All posts by dreamboy

ইমাম আলী ইবনে আবি তালিব (আ.) ও তাঁর ন্যায়পরায়ণ শাসনব্যবস্থা

মো. আশিফুর রহমান –

ইমাম আলী ইবনে আবি তালিব (আ.) সম্পর্কে একটি কথা খুবই প্রসিদ্ধ যে, ন্যায়পরায়ণতা ও ন্যায় বিচারের প্রতি অতিশয় গুরুত্ব দেয়ার কারণেই তিনি শাহাদাত বরণ করেছিলেন। এটি খুবই আশ্চর্যের বিষয় যে, যে ধর্মের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো এবং এ ধর্মের অনুসারীদের বৈশিষ্ট্য ছিল ন্যায়পরায়ণ হওয়া, সেখানে কেবল ন্যায়নীতিকে প্রাধান্য দেয়ার কারণেই ইমাম আলী (আ.)-কে শহীদ হতে হয়েছিল! মূল বিষয়ে প্রবেশের আগে ন্যায়পরায়ণতা ও ন্যায় বিচার সম্পর্কিত কিছু বিষয় নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করতে চাই।
যেসব মূল্যবোধ আমাদের সমাজের সুতাগুলোকে একত্রে গেঁথে রাখে এবং আমাদের সামাজিক অস্তিত্বে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে সেগুলো অনেক এবং এগুলোর মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্কের বিষয়টিও স্পষ্ট। কিন্তু সামাজিক মূল্যবোধগুলোর মধ্যে কোন্্টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা অনেক বিশ্লেষণ করেছেন। তারপর তাঁরা যে বিষয়ে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন তা হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ন্যায় বিচার।
ন্যায় প্রতিষ্ঠার বিষয়ে কোরআন মজীদের ঘোষণা
মহান আল্লাহ পৃথিবীতে ন্যায় প্রতিষ্ঠা এবং সকল প্রকার অন্যায়-অবিচারের মূলোৎপাটন করার জন্য নবী-রাসূলগণকে প্রেরণ করেছিলেন। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে :
         ক্সক্স  
‘নিশ্চয়ই আমরা আমাদের রাসূলগণকে স্পষ্ট প্রমাণাদিসহ প্রেরণ করেছি এবং তাদের সাথে কিতাব ও মানদ- অবতীর্ণ করেছি যাতে মানুষ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করে।’ (সূরা হাদীদ : ২৫)
কোরআন মজীদের অন্যত্র বলা হয়েছে :
    
‘(হে রাসূল) বল, আমার প্রতিপালক ন্যায়বিচারের নির্দেশ দিয়েছেন।’ (সূরা আরাফ : ২৯)
আরো বলা হয়েছে :
ক্স                 
নিশ্চয় আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা, সদাচরণ এবং আত্মীয়দের অধিকার প্রদানের আদেশ করেন এবং অশ্লীলতা, অসমীচীন (ও অপছন্দনীয়) কর্ম ও সীমালঙ্ঘন করতে নিষেধ করেন; তিনি তোমাদের উপদেশ দান করেন যাতে তোমরা উপদেশ (ও শিক্ষা) গ্রহণ কর।-সূরা নাহল : ৯০
মহাগ্রন্থ আল-কোরআনের সূরা নিসার ১৩৫ নং আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন :
                                  ক্স      
‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা সর্বদাই ইনসাফের ওপর দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত থেক এবং নিজেকে আল্লাহ তা‘আলার জন্য সত্যের সাক্ষী হিসেবে পেশ করো যদি এই কাজটি তোমার নিজের পিতা-মাতার কিংবা নিজের আত্মীয়-স্বজনের ওপরেও আসে। সে ব্যক্তি ধনী হোক বা গরিব হোক এটা কখনও দেখবে না। কেননা, তাদের উভয়ের চেয়ে আল্লাহর অধিকার অনেক বেশি। অতএব, তুমি কখনও ন্যায় বিচার করতে খেয়াল-খুশির অনুসরণ করো না।’
ন্যায়বিচারকের প্রতি আল্লাহর ভালোবাসা
মহান আল্লাহ বলেন :
      ক্স    
‘আর যদি তাদের মধ্যে বিচার-নিষ্পত্তি কর, তবে ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে বিচার-নিষ্পত্তি কর; নিশ্চয়ই আল্লাহ সুবিচারকারীদেরকে ভালোবাসেন।’Ñ সূরা মায়েদা : ৪২
কিয়ামতে ন্যায়বিচারকারীদের অবস্থা
ন্যায়পরায়ণ খলিফা আল্লাহ তাআলার কাছে খুবই প্রিয়। পক্ষান্তরে অত্যাচারী রাষ্ট্রপ্রধান আল্লাহ তাআলার কাছে খুবই ঘৃণিত। এ প্রসঙ্গে মহানবী (সা.) বলেন : ‘ন্যায়পরায়ণ খলিফা কিয়ামতের দিন আল্লাহর সর্বাধিক নৈকট্যপ্রাপ্ত হবে। আর অত্যাচারী রাষ্ট্রপ্রধান কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলার নিকট সর্বাধিক ঘৃণিত ও সর্বাধিক শাস্তিপ্রাপ্ত হবে। অধিকন্তু সে আল্লাহর দরবার থেকেও বহু দূরে অবস্থান করবে।’ অন্য একটি হাদিসে রয়েছে যে, ন্যায়পরায়ণ লোকদেরকে আল্লাহ তাআলা তাঁর পাশে স্থান দেবেন।
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : কঠিন হাশরের দিনে যখন মহান আল্লাহর আরশের ছায়া ব্যতীত আর কোথাও কোনো ছায়া থাকবে না তখন মাত্র সাত শ্রেণির মানুষ আল্লাহ তাআলার আরশের নিচে ছায়া পাবে, তাদের প্রথম হচ্ছে ন্যায়পরায়ণ শাসক বাদশা বা বিচারক। (বুখারী, মুসলিম, মুসনাদে আহমদ)
ইমাম আলী (আ.)-এর দৃষ্টিতে ন্যায়বিচার
ন্যায়বিচার সম্পর্কে ইমাম আলী (আ.) থেকে অনেক কথা বর্ণিত হয়েছে। ইমাম আলীর দৃষ্টিতে ঐশী বিধি ও নির্দেশমালা হলো শরীরের মতো যার আত্মা হলো ন্যায়বিচার। এজন্যই তিনি বলেন : ‘আইনের আত্মা হলো ন্যায়বিচার।’Ñ ফেহেরেস্তে গুরারুল হিকাম, ৭ম খ-, পৃ. ২৩৬
তিনি বিশ্বাস করতেন যে, সম্প্রীতির সাথে জীবন যাপনের লক্ষ্যে ব্যক্তি এবং সমাজের একটি সমন্বিত নীতির প্রয়োজন রয়েছে। আর তা ন্যায়বিচার ছাড়া অন্য কিছুই নয়। তাই তিনি বলেন : ‘ন্যায়বিচার হলো শাসনকার্য পরিচালনার পদ্ধতি।’Ñ ফেহেরেস্তে গুরারুল হিকাম, ৭ম খ-, পৃ. ২৩৬
ইমাম আলী আরো বলেন : ‘ন্যায়বিচার ও স্বচ্ছতা হলো মানব জাতির জন্য আল্লাহ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মানদ- যাতে সমাজে সত্য প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। সুতরাং আল্লাহর আনুগত্য কর এবং এই ঐশী মানদ- অনুযায়ী কর্ম কর। একে অমান্য করো না।’Ñ মিযানুল হিকমা, মুহাম্মদ রেইশাহরী, ৬ষ্ঠ খ-, পৃ. ৭৮
ইমাম আলীর দৃষ্টিতে ন্যায়নীতি হলো এমন বৈশিষ্ট্য যার দ্বারা নীতি, কর্ম এবং মানুষের ব্যক্তিত্ব ও চরিত্রকে বিচার করা হয়। এ বিষয়টি ‘নাহজুল বালাগা’য় ভালোভাবে ফুটে উঠেছে। একদিন এক ব্যক্তি তাঁকে জিজ্ঞেস করে : ‘কোন্টি উত্তমÑ ন্যায় বিচার নাকি উদারতা? উত্তরে তিনি (আ.) বললেন : ন্যায়বিচার প্রত্যেক জিনিসকে তার যথাস্থানে রাখে। আর উদারতা সেটাকে তার স্থান হতে বের করে নিয়ে যায়। ন্যায়বিচার সর্জজনীন রক্ষক। আর উদারতা বিশেষ এক শ্রেণির জন্য উপকার বয়ে আনে। সুতরাং ন্যায় বিচারই শ্রেয়তর।’Ñ নাহজুল বালাগা, সংক্ষিপ্ত জ্ঞানগর্ভমূলক বাণী নং ৪৩৭
ইমাম আলীর আরেকটি বক্তব্যেও বিষয়টি প্রকাশিত হয়েছে : ‘সকল গুণের মধ্যে মূল্যবান হলো ক্ষমা ও মহানুভবতা এবং সবচেয়ে কার্যকরী বৈশিষ্ট্য হলো ন্যায়বিচার।Ñ গুরারুল হিকাম, ৭ম খ-, পৃ. ১৫৬
সামাজিক ন্যায়বিচার অন্যান্য মূল্যবোধকেও ধারণ করে। আর তাই তা অর্জনের মধ্য দিয়ে অন্য সকল মূল্যবোধও অর্জিত হয়। এই কারণে ইমাম আলীর দৃষ্টিতে ন্যায়বিচারের মধ্যেই এর সার নিহিত রয়েছে। তিনি বলেন : ‘ন্যায়বিচারের মধ্যে অনেক সুযোগ রয়েছে, আর যে ন্যায়বিচারকে সহ্য করতে পারে না সে অবিচারকে আরো কঠিন হিসেবে দেখতে পাবে।Ñ নাহজুল বালাগা, খুতবা নং ১৫
ন্যায়বিচার ও ইমাম আলী (আ.)
ইমাম আলী (আ.)-এর বিষয়ে মহানবী (সা.)-এর একটি প্রসিদ্ধ হাদিস রয়েছে, যেখানে তিনি বলেন : ‘আলী মানুষের মধ্যে সর্বোত্তম ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাকারী।’
আলী (আ.) ছিলেন ন্যায়পরায়ণতার মূর্ত প্রতীক। ৩৫ হিজরিতে খেলাফতে অধিষ্ঠিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তিনি পূর্ববর্তী তিন খলিফার সময়ে অনেক ক্ষেত্রেই তাঁদেরকে বিচার কার্যে সাহায্য করেছেন। যখনই তাঁর কাছে বিচারকার্য ও অন্যান্য বিষয়ে পরামর্শ চাওয়া হয়েছে তখনই তিনি এগিয়ে গিয়েছেন। এ ব্যাপারে দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমরের উক্তি প্রসিদ্ধ যে, ‘আবুল হাসান (ইমাম আলী) না থাকলে উমর ধ্বংস হয়ে যেত।’ (ইবনে যাওযী প্রণীত তাযকিরাতুল খাওয়াস, পৃ. ৫৭; ইস্তিয়াব, পৃ. ১৫-২০; এমদাদিয়া লাইব্রেরী কর্তৃক প্রকাশিত আশারা মোবাশ্শারা, পৃ. ১৯৩)
আমরা জানি যে, একটি রাষ্ট্রের উন্নয়ন ও অগ্রগতি নির্ভর করে আইনের শাসনের ওপর। আর যদি আইনের শাসন না থাকে তাহলে সমাজে বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হয়। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ওফাতের পরে তৃতীয় খলিফা হযরত উসমানের সময়ে ইসলামি বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের গভর্নর ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের দুর্নীতি ও ন্যায়নীতি লঙ্ঘনের কারণে বিদ্রোহ দেখা দেয়। এর একটি পর্যায়ে হযরত উসমান নিহত হন। এরপর জনগণ ইমাম আলী (আ.)-কে তাদের খলিফা নির্বাচন করে। ৩৫ হিজরিতে খেলাফতে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর ইমাম আলী রাষ্ট্রের প্রতিটি ক্ষেত্রে ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। আলী (আ.) খেলাফতের দ্বিতীয় দিনে মিম্বারে আরোহণ করেন এবং জনগণকে সম্বোধন করে বলেন : ‘… হে লোক সকল! আমি তোমাদেরকে মহানবী (সা.)-এর সুস্পষ্ট পথে ফিরে আসতে বাধ্য করব এবং নিজের আদেশ সমাজে প্রতিষ্ঠিত করব। আমি যা কিছু বলব তার ওপর আমল করো, আর যে ব্যাপারে নিষেধ করব তা থেকে দূরে থেক।’
আলী (আ.) তাঁর খেলাফত গ্রহণের অবস্থার বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে : ‘আমার বাইয়াত গ্রহণের জন্য তোমরা আমার হাত তোমাদের দিকে টেনে নিয়েছিলে, কিন্তু আমি হাত ফিরিয়ে নিয়েছি। আবার তোমরা আমার হাত টেনে ধরে রেখেছিলে, কিন্তু আমি জোর করেছিলাম। তৎপর তৃষ্ণার্ত উট যেভাবে জলাধারে ভিড় করে তোমরাও সেভাবে আমার চারদিকে ভিড় করে এমন অবস্থার সৃষ্টি করেছিলে যে, আমার জুতা ছিঁড়ে গিয়েছিল, কাঁধের কাপড় পড়ে গিয়েছিল এবং দুর্বলরা পদদলিত হয়েছিল। আমার বাইয়াত গ্রহণ করে মানুষ এত বেশি উল্লসিত হয়েছিল যে, শিশু-কিশোররা নাচতে শুরু করেছিল। বৃদ্ধরা কাঁপতে কাঁপতে (বার্ধ্যেকের কারণে) আমার কাছে চলে এসেছিল, রুগ্নরা এলোপাথারিভাবে, আর কিশোরীরা মাথায় ঘোমটা ফেলে আমার দিকে ছুটে এসেছিল।’- নাহজুল বালাগা, খুতবা নং ২২৭
কিন্তু কিছুদিন না যেতেই অবস্থা সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হয়ে যায়। কেউ কেউ তাঁর আনুগত্যকে অস্বীকার করে। অনেকে আলী (আ.)-এর বিরোধিতায় লিপ্ত হয়। কোনো কোনো দল আলী (আ.)-এর সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। পরিশেষে ইমাম আলী (আ.) কুফার মসজিদে মাথায় বিষাক্ত তরবারির আঘাতে আহত হয়ে শাহাদাত বরণ করেন।
প্রশ্ন হলো ইমাম আলীর নেতৃত্বের প্রতি এত উচ্ছ্বাস, এত স্বতঃস্ফূর্ততা কিছুদিন পরেই কেন মিলিয়ে গিয়েছিল? শুধু তা-ই নয়, কেনই বা মুসলিম জনগোষ্ঠীর একটি অংশ তাঁর বিরোধিতায় লিপ্ত হয়েছিল?
এ সম্পর্কে গবেষকগণ এই কথাই বলেছেন যে, এ অবস্থা সৃষ্টি হওয়ার পেছনে মূল কারণটি ছিল ন্যায়বিচারের প্রতি ইমাম আলী (আ.)-এর অধিক গুরুত্ব আরোপ। আমরা আলী (আ.)-এর ন্যায়ানুগ শাসন সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করব।
ন্যায়পরায়ণ শাসনব্যবস্থার দৃষ্টান্ত স্থাপন
ইমাম আলী (আ.)-এর সরকার ও প্রশাসনের ভিত্তি ছিল ন্যায়পরায়ণতা। সর্বক্ষেত্রে ন্যায়পরায়ণতা প্রতিষ্ঠা তাঁকে কঠিন অবস্থার সম্মুখীন করে। এটি উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, যিনি ন্যায়পরায়ণতার মূর্ত প্রতীক তিনি ন্যায়পরায়ণতার দৃষ্টিকোণ থেকেই সকল রাজনৈতিক কার্যকে এবং দলগুলোকে দেখতেন এবং তাঁর শত্রুদের সাথেও একইভাবে ন্যায়নীতি অনুসরণ করেন এবং ন্যায়নীতিকে বিন্দু পরিমাণ লঙ্ঘন করতে ইচ্ছুক ছিলেন না। তিনি জানতেন যে, সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে একটি পুনঃমূল্যায়ন ও মৌলিক সংস্কারের প্রয়োজন। তিনি তাঁর খেলাফত গ্রহণের সময়ই এ বিষয়টি উল্লেখ করেন যে, তিনি প্রশাসন পরিচালনার ক্ষেত্রে কারো তোয়াক্কা করবেন না। তিনি রাসূলের সুন্নাতকে ফিরিয়ে আনবেন। একটি খুতবায় তিনি বলেন : ‘জেনে রাখ, আল্লাহর নিকট সর্বোত্তম বান্দা হচ্ছে ন্যায়বান নেতা, যে পথপ্রদর্শিত হয় ও পথপ্রদর্শন করে।’ নাহজুল বালাগা, খুতবা নং ১৬৩
যখন তিনি মালিক আশতারকে মিশরের গভর্নর হিসেবে নিযুক্ত করেন তখন তাঁর উদ্দেশে যে পত্র তিনি লেখেন সেখানে বলেন : ‘আল্লাহর জন্য ন্যায়বিচার কর এবং জনগণের প্রতি ন্যায়বিচার কর… যদি তুমি তা না কর তাহলে তুমি অত্যাচারী হবে এবং যখন কোনো ব্যক্তি আল্লাহর কোনো সৃষ্টিকে অত্যাচার করে তখন তাঁর সৃষ্টির পরিবর্তে আল্লাহ নিজেই তার বিরুদ্ধ পক্ষ হয়ে দাঁড়ান…।’Ñ নাহজুল বালাগা, পত্র নং ৫৩
ইমাম আলীর কর্মকর্তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল যে, প্রতিটি জায়গায় মানুষের মধ্যে দুর্বলতা ও ত্রুটি রয়েছে; আর গভর্নরদের দায়িত্ব হলো তাদের ছোটখাটো ত্রুটিগুলোকে উপেক্ষা করা এবং তাদেরকে পথপ্রদর্শন করা। গভর্নরদেরকে উপদেশ দেয়া হয়েছিল যাতে তাঁরা সকলের সাথে কোনোরকম বৈষম্য ছাড়া স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা এবং ন্যায়পরায়ণতার সাথে আচরণ করেন।
পরিকল্পনা প্রণয়নে ন্যায়নীতিকে অগ্রাধিকার দেয়া
একটি দেশের যথাযথ ও দক্ষ প্রশাসনের জন্য এবং এর সার্বিক উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য পরিকল্পনা আবশ্যক। যদি ন্যায় বিচারকে পরিকল্পনা প্রণয়নে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয় তাহলে স্থিতিশীল ও ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়। ইমাম আলী (আ.) মিশরের গভর্নর মালিক আশতারের কাছে লেখা পত্রে এ বিষয়ে বলেন : ‘কর্মকা- বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এমন নীতি অবলম্বন করবে যেন তা ন্যায় পরায়ণতাকে ছাড়িয়ে না যায় আবার ন্যায় বিচারের চেয়ে কম না হয়। তোমাকে এমন নীতি অবলম্বন করতে হবে যা ন্যায় বিচারকে এগিয়ে নেয় এবং তোমার প্রজাদের জন্য সবচেয়ে তৃপ্তিদায়ক হয়।’Ñ নাহজুল বালাগা, পত্র নং ৫৩
যদি ইসলামি রাষ্ট্রের শাসক ও কর্মকর্তারা এই নীতি অনুসরণ করেন তাহলে তাঁরা পৃথিবীতে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবেন। আর এমনটিই হওয়া প্রয়োজন। আলী (আ.) বলেছেন : ‘সত্যই গভর্নরদের জন্য সবচেয়ে খুশির কথা হলো দেশে ন্যায়নীতির প্রচলন ঘটা এবং জনগণের কাছে প্রিয় হওয়া।’Ñ নাহজুল বালাগা, পত্র নং ৫৩
পদ বণ্টনে ন্যায়নীতি অনুসরণ
আলীর সরকারে মন্ত্রীত্বের পদ ধন-সম্পদ, আত্মীয়তার সম্পর্ক, গোত্রীয় প্রীতি বা সমাজের প্রভাবশালী হওয়ার কারণে বণ্টিত হয় নি। তাদেরকে যোগ্যতা ও প্রতিভার কারণে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। মন্ত্রীরা হবে খোদাভীরু এবং নীতিবান। সরকারি দায়িত্বশীলরা কখনই দ্বিমুখি নীতির অধিকারী হতে পারবে না।
ইমাম আলী (আ.) তাঁর গভর্নরদেরকে নির্দেশ দিয়েছিলেন যেন তাঁরা সেসকল লোককে উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ না দেন যারা গীবতকারী, গুজব রটনাকারী, কৃপণ এবং ভীরু। তাঁদের আরো বলা হয়েছিল যেন তারা লোভী ও উচ্চাভিলাষী লোকদেরকে উপদেষ্টা হিসেবে গ্রহণ না করে কারণ, তারা অন্যদেরকে ব্যবহার করবে এবং তাদের সম্পদকে ছিনিয়ে নেবে।
দুর্নীতির মূলোৎপাটন
আলী (আ.) খেলাফতে অধিষ্ঠিত হয়ে দুর্নীতিবাজ ও অযোগ্য গভর্নরদেরকে পদ থেকে অপসারণ করে যোগ্য ও সৎ ব্যক্তিদের নিয়োগ দেন। এ বিষয়টিতে একটি মহল তাঁর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে। অন্যদিকে তাঁর শুভকাক্সক্ষীরা তাঁকে এ ব্যাপারে তাড়াহুড়া না করার পরামর্শ দেন। কিন্তু তিনি তাঁর সিদ্ধান্তে অবিচল থাকেন। তিনি এ বিষয়ে বলেন : ‘আল্লাহর শপথ, আমি আমার দ্বীনে প্রতারণা করব না এবং আমার দেশের শাসনকার্য ঘৃণ্য লোকদের নিকট ন্যস্ত করব না।’Ñ তারীখে তাবারী, ৫ম খ-, পৃ. ১৬০
ইমাম আলী (আ.) তাঁর গভর্নরদেরকেও ন্যায় প্রতিষ্ঠা এবং দুর্নীতির মূলোৎপাটনের উপদেশ দিতেন।
সামাজিক বৈষম্য দূরীকরণ
ইমাম আলী (আ.)-এর নীতি তাঁর উদ্দেশ্যের বিশুদ্ধতা, বিশ্বাসের বিশুদ্ধতা এবং জমিনের বুকে আল্লাহর নীতি কায়েমের ক্ষেত্রে বিশুদ্ধতাকে প্রকাশ করে। যে কেউ এই নীতি দ্বারা কর্ম পরিচালনা না করে তবে সে কোরআন ঘোষিত অবিশ্বাসী, ন্যায়হীন এবং অপকর্মকারী হিসেবে স্বীকৃত। ইসলামের অন্যতম নীতি হলো আরব-অনারবের মধ্যে পার্থক্যের দেয়াল ভেঙ্গে ফেলা এবং মুমিনদেরকে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করা।
ইসলামী ন্যায়নীতির ক্ষেত্রে ইমাম আলী (আ.)-এর অবদান ছিল বংশ গৌরবের মূলোৎপাটন এবং দরিদ্র, অবহেলিত ও অত্যাচারিত শ্রেণিকে সম্মান দেয়া যা তারা সমাজে দাবি করে। তিনি এ ব্যাপারে সমাজের প্রভাবশালীদের কারো প্রতি কোনোরূপ তোয়াক্কা করেন নি। বাইতুল মাল বণ্টনে ইমাম আলী তাঁর সচিব আবদুল্লাহ বিন আবি রাফেকে আনসার ও মুহাজিরদের প্রত্যেককে তিন দীনার করে দেয়ার নির্দেশ দেন। এ সময় সাহ্ল্ ইবনে হুনাইফ আনসারী বিরোধিতা করে বলেন : ‘এই যে কৃষ্ণাঙ্গ গতকাল পর্যন্তও আমার গোলাম ছিল আমি তার সমান হবÑ এটা কি সমীচীন হবে?’ ইমাম জবাবে বলেন : ‘আমি আল্লাহ্র কিতাবে ইসমাঈলের পুত্র (আরব) ও ইসহাকের পুত্রের (অনারব) মধ্যে কোন পার্থক্য দেখি না।’Ñ বেলায়াতের দ্যুতি, আয়াতুল্লাহ জাফর সুবহানী, পৃ. ৩৫৭
কর্ম মূল্যায়নে নিরপেক্ষতা বজায় রাখা
একটি সমাজে অন্যতম যে পথে সম্প্রীতি ও ভারসাম্য আসে এবং যে পথ রাষ্ট্রের নাগরিকদেরকে গতিশীল, সৃষ্টিশীল, উৎপাদনমুখী এবং প্রত্যয়দীপ্ত করে তা হলো নাগরিকদের কাজকে ন্যায় বিচার ও স্বচ্ছ মানদ-ের ভিত্তিতে যাচাই করা। সমাজের সকল লোকের কর্মকে একই রকম মনে করা সঠিক নয়। যারা যত বেশি নিষ্ঠা, দক্ষতা ও যোগ্যতার সাথে কাজ সম্পাদন করবে তাদেরকে অযোগ্যদের ওপর প্রাধান্য দিতে হবে। ইমাম আলী (আ.)-এর প্রশাসনের নীতিও ছিল এটিই। তিনি মালিক আল আশতারকে বলেন : ‘ভালো আর মন্দ যেন তোমার কাছে একরকম স্থান না পায়। কারণ, তা ভালো মানুষকে ভালো কাজ থেকে নিরুৎসাহিত আর দুষ্কৃতিকারীদেরকে মন্দকাজে উৎসাহিত করবে। সুতরাং যে যে রকম কাজ করে তার যথোপযুক্ত মূল্যায়ন করবে।’Ñ নাহজুল বালাগাহ, পত্র নং ৫৩
প্রশাসনিক কর্মকর্তারা তাদের অতীতের ভালো কর্মকা-ের জন্য প্রশংসিত হবে ও পুরস্কার পাবেÑ তাদের বন্ধুত্ব অথবা আত্মীয়তার কারণে নয়। আমীরুল মুমিনীন (আ.) এই বিষয়টিকে মনস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করে এর গুরুত্ব তুলে ধরছেন : ‘আর কারো কর্তব্যনিষ্ঠাকে অন্যের নামে চালিয়ে দেবে না এবং এর অবমূল্যায়ন করবে না। প্রত্যেককে তার সেবা অনুযায়ী প্রতিদান দেবে এবং তোমার ধন্যবাদ তারই জন্য নির্ধারিত জানবে। কোনো ব্যক্তির পারিবারিক মর্যাদা যেন তোমাকে একাজে প্রবৃত্ত না করে যে, তার সামান্য কাজকে তুমি অনেক বড় করে দেখবে। আবার কোনো ব্যক্তির হীন পারিবারিক অবস্থানের কারণে যেন তুমি তার বড় কাজকে তুচ্ছ মনে কর না।’Ñ নাহজুল বালাগাহ, পত্র নং ৫৩
সম্পদের সুষম বণ্টন
রাষ্ট্রের সকল সদস্যের সামগ্রিক উন্নতির জন্য সম্পদের সুষম বণ্টন হওয়া প্রয়োজন। অন্যায়ভাবে বৈষম্য সৃষ্টি করার কোনো অবকাশ নেই। আলী (আ.) এক বক্তব্যে বলেন : ‘…যারা মনে করে যে, মহানবী (সা.)-এর সাথে সাক্ষাতের ফলে অন্যদের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব রাখে তাদের জানা উচিত শ্রেষ্ঠত্বের মানদ- অন্য কিছুতে। শ্রেষ্ঠত্ব তারই জন্য যে আল্লাহ্ ও তাঁর নবীর আহ্বানে সাড়া দেয় এবং ইসলামকে গ্রহণ করে। এমতাবস্থায়, সকলেই অধিকারের দিক থেকে পরস্পর সমান হবে। তোমরা আল্লাহ্র বান্দা, আর ধনসম্পদ হলো আল্লাহ্র ধনসম্পদÑ যা তোমাদের মধ্যে সমহারে বণ্টিত হবে। এ ক্ষেত্রে কারো ওপর কারো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। অগামীকাল বাইতুল মাল তোমাদের মধ্যে বণ্টন করা হবে এবং আরব ও অনারব এতে এক সমান।’Ñ শারহে নাহজুল বালাগাহ, ইবনে আবিল হাদীদ, ৭ম খ-, পৃ. ৩৭
‘আল-কাফি’ গ্রন্থে আবু মিখনাফ থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, ইমাম আলী (আ.)-এর একদল অনুসারী তাঁর কাছে আসল এবং বলল : ‘হে আমীরুল মুমিনীন! যদি আপনি এসব সম্পদ গণমান্য ব্যক্তি ও নেতাদের মধ্যে বিতরণ করেন এবং তাদেরকে আমাদের ওপর প্রাধান্য দেন তাহলে এই বিষয়টির ফয়সালা হতে পারে। তারপর আপনি আল্লাহ আপনাকে যে গুণে ভূষিত করেছেন সেখানে ফিরে যেতে পারেন। আর তা হলো সমবণ্টন এবং জনগণের মধ্যে ন্যায়বিচার চর্চা।’
আমীরুল মুমিনীন (আ.) বললেন : তোমাদের জন্য দুর্ভোগ! তোমরা আমাকে মুসলমানদের প্রতি অন্যায় ও বৈষম্য সৃষ্টির মাধ্যমে সমর্থন নিতে বলছÑ যাদের ওপর আমি অভিভাবক মনোনীত হয়েছি? আল্লাহর শপথ, আমি ততক্ষণ পর্যন্ত তা করব না যতক্ষণ এ পৃথিবী বিদ্যমান এবং যতক্ষণ আমি আকাশে তারকারাজি দেখতে পাই। যদি তা আমার নিজের সম্পদও হতো তাহলেও আমি তা সমভাবে বণ্টন করতাম; আর যেখানে এটি তাদেরই সম্পদ সেখানে কীরূপ অবস্থা হবে?’Ñ সাওয়াবুল আমাল, ৩১০/১; বিহারুল আনওয়ার : ৭২/৩৪৫/৪২
নিজ ভাই আকীল তাঁর কাছে বাইতুল মাল থেকে অতিরিক্ত সাহায্য দাবি করলে আলী (আ.) তাঁকে তা দিতে অস্বীকার করেন। আলী (আ.) নিজেই এ প্রসঙ্গে বলেন : ‘আল্লাহর কসম! আমি [ভাই] আকীলকে অনটনে দেখেছি, সে [বাইতুল মালে] তোমাদের গম হতে এক সা আমার কাছে চেয়েছিল। আমি তার শিশুদেরকে দারিদ্র্যের তাড়নায় উস্কখুস্ক চুলে ও ধূলি-ধূসরিত চেহারায় দেখেছি। যেন তাদের মুখম-লসমূহ নীল দ্বারা কালো করা হয়েছিল। আকীল তার আবেদনে জোরাজুরি করছিল এবং আমার কাছে তার কথা বারবার বলছিল। আমি তার দিকে কর্ণপাত করছিলাম। সে মনে করছিল আমি আমার দ্বীনকে তার কাছে বিক্রি করে দেব এবং আমার নিজের পথ পরিত্যাগ করে তার পথ অনুসরণ করব। ইত্যবসরে আমি এক টুকরা লোহা উত্তপ্ত করলাম এবং তার শরীরের নিকটে নিয়ে গেলাম, যাতে এর দ্বারা সে শিক্ষা নেয়। তখন সে এর যন্ত্রণায় একজন রোগীর আর্তনাদের ন্যায় আর্তনাদ করে উঠলো এবং এর উত্তাপে তার পুড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। তখন আমি তাকে বললাম : বেদনাহত মায়েরা তোমার শোকে রোদন করুক হে আকীল! তুমি কি এক টুকরা লোহার উত্তাপে চিৎকার করছ যা একজন মানুষ ক্রীড়া [কৌতুক] বশত উত্তপ্ত করেছে? অথচ তুমি আমাকে এমন এক আগুনের দিকে টেনে নিয়ে যেতে চাও যা তার [শক্তিমান] মনিব স্বীয় ক্রোধের জন্য প্রজ্বলিত করেছেন? এই সামান্য যন্ত্রণায় তুমি কাঁদছ। তবে কি আমি [জাহান্নামের] লেলিহান আগুনে কাঁদব না?’
যিয়াদ ইবনে আবিহর কাছে লিখিত এক পত্রে তিনি বলেন : ‘আমি সত্যিকার অর্থে আল্লাহর নামে কসম করছি যে, আমার কাছে যদি খবর আসে যে, তুমি মুসলমানদের বাইতুল মালে কিঞ্চিৎ কিংবা বৃহৎ কোন খেয়ানত করেছ, তাহলে আমি তোমার ব্যাপারে এমন কঠোর হব যে, তুমি সর্বস্বহারা, বোঝার ভারে ন্যুব্জ এবং দিগি¦দিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়বে।’Ñ নাহজুল বালাগাহ, পত্র নং ২০
শত্রুদের ক্ষেত্রেও সম্পদ বণ্টন
রাষ্ট্রের সম্পদ আত্মীয়তা, পক্ষপাতিত্ব অথবা ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের ওপর ভিত্তি করে বণ্টন হওয়া কখনই কাম্য নয়। আবদুল্লাহ বিন কাওয়া ছিল ইমাম আলী (আ.)-এর শত্রু, যে কুফায় বসবাস করত, সে প্রকাশ্যে আলী (আ.)- কে গালমন্দ করত, যেটা আলী (আ.) জানতেন। কিন্তু তিনি সর্বদাই বায়তুল মালে তার অংশ কোনরকম কাটছাট করা ছাড়াই তার বাড়িতে পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করতেন।
সম্পদ ফিরিয়ে আনা
যখন আলী (আ.) ক্ষমতা গ্রহণ করার পর কোরআন মজীদ ও রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নির্দেশনা অনুযায়ী শাসন করা শুরু করেন তখন যেসব লোক অবৈধ কর্মে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল তারা আলীর পক্ষ থেকে বিপদ অনুভব করে। বিশেষ করে মুসলমানদের বাইতুল মাল থেকে যেসব সম্পদ অন্যায়ভাবে বণ্টন করা হয়েছিল সেগুলো ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে ইমাম আলী (আ.) কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেন : ‘আল্লাহর কসম! যদি আমি সে সম্পত্তি পাই তাহলে অবশ্যই ফিরিয়ে নেব, [এমনকি] যদি দেখি তা নারীদের মোহরানাভুক্ত হয়েছে কিম্বা তা দ্বারা ক্রীতদাসী খরিদ করা হয়েছে। কারণ, ন্যায়পরায়ণতার মধ্যেই প্রসারতা রয়েছে। যার উপর ন্যায়পরায়ণতা কঠিন হয়, অন্যায় তার উপর আরো কঠিন।’Ñ নাহজুল বালাগাহ, খুতবা নং ১৫
এছাড়াও যারা রাষ্ট্রের কাছ থেকে অন্যান্য অবৈধ সুযোগ গ্রহণ করেছিল তারাও আলী (আ.)-এর পদক্ষেপে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এতে অনেক ক্ষমতাশীল ও প্রভাবশালী ব্যক্তি তাঁর থেকে দূরে সরে যায়। ইমাম আলী (আ.) তাঁর একটি ভাষণে জনগণের শপথ ভঙ্গের এই বিষয়টিকে এভাবে ব্যক্ত করেন : যখন আমি শাসনক্ষমতা গ্রহণ করলাম তখন একটি দল শপথ ভঙ্গ করল এবং আরেক দল অবাধ্য হয়ে গেল, আর অবশিষ্টরা অন্যায় আচরণ শুরু করল যেন তারা আল্লাহর এই বাণী শোনে নি :
               
এ পরকালের গৃহ, যা আমরা তাদের জন্য নির্দিষ্ট করেছি যারা পৃথিবীতে না উদ্ধত হতে চায়, আর না বিপর্যয় সৃষ্টি করতে চায়; এবং সাবধানীদের জন্যই তো শুভ পরিণাম।Ñ সূরা কাসাস : ৮৩
এক্ষেত্রে যে বিষয়টি লক্ষণীয় তা হলো, যদিও জনগণ একজন ভালো ও পুণ্যবান শাসক চায়, কিন্তু তারা প্রকৃত ন্যায়পরায়ণ শাসককে চায় নাÑ যে শাসক প্রশাসনিক ন্যায়বিচার ও সততার ক্ষেত্রে কোনো রকম বংশগত বা পরিচয়গত সম্পর্ককে বিবেচনা করে না।
ইমাম আলী (আ.) তাঁর কর্মকর্তা, প্রশাসক এবং প্রাদেশিক গভর্নরদেরকে ন্যায়নীতি অনুসরণের জন্য কঠোরভাবে নির্দেশ দান করেন। তিনি দুর্নীতিগ্রস্ত ও ন্যায়নীতিহীন প্রশাসক ও গভর্নরদেরকে শাস্তি দেন এবং তাদেরকে পদচ্যুত করেন।
ঘুষ ও উপহার গ্রহণ নিষিদ্ধ করা
ইমাম আলী (আ.) কঠোরভাবে তাঁর গভর্নর ও কর্মকর্তাদেরকে ঘুষ ও উপহার নেয়াকে নিষেধ করে বলেন : ‘যে শাসক জনগণের প্রয়োজন থেকে নিজেকে লুকিয়ে রাখে, কিয়ামত দিবসে আল্লাহও নিজেকে সেই ব্যক্তি ও তার প্রয়োজন থেকে লুকিয়ে রাখবেন; যদি সে উপহার গ্রহণ করে তবে সে একজন দেশদ্রোহী; আর যদি সে ঘুষ নেয় তবে সে একজন মুশরিক।’Ñ সাওয়াবুল আমাল, ৩১০/১; বিহারুল আনওয়ার : ৭২/৩৪৫/৪২
আলী (আ.) নিজেও উপঢৌকনের ব্যাপারে সজাগ ছিলেন। একটি ঘটনা তিনি নিজেই বর্ণনা করেনÑ “…এটি অপেক্ষা আরো আশ্চর্যজনক একটি ঘটনা হলো ঐ ব্যক্তির কথা, যে রাতের আঁধারে মুখঢাকা পাত্রে কিছু উপঢৌকন এবং মা’জুন (এক প্রকার খাবার) নিয়ে আমার নিকটে এসেছিল, যে মা’জুন আমার পছন্দের ছিল না, যেন মনে হচ্ছিল এ মা’জুন সাপের লালা অথবা তার বমি দ্বারা মাখানো হয়েছে। আমি তাকে বললাম : ‘এটি কি আত্মীয়ের উপহার, নাকি যাকাত নাকি দান? আমরা (অর্থাৎ) আহলে বাইতের জন্য তো এসব নিষিদ্ধ।’ সে বলল : ‘এটিও নয়, ঐটিও নয়। বরং এটি একটি উপঢৌকন।’ ‘আমি বললাম : সন্তানহারা মা তোমার শোকে ক্রন্দন করুক! আল্লাহর দ্বীনের মাধ্যমে আমাকে প্রতারিত করতে এসেছ? নাকি তোমার মাথা নষ্ট হয়ে গেছে, নাকি তুমি একজন পাগল, নাকি তুমি আবোল-তাবোল বকছ? আল্লাহর কসম! আমাকে যদি সাত আকাশ এবং তার নিচে যা কিছু রয়েছে সবই প্রদান করা হয় যেন আমি পিঁপড়ার মুখ হতে যবের বীজের একটি খোসাও [অন্যায়ভাবে] ছিনিয়ে নিয়ে আল্লাহর অবাধ্যতা করি, [কস্মিনকালেও] আমি তা করব না! নিশ্চয় তোমাদের দুনিয়া আমার কাছে পঙ্গপালের মুখের ঐ পাতার চেয়েও তুচ্ছ যা সে চিবাচ্ছে। যে নেয়ামত নস্যাৎ হয়ে যাবে এবং যে মজা স্থায়ী হবে না তার সাথে আলীর কি! বুদ্ধির তন্দ্রাভাব ও বিচ্যুতির মন্দত্ব হতে আমরা আল্লাহর আশ্রয় কামনা করি এবং তাঁর কাছেই সাহায্য প্রার্থনা করি’।”Ñ নাহজুল বালাগাহ, খুতবা নং ২১৫
বন্ধুত্ব ও শত্রুতার ক্ষেত্রে ন্যায়নীতি অনুসরণ
যখন কারো হৃদয় আবেগ ও ভালোবাসা দ্বারা পূর্ণ হয়ে যায় যে ভালোবাসা তাকে সৎ ও নিরপেক্ষতার আলোকে ম্লান করে দেয় তখন তার পক্ষে ন্যায়বান হিসেবে বহাল থাকাটা সহজ নয়। এ প্রসঙ্গে ইমাম আলী (আ.) বলেন : ‘পরসংবাদ, যদি শাসনকর্তার কর্মকা- আবেগজড়িত হয় তাহলে তা অনেক ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।’Ñ নাহজুল বালাগাহ, পত্র নং ৫৯
একইভাবে, চারিত্রিকভাবে দৃঢ় ও মহান না হলে কারো পক্ষে ন্যায়ের গ-িতে আবদ্ধ থাকা সম্ভব নয় যখন সে তার শত্রু ও বিরোধীদের সাথে কাজ করে। আলী (আ.) কথা ও কর্মে প্রমাণ করেছেন যে, তিনি ছিলেন ন্যায়পরায়ণতার প্রতিমূর্তি। যিনি পবিত্র কোরআন ও রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর শিক্ষায় গড়ে উঠেছিলেন তিনি নিচের এই আয়াতকে তাঁর পথের আলো হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন:
          ক্স            ক্স        
হে বিশ্বাসিগণ! আল্লাহর উদ্দেশ্যে পদক্ষেপ গ্রহণকারী এবং ন্যায়ের ভিত্তিতে সাক্ষ্যদানকারী হও এবং (সাবধান!) কোন সম্প্রদায়ের প্রতি বৈরিতা যেন তোমাদের কখনও এ ব্যাপারে উদ্যোগী না করে যে, তোমরা সুবিচার করবে না; বরং সুবিচার কর, এটাই আত্মসংযমের নিকটতর এবং আল্লাহকে ভয় করতে থাক, কেননা, আল্ল¬াহ তোমাদের কৃতকর্মের ব্যাপারে সবিশেষ অবহিত।Ñ সূরা মায়েদা : ৮
একই বিশ্বাসের ভিত্তিতে তিনি তাঁর এক সন্তানকে উপদেশ দেন : তুমি অবশ্যই তোমার বন্ধু ও শত্রুর সাথে ন্যায়ানুগ আচরণ করবে।’Ñ গুরারুল হিকাম, ৭ম খ-, পৃ. ২৩৮
খোদাভীরু ব্যক্তির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আলোচনা করতে গিয়ে তিনি এই গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক নীতির উল্লেখ করে বলেন : ‘(একজন মুত্তাকী ব্যক্তি হলো সে) যে তার শত্রুর সাথে কেবল শত্রুতার কারণে অন্যায় আচরণ করে না এবং কেবল তার বন্ধুর প্রতি ভালোবাসার কারণে পাপে পতিত হয় না।’Ñ নাহজুল বালাগাহ, খুতবা নং ১৯৩
এটি নিশ্চিতভাবেই প্রকাশিত যে, যদিও আলী (আ.)-এর শত্রুরা তাঁকে সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে ভীষণ কঠিন অবস্থায় ফেলে দিয়েছিল এবং তাঁকে মানসিকভাবে প্রচ- চাপের মধ্যে নিক্ষেপ করেছিল, তবু তিনি এসব ঝড়-ঝঞ্ঝায় ভীত হন নি, তাঁকে ন্যায় ও সত্যপথ থেকে বিচ্যুত করতে পারে নি।
এর সপক্ষে প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো খারেজীদের বিষয়টি। যতক্ষণ পর্যন্ত তারা রাষ্ট্রের জন্য সুস্পষ্টভাবে হুমকি সৃষ্টি করে নি ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি তাদের সাথে নমনীয় আচরণ করেন, যদিও তারা তাঁকে প্রকাশ্যে অভিশাপ দিত এবং তাঁকে অপমান করত। তিনি এই দলের প্রতি এভাবে সম্বোধন করেন : ‘তোমাদের তিনটি অধিকার রয়েছে যেগুলোকে আমি সম্মান করব: প্রথমত, এই মসজিদে নামায পড়তে নিষেধ করব না। দ্বিতীয়ত, যতক্ষণ পর্যন্ত তোমরা আমাদের সাথে রয়েছ এবং নীতিগতভাবে এই রাষ্ট্রের আনুগত্য স্বীকার কর ততক্ষণ পর্যন্ত আমি তোমাদেরকে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে তোমাদের অংশ প্রদান করব। তৃতীয়ত, আমি তোমাদের সাথে শত্রুতায় লিপ্ত হব না যতক্ষণ না তোমরা প্রথমে তা শুরু কর।’Ñ আল উমাম ওয়াল মুল্্ক, মুহাম্মাদ ইবনে জারীর তাবারী, ৪র্থ খ-, পৃ. ৫৪
তবুও খারেজীরা ইমাম আলী (আ.)-এর সরকারের বিরুদ্ধে মিথ্যা গুজব ছড়াতে থাকে এবং মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ চালাতে থাকে। ইমাম আলী (আ.)-এর সত্যিকার ও সত্যপন্থী অনুসারীরা খারেজীদেরকে আর সহ্য করতে পারছিলেন না এবং সে মুহূর্তে একটি প্রকাশ্য দ্বন্দ্ব ছড়িয়ে পড়ার বিপদ দেখা দেয়। ইমাম আলী (আ.) উত্তেজনা প্রশমন, বিবাদ বন্ধ এবং সামাজিক অস্থিরতা দূর করার জন্য তাঁর অনুসারীদেরকে সবসময় নি¤েœর উপদেশ দিতে থাকেন : ‘আনন্দ ও ক্রোধে ন্যায়বান হও।’Ñ মিযানুল হিকমা, ৬ষ্ঠ খ-, পৃ. ৮৮
বিধর্মীদের প্রতি ন্যায় আচরণ
ইমাম আলীর দৃষ্টিতে কোরআনের সংস্কৃতি থেকে যে দৃষ্টিভঙ্গি বের হয়ে আসে তা হলো একটি ভূমির সকল জনগণ স্রষ্টার সৃষ্টি। তারা হয় তাদের শাসকের ধর্মবিশ্বাসের অনুসারী অথবা তার মতোই একজন মানুষ। যে কোনো ক্ষেত্রেই তাদের মানবাধিকার রয়েছে। সংক্ষেপে বলা যায়, তাঁর রাজনৈতিক দর্শন তাঁকে এ দিকে পরিচালিত করে যে, সকল অধিবাসীর প্রতি মানবিক ও ইসলামি আচরণ করতে হবে এবং শাসককে সর্বাবস্থায় ন্যায়ানুগ, সৎ ও নিরপেক্ষ আচরণ করতে হবে।
খারাজ আদায়ে ন্যায়পরায়ণতা অবলম্বন
আমীরুল মুমিনীন (আ.) যখন যিয়াদ ইবনে আবিহিকে ফার্স ও তদসংলগ্ন এলাকার শাসক নিযুক্ত করেন তখন তাকে অগ্রিম খারাজ আদায় করতে নিষেধ করেন, আর বলেন : ন্যায় বিচারকে কাজে লাগাবে। আর কঠোরতা অবলম্বন ও অত্যাচার করা হতে বিরত থাকবে। কারণ, কঠোরতা জনগণের উদ্বাস্তু হয়ে পড়ার কারণ হয়। আর অত্যাচার [তাদেরকে] অস্ত্রের [যুদ্ধের] দিকে আহ্বান করে।Ñ নাহজুল বালাগাহ, সংক্ষিপ্ত জ্ঞানগর্ভমূলক বাণী নং ৪৭৬
বিচারালয় ও বিচারের ক্ষেত্রে ন্যায়পরায়ণতা
আলী (আ.)-এর দৃষ্টিতে বিচারালয়ের ন্যায়বিচার হলো অন্য সকল মূল্যবোধের মাপকাঠি, ন্যায়বিচার সেগুলোকে সমুন্নত করে এবং জনগণকে ইসলামি সরকার ও এর কর্মকর্তাদের ওপর আস্থাবান করে তোলে।
আর বিচারালয়ের স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ বিচার হলো ন্যায়নীতি বাস্তবায়নের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপায়। প্রকৃতপক্ষে এটিই হলো সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের অস্তিত্বের নির্দেশক। যে সমাজে ন্যায়, স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার নীতির ওপর ভিত্তি করে রায় দেয়া হয় সেই সমাজে শত্রুতা, দ্বন্দ্ব এবং উদ্বিগ্নতা কম পরিদৃষ্ট হয়।
সংক্ষেপে বলা যায়, বিচারালয়ে ন্যায়বিচার হলো সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের ভিত্তি। একারণেই কুরআন শাসক ও বিচারকদেরকে এর ওপর দৃঢ় থাকার ব্যাপারে বিশেষ জোর দিয়েছে :
ক্স           ক্সক্স     ক্স      ক্স     
(হে বিশ্বাসিগণ!) আল্লাহ তোমাদের আদেশ করেছেন যে, আমানতসমূহকে তার অধিকারীর নিকট পৌঁছে দাও এবং যখন মানুষের মধ্যে কোন বিচার করবে তখন ন্যায়ের ভিত্তিতে তা করবে; আল্লাহ তোমাদের সর্বোত্তম উপদেশ দান করছেন; নিশ্চয় আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।Ñ সূরা নিসা : ৫৮
আলী (আ.) তাঁর কর্মকর্তাদেরকে সবসময় যে গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ দিতেন তা হলো : ‘যখন তোমাকে কোন দায়িত্বশীল পদে অধিষ্ঠিত করা হয় তখন ন্যায় বিচার করবে।’Ñ তুহাফুল উকুল, আবুল হাসান হাররানি, পৃ. ১০২
উপরন্তু এই সাধারণ উপদেশের বাইরেও আলী (আ.) বিচারালয়ের কার্যপদ্ধতি সম্পর্কে মুহাম্মাদ বিন আবু বকরের প্রতি লেখা পত্রে নির্দেশনা দিয়ে বলেন : ‘তাদের প্রতি বিনয়শীল হবে, তাদের সাথে কোমল আচরণ করবে এবং উদারতা প্রদর্শন করবে। চোখের কোণ থেকে তাকানো এবং চোখের সামনে দিয়ে তাকানোর ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখবে (অর্থাৎ সকলকে সমান চোখে দেখবে)। যাতে ধনীরা তোমার থেকে কামনা না করে যে, (তুমি দুর্বলদের প্রতি) অবিচার করবে আর দুর্বলরা যেন তোমার ন্যায়বিচার পাওয়ার আশা থেকে নিরাশ না হয়। কারণ, মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাসকল, (অর্থাৎ) তোমাদের সমস্ত কৃতকর্মের কৈফিয়ত চাইবেন, তা ছোটই হোক আর বড় হোক, প্রকাশ্যই হোক আর গোপন হোক। অতঃপর যদি তিনি শাস্তি দেন, সেটা তোমাদের অন্যায়ের কারণে। আর যদি ক্ষমা করেন, তাহলে সেটা তাঁর মহানুভবতার কারণে।’Ñ নাহজুল বালাগাহ, পত্র নং ২৭
যদি বিচারক ও বিচারিক কর্মকা-ের সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা অহমিকা ও যুক্তি-বুদ্ধির পরিপন্থী বিষয়গুলো নিজেদের থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারে তবে সে বিচারকার্যের ক্ষেত্রে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে এবং জনসাধারণকে দুষ্কৃতিকারীদের থেকে রক্ষা করতে পারে। এই বিষয়টিই আলী (আ.) এভাবে বলেছেন : ন্যায় বিচারের ক্ষেত্রে তাদের পদক্ষেপ হওয়া উচিত নিজেদের স্বার্থচিন্তাকে দূরে ঠেলে দেয়া।Ñ নাহজুল বালাগাহ, খুতবা নং ৮৭
তিনি তাঁর এক গভর্নরকে একটি পত্রে সতর্ক করে লেখেন : যাতে অভিজাত লোকেরা আকাক্সক্ষা না দেখায় যে, তোমাকে দিয়ে অন্যায় করাবে আর দুর্বলেরা তোমার ন্যায়বিচার থেকে নিরাশ না হয়।Ñ নাহজুল বালাগাহ, পত্র নং ৪৬
ইমাম আলী (আ.) বলেন : ‘বিশ্বাসভাজন লোকের প্রতি অনুমানের ভিত্তিতে রায় দেওয়া ন্যায়বিচার নয়।’Ñ নাহজুল বালাগাহ, সংক্ষিপ্ত জ্ঞানগর্ভমূলক বাণী নং ২২০
আলী (আ.) ন্যায়নীতির ক্ষেত্রে সম্পূর্ণরূপে সচেতন ছিলেন। এখানে এমনই একটি ঘটনা উল্লেখ করা হলো। আলী (আ.) একদিন বাজারে গিয়ে দেখেন, একজন খ্রিস্টান একটি লোহার বর্ম বিক্রি করছে। আলী (আ.) তৎক্ষণাৎ বর্মটি চিনে ফেলেন এবং বলেন : ‘এ বর্ম তো আমার। চল, আদালতে তোমার ও আমার মধ্যে ফায়সালা হবে।’ সেসময় ঐ আদালতের বিচারক ছিলেন কাযী শুরাইহ। তিনি যখন আমীরুল মুমিনীনকে আসতে দেখলেন, তখন তাঁর বসার স্থান থেকে উঠে দাঁড়ালেন এবং ইমামকে নিজ স্থানে বসিয়ে তিনি তাঁর পাশে বসলেন। আলী (আ.) বিচারপতি শুরাইহকে বললেন : ‘এই ব্যক্তির সাথে আমার বিরোধ মিটিয়ে দিন।’ শুরাইহ বললেন : ‘আমীরুল মুমিনীন! আপনার বক্তব্য কী?’ আলী বললেন : ‘এই বর্মটি আমার। অনেক দিন হলো এটি হারিয়ে গেছে। আমি তা বিক্রি করিনি, দানও করিনি।’ শুরাইহ বললেন : ‘ওহে! আমীরুল মুমিনীন যা বলছেন, সে ব্যাপারে তুমি কী বলতে চাও?’ সে বলল : ‘আমি আমীরুল মুমিনীনকে মিথ্যাবাদিতার অভিযোগে অভিযুক্ত করছি না, তবে বর্মটি আমারই।’ শুরাইহ হযরত আলীকে লক্ষ্য করে বললেন : ‘বর্মটিতো এই ব্যক্তির দখলে রয়েছে। কোনো প্রমাণ ছাড়া তার কাছ থেকে সেটা নেয়া যাবে বলে আমি মনে করি না। আপনার কাছে কোনো প্রমাণ আছে কি?’ আলী (আ.) হেসে ফেললেন এবং বললেন : ‘শুরাইহ ঠিকই বলেছেন। আমার নিকট তো কোনো প্রমাণ নেই।’ নিরুপায় শুরাইহ খ্রিস্টানের পক্ষেই রায় দিলেন এবং সে বর্মটি গ্রহণ করে রওয়ানা হলো। কিন্তু কিছু দূর গিয়ে সে আবার ফিরে এল এবং বলল : ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, এটাই নবীদের বিধান ও শিক্ষা। আমীরুল মুমিনীন নিজের দাবি বিচারকের সামনে পেশ করেছেন, আর বিচারক তাঁর বিপক্ষে রায় দিচ্ছেন। আল্লাহ্র কসম, হে আমীরুল মুমিনীন! এটা আপনারই বর্ম। আমি এটি আপনার কাছে বিক্রি করেছিলাম। পরে তা আপনার মেটে রঙের উটটির উপর থেকে ছিটকে পড়ে গেলে আমি ওটা তুলে নেই। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ্ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই এবং মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহর রাসূল।’ আলী (আ.) বললেন : ‘তুমি যখন মুসলমান হয়ে গেলে, তখন এ বর্ম এখন থেকে তোমার।’ অতঃপর আলী তাকে ভালো দেখে একটি ঘোড়াও উপহার দিলেন এবং তাতে চড়িয়ে তাকে বিদায় দিলেন।Ñ আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া ৮/৫
শুধু নিজ খেলাফতকালেই নয়; বরং পূর্ববর্তী খলিফাগণের সময়েও তাঁকে সূক্ষ্মভাবে ন্যায় বিচারের নীতির প্রতি অতিশয় গুরুত্ব প্রদানকারী হিসেবে দেখতে পাওয়া যায়। প্রসঙ্গত একটি ঘটনা উল্লেখ করা হলো। দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমরের সময় এক ব্যক্তি আলী (আ.)-এর বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করে। বিচারের দিন আলী (আ.) ও ওই ব্যক্তি উপস্থিত হন। উমর তাঁর বিচারকের আসনে বসেন এবং ওই ব্যক্তিকে নাম ধরে সম্বোধন করে একটি নির্দিষ্ট স্থানে দাঁড়াতে বলেন। আর ইমাম আলীকে সম্বোধন করে বলেন : ‘হে আবুল হাসান! আপনি ওই ব্যক্তির পাশে দাঁড়ান।’ এতে ইমাম আলীর চেহারার মধ্যে অনুশোচনার একটি ভাব পরিলক্ষিত হয়। খলিফা বলেন : আপনি কি অভিযোগকারীর ব্যক্তির পাশে দাঁড়াতে ইচ্ছুক নন?’ আলী বলেন : আমি একারণে হতাশ নই যে, তার পাশে আমাকে দাঁড়াতে হবে। বরং আমি একারণে হতাশ যে, আপনি ন্যায় বিচারের নীতির প্রতি যথাযথভাবে অনুগত ও নিরপেক্ষ থাকেননি, কারণ, আপনি আমাকে সম্মানজনক পদবি সহকারে সম্বোধন করেছেন যেখানে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগকারী ব্যক্তিকে তার নাম ধরে সম্বোধন করেছেন।’
উপসংহার
ইমাম আলী (আ.) শাসনকর্তৃত্ব লাভ করার পর কোনোরকম বৈষম্য ছাড়া এবং এক মুসলমানকে অপর মুসলমানের ওপর অগ্রাধিকার প্রদান ছাড়া মহানবী (সা.)-এর স্বর্ণযুগ ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট হন।
যারা পূর্বে ইমাম আলী (আ.)-এর সাথে ছিল তাদের অনেকেই তাঁকে পরিত্যাগ করে এবং তাঁর বিরুদ্ধ পক্ষে নানা পদে যোগদান করে শুধু এই কারণে যে, তারা তাঁর ন্যায়পরায়ণতাকে সহ্য করতে পারে নি। যখন ইমাম আলী (আ.) তাদেরকে তাদের দুর্নীতি ও অপকর্মের জন্য শাস্তি দিয়েছেন অথবা যখন তারা বুঝতে পারে যে, তারা অন্যায় ও অবৈধভাবে যা কিছু অর্জন করেছে তা আলী (আ.)-এর ন্যায়পরায়ণ শাসনের মাধ্যমে তাদের কাছ থেকে ফিরিয়ে নেয়া হবে তখন তারা তাঁর বিরুদ্ধে সরব হয় এবং মুয়াবিয়া ইবনে আবি সুফিয়ানের দলে যোগ দেয়। বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের ষড়যন্ত্রের মধ্যেও তিনি মুমিনদেরকে কোরআন মজীদ ও রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নাতের দিকে আহ্বান জানাতে থাকেন।
বস্তুত, মহান আল্লাহ তাঁর চূড়ান্ত গ্রন্থ কোরআন মজীদকে সত্য ও মিথ্যার মধ্যকার পার্থক্যকারী হিসেবে পাঠিয়েছেন। এর বাণী সকলের জন্য ন্যায়পরায়ণতার নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত। আর আলী (আ.) এক্ষেত্রে তাঁর সর্বোচ্চ সেবা দিয়েছেন। যেখানেই এবং যখনই মিথ্যাকে সত্যের সাথে মিশ্রিত করার চেষ্টা করা হয়েছে এবং অন্যায়কে ন্যায়ের ওপর স্থান দেয়ার অপচেষ্টা হয়েছে সেখানেই ইমাম আলী (আ.) ও তাঁর সন্তান ও উত্তরাধীকারীদের রক্ত ষড়যন্ত্রকারীদের পরিকল্পনা নস্যাতের ক্ষেত্রে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করেছে।

সম্পাদকীয়

বিশ্বকুদস দিবস ও শবে কদর
সকলেই অবগত যে, ইরানের ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ.) কর্তৃক পবিত্র রামাযান মাসের শেষ শুক্রবারকে বিশ্বকুদ্স্ দিবস হিসেবে নামকরণ করা হয় এবং তখন থেকে প্রতি বছর বিশ^ব্যাপী এ দিনটি পালিত হয়ে আসছে। এ উদ্দেশ্যে বিশ্বের বিশেষতঃ বিশ্বের মুসলমানদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য বছরের একটি দিন বরাদ্দ কম হলেও অনেক গুরুত্বের দাবি রাখে। কারণ, কুদস বা বায়তুল্ মুক্বাদ্দাস্ হচ্ছে মুসলমানদের প্রথম ক্বিবলা এবং অনেক নবী-রাসূলের (‘আ.) সমাধিস্থল। তবে এ বছর পবিত্র রামাযান মাসের শেষ শুক্রবার কুদস দিবসের সাথে সাথে শবে কদর হবার সম্ভাবনাযুক্ত একটি রাতের সমন্বয় ঘটেছেÑ যা বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের জাগরণের রাত। কারণ, সর্বশক্তিমান আল্লাহ্ তা‘আলা সূরা আল্-ক্বাদ্রে এ রাতকে হাজার মাসের তুলনায় উত্তম বলে ঘোষণা করেছেন। শবে কদর হবার সম্ভাবনাযুক্ত রাতগুলোতে তথা রামাযানের শেষ দশ দিনের বেজোড় রাতগুলোতে মুসলমানরা ও বিশ্বের সমস্ত স্বাধীনচেতা মানুষ সারা রাত জেগে ইবাদত করে থাকে। তাই বিশ্বের মুসলমানদের আশা এই যে, মুসলমানদের এতো মূল্যবান রাতে আল্লাহ্ তা‘আলা তাদের নিয়তিতে সর্বোৎকৃষ্ট কল্যাণ দান করবেন এবং মুসলমানদের প্রথম ক্বিবলার আশু মুক্তকরণ মঞ্জুর করবেন।
এ বছরের কুদস দিবসের অনুষ্ঠান পূর্ববর্তী সমস্ত বছরের চেয়ে আলাদা এবং করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে বিশে^র অধিকাংশ স্থানেই এ বছর অনলাইনে ইন্টারনেটের মাধ্যমে কুদস্ দিবস্ পালিত হচ্ছে। এতে দেখা যায় যে, সারা বিশ্বের মুসলমানদের ঘরে বসে থাকতে হলেও এবং তাদের পারস্পরিক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে একমাত্র মোবাইল-ইন্টারনেট থাকলেও বায়তুল্ মুক্বাদ্দাস্ ইস্যু নিয়ে নীরব থাকতে ú্রস্তুত নয়।
শবে কদরের রাতসমূহের শুরু ও কুদস দিবসের মধ্যবর্তী সময়ের ব্যবধান এক সপ্তাহ এবং এই রাতগুলো দোয়া কবুলের রাত। তাই প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরও শবে কদরের রাতগুলোতে আমাদের দোয়া, বাইতুল মুক্বাদ্দাস যেন তার মূল মালিকদের কাছে ফিরে আসে।
গোটা বিশ্ব সাক্ষী যে, এখন গাযা এলাকায় মুসলমানরা করোনাভাইরাসের মারাত্মক অবস্থার সাথে সাথে গুরুতর অর্থনৈতিক ও চিকিৎসা অবরোধের মুখোমুখি হয়েছে। নিশ্চয়ই কদরের রাতেÑযা অন্যান্য ত্রিশ হাজার রাতের চেয়ে উত্তমÑমুসলমানদের প্রার্থনা কবুল হবে এবং তারা উপনিবেশবাদীদের দুষ্ট পরিকল্পনাটিকে ব্যর্থ করতে সক্ষম হবে।
وَمَكَرُوا وَمَكَرَ اللَّهُ وَاللَّهُ خَيْرُ الْمَاكِرِينَ
‘তারা চক্রান্ত করলো এবং আল্লাহ্ও কৌশল করলেন; নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ সর্বোত্তম কৌশলকারী।’ (সূরা আলে ‘ইম্রান্ : ৫৪)
পরিশেষে বিশ্ব বিবেকের কাছে প্রশ্ন : বিশ্ব যদি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী হয় তবে তারা কেন ফিলিস্তিন ও কুদসের মালিকানার বিষয়ে জাতীয় গণভোট করতে রাযি হচ্ছে না?
আমরা নিউজলেটারের পাঠক-পাঠিকাদের সহ বিশ^ মুসলিমের উদ্দেশে শবে কদর উপলক্ষে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাচ্ছি ও তাঁদের দোয়া কবূল হওয়ার কামনা করছি এবং বিশ^ কুদস্ দিবস উপলক্ষে কুদস্ মুক্ত করার জন্য শপথ গ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছি।

স্মরণীয় বাণী

 

হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) এরশাদ করেন: ‘আসমানের রহমতের দরজাসমূহ চার সময় খোলা হয় : বৃষ্টি বর্ষণের সময়, সন্তান কর্তৃক পিতামাতার চেহারার প্রতি দৃষ্টিপাতের সময়, কা‘বার দরজা খোলার সময় এবং বিবাহ সম্পাদনের সময়।’
হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) এরশাদ করেন : ‘যে ব্যক্তি প্রত্যেক জুমুআর দিনে তার পিতামাতার কবর যিয়ারত করবে তাকে ক্ষমা করা হবে এবং তাকে নেককারদের মধ্যে গণ্য করা হবে।’
হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) এরশাদ করেন : ‘আমি কি তোমাদেরকে আচরণের বিচারে দুনিয়া ও আখিরাতের জন্য সর্বোত্তম ব্যক্তি কা’রা বলে দেব? (সাহাবিগণ) বললেন : ‘জ্বী।’ তিনি এরশাদ করলেন : ‘যে ব্যক্তি তার সাথে সম্পর্ক ছিন্নকারীর সাথে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে।’
হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) এরশাদ করেন : ‘যে কেউ তার মৃত্যু পিছিয়ে যাওয়া ও রুযী বৃদ্ধি পাওয়া পছন্দ করে, সে যেন আল্লাহ্কে ভয় করে চলে এবং আত্মীয়-স্বজনের খোঁজখবর নেয়।’
হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) এরশাদ করেন : ‘যে কোনো উত্তম কাজই সাদাকাহ্ হিসেবে পরিগণিত হয়ে থাকে এবং মু‘মিন ব্যক্তি তার নিজের পরিবারের ও স্ত্রীর জন্য যা কিছু ব্যয় করে এবং যা দ্বারা সে তার ইজ্জত-আব্রুর হেফাযত করে তার সবই সাদাকাহ্ হিসেবে লিখিত হয়।’
আমীরুল্ মু‘মিনীন্ হযরত আলী (আ.) এরশাদ করেন : ‘যে জাতি পানি ও কৃষিযোগ্য ভূমির অধিকারী, কিন্তু (কম পরিশ্রম বা অপকর্মের কারণে) অন্যদের মুখাপেক্ষী হয় তারা আল্লাহ্র রহমত থেকে দূরে রয়েছে।’
আমীরুল্ মু‘মিনীন্ হযরত আলী (আ.) এরশাদ করেন : ‘কারো জ্বর হলে তার ওপর ঠা-া পানি ছিটিয়ে দাও, তাহলে তার জ্বর নেমে যাবে।’
হযরত ইমাম বাকের (আ.) এরশাদ করেন : হযরত মূসা (আ.) একদিন আল্লাহ্র কাছে মুনাজাত করার সময় এক ব্যক্তিকে আল্লাহ্র ‘আরশের ছায়াতলে দেখতে পেলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন : ‘হে আমার রব! এই ব্যক্তি কে, যে, তোমার ‘আরশ তার ওপরে ছায়া ফেলেছে?’ আল্লাহ্্ বললেন : ‘এ হচ্ছে এমন এক ব্যক্তি যে তার পিতা ও মাতার কল্যাণ করেছে এবং সে চোগলখুরি করে নি।’
হযরত ইমাম জা‘ফর সাদেক (আ.)-কে জিজ্ঞেস করেন : ‘সবচেয়ে মূল্যবান আমল কোনটি?’ হযরত ইমাম এরশাদ করেন : ‘সময়মতো নামায আদায় করা, পিতামাতার প্রতি সদাচরণ ও তাদের কল্যাণ সাধন এবং আল্লাহ্র রাস্তায় জিহাদ।’
হযরত ইমাম জা‘ফর সাদেক (আ.) এরশাদ করেন : ‘পিতামাতাকে কষ্টদানের পার্থিব পরিণতিসমূহের অন্যতম হচ্ছে দো‘আ কবূল না হওয়া এবং তা (নৈতিক-আত্মিক) পরিবেশকে অন্ধকার করে।’
হযরত ইমাম জা‘ফার সাদেক (আ.) এরশাদ করেন : ‘পাত্রাদি ধৌতকরণ এবং যিন্দেগীর পরিবেশকে (বাসস্থান ও তার আশপাশকে) ঝাড়– দেয়া ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা রুযী বৃদ্ধির কারণ।’
হযরত ইমাম জা‘ফার সাদেক (আ.) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি এরশাদ করেছেন : ‘যে ভূখ-ে তিনটি উপাদান নেই সেখানে যিন্দেগী উপভোগ্য নয়, তা হচ্ছে : পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হাওয়া, প্রচুর ও সুপেয় পানি এবং কৃষিযোগ্য উর্বর যমীন।’
হযরত ইমাম মূসা কাযেম্ (আ.) এরশাদ করেন : ‘যে কেউ তার ভাইদের ও স্বীয় পরিবারের কল্যাণ সাধন করে তার হায়াত দীর্ঘ হয়।’
হযরত ইমাম রেযা (আ.) এরশাদ করেন : ‘যে কেউ হালাল পন্থায় রুযী সন্ধান করে এবং নিজের ও স্বীয় পরিবারের জন্য ব্যয় করে সে হচ্ছে আল্লাহ্র রাস্তায় জিহাদরত ব্যক্তির ন্যায়।’
‘মাফাতিহুল হায়াত’ গ্রন্থ থেকে সংকলিত
অনুবাদ : নূর হোসেন মজিদী

স্মরণে মহান কবি শেখ সাদী

মুজতাহিদ ফারুকী : প্রাচীন পারস্যের মহান কবি শেখ সাদীর নৈতিক শিক্ষা ও মানবিকতা বোধের উজ্জীবক গল্পগুলোর এক সময় যথেষ্ট আবেদন ছিল বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে। সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বজুড়েই নৈতিকতার মানদ- ঠিক আগের মতো নেই। শুদ্ধ চিত্ত, শুদ্ধ চিন্তা, পরিপূর্ণ সততা এসব এখন মানব চরিত্রের জন্য আর অত্যাবশ্যকীয় গুণ বা বৈশিষ্ট্য হিসাবে যেন বিবেচিত নয়। অন্য সব মূল্যবোধের মতোই নৈতিক মূল্যবোধেও অবক্ষয় এসেছে। পরিবেশ পরিস্থিতি বুঝে একজন আধুনিক মানুষ তার আচরণের ধারা নির্ধারণ করবেন বর্তমান সময়ে সেটাই কাক্সিক্ষত। অর্থাৎ সবকিছুই আপেক্ষিক হয়ে গেছে। হয়তো সে জন্যই শেখ সাদীর গল্পগুলো এখন আর কোনও পত্র-পত্রিকায়, এমনকি শিশুদের পাতায়ও ছাপা হতে দেখি না। সাদীর সেই গল্পটা নিয়ত মনে পড়ে। আমন্ত্রিত হয়ে বাদশাহর দরবারে যাবার সময় পথে এক ধনাঢ্য ব্যক্তির বাড়িতে আশ্রয় নেন শেখ সাদী। তখন তাঁর পরনে ছিল অত্যন্ত সাধারণ পোশাক। তাই আশ্রয়দাতা সাদীকে তেমন ভালোভাবে সমাদর করলেন না। সাদী বিদায় নিয়ে বাদশাহর দরবারে যান এবং সেখানে কিছুদিন কাটানোর পর আবার বাড়ির পথ ধরেন। পথে রাত ঘনিয়ে এলে তিনি আবারও সেই ধনাঢ্য ব্যক্তির বাড়িতে আশ্রয় নেন। এবারে অবশ্য সাদীর পরনে ছিল অত্যন্ত মূল্যবান এবং ঝলমলে অভিজাত পোশাক। সুতরাং আশ্রয়দাতা এবার খুব ভালো ভালো দামি খাবার-দাবারের আয়োজন করলেন সাদীকে আপ্যায়ন করার জন্য। খাবার সময় সাদী করলেন অদ্ভুত কাজ। তিনি দামি দামি খাবারগুলো নিজের পোশাকের পকেটে পুরতে শুরু করলেন। এই দেখে ধনাঢ্য আশ্রয়দাতা খুবই অবাক হয়ে এর কারণ জিজ্ঞাসা করলেন।
সাদী বললেন, আগের বার আমি এতসব দামি দামি খাবার পাই নি। কিন্তু এবার পেয়েছি আমার দামি পোশাকের কারণে। সুতরাং খাবারগুলো পোশাকেরই প্রাপ্য।
আশ্রয়দাতা নিজের ভুল বুঝতে পারলেন এবং সাদীর কাছে নিজের আচরণের জন্য দুঃখ প্রকাশ করলেন।
এই গল্পের মূল বাণী কী? মানুষকে মানুষ হিসাবেই মর্যাদা দিতে হবে। তার অর্থসম্পদ বা পোশাক-আশাক দেখে নয়।মানুষের মর্যাদা সম্পর্কে এর চেয়ে ভালো কোনও দৃষ্টান্ত আর কোনও লেখকের রচনায় মিলবে কিনা সন্দেহ। শেখ সাদীর অন্য গল্পগুলোও এমনই সব মহত্তর মানবিক ও নৈতিক শিক্ষায় উজ্জীবিত। তাই তো এখনও বিশ্বের সর্বত্র শেখ সাদীর কদর আছে শিক্ষিত মানুষের কাছে। আছে তার প্রাসঙ্গিকতা।
প্রাসঙ্গিকতা যে আছে তার প্রমাণ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসাবে বারাক ওবামা যখন ইরানি নববর্ষে ইরানবাসীকে শুভেচ্ছা জানান তখন তিনি শেখ সাদীর কবিতাই বেছে নেন নিজের ভাব প্রকাশের জন্য। ২০০৯ সালের ২০ মার্চ নওরোজের শুভেচ্ছাবার্তায় ওবামা উদ্ধৃত করেন সাদীর বিখ্যাত রচনা ‘বনি আদম’ এর প্রথম দুটি চরণ,
‘আদমসন্তান পরস্পর একই দেহের অঙ্গ
সৃষ্টির উৎসে তাদের উপাদান যে অভিন্ন।’
বিশে^র সমস্ত মানব সম্প্রদায়কে এভাবে একই দেহের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসাবে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি এমনকি আধুনিককালের মানবাধিকারের অতিউৎসাহী প্রবক্তাদের কারও রচনায়ও দেখি না। অথচ শেখ সাদী জন্মেছিলেন সেই মধ্যযুগে যেটিকে আমরা এখনকার মানুষেরা বর্বরতার যুগ হিসাবে উল্লেখ করি।
শেখ সাদীর পুরো নাম শেখ আবু আবদুল্লাহ মুশাররফ উদ্দীন ইবনে মুসলেহ সাদী। জন্মেছিলেন ইরানের তখনকার রাজধানী সিরাজ নগরে, ১১৭৫ মতান্তরে ১১৮৪ খ্রিস্টাব্দে। বাবা আবদুল্লাহ ছিলেন সিরাজের বাদশাহর সচিব। তিনি অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ মানুষ ছিলেন এবং তাঁর কাছেই সাদীর শৈশবের লেখাপড়ার হাতেখড়ি হয়। পরে তিনি তখনকার বিশে^র অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ বাগদাদের নিযামিয়া বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখানে তিনি ইসলামি ধর্মতত্ত্ব (যেমন কুরআন, হাদিস, তাফসির, ফিকাহ, উসুল, ফরায়েজ, হিকমা), দর্শন, সাহিত্য (যেমন : ভাষাবিজ্ঞান, ধ্বনিতত্ত্ব, অলঙ্কারশাস্ত্র), নীতিশাস্ত্র ইত্যাদি বিষয়ে গভীর জ্ঞান অর্জন করেন। তিনি ভাষা শিক্ষার ওপর আকৃষ্ট হয়েছিলেন এবং আরবি, ফারসি, হিব্রু, গ্রিক, তুর্কি, ল্যাটিন, উর্দু, হিন্দি, সংস্কৃত, আফগানি ইত্যাদি ২৪টির মতো ভাষা শিখে ফেলেন। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি ভাষায় তিনি এতটাই দক্ষ হয়ে ওঠেন যে, সেগুলো তিনি নিজের মাতৃভাষা ফারসির মতোই সচ্ছন্দে বলতে এবং লিখতে পারতেন।
শিক্ষাজীবন শেষে সাদী প্রথমে পবিত্র হজ পালন করতে মক্কা-মদীনায় যান। এরপর শুরু করেন দেশভ্রমণ। আরব বিশে^র বিভিন্ন দেশ ইরাক, সিরিয়া, ওমান, জেরুজালেম, মিসর, লিবিয়া ছাড়াও তিনি স্পেন, ইতালি, চীন, সমরখন্দ (রাশিয়া), আফগানিস্তান, ভারত এবং আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ সফর করেন। সাদী এত বেশি দেশ সফর করেন যে, একমাত্র বিশ্বপর্যটক ইবনে বতুতা ছাড়া তাঁর মতো পর্যটক সে সময় আর কেউ ছিলেন না।
ত্রিশ বছরের শিক্ষাজীবন শেষে পরবর্তী ত্রিশ বছর ধরে সাদী বিশ্ব ভ্রমণ করেন এবং এরপর নিজ শহর সিরাজে এসে গ্রন্থ রচনায় মনোনিবেশ করেন। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন এবং তাঁর কবিতা তাঁর একজন শিক্ষককে এতটাই মুগ্ধ করে যে, সেই শিক্ষক সাদীর লেখাপড়ার বিষয়টি দেখাশোনার ভার নেন।
তাঁর সময়ে শেখ সাদীর মতো জ্ঞানী ব্যক্তি মুসলিম বিশে^ দ্বিতীয় কেউ ছিল না। ১২৫৮ সালে তাঁর রচিত গ্রন্থ ‘গুলিস্তাঁ’ প্রকাশিত হয়। এটিকে বলা হয় প্রাচীন পারস্যের কবিদের রচিত চারটি শ্রেষ্ঠ গ্রন্থের একটি। অন্য তিনটি শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ হলো ফেরদৌসীর ‘শাহনামা’, রুমির ‘মসনভি’ এবং হাফিজের ‘দিওয়ান’। অনেক ইংরেজ লেখক প-িত সাদীকেই প্রাচ্যের শেক্সপিয়র বলে আখ্যা দেন।
শেখ সাদীর ২২টির মতো গ্রন্থের নাম জানা যায়। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো গুলিস্তাঁ, বূস্তাঁ, করিমা, সাহাবিয়া, কাসায়েদে ফারসী, কাসায়েদে আরাবিয়া, গযলিয়াত, কুল্লিয়াত ইত্যাদি।
সাদীর গুলিস্তাঁ বিশ^ সাহিত্যের অমূল্য সেরা সম্পদ হিসাবে স্বীকৃত। এটি পৃথিবীর প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তবে বূস্তাঁও সমমর্যাদার দাবিদার। এই দুটি কালজয়ী গ্রন্থ সেকালে সমগ্র এশিয়ায় বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। দুটি গ্রন্থের অনেক পঙ্ক্তি পারস্য সাহিত্যে প্রবাদে পরিণত হয়েছে।
‘গুলিস্তাঁ’ হচ্ছে উপদেশমূলক গদ্যের ফাঁকে ফাঁকে কাব্যে রচিত একটি গ্রন্থ। আর ‘বূস্তাঁ’ পুরোটাই কাব্য। ‘গুলিস্তাঁ’ মানে ফুলের বাগান আর ‘বূস্তাঁ’ মানে সুবাসিত স্থান। ‘গুলিস্তাঁ’ গ্রন্থে সাদী যেসব কাহিনী দিয়ে মানবমনের চিরন্তন বাগানে ফুল ফুটিয়েছেন তা অনেকটা দৃশ্যমান। কিন্তু বূস্তাঁর ফুলগুলো দৃশ্যমান নয়, কাছে গেলে অর্থাৎ নিয়মিত চর্চা করলে এর অন্তর্গত সুবাস মন-মস্তিষ্ককে বিমোহিত করে।
বর্ণনাশৈলির চমৎকারিত্ব, ভাষার লালিত্য ও মাধুর্য এবং মানবীয় গুণাবলির উৎকর্ষ সাধনে তাঁর অবদান বিশ^ সভ্যতায় অবিস্মরণীয়।

মানবতার কবি
ফারসি সাহিত্যের কিংবদন্তি পুরুষ কবি শেখ সাদী তাঁর সাহিত্যকর্মের সর্বত্রই মানবতার জয়গান গেয়েছেন। তাঁর ‘গুলিস্তাঁ’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত সেই উদ্ধৃতিটি দেখুন,
‘সবল বাহু আর শক্তিশালী হাতের পাঞ্জায়
নিরীহ দুর্বলের হাত ভাঙা বড় অন্যায়।
পতিতের প্রতি যে দয়া দেখায় না, সে কি ভয় পায় না
নিজে পতিত হলে কেউ যে এগিয়ে আসবে না?
মন্দের দানা বুনে যে দিন কাটে ভালোর আশায়
ভ্রান্ত চিন্তায় ঘুরপাক খায় বেভুল বাতিল কল্পনায়।
কানের তুলা বের করো, শোধ কর মানুষের প্রাপ্য
যদি না দাও, সেদিন ফেরত দেবে অবশ্যই।
আদমসন্তান পরস্পর এক দেহের অঙ্গ
সৃষ্টির উৎসে তাদের উপাদান যে অভিন্ন
কালের দুর্বিপাকে ব্যথিত হয় যদি একটি অঙ্গ
স্বস্তিতে থাকতে পারে না বাকি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ
অন্যদের দুঃখে-কষ্টে তুমি যে নির্বিকার
তোমাকে মানুষ বলা অনুচিৎ, অবিচার।’ (গুলিস্তাঁ, প্রথম অধ্যায়, হেকায়েত-১০)
এই উদ্ধৃতিতে সাদী অধিকারবঞ্চিত, দুর্বল, সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ের যে গভীর আবেদন রেখেছেন তা অতুলনীয়। শেষ ছয়টি চরণে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন মানবপ্রেমের এক বিশ^জনীন আবেদন। অত্যন্ত সহজ-সরল ভাষায়, অতি সংক্ষেপে, কাব্যশৈলির অসাধারণ নৈপুণ্যে ও যুক্তির মানদ-ে উপস্থপিত এই আবেদন বিশে^র সব মানুষের হৃদয় স্পর্শ করে। মানুষের চিন্তায় মুহূর্তে উঠে আসে আপন সৃষ্টিতত্ত্ব, সমগোত্রীয় মানুষের প্রতি দায়িত্ব বিশেষ করে মানুষে মানুষে সাম্য ও সম্প্রীতির অনিন্দ্য চেতনা।
আজকের বিশে^ জাতিগত, ধর্মীয়, রাজনৈতিক এবং বর্ণ ও জাতপাতের ভিত্তিতে মানুষে মানুষে বিভেদ ও হানাহানি চরমে পৌঁছেছে। কবি শেখ সাদী কবিতার অলঙ্কারে মানবজাতির সামনে যে সত্যটি উপস্থাপন করেছেন সেটি হলো, বিশে^র সব মানুষ এক আদমের সন্তান, সবারই সৃষ্টির মূলে রয়েছে একই উপাদান। সুতরাং তাদের মধ্যে সম্পর্ক হওয়া চাই একটি দেহের বিভিন্ন অঙ্গের অন্তর্গত সম্পর্কের মতো। দেহের কোনও অঙ্গ আঘাতপ্রাপ্ত হলে যেমন অন্য অঙ্গগুলো স্বস্তিতে থাকতে পারে না, তেমনই পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তে যে কোনও আদমসন্তান ব্যথায় কাতর হলে কোনও মানুষ তার সমব্যথী না হয়ে পারে না। এই দায়িত্ব যে ভুলে যায়, অন্যের দুঃখ-দুর্দশা দেখেও যে নির্বিকার থাকে, সাদীর ভাষায়, সে মানুষ নয়, তাকে মানুষ বলা যায় না।
মানব সমাজকে সৌহার্দ্যপূর্ণ ও শান্তিময় করার আদর্শ ও শিক্ষা সাদী প্রচার করে গেছেন তাঁর অমর সাহিত্যে। মানুষের চেতনার দুয়ারে করাঘাত করে তাদের চিন্তার পরিশুদ্ধির সূত্রে সুন্দর চরিত্র ও আদর্শ সমাজ নির্মাণের উপাদান যোগান দিয়েছেন। তাঁর রচিত গল্পগুলোতে তিনি প্রধানত শাসকদের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। বিভিন্ন রাজা-বাদশাহর জীবনী তুলে ধরেছেন নানা কাহিনীর অবতারণা করে। এগুলোর মূল উদ্দেশ্য ছিল প্রকারান্তরে শাসকশ্রেণিকে ভালো কাজে অনুপ্রাণিত করা এবং মন্দ কাজে বিরত থাকার তাগিদ দেওয়া। মানুষ যখন জীবন ও জগতের রহস্য হৃদয়ঙ্গম করতে পারে তখন নিজে থেকেই সুপথের অনুসারী হয়। তার কথা ও কাজে মানবীয় সৌন্দর্যের ফুল ফোটে। শেখ সাদী মানুষের ওই অন্তর্চক্ষু খুলে দেওয়ার কাজটি করেছেন তাঁর রচনার ভাজে ভাজে নানা উপমা-উৎপ্রেক্ষায় জীবন ও জগতের নানা রহস্যের নির্দেশনা দিয়ে।
যারা ক্ষমতার মোহে অন্ধ তাদের চোখ খুলে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন সাদী নানা উপাখ্যানের অবতারণায়। যাতে মহাক্ষমতাধর ব্যক্তিরাও নিজের ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী না ভাবে।
তাঁর সেসব গল্পেরও ভাষাশৈলি অতিশয় সরল ও সহজ। কিন্তু তা ছিল অননুকরণীয়। রচনাশৈলির সারল্য, মাধুর্য ও বিষয়বস্তুর সার্বজনীন মানবিকতার কারণেই আজ প্রায় সাড়ে আটশ’ বছর পরও বিশে^র কোটি কোটি মানুষ এই মহান কবির রচনা পাঠ করে অনুপ্রাণিত হয়। নিজের জীবনে অনুসরণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে।
বাংলাদেশসহ মুসলিম বিশে^র লাখো মসজিদ মাদরাসায় এবং মানুষের ঘরে ঘরে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (স.)-এর দিনে এবং নানা উপলক্ষে প্রতিদিন শেখ সাদীর রচিত বিশ্বের শ্রেষ্ঠ নাতে রাসূল সমস্বরে কত লক্ষবার উচ্চারিত হয় তার কোনও ইয়ত্তা নেই। সেটি হলো :
‘বালাগাল উলা বি কামালিহি, কাশাফাদ্দোজা বি জামালিহি
হাসুনাত জামিউ খিসালিহি, সাল্লু আলাইহি ওয়া আলিহি।’
সুউচ্চ শিখরে সমাসীন তিনি নিজ মহিমায়
তিমির-তমসা কাটিল তার রূপের প্রভায়
সুন্দর আর সুন্দর তার স্বভাব চরিত্র তামাম
জানাও তাঁর ও তাঁর বংশের ‘পরে দরূদ সালাম। (অনুবাদ : ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী)
মহান কবি শেখ সাদী এই নাতে যেমন রাসূলে খোদার (স.) ওপর দরূদ ও সালাম পৌঁছে দিয়েছেন, তেমনই তাঁর নিজের ওপরও প্রতিটি মুসলমানের কাছ থেকে প্রতিনিয়ত সালাম বর্ষিত হচ্ছে। হতে থাকবে হয়তো অনন্তকাল।
মানবতাবাদী এই মহান কবি ১২৯২ সালে নিজ জন্মস্থান সিরাজ শহরেই মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু বিশ^ব্যাপী পাঠকের চিত্তে তিনি চির অমর।
*লেখক, গবেষক, সিনিয়র সাংবাদিক

রেডিও তেহরান

 

আইআরআইবি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস, ইরান।

Website: parstoday.com/bnEmail:[email protected] Tel:+98-21-22013764

ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের জাতীয় সম্প্রচার সংস্থার (আইআরআইবি) বিশ্ব কার্যক্রমের অধীনেবাংলা অনুষ্ঠানের সম্প্রচার শুরু হয় ১৯৮২ সালের ১৭ এপ্রিল থেকে। আররেডিও তেহরানের অনলাইন সংস্করণ পার্সটুডে ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে মূলধারার গণমাধ্যম হিসেবে কাজ শুরু করেছে।

 
   

 

 

 

অধিবেশনের শুরুতে বাংলা অনুবাদসহ কুরআন তেলাওয়াত। এরপর বিশ্বের সর্বশেষ খবরাখবর নিয়ে পরিবেশিত হয় বিশ্বসংবাদ। এতে থাকে ঢাকা ও কোলকাতা থেকে প্রতিনিধিদের পাঠানো রিপোর্ট। এরপর সংবাদভাষ্যের অনুষ্ঠান দৃষ্টিপাতে দুটি প্রতিবেদন প্রচার হয়।দৃষ্টিপাতের পর নিচের তালিকা অনুযায়ী অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়।

শনিবার ইরান ভ্রমণ কথা-বার্তা ঐশী দিশারী
রোববার পারস্যের প্রতিভা বিশ্বের গর্ব কথা-বার্তা আসমানি সূরা
সোমবার চিঠিপত্রের আসর প্রিয়জন কথা-বার্তা জীবনশৈলী
মঙ্গলবার দর্পন কথা-বার্তা ইরানি পণ্য-সামগ্রী
বুধবার স্বাস্থ্যকথা কথা-বার্তা কুরআনের আলো
বৃহস্পতিবার রংধনু আসর কথা-বার্তা  
শুক্রবার চিঠিপত্রের আসর প্রিয়জন কথা-বার্তা আলাপন (সাক্ষাৎকার)

* বিশেষ দিবস উপলক্ষে নিয়মিত অনুষ্ঠানের পরিবর্তে বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করা হয়।​

 
   

 

 

 

সান্ধ্য অধিবেশন ৪৯ মিটার ব্যান্ডে ৬১৫০ কিলোহার্টসে (বাংলাদেশ ও ভারতে)
সান্ধ্য অধিবেশন ৩১ মিটার ব্যান্ডে ৯৮৭০ কিলোহার্টসে (সৌদি আরবে)
নৈশ অধিবেশন ৪৯ মিটার ব্যান্ডে ৬১৫০ কিলোহার্টসে (বাংলাদেশ ও ভারতে)

 

 

 

 

 

 

ইউটিসি সময় সান্ধ্য অধিবেশন

 

14:20-15:20

 

নৈশ অধিবেশন 16:20-16:50
বাংলাদেশ সময় সান্ধ্য অধিবেশন

 

20:23-21:23

 

নৈশ অধিবেশন 22:23-22:53
ভারত সময় সান্ধ্য অধিবেশন

 

19:53-20:53 নৈশঅধিবেশন 21:53-22:23
সৌদি আরব সময় সান্ধ্য অধিবেশন 17:23-18:23 পুনঃপ্রচার 03:50-4-50

 

* আমাদের অনুষ্ঠান ইরান স্যাট বা বাদ্‌র-৫ স্যাটেলাইটেও প্রচারিত হয়।

 
   

 

 

 

www.facebook.com/groups/radiotehran www.facebook.com/RadioTehranBN
www.instagram.com/parstodaybangla twitter.com/RadioTehranBN

 

 
   

 

 

 

ভারত বাংলাদেশ ইরান
Bangla Program

Radio Tehran

Post Box no : 4222

New Delhi :110048, India

বাংলা অনুষ্ঠান

রেডিও তেহরান

জি. পি. ও বক্স নম্বর : ৪০০২

ঢাকা- ১০০০, বাংলাদেশ

Bangla Program

Radio Tehran

Post Box No- 6767-19395

Tehran, Iran

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

বুদ্ধিমান বালক

সুজন পারভেজ

এক দরিদ্র ব্যক্তির একটি ছোট ছেলে ছিল। একদিন সে তার ছেলেকে বলল : ‘আজ আমার সাথে এসো, আমরা এক সাথে মানুষের বাগানে গিয়ে ফুল চুরি ও কিছু ফল চুরি করবো।’
অল্প বয়সী ছেলেটি পিতার সাথে যাত্রা শুরু করল। সে জানত যে, এই কাজ সঠিক নয়। কিন্তু সে তার পিতার বিরোধিতা করতে পারল না। যখন ছেলেটি ও তার পিতা গন্তব্যস্থলে পৌঁছল, পিতা তার ছেলেকে বলল : ‘এখানে দাঁড়িয়ে থাক। যদি আশপাশের কেউ আমাদের দূর থেকে দেখে তা হলে আমাকে খবর দেবে।’
ছেলেটি দাঁড়িয়ে ছিল আর তার পিতা গাছ থেকে ফুল তোলায় ব্যস্ত ছিল। কিছু সময় পর ছেলেটি তার পিতাকে বলল : ‘বাবা একজন আমাদেরকে দেখছে!’
তার পিতা এই কথা শুনে ভয় পেল। দ্রুততার সাথে গাছ থেকে নিচে নেমে এল এবং ছেলেকে জিজ্ঞেস করল : ‘ঐ বক্তি কোথায়, যে আমাদের দেখছে ?’
বুদ্ধিমান ছেলেটি বলল : ‘তিনি হলেন খোদা। তিনি সব কিছু দেখেন, সব বিষয়ে অবগত।’
পিতা তার ছেলের গভীর তাৎপর্যপূর্ণ কথা শুনে লজ্জিত হলো। তারপর এ সময় হতে সে আর কখনো চুরি করে নি। কত দ্রুত আমরা বুঝতে সক্ষম হলাম যে, আমাদের এই কাজগুলো কখনো করা উচিত নয়।

ভ্রমণ স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী

বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ যেমন মানসিক শান্তি আনয়ন করে তেমনি শারীরিক ভাবেও মানুষকে সুস্থ রাখে। নিচে ভ্রমণ যে স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী তেমন ৭টি বিষয় তুলে ধরা হলো।
১. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি : ভ্রমণে তুমি বিভিন্ন ধরনের পরিবেশের মুখোমুখি হও যা শক্তিশালী এন্টিবডি তৈরি করে এবং তোমার শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে বহু গুণে বৃদ্ধি করে।
এন্টিবডি হলো ক্ষুদ্র প্রোটিন যা বিভিন্ন ক্ষতিকারক জীবাণু থেকে তোমার রোগ প্রতিরোধকারী ক্ষমতাকে রক্ষা করে। মূলত গবেষণায় এটি প্রমাণিত হয়েছে যে, সামান্য পরিমাণ ময়লা ও ছোটখাটো অসুস্থতা তোমার দেহ ও অন্ত্রকে শক্তিশালী করে। এর অর্থ এই নয় যে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার জন্য যেসকল অবশ্য করণীয় রয়েছে তুমি চলার পথে সেগুলোর চর্চা পরিহার করবে। অবশ্যই যখন তোমার হাত অপরিষ্কার হবে তখন তা ধুতে হবে বা সামান্য পরিমাণ স্যানিটাইজার ব্যবহার করতে হবে। কিন্তু জীবনে নতুন ধরনের ব্যাকটেরিয়া এতটাও মন্দ নয়। একজন ভ্রমণকারী এমনও বলেছেন যে, সতের বছরে ভ্রমণই তার জন্য শ্রেষ্ঠ রোগ প্রতিরোধকারী হয়েছে। যখন এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ভ্রমণ করা হয় তখন তোমার দেহ হাজার হাজার নতুন ব্যাকটেরিয়ার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে শেখে, যা দেহকে আরো সবল হতে সাহায্য করে।
২. মানসিক চাপ হ্রাস পাওয়া : ভ্রমণ প্রচুর পরিমাণে মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে। এটি হয়তো বা তোমার জন্য আশ্চর্যের বিষয় নাও হতে পারে, কিন্তু এটি বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত যে, ভ্রমণের ফলে সুখানুভূতি বৃদ্ধি পায়, উদাসীনতা হ্রাস পায় এবং ভ্রমণ তোমার মানসিক প্রশান্তিকে সর্বোচ্চ স্তরে নিয়ে যায়। একটি গবেষণায় পাওয়া গেছে যে, অবকাশ যাপনের তিন দিন পর ভ্রমণকারীরা পর্যাপ্ত বিশ্রাম, অপেক্ষাকৃত কম উদ্বিগ্ন এবং সুন্দর মেজায অনুভব করে। আর শরীর ও মনের এই উন্নত অবস্থা বাড়িতে ফিরলেই দূর হয়ে যায় না। বাড়িতে ফেরার প্রায় কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত এ অবস্থা বিরাজ করতে পারে।
৩. মানসিক স্বাস্থ্যেরে উন্নতি : ভ্রমণের ফলে মন-মানসিকতা প্রশস্ত হয়। নতুন নতুন ব্যক্তির সঙ্গে পরিচয় লাভের সুযোগ হয়, নতুন পরিস্থিতিতে খাপ খাওয়ানো শেখা যায়। ভ্রমণের মাধ্যমে তুমি বৈশি^ক ও সাংস্কৃতিকভাবে অধিকতর সচেতন হতে পার। এগুলোর সবই তোমার স্বাস্থ্যের জন্য উত্তম। কারণ, নতুন নতুন অভিজ্ঞতা জ্ঞানগত নমনীয়তার সৃষ্টি করে এবং তোমার বুদ্ধিকে তীক্ষè করে তোলে। গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, সৃজনশীলতা বৃদ্ধি, সংস্কৃতি সম্বন্ধে গভীর সচেতনতাবোধ ও ব্যক্তিক বিকাশের সাথে ভ্রমণের সম্পর্ক রয়েছে। ব্যক্তিত্ব ও সামাজিক মনস্তত্ত্ব সম্পর্কিত ম্যাগাজিনের বক্তব্য অনুযায়ী, যারা ভ্রমণ করে এবং বিদেশে লেখাপড়া করে তারা অধিকতর উন্মুক্ত মনা ও মানসিকভাবে স্থিতিশীলতার অধিকারী হয়।
৪. হৃদরোগের আশঙ্কা হ্রাস : ভ্রমণের ফলে হৃদরোগের আশঙ্কা কম হওয়ার কারণ হলো যে সকল ব্যক্তি তাদের বাড়ি থেকে দূরে কিছুদিন অবকাশে কাটায় তারা কম চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন থাকে অথবা নিদেনপক্ষে তাদেরকে যারা চিন্তিত করে তোলে তাদের থেকে দূরে অবস্থান করে। এ কারণে দীর্ঘকাল ধরে চলা ফ্রেমিংহাম হার্ট গবেষণায় এটি দেখা গেছে, যেসকল মহিলা বা পুরুষ বছরে একবার কোথাও ভ্রমণে গিয়েছে তাদের খুবই কম হার্ট অ্যাটাক অথবা হৃদরোগ হয়েছে।
৫. স্বাস্থ্য অটুট রাখা : ভ্রমণ মানেই হলো দীর্ঘ সময় ধরে একটি চলমান যানের ওপর বসে থাকা। কিন্তু এর মাধ্যমে নিজেকে সক্রিয় হতে বাধ্য করারও সুযোগের সৃষ্টি হয়। যখন আমরা ভ্রমণ করি তখন আমরা নতুন কিছু করার চেষ্টা করি এবং সেখানে যা কিছু আছে তার প্রায় সবকিছুই দেখার চেষ্টা করি। সেখানে পৌঁছতে আমরা অর্থ ব্যয় করি। এ কারণে আমরা আরও কঠিন কাজ করি ও বাড়িতে যতটুকু পথ চলি তার থেকে বেশি পথ ঘুরে ঘুরে দেখি বা সবথেকে সুন্দর দৃশ্যটি দেখতে কোনো স্থানে যাই বা উপরে উঠি। এমনকি যদি তুমি সারা দিন সমুদ্র সৈকতে থাকার পরিকল্পনা কর তা হলে বালুর মধ্যে হাঁটতে মাংসপেশীগুলোকে বরাবরের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ শক্তি ব্যবহার করতে হবে। এতে মাংসপেশী আরো শক্তিশালী হয়ে উঠবে।
৬. উপশমকারী স্থান : পৃথিবীতে এমন কিছু স্থান রয়েছে যেগুলোর উপশমকারী গুণ রয়েছেÑ এমন স্থান সম্ভবত তোমার বাড়ির আশেপাশে নেই। কিন্তু তুমি যখন ভ্রমণ কর তখন তুমি এমন উপশমকারী স্থানে যেতে পার যেগুলোতে অন্যরা যায় না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, তুরস্কের গরম ঝরনা, আইসল্যান্ড বা কোস্টারিকাÑ যেগুলো পৃথিবীতে উপশমকারী স্থান নামে পরিচিত। এ স্থানগুলো খনিজ সমৃদ্ধ পানিতে পূর্ণ যা ত্বকের জন্য ভালো, ব্যথা ও চাপ উপশমকারী এবং আয়ুবর্ধক। প্রথমত শক্তি আবর্ত আসলেই বিদ্যমান এবং পবিত্র স্থানসমূহও রয়েছে যেগুলো বায়ু, পানি কিংবা বিদ্যুৎ প্রভৃতি প্রবহমান শক্তির অধিকারী। পৃথিবীতে এমন স্থানসমূহ রয়েছে যেখানে পৃথিবীর শক্তিগুলো মানুষের রোগ নিরাময়, শক্তি বৃদ্ধি ও পুনঃযৌবন দান করতে সক্ষম। প্রসিদ্ধ কয়েকটি স্থানের মধ্যে রয়েছে ইংল্যান্ডের স্টোনহেইঞ্জ বা মিশরের পিরামিড ইত্যাদি। কিছু কিছু উৎস যুক্তরাষ্ট্রেও রয়েছে যার মধ্যে সেডোনা, মাউন্ট ডেজার্ড আইল্যান্ড, মাইন উল্লেখযোগ্য।
৭. ভ্রমণ দীর্ঘায়ু লাভে সহায়ক : এটি সত্য যে, যারা ভ্রমণ করে তারা অন্যদের চেয়ে দীর্ঘায়ু হয়। এই ভ্রমণ হতে পারে দেশের অভ্যন্তরে অথবা দেশের বাইরে অর্থাৎ সকল ধরনের ভ্রমণই আমাদের জীবনকে ছন্দময় করে তোলে এবং আমাদের আয়ু দীর্ঘ হতে সাহায্য করে। গবেষণায় প্রমাণিত হয়ছে যে, ভ্রমণে দুুশ্চিন্তা কমে, ভেতর বাহির উভয় দিক থেকেই শরীরকে স্বাস্থ্যবান রাখে এবং বুদ্ধিবৃত্তিকে উন্নত করে। এর ফলে দীর্ঘ জীবন লাভের সম্ভাবনা বেড়ে যায় এবং এতে জীবন আরো রসময় হয়ে ওঠে।

ধূপওয়ালী

অনুবাদ : কামাল মাহমুদ

সে অনেক দিন আগের কথা। এক নিঃস্ব বৃদ্ধা ছিলেন, যাঁর সম্পত্তির মধ্যে ছিলো ভাঙ্গাচোরা একখানা ঘর। এ ছাড়া তাঁর আর কিছুই ছিলো না। তিনি কোনো প্রকার কাজ জানতেন না। কাজের মধ্যে তিনি প্রতিদিন তাঁর বাড়ির সামনে বসে একটি চুলার মধ্যে আগুন জ¦ালিয়ে তার মধ্যে এসফান্দ (এক প্রকার ফলের বিচি) যা পোড়ালে অনেকটা ধূপের মতো গন্ধ আসতো তা পুড়িয়ে ধোঁয়া তৈরি করতেন আর বারবার বলতে থাকতেনÑ হিংসুকের চোখ যেন ফেটে যায়। ধোঁয়া যেন শত্রুর চোখে গিয়ে ঢোকে। সেখান দিয়ে যে সকল লোক হেঁটে যেতো তারা এই বৃদ্ধাকে কিছু না কিছু টাকা-পয়সা দিতো। এটা দিয়ে তিনি জীবন যাপন করতেন।
পাড়ার লোকেরা ঐ বৃদ্ধা মহিলাকে সব সময় ঐখানেই দেখতো। যখনই কোনো ঠিকানা বলার প্রয়োজন হতো তখনই তাঁর নাম স্মরণ করতো এবং বলতো : ‘ঐ ধূপওয়ালী মহিলার বাড়ির নিকটেই একশ’ কদম সামনে’, ‘দশ কদম পেছনে’ ইত্যাদি। ঐ নিঃস্ব মহিলার বাড়ির কাছেই একজন ধনী লোক বাস করতেন। তিনি প্রতিদিন ঐ ধূপওয়ালী মহিলাকে দেখতেন এবং কখনো কখনো তাঁর বাড়ির লোকেরা ঐ বৃদ্ধা মহিলাকে বিভিন্ন জিনিসপত্র দিয়ে সাহায্য করতেন। কিন্তু একদিন একটি ঘটনা ঘটলো।
ধনী লোকটি বাজার থেকে এক বস্তা পাকা পেস্তা কিনে বাসায় পাঠাতে চাইলেন এবং বাড়ির ঠিকানা দিয়ে দিলেন। কিন্তু কুলি সে ঠিকানা অনুযায়ী চিনতে পারছিলো না। নানাভাবে তাকে বুঝিয়ে দিলেনÑ ‘গলির মাঝামাঝি বাম পাশে, যার দরজা সবুজ রঙের। বাড়ি নম্বর ১৬, অমুকের বাড়ির সামনে। যার দরজার সামনে ইট সিমেন্ট দিয়ে সবুজ রঙের গালিচা আঁকা রয়েছে।’ শেষ পর্যন্ত কুলি বললো : ‘বুঝতে পারছি, এটা তো ঐ দরিদ্র ধূপের ধোঁয়া বিতরণকারী মহিলার বাড়ির কাছেই।’
ধনী লোকটি বললেন : ‘হ্যাঁ ঠিক বলেছো। ঐ জায়গায়ই।’
অতঃপর কুলি চলে গেল এবং তার বোঝা পৌঁছে দিলো। কিন্তু ধনী লোকটি তার এই কথায় অসন্তুষ্ট হলেন। মনে মনে বললেন : ‘মানুষ ঐ ধূপওয়ালী নিঃস্ব মহিলার বাড়ির কাছে হিসেবে আমার বাড়িকে চেনে, এটা ভালো কথা নয়। আমাদের তো সম্মান আছে। আমাদের বাড়ির ঠিকানা দিতে চাইলে ঐ মহিলার বাড়ির কাছে বলে পরিচয় দিতে হয়। এতগুলো দুর্ভাগা মানুষের মধ্যে একজন ধনী মানুষ শান্তিতে বসবাস করতে পারে না। সবাই ভালো না থাকলে (সম্পদশালী না হলে) কেউ একা শান্তিতে থাকতে পারে না। এই প্রতিবেশীর জন্য আমাকে কিছু একটা করতে হবে।’
চিন্তা করে বললেন : ‘ঐ মহিলার বাড়িটা কিনে নেবো। তা হলে এই ধূপওয়ালী মহিলার খপ্পর থেকে গলির লোকদেরকে মুক্ত করতে পারবো।’ রাতে বাড়িতে এক দালালাকে ডেকে এনে তাকে বিষয়টি বললেন। দালাল গিয়ে ঐ বৃদ্ধা মহিলাকে বললো : ‘তোমার বাড়ি কত টাকায় বিক্রি করবে? বিক্রি করলে বলো। আমার হাতে একজন ভালো ক্রেতা আছে।’ বৃদ্ধা বললেন : ‘কখনই বিক্রি করবো না। এই বাড়ি আমার হাসি আনন্দের সাথে জড়িত। এখানে আমার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত থাকবো।’
ধনী লোকটি এ সংবাদ শুনে বুঝতে পারলেন যে, এভাবে হবে না। আবার লোকজন এটাও বলতে পারে যে, অসহায় বৃদ্ধার বাড়ির দিকে এই লোকটির নজর পড়েছে। এটা সম্মানজনক কাজ হবে না। নিজে নিজে বললেন : ‘তাঁকে এ ধোঁয়া তৈরির কাজ থেকে বিরত রাখতে হবে। যদি তিনি আমার কাছে এসে কিছু বলেন তা হলে তাঁর জন্য কিছু করবো। আর যদি তিনি এটা অভ্যাস করে ফেলেন তা হলে অন্য পন্থা অবলম্বন করবো।’ এরপর বৃদ্ধাকে দাওয়াত করে তাঁর বাড়িতে নিয়ে আসলেন। ধনী লোকটি ঐ বৃদ্ধার কুশলাদি জিজ্ঞেস করলেন। বৃদ্ধা মহিলা বললেন : ‘খোদার শোকর। আপনার বাচ্চাদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ যে, তারা মাঝে মধ্যে আমার খোঁজ-খবর নেয়।’ এরপর সেই ধূপের ধোঁয়া বিষয়ে কথাবার্তা শুরু হলো।
ধনী লোকটি জিজ্ঞেস করলেন : ‘আপনি এই যে ধূপের ধোঁয়া দেন, এর উপকারিতা কী?’ বৃদ্ধা বললেন : ‘জনাব! আপনি এমন কথা বলবেন না, এটা অতীত কালের জ্ঞানীরা বলে গেছেন ধূপের ধোঁয়া হলো বদনজরের ঔষধ, আর সকলেই এটা জানে।’
ধনী লোকটি বললেন : ‘বদনজর মানে কী?’ বৃদ্ধা বললেন : ‘বদনজর হলো হিংসুকের দৃষ্টি। কারো কোনো কিছু দেখে হিংসা করে, কারো হাতে ভালো কিছু দেখলে হিংসায় চোখ জ¦লে যায়। ঐ জিনিসের দিকেই তার চোখ গিয়ে পড়ে এবং ঐ জিনিসের ওপর প্রভাব পড়ে, যেটা হিংসুকের চোখে ভালো লাগে, সেটা ধ্বংস হয়ে যায় বা নষ্ট হয়ে যায়।’
ধনী লোকটি একথা শুনে অট্টহাসি দিয়ে বললেন : ‘আজব কথা শুনছি, একজন হিংসুকের দৃষ্টি পড়লেই কোনো জিনিস কিভাবে ধ্বংস হতে পারে? বিষয়টি মোটেই এরকম নয়। দেখুন ইট, বালু, সিমেন্ট দিয়ে একটি ভবন মজবুত করে বানানো হয়। কোনো হিংসুকের বদনজর সেটাকে ধ্বংস করতে পারে না। সেটাকে ধ্বংস করার জন্য গাইতি বা হাতুরি হাতে নিতে হয় বা কামানের সাহায্য নিতে হয়।’
বৃদ্ধা বললেন : ‘না জনাব! বলার উদ্দেশ্য ছিলো যদি কোনো হিংসুকের বদনজর ভবনের ওপরে পড়ে তা হলে কোনো না কোনো ভাবে ওটা মালিকের হাতছাড়া হয়ে যায়।’
ধনী লোকটি বললেন : ‘এ কথাটিও সঠিক নয়। কোনো ভবন তখনই মালিকের হাতছাড়া হতে পারে যখন সে ওটা বিক্রি করার জন্য মনস্থির করে অথবা ভুলক্রমে চরম ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়লে বাধ্য হয়ে বিক্রি করে। এর সাথে হিংসুকের চোখের বদনজরের কোনো সম্পর্ক নেই। যদি হিংসুকের চোখ সত্যি কোনো জিনিসে বদনজর দিয়ে ধ্বংস করতে পারতো তা হলে জগতে কোনো ধনী মানুষ থাকতো না। কেননা, প্রত্যেকই তার চেয়ে তুলনামূলক ধনী ব্যক্তির সম্পদে ঈর্ষান্বিত হতো। তা হলে কেন অসহায়রা হিংসুকের চোখ আর তার বদনজরের চিন্তায় মশগুল থাকবে? আমরা কেন এমন ভাবনায় ডুবে থাকি না?’
বৃদ্ধা বললেন : ‘এটাও আল্লাহর ইচ্ছা। হয় তো ধনীরা এমন কোনো ভালো কাজ করে যাতে তাদের সম্পদে আর বদনজর কোনো কাজে আসে না।’
ধনী লোকটি বললেন : ‘ভালো কাজের মূল্যই অন্যরকম। যে ব্যক্তি সন্তুষ্ট চিত্তে তার কাজ করে, তার কর্তব্য অনুযায়ী সকল কাজ সম্পন্ন করে, ধূপের ধোঁয়া তার কিছুই করতে পারে না। যদি ধূপের ধোঁয়া সমস্যার সমাধান করতে পারতো তাহলে মানুষ কেন ভালো কাজ করতে যাবে? তারা কয়েকটা এসকান্দ বিচি আগুনে পোড়াবে আর নিশ্চিন্তে নাক ডেকে ঘুমাবে। আসলে ধূপের ধোঁয়া ভালো চোখ বা মন্দ চোখ চেনে না। এই ধোঁয়া আপনার নিজের চোখে গেলেও ব্যথা করবে। এখন আপনার কি মনে হয় ধূপের ধোঁয়ার কোনো আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে?’
বৃদ্ধা মহিলা বললেন : ‘কি জানি, হয়তো এমন হতে পারে যে, এর ঘ্রাণ মনোমুগ্ধকর, এজন্য এতে কাজ হয়।’
লোকটি বললেন : ‘এটাও হতে পারে না, ফুলের ঘ্রাণও তো সুন্দর। গোলাপের ঘ্রাণ, আওদ ও চন্দন কাঠের ঘ্রাণও মনোমুগ্ধকর। আর আওদ ও চন্দন কাঠ পোড়ালে অধিক সুঘ্রাণ পাওয়া যায়।’
বৃদ্ধা বললেন : ‘আওদ বা চন্দন কাঠ অনেক দামী আর এসকান্দ তুলনামূলক সস্তা।’
লোকটি বললেন : ‘বেশ তো, আনার, কমলালেবুর খোসাতো আরো সস্তা। এগুলোর ঘ্রাণ তো আরো মুগ্ধকর।’
বৃদ্ধা মহিলা বললেন : ‘আর একটি বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ আর তা হলো এসকান্দ আগুনে শব্দ করে যা হিংসুকের চোখে গিয়ে লাগে।’
লোকটি বললেন : ‘এটাও হতে পারে না। আগুনে লাকড়ি পুড়লে আরো বেশি শব্দ হয়, আগুনে যে কোনো বিচি দিলে এই রকম শব্দ করে। কমলা, বুট, তরমুজ, বাঙ্গি সব বিচিই আগুনে পুড়লে শব্দ হয়। কামান বা বন্দুকের আওয়াজও তো আরো বেশি হয়, এই চড়চড় করার সাথে চোখের কোনো সম্পর্ক নেই, সম্পর্ক কানের সাথে।’
এসব কথা শুনে লোকটির স্ত্রীও বারবার হেসে উঠলো এবং বৃদ্ধা নিজেও হাসলেন।
বৃদ্ধা বললেন : ‘জনাব! আপনার অনেক ধৈর্য ও বুদ্ধিমত্তা অনেক। আমি আসলে জানি না কেন এসকান্দের বিচি (ধূপ জাতীয়) ভালো। অতীতকালের লোকেরা এগুলো এভাবেই জানতো। কিন্তু সবাই এসব বিশ^াস করছে কেন?’
লোকটি বললেন : ‘অতীতকালে লোকেরা অনেক ফালতু কথা বলতো, মানুষ এগুলো বিশ^াস করতো। কারণ, তাদের কাছেও কোনো প্রমাণাদি ছিলো না। অতীতকালের মানুষ রোগ এবং এর নিরাময়ের বিষয়ে নানা ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করতো। এখন সবাই জানে যে, এগুলো ভুল ছিলো। এই এসফান্দ সবই অতীতকাল থেকে এমন প্রসিদ্ধ ছিল যে, এর গন্ধ মশা ও অন্যান্য পোকামাকড় সহ্য করতে পারে না তাই এর ধারে কাছে আসে না। এটি প্রজ¦লন করলে সেখান থেকে পলায়ন করে। আস্তে আস্তে মানুষের মনে এ ধারণা বাড়তে থাকে এবং বদ্ধমূল হয়ে যায়। এরপর এর সাথে আবার নানা বিষয় যুক্ত করে বিশ্বাস করতে শুরু করে।
বৃদ্ধা বললেন : ‘কিন্তু জনাব! যেহেতু আপনি এসব জানেন, আপনাকে আমি একটি কথা বলি, আমি নিজেও এই ধূপের ধোঁয়ায় বিশ^াস করি না। কয়েক বছর আগে আমার স্বামী অসুস্থ হলো, যতই ধূপের ধোঁয়া দিলাম। কোনো কাজে আসলো না। আমি নিজে এই গলিতে ধোঁয়া দিয়ে বেড়াই। অথচ আমিই সবচেয়ে দুর্ভাগা। যদি ধূপের ধোঁয়ায় কাজ হতো তাহলে যারা ধূপের ধোঁয়া দেয় তারা সবার চেয়ে ভালো থাকতো। কিন্তু তা তো নয়। আমি নিজেও জানি এটি এক প্রকার ভিক্ষা করার নামান্তর। কিন্তু কী করবো। মানুষ এটা বিশ^াস করে, যখন বলি ধূপের ধোঁয়া হিংসুকের চোখে জ¦ালা ধরায় আর শত্রুর চোখে গিয়ে লাগে, তখন তারা আমাকে কিছু একটা দেয়। এছাড়া অবশ্য কিছু করারও নেই। আর আমার ছেলেটাও জেলখানায়।’
ধনী লোকটি তাঁর কথায় কিছুটা ব্যথিত হলেন এবং বললেন : ‘আপনি নিজেও জানেন যে, ধূপের ধোঁয়ায় কোনো কাজ হয় না। তা হলে আমি আপনার জন্য কী করতে পারি যাতে আপনি এই ধোঁয়া জ¦ালানো থেকে বিরত থাকবেন? আপনার এই ধোঁয়া আমাদেরকে কষ্ট দেয়। আমি জানি না, আমাদের কোনো প্রতিবেশী আপনার কোনো ক্ষতি করেছে কি না?’
বৃদ্ধা বললেন : ‘না, জনাব! আল্লাহ না করুন আমি আপনার এবং অন্যান্য প্রতিবেশীর সহায়তার জন্য আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞ এবং আপনাদের জন্য আমি আল্লাহর কাছে দোয়া করি। যদি আপনি আমার জন্য কোনো কিছু করে দিতে চান তা হলে আমার ছেলেটাকে জেলখানা থেকে বের করার ব্যবস্থা করুন।’
লোকটি বললেন : ‘আপনার ছেলে এমন কি কাজ করেছে যে তাকে জেলে যেতে হলো?’
বৃদ্ধা বললেন : ‘কিছু না জনাব, সে শুধু আমার সাথে এসকান্দের ধোঁয়া দিত। সে আমার কাছ থেকে এ কাজের তালিম নিচ্ছিলো। সে যখন ছোট ছিলো আমি অলিগলিতে ধোঁয়া দিতাম, সেও আমার সাথে সাথে হাঁটতো এবং এ কাজ শিখতো। যখন সে বড় হয়ে একাজ আরো ভালো ভাবে শিখলো, তখন গত বছর এক কসাইয়ের দোকানের সামনে এসফান্দের ধোঁয়া দিয়ে টাকা চাইলো আর ঐ দোকানদার আপনার মতো এসব কাজে বিশ^াসী ছিলো না। সে আমার ছেলেকে খোঁচা মেরে কথা বলেছিলো। আমার ছেলেও বাজে ভাবে এর জবাব দিয়েছে। এ কারণে ঝগড়া হয়েছে। শেষ পর্যন্ত তাকে মেরে রক্তাক্ত করেছে, জেলে পুরে দিয়েছে। আর এখনও সে জেলখানায় আছে।’
লোকটি বললেন : ‘বলুন, এটাও কি ঐ এসকান্দের ধোঁয়ার ফলাফল। এখন যদি সে জেলখানা থেকে বের হয়, তাহলে একাজ করা হতে বিরত হবেন?’
বৃদ্ধা বললেন : ‘যদি আমার ছেলে ভালো কোনো কাজ পায়, তাহলে কেন একাজ থেকে বিরত হবো না? কেউ কি চায় এই এসকান্দের বিচি পুড়িয়ে জীবন যাপন করতে। এই কাজ করা আর ভিক্ষা করার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। বরং ভিক্ষার চেয়েও জঘন্য, কেননা, এটা তো একপ্রকার প্রতারণাও বটে।’
লোকটি বললেন : ‘বেশ ভালো কথা, আগামীকাল থেকে আপনারা এই ঘরে বসবাস করবেন, যা লাগবে বলবেন। আপনারা আমার প্রতিবেশী, আপনাদের তো আমাদের ওপর হক আছে, আপনার ছেলেকে জেল থেকে বের করার ব্যবস্থা করব। কিন্তু শর্ত হচ্ছে কারো দরজার সামনে যেন ঘুরে ধোঁয়া দিতে না দেখি।’
পরের দিন বৃদ্ধা তাঁর ঘরের দরজা ঠিকঠাক করে নতুন রঙ করালেন এবং বেশ প্রশান্তি লাভ করলেন। ছেলেও জেলখানা থেকে বেরিয়ে আসলো। তার জন্য কাজের ব্যবস্থা করা হলো এবং সম্মানজনকভাবে জীবন যাপন করতে আরম্ভ করলো। কিছু দিন পরে ঐ বৃদ্ধা ঐ দালালের কাছে গিয়ে তাঁর ঘর বিক্রি করার আগ্রহের কথা জানালেন। দালালও তাঁর ঐ প্রতিবেশীকে এই খবর দিল।
প্রতিবেশী লোকটি বৃদ্ধা মহিলাকে বললেন : ‘এখন তো আমি চাই না যে, এরকম একজন ভালো প্রতিবেশী চলে যাক, আপনি কেন এই বাড়ি থেকে চলে যেতে চান?’
বৃদ্ধা বললেন : ‘আমি সব সময় আপনার জন্য দোয়া করি। কেননা, আপনি আমাদের এই এসকান্দের বিচির ধোঁয়া থেকে বাঁচিয়েছেন। এই গলিতে সকলে আমাকে এসকান্দের ধোঁয়াওয়ালী বলে চেনে। আমরা অন্যত্র গিয়ে জীবনযাপন করতে চাই যাতে সম্মানের সাথে জীবন যাপন করতে পারি।’
লোকটি বললেন : ‘বেশ তো, তাহলে আপনি বুঝতে পেরেছেন। আমিও জানি, যদি কেউ তার প্রতিবেশীর সুখের চিন্তা করে তা হলে সেও সুখে থাকতে পারে। আপনি সুবিধা মতো কোনো ঘর খুঁজে পেলে আমাকে বলবেন, তারপর আমি আপনার ঘর কেনার ব্যাপারে কথাবার্তা বলবো।’

শিশু-কিশোরদের প্রতি মহানবী (সা.)-এর আচরণ

মুহাম্মাদ আলী চানারানী

শিশুর যেমন খাবার ও পানির প্রয়োজন রয়েছে তেমনি তার যতœ ও আদরেরও প্রয়োজন রয়েছে এবং তার সাথে ¯েœহ ও ভালোবাসাপূর্ণ আচরণ করা উচিতÑ যা শিশুর মনের জন্য সর্বোত্তম খাবারস্বরূপ। যেসব শিশু শৈশবকাল থেকেই তাদের পিতা-মাতার নিকট হতে পর্যাপ্ত পরিমাণে ভালোবাসা পেয়েছে তারা সাধারণত হাসি-খুশি স্বভাবের হয়ে থাকে। আমাদের ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের অনেক বক্তব্যে শিশুদের প্রতি ¯েœহ ও ভালোবাসার দিকটি আলোচিত হয়েছে এবং বিভিন্নভাবে তাদেরকে ¯েœহের উপদেশও দেওয়া হয়েছে। এখানে তার মধ্য থেকে কয়েকটি উল্লেখ করা হলো :
‘খুতবায়ে শা’বানীয়া’ নামে প্রসিদ্ধ বক্তব্যে মহানবী (সা.) যখন বিভিন্ন দায়িত্ব সম্পর্কে সাহাবীদেরকে দিকনির্দেশনা দিচ্ছিলেন সেখানে তিনি উপদেশ দেন : ‘তোমরা বয়োজ্যেষ্ঠদের সম্মান কর এবং ছোটদের প্রতি দয়াশীল হও।’ উয়ুনু আখবারির রিযা, ১ম খ-, পৃ. ২৯৫
মহানবী (সা.) অন্যত্র বলেন : ‘যে শিশুদের প্রতি ¯েœহ করে না এবং বড়দের সম্মান করে না সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়।’ আল মুহাজ্জাতুল বাইদা, ৩য় খ-, পৃ. ৩৬৫
শিশুদের প্রতি মহানবী (সা.)-এর ভালোবাসা
হযরত আলী (আ.) বলেন : ‘যখন আমি শিশু ছিলাম তখন মহানবী (সা.) আমাকে তাঁর কোলে বসাতেন, বুকে জড়িয়ে ধরতেন এবং কখনও কখনও তাঁর বিছানায় ঘুম পাড়িয়ে দিতেন। তিনি পরম মমতায় তাঁর মুখম-ল আমার মুখের ওপর রাখতেন এবং তাঁর শরীরের সুঘ্রাণ নেওয়াতেন।’ নাহজুল বালাগা
যখন মহানবী (সা.) আনসার সাহাবীদের শিশুদেরকে দেখতেন তখন তাদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন, তাদেরকে সালাম দিতেন এবং তাদের জন্য দোয়া করতেন। আনাস ইবনে মালিক বলেন : ‘আমি মহানবী (সা.) ছাড়া আর কাউকে নিজ পরিবারের প্রতি এত বেশি দয়াশীল দেখি নি। সীরাতুন নাবাবীয়্যাহ, ইবনে কাসীর, ৪র্থ খ-, পৃ. ৬১২
প্রতিদিন তিনি তাঁর সন্তান-সন্ততি ও নাতি-নাতনিদের মাথায় চুম্বন করতেন। বিহারুল আনওয়ার, ১০৪তম খ-, পৃ. ৯৯
ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইনের প্রতি মহানবী (সা.)-এর ভালোবাসা
ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইনের প্রতি মহানবীর গভীর ও ভীষণ ভালোবাসা ছিল। আনাস ইবনে মালিক বর্ণনা করেন : ‘মহানবী (সা.)-কে জিজ্ঞেস করা হলো : ‘আপনার পরিবারের মধ্য থেকে কোন্ ব্যক্তিকে আপনি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন।’ মহানবী জবাব দেন : ‘আমি হাসান ও হুসাইনকে অন্যদের চেয়ে বেশি ভালোবাসি।’ ইহকাকুল হক, ১০ম খ-, পৃ. ৫৯৫
ইমাম হাসান (আ.) বলেন : “মহানবী (সা.) আমাকে বলেন : ‘হে আমার সন্তান! তুমি আমার শরীরের অংশসদৃশ; তাদের ভালো হোক যারা তোমাকে এবং তোমার সন্তানদেরকে ভালোবাসবে এবং তাদের জন্য আফসোস যারা তোমাকে হত্যা করবে।’” ইহকাকুল হাক এর পরিশিষ্ট, ১১তম খ-, পৃ. ৩১১-৩১৪
ইমাম হুসাইনের প্রতি মহানবীর ভালোবাসা এত বেশি ছিল যে, তিনি তাঁর ক্রন্দন সহ্য করতে পারতেন না।
ইয়াযীদ বিন আবি যিয়াদ বলেন : ‘মহানবী (সা.) হযরত আয়েশার ঘর থেকে বের হয়ে হযরত ফাতিমার ঘর অতিক্রম করছিলেন। তিনি হুসাইনের ক্রন্দনধ্বনি শুনলেন এবং ফাতিমাকে বললেন : ‘তুমি কি জান না, হুসাইনের ক্রন্দন আমাকে ব্যথিত করে?’ ইহকাকুল হাক এর পরিশিষ্ট, ১১তম খ-, পৃ. ৩১১-৩১৪
শিশুদেরকে সহ্য করা
হযরত আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিবের স্ত্রী উম্মে ফযল বলেন : “যখন ইমাম হুসাইন একজন দুগ্ধপোষ্য শিশু তখন একদিন মহানবী (সা.) তাকে আমার কাছ থেকে নিয়ে কোলে নেন এবং তাকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। ইমাম হুসাইন তাঁর কোলে প্র¯্রাব করে দিলে আমি তাকে মহানবীর কোল থেকে দ্রুত নিয়ে নিলাম আর সে ক্রন্দন করা শুরু করল। মহানবী আমাকে বললেন : ‘তাড়াহুড়া করো না। আমার কাপড় তো পানি দিয়ে পরিষ্কার করা যাবে, কিন্তু আমার সন্তান হুসাইনের মন থেকে এই ব্যথার স্মৃতি কী করে দূর হবে?’”
শহীদদের শিশুদের সাথে মহানবীর আচরণ
বাশীর বিন আকরিয়া বিন যাহনী বলেন : “উহুদের যুদ্ধের দিন আমি মহানবীকে জিজ্ঞেস করলাম, আমার পিতা কীভাবে শহীদ হয়েছেন?’ মহানবী (সা.) বললেন : ‘সে আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হয়েছে। তার ওপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক!’ তখন আমি কেঁদে ফেললাম। মহানবী (সা.) আমাকে জড়িয়ে ধরলেন, আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন এবং আমাকে তাঁর ঘোড়ার ওপর বসিয়ে বললেন : ‘তুমি কি আমাকে তোমার পিতার মতো হওয়া পছন্দ করো না?’ মাজমাউল জাওয়ায়েদ, ৮ম খ-, পৃ. ১৬১
ইবনে হিশাম লিখেছেন : আবুদল্লাহ ইবনে জাফরের স্ত্রী আসমা বিনতে উমাইস বলেন : “যেদিন মুতার যুদ্ধে জাফর শহীদ হন, সেদিন মহানবী (সা.) আমাদের বাড়িতে আসেন। আমি সবেমাত্র ঘরের কাজগুলো শেষ করে ছেলেমেয়েদেরকে পরিপাটি করছিলাম। মহানবী (সা.) আমাকে বললেন : ‘জাফরের সন্তানদেরকে আমার কাছে নিয়ে আস।’ আমি সন্তানদেরকে তাঁর কাছে নিয়ে আসলাম। তিনি তাদেরকে বুকে টেনে নিলেন এবং আদর করতে থাকলেন, তখন তাঁর চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরছিল।”
“আমি জিজ্ঞেস করলাম : ‘হে নবী! আপনি কাঁদছেন কেন? জাফর ও তাঁর সঙ্গী-সাথিদের কোনো খবর এসেছে কি?’ তখন মহানবী বললেন : ‘তারা আজকে শহীদ হয়েছে।’” সিরাতে ইবনে হিশাম, ২য় খ-, পৃ. ২৫২
অন্য শিশুরাও মহানবীর এমন দয়া ও পিতৃসুলভ ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত ছিল না। বর্ণিত হয়েছে যে, মহানবী (সা.) শিশুদেরকে জড়িয়ে ধরতেন এবং কাউকে কাউকে তাঁর ঘাড়ে ও পিঠে উঠাতেন। তিনি তাঁর সাথিদের বলতেন, শিশুদেরকে জড়িয়ে ধর এবং তাদেরকে তোমাদের কাঁধে নাও। শিশুরা তাঁর এমন আচরণকে খুবই পছন্দ করত, এতে তারা অপরিসীম আনন্দ পেত এবং কখনই এরকম মধুর মুহূর্তগুলোকে ভুলে যেত না। পরবর্তী কালে কেউ কেউ গর্ব করে বলতেন : ‘মহানবী (সা.) আমাকে তাঁর পিঠে নিয়েছেন।’ আবার কেউ বলতেন : ‘মহানবী (সা.) তাঁর সাহাবীকে নির্দেশ দিয়েছিলেন তোমাকে পিঠে নেয়ার জন্য।’ আল মাহাজ্জাতুল বাইদা, ৩য় খ-, পৃ. ৩৬৬
মহানবী (সা.) নিজেও শিশুদের চুমু দিতেন।
মহানবী (সা.) বলেন : ‘যে কেউ তার সন্তানকে চুমু দেয় সে একটি সৎকর্ম সম্পাদন করে এবং যে কেউ তার সন্তানকে খুশি করে আল্লাহ পুনরুত্থান দিবসে তাকে খুশি করবেন।’ মাকারিমুল আখলাক, পৃ. ১১৩
হযরত আয়েশা বলেন : “এক ব্যক্তি মহানবী (সা.)-এর নিকট আসলেন এবং বললেন : ‘আপনি কি শিশুদেরকে চুম্বন করেন? আমি কখনও তা করি নি।’ মহানবী (সা.) জবাব দিলেন : ‘যখন আল্লাহ তোমার হৃদয় থেকে তাঁর মায়া-মমতা উঠিয়ে নিয়েছেন তখন আমি কী করতে পারি?” সহীহ বুখারী, ৮ম খ-, পৃ. ৯
ইবনে আব্বাস বলেন : ‘আমি মহানবী (সা.)-এর সাথে ছিলাম। তাঁর পুত্রসন্তান ইবরাহীম তাঁর বাম ঊরু এবং ইমাম হুসাইন ডান ঊরুর ওপর ছিলেন। মহানবী (সা.) কোনো সময় ইবরাহীমকে আবার কোনো সময় হুসাইনকে চুম্বন করছিলেন।’ মানাকিবে ইবনে শাহর আ’শুব, ৩য় খ-, পৃ. ২৩৪
শিশুদের ক্ষেত্রে ন্যায়পরায়ণতা
হযরত আবু সাঈদ খুদরী বলেন : ‘একদিন মহানবী (সা.) তাঁর কন্যার বাড়িতে গেলেন। আলী (আ.) বিছানায় ঘুমাচ্ছিলেন এবং তাঁর সন্তানদ্বয় হাসান এবং হুসাইন তাঁর পাশে ছিল। তারা পানি চাইল। মহানবী (সা.) তাদের জন্য পানি আনলেন। হুসাইন প্রথমে সামনে এলো। মহানবী (সা.) বললেন : “হাসান প্রথমে পানি চেয়েছিল।’ হযরত ফাতিমা (আ.) জিজ্ঞেস করলেন : ‘আপনি কি হাসানকে বেশি ভালোবাসেন?’ মহানবী (সা.) জবাব দিলেন : ‘দুজনই আমার নিকট সমান। [কিন্তু ন্যায়পরায়ণতা এটাই দাবি করে যে, প্রত্যেকে পর্যায়ক্রমে পানি পান করবে।]’” মাজমাউল জাওয়ায়েদ, ৯ম খ-, পৃ. ১৭১
শিশুদের খেলাধুলা করার প্রবণতা
মহানবী (সা.) বলেন : ‘এমন ব্যক্তি যার সাথে একটি সন্তান আছে তার সাথে শিশুর মতো আচরণ করো।’ কানযুল উম্মাল, বক্তব্য ৪৫৪১৩
মহানবী (সা.) আরো বলেন : ‘সেই পিতার ওপর আল্লাহর কৃপা বর্ষিত হোক যে উত্তম নিয়্যতে তার সন্তানকে সাহায্য করে, তার সাথে সদাচরণ করে, তার বন্ধু এবং তাকে ভালোভাবে শিক্ষিত করে।’ মুসতাদরাকুল ওয়াসায়েল, ২য় খ-, পৃ. ৬২৬
শিশুদের সাথে মহানবী (সা.)-এর খেলা করা
মহানবী (সা.) ইমাম হাসান ও হুসাইনের সাথে খেলা করেছেন।
ইয়ালা বিন মুররা বলেন : “মহানবী (সা.) দুপুরের খাওয়ার জন্য নিমন্ত্রিত হয়েছিলেন। আমরা তাঁর সাথে ছিলাম, হঠাৎ আমরা হাসানকে গলিপথে খেলতে দেখলাম। মহানবী (সা.) তাকে দেখলেন এবং তাকে ধরার জন্য দুই হাত প্রসারিত করে দৌড়ে গেলেন। হাসান তার থেকে পালানোর জন্য এদিক-ওদিক দৌড়াতে লাগল যা মহানবীর হাসির উদ্রেক করল। মহানবী (সা.) হাসানকে ধরে ফেললেন। তিনি তার একটি হাত তার চিবুকের নিচে এবং অন্য হাত তার মাথার ওপর রাখলেন। তিনি তাঁর মুখ শিশুটির কাছে নিলেন এবং তাকে এই বলে চুম্বন করলেন : ‘হাসান আমার একটি অংশ এবং আমি তার অংশ। যারা তাকে ভালোবাসে আল্লাহ তাদেরকে ভালোবাসবেন।’ বিহারুল আনওয়ার, ৪৩তম খ-, প.ৃ ৩০৬
অনেক বর্ণনায় এসেছে যে, এটি ইমাম হুসাইনের সাথে সম্পর্কিত একটি ঘটনা (অর্থাৎ ইমাম হাসানের সাথে সম্পর্কিত নয়)। সহীহ তিরমিযী, ৫ম খ-, পৃ. ৬১৫
একটি বর্ণনায় এসেছে যে, মহানবী (সা.) আব্বাসের সন্তানদেরকে ডাকতেন। তারা ছোট ছিল এবং খেলাধুলা করতে ভালোবাসত। তিনি তাদেরকে বলতেন : ‘যে আমার কাছে সবচেয়ে দ্রুত আসতে পারবে সে পুরস্কৃত হবে।’
শিশুদের খাওয়ানো
সালমান ফারসি বলেন : “আমি মহানবীর গৃহে প্রবেশ করলাম। হাসান ও হুসাইন তাঁর সাথে খাবার খাচ্ছিল। মহানবী (সা.) কিছু খাবার হাসানের মুখে দিচ্ছিলেন এবং কিছু খাবার হুসাইনের মুখে দিচ্ছিলেন। যখন তাঁরা খাওয়া শেষ করলেন তখন মহানবী হাসানকে তাঁর কাঁধে নিলেন এবং হুসাইনকে তাঁর কোলে বসালেন। এরপর তিনি আমার দিকে মুখ করলেন এবং বললেন : ‘হে সালমান! তুমি কি তাদেরকে পছন্দ কর?’ আমি বললাম : ‘হে নবী! কীভাবে আমি তাদেরকে পছন্দ করব না যখন আমি আপনার নিকট তাদের অবস্থান ও মর্যাদা প্রত্যক্ষ করি।’” বিহারুল আনওয়ার, ৩৬তম খ-, পৃ. ৩০৪
শিশুদেরকে সালাম দেয়া
মহানবী (সা.)-এর আরেকটি অভ্যাস ছিল শিশুদেরকে সালাম দেয়া।
হযরত আনাস ইবনে মালিক বলেন : ‘মহানবী (সা.) কয়েকটি শিশুর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তাদেরকে সালাম দিলেন এবং তাদেরকে খাবার দিলেন।’ সুনানে ইবনে মাজাহ, ২য় খ-, পৃ. ২২২০
ইমাম বাকির (আ.) বলেন : “মহানবী (সা.) বলেছেন : ‘মৃত্যু পর্যন্ত আমি পাঁচটি জিনিস পরিত্যাগ করব না। এগুলোর অন্যতম হলো শিশুদেরকে সালাম দেয়া।’ উয়ুনু আখবারির রিযা (আ.), পৃ. ২৩৫
আরেকটি বর্ণনায় এসেছে যে, মহানবী (সা.) ছোট-বড় সকলকে সালাম দিতেন। মুসতাদরাকুল ওয়াসায়েল, ২য় খ-, পৃ. ৬৯ তিনিই প্রথমে অন্যদেরকে সালাম দিতেন, এমনকি শিশুদেরকেও। রাহমাতে আলামীন, পৃ. ৬৬৩
তিনি যাকেই দেখতেন, তাকেই প্রথমে সালাম করতেন এবং মুসাফাহা করতেন।’ মাকারিমুল আখলাক, ১ম খ-, পৃ. ২৩
সংকলন ও অনুবাদ : সরকার ওয়াসি আহমেদ