All posts by dreamboy

বিশ্ব পরিস্থিতিতে এবারের আল-কুদস দিবসের আহ্বান

 

রাশিদুল ইসলাম

পবিত্র মাহে রমজানে এবার শুধু মুসলমান নয়, বরং সারাবিশে^র মানুষকে করোনাভাইরাস মহামারির কারণে সামাজিক ও শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হচ্ছে। এহেন পরিস্থিতিতেও ফিলিস্তিনে ইসরাইলি আগ্রাসন থেমে নেই। সিরিয়াতে ইসরাইলি বোমারু বিমান হামলা চলছেই।
রমজানের শেষ শুক্রবার যথারীতি মুসলিম বিশ্বে পালিত হবে আন্তর্জাতিক আল-কুদস দিবস। দীর্ঘ দিন ধরে ইহুদিবাদী ইসরাইলের দখলে থাকা মুসলমানদের প্রথম কিবলা বায়তুল মোকাদ্দাস পুনরুদ্ধারের দাবিতে প্রতি বছর রমজানের শেষ শুক্রবার বিশ্বব্যাপী পালিত হয় দিনটি। ১৯৭৯ সালে ইরানে সংঘটিত সফল ইসলামি বিপ্লবের পর মহান নেতা ইমাম খোমেইনী (রহ.) পবিত্র রমজান মাসের শেষ শুক্রবারকে কুদস দিবস ঘোষণা করেন। সেই থেকে ইরানসহ বিশ্বের বহু দেশে কুদস দিবস পালিত হয়ে আসছে এবং দিন দিন কুদস পালনকারী দেশের সংখ্যা বাড়ছে।
এবার এমন এক সময় দিবসটি পালিত হতে যাচ্ছে যখন ইসরাইল জর্ডান নদীর পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনি অঞ্চলগুলোকে গ্রাস করার জন্য অগ্রসর হওয়ার ফন্দি আঁটছে। ইতিমধ্যে সিরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এর নিন্দা জানিয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ মুসলিম দেশ এব্যাপারে নিশ্চুপ অথবা কার্যকর কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারছে না। আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে ইসরাইল এ আগ্রাসন শুরু করতে যাচ্ছে যা ফিলিস্তিনির সঙ্গে চুক্তিরও বরখেলাপ। জেরুসালেম ও সিরিয়ার গোলান মালভূমি নিয়ে যে সমঝোতা রয়েছে তাকে কোনো পাত্তাই দিচ্ছে না ইসরাইল। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রশাসনের তথাকথিত ‘দি ডিল অব দি সেঞ্চুরি’ ফিলিস্তিনিদের আইনগত কোনো অধিকার রক্ষা করতে কাজে আসছে না।
গত ২০ এপ্রিল ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও তাঁর প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বেন্নি গান্তজ ঐক্যমতের সরকার গঠন করতে চুক্তি করেন। এখন ট্রাম্পের ‘ডিল অব দি সেঞ্চুরি’র আলোকেই বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ফিলিস্তিনি ভূমিতে আগ্রাসন চালাতে অগ্রসর হচ্ছেন। ১৭৬৭ সালে ইসরাইল পশ্চিম তীর দখল করে নেয়ার পর তা ফেরত দেয়ার দাবি জানিয়ে আসছে ফিলিস্তিন। ট্রাম্পের নতুন মধ্যপ্রাচ্য শান্তি পরিকল্পনায় পশ্চিম তীরে ইসরাইলের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা এবং জেরুসালেমকে তার অবিভক্ত রাজধানী হিসেবে রেখে একটি নতজানু ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের আহ্বান জানানো হয়েছে। ট্রাম্পের এ পরিকল্পনা ফিলিস্তিনে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। পশ্চিম তীর নিয়ে দীর্ঘস্থায়ী বিরোধ নিস্পত্তির জন্য মুসলিম দেশগুলো এগিয়ে আসতে ব্যর্থ হয় বরং ট্রাম্পের তথাকথিত ডিল অব দি সেঞ্চুরি মেনে নেয়ার জন্য কোনো কোনো দেশ সরাসরি ফিলিস্তিনের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। এতে সায় দিয়ে নিশ্চুপ বসে থাকে মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী দেশগুলো। ওআইসির এতে কার্যকর কোনো ভূমিকা নেই।
এবারের আল-কুদস দিবসে এসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে। প্রতিরোধ গড়ে তোলার পূর্বশর্ত হিসেবে ঐক্য গড়ে তোলার তাগিদ দিচ্ছে। এরই মধ্যে জার্মানিতে হিজবুল্লাহ আন্দোলনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ফিলিস্তিনিদের পক্ষে হাতে গোনা যে কয়েকটি দেশ বা গোষ্ঠী সোচ্চার হয়ে আছে তার মধ্যে ইরান ও হিজবুল্লাহ অন্যতম প্রধান মিত্র হিসেবে কাজ করছে। তেহরান জার্মানির এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়েছে।
আল-কুদস দিবসে আমাদের ভাবনায় আন্তর্জাতিক ইস্যুগুলোর বিচার বিশ্লেষণ জরুরি। রমজানে যেমন দৈহিক ও আত্মিক সংযমের মধ্য দিয়ে আত্মশুদ্ধির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার সুযোগ আসে তেমনি জাগতিক ও আধ্যাত্মিক যাবতীয় কল্যাণকর্মে সাফল্যের সোপানে সহজে আরোহণ করা সম্ভব তখনি হবে যখন পরিবর্তিত বিশ^পরিস্থিতি নিয়েও আমাদের সম্যক ধারণা থাকবে। তা না হলে মুসলমানদের আর্থ-সামাজিক অবস্থান, অর্থনৈতিক মুক্তি ও রাজনৈতিক দিকনির্দেশনা জানা সম্ভব হবে না। আল-কুদস দিবস সেই ডাকই দিয়ে যায় যাতে আমরা অনুধাবন করতে পারি, মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে কেন এবং কিভাবে পরাশক্তিগুলো বিভেদ জিইরে রাখে এবং সেই চক্রান্তের জালে বিভ্রান্ত হয়ে আমরা কিভাবে বছরে পর বছর জুড়ে আঞ্চলিক, আন্তর্জাতিকভাবে মার খেতে থাকি!
মুসলমানদের মার খাওয়ার একটি বড় কারণ যে অনৈক্য, তা সবার জানা। কিন্তু এই অনৈক্য কিভাবে লজ্জাজনকভাবে বহিঃপ্রকাশ ঘটায় তাও জানা প্রয়োজন। হিজবুল্লাহকে সন্ত্রাসী সংগঠন ঘোষণা করায় জার্মানিকে স্বাগত জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু কোনো মুসলিম দেশ একই ভূমিকা পালন করছে। অথচ ইয়েমেনে বছরের পর বছর আগ্রাসন চলছে এবং পশ্চিমা দেশগুলো এ আগ্রাসনে অস্ত্র সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। এর চেয়ে বড় সন্ত্রাস আর কী হতে পারে? এই সন্ত্রাসের শিকার হতে হচ্ছে ইয়েমেনের নিরস্ত্র জনতাকে। দুর্ভিক্ষ চলছে দেশটিতে। অনাহারে অপুষ্টিতে নারী ও শিশু মারা যাচ্ছে। এধরনের সন্ত্রাস সম্ভব হচ্ছে কোনো মুসলিম দেশগুলোর সহায়তায় যা পশ্চিমা রাষ্ট্র ও ইসরাইল সিরিয়া, লিবিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান সহ বিভিন্ন দেশে অব্যাহত রেখেছে। এবং তা হচ্ছে সন্ত্রাস দমনের নামেই। আল-কুদস দিবসের অন্যতম আহ্বান হচ্ছে এসব বিভ্রান্তির জাল ছিন্ন করে মুসলমানদের বিরদ্ধে ষড়যন্ত্র সম্পর্কে অবহিত হওয়া এবং তাহলেই ফিলিস্তিনিদের পাশে মুসলিম বিশ^ একাট্টা হয়ে দাঁড়াতে পারবে এবং বায়তুল মোকাদ্দাসকে মুক্ত করার সত্যিকার লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করা সম্ভব হবে।
মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী একটি দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে হিজবুল্লাহ’র ব্যাপারে জার্মানির সর্বশেষ নেওয়া সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আন্তরিকভাবে স্বাগত জানিয়েছে। এও বলেছে, বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় এই প্রচেষ্টাকে এগিয়ে নিতে তারা তাদের সাহায্যে এগিয়ে যাবে। অথচ হিজবুল্লাহ বিশে^র কোথাও কোনো সন্ত্রাসী কর্মকা-ের সঙ্গে জড়িত তার কোনো প্রমাণ আন্তর্জাতিক বিশ^ দিতে পারেনি। ফিলিস্তিনিদের পাশে, গাজায় অবরুদ্ধ ফিলিস্তিনিদের সাহায্য করছে হিজবুল্লাহ তার সাধ্যমত। এটি সন্ত্রাসের সংজ্ঞায় পড়ে কিভাবে? দেশটি বিশ্বব্যাপী শান্তি ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সন্ত্রাসী ও তাদের সমর্থকদের বিরুদ্ধে কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার বলেও মন্তব্য করছে। অথচ ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু জর্দানের পশ্চিম তীরে আগ্রাসনে যে অগ্রসর হচ্ছেন তার বিরুদ্ধে কোনো কথা বলছে না কেন প্রভাবশালী দেশগুলো।
উল্টো বরং দেশটি রীতিমত ইসরাইলের সাংস্কৃতিক সেবায় নেমেছে। ফিলিস্তিনের ভূমি দখলদার ও বর্ণবাদী ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রক্রিয়াকে এবার সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও টেনে এনেছে তারা। প্রভাবশালী মুসলিম দেশগুলোর প্রখ্যাত আলেম ওলামাদের মতামত গ্রহণ না করে গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকবার ইসরাইলের পক্ষে বক্তব্য রেখে ও ইহুদি ধর্ম আর ইসরাইলকে একই অর্থবোধকরূপে দেখিয়ে ভূমিকার প্রতিবাদে আলেম ওলামাদের জেল খাটতে হচ্ছে এমন নজীরও রয়েছে। ইসরাইলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ানোর প্রক্রিয়ায় এবার ‘উম্মে হারুন’ বা ’হারুনের মা’ নামে একটি টেলিভিশন সিরিয়াল সম্প্রচার শুরু হয়েছে।
এই সিরিয়ালে গত শতকের চল্লিশের দশকে কুয়েতের কোনো কোনো ইহুদির ওপর কোনো কোনো মুসলমানের নির্যাতনের কথিত কাহিনী প্রচার করে পরোক্ষভাবে ফিলিস্তিনে ইসরাইলি দখলদারিত্বকে বৈধতা দেয়ার এবং ফিলিস্তিনিদের ওপর গণহত্যা ও তাদেরকে বিতাড়নের অপরাধগুলোকে ধামাচাপা দেয়ার পরিবেশ সৃষ্টির চেষ্টা চলছে। এ ছাড়াও ইসরাইলের অবৈধ অস্তিত্বকে বৈধ ও বাস্তব হিসেবে তুলে ধরা এবং ফিলিস্তিনি জাতির অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সন্দেহ ও দ্বিধা-দ্বন্দ্ব সৃষ্টির উদ্দেশ্যে প্রচার করা হচ্ছে কমেডি সিরিজ ‘মাখরাজ-সাত’। এ দুই সিরিজেই ফিলিস্তিনিদের ত্যাগ ও কুরবানিকে পদদলিত করা হয়েছে।
পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, পবিত্র রমজান মাসে এসব সিরিয়াল সম্প্রচার শুরু হয়েছেÑ যে রমজানের শেষ শুক্রবারকে পালন করা হয় মুসলমানদের প্রথম কিবলাকে ইসরাইলি দখল থেকে মুক্ত করার জন্য বিশ্ব কুদস দিবস হিসেবে। এ দিবসে ইসরাইলি অপরাধযজ্ঞের বিরুদ্ধেও বৈশ্বিক গণ-বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করা হয়। এখানে আল-কুদস দিবস পালনের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব নিহিত রয়েছে। কারণ, নেতানিয়াহুসহ সন্ত্রাসী কোনো কোনো ইসরাইলি নেতা দাবি করেন যে আরব বিশ্বের জনগণকে ইসরাইলের বিরুদ্ধে বহু বছর ধরে বিদ্বেষমূলক নানা প্রচারণার মাধ্যমে ক্ষেপিয়ে রাখা হয়েছে যা আরব-ইসরাইল শান্তি প্রতিষ্ঠার পথে প্রধান বাধা! তাহলে ইসরাইলি সেনাদের গুলিতে ফিলিস্তিনি শিশু হত্যা কি বন্ধ রয়েছে? ইসরাইলি কারাগারগুলোতে বিনা বিচারে আটক হাজার হাজার ফিলিস্তিনিকে কেনো মুক্তি দেয়া হচ্ছে না সে নিয়ে কি কোনো দেশ ধারাবাহিক টেলিভিশন অনুষ্ঠান বা প্রামাণ্য চিত্র তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে?
বরং ইতিহাস বিকৃত করে ও জনগণের তেল-বিক্রির অর্থ খরচ করে ইসরাইলের নেতানিয়াহুদের পক্ষ নিয়ে সাংস্কৃতিক প্রচারণা মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। মন থেকে না চাইলেও অনেক দেশ ইসরাইল ও মার্কিন সরকারের সেবাদাসত্বে নিয়োজিত। আল-কুদস দিবসের আহ্বান হচ্ছে মুসলমানদের এধরনের সেবাদাসত্ব থেকে বের হয়ে আসতে প্রয়োজনীয় বুদ্ধিবৃত্তিক প্রস্তুতি নিতে হবে।
এরপরও বলছি পরিস্থিতি পাল্টে যেতে শুরু হচ্ছে। করোনাভাইরাসের কারণেই মার্কিন অর্থনীতির বেহাল দশা প্রকাশ হয়ে পড়েছে। তারা বিভিন্ন দেশ থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করে নিতে শুরু করেছে। মার্কিন সরকারের দেনা পৌঁছে গেছে ২৫ ট্রিলিয়ন ডলার। বেকারত্ব গিয়ে ঠেকেছে গত মার্চ পর্যন্ত সাড়ে তেত্রিশ মিলিয়নে। সিএনএন বলছে, এপ্রিল মাসে বেকারের সংখ্যা আরো বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০.৫ মিলিয়নে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ১৪.৭ শতাংশ মানুষ বেকার। মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষ বেকার ভাতার জন্য আবেদন করেছে। এদের সংখ্যা আরো বাড়বে। এই যুক্তরাষ্ট্রই ইরান, ভেনিজুয়েলা সহ বিশে^র যেসব দেশ মাথা তুলে স্বাধীনভাবে চলতে চেয়েছে তাদের ওপর দশকের পর দশক ধরে অন্যায়ভাবে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে অর্থনৈতিক অবরোধ আর নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রেখেছে। তেল রফতানিতে বাধ সেধেছে। আর আজ সেই তেলের দর পড়ে গিয়েছে প্রায় শূন্যের অঙ্কে। বিশে^র সবচেয়ে বড় উড়োজাহাজ তৈরি প্রতিষ্ঠান বোয়িং ইরানের সঙ্গে চুক্তি করেছিল শতাধিক বিমান সরবরাহের। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসন তা হতে দেয়নি। আজ সেই বোয়িং লে-অফে মালিকানা হারিয়েছে ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে যেয়ে। এসব অর্থনৈতিক বিষয় আল-কুদস দিবসে নানা আনুষ্ঠানিকতার পাশাপাশি বিবেচনার দাবি রাখে।
একই সঙ্গে ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখি আরব সরকারগুলো রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ইহুদিবাদী ইসরাইলের সঙ্গে গোপনে সহযোগিতা করে এসেছে। একদিকে সস্তায় তেলসম্পদ কিনের নেয়ার নামে লুটপাট অন্যদিকে ট্রিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রি করে পরাশক্তি দেশগুলো মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ জিইয়ে রেখেছে। ১৯৯০-র দশকে ওমান ও কাতারে খোলা হয় ইসরাইলি বাণিজ্য দপ্তর। আরও আগে ইহুদিবাদী ইসরাইলের সঙ্গে প্রকাশ্যে নতজানুমূলক রাজনৈতিক আপোষ-চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল মিশর ও জর্দান। আর আরব বিশ্বের বাইরেও কোনো মুসলিম দেশের সঙ্গেও ইহুদিবাদী ইসরাইলের প্রায় সব ধরনের সহযোগিতার সম্পর্ক ছিল ও তা এখনও বজায় রয়েছে। গত কয়েক বছর ধরে অনেক প্রভাশালী মুসলিম দেশে একাধিক ইসরাইলি শীর্ষ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তারা সফর করেছেন। ইসরাইলি মিডিয়াগুলোতে তা বড় বড় হেডলাইনে সংবাদ হিসেবে প্রচার পেয়েছে। নিশ্চুপ আর অসহায় হয়ে কোনো মুসলিম দেশের নেতারা মরুভূমিতে উটপাখির মতো মুখ গুঁজে থেকেছেন। ২০১৮ সালে ওমান সফর করে ওমানের তৎকালীন সুলতানের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু। তারপর থেকে শুরু। কিন্তু আল-কুদস দিবসকে সামনে রেখে প্রশ্ন হচ্ছে, এত কিছুর পরও কি ফিলিস্তিনিরা তাদের হারানো ভূমি, বায়তুল মোকাদ্দাস ফিরে পেয়েছে।
এজন্যই গত তিরিশে এপ্রিল এক বিবৃতিতে ইরান বলেছে, জার্মানিতে হিজবুল্লাহকে নিষিদ্ধ ঘোষণা এবং দেশটির সরকারের এ সিদ্ধান্ত লেবানন সরকার ও জনগণের জন্য সম্পূর্ণ অসম্মানজনক, যেহেতু হিজবুল্লাহ ওই দেশের সরকার এবং সংসদের একটি সরকারি ও বৈধ অঙ্গ। প্রশ্ন হচ্ছে অন্য কোনো মুসলিম দেশ জার্মানির কাছে এ প্রশ্ন তুলতে পারছে না কেন? কোথায় ওআইসি? কোথায় আরব লীগ?
তার মানে কার্যকরভাবে ফিলিস্তিনিদের পাশে যে কোনো সংগঠন দাঁড়ালেই তাকে সন্ত্রাসীর সংজ্ঞায় ফেলে দেয়া হবে? অথচ আমরা সবাই জানি মহানবী (সা)-এর নবুওয়াতের ঘোষণার পর থেকে মুসলমানদের কাছে বায়তুল মোকাদ্দাস পবিত্র স্থান হিসাবে বিবেচিত হয়ে আসছে। কুরআন শরিফে বায়তুল মোকাদ্দাসকে পবিত্র ভূমি বলে উল্লেখ করা হয়েছেÑ ‘(স্মরণ করো, মূসা তার সম্প্রদায়কে বলেছিল) হে আমার সম্প্রদায়! আল্লাহ তোমাদের জন্য যে পবিত্র ভূমি নির্দিষ্ট করেছেন, এতে তোমরা প্রবেশ করো এবং পশ্চাৎপসারণ করো না, করলে তোমরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়বে।’ (সূরা আল-মায়িদা, আয়াত : ২১)
এবার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে কেনো বায়তুল মোকাদ্দাসকে মুক্ত করা প্রয়োজন তার সংক্ষেপ বর্ণনা দিয়ে এ লেখা শেষ করছি। এটা শুধু মুসলিম উম্মাহর হারানো গৌরব বা মান-সম্মান ফিরিয়ে আনার প্রশ্ন নয়, বিশ্বব্যাপী সত্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্যও তা জরুরি। বায়তুল মোকাদ্দাস ও ফিলিস্তিন হচ্ছে রাজনৈতিক এবং ভৌগোলিক কৌশলগত দিক থেকে ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকাÑ এ গুরুত্বপূর্ণ তিন মহাদেশের ট্রানজিট পয়েন্ট বা প্রবেশদ্বার। এই গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলটি সাম্রাজ্যবাদীদের নিয়ন্ত্রণে থাকার কারণে আজ তেলসমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের প্রধান তিন মহাদেশের ওপর কর্তৃত্ব করা সাম্রাজ্যবাদীদের জন্য সহজ হয়েছে।
আল-কুদস দিবস এসব বিষয় নিয়ে ভাবনার তাগিদ দিচ্ছে। মজলুম ফিলিস্তিনি জাতির ওপর জগদ্দল পাথর হয়ে ইহুদিবাদী শাসন, শোষণ, নিপীড়ন ও তাদের নৃশংস হত্যাযজ্ঞের অবসান ঘটানো এবং বায়তুল মোকাদ্দাসকে রাজধানী করে ফিলিস্তিনি জাতির নিজস্ব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাও এ দিবসের আরেকটি বড় লক্ষ্য। এজন্য মুসলমানদের ঐক্যই যথেষ্ট।

আল কুদস দিবসের লক্ষ্যÑ বায়তুল মুকাদ্দাসের মুক্তি ও ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা

 

মুহাম্মদ শওকাত হোসেন

পবিত্র মাহে রমজানের শেষ শুক্রবার ‘জুমাতুল বিদা’ এর দিনটি বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী ‘আল-কুদস দিবস’ হিসেবে পালিত হয়। আমরা অনেকেই জানি না আল-কুদস দিবস কী? কেন? কখন থেকে? কোন্ লক্ষে পালিত হচ্ছে? তাই এ দিবসটির লক্ষ ও তাৎপর্য স¤পর্কে মৌলিক ধারণা আমাদের সকলের প্রয়োজন।
মূলত ইসলামের তৃতীয় পবিত্রতম মসজিদ ‘বায়তুল মুকাদ্দাস’ এর মুক্তি ও পবিত্র ভূখ- ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার লক্ষ্যে বিশ্বব্যাপী জনমত সৃষ্টি করা , বিশেষত মুসলিম উম্মাহকে সতর্ক ও সচেতন করার লক্ষ্যে এ দিবসটি প্রতিবছর পালিত হচ্ছে। ১৯৭৯ সালে ইরানের ইসলামি বিপ্লবের পরপরই বিপ্লবের নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেইনী (র.) পবিত্র রমজান মাসের শেষ শুক্রবারকে ‘আল-কুদস দিবস’ হিসেবে ঘোষণা দেন। বিশ্বব্যাপী দিবসটি পালনের জন্য তিনি আহ্বান জানান। উদ্দেশ্য একটাই, বিশ্ব মুসলিমের প্রাণের চেয়ে প্রিয় মসজিদুল আকসাকে মুক্ত করা এবং ‘ইসরাইল’ নামের অবৈধ রাষ্ট্রের কবল থেকে পবিত্র ভূমি ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার জন্য বিশ্বব্যাপী মুসলমানদেরকে উদ্বুদ্ধ করা। দীর্ঘ ৪১ বছর যাবত সে লক্ষ্যে বিশ্বব্যাপী রমজানের শেষ শুক্রবারে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে র‌্যালি, সমাবেশ, সেমিনার, আলোচনা সভা ইত্যাদির মাধ্যমে ফিলিস্তিনি মুক্তি সংগ্রামের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করা হয় এবং অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইলেরর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো হয়। এবং বায়তুল মুকাদ্দাসের মুক্তি ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে ঐকমত্য পোষণ করা হয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে চলতি বছর করোনা মহামারির কারণে লোক সমাগমের মাধ্যমে দিবসটি পালন সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তি ও মিডিয়ার মাধ্যমে প্রতিটি মানুষের কাছে এই মেসেজ পৌঁছে দেওয়া প্রয়োজন। আমরা ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা ও বায়তুল মুকাদ্দাস এর মুক্তির পক্ষে এবং অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইল নামের অপশক্তির বিপক্ষে। এ মেসেজটি আমাদের সকলের দ্বারে দ্বারে পৌঁছে দেয়া প্রয়োজন।
প্রসঙ্গক্রমে আমাদের পবিত্র বায়তুল মুকাদ্দাসের গুরুত্ব উপলব্ধি করা প্রয়োজন। কারণ, বায়তুল মুকাদ্দাস বা মসজিদুল আকসা মুসলিম উম্মার প্রথম কিবলা। প্রায় ১৪ বছর ৫ মাস রাসূলে করীম (সা.)-এর নেতৃত্বে মুসলমানরা বায়তুল মুকাদ্দাসের দিকে মুখ করে নামাজ আদায় করেছেন। নবীজি (সা.)-এর মাদানী জীবনে আল্লাহর নির্দেশে কাবা শরীফের দিকে কেবলা পরিবর্তিত হয়। পবিত্র কুরআনে এই মসজিদের কথা ২ বার উল্লেখ হয়েছে। মহানবী (সা.) মেরাজের সময় বায়তুল মোকাদ্দাসে যাত্রাবিরতি করে সেখানে সকল নবীর সঙ্গে তিনি ইমাম হয়ে নামাজ আদায় করেছেন। ইসলামের দৃষ্টিতে যে তিনটি মসজিদ জিয়ারতের উদ্দেশ্যে সফর করা সওয়াবের কাজ, তার মধ্যে একটি হচ্ছে ‘মসজিদুল আকসা’। এই তিনটি মসজিদ হচ্ছে মসজিদুল হারাম, মদীনার মসজিদে নববী এবং জেরুসালেমে অবস্থিত মসজিদুল আকসা বা বায়তুল মুকাদ্দাস। কাজেই মুসলিম উম্মাহর কাছে এই মসজিদের গুরুত্ব অপরিসীম।
ইতিহাসের আলোকে হযরত ইবরাহিম (আ.) কর্তৃক কাবা ঘর নির্মাণের ৪০ বছর পর হযরত ইয়াকুব আলাইহিস সালাম সর্বপ্রথম মসজিদুল আকসা নির্মাণ করেন। যদিও পরবর্তীকালে হযরত সুলাইমান (আ.) এই মসজিদটিকে পুনঃনির্মাণ করেছেন। এক লক্ষ ৪৪ হাজার বর্গমিটার এলাকার উপর বায়তুল মুকাদ্দাস বা আল-কুদস শহর অবস্থিত। এখানে মসজিদ আকারে ২টি স্থাপনা রয়েছে। প্রধান মসজিদ মসজিদে কিবালি ও মসজিদে কুব্বাতুহ ছাখরা। মুছাল্লাহ (মসজিদ) হিসেবে রয়েছে আরও পাঁচটি স্থাপনা। ছোট-বড় মিলিয়ে ১৫টি গম্বুজ, বারটি মাদ্রাসা, ২৫টি কূপ, তেইশটি মাসতাবা (খালি মাঠে বর্গাকৃতির উঁচু জায়গা), ৮টি বায়েকা (গেটসদৃশ একাধিক স্তম্ভের স্থাপনা) চারটি আজান খানা সহ বিভিন্ন ধরনের ১৯০টি স্থাপনা রয়েছে। মসজিদে আকসার পনেরটি গেট এর দশটি ব্যবহৃত হচ্ছে, এর উপরে রয়েছে সীসার গম্বুজ, এটা ১৫ হিজরিতে খলিফা ওমর রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু নির্মাণের নির্দেশ দেন। ওখানে দাঁড়িয়ে খতীব ইমামতি করেন। কুব্বাতুস সাখরা পাথর গম্বুজ মসজিদ ইসলামি স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন। আব্দুল মালিক বিন মারওয়ান ৬৬ থেকে ৭২ হিজরিতে এর নির্মাণ স¤পন্ন করেন। এর অভ্যন্তরে বৃত্তের মাঝখানে পাথর রয়েছে যার উপর দাঁড়িয়ে বোরাকে আরোহণ করে মহানবী (সা.) মেরাজে গেছেন।
ইসলাম ও মুসলমানদের শত্রুরা বিগত শতাব্দীর শুরু থেকেই মুসলিম উম্মাহকে ধ্বংস ও দুর্বল করার লক্ষ্যে ফিলিস্তিনে অবৈধ ইসরাইল রাষ্ট্র সৃষ্টি করার উদ্যোগ নেয়। এর নেতৃত্বে ছিল সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ এবং তাকে সহযোগিতা করছে যুক্তরাষ্ট্র সহ ইউরোপের আরো কিছু রাষ্ট্র এবং মক্কা-মদিনার দখলদার সৌদি আরবের ৩য় বারের প্রতিষ্ঠাতা আব্দুল আজিজ বিন সৌদ। একটি সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্র করে ব্রিটেন আমেরিকা এবং ইহুদীবাদের প্রবক্তারা মুসলিম বিশ্বের হৃদয়ের মাঝখানে একটি বিষফোঁড়ার মতো কৃত্রিম রাষ্ট্র ইসরাইলকে সৃষ্টি করেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ইহুদিদেরকে নিয়ে এসে ফিলিস্তিনের পবিত্র ভূমিতে তাদেরকে পুনর্বাসিত করেছে। একদিকে এইসব ইহুদিকে সশস্ত্র এবং বেপরোয়া হিসেবে তৈরি করা হয়েছে। অন্যদিকে ওই অঞ্চলের বাসিন্দা মুসলমানদেরকে নির্মমভাবে নির্যাতন-নিপীড়নের মাধ্যমে এলাকা থেকে বের করে দিয়েছে।
লক্ষ লক্ষ ফিলিস্তিনি শরণার্থী প্রতিবেশী জর্ডান, সিরিয়া, মিশরসহ বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়ে যুগের পর যুগ ধরে মানবেতর জীবন যাপনে বাধ্য হয়েছে। ১৯৪৮, ৫৬, ৬৭ ও ৭৩-এ চার চারবার আরব-ইসরাইল যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। আরবরা সবাই মিলেও এই বায়বীয় রাষ্ট্র বিষাক্ত বিষফোঁড়া ইসরাইলের সঙ্গে পেরে উঠেনি। ওরা ওদের জন্মদাতা ব্রিটেন আমেরিকার শক্তিতে সিরিয়া, জর্ডান, লেবানন এবং মিশরের বিস্তীর্ণ ভূমি দখল করে নিয়েছে। তেল আবিবকে রাজধানী করে ওরা প্রথম অবৈধ ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিল। পরবর্তীকালে তারা জেরুসালেমকে রাজধানী হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। ১৯৬৭ সালে ওরা মসজিদুল আকসা দখল করে ওদের আয়ত্তে নিয়ে নেয়।
১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনিদের চৌদ্দ পুরুষের জায়গার উপরে অবৈধভাবে ইসরাইল রাষ্ট্র ঘোষণা দেয়ার আগ থেকেই সেখানকার মুসলিম অধিবাসীদের উপর হত্যা-নির্যাতন-নিপীড়ন চলেছে। এর পেছনে ছিল ব্রিটিশ হানাদার বাহিনী। মুসলিম অধিবাসীরা বাধ্য হয়ে সপরিবারে অন্য দেশে আশ্রয় নিয়েছে। এবং তাদের মধ্য থেকেই বিভিন্ন গ্রুপ ওদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রাম তখনই শুরু করেছে। পরবর্তীকালে বেশ কয়েকটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে ফিলিস্তিনের মুক্তির জন্য সংগ্রাম চলতে থাকে। এদের মধ্যে আলফাতাহ গ্রুপ ছিল সবচেয়ে শক্তিশালী। ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বে পরবর্তীকালে এই গ্রুপগুলোর সমন্বয়ে ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থা পিএলও গঠন করা হয়। দীর্ঘকাল ইয়াসির আরাফাত এর নেতৃত্বে নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ফলাফল ছিল শূন্য। ১৯৭৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের নেতৃত্বে ‘ক্যা¤প ডেভিড চুক্তি’ হয়েছিল পিএলও, মিশর ও ইসরাইলের মধ্যে। কিন্তু তাতে কোন ফলোদয় হয়নি, বরং পিএলও ও কিছু আরব রাষ্ট্র ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিয়েছিল মাত্র ।
১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামি বিপ্লবের পর বিশ্বরাজনীতি বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে আমূল পরিবর্তন আসে। ইসলামি বিপ্লবের নেতা ইমাম খোমেইনী (রহ.) শুরুতেই বাইতুল মুকাদ্দাসের মুক্তির বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে রমজানের শেষ শুক্রবারকে ‘আল-কুদস দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেন। শুধু তাই নয় তিনি ‘তারিকুল কুদস’ অভিযান চালানোর ঘোষণা দেন। এরই ফলশ্রুতিতে ফিলিস্তিন বিষয়ে বিশ্বব্যাপী নতুন চিন্তা-চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গির সৃষ্টি হয়। পাশাপাশি ফিলিস্তিনিদের মধ্যে সংঘটিত হয় ফিলিস্তিনের সত্যিকারের মুক্তিবাহিনী ‘হামাস’। যাদের লক্ষ্য একটাই, অবৈধ ইসরাইলকে নির্মূল করে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র তৈরি করা এবং বায়তুল মুকাদ্দাস মুক্ত করা। ফিলিস্তিনের সাথে স¤পৃক্ত রয়েছে পার্শ্ববর্তী দেশ লেবানন। সেখানে রয়েছে ফিলিস্তিনের লক্ষ লক্ষ শরণার্থী, যারা বহুযুগ ধরে সে দেশে অবস্থান করছে। এ সময়ে লেবাননে সংগঠিত হয় বিপ্লবী নেতা হাসান নাসরুল্লাহর নেতৃত্বে ‘হিজবুল্লাহ’। যাদের লক্ষ্য হচ্ছে ফিলিস্তিনি মুক্তি আন্দোলনে সহযোগিতা করা এবং ইসরাইলকে ধ্বংস করা। বিগত ৭২ বছরের ইতিহাসে আমরা দেখেছি অভিশপ্ত ইসরাইলিরা হামাস ও হিজবুল্লার কাছে একাধিকবার মার খেয়েছে, পরাজিত হয়েছে এবং তাদের অগ্রযাত্রা সীমিত হয়ে গেছে । শুধু সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা এবং তার দোসররা আর কিছু সংখ্যক রাজতান্ত্রিক আরব রাষ্ট্র ওদেরকে অক্সিজেন দিয়ে টিকিয়ে রেখেছে মাত্র। ইসরাইলের নতুন প্রজন্মের মধ্যেও তাদের অস্তিত্ব এবং কার্যক্রম নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। অন্যদিকে শত প্রতিকূলতা ও অবরোধের মধ্যেও ফিলিস্তিনের একটা অংশ নিয়ন্ত্রণ করে তাদের সফলতার প্রমাণ দিয়ে যাচ্ছে। সেদিন বেশি দূরে নয় বিশ্ব মুসলিমের সহায়তায় হামাস ও হিজবুল্লাহ সাম্রাজ্যবাদের সৃষ্ট অবৈধ বায়োবীয় রাষ্ট্র ইসরাইলকে ধ্বংস করে ফিলিস্তিনকে স্বাধীন করবে এবং আমাদের প্রথম কেবলা পবিত্র বায়তুল মুকাদ্দাসকে মুক্ত করবে ইনশাআল্লাহ।
সে লক্ষ্যে বিশ্বের প্রতিটি তাওহিদী মুসলিম এর দায়িত্ব হচ্ছে ফিলিস্তিনের এই মুক্তি সংগ্রামে হামাসকে সমর্থন দেয়া, হিজবুল্লাহকে সমর্থন দেয়া। পাশাপাশি ওই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের সাথে মিলে মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী দেশ ইসরাইলের বন্ধু ইসলামের দুশমনদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া। আল-কুদস দিবসের আহ্বান হচ্ছে এই ঘোষণাকে সমস্ত মুসলমানের কানে পৌঁছে দেয়া।
আল-কুদস দিবসের প্রাক্কালে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি ইরানের তারিকুল কুদস ফোর্স এর কমান্ডার বীর মুজাহিদ শহীদ কাশেম সোলাইমানিকে। হিজবুল্লাহ ও হামাস সংগঠন এবং এদের অগ্রযাত্রায় যিনি নেপথ্যে অভিভাবকের ভূমিকা পালন করেছেন। মহান আল্লাহ তাঁকে জান্নাতবাসী করুন।
আল কুদস দিবস জিন্দাবাদ, ফিলিস্তিন স্বাধীন হোক, বায়তুল মুকাদ্দাস মুক্ত হোক।
সাবেক অধ্যক্ষ ও স¤পাদক, দৈনিক আজকের ভোলা
ও সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট, আল-কুদস কমিটি বাংলাদেশ

ফিলিস্তিন সমস্যা : মুসলিম উম্মাহ্র ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপ অপরিহার্য

নূর হোসেন মজিদী
একবিংশ শতাব্দীরও দুই দশক অতিক্রান্ত হতে চলেছে, কিন্তু ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধানের কোনো লক্ষণ দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। ফিলিস্তিনী জনগণের ন্যায্য অধিকার অনুযায়ী সমগ্র ফিলিস্তিনী ভূখ- নিয়ে মুসলিম, খৃস্টান ও ইযাহূদী নির্বিশেষে ফিলিস্তিনী ভূমিপুত্রদের জন্য একক ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন করা তো দূরের কথা, ১৯৯৭-র চুক্তি অনুযায়ী জাতিসংঘ-স্বীকৃত ফিলিস্তিনী এলাকায় খ-িত ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনেরও কোনো খবর নেই। শুধু তা-ই নয়, উক্ত চুক্তি অনুযায়ী পশ্চিম তীরের যে এলাকা ফিলিস্তিনী কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে অর্পিত হওযার কথা তারও শতকরা ৬০ ভাগ এখনো যায়নবাদী ইসরাঈলের নিয়ন্ত্রণে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সহায়তায় যায়নবাদী ইসরাঈল তার সম্প্রসারণবাদী পরিকল্পনার বাস্তবায়ন এগিয়ে নিচ্ছে, কিন্তু ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধানের ব্যাপারে ফিলিস্তিনী ও লেবাননী জনগণ এবং ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান ব্যতীত বিশ^সম্প্রদায়ের কোনো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হচ্ছে না।
চলতি ২০২০ সালেও ফিলিস্তিনী জনগণ অধ্যুষিত পশ্চিম তীরে ও পূর্ব বায়তুল মুক্বাদ্দাসে নতুন নতুন ইয়াহূদী বসতি স্থাপনের কাজ এগিয়ে চলেছে। অন্যদিকে যায়নবাদী ইসরাঈল সরকার বায়তুল মুক্বাদ্দাসের পূর্ব দিকে একটি দেয়ালঘেরা সড়ক নির্মাণের পরিকল্পনা ঘোষণা করেছেÑ যে সড়ক দিয়ে ফিলিস্তিনী যানবাহন বায়তুল মুক্বাদ্দাসের উত্তর ও দক্ষিণে অবস্থিত ফিলিস্তিনী গ্রামাঞ্চলের মধ্যে যাতায়াত করতে পারবেÑ যার মূল লক্ষ্য হচ্ছে ফিলিস্তিনী জনগণকে দেয়াল দ্বারা পরস্পর থেকে যোগাযোগবিচ্ছিন্ন করে ফেলা।
এরই পাশাপাশি যায়নবাদী বাহিনীর দ্বারা গাযা, পশ্চিম তীর ও বায়তুল মুক্বাদ্দাসের ফিলিস্তিনীদেরকে হত্যা ও তাদের বাড়িঘর ধ্বংসকরণ এবং একই সাথে ফিলিস্তিনীদের পক্ষ থেকে তাদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে প্রতিবাদ, বিক্ষোভ ও প্রতিরোধ অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু যায়নবাদী ইসরাঈল কর্তৃক ফিলিস্তিনীদের হত্যা ও নির্যাতন এবং নতুন নতুন ইয়াহূদী বসতি নির্মাণের প্রতি না বিশ^সম্প্রদায় যথাযথ দৃষ্টি দিয়েছে, না এ ব্যাপারে বিশ^সম্প্রদায় যে অযথেষ্ট আপত্তি ও নিন্দা জানিয়েছে যায়নবাদী ইসরাঈল ও তার পৃষ্ঠপোষক আমেরিকা তার প্রতি বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করেছে।
ফিলিস্তিনী জনগণ অধ্যুষিত সমগ্র এলাকা গ্রাসের সম্প্রসারণবাদী পরিকল্পনা সহ যায়নবাদী সরকারের সমস্ত অবৈধ কার্যকলাপের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চোখ বুঁজে সমর্থন দিয়ে আসছে। এ প্রক্রিয়ারই অংশ হিসেবে মার্কিন সরকার ইসলামের প্রথম ক্বিব্লা পবিত্র শহর আল্-ক্বুদ্স্ বা বায়তুল মুক্ব্াদ্দাস্কেÑযা জেরুসালেম নামেও পরিচিতÑইসরাঈলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এবং এ স্বীকৃতির নিদর্শনস্বরূপ ২০১৮ সালের ১৫ই মে তার দূতাবাস তেল আবীব থেকে সেখানে স্থানান্তরিত করে। ফিলিস্তিনী জনগণ, বিশেষত গাযার অধিবাসীরা আমেরিকার এ পদক্ষেপের প্রতিবাদে এবং সেই সাথে অধিকৃত ভূমিতে তাদেরকে ফিরে যেতে দেয়ার দাবিতে ঐ তারিখের আগে-পরে সাম্প্রতিক কালের অন্যতম প্রচ- বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। আর যায়নবাদী সরকার নির্মম হত্যাকা-ের মাধ্যমে এর জবাব দেয়; ঐ সময় এপ্রিল-মে মাত্র দুই মাসে যায়নবাদী সরকার কমপক্ষে ১২১ জন ফিলিস্তিনীকে হত্যা করে।
এর পাশাপাশি হামাস-শাসিত গাযায় যায়নবাদী বিমান হামলাও অব্যাহত থাকে। বস্তুত গাযায় যায়নবাদী বিমান হামলা একটি অব্যাহত প্রক্রিয়া; চলতি ২০২০ সালের শুরুর দিকেও যায়নবাদী বিমান বাহিনী গাযায় হামলা চালায়।
অবৈধ যায়নবাদী রাষ্ট্র ইসরাঈল প্রতিষ্ঠিত হবার দিন (১৫ই মে ১৯৪৮) থেকেই একে রক্ষা করা, শক্তিশালী করা ও মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে এর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য নীতির অক্ষ হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছে।
অবশ্য কেবল বৃটিশ সরকারের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক সহায়তা প্রদান, বিশেষ করে বাইরে থেকে অ-ফিলিস্তিনী ইয়াহূদীদেরকে ফিলিস্তিনে এনে বসানোর সুযোগ প্রদানের ফলেই যায়নবাদী সংস্থা (তরড়হরংঃ ঙৎমধহরুধঃরড়হ)-এর পক্ষে ইসরাঈল রাষ্ট্র গঠন করা সম্ভব হয়েছিল। কারণ, প্রথম বিশ^যুদ্ধের শেষে যেখানে ফিলিস্তিনে ইয়াহূদী জনসংখ্যা ছিল মাত্র ৫৪ হাজার (ঊহপুপষড়ঢ়বফরধ ঔঁফরপধ, ঠড়ষ. ৯, চ. ৪৭৪), সেখানে অভিবাসনের ফলে ১৯২২ সালে তা দাঁড়ায় ৮৪ হাজারে (যা ছিল ফিলিস্তিনের ঐ সময়কার মোট জনসংখ্যার মাত্র ৭% ভাগ) এবং ১৯৪৭ সালে তা দাঁড়ায় ৬ লাখ ১৪ হাজার ২৩৯ জনে (ফিলিস্তিনের তখনকার মোট জনসংখ্যার ৩১.৭৬% ভাগ) (প্রাগুক্ত, পৃ. ১০২৪)। কিন্তু যেহেতু দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের পর পুঁজিবাদী পশ্চিমা শিবিরের তথা সাম্রাজ্যবাদী শিবিরের নেতৃত্ব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতে চলে যায় সেহেতু অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই যায়নবাদী রাষ্ট্রের অভিভাবকত্বও তার ওপরে ন্যস্ত হয়। এ কারণেই একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ইসরাঈলের প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষিত হবার মাত্র ১১ মিনিট পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাকে স্বীকৃতি প্রদান করে (ওংৎধবষ – টহরঃবফ ঝঃধঃবং জবষধঃরড়হং: ডরশরঢ়বফরধ; ছঁড়ঃবফ ভৎড়স ঞযব টহরঃবফ ঝঃধঃবং ধহফ ঃযব জবপড়মহরঃরড়হ ড়ভ ওংৎধবষ: অ ঈযৎড়হড়ষড়মু)। আর এর পর থেকে সব সময়ই আমেরিকা যায়নবাদী রাষ্ট্রটিকে সর্বাত্মকভাবে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক সহায়তা দিয়ে আসছে, ফিলিস্তিনী জনগণের বিরুদ্ধে যায়নবাদীদের সমস্ত মানবতাবিরোধী অপরাধকে সমর্থন দিয়েছে এবং ভেটো-ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করে ফিলিস্তিনী জনগণের ন্যূনতম মানবিক অধিকার রক্ষায় জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সকল উদ্যোগকে ব্যর্থ করে দিয়েছে।
যায়নবাদী ইসরাঈলের প্রতি আমেরিকার সর্বাত্মক পৃষ্ঠপোষকতা সত্ত্বেও মুক্তিকামী ফিলিস্তিনী জনগণ ও তাদের প্রতিরোধ ফ্রন্ট হামাস-ও যায়নবাদী রাষ্ট্রটির ওপর বার বার বহু নৈতিক ও বাস্তব ক্ষতি চাপিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে।
এমনকি বৃটেন কর্তৃক ফিলিস্তিন দখল ও অ-ফিলিস্তিনী ইয়াহূদীদের ফিলিস্তিনে অভিবাসনের সূচনাকাল থেকে শুরু করে অবৈধ যায়নবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়া পর্যন্ত ফিলিস্তিনী জনগণ অবৈধ অভিবাসনের প্রতিবাদে ও ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার দাবিতে অনবরত রাজনৈতিক বিক্ষোভের ও বহুবার সশস্ত্র অভ্যুত্থানের আশ্রয় নেয়Ñ যার মধ্যে শহীদ শায়খ্ ‘ইয্যুদ্দীন আল্-ক্বাস্সামের গৌরবময় নেতৃত্বে সশস্ত্র জিহাদ (১৯৩২-১৯৩৫) সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য।
হামাস গঠনের প্রায় সমসময়ে ইন্তিফাদাহ্ নামে মশ্হূর ফিলিস্তিনী জনগণের ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থান শুরু হয় (৯ই ডিসেম্বর ১৯৮৭)Ñ যা ১৯৯৩-র ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় বছর অব্যাহত থাকে। এ প্রথম ইন্তিফাদায় যায়নবাদী বাহিনীর হাতে এক হাজার ছয়শ’রও বেশি ফিলিস্তিনী নারী-পুরুষ ও শিশু-বৃদ্ধ শহীদ হন। কিন্তু যায়নবাদীরা ফিলিস্তিনী জনগণের মনোবল নষ্ট করতে ব্যর্থ হয় এবং তারা সমগ্র ফিলিস্তিন উদ্ধারের লক্ষ্যে অটল থাকে।
এরপর ১৯৯৬-র সেপ্টেম্বরে যায়নবাদী সরকার বায়তুল মুক্বাদ্দাসের মসজিদুল আক্বসা ধ্বংস করার লক্ষ্যে এর দেয়ালের নিচের সুড়ঙ্গটি লোক চলাচলের জন্য খুলে দিলে ফিলিস্তিনী জনগণ প্রচ- প্রতিবাদ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে এ ষড়যন্ত্রকে বানচাল করে দিতে সক্ষম হয়।
অতঃপর ২০০০ সালের সেপ্টেম্বরে দ্বিতীয় ইন্তিফাদাহ্ শুরু হয় এবং ২০০৮ সালের শেষ পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। দ্বিতীয় ইন্তিফাদাহ্ দমনের লক্ষ্যে যায়নবাদী সরকার সাড়ে পাঁচ হাজার ফিলিস্তিনীকে শহীদ করে, কিন্তু এর পরও ফিলিস্তিনী জনগণ আগের মতোই তাদের দাবিতে অটল থাকে।
হামাস এ সবের পাশাপাশি স্বীয় জনপ্রিয়তার প্রমাণ তুলে ধরার জন্য ২০০৬ সালের ২৫শে জানুয়ারি অনুষ্ঠিত ফিলিস্তিনী স্বায়ত্ত্বশাসন কর্তৃপক্ষের পার্লামেন্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে এবং ১৩২টি আসনের মধ্যে ৭৪টিতে জয়লাভ করে। এরপর হামাস ঐ বছর মার্চ মাসে সরকার গঠন করে। কিন্তু গণতন্ত্রের পতাকাবাহী হবার দাবিদার ও এ জন্য অহঙ্কার প্রদর্শনকারী আমেরিকা অত্যন্ত নির্লজ্জভাবে হামাস সরকারকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করে। এরপর মাত্র সোয়া এক বছরের মাথায় (২০০৭-এর ১৪ই জুন) ফিলিস্তিনী কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট আমেরিকা ও যায়নবাদী সরকারকে খুশি করার লক্ষ্যে হামাস সরকারকে বরখাস্ত করার কথা ঘোষণা করেন। কিন্তু এর ফল হলো দু’টি ফিলিস্তিনী সরকারের অস্তিত্ব লাভ : একটি গাযায় হামাসের সরকার, আরেকটি পশ্চিম তীরে আল্-ফাতাহ্র সরকার।
অন্যদিকে, হামাস কর্তৃক ফিলিস্তিনী সরকার গঠনের মাত্র তিন মাসের মধ্যে ২০০৬ সালের ৯ই জুন যায়নবাদী সরকারের বাহিনী গাযায় বিমান হামলা শুরু করে। এর ফলে সূচিত যুদ্ধ ঐ বছরের ২৭শে ডিসেম্বর পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। যায়নবাদী সরকার ২০০৮ সালের ২৭শে ডিসেম্বর পুনরায় গাযায় হামলা শুরু করেÑ যা ২০০৯-এর ১৭ই জানুয়ারি পর্যন্ত অব্যাহত থাকে, কিন্তু যায়নবাদী বাহিনী লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়। যায়নবাদী সরকার গাযার জনগণের বিরুদ্ধে ২০১৪ সালের ৮ই জুলাই একটি সর্বাত্মক হামলা শুরু করে, কিন্তু লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়ে যায়নবাদী সরকার পরবর্তী ২৬শে আগস্ট একতরফা যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করতে বাধ্য হয়।
লেবাননের প্রতিরোধ সংগঠন হিয্বুল্লাহ্-ও ফিলিস্তিনী জনগণের পক্ষে ও যায়নবাদী ইসরাঈলের বিরুদ্ধে বিরাট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
১৯৮২ সালের জুনে ইসরাঈল লেবাননের রাজধানী বৈরুত সহ দেশটির অর্ধেকের বেশি ভূখ- দখল করে নেয়ায় যায়নবাদীদের বিতাড়িত করে লেবাননের ভূখ- পুনরুদ্ধার ও ফিলিস্তিনী জনগণের মুক্তিসংগ্রামকে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়ার লক্ষ্যে দক্ষিণ লেবাননে হিযবুল্লাহ্ গঠন করা হয় (১৯৮৩)। নবগঠিত হিয্বুল্লাহ্ বাহিনী ১৯৮৫ সালের এপ্রিলে দখলদার ইসরাঈলী বাহিনীকে লেবানন ত্যাগে বাধ্য করে।
এরপর হিয্বুল্লাহ্ ২০০০ সালে ইসরাঈলের তাঁবেদার ও পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত তথাকথিত দক্ষিণ লেবানন বাহিনী (এসএলএ)-র দখল থেকে দক্ষিণ লেবাননকে মুক্ত করে।
অতঃপর হিয্বুল্লাহ্কে নির্মূল করার লক্ষ্যে ইসরাঈল ২০০৬ সালের ১২ই জুলাই একটি সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু করে এবং দক্ষিণ লেবাননের অংশবিশেষ দখল করে নেয়। কিন্তু হিয্বুল্লাহ্র প্রতিরোধের মুখে টিকতে না পেরে প্রাণ বাঁচানোর লক্ষ্যে মাত্র ৩৪ দিনের মাথায় জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের দেয়া অস্ত্র বিরতি প্রস্তাবের আশ্রয় নিয়ে লেবাননের মাটি থেকে সরে যেতে বাধ্য হয়।
যায়নবাদী সরকার আজ পর্যন্ত ফিলিস্তিনী জনগণের বিরুদ্ধে যতো হামলা চালিয়েছে এবং হিয্বুল্লাহ্ ও হামাসের সাথে যায়নবাদী বাহিনীর যতো যুদ্ধ ও সংঘর্ষ সংঘটিত হয়েছে সে সব থেকে যায়নবাদী সরকার মানুষ হত্যা করা এবং ফিলিস্তিন ও লেবাননের ওপর ধ্বংস চাপিয়ে দেয়া ব্যতীত কিছুই অর্জন করতে পারে নি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার ইসরাঈলকেন্দ্রিক মধ্যপ্রাচ্য নীতির কারণেই, যায়নবাদী রাষ্ট্রের মিত্র হিসেবে ইসলামি বিপ্লব-পূর্ব শাহ্-শাসিত ইরানকে মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে বড় সামরিক শক্তি বানিয়ে দিয়েছিল, কিন্তু ইসলামি বিপ্লবের বিজয়ের পরে আমেরিকা ইরানকে তার ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণে বাধ্য করা বা তাকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য কোনো অপচেষ্টাই বাদ রাখে নি। আমেরিকার এ সব অপচেষ্টার মধ্যে সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রসমূহ, অর্থনৈতিক ও সামরিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং ইরাকের তৎকালীন সাদ্দাম সরকারের মাধ্যমে আট বছর ব্যাপী যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া অন্যতম। কিন্তু আমেরিকার সমস্ত অপচেষ্টাই ব্যর্থ হয়।
অবশ্য যায়নবাদীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত একটি সরকার হিসেবে মার্কিন সরকারের জন্য এটাই স্বাভাবিক ছিল। কারণ, হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্.) এমনকি বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে ইরানি আলেম সমাজের নেতৃত্বে বরিত হবার আগে থেকেই সব সময়ই পবিত্র ফিলিস্তিন ভূমি, বিশেষ করে মুসলিম উম্মাহ্র প্রথম ক্বিব্লা আল্-ক্বুদ্স্-কে মুক্ত করা, অবৈধ ইসরাঈল রাষ্ট্রের বিলুপ্তি সাধন এবং সমগ্র ফিলিস্তিন ভূখ-ের ওপর ফিলিস্তিনী বংশোদ্ভূত মুসলিম, খৃস্টান ও ইয়াহূদী নির্বিশেষে সকল ফিলিস্তিনীর সমানাধিকার বিশিষ্ট স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে আসছিলেন। এ কারণেই, বিপ্লবের বিজয়ের পরে ইরানের ইসলামি সরকার এ বিষয়টিকে স্বীয় পররাষ্ট্র নীতির অক্ষ হিসেবে গ্রহণ করে। এ লক্ষ্যে যে সব বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে সেগুলোর অন্যতম : ইসরাঈলের ওপর থেকে স্বীকৃতি প্রত্যাহার, তেহরানস্থ ইসরাঈলী দূতাবাসকে ফিলিস্তিনী দূতাবাসে পরিণতকরণ, হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্.) কর্তৃক রামাযান মাসের শেষ শুক্রবারকে আন্তর্জাতিক ক্বুদ্স্ দিবস ঘোষণা, পিএলও সহ ফিলিস্তিনের সকল প্রতিরোধ গ্রুপকে সর্বাত্মক সহায়তা প্রদান, হিয্বুল্লাহ্ ও হামাসকেÑএরপর হামাস সরকার গঠন করলে সে সরকারকেÑসম্ভবমতো সব রকমের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক সহায়তা প্রদান, এবং অতি সাম্প্রতিক কালে হিয্বুল্লাহ্ ও ফিলিস্তিনী জনগণের কাছে ইরানি সাহায্য পৌঁছানোর পথ হিসেবে সিরিয়াকে রক্ষার জন্য সেখানে, আমেরিকা-সৃষ্ট তথাকথিত ইসলামি রাষ্ট্র (আইএস)-কে উৎখাতের লক্ষ্যে যুদ্ধে অংশগ্রহণ এবং সফলতা লাভ।
যায়নবাদী ইসরাঈল ১৯৮২ সালের জুনে লেবাননের রাজধানী বৈরুত সহ দেশটির অর্ধেকের বেশি ভূখ- দখল করে নিলে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান লেবাননকে মুক্ত করার লক্ষ্যে ইরাকের মধ্য দিয়ে সেখানে সাঁজোয়া ও পদাতিক বাহিনী পাঠাবার জন্য সাদ্দাম সরকারের কাছে অনুমতি চাইলে ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত সাদ্দাম সরকার অনুমতি দিতে অস্বীকৃতি জানায়। ফলে ইসরাঈলের পক্ষে লেবাননস্থ ফিলিস্তিনী মুক্তিযোদ্ধদেরকে ১লা সেপ্টেম্বরের মধ্যে লেবানন ত্যাগে বাধ্য করা সম্ভব হয় এবং ইসরাঈলী বাহিনী দ্বারা অবরুদ্ধ ছ¡াব্রা ও শাতিলাস্থ ফিলিস্তিনী শরণার্থী শিবিরে ১৬ থেকে ১৮ই সেপ্টেম্বর ফালাঞ্জিস্ট সন্ত্রাসীরা এক পৈশাচিক গণহত্যা চালায়। অবশ্য নবগঠিত হিয্বুল্লাহ্ বাহিনী ১৯৮৫ সালের এপ্রিলে দখলদার ইসরাঈলী বাহিনীকে লেবানন ত্যাগে বাধ্য করে।
আমেরিকান সরকার হিয্বুল্লাহ্, হামাস্ ও ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের বিরুদ্ধে যতো পদক্ষেপ নিয়েছে তার সবগুলোই ব্যর্থ হওয়ায়, তেমনি ইরাকী জনগণকে মার্কিন আধিপত্য মেনে নিতে বাধ্য করার ক্ষেত্রেও ব্যর্থ হওয়ার পর, সিরিয়ার আসাদ সরকারকে উৎখাত করার সিদ্ধান্ত নেয়। কারণ, আসাদ সরকার হচ্ছে একমাত্র আরব সরকার যে সব সময় ফিলিস্তিনী জনগণকে সমর্থন দিয়ে আসছে, তেমনি সিরিয়া হচ্ছে হিয্বুল্লাহ্র কাছে ইরানি সাহায্য পৌঁছানোর পথ। এ লক্ষ্যে আমেরিকা প্রথমে তথাকথিত ফ্রী সিরীয়ান আর্মি গঠন করে এবং এটির ব্যর্থতার পর তথাকথিত ইসলামিক স্টেট্ (আইএস্) গঠন করে। আমেরিকা তার বশংবদ মিত্র দেশগুলোর সীমান্ত অতিক্রম করে সকল প্রকার অস্ত্রশস্ত্র ও বিদেশী সন্ত্রাসীদের আইএস-এর কাছে পৌঁছার জন্য সুযোগ দেয় এবং আইএস-এর শত্রু হবার ভান করে তার বিরুদ্ধে বছরের পর বছর যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা অব্যাহত রাখে। এমতাবস্থায় সিরীয় সরকারের অনুরোধে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান ও রাশিয়া মঞ্চে পদার্পণ করে এবং আইএসবিরোধী যুদ্ধের সফল সমাপ্তি ঘটায়। অবশ্য সিরিয়ায় বিদ্রোহ দমনের পুরো সময়টিতে হিয্বুল্লাহ্্ গুরুত্বপূর্ণ ও প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করে।
সমগ্র ফিলিস্তিন ভূখ-ের ওপর ফিলিস্তিনী জনগণের অধিকারের সপক্ষে ও বিপক্ষে বিশ^ জনমতের, বিশেষ করে মুসলিম উম্মাহ্র মেরুকরণ অত্যন্ত দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে। অ-পারমাণবিক ও অ-রাসায়নিক প্রচলিত সমরাস্ত্রের ওপর ভিত্তি করেই ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান যে নযীরবিহীন অভিনব সামরিক স্ট্রাটেজি গ্রহণ করেছে তার ফলে আমেরিকা ও যায়নবাদী সরকার ইরানে হামলা চালাতে সাহসী হচ্ছে না। হামাস্, হিয্বুল্লাহ্ ও ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের মোকাবিলায় ইসরাঈল ও আমেরিকার অক্ষমতা থেকে সুস্পষ্ট যে, আল্-ক্বুদ্স্ সহ সমগ্র ফিলিস্তিন উদ্ধারে মুসলিম উম্মাহ্র পক্ষ থেকে ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলে ক্বুদ্স্ সহ ফিলিস্তিনের মুক্তি সময়ের প্রশ্ন মাত্র।

কঠিন অবরোধের মধ্যেও করোনা মোকাবেলায় যেভাবে সাফল্য পেল ইরান

 

সাইদুল ইসলাম

নোভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯)এর প্রাদুর্ভাব চীনে প্রথম দেখা দিলেও প্রাণঘাতী এই উপসর্গটি এখন ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বজুড়ে। দিনকে দিন অবস্থার চরম অবনতি হচ্ছে। চীন করোনার ধাক্কা অনেকটা সামলে উঠলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ইতালি ও ¯েপনসহ বিশ্বের অনেক দেশের অবস্থাই এখন ভয়াবহ। মৃত্যুর মিছিল ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে। আর আক্রান্তের সংখ্যাও বিশ্বজুড়ে বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। ৩০ এপ্রিল বৃহ¯পতিবার বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা সাড়ে ৩২ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। এর মধ্যে সুস্থও হয়ে উঠেছেন ১০ লাখের বেশি। করোনার সংক্রমণের সার্বক্ষণিক তথ্য প্রকাশকারী ওয়েবসাইট ওয়ার্ল্ডোমিটারস ডট ইনফোর তথ্যমতে, ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে করোনা সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা ৩২ লাখ ৭২ হাজারের বেশি। এর মধ্যে মৃত্যু হয়েছে প্রায় ২ লাখ ৩১ হাজার মানুষের। সুস্থ হয়েছেন ১০ লাখ ৩০ হাজারের বেশি। অর্থাৎ বৃহ¯পতিবার পর্যন্ত সুস্থ হয়েছেন মোট শনাক্ত রোগীর ৩২ শতাংশের মতো। বেশি আক্রান্ত দেশগুলোর মধ্যে চীন, ইরান ও জার্মানিতে সুস্থ হওয়ার হার বেশি। সেই তুলনায় অনেক কম যুক্তরাষ্ট্রে। মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনসহ দেশটির অন্যান্য সংবাদমাধ্যমের তথ্যমতে, যুক্তরাষ্ট্রে করোনায় বুধবার ২৯ এপ্রিল আরও ২ হাজার ৩৯০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে দেশটিতে মৃত্যু ৬২ হাজার ছাড়িয়েছে। সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা ১০ লাখ ৭৫ হাজার ছাড়িয়েছে, যা সারা বিশ্বে মোট আক্রান্তের প্রায় এক তৃতীয়াংশ। ওয়ার্ল্ডোমিটারসের তথ্যমতে, বৃহ¯পতিবার রাত ১২টা পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে সুস্থ হয়েছেন ১ লাখ ৪৯ হাজারের কিছু বেশি রোগী। অর্থাৎ দেশটিতে সুস্থ হয়েছেন প্রায় ১৪ শতাংশ রোগী, যা করোনার সংক্রমণ ছড়ানো শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যে সবচেয়ে কম। তবে যুক্তরাজ্যে বৃহ¯পতিবার পর্যন্ত ঠিক কতজন সুস্থ হয়েছেন, সে তথ্য জানা যায়নি। বিবিসির তথ্যমতে, দেশটিতে বৃহ¯পতিবার পর্যন্ত ১ লাখ ৭১ হাজারের বেশি আক্রান্ত হয়েছেন। মৃত্যু ২৬ হয়েছে ২৬ হাজার ৭১১ জনের। অন্য দেশগুলোতে কমে আসায় ইউরোপে এখন প্রতিদিন সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু হচ্ছে যুক্তরাজ্যে।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়, ¯েপনে বৃহ¯পতিবার করোনায় মৃত্যু হয়েছে ২৬৮ জনের। গত ২০ মার্চের পর দেশটিতে একদিনে মৃত্যুর ঘটনা এদিনই সবচেয়ে কম। এ নিয়ে ¯েপনে মারা গেলেন সাড়ে ২৪ হাজারের বেশি মানুষ। ওয়ার্ল্ডোমিটারসের তথ্যমতে, ¯েপনে ৩০ এপ্রিল বৃহ¯পতিবার পর্যন্ত রোগী শনাক্ত হয়েছেন ২ লাখ ৩৯ হাজারের বেশি। সুস্থ হয়েছেন প্রায় ১ লাখ ৩৮ হাজার রোগী। অর্থাৎ ¯েপনে সুস্থ হয়েছেন ৫৭ দশমিক ৫৮ শতাংশ রোগী। বার্তা সংস্থা এএফপি জানায়, ইতালিতে বৃহ¯পতিবার মৃত্যু হয় ২৮৫ জনের। এ নিয়ে দেশটিতে সাড়ে ২৭ হাজার ৯৬৭ জনের প্রাণ গেল করোনায়। বৃহ¯পতিবার পর্যন্ত সংক্রমিত রোগী শনাক্ত হয়েছেন ২ লাখ ৫ হাজারের বেশি। এর মধ্যে সুস্থ হয়েছেন প্রায় ৭৬ হাজার। অর্থাৎ ইউরোপের এই দেশে এ পর্যন্ত সুস্থ হয়েছেন প্রায় ৩৫ শতাংশ। ব্যাপকভাবে করোনার সংক্রমণ ছড়ানো ইউরোপের আরেক দেশ ফ্রান্সেও সুস্থ হয়ে ওঠার হার প্রায় ২৯ শতাংশ। দেশটিতে মৃত্যু ২৪ হাজার ছাড়িয়েছে।
ইউরোপের আরেক দেশ জার্মানিতে বুধবার পর্যন্ত রোগী শনাক্ত হয়েছেন ১ লাখ ৬১ হাজারের বেশি। এর মধ্যে সুস্থ হয়েছেন ১ লাখ ২০ হাজারের বেশি। অর্থাৎ দেশটিতে সুস্থ হয়ে উঠেছেন মোট শনাক্ত রোগীর ৭৪ দশমিক ৫৩ শতাংশ। করোনার সংক্রমণ যে চীন থেকে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে, সেখানেও সুস্থ হয়ে উঠেছেন মোট শনাক্ত রোগীর ৯৩ দশমিক ৬২ শতাংশ। আর মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইরানে সুস্থ হয়ে উঠেছেন মোট শনাক্ত রোগীর ৭৮ দশমিক ৭৯ শতাংশ। ৩০ এপ্রিল বৃহ¯পতিবার পর্যন্ত দেশটিতে করোনাভাইরাসে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৯৪ হাজার ৬৪০ জনের বেশি, মৃত্যূর সংখ্যা ৬ হাজার ২৮ জন এবং সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ত্যাগ করেছেন ৭৫ হাজার ১০৩ জন। তুরস্কে শনাক্ত হওয়া প্রায় ১ লাখ ১৮ হাজার রোগীর মধ্যে সুস্থ হয়েছেন ৩৭ দশমিক ৪৫ শতাংশ। আর রাশিয়ায় শনাক্ত হওয়া ১ লাখ ৬ হাজারের বেশি রোগীর মধ্যে এ পর্যন্ত সুস্থ হয়েছেন ১০ দশমিক ৯১ শতাংশ।
চীনের পরেই যে দেশটিতে করোনা ভাইরাস দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে সেটি হলো ইরান। তেমন কোনো পূর্ব প্রস্তুতির সুযোগ না দিয়ে হঠাৎ করেই করোনার তা-ব শুরু হয় চীনের ঘনিষ্ঠ ইরানে। ফলে প্রথমদিকে পরিস্থিতি সামলাতে কর্তৃপক্ষকে হিমশিম খেতে হয়েছে। তবে দ্রুতই ঘুরে দাঁড়ায় মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশটি । যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে সংকটে থাকা ইরান করোনা পরিস্থিতি যে খুব দক্ষতার সাথেই সামলে নিচ্ছে দেশটির অস্থায়ী করোনা চিকিৎসাকেন্দ্রগুলোর দিকে তাকালে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। খুবই পরিপাটি সেগুলো। সংকটের কয়েকমাস পর যুক্তরাজ্যের মত দেশকে যেখানে স্বাস্থ্য কর্মীদের পিপিই দিতে হিমশিম খেতে হয়, সেখানে ইরানে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। ইরান মৃত্যুর হার নিয়ন্ত্রণে ইউরোপ আমেরিকার চেয়ে সফলতা দেখিয়েছে। অথচ কঠিন এই সময়টাতে আইএমএফ এর কাছে ঋণ চেয়েও ইরান তা পায়নি যুক্তরাষ্ট্রের বাধার কারণে। ইরানে দ্রুত আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকলেও মৃত্যু ছিল সে তুলনায় অনেক কম। তার মানে হলো অসুস্থদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করতে সক্ষম হয়েছে ইরান।
জনসংখ্যার অনুপাতে ইরানে মৃত্যুর হার ইউরোপ-আমেরিকার চেয়ে অনেক কম। মৃত্যুর হার নিয়ন্ত্রণে দেশটি ইউরোপের সবচেয়ে সফল দেশে জার্মানির চেয়েও সাফল্য দেখিয়েছে । যেমন ¯েপনে প্রতি ১ হাজারে মারা গেছেন ৪৮২ জন আর ইরানে ৬৬ জন। যুক্তরাষ্ট্রে এই হার ১৫৮ এবং জামানিতে ৬৯। এতে বুঝা যাচ্ছে যে, অর্থনৈতিক সংকটে পর্যুদস্ত থাকলেও ইরানে স্বাস্থ্য সেবার মান এসব দেশের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।
ইরান এই সাফল্য পেয়েছে পদে পদে যুক্তরাষ্ট্রের বাধা উপেক্ষা করেই। ভয়াবহ এই মানবিক সংকটের মধ্যেও ইরানের উপর অবরোধ কঠিন থেকে কঠিনতর করেছে মার্কিন প্রশাসন। এই নিয়ে দেশের ভেতরে এবং বাইরে যথেষ্ট সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়েছে প্রেসিডেন্ট ট্রা¤পকে। ডেমোক্রেটরা বার বার বলছে ইরানের এই বিপদের সময় অমানবিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া উচিত। তবে নিষেধাজ্ঞা তোলা তো দূরের কথা, যুক্তরাষ্ট্র পদে পদে বাধা দিয়ে চলেছে ইরানকে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফ থেকে জরুরি ভিত্তিতে ৫০০ কোটি ডলার ঋণ চেয়েছিল ইরান। যুক্তরাষ্ট্র এই ঋণের বিরোধিতা করেছে। ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি বলেছেন, এই সংকটের সময় আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর উচিত তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করা। তিনি বলেন, আমরা আইএমএফ এর সদস্য। আমরা তাদের কাছে একটা আবেদন করেছি। ঋণ অনুমোদনের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের বৈষম্য করা তাদের উচিত হবে না। তবে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের এক খবরে বলা হয় আইএমএফের সর্ববৃহৎ অংশীদার যুক্তরাষ্ট্র ওই ঋণ আবেদন আটকে দেয়ার পরিকল্পনা করছে। প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি বলেছেন, এই মহামারির মধ্যেও ইরানের উপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা বহাল রাখা বর্বোরোচিত অপরাধ। তিনি বলেন, ইরানি জনগণ যখন করোনাভাইরাস মহামারির বিরুদ্ধে কঠিন লড়াইয়ে রয়েছে তখন মার্কিন নিষেধাজ্ঞা অমানবিকতার সকল সীমা অতিক্রম করেছে। নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকলেও করোনা মোকাবেলায় তেহরানের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়নি বলে দাবি করেন রুহানি। তিনি বলেন, মহামারি মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নির্মাণে ইরান প্রায় স্বয়ংস¤পূর্ণ। এই রোগ মোকাবেলায় অন্য দেশের তুলনায় ইরান অনেক বেশি সফল। ইরানি কর্মকর্তারা বলছেন, মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে করোনা মহামারি মোকাবেলায় তাদেরকে বেগ পেতে হলেও পরিস্থিতি এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার কমতে শুরু করেছে। ইরানের এই মহাবিপদ পাড়ি দেয়ার নেপথ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি দেশটির সেনাবাহিনী, বিপ্লবী গার্ড বাহিনীসহ সকল সশস্ত্র বাহিনী, অনেক বেসরকারি সংস্থা, ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান রেখেছে অনন্য অবদান।
ইরানের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম জানায়, করোনা মোকাবেলায় সারাদেশে কাজ করছে ১০ হাজার স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। এর মধ্যে চিকিৎসাবিজ্ঞানে অধ্যয়নরত ২৩০টি দলও রয়েছে। সারাদেশে সোয়া লাখ স্বেচ্ছাসেবী কাজ করছেন। তাঁরা ফেইস মাস্কসহ নানা প্রয়োজনীয় উপকরণ তৈরি করে তা বিলি করছেন। ইরানের সেনাবাহিনী করোনা চিকিৎসায় ২৮টি হাসপাতাল এবং বিপ্লবী গার্ডবাহিনী ৬টি ফিল্ড হাসপাতাল তৈরি করেছে। ইরানের শহর এবং খোলা জায়গাগুলো জীবাণুমুক্ত করার জন্য সেনাবাহিনী একটি মেগা প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এই প্রকল্পের আওতায় মাস্ক, জীবাণুনাশক সামগ্রী তৈরি, সারা দেশে কনসালটেশন কেন্দ্র এবং মোবাইল হাসপাতাল পরিচালনাসহ নানামুখি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। করোনাভাইরাস মোকাবেলায় ইরানের তৈরি ভেন্টিলেটর কেবল নিজেদের চাহিদা মেটাতেই সক্ষম হয়েছে তাই নয়; বরং এর চাহিদা বাড়ছে বিশ্বের অনেক দেশেই। রাশিয়া, ইতালি ও ¯েপনসহ কয়েকটি দেশ ইতোমধ্যে ভেন্টিলেটর রপ্তানির জন্য অনুরোধ জানিয়েছে ইরানকে। বর্তমানে ইরানের বিশেষজ্ঞরা করোনা নির্ণয়ের কিট তৈরি করছেন এবং সপ্তাহে এক লাখ কিট তৈরিতে তারা সক্ষম। করোনা সংক্রমিত ব্যক্তিকে দ্রুত চিহ্নিত করতে র‌্যাপিড অ্যান্টিবডি টেস্ট কিটও তৈরি করেছে দেশটি। এই টেস্ট কিট এর মাধ্যমে কম সময়ে বেশি মানুষকে পরীক্ষা করা যাবে। করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় ওষুধ উৎপাদনের চেষ্টাও থেমে নেই ইরানে। অ্যান্টিভাইরাল ড্রাগ ‘ফাভিপিরাভি’র উৎপাদনে কাজ করছে দেশটির তিন কো¤পানি। কোভিড-১৯ এর চিকিৎসায় ওষুধটি কার্যকর হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
বিশ্বে করোনাভাইরাসের ওপর পরিচালিত বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রকল্পের সংখ্যায় তৃতীয় স্থান অধিকার করেছে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান। দেশটির গবেষকরা এ পর্যন্ত করোনাভাইরাস সংশ্লিষ্ট ১ হাজার ২শ’র অধিক প্রকল্প পরিচালনা করেছেন। ইরানের উপস্বাস্থ্যমন্ত্রী রেজা মালেকজাদেহ এই তথ্য জানিয়েছেন।
তিনি জানান, করোনাভাইরাসের ওপর গবেষণা ও উন্নয়ন প্রকল্প পরিচালনা করে আন্তর্জাতিক পরিম-লে আমরা স্বল্প সময়ের মধ্যে দারুণ সব বৈজ্ঞানিক পণ্য তুলে ধরেছি। বর্তমানে দেশে পরিচালিত করোনাভাইরাস গবেষণার অধিকাংশই ইন্টারভেনশনাল স্কিমের আওতায়। এর মধ্যে ৩৫টি স্কিম কোভিড-১৯ এর কার্যকর চিকিৎসা উদ্ভাবন করছে বলে জানান ইরানি এই মন্ত্রী।
ইরানের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট সোরেনা সাত্তারি বলেছেন, তাঁর দেশের জ্ঞানভিত্তিক কোম্পানিগুলো করোনাভাইরাসের চিকিৎসায় প্রচুর সংখ্যক সরঞ্জাম উৎপাদন করেছে। ইরান এখন এসব সরঞ্জাম অন্যান্য দেশে রপ্তানি করতে সক্ষম। সাত্তারি বলেন, মেডিকেল সরঞ্জাম ও স্বাস্থ্যসেবা খাতে জ্ঞানভিত্তিক কোম্পানিগুলো দুর্দান্ত অগ্রগতি লাভ করেছে। এসব কোম্পানি আইসিইউ ও সিসিইউ সরঞ্জাম, সিটি-স্ক্যান মেশিন, করোনাভাইরাস শনাক্তকারী কিট, জীবাণুনাশক উৎপাদন করছে। ফার্মগুলোর বিশেষভাবে লক্ষণীয় পদক্ষেপের একটি হলো দিনে ৬০ লাখ মাস্ক উৎপাদন করা।
অপরদিকে ইরানে করোনাভাইরাস মোকাবেলায় বক্তিগত ও গোষ্ঠীগত স্থাস্থ্য সচেতনতা বাড়াতে দেশটিতে আয়োজন করা হয়েছে আন্তর্জাতিক চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার। একইসাথে করোনাভাইরাস মহামারি প্রতিরোধে স্বেচ্ছায় বাসাবাড়িতে অবস্থান করা নাগরিকদের মনোরঞ্জনে ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নিয়েছেন ইরানি শিল্পীরা। এলক্ষ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেশব্যাপী একটি বিনোদনমূলক ক্যা¤েপইন চালু করেছেন দেশটির কয়েকশ শিল্পী। এক বিবৃতিতে নাটকের অভিনেতা, চলচ্চিত্র নির্মাতা, চিত্রশিল্পী, কার্টুনিস্ট ও লেখকরা বলেন, তাঁরা সোশ্যাল নেটওয়ার্কে প্রদর্শনের জন্য বিভিন্ন শিল্পকর্ম তৈরি করছেন। বাসাবাড়িতে থাকা আনন্দময় ও সহনীয় করে তুলতে তারা আগামী ১শ দিন এসব শিল্পকর্ম প্রদর্শন করবেন। এক্ষেত্রে এগিয়ে এসেছে দেশটির বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় মিউজিক দলও। হোম কোয়ারিন্টিনে থাকা মানুষের দিনগুলো আনন্দময় করে তুলতে অনলাইন কনসার্টের আয়োজন করেছে তারা। রাস্তাক, জুয়ানা ও গিল-ও-আমার্দ এর মতো বিখ্যাত সংগীত ব্যান্ডগুলো এতে পারফর্ম করছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা হু এর রিজিওনাল ইমারজেন্সি ডিরেক্টর রিচার্ড ব্রেননান বলেছেন, করোনাভাইরাস মোকাবেলায় ইরান গঠনমূলক প্রতিরোধ পদক্ষেপ নিয়েছে। তিনি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া নোভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) মোকাবেলায় ইরানের ফলপ্রসূ অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানোর জন্য অঞ্চলের অন্য দেশগুলোকে আহ্বান জানিয়েছেন।
ইরানের প্রেসিডেন্ট ড. হাসান রুহানি বলেছেন, মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে চিকিৎসা সরঞ্জাম সংগ্রহের ক্ষেত্রে নানা প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও করোনাভাইরাস মোকাবিলায় তাঁর দেশ উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। তিনি বলেন, বিশ্বের অনেক উন্নত দেশ করোনা রোগীদের চিকিৎসা দিতে হিমশিম খেলেও ইরানে এই প্রাণঘাতী রোগে আক্রান্ত কোনো রোগী বিনা চিকিৎসায় মারা যায়নি। নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও করোনা রোগীদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করেছে তেহরান।

ইসলামি বিপ্লবের ৪১ বছরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইরানের বিস্ময়কর উন্নয়ন

সাইদুল ইসলাম

দুনিয়া-কাঁপানো ইসলামি বিপ্লবের গৌরবময় ৪১ বছর পূর্তি হলো গত ১১ ফেব্রুয়ারি। ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দিবসটি পালিত হয়েছে। এই বিপ্লব ইরানে যুগান্তকারী পরিবর্তনের সূচনা করেছিল।বলা হয় এটি ছিল মানব ইতিহাসের এক নজিরবিহীন বিপ্লব। যার মাধ্যমে পতন ঘটে আড়াই হাজার বছরের শক্তিশালী ও স্বৈরাচারী রাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার। অবসান হয় মার্কিন কর্তৃত্বসহ পরাশক্তিগুলোর মোড়লিপনার। বহু বিশ্লেষকের মতে এ বিপ্লব বিগত এক হাজার বছরের সেরা আদর্শিক বিপ্লব, যা ইরানি জাতির জন্য ফিরিয়ে আনে প্রকৃত স্বাধীনতা, সম্মান ও উন্নয়নের বিরতিহীন অগ্রযাত্রার সেই গৌরবের ধারা।
কিন্তু এ বিপ্লবের ফলে দিশেহারা হয়ে পড়া মার্কিন পরাশক্তি ও তার মিত্ররা গত প্রায় চার দশক ধরে একের পর এক বিছিয়ে যাচ্ছে নানা ধরনের ষড়যন্ত্রের জাল। এইসব ষড়যন্ত্র অনুযায়ী তারা কখনও পরোক্ষ যুদ্ধ আবার কখনও কঠোর অর্থনৈতিক অবরোধসহ নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে এবং এখনও করে যাচ্ছে। কিন্তু মার্কিন নেতৃত্বাধীন ওইসব দাম্ভিক পরাশক্তির চাপিয়ে দেয়া এসব অবরোধ ও কূটকৌশলের কাছে নতজানু হওয়া দূরের কথা, বরং খাঁটি ইসলামের অদম্য শক্তির বলে দিনকে দিন ভেতরে ও বাইরে এবং বিশ্ব-অঙ্গনে শক্তিশালী হচ্ছে ইসলামি বিপ্লবের দেশ ইরান। বিশেষ
করে উন্নয়নের অনেক মৌলিক ক্ষেত্রে দুনিয়াকে তাক লাগিয়ে দেয়ার মতো বহু সাফল্য অর্জন করেছে দেশটি। কৃষি, শিক্ষা, শিল্প, পর্যটন, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, স্বাস্থ্য-চিকিৎসা, মহাকাশ গবেষণা ও সামরিক খাতে ইরানের উন্নয়ন বিশ্ববাসীকে বিস্মিত করে চলেছে।
সম্প্রতি ইরান মহাকাশে উৎক্ষেপণ করেছে নিজস্ব প্রযুক্তির সামরিক উপগ্রহ ‘নুর-১’। এর মধ্য দিয়ে ইরানের প্রতিরক্ষা শক্তির নতুন একটি অধ্যায় রচিত হয়েছে। সামরিক উপগ্রহ হিসেবে ‘নুর-১’ এর অবস্থান প্রথম হলেও এটি নিয়ে ইরান এ পর্যন্ত মহাকাশে পাঁচটি উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করেছে। দেশটির দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র এবং ক্রুজ ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলো এখন লক্ষ্যবস্তুতে নিখুঁতভাবে আঘাত হানতে সক্ষম। বিজ্ঞান-গবেষণায় ইসলামি ইরান এখন বিশ্বের শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকটি দেশের অন্যতম। এই নিবন্ধে ইসলামি বিপ্লবের পর গত ৪১ বছরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইরানের সার্বিক উন্নয়নের একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরা হলো:

শিল্প, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে উন্নয়ন
একটি দেশ তথা জাতির উন্নয়নের প্রধান চালিকাশক্তি হচ্ছে জ্ঞান-বিজ্ঞান। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে যে জাতি যত বেশি এগিয়ে সে জাতি তত উন্নত। বলা হয়ে থাকে, জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ কোন জাতি যেকোন সময় যে কোন কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে সক্ষম। আর এ বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব দিয়েই ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতার নির্দেশে দেশটির বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদরা চরম আত্মত্যাগ ও সাধনার মাধ্যমে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অভাবনীয় সাফল্যের স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। বিজ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রে ইরানের বিজ্ঞানীদের অগ্রগতি সমগ্র বিশ্বের বিজ্ঞানীদের গড় অগ্রগতির চেয়ে ১১ গুণ দ্রুততর (ঋধংঃবংঃ)। সব দেশের বৈজ্ঞানিক অবস্থান বিশ্লেষণ নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান সায়েন্স-মেট্রিক্স এ তথ্য জানিয়ে বলেছে, বৈশ্বিক পরিম-লে ইরানের বাস্তবিক এই উন্নতি বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে দেশটিকে দ্রুতবর্ধণশীল দেশ হিসেবে পরিণত করেছে। বিশ্বের সকল দেশের বৈজ্ঞানিক অবস্থানের তুলনামূলক বিভিন্ন পরিসংখ্যানে ইরানের অগগ্রতি সু¯পষ্টভাবে উঠে এসেছে।
মর্যাদাপূর্ণ বিশ্লেষণধর্মী ওয়েবসাইট ও গবেষণা বুদ্ধিমত্তা প্ল্যাটফর্ম ওয়েব অব নলেজ এ নিয়ে দারুণ ফলাফল তুলে ধরেছে। ওয়েবসাইটটির প্রতিবেদনে বলা হয়, ইরান ১৯৭৮ সালে ৬৬৯টি বৈজ্ঞানিক নিবন্ধ প্রকাশ করে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বৈশ্বিকভাবে নিবন্ধ প্রকাশে ইরানের অবদান ছিল ০.০১ শতাংশ। একই সূচকে ইসলামি বিপ্লবত্তোর ইরান ব্যাপক অগ্রগতি লাভ করে। ২০১৮ সালে ইরানি বিজ্ঞানী ও গবেষকদের মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক নিবন্ধ প্রকাশের সংখ্যা নাটকীয়ভাবে বেড়ে দাঁড়ায় ৫৫ হাজার ৫০৯টিতে। অর্থাৎ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৮২ গুণ। এই আকস্মিক প্রবৃদ্ধিতে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও প্রকাশনায় বিশ্বের শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে ১৬তম অবস্থানে উঠে আসে।
এসসিআইমাগো জার্নাল র‌্যাঙ্কিংয়ে, ১৯৯৬ সালে উদ্ধৃতযোগ্য বৈজ্ঞানিক নিবন্ধ প্রকাশের দিক দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে ইরান ৫ম স্থান অধিকার করেছিল। ২০১৭ সালে সেখানে ইরান সৌদি আরব, মিশর, তুরস্ক ও ইহুদিবাদী ইসরাইলকে পেছনে ফেলে উদ্ধৃতযোগ্য বৈজ্ঞানিক নিবন্ধ প্রকাশে মধ্যপ্রাচ্যে শীর্ষস্থান অধিকার করে।
এদিকে, বিশ্বে করোনাভাইরাসের ওপর পরিচালিত বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রকল্পের সংখ্যায় তৃতীয় স্থান অধিকার করেছে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান। দেশটির গবেষকরা এ পর্যন্ত করোনাভাইরাস সংশ্লিষ্ট ১ হাজার ২শ’র অধিক প্রকল্প পরিচালনা করেছেন। ১ মে ইরানের উপস্বাস্থ্যমন্ত্রী রেজা মালেকজাদেহ এই তথ্য জানিয়েছেন।
তিনি জানান, করোনাভাইরাসের ওপর গবেষণা ও উন্নয়ন প্রকল্প পরিচালনা করে আন্তর্জাতিক পরিম-লে আমরা স্বল্প সময়ের মধ্যে দারুণ সব বৈজ্ঞানিক পণ্য তুলে ধরেছি। বর্তমানে দেশে পরিচালিত করোনাভাইরাস গবেষণার অধিকাংশই ইন্টারভেনশনাল স্কিমের আওতায়। এর মধ্যে ৩৫টি স্কিম কোভিড-১৯ এর কার্যকর চিকিৎসা উদ্ভাবন করছে বলে জানান ইরানি এই মন্ত্রী।
২০০৫ সালে মধ্যপ্রাচ্যে বৈজ্ঞানিক প্রকাশনায় ইরানের অবদান ছিল ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ। ২০১৪-১৫ সালে অবদান বেড়ে দাঁড়ায় ২৮ দশমিক ৬ শতাংশ। ২০০৫ সালে বৈজ্ঞানিক প্রকাশনায় মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের অবস্থান ছিল তৃতীয়, সেখানে ২০১৪-১৫ সালে একেবারে শীর্ষ স্থান দখল করেছে দেশটি। ইরানে ২০১৪ সালে জ্ঞানভিত্তিক ফার্ম ছিল ৫২টি, ২০১৭ সালের মে পর্যন্ত তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩০৩২টিতে। এসব কো¤পানিতে ৯০ হাজার ব্যক্তির কর্মসংস্থান হয়েছে, রাজস্ব আদায় হয়েছে ৯ দশমিক ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ইরানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি পার্কের সংখ্যাও উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। ২০০২ সালে যেখানে মাত্র ১টি পার্ক ছিল এখন সেখানে রয়েছে ৩৯টি।
এক কথায় বলতে গেলে ইসলামি বিপ্লবের গত ৪১ বছরে ইরান বায়োপ্রযুক্তি, ন্যানোপ্রযুক্তি, ওষুধ শিল্পসহ বিজ্ঞানের প্রায় সব ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব উন্নতি সাধন করেছে। দেশটি এখন মধ্যপ্রাচ্যে সবচেয়ে বেশি গাড়ি নির্মাণকারী দেশ। পরিবহন খাতে বিরাট উন্নতি ঘটিয়েছে। এছাড়া, মধ্যপ্রাচ্যের ভেতরে ইরান হচ্ছে নির্মাণ, গৃহস্থালিতে ব্যবহার্য জিনিসপত্র, খাদ্য ও কৃষিপণ্য উৎপাদন, অস্ত্র ও তথ্যপ্রযুক্তি, বিদ্যুৎ এবং পেট্রোকেমিক্যাল উৎপাদনে সবচেয়ে অগ্রগামী দেশ। ২০০৯ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ‘সাফির’ নামে একটি রকেট উৎক্ষেপণের মাধ্যমে ইরান সর্বপ্রথম কক্ষপথে তার কৃত্রিম উপগ্রহ স্থাপনে সাফল্য অর্জন করে। নিজস্ব র্প্রযুক্তিতে তৈরি স্যাটেলাইট ও দেশে নির্মিত লাঞ্চারের মাধ্যমে রকেট উৎক্ষেপণে বিশ্বে যে সাতটি দেশ সক্ষম ইরান এখন তার একটি। এছাড়া, ইউরেনিয়াম হেক্সাফ্লুরাইড উৎপাদন ও পুরো ‘পরমাণু জ্বালানি চক্র’ নিয়ন্ত্রণে সক্ষম এলিট ক্লাবের সদস্য দেশ ইরান। অ্যারো¯েপইস সায়েন্সেও আঞ্চলিক ক্ষেত্রে প্রথম এবং বিশ্বে ১৫তম অবস্থানে রয়েছে। এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে মহাকাশ বিজ্ঞান গবেষণা র‌্যাঙ্কিংয়ে শীর্ষে রয়েছে ইরান। মহাশূন্যে নিজস্ব র্প্রযুক্তিতে নির্মিত স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণে সক্ষম দেশের মধ্যে ইরানের অবস্থান নবম এবং মহাকাশযানে প্রাণি পাঠানোর ক্ষেত্রে ইরানের অবস্থান ষষ্ঠ। স্টেমসেল গবেষণার ক্ষেত্রে ইরান প্রথম সারির ১০টি দেশের মাঝে অবস্থান করছে। স্টেমসেল রিপ্লেস করার ক্ষেত্রে বিশ্বে ইরানের অবস্থান দ্বিতীয়।

ন্যানো প্রযুক্তির ব্যবহার
কারিগরি ও প্রযুক্তিক্ষেত্রে এখন ন্যানোর্প্রযুক্তি একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রায় সকল বিভাগেই এই ন্যানো প্রযুক্তি এখন গুরুত্বপূর্ণ স্থান করে নিয়েছে। এই প্রযুক্তিতে বিশ্বে ইরানের অবস্থান চতুর্থ। মেডিসিন, ইঞ্জিনিয়ারিং, ফার্মাসিউটিক্যালস, পশু চিকিৎসা, পরিবেশবিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান, মলিকিউল, এমনকি মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়েও এই প্রযুক্তির ব্যবহার লক্ষণীয়। ন্যানো র্প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ইরানে এখন অন্তত ৩০০টি পণ্য উৎপাদিত হচ্ছে। এসব পণ্য ইরানের বাইরে ১৭টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। গবেষণাগারের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম, শিল্প সরঞ্জাম, টেক্সটাইল সরঞ্জাম, লন্ড্রি বা ডিজারজেন্ট পণ্য সামগ্রী, কৃষি ও ভবন নির্মাণ সরঞ্জাম ইত্যাদি ন্যানো প্রযুক্তিজাত পণ্যের অন্তর্ভুক্ত। টেক্সটাইল শিল্প পণ্যের ক্ষেত্রে হাসপাতালে ব্যবহৃত বেডশিটের কথা বলা যেতে পারে। ন্যানো প্রযুক্তির ব্যবহার করে নির্মিত এইসব বেডশিট অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল মানে কোনোরকম ব্যাকটেরিয়া এসব চাদরে আক্রমণ করতে পারবে না। শিশুদের জামা-কাপড়ও এই ন্যানো প্রযুক্তির মাধ্যমে তৈরি করা হয়। স্যাটেলাইট-রশ্মি, মাইক্রোওয়েভ রশ্মি প্রতিরোধক কাপড়ও ন্যানো প্রযুক্তির মাধ্যমে তৈরি করা হয়। বায়ুম-লীয় ঠা-া প্লাজমা শিল্প মেশিনের কথা না বললেই নয়। এই শিল্পে এখন তাঁত শিল্পসহ খাবার, চিকিৎসা, প্যাকেজিং এবং স্টেরিলাইজ করা হয়। এমনকি পরিবেশবিজ্ঞানেও এই প্রযুক্তির ব্যবহার ব্যাপকভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

মহাকাশবিজ্ঞান
মহাকাশ প্রকৌশলেও ইরানের ক্রমবর্ধমান প্রবৃদ্ধি দেখা গেছে। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ১৯৯৬ সালে বিশ্বে মহাকাশ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বৈজ্ঞানিক নিবন্ধ উৎপাদনে ইরান ৪৫তম অবস্থানে ছিল। এই র‌্যাঙ্কিংয়ে দেশটি দ্রুত প্রবৃদ্ধি লাভ করে। ২০১৭ সালে মহাকাশের ওপর বৈজ্ঞানিক উৎপাদনের দিক দিয়ে বিশ্বে ইরান ১১তম স্থান অর্জন করে। পশ্চিম এশিয়া অঞ্চলে ১৯৯৬ সালে মহাকাশের ওপর বৈজ্ঞানিক নিবন্ধ প্রকাশে ইরান ষষ্ঠতম স্থানে ছিল। ইসলামি প্রজাতন্ত্র সরকার বিজ্ঞানের উৎপাদন বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করে এবং বিজ্ঞানী ও গবেষকদের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সরবরাহ ও পরিবেশ নিশ্চিত করে। ফলে ২০১৭ সালে মহাকাশে বৈজ্ঞানিক উৎপাদনের দিক দিয়ে পশ্চিম এশিয়া অঞ্চলে দেশটি প্রথম স্থান অধিকার করে। অঞ্চলের অন্যান্য দেশ এক্ষেত্রে ইরান থেকে অনেক পিছিয়ে রয়েছে।

পরমাণু প্রযুক্তি
ইসলামি বিপ্লব পরবর্তী সময়ে বিজ্ঞানের আরও একটি ক্ষেত্রে ইরান উল্লেখযোগ্য অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। সেটি হলো পরমাণু প্রকৌশল ও বিজ্ঞান। এসসিআইম্যাগো জার্নালের তথ্যমতে, ১৯৯৬ সালে ইরান বৈজ্ঞানিক উৎপাদন ও পেপারের দিক দিয়ে বিশ্বে ৭০তম স্থানে ছিল। ইরানি স্কলার ও বিশেষজ্ঞদের প্রচেষ্টায় ২০১৭ সালে এই ক্ষেত্রে ইরান ৩৫৪টি বৈজ্ঞানিক নিবন্ধ প্রকাশ করে। এতে বিশ্বে ১২তম অবস্থানে উঠে আসে ইরান। বর্তমানে পরমাণু প্রকৌশল ও জ্বালানির ওপর বৈজ্ঞানিক নিবন্ধ প্রকাশের সংখ্যায় পশ্চিম এশিয়ায় ইরান প্রথম স্থানে রয়েছে।

শিক্ষা
ইসলামি বিপ্লবের গত ৪১ বছরে ইরানে শিক্ষা খাতে ব্যাপক অগ্রগতি হয়েছে। বর্তমানে দেশটির শতকরা ৯৭ ভাগ মানুষ শিক্ষিত। ইসলামি শিক্ষা-দর্শনের ভিত্তিতে দেশের প্রয়োজনের প্রতি দৃষ্টি রেখে এবং বিজ্ঞান ও র্প্রযুক্তি ক্ষেত্রে অগ্রগতির সাথে তাল মিলিয়ে শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো হয়েছে।বিশেষ করে উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে দেশটির অগ্রগতি চোখে পড়ার মতো। ইরানের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে ১৫৪টি, পাবলিক মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে ৫৮টি, বেসরকারি ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় ৫৬৭টি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে ৩৫৪টি। এর মধ্যে বিশ্ব সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তালিকায় রয়েছে ইরানের ২৪টি বিশ্ববিদ্যালয়। ইনফরমেশন সায়েন্স ইনস্টিটিউটের (আইএসআই) এক জরিপে এ তথ্য জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বিশ্বের সবচেয়ে কার্যকর শিক্ষাকেন্দ্র ও প্রতিষ্ঠানের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে ইরানের ২৪টি বিশ্ববিদ্যালয়। এর মধ্যে তেহরান মেডিকেল সায়েন্স ইউনিভার্সিটি, ইরান পলিমার অ্যান্ড পেট্রোকেমিকেল ইনস্টিটিউট, তেহরান বিশ্ববিদ্যালয় ও আমির কবির ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি অন্যতম।

চিকিৎসা
ইসলামি বিপ্লবের গত ৪১ বছরে চিকিৎসাখাতে ইরানের উন্নয়ন যেকারো দৃষ্টি আকর্ষণ করতে বাধ্য। বিপ্লবের আগে যে দেশটির অনেক শহরে ইরানি ডাক্তার খুঁজে পাওয়া দুরূহ ব্যাপার ছিল সে ইরানের নাম এখন চিকিৎসাবিজ্ঞানে বিশ্বের শীর্ষ দেশগুলোর তালিকায়। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন মতে, স্বাস্থ্য ও ওষুধের ক্ষেত্রে ইরান বিস্ময়কর প্রবৃদ্ধি ও বিশাল অগ্রগতি লাভ করেছে। সম্ভাব্য আয়ুষ্কাল ৫০ বছর থেকে বেড়ে ৭৫ এ ছুঁয়েছে। বিপ্লবের আগে অনূর্ধ্ব ৫ বছর বয়সী শিশুদের প্রতি হাজারে মৃত্যু হার ছিল ১৮৫। চিকিৎসা বিজ্ঞানের আশীর্বাদে অনূর্ধ্ব ৫ বছর বয়সী শিশুদের মৃত্যুহার কমে হাজারে ১৪ দশমিক ৯ জনে নেমে এসেছে। এছাড়া ইরানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়তে দেখা গেছে। বিপ্লবের আগে সাধারণ মানুষদের উচ্চ শিক্ষা, বিশেষত মেডিসিনে পড়ালেখা করা প্রায় অসম্ভব ছিল। কেবল অভিজাত শ্রেণির মানুষজন এই সুযোগ পেতো। সেই সময় গোটা দেশে মাত্র ৫ হাজার ৮৯০ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ছিলেন। বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে দেশটিতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, বিশেষত নারী চিকিৎসকদের সংখ্যাই ৩৬ হাজারে পৌঁছেছে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন মতে, ইরান ২০১৯ সালে হাসপাতালের সংখ্যা ও মানের দিক দিয়ে বিশ্বে ২১তম স্থান অর্জন করে। সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণের দিক দিয়ে ইরান বিশ্বে দ্বিতীয় দেশের স্বীকৃত লাভ করে। ইরানের সেনিটেশন ও মেডিকেল অগ্রগতির অবস্থা এত প্রশংসনীয় যে, এই ক্ষেত্রে অবদানের জন্য ইউনিসেফ ইরানকে ধন্যবাদ জানিয়েছে। বিশ্বব্যাপী মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়া করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় ইরানের অবস্থান তুলে ধরে দেশটির প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি বলেন, বিশ্বের বহু উন্নত দেশ করোনা রোগীদের চিকিৎসা দিতে হিমশিম খেলেও ইরানে এই প্রাণঘাতী রোগে আক্রান্ত কোনো রোগী বিনা চিকিৎসায় মারা যায়নি। নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও করোনা রোগীদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করেছে তেহরান।
২০১৬ সালের জানুয়ারিতে প্রকাশিত থমসন রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের সেরা ১ ভাগ চিকিৎসা গবেষকদের মধ্যে অন্তত ৩৬ জন ইরানি গবেষক স্থান করে নিয়েছেন। থমসন রয়টার্স প্রতিনিয়ত বিশ্বের চিকিৎসা গবেষকদের একটি তালিকা আপডেট করে থাকে। গত ১০ বছরের চিকিৎসা গবেষণার কর্ম থেকে গবেষকদের এ ধরনের তালিকা করা হয়েছে। বার্তা সংস্থা ইরনার এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, ইরান বিশ্বের শীর্ষ ১০টি ওষুধ উৎপাদনকারী দেশের একটি। দেশটি বর্তমানে বিশ্বের ৪৪টি দেশে চিকিৎসা সরঞ্জাম রপ্তানি করছে। সম্প্রতি ইরানের চিকিৎসা সরঞ্জাম রপ্তানিকারকদের ইউনিয়নের সচিব মোহাম্মাদ রেযা জানিয়েছেন, প্রতি বছর বিশ্বের ৪৪টি দেশে তিন কোটি ডলারের চিকিৎসা সরঞ্জাম ইরান থেকে রপ্তানি হয়। রপ্তানির পরিমাণ আরও বাড়ানোর ইচ্ছে রয়েছে বলে তিনি জানান। তিনি আরও বলেন, ইরানের চিকিৎসা সরঞ্জাম জার্মানি ও ইতালিসহ ইউরোপের দেশগুলোতে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয়। এসব সরঞ্জাম ইউরোপীয় মান নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিই-র অনুমোদনপ্রাপ্ত।
এদিকে, ইরানের চিকিৎসা খাতে ব্যবহৃত জৈব পণ্য উৎপাদন এবং রপ্তানি সংস্থার পরিচালক আমির হোসেইন কারাগাহ জানিয়েছেন, ইরান কেবল বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ওষুধ রপ্তানি করছে তা-ই নয়, একই সাথে দেশটি জৈব ওষুধ প্রস্তুত সংক্রান্ত প্রযুক্তি এবং অভিজ্ঞতাও রপ্তানি করছে। তিনি বলেন, এ জাতীয় র্প্রযুক্তি রপ্তানির মধ্য দিয়ে ইরানের জৈব ওষুধ উৎপাদনের উচ্চ সক্ষমতাই ফুটে উঠেছে। বর্তমানে ইরান এ জাতীয় ওষুধ নির্মাণের প্রযুক্তি তুরস্ক, মালয়েশিয়া, ইরাক, আর্মেনিয়া, কাযাকস্তান এবং রাশিয়াসহ বিভিন্ন দেশ রপ্তানি করছে। গত কয়েক বছরে ইরান প্রায় এক ডজনের বেশি জৈব ওষুধ উৎপাদন করেছে। এতে ইরান প্রায় ৭০ কোটি ডলারের বেশি পরিমাণে অর্থ বিদেশে যাওয়া থেকে সাশ্রয় করতে পেরেছে।
এ ছাড়াও ইরানি বিজ্ঞানীরা শক্তিশালী মৌলিক কোষ তৈরি করতে সক্ষম হওয়ায় ইরান এ ক্ষেত্রে বিশ্বের সেরা ৫টি দেশের মধ্যে স্থান করে নিয়েছে। বিশ্বের খ্যাতনামা বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী মৌলিক কোষ নির্মাণে ইরানের সাফল্যের কথা স্বীকার করেছে। ফলে ইরান এক্ষেত্রে বিশ্ব অঙ্গনে জার্মানি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও চীনের পরই নিজের বিজয় পতাকা উড্ডীন করতে সক্ষম হয়।
ক্যান্সার চিকিৎসায়ও ইরানি বিজ্ঞানীরা উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছেন। তেহরানের কে এন তূসি প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা ন্যানো র্প্রযুক্তি ব্যবহার করে এমন একটি যৌগ আবিষ্কার করেছেন যার সাহায্যে মানবদেহে ক্যান্সার চিহ্নিত করা যাবে। এধরনের যৌগ উৎপাদন করা যাবে বেশ সস্তায় এবং এতে অপেক্ষাকৃত কম খরচে ক্যান্সার রোগীর চিকিৎসা স¤পন্ন করা যাবে।
হৃদযন্ত্র প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রেও ইরানি চিকিৎসকদের সাফল্য চোখে পড়ার মতো। ইরান বছরে প্রায় ১০০ হৃদযন্ত্র প্রতিস্থাপন অস্ত্রোপচার করে থাকে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে ইরান হৃদযন্ত্র প্রতিস্থাপন ও হৃদরোগ চিকিৎসায় শীর্ষে অবস্থান করছে। এছাড়া অঙ্গ ও কিডনি প্রতিস্থাপনে ইরানি চিকিৎসকদের খ্যাতি এখন বিশ্বজুড়ে।২০১৬ সালের প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ২০১৫ সালে আড়াই হাজার মানুষের কিডনি ও ৩৩শ’ মানুষের অঙ্গ প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। ইরানে বর্তমানে ২৯টি কিডনি প্রতিস্থাপন কেন্দ্র, যকৃত প্রতিস্থাপনে ৭টি কেন্দ্র, ৮টি হৃদযন্ত্র ও ২টি ফুসফুস প্রতিস্থাপন কেন্দ্র কাজ করছে।

মেডিক্যাল ট্যুরিজম
মেডিক্যাল ট্যুরিজম শিল্পে ইরান এখন উন্নয়নশীল দেশগুলোর কাতারে রয়েছে। এখন সারা বছর জুড়েই বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বহু মানুষ চিকিৎসার জন্য ইরানে আসছেন। বেশিরভাগ রোগী হলেন ব্রিটেন, সুইডেনসহ পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলোর। ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য নীতিতে চিকিৎসা ব্যয় কমানোর ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এ কারণে ইরানে যেকোনো অপারেশনের ব্যয় তুরস্ক, ব্রিটেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক চতুর্থাংশের মতো। তবে চিকিৎসার গুণগত অবস্থা বিশ্বমানের। সেজন্যই বিদেশী রোগীরা ইরানের চিকিৎসার মানের ব্যাপারে সন্তুষ্ট। এছাড়া ইরানি অস্ত্রোপচারকারী চিকিৎসক এবং সাধারণ চিকিৎসকগণ বেশ দক্ষ। বিদেশী সহযোগীরা সবসময়ই তাঁদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। এশিয়ার দেশগুলোর মাঝে মেডিক্যাল ট্যুরিজম ক্ষেত্রে কঠোর প্রতিযোগিতা চলছে। এই প্রতিযোগিতায় ইরানের অবস্থান বিশ্বের শ্রেষ্ঠ দশটি দেশের মধ্যে রয়েছে। ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় মেডিক্যাল ট্যুরিজম ক্ষেত্রে এশীয় দেশগুলোর সাথে সহযোগিতা বৃদ্ধি সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষরও করেছে। বর্তমানে বছরে প্রায় ২ লাখ রোগী মেডিক্যাল ট্যুরিজমের লক্ষ্যে ইরান সফরে আসে এবং ইরানের উন্নত চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করে উপকৃত হচ্ছে। ইরানের অন্তত ৬০টি হার্ট অপারেশন কেন্দ্রে ওপেন হার্ট সার্জারি হচ্ছে। ইরানের এই চিকিৎসা সেবা বিশ্বের চিকিৎসকগণকে আকৃষ্ট করছে। কেবল ওপেন হার্ট সার্জারিই নয়, আরো বহু জটিল ও মারাত্মক রোগের চিকিৎসা এখন বেশ উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে করা হচ্ছে।

রপ্তানি খাত
একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি হলো রপ্তানি খাত। এই খাতে যে দেশ যত বেশি শক্তিশালী সেই দেশ অর্থনৈতিকভাবে তত বেশি সমৃদ্ধ। আর এক্ষেত্রে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান উদীয়মান অর্থনীতির সম্ভাবনাময় দেশ হিসেবে পরিকল্পিতভাবে এগিয়ে যাচ্ছে সমৃদ্ধির ইতিবাচক গতিধারায়। তেলের ওপর নির্ভরতাই ছিল এক সময় দেশটির অর্থনীতির প্রধান চালিকা শক্তি। কিন্তু সেই তেলনির্ভর অর্থনীতি থেকে ক্রমশ বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে দেশটি। ইসলামি বিপ্লবের পর বিগত ৪১ বছরে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তিগুলোও পাল্টে যাচ্ছে। ক্রমশ শিল্প, কৃষি ও সেবা খাতের বিকাশ ঘটছে। এর ফলে দেশটির অর্থনীতির মৌলিক কাঠামো অনেকটাই বদলে যাচ্ছে। ইরানের ওপর চাপিয়ে দেওয়া নিষ্ঠুর অবরোধ সত্বেও দেশটি গত ফারসি বছরে বিশ্বের ১২৮টি দেশে পণ্য রপ্তানি করতে সক্ষম হয়েছে।
ইরানের শুল্ক প্রশাসনের (আইআরআইসিএ) প্রেসিডেন্ট মেহদি মির-আশরাফি বলেন, গত বছর ইরানের বৈদেশিক বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৮৫ দশমিক ১০৭ বিলিয়ন ডলার। ইরান গত ফারসি বছরের প্রথম দশ মাসে কেবল (২১ মার্চ ২০১৮ থেকে ২১ জানুয়ারি ২০১৯) প্রতিবেশী ১৫টি দেশে ৫৭ দশমিক ২৮ মিলিয়ন টনের তেলবহির্ভূত পণ্য রপ্তানি করেছে। এই রপ্তানি থেকে দেশটির আয় হয়েছে প্রায় ৩০বিলিয়ন মার্কিন ডলার। যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ওজনের দিক দিয়ে ৩৪ দশমিক ৩৪ শতাংশ কম এবং মূল্যের দিক দিয়ে ৩ দশমিক ৪৯ শতাংশ বেশি। ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের শুল্ক প্রশাসন প্রকাশিত সর্বশেষ পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত বছরের প্রথম দশ মাসে ইরান সর্বমোট ৫০ দশমিক ৪৬ মিলিয়ন টন পণ্যসামগ্রী রপ্তানি করেছে। এই রপ্তানি থেকে দেশটির আয় হয়েছে ২০ দশমিক ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ওজনের দিক দিয়ে ১৬ দশমিক ১২ শতাংশ এবং মূল্যের দিক দিয়ে ২১ দশমিক ৯৬ শতাংশ বেশি।
ইরানে তেলবহির্ভূত পণ্য রপ্তানির তালিকায় প্রথম স্থানে রয়েছে প্লাস্টিক ও প্লাস্টিকের জিনিসপত্র, দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে জৈব রাসায়নিক পণ্যসামগ্রী, তালিকায় তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে আকরিকসহ ধাতব দ্রব্যসমূহ, চতুর্থ স্থানে রয়েছে ফলমূল ও বাদাম। এছাড়া ইরানের রপ্তানিযোগ্য পণ্যের মধ্যে আয়রন ও স্টিল, কপার, সার, লবণ, সালফার, পাথর ও সিমেন্ট, পেট্রোকেমিক্যাল, কৃষিপণ্য, খাদ্যপণ্য, খনিজ ও ওষধি পণ্য উল্লেখযোগ্য।

বিশ্বে উদ্যোক্তা বৃদ্ধিতে শীর্ষ পাঁচে ইরান
বিশ্বে উদ্যোক্তার সংখ্যা বৃদ্ধিতে শীর্ষ পাঁচ দেশের তালিকায় রয়েছে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান। দেশটির বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের সূচকের অবস্থা পর্যবেক্ষণে এই চিত্র উঠে এসেছে। ইরানের বিজ্ঞান, র্প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের সূচকের অবস্থা পর্যবেক্ষণের একটি প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে ২০১৮ সালের জন্য এই র্যা ঙ্কিং প্রকাশ করা হয়।ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, উদ্যোক্তা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বিশ্বে শীর্ষ পাঁচ দেশের অন্যতম ইরান।

কৃষি উন্নয়ন
ইসলামি বিপ্লবের গত ৪১ বছরে কৃষিখাতে ইরানের অগ্রগতির চিত্র রীতিমত বিস্ময়কর। ২০১৭ সালে বিশ্বে কৃষি পণ্যের বৈচিত্র্যের দিক দিয়ে তৃতীয় অবস্থান দখল করতে সক্ষম হয়েছে ইরান। এছাড়া ইরানের তুলনামূলক রপ্তানি সম্ভাবনাময় খাতগুলোর তালিকায় শীর্ষে উঠে এসেছে দেশটির কৃষি খাত। ইরানের বাণিজ্য উন্নয়ন সংস্থা (টিপিও) প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে এই চিত্র পাওয়া গেছে। বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা বা ফাওর তথ্য মতে, ইরান হচ্ছে বিশ্বের প্রধান পাঁচটি দেশের মধ্যে একটি যে দেশটি কমলা, মাল্টা ও লেবুজাতীয় ফল উৎপাদনে সেরা অবস্থানে রয়েছে। এছাড়া শশা, ক্ষীরা, খেজুর, বেগুন, ডুমুর, পেস্তা, নাশপাতি, আখরোট ও তরমুজ উৎপাদনে বিশ্বের সেরা পাঁচ দেশের মধ্যে রয়েছে ইরান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাপিয়ে দেয়া কঠিন অবরোধের মধ্যেও গত ফারসি বছর (২১ মার্চ ২০১৯ থেকে ২০ মার্চ ২০২০) ইরানে ৫ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলারের কৃষি খাদ্যদ্রব্য রপ্তানি হয়েছে।

বিশ্ব র‌্যাঙ্কিংয়ে ইরানি কৃষিপণ্য
পৃথিবীর অন্যতম মূল্যবান কৃষিপণ্যের একটি জাফরান। যাকে ইরানের ‘লাল স্বর্ণ’ বলা হয়ে থাকে। বিশ্বের মোট উৎপাদিত জাফরানের প্রায় ৯০ শতাংশই উৎপাদিত হয় মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশটিতে। বিশ্বের সবচেয়ে দামি খাবার ক্যাভিয়ার যাকে ‘কৃষ্ণ সোনা’ হিসেবেও অভিহিত করা হয়ে থাকে সেটি উৎপাদনে বিশ্বে শীর্ষ স্থানে রয়েছে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান। বিশ্বে উটপাখির মাংস উৎপাদনে ইরান দ্বিতীয়। বৈশ্বিকভাবে ডিম উৎপাদনের র‌্যাঙ্কিংয়ে ১২তম অবস্থানে রয়েছে ইরান। মধু উৎপাদনে ইরানের অবস্থান বিশ্বে তৃতীয়। খেজুর উৎপাদনে বিশ্বে ইরানের অবস্থান দ্বিতীয় এবং বিশ্বের বৃহত্তম খেজুর রপ্তানিকারক দেশ ইরান। বিশ্বে বর্তমানে তৃতীয় বৃহত্তম কিসমিস রপ্তানিকারক দেশ ইরান। বিশ্বের শীর্ষ আক্সগুর উৎপাদনকারী দেশের তালিকায় ৮ম স্থান অধিকার করেছে ইরান। পৃথিবীতে যত দামী ফল বিশেষ করে বাদামজাতীয় ফল রয়েছে পেস্তা তার অন্যতম। এই ফলটির নাম উঠলেই যে দেশটির কথা সবার আগে উচ্চারিত হয় তার নাম ইরান। আখরোট উৎপাদনে ইরান বিশ্বে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে।

সামরিক শক্তি
ইরান সারা বিশ্বে এখন যেসব কারণে বিশেষ আলোচিত তার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে এর সামরিক শক্তি। সামরিক শক্তি নিয়ে পূর্ণাঙ্গ আলোচনায় না গিয়েও বলা যায়, ইরানের রয়েছে প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ সক্রিয় সেনা সদস্য। এছাড়া আছে সাড়ে তিন লাখ রিজার্ভ সেনা। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী বাসিজ, যার সদস্য সংখ্যা দশ লাখের বেশি। এতে পুরুষের পাশাপাশি নারী সদস্যও রয়েছে। সব মিলিয়ে ইরান যেকোনো সময় দশ লাখের বেশি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেনা মোবিলাইজ করতে পারে এবং এ সুবিধা বিশ্বের হাতেগোনা কয়েকটি দেশের রয়েছে। ইরানের হাতে রয়েছে নিজস্ব সামরিক শিল্প-কারখানা যেখানে ট্যাংক, আর্মার্ড পারসোনেল ক্যারিয়ার, গাইডেড মিসাইল, সাবমেরিন, সামরিক নৌযান, গাইডেড মিসাইল ডেস্ট্রয়ার, রাডার সিস্টেম, হেলিকপ্টার এবং জঙ্গিবিমান তৈরি করা হয়। এছাড়া ইরানের কারখানায় তৈরি করা হচ্ছে হুত, কাউসার, জেলযাল, ফতেহ-১১০, শাহাব-৩ ও সিজ্জিল ক্ষেপণাস্ত্র এবং নানা ধরনের ড্রোন।

ক্ষেপণাস্ত্র শক্তি
ইরানের আক্রমণাত্মক ও প্রতিরক্ষা কৌশলের প্রধান স্তম্ভ হলো অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র। ক্ষেপণাস্ত্র শক্তিতে দেশটির অবস্থান এখন বিশ্বে চতুর্থ। ইরান বিশ্বের যত বড় পরাশক্তির হাতেই আক্রান্ত হোক না কেন দেশটির ব্যালিস্টিক ও দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্টা আঘাতগুলো প্রতিপক্ষের জন্য হজম করা হবে খুবই কঠিন এবং অসহনীয়। তাই ইরানের শত্রুরা এ দিকটি বিশেষ বিবেচনায় রেখে সামরিক হামলার কথা খুব কমই ভাবতে বাধ্য। উল্লেখ্য, ইরান এর আগে নিজস্ব র্প্রযুক্তিতে তৈরি করেছে ‘ইমাদ’ ও ‘ফজর’ এর মতো উন্নত র্প্রযুক্তির ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র।

বিদেশী হুমকি মোকাবিলায় ইরানের প্রস্তুতি
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আমির হাতামি বলেছেন, শত্রুর যেকোনো হুমকি মোকাবিলায় তাঁর দেশের সামরিক প্রস্তুতি সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে।তিনি আরো বলেন, মার্কিন একতরফা নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ইরান সর্বোচ্চ পর্যায়ের সামরিক প্রস্তুতি নিতে সক্ষম হয়েছে; এর মাধ্যমে একথা পরিষ্কার হয় যে, শত্রুর নিষেধাজ্ঞা ইরানের সামরিক শক্তি বৃদ্ধিতে কোনো রকমের বাধা সৃষ্টি করতে পারেনি। এমনকি এখন আমেরিকা ও তার আঞ্চলিক পুতুল সরকারগুলো ইরানের সামরিক শক্তিকে স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছে।

পর্যটন শিল্প
আনন্দ, ভালোলাগা আর রূপময় স্বপ্নিল পৃথিবীর অজানা কোন সৌন্দর্যের হাতছানিতে ক্ষণিকের জন্য হারিয়ে যেতে মন ছুটে চলে পাহাড়, নদী, সাগর ও অরণ্যে। কখনও মন চায় কোন শিল্পকর্মের সুনিপুণ কারুকার্যে মন রাঙাতে। আর সে মনের খোরাক জোগাতেই দূর থেকে দূরে ছুটে চলা। সে চলার পথের গন্তব্য যদি হয় ইতিহাস, ঐত্যিহ্যে সমৃদ্ধ কোন দেশ তাহলে যে একজন ভ্রমণপিপাসুর মনের ষোলকলা পূর্ণ হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। ঠিক এমনই এক দেশের নাম হলো ইরান। বলা হয়ে থাকে, পৃথিবীর অর্ধেক সৌন্দর্যের দেশ এটি। যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী মিডিয়া সিএনএন এর সিনিয়র প্রডিউসার ব্যারি নিল্ড ইরানের পর্যটন স¤পর্কে তাঁর প্রতিবেদনের শিরোনাম করেছেন, ‘থার্টি ফোর ইনক্রেডিবল বিউটিফুল রিজন্স টু ভিজিট ইরান’। অর্থাৎ ইরান সফরের ৩৪টি অবিশ্বাস্য সুন্দর কারণ। ইরানের ৩৪টি আকর্ষণীয় নিদর্শনের বর্ণনা দিয়ে এই প্রতিবেদনটি লেখা হয়। এমন একটি দেশে ইসলামি বিপ্লবের গত ৪১ বছরে সরকারের নানামুখী পদক্ষেপ দেশটিকে বিশ্বপর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রে পরিণত করেছে। বর্তমানে ইরান বিশ্বের সেরা ১০ পর্যটন গন্তব্যের অন্যতম।
জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় রয়েছে ইরানের ২৪টি নিদর্শন। প্রাকৃতিক পরিবেশের দিক থেকে বলতে গেলে দেশটিতে যেমন রয়েছে পাহাড় আর সাগর, তেমনি রয়েছে বিশাল মরুভূমি, কোথাও নদ-নদী, আবার কোথাও সুবিস্তৃত সমতল ভূমি। ভূমি-বৈচির্ত্যের মতো এখানকার আবহাওয়াতেও রয়েছে বেশ বৈচির্ত্য। সারা ইরানে বসন্ত, গ্রীষ্ম, শরৎ ও শীত-এই চারটি ঋতু রয়েছে। রাজধানী তেহরানসহ বিশাল এলাকাজুড়ে যখন প্রচ- শীত কিংবা তুষারাবৃত তখন দক্ষিণে (পারস্য উপসাগর সংলগ্ন) দিব্যি বসন্তের হাওয়া। পাহাড়, সাগর, নদ-নদী আর জঙ্গলাকীর্ণ বৈচিত্র্যময় ভূমি এবং আবহাওয়ার কারণে ইরানে পর্যটকের ভিড়ও লেগে থাকে সারা বছর। শুধু পারস্য উপসাগরের কিশ দ্বীপ ভ্রমণ করেন প্রতি বছর ১০ লাখের বেশি বিদেশী পর্যটক। গত ইরানি বছরের প্রথম তিন মাসে বিগত বছরের একই সময়ের তুলনায় দেশটিতে বিদেশী পর্যটক আগমনের হার বেড়েছে ৪১ শতাংশ। ফারসি দৈনিক দোনিয়া-ই-ইকতেসাদের প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছরের প্রথম তিন মাসে ইরানে মোট ২০ লাখ ৩০ হাজার ৫২৩ জন বিদেশী পর্যটক ইরান ভ্রমণ করেছেন। আগের বছরের একই সময়ে পর্যটকদের এই সংখ্যা ছিল ১৪ লাখ ৪৩ হাজার ৫৫১ জন। এশিয়ার বহু দেশ, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা থেকেই আসেন বেশি।

ইরানের জিডিপিতে পর্যটনের অবদান ১১.৮ বিলিয়ন ডলার
ইরানের মোট জাতীয় উৎপাদনে (জিডিপি) পর্যটন খাতের অবদান ১১ দশমিক ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বিগত ফারসি ১৩৯৭ সালে পর্যটন শিল্প থেকে এই অর্থ আয় হয়েছে। ইরানের পর্যটন সংস্থার প্রধান আলি-আসকার মুনেসান এই তথ্য জানিয়েছেন।
ওই কর্মকর্তা জানান, ইরানের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘সেন্ট্রাল ব্যাংক অব ইরান’ এর তথ্যমতে, গত বছর ইরানের জিডিপিতে পর্যটন শিল্প ১১ দশমিক ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের অবদান রাখতে সক্ষম হয়। এছাড়া একই বছর জিডিপিতে হ্যান্ডিক্রাফট রপ্তানি থেকে যোগ হয় আরও ৬শ মিলিয়ন ডলার।
মুনেসান বলেন, পর্যটন শিল্প থেকে যেসব ক্ষেত্রে লাভবান হওয়া গেছে তার মধ্যে এই খাতে টেকসই কর্মসংস্থানের বিষয়টি অন্যতম। গত বছর ইরানের কর্মসংস্থান তৈরিতে যেসব খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে তার অন্যতম ছিল সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, হস্তশিল্প ও পর্যটন সংস্থা (সিএইচএইচটিও)। বিশ্ব ব্যাংক প্রকাশিত সর্বশেষ তথ্যমতে, ২০১৭ সালে ইরানের জিডিপির পরিমাণ ছিল ৪৫৪.০১৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। সিএইচএইচটিও প্রধান মুনেসান জানান, ফারসি বছর ১৩৯৭ সালে আন্তর্জাতিক পর্যটকরা ইরান ভ্রমণে ব্যয় করেছে ১১ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার।

গ্রামীণ উন্নয়ন
আট কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত ইরানের ৭৪ শতাংশ মানুষ শহরে এবং ২৬ শতাংশ মানুষ গ্রামে বাস করে। তবে শহরের মতো গ্রামের মানুষও সকল মৌলিক নাগরিক সুবিধা ভোগ করছে। স্বল্প আয়ের জনগণ কম খরচে ও ঋণসুবিধা পেয়ে বাড়ির মালিক হচ্ছে। ইসলামি বিপ্লবের পর পরই প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ, পানি, স্কুল-কলেজ ও হাসপাতাল-ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা করে তাৎক্ষণিক নাগরিক সুবিধা পৌঁছে দেয়া হয়েছে। এখন ইরানের গ্রামের মানুষও স্বাস্থ্যবিমার আওতায় চলে এসেছে।তিন বছর আগে অর্থাৎ ফারসি ১৩৯৩ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ইরানের গ্রামাঞ্চলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল ৫৫ হাজার, বিপ্লবের আগে ছিল ২২ হাজার ২৪৬টি। গত চার দশকে ডে-নাইট স্কুল ৯টি থেকে বেড়ে হয়েছে ১৩৮৭টি। শাহ সরকারের আমলে গ্রামে খেলার মাঠ ছিল মাত্র ১২টি, বর্তমানে ২ হাজার ১৮২টি। বিপ্লবের আগে গ্রামে পাকা রাস্তা ছিল মাত্র ২০০ কিলোমিটার, বর্তমানে তা বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৩ হাজার কিলোমিটার। আধাপাকা রাস্তা ছিল ৮ হাজার ২০০ কিলোমিটার আর এখন ১ লাখ ২৯ হাজার কিলোমিটার। বিপ্লবের আগে ইরানের গ্রামাঞ্চলের জন্য কোনো ফায়ার সার্ভিস কেন্দ্র ছিল না, বর্তমানে ৩৮০টি গ্রামে ফায়ার সার্ভিস সেবা চালু আছে। সেসময় ইরানের ৩১২টি গ্রামে টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল। বর্তমানে ইরানের ৫ হাজার ৩১২টি গ্রামের মানুষ টেলিফোন ব্যবহার করে। দেশটিতে গত ৪০ বছরে ৩৩ হাজার ৫০০ পল্লি উন্নয়ন পরিষদ গড়ে তোলা হয়েছে। এভাবে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই ইরানের গ্রামীণ জীবনে ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছে।

সামাজিক নিরাপত্তা
যে কোনো দেশের শান্তি ও সমৃদ্ধির বিষয়টি অনেকাংশই নির্ভর করে সেই দেশের সামাজিক নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলার ওপর। ইরানে ইসলামি বিপ্লবের পর দেশটির সামাজিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। তাই তো সারা বিশ্বের নজর আজ শান্ত ও স্থিতিশীল ইরানের দিকে, দেশটির সামাজিক নিরাপত্তার দিকে। যেখানে ইউরোপ ও আমেরিকার মতো উন্নত দেশের মানুষ সারাক্ষণ নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে, আত্মরক্ষার জন্য বাধ্য হয় অস্ত্র বহন করতে, বর্ণবৈষম্য, সামাজিক বৈষম্য, সংখ্যালঘুদের অধিকার হরণ, খুন, ধর্ষণ, সন্ত্রাস, চরম নৈতিক অবক্ষয়, গভীর পারিবারিক সংকট, তালাক প্রভৃতি যেখানে নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার সেখানে ইরানে বিরাজ করছে উল্টো চিত্র। এখানে নেই কোন মারামারি, নেই চুরি-ছিনতাই, গোলাগুলি-অস্ত্রবাজি। প্রতিদিনের পত্রিকায় কিংবা টেলিভিশনের খবরে খুন-হত্যাকা-ের খবর ‘মাস্ট আইটেম’ হিসেবে থাকে না- যা অনেক উন্নত দেশেও কল্পনা করা যায় না। এখানে মানুষ অনেক বেশি নিরাপদে পথ চলে। সেই নিরাপত্তা দিনে-রাতে একই রকম। রাতের আঁধার নামার সঙ্গে সঙ্গে এখানে ভয় নেমে আসে না। নিশ্চিন্তে পথ চলা যায় একাকী। ভাবতেও হয় না- ‘কেউ জানতে চাইবে কাছে কী আছে!’বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে এই নিরাপত্তা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার ক্ষেত্রেই সমান। একজন নারী কিংবা তরুণী যদি একাকী রাতের বেলায় পথে হেঁটে যায় তাকেও আলাদা করে ভাবতে হয় না নিরাপত্তার কথা। পথ চলতে গেলে ডাকাত-ছিনতাইকারীর সামনে পড়ার ভয় নেই। রাস্তায় নেই কোন উটকো মাস্তানি। কেউ পথ আগলে দাঁড়াবে না, কেউ অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করবে না বা শিস দেবে না। এ এক অন্যরকম সমাজ; সামাজিক নিরাপত্তাই যার বড় বৈশিষ্ট্য। সার্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি আসলে ইরানকে নিয়ে গেছে অন্যরকম উচ্চতায়।

চলচ্চিত্র শিল্পের উন্নয়ন
চলচ্চিত্র একটি সৃজনশীল গণমাধ্যম। এর সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক উপাদান। যে দেশে তা নির্মিত হয় সে দেশেরই জাতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতিনিধিত্ব করে চলচ্চিত্রটি। শিল্পকলার প্রভাবশালী মাধ্যম, শক্তিশালী বিনোদন মাধ্যম এবং শিক্ষার অন্যতম সেরা উপকরণ হিসেবেও খ্যাতি রয়েছে চলচ্চিত্রের। গণযোগাযোগ বা সাধারণ মানুষের কাছাকাছি খুব সহজে পৌঁছার ক্ষেত্রেও চলচ্চিত্রের ভূমিকা অপরিসীম। আবার সৃষ্টিশীল মানুষ ও আলোকিত সমাজ উপহার দেয়ার ক্ষেত্রেও এর রয়েছে জাদুকরি প্রভাব। আর এক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই ইতিহাস, ঐতিহ্য ও শিল্প-সাহিত্যে সমৃদ্ধ দেশ ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান। দেশটির চলচ্চিত্র এখন বিশ্বমানের। অসংখ্য আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ইরানি সিনেমার হৃদয়¯পর্শী ও প্রভাবশালী উপস্থিতি বিশ্বে ইরানি সংস্কৃতি ও শিল্পের স্বচ্ছ ভাবমূর্তি তুলে ধরেছে। ১৯০০ সালে শুরু হয় ইরানি চলচ্চিত্রের পথচলা। বর্তমানে দেশটিতে প্রতি বছর প্রায় ২০০টি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। শক্তিশালী চিত্রনাট্য, অসাধারণ ও অভূতপূর্ব অভিনয়, কলাকুশলির মনকাড়া আবেদন ছাড়াও বিশ্বমানের কারিগরি কৌশলের কারণে বিশ্বের সর্বত্র আজ ইরানি সিনেমা ব্যাপকভাবে দর্শক সমাদৃত হচ্ছে। সেইসাথে পুরস্কৃত হচ্ছে শীর্ষ আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবগুলোতে।
আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র অঙ্গনে সবচেয়ে আলোচিত ও সম্মানজনক পুরস্কার অস্কার থেকে শুরু করে অনেক গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক পুরস্কার ঘরে তুলে নিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের এ দেশটি। অস্কারের ৮৯তম আসরে সেরা বিদেশী ভাষার চলচ্চিত্র হিসেবে পুরস্কার জিতে নেয় ইরানি ছবি ‘দ্য সেলসম্যান’। এ নিয়ে দ্বিতীয়বার অস্কার জিতলেন ছবিটির পরিচালক আসগর ফারহাদি। এর আগে ‘অ্যা সেপারেশন’ তাঁকে এনে দেয় এই সম্মাননা।
পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন এবং প্রভাবশালী চলচ্চিত্র উৎসব কান চলচ্চিত্র এই উৎসবের ৭০তম আসরে সিনেফন্ডেশন পুরস্কার জিতেছে ইরানি স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি ‘অ্যানিমল’। গত কান চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনও হয়েছে ইরানি চলচ্চিত্র দিয়ে এবং এই উৎসবের শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকারের পুরস্কারও জিতে নিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশটি।
ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবের ৭৪তম আসরে দুই অ্যাওয়ার্ড জয় করে ইরানি চলচ্চিত্র ‘নো ডেট, নো সিগনেচার’। ছবিটির জন্য সেরা পরিচালকের অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন এর পরিচালক চলচ্চিত্রকার ভাহিদ জলিলভান্দ এবং সেরা অভিনেতার অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন নাভিদ মোহাম্মাদজাদেহ।
ভারতে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় কার্গিল আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে অ্যাওয়ার্ড জেতে ইরানের চারটি ছবি।পঞ্চদশ ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে তিন বিভাগে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার পেয়েছে ইরান। সেরা ছায়াছবি, সেরা অভিনয় ও শ্রেষ্ঠ পরিচালনা বিভাগে পুরস্কার জিতে নেয় ইসলামি প্রজাতন্ত্রের এই দেশটি।এক কথায় বলতে গেলে প্রাচ্য থেকে পাশ্চাত্যে সর্বত্র ইরানি চলচ্চিত্রের জয়জয়কার।

আর্থ-সামাজিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইরানি নারীদের সাফল্য
নারীর উন্নয়নে বিশ্বের যে দেশগুলো এগিয়ে রয়েছে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান তাদের অন্যতম। জ্ঞান-বিজ্ঞান, রাজনীতি, অর্থনীতি, খেলাধুলাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইরানের নারীদের সাফল্য চোখে পড়ার মতো। ফারসি ১৩৯৫ সালের হিসাব অনুযায়ী ৮ কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত ইরানে সাক্ষরতার হার ৯৭ শতাংশ। এর মধ্যে ৪৬ শতাংশ নারী। দেশটিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারী মানুষের সংখ্যা ১১ মিলিয়ন। যার ৫০ শতাংশই নারী। বিশ্বে সর্বোচ্চ সংখ্যক নারী বিজ্ঞানীর তালিকার শীর্ষে রয়েছে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে পশ্চিমা বিশ্বের প্রতিপক্ষদের বহুদূর ছাড়িয়ে গেছেন দেশটির নারীরা। এক হিসাব মতে, বিজ্ঞানে ডিপ্লোমা স¤পন্ন করেন ইরানের অর্ধেকেরও বেশি নারী। ইরানের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান, র্প্রযুক্তি, প্রকৌশল এবং গণিত (সংক্ষেপে এসটিইএম) বিষয়ে øাতক স¤পন্ন করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশই নারী। যা বিশ্বের যে কোনো দেশের তুলনায় শতাংশে অনেক বেশি। লেখিকা সাদিয়া জাহিদি তাঁর নতুন বই ‘ফিফটি মিলিয়ন রাইজিং’-এ এসব তথ্য তুলে ধরেন।
কর্মক্ষেত্রে ইরানি নারীদের সাফল্য চোখে পড়ার মতো। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, প্রশাসন, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও চিকিৎসা কেন্দ্র থেকে শুরু করে প্রায় সব ধরনের কর্মক্ষেত্রে ইরানি নারীদের রয়েছে সরব উপস্থিতি। বর্তমানে ইরানের রাষ্ট্রীয় এয়ারলাইন্স ইরান এয়ারের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন একজন নারী। কর্মক্ষেত্রে নারীর এমন সফলতার কারণে চাকরির বাজারে দেশটির নারীদের চাহিদা বাড়ছে। ইরানের চাকরির বাজারে বিগত তিন বছরে নারীদের উপস্থিতির সংখ্যা বেড়েছে ৪০ ভাগ। ইরান ট্যালেন্ট ডটকমের এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ফারসি বছরে আন্তর্জাতিক কো¤পানিগুলোর বিভিন্ন শাখায় নারী কর্মচারীদের সংখ্যা বেড়েছে ২৯ ভাগ। অন্যদিকে, বেসরকারি মালিকানাধীন কো¤পানিগুলোতে বেড়েছে ৩২ শতাংশ এবং রাষ্ট্রীয় পরিচালিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে নারীর সংখ্যা বেড়েছে ২০ শতাংশ। প্রতিবেদন মতে, ইরানে মধ্যম সারির ব্যবস্থাপক পর্যায়ে ২৫ শতাংশ নারী কর্মরত রয়েছেন এবং উচ্চ পর্যায়ের ব্যবস্থাপনা পদে রয়েছেন ১৯ শতাংশ নারী। এছাড়া দেশটিতে প্রায় ৬০ শতাংশ নারী কার্যনির্বাহী ও প্রশাসনিক কর্মী হিসেবে সক্রিয় রয়েছেন। বিদেশী ভাষা থেকে অনুবাদের কাজে কর্মরত রয়েছেন ৫০ শতাংশ নারী। ইরান ট্যালেন্ট ডটকমের অপর আরেকটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, প্রায় ৫০ শতাংশ ইরানি নারী শিল্প ক্ষেত্রে কাজ করছেন। দেশজুড়ে ২৮টি ভিন্ন ভিন্ন চাকরি ক্ষেত্রের ১ লাখ কর্মচারীর ওপর জরিপ পরিচালনা করে এই তথ্য দেয়া হয়।

বিদ্যুৎ উৎপাদনে ইরানের সাফল্য
যে-কোনো দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও জনগণের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে বিদ্যুৎ অপরিহার্য। শিল্প, কলকারখানা, কৃষিকাজ, মানব স¤পদ উন্নয়ন, আধুনিক জীবনযাত্রা, চিকিৎসা, যোগাযোগ, ক¤িপউটার প্রযুক্তির ব্যবহার থেকে শুরু করে উন্নয়নের প্রায় সকল ক্ষেত্রেই প্রয়োজন বিদ্যুৎ। বাস্তবতার নিরিখে এ সকল উপলব্ধি থেকে বিদ্যুৎ খাতের কাক্সিক্ষত উন্নয়ন ও পরিচালনা দক্ষতা বৃদ্ধি ও উন্নত গ্রাহক সেবা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান এরই মধ্যে ব্যাপক সফলতা অর্জন করেছে। দেশটি বর্তমানে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ খাতে কেবল পুরোপুরি স্বয়ংস¤পূর্ণতা অর্জন করেছে তাই নয় একই সাথে দেশটিতে উৎপাদিত বিদ্যুৎ এখন অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। বর্তমানে ইরানের উৎপাদিত বিদ্যুতের পরিমাণ প্রায় হাজার মেগাওয়াট। ২০১৫ সালে দেশটিতে যেখানে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৭৫ হাজার মেগাওয়াট সেখানে ২০১৯ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৮৪ হাজার ৭৯৫ মেগাওয়াটে। এর মধ্য দিয়ে ইরান বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিক থেকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে এক নম্বর স্থানে রয়েছে। আর সারা বিশ্বে দেশটির অবস্থান ১৪ নম্বরে।
এছাড়া আরও অনেক ক্ষেত্রেই ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান সাফল্যের স্বাক্ষর রেখে চলেছেন যা এই সীমিত পরিসরে তুলে ধরা প্রায় অসম্ভব। তবে যেকথা না বললেই নয় তা হচ্ছে, শত বাধা বিপত্তি সত্ত্বেও ইসলামি বিপ্লবের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম খোমেইনী (র.)-এর সুযোগ্য উত্তরসূরি ও ইসলামি বিপ্লবের বর্তমান নেতা হযরত আয়াতুল্লাহ উজমা খামেনেয়ীর নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ ইরানি জাতি কোনো অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করে উন্নয়নের ধারায় যেভাবে অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলেছে তাতে দেশটি একদিন বিশ্বের নেতৃত্বের আসনে অবস্থান করবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

বসন্তের হাত ধরে আসে ইরানি নওরোজ, প্রাণের দোলা পহেলা বৈশাখ

সিরাজুল ইসলাম –

ইরানি ‘নওরোজ’ সারা বিশ্বের এক অনন্য সংস্কৃতির ধারা। বসন্তের হাত ধরে পত্র-পল্লবিত ফুলশোভিত হয়ে আসে এ নওরোজ। নব আনন্দের এক দিগন্তজোড়া বার্তা ছড়িয়ে দেয় বিশ্বের দিকে দিকে। ঈদের খুশি নিয়ে আসে নওরোজ। আসলে ইরানিদের কাছে নওরোজ মানেই ঈদ। নওরোজ শুরুর দু’চারদিন আগে থেকেই ইরানিরা একে অপরকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেনÑ ‘ঈদে শোমা মুবারাকে’ যা আমাদের বাংলা অঞ্চলে ঈদ মুবারক বলে পরিচিত। কালের পরিক্রমায় নওরোজ এখন বিশ্ব ঐত্যিহের অংশ। নওরোজ একটি ফারসি শব্দÑ যার অর্থ হলো নতুন দিন। জনপ্রিয় এ সাংস্কৃতিক উৎসব আজ শুধু ইরানের জাতীয় উৎসব নয়, আফগানিস্তান, তাজিকিস্তান, আযারবাইজান, তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান, তুরস্ক ও ইরাকেও এ উৎসব জাতীয় পর্যায়ে উদ্যাপিত হয়। নওরোজের উৎসব কম-বেশি পালিত হয় জর্জিয়া, পাকিস্তান ও ভারতেও। সাধারণত ২০ বা ২১ মার্চ ফারসি নববর্ষ শুরু হয়। এই সময় শুরু হয় ইরানে বসন্তকাল। বসন্তকেই আলিঙ্গন করে আসে ইরানি নওরোজ।
নওরোজ বিশ্বের প্রাচীনতম উৎসবগুলোর অন্যতম। প্রাচীন ইরান বিস্তৃত ছিল মধ্য এশিয়া ও ককেশাস অঞ্চল থেকে ভারতবর্ষ, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর-আফ্রিকার এক বিশাল অঞ্চলজুড়ে। তাই এইসব অঞ্চলের অন্যতম প্রধান উৎসব হলো এই নওরোজ। নওরোজ উৎসবকে আন্তর্জাতিক উৎসব যে বলা যায় তা তো ইউনেস্কোর স্বীকৃতি থেকেই পরিষ্কার।
নওরোজ উৎসবের কোনো কোনো প্রথা সেই সুদূর প্রাচীনকাল থেকে এখনো প্রচলিত। এইসব প্রথা সর্বত্র ছড়িয়ে দেয় নতুনত্ব ও বসন্তের আমেজ। নওরোজ-কেন্দ্রিক একটি প্রাচীন প্রথার নাম হলো ‘খনে তেক্কনি’ বা ঘর নাড়া দেয়া। এই পর্বটির উদ্দেশ্য হলো ঘর ও ঘরের আসবাবপত্র পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা। বছরের শেষের দিকে ইরানে রাস্তাঘাটের মতো সর্বসাধারণের ব্যবহৃত স্থানগুলোও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার ধুম পড়ে যায়। বিত্তবানরা ঘরের পুরনো সব আসবাবপত্র, পর্দা, পোশাক ইত্যাদি ফেলে দিয়ে বা বিক্রি করে দিয়ে ঘর-বাড়িকে আবার নতুন করে সাজান। ঈদ বা নওরোজের অনেকে আগেই পুরোনো আসবাবপত্র বা জরাজীর্ণ জিনিস ফেলে দিয়ে তাঁরা নতুন জিনিস কেনেন। নতুন জামা-কাপড়,
জুতা প্রভৃতি কেনার হিড়িক পড়ে যায়। নওরোজের মেহমানদারির জন্য তাঁরা প্রচুর পরিমাণ ফল, মিষ্টি ও অন্যান্য খাদ্য-সামগ্রী কিনে থাকেন। এ সময় স্থায়ী বাজার ছাড়াও অনেক অস্থায়ী বাজার বা মেলার আসর জমজমাট হয়ে ওঠে।
নওরোজ উৎসবের প্রাক্কালে কেনাকাটার ধুম পড়ে যায়। সাধারণত এ সময় বেশি বেশি কেনা হয় পোশাক, আজিল নামে পরিচিত শুকনো কিসমিসসহ নানা ধরনের ফল ও বুট-বাদামের মিশ্রণ, তাজা ফল, মিষ্টি ও ঘরবাড়ির কোনো কোনো সামগ্রী ইত্যাদি। নতুন বছরে সবাই নতুন পোশাক পরতে আগ্রহী। এছাড়াও তাঁরা মেহমানকে আপ্যায়নের জন্য সবচেয়ে ভালো খাবার কিনতে চান। ফলে ব্যবসায়ীদের জন্যও এই সময়টা খুব ভালো কাটে।
ইরানিরা নওরোজের সময় ঘরের মধ্যে ৭টি আইটেম সাজিয়ে রাখেন। এই সাতটি আইটেমকে বলা হয় ‘হাফ্্ত সিন’। হাফত সিন অর্থ সাতটি সিন। ওই সাতটি জিনিসের নামের প্রথম অক্ষর ফারসি বা আরবি বর্ণমালার ‘সিন’ অক্ষর দিয়ে শুরু হওয়ায় সেগুলোকে এ নাম দেয়া হয়েছে। এ ৭টি সামগ্রী হলো, ‘সাবজে’ বা গম বা ডালের সবুজ চারা, ‘সামানু’ বা গমের অঙ্কুর দিয়ে তৈরি করা খাবার, ‘সিব’ বা আপেল, ‘সেনজেদ’ নামের একটি বিশেষ ফল, ‘সোমাক্ব’ নামক বিশেষ মশলা, ‘সির’ বা রসুন এবং ‘সের্কে’ বা সিরকা। এসব সামগ্রী হলো নব-জীবন, প্রবৃদ্ধি, ফলবান হওয়া, প্রাচুর্য, সৌন্দর্য, সুস্থতা, ভালোবাসা, আনন্দ ও ধৈর্য প্রভৃতির প্রতীক। এছাড়া, নওরোজের দস্তরখানে ডিম, ফুল, আয়না, পানি, লাল রংয়ের ছোট মাছ ও ধাতব মুদ্রা রাখা হয়। এসবেরই রয়েছে বিশেষ অর্থ। ফুল ও সবুজ কিশলয় আনন্দ ও নব-জীবনের প্রতীক। প্রকৃতিতে নব-জাগরণের বার্তা নিয়ে আসে বসন্ত। চারদিকে ফুলের সমারোহ এটাই মনে করিয়ে দেয় যে, কেবল প্রকৃতি নয়, মানুষের মনও হওয়া উচিত ফুলের মতো সুরভিত ও সুন্দর।
নওরোজ উপলক্ষে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় ঈদের আনন্দকে ভাগ করে নেয়ার জন্য অনেক ইরানি বিশেষ ত্রাণ-তহবিলে অর্থ বা নানা জিনিস-পত্র দান করে থাকেন। এসব অর্থ বা জিনিসপত্র গরীব, এতিম ও অভাবগ্রস্তদের দান করা হয়। ফলে নওরোজ হয়ে ওঠে গণমুখী, সবার উৎসব। এ যেন এক আধ্যাত্মিক উৎসব, মানবীয় উৎসব তো বটেই।
ঠিক কবে এবং কে প্রথম নওরোজ উৎসব চালু করেছিলেন তা ¯পষ্ট নয়। কবি ফেরদৌসির অমর কাব্য ‘শাহনামা’ ও ঐতিহাসিক তাবারির বর্ণনা অনুযায়ী ইরানের প্রাচীন কিংবদন্তিতে উল্লিখিত বাদশাহ জামশিদ ছিলেন এ উৎসবের প্রথম আয়োজক। কেউ কেউ বলেন, ইরানের হাখামানেশী সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট দ্বিতীয় সাইরাস বা কুরুশ বাবেল বা ব্যাবিলন জয়ের বছর তথা খ্রিস্টপূর্ব ৫৩৮ সালে সর্বপ্রথম নওরোজকে জাতীয় উৎসব হিসেবে ঘোষণা ও পালন করেন। পারস্য সম্রাট প্রথম দারিউশের শাসনামলে এ উৎসব পার্সেপোলিস প্রাসাদ কমপ্লেক্স বা তাখ্তে জামশিদে অনুষ্ঠিত হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা এ উৎসবে উপস্থিত হয়ে ইরানি সম্রাটকে নানা উপহার সামগ্রী দিতেন।
প্রথম দারিউশ নওরোজ উপলক্ষে খ্রিস্টপূর্ব ৪১৬ সনে স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন করেছিলেন। আশকানি ও সাসানি সম্রাটদের যুগেও নওরোজ উৎসব পালিত হতো। সাসানি শাসনামলে নওরোজের প্রথম ৫ দিন ছোট নওরোজ হিসেবে অভিহিত হতো। এ সময় সাধারণ জনগণ বা প্রজারা সম্রাটের সাথে দেখা করতো এবং সম্রাট তাদের কথা শুনতেন। কিন্তু ষষ্ঠ দিনকে বলা হতো বড় নওরোজ। এ দিনে কেবল সম্রাটের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরাই তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করত এবং বিশেষ উৎসব পালিত হতো। খ্রিস্টিয় ২৩০ সালে সাসানি সম্রাট আর্দেশিরের সঙ্গে যুদ্ধে রোমান সেনারা পরাজিত হয়। আর্দেশির বিজিত অঞ্চলেও নওরোজ পালনের নির্দেশ দিয়েছিলেন। সাসানি যুগেই নওরোজ উৎসবের অনুষ্ঠানমালা ও পর্বগুলো তুলনামূলকভাবে বেশি বিস্তৃত হয়েছিল।
ইসলামের আবির্ভাবের পর ইরানে নওরোজ উৎসবের রীতিতে পরিবর্তন দেখা দেয়। ইসলামি আচার-অনুষ্ঠান যুক্ত হয় এ উৎসবের সাথে। মুসলমানরা বসন্ত ঋতুতে গাছপালার পুনরায় সবুজ হওয়াকে পারলৌকিক জীবনের প্রমাণ বলে মনে করেন। বিশেষ দোয়া পাঠের মধ্য দিয়ে ইরানি মুসলমানরা নওরোজ বা নববর্ষ শুরু করেন। মুনাজাতে তাঁরা বলেন, ‘হে অন্তর ও দৃষ্টির পরিবর্তনকারী এবং দিন ও রাতের পরিচালনাকারী এবং অবস্থার পরিবর্তনকারী (মহান আল্লাহ)! আমাদের অবস্থাকে সর্বোত্তম অবস্থায় রূপান্তরিত করুন।’ নওরোজের প্রথম সেকেন্ডেই সবাই এ দোয়া পাঠ করেন। এ সময় তাঁদের সামনে টেবিলে বা দস্তরখানে থাকে পবিত্র কোরআন, তসবিহ এবং ‘হাফ্্ত সিন’ নামে খ্যাত সাতটি বিশেষ সামগ্রীসহ আরো কিছু সামগ্রী।
ইরানিরা নওরোজের দিন মা-বাবাসহ নিকটাত্মীয় ও ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ সময় বেশ কয়েকদিন ছুটি থাকে এবং ইরানিরা দেশের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান সফর করেন; কেউ কেউ বিদেশেও যান। অনেক ইরানি নওরোজের প্রথম প্রহর বা প্রথম দিনটি পবিত্র কোনো স্থানে কাটাতে পছন্দ করেন। যেমন, অনেকেই পবিত্র মাশহাদ শহরে বিশ্বনবী হযরত মুমহাম্মাদ (সা.)-এর পবিত্র আহলে বাইতের সদস্য হযরত ইমাম রেযা (আ.)-এর মাজার জিয়ারত করেন। অনেকে এ উপলক্ষে পবিত্র কোম শহরে হযরত ইমাম রেযা (আ.)-এর বোন হযরত মাসুমা (সা.আ.)-এর মাজারে, কিংবা শিরাজ শহরে অবস্থিত তাঁর ভাই হযরত শাহ চেরাগ (র.)-এর মাজারে যান, কেউবা ইরাকে হযরত ইমাম হোসাইন (আ.)-এর মাজারে বা আহলে বাইতের অন্য কোনো সদস্যের মাজারে নববর্ষ শুরু করেন। ইমামদের পরিবারের অন্য সদস্যদের মাজারেও এ সময় ভীড় দেখা যায়। তেহরানের আধিবাসীদের অনেকেই ভীড় জমান দক্ষিণ তেহরানে অবস্থিত হযরত শাহ আবদুল আজিম (র.) কিংবা শহরের অন্যান্য অঞ্চলে অবস্থিত কয়েকটি মাজারে। নওরোজের দিন অনেকেই একে-অপরকে উপহার বা বখশিশ দিয়ে থাকেন। ছোট শিশুরা বড়দের কাছ থেকে বখশিশ পেয়ে খুব খুশি হয়।
ফারসি প্রথম মাস বা ফারভারদিন মাসের এক তারিখ থেকে শুরু হয় নওরোজ উৎসব এবং শেষ হয় ১৩ তারিখে। ১৩ তারিখে ইরানিরা কেউই ঘরে থাকেন না। তাঁরা সেদিন ঘরের বাইরে বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ও মনোরম প্রাকৃতিক ¯পটে সময় কাটান। বিশেষ করে উদ্যান, ঝরনা, পাহাড়, পার্কÑ এসব স্থানে তাঁরা চাদর বিছিয়ে বা তাঁবু খাটিয়ে খোশ-গল্প করে এবং মজাদার খাবার খেয়ে সময় কাটান।
যেকোনো ঈদ বা উৎসব মানবীয় আনন্দের অপার উৎস। মানুষ আনন্দ-উৎসব ছাড়া বেঁচে থাকতে পারে না। তবে আল্লাহর স্মরণই মানুষকে জোগায় সবচেয়ে বড় প্রশান্তি এবং অপার মানসিক সুখ। আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.) বলেছেন, যে দিনটিতে মানুষ কোনো পাপ করে না, সে দিনটিই তার জন্য ঈদ বা উৎসবের দিন।

বাংলা নববর্ষ
ইরানি নওরোজের মতো বাংলাদেশেও অত্যন্ত আড়ম্বরের সঙ্গে বাংলা নববর্ষ উদ্যাপন করা হয়। যদিও ইরানি নববর্ষের মতো দীর্ঘ সময় জুড়ে বাংলা নববর্ষ উদ্যাপন করা হয় না তবে একদিনের আনন্দ-উৎসব কিন্তু কোনো অংশেই কম নয়। পহেলা বৈশাখ বাংলা সনের প্রথম দিন। এ দিনটি বাংলাদেশে নববর্ষ হিসেবে উদ্যাপিত হয়। এটি বাঙালির একটি সর্বজনীন লোকউৎসব। এদিন আনন্দঘন পরিবেশে বরণ করে নেয়া হয় নতুন বছরকে। কল্যাণ ও নতুন জীবনের প্রতীক হলো নববর্ষ।
বাংলা নববর্ষ পালনের সূচনা হয় মূলত সম্রাট আকবরের সময় থেকেই। সে সময় বাংলার কৃষকরা চৈত্র মাসের শেষদিন পর্যন্ত জমিদার, তালুকদার এবং অন্যান্য ভূ-স্বামীর খাজনা পরিশোধ করত। পরদিন নববর্ষে ভূস্বামীরা তাদের মিষ্টিমুখ করাতেন। এ উপলক্ষে তখন মেলা এবং অন্যান্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। ক্রমান্বয়ে পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশে পহেলা বৈশাখ আনন্দময় ও উৎসবমুখী হয়ে ওঠে এবং বাংলা নববর্ষ শুভদিন হিসেবে পালিত হতে থাকে।
নববর্ষের উৎসব বাংলার গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, ফলে গ্রামের সাধারণ মানুষের কাছে দিনটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। সাধারণত নববর্ষে তাঁরা বাড়িঘর পরিষ্কার রাখেন, ব্যবহার্য সামগ্রী ধোয়ামোছা করেন এবং সকালে গোসল সেরে পবিত্র হন। এ দিনটিতে ভালো খাওয়া, ভালো থাকা এবং ভালো পরতে পারাকে ভবিষ্যতের জন্য মঙ্গলজনক বলে মনে করেন অনেকেই। নববর্ষে ঘরে ঘরে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব এবং প্রতিবেশীদের আগমন ঘটে। মিষ্টি-পিঠা-পায়েসসহ নানা রকম লোকজ খাবার তৈরির ধুম পড়ে যায়। একে অপরের সঙ্গে নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময় চলে।
প্রিয়জনকে উপহার দেয়ার মাধ্যমেও নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময় হয়, যা শহরাঞ্চলেও এখন বহুল প্রচলিত। এ দিন রাজধানী ঢাকার রমনা বটমূলে চলে নানা রঙের, নানা ঢঙের বৈশাখী উৎসব। চলে পান্তা ইলিশের অফুরান আনন্দ। শহরে নগরে করা হয় আল্পনার বিস্তৃত কারুকাজ।
নববর্ষকে উৎসবমুখর করে তোলে বৈশাখী মেলা। এটি মূলত সর্বজনীন লোকজ মেলা। এ মেলা অত্যন্ত আনন্দঘন হয়ে থাকে। স্থানীয় কৃষিজাত দ্রব্য, কারুপণ্য, লোকশিল্পজাত পণ্য, কুটির শিল্পজাত সামগ্রী, সব প্রকার হস্তশিল্পজাত ও মৃৎশিল্পজাত সামগ্রী এই মেলায় পাওয়া যায়। এছাড়া শিশু-কিশোরদের খেলনা, মহিলাদের সাজ-সজ্জার সামগ্রী এবং বিভিন্ন লোকজ খাদ্যদ্রব্য, যেমনÑ চিড়া, মুড়ি, খৈ, বাতাসা, বিভিন্ন প্রকার মিষ্টি প্রভৃতির বৈচিত্র্যময় সমারোহ থাকে মেলায়। মেলায় বিনোদনেরও ব্যবস্থা থাকে। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের লোকগায়ক ও লোকনর্তকদের উপস্থিতি থাকে। তাঁরা যাত্রা, পালাগান, কবিগান, জারিগান, গম্ভীরা গান, গাজীর গান, আলকাপ গানসহ বিভিন্ন ধরনের লোকসংগীত, বাউল-মারফতি-মুর্শিদি-ভাটিয়ালি ইত্যাদি আঞ্চলিক গান পরিবেশন করেন।
লাইলী-মজনু, ইউসুফ-জুলেখা, রাধা-কৃষ্ণ প্রভৃতি আখ্যানও উপস্থাপিত হয়। চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, নাটক, পুতুলনাচ, নাগরদোলা, সার্কাস ইত্যাদি মেলার বিশেষ আকর্ষণ। এছাড়া শিশু-কিশোরদের আকর্ষণের জন্য থাকে বায়োস্কোপ। শহরাঞ্চলে নগর সংস্কৃতির আমেজেও এখন বৈশাখী মেলা বসে এবং এই মেলা বাঙালিদের কাছে এক অনাবিল মিলন মেলায় পরিণত হয়। বৈশাখী মেলা বাঙালির আনন্দঘন লোকায়ত সংস্কৃতির ধারক।
এত কিছুর পরও যে কথাটি বলতে হয় তাহলো এ বছর ইরান কিংবা বাংলাদেশÑ কোথাও সেভাবে নতুন বছর উদ্যাপন করা যায় নি। এর একমাত্র কারণ বিশ্বেজুড়ে করোনাভাইরাসের মহামারি।
এর মধ্যে এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে ইরানে মারা গেছেন পাঁচ হাজারের বেশি মানুষ। আর বাংলাদেশে মারা গেছেন শতাধিক। এ বছর যেভাবে ইরান ও বাংলাদেশে নওরোজ কিংবা পহেলা বৈশাখ উদ্যাপিত হয়েছে এর আগে এমনটা আর কখনো দেখা যায় নি। দু দেশেই বলতে গেলে কোনো উৎসব অনুষ্ঠান ছিল না। বড় বেশি ¤¬ান ছিল এবারের নওরোজ ও পহেলা বৈশাখ। তবে আশাÑ হয়ত আগামীতে নওরোজ আর পহেলা বৈশাখ আসবে দ্বিগুণ উদ্দীপনা নিয়ে।

ইরানের ভাষা, ধর্ম ও জাতিসমূহ

 

ফারসি ইরানের রাষ্ট্রীয় ও প্রশাসনিক ভাষা। ফারসি ভাষা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর অন্যতম। ইরানে ইসলাম প্রবেশের পর কিছু সময় আরবি ভাষা ইরানের রাষ্ট্রীয় ভাষা ছিল। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ একইভাবে বা অব্যাহতভাবে ফারসিতে কথাবার্তা বলত। এখনও ইরানের একদল মানুষ ফারসি ছাড়াও স্থানীয় ও গোত্রীয় ভাষাগুলো, যেমন : কুর্দি, লোরী, গিলাকী, বালুচি, তোর্কি ও আরবিতে কথা বলে। শিক্ষামাধ্যম হিসেবে সাধারণভাবে ফারসি ব্যবহৃত হলেও অন্য ভাষাভাষী এলাকাগুলোতে স্থানীয় ভাষাগুলো শিক্ষামাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
ইসলাম ইরানের রাষ্ট্রীয় ধর্ম। খ্রিস্টীয় ৭ম শতাব্দীতে ইরান মালভূমির অধিবাসীরা ইসলাম গ্রহণ করে। ক্রমান্বয়ে ইরানে শিয়া মাযহাবের প্রভাব বৃদ্ধি পায় এবং এক সময় সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ শিয়া মাযহাবের অনুসারীতে পরিণত হয়। তবে এখানে বিভিন্ন সুন্নি মাযহাবের অনুসারীরাও আছে।
একইভাবে ইরানের সংবিধান খ্রিস্ট, ইয়াহুদি ও যরথুস্ত্রীয় ধর্মকে স্বীকৃতি প্রদান করেছে। এ ধর্মগুলোর অনুসারীরা স্বাধীনভাবে ইরানে বসবাস করছে। ২০১৬ সালের পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে, ইরানের জনসংখ্যার শতকরা ৯৯ ভাগের বেশি মুসলমান। বিভিন্ন জাতি বা সম্প্রদায় ইরানে বসবাস করে এবং তাদের সকলেই ইরানের নাগরিক। ইরানি জাতিগুলোর মধ্য থেকে আযারবাইজানি তুর্কিরা উত্তর-পশ্চিমে, কুর্দিরা পশ্চিমে, লোরীরা দক্ষিণ-পশ্চিমে, বালুচরা দক্ষিণ-পূর্বে, আরবরা দক্ষিণে এবং তুর্কমানরা উত্তর-পূর্বে বসবাস করে। অবশ্য ইরানের বেশিরভাগ জনগণই ফার্স্ বা ফার্সীভাষী পরস্য বংশোদ্ভূতÑ যারা ইরানের সকল প্রদেশে বসবাস করে।
ইরানের জনসংখ্যার অন্য একটি অংশ যাযাবরÑ যাদেরকে উপজাতি হিসেবে অভিহিত করা হয়। উপজাতিরা ইরানের কেন্দ্রীয় ও পশ্চিমের প্রদেশগুলোতে বসবাস করে এবং তাদের অধিকাংশ পশুপালক। উজাতিরা তাঁবুতে বসবাস করে। তারা গ্রীষ্মকালে নিজেদের পশুপালের সাথে অধিকতর ঠা-া এলাকায় এবং শীতকালে অধিকতর গরম অঞ্চলগুলোতে যায়। প্রত্যেক গোত্র বা সম্প্রদায়ের নিজস্ব শীতকালীন ও গ্রীষ্মকালীন এলাকা এবং স্থানান্তরিত হওয়ার বিশেষ সময় রয়েছে।
ইরানি জাতি বা গোত্রগুলোর প্রতিটির বিশেষ ধরনের রীতি-নীতি আছে। কিন্তু অধিকাংশ নিয়ম-কানুন বা রীতি-নীতি জাতীয় এবং ধর্মীয়; সেগুলো তাদের মধ্যে অভিন্ন।
অনুবাদ : সুজন পারভেজ

ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ ভৌগোলিক অবস্থান

 

ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান একটি উঁচু ভূমির দেশ। দেশটির বৃহত্তম অংশ ইরান মালভূমি দ্বারা গঠিত হয়েছে। ইরানের আয়তন প্রায় ১৮ লক্ষ ৭৩ হাজার ৯৫৯ বর্গকিলোমিটার। দেশটি উত্তর গোলার্ধের দক্ষিণ-পশ্চিম এশীয় মহাদেশে অবস্থিত। ইরান বিশ্বের স্থলভাগের নব্বই ভাগের একভাগ জুড়ে রয়েছে। ভৌগোলিক মানচিত্রে ইরানের সীমানা দেখতে বিড়ালের মতো এবং কিছ্টুা লম্বিক। ইরানের ৫০ শতাংশেরও বেশি অঞ্চল পাহাড় এবং উচ্চভূমি নিয়ে গঠিত। এর ২৫ শতাংশ সমভূমি বা প্রান্তর এলাকা এবং ২৫ শতাংশের কম আবাদযোগ্য জমি নিয়ে গঠিত। দেশটি উত্তর সীমান্তে আযারবাইজান, আর্মেনিয়া ও তুর্কমেনিস্তানের সাথে; পূর্বে আফগানিস্তান ও পাকিস্তান এবং পশ্চিমে তুরস্ক ও ইরাকের সাথে প্রতিবেশী হিসেবে অবস্থান করছে। দক্ষিণে পারস্য উপসাগর ও এর সীমান্তবর্তী দেশগুলো, যেমন : বাহরাইন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, ওমান ও সৌদি আরব। দক্ষিণের ওমান সাগর ও পারস্য উপসাগর ইরানকে ভারত মহাসাগরের মাধ্যমে বিশ্বের উন্মুক্ত জলভাগেরর সাথে সংযুক্ত করেছে। পারস্য উপসাগরে প্রায় ৪০টি বড় ও ছোট দ্বীপ রয়েছে।
এছাড়া ইরানের উত্তরে ক্যাস্পিয়ান হ্রদ অবস্থিত, যা বিশ্বের বৃহত্তম হ্রদÑ বাংলা ভাষায় যাকে কাস্পিয়ান সাগর বলা হয়। কয়েকটি দেশ, যেমন : আযারবাইজান, তুর্কমেনিস্তান, কাজাখস্তান ও রাশিয়া এ হ্রদের কিনার ঘেঁষে অবস্থান করছে। এ সমস্ত দেশের ক্যাস্পিয়ান হ্রদে সাধারণ স্বার্থ রয়েছে।
ইরাকের সাথে ইরানের দীর্ঘতম সীমানা ১২৮০ কিলোমিটার এবং আর্মেনিয়ার সাথে সংক্ষিপ্ততম সীমান্ত ৪৫ কিলোমিটার।
কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে পশ্চিম এশীয় অঞ্চলে এবং বিশ্বে সব সময়ই ইরান বিশেষ গুরুত্বের অধিকারী।
অনুবাদ : জাকারিয়া

হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর অসিয়তনামা

ইসলামী উম্মাহর অবিসংবাদিত নেতা হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ.) সারাটি জীবন ধরে ইসলামী উম্মাহর ইহ-পরকালীন মুক্তি ও কল্যাণের জন্য সংগ্রাম করে গেছেন। তাঁর এ সংগ্রামের ফলে ১৯৭৯ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি ইরানের বুকে ইসলামী  বিপ্লব বিজয়ী হয় এবং ইসলামী প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় । তাই ইরানের বিপ্লবী মুসলিম জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাঁকে নেতৃত্বে বরণ করে নেয়। এ বিপ্লব বিজয়ী হবার পরে ও ইন্তেকালের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি ইসলামী বিপ্লবের হেফাযত, বিস্তার এবং সমগ্র মুসলিম উম্মাহর মুক্তি ও কল্যাণের জন্য কথা, লিখা ও চিন্তার মাধ্যমে সাধ্য অনুযায়ী চেষ্টা করে  গেছেন। এমনকি তাঁর ইন্তেকালের পরে সমগ্র মুসলিম উম্মাহ বিশেষত ইরানের বিপ্লবী জনগণ কিভাবে পথ চলবে সে ব্যাপারে পথনির্দেশ দানের জন্য তিনি তাঁর অন্তিম বাণী রেখে গেছেন। আর অন্তিম বাণীসহ তাঁর এ সমগ্র ততপরতারই একটি মাত্র লক্ষ্য ছিল, তা হচ্ছে, মহান আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে একজন মুমিন বান্দার উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন  করে প্রশান্ত চিত্তে তাঁর সমীপে হাজির হওয়া।           

আরেফে রব্বানী হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ.) প্রতিটি মুহূর্তেই খোদার দিদারের জন্য যথাযথভাবে প্রস্তুত ছিলেন। তাই ইন্তেকালের সাড়ে ছয় বছর পূর্বে তিনি তাঁর অন্তিমবাণী রচনা করেন এবং রচনার সমাপ্তিতে হিজরি ১৪০৩ সালের পহেলা জমদিউল আওয়াল (মোতাবেক ১৫ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৩) তারিখে স্বহস্তে লিখিত এ বাণীতে সমাপ্তি স্বাক্ষর ও তারিখ লিপিবদ্ধ করেন। এ অন্তিমবাণীর প্রতিটি পৃষ্ঠার শেষে তিনি স্বাক্ষর করেন এবং তাঁর সীলমোহর সহকারে তা ধর্মীয় নগরী মাশহাদে আহলে বাইতের অষ্টম নিষ্পাপ ইমাম হযরত রেযা (আ.)-এর মাযারে হেফাযতের ব্যবস্থা করা হয়। এর একটি অনুলিপি তিনি নিজের কাছে সংরক্ষণ করেন। বছর দুই পূর্বে তিনি তাঁর এ অন্তিমবাণীর মূল কপি মাশহাদ থেকে আনিয়ে নেন এবং কিছুটা সংশাধন করে পুনরায় সীলমোহর করে মাশহাদে পাঠিয়ে দেন।

হযরত ইমামের ইন্তেকালের পরদিন ৪ঠা জুন (১৯৮৯) সকাল ৯টা ১০ মিনিটের সময় মজলিশে শুরায়ে ইসলামী ভবনে অনুষ্ঠিত নেতা নির্বাচনী বিশেষজ্ঞ পরিষদের সদস্যগণ, মজলিশে শুরায়ে ইসলামীর সদস্যগণ, মন্ত্রী পরিষদের সদস্যগণ এবং দেশের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও সামরিক ব্যক্তিত্বের যৌথ সমাবেশে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের ততকালীন প্রেসিডেন্ট (বর্তমান রাহবার) হযরত আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী কর্তৃক এ অসিয়তনামা পঠিত হয়। এরপর জাতীয় প্রচারমাধ্যমসমূহে তা প্রচারিত হয়।

হযরত আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী কর্তৃক হযরত ইমামের অন্তিম বাণীটি মরহুমের সংরক্ষিত অনুলিপি থেকে পঠিত হয়; পরে এক বিশেষ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মাশহাদে সংরক্ষিত মূল কপিটি খোলা হয়। হযরত ইমামের স্বহস্তলিখিত এ অসিয়তনামার মূল অংশটি ২৯ পৃষ্ঠা, ৬ পৃষ্ঠা ভূমিকা ও ১ পৃষ্ঠা পরিশিষ্টসহ মোট ৩৬ পৃষ্ঠা।

 হযরত ইমামের অসিয়তনামার পূর্ণ বিবরণ

 নবীপাক (সা.) বলেন : ‘আমি তোমাদের কাছে অতীব মূল্যবান ও সম্মানিত দু’টি জিনিস (সাকালাইন) রেখে যাচ্ছি : আল্লাহর কিতাব এবং আমার আহলে বাইত। অতঃপর নিশ্চয়ই এ দুটি  জিনিস হাউজে (কাউসারে) আমার সাথে মিলিত না হওয়া পর্যন্ত কখনও পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হবে না।’-হাদীসে সাকালাইন

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের, যিনি সকল কিছু থেকে পবিত্র। হে আল্লাহ! তুমি মুহাম্মাদ (সা.) ও তাঁর আহলে বাইতের উপর অবারিত শান্তি বর্ষণ কর, যাঁরা তোমার সৌন্দর্য ও মহিমার বহিঃপ্রকাশ। তাঁরা তোমার আসমানি গ্রন্থের গুপ্ত রহস্যের ভাণ্ডার। এটা এমন এক গ্রন্থ যার মাঝে তোমার সকল পবিত্র নাম, এমনকি ইসমে মুন্তাসার (ইস্মে আযম) সহ একত্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে, যে ইসমে মুন্তাসার-এর প্রকৃত তাৎপর্য সম্বন্ধে তুমি ব্যতীত আর কেউ অবহিত নয়। আর অপবিত্র বৃক্ষের মূল যালেমদের প্রতি তোমার অভিশাপ বর্ষিত হোক।

অতঃপর এই ‘দুই পবিত্র আমানত’ (সাকালাইন)  সম্পর্কে সংক্ষেপে আপনাদের কিছু অবহিত করা আমি যুক্তিযুক্ত মনে করছি। এদের অলৌকিক, আধ্যাত্মিক বা মরমি দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে বলা আমার উদ্দেশ্য নয়। যেখানে আমার মতো খালকের লেখনি কূল মখলুকের সেই সুবিশাল সাম্রাজ্যে এগিয়ে যেতে অক্ষম, যা দুনিয়া থেকে সপ্ত আসমান এবং সেখান থেকে সুমহান খোদায়ী অস্তিত্ব অবধি পরিব্যাপ্ত। যার ধারণা আমার এবং আপনার বোধগম্য নয়, বরং সাধ্যেরও বাইরে। যদিও এটাকে অসম্ভব বলছি না। সর্বোত্তম আমানত ‘আল কোরআন’ ও তার পরের মর্যাদায় ‘আহলে বাইত’ বস্তুতপক্ষে এই ‘আহলে বাইত’ সমগ্র অস্তিত্বশীল সত্তার মাঝে সর্বোত্তম আমানত ছাড়া আর কিছুই নয় যা ‘পরম শ্রেষ্ঠতম’ (আকবরই  মতলুক)। সর্বোত্তম আমানতদ্বয়ের প্রকৃতি ও গুণাবলির প্রতি অবহেলা ও এর থেকে দূরে থাকার কারণে মানবজাতির পরিণতি কি হয়েছে তার কোন ফিরিস্তি আমি দিচ্ছি না কিংবা আল্লাহর দুশমনদের এবং কুচক্রী শাসকদের তরফ থেকে এই দুই আমানতের প্রতি কী আচরণ করা হয়েছে তারও কোন হিসাব আমি তুলে ধরছি না। এদের সংখ্যা এতো বেশি যে, সময়ের অভাবে ও সীমিত জ্ঞানের দ্বারা তার সম্যক অনুধাবন আমার পক্ষে প্রায় অসম্ভব। আমি শুধু পবিত্র এ দুই আমানতের ভাগ্যে কী ঘটেছে তারই খানিকটা বক্তব্য তুলে ধরা উপযুক্ত মনে করছি।

‘এই দুটি কখনো পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হবে না আমার সাথে হাউজে (কাওসার) মিলিত না হওয়া পর্যন্ত’- কথাটি দ্বারা সম্ভবত এটাই ইংগিত বহন করে যে, নবী করিম (সা.)-এর তিরোধানের বেলায়ও ঘটেছে তাই। একটিকে অমান্য করা মানে অপরটিকেও অমান্য করা ততক্ষণ পর্যন্ত, যতক্ষণ না হাউজে কাওসারে, রাসূলুল্লাহর সাথে উভয়ের মিলন ঘটে। এ ‘হাউজ’ বলতে কি একত্বের মাঝে একাধিকত্বের সম্মিলন, না বারিবিন্দুসমূহের মহাসমুদ্রে বিলীন হওয়ার মতো অবস্থা, না অন্য কিছু তা সাধারণ মানববোধের অতীত বিষয়! এটাও প্রণিধানযোগ্য যে, আল্লাহর রাসূলের দুই আমানতের প্রতি অত্যাচারীদের পক্ষ থেকে যে অন্যায় করা হয়েছে ঠিক তদ্রূপ অবিচার করা হয়েছে সাধারণ মুসলিম জাতির (উম্মতে ইসলামীয়া) প্রতি, তথা গোটা মানবজাতির প্রতি, যার বর্ণনা দানে এই ক্ষুদ্র লেখনি অপারগ।

এটা উল্লেখ করা অত্যাবশ্যক যে, ‘হাদীসে সাকালাইন’ রাসূলে পাক (সা.) থেকে ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন পর্যায়ে (মুতাওয়াতির) বর্ণিত হয়ে এসেছে। এই মহান হাদীস সমগ্র মানবজাতির জন্য বিশেষভাবে মুসলমানদের সকল মাযহাবের জন্য এক অকাট্য দলিল (হুজ্জাতে কাতে)। সব মুসলমানের ক্ষেত্রেই এই দলিল প্রযোজ্য। অজ্ঞ-মূর্খদের এতে ওজর থাকলেও মাযহাবসমূহের আলেমদের কোন অজুহাতই নেই।

এখন দেখা যাক সুমহান খোদায়ী নেয়ামত এই আল্লাহর কিতাব এবং ইসলামের নবী (সা.)-এর রেখে যাওয়া পবিত্র আমানতের ভাগ্যে কী ঘটেছে। সেই দুঃখজনক ঘটনাবলি শুরু হয়েছিল ইমাম আলী (আ.)-এর শাহাদাতের পর থেকেই- যার স্মরণে অবশ্যই রক্তাশ্রু ঝরা উচিত। কোরআনবিরোধী শাসকগোষ্ঠীর স্বার্থে স্বার্থান্বেষী লোকজন ও যুলুমবাজের দল কোরআনকে উদ্দেশ্য হাসিলের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছিল। কুরআনের প্রকৃত ব্যাখ্যাকারীদেরকে, শিক্ষিত ও জ্ঞানীদেরকে, যাঁরা সরাসরি রাসূলে পাক (সা.)-এর কাছ থেকে কুরঅআনের পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা লাভ করেছিলেন তাঁদেরকে সুপরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন অজুহাত তুলে দৃশ্যান্তরালে নিক্ষেপ করা হয়েছিল; যাঁদের কানে অনুরণিত হচ্ছিল বারবার সেই নবীবাণী- ‘আমি তোমাদের কাছে অতীব মহান ও মূল্যবান দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি।’

প্রকৃতপক্ষে যে কোরআন মানবজাতির জন্য নিয়ে এসেছে সর্বোতকৃষ্ট জাগতিক ও আধ্যাত্মিক পথনির্দেশনা সেইদিন পর্যন্ত যেদিন হাউজে কাওসারে নবীর সাথে ঘটবে মিলন, সেই কোরআনুল কারিমকে সমাজ থেকে বিতাড়িত করা হয়েছিল। পবিত্র কিতাবের অন্যতম আদর্শ, সঠিক খোদায়ী ইনসাফভিত্তিক হুকুমতকে তারা বাতিল ঘোষণা করে এবং আল্লাহর দ্বীন, তাঁর পবিত্র কিতাব ও সুন্নাহ থেকে এত বেশি বিভ্রান্তিকর ধারণার জন্ম দেয় যে, তা বর্ণনা করতে রীতিমত হতবাক হতে হয়। আর যতই এই ভ্রষ্ট কাঠামোটি এগিয়ে যেতে লাগল ততই বক্রতা ও বিচ্যুতির পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে লাগল। আর তা এমন এক পর্যায়ে গিয়ে উপনীত হলো যে, পাক কোরআন- যে পবিত্র গ্রন্থ মহানবী মুস্তাফা (সা.)-এর ওপর পূর্ণাঙ্গভাবে ও ওহীর সমাপ্তি হিসেবে অবতীর্ণ হয়েছিল দুনিয়ার মানবজাতিকে সমুন্নত করতে, মুসলমানদের ঐক্য, এমনকি গোটা মানবজাতির ঐক্যের উতস হিসেবে, যাতে মানবতার যথার্থ উন্নয়ন সাধিত হয়, যার আগমন শয়তান এবং তাগুতীদের হাত থেকে আল্লাহ পাকের পবিত্র নামোদ্ভূত জ্ঞানের সৃষ্টি মানবসন্তানদের (ওয়ালীদা-ইলমুল আসমা) রক্ষা করতে, ন্যায়বিচার (আদল) এবং সাম্য (ক্বিস্‌ত) প্রতিষ্ঠা করতে, হুকুমতকে আল্লাহর মাসুম বন্ধুদের (তাঁদের উপর দরুদ ও সালাম পৃথিবীর আদিকাল হতে তার সমাপ্তিকাল পর্যন্ত) হাতে সমর্পণ করতে, যেন তাঁরা মানবতার স্বার্থে উতসর্গকৃত ব্যক্তিদের হাতে অর্পণ করতে পারেন, কিন্তু এই কোরআনকে এমনভাবে ময়দান থেকে বিদায় দেয়া হয়েছিল যে, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছিল যেন মানবতার পথনির্দেশনায় এর কোন ভূমিকাই নেই। এই বিচ্যুতি এমন এক পর্যায়ে উপনীত হয়েছিল যে, স্বৈরাচারী সরকারগুলো এর অপব্যবহার শুরু করেছিল। পরম প্রভু আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দুশমন এবং যালেমদের শাসনকে বৈধ রূপ দেবার জন্য এবং সমাজে অবিচার ও দুর্নীতি প্রতিষ্ঠার (হুকুমতে গায়ের) জন্য অত্যাচারী শাসকদের চেয়ে নিকৃষ্ট দুর্নীতিপরায়ণ আলেমদের (আখুন্দ) দ্বারাই কোরআনের অপব্যবহার হয়েছিল বেশি। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, কুচক্রী ও মূর্খ বন্ধুদের কাছে এই ভাগ্যনির্ধারক কিতাব আল-কোরআন এর কবরস্থান আর দাফন অনুষ্ঠানগুলোতে আবৃত্তি ছাড়া যেন অন্য কোন ভূমিকাই আর থাকল না। যে কিতাব হওয়ার কথা ছিল মুসলমানদের তথা সমগ্র মানবজাতির একতার উতস এবং তাদের এক জীবন্ত নিদের্শনা, অথচ হয়ে গেল অনৈক্য আর বিচ্ছিন্নতার উতস। কিংবা কোরআনকে সম্পূর্ণরূপে সরিয়ে ফেলা হলো যে, কেউ যখনই ইসলামী সরকার বা ইসলামী রাজনীতির প্রসঙ্গ তুলত অর্থাত সেই সুমহান ইসলাম- যা মহানবী (সা.)-এর জীবন এবং কোরআন-সুন্নাহর বিষয়বস্তুর পূর্ণাঙ্গ রূপ, তখনই ‘রাজনৈতিক আলেম’ (আখুন্দে সিয়াসী) তথা পরিপূর্ণ ধর্মচ্যুত আলেম নামে আখ্যয়িত করা হত। যেন ইসলামী রাজনীতির কথা বলে সে কোন মহা-অপরাধ করে ফেলেছে। এ অবস্থা বর্তমানকালেও বিদ্যমান।

অতি সম্প্রতি পাক কোরআনের সঠিক পরিচয় মুছে ফেলার লক্ষ্যে এবং বৃহত শক্তিগুলোর স্বার্থ হাছিলের উদ্দেশ্যে শয়তান শক্তিগুলো ইসলামের প্রতি দায়িত্বশীল বলে মিথ্যা দাবিদার, পথভ্রষ্ট মুসলিম সরকারগুলোর মাধ্যমে চোখধাঁধাঁনো লিপি-চাতুর্যের সাহায্যে রঙচঙে কোরআন শরীফ প্রকাশ করে। লোকজনকে মিথ্যার মোহজালে বিভ্রান্ত করার মানসে সর্বত্র এই ধরনের কোরআন শরীফ ছড়িয়ে দেয়। এটা হলো কোরআনকে জীবনপট থেকে সরিয়ে ফেলার অপকৌশল। আমরা সকলেই নিজ চোখে দেখেছি, মুহাম্মাদ রেযা খান পাহলভী (শাহ) কর্তৃক মুদ্রিত কোরআন কিভাবে কতিপয় মৌলভীসহ লোকজনকে প্রতারণা করেছে। ইসলামের লক্ষ্যসমূহ সম্পর্কে অজ্ঞ এসব লোকজন শাহের গুণগানে ছিল মুখর। আমরা আরো দেখেছি, প্রতিবছর কিভাবে বাদশাহ ফাহদ জনগণের বিপুল পরিমাণ সম্পদের অপচয় করে এই ধরনের কোরআন শরীফ অজস্র পরিমাণে প্রকাশ করে থাকে। এর মাধ্যমে সে কোরআনবিরোধী ওয়াহাবী মতবাদ (যা কুসংস্কারপূর্ণ ও ভিত্তিহীন একটা জঘন্য মতবাদ) এর ঘৃণ্য প্রচারণায় লিপ্ত। এর ফলে অজ্ঞ ও নিরীহ জনসাধারণ ও বিভিন্ন জাতি বৃহত শক্তিগুলোর প্রতি আকর্ষিত হয়। আর এই অপকৌশল থেকে ফায়দা হাছিল করে তা তারা প্রিয় ইসলাম এবং পবিত্র কোরআনের ধ্বংসের কাজে নিয়োজিত করে।

আমরা গর্ব অনুভব করি এই জন্য যে, আমরা মহান ইসলাম ও কোরআনের প্রতি আত্মোতসর্গকৃত জাতি। গৌরবান্বিত এই জন্য যে, আমরা এমন একটি মাযহাবের অনুসারী যা কোরআনী সত্যকে কালের সমাধি খুঁড়ে উন্মোচনে ততপর, সে সত্য মুসলমানের ঐক্য, এমনকি মানবতার ঐক্যের কথা বলে। যে সত্য সকল প্রকার বন্ধন ও শৃঙ্খল থেকে মানবতার মুক্তির ব্যবস্থাপনা- যে বন্ধন ও শৃঙ্খলসমূহ মানবতার হাত-পা, অন্তর ও বিবেকের টুটি চেপে ধরেছে আর তাকে (মানবতাকে) ঠেলে দিচ্ছে ধ্বংস ও তাগুতীদের (মিথ্যাশ্রয়ীদের) দাসত্ব ও উপাসনার দিকে।

আল্লাহ তাআলার অনুশাসনের উপর ভিত্তি করে নবীপাক (সা.) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত সে পবিত্র মাযহাবের অনুসারী হয়ে আমরা আজ গর্বিত এবং আমরা এ জন্যও গর্বিত যে, বিশ্বাসীদের মহান নেতা আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.) ইবনে আবি তালিব-সকল শৃঙ্খল থেকে মুক্ত মহান সেই বান্দা-যাঁর উপর মানুষকে দাসত্বের সকল প্রকার শৃঙ্খল থেকে মক্ত করার ভার অর্পিত।

আমরা গৌরবান্বিত যে, নাহজুল বালাগাহ্ নামের মহাগ্রন্থটি আমাদের নিষ্পাপ (মাসুম) ইমাম [হযরত আলী (আ.)] থেকে- যে নাহজুল বালাগাহ হচ্ছে কোরআনের পর মানবজাতির জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ ও জাগতিক জীবনব্যবস্থা ও মানবজাতির মুক্তির সর্বোতকৃষ্ট গ্রন্থ। যে গ্রন্থের আধ্যাত্মিক ও প্রশাসনিক অনুশাসন ও নীতিমালাগুলো হচ্ছে পরম মুক্তির শ্রেষ্ঠ পথ।

আমরা এজন্য গর্বিত যে, আমদের মাসুম ইমামগণ হচ্ছেন হযরত আলী বিন আবি তালিব (আ.) থেকে মানবজাতির ত্রাণকর্তা যামানার সর্দার হযরত মাহদী (আ.) পর্যন্ত যিনি সর্বশক্তিমান আল্লাহ পাকের কুদরতে জীবিত (আছেন) ও আমদের সকল কার্যকলাপ অদৃশ্য থেকে পর্যবেক্ষণ করছেন।

আমরা এজন্যও গর্ব অনুভব করছি যে, প্রাণসঞ্জীবনী দু’আ বা প্রার্থনাসমূহ যা ‘কোরআনে সায়েদ’ অর্থাত ‘ঊর্ধ্বগামী কোরআন’ নামে পরিচিত তা আমাদের ইমামদেরই রচিত। ইমামদের শা’বানীয়া মুনাজাত, ইমাম হোসাইন (আ.)-এর আরাফাতের দু’আ, আলে মুহাম্মাদ (সা.)-এর ধর্মীয় বন্দনা বা ‘যাবুর-ই আলে মুহাম্মাদ’ নামে প্রসিদ্ধ ‘সাহীফা-ই-সাজ্জাদিয়াহ’, হযরত ফাতেমা যাহরা মারযীয়ার প্রতি আল্লাহপাকের তরফ থেকে ইলহামকৃত ‘সাহীফা-ই ফাতেমীয়া’- এগুলো সবই হচ্ছে আমাদের।

পঞ্চম ইমাম বাকের-উল উলুম (আ.)-কে নিয়েও আমরা গর্বিত। তিনি হচ্ছেন ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব। একমাত্র আল্লাহ জাল্লা শানুহু, তাঁর পেয়ারা রাসূল (সা.) এবং মাসুম ইমামাগণই তাঁর মর্যাদা যথার্থভাবে উপলব্ধি করতে সক্ষম।

আর আমরা গৌরবান্বিত যে, আমরা জাফরী মাযহাবের অনুসারী। সীমাহীন মহাসমুদ্রের মতো বিশাল এই (ফিকহী) চিন্তাধারা তাঁর [ইমাম জাফর সাদেক (আ.)] দ্বারাই বিকশিত হয়েছে। আমরা সকল মাসুম ইমাম (আ.)-কে নিয়েই গর্ব অনুভব করি এবং তাঁদের অনুসরণ করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

আমরা গৌরবান্বিত এজন্যও যে, মাসুম ইমামগণ ইসলামকে সমুন্নত রাখতে গিয়ে, সত্য ও ন্যায়নীতির হুকুমত প্রতিষ্ঠায় কোরআনের প্রয়োগ করতে গিয়ে এবং তাঁদের যামানার স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠীকে এবং যুলুমবাজদের উতখাত করতে গিয়ে কারাবরণ করেছেন, নির্বাসিত জীবন যাপন করেছেন এবং পরিশেষে শাহাদাতবরণ করেছেন। আমরা এজন্য গৌরবান্বিত যে, আমরা চাই পাক কোরআন ও সুন্নাহর নীতিমালাকে কার্যে পরিণত করতে এবং এও গৌরবের বিষয় যে, আমাদের জাতির বিভিন্ন স্তর ও শ্রেণির জনগণ এ মহান ভাগ্যনির্ধারক প্রচেষ্টায় আল্লাহর রাহে স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজেদের জানমাল ও প্রিয় বস্তুসমূহ কুরবান করে দিচ্ছে।

আমাদের জন্য এও গৌরবের বিষয় যে, আমাদের নারীরা সকল বয়সের, খ্যাত কিংবা অখ্যাত, সবাই ইসলামের উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়িত করতে, ইসলামের সৌন্দর্যকে সমুন্নত রাখতে, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক অঙ্গনে পুরুষের পাশাপাশি- অনেক সময় অধিকতর যোগ্যতায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। যে সকল নারী যুদ্ধ করতে সক্ষম তারা মিলিটারি ট্রেনিং নিচ্ছে- যা ইসলাম ও ইসলামী ভূখণ্ডের প্রতিরক্ষায় এক গুরুত্বপূর্ণ কৌশল। তারা সাহস ও দৃঢ়তার সাথে উপেক্ষা করেছে- কুচক্রী দুশমন ও মূর্খ সুহৃদ কর্তৃক তাদের উপর তথা ইসলামের অনুশাসন ও কোরআনের উপর আরোপিত হীনতা ও বঞ্চনাকে। সাধারণ মুসলমানদের স্বার্থহানি করে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করার মানসে দুশমনরা মূর্খ ও ভণ্ড আলেমদের দ্বারা যে সমস্ত কুসংস্কারের জন্ম দিয়েছে, সেসবের শৃঙ্খলও নারীরা নির্ভয়ে ভেঙে ফেলেছেন। আর যারা যুদ্ধ করতে অক্ষম তারা যুদ্ধময়দানের পশ্চাতে বিভিন্ন সেবামূলক কাজে এত বেশি নিবিষ্টচিত্ত যে, তা দেখে আমাদের গোটা জাতি আজ অভিভূত এবং তাদের মহতী সেবা দেখে দুশমন ও দুশমনদের চেয়ে নিকৃষ্ট মূর্খদের অন্তর ক্রোধ ও উষ্মায় ফেটে পড়ছে।

বারবার আমাদের চোখে পড়ছে মহিয়সী নারীরা উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করছে, সেই মহাসম্মানিতা নারী হযরত যায়নব (আ.)-এর মতো যে, সর্বশক্তিমান আল্লাহর রাহে এবং মহা ইসলামকে বুলন্দ করার লক্ষ্যে তাদের সন্তানদের কুরবানি দিয়ে আজ তাঁরা গর্বিত এবং তাঁদের সবকিছু তাঁরা এভাবে বিলিয়ে দিতে সদা প্রস্তুত। তাঁরা জানেন যে, এর ফলে তাঁরা যা কিছু অর্জন করেছেন তা দুনিয়ার তুচ্ছাতিতুচ্ছ জিনিস তো কোন ছার, স্বয়ং বেহেস্তের অফুরন্ত নেয়ামতের চেয়েও মর্যাদাপূর্ণ। আমাদের জাতি তথা সমগ্র মুসলিম উম্মাহ্ ও অন্যান্য নির্যাতিত জাতি এজন্য আজ গর্বে উদ্বেলিত যে, তাদের দুশমন স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দুশমন, কোরআন এবং সত্যধর্ম ইসলামের দুশমন। যারা নিষ্ঠুর-বর্বর এবং যারা নিজেদের ঘৃণ্য দুষ্কর্ম হাসিলের উদ্দেশ্যে তাদের আধিপত্য বিস্তারে শত্রুমিত্র নির্বিশেষে সকলের প্রতি পাশবিক আচরণ ও বিশ্বাসঘাতকতা করতেও দ্বিধাবোধ করে না। এদের প্রধান হচ্ছে জাত সন্ত্রাসবাদী আমেরিকান সরকার, যে সারা দুনিয়াব্যাপী ছড়িয়ে দিয়েছে সন্ত্রাসের অগ্নিশিখা। তার অন্যতম দোসর আন্তর্জাতিক ইহুদিবাদ, যে নিজের শয়তানি খায়েশ পুরো করার মানসে যে কোন অপকর্ম করতে ততপর, যার হিসাব লিখতে গেলে কলম থেমে যায়, বর্ণনা দিতে গেলে কণ্ঠ লজ্জায় রুদ্ধ হয়ে আসে। বৃহত্তর ইসরাইল গঠনের ঘৃণ্য দুরাশা তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করে সব রকমের ইবলিসি ততপরতায়। মুসলিম জাতি এবং দুনিয়ার মযলুম জনগণ আজ এটা উপলব্ধি করে গর্বিত যে, পেশাদার বর্বর জর্দানের বাদশাহ হোসেন, মরক্কোর বাদশাহ হাসান ও মিশরের প্রেসিডেন্ট হোসনী মোবারক তাঁদের দুশমন এবং অপরাধী আমেরিকা ও ইসরাইলের সেবায় নিবেদিতপ্রাণ। এরা নিজেদের জাতি ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যে কোন ধরনের বিশ্বাসঘাতকতামূলক কার্যকলাপে লিপ্ত হতে মোটেও ইতস্তত নয় এবং আমরা আরও গৌরবান্বিত এ জন্য যে, ইরাকের বামপন্থী সাদ্দামও আমাদের দুশমন যাকে তার দোস্ত ও দুশমনরাও মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক নীতিমালার সুস্পষ্ট লঙ্ঘনকারী অপরাধী হিসেবেই জানে। সকলের কাছেই এটা পরিষ্কার যে, ইরাক ও পরস্য উপসাগরীয় শেখশাসিত রাষ্ট্রগুলোর জনসাধারণের বিরুদ্ধে সাদ্দামের যে বিশ্বাসঘাতকতা, তা ইরানী জাতির বিরুদ্ধে তার বিশ্বাসঘাতকতার চেয়ে কোন অংশে কম নয়।

বর্বর পরাশক্তিগুলোর দ্বারা পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রচারযন্ত্রগুলো যে আমাদের দোষী সাব্যস্ত করেছে তাতেও আমরা এবং পৃথিবীর অন্যান্য জাতি গর্বিত।

এরচেয়ে সুখবর আর গৌরবের বিষয় কী হতে পারে যে, বিশ্বের নির্যাতিত ও পশ্চাদপদ বিপুল বৈভবের উপর একচ্ছত্র অধিকার, সামরিক শক্তি, বিভিন্ন পুতুল সরকারের সমর্থন এবং প্রচারমাধ্যমগুলোর নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা পেয়েও আমেরিকার সরকার তার সকল নির্জলা মিথ্যা দাবি নিয়ে বাহাদুর ইরানী জাতি এবং হযরত বাকিয়াতুল্লাহ (আ.) (তাঁর পবিত্র আগমনে আমাদের জীবনসমূহ কুরবান হোক) এর দেশ ইরানের মোকাবেলায় এমনভাবে পর্যুদস্ত ও লাঞ্ছিত হয়েছে যে, এরপর কোন্ উপায় অবলম্বন করতে হবে সে জ্ঞান পর্যন্ত তার (আমেরিকার) লোপ পেয়ে গেছে। অতঃপর সে যার কাছেই যায় তার কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়। এটা সম্ভব হত না মহাপ্রভু আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের গায়েবি মদদ ছাড়া। যিনি জাতিসমূহকে বিশেষভাবে ইরানী জাতিকে জাগ্রত করেছেন, তাদেরকে স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের ঘোর অন্ধকার থেকে উদ্ধার করে ইসলামের পবিত্র নূরে করেছেন আলোকিত। এহেন সন্ধিক্ষণে মযলুম মহান জাতিসমূহ এবং প্রিয় ইরানী জাতির প্রতি আমার অসিয়ত, তাঁরা যেন নাস্তিক প্রাচ্য বা অত্যাচারী কাফের পাশ্চাত্যের কোন পথই অনুসরণ না করেন। একমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামীন প্রদত্ত সিরাতুল মুস্তাকীমে স্থির সংকল্প, দৃঢ়চিত্ত ও আনুগত্যের সাথে অবিচল থাকেন। খোদার নিয়ামতের শোকর আদায় করতে মুহূর্তের জন্য যেন উদাসীন না হন এবং পরাশক্তিগুলোর দোসরদের নাপাক হস্তসমূহকে প্রশ্রয় না দেন- তারা বিদেশি হোক বা দেশি- যারা বিদেশি দুশমনদের চেয়েও জঘন্যতম এবং এরা যেন আপনাদের নিয়তের পবিত্রতা এবং দৃঢ় সংকল্পের মধ্যে কোনরকম নাড়া দিতে না পারে। আপনাদের জেনে রাখা উচিত যে, আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যমগুলো যতই আপনাদের বিরুদ্ধাচরণ করবে ততই আপনাদের খোদায়ী শক্তি প্রস্ফুটিত হবে এবং সর্বশক্তিমান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাদেরকে (পরাশক্তিগুলো ও তাদের দোসরদেরকে) ইহজগত ও পরজগত উভয় জগতেই শাস্তি বিধান করবেন। নিশ্চয়ই তিনি সকল নিয়ামতের সর্বময় কর্তা, ‘তাঁর অধিকারেই সকল কিছুর কর্তৃত্ব’ (আল-কোরআন ২৩ : ৮৮)। মুসলিম জাতিসমূহের প্রতি আমি একান্ত বিনীতভাবে আরজ করছি, পূর্ণ আন্তরিকতার সাথে আত্মোতসর্গের মনোভাব নিয়ে যথাযোগ্য আদবের সাথে মানবজাতির সর্বোত্তম পথনির্দেশক মাননীয় পবিত্র ইমাম (আ.) গণের অনুসরণ করতে; বিশেষ করে তাঁদের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক কায়দাকানুন, অর্থনৈতিক ও সামরিক নীতিমালাকে মেনে চলতে এবং আহ্বান জানাই ফিকহ-ই সুন্নাতী থেকে সামান্যতমও সরে না যেতে। এই সুন্নাতী ঐতিহ্যই নববী এবং ইমামী চিন্তাধারার বহিঃপ্রকাশ এবং জাতিসমূহের উন্নতিবিধান এবং মর্যাদার নিশ্চয়তা প্রদানকারী। যদিও বা তা ‘প্রাথমিক অধ্যাদেশসমূহ’ (আহকাম-ই আওয়ালিয়াহ্) বা ‘দ্বিতীয় পর্যায়ের অধ্যাদেশসমূহ’ (আহকাম-ই সানাভিয়াহ্) হয় যেগুলো উভয়ই ইসলামী আইনশাস্ত্রের অন্তর্ভুক্ত। হক ও মাযহাবের বিভ্রান্ত দুশমন শয়তানদের প্রলুব্ধকর বিষয়াদির দিকে কখনো যেন মনোযোগ না দেন। এক বিঘত পরিমাণ বিচ্যুতি ধর্মের তথা ইসলামী অধ্যাদেশ এবং ইনসাফপূর্ণ খোদায়ী হুকুমত ও আইন-কানুনের ধ্বংসসাধন করার জন্য যথেষ্ট। উদাহরণস্বরূপ, কখনো জুমআর নামাযের প্রতি অবহেলা করবেন না। এই নামায, নামাযের রাজনৈতিক তাতপর্য ফুটিয়ে তোলে। শুক্রবারের এই জুমআর নামায আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নেয়ামত যা ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের জন্য তিনি মনোনীত করেছেন। ইমামগণের শাহাদাত বার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত শোক অনুষ্ঠানগুলোর প্রতিও অবজ্ঞা প্রদর্শন করবেন না। বিশেষ করে সাইয়্যেদুশ শুহাদা ও মযলুমদের নেতা হযরত আবি আবদিল্লাহ হুসাইন (আ.)-এর শোক অনুষ্ঠানের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবেন। (মহান আল্লাহ্, তাঁর ফেরেশতাকূল, নূরনবী এবং সকল সালেহ বান্দার পূর্ণ দরুদ ও সালাম তাঁর পবিত্র ও নির্ভীক রুহের উপর বর্ষিত হোক)।

জনগণের স্মরণ রাখা উচিত কারবালার প্রেরণাদায়ক ঐতিহাসিক মহাঘটনার স্মৃতিচারণের জন্য ইমামদের নির্দেশনাবলি। নবী (সা.)-এর আহলে বাইতের দুশমনদের উপর যেসব ধিক্কার ও অভিশাপ আপতিত হয়েছে তা আসলে যুগ যুগ স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে জাতিসমূহের বীরত্বপূর্ণ প্রতিবাদ। আপনাদের জানা উচিত, উমাইয়্যাদের (তাদের উপর আল্লাহ্র লা’নত) অত্যাচার আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে ধিক্কার, নিন্দাবাদ ও অভিশাপের কথা। যদিও তারা এখন পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে জাহান্নামের অতল গহ্বরে নিমজ্জিত, তথাপি এই ফরিয়াদ ইঙ্গিত বহন করে বর্তমান দুনিয়ার যালেমদের বিরুদ্ধে মজলুম জনতার আর্তচিতকার। এ যুলুমবিধ্বংসী ফরিয়াদকে সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। ইমামদের স্মরণে শোকগাথা ও প্রশংসাসূচক কাব্যগুলোতে প্রতিটি যুগের যালেমদের দ্বারা সংগঠিত অত্যাচার ও দুঃখজনক ঘটনাগুলো জোরালোভাবে আলোচিত হওয়া উচিত। আর বর্তমান যুগ- যা হচ্ছে আমেরিকা, রাশিয়া ও তাদের দোসরদের বিশেষ করে আল্লাহ পাকের পবিত্র হারামের প্রতি বিশ্বাসঘাতক সৌদি রাজবংশের (তাদের উপর আল্লাহ্ ও তাঁর ফেরেশতা ও রাসূলগণের লা’নত বর্ষিত হোক) হাতে মুসলিম বিশ্বের নির্যাতিত হওয়ার যুগ, (এই যুগেও) জোরালোভাবে (সত্য ইমামগণের স্মরণে শোকগাথা ও প্রশংসাসূচক কাব্যগুলোতে) আলোচনা করা, অভিশাপ ও ধিক্কার দেয়া উচিত। আমাদের সকলেরই বুঝা উচিত, যে জিনিস মুসলমানদের ঐক্য সাধন করবে তাহলো এই রাজনৈতিক অনুষ্ঠানমালা- যেগুলো মুসলমানদের বিশেষ করে বার ইমামের অনুসারী শিয়াদের জাতিসত্তাকে সংরক্ষণ করবে।

এখানে প্রত্যককে যা স্মরণ করিয়ে দেয়া প্রয়োজন বলে মনে করি তা হলো, আমার ধর্মীয়, রাজনৈতিক এই অসিয়ত শুধু ইরানের মহান জনগণের জন্য লিখিত নয়; বরং এটা সকল মুসলমান তথা জাতিধর্ম নির্বিশেষে দুনিয়ার তাবত মযলুম জনগণের জন্য এক উপদেশ হিসেবেও পরিগণিত।

মহামহিম আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের খেদমতে আমার সবিনয় নিবেদন, আমাদের এবং আমাদের জাতিকে যেন তিনি কখনও একা ছেড়ে না দেন। ইসলামের সন্তানদের এবং আমাদের প্রিয় সৈনিকদের যেন এক মুহূর্তের জন্যও স্বীয় গায়েবি মদদসমূহ থেকে বঞ্চিত না করেন।

রুহুল্লাহ্ আল-মুসাভী খোমেইনী

 বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম

বহু সহস্র অমর শহীদ, এ বিপ্লবে ক্ষতিগ্রস্ত প্রিয় নাগরিকবৃন্দ- যাঁরা জীবন্ত শহীদ ও লক্ষ লক্ষ জনতার সীমাহীন কুরবানির বিনিময়ে অর্জিত এই মহিমাময় ইসলামী বিপ্লব, যার গুরুত্ব এত অধিক যে, এর পরিমাপ লেখনি এবং বাগ্মিতার ক্ষমতারও অতীত। যে বিপ্লব সারা দুনিয়ার কোটি কোটি মুসলমান ও মুস্তাযআফের আশা-আকাঙ্ক্ষার আলোকবর্তিকা।

আমি রুহুল্লাহ্ মুসাভী খোমেইনী, যে নিজের অসংখ্য দোষত্রুটি থাকা সত্ত্বেও মহাপ্রভু আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের অসীম রহমত হতে নিরাশ নই। রহমানুর রহীম আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের অসীম রহমতের আশাকে সম্বল করে আখেরাতের পথে দুর্গম সফর শুরু করছি। ধর্মতত্ত্বের একজন নগণ্য ছাত্র হিসেবে অন্যান্য মুমিন ভাইয়ের মত এই ইসলামী বিপ্লব, এর ফলাফলের স্থায়িত্ব এবং অনাগত উত্তরোত্তর ফলোদয়ের প্রতি আশা রেখে আমি আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যতের প্রিয় প্রজন্মের প্রতি অসিয়ত হিসেবে ইত্যবসরে পুনরাবৃত্তি হলেও কিছু বিষয় সম্পর্কে বলার ইচ্ছে পোষণ করছি। এজন্য পরম প্রভু দয়ালু আল্লাহ্ তাআলার কাছে আমার মিনতি, যেন তিনি আমাকে এই কাজে পূর্ণাঙ্গ আন্তরিক হওয়ার তওফিক দান করেন।

১. আমরা জানি, ইরানের বুক থেকে বিশ্বগ্রাসী আর স্বৈরাচারীদের প্রভাবকে খতম করে আল্লাহ তাআলার গায়েবি মদদের মাধ্যমে এই মহা ইসলামী বিপ্লব বিজয় লাভ করেছে। বিশেষ করে বর্তমান শতাব্দীর প্রাক্কালে ইসলাম ও আলেমসমাজের বিরুদ্ধে যখন ব্যাপক প্রচারণা চলছে, যখন বিভিন্ন জনসভা আর প্রচারমাধ্যমগুলোয় জাতীয়তাবাদের ধুয়া তুলে বাকপটু আর প্রচারকরা অসংখ্য বিভেদমূলক টিট্কারি প্রচারে ততপর, যখন চারদিকে অশ্লীল কবিতা ও সরস রচনার ঢেউ, অসংখ্য এবং বিচিত্র প্রকারের গণিকালয়, জুয়ার আড্ডা, শুঁড়িখানা, অবৈধ ক্লাব ও মাদকদ্রব্যের ছড়াছড়ি- এ সবগুলোই দেশের যুবসমাজ- (যারা) আমাদের দেশের প্রিয় ভবিষ্যত, অগ্রগতির মূল চালিকাশক্তি (তাদেরকে) দুর্নীতি, ধ্বংস, শাহ ও শাহের অসভ্য পিতার বিশ্বাসঘাতকতামূলক কার্যকলাপের অনুকূলে ঠেলে দিচ্ছিল; যখন শক্তিধর বিদেশি দূতাবাসসমূহের পক্ষ থেকে আয়োজিত সভা-মজলিসগুলো জাতির উপর চাপিয়ে দেয়া হচ্ছিল, যখন সর্বাধিক জঘন্য অবস্থায় নিপতিত সকল স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে-যেগুলোর উপর দেশের ভাগ্য নির্ভরশীল-পাশ্চাত্যঘেঁষা বা প্রাচ্যঘেঁষা সম্পূর্ণরূপে ইসলাম ও ইসলামী সংস্কৃতি, এমনকি জাতীয়তাবাদের নামে সঠিক জাতীয়তাবাদবিরোধী শিক্ষক ও অধ্যাপকরা শয়তানি চর্চায় রত ছিল আর যে সমস্ত নিষ্ঠাবান ও দরদি শিক্ষক-অধ্যাপক ইসলামের ন্যায় ও সত্য প্রচারে সচেষ্ট ছিলেন তাঁদেরকে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় আবদ্ধ করে রেখেছিল, ফলে সংখ্যাল্পতার দরুন এই সৎলোকগুলোর পক্ষে কিছুই করা সম্ভব ছিল না। তাছাড়া সে সময় যখন দেশের আলেমসমাজকে শাহের স্বৈরাচারী সরকার কোন জাতীয় বা রাষ্ট্রীয় কাজে অংশগ্রহণ করতে দিত না এবং জোরপূর্বক তাদের অনেকের মতাদর্শকে বিকৃত করার অপপ্রয়াসে লিপ্ত ছিল, এরকম পরিস্থিতিতে ৩৬ মিলিয়ন ইরানী জনতার পক্ষে একই স্লোগান এবং পতাকাতলে সমবেত হয়ে, একই লক্ষ্যের ভিত্তিতে ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি দিয়ে, চোখধাঁধাঁনো এবং মোজেযাপূর্ণ কুরবানির মাধ্যমে ক্ষমতাসীন সরকারকে উৎখাত এবং বিদেশি শক্তিগুলোকে বিতাড়িত করে দেশের ভাগ্যকে নিজেদের হাতে তুলে নেয়া কোনক্রমেই সম্ভব হতো না। সন্দেহ নেই যে, ইরানের ইসলামী বিপ্লব এবং এর সূচনা, প্রকৃতি ও উদ্দেশ্য অন্যান্য বিপ্লব থেকে সম্পূর্ণরূপে আলাদা, একেবারে স্বতন্ত্র। নিঃসন্দেহে এই দেশে এই বিপ্লব মহান আল্লাহ্ তাআলার এক ঐশী উপঢৌকন ও গায়েবি হাদিয়া যা এই লুণ্ঠিত, অত্যাচারিত জাতিকে তিনি দান করেছেন।

২. ইসলাম এবং ইসলামী সরকার হলো খোদায়ী সত্তার প্রকাশ। এদের বাস্তব রূপায়ন তোমাদের সন্তানদের জন্য এই জগতের সমৃদ্ধি ও পরজগতের নাজাতের একমাত্র সর্বোত্তম নিশ্চয়তা। ইসলাম অন্যায়, অত্যাচার, লুণ্ঠন, ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ এবং দুর্নীতিসমূহের মূলোতপাটনে সক্ষম। এটা মানবতার সর্বোচ্চ উদ্দেশ্য হাসিলের সহায়ক। এটা নাস্তিক মতাদর্শসমূহের বিপরীত এমন এক মতাদর্শ যার রয়েছে পথনির্দেশিকাসমূহ, যেগুলোর সাহায্যে ব্যক্তিজীবনের তুচ্ছাতিতুচ্ছ খুঁটিনাটি বিষয়সমূহসহ সঠিক ব্যাপার তথা জনগণের সামাজিক, আধ্যাত্মিক, সাংস্কৃতিক, জাগতিক, রাজনৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক জীবনব্যবস্থার সমস্যাসমূহের সুষ্ঠু সমাধান দেয় এবং পরিচালিত করে। যত সামান্যই হোক না কেন সকল খুঁটিনাটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি দিয়েই এই ইসলামী নির্দেশনাগুলো মানুষের শিক্ষা, সামাজিক, বস্তুগত ও আধ্যাত্মিক প্রগতির আলোকে সমস্যাগুলোর সুষ্ঠু সমাধান উপহার দেয়।

মহান আল্লাহ্‌র ফজলে জাতির দৃঢ়চিত্ত ও নিষ্ঠাবান জনতার সম্মিলিত শক্তির সাহয্যে এখন ‘জমহুরিয়ে ইসলামী’ (ইসলামী প্রজাতন্ত্র) কায়েম হয়েছে। এর একমাত্র লক্ষ্য হলো ইসলাম ও ইসলামের আহকামসমূহের উন্নয়ন। যতটা সম্ভব ইসলামী প্রজাতন্ত্রের খাতিরে ইসলাম এবং এর অনুশাসনমালার শ্রেষ্ঠত্বের কথা মনে করে ইরানী জনগণের অবশ্যই কর্তব্য ইসলামী ব্যবস্থার সকল দিকের পরিপূর্ণতা বিধানের পর এর হেফাজতের জন্য জোর প্রচেষ্টা চালানো। কারণ, ইসলামের হেফাজত অন্য সকল ফরজের চেয়ে অগ্রগণ্য।

হযরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে খাতামুন নাবিয়্যীন রাসূলুল্লাহ্ (সা.) পর্যন্ত সকল নবী-রাসূল এই ইসলামের হেফাজতের জন্যই কোন বাধাবিপত্তিকে প্রশ্রয় না দিয়ে অবিচল নিষ্ঠা ও সংগ্রামের মাধ্যমে নিজেদের জান কুরবান করেছিলেন, আর কোন বাধাবিপত্তিই তাঁদেরকে এই সুমহান ফারিযা (ফরয কাজ) থেকে পিছু হটাতে পারেনি এবং তাদের এই সংগ্রামের দায়িত্ব পরবর্তীকালে নিজেদের কাঁধে তুলে নেন তাঁদের সুযোগ্য সাহাবা ও অনুসারীবৃন্দ এবং পবিত্র ইমাম (আ.) গণ যাঁরা এর হেফাজত ও উন্নয়নের জন্য সাধ্যাতীত চেষ্টা করেছিলেন, এমনকি নিজেদের রক্ত দান করতেও কুণ্ঠাবোধ করেননি।

আজ ইরানে সরকারিভাবে ঘোষিত এই খোদায়ী পবিত্র আমানত- যার বিচ্ছুরণে অতি স্বল্প সময়ে বিরাট সাফল্য অর্জিত হয়েছে, সেই ‘ইসলামী রাষ্ট্রের’ যথাসাধ্য নিরাপত্তা বিধান করা দুনিয়ার সকল মুসলিম, বিশেষ করে ইরানী জাতির একান্ত দায়িত্ব এবং কর্তব্য (ফরয)। আরো কর্তব্য এমন সব দরকারি পদক্ষেপ গ্রহণ করা যাতে প্রজাতন্ত্রের সাফল্যের পথে যাবতীয় বাধাবিপত্তি পরিষ্কার হয়ে এর স্থায়িত্ব বিধান সুসম্পন্ন হয়। এর ফলে আশা করা যায় যে, এর নূরানি আলোকে হয়তো সকল মুসলিম দেশ আলোকিত হবে; সরকার এবং জনতার মাঝে এই অত্যাবশ্যকীয় বিষয়টি সম্পর্কে সমঝোতার সৃষ্টি হবে এবং যা দুনিয়ার নির্যাতিত ও অবহেলিত (মুস্তাযআফিন) জনগোষ্ঠীর উপর থেকে বিশ্বগ্রাসী পরাশক্তিগুলো ও ইতিহাসের দুষ্কৃতকারীদের ঘৃণ্য প্রভাবের শৃঙ্খল চিরতরে ছিন্ন করতে সাহায্য করবে।

আমি যে এখন জীবনের শেষ মুহূর্তগুলো অতিক্রম করছি, বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের প্রতি আমার ইতিকর্তব্য স্মরণ করে এই মর্মে কিছু মৌলিক বিষয় যা এই পবিত্র বেহেশতি হাদিয়ার প্রতিরক্ষা এবং স্থায়িত্বে সহায়ক হাতিয়ার হিসেবে গণ্য হবে। আর এমন কিছু বাধাবিপত্তি ও অসুবিধার উল্লেখ করব যা এই স্বর্গীয় উপহারের প্রতি হুমকিস্বরূপ। সকলের সাফল্য ও সমৃদ্ধি হোক এটাই সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছে আমার একান্ত মোনাজাত।

ক. তর্কাতীতভাবে এটা সত্য যে, ইরানে ইসলামী বিপ্লবের টিকে থাকার রহস্য আর এর বিজয়ের রহস্য একই। আর ইরানী জাতি ইসলামী বিপ্লবের বিজয়ের রহস্য সম্পর্কে পরিপূর্ণ ওয়াকেবহাল। ভবিষ্যত প্রজন্মের বংশধরেরা তাদের ইতিহাস গ্রন্থসমূহে পড়বে যে, এই মহান বিপ্লবের দু’টি প্রধান অংশের একটি ছিল ঐশী চেতনা ও ইসলামী হুকুমাতের সুমহান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং অপরটি ছিল এই একই চেতনা ও উদ্দেশ্যে অনুপ্রাণিত মতাদর্শগত ঐক্যের ভিত্তিতে সারা দেশের জনগণের সংহতি।

বর্তমান এবং ভবিষ্যতের সকল প্রজন্মের বংশধরদের প্রতি আমার অসিয়ত, যদি আপনারা আল্লাহর হুকুমাত প্রতিষ্ঠিত দেখতে চান, যদি আপনাদের দেশ থেকে দেশি ও বিদেশি শোষক ও উপনিবেশবাদীদের প্রভাব-প্রতিপত্তির বিলোপ সাধন স্বচক্ষে অবলোকন করতে চান তাহলে এই খোদায়ী চেতনাকে কোনক্রমেই হাতছাড়া হতে দিবেন না- যার উপর পাক কোরআনে আল্লাহ্ তাআলা সবিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন। এই খোদায়ী চেতনা- যা ইসলামী বিপ্লবের বিজয় ও স্থায়িত্বেরই রহস্য আর লক্ষ্য বিস্মৃতি, বিভেদ-বিসংবাদ হলো এই চেতনার ঠিক পরিপন্থী; এটা অযথাই নয় যে, আমাদের দুশমন এবং তাদের স্থানীয় দোসরদের মুখপাত্র সুনিপুণ আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যমগুলো তাদের অসৎ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য কোটি কোটি ডলার অপচয় করে সাধ্যমত চারদিকে ছড়িয়ে দিচ্ছে বিভেদমূলক মিথ্যাগুজব, আর বানোয়াট প্রচারণা। ঠিক একইভাবে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানবিরোধীদের এতদঅঞ্চলে অনবরত সফর কোন উদ্দেশ্যবিহীন ঘটনা নয়। দুর্ভাগ্যবশত এদের মঝে কিছু মুসলিম দেশের হর্তাকর্তাদেরকেও দেখতে পাওয়া যায়, যারা শুধু নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির চিন্তাতেই মশগুল এবং অন্ধভাবে যুক্তরাষ্ট্রের নিকট আত্মসমর্পণ করেছে। আরও কিছু ভণ্ড আলেমও এদের সাথে যোগ দিয়েছে। এই বিভেদকারী ও ধ্বংসাত্মক প্রচারণাকে নির্মূল করার চিন্তাই আজ এবং আগামীকালের ইরানী জাতি এবং বিশ্বমুসলিমের অতীব গুরুত্বপূর্ণ চিন্তার বিষয় হওয়া বাঞ্ছনীয়। মুসলমানদের বিশেষভাবে বর্তমানকালের ইরানীদের প্রতি আমার পরামর্শ তারা যেন এই সকল বৈরী প্রচারণামূলক ষড়যন্ত্রসমূহের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় আর যে কোন উপায়ে যেন তাদের নিজেদের ঐক্য ও অবস্থান সুদৃঢ় থেকে সুদৃঢ়তর করে এবং ইসলাম ও ইসলামী বিপ্লবের দুশমন কাফের ও মুনাফেক বকধার্মিকদের দলকে যেন নিদারুন হতাশায় নিমজ্জিত রাখে।

খ. বর্তমান শতাব্দীতে, বিশেষ করে গত কয়েক দশকে, বিশষভাবে ইসলামী বিপ্লবের বিজয়ের পর থেকে যে উল্লেখযোগ্য ষড়যন্ত্রগুলো প্রকাশ্যভাবে আমাদের চোখে ধরা পড়ে তাদের অন্যতম হলো বিশ্বব্যাপী তাদের সুদূরপ্রসারী প্রচারণার মাধ্যমে জাতিসমূহেকে আতঙ্কিত করে তোলা। বিশেষ করে আত্মোতসর্গী ইরানী জনগণের ইসলামের প্রতি আস্থাকে দুর্বল করে দেয়া। কোন কোন সময় ওরা সরাসরি একেবারে নগ্নভাবে ঘৃণ্য ততপরতায় লিপ্ত হয়। যুক্তি দেখায় যে, চৌদ্দশ’ বছরের পুরোনো ইসলামী অনুশাসনগুলো বর্তমান শতাব্দীর দেশগুলোর প্রশাসন পরিচালনায় অপারগ। কেননা, ইসলাম আধুনিক সভ্যতার প্রতিটি উদ্ভাবন ও প্রগতিবিরোধী পশ্চাদপদ ধর্ম। তাছাড়া বর্তমান যুগের দেশগুলো দুনিয়ার আধুনিক সভ্যতা এবং আত্মপ্রকাশকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারে না। আর একই রকম মূর্খতাপূর্ণ এবং অনেক সময় অসৎ ও বিদ্বেষপূর্ণ শয়তানি প্রচারণাকে অত্যন্ত চমতকারভাবে ইসলামী কথাবার্তার মোড়কে সাজিয়ে ইসলামপন্থী প্রচারণারূপে উপস্থাপন করে এরূপ ধারণাকে সমর্থনের ছুতা তোলা হয় যে, ইসলাম এবং অন্যান্য ঐশী ধর্ম আসলে আধ্যাত্মিক ব্যাপার সম্পর্কিত, মানবজাতির নৈতিক পরিশুদ্ধির সাথে সম্পর্কিত- (এগুলো) পার্থিব কোন কার্যক্রমের সাথে সম্পর্কিত নয়, বরং দুনিয়াকে ত্যাগ করতে আহ্বান জানায়। এসব ধর্ম মানুষকে বস্তুজগতের বন্ধন থেকে সরিয়ে ইবাদত-বন্দেগি, যিকির-আযকার ও দোয়া-প্রার্থনা প্রভৃতির দিকে নিমগ্ন রাখে, যার ফলে (ওদের যু্ক্তিতে) বস্তুজগতের বিষয়াবলি থেকে দূরে সরিয়ে মানুষকে খোদার নৈকট্যে নিয়ে যায়। তাই পার্থিব সরকারের প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ সেই আধ্যাত্মিক লক্ষ্যসমূহের পরিপন্থী এবং এই কর্মকাণ্ডগুলো কেবল দুনিয়াবি ব্যাপার এবং নবী-রাসূলদের শিক্ষার বিপরীত এবং এটা দুর্ভাগ্যের বিষয় যে, ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞ কতিপয় মুসলিম মৌলভী-মাওলানার দল এই মারাত্মক ধারণায় প্রভাবিত এবং তাদের মনে এ সম্পর্কে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে যে, রাজনীতি এবং সরকারের কর্মকাণ্ডে নাক গলানো অমার্জনীয় অপরাধ এবং ফাসেকি কাজ। এটাই ইসলামের উপর আপতিত এক মহাদুর্যোগ।

প্রথম ধরনের মতামতের প্রবক্তারা হয় সরকার, আইন ও রাজনীতি সম্পর্কে একবারেই অজ্ঞ নতুবা নিজেদের ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য হাসিলের জন্যই এরূপ ভান করে থাকে। কারণ, সততা, সাম্য ও নায়বিচারের ভিত্তিতে আইন প্রণয়ন, স্বৈরাচারী শাসন ও শাসকের বিরোধিতা করা, ব্যক্তি ও সমাজের জন্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা, বিভিন্ন প্রকার দুর্নীতি, পতিতাবৃত্তি প্রভৃতিকে বাধা দান করা এবং একই সাথে স্বাধীনতা ও স্বনির্ভরতা অর্জনের জন্য উপনিবেশবাদ, শোষণ, বাঞ্চনা, দাসত্ব ও গোলামিকে উৎখাত করার লক্ষ্যে ন্যায়বিচার ও যুক্তির ভিত্তিতে নাগরিক স্বাধীনতার সমর্থন দান করা, ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে শারীরিক শাস্তির বিধান প্রচলন করা ও সমাজের দুর্নীতি ও অবনতি দমন করা এবং একইভাবে যুক্তি, ন্যায়বিচার, সাম্য ও অন্য গুণাবলির ভিত্তিতে রাজনীতি ও সমাজের প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত থাকা প্রভৃতি কালের প্রবাহে এবং মানুষের সামাজিক জীবনের জন্য কোন প্রাচীনপন্থী সেকেলে বিষয় নয়। এদের দাবির অর্থ কেবল এই ধারণায় পর্যবসিত যে, বর্তমান শতাব্দীতে সাধারণ জ্ঞানের নিয়মসমূহ গণিতের নিয়মসমূহের মতোই নতুন নিয়মনীতি দ্বারা সম্প্রসারিত হওয়া উচিত। তাহলে ধরে নিতে হবে, যদিও মানবজাতির সৃষ্টির শুরু থেকেই সর্বশক্তিমান আল্লাহ্ তাআলার আদেশ রয়েছে যে, সামাজিক সাম্য চালু করতে হবে, স্বৈরাচার, লুটতরাজ ও নরহত্যা বন্ধ করতে হবে তথাপি বর্তমান এই আণবিক যুগে (বিরুদ্ধবাদীদের মতে) ওইসব খোদায়ী আইন সেকেলে এবং অচল।

নির্জলা মিথ্যা একটা দাবি যে, ইসলাম নব নব কারিগরি উদ্ভাবনের বিরোধী। এরূপ একটি সুপরিকল্পিত ধারণা ছিল ক্ষমতাচ্যুত মুহাম্মাদ রেযা শাহ পাহলভীর যে, ইসলামী বিপ্লবের সমর্থক ও আলেম সম্প্রদায় আধুনিক যুগেও চতুস্পদ জন্তুতে করে সফরের ওকালতি করে। এটা একটা নেহায়েতই আহাম্মকি অভিযোগ ছাড়া আর কিছুই নয়। কারণ, তারা যদি সভ্যতার নিদর্শন ও নতুন কিছুর উদ্ভাবনকে এবং মানুষ ও তার সভ্যতার অগ্রগতিতে অবদান রাখতে সক্ষম কোন আবিষ্কার, নতুন দ্রব্যসামগ্রী ও উন্নতমানের প্রকৌশলীকেই বুঝায়, তাহলে তাদের এই ধারণাকে কখনো ইসলাম বা অন্য কোন তাওহীদী ধর্ম বিরোধিতা করেনি এবং ভবিষ্যতেও করবে না। উপরন্তু ইসলাম এবং পাক কিতাব কোরআনুল হাকিম বিজ্ঞানশিক্ষা এবং প্রকৌশল শিল্পের উপর সবিশেষ গুরুত্বারোপ  করেছে। কিন্তু যদি ‘সভ্যতা এবং আধুনিকতা’কে কিছু পেশাদার বুদ্ধিজীবীর ধারণামতে ব্যাখ্যা করা হয যেসব বুদ্ধিজীবী সভ্যতা এবং আধুনিকতা বলতে বদমায়েশি এবং সমকামিতাসহ সকল প্রকার ধর্মনিষিদ্ধ দুষ্কর্ম সক্রিয়ভাবে পালন করাকে ‘স্বাধীনতা’ বলে আখ্যায়িত করে তাহলে আমি শুধু এর জবাবে এটাই বলতে চাই যে, সকল ঐশী ধর্ম, বিবেকবান ও জ্ঞানী ব্যক্তিগণ নির্বিবাদে এই কুধারণার বিরোধী। যতই অপ্রাচ্য ও পাশ্চাত্যঘেষাঁ লোকেরা তদীয় প্রভুদের অন্ধ অনুকরণে এর প্রচার ও প্রসারে ততপর হোক না কেন।

ইসলামবিরোধী দ্বিতীয় শ্রেণি- যারা রাজনীতি ও সরকার থেকে ইসলামকে আলাদা করে রাখতে চায় এবং যাদের ভূমিকা অত্যন্ত বেদনাদায়ক। এই অজ্ঞদের আবশ্যিকভাবে বলা উচিত যে, পাক কোরআন ও রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর সুন্নাহয় অন্যান্য ক্ষেত্রের চেয়ে সরকার এবং রাষ্ট্রযন্ত্র সম্পর্কীয় অনুশাসনমালা এতই বেশি রয়েছে যে, অন্য কোন বিষয়ে ততটা নেই। এমনকি বাহ্যত ইসলামের যেসব ইবাদতের বিধিমালা রয়েছে তার অনেকগুলোই রাজনৈতিক ইবাদত সংক্রান্ত বিধিমালা। যার অবহেলার কারণে বর্তমান মুসলিম দুনিয়ার এই দুর্দশা।

ইসলামের মহান নবী (সা.) পৃথিবীর অন্য সরকারগুলোর মতোই একটা সরকার গঠন করেছিলেন, কিন্তু তফাতটা ছিল এই যে, নবী করিম (সা.)-এর সরকার গঠনের উদ্দেশ্য ছিল সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রসার ঘটানো। ঠিক তদ্রূপ প্রাথমিক মুসলিম খলিফাদেরও ছিল ব্যাপকভিত্তিক সরকার এবং তেমনি ছিল হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর সরকার। যা ছিল সঠিক নবুওয়াতী চেতনায় উদ্বুদ্ধ, অধিকতর ব্যাপক, বিস্তৃত এবং যে সরকার ইতিহাসের এক অনন্য নিদর্শন ও আদর্শ। এর পরবর্তীকালীন সরকারগুলো ইসলামের নামেই স্থাপিত হয়োছল। এমনকি বর্তমানেও বিভিন্ন ধরনের বহু সরকার ইসলাম এবং নবী মুহাম্মাদ (সা.)-এর অনুশাসনের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত বলে দাবি করে থাকে।

আমার এ অসিয়তনামায় এ প্রসঙ্গে শুধু আভাস দিয়ে গেলাম, তবে আশা করি লেখক, সমাজতত্ত্ববিদ ও ঐতিহাসিকগণ মুসলিম জাতির মোহমুক্তি ঘটাবেন। যেন ওরা বুঝতে পারে যে, নবী (সা.) শুধু আধ্যাত্মিকতা নিয়েই বিভোর ছিলেন না, বরং এসব রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে নবী এবং তাঁর অনুসারীরাও অশংগ্রহণ করতে কোনরূপ দ্বিধাবোধ করতেন না এবং ঠিক একই কারণে এই সব কর্মকাণ্ডে আমাদেরও নির্দ্বিধায় জড়িয়ে পড়া উচিত। কেননা, এতদিন এসব থেকে দূরে থেকে আমরা ভুল করেছি এবং এই দুঃখজনক ভুলের কারণে মুসলিম দেশগুলো ধ্বংসের দিকে ঢলে পড়ে এবং রক্তপিপাসু উপনিবেশবাদীদের জন্য দরজা উন্মুক্ত হয়ে পড়ে। অপরপক্ষে, হতাশাব্যঞ্জক একটা ব্যাপার হলো স্বৈরাচারী, একনায়কতান্ত্রিক ইবলীসী সরকারগুলোর অস্তিত্ব। যেগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়েছে জনগণের উপর প্রভাব বিস্তার করার জন্য আর যারা পার্থিব দুষ্কৃতি সম্পাদনে ততপর- যেগুলোর অন্তর্ভুক্ত রয়েছে সম্পদ কুক্ষিগত করা, ক্ষমতা হস্তগত করা এবং দুনিয়াতে খোদাবিমুখ রাখার মতো মারাত্মক অপরাধ করা। যেসবের ফলশ্রুতিতে মানুষ প্রকৃত এবং সর্বশ্রেষ্ঠ খোদাকে এড়িয়ে যাওয়ার পথে পা বাড়ায়- এটাকে ইসলাম নিষেধ করেছে। নির্যাতিত এবং অহেলিত জনগণের স্বার্থে স্বৈরাচার ও অত্যাচার দমনের নিমিত্তে সামাজিক সাম্য ও ন্যায়বিচারের শাসন কায়েমের জন্য সরকার গঠন এক মহান দায়িত্ব। যে রকম একটা দায়িত্ব সম্পাদনের জন্য সংগ্রাম করে গেছেন নবী সোলায়মান ইবনে দাউদ (আ.) এবং ইসলামের মহান নবী (সা.) এবং তাঁর মহান অসিয়তপ্রাপ্ত ইমামগণ। এ ধরনের সরকারসংশ্লিষ্ট সুষ্ঠু রাজনীতি অন্যন্ত জরুরি বিষয়।

সদাজাগ্রত এবং সতর্ক ইরানী জনগণের প্রতি অনুরোধ, ইসলামী জোশে বলীয়ান হয়ে তাঁরা যেন এই ধরনের ঘৃণ্য ততপরতাকে নস্যাত করে দেন এবং আমি আরো অনুরোধ জানাই নিবেদিতপ্রাণ লেখক ও বক্তাদের, তাঁরা যেন আমাদের কালের ষড়যন্ত্রকারী বিশ্ব শয়তানদের বিনাশ সাধনে জাতির প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন।

গ. একই শ্রেণির আর একটা ষড়যন্ত্র সম্ভবত অন্য সবগুলোর চেয়ে অধিক বিদ্বেষপ্রসূত, তা হলো গুজব সৃষ্টির মাধ্যমে বৈরী প্রচারণা। এই ধরনের ছড়ানো গুজব নিয়মিত আমাদের দেশের বাতাসকে দূষিত করে তোলে। এর ফলে এই ধরনের কটাক্ষের জন্ম হয় যে, পূর্বসূরির মতোই বর্তমানের ইসলামী প্রজাতন্ত্র জনগণের জন্য কিছুই করেনি। হতভাগা জনগণ উতসাহ ও উদ্যম সহকারে আত্মোতসর্গী সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিল নিজেদেরকে স্বৈরাচারী শাসন ও যালিমদের হাত থেকে বাঁচাতে, কিন্তু বিজয়লাভ করেও তারা দেখলো এক মারাত্মক প্রশাসনের নিগড়ে তারা বন্দি, উদ্ধত ধনীরা আরও উদ্ধত হয়ে উঠেছে, নির্যাতিত জনগণ আরো বেশি নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, জেলখানাগুলো যুবা-বয়সী জনসাধারণে ভরে উঠেছে- যে যুবাশ্রেণি দেশের ভবিষ্যতের আশা-ভরসা। নির্যাতনের পরিমাণ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং আগের চেয়ে অধিকতর পাশবিক রূপে সংঘটিত হচ্ছে। প্রতিদিন ইসলামের নামে অনেক মানুষ বলি হচ্ছে। এই প্রশাসন ‘ইসলামী’ নাম ধারণ না করলে সুবুদ্ধিরই পরিচয় দিতো। এখনকার সময় রেযা খান, এমনকি তার ছেলের আমলের চেয়েও অনেক বেশি ভয়াবহ। লোকজন এখন নিদারুণ যন্ত্রণা, কঠোরতা ও জীবনযাপনের উচ্চমূল্যের অথৈ পাথারে হাবুডুবু খাচ্ছে। রাষ্ট্রের কর্ণধার ব্যক্তিরা এ সরকারকে এক কম্যুনিস্ট সরকারে পরিণত করছে। জনগণের ব্যক্তিগত সম্পত্তির মালিকানা হরণ করা হচ্ছে। প্রতিটি পদক্ষেপে তাদের নাগরিক স্বাধীনতাকে অস্বীকার করা হচ্ছে। ইত্যাদি ইত্যাদি আরো হরেক রকমের গুজব, যা শয়তানদের উদ্দেশ্য হাসিলের  হাতিয়ার হিসেবে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে চারদিকে। একটা ষড়যন্ত্রকে খাড়া করতে এগুলো যে কার্যকরী হাতিয়ার স্পষ্টতঃই প্রতীয়মান হয়। প্রত্যেকটা গুজবই আর একটা গুজব সৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত রাষ্ট্রের আনাচে-কানাচে শহরের অলিগলিতে সকলের মুখে মুখে কয়েকদিন ধরে প্রচার করা হয়। সাধারণত এসব ছড়ানোর প্লাটফরমগুলো হলো আমাদের ট্যাক্সি, বাস এবং ছোটখাট লোক সমাগমের যে কোন জায়গা এবং একবার যদি কোন গুজব পুরোনো হয়ে যায়, সাথে সাথে অন্য আর একটা নতুন গুজব বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। এটা একটা দঃখজনক ব্যাপার যে, আমাদের কতিপয় আলেম যারা শয়তানি ফিকির সম্পর্কে একেবারে আনকোরা, সহজেই গুজব প্রচারকারীদের ফাঁদে পড়েন এবং নিজেরা দুই একজন ষড়যন্ত্রকারীর সংস্পর্শে এসেই স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, তাঁরা যেটাই গুজব আকারে শুনেছেন সেটাই সত্য। এর একমাত্র কারণ হলো এসব আলেম চলতি দুনিয়ার ঘটনাবলি সম্পর্কে ওয়াকেবহাল নন, দুনিয়ার বিপ্লবগুলোর কোন খবরই তাঁরা রাখেন না। বিপ্লবগুলোর পরবর্তী ঘটনাক্রমের অপরিহার্য কঠিন মুছিবত সম্পর্কেও তেমন জ্ঞান রাখেন না।  ইসলামের খাতিরেই যেসব (সামাজিক) পরিবর্তন হচ্ছে সে সম্পর্কেও তাঁদের সঠিক ধারণা নেই। তাঁরা এসব গুজব অন্ধভাবে শোনেন এবং এভাবে তাঁরা ইচ্ছায় হোক, অনিচ্ছায় হোক একই ধরনের ব্যাঙ্গাত্মক ধারণার শ্রীবৃদ্ধি করেন।

তোমাদের সকলের প্রতি আমার অনুরোধ, ইসলামী সরকারের দোষ খুঁজতে চেষ্টা করো না, একে হেয় প্রতিপন্ন করতে চেষ্টা করো না, কিংবা এই ইসলামী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ভাঁড়ামোপূর্ণ অবমাননা করো না; তার পূর্বে চলতি দুনিয়ার পরিস্থিতি সম্বন্ধে তোমাদের সম্যক অধ্যয়ন করা উচিত। ইরানী বিপ্লবের সাথে পৃথিবীর অন্যান্য বিপ্লবের তুলনা করে ওসব বিপ্লবের সময় এবং বিপ্লবের পরে দেশ ও জাতির অবস্থা কী দাঁড়িয়েছে তাও জানা উচিত। আরো জানা উচিত ইরানী জাতির সম্পদ কুক্ষিগত করার জন্য রেযা খান এবং তার চেয়েও বদ্ মুহাম্মাদ রেযার (রেযা খানের পুত্র) লুট-পাটের শাসনামলে ইরানে কী ধরনের মুছিবত চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল আর সেই বদশাসনের জের এই সরকারের উপর বর্তেছে। বিপ্লবপূর্ব সময়ে বিদেশি শক্তিগুলোর উপর ধ্বংসাত্মক নির্ভরতা সে সময়ের সরকারের মন্ত্রণালয় ও অফিস আদালতগুলো পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। আরো জানা উচিত বিপ্লবপূর্বে এই জাতির অর্থনীতি এবং সশস্ত্র বাহিনীর অবস্থা কী রকম ছিল। ফূর্তি ও মজা করার জন্য বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতির আড্ডাখানা নির্মাণ করে এবং নেশাকারক অলস সংস্কৃতি ছড়িয়ে দিয়ে কিভাবে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রকে বিষিয়ে তুলেছিল! বিপ্লবপূর্ব আমলে শিক্ষার মান এবং স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থাই বা কেমন ছিল! আরো স্মরণ করা উচিত চলচ্চিত্রগুলোর অবস্থার কথা! যুবসমাজ, নারীসমাজ ও আলেমসমাজের অবস্থার কথা! আত্মবিশ্বাসী মুক্তিকামী জনতার এবং শাহ আমলের মযলুম অথচ পবিত্র সেই নারীদের অবস্থা আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে। তাগুতী আমলে মসজিদগুলোর অবস্থা পর্যালোচনা করতে হবে। তাদের ব্যাপারগুলো, যাদের ইসলামী বিপ্লবের পর ফাঁসি দেয়া হয়েছে কিংবা যারা দোষী সাব্যস্ত হয়ে জেলে গেছে, খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে। আরো দেখতে হবে গণকর্মচারীরা কী করেছে! বড় বড় ধনী ও জমিদার শ্রেণির সম্পদের হিসাব নিতে হবে এবং মজুতদার ও মুনাফাখোরদের অবস্থা জানতে হবে। জানতে হবে বিপ্লবপরবর্তী আদালত ও বিপ্লবী ট্রাইবুনালসমূহ এবং বিপ্লবপূর্বের বিচার ব্যবস্থার তুলনামূলক অবস্থা। এই তুলনামূলক বিচারের মাধ্যমে দেখতে হবে মজলিস-ই শুরা-ই ইসলামী প্রতিনিধিবৃন্দের মর্যাদা এবং মন্ত্রীসভার সদস্যবৃন্দ ও অন্যান্য গভর্নর ও বিপ্লবোত্তর কর্মচারীর মর্যাদা তাঁদের পূর্ববর্তীদের তুলনায় কেমন ছিল! অনুসন্ধান করে দেখতে হবে বর্তমান সরকারের ততপরতা এবং বঞ্চিত গ্রামগুলোর পুনর্গঠন জিহাদ-এর কার্যক্রম, যেসব গ্রামে আগে, এমনকি পানি সরবরাহ ব্যবস্থা, মৌলিক চিকিতসা সুবিধারও কোন বন্দোবস্ত ছিল না। পূর্বের অবস্থার সাথে এগুলোর তুলনা করে দেখা উচিত। চাপিয়ে দেয়া এতবড় যুদ্ধের বোঝা মাথায় নিয়ে লক্ষ লক্ষ যুদ্ধবন্দি শরণার্থী এবং অসহায় যুদ্ধাহত জনগণ ও তাদের শহীদ পরিবার এবং আফগানিস্তান ও ইরাক থেকে আসা লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর ভারে জর্জরিত ইরান কিভাবে এই উন্নয়ন ততপরতায় লিপ্ত! চিন্তা করে দেখা উচিত অর্থনৈতিক অবরোধ সৃষ্টির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ও তার দেশি-বিদেশি দোসররা ইরানের বিরুদ্ধে কত রকম ষড়যন্ত্র পাকিয়ে চলছে! ইসলামী বিপ্লব পূর্ণাঙ্গ রূপ নেয়ার পর থেকে ইসলামী বিপ্লবের নাদান বন্ধুগণ কর্তৃক যেসব বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়েছে (ইসলামী বিপ্লব সম্পর্কে) তা অবশ্যই প্রণিধানযোগ্য, আর সে সময় পর্যাপ্ত মোবাল্লেগ ও ইসলামী বিচারকের অভাব ছিল । আমি আপনাদের অনুরোধ জানাই এই অসহায় ইসলামের প্রতি রহম করতে, যে ইসলাম শত শত বছরের শক্তি মদমত্ত স্বৈরশাসনের দাপটে জর্জরিত এবং জনসাধারণের অজ্ঞতার ফলশ্রুতি হিসেবে তা এখন কম্পিতপদ শিশুর মতো দেশের ভেতরে-বাইরে শত্রু পরিবেষ্টিত হয়ে টলমল পায়ে  উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করছে শুধু। আপনারা, সমালোচকগণ, একটু চিন্তা করে দেখুন যে, এই বিপ্লবকে ধ্বংস করার পরিবর্তে এর সংশোধন ও সাহায্যে এগিয়ে আসা কি উত্তম হবে না? যালেম, মুনাফেক, বেইনসাফী, খোদাবিমুখ মজুতদার ও পুঁজিপতিদের বদলে মযলুম ও বঞ্চিত জনতার সমর্থন করুন।

বিভিন্ন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী, সন্ত্রাসী ও ফ্যাসাদ সৃষ্টিকারীদের প্রতি আপনাদের পরোক্ষ সমর্থনের পরিবর্তে এদের হাতে শাহাদাতপ্রাপ্ত মযলুম নিষ্ঠাবান ইসলামের খাদেম আলেমগণের প্রতি একটু নজর দিন।

আমি পূর্বে কখনো বলি নি কিংবা কখনো এমন কোন দাবি উত্থাপন করছি না যে, আমাদের প্রজাতন্ত্রে মহান ইসলামকে পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। কিংবা এ-ও বলছি না যে, অজ্ঞতাবশতই হোক, ব্যক্তিগত ঘৃণাবশত হোক, কিংবা আত্মশৃঙ্খলার অভাবের কারণেই হোক, ইসলামী বিধিনিষেধের বিরুদ্ধে কেউ কিছু করেনি। তবে আমি বলতে চাই, এই সরকারের মতো বিচার বিভাগ ও শাসন বিভাগ এই দেশকে ইসলামীকরণের কাজে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। লক্ষ-কোটি জনতার এই জাতিও এই সরকারকে সমর্থন করে। যদি সংখ্যালঘিষ্ঠ মুষ্টিমেয় এই সমালোচক ও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী দল সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়, তাহলে বিপ্লবের এই লক্ষসমূহ আরো সহজ ও দ্রুতগতিতে অর্জিত হবে। এবং আল্লাহ না করুন যদি এই সমালোচক ও বিপথগামীদের বোধোদয় না হয় তাহলে কখনো জনগণের প্রবল প্রমত্ততার মুখে তারা টিকে থাকতে পারবে না।

যেহেতু এই সচেতন বিশাল জনগণ প্রকৃত পরিস্থিতি ওয়াকেবহাল এবং তারা ময়দানে সদা উপস্থিত তাই আল্লাহপাকের অপার ইচ্ছায় বিপ্লবের মানবতাবাদী ও ইসলামী দিকগুলো অচিরেই বাস্তব রূপ লাভ করবে। দৃঢ় আত্মবিশ্বাসের সাথে আমি দাবি করছি যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর যামানার হিজাজের জনগণের চেয়ে এবং ইমাম আলী (আ.) ও ইমাম হোসাইন (আ.)-এর যামানার কুফা ও ইরাকের জনগণের চেয়ে আজকের ইরানী জাতি এবং ইরানের লক্ষ-কোটি জনগণ অধিকতর উত্তম।

আমাদের নবী (সা.)-এর যামানায় হিজাজের জনগণ জিহাদে যাবার জন্য নবী (সা.)-এর আদেশ লঙ্ঘন করত এবং এ জন্য বিভিন্ন প্রকার ওজর আপত্তি উত্থাপন করে এরা যুদ্ধের ময়দান থেকে নিজেদের মুখ ফিরিয়ে রাখত। তাদের ওই  ধরনের মুনাফেকী আচরণের জন্য স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কোরআন পাকের সূরা তাওবায় বিভিন্ন আয়াতে তাদেরকে তিরষ্কার করেছেন এবং তাদেরকে চরম শাস্তিদানের কথাও ঘোষণা করেছেন। এই মুনাফেকরা নবী করিম (সা.)-এর প্রতি এত বেশি মিথ্যা অপবাদ উত্থাপন করেছিল যে, বর্ণনানুসারে নবীজী বিরক্ত হয়ে নিজে মিম্বরের উপর দাঁড়িয়ে তাদেরকে বদদোয়া দিয়েছিলেন। অপরদিকে ইরাক ও কুফার জনগণও আমীরুল মুমিনীন ইমাম আলী (আ.)-এর সাথে অসদাচরণ করেছে। যথাসম্ভব তারা তাঁকে অপদস্থ ও অমান্য করতে দ্বিধাবোধ করেনি। তাঁর যামানার এই ঘটনা, মুনাফেকদের সম্পর্কে পবিত্র ইমামের অভিযোগসমূহ ধর্মীয় এবং ইতিহাসের কিতাবসমূহে লিপিবদ্ধ রয়েছে। ঠিক তেমনি ইরাক ও কুফার এই মুসলমানদের আমলেই সর্বকালের বৃহত্তম অবিচার সংঘটিত হয়েছিল সাইয়্যেদুশ শুহাদা-শহীদকুল শিরোমণি হযরত ইমাম হোসাইন (আ.)-এর উপর । এমনকি এই কুফার যারা তলোয়ার হাতে সরাসরি ইমামের বিরুদ্ধে যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়নি তারা হয় এই যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে গেছে, নয়তো যুদ্ধক্ষেত্রের পিছনে থেকে কী ঘটে তা দেখার জন্য দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে। অপরদিকে আমরা আজ দেখতে পাই, গোটা ইরানী জাতি তথা জাতির সশস্ত্র বাহিনী, সেপাহ্ (ইসলামী বিপ্লবী রক্ষী বাহিনী IRGC), বাসিজ (গণবাহিনী), বিভিন্ন উপজাতীয় বাহিনী এবং অন্যান্য সকল স্বেচ্ছাসেবী দল জেহাদের ময়দানে নিজেদের জান কুরবান করতেও পিছপা হয়নি। যুদ্ধক্ষেত্রের বাইরে যাঁরা রয়েছেন তাঁরাও সমান আত্মত্যাগী মনোভাব নিয়ে অপরিসীম উদ্যম সহকারে ইসলামী হুকুমতের খেদমতে যুগান্তকারী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। আমরা দেখতে পাচ্ছি, সারা দেশব্যাপী আমাদের সম্মানিত জনগণ জাতীয় প্রচেষ্টার প্রতি কীরকম প্রশংসনীয় সহযোগিতা করেছেন! আমরা আরো দেখতে পাই, শহীদ পরিবার এবং যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত জনগণ যাঁরা যুদ্ধে নিজেদের আত্মীয়স্বজন হারিয়েছেন এবং আহত যোদ্ধদের আত্মীয়স্বজনরা ঈমানী তেজ ও আত্মবিশ্বাস সহকারে আমাদের শুধু কথা ও কাজের মাধ্যমে উৎসাহই যোগাচ্ছেন। এগুলোর সবটাই তাঁদের মহান প্রভু, ইসলাম ও অমর জীবনের প্রতি ঈমান ও ভালোবাসার প্রমাণ। যদিও বাস্তবতা এই যে, তাঁরা নবী করিম (সা.)-এর যামানার লোকও নন আবার নিষ্পাপ ইমামদের (আ.) যামানার বাসিন্দাও নন। এভাবে তাঁরা গায়েবি খোদার উপর ঈমানের বলে বলিয়ান- যা কোন ক্ষেত্রে বিজয় লাভের মূল রহস্য। এই ধরনের সন্তানদের লালন করে ইসলাম গৌরবান্বিত এবং এই যুগে বাস করা, বিশেষ করে এই ধরনের জাতির অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য সত্যিকার অর্থে আমরা সবাই গর্বিত।

আজকের এই মুহূর্তে আমার অসিয়ত কিছু ব্যক্তির প্রতি যারা বিভিন্ন উদ্দেশ্যে ইসলামী বিপ্লবের বিরোধিতা করে এবং ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে সকল যুবাশ্রেণির প্রতি- যারা মুনাফেকদের দ্বারা বিভ্রান্ত এবং সুযোগসন্ধানী কতিপয় পথভ্রষ্টের প্রতি যারা অপরের স্বার্থহানি করে নিজেরা লাভবান হতে চায়। সকলের প্রতি আমার আহ্বান তারা যেন নিরপেক্ষ ও মুক্ত মন নিয়ে নিজেরাই নিজেদের বিচার করে দেখে এবং ইসলামী প্রজাতন্ত্রকে অঙ্কুরে বিনষ্ট করার জন্য দুশমনদের অপপ্রচারসমূহকেও পরীক্ষা করে দেখে। এসব দুশমন মযলুম জনগণের প্রতি কিরূপ আচরণ করে এবং বিদেশি সরকারগুলো এবং কিছু কুচক্রী দলের সাথে যোগসাজশের মাধ্যমে সরলমনা দেশবাসীকে ফাঁকি দিয়ে নিজেদের মতলব হাসিল করে এবং সময়ে সময়ে প্রয়োজনমত নিজেদের ভোল পাল্টায়! যারা ইসলামী প্রজাতন্ত্রের বিলোপ কামনা করে, আমি চাই তারা অনুসন্ধান করে দেখুক মুনাফেক ও পথভ্রষ্টদের হাতে মৃত্যুবরণ করে যাঁরা শহীদ হয়েছেন তাঁদের চরিত্র কেমন ছিল এবং তাঁদের দুশমনদের মোকাবেলায় তাঁদের পুনর্মূল্যায়ন করুক। ঐসব শহীদের রেকর্ডকৃত টেপসমূহ রয়েছে এবং আপনারাও হয়তো ইসলামী শাসনবিরোধীদের টেপরেকর্ড করেছেন। এবার শুধু খুঁজে বের করুন কোন দলটা আসলে অত্যাচারিত ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর সমর্থক।

প্রিয় ভাইয়েরা আমার, আমার জীবদ্দশায় আপনারা এই লেখাগুলো পাঠ করবেন না। যখন হয়তো এই লেখা পড়বেন তখন আর আমি আপনাদের মাঝে নেই যে, ক্ষমতার জন্য সংগ্রামে অথবা স্বার্থপরতার লোভের বশবর্তী হয়ে আপনাদের যুব অনুভূতিকে বিপথগামী করার খেলা করব। যেহেতু আপনারা মেধাবী যুবসমাজ, তাই আমি চাই আপনারা সর্বশক্তিমান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের খেদমতে, আমাদের প্রিয় ইসলাম  ও ইসলামী প্রজাতন্ত্রের খাতিরে আপনাদের তারুণ্যদীপ্ত জীবনকালকে এমনভাবে ব্যয় করুন যেন ইহলোকে এবং পরলোকে উভয়কালেই আপনারা সৌভাগ্যবান হতে পারেন। পাপমোচনকারী গাফুরুর রাহীম খোদার কাছে আমার আকুল মোনাজাত তিনি যেন আপনাদের মানবতার সহজ সরল পথে তথা সিরাতুল মুস্তাকিমে পরিচালিত করেন এবং তাঁর অফুরান রহমতের বরকতে আমাদের ও আপনাদের অতীত গোনাহ-খাতা মাফ করে দেন। আপনারাও একান্ত নিরিবিলি সময়ে আল্লাহর কাছে এই আকুল দোয়া করুন। কারণ, তিনিই পথপ্রদর্শক ও রহমান।

আমার এই অসিয়তনামায় ইরানী জনগণ ও দুনিয়ার দুর্নীতিবাজ সরকারসমূহ এবং বৃহত শক্তিগুলোর চাপে জর্জরিত অন্যান্য জাতির প্রতি একটি কথা বলার আছে। প্রিয় ইরানী জাতির প্রতি আমি আহ্বান জানাই অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার পর নিজেদের সন্তানদের তাজা খুনের বিনিময়ে যে মহা নেয়ামত (ইসলামী প্রজাতন্ত্র) তাঁরা লাভ করেছেন সে নেয়ামতের যেন অত্যন্ত সম্মানের সাথে সমাদর করা হয়। তার উপযুক্ত হেফাজত করা হয়, তাকে যেন নিজেদের সবচেয়ে প্রিয় হিসেবে গণ্য করে উপযুক্ত মর্যাদা দেয়া হয়। এই খোদায়ী রহমত, এই মহাদানকে যেন কোনমতেই অবহেলা করা না হয় এবং নির্ভয়ে এই রহমতের হেফাজতের জন্য সকল বাধাবিপত্তির মোকাবেলা করা হয়। কারণ, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পাক কোরআনে এরশাদ করেছেন : ‘যদি তোমরা আল্লাহকে সাহায্য করো, তিনিও তোমাদের সাহায্য করবেন এবং তোমাদের অবস্থানকে দৃঢ় করে দেবেন।’ (আল কোরআন) হৃদয় দিয়ে শরীক হয়ে ইসলামী প্রজাতন্ত্রের সমস্যা সমাধানে অক্লান্ত প্রয়াস চালিয়ে যান। আমি আহ্বান জানাই, দেশের মজলিশ ও সরকারকে নিজেদের আপন বলে মনে করুন এবং তাদেরকে সম্মানী ও প্রিয় বলে সংরক্ষণ করুন।

মজলিশ, সরকার ও সকল প্রশাসনের প্রতিও আমার সনির্বন্ধ অনুরোধ, যেন এই জাতির দায়িত্বকে তাঁরা সম্মান করে জনগণ সেবায় নিজেদের নিয়োজিত রাখেন। বিশেষ করে শোষিত, বঞ্চিত ও মযলুম জনতার দিকে তাঁদের খেয়াল রাখা উচিত। তাঁরা আমাদের নয়নের মনি, সবকিছুর হিতসাধনকারী, যাঁরা নিজেদের জান কুরবান করে ইসলামী প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং প্রজাতন্ত্রের স্থায়িত্বও তাঁদের মহান অবদানের ফল। নিজেদেরকে আপনারা জনগণের বলেই মনে করুন আর জনগণও আপনাদেরই অংশ। সবসময়ই ইসলামী হুকুমতের উপযুক্ত ও শোভন মানবিক আচরণের দ্বারা যালিম সরকারগুলোকে নিন্দাজ্ঞাপন করবেন- যারা আগেও যেমন ছিল, বর্তমানেও ঠিক তেমনি মস্তিষ্কশূন্য ও বর্বর দল।

আর সকল মুসলিম জাতির প্রতি আমার একান্ত অনুরোধ, ইরানের ইসলাকী হুকুমত ও ইরানের মুজাহিদ জনগণকে দৃষ্টান্ত হিসেবে সামনে রাখুন। নিজেদের জনগণের চাহিদার নিকট নতি স্বীকার করে সেই ধরনের নিষ্ঠুর সরকারকে বশীভূত করুন। ইরানী জাতিরও এই একই দাবি। এটা স্মরণ করা দরকার যে, প্রাচ্য বা পাশ্চাত্যের উপর নির্ভরশীল সরকারগুলোই মুসলমানদের দুর্ভাগ্যের প্রকৃত কারণ। আপনাদের প্রতি আমার জোরালো নসিহত, কখনো ইসলামের এবং মহান ইসলামী প্রজাতন্ত্রের দুশমনদের বিদ্বেষপূর্ণ প্রচারণায় কর্ণপাত করবেন না। কারণ, ইসলামকে ময়দান থেকে বিতাড়িত করাই এদের মূল উদ্দেশ্য যাতে পরাশক্তিগুলোর স্বার্থ সংরক্ষিত হয়।

ঘ. অনেকদিন ধরে সাম্রাজ্যবাদী ও ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর একটা ইবলিসী পরিকল্পনা হলো দেশের আলেমসমাজকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা। ইরানে রেযা খান এবং তার পুত্র মুহাম্মাদ রেযার আমলে এই ষড়যন্ত্র চরম আকার ধারণ করে। রেযা খানের শাসনামলে শয়তানদের অপকৌশল ছিল আলেমদের উপর অত্যাচার চালানো, তাঁদের ইসলামী লেবাস ছিনিয়ে নেয়া, তাদেরকে বন্দি করা। আর তার সুযোগ্য পুত্র মুহাম্মাদ রেযা পাহলভীর আমলে তাদের ঘৃণ্য পরিকল্পনায় আরও কিছু বিষয় যোগ হয়েছিল, যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শিক্ষক ও আলেমদের মাঝে পরস্পরের বিরুদ্ধে শত্রুতার আগুন ছড়িয়ে দেয়া যেন সবাই অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও অন্তর্দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়ে পড়ে। এতে বৃহত শক্তিগুলোর শয়তানি চালবাজির প্রতি ছাত্র-শিক্ষক ও আলেমরা নজর না রাখায় এবং তাদের সরলতার সুযোগে পাহলভী শাসকগোষ্ঠী অবাধ প্রচারণার সাহায্যে নিজেদের মতলব হাসিল করেছিল। একদিকে তারা খুব সতর্কতার সাথে খেয়াল রাখত যে, সকল স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, অধ্যাপক ও উপাচার্য পাশ্চাত্য বা প্রাচ্যঘেঁষা কিংবা ইসলামবিরোধী বা ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের থেকে যেন নির্বাচিত হয়। প্রকৃত মুমিন, ইসলাম অনুরাগীরা যেন সংখ্যালঘু অবস্থায় থাকে। ওরা আপ্রাণ চেষ্টায় রত ছিল দেশের ভবিষ্যত শিশু-কিশোর-যুবকদের এমনভাবে গড়ে তুলতে যেন ওরা ধর্মকে তথা ইসলামকে ঘৃণা করা এবং ধর্মের সাথে জড়িত লোকজন, বিশেষ করে আলেমদের কাছ থেকে দূরে সরে থাকে। সেই সময় পাহলভী শাসকরা বলে বেড়াত যে, আলেমরা ব্রিটেনের দালাল এবং পুঁজিবাদী ও বৃহত ভূস্বামীদের পক্ষে কথা বলে এবং প্রতিক্রিয়াশীল সমর্থক। পরে আলেমদের বিরুদ্ধে বদনাম ছড়ানো হলো যে, তারা প্রগতি ও সভ্যতার বিরোধী। একই সাথে ওই শাসকগোষ্ঠীর নিজেদের ধূর্ত কূটকৌশলের মাধ্যমে আলেমদের নিয়ে নতুন ফন্দি আঁটলো। তারা কলেজছাত্র ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকশ্রেণির মধ্যে আলেমদের প্রতি অহেতুক ভয়ের সৃষ্টি করলো। আর আলেমদেরকে বিভ্রান্ত করার জন্য শয়তানরা প্রচারণা চালালো যে, কলেজছাত্র ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকম-লী অধার্মিক ও ইসলামবিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত। এভাবে তারা রাষ্ট্র পরিচালনার মূলে যারা আছে তাদেরকে ইসলাম ধর্ম, আলেমসমাজ ও ধার্মিক লোকদের বিরোধী রাখার ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করে। ইসলাম ও আলেমদের প্রতি অনুগত সাধারণ জনগণকে সরকারের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়াদির ব্যাপারে একটা বিরোধপূর্ণ অবস্থার সৃষ্টি করে। সরকার ও সাধারণ জনগণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যকার এই বিরোধ শোষক-লুটেরাদের খায়েশ পুরো করার উপযোগী পথ তৈরি করে। ফলে সরকারের প্রতিটি ব্যাপারেই লুটোরারা নাক গলাত এবং আমাদের জাতির সম্পদ কুক্ষিগত করে নিজেদের পকেট ভর্তি করত। আপনারা যেমনটি প্রত্যক্ষ করেছেন, এই মযলুম জাতির ভাগ্যে কী ঘটেছে এবং কী ঘটতে যাচ্ছিল।

সর্বশক্তিমান রাহমানুর রাহীম আল্লাহ তাআলার ইচ্ছায় এবং আমাদের মহান জাতি তথা আমাদের আলেমসমাজ, ছাত্র-শিক্ষক, ব্যবসায়ী, বিভিন্ন পেশাজীবী জনগণ, কৃষক-মজুর প্রভৃতি নির্বিশেষে সকল শ্রেণির জনগণের প্রচেষ্টায় এখন সকল প্রকার গোলামির জিঞ্জির ভেঙে চুরমার করা হয়েছে। প্রতিরোধের দেয়াল ভেঙে দেয়া হয়েছে। দেশকে পরাশক্তি ও তার দোসরদের হাত থেকে মুক্তি দেয়া হয়েছে। তারা যেন প্রকৃত পরিস্থিতি সম্পর্কে গাফেল না হোন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও প্রিয় সাহসী যুবকদের প্রতি আমার আহ্বান, তাঁরা যেন ওলামা ও ধর্মীয় ছাত্রদের সাথে তাদের একতা ও ভালোবাসার বন্ধনকে দৃঢ় করেন। বিপজ্জনক দুশমনদের কুপরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্রসমূহ থেকে যেন অনবহিত না থাকেন । কথা ও কাজের মাধ্যমে যে কেউ তাঁদের মাঝে বিভেদের বীজ বপন করতে চায় তাকে যেন সৎপথে আনার চেষ্টা করা হয়। এ ক্ষেত্রে  যদি সে সুপথে না আসে তাহলে তাকে অস্বীকার করে সমাজ থেকে যেন বহিষ্কার করে দেয়া হয় । যেন সে আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের শিকড় গাড়তে না পারে। কারণ, ঝরনার উৎসমুখেই স্রোতধারার গতিরোধ করা অধিকতর সহজ। বিশেষ করে কোন অধ্যাপককে যদি যুবসমাজকে বিভ্রান্ত করার প্রয়াস দেখা যায় তাহলে সেই অধ্যাপককে ছাত্রদের উচিত নসিহত করা! এতে যদি কাজ না হয় তাহলে সেই অধ্যাপককে পরিত্যাগ করা। আমার এ নসিহত আলেমসমাজ ও ধর্মীয় ছাত্রদের প্রতি বিশেষভাবে প্রযোজ্য, যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে ষড়যন্ত্রের জাল অত্যন্ত মারাত্মক। এই জাল খুঁজে বের করা সমাজের সম্মানিত বুদ্ধিজীবীর কর্তব্য।

ঙ. যেসব মারাত্মক চক্রান্ত দুর্ভাগ্যবশত আমাদের প্রিয় দেশের উপর ধ্বংসাত্মক প্রভাব ফেলেছে, সে চক্রান্তের অনেকগুলোর প্রভাব এখনও বিদ্যামান। সেগুলোর মধ্যে একটা চক্রান্ত হলো ঔপনিবেশিক দেশগুলোকে স্ববিরোধিতায় ঠেলে দিয়ে পরমুখাপেক্ষী করা। তাদেরকে পাশ্চাত্য বা প্রাচ্যঘেঁষা করে তোলা। এই হীন চক্রান্ত এত বেশি পরিমাণে প্রভাব বিস্তার করেছে যে, ঐসব দেশ এমনকি তাদের নিজেদের আত্মসম্মানবোধ ও আত্মবিশ্বাসটুকুও হারিয়ে বসেছে। নিজেরা উজ্জ্বল সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও উত্তম প্রজন্মের অধিকারী হয়েও এখন তারা হতাশাগ্রস্ত হয়ে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দুই শিবিরকে দুই মূল শক্তিকেন্দ্র বলে বিশ্বাস করেছে এবং স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে, তাদের দেশ এই দুই শক্তির যে কোন একটির উপর নির্ভরশীল না হয়ে থাকতে পারবে না। সে এক সুদীর্ঘ দুঃখজনক কাহিনী । এই দুই পরাশক্তির কাছ থেকে যে আঘাত আমরা পাচ্ছি তা মারাত্মক এবং বেদনাদায়ক। এর চেয়ে দুঃখজনক হলো যে, দুই পরাশক্তি অধঃস্তন মযলুম জাতিসমূহকে সবদিকে থেকে পদানত রাখতে চায়। তারা চায় এইসব দেশ যেন উতপাদনমুখী না হয়ে ব্যয়মুখী দেশ হিসেবে ঋণভারে জর্জরিত হয়ে থাকে। ওরা আমাদের স্বকীয়তকে পরখ করার মতো আমাদের আত্মবিশ্বাসকে ধ্বংস করে দিয়েছে যেন আমাদের যা কিছু আছে তা ওদের হাতে তুলে দিয়ে আমরা চুপচাপ অন্ধের মতো বসে থাকি এবং আমাদের দেশ, আমাদের ভাগ্য ওদের হাতে ছেড়ে দেই। এই অন্তঃসারশূন্যতা এবং জড় অনুভূতি বৃহত শক্তিগুলোকে আমাদের মনে গেঁথে দিয়েছে। এই কারণে সকল ক্ষেত্রে আমরা আমাদের নিজস্ব জ্ঞান গরিমা ও ক্ষমতাকে অবিশ্বাস করছি এবং অন্ধের মতো প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের অনুসরণ করে চলেছি। এমনকি আমাদের নিজেদের পাশ্চাত্যঘেঁষা বা প্রাচ্যমুখী অসভ্য লেখক এবং বক্তারা আমাদের নিজস্ব সাহিত্য-সংস্কৃতি, বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি ও স্বকীয়তাকে নিয়ে ঠাট্টাবিদ্রূপ করত। বিদেশি রসম-রেওয়াজ যতই ধ্বংসাত্মক বা উত্তেজনাকর হোক না কেন, এসব লেখক, বক্তারা তাদের কথা, কাজ ও কলম দ্বারা সেগুলোর প্রচারণা চালিয়েছে এবং এই অপসংস্কৃতিকে জাতিসমূহের সামনে উপস্থাপন করার জন্য তারা ছিল প্রশংসা ও গুণগানে মুখর। আর এখনো তারা তাই করছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, যদি কোন একটা বইয়ে বা কোন একটা রচনায় কিংবা কোন বক্তৃতায় কতিপয় বিজাতীয় শব্দ ব্যবহার করা হয় তাহলে সেই বই, রচনা বা বক্তৃতা আকর্ষণীয় বলে দাবি করা হয়। আর লেখক বা বক্তাকে বুদ্ধিজীবী ও জ্ঞানী হিসেবে গণ্য করা হয়। দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত সব কিছুরই নাম যদি প্রাচ্য বা পাশ্চাত্য পরিভাষায় ব্যবহার করা হয় তবে জনগণ তাকে সাদরে বরণ করে নেয়, একে উন্নতি ও সভ্যতার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে স্বগতম জানায়। স্বদেশী নামগুলোকে গণ্য করা হয় সেকেলে, পরিত্যক্ত এবং প্রতিক্রিয়াশীলতার প্রতীক হিসেবে। পাশ্চাত্য সংস্কৃতির জন্য আকুতি সব জায়গায়ই বিদ্যমান। যদি আমাদের সন্তাদের পাশ্চাত্য নাম হয় তাহলে তারা গর্ব অনুভব করে, আর যদি তাদের দেশীয় নাম হয় তাহলে নিদারুণ লজ্জা এবং হীনমন্যতায় ভোগে। আমাদের নগরীর রাস্তাসমূহ, দোকানপাট, কোম্পানি, ঔষধের দোকান, লাইব্রেরিসহ যে কোন পণ্যসামগ্রী সবকিছুর লিখিত নাম অধিকতর আকর্ষণীয় এবং উপযুক্ত হয়, যদি তা হয় বিদেশি নাম। যদিও সেসব সামগ্রী দেশেই তৈরি। প্রতিটি আচার-আচরণে, সামাজিক কায়দা-কানুনে এবং প্রাত্যহিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইউরোপীয় ধাঁচের রীতির আধিক্য একটা গৌরবের ব্যাপার এবং সভ্য ও প্রগতিশীল হওয়ার পরিচায়ক বলে মনে করা হয়। অপরদিরকে স্বদেশী সংস্কৃতির প্রয়োগ পশ্চাদপদতা ও প্রাচীনমুখী হওয়ার চিহ্ন। অসুখ ভালো করার জন্য- যে অসুখ স্বদেশে যদিওবা নিরাময়যোগ্য, তবুও সেজন্য বিদেশে যাওয়ার দরকার। এভাবে নিজেদের অভিজ্ঞ চিকিতসকদের হেয় প্রতিপন্ন করে প্রত্যাখান করা হয়।

ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র্র এবং মস্কো সফর করা একটা গৌরব ও মূল্যবান বিষয়, কিন্তু হজ পালনার্থে মক্কায় বা অন্যান্য পবিত্র স্থানে গমন করা তাদের কাছে পশ্চাদপদতা ও প্রাচীনপূজারি হিসেবে আখ্যায়িত। এদের কাছে ধর্ম, ধর্মীয় আধ্যাত্মিক ব্যাপারগুলোতে উদাসীন থাকাই বুদ্ধিবৃত্তি ও সভ্যতার পরিচায়ক।

আমি এটা দাবি করছি না যে, আমাদের প্রয়োজনীয় সব জিনিসই আমাদের নিজেদের রয়েছে। সুস্পষ্টভাবে সত্য যে, সাম্প্রতিক শতাব্দীতে বিশেষ করে গত কয়েক শতাব্দীতে বিদেশি শক্তিগুলো প্রতিটি ক্ষেত্রে আমাদের কোন অগ্রগতি সাধিত হতে দেয়নি। রাষ্ট্রযন্ত্রের বিশ্বাসঘাতক বা কর্ণধাররা, বিশেষ করে পাহলভী বংশের কুখ্যাত ব্যক্তিরা আমাদের স্বীয় সামর্থ্যরে বিরুদ্ধে ধ্বংসাত্মক প্রচারণা চালিয়ে ও সেই সাথে স্বীয় অযোগ্যতার অনুভূতি সৃষ্টি করে আমাদের প্রযুক্তিগত অগ্রগতির প্রচেষ্টাকে বাধা দিয়েছে। দুশমনের যে সকল ফন্দিফিকিরের কারণে আমাদের দেশ পিছিয়ে পড়েছে সেগুলো হলো, যে কোন ধরনের বিদেশি জিনিসের আমদানি, আমদানিকৃত বিবিধ প্রকার দ্রব্যসামগ্রী বিশেষত প্রসাধনী, বিনোদনমূলক ও খেলনার সামগ্রী প্রতি নারী-পুরুষ বিশেষ করে যুবসমাজের আকর্ষণ, ভোগের প্রতিযোগিতায় জনগণ এবং পরিবারসমূহের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত ইত্যাদি। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, আমাদের সমাজের সবচেয়ে কর্মক্ষম যে অংশ, সেই যুবসমাজকে রিপুর তাড়না চরিতার্থের জন্য বেশ্যাবৃত্তি ও পতিতালয়ে টেনে আনা হয়েছিল।

আমরা এখন যেহেতু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ঐসব ফাঁদ থেকে মুক্ত হয়েছি, আমরা দেখতে পাচ্ছি, বর্তমানের বঞ্চিত জনগণের নবীন বংশধররা আমাদের দেশের শিল্পোন্নয়ন ও প্রযুক্তিগত উন্নতিতে অবদান রাখার জন্য জেগে উঠেছে। আমাদের অনেক কারখানায় এখন এয়ারক্রাফটের মতো জিনিস তৈরি হচ্ছে। যেখানে প্রাথমিক ধারণা ছিল কারখানাগুলোর চাকা ঘুরবে না, সাহায্যের জন্য পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের দিকে তাকাতে হবে- এ অবস্থায় আমাদের তরুণরা অর্থনৈতিক অবরোধ ও চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধকে মোকাবেলা করার জন্য এমনসব প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ তৈরি করেছেন, যেগুলো বিদেশি যন্ত্রাংশের চেয়ে অধিকতর সস্তায় সরবরাহ করে আমাদের উতপাদন ক্ষমতায় এক বাস্তব প্রমাণ রেখেছেন। আমার এই শেষ ইচ্ছা ও নির্দেশনার মাধ্যমে প্রিয় জাতির প্রতি আমার হৃদয়স্পর্শী ও সেবাব্রত মন নিয়ে নসিহত- আপনারা সজাগ দৃষ্টিতে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করুন। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের উপর নির্ভরশীল রাজনীতিবিদরা যেন তাদের ইবলিসি কুপ্ররোচনার মাধ্যমে আপনাদেরকে এই আন্তর্জাতিক লুটেরাদের বশীভূত করে না ফেলে। দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি ও অক্লান্ত প্রচেষ্টার মাধ্যমে পরাধীনতার অবশিষ্ট আলামতগুলোকে নির্মূল করার জন্য জেগে উঠুন। এ সম্পর্কে নিশ্চিত হোন যে, আর্য এবং আরবরা ইউরোপীয়ান, আমেরিকান বা সোভিয়েতদের  চেয়ে হীন প্রকৃতির নয়। আমি তাঁদেরকে এই নিশ্চয়তা প্রদান করছি যে, একবার যদি তাঁরা নিজেদের স্বরূপ আবিষ্কার করতে সক্ষম হন, হতাশার চিহ্নটুকু ছুঁড়ে ফেলে দেন, আর অন্যের সাহায্য পাবার প্রত্যাশা পরিত্যাগ করেন, তাহলে অবশেষে আপনারা আপনাদের কর্মক্ষমতা ও সকল কিছুর উতপাদন ক্ষমতার জ্বলন্ত প্রমাণ রাখতে সক্ষম হবেন। এদের মতো অন্যদের সমপর্যায়েও আপনারা যেতে সক্ষম হবেন, কিন্তু তার শর্ত হলো যে, আপনারা মহাপ্রভু রাহমানুর রাহীম আল্লাহ তাআলার প্রতি পরির্পূণ আস্থা আনবেন। নিজেদের আত্মবিশ্বাসে বলিয়ান হয়ে বিদেশি দেশগুলোর উপর প্রযুক্তিগত নির্ভরতার অবসান ঘটাবার লক্ষ্যে দৃঢ়চিত্ত হবেন, বিদেশি মাতব্বরি থেকে নিজেদের মুক্ত করার লক্ষ্যে এবং মর্যাদাপূর্ণ জীবনের অধিকারী হবার মানসে সব ধরনের কঠোরতার বোঝা সহ্য করার জন্য সব সময় প্রস্তুত থাকবেন । বর্তমান এবং ভবিষ্যত সরকার ও দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের উপর অর্পিত একটা দায়িত্ব হলো, স্বদেশি বিজ্ঞানীদের মর্যাদা দেয়া, বস্তুগত ও নৈতিক সাহায্যের মাধ্যমে তাদেরকে কাজকর্মে উতসাহ প্রদান করা যাতে দেশে অপ্রয়োজনীয়, ব্যয়বহুল ও ধ্বংসাত্মক সামগ্রীর অনুপ্রবেশ রোধ হয়। যা আছে তা নিয়েই তৈরি করার কাজে হাত দিতে হবে। আর এভাবে একদিন নিজেরাই সমস্ত কিছু প্রস্তুত করতে সক্ষম হবেন। আমি ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে তরুণ সমাজের প্রতি আহ্বান জানাই, আপনারা ভোগবিলাসের জিন্দেগি আর অশ্লীল ক্রিয়াকর্ম, যেমন পতিতালয়গুলোতে উপস্থিতির বিনিময়ে নিজেদের স্বাধীনতা, মুক্তি ও মানবিক গুনাবলিকে বিসর্জন দেবেন না। কারণ, এগুলো পাশ্চাত্য ও তাদের দুষ্ট চেলাদের কাছ থেকে এদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। স্বাধীনতা, মুক্তি ও এসব মানবিক গুণের সংরক্ষণে যদিও বা সমস্ত দুঃখ-কষ্টকে বরণ করে নিতে হয়। অতীত সকল অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, ওরা শুধু আপনাদের ধ্বংস দেখতে চায়। তারা চায় আপনাদেরকে দেশের ভবিষ্যত সম্বন্ধে গাফেল রাখতে। যাতে ওরা আপনাদের ধনসম্পদ অবাধে লুণ্ঠন করতে পারে। আপনাদের পায়ে গোলামি ও উপনিবেশবাদের জিঞ্জির পরিয়ে দিয়ে একমাত্র বিদেশি পণ্যের ক্রেতা জাতি হিসেবে দাঁড় করাতে পারে। এটা এমন এক অপকৌশল, যদ্বারা আপনাদেরকে ওরা পশ্চাদমুখীই রাখতে চায়, যা তাদের ভাষায় ‘অর্ধ-বর্বর’ হিসেবে পরিচিত।

চ. পাশ্চাত্য শক্তিগুলোর চক্রান্তসমূহের মধ্যে একটা হলো শিক্ষাদীক্ষার কেন্দ্রগুলোর নিয়ন্ত্রণক্ষমতা নিজেদের হাতে তুলে নেয়া। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিয়ন্ত্রণভার, যার কথা পূর্বে বলা হয়েছে এবং বারবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, যেগুলো আসলে ভবিষ্যত রাষ্ট্রতরণীর কর্ণধার তৈরির জন্য জনগণকে গড়ে তোলার কেন্দ্রবিশেষ। আলেমবৃন্দ এবং দ্বীনি মাদ্রাসাগুলোর ব্যাপারে তাদের একটা আলাদা কৌশল রয়েছে, যা হাইস্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয় সংক্রান্ত কৌশল থেকে ভিন্ন প্রকৃতির। এই চক্রান্তটি হলো তাদের পথের কাঁটা আলেমসমাজকে ধ্বংস করে দেয়া এবং তাদেরকে একাকী বিচ্ছিন্ন করে রাখা। আর সরাসরি দমনমূলক নীতি-পদক্ষেপের মাধ্যমে তাদেরকে অপমান করা। যেমনটি রেযা খানের আমলে করা হয়েছিল- যা তাদের প্রতি বুমেরাং হয়ে ফিরে এসেছে এবং উল্টো প্রতিক্রিয়া ঘটিয়েছে। আর নয়তো মিথ্যা বদনাম ছড়িয়ে এবং অন্যান্য ইবলিসি কৌশল খাটিয়ে আলেমসমাজকে শিক্ষিত ও তথাকথিত বুদ্বিজীবীদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা। এ নীতিটিও রেযা খানের আমলে চালু ছিল। আর তা দমননীতির পরিবর্তে ধূর্তামির পন্থা অবলম্বনে একইভাবে চালু ছিল মুহাম্মাদ রেযা শাহের আমলেও। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে বিদেশি শক্তিগুলোর চক্রান্ত হলো স্বদেশি সংস্কৃতি ও স্বীয় মূল্যবোধ থেকে যুবকদেরকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা। পাশ্চাত্য বা প্রাচ্যের প্রতি প্রলুব্ধ করা, আর এ ধরনের মতাদর্শে শিক্ষিত ব্যক্তিদের থেকেই সরকারি প্রশাসকদের মনোনীত করা। দেশের ভাগ্য নির্ধারণের কাজে তাদেরকে ক্ষমতা প্রদান করা। যাতে তারা বিদেশি শক্তিগুলোর হাতের পুতুল হিসেবে কাজ করতে পারে। আর এই শিক্ষিত সমাজ যেন এমনভাবে দেশ পরিচালনা করে যাতে বিদেশিদের শোষণ ও সম্পদ লুণ্ঠনের পথ সুগম থাকে। পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রতি প্রবণতা বজায় থাকে। আর সমাজের আলেমশ্রেণি বিচ্ছিন্ন, ঘৃণিত এবং পরাজিত হবার কারণে তাদের এই ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের মোকাবেলা (আলেমগণ) যেন করতে না পারে। এটা হচ্ছে ঔপনিবেশিক দেশগুলোকে পশ্চাদমুখী করে রেখে তাদের সম্পদ লুণ্ঠন করার অন্যতম শ্রেষ্ঠ চক্রান্ত। কেননা, এর মাধ্যমে বৃহত শক্তিগুলো বিনা বাধায় এবং বিনামূল্যে অব্যাহতভাবে নিরীহ অসহায় জাতিসমূহের বিষয়সম্পত্তি পকেটস্থ করার পথ নিশ্চিত করতে পারে।

তাই, এখন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে সংস্কার প্রক্রিয়া এবং প্রশাসনিক পরিবর্তন ও পরিশুদ্ধি আনা হচ্ছে আমাদের সকলের কর্তব্য এই দায়িত্বে নিয়োজিতদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়ে সবসময়ের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বিচ্যুতির হাত থেকে মুক্তি দেয়া, বিচ্যুতির কবল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চিরস্থায়ী মুক্তি নিশ্চিত করা। কোথাও বিপথগামিতার আলামত পরিলক্ষিত হওয়ামাত্রই যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি তা সংশোধনে সচেষ্ট হওয়া। এই অত্যাবশ্যকীয় কাজটি প্রথমত বিশ্ববিদ্যালয়ের যুবকদের শক্তিশালী হাতেই সুসম্পন্ন হওয়া উচিত। শিক্ষাগত বিপর্যয় থেকে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে উদ্ধার করা মানে দেশ ও জাতিকে বিপথগামিতার হাত থেকে উদ্ধার করা।

আমার অসিয়ত প্রথমত তরুণ ও যুবসমাজের প্রতি এবং দ্বিতীয়ত তাদের পিতামাতা ও বন্ধুবান্ধবদের প্রতি এবং সর্বোপরি রাষ্ট্রের কর্ণধার ও দেশের প্রতি সহানুভূতিশীল দেশপ্রেমিক বুদ্ধিজীবীদের প্রতি। তাঁরা যেন এই গুরুত্বপূর্ণ কাজে সর্বান্তঃকরণে তাঁদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখেন, যা দেশকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করবে এবং তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে যেন আগামীদিনের বংশধরদের জন্য আমানত হিসাবে রেখে যেতে পারেন। ভবিষ্যত সকল প্রজন্মের প্রতি আমার পরামর্শ, তাঁরা যেন আত্মমুক্তি, প্রিয় দেশ ও মানুষ গড়ার ধর্ম ইসলামের মুক্তির উদ্দেশ্যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বিপথগামিতা এবং পূর্ব ও পশ্চিমা শক্তির গুপ্ত ফাঁদ থেকে রক্ষা করেন। আপনাদের এই মানবতাবাদী ইসলামী প্রচেষ্টার মাধ্যমে রাষ্ট্রের উপর থেকে বৃহত শক্তিগুলোর হস্ত কর্তন করে তাদেরকে যেন হতাশাগ্রস্ত করে দেন। মহান আল্লাহ আপনাদের সহায় হোন এবং আপনাদের হেফাজত করুন।

ছ. একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ইসলামী পরামর্শ পরিষদ (মজলিশ) সদস্যদের একনিষ্ঠতা । আমরা স্বচক্ষে দেখেছি শাসনতান্ত্রিক রাজতন্ত্র্রের আবির্ভাবের পর থেকে বর্বর পাহলভী শাসন আমল পর্যন্ত অযোগ্য এবং পথভ্রষ্ট আইনসভাগুলোর কারণে ইসলাম ও ইরানী জাতির কি ভোগান্তিই না হয়েছে! আর তা সবচেয়ে জঘন্যভাবে হয়েছে চাপিয়ে দেয়া এই ফাসেদ সরকারের আমলে। আমাদের স্মরণ আছে, এই হীন অপরাধী সরকার ও তাদের দোসরদের দ্বারা দেশ ও জাতিকে কি অসহ্য যন্ত্রণাই না পোহাতে হয়েছে!

গত পঞ্চাশ বছরের সময়কালে জাতীয় পরিষদে একটা বিশ্বাসঘাতক নকল সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের মোকাবেলায় মযলুম জনগণের সংখ্যালঘিষ্ঠতার কারণে ব্রিটেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং আরো পরে আমেরিকার বাসনা পূরণ করতে এই সমস্ত খোদাবিমুখ বিপথগামী দল সদা সচেষ্ট ছিল। আর তারা দেশকে রসাতলে ডুবিয়ে দেয়ার বজ্জাতিতেও লিপ্ত ছিল।

শাসনতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার পর থেকে এদেশে সংবিধানের কোন গুরুত্বপূর্ণ নীতি বাস্তবায়ন করা হয়নি। রেযাখানের পূর্বে পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রবর্তক বড় বড় জমিদার ও মুষ্টিমেয় খানেরা বিদেশি শক্তিগুলোর স্থানীয় দালাল হিসেবে কাজ করত। পাহলভী শাসনামলেও এসব বদমাশ ও তাদের লেজুড়ে শ্রেণির রাজত্বই কায়েম ছিল।

এখন যেহেতু দেখা যাচ্ছে, মহামহিম আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সাহায্যে এবং গৌরবময় ইরানী জাতির হিম্মতের বদৌলতে দেশের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের অধিকার আজ জনগণের হাতে অর্পিত, সংসদের প্রতিনিধিরা সরকার ও বিভিন্ন প্রদেশের খানদের প্রভাবমুক্ত ও প্রত্যক্ষভাবে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হয়ে ‘মজলিসে শুরা-ই-ইসলামি’তে আগত, সেহেতু ইসলাম ও দেশের প্রতি তাঁদের অঙ্গীকারের পরিপ্রেক্ষিতে এটা আশা করা যায় যে, সত্যপথ থেকে সকল ধরনের বিচ্যুতিকে বাধা দেয়া হবে। তাই জাতির বর্তমান ও ভবিষ্যত বংশধরদের প্রতি আমার অসিয়ত, তাঁরা যেন দৃঢ় মনোবল নিয়ে দেশ ও ইসলামী অনুশাসনের প্রতি ওয়াদাবদ্ধ হয়ে প্রতিবারের সংসদ নির্বাচনে এমন প্রার্থী নির্বাচন করেন, যাঁরা হবেন ইসলাম ও ইসলামী প্রজাতন্ত্রের প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ। যাঁরা সাধারণত মধ্যবিত্ত পরিবার ও অবহেলিত শ্রেণি থেকেই আসবেন। সত্যপথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পাশ্চাত্য বা প্রাচ্য অথবা অন্য কোন বিভ্রান্তিকর শয়তানি মতাদর্শের প্রতি যাঁদের অনীহা থাকবে, যাঁরা হবেন সুশিক্ষিত, সুযোগ্য, দৈনন্দিন জীবনের সমস্যাবলি এবং ইসলামী রাজনীতি সম্পর্কে সম্যক ওয়াকেবহাল।

শ্রদ্ধেয় আলেম সমাজের প্রতি আমার পরামর্শ, বিশেষ করে আমাদের সম্মানিত দ্বীনী উৎস মারজাদের  প্রতি আমার অসিয়ত, তাঁরা যেন সমাজের মৌলিক বিষয়গুলোর প্রতি বিশেষ করে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ও সংসদ নির্বাচনের মতো গুরুত্বর্পূণ বিষয়ের প্রতি উদাসীন না থাকেন। এ সবের সংস্পর্শকে এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করবেন না। আপনারা সকলেই স্বচক্ষে অবলোকন করেছেন, ভবিষ্যত বংশধররাও পড়বে এবং শুনবে যে, পাশ্চাত্য বা প্রাচ্যপন্থী ঝানু রাজনীতিবিদরা রাজনৈতিক পটভূমি থেকে আলেমদের উতখাত করতে চেয়েছিল, অথচ এ সমস্ত আলেমই শাসনতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের শিকড়কে প্রতিষ্ঠিত করেছেন বিপুল কষ্ট ও পরিশ্রমের বিনিময়ে। অপরদিকে আলেমরাও এই সমস্ত ঝানু রাজনীতিবিদের ছল-চাতুর্যের খেলায় ধোঁকা খেয়েছিলেন আর রাষ্ট্রীয় ও সাধারণ মুসলমানদের কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে জড়িত হওয়াকে তাঁদের জন্য মর্যাদাহানিকর কাজ বলে মনে করতে শুরু করলেন। আর এটাও দেখেছেন, রাজনীতি থেকে সরে গিয়ে কিভাবে আলেমগণ বিদেশি পুতুলদের কাছে রাজনৈতিক ময়দানকে ছেড়ে দিয়েছিলেন। এর ফলে শাসনতান্ত্রিক আন্দোলন, সংবিধান, দেশ ও ইসলামের যে বিরাট ক্ষতি হয়েছে তা কাটিয়ে উঠতে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন।

এখন যেহেতু সর্বশক্তিমান আল্লাহর রহমতে সকল বাধাবিপত্তি অপসারিত হয়েছে এবং সমাজের সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য ব্যক্তিগত দায়িত্ব এড়ানোর জন্য আর কোন ওজর-আপত্তি থাকলো না, (তাই) আমি আপনাদেরকে একটা কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, তা হলো মুসলমানদের সমাজিক কাজকর্মের ব্যাপারকে অবহেলা করা একটা অমার্জনীয় অপরাধ- কবিরা গুনাহ। প্রত্যেককে অবশ্যই সাধ্যমতো সমাজে নিজ নিজ প্রভাব অনুযায়ী ইসলাম ও দেশের সেবা করতে হবে। মহান ইসলামী আদর্শের পরিপন্থী পথভ্রষ্ট ব্যক্তিবর্গ, প্রাচ্য-পাশ্চাত্য মতাদর্শের প্রতি আসক্ত লোকদের এবং দুই উপনিবেশবাদী পরাশক্তির দলালদের অনুপ্রবেশকে অবশ্যই কঠোরভাবে বাধা দিতে হবে। আপনাদের অবশ্যই জানা থাকা উচিত, ইসলাম ও মুসলিম দেশসমূহের দুশমন তথা আন্তর্জাতিক লুটেরা পরাশক্তিগুলো ক্রমান্বয়ে আমাদের দেশ ও অন্যান্য মুসলিম দেশে অনুপ্রবেশ করে সূক্ষ্মভাবে এবং খোদ দেশীয় লোকদের হাতেই ঐ সমস্ত দেশকে শোষণের জালে আবদ্ধ করে। আপনাদের অবশ্যই সজাগ দৃষ্টিতে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা উচিত। আর এ ধরনের অনুপ্রবেশের ইঙ্গিত পাওয়া মাত্রই মুহূর্তকাল বিলম্ব না করে এদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো উচিত। আল্লাহ আপনাদের সহায় হোন, তিনি আপনাদের হেফাযত করুন।

বর্তামান ও ভবিষ্যত ইসলামী সংসদ সদস্যবর্গের প্রতি আহ্বান, আল্লাহ না করুন, যদি কোন পথভ্রষ্ট লোক ষড়যন্ত্র ও রাজনৈতিক ধূর্ততার মাধ্যমে স্বীয় সদস্য পদ জনগণের উপর চাপিয়ে দেয়, তাহলে মজলিশ যেন এর বিরুদ্ধে অনাস্থা আনে। এ ব্যাপারে সতর্ক থাকবেন যেন কোন একজন বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী লোকও মজলিশে অনুপ্রবেশ করতে না পারে। সরকারিভাবে স্বীকৃত অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতি আমার পরামর্শ, তাঁরা যেন পাহলভী সরকারের শাসনামল থেকে শিক্ষাগ্রহণ করেন এবং নিজেদের সংসদ প্রতিনিধিদেরকে এমন লোকদের মধ্য থেকে নির্বাচিত করেন যাঁরা হবেন নিজেদের ধর্ম ও ইসলামী প্রজাতন্ত্রের প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ। যাঁরা বিশ্বগ্রাসী বিদেশি শক্তিগুলোর উপর নির্ভরশীল হবেন না। আর যাঁরা হবেন খোদাবিরোধী পথভ্রষ্ট বা বিকৃত আদর্শের প্রতি অনাকৃষ্ট। মজলিশের সদস্যদের প্রতি আমার অনুরোধ, তাঁরা যেন প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ডে পরস্পরের সাথে পরিপূর্ণরূপে ভ্রাতৃসুলভ আচরণ ও সম্প্রীতি বজায় রাখতে সচেষ্ট হন। আর খোদা না করুন, মজলিশে পাশকৃত বিলসমূহ যেন ইসলামবিরোধী না হয় এবং আপনারা যেন ইসলাম ও তার আসমানি বিধিবিধানসমূহে অবিচল থাকেন। এর ফলে আপনারা দুনিয়া ও আখেরাতে পরম সৌভাগ্যের অধিকারী হতে পারবেন। বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের সম্মানিত অভিভাবক পরিষদের (শুরা-ই-নেগাহবান) প্রতি আমার একান্ত নসিহত, তাঁরা যেন অত্যন্ত সতর্কতা ও শক্তিমত্তার সাথে তাঁদের ইসলামী ও জাতীয় কর্তব্যসমূহ সম্পাদন করেন। অন্য কোন শক্তির কাছে বশীভূত হয়ে না পড়েন। তাঁরা যেন পবিত্র শরিয়ত ও সংবিধানবিরোধী আইনকানুন প্রচলনের বিরুদ্ধে বিনা দ্বিধায় বাধা প্রদান করেন আর যেন দেশের বিবিধ চাহিদার প্রতিও তাঁরা সজাগ থাকেন। এগুলো কখনো দ্বিতীয় পর্যায়ের অধ্যাদেশমালার (আহকাম-ই-সানাভিয়াহ) দ্বারা, কখনো বেলায়াতে ফকীহর নির্দেশনামার মাধ্যমে কার্যে পরিণত হতে পারে।

রাষ্ট্রের সকল নির্বাচনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করার জন্য আমি ইরানের মহান জনগণের প্রতি আহ্বান জানাই। তা সে মজলিশ-ই-শুরা-ই ইসলামীর নির্বাচন বা রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অথবা নেতা বা নেতৃপরিষদ গঠনের জন্য বিশেষজ্ঞ পরিষদের (Assembly of Experts) নির্বাচনই হোক। আর নির্ভরযোগ্য আইনের মাপকাঠিতে যেন ঐ সমস্ত ব্যক্তিকে নির্বাচন করা হয়। উদাহরণস্বরূপ নেতা নির্ধারণ বা নেতৃপরিষদ গঠনের জন্য বিশেষজ্ঞদের নির্বাচনের বেলায় যেন যথেষ্ট খেয়াল রাখা হয়। আর যদি সতর্কভাবে বিশেষজ্ঞদের সাংবিধানিক ও ধর্মীয় বিধি মোতাবেক নির্বাচন করা না হয়, তাহলে এমনও হতে পারে যে, সেই নির্বাচনের ফলে তারা দেশ ও ইসলামের অপূরণীয় ক্ষতি সাধন করবে। যার কারণে প্রত্যেকেই আল্লাহর কাছে দায়ী থাকবেন। সুতরাং এই অবস্থায় জাতির সর্বস্তরের জনগণ, তথা মারজা থেকে শুরু করে উচ্চস্তরের আলেম, ব্যবসায়ী, কৃষক, শ্রমিক ও সরকারি কর্মচারী সবার উচিত দেশের সমস্ত কাজকর্মে নিজেদের জড়িয়ে ফেলা। আর যদি তাঁরা নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখেন তাহলে দেশ ও ইসলামের ভবিষ্যত অবস্থার জন্য তারাই দায়ী থাকবেন। এ ব্যাপারটা বর্তমান ও ভবিষ্যত বংশধরদের ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য। অনেক সময় কিছু কিছু ক্ষেত্রে জনগণের অনুপস্থিতি ও অবহেলার বিষয়টি এমন একটি ব্যাপার হিসেবে গণ্য যা কবিরা গুনাহগুলোর মধ্যেও সর্ববৃহত গোনাহ। সুতরাং কোনকিছু সংঘটিত হওয়ার পূর্বেই এর নিরাময়ের ব্যবস্থা করা উচিত। তা না হলে পরিস্থিতি সকলের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। আর এটাই প্রকৃত অবস্থা, যা শাসনতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের পর আমরা ও আপনারা সবাই হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করেছি। এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ নিরাময় আর কি হতে পারে যে, একটা জাতি তার উপর অর্পিত সমস্ত কাজকর্ম ইসলামী আইনকানুন ও সংবিধান অনুসারে করবেন, রাষ্ট্রপতি ও মজলিশ সদস্যদের নির্বাচনের ব্যাপারে অনুগত শিক্ষিত সমাজ যাঁরা বর্তমান ঘটনাবলি সম্বন্ধে পরিজ্ঞাত, যাঁরা বিদেশি শক্তির উপর নির্ভরশীল নন এবং তাকওয়া, ইসলাম ও ইসলামী প্রজাতন্ত্রের প্রতি অঙ্গীকারের ব্যাপারে যাঁদের সুনাম রয়েছে এমন সব বুদ্ধিজীবীর সাথে পরামর্শ করবেন, আর খোদাভীরু ও ইসলামী প্রজাতন্ত্রের অনুগত আলেমদের সাথেও পরামর্শ করবেন। এ ব্যাপারে দৃষ্টি দিতে হবে যে, প্রেসিডেন্ট এবং মজলিশ প্রতিনিধিরা যেন এমন সব প্রার্থী থেকে নির্বাচিত হন, যাঁরা সমাজের অসহায় ও নির্যাতিত জনগণের প্রতি কৃত যুলুমকে উপলব্ধি করেছেন, আর যাঁরা জমিদার এবং অভিজাত শ্রেণির কথা চিন্তা না করে দরিদ্র জনসাধারণের কল্যাণের ব্যাপারে সচেতন। কারণ, সেই পুঁজিবাদী জমিদার ও অভিজাতরা তো ইন্দ্রিয়াসক্তিতেই মশগুল, তারা তো বঞ্চনার তিক্ততা, ক্ষুধা ও নগ্নপদীদের কষ্ট-বেদনা সম্পর্কে মোটেই অবহিত নয়।

আমাদের স্মরণ রাখা উচিত, যদি রাষ্ট্রপতি ও মজলিশ প্রতিনিধিবৃন্দ যোগ্য, ইসলামের প্রতি নিষ্ঠাবান এবং দেশ ও জাতির প্রতি সহানুভূতিশীল হন, তাহলে অনেক সমস্যাই আমাদের সামনে থাকবে না, আর থাকলেও তা খুব সহজেই সমাধান হয়ে যাবে। সেই একই বিবেচনায় ‘বিশেষজ্ঞদের’ নির্বাচনের বেলায়ও বিশেষভাবে দৃষ্টি দেয়া উচিত। কারণ, তাঁরা নেতা বা নেতৃপরিষদ গঠনের দায়িত্বে নিয়োজিত। যদি এই সকল জননির্বাচিত বিশেষজ্ঞ অত্যন্ত সতর্কতার সাথে সমসাময়িক মহামান্য মারজা ও সারা দেশের শ্রেষ্ঠ আলেম, দ্বীনী ব্যক্তিত্ব ও নিষ্ঠাবান জ্ঞানী ব্যক্তিদের সাথে পরামর্শ করে সংসদে প্রবেশ করেন, তাহলে নেতা অথবা নেতৃপরিষদ নির্ধারণের জন্য সবচেয়ে যোগ্য ও নিষ্ঠাবান ব্যক্তিদের নির্বাচনের কারণে অনেক সমস্যাই আর সামনে উপস্থিত হবে না, আর সমস্যা থাকলেও তা খুবই যোগ্যতার সাথে সমাধান করা সম্ভব হবে। শাসনতন্ত্রের ১০৯ এবং ১১০ অনুচ্ছেদে বিশেষজ্ঞ নির্বাচনের ক্ষেত্রে জনগণের গুরুদায়িত্বের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আর পর্যায়ক্রমে নেতা বা নেতৃপরিষদ নির্বাচনের ব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের কথা বলা হয়েছে। এ ধারা দু’টিতে একটি কথা পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, নির্বাচনের ব্যাপারে সামান্যতম অবহেলা বা অমনোযোগিতাও ইসলাম ও ইসলামী প্রজাতন্ত্রের বিরাট ক্ষতি সাধন করতে পারে। এটা একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা তাঁদেরকে তাঁদের প্রতি অর্পিত খোদায়ী দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।

এ যামানার রাহবার বা নেতৃপরিষদের প্রতি আমার অসিয়ত যে, এ যামানাটি হলো ইসলামী প্রজাতন্ত্রের বিরুদ্ধে দেশের ভেতর ও বাইরে পরাশক্তি ও তাদের দোসরদের আগ্রাসনের যামানা, যদিও ইসলামী প্রজাতন্ত্রের নামে (প্রকৃতপক্ষে তা ইসলামেরই বিরুদ্ধে)। পরবর্তী সকল যুগের নেতা এবং নেতৃপরিষদের প্রতি আমার সবিশেষ উপদেশ, তাঁরা যেন ইসলাম, ইসলামী প্রজতন্ত্র এবং বঞ্চিত ও নির্যাতিত জনগণের খেদমতে নিজেদেরকে ওয়াক্ফ করে দেন। তাঁরা যেন এটা মনে না করেন যে, নেতৃত্ব জিনিসটা নিজেই তাঁদের জন্য একটা পুরস্কার, মর্যাদাপূর্ণ পদ; বরং এটা হচ্ছে বিপজ্জনক একটি গুরুভার। এক্ষেত্রে যদি সামান্যতম ত্রুটিও হয় আর খোদা না করুন, সেটা যদি প্রবৃত্তির তাড়নায় হয়ে থাকে তাহলে তা এ দুনিয়ায় বয়ে নিয়ে আসবে এক অনন্ত লাঞ্ছনা এবং পরকালে রয়েছে পরম পরাক্রমশালী আল্লাহ তাআলার ক্রোধের অগ্নিশিখা।

রাহমানুর রাহীম সর্বশক্তিমান আল্লাহ তাআলার কাছে আমার আকুল প্রার্থনা, তিনি যেন আপনাদেরকে ও আমাকে বিপদসঙ্কুল এই মহাপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার তওফিক দান করেন এবং মৃত্যুর পর তাঁর মহান দরবারে আমাদেরকে আশ্রয় দিয়ে নাজাতের সুবন্দোবস্ত করেন। প্রেসিডেন্ট, সরকার এবং দায়িত্বমাফিক নিচু স্তরের গণকর্মচারীদের বর্তমান ও ভবিষ্যতে এ বিপদ কিছুটা কম। তাঁরাও আজ বা আগামীকাল কর্তব্য পালনে অক্ষমতার গভীর খাদে নিমজ্জিত হতে পারেন। এই কারণে তাঁদের উচিত সর্বদা মহাপ্রভু আল্লাহর উপস্থিতি ও দৃষ্টির কথা স্মরণ রাখা এবং নিজেদেরকে আল্লাহর সামনে হাজির বলে বিশ্বাস করা। আল্লাহ আপনাদের চলার পথকে সুগম করে দিন।

জ. বিচারব্যবস্থা হলো সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা জনগণের জান-মাল ও ইজ্জতের সাথে জড়িত। নেতা বা নেতৃপরিষদের প্রতি আমার অসিয়ত- তাঁরা যেন বিচার বিভাগের সর্বোচ্চ পদে কোন ব্যক্তিকে নিয়োগের বেলায় অভিজ্ঞ, নিষ্ঠাবান, শরিয়তী আইন-কানুন, ইসলাম ও রাজনীতি সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদেরকে নিয়োগ করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করেন। সর্বোচ্চ বিচার পরিষদ (High Judiciary Council) এর প্রতি আমার আবেদন, তাঁরা যেন সাবেক সরকারের আমলের দুঃখজনক ও শোচনীয় বিচারকার্যগুলোকে একান্তভাবে সংশোধনের চেষ্টা করেন। আমার অনুরোধ, সেইসব বিচারককে যেন এই গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে অপসারণ করা হয়- যারা ইসলামী ন্যায়বিচারকে অবজ্ঞা করে জনগণের জীবন ও সম্পদ নিয়ে ছিনিমিনি খেলে। আর অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে এই  বিচার বিভাগীয় প্রশাসনের যেন পরিবর্তন সাধন করা হয়, যেন ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে অযোগ্য ও অশিক্ষিত বিচারককের সরিয়ে ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত, যোগ্য ও মনোনীত বিশেষ করে আমাদের সুমহান কোমের দ্বীনী মাদ্রাসার মনোনীত ব্যক্তিদের নিয়োগ করা হয়। যাতে রাহমানুর রাহীম আল্লাহ তাআলার রহমতে সারা দেশে ইসলামী ন্যায়বিচার সুপ্রতিষ্ঠিত হতে পারে।

চৌদ্দ মাসুমীন (১৪ জন সম্মানিত নিষ্পাপ ব্যক্তিত্ব) সম্পর্কিত হাদীসের কথা স্মরণ করে বিচারকদের গুরুত্ব এবং দ-বিধিসমূহের নিদারুণ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এই শেষ অসিয়তের মাধ্যমে বর্তমান ও ভবিষ্যতের সম্মানিত বিচারকদের প্রতি আমার সনির্বন্ধ অনুরোধ- তাঁরা যেন যথাযথ ওয়াদাসহকারে এই পবিত্র দায়িত্বভার গ্রহণ করেন এবং অনুপযুক্ত ব্যক্তি কর্তৃক বিচার বিভাগীয় পদ গ্রহণকে বাধা দেন, যোগ্য ব্যক্তিদের পরামর্শ প্রদান করেন এবং যেন বিচার কাজের দায়িত্বভার গ্রহণের আমন্ত্রণকে প্রত্যাখান না করেন। তাঁদের জানতে দেন যে, এই পদের ঝুঁকি যেমন বেশি, তেমনি এর জন্য খোদায়ী প্রতিদানও বেশি। আর এটাও জানিয়ে দেন যে, উপযুক্ত ব্যক্তিদের এই কাজে অংশগ্রহণ একটা দ্বীনী দায়িত্ব।

ঝ. আমাদের দ্বীনী শিক্ষালাভের ব্যাপারে আমার এই অসিয়ত ও নির্দেশনামার মাধ্যমে আমার কিছু কথার পুনরাবৃত্তির তাকিদ অনুভব করছি। যেমন আমাদের এই যুগ ইসলাম ও ইসলামী প্রজাতন্ত্র বিরোধীদের ততপরতার দ্বারা চিহ্নিত। তারা চায় শয়তানি চক্রান্তের মাধ্যমে এই দ্বীনী শিক্ষালয়গুলোতে পথভ্রষ্ট দুষ্টলোকদের ঢুকিয়ে ইসলামের ধ্বংস সাধন করতে। তাদের তাতক্ষণিক কৌশল হলো তাদের অসদাচরণ ও পথভ্রষ্ট নিয়মনীতির মাধ্যমে দ্বীনী প্রতিষ্ঠানগুলোর বদনাম ছড়িয়ে দেয়া। এর দীর্ঘমেয়াদি ও গুরুতর ফল হবে উচ্চতর পদে এক বা একাধিক ভণ্ড-প্রতারকের অনুপ্রবেশ। তারা নিজেদের ভণ্ড ইসলামী জ্ঞানবিজ্ঞানের পাণ্ডিত্য জাহির করে সরলমতি জনগণের মন জয় করে এবং সুযোগ বুঝে প্রিয় ইসলাম, দ্বীনী শিক্ষালয়সমূহ ও আমাদের দেশের উপর মরণাঘাত হানে।

আমরা জানি, অন্যান্য দেশে মহা শোষক বিশ্ব-লুটেরাদের বিভন্ন ধরনের দালাল-গুপ্তচর রয়েছে। এ চরদের মধ্যে থাকে জাতীয়তাবাদী, ভ- বুদ্ধিজীবী এবং পাগড়িধারী মোনাফেকের দল। এই শেষোক্ত দলটিই সবচেয়ে মারাত্মক হয়ে ওঠে। অনেক সময় তারা জনগণের সাথে তিরিশ বা চল্লিশ বছর পর্যন্ত বসবাস করে আপাত ইসলামী একজন মৌলভী, একজন পবিত্র বুজুর্গ ব্যক্তির ছদ্মবেশে। এই মোনাফেকেরা ‘প্যান ইরানবাদের’ মুখোশ পরে কিংবা দেশপ্রেমিক সেজে জনগণের চোখে ধুলো দেয়। এড়িয়ে যাবার সম্ভাব্য সবরকম কৌশল ব্যবহার করে এরা সুযোগ বুঝে সমাজের বুকে তাদের মারাত্মক আঘাত হানে। ইসলামী বিপ্লব প্রতিষ্ঠার পর অত্যন্ত অল্প সময়ের মধ্যেই আমাদের প্রিয় জাতি এই রকম বহু লোকজন দেখেছে। এদের অন্যতম হলো মুজাহিদিন খাল্ক (MKO), ফেদাইনে খাল্‌ক, তুদেহ পার্টি এবং আরো অন্যান্য সংগঠন। এই ধরনের চক্রান্তসমূহকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বানচাল করে দেয়া আমাদের সকলের জন্য জরুরি। তবে সবচেয়ে দরকারি বিষয় হচ্ছে আমাদের দ্বীনী শিক্ষালয়সমূহ। আমাদের সম্মানিত শিক্ষক ও অভিজ্ঞ আলেমগণের যৌথ প্রচেষ্টার সাহায্যে এবং যামানার মারজাদের অনুমোদন নিয়ে দ্বীনী শিক্ষালয়গুলোতে অবশ্যই শুদ্ধি অভিযান চালাতে হবে। ‘বিশৃঙ্খলার’ মাঝে ‘শৃঙ্খলা’ কথাটা সম্ভবত একই চক্রান্তকারীদের একটা তথাকথিত শিক্ষা তত্ত্ববিশেষ। যাই হোক, আমার অসিয়ত হলো সব যুগের বিশেষ করে এ যুগের দুশমনদের নানা চক্রান্ত ও পরিকল্পনার কারণে আমাদের দ্বীনী মাদ্রাসাগুলোতে একটা লক্ষ্যভেদী অভিযান চালানো দরকার। যাতে সেই আঘাতের কারণে একটা কার্যকরী পদ্ধতি চালু হয়ে যায়। আর এটাও প্রয়োজনীয় যে, আমাদের শ্রদ্ধেয় দ্বীনী শিক্ষকগণ এই কাজের সহায়তায় নিজেদের সময় ও প্রচেষ্টা নিয়োজিত করবেন। আর তাঁরা যেন সঠিক সূক্ষ্ম কর্মসূচির মাধ্যমে আমাদের দ্বীনী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বিশেষ করে কোমের দ্বীনী মাদ্রাসাসমূহ ও অন্যান্য বড় বড় হাওযায়ে ইলমিয়াকে (মাদ্রাসা-শিক্ষাকেন্দ্র) শয়তানি চক্রান্ত থেকে রক্ষা করেন। আলেম এবং দ্বীনী শিক্ষকদের উপর এটা একটা অর্পিত দায়িত্ব যে, তাঁরা ফিকাহ্গত ক্লাসসমূহে প্রধান প্রধান বিষয়ের প্রতি সতর্ক নযর রাখবেন, যেন কোন পরিবর্তন ছাড়াই ওগুলোর প্রয়োগ হয়। কারণ, ফিকাহ্র এসব নীতি বিখ্যাত সব ফকীহর মাধ্যমে আমাদের কাছে এসেছে। আর এটাই ইসলামী আইনশাস্ত্রের (ফিকাহ্) হেফাযতের পথ। প্রতিদিন তাঁদের আলোচনা-পর্যালোচনা, নতুন মতামত ও গবেষণাতে তাঁরা যেন সর্তকতার মাত্রা আরো বাড়িয়ে দেন। ঐতিহ্যময় ফিকাহ্শাস্ত্র আমাদের সম্মানিত পূর্বসূরিদের আমানত যা থেকে বিচ্যুতি মানে গবেষণা ও অনুসন্ধান ত্রুটিযুক্ত হয়ে পড়া। তাকে হেফাযত করা ও গবেষণার মাত্রা বাড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করুন। অবশ্য দেশ ও ইসলামের প্রয়োজন অনুযায়ী জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখা-প্রশাখা ও পরিকল্পনা প্রণয়ন হতে হবে এবং ঐসব শাখায়ও লোকদেরকে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। সর্ববৃহত ও সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্তব্য হলো ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার মাধ্যমে শিক্ষা-দীক্ষার কাজ চালিয়ে যাওয়া। কিন্তু মানবশিক্ষা পরিসরের সবচেয়ে মহিমান্বিত ক্ষেত্র হচ্ছে ইসলামের নৈতিক-আধ্যত্মিক জ্ঞান (রুহানীয়াত), যেমন নীতিবিজ্ঞানসমূহ (ইলমে আখলাক), আত্মিক পরিশুদ্ধতা এবং সেই মহান আল্লাহর (যিনি আমাদের সবার রিযিকদাতা) নৈকট্য লাভের সাধনা- যা ‘জিহাদে আকবর’ বা ‘শেষ্ঠ জিহাদ’ হিসেবে পরিগণিত।

ঞ. সরকারের নির্বাহী বিভাগকে সংস্কার, পরিশুদ্ধ এবং সুরক্ষিত করার প্রয়োজন রয়েছে। মাঝে মাঝে এমন হয় যে, আপাতঃদৃষ্টিতে ন্যায়সঙ্গত বিলগুলো পাশ করল, অভিভাবক পরিষদ কর্তৃক তা অনুমোদনও লাভ করল, তারপর সেগুলো কার্যে পরিণত করার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদের মাধ্যমে দায়িত্বশীল প্রশাসকের নিকট প্রেরিত হলো। কিন্তু এই প্রশাসক শ্রেণির হাতে আইন তার মর্যাদা হারিয়ে ফেলে। এসবের প্রয়োগ সেই প্রথাগত লালফিতা ও আমলাতন্ত্রের শৃঙ্খলে বন্দি হয়ে পড়ে। এভাবে ন্যায় বিচারের গতিরোধ করা হয় এবং জনগণের মাঝে অস্থিরতা ও অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। তারা ক্রমেই বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।

বর্তমানকালের দায়িত্বশীল মন্ত্রীবর্গ এবং তাঁদের ভবিষ্যত উত্তরসূরিদের প্রতি আমার পরামর্শ- আপনারা এবং মন্ত্রণালয়ের কর্মচারীবৃন্দ যে বেতন নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন তা তো জনগণের সম্পদ থেকেই আসে। কাজেই আপনাদের সকলেরই উচিত জনগণ, বিশেষ করে মযলুম জনতার সেবা করা। অহেতুক জনগণকে অসুবিধায় ফেলা আর নিজের উপর অর্পিত দায়িত্বের বিরুদ্ধে কাজ করা সম্পূর্ণ নিষেধ- এটা একটা হারাম কাজ। খোদা না করুন, এই কারণে অনেক সময় আল্লাহর গজবও নাযিল হতে পারে ।

আপনাদের সবারই জাতির সমর্থন প্রয়োজন রয়েছে। ইসলামী বিপ্লবের বিজয়ের জন্য জনগণের সমর্থনের কাছে আমরা ঋণী। বিশেষ করে জনতার সমর্থনের প্রতি। তাঁদের কাছে এজন্যও আমরা ঋণী যে, তাঁরা আমাদের দেশ ও সম্পদকে স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের শোষণের হাত থেকে রক্ষা করেছেন। যদি আপনারা জনসমর্থন থেকে বঞ্চিত হন তাহলে তাঁরাই আপনাদের অপসারিত করবেন এবং যালেম শাহের আমলের মতো যুলুমবাজ লোকেরা আপনাদের সম্পদগুলো দখল করে ফেলবে। কাজেই এই বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে আপনাদের উচিত যথাসাধ্য প্রচেষ্টার মাধ্যমে জনগণের মন জয় করা এবং অনৈসলামী আচরণগুলো পরিহার করা।

একই দৃষ্টিকোণ থেকে ভবিষ্যতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রিগণের প্রতি আমার অসিয়ত যে, অত্যন্ত সতর্কতার সাথে প্রাদেশিক গর্ভনর নিয়োগ করবেন। এ পদে যোগ্য, দ্বীনীদার, নিষ্ঠাবান, সুস্থ বিচার বুদ্ধিসম্পন্ন এবং জনগণের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে সক্ষম  লোকদের নিয়োগ করবেন যাতে দেশে যত বেশি সম্ভব শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় থাকে। আপনাদের মনে রাখতে হবে, যদিও সকল মন্ত্রী ইসলামী অনুশাসনের ভিত্তিতে নিজ নিজ মন্ত্রণালয়ের অধীন সমস্ত প্রশাসনিক ব্যাপারে দায়িত্বশীল, তবুও কারো কারো উপর কিছুটা বেশি দায়িত্ব রয়েছে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এটা বিদেশে আমাদের দূতাবাসগুলোর পরিচালনায় নিয়োজিত। ইসলামী বিপ্লবের শুরুতেই মন্ত্রণালয়গুলোতে বিরাজমান তাণ্ডবি মনোবৃত্তি সম্পর্কে আমি ধারাবাহিক কিছু পরামর্শ রেখেছিলাম। কিন্তু সরকারের কতিপয় মন্ত্রী তাঁদের মন্ত্রণালয়কে এ আলোকে সংস্কার করতে অস্বীকৃতি জানান। আবারো অনেক চেষ্টা করেও সে কাজে সফল হতে পারেন নি। আজ ইসলামী বিপ্লবের তিন বছর  পর এই সংস্কারের লক্ষ্যে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। আমি আশা করি, এসকল গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনা যথাসময়ে নিরলস প্রচেষ্টার মাধ্যমে সাফল্যমণ্ডিত হবে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং তার ভবিষ্যত পদাধিকারদের প্রতি আমার অসিয়ত, আপনারা একটি গুরুদায়িত্ব কাঁধে নিয়েছেন। আপনাদেরকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এবং বিদেশে আমাদের দূতাবাসগুলোর সংস্কার সাধন করতে হবে। আমাদের পররাষ্ট্রনীতিকে ঢেলে সাজাতে হবে। জাতির স্বাধীনতা ও স্বার্থকে সংরক্ষণ করতে হবে। অন্যান্য রাষ্ট্রের মধ্যে যারা আমাদের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে না তাদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। যে কোন ধরনের পরনির্ভরশীলতার দোষে দুষ্ট ক্রিয়াকলাপ আপনাদেরকে পরিহার করে চলতে হবে।

মনে রাখবেন, অনেক ক্ষেত্রে বিদেশের উপর নির্ভরশীলতাকে সঠিক এবং প্রয়োজনীয় বলে প্রতীয়মান হয়, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা ক্ষণস্থায়ী এবং  শেষ পর্যন্ত এটা দেশের ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মুসলিম জাতিগুলোর সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করুন। অন্যান্য মুসলিম দেশের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের জাগিয়ে তোলার জন্য ঐক্য ও সংহতির প্রতি তাদেরকে আহ্বান জানান। এটা নিশ্চিত যে, সর্বশক্তিমান আল্লাহ তাআলা আপনাদের সহায় হবেন।

মুসলিম জাতিগুলোর প্রতি আমার অসিয়ত- তাঁরা যেন নিজেদের লক্ষ্যে পৌঁছতে তথা ইসলাম ও ইসলামী অনুশাসন বাস্তবায়নের উপায় হিসেবে কখনো বাইরের সাহায্যের প্রত্যাশা না করেন। এই জীবন সঞ্জীবনী কাজে আপনাদের নিজদেরকেই জেগে ওঠা উচিত, যা আপনাদের স্বাধীনতা ও মুক্তির নিশ্চয়তা বিধান করবে।

সুতরাং মুসলিম রাষ্ট্রের আলেম ও ওয়ায়েজগণের কর্তব্য হলো তাঁদের সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো, তাঁরা যেন বৈদেশিক শক্তিগুলোর উপর নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসেন এবং দেশের জনগণের সাথে ঐক্যে উপনীত হন। এর মধ্যে তাঁদের জন্য সাফল্য নিহিত রয়েছে। ঐক্য প্রতিষ্ঠা ও ইসলামবিরোধী বর্ণপ্রথার বিলোপ সাধনের জন্য আলেম ও ওয়ায়েজগণ আহ্বান করুন। তাঁরা যেন বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সকল বিশ্বাসী ভাইয়ের সাথে হাত মেলান। কারণ, ইসলামের জন্য তাঁরা পরস্পরের ভাই।

যখন ভ্রাতৃত্ববোধের চেতনা একবার সকল মুসলিম সরকার ও জনগণের মাঝে বাস্তবে রূপলাভ করবে তখন আপনারাই দেখবেন, মুসলমানরাই দুনিয়ার বুকে সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। ইন শাআল্লাহ একদিন আমরা মুসলিম জাতিগুলোর মধ্যে এই ধরনের ভ্রাতৃত্ববোধ ও সাম্য স্বচক্ষে দেখার সৌভাগ্য লাভ করব, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

বর্তমান ও আগামীদিনের ইসলামী নির্দেশনা মন্ত্রণালয়ের প্রতি আমার পরামর্শ, তাঁরা যেন মিথ্যার বিরুদ্ধে সত্যের প্রসারে যথাসাধ্য সচেষ্ট হন এবং ইসলামী প্রজাতন্ত্রের সত্যিকার রূপকে জনসমক্ষে তুলে ধরেন। এখন আমরা যেহেতু আমাদের দেশ থেকে বৃহত শক্তিগুলোকে বিতাড়িত করেছি, তাই আজ আমরা বৃহত শক্তিগুলোর মদদপুষ্ট সকল প্রচারমাধ্যমের অপপ্রচারের শিকারে পরিণত হয়েছি। বৃহত শক্তিগুলোর লেজুড়বৃত্তিকারী লেখক ও মুখপাত্ররা সদ্য প্রস্ফুটিত এই ইসলামী প্রজাতন্ত্রের বিরুদ্ধে যে কোন ধরনের মিথ্যা অপবাদও দিতে কুণ্ঠাবোধ করে না। অধিকতর পরিতাপের বিষয় এ এলাকার (ইমাম এখানে পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলোকে বুঝাচ্ছেন) অধিকাংশ মুসলিম সরকারই আমাদের ও ইসলামের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। অথচ ইসলামী বিধি মোতাবেক তাদের উচিত ছিল আমাদের প্রতি ভ্রাতৃত্বের হাত বাড়িয়ে দেয়া। অথচ তারা সবাই বিশ্বগ্রাসী শয়তানদের সেবায় মগ্ন। তাই চতুর্দিক থেকে তারা আমাদের উপর হামলা চালাচ্ছে। এর মোকাবেলায় আমাদের প্রচারণাশক্তি খুবই দুর্বল এবং অপারগ।

আপনারা ভালো করেই জানেন, বর্তমান দুনিয়া প্রচারণার ঘূর্ণাবর্তেই হচ্ছে। অত্যন্ত দুঃখজনক ব্যাপার এই যে, দুই পরাশক্তির যে কোন একটির প্রতি আকৃষ্ট তথাকথিত বুদ্ধিজীবী লেখকগণ দেশ ও জাতির স্বাধীনতা ও মুক্তির কথা চিন্তা করার পরিবর্তে পরাশক্তির স্বার্থপরতা, সুবিধাবাদ ও একচেটিয়া আধিপত্যের জালে আবদ্ধ হয়ে পড়েছেন । আর এ কাজ তাঁদেরকে দেশ ও জাতির কোন মঙ্গলের কথা চিন্তা করতে দিচ্ছে না। তাঁরা সাবেক যালেমশাহীর প্রশাসন-প্রকৃতির সাথে বর্তমান ইসলামী প্রজাতন্ত্রের স্বাধীনতা ও মুক্তির অবস্থাটি তুলনা করতে অক্ষম।

বর্তমান ইসলামী রাষ্ট্রের নিছক বস্তুগত প্রাচুর্য ও মাত্রাতিরিক্ত আরাম-আয়েশ না থাকলেও তাঁরা যে সম্মানিত জীবন যাপন করছেন তা অতীতের স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের আমলে কখনো করতে পারতেন না। তখন তো তাঁরা ঘৃণ্য আনুগত্য ও গোলামির মাধ্যমে বিভিন্ন প্রকার দুর্নীতির আখড়া, স্বৈরাচারের উৎস এবং বেশ্যাবৃত্তির প্রশংসা করে সেগুলোকে উদ্দীপ্ত করার কাজে ব্যস্ত থাকতেন। (উপরে বর্ণিত এই জঘন্য প্রকৃতির লেখকদের প্রতি ইমামের আহ্বান) তাঁরা যেন এই সদ্যপ্রসূত ইসলামী প্রজাতন্ত্রের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা ও অন্যায় অভিযোগ উত্থাপন থেকে বিরত থাকেন এবং জনগণ ও সরকারের সাথে একই কাতারে মিশে বিশ্বব্যাপী সকল যালেম ও তাগুতের বিরুদ্ধে তাঁদের কথা ও লেখনিকে কাজে লাগান।

প্রচারের দায়িত্ব কেবল ইসলামী নির্দেশনা মন্ত্রণালয়ের একারই নয়; বরং সকল জ্ঞানী-গুণী, বক্তা, লেখক, শিল্পীরও দায়িত্ব। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চেষ্টা করা উচিত যাতে দূতাবাসসমূহ প্রচারমূলক সাময়িকী সংরক্ষণ করে এবং ইসলামের জ্যোতির্ময় চেহারাকে বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরে। কোরআন ও সুন্নাহ ইসলামের যে সকল জ্যোতির্ময়  দিকের প্রতি মানুষকে আহ্বান জানিয়েছে তার সে জ্যোতির্ময় চেহারার উপর থেকে যদি ইসলামবিরোধীদের ও বিচ্যুত চিন্তার অধিকারী বন্ধুদের দ্বারা সৃষ্ট অবগুণ্ঠন সরিয়ে দেয়া যায়, তাহলে তা ইসলামের বিশ্বজনীন রূপকেই প্রকাশ করবে এবং তার গৌরবময় পতাকা সর্বত্র উড্ডীন হবে। বড়ই মুছিবত ও দুঃখজনক অবস্থা যে, মুসলমানদের অধিকারে অদ্বিতীয় ও অমূল্য এক রত্ম (ইসলামী আদর্শ, মানুষ স্বাভাবিকভাবে যে আর্দশের প্রয়োজন অনুভব করে) থাকা সত্ত্বেও তারা অন্যদের তা উপহার দিতে শুধু ব্যর্থ হয়নি, বরং একে বিস্মৃতির অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে। এর গুরুত্ব সম্পর্কে তারা অজ্ঞ এবং অনেক সময় তারা এই কাজ থেকে পালিয়ে থাকে।

ট. আর একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও ভাগ্যনির্ধারক বিষয় হলো বিদ্যালয় থেকে শুরু করে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সকল শ্রেণির প্রতিষ্ঠানের অবস্থা। যার অপরিসীম গুরুত্বের কারণে এ সম্পর্কে আমি সংক্ষিপ্তকারে পুনরায় কিছু কথা বলতে চাই। ইরানী জাতির অবশ্যই জানা থাকা উচিত যে, বিগত পঞ্চাশ বছরে ইরান এবং ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কাছ থেকে যত মারাত্মক আঘাত পেয়েছে অন্য কিছু হতে ততটা পায়নি। যদি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দেশীয় স্বার্থের সাথে সংগতিপূর্ণ ইসলামী ও জাতীয় পাঠ্যক্রমের মাধ্যমে শিশু, নওজোয়ান ও যুবকদের শিক্ষা-দীক্ষা ও মানসিক পরিশুদ্ধির কাজে ব্যস্ত থাকত তাহলে আমাদের দেশ ইংল্যান্ড এবং পরে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃক কখনো কুক্ষিগত হতো না। সেক্ষেত্রে কখনও ধ্বংসাত্মক চুক্তিসমূহ আমাদের এই মযলুম ও লুণ্ঠিত জাতির ঘাড়ে চাপানো যেত না; বিদেশি উপদেষ্টারা কখনো ইরানে আসার পথ খুঁজে পেত না; কষ্টভোগী এই জাতির সম্পদ ও কালো সোনা (তেল) কখনো বিশ্ব শয়তানি শক্তিগুলোর পকেটস্থ হতো না। পাহলভী বংশ এবং তার চেলা-চামুণ্ডারা কখনো জনগণের ধনদৌলত হরণ করে তা দিয়ে দেশের ভেতরে-বাইরে নির্যাতিত জনগণেরই কবরের উপর বিলাসী প্রাসাদ তৈরী করার সুযোগ পেত না । মযলুম জনতার কষ্টার্জিত অর্থসম্পদ দিয়ে বিদেশি ব্যাংকগুলোর উদর পূর্তি করতে এবং নানা প্রকার ইবলিসি আমোদ-প্রমোদ এবং নিজের ও তার আত্মীয়-স্বজনদের লাম্পট্যের পেছনে অর্থকড়ি ব্যয় করতেও পারত না।

যদি আমাদের মজলিশ, মন্ত্রীসভা, বিচারবিভাগ এবং অন্য সংগঠনগুলোকে ইসলামী ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষিত লোকদের দ্বারা পূর্ণ করা যেত, তাহলে আজ আমাদের জাতিকে এই ধরনের ধ্বংসাত্মক সম্যস্যাবলির মোকাবেলা করতে হতো না। যদি চরিত্রবান, ইসলাম ও খাঁটি জাতীয়তাবাদের প্রতি আকৃষ্ট (সেই জাতীয়তাবাদ নয় যা আজকের যুগে ইসলামের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়) ব্যক্তিবর্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসে সরকারের তিনটি বিভাগে নিজেদের পদচারণা করত তাহলে আজ অবস্থা অন্যরকম হতো। আজ আমরা একটা আলাদা জাতিকে দেখতে পেতাম। আমাদের বঞ্চিত জনগণ আজ বঞ্চনার বন্দিত্ব থেকে নিজেরা মুক্ত হয়ে আসত এবং স্বৈরাচারী রাজতন্ত্র, বেশ্যাবৃত্তি, নেশাগ্রস্ততা এবং অন্যান্য দুষ্কর্মের সামান্যতম নির্দশনও সমাজ থেকে নির্মূল করে ফেলত। এসব দূষিত প্রভাবের প্রতিটিই এককভাবে আমাদের মূল্যবান কর্মক্ষম যুবশক্তিকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যেতে যথেষ্ট। আর পরিস্থিতি যদি অন্যরকম হতো তাহলে আজ আমাদের জনগণ আত্মবিনাশী এবং জাতীয়ভাবে ধ্বংসাত্মক উত্তরসূরিতে পরিণত হতো না। যদি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ইসলামী আদর্শ, মানবীয় মূল্যবোধ এবং জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হতো তাহলে তারা এই সমাজকে হাজার হাজার শিক্ষাবিদ উপহার দিতে পারত। কিন্তু এটা দুঃখজনক ও পরিতাপের ব্যাপার যে, আমাদের স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তত্ত্বাবধানে এবং আমাদের ছেলেমেয়েদের শিক্ষা-দীক্ষার কাজে (কতিপয় নির্যাতিত সংখ্যালঘু ছাড়া) এমনসব লোকজন নিয়োজিত ছিল, যাদের সবাই ছিল পাশ্চাত্য কিংবা প্রাচ্যপন্থী এবং সুপরিকল্পিতভাবে পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের দিকনির্দেশনার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তাদের আসন বজায় রাখত। আর কোন বিকল্প না থাকায় আমাদের যুবসমাজ পরাশক্তির উপর নির্ভরশীল নেকড়েগুলোর বদ-সংসর্গে লালিত হয়েছিল। তারা আইনসভা, সরকার ও বিচারবিভাগের বিভিন্ন পদলোভী হয়ে স্বৈরাচারী পাহলভী শাসনের নির্দেশমতো কাজ করত।

রাহমানুর রাহীম আল্লাহ তাআলার শোকর, এখন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দুর্নীতিবাজদের থাবামুক্ত হয়েছে। সর্বযুগে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সরকার ও জনগণের উপর অর্পিত একটা দায়িত্ব হলো, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভ্রষ্ট নষ্ট মতবাদ ও দুই পরাশক্তির মতাদর্শের অনুপ্রবেশকে বাধা দেয়া। প্রথমেই যেন তাদেরকে বাধা দেয়া হয়, যাতে কোন অসুবিধার সম্মুখীন হতে না হয় এবং পরিস্থিতি হাতের মুঠোর বাইরে চলে না যায়। মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিয় যুবকদের প্রতি আমার অসিয়ত- তাঁরা যেন তাঁদের নিজেদের এবং দেশ ও জাতির মুক্তি ও স্বাধীনতা রক্ষার্থে নিজেরাই সাহসের সাথে এই সমস্ত ভ্রষ্টতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান।

ঠ. দেশের সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে সেনাবাহিনী, বিপ্লবী রক্ষীবাহিনীসহ (সশস্ত্র পুলিশ) রাষ্ট্রীয় পুলিশ, বিপ্লবী কমিটিসমূহ, বসিজ (গণবাহিনী) এবং উপজাতীয়রা। তাঁরা ইসলামী প্রজাতন্ত্রের শক্তিশালী বাহু এবং দেশের সীমান্ত এলাকা, সড়ক, শহর, নগর ও গ্রামসহ সর্বত্র নিরাপত্তা বিধান করে জাতির অন্তরে স্বস্তির পরশ বুলিয়ে দেন। এদেরকেও মজলিশের সামনে এক মর্যাদাপূর্ণ স্থানে সমাসীন করানো উচিত। তাদের (সরকার ও জনগণের) সকলেরই খেয়াল রাখা দরকার যে, বৃহত শক্তিগুলো ও তাদের ধ্বংসাত্মক রাজনীতি অন্য দেশের সেনাবাহিনীকে অন্য যে কোন গোষ্ঠী বা সংস্থার তুলনায় বেশি ব্যবহার করতে চায়। সশস্ত্রবাহিনীই তো রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার মাধ্যমে অভ্যুত্থান ঘটায় এবং সরকার ও প্রশাসনের পরিবর্তন করে থাকে। প্রতারক ও বদমাশ লোকেরা সেনাবাহিনীর প্রধানদের কিনে নিতে চায় এবং সেই স্থানীয় প্রধানদের মাধ্যমে কোন দেশের উপর কর্তৃত্ব লাভ করে। প্রতারিত সেনাপতিদের ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে তারা প্রাধান্য বিস্তার করে এবং মযলুম জনগণের মুক্তি ও স্বাধীনতা হরণ করে নেয়। কিন্তু সেনাপতিগণ যদি ন্যায়পরায়ণ ও সৎ হন তাহলে জাতিসমূহের শত্রুরা অন্য দেশে অভ্যুত্থান ঘটাতে বা তা দখল করতে সক্ষম হবে না। আর যদি এরকম কোন ঘটনা ঘটেই যায় তাহলে সেসব দেশের নিবেদিতপ্রাণ সেনাপতিরা তাদের ঘৃণ্য প্রত্যাশাকে নিরাশার ডাস্টবিনে নিক্ষেপ করতে সক্ষম হবেন।

ইরানেও- যেখানে জনগণের দ্বারা যুগান্তকারী এক অলৌকিক ঘটনা (ইসলামী বিপ্লব) সংঘটিত হয়েছে সেখানেও নিষ্ঠাবান সশস্ত্রবাহিনী এবং চরিত্রবান ও দেশপ্রেমিক সেনানায়কদের ছিল এক বিরাট ভূমিকা। আজ সাদ্দাম আমাদের উপর যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য বিশ্বশক্তির নির্দেশে এক অভিশপ্ত যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে। এ যুদ্ধ শুরু হবার দু’বছর পরে আজ ইরাকের বাথপন্থী সেনাবাহিনীর জন্য এসেছে রাজনৈতিক ও সামাজিক পরাজয়। এটা আমাদের জন্য একটা বিজয় যা আমাদের সশস্ত্র বাহিনী, বিপ্লবী রক্ষীবাহিনী (সেপাহ পাসদারান), গণবাহিনী ও জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থন দানের ফলে অর্জিত হয়েছে এবং যুদ্ধের ময়দানে ও তার বাইরে সর্বসাধারণের অমূল্য অবদানের মাধ্যমে সম্ভব হয়েছে। এরাই তো সেই জনগণ যাঁরা ইরানকে মহা গৌরবান্বিত করেছেন, যাঁরা বিশ্বে ইরানের খ্যাতি ছড়িয়েছেন। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য শিবিরভুক্ত দেশগুলোর চেলা-চামুণ্ডারা দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন ধরনের ষড়যন্ত্র ও নাশকতামূলক কার্যকলাপ সংঘটনের মাধ্যমেও ইসলামী প্রজাতন্ত্রের মূলোৎপাটনে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু বিপ্লবী কমিটি, রক্ষীগার্ড, গণবাহিনী, পুলিশবাহিনীর শক্তিশালী যুবকদের দৃঢ় পদক্ষেপের মাধ্যমে আর সাহসী জনগণের সাহায্যে এ সমস্ত ষড়যন্ত্রকে নস্যাত করা হয়েছে। এরাই সেই প্রিয় উৎসর্গী যুবক, যারা তাদের পরিবারসমূহকে নিশ্চিন্তে রাখার জন্য রাত্রি জাগরণ করে। মহান প্রভু তাদের সহায় হোন।

কাজেই আমার জীবনের এই শেষ লগ্নে এসে সশস্ত্র বাহিনীর সকল সদস্যের প্রতি সাধারণভাবে ভ্রাতৃসুলভ অসিয়ত- ‘হে আমার প্রিয় ভাইয়েরা! তোমরা যারা ইসলামকে প্রিয় করে নিয়েছ, জিহাদের ময়দানে তোমাদের জান কুরবান করে দিয়েছ এবং দেশব্যাপী বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজে আত্মনিবেদিত হয়েছ, শুধু আল্লাহর খাতিরে আর পরকালে আল্লাহ পাকের দীদার লাভের উদ্দেশ্যে, তোমরা হুঁশিয়ার! বেঈমানী ও গুপ্তহত্যার শাণিত অস্ত্রের ধার তোমাদের প্রতি উদ্যত। চুতর পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যঘেঁষা রাজনীতিকরা এবং দৃশ্যান্তরালে শয়তানদের গোপন হাত অন্যদের চেয়ে তোমাদের প্রতিই বেশি নিবদ্ধ। তারা তোমাদের ক্ষতিসাধন করতে চায়। কারণ, তোমরাই তো নিজেদের জান কুরবানের মাধ্যমে ইসলামী বিপ্লবের বিজয়কে এগিয়ে নিয়েছ এবং ইসলামকে পুনর্জীবিত করেছ। ওরা ইসলামী প্রজাতন্ত্রকে উপড়ে ফেলতে চায়, জাতির কাছ থেকে তোমাদেরকে বিচ্ছিন্ন করে যে কোন একটা পরাশক্তির খোঁয়াড়ে আবদ্ধ করতে ওরা বদ্ধপরিকর। ইসলাম এবং জাতীয়তাবাদের প্রতি মেকি আনুগত্য দেখিয়ে ওরা রাজনৈতিক চালবাজির সাহায্যে তোমাদের প্রচেষ্টা ও জান কুরবানিকে বানচাল করে দিতে আপ্রাণ চেষ্টায় রত।

জোরালো কণ্ঠে আমি সশস্ত্র বাহিনীর প্রতি অসিয়ত করছি কোন প্রকার রাজনৈতিক দলের সাথে সংশ্রব না রাখতে এবং সকল প্রকার রাজনৈতিক চালবাজি থেকে দূরে থেকে নিজেদের দায়িত্ব ও কর্তব্যে অবিচল থাকতে। এ নির্দেশ নির্বিশেষে সশস্ত্র বাহিনীর সকল বিভাগের প্রতি প্রযোজ্য। যেমন : সাধারণ সৈনিক, নিরাপত্তা বাহিনী, বিপ্লবী রক্ষীগার্ড, গণবাহিনী এবং অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী প্রভৃতি। শুধু এভাবেই তাঁরা তাঁদের সামরিক শক্তি টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হবেন। সেনানায়কদেরও দায়িত্ব রয়েছে, তাঁদের অধীনস্থ সৈনিকদের কোন প্রকার রাজনৈতিক দলের সংশ্রবে যাওয়া থেকে বিরত রাখা।

যেহেতু এই বিপ্লবের হকদার হলো সর্বস্তরের জনগণ, আর তাই এর সংরক্ষণের দায়িত্বও সকলের উপর ন্যস্ত। তাই সরকার, জনগণ, প্রতিরক্ষা পরিষদ এবং ইসলামী পরামর্শ পরিষদ প্রভৃতি সকলেরই এটা একটা শরীয়তী ও জাতীয় দায়িত্ব যে, সশস্ত্র বাহিনী ও এর সেনানায়কদের দ্বারা ইসলাম ও দেশের স্বার্থবিরোধী যে কোন ততপরতার বিরোধিতা করা। সেই সাথে এই খেয়ালও রাখতে হবে তাঁরা যেন কোন প্রকার রাজনৈতিক কর্মকা- কিংবা কোন রাজনৈতিক দলের সাথে জড়িয়ে না পড়েন। কারণ, এগুলো তাঁদের জন্য ধ্বংসই ডেকে আনবে। এসবের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো ইসলামী প্রজাতন্ত্রের নেতা বা নেতৃপরিষদের সকলেরই ঈমানী দায়িত্ব ও কর্তব্য যাতে জাতি অনিষ্ট থেকে রক্ষা পায়। পার্থিব জীবনের শেষ প্রান্তে এসে আমি সব ধরনের সশস্ত্র বাহিনীর প্রতি আন্তরিকতার সাথে অসিয়ত করছি- আপনারা আজকে যেমন একমাত্র স্বাধীনতা ও মুক্তিকামী আদর্শ- যার হেদায়াতের আলোয় আল্লাহ তাআলা সকল মানুষকে মানবতার সবচেয়ে সমুন্নত স্তরে উন্নীত হবার জন্য দাওয়াত করেছেন, সেই ইসলামের প্রতি নিষ্ঠাবান রয়েছেন, সে নিষ্ঠাকে দৃঢ়তর করুন। কেননা, তা আপনাদেরকে এবং আপনাদের দেশ ও জনগণকে লজ্জা, অপমান এবং সেই সব শক্তির- যারা শুধু আপনাদের সবাইকে গোলামে পরিণত করে রাখতে, আপনাদের দেশ ও জনগণকে পশ্চাদপদ রাখতে, তাদের দেশের পণ্যের বাজারে পরিণত করতে অপমানজনক যুলুম সইয়ে নিতে চায়- তাদের তাঁবেদারি থেকে মুক্তি দেবে। দুঃখ-কষ্ট সহকারে হলেও সম্মানজনক জীবনকে জৈবিক পাশবিক আরাম-আয়েশযুক্ত লাঞ্ছিত গোলামির জীবনের উপর অগ্রাধিকার দিন। মনে রাখবেন, উন্নততর শিল্পের প্রয়োজনে যতদিন অন্যদের কাছে হস্ত প্রসারিত করবেন এবং তাদের দুয়ারে ধর্ণা দিবেন ততদিন আপনাদের আবিষ্কার, উদ্ভাবনক্ষমতা বিকশিত হবে না। আপনারা ইতিমধ্যেই অত্যন্ত ভালোভাবে প্রত্যক্ষ করেছেন যে, ইতিপূর্বে যাঁরা কোন কিছু তৈরির ব্যাপারে নিজেদের অক্ষম বলে মনে করতেন এবং কল-কারখানা চালানোর প্রশ্নে হতাশায় নিমজ্জিত থাকতেন তাঁরাই অর্থনৈতিক বয়কটের পর এ সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যেই নিজেদের চিন্তাকে কাজে লাগিয়ে সশস্ত্রবাহিনী ও কল-কারখানাসমূহের বহু প্রয়োজন মিটাতে সক্ষম হয়েছেন। বস্তুত এই যুদ্ধ, অর্থনৈতিক বয়কট ও বিদেশি বিশেষজ্ঞদের বহিষ্কার হচ্ছে এক খোদায়ী উপঢৌকন যে সম্পর্কে আমরা উদাসীন ছিলাম। এখন যদি স্বয়ং সরকার ও  সশস্ত্রবাহিনী বিশ্বগ্রাসীদের উৎপাদিত পণ্য বয়কট করে আর আবিষ্কার, উদ্ভাবনের পেছনে শ্রম সাধনা বৃদ্ধি করে তাহলে আশা করা যায় যে, দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ ও স্বনির্ভর হবে এবং দুশমনদের দ্বারে ধর্ণা দেয়া থেকে পরিত্রাণ পাবে। এখানে আরও কিছু কথা যোগ করছি যে, এতসব কৃত্রিম পশ্চাদপদতা সত্ত্বেও বিদেশি বৃহত শিল্পের প্রতি আমাদের মুখোপেক্ষিতা এক অনস্বীকার্য সত্য । কিন্তু তার মানে এই নয় যে, উন্নততর বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের জন্য আমাদেরকে দুই পরাশক্তির কোন একটির উপর নির্ভর করতে হবে। বরং যেসব দেশ উন্নততর বৃহত শিল্পের অধিকারী অথচ সাম্রাজ্যবাদী শোষক নয়, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের নিষ্ঠাবান ছাত্রদেরকে সেসব দেশে প্রেরণের জন্য সরকার ও সশস্ত্রবাহিনীর সচেষ্ট হওয়া উচিত। কিন্তু আমেরিকা ও রাশিয়া এবং এই শক্তির বলয়ে অবস্থানরত অন্যান্য দেশে প্রেরণকে পরিহার করতে হবে। যতদিন না এই দুইশক্তি ইনশাআল্লাহ স্বীয় ভুল বুঝতে পারে এবং মানবিক, মানবপ্রেমিক ও অন্যদের অধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের ধারা গ্রহণ করে। অথবা বিশ্বের মুস্তাযআফ (নির্যাতিত) জনগণ ও সচেতন, নিষ্ঠাবান মুসলিম জনগোষ্ঠীসমূহ তাদেরকে ইনশাআল্লাহ স্বীয় গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে বাধ্য করতে সক্ষম হয়। সে দিনটারই আমরা প্রত্যাশা করছি।

ড. রেডিও, টেলিভিশন, সংবাদপত্র, সিনেমা ও থিয়েটার বিশ্বের জনগোষ্ঠীর বিশেষ করে যুবসমাজকে ধ্বংস ও অচেতন করার মোক্ষম হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। বিগত শতাব্দীতে বিশেষ করে এর দ্বিতীয়ার্ধ্বে ইসলাম ও জনগণের খাদেম ওলামায়ে কেরামের বিরুদ্ধে এবং প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সাম্রাজ্যবাদীদের পক্ষে প্রচারণার ক্ষেত্রে এসব প্রচারমাধ্যমের দ্বারা বিরাট ভূমিকা পালন করানো হয়েছে। পণ্যের বাজার তৈরির জন্য, বিশেষ করে রূপচর্চার ও প্রসাধন সামগ্রী, এমনকি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জিনিস, গৃহনির্মাণ ও গৃহের ডিজাইন-সাজসজ্জার ক্ষেত্রে এবং পানীয়, পরিধেয় সামগ্রী ও তার ডিজাইনের ব্যাপারে অন্ধ অনুকণের ক্ষেত্রে এসব প্রচারমাধ্যমকে এমনভাবে ব্যবহার করা হয়েছে যে, আচার-আচরণ, কথাবার্তা, পোশাক-পরিচ্ছদ ও তার ডিজাইন থেকে শুরু করে জীবনের সর্বক্ষেত্রে বিশেষেত বিলাসী ও অর্ধবিলাসী নারীদের জন্য এই পাশ্চাত্য-সংস্কৃতি এক বিরাট গৌরবের ব্যাপার বলে গণ্য হতো। আর পারস্পরিক মেলামেশা, আদব-কায়দা, কথা বলার ধরন এবং কথায় ও লিখায় পশ্চিমা শব্দাবলির ব্যবহার প্রচলিত হয়ে গিয়েছিল যে, অধিকাংশ জনগণের পক্ষেই তা অনুধাবন করা সম্ভব হতো না। এমনকি সমপর্যায়ের লোকদের জন্যও বুঝে ওঠা কঠিন হতো। টেলিভিশনে প্রাচ্য বা পাশ্চাত্যে নির্মিত ছায়াছবি দেখানো হতো যা তরুণ-তরুণী ও যুবক-যুবতীদেরকে তাদের স্বাভাবিক জীবনধারা, কাজকর্ম, শিল্প, উতপাদন ও জ্ঞানার্জন থেকে বিচ্যুত করে নিজের ও নিজের ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে উদাসীন করে তুলতো। অথবা নিজের ও নিজ দেশের সবকিছু সম্পর্কে, এমনকি স্বীয় সংস্কৃতি, সাহিত্য ও মহামূল্য শৈল্পিক অবদানসমূহ- যার অনেকাংশই স্বার্থসন্ধানী, বিশ্বাসঘাতক ও দেশদ্রোহীদের মাধ্যমে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের গ্রন্থাগার ও যাদুঘরসমূহে স্থানান্তরিত হয়েছে, এসব সম্পর্কে পর্যন্ত সন্ধিগ্ধ করে তুলতো। সাময়িকীসমূহ অশ্লীলতাপূর্ণ, কলঙ্কময় প্রবন্ধ ও ছবি প্রকাশ করে এবং দৈনিক পত্রিকাসমূহ স্বকীয় সংস্কৃতি ও ইসলামবিরোধী প্রবন্ধ প্রকাশের প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সগৌরবে জনগণকে, বিশেষ করে আবেগপ্রবণ যুবসমাজকে প্রাচ্য বা পাশ্চাত্যের দিকে ঠেলে দিচ্ছিল। এছাড়া অশ্লীলতার কেন্দ্র, প্রমোদাগার, জুয়ার আড্ডা, লটারি, বিলাস-সামগ্রী বিক্রয়ের দোকান, প্রসাধনী, খেলাধুলার সরঞ্জাম, মাদকদ্রব্য বিশেষ করে পশ্চিমা মাদ্রকদ্রব্য এবং তেল, গ্যাস ও অন্যান্য সম্পদ রপ্তানির বিনিময়ে পাশ্চাত্য থেকে আমদানিকৃত খেলার পুতুল ও অন্যান্য খেলাধুলা ও বিলাস সামগ্রী, আর এ ধরনের আরো শতশত জিনিস যে সম্পর্কে আমার মতো ব্যক্তিগণ খবর রাখেন না, এসব প্রচলনের জন্য যে ব্যাপক প্রচার চালানো হতো তাও এর সাথে যোগ করুন। আল্লাহ তাআলার ইচ্ছা যদি এরূপ হতো যে, বহিঃশক্তির তাঁবেদার দুর্বৃত্ত পাহলভী সরকারের আয়ু অব্যাহত থাকত তাহলে দুর্নীতিপরায়ণ সরকার, প্রচারমাধ্যমসমূহ এবং প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যপন্থী বুদ্ধিজীবীদের নানাবিধ শয়তানি ষড়যন্ত্র ও অপকৌশলের মাধ্যমে ইসলাম ও দেশের মহান সন্তানগণ যুবসমাজকে-জনগণের আশাপূর্ণ দৃষ্টি যাদের প্রতি নিবদ্ধ রয়েছে-জনগণ ও ইসলামের নিকট থেকে চিরবিদায় নিতে হতো। অথবা নিজেদের যৌবনকে পাপাচারের কেন্দ্রসমূহে নিঃশেষ করে দিতে হতো। কিংবা বিশ্বগ্রাসী শক্তিসমূহের সেবায় লিপ্ত হয়ে দেশকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিত। মহান আল্লাহ তাআলা আমাদের ও তাদের প্রতি বিরাট অনুগ্রহ করেছেন এবং আমাদের সকলকেই পাপিষ্ঠ ও লুটেরাদের অনিষ্ট থেকে রেহাই দিয়েছেন।

এখন, বর্তমান ও ভবিষ্যত মজলিশ-ই-শুরা-ই ইসলামী, বর্তমান প্রেসিডেন্ট ও ভবিষ্যতের প্রেসিডেন্টগণ এবং বর্তমান ও ভবিষ্যতের সকল অভিভাবক পরিষদ, বিচারপরিষদ ও মন্ত্রীপরিষদের প্রতি আমার অসিয়ত- তাঁরা যেন এই সংবাদ সংস্থা, সংবাদপত্র ও সাময়িকীসমূহকে ইসলাম ও দেশের কল্যাণের পথ থেকে বিচ্যুত হতে না দেন। আর আমাদের সকলেরই জেনে রাখা উচিত যে, পশ্চিমা ধরনের স্বাধীনতা যা ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে যুবসমাজকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়, সে ধরনের স্বাধীনতা ইসলাম ও বিচারবুদ্ধির দৃষ্টিতে নিন্দনীয়। ইসলাম শালীনতাবোধ ও জাতীয় কল্যাণের পরিপন্থী যে কোন ধরনের প্রচারণা, প্রবন্ধ রচনা, বক্তব্য, গ্রন্থ-রচনা ও সাময়িকীসমূহের প্রকাশনা হারাম করেছে। তাই আমাদের সকলের এবং সকল মুসলমানের জন্যই ফরজ হলো এ সবের প্রতিরোধ করা। এহেন ধ্বংসাত্মক স্বাধীনতাকে অবশ্যই প্রতিরোধ করতে হবে। শরীয়তের দৃষ্টিতে যা কিছু হারাম আর যা কিছু জনমত ও ইসলামী রাষ্ট্রের পরিপন্থী এবং ইসলামী প্রজাতন্ত্রের মর্যাদা হানিকর, তা অবশ্যই অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে প্রতিরোধ করতে হবে। অন্যথায় সকলকেই এ জন্য দায়ী থাকতে হবে। হিযবুল্লাহী (আল্লাহর দলের) জনতা ও যুবসমাজ যদি উপরোল্লিখিত যে কোন বিষয়েরও সম্মুখীন হন, তাহলে তাঁরা তা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের গোচরীভূত করবেন, যদি কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে দায়িত্ব পালনে অগ্রসর না হন তাহলে উক্ত বিষয়ের প্রতিরোধের দায়িত্ব তাঁদের নিজেদেরই। আল্লাহ তাআলা এ পথে সকলেরই জন্য সহায়ক হোন।

ঢ. জনগণ, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ও ইসলামের বিরুদ্ধে ততপর এমনসব দল, উপদল ও ব্যক্তির প্রতি বিশেষ করে দেশের ভিতরে ও বাইরে অবস্থানরত তাদের নেতাদের প্রতি আমার অসিয়ত ও নসিয়ত- এ পর্যন্ত আপনারা যত পন্থায়ই পদক্ষেপ নিয়েছেন, যত ষড়যন্ত্রেরই আশ্রয় নিয়েছেন, যত দেশ ও বড় বড় কর্তাব্যক্তির নিকটই আশ্রয় ভিক্ষা করেছেন এর দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে আপনারা- যাঁরা নিজেদেরকে জ্ঞানী ও সুস্থ-বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন বলে দাবি করেন নিশ্চয়ই বুঝে থাকবেন যে, সন্ত্রাস, বিস্ফোরণ, বোমাবাজি এবং অবাস্তব ও উদ্ভট মিথ্যা বেসাতির দ্বারা একটি আত্মোৎসর্গী জাতিকে পথভ্রষ্ট করা সম্ভব নয়। এহেন অমানবিক ও অযৌক্তিক প্রক্রিয়ার আশ্রয় নিয়ে কোনদিনই কোন হুকুমত ও সরকারের পতন ঘটানো সম্ভব নয়। বিশেষ করে ইরানের মতো কোন দেশ- যেখানে শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলেই তাঁদের জীবনের লক্ষ্য হাসিলের জন্য, ইসলামী প্রজাতন্ত্র, কোরআন ও ধর্মের জন্য প্রাণ উৎসর্গ করেছেন। আপনাদের তো জানাই আছে (আর যদি জানা না থকে, তাহলে বলব, আপনাদের চিন্তা অত্যন্ত অগভীর ও নির্বুদ্ধিতাপূর্ণ) যে, জনগণ আপনাদের সাথে নেই এবং সশস্ত্র বাহিনী আপনাদের শত্রু। আর আপনারা যদি ধরে নেন যে, এরা আপনাদের সাথে ছিলেন, আপনাদের বন্ধু ছিলেন তাহলেও আপনাদের ধ্বংসাত্মক ততপরতা ও উস্কানিতে সংঘটিত অপরাধসমূহ তাঁদেরকে আপনাদের থেকে পৃথক করে ফেলেছে। বস্তুত দুশমন সৃষ্টি ছাড়া আপনারা কিছুই করতে পারেননি। জীবনের এ শেষ লগ্নে আমি আপনাদের প্রতি কল্যাণময় অসিয়ত করছি যে, প্রথমত, দীর্ঘ আড়াই হাজার বছরের যুলুমশাহীর পর খোদাদ্রোহীদের দ্বারা নির্যাতিত-নিষ্পেষিত এই জনগণ যখন নিজেদের শ্রেষ্ঠতম সন্তান ও যুবকদের উৎসর্গ করে নিজেদেরকে পাহলভী সরকারের ন্যায় দুর্বৃত্তদের এবং প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বিশ্বগ্রাসী শক্তির কবল থেকে মুক্ত করেছে তখন কেমন করে আপনারা সে সমস্ত জনগণের বিরুদ্ধে লড়ছেন? একজন মানুষের বিবেক- তা যতই কালিমালিপ্ত হোক না কেন কোন সম্ভাব্য পদ হস্তগত কারার আশায় স্বীয় দেশ ও জনগণের সাথে এহেন আচরণ করতে এবং ছোট-বড় কাউকেই রেহাই না দিতে কি করে রাজি হতে পারে? আপনাদের প্রতি আমার নসিহত এ ধরনের অর্থহীন ও বিবেকবিরোধী কাজ বন্ধ করুন। বিশ্বগ্রাসীদের প্রতারণার শিকার হবেন না। আর যেখানেই অবস্থান করুন না কেন, যদি কোন অপরাধে অংশ না নিয়ে থাকেন তাহলে স্বীয় দেশ ও ইসলামের কোলে ফিরে আসুন এবং তাওবা করুন। কেননা, আল্লাহ তাআলা অতীব দয়াময় ও দয়ালু (আরহামুর রাহিমীন)। এর ফলে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ও তার জনগণও ইন শাআল্লাহ ক্ষমা করে দেবেন। আর যদি কোন অপরাধ সংঘটিত করে থাকেন- যে সম্পর্কে আল্লাহর আইনের ফয়সালা রয়েছে, তাহলেও মাঝপথ থেকেই ফিরে এসে তাওবা করুন। আর যদি সৎসাহস থাকে তাহলে শাস্তি মাথা পেতে নিন। এভাবে নিজেকে আল্লাহ তাআলার কঠিন শাস্তি থেকে রক্ষা করুন। নচেৎ যেখানেই থাকুন না কেন জীবনের সময়কে আর অপচয় না করে অন্য কাজে নিজেকে ব্যাপৃত রাখুন। কেননা, এতেই আপনাদের কল্যাণ নিহিত। এতঃপর দেশে-বিদেশে অবস্থানরত এদের সমর্থক ও অনুসারীদের উদ্দেশে আমার অসিয়ত- যেসব লোক বিশ্বগ্রাসী শক্তিধরদের সেবায় রত রয়েছে ও তাদেরই পরিকল্পনাসমূহ বাস্তবায়িত করে চলছে এবং না জেনে-শুনে তাদের ফাঁদে আটকা পড়েছে বলে এখন প্রমাণিত হয়েছে, তোমরা কোন্ চিন্তায় তাদের জন্য নিজেদের যৌবনকে বরবাদ করে দিচ্ছ? কার পথে স্বীয় জনগণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছ? তোমরা তাদের ক্রীড়নক হয়ে আছ। যদি তোমরা ইরানে অবস্থান করে থাক, তাহলে তা স্বচক্ষেই দেখতে পাচ্ছ যে, কোটি কোটি জনতা ইসলামী প্রজাতন্ত্রের নিষ্ঠাবান সমর্থক। তারা এজন্য আত্মোৎসর্গপ্রাণ। তোমরা স্বচক্ষে অবলোকন করছ যে, বর্তমান হুকুমত ও সরকার প্রাণপণে নিঃস্ব মানবতার খেদমতেই রত রয়েছে। আর যারা জনদরদি, মুজাহিদ বা গণমানুষের জন্য উৎসর্গপ্রাণ (ফেদাইনে খাল্ক) হবার দাবি করছে তারা জনগণের বিরুদ্ধে শত্রুতায় উঠেপড়ে লেগেছে। স্বীয় উদ্দেশ্য ও দুই বিশ্বগ্রাসী শক্তিবলয়ের কোন একটির উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার মানসে তোমাদের মতো সরলমনা ছেলে-মেয়েদেরকে নিয়ে নিষ্ঠুর খেলায় মেতে উঠেছে। অথচ তারা নিজেরা বিদেশে থেকে দুই অপরাধী শক্তির কোন একটির কোলে আশ্রয় নিয়ে আরাম-আয়েশ ও আনন্দ-আহ্লাদে নিমগ্ন রয়েছে অথবা দেশের জাঁকজমকপূর্ণ বিশাল বালাখানায় থেকে বিলাসী জীবন যাপন করছে এবং হতভাগা অপরাধীদের অপরাধকেন্দ্রসমূহের ন্যায় নিজেদের অপরাধী ততপরতা অব্যাহত রেখেছে। আর তোমাদের ন্যায় যুবকদেরকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে।

দেশে-বিদেশে অবস্থানরত তোমাদের (তরুণ ও যুবকদের) প্রতি আমার আন্তরিক অসিয়ত- তোমরা ভুল পথ থেকে ফিরে এস। সমাজের বঞ্চিত জনগণ, যারা মনপ্রাণ দিয়ে ইসলামী প্রজাতন্ত্রের খেদমত করে চলছে তাদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হও ও স্বাধীন-সার্বভৌম ইরান গড়ার লক্ষ্যে তৎপরতা চালিয়ে যাও যাতে দেশ ও জাতি বিরোধীদের অনিষ্ট থেকে মুক্তিলাভ করতে পারে। সবাই মিলে সম্মানজনক জীবনযাত্রা অব্যাহত রাখ। যারা শুধু নিজেদের স্বার্থ নিয়েই চিন্তা করছে, পরাশক্তিবর্গের কোলে আশ্রয় নিয়ে স্বীয় দেশ ও জনগণের বিরুদ্ধে লড়ছে আর নিজেদের অশুভ লক্ষ্য ও ক্ষমতালিপ্সা চরিতার্থ করার জন্য তোমাদেরকে বলি দিচ্ছে- তোমরা আর কতদিন এবং কিসের জন্য ঐসব লোকের আদেশ পালনে সদাপ্রস্তুত থাকবে? ইসলামী বিপ্লবের বিজয় পরবর্তী গত কয়েক বছরে তোমরা অবলোকন করেছ যে, তাদের দাবি, কর্ম ও আচরণসমূহ পরস্পর বিরোধী। তাদের বড় বড় বুলির উদ্দেশ্য হচ্ছে শুধু সরলমনা যুবকদের প্রতারণা করা। আরো অবগত আছ যে, জনগণের দুর্বার প্লাবনের মোকাবেলায় তোমাদের কোন শক্তিই নেই। নিজেদের ক্ষতিসাধন ও জীবনের অপচয় ছাড়া তোমাদের কাজের আর কোন ফলাফল নেই। আমার উপর অর্পিত পথনির্দেশনার দায়িত্বটুকু আমি পালন করলাম। আশা করা যায়, আমার এই নসিহত- যা আমার মৃত্যুর পর তোমাদের নিকট পৌঁছবে তাতে যেহেতু ক্ষমতালিপ্সার কোন গন্ধ নেই, সেহেতু তোমরা তা মনোযোগ সহকারে শুনবে এবং নিজেদেরকে কঠিন খোদায়ী শাস্তি থেকে মুক্তি দেবে। মহান দয়াময় আল্লাহ তাআলা তোমাদের হেদায়াত করুন এবং সরল সঠিক পথ প্রদর্শন করুন।

কম্যুনিস্ট ও ফেদাইনে খাল্‌কের বিভিন্ন গুপ্ত সংগঠন এবং বামপন্থী অন্যান্য দল-উপদলসহ সকল বামপন্থীর প্রতি আমার অসিয়ত- বিভিন্ন মতাদর্শের সঠিক পর্যালোচনা ব্যতিরেকে এবং বিভিন্ন মতাদর্শ বিশেষ করে ইসলামী বিশেষজ্ঞদের নিকট থেকে ইসলাম সম্পর্কে সঠিক ধারণা অর্জন ব্যতিরেকে কোন্ চিন্তায় আপনারা এমন এক মতাদর্শকে গ্রহণ করতে সম্মত হলেন যা আজকের বিশ্বে পরাজয়ের গ্লানি বরণ করে নিয়েছে? কি  হলো যে, আপনারা এমন কয়েকটি মতবাদ দ্বারা নিজেদের অন্তঃকরণকে পরিতৃপ্ত করলেন- যেসব মতাদর্শের বিষয়বস্তু গবেষক ও বিশ্লেষকদের কাছে আন্তঃসারশূন্য বলে প্রমাণিত হয়েছে? আর কোন্ চেতনা আপনাদের বাধ্য করেছে যে, যার জন্য নিজেদের দেশকে রাশিয়া বা চীনের কোলে ঠেলে দিতে চাচ্ছেন? জগগণের প্রতি ভালোবাসার নামে স্বীয় দেশের জনগণের বিরুদ্ধে লড়তে নেমেছেন? বহিঃশক্তির স্বার্থে নিজের দেশ ও নিপীড়িত জনগণের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে অংশ নিচ্ছেন? আপনারা দেখতে পাচ্ছেন যে, কম্যুনিজমের জন্মলগ্ন থেকেই এর দাবিদাররা বিশ্বের সবচেয়ে বড় একনায়ক, ক্ষমতালোভী ও আত্মকেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা কায়েম করেছে। জনগণের সমর্থক হবার দাবিদার রাশিয়ার দ্বারা কত জাতি ও জনগোষ্ঠীই না ছিন্ন-ভিন্ন হয়েছে এবং স্বীয় অস্তিত্ব হারিয়েছে। রুশ মুসলিম ও অমুসলিম জনগোষ্ঠীসমূহ এখনও কম্যুনিস্ট পার্টির নিষ্পেষণের যাঁতাকলে ছটফট করছে। তারা সবরকমের স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত হয়ে বিশ্বের একনায়ক সরকারসমূহের সৃষ্ট শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির তুলনায়ও অধিকতর কঠিন ও ভয়ঙ্কর অবস্থার মধ্যে কালাতিপাত করছে। কম্যুনিস্ট পার্টির তথাকথিত উজ্জ্বল ব্যক্তিত্বসমূহের অন্যতম স্টালিনের আগমন-প্রত্যাগমন, আনুষ্ঠানিকতা ও বিলাসিতা আমরা দেখেছি। আর এখন যে আপনারা-যারা প্রতারণার শিকার-রুশ সরকারের জন্য জীবন দিচ্ছেন ঠিক সেই মুহূর্তেই রাশিয়ার মযলুম জনগণ ও তার (রাশিয়ার) উপনিবেশসমূহের, যেমন আফগানিস্তানের জনগণ কম্যুনিস্টদের অত্যাচারে জীবন বিসর্জন দিচ্ছে, অথচ আপনারা-জনদরদি হবার দাবিদাররা যেখানেই পেরেছেন বঞ্চিত জনতার বিরুদ্ধে কি অপরাধেরই না আশ্রয় নিয়েছেন!

আর আমোলবাসীদেরকে আপনারা নিজেদের কট্টর সমর্থক বলে যে ভিত্তিহীন দাবি করতেন এবং বিভিন্ন প্রতারণামূলক প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে তাদেরকে জনগণ ও সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পাঠিয়ে মৃত্যুর মুখে এগিয়ে দিতেন তাদেরই বিরুদ্ধে কি জঘন্য অপরাধই না সংঘটন করলেন? আপনারা বঞ্চিত জনতার সমর্থক হবার ভুয়া দাবিদার। ইরানের মযলুম ও বঞ্চিত জনগণকে রুশ একনায়কতন্ত্রের হাতে তুলে দিতে চাচ্ছেন? আপনারা ফেদাইনে খাল্‌ক ও বঞ্চিতদের সমর্থকের আবরণে বর্তমানে এ ধরনের বিশ্বাসঘাতকতামূলক কাজে লিপ্ত রয়েছেন। সর্বোপরি তুদেহ পার্টি ও ইসলামী প্রজাতন্ত্রের সমর্থকের ছদ্মাবরণে ষড়যন্ত্রকারী বন্ধুরা এবং অন্যান্য দল-উপদল সন্ত্রাস, বিস্ফোরণ ও সশস্ত্র পন্থায় এ কাজে লিপ্ত রয়েছে।

বিভিন্ন নিদর্শন ও সাক্ষ্যপ্রমাণ থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, বামপন্থী দল-উপদলগুলো হচ্ছে আমেরিকান কম্যুনিস্ট। আপনারা যাঁরা বামপন্থী হিসেবে পরিচিত, বিভিন্ন দল-উপদল যাঁরা পাশ্চাত্য  থেকে  বেতন-ভাতা, প্রেরণা ও উদ্দীপনা পেয়ে থাকেন, যাঁরা স্বায়ত্তশাসন এবং কুর্দি ও বালুচদের সমর্থক হবার ভান করে অস্ত্র হাতে নিয়েছেন, কুর্দিস্থান ও অন্যান্য এলাকার বঞ্চিত জনতাকে নিশ্চিহ্ন করছেন এবং ঐসব প্রাদেশিক সরকারের সাংস্কৃতিক, স্বাস্থ্য, পুনঃনির্মাণ ও অর্থনৈতিক কর্মতৎপরতায় বাধা দিচ্ছেন, তাদের মধ্যে যেমন ‘কুর্দি  গণতান্ত্রিক দল’ ও ‘কুমেলাহ’ দল- আপনাদের সকলের প্রতি আমার অসিয়ত- আপনারা জনগণের সাথে যোগ দিন।

এতদিনে নিশ্চয়ই এদের অভিজ্ঞতা হয়েছে যে, তারা ঐসব এলাকার অধিবাসীদের জন্য দুর্দশা ডেকে আনা ছাড়া অন্য কিছুই করতে পারেনি এবং কিছু করতেও সক্ষম হবে না। অতএব, তাদের নিজেদের, নিজ জনগণ ও এলাকার কল্যাণের দাবি হচ্ছে তারা সরকারের প্রচেষ্টার সাথে শরিক হোক। বিদ্রোহ, বহিঃশক্তির গোলামি ও দেশদ্রোহিতা থেকে বিরত থাকুক। আর দেশ গড়ার কাজে অংশ নিক। তাদের নিশ্চিত থাকা উচিত যে, ইসলামী আদর্শ তাদের জন্য অপরাধী পাশ্চাত্য এবং একনায়কতান্ত্রিক প্রাচ্য শক্তির চেয়ে অধিকতর শ্রেষ্ঠ। ইসলামই জনগণের মানবিক আশা-আকাঙ্ক্ষার সর্বোত্তম বাস্তব রূপ।

আর যেসব মুসলিম দল-উপদল ভুলবশত পাশ্চাত্য অথবা প্রাচ্যের প্রতি আগ্রহ প্রদর্শন করছে এবং যারা কখনো কখনো মুনাফেকদের সমর্থন করত (ঐসমস্ত মুনাফেকের বিশ্বাসঘাতকতা বর্তমানে সুস্পষ্ট হয়ে গেছে), যারা ভুলবশত ইসলামের কট্টর দুশমনদের বিরোধিতাকারীদেরকে অভিশাপ দিত, তাদের সকলের প্রতি আমার অসিয়ত- তারা যেন নিজেদের ভুলের উপর অবিচল না থাকে, বরং ইসলামী সৎসাহসের সাথে নিজেদের ভুল-ভ্রান্তি স্বীকার করে নেয়, আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে সরকার, মজলিশ ও মযলুম জনগণের সাথে অভিন্ন কণ্ঠ ও অভিন্ন পথাবলম্বী হয়ে ইতিহাসের এই নির্যাতিত মানুষদেরকে নিপীড়কদের দুর্বৃত্তপনা থেকে মুক্ত করে। তারা যেন পবিত্র পথ ও নির্মল চিন্তার অধিকারী নিষ্ঠাবান আলেম মরহুম আয়াতুল্লাহ মুদাররেসের কথা স্মরণ করে, যিনি ততকালীন পরিত্যক্ত মজলিশে বলেছিলেন : ‘এখন আমরা তো ধ্বংস হয়েই যাব, তাহলে নিজেদের হাতে কেন ধ্বংস হব?’ আমিও আজ উক্ত শহীদের স্মরণে আপনাদের মতো ঈমানদার ভাইদের প্রতি নিবেদন করতে চাই, আমরা যদি আমেরিকা ও রাশিয়ার অপরাধী হস্তের দ্বারা জীবনপট থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাই, আর সম্মানের সাথে রক্তরঞ্জিত অবস্থায় স্বীয় খোদাতাআলার সাথে সাক্ষাত করি, তাহলে তা হবে প্রাচ্যের লাল বাহিনীর পতাকা ও পাশ্চাত্যের কাল পতাকার নিচে বিলাসবহুল ও স্বচ্ছল জীবন যাপনের তুলনায় অধিকতর উত্তম। আর এটাই হচ্ছে মহান আম্বিয়ায়ে কেরাম (আ.), মুসলমানদের ইমামগণ (আ.), বুজুর্গানে দ্বীনের অনুসৃত কর্মপন্থা। আমাদেরকে এই পথ অনুসরণ করতে হবে। নিজেদেরকে বিশ্বাস করাতে হবে যে, কোন জাতি পরনির্ভরশীলতা থেকে বাঁচতে চাইলে তা সে পারবেই। আর বিশ্বের পরাশক্তিগুলো কোন জাতির উপর সেই জাতির আর্দশের বিপরীত কিছু চাপিয়ে দিতে পারে না। আফগানিস্তান থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত। সেদেশের জবরদখলকারী সরকার ও অন্যান্য বামপন্থী দল রাশিয়ার সাথে থাকা সত্ত্বেও এখনও তারা সেখানকার জনগণকে দমন করতে সক্ষম হয়নি।

এছাড়া বর্তমান বিশ্বের বঞ্চিত জাতিসমূহ জাগ্রত হয়ে উঠেছে। এই জাগরণ-সংগ্রাম গণঅভ্যুত্থান ও বিপ্লবে রূপান্তরিত হতে খুব বেশি দিন লাগবে না, যার মাধ্যমে তারা নিজেদেরকে যালেম-নিপীড়কদের আধিপত্য থেকে মুক্তি দেবে। আর আপনারা-যাঁরা ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী মুসলমান-এখন দেখতে পাচ্ছেন যে, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সাথে সম্পর্কহীনতা তার সুফল প্রদর্শন করছে। স্থানীয় ব্যক্তিদের চিন্তাশীল মগজগুলো কাজ করতে শুরু করেছে ও আত্মনির্ভরশীলতার পানে এগিয়ে চলছে। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যপন্থী বিশ্বাসঘাতক বিশেষজ্ঞরা যেসব আমাদের জাতির পক্ষে অসম্ভব বলে প্রদর্শন করত সেগুলো আজ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে আমাদের জনগণের হাতে ও তাদেরই চিন্তার ফলশ্রুতিতে সম্পাদিত হয়েছে। ইন শাআল্লাহ সুদীর্ঘ মেয়াদে তা সম্পাদিত হবে। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, এই বিপ্লব বিলম্বে সংঘটিত হয়েছে। অন্তত মুহাম্মাদ রেযার নোংরা স্বৈরাচারী শাহীশাসনের শুরুতে যদি এ বিপ্লব সংঘটিত হতো তাহলে আজকের এই লুণ্ঠিত ইরান অন্য এক ইরানে পরিণত হতো।

লেখক, বক্তা, বুদ্ধিজীবী ও সমালোচকগণের প্রতি আমার অসিয়ত- ইসলামী প্রজাতন্ত্রের বিপরীত ধারায় সময়ের অপচয় না করে এবং সাধ্যাতীতভাবে মজলিশ, সরকার ও অন্য জনসেবকদের দুর্নাম রটনা, অকল্যাণ কামনা করা ও এসব কাজের মাধ্যমে গোটা দেশটাকে পরাশক্তিবর্গের দিকে ঠেলে দেয়ার পরিবর্তে অন্তত একটি রাত একান্তে স্বীয় প্রতিপালকের সামনে উপস্থিত হোন। আর যদি আল্লাহতে বিশ্বাসী না হয়ে থাকেন, তাহলে স্বীয় বিবেকের মুখোমুখি হোন এবং স্বীয় অন্তঃকরণের গোপন প্রকোষ্ঠনিহিত প্রবণতা-যে সম্পর্কে অনেকেই অবহিত নন-নিয়ে পর্যালোচনা করে দেখুন। কোন্ মানদণ্ডের ভিত্তিতে, কোন্ ইনসাফ নীতির অনুসরণে রণাঙ্গনে ও বিভিন্ন শহরে এই যুবকদের রক্ত ঝরার বিষয়টি উপেক্ষা করছেন? যে জাতি দেশি-বিদেশি যালেম ও লুটেরাদের আধিপত্য থেকে মুক্তি পেতে চাচ্ছে, আর নিজেদের ও তাদের প্রিয় সন্তানদের জীবনের বিনিময়ে মুক্তি ও স্বাধীনতা অর্জন করেছে এবং আত্মোৎসর্গের মাধ্যমে তার হেফাযত করতে চাচ্ছে, কোন্ মানদণ্ডের ভিত্তিতে সে জাতির বিরুদ্ধে স্নায়ুযুদ্ধে অংশ নিচ্ছেন? তাদের মধ্যে পারস্পরিক মতবিরোধ সৃষ্টির চেষ্টা করছেন? দেশদ্রোহিতা ও বিশ্বাসঘাতকমূলক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হচ্ছেন? যালেম ও নিপীড়কদের জন্য পথ প্রশস্ত করে দিচ্ছেন? এটাই কি উত্তম নয় যে, স্বীয় চিন্তা, কণ্ঠ ও লেখনির সাহায্যে সরকার, মজলিশ ও জাতিকে স্বদেশের হেফাযতে পথনির্দেশনা দান করবেন? আর এটাই কি উচিত নয় যে, এই বঞ্চিত-মযলুম জাতিকে সাহায্য করবেন এবং স্বীয় সহযোগিতা দ্বারা ইসলামী হুকুমতের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করবেন? আপনারা কি বর্তমান মজলিশ, প্রেসিডেন্ট, সরকার ও বিচার বিভাগকে সাবেক সরকারের আমলের চেয়েও নিকৃষ্টতর মনে করেন? উক্ত অভিশপ্ত সরকারের আমলে এই  নিরাশ্রয় মযলুম জাতির উপরে যে নির্যাতন-নিপীড়ন চলত তা কি আপনারা ভুলে গেছেন? আপনারা কি অবগত নন, ঐ যুগে এ দেশটি আমেরিকার সামরিক ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছিল? আর এর সাথে তারা একটি উপনিবেশের ন্যায় আচরণ করত? মজলিশ থেকে শুরু করে সরকার ও সামরিক বাহিনী তাদেরই নিয়ন্ত্রণে ছিল? এছাড়া তাদের উপদেষ্টাগণ, শিল্পকর্মী ও বিশেষজ্ঞরা এ জাতি ও তাদের সম্পদ নিয়ে যেভাবে ছিনিমিনি খেলত তা কি জানেন না? সারাদেশে নির্লজ্জতা ও বেহায়াপনার বিস্তার, প্রমোদকেন্দ্র, জুয়ার আড্ডা, পানশালা, মদের দোকান, সিনেমা ও চরিত্রহানিকর অন্যান্য কেন্দ্র-যার প্রতিটিই ছিল দেশের যুবসমাজকে ধ্বংস করার এক একটি বড় হাতিয়ার-এগুলো কি আপনাদের স্মৃতিপট থেকে মুছে গেছে? ঐ সরকারের প্রচারমাধ্যম, অশ্লীল সাময়িকী ও দৈনিক পত্রিকাসমূহের কথা কি একেবারেই ভুলে গেছেন? এখন তো সে দুর্নীতিগুলোর লেশমাত্র নেই। তাথাপি বিভিন্ন বিকৃত ও পথভ্রষ্ট দল-উপদল থেকে অনুপ্রবেশকৃত এবং ইসলাম ও ইসলামী প্রজাতন্ত্রের দুর্নাম সৃষ্টির লক্ষ্যে বিভিন্ন ধরনের অন্যায় কাজে লিপ্ত কতিপয় যুবক ও কয়েকটি আদালতকে দেখে আর কতিপয় দুর্নীতিবাজ এবং ইসলাম ও ইসলামী প্রজাতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সৃষ্টিকারীকে হত্যার কারণে আপনারা হৈ-চৈ করছেন? যারা সুস্পষ্ট ভাষায় ইসলামের নিন্দা করছে, আর তার বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম অথবা এর চেয়েও দুঃখজনক লেখনি ও বাকযুদ্ধে নেমেছে, আপনারা তাদের সাথেই যোগ দিয়েছেন? তাদের প্রতি ভ্রাতৃত্বের হাত প্রসারিত করে দিয়েছেন? আর আল্লাহ তাআলা যাদেরকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছেন তাদেরকে নয়নের মণিরূপে আখ্যায়িত করছেন? যারা ১৪ই ইসফান্দ এর সেই লোমহর্ষক ঘটনার নায়ক, যারা নিরীহ যুবকদের উপর নির্যাতনের স্টিম রোলার চালিয়েছে তাদের পাশে বসে এ লড়াইয়ের দর্শক সেজেছেন? সরকার ও বিচার বিভাগ ইসলামের অন্ধ দুশমন, বিকৃত, পথভ্রষ্ট ও নাস্তিকদেরকে তাদের অপরাধসযজ্ঞের যে উপযুক্ত শাস্তি দিচ্ছে-সেটি একটি ইসলামী কাজ এবং নৈতিক দায়িত্ব পালন বৈ নয়-তা আপনাদের মুখে আর্তচিতকার ও নির্যাতিতের ধ্বনি সৃষ্টি করেছে।

প্রিয় ভাইয়েরা, আপনাদের যাদের অতীত ইতিহাস সম্পর্কে মোটামুটি অবগত আছি এবং যাদের কতককে আমি পছন্দও করি তাদের জন্য আমার দুঃখ হয়। তবে কল্যাণকামীর ছদ্মবেশী সেই দুর্বৃত্তদের জন্য নয়। তারা রাখালবেশে নেকড়েতুল্য। এসব খেলোয়াড় সবাইকে নিয়ে খেলতে ও উপহাসের পাত্রে পরিণত করতে অভ্যস্ত। তারা দেশ, জাতি ও তার সেবকদেরকে দুই লুটেরা শক্তির কোন একটির কোলে ঠেলে দিয়ে ধ্বংস করার লক্ষ্য পোষণ করছে। যারা তাদের নোংরা হাতে দেশের যুবক, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ এবং সমাজের শিক্ষক ওলামায়ে কেরামকে শহীদ করছে। এমনকি তারা মযলুম মুসলিম শিশুদের পর্যন্ত রেহাই দেয়নি। এরা সমাজের কাছে নিজেদেরকে অপমানিত করে ফেলেছে, মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে লাঞ্ছিত করেছে। এদের প্রত্যাবর্তনের আর কোন পথ নেই। শয়তানি নাফ্সে আম্মারা এদের উপর আধিপত্য বিস্তার করেছে।

প্রিয় মুমিন ভাইয়েরা, আপনারা কেন্ বঞ্চিত মযলুম ও সর্বহারা জনগণের, যারা জীবনের সকল সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছে, তাদের খেদমতে প্রচেষ্টারত সরকার ও মজলিশের সাথে সহযোগিতা করছেন না? অথচ অভিযোগ করছেন? এতসব সমস্যা-সংকট যা যে কোন বিপ্লবের সাথেই অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত এবং এতো বিরাট ক্ষয়ক্ষতিসহ চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধ ও দেশি-বিদেশি কয়েক লক্ষ ছিন্নমূল মানুষ আর সীমাহীন নাশকতা সত্ত্বেও এ সংক্ষিপ্ত সময়ে ইসলামী প্রজাতন্ত্রী সরকার ও তার দেশের বিভিন্ন সংস্থা যে খেদমত আঞ্জাম দিয়েছে, সাবেক সরকারের আমলে সম্পাদিত উন্নয়ন ততপরতার সাথে তার তুলনা করে দেখেছেন কি? আপনাদের কি জানা নেই যে, সে যুগের উন্নয়ন ততপরতা বলতে গেলে শুধু শহরগুলোতেই আর তা ধনী এলাকায় সীমাবদ্ধ ছিল? দরিদ্র ও বঞ্চিত জনগণ তা থেকে অতি সামান্যই লাভবান হতো অথবা আদৌ লাভবান হতো না। অথচ বর্তমান সরকার ও ইসলামী সংস্থাসমূহ মনপ্রাণ দিয়ে সমাজের এই বঞ্চিত শ্রেণির খেদমত করে যাচ্ছে। প্রিয় মুমিন ভাইয়েরা, আপনারাও সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা করুন যাতে এসব কাজ আরও দ্রুতগতিতে এগিয় যেতে পারে। ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক মহান প্রভু আল্লাহ তাআলার কাছে আপনাদেরকে ফিরে যেতে হবেই। তাঁর বান্দাদের খেদমতের চিহ্ন সহকারে তাঁর দরবারে উপস্থিত হোন। (এই বাদ দেয়া অংশটুকু আমি নিজেই আঞ্জাম দিয়েছি) ।

ণ. উপদেশমূলক ও স্মরণযোগ্য আর একটি অপরিহার্য বিষয় হচ্ছে, ইসলাম অত্যাচারপূর্ণ, অবাধ ও বল্গাহীনভাবে সম্পদ পুঞ্জীভূতকারী এবং মযুলম-নিপীড়ত জনতাকে বঞ্চনার কবলে নিক্ষেপকারী পুঁজিবাদের সমর্থক নয়; বরং কোরআন ও সুন্নায় দৃঢ়তার সাথে এর বিরোধিতা করা হয়েছে এবং একে সামাজিক সুবিচারের পরিপন্থী বলে গণ্য করা হয়েছে। যদিও ইসলামী রাষ্ট্রের সমাজব্যবস্থা ও ইসলামের রাজনৈতিক বিষয়াদি সম্পর্কে অজ্ঞ বক্রচিন্তার অধিকারী কিছু লোক তাদের কথা ও লেখনির মাধ্যমে যা বুঝাতে চেয়েছে (এখনও তারা একাজ থেকে বিরত হয়নি) তা হচ্ছে, ইসলাম অবাধ পুঁজিবাদ ও মালিকানার সমর্থক। এভাবে তারা স্বীয় বক্রচিন্তার কারণে ইসলামের এ অর্থ গ্রহণ করে ইসলামের উজ্জ্বল চেহারাকে আবৃত করে দিয়েছে। ইসলামের দুশমন মতলববাজদের জন্য ইসলামের বিরুদ্ধে আঘাত হানার পথ খুলে দিয়েছে। এর ফলে শত্রুরা ইসলামকে পাশ্চাত্যের পুঁজিবাদী ব্যবস্থা, যেমন আমেরিকা, ব্রিটেন ও অন্যান্য লুটেরা ব্যবস্থার অনুরূপ বলে গণ্য করতে পারছে। এই অজ্ঞদের কথার উপর ভিত্তি করে তারা উদ্দেশ্যমূলকভাবেই হোক আর অজ্ঞতাবশতই হোক, প্রকৃত ইসলামী বিশেষজ্ঞদের সাথে আলোচনা ব্যতিরেকেই ইসলামের বিরোধিতায় অবতীর্ণ হয়েছে। অন্যদিকে ইসলাম মার্কসবাদী, লেনিনবাদী, কম্যুনিস্ট ব্যবস্থারও অনুরূপ নয়। যে ব্যবস্থা ব্যক্তি মালিকানার বিরোধী, কিন্তু যৌথ মালিকানার প্রবক্তা, যে মতবাদে প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত বহু মতপার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে। এমনকি নারীর উপর যৌথ অধিকার ও সমকামিতার অধিকারের কথা পর্যন্ত বলা হয়েছে। আর সেই সাথে রয়েছে এক কঠোর স্বৈরাচারী একনায়কতন্ত্রের কথা।

এ দুয়ের বিপরীতে ইসলামে রয়েছে এক ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবস্থা যা ব্যক্তি মালিকানার স্বীকৃতি দিয়েছে এবং সীমিত পর্যায়ে তার প্রতি সম্মান দেখিয়েছে। এ ব্যবস্থায় মালিকানা সৃষ্টি, সম্পদের ভোগ-ব্যবহার- যা সঠিক পন্থায় হলে সুস্থ অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে সহায়তা করবে, একটি স্থিতিশীল সরকারের জন্য অপরিহার্য সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু এক্ষেত্রেও কতিপয় বক্র চিন্তার অধিকারী এবং ইসলামের সুস্থ অর্থব্যবস্থা সম্পর্কে অজ্ঞ ব্যক্তিবর্গ উপরিউক্ত প্রথম দলের বিপরীতে অবস্থান গ্রহণ করেছে। অনেক ক্ষেত্রে তারা কোরআন মজিদের কিছু আয়াত অথবা নাহজুল বালাগার কতিপয় বাক্যের আশ্রয় নিয়ে ইসলামকে মার্ক্স ও অনুরূপ অন্যান্য ব্যক্তির উপস্থাপিত বিকৃত পথভ্রষ্ট আদর্শের সমর্থক বলে দাবি করে থাকে। এরা কোরআন পাকের অন্যান্য আয়াত ও নাহজুল বালাগার অন্যান্য অংশের প্রতি দৃষ্টি না দিয়েই নিজেদের ত্রুটিপূর্ণ অনুধাবন ক্ষমতার ভিত্তিতেই দৃঢ় অভিমত ব্যক্ত করছে ও যৌথ তত্ত্বের  মতবাদ নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এর মাঝে নিহিত কুফ্রী, একনায়কতন্ত্র ও শ্বাসরুদ্ধকর আত্মকেন্দ্রিক ব্যবস্থা যা সমগ্র মানবিক মূল্যবোধকে পদদলিত করে, সেসবকে এড়িয়ে সাধারণ জনগণের সাথে পশুসুলভ আচরণকারী একটি সংখ্যালঘু দলের শাসনের সমর্থন করছে।

মজলিশ-ই-শুরা-ই ইসলামী, অভিভাবক পরিষদ, সরকার, প্রেসিডেন্ট ও বিচার পরিষদের প্রতি আমার অসিয়ত- আল্লাহ তাআলার হুকুম-আহকামের সামনে বিনয়াবনত ও অনুগত থাকুন। আর যালেম লুটেরা পুঁজিবাদী ব্লক এবং নাস্তিক্যবাদী সামজতন্ত্র ও কম্যুনিস্ট ব্লকের অন্তঃসারশূন্য প্রচারণায় প্রভাবিত হবেন না। ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে বৈধ ব্যক্তিমালিকানা ও পুঁজির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করুন। জগগণকে নিশ্চিন্ত করুন যাতে তারা গঠনমূলক পুঁজি ও শ্রমততপরতাকে কাজে লাগায় এবং হাল্কা ও ভারী শিল্পে দেশ ও সরকারেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ ও স্বনির্ভরতায় উপনীত করে। আর বৈধ অর্থ-সম্পদের অধিকারীদের প্রতি আমার অসিয়ত- তাঁরা যেন তাঁদের বৈধভাবে উপার্জিত সম্পদকে কাজে খাটান এবং কৃষি ক্ষেত্রে, গ্রামাঞ্চল ও কলকারখানায় গঠনমূলক ততপরতায় সচেষ্ট হন। কারণ, এটি একটি মূল্যবান ইবাদত।

আর সবাইকে বঞ্চিত শ্রেণির জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে সচেষ্ট হওয়ার জন্য অসিয়ত করছি। কেননা, তাদের সেবায় আত্মনিয়োগের মাঝেই ইহ ও পরকালের কল্যাণ নিহিত রয়েছে। তারা যালেমশাহী ও জমিদারদের দীর্ঘ শাসনামলে চরম দুঃখকষ্টের মধ্যে নিমজ্জিত ছিল। কতই না উত্তম কাজ হতো যদি সামর্থ্যবান ব্যক্তিগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ছিন্নমূল বস্তিবাসীদের জন্য বাড়িঘরের ব্যবস্থা ও তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করতো। আপনারা নিশ্চতভাবে জেনে রাখুন যে, ইহ ও পরকালের কল্যাণ এতেই নিহিত রয়েছে। আর এটা আদৌ ইনসাফসম্মত নয় যে, কেউ গৃহহীন থাকবে, আর কেউ অনেক ঘরবাড়ির মালিক হবে।

ত. সেই সকল আলেম ও আলেম বেশধারী যাঁরা বিভিন্ন উদ্দেশ্যে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ও এর প্রতিষ্ঠানসমূহের বিরোধিতা করছেন, এর উৎখাতে নিজেদের সময় ও শ্রম ব্যয় করছেন, সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্রকারী ও রাজনৈতিক চালবাজদের সাহায্য করছেন, এমনকি যেরূপ বলতে শোনা যায়, একাজে তারা খোদাবিমুখ পুঁজিপতিদের কাছ থেকে মোটা অংকের অর্থ গ্রহণ করছেন এবং তার বিনিময়ে তাদেরকে ব্যাপক সহযোগিতা প্রদান করছেন, তাঁদের প্রতি আমার অসিয়ত- আপনারা এই ভ্রান্ত কর্মকাণ্ডগুলো পরিত্যাগ করুন যা এখনও পরিত্যাগ করেননি এবং এরপরও ত্যাগ করবেন বলে মনে হয় না। আপনারা যদি পার্থিব স্বার্থে এ কাজে হাত বাড়িয়ে থাকেন তাহলে আল্লাহ তাআলা আপনাদেরকে এ ঘৃণ্য লক্ষ্যে উপনীত হবার কোন সুযোগই যেন না দেন। এটাই উত্তম যে, তাওবার দুয়ার খোলা থাকতেই তাঁর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করুন। মযলুম অসহায় জনগণের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করুন। জনগণের বহু ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে অর্জিত ইসলামী প্রজাতন্ত্রের প্রতি আপনাদের সমর্থন ঘোষণা করুন। কারণ, এতেই আপনাদের ইহ ও পরকালের কল্যাণ নিহিত রয়েছে। যদিও আমি মনে করি না যে, আপনারা তাওবা করতে সমর্থ হবেন। অপরদিকে, আলেমদের যে অংশটি বিভিন্ন ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের ইসলামী অনুশাসনের বিপরীত ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত ভুলত্রুটি ও অপরাধযজ্ঞ দেখে স্বয়ং ইসলামী প্রজাতন্ত্র ও তার সরকারের তীব্র বিরোধিতায় মেতে ওঠেন, আল্লাহর সন্তুষ্টি অজর্নের আশায় এ সরকার উৎখাতে অংশ নিচ্ছেন, আর নিজেদের কল্পিত ধারণা অনুযায়ী এ ইসলামী প্রজাতন্ত্রকে শাহী ব্যবস্থার চেয়েও নিকৃষ্টতর বা তার অনুরূপ বলে মনে করছেন, তাঁদের সকলের প্রতি আমার অসিয়ত- তাঁরা যেন এ ব্যাপারে একান্তে বসে গভীরভাবে চিন্তা করেন এবং ন্যায়নীতি সহকারে সাবেক সরকারের সাথে বর্তমান সরকারের তুলনা করেন। আর সেই সাথে এ বিষয়টির প্রতিও লক্ষ্য রাখবেন যে, বিশ্বের অন্যান্য বিপ্লবের ক্ষেত্রে অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা, ভুল-ভ্রান্তি, দোষ-ত্রুটি ও সুযোগসন্ধানীদের দৌরাত্ম্য ছিল এক অনিবার্য ও অপরিহার্য বিষয়। আপনারা যদি উক্ত বিষয়টি স্মরণ রাখেন এবং ইসলামী প্রজাতন্ত্র যেসব সমস্যার মাঝে হাবুডুবু খাচ্ছে সেদিকে লক্ষ্য রাখেন, তাহলে দেখতে পাবেন এসবের মধ্যে রয়েছে ষড়যন্ত্র, মিথ্যা প্রচারণা, সীমান্তের অভ্যন্তরে ও বাইরে সশস্ত্র হামলা, ইসলাম ও ইসলামী হুকুমত সম্পর্কে জনগণকে অসন্তুষ্ট করে তোলার লক্ষ্যে সকল সরকারি সংস্থায় দুর্নীতিপরায়ণ ও ইসলামবিরোধী উপদলসমূহের পক্ষ থেকে অপ্রতিরোধ্য অনুপ্রবেশ, দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের অধিকাংশেরই কিংবা অনেকেরই পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকা, পুঞ্জিভূত বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদের ভোগ ব্যবহারে সুযোগ থেকে বঞ্চিত অথবা এর সুযোগ কম পাচ্ছে এমন ব্যক্তিবর্গের পক্ষ থেকে মিথ্যা গুজব রটনা ও প্রচার, ইসলামী বিচারকদের সংখ্যাল্পতা, মেরুদণ্ড ভঙ্গকারী অর্থনৈতিক সমস্যাবলি, কয়েক লক্ষ কর্মকর্তা ও কর্মচারীর মধ্যে শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা ও সংস্কার সাধনের পথে বিরাট বিরাট সমস্যা, সৎ ও যোগ্য কর্মক্ষম লোকের অভাব এবং এরূপ আরো ডজন ডজন সমস্যা- যে সম্পর্কে এর অভ্যন্তরে প্রবেশ ব্যতীত বোঝা অসম্ভব। এর পাশাপাশি রয়েছে মতলববাজ ও আধিপত্যবাদী বিপুল অর্থের মালিকেরা- যারা সুদ, মুনাফাখোরী, বৈদেশিক মুদ্রা পাচার, নাভিশ্বাস সৃষ্টিকারী উচ্চমূল্যে বিক্রি, চোরাচালান, মজুদদারী ইত্যাদির মাধ্যমে সমাজের অসহায় ও বঞ্চিত জনগণের ওপর চাপ সৃষ্টি করে তাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত করে তুলছে এবং সমাজে অনাচার সৃষ্টি করছে। এরাই আবার আপনাদের সামনে গিয়ে প্রতারণামূলক অভিযোগ করে থাকে। অনেক সময় নিজেদেরকে নিষ্ঠাবান মুসলমান বলে দেখানো ও তাদের কথা আপনাদের বিশ্বাস করানোর লক্ষ্যে খোমসের  নামে মোটা অংকের অর্থ প্রদান করে এবং কুম্ভীরাশ্রু বর্ষণ করে আপনাদেরকে ব্যথিত ও অসন্তুষ্ট করে তুলে ইসলামী প্রজাতন্ত্রের বিরোধিতায় অনুপ্রাণিত করে। অথচ এদের অনেকেই অবৈধভাবে জনগণের রক্ত শোষণ করছে এবং দেশের অর্থনীতিক ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এই সম্মানিত আলেমদের প্রতি আমার বিনীত ও ভ্রাতৃসুলভ নসিহত- তাঁরা যেন এ ধরনের তৈরি গুজবের দ্বারা প্রভাবিত না হন। আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে ও ইসলামের হেফাযতের উদ্দেশ্যে এই ইসলামী প্রজাতন্ত্রকে শক্তিশালী করুন। আর তাঁরা যেন মনে রাখেন যে, ইসলামী প্রজাতন্ত্রের যদি পতন ঘটে তাহলে তার পরিবর্তে হযরত ইমাম মাহদী (আ.) (আমার আত্মা তাঁর জন্য উৎসর্গিত)-এর পছন্দনীয় কোনো ইসলামী সরকার অথবা আপনাদের পরিচালনাধীন কোনো সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে না, বরং বিশ্বের দুই শক্তিবলয়ের কোনো একটির ইচ্ছা অনুযায়ী সরকার ক্ষমতাসীন হবে। আর তাহলে বিশ্বের বঞ্চিত জনগণ- যারা ইসলাম ও ইসলামী প্রজাতন্ত্রের প্রতি আশার দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে তারা হতাশাগ্রস্ত হবে, ইসলাম চিরদিনের তরে কোণঠাসা হয়ে পড়বে। এমন একদিন আসবে যখন আপনারা স্বীয় কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হবেন, যখন আপনাদের অতীত কর্ম ও অনুতাপ কোনটিই কাজে আসবে না।

আপনারা যদি এই আশা করে থাকেন যে, রাতারাতিই সবকিছু ইসলাম এবং আল্লাহ তাআলার আহকাম অনুযায়ী পরিবর্তিত হয়ে যাবে তাহলে বিরাট ভুল করবেন। কেননা, সমগ্র মানবজাতির ইতিহাসে কখনই এহেন অলৌকিক ঘটনা সংঘটিত হয়নি এবং হবে না। আর ইন শাআল্লাহ যেদিন বিশ্ব সংস্কারক (ইমাম মাহদী আ.) আত্মপ্রকাশ করবেন, মনে করবেন না যে, সেদিন এক অলৌকিক ঘটনা সংঘটিত হবে। আর একদিনের মধ্যেই সারা বিশ্বের সংশোধনী ও সংস্কার সাধিত হবে। বরং বহু চেষ্টা-সাধনা ও ত্যাগ-তিতিক্ষার মাধ্যমেই যালেম-নিপীড়কদের পতন ঘটানো ও তাদেরকে কোণঠাসা করা সম্ভব হবে। আর আপনাদের ধারণা যদি সেই অজ্ঞ-মূর্খ ও পথভ্রষ্ট লোকদের অনুরূপ হয়ে থাকে, যারা মনে করে উক্ত মহিমান্বিত ব্যক্তির আগমনের জন্য কুফরী ও যুলুম প্রবর্তনের চেষ্টা করা উচিত, যাতে সারা বিশ্ব যুলুম-অত্যাচারে ভরপুর হয়ে যায় ও তাঁর আবির্ভবের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয় তাহলে শুধু বলব, ‘ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন’।

থ. বিশ্বের সকল মুসলমান ও নির্যাতিত জনগণের প্রতি আমার অসিয়ত- আপনাদের স্ব-স্ব দেশের শাসকবর্গ ও কর্তাব্যক্তিরা বা বিদেশি শক্তিবর্গ নিজেরা এসে আপনাদেরকে মুক্তি ও স্বাধীনতা উপহার দেবে- এ আশায় বসে থাকবেন না। আমরা ও আপনারা অন্তত বিগত একশ’ বছরের ঘটনাবলি পর্যবেক্ষণ করেছি বা সঠিক ও নির্ভরযোগ্য ইতিহাসে তা অধ্যয়ন করেছি, যে সময়টিতে বিশ্বগ্রাসী বৃহৎ শক্তিবর্গ পর্যায়ক্রমে সকল মুসলিম দেশে এবং অন্যান্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দেশের ওপর আধিপত্য বিস্তার করছিল। তৎকালীন সময়ের এসব দেশের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত একটি সরকারও নিজ দেশের জনগণের মুক্তি, স্বাধীনতা ও কল্যাণ নিয়ে মাথা ঘামাতো না এবং এখনও নয়; বরং অধিকাংশ সরকার, বলা যায় প্রায় সকলেই জনগণের ওপর যুলুম-নির্যাতন ও শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা চাপিয়ে দিয়েছিল, আর যা কিছু করেছিল তা ছিল শুধু ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীবিশেষ অথবা প্রাসাদ-অট্টালিকার বিলাসী শ্রেণির জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের স্বার্থেই। অন্যদিকে ছিন্নমূল বস্তিবাসী মযলুম শ্রেণি তাদের জীবন ধারণের সব রকম উপকরণ, এমনকি পানি, রুটি ও কোনমতে বেঁচে থাকার শক্তি থেকেও বঞ্চিত হয়েছে। এই হতভাগাদেরকে বিলাসী ধনীক শ্রেণির স্বার্থে কাজে লাগানো হয়। আর বৃহত শক্তিবর্গের হাতের পুতুলরা স্ব-স্ব দেশ ও জনগণকে ঐসব শক্তির তাঁবেদারে পরিণত করার লক্ষ্যে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে এবং বিভিন্ন অপকৌশলের আশ্রয় নিয়ে স্ব-স্ব দেশকে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের অবাধ বাজারে পরিণত করেছে। এর ফলে শুধু তাদের স্বার্থই নিশ্চিত হয়েছে। তারা জতিসমূহের পশ্চাদপদতা ও বিলাসভোগিতার পর্যায়ে নামিয়ে এনেছে। আর এখনো তারা এসব পরিকল্পনা সহকারেই অগ্রসর হচ্ছে।

হে বিশ্বের নির্যাতিত (মুস্তাযাফ) জনগণ! হে মুসলিম দেশসমূহ!! হে বিশ্বের মুসলমানগণ!!! উঠে দাঁড়ান, সত্যকে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরুন এবং পরাশক্তিবর্গ ও তাদের পদলেহী দালালদের প্রচারণামূলক হৈ-চৈ এ ভীতসন্ত্রস্ত হবেন না। আর অপরাধী শাসকগোষ্ঠী আপনাদের কষ্টার্জিত সম্পদকে আপনাদের ও ইসলামের দুশমনদের হাতে তুলে দেয়ার কারণে তাদেরকে স্বদেশ থেকে বিতাড়িত করুন। আপনারা নিজেরাই এবং নিষ্ঠাবান জনসেবকগণ দেশের নিয়ন্ত্রণভার গ্রহণ করুন। আর সবাই ইসলামের গৌরবময় পতাকাতলে সমবেত হয়ে ইসলাম ও বিশ্বে বঞ্চিত জনগণের দুশমনদের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষায় উঠে দাঁড়ান এবং এক একটি স্বাধীন-সার্বভৌম প্রজাতন্ত্রে ইসলামী সরকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যপানে এগিয়ে যান- যার বাস্তবায়নের মাধ্যমে আপনারা বিশ্বের সমস্ত দাম্ভিক পরাশক্তির আধিপত্যকে খর্ব করে দিতে আর মুস্তাযাফ জনগণকে নেতৃত্বের আসনে সমাসীন করতে ও ধরণীর উত্তরাধিকারিতে পরিণত করতে সক্ষম হবেন। আল্লাহ তাআলা কর্তৃক প্রতিশ্রুত সে দিবসের প্রতীক্ষায় রইলাম।

দ. অত্র অসিয়তনামার শেষ পর্যায়ে এসে পুনরায় সম্মানিত ইরানী জাতির উদ্দেশে অসিয়ত করছি- এ বিশ্বে দুঃখ-কষ্টকে সয়ে নেয়া শ্রমসাধনা, ত্যাগ-তিতিক্ষা ও বঞ্চনার ব্যাপকতা এর বিরাট লক্ষ্য, মর্যাদা ও চরম উতকর্ষের ব্যাপকতারই অনিবার্য দাবি। হে সম্মানিত ও মুজাহিদ ইরানী জাতি! আপনারা যে জন্য উঠে দাঁড়িয়েছেন এবং যার পেছনে এখনও চলছেন, যার জন্য জানমাল কোরবান করে দিচ্ছেন তা হচ্ছে সৃষ্টি শুরুর পূর্ববর্তী অনাদিকাল থেকে শুরু করে সৃষ্টি শুরুর পরবর্তী অনন্তকাল পর্যন্ত উপস্থাপিত ও উপস্থাপিতব্য লক্ষ্যস্থল ও লক্ষ্যবস্তুসমূহের মধ্যে সর্বোচ্চ, সর্বাধিক মর্যাদাসম্পন্ন ও সর্বাধিক মূল্যবান লক্ষ্যস্থল ও লক্ষ্যবস্তু। আর এটা ব্যাপকতম অর্থে খোদীয় এক আদর্শ এবং তার সকল সমুন্নত দিক সহকারে এক তাওহিদী মতাদর্শ- যার বৈশিষ্ট্য ও চূড়ান্ত লক্ষ্য সুবিশাল সৃষ্টিলোক এবং প্রকাশ্য ও গুপ্তজগতের সর্বস্তরে পরিব্যাপ্ত। এ আদর্শ তার সর্বস্তর ও সর্বপর্যায়ে সকল দিক পূর্ণাঙ্গ তাতপর্য সহকারে হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর আদর্শে প্রকাশ লাভ করেছে। মহান নবী-রাসূলগণ (আ.) ও সম্মানিত আল্লাহর অলিগণ (তাঁদের সকলের ওপরে সালাম) সকলেই আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য চেষ্টা করে গেছেন। আর এ আদর্শ ব্যতীত পরম পূর্ণতা এবং সীমাহীন মহিমা ও সৌন্দর্যে উপনীত হওয়া সম্ভব নয়। কেননা, এ আদর্শ মাটির মানুষকে অতীন্দ্রিয় জগতের অধিবাসীদের ওপর মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করেছে। এ আদর্শ অনুসরণের ফলে মৃত্তিকাবাসীর পক্ষে যা অর্জন করা সম্ভব সমগ্র সৃষ্টিলোকের প্রকাশ্য ও গুপ্ত কোন সৃষ্টির পক্ষেই তা সম্ভব নয়।

হে মুজাহিদগণ! আপনারা এমন এক পাতাকাতলে সমবেত হচ্ছেন যা সমগ্র বস্তু ও আধ্যাত্মিক জগতে উড্ডীন রয়েছে। সফল হোন বা না-ই হোন, আপনারা এমন এক পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছেন যা নবী রাসূলদের (আ.) একমাত্র পথ, চরম ও পরম সৌভাগ্যের অদ্বিতীয় পথ। এ পথে আল্লাহর প্রিয় বন্ধুগণ শাহাদাতকে আলিঙ্গন করেন এবং রক্তাক্ত মৃত্যুকে মধুর চেয়েও সুমিষ্ট গণ্য করেন। আর আপনাদের যুবকরা রণাঙ্গনগুলোতে এ থেকে শুধু এক চুমুকই পান করেছে। ফলে মহাশক্তির উদ্ভাবন ঘটিয়েছে। তাদের পিতা-মাতা ও ভাই-বোনদের মাঝেও এ শক্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। তাই যথার্থই বলতে হয়-

يا ليتنا كنّا معكم فنفوز فوزاً عظيماً

হায়! আমরাও যদি তোমাদের সাথে থাকতাম তাহলে আমরাও বিরাট সাফল্যের অধিকারী হতাম!

হৃদয় আপ্লুতকারী বসন্ত সমীরণ ও তার চাঞ্চল্যকর বহিঃপ্রকাশ তাদের জন্য উপভোগ্য হোক!!

আমাদের মনে রাখতে হবে, এই চাঞ্চল্যকর বহিঃপ্রকাশের একটি দিক সেই রৌদ্রতপ্ত উন্মুক্ত মাঠের কৃষিকাজে, উতপাদনক্ষম কলকারখানাগুলোতে, আবিষ্কার-উদ্ভাবন কেন্দ্রসমূহে এবং হাটে-বাজারে, রাস্তা-ঘাটে ও গ্রামগঞ্জের অধিকাংশ জনসাধারণের মাঝে, আর যারা ইসলাম, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ও দেশের অগ্রগতি ও স্বনির্ভরতার লক্ষ্যে এসব কাজের পরিচালনার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন তাঁদের সকলের মাঝেই প্রকাশিত। সমাজে যতদিন এ সহযোগিতা ও নিষ্ঠার মনোভাব বহাল থাকবে ততদিন এদেশ কালের ক্ষতি থেকে রক্ষা পাবে ইন শাআল্লাহ। আর আল্লাহর রহমতে দীনী শিক্ষাকেন্দ্র, বিশ্ববিদ্যালয় এবং জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রসমূহের যুবসমাজ এ গায়েবী খোদায়ী উপঢৌকনের অধিকারী। এই কেন্দ্রগুলো পুরোপুরি তাদেরই করতলগত। আর আল্লাহর রহমতে এদের ওপর থেকে নাশকতা ও বিকৃতির  নায়কদের নিয়ন্ত্রণের বিলুপ্তি ঘটেছে।

সকলের প্রতি আমার অন্তিম আবেদন, সদাসর্বদা আল্লাহ তাআলাকে স্মরণ রেখে নিজকে চেনা এবং সকল ক্ষেত্রে স্বনির্ভরতা ও স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে এগিয়ে যান। নিশ্চয় এ ক্ষেত্রে আল্লাহ তাআলা আপনাদের সহায়ক হবেন। আপনারা যদি সর্বদা আল্লাহকে হাজির-নাজির জেনে ইসলামী রাষ্ট্রের উন্নিত ও অগ্রগতির লক্ষ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার মনোভাবকে ধরে রাখেন, আর আমি যেভাবে প্রিয় দেশবাসীর মাঝে জাগরণ, সতর্কতা, একনিষ্ঠতা, আত্মোৎসর্গ-মনোভাব, প্রতিরোধ চেতনা ও দৃঢ়তা দেখতে পাচ্ছি তারই ভিত্তিতে এ আশা পোষণ করছি, আল্লাহ তাআলার অপার অনুগ্রহে এ মানবিক ভাবধারা বংশপরম্পরায় অব্যাহত থাকবে। এমনকি পরবর্তী বংশধরদের মাঝে ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকবে।

প্রশান্ত হৃদয়, পরিতৃপ্ত অন্তঃকরণ, আনন্দিত আত্মা ও আশাভরা মন নিয়ে আল্লাহ তাআলার ইচ্ছায় ভ্রাতা ও ভগ্নীদের খেদমত থেকে বিদায় নিচ্ছি এবং চিরন্তন আবাসপানে যাত্রা করছি। আর এ ক্ষেত্রে আপনাদের দোয়ার প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভব করছি। অসীম দয়াময় ও দয়ালু আল্লাহ তাআলার নিকট প্রার্থনা করছি, তিনি যেন খেদমতের ভুলত্রুটির ক্ষেত্রে আমার ওজরসমূহ কবুল করেন। আর আশা করছি, জনগণও আমার ভুলত্রুটির ওজরসমূহ কবুল করে নিবেন। আপনারা শক্তিমত্তা ও দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি সহকারে সম্মুখপানে এগিয়ে যান। সবাই যেন মনে রাখেন, একজন খাদেমের প্রস্থানের ফলে এ জাতির ইস্পাতকঠিন দৃঢ়তায় কোনো ফাটল দেখা দেবে না। কেননা, মহা সম্মানিত খাদেমগণ এ জনগণের সেবায় নিয়োজিত আছেন। আল্লাহই এ জাতি ও বিশ্ব মযলুমদের রক্ষাকর্তা।

السلام عليكم و على عباد الله الصالحين و رحمت الله و بركاته

আপনাদের ওপর সালাম। আরো সালাম আল্লাহর নেক বান্দাদের ওপর এবং তাঁর রহমত ও বরকত বর্ষিত হোক।

২৬শে বাহমান, ১৩৬১ সন, পহেলা জমাদিউল আউয়াল ১৪০৩ হিজরি।

রুহুল্লাহ আল-মুসাভী আল-খোমেইনী।

মহান প্রভু আল্লাহর নামে

আমার মৃত্যুর পর এই অসিয়তনামা আহমদ খোমেইনী জনগণকে পড়ে শোনাবেন। যদি তিনি না পারেন তাহলে সম্মানিত রাষ্ট্রপতি অথবা সম্মানিত মজলিশ স্পিকার অথবা সুপ্রিম কোর্টের সম্মানিত প্রধান বিচারপতি এই কষ্টটুকু বরণ করবেন। আর তাঁরাও যদি অক্ষম হন তাহলে সম্মানিত অভিভাবক পরিষদের কোনো ফকিহ এই কষ্টটুকু কবুল করবেন।

রুহুল্লাহ আল-মুসাভী আল-খোমেইনী।

মহান প্রভু আল্লাহর নামে

ভূমিকাসহ ২৯ পৃষ্ঠাবিশিষ্ট এই অসিয়তনামা শেষে কয়েকটি বিষয় স্মরণ করিয়ে দিতে চাই :

১. এখন আমার জীবিতাবস্থাতেই আমার নামে অনেক অবাস্তব কথা বলা হচ্ছে। সম্ভবত আমার মৃত্যুর পর এর পরিমাণ আরো বৃদ্ধি পাবে। এ কারণে বলতে চাই, আমার কণ্ঠ ও বিশেষজ্ঞগণ বা  ইসলামী প্রজাতন্ত্রের টেলিভিশনের সত্যায়ন অনুযায়ী আমার হস্তাক্ষর ও স্বাক্ষর দ্বারা যা আমার বক্তব্যরূপে প্রমাণিত হবে তার বাইরে আমার নামে যা কিছু বলা হচ্ছে তা সবই মিথ্যা।

২. আমার জীবদ্দশায়ই কিছু লোক দাবি করছে যে, তারা আমার বিভিন্ন বিবৃতি লিখে দিয়েছিলেন। আমি এ দাবি দৃঢ়তার সাথে প্রত্যাখ্যান করছি, কেননা, এ পর্যন্ত কোন বিবৃতিই আমি নিজে ছাড়া অন্য কেউ লিখে দেয়নি।

৩. উপরিউক্ত দাবিসমূহের পাশাপাশি কেউ কেউ দাবি করছেন যে, আমি তাঁদের সহায়তায় প্যারিসে গমন করেছিলাম। এটা একটা মিথ্যা কথা। আমাকে কুয়েত থেকে ফেরত দেবার পর আহমদ (খোমেইনীর)-এর পরামর্শক্রমে গন্তব্যস্থল হিসেবে প্যারিসকে বেছে নেই। কারণ, মুসলিম দেশসমূহে প্রবেশের সুযোগ না দেয়ারই সম্ভাবনা ছিল। তাদের ওপর শাহের প্রভাব ছিল। কিন্তু প্যারিসে সে সম্ভবনা ছিল না।

৪. আন্দোলন ও বিপ্লবের এই দীর্ঘ সময় আমি কিছু লোকের প্রতারণাময় বাহ্যিকতা ও ইসলামী বেশের কারণে তাদের কথা উল্লেখ করে প্রশংসা করেছিলাম। কিন্তু পরে বুঝতে পেরেছি, আমি তাদের প্রতারণার শিকার হয়েছি। ঐসব প্রশংসা তখনই হয়েছে যখন তারা নিজেদেরকে ইসলামী প্রজাতন্ত্রের প্রতি নিষ্ঠাবান ও আন্তরিক রূপে প্রদর্শন করেছে। অতএব, এসব কিছুর অপব্যবহার করা উচিত হবে না; বরং প্রত্যেককে তার বর্তমান অবস্থা দ্বারাই বিচার করতে হবে।

রুহুল্লাহ আল-মুসাভী আল-খোমেইনী।

 

টীকা

১.    উপরে উদ্ধৃত বাণীটি নবীপাক (সা.)-এর একটি হাদীস। এটি একটি বিখ্যাত হাদীস। এটি ‘হাদীসে সাকলাইন’ নামে সুপরিচিত,  যা বহু নির্ভরযোগ্য হাদীসগ্রন্থে সংকলিত হয়েছে। দেখুন : সহিহ্ তিরমিযী, ৫ম খণ্ড, হাদীস নং ৩৮৭৪, সহিহ্ মুসলিম, ২য় খণ্ড, মুসনাদে আহমদ,  ৩য় খণ্ড, নাসাঈ শরীফ, কানযুল উম্মাল, ১ম খণ্ড, তাফসীর ইবনে কাছির, ৪র্থ খণ্ড, মিশকাতুল মাছাহিব, ৩য় খণ্ড, তাফসীর আল কাবীর, ফখরুদ্দিন রাযী, ৩য় খণ্ড।
২.   যাঁরা জনগণের সকল দ্বীনী কর্মকাণ্ডের দায়িত্বশীল। যাঁরা আলেমসমাজের সর্বোচ্চ স্তরের ব্যক্তিত্ব। দ্বীনী মাদ্রাসাগুলোতে সর্বোচ্চ শিক্ষালাভের পর তাঁরা নিজেরা অব্যাহতভাবে ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ের উপর গবেষণা করে জনগণের দৈনন্দিন জীবন থেকে সর্বস্তরের মসলা-মাসায়েলের উত্তর দিয়ে থাকেন।
৩.   ইরানে ইসলামী বিপ্লব সাধিত হয় ১৯৭৯ সালে। আর ইমাম খোমেইনী (রহ.) এই অসিয়তনামা লেখেন ১৯৮২ সালে।
৪.    উত্তর ইরানের একটি শহরের নাম
৫.   এই বাক্যটি ইমাম অত্র পৃষ্ঠার শেষে উল্লেখ করেছেন বিধায় আমরাও উল্লেখ করলাম।
৬.  যৌথমালিকানার ভিত্তিতে যে তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত।
৭.    খোমসের শাব্দিক অর্থ এক পঞ্চমাংশ। ইসলামী পরিভাষায় বাৎসরিক ব্যয়ের পর অবশিষ্ট থেকে এক পঞ্চমাংশ অর্থ বা অন্যান্য সকল কিছু (ব্যবহারিক জিনিস ছাড়া) আল্লাহ, তাঁর রাসূল (সা.) এবং এর পরে তাঁর আহলে বাইতের নিকট অর্পণ করাকে খোমস বলে।

 

হযরত ফাতেমা যাহরা (আ.) এবং নারীর ত্রিমাত্রিক ভূমিকা

হযরত ফাতেমা যাহরা (আ.) এবং নারীর ত্রিমাত্রিক ভূমিকা
[২০ জমাদিউসসানি নবীনন্দিনী হযরত ফাতেমা যাহরা (আ.) এর পবিত্র জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে এ নিবন্ধটি রচিত]

আব্দুল কুদ্দুস বাদশা

যে ব্যক্তি পৃথিবীতে ও পরলোকে উৎকৃষ্ট জীবন লাভ করতে চায় তার জন্য রাসূলুল্লাহ্ (সা.) ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের জীবনচরিতেই রয়েছে সর্বোত্তম নির্দেশনা। এ বিষয়টি এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, তাঁদের ব্যবহারিক জীবনকে আদর্শ হিসাবে অনুসরণ করা ব্যতীত কোনো মানুষের পক্ষে সেই উৎকৃষ্ট জীবন অর্জন করা সম্ভবপর নয়।
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পবিত্র আহলে বাইতের মধ্যে কেন্দ্রিয় ব্যক্তিত্ব হলেন নবীনন্দিনী হযরত ফাতেমা যাহরা (সা.)। তাঁর পূত-পবিত্র জীবনচরিত বিশেষ করে মুসলিম নারীদের জন্য সূর্যের ন্যায় আলোকবর্তিকাস্বরূপ। আজকের বিশ্ব নারীসমাজ যে সমস্ত কঠিন সমস্যায় জর্জরিত, তার বহুলাংশের নিরসন সম্ভব এই মহীয়সী নারীর জীবনাচারের সাথে পরিচিত হওয়া এবং সেখান থেকে আদর্শ গ্রহণের মাধ্যমে। বর্তমান বিশ্বে যখন পশ্চিমা পুঁজিবাদী ব্যবস্থা তার সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মাধ্যমে মুসলমান নারী ও তরুণীদের জন্য একটি অশ্লীল ও অমানবিক আদর্শ উপস্থাপন করতে চায়, তখন হযরত ফাতেমা যাহরা (আ.)-এর বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্বের সূক্ষ্ম দিকগুলো আবিষ্কার করার মাধ্যমে শুধু মুসলিম নারীর জন্য নয়, বরং গোটা বিশ্বের নারীদের জন্য একটি ব্যবহারিক জীবনাদর্শ উপস্থাপন করা যেতে পারে।
আজকের নারীর তার সত্যিকার আপন সত্তাকে খুঁজে পাওয়ার ক্ষেত্রে যত সমস্যার সম্মুখীন, সেগুলো জন্ম নিয়েছে একটি বিষয় থেকে। আর তা হল ব্যক্তিগত, পারিবারিক এবং সামাজিকÑ এই তিন ক্ষেত্রে নারীর জীবনে ভারসাম্যতা প্রতিষ্ঠিত না থাকা। অর্থাৎ তার দরকার একটি ভারসাম্যশীল জীবনাদর্শ। এক্ষেত্রে হযরত ফাতেমা যাহরা (আ.)-এর জীবনচরিতই তার জন্য সর্বোত্তম জীবনাদর্শ, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।
প্রত্যেক নারীর জন্য ধর্মীয় কর্তব্যসমূহ যথাযথ পালন ব্যতিরেকেও তিনটি ভূমিকা থাকে : ব্যক্তিগত, পারিবারিক এবং সামাজিক। হয়ত কোন কোন ধর্মে নারীর এই ত্রিমাত্রিক ভূমিকার মধ্য থেকে একটিকে অপরটি অপেক্ষা হালকা করে দেখা হয়েছে। কিংবা নারীর মঙ্গলার্থে সঠিকভাবে তা সংজ্ঞায়ন করা হয়নি। উদাহরণস্বরূপ মধ্যযুগীয় খ্রিষ্ট ধর্মে তারাই খ্রিষ্টান হতে পারতো যারা কখনো নারীর চারপাশে ঘুরবে না। একারণেই দেখা যায় যে, পাদ্রি ও পুরোহিতরা আজীবনে বিবাহ করে না। কেননা, বিবাহ হচ্ছে এমন বন্ধন যা ঈশ্বরকে ক্রোধান্বিত করে থাকে। তওরাতেও নারীদের অস্তিত্বকে মৃত্যুর চেয়ে তিতা বলে মনে করা হয়েছে। ইয়াহুদীদের প্রাত্যহিক প্রার্থনাবাণীর মধ্যে বলা হয়েছে, কৃতজ্ঞতা ঈশ্বরকে যিনি আমাকে পুরুষ হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। অথবা উপাসনালয় ও গির্জার শিক্ষায় বলা হয়েছে, নারী হচ্ছে পুরুষের সেবাকারিণী, আর পুরুষ নারীর মনিব। কখনোবা নারীকে তার সৃষ্টি-স্বভাবের দাবি অনুসারে ক্রীতদাসে পরিণত করা হয়। অবশ্য নিঃসন্দেহে সকল নবী-রাসূলই নারীর মর্যাদার প্রতিরক্ষক ছিলেন এবং তার প্রতি যে কোন ধরনের অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু বিকৃত কিতাবসমূহের বিধানাবলির কারণেই নারী তার মর্যাদা ও সম্মান হারায়।
এই বিচ্যুতির ধারা চলতে থাকে। যা এক পর্যায়ে পাশ্চাত্যে প্রতিবাদের মুখে পড়ে এবং নারীবাদী আন্দোলনে রূপ পরিগ্রহ করে। এ আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল নারী অধিকারকে পুনরুদ্ধার করা। কিন্তু পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশে বাড়াবাড়ি এমন জায়গায় পৌঁছায় যে, কিছু কিছু বিষয়, যেমন : গর্ভপাতের স্বাধীনতা, প্রজনন প্রযুক্তির যথেচ্ছ ব্যবহার, সেক্সুয়্যাল সোশ্যালিজম ইত্যাদি অবাঞ্ছিত বিষয়াবলিও বৈধ করার দাবি ওঠে। যার ফলে নৈতিক প্রতিশ্রুতিশীলতার আর কোন জায়গাই অবশিষ্ট থাকেনি। এতে শুধু যে নারীর নৈতিক দিকের খর্ব ঘটেছে, তা নয়, বরং তার সামাজিক ও অর্থনৈতিক মর্যাদাও উন্নত হয়নি। জাতিসংঘের জরিপ অনুযায়ী নারীর কর্ম ও পেশাভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গিকে তার পরিবারভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গির স্থলাভিষিক্ত করার পরও এখনও ৯০ ভাগ উপার্জন পুরুষের হাতে। অপরদিকে কর্ম-বাজারে নারীকে অতিমাত্রায় টেনে আনার কারণে পাশ্চাত্যে পরিবারের ভিত্ নড়বড়ে হয়ে পড়েছে এবং সন্তানদের মাতৃ¯েœহ ও মাতৃমমতা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। সেই সাথে সমানতালে বৃদ্ধি পেয়েছে যৌন নিপীড়ন ও নারী নিগ্রহের হার। এটা খুবই স্বাভাবিক যে, যখন স্বাধীনতার নামে নারীর সম্ভ্রম ও লজ্জাশীলতা বিস্মৃতির কবলে পড়ে, তখন ফলাফল এটা ভিন্ন অন্য কিছু আশা করা যায় না। আশার কথা হল, এই ভ্রান্ত পথের অভিজ্ঞতা আজ নারীকে পুনরায় পরিবার ও সম্ভ্রমের দিকে প্রত্যাবর্তনে চালিত করছে। কিন্তু প্রশ্ন হল একটি সঠিক শিক্ষা ও আদর্শ না থাকলে কি নারী তার ত্রিমাত্রিক (ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক) ভূমিকা যথাযথভাবে পালন করতে সক্ষম হবে?
হযরত ফাতেমা যাহরা (আ.) তাঁর ঈমান ও আকিদা-বিশ্বাসগত গুণাবলির (যা একজন মুসলমান নারীর জন্য স্বতন্ত্র) পাশাপাশি কিছু সর্বজনীন গুণ-বৈশিষ্ট্যেরও অধিকারী ছিলেন, যা সকল সম্প্রদায় ও জাতির নারীর জন্য আদর্শ হওয়ার উপযুক্ত। তিনি তাঁর জীবনধারায় ব্যক্তিগত, পারিবারিক (মা ও স্ত্রী হিসাবে) এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক ভূমিকায় নারীর জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ আদর্শ। ব্যক্তিজীবনে সরলতা ও অনাড়ম্বরতা, মানবপ্রেম ও পরোপকার, ধৈর্য ও আত্ম-ত্যাগ, লজ্জাশীলতা ও আত্ম-সম্ভ্রম ইত্যাদি মানবিক গুণাবলিতে এই মহিয়সী রমণী ছিলেন আদর্শ দর্পণস্বরূপ। এই মানবিক তাৎপর্যগুলো সর্বযুগে প্রশংসনীয় ছিল এবং থাকবে। প্রকৃতপক্ষে এগুলো মানবের সহজাত প্রবৃত্তির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। তাই এগুলো চিরসত্য। পরিবেশের প্রভাব কিংবা বস্তুগত ও প্রযুক্তিগত চাকচিক্য কোনদিন এ সত্যকে বদলাতে পারে না। অর্থাৎ পরিবেশ, প্রযুক্তি ইত্যাদি বাহ্যিক কারণে কখনো অশ্লীলতা ও মিথ্যাচার পছন্দনীয় আর লজ্জাশীলতা ও সত্যবাদিতা নিন্দনীয় হয়ে যায় না। হযরত ফাতেমা যাহরা (আ.)-এর জীবনচরিত প্রকৃতপক্ষে নির্দেশ করে যে, ইসলাম চুলচেরা মনোযোগের সাথে ব্যক্তির সুস্থতা ও নিরাপত্তা এবং তারই সূত্র ধরে সমাজের সুস্থতা ও নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তা করে। তাই তো দেখা যায় যখন তাঁকে প্রশ্ন করা হয় ‘নারীর জন্য সবচেয়ে উত্তম কী?’- এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘নারীরা পুরুষদেরকে দেখবে না, আর পুরুষরা নারীদেরকে দেখবে না’। প্রকৃতপক্ষে তাঁর এ উক্তি থেকে যা উপলব্ধ হয়, সেটা হল সমাজের নৈতিক ও সামাজিক সুস্থতা ও নিরাপত্তার চাবিকাঠি নিহিত রয়েছে নারীদের সম্ভ্রম সংরক্ষণ ও পর্দানশীন থাকার মধ্যে। দুঃখজনকভাবে আজ যা শুধু পাশ্চাত্য সমাজেই নয়, মুসলিম সমাজগুলোতেও প্রচ-ভাবে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের কবলে পড়েছে।
হযরত ফাতেমা যাহরা (আ.) পারিবারিক জীবনের পরিসরে এবং মা ও স্ত্রী হিসাবে ভূমিকা রাখার ক্ষেত্রে ইসলাম প্রদত্ত সর্বতো অধিকার ভোগ করেন, যে অধিকার অন্য কোন মতাদর্শে কিংবা ধর্মে এমনকি চিন্তাও করা যায় না। পাশাপাশি তিনি স্বীয় ধর্মীয় কর্তব্যসমূহকে সর্বোত্তমভাবে পালন করেন। ইসলামে নারী নিজের জন্য কিংবা তার পরিবারের জন্য কাজ করতে বাধ্য নয়। নারীর ভরণপোষণ বহন করা শরয়ীভাবে পুরুষের ওপর ওয়াজিব। এমনকি এই যে নারী পরিবারে শিশুকে দুধ পান করায়, এ বাবদ স্বামীর নিকট থেকে অর্থ গ্রহণের অধিকার ছাড়াও অন্যান্য অধিকার তার রয়েছে। কিন্তু ফাতেমা যাহরা (আ.) অন্য কোন কিছুর আগে নিজের মাতৃত্ব ও স্ত্রীত্বের ভূমিকার প্রতি বেশি আকৃষ্ট ছিলেন, যা বর্তমানে অনেক পরিবারে চোখে পড়ে না। নারী যখন একাকীত্বের ভয়ে কিংবা অর্থ-সম্পদ না থাকার ভয়ে বিবাহে ব্রতী হয়, অথবা বিবাহের পূর্বে বিচিত্র সম্পর্কের জগতকে পরখ করে আসে, তখন তার ফলাফল দাঁড়ায় শ্বেত বিবাহ, সিঙ্গেল মাদার, আলাদা পরিবার, নিঃসন্তান দম্পতি, পরিচয়হীন সন্তান, যথেচ্ছ বিবাহবিচ্ছেদের মত ঘটনাবলির দৌরাত্ম্য। আর এই সবকিছুর কুফল হল ভয়ানক আত্মিক ও মানসিক সমস্যার অশান্তি। কেউ বা মাদকাসক্তির মধ্যে ডুব দেয়। আবার কেউ বা বেছে নেয় আত্মহননের পথ। সুতরাং পরিবারে নারীর মা ও স্ত্রী হিসাবে ভূমিকা পালনের প্রতি অকৃত্রিম আগ্রহ ও ভালবাসা যে জীবনের বুনিয়াদ রচনা করে, তা মানব জীবনযাত্রাকে সুদৃঢ়করণ, সুযোগ্য সন্তান-সন্ততি লালন পালন এবং সৌভাগ্যবান সমাজ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখে।
আরেকটি বিষয় হল, ইসলামের বিরুদ্ধে যে কু-ধারণা ও অপপ্রচার চালানো হয়ে থাকে যে, এখানে নারীরা ঘরে বন্দি, তা মোটেও সত্য নয়। বরং ইসলামে শুধু যে সমাজে নারীর সক্রিয় উপস্থিতিকে নিষেধ করা হয়নি, বরং সমাজে তাদের ভূমিকা রাখতে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। ফাতেমা যাহরা (আ.) সর্বকালের নারীদের আদর্শ হিসাবে সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে উপস্থিত ছিলেন। তবে এ উপস্থিতি কিরূপে হবে সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। যেমনটা আজকে বিভিন্ন সমাজে পরিলক্ষিত হয় যে, নারীদের অজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে এবং চমকপ্রদ সব স্লোগান ব্যবহার করে তাদেরকে কেবল রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য উপকরণের ন্যায় ব্যবহার করা হচ্ছে। কাজেই সমাজ ও রাজনীতির অঙ্গনে নারীদের উপস্থিতির অন্যতম পূর্বশর্ত হল নারীর মর্যাদা সুরক্ষিত থাকা। অর্থাৎ সমাজে এই উপস্থিতি যেন নারীর মানবিক মর্যাদায় আঘাত হানার কারণ না হয়। পাশ্চাত্যে নারীমুক্তির যেসব স্লোগান দেওয়া হয়ে থাকে সবই অন্তঃসারশূন্য। বাস্তবিকপক্ষে তা নারীর স্খলনের পথকেই প্রশস্ত করে থাকে। কেননা, তাদের বিভিন্ন ধরনের অধিকার ও স্বাধীনতার কথা বলা হয়। যেমন ভোট প্রদানের অধিকার, গর্ভপাতের অধিকার, বিনাদোষে বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকার, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, যৌন স্বাধীনতা, রাজনীতি সমাজ ও অর্থনীতিতে ব্যাপকভিত্তিক উপস্থিতির স্বাধীনতা ইত্যাদি। ফলে বিবাহের বয়স ও সিঙ্গেল লাইফের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া, পরিবার ভেঙ্গে যাওয়া, বিবাহ বিচ্ছেদ বেড়ে যাওয়া, দুই লিঙ্গের মাঝে দ্বান্দ্বিক মনোভাব সৃষ্টি, নারীত্ব ধ্বংসকরণ এবং নারীদের পরিচয় সঙ্কট, পৌরুষত্বের দুর্বলীকরণ, ব্যক্তি ও সমাজের সীমানা তুলে দেওয়া, সমকামিতার প্রচলন, গর্ভপাত সৃষ্টির মাধ্যমে নারীদের পুঁজিবাদের সেবায় উপকরণসর্বস্ব হয়ে পড়া, সেক্স ইন্ডাস্ট্রি গড়ে ওঠা ইত্যাদি সমস্যা আজ প্রকট রূপ ধারণ করেছে।
নারীদের সামাজিক অঙ্গনে উপস্থিতির আরেকটি পূর্বশর্ত হচ্ছে তা যেন তাদের মাতৃত্ব ও স্ত্রীত্বের ভূমিকা পালনে বাধা না হয়। পাশ্চাত্যে নারীমুক্তি আন্দোলনসমূহের সূত্র ধরে যে ভ্রান্তিটা জন্ম নেয় তাতে নারীর মা ও স্ত্রী হিসাবে ভূমিকা পালন করা দুষ্কর হয়ে পড়ে এবং সামগ্রিকভাবে পরিবার বন্দি হয়ে পড়ে। যা স্বাধীনতা বাস্তবায়নের পথে অন্তরায়। আরেকটি শর্ত হল সমাজে নারীর কার্যকর উপস্থিতি। পাশ্চাত্য মনে করে নারীর কার্যকর উপস্থিতি শুধু তাদের দৈহিক আবির্ভাবের মাধ্যমেই সম্ভব। এর ফলে পাশ্চাত্য দৃষ্টিকোণ থেকে নারী তার ব্যক্তিগত স্বাধীনতা সত্ত্বেও কেবল বাহ্যিকভাবে গুরুত্ব পেয়েছে, যে দৃষ্টিভঙ্গি আজকের পশ্চিমা নারীকে অসহায় ও মরিয়া করে তুলেছে। অথচ ইসলামে নারীর এই উপস্থিতি তার কার্যকারিতা সহকারে নির্দেশিত হয়েছে। যেমনটা আমরা দেখতে পাই উহুদের যুদ্ধে হযরত ফাতেমার উপস্থিতি একজন চিকিৎসক হিসাবে। আহযাবের যুদ্ধে পরিখা খনন করার সময় তাঁর সক্রিয় উপস্থিতি, বাগে ফাদাক এর পরিচালনা, নারীদের জন্য ধর্মীয় জিজ্ঞাসাসমূহের উত্তর প্রদানের জন্য জলসার আয়োজন ইত্যাদি। তাছাড়া ইসলামের ক্রান্তিলগ্নে মুনাফিকদের তাবত চক্রান্তকে নস্যাৎ করে দিয়ে ইসলামকে রক্ষার্থে তাঁর মসজিদে নববীতে হাজির হওয়া এবং অগ্নিঝরা বক্তৃতার মাধ্যমে মুনাফিকদের কূট্চক্রান্তকে ফাঁস করে দেওয়াÑ এ সকল ঘটনাই সমাজে নারীর ইতিবাচক কার্যকর উপস্থিতির একেকটি দৃষ্টান্ত, যা অমুসলিম নারীদের জন্যও প্রযোজ্য। নারীর ত্রিমাত্রিক ভূমিকার উপরোক্ত এ বিশ্লেষণ থেকে প্রতিপন্ন হয় যে, আজ যেসকল বিষয় নারীর স্কন্ধে ন্যস্ত করা হয়েছে সেগুলোর অনেক কিছুই প্রাসঙ্গিকতা হারায়। কারণ, তা নারীর মর্যাদা ও ইতিবাচক কার্যকর উপস্থিতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় তাকে এ পরিস্থিতি থেকে বের করে আনতেই হবে। ফাতেমা যাহরা (আ.)-এর জীবনচরিতই হোক নারীর জীবনাদর্শ।