাঁরা দুশমনীটা বুঝুন; তাঁরা বুঝুন এ দুশমনীর মোকাবিলায় একজন আত্মমর্যাদার অধিকারী মানুষের দায়িত্ব কী; এ ধরনের অবমাননার মোকাবিলায় ইসলামি আত্মমর্যাদা, ইসলামি ইজ্জত, আরব ইজ্জত্ কী দাবি করে? তাঁরা তাঁদের নিজেদের দায়িত্ব-কর্তব্য বুঝুন। কিন্তু তাঁরা বুঝতে পারছেন না। আসলে আমেরিকানরা সকলেরই দুশমন।
এতদঞ্চলে আমেরিকার উপস্থিতি দুর্বৃত্তপনা করা ও দুর্নীতি-পাপাচার বিস্তার করা ব্যতীত অন্য কোনো ধরনের প্রভাবই বিস্তার করে নি। তারা এ অঞ্চলে প্রবেশ করেছে এবং তাদের নিজেদের সাথে করে দুর্বৃত্তপনা, দুর্নীতি ও পাপাচার নিয়ে এসেছে। তারা যেখানেই পা রাখে সেখানেই নিরাপত্তাহীনতা দেখা দেয় বা গৃহযুদ্ধ বেঁধে যায় অথবা তারা দা‘এশ্ (আইএসআইএস) ও এ ধরনের কিছু তৈরি করে।
আমরা চাই যে, আমেরিকার প্রকৃত চেহারা দেখা যাক; মুসলিম জাতিসমূহ বুঝুক আমেরিকার প্রকৃত চেহারা কী এবং তারা কারা, তারা যে বাহ্যত গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের সমর্থক হবার দাবি করে এবং এ ধরনের আরো অনেক মিথ্যা ও মুনাফেক্বী কথা বলে, তার অন্তরালে কী রয়েছেÑ লোকদের এ সম্পর্কে জানা উচিত।
আমাদের দৃষ্টিতে এ অঞ্চলে আমেরিকার আসল অস্ত্রÑআমরা ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানে যে অস্ত্রের ব্যাপারে সতর্ক আছিÑতা হচ্ছে অনুপ্রবেশÑ সংবেদনশীল ও গুরুত্বপূর্ণ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী কেন্দ্রসমূহে অনুপ্রবেশÑ এবং এর মাধ্যমে জাতিসমূহের জাতীয় দৃঢ়তাকে নড়বড়ে করে দেয়া। তারা জাতিসমূহের পরস্পরের মধ্যে এবং জাতিসমূহের ও তাদের সরকারগুলোর মধ্যে পারস্পরিক আস্থাহীনতা সৃষ্টি করে। তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের হিসাব-নিকাশের মধ্যে পরিবর্তন সাধন করে এবং ভান করে যে, তারাই সকল সমস্যার সমাধানকারী, সুতরাং আমেরিকার পতাকাতলে আশ্রয় নাও, আমেরিকার কাছে আত্মসমর্পণ কর এবং আমেরিকার কথা মেনে নাও, আমেরিকা যা-ই বলে তা-ই শোনোÑ মেনে নাও, কার্যকরী কর। তারা মুসলিম জাতিসমূহের ও মুসলিম দেশসমূহের সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের মন-মগযে এগুলো প্রবেশ করাতে চায়। এগুলো হচ্ছে তাদের অস্ত্রÑ যা শক্ত অস্ত্র ও সমরাস্ত্রের তুলনায় অধিকতর বিপজ্জনক।
বাস্তবিকই লোকেরা তাদের কাজের মধ্যে যা দেখতে পায় তা হচ্ছে সেই নেফাক্বÑ কোরআন মজীদে যে সম্পর্কে এরশাদ হয়েছে :
كَيْفَ وَإِنْ يَظْهَرُوا عَلَيْكُمْ لا يَرْقُبُوا فِيكُمْ إِلا وَلا ذِمَّةً يُرْضُونَكُمْ بِأَفْوَاهِهِمْ وَتَأْبَى قُلُوبُهُمْ
এদের অবস্থা এমনইÑ আল্লাহ্ তা‘আলা তাদের বৈশিষ্ট্য যেরূপ বর্ণনা করেছেন।
এরপর যা আরয করতে চাই তা হচ্ছে, এ দুশমনীর চিকিৎসা মাত্র একটিই, তার চেয়ে বেশি নয়। তা হচ্ছে : فَاستَقِم کـَما اُمِرتَ ; রুখে দাঁড়াতে হবে। কারণ, আল্লাহ্ তা‘আলা সমস্যাবলির মোকাবিলায় তাঁর রাসূলকে (সা.) এরশাদ করেন : فَاستَقِم کـَما اُمِرتَ وَ مَن تابَ مَعَک অর্থাৎ দৃঢ়তার পরিচয় দিতে হবে, রুখে দাঁড়াতে হবে।
অবশ্য রুখে দাঁড়ানো খুবই কষ্টের ও কঠিন কাজ; এমন নয় যে, এটি খুবই সহজ কাজ। কিন্তু আত্মসমর্পণের পরিণামে তার চেয়ে অনেক বেশি কষ্ট, কঠিনতা ও দুর্দশা অপেক্ষা করে। এ দুই অবস্থার মধ্যে পার্থক্য এই যে, আপনারা দৃঢ়তা, রুখে দাঁড়ানো ও প্রতিরোধের পথে যে কোনো কষ্ট ও কঠিনতার শিকার হোন না কেন, তার বিনিময়ে আল্লাহ্ তা‘আলা আপনাদেরকে পুরষ্কার দেবেন; এরশাদ হয়েছে :
ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ لا يُصِيبُهُمْ ظَمَأٌ وَلا نَصَبٌ وَلا مَخْمَصَةٌ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَلا يَطَئُونَ مَوْطِئًا يَغِيظُ الْكُفَّارَ وَلا يَنَالُونَ مِنْ عَدُوٍّ نَيْلا إِلا كُتِبَ لَهُمْ بِهِ عَمَلٌ صَالِحٌ
বস্তুত এ পথে আপনাদের ওপর যে কোনো কষ্ট ও কঠিনতাই আপতিত হোক না কেন, তা-ই একেকটি নেক আমল। অথচ আপনারা যদি আত্মসমর্পণ করেন তাহলে সে ক্ষেত্রে আপনাদের ওপর যে কোনো কষ্ট ও কঠিনতাই আপতিত হোক তার বিনিময়ে আল্লাহ্ তা‘আলার নিকট কোনোই পুরষ্কার নেই, বরং যুলুমের কাছে আত্মসমর্পণের জন্য শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে; কোরআন মজীদ এমনই বলেছে যে, না যুলুম করবেন, না যুলুম সহ্য করবেন।
সবশেষে যে বিষয়টি আরয করতে চাই তা হচ্ছে আমলে সালেহ্ বা নেক আমল সম্পর্কে, যেমনটি আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেছেন : كُتِبَ لَهُمْ بِهِ عَمَلٌ صَالِحٌ
আমি আরয করতে চাই যে, আজকের বিশে^ দেশসমূহের ও জাতিসমূহের রাজনৈতিক স্বাধীনতার সপক্ষে যে কোনো আন্দোলনই করা হোক, যে কোনো পদক্ষেপই নেয়া হোক, যে কোনো কথাই বলা হোক, তা দেশসমূহের ও জাতিসমূহের সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার লক্ষ্যে হওয়া উচিত, দেশসমূহের ও জাতিসমূহের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও বিকাশের লক্ষ্যে হওয়া উচিত, ঐক্যের লক্ষ্যে হওয়া উচিত, ইসলামি উম্মাহ্র শক্তিমত্তা অর্জনের লক্ষ্যে হওয়া উচিত, ইসলামি জাহানে বিজ্ঞানের প্রচলনের লক্ষ্যে হওয়া উচিত, ইসলামি জাহানের যুব শক্তির বিকাশের লক্ষ্যে হওয়া উচিত। এ লক্ষ্যে যে কোনো তৎপরতাই চালানো হোক না কেন তা-ই নেক আমল, তাই উত্তম কাজ।
আপনারা যদি বিজ্ঞানের অঙ্গনে কাজ করেন, গবেষণার ক্ষেত্রে কাজ করেন, পারমাণবিক শক্তির ক্ষেত্রে কাজ করেন তো তার সবই নেক আমল।
পারমাণবিক শক্তি জাতিসমূহের প্রয়োজনীয় বিষয়। কারণ, এ বিশে^র ভবিষ্যতের জন্যÑ সকল জাতির ভবিষ্যতের জন্য শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক শক্তি অপরিহার্য প্রয়োজন। কিন্তু পাশ্চাত্যের একচেটিয়াবাদীরা চায় যে, এটি কেবল তাদের নিজেদের হাতে রেখে দেবে এবং অন্যান্য জাতিকে তারা সে সব জাতির মর্যাদার বিনিময়ে, তাদের স্বাধীনতার বিনিময়ে তা এক ফোঁটা এক ফোঁটা করে দান করবে। তারা যে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের পারমাণবিক তৎপরতার বিরুদ্ধে মোকাবিলা করছে তা কেবল এ কারণেই, নচেৎ তারা নিজেরাও জানে যে, আমরা আমাদের মৌলিক নীতিগত, দ্বীনী ও ‘আক্বায়েদী কারণে পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের বিরোধী এবং এ অস্ত্রের বিরোধী। তারা চায় যে, জাতিসমূহ পারমাণবিক বিজ্ঞানের, এ শিল্পের, এ সক্ষমতার অধিকারী না হোক; আমাদের বেলায়ও এমনটিই, অন্যদের বেলায়ও এমনটিই। তারা বলে : আমাদের কাছ থেকে কিনে নাও; তোমরা নিজেরা ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ করো না।
কিন্তু এ শক্তি অর্জনের লক্ষ্যে যে কোনো তৎপরতা চালানো হোক তা নেক আমল, যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক তৎপরতা চালানো হোক তা-ও নেক আমল; জনগণকে সাহায্য করার লক্ষ্যে, দুর্বল করে রাখা লোকদেরকে সাহায্য করার লক্ষ্যে, দরিদ্রদেরকে সাহায্য করার লক্ষ্যে যে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হোক তা-ও নেক আমল। সত্য ও প্রকৃত বিষয়াদি ও ঘটনাবলি প্রচারের লক্ষ্যে এবং কল্পিত ও মিথ্যা ধারণা-কল্পনাসমূহের বিরুদ্ধে মোকাবিলা করার লক্ষ্যে যে কোনো তৎপরতা চালানো হোক তা-ও নেক আমল।
আপনারা ইসলামি জাহানের সমুজ্জ্বল চিন্তার অধিকারী বুদ্ধিজীবিগণ এবং ইসলামি জাহানের ওলামায়ে কেরামÑ আল্লাহ্ তা‘আলার শুকরিয়া যে, আপনাদের মধ্যকার কিছু সংখ্যক ইসলামি ঐক্য সপ্তাহ্ উপলক্ষে মেহমান হিসেবে এখানে সমুপস্থিত আছেন এবং ইসলামি জাহানের আরো অনেকে এখানে সমুপস্থিত আছেন; আপনাদের মধ্যে অনেকে আছেন সমুজ্জ্বল চিন্তার অধিকারী, আপনাদের মধ্যে অনেকে আছেন যাঁরা দ্বীনী আলেমÑ আপনার দেখতে পাচ্ছেন যে, আজ আপনাদের সামনে নেক আমলের জন্য কতো বড় একটি ক্ষেত্র! আপনারা চাইলে কতো নেক আমল আঞ্জাম দিতে পারেন! আপনার কলম চালান, সত্যের প্রতিরক্ষা করুন, নিজেদের বক্ষকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করুন, দুশমনদেরকে ভয় পাবেন না। কারণ,
الَّذِينَ يُبَلِّغُونَ رِسَالاتِ اللَّهِ وَيَخْشَوْنَهُ وَلا يَخْشَوْنَ أَحَدًا إِلا اللَّهَ وَكَفَى بِاللَّهِ حَسِيبًا
বস্তুত এ কাজের হিসাব-নিকাশ আল্লাহ্র হাতে; আল্লাহ্ই এর হিসাব-নিকাশ করবেন, তিনিই আপনাদেরকে পুরস্কার প্রদান করবেন।
আমি আপনাদের খেদমতে আরয করতে চাই যে, আল্লাহ্ তা‘আলার অনুগ্রহে ইসলামি জাহান একদিনÑযেদিন খুব বেশি দূরেও নয়Ñআল্লাহ্ তা‘আলারই অনুগ্রহ ও শক্তির বদৌলতে এ আশা-আকাক্সক্ষাসমূহের বাস্তব রূপায়ণ প্রত্যক্ষ করবে।
ওয়াস্-সালামু ‘আলাইকুম্ ওয়া রাহ্মাতুল্লাহ্ িওয়া বারাকাতুহ্।
ফারসি থেকে অনুবাদ : নূর হোসেন মজিদী

মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)- জগৎসমূহের জন্য রহমত

 

মো. আশিফুর রহমান

মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) সর্বশেষ নবী ও রাসূল। তাঁর পরে আর কোনো নবী বা রাসূল আসবেন না। মহান আল্লাহ সর্বশেষ নবীকে প্রেরণ করেছেন সমগ্র সৃষ্টির জন্য রহমত হিসেবে।মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করেন :
আমি তো আপনাকে জগৎসমূহের জন্য রহমত হিসেবে বৈ প্রেরণ করি নি।
মহানবী (সা.) এমন এক সময়ে আরব জাতির মধ্যে আগমন করেছিলেন যখন আরবরা জাহেলিয়াতের অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল।জীবনের ন্যূনতম নিরাপত্তা ছিল না। খুব ছোটখাটো বিষয়ে মানুষ সংঘর্ষে লিপ্ত হতো। গোত্রে গোত্রে বিবাদ লেগেই থাকত। মানুষের অধিকার হরণ, রাহাজানি ও হত্যাকা- নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার ছিল। ইয়াতীমদেরকে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হতো। নারীদেরকে মানুষ বলে গণ্য করা হতো না। কন্যাসন্তানদের জীবন্ত কবর দেয়া হতো।
শুধু আরব নয়; সমগ্র পৃথিবী অন্যায়-অত্যাচারে পূর্ণ ছিল। ধন-সম্পদ ও শক্তিমত্তার অধিকারীরা দুর্বলদের ওপর প্রতিনিয়ত অত্যাচার-নিপীড়ন চালাত। মানুষ মূর্তিপূজা, প্রকৃতিপূজা, অগ্নিপূজা ইত্যাদিতে লিপ্ত ছিল।
পৃথিবীতে এমন অবস্থা বিরাজমান থাকাকালে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর প্রিয় বান্দা মহানবী (সা.)-কে মানুষের জন্য রহমত হিসেবে প্রেরণ করেছিলেন।যখন তিনি জন্মগ্রহণ করেন সেই সময় যেসব প্রাকৃতিক নিদর্শন প্রকাশিত হয়েছিল তাতেই তাঁর রহমত হিসেবে আগমনের চিহ্ন ফুটে ওঠে। মূর্তিপূজা, কুসংস্কার, কূপম-ূকতা, অশ্লীলতা, মন্দ কাজ, ব্যভিচারকে উৎপাটন করা এবং এর বিপরীতে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করাÑ নারীর অধিকার, শিশুর অধিকার, গরীবের অধিকার, ইয়াতিমের অধিকার, দাসদের অধিকার, বন্দির অধিকার এভাবে সমস্ত মানুষের অধিকারের পয়গাম নিয়ে মহানবী (সা.) আবির্ভূত হয়েছিলেন।মানুষকে সকল প্রকার বন্দিত্বের নিগঢ় থেকে মুক্ত করতে এসেছিলেন। অপমানের হাত থেকে উদ্ধার করে সম্মান সহকারে বাঁচার পথ বাতলে দেয়ার জন্য এসেছিলেন।
মহানবী (সা.) জীবনের শুরু থেকেই সকলের কল্যাণকামী ছিলেন। সহমর্মিতা, সম আচরণ তাঁর অস্থিমজ্জায় মিশে ছিল। বালক বয়সে তাঁর ধাত্রীমাতা নিজ সন্তানদেরকে কাজে পাঠিয়ে মহানবীকে ঘরে বসিয়ে রাখলে তিনি তাঁর অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে বলেন যে, তিনিও তাঁর দুধভাইদের সাথে কাজে যাবেন। যুবক বয়সে তিনি হিলফুল ফুযূল নামে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনে যোগ দিয়ে মানুষের জন্য কল্যাণমূলক কাজে অংশগ্রহণ করেন।
মহানবী (সা.) মুসলিম, অমুসলিম, ছোট-বড়, নারী-পুরুষ, ধনী-গরীব সকলের জন্য রহমত হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তিনি কিয়ামত পর্যন্ত যত মানুষের আগমন ঘটবে সকলের জন্য রহমত। তিনি কেবল মানব জাতির জন্য রহমত নন; বরং তিনি পশু-পাখি, উদ্ভিদ এবং দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান সকল জগতের জন্য রহমত। নিচে মহানবী (সা.) যে রহমত হিসেবে এসেছিলেন তার ব্যাপ্তি সম্পর্কে সংক্ষেপে কিছু বর্ণনা করা হলো :
মানব জাতির প্রতি রহমত
মহানবী (সা.) ছিলেন কোমল হৃদয়ের অধিকারী। তিনি সকলের সাথে কোমল ও দয়ার্দ্র্য আচরণ করতেন। মহানবীর এই বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেন :
‘(হে রাসূল!) আল্লাহর পক্ষ থেকে এ এক অনুগ্রহ যে, তুমি তাদের প্রতি দয়ার্দ্রচিত্ত হয়েছ। যদি তুমি রুক্ষ মেজাজ ও কঠিন হৃদয়সম্পন্ন হতে তবে অবশ্যই তারা তোমার চারপাশ থেকে ছত্রভঙ্গ হয়ে যেত…।’Ñ সূরা আলে ইমরান : ১৫৯
মহানবী (সা.) অপরকে দয়ার ব্যাপারে এরশাদ করেন : ‘যে মানুষের প্রতি দয়া করে না, আল্লাহও তার প্রতি দয়া করেন না।’Ñ মুসলিম : ২৩১৯
মহানবী (সা.) অন্যত্র বলেন : ‘আল্লাহ তা‘আলা দয়ালুদের ওপর দয়া ও অনুগ্রহ করেন। তোমরা জমিনবাসীকে দয়া কর, তাহলে যিনি আসমানে আছেন তিনি তোমাদের ওপর দয়া করবেন। দয়া রহমান হতে উদগত। যে লোক দয়ার স¤পর্ক বজায় রাখে আল্লাহ তা‘আলাও তার সাথে নিজ স¤পর্ক বজায় রাখেন। আর যে লোক দয়ার স¤পর্ক ছিন্ন করে, আল্লাহ তা‘আলাও তার সাথে দয়ার স¤পর্ক ছিন্ন করেন।’Ñতিরমিজি : ১৯২৪
মুমিনদের প্রতি রহমত
মহানবী (সা.) দীর্ঘ ২৩ বছর মানুষকে মহান আল্লাহর পথে আহ্বান করেন। এ সময়ে মানুষ তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে তাওহীদের পতাকাতলে সমবেত হয়। কিন্তু এ পথ মসৃণ ছিল না। তাঁদেরকে এ পথে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। তাঁরা আল্লাহ তা‘আলার জন্য পার্থিব বিষয়াদিকে বিসর্জন দেন। মহান আল্লাহর পথে তাঁরা নিজেদেরকে উৎসর্গ করেন। মহানবী (সা.)-এর কাছে তাঁদের দুঃখ-কষ্ট ছিল অসহনীয়। তাই তিনি তাঁদের কারণে ব্যথিত হতেন। আল্লাহ তা‘আলা নিজ গুণবাচক নাম ‘রাউফ’ (দয়ার্দ্র) ও ‘রাহীম’ (পরম দয়ালু) ব্যবহার করেমহানবী (সা.)-এর এমন অবস্থার প্রশংসা করেছেন।মুমিনদের প্রতি তাঁর ভালোবাসাকে আল্লাহ্ তা‘আলা এভাবে ব্যক্ত করেছেন :
‘(হে লোকসকল!) তোমাদের মধ্য থেকেই তোমাদের নিকট এক রাসূল এসেছে, (তোমাদের প্রতি তার অনুকম্পার পরিচয় এই যে,) তোমাদের দুর্ভোগ তার পক্ষে দুর্বিষহ। সে তোমাদের (পথ প্রদর্শনের) অভিলাষী, বিশ্বাসীদের প্রতি দয়ার্দ্র ও পরম দয়ালু।’Ñ সূরা তওবা : ১২৮
কাফিরদের প্রতিও পরম সহানুভূতিশীল
শুধু মুমিন নয়, কাফিরদের প্রতিও তিনি সহানুভূতিশীল ও অত্যন্ত দয়ালু ছিলেন।প্রকৃতপক্ষে, মানুষের জন্য সবচেয়ে আগে প্রয়োজন নিজ ¯্রষ্টা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা। ¯্রষ্টা সম্পর্কিত জ্ঞান মানুষকে সকল পরাধীনতার বন্ধন থেকে মুক্ত করে। যখন মানুষ এক-অদ্বিতীয় আল্লাহকে প্রভু হিসেবে আনুগত্য স্বীকার না করবে তখন সে অনেক প্রভুকে মেনে নিতে বাধ্য হবে। কিন্তু জাহেল আরবরা এটি স্বীকার করতে চাইত না। অন্যদিকে মহানবী (সা.) আল্লাহ্র সেরা সৃষ্টি মানুষকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন। মহানবী (সা.) দীর্ঘদিন মানুষকে আল্লাহর পথে আহ্বান করেছেন। কিন্তু মানুষের অসচেতনতা ও গোঁড়ামি তাঁকে ব্যথিত করত। তিনি স্পষ্ট দেখতে পেতেন যে, আল্লাহ্্র শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষ জাহান্নামের আগুনে দগ্ধ হবে। ‘রাহমাতুল্লিল আলামীন’ হয়ে তিনি তা সহ্য করতে পারতেন না।তাই তিনি মানুষকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচানোর জন্য অস্থির হয়ে উঠতেন। মহান আল্লাহ্ তাঁর এ অবস্থাকে বর্ণনা করেছেন এভাবে :
‘আর সম্ভবত তুমিতোমার জীবনকে তাদের পেছনে শোকে-দুঃখে ধ্বংস করে দেবেন যদি তারা এ কথায় ঈমান না আনে।’Ñ সূরা কাহাফ : ৬
একইভাবে সূরা ফাতিরের ৮ নং আয়াতে আল্লাহ্্ বলছেন : فَلَا تَذْهَبْ نَفْسَكَ عَلَيهِمْ حَسَراتٍ ‘তাদের পেছনে যেন আক্ষেপ ও দুঃখে তোমার জীবন নিঃশেষ না হয়।’
এখানে আরেকটি বিষয় লক্ষ্যণীয় যে, মহানবী (সা.) কাফির-মুশরিকদের জন্য কখনই মহান আল্লাহর কাছে বদদোয়া করেন নি। এটিও তাঁর রহমাতুল্লিল আলামীন হওয়ার অন্যতম উদাহরণ। তিনি বলেছিলেন : ‘আমি অভিশাপকারীরূপে প্রেরিত হই নি; আমি কেবল করুণারূপে প্রেরিত হয়েছি।’ (মুসলিম : ৪৭০৭, মিশকাত : ৫৮১২)
ক্ষমা ও উদারতা : মহানবী (সা.) মক্কার ১০ বছরের নবুওয়াতি জীবনে কাফির-মুশরিকদের দ্বারা ভীষণভাবে নিপীড়নের শিকার হন। তারা তাঁকে পাগল, জাদুকর প্রভৃতি নামে আহ্বান করে মানসিকভাবে নির্যাতন করে এবং শারীরিকভাবেও নির্যাতন করে। একই সাথে অন্যান্য মুসলমানকেও তারা শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করে। আর এ নির্যাতন থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য মুসলমানরা প্রথমে আবিসিনিয়া ও পরে মদিনায় হিজরত করে। মহানবী (সা.) নিজেও মদিনায় হিজরত করতে বাধ্য হন। এরপর প্রায় ৮ বছর ধরে তারা মুসলমানদের সাথে সশস্ত্র যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এসব যুদ্ধে অনেক মুসলমান শাহাদাত বরণ করেন। কিন্তু অষ্টম হিজরিতে মক্কা বিজয়ের পর মহানবী (সা.) কাফির-মুশরিকদের থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ না করে তাদের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। এমনকি মহানবী (সা.) তাঁর চাচা হামযার হত্যাকারী ওয়াহশী ও হযরত হামযার কলিজা ভক্ষণকারিণী হিন্দাকেও ক্ষমা করে দিয়েছিলেন।
সমবেদনা ও সহানুভূতি :সহানুভূতি প্রকাশ, হিত কামনা ও উপকার করার ক্ষেত্রে মুসলমান-অমুসলমানে কোনো পার্থক্য নেই। যাদের সাথে মুসলমানদের যুদ্ধাবস্থা বিরাজমান এমন অমুসলিম ব্যতীত সবার প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করা যায়। অমুসলমানদের উপকার করার কোনো বাধা তো নেইই; বরং ইসলামি রাষ্ট্রে বসবাসরত অমুসলিম জনগণ এক্ষেত্রে মুসলমান নাগরিকের সমান হকদার। মহানবী (সা.) ও সাহাবায়ে কেরাম নিজেদের জীবনে এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্তসমূহ রেখে গিয়েছেন। জনৈক ইহুদি বালক মহানবীর নিকট আসা-যাওয়া করতো। একদিন তিনি ছেলেটিকে দেখতে না পেয়ে তার খোঁজ নিলেন। জানা গেল, ছেলেটি অসুস্থ। তিনি তৎক্ষণাত তার বাড়িতে গিয়ে তার সেবা-শুশ্রƒষা করতে লাগলেন। এক পর্যায়ে তিনি তাকে ইসলামের দাওয়াত দিলে ছেলেটি তার পিতামাতার সম্মতিক্রমে মুসলমান হয়ে যায়। কোরআন মজিদে মুসলমানদের প্রতি এরূপই নির্দেশ রয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘যারা ধর্মের ব্যাপারে তোমাদের সাথে যুদ্ধরত নয় এবং মাতৃভূমি থেকে তোমাদেরকে বহিষ্কার করেনি তাদের সাথে দয়া ও ন্যায়বিচারের ব্যবহার করতে আল্লাহ তোমাদের নিষেধ করেন না।’Ñসূরা মুমতাহিনা : ৮
বয়োজ্যেষ্ঠ ও ছোটদের প্রতি রহমত
সমাজের বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিদের যেমন সম্মান দেয়া প্রয়োজন তেমনি ছোটদেরও ¯েœহ ও ভালোবাসা প্রাপ্য। এ বিষয়টি মহানবী (সা.) নিজ জীবনে দেখিয়েছেন এবং মুসলমানদেরকে এ বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করেছেন। ‘খুতবায়ে শা’বানীয়া’ নামে প্রসিদ্ধ বক্তব্যে মহানবী (সা.) যখন বিভিন্ন দায়িত্ব সম্পর্কে সাহাবীদেরকে দিকনির্দেশনা দিচ্ছিলেন সেখানে তিনি উপদেশ দেন : ‘তোমরা বয়োজ্যেষ্ঠদের সম্মান কর এবং ছোটদের প্রতি দয়াশীল হও।’Ñউয়ুনু আখবারির রিযা, ১ম খ-, পৃ. ২৯৫
মহানবী (সা.) অন্যত্র বলেন : ‘যে শিশুদের প্রতি ¯েœহ করে না এবং বড়দের সম্মান করে না সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়।’Ñ আল মুহাজ্জাতুল বাইদা, ৩য় খ-, পৃ. ৩৬৫
একটি বর্ণনামোতাবেক মহানবী (সা.) আরও বলেছেন :‘তোমরা শিশুদেরকে ভালোবাসো ও তাদের প্রতি দয়াশীল হও।’Ñ বিহারুল আনওয়ার, ৯৩তম খ-, পৃ. ১০৪
মহানবী (সা.) শিশুদের প্রতি এতই মেহেরবান ছিলেন যে, বলা হয়ে থাকে, তায়েফ সফরে যেসব শিশু তাঁর দিকে পাথর ছুঁড়ে মেরেছিল তিনি তাদের প্রতি কোনো প্রতিক্রিয়া দেখান নি; বরং হযরত আলী (আ.) তাদেরকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলেন।’Ñ তাফসীরে কুম্মী, ১ম খ-, পৃ. ১১৫
নারীদের প্রতি রহমত
মহানবী (সা.)-এর জন্মের সময় নারীদেরকে কেবল ভোগ্যপণ্য বলে মনে করা হতো। তাদের কোনো মর্যাদা ছিল না। মহানবী (সা.) নারীদের জন্য রহমত হিসেবে আবির্ভূত হন। তিনি নারীদেরকে যথাযোগ্য আসনে অধিষ্ঠিত করেন। পরিবারে একজন মা, বোন, স্ত্রী ও কন্যা হিসেবে নারী অধিকারের প্রবক্তা ছিলেন মহানবী (সা.)। শুধু কথা নয়, কাজের মাধ্যমে নিজের জীবনে তিনি নারীদের মর্যাদাকে পরিস্ফুট করেন। হযরত খাদীজাকে স্ত্রী হিসেবে যে সম্মান তিনি দিয়েছিলেন তা ছিল তৎকালীন সমাজের সম্পূর্ণ বিপরীত। বিধবা নারীদেরকে তিনি স্বমর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেন। কয়েকজন বিধবার অসহায়ত্ব দূর করার জন্য তিনি নিজে তাঁদেরকে বিবাহ করেন।
কন্যাসন্তানকে জীবন্ত কবর দেয়া ও তাদেরকে তুচ্ছ গণ্য করার জাহেলী সমাজে তিনি হযরত ফাতেমা যাহরা (সা.আ.)-এর প্রতি কন্যা হিসেবে যে আচরণ করেছিলেন তাতে তিনি যে নারী জাতির মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য এসেছিলেন তা স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। পবিত্র কোরআনের বাণী অনুযায়ী নারী-পুরুষের মর্যাদার কারণ যে তাকওয়া তা মানব সমাজে প্রচারের মাধ্যমে তিনি নারী জাতিকে ঘৃণিত ও অপমানিত অবস্থা থেকে রক্ষা করেন।
ইয়াতিম ওগরীব-মিসকিনদের প্রতি রহমত
জাহেলী যুগে ইয়াতিমদের প্রতি ¯েœহ-মমতা প্রদর্শন করা হতো না, তাদেরকে নিগৃহীত করা হতো, ন্যায্য পাওনা থেকে তাদেরকে বঞ্চিত করা হতো, তাদের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করা হতো। মহানবী (সা.) ইয়াতিমদের জন্য রহমতস্বরূপ আগমন করলেন। মহানবী (সা.) নিজেই ইয়াতিম ছিলেন। তিনি ইয়াতিমের কষ্ট বুঝতেন। আর তাই তিনি ইয়াতিমদের সাথে সদাচরণের ও তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়ার এবং তাদের প্রতি দায়িত্ব পালনের জন্য উপদেশ দিয়েছেন। মহানবী (সা.) বলেন : ‘আমি এবং অনাথের দায়িত্বগ্রহণকারী জান্নাতে এই দুই অঙ্গুলির কাছাকাছি থাকব।’ এ কথা বলে তিনি তর্জনী এবং মধ্যমা অঙ্গুলির মাঝে একটু ফাঁক করলেন।- বুখারী
নবী করীম (সা.) বলেন : ‘মুসলমানদের সর্বাপেক্ষা উত্তম গৃহ হলো সে গৃহ, যে গৃহে কোনো ইয়াতিম বসবাস করে আর সে গৃহবাসীরা তার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করে; এবং সবচেয়ে মন্দ গৃহ সে গৃহ, যে গৃহে কোনো ইয়াতিম থাকে অথচ সে গৃহবাসীরা তার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করে না।’Ñ ইবনে মাজাহ
নবী করীম (সা.) আরো বলেন :‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যেইয়াতিম অনাথদের মাথায় ¯েœহের হাত বোলাবে, ইয়াতিমের স্পর্শকৃত প্রত্যেকটি চুলের বিনিময়ে আল্লাহ ঐ ¯েœহকারীকে অসংখ্য নেকী দান করবেন।’ তিরমিযী
ইয়াতিমদের ধন-সম্পদ যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ করার ওপর মহানবী (সা.) গুরুত্ব আরোপ করেছেন। পবিত্র কোরআনের আয়াতে ঘোষিত হয়েছে : ‘…আর স¤পদ ব্যয় করবে তাঁরই মুহব্বতে আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতিম-মিসকীন, মুসাফির-ভিক্ষুক ও মুক্তিকামী ক্রীতদাসদের জন্য…’Ñ সূরা বাকারা : ১৭৬
মহান আল্লাহ অসহায় ইয়াতিমদের হক আদায় না করা এবং মিসকিনদের খাবার না দেয়া লোকদেরকে স¤পর্কে সূরা মাউনে বলেছেন, ‘তুমি কি এমন লোককে দেখেছ, যে দ্বীনকে অস্বীকার করে ? সে তো ওই ব্যক্তি যে ইয়াতিমের প্রতি রুঢ় আচরণ করে তাড়িয়ে দেয় আর মিসকিনদের খাবার প্রদানে মানুষকে নিরুৎসাহিত করে।’Ñ সূরা মাউন: ১-৩
মহানবী (সা.) গরীব-মিসকিনদের সাথে উত্তম ব্যবহার করতেন। তাদেরকে সাহায্য-সহযোগিতা করতেন এবং অন্য সকলকে তাদের সাহায্য করার জন্য উপদেশ দিতেন। সূরা বনি ইসরাইলের ২৬ নং আয়াতে বলা হয়েছে : ‘আর নিজের নিকটবর্তীদের হক আদায় করে দাও এবং গরীব-মিসকিন, প্রতিবেশী ও প্রবাসী মুসাফিরদেরও তাদের হক দিয়ে দাও…’
অন্য একটি আয়াতে বলা হয়েছে : ‘সুতরাং নিকটাত্মীয়দেরকে তাদের হক দিয়ে দাও এবং (তেমনিভাবে) দিয়ে দাও গরীব-মিসকীন, অভাবগ্রস্ত ও প্রতিবেশীদের হক…’Ñ সূরা রূম : ৩৮
পবিত্র কোরআনের বাণী অনুযায়ী গরীব-মিসকিনদেরকে সাহায্য ও সহযোগিতার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করতেন।তাদের জন্য দান-সাদাকার নসিহত করতেন।
আবূ সাঈদ খুদরী হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা মিসকিনদের ভালোবাস।’ কেননা আমি রাসূল (সা.)-কে তাঁর দুআয় বলতে শুনেছি, ‘হে আল্লাহ! তুমি আমাকে মিসকিন রূপে জীবিত রাখ, মিসকিন রূপে মৃত্যুদান কর এবং মিসকিনদের দলভুক্ত করে হাশরের ময়দানে উত্থিত কর।’Ñ ইবনু মাজাহ, হাদিস ৪১২৬
ঋণগ্রস্তের প্রতি দয়া
বুরায়দা (রা.) হতে বর্ণিত; তিনি বলেন, আমি রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি: যে ব্যক্তিকোনো অভাবী ঋণীকে অবকাশ দিবে তার বিনিময়ে প্রতিদিন সাদকার সাওয়াব পাবে। বুরায়দা বলেন, আমি রাসূল হতে আরো শুনলাম যে, যে ব্যক্তি কোনো অভাবী ঋণীকে অবকাশ দিবে সে প্রতিদিন দ্বিগুণ সাওয়াব পাবে। অতঃপর বুরায়দা বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি এমন কথা বলেছেন, যে ব্যক্তি কোনো অভাবী ঋণীকে অবকাশ দিবে তাকে প্রতিদিন দ্বিগুণ সাওয়াব দেওয়া হবে? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন : ঋণ পরিশোধের আগ পর্যন্ত প্রতিদিন সাদকার সাওয়াব পাবে, আর মাফ করে দেওয়া হয়, তাহলে প্রতিদিন দ্বিগুণ সাওয়াব পাবে।’Ñ মুসনাদে আহমাদ : ২২৫৩৭
দাসদের প্রতি রহমত
জাহেলী যুগে দাসদেরকে পশুর মতো গণ্য করা হতো। শুধু আরবে নয়, সারা পৃথিবীতে দাসদেরকে নীচু শ্রেণির মানুষ মনে করা হতো। তাদেরকে দিয়ে অমানুষিক ও সাধ্যাতীত পরিশ্রম করানো হতো। কাজের ত্রুটি ঘটলে নির্মমভাবে প্রহার করা হতো ও কঠিন শাস্তি দেয়া হতো। তাদেরকে পর্যাপ্ত খাবার দেয়া হতো না। কোনো বিষয়েই তারা স্বাধীন ছিল না, মালিকের কথামতো সবকিছু করতে হতো।তাদেরকে বিয়ের অধিকার দেয়া হতো না। যদিও বা তাদেরকে বিয়ে করার অনুমতি দিত, কিন্তু সন্তানের মালিকানা মালিকের হাতে চলে যেত।
এমন অবস্থায় মহানবী (সা.) দাসদের প্রতি সদয় আচরণ করার নির্দেশ দিলেন।ইসলামের শান্তির বাণীতে আকৃষ্ট হয়ে বেলাল, খাব্বাবসহ অনেক দাস ইসলাম গ্রহণ করেন। মহানবী (সা.) নিজে অনেক দাসকে ক্রয় করে মুক্ত করে দেন এবং সাহাবীদেরকে দাসমুক্তির ব্যাপারে উৎসাহিত করেন। তিনি বলেন : ‘যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমকে দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করবে, তাকে তার প্রতিটি অঙ্গের বিনিময়ে প্রতিটি অঙ্গকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা জাহান্নাম থেকে মুক্তি দান করবেন।’ [৫]
পবিত্র কোরআনেও সৎকর্মের উল্লেখের সময় মুক্তিকামী ক্রীতদাসের জন্য ব্যয়ের কথা উল্লেখ করেছেনÑ‘…আর স¤পদ ব্যয় করবে তাঁরই মুহব্বতে আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতিম-মিসকীন, মুসাফির-ভিক্ষুক ও মুক্তিকামী ক্রীতদাসদের জন্য…’ (সূরা বাকারা : ১৭৬)।এমনকি ইসলামি শরীয়তে বিশেষ কিছু বিষয়ের কাফ্ফারারক্ষেত্রে দাসমুক্তিকে অন্যতম বিধান হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। যেমন : ইচ্ছাকৃত শপথ ভঙ্গের কাফ্ফারা।
মহানবী (সা.) বিদায় হজের ভাষণে দাসদের সম্পর্কে বলেন :‘তোমাদের দাস ও অধীনদের বিষয়ে আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় কর। তোমরা তোমাদের দাস-দাসীদের সাথে ভালো ব্যবহার কর। তাদের সাথে খারাপ ব্যবহার কর না। তাদের ওপর নির্যাতন করবে না। তোমরা যা খাবে তাদেরকে তা খেতে দেবে। তোমরা যা পরবে তাদেরকে সেভাবে পরতে দেবে। মনে রেখ, তারাও মানুষ, তোমরাও মানুষ। এরাও একই আল্লাহর সৃষ্টি।’
বন্দিদের প্রতি রহমত
প্রাচীনকালে যুদ্ধবন্দিদেরকে অমানুষিক নির্যাতন করা হতো। একই কক্ষে অনেককে বন্দি করে রাখা হতো। তাদেরকে ঠিকমতো খাবার দেয়া হতো না। অনেককে গরম পানিতে সিদ্ধ করে, ক্রুশ বিদ্ধ করে, শরীরের মাংস কেটে ইত্যাদি নৃশংস পন্থায় হত্যা করা হতো। এমন অবস্থায় মহানবী (সা.) বন্দিদের জন্যও রহমতস্বরূপ এসেছিলেন। বদর যুদ্ধে প্রথম মুসলমানদের হাতে কাফের-মুশরিকরা বন্দি হয়। মহানবী (সা.) বন্দিদেরকে হত্যা না করে মুক্তিপণ নিয়ে এবং বন্দিদের মধ্যে যারা পড়ালেখা জানত তাদের জন্য মুক্তির মাধ্যম হিসেবে মুসলমানদেরকে শিক্ষা দেয়াকে ঘোষণা করেন। এতে মহানবীর বন্দিদের প্রতি মমত্ববোধ প্রকাশিত হয়।
বন্দিদেরকে শারীরিক অত্যাচার না করা, তাদেরকে খাবার দেয়া, তাদের সাথে ভালো আচরণ করা হলো ইসলামের বিধান।রাসূলুল্লাহ(সা.) বলেছেন :‘যে মুসলিম তার বন্দির সাথে খারাপ ব্যবহার করবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।’ মুসনাদে আহমদ : ৩২
জাতিভেদ ও বর্ণভেদ প্রথা বাতিল
বিদায় হজের ভাষণে মহানবী (সা.) বলেন : আরবের ওপর অনারবের এবং অনারবের ওপর আরবের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই, সাদার ওপর কালোর আর কালোর ওপর সাদার কোনো মর্যাদা নেই। তাকওয়াই শুধু পার্থক্য নির্ণয় করবে।
এভাবে মহানবী (সা.) মানব জাতির জন্য রহমত হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন।
পশুপাখিরজন্য রহমত
মানব জাতির প্রতি রহমত হিসেবে আগমনের কিছু বিষয় উল্লেখের পর এখন সৃষ্টিজগতের অন্যান্য সৃষ্টির প্রতি মহানবীর করুণা সম্পর্কে কিছুটা আলোকপাত করা হলো।
হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) পশু-পাখির জন্যও রহমতস্বরূপ এসেছেন। তৎকালীন সময়ে যখন মানুষের প্রতি মানুষের মমত্ববোধ ছিল না তখন পশপাখিদের প্রতি তাদের আচরণ কেমন ছিল তা কিছুটা হলেও ধারণা করা যায়। মহানবী (সা.)-এর আগমনের মাধ্যমে পশুপাখিরাও মানুষের কাছ থেকে যথাযথ আচরণ পেতে শুরু করে। মহানবী (সা.) প্রাণীদের যতœ নেয়া, খাদ্য ও পানি দেয়া, চিকিৎসা করা, এদের অপরিহার্য প্রয়োজনসমূহ পূরণ করা, প্রাণিদের ওপর যুলুম-নির্যাতন না করার বিষয়বিভিন্ন হাদিসের মাধ্যমে বারবার তুলে ধরেছেন। এজন্যই আমরা ইসলামি শরীআতের আহকামে প্রাণিদের সাথে মানুষের আচরণ সম্পর্কে প্রচুর বিধিবিধান লক্ষ করে থাকি।
হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) জন্তু-জানোয়ারের সাথে আচরণের ক্ষেত্রে আল্লাহ্ তা‘য়ালাকে ভয় করার জন্য নসিহত করেছেন। মহানবী (সা.) বলেন : ‘উত্তমভাবে (এগুলোকে কষ্ট না দিয়ে) ওদের পিঠে সওয়ার হও (এবং উত্তমভাবে তাদের কাছ থেকে সেবা গ্রহণ করো) আর উত্তমভাবে ওদের গোশত ভক্ষণ করো।’Ñ জামেউস সাগীর, ১ম খ-, পৃ. ২৪
পশুর ওপরে বেশি বোঝা চাপানো, মাঝখানে বিশ্রাম ব্যতীত বোঝাসহ দীর্ঘ পথ অতিক্রম করা এবং একটি পশুর ওপরে তিনজন সওয়ার হওয়া থেকে নিষেধ করা হয়েছে এবং পশুকে তার সাধ্যের অতীত পথ অতিক্রম করতে বাধ্য না করতে বলা হয়েছে।Ñজাওয়াহেরুল্ কালাম, ৩১তম খ-, পৃ. ৩৯৭
ঘোড়ার কপালের পশম কামিয়ে ফেলতে নিষেধ করা হয়েছে, ওগুলোর ঘাড়ের লোমও কামিয়ে ফেলতেও নিষেধ করা হয়েছে যেহেতু তা শীতের সময় ওগুলোর ঘাড় গরম রাখে। আর তার লেজের পশম খাটো করতে নিষেধ করা হয়েছে। কারণ, এটা হচ্ছে ওদের পোকামাকড় তাড়াবার হাতিয়ার।Ñ মাকারেমুল আখলাক, পৃ. ২৬৪
ইসলামি শরীয়তে পশুকে শারীরিকভাবে কষ্ট দেয়া অপছন্দনীয় হওয়া ছাড়াও কথায় পশুকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা, গালি দেয়া,মন্দ বলা ও অভিশাপ দেয়া অপছন্দনীয় কাজ।ইসলাম-পূর্ব যুগে যখন ঘোড়া ছিল যুদ্ধের জন্য অত্যন্ত প্রভাবশালী একটি উপকরণ এবং ঘোড়া যুদ্ধে প্রাধান্যের কারণ হিসেবে পরিগণিত হতো তখন লোকদের মধ্যে একটি বহুলপ্রচলিত নিয়ম ছিল রণাঙ্গণে দ্বন্দ্বযুদ্ধের সময় প্রত্যেক যোদ্ধাই তার সম্ভাব্য পরাজয় ও মৃত্যুর পর তার ঘোড়া যাতে শত্রুর হাতে না পড়ে সে লক্ষ্যে অথবা বীরত্বের নিদর্শনস্বরূপ স্বীয় ঘোড়ার পাগুলো কেটে দিত। ইসলাম এ কাজ করতে নিষেধ করেছে। একইভাবেপ্রাণিদের চেহারার ওপর আঘাত করতেও নিষেধ করা হয়েছে।Ñ আল-কাফী, ৬ষ্ঠ খ-, পৃ. ৫৩৮
এমনকি পশুপাখিকে জবেহ করার সময়ও পশুর সাথে ভালো আচরণ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।Ñ বিহারুল আনওয়ার,৬২তম খ-, মুসনাদে আহমাদ ইবনে হাম্বাল, ৪র্থ খ-, পৃ. ১২৩
প্রাণীর দুধ পুরোপুরি দোহন করতে নিষেধ করা হয়েছে যাতে তার বাচ্চার কষ্ট না হয়। বিনা কারণে গর্ভবতী পশু হত্যা ও বিনা কারণে পশুহত্যাকে নিষেধ করা হয়েছে।Ñ দায়ায়েমুল ইসলাম, ২য় খ-, পৃ. ১৭৭
প্রাচীনকাল থেকে মানুষের অন্যতম বিনোদন হচ্ছে পশু-পাখিদের মধ্যে লড়াই লাগিয়ে দেয়া। যেমন : মোরগের লড়াই, দুম্বার লড়াই, কুকুরের লড়াই, ষাঁড়ের লড়াই ইত্যাদি। বর্তমানেও বিশ্বের কোনো কোনো অঞ্চলে এগুলোর প্রচলন রয়েছে। এমনকি টিভি-চ্যানেলসমূহ এসব প্রতিযোগিতা প্রচার করে বা কখনো কখনো নিজেরাই এ সবের আয়োজন করে। ইসলামে প্রাণিদের সাথে এ ধরনের আচরণ করতে নিষেধ করা হয়েছে।
হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) ঘোড়া, দুম্বা ও মোরগসহ যে কোনো প্রাণীকে বন্ধ্যা করতে নিষেধ করেছেন।Ñ বিহারুল আনওয়ার, ৬২তম খ-, পৃ. ১০
গাছপালার প্রতি রহমত
রাসূলুল্লাহ্(সা.) যখন সৈন্যদেরকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করেন তখন তাদের উদ্দেশে এরশাদ করতেন : ‘একান্ত অনন্যোপায় না হলে কোনো বৃক্ষ কর্তন করবে না।’Ñ আল মাহাসিন, পৃ. ৩৫৫
ইসলামে বৃক্ষের রক্ষণাবেক্ষণ ও বৃক্ষের গোড়ায় পানি দেয়ার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং গাছ কাটতে নিষেধ করা হয়েছে। হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)এরশাদ করেন :‘যে কেউ তাল্হ্ ও সিদ্র্ বৃক্ষের (যেগুলোর গোড়ায় পানি না দিলে বেঁচে থাকে না) পানি দেবে সে যেন তৃষ্ণার্ত মু‘মিনের পিপাসা নিবৃত্ত করল।’Ñ তাফসীরে আয়াশী, ২য় খ-, পৃ. ৮৭
হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) ফলের গাছের নিচে প্রস্রাব করতে সকলকে নিষেধ করেছেন।Ñ আল-ফাকীহ, ৪র্থ খ-, পৃ. ৪
প্রকৃতির প্রতি রহমত
হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) এরশাদ করেন :‘তোমরা তোমাদের যিন্দেগীর পরিবেশকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখ এবং তোমরা ইহুদিদের মতো হয়ো না।’Ñ আল কাফী, ৬ষ্ঠ খ-, পৃ. ৫৩১
হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) এরশাদ করেন :‘তোমরা বায়ুপ্রবাহকে গালি দিয়ো না। কারণ, তা সুসংবাদদাতা, সতর্ককারী ও পরাগায়ণকারী। অতএব, তোমরা আল্লাহ্র কাছে তার কল্যাণসমূহ প্রার্থনা করো এবং তার ক্ষতিসমূহ থেকে তাঁর কাছে আশ্রয় গ্রহণ করো।’Ñ তাফসীরে আয়াশী, ২য় খ-, পৃ. ২৩৯
হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) উহুদ পাহাড় সম্বন্ধে এরশাদ করেন :‘এই উহুদ হচ্ছে এমন একটি পাহাড় যা আমাদেরকে ভালোবাসে এবং আমরাও এটাকে ভালোবাসি।’Ñ বিহারুল আনওয়ার, ২১তম খ-, পৃ. ২৪৮
হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর এ উক্তি কেবল বিশেষভাবে উহুদ পাহাড় সম্পর্কে নয়, বরং তাঁর এ কথার মানে হচ্ছে এই যে, সমস্ত পাহাড়-পর্বতই আমাদেরকে ভালোবাসেÑ আমাদের বন্ধু এবং আমাদের উচিত সকল পাহাড়-পর্বতের বন্ধু হওয়া তথা এগুলোকে ভালোবাসা। এখানে উহুদ পাহাড়ের কথা কেবল উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
তিনি ব্যবহার করা হয় এমন সুপেয় পানির বা সুপেয় পানির নালা ও নদীর কিনারে পায়খানা-প্রস্রাব করতে নিষেধ করেছেন।Ñ কিতাবুল খিসাল, পৃ. ৯৭
আবার তিনি যে কূপের পানি ব্যবহার করা হয় তাতে থুথু বা কুলি ফেলতে নিষেধ করেছেন।Ñ আল ফাকীহ্, ৪র্থ খ-, পৃ. ১০
উপসংহার
প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তা‘আলা মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-কে সৃষ্টিজগতের সকলের জন্য দয়া ও করুণার প্রতীক রূপে প্রেরণ করেছেন। মহানবীর ওপর নাযিলকৃত মহাগ্রন্থ আল কোরআন ও মহানবীর জীবনীতে এই দয়া ও করুণার পরিচয় স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। মহানবী (সা.) নিজে যেমন দয়া ও করুণার মূর্ত প্রতীক ছিলেন তেমনি তিনি সকল মানুষকে তাঁর মতো হওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছেন। তিনি যেমন দয়া ও করুণার মাহাত্ম্য বর্ণনা করেছেন তেমনি কঠোরতা আরোপের কুফল বর্ণনা করেছেন। কোথাও উপদেশ দিয়েছেন আবার কোথাও নির্দেশ জারি করছেন। তাই প্রতিটি মুমিন-মুসলমানের জন্য একান্ত প্রয়োজন হলো মহানবী (সা.)-এর দেখানো পথে নিজেদেরকে গড়ে তোলা যাতে বিশ^জগৎ একটি দয়ামায়াপূর্ণ ও শান্তির আবাসস্থলে পরিণত হতে পারে।

ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) ও আজকের ভাবনা

মুজতাহিদ ফারুকী
মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর পৃথিবীতে শুভ আগমনের দিন ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)। এটি মুসলিম বিশ্বের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিন। আনন্দের দিন। প্রতি বছর হিজরি সালের ১২ রবিউল আউয়াল মাসে দিনটি পালন করা হয়ে থাকে।
খ্রিস্টজন্মের ৫৭০ বছর পর রবিউল আউয়াল মাসের সোমবার সুবহে সাদিকের নির্মল প্রকৃতিতে ধরাধামে আগমন করেন হযরত মুহাম্মাদ (সা.)। এই মহামানবের জন্মতারিখ নিয়ে সিরাত গ্রন্থ, জীবনীকার, ইতিহাসবেত্তা ও জ্যোতির্বিদগণের মধ্যে বিস্তর মতপার্থক্য রয়েছে। তবে প্রায় সবাই এ বিষয়ে একমত যে, তাঁর জন্ম হয়েছিল রবিউল আউয়াল মাসের শুক্লপক্ষে সোমবার প্রত্যুষে বা ভোরবেলায়। এছাড়া ৭, ৮, ১১, ১২ রবিউল আউয়াল সম্পর্কেও কেউ কেউ মত দিয়েছেন। আমাদের উপমহাদেশে সুদীর্ঘকাল ধরেই ১২ রবিউল আউয়াল মহানবী (সা.)-এর জন্মদিন হিসেবে পালন হয়ে আসছে। আবার কোন কোন মাজহাবের অনুসারীরা ১৭ রবিউল আউয়ালে মহানবীর জন্মদিন পালন করে থাকেন। তবে ইসলামি বিপ্লবের পর ইমাম খোমেইনীর নির্দেশনায় ঈদে মিলাদুন্নবী উপলক্ষে ইরান ১২ রবিউল আউয়াল থেকে ১৭ রবিউল আউয়াল পর্যন্ত ‘ইসলামি ঐক্য সপ্তাহ’ পালন করে আসছে।
ইমাম খোমেইনীর উদ্দেশ্য ছিল, নবীজীর জন্মতারিখ নিয়ে যে মতপার্থক্য রয়েছে সেটিকে প্রাধান্য না দিয়ে বরং এই ঐক্য সপ্তাহে নবীর আদর্শ অনুসরণ ও বাস্তবায়নে কীভাবে আরও বলিষ্ঠ উদ্যোগ নেওয়া যায়, এক্ষেত্রে কী কী করণীয় সেসব বিষয়ে সারা বিশ্বের সব মাজহাবের প-িতরা একসঙ্গে বসে যেন চিন্তা-ভাবনা করতে এবং সুনির্দিষ্ট উপায় উদ্ভাবন করতে পারেন সেই সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া। প্রসঙ্গত বলা দরকার, মুসলমানদের প্রথম কেবলা বায়তুল মোকাদ্দাস ইহুদিদের হাত থেকে পুনরুদ্ধার এবং নির্যাতিত ফিলিস্তিনী মুসলমানদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে গোটা মুসলিম বিশ্বে বর্তমানে যে ‘আল-কুদ্স দিবস’ পালন করা হচ্ছে সেই দিনটিরও ঘোষণা দিয়েছিলেন ইমাম খোমেইনী।
আমাদের দুর্ভাগ্য, ঈদে মিলাদুন্নবী উদ্যাপন নিয়ে আমরা বিতর্ক ও বিভ্রান্তির বেড়াজালে আটকে গেছি। ইমাম খোমেইনীর ঐক্য সপ্তাহ পালনের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তাও আমরা উপলব্ধি করি নি। নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর আগমনে দূরীভূত হয়েছিল অন্ধকার, নির্যাতন-নিপীড়ন-নিষ্পেষণের হাত থেকে মুক্তি পেয়েছিল মানবতা। কিন্তু বর্তমানে তাঁর রেখে যাওয়া আদর্শ থেকে আমরা অনেকটাই বিচ্যুত হয়ে পড়েছি এবং তাঁর আদর্শ সঠিকভাবে উপলব্ধি ও অনুসরণ করতে না পারায় আমাদের ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে ঘোর অমানিশার অন্ধকারের সৃষ্টি হয়েছে। বিভিন্ন ধরনের বিভ্রান্তি আমাদের মধ্যে গভীর অনৈক্য সৃষ্টি করেছে যা চিন্তা ও মননে যেমন বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে তেমনই লক্ষ্যভ্রষ্ট করে দিচ্ছে। এমন প্রেক্ষাপটে প্রতিবছর ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উদ্যাপনের তাৎপর্য কোথায়?
এই দিনটিতে সর্বস্তরের মুসলমানই নবীজীর শানে মিলাদ পাঠ করেন, তাঁর প্রতি দরুদ ও সালাম পৌঁছে দেন, তাঁর জীবন, কর্ম ও আদর্শ অর্থাৎ ইসলাম নিয়ে আলোচনা এবং তা জীবনে বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, বেশিরভাগ মুসলমান ইসলামের অবশ্য পালনীয় নির্দেশাবলিও পালন করেন না; ঘুষ, দুর্নীতি, মিথ্যাচার, অন্যের অধিকার হরণ ইত্যাদি অন্যায়-অপকর্ম ছাড়তে পারেন না; মিথ্যা বর্জন করতে পারেন না; লোভ, হিংসা, মোহ থেকে মুক্ত হতে পারেন না।
এর কারণ, মানুষের স্বভাবগত পারলৌকিক তথা আধ্যাত্মিকতার চেতনা আজ নানা কারণে লুপ্ত হতে চলেছে। বিশ্বজুড়ে আধিপত্য বিস্তারকারী পাশ্চাত্যের বস্তুবাদী চেতনা এবং বৈষয়িক ভাবনাসঞ্জাত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ক্রমশই মানুষকে যেনতেন প্রকারে বৈষয়িক লাভালাভের দিকে চালিত করছে। এক্ষেত্রে নীতি-নৈতিকতারও কোনও পরোয়া করছে না তারা। শুধু তা-ই নয়, পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রবৃত্তিতাড়িত সংস্কৃতির নিত্য হাতছানিতে মুসলমানদের আদর্শিক ও মূল্যবোধনির্ভর ইসলামি সংস্কৃতিও আজ হুমকিগ্রস্ত। কোনো জাতিকে ধ্বংস ও নিশ্চিহ্ন করতে হলে আগে তার নিজস্ব সংস্কৃতি ঐতিহ্য মুছে দিতে হবেÑ সাম্রাজ্যবাদী অপশক্তির এই এজেন্ডা বাস্তবায়িত হচ্ছে আজ মুসলিম দেশগুলোতে। প্রযুক্তির ঔৎকর্ষের এই যুগে প্রযুক্তিনির্ভর অপসংস্কৃতিতে আচ্ছন্ন যুবসমাজ। মুসলমানদের বড় একটি অংশের মাঝে বিরাজিত অপসংস্কৃতির অপচ্ছায়া দূর করতে হলে নিজস্ব বোধ-বিশ্বাসের ইসলামি সংস্কৃতি সামনে নিয়ে আসতে হবে। কেননা, মুসলমানদের জন্য অনুসরণীয় আদর্শ রয়েছে কেবল রাসূলের জীবনেই।
মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন : ‘(হে নবী) আমি আপনাকে সমগ্র জগতের জন্য রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছি।’ সুতরাং মুহাম্মাদ (সা.)-এর পৃথিবীতে আবির্ভাব কেবল মুসলমানদের জন্য নয়; বরং গোটা মানব জাতির মহান পথপ্রদর্শক রূপে। মুহাম্মাদ (সা.) এক আদর্শ মহামানব। এর স্বীকৃতিস্বরূপ আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেনÑ ‘নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের জীবনে রয়েছে অনুপম আদর্শ।’ তিনি মানবজীবনের সকল ক্ষেত্রে আদর্শ। শিশু, যুবা, বৃদ্ধ, নারী-পুরুষ সবার জন্যই তিনি আদর্শ।
মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর জন্মের সময় পবিত্র কাবাঘরে তিন শতাধিক মূর্তি স্থান পেয়েছিল। আরবসহ সারা বিশ্বের আইন-বিচার ও প্রশাসনের ক্ষেত্রে চলছিল বর্বর শাসন, মানুষে মানুষে হানাহানি, উটকে পানি খাওয়ানোর মতো তুচ্ছ বিষয় নিয়ে চলছিল যুগের পর যুগ যুদ্ধ, জীবন্ত কবর দিচ্ছিল বাবা তার নিজ কন্যাসন্তানকে, সুদ ছিল দুনিয়ার অর্থনৈতিক ভিত্তি, ব্যভিচার, মদ ও জুয়া ছিল সমাজের উপর তলার লোকদের নিত্যদিনের কাজ। অসহায় অনাথ বঞ্চিত মানবতা তখন গগণবিদারী আর্তনাদ করছিল। নারী জাতি ছিল মর্যাদাহীন খেলার বস্তু, আদর্শিক-নৈতিক অবস্থা বলতে কিছুই ছিল নাÑ সে সময়, মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) জন্মগ্রহণ করেন।
মুহাম্মাদ (সা.) নিজের সততা, আমানতদারি, বিচক্ষণতা, অনুপম ব্যবহারের মাধ্যমে বিশ্বের সেরা ব্যক্তিত্ব হিসেবে নিজেকে তুলে ধরেন। সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাসহ নারীদের মর্যাদা দান এবং দাসপ্রথার অবসানের মধ্য দিয়ে মানুষের মুক্তির দিশা দেখান। অত্যাচার, নিপীড়ন অর্থনৈতিক অবরোধ, সামাজিক বয়কট, হত্যার হুমকি, কুৎসা রটনা এবং পাগল-জাদুকর, কবি, দেশদ্রোহী, গণক, ধর্মবিরোধীরূপে আখ্যাসহ সকল প্রকার বাধা-বিপত্তির মুখে তিনি সুদৃঢ় ঈমান নিয়ে তাঁর সঙ্গীদেরকে আল-কোরআনের আদর্শে গড়ে তোলেন। মহাগ্রন্থ আল-কোরআনের আলোয় আলোকিত হয়ে ওঠে আরবের এক পশ্চাদপদ বর্বর মানবগোষ্ঠী। এই মহামানবের জীবনচরিত আলোচনা ও তা বাস্তবে রূপদান করাই হলো আজকে ঈদে মিলাদুন্নবী উদ্যাপনের মহান শিক্ষা ও তাৎপর্য।
মুসলমানদের যে একক জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে এবং এথেকে বিচ্ছিন্ন না হওয়ার মধ্যেই ঐক্যের মূলভিত্তি নিহিত রয়েছে তা উপলব্ধি করতে না পারলে পরাশক্তি কর্তৃক উম্মাহর মাঝে ছড়িয়ে দেয়া দ্বন্দ্ব থেকে আমরা উদ্ধার পাব না। আমাদের তেলসম্পদ, মানবসম্পদ, মেধাশক্তি ব্যবহার করে অন্যরা লাভবান হবে আর আমরা চিরকাল পরস্পর বিভক্ত হয়ে খাঁচার পাখির মতো কেবল ডানা ঝাঁপটাব, তা কখনো হতে পারে না। এজন্য আমাদেরকে কোরআন ও হাদিসের আলোকেই নিজেদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। যেখানে আল্লাহর রঙে জীবন রাঙানো এবং আল্লাহর রজ্জুকে শক্ত করে ধরার কথা বলা হয়েছে। এটি হতে পারে কেবল তখনই যখন আমরা ধর্মের মৌলিক বিষয়গুলোতে ঐকমত্যের ভিত্তিতে সমঝোতায় আসতে পারব। মুসলমানদের কিছু মৌলিক বিষয়, যেমন : নামাজ, রোজা, হজ্ব, যাকাত এগুলো নিয়ে যেহেতু কারো মধ্যে কোনও বিরোধ নেই সেহেতু এগুলো মুসলমানদের ঐক্যের ভিত্তি হতে পারে। মৌলিক বিষয়ের বাইরে ছোটখাটো বিষয়ে কে কী করছে, যেমন : কে লম্বা টুপি পরছে আর কে গোল টুপি, কে কোন পীর মানছেন, কে ছোট জোব্বা পরছেন কে লম্বা জোব্বা, নামাজে হাত বুকে বাঁধছেন নাকি নাভির ওপর, ফরজের পর দোয়া মোনাজাত করছেন কি করছেন না, কে দেওবন্দী আর কে কওমী ধারার অনুসারী এসব বিষয় সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে যেতে হবে। কিংবা বিভিন্ন দিবস উদ্যাপন জায়েয কি না-জায়েয এধরনের বিষয়গুলোও পরিহার করতে হবে। কারণ, এগুলো কোনভাবেই ধর্মীয় মৌলিক বিশ্বাসের অন্তর্ভুক্ত নয়। অথচ বেশিরভাগ মুসলমান এসব বিষয় নিয়েই অযথা বিপুল সময় ব্যয় করেছেন এবং এভাবে অনৈক্যের আবর্তে পুরো উম্মাহকে টুকরো টুকরো করে ফেলছেন।
আমরা সবাই একমত যে, মিলাদুন্নবী (সা.)-এর মূল শিক্ষা হলো একমাত্র কালিমা তৈয়্যবা, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ।’ আল্লাহ ভিন্ন উপাস্য নেই, মুহাম্মাদ (সা.) তাঁর প্রেরিত পুরুষ। এ কালেমার গূঢ়ার্থ হাজারও প্রকারে বিশ্লেষণ করা হয়েছে, এর মধ্যে সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ অথচ অতি সংক্ষিপ্ত ও অতি নিখুঁত বিশ্লেষণ হলো ইমানে মুজমাল- ‘বিশ্বপ্রভু আল্লাহর প্রতি আমি ইমান আনলাম, তাঁর সব আদেশ মেনে নিলাম।’
মোদ্দা কথা, মিলাদুন্নবী (সা.)-এর আসল শিক্ষা হলো : মহানবী (সা.)-এর ২৩ বছরের ভালোবাসার, কঠোর সাধনার পরিপূর্ণ ও একমাত্র গ্রহণযোগ্য ধর্ম বা জীবনবিধান ইসলামকে পূর্ণাঙ্গরূপে সর্বস্তরে বাস্তবায়নের মাধ্যমে শান্তির ধর্ম ইসলামকে সগৌরবে প্রতিষ্ঠা করা। আর এটাই নবী বা রাসূল প্রেরণের মূল উদ্দেশ্য; যা পবিত্র কোরআনে বারবার বিবৃত হয়েছে : ‘তিনি সেই মহান প্রভু, যিনি রাসূল প্রেরণ করেছেন, সঠিক পন্থা ও সত্যধর্ম সহযোগে, যাতে সেই ধর্মকে প্রকাশ করতে পারেন সর্বধর্মের শিখরে।’ (সূরা তাওবা : ৩৩ / সূরা ফাতহ : ২৮)।
নবী-রাসূল পাঠানোর লক্ষ্য হলো মানুষকে আল্লাহর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। তাই আল্লাহর ভালোবাসা পেতে হলে রাসূল (সা.)-এর পথ অনুসরণ করতে হবে। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনের ঘোষণা : ‘…যা দিয়েছেন তোমাদের রাসূল (সা.), সুতরাং তা ধারণ করো; আর যা থেকে বারণ করেছেন, তা থেকে বিরত থাকো।’ (সূরা হাশর : ৭)।
আল-কোরআনে আরও বলা হয়েছে : ‘বলুন (হে রাসূল!) যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসবে, তবে আমার অনুকরণ করো; আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন।” (সূরা বাকারা : ৩১)
এ আলোকে নিশ্চিত করে বলা যায়, রাসূল (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসা ইমানের পূর্বশর্ত। আর এই ভালোবাসা তাঁর নির্দেশ পালন ও অনুকরণের মধ্যেই প্রকাশ পাবে। দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তথা ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, আইন-কানুন যে কোনো ক্ষেত্রেই হোক না কেন, সর্বত্রই রাসূল (সা.)-এর অনুপম আদর্শ রয়েছে। বর্তমান দুনিয়ার সর্বত্র মহানবী (সা.)-এর আদর্শ অনুসরণ করলে সত্যিকারের কল্যাণময় বিশ্ব বিনির্মাণ সম্ভব।

রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় ইসলামি উম্মাহ্র ঐক্য অপরিহার্য

সম্পাদকীয়

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ.
مِنَ الْمُؤْمِنِينَ رِجَالٌ صَدَقُوا مَا عَاهَدُوا اللَّهَ عَلَيْهِ فَمِنْهُمْ مَنْ قَضَى نَحْبَهُ وَمِنْهُمْ مَنْ يَنْتَظِرُ وَمَا بَدَّلُوا تَبْدِيلا.
‘মুমিনদের মধ্যে কতক আল্লাহ্র সাথে কৃত তাদের অঙ্গীকার পূর্ণ করেছে, তাদের কেউ কেউ শাহাদাত বরণ করেছে এবং কেউ কেউ প্রতীক্ষায় রয়েছে; বস্তুতঃ তারা তাদের অঙ্গীকারে কোনোই পরিবর্তন করে নি।’ (সূরা আল্-আহ্যাব : ২৩)
এমন এক অবস্থায় নিউজলেটারের অত্র সংখ্যার স¤পাদকীয় নিবন্ধ লিখছি যখন কাফের ও তাকফিরীদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ে ইসলামি শক্তির অন্যতম অগ্রসেনানী হাজ্বী ক্বাসেম সোলায়মানি আর আমাদের মাঝে নেই; গত ৩রা জানুয়ারি (২০২০) বিশ^ব্যাপী সন্ত্রাসবাদের হোতা ও লালনকারী বলদর্পী আমেরিকার কাপুরুষোচিত হামলায় তিনি শাহাদাত বরণ করেছেন। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজি‘ঊন্।) হাজ্বী ক্বাসেম সোলায়মানির শাহাদাতে আমরা নিউজলেটারের পাঠক-পাঠিকাগণ সহ সারা বিশে^র, বিশেষত বাংলাদেশের সকল মুসলিম ও মুস্তায‘্আফ্ জনগণের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করছি এবং সর্বশক্তিমান আল্লাহ্ তা‘আলার কাছে এ মহান শহীদের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত্ কামনা করছি।
হাজ্বী ক্বাসেম সোলায়মানিকে এ কারণে শহীদ করা হয় যে, তাঁর লক্ষ্য ছিল ইসলামের চির দুশমন সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার গড়া আইএস নামধারী তাকফিরী সন্ত্রাসীদের বাতিল চিন্তাধারার গতিরোধ করা ও মধ্যপ্রাচ্যের ইসলামি ভূখ- থেকে তাদেরকে সমূলে উৎপাটিত করা। আইএস-বিরোধী হবার অভিনয়কারী বলদর্পী আমেরিকার দৃষ্টিতে হাজ্বী ক্বাসেম সোলায়মানির অপরাধ ছিল এই যে, তিনি ফিলিস্তিন-গ্রাসী যায়নবাদী সরকারের পৃষ্ঠপোষক আইএস-সন্ত্রাসীদেরকে ইরাক ও সিরিয়া থেকে বহিষ্কার করেছিলেন। তাই তাঁকে শহীদ করে মার্কিন সরকার নিজেকে একটি সন্ত্রাসী সরকার হিসেবে আরো একবার প্রমাণ করলোÑ যে সরকার কোনো আন্তর্জাতিক আইনের ও মানবাধিকারের প্রতি ন্যূনতম সম্মানও প্রদর্শন করে না।
যদিও তৎকালীন ইরানের জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত ড. মোসাদ্দেকের সাংবিধানিক ও আইনগত বৈধ সরকারের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান ঘটানোর কারণে এ পর্যন্ত মার্কিন সরকার ইরানি জাতির নিকট প্রধানতঃ একটি সামরিক অভ্যুত্থান সৃষ্টিকারী সরকার হিসেবে পরিচিত ছিলÑ যে সরকার বিশে^র আরো বহু দেশে তার সেবাদাসদের দিয়ে সামরিক অভ্যুত্থান সৃষ্টি করে আসছে, তবে এবার ইরানি জনগণের নিকট মার্কিন সরকারের চেহারা প্রধানতঃ একটি সন্ত্রাসী সরকার হিসেবে সুস্পষ্ট হলÑ যে সরকার ইসলামি ও স্বাধীনতাকামী সংগ্রামী মানুষদেরকে সন্ত্রাসী হামলার মাধ্যমে হত্যা করে থাকে। তবে শহীদ সেনাপতিদের রক্ত ইসলামি উম্মাাহ্্কে ঐক্যবদ্ধ করবে ইনশাআল্লাহ। সর্বশক্তিমান আল্লাহ্ তা‘আলার ঘোষণা অনুযায়ীÑ
سَيَعْلَمُ الَّذِينَ ظَلَمُوا أَيَّ مُنْقَلَبٍ يَنْقَلِبُونَ.
‘যালিমরা অচিরেই জানতে পারবে যে, তারা কোন্ বিপরীত অবস্থায় গিয়ে উপনীত হবে।’ (সূরা আশ্-শু‘আরা : ২২৭)

ড. সাইয়্যেদ হাসান সেহাত
কালচারাল কাউন্সেলর
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান দূতাবাস, বাংলাদেশ

স্মরণীয় বাণী

 

রাসূলুল্লাহ্ (সা.) এক ব্যক্তির উদ্দেশে এরশাদ করেন : ‘আমি তোমাকে নসীহত্ করছি যে, যখনই তুমি কোনো কাজ আঞ্জাম দিতে চাইবে তখন তার পরিণতি সম্বন্ধে চিন্তা করবে; কাজটি যদি উন্নতি ও হেদায়াতের উৎস হয়ে থাকে তাহলে তা আঞ্জাম দাও এবং তা যদি ফাসাদ্ ও ধ্বংসের উৎস হয়ে থাকে তাহলে তা বর্জন করো।’
রাসূলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন : ‘যে কেউ জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তিপ্রাপ্তদেরকে দেখতে চায় সে যেন জ্ঞানার্জনে রতদের প্রতি দৃষ্টিপাত করে। আল্লাহ্র শপথ, জ্ঞানসন্ধানী ব্যক্তি (তালেবে ‘ইল্ম্) জ্ঞানীর গৃহের পানে যে পদক্ষেপ গ্রহণ করে তার প্রতিটি পদক্ষেপের বিনিময়ে আল্লাহ্্ তার জন্য এক বছরের ইবাদত লিখে দেন এবং তার প্রতিটি পদক্ষেপের বিনিময়ে তার জন্য বেহেশতে একটি শহর তৈরি করে দেন। সে যখন যমীনের ওপর দিয়ে পথ চলে যমীন তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং এমন অবস্থায় তার সকাল ও সন্ধ্যা হয় যে, তাকে ক্ষমা করা হয়েছে এবং ফেরেশতারা সাক্ষ্য দেন যে, সে জাহান্নামের আগুন থেকে রেহাই পেয়েছে।’
হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) এরশাদ করেন : ‘কেউ স্বীয় কাজের দ্বারা অর্জিত খাবারের চেয়ে উত্তম খাবার কখনো খায় নি। আর নবী দাউদ (আ.) স্বীয় কাজের মাধ্যমে অর্জিত খাবার খেতেন।’
আমীরুল মু‘মিনীন হযরত আলী (আ.) এরশাদ করেন : ‘জীবনের সুদৃঢ়তা উত্তম কর্মপরিকল্পনায় নিহিত এবং তার মানদ- হচ্ছে উত্তম লক্ষ্যে দূরদর্শিতা।’
হযরত আলী (আ.) এরশাদ করেন : ‘সবচেয়ে উপভোগ্য যিন্দেগী হচ্ছে কৃত্রিম আনুষ্ঠানিকতাকে দূরে নিক্ষেপ।’
হযরত ইমাম হাসান মুজ্তাবা (আ.) যখনই নামাযের জন্য দাঁড়াতেন তখন তাঁর সর্বোত্তম পোশাকটি পরিধান করতেন। লোকেরা জিজ্ঞেস করল : “আপনার সর্বোত্তম পোশাকটি পরেছেন কেন?’ তিনি এরশাদ করেন : ‘‘আল্লাহ্্ সুন্দর এবং সৌন্দর্যকে পছন্দ করেন। এ কারণে আমি আমার রবের জন্য নিজেকে সুন্দর করছি। তাছাড়া তিনি (আল্লাহ্্) এরশাদ করেছেন : ‘তোমরা যে কোনো নামাযের জায়গায় তোমাদের সৌন্দর্য ধারণ করো।’ এ কারণে আমি (নামাযের সময়) আমার সর্বোত্তম পোশাক পরিধান পছন্দ করি।’’
হযরত ইমাম বাকের (আ.) এরশাদ করেন : ‘রাসূলুল্লাহ্ (সা.) তাঁর উম্মাতকে হাতে স্বর্ণের আংটি পরিধান করতে এবং বিভিন্ন ধরনের সোনার কাজ করা পোশাক ও রেশমি পোশাক পরিধান করতে নিষেধ করেছেন।’
হযরত ইমাম বাকের (আ.) এরশাদ করেন : ‘তোমরা যখন সবুজ ভূমিতে সফর করবে তখন আস্তে অগ্রসর হও এবং যখন শুষ্ক ও অনাবাদী ভূমি অতিক্রম করবে তখন দ্রুত অতিক্রম করে যাও।’
ইমাম জাফর সাদিক (আ.) এরশাদ করেন : ‘মু‘মিনের জন্য নিজেকে লাঞ্ছিত করা শোভা পায় না।’ প্রশ্ন করা হলো : ‘কীভাবে সে নিজেকে লাঞ্ছিত করে? তিনি বললেন : ‘সে এমন কাজে হাত দেয় যা করা তার সাধ্যের বাইরে।’
হযরত ইমাম জা‘ফর সাদেক (আ.) এরশাদ করেন : ‘পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা নবী-রাসূলগণের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যসমূহের অন্যতম।’
হযরত ইমাম মূসা কাযেম্ (আ.) এরশাদ করেন : ‘মাথার সাথে সম্পর্কিত সুন্নাতসমূহের অন্যতম হচ্ছে চুল আঁচড়ানো।’
হযরত ইমাম রেযা (আ.) এরশাদ করেন : ‘জুমুআর দিনে পাগড়ি পরিধান করা, সর্বোত্তম ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পোশাক পরিধান করা এবং সর্বোত্তম আতর দ্বারা নিজেকে খুশবু করা মুস্তাহাব।’

(মাফাতীহুল্ হায়াত্ গ্রন্থ থেকে সংকলিত)
অনুবাদ : নূর হোসেন মজিদী

কবিতার দেশে বিপ্লবের দেশে কিছু অনুভূতি : আমিন আল আসাদ

কবিতার দেশে বিপ্লবের দেশে কিছু অনুভূতি
আমিন আল আসাদ

পারস্য বা ইরানের কথা সর্বপ্রথম জেনেছিলাম ছোটবেলায় স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে। ইরানের কবি শেখ সাদীর জীবনের ঘটনা নিয়ে একটি গল্প ‘পোশাকের গুণে’ পাঠের মাধ্যমেই সর্বপ্রথম ইরানের নাম আমার চেতনায় স্থান লাভ করে। এছাড়া সপ্তম শ্রেণির সাহিত্য পাঠে ‘সোহরাব রুস্তমের কাহিনী’ নামে একটি গল্প পাঠ করেছিলাম। বিদ্যালয়ের সেলিম স্যার কি দারুণভাবে পড়িয়েছিলেন গল্পটি আজো মনে আছে। গল্পটি ইরানের জাতীয় কবি মহাকবি ফেরদৌসীর ‘শাহানামা’য় রয়েছে।
আমার মেজ চাচা মরহুম জহুরুল করিম চৌধুরী একজন জ্ঞানী মানুষ ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন বইপ্রেমিক ও পাঠপ্রিয় মানুষ। তিনি আমাদেরকে নানা উপলক্ষে বই উপহার দিতেন। বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর ভালো রেজাল্ট করায় তিনি আমাকে ও তাঁর ছেলে মঞ্জুর-উল করিম চৌধুরীকে যথাক্রমে ‘ফুটলো গোলাপ ইরান দেশে’ এবং ‘শাহনামার গল্প’ নামে দুটি বই উপহার দেন। আমি পেয়েছিলাম মরহুম আখতার ফারুকের লেখা ফুটলো গোলাপ ইরান দেশে বইটি। দুটি বইই আমরা বিনিময় করে পড়েছিলাম। এভাবে শৈশব কৈশোর কাল থেকেই আমাদের স্বদেশের পাশাপাশি ইরান দেশটিও যেনো কেমন করে আপন হয়ে পরে। কিন্তু তখনো ভাবি নি মহান আল্লাহ সেই ভালো লাগা দেশটি ভ্রমণের তওফিক দেবেন। গিয়েছিলাম ইমাম খোমেইনী (র.)-এর ১৮তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে অনুষ্ঠানে ২০০৮ সালে। আমি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক লালকুঠি দরবার শরীফের পীর সাহেব জনাব আহসানুল হাদী, বিশিষ্ট লেখক আহমেদুল ইসলাম চৌধুরী, কবি মোহন রায়হান, কবি রোকন জহুর, কবি আহমেদ কায়সার, প্রকাশক মিজানুর রহমান পাটোয়ারী, ব্যবসায়ী সাখাওয়াত হোসেন, মাওলানা সাবির রেজা, জনাব রাশেদুজ্জামান, জনাব আবু সায়িদ প্রমুখ। এর মধ্যে জনাব আবু সায়িদ ইরানেই থাকতেন। দেশে এসেছিলেন, তাই ফিরছিলেন আমাদের সাথে। তিনিও যোগ দেবেন ইমাম খোমেইনী (র.)-এর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে। আমরা গাল্ফ এয়ারে বাহরাইন হয়ে তেহরান যাব। জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ইরানের উদ্দেশ্যে আমাদের বোয়িং আকাশের উড়াল দেয়ার সাথে সাথে এক অভাবনীয় আনন্দের ঢেউ খেলে গেল দেহমনে। কারণ, এটাই ছিল আমার জীবনের প্রথম বিমান যাত্রা। আর যাচ্ছি আমার আদর্শের প্রতিষ্ঠাভূমিতে। কারণ, আমি যে সমাজের স্বপ্ন দেখি তা বিংশ শতাব্দীতে ইরানই করে দেখিয়েছে। যেখানে ঘটেছে এক আলোকের বিস্ফোরণ যা আলোকিত করেছে ইরানবাসীকে ও বিশ্ববাসীকে। হ্যাঁ, আমরা যাচ্ছি কবিতার দেশে ও বিপ্লবের দেশে। পারস্য সভ্যতার দেশে। সাহাবী সালমান ফারসি (রা.)-এর দেশে। যে দেশ সম্পর্কে আমাদের প্রিয়নবী (সা.) ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যখন সূরা মুহাম্মাদের শেষ আয়াত নাযিল হয়- ‘যদি তোমরা পেছন ফিরে যাও তবে আল্লাহ এমন এক জাতিকে বছাই করবেন যারা তোমাদের মতো হবে না’। সাহাবীরা রাসূল (সা.)-কে বললেন : ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ (সা.)! যদি আমরা পেছন ফিরে যাই তবে আল্লাহ পাক কোন্ জাতিকে বাছাই করবেন?’ সালমান ফারসি (রা.) রাসূল (সা.)-এর পাশেই বসা ছিলেন। মহানবী (সা.) সালমান ফারসির ঊরুতে আঘাত করে বললেন : ‘এই ব্যক্তি ও তার জাতি। শপথ তাঁর, যাঁর হাতে আমার জীবন, ঈমান যদি আকাশের সুরাইয়া তারকাতেও ঝুলে থাকে, ফারসের মানুষ সেখান থেকে তা ছিনিয়ে আনবে।’ সেদিনকার সেই র্ফাস-ই আজকের ইরান বা ফারসি বা পারস্য। সপ্তম শতকে মুসলিম বিশ্বে যত জ্ঞানী-গুণী জন্মগ্রহণ করেছিলেন এর বেশিরভাগই জন্মেছিলেন ইরানি ভূখণ্ডে। তখন ইরান আরো বড় ছিল। ইরাকের একটি বিরাট অংশ আর সমরকন্দ, বোখারা, তাজিকিস্তান, কাজাখস্তান প্রভৃতি রাশিয়া অধিকৃত প্রদেশগুলোও ইরানের ছিল। শিয়া ও সুন্নি উভয় মাযহাবের পণ্ডিতগণ ইরানে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মগ্রহণ করেন কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক, বিজ্ঞানী, গণিতবিদ, মহাকাশবিদ, ধর্মত্ত্ববিদ প্রমুখ।  
ইরানের কবিদের নাম বিশ্বসাহিত্যের আসরে বিশেষ মর্যাদা নিয়ে অবস্থান করছে। বিশেষ করে ইরানের জাতীয় কবি ফেরদৌসী ছাড়াও শেখ সাদী, হাফিজ, ওমর খৈয়াম, নিযামী, রুদাকী, সুফিকবি মাওলানা রুমি, ফরিদউদ্দিন আত্তারের কথা বিশ্বের কবিদের মুখে মুখে বিরাজমান। মুসলিম দার্শনিক ইমাম গাজ্জালী, চিকিৎসাবিদ ইবনে সীনা, মহাকাশ বিজ্ঞানী ও দার্শনিক আল বিরুনী, পদার্থবিদ আল ফারাবী প্রমুখ জ্ঞানী-গুণী ইরানে জন্মেছিলেন। আমাদের দেশে মরহুম সাহিত্য গবেষক মুহাম্মদ মনসুর উদ্দীন ইরানের কবিদের নিয়ে লিখেছিলেন ‘ইরানের কবি’ নামে এক বিশাল বই। আর মুহাম্মদ বরকতুল্লাহ লিখেছিলেন ‘পারস্য প্রতিভা’। আমরা জ্ঞানীদের দেশ, কবিদের দেশ এবং মহান ইমাম খোমেইনী (র)-এর দেশ, মহান ইসলামি বিপ্লবের দেশ ইরানে যাচ্ছি। আমরা ঢাকা থেকে বাহরাইন এবং বাহরাইন থেকে তেহরান গেলাম।
আমাদের প্রাণপ্রিয় স্বদেশ হচ্ছে বাংলাদেশ। আমাদের রয়েছে হাজার বছরের ইতিহাস। আমাদের রয়েছে জাতীয় সংস্কৃতি। আমরা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করেছি এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পেয়েছি স্বাধীন স্বদেশ। তেমনি ইরানেরও রয়েছে হাজার বছরের ইতিহাস। রয়েছে নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। হাজার বছরের নানা সংগ্রামের ভেতর দিয়ে ১৯৭৯ সালে মহান ইসলামি বিপ্লবের মাধ্যমেই সত্যিকার স্বাধীন দেশে পরিণত হয় ইরান। প্রকৃত স্বাধীনতা মানে কি? প্রকৃত স্বাধীনতা মানে আল্লাহ ছাড়া আর কারো কাছে মাথা নত না করা। দুনিয়ার কোন দেশ বা কোন মানুষ আমার প্রভু নয়, বরং বন্ধু। আমার দেশের সীমানা, আমার দেশের জনগণের ভালো-মন্দ, আমাদের আয়-উন্নতি, শিক্ষাদীক্ষা, সংস্কৃতি, ভাষা ও ধর্মের ব্যাপারে অন্য কেউ নাক গলাতে পারবে না। কিন্তু কেউ কিছু জোর করে আমাদের মাঝে চাপিয়ে দিতে পারবে না। এটাই হলো আসল স্বাধীনতা। কাজেই আমাদের স্বাধীনতাকে মজবুত করতে হলে আমাদেরকে আত্মবিশ্বাসী হতে হবে। দৃঢ় শপথ নিতে হবে। কঠোর পরিশ্রমী ও সৎ হতে হবে। এটি ইরানি জাতি থেকে শেখার আছে। কারণ, ইরান ও আমাদের বাংলাদেশের সাথে অনেক বিষয়ে মিল রয়েছে। যেমন আমরা বলি- ‘একুশ মানে মাথা নত না করা’। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারির ভাষা সংগ্রাম আমাদেরকে মাথা নত না করার শিক্ষায় শিক্ষিত করেছে। কারণ, একজন দেশপ্রেমিক ও প্রকৃত ঈমানদার কোন আধিপত্যবাদীর কাছে মাথা নত করতে পারে না। আমরা বাংলাদেশিরা যেমন নিজেদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ভাষা ও ইতিহাসের ওপর দাঁড়িয়ে সাহসী ও স্বাধীন চেতনার অধিকারী হয়েছি। ইরানিরাও ১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে যে ইসলামি বিপ্লব করেছে সেখান থেকে মাথা নত না করার শিক্ষা লাভ করেছে এবং দিনে দিনে উন্নতি লাভ করেছে। ইরানের সাথে বাংলাদেশের রয়েছে জনগণের ধর্মবিশ্বাসের মিল, ইতিহাসের বিভিন্ন সময় আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতিতেও ইরানের নানা বিষয় প্রবেশ করেছে। যেমন এদেশে যে সুফিগণ ইসলাম প্রচারে এসেছিলেন তাঁদের বেশিরভাগ ছিলেন ইরানি ভাবধারার। তাঁরা সবাই ছিলেন নবীবংশের ভক্ত। বাংলা ভাষায় সাড়ে সাত হাজার ফারসি শব্দ সরাসরি প্রবেশ করেছে নানা পরিভাষায়। আরো অনেক ফারসি শব্দ এসেছে বাংলায় পরিবর্তন পরিবর্ধন হয়ে।
এদেশের শাসকদের সাথেও ইরানের এবং ইরানের কবিদের সম্পর্ক ছিল। আমরা জানি, সোনারগাঁ থেকে যে সব সুলতান বাংলা শাসন করতেন তাঁদের সাথে ইরানের বন্ধুত্ব ছিল। সুলতান গিয়াসউদ্দিন আযম শাহ ইরানের কবি হাফিজকে বাংলায় আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।
এইসব কথা ভাবতে ভাবতেই মধ্য আকাশ থেকে আমরা ক্রমেই তেহরানের আকাশে এবং তেহরানের মাটির দিকে নেমে আসছিলাম। আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম মধ্যদুপুরের সোনালি রোদে চকচক করছিল তেহরানের রাস্তাঘাট, গাড়ি, বাড়িঘর, গাছপালা, বিস্তীর্ণ খোলা মাঠ, উঁচু গম্বুজ ইত্যাদি। আমরা অবতরণ করছি ইমাম খোমেইনী (র.) বিমানবন্দরে। কবিতার দেশ ও বিপ্লবের দেশ আর বিশ্বসেরা গোলাপের দেশ ইরানের মাটি স্পর্শ করতে করতে অপার এক আনন্দে দুলে উঠল মন এই ভেবে যে, আমরা আমাদের স্বপ্নের ভূমিতে এসে পড়েছি। বিমানের চাকা তেহরানের মাটি স্পর্শ করার সাথে সাথেই সকল যাত্রী সহ একসাথে দরূদ পাঠ করলাম নবীর শানে ‘আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মুহাম্মাদ ওয়া আলে মুহাম্মাদ’। ইমিগ্রেশনের যাবতীয় কাজ শেষ করে এগিয়ে যেতেই লক্ষ্য করলাম দু’জন যুবক আমাদের জন্য দাঁড়িয়ে আছে ইমামের ছবিযুক্ত এক প্লাকার্ড হাতে নিয়ে। তাতে ইংরেজিতে যা লেখা তার অর্থ হচ্ছে ‘আমরা ইমাম খোমেইনী (রহ)-এর উনিশতম মৃত্যুবার্ষিকী উদ্যাপন কমিটির পক্ষ থেকে বিদেশী অতিথিদের আগমনের অপেক্ষা করছি।’ আমরা বললাম : ‘আমরা বাংলাদেশ থেকে এসেছি।’
তারা বলল : ‘হ্যাঁ, আমরা আপনাদের জন্যই অপেক্ষা করছি।’ তারা তাদের অতিথিদের নামের তালিকা বের করে আমাদের সাথে পরিচিত হলো। যুবক দু’জন তেহরান ইউনিভার্সিটির ছাত্র। আমাদের লাগেজগুলো খুঁজে বের করতে সহযোগিতা করল তারা। এরপর আমাদেরকে সাথে করে নিয়ে এলো বিমান বন্দরের বাইরে। এখানে আমাদের জন্য দাঁড়িয়ে আছে চারটি মূল্যবান মোটর কার। হাত ইশারায় গাড়িতে চড়তে অনুরোধ করে বলল : ‘বেফারমাইদ’ অর্থাৎ দয়া করে উঠুন। গাড়ি ছুটে চলল ‘খিয়া’বানে ইমাম খোমেইনী’ অর্থাৎ ইমাম খোমেইনী (র.) সড়কের ওপর দিয়ে। সূর্য তখন অস্ত যাচ্ছে। দু’চোখ ভরে দেখলাম ইরানি বিকাল। তেহরান বিশ্বের অন্যতম আধুনিক শহর। চতুর্দিকে পাহাড় আর পাহাড়। পুরো তেহরান শহর ঘিরে আছে আল-বোর্য পর্বতমালা। এর আশ-পাশে ছড়িয়ে আছে ধূসর পাহাড়। পাদদেশে সমতল ভূমিও রয়েছে বিস্তীর্ণ। ছোট বড় পাহাড়ের ওপর নির্মিত হয়েছে বড় বড় অট্টালিকা। আমাদের গাড়ি ছুটে চলেছে সত্তর কিলোমিটার গতিতে হু হু করে। অজস্ত্র গাড়ি আসছে যাচ্ছে। আমরা ইমাম খোমেইনী (র.)-এর মাযারের পাশ দিয়েই অতিক্রম করলাম। ড্রাইভার আমাদের হাত ইশারায় দেখালেন ইমামের মাযার। এটাই বেহেশত যাহরা। এখানে শুয়ে আছেন সত্তর হাজারেরও অধিক শহীদ। যাঁরা ইসলাম ও ইসলামি প্রজাতন্ত্রের জন্য অকাতরে তাঁদের জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন। তাঁরা মারা যান নি। তাঁরা জীবিত। ‘আল্লাহর রাস্তায় যারা শহীদ তাদেরকে তোমরা মৃত বল না, বরং তারা জীবিত।’ আল কোরআনের বাণী অনুসারে কবিও বলেন সেকথা-
‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী, ভয় নাই ওরে ভয় নাই/নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান, ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।’
আমাদেরকে হোটেল ইস্তেকলাল-এ নিয়ে যাওয়া হবে। ইরানে তিনটি ফাইভস্টার হোটেল খুবই নামকরা। হোটেল ইস্তেকলাল, হোটেল আজাদী, হোটেল লালেহ। হোটেলগুলোর অন্য নাম ছিল। বিপ্লবের পর এধরনের নামকরণ করা হয়েছে। ইস্তেকলাল মানে স্বাধীনতা, আজাদী মানে মুক্তি, আর লালেহ অর্থ লাল টিউলিপ। সংগ্রামের প্রতীক। আমাদের দেশে যেমন সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে পলাশ, শিমুল, রক্তজবার কথা উল্লেখ করা হয়। আমরা হোটেল আজাদীর পাশ দিয়েই গেলাম। হোটেল আজাদী পাহাড়ের ঠিক মাঝখানে। চলতি পথে একটি টাওয়ার দেখতে পেলাম। এর নাম বোর্জে মিলাদ। বড় অট্টালিকাগুলোর দেয়ালে দেয়ালে ইরানের কৃতি সন্তান যাঁরা শহীদ হয়েছেন তাঁদের প্রকা- ছবি আঁকা রয়েছে। শহীদ ড. বেহেশতি, শহীদ আয়াতুল্লাহ মোরতাজা মোতাহারী, শহীদ ড. মোস্তাফা চামরান, শহীদ ড. জাভেদ বাহোনার, শহীদ প্রেসিডেন্ট আলী রাজাই প্রমুখ। আরেকটি অট্টালিকার দেয়ালে দেখলাম ফিলিস্তিনের ইসলামি বিপ্লবের (হামাস) নেতা শহীদ শেখ মুহাম্মদ ইয়াসিন এবং শহীদ ইমাদ মুগনিহ-এর ছবি যার পেছনে আল-কুদ্স বা বায়তুল মোকাদ্দাসের বিশাল আকৃতির ছবি। এসব দেখতে দেখতে যখন হোটেল ইস্তেকলালে আমরা এসে পৌঁছলাম তখন মাগরিবের আজান হচ্ছে।
বিশ্ব সাহিত্যের আসর মাতানো শাহনামার দেশ, মসনবী শরীফের দেশ, গুলিস্তা, বোস্তা আর কারিমায়ে সাদীর দেশ, দিওয়ানে হাফিজ ও রুবাইয়াতে ওমর খৈয়ামের দেশ, আলো ঝলমল ও মোহময় পারস্য উপন্যাসের দেশ, সর্বোপরি ইমাম হোসাইন (আ.)-এর বিপ্লবী চেতনার দেশ ইরান যেমন এক স্বপ্নের ভূমি, তেমনি এক আপোষহীন সংগ্রামেরও ভূমি। সেজন্যই ইরান যেমন কবিতার দেশ, তেমনি বিপ্লবের দেশ। ইরানের ইসলামি বিপ্লবের মাধ্যমে আড়াই হাজার বছরের রাজতন্ত্র উচ্ছেদ হয়েছিল একটি ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক বৈপ্লবিক প্রক্রিয়ায়। ইসলামের ইতিহাসের এক মহান আত্মত্যাগের ঘটনা হলো কারবালায় সপরিবারে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর আত্মত্যাগ। কারবালায় ইমাম হোসাইন (আ.)-এর আত্মত্যাগ ও কালজয়ী বিপ্লবের চেতনাই সমগ্র ইরানি জাতিকে উদ্দীপ্ত করেছিল। সেজন্যই ইরানকে বলা হয় ‘আশুরা সংস্কৃতির লালন ভূমি’।
মহান ইমাম খোমেইনী (র.) ইরানি জাতির মাঝে আবির্ভূত হয়েছিলেন ভোরের আকাশে সূর্যের মতো। ইমাম খোমেইনী (র)-এর পুরো নাম সাইয়্যেদ আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ মুসাভী আল খোমেইনী। তিনি ছিলেন নবী বংশের সন্তান। ইমাম হোসাইন (আ.)-এর বংশধারায় জন্ম নেয়া ৭ম ইমাম মূসা কাযেম (আ.)-এর বংশধর। ইরানের জনগণ তাঁর মতো মানুষের নেতৃত্ব পেয়ে বিশ্বের মাঝে মাথা উঁচু করে দাঁড়ালো। যেন কুয়াশা আর বরফে আবৃত শীতের জড়তা ভেঙে জেগে উঠল হাজারো পুষ্প কানন। মানুষ তার অধিকার ফিরে পেল। ইরানের জনগণের ওপর চেপে থাকা অত্যাচারী শাহ দেশ ছেড়ে পালালো। ইমাম খোমেইনী শুধু ইরানি জাতিকেই ঝাঁকুনি দিয়ে জাগিয়ে দেন নি, গোটা বিশ্বের মুসলমান ও নির্যাতিত মানুষের হৃদয়ে নতুন করে আশা জাগালেন। বিংশ শতাব্দীর শেষ প্রান্তে এসে পৃথিবীর দিকে দিকে দেশে দেশে মুসলমানদের জাগরণ আমরা দেখতে পেয়েছি। ইরানের ইসলামি বিপ্লব সেইসব জাগরণকে নুতনভাবে প্রেরণা দিল। যুগ যুগ ধরে ফিলিস্তিনের মুসলমানদের ওপর ইহুদিদের নির্যাতন বর্বরতার সকল সীমানা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। ইমাম এসব কঠিন মুহূর্তে মুসলিম জাতিকে ধৈর্য ধারণ করার উপদেশ দিলেন। ইমাম সকল দেশ-ভাষা, বর্ণ ও মাযহাবের মুসলমানদেরকে ঐক্যবদ্ধ হবার উপদেশ দিলেন। মুসলমানদের প্রথম কেবলা আল-কুদ্স বা বায়তুল মোকাদ্দাস ও ফিলিস্তিনের মুসলমানদের মুক্তির ব্যাপারে সকল মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ করার জন্য প্রতি বছর মাহের রমযানের শেষ শুক্রবার তথা পবিত্র জুমাতুল বিদা-কে আল-কুদ্স দিবস ঘোষণা করলেন। আজো প্রতিবছর বিশ্বের সবকটি মুসলিম দেশে আল-কুদ্স দিবস পালিত হয়। ইমাম বলেছিলেন, ‘বিশ্বের সব মুসলমান যদি ঐক্যবদ্ধ হতো আর ইসরাঈলের ওপর সকলে মিলে এক বালতি করে পানিও ঢেলে দিত তবে ইসরাঈল বানে ভেসে যেত।’ আমরা দেখেছি, সালমান রুশদী নামের এক কুখ্যাত ব্রিটিশ লেখক মহানবী (সা.) সম্পর্কে যখন খারাপ মন্তব্য করে ‘স্যাটানিক ভার্সেস’ নামে এক বই লিখে তখন একমাত্র ইমাম খোমেইনী (রহ.) পরাশক্তির সকল ভয়ভীতিকে উপেক্ষা করে সালমান রুশদীর মৃত্যুদ-ের ফতোয়া দিলেন। আমরা দেখেছি, ইমামের ফতোয়া ঘোষণার মাধ্যমেই সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সালমান রুশদী ও তার ‘স্যাটানিক ভার্সেস’ বইয়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়। পৃথিবীতে একই বিষয় নিয়ে একই সাথে সব মানুষের এমন আন্দোলন আর দেখা যায় নি। আমাদের দেশের মুসলমানরাও সালমান রুশদীবিরোধী আন্দোলন করেছিল।
ইরানের রাজধানী তেহরানের পুরোটাই ইমাম ও ইসলামি বিপ্লবের স্মৃতিতে উজ্জ্বল। তেহরানের রাস্তাঘাট, মেহেরাবাদ বিমান বন্দর, আযাদী স্কোয়ার, ময়দানে ইনকেলাব, তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়, ইমামের বাসগৃহ, সর্বোপরি বেহেস্ত যাহরা সহ স্মৃতিময় প্রত্যেকটি স্থান যেন বিপ্লবের এক একটি সৌধ। বাতাসে কান পাতলে আজো যেন শোনা যায় উত্তাল জনতার আকাশ কাঁপানো স্লোগান যা ফিরআউনরূপী শাহ, হামানরূপী আমেরিকা ও কারূণরূপী ইসরাঈলের বুকে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিল। মাটিতে হৃদয় বিছালে আজো পাওয়া যায় বীর শহীদদের বক্ষ থেকে ছিটকে পড়া রক্তের উত্তাপ। আমি আর হাদী সুযোগ পেলেই রেড়িয়ে যেতাম রাস্তায়। ফুটপাথ দিয়ে হাঁটতাম। কল্পনায় খুঁজে বেড়াতাম সেই দৃশ্যগুলো। মনে হতো যেন এই ফ্লাইওভারের ওপরে ও নিচের রাস্তায় লক্ষ জনতার মিছিল। এই সব রাস্তাঘাটেই ইমামের মুক্তির দাবিতে, ইমামের নির্বাসনের বিরুদ্ধে, ইমামকে স্বদেশে ফিরিয়ে আনার জন্য শিশু-কিশোর, যুবক-বৃদ্ধ সকলেই নেমে এসেছিল। ‘মার্গ বার শাহ’ অর্থাৎ শাহের পতন হোক। কিংবা ‘আজাদী, নাজাতি, জমহুরীয়ে ইসলামি’ অর্থাৎ স্বাধীনতা, মুক্তি ও ইসলামি প্রজাতন্ত্র। কিংবা ‘আজ মুক্তির দিন’, ‘শহীদদের আত্মাদের ফিরে আসার দিন’, ‘শাহের পতন হোক’, ‘খোমেইনী স্বাগতম’, ‘হয় খোমেইনী, না হয় মৃত্যু’। আমরা পথে পথে হাঁটতে হাঁটতে আর তেহরান ইউনিভার্সিটি ও ময়দানে ইনকিলাবে গিয়ে বিপ্লব চলাকালীন ময়দানে ইনকিলাব ও তেহরান ইউনিভার্সিটির কথা মনে করলাম যা ছিল জনতার প্রতিরোধ দুর্গ। এইতো সেই জুমআর নামাযের স্থান। যেখানে আজো জাতীয়ভাবে জুমআর নামায অনুষ্ঠিত হয়। মেহেরাবাদ বিমানবন্দরে গেলাম। মেহেরাবাদ বিমান বন্দর ইসলামি বিপ্লবের ইতিহাসে এক অক্ষয় মনুমেন্ট। এই বিমান বন্দর দিয়েই অত্যাচারী শাহ ইমামকে নির্বাসনে পাঠিয়েছিল। অদৃষ্টের অবধারিত পরিণামে ইরানি জনগণের ঘৃণা অবজ্ঞার আবর্জনা মাথায় করে শাহ সপরিবারে এই বিমান বন্দর দিয়েই পালিয়েছিল। আর এ বিমান বন্দরেই ইমাম অবতরণ করেছিলেন বীরের বেশে। ইমামকে জীবিতাবস্থায় না দেখলেও আমার মনে হলো যেনো আমি দেখছি ওইতো এয়ার ফ্রান্সের সিঁড়ি বেয়ে ইমাম দৃঢ়তার সাথে বীরের বেশে নামছেন তাঁর প্রাণপ্রিয় স্বদেশের মাটিতে। সারা বিমানবন্দর লোকে লোকারণ্য, ফটোসাংবাদিক, পত্রিকার রিপোর্টার ও টেলিভিষন ক্যামেরাম্যানদের দারুণ ব্যস্ততা। মেহেরাবাদ থেকে আযাদী স্কয়ার পর্যন্ত লক্ষ মানুষের ভীড়। তিলধারণের ঠাঁই নেই। স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরাও এসেছে। প্রত্যেকের হাতে রক্তগোলাপ, লাল টিউলিপ আর কারনেশন। মেহেরাবাদ বিমান বন্দরের অদূরেই আযাদী স্কয়ার মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ওইতো এখানে ইরানি জাতি সম্বর্ধনা জানাচ্ছে ইমামকে। ইমাম জনতার উদ্দেশে ভাষণ দিচ্ছেন। জনতা স্লোগান দিচ্ছে। ‘আল্লাহু আকবার, খোমেইনী রাহবার’। আযাদী স্কয়ারের পাদদেশে দাঁড়িয়ে নীরবে অনুভব করা যায় সেদিনের উত্তপ্ত দিনগুলোর কথা।
রাজধানী তেহরানের একপ্রান্তে পাহাড়ের ওপর যে মহল্লায় ইমামের বাড়ি তার নাম জামারান। ইমাম এখানে থাকতেন বলে তাঁকে বলা হতো জামারানের পীর। এখানে একটি ছোট্ট ঘরে ইমাম থাকতেন। ইরানের শাহ যেখানে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করেছিল বিশাল রাজপ্রাসাদ। সেই জাতির নেতৃত্ব দিয়ে ইমাম দিন কাটাতেন গরীবের বেশে। ইমামের ঘরে রয়েছে একটি সাধারণ সোফা, সাদা কভারে আচ্ছাদিত, একটি ছাতা, ইমামের ছেলে মোস্তফা খোমেইনীর ছবি, একটি ঘড়ি ও সাদাকালো একটি টেলিভিশন। পাশেই রয়েছে মসজিদ। যেখানে উপরে একটি চেয়ার পাতা রয়েছে। এখানে বসে ইমাম ভাষণ দিতেন। আমার মনে হলো আমি তাঁর বয়ান শুনতে পাচ্ছি। ইমামকে সরাসরি না দেখলেও তাঁর স্মৃতিবিজরিত একেকটি স্থানে গিয়ে গিয়ে তাঁর জীবিতকালের দৃশ্যগুলোই আমি কল্পনার পর্দায় দেখতে লাগলাম। ইমামের বাসস্থানের পাশেই একটি ঘরে ইমামের অন্তিম জীবনের স্মৃতিগুলো সংরক্ষণ করা হয়েছে যা ইমামের হাসপাতাল জীবনের শেষদিনগুলোকে মনে করিয়ে দেয়। ওইতো সেই বেড- যেখানে অসুস্থাবস্থায় ইমাম শুয়েছিলেন। ওইতো সেই স্যালাইনের বোতল ও পাইপগুলো- যা অক্ষত রাখা হয়েছে। এই সেলাইনের বোতল ঝোলানো অবস্থায়ও ইমাম তাহাজ্জুদের নামায আদায় করেছেন। রুকু-সিজদা দিয়েছেন, পেছন থেকে ডাক্তার ইমামের রুকু-সিজদার সময় স্যালাইনের বোতলটি সাবধানে ওঠাচ্ছিলেন-নামাচ্ছিলেন যাতে ইমাম কষ্ট না পান।
ইমামের বাড়িটি দেখলাম, আবার পাশাপাশি আমাদেরকে রেযা শাহ পাহলভীর জৌলুশপূর্ণ জীবন যাপনের প্রমাণস্বরূপ শাদাবাদ প্যালেস জাদুঘরও দেখানো হলো। সমস্ত ইরানবাসীকে শোষণ করে শাহ কীভাবে বিলাসবহুল জীবনযাপন করত, কিভাবে শাহ ও তার বংশধর সাঙ্গ-পাঙ্গরা ইরানি জাতিকে ভিক্ষুকের জাতিতে পরিণত করছিল আমেরিকার তাঁবেদারি করে সেটা না দেখলে বোঝানো যাবে না।
ইমামের মৃত্যু দিবস ৩রা জুনে বেহেস্ত যাহরায় জড়ো হয়েছে লক্ষ লক্ষ নারী-পুরুষ। সারা ইরানের বিভিন্ন শহর থেকে গাড়ি বোঝাই করে জনতা ছুটে এসেছে ইমামের রওজায়। ইমামের মাযারের পশ্চিম পার্শ্বে উপরে স্থাপিত হয়েছে মঞ্চ। আমরা মঞ্চের সামনে ছিলাম। ইরানের নেতৃবৃন্দ ভাষণ দিলেন। আলেমগণ বয়ান রাখলেন। ইমামের নাতি সৈয়দ হাসান খোমেইনী ভাষণ দিলেন, প্রেসিডেন্ট ভাষণ দিলেন। মুহুর্মুহু দরূদ, দোয়া, আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে এবং কিছুক্ষণ পরপর আমেরিকা ও ইসরাঈলবিরোধী স্লোগানে এক অন্যরকম দৃশ্যের সৃষ্টি হলো। অবশেষে রাহাবার ভাষণ দেয়ার জন্য দাঁড়ালেন। তখন জনতার স্লোগানের আওয়াজ আরো বেড়ে গেল।
এই সেই বেহেশত যাহরা। এখানে আমরা দাঁড়িয়ে। এখানে শুয়ে আছেন দুই লক্ষেরও অধিক শহীদ, যাঁরা আমেরিকার নির্দেশে ইরানের বিরুদ্ধে সাদ্দামের চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন, যাঁরা ইসলামি প্রজাতন্ত্রের জন্য অকাতরে তাঁদের জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন। এত শাহাদাত, এত রক্তাদান কিন্তু ইরানি জাতিকে ভয় পাইয়ে দেয় নি; বরং কারবালায় সত্যের জন্য ইমাম হোসাইন (আ.)-এর আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করে এই ত্যাগকে খুব সামান্যই মনে করেছে তারা। ইমাম হোসাইন (আ.)-এর শাহাদাতের চেতনায় নুতনভাবে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। মনে হলো ওইতো জনতা স্লোগান দিচ্ছে ‘হার রুয আশুরা, হার যামিন কারবালা’।
তেহরানের পথে প্রান্তরে ইমাম খোমেইনী (র.) ও ইসলামি বিপ্লবের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলো যেমন স্পর্শ করার সুযোগ পেয়েছিলাম, সুযোগ পেয়েছিলাম ইমামের বাড়ি-ঘর ও মাযার যিয়ারতের, তেমনি আমরা সৌভাগ্য লাভ করেছিলাম মাশহাদ প্রদেশে গিয়ে নবী বংশের ৮ম ইমাম রেযা (আ.)-এর মাযার যিয়ারতের। এই মহান ইমাম ও অলি-আল্লাহর রুহানি বরকত ইরানবাসী সবসময় পাচ্ছে। ইমামগণ, অলি-আল্লাহগণ, শহীদগণ অমর এবং তাঁদের আত্মা সর্বদা সজীব ও জীবন্ত, সেটি পবিত্র কোরআনে আছে- ‘আল্লার পথে যারা জীবন দিয়েছে তাদেরকে তোমরা মৃত বলো না, বরং তারা জীবিত’। আল্লাহর পথে থেকে তাঁরা ইহকালে যেমন অগণিত মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন তেমনি মৃত্যুর পরও তাঁরা তা পাচ্ছেন। ইমাম রেযা (আ.)-এর মাযারে সবসময় হাজার হাজার লোকের ভীড় লেগেই আছে। ইমাম রেযা (আ.)-এর মাযার যিয়ারত করে পেলাম আত্মার প্রশান্তি।
ইমাম রেযা (আ.)-এর পূর্বপুরুষ ইমাম মূসা কাযেম (আ.)-এর বংশেই জন্মেছিলেন ক্ষণজন্মা মহান ইমাম খোমেইনী (র.)। তাঁর মতো মানুষ কালে ভদ্রে জন্মায়, যিনি ছিলেন ইসলামি জনতার জন্য মহান আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ। কারণ, তিনি ঘুমন্ত জাতিসমূহকে জাগিয়ে তুলেছিলেন। আজ পৃথিবীর সকল অপশক্তি ও পরাশক্তির বিরুদ্ধে সকল নির্যাতিত মানুষের পক্ষে একা দাঁড়িয়ে আছে ইরান। আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের সাথে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সকল ক্ষেত্রে ইরান এগিয়ে গেছে। অজস্র সংগ্রামী মানুষের রক্তে পবিত্র যে দেশের মাটি তা আজ দুনিয়ার মুসলমানদের গর্ব। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের ভরসা ও আশ্রয়স্থল। ইমাম খোমেইনী (র.) আজ আর নেই, কিন্তু তিনি পৃথিবীর ইতিহাসে অমর হয়ে রয়েছেন।
কথায় আছে যে, ছুটি যত লম্বাই হোক না কেনো একদিন তা শেষ হয়। বেড়ানোর দিনগুলোও তাই শেষ হয়ে আসে একসময়। আমাদের পনর দিনের ভিসাও একদিন শেষ হয়। শেষের দিকে এসে দেশে ফিরে যাবার জন্য প্রাণ টানছিল। একদিকে প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ ও তথায় রেখে আসা প্রিয়জনদের টান অন্যদিকে স্বপ্নের ভূমি ইরানের প্রতি গভীর মমতায় দোটানার ভেতরেই স্বদেশের উদ্দেশে উড়াল দিলাম আবারো সেই ‘ফুরুতগাহে ইমাম খোমেইনী (র)’ বা ‘ইমাম খোমেইনী (র.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে। স্মৃতিতে সঙ্গে করে আনলাম ইরান ভ্রমণের অভিজ্ঞাতা ও অনুভূতি।
কবিতার দেশ ও কবিদের দেশ ইরান। বিপ্লবের দেশ ও বিপ্লবীর দেশ ইরান। অলিদের দেশ, সুফিদের দেশ ইরান। হাজার বছরের ইতিহাস আর ঐতিহ্যের দেশ ইরান। টিউলিপ আর বিশ্বসেরা গোলাপের দেশ ইরান। গানের দেশ প্রাণের দেশ ইরান। বাস্তবিক ইরান দেশটি খুবই সুন্দর। সুন্দর এর প্রকৃতি, পাহাড় ও মালভূমি। সুন্দর এর শহরের রাস্তাঘাট, ফুটপাথ, বাড়িঘরগুলো। তেমনি সুন্দর ইরানের মানুষের মন। তাদের আতিথেয়তার তুলনা হয় না। পথচারী, দোকানদার, বাস কন্ডাকটভর, ট্যাক্সি ড্রাইভার সবার কাছেই সুন্দর আচার-ব্যবহার পেয়ে মুগ্ধ হয়েছি। বিদেশী পেয়ে কোথাও ঠকানো তো দূরের কথা যেখানেই গিয়েছি তারা বলেছে, ‘শোমো মেহমানে মা’ অর্থাৎ আপনারা আমাদের মেহমান। তেমনি আতিথেয়তা পেয়েছি বিভিন্ন কাজে ও বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণে আমাদের গাইড হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত আল্লামা তাবাতাবায়ী ও তেহরান ইউনির্ভাসিটির ছাত্র-ছাত্রীদের থেকে। হোটেলের বাইরে ফুটপাথে ও খোলা স্থানে হাঁটতে গিয়ে স্কুলের ছোট দুটি ছেলে-মেয়েও আমাদেরকে হেল্প করেছে পথের পাশে টেলিফোন বুথ থেকে কথা বলার কৌশল শিখিয়ে দিয়ে। আসলে তাদের সঙ্গে আমাদের এক প্রস্থ স্মৃতির কথা কোনদিনই ভুলব না।

বাংলা রূপ ফারসি রূপ আধুনিক ফারসি উচ্চারণ

বাংলা রূপ ফারসি রূপ আধুনিক ফারসি উচ্চারণ
কওমী قومى গৌমী
কেচি قيچى গেই-চী
কয়েদী (বন্দী) قيدى গেই-দী
কয়েদখানা قيدخانه গেইদ-খনেহ্
কীমা (গোশতের কীমা) قيمه গেইমে
কবুল كابل ক-বোল্
কাবিন كابين ক-বিন
কাবিননামা كابين نامه কবিন নমেহ্
কারখানা كارخانه কর খনেহ্
কারসাজি كارسازى কর-সযী
কারিগর كارگر কর-গার
কারিগরী كارگرى কর গারী
কারবার كاروبار করোবর
কারবারী كاروبارى করোবরী
কাগজ كاغذ ক-গায
কাফুর / কর্পূর كافور ক-ফুর
গাহ (যেমন ঈদগাহ) گاه গহ্
ঈদগাহ্ عيدگاه এইদ্ গহ্
গর্দান گردن গারদান
গ্রেফতার گرفتار গেরেফ্ তর
গ্রেফতারী گرفتارى গেরেফ্তরী
গরম گرم গারম্
গিরা گره গেরেহ্
গাজর گزر গার্যা
গোস্তাখী گستاخى গোস্তখী
মহব্বত محبت মোহাব্বাত্
মুহতারাম محترم মোহ্তারাম
মাহফিল محفل মাহ্ফেল্
মহকুমা محكمه মাহ্কামে
মহাল (যেমন, জলমহাল) محل মাহ্ল
মহল্লা محله মাহাল্লে
মেহনত محنت মেহ্নাত
মখমল مخمل মাখ্মাল
মদদ مدد মাদাদ্
মোরব্বা مربا মোরাব-Ÿ
মুরুব্বী مربى মোরাব্বি
মর্সিয়া مرثيه মার্সিয়ে
মরহুম مرحوم মারহুম
মর্দ مرد মার্দ

Farsi shobdo edited