ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী –
দিনের বেলা আকাশে দেদীপ্যমান সূর্যকিরণ বিলায়। রাতে চাঁদের জোছনা ঘুমন্ত পৃথিবীর উপর শান্তি সুখের শামিয়ানা টানায়। তার সাথে অগণিত গ্রহতারার মিটিমিটি বাতি যদি না থাকে এই পৃথিবী অন্ধকারে ডুবে যাবে, ভুতুড়ে মৃত্যুপুরিতে পরিণত হবে। মানবসভ্যতার আকাশে চাঁদসূর্য তারকারাজির আলোর মেলার সাথে তুলনা করা যায় প্রত্যেক জাতির সাহিত্য সম্ভারকে। কারণ, কবি, সাহিত্যিক, চিন্তাবিদ ও তাঁদের রচনা ও সাহিত্যকর্ম মানব সমাজকে সত্য ও সুন্দরের পথ দেখায়। আকাশের গ্রহ-তারকা হয়ে মানব সভ্যতার সাজানো মঞ্চে আলো বিকিরণ ঘটায়।
বিশ^সভ্যতার আলোকসজ্জা সাহিত্য ভা-ারের একটি হচ্ছে ফারসি ভাষা ও সাহিত্য। ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের আকাশে রয়েছে অসংখ্য অগণিত গ্রহ-নক্ষত্র দুর্লভ প্রতিভা, যাঁরা মানব জাতিকে সত্য, সুন্দর, প্রেম ও মানবীয় গুণাবলিতে সজ্জিত হওয়ার পথ দেখিয়েছেন, এখনো দিকপালের ভূমিকায় বাতিঘর হয়ে রয়েছেন। এসব মনীষীর অমর সাহিত্যকর্ম বিশ^সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। সেই সম্পদ সম্ভারের একটি হচ্ছে শেখ সাদীর ‘বূস্তান’। ‘গুলিস্তান’ ও ‘বূস্তান’ শেখ সাদীর জগদ্বিখ্যাত রচনা। এ দুটি গ্রন্থ ফারসি ভাষায় রচিত। ‘গুলিস্তান’ গদ্য সাহিত্য, তবে প্রতিটি বাক্যে রয়েছে ভাষার ঝংকার, ছন্দের সমাহার আর মাঝে মাঝে কবিতার পুষ্পমাল্য সাজানো। আর ‘বূস্তান’ একেবারে পদ্য রচনা।
‘গুলিস্তান’ ও ‘বূস্তানকে’ আমরা ফারসির জগতে আঁধার রাতের প্রদীপের সাথে তুলনা করতে পারি। গ্রামীণ জীবনে সন্ধ্যালগ্নে যখন ঘরের বাইরে চেরাগ জ¦ালানো হয়, চারিদিক থেকে প্রেমাসক্ত কীটপতঙ্গ উড়ে উড়ে জড়ো হয়। তারা ঘুরতে থাকে। নীরবে অশ্রু বিসর্জন দেয়। প্রদীপের আলোতে আত্মাহুতি দিয়ে প্রেমের চরম পরাকাষ্ঠা দেখায়। প্রাণটা বিসর্জন দিতে মুখে ‘উহ’ শব্দটিও আনে না প্রেমের অনুরাগে। বস্তুত শেখ সাদী ‘গুলিস্তান’ ও ‘বূস্তান’ রচনার পর থেকে এই দুটি প্রদীপের উপর সাহিত্যের কত প্রেমাক্ত আত্মহারা হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে তার পরিসংখ্যান কারো জানা নেই।
শেখ সাদীর পুরো নাম ফারসি উইকিপিডিয়ার মতে আবু মুহাম্মদ মুশাররফ উদ্দীন মুসলেহ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে মুশাররাফ সাদী (৬০৬-৬০ হিজরি) । খ্রিস্টীয় পঞ্জিকার হিসেবে জন্ম ১২১০ খ্রিস্টাব্দ আর মৃত্যু ১২৯১ বা ১২৯২ সাল। শেখ সাদী নামটি আমাদের মাঝে এতো পরিচিত স্মরণীয়-বরণীয় হলেও তিনি কিন্তু আমাদের দেশের বা বাংলা ভাষার কবি নন। দুনিয়ার বুকে এসেছিলেন আজ থেকে সাড়ে সাতশ’ বছর আগে প্রাচীন পারস্যের রাজধানী শিরাজে। তিনি কবি-সাহিত্যিকদের স্বপ্নের দেশ ইরানের কবি। সাহিত্যচর্চা করেছেন ফারসি ভাষায়। মাঝে মধ্যে আরবি রচনাও স্থান কাল অতিক্রম করে চিরন্তনতা পেয়েছে তাঁর রচনায়। আমাদের দেশে মসজিদে মাহফিলে একটি না’তে রাসূল (সা.) পাঠ করা হয় পরম ভক্তিতে পবিত্র চেতনায়। নবী করিম (সা.) এর প্রতি উম্মতের ভালোবাসা ও আবেগের সবটুকু উজাড় করা হয় মাত্র চার লাইনের এই কবিতায়। বালাগাল উলা…-এর সাথে আমাদের দেশের ছোট বড় প্রায় সবাই পরিচিত। দুনিয়ার তাবৎ রাসূলপ্রেমিকের জপমালা ‘বালাগাল উলা’র চতুষ্পদি কবিতাটি রয়েছে শেখ সাদীর ‘গুলিস্তান’-এর ভূমিকায়। এ নিয়ে আমার একটি আলাদা পুস্তিকা আছে, তাতে আমাদের জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম ‘বালাগাল উলা’র যে অসাধারণ অনুবাদ করেছেন তার উপর বিশদ আলোচনা করেছি। তবে বইটি বাজার থেকে উধাও। আবার ছাপানোর তাগাদা পূরণ করতে পারছি না। ‘গুলিস্তান’ ফারসি ভাষায় রচিত হলেও ‘বালাগাল উলা’ রচিত হয়েছে আরবিতে। তাতে প্রমাণিত হয় ‘গুলিস্তান’ বা শেখ সাদীর রচনার ভাবে ও ভাষায় রয়েছে আরবির মিশেল।
জানার বিষয় হলো, শেখ সাদী তাঁর ‘গুলিস্তান’ ও ‘বূস্তান’-এ মানব সভ্যতার জন্য এমন কী উপঢৌকন রেখে গেছেন, যার আবেদন এখনো কালজয়ী। গবেষকরা একমত, মানবতা, মানব প্রেম, মনুষ্যত্বের অলঙ্কার সুন্দর চরিত্র, জীবনাচার আর সদুপদেশের শৈল্পিক উপস্থাপনায় এই দুটি গ্রন্থ ফারসি ভাষায় তো বটেই, বিশ^সাহিত্যে নজিরবিহীন। গুলিস্তানে গুল মানে ফুল স্তান অর্থ অনেকটা বাংলায় স্থানের মতো। মানে যেখানে ফুল পাওয়া যায়। ফুলের কানন। গুলশান মানেও ফুলবাগান। আমাদের রাজধানী ঢাকায় দুটি প্রধান জনবহুল কেন্দ্রের নাম গুলিস্তান ও গুলশান।
ঢাকার গুলিস্তান সাধারণ মানুষের সমাগমে মুখরিত। আশপাশে রয়েছে জাতীয় স্টেডিয়াম, জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম, বঙ্গবন্ধু এভিন্যু, অদূরে প্রেসিডেন্ট হাউজ বঙ্গভবন। আগে এটিই ছিল সারা দেশের মূল যোগাযোগ-পরিবহনের প্রাণকেন্দ্র। টেলিযোগাযোগের প্রধান কেন্দ্র এখনো এখানেই অবস্থিত। কমলাপুরে রেল স্টেশন হওয়ার আগে গুলিস্তান ছিল সারা দেশের কেন্দ্রীয় রেল স্টেশন। সত্তরের দশকের শেষ দিকেও এখান থেকে বাসে চেপে দূর পাল্লার গাড়িতে চট্টগ্রাম গিয়েছি। রাজধানীর ভেতরের চলাচলরত বাসগুলো এখনো গুলিস্তান থেকে ছেড়ে যায়। ঢাকার উত্তরাংশের গুলশান ১ ও ২ বিশাল অভিজাত এলাকা ও কূটনৈতিক পাড়া।
শেখ সাদীর ‘গুলিস্তান’ ইরানের প্রাচীন রাজধানী শিরাজে অবস্থিত। ফুল দূর থেকে দেখে চোখ জুড়ায়, মন ভুলায়। কাছে এলে খুশবুতে আমোদিত করে। বূস্তানের বূ মানে খূশবু। তার মানে বূস্তানের কাছে এলে তার সুবাসের মোহ মায়ায় সমঝদার লোকেরা আত্মহারা হয়ে যায়। ইরানি গবেষকরা বলেন, বূস্তান আরবি বোস্তান হতে ফারসিতে রূপান্তরিত। মানে বাগান। বূস্তানের সঠিক পরিচয়ের জন্য আমরা এর রচনার প্রেক্ষাপট বিবেচনায় আনতে পারি। শেখ সাদী নিজেই এই প্রেক্ষাপট ব্যক্ত করেছেন কবিতায় বূস্তানের ভূমিকায়। কবিতায় তাঁর ভাষার লালিত্য ও মমতা কিছুতেই ভাষান্তর করা সম্ভব নয়। এরপরও আমরা শেখ সাদীর মনের কথাটি বুঝবার চেষ্ট করব।
در اقصای عالم بگشتم بسی
بسر بردم ایام با هرکسی
দার আকসা’য়ে আ’লাম বেগাশতাম বাসী
বসর বোর্দাম আইয়া’ম বা’ হারকেসী
বিশে^র আনাচ কানাচে আমি অনেক ঘুরেছি
দিনকাল কাটিয়েছি সবার সাথে মিলেমিশি।
تمتع به هر گوشه یی یافتم
زهر خرمنی خوشه یی یافتم
তামাত্তু বে হার গূশেয়ী য়া’ফতাম
যে হার খেরমানী খোশেয়ী য়া’ফতাম
যেখানে গিয়েছি পেয়েছি জীবনের পাথেয়
প্রতিটি ফলফুলের এক গুচ্ছ করেছি সংগ্রহ।
چو پاکان شیراز خاکی نهاد
ندیدم که رحمت براین خاک باد
চো পা’কা’নে শীরা’যে খা’কী নেহা’দ
নাদীদাম কে রাহমত বার ইন খা’ক বা’দ
শিরাজের পবিত্র মনের মাটির মানুষ কোথাও
দেখিনি, এই মাটির উপর হোক রহমত অবারিত!
تولای مردان این پاک بوم
برانگیختم خاطر از شام و روم
তাওয়াল্লায়ে মারদা’নে ইন পা’ক বূম
বার আঙ্গীখতাম খা’তের আয শা’ম ও রূম
এই পবিত্র ভূমির মানুষদের ভালোবাসার টানে
মনের আকর্ষণ ছিন্ন করেছি রোম, সিরিয়ার সাথে।
دریغ آمدم زانهمه بوستان
تهی دست رفتن سوی دوستان
দারীগ আ’মাদাম যে আনহামে বূস্তা’ন
তুহী দাস্ত রাফতান সূয়ে দুসতা’ন
খারাপ লাগছিল কীভাবে এসব বূস্তান ছেড়ে
খালি হাতে ফিরে যাই প্রিয়জনদের মাঝে।
শেখ সাদী বলছেন, দুনিয়ার আনাচে কানাচে আমি অনেক ঘুরেছি। পরিস্থিতির চড়াই-উতরাইয়ের সাথে পাল্লা দিয়েছি। নানা জনের সাথে মিশেছি। যেখানে যা পেয়েছি জীবনের পাথেয় সংগ্রহ করেছি। বাস্তবতা হল, শিরাজের বাসিন্দাদের মতো পবিত্র মনের মাটির মানুষ দুনিয়ার কোথাও আমি দেখিনি। শিরাজ ভূমির উপর আল্লাহর রহমত অবারিত হোক! স্বদেশ প্রেম, স্বদেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসার উজ্জ্বল নমুনা সাদীর এই অভিব্যক্তি। তিনি আরো বলেন, পবিত্র ভূমি শিরাজের জনগণের ভালোবাসার টানে যখন রোম-সিরিয়ার মায়ার বাঁধন ছেড়ে স্বদেশে ফিরে আসার মনস্থ করলাম, তখন মনটা ভারী হলো এই ভেবে যে, কীভাবে সুন্দর সুবাসিত এসব বূস্তানের প্রবাস জীবন থেকে খালি হাতে স্বদেশবাসীর মাঝে ফিরে যাব। বস্তুত প্রবাস জীবনের অর্জিত অভিজ্ঞতা ও সঞ্চয়ের সওগাত হলো এই বূস্তান, খুশবুতে আমোদিত ফুলবন। শেখ সাদী অন্যত্র বলেন,
گل آورده سعدی سوی بوستان
بشوخی و فلفل به هندوستان
গোল আ’ওয়ার্দে সাদী সূয়ে বূস্তা’ন
বেশওখী ও ফেলফেল বে হিন্দুস্তা’ন
সাদী ফুলের ডালি নিয়ে এসেছে বূস্তানের পানে
এ যেন মরিচের সওগাত নিয়ে যাওয়া হিন্দুস্তানে।
হিন্দুস্তান মরিচের জন্য বিখ্যাত। কেউ যদি একহালি মরিচ উপহার নিয়ে হিন্দুস্তানে যায় বড় বেমানান হবে। শিরাজও হচ্ছে ফুলের কানন। কাজেই ফুল উপহার নিয়ে ফুলের বনে বেড়াতে যাওয়াও বড্ড বেমানান। আমার জন্যও শিরাজের ফুলের জলসায় ফুলের নজরানা নিয়ে হাজির হওয়া নিশ্চয়ই বেমানান। এখানেও শিরাজের প্রতি মহাকবি শেখ সাদীর বিন¤্র বিনয়ের নিবেদন সত্যিই অভিনব।
দীর্ঘ সফর জীবনের তিতা-মিঠা হরেক রকম অভিজ্ঞতার সঞ্চয় ‘বূস্তান’। কবিতার এই ফুলের ডালি তিনি উপহার দিয়েছেন প্রথমে স্বদেশবাসীর করকমলে। তারপর মানব সভ্যতার বিশাল জলসায়। সেই উপহার বিশ^সমাজ প্রাণ ভরে নিয়েছে। তাই সাড়ে সাতশ’ বছর পরও ভিন দেশের মানুষের কাছেও ‘গুলিস্তান’, ‘বূস্তান’ এর এতো কদর। আর শেখ সাদীর নাম শুনলে সবাই ভাবে একান্ত কাছের প্রাণের প্রিয়জন। সম্পূর্ণ কবিতায় লেখা ‘বূস্তান’-এ দ্বিপদী শ্লোকের সংখ্যা প্রায় ৫ হাজার। ‘বূস্তান’-এর আলোচ্য বিষয়ের মধ্যমণি মানুষ। মানব জীবনকে সাজানোর নীতিমালা, সুন্দর সহযোগিতাপূর্ণ সমাজ পরিচালনার রূপরেখা, দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন, জুলুমের অবসান ও সুন্দরের পরিচর্যা, রাষ্ট্রপরিচালনার ঐতিহ্যনির্ভর নির্দেশনা আর প্রেমপ্রীতির বন্ধনে পরিবার ও গোটা মানব সমাজকে আত্মীয়তার চেতনায় উজ্জীবিত করার উপদেশমালার বিশাল সম্ভার ‘বূস্তান’। বর্ণনার প্রতিটি স্তরে রয়েছে আধ্যাত্মিক চেতনার স্ফুরণ, মিথ্যা ভ-ামি ও প্রতারণার অবলোপন আর চারিত্রিক অসঙ্গতি দূর করার তীব্র তাগাদা।
‘বূস্তান’-এর রচনাকাল ৬৫৫ হিজরি। তখন শিরাজের শাসনক্ষমতায় ছিলেন আতাবক বংশের রাজা আবু বকর ইবনে সাদ। শেখ সাদী ন্যায়পরায়ন শাসক ইবনে সাদ এর নামানুসারে নিজের কবিনাম গ্রহণ করেন সাদী আর অমূল্য গ্রন্থটি উৎসর্গ করেন আবু বকর ইবনে সাদ এর নামে। এই উৎসর্গ ইবনে সাদ এর হাত হয়ে এখন গোটা মানব সভ্যতার জন্য সওগাত। গবেষকরা বলেছেন, মানব সমাজে সর্বস্তরের মানুষের সামনে পেশ করার উপযোগী একক পূর্ণাঙ্গ সাহিত্যকর্ম ‘বূস্তান’। এর মতো কোনো পূর্ণাঙ্গ সাহিত্যকর্ম জগতের কোনো কবি-সাহিত্যিক বা মনিষী রচনা করতে পারেন নি। এই দাবিটি করেছেন ‘বূস্তান’-এর টীকাকার ইরানের সর্বমহলে সমাদৃত সাহিত্য ব্যক্তিত্ব ড. মুহাম্মদ খাযআলী।
‘বূস্তান’-এর গল্পরীতির ধরন অনুমানের জন্য আমরা একটি গল্পের উপর আলোকপাত করতে পারি। ‘বূস্তান’-এর গল্পের বেশকিছু চরিত্রের নায়ক পশুপাখি। এই রীতি বিশ^খ্যাত সাহিত্যকর্মের আচরিত ও স্বীকৃত রেওয়াজ। এক বুড়ির বাড়িতে একটি আদুরে বিড়াল ছিল। বিড়াল বেশ কিছুদিন ক্ষুধার জ¦ালা সয়ে যাচ্ছিল। একদিন একটি ইঁদুর পেল শিকার হিসেবে। ঠিক সে সময় বিড়ালের কাছে খবর পৌঁছে পাশে আমীরের বাড়িতে যেয়াফতের মহাধুমধাম। ওখানে পেটভরে সুস্বাদু খাবার খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তোলার বিরাট সুযোগ। বিড়াল তার শিকার ছেড়ে চলে যায় পাশে আমীরের বাড়ির যেয়াফতে। কিন্তু বিধিবাম। সুলতানের চাকররা দেখে ফেলে বিড়ালের লুকিয়ে লুকিয়ে পথ চলা। তারা বিড়ালকে নিশানা বানায় তীর বর্শার। নিষ্ঠুরভাবে তাড়িয়ে দেয় যেয়াফত হতে। খাবারের উপর পাঞ্জা বিস্তারের আগেই শুরু হয় বেচারা বিড়ালের গায়ে রক্তক্ষরণ। বিড়াল বুঝতে পারে তার জীবনের শেষ সময়। তখন করুণ চাহনিতে উপদেশের সুরে লোভী মানুষের উদ্দেশে বলে, ‘ডালভাতে তুষ্ট থাকাই উত্তম। লোভে পড়ে মধু খেতে গেলে হুলের দংশনই তার ভাগ্যে জুটে।’
‘গুলিস্তান’-এর মতো ‘বূস্তান’ও আট অধ্যায়ে বিন্যস্ত। আমরা এখানের শিরোনামগুলোর পরিচয় দেয়ার চেষ্টা করব।
باب اول در عدل و تدبیر ورای বাবে আউয়াল দার আদ্ল ও তাদবীর ও রা’য়
প্রথম অধ্যায় : ন্যায়-ইনসাফ, রাষ্ট্রপরিচালনা, মত ও সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গ
সে যুগে রাজা-বাদশাহদের কোনো কাজের সমালোচনা বা সংশোধনের চেষ্টা করা ছিল মৃত্যুদ-যোগ্য অপরাধ। এ ক্ষেত্রে শেখ সাদী এক অভিনব পন্থা অবলম্বন করেন রাজা-বাদশাহদের সংশোধনের উদ্দেশ্যে। তিনি ‘বূস্তান’-এর প্রথম অধ্যায় রচনা করেন রাজা-বাদশাহদের শাসনকার্য ও ন্যায়-ইনসাফের গুরুত্ব নিয়ে। অতীত-বর্তমানের নানা প্রসঙ্গ টেনে সুশাসনের বিষয়টি তুলে ধরেন এবং রাজ্য রক্ষায় জনগণের শান্তি ও সুখের গুরুত্ব এবং ন্যায়বিচারের ভূমিকার উপর শৈল্পিক ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করেন। রাজা-বাদশাহদের চিন্তা, মতামত ও সিদ্ধান্তের গুরুত্ব কতখানি সে ব্যাপারে শাসকবর্গকে সজাগ করেছেন। বলেছেন, দেশের শান্তিসুখের চাবিকাঠি হচ্ছে জনগণ তথা সৃষ্টির সুরক্ষা আর ¯্রষ্টার আদেশ নিষেধের সযতœ পরিপালন।
باب دوم در احسان বাবে দোওওম দার এহসা’ন
দ্বিতীয় অধ্যায় : মাহনুভবতা প্রসঙ্গে
মানবতার সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ ও সর্বশ্রেষ্ঠ সুষমা হচ্ছে মহানুভবতা বা অন্যের প্রতি দয়া, উদারতা ও অনুগ্রহ। শেখ সাদী দেখিয়ে দিয়েছেন কীভাবে রাষ্ট্রনীতিকে মহানুভবতার উপর প্রতিষ্ঠিত করা যায়। তিনি প্রমাণ করেছেন মেকিয়াভেলীর রাজনীতির দ্বিমুখিতা ও ভ-ামি চরিত্র কত ঘৃণ্য, কৌশল হিসেবে ব্যর্থ ও পরিত্যাজ্য।
باب سوم در عشق ومستی و شور বাবে সেওওম দার এশকো মাস্তী ও শূর
তৃতীয় অধ্যায় : প্রেম, আসক্তি ও উন্মাদনা প্রসঙ্গে
শেখ সাদী নিজেই প্রেমের শরাবে মাতোয়ারা। তিনি চেয়েছেন বিশ^সভায় প্রেমের বীজ ছড়িয়ে দেবেন। বিশ^ প্রেমের আবহ তৈরির প্রয়োজনে তাঁর লেখুনি ক্ষুরধার অথচ মায়াময়। সৃষ্টির প্রেম থেকে কীভাবে ¯্রষ্টার প্রেমে উত্তরণ ঘটানো যায়, সেই পথ বাৎলে দিয়েছেন তিনি এই অধ্যায়ের কাহিনীগুলোয় কবিতার পসরা সাজিয়ে।
باب چهارم در تواضع বাবে চাহারোম দার তাওয়া’যু
চতুর্থ অধ্যায় : বিনয় প্রসঙ্গ
বিনয়ী জীবন বলতে কী বুঝায়, বিনয় মানুষকে কোন্্ উচ্চতায় নিয়ে যায়, বিনয় কার জন্য শোভন, কার জন্য অশোভন সেসব সূক্ষ্ম তত্ত্ব ব্যক্ত হয়েছে এ অধ্যায়ে। তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন মানব জীবনকে সুন্দর সুষমাম-িত করতে হলে চলনে বলনে থাকতে হবে বিনয়।
باب پنجم در رضا বাবে পাঞ্জোম দার রেযা’
পঞ্চম অধ্যায় : সন্তুষ্টি প্রসঙ্গে
মানব জীবনের সৌন্দর্যের প্রধানতম অলঙ্কার তাওয়াজু বা বিনয়। বিনয়ের মধ্য দিয়ে আল্লাহর প্রতি সমর্পিত জীবনের মহিমা প্রকাশ পায়। এই সৌন্দর্যগুলো তিনি গল্প আর গল্পের আসরে আমাদের কাছে বলে গেছেন অসাধারণ কাব্যরসের একেক আসরে।
باب ششم در قناعت বাবে শেশুম দর কানাআত
ষষ্ঠ অধ্যায়: অল্পেতুষ্টি প্রসঙ্গ
ইসলামের আধ্যাত্মিক সাধনায় যে ধরনের জীবন গড়ার তাগিদ দেয়া হয় তাতে থাকে বিনয়, সন্তুষ্টি ও অল্পেতুষ্টি। শেখ সাদী আধ্যাত্মিক অবহে নির্লোভ অল্পেতুষ্টির জীবনে কী সুখ ও শান্তি নিহিত তার মহিমা গেয়েছেন এই অধ্যায়ে।
باب هفتم در عالم تربیت বাবে হাফতোম দার আ’লামে তারবিয়াত
সপ্তম অধ্যায় : শিক্ষার জগৎ
শিক্ষাই মানব জীবনকে উন্নত ও মহিমান্বিত করে, এই সত্যটি দুনিয়ার সবাই বিশ^াস করে। তাই দেশে দেশে জাতিতে জাতিতে এত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কিন্তু মনুষ্যত্বের উন্নয়ন সাধন করে প্রকৃত সোনার মানুষ বানানোর শিক্ষা কোন্্টি শেখ সাদী গল্পের আসরে তার পথ ও প্রক্রিয়া বাৎলে গেছেন মানব জাতির উদ্দেশে। জ্ঞান ও প্রজ্ঞার মহিমা নিয়ে দুনিয়ার তাবৎ মনীষি নির্দেশনা দিয়েছেন তাঁদের রচনায়। ইমাম গাযযালী ‘নাসিহাতুল মুল্্ক’ গ্রন্থে দুটি অধ্যায় বরাদ্দ করেছেন শিক্ষা দীক্ষা ও মনীষীদের প্রজ্ঞার আলোচনা নিয়ে। শেখ সাদীর অপর গ্রন্থ ‘গুলিস্তান’ কিতাবের সপ্ত অধ্যায়টির আলোচ্য বিষয়ও হচ্ছে তারবিয়াত বা শিক্ষা ও দীক্ষা। শেখ সাদীর শিক্ষা দর্শনের মূল কথা নিজের ও অন্যের অধিকার চিনতে হবে। ভুলত্রুটি ও দোষখাতা বর্জন করার প্রেরণা থাকতে হবে। এই পথে মানুষ নিজেকে চিনবে আর আত্মপরিচয়ের সূত্র ধরে আপন ¯্রষ্টাকে চিনবে আর ¯্রষ্টার তরফ হতে অর্পিত নিজের দায়িত্ব পালনে যতœবান হবে।
باب هشتم در شکر بر عافیت বাবে হাশতোম দার শোক্্র বার আ’ফিয়াত
অষ্টম অধ্যায় :সুস্থতার শোকরিয়া প্রসঙ্গ
পৃথিবীতে মানুষকে দেয়া আল্লাহর অন্যতম শ্রেষ্ঠ নেয়ামত সুস্থতা। সুস্থ থাকতে হলে এর গুরুত্ব বুঝতে হবে। তখনই মানুষ সুস্থতার পক্ষের বিষয়গুলো অর্জন আর বিপক্ষের বিষয়গুলো বর্জনে যতœবান হবে। কাজেই মানুষ যেন সুস্থতার জন্য নিয়ত আল্লাহর দরবারে কৃতজ্ঞ থাকে। তার কথা ও আচরণে সেই শোকরিয়া ও কৃতজ্ঞতা বোধের প্রকাশ ঘটে কবিতার ছন্দে সাদী সেই প্রেরণার সুর তুলেছেন মানুষের হৃদয়তন্ত্রীতে।
باب نهم در توبه و راه صواب বাবে নোহোম দার তাওবা ও রা’হে সাওয়া’ব
নবম অধ্যায় : তওবা ও সঠিক পথ প্রসঙ্গে
তওবা ও আল্লাহর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনার মধ্য দিয়ে মানুষ কীভাবে সঠিক পথের সন্ধান পেতে পারে সেই আবেদন নিয়ে শেখ সাদী তাঁর ‘বূস্তান’-এর নবম অধ্যায় সাজিয়েছেন।
باب دهم در مناجات বাবে দাহোম দার মোনাজাত
দশম অধ্যায় : মোনাজাত প্রসঙ্গে
‘বূস্তান’-এর দশম অধ্যায়ের বিষয়বস্তু আল্লাহর দরবারে হৃদয়কাড়া আর্তি আর্জি।
ختم کتاب খতমে কিতাব
কিতাবের সমাপনীতে শেখ সাদীর অনুভূতি, সৃষ্টিজগতের সবকিছু আল্লাহর। তাঁর রচনার পরতে পরতে আল্লাহরই অনুগ্রহ ও দয়ার প্রকাশ।
আমাদের দেশে আধ্যাত্মিক সাধনা বলতে বুঝায় দুনিয়ার ঝক্কি ঝামেলা দূরে ঠেলে মসজিদে খানকায় বসে তপজপ করা। এক শ্রেণির মানুষের ধারণা দুনিয়াকে বর্জন না করলে আধ্যত্মিক উন্নতি সম্ভব হবে না। এই মতবাদে আক্রান্তরা এতদিনের ঘরসংসার, ব্যবসা-বাণিজ্য, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় বা জাতীয় দায়িত্ব ত্যাগ করে সম্পূর্ণ উদাসীন হয়ে যায়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ধর্মীয় জীবনের জন্য আত্মঘাতি এমন সিদ্ধান্তকে মনে করে প্রচ- ধার্মিকতা আর মোক্ষ লাভের সোপান। শেখ সাদী একটি কবিতায় এই মতবাদ খ-ন করে যে মন্তব্যটি করেছেন তা আমাদের ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক মহলের জন্য পথের দিশা। বলেছেনÑ
طریقت به جز خدمت خلق نیست
به تسبیح و سجاده و دلق نیست
তারীকাত বজুয খেদমতে খাল্্ক নীস্ত
বতাসবীহ ও সাজ্জা’দা ও দাল্্ক নীস্ত
‘সৃষ্টির সেবা ছাড়া সিদ্ধি নাই তরিকায়
নহে তসবীহ,জায়নামায ও আলখেল্লায়।’
বুস্তান, ১ম অধ্যায়, ৯ নং হেকায়তের পুরো কবিতাটির অনুবাদ এখানে তুলে ধরছি।
আগেকার দিনের বাদশাহদের কাহিনীতে আছে,
পারস্য-রাজ তাক্লা যখন বসলেন সিংহাসনে।
শান্তিতে জনগণ কারো ক্ষতি কেউ করে না দেশে,
সবাইকে ছাড়িয়ে অগ্রণী তিনি একা এই কীর্তিতে।
এক দরবেশের কাছে গিয়ে একদিন বললেন রাজা,
আমার এ জীবন কেটে গেল হুযুর নিষ্ফল, অযথা।
হতে চাই নিমগ্ন ইবাদত-বন্দেগিতে একাগ্রভাবে,
জীবনের বাকি কয়দিন কাটে যেন সৎভাবে।
এই প্রতিপত্তি, রাজত্ব ও সিংহাসন যখন চলে যাবে
জগতের সম্পদ যাবে না সাথে, নিঃস্বই যেতে হবে।
আলোকিত-হৃদয় দরবেশ শুনে তার কথা
তীব্র প্রতিক্রিয়ায় বললেন, থামো তাক্লা।
‘সৃষ্টির সেবা ছাড়া সিদ্ধি নাই তরিকায়
নহে তসবীহ,জায়নামায ও আলখেল্লায়।’
তুমি সমাসীন থাক তোমার রাজ সিংহাসনে
তবে পূতঃচরিত্রে হও সজ্জিত দরবেশি গুণে।
সততা, নিষ্ঠা ও একাগ্রতায় উদ্যোগী হও,
বড়বড় বুলি, আস্ফালন হতে মুখ সামলাও।
তরিকত সাধনায় বুলি নয়, চেষ্টাই চাই,
বিনা চেষ্টায় এখানে আস্ফালনের মূল্য নাই।
বুযুর্গগণ, যারা সজ্জিত ছিলেন স্বচ্ছতার সম্পদে
এই উত্তরীয় শোভিত ছিল তাদের আচকানের নিচে।
এক শ্রেণির বিভ্রান্ত তাসাউফ বা তরিকতকে ইসলামের বিকল্প হিসেবে দাঁড় করাতে চান। তাঁরা এমনভাবে কথা বলেন যেন তাসাউফ আলাদা একটি ধর্ম। বুঝতে হবে, তাসাউফ ইসলামের বিকল্প হিসেবে সুফিজম বা সুফিবাদ হতে পারে না। ইসলামে আধ্যত্মিকতা একটি আত্মিক চেতনা, ইসলামের সৌন্দর্য। হাদীসে জিব্রাঈলের ভাষ্য মতে যদি ঈমানকে একটি দালানের ভিত্তি বা মাটির নিচের গাঁথুনি পাইলিং এর সাথে তুলনা করি, তাহলে উপরের কাঠামো হলো ইসলামের পাঁচটি মৌলিক বিধান। দালানের মাটির নিচের গাঁথুনি ও উপরের কাঠামো তৈরি হলেও সেখানে বসবাস করা যায় না। বসবাস করতে হলে দালানের দরজা, জানালা, বাথরুমের ফিটিংস লাগবে। যাকে আমরা সাজসজ্জা ডেকোরেশন বলতে পারি।
হাদিসে ‘ইহসান’ শব্দের মধ্যে এর ইঙ্গিত রয়েছে। ইহসান এর মূল ধাতু হাসান। হাসান অর্থ সুন্দর। বাবে ইফআলে গিয়ে ব্যাকরণের রূপান্তরে ইহসান মানে সাজসজ্জা, অলঙ্করণ। ইংরেজিতে বললে ‘ডেকোরেশন’। একথাগুলো চিন্তা না করে কুরআনে বর্ণিত তাযকিয়া ও হাদিসের পরিভাষা ইহসানকে সুফিবাদ নামে ইসলাম থেকে আলাদা একটি মতবাদ হিসেবে যারা দাঁড় করাতে চান তাঁরা নিঃসন্দেহে বিভ্রান্ত। এদের পথ-মত-চিন্তা ভ্রান্ত। শেখ সাদী (র.) এ কথাটি কবিতার ভাষায় ব্যক্ত করেছেন মোহনীয়ভাবে। তার এই উক্তি কাল থেকে কালান্তরে ইসলামের আধ্যাত্মিক সাধনার পথের মাইল ফলক। শেখ সাদীর বলিষ্ঠ উচ্চারণÑ
خلاف پیمبر کسی ره گزید
که هرگز بمنزل نخواهد رسید
খেলা’ফে পায়াম্বার কেসী রাহ গোযীদ
কে হারগেয বেমানযেল না খা’হাদ রেসীদ
পয়গাম্বরের পথ ভিন্ন অন্য পথে যে গেছে
কক্ষণো সে পৌঁছবে না মনজিলে মকসুদে।
সাধনার পথ হতে হবে নবীজির অনুসৃত পথের অনুকীর্তি। এ ছাড়া আর যত পথ মত সব বিভ্রান্তি।
সূত্র : শেখ সা‘দী, বুস্তান, জাভিদান প্রকাশনা সংস্থা, তেহরান, ১৩৬৬ (১৯৮৭ ইংরেজি)
All posts by dreamboy
বিশ^পরিস্থিতিতে এবারের আল-কুদস দিবসের আহ্বান
রাশিদুল ইসলাম
পবিত্র মাহে রমজানে এবার শুধু মুসলমান নয়, বরং সারাবিশে^র মানুষকে করোনাভাইরাস মহামারির কারণে সামাজিক ও শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হচ্ছে। এহেন পরিস্থিতিতেও ফিলিস্তিনে ইসরাইলি আগ্রাসন থেমে নেই। সিরিয়াতে ইসরাইলি বোমারু বিমান হামলা চলছেই।
রমজানের শেষ শুক্রবার যথারীতি মুসলিম বিশ্বে পালিত হবে আন্তর্জাতিক আল-কুদস দিবস। দীর্ঘ দিন ধরে ইহুদিবাদী ইসরাইলের দখলে থাকা মুসলমানদের প্রথম কিবলা বায়তুল মোকাদ্দাস পুনরুদ্ধারের দাবিতে প্রতি বছর রমজানের শেষ শুক্রবার বিশ্বব্যাপী পালিত হয় দিনটি। ১৯৭৯ সালে ইরানে সংঘটিত সফল ইসলামি বিপ্লবের পর মহান নেতা ইমাম খোমেইনী (রহ.) পবিত্র রমজান মাসের শেষ শুক্রবারকে কুদস দিবস ঘোষণা করেন। সেই থেকে ইরানসহ বিশ্বের বহু দেশে কুদস দিবস পালিত হয়ে আসছে এবং দিন দিন কুদস পালনকারী দেশের সংখ্যা বাড়ছে।
এবার এমন এক সময় দিবসটি পালিত হতে যাচ্ছে যখন ইসরাইল জর্ডান নদীর পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনি অঞ্চলগুলোকে গ্রাস করার জন্য অগ্রসর হওয়ার ফন্দি আঁটছে। ইতিমধ্যে সিরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এর নিন্দা জানিয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ মুসলিম দেশ এব্যাপারে নিশ্চুপ অথবা কার্যকর কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারছে না। আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে ইসরাইল এ আগ্রাসন শুরু করতে যাচ্ছে যা ফিলিস্তিনির সঙ্গে চুক্তিরও বরখেলাপ। জেরুসালেম ও সিরিয়ার গোলান মালভূমি নিয়ে যে সমঝোতা রয়েছে তাকে কোনো পাত্তাই দিচ্ছে না ইসরাইল। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রশাসনের তথাকথিত ‘দি ডিল অব দি সেঞ্চুরি’ ফিলিস্তিনিদের আইনগত কোনো অধিকার রক্ষা করতে কাজে আসছে না।
গত ২০ এপ্রিল ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও তাঁর প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বেন্নি গান্তজ ঐক্যমতের সরকার গঠন করতে চুক্তি করেন। এখন ট্রাম্পের ‘ডিল অব দি সেঞ্চুরি’র আলোকেই বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ফিলিস্তিনি ভূমিতে আগ্রাসন চালাতে অগ্রসর হচ্ছেন। ১৭৬৭ সালে ইসরাইল পশ্চিম তীর দখল করে নেয়ার পর তা ফেরত দেয়ার দাবি জানিয়ে আসছে ফিলিস্তিন। ট্রাম্পের নতুন মধ্যপ্রাচ্য শান্তি পরিকল্পনায় পশ্চিম তীরে ইসরাইলের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা এবং জেরুসালেমকে তার অবিভক্ত রাজধানী হিসেবে রেখে একটি নতজানু ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের আহ্বান জানানো হয়েছে। ট্রাম্পের এ পরিকল্পনা ফিলিস্তিনে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। পশ্চিম তীর নিয়ে দীর্ঘস্থায়ী বিরোধ নিস্পত্তির জন্য মুসলিম দেশগুলো এগিয়ে আসতে ব্যর্থ হয় বরং ট্রাম্পের তথাকথিত ডিল অব দি সেঞ্চুরি মেনে নেয়ার জন্য কোনো কোনো দেশ সরাসরি ফিলিস্তিনের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। এতে সায় দিয়ে নিশ্চুপ বসে থাকে মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী দেশগুলো। ওআইসির এতে কার্যকর কোনো ভূমিকা নেই।
এবারের আল-কুদস দিবসে এসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে। প্রতিরোধ গড়ে তোলার পূর্বশর্ত হিসেবে ঐক্য গড়ে তোলার তাগিদ দিচ্ছে। এরই মধ্যে জার্মানিতে হিজবুল্লাহ আন্দোলনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ফিলিস্তিনিদের পক্ষে হাতে গোনা যে কয়েকটি দেশ বা গোষ্ঠী সোচ্চার হয়ে আছে তার মধ্যে ইরান ও হিজবুল্লাহ অন্যতম প্রধান মিত্র হিসেবে কাজ করছে। তেহরান জার্মানির এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়েছে।
আল-কুদস দিবসে আমাদের ভাবনায় আন্তর্জাতিক ইস্যুগুলোর বিচার বিশ্লেষণ জরুরি। রমজানে যেমন দৈহিক ও আত্মিক সংযমের মধ্য দিয়ে আত্মশুদ্ধির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার সুযোগ আসে তেমনি জাগতিক ও আধ্যাত্মিক যাবতীয় কল্যাণকর্মে সাফল্যের সোপানে সহজে আরোহণ করা সম্ভব তখনি হবে যখন পরিবর্তিত বিশ^পরিস্থিতি নিয়েও আমাদের সম্যক ধারণা থাকবে। তা না হলে মুসলমানদের আর্থ-সামাজিক অবস্থান, অর্থনৈতিক মুক্তি ও রাজনৈতিক দিকনির্দেশনা জানা সম্ভব হবে না। আল-কুদস দিবস সেই ডাকই দিয়ে যায় যাতে আমরা অনুধাবন করতে পারি, মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে কেন এবং কিভাবে পরাশক্তিগুলো বিভেদ জিইরে রাখে এবং সেই চক্রান্তের জালে বিভ্রান্ত হয়ে আমরা কিভাবে বছরে পর বছর জুড়ে আঞ্চলিক, আন্তর্জাতিকভাবে মার খেতে থাকি!
মুসলমানদের মার খাওয়ার একটি বড় কারণ যে অনৈক্য, তা সবার জানা। কিন্তু এই অনৈক্য কিভাবে লজ্জাজনকভাবে বহিঃপ্রকাশ ঘটায় তাও জানা প্রয়োজন। হিজবুল্লাহকে সন্ত্রাসী সংগঠন ঘোষণা করায় জার্মানিকে স্বাগত জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু কোনো মুসলিম দেশ একই ভূমিকা পালন করছে। অথচ ইয়েমেনে বছরের পর বছর আগ্রাসন চলছে এবং পশ্চিমা দেশগুলো এ আগ্রাসনে অস্ত্র সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। এর চেয়ে বড় সন্ত্রাস আর কী হতে পারে? এই সন্ত্রাসের শিকার হতে হচ্ছে ইয়েমেনের নিরস্ত্র জনতাকে। দুর্ভিক্ষ চলছে দেশটিতে। অনাহারে অপুষ্টিতে নারী ও শিশু মারা যাচ্ছে। এধরনের সন্ত্রাস সম্ভব হচ্ছে কোনো মুসলিম দেশগুলোর সহায়তায় যা পশ্চিমা রাষ্ট্র ও ইসরাইল সিরিয়া, লিবিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান সহ বিভিন্ন দেশে অব্যাহত রেখেছে। এবং তা হচ্ছে সন্ত্রাস দমনের নামেই। আল-কুদস দিবসের অন্যতম আহ্বান হচ্ছে এসব বিভ্রান্তির জাল ছিন্ন করে মুসলমানদের বিরদ্ধে ষড়যন্ত্র সম্পর্কে অবহিত হওয়া এবং তাহলেই ফিলিস্তিনিদের পাশে মুসলিম বিশ^ একাট্টা হয়ে দাঁড়াতে পারবে এবং বায়তুল মোকাদ্দাসকে মুক্ত করার সত্যিকার লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করা সম্ভব হবে।
মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী একটি দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে হিজবুল্লাহ’র ব্যাপারে জার্মানির সর্বশেষ নেওয়া সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আন্তরিকভাবে স্বাগত জানিয়েছে। এও বলেছে, বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় এই প্রচেষ্টাকে এগিয়ে নিতে তারা তাদের সাহায্যে এগিয়ে যাবে। অথচ হিজবুল্লাহ বিশে^র কোথাও কোনো সন্ত্রাসী কর্মকা-ের সঙ্গে জড়িত তার কোনো প্রমাণ আন্তর্জাতিক বিশ^ দিতে পারেনি। ফিলিস্তিনিদের পাশে, গাজায় অবরুদ্ধ ফিলিস্তিনিদের সাহায্য করছে হিজবুল্লাহ তার সাধ্যমত। এটি সন্ত্রাসের সংজ্ঞায় পড়ে কিভাবে? দেশটি বিশ্বব্যাপী শান্তি ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সন্ত্রাসী ও তাদের সমর্থকদের বিরুদ্ধে কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার বলেও মন্তব্য করছে। অথচ ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু জর্দানের পশ্চিম তীরে আগ্রাসনে যে অগ্রসর হচ্ছেন তার বিরুদ্ধে কোনো কথা বলছে না কেন প্রভাবশালী দেশগুলো।
উল্টো বরং দেশটি রীতিমত ইসরাইলের সাংস্কৃতিক সেবায় নেমেছে। ফিলিস্তিনের ভূমি দখলদার ও বর্ণবাদী ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রক্রিয়াকে এবার সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও টেনে এনেছে তারা। প্রভাবশালী মুসলিম দেশগুলোর প্রখ্যাত আলেম ওলামাদের মতামত গ্রহণ না করে গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকবার ইসরাইলের পক্ষে বক্তব্য রেখে ও ইহুদি ধর্ম আর ইসরাইলকে একই অর্থবোধকরূপে দেখিয়ে ভূমিকার প্রতিবাদে আলেম ওলামাদের জেল খাটতে হচ্ছে এমন নজীরও রয়েছে। ইসরাইলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ানোর প্রক্রিয়ায় এবার ‘উম্মে হারুন’ বা ’হারুনের মা’ নামে একটি টেলিভিশন সিরিয়াল সম্প্রচার শুরু হয়েছে।
এই সিরিয়ালে গত শতকের চল্লিশের দশকে কুয়েতের কোনো কোনো ইহুদির ওপর কোনো কোনো মুসলমানের নির্যাতনের কথিত কাহিনী প্রচার করে পরোক্ষভাবে ফিলিস্তিনে ইসরাইলি দখলদারিত্বকে বৈধতা দেয়ার এবং ফিলিস্তিনিদের ওপর গণহত্যা ও তাদেরকে বিতাড়নের অপরাধগুলোকে ধামাচাপা দেয়ার পরিবেশ সৃষ্টির চেষ্টা চলছে। এ ছাড়াও ইসরাইলের অবৈধ অস্তিত্বকে বৈধ ও বাস্তব হিসেবে তুলে ধরা এবং ফিলিস্তিনি জাতির অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সন্দেহ ও দ্বিধা-দ্বন্দ্ব সৃষ্টির উদ্দেশ্যে প্রচার করা হচ্ছে কমেডি সিরিজ ‘মাখরাজ-সাত’। এ দুই সিরিজেই ফিলিস্তিনিদের ত্যাগ ও কুরবানিকে পদদলিত করা হয়েছে।
পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, পবিত্র রমজান মাসে এসব সিরিয়াল সম্প্রচার শুরু হয়েছেÑ যে রমজানের শেষ শুক্রবারকে পালন করা হয় মুসলমানদের প্রথম কিবলাকে ইসরাইলি দখল থেকে মুক্ত করার জন্য বিশ্ব কুদস দিবস হিসেবে। এ দিবসে ইসরাইলি অপরাধযজ্ঞের বিরুদ্ধেও বৈশ্বিক গণ-বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করা হয়। এখানে আল-কুদস দিবস পালনের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব নিহিত রয়েছে। কারণ, নেতানিয়াহুসহ সন্ত্রাসী কোনো কোনো ইসরাইলি নেতা দাবি করেন যে আরব বিশ্বের জনগণকে ইসরাইলের বিরুদ্ধে বহু বছর ধরে বিদ্বেষমূলক নানা প্রচারণার মাধ্যমে ক্ষেপিয়ে রাখা হয়েছে যা আরব-ইসরাইল শান্তি প্রতিষ্ঠার পথে প্রধান বাধা! তাহলে ইসরাইলি সেনাদের গুলিতে ফিলিস্তিনি শিশু হত্যা কি বন্ধ রয়েছে? ইসরাইলি কারাগারগুলোতে বিনা বিচারে আটক হাজার হাজার ফিলিস্তিনিকে কেনো মুক্তি দেয়া হচ্ছে না সে নিয়ে কি কোনো দেশ ধারাবাহিক টেলিভিশন অনুষ্ঠান বা প্রামাণ্য চিত্র তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে?
বরং ইতিহাস বিকৃত করে ও জনগণের তেল-বিক্রির অর্থ খরচ করে ইসরাইলের নেতানিয়াহুদের পক্ষ নিয়ে সাংস্কৃতিক প্রচারণা মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। মন থেকে না চাইলেও অনেক দেশ ইসরাইল ও মার্কিন সরকারের সেবাদাসত্বে নিয়োজিত। আল-কুদস দিবসের আহ্বান হচ্ছে মুসলমানদের এধরনের সেবাদাসত্ব থেকে বের হয়ে আসতে প্রয়োজনীয় বুদ্ধিবৃত্তিক প্রস্তুতি নিতে হবে।
এরপরও বলছি পরিস্থিতি পাল্টে যেতে শুরু হচ্ছে। করোনাভাইরাসের কারণেই মার্কিন অর্থনীতির বেহাল দশা প্রকাশ হয়ে পড়েছে। তারা বিভিন্ন দেশ থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করে নিতে শুরু করেছে। মার্কিন সরকারের দেনা পৌঁছে গেছে ২৫ ট্রিলিয়ন ডলার। বেকারত্ব গিয়ে ঠেকেছে গত মার্চ পর্যন্ত সাড়ে তেত্রিশ মিলিয়নে। সিএনএন বলছে, এপ্রিল মাসে বেকারের সংখ্যা আরো বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০.৫ মিলিয়নে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ১৪.৭ শতাংশ মানুষ বেকার। মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষ বেকার ভাতার জন্য আবেদন করেছে। এদের সংখ্যা আরো বাড়বে। এই যুক্তরাষ্ট্রই ইরান, ভেনিজুয়েলা সহ বিশে^র যেসব দেশ মাথা তুলে স্বাধীনভাবে চলতে চেয়েছে তাদের ওপর দশকের পর দশক ধরে অন্যায়ভাবে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে অর্থনৈতিক অবরোধ আর নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রেখেছে। তেল রফতানিতে বাধ সেধেছে। আর আজ সেই তেলের দর পড়ে গিয়েছে প্রায় শূন্যের অঙ্কে। বিশে^র সবচেয়ে বড় উড়োজাহাজ তৈরি প্রতিষ্ঠান বোয়িং ইরানের সঙ্গে চুক্তি করেছিল শতাধিক বিমান সরবরাহের। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসন তা হতে দেয়নি। আজ সেই বোয়িং লে-অফে মালিকানা হারিয়েছে ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে যেয়ে। এসব অর্থনৈতিক বিষয় আল-কুদস দিবসে নানা আনুষ্ঠানিকতার পাশাপাশি বিবেচনার দাবি রাখে।
একই সঙ্গে ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখি আরব সরকারগুলো রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ইহুদিবাদী ইসরাইলের সঙ্গে গোপনে সহযোগিতা করে এসেছে। একদিকে সস্তায় তেলসম্পদ কিনের নেয়ার নামে লুটপাট অন্যদিকে ট্রিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রি করে পরাশক্তি দেশগুলো মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ জিইয়ে রেখেছে। ১৯৯০-র দশকে ওমান ও কাতারে খোলা হয় ইসরাইলি বাণিজ্য দপ্তর। আরও আগে ইহুদিবাদী ইসরাইলের সঙ্গে প্রকাশ্যে নতজানুমূলক রাজনৈতিক আপোষ-চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল মিশর ও জর্দান। আর আরব বিশ্বের বাইরেও কোনো মুসলিম দেশের সঙ্গেও ইহুদিবাদী ইসরাইলের প্রায় সব ধরনের সহযোগিতার সম্পর্ক ছিল ও তা এখনও বজায় রয়েছে। গত কয়েক বছর ধরে অনেক প্রভাশালী মুসলিম দেশে একাধিক ইসরাইলি শীর্ষ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তারা সফর করেছেন। ইসরাইলি মিডিয়াগুলোতে তা বড় বড় হেডলাইনে সংবাদ হিসেবে প্রচার পেয়েছে। নিশ্চুপ আর অসহায় হয়ে কোনো মুসলিম দেশের নেতারা মরুভূমিতে উটপাখির মতো মুখ গুঁজে থেকেছেন। ২০১৮ সালে ওমান সফর করে ওমানের তৎকালীন সুলতানের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু। তারপর থেকে শুরু। কিন্তু আল-কুদস দিবসকে সামনে রেখে প্রশ্ন হচ্ছে, এত কিছুর পরও কি ফিলিস্তিনিরা তাদের হারানো ভূমি, বায়তুল মোকাদ্দাস ফিরে পেয়েছে।
এজন্যই গত তিরিশে এপ্রিল এক বিবৃতিতে ইরান বলেছে, জার্মানিতে হিজবুল্লাহকে নিষিদ্ধ ঘোষণা এবং দেশটির সরকারের এ সিদ্ধান্ত লেবানন সরকার ও জনগণের জন্য সম্পূর্ণ অসম্মানজনক, যেহেতু হিজবুল্লাহ ওই দেশের সরকার এবং সংসদের একটি সরকারি ও বৈধ অঙ্গ। প্রশ্ন হচ্ছে অন্য কোনো মুসলিম দেশ জার্মানির কাছে এ প্রশ্ন তুলতে পারছে না কেন? কোথায় ওআইসি? কোথায় আরব লীগ?
তার মানে কার্যকরভাবে ফিলিস্তিনিদের পাশে যে কোনো সংগঠন দাঁড়ালেই তাকে সন্ত্রাসীর সংজ্ঞায় ফেলে দেয়া হবে? অথচ আমরা সবাই জানি মহানবী (সা)-এর নবুওয়াতের ঘোষণার পর থেকে মুসলমানদের কাছে বায়তুল মোকাদ্দাস পবিত্র স্থান হিসাবে বিবেচিত হয়ে আসছে। কুরআন শরিফে বায়তুল মোকাদ্দাসকে পবিত্র ভূমি বলে উল্লেখ করা হয়েছেÑ ‘(স্মরণ করো, মূসা তার সম্প্রদায়কে বলেছিল) হে আমার সম্প্রদায়! আল্লাহ তোমাদের জন্য যে পবিত্র ভূমি নির্দিষ্ট করেছেন, এতে তোমরা প্রবেশ করো এবং পশ্চাৎপসারণ করো না, করলে তোমরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়বে।’ (সূরা আল-মায়িদা, আয়াত : ২১)
এবার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে কেনো বায়তুল মোকাদ্দাসকে মুক্ত করা প্রয়োজন তার সংক্ষেপ বর্ণনা দিয়ে এ লেখা শেষ করছি। এটা শুধু মুসলিম উম্মাহর হারানো গৌরব বা মান-সম্মান ফিরিয়ে আনার প্রশ্ন নয়, বিশ্বব্যাপী সত্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্যও তা জরুরি। বায়তুল মোকাদ্দাস ও ফিলিস্তিন হচ্ছে রাজনৈতিক এবং ভৌগোলিক কৌশলগত দিক থেকে ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকাÑ এ গুরুত্বপূর্ণ তিন মহাদেশের ট্রানজিট পয়েন্ট বা প্রবেশদ্বার। এই গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলটি সাম্রাজ্যবাদীদের নিয়ন্ত্রণে থাকার কারণে আজ তেলসমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের প্রধান তিন মহাদেশের ওপর কর্তৃত্ব করা সাম্রাজ্যবাদীদের জন্য সহজ হয়েছে।
আল-কুদস দিবস এসব বিষয় নিয়ে ভাবনার তাগিদ দিচ্ছে। মজলুম ফিলিস্তিনি জাতির ওপর জগদ্দল পাথর হয়ে ইহুদিবাদী শাসন, শোষণ, নিপীড়ন ও তাদের নৃশংস হত্যাযজ্ঞের অবসান ঘটানো এবং বায়তুল মোকাদ্দাসকে রাজধানী করে ফিলিস্তিনি জাতির নিজস্ব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাও এ দিবসের আরেকটি বড় লক্ষ্য। এজন্য মুসলমানদের ঐক্যই যথেষ্ট।
অমর একুশে গ্রন্থমেলায় ‘সমকালীন ইরানের কবি ও কবিতা’ গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচিত
অমর একুশে গ্রন্থমেলায় শোভা প্রকাশ থেকে প্রকাশিত ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান, কথাশিল্পী ড. আবদুস সবুর খান (সাকির সবুর) কর্তৃক অনূদিত সমকালীন ইরানের ৫০ জন কবির সংকলন গ্রন্থ ‘সমকালীন ইরানের কবি ও কবিতা’ গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন করেন ঢাকাস্থ ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের কালচারাল কাউন্সেলর ড. হাসান সেহাত, খ্যাতিমান শিশুসাহিত্যিক ও টিভি ব্যক্তিত্ব আলী ইমাম, নাট্যকার ফেরদৌস হাসান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. আবুল কালাম সরকার এবং ইরানি ভিজিটিং প্রফেসর ড. কাজেম কাহদুয়ি, কথাসাহিত্যিক মনি হায়দার, কবি আমিন আল আসাদ, ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের কর্মকর্তা জনাব সাইদুল ইসলাম, লেখক গবেষক কামাল মাহমুদ এবং শোভা প্রকাশের স্বত্বাধিকারী মিজানুর রহমান।
জনাব আলী ইমাম বলেন, পারস্যের সাথে আমাদের বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক সম্পর্ক খুবই প্রাচীন। সুলতানি আমলে হাফিজের বাংলায় আমন্ত্রণের ইতিহাস আমরা জানি। হাফিজ এদেশে আসতে পারেননি, কিন্তু তাঁর সাহিত্য এসেছে। তিনি সুলতান গিয়াস উদ্দীন আযম শাহের অসমাপ্ত কবিতা মিলিয়ে দিয়েছিলেন। হাফিজ এর ‘দিওয়ান’ অনুবাদ করেছিলেন আমাদের জাতীয় কবি নজরুল। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ইরানে গিয়েছিলেন হাফিজ সম্মেলনে যোগ দিতে। ইরানের কবি শেখ সাদী, রুমী, ওমর খৈয়ামের রচনাবলি বাংলা ভাষায় অনূদিত হয়েছে। বাংলা ভাষার সঙ্গে মিশে আছে অগণিত ফারসি শব্দ। ঐতিহাসিকভাবে আমাদের দেশের সাথে ইরানের সম্পর্কের কারণেই সেটি হয়েছে। বর্তমান সময়ে সে ধারাকে আরো সমুন্নত করে চলেছেন কথাশিল্পী আবদুস সবুর খান। যিনি ফারসি ভাষায় একজন সুপ-িত।
ড. সাইয়্যেদ হাসান সেহাত সুসাহিত্যিক আলী ইমামের বক্তব্যকে সমর্থন জানিয়ে বলেন, ইরানের সাথে যুগ যুগান্তরের এই সাংস্কৃতিক সম্পর্ক ছিল, আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে ইনশাআল্লাহ। তিনি ড. আবদুস সবুর খানের এই অনুবাদ কর্মকে অসাধারণ কর্ম উল্লেখ করে বইটির পাঠকপ্রিয়তা কামনা করেন।
প্রফেসর ড. কাজেম কাহদুয়ী বলেন, ড. আবদুস সবুর খানের ধারাবাহিক এই সব অনুবাদ কর্মের কারণে বাংলাদেশের লেখক-গবেষক মহলে আধুনিক ইরানি সাহিত্য সম্পর্কে ব্যাপক আগ্রহ তৈরি হচ্ছে। যা চলমান সময়ে ইরান বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক সম্পর্ককে জোরদার করছে।
প্রফেসর ড. আবুল কালাম সরকার বলেন, গ্রন্থটি ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের শিক্ষার্থী ও শিক্ষক উভয়ের সহায়ক গ্রন্থ হিসেবে বেশ কাজে লাগবে।
জনাব ফেরদৌস হাসান ও জনাব মনি হায়দার বইটির প্রচ্ছদ, অঙ্গসজ্জা, ও সফল কাব্যনুবাদের প্রশংসার সাথে সাথে বইটির বহুল প্রচার কামনা করেন।
সঞ্চালক কবি আমিন আল আসাদ বলেন, শিশু-সাহিত্য, ছড়া, কবিতার মাধ্যমে সাকির সবুর-এর লেখালেখির শুরু হলেও তাঁর পূর্ণতা প্রাপ্তি ঘটে কথাশিল্পে। তরুণ বয়সে লেখা তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘আমি যখন অনেক দূরে’ পাঠকপিয়তা পায়। দ্বিতীয় উপন্যাস ‘অনেক দিনের চেনা’ প্রকাশের মুহূর্তে তিনি বরেণ্য কথাশিল্পী ড. হুমায়ুন আহমদ-এর সুনজরে আসেন। তিনি সবুরের গদ্যভাষার মাঝে অমিত সম্ভাবনার সন্ধান পান এবং তাঁকে এগিয়ে যেতে উৎসাহ প্রদান করেন। বাংলা ভাষার প্রধান কবি ও কথাশিল্পী মরহুম আল মাহমুদ এবং কবি আল মুুুুুুজাহিদী সাকির সবুর অনূদিত যথাক্রমে ‘জালালে আলে আহমদের নির্বাচিত গল্প’ এবং মুস্তফা মাস্তুর ‘খোদার চাঁদ মুখে চুমু খাও’ শীর্ষক পরাবাস্তব উপন্যাস সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে সবুরকে ফারসি সাহিত্যের একজন যথার্থ অনুবাদক হিসেবে উল্লেখ করেন।
উল্লেখ্য যে, আবদুস সবুর খান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ এবং কথাশিল্পী ড. হুমায়ুন আহমদের ‘গৌরীপুর জংশন’ উপন্যাসকে ফারসি ভাষায় অনুবাদ করেন। এছাড়া ইরানের শক্তিমান কথাসাহিত্যিক বুজুর্গে আলাভির ‘চাশমহায়াস’-এর অনুবাদ ‘তার চোখগুলো’, কথাসাহিত্যিক সাদেক হেদায়াত-এর কালজয়ী উপন্যাস ‘বুফে কুর’ বাংলা অনুবাদ ‘অন্ধ পেচা’ এবং মোহাম্মদ আলী জামাল জাদেহ-র কথাসাহিত্য ‘একদা এক সময়’ শিরোনামে প্রকাশ করে বাংলা ভাষায় আধুনিক ইরানি সাহিত্যকে সফলতার সাথে তুলে ধরেন।
Ñআমিন আল আসাদ
আল কুদস দিবস, বিশ্ব মানবতার জাগরণের দিন
আবু সাইদ –
কুদস অর্থ পবিত্র। আর ‘আল কুদস’ বলতে বোঝায় ফিলিস্তিনের পবিত্র নগরী বায়তুল মোকাদ্দাসকে যা জেরুসালেম নামেও পরিচিত। অগণিত নবী-রাসূলের স্মৃতিধন্য পুণ্যভূমি এটি। এই শহরেই রয়েছে মুসলমানদের প্রথম কিবলা মসজিদুল আকসা। প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর পবিত্র মেরাজ বেহেশতি বাহন বোরাকে চড়ে শুরু হয়েছিল এখান থেকেই। পবিত্র আল-কুরআনে এ স¤পর্কে বলা হয়েছে, ‘পরম পবিত্র ও মহিমাময় সত্তা তিনি, যিনি স্বীয় বান্দাকে রাতের বেলা ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্তÑ যার চারদিকে আমি পর্যাপ্ত বরকত দান করেছি, যাতে আমি তাঁকে কুদরতের কিছু নিদর্শন দেখিয়ে দেই। নিশ্চয়ই তিনি পরম শ্রবণকারী ও দর্শনশীল।’ (সূরা আল ইসরা : ১)
এখানে মসজিদে আকসার চারদিক বলতে জেরুসালেম শহরকেই বোঝানো হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘আল কুদসের (জেরুসালেম) এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে একজন নবী সালাত আদায় করেননি বা কোনো ফেরেশতা দাঁড়াননি।’ (তিরমিজি)
মুসলমানদের কাছে জেরুসালেম শহরটি আল-কুদস নামেও পরিচিত। যে তিনটি মসজিদের উদ্দেশে ইবাদতের নিয়তে সফরের অনুমতি আছে, তার মধ্যে একটি হলো আল-আকসা মসজিদ। বাকি দুটি হলোÑ মসজিদে হারাম (মক্কা) ও মসজিদে নববী (মদিনা), (বুখারি ১১৮৯; মুসলিম : ১৩৯৭)। এর গুরুত্ব স¤পর্কে মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘ঘরে নামাজ পড়লে এক গুণ, মসজিদে ২৫ গুণ, মসজিদে নববী ও আকসায় ৫০ হাজার গুণ, মসজিদে হারামে এক লাখ গুণ সওয়াব।’ (ইবনে মাজাহ)।
মহানবী (সা.) মদিনায় হিজরত করার পর প্রায় ১৬ মাস মসজিদুল আকসার দিকে মুখ করে নামাজ আদায় করেন। তাই বায়তুল মুকাদ্দাস দুনিয়ার অন্য অনেক ভূখ-ের মতো কোনো সাধারণ ভূখ- নয়। বায়তুল মুকাদ্দাস ও তার আশপাশের এলাকা তথা সমগ্র ফিলিস্তিন ভূখ- বহু নবী-রাসূলের (আ.) স্মৃতিবিজড়িত হওয়ায় কোরআন মজিদে এ পুরো ভূখ-কে ‘আরদে মুকাদ্দাস’ বা ‘পবিত্র ভূমি’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সুতরাং মসজিদুল আকসা, বায়তুল মুকাদ্দাস ও ফিলিস্তিন- এ পবিত্র নামগুলো মুসলমানদের ঈমান ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। তাই মসজিদুল আকসা, বায়তুল মুকাদ্দাস ও ফিলিস্তিনের প্রতি ভালোবাসা প্রতিটি মুমিনের হৃদয়ের গভীরে প্রোথিত। হাদিসের বর্ণনা অনুযায়ী, হজরত ইবরাহিম (আ.) কর্তৃক কাবাঘর নির্মাণের ৪০ বছর পর তাঁর প্রিয় দৌহিত্র হজরত ইয়াকুব (আ.) ফিলিস্তিনের জেরুসালেম নামক স্থানে ‘আল আকসা’ মসজিদটি নির্মাণ করেন। পরে হজরত ইউসুফ (আ.)-এর বংশধর হজরত সুলায়মান (আ.) তা পুনর্নির্মাণ করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই পবিত্র মসজিদ আজ মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। ১০৯৬ খ্রিস্টাব্দে ইউরোপের ক্রুসেডার খ্রিস্টানরা সমগ্র সিরিয়া ও ফিলিস্তিন দখল করে নেয়ার পর বায়তুল মুকাদ্দাসের বিভিন্ন ইসলামি স্থাপনায় পরিবর্তন আনে। এরপর ১১৮৭ খ্রিস্টাব্দে সালাহ উদ্দীন আইয়ুবি বায়তুল মুকাদ্দাস শহরকে আবারও মুসলমানদের অধিকারে নিয়ে আসেন। তবে ১৯৪৮ সালের ১৫ মে ব্রিটিশ সরকারের সহযোগিতায় ফিলিস্তিনে অবৈধ ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সেখানকার মুসলমানদের ওপর বিপদ নামতে শুরু করে। ইহুদিবাদীরা বেপরোয়া হয়ে ওঠে এবং মুসলমানদের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালানো শুরু করে। তাদের অত্যাচারে জর্জরিত আরবরা জীবন বাঁচাতে দলে দলে দেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়। এ সত্ত্বেও তখনও বায়তুল মুকাদ্দাস মুসলমানদের দখলে ছিল। কিন্তু আরবদের দুর্বলতার মুখে ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধে তা মুসলমানদের হাতছাড়া হয়ে যায়। ফিলিস্তিনের নির্যাতিত জনগণ দীর্ঘদিন ধরে তাদের আবাসভূমি ও আল-কুদস (বায়তুল মুকাদ্দাস) উদ্ধারের জন্য রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম চালিয়ে যেতে থাকে। তাদের সংগ্রামে দিশেহারা হয়ে ইহুদিবাদী ইসরাইল ফিলিস্তিনি জনগণের মধ্যে ভাঙন ধরানোর জন্য ফিলিস্তিনের একটি ক্ষুদ্র অংশে সীমিত স্বায়ত্তশাসনের কথা বলে কিছুসংখ্যক নেতাকে আপসকামী ভূমিকায় নিয়ে আসে। তথাকথিত শান্তি আলোচনার সুযোগে তারা একে একে ফিলিস্তিনের প্রকৃত সংগ্রামী নেতাদের হত্যা করে চলেছে এবং ফিলিস্তিনের নতুন নতুন এলাকা দখল করে ইহুদি বসতি সম্প্রসারণ অব্যাহত রেখেছে । গত ৬ মে ২০২০ অধিকৃত ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরে আরো ৭ হাজার অবৈধ ইহুদি বসতি নির্মাণের পরিকল্পনা অনুমোদন দিয়েছে ইসরাইলের যুদ্ধবাজ সরকার। আন্তর্জাতিক প্রতিবাদ সত্ত্বেও ইসরাইল এই বসতি নির্মাণের পরিকল্পনা অনুমোদন করে। পবিত্র বায়তুল মুকাদ্দাস শহর থেকে ১২ কিলোমিটার দক্ষিণে নতুন এই বসতি নির্মাণ করা হবে। তবে এই বসতি নির্মানের মধ্যেই থেমে নেই ইসরাইলের এই অবৈধ দখলদারিত্ব। তারা এখন ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরকেই ইসরাইলের সঙ্গে সংযুক্ত করার পরিকল্পনা করছে। গত ৭ মে এক ভার্চুয়াল বৈঠকে আরব দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা বলেন, ১৯৬৭ সালে দখল করা জর্দান উপত্যকাসহ ফিলিস্তিনের যেকোনো অংশকে ইসরাইলের সঙ্গে সংযুক্ত করে নেয়ার পদক্ষেপকে ফিলিস্তিনি জাতির বিরুদ্ধে নতুন যুদ্ধাপরাধ বলে বিবেচনা করা হবে। ইহুদিবাদী ইসরাইলের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করতে এবং আন্তর্জাতিক প্রস্তাবনা মেনে চলতে আমেরিকার প্রতিও আহ্বান জানান আরব লিগের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা।
ফিলিস্তিন সমস্যার শুরু থেকেই যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও তাদের সহযোগীরা কখনো সরাসরি, কখনো জাতিসংঘের মাধ্যমে ফিলিস্তিন ইস্যুতে ‘শান্তি শান্তি’ খেলা খেলেছে। আর চক্রান্তকারী ইহুদিরা নতুন নতুন নীল নকশা নিয়ে মাঠে নেমেছে। তাই আজ সময় এসেছে বিশ্ব মুসলিমের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার।
বিশ্বের সকল মানবতাবাদী মানুষকে এ সংগ্রামে সর্বাত্মক সমর্থন জানাতে হবে। কারণ ফিলিস্তিনের ইস্যু কেবল মুসলমানদের ইস্যু নয়, এটি একটি মানবতাবাদী ইস্যু। ফিলিস্তিন সমস্যা ইহুদিদের সাথে মুসলমানদের সমস্যা নয়। ইসরাইল প্রতিষ্ঠার পূর্বে ফিলিস্তিনে মুসলিম, ইহুদি, খ্রিস্টানরা একত্রে শান্তিতে বসবাস করছিল। যখন ইহুদিবাদী ইসরাইল ফিলিস্তিন দখল করে তখনই ফিলিস্তিন সমস্যা তৈরি হয়। ইসরাইল ফিলিস্তিন ইস্যুকে ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করতে
চায়। এ কারণেই ইরানের ইসলামি বিপ্লবের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম খোমেইনী (র.) এটিকে বিশ্ব মানবতার সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করে মসজিদুল আকসাসহ সমগ্র ফিলিস্তিনের মুক্তির লক্ষ্যে রমজান মাসের শেষ শুক্রবার ‘বিশ্ব কুদস দিবস’ ঘোষণা করেন। তিনি ইসরাইলকে মধ্যপ্রাচ্যের বুকে বিষাক্ত টিউমার বা ক্যান্সার বলে অভিহিত করে ফিলিস্তিনের সংগ্রামী জনগণের ইচ্ছা-আকাক্সক্ষা এবং তাদের অধিকারের প্রতি সাহায্য-সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়ার জন্য রমযানের শেষ শুক্রবারে নানা কর্মসূচি, অনুষ্ঠান ও বিক্ষোভ প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিনিদের প্রতি পরিপূর্ণ সমর্থন ঘোষণার আহ্বান জানান।
বিশ্ববাসী বিশেষ করে মুসলিম বিশ্ব তাঁর এই আহ্বানে ব্যাপক সাড়া দেয় এবং এই দিনকে কুদস দিবস হিসেবে পালন করতে থাকে। এই দিনে বিশ্বজুড়ে জনগণের এই ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচি ফিলিস্তিনিদের আশা-আকাক্সক্ষাকে জাগ্রত রাখা এবং ইহুদিবাদী ইসরাইলের প্রতি বিশ্ব মুসলমানের ঘৃণা প্রকাশের মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। তাই মজলুম ফিলিস্তিনি জাতির ওপর জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসা ইহুদি শাসন, শোষণ, নিপীড়ন ও তাদের নৃশংস হত্যাযজ্ঞের অবসান ঘটানো এবং বায়তুল মোকাদ্দাসকে রাজধানী করে ফিলিস্তিনি জাতির নিজস্ব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাসহ মজলুমের ওপর আধিপত্যকামী শক্তিগুলোর আগ্রাসন মোকাবেলায় বিশ্বের সকল মানবতাবাদীকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে এ দিবস।
আল কুদস দিবসের লক্ষ্য বায়তুল মুকাদ্দাসের মুক্তি ও ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা
মুহাম্মদ শওকাত হোসেন –
পবিত্র মাহে রমজানের শেষ শুক্রবার ‘জুমাতুল বিদা’ এর দিনটি বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী ‘আল-কুদস দিবস’ হিসেবে পালিত হয়। আমরা অনেকেই জানি না আল-কুদস দিবস কী? কেন? কখন থেকে? কোন্ লক্ষে পালিত হচ্ছে? তাই এ দিবসটির লক্ষ ও তাৎপর্য স¤পর্কে মৌলিক ধারণা আমাদের সকলের প্রয়োজন।
মূলত ইসলামের তৃতীয় পবিত্রতম মসজিদ ‘বায়তুল মুকাদ্দাস’ এর মুক্তি ও পবিত্র ভূখ- ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার লক্ষ্যে বিশ্বব্যাপী জনমত সৃষ্টি করা , বিশেষত মুসলিম উম্মাহকে সতর্ক ও সচেতন করার লক্ষ্যে এ দিবসটি প্রতিবছর পালিত হচ্ছে। ১৯৭৯ সালে ইরানের ইসলামি বিপ্লবের পরপরই বিপ্লবের নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেইনী (র.) পবিত্র রমজান মাসের শেষ শুক্রবারকে ‘আল-কুদস দিবস’ হিসেবে ঘোষণা দেন। বিশ্বব্যাপী দিবসটি পালনের জন্য তিনি আহ্বান জানান। উদ্দেশ্য একটাই, বিশ্ব মুসলিমের প্রাণের চেয়ে প্রিয় মসজিদুল আকসাকে মুক্ত করা এবং ‘ইসরাইল’ নামের অবৈধ রাষ্ট্রের কবল থেকে পবিত্র ভূমি ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার জন্য বিশ্বব্যাপী মুসলমানদেরকে উদ্বুদ্ধ করা। দীর্ঘ ৪১ বছর যাবত সে লক্ষ্যে বিশ্বব্যাপী রমজানের শেষ শুক্রবারে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে র্যালি, সমাবেশ, সেমিনার, আলোচনা সভা ইত্যাদির মাধ্যমে ফিলিস্তিনি মুক্তি সংগ্রামের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করা হয় এবং অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইলেরর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো হয়। এবং বায়তুল মুকাদ্দাসের মুক্তি ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে ঐকমত্য পোষণ করা হয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে চলতি বছর করোনা মহামারির কারণে লোক সমাগমের মাধ্যমে দিবসটি পালন সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তি ও মিডিয়ার মাধ্যমে প্রতিটি মানুষের কাছে এই মেসেজ পৌঁছে দেওয়া প্রয়োজন। আমরা ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা ও বায়তুল মুকাদ্দাস এর মুক্তির পক্ষে এবং অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইল নামের অপশক্তির বিপক্ষে। এ মেসেজটি আমাদের সকলের দ্বারে দ্বারে পৌঁছে দেয়া প্রয়োজন।
প্রসঙ্গক্রমে আমাদের পবিত্র বায়তুল মুকাদ্দাসের গুরুত্ব উপলব্ধি করা প্রয়োজন। কারণ, বায়তুল মুকাদ্দাস বা মসজিদুল আকসা মুসলিম উম্মার প্রথম কিবলা। প্রায় ১৪ বছর ৫ মাস রাসূলে করীম (সা.)-এর নেতৃত্বে মুসলমানরা বায়তুল মুকাদ্দাসের দিকে মুখ করে নামাজ আদায় করেছেন। নবীজি (সা.)-এর মাদানী জীবনে আল্লাহর নির্দেশে কাবা শরীফের দিকে কেবলা পরিবর্তিত হয়। পবিত্র কুরআনে এই মসজিদের কথা ২ বার উল্লেখ হয়েছে। মহানবী (সা.) মেরাজের সময় বায়তুল মোকাদ্দাসে যাত্রাবিরতি করে সেখানে সকল নবীর সঙ্গে তিনি ইমাম হয়ে নামাজ আদায় করেছেন। ইসলামের দৃষ্টিতে যে তিনটি মসজিদ জিয়ারতের উদ্দেশ্যে সফর করা সওয়াবের কাজ, তার মধ্যে একটি হচ্ছে ‘মসজিদুল আকসা’। এই তিনটি মসজিদ হচ্ছে মসজিদুল হারাম, মদীনার মসজিদে নববী এবং জেরুসালেমে অবস্থিত মসজিদুল আকসা বা বায়তুল মুকাদ্দাস। কাজেই মুসলিম উম্মাহর কাছে এই মসজিদের গুরুত্ব অপরিসীম।
ইতিহাসের আলোকে হযরত ইবরাহিম (আ.) কর্তৃক কাবা ঘর নির্মাণের ৪০ বছর পর হযরত ইয়াকুব আলাইহিস সালাম সর্বপ্রথম মসজিদুল আকসা নির্মাণ করেন। যদিও পরবর্তীকালে হযরত সুলাইমান (আ.) এই মসজিদটিকে পুনঃনির্মাণ করেছেন। এক লক্ষ ৪৪ হাজার বর্গমিটার এলাকার উপর বায়তুল মুকাদ্দাস বা আল-কুদস শহর অবস্থিত। এখানে মসজিদ আকারে ২টি স্থাপনা রয়েছে। প্রধান মসজিদ মসজিদে কিবালি ও মসজিদে কুব্বাতুহ ছাখরা। মুছাল্লাহ (মসজিদ) হিসেবে রয়েছে আরও পাঁচটি স্থাপনা। ছোট-বড় মিলিয়ে ১৫টি গম্বুজ, বারটি মাদ্রাসা, ২৫টি কূপ, তেইশটি মাসতাবা (খালি মাঠে বর্গাকৃতির উঁচু জায়গা), ৮টি বায়েকা (গেটসদৃশ একাধিক স্তম্ভের স্থাপনা) চারটি আজান খানা সহ বিভিন্ন ধরনের ১৯০টি স্থাপনা রয়েছে। মসজিদে আকসার পনেরটি গেট এর দশটি ব্যবহৃত হচ্ছে, এর উপরে রয়েছে সীসার গম্বুজ, এটা ১৫ হিজরিতে খলিফা ওমর রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু নির্মাণের নির্দেশ দেন। ওখানে দাঁড়িয়ে খতীব ইমামতি করেন। কুব্বাতুস সাখরা পাথর গম্বুজ মসজিদ ইসলামি স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন। আব্দুল মালিক বিন মারওয়ান ৬৬ থেকে ৭২ হিজরিতে এর নির্মাণ স¤পন্ন করেন। এর অভ্যন্তরে বৃত্তের মাঝখানে পাথর রয়েছে যার উপর দাঁড়িয়ে বোরাকে আরোহণ করে মহানবী (সা.) মেরাজে গেছেন।
ইসলাম ও মুসলমানদের শত্রুরা বিগত শতাব্দীর শুরু থেকেই মুসলিম উম্মাহকে ধ্বংস ও দুর্বল করার লক্ষ্যে ফিলিস্তিনে অবৈধ ইসরাইল রাষ্ট্র সৃষ্টি করার উদ্যোগ নেয়। এর নেতৃত্বে ছিল সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ এবং তাকে সহযোগিতা করছে যুক্তরাষ্ট্র সহ ইউরোপের আরো কিছু রাষ্ট্র এবং মক্কা-মদিনার দখলদার সৌদি আরবের ৩য় বারের প্রতিষ্ঠাতা আব্দুল আজিজ বিন সৌদ। একটি সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্র করে ব্রিটেন আমেরিকা এবং ইহুদীবাদের প্রবক্তারা মুসলিম বিশ্বের হৃদয়ের মাঝখানে একটি বিষফোঁড়ার মতো কৃত্রিম রাষ্ট্র ইসরাইলকে সৃষ্টি করেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ইহুদিদেরকে নিয়ে এসে ফিলিস্তিনের পবিত্র ভূমিতে তাদেরকে পুনর্বাসিত করেছে। একদিকে এইসব ইহুদিকে সশস্ত্র এবং বেপরোয়া হিসেবে তৈরি করা হয়েছে। অন্যদিকে ওই অঞ্চলের বাসিন্দা মুসলমানদেরকে নির্মমভাবে নির্যাতন-নিপীড়নের মাধ্যমে এলাকা থেকে বের করে দিয়েছে।
লক্ষ লক্ষ ফিলিস্তিনি শরণার্থী প্রতিবেশী জর্ডান, সিরিয়া, মিশরসহ বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়ে যুগের পর যুগ ধরে মানবেতর জীবন যাপনে বাধ্য হয়েছে। ১৯৪৮, ৫৬, ৬৭ ও ৭৩-এ চার চারবার আরব-ইসরাইল যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। আরবরা সবাই মিলেও এই বায়বীয় রাষ্ট্র বিষাক্ত বিষফোঁড়া ইসরাইলের সঙ্গে পেরে উঠেনি। ওরা ওদের জন্মদাতা ব্রিটেন আমেরিকার শক্তিতে সিরিয়া, জর্ডান, লেবানন এবং মিশরের বিস্তীর্ণ ভূমি দখল করে নিয়েছে। তেল আবিবকে রাজধানী করে ওরা প্রথম অবৈধ ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিল। পরবর্তীকালে তারা জেরুসালেমকে রাজধানী হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। ১৯৬৭ সালে ওরা মসজিদুল আকসা দখল করে ওদের আয়ত্তে নিয়ে নেয়।
১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনিদের চৌদ্দ পুরুষের জায়গার উপরে অবৈধভাবে ইসরাইল রাষ্ট্র ঘোষণা দেয়ার আগ থেকেই সেখানকার মুসলিম অধিবাসীদের উপর হত্যা-নির্যাতন-নিপীড়ন চলেছে। এর পেছনে ছিল ব্রিটিশ হানাদার বাহিনী। মুসলিম অধিবাসীরা বাধ্য হয়ে সপরিবারে অন্য দেশে আশ্রয় নিয়েছে। এবং তাদের মধ্য থেকেই বিভিন্ন গ্রুপ ওদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রাম তখনই শুরু করেছে। পরবর্তীকালে বেশ কয়েকটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে ফিলিস্তিনের মুক্তির জন্য সংগ্রাম চলতে থাকে। এদের মধ্যে আলফাতাহ গ্রুপ ছিল সবচেয়ে শক্তিশালী। ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বে পরবর্তীকালে এই গ্রুপগুলোর সমন্বয়ে ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থা পিএলও গঠন করা হয়। দীর্ঘকাল ইয়াসির আরাফাত এর নেতৃত্বে নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ফলাফল ছিল শূন্য। ১৯৭৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের নেতৃত্বে ‘ক্যা¤প ডেভিড চুক্তি’ হয়েছিল পিএলও, মিশর ও ইসরাইলের মধ্যে। কিন্তু তাতে কোন ফলোদয় হয়নি, বরং পিএলও ও কিছু আরব রাষ্ট্র ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিয়েছিল মাত্র ।
১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামি বিপ্লবের পর বিশ্বরাজনীতি বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে আমূল পরিবর্তন আসে। ইসলামি বিপ্লবের নেতা ইমাম খোমেইনী (রহ.) শুরুতেই বাইতুল মুকাদ্দাসের মুক্তির বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে রমজানের শেষ শুক্রবারকে ‘আল-কুদস দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেন। শুধু তাই নয় তিনি ‘তারিকুল কুদস’ অভিযান চালানোর ঘোষণা দেন। এরই ফলশ্রুতিতে ফিলিস্তিন বিষয়ে বিশ্বব্যাপী নতুন চিন্তা-চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গির সৃষ্টি হয়। পাশাপাশি ফিলিস্তিনিদের মধ্যে সংঘটিত হয় ফিলিস্তিনের সত্যিকারের মুক্তিবাহিনী ‘হামাস’। যাদের লক্ষ্য একটাই, অবৈধ ইসরাইলকে নির্মূল করে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র তৈরি করা এবং বায়তুল মুকাদ্দাস মুক্ত করা। ফিলিস্তিনের সাথে স¤পৃক্ত রয়েছে পার্শ্ববর্তী দেশ লেবানন। সেখানে রয়েছে ফিলিস্তিনের লক্ষ লক্ষ শরণার্থী, যারা বহুযুগ ধরে সে দেশে অবস্থান করছে। এ সময়ে লেবাননে সংগঠিত হয় বিপ্লবী নেতা হাসান নাসরুল্লাহর নেতৃত্বে ‘হিজবুল্লাহ’। যাদের লক্ষ্য হচ্ছে ফিলিস্তিনি মুক্তি আন্দোলনে সহযোগিতা করা এবং ইসরাইলকে ধ্বংস করা। বিগত ৭২ বছরের ইতিহাসে আমরা দেখেছি অভিশপ্ত ইসরাইলিরা হামাস ও হিজবুল্লার কাছে একাধিকবার মার খেয়েছে, পরাজিত হয়েছে এবং তাদের অগ্রযাত্রা সীমিত হয়ে গেছে । শুধু সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা এবং তার দোসররা আর কিছু সংখ্যক রাজতান্ত্রিক আরব রাষ্ট্র ওদেরকে অক্সিজেন দিয়ে টিকিয়ে রেখেছে মাত্র। ইসরাইলের নতুন প্রজন্মের মধ্যেও তাদের অস্তিত্ব এবং কার্যক্রম নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। অন্যদিকে শত প্রতিকূলতা ও অবরোধের মধ্যেও ফিলিস্তিনের একটা অংশ নিয়ন্ত্রণ করে তাদের সফলতার প্রমাণ দিয়ে যাচ্ছে। সেদিন বেশি দূরে নয় বিশ্ব মুসলিমের সহায়তায় হামাস ও হিজবুল্লাহ সাম্রাজ্যবাদের সৃষ্ট অবৈধ বায়োবীয় রাষ্ট্র ইসরাইলকে ধ্বংস করে ফিলিস্তিনকে স্বাধীন করবে এবং আমাদের প্রথম কেবলা পবিত্র বায়তুল মুকাদ্দাসকে মুক্ত করবে ইনশাআল্লাহ।
সে লক্ষ্যে বিশ্বের প্রতিটি তাওহিদী মুসলিম এর দায়িত্ব হচ্ছে ফিলিস্তিনের এই মুক্তি সংগ্রামে হামাসকে সমর্থন দেয়া, হিজবুল্লাহকে সমর্থন দেয়া। পাশাপাশি ওই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের সাথে মিলে মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী দেশ ইসরাইলের বন্ধু ইসলামের দুশমনদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া। আল-কুদস দিবসের আহ্বান হচ্ছে এই ঘোষণাকে সমস্ত মুসলমানের কানে পৌঁছে দেয়া।
আল-কুদস দিবসের প্রাক্কালে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি ইরানের তারিকুল কুদস ফোর্স এর কমান্ডার বীর মুজাহিদ শহীদ কাশেম সোলাইমানিকে। হিজবুল্লাহ ও হামাস সংগঠন এবং এদের অগ্রযাত্রায় যিনি নেপথ্যে অভিভাবকের ভূমিকা পালন করেছেন। মহান আল্লাহ তাঁকে জান্নাতবাসী করুন।
আল কুদস দিবস জিন্দাবাদ, ফিলিস্তিন স্বাধীন হোক, বায়তুল মুকাদ্দাস মুক্ত হোক।
সাবেক অধ্যক্ষ ও স¤পাদক, দৈনিক আজকের ভোলা
ও সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট, আল-কুদস কমিটি বাংলাদেশ
কুদস মুক্ত করতে হলে মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা জরুরি
সিরাজুল ইসলাম –
মসজিদুল আকসা, বায়তুল মুকাদ্দাস ও ফিলিস্তিনÑ পবিত্র এ নামগুলো মুসলমানদের ঈমান ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। মসজিদুল আকসা, বায়তুল মুকাদ্দাস ও ফিলিস্তিনের প্রতি ভালোবাসা প্রতিটি মুমিনের হৃদয়ের গভীরে প্রোথিত। পবিত্র নগরী বায়তুল মুকাদ্দাস হচ্ছে মক্কা মু’আজ্জামা ও মদিনা মুনাওয়ারার পর ইসলামের তৃতীয় পবিত্র স্থান, যেখানে অবস্থিত ইসলামের প্রথম কিবলা মসজিদুল আকসা।
মসজিদুল হারাম, মসজিদে নববী ও বায়তুল মুকাদ্দাসে অবস্থিত মসজিদুল আকসার উদ্দেশে সফর বিশেষ সওয়াবের কাজÑ সেকথা ঘোষণা করেছেন স্বয়ং রাসূল (সা.)। মহানবী (সা.)-এর হিজরতের আগে মক্কায় এবং হিজরতের পরে মদিনায় বেশকিছু দিন মসজিদুল আকসাই ছিল মুসলমানদের কিবলা। পরে আল্লাহ তাআলার আদেশে মক্কা নগরীর কাবাঘর কিবলা হিসেবে নির্ধারিত হয়। রাসূলে আকরাম (সা.) এ মসজিদুল আকসা থেকেই মিরাজে গিয়েছিলেন। তাই
বায়তুল মুকাদ্দাস সাধারণ কোনো ভূখ- নয়। বায়তুল মুকাদ্দাস ও তার আশপাশের এলাকা তথা সমগ্র ফিলিস্তিন ভূমি বহু নবী-রাসূলের (আ.) স্মৃতিবিজড়িত এবং কোরআন মজিদে পুরো এই ভূখ-কে ‘আরদে মুকাদ্দাস’ বা ‘পবিত্র ভূমি’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সুতরাং হাদিসের বর্ণনা অনুযায়ী, হযরত আদম (আ.) মক্কায় কাবাঘর নির্মাণের চল্লিশ বছর পর বায়তুল মুকাদ্দাস শহরে মসজিদুল আকসা নির্মাণ করেন। এরপর হজরত সুলায়মান (আ.) বায়তুল মুকাদ্দাসের এ পবিত্র মসজিদের পুনঃনির্মাণ করেন। কিন্তু বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহে ওই মসজিদ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে বায়তুল মুকাদ্দাস মুসলমানদের অধিকারে আসে এবং পরবর্তীকালে ওই পবিত্র স্থান আবাদ করে সেখানে মসজিদুল আকসা ও কুব্বাতুস সাখরাহসহ (মসজিদ) বিভিন্ন স্থাপনা নির্মিত হয়। ১০৯৬ খ্রিস্টাব্দে ইউরোপের ক্রুসেডার খ্রিস্টানরা সমগ্র সিরিয়া ও ফিলিস্তিন দখল করে নেয়ার পর বায়তুল মুকাদ্দাসের বিভিন্ন ইসলামি স্থাপনায় পরিবর্তন করে, বিশেষ করে মসজিদুল আকসাকে গির্জায় পরিণত করে। এরপর ১১৮৭ খ্রিস্টাব্দে সালাহউদ্দীন আইয়ুবি বায়তুল মুকাদ্দাস শহরকে আবারও মুসলমানদের অধিকারে নিয়ে আসেন। অবশেষে ব্রিটিশ সরকার ফিলিস্তিনকে আরব ও ইহুদিদের মধ্যে ভাগ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। ফলে ১৯৪৮ সালের ১৫ মে ফিলিস্তিনে অবৈধ ইহুদিবাদী ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়।
এ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা লাভের পর ইহুদিরা আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে এবং মুসলমানদের ওপর ব্যাপকভাবে হত্যাযজ্ঞ চালায়। তাদের অত্যাচারে জর্জরিত আরবরা জীবন বাঁচাতে দলে দলে দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়। এ সত্ত্বেও তখনও বায়তুল মুকাদ্দাস মুসলমানদের দখলে ছিল। কিন্তু ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধে তা মুসলমানদের হাতছাড়া হয়ে যায়। ফিলিস্তিনের নির্যাতিত জনগণ দীর্ঘদিন ধরে তাদের আবাসভূমি ও আল-কুদস (বায়তুল মুকাদ্দাস) উদ্ধারের জন্য রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম চালিয়ে যেতে থাকে। তাদের সংগ্রামে দিশেহারা হয়ে ইহুদিবাদী ইসরাইল ফিলিস্তিনি জনগণের মধ্যে ভাঙন ধরানোর জন্য ফিলিস্তিনের একটি ক্ষুদ্র অংশে সীমিত স্বায়ত্তশাসনের কথা বলে কিছুসংখ্যক নেতাকে আপসকামী ভূমিকায় নিয়ে আসে। তথাকথিত শান্তি আলোচনার সুযোগে তারা একে একে ফিলিস্তিনের প্রকৃত সংগ্রামী নেতাদের হত্যা করে চলেছে এবং ফিলিস্তিনের নতুন নতুন এলাকা দখল করে ইহুদি বসতি সম্প্রসারণ অব্যাহত রেখেছে, এমনকি ফিলিস্তিনে মানবিক ত্রাণসহায়তা পৌঁছাতে পর্যন্ত বাধা দিচ্ছে। এ ধরনের অমানবিক কার্যক্রম তারা এখনও অব্যাহত রেখেছে। এছাড়া তারা ফিলিস্তিনের গাজা ভূখ-ে বারবার বিমান হামলা চালিয়ে নারী, শিশু ও বৃদ্ধসহ এ পর্যন্ত কয়েক হাজার নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছে এবং হাজার হাজার বাড়িঘর, মসজিদ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও হাসপাতাল ধ্বংস করেছে। ইহুদিবাদীদের ষড়যন্ত্র ও ধ্বংসলীলা আজ ফিলিস্তিনি ভূখ-ে সীমাবদ্ধ নেই। সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে, বিশেষ করে সিরিয়া, ইরাক, ইয়ামেন, লিবিয়া, বাহরাইনসহ গোটা আরব বিশ্বে মুসলিম দেশগুলোর যায়নবাদী আগ্রাসন ছড়িয়ে পড়েছে। এই ইহুদিবাদীদের ষড়যন্ত্রের ফাঁদে কোনো কোনো মুসলিম শাসক পতিত হয়েছেন। ফলে লাখ লাখ মুসলিম হত্যার শিকার হয়েছে। কোটি মুসলিম নিজ বাড়িঘর থেকে বিতাড়িত হয়ে ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। সেসব জায়গায় ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠী মানবেতর জীবনযাপন করছে।
ইহুদিবাদীদের পরিকল্পনা ছিল গোটা আরববিশ্ব দখল করার। কিন্তু ফিলিস্তিনিদের দীর্ঘ সংগ্রামের পাশাপাশি অন্যান্য আরব রাষ্ট্রের জনগণও আজ জেগে উঠছে। তারা নিজ নিজ দেশে শান্তি ও মুক্তির সংগ্রামের পাশাপাশি ফিলিস্তিনিদের অধিকারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। ইহুদি আগ্রাসন শুরুর দিন থেকেই কোনো না কোনো গ্রুপ প্রতিরোধ সংগ্রাম করে যাচ্ছে। হামাস, জিহাদ আন্দোলন, হিজবুল্লাহ এক্ষেত্রে আশাজাগানিয়া ভূমিকা রাখছে। ফলে সাম্প্রতিক দশকে তিনবার ইসরাইল যুদ্ধে পরাজিত হয়েছে।
অন্যদিকে ওআইসি, ন্যাম, জাতিসংঘ সবসময়ই ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার পক্ষে প্রস্তাব পাস করে আসছে। বিশ্বজনমত আজ ফিলিস্তিনের পক্ষে এবং আরববিশ্বের ‘ক্যান্সার’ খ্যাত ইসরাইলের বিপক্ষে। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা ও আল-কুদস মুক্তির দাবিতে সোচ্চার বিশ্বের সব ইসলামি পক্ষ। প্রতিবছর কুদস শরীফ মুক্ত করার লক্ষ্য নিয়ে বিশ্বের দেশে দেশে আন্তর্জাতিক কুদস দিবস পালিত হয়। শিয়া-সুন্নি, আরব-অনারবসহ সবাই বিশ্ব মুসলিমের ঐক্য ও আল কুদস-ফিলিস্তিনের মুক্তির কথা বলে। এ ঐক্যে ফাটল ধরানোর বহুবিধ প্রচেষ্টা এরই মধ্যে ব্যাপকভাবে শুরু হয়েছে। এর পাশাপাশি ইহুদিবাদী চক্রের এজেন্টরা মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে উগ্রবাদী জঙ্গিগোষ্ঠী প্রতিষ্ঠা করেছিল। যারা পর¯পরকে কাফের ফতোয়া দিয়ে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে থাকে। এসব জঙ্গিগোষ্ঠী নিজেদের ইসলামি বলে দাবি করলেও ফিলিস্তিন এবং আল কুদসের ব্যাপারে যেমন কোনো কথা বলে না, তেমনি ইসরাইলের সন্ত্রাসী কর্মকা-েরও প্রতিবাদ করে না। উপরন্তু মধ্যপ্রাচ্যে তাদের উগ্র হাঙ্গামার কারণে ফিলিস্তিন ও আল কুদস ইস্যু চাপা পড়ে যাচ্ছে।
ষড়যন্ত্রকারীরা নতুন নতুন দল-উপদল সৃষ্টি করে অর্থ, অস্ত্র ও অন্যান্য সহায়তা দিয়ে যুদ্ধের বিস্তার ঘটানোর মাধ্যমে মুসলমানদের শক্তিকে দুর্বল করার চেষ্টায় নিয়োজিত হয়েছে। একই সঙ্গে তারা এ কর্মকা-ের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের মূল সমস্যা ফিলিস্তিন ইস্যু থেকে মুসলমানদের দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে দেয়ার এবং মুসলমানদের মধ্যে অনৈক্যের বীজ বপনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রা¤প জেরুসালেম বা বায়তুল মুকাদ্দাসকে ইহুদিবাদী ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। ২০১৮ সালের ১৪ মে মার্কিন দূতাবাস তেলআবিব থেকে জেরুসালেমে স্থানান্তরের সময় নিরস্ত্র প্রতিবাদী ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরাইলের বর্বর সেনাবাহিনীর গুলিতে শতাধিক ফিলিস্তিনি শহীদ হন এবং বর্বোরচিত হামলায় আহতের সংখ্যা ২,৫০০-এ পৌঁছায়। ২০১৮ সালের ১৫ মে ছিল ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরাইলি দখলদারিত্বের তথা মহাবিপর্যয়ের (নাকাবা) ৭০ বছর। এদিন উপলক্ষে আয়োজিত তাদের বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ মিছিলে গুলি চালানোর কোনো বৈধতা ইসরাইলের নেই। স¤পূর্ণ অন্যায় ও বর্বরোচিতভাবে ফিলিস্তিনিদের যুগের পর যুগ হত্যা করে আসছে ইসরাইল। এর প্রতিবাদে সমগ্র মুসলিমবিশ্ব প্রতিবাদ জানাচ্ছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত কিছু আরব শাসক ইসরাইলি এ নৃশংসতার প্রতিবাদ না করে পরোক্ষভাবে তাদের ঘৃণ্য কাজে সহযোগিতায় লিপ্ত রয়েছে। শুধু তাই নয়, বেশ কিছু আরব দেশ ইসরাইলের সঙ্গে এখন প্রকাশ্যে স¤পর্ক স্থাপনের জোরদার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রা¤প ও ইসরাইলের যুদ্ধবাজ প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ফিলিস্তিনের মুক্তিসংগ্রামকে চিরতরে নিঃশেষ করার লক্ষ্যে এক ভয়াবহ ষড়যন্ত্রমূলক চুক্তি (‘ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি’ বা শতাব্দীর সেরা চুক্তি) স্বাক্ষর করেছেন। যে মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিশ্বের প্রায় সব পক্ষ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের অস্তিত্বকে মেনে নিয়ে একটি শান্তিপূর্ণ সমঝোতায় পৌঁছার জন্য তৎপর, ঠিক তখনই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রা¤প কতিপয় আরব রাষ্ট্রের সহযোগিতায় ফিলিস্তিনিদের স্বাধীন রাষ্ট্রকে সমূলে বিনাশ করার লক্ষ্যে ইহুদিবাদী ইসরাইলের সঙ্গে শতাব্দীর সেরা চুক্তি (!) স্বাক্ষর করে তা বাস্তবায়নের জন্য চেষ্টা চালাচ্ছেন।
এ চুক্তি মোতাবেক স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের কোনো অস্তিত্ব নেই। গাজা উপত্যকা, জিহুদিয়া পার্বত্য অঞ্চল ও পশ্চিম তীরের সামারিয়া অঞ্চল নিউ প্যালেস্টাইন নামে পরিচিত হবে। আর বাকি সব অঞ্চল, এমনকি এসব এলাকার ইহুদি বসতিগুলো সব স্বাধীন রাষ্ট্র ইসরাইলের অন্তর্ভুক্ত থাকবে। জেরুসালেম ইসরাইল ও নিউ প্যালেস্টাইনের যৌথ রাজধানী হবে। আরবরা নিউ প্যালেস্টাইন এবং ইহুদিরা ইসরাইলের নাগরিক হিসেবে গণ্য হবে। নিউ প্যালেস্টাইনের কোনো সেনাবাহিনী থাকবে না। হালকা অস্ত্রধারী পুলিশ থাকবে। বহিঃশত্রু থেকে তাদের রক্ষার দায়িত্বে থাকবে ইসরাইল। অর্থাৎ সেনাবাহিনী অস্ত্রভা-ার সবই থাকবে ইহুদিদের ও ইসরাইলের নিয়ন্ত্রণে। জেরুসালেমের নিয়ন্ত্রণ থাকবে ইসরাইলি পৌরসভার হাতে।
পিএলও, হামাস ও ইসরাইলের মধ্যে এ বিষয়ে একটি চুক্তি করে এর বাস্তবায়ন করা হবে। পিএলও যদি চুক্তিতে রাজি না হয়, তাহলে তাদের সব সাহায্য বন্ধ করে দেয়া হবে। অন্যদিকে হামাস যদি রাজি না হয়, তাহলে সরাসরি যুদ্ধ করে হামাসকে নির্মূল করে দেয়া হবে। সেক্ষেত্রে ইসরাইলের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি অংশগ্রহণ করবে। সৌদি আরব, মিসর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন ও জর্দান এ চুক্তির পক্ষে এরই মধ্যে প্রচারণা শুরু করেছে। সৌদি যুবরাজ মুহাম্মাদ বিন সালমান পিএলওকে অর্থ সাহায্যের কথা বলে চাপ সৃষ্টি করছেন।
মূলত পবিত্র বায়তুল মুকাদ্দাস তথা আল কুদসের মুক্তি ও স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের সংগ্রামকে সমূলে বিনাশ করার জন্যই ইসরাইলের জন্মদাতা ব্রিটিশ, আমেরিকা এবং ইহুদিদের বন্ধু কিছু আরব রাষ্ট্র এক মহাষড়যন্ত্র নিয়ে মাঠে নেমেছে। তাই আজ বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের এর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়া অপরিহার্য। সবাইকে একথা জানিয়ে দেয়া দরকার যে, ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইলের কবল থেকে আল- কুদসের মুক্তি এবং স্বাধীন সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাই মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির একমাত্র পথ।
১৯৭৯ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ইরানে ইসলামি বিপ্লব সফল হয়। এই বিপ্লবের মহান নেতা হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ.) মসজিদুল আকসাসহ সমগ্র ফিলিস্তিনকে মুক্ত করার লক্ষ্যে মুসলিম উম্মাহকে প্রতিবছর রমজানের শেষ শুক্রবার ‘আল-কুদস দিবস’ হিসেবে পালনের জন্য আহ্বান জানান। সেই থেকে প্রতিবছর বিশ্বে এ দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। কিন্তু প্রতিবছর গতানুগতিকভাবে আন্তর্জাতিক কুদস পালন না করে বরং আল-কুদসকে কীভাবে প্রকৃত অর্থে মুক্ত করা যায় সে বিষয়টি নিয়ে চিন্তভাবনা করা দরকার। এ সংগ্রামের পথে সবচেয়ে বড় যে বাধাÑ মুসলমানদের অনৈক্য তাকে সবার আগে সমূলে বিনাশ করতে হবে। তাহলে আশা করা যায় পবিত্র আল-কুদস আবার মুসলমানদের হাতে আসবে। ফিলিস্তিনি ভূমিও স্বাধীন হবে।
লেখকÑ সাংবাদিক ও কলামিস্ট
কুদস মুক্ত করতে হলে মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা জরুরি
সিরাজুল ইসলাম
মসজিদুল আকসা, বায়তুল মুকাদ্দাস ও ফিলিস্তিনÑ পবিত্র এ নামগুলো মুসলমানদের ঈমান ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। মসজিদুল আকসা, বায়তুল মুকাদ্দাস ও ফিলিস্তিনের প্রতি ভালোবাসা প্রতিটি মুমিনের হৃদয়ের গভীরে প্রোথিত। পবিত্র নগরী বায়তুল মুকাদ্দাস হচ্ছে মক্কা মু’আজ্জামা ও মদিনা মুনাওয়ারার পর ইসলামের তৃতীয় পবিত্র স্থান, যেখানে অবস্থিত ইসলামের প্রথম কিবলা মসজিদুল আকসা।
মসজিদুল হারাম, মসজিদে নববী ও বায়তুল মুকাদ্দাসে অবস্থিত মসজিদুল আকসার উদ্দেশে সফর বিশেষ সওয়াবের কাজÑ সেকথা ঘোষণা করেছেন স্বয়ং রাসূল (সা.)। মহানবী (সা.)-এর হিজরতের আগে মক্কায় এবং হিজরতের পরে মদিনায় বেশকিছু দিন মসজিদুল আকসাই ছিল মুসলমানদের কিবলা। পরে আল্লাহ তাআলার আদেশে মক্কা নগরীর কাবাঘর কিবলা হিসেবে নির্ধারিত হয়। রাসূলে আকরাম (সা.) এ মসজিদুল আকসা থেকেই মিরাজে গিয়েছিলেন। তাই
বায়তুল মুকাদ্দাস সাধারণ কোনো ভূখ- নয়। বায়তুল মুকাদ্দাস ও তার আশপাশের এলাকা তথা সমগ্র ফিলিস্তিন ভূমি বহু নবী-রাসূলের (আ.) স্মৃতিবিজড়িত এবং কোরআন মজিদে পুরো এই ভূখ-কে ‘আরদে মুকাদ্দাস’ বা ‘পবিত্র ভূমি’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সুতরাং হাদিসের বর্ণনা অনুযায়ী, হযরত আদম (আ.) মক্কায় কাবাঘর নির্মাণের চল্লিশ বছর পর বায়তুল মুকাদ্দাস শহরে মসজিদুল আকসা নির্মাণ করেন। এরপর হজরত সুলায়মান (আ.) বায়তুল মুকাদ্দাসের এ পবিত্র মসজিদের পুনঃনির্মাণ করেন। কিন্তু বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহে ওই মসজিদ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে বায়তুল মুকাদ্দাস মুসলমানদের অধিকারে আসে এবং পরবর্তীকালে ওই পবিত্র স্থান আবাদ করে সেখানে মসজিদুল আকসা ও কুব্বাতুস সাখরাহসহ (মসজিদ) বিভিন্ন স্থাপনা নির্মিত হয়। ১০৯৬ খ্রিস্টাব্দে ইউরোপের ক্রুসেডার খ্রিস্টানরা সমগ্র সিরিয়া ও ফিলিস্তিন দখল করে নেয়ার পর বায়তুল মুকাদ্দাসের বিভিন্ন ইসলামি স্থাপনায় পরিবর্তন করে, বিশেষ করে মসজিদুল আকসাকে গির্জায় পরিণত করে। এরপর ১১৮৭ খ্রিস্টাব্দে সালাহউদ্দীন আইয়ুবি বায়তুল মুকাদ্দাস শহরকে আবারও মুসলমানদের অধিকারে নিয়ে আসেন। অবশেষে ব্রিটিশ সরকার ফিলিস্তিনকে আরব ও ইহুদিদের মধ্যে ভাগ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। ফলে ১৯৪৮ সালের ১৫ মে ফিলিস্তিনে অবৈধ ইহুদিবাদী ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়।
এ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা লাভের পর ইহুদিরা আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে এবং মুসলমানদের ওপর ব্যাপকভাবে হত্যাযজ্ঞ চালায়। তাদের অত্যাচারে জর্জরিত আরবরা জীবন বাঁচাতে দলে দলে দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়। এ সত্ত্বেও তখনও বায়তুল মুকাদ্দাস মুসলমানদের দখলে ছিল। কিন্তু ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধে তা মুসলমানদের হাতছাড়া হয়ে যায়। ফিলিস্তিনের নির্যাতিত জনগণ দীর্ঘদিন ধরে তাদের আবাসভূমি ও আল-কুদস (বায়তুল মুকাদ্দাস) উদ্ধারের জন্য রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম চালিয়ে যেতে থাকে। তাদের সংগ্রামে দিশেহারা হয়ে ইহুদিবাদী ইসরাইল ফিলিস্তিনি জনগণের মধ্যে ভাঙন ধরানোর জন্য ফিলিস্তিনের একটি ক্ষুদ্র অংশে সীমিত স্বায়ত্তশাসনের কথা বলে কিছুসংখ্যক নেতাকে আপসকামী ভূমিকায় নিয়ে আসে। তথাকথিত শান্তি আলোচনার সুযোগে তারা একে একে ফিলিস্তিনের প্রকৃত সংগ্রামী নেতাদের হত্যা করে চলেছে এবং ফিলিস্তিনের নতুন নতুন এলাকা দখল করে ইহুদি বসতি সম্প্রসারণ অব্যাহত রেখেছে, এমনকি ফিলিস্তিনে মানবিক ত্রাণসহায়তা পৌঁছাতে পর্যন্ত বাধা দিচ্ছে। এ ধরনের অমানবিক কার্যক্রম তারা এখনও অব্যাহত রেখেছে। এছাড়া তারা ফিলিস্তিনের গাজা ভূখ-ে বারবার বিমান হামলা চালিয়ে নারী, শিশু ও বৃদ্ধসহ এ পর্যন্ত কয়েক হাজার নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছে এবং হাজার হাজার বাড়িঘর, মসজিদ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও হাসপাতাল ধ্বংস করেছে। ইহুদিবাদীদের ষড়যন্ত্র ও ধ্বংসলীলা আজ ফিলিস্তিনি ভূখ-ে সীমাবদ্ধ নেই। সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে, বিশেষ করে সিরিয়া, ইরাক, ইয়ামেন, লিবিয়া, বাহরাইনসহ গোটা আরব বিশ্বে মুসলিম দেশগুলোর যায়নবাদী আগ্রাসন ছড়িয়ে পড়েছে। এই ইহুদিবাদীদের ষড়যন্ত্রের ফাঁদে কোনো কোনো মুসলিম শাসক পতিত হয়েছেন। ফলে লাখ লাখ মুসলিম হত্যার শিকার হয়েছে। কোটি মুসলিম নিজ বাড়িঘর থেকে বিতাড়িত হয়ে ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। সেসব জায়গায় ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠী মানবেতর জীবনযাপন করছে।
ইহুদিবাদীদের পরিকল্পনা ছিল গোটা আরববিশ্ব দখল করার। কিন্তু ফিলিস্তিনিদের দীর্ঘ সংগ্রামের পাশাপাশি অন্যান্য আরব রাষ্ট্রের জনগণও আজ জেগে উঠছে। তারা নিজ নিজ দেশে শান্তি ও মুক্তির সংগ্রামের পাশাপাশি ফিলিস্তিনিদের অধিকারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। ইহুদি আগ্রাসন শুরুর দিন থেকেই কোনো না কোনো গ্রুপ প্রতিরোধ সংগ্রাম করে যাচ্ছে। হামাস, জিহাদ আন্দোলন, হিজবুল্লাহ এক্ষেত্রে আশাজাগানিয়া ভূমিকা রাখছে। ফলে সাম্প্রতিক দশকে তিনবার ইসরাইল যুদ্ধে পরাজিত হয়েছে।
অন্যদিকে ওআইসি, ন্যাম, জাতিসংঘ সবসময়ই ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার পক্ষে প্রস্তাব পাস করে আসছে। বিশ্বজনমত আজ ফিলিস্তিনের পক্ষে এবং আরববিশ্বের ‘ক্যান্সার’ খ্যাত ইসরাইলের বিপক্ষে। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা ও আল-কুদস মুক্তির দাবিতে সোচ্চার বিশ্বের সব ইসলামি পক্ষ। প্রতিবছর কুদস শরীফ মুক্ত করার লক্ষ্য নিয়ে বিশ্বের দেশে দেশে আন্তর্জাতিক কুদস দিবস পালিত হয়। শিয়া-সুন্নি, আরব-অনারবসহ সবাই বিশ্ব মুসলিমের ঐক্য ও আল কুদস-ফিলিস্তিনের মুক্তির কথা বলে। এ ঐক্যে ফাটল ধরানোর বহুবিধ প্রচেষ্টা এরই মধ্যে ব্যাপকভাবে শুরু হয়েছে। এর পাশাপাশি ইহুদিবাদী চক্রের এজেন্টরা মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে উগ্রবাদী জঙ্গিগোষ্ঠী প্রতিষ্ঠা করেছিল। যারা পর¯পরকে কাফের ফতোয়া দিয়ে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে থাকে। এসব জঙ্গিগোষ্ঠী নিজেদের ইসলামি বলে দাবি করলেও ফিলিস্তিন এবং আল কুদসের ব্যাপারে যেমন কোনো কথা বলে না, তেমনি ইসরাইলের সন্ত্রাসী কর্মকা-েরও প্রতিবাদ করে না। উপরন্তু মধ্যপ্রাচ্যে তাদের উগ্র হাঙ্গামার কারণে ফিলিস্তিন ও আল কুদস ইস্যু চাপা পড়ে যাচ্ছে।
ষড়যন্ত্রকারীরা নতুন নতুন দল-উপদল সৃষ্টি করে অর্থ, অস্ত্র ও অন্যান্য সহায়তা দিয়ে যুদ্ধের বিস্তার ঘটানোর মাধ্যমে মুসলমানদের শক্তিকে দুর্বল করার চেষ্টায় নিয়োজিত হয়েছে। একই সঙ্গে তারা এ কর্মকা-ের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের মূল সমস্যা ফিলিস্তিন ইস্যু থেকে মুসলমানদের দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে দেয়ার এবং মুসলমানদের মধ্যে অনৈক্যের বীজ বপনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রা¤প জেরুসালেম বা বায়তুল মুকাদ্দাসকে ইহুদিবাদী ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। ২০১৮ সালের ১৪ মে মার্কিন দূতাবাস তেলআবিব থেকে জেরুসালেমে স্থানান্তরের সময় নিরস্ত্র প্রতিবাদী ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরাইলের বর্বর সেনাবাহিনীর গুলিতে শতাধিক ফিলিস্তিনি শহীদ হন এবং বর্বোরচিত হামলায় আহতের সংখ্যা ২,৫০০-এ পৌঁছায়। ২০১৮ সালের ১৫ মে ছিল ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরাইলি দখলদারিত্বের তথা মহাবিপর্যয়ের (নাকাবা) ৭০ বছর। এদিন উপলক্ষে আয়োজিত তাদের বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ মিছিলে গুলি চালানোর কোনো বৈধতা ইসরাইলের নেই। স¤পূর্ণ অন্যায় ও বর্বরোচিতভাবে ফিলিস্তিনিদের যুগের পর যুগ হত্যা করে আসছে ইসরাইল। এর প্রতিবাদে সমগ্র মুসলিমবিশ্ব প্রতিবাদ জানাচ্ছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত কিছু আরব শাসক ইসরাইলি এ নৃশংসতার প্রতিবাদ না করে পরোক্ষভাবে তাদের ঘৃণ্য কাজে সহযোগিতায় লিপ্ত রয়েছে। শুধু তাই নয়, বেশ কিছু আরব দেশ ইসরাইলের সঙ্গে এখন প্রকাশ্যে স¤পর্ক স্থাপনের জোরদার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রা¤প ও ইসরাইলের যুদ্ধবাজ প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ফিলিস্তিনের মুক্তিসংগ্রামকে চিরতরে নিঃশেষ করার লক্ষ্যে এক ভয়াবহ ষড়যন্ত্রমূলক চুক্তি (‘ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি’ বা শতাব্দীর সেরা চুক্তি) স্বাক্ষর করেছেন। যে মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিশ্বের প্রায় সব পক্ষ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের অস্তিত্বকে মেনে নিয়ে একটি শান্তিপূর্ণ সমঝোতায় পৌঁছার জন্য তৎপর, ঠিক তখনই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রা¤প কতিপয় আরব রাষ্ট্রের সহযোগিতায় ফিলিস্তিনিদের স্বাধীন রাষ্ট্রকে সমূলে বিনাশ করার লক্ষ্যে ইহুদিবাদী ইসরাইলের সঙ্গে শতাব্দীর সেরা চুক্তি (!) স্বাক্ষর করে তা বাস্তবায়নের জন্য চেষ্টা চালাচ্ছেন।
এ চুক্তি মোতাবেক স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের কোনো অস্তিত্ব নেই। গাজা উপত্যকা, জিহুদিয়া পার্বত্য অঞ্চল ও পশ্চিম তীরের সামারিয়া অঞ্চল নিউ প্যালেস্টাইন নামে পরিচিত হবে। আর বাকি সব অঞ্চল, এমনকি এসব এলাকার ইহুদি বসতিগুলো সব স্বাধীন রাষ্ট্র ইসরাইলের অন্তর্ভুক্ত থাকবে। জেরুসালেম ইসরাইল ও নিউ প্যালেস্টাইনের যৌথ রাজধানী হবে। আরবরা নিউ প্যালেস্টাইন এবং ইহুদিরা ইসরাইলের নাগরিক হিসেবে গণ্য হবে। নিউ প্যালেস্টাইনের কোনো সেনাবাহিনী থাকবে না। হালকা অস্ত্রধারী পুলিশ থাকবে। বহিঃশত্রু থেকে তাদের রক্ষার দায়িত্বে থাকবে ইসরাইল। অর্থাৎ সেনাবাহিনী অস্ত্রভা-ার সবই থাকবে ইহুদিদের ও ইসরাইলের নিয়ন্ত্রণে। জেরুসালেমের নিয়ন্ত্রণ থাকবে ইসরাইলি পৌরসভার হাতে।
পিএলও, হামাস ও ইসরাইলের মধ্যে এ বিষয়ে একটি চুক্তি করে এর বাস্তবায়ন করা হবে। পিএলও যদি চুক্তিতে রাজি না হয়, তাহলে তাদের সব সাহায্য বন্ধ করে দেয়া হবে। অন্যদিকে হামাস যদি রাজি না হয়, তাহলে সরাসরি যুদ্ধ করে হামাসকে নির্মূল করে দেয়া হবে। সেক্ষেত্রে ইসরাইলের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি অংশগ্রহণ করবে। সৌদি আরব, মিসর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন ও জর্দান এ চুক্তির পক্ষে এরই মধ্যে প্রচারণা শুরু করেছে। সৌদি যুবরাজ মুহাম্মাদ বিন সালমান পিএলওকে অর্থ সাহায্যের কথা বলে চাপ সৃষ্টি করছেন।
মূলত পবিত্র বায়তুল মুকাদ্দাস তথা আল কুদসের মুক্তি ও স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের সংগ্রামকে সমূলে বিনাশ করার জন্যই ইসরাইলের জন্মদাতা ব্রিটিশ, আমেরিকা এবং ইহুদিদের বন্ধু কিছু আরব রাষ্ট্র এক মহাষড়যন্ত্র নিয়ে মাঠে নেমেছে। তাই আজ বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের এর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়া অপরিহার্য। সবাইকে একথা জানিয়ে দেয়া দরকার যে, ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইলের কবল থেকে আল- কুদসের মুক্তি এবং স্বাধীন সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাই মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির একমাত্র পথ।
১৯৭৯ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ইরানে ইসলামি বিপ্লব সফল হয়। এই বিপ্লবের মহান নেতা হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ.) মসজিদুল আকসাসহ সমগ্র ফিলিস্তিনকে মুক্ত করার লক্ষ্যে মুসলিম উম্মাহকে প্রতিবছর রমজানের শেষ শুক্রবার ‘আল-কুদস দিবস’ হিসেবে পালনের জন্য আহ্বান জানান। সেই থেকে প্রতিবছর বিশ্বে এ দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। কিন্তু প্রতিবছর গতানুগতিকভাবে আন্তর্জাতিক কুদস পালন না করে বরং আল-কুদসকে কীভাবে প্রকৃত অর্থে মুক্ত করা যায় সে বিষয়টি নিয়ে চিন্তভাবনা করা দরকার। এ সংগ্রামের পথে সবচেয়ে বড় যে বাধাÑ মুসলমানদের অনৈক্য তাকে সবার আগে সমূলে বিনাশ করতে হবে। তাহলে আশা করা যায় পবিত্র আল-কুদস আবার মুসলমানদের হাতে আসবে। ফিলিস্তিনি ভূমিও স্বাধীন হবে।
লেখকÑ সাংবাদিক ও কলামিস্ট
হযরত ফাতেমা যাহরা (আ.) এবং নারীর ত্রিমাত্রিক ভূমিকা [২০ জমাদিউসসানি নবীনন্দিনী হযরত ফাতেমা যাহরা (আ.) এর পবিত্র জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে এ নিবন্ধটি রচিত] আব্দুল কুদ্দুস বাদশা যে ব্যক্তি পৃথিবীতে ও পরলোকে উৎকৃষ্ট জীবন লাভ করতে চায় তার জন্য রাসূলুল্লাহ্ (সা.) ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের জীবনচরিতেই রয়েছে সর্বোত্তম নির্দেশনা। এ বিষয়টি এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, তাঁদের ব্যবহারিক জীবনকে আদর্শ হিসাবে অনুসরণ করা ব্যতীত কোনো মানুষের পক্ষে সেই উৎকৃষ্ট জীবন অর্জন করা সম্ভবপর নয়। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পবিত্র আহলে বাইতের মধ্যে কেন্দ্রিয় ব্যক্তিত্ব হলেন নবীনন্দিনী হযরত ফাতেমা যাহরা (সা.)। তাঁর পূত-পবিত্র জীবনচরিত বিশেষ করে মুসলিম নারীদের জন্য সূর্যের ন্যায় আলোকবর্তিকাস্বরূপ। আজকের বিশ্ব নারীসমাজ যে সমস্ত কঠিন সমস্যায় জর্জরিত, তার বহুলাংশের নিরসন সম্ভব এই মহীয়সী নারীর জীবনাচারের সাথে পরিচিত হওয়া এবং সেখান থেকে আদর্শ গ্রহণের মাধ্যমে। বর্তমান বিশ্বে যখন পশ্চিমা পুঁজিবাদী ব্যবস্থা তার সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মাধ্যমে মুসলমান নারী ও তরুণীদের জন্য একটি অশ্লীল ও অমানবিক আদর্শ উপস্থাপন করতে চায়, তখন হযরত ফাতেমা যাহরা (আ.)-এর বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্বের সূক্ষ্ম দিকগুলো আবিষ্কার করার মাধ্যমে শুধু মুসলিম নারীর জন্য নয়, বরং গোটা বিশ্বের নারীদের জন্য একটি ব্যবহারিক জীবনাদর্শ উপস্থাপন করা যেতে পারে। আজকের নারীর তার সত্যিকার আপন সত্তাকে খুঁজে পাওয়ার ক্ষেত্রে যত সমস্যার সম্মুখীন, সেগুলো জন্ম নিয়েছে একটি বিষয় থেকে। আর তা হল ব্যক্তিগত, পারিবারিক এবং সামাজিকÑ এই তিন ক্ষেত্রে নারীর জীবনে ভারসাম্যতা প্রতিষ্ঠিত না থাকা। অর্থাৎ তার দরকার একটি ভারসাম্যশীল জীবনাদর্শ। এক্ষেত্রে হযরত ফাতেমা যাহরা (আ.)-এর জীবনচরিতই তার জন্য সর্বোত্তম জীবনাদর্শ, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রত্যেক নারীর জন্য ধর্মীয় কর্তব্যসমূহ যথাযথ পালন ব্যতিরেকেও তিনটি ভূমিকা থাকে : ব্যক্তিগত, পারিবারিক এবং সামাজিক। হয়ত কোন কোন ধর্মে নারীর এই ত্রিমাত্রিক ভূমিকার মধ্য থেকে একটিকে অপরটি অপেক্ষা হালকা করে দেখা হয়েছে। কিংবা নারীর মঙ্গলার্থে সঠিকভাবে তা সংজ্ঞায়ন করা হয়নি। উদাহরণস্বরূপ মধ্যযুগীয় খ্রিষ্ট ধর্মে তারাই খ্রিষ্টান হতে পারতো যারা কখনো নারীর চারপাশে ঘুরবে না। একারণেই দেখা যায় যে, পাদ্রি ও পুরোহিতরা আজীবনে বিবাহ করে না। কেননা, বিবাহ হচ্ছে এমন বন্ধন যা ঈশ্বরকে ক্রোধান্বিত করে থাকে। তওরাতেও নারীদের অস্তিত্বকে মৃত্যুর চেয়ে তিতা বলে মনে করা হয়েছে। ইয়াহুদীদের প্রাত্যহিক প্রার্থনাবাণীর মধ্যে বলা হয়েছে, কৃতজ্ঞতা ঈশ্বরকে যিনি আমাকে পুরুষ হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। অথবা উপাসনালয় ও গির্জার শিক্ষায় বলা হয়েছে, নারী হচ্ছে পুরুষের সেবাকারিণী, আর পুরুষ নারীর মনিব। কখনোবা নারীকে তার সৃষ্টি-স্বভাবের দাবি অনুসারে ক্রীতদাসে পরিণত করা হয়। অবশ্য নিঃসন্দেহে সকল নবী-রাসূলই নারীর মর্যাদার প্রতিরক্ষক ছিলেন এবং তার প্রতি যে কোন ধরনের অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু বিকৃত কিতাবসমূহের বিধানাবলির কারণেই নারী তার মর্যাদা ও সম্মান হারায়। এই বিচ্যুতির ধারা চলতে থাকে। যা এক পর্যায়ে পাশ্চাত্যে প্রতিবাদের মুখে পড়ে এবং নারীবাদী আন্দোলনে রূপ পরিগ্রহ করে। এ আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল নারী অধিকারকে পুনরুদ্ধার করা। কিন্তু পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশে বাড়াবাড়ি এমন জায়গায় পৌঁছায় যে, কিছু কিছু বিষয়, যেমন : গর্ভপাতের স্বাধীনতা, প্রজনন প্রযুক্তির যথেচ্ছ ব্যবহার, সেক্সুয়্যাল সোশ্যালিজম ইত্যাদি অবাঞ্ছিত বিষয়াবলিও বৈধ করার দাবি ওঠে। যার ফলে নৈতিক প্রতিশ্রুতিশীলতার আর কোন জায়গাই অবশিষ্ট থাকেনি। এতে শুধু যে নারীর নৈতিক দিকের খর্ব ঘটেছে, তা নয়, বরং তার সামাজিক ও অর্থনৈতিক মর্যাদাও উন্নত হয়নি। জাতিসংঘের জরিপ অনুযায়ী নারীর কর্ম ও পেশাভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গিকে তার পরিবারভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গির স্থলাভিষিক্ত করার পরও এখনও ৯০ ভাগ উপার্জন পুরুষের হাতে। অপরদিকে কর্ম-বাজারে নারীকে অতিমাত্রায় টেনে আনার কারণে পাশ্চাত্যে পরিবারের ভিত্ নড়বড়ে হয়ে পড়েছে এবং সন্তানদের মাতৃ¯েœহ ও মাতৃমমতা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। সেই সাথে সমানতালে বৃদ্ধি পেয়েছে যৌন নিপীড়ন ও নারী নিগ্রহের হার। এটা খুবই স্বাভাবিক যে, যখন স্বাধীনতার নামে নারীর সম্ভ্রম ও লজ্জাশীলতা বিস্মৃতির কবলে পড়ে, তখন ফলাফল এটা ভিন্ন অন্য কিছু আশা করা যায় না। আশার কথা হল, এই ভ্রান্ত পথের অভিজ্ঞতা আজ নারীকে পুনরায় পরিবার ও সম্ভ্রমের দিকে প্রত্যাবর্তনে চালিত করছে। কিন্তু প্রশ্ন হল একটি সঠিক শিক্ষা ও আদর্শ না থাকলে কি নারী তার ত্রিমাত্রিক (ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক) ভূমিকা যথাযথভাবে পালন করতে সক্ষম হবে? হযরত ফাতেমা যাহরা (আ.) তাঁর ঈমান ও আকিদা-বিশ্বাসগত গুণাবলির (যা একজন মুসলমান নারীর জন্য স্বতন্ত্র) পাশাপাশি কিছু সর্বজনীন গুণ-বৈশিষ্ট্যেরও অধিকারী ছিলেন, যা সকল সম্প্রদায় ও জাতির নারীর জন্য আদর্শ হওয়ার উপযুক্ত। তিনি তাঁর জীবনধারায় ব্যক্তিগত, পারিবারিক (মা ও স্ত্রী হিসাবে) এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক ভূমিকায় নারীর জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ আদর্শ। ব্যক্তিজীবনে সরলতা ও অনাড়ম্বরতা, মানবপ্রেম ও পরোপকার, ধৈর্য ও আত্ম-ত্যাগ, লজ্জাশীলতা ও আত্ম-সম্ভ্রম ইত্যাদি মানবিক গুণাবলিতে এই মহিয়সী রমণী ছিলেন আদর্শ দর্পণস্বরূপ। এই মানবিক তাৎপর্যগুলো সর্বযুগে প্রশংসনীয় ছিল এবং থাকবে। প্রকৃতপক্ষে এগুলো মানবের সহজাত প্রবৃত্তির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। তাই এগুলো চিরসত্য। পরিবেশের প্রভাব কিংবা বস্তুগত ও প্রযুক্তিগত চাকচিক্য কোনদিন এ সত্যকে বদলাতে পারে না। অর্থাৎ পরিবেশ, প্রযুক্তি ইত্যাদি বাহ্যিক কারণে কখনো অশ্লীলতা ও মিথ্যাচার পছন্দনীয় আর লজ্জাশীলতা ও সত্যবাদিতা নিন্দনীয় হয়ে যায় না। হযরত ফাতেমা যাহরা (আ.)-এর জীবনচরিত প্রকৃতপক্ষে নির্দেশ করে যে, ইসলাম চুলচেরা মনোযোগের সাথে ব্যক্তির সুস্থতা ও নিরাপত্তা এবং তারই সূত্র ধরে সমাজের সুস্থতা ও নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তা করে। তাই তো দেখা যায় যখন তাঁকে প্রশ্ন করা হয় ‘নারীর জন্য সবচেয়ে উত্তম কী?’- এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘নারীরা পুরুষদেরকে দেখবে না, আর পুরুষরা নারীদেরকে দেখবে না’। প্রকৃতপক্ষে তাঁর এ উক্তি থেকে যা উপলব্ধ হয়, সেটা হল সমাজের নৈতিক ও সামাজিক সুস্থতা ও নিরাপত্তার চাবিকাঠি নিহিত রয়েছে নারীদের সম্ভ্রম সংরক্ষণ ও পর্দানশীন থাকার মধ্যে। দুঃখজনকভাবে আজ যা শুধু পাশ্চাত্য সমাজেই নয়, মুসলিম সমাজগুলোতেও প্রচ-ভাবে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের কবলে পড়েছে। হযরত ফাতেমা যাহরা (আ.) পারিবারিক জীবনের পরিসরে এবং মা ও স্ত্রী হিসাবে ভূমিকা রাখার ক্ষেত্রে ইসলাম প্রদত্ত সর্বতো অধিকার ভোগ করেন, যে অধিকার অন্য কোন মতাদর্শে কিংবা ধর্মে এমনকি চিন্তাও করা যায় না। পাশাপাশি তিনি স্বীয় ধর্মীয় কর্তব্যসমূহকে সর্বোত্তমভাবে পালন করেন। ইসলামে নারী নিজের জন্য কিংবা তার পরিবারের জন্য কাজ করতে বাধ্য নয়। নারীর ভরণপোষণ বহন করা শরয়ীভাবে পুরুষের ওপর ওয়াজিব। এমনকি এই যে নারী পরিবারে শিশুকে দুধ পান করায়, এ বাবদ স্বামীর নিকট থেকে অর্থ গ্রহণের অধিকার ছাড়াও অন্যান্য অধিকার তার রয়েছে। কিন্তু ফাতেমা যাহরা (আ.) অন্য কোন কিছুর আগে নিজের মাতৃত্ব ও স্ত্রীত্বের ভূমিকার প্রতি বেশি আকৃষ্ট ছিলেন, যা বর্তমানে অনেক পরিবারে চোখে পড়ে না। নারী যখন একাকীত্বের ভয়ে কিংবা অর্থ-সম্পদ না থাকার ভয়ে বিবাহে ব্রতী হয়, অথবা বিবাহের পূর্বে বিচিত্র সম্পর্কের জগতকে পরখ করে আসে, তখন তার ফলাফল দাঁড়ায় শ্বেত বিবাহ, সিঙ্গেল মাদার, আলাদা পরিবার, নিঃসন্তান দম্পতি, পরিচয়হীন সন্তান, যথেচ্ছ বিবাহবিচ্ছেদের মত ঘটনাবলির দৌরাত্ম্য। আর এই সবকিছুর কুফল হল ভয়ানক আত্মিক ও মানসিক সমস্যার অশান্তি। কেউ বা মাদকাসক্তির মধ্যে ডুব দেয়। আবার কেউ বা বেছে নেয় আত্মহননের পথ। সুতরাং পরিবারে নারীর মা ও স্ত্রী হিসাবে ভূমিকা পালনের প্রতি অকৃত্রিম আগ্রহ ও ভালবাসা যে জীবনের বুনিয়াদ রচনা করে, তা মানব জীবনযাত্রাকে সুদৃঢ়করণ, সুযোগ্য সন্তান-সন্ততি লালন পালন এবং সৌভাগ্যবান সমাজ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখে। আরেকটি বিষয় হল, ইসলামের বিরুদ্ধে যে কু-ধারণা ও অপপ্রচার চালানো হয়ে থাকে যে, এখানে নারীরা ঘরে বন্দি, তা মোটেও সত্য নয়। বরং ইসলামে শুধু যে সমাজে নারীর সক্রিয় উপস্থিতিকে নিষেধ করা হয়নি, বরং সমাজে তাদের ভূমিকা রাখতে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। ফাতেমা যাহরা (আ.) সর্বকালের নারীদের আদর্শ হিসাবে সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে উপস্থিত ছিলেন। তবে এ উপস্থিতি কিরূপে হবে সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। যেমনটা আজকে বিভিন্ন সমাজে পরিলক্ষিত হয় যে, নারীদের অজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে এবং চমকপ্রদ সব স্লোগান ব্যবহার করে তাদেরকে কেবল রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য উপকরণের ন্যায় ব্যবহার করা হচ্ছে। কাজেই সমাজ ও রাজনীতির অঙ্গনে নারীদের উপস্থিতির অন্যতম পূর্বশর্ত হল নারীর মর্যাদা সুরক্ষিত থাকা। অর্থাৎ সমাজে এই উপস্থিতি যেন নারীর মানবিক মর্যাদায় আঘাত হানার কারণ না হয়। পাশ্চাত্যে নারীমুক্তির যেসব স্লোগান দেওয়া হয়ে থাকে সবই অন্তঃসারশূন্য। বাস্তবিকপক্ষে তা নারীর স্খলনের পথকেই প্রশস্ত করে থাকে। কেননা, তাদের বিভিন্ন ধরনের অধিকার ও স্বাধীনতার কথা বলা হয়। যেমন ভোট প্রদানের অধিকার, গর্ভপাতের অধিকার, বিনাদোষে বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকার, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, যৌন স্বাধীনতা, রাজনীতি সমাজ ও অর্থনীতিতে ব্যাপকভিত্তিক উপস্থিতির স্বাধীনতা ইত্যাদি। ফলে বিবাহের বয়স ও সিঙ্গেল লাইফের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া, পরিবার ভেঙ্গে যাওয়া, বিবাহ বিচ্ছেদ বেড়ে যাওয়া, দুই লিঙ্গের মাঝে দ্বান্দ্বিক মনোভাব সৃষ্টি, নারীত্ব ধ্বংসকরণ এবং নারীদের পরিচয় সঙ্কট, পৌরুষত্বের দুর্বলীকরণ, ব্যক্তি ও সমাজের সীমানা তুলে দেওয়া, সমকামিতার প্রচলন, গর্ভপাত সৃষ্টির মাধ্যমে নারীদের পুঁজিবাদের সেবায় উপকরণসর্বস্ব হয়ে পড়া, সেক্স ইন্ডাস্ট্রি গড়ে ওঠা ইত্যাদি সমস্যা আজ প্রকট রূপ ধারণ করেছে। নারীদের সামাজিক অঙ্গনে উপস্থিতির আরেকটি পূর্বশর্ত হচ্ছে তা যেন তাদের মাতৃত্ব ও স্ত্রীত্বের ভূমিকা পালনে বাধা না হয়। পাশ্চাত্যে নারীমুক্তি আন্দোলনসমূহের সূত্র ধরে যে ভ্রান্তিটা জন্ম নেয় তাতে নারীর মা ও স্ত্রী হিসাবে ভূমিকা পালন করা দুষ্কর হয়ে পড়ে এবং সামগ্রিকভাবে পরিবার বন্দি হয়ে পড়ে। যা স্বাধীনতা বাস্তবায়নের পথে অন্তরায়। আরেকটি শর্ত হল সমাজে নারীর কার্যকর উপস্থিতি। পাশ্চাত্য মনে করে নারীর কার্যকর উপস্থিতি শুধু তাদের দৈহিক আবির্ভাবের মাধ্যমেই সম্ভব। এর ফলে পাশ্চাত্য দৃষ্টিকোণ থেকে নারী তার ব্যক্তিগত স্বাধীনতা সত্ত্বেও কেবল বাহ্যিকভাবে গুরুত্ব পেয়েছে, যে দৃষ্টিভঙ্গি আজকের পশ্চিমা নারীকে অসহায় ও মরিয়া করে তুলেছে। অথচ ইসলামে নারীর এই উপস্থিতি তার কার্যকারিতা সহকারে নির্দেশিত হয়েছে। যেমনটা আমরা দেখতে পাই উহুদের যুদ্ধে হযরত ফাতেমার উপস্থিতি একজন চিকিৎসক হিসাবে। আহযাবের যুদ্ধে পরিখা খনন করার সময় তাঁর সক্রিয় উপস্থিতি, বাগে ফাদাক এর পরিচালনা, নারীদের জন্য ধর্মীয় জিজ্ঞাসাসমূহের উত্তর প্রদানের জন্য জলসার আয়োজন ইত্যাদি। তাছাড়া ইসলামের ক্রান্তিলগ্নে মুনাফিকদের তাবত চক্রান্তকে নস্যাৎ করে দিয়ে ইসলামকে রক্ষার্থে তাঁর মসজিদে নববীতে হাজির হওয়া এবং অগ্নিঝরা বক্তৃতার মাধ্যমে মুনাফিকদের কূট্চক্রান্তকে ফাঁস করে দেওয়াÑ এ সকল ঘটনাই সমাজে নারীর ইতিবাচক কার্যকর উপস্থিতির একেকটি দৃষ্টান্ত, যা অমুসলিম নারীদের জন্যও প্রযোজ্য। নারীর ত্রিমাত্রিক ভূমিকার উপরোক্ত এ বিশ্লেষণ থেকে প্রতিপন্ন হয় যে, আজ যেসকল বিষয় নারীর স্কন্ধে ন্যস্ত করা হয়েছে সেগুলোর অনেক কিছুই প্রাসঙ্গিকতা হারায়। কারণ, তা নারীর মর্যাদা ও ইতিবাচক কার্যকর উপস্থিতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় তাকে এ পরিস্থিতি থেকে বের করে আনতেই হবে। ফাতেমা যাহরা (আ.)-এর জীবনচরিতই হোক নারীর জীবনাদর্শ।
আব্দুল কুদ্দুস বাদশা
যে ব্যক্তি পৃথিবীতে ও পরলোকে উৎকৃষ্ট জীবন লাভ করতে চায় তার জন্য রাসূলুল্লাহ্ (সা.) ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের জীবনচরিতেই রয়েছে সর্বোত্তম নির্দেশনা। এ বিষয়টি এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, তাঁদের ব্যবহারিক জীবনকে আদর্শ হিসাবে অনুসরণ করা ব্যতীত কোনো মানুষের পক্ষে সেই উৎকৃষ্ট জীবন অর্জন করা সম্ভবপর নয়।
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পবিত্র আহলে বাইতের মধ্যে কেন্দ্রিয় ব্যক্তিত্ব হলেন নবীনন্দিনী হযরত ফাতেমা যাহরা (সা.)। তাঁর পূত-পবিত্র জীবনচরিত বিশেষ করে মুসলিম নারীদের জন্য সূর্যের ন্যায় আলোকবর্তিকাস্বরূপ। আজকের বিশ্ব নারীসমাজ যে সমস্ত কঠিন সমস্যায় জর্জরিত, তার বহুলাংশের নিরসন সম্ভব এই মহীয়সী নারীর জীবনাচারের সাথে পরিচিত হওয়া এবং সেখান থেকে আদর্শ গ্রহণের মাধ্যমে। বর্তমান বিশ্বে যখন পশ্চিমা পুঁজিবাদী ব্যবস্থা তার সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মাধ্যমে মুসলমান নারী ও তরুণীদের জন্য একটি অশ্লীল ও অমানবিক আদর্শ উপস্থাপন করতে চায়, তখন হযরত ফাতেমা যাহরা (আ.)-এর বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্বের সূক্ষ্ম দিকগুলো আবিষ্কার করার মাধ্যমে শুধু মুসলিম নারীর জন্য নয়, বরং গোটা বিশ্বের নারীদের জন্য একটি ব্যবহারিক জীবনাদর্শ উপস্থাপন করা যেতে পারে।
আজকের নারীর তার সত্যিকার আপন সত্তাকে খুঁজে পাওয়ার ক্ষেত্রে যত সমস্যার সম্মুখীন, সেগুলো জন্ম নিয়েছে একটি বিষয় থেকে। আর তা হল ব্যক্তিগত, পারিবারিক এবং সামাজিকÑ এই তিন ক্ষেত্রে নারীর জীবনে ভারসাম্যতা প্রতিষ্ঠিত না থাকা। অর্থাৎ তার দরকার একটি ভারসাম্যশীল জীবনাদর্শ। এক্ষেত্রে হযরত ফাতেমা যাহরা (আ.)-এর জীবনচরিতই তার জন্য সর্বোত্তম জীবনাদর্শ, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।
প্রত্যেক নারীর জন্য ধর্মীয় কর্তব্যসমূহ যথাযথ পালন ব্যতিরেকেও তিনটি ভূমিকা থাকে : ব্যক্তিগত, পারিবারিক এবং সামাজিক। হয়ত কোন কোন ধর্মে নারীর এই ত্রিমাত্রিক ভূমিকার মধ্য থেকে একটিকে অপরটি অপেক্ষা হালকা করে দেখা হয়েছে। কিংবা নারীর মঙ্গলার্থে সঠিকভাবে তা সংজ্ঞায়ন করা হয়নি। উদাহরণস্বরূপ মধ্যযুগীয় খ্রিষ্ট ধর্মে তারাই খ্রিষ্টান হতে পারতো যারা কখনো নারীর চারপাশে ঘুরবে না। একারণেই দেখা যায় যে, পাদ্রি ও পুরোহিতরা আজীবনে বিবাহ করে না। কেননা, বিবাহ হচ্ছে এমন বন্ধন যা ঈশ্বরকে ক্রোধান্বিত করে থাকে। তওরাতেও নারীদের অস্তিত্বকে মৃত্যুর চেয়ে তিতা বলে মনে করা হয়েছে। ইয়াহুদীদের প্রাত্যহিক প্রার্থনাবাণীর মধ্যে বলা হয়েছে, কৃতজ্ঞতা ঈশ্বরকে যিনি আমাকে পুরুষ হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। অথবা উপাসনালয় ও গির্জার শিক্ষায় বলা হয়েছে, নারী হচ্ছে পুরুষের সেবাকারিণী, আর পুরুষ নারীর মনিব। কখনোবা নারীকে তার সৃষ্টি-স্বভাবের দাবি অনুসারে ক্রীতদাসে পরিণত করা হয়। অবশ্য নিঃসন্দেহে সকল নবী-রাসূলই নারীর মর্যাদার প্রতিরক্ষক ছিলেন এবং তার প্রতি যে কোন ধরনের অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু বিকৃত কিতাবসমূহের বিধানাবলির কারণেই নারী তার মর্যাদা ও সম্মান হারায়।
এই বিচ্যুতির ধারা চলতে থাকে। যা এক পর্যায়ে পাশ্চাত্যে প্রতিবাদের মুখে পড়ে এবং নারীবাদী আন্দোলনে রূপ পরিগ্রহ করে। এ আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল নারী অধিকারকে পুনরুদ্ধার করা। কিন্তু পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশে বাড়াবাড়ি এমন জায়গায় পৌঁছায় যে, কিছু কিছু বিষয়, যেমন : গর্ভপাতের স্বাধীনতা, প্রজনন প্রযুক্তির যথেচ্ছ ব্যবহার, সেক্সুয়্যাল সোশ্যালিজম ইত্যাদি অবাঞ্ছিত বিষয়াবলিও বৈধ করার দাবি ওঠে। যার ফলে নৈতিক প্রতিশ্রুতিশীলতার আর কোন জায়গাই অবশিষ্ট থাকেনি। এতে শুধু যে নারীর নৈতিক দিকের খর্ব ঘটেছে, তা নয়, বরং তার সামাজিক ও অর্থনৈতিক মর্যাদাও উন্নত হয়নি। জাতিসংঘের জরিপ অনুযায়ী নারীর কর্ম ও পেশাভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গিকে তার পরিবারভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গির স্থলাভিষিক্ত করার পরও এখনও ৯০ ভাগ উপার্জন পুরুষের হাতে। অপরদিকে কর্ম-বাজারে নারীকে অতিমাত্রায় টেনে আনার কারণে পাশ্চাত্যে পরিবারের ভিত্ নড়বড়ে হয়ে পড়েছে এবং সন্তানদের মাতৃ¯েœহ ও মাতৃমমতা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। সেই সাথে সমানতালে বৃদ্ধি পেয়েছে যৌন নিপীড়ন ও নারী নিগ্রহের হার। এটা খুবই স্বাভাবিক যে, যখন স্বাধীনতার নামে নারীর সম্ভ্রম ও লজ্জাশীলতা বিস্মৃতির কবলে পড়ে, তখন ফলাফল এটা ভিন্ন অন্য কিছু আশা করা যায় না। আশার কথা হল, এই ভ্রান্ত পথের অভিজ্ঞতা আজ নারীকে পুনরায় পরিবার ও সম্ভ্রমের দিকে প্রত্যাবর্তনে চালিত করছে। কিন্তু প্রশ্ন হল একটি সঠিক শিক্ষা ও আদর্শ না থাকলে কি নারী তার ত্রিমাত্রিক (ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক) ভূমিকা যথাযথভাবে পালন করতে সক্ষম হবে?
হযরত ফাতেমা যাহরা (আ.) তাঁর ঈমান ও আকিদা-বিশ্বাসগত গুণাবলির (যা একজন মুসলমান নারীর জন্য স্বতন্ত্র) পাশাপাশি কিছু সর্বজনীন গুণ-বৈশিষ্ট্যেরও অধিকারী ছিলেন, যা সকল সম্প্রদায় ও জাতির নারীর জন্য আদর্শ হওয়ার উপযুক্ত। তিনি তাঁর জীবনধারায় ব্যক্তিগত, পারিবারিক (মা ও স্ত্রী হিসাবে) এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক ভূমিকায় নারীর জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ আদর্শ। ব্যক্তিজীবনে সরলতা ও অনাড়ম্বরতা, মানবপ্রেম ও পরোপকার, ধৈর্য ও আত্ম-ত্যাগ, লজ্জাশীলতা ও আত্ম-সম্ভ্রম ইত্যাদি মানবিক গুণাবলিতে এই মহিয়সী রমণী ছিলেন আদর্শ দর্পণস্বরূপ। এই মানবিক তাৎপর্যগুলো সর্বযুগে প্রশংসনীয় ছিল এবং থাকবে। প্রকৃতপক্ষে এগুলো মানবের সহজাত প্রবৃত্তির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। তাই এগুলো চিরসত্য। পরিবেশের প্রভাব কিংবা বস্তুগত ও প্রযুক্তিগত চাকচিক্য কোনদিন এ সত্যকে বদলাতে পারে না। অর্থাৎ পরিবেশ, প্রযুক্তি ইত্যাদি বাহ্যিক কারণে কখনো অশ্লীলতা ও মিথ্যাচার পছন্দনীয় আর লজ্জাশীলতা ও সত্যবাদিতা নিন্দনীয় হয়ে যায় না। হযরত ফাতেমা যাহরা (আ.)-এর জীবনচরিত প্রকৃতপক্ষে নির্দেশ করে যে, ইসলাম চুলচেরা মনোযোগের সাথে ব্যক্তির সুস্থতা ও নিরাপত্তা এবং তারই সূত্র ধরে সমাজের সুস্থতা ও নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তা করে। তাই তো দেখা যায় যখন তাঁকে প্রশ্ন করা হয় ‘নারীর জন্য সবচেয়ে উত্তম কী?’- এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘নারীরা পুরুষদেরকে দেখবে না, আর পুরুষরা নারীদেরকে দেখবে না’। প্রকৃতপক্ষে তাঁর এ উক্তি থেকে যা উপলব্ধ হয়, সেটা হল সমাজের নৈতিক ও সামাজিক সুস্থতা ও নিরাপত্তার চাবিকাঠি নিহিত রয়েছে নারীদের সম্ভ্রম সংরক্ষণ ও পর্দানশীন থাকার মধ্যে। দুঃখজনকভাবে আজ যা শুধু পাশ্চাত্য সমাজেই নয়, মুসলিম সমাজগুলোতেও প্রচ-ভাবে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের কবলে পড়েছে।
হযরত ফাতেমা যাহরা (আ.) পারিবারিক জীবনের পরিসরে এবং মা ও স্ত্রী হিসাবে ভূমিকা রাখার ক্ষেত্রে ইসলাম প্রদত্ত সর্বতো অধিকার ভোগ করেন, যে অধিকার অন্য কোন মতাদর্শে কিংবা ধর্মে এমনকি চিন্তাও করা যায় না। পাশাপাশি তিনি স্বীয় ধর্মীয় কর্তব্যসমূহকে সর্বোত্তমভাবে পালন করেন। ইসলামে নারী নিজের জন্য কিংবা তার পরিবারের জন্য কাজ করতে বাধ্য নয়। নারীর ভরণপোষণ বহন করা শরয়ীভাবে পুরুষের ওপর ওয়াজিব। এমনকি এই যে নারী পরিবারে শিশুকে দুধ পান করায়, এ বাবদ স্বামীর নিকট থেকে অর্থ গ্রহণের অধিকার ছাড়াও অন্যান্য অধিকার তার রয়েছে। কিন্তু ফাতেমা যাহরা (আ.) অন্য কোন কিছুর আগে নিজের মাতৃত্ব ও স্ত্রীত্বের ভূমিকার প্রতি বেশি আকৃষ্ট ছিলেন, যা বর্তমানে অনেক পরিবারে চোখে পড়ে না। নারী যখন একাকীত্বের ভয়ে কিংবা অর্থ-সম্পদ না থাকার ভয়ে বিবাহে ব্রতী হয়, অথবা বিবাহের পূর্বে বিচিত্র সম্পর্কের জগতকে পরখ করে আসে, তখন তার ফলাফল দাঁড়ায় শ্বেত বিবাহ, সিঙ্গেল মাদার, আলাদা পরিবার, নিঃসন্তান দম্পতি, পরিচয়হীন সন্তান, যথেচ্ছ বিবাহবিচ্ছেদের মত ঘটনাবলির দৌরাত্ম্য। আর এই সবকিছুর কুফল হল ভয়ানক আত্মিক ও মানসিক সমস্যার অশান্তি। কেউ বা মাদকাসক্তির মধ্যে ডুব দেয়। আবার কেউ বা বেছে নেয় আত্মহননের পথ। সুতরাং পরিবারে নারীর মা ও স্ত্রী হিসাবে ভূমিকা পালনের প্রতি অকৃত্রিম আগ্রহ ও ভালবাসা যে জীবনের বুনিয়াদ রচনা করে, তা মানব জীবনযাত্রাকে সুদৃঢ়করণ, সুযোগ্য সন্তান-সন্ততি লালন পালন এবং সৌভাগ্যবান সমাজ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখে।
আরেকটি বিষয় হল, ইসলামের বিরুদ্ধে যে কু-ধারণা ও অপপ্রচার চালানো হয়ে থাকে যে, এখানে নারীরা ঘরে বন্দি, তা মোটেও সত্য নয়। বরং ইসলামে শুধু যে সমাজে নারীর সক্রিয় উপস্থিতিকে নিষেধ করা হয়নি, বরং সমাজে তাদের ভূমিকা রাখতে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। ফাতেমা যাহরা (আ.) সর্বকালের নারীদের আদর্শ হিসাবে সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে উপস্থিত ছিলেন। তবে এ উপস্থিতি কিরূপে হবে সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। যেমনটা আজকে বিভিন্ন সমাজে পরিলক্ষিত হয় যে, নারীদের অজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে এবং চমকপ্রদ সব স্লোগান ব্যবহার করে তাদেরকে কেবল রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য উপকরণের ন্যায় ব্যবহার করা হচ্ছে। কাজেই সমাজ ও রাজনীতির অঙ্গনে নারীদের উপস্থিতির অন্যতম পূর্বশর্ত হল নারীর মর্যাদা সুরক্ষিত থাকা। অর্থাৎ সমাজে এই উপস্থিতি যেন নারীর মানবিক মর্যাদায় আঘাত হানার কারণ না হয়। পাশ্চাত্যে নারীমুক্তির যেসব স্লোগান দেওয়া হয়ে থাকে সবই অন্তঃসারশূন্য। বাস্তবিকপক্ষে তা নারীর স্খলনের পথকেই প্রশস্ত করে থাকে। কেননা, তাদের বিভিন্ন ধরনের অধিকার ও স্বাধীনতার কথা বলা হয়। যেমন ভোট প্রদানের অধিকার, গর্ভপাতের অধিকার, বিনাদোষে বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকার, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, যৌন স্বাধীনতা, রাজনীতি সমাজ ও অর্থনীতিতে ব্যাপকভিত্তিক উপস্থিতির স্বাধীনতা ইত্যাদি। ফলে বিবাহের বয়স ও সিঙ্গেল লাইফের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া, পরিবার ভেঙ্গে যাওয়া, বিবাহ বিচ্ছেদ বেড়ে যাওয়া, দুই লিঙ্গের মাঝে দ্বান্দ্বিক মনোভাব সৃষ্টি, নারীত্ব ধ্বংসকরণ এবং নারীদের পরিচয় সঙ্কট, পৌরুষত্বের দুর্বলীকরণ, ব্যক্তি ও সমাজের সীমানা তুলে দেওয়া, সমকামিতার প্রচলন, গর্ভপাত সৃষ্টির মাধ্যমে নারীদের পুঁজিবাদের সেবায় উপকরণসর্বস্ব হয়ে পড়া, সেক্স ইন্ডাস্ট্রি গড়ে ওঠা ইত্যাদি সমস্যা আজ প্রকট রূপ ধারণ করেছে।
নারীদের সামাজিক অঙ্গনে উপস্থিতির আরেকটি পূর্বশর্ত হচ্ছে তা যেন তাদের মাতৃত্ব ও স্ত্রীত্বের ভূমিকা পালনে বাধা না হয়। পাশ্চাত্যে নারীমুক্তি আন্দোলনসমূহের সূত্র ধরে যে ভ্রান্তিটা জন্ম নেয় তাতে নারীর মা ও স্ত্রী হিসাবে ভূমিকা পালন করা দুষ্কর হয়ে পড়ে এবং সামগ্রিকভাবে পরিবার বন্দি হয়ে পড়ে। যা স্বাধীনতা বাস্তবায়নের পথে অন্তরায়। আরেকটি শর্ত হল সমাজে নারীর কার্যকর উপস্থিতি। পাশ্চাত্য মনে করে নারীর কার্যকর উপস্থিতি শুধু তাদের দৈহিক আবির্ভাবের মাধ্যমেই সম্ভব। এর ফলে পাশ্চাত্য দৃষ্টিকোণ থেকে নারী তার ব্যক্তিগত স্বাধীনতা সত্ত্বেও কেবল বাহ্যিকভাবে গুরুত্ব পেয়েছে, যে দৃষ্টিভঙ্গি আজকের পশ্চিমা নারীকে অসহায় ও মরিয়া করে তুলেছে। অথচ ইসলামে নারীর এই উপস্থিতি তার কার্যকারিতা সহকারে নির্দেশিত হয়েছে। যেমনটা আমরা দেখতে পাই উহুদের যুদ্ধে হযরত ফাতেমার উপস্থিতি একজন চিকিৎসক হিসাবে। আহযাবের যুদ্ধে পরিখা খনন করার সময় তাঁর সক্রিয় উপস্থিতি, বাগে ফাদাক এর পরিচালনা, নারীদের জন্য ধর্মীয় জিজ্ঞাসাসমূহের উত্তর প্রদানের জন্য জলসার আয়োজন ইত্যাদি। তাছাড়া ইসলামের ক্রান্তিলগ্নে মুনাফিকদের তাবত চক্রান্তকে নস্যাৎ করে দিয়ে ইসলামকে রক্ষার্থে তাঁর মসজিদে নববীতে হাজির হওয়া এবং অগ্নিঝরা বক্তৃতার মাধ্যমে মুনাফিকদের কূট্চক্রান্তকে ফাঁস করে দেওয়াÑ এ সকল ঘটনাই সমাজে নারীর ইতিবাচক কার্যকর উপস্থিতির একেকটি দৃষ্টান্ত, যা অমুসলিম নারীদের জন্যও প্রযোজ্য। নারীর ত্রিমাত্রিক ভূমিকার উপরোক্ত এ বিশ্লেষণ থেকে প্রতিপন্ন হয় যে, আজ যেসকল বিষয় নারীর স্কন্ধে ন্যস্ত করা হয়েছে সেগুলোর অনেক কিছুই প্রাসঙ্গিকতা হারায়। কারণ, তা নারীর মর্যাদা ও ইতিবাচক কার্যকর উপস্থিতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় তাকে এ পরিস্থিতি থেকে বের করে আনতেই হবে। ফাতেমা যাহরা (আ.)-এর জীবনচরিতই হোক নারীর জীবনাদর্শ।
পরিশেষে মুসলমানরাই ইহুদিদের ওপর বিজয় লাভ করবে
মো. আশিফুর রহমান
বনি ইসরাইল তথা ইহুদি জাতির অতীত ও বর্তমান ইতিহাস হলো আল্লাহ্র বিরুদ্ধাচরণ, ষড়যন্ত্র ও যুদ্ধ-বিগ্রহের ইতিহাস। তারা সবসময় পৃথিবীতে যুদ্ধের আগুন প্রজ্বলনের ব্যাপারে চেষ্টা করে এসেছে। সম্ভবত তাদের বৃহত্তম যুদ্ধের আগুন তারা প্রজ্বলিত করেছে মুসলিম উম্মাহ্র বিরুদ্ধে, যার বিস্তৃতি ঘটানোর জন্য তারা প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যকেও উস্কে দিচ্ছে।
ইহুদিরা সব সময় মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে করে এসেছে। মদীনায় হিজরত করার পর মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) তাদের সাথে সন্ধিচুক্তি করেছিলেন, কিন্তু তারা সুযোগ পেলেই চুক্তি ভঙ্গ করে ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছে। শুধু তা-ই নয় পূর্ববর্তী নবী-রাসূলের সময়ও তারা তাঁদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছে, এমনকি অনেক নবীকে তারা হত্যাও করেছে।
অতীতের মতো বর্তমানেও ইহুদীরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। বিশেষ করে মুসলমানদের ভূখ- ফিলিস্তিন দখল করে সেখানে অবৈধ ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। কিন্তু ইহুদিদের পরাজয়ের ব্যাপারে পবিত্র কোরআন এবং মহানবী (সা.) ও ইমামগণের হাদিসে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে যা অবশ্যম্ভাবী।
পবিত্র কোরআনের সূরা বনি ইসরাইলে মহান আল্লাহ্ ইহুদীদের বিপর্যয় সৃষ্টি সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন এবং তাদের ধ্বংসের বিষয়ে তাঁর প্রতিজ্ঞার কথা ঘোষণা করেছেন : ‘আমি বনি ইসরাইলকে (তাদের) কিতাবে স্পষ্ট বলে দিয়েছি, তোমরা পৃথিবীতে দু’বার বিপর্যয় (ফিতনা) সৃষ্টি করবে এবং তোমরা অতিশয় অহংকার প্রকাশ করবে। অতঃপর যখন এ দুয়ের প্রথমটির প্রতিশ্রুতিকাল উপস্থিত হলো তখন আমরা তোমাদের বিরুদ্ধে আমার কঠোর যোদ্ধা বান্দাদেরকে প্রেরণ করলাম। অতঃপর তারা (তোমাদের) প্রতিটি জনপদের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়ল। আর এ প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হওয়ারই ছিল। অতঃপর আমি তোমাদের অনুকূলে তাদের বিরুদ্ধে পালা ঘুরিয়ে দেব, তোমাদেরকে ধন-সম্পদ ও পুত্র-সন্তান দ্বারা সাহায্য করব এবং তোমাদের জনবল (সামরিক শক্তি) বৃদ্ধি করে দেব। তোমরা যদি ভালো কর তবে নিজেদের জন্যই ভালো করবে। আর যদি মন্দ কর তবে তাও নিজেদের জন্যই। এরপর যখন দ্বিতীয় অঙ্গীকারের সময় এসে যাবে তখন (অন্য) বান্দাদেরকে প্রেরণ করব যারা তোমাদের মুখম-ল বিকৃত করে দেবে, মসজিদে ঢুকে পড়বে যেমন প্রথমবার তারা ঢুকেছিল এবং যা কিছু তাদের করায়ত্বে আসবে তারা তা পুরোপুরি ধ্বংস করে দেবে।’ (বনি ইসরাইল : ১-৭)
আয়াতে উল্লিখিত ইহুদিদের প্রথম ফিতনার শাস্তি ইসলামের প্রাথমিক যুগেই মুসলমানদের হাতে বাস্তবায়িত হয়েছে। আজ যখন মুসলমানরা প্রকৃত ইসলাম থেকে দূরে সরে গেছে, তখন মহান আল্লাহ্ ইহুদিদেরকে তাদের ওপর বিজয়ী করে দিয়েছেন। এ পর্যায়ে আবারও ইহুদিরা পৃথিবীতে বিশৃঙ্খলা ও সীমা লঙ্ঘন করছে। কিন্তু যখনই মুসলমানরা ইসলামের দিকে প্রত্যাবর্তন করবে তখনই দ্বিতীয় শাস্তির সময় এসে যাবে এবং তা মুসলমানদের হাতে বাস্তবায়িত হবে।
অনেকে বলতে চান ইহুদিদের দ্বিতীয় শাস্তি তারা পেয়েছে মিশর, ইরান বা রোমের শাসনকর্তারা যখন তাদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছিল সে সময়ে। কিন্তু এটি ঠিক নয়। ইহুদিদের প্রতিশ্রুত দ্বিতীয় শাস্তিপ্রাপ্তি যে মুসলমানদের হাতেই হবে তার প্রমাণ হচ্ছে, যে জাতিকে ইহুদিদের বিরুদ্ধে পুনরায় প্রেরণ করার প্রতিশ্রুতি মহান আল্লাহ্ দিয়েছেন তারা একই উম্মততুক্ত এবং তাদের যেসব বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হয়েছে কেবল মুসলমানদের সাথেই সাদৃশ্যপূর্ণ। কারণ, মিশর, ব্যাবিলন, গ্রীস, ইরান, রোম এবং অন্যান্য জাতির রাজা-বাদশাহ্ বা শাসকবৃন্দ যারা ইহুদিদের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিল তাদের সাথে পবিত্র কোরআনের আয়াতে উল্লিখিত ‘আমাদের বান্দা’Ñ এ বৈশিষ্ট্যটি খাপ খায় না। আবার ঐ সব রাজা-বাদশাহ্ ও শাসকের ওপর ইহুদীদের বিজয়ী হবারও কোন ঘটনা ঘটে নি। অথচ ইসলামের প্রথম যুগে মুসলমানদের হাতে ইহুদিদের প্রথম শাস্তিভোগের পর তারা বর্তমানে আমাদের ওপর বিজয়ী হয়েছে। আর মহান আল্লাহ্ তাদেরকে এমনভাবে ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি দিয়ে সাহায্য করেছেন যে, বিশ্বে তাদের সমর্থকদের সংখ্যা মুসলমান এবং তাদের মিত্রদের চেয়েও বেশি এবং তারা পরাশক্তিবর্গের সাহায্য ও পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েই আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ লিপ্ত হয়েছে। আজ ইহুদিরা তাদের নাশকতামূলক কর্মকা- ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার দ্বিতীয় পর্যায়ে এবং শ্রেষ্ঠত্ব ও আধিপত্যের তুঙ্গে অবস্থান করছে। তাই নিঃসন্দেহে বলা যায়, যেমনভাবে মুসলমানদের পূর্বপুরুষরা প্রথমবার মসজিদুল আকসায় প্রবেশ করে পৃথিবীতে তাদের গর্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের ধারাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিয়েছিল ঠিক তেমনি মুসলমানরা ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের আগে অথবা তাঁর সাথে মসজিদুল আকসায় প্রবেশ করবে এবং তাদের আধিপত্য ও শ্রেষ্ঠত্বকে ধ্বংস করে দেবে।
ইহুদিদের অস্তিত্ব বিলুপ্তকারী যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার আগে ফিলিস্তিনে ইহুদীদের আগমন ও বসতি স্থাপন এবং তাদের সে দেশটি জবর-দখলের সাথে সংশ্লিষ্ট বেশ কিছু বর্ণনা (রেওয়ায়েত) পাওয়া যায়। আর এ বর্ণনাগুলো নিম্নোক্ত আয়াতেরও ব্যাখ্যাস্বরূপ : ‘আর তার পরে আমরা বনি ইসরাইলকে বললাম : তোমরা পৃথিবীতে বসবাস কর। আর যখন কিয়ামতের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হবে তখন তোমাদেরকে একত্র করে উপস্থিত করব।’ (সূরা বনি ইসরাইল : ১০৪)
অর্থাৎ আমরা প্রতিটি প্রান্ত থেকে তোমাদের সকলকে একত্রিত করব। ‘নূরুস সাকালাইন’ নামক তাফসীর গ্রন্থেও এ বিষয়টি এভাবে বর্ণিত হয়েছে। মহানবী (সা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে : ‘তোমরা কি ঐ নগরীর নাম শুনেছ যার খানিকটা অংশ সমুদ্রের ভেতরে।’ যখন তাঁকে সবাই হ্যাঁ বলল, তখন তিনি বললেন : ‘নবী ইসহাকের সত্তর হাজার বংশধর কর্তৃক ঐ শহরটি আক্রমণের শিকার না হওয়া পর্যন্ত কিয়ামত সংঘটিত হবে না।’ (মুসতাদরাকে হাকিম, ৪র্থ খ-, পৃ. ৪৭৬)
ইমাম মাহ্দী (আ.) এবং মুসলমানরা এ সব ফিতনা সৃষ্টিকারীদের চূড়ান্তভাবে ধ্বংস করবেন এবং তাদের মধ্য থেকে যারা নিহত হবে তাদের জন্য মহান আল্লাহ্ জাহান্নামকে কারাগার করে দেবেন এবং মুসলমানরা তাদের অবশিষ্টদেরকে কারাগারে অন্তরীণ করে তাদের নাশকতামূলক কর্মতৎপরতা ও ফিতনা চিরতরে বন্ধ করে দেবে। আর এভাবেই মুসলমানদের চূড়ান্ত বিজয়ের মাধ্যমে আল্লাহ্ তায়ালার প্রতিজ্ঞা বাস্তবায়িত হবে।
ইসলাম ধর্মের বিজয়ের যুগ হবে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের যুগ। মহানবী (সা.) এবং তাঁর বংশের পবিত্র ইমামগণ থেকে অসংখ্য হাদিস ও বর্ণনা এ বিজয়ের সুসংবাদ প্রদান করেছে। ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর সাহায্যকারী হিসাবে ইরান ও ইয়েমেনের ভূমিকা প্রধান হবে বলে হাদীসসমূহে উল্লেখ করা হয়েছে। এ সব হাদীস ও বর্ণনায় বলা হয়েছে, ইরান ও ইয়েমেনে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর সমর্থক সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে। মাহ্দী (আ.)-এর ইরানি সাথিরা তাঁর আবির্ভাবের কিছুকাল আগে সরকার গঠন করে একটি দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে। অবশেষে তারা ঐ যুদ্ধে বিজয়ী হবে।
ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের কিছুকাল আগে ইরানীদের মধ্য থেকে দু’ব্যক্তি আবির্ভূত হবেন। তাঁদের একজনকে ‘খোরাসানী সাইয়্যেদ’ বলে হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে যিনি রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর বংশধর এবং তিনি রাজনৈতিকভাবে নেতৃত্ব দেবেন। আর অপরজন শুআইব ইবনে সালিহ্, যিনি হবেন সামরিক নেতা এবং এ দু’ব্যক্তির নেতৃত্বে ইরানি জাতি তাঁর আবির্ভাবের আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবেন।
ইমাম বাকির (আ.) থেকে বর্ণিত হয়েছে : ‘কালো পাতাকাসমূহ খোরাসান (ইরান) থেকে বের হয়ে বাইতুল মাকাদ্দাসে (জেরুজালেম) পতপত করে উড়া পর্যন্ত কোনো কিছুই তাদেরকে পরাস্ত করতে ও প্রতিহত করতে পারবে না।’ (মালাহিত ওয়া ফিতান, পৃ. ৪৩); হযরত আবু হুরাইরা থেকে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন : “রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেছেন : ‘খোরাসানের দিক থেকে কালো পতাকাবাহীরা আবির্ভূত হবে (মাহ্দীর সমর্থনে)। অবশেষে সেগুলো ইলিয়ায় (বায়তুল মুকাদ্দাসে) স্থাপিত হবে এবং কোনো কিছুই তা প্রতিহত করতে সক্ষম হবে না’।” (জামে আত তিরমিযী, ৪র্থ খ-, হাদীস নং ২২১৫, পৃ. ১৫৬, বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার, ঢাকা কর্তৃক প্রকাশিত)
বিশ্ব কুদস দিবস ও শবে কদর
সম্পাদকীয়
সকলেই অবগত যে, ইরানের ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ.) কর্তৃক পবিত্র রামাযান মাসের শেষ শুক্রবারকে বিশ^ কুদ্স্ দিবস হিসেবে নামকরণ করা হয় এবং তখন থেকে প্রতি বছর বিশ^ব্যাপী এ দিনটি পালিত হয়ে আসছে। এ উদ্দেশ্যে বিশ্বের বিশেষতঃ বিশ্বের মুসলমানদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য বছরের একটি দিন বরাদ্দ কম হলেও অনেক গুরুত্বের দাবি রাখে। কারণ, কুদস বা বায়তুল্ মুক্বাদ্দাস্ হচ্ছে মুসলমানদের প্রথম ক্বিবলা এবং অনেক নবী-রাসূলের (‘আ.) সমাধিস্থল। তবে এ বছর পবিত্র রামাযান মাসের শেষ শুক্রবার কুদস দিবসের সাথে সাথে শবে কদর হবার সম্ভাবনাযুক্ত একটি রাতের সমন্বয় ঘটেছেÑ যা বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের জাগরণের রাত। কারণ, সর্বশক্তিমান আল্লাহ্ তা‘আলা সূরা আল্-ক্বাদ্রে এ রাতকে হাজার মাসের তুলনায় উত্তম বলে ঘোষণা করেছেন। শবে কদর হবার সম্ভাবনাযুক্ত রাতগুলোতে তথা রামাযানের শেষ দশ দিনের বেজোড় রাতগুলোতে মুসলমানরা ও বিশ্বের সমস্ত স্বাধীনচেতা মানুষ সারা রাত জেগে ইবাদত করে থাকে। তাই বিশ্বের মুসলমানদের আশা এই যে, মুসলমানদের এতো মূল্যবান রাতে আল্লাহ্ তা‘আলা তাদের নিয়তিতে সর্বোৎকৃষ্ট কল্যাণ দান করবেন এবং মুসলমানদের প্রথম ক্বিবলার আশু মুক্তকরণ মঞ্জুর করবেন।
এ বছরের কুদস দিবসের অনুষ্ঠান পূর্ববর্তী সমস্ত বছরের চেয়ে আলাদা এবং করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে বিশে^র অধিকাংশ স্থানেই এ বছর অনলাইনে ইন্টারনেটের মাধ্যমে কুদস্ দিবস্ পালিত হচ্ছে। এতে দেখা যায় যে, সারা বিশ্বের মুসলমানদের ঘরে বসে থাকতে হলেও এবং তাদের পারস্পরিক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে একমাত্র মোবাইল-ইন্টারনেট থাকলেও বায়তুল্ মুক্বাদ্দাস্ ইস্যু নিয়ে নীরব থাকতে ú্রস্তুত নয়।
শবে কদরের রাতসমূহের শুরু ও কুদস দিবসের মধ্যবর্তী সময়ের ব্যবধান এক সপ্তাহ এবং এই রাতগুলো দোয়া কবুলের রাত। তাই প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরও শবে কদরের রাতগুলোতে আমাদের দোয়া, বাইতুল মুক্বাদ্দাস যেন তার মূল মালিকদের কাছে ফিরে আসে।
গোটা বিশ্ব সাক্ষী যে, এখন গাযা এলাকায় মুসলমানরা করোনাভাইরাসের মারাত্মক অবস্থার সাথে সাথে গুরুতর অর্থনৈতিক ও চিকিৎসা অবরোধের মুখোমুখি হয়েছে। নিশ্চয়ই কদরের রাতেÑযা অন্যান্য ত্রিশ হাজার রাতের চেয়ে উত্তমÑমুসলমানদের প্রার্থনা কবুল হবে এবং তারা উপনিবেশবাদীদের দুষ্ট পরিকল্পনাটিকে ব্যর্থ করতে সক্ষম হবে।
وَمَكَرُوا وَمَكَرَ اللَّهُ وَاللَّهُ خَيْرُ الْمَاكِرِينَ
‘তারা চক্রান্ত করলো এবং আল্লাহ্ও কৌশল করলেন; নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ সর্বোত্তম কৌশলকারী।’ (সূরা আলে ‘ইম্রান্ : ৫৪)
পরিশেষে বিশ্ব বিবেকের কাছে প্রশ্ন : বিশ্ব যদি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী হয় তবে তারা কেন ফিলিস্তিন ও কুদসের মালিকানার বিষয়ে জাতীয় গণভোট করতে রাযি হচ্ছে না?
আমরা নিউজলেটারের পাঠক-পাঠিকাদের সহ বিশ^ মুসলিমের উদ্দেশে শবে কদর উপলক্ষে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাচ্ছি ও তাঁদের দোয়া কবূল হওয়ার কামনা করছি এবং বিশ^ কুদস্ দিবস উপলক্ষে কুদস্ মুক্ত করার জন্য শপথ গ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছি।