ড. মওলানা মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী
গল্পের পর গল্প দিয়ে সাজানো মওলানা রূমী (র)-এর বিশ^বিখ্যাত গ্রন্থ ‘মসনবী’ শরীফের প্রথম গল্প ‘এক দাসীর উপর জনৈক বাদশাহর প্রেমাসক্ত হওয়া’র কাহিনী। এই মনোজ্ঞ রোমান্টিক গল্পে মওলানা ইসলামের সুন্দর জীবনদর্শন ও আধ্যাত্মিক ও নৈতিক শিক্ষার সৌধমালা রচনা করেছেন। আমরা গল্পের ভাঁজে ভাঁজে মওলানা রূমী এসব শিক্ষা ও জীবন দর্শন কীভাবে তুলে ধরেছেন তা মূল্যায়ন করার প্রয়াস পাব।
প্রাচীনকালে এক বাদশাহ ছিলেন জাগতিক ও আধ্যাত্মিক উভয়বিধ ক্ষমতার অধিকারী। দীন ও দুনিয়া, যাহেরী ও বাতেনী উভয় গুণের সমাবেশ ছিল তাঁর চরিত্রে। তিনি একবার শিকারের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। যাওয়ার সময় পথের ধারে দেখতে পেলেন এক যুবতী রূপসী দাসী। বাদশাহ সেই দাসীর প্রেমে পড়ে যান। প্রচুর অর্থ দিয়ে খরিদ করেন দাসীকে। মাওলানা রূমী এই রোমাঞ্চকর কাহিনীর শুরুতে এখানে সংসার জীবনের একটি শাশ্বত সত্য তুলে ধরে বলেন, পূর্ণ আনন্দ বলতে যা বুঝায় তা জগতে কারো নসীব হয় না। একদিকে মন আনন্দে ভরে গেলে অন্যদিকে ভেঙে যায়। বাদশাহও সেই অবস্থার সম্মুখীন হন।
দাসীকে রাজপ্রাসাদে আনার পর ঘটনাক্রমে দাসী অসুস্থ হয়ে পড়ে। তখন বাদশাহর অন্তরজ্বালা ভীষণভাবে বেড়ে যায়। তিনি দেশের বড় বড় হেকিম জড়ো করেন বাঁদীর চিকিৎসার জন্য। তাদেরকে মোটা অংকের সম্মানীর ওয়াদা দেন। ডাক্তাররা মাত্রাতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের অহমিকায় আক্রান্ত হন। রোগীর চিকিৎসার ব্যাপারে দর্পভরে তাঁরা বলেন, ‘আমরা অবশ্যই আপনার রোগীকে ভালো করে দেব।’ অহংকারের বশে তাঁরা ‘ইনশাআল্লাহ’ অর্থাৎ আল্লাহ যদি চানÑ একথা বলেননি। মানুষের অক্ষমতা আর আল্লাহর কুদরতের মহিমা তাঁরা বুঝতে পারেননি। এজন্য আল্লাহ মানুষের অক্ষমতা হাতেনাতে প্রমাণ করে দিলেন। তাঁদের চিকিৎসায় উল্টা ফল হতে থাকে। মওলানা রূমী (র) এখানে ‘ইনশাআল্লাহ’ বলার তাৎপর্য তুলে ধরে বলেন : ইনশাআল্লাহ বা ‘লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ’ বলার আসল তাৎপর্য মৌখিক উচ্চারণ নয়; বরং অন্তরের উপলব্ধিই মূল কথা।
মওলানা এখানে মৌখিক দু‘আ-দরূদ নিয়ে যারা মনে মনে তুষ্ট, অন্তরের উন্নতি-অগ্রগতির খবর যাদের নেই, তাদের ভুল ধরিয়ে দিতে চান। বাদশাহ তাঁর বাতেনী দৃষ্টিতে বুঝতে পারেন, গলদ কোথায়? হেকিমদের চিকিৎসা কেন উল্টা ফল দিচ্ছে? বাহ্যিক উপায়-অবলম্বন ব্যর্থ দেখে বাদশাহ আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ করেন। দৌড়ে চলে যান মসজিদে। মেহরাবের নিকটে গিয়ে সিজদায় লুটিয়ে পড়েন মহান রাব্বুল আলামীনের দরবারে। তিনিই তো নিরাশার আশা, মানুষের একমাত্র ভরসা। বুকফাটা কান্নায় বাদশাহ চোখের পানিতে সিজদার স্থান ভিজিয়ে দেন। আল্লাহ্ তাঁর দু‘আ কবূল করেন।
কঠিন সমস্যা ও সংকট থেকে উদ্ধার পেতে হলে আল্লাহর কাছে পূর্ণ আত্মসমর্পণ এবং বুক ভাসিয়ে কান্নাকাটি করলে আল্লাহর রহমতের দরিয়ায় জোয়ার আসেÑ এই চিরন্তন সত্যটি এখানে অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী করে তুলে ধরেন মওলানা। মওলানা এ সূক্ষ্ম তত্ত্বটি ব্যক্ত করেন যে, দু‘আ তখনই কবূল হয়, যখন মুখ ও অন্তরের ভাষা এক হয়, যখন ইখলাস ও অসহায়ত্ব মানুষের সমগ্র অস্তিত্বকে আচ্ছন্ন করে ফেলে এবং তার ফলে বুকফাটা কান্না আসে।
বাদশাহ কাঁদতে কাঁদতে ঘুমে তলিয়ে যান। সুফিদের মতে স্বপ্নের জগতে অনেক আধ্যাত্মিক সত্য-তথ্য প্রকাশিত হয়। এখানেও ঘুমের ঘোরে বাদশাহর সমস্যার জট খুলে যায়। এক বৃদ্ধ এসে তাঁকে আশ্বাস দেন আগামীকাল এক আগন্তুক রাজদরবারে আসবেন। যিনি ঐ রোগীর উপযুক্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা করবেন। আনন্দের আতিশয্যে বাদশাহর ঘুম ভেঙ্গে যায়। তিনি ভোর হওয়ার অপেক্ষা করতে থাকেন রাজপ্রাসাদের বৈঠকখানার বারান্দায় সেই আগন্তুক হেকিমের জন্য। হেকিম আসছিলেন। কল্পনায় মনে হচ্ছিল আলো-ছায়ার মাঝখানে নতুন চাঁদ যেন ভেসে ভেসে আসছে। কল্পনা বা ‘খেয়াল’ শব্দটি উচ্চারিত হওয়ায় মওলানার চিন্তা চলে গেল দর্শনের জগতে। মানুষের কল্পনাশক্তি এবং মানব জীবনের সর্বত্র ধারণা ও কল্পনার আধিপত্যের ব্যাখ্যা দেন নানা উপমার সাহায্যে। এখানে আল্লাহর অলিদের কল্পনাশক্তির মহিমা ব্যাখ্যা করে বলেন, আল্লাহ্র গুণাবলির যে বাগান সেই বাগানের সৌন্দর্যের প্রতিচ্ছবি পতিত হয় আউলিয়ায়ে কেরামের কল্পনায়।
বাদশাহ আগন্তুক মেহমান হেকিমকে অভ্যর্থনা জানান। তাঁর প্রতি পূর্ণ আদব প্রদর্শন করেন। মওলানা এখানে ‘আদবের’ সুফল এবং মানব চরিত্রের জন্য ‘আদব’ যে এক মহা ভূষণ ও অলংকার, তার তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেন এবং ‘বেয়াদবির’ শোচনীয় পরিণাম ও কুফল বর্ণনায় শয়তান, হযরত আদম (আ.) ও আসমান-যমীনের নানা উপমা পেশ করেন। হযরত মূসা (আ.)-এর কওম বেয়াদবির কারণে আসমানি খাবার থেকে বঞ্চিত হওয়ার কুরআনে বর্ণিত ঘটনাকে তিনি দলিল হিসেবে উল্লেখ করেন। আমাদের সংস্কৃতিতে ‘আদব’ ‘বেয়াদব’ শব্দটি বহুল প্রচলিত এবং এর ভাবার্থ ব্যাপক। খুব সম্ভব মওলানা রূমী (র.)-এর ‘মসনবী’ শরীফের এই আলোচ্য শিক্ষা থেকে এই দুটি পরিভাষা আমাদের সংস্কৃতিকে ঋদ্ধ করেছে।
আগন্তুক হেকিমের সাথে বাদশাহর সাক্ষাতের দৃশ্যটি বড় চমৎকার। বাদশাহ বলছেন যে, আমি যেন আপনার জন্যই পাগল হয়েছিলাম। আমার প্রেমানন্দ দাসী নয়, আপনি। তবে আল্লাহ একটার উসিলায় আরেকটা মিলান। এটিই দুনিয়ার নিয়ম। কাজেই লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টায় কেউ যেন কখনো হতাশ না হয়। হেকিমকে সম্বোধন করে বাদশাহ বলেন, আপনাকে পেয়ে আজ আমি বড়ই ধন্য। এই হেকিম আসলে আল্লাহর অলি, আধ্যাত্মিক কবিরাজ। মওলানা এই সূত্রে অলি-আল্লাহর গুণ ও বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেন। বলেন যে, তাঁদের দর্শন লাভই মানুষের হাজারো সমস্যার সমাধান।
বাদশাহ হেকিমকে রোগীর কাছে নিয়ে যান। হেকিম বলেন যে, বাড়ির ভেতর বাহির থেকে সব লোককে সরে যেতে হবে। হেকিম বুঝতে পারেন, এই রোগী সাধারণ রোগী নয়; প্রেমের রোগে আক্রান্ত হয়েছে দাসী।
প্রেম ও ‘এশ্ক্’-এর প্রসঙ্গ আসতেই তা মওলানার চিন্তাকে আলোড়িত করে। তিনি প্রেমের পরিচয় বর্ণনায় কয়েকটি বয়েত রচনা করে বলেন, সেটিই আসল প্রেম যা মানুষের আত্মিক পূর্ণতা আনে এবং মানুষকে চূড়ান্ত গন্তব্যে পৌঁছে দেয়। তবে আল্লাহর রহস্য দর্শনের অনুবীক্ষণযন্ত্ররূপী প্রেম এত ব্যাপক-বিশাল ও অবর্ণনীয় যে, তা ভাষা-বর্ণনা ও লিখনির আয়ত্তে আনা যায় না। কেননা, যে কোনো বর্ণনা ও সংজ্ঞা সেই অর্থ ও আকৃতিকেই প্রকাশ করে, যা মানুষের মনের আয়ত্তাধীন। কারণ, মানব মনে আয়ত্তাধীন না হলে তা ভাষায় ও বর্ণনায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। কেউ প্রকাশের চেষ্টা করার অর্থ হবে সেই বিষয়কে আরো অধিক অস্পষ্ট ও আচ্ছন্ন করা। কাজেই প্রেমকে দিয়েই প্রেমকে চেনা উচিত। ঠিক সূর্যের আলোর মতো। আলো দিয়েই সূর্যকে চেনা যায়। অবশ্য ছায়া দিয়েও সূর্যকে চেনা যায়, কিন্তু ছায়া তো সেখানেই থাকে, যেখানে সূর্যের আলো থাকে না।
সূর্যের প্রসঙ্গ আসাতে মাওলানার মন চলে গেল আরেক সূর্যের দিকে। সূর্য ফারসিতে খুরশীদ, আরবিতে শামস। এই শামস আসমানের নয়, মওলানার হৃদয়-আকাশের। শামসে তাবরিযী। তাবরিযের সূর্য। শামসে তাবরিযী হলেন নূরে হক। এখানে এসে মওলানা প্রেমের আতিশয্যে কোনো কথা বলতে অপারগ, নির্বাক। কাজেই সেই প্রেমের আলেখ্য অন্য সময়ে ন্যস্ত করেন। বন্ধুরা বারবার অনুরোধ করেন শামসে তাবরিযীর প্রেমের রহস্য বর্ণনার জন্য। কিন্তু মওলানা ফিতনা ও রক্তপাতের আশংকা করেন। তাই মুখ বন্ধ করে ফিরে আসেন আসল গল্পে।
আগন্তুক হেকিম দক্ষ মনোবিজ্ঞানীর মতো ধীরে ধীরে বিনম্র ভাষায় বাঁদীর সাথে আলাপ জমান। মনে কোনো সন্দেহ জাগার সুযোগ না দিয়ে দাসীর অতীত জীবনের নানা কথা জিজ্ঞেস করেন : কোথায় তার বাড়ি, আত্মীয়-স্বজন, চেনা-জানা কারা? কোথায় কোথায় ছিল? তিনি একেক শহরের নাম নেন আর হাতের শিরার দিকে লক্ষ্য রাখেন। হেকিম যখন সমরকন্দ নামোল্লেখ করলেন লক্ষ্য করলেন, দাসীর শিরার স্পন্দন দ্রুততর হয়েছে। হেকিম তখনই সমস্যার সূত্র ধরতে পারেন। হেকিম এসব প্রশ্ন এমনভাবে করেন, যাতে দাসী হেকিমের গোপন উদ্দেশ্য বুঝতে না পারে।
মওলানা ব্যাপারটিকে পায়ের নিচ থেকে কাঁটা বের করার দক্ষতার সাথে তুলনা করেন। অদক্ষ চিকিৎসকদের তিনি এমন লোকের সাথে তুলনা করেন, যারা গাধার লেজের নিচে কাঁটা গুঁজে দেয়। গাধা কাঁটা বের করবার জন্য যতই লাফায়, কাঁটা ততই আরো শক্তভাবে বিদ্ধ হয়। হেকিম এই পন্থায় এ তথ্য উদঘাটন করেন যে, দাসীর প্রেমাস্পদ হচ্ছে এক স্বর্ণকার। সমরকন্দে তার বসবাস। হেকিম তার ঠিকানা জিজ্ঞেস করে জানতে পারেন, সারপোল মহল্লার গাতফার গলিতে তার বাড়ি। হেকিম দাসীকে নিশ্চয়তা দেন, তার মনের মানুষকে অবশ্যই তার কাছে আনার ব্যবস্থা করবেন। তবে শর্ত হলো, এর গোপনীয়তা রক্ষা করতে হবে।
মওলানা এখানে মনের গোপন কথা গোপন রাখার সুফল বর্ণনা করেন। একটি তত্ত্বকথার উদ্ধৃতি দিয়ে কয়েকটি উপমা ও উদাহরণ পেশ করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি সত্য ওয়াদা ও মিথ্যা ওয়াদার মধ্যকার তফাৎ নির্দেশ করে মানব মনে এর প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে, সংক্ষেপে তা ব্যাখ্যা করেন।
হেকিম বাদশাহকে এসে বললেন, দাসীর চিকিৎসার একমাত্র পথ হচ্ছে, প্রথমে সমরকন্দ হতে স্বর্ণকারকে আনার ব্যবস্থা করতে হবে। বাদশাহ সমরকন্দে কয়েকজন দূত প্রেরণ করেন। রাজকীয় সম্মান ও অঢেল সম্পদের প্রলোভন দেখিয়ে আত্মীয়-স্বজন থেকে বিচ্ছিন্ন করে স্বর্ণকারকে রাজদরবারে নিয়ে আসা হলো। মওলানা এখানে সম্পদের লোভ কীভাবে মানুষকে মৃত্যুর দুয়ারে টেনে নিয়ে আসে তার হাকীকত বর্ণনা করেন।
স্বর্ণকার আসার পর হেকিমের পরামর্শে দাসীকে তার কাছে ফেরত দেয়া হয়। কিন্তু হেকিম গোপনে শরবতের মাধ্যমে স্বর্ণকারকে বিষপান করান। সেই স্লো-পয়জনে ধীরে ধীরে স্বর্ণকার দুর্বল ও শ্রীহীন হয়ে পড়ে। ওদিকে স্বর্ণকারের প্রতি দাসীর প্রেমেও ভাটা পড়ে। এক পর্যায়ে কৃত্রিম প্রেম নিঃশেষ হয়ে যায়। মাওলানা প্রমাণ করেন যে, যে প্রেম রং রূপ ও আকৃতির জন্য জাগতিক, তার পরিণতি এরূপই হয়।
শেষ পর্যন্ত স্বর্ণকার মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। তবে মৃত্যুর আগেই বুঝতে পারে যে, তার প্রাণের শত্রু কে এবং কেন তাকে প্রাণ দিতে হচ্ছে। এ স্তরে এসে মাওলানা মানুষের কর্মের প্রতিফল সম্পর্কে স্বর্ণকারের যবানীতে অভাবনীয় বর্ণনা উপস্থাপন করেন। স্বর্ণকারের প্রতি দাসীর প্রেম লোপ পাওয়াকে মওলানা এ কথার প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করেন যে, বস্তু ও দেহগত যে প্রেম, তা ক্ষণস্থায়ী। কেননা, স্বয়ং মানুষেরই তো স্থায়িত্ব নেই; কাজেই মানুষের উচিত সেই চিরঞ্জীব চিরন্তন সত্তার প্রেমে আসক্ত হওয়া। কেননা, সেই প্রেম মানুষকে প্রতিমুহূর্তে নতুন জীবন দান করে। আল্লাহ কারো প্রেমের, আসক্তির আদৌ মুখাপেক্ষী না হলেও তিনি দয়ার্দ্র-দয়ালু বিধায় তাঁর সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলা আমাদের পক্ষে সম্ভবপর। কারণ, দয়ালু দাতার পক্ষে কোনো কাজই অসম্ভব নয়।
স্বর্ণকারকে হত্যার ঘটনায় এক জটিল প্রশ্ন জাগে, কীভাবে দ্বীন ও দুনিয়ার রাজত্বের অধিকারী একজন বাদশাহ একজন লোকের প্রাণহানিতে সন্তুষ্ট হতে পারলেন। এই প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে মওলানা কামিল (পরিপক্ব) লোক ও নাকেস (অপরিপক্ব) লোকদের কাজের মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করেন। এ আলোচনা অনেক দীর্ঘ ও মনোমুগ্ধকর। মাওলানার মতে, কাজের সৌন্দর্য বা কদর্যতা ব্যক্তির নিয়ত ও উদ্দেশ্যের ওপর নির্ভরশীল। যেখানে নিয়ত ও উদ্দেশ্য হয় কোনো কল্যাণ সাধন, সেখানে কাজটি সুন্দর বলে গণ্য হয়। আর যদি উদ্দেশ্য ও নিয়ত খারাপ হয় তাহলে কাজটিও মন্দ হয়ে যায়। এর প্রমাণ হিসেবে খিযির (আ.) কর্তৃক কয়েকজন দরিদ্র মানুষের মালিকানাধীন নৌকা ফুটো করে ডুবিয়ে দেয়া এবং আরেক ঘটনায় এক বালককে হত্যা করার ঘটনা উল্লেখ করেন, যা কুরআন মজীদে সূরা কাহফে (সূরা নং ১৮) বর্ণিত।
প্রথম ঘটনায় নিরীহ ইয়াতীমের সম্পদ ধ্বংস এবং পরের ঘটনায় নিরপরাধ বালকের হত্যাকা- ঘটানো হয়। যা দৃশ্যত খুবই মন্দ। কিন্তু খিযির (আ.)-এর উদ্দেশ্য সৎ, মহৎ ও কল্যাণময় ছিল বিধায় কাজগুলো পছন্দনীয় হয়েছিল। উদাহরণ হিসেবে, তিনি বাচ্চাদের সুন্নতে খাতনার কথা উল্লেখ করেন। হাজাম এসে ধারালো ক্ষুর দিয়ে বাচ্চার খতনা করাচ্ছে, রক্তপাতের আশংকায় বাচ্চা চিৎকার দিয়ে কাঁদছে; কিন্তু বাচ্চার ভবিষ্যৎ কল্যাণ চিন্তা করে মা আনন্দে হাসছে এবং আত্মীয়-স্বজনের সাথে সেই আনন্দ ভাগাভাগি করছে।
মওলানা রূমী (র) বলছেন যে, কামিল লোক আল্লাহর হুকুম ও ওহীর নির্দেশ মোতাবিক কাজ করেন, প্রবৃত্তির কামনা-বাসনা বা ব্যক্তিগত মতলব নিয়ে কিছু করেন না। তাদের মধ্যে কেউ যদি আল্লাহ্্র নির্দেশে হত্যাকা-ও ঘটায়, তা আল্লাহ্র হুকুমেই ঘটায়। এই হত্যা হয় উন্নততর ও আনন্দময় জীবনের পটভূমি। অনুরূপভাবে পীরের নির্দেশ মতো সাধক যে কৃচ্ছ্রসাধনায় রত হয়, দৃশ্যত তা কারো মৃত্যু ঘটানোর মতো। কারণ, দুনিয়ার সুখ-সম্ভোগ তাকে ত্যাগ করতে হয়। আসলে কিন্তু তা নয়। কারণ, উন্নত চরিত্র ও আত্মিক উন্নতি হচ্ছে সুন্দর-সুখী জীবনের পটভূমি। এই পটভূমি এসব দিক চিন্তা করে ভবিষ্যৎ কল্যাণ বিচার-বিবেচনায় রেখে তিনি স্বর্ণকারকে হত্যার ব্যাপারে সম্মতি দেন।
মওলানা এখন নিজকে দায়মুক্ত করার মানসে বলছেন, বাদশাহ যদি নিজস্ব কুমতলব বা স্বার্থদুষ্ট হয়ে স্বর্ণকারকে হত্যার পরিকল্পনা করতেন, তাহলে তার নামও আমি মুখে আনতাম না, কারণ, আল্লাহ্র বান্দা কোনো পাপিষ্ঠের প্রশংসা করতে পারে না। কাজেই আল্লাহ্র অলি আর নাফসের অনুসারী মানুষকে এক পাল্লায় ওজন করা উচিত নয়। মওলানা বিষয়টি ব্যাখ্যার জন্য অসংখ্য উপমার আশ্রয় নিয়েছেন অপর একটি বিখ্যাত গল্পের সূত্রে। অর্থাৎ মুদির দোকানি ও তোতা পাখির গল্পে।
মনীষীদের গুরুত্বপূর্ণ মূল্যায়ন
‘মসনবী’র ব্যাখ্যাতা মনীষিগণ এ কাহিনীকে রূপক গল্প হিসেবে মূল্যায়ন করেছেন। তাঁরা কাহিনীর ভিন্ন অর্থ গ্রহণ করেছেন। এ কাহিনীতে বাদশাহ হলেন আক্ল ও রূহের রূপক। বাঁদী হচ্ছে নাফসে আম্মারা। স্বর্ণকারের প্রতি বাঁদীর প্রেম দুনিয়াবি ভোগ-বিলাসের প্রতি নাফসে আম্মারার আসক্তির পরিচায়ক। অদৃশ্য জগতের আধ্যাত্মিক চিকিৎসকই নাফস আম্মারার রোগ ধরতে পারেন এবং তিনিই তার সুচিকিৎসা করতে সক্ষম। তিনি রূহ ও আক্লকে শাহওয়াতে নফসানি বা প্রবৃত্তির কামনা-বাসনার ফাঁদ থেকে উদ্ধার করেন। প্রফেসর নিকলসন কাহিনীর এরূপ ব্যাখ্যার পক্ষপাতি।
মওলানা আশরফ আলী থানবী (র.) উপরিউক্ত ঘটনার গূঢ়রহস্য বর্ণনা করেছেন এভাবে : ‘এ কাহিনী মূলত আমাদের বাস্তব অবস্থার অনুরূপ। অনুরূপতা এ দিক থেকে যে, কাহিনীতে যেভাবে বাদশাহ বাঁদীর ওপর প্রেমাসক্ত হয়েছেন তদ্রƒপ আমাদের রূহরূপী বাদশাহ, নাফসরূপী দাসীর ওপর প্রেমাসক্ত হয়ে তার অনুগত হয়ে গেছে। বাঁদী যেরূপ স্বর্ণকারের প্রতি আশেক ছিল তেমনি নাফসও দুনিয়াবি ভোগ-বিলাসের প্রতি আশেক হয়ে আছে। বাদশাহ যেভাবে বাঁদীর চিকিৎসার জন্য অদক্ষ হেকিমদের সাহায্য নিয়েছেন, অথচ কোনো ফায়দা হয়নি। তেমনি অপক্ব পীরদের কাছে গিয়ে কোনো ফায়দা হবে না। কাহিনীতে গায়বী হেকিম যেভাবে চিকিৎসা করলেন এবং স্বর্ণকারকে বিষপানে কুৎসিত আকৃতির বানিয়ে দিলেন, যাতে তার প্রতি বাঁদীর মনে ঘৃণার সৃষ্টি হয়, অতঃপর স্বর্ণকারকে মেরে ফেললেন এবং এ পন্থায় বাঁদীর সুচিকিৎসা করলেন, তদ্রƒপ কামেল পীর দুনিয়াবি ভোগ বিলাসের আসক্তিকে ক্রমান¦য়ে নাফস থেকে পৃথক করে ফেলেন। এক পর্যায়ে নাফস সেগুলো ত্যাগ করে এবং নফসানি রোগব্যাধি হতে মুক্তি পায়। এরপর বাদশাহ রূহ, নাফসের দ্বারা উপকৃত হন।
মোটকথা এ শিক্ষণীয় বিষয়টি পাওয়া গেল যে, যদি হৃদয়ের মরিচা দূর করতে চাও, তাহলে কামেল পীরের শরণাপন্ন হও। তাঁর আদেশ-নিষেধ মেনে চল। তিনি যথাযথ পন্থায় তোমার রোগের চিকিৎসা করবেন।
মওলানা রূমী (র.)-এর বক্তব্যের দুটি প্রধান বিষয় রয়েছে। একটি বিষয়, যা পরম কাম্য তা হলো তাওহীদ। দ্বিতীয়টি হলো তাওহীদে উপনীত হওয়ার কর্মপন্থা অর্থাৎ শেখে কামেল বা কামেল পীরের আনুগত্য।’Ñ (কলীদে মসনবী, প্রথম দপ্তর, পৃ : ১৩)
ড. বদিয়ুযযামান ফরুযানফার এ ধরনের ব্যাখ্যাকে পছন্দ করেননি। তিনি বলেন, ‘এ জাতীয় ব্যাখ্যা মওলানার রুচির সাথে খাপ খায় না। কারণ হচ্ছে, সাধারণত ‘মসনবী’তে গল্প, কাহিনী ও উপমা কোনো বিষয় বা বক্তব্যের ব্যাখ্যা ও বর্ণনার যুক্তি হিসেবে উপস্থাপন করা হয় না; বরং বক্তব্য ও বিষয়গুলোর প্রতি পাঠক ও শ্রোতার মনোযোগ আকর্ষণের মাধ্যম হিসেবে পল্প-কাহিনীর অবতারণা করা হয়। মাওলানা চান না যে, এসব কাহিনী বা গল্পকে নৈতিক বা সামাজিক বিষয়ের আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করা হোক। এ জন্য আমরা দেখতে পাই, ‘মসনবী’তে এমন কতক কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে যেগুলো বাহ্যিক দৃষ্টিতে কুৎসিত ও অপছন্দনীয়। কিন্তু তা দ্বারা যেহেতু কাক্সিক্ষত উদ্দেশ্য বা আসল বক্তব্য পরিষ্কাররূপে তুলে ধরা সম্ভব হয়েছে সেহেতু মওলানা সেসব উপমা বা গল্প বর্ণনা থেকে বিরত থাকেন নি। কারণ, গল্পের কাঠামো বা তার অংশগুলো কী রকম হচ্ছে তার প্রতি মওলানার আদৌ দৃষ্টি নেই। তিনি গল্প ও উপমাকে দাঁড়িপাল্লা বা মাপকযন্ত্র হিসাবে ব্যবহার করেছেন। দৃশ্যত এ গল্পেও তিনি গল্পের আঙ্গিক কাঠামোকে মোটেও গুরুত্ব দেননি; বরং এর ফলাফলই তাঁর লক্ষ্য ছিল।’Ñ (শারহে মসনবী শরীফ, পৃ : ৫০)
আমার ক্ষুদ্র অনুভবে জনাব ফরুযানফারের ব্যাখ্যাই সঠিক। কারণ, মওলানার উদ্দেশ্য কাহিনী বর্ণনা নয়, বরং কাহিনীর ছদ্মাবরণে নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শিক্ষা ও গূঢ়-রহস্যগুলো ব্যাখ্যা করাই তাঁর লক্ষ্য। এ জন্য দেখা যায়, তিনি কোনো গল্প কাহিনী বর্ণনা করতে গিয়ে নানা ধর্মীয়, নৈতিক ও দার্শনিক বিষয় এমনভাবে তুলে ধরেন, যা পড়তে গিয়ে মনে হবে মওলানা নিজেই কাহিনী শেষ করার কথা ভুলে গেছেন। আবার দেখা যাবে, এক কাহিনী শেষ না করেই আরেক কাহিনীর অবতারণ করেছেন। এভাবে ‘এক গল্পের মাঝে আরেক গল্পের’ আধিক্যে সাধারণত ঐসব পাঠক অস্বস্তি ও বিরক্তি বোধ করবেন যাঁরা মসনবীকে কোনো কাহিনীকাব্য মনে করে এর রস আস্বাদনের চেষ্টা করেন।
মসনবীর কাহিনীগুলোকে কোনো দেশের পর্যটন বিভাগের সুসজ্জিত গাড়ির সাথে তুলনা করা যায়। এ ধরনের গাড়িতে পর্যটকদের নিয়ে কোনো ঐতিহাসিক স্থানে নামানো হয়। গাইড সেখানকার ঐতিহাসিক বিষয় ও নিদর্শনগুলোর বর্ণনা দেন। আবার যাত্রীদের তুলে কোনো পরিত্যক্ত স্থানে নিয়ে নামান, সেখানকার দৃশ্যাবলি দেখানোর পর আবার গাড়িতে ওঠান। এভাবে মনোরম হোক বা দৃশ্যত অপছন্দনীয় হোক, নানা গম্য-অগম্য স্থানে নিয়ে যান। স্থুলদৃষ্টির যাত্রীরা হয়ত বলবে, এত অল্প রাস্তা পাড়ি দিতে এতবার দাঁড়াল কেন, গাইডের এত কথা বলার দরকার কী ছিল? শহরটি এক চক্কর ঘুরিয়ে আনলেই তো হত। শহরের প্রাচীন স্থাপত্যের দুর্গন্ধময় গলিতে নিয়ে গেলেন কেন? কিন্তু সূক্ষ্মদর্শী পর্যটকরা এমন গাইড ও ভ্রমণের জন্য নিজকে ধন্য মনে করবেন। বুঝতে হবে যে, গাইডের উদ্দেশ্য শুধু শহরের কয়েকটি সড়কে বা মোড়ে চক্কর দেয়া নয়, প্রতিটি ঐতিহাসিক স্থান ও নিদর্শন খতিয়ে দেখানোই উদ্দেশ্য। ‘মসনবী’ শরীফকেও সে দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করতে হবে। তাহলেই কোনো বিরক্তির ছোঁয়া লাগবে না। আধ্যাত্মিক তৃপ্তিতে মন ভরে যাবে। অন্যথায় একে সুন্দর সুখপাঠ্য কাহিনী কাব্য মনে করলে সম্পূর্ণ নিরাশ হতে হবে। বাদশাহ ও বাঁদীর প্রেম কাহিনীকেও আমরা এই নিরিখে আধ্যাত্মিক শরাব পানের পেয়ালা অথবা আধ্যাত্মিক জগতের রহস্য দর্শনের উদ্দেশ্যে পর্যটনের গাড়ি মনে করব। তাহলেই স্বর্ণকারকে বিষপ্রয়োগে হত্যার মতো জটিল প্রশ্নের সমাধান মিলবে। মওলানা রূমীর বিশ্লেষণের ধারাভাষ্য বিস্তারিতভাবে সামনে আনলেই এ বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে এবং এ সম্পর্কিত যে কোনো প্রশ্নের জবার পাওয়া যাবে।
গল্পের উপসংহারে মওলানা সতর্ক করে বলেছেন, আল্লাহর কাজ এবং অলি-আল্লাহদের কাজকে নিজের সাথে তুলনা করা মারাত্মক ভুল। নিজের অবস্থা ও অবস্থান ভালো করে চিন্তা করে দেখ, তাহলেই এর হাকীকত বুঝতে পারবে। আমাদের জীবনে ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনায় আমরা সে সত্যের সাক্ষাৎ পাই। আমাদের জীবনে এমন অনেক ঘটনা ঘটে, তাৎক্ষণিকভাবে মনে হয় তাতে আমাদের জন্য কোনো কল্যাণ নেই; এমনকি নিজের জন্য ক্ষতিকর মনে করে অস্থির হয়ে উঠি, অধৈর্য হয়ে যাই; কিন্তু একটা নির্দিষ্ট সময় যাবার পর ঘটনার প্রকৃত কল্যাণ আমাদের সামনে আসে। কাজেই আল্লাহর কাজকে নিজের বুদ্ধি-বিবেচনার মানদ-ে বিচার করতে নাই।
একইভাবে আল্লাহর অলিদের কোনো কোনো কাজ সাধারণ দৃষ্টিতে বুঝে আসবে না, আপত্তিকর মনে হতে পারে। এর আসল কারণ, নির্বোধ লোকেরা আল্লাহ্র নবী (আ.) ও অলিদেরকে নিজের সাথে তুলনা করে। তাতে মারাত্মক ভ্রম ও পরিণতির শিকার হয়। মওলানা বলছেন : ‘তোমার মধ্যে আর ঐ শ্রেণির মধ্যে আকাশ-পাতাল ব্যবধান। তাঁদের নিকট আল্লাহর আদেশ ও ইলহাম আসে। তাঁরা সেই নির্দেশনা অনুসারেই কাজ করেন। উপরের গল্পে গায়েবী হেকিম সেরূপ ইলহাম যোগেই দাসীর চিকিৎসা করেন। কুরআন মজীদে মূসা (আ.) ও খিজির (আ.)-এর ঘটনাও এর নিরিখে বুঝতে হবে।’
বস্তুত সবকিছুকে নিজের সাথে তুলনা করে বিচার করলে কী ধরনের বিভ্রাট ঘটে এবং গোটা সৃষ্টিতে একই ধরনের বস্তুর পরস্পরের মধ্যে যে তারতম্য বিরাজমান তার ব্যাখ্যায় মওলানা আরেকটি গল্পের অবতারণা করছেন। সেটি হচ্ছে ‘মুদির দোকানি ও তোতা পাখি’র গল্প।
লেখক : ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রকাশিত মসনবী শরীফের বাংলা অনুবাদক ও ব্যাখ্যাতা।
ঊ-সধরষ: রংধংযধযবফর@মসধরষ.পড়স
All posts by dreamboy
কবি আল মাহমুদ ও তাঁর ইরান ভাবনা
আমিন আল আসাদ
কিশোর বয়সেই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী কবি আল মাহমুদ এর রক্তে যে সংগ্রামী চেতনা বিরাজমান ছিল তা এসেছিল তাঁর পূর্ব-পুরুষদের থেকে যাঁরা এ উপমহাদেশে এসেছিলেন জনগণকে মুক্তি দিতে, ইসলামের সুমহান আলো নিয়ে। পৌত্তলিক জাহেলিয়াতের শোষণ-বঞ্চনার ঘন অন্ধকার থেকে মানুষকে মুক্তিদান করতে আসা হযরত শাহ জালাল (র.)-এর অনুসারী বাহিনী বীর, পীর আওলিয়ার কাফেলার অন্যতম শাহ গেছুদরাজ (র.) ওরফে কল্লা শহীদ (র.)-দের রক্তধারা থেকেই কবি আল মাহমুদের রক্তধারায় এসেছে সংগ্রামী চেতনা। আল মাহমুদ-এর জন্মজেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ সারা বাংলাদেশের মুসলমানেরা সেসব বীর, পীর, মুজাহিদদের সম্মানের সাথে স্মরণ করে থাকেন। ভুখা-নাঙ্গা, ক্ষুধিত-বঞ্চিত গণমানুষের মুক্তির চেতনা আল মাহমুদের রক্তধারায় প্রবহমান ছিল। সেই চেতনা থেকেই তিনি একদা সাম্যবাদী তথা সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের সাথে যুক্ত হন। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় একদা তিনি সেই সাম্যবাদী চেতনার মুখপত্র ‘দৈনিক
গণকণ্ঠ’-এরও স¤পাদক হন। তিনি দেশের মানুষের ন্যায্য মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। শোষিত-বঞ্চিত, হতদরিদ্র, মানুসের মুক্তির লক্ষ্যে, মৌলিক মানবাধিকার ও বাক-স্বাধীনতার লক্ষ্যে সংগ্রামী চেতনা ছিল একটি নির্মোহ চেতনা। কোনো বৈষয়িক স্বার্থ বা রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদ লাভের জন্য নয়। তাই তাঁর বিবেক ছিল নিরপেক্ষ। ভুখা নাঙ্গা, বঞ্চিত, লাঞ্ছিত, বৈষম্যপীড়িত গণমানুষের মুক্তির চিন্তাভাবনা থেকে একদা যিনি সাম্যবাদী বা সমাজতান্ত্রিক দর্শনকে পছন্দ করেছিলেন, একসময় তিনি দেখতে পেলেন সাম্যবাদ যে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের চেতনা থেকে মানুষের বৈষয়িক মুক্তির কথা বলে তাতে মানুষের আত্মিক মুক্তির কোনো ফয়সালা নেই। কারণ, তা মানুষের তৈরি করা একটি মতবাদ। যা তাঁর ধমনীতে প্রবহমান রক্তধারার সাথে যায় না। এই সমাজতান্ত্রিক মতবাদ নিরন্ন মানুষের মুক্তির কথা বলে ঠিকই, কিন্তু এটাকে কেমন যেন অপূর্ণাঙ্গ মনে হয়। যেখানে মানুষকে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার কোনো মূলমন্ত্র নেই। এই গণমুক্তির চেতনা, মানুষের পার্থিব ও বৈষয়িক সমস্যার সমাধান, অর্থনৈতিক সাম্য সমতা অর্জনের আন্দোলনের সাথে যদি মানুষের আত্মিক মুক্তি, ইহলৌকিক ও পারলৌকিক মুক্তির কোনো মূলমন্ত্র যুক্ত করা যায় তবেই সেটা একটি পূর্ণাঙ্গ মুক্তির আন্দোলন হতে পারে।
আশ্চর্যজনক ভাবে তিনি লক্ষ্য করেন তাঁর ধমনীতে প্রবহমান রক্তধারার ভেতরে যে চেতনা লুক্কায়িত রয়েছে, যা এসেছে তাঁর পূর্বপুরুষদের মাধ্যমে, সেই চেতনার ভেতরেই রযেছে মানুষের মৌলিক সমস্যার সকল সমাধান, মানুষের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক মুক্তির বাণী। তিনি বহুদিন হারিয়ে আবার খুঁজে পেলেন পূর্ণাঙ্গ জীবন দর্শন ইসলামকেÑ যা কেবল একটি আচারস্বর্বস্ব ধর্ম নয়; বরং বঞ্চিত মানুষের মুক্তির বাণী। যা কেবল কোনো একটি ধর্ম মাত্র নয়। মানুষের মুক্তির ঐশী মতবাদ।
সাম্যবাদ যা বলে বা বলতে চায়, এর সবটুকুই এখানে আছে। তবে তা অন্যভাবে আছে। এই মহামুক্তির মহাবাণীগুলো যদি মানুষ পূর্ণাঙ্গ অনুসরণ করে তবে যে কোনো মানব সমাজ লাভ করবে মুক্তির ফল্গুধারা। এ তো সেই ইসলাম যা তাঁর হৃদয়ের ভেতরেই ছিল, কিন্তু দেখতে তিনি পাননি। রবী ঠাকুরের ভাষায়Ñ ‘আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলো দেখতে আমি পাইনি।’ যে ‘পলেতারিয়েত’ বা বঞ্চিত মানুষদের অধিকারের কথা কমিউনিজম বলে, সেই পলেতারিয়েত বা বঞ্চিত মানুষের মুক্তির কথা ইসলামও বলে। তিনি তা টের পেয়েছিলেন বলেই তিনি বলতেনÑ ‘আসছে এক শাশ্বত ঐশী আদর্শ নিয়ে নুতন বিপ্লব। বিশ্বকে কাঁপিয়ে আসছে আবার মানুষের মুক্তির বাণী নিয়ে ইসলাম। যা আগেও ছিল, এখনও আছে। বঞ্চিত মানুষের মুক্তির জন্য আসছে ইসলাম।’ তিনি দেখতে পেয়েছেন তাঁর পূর্বসূরি কবি নজরুলের ভাষায়, ‘দিকে দিকে পুনঃ জ্বলিয়া উঠেছে দ্বীন ইসলামী লাল মশাল/ ওরে বেখবর তুইও জেগে ওঠ তুইও তোর প্রাণ প্রদীপ জ্বাল’ বাণীর শাশ্বত আহ্বান।
কবি আল মাহমুদ-এর স্মৃতিচারণা ও মানুষের মুক্তি প্রসঙ্গে এক আলোচনায় বাংলাদেশের শিকড় সন্ধানী কবি আবদুল হাই শিকদার বলেছিলেনÑ ‘ইসলাম অব দা পলেতারিয়েত, বাই দা পলেতারিয়েত, ফর দা পলেতারিয়েত’। ইসলাম বঞ্চিত-লাঞ্ছিত মানুষের মধ্য থেকে, বঞ্চিত লাঞ্ছিত মানুষদের দ্বারা ও বঞ্চিত লাঞ্ছিত মানুষদের জন্য।’
মহানবী (সা.) আরবের বঞ্চিত লাঞ্ছিত মানুষদের নিয়েই ইসলামের বিজয় সূচিত করেছিলেন। যে চেতনা বহুদিন বক্ষে ধারণ করে রেখেছিলেন রাসূল (সা.)-এর আধ্যাত্মিক নেতৃত্বের উত্তরসূরি হয়রত আলী (রা.), রাসূলের মশহুর সাহাবী, খলিফা ও রাসূলের বংশধরেরা। কিন্তু পড়ে একসময় মুসলমান কেবল নামে মুসলমান হয়ে থাকে। গণমুক্তির চেতনার ইসলাম দর্শন আর তাদের বক্ষে থাকেনি। যদিও পোশাক রয়েছে গায়ে। আরবের বর্তমান রাজতান্ত্রিক বিলাসের জন্য ইসলাম আসে নাই। নজরুল বলেছেন, ‘তুমি চাও নাই আমরা হইবো বাদশা নওয়াব কভু।’ কিন্তু দুঃজনক হলেও সত্য মুসলমানরা ইসলাম ভুলে গিয়ে বিলাস ব্যসন আর অত্যাচারী রাজতন্ত্রের তাঁবেদারি করতে থাকে। অথচ ইসলাম এসেছে দরিদ্র মানুষের মুক্তির জন্য। মানুষের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক মুক্তির পথ দেখাতে।
সাম্যবাদী আন্দোলনের সাথে যুক্ত আল মাহমুদের মাঝে যে ধনতান্ত্রিক শোষণ, আধিপত্যবাদ, সা¤্রাজ্যবাদবিরোধী চেতনা বিকশিত হয় তা তিনি প্রকৃত ইসলামের মাঝেও দেখতে পান। তাইতো তাঁর শাশ্বত উচ্চারণ ‘আসছে এত শাশ্বত পুরাতন ঐশী আদর্শ নিয়ে নুতন বিপ্লব। বিশ্বকে কাঁপিয়ে আসছে আবার মানুষের মুক্তির বাণী নিয়ে ইসলাম। বঞ্চিত মানুষের মুক্তির জন্যে আসছে ইসলাম।’
যেমনিভাবে তাঁর পূর্বসূরি কবি নজরুল দেখেছিলেন, ‘জাগিল আবার ইরান তুরান মরক্কো আফগান মেশের/ সর্বনাশের পর পৌষ মাস এলো কি আবার ইসলামের।’
১৯৭৯ সালে পৃথিবীর ইতিহাসে ঘটে এক বিস্ময়কর ঘটনা। সাইয়্যেদ আয়াতুল্লাহ খোমেইনী (র.)-এর নেতৃত্বে ইরানে ঘটে এক ইসলামি গণজাগরণ। সারা পৃথিবীকে ঝাঁকুনি দিয়ে ইরানের মাটিতে সংঘটিত হয় এই মহান গণবিপ্লব। যা ফেরাউনরূপী শাহকে উৎখাত করে আড়াই হাজার বছরের ইসলামবিরোধী রাজতন্ত্রের শেকড় উপড়ে ফেলে।
১৭৮৯-৯৯ সালের ফরাসি বিপ্লব, ১৮৫৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যবাদবিরোধী সিপাহি বিপ্লব, ১৮৮৬ সালের শিকাগো শহরের শ্রমিক বিপ্লব, ১৯১৮ সালের রুশ জারতন্ত্র উচ্ছেদকারী সোভিয়েত কমিউনিস্ট বলশেভিক আন্দোলনের পর ১৯৮৯ সালের ইরানের ইসলামি বিপ্লবের মতো দুনিয়া কাঁপানো বড় ঘটনা বিশ্ববাসী আর দেখেনি। তাই গণমানুষের মুক্তির এই ইরানি বিপ্লবের শত্রু হয়ে যায় সা¤্রাজ্যবাদী শক্তি, যায়নবাদী ইসরাইল, বৈষয়িক ও ভোগবাদী রাজতান্ত্রিক আরব বিশ্বসহ দুনিয়ার তাবৎ কায়েমী স্বার্থবাদী শক্তি।
ইরানের ইসলামি বিপ্লবের পর আবহমান বাংলার ঐতিহ্যের শিল্পরূপকার কবি, গণমানাুষের মুক্তির চেতনার কবি আমাদের প্রিয় কবি আল মাহমুদও তাঁর বাণী : ‘আসছে এত শাশ্বত ঐশী আদর্শ নিয়ে নুতন বিপ্লব। বিশ্বকে কাঁপিয়ে আসছে আবার মানুষের মুক্তির বাণী নিয়ে ইসলাম। বঞ্চিত মানুষের মুক্তির জন্য আসছে ইসলাম।’ এই কথার সফল বাস্তবায়ন দেখতে পান। মানুষের মুক্তির ভিত্তি আবার দেখতে পান। তিনি ইরানি বিপ্লবকে সেই নুতন মুক্তির প্রথম ধাপ হিসেবে দেখেন।
তিনি বিভিন্ন লেখায়, বক্তৃতায় ও কলামে তা প্রকাশ করেন। তিনি ‘সাপ্তাহিক বিক্রম’ এ একটি কলাম লিখতেন ‘আল মাহদুদের কলাম’ নামে।
আল মাহমুদ একজন কবি ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান সফর করেন ইরানের রাষ্ট্রীয় আতিথেয়তায়। তিনি তাঁর লেখা ‘কবিতার জন্যে বহুদূর’ এ সেই কথা উল্লেখ করেছেন। এছাড়া তিনি ইরান থেকে ফিরে আলোচনা অনুষ্ঠানে ইরানের বিপ্লব, ইরানের সংস্কৃতি, ইরানের কবিদের সাহিত্য ভাবনা ও স্বপ্নের শক্তিকে প্রকাশ করেন। তিনি ফেরদৌসী, হাফিজ, রূমী, ওমর খৈয়াম, জামি, ফরিদউদ্দীন আত্তার এর সাহিত্য স¤পর্কেও কথা বলতেন তাঁর আলোচনায়।
কবি সৈয়দ আলী আহসান, কবি আল মাহমুদ, কবি ফজল শাহাবুদ্দিন, কবি আবদুস সাত্তার পরিবেষ্টিত বাংলাদেশ কবিতা কেন্দ্রের আন্তর্জাতিক কবি সম্মেলনে বিভিন্ন দেশের কবিদের সাথে ইরানের কবি তাহেরা সফরজাদেহও এসেছিলেন। তাঁর (আল মাহমুদ) ধমনীতে যে সুফি ভাবধারা ছিল যা তাঁর কাব্যে কোথাও কোথাও এসেছে, এই সুফিজমের সুতিকাগারও ইরান। তিনি বিপ্লবের পর ইরানে গিয়ে বিপ্লবের নেতা ইমাম আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ খোমেইনী (র.)-কে কাছে থেকে দেখেছেন। তিনি ইরানের ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা ইমাম খোমেনীর আধ্যাত্মিক কবিতারও বাংলায় অনুবাদ করেছেন। কবিতাটি নি¤œরূপ :
আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেইনীর কবিতা
গজল
‘হে প্রিয়তম সুহৃদ আমার
তোমার ওষ্ঠের তিল চিহ্নটি আমায় করেছে মোহাবিষ্ট
তোমার কাতর দৃষ্টিতে আমিও কাতর
আমার আমিত্ব থেকে মুক্ত আমি এবং
বোল তুলেছি ‘আনাল হক’-এর তবলায়।
মনসুরের মতো আমিও আমার জন্য কিনেছি ফাঁসিকাঠ
প্রিয়ের বিচ্ছেদ আমার অন্তরে আগুন জ¦ালিয়ে দিয়েছে
আর আমি আমার আত্মার কাছে ফিরে শুনি
আমাকে নিয়ে বাজারে গুঞ্জন।
আমার জন্যে দাও শুঁড়িখানার কপাট খুলে দিনরাত
মসজিদ আর মাদ্রাসার প্রতি আমি বেজার।
আমি দেহ থেকে খুলে ফেলেছি খোদাভীতি ও লোকদেখানো
ধার্মিকতার পোশাক।
এবং পরে নিয়েছি নিরাসক্ত পীরের মোটা আলখেল্লাহ, শালীন।
বকবাজ শহুরে মোল্লাদের উপদেশে আমি তিতিবিরক্ত
আর সাহায্যটুকু তো মদাসক্ত মাতালের নিঃশ্বাস থেকেই পেয়েছি
আমাকে সেই মন্দিরের স্মৃতি ব্যক্ত করতে দাও
যে আমি জেগে উঠেছিলাম শুঁড়িখানার মূর্তিমতীর হাতের ছোঁয়ায়’
বিপ্লবী নেতা ও আধ্যাত্মিক কবি আয়াতুল্লাহ খোমেইনী (র.)-এর উক্ত কবিতাটি একটি শক্তিশালী আধ্যাত্মিক কবিতা। এখানে ব্যবহৃত কিছু শব্দের বাহ্যিক অর্থ দিয়ে কবিতাটি বোঝা যাবে না। অন্তর্নিহিত আধ্যাত্মিক অর্থ দিয়ে কবিতাটি বুঝতে হবে। বোঝার সুবিধার্থে তা উল্লেখ করা হলো ।
যেমন ওষ্ঠের তিল বলতে খোদায়ী নূরের আকর্ষণকে বোঝানো হয়েছে। শুঁড়িখানা বলতে ইহজগতের সকল কিছু থেকে ভিন্ন সেই সুমহান খোদায়ী জগৎকে বোঝানো হয়েছে যেখানে আল্লাহর সবচাইতে প্রিয় বন্ধুগণ তাঁর সাক্ষাতে হাজির হন। কাতর দৃষ্টি বলতে বোঝানো হয়েছে যে দৃষ্টি প্রেমের স্বর্গীয় উৎস থেকে আসে। মূর্তিমতি বলতে বোঝানো হয়েছে আধ্যাত্মিক জগতের সেই নূর, যে নূরের ছোঁয়ায় খোদাপ্রেমিকদের হৃদয় আন্দোলিত হয়।
আয়াতুল্লাহ খোমেইনী কবিতার সংকলন ‘দিওয়ানে ইমাম’ এর বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হয় ২০১৮ সালে অমর একুশে গ্রন্থমেলায়। ইরান গবেষক, ইসলামি চিন্তাবিদ কবি ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদীর অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল ২৫০ পৃষ্ঠার এই ‘দিওয়ানে ইমাম’ বাংলা ভাষায় ইমাম খোমেইনী (র.)-এর কবিতার সবচেয়ে বড় বই। এই গ্রন্থে ইমামের লেখা ১৪৭টি গজল, ২২৮টি রূবাই, ২টি মুসাম্মাত, ১টি তারজীবান্দ, কয়েকটি কিতআ ও কতিপয় বিক্ষিপ্ত বয়েত সংকলিত হয়েছে। এর আগে লেখক, কবি, গবেষক মরহুম ফরিদ উদ্দীন খান প্রকাশ করেছিলেন ‘ইমাম খোমেনীর কবিতা’ নামে ছোট একটি সংকলন গ্রন্থ।
যা হোক ড. ঈশা শাহেদী অনূদিত এই কাব্য সংকলন ২০১৮ সালো আলোর মুখ দেখলেও এর কাজ তিনি শুরু করেছিলেন এক দশক আগে থেকেই। এই বিশাল অনুবাদ কর্মে কবি আল মাহমুদ-এর হাতের ছোঁয়াও লেগেছিলো। প্রায় অর্ধশতাধিক কবিতা কবি আল মাহমুদ স¤পাদিত। ড. ঈশা শাহেদী নিজেই বলেন, ‘ইরানি কালচারাল কাউন্সেলর ড. রেযা হাশেমীর পরামর্শে আমার অনুবাদের কাব্যরূপ পরিমার্জনায় বরেণ্য কবি কবি আল মাহমুদের সহায়তা নিয়েছি। তাকে আমি পড়ে শোনাতাম। আর তিনি প্রয়োজনীয় শব্দ সংযোজন বা বিয়োজন করতেন। এই প্রক্রিয়ায় প্রথম দিককার ৩৩টি কবিতার কাব্যরূপ সমন্বিত করা হয়।’
ইরানে ইসলামি বিপ্লবের পর বিগত চল্লিশ বছরে রাজতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র, ইহুদি যায়নবাদ, আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াকু ইরানি জনতার আত্মচেতনা আর কবি আল মাহমুদ-এর সাম্রাজ্যবাদবিরোধী কবিতাসমূহের চেতনা মূলত অভিন্ন।
ইরানের ইসলামি বিপ্লবের পর বিপ্লবের নেতা ইমাম খোমেইনী (র.) ফিলিস্তিনি গণ-মানুষের মুক্তির লড়াইকে সমর্থন দেন। ইসরাইলের সাথে স¤পর্কচ্ছেদ করে ইসরাইলের দূতাবাস উচ্ছেদ করে সেই ভবনে ফিলিস্তিনের দূতাবাস স্থাপন করেন। ইসরাইলের পতাকা নামিয়ে ইরানি বিপ্লবীরা উড়িয়ে দেয় ফিলিস্তিনি পতাকা। অসংখ্য নবী-রাসূলের (আ.) স্মৃতি বিজরিত মুসলমানদের প্রথম কেবলা বায়তুল মোকাদ্দাস তথা আল কুদস পুনরুদ্ধারের জন্য মাহে রমজানের শেষ শুক্রবারকে ‘আল কুদস দিবস ঘোষণা’ করে সারা দুনিয়ায় আল কুদস পুনরুদ্ধারের আন্দোলনের চেতনাকে ছড়িয়ে দেন।
এই ধনতান্ত্রিক ইহুদিবাদের বিরুদ্ধে কবি আল মাহমুদও লিখেন অম্লান সব কবিতা।
পৃথিবীর বুকে ইহুদিবাদ এবং বিগত শতাব্দীতে উদ্ভূত সম্প্রসারণবাদের ইহুদি সংস্করণ ‘যায়নবাদ’ মানব সমাজের শান্তি এবং ভারসাম্যপূর্ণ স¤পর্ক বিনষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই নীতিতে ইহুদিরা অভিশপ্ত করে তুলেছে ধরাপৃষ্ঠকে এবং নিজেরাও হয়েছে অভিশপ্ত। কোরআনে আল্লাহপাক এই ইহুদি জাতিগোষ্ঠীটিকে বিপর্যয় সৃষ্টিকারী অভিশপ্ত জাতি হিসেবেই ঘোষণা দিয়েছেন। কবি আল মাহমুদের অনুভবেও তাই অনুরণিত হয়Ñ
‘অনিষ্টকর অন্ধকারে যখন পৃথিবী আচ্ছন্ন হয়ে যায়
চারিদিকে ডাইনীদের ফুৎকারের মতো হাওয়ার ফিসফাস
আর পাখিরা গুপ্ত সাপের আতংকে আশ্রয় ছেড়ে অন্ধকারে ঝাঁপ দেয়
ঠিক তখনি ইহুদীরা হেসে ওঠে।’
[ইহুদীরা/কাব্যগ্রন্থ অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না ]
ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর ১৭তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ৩ জুন ২০০৭ তারিখে ঢাকাস্থ ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে, বাংলাদেশে নিযুক্ত ইরানের কালচারাল কাউন্সেলর ড. হাশেমীর সভাপতিত্বে বিশিষ্ট সাংবাদিক অধ্যাপক সিরাজুল হক সাহেবের পরিচালনায় এক আন্তর্জাতিক মানের কবিতা পাঠের আসর অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কবি আল মাহমুদ। কবিতা পাঠে অংশ নেন কবি কে.জি. মোস্তফা, কবি এরশাদ মজুমদার, কবি আবদুল মুকিত চৌধুরী, কবি অধ্যাপক সিরাজুল হক, কবি আ.স.ম. বাবর আলী, কবি হাসান আলীম, কবি আসাদ বিন হাফিজ, কবি রেজাউদ্দিন স্টালিন, কবি ঈসা শাহেদী, কবি মাওলানা মাহবুবুর রহমান, কবি শাহনেওয়াজ তাবীব, কবি আমিন আল আসাদ, কবি ও রম্য লেখক লিয়াকত আলী, ড. আবদুস সবুর খান, ড. তারিক সিরাজী। আসরে বাংলা, ইংরেজি, উর্দু, ফারসি, আরবি কবিতা পঠিত হয়। প্রধান অতিথির ভাষণে কবি আল মাহমুদ বলেন, ‘ইমাম খোমেইনী (রহ) ছিলেন এক সুমহান ব্যক্তিত্ব যাঁর ভেতর সুপ্ত ছিল প্রজ্ঞার এক মহাসমুদ্র। জ্ঞান, বিজ্ঞান, সাহিত্য, দর্শন, রাজনীতি, ধর্মীয় প্রজ্ঞা, আধ্যাত্মিকতা, ইতিহাস ঐতিহ্যের নানা শাখায় তাঁর বিচরণ ছিল। তিনি জ্ঞানী ছিলেন। একই সাথে আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব ও দার্শনিক ছিলেন। সেকারণে তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়েছিল বিংশ শতাব্দীতে ইসলামি বিপ্লবের বিশ্বয়কর সফলতার দ্বার উন্মোচন। শুধু তাই নয়, তিনি একজন কবিও ছিলেন। তবে তিনি শুধু কবি ছিলেন না, ছিলেন আধ্যাত্মিক পুরুষ ও কবি। তাঁর কবিতাগুলো আধুনিক ফারসি সাহিত্যে স্থান করে নিয়েছে। তাঁর কবিতা আধ্যাত্মিকতা এবং প্রেমের দ্বৈত সম্মিলন ঘটিয়েছে। হতে পারে সেটা খোদার সাথে গভীর প্রণয়। আমি ইমাম খোমেইনী (রহ)-এর একটি কবিতা অনুবাদ করেছিলাম। তা পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে। [ ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বাংলা ভাষায় প্রকাশিত বিশাল স্মারক গ্রন্থ ‘আলোর স্মারক’-এ সেটি আছে।] আমি ইমাম খোমেইনী (রহ)-এর মতো বিশাল ব্যক্তিত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আমি আমার একটি কাব্যগ্রন্থে সেই অনূদিত কবিতাটি প্রকাশ করেছি। এছাড়া আমার কবিতাসমগ্রেও তা আছে। আমি একবার কলকাতায় একটি সাহিত্যের অনুষ্ঠানে ছিলাম। সেখানকার কয়েকজন বড় কবি, যাঁরা আমার অনূদিত ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর কবিতা পড়েছিল, আমাকে তাঁরা বিস্ময়ের সাথে জিজ্ঞেস করেছেন ইমাম খোমেইনী কবিতা লিখতেন!
আমি বিপ্লব-পরবর্তীকালে ইরানে গিয়েছিলাম । ইমাম খোমেইনী (রহ)-এর নীতি নৈতিকতা, আদর্শ, তাঁর চিন্তা ও দর্শন একটি জাতিকে কীভাবে আলোড়িত করেছিল আমি তা স্বচক্ষে দেখে এসেছি। তিনি গোটা ইরানি জাতিকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। ইসলামি দুনিয়ায় তিনি এক জ্বলন্ত ইতিহাস হয়ে আছেন। আমি তেহরান গিয়েছি। ইসফাহান গিয়েছি, সিরাজে গিয়েছি, কাশানে গিয়েছি, দামাভান্দ-এ গিয়েছি। তেহরান ইউনিভার্সিটিতে জুম্মার নামাজে প্রেসিডেন্ট বক্তৃতা করেছিলেন। আমার মনে আছে। সেবার ছিল একটি বরফে ঢাকা দিন। প্রচ- বরফ পড়ছে। আমি গায়ে দিয়েছিলাম একটি প্যারাসুট কাপড়ে তৈরি চাদর। এ ধরনের চাদর যেসব দেশে বরফ পড়ে সেসব দেশের মানুষেরা পরিধান করে। চতুর্দিকে বরফ আর বরফ। প্রেসিডেন্টের বক্তব্যের পূর্বে একজন বক্তা বক্তৃতা করলো। বক্তব্যের অভিব্যক্তি তার চেহারায় ফুটে উঠেছিল। সে কেদে কেদে বক্তৃতা করছিল। তার অন্তরাত্মা থেকে যেন আগুন-জলোচ্ছাস উপচে পড়ছিল। আমি অভিভূত হয়ে শুনেছি সে বক্তৃতা। আমার ফারসি-জানা বন্ধু বক্তব্যের ভাবার্থ আমাকে সাথে সাথে বুঝিয়ে বলছিল।
কবিদের কাজ কী? মানুষের জন্য স্বপ্ন নির্মাণ করা। স্বপ্ন ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না। মানুষের জীবনে যতটুকু বাস্তবতা তার তিন গুণ স্বপ্ন দ্বারা পরিবেষ্টিত। স্বপ্নহীন মানুষ নিশ্চল পাথরের মতো। স্বপ্ন মানুষের ফিতরাত। আর কবিদের কাজ হলো মানুষের ভেতরের স্বপ্নকে উজ্জীবিত করা। তাকে আন্দোলিত করা। আমি সারা জীবন তাই করেছি। ইমাম খোমেইনী (রহ.) যেমন বিপ্লবী ছিলেন তেমনি মানুষকে স্বপ্ন দেখিয়ে ছিলেন। সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপও দিয়েছিলেন। তিনি একই সাথে বিপ্লবী,
মুজতাহিদ ও কবি। সে কারণেই কাজটি তিনি শৈল্পিকভাবে সুস¤পন্ন করতে পেরেছিলেন। আমি আর কি বলব তাঁর স¤পর্কে? আমি একজন নগন্য মানুষ। তিনি ছিলেন বিরাট সমুদ্রতুল্য। বিশাল বটবৃক্ষ ছিলেন তিনি ইরানি জাতির কাছে। তিনি শুধু ইরানি জাতির নেতাই নন। তিনি গোটা মুসলিম বিশ্বকে আত্মসচেতন করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন।
আমি খুবই অসুস্থ। ঘরের বাইরে খুব একটা যাই না। আগের মতো এতো অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে পারি না। আমি একজন প্রায়ান্ধ মানুষ। কানেও কম শুনি। ৭২ বছর বয়স হয়েছে আমার। ডাক্তার আমাকে বলেছে, ‘হায়াত-মওত-এর মালিক আল্লাহ। তবে আরো কয়েকটা দিন যদি সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে চান তবে বিছানা ছেড়ে এবং ঘর থেকে কোথাও যাওয়া যাবে না। চুপ-চাপ শুয়ে বসে কাটিয়ে দিতে হবে। এহেন অবস্থায়ও আমি ছুটে এসেছি ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর মতো এক মহান আধ্যত্মিক ব্যক্তিত্বের স্মরণসভায়। একজন মুসলমান হিসেবে আমার বিশ্বাস আজকে যেসব কবি এখানে তাঁকে নিবেদিত কবিতা পড়লেন এবং উপস্থিত শ্রোতাম-লী যাঁরা এখানে উপস্থিত হয়েছেন এবং আজকে যাঁরা এ অনুষ্ঠানের আয়োজক তাঁরা নিশ্চয়ই এ জন্য মহান প্রভুর কাছ থেকে পুরস্কার পাবেন। এই মহাত্মার পরকালীন জীবনের শান্তি কামনা করে এবং সেই সাথে আমাদের দুনিয়া ও আখেরাতের জীবনের কল্যাণ কামনা করে বক্তব্য শেষ করছি।’ [ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর মৃত্যুবাষিকী উপলক্ষে আয়োজিত নিবেদিত কবিতা পাঠের আসরে কবি আল মাহমুদ/ সূত্র : জুন-জুলাই সংখ্যা, নিউজলেটার, ২০০৭]
ইসলাম ও মানবাধিকার
সিরাজুল ইসলাম
সারা বিশ্বে মানবাধিকার এখন অত্যন্ত আলোচিত একটি শব্দ। মানব সমাজের সব সদস্যের জন্য সর্বজনীন, সহজাত, অহস্তান্তরযোগ্য এবং অলঙ্ঘনীয় অধিকারই হলো মানবাধিকার। মানবাধিকার প্রতিটি মানুষের এমন এক ধরনের অধিকার যেটা তার জন্মগত ও অবিচ্ছেদ্য। মানুষ এ অধিকার ভোগ করবে এবং চর্চা করবে। এ চর্চার মধ্য দিয়ে অন্যের মানবাধিকার নিশ্চিত হলেই বিশ্বশান্তি নিশ্চিত ও মানবতার কল্যাণ হয়। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্ব মানবাধিকারকে মূলত প্রতিদ্বন্দ্বী ও তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিরুদ্ধে রাজনীতির বিরাট বড় হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। ফলে মোটা দাগে বলা যায় যে, পশ্চিমা দুনিয়ার অন্যায্য ও কৌশলী আচরণের কারণেই বিশ্বে প্রতিনিয়ত মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে।
ইসলামে মানবাধিকার বলতে সেসব অধিকারকে বোঝানো হয়, যেগুলো স্বয়ং আল্লাহতায়ালা তাঁর বান্দাকে প্রদান করেছেন। পৃথিবীর কেউ তা রহিত করার অধিকার রাখে না। এ অধিকার কখনো রহিত হওয়ার নয়। ইসলামে মানবাধিকারের ধারণা কেবল ঘোষণার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে নি; বরং তা প্রতিটি মুসলমানের বিশ্বাসের অবিচ্ছেদ অংশও বটে। হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) জীবনব্যাপী সংগ্রাম করে সব মানুষের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করে গেছেন।
মানবাধিকারকে ইসলাম পদদলিত করে নি; বরং সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে উচ্চে তুলে ধরেছে। ইসলাম মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার নামে কোনোরূপ প্রতারণার আশ্রয় নেয় নি। জীবনের নিরাপত্তা লাভের অধিকার মানুষের সব অধিকারের মূল। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-ভাষা-সংস্কৃতি নির্বিশেষে সব মানুষের জীবনের নিরাপত্তা প্রদান করেছে ইসলাম। রাজনৈতিক বা অন্য কোনো মতামত, সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় কোনো কারণে কেউ মানুষের এ মৌলিক অধিকার খর্ব করতে পারে না।
মানুষের অবিচ্ছেদ্য অধিকারের মধ্যে রয়েছেÑ জীবন ধারণের অধিকার, ধর্মের অধিকার, কর্মসংস্থানের অধিকার, পরিবার গঠনের অধিকার, ন্যায়বিচার লাভের অধিকার, মত প্রকাশের অধিকার ইত্যাদি। এসব অধিকার লঙ্ঘিত হলে মানুষের বেঁচে থাকা অর্থহীন ও অসম্ভব হয়ে পড়ে।
১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘে সর্বজনীন মানবাধিকার সনদ ঘোষিত হয় এবং এ সনদ কার্যকর করার জন্য মানবাধিকার কমিশন গঠন করা হয়। জাতিসংঘ ঘোষিত সর্বজনীন ঘোষণাপত্রের ৩০টি ধারা মানুষের মৌলিক ও আইনগত অধিকার সংরক্ষণের জন্য চমৎকারÑ সন্দেহ নেই। কিন্তু তার বাস্তবায়ন দেশে দেশে, সমাজভেদে ভিন্ন। এর বহু আগেই মানবতার মুক্তির দূত হযরত মুহাম্মাদ (সা.) যে ইসলাম এনেছিলেন তাতে মানুষের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে, সে অধিকার আদায়ের সঙ্গে পাপ-পুণ্যের ধারণা জড়িত। অর্থাৎ মানুষের অধিকার আদায়ে ইতিবাচক ভূমিকার সঙ্গে রয়েছে পুণ্যের সম্পর্ক তথা পরকালীন মুক্তি। আর মানুষের অধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে রয়েছে পাপের সম্পর্ক তথা আখিরাতের শাস্তি।
ইসলামে মানবাধিকারের বিষয়টিকে শক্তভাবে ধর্মীয় বাধ্যবাধকতার আওতাভুক্ত করা হয়েছে। সহজ কথায়Ñ ইসলামে মানবাধিকারের ধারণা শুধু কোনো ঘোষণার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং তা প্রতিটি মুসলমানের ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
ইসলাম মানুষের অধিকার ও মর্যাদার ওপর সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করেছে।
এই বিশ্বচরাচরে সৃষ্টিকুলের মধ্যে সবচেয়ে মর্যাদাবান হচ্ছে মানুষ। তাকে অন্যসব সৃষ্টির তুলনায় উত্তমরূপে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং জগতের সমস্ত নিয়ামত ও শক্তিসমূহ মানুষের নিয়ন্ত্রণাধীন করে তার সেবায় নিয়োজিত করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা কি দেখ না যে, আল্লহ আকাশম-লী ও ভূপৃষ্ঠে যা কিছু আছে তার সবই তোমাদের কল্যাণে নিয়ন্ত্রণাধীন রেখেছেন এবং তোমাদের প্রতি তার প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য অনুগ্রহ প্রকাশ করেছেন।’Ñ সূরা লোকমান : ২০
মানবধিকারের সর্বজনীন ঘোষণার দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে মানুষে মানুষে সকল বৈষম্য বিলোপের কথা এসেছে। ইসলাম ধর্মও এরূপ বৈষম্যের বিপক্ষে। ইসলাম মানবজাতিকে জন্মগতভাবে সমানভাবে সমান মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছে। মানুষের জীবন, স্বাধীনতা এবং ব্যক্তিগত নিরাপত্তার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে ইসলামে বিবেচনা করা হয়। ইসলামের দৃষ্টিতে মানবজীবন অতি পবিত্র এক সম্পদ। মহান আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আল্লাহ যে জীবনকে হত্যা করা নিষিদ্ধ করেছেন, যথার্থ কারণ ছাড়া তোমরা তাকে হত্যা করো না। এবং যদি কেউ অন্যায়ভাবে মারা পড়ে তার উত্তরাধিকারীকে তো আমি ক্ষমতা দিয়েছি প্রতিকার করার। কিন্তু সে যেন হত্যার ব্যাপারে সীমা অতিক্রম না করে। কেননা, সে সাহায্য পেয়েছে।’Ñ সূরা বনী ইসরাঈল : ৩৩
ইসলাম মানুষের জীবনকে অসঙ্গত কারণে হরণ করতে নিষেধ করেছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘মানুষ হত্যা বা পৃথিবীতে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তি ছাড়া কেউ কাউকে হত্যা করলে সে যেন পৃথিবীর সমগ্র মানবগোষ্ঠীর প্রাণ হরণ করলো।’Ñ সূরা মায়েদা : ৩২
ইসলামি শাসনব্যবস্থায় মানুষের ন্যায়বিচার পাবার অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে ইসলামি শরীয়তে ছোট-বড়, ধনী-দরিদ্রের কোনো পার্থক্য করা হয় নি। ইনসাফ এবং সাম্য ইসলামি বিচারব্যবস্থার অন্যতম মূল বৈশিষ্ট্য। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা যখন মানুষের মাঝে বিচারকার্য পরিচালনা করবে তখন ন্যায়পরায়ণতার সাথে করবে।’Ñ সূরা নিসা : ৫৮
ইসলামে হালাল উপায়ে অর্জিত ও ব্যক্তিগত সম্পদের অধিকার স্বীকৃত। তবে এক্ষেত্রে শরিয়ত নির্ধারিত সমস্ত অধিকার ও কর্তব্য পালন করতে হবে। মাতা-পিতা, স্ত্রী-পুত্র-কন্যা, নিকটাত্মীয়ের লালন-পালন ও দায়িত্বভার গ্রহণ করতে হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘ইবাদত করো আল্লাহর, তাঁর সাথে অপর কাউকে শরীক করো না। পিতা-মাতার সাথে সৎ ও সদয় ব্যবহার করো এবং নিকটাত্মীয়, এতিম, মিসকীন, প্রতিবেশী, অসহায় মুসাফির এবং নিজের দাসদাসীর প্রতিও।’Ñ সূরা নিসা : ৩৬
অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করা যাবে না। মহান আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা পরস্পরের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না।’Ñ সূরা বাকারা : ১৮৮
ইসলাম মানুষের বিবেক ও ধর্মবিশ্বাসের স্বাধীনতার স্বীকৃতি দিয়েছে। এটি মানুষের এক বিরাট অধিকার। মানুষ যার যার পছন্দমতো নিজের ধর্মমত ও পথ বেছে নিতে পারে। এ নিয়ে কারো ওপর কোনো কিছু জোর করে চাপিয়ে দেয়া যাবে না। দ্বীনের ব্যাপারে কোনো জবরদস্তি নেই। মহান আল্লাহ বলেন, ‘দ্বীনের ব্যাপারে কোনো জবরদস্তি নেই। সত্য পথ ভ্রান্ত পথ থেকে সুস্পষ্ট হয়ে গেছে।’Ñ সূরা বাকারা : ২৫৬
মহানবী (স.) তাঁর কথা ও কর্মের মাধ্যমে পরিবার, সমাজ ও বিশ্ব পরিম-লে চূড়ান্ত এবং বাস্তবরূপে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে সফল হয়েছেন। বিদায় হজের ভাষণে আল্লাহর রাসূল (সা.) দীপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছেন, ‘হে মানবম-লী! তোমাদের জন্য অপরের জান, মাল, ইজ্জত-আব্রুর উপর হস্তক্ষেপ হারাম করা হলো।’ মানবাধিকারের বিষয়ে এর চেয়ে বড় ঘোষণা আর কী হতে পারে?
ইসলাম ধর্মে শিশু অধিকারের ওপর অপরিসীম গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি সমাজ ও রাষ্ট্রে সুসন্তানের প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়েছে। এ কারণে ভালো ও ধার্মিক সন্তান পেতে হলে কী করা উচিত তা নিয়ে পবিত্র ইসলাম ধর্মে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা রয়েছে। এতে বলা হয়েছে, সুসন্তানের অধিকারী হওয়ার চেষ্টা শুরু করতে হবে বিয়ের আগে থেকেই। একজন নারী ও পুরুষ যদি সুসন্তান পেতে চায় তাহলে তাকে প্রথমেই ভালো ও ধার্মিক জীবনসঙ্গী বেছে নিতে হবে। ইসলামের সব মাজহাবেই এ বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। স্বামী বা স্ত্রী নির্বাচনে সতর্কতার ওপর বারবার গুরুত্ব দেয়ার কারণ হচ্ছে নতুন দম্পতি যাতে পৃথিবীকে সুসন্তান উপহার দিতে পারে। ইসলাম ধর্মে বিয়ের বিধান রাখার অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে, সন্তান জন্মদান। শুধু সন্তান জন্মদানই যথেষ্ট নয়, সেই সন্তানকে সৎ ও ধার্মিক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।
ধর্মীয় দৃষ্টিতে মায়ের গর্ভে ডিম্বাণু নিষিক্ত হওয়ার পর থেকেই সেখানে নতুন প্রাণ সঞ্চারিত হয়। এ কারণে ধর্মে ভ্রূণ সংক্রান্ত নানা দিকনির্দেশনা দেয়া হয়েছে। নবীবংশের অন্যতম সদস্য ইমাম মূসা কাযেম (আ.)-কে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিলÑ কোনো নারী যদি গর্ভপাতের উদ্দেশ্যে ওষুধ খায় এবং গর্ভপাত ঘটায় তাহলে তা গ্রহণযোগ্য কিনা। উত্তরে তিনি বলেছেন, কারোরই এ ধরনের অধিকার নেই। ইমাম বাকের (আ.) এ সংক্রান্ত এক প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, কোনো নারী যদি ইচ্ছাকৃতভাবে গর্ভপাত ঘটায় এবং সেই গর্ভজাত সন্তানের হাড়ের ওপর যদি মাংস গজিয়ে থাকে তাহলে এর জন্য রক্তমূল্য পরিশোধ করতে হবে। স্বামীকে না জানিয়ে এ কাজ করে থাকলে সন্তানের বাবা হিসেবে ওই নারীর স্বামী রক্তমূল্য পাবে। রক্তমূল্যের কোনো অংশই ওই নারীর জন্য প্রযোজ্য হবে না, কারণ, সে হচ্ছে গর্ভের সন্তানের হত্যাকারী। আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.)-ও গর্ভপাতকে মারাত্মক অপরাধ হিসেবে গণ্য করে রক্তমূল্য পরিশোধের কথা বলেছেন।
ইসলাম ধর্মে গর্ভে থাকা অবস্থাতেই একটি মানব সন্তান বিভিন্ন ধরনের অধিকারের আওতায় আসে এবং এ অধিকার লঙ্ঘিত হলে এর জন্য শাস্তির কথা বলা হয়েছে। গর্ভপাতের কারণে রক্তমূল্য পরিশোধের নির্দেশ এ ধরনেরই একটি বিধান। ইসলামি দ-বিধিতে বলা হয়েছে, কোনো গর্ভবতী নারী যদি এমন শাস্তির আওতায় পড়ে যা তার ভ্রূণ বা গর্ভের সন্তানের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে তাহলে ওই নারীর শাস্তি শুরুর সময় পিছিয়ে দিতে হবে। নারী যদি অবৈধভাবে সন্তানের অধিকারী হয়ে থাকে তাহলেও তাকে শাস্তি দেয়া যাবে না। কারণ, অপরাধী হচ্ছে ওই নারী। তার গর্ভে যে মানব সন্তান রয়েছে সে কোনো অপরাধ করে নি। ওই নারীর কারণে সন্তানের ক্ষতি করা যাবে না। কাজেই ইসলাম ধর্মে একটি মানব সন্তান ভ্রূণ অবস্থাতেই আলাদা একজন মানুষ হিসেবে আইনি অধিকার লাভ করে। এই অধিকার এমন যে, গর্ভে ধারণকারী মা নিজেও ওই সন্তানের কোনো ক্ষতি করার অধিকার রাখে না। ঐশী আইন অনুযায়ী গর্ভে অস্তিত্ব লাভ করার পর থেকেই মানব সন্তানের শিশুকাল শুরু হয়।
মানবাধিকারই হচ্ছে ইসলামি আইনের মূল ভিত্তি। ইসলাম শুধু মানুষের মুক্তি ও স্বাধীনতার কথাই ঘোষণা করে নি; বরং মানুষের কর্তব্য ও দায়িত্বের ব্যাপারেও অবহিত করেছে। আল-কুরআন হচ্ছে ফুরকানÑ সত্যাসত্যের পার্থক্যকারী। কুরআন মানুষকে সত্য ও মিথ্যার মাঝে পার্থক্য করতে শেখায়। কুরআন মানুষকে কল্যাণ ও আলোর পথ দেখায়। মানুষের অধিকার আদায়ে সত্যের পক্ষে থেকে পাপাচারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানায়। পশ্চিমা বিশ্ব মানবাধিকারকে ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের মাঝে সীমাবদ্ধ করে রেখেছে। এর বিপরীতে ইসলাম শুধু মানবাধিকারের রূপরেখাই পেশ করে নি, আল্লাহ তাআলার হুকুম এবং রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর তরিকা হিসাবে ঘোষণা দিয়ে তা মানার বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করেছে এবং সেসকল অধিকার পরিপূর্ণভাবে সংরক্ষণ করেছে।
মানবাধিকারের রূপরেখা পেশ করা এবং তার ব্যাখ্যাদানের ক্ষেত্রে ইসলামের এমন কিছু বৈশিষ্ট্য আছে, পৃথিবীর কোনো আইন ও সংবিধান, কোনো ধর্ম ও মতবাদ, কোনো প-িত ও বিজ্ঞজন যা অস্বীকার করতে পারবে না। ইসলাম মানবাধিকারের সীমাকে এত প্রশস্ত করেছে যে, পুরো জীবন এর মাঝে এসে পড়ে। পিতা-মাতার হক, সন্তানের হক, স্বামী-স্ত্রীর হক, নারীর অধিকার, বন্ধু-বান্ধবের হক, শ্রমিক-মালিক এবং শাসক ও জনগণের হক, সরকারের হক, শ্রমজীবী মানুষদের হক, দুর্বল ও অসহায়দের হক, এতিম-মিসকিনের হক, সাধারণ মুসলমানের হক, সাধারণ মানুষের হক ইত্যাদি।
শুধু মানুষেরই নয়, ইসলাম চতুষ্পদ জন্তু ও অবলা প্রাণীর অধিকারও নিশ্চিত করেছে। গভীরভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, বান্দার হক এবং আল্লাহর হক আদায় করার নামই হচ্ছে ইসলাম।
ইসলাম মানুষকে অধিকার আদায়ের চেয়ে অধিকার প্রদানের বিষয়ে বেশি উৎসাহিত করেছে। বর্তমান সমাজের বড় একটি দুর্বলতা হচ্ছে, সমাজের প্রত্যেকেই নিজ নিজ অধিকারের তালিকা হাতে নিয়ে তা আদায়ের স্লোগান দেয়। কিন্তু অন্যদের যেসকল হক তার উপর রয়েছে তা আদায়ের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত। যখন সমাজের প্রতিটি মানুষ নিজের অধিকার আদায়ে ব্যস্ত থাকবে, কিন্তু অন্যের অধিকার প্রদানের ক্ষেত্রে থাকবে গাফেল তখন সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও অস্থিরতা হবে তার অবশ্যম্ভাবী ফলাফল, যা বর্তমান পৃথিবীতে একেবারেই স্পষ্ট। ইসলাম প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে গুরুত্বের সাথে অন্যের হক ও অধিকার আদায়ের অনুভূতি জাগ্রত করে। কারণ, কিয়ামতের দিন এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে।
নারীদের কী কী অধিকার পুরুষের ওপর আছে সে ব্যাপারে ইসলাম পুরুষদের সচেতন করে; কিন্তু নারীদেরকে অধিকার আদায়ের নামে রাস্তায় নামার উস্কানি দেয় না। স্ত্রীদেরকে স্বামীর হকের কথা মনে করিয়ে দেয়; স্বামীকে নিজ হক আদায়ের জন্য প্রতিবাদ করতে বলে না। ইসলাম শ্রমিকের ঘাম শুকিয়ে যাওয়ার আগেই তার পারিশ্রমিক আদায় করে দেয়ার জন্য মালিককে উৎসাহিত করে। শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের জন্য কাজ ছেড়ে রাস্তায় ব্যানার নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে প্ররোচিত করে না। মোটকথা ইসলামে প্রতিটি মানুষকে তার ওপর অন্যের যে হক রয়েছে তা আল্লাহ তাআলার হুকুম মোতাবেক সঠিকভাবে আদায় করছে কি না সে ব্যাপারে সচেতন করে তোলে। এভাবে ইসলাম পুরো দেশ ও সমাজকে শতভাগ অধিকার প্রদানকারী হিসাবে দেখতে চায়। অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে শতভাগ সরব, কিন্তু অধিকার প্রদানের ক্ষেত্রে পুরোপুরি নীরবÑ সমাজের এ দৃশ্য ইসলামের শিক্ষা ও আদর্শের সম্পূর্ণ বিপরীত। বর্তমান সমাজে যে অস্থিরতা, বিশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তাহীনতা দেখা যাচ্ছে তা ইসলামের এ শিক্ষা ও আদর্শ থেকে বিমুখ হওয়ারই ফল।
দায়িত্ব ও অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে ইসলাম শুধুই আইন ব্যবহার করে না; বরং মানুষের হৃদয়ে এমন বোধ ও চেতনা জাগ্রত করে, যা ব্যক্তির মাঝে দায়িত্ব পালনের স্বতঃস্ফূর্ত অনুভূতি সৃষ্টি করে। ফলে শুধু আইনের হাত থেকে বাঁচার জন্য নয়; বরং আল্লাহর সন্তুষ্টির আশা ও অসন্তুষ্টির ভয় এবং কিয়ামতের ময়দানে জবাবদিহিতার হাত থেকে বাঁচার জন্য সে নিজ থেকে সকলের হক ঠিক ঠিকভাবে আদায় করে দেয়।
ইসলাম বলে, দুনিয়াতে কেউ যদি অন্যের কোনো ক্ষতি করে তাহলে কিয়ামতের দিন প্রতিটি অণু-পরমাণুর হিসাব নেয়া হবে; কড়ায় গ-ায় সমস্ত হক শোধ করতে হবে। এমনকি কোনো শিংওয়ালা বকরি যদি শিংবিহীন বকরিকে দুনিয়াতে আঘাত করে থাকে তাহলে কিয়ামতের দিন উভয়কে জীবিত করে শিংবিহীন বকরির বদলা দেয়া হবে। যখন বিবেকহীন প্রাণীদের মাঝে পর্যন্ত ইনসাফ করা হবে, প্রত্যেককে তার ন্যায্য পাওনা বুঝিয়ে দেয়া হবে তাহলে যেসব মানুষ সজ্ঞানে ও জাগ্রত বিবেকে অন্যের হক আত্মসাৎ করেছে তাদের সাথে কিয়মতের দিন কেমন আচরণ হবে?
ইসলাম অমুসলিমদেরকে যথাযথ নিরাপত্ত ও অধিকার, শিক্ষার অধিকার, মান সম্মানের অধিকার, পরিবার গঠনের অধিকারসহ সব রকমের অধিকার নিশ্চিত করেছে। ধর্মীয় অধিকার সম্পর্কে আল-কুরআনে বলা হয়েছেÑ ‘তোমরা তাদেরকে মন্দ বলো না যাদের তারা আরাধনা করে আল্লাহকে ছেড়ে, তাহলে তারা ধৃষ্টতা করে অজ্ঞতাবশত আল্লাহকে মন্দ বলবে।’Ñ সূরা-আনআম : ১০৭। অন্য এক আয়াতে আল্লাহপাক বলেনÑ ‘দ্বীনের ব্যাপারে কোনো জবরদস্তি নেই।’Ñ সূরা বাকারা : ২৫। হযরত মুহাম্মাদ (সা.) অমুসলিমদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। একবার নাজরানের একদল লোক (নাসারা) নবীজির নিকট মেহমান হিসেবে আগমন করে। রাসূল (সা.) মসজিদে নববীতে তাদের থাকার ব্যবস্থা করে দেন, তাদের নিয়মানুযায়ী সেখানে উপাসনা করারও অনুমতি দিয়েছিলেন।
মোটকথা, ইসলাম তার পবিত্র শিক্ষার মাধ্যমে মানবাধিকারকে এ পরিমাণ সংরক্ষণ করেছে যে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে হক্কুল্লাহর তুলনায় হক্কুল ইবাদকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। ইসলাম মুসলমানদের মাঝে এই অনুভূতি সৃষ্টি করতে চায় যে, কারো মনে যেন অন্যের হক নষ্ট করার চিন্তাও না থাকে। ভুলবশত কারো হক নষ্ট হয়ে গেলে তা শোধরানো পর্যন্ত মনে শান্তি না আসে।
লেখক সাংবাদিক ও কলামিস্ট
নারীর হিজাব বা পর্দা : মানবীয় ও মনস্তাত্ত্বিক পর্যালোচনা
শাহনাজ আরফিন
ইসলাম একটি ঐশী ধর্ম, তাই এ ধর্মের চিন্তাধারাগুলো নির্ভুল এবং মানুষের জন্য কল্যাণকামী। ইসলাম মানুষের চারিত্রিক সৌন্দর্য ও নৈতিক সুষমা এবং সামাজিক সুস্থতা রক্ষার জন্য হিজাব বা পর্দার বিধান অবশ্য পালনীয় হিসাবে নির্ধারণ করেছে। ‘পর্দা’ শব্দটি মূলত ফারসি যার আরবি প্রতিশব্দ ‘হিজাব’। পর্দা বা হিজাবের বাংলা অর্থ আবৃত করা, ঢেকে রাখা, আবরণ, আড়াল, অন্তরায়, আচ্ছাদান, বস্ত্রাদি দ্বারা সৌন্দর্য ঢেকে নেয়া, আবৃত করা বা গোপন করা ইত্যাদি।
ইসলামি শরীয়তের পরিভাষায়, নারী-পুরুষ উভয়ের চারিত্রিক পবিত্রতা ও আত্মিক শুদ্ধতা অর্জনের জন্য উভয়ের মাঝে শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারিত যে আড়াল বা আবরণ রয়েছে তাকে পর্দা বলা হয়। আবার অনেকে বলেন, নারীর বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ রূপলাবণ্য ও সৌর্ন্দয পরপুরুষের দৃষ্টি থেকে আড়ালে রাখার যে বিশেষ ব্যবস্থা ইসলাম প্রণয়ন করেছে তাকে পর্দা বা হিজাব বলা হয়।
মূলত হিজাব বা পর্দা শুধু পোশাকের আবরণই নয়, বরং সামগ্রিক একটি সমাজ ব্যবস্থা, যাতে নারী-পুরুষের মধ্যে অপবিত্র ও অবৈধ স¤পর্ক এবং নারীর প্রতি পুরুষের অন্যায় ও অশালীন আচরণ রোধের বিভিন্ন ব্যবস্থা রয়েছে। আধুনিক বিশ্বের বহু চিন্তাবিদ ও মনীষীও সমাজে নারী ও পুরুষের উপস্থিতি ও তাদের ব্যক্তিগত এবং সামাজিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে নারীর পর্দা বা শালীন পোশাকের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন।
অনেকে মনে করেন, পর্দার বিধান শুধু নারীর জন্য। এ ধারণাও ঠিক নয়। পুরুষের জন্যও পর্দা অপরিহার্য। তবে উভয়ের পর্দার ক্ষেত্রে পার্থক্য রয়েছে। যে শ্রেণির জন্য যে পর্দা উপযোগী তাকে ঠিক সেভাবেই পর্দা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
পোশাকের শালীনতা বা পর্দা নারীর ব্যক্তি জীবনে, সমাজ ও রাষ্ট্রে স্বমহিমায় অবস্থান ও অগ্রগতির জন্য উপযুক্ত বিধান। নারী-পুরুষের মাঝে রয়েছে সৃজনগত ও প্রাকৃতিক ভিন্নতা। তা সত্ত্বেও প্রত্যেকে স্ব-স্ব অবস্থান থেকে অনন্য। একজন নারী তার কর্মগুণে হতে পারেন পুরুষর চেয়েও অনেক বেশি মর্যাদাবান। ইসলাম নারীকে অশিক্ষিত, অবরোধবাসিনী হতে বলেনি। হিজাব বা পর্দার বিধান পালন করে নারী নিরাপদে এগিয়ে যেতে পারে জ্ঞান-বিজ্ঞানে, শিক্ষাঙ্গনে, শিল্প ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনসহ সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বস্তরে।
মূলত হিজাব বা পর্দা নারীর সৌন্দর্য ও মর্যাদার প্রতীক। তাঁর সম্মান, মর্যাদা ও শুদ্ধতা রক্ষার হাতিয়ার। নারী-পুরুষ উভয়ের পবিত্রতা রক্ষার অতি সহজ ও কার্যকর উপায় হল ইসলামের পর্দা বা হিজাবের বিধান। এই বিধানের অনুসরণের মাধ্যমেই হৃদয়-মনের শুদ্ধতা ও পবিত্রতা অর্জন করা সম্ভব। পর্দার এই সুফল স্বয়ং আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন। সূরা আহযাবের ৩৩ নম্বর আয়াতে মহান আল্øাহ বলেছেন :
ক্স
‘তোমরা ঘরের ভেতরে অবস্থান করবেÑ প্রথম অজ্ঞতার যুগের মতো নিজেদেরকে প্রদর্শন করবে না।’
সুতরাং মানবসমাজকে পবিত্র ও পঙ্কিলতামুক্ত রাখতে পর্দা-বিধানের কোনো বিকল্প নেই। বিশেষ করে বর্তমান সমাজের যুবক ও তরুণ প্রজন্মকে রক্ষা ও নারীজাতির নিরাপত্তার জন্য পর্দা-বিধানের পূর্ণ অনুসরণ প্রয়োজন। যে কোনো প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিই কুরআন ও সুন্নাহর পর্দা স¤পর্কিত আয়াত ও হাদীস গভীরভাবে অধ্যয়ন করবেন নিঃসন্দেহে তিনিই এই বাস্তবতা স্বীকার করবেন যে, ইসলামে পর্দার বিধানটি অন্যান্য হিকমতের পাশাপাশি নারীর সম্মান ও সমাজের পবিত্রতা রক্ষার জন্যই দেওয়া হয়েছে।
হিজাব বা পর্দা স¤পকে পবিত্র কোরআনের আয়াত ও হাদীসগুলো গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে বোঝা যায়, ইসলামে পর্দার বিধানটি নারীর আত্মিক ও মনস্তাত্ত্বিক দিকের সাথেও পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ।
অধিকাংশ মনোবিজ্ঞানীর মতে, মানুষের বিকাশ বিভিন্ন ধাপে বিভক্ত। মানুষ তার বিকাশের প্রতিটি ধাপেই কিছু চাহিদার বিষয় উপলব্ধি করে। তার এই চাহিদা ও প্রয়োজনীয়তা যদি যথাযথভাবে না মেটে, তাহলে মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং তার মানসিক ও ব্যক্তিত্বের বিকাশ স্তব্ধ হয়ে পারে অর্থাৎ তার মানসিক বিকাশ একটা পর্যায়ে গিয়ে থেমে যায় এবং সেখানেই স্থবির হয়ে পড়ে। যদিও তার বয়স বাড়ে, শারীরিক বিকাশও ঘটে, কিন্তু মানসিক স্থবিরতার ঐ ধাপ সে আর অতিক্রম করতে পারে না, সেখানেই ঘুরপাক খেতে থাকে। এটা ¯পষ্ট যে, ছেলেদের ও মেয়েদের মানসিক বিকাশের এই পর্বে তাদের ব্যবহারে, আচার-আচরণে পর¯পরের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। ছেলেরা এই সময় নিজেদেরকে অন্যদের উপর প্রভাবশালী ভাবতে থাকে এবং সে অনুযায়ী তারা উগ্র এবং অশালীন আচরণও করে। কিন্তু মেয়েরা ঠিক ছেলেদের বিপরীতে আরও বেশি আকর্ষণীয় হয়ে উঠে। তাদের প্রতি অন্যদের আকর্ষণও বৃদ্ধি পেতে থাকে। আকর্ষণীয় পোশাক পরা, সাজগোজ করা ইত্যাদি প্রবণতা মেয়েদের এ বয়সের বৈশিষ্ট্য। মনোবিজ্ঞানীদের মতে এই সময় যেসব মেয়ের বিকাশ রুদ্ধ হয়ে যায় তারা আসলে এক ধরনের ব্যাধিতে ভোগে যা তাদের উন্নতির পথরোধ করে দাঁড়ায়। ইসলাম নারীদের মেধা ও শক্তিকে নষ্ট হবার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য এবং তাদেরকে কেবল আত্মসজ্জার মধ্যে মগ্ন না থেকে মানবীয় পূর্ণতা অর্জনের দিকে আহ্বান জানায়। ইসলামের নির্দেশিত শালীন পোশাক পরিধান, নারীর এ মর্যাদা রক্ষার উপযুক্ত মাধ্যম।
ইরানের বিশিষ্ট লেখক ও মনোবিজ্ঞানী ডাক্তার শাহরিয়ার রূহানী বলেছেন, নারীর প্রতি কোনো কোনো পুরুষের আধিপত্য বিস্তারের ঘটনা এবং কোনো কোনো নারীর সাজগোজের ব্যাপক ঝোঁক তাদের মানসিক বিকাশের পথ রুদ্ধ হবারই প্রমাণ। তবে স্বামীর জন্য স্ত্রীর সাজগোজের ব্যাপারটি ইতিবাচক ও পছন্দনীয়। কেননা, এর মাধ্যমে পরিবারে শান্তি ও সৌহার্দের ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী এ স¤পর্কে বলেছেন, ‘নারীর সাজসজ্জা যদি কেবল স্বামীর জন্য হয় এবং সে নিজেকে যদি কেবল স্বামীর জন্যই সাজায় তাহলে তাতে একদিকে যেমন সাজগোজের নিজস্ব স্বাভাবিক ইচ্ছাও মিটল অপরদিকে স্বামীকেও অন্য কারো প্রতি আকৃষ্ট হবার প্রবণতা থেকে রক্ষা করল…।’
আধুনিক বিশ্বের অনেকেই মনে করেন, সমাজে মেয়েদের উপস্থিতির জন্য হিজাবের কোনো প্রয়োজন নেই। আবার অনেকে বলেন, হিজাব নারীর উপর অন্যায় ও বৈষম্যের নামান্তর। এ ধারণাগুলোর সমাধান খোঁজার জন্য প্রথমেই আমাদের দেখতে হবে কেন নারীরা যুগে যুগে পর্দা ও হিজাবের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন।
ডাক্তার শাহরিয়ার রূহানী এ স¤পর্কে বলেছেন, ‘নারী-পুরুষের পোশাকের পার্থক্য থেকে অনেকেই নারীর উপর পুরুষের শ্রেষ্ঠত্ব খোঁজার চেষ্টা করেন, অনেকে আবার নারী-পুরুষের অধিকারে বৈষম্য খোঁজেন কেউবা আবার মনে করেন এটা নারীর বন্দিত্ব ও তুচ্ছতার শামিল। তারা এ বাস্তবতার ব্যপারে উদাসীন যে, ছেলে এবং মেয়ের বেড়ে উঠা এবং তাদের মানসিক বিকাশের পথ স¤পূর্ণ আলাদা। আর নারীদের জন্য উপযুক্ত হিজাব তাদের মানসিক পরিপক্বতার সাথে জড়িত এবং মানুষের মনস্তত্ত্বের গভীরে এর শেকড় প্রথিত।’
নারীর মনস্তাত্ত্বিক দিক নিয়ে যারা গবেষণা করেছেন, তাঁদের মতে নারীরা সৃষ্টিগতভাবে তাঁদের সতীত্ব ও পবিত্রতা রক্ষার ব্যাপারে আগ্রহী। পর্দার বিধান নারীকে তাঁর এ সহজাত প্রকৃতি অনুযায়ী চলতে সাহায্য করে।
এ প্রসঙ্গে মহান স্রষ্টা বলেন :
‘যখন তোমরা তাদের নিকট কিছু চাইবে তখন পর্দার আড়াল থেকে চাইবে।এ বিধান তোমাদের ও তাদের অন্তরের জন্য অধিকতর পবিত্রতার কারণ।’Ñ সূরা আহযাব : ৫৩
নারীর অপরাপর সহজাত গুণ বা বৈশিষ্ট্যের মধ্যে লজ্জাশীলতা, শালীনতা, সংবেদনশীলতা ইত্যাদি অন্যতম।
আর এ জন্যই নারীর শালীন পোশাক তথা পর্দার গুরুত্ব স¤পর্কে স্বয়ং আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআন মজীদে ঘোষণা করেছেন :
ক্স
‘হে নবী! আপনি আপনার স্ত্রী, কন্যা ও মুমিন নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের জিলবাবের একাংশ নিজেদের উপর টেনে দেয়। এতে তাদেরকে চেনা সহজ হবে। ফলে তাদেরকে উত্যক্ত করা হবে না। আর আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’Ñ সূরা আহযাব : ৫৯
এ আয়াতে শালীন পোশাক পরে চলাফেরা করার উপর গুরুত্বারোপ করে বলা হয়েছে যে, পর্দার বিধান মেনে চলাফেরা করলে নারীর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত হয়। ফলে পর্দানশীন নারীকে কেউ হেয় ও উত্যক্ত করার সাহস করে না। অন্যদিকে যারা পর্দাহীনভাবে চলাফেরা করে অধিকাংশ সময় তারাই ইভটিজিং সহ নানা রকমের নির্যাতনের সম্মুখীন হয়।
এছাড়াও পর্দা-বিধান স¤পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করলে আমরা উপলব্ধি করতে পারি যে, এ বিধানের পূর্ণ অনুসরণের মাধ্যমে নারী ও পুরুষের নৈতিক চরিত্রের হিফাযত হয়। পারিবারিক ব্যবস্থা সুরক্ষিত ও সুদৃঢ় হয়।
পর্দা পালনের কারণে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে পরকিয়াবিহীন পবিত্র জীবন গঠিত হয় এবং চরিত্রহীনতা ও অবিশ্বাস তাদের থেকে বিদায় নেয়।
পর্দাহীনতার কারণে আজ বিভিন্ন দেশে আত্মপ্রদর্শনীর সংস্কৃতি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রায় প্রতিটি সমাজে পরকিয়া, চরিত্রহীনতা, অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, নির্লজ্জতা, অপকর্ম ও ব্যভিচারের মতো নিকৃষ্ট ব্যাধির সংক্রমণ ব্যপক হারে বাড়ছে। পশ্চিমা অনেক দেশেই নারীকে পণ্যের মতো দেখা হয়। আর তাই সেখানে নারীর উপর নির্যাতন ও যৌন সন্ত্রাস প্রকট আকার ধারণ করেছে। যার বাস্তব চিত্র প্রতিদিনের খবরাখবর ও সংবাদপত্র খুললেই চোখে পড়ে।
এরই আলোকে বলা যায় যে, নারীদের জন্য হিজাবের বিধানটি তাঁদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা তথা সমাজকে অবক্ষয়ের হাত থেকে রক্ষা করার অন্যতম হাতিয়ার। এটি ইসলামের একটি মহা গুরুত্বপূর্ণ আধ্যাত্মিক ও মানবীয় অবদান, যা শুধু ধর্মীয় অনুভূতি নয়, বরং বিশ্বমানবের জাতীয় সত্তার রক্ষকও বটে ।
লেখক ও গবেষক
আত্মত্যাগের ঈদ – ঈদুল আযহা
মো. আশিফুর রহমান
প্রতি বছর বিশ্বের মুসলিম জনসাধারণ বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা ও ধর্মীয় ভাবগাম্বীর্যের সাথে দুটি বড় উৎসব পালন করে থাকেন। এর একটি ঈদুল ফিত্্রÑ যা পবিত্র রমযান মাস শেষে ১লা শাওয়াল উদ্যাপন করা হয়। আর অন্যটি ঈদুল আযহাÑ যা উদ্যাপন করা হয় ১০ থেকে ১২ যিলহজ। ঈদুল আযহা আমাদের কাছে কোরবানির ঈদ বলেও পরিচিত।
কোরবানি ইসলাম ধর্মের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। কোরবানি একটি আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ হলো ত্যাগ, উৎসর্গ, নিকটবর্তী হওয়া ইত্যাদি। শরীয়তের পরিভাষায় আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের আশায় নির্দিষ্ট কয়েকটি দিনে নির্দিষ্ট কিছু হালাল পশু জবাই করাকে কোরবানি বলা হয়।
প্রথম কোরবানি
হযরত আদম (আ.)-এর সময় থেকেই আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে পশু কোরবানি করার প্রচলন চলে এসেছে। মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআন মজীদে বলেন,
ক্স
(হে রাসূল!) তুমি তাদের নিকট আদমের দুই পুত্রের সত্য বড় ঘটনা বর্ণনা কর, যখন তারা উভয়ে (আল্লাহর) নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে কোরবানি করল এবং তাদের একজন থেকে কোরবানি গৃহীত হয়েছিল, আর অপরজন থেকে গৃহীত হয়নি; সে (দ্বিতীয়জন) বলল : ‘আমি অবশ্যই তোমাকে হত্যা করব’, সে (প্রথমজন) বলল : ‘(আমি তো কোনো অপরাধ করিনি) আল্লাহ তো কেবল আত্মসংযমীদের থেকে গ্রহণ করে থাকেন।’Ñ সূরা মায়েদা : ২৭
আদম (আ.)-এর এক সন্তান হাবিল অত্যন্ত আগ্রহ সহকারে আল্লাহর নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভের আশায় একটি দুম্বা কোরবানি করেছিলেন এবং এই কোরবানি আল্লাহর দরবারে কবুল হয়। পক্ষান্তরে অন্য সন্তান কাবিল নির্লিপ্তভাবে কিছু খাদ্যশস্য কোরবানি হিসেবে পেশ করেছিল। ফলে তা কবুল হয় নি।
প্রত্যেক উম্মতের জন্য কোরবানি
মানব জাতির শুরু থেকেই প্রত্যেক উম্মতের ইবাদতে কোরবানি একটি অপরিহার্য অংশ হিসেবে বিবেচিত ছিল। আল্লাহ তাআলা কোরআনে বলছেন,
ক্স
‘আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্য কোরবানি নির্ধারণ করেছি, যাতে তারা আল্লাহর দেয়া চতুস্পদ জন্তু যবেহ করার সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে।’Ñ সূরা হাজ : ৩৪
মুসলিম মিল্লাতের কোরবানি
বর্তমানে মুসলিম সমাজে কোরবানির যে প্রচলন তা মূলত মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর আত্মত্যাগের স্মরণ। প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে আল্লাহর নবী হযরত ইবরাহীম (আ.) ও তাঁর ছেলে হযরত ইসমাইল (আ.) কোরবানির নিমিত্তে অনন্য ত্যাগের আদর্শ স্থাপন করে গেছেন মানব ইতিহাসে। হযরত ইবরাহীম (আ.) আল্লাহ তাআলার নির্দেশে শিশুপুত্র ইসমাইলকে কোরবানি দিতে চেয়েছিলেন। মহান আল্লাহ হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর পরম আনুগত্য ও সঙ্কল্পের দৃঢ়তা দেখে তাঁর কোরবানি কবুল করে নেন এবং হযরত ইসমাইল (আ.)-এর স্থলে একটি দুম্বা কোরবানি মঞ্জুর করেন।
এ বিষয়টি পবিত্র কোরআনে এভাবে এসেছেÑ
সুতরাং আমি তাকে এক ধৈর্যশীল পুত্রের সুসংবাদ দান করলাম। অতঃপর সে যখন তার পিতার সাথে শ্রম দেওয়ার উপযুক্ত হলো তখন সে (ইবরাহীম) বলল : ‘হে বৎস! নিশ্চয়ই আমি স্বপ্ন দেখছি যে, তোমাকে আমি যবেহ করছি, এখন তুমি দেখ, তোমার অভিমত কী?’ সে বলল : ‘হে পিতা! আপনি যা আদিষ্ট হয়েছেন তার ওপর কর্মরত হোন; আল্লাহ ইচ্ছা করলে অচিরেই আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন।’ অতঃপর যখন উভয়ে (আদেশ) শিরোধার্য করল এবং সে (পিতা) তাকে (পুত্রকে) কপালের ওপর উপুড় করে শায়িত করল তখন আমরা তাকে আহ্বান করে বললাম : ‘হে ইবরাহীম! নিঃসন্দেহে তুমি তোমার স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করেছ; এরূপে আমরা পুণ্যকর্মশীলদের প্রতিদান দিয়ে থাকি। নিশ্চয় এটা (তোমার জন্য) প্রকাশ্য পরীক্ষা ছিল’; এবং আমি এর পরিবর্তনস্বরূপ এক মহাকোরবানিকে সাব্যস্ত করেছি, এবং তার স্মরণকে পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে বিদ্যমান রেখেছি। ইবরাহীমের ওপর শান্তি বর্ষিত হোক। এরূপেই আমরা পুণ্যকর্মশীলদের প্রতিদান দিয়ে থাকি।Ñ সূরা সাফফাত : ১০১-১১০
কোরবানির গুরুত্ব ও ফযিলত
মুসলমানরা প্রতি বছর পশু কোরবানি করার মাধ্যমে প্রতীকিভাবে নিজেদের মধ্যকার পাশবিকতাকে ত্যাগ করার খুশিকে উদ্যাপন করেন। তাঁরা কুপ্রবৃত্তিকে বিসর্জন করার মহড়া দিয়ে থাকেন। আল্লাহর রাস্তায় সকল কিছুকে বিলিয়ে দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি ঘোষণা করেন।
কোরবানি মানুষের ঈমান ও তাকওয়া বৃদ্ধি করে ও পরকালের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করে। একারণেই মহান আল্লাহ বলেন যে, তাঁর কাছে কেবল তাকওয়া পৌঁছে। (সূরা হজ : ৩২)
মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে মহানবী (সা.)-কে নির্দেশ দিচ্ছেন,
‘অতএব, আপনি আপনার পালনকর্তার উদ্দেশে নামায পড়ুন এবং কোরবানি করুন।’Ñ সূরা কাউসার, আয়াত ২
মহানবী (সা.) মদিনার জীবনে সবসময় কোরবানি করেছেন এবং কোরবানি করার জন্য তাঁর সাহাবিদেরকে নানাভাবে উৎসাহিত করেছেন। তিনি কোরবানিদাতার জন্য মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে সীমাহীন সওয়াব দানের কথা ব্যক্ত করেছেন।
হযরত যায়েদ ইবনে আরকাম (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, কতিপয় সাহাবা রাসূল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (সা.)! কোরবানি কী?’ রাসূল (সা.) বললেন, ‘কোরবানি মুসলিম মিল্লাতের পিতা ইবরাহীম (আ.)-এর সুন্নাত।’ তাঁরা আবারও প্রশ্ন করলেন, ‘এর মধ্যে আমাদের জন্য কী আছে?’ রাসূল (সা.) বললেন, ‘কোরবানির পশুর প্রতিটি পশমের বিনিময়ে একটি করে নেকী আছে।’ তাঁরা বললেন, ‘ভেড়ার তো অসংখ্য পশম আছে।’ রাসূল (সা.) বললেন, ‘ভেড়ার প্রতিটি পশমের বিনিময়ে একটি করে নেকী দেওয়া হবে, যদি তা খালেস নিয়তে কোরবানি করা হয়।’Ñ ইবনে মাযাহ
কোরবানিদাতা কোরবানির পশু জবাই করার সময় কোরআনের নিম্নোক্ত আয়াতটি পাঠ করে থাকেনÑ
ক্স
‘আমার সালাত, আমার কোরবানি, আমার জীবন, আমার মরণ বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহ তাআলার জন্য নিবেদিত’।Ñ সূরা আনআম : ১৬২
এ থেকে বোঝা যায়, কেবল মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কোরবানি দিলে এবং নিজ সত্তার মধ্যকার কলুষতা, আমিত্ব ও অহংকারকে বিসর্জন দিতে পারলেই তা মহান আল্লাহর দরবারে কবুল হবে। এরূপ কোরবানি সম্পর্কেই মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘কোরবানির পশুর রক্ত জবাই করার সময় মাটিতে পড়ার আগেই তা আল্লাহর দরবারে কবুল হয়ে যায়।’Ñ মেশকাত
কোরবানির শিক্ষা
মহান আল্লাহর নিরঙ্কুশ আনুগত্য ও তাঁর কারণে সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ করাই কোরবানির শিক্ষা। ত্যাগের অনুপম বার্তা নিয়েই প্রতি বছর ঈদ আমাদের মাঝে উপস্থিত হয়। মুমিন বান্দা পশু কোরবানি দিয়ে আল্লাহ তাআলাকে বেশি বেশি স্মরণ করেন এবং এর মাধ্যমে আল্লাহর সামনে আত্মসমর্পণের স্পৃহা জাগ্রত হয়।
হযরত ইবরাহীম ও হযরত ইসমাইল (আ.)-এর ঘটনা থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, ইবরাহীম (আ.)-এর কাছে সবচেয়ে প্রিয় ছিলেন হযরত ইসমাইল (আ.)। আর তাঁকেই কোরবানি করার জন্য আল্লাহ তাআলা ইবরাহীম (আ.)-কে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। তাই আমাদেরও উচিত নিজেদের সবচেয়ে প্রিয় বস্তুকে আল্লাহর রাস্তায় কোরবানি করা। যেহেতু সকল মানুষ একই মানসিকতার অধিকারী নয় সেহেতু তাদের সকলের কাছে যে একই বস্তু প্রিয় হবে এমনটি কখনই নয়। বরং একেক জনের কাছে একেক জিনিস প্রিয় হতে পারে। কেউ হয়তো নিজেকে ছাড়া অন্য কিছু নিয়ে চিন্তিত নয়, কারো কাছে হয়তো তার পরিবার-পরিজন সবচেয়ে প্রিয়, আবার কারো কাছে হয়তো তার ধন-সম্পদ, সামাজিক অবস্থান, খ্যাতি ইত্যাদি সবচেয়ে প্রিয় হতে পারে। যেটিই মানুষের কাছে প্রিয় হবে সেটিকেই কোরবানি দেওয়ার মানসিকতা তার থাকতে হবে।
এক্ষেত্রে হজ পালনকালে কোরবানি করা প্রসঙ্গে প্রখ্যাত ইসলামি চিন্তাবিদ ড. আলী শরীয়তির একটি বক্তব্যের প্রতি আলোকপাত করা যেতে পারে। তিনি বলেন, ‘ইবরাহীমের মতো আপনার ইসমাইলকেও আপনার বুঝে চিনে নিতে হবে। অতঃপর তাকে নিয়ে আসতে হবে মিনায়। কোন্টি আপনার ইসমাইল? আপনাকেই চিনতে হবে, অন্যদের তা চেনার প্রয়োজন নেই। হয়তো আপনার স্ত্রী (স্বামী), চাকুরি, মেধা, যৌনতা, ক্ষমতা-প্রতিপত্তি, পদমর্যাদা ইত্যাদি এক বা একাধিক যে কোনোটি। আমি জানি না, এর মধ্যে কোন্টি আপনার ইসমাইল, কিন্তু যেটিকে আপনার ইসমাইলসম প্রিয় ও অচ্ছেদ্য বলে মনে হবে, যেমন ইবরাহীমের মনে হয়েছিল, সেটিই হয়তো আপনার ইসমাইল। যা আপনার দায়িত্ব-কর্তব্য পালনে বাধা দেয়, আপনার স্বাধীনতা কেড়ে নেয়, যা আপনাকে আমোদিত-বিহ্বল করে রাখে, সত্যকে চিনতে ও জানতে বাধা দেয়, বাধা দেয় সত্যের আহ্বান আপনার কাছে পৌঁছাতে, যা আপনাকে দায়িত্ব গ্রহণ না করে নানা অজুহাত-ছলছুতা দাঁড় করাতে প্ররোচিত করে এবং (ঐ ব্যক্তি যে) ভবিষ্যতে আপনার কাছে কিছু পাবে বলে এখন আপনাকে সাহায্য করেÑ এসবের সবগুলো বা যে কোনো একটিই আপনার ইসমাইল। আপনাকে নিজের জীবনের এই ইসমাইলকে খুঁজে বের করতে হবে, চিহ্নিত করতে হবে। যদি আপনি আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নৈকট্য পেতে আশা করে থাকেন তাহলে ইসমাইলকে এই মিনায় কোরবানি করে যেতে হবে।’Ñ হজ্জ আমাদের কি শেখায়, পৃ. ৯৭
কোরবানি কবুল হওয়ার শর্ত
কোরবানি কবুল হওয়ার জন্য কিছু শর্ত রয়েছে। আমাদের উচিত সে বিষয়ে সাবধানতা অবলম্বন করা ও সচেতন হওয়া। প্রথম শর্তই হচ্ছে, কোরবানি কেবলই মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে হতে হবে। যদি রিয়া বা লোকদেখানোর উদ্দেশ্য এর মধ্যে থাকে তবে কখনই এমন কোরবানি কবুল হবে না। কেননা, লোকদেখানো ইবাদত র্শ্িেক পর্যবসিত হয়। অনেক সময় মানুষ বেশি দামে বড় বড় পশু কোরবানি করার মাধ্যমে সমাজে সুনাম অর্জন করতে চায়। অথবা অপরের সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে অধিক সংখ্যক কোরবানি করে থাকে। এরূপ কর্ম ইসলামের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণরূপে অবৈধ।
দ্বিতীয় শর্ত হচ্ছে, কোরবানি হতে হবে হালাল উপার্জন থেকে। যদি হারাম উপার্জন থেকে কোরবানি দেওয়া হয় তবে এটি গ্রহণযোগ্য হবে না।
আরেকটি বিষয় হলো, আল্লাহপাকের দরবারে আমাদের কোরবানি তখনই কবুল হবে, যখন আমরা পশু কোরবানির সাথে সাথে মনের পশুকেও কোরবানি করতে পারব। অর্থাৎ যাবতীয় পাপ ও হারাম কাজ থেকে বিরত থাকতে পারব এবং হিংসা, দ্বেষ, ঘৃণা, পরশ্রীকাতরতা, অহমিকা, স্বার্থপরতা, ভোগবাদী প্রবণতা ইত্যাদি কুপ্রবৃত্তিকে কোরবানি দিতে পারব। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এ কথাটিই তাঁর কবিতায় তুলে ধরেছেনÑ
‘মনের মাঝে পশু যে তোর
আজকে তারে কর জবেহ,
পুল সেরাতের পুল হতে পার
নিয়ে রাখ আগাম রশিদ।’Ñ ঈদজ্জোহার চাঁদ হাসে ঐ
যদি এ বিষয়গুলো হতে আমরা মুক্ত হতে না পারি তবে পশু কোরবানি আমাদের জন্য কোনো উপকার বয়ে আনবে না। আর এজন্যই দেখা যায়, অনেক কোরবানিদাতা একদিকে যেমন ইসলামের অবশ্যকরণীয় বিষয়গুলো থেকে দূরে থাকছেন, অন্যদিকে অবৈধ কর্মকা-ের সাথে জড়িয়ে পড়েছেন। এতে বোঝা যায়, কোরবানিদাতা কোরবানির প্রকৃত শিক্ষাকে ধারণ করতে পারেন নি। অথচ কোরবানির মাধ্যমে কে কতটুকু আত্মত্যাগ করছে, নিজের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করছে এবং ধর্মীয় নির্দেশ মান্য করছে মহান আল্লাহ তা প্রত্যক্ষ করেন। আর আল্লাহর কাছে কেবল মানুষের তাকওয়া পৌঁছায়, কোরবানিকৃত পশুর রক্ত, মাংস কিছুই পৌঁছে না। আল্লাহ তাআলা বলেন,
‘আল্লাহর নিকট কখনই না সেগুলোর মাংস পৌঁছায়, আর না সেগুলোর রক্ত, তবে তাঁর নিকট তোমাদের তাকওয়া পৌঁছায়।’Ñ সূরা হাজ : ৩৭
কোরবানির আনন্দের ভাগাভাগি
আনন্দকে বিলিয়ে দিতে হয়। কোরবানির আনন্দকে ছড়িয়ে দেওয়া না হলে সেটি প্রকৃত আনন্দ থাকে না। এজন্যই সকলকে এ আনন্দে শরীক করার কথা হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। হাদিসের বর্ণনা অনুযায়ী, কোরবানির পশুর মাংসগুলো তিন ভাগ করে এক ভাগ নিজের জন্য রেখে এক ভাগ আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে বণ্টন এবং অন্য ভাগ গরিবদের জন্য দান করতে হয়। এভাবে কোরবানির আনন্দকে সকলের সাথে ভাগ করে নেওয়া হয়। ধনী-গরিব নির্বিশেষে সকলে আনন্দে শরীক হয়। এ আনন্দ ভাগাভাগি করার মাধ্যমে পরস্পরের সাথে হৃদ্যতার সম্পর্ক তৈরি হয়, সৌভ্রাতৃত্বের বন্ধন দৃঢ় হয়, মানবিকতার দিকটির চর্চা হয়। যদিও এর ব্যতিক্রম হিসেবে ভোগবাদী প্রবণতার মানুষের অস্তিত্বও সমাজে পরিলক্ষিত হয়Ñ যারা নিজেদের উদরপূর্তি ছাড়া আর কিছু ভাবে না, সমাজের হত-দরিদ্র শ্রেণির মানুষের কথা যাদের চিন্তায়ও আসে না তাদের কোরবানি দেওয়া ও না-দেওয়ার মধ্যে কোনো পার্থক্যই নেই।
উপসংহার
কোরবানির উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর প্রতি ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে নিজের সবচেয়ে প্রিয় বস্তু মনে করে প্রতীকী অর্থে পশু কোরবানি করা। এ ধর্মীয় উৎসবে তাই ত্যাগের মহিমা বিজড়িত। কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ‘বকরীদ’ কবিতায় ত্যাগের প্রসঙ্গ টেনে বলেনÑ
ইব্রাহিমের কাহিনি শুনেছ? ইসমাইলের ত্যাগ?
আল্লারে পাবে মনে কর কোরবানি দিয়ে গরু ছাগ?
আল্লার নামে, ধর্মের নামে, মানব জাতির লাগি
পুত্রেরে কোরবানি দিতে পারে, আছে কেউ হেন ত্যাগী?
আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে হলে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারের মানসিকতা কোরবানির মাধ্যমে আমরা পেতে পারি। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন,
ক্স
‘কস্মিণকালেও কল্যাণ লাভ করতে পারবে না, যদি তোমাদের প্রিয় বস্তু থেকে তোমরা ব্যয় না কর। আর তোমরা যদি কিছু ব্যয় কর আল্লাহ তা জানেন।’Ñ সূরা আলে ইমরান : ৯২
মহান আল্লাহর পথে শুধু প্রিয় বস্তু নয়; বরং সর্বস্ব কোরবানি করার সর্বোৎকৃষ্ট নমুনা হলেন বেহেশতের যুবকদের নেতা ইমাম হোসাইন (আ.)। যখন আমীরে মুয়াবিয়া তাঁর অযোগ্য পুত্র ইয়াযীদকে মুসলিম বিশ্বের খলিফা মনোনীত করেন এবং তাঁর মৃত্যুর পর ইয়াযীদ খলিফার পদে আসীন হয় তখন সে একের পর এক ইসলামের বিধান লঙ্ঘন করা শুরু করে। হালালকে হারাম এবং হারামকে হালাল ঘোষণা দিতে থাকে। সে ইসলামকে ধ্বংসের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। এ অবস্থায় ইসলামকে টিকিয়ে রাখতে ইমাম হোসাইন (আ.) নিজের পরিবার-পরিজন, বন্ধু-বান্ধব ও সঙ্গীদেরকে সাথে নিয়ে আল্লাহর রাস্তায় কোরবানির সুমহান ও অতুলনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। এটিই প্রকৃত কোরবানি। যখনই প্রয়োজন হবে তখনই আল্লাহর রাস্তায় সকল কিছু উৎসর্গ করার মনোবৃত্তি না থাকলে কোরবানি নিছকই আনুষ্ঠানিকতায় পর্যবসিত হবে, এ থেকে আমরা কোনো কল্যাণই লাভ করতে সক্ষম হব না।
বস্তুতপক্ষে ভোগের মধ্যে সুখ খুঁজে পাওয়া যায় না; বরং ত্যাগের মধ্যেই রয়েছে প্রকৃত সুখ। নিছক ধর্মীয় অনুশাসন পালন বা লোকদেখানো আয়োজন বা প্রতিযোগিতার মনোবৃত্তি যেন আমাদেরকে কোরবানির প্রকৃত শিক্ষা থেকে দূরে সরিয়ে না নেয় সেটিই হোক আমাদের একান্ত কামনা।
ইমাম আলী ইবনে মূসা আর-রেযা (আ.)
মো. আশিফুর রহমান –
ইমাম আলী ইবনে মূসা আর-রেযা (আ.) মহানবী (সা.)-এর বংশধারার অস্টম ইমাম। ইমাম রেযা (আ.) ১৪৮ হিজরিতে ১১ যিলকদে পবিত্র মদীনায় জন্মগ্রহণ করেন। তবে তাঁর জন্মের সন ও মাস সম্পর্কে মতপার্থক্য রয়েছে। তাঁর পিতা ছিলেন ইমাম মূসা কাযিম (আ.)। তাঁর মায়ের নাম ছিল নাজমা। এ মহান ইমামের নাম ‘আলী’ এবং আহলে সুন্নাতের দৃষ্টিতে তিনি মহানবী (সা.) এর আহলে বাইতবর্গের মধ্যে তৃতীয় ব্যক্তি, যার নাম ইমাম আলী (আ.) ও ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.) এর পরে ‘আলী’ রাখা হয়।
ইমাম রেযা (আ.) ৩৫ বছর বয়সে ইমামতের দায়িত্ব লাভ করেন। ইমাম কাযেম (আ.) তাঁর ইমামতের ব্যাপারে তাঁর শিষ্যদেরকে জানিয়ে যান। তাঁর জীবনকালে আব্বাসি খলিফারা শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল। তিনি এসময় কঠিন দুর্ভোগের মধ্যে জীবন অতিবাহিত করেন। মার্ভে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ইমাম রেযা (আ.) মদিনাতেই বসবাস করতেন। তিনি সেখানে মানুষকে হেদায়াত করা ও ইসলামি শিক্ষা প্রচারে নিয়োজিত ছিলেন। মদিনার লোকজন ইমামকে খুবই শ্রদ্ধা করত ও ভালোবাসত। পুরো ইসলামি বিশে^ই তাঁর অনেক অনুসারী ছিল।
কুনিয়াত ও পদবি
ইমাম রেযা (আ.)-এর নাম ছিল আলী, কুনিয়াত ছিল আবুল হাসান। তাঁর বিখ্যাত সম্মানসূচক উপাধি ছিল রেযা যার অর্থ সন্তুষ্টি। তাঁর সন্তান ইমাম মুহাম্মাদ আত-তাকী (আ.) বলেন, মহিমান্বিত ও সর্বশক্তিমান প্রভু তাঁর নাম রাখেন রেযা। কারণ, আল্লাহ তাঁর প্রতি বেহেশতে সন্তুষ্ট এবং আল্লাহর নবী (সা.), পবিত্র ইমামগণ তাঁর ওপর সন্তুষ্ট এবং তাঁর নেতৃত্বের প্রতি সন্তুষ্ট। তাঁর বন্ধু-বান্ধব এবং আত্মীয়-স্বজন এমনকি তাঁর শত্রুরাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট তাঁর উন্নত নৈতিক চরিত্রের কারণে।
তাঁর অন্যতম প্রধান উপাধি ছিল ‘আলিমে আলে মুহাম্মাদ’ অর্থাৎ মুহাম্মাদের বংশের জ্ঞানী ব্যক্তি। এই উপাধি দেখায় যে, তাঁর জ্ঞান ও বিজ্ঞানের বিষয়টি প্রকাশ করে। সমসাময়িক বিজ্ঞানীদের সাথে তাঁর বিতর্ক, বিশেষ করে বিভিন্ন ধর্মের প-িতদের সাথে বির্তক এই বিষয়ের সত্যতাকে প্রকাশ করে।
রাজনৈতিক পরিস্থিতি
ইমাম রেযা (আ.)-এর ইমামতকাল ছিল ২০ বছর যেটিকে তিনটি শাসনকালে বিভক্ত করা যায় :
১. হারুনুর রশিদের খেলাফতকালের দশ বছর
২. আমিনের খেলাফতকালের পাঁচ বছর
৩. মামুনের খেলাফতকালের পাঁচ বছর
প্রথম দশ বছরের শুরুর দিকে ইমাম মূসা কাযেম (আ.)-কে শহীদ করা হয় এবং ইমাম আলী (আ.)-এর বংশধররা নির্যাতন ও দুঃখ-কষ্টের মধ্যে দিন অতিবাহিত করেন। হারুনুর রশিদ রেযা (আ.)-কে হত্যা করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সেই সুযোগ করে উঠতে পারেন নি। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর বড় ছেলে আমিন খলিফা হন। এই সময়ে হারুনের মৃত্যুর কারণে সরকার দুর্বল হয়ে পড়েছিল। আমিন দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়ায় তিনি বা তাঁর গভর্নররা ইমামের দিকে লক্ষ্য দিতে পারেন নি। তাই এ সময়টি ইমাম ও ইমামের অনুসারীরা মোটামুটি নির্বিঘেœ দিন কাটান।
অবশেষে মামুন তাঁর ভাই আমিনকে হত্যা করে খলিফা হন। তিনি তাঁর বিদ্রোহীদেরকে কঠোর হস্তে দমন করে ইসলামি ভূখ-ের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেন। তিনি তাঁর একজন প্রতিনিধিকে ইরাকের দায়িত্ব দিয়ে নিজে মারভে স্থিত হন। তিনি ফযল ইবনে সাহল নামের একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদকে তাঁর মন্ত্রী ও উপদেষ্টা নিয়োগ করেন। আলী বংশীয়রা মামুনের রাজত্বের জন্য বড় হুমকিস্বরূপ ছিল। অনেক দিন নির্যাতন ভোগের পর তারা শাসনক্ষমতার মধ্যে ভাঙ্গন ধরানোর সুযোগ পায়। যে কোনো প্রকাশ্য বা গোপন সুযোগ আসলেই তারা মামুনের বিরোধিতা করত এবং আব্বাসী খেলাফতের পতন ঘটানোর চেষ্টা করত। উপরন্তু তারা সাধারণ জনগণকে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয় এবং মুসলমানদের সমর্থন লাভ করে। তাই যখনই আলাভীরা আব্বাসীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করত তখন সমাজের প্রতিটি শ্রেণি থেকে লোকদের সমর্থন পেত, বিশেষ করে আহলে বাইতের অনুসারীদের নিকট থেকেÑ যারা আব্বাসী খেলাফতের পক্ষ থেকে কঠিন নির্যাতনের শিকার হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে আব্বাসী ও উমাইয়্যারা সবসময় ইমামদেরকে তাদের খেলাফতের জন্য হুমকি মনে করত যাঁরা জনসাধারণের কাছে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সত্যিকার উত্তরসূরি বলে পরিচিত ছিলেন। তাই ইমামগণ সবসময়ই ক্ষমতাশীন খলিফাদের দ্বারা নির্যাতিত হয়েছেন।
মামুন তাদের সাথে সরাসরি দ্বন্দ্বে লিপ্ত হতে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি চাচ্ছিলেন যে, প্রথমে তিনি তাঁর শাসনক্ষমতাকে দুর্বল করে দেয় সেগুলোকে কাটিয়ে উঠতে এবং সমাজে নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে সুসংহত করতে। মামুন কঠিন অবস্থা মোকাবেলার জন্য একটি নতুন সমাধান বের করেন যা তাঁর পূর্বসূরিরা করতে সক্ষম হননি। মামুন তাঁর মন্ত্রী ফাযলের সাথে পরামর্শ করে একটি ষড়যন্ত্রমূলক পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হলেন। তিনি ইমাম রেযা (আ.)-কে খলিফা হবার প্রস্তাব দেয়ার এবং নিজে খেলাফতের পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর চিন্তা করলেন। কারণ, তিনি জানতেন যে ইমাম সেই প্রস্তাব গ্রহণ করুন বা না করুন এটি মামুনের জন্য একটি বিজয় হিসেবে দেখা হবে। যদি ইমাম সেই প্রস্তাব গ্রহণ করে খলিফা হন তাহলে মামুন হবেন যুবরাজ এবং এটি ইমামের পরবর্তীকালে মামুনের জন্য শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পথে উন্মুক্ত করে দেবে। সে যদি এমন কাজ করতে পারে তাহলে গোপনে ইমাম রেযা (আ.)-কে সরিয়ে সে আইনগতভাবেই খলিফা হওয়ার সুযোগ লাভ করবে। এক্ষেত্রে আহলে বাইতের অনুসারীরা তাঁর শাসনব্যবস্থায় খুশি হবে এবং তাঁকে ইমামের পর বৈধভাবে তাঁর উত্তরাধিকারী হিসেবে মেনে নেবে। অন্যদিকে জনগণ যখন তাঁর খেলাফতকে ইমাম কর্তৃক বলে মেনে নেবে তখন তাঁর শাসনের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা আন্দোলন বৈধতা হারিয়ে ফেলবে।
আর যদি ইমাম খলিফা হওয়ার প্রস্তাব মেনে না নেন তাহলে তাঁর খেলাফতকে বৈধতা দিতে তিনি ইমামকে যুবরাজ হওয়ার ব্যাপারে বাধ্য করবেন। এর মাধ্যমে তিনি আহলে বাইতের অনুসারী বিদ্রোহীদের বিদ্রোহ করার ভিত্তিকে দুর্বল করতে সক্ষম হবেন এবং সেই বিদ্রোহ জনগণকেও যেমন সন্তুষ্ট করবে না, অপরদিকে ইমামের অনুসারীদেরকেও সন্তুষ্ট করবে না। অন্যদিকে তিনি ইমামকে তাঁর নিকটে অবস্থান করতে বাধ্য করে আন্দোলনকে দমন করতে সক্ষম হবেন। উপরন্তু ইমামের অনুসারীরা ইমামকে খেলাফতের পদ গ্রহণ না করার কারণে সমালোচনা করবে এবং তিনি জনগণের মাঝে তাঁর যে সম্মান ছিল তা হারিয়ে ফেলবেন।
মামুন তাঁর অভীষ্ট লক্ষে পৌঁছানোর জন্য তাঁর কিছু বিশেষ প্রতিনিধিকে মদিনায় ইমামের নিকট প্রেরণ করেন যাতে তারা ইমামকে খোরাসানে আসতে বাধ্য করতে পারে। তিনি আরো নির্দেশ দেন যে, ইমামকে এমন পথ দিয়ে নিয়ে আসতে হবে যে পথে তাঁর অনুসারীদের সংখ্যা নিতান্তই কম হবে। সেই সময়ে প্রধান সড়কগুলো ছিল কুফা, জাবাল, কেরমানশাহ এবং কোমÑ যে নগরীগুলো প্রধানত আহলে বাইতের অনুসারীদের বাসস্থান ও তাদের শক্তির কেন্দ্র ছিল। মামুন ভেবেছিলেন যে, যদি এই রাস্তা দিয়ে ইমামকে নিয়ে আসা হয় তাহলে হয়তো তাঁর অনুসারীরা তাঁকে খোরাসানে আসতে বাধা দেবে আর তখন পরিস্থিতি অন্যরকম হয়ে যেতে পারে যা তাঁর শাসনক্ষমতার জন্য সমস্যা তৈরি করতে পারে। এই সমস্যা মোকাবিলার জন্য মামুন ইমাম রেযা (আ.)-কে বসরা, আহওয়াজ এবং ফার্সের পথ ধরে নিয়ে আসার জন্য নির্দেশ প্রদান করেন। তাঁর প্রতিনিধিরা সর্বক্ষণ ইমামের গতিবিধি লক্ষ্য করছিল এবং সবসময় তাঁর কর্মকা-ের প্রতিবেদন মামুনের নিকট পাঠাচ্ছিল।
যখন ইমাম রেযা (আ.) মার্ভে প্রবেশ করলেন তখন মামুন তাঁকে রাজকীয় অভ্যর্থনা জানান এবং জনসাধারণের উদ্দেশে একটি বক্তব্য রাখেন যেখানে তিনি বলেন : ‘সবার জানান উচিত যে, আমি বনু আব্বাস অথবা বনু আলীর মধ্যে আলী ইবনে মূসা আর-রেযার চেয়ে খেলাফতের যোগ্য আর কাউকে চিনি না।’ এরপর তিনি ইমামের দিকে মুখ ফিরান এবং বলেন : ‘আমি খেলাফতের পদ থেকে ইস্তফা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি এবং আপনাকে খলিফা হিসেবে ঘোষণা করছি।’ ইমাম রেযা (আ.) বলেন : ‘যদি আল্লাহ তোমার জন্য খেলাফতকে বিশেষভাবে নির্ধারণ করে থাকেন তাহলে অন্য কাউকে সেটি দেয়ার অনুমতি নেই আর যদি এটি তোমার জন্য না হয়ে থাকে তবে অন্য কাউকে তা দিয়ে দেয়ার অধিকারও তোমার নেই।’ মামুন তাঁকে পীড়াপীড়ি ও যুক্তি প্রদর্শন করতে থাকেন যেন তিনি এ প্রস্তাব গ্রহণ করেন। কিন্তু ইমাম বলেন : ‘আমি কখনই তা গ্রহণ করব না।’ মামুন হতাশ হয়ে ইমামকে বলেন : ‘তাহলে আমার উত্তরাধিকারী ও আমার মৃত্যুর পর খলিফা হওয়াকে মেনে নিন।’ এমন অবস্থা দুই মাস যাবত চলতে থাকে। ইমাম রেযা (আ.) মামুনকে এক পর্যায়ে বলেন : ‘আমি আমার পিতৃপুরুষদের কাছ থেকে শুনেছি যে, আমি তোমার আগে মারা যাব এবং আমাকে বিষপ্রয়োগে হত্যা করা হবে আর পৃথিবী ও বেহেশতের ফেরেশতারা আমার জন্য ক্রন্দন করবে এবং আমি বিদেশ বিভূঁইয়ে হারুন অর রশিদের কবরের পাশে সমাহিত হব।’
আবাসাল্ত হারাভী বলেন : খেলাফত ও যুবরাজ পদের প্রস্তাবের পর এবং ইমাম কর্তৃক তা প্রত্যাখ্যান ও মামুনের পক্ষ থেকে অনেক পীড়াপীড়ির পর অবশেষে মামুন ইমামকে উদ্দেশ্য করে বলেন : ‘খোদার কসম! হয় আপনি যুবরাজ পদ গ্রহণ করবেন নতুবা আপনাকে তা গ্রহণে বাধ্য করব। সেক্ষেত্রে আপনি যদি তা মেনে নেন (তাহলে তো মেনেই নিলেন) অন্যথায় আপনার শিরñেদ করব।’ এরপর ইমাম বলেন : ‘যেহেতু আমাকে বাধ্য করা হচ্ছে, তাই আমি তা গ্রহণ করছি তবে আমি কাউকে পদে অধিষ্ঠিত করব না বা কাউকে ক্ষমতাচ্যুতও করব না এবং কোনো রীতি-নীতিকে পরিবর্তন করব না এবং শাসনকার্যে জড়িত হব না।’ মামুনও এ প্রস্তাব গ্রহণ করে নেন।
এরপর ইমাম রেযা (আ.) তাঁর দুই হাত তুলে মোনাজাতে বলেন, ‘হে আমার প্রভু! তুমি জান যে, তারা আমাকে বন্দি করেছে এবং আমি বাধ্য হয়ে এটি (যুবরাজের পদ) গ্রহণ করেছি। তাই দয়া করে আমাকে তিরস্কার করো না তোমার দুই নবী, ইউসুফ ও দানিয়েলের মতো, যখন তাঁরা তাঁদের সময়ের রাজাদের কর্তৃক (বাধ্য হয়ে) তাঁদেরকে দেয়া পদ গ্রহণ করেছিলেন। হে আমার প্রভু! তোমার প্রতিশ্রুতি ছাড়া কোনো প্রতিশ্রুতি নেই এবং তোমার প্রভুত্ব ছাড়া কোনো প্রভুত্ব নেই। সুতরাং আমাকে তোমার ধর্মকে প্রতিষ্ঠা করতে এবং তোমার নবীর সুন্নাতকে অনুসরণ করতে সাহায্য কর। নিশ্চয়ই তুমি সর্বোত্তম প্রভু এবং সর্বোত্তম সাহায্যকারী।’
যুবরাজ পদে অধিষ্ঠিত করার কারণ
যখন ইমাম রেযা (আ.) যুবরাজ পদে আসীন হন, তখন ইমামের চারপাশের সহচররা আনন্দিত হন। তাদের মধ্যে একজন বলেন : ‘আমি বড়ই আনন্দ ও উৎসাহের মধ্যে ছিলাম।’ এমন সময় ইমাম (আ.) আমাকে বললেন : ‘তোমার অন্তরকে বাইরের এ ভালো দেখে উদ্বেলিত করো না এবং আনন্দিত হয়ো না। কারণ, একাজের একটা পরিণতি রয়েছে।’
কয়েকটি কারণে মামুন ইমাম রেযা (আ.)-কে যুবরাজের পদ গ্রহণে আহ্বান জানায় বলে মনে করা হয়। যেমন-
১. যদি ইমাম রেযা (আ.) উপযুক্ত হয়ে থাকেন তবে তাঁর মর্যাদাকে ব্যবহার করা।
২. আর যদি তিনি উপুক্ত না হয়ে থাকেন তবে তাঁকে জনগণের সামনে হেয় প্রতিপন্ন করার অভিলাষ।
৩. আমিনের সমর্থক বনি আব্বাসের নিকট থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করা।
৪. ইমাম আলী (আ.)-এর বংশধরদের বিদ্রোহকে প্রতিহত করা এবং
৫. রাষ্ট্রের অবস্থা স্থিতিশীল করা।
তবে মামুন নিজেই বনি আব্বাসের চাপের কারণে নিজ অভিসন্ধির কথা প্রকাশ করতে বাধ্য হন। তিনি বলেন : ‘এ লোকটি আমাদের দৃষ্টির অগোচরে ছিল, লোকদেরকে নিজের দিকে আহবান জানাতো। তাই আমি চেয়েছি তাকে নিজের যুবরাজ পদে বসাতে। যাতে যদি সে লোকজনকে আহবান জানায়, সেটা যেন হয় আমাদের দিকে। আর তার বিরোধিতাকারীকে চিনতে পারি এবং রাজত্বও থাকে আমাদের অধিকারে, তাঁর নয়। আমার ভয় হচ্ছিল তাকে ঐ অবস্থায় ছেড়ে দিয়ে রাখতে। এখন আমি যেটা করতে চেয়েছিলাম, সেটা করেছি। এটা আমার ভুল হয়েছে। ভুলটা হলো এই যে তাকে বিখ্যাত ও শ্রদ্ধাবান করে নিজের ধ্বংসই কাছে ডেকে এনেছি। সুতরাং এখন আর তাঁর ব্যাপারে কোনো ছাড় দেয়া যাবে না। তবে আমাদের উচিত হবে তাঁকে তিলে তিলে ভেঙ্গে ফেলা এবং হেয় করা । যাতে জনগণের কাছে তাঁকে এমনভাবে তুলে ধরবো যে, সে এ খেলাফত ও যুবরাজ পদের যোগ্য নয়। তারপর পরিকল্পনা করে তাঁকে শেষ করে দিব।’
এথেকে বোঝা যায় যে, মামুন ইমাম রেযা (আ.)-কে যুবরাজ করার বাহানায় নিজ আয়ত্তের মধ্যে রাখতে চেয়েছিলেন যাতে তিনি ইমামের প্রতিটি গতিবিধির ওপর নজরদারি করতে পারেন। আর খেলাফত প্রদানের বিন্দুমাত্র ইচ্ছা তাঁর ছিল না। তিনি এর মাধ্যমে এটাও চেয়েছিলেন যে, আলী বংশীয়রা যাতে তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ না করে।
মামুন ইমাম রেযা (আ.)-কে যুবরাজ ঘোষণার পরে জাঁকজমকপূর্ণভাবে উৎসব পালন করে। দিরহাম ও দিনারে ইমামের নাম মুদ্রণ করে। তার মেয়ের সাথে ইমাম রেযা (আ.)-এর বিয়ে দেয়।
ইমাম রেযা (আ.) কিছু ঘটনার মাধ্যমে মামুনের মুখোশ উন্মোচন করে দেন। মামুন ভাবতেন যে, ইমাম ভুল করতে পারেন। আর তাই তিনি চেয়েছিলেন সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকা-ে জড়িত করার মাধ্যমে ইমামের ভুল-ভ্রান্তি জনগণের সামনে তুলে ধরবেন। কিন্তু ইমাম এ অবকাশটুকুও মামুনকে দেননি। অন্যদিকে ইমাম রেযা (আ.) বিভিন্ন বিতর্কে অন্যান্য প-িতকে পরাজিত করে প্রমাণ করেন যে, তিনিই ইমাম। এর ফলে ইমামের মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। বিপরীতে এতে মামুন ভয় পেয়ে যান।
জনগণের পক্ষ থেকে ইমামকে নজিরবিহীন সম্বর্ধনা প্রদান মামুনকে প্রতিক্রিয়াশীল আচরণে বাধ্য করে। এর ফলে মামুনের আসল চেহারা উন্মোচিত হয়ে পড়ে। অপরদিকে ইমাম (আ.) জনগণকে বুঝিয়ে দিলেন যে, মামুন ইমাম রেযা (আ.) ও আহলে বাইত এবং আলাভীদের বিরোধী। আর তাঁর অন্যান্য কাজ, যেমন সবুজ রংকে সেøাগানে পরিণত করা, ইমাম রেযা (আ.)-এর নামে মুদ্রা বের করা… সবই তাঁর কূটকৌশল মাত্র।
প-িতদের সাথে বিতর্ক
যখন মামুন ইমামের প্রতি জনগণের ব্যাপক আকর্ষণ ও উদ্দীপনার বিষয়টি লক্ষ্য করলেন তখন তিনি ইমামের পবিত্র ও সম্মানজনক অবস্থানকে খাটো করার জন্য সিদ্ধান্ত নিলেন। ইমামকে হেয় করার একটি পরিকল্পনা ছিল তৎকালীন বিশে^র বিভিন্ন অঞ্চলের বিজ্ঞানীদের সাথে ইমামের বিতর্কের আয়োজন করা। তিনি আশা করছিলেন যে, প-িতরা হয়তো এই বিতর্ক প্রতিযোগিতায় জয় লাভ করবে এবং ইমামের বৈজ্ঞানিক জ্ঞানকে পরাজিত করতে সক্ষম হবেন।
মামুন ফাযলকে নির্দেশ দিলেন বিশে^র বিভিন্ন প্রান্তের দার্শনিক ও ধর্মতাত্ত্বিকদেরকে দাওয়াত দেয়ার। ফযল খ্রিস্টান বিশপ, ইহুদি প-িত, সাবেয়ী, যরাথ্রুস্টদের ধর্মযাজক এবং অন্য ধর্মতাত্ত্বিকদেরকে দাওয়াত দিলেন। মামুন তাঁদেরকে অভ্যর্থনা জানালেন এবং পরবর্তী দিনে ইমাম রেযা (আ.)-এর সাথে বিতর্কের আয়োজন করেন। সকালে মামুন এক লোককে ইমাম রেযা (আ.)-এর কাছে প্রেরণ করেন। ইমাম রেযা (আ.) তাকে বলেন : ‘তুমি কি জান কখন মামুন তার এ সিদ্ধান্তের জন্য অনুতাপ করবে?’ লোকটি বলল : ‘কখন, হে জনাব?’ ইমাম বললেন : ‘যখন মানুষ আমাকে ইহুদিদেরকে তাওরাত থেকে, খ্রিস্টানদেরকে বাইবেল থেকে, দাউদের অনুসারীদেরকে দাউদের সহীফা থেকে, সাবেয়ীনদেরকে তাদের নিজেদের ভাষায় অগ্নিপূজকদেরকে ফারসিতে এবং রোমানদেরকে তাদের ভাষায় তাদের যুক্তিকে খ-ন করতে দেখবে এবং যখন তারা তাদের বিশ^াসকে একপাশে রেখে আমার কথায় বিশ^াস করতে দেখবে। সেই সময়ে মামুন বুঝতে পারবে যে, সে যা করতে চায় তা করতে সক্ষম নয় এবং পরিতাপ করবে। আর আল্লাহ ছাড়া কোনো শক্তি নেই, তিনি সুউচ্চ ও সুমহান।’ তারপর ইমাম মামুনের সভায় যোগ দিলেন। তিনি প্রবেশ করলে মামুন তাঁকে সকলের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন : ‘আমি চাই আপনারা তাঁর সাথে বিতর্ক করুন।’ ইমাম রেযা (আ.) তাঁদের সাথে তাঁদের নিজ নিজ গ্রন্থ থেকেই তাঁদের বিশ^াস ও ধর্ম নিয়ে আলোচনা করলেন। তারপর তিনি বললেন : আপনাদের মধ্যে যদি এমন কেউ থাকেন যিনি ইসলামের বিরোধী তাহলে তিনি নিঃসঙ্কোচে জিজ্ঞাসা করতে পারেন।’ উমরান সায়েবী, যিনি অন্যতম ধর্মতত্ত্ববিদ ছিলেন, তিনি ইমামকে অনেকগুলো প্রশ্ন করলেন এবং ইমাম একে একে সবগুলো প্রশ্নের উত্তর দিলেন এবং তাঁকে অভিভূত করে ফেললেন। ইমামের নিকট থেকে তাঁর প্রশ্নসমূহের জবাব শুনে তিনি কলেমা শাহাদাত পড়লেন এবং মুসলমান হয়ে গেলেন। বিতর্ক প্রতিযোগিতা ইমামের বিজয় ও শ্রেষ্ঠত্বের মাধ্যমে শেষ হলো এবং জনগণ বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ল। এরপর থেকে ইমাম উমরান সায়েবীর সাক্ষাৎ করতেন এবং তাঁকে সম্মান জানাতেন। তারপর তেকে তিনি ইসলামের একজন প্রচারকে পরিণত হন।
রাযা বিন যাহাক, যে মামুনের নির্দেশে ইমামকে মদিনা থেকে মার্ভে নিয়ে এসেছিল সে বলে : ‘ যে শহরেই ইমাম প্রবেশ করছিলেন সেখানেই জনগণ সব জায়গা থেকে এসে ভিড় করছিল এবং তারা তাদের ধর্মীয় প্রশ্নের উত্তর জিজ্ঞাসা করছিল। এর বিপরীতে ইমাম তাদের প্রশ্নগুলোর জবাব দিচ্ছিলেন এবং মহানবী (সা.) ও ইমাম আলী (আ.) থেকে অনেক হাদিস বর্ণনা করছিলেন। যখন আমি এই সফর থেকে ফিরে আসলাম তখন আমি মামুনের কাছে গেলাম। মামুন সফরের সময় ইমামের আচরণ কেমন ছিল তা জিজ্ঞাসা করলে আমি সফরকালে যা হয়েছিল তার বর্ণনা দিলাম। মামুন বললেন : ‘হ্যাঁ, যাহাকের পুত্র! তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ, সবচেয়ে জ্ঞানী এবং দুনিয়ার বুকে সবচেয়ে ধার্মিক ব্যক্তি।’
ঈদের নামায পড়ানো
রমযান মাসের শেষে মামুন ইমাম রেযা (আ.)-কে ঈদুল ফিতরের নামায পড়ানোর জন্য আহ্বান জানান। ইমাম রেযা (আ.) এই শর্তে নামায পড়ানোর জন্য রাজি হন যে তিনি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মতো করে এই দিনে নামাযের আয়োজন করবেন।
ঈদের দিনে ইমাম সাধারণ কাপড় পরিধান করে এবং খালি পায়ে নামাযের জন্য বের হলেন। তিনি উচ্চৈঃস্বরে ‘আল্লাহু আকবার’ স্লোগান দিতে থাকলেন। নগরীর প্রতিটি প্রান্ত থেকে ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি শোনা যাচ্ছিল যেহেতু তারা সবাই ইমামের সাথে স্লোগান দিচ্ছিলেন। মামুন এ অবস্থা দেখে ভড়কে যান এবং ইমামকে নামায পড়ানো থেকে বিরত থাকার জন্য অনুরোধ জানান।
ইমামের নৈতিক চরিত্র ও আচরণ
তাঁর নৈতিক গুণাবলি ও ধার্মিকতা তাঁর বন্ধুদেরকে যেমন তেমনি তাঁর শত্রুদেরকেও আকৃষ্ট করত। তিনি মানুষকে সৌজন্যতা, সম্মান ও দয়ালু আচরণ করতেন যতটা সম্ভব এবং তিনি কখনই সাধারাণ জনগণ থেকে পৃথক হননি।
তাঁর একজন সাথি বলেন, আমি কখনই তাঁকে মন্দ কথা বলতে শুনিনি কিংবা কারো কথার মধ্যে বিঘœ সৃষ্টি করতে দেখি নি। যদি তিনি দরিদ্রকে দেয়ার সামর্থ্য রাখতেন তখন তিনি দরিদ্রকে প্রত্যাখ্যান করেন নি এবং তিনি কখনই তাঁর পা অন্যদের সামনে বিছিয়ে দেন নি। আমি কখনও তাঁর দাসদের প্রতি কটু কথা বলতে শুনেছি বলে মনে করতে পারি না। তিনি সবসময় উচ্চ শব্দে হাসার পরিবর্তে মৃদু হাস্য করতেন।তিনি যখন খেতে বসতেন তখন বাড়ির সকলকে নিয়ে একসাথে খেতে বসতেন। তিনি রাত্রিকালে অল্প ঘুমাতেন আর বেশিরভাগ সময় জেগে থাকতেন ও নামায পড়তেন। তিনি প্রচুর রোযা রাখতেন। তিনি প্রতি মাসে তিনটি রোযা রাখতেন। তিনি প্রচুর দান-খয়রাত করতেন এবং রাতের অন্ধকারে গোপনে দরিদ্রদেরকে সাহায্য করতেন।’
তাঁর আরেক জন সাথি বলেন, ‘গ্রীষ্মকালে তাঁর বিছানা ছিল একটি ম্যাট আর শীতকালে ছিল একটি কাপড়ের চট। তিনি বাড়িতে মোটা কাপড় পরিধান করতেন, কিন্তু জনসাধারণের সমাবেশে তিনি নিজেকে উত্তম কাপড়ে সজ্জিত করতেন।
ইমামের সমাধিক্ষেত্র
ইমাম রেযা (আ.) আব্বাসীয় খলীফা মামুনের আমলে তুস নগরীর নওকন এলাকার অন্তর্গত ‘সানাবাদ’ নামক গ্রামে পঞ্চান্ন বছর বয়সে ২০৩ হিজরির ২৩ যিলকদ শাহাদাতবরণ করেন এবং মামুনের নির্দেশে হারুনের কবরের পাশে সমাধিস্থ হন। ইমাম রেযা (আ.)-এর সন্তান ইমাম জাওয়াদ (আ.) তাঁর পিতার দাফন, কাফন ও জানাযা পড়ান।
যেহেতু তিনি প্রাচীন শহর তূসে শহীদ হয়েছিলেন সেজন্য জায়গাটি প্রথমে মাশহাদুর রেযা নামে এবং পরবর্তীকালে শুধুই মাশহাদ নামে পরিচিত হয়। আরবি ‘মাশহাদ’ শব্দের অর্থ শহীদ হওয়ার স্থান।
ইমাম রেযা (আ.) তাঁর পবিত্র জীবদ্দশায় বিভিন্ন অধ্যায়ে স্পষ্ট ঘোষণা করেছিলেন যে, ‘আমি বিষ প্রয়োগে নিহত ও বিদেশের মাটিতে সমাহিত হব’ এবং খলীফা মামুনকেই তাঁর হত্যাকারী বলে জানিয়ে দিয়েছিলেন।
ইমাম রেযা (আ.)-এর বংশধর
ইমাম রেযা (আ.) পাঁচ পুত্রের জনক ছিলেন। তাঁরা হলেন : ইমাম আবু জাফর মুহাম্মদ তাকী, হাসান, আলী, হোসাইন, মূসা এবং এক কন্যা ছিল ফাতেমা নাম্মী। ইমাম রেযা (আ.) এর সন্তান ইমাম মুহাম্মাদ তাকী আল জাওয়াদ (আ.)-এর মাধ্যমেই তাঁর বংশধারা অব্যাহত থাকে।
সমসাময়িক চিন্তাবিদদের বিশ্লেষণে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর বিপ্লবের প্রেক্ষাপট
আব্দুল কুদ্দুস বাদশা –
মানব ইতিহাস সুখময় ও বিষাদময় উভয় প্রকার ঘটনায় পরিপূর্ণ। এসব ঘটনায় মহানায়কদের আত্মত্যাগী ও বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য মানুষ যেমন তাঁদেরকে যুগ যুগ ধরে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। একইভাবে যারা কাপুরুষের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে মানবতার পিঠে খঞ্জর হেনেছে, তারা মানুষের ঘৃণার পাত্রে পরিণত হয়েছে। কিন্তু ৬১ হিজরিতে মরু কারবালায় নবী-দৌহিত্র ইমাম হোসাইন (আ.)-এর উপর সংঘটিত ইয়াযিদ বাহিনীর চরম নৃশংসতার সামনে থমকে দাঁড়ায় মানব ইতিহাস। অন্য সব ঘটনাই যেন চাপা পড়ে যায়। একদিকে সত্য ও ন্যায়ের প্রতি আপোষহীনতার পরাকাষ্ঠা, অপরদিকে অন্যায় ও অসত্যের চরম কুৎসিত চেহারা।
কারবালার ঘটনা ছিল হকপন্থী ও বাতিলপন্থীদের সংঘাত। ইমাম হোসাইন (আ.) এ কথা বলেন নি যে, আমি ইয়াযিদের কাছে বাইয়াত করব না। বরং তিনি বলেন, مثلی لا یبایع مثله ‘আমার মতো কেউ তার মতো কারো কাছে বাইয়াত করতে পারে না।’ এখানে ব্যক্তি নয়, হক ও বাতিলের প্রশ্ন। হক বাতিলের কাছে শির নত করে না।
ইতিহাসের বিবরণ থেকে দৃশ্যমান হয় যে, সেদিন ইয়াযিদী হুকুমতের বিপরীতে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর জন্য দুইটি পথই খোলা ছিল, হয় বাইয়াত, না হয় বিদ্রোহ। বিদ্রোহের ফলাফল ছিল শাহাদাত অথবা নিজে হুকুমত প্রতিষ্ঠা করা। পক্ষান্তরে বাইয়াতের ফলাফল ছিল অপমান ও ধ্বংস। ইমাম বেছে নিলেন বিদ্রোহের পথ আর ঘোষণা করলেন ‘সৎকাজে আদেশ আর অসৎ কাজে নিষেধ’ই উদ্দেশ্য। তিনি বার বার উমাইয়া শাসনচক্রের দ্বারা দ্বীন পদদলিত হওয়া এবং বেদআত ছড়িয়ে পড়ার ব্যাপারে সাবধান করে দেন। পাশাপাশি তিনি ইয়াযিদের খোদাদ্রোহী জুলুমশাহীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার আহ্বান জানান। ইমাম হোসাইন (আ.)-এর বিদ্রোহের ফলাফল ছিল ইসলামের পুনরুজ্জীবন, দ্বীনবিদ্বেষী উমাইয়া শাসনের বিলুপ্তি এবং একত্ববাদী মুমিনের মাথা উঁচু করে বাঁচার সংস্কৃতির গোড়াপত্তন। মুসলিম অভিধানে যার মূল্যায়নে বলা হয়েছে : ان الاسلام محمدی الحدوث، حسینی البقاء ইসলামের ভিত্তিপ্রস্তর মুহম্মদী পরিচয়ে, আর এর চিরস্থায়িত্ব হোসাইনী পরিচয়ে।
প্রখ্যাত জার্মান গবেষক ও ঐতিহাসিক গ. গড়ৎরিহ বলেন, ‘হোসাইন তাঁর প্রাণপ্রিয় স্বজনদেরকে উৎসর্গ করার মাধ্যমে দুনিয়াকে আত্মত্যাগের শিক্ষা দিয়েছেন এবং ইসলাম ও মুসলমানদের নাম ইতিহাসে লিপিবদ্ধ এবং বিশ্বে গৌরবান্বিত করেছেন। যদি এরূপ ঘটনা সংঘটিত না হতো, নিশ্চিত বলা যায় যে, ইসলাম বর্তমানের এই অবস্থায় থাকত না। সম্ভাবনা ছিল ইসলাম ও মুসলমানদের নাম সম্পূর্ণরূপে মুছে যাওয়ার।’
ইমাম হোসাইন (আ.) একটি অসম যুদ্ধে শাহাদাতবরণ করেন। আর তাঁর স্বজন পরিজনকে বন্দি করা হয়। তবে উস্তাদ শহীদ মুর্তাজা মোতাহহারী’র ভাষায় ইমাম তাঁর অভীষ্ট অর্জন করেছেন। অথচ ইমাম যদি ইয়াযিদের হাতে বাইয়াত করতেন, তা হলে শুধু যে তাঁর অভীষ্ট ও লক্ষ্য অর্জিত হতো না, তা নয়, উপরন্তু তাঁর বাইয়াতের অসংখ্য নেতিবাচক প্রভাব পড়ত গোটা ইসলাম ও মুসলিম জাহানের উপর। এরূপ কয়েকটি প্রধানতম নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো :
প্রথমত : উমাইয়াদের দ্বীনবিরোধী অবৈধ হুকুমতের বৈধতা
উমাইয়ারা তাদের হুকুমতকে উত্তরাধিকার সম্পদে পরিণত করার চেষ্টায় লিপ্ত ছিল। আবু সুফিয়ান এক খাস বৈঠকে স্বীয় গ্রোত্রের লোকদের উদ্দেশ্যে বলেন, یا بنی امیّة! تلقّفوها تلقف الکرة.. ‘হে উমাইয়া বংশ! ইসলামের খেলাফতকে নিয়ে [ফুট]বলের ন্যায় খেলতে থাক এবং একজনের পা থেকে আরেক জনের পায়ে ঠেলে দাও।’
মুয়াবিয়াও শতচেষ্টা করেছেন রাজশক্তি, রাজকোষ ও মিথ্যাচারের জোরে উমাইয়া শাসনকে টিকিয়ে রাখতে। এই উদ্দেশ্যে তিনি ইয়াযিদের যুবরাজ পদের প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেন। অতঃপর ইয়াযিদের অনুকূলে বাইয়াত আদায়ের মাধ্যমে লক্ষ্যে পৌঁছবার চেষ্টা করেন। সন্দেহের অবকাশ নেই যে, এক্ষেত্রে ইয়াযিদের হুকুমত যোগ্যতা, খোদায়ী বৈধতা কিংবা জনগণের গ্রহণযোগ্যতাÑ এগুলোর কোনো একটির ভিত্তিতে গঠিত হয়নি। কারণ, শীর্ষ ইসলামী নেতৃত্বের কোনো গুণই তার মধ্যে ছিল না। জনগণ বিশেষ করে সুশীল সমাজ ইয়াযিদকে চিনত একজন ফাসেক হিসাবে, যার মধ্যে খেলাফত পরিচালনার কোনোই যোগ্যতা নেই। এমনকি মুয়াবিয়ার অনুচররাও এ বিষয়ে জ্ঞাত ছিল এবং তারা মুয়াবিয়ার এ প্রস্তাবে আপত্তি জানিয়েছিল।
মুয়াবিয়া যখন মদীনার গভর্নর যিয়াদের কাছে চিঠি লিখে ইয়াযিদের অনুকূলে বাইয়াত আদায়ের ফরমান পাঠান, এর উত্তরে গভর্নর লিখেন : যদি জনগণকে তার জন্য বাইয়াত করতে বলি তাহলে তারা আমাদেরকে কী বলবে? হোসাইন ইবনে আলী (আ.) ও আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস… এর ন্যায় ব্যক্তিরা এখনও তাদের মাঝে রয়েছেন। স্বয়ং ইমাম হোসাইন (আ.) এক পত্র মারফত ইয়াযিদের নেতৃত্বের প্রসঙ্গ উত্থাপন করায় মুয়াবিয়াকে তীব্র ভর্ৎসনা করেন এবং তাকে মদ্যপ ও ফাসেক বলে উল্লেখ করেন।
মুয়াবিয়া তাঁর জীবদ্দশায় ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কাছ থেকে বাইয়াত আদায় করতে সক্ষম হননি। কিন্তু তিনি ইয়াযিদকে আবদুল্লাহ্ ইবনে যুবাইর ও ইমাম হোসাইন (আ.)-এর ন্যায় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের থেকে বাইয়াত আদায়ের কথা বলে যান। অবশ্য তিনি ইমাম হোসাইনের সাথে সহিংস আচরণ না করার জন্য উপদেশ দেন। কারণ, ইমাম হোসাইন বিশেষ সামাজিক মর্যাদার অধিকারী ছিলেন। ইমাম হোসাইনের বাইয়াত তাদের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কারণ, এর মাধ্যমে তাদের দুইটি ফায়দা হাসিল হতো- (১) অন্যদের বাইয়াতের ক্ষেত্র প্রস্তুত হওয়া এবং (২) উমাইয়া হুকুমত রাজতন্ত্রে পরিণত হওয়ার বন্দোবস্ত পাকা হওয়া।
মুয়াবিয়ার মৃত্যু হলে ইয়াযিদ মদীনার গভর্নর ওয়ালিদ ইবনে উত্বাকে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর বাইয়াত আদায়ের ফরমান পাঠায়। ইমামকে এ ফরমানের কথা জানানো হলে তিনি ওয়ালিদকে বলেন, ‘আমরা হলাম নবীর আহলে বাইত, রেসালাতের খনি, ফেরেশতাদের গমনাগমনের ঠিকানা। আর ইয়াযিদ একজন ফাসেক লোক, মদপায়ী, নিরপরাধ মানুষদের হত্যাকারী। সে এমন লোক যে প্রকাশ্যে পাপাচারে ও ব্যভিচারে লিপ্ত হয়। অতএব, আমার মত কেউ তার মত কারও সাথে বাইয়াত করতে পারে না।’
এ প্রসঙ্গে উস্তাদ শহীদ মুর্তজা মোতাহ্হারী বলেন, ‘অন্যান্য ফ্যাসাদ ছাড়াও এই লোকটির [ইয়াযিদের] বাইয়াতের মধ্যে আরও দুইটি ফ্যাসাদ নিহিত ছিল যা মুয়াবিয়ার ক্ষেত্রে ছিল না। প্রথমত. ইয়াযিদের সাথে বাইয়াত ইমাম হোসাইন (আ.)-এর পক্ষ থেকে [উমাইয়াদের] রাজতান্ত্রিক খেলাফতকে স্বীকৃতির কারণ হতো। অর্থাৎ এটা কোনো ব্যক্তি বিশেষের খেলাফতের বিষয় ছিল না। বরং খেলাফতকে রাজতন্ত্রে পরিণত করার ব্যাপার ছিল। আর দ্বিতীয়ত খোদ্ ইয়াযিদকে নিয়ে সমস্যা ছিল…।’
কিন্তু ইমাম হোসাইন (আ.) বাইয়াত না করায় উমাইয়া হুকুমতের ধ্বংসের কারণ হলো। উমাইয়া শাসনামলের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় তাদের নাতিদীর্ঘ শাসনামল অগণিত সমস্যা ও সংকটের সম্মুখীন হয় এবং টিকতে পারে নি। প্রখ্যাত মিশরীয় জার্নালিস্ট ও সাহিত্য সমালোচক আব্বাস মাহমুদ আক্কাদ লিখেন, ‘উমাইয়া হুকুমতের এক দিনের [কারবালা ট্রাজেডি] অর্জন হলো এটা যে, ঐরূপ সুবিশাল ও সুবিস্তৃত সা¤্রাজ্য হয়েও একজন মানুষের স্বাভাবিক আয়ুষ্কালের সমানও টিকলো না, তাদের থাবা থেকে বের হয়ে গেল। আজকে যখন উভয় পক্ষের আয়ুষ্কালকে দাড়িপাল্লায় রাখি এবং প্রত্যেকের জয় পরাজয় পরিমাপ করি, তখন কারবালার দিনের বিজয়ীকে (ইয়াযিদ) পরাজিতের চেয়ে বেশি পরাজিত দেখতে পাই এবং বিজয়কে সম্পূর্ণরূপে তার প্রতিদ্বন্দ্বী (ইমাম হোসাইন) এর সাথে দেখতে পাই।’
দ্বিতীয়ত : দ্বীনের উপরে আঘাত
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, উমাইয়ারা ছিল দ্বীন-বিদ্বেষী। দ্বীনকে জীবন থেকে বাদ দিয়েই তারা জীবনের সন্ধান করত। একদিন আবু সুফিয়ান উমাইয়াদের উদ্দেশে বলে, ‘হে আমার স্বজনরা! জেনে রাখ, বেহেশতও নেই, দোযখও নেই। বরং আসল কথা হল হুকুমত। এ হুকুমতকে কুক্ষিগত করতে হবে…।’ একরাতে মুগীরা আসলেন মুয়াবিয়ার কাছে। ঠিক তখনই আযানের ধ্বনি ভেসে আসলো। মুয়াবিয়া আযানের মধ্যে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর রেসালাতের প্রতি সাক্ষ্য শোনা মাত্রই প্রচ- ক্ষিপ্ত হয়ে বলে উঠলেন, ‘দ্যাখো, মুহাম্মদ কী করেছে, নিজের নামকে খোদার নামের পাশে স্থাপন করেছে।’ তিনি দ্বীন ও দ্বীনি মূল্যবোধ সম্পর্কে এতটাই অবজ্ঞাশীল ছিলেন যে, জুমা’র নামাযকে বুধবারে অনুষ্ঠিত করান। ওয়ালিদ ইবনে আবদুল মালেক যখন খেলাফত পেলেন, কুরআনকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘[হে কোরআন!] তুমি যখন আল্লাহর কাছে যাবে, বলবে ওয়ালিদ আমাকে তীরবর্ষণ করেছে।’ আর ইয়াযিদ তো বলতো, لعبت هاشم بالملک فلا خبر جاء و لا وحی نزل ‘বনি হাশিম রাজত্ব নিয়ে খেলেছে, আসলে কোনো খবরই আসেনি, আর কোনো ওহিও নাযিল হয়নি।’
ইমাম (আ.) স্বীয় বক্তব্যের অনেক জায়গায় উমাইয়াদের দ্বীনবিরোধী চরিত্রের বিবরণ দিয়েছেন এবং তৎকালীন সমাজের অবস্থা তুলে ধরেছেন। কারবালার পথে ফারাযদাকের সাথে ইমামের সাক্ষাৎ ঘটে। এ সাক্ষাতে তিনি সুস্পষ্টভাবে শামের শাসকবর্গের দ্বীনের বরখেলাফ কর্মকা- প্রসঙ্গে বলেন, ‘একদল রয়েছে যারা শয়তানের আনুগত্যকে গ্রহণ করেছে এবং দয়াময় আল্লাহর আনুগত্যকে বর্জন করেছে। তারা জমিনে ফ্যাসাদকে প্রকাশ্য রূপ দিয়েছে আর খোদায়ী সীমাকে লঙ্ঘন করেছে…।’
একটি চিঠিতে ইমাম বসরার অধিবাসীদের উদ্দেশে লিখেন, ‘আমি তোমাদেরকে আল্লাহর কিতাব ও রাসূল (সা.)-এর সুন্নাতের দিকে আহ্বান জানাই। কেননা, এ দলটি [উমাইয়ারা] রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নাতকে ধ্বংস করে দিয়েছে এবং খোদার দ্বীনের মধ্যে বেদআতকে জিন্দা করেছে।’
তৃতীয়ত : জনগণের পথভ্রষ্টতা
আহলে বাইতের অনুসারী হিসাবে আমরা বিশ্বাস পোষণ করি যে, মাসুম ইমামগণের কথা ও কাজ আমাদের জন্য হুজ্জাত তথা আদর্শস্বরূপ। অর্থাৎ তাঁরা মানুষের জীবনের কর্মপন্থা নির্ধারণ করে দেন। একারণে তাঁদেরকে এমনভাবে চলতে হবে যাতে জনগণের হেদায়াতের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। যদি ইমাম হোসাইন (আ.) ইয়াযিদের হাতে বাইয়াত করতেন, তাহলে জনগণের পথভ্রষ্টতার ক্ষেত্র তৈরি হতো। কারণ, বাইয়াতসূত্রে তখন ইমামকে ইয়াযিদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হতো। ফলে তাদের মধ্যে এ চিন্তার উদ্রেক হতো যে, জালিম হুকুমতের সাথে বাইয়াত করা এবং তাকে সমর্থন করা যায়। তাদের বাইয়াত চাওয়ার একটা উদ্দেশ্যও ছিল এটা যে, ইমাম হোসাইন (আ.) বাইয়াত করে ফেললে অন্য মুসলমানদের বাইয়াত করার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়ে যাবে। একারণে ইমাম তদীয় ভ্রাতা মুহাম্মদ ইবনে হানাফিয়্যাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘হে ভাই! আল্লাহর শপথ! যদি দুনিয়ার কোনো প্রান্তে আমার কোনো আশ্রয় ও নিরাপদ স্থান না থাকে তবুও কিছুতেই আমি ইয়াযিদের হাতে বাইয়াত করব না।’
ইমামের বাইয়াত না করার ফলে এ দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিষ্ঠিত হলো যে, ইয়াযিদের হুকুমত অবৈধ। কুফার জনগণও ইমাম বাইয়াত না করার পর ইয়াযিদের হুকুমতের প্রতি তাদের বিরোধিতা ঘোষণা করে এবং ইমামকে কুফায় আমন্ত্রণ জানায়। তাছাড়া ইমামের বাইয়াত না করার কারণে চিন্তার বিকাশ এবং পরবর্তীকালের গণজাগরণসমূহের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত চিন্তাবিদ আয়াতুল্লাহ মেসবাহ্ ইয়াযদী লিখেন, ‘সাইয়্যেদুশ শুহাদা ইমাম হোসাইন (আ.)-এর বিদ্রোহের ফলশ্রুতিতে জনগণ অনুধাবন করতে পারল যে, ইয়াযিদ রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রকৃত খলিফা নয়। আর এটা ছিল উম্মাহর প্রতি ইমাম হোসাইনের সর্বপ্রথম খেদমত যা তিনি তাঁর বিদ্রোহের মাধ্যমে আঞ্জাম দিয়েছেন।’ তাওয়াবীনদের বিদ্রোহ, মদীনার গণবিদ্রোহ, মুখতার ছাকাফী’র বিদ্রোহ ইত্যাদি বিদ্রোহসমূহ ইমাম হোসাইনের বাইয়াত না করা থেকে অনুপ্রেরণা গ্রহণ করে সংঘটিত হয়েছে। এরই ধারায় সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে ইরানের মহান ইসলামি বিপ্লব।
চতুর্থত : অন্যায় ও অত্যাচারের প্রশ্রয়
এটা সকলের কাছে স্পষ্ট ছিল যে, ইয়াযিদ উম্মাহর নেতৃত্ব প্রদানের যোগ্যতা রাখত না। কারণ, সে খেলাফতের পূর্বে যেমন তদ্রƒপ খেলাফতের পরেও সীমাহীন গোনাহ ও পাপের মধ্যে ডুবে ছিল। তাছাড়া তার সবচেয়ে বড় ব্যাধি ছিল প্রকাশ্যে পাপকর্ম করা। উস্তাদ মোতাহ্হারী বলেন, ‘খোদ ইয়াযিদের অস্তিত্বই [উম্মাহর জন্য] সবচেয়ে বড় মুসিবতের কারণ ছিল। কারণ, সে না শাসন পরিচালনায় দক্ষ ছিল। আর না ন্যায়পরায়ণতা ও তাকওয়ার অধিকারী ছিল। সে শুধু যে পাপাচার ও ব্যভিচারেই লিপ্ত ছিল, তা নয়, বরং এসব পাপাচার করত প্রকাশ্যে। অন্যান্য উমাইয়া খলিফাও পাপাচারে লিপ্ত হতো, তবে ইয়াযিদের মতো এরূপ প্রকাশ্যে করত না।’ কারবালার নির্মম হত্যাকা-ের পরেও সে থেমে থাকেনি। এ ঘটনার খবর যখন মদীনায় পৌঁছে তখন আবদুল্লাহ ইবনে হানযালার নেতৃত্বে মদীনার কয়েকজন লোক ইয়াযিদের ব্যাপারে অনুসন্ধান করতে শামে যান। সেখানে তাঁরা ইয়াযিদের কার্যকলাপ দেখে বললেন, ‘আমরা এমন এক লোককে দেখে এলাম যার দ্বীন নেই, মদ পান করে, ঢাক বাজায় আর কুকুর নিয়ে খেলে।’ ইবনে জওযী আবদুল্লাহ ইবনে হানযালার উদ্ধৃতি দিয়ে বর্ণনা করেন যে তিনি বলেন, ‘আমরা এমন অবস্থায় ইয়াযিদের দরবার থেকে বের হয়ে এসেছি যখন ভয় হচ্ছিল যে [তার অতিশয় পাপাচারের কারণে] আসমান থেকে আমাদের উপর পাথর বর্ষিত হয় কিনা। সে এমন এক নরাধম যে তার মা ও বোনের সাথেও ব্যভিচারে লিপ্ত হয়। সে মদ পান করে এবং নামায তরক করে।’
ইয়াযিদ কারবালা হত্যাকা-ের পর মদীনায় আক্রমণ চালায় এবং নির্বিচারে গণহত্যা, ধর্ষণ ও লুণ্ঠন পরিচালনা করে, যা ইতিহাসে ‘ওয়াকিআতু হাররা’ নামে পরিচিত। মক্কার মসজিদুল হারামও ইয়াযিদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি। আহলে সুন্নাতের প্রখ্যাত প-িত সয়ুতী হাসান বসরী থেকে বর্ণনা করেন যে তিনি বলেন, ‘আল্লাহর শপথ! ঐ ঘটনায় কেউই রক্ষা পায়নি এবং এক হাজার কন্যাকে ধর্ষণ করা হয়।’ কা’বা ঘরে অগ্নিসংযোগ করা হয়। ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন যে, ইয়াযিদ বাহিনীর সেনাপতি হাসিন ইবনে নামির যখন লস্কর নিয়ে মক্কায় প্রবেশ করে, সবদিক থেকে ঘিরে ফেলে। আর আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর মসজিদুল হারামে আশ্রয় নিয়েছেন এই কারণ দেখিয়ে তারা খানা কা’বায় আক্রমণ চালায় এবং মিনজানিকের মাধ্যমে আল্লাহর পবিত্র হেরেম শরীফে অগ্নি নিক্ষেপ করে এমনভাবে যে, কা’বার পর্দায় এবং ছাদে আগুন ধরে যায়।’
ইয়াযিদের হাতে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর বাইয়াত হওয়া শুধু যে এক জালেমশাহীকে সাহায্য করা হতো, তাই না, এক ধরনের অন্যায় ও অত্যাচারকে প্রশ্রয় দেওয়া হতো। অথচ পবিত্র আহলে বাইতের পুণ্যময় সংস্কৃতিতে অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়ার কোনো অর্থ হয় না। একারণেই ইমাম হোসাইন (আ.) ইয়াযিদকে খোদাদ্রোহী শাসক আখ্যা দিয়ে ফরিয়াদ তোলেন : ما الامام الاّ العامل بالکتاب و القائم بالقسط ‘আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী আমলকারী ও ন্যায় প্রতিষ্ঠাকারী না হলে সে নেতা নয়।’
পরিশেষে বলা যায়, কারবালার ইতিহাসকে মুছে ফেলার জন্য ইসলামের ভেতরে ও বাইরে শত্রুদের ঘাম ঝরানো চেষ্টা সত্ত্বেও কোনো ক্ষতিই তারা সাধন করতে পারেনি। কারণ, এ ঘটনাকে চির অম্লান করে রাখতে স্বয়ং আল্লাহর অনুগ্রহ ছাড়াও এমন কিছু উপাদান এর সাথে মিশে রয়েছে যা সকল প্রতিকূলতার মধ্যেও একে অক্ষয় রাখবে চিরকাল। হক পথে অবিচলতা, মানবের প্রকৃতি ও সহজাত প্রবৃত্তিগত ভিত্তি আর ইসলামের নিখাঁদ আধ্যাত্মিক অনুপ্রেরণাÑ এগুলোই হল সেই উপাদান। তাই সমকালীন প্রখ্যাত চিন্তাবিদ ও মুফাস্সির আয়াতুল্লাহ জাওয়াদী আমুলী’র মতে , ইমাম হোসাইন (আ.) ইসলামের জন্য সর্বস্ব উজাড় করে দিয়েছেন। একারণে তাঁর আন্দোলনও ইসলামের ন্যায় দুটি চিরায়ত বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হয়েছে। যথা (১) সামগ্রিকতা এবং (২) চিরস্থায়িত্ব। অর্থাৎ একটি হচ্ছে সর্বজনীনতা, জাতি ধর্ম নির্বিশেষে বিশ্বের সকল ন্যায়কামী ও স্বাধীনচেতা মানুষ এ বিপ্লবকে তাদের অনুপ্রেরণার বাতিঘর বলে জানবে। আর অপরটি হচ্ছে চিরন্তনতা, অনাদিকালের কোনো আস্তরণই একে চাপা দিতে পারবে না। তাই তো যিয়ারতের মধ্যে আমরা বলি ঃ ما بقی اللیل و النهار [হে ইমাম! আমাদের সালাম হোক আপনার প্রতি] যতদিন অবশিষ্ট থাকবে রাত্রি ও দিবস।
. ইবনে আছির, আল-কামেল খ. ৪, পৃ. ১১২; মুজামুল বুলদান, খ. ২, পৃ. ২৪৯; আল-ইমামা ওয়া আল-সিয়াসাহ, খ. ১, পৃ. ২৩৮।
. তারিখুল খুলাফা, পৃ. ২৩৩।
. উদ্ধৃত, সাঈদ দাউদী, আশুরা, পৃ. ২২৫।
. তারিখে তাবারী, খ. ৪, পৃ. ২৬২।
. ২৩ অক্টোবর ২০১৫ তারিখে প্রদত্ত উস্তাদের লেকচার থেকে উদ্ধৃত।
স্মরণীয় বাণী
হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) এমন এক সময় মসজিদে প্রবেশ করেন যখন সেখানে দু’টি বৈঠক চলছিল। একটি বৈঠক ছিল দ্বীনী ‘ইল্মের এবং অপর বৈঠকটি ছিল দো‘আর। তখন তিনি এরশাদ করেন : ‘দু’টি বৈঠকের ফলই উত্তম; একটিতে আল্লাহ্কে ডাকা হচ্ছে এবং অপরটিতে যারা জানে না তাদেরকে দ্বীনী ‘ইল্ম’ ও আহ্কাম্ শিক্ষা দেয়া হচ্ছে; এই (দ্বীনী শিক্ষার) বৈঠকটি অধিকতর উত্তম। আমি শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে প্রেরিত হয়েছি।’ এরপর তিনি তাদের পাশে বসে পড়লেন।
হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) এরশাদ করেন : ‘তোমাদের শিশুদেরকে সর্বপ্রথম যে শব্দাবলি শিক্ষা দেবে তা হচ্ছে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্।’
হযরত ইমাম হাসান ‘আসকারী (আ.) হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) থেকে উদ্ধৃত করেন যে, তিনি এরশাদ করেন : ‘আমাদের অনুসারীদের মধ্যে যে কেউ আমাদের ‘ইল্ম’ অবগত হবে এবং কোনো জাহিলকে হেদায়াত করবে ও তাকে আমাদের শরী‘আত্ শিক্ষা দেবে সে বেহেশতে আমাদের সাথে থাকবে।’
হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) এরশাদ করেন : ‘কাউকে খাওয়ার জন্য দাওয়াত করা হলে সে যদি তা কবূল না করে অথবা কবূল করেও খেতে না যায় তাহলে তা নিষ্ঠুরতা।’
ইমাম আলী (আ.) বলেন : ‘কোনো ব্যক্তি যখন কোনো অকাট্য জ্ঞানের কথা শ্রবণ করে এবং এরপর তা অন্যের কাছে বর্ণনা করে বা তদনুযায়ী আমল করে, সে ক্ষেত্রে তা এক বছরের (নফল) ইবাদতের চেয়ে উত্তম।’
এক ব্যক্তি আমীরুল্ মু‘মিনীন্ হযরত আলী (আ.)-এর কাছে আরয করল : ‘আমি ব্যবসা করতে চাই।’ তিনি এরশাদ করলেন : ‘তুমি কি দ্বীনী ‘ইল্ম্ (ফিকাহ্) আয়ত্ত করেছ? সে বলল : ‘শিক্ষা করব।’ তিনি বললেন : তোমার জন্য আফসোস্! প্রথমে ফিকাহ্ শিক্ষা করো, এরপর ব্যবসা করো। কারণ, যে ব্যক্তি বেচাকেনা করে, কিন্তু হালাল-হারামের বিষয়াদি সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করে না সে রিবা’র ঘূর্ণাবর্তে নিপতিত হয়।’
হযরত ইমাম বাকের (আ.) এরশাদ করেন : ‘জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে পরস্পর প্রতিযোগিতা করো। আল্লাহ্র শপথ, তুমি যদি কোনো সত্যবাদী লোকের কাছ থেকে হালাল ও হারাম সংক্রান্ত একটি হাদীস শিক্ষা করো তাহলে তা এ দুনিয়া এবং তার সমস্ত স্বর্ণ ও রৌপ্যের চেয়েও উত্তম।’
হযরত ইমাম বাকের (আ.) এরশাদ করেন : ‘চারটি জিনিস এমন যার স্বল্প পরিমাণও অনেক : আগুন, নিদ্রা, রোগ ও দুশমনী। (অর্থাৎ এ চারটি জিনিসের যে কোনোটির স্বল্প পরিমাণও অনেক এবং তা বিরাট ক্ষতিকর পরিণতি নিয়ে আসতে পারে।)’
হযরত ইমাম জা‘ফর সাদেক (আ.) এরশাদ করেন : ‘তিনটি জিনিস ব্যতীত কোনো কিছু মুসলমানদেরকে উপযুক্ত করে তোলে না (বা সংশোধন করে না), তা হচ্ছে : দ্বীনের জ্ঞান, বিপদাপদে ধৈর্য ও জীবনের জন্য উত্তম পরিকল্পনা।’
হযরত ইমাম মূসা কাযেম্ (আ.) এরশাদ করেন : ‘তোমরা তোমাদের দিন-রাতকে চার ভাগে ভাগ করার চেষ্টা করো : এক ভাগ আল্লাহ্র কাছে মুনাজাতের জন্য, এক ভাগ যিন্দেগীর ব্যয় নির্বাহের পিছনে, এক ভাগ তোমার দোষত্রুটি দূরীকরণে অংশীদার স্বচ্ছ অন্তরের অধিকারী তোমার এমন ভাই ও বন্ধুদের সাথে ওঠা-বসার জন্য এবং এক ভাগ হালাল-এর ভোগ-আস্বাদনের জন্য।’
হযরত ইমাম মূসা কাযেম্ (আ.) এরশাদ করেন : ‘তিনটি জিনিস ছাড়া অন্য কিছু রোগব্যাধির নিরাময় করে না। তা হচ্ছে : দো‘আ, সাদাকাহ্ ও ঠা-া পানি।’
হযরত ইমাম রেযা (আ.) এরশাদ করেন : ‘নিঃসন্দেহে আল্লাহ্্ মদকে এ কারণে হারাম করেছেন যে, তা পানকারীদের বিচারবুদ্ধিকে ধ্বংস করে দেয়।’
(মাফাতীহুল্ হায়াত্ গ্রন্থ থেকে সংকলিত)
অনুবাদ : নূর হোসেন মজিদী

কিশোর নিউজ লেটার জুলাই সেপ্টেম্বর ২০২০
ইরানের ভাষা, ধর্ম ও জাতিসমূহ
ফারসি ইরানের রাষ্ট্রীয় ও প্রশাসনিক ভাষা। ফারসি ভাষা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর অন্যতম। ইরানে ইসলাম প্রবেশের পর কিছু সময় আরবি ভাষা ইরানের রাষ্ট্রীয় ভাষা ছিল। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ একইভাবে বা অব্যাহতভাবে ফারসিতে কথাবার্তা বলত। এখনও ইরানের একদল মানুষ ফারসি ছাড়াও স্থানীয় ও গোত্রীয় ভাষাগুলো, যেমন : কুর্দি, লোরী, গিলাকী, বালুচি, তোর্কি ও আরবিতে কথা বলে। শিক্ষামাধ্যম হিসেবে সাধারণভাবে ফারসি ব্যবহৃত হলেও অন্য ভাষাভাষী এলাকাগুলোতে স্থানীয় ভাষাগুলো শিক্ষামাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
ইসলাম ইরানের রাষ্ট্রীয় ধর্ম। খ্রিস্টীয় ৭ম শতাব্দীতে ইরান মালভূমির অধিবাসীরা ইসলাম গ্রহণ করে। ক্রমান্বয়ে ইরানে শিয়া মাযহাবের প্রভাব বৃদ্ধি পায় এবং এক সময় সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ শিয়া মাযহাবের অনুসারীতে পরিণত হয়। তবে এখানে বিভিন্ন সুন্নি মাযহাবের অনুসারীরাও আছে।
একইভাবে ইরানের সংবিধান খ্রিস্ট, ইয়াহুদি ও যরথুস্ত্রীয় ধর্মকে স্বীকৃতি প্রদান করেছে। এ ধর্মগুলোর অনুসারীরা স্বাধীনভাবে ইরানে বসবাস করছে। ২০১৬ সালের পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে, ইরানের জনসংখ্যার শতকরা ৯৯ ভাগের বেশি মুসলমান। বিভিন্ন জাতি বা সম্প্রদায় ইরানে বসবাস করে এবং তাদের সকলেই ইরানের নাগরিক। ইরানি জাতিগুলোর মধ্য থেকে আযারবাইজানি তুর্কিরা উত্তর-পশ্চিমে, কুর্দিরা পশ্চিমে, লোরীরা দক্ষিণ-পশ্চিমে, বালুচরা দক্ষিণ-পূর্বে, আরবরা দক্ষিণে এবং তুর্কমানরা উত্তর-পূর্বে বসবাস করে। অবশ্য ইরানের বেশিরভাগ জনগণই ফার্স্ বা ফার্সীভাষী পরস্য বংশোদ্ভূতÑ যারা ইরানের সকল প্রদেশে বসবাস করে।
ইরানের জনসংখ্যার অন্য একটি অংশ যাযাবরÑ যাদেরকে উপজাতি হিসেবে অভিহিত করা হয়। উপজাতিরা ইরানের কেন্দ্রীয় ও পশ্চিমের প্রদেশগুলোতে বসবাস করে এবং তাদের অধিকাংশ পশুপালক। উজাতিরা তাঁবুতে বসবাস করে। তারা গ্রীষ্মকালে নিজেদের পশুপালের সাথে অধিকতর ঠা-া এলাকায় এবং শীতকালে অধিকতর গরম অঞ্চলগুলোতে যায়। প্রত্যেক গোত্র বা সম্প্রদায়ের নিজস্ব শীতকালীন ও গ্রীষ্মকালীন এলাকা এবং স্থানান্তরিত হওয়ার বিশেষ সময় রয়েছে।
ইরানি জাতি বা গোত্রগুলোর প্রতিটির বিশেষ ধরনের রীতি-নীতি আছে। কিন্তু অধিকাংশ নিয়ম-কানুন বা রীতি-নীতি জাতীয় এবং ধর্মীয়; সেগুলো তাদের মধ্যে অভিন্ন।
অনুবাদ : সুজন পারভেজ