All posts by dreamboy

সংবাদ

১ ক্ষমার অযোগ্য মহাপাপ করেছে ফরাসি ম্যাগাজিন : ইরানের সর্বোচ্চ নেতা
সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হযরত মুহাম্মাদ (স.)-কে অবমাননার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী।
তিনি গত ৮ সেপ্টেম্বর এক বার্তায় বলেছেন, পবিত্র ও নুরানি ব্যক্তিত্ব মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-কে অবমাননা করে ক্ষমার অযোগ্য মহাপাপ করেছে ফরাসি পত্রিকা। তাদের এই পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে ইসলাম ধর্ম ও মুসলিম জাতির সঙ্গে পাশ্চাত্যের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর হিংসা-বিদ্বেষের বিষয়টি আবারও ¯পষ্ট হয়েছে।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আরও বলেছেন, বাক্ স্বাধীনতার অজুহাত দেখিয়ে ফ্রান্সের কোনো কোনো রাজনীতিবিদ এই মহা অপরাধের নিন্দা পর্যন্ত জানাননি। তাদের এই অজুহাত অগ্রহণযোগ্য ও ভুল। এর মাধ্যমে তারা মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করেছে।
আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী বলেন, ইহুদিবাদী গোষ্ঠী ও সাম্রাজ্যবাদী সরকারগুলোর ইসলামবিরোধী কঠোর নীতির কারণে মাঝে মধ্যেই এ ধরনের বিদ্বেষী ঘটনা ঘটছে। পশ্চিম এশিয়াকে নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইহুদিবাদীদের অশুভ পরিকল্পনা থেকে এই অঞ্চলের বিভিন্ন জাতি ও সরকারগুলোর দৃষ্টিকে ভিন্ন দিকে সরিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যেও এই সময়টাকে মহানবী (স.)-কে অবমাননার জন্য বেছে নেওয়া হয়ে থাকতে পারে বলে তিনি জানান।
তিনি গোটা বিশ্বের মুসলমান বিশেষকরে পশ্চিম এশিয়ার মুসলমানদের উদ্দেশে বলেন, ¯পর্শকাতর এই অঞ্চলের ইস্যুগুলোর বিষয়ে আপনাদেরকে সদা সতর্ক ও সজাগ থাকতে হবে। একই সঙ্গে পবিত্র ইসলাম ধর্ম ও মুসলমানদের বিষয়ে পাশ্চাত্যের রাজনীতিবিদ ও নেতাদের শত্রুতার বিষয়টিও কখনোই ভুলে যাওয়া যাবে না।
সম্প্রতি সর্বশেষ নবী ও রাসূল হযরত মুহাম্মাদ (স.)-কে নিয়ে আবারও ব্যঙ্গাত্মক কার্টুন প্রকাশ করেছে বিতর্কিত ফরাসি ম্যাগাজিন শার্লি এবদো। হযরত মুহাম্মাদ (স.)-কে নিয়ে ২০১৫ সালের কার্টুনগুলোই আবার প্রকাশ করে তারা।

২ মহানবী (স.)-কে অবমাননা; ইরানজুড়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালিত
সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হযরত মুহাম্মাদ (স.)-কে অবমাননার প্রতিবাদে গত ১০ সেপ্টেম্বর ইরানজুড়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালিত হয়েছে। ফার্স প্রদেশের শিরাজ শহরের প্রতিবাদ সমাবেশে বিপুল সংখ্যক মানুষ অংশ নেন।
প্রধান সমাবেশে ফার্স প্রদেশের গভর্নর ও শহরের প্রধান জুমার নামাজের ইমামসহ শীর্ষ কর্মকর্তারাও অংশ নেন। এ সময় তাঁরা ফ্রান্স, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইহুদিবাদী ইসরাইলের বিরুদ্ধে বিভেন্ন ¯ে¬াগান দেন।
তাঁদের প্রায় সবার হাতে ছিল নানা ধরণের পোস্টার ও প্ল্যাকার্ড। কোনো কোনো পোস্টার ও প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল, ‘হে রাসূল (স.)! আপনাকে ভালোবাসি, আপনার জন্য জীবন দিতেও প্রস্তুত আছি’। বিক্ষোভ সমাবেশে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে বিপুল সংখ্যক নারীও ছিলেন।
ইরানের অন্যান্য শহরেও একই ধরনের বিক্ষোভ কর্মসূচি পালিত হয়। কয়েক দিন ধরে মহানবী (স.)-কে অবমাননার বিরুদ্ধে ইরানে ব্যাপক প্রতিবাদ অনুষ্ঠিত হয়।
৯ সেপ্টেম্বর রাজধানী তেহরানে ফ্রান্সের দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ করেছেন অসংখ্য মানুষ। তাঁরা অবমাননাকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে ফ্রান্স সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। ফরাসি দূতাবাস ঘেরাও করে তাঁরা ইসলামবিদ্বেষীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ¯ে¬াগান দেন এবং বিশ্বনবী (স.)-এর প্রতি নিজেদের ভালোবাসা প্রকাশ করেন।
এছাড়া গতকাল মাশহাদ ও কোমেও বিক্ষোভ হয়েছে। মাশহাদ শহরে স্বাস্থ্যবিধি মেনে একদল মানুষ শহরে সমবেত হন এবং ফরাসি ম্যাগাজিন শার্লি এবদোতে মহানবী (স.)-কে নিয়ে ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশের নিন্দা জানিয়ে বিভিন্ন ¯ে¬াগান দেন। এ সময় তারা এ ধরনের পদক্ষেপ বন্ধে জোরালো পদক্ষেপের আহ্বান জানান এবং বিশ্বের সব মুসলমানকে সোচ্চার হতে বলেন।
একই ধরনের বিক্ষোভ সমাবেশ হয় ইরানের কোম নগরীতে। সেখানে ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ছাত্র-ছাত্রীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ বিক্ষোভে অংশ নেন। এ সময় তাঁদের হাতে শোভা পাচ্ছিল বিভিন্ন পোস্টার ও প্ল্যাকার্ড। কোনো কোনো প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল ‘আমি মুহাম্মাদ (স.)-কে ভালোবাসি’।
ইরানের ইসলামি তাবলিগাত সংস্থার সমন্বয় বিষয়ক পরিষদের উপ-প্রধান নুসরাতুল্লাহ লুতফি বলেছেন, সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ উজমা খামেনেয়ী ফরাসি ম্যাগাজিনের ন্যক্কারজনক পদক্ষেপের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দেওয়ার পর দেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ ও সংস্থা বিক্ষোভের ডাক দিয়েছে।
মানুষ সরকারের নির্দেশনা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে মাস্ক পরে এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে এই সমাবেশে যোগ দিচ্ছেন বলে তিনি জানান।

২ ক। ইরানে পালিত হচ্ছে পবিত্র প্রতিরক্ষা সপ্তাহ
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানে গত ২১ সেপ্টেম্বর ইরাকের সাদ্দাম সরকারের চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধ শুরুর বার্ষিকী পালিত হচ্ছে। এ উপলক্ষে এক সপ্তাহ ধরে নানা কর্মসূচি পালন করা হয়। ১৯৮০ সালের এই দিনে হামলা শুরু করে সাদ্দাম বাহিনী।
এই এক সপ্তাহকে বলা হয় ‘ইসলামি প্রতিরক্ষা সপ্তাহ’। ইরাকের তৎকালীন সাদ্দাম সরকারের চাপিয়ে দেয়া আট বছরের যুদ্ধের বার্ষিকী উপলক্ষে প্রতিবছরই ইরানে প্রতিরক্ষা সপ্তাহ পালিত হয়। ১৯৮০ সালের ওই যুদ্ধকে ইরানে ‘পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধ’ বলা হয়।
ইরানে আগ্রাসন চালিয়ে তৎকালীন ইরাকি শাসক সাদ্দাম ঘোষণা করেছিলেন, এক সপ্তাহের মধ্যে তিনি ইরানের রাজধানী তেহরানে বসে চা পান করবেন। ইরানে তার এক বছর আগে ইসলামি বিপ্লব হয়েছিল বলে সাদ্দাম সরকারের ধারণা ছিল, ইরানের সদ্য প্রতিষ্ঠিত ইসলামি সরকার ইরাকের মতো সুসজ্জিত একটি সেনাবাহিনীর মোকাবিলা করতে পারবে না।
কিন্তু বাস্তবে ইরাকি বাহিনী পাশ্চাত্য ও আরব দেশগুলোর সর্বাত্মক পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া সত্ত্বেও ইরানকে পরাজিত করতে বা ইরানের এক ইঞ্চি ভূমিও জবরদখল করে রাখতে পারেনি এবং ১৯৮৮ সালে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপে ওই যুদ্ধ শেষ হয়।

৩ গোটা বিশ্বের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বিজয়ী হয়েছে ইরান : সর্বোচ্চ নেতা
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী বলেছেন, ইরাকের সাবেক স্বৈরশাসক সাদ্দামের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তার দেশের চূড়ান্ত বিজয় প্রমাণ করেছে, ইরানের দিকে চোখ তুলে তাকালে আগ্রাসী শক্তিকে ‘চরম মূল্য’ দিতে হয়। ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানে গত ২১ সেপ্টেম্বর থেকে পবিত্র প্রতিরক্ষা দিবসের অনুষ্ঠান পালন শুরু হয়েছে। এ উপলক্ষে প্রতিরক্ষা যুদ্ধে (ইরাক-ইরান যুদ্ধ) অংশগ্রহণকারী যোদ্ধাদের এক সমাবেশে ভাষণ দেন সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল
উজমা খামেনেয়ী।
পবিত্র প্রতিরক্ষা সপ্তাহের উদ্বোধনি অনুষ্ঠানে ভাষণ দেয়ার সময় তিনি এ হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। তিনি বলেন, ‘যখন একটি দেশ আত্মরক্ষার চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে তখন যেকোনো আগ্রাসী শক্তি সেই দেশের দিকে চোখ তুলে তাকাতে দুবার ভাবে। কারণ, ওই শক্তি জানে আগ্রাসন চালালে তাকে চরম মূল্য দিতে হবে।’
ইরানে ২১ সেপ্টেম্বর থেকে পবিত্র প্রতিরক্ষা দিবসের অনুষ্ঠান পালন শুরু হয়। এ উপলক্ষে প্রতিরক্ষা যুদ্ধে (ইরাক-ইরান যুদ্ধ) অংশগ্রহণকারী যোদ্ধাদের এক সমাবেশে ভাষণ দিতে গিয়ে এসব কথা বলেন সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী।
ফারসি ১৩৫৯ সালের ৩১ শাহরিভার (১৯৮০ সালের ২১ সেপ্টেম্বর) ইরাকের তৎকালীন শাসক সাদ্দাম ইরানে আগ্রাসন চালায়। ওই আগ্রাসনের ফলে সৃষ্ট যুদ্ধ আট বছর স্থায়ী হয়। এ উপলক্ষে ইরানে প্রতি বছর ২১ সেপ্টেম্বর থেকে টানা এক সপ্তাহ ধরে ‘পবিত্র প্রতিরক্ষা সপ্তাহ’ পালিত হয়।
ভিডিও লিঙ্কের মাধ্যমে দেয়া ভাষণে সর্বোচ্চ নেতা বলেন, ইরানে ১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লবের পর সৃষ্ট ইসলামি শাসনব্যবস্থাকে অঙ্কুরেই ধ্বংস করে দেয়ার জন্য ইরাকের মাধ্যমে ইরানের ওপর ওই যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল। বিশ্বের তৎকালীন দুই পরাশক্তি আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন হাতে হাত মিলিয়ে ওই যুদ্ধে ইরাককে সার্বিক পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিল। কিন্তু এতসব সত্ত্বেও ওই যুদ্ধে ইরানের নিশ্চিত বিজয় হয়।
আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী প্রতিরক্ষা যুদ্ধ সম্পর্কে বলেন, আট বছর সারাবিশ্বের সকল শক্তির সম্মিলিত পৃষ্ঠপোষকতা নিয়ে ইরাকের আগ্রাসী বাহিনী ইরানের এক বিঘত ভূমিও দখলে রাখতে পারেনি। ইসলামি বিপ্লবকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে ওই যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া হলেও তাদের সে লক্ষ্য তো অর্জিত হয়ই নি, উল্টো ইসলামি বিপ্লব যুদ্ধ শুরুর আগের তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী হয়েছে।
সর্বোচ্চ নেতা বলেন, অথচ এর আগের দুইশ’ বছরে ইরান যে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে তাতেই পরাজিত হয়েছে। তিনি বলেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইরানের কাজার শাসক এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইরানের পাহলাভি শাসক নিজেদের নিরপেক্ষতা ঘোষণা করেন। কিন্তু তারপরও দুই যুদ্ধেই বিদেশী সেনা ইরানে অনুপ্রবেশ করে ও সাময়িকভাবে এ দেশকে দখল করে নেয়। আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী বলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন ও সোভিয়েত সেনারা এই তেহরানে দম্ভের সঙ্গে প্যারেড করেছে। তিনি বলেন, এই যখন ছিল ইরানের অতীতের অবস্থা তখন ইসলামি বিপ্লবের পর ইসলামপ্রিয় যোদ্ধারা তাদের দেশের এক ইঞ্চি ভূমিও বিদেশিদেরকে দখল করতে দেননি।
পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী যোদ্ধাদের পাশাপাশি অনুষ্ঠানে ইরানের সশস্ত্র বাহিনী চিফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল মোহাম্মাদ বাকেরি, ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসি’র কমান্ডার মেজর জেনারেল হোসেইন সালামি ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আমির হাতামি উপস্থিত ছিলেন।

 

৩-১ ইরানের মুসলিম নারীদের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস

ইরানের সমসাময়িক ইতিহাস প্রতিরক্ষার বিভিন্ন প্রেক্ষাপট, যুদ্ধ, রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনে ইরানের ‎মুসলিম নারীদের ব্যাপক ও সক্রিয় উপস্থিতির সাক্ষ্য বহন করছে। এসব নারী তাঁদের আদর্শ এবং ‎বিশ্বাসের জন্য আবেগ-অনুভূতিকে উপেক্ষা করেছে, তারা ইরান-ইরাক যুদ্ধে মৌলিক এবং মূল্যবান ভূমিকা ‎পালন করেছে এবং আশুরার শিক্ষা অনুসরণ করে ‘অবিস্মরণীয়’ মহাকাব্য তৈরি করেছে। ঠিক যেমন ইমাম খোমেইনী (রহ.) তাঁদের ভূমিকা স¤পর্কে বলেছেন : ‘আমরা ইসলামি আন্দোলনের বিজয়ে এই মহান শ্রেণির (ইরানের সম্মানিত নারীদের) জন্য গর্বিত, যাঁরা ইসলামি রাষ্ট্র, কোরআন ও বিপ্লবের প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে মূল্যবান ও সাহসী উপস্থিতির মাধ্যমে বিজয় অর্জনে ভূমিকা রেখেছে এবং ইসলামি বিপ্লবের অগ্রভাগ ও ‎পশ্চাত উভয় ক্ষেত্রেই সক্রিয় থাকার পাশাপাশি ত্যাগের জন্য প্রস্তুত রয়েছেন।’
আরোপিত যুদ্ধে শহীদদের তালিকা থেকে প্রাপ্ত পরিসংখ্যান অনুসারে, শহীদ নারীদের সংখ্যা ৬৪২৮ জন, ‎যার মধ্যে ৫০০ জন ছিলেন স্থলযোদ্ধা এবং তাঁরা যুদ্ধরত অবস্থায় শহীদ হয়েছেন।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের স্থপতির ভাষায়, বিগত অত্যাচারী শাসকের মোকাবেলায় আমাদের সম্মানিত ‎নারীরা বিজয় অর্জন করার পর এহেন পরাশক্তি ও তাদের মিত্রদের মোকাবেলায় প্রতিরোধের ক্ষেত্রে যে দৃঢ়তা ‎এবং সাহসিকতার নজির সৃষ্টি করেছেন সেরূপ দৃষ্টান্ত কোনো যুগের পুরুষদের দৃঢ়তা এবং সাহসিকতার ‎ইতিহাসেই লিপিবদ্ধ হয়নি।
সমস্ত রাজনৈতিক এবং সামাজিক প্রেক্ষাপটে বিশেষত প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে নারীদের ভূমিকা, ইরানের ‎সমসাময়িক ইসলামি আন্দোলনে এবং বিদেশীদের সাথে দ্বন্দ্বের সমস্ত ক্ষেত্রে পুরুষদের পাশাপাশি নারীদের ‎সক্রিয় ভূমিকা ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।

৩-২ অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা উঠলেই প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম রপ্তানি শুরু করবে ইরান
ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর (আইআরজিসি) অ্যারো¯েপস ফোর্সের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আমির আলি হাজিজাদেহ বলেছেন, ইরানের ওপর থেকে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম রপ্তানির দরজা উন্মুক্ত হবে।
গত ২১ সেপ্টেম্বর তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ইরান তার প্রয়োজনীয় অস্ত্রের জন্য বিদেশ থেকে আমদানির ওপর নির্ভর করে না এবং এই খাতে তাঁর দেশ স্বয়ংস¤পূর্ণ।
আমেরিকার অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা স¤পর্কে করা এক প্রশ্নের জবাবে হাজিজাদেহ বলেন, ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের পরিকল্পনা ও কর্মসূচির কোনো পরিবর্তন করা হয়নি এবং আমরা স্বয়ংস¤পূর্ণ। যদি অবরোধ উঠে যায় তাহলে রপ্তানির পথ খুলে যাবে।

৩-৩ তেহরানে প্রতিরক্ষা খাতের অর্জন নিয়ে প্রদর্শনী শুরু
ইরানের প্রতিরক্ষা খাতের বিভিন্ন অর্জনাবলি নিয়ে প্রদর্শনী ‘দ্যা স্যাকরেড ডিফেন্স অ্যাচিভমেন্টস এক্সিবিশন’ শুরু হয়েছে। ২৩ সেপ্টেম্বর রাজধানী তেহরানের স্যাকরেড ডিফেন্স মিউজিয়ামে ইরানি পার্লামেন্টের ¯িপকার মোহাম্মাদ বাঘের গালিবাফ ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে মেলার উদ্বোধন করেন।
ইরানের আটটি প্রদেশে একই সাথে এই প্রতিরক্ষা প্রদর্শনীর উদ্বোধন করা হয়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পবিত্র প্রতিরক্ষা খাতের ৫৬টি ম্যাক্রো গবেষণা প্রকল্প উন্মোচন করা হয়। দীর্ঘ ১৩ বছরের নিরবচ্ছিন্ন কর্মকা- শেষে এগুলো উন্মোচন করা হয়।

৩-৪ ইরানে প্রতিরক্ষা ও জাতীয় পর্যটন দিবসে গাড়ি যাত্রায় অংশ নেবেন নারী চালকরা
ইরানের পবিত্র প্রতিরক্ষা সপ্তাহ ও সেই সাথে জাতীয় পর্যটন সপ্তাহ উদ্যাপনে ২৩ সেপ্টেম্বর একটি গাড়ি শোভাযাত্রায় অংশ নেন দেশটির কিছু সংখ্যক নারী গাড়ি চালক। ট্যুরিং অ্যান্ড অটোমোবাইল ক্লাব অব ইসলামিক রিপাবলিক অব ইরানের (টিএসিআই) আয়োজনে মাজান্দারান প্রদেশের উত্তরের নামাক আবরুদ গ্রাম ও তেহরানের মধ্যখানে দুদিনব্যাপী এই গাড়ি শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়।
সমাবেশকালে কঠোর স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ববিধি মেনে চলা হয়। ১৯৬০-৮৮ সালের ইরান-ইরাক যুদ্ধের স্মরণে ইরানে প্রতি বছর পবিত্র প্রতিরক্ষা সপ্তাহ উপলক্ষে কয়েকটি কর্মসূচি পালন করা হয়। প্রতি বছর ২১ সেপ্টেম্বর প্রতিরক্ষা সপ্তাহ শুরু হয় আর জাতীয় পর্যটন সপ্তাহ শুরু হয় ২৭ সেপ্টেম্বর।

৩-৫ ড্রোন ও মিসাইল প্রযুক্তিতে বিশ্বে শীর্ষ পাঁচে ইরান
ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর (আইআরজিসি) মহাকাশ বাহিনীর কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আমির আলি হাজিজাদেহ বলেছেন, ইরানের প্রতিরক্ষা খাত ইরানি বিশেষজ্ঞদের তৈরি করা সর্বাধুনিক প্রযুক্তির সরঞ্জাম উপভোগ করছে।
গত ২৭ সেপ্টেম্বর মহাকাশ বাহিনীর সামরিক সরঞ্জাম নিয়ে প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে একথা বলেন। তিনি বলেন, ইরানের মহাকাশ সেকশন ও এর অর্জনাবলি বিশ্বের শীর্ষ পর্যায়ে রয়েছে।
অ্যারো¯েপস ফোর্সের প্রধান আরও বলেন, যখন আমরা মিসাইল, ড্রোন, রাডার উন্নয়ন স¤পর্কে কথা বলি তখন বলতে হয় এগুলো সর্বাধুনিক প্রযুক্তির এবং এই ক্ষেত্রে শীর্ষ পাঁচ দেশের মধ্যে আমরা রয়েছি।

৪ আয়াতুল্লাহ তাসখিরির ইন্তেকাল; সর্বোচ্চ নেতার শোক
মাজহাবগত ঐক্য বিষয়ক বিশ্ব সংস্থার সর্বোচ্চ পরিষদের প্রধান আয়াতুল্লাহ মোহাম্মাদ আলী তাসখিরি ইন্তেকাল করেছেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তেহরানের একটি হাসপাতালে ১৪ সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করেন ৭৬ বছর বয়সী এই বিজ্ঞ আলেম।
তিনি ইসলাম ধর্মের বিভিন্ন মাজহাবের মধ্যে মতপার্থক্য নিরসনে নিরলসভাবে পরিশ্রম করেছেন। এ সংক্রান্ত বহু বইয়ের লেখক তিনি।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ীর মুসলিম বিশ্ব বিষয়ক উপদেষ্টার দায়িত্বও পালন করে আসছিলেন আয়াতুল্লাহ তাসখিরি।
তাঁর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন সর্বোচ্চ নেতা। তিনি এক শোকবার্তায় বলেছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তিনি শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন, কিন্তু তাঁর দৃঢ় মনোবলের কাছে শারীরিক অক্ষমতাও হার মেনেছিল।

 

৫ আমেরিকার এ ব্যর্থতা জাতিসংঘের ইতিহাসে নজিরবিহীন : ড. রুহানি
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রেসিডেন্ট ড. হাসান রুহানি বলেছেন, তাঁর দেশের বিরুদ্ধে আমেরিকা অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব পাস করতে যে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে জাতিসংঘের ইতিহাসে তা নজিরবিহীন।
ইরানের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় কেরমানশাহ, পূর্ব আজারবাইজান ও আরদেবিল প্রদেশে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গত ৪ সেপ্টেম্বর প্রেসিডেন্ট রুহানি একথা বলেন। ইরানের জ্বালানি মন্ত্রণালয় এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।
গত ৪ আগস্ট জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে আমেরিকা ইরানবিরোধী নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ বাড়ানোর জন্য একটি প্রস্তাব তোলে এবং তার উপর ভোটাভুটিতে শুধু আমেরিকার পক্ষে ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্র ভোট দেয়। ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জার্মানিসহ আমেরিকার সমস্ত মিত্র দেশ এবং রাশিয়া ও চীন ওই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়।
প্রেসিডেন্ট রুহানি বলেন, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে ইরানের বিরুদ্ধে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব পাসে ব্যর্থ হওয়ার আগে জাতিসংঘের ৭০ বছরের ইতিহাসে কখনো ইরানবিরোধী প্রস্তাব পাসের জন্য আমেরিকাকে এদেশ থেকে ওদেশ ঘুরে বেড়াতে হয় নি। কয়েক মাস এভাবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভোটভিক্ষা করেও একটি মাত্র দেশের সমর্থন লাভে সক্ষম হয়েছে ওয়াশিংটন। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যাপার এবং ইরানের জনগণের দৃঢ় অবস্থানের কারণে আমেরিকাকে পরাজয় বরণ করতে হয়েছে।
এই ব্যর্থতার মধ্য দিয়ে আমেরিকার ইরানবিরোধী সমস্ত স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে গেছে বলেও মন্তব্য করেন প্রেসিডেন্ট রুহানি।

৬ ইরানে পবিত্র আশুরা পালিত; গোটা জাতি শোকাচ্ছন্ন
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গত ৩০ আগস্ট কারবালার মর্ম¯পর্শী ঘটনার স্মরণে শোকাবহ আশুরা পালিত হয়েছে। ইরানের সর্বত্রই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে নানা শোকানুষ্ঠান।
সড়কের পাশে ও খোলা স্থানে সমবেত মানুষের সামনে কান্নাজড়িত কণ্ঠে কারবালার ঘটনা বর্ণনা করা হয়। কারবালার বিভিন্ন ঘটনা বর্ণনা করতে করতে বর্ণনাকারী যেমন কেঁদেছেন তেমনি উপস্থিত জনতাও কান্না করেন ও বুক চাপড়ান।
গোটা জাতিই শোকাচ্ছন্ন। আশুরা উপলক্ষে ইরানে দুই দিন সরকারি ছুটি ছিল। করোনা মহামারির কারণে এবার সীমিত আকারে শোকানুষ্ঠান পালিত হয়।
প্রায় চৌদ্দশ’ বছর আগের আশুরার দিনে ইরাকের কারবালায় বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (স.)-এর প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র ইমাম হোসাইন (আ.) ও তাঁর ৭২ জন সঙ্গী-সাথি সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা সংগ্রামে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। অন্যায়ের কাছে মাথানত না করার কারণেই সেদিন ইমাম হোসাইন (আ.) পাপিষ্ঠ ইয়াজিদ বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে শহীদ হন। এ কারণে ১০ মহররম বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর জন্য একটি বেদনাবিধুর দিন। এ ঘটনা শুধু ইসলামের ইতিহাসেরই করুণ ঘটনা নয়, বিশ্ব ইতিহাসেরও সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা।
সত্য ও ন্যায়ের জন্য আত্মত্যাগের মহিমায় গৌরবান্বিত আশুরা আজও মুসলিম হৃদয়ে সংগ্রাম ও ত্যাগের গতি সঞ্চার করে।

৭ যথাযথ ধর্মীয় মর্যাদায় সারাদেশে পবিত্র আশুরা পালিত
যথাযথ ধর্মীয় মর্যাদা ও ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে গত ৩০ আগস্ট বাংলাদেশে পবিত্র আশুরা পালিত হয়েছে। সারাবিশ্বের মুসলমানদের কাছে আশুরার দিনটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যময়। করোনা পরিস্থিতির কারণে এবার ব্যাপক পরিসরে জনসমাবেশের মাধ্যম মুহররমের শোক মিছিল আয়োজন করা হয় নি। এ ব্যাপারে কদিন আগেই পুলিশের নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে।
রাজধানীতে ৩০ আগস্ট সকাল থেকেই পুরান ঢাকার হোসেনি দালান এলাকায় বিভিন্ন এলাকা থেকে জড়ো হয় ধর্ম অনুরাগী নারী-পুরুষগণ। এ সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা একজন একজন করে পরীক্ষা করে আর্চওয়ের মধ্য দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়। ইমামবাড়ার ভেতরে সাজানো হয় তাজিয়া।
এ বছর মিছিল করার সুযোগ না থাকলেও কালো পোশাক পড়ে শোকের আচ্ছাদনে কিশোর ও তরুণ-তরুণীরা ইমামবাড়ায় জড়ো হয়। হাতে আলাম নিয়ে তারা মিছিলের জন্য অপেক্ষাও করে। এরপর ইমামবাড়া চত্বরে আশুরার আনুষ্ঠানিকতা পালন করে।
হোসেনি দালানের ইমামবাড়া কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সীমিত পরিসরে কিছু আয়োজন হয়েছে ইমামবাড়ার ভেতরে। ওই দিন সকাল ১০টায় সীমিত পরিসরে তাজিয়া মিছিল ইমামবাড়া চত্বর প্রদক্ষিণ করেছে। এ ছাড়া সেখানে মুহররমের মজলিসও অনুষ্ঠিত হয়। সন্ধ্যায় পালিত হয় শোকের অনুষ্ঠান শামে গরিবা।
উল্লেখ্য, হিজরি ৬১ সনের (৬৮০ খ্রিস্টাব্দ) ১০ মহররম ইরাকের কুফা নগরের অদূরে ফোরাত নদীর তীরে কারবালা প্রান্তরে ইয়াজিদ বাহিনীর হাতে সঙ্গী-সাথিসহ নির্মমভাবে শহীদ হন মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর প্রিয় দৌহিত্র ইমাম হোসাইন (আ.)। অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে ইমাম হোসাইন-এর আত্মত্যাগের এই ঘটনা ইসলামের ইতিহাসে সমুজ্জ্বল হয়ে আছে। কারবালার এ শোকাবহ ঘটনা ও পবিত্র আশুরার শাশ্বত বাণী সবাইকে অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে এবং সত্য ও সুন্দরের পথে চলতে প্রেরণা যোগায়।
কারবালার শোক ও স্মৃতিকে স্মরণ করে বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্যে ছিল বিশেষ মোনাজাত, দোয়া মাহফিল ও কোরানখানি।
পবিত্র আশুরা উপলক্ষে সারা দেশে সরকারি ছুটি পালিত হয়েছে। এ উপলক্ষে বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকা বিশেষ নিবন্ধ প্রকাশ করে। বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ বিভিন্ন বেসরকারি রেডিও এবং স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেল আশুরার তাৎপর্য তুলে ধরে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা সম্প্রচার করে। দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দেন।

৮ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সহযোগিতার প্রসারে ইরান ও রাশিয়ার গুরুত্বারোপ
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে সহযোগিতা প্রসারে গুরুত্বারোপ করেছে ইরান ও রাশিয়া। গত ১৭ সেপ্টেম্বর রুশ অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সের প্রধান আলেকজান্দার সারগেয়েভের সাথে ভিডিও কনফারেন্সে মিলিত হন ইরানের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট সোরেনা সাত্তারি। এসময় তারা বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তি খাতে সহযোগিতা বাড়ানোর ওপর জোর দেন।
ভিডিও কনফারেন্সে সাত্তারি বলেন, কূটনৈতিক ক্ষেত্রে দুদেশের বিস্তৃত ও গভীর স¤পর্ক রয়েছে। একইভাবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে এই মাত্রার স¤পর্ক অর্জন করা প্রয়োজন।
সাত্তারি বলেন, প্রাচীন প্রতিবেশী দেশ হিসেবে রাশিয়া অসংখ্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সহযোগিতা সক্ষমতা ভোগ করে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশেষত অত্যাধুনিক ফার্মাসিউটিক্যাল প্রযুক্তির ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়াতে মাঠ প্রস্তুত রয়েছে।

৯ ড্রোন ও মিসাইল প্রযুক্তিতে বিশ্বে শীর্ষ পাঁচে ইরান
ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর (আইআরজিসি) মহাকাশ বাহিনীর কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আমির আলি হাজিজাদেহ বলেছেন, ইরানের প্রতিরক্ষা খাত ইরানি বিশেষজ্ঞদের তৈরি করা সর্বাধুনিক প্রযুক্তির সরঞ্জাম উপভোগ করছে।
গত ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ মহাকাশ বাহিনীর সামরিক সরঞ্জাম নিয়ে প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে একথা বলেন। তিনি বলেন, ইরানের মহাকাশ সেকশন ও এর অর্জনাবলি বিশ্বের শীর্ষ পর্যায়ে রয়েছে।
অ্যারো¯েপস ফোর্সের প্রধান আরও বলেন, যখন আমরা মিসাইল, ড্রোন, রাডার উন্নয়ন স¤পর্কে কথা বলি তখন বলতে হয় এগুলো সর্বাধুনিক প্রযুক্তির এবং এই ক্ষেত্রে শীর্ষ পাঁচ দেশের মধ্যে আমরা রয়েছি।

১০ ইরানের পার্স-১ স্যাটেলাইটের চূড়ান্ত পরীক্ষা স¤পন্ন
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের তৈরি স্যাটেলাইট ‘পার্স-১’ এর নির্মাণ শেষে চূড়ান্ত পর্যায়ের পরীক্ষা সাফল্যের সঙ্গে স¤পন্ন হয়েছে। ইরানি মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রে উন্নত প্রযুক্তির স্যাটেলাইটটির চূড়ান্ত পরীক্ষা স¤পন্ন হয়। আগামী সপ্তাহে ইরানের মহাকাশ সংস্থাকে এটি সরবরাহ করা হবে।
গত ১৪ সেপ্টেম্বর ইরানের তথ্য ও প্রযুক্তি (আইসিটি) বিষয়ক মন্ত্রী মোহাম্মাদ জাওয়াদ অযারি জাহরোমি এ তথ্য জানিয়েছেন। একটি প্রদর্শনীর উদ্বোধনীতে তিনি এই ঘোষণা দেন।
তিনি বলেন, ‘পার্স-১’ হচ্ছে ইরানের তৈরি এযাবতকালের সবচেয়ে উন্নত কৃত্রিম উপগ্রহ বা স্যাটেলাইট। ইরানি মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রে এটির চূড়ান্ত পরীক্ষা সফলভাবে স¤পন্ন হয়। এই স্যাটেলাইট রাতেও ছবি তুলে তা প্রেরণ করতে পারবে।
পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর্ব শেষ হওয়ায় এখন তা আগামী সপ্তাহে জাতীয় মহাকাশ সংস্থার কাছে হস্তান্তর করা হবে। এরপরই উৎক্ষেপণের লক্ষ্যে তৎপরতা শুরু হবে।

১১ ডুয়াল-ফুয়েল লোকোমোটিভ ইঞ্জিন উন্মোচন করলো ইরান
প্রথম ডুয়াল-ফুয়েল লোকোমোটিভ ইঞ্জিন উন্মোচন করলো ইরান। গত ১৩ সেপ্টেম্বর এক অনুষ্ঠানে ইঞ্জিনটির উদ্বোধন করে ইরান হেভি ডিজেল ম্যানুফেকচারিং কো¤পানি (ডিইএসএ)। পরিবহন ও নগর উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের পোর্টালে এই তথ্য জানানো হয়।
৪ হাজার-হর্সপাওয়ারের হেভি ইঞ্জিন উন্মোচন অনুষ্ঠানে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান রেলওয়ের (যা আরএআই নামে পরিচিত) প্রধান সাইদ রাসুলি যোগ দেন।
অনুষ্ঠানে রাসুলি বলেন, বিগত কিছু বছর দেশের রেলওয়ের পরিমাণগত এবং গুণগত বিকাশ ব্যাপকতর হয়েছে। কেরমানশাহ, হামেদান, উরমিয়া, ও গিলানসহ কয়েকটি প্রদেশ দেশের রেল নেটওয়ার্কে যুক্ত হয়েছে।
তিনি বলেন, প্রয়োজনীয় তহবিল সরবরাহ করলে আরআইএ বর্তমান সরকারের মেয়াদকালে এক হাজার কিলোমিটার নতুন রেলপথ চালু করতে সক্ষম হবে।
এই কর্মকর্তা জোর দিয়ে বলেন, এই ধরনের ইঞ্জিনের উৎপাদন দেশের রেল শিল্পের জন্য উল্লেখযোগ্য সফলতা এবং এটা এই শিল্পের বিদেশি উৎসের ওপর নির্ভরতা কমাতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে।

১২ করোনা রোগী শনাক্তে নতুন যন্ত্র আবিষ্কার করল ইরান
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের বিজ্ঞানীরা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের দ্রুত শনাক্ত করতে নতুন একটি যন্ত্র আবিষ্কার করেছেন। এই যন্ত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই মানবদেহে করোনাভাইরাসের উপস্থিতির বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারে।
ইরানের তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা গত ২৪ আগস্ট তেহরানে ন্যানোটেকনোলজি হেডকোয়ার্টার্সে এই যন্ত্র উদ্বোধন করেছেন। এটি মূলত মানুষের থুথু ও কফ সংগ্রহ করে সেটাকে নমুনা হিসেবে ব্যবহার করে।
যন্ত্রটি আবিষ্কারের সঙ্গে জড়িত গবেষকরা জানিয়েছেন, থুথু ও কফে অক্সিজেনের ক্ষুদ্র মলিকিউলের উপস্থিতির মাত্রা নির্ণয়ের মাধ্যমে যন্ত্রটি করোনাভাইরাসের উপস্থিতি স¤পর্কে সংকেত দিতে পারে।
এরই মধ্যে ইমাম খোমেইনী (রহ.) হাসপাতালসহ কয়েকটি হাসপাতালে ছয়শ’ ব্যক্তির নমুনা সংগ্রহ করে এই যন্ত্রের কার্যকারিতা পরীক্ষার কাজ স¤পন্ন করা হয়েছে। এতে যন্ত্রটির কার্যকারিতা প্রমাণিত হয়েছে এবং ইরানের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন বাণিজ্যিকভাবে এই যন্ত্র তৈরির অনুমোদন দিয়েছে।
করোনায় আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করার পাশাপাশি অ্যাজমা ও টিবি রোগে আক্রান্তদের শনাক্ত করতেও এই যন্ত্র কার্যকরী বলে গবেষকদল জানিয়েছে। এই যন্ত্র আবিষ্কারের ফলে করোনা রোগী শনাক্তের কাজ আরও সহজ হবে বলে তাঁরা দাবি করেছেন।

১৩ করোনা চিকিৎসায় ইরানে তৈরি ওষুধ ‘রেমডেসিভির’ ১০ দেশে রপ্তানি
প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় ইরানে তৈরি ওষুধ রেমডেসিভির বিশ্বের ১০টি দেশে রপ্তানি করা হয়েছে। ইরানের হাসপাতালগুলোতেও কোভিড-১৯ রোগীদের এই ওষুধ দেওয়া হচ্ছে।
ইরানের একটোভেরকো ফার্মাসিউটিক্যাল কো¤পানির নির্বাহী পরিচালক রেজা মোস্তাফি এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে ইরান প্রেসকে বলেছেন, গতমাসে ইরানের হাসপাতালগুলোতে রেমডেসিভির ওষুধ সরবরাহ করা হয়েছে এবং করোনা রোগীদের চিকিৎসায় এটি কার্যকর ভূমিকা পালন করছে।
তিনি বলেন, রেমডেসিভির করোনা রোগ চিকিৎসার জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো ওষুধ নয় তবে এটা যদি সঠিক সময়ে প্রয়োগ করা যায় তাহলে দ্রুততম সময়ের মধ্যে কোভিড-১৯ রোগীরা সুস্থ হয় উঠেন।
রেজা মোস্তাফি জানান, ইরানে তৈরি রেমডেসিভির ওষুধের দাম ধরা হয়েছে প্রায় ছয় লাখ তুমান যা অন্য দেশে তৈরি একই ওষুধের চেয়ে বেশ সস্তা।
ইরানের স্বাস্থ্যমন্ত্রী সাঈদ নামাকি গত ১৫ জুলাই জানিয়েছিলেন, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় ইরান রেমডেসিভির ওষধু তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত রোগীকে স¤পূর্ণ সুস্থ করে দিতে পারে এখন পর্যন্ত এমন নির্ভরযোগ্য কোনো ওষুধ বিশ্বে তৈরি হয়নি। তবে আমেরিকা ও ইউরোপীয় দেশগুলোতে করোনার চিকিৎসার জন্য রেমডেসিভির প্রয়োগ করা হচ্ছে।

১৪। ৪৫ দেশে ন্যানোপণ্য রপ্তানি করছে ইরান
ইরান বর্তমানে বিশ্বের ৪৫টির বেশি দেশে ন্যানোপণ্য রপ্তানি করছে। ন্যানোপ্রযুক্তি পণ্যের ডাটাবেজে প্রকাশিত পরিসংখ্যান থেকে এই তথ্য জানা গেছে।
২২ জুলাই হতে ইরানের ৩০টি ইরানি কো¤পানি ৬৮৪টি ন্যানোপণ্য উৎপাদন করছে। এর মধ্যে ২৫৯টি পণ্যের ন্যানোস্কেল ছাড়পত্র রয়েছে।
৬৮৪টি ন্যানোপণের মধ্যে ২১৫টি সাজ-সরঞ্জাম সংশ্লিষ্ট এবং ৪৬৯টি মালামাল সংশ্লিষ্ট। এসব পণ্য অস্ট্রেলিয়া, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও অঞ্চলের অন্যান্য দেশগুলোসহ ৪৫টির অধিক দেশে রপ্তানি করা হয়। ইরানে বিগত সাত বছরে ন্যানোপণ্যের সংখ্যায় উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি প্রবণতা দেখা গেছে।

১৫ ইরানের সিমেন্ট রপ্তানিতে আয় ১২৮ মিলিয়ন ডলার
চলতি ফারসি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে (২০ মার্চ থেকে ২১ আগস্ট) ইরান ৫ দশমিক ৮৪৭ মিলিয়ন টন সিমেন্ট রপ্তানি করেছে। এই রপ্তানি থেকে দেশটির আয় হয়েছে ১২৭ দশমিক ৯৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের শুল্ক প্রশাসন (আইআরআইসিএ) এই তথ্য জানিয়েছে।
উল্লিখিত পাঁচ মাসে ইরানি সিমেন্টের প্রধান প্রধান আমদানিকারক দেশ ছিল ভারত, আফগানিস্তান, রাশিয়া, ইরাক, কাতার, কেনিয়া, কুয়েত, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, আর্মেনিয়া, তুর্কমেনিস্তান, কাজাখস্তান, আজারবাইজান, বাংলাদেশ, চীন এবং ওমান। এই সময়ে সবচেয়ে বেশি সিমেন্ট আমদানি করেছে ইরাক, কুয়েত ও আফগানিস্তান।
ইরানে বছরে ৮৫ মিলিয়ন টন সিমেন্ট উৎপাদিত হয় এবং দেশটির অভ্যন্তরীণ চাহিদা ৬৫ মিলিয়ন টন। ইরান বর্তমানে বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম সিমেন্ট উৎপাদক দেশ। গত বছর দেশটি ৭ বিলিয়ন ডলারের নির্মাণ সামগ্রী রপ্তানি করেছে।

১৬ ইরানে প্রতিস্থাপন ওষুধ উৎপাদনে ২০ মিলিয়ন ডলার সাশ্রয়
ইরানের একটি বিজ্ঞানভিত্তিক কো¤পানি অঙ্গ প্রতিস্থাপনে প্রয়োজন এমন একটি ওষুধ দেশীয়ভাবে উৎপাদন করে বছরে ২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের অধিক সাশ্রয় করতে সফল হয়েছে। সম্প্রতি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক ভাইস প্রেসিডেন্সি সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।
আইমনোরাল নামের দেশীয় ওষুধটি অভ্যন্তরীণ চাহিদার ৯৫ শতাংশ পূরণ করে। অঙ্গ প্রতিস্থাপন করা রোগীদের ওষুধটি সেবন করার জন্য লেখা হয়। রোগীর শরীর যাতে প্রতিস্থাপিত অঙ্গ প্রত্যাখ্যান না করে সেজন্য এটি শরীরে ইমিউন সিস্টেমকে দমন করে রাখতে পারে।
আইমনোরালের ২৫, ৫০ ও ১০০ গ্রামের তিনটি ডোজ রয়েছে। বছরে ওষুধটির উৎপাদন ও বিক্রয় মূল্য বছরে বিলিয়ন রিয়াল। একই ধরনের বিদেশি নমুনার তুলনায় এটি ৪০ শতাংশ সস্তা। অন্যদিকে. কয়েকটি পরীক্ষায় ওষুধটির উচ্চ মানের প্রমাণ পাওয়া গেছে।

১৭ ভেনিজুয়েলায় পৌঁছেছে ইরানের তরলীকৃত গ্যাসবাহী জাহাজ
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান থেকে প্রথমবারের মতো একটি কার্গো জাহাজে করে তরলীকৃত গ্যাস নেয়া হয়েছে ভেনিজুয়েলায়। এরই মধ্যে কার্গো জাহাজ থেকে এই গ্যাস ভেনিজুয়েলার পোর্টো হোসে বন্দরে খালাস করা হয়েছে।
শনিবার থেকে জাহাজটিতে গ্যাস খালাস করা শুরু হয়। ইরানের সাউথ পার্স গ্যাসক্ষেত্র থেকে এ জাহাজে প্রায় ২০ লাখ ব্যারেল তরলীকৃত গ্যাস ভেনিজুয়েলায় নেয়া হয়।
এই প্রথম ইরান ও ভেনিজুয়েলার মধ্যে গ্যাস লেনদেনের ঘটনা ঘটলো। এর আগে ইরান থেকে অন্তত পাঁচটি জাহাজে করে জ্বালানি তেল নেয়া হয়েছে ভেনিজুয়েলায়।
ইরান থেকে ভেনিজুয়েলায় জ্বালানি তেল রপ্তানি করা হয়েছিল গত মে এবং জুন মাসের মধ্যে। এরপর এই গ্যাস রপ্তানি করা হলো। জ্বালানি তেল রপ্তানি সময় আমেরিকা ইরানি জাহাজ আটক কিংবা ওই জাহাজে হামলার হুমকি দিয়েছিল।
ইরান সমস্ত হুমকি উপেক্ষা করে তেল রপ্তানি অব্যাহত রাখে। শুধু তাই নয়- ইরান তখন প্রস্তুতি নিয়েছিল যে, আমেরিকা যদি ইরানি জাহাজ আটক করে তাহলে ইরানও পারস্য উপসাগরে মার্কিন জাহাজ আটক করবে।

১৮ ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্যের নিবন্ধন তালিকায় দশম ইরান
জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্যের নিবন্ধন তালিকায় সর্বোচ্চ সংখ্যক ঐতিহাসিক নিদর্শন ও স্থান থাকার দিক দিয়ে দশম স্থানে রয়েছে ইরান।
ইরানের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, হস্তশিল্প, ও পর্যটন সংস্থার বিশ্ব ঐতিহ্য বিষয়ক দপ্তরের পরিচালক ফারহাদ আজিজি বলেন, ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় ঐতিহাসিক নিদর্শন ও স্থান থাকার সংখ্যার দিক দিয়ে ইরান দশম স্থানে রয়েছে। দেশের পর্যটনের উন্নয়নে এই অবস্থানের অগ্রগতিকরণ খুবই কার্যকর হতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
ইরানের ইসলামি বিপ্লবের আগে দেশটিতে ইউনেসকোর তালিকাভুক্ত মাত্র তিনটি স্মৃতিস্তম্ভ ছিল। এগুলো হলো পারসেপোলিস, নাকশ-ই জাহান স্কয়ার ও চোঘাজানবিল। কিন্তু আজকে ঐতিহাসিক এসব স্থানের এই সংখ্যা বেড়ে ২৪টিতে দাঁড়িয়েছে।
১৯ ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে বিদায়ী সংবর্ধনা
গত ১৭ সেপ্টেম্বর ঢাকাস্থ ইরান দূতাবাসের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের ডেপুটি কালচারাল কাউন্সেলর ড. সাইয়্যেদ মাহদী হোসেইনী ফায়েকের বিদায়ী সংবর্ধনা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ড. মাহদী ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে দুই বছর দায়িত্ব পালন শেষে ২০ সেপ্টেম্বর ২০২০ ইরানে ফিরে যান।
অনুষ্ঠানে ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের কালচারাল কাউন্সেলর ড. সাইয়্যেদ হাসান সেহাত বলেন, যাঁরা দেশের বাইরে কর্মক্ষেত্রে দায়িত্ব পালন করেন তাঁদের একটি সময়ে নিজ দেশে ফিরে যেতে হয়। এটিই নিয়ম। ড. মাহদীও তাঁর ওপর অর্পিত দায়িত্ব দক্ষতার সাথে স¤পাদন করে নিজ দেশে ফিরে যাচ্ছেন। আমরা তাঁর সাফল্য কামনা করছি।
তিনি আরো বলেন, একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা কর্মচারীরা একটি ফুটবল দলের মতো যেখানে দলীয়ভাবে সবাইকে দায়িত্ব পালন করতে হয়। প্রত্যেকে নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে সাফল্যের পরিচয় দিলেই দলীয় সাফল্য অর্জিত হয়। একজনের ব্যর্থতায় পুরো দল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এক্ষেত্রে কাজের মধ্যে বড়-ছোট কোনো ভেদ নেই।
অনুষ্ঠানে ইরান ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের ভাইস প্রিন্সিপাল আব্দুল কুদ্দুস বাদশা বলেন, দুটি বছর যেন খুব দ্রুতই চলে গেছে। ড. মাহদী যখন বাংলাদেশে আসেন তখন থেকেই বিভিন্ন সমস্যার মোকাবিলা করে তাঁকে কাজ করতে হয়েছে এবং তিনি দক্ষতার সাথে সবকিছুকে মোকাবিলা করেছেন। ঢাকাস্থ ইরান ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের কর্মকা-ে সময় ব্যয় করেছেন এবং পরামর্শ দিয়েছেন। বয়সের তুলনায় তাঁকে অনেক অভিজ্ঞ মনে হয়েছে। তিনি তাঁর অভিজ্ঞতার সর্বোচ্চটুকু দিয়ে আমাদেরকে সাহায্য ও পরিচালনা করেছেন। অধিকাংশ সময় কালচারাল কাউন্সেলরের অনুপস্থিতিতে তাঁকে গুরুদায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। আমরা তাঁর সর্বাঙ্গীন সফলতা কামনা করছি।
ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের চলচ্চিত্র ও জনসংযোগ বিভাগের উপপরিচালক মো. সাইদুল ইসলাম বলেন, যে কোনো বিদায়ই অনেক কষ্টের। আজও আমাদেরকে ভারাক্রান্ত মনে ড. মাহদী হোসেইনীকে বিদায় জানাতে হচ্ছে। তিনি একজন দক্ষ ও সক্রিয় কর্মকর্তা ছিলেন যিনি নানা প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করে সফলভাবে কর্মতৎপরতা চালিয়েছেন। আমরা তাঁর প্রতি আমাদের আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
সবশেষে ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের কালচারাল কাউন্সেলর ড. হাসান সেহাত ড. মাহদী হোসেইনীর হাতে বিদায়ী সম্মাননা তুলে দেন। অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পক্ষ থেকে তাঁকে একটি স্মারক উপহার প্রদান করা হয়।অনুষ্ঠানে ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের কর্মকর্তা ও কর্মিগণ উপস্থিত ছিলেন।

২০ রসায়নবিদ রাজির স্মরণে ইরানে ফার্মাসিউটিক্যাল দিবস উদ্যাপন
পার্সিয়ান চিকিৎসক এবং দার্শনিক আবু বকর মোহাম্মাদ ইবন যাকারিয়া আল-রাজির স্মরণে ২৬ আগস্ট ইরানে ফার্মাসিউটিক্যাল দিবস উদযাপিত হয়েছে। এদিন তিনি জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর সম্মানে জন্মদিবসে ফার্মাসিউটিক্যাল দিবস পালন করা হয়।
রাজি ৮৪১ খ্রিস্টাব্দে ইরানের তেহরানে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি চিকিৎসাবিদ্যা, আল-কেমি, পদার্থবিদ্যা এবং অন্যান্য বিষয়ের উপর ১৮৪টিরও বেশি বই লিখেছেন। তিনি সালফিউরিক এসিড আবিষ্কার করেন। তিনি ইথানল উৎপাদন, বিশোধন ও চিকিৎসায় এর ব্যবহার প্রক্রিয়া আবিষ্কার করেন। তিনি একজন বিখ্যাত ইসলামি চিন্তাবিদ ছিলেন। তিনি বহু দেশ ভ্রমণ করেন।
তিনি বিশ্বের সেরা মনীষীদের একজন। একই সাথে তিনি চিকিৎসক, চিকিৎসাবিজ্ঞানী, দার্শনিক ও রসায়নবিদ হিসেবে খ্যাতিমান। তিনি ছিলেন তাঁর সময়ের মুসলিম জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ চিকিৎসক। জ্ঞানরাজ্যের অন্যান্য শাখাতেও তিনি অভিজ্ঞতা অর্জন করেন।
আল-রাজি রসায়নশাস্ত্রে অনেক নতুন বিষয় প্রবর্তন করেন। এর মধ্যে বিভিন্ন প্রতীক চিহ্ন অন্যতম। তাঁকে বর্তমান রসায়নশাস্ত্রের অন্যতম প্রবর্তক হিসেবে অভিহিত করা যায়। চিকিৎসাশাস্ত্রে তিনি বহু বই লিখেন। জ্যোতির্বিজ্ঞান ও জ্যামিতির ওপরও তিনি বই লিখেন। বল-বিজ্ঞানে ওজন স¤পর্কিত তাঁর একটি বইয়ের খোঁজ পাওয়া যায়, যার নাম মিজান তাবিই। পদার্থ ও আলোকবিজ্ঞান স¤পর্কেও তিনি বই লিখেন, যার অনেকগুলোই বিলুপ্ত।
আল-রাজির পুরো নাম আবু বকর মুহাম্মদ ইবনে জাকারিয়া আল-রাজি। তবে তিনি আল-রাজি বা আর-রাজি নামে বেশি পরিচিত। পশ্চিমা বিশ্বে তিনি জযধুবং বা জধংরং নামে পরিচিত। তাঁর জন্ম পারস্যের (ইরান) রেই নগরে, যা বর্তমানে বৃহত্তর তেহরানের অংশ, ৮৬৫ সালে মতান্তরে ৮৬৪ সালে। মৃত্যু ৯২৫ সালে মতান্তরে ৯৩০ সালে।

২১ রেজিস্টেন্স চলচ্চিত্র উৎসবে তিন প্রবীণ ইরানি শিল্পীকে সম্মাননা
ষোড়শ রেজিস্টেন্স আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে তিন কিংবদন্তি ইরানি শিল্পীকে সম্মাননা জানানো হয়েছে। উৎসবের সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রবীন শিল্পী জমশিদ হাশেমপুর, জামাল শোরজেহ ও মোহসেন আলি আকবারিকে এই সম্মাননা দেয়া হয়।
জমশিদ হাশেমপুর তেহরানে ১৯৪৪ সালের ২৩ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬৮ সালে ‘হোয়াইট হেল’ সিনেমা দিয়ে চলচ্চিত্রে তার অভিষেক ঘটে।
১৯৮৩ সালে নির্মিত ‘উইক পয়েন্ট’ ছবিতে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে তিনি চলচ্চিত্র নির্মাতাদের নজর কাড়তে সক্ষম হন।
জামাল শুরজেহ অন্যতম চলচ্চিত্র নির্মাতা, যার নাম পবিত্র প্রতিরক্ষা ও বিপ্লবের সাথে জড়িয়ে রয়েছে। ইরান-ইরাক দীর্ঘ আট বছরের যুদ্ধে বিজয় শেষে তিনি সবসময় পবিত্র প্রতিরক্ষা নিয়ে সিনেমা নির্মাণের কাজে ব্যস্ত ছিলেন।
মোহসেন আলি আকবারিও পবিত্র প্রতিরক্ষা নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ নিয়ে সর্বদা চিন্তা-ভাবনা করতেন। প্রতিরক্ষা নিয়ে তিনি বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন।

২২ ইরানের করোনা ভাইরাস কার্টুন প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণ
ইরানের ‘উই ডিফিট করোনাভাইরাস’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক কার্টুন প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠিত হয়েছে। তেহরানে ৫ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় করোনা ভাইরাস মহামারি নিয়ে অনুষ্ঠিত কার্টুন প্রতিযোগিতার বিজয়ীদের মাঝে এসব পুরস্কার তুলে দেয়া হয়।
প্রতিযোগিতায় শীর্ষ পুরস্কার লাভ করেন ইরানি কার্টুনিস্ট আলি রাদমান্দ। ইভেন্টের প্রধান আয়োজক আর্ট ব্যুরোর পরিচালক মোহাম্মাদ মেহদি দাদমানের কাছ থেকে তিনি পুরস্কার গ্রহণ করেন।
করোনাভাইরাস মহামারিতে ভ্রমণ বিধিনিষেধ থাকায় অনুষ্ঠানে কোনো বিদেশী বিজয়ী যোগদান করতে পারেননি। তাঁদের কাছে পুরস্কার পাঠিয়ে দেয়া হবে বলে জানিয়েছেন আর্ট ব্যুরোর ভিজুয়াল আর্টস অফিসের পরিচালক মাসুদ শোজায়েই-তাবাতাবাই।
পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে দাদমান বলেন, করোনাভাইরাসের সাথে মানুষ কিভাবে তাদের জীবনযাত্রাকে খাপ খাওয়াতে পারে তা শিখতে শিল্পীদের সাহায্য করা উচিত। কার্টুনের মাধ্যমে জনগণকে করোনাভাইরাসের হুমকি স¤পর্কে সচেতন করার চেষ্টা করেছেন বলে জানান তিনি।
ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় ইরান আর্টস ব্যুরোর আয়োজনে অনুষ্ঠিত এই কার্টুন প্রতিযোগিতার বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হয় গত ২৫ আগস্ট। প্রথম পুরস্কার হিসেবে রাদমান্দ দেড় হাজার ইউরো জিতে নিয়েছেন। দ্বিতীয় পুরস্কার হিসেবে এক হাজার ইউরো লাভ করেছেন ব্রাজিলের কাউ গোমেজ এবং তৃতীয় পুরস্কার হিসেবে পাঁচশ ইউরো পেয়েছেন বেলজিয়ামের স্টেফান প্রোফিজন।

২৩ তাজিকিস্তানে ইরানি আলোকচিত্রীর শীর্ষ পুরস্কার লাভ
তাজিকিস্তানের রাজধানী দুশেনবেতে অনুষ্ঠিত প্রথম সোমোনি আন্তর্জাতিক আলোকচিত্র প্রদর্শনীতে শীর্ষ পুরস্কার লাভ করেছে ইরানি আলোকচিত্রী আমিন মাহদাভি ও মেহরজাদ মাকসুদিয়ান। গত ৩০ আগস্ট প্রতিযোগিতার বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হয়।
আন্তর্জাতিক আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করে ফটোগ্রাফিক সোসাইটি অব আমেরিকা (পিএসএ) ও ফেডারেশন ইন্টারন্যাশনাল ডি আইআর্ট ফটোগ্রাফিক (এফআইএপি)।
মাহদাভি তাঁর ‘বোল্ড ফটো’র জন্য এফআইএপি স্বর্ণপদক লাভ করেন। তাঁর তোলা ছবিটিতে একজন বালককে কাঁধে করে একটি ছাগলছানা বহন করে নিয়ে যেতে দেখা যায়। এটি তোলা হয়েছে উত্তরাঞ্চলীয় ইরানের পল্লি এলাকা থেকে।
এছাড়া ইরানি আলোকচিত্রী আমির-হোসেইন হোনারভি, মাহমুদ কামেলি, আমির-আলি নাভাদেশাহলা, সৈয়দ মোহাম্মাদ-জাভাদ সাদরি ও মেহদি জাবোলাব্বাসি সম্মানজনক মেনশন লাভ করেন।

২৪ আন্তর্জাতিক চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় প্রথম ইরানি কিশোর
চীনে অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ আন্তর্জাতিক এশিয়ান শিশু চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় পুরস্কার জিতেছে ইরানি কিশোর পারমিয়ান খোসরোবাদি।
১২ বছর বয়সী এই কিশোর উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় ইরানের এসফারায়েনের ইন্সটিটিউট ফর দ্যা ইন্টেলেকচুয়াল ডেভেলপমেন্ট অব চিলড্রেন অ্যান্ড ইয়ং অ্যাডাল্টসের একজন সদস্য। চীনের এশীয় শিশুদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার ষষ্ঠ আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে প্রথম স্থান অধিকার করে।
শান্তির বিষয়বস্তু নিয়ে আয়োজিত শিশু-কিশোরর চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতাটি চায়না শহর বেনশিতে অনুষ্ঠিত হয়। এশিয়ার শিশুদের মধ্যে সাংস্কৃতিক ও শিল্পগত স¤পর্ক সম্প্রসার এবং ভবিষ্যতে বন্ধুত্ব প্রসারে একটি উপযুক্ত ক্ষেত্র তৈরি করতে এই প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। এতে বিশ্বের সাতটি দেশের ৪৩৯টি চিত্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে।

২৫ আন্তর্জাতিক গণিত অলি¤িপয়াডে ইরানের ৬ পদক
৬১তম আন্তর্জাতিক গণিত অলি¤িপয়াডে (আইএমও) একটি স্বর্ণ, তিনটি রৌপ্য ও দুটি ব্রোঞ্জপদক পেয়েছে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান। মোট ১৪৯ নম্বর পেয়ে ১০৭টি দেশের মধ্যে ১৮তম স্থান অধিকার করেছে ইরান।
রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ থেকে ভার্চ্যুয়ালি অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক গণিত অলি¤িপয়াডে পুরস্কার বিজয়ীদের নামের তালিকা গত ২৭ সেপ্টেম্বর প্রকাশ করা হয়। ৪২ নম্বরের মধ্যে ৩৩ নম্বর পেয়ে ইরানের পক্ষে একমাত্র স্বর্ণপদকটি পেয়েছেন আলীরেজা হাকি।
ইরানের রৌপ্যপদক জয়ী অন্য তিন প্রতিযোগী হলেন মোহাম্মদ মোশতাকিফার (প্রাপ্ত নম্বর ২৮), কিয়ান শামসাইয়া (২৪ নম্বর) এবং আলী মিরজায়ী আনারি (২৪)। ব্রোঞ্জপদক প্রাপ্তরা হলেন মতিন ইয়াদোল্লাহি (২৩ নম্বর) এবং সাইয়েদ রেজা হোসাইনি দোলাতাবাদি (১৭)। ইরান গণিত দলের নেতৃত্ব দেন মোর্তেজা সাকাফিয়ান। সহকারি কোচ ছিলেন সাইয়েদ হেসাম ফিরোজি।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান ১৯৮৫ সালে প্রথম আন্তর্জাতিক গণিত অলি¤িপয়াডে অংশ নেয়। এ পর্যন্ত ৩৫ বার অলি¤িপয়াডে অংশ নিয়ে ৪৬টি স্বর্ণ, ১০০টি রৌপ্য, ৪৫টি ব্রোঞ্জপদক এবং ৪টি সম্মানসূচক স্বীকৃতি পেয়েছে।

২৬ আন্তর্জাতিক ইনফরমেটিকস অলি¤িপয়াডে ইরানি শিক্ষার্থীদের চার মেডেল
আন্তর্জাতিক ইনফরমেটিকস অলি¤িপয়াডে (আইওআই ২০২০) ইরানের শিক্ষার্থীরা তিনটি স্বর্ণপদক ও একটি রৌপ্যপদক জিতেছে। সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত স্কুল–কলেজের শিক্ষার্থীদের এই আন্তর্জাতিক ক¤িপউটার প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতার এবারের ৩২তম পর্বে তারা এসব পদক জিতে।
ইরানি শিক্ষার্থী শায়ান পারদিস, আলি সাফারি ও কাসরা মাজাহেরি স্বর্ণপদক জিতেছ এবং আবোলফজল সোলতানি জিতেছে রৌপ্যপদক। সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক ইনফরমেটিকস অলি¤িপয়াডের এবারের আসরে তারা মোট চারটি পদক ঘরে তোলে।
আন্তর্জাতিক এই প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের র‌্যাঙ্কিংয়ে বিশ্বে চতুর্থ স্থান দখল করে ইরানি দল। প্রতিবেদন মতে, চায়না, আমেরিকা ও দক্ষিণ কোরিয়ার দল যথাক্রমে প্রথম থেকে তৃতীয় স্থান লাভ করে।
করোনা ভাইরাস মহামারির কারণে এবার ৩২তম আন্তর্জাতিক ইনফরমেটিকস অলি¤িপয়াড ১৩ থেকে ১৯ সেপ্টেম্বর ভারচুয়ালি অনুষ্ঠিত হয়।

 

 

 

 

 

ইরানি প্রবাদ

 

شتر دیدی ندیدی
উচ্চারণ : শোতোর দীদী না দীদী
অর্থ : তুমি উট দেখেছ? দেখনি।
মর্মার্থ : তার মানে, যে রহস্য কথা বলা উচিত নয়, তা মুখেও আনবে না। তুমি উট দেখেছ বটে তারপরও বল যে, আমি উট কেন, উটের পদচিịও দেখিনি।
شتر را چه به علاقبندی
উচ্চারণ : শোতোর রা’ চে বে এলা’কবান্দি
অর্থ : বুদ্ধিমত্তায় চলা কি উটের কাজ?
মর্মার্থ : এমন কথা বল যা যুক্তিতে ও বিবেক বুদ্ধির সাথে খাপ খায়। কথায় বলে, সুতার মিস্ত্রির কাজ বানরের কাজ নয়।
شتر سواری و دولا دولا
উচ্চারণ : শোতোর সওয়া’রী ও দোলা’ দোলা’
অর্থ : উটে সওয়ার হয়ে আবার দুলে দুলে
মর্মার্থ : সবার কাছে জানা আছে এমন রহস্য গোপন করে রাখা।
شتر گاو و پلنگ
উচ্চারণ : শোতোর গা’ও ও পালাঙ্গ
অর্থ : উট, গরু ও নেকড়ে
মর্মার্থ : এলোমেলো জগাখিচুড়ি লোকসমাবেশ। অসংগতিপূর্ণ সব লোকের সমাগম যেখানে। যেমন বলা হয়,
একদিকে আমাদের মজলিস সুন্দর পরিপাটি
অপরদিকে লাখ লাখ মানুষের আহাজারি।
পুলিশী শাসন চলছে আর জীবন রুদ্ধশ^াসে
উট, গরু নেকড়ের শাসন, মগের মুল্লুক একেই বলে।
شتر مرد و حاجی خلاص
উচ্চারণ : শোতোর মোর্দ ও হা’জী খালাস
অর্থ : উটটা মরে গেল আর হাজী নিষ্কৃতি পেল।
মর্মার্থ : কারো কর্ম প্রচেষ্টা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে বুঝাতে এ প্রবাদটির ব্যবহার ব্যাপক। যেমন বলা হয়, পানি যাঁতাকল থেকে নেমে গেছে।
شتر مرغ را گفتند بار بردار گفت من مرغم، گفتند پرواز کن گفت شترم
উচ্চারণ : শোতোর মোর্গ রা’ গোফতান্দ বা’র বারদা’র, গোফত মন মোর্গাম, গোফতান্দ পারওয়ায কুন গোফত শোতোরাম।
অর্থ : উটপাখিকে বলা হলো, ‘তুমি বোঝা বহন কর।’ সে বলে, ‘আমি তো পাখি।’ তাকে বলা হয়, ‘পাখি হলে তুমি উড়াল দাও, বলে আমি হলাম উট।’
মর্মার্থ : কেউ দায়িত্ব কাঁধে না নেয়ার জন্য বাহানা ও অজুহাত দেখালে তার ব্যাপারে এই প্রবাদটি প্রয়োগ করা হয়।
شتر نقاره خانه است
উচ্চারণ : শোতোরে নাক্কা’রে খা’নে আস্ত
অর্থ : যে ঘরে ঢোলবাদ্য বাজে সে ঘরের উট।
মর্মার্থ : অর্থাৎ তোমার কথা শোনার জন্য তার কান প্রস্তুত নয়। তোমার কথার প্রতি কারো ভ্রুক্ষেপ নেইÑ এ কথা বুঝাতে এই প্রবাদের ব্যবহার।
شراب مفت را قاضی هم می خورد
উচ্চারণ : শারা’বে মোফত রা’ কা’জী হাম মী খোরদ
অর্থ: মদ মাগনা পেলে কাজী সাহেবও খায়।
মর্মার্থ : যদি কারো ভাগ্যে কোনো নেয়ামত বা সুযোগ সুবিধা জুটে তা প্রত্যাখ্যান করা উচিত নয় বুঝাতে এই প্রবাদ ব্যবহৃত হয়।
شرم و حیا را قورت دادن
উচ্চারণ : শারমো হায়া’ রা’ কোর্ত দা’দান
অর্থ: লজ্জা শরম গিলে ফেলা।
মর্মার্থ : লজ্জা শরমের মাথা খাওয়া। হায়া শরম পদদলিত করা ও নির্লজ্জতা বুঝাতে এ প্রবাদের প্রচলন ব্যাপক।
شر و ور گفتن
উচ্চারণ : শার ও ওয়ার গোফতান
অর্থ: উল্টাপাল্টা কথা বলা।
মর্মার্থ : ভিত্তিহীন, এলোপাতাড়ি কথা বলা। আজে বাজে বক বক করা।
شریک اگر خوب بود خدا هم می گرفت
উচ্চারণ : শরীক আগার খূব বূদ খোদা’ হাম মী গেরেফত
অর্থ : অংশীদার ভালো কিছু হলে আল্লাহও তা গ্রহণ করতেন।
মর্মার্থ : সবকিছুতে অংশীদারিত্ব ভালো নয় বুঝাতে এই প্রবাদটি ব্যবহৃত হয়।
شریک دزد و رفیق قافله
উচ্চারণ : শারীকে দোয্্দ ও রাফীকে কা’ফেলে
অর্থ : চোরের অংশীদার আবার কাফেলারও বন্ধু।
মর্মার্থ : যে ব্যক্তি উভয় পক্ষের সাথে আঁতাত রাখে। দ্বিমুখি চরিত্রের ফন্দিবাজ মানুষ বুঝাতে এই প্রবাদ ব্যবহৃত হয়।
অনুবাদ : ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী

 

পর্যটন শিল্পে ইরানের সাফল্য

সাইদুল ইসলাম
ভ্রমণপিপাসু মানুষ একটু সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়ে নতুন দিগন্তের খোঁজে। পাহাড়, নদী, সাগর বা অরণ্যের সান্নিধ্যে যেতে ছুটে চলে পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। জীবনের ব্যস্ত সময় থেকে ছুটি নিয়ে একটু প্রশান্তির খোঁজে ছুটে চলা এসব মানুষকে যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দেশ ইরান। বলা হয়ে থাকে, পৃথিবীর অর্ধেক সৌন্দর্যের দেশ এটি। অনেকে আবার বলেন, ইরানের ইসফাহান শহর দেখলেই যেন পৃথিবীর অর্ধেক সৌন্দর্য দেখা হয়ে যায়। যেমনটি ফারসিতে বলা হয়ে থাকে, ‘শাহরে ইসফাহান, নেসফে জাহান’।
সত্যিই তাই, পৃথিবীর অর্ধেক সৌন্দর্য নিয়ে এক ঘোরলাগা প্রাকৃতিক মহুয়া বন, জনশূন্য বিরান মরুভূমি আর এবড়ো-থেবড়ো সুউচ্চ পাহাড়ের কোল ঘেঁষে অবস্থান করছে ইসফাহান প্রদেশ। এখানকার উঁচু পাহাড়গুলোর মধ্যে রয়েছে বিদকান এবং সিমানসাফে। সাফাভি শাসনামলের ইরানের রাজধানী ইসফাহানের সৌন্দর্যের নয়নাভিরাম দৃশ্যাবলি আর ইমাম স্কয়ারে ইমাম মসজিদের কারুকার্যময় দেয়ালচিত্র ও চোখধাঁধানো রং-বেরঙের হাজারও বাতির আলোর নাচন কিংবা ‘নাকশে জাহান’-এর স্ফটিকশুভ্র আলোগুলো যেকোনো পর্যটককে মুগ্ধ করবে।
ইসফাহান শহরের মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে যায়াইন্দে রুদ নদী। নদীটি শহরটিকে দু’ভাগে ভাগ করে দিয়েছে। নদীটি পূর্ব-পশ্চিমে প্রবাহিত হওয়ায় শহরটি উত্তর-দক্ষিণে বিভক্ত হয়েছে। কেন্দ্রীয় ইরানের মধ্যে সবচেয়ে জলটৈটুম্বুর নদী হলো এই যায়াইন্দে রুদ। এ নদীর ওপর তৈরি করা হয়েছে খাজু ব্রিজ বা সেতু, আল্লাভারদিখান সেতু বা সি ও সেহ সেতু ও শাহরেস্তান সেতুÑ যা সত্যি দেখার মতো। সি ও সেহ পুল বা তেত্রিশ দ্বার বা গেটবিশিষ্ট সেতুটি দৈর্ঘ্যে তিনশ’ মিটার আর প্রস্থে চৌদ্দ মিটার। যাইয়ান্দে রুদের ওপরে যতগুলো সেতু আছে সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে লম্বা সেতু এটি। ইসফাহান শহরে নদীটির ওপর অসংখ্য সেতু ও নদীর দুই পাড় বাধাই করার পাশাপাশি পানির ফোয়ারা ও ফুলের বাগান দিয়ে নদীর দুই ধার এমনভাবে সাজানো হয়েছে, যেখানে কোনো পর্যটক এলে নিঃসন্দেহে তার হৃদয়-মন প্রশান্তিতে ভরে যাবে। এছাড়া এই শহরে রয়েছে বিখ্যাত ফ্লাওয়ার ও বার্ড গার্ডেন। কেউ ইসফাহানের এ দুটি গার্ডেন পরিদর্শন করেছেন, অথচ তা তাঁর স্মৃতির মণিকোঠায় চিরদিনের জন্য ঠাঁই করে নেয়নি এ যেন একেবারেই অবিশ্বাস্য। কারণ, পৃথিবীর এমন কোনো প্রজাতির ফুল নেই যা ইসফাহানের ফ্লাওয়ার গার্ডেনে পাওয়া যাবে না। একইসাথে আপনি যদি ইসফাহানের বার্ড গার্ডেন পরিদর্শন করেন তাও যে আপনার হৃদয়-মন ভরিয়ে দেবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বার্ড গার্ডেন পরিদর্শনকারীর চারপাশে বিচিত্র রকমের পাখি উন্মুক্তভাবে ঘুরে বেড়ানোর দৃশ্য যে কোনো পর্যটকের মনোযোগ আকর্ষণ করতে বাধ্য।
একইভাবে ইরানের আরেকটি আকর্ষণীয় নগরী শিরাজের কথা না বললেই নয়। ইতিহাস, ঐতিহ্য ও কাব্য-সাহিত্যের ডানায় ভর করে সম্ভবত পৃথিবীর আর কোনো স্থান এত জনপ্রিয় হয়নি কখনও।
শিরাজ ইরানের দক্ষিণ-পশ্চিমে ফার্স প্রদেশে অবস্থিত। যাকে বলা হয় গোলাপ, বাগান ও বুলবুলের শহর। যদিও বিশ্ব জনমানসে শিরাজের বেশি পরিচিতি কবি ও কবিতার শহর হিসেবে। কবিরাই হচ্ছেন ইরানের বুলবুল, যাঁদের গান পৃথিবীর কবিরা আজও ফেরি করে ফেরেন। বলা হয়, ইরানেরই আরেক নগরী নিশাপুর (ওমর খৈয়ামের জন্মভূমি) ছাড়া আর কোনো শহর বিশ্বজোড়া এত খ্যাতি লাভ করেনি। শিরাজের যেসব কবি-সাহিত্যিকের কাব্যকৃতী আজো পৃথিবীতে অম্লান, তাঁদের একজন সা’দী শিরাজী এবং অপর জন ‘বুলবুল-ই-শিরাজ’ বা ‘শিরাজের বুলবুল’ বলে খ্যাত মহাকবি হাফিজ।
ইরানের দর্শনীয় ঐতিহাসিক স্থানগুলোর অন্যতম হলো ‘তাখ্তে জামশীদ’। পাশ্চাত্যে একে ‘পার্সেপোলিশ’ নামেও অভিহিত করা হয়, যা এই ফার্স প্রদেশেই অবস্থিত। ‘তাখ্তে জামশীদ’ একটি প্রাচীন রাজপ্রাসাদ। ইরানের হাখামানশী বংশের বাদশাহদের এই নগরী প্রাচ্য সভ্যতার এক উজ্জ্বল নিদর্শন হিসেবে আজো টিকে রয়েছে। কালের বিবর্তনে এই নগরীর জৌলুশ আর নেই। তবে এর ধ্বংসাবশেষ আজো বিশ্ববাসীকে প্রাচীন পারস্য সভ্যতার শৌর্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। প্রতি বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের হাজার হাজার পর্যটক এই তাখ্তে জামশীদের নিদর্শন দেখার জন্য ইরানে এসে ভিড় করেন।
ইরানের শিরাজ নগরীর উত্তর-পূর্বে ৭৫ কিলোমিটার দূরে বিশাল এক সমভূমির মাঝে প্রায় আড়াই হাজার বছরের প্রাচীন ইতিহাসের সাক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তাখ্তে জামশীদের স্তম্ভশ্রেণি।
প্রাচীন ইরানের হাখামানশী রাজবংশ ছিল খুবই বিখ্যাত। এই বংশের বিখ্যাত রাজা ছিলেন প্রথম দারিয়ুস। রাজা প্রথম দারিয়ুসের আমলে হাখামানশী সাম্রাজ্য সমৃদ্ধির সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ করে। তিনি ৫২২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৪৮৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত শাসন করেন। দারিয়ুসই প্রথম তাখ্তে জামশীদ নির্মাণ শুরু করেন।
দেশটিতে এমন আরো অনেক দর্শনীয় স্থান রয়েছে যা একটিমাত্র লেখায় বর্ণনা করা অসম্ভব।
দেশটিতে রয়েছে অসংখ্য বাগান। যেগুলো পরিদর্শনে যেকোনো পর্যটকের মন সত্যি ছুঁয়ে যাবে। এ পর্যন্ত দেশটির ৯টি বাগান বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ইউনেস্কোর প্রতিবেদনে ইরানের বাগিচাগুলো সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘এই বাগিচাগুলোর ডিজাইন চারটি আলাদা আলাদা ভাগে বিভক্ত। এগুলোর মাঝখানে রয়েছে পানির ব্যবস্থা যা একদিকে দৃশ্য নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে অপরদিকে বাগানের সজ্জাকৌশল ও স্থাপত্যশৈলীর দিক থেকেও এই পানির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।’ ওই প্রতিবেদনে আরো এসেছে, ইরানের বাগিচাগুলো কাল্পনিকভাবে বেহেশতের বাগানের অনুসরণে তৈরি করা হয়েছে। ইরানের বাগিচা নির্মাণ পদ্ধতি ও সজ্জা কৌশলের প্রভাব সুস্পষ্টভাবে ভারত এবং স্পেনের মতো দেশগুলোর বাগিচা তৈরির স্টাইলের ওপর ব্যাপকভাবে পড়েছে।
ইউনেস্কো তালিকাভুক্ত ইরানের নয়টি বাগিচা হলো : বাগে পাসারগাদ, বাগে এরাম, বাগে চেহেল সুতুন, বাগে ফিন, বাগে আব্বাসাবাদ, বাগে শাযদেহ মহন, বাগে দৌলাতাবাদ, বাগে পাহলাভনপুর এবং বাগে আকবারিয়া। মজার ব্যাপার হলো, এইসব বাগিচা ইরানের বিভিন্ন অঞ্চলে বিচিত্র আবহাওয়াময় পরিবেশে নির্মাণ করা হয়েছে।
তবে ইউনেস্কোর বিশেষজ্ঞগণ স্বীকার করেছেন, অঞ্চলগত বৈচিত্র্য, পরিকল্পনা ও ডিজাইন এবং ইরানের ঐতিহাসিক রীতি ও সাংস্কৃতিক শেকড়গুলো এই মনোনয়নের ক্ষেত্রে যে কাজ করেনি তা নয়। এই বাগিচাগুলো ইতিহাসের বিভিন্ন যুগে গড়ে উঠেছে। সেই হাখামানশী যুগ অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দী থেকে দুই শতাব্দী আগের কাজার শাসনামল পর্যন্ত সময়কালের মধ্যে বাগিচাগুলো তৈরি করা হয়েছে। ইরানিদের বিশ্বাস ও মূল্যবোধের মাঝে বাগিচা সবসময়ই একটি পবিত্র স্থান হিসেবে সম্মানিত ও মর্যাদাময়।
প্রাকৃতিক পরিবেশের দিক থেকে বলতে গেলে দেশটিতে যেমন রয়েছে পাহাড় আর সাগর, তেমনি রয়েছে বিশাল মরুভূমি, কোথাও নদ-নদী, আবার কোথাও সুবিস্তৃত সমতল ভূমি। ভূমি-বৈচিত্র্যের মতো এখানকার আবহাওয়াতেও রয়েছে বেশ বৈচিত্র্য। সারা ইরানে বসন্ত, গ্রীষ্ম, শরৎ ও শীতÑ এই চারটি ঋতু রয়েছে। রাজধানী তেহরানসহ বিশাল এলাকাজুড়ে যখন প্রচ- শীত কিংবা তুষারাবৃত তখন দক্ষিণে (পারস্য উপসাগর সংলগ্ন) দিব্যি বসন্তের হাওয়া। পাহাড়, সাগর, নদ-নদী আর জঙ্গলাকীর্ণ বৈচিত্র্যময় ভূমি এবং আবহাওয়ার কারণে ইরানে পর্যটকের ভিড়ও লেগে থাকে সারা বছর। ফারসি দৈনিক ‘দোনিয়া-ই-ইকতেসাদ’-এর প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছরের প্রথম তিন মাসে ইরানে মোট ২০ লাখ ৩০ হাজার ৫২৩ জন বিদেশি পর্যটক ইরান ভ্রমণ করেছেন। আগের বছরের একই সময়ে পর্যটকদের এই সংখ্যা ছিল ১৪ লাখ ৪৩ হাজার ৫৫১ জন। এশিয়ার বহু দেশ, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা থেকেই আসেন বেশি পর্যটক। ইউনেস্কোর হিসাব মতে, ইরান বিশ্বের ১০ম প্রধান পর্যটনের দেশ।

ইরানের জিডিপিতে পর্যটনের অবদান ১১.৮ বিলিয়ন ডলার
ইরানের মোট জাতীয় উৎপাদনে (জিডিপি) পর্যটন খাতের অবদান ১১ দশমিক ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ফারসি বছর ১৩৯৭ সালে পর্যটন শিল্প থেকে এই অর্থ আয় হয়েছে। ইরানের পর্যটন সংস্থার প্রধান আলি-আসকার মুনেসান এই তথ্য জানিয়েছেন।
ওই কর্মকর্তা জানান, ইরানের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘সেন্ট্রাল ব্যাংক অব ইরান’-এর তথ্যমতে, গত বছর ইরানের জিডিপিতে পর্যটন শিল্প ১১ দশমিক ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের অবদান রাখতে সক্ষম হয়। এছাড়া একই বছর জিডিপিতে হ্যান্ডিক্রাফ্ট রপ্তানি থেকে যোগ হয় আরও ৬শ মিলিয়ন ডলার।
মুনেসান বলেন, ‘পর্যটন শিল্প থেকে যেসব ক্ষেত্রে লাভবান হওয়া গেছে তার মধ্যে এই খাতে টেকসই কর্মসংস্থানের বিষয়টি অন্যতম। গত বছর ইরানের কর্মসংস্থান তৈরিতে যেসব খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে তার অন্যতম ছিল সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, হস্তশিল্প ও পর্যটন সংস্থা (সিএইচএইচটিও)। গত বছর আমরা ২ লক্ষাধিক লোকের কর্মসংস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছি।’
বিশ্ব ব্যাংক প্রকাশিত সর্বশেষ তথ্যমতে, ২০১৭ সালে ইরানের জিডিপির পরিমাণ ছিল ৪৫৪.০১৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। সিএইচএইচটিও প্রধান মুনেসান জানান, ফারসি বছর ১৩৯৭ সালে আন্তর্জাতিক পর্যটকরা ইরান ভ্রমণে ব্যয় করেছেন ১১ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার। তিনি বলেন, ‘সময়ের ব্যবধানে বিশ্ব অর্থনীতিতে পর্যটন খাত আয়ের তৃতীয় উৎসতে পরিণত হয়েছে। সুতরাং আমাদের দেশের এই খাতে আরও বেশি মনোযোগ দেওয়া উচিত।’ সিএইচএইচটিও এর তথ্যমতে, গত বছরে আগের বছরের তুলনায় ইরান ভ্রমণ করা পর্যটকদের সংখ্যা বেড়েছে ৫২ দশমিক ৫ শতাংশ। এই বছর সর্বমোট ৭৮ লাখ বিদেশি পর্যটক ইরান ভ্রমণ করেন।
বিশ্বের দ্বিতীয় দ্রুত বর্ধনশীল পর্যটন গন্তব্য ইরান
২০১৮ সালে বিশ্বের দ্বিতীয় দ্রুত বর্ধনশীল পর্যটন গন্তব্য হিসেবে ইরানকে স্বীকৃতি দিয়েছে বিশ্ব পর্যটন সংস্থা ইউনাইটেড নেশনস ওয়ার্ল্ড ট্যুরিজম অর্গানাইজেশন (ইউএনডব্লিউটিও)। গত বছর আগের বছরের তুলনায় দেশটিতে পর্যটক আগমনের পরিমাণ বাড়ে ৪৯.৯ শতাংশ। এই প্রবৃদ্ধি নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসে ইরান। ২০১৮ সালের ইউএনডব্লিউটিও-এর বার্ষিক প্রতিবেদন মতে, মিসর, নেপাল, জর্জিয়া এবং দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশকে পেছনে ফেলে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করে ইরান। অন্যদিকে, দ্রুত বর্ধনশীল পর্যটন গন্তব্য হিসেবে প্রথম স্থান অর্জন করেছে ইকুয়েডর। প্রতিবেদনে বিশ্বের যেসব দেশের পর্যটন প্রবৃদ্ধি সর্বাপেক্ষা বেশি সেসব দেশের পর্যটন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় তুলে আনা হয়।
র‌্যাঙ্কিংয়ে ইরানের পরে রয়েছে মিসর, যাদের পর্যটক আগমনের হার বেড়েছে ৩৬ শতাংশ। এরপরে যথাক্রমে উগান্ডার বেড়েছে ৩১.৯ শতাংশ, নেপালের ২৪ শতাংশ, স্লোভেনিয়ার ২৩ শতাংশ, ভিয়েতনামের ১৯.৯ শতাংশ, জর্জিয়ার ১৬.৯ শতাংশ এবং দক্ষিণ কোরিয়ার ১৫.১ শতাংশ।
ইরানের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, পর্যটন ও হস্তশিল্প মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত ইরানি বছরে প্রায় ৭৮ লাখ বিদেশী পর্যটক আকৃষ্ট করে ইরান। এই পর্যটক সংখ্যা আগের বছরের তুলনায় ৫০ শতাংশ বেশি।
ইরানে বাজার, জাদুঘর, মসজিদ, সেতু, বাথহাউস, মাদ্রাসা, মাযার, গির্জা, টাওয়ার এবং ম্যানসিসের মতো শত শত ঐতিহাসিক স্থান রয়েছে যা বিদেশী পর্যটকদের বেশ জনপ্রিয়। এসব ঐতিহাসিক স্থানের মধ্যে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান পেয়েছে ২২টি দর্শনীয় স্থান।
২০১৯ সালের ট্র্যাভেল রিস্ক ম্যাপে ‘ইনসিগনিফিকেন্ট’ ক্যাটাগরিতে স্থান পায় ইরান। এই বিভাগের দেশটির সাথে আরও রয়েছে যুক্তরাজ্য, ডেনমার্ক, সুইজারল্যান্ড, নরওয়ে এবং ফিনল্যান্ড। ট্র্যাভেল রিস্ক ম্যাপে পর্যটন গন্তব্যের দিক দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর ঝুঁকির মাত্রা বিশ্লেষণ করে র‌্যাঙ্কিং প্রকাশ করা হয়।
ইতিহাস-ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ এই দেশটিকে আধুনিকতার ছোঁয়ায় বিশ্বের পর্যটকদের কাছে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করতে ইরান সরকার এরই মধ্যে নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
ইরানের নাগরিক ছাড়াও বিদেশি পর্যটকদের নজর কাড়তে দেশটিতে একাধিক নিত্য নতুন ধরনের ওয়াটার পার্ক চালু হচ্ছে। সর্বশেষ ওয়াটার পার্ক চালু হয়েছে ধর্মীয় নগরী কোমে। আধুনিক বিনোদন ব্যবস্থা ছাড়াও সর্বশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে এসব ওয়াটার পার্কে। ইরানের পৌর সরকার এধরনের বিনোদন কেন্দ্রে সবাইকে বিনোদন পেতে যোগ দেয়ার আহ্বান জানিয়েছে। বিশেষ করে শিশু ও তরুণদের কাছে ওয়াটার পার্কগুলো অত্যন্ত আকর্ষণীয়। গরমে প্রশান্তি এনে দেয় এসব আয়োজন।
ওয়াটার পার্কগুলোতে বিভিন্ন রংয়ের ব্যবহার নজর কাড়ে সহজেই। সাঁতার কাটা ছাড়াও বিভিন্ন ওয়াটার রাইড বেশ রোমাঞ্চকর। রয়েছে ঝরনা। সুইমিং পুলের পাশাপাশি ধীর কিংবা দ্রুত গতির রাইড রাখা হয়েছে। এধরনের ওয়াটার পার্কে নারীরা অংশগ্রহণ করতে পারবেন ভিন্ন স্থানেÑ যা তাঁদের জন্য সংরক্ষিত। ইসলামি বিধি মেনে এব্যবস্থা করা হয়েছে। মাশহাদ শহরে ‘ওয়াটার ওয়েভ্স ল্যান্ড’ নামে একটি ওয়াটার পার্কে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য প্রবেশ মূল্য ধরা হয়েছে ১৭ মার্কিন ডলার। এটি মধ্যপ্রাচ্যে সবচেয়ে বড় ওয়াটার পার্ক।
মাশহাদ শহরেই আরেকটি ওয়াটার পার্ক হচ্ছে আফতাব কোস্ট পার্ক। এটি এ শহরের দ্বিতীয় বৃহত্তম ওয়াটার পার্ক। চার হাজার বর্গফুট এলাকায় ১৫ হাজার বর্গফুটের অবকাঠামো স্থাপন করা হয়েছে। সাত তলার একটি কমপ্লেক্স রয়েছে। এ কমপ্লেক্সের একেকটি তলায় বিভিন্ন ধরনের আয়োজন রয়েছে। স্পিড স্লাইস ছাড়াও রয়েছে ১৮ মিটার উঁচু ওয়াটারফল। পাশাপাশি জোড়া স্লাইড রয়েছে। স্পেস হোল ছাড়াও রয়েছে খোলা স্লাইড, শরীরচর্চা ছাড়াও বালির স্টিমবাথসহ রয়েছে বিভিন্ন ধরনের আয়োজন।
থ্রিডি মডেলে পুনর্নির্র্মিত হচ্ছে ইরানের দক্ষিণাঞ্চলের ফারস প্রদেশে অবস্থিত ইউনেস্কো স্বীকৃত বিশ্ব ঐতিহ্য পাসারগাদে। এটির অভ্যন্তরে রয়েছে ১৯০ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা বেশ কিছু সংখ্যক স্থাপত্যকর্ম।
ঐতিহাসিক কমপ্লেক্সটিতে রয়েছে সাইরাস দ্যা গ্রেটের সমাধির ধ্বংসাবশেষ, মোজাফফরি সরাইখানা, স্টোন টাওয়ার, তাল থ্রোন, কিং গার্ডেন পানি-নালা, হাখামানশী বাঁধ বোস্তানখানির অংশবিশেষ ও কয়েকটি প্রাসাদ। এতিহাসিক স্থানটি গবেষণা ও শনাক্তকরণের কাজ পরিচালনায় থ্রি-ডাইমেনশনাল মডেল নকশা করা হচ্ছে। ইরানের বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের পরিচালক আফশিন ইব্রাহিমি এ তথ্য জানান।
বিদেশী পর্যটকদের জন্য আতিথেয়তার কথা চিন্তা করে ইরানের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, হস্তশিল্প ও পর্যটন সংস্থা এরইমধ্যে বেশ কিছু আন্তর্জাতিক মানের হোটেল নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। যার মাধ্যমে আতিথেয়তার দিক দিয়ে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করতে যাচ্ছে ইরান। এদিকে ইরানের বিভিন্ন পর্যটন প্রকল্পে বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করেছে ইতালীয় পর্যটন শিল্প মালিকসহ ইউরোপীয় বিনিয়োগকারীরা। এরইমধ্যে দেশটির ঐতিহাসিক গোরগান শহরের পুনরুজ্জীবন ও সেভেন সিটিজ মার্কেট নির্মাণে বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন তাঁরা।
ইতালীয় পর্যটন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ও এর কিছু সদস্য সম্প্রতি ঐতিহাসিক গোরগান শহরের প্রাকৃতিক পর্যটন আকর্ষণগুলো পরিদর্শন করেছেন। তাঁদের এই কর্মকা-কে এই অঞ্চলের পর্যটন সক্ষমতার সাথে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের পরিচয় করানোর ভালো সুযোগ হিসেবে ভাবা হচ্ছে।
দেশটির যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই উন্নত। রয়েছে ৩১৯টি এয়ারপোর্ট ও ১৪টি নিজস্ব এয়ারলাইন্স। রাজধানী শহরে রয়েছে আধুনিক পাতাল রেল। রয়েছে উন্নতমানের বাস ও ট্রেন সার্ভিস। দেশটির যোগাযোগ ব্যবস্থাকেও আরো আকর্ষণীয় করতে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে ইরান সরকার। সম্প্রতি ইরান রেলওয়ে কোম থেকে মাশহাদে পাঁচ তারকা ট্রেন সার্ভিস চালু করেছে। এ ট্রেনের নাম দেয়া হয়েছে ‘ফাদাক’। ইরানের বিখ্যাত এ দুটি শহরের মধ্যে মাযার যিয়ারত ও ধর্মীয় তীর্থযাত্রীদের যাতায়াতে এ ট্রেন সার্ভিস বিশেষ সুবিধা দেবে। ‘ফাদাক’ ট্রেন প্রথমবারের মতো কোম থেকে মাশহাদে পাঁচ তারকা মানের ট্রেনসার্ভিস। কোম থেকে মাশহাদে এবং মাশহাদ থেকে কোমে এ ট্রেন যাতায়াতে প্রতিবার সময় লাগবে ৭ ঘণ্টা।
এ ট্রেন সার্ভিসে উন্নত মানের সেবা নিশ্চিত করা হয়েছে। পুরো ট্রেনটিই তৈরি হয়েছে ইরানে। মাশহাদের পর কোম হচ্ছে ইরানের দ্বিতীয় পবিত্র শহর। কোমে হযরত মাসুমা (আ.) এবং মাশহাদে হযরত ইমাম রেযা (আ.)-এর পবিত্র মাযার শরীফে লাখ লাখ ইরানি নাগরিক ছাড়াও বিদেশী পর্যটকরা যিয়ারত করতে আসেন। এদিকে, পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে ইলেক্ট্রনিক ভিসা (ই-ভিসা ) চালু করেছে ইরান। এর ফলে ভিসাপ্রথায় বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। সবাই নিজ নিজ দেশ থেকে পর্যটক ভিসার জন্য আবেদন করতে পারবেন।
হালাল ট্যুরিজম
আজকাল হালাল ট্যুরিজম নিয়ে বেশ আলোচনা চলছে। মুসলিম বিশ্বের গ-ি পেরিয়ে বিষয়টি নিয়ে পাশ্চাত্যেও আলোচনা হচ্ছে। এই রকম একটা প্রেক্ষাপটে মুসলিম বিশ্বে হালাল ট্যুরিজমের ক্ষেত্রে ইরান হয়ে উঠতে পারে মূল কেন্দ্র। ইরানের কালচারাল হেরিটেজ, ট্যুরিজম অ্যান্ড হ্যান্ডিক্র্যাফ্ট অর্গানাইজেশনের প্রধান বলেছেন, হালাল ট্যুরিজমে ইরান সবার আগে যে জিনিস উপহার দিতে পারে তা হচ্ছে হ্যান্ডিক্র্যাফ্ট বা হস্তশিল্প। তাঁর মতে বিশ্বের পর্যটকদের জন্য ইরানের হস্তশিল্প হতে পারে আকর্ষণের অন্যতম প্রধান বস্তু। তাদের হাতে রয়েছে বিখ্যাত আকিক পাথর, নানা রঙের ক্রিস্টাল পাথর, রয়েছে ভুবনবিখ্যাত কার্পেট, মাটির পাত্র; রয়েছে আকর্ষণীয় সব ক্যালিগ্রাফির চর্চা। এসবকে কেন্দ্র করে হালাল ট্যুরিজমের জন্য নতুন পরিকল্পনা নিয়ে এগুতে চাইছে ইরান।
ইরানের দুই পাশে রয়েছে দুই সাগর অর্থাৎ পারস্য উপসাগর ও কাস্পিয়ান সাগর। রয়েছে বিশাল মরুভূমি, পাহাড়-পর্বত, জঙ্গলাকীর্ণ জনপদ; প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন। রয়েছে জাতিসংঘ ঘোষিত বহু ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ। এর বাইরে রয়েছে বহু অলি, আউলিয়া, ইমাম ও সাহাবির মাযার। ইরানের মাশহাদ শহরে ইমাম রেযার যে মাযার রয়েছে তাতেই তো প্রতিদিন দেশ-বিদেশের লাখো মানুষের আগমন ঘটে। এছাড়াও বহু মাযার রয়েছে। আছে কোমের মতো ধর্মীয় নগরী।
মেডিক্যাল ট্যুরিজম
মেডিক্যাল ট্যুরিজমেও ইরান ঈর্ষণীয় সাফল্য অজর্ন করেছে। এখন সারা বছরই বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বহু মানুষ ইরানে আসছেন চিকিৎসার জন্য। বেশিরভাগ রোগী হলেন ব্রিটেন, সুইডেনসহ পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলোর। ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য নীতিতে চিকিৎসা ব্যয় কমানোর ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এ কারণে ইরানে যেকোনো অপারেশনের ব্যয় তুরস্ক, ব্রিটেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক চতুর্থাংশের মতো। তবে গুণগত দিক থেকে এখানকার চিকিৎসা বিশ্বমানের। সেজন্যই বিদেশী রোগীরা ইরানের চিকিৎসার মানের ব্যাপারে সন্তুষ্ট। এছাড়া ইরানি অস্ত্রোপচারকারী চিকিৎসক এবং সাধারণ চিকিৎসকগণ বেশ দক্ষ। বিদেশী সহযোগীরা সবসময়ই তাঁদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। এশিয়ার দেশগুলোর মাঝে মেডিক্যাল ট্যুরিজমের ক্ষেত্রে কঠোর প্রতিযোগিতা চলছে। এই প্রতিযোগিতায় ইরানের অবস্থান বিশ্বের শ্রেষ্ঠ দশটি দেশের মধ্যে রয়েছে। ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় মেডিক্যাল ট্যুরিজমের ক্ষেত্রে এশীয় দেশগুলোর সাথে সহযোগিতা বৃদ্ধি সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষরও করেছে। বছরে প্রায় ২ লাখ রোগী মেডিক্যাল ট্যুরিজমের লক্ষ্যে ইরান সফরে আসেন এবং ইরানের উন্নত চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করে উপকৃত হচ্ছেন। যদিও বর্তমান করোনা মহামারির কারণে অনেক বিদেশী ইরানের এই চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। তবে আশা করা হচ্ছে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ইরানের মেডিকেল ট্যুরিজম শিল্পে আরো গতি আসবে।
ইরানের অন্তত ষাটটি হার্ট অপারেশন কেন্দ্রে ওপেন হার্ট সার্জারি হচ্ছে। ইরানের এই চিকিৎসা সেবা বিশ্বের চিকিৎসকগণকে আকৃষ্ট করছে। কেবল ওপেন হার্ট সার্জারিই নয়, আরো বহু জটিল ও মারাত্মক রোগের চিকিৎসা এখন বেশ উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে করা হচ্ছে।
চিকিৎসা সেবা নিতে যাওয়া বিদেশী পর্যটকদের জন্য সুযোগ-সুবিধা আরও সম্প্রসারিত করতে ইরানের খোরাসান প্রদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় মাশহাদ শহরে এ পর্যন্ত ১২টি হাসপাতালকে বিদেশী রোগী ভর্তির লাইসেন্স দিয়েছে দেশটির কর্তৃপক্ষ। সেখানকার একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা এই তথ্য জানিয়েছেন।
মাশহাদ ইউনিভার্সিটি অব মেডিকেল সায়েন্সের মেডিকেল ট্যুরিজম ডিপার্টমেন্টের প্রধান মোহাম্মাদ ইসমাইল খায়ামি বলেন, ১২টি হাসপাতাল বিদেশী রোগী ভর্তির অনুমতি পেয়েছে।
খায়ামির তথ্যমতে, গত ফারসি বছরের প্রথম ছয় মাসে মাশহাদের স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোতে চিকিৎসা সেবা নিতে আসা বিদেশী রোগীর সংখ্যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৫ শতাংশ বেড়েছে।
বর্তমানে মধ্য এশিয়া ও আরব দেশগুলো থেকে অনেকে পর্যটক চিকিৎসা সেবায় ইরান ভ্রমণ করেন। ইরানের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, হস্তশিল্প ও পর্যটন সংস্থার তথ্যমতে, স্বাস্থ্যসেবা পর্যটন থেকে দেশটির বাৎসরিক রাজস্ব আয়ের পরিমাণ ৪শ’ থেকে ৫শ’ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২৫ সাল নাগাদ এই খাত থেকে আড়াই বিলিয়ন ডলার রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে দেশটি। ইরানের স্বাস্থ্যসেবা খাতে প্রায় ৪শ’ হাসপাতাল চিকিৎসা সেবা দিচ্ছে। দেশটির ৫ থেকে ৬ লাখ মেডিকেল পর্যটক আকৃষ্টের পরিকল্পনা রয়েছে। ‘২০২৫ ট্যুরিজম ভিশন প্ল্যান’ অনুযায়ী, ইরান ২০২৫ সাল নাগাদ ২ কোটি বিদেশী পর্যটক আকৃষ্টের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। ২০১৪ সালে যেখানে দেশটিতে বিদেশী পর্যটক আগমনের সংখ্যা ছিল ৪৮ লাখ।
বতর্মানে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসের কারণে সারা বিশে^র পর্যটন শিল্পে ব্যাপক মন্দাবস্থা বিরাজ করছে তখনও পর্যটন শিল্পের গতি ধরে রাখতে ইরানের পর্যটন মন্ত্রণালয় যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে তার ভূয়সী প্রশংসা করেছে জাতিসংঘ পর্যটন সংস্থা (ইউএনডব্লিউটিও)। ইরানের পর্যটন মন্ত্রী আলি-আসগার মুনেসানকে লেখা এক চিঠিতে ইউএনডব্লিউটিও মহাসচিব জুরাব পোলোলিকাশভিল বলেন, পর্যটনের ওপর করোনার প্রভাব কমাতে ইরানের নেয়া পদক্ষেপসমূহ সত্যিকারেই প্রশংসা কুড়িয়েছে।
চিঠিতে তিনি লিখেছেন, ‘ইউএনডব্লিউটিও এর নিকনির্দেশনা ও সুপারিশমালা মোতাবেক ইরানের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, হস্তশিল্প ও পর্যটন মন্ত্রণালয় ধারাবাহিক পদক্ষেপ নিয়েছে। পর্যটনের ওপর প্রভাব কমাতে কার্যকর অনুশীলন চালিয়ে সত্যিকারেই প্রশংসা কুড়িয়েছে।’
১৬ জুন লেখা চিঠিতে পোলোলিকাশভিল ইরানের মুনেসানকে বলেন, ‘আমি বিশেষভাবে আপনার অসাধারণ নেতৃত্বের প্রশংসা করছি। এই চ্যালেঞ্জিং মুহূর্তে যা গুরুত্বপূর্ণ।’
উল্লেখ্য, করোনাভাইরাস মহামারিতে ইরানের পর্যটন মন্ত্রণালয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় দেশব্যাপী ভ্রমণ নিরাপত্তা জোরদারে ধারাবাহিক দিকনির্দেশনা জারি করে। প্রাথমিক পর্যায়েই জরুরি কাজকর্মের জন্য ভ্রমণ বিষয়ক পদ্ধতি প্রণয়ন করা হয় এবং তা দেশের হোটেল, গেস্ট হাউজ, ইকো-লজ ইউনিট, পর্যটন গন্তব্য, যানবাহন, বিনোদন কেন্দ্র ও রেস্তোরাঁগুলোতে বাস্তবায়ন করা হয়।
যে বিষয়গুলো দেশটিতে পর্যটকদের বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে তা হলো ইরানিদের আতিথেয়তা, থাকা-খাওয়ায় স্বল্প ব্যয়, সহজ ও উন্নত যাতায়াত ব্যবস্থা, অভিজাত ও ঐতিহ্যবাহী হোটেল, এক ভ্রমণে সব মৌসুমের অভিজ্ঞতা লাভের সুযোগ ও লোভনীয় বিভিন্ন খাবারের স্বাদ। সব মিলিয়ে ইরান ভ্রমণপিপাসুদের জন্য হয়ে উঠেছে অন্যরকম এক আকর্ষণের স্থান।

  ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রতিরক্ষা জিহাদের চল্লিশ বছর

নূর হোসেন মজিদী

ইসলামের ইতিহাসে প্রথম বারের মতো একজন মুজতাহিদ ফক্বীহ্র নেতৃত্বে গণবিপ্লবের মাধ্যমে ইরানের বুকে ইসলামি হুকুমাত প্রতিষ্ঠিত হয়। হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর নেতৃত্বে ১৯৭৯ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি ইসলামি বিপ্লবের বিজয়ের ফলে ইরানের বুকে একদিকে যেমন দীর্ঘ আড়াই হাজার বছরের স্বৈরাচারী ত্বাগূতী রাজতান্ত্রিক শাসনের বিলোপ ঘটে, সেই সাথে দেশটির ওপর থেকে সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার পরোক্ষ ঔপনিবেশিক নিয়ন্ত্রণেরও অবসান ঘটে।
বিপ্লব-পূর্ব শাহী সরকারের গুপ্ত পুলিশ সংস্থা সাভাক ও মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ-র দিকনির্দেশে হাজার হাজার বিপ্লবী নারী-পুরুষকে হত্যা করেও যখন ইসলামি বিপ্লবের বিজয় রোধ করা সম্ভব হয় নি তখন আমেরিকা আশা করেছিল যে, ইরানের ওলামায়ে কেরাম দেশ শাসনে সক্ষম হবেন না, ফলে বিপ্লবোত্তর ইরানে শেষ পর্যন্ত মার্কিন সেবাদাস পাশ্চাত্যপন্থীরাই শাসন ক্ষমতার ওপর নিযন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হবে। কিন্তু ইসলামি ইরানের একনিষ্ঠ ওলামায়ে কেরাম ও দ্বীনদার বিপ্লবী জনগণ আমেরিকার সে আশাকে হতাশায় পরিণত করে দেয়। শুধু তা-ই নয়, বিপ্লবের বিজয়ের পর পরই ইসলামি সরকার কর্তৃক যায়নবাদী ইসরাঈলের ওপর থেকে স্বীকৃতি প্রত্যাহার ও ইসরাঈলি দূতাবাসকে ফিলিস্তিনী দূতাবাসে পরিণত করা হলে এবং এর অত্যল্পকালের মধ্যেই হযরত ইমাম খোমেইনীর অনুসারী বিপ্লবী ছাত্ররা তেহরানন্থ দূতাবাস নামক মার্কিন গুপ্তচর বৃত্তির আখড়াটি দখল করে নিলে আমেরিকার পক্ষে ইরানের অভ্যন্তর থেকে বিপ্লবকে ব্যর্থ করে দেয়ার ষড়যন্ত্র কার্যকর করা অধিকতর কঠিন হয়ে পড়ে।
এমতাবস্থায় আমেরিকা ইসলামি বিপ্লবকে অকার্যকর করা ও ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের ইসলামি সরকারের পতন ঘটানোর লক্ষ্যে ইরানকে টুকরো টুকরো করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এ পরিকল্পনা অনুযায়ী ইরানের কুর্দিস্তান, বেলুচিস্তান ও খুযেস্তান এলাকায় বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী তৈরি করা হয় এবং পরিকল্পনাটি পুরোপুরি কার্যকর করার লক্ষ্যে ইরানের সামরিক শক্তিকে ধ্বংস করার জন্য আমেরিকার অঘোষিত এজেন্ট ইরাকের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট স্বঘোষিত কমরেড সাদ্দাম হোসেনকে দায়িত্ব দেয়া হয়। এরই ভিত্তিতে ১৯৮০ সালের ২২শে সেপ্টেম্বর ইরাকের বাথপন্থী বাহিনী আকস্মিক হামলা চালিয়ে ইরানি ভূখ-ের অংশবিশেষ দখল করে নেয়। এভাবে দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, সাদ্দাম হোসেন যে বাহানায় ইরানের ওপর হামলা চালান তা ছিল পুরোপুরি অযৌক্তিক এবং আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন।
প্রতিবেশী দেশ হিসেবে এর আগে ইরান ও ইরাকের মধ্যে স্বভাবতঃই সীমান্তবিরোধ ছিল। ১৯৭৫ সালে আলজিয়ার্স চুক্তির মাধ্যমে এ বিরোধের নিষ্পত্তি করা হয়। এ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন ইরানের পক্ষে তৎকালীন শাহ্ মোহাম্মাদ রেযা পাহ্লাভী ও ইরাকের পক্ষে তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন। এ চুক্তি অনুযায়ী ইরান ও ইরাকের সীমান্তবর্তী নদী র্আবান্দ রূদ বা শাতিল ‘আরাবের গভীর পানির মধ্যরেখাকে দুই দেশের সীমান্ত হিসেবে নির্ধারণ করা হয়।
ইরানের বিরুদ্ধে আগ্রাসনের জন্য ইরাকের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের আগ্রহী হবার পিছনে দু’টি প্রধান কারণ ছিল। প্রথমত, শাহের মনোনীত প্রধানমন্ত্রী শাপুুর বাখতিয়ার শাহী সরকারের পতনের আগের দিন, আমেরিকার কাছ থেকে ইরানের ক্রয়কৃত সাড়ে তিনশ’ কোটি ডলার মূল্যের কয়েকশ’ জঙ্গী বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র মূল্য ফেরত ব্যতীতই আমেরিকার কাছে ফিরিয়ে দেয়, বিপ্লবোত্তর বাযারগান সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী বাধ্যতামূলক সামরিক সেবার মেয়াদ দুই বছর থেকে কমিয়ে এক বছর করে এবং ইরানে ১৯৮০ সালের ৯ই জুলাইর সামরিক অভ্যুত্থান পরিকল্পনা ফাশ হয়ে যাবার পর এর সাথে জড়িত সামরিক অফিসারদেরকে বরখাস্ত করা হয়; এ পরিপ্রেক্ষিতে সাদ্দাম মনে করেন যে, ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রতিরক্ষা ক্ষমতা বলতে কিছুই নেই। দ্বিতীয়ত, সাদ্দাম হোসেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের সরকারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ব্রেজিনস্কির সাথে সাক্ষাতে খুযেস্তান প্রদেশ দখল করার পরিকল্পনার কথা জানালে ব্রেজিনস্কি তাঁকে নিশ্চয়তা দেন যে, খুযেস্তানকে ইরাকভুক্ত করা হলে তাতে আমেরিকার কোনো আপত্তি থাকবে না।
এর ভিত্তিতে সাদ্দাম হোসেন ইরানে আগ্রাসন চালানোর বাহানা হিসেবে তিনটি দাবি তোলেন, তা হচ্ছে : (১) শাতিল্ ‘আরাব্ (র্আবান্দ রূদ) সংক্রান্ত আলজিয়ার্স চুক্তি সংশোধন করতে হবে অর্থাৎ পুরো র্আবান্দ রূদ ইরাককে দিতে হবে, (২) ইরানের কুর্দী, বেলুচ ও আরবদেরকে স্বায়ত্বশাসন দিতে হবে এবং (৩) হরমূয প্রণালীস্থ ইরানি দ্বীপ তোম্বে বোযোর্গ, তোম্বে কুচাক ও আবূ মূসা থেকে ইরানি সেনাবাহিনী সরিয়ে নিতে হবে। বলা বহুল্য যে, তিনটি দাবিই ছিল অযৌক্তিক। কারণ, আল্জিয়ার্স চুক্তি একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি এবং অপর দু’টি দাবি ইরানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানো বৈ ছিল না। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান এ সব দাবি প্রত্যাখ্যান করে।
এর ভিত্তিতে, আগ্রাসন শুরু করার পাঁচ দিন আগে সাদ্দাম হোসেন ইরাকি টেলিভিশনের সরাসরি সম্প্রচারে আলজিয়ার্স চুক্তির ডকুমেন্ট ছিঁড়ে ফেলেন। এরপর ২২শে সেপ্টেম্বর (১৯৮০) ইরাকি স্থল ও বিমান বাহিনী ইরানের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। শুধু তা-ই নয়, সাদ্দাম হোসেন সদম্ভ প্রত্যয় ব্যক্ত করেন যে, এক সপ্তাহের মধ্যে তেহরান দখল করে সেখানে গিয়ে চা খাবেন।
আগ্রাসনের প্রথম দিনেই ইরাকি বিমান বাহিনী ইরানের দশটি সামরিক ও বেসামরিক বিমান বন্দরে হামলা চালায় এবং সীমান্তে দুই দেশের স্থল বাহিনীর মধ্যে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ শুরু হয়ে যায়।
যুদ্ধের শুরুতে ইরানি সশস্ত্র বাহিনীর দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে পরিচালিত আকস্মিক সর্বাত্মক হামলার মাধ্যমে ইরাক কয়েক দিনের মধ্যে ইরানের তিন হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকা দখল করে নেয়Ñ যার মধ্যে খুযেস্তানের খুররমশাহ্র ছিল সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। এরপর ইরাকি বাহিনীর আগ্রাসী অভিযান অব্যাহত থাকে এবং তারা ইরানের আবাদান বন্দর এবং দেযফুল্ ও আহ্ওয়ায্ সহ আরো অনেক শহর সহ মোট ১৩ হাজার ৬০০ বর্গ কিলোমিটার ইরানি এলাকা দখল করতে সক্ষম হয়। কিন্তু অচিরেই ইরানের সশস্ত্র বাহিনী ও জনগণের মধ্য থেকে গড়ে তোলা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী ঈমানী ও জিহাদী চেতনায় দীপ্ত হয়ে ইসলামি হুকুমাতের পবিত্র প্রতিরক্ষায় ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং সাদ্দামের আশাকে হতাশায় পরিণত করে দিয়ে যুদ্ধ অব্যাহত রাখে।
ইরানের বিরুদ্ধে আগ্রাসন পরিচালনার আগে থেকেই ইরাকি সশস্ত্র বাহিনী ছিল প্রধানত সোভিয়েত ইউনিয়নের অস্ত্রে সজ্জিত মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে শক্তিশালী বাহিনী। আমেরিকার নির্দেশে মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সকল আরব দেশ এ যুদ্ধে ইরাকের প্রতি আর্থিক ও কূটনৈতিক সমর্থন নিয়ে এগিয়ে আসে, কেবল সিরিয়া ও লিবিয়ার কূটনৈতিক সমর্থন ছিল ইরানের পক্ষে। যুদ্ধ শুরু হবার পর থেকে আরবদের অর্থে সাদ্দাম সরকার আমেরিকা, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ফ্রান্স, চীন, দক্ষিণ আফ্রিকা ও যুগোশ্লাভিয়া সহ তেইশটি দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ সমরাস্ত্র ক্রয় করে। এর বিপরীতে অস্ত্রশক্তিতে দুর্বল হয়ে পড়া ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সশস্ত্র বাহিনী ও জনগণের ঈমানী অস্ত্রই ছিল সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র।
যুদ্ধের চতুর্থ ও পঞ্চম বছরে ইরাকি বাহিনী ইরানী বাহিনীর বিরুদ্ধে এবং ইরাকের সরকার-বিরোধী বেসামরিক কুর্দী জনগণের বিরুদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করে। কিন্তু তা সত্ত্বেও বিশ^ সম্প্রদায় আমেরিকার পৃষ্ঠপোষকতাধীন সাদ্দাম সরকারের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপই নেয় নি।
যুদ্ধের দ্বিতীয় ও তৃতীয় বছরে ইরানি জনগণ ও সশস্ত্র বাহিনী খুররমশাহ্র সহ ইরাক কর্তৃক দখলকৃত ইরানি এলাকার বেশির ভাগ (৮,৬০০ বর্গ কিলোমিটার) পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয় এবং ১৯৮৪ সালে যুদ্ধ ইরানি ভূখ- থেকে ইরাকি ভূখ-ে স্থানান্তরিত হয়। এরপর ইরানি বাহিনী ১৯৮৬-র ফেব্রুয়ারি মাসে ইরাকের অন্যতম তেল রফতানি বন্দর ‘ফাও’ এবং আরো অনেক এলাকা দখল করতে সক্ষম হয়।
ইতিমধ্যে দুই দেশের পক্ষ হতে পরস্পরের তেল-ট্যাঙ্কারে হামলা চালানো শুরু হয়। এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে তৃতীয় পক্ষের তেল-ট্যাঙ্কারও হামলার শিকার হতে থাকে। যেহেতু বিশে^র তেল মওজূদের বেশির ভাগই পারস্য উপসাগরীয় এলাকায় অবস্থিত সেহেতু তেল সরবরাহ বিঘিœত হওয়ার ফলে বিশে^র বাজারে তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় এবার বিশে^র বৃহৎ শক্তিবর্গের টনক নড়ে।
প্রথম দিকে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ ইরান-ইরাক যুদ্ধ বন্ধের জন্য দায়সারা গোছের প্রস্তাব নিলেও এবার এ যুদ্ধের বিষয়টিকে অনেক বেশি গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করে। ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান তার হৃত এলাকার বেশির ভাগ পুনরুদ্ধার করে যুদ্ধকে ইরাকি এলাকায় নিয়ে যাবার পর ইরাক স্বভাবতঃই যুদ্ধ বন্ধের ব্যাপারে আগ্রহ প্রদর্শন করে। কিন্তু ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান যুক্তিসঙ্গতভাবেই শর্ত আরোপ করে যে, আগে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে তদন্ত করে যুদ্ধের সূচনাকারী কে তা নির্ণয় করতে হবে। কিন্তু ইরাকের পৃষ্ঠপোষক বৃহৎ শক্তিবর্গের নিয়ন্ত্রণাধীন জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ এ ব্যাপারে কোনো আগ্রহ দেখায় নি। এদিকে ইরানি বাহিনীর অগ্রাভিযান অব্যাহত থাকে এবং ইরানি বাহিনী ইরাকের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ শহর বসরার ১২ কিলোমিটার ব্যবধানে গিয়ে পৌঁছে।
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ ইরান-ইরাক যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানিয়ে মোট ৮টি প্রস্তাব গ্রহণ করে, তবে ১৯৮৭ সালের ২০শে জুলাই গৃহীত ৫৯৮ নং প্রস্তাবে পূর্বেকার প্রস্তাবগুলো থেকে পার্থক্য ছিল এই যে, এতে যুদ্ধ বন্ধের পরে যুদ্ধের সূচনাকারী কে তা নির্ণয় করার জন্য জাতিসংঘ মহাসচিবকে তদন্ত কমিটি গঠনের ক্ষমতা দেয়া হয়। ইরানের পক্ষ থেকে এ প্রস্তাব গ্রহণ করা না হলেও প্রত্যাখ্যানও করা হয় নি।
যুদ্ধের শেষের দিকে ইরাক সরকার তার ক্রমবর্ধমান পরাজয়ের পরিপ্রেক্ষিতে ইরানের বিভিন্ন শহরের ওপর ব্যাপকভাবে বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় Ñ যার ফলে ইরানের বহু সরকাপর ও বেসরকারি স্থাপনা ধ্বংস হয় ও বহু বেসামরিক লোক নিহত হয়। ইরানের পক্ষ থেকে এর সীমিত মাত্রায় জবাব দেয়া হয়, তবে বেসামরিক জনগণের প্রাণহানি রোধ করার লক্ষ্যে প্রতিটি হামলার যথেষ্ট আগে তা ঘোষণা করে তাদেরকে সরে যেতে বলা হয়।
এদিকে যুদ্ধে ইরাকের ক্রমবর্ধমান বিপর্যস্ত অবস্থা লক্ষ্য করে আমেরিকা অঘোষিতভাবে ইরাকের পক্ষে সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান ২২শে সেপ্টেম্বর ১৯৮৭ তারিখে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে প্রদত্ত ভাষণে নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব না মানলে ইরানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার হুমকি দেন। এরপর ১৯৮৮-র ৪ঠা এপ্রিল আমেরিকার যুদ্ধ জাহায থেকে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে পারস্য উপসাগরের আকাশে উড্ডয়নরত ইরানের একটি যাত্রীবাহী বিমানকে ধ্বংস করে দেয়া হয়Ñ যার ফলে নারী ও শিশু সহ এর ২৯০ জন আরোহীর সকলেই নিহত হয়Ñ যার মাধ্যমে আমেরিকা এ বাণীই প্রদান করে যে, প্রয়োজন মনে করলে ইরানের বিরুদ্ধে যে কোনো পৈশাচিকতার আশ্রয় নিতে দ্বিধা করবে না। আর ১৯শে এপ্রিল আমেরিকান নৌবাহিনী ইরানের কয়েকটি তেল সরবরাহ জেটি ও কয়েকটি তেল-ট্যাঙ্কারের ওপর হামলা চালিয়ে সেগুলো ধ্বংস করে দেয় এবং ইরান ও আমেরিকান নৌবাহিনীর মধ্যে অঘোষিত সংঘর্ষ চলতে থাকে। এই সুযোগে ইরাক তার হারানো এলাকার অংশবিশেষ পুনরুদ্ধার করে এবং নতুন করে কিছু ইরানি এলাকাও দখল করে, তবে দখলকৃত ইরানি এলাকা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হবে না মনে করে সেখান থেকে পশ্চাদপসরণ করে; কেবল যুদ্ধের প্রথম দিকে দখলকৃত এলাকার অংশবিশেষ (২,৫০০ বর্গ কিলোমিটার) ইরাকের দখলে থেকে যায়।
এদিকে গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায় যে, ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব না মানলে আমেরিকা আনুষ্ঠানিকভাবে ইরাকের পক্ষে যুদ্ধ নামার ঘোষণা দেবে এবং প্রয়োজন মনে করলে ইরানের বিরুদ্ধে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করবেÑ তখন পর্যন্ত যার মোকাবিলা করার সামর্থ্য ইরানের ছিল না।
এ যুদ্ধে পরাশক্তিবর্গ সহ বিশে^র প্রায় সকল সরকার ছিল ইরাকের পক্ষে, কেবল সিরিয়া, লিবিয়া ও উত্তর কোরিয়া ব্যতীত উল্লেখ করার মতো কোনো দেশই ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের পক্ষে ছিল না। অধিকন্তু ইরানকে আমেরিকার বয়কট মোকাবিলা করতে হচ্ছিল। বস্তুত ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের জনগণ মূলত ঈমানের অস্ত্র ও শক্তির বদৌলতে দীর্ঘ প্রায় আট বছর তার পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধ চালিয়ে যায়। এমতাবস্থায়ও যুদ্ধ আরো চালিয়ে যাওয়া ইরানের পক্ষে সম্ভব হলেও বিশেষ করে পারমাণবিক বোমার ক্ষতিকারকতা বিবেচনা করে ইরানি জনগণের ওপর যে দুঃসহ দুঃখকষ্ট চেপে বসার আশঙ্কা ছিল তা বিবেচনা করে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান ১৯৮৮-র ১৮ই জুলাই নিরাপত্তা পরিষদের ৫৯৮ নম্বর যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব মেনে নেয় এবং ইরাকও তা মেনে নেয়। এভাবে প্রায় ৮ বছরব্যাপী যুদ্ধের অবসান ঘটে। এরপর উভয় পক্ষ পরস্পরের দখলকৃত এলাকা থেকে সরে যায় এবং যুদ্ধবন্দি বিনিময় ঘটে।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার হিসাব অনুযায়ী এ যুদ্ধে উভয় পক্ষে দশ লক্ষাধিক লোক হতাহত হয় এবং দুই পক্ষের মোট আর্থিক ক্ষতি হিসাব করা হয় এক লক্ষ ১৯ হাজার কোটি ডলার। ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের পক্ষে শহীদের সংখ্যা মোটামুটি এক লাখ সত্তর হাজার হিসাব করা হয়েছে।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রতিরক্ষা জিহাদ : অব্যাহত প্রক্রিয়া
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রতিরক্ষা জিহাদ কেবল ইরানের ওপর ইরাকের তৎকালীন সাদ্দাম সরকারের চাপিয়ে দেয়া আট বছরব্যাপী যুদ্ধের মোকাবিলা করার মধ্যেই সীমিত ছিলো না; বরং এটি একটি অব্যাহত প্রক্রিয়া যা এখনো অব্যাহত রয়েছে।
বস্তুত ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের বিরুদ্ধে সাদ্দাম সরকারের আগ্রাসন কেবল ঐ সরকারের আগ্রাসন ছিল না; বরং সেটি ছিল তৎকালীন সকল পরাশক্তি ও তাদের তাঁবেদারদের সম্মিলিত আগ্রাসন; সাদ্দাম সরকার তাদের পক্ষ হতে প্রক্সি যুদ্ধ চালিয়েছিলেন মাত্র। ইরানের ইসলামি বিপ্লবের নেতা হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ.) ও অন্য ইরানি নেতৃবৃন্দ আগ্রাসনের শুরু থেকেই এটা ভালোভাবেই জানতেন। তাই শুরু থেকেই তাঁরা ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানকে সকল ক্ষেত্রে, বিশেষ করে প্রতিরক্ষা সামর্থ্যরে ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার পরিকল্পনা নিয়ে আগ্রসর হন। তাঁরা জানতেন যে, ইরানের জন্য বিদেশী অস্ত্র আমদানির সুযোগ প্রায় শূন্যের কোঠায়। তাই তাঁরা দেশে মওজূদ সীমিত অস্ত্রের সুষ্ঠু ব্যবহার এবং দেশের অভ্যন্তরে অস্ত্রের খুচরা অংশ উৎপাদন ও মানোন্নয়ন সহ অস্ত্র উৎপাদনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। এভাবেই আট বছর যুদ্ধ চালানো হয় এবং যুদ্ধের পরে এ কার্যক্রম একইভাবে অব্যাহত থাকে।
এখানে প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের বিরুদ্ধে পারমাণবিক অস্ত্র উৎপাদনের প্রচেষ্টার অভিযোগ তুলে দেশটির বিরুদ্ধে কঠোর থেকে কঠোরতর নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দিলেও প্রকৃত ব্যাপার হলো এই যে, ইসলামি ইরান কখনোই পারমাণবিক অস্ত্র উৎপাদনের চিন্তা করে নি। কারণ, পারমাণবিক অস্ত্র দ্বারা প্রতিপক্ষের সাধারণ জনগণকে হত্যা ও শহর ধ্বংস করা সম্ভবÑ যা ইসলামের দৃষ্টিতে অনুমোদিত নয়, কিন্তু তা যুদ্ধে জয়ের নিশ্চয়তা দিতে পারে না। তাছাড়া ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান কখনোই অন্য দেশের ভূখ- দখলের লক্ষ্য পোষণ করে নি। অন্যদিকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সবচেয়ে বড় দুশমন সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার সম্ভাব্য প্রত্যক্ষ আগ্রাসনের মুখেও পারমাণবিক অস্ত্র তেমন কার্যকর হতে পারে না। কারণ, এ ধরনের অস্ত্র নির্মাণ করা সম্ভব হলেও আমেরিকার পামাণবিক অস্ত্রের বিশাল ভা-ারের সাথে মোকাবিলা করা সম্ভব নয়, বিশেষত সে অস্ত্র আমেরিকান ভূখ-ে পৌঁছানোর প্রশ্নও আছে। বরং পারমাণবিক প্রকল্পে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের বিনিয়োগের একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে স্বল্প ব্যয়সাপেক্ষ বিদ্যুৎ উৎপাদন, চিকিৎসা ও অন্যান্য বৈজ্ঞানিক ক্ষেত্রে অগ্রগতি অর্জন করা।
অন্যদিকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের পুরো সামরিক পরিকল্পনার লক্ষ্য হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদীদের আগ্রাসন সহ বাইরের যে কোনো সম্ভাব্য আগ্রাসন থেকে দেশকে নিরাপদ করা। এ কারণে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান সরকার তার সামরিক খাতে প্রতিরক্ষামূলক প্রচলিত সমরাস্ত্র উন্নয়ন ও উৎপাদন, এ কাজে ইলেকট্রনিক প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার ও অভিনব প্রতিরক্ষা স্ট্রাটেজি গ্রহণÑ এ তিনটি বিষয়ের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব আরোপ করে। এর ফলে বিগত বছরগুলোতে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান যে বিরাট সাফল্যের তথা স্বয়ংসম্পূর্ণতার অধিকারী হয়েছে তার প্রমাণ অতি সাম্প্রতিক কালে বিশ^বাসী দেখতে পেয়েছে।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের আশেপাশে বিভিন্ন দেশে আমেরিকার সামরিক ঘাঁটি রয়েছে এবং ইরানি উপকূলের অদূরে পারস্য উপসাগরে ও ভারত মহাসাগরে রয়েছে আমেরিকার যুদ্ধজাহায। এছাড়া আমেরিকার পারমাণবিক অস্ত্রে সমৃদ্ধ অবৈধ যায়নবাদী রাষ্ট্র ইসরাঈলের অবস্থানও ইরান থেকে বেশি দূরে নয়। এ পরিস্থিতি সামনে রেখে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান বিশেষভাবে বিভিন্ন ধরনের ক্ষেপণাস্ত্রের উন্নয়ন ও ব্যাপক উৎপাদনের পদক্ষেপ নেয় যাতে মার্কিন আগ্রাসনের শিকার হলে দাঁতভাঙ্গা জবাব দেয়া সম্ভব হয়।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান নিকট পাল্লা, মধ্যম পাল্লা ও দূর পাল্লার বিভিন্ন ধরনের ক্ষেপণাস্ত্রের উন্নয়ন ও ব্যাপক উৎপাদন করেছে ও করছে। আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ইরানের বেশির ভাগ ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লা ৩০০ থেকে ২,০০০ কিলোমিটার এবং সাম্প্রতিক কালে যে সুমার ক্রুজ মিসাইলের উন্নয়ন করা হয়েছে তার পাল্লা ২,৫০০ কিলোমিটার। এর মানে হচ্ছে, ইরানের আশেপাশে অবস্থিত আমেরিকার সমস্ত সামরিক ঘাঁটি ও যুদ্ধজাহায এবং গোটা ইসরাঈল, এমনকি দক্ষিণ ও পূর্ব ইউরোপ পর্যন্ত ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রের আওতাধীন। এছাড়া ইরান গুচ্ছ বোমা নিক্ষেপের জন্য তার শাহাব-৩ ক্ষেপণাস্ত্রে এমন ধরনের পরিবর্তন সাধন করেছে যার ফলে একটি ক্ষেপণাস্ত্র এক বারে ১,৪০০ বোমা বহন করতে সক্ষম। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান ভূগর্ভ থেকে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে লক্ষ্যস্থলে আঘাত হানার প্রযুক্তিও উদ্ভাবন করেছে।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান পাইলটবিহীন ক্ষুদ্র বিমান (ড্রোন) নির্মাণের ক্ষেত্রে বিরাট সাফল্যের পরিচয় দিয়েছে। এসব ড্রোনের মধ্যে রয়েছে বিমানবিধ্বংসী কামানবাহী ড্রোন ও ছোট বোমা নিয়ে ৯৬৫ কিলোমিটার পর্যন্ত উড্ডয়নে সক্ষম ড্রোন। এছাড়া ইরান সাবমেরিনে বহনক্ষম যুদ্ধজাহায বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র ও বিমানে বহনক্ষম ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রও নির্মাণ করেছে এবং সাম্প্রতিক কালে এগুলোর সফল পরীক্ষা চালিয়েছে।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে যে বিরাট সাফল্যের অধিকারী হয়েছে তার একটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে এ ক্ষেত্রে ইলকট্রনিক প্রযুক্তির মোক্ষম ব্যবহার। ইরান ইতিমধ্যেই ১০০ কিলোমিটার পাল্লার ‘সিরাফ্’ ড্রোন্ নির্মাণ করেছে Ñ যা শত্রুপক্ষের বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্রকে আকাশে থাকা অবস্থায় জ্যামিং-এর মাধ্যমে লক্ষ্যভ্রষ্ট ও বিভ্রান্ত করে দিতে সক্ষম হবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানকে পদানত করার লক্ষ্যে দেশটির পারমাণবিক প্রকল্প সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তি থেকে একতরফাভাবে সরে গিয়ে সর্বাত্মক নিষেধাজ্ঞার আশ্রয় নিয়েও ইরানকে নত করতে ব্যর্থ হয়ে ইরানের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক হামলা চলানোর সম্ভাব্যতা জরীপের লক্ষ্যে ২০১৯ সালের ২০শে জুন সমরাস্ত্রের ইতিহাসে অপরাজেয় হিসেবে পরিগণিত বিমান বিধ্বংসী কামানের পাল্লার ঊর্ধ্বে উড্ডয়নক্ষম সর্বাধুনিক ও বিশালায়তন পাইলটবিহীন গ্লোবাল হক বিমান (ড্রোন) প্রেরণ করে এবং এর পিছন পিছন প্রেরণ করে ৩৮ জন সৈন্যবাহী আরেকটি সামরিক বিমান। গ্লোবাল হক বিমানটি হরমূয প্রণালীর কাছে ইরানি আকাশ সীমায় প্রবেশের সাথে সাথে ইরানের একটি ছোট্ট ড্রোন সেটিকে আঘাত করে ভূপাতিত করে ইতিহাস সৃষ্টি করে। সেই সাথে ইরানের পক্ষ থেকে আমেরিকার সৈন্যবাহী বিমানটিকে সতর্ক করে ফিরে যেতে বলা হয় এবং সেটি গ্লোবাল হকের পরিণতি লক্ষ্য করে ফিরে যায়।
আমেরিকা তার পরাজয়ের লজ্জা ঢাকার জন্য প্রথমে গ্লোবাল হক ভূপাতিত হওয়ার ঘটনা অস্বীকার করে। কিন্তু অচিরেই কার্যত তা স্বীকার করে নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের বিপ্লবী রক্ষী বাহিনী (আইআরজিসি)-র রাডার ও ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপনাগুলোতে হামলা চালাবার আদেশ দেন। কিন্তু অধিকতর লজ্জাজনক পরাজয় এড়ানোর জন্য তাঁর সামরিক উপদেষ্টাগণ এ থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিলে তিনি এ আদেশ প্রত্যাহার করেন এবং এর পরিবর্তে আইআরজিসি-র ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সাইবার হামলা চালাবার আদেশ দেন, কিন্তু ইরানের সর্বাধুনিক সাইবার নিরাপত্তা ব্যবস্থার কারণে এ হামলা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়।
তবে ইসলামি প্রজতন্ত্র ইরানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সবচেয়ে অভিনব দিকটি হচ্ছে ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন ব্যবস্থা। ইরান তার ক্ষেপণাস্ত্রগুলো কেবল সামরিক ঘাঁটিসমূহে মোতায়েন করে নি। ইরান জানে যে, আমেরিকার মতো পৈশাচিক শক্তি প্রয়োজন মনে করলে ইরানের বিরুদ্ধে পারমাণবিক হামলা চালিয়ে ইরানের সকল বড় বড় শহর, সেনানিবাস ও সামরিক স্থাপনা ধ্বংস করার অপচেষ্টা চালাতেও দ্বিধা করবে না। এ কারণে ইরান বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই তার শহর, গ্রাম, পাহাড়-পর্বত, মরুভূমি, বনজঙ্গল ও যুদ্ধজাহাযে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করেÑ যার ফলে আমেরিকার পক্ষে সর্বাত্মক হামলা চালিয়েও ইরানের সকল ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করা সম্ভব হবে না।
প্রশ্ন হচ্ছে, ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের ক্ষেপণাস্ত্রসংখ্যা কতো?
এ হচ্ছে এমন একটি তথ্য যা ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয় নি এবং এটাই স্বাভাবিক। তবে কয়েক বছর আগে ইরানের সর্বোচ্চ জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের সেক্রেটারি আলী শামখানী ঘোষণা করেছিলেন যে, ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান আক্রান্ত হলে প্রথম আধ ঘণ্টার মধ্যে আড়াই হাজার ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র তার লক্ষ্যস্থলে আঘাত হানবে। এ থেকেই আঁচ করা চলে যে, ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান ক্ষেপণাস্ত্রের দিক থেকে কতোখানি সমৃদ্ধ। তবে ইরানের হাতে যে লক্ষ লক্ষ ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে তাতে সন্দেহ নেই, যদিও অসমির্থত তথ্য অনুযায়ী এর সংখ্যা এগারো লক্ষের বেশি।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রী মোহাম্মাদ জাওয়াদ যারীফ্ ২০১৯ সালের পয়লা জুন বলেন, আমেরিকান আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষা করার অধিকার ইরানের রয়েছে। তিনি বলেন, মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে আমেরিকার ক্রমবর্ধমান সামরিক উপস্থিতি মোকাবিলার ক্ষেত্রে ইরান ‘যতো চায়’ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করবে। এ থেকেও ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র সামর্থ্য সম্পর্কে ধারণা করা চলে।
প্রশ্ন হচ্ছে, ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের বিরুদ্ধে আমেরিকা বা যায়নবাদী ইসরাঈলের পারমাণবিক হামলার সম্ভাবনা ও তাতে সাফল্যের সম্ভাবনা কতোখানি?
গ্লোবাল হক ভূপাতিত করণ এবং আকাশপথে আগত শত্রুপক্ষের বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র চিহ্নিতকরণ ও তা ধ্বংসকরণে সর্বাধুনিক ইলেকট্রনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে ইরানের সক্ষমতার যে পরিচয় আমেরিকা ও ইসরাঈল ইতিমধ্যেই পেয়েছে তাতে ইরানের আকাশ সীমায় শত্রুপক্ষের বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রবেশ করে পারমাণবিক বা অপারমাণবিক অস্ত্রের হামলা চালাতে সক্ষম হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় শূন্যের কাছাকাছি। অন্যদিকে ইরান তার যে জবাব দেবে তাতে ইরানের আশেপাশে আমেরিকার যতো সামরিক ঘাঁটি ও যুদ্ধজাহায আছে সেগুলোর এবং যায়নবাদী ইসরাঈলের নিশ্চিহ্ন হওয়া কয়েক ঘণ্টার ব্যাপার মাত্র। এটা জানা আছে বলেই পরাজয়ের গ্লানি মেনে নিয়ে আমেরিকা ও ইসরাঈল ইরানের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক হামলা চালানো থেকে বিরত রয়েছে এবং তার পরিবর্তে আমেরিকা সর্বাত্মক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে ইরানি জনগণকে ইসলামি প্রজাতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও তার বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেÑ ইসলামি ইরানের লৌহকঠিন ঈমানদীপ্ত জনগণের বিরুদ্ধে যে অপচেষ্টা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে।
এ হচ্ছে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রতিরক্ষা জিহাদের কেবল একটি দিকের সংক্ষিপ্ত চিত্র মাত্র। এর অন্যান্য দিকের মধ্যে রয়েছে ইরানি জনগণের, বিশেষত যুবসমাজের মধ্যে ইসলামি হুকুমাতের প্রতিরক্ষার জন্য শাহাদাতের চেতনা; বিপ্লবের বিজয়ের পর থেকেই বিপ্লবের দুশমন আমেরিকা ও ইসরাঈলের পক্ষ হতে এবং দেশের ভিতরে অবস্থিত মার্কিন এজেন্ট অন্তর্ঘাতকদের পক্ষ হতে রণাঙ্গনের ও সেনানিবাসের বাইরে ইরানের অনেক আলেম, ইসলামি চিন্তাবিদ, সরকারি নেতৃবৃন্দ, বিজ্ঞানী প্রমুখ বেসামরিক ব্যক্তিত্বকে ও সামরিক কর্মকর্তাকে কাপুরুষোচিতভাবে হত্যা সত্ত্বেও সকল অঙ্গনের মুজাহিদদের দৃঢ় প্রতিজ্ঞা সহকারে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন অব্যাহত রাখা; ইসলামের প্রথম ক্বিবলাহ্ বায়তুল মুক্বাদ্দাস সহ পবিত্র ভূমি ফিলিস্তিনকে মুক্ত করার লক্ষ্যে হিযবুল্লাহ্ ও হামাসকে সর্বাত্মক সামরিক ও আর্থিক সহায়তা প্রদান; হিযবুল্লাহ্ ও হামাসের কাছে সামরিক সাহায্য পৌঁছানোর একমাত্র রুট সিরিয়াকে আমেরিকার তৈরি করা তথাকথিত আইএস্ (দাা‘এশ্) থেকে মুক্তকরণ এবং আরো অনেক দিক।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রতিরক্ষা জিহাদের সকল দিকের ওপর পরিপূর্ণ আলোকপাত করা একটি প্রবন্ধে কোনাভাবেই সম্ভব নয়; এটা করতে গেলে অবশ্যই তা একটি গ্রন্থের রূপ নেবে।

স্মরণীয় দিবস

 

১ জুলাই : বিশ্ব হস্তশিল্প দিবস।
৩ জুলাই : আহলে বাইতের অষ্টম ইমাম রেযা (আ.)-এর জন্মদিবস। *১৯৮৮ সালের এ দিনে পারস্য উপসাগরে মার্কিন রণতরী থেকে পরিচালিত ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইরানি এয়ারবাসের তিন শতাধিক যাত্রী শহীদ হন।
৫ জুলাই : বিশ্ব কলম দিবস।
৯ জুলাই : ইরানে শিশু-কিশোর সাহিত্য দিবস হিসেবে পালিত হয়।
১২ জুলাই : ইরানে হিযাব ও সতীত্ব দিবস।
১৫ জুলাই : ইমাম রেযা (আ.)-এর শাহাদাত দিবস।
২১ জুলাই : ইমাম তাকী (আ.)-এর শাহাদাত দিবস।
২৩ জুলাই : আহলে বাইতের প্রথম ইমাম আলী (আ.) এবং নবীকন্যা হযরত ফাতিমা (আ.)-এর বিবাহ বার্ষিকী। ইরানে দিবসটি বিবাহ দিবস হিসেবে উদ্যাপিত হয়।
২৯ জুলাই : আহলে বাইতের পঞ্চম ইমাম বাকের (আ.)-এর শাহাদাত দিবস।
৩১ জুলাই : আরাফাত দিবস (৯ যিলহজ)।
*বিশ্ব স্বেচ্ছায় রক্তদান দিবস।
১ আগস্ট : ঈদুল আযহা বা কোরবানির ঈদ।
৫ আগস্ট : ইসলামি মানবাধিকার ও মানবতা দিবস।
৬ আগস্ট : নবীবংশের নবম ইমাম মুহাম্মাদ তাকী (আ.)-এর জন্মদিবস। *বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুবার্ষিকী।
৮ আগস্ট : ইরানে সাংবাদিক দিবস।
৯ আগস্ট : ঈদ-ই গাদীর দিবস। বিদায় হজ থেকে ফেরার সময় মহানবী (সা.) ১৮ যিলহজ হাজীদের সমাবেশে ইমাম আলীকে মহানবীর ওফাত পরবর্তীকালে উম্মতের মাওলা ঘোষণা করেন।
১১ আগস্ট : ১৯৮১ সালের ৩০ আগস্ট প্রেসিডেন্ট ভবনে গুপ্তঘাতকের পাতা বোমা বিস্ফোরণে শহীদ হন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মুহাম্মাদ আলী রাজাই ও প্রধানমন্ত্রী হুজ্জাতুল ইসলাম ড. জাভাদ বাহোনার। দিবসটি সন্ত্রাসবিরোধী দিবস হিসেবে পালিত হয়।
১৫ আগস্ট : মহানবী (সা.)-এর সাথে খ্রিস্টান পাদ্রিদের মুবাহিলা দিবস। *বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান সপরিবারে নিহত হন।
২১ আগস্ট : হিজরি ১৪৪২ সাল শুরু। *ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান কর্তৃক ঘোষিত বিশ্ব মসজিদ দিবস। *আল্লামা মাজলিসী স্মরণে দিবস।
২৩ আগস্ট : বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক ও বিজ্ঞানী বু-আলী সীনা স্মরণে দিবস; ইরানে এ দিনটি চিকিৎসক দিবস হিসেবে পালিত হয়।
২৭ আগস্ট : বিশ্ববিখ্যাত চিকিৎসাবিজ্ঞানী যাকারিয়া রাযী স্মরণে দিবস; ইরানে এ দিনটি ওষুধ শিল্প দিবস হিসেবে পালিত হয়। *বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যুবার্ষিকী।
৩০ আগস্ট : পবিত্র আশুরা। ইমাম হোসাইন (আ.)-এর শাহাদাত দিবস।
৪ সেপ্টেম্বর : বিজ্ঞানী ও দার্শনিক আবু রায়হান বিরুনী স্মরণে দিবস।
১০ সেপ্টেম্বর : আয়াতুল্লাহ তালেকানী (রহ.)-এর ওফাত দিবস।
১৪ সেপ্টেম্বর : নবীবংশের চতুর্থ ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.)-এর শাহাদাত দিবস।
১৮ সেপ্টেম্বর : ইরানে কবিতা ও ফারসি সাহিত্য দিবস হিসেবে পালিত হয়। কবি সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ হোসাইন শাহরিয়ার স্মরণে দিবস।
২০ সেপ্টেম্বর : বাংলা ভাষার প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক আবুল খায়ের মুসলেহ উদ্দিনের মৃত্যুবার্ষিকী।
২২ সেপ্টেম্বর : ইরাকের সাদ্দাম সরকার এদিনে ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। ইরানের পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধের শুরু।
২৫ সেপ্টেম্বর : নবীবংশের সপ্তম ইমাম মূসা কাযেম (আ.)-এর জন্মদিবস।
২৭ সেপ্টেম্বর : বিশ্ব পর্যটন দিবস।
৩০ সেপ্টেম্বর : বিশ্ববিখ্যাত মরমি কবি মওলানা জালালউদ্দিন রূমির (মৌলভী রূমি) জন্মবার্ষিকী।
*ফিলিস্তিনের শিশু-কিশোরদের সাথে সংহতি প্রকাশের জন্য দিবসটি পালিত হয়।

বাংলাদেশের ঐতিহাসিক মসজিদের ইতিকথা

রাশিদুল ইসলাম

ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজীর গৌড় জয়ের পরে ও দিল্লি সালতানাত আমলে ভারতবর্ষে ইসলাম ছড়িয়ে পড়ে। ইউরোপবাসীরা শাহী বাংলাকে পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী বাণিজ্য দেশ হিসেবে গণ্য করত। বাংলাদেশের লালমনিরহাট জেলায় ৬৯ হিজরি সনে নির্মিত একটি মসজিদের সন্ধান পাওয়া গেছে। মসজিদটির কেবল ধ্বংসাবশেষ অবশিষ্ট থাকায় এটি স্থানীয়ভাবে ‘হারানো মসজিদ’ নামে পরিচিত। এই মসজিদটিকে বাংলাদেশের তথা দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে পুরনো মসজিদ বলে ধারণা করা হয়। মসজিদের স্থাপত্যের কথা বলতে গেলে বলতে হয় ইসলামিক এবং মুঘল স্থাপত্যের কথা। বাংলার সালতানাত ছিল ১৩৪২ থেকে ১৫৭৬ এর মধ্যবর্তী সেই সময় যখন মধ্য এশীয় বংশোদ্ভূত মুসলিম নবাবেরা মুঘল সাম্রাজ্য থেকে প্রভাবমুক্ত থেকে স্বাধীনভাবে শাসন করছিলেন। এই সময়ের অধিকাংশ মুসলিম স্থাপত্য পাওয়া যায় গৌড় অঞ্চলে, যা আজকের রাজশাহী বিভাগ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মালদা জেলা জুড়ে ছিল। এই সময়ের স্থাপত্যের বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল স্থানীয় বাঙালি স্থাপত্য ঐতিহ্যের প্রভাব। সালতানাতের স্থাপত্যের প্রভাব বিস্তার করেছিল ষাট গম্বুজ মসজিদ, সোনা মসজিদ এবং কুসুম্বা মসজিদ এর মতো স্থাপত্যতে।
১৫৭৬ এর দিকে মুঘল সাম্রাজ্য বাংলার বেশিরভাগ জায়গায় বিস্তার লাভ করে। ঢাকা মুঘলদের সামরিক ঘাঁটি হিসেবে আবির্ভূত হয়। ১৬০৮ সালে সুবাদার প্রথম ইসলাম খান শহরটিকে বাংলা সুবাহর রাজধানী হিসেবে ঘোষণা দিলে নগরায়ন এবং আবাসনের ব্যাপক উন্নতির ফলে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে, এবং এই সময়ে অসংখ্য মসজিদ এবং দুর্গ নির্মাণ হতে থাকে। বড় কাটরা নির্মাণ করা হয়েছিল ১৬৪৪ থেকে ১৬৪৬ সালের মধ্যে, সম্রাট শাহজাহানের দ্বিতীয় পুত্র শাহ সুজার দাপ্তরিক বাসভবন হিসেবে।
আজকের বাংলাদেশে ভারতীয় মুঘল স্থাপত্য চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায় সুবেদার শায়েস্তা খানের শাসনামলে, যিনি আধুনিক নগরায়ন ও সরকারি স্থাপত্যকে উৎসাহ দিয়ে একটি বিশাল মাত্রার নগরায়ন ও অর্থনৈতিক সম্প্রসারণ শুরু করেন। তিনি শিল্পের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এবং প্রদেশজুড়ে অসংখ্য বিশাল স্থাপত্য, যেমন মসজিদ, সমাধিসৌধ এবং প্রাসাদ নির্মাণে উৎসাহ দিয়েছেন, যেগুলো কিছু সেরা মুঘল স্থাপত্য নিদর্শনের প্রতিনিধিত্ব করত। শায়েস্তা খান লালবাগ কেল্লা (আওরঙ্গবাদ কেল্লা নামেও পরিচিত), চক বাজার মসজিদ, সাত মসজিদ এবং ছোট কাটরার ব্যাপক সম্প্রসারণ করেন। তিনি তাঁর কন্যা পরীবিবির সমাধিসৌধের নির্মাণ কাজ তদারকি করেন।
বাংলাদেশের কয়েকটি প্রাচীন মসজিদ
বাংলাদেশে মুঘল আমলের বিভিন্ন স্থাপনা ধ্বংস হয়ে গেলেও এখনও টিকে আছে অনেক নিদর্শন। এর মধ্যে প্রাচীন মসজিদগুলো অন্যতম। বাংলাদেশে অবস্থিত কয়েকটি ঐতিহ্যবাহী মসজিদের দেখা মিলেছে। এখনো কালের গর্ভে ধ্বংসস্তূপ থেকে আবিষ্কার হচ্ছে অনেক প্রাচীন মসজিদ। জানান দিচ্ছে এদেশের সুপ্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ইতিবৃত্ত।
বাবা আদম মসজিদ
মুন্সীগঞ্জের দরগাবাড়ি গ্রামে ১৪৮৩ খ্রিস্টাব্দে বাবা আদম মসজিদটি নির্মিত হয়। এ মসজিদ চত্বরে রয়েছে বাবা আদমের (র.) মাজার। ছয় গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদটির দৈর্ঘ্য ৪৩ ফুট ও প্রস্থ ৩৬ ফুট। বর্তমানে বাবা আদম মসজিদটি বাংলাদেশ প্রতœতত্ত্ব অধিদফতরের তত্ত্বাবধানে রয়েছে।
দারাসবাড়ি মসজিদ
চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে দারাসবাড়ি মসজিদ অবস্থিত। ১৪৯৩ সালে নির্মাণের পর মসজিদটি ফিরোজপুর জামে মসজিদ নামে পরিচিত ছিল। মসজিদটি দীর্ঘদিন মাটিচাপা ছিল, যা গত শতাব্দীর সত্তরের দশকে উন্মোচন করা হয়।
ছোট সোনা মসজিদ
চাঁপাইনবাবগঞ্জে আরও একটি ঐতিহাসিক মসজিদ রয়েছে। এ মসজিদও ১৪৯৩ সালে নির্মিত হয়। শিলালিপি থেকে জানা যায়, মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ওয়ালি মোহাম্মদ। উত্তর-দক্ষিণে ৮২ ফুট লম্বা ও পূর্ব-পশ্চিমে ৫২ দশমিক পাঁচ ফুট চওড়া মসজিদটি সম্পূর্ণ সোনালি রঙে ঢাকা ছিল। তাই একে ‘গৌড়ের রতœ’ বলা হতো।
বাঘা মসজিদ
রাজশাহী সদর থেকে ৪১ কিলোমিটার দূরে বাঘা উপজেলায় ঐতিহাসিক বাঘা মসজিদটি অবস্থিত। ১৫২৩ সালে আলাউদ্দিন শাহের ছেলে সুলতান নুসরাত শাহ এ মসজিদটি নির্মাণ করেন। ২৫৬ বিঘা জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত মসজিদে ১০টি গম্বুজ রয়েছে। ২২ দশমিক ৯২ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১২ দশমিক ১৮ মিটার প্রস্থের বাঘা মসজিদে রয়েছে চারটি কারুকার্যময় মেহরাব। এ মসজিদের পাশে একটি মাজার শরিফ রয়েছে।
কুসুম্বা মসজিদ
নওগাঁর মান্দা উপজেলার কুসুম্বা গ্রামে অবস্থিত কুসুম্বা মসজিদ। এটি বাংলাদেশের একটি প্রাচীন স্থাপনা। ১৫৫৪ সালে নির্মিত মসজিদটির দৈর্ঘ্য ৫৮ ফুট, প্রস্থ ৪২ ফুট। কুসুম্বা মসজিদের ছাদে দুই সারিতে ছয়টি গম্বুজ রয়েছে। আফগানী শাসনামলে জনৈক সুলায়মান নামক এক ব্যক্তি এ মসজিদটি নির্মাণ করেন।
চাটমোহর শাহি মসজিদ
পাবনার চাটমোহর উপজেলায় অবস্থিত চাটমোহর শাহি মসজিদ। ১৫৮১ সালে মাসুম খাঁ কাবলি নামের সম্রাট আকবরের জনৈক সেনাপতি চাটমোহর শাহি মসজিদ নির্মাণ করেন। একসময় এ মসজিদ প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ প্রতœতত্ত্ব অধিদফতর এটিকে পুনঃনির্মাণ করে।
হাজীগঞ্জ ঐতিহাসিক বড় মসজিদ
চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে অবস্থিত শৈল্পিক কারুকার্যময় হাজীগঞ্জ ঐতিহাসিক বড় মসজিদটি আয়তনের দিক দিয়ে উপমহাদেশের বড় মসজিদগুলোর অন্যতম। ১৩৩৭ বঙ্গাব্দে হাজী আহমদ আলী পাটোয়ারী হাজীগঞ্জ ঐতিহাসিক বড় মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। এর আয়তন ২৮ হাজার ৪০০ বর্গফুট।
আতিয়া মসজিদ
টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলায় অবস্থিত আতিয়া বা আটিয়া মসজিদ। এ মসজিদের প্রধান কক্ষের ওপর একটি এবং বারান্দার ওপর ছোট তিনটি গম্বুজ রয়েছে। জানা যায়, আফগানের সাঈদ খান পন্নি ১৬০৯ সালে মসজিদটি নির্মাণ করেন। ২২৮ বছর পর অর্থাৎ ১৮৭৩ সালে মসজিদটি ঝুঁকিপূর্ণ হলে সংস্কার করা হয়। শেষ সংস্কার করা হয় ১৯০৯ সালে।
ফুলচৌকি মসজিদ
রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার ফুলচৌকি গ্রামে মসজিদটির অবস্থান। গ্রামের নামেই এর নামকরণ করা হয়েছে। ১৮২২ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত এ মসজিদটির কোনো সংস্কার করার প্রয়োজন পড়ে নি। এর দৃষ্টিনন্দন কারুকাজ এখনও আগের মতোই সুন্দর। মসজিদের প্রবেশদ্বারে একটি ফুলবাগান ছিল। বর্তমানে স্থানীয়রা সে জায়গাটি কবরস্থান হিসেবে ব্যবহার করছে।
লক্ষ্য করার মতো বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এবং ইসলামি সংস্কৃতির পরিচয় জানান দেয়া এসব মসজিদের অবস্থান, ইতিহাস, শিলালিপি, গবেষণা, স্থাপত্যশৈলী, গ্যালারি, তথ্যসূত্র বহিঃসংযোগ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় নানা ধরনের ঐতিহাসিক ঘটনা, মুসলিম শাসকদের শাসনামলের গৌরব উঠে আসে সহজেই। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন মসজিদের কথা। সুপ্রাচীন এই মসজিদটি রংপুর-কুড়িগ্রাম মহাসড়কের ১ কিলোমিটার দক্ষিণে লালমনিরহাট সদর উপজেলার পঞ্চগ্রাম ইউনিয়নের রামদাস মৌজায় অবস্থিত। লালমনিরহাটের পঞ্চগ্রাম ইউনয়নের রামদাস মৌজায় বহুদিন ধরে একটি পতিত জঙ্গল ছিল। জঙ্গলের নাম ছিল মজদের আড়া। স্থানীয় ভাষায় আড়া শব্দের মানে জঙ্গলময় স্থান। জঙ্গল পরিষ্কার করার সময় প্রাচীনকালের কিছু ইট বেরিয়ে আসে। এমনিভাবে মাটি ও ইট সরাতে গিয়ে একটি মসজিদের ভিত খুঁজে পাওয়া যায়। এখানের একটি প্রচিীন শিলালিপির পাঠ থেকে মসজিদের প্রতিষ্ঠাকাল ৬৯ হিজরি জানা গেছে। মসজিদের ধ্বংসস্তূপের ভিতরে একটি শিলালিপি পাওয়া যায়। লিপিটিতে আরবি ভাষায় স্পষ্টাক্ষরে লেখা আছে ‘লা-ইলাহা-ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ, হিজরি সন ৬৯’। লিপিটি থেকে বোঝা যায় যে, মসজিদটি প্রায় ৬৯০ খ্রিস্টাব্দের দিকে নির্মিত হয়েছিল। শিলালিপিটি বর্তমানে রংপুরের তাজহাট জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।
১৯৮৭ সালের প্রথমভাগে স্থানীয়রা সাংবাদিক ও গবেষকদের কাছে হারানো মসজিদ সম্পর্কে অবহিত করেন। তখন শতাধিক গবেষক, প্রতœতাত্ত্বিক ও ইতিহাসবিদ এখানে গবেষণা করতে ছুটে আসেন। প্রথাগত ইতিহাস অনুযায়ী ১০০০ শতকে চট্টগ্রাম অঞ্চলে সুফিদের প্রথম আগমন ঘটে। ১১০০ থেকে ১২০০ শতকে সুফিদের মাধ্যমে পূর্ববাংলায় ইসলামের প্রচার ও প্রসার শুরু হয় এবং তাঁদের হাতেই এই অঞ্চলে প্রথম মসজিদ নির্মাণ হয়। তাই এত আগে এখানে মসজিদ নির্মাণের বিষয়টি আশ্চর্যজনক। গবেষক টিম স্টিল তখন আমেরিকান ইনস্টিটিউট অফ আর্কিওলজিস্ট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সেখানকার ইসলামের ইতিহাস সংক্রান্ত গবেষকগণ বলেন অনেক রোমান ও জার্মান ইতিহাসবিদের লেখায় আরব ও রোমান বণিকদের ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় নৌ-বাণিজ্যের সূত্রে আসা-যাওয়ার কথা জানা যায়। এছাড়া বেশ কয়েকটি চলমান গবেষণায় ব্রহ্মপুত্র-তিস্তা অববাহিকাকে পৃথিবীর সবচেয়ে পুরোনো আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের নৌপথ হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার প্রমাণও পাওয়া গেছে। টিম স্টিল পঞ্চগড়ের ভিটাগড়ে প্রাচীন নগরের নিদর্শন পাওয়া প্রতœতাত্ত্বিক অধ্যাপক শাহনেওয়াজের গবেষণা থেকেও সহায়তা পান। তিনি মনে করেন মসজিদটি নির্মাণের ইতিহাস খুঁজে পেলে হয়তো বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের ইতিহাসের সঙ্গে বিশ্ব সভ্যতার সম্পর্কের আরেক ইতিহাস জানার পথ উন্মোচিত হবে। মসজিদটি ২১ ফুট চওড়া এবং ১০ ফুট লম্বা ছিল। এর চারটি স্তম্ভ ছিল, যার দুটি সম্পূর্ণ ধ্বংসপ্রাপ্ত।
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাকে মসজিদের শহর বলা হলেও ঐতিহাসিক মসজিদের শহর বলা হয় বাগেরহাটকে। ১৯৮৫ সালে বাগেরহাটকে ঐতিহাসিক মসজিদের শহর হিসেবে ঘোষণা করে ৩২১তম বিশ্ব-ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত করে ইউনেস্কো। এর মধ্যে বাগেরহাটের ১৭টি স্থাপনাকে তালিকাভুক্ত করা হয়, যার ১০টিই মসজিদ। মসজিদগুলো হল বিশ্ব-ঐতিহ্য ষাট গম্বুজ মসজিদ, বিবি বেগুনি মসজিদ, চুনাখোলা মসজিদ, নয় গম্বুজ মসজিদ, জিন্দা পীরের মসজিদ, দশ গম্বুজ মসজিদ, রন বিজয়পুর মসজিদ, রেজা খোদা মসজিদ, সিংগাইর মসজিদ ও এক গম্বুজ মসজিদ। মসজিদগুলো বাগেরহাট শহরের আশপাশ জুড়ে রয়েছে। এছাড়াও খানজাহান আলী (রহ.)-এর কবর, পীর আলী তাহেরের কবর, জিন্দা পীরের কবর, সাবেক ডাঙ্গা প্রার্থনা কক্ষ, খানজাহান আলী (রহ)-এর বসতভিটা, বড় আদিনা ডিবি, খানজাহানের তৈরি প্রাচীন রাস্তাকেও বিশ্ব-ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত করা হয়।
চুনাখোলা মসজিদ
ষাট গম্বুজ মসজিদ থেকে প্রায় এক কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে এবং বিবি বেগুনি মসজিদের উত্তরে বাগেরহাট সদর উপজেলার ষাট গম্বুজ ইউনিয়নের চুনোখোলা গ্রামে মাঠের মধ্যে এ মসজিদটির অবস্থান। ১৯৮৩ সালে ইউনেস্কো ঐতিহাসিক ষাট গম্বুজ মসজিদসহ তৎকালীন ‘খলিফাবাদ’ নগর রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা ‘খান-উল-আযম উলুঘ খান-ই-জাহান’ নির্মিত প্রাচীন নগরীর অংশ হিসেবে এই মসজিদটিকে ‘বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করে। এর আগে ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ সরকার চুনাখোলা মসজিদকে ঐতিহাসিক পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষণা করে এবং প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরের আওতায় সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়।
চুনাখোলা মসজিদের বাইরের অংশ দৈর্ঘ্যে প্রায় ৪০ ফুট এবং প্রস্থে ২৫ ফুট। পূর্বদিকে ১টি বড় (প্রধান) দরজাসহ মোট ৩টি এবং উত্তর ও দক্ষিণ দিকে ১টি করে মোট ২টি দরজা রয়েছে। পূর্বদিকের বড় দরজাটির উচ্চতা ৯ ফুট, প্রস্থ ৪ ফুট ৪ ইঞ্চি এবং ছোট ২টি দরজার উচ্চতা ৭ ফুট এবং প্রস্থ ৩ ফুট। উত্তর-দক্ষিণ দিকের দরজা ২টির উচ্চতা ৯ ফুটের বেশি এবং প্রস্থ ৫ ফুট করে। মসজিদের মধ্যে ১টি কেন্দ্রীয় মেহরাব ও ২টি ছোট মেহরাব রয়েছে। বড়টির উচ্চতা ৭ ফুট ও প্রস্থ ৪ ফুট। ছোট মেহরাব ২টির উচ্চতা ৪ ফুট প্রায় এবং প্রস্থ ৩ ফুট। মসজিদের দেওয়ালের পুরুত্ব ৭ ফুট ৮ ইঞ্চি এবং বাইরের চার কোণের চারটি খান জাহানি-রীতি অনুযায়ী গোলাকার ইটের খাম্বা বা পিলার রয়েছে। মসজিদে স্থানীয়রা নিয়মিত নামাজ আদায় করে। লোকালয় থেকে মসজিদে যাওয়ার জন্য একটি ইটের সড়ক করা হয়েছে।
নয় গম্বুজ মসজিদ
ঠাকুর দিঘী বা খাঞ্জেলী দিঘীর পশ্চিম পাড়ে ১৬.৪৫ মি. থেকে ১৬.১৫ মি. ভূমি পরিকল্পনায় নির্মিত নয় গম্বুজ মসজিদটি অবস্থিত। এর দেয়ালগুলো ২.৫৯ মি. পুরো। মসজিদের ছাদ ৯টি নিচু অর্ধবৃত্তাকার গম্বুজ দ্বারা আচ্ছাদিত। পূর্ব, উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালে তিনটি করে প্রবেশ পথ এবং পশ্চিম দেয়ালে পোড়া-মাটির ফুল ও লতা পাতায় অলংকৃত তিনটি মেহরাব রয়েছে। মসজিদের মত এ মসজিদের কেন্দ্রীয় মেহরাবটিও অপেক্ষাকৃত বড়। মসজিদের কার্নিশ সামান্য বক্র। মসজিদের ভেতরের একটি পিলারে বড় আকারের তেলতেলে গর্ত রয়েছে। জনশ্রুতি রয়েছে কোন এক পীর আঙ্গুলের খোঁচায় ওই গর্ত করেছিলেন। মসজিদের কার্নিশ সামান্য বক্র। এ মসজিদে এখনও নিয়মিত নামাজ পড়েন স্থানীয়রা।
জিন্দা পীরের মসজিদ
বর্গাকারে নির্মিত এক গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদটি ষাটগম্বুজ মসজিদ থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে সদর উপজেলার সুন্দরঘোনা গ্রামে অবস্থিত। জিন্দাপীর মাজার কমপেস্নক্সের উত্তর-পশ্চিম কোনে মধ্যযুগীয় এই মসজিদটি অবসিহত। মসজিদটি বর্গাকার ভূমি পরিকল্পনায় (৬মি.-৬মি.) নির্মিত এটি এক গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ। মসজিদের চারপাশের চারটি গোলাকার বুরুজ রয়েছে। মসজিদের দেয়ালগুলো গড়ে ১.৫২ মি. পুরু। পূর্ব বাহুতে ৩টি, উত্তর ও দক্ষিণ বাহুতে একটি করে খিলান দরজা আছে। সামনের বাহুতে আছে তিনটি মিহরাব। ছাদের অর্ধগোলাকার গম্বুজটি ভাঙ্গা অবস্থায় ছিল। ২০০২ সালে এটিকে প্রতœতাত্ত্বিক সংস্কারের মাধ্যমে পূর্ণ অবয়ব প্রদান করা হয়েছে।
ষাট গম্বুজ মসজিদ থেকে পূর্বে রনবিজয়পুর গ্রামে অবস্থিত এ মসজিদটিতে দশটি গম্বুজ রয়েছে। খানজাহান আমলের মসজিদ বলে জনশ্রুতি থাকলেও ইতিহাসবিদরা এটিকে খানজাহান পরবর্তী হোসেন শাহ-ই আমলের মসজিদ বলে উল্লেখ করেছেন। ৫০.৫ ফুট দৈর্ঘ্য ও ১৮.১০ ফুট প্রস্থ মসজিদটিতে এখন আর আগের অবয়ব নেই। সংস্কার ও সম্প্রসারণের ফলে মসজিদটি তার নিজস্ব স্বকীয়তা হারিয়েছে। মসজিদের সামনে একটি বারান্দা ও উত্তর পাশে কবর স্থান রয়েছে। সড়ক থেকে মসিজিদে ঢোকার জন্য একটি সু-সজ্জিত গেট করা হয়েছে। মূল মসজিদের পূর্ব, উত্তর ও দক্ষিণ পাশে দু’টি করে প্রবেশদ্বার রয়েছে। দক্ষিন-পশ্চিম কোনে ছাদে ওঠার জন্য একটি সিঁড়ি রয়েছে। এ মসজিদে বর্তমানে স্থানীয় লোকজন নামাজ আদায় করেন। মসজিদের বিপরীত দিকে মসজিদের নামে একটি হাফেজিয়া মাদরাসা রয়েছে।
এছাড়া ষাট গম্বুজ মসজিদের দেড় কিলোমিটার পূর্ব দিকে রণবিজয়পুর গ্রামে এক গম্বুজ বিশিষ্ট বর্গাকার (১৮.৪৯/১৮.৪৯মি.) মসজিদটি অবস্থিত। মসজিদটি বাংলাদেশে প্রাচীন আমলে নির্মিত এক গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদের মধ্যে সর্ববৃহৎ। মসজিদের পূর্ব, উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালে তিনটি করে প্রবেশ পথ এবং পশ্চিম দেয়ালে তিনটি মেহরাব রয়েছে। মসজিদটিতে স্থানীয় লোকজন নামাজ আদায় করে এখনও।
রেজা খোদা মসজিদ
বাগেরহাট শহর থেকে পাঁচ কিলোমিটার ও ষাটগম্বুজ থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে সুন্দরঘোনা গ্রামে অবস্থিত ঐতিহাসিক রেজাখোদা মসজিদ। বর্তমানে মসজিদটির ধ্বংসাবশেষ বিদ্যমান। ধারণা করা হয়, এটি ছয় গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ ছিল। বর্তমানে শুধু দেয়ালের কিছু কিছু অংশ ও খিলানযুক্ত মিহরাবের অংশ বিশেষ টিকে আছে। প্রায় অর্ধশত বছর আগে স্থানীয় লোকজন মসজিদের ওই জায়গায় নতুন করে একটি টিনশেড মসজিদ নির্মাণ করে। সেখানে এখন নামাজ আদায় করে স্থানীরা।
খান-জাহান-আলী (রহ.)-এর মাজারের পশ্চিম পাশে এবং ঠাকুর দিঘীর পূর্ব পাড়েই এ মসজিদটি অবস্থিত। সংস্কার ও সম্প্রসারণের ফলে এক গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদের মূল অবয়ব এখন বোঝা যায় না। এখানে মসজিদের খাদেম ও দিঘীর আশপাশের লোকজন নামাজ পড়ে। খানজাহানের ভক্তবৃন্দ মাজার জিয়ারতের পরে এখানে নামাজ আদায় করেন।
বাংলাদেশে মসজিদের সংখ্যা দুই লাখ ৫০ হাজার ৩৯৯টি। ঐতিহাসিক ছাড়াও বাংলাদেশের দৃষ্টিনন্দন কয়েকটি মসজিদের মধ্যে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম অন্যতম। ১৯৫৯ সালে বায়তুল মোকাররম মসজিদ সোসাইটি গঠনের মাধ্যমে ঢাকায় একটি উচ্চ ধারণক্ষমতাসম্পন্ন মসজিদ নির্মাণের উদ্যোগ নেন তৎকালীন বিশিষ্ট শিল্পপতি লতিফ বাওয়ানি ও তাঁর ভাতিজা ইয়াহিয়া বাওয়ানি। পুরান ঢাকা ও নতুন ঢাকার মিলনস্থলে মসজিদটির জন্য ৮.৩০ একর জায়গা অধিগ্রহণ করা হয়।
স্থানটি নগরীর প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র থেকেও ছিল নিকটবর্তী। সেই সময় মসজিদের অবস্থানে একটি বড় পুকুর ছিল, যা পল্টন পুকুর নামে পরিচিত ছিল। পুকুরটি ভরাট করে ১৯৬০ সালের ২৭ জানুয়ারি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খান মসজিদের কাজের উদ্বোধন করেন। পুরো মসজিদ কমপ্লেক্সটির নকশা করেন সিন্ধুর বিশিষ্ট স্থপতি আব্দুল হুসেন থারিয়ানি। নকশায় স্থান পায় দোকান, অফিস, গ্রন্থাগার, কার পার্কিংয়ের ব্যবস্থাসহ নানা সুবিধা। মসজিদটির প্রথম জামাত অনুষ্ঠিত হয় ১৯৬৩ সালের ২৫ জানুয়ারি, শুক্রবার। অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন ও মনোমুগ্ধকর এই মসজিদে একসঙ্গে ৩০ হাজার মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারে। ধারণক্ষমতার দিক দিয়ে এটি বিশ্বের দশম বৃহত্তম মসজিদ।
১৯৭৫ সালের ২৮ মার্চ থেকে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ এই মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণ করে আসছে। বর্তমানে বায়তুল মোকাররম মসজিদটি আটতলা। নিচতলায় রয়েছে বিপণিবিতান ও অত্যাধুনিক সুসজ্জিত একটি বৃহৎ মার্কেট কমপ্লেক্স। দোতলা থেকে ছয়তলা পর্যন্ত প্রতি তলায় নামাজ পড়া হয়। মসজিদের অভ্যন্তরে রয়েছে অজুর ব্যবস্থাসহ মহিলাদের জন্য পৃথক নামাজকক্ষ ও পাঠাগার।
২০০৮ সালে সৌদি সরকারের অর্থায়নে মসজিদটি সম্প্রসারণ করা হয়। বর্তমানে এই মসজিদে একসঙ্গে ৪০ হাজার মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারে। এই মসজিদের শোভাবর্ধন ও উন্নয়নের কাজ এখনো অব্যাহত।
ধনবাড়ী শাহি মসজিদ
ইসলামি ঐতিহ্য ও কালের সাক্ষী হয়ে স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে আছে প্রাচীন স্থাপত্যশিল্পের ধারক ও বাহক টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী নওয়াব শাহি জামে মসজিদ। এটি টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী উপজেলার প্রাণকেন্দ্র পৌরসভায় অবস্থিত। মসজিদটির প্রথম খ- নির্মাণ করেন তুর্কি বংশোদ্ভূত ইসপিঞ্জার খাঁ ও মনোয়ার খাঁ নামের দুই সহোদর। পরবর্তী সময়ে মসজিদটির সম্প্রসারণকাজ করেন বাংলা ভাষার প্রথম প্রস্তাবক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, যুক্ত বাংলার প্রথম মুখ্যমন্ত্রী, ধনবাড়ীর বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী। আজ থেকে ১১৫ বছর আগে মসজিদটির সম্প্রসারণের মাধ্যমে আধুনিক রূপ দেন তিনি। প্রায় ১০ কাঠা জমির ওপর বানানো এই মসজিদ সংস্কারের আগে ছিল আয়তাকার। তখন এর দৈর্ঘ্য ছিল ১৩.৭২ মিটার (৪৫ ফুট) এবং প্রস্থ ছিল ৪.৫৭ মিটার (১৫ ফুট)।
বর্তমানে এটি একটি বর্গাকৃতির মসজিদ এবং সাধারণ তিন গম্বুজবিশিষ্ট আয়তাকার মোগল মসজিদের সঙ্গে বৈসাদৃশ্যপূর্ণ। সংস্কারের পর মসজিদের প্রাচীনত্ব কিছুটা লোপ পেলেও এর চাকচিক্য ও সৌন্দর্য অনেক বেড়েছে। দৃষ্টিনন্দন এই মসজিদের ভেতরের দেয়ালে ব্যবহার করা হয়েছে কড়িপাথরের লতা-পাতা আঁকা অসংখ্য রঙিন নকশা ও কড়িপাথরের মোজাইক, যা প্রাচীন স্থাপত্যের নিদর্শন বহন করছে। বাইরের দেয়ালে ব্যবহার করা হয়েছে সিমেন্ট আর কড়িপাথরের টেরাকোটা নকশা।
মসজিদে প্রবেশ করার জন্য বানানো হয়েছে পাঁচটি প্রবেশপথ। পূর্ব দিকে বহু খাঁজবিশিষ্ট খিলানযুক্ত তিনটি আর উত্তর ও দক্ষিণে আরো একটি করে দুটি সর্বমোট পাঁচটি। ৩৪টি ছোট ও বড় গম্বুজ মসজিদটিকে করেছে আরো নান্দনিক। আরো আছে ১০টি বড় মিনার। প্রতিটির উচ্চতা ছাদ থেকে প্রায় ৩০ ফুট। মসজিদের দোতলার মিনারটির উচ্চতা প্রায় ১৫ ফুট। মিনারের ওপর লাগানো তামার চাঁদগুলো মসজিদের সৌন্দর্য আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।
মসজিদের ভেতরটা অলংকৃত করেছে মুঘল আমলের তিনটি ঝাড়বাতি। শোভা পাচ্ছে সংরক্ষিত ১৮টি হাঁড়িবাতি, যা নারকেল ব্যবহার করে জ্বালানো হতো। সুপ্রাচীন মসজিদটিতে একসঙ্গে ২০০ মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারে।
মসজিদের পাশেই রয়েছে শান-বাঁধানো ঘাট ও কবরস্থান। এখানে চিরনিদ্রায় শুয়ে আছেন নবাব বাহাদুর সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী। ১৯২৯ সালের ১৭ এপ্রিল তিনি ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুর দুই বছর আগে তিনি এই মসজিদে চালু করেন ২৪ ঘণ্টা কোরআন তিলাওয়াতের ব্যবস্থা (নামাজের সময় বাদে), যা গত প্রায় এক শ বছরে এক দিনের জন্যও বন্ধ হয়নি। নিরবচ্ছিন্ন তিলাওয়াত সচল রাখতে নিয়োজিত আছেন পাঁচজন হাফেজ, যা প্রতিদিন মসজিদে আসা মুসল্লি ও দর্শনার্থীদের অভিভূত করে। এককথায় প্রাচীন আমলের মানুষের ইবাদত-বন্দেগি ও ইসলামি ঐতিহ্যের স্মৃতিচিহ্ন ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে ধনবাড়ী শাহি মসজিদ।
ষাট গম্বুজ মসজিদ
খুলনা বিভাগের বাগেরহাট জেলার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত একটি প্রাচীন মসজিদ। মসজিদটির গায়ে কোনো শিলালিপি না থাকায় এর নির্মাণকারী সম্পর্কে কোনো সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। তবে মসজিদটির স্থাপত্যশৈলী দেখলে এটি যে খান-ই-জাহান নির্মাণ করেছিলেন সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ থাকে না। ধারণা করা হয়, তিনি ১৫০০ শতাব্দীতে এটি নির্মাণ করেন। মসজিদটি বহু বছর ধরে বহু অর্থ খরচ করে নির্মাণ করা হয়েছিল। পাথরগুলো আনা হয়েছিল রাজমহল থেকে।
মসজিদটি উত্তর-দক্ষিণে বাইরের দিকে প্রায় ১৬০ ফুট, ভেতরের দিকে প্রায় ১৪৩ ফুট লম্বা এবং পূর্ব-পশ্চিমে বাইরের দিকে প্রায় ১০৪ ফুট, ভেতরের দিকে প্রায় ৮৮ ফুট চওড়া। দেয়ালগুলো প্রায় ৮.৫ ফুট পুরু। সুলতান নাসিরউদ্দীন মাহমুদ শাহর (১৪৩৫-৫৯) আমলে খান আল-আজম উলুগ খান-ই-জাহান সুন্দরবনের কোল ঘেঁষে খলিফাবাদ রাজ্য গড়ে তোলেন। খান-ই-জাহান বৈঠক করার জন্য একটি দরবার হল গড়ে তোলেন, যা পরে ষাটগম্বুজ মসজিদ হয়। তুঘলকি ও জৌনপুরি নির্মাণশৈলী এতে সুস্পষ্ট।
মসজিদটির পূর্ব দেয়ালে ১১টি বিশাল আকারের খিলানযুক্ত দরজা আছে। মাঝের দরজাটি অন্যগুলোর চেয়ে বড়। উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালে আছে সাতটি করে দরজা। মসজিদের চার কোণে চারটি মিনার আছে। এগুলোর নকশা গোলাকার এবং ওপরের দিকে সরু হয়ে গেছে। এদের কার্নিসের কাছে বলয়াকার ব্যান্ড এবং চূড়ায় গোলাকার গম্বুজ আছে। মিনারগুলোর উচ্চতা ছাদের কার্নিসের চেয়ে বেশি। সামনের দুটি মিনারে পেঁচানো সিঁড়ি আছে এবং এখান থেকে আজান দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল। এর একটির নাম রওশন কোঠা, অন্যটির নাম আন্ধার কোঠা। মসজিদের ভেতরে ৬০টি স্তম্ভ বা পিলার আছে। এগুলো উত্তর থেকে দক্ষিণে ছয় সারিতে অবস্থিত এবং প্রতি সারিতে ১০টি স্তম্ভ আছে। প্রতিটি স্তম্ভই পাথর কেটে বানানো, শুধু পাঁচটি স্তম্ভ বাইরে থেকে ইট দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। এই ৬০টি স্তম্ভ এবং চারপাশের দেয়ালের ওপর তৈরি করা হয়েছে গম্বুজ। মসজিদটির নাম ষাটগম্বুজ মসজিদ হলেও এখানে গম্বুজ মোটেও ৬০টি নয়, গম্বুজ ১১টি সারিতে মোট ৭৭টি। পূর্ব দেয়ালের মাঝের দরজা ও পশ্চিম দেয়ালের মাঝের মেহরাবের মধ্যবর্তী সারিতে যে সাতটি গম্বুজ, সেগুলো দেখতে অনেকটা বাংলাদেশের চৌচালা ঘরের চালের মতো। বাকি ৭০টি গম্বুজ অর্ধগোলাকার।
মসজিদের ভেতরে পশ্চিম দেয়ালে ১০টি মেহরাব আছে। মাঝের মেহরাবটি আকারে বড় এবং কারুকার্যম-িত। এই মেহরাবের দক্ষিণে পাঁচটি এবং উত্তরে চারটি মেহরাব আছে। শুধু মাঝের মেহরাবের ঠিক পরের জায়গাটিতে উত্তর পাশে যেখানে একটি মেহরাব থাকার কথা, সেখানে আছে একটি ছোট দরজা। কারো কারো মতে, খান-ই-জাহান এই মসজিদটি নামাজের কাজ ছাড়াও দরবারঘর হিসেবে ব্যবহার করতেন, আর এই দরজাটি ছিল দরবারঘরের প্রবেশপথ। আবার কেউ কেউ বলেন, মসজিদটি মাদরাসা হিসেবেও ব্যবহৃত হতো।
বজরা শাহি মসজিদ
মুঘল স্থাপত্যশৈলীর উজ্জ্বল নিদর্শন বজরা শাহি মসজিদ, যা নোয়াখালী জেলার প্রাণকেন্দ্র মাইজদী থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার উত্তরে সোনাইমুড়ী উপজেলার বজরা নামক স্থানে অবস্থিত। প্রায় তিন শ বছর আগে, ১৭৪১ সালে মোগল জমিদার আমান উল্লাহ খান দিল্লির বিখ্যাত জামে মসজিদের আদলে এই মসজিদ নির্মাণ করেন, যা আজও মোগল স্থাপত্যশিল্পের এক অনন্য নিদর্শন হিসেবে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আসছে। জমিদার আমান উল্লাহ তাঁর বাড়ির সামনে ৩০ একর জমির ওপর উঁচু পারযুক্ত একটি বিশাল দিঘি খনন করেছিলেন। সেই দিঘীর পশ্চিম পারেই নির্মাণ করা হয়েছিল আকর্ষণীয় তোরণবিশিষ্ট ঐতিহাসিক এই মসজিদ। প্রায় ১১৬ ফুট দৈর্ঘ্য, ৭৪ ফুট প্রস্থ ও ২০ ফুট উচ্চতার তিন গম্বুজবিশিষ্ট এই মসজিদ যে কাউকে মুগ্ধ করবে।
মসজিদকে মজবুত করার জন্য মাটির প্রায় ২০ ফুট নিচ থেকে ভিত তৈরি করা হয়েছিল। দৃষ্টিনন্দন মার্বেল পাথরে অলংকৃত করা হয়েছিল গম্বুজগুলো। মসজিদে প্রবেশের জন্য রয়েছে তিনটি ধনুকাকৃতি দরজা। প্রবেশপথের ওপরই রয়েছে কয়েকটি গম্বুজ। পশ্চিমের দেয়ালে আছে কারুকার্যখচিত তিনটি মেহরাব।
মুঘল সম্রাট মোহাম্মদ শাহর বিশেষ অনুরোধে মক্কা শরিফের বাসিন্দা, তৎকালীন অন্যতম বুজুর্গ আলেম হজরত মাওলানা শাহ আবু সিদ্দিকী ঐতিহাসিক এই মসজিদের প্রথম ইমাম হিসেবে নিয়োজিত হন। তাঁর বংশধররা যোগ্যতা অনুসারে আজও এই মসজিদের ইমামের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। বর্তমানে প্রথম ইমাম সাহেবের সপ্তম পুরুষ ইমাম হাসান সিদ্দিকী ওই মসজিদের ইমামের দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে আসা বহু মানুষ এই মসজিদে নামাজ আদায় করে। বাংলাদেশ প্রতœতত্ত্ব বিভাগ ঐতিহাসিক মসজিদটির ঐতিহ্য রক্ষার্থে এবং দুর্লভ নিদর্শন সংরক্ষণের জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
আজগর আলী চৌধুরী জামে মসজিদ
চট্টগ্রামের বাণিজ্যিক এলাকা আগ্রাবাদ থেকে সোজা পশ্চিমে তিন কিলোমিটার গেলেই হালিশহরের বড়পোল এলাকা। সেখান থেকে আরো প্রায় পাঁচ কিলোমিটার পশ্চিম-উত্তরে এগোলেই হালিশহরের চৌধুরীপাড়া। ১৭৯৫ সালে এখানেই নির্মাণ করা হয় মোগল স্থাপত্য নকশায় চুন-সুরকির দৃষ্টিনন্দন আজগর আলী চৌধুরী জামে মসজিদ। মসজিদটি নির্মাণ করেন হালিশহরের সম্ভ্রান্ত চৌধুরী পরিবারের প্রয়াত আজগর আলী চৌধুরী। ১০ শতক জায়গায় তৈরি মসজিদটির সামনে আছে বিশাল এক পুকুর, যা প্রায় ১০০ শতক জায়গাজুড়ে। মসজিদের দক্ষিণে ২০ শতক জায়গায় আছে কবরস্থান। উত্তরে ২৬ শতক জায়গার ওপর আছে চৌধুরী পরিবারের প্রতিষ্ঠিত উত্তর হালিশহর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
প্রায় আড়াই শ’ বছর আগে মসজিদটি তৈরি করা হয়েছিল তাজমহলের আদলে। মসজিদের ছাদে শোভা পেয়েছে বড় তিনটি গম্বুজ ও ২৪টি মিনার। পোড়ামাটির রঙের এই মসজিদের চারপাশ সাজানো হয়েছে নানা রকম নকশা দিয়ে। শুধু বাইরের দেয়ালই নয়, ভেতরের দেয়াল ও কাঠামোজুড়ে মোগল স্মৃতিচিহ্ন প্রদর্শন করে যাচ্ছে চোখ-ধাঁধানো নানা রকম নকশা। মজার ব্যাপার হলো, এই মসজিদে প্রচলিত কোনো জানালা নেই। মসজিদটি দেখতে দেশি-বিদেশি অনেক পর্যটক প্রতিদিন এখানে ভিড় জমায়।
এলাকাবাসীর আগ্রহে পুরাতাত্ত্বিক এই নির্দশন না ভেঙে পেছনে ৭০ শতক জায়গার ওপর সাড়ে চার কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন মসজিদটি নির্মাণ করছেন চৌধুরী পরিবারের ওয়ারিশরা। নতুন মসজিদের নকশাও নজর কাড়ছে দর্শনার্থীদের। নতুন মসজিদটি বানানো হয়েছে অনেকটা সংসদ ভবনের আদলে। মসজিদটির তিন পাশেই রাখা হয়েছে জলাধার। ওপর থেকে মনে হবে পানির ওপরই ভেসে আছে যেন আল্লাহর এই প্রিয় ঘর।
তারা মসজিদ
সাদা মার্বেলের গম্বুজের ওপর নীলরঙা তারায় খচিত ঐতিহাসিক তারা মসজিদ। পুরান ঢাকার আরমানিটোলায় আবুল খয়রাত সড়কে অবস্থিত এটি, যা তৎকালে মহল্লা আলে আবু সাঈয়ীদ নামে পরিচিত ছিল। মসজিদটি নির্মিত হয় আঠারো শতকের প্রথম দিকে; যদিও মসজিদের গায়ে কোনো ধরনের নির্মাণ তারিখ খোদাই করা নেই। মসজিদটির পূর্ব নাম মির্জা সাহেবের মসজিদ। জানা যায়, আঠারো শতকে ঢাকার মহল্লা আলে আবু সাঈয়ীদ (পরে যার নাম আরমানিটোলা হয়) আসেন ঢাকার ধনাঢ্য ব্যক্তি মীর আবু সাঈয়ীদের নাতি জমিদার মির্জা গোলাম পীর (মির্জা আহমদ জান)। তিনিই এই মসজিদটি নির্মাণ করেন। সেকালে মির্জা সাহেবের মসজিদ হিসেবে এটি বেশ পরিচিতি পায়। ১৮৬০ সালে মারা যান মসজিদের মূল নির্মাণকারী মির্জা গোলাম পীর।
পরে ১৯২৬ সালে ঢাকার তৎকালীন স্থানীয় ব্যবসায়ী আলী জান বেপারী মসজিদটির সংস্কার করেন। সে সময় মসজিদের সৌন্দর্য বর্ধনে এর কারুকার্যে ব্যবহার করা হয় জাপানের রঙিন চিনি-টিকরি পদার্থ। মনোমুগ্ধকর কারুকার্যখচিত মসজিদটিতে মোগল স্থাপত্যশৈলীর প্রভাব পাওয়া যায়। জমিদার মির্জা গোলামের আমলে মসজিদটি ছিল তিন গম্বুজবিশিষ্ট। মসজিদের দৈর্ঘ্য ছিল ৩৩ ফুট (১০.০৬ মিটার) আর প্রস্থ ছিল ১২ ফুট (৪.০৪ মিটার)।
পরবর্তী সময়ে ১৯২৬ সালে আলী জানের সংস্কারের সময় মসজিদের পূর্ব দিকে একটি বারান্দা বাড়ানো হয়। ১৯৮৭ সালে তিন গম্বুজ থেকে পাঁচ গম্বুজ করা হয়। পুরনো একটি মেহরাব ভেঙে দুটি গম্বুজ আর তিনটি নতুন মেহরাব বানানো হয়। বর্তমানে মসজিদের দৈর্ঘ্য ৭০ ফুট (২১.৩৪ মিটার) এবং প্রস্থ ২৬ ফুট (৭.৯৮ মিটার)।

 

‘হায়দার বাবার কবি’ মোহাম্মদ হোসাইন শাহরিয়ার

 

আবদুস সবুর খান

বিশ শতকের গোড়ার দিকেই ফারসি সাহিত্যে আধুনিকতার সূচনা ঘটে। তবে উনিশ শতকের শেষার্ধ থেকেই এ লক্ষণ সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। বিশেষ করে কাচার শাসক নাসিরউদ্দিন শাহ্ (শাসনকাল ১৮৪৮১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দ)-এর শাসনামলে ইরানে নবজাগরণের সূচনা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে ইরানে মাশরুতিয়াত বা সংবিধান আন্দোলনের সূচনা হয়, যা ইরানের সমাজ, রাজনীতি এবং সাহিত্যে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটায়। এ সময় ইউরোপীয় ধারার অনুসরণে ইরানি সাহিত্যেও নবতর ধারার সূচনা ঘটে। নিমা ইউশিজের (১৮৯৭১৯৬০) মাধ্যমে ফারসি কবিতা পূর্ণাঙ্গ আধুনিক রূপ পায়।
এই যুগে ইরানে আধুনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ এবং পত্রপত্রিকার বিকাশ সাহিত্যের বিকাশ ও সর্বজনীনতার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। যার ফলে ফারসি সাহিত্য পূর্বের তুলনায় সাধারণ মানুষের কাছে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে এবং সহজপ্রাপ্যতার কারণে সাধারণ মানুষ শিক্ষা ও সাহিত্যের প্রতি বিশেষভাবে আগ্রহী হয়ে ওঠে। সাধারণ মানুষ, চিন্তক শ্রেণি এবং সংকলকদের মধ্যে পূর্বের তুলনায় সাহিত্য বিষয়ক গ্রন্থাবলি ও সংকলন প্রকাশের প্রতি অধিক ঝোঁক লক্ষ করা যায়। বিশেষ করে পশ্চিমা সাহিত্য অনুবাদ এবং পূর্ববর্তী ইরানি কবি-সাহিত্যিকগণের রচনাবলি সম্পাদনা করে প্রকাশের প্রতিও বিশেষ প্রবণতা দেখা যায়।
এই যুগে বিষয়বস্তু, লক্ষ্য ও বর্ণনধারার দিক থেকে ফারসি সাহিত্য ছিল বিবর্তন ও বিপ্লবমুখী। প্রাচীন ছন্দরীতি একেবারে ভেঙ্গেও পড়েনি আবার নতুন ধারার ছন্দরীতিও পরিপূর্ণ রূপ পরিগ্রহ করেনি। আধুনিক ফারসি সাহিত্য সম্পূর্ণরূপে পরিপূর্ণতার দিকে পরিক্রমণ করছে, এরকম একটি অবস্থা। মাশরুতিয়াত যুগে ফারসি কাব্যসাহিত্য ক্রমবিকাশের যে কয়টি পর্যায় অতিক্রম করে ইতঃপূর্বের ফারসি সাহিত্যের ইতিহাসে তা ছিল নজিরবিহীন। এই যুগের ফারসি কবিতা নির্দিষ্ট শাসকগোষ্ঠী এবং অভিজাত শ্রেণির রুচি ও জৌলুসপূর্ণ ঘটনাবলির বর্ণনায় সীমাবদ্ধ না থেকে সর্বজনীন বিষয়াবলি এবং সমাজের বিশাল জনগোষ্ঠীর মুখপাত্রে পরিণত হয়। দরবার ও সমাজের অভিজাত শ্রেণির সাথে সরাসরি সম্পর্কের পরিবর্তে অসংখ্য পত্র-পত্রিকার সাহায্যে রাজনৈতিক ও বৈপ্লবিক বিষয় ও বক্তব্যের মাধ্যমে সাধারণ জনগোষ্ঠীর সাথে সরাসরি সম্পর্ক স্থাপন করে। শহর ও গ্রামের আনাচে-কানাচের সাধারণ জনগোষ্ঠীই হয়ে ওঠে কবিতার পাঠক বা অন্বিষ্ট। পুনর্জাগরণী বা আধুনিক যুগের ফারসি কবিতা কার্যকারিতা ও ব্যাপ্তির দিক থেকে সর্বজনীনতা লাভ করে এবং পত্র-পত্রিকা ও প্রকাশনা আন্দোলনের তীক্ষè ভাষার রূপ পরিগ্রহ করে।
বিষয়বস্তু ও বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে আধুনিক যুগের ফারসি কবিদেরকে প্রধানত তিনটি দলে বিভক্ত করা যায়। প্রথম দল হচ্ছে সনাতনী কাব্যধারার অনুসারী। দ্বিতীয় দলটি হচ্ছে যোগসূত্রকারী কবি।এই শ্রেণিভুক্ত কবিদের অধিকাংশই ছিলেন ফর্মালিস্ট। তবে তাঁদের কবিতায় এরফানি বা আধ্যাত্মিক বিষয়াবলিও, বিশেষ করে বিভিন্ন এরফানি পরিভাষা ও উক্তি উল্লিখিত হয়েছে। তৃতীয় দল হচ্ছে মেহনতি মানুষের কবি। যাঁরা অভিজাত উচ্চবিত্ত ও রাজদরবার থেকে কবিতা ও সাহিত্যকে সাধারণ মানুষের কাছে নিয়ে যান এবং তাঁদের কবিতায় সমাজের অধিকার-বঞ্চিত সাধারণ মানুষের প্রাত্যহিক দুঃখ-বেদনা ও বঞ্চনা প্রতিধ্বনিত হয়।
তবে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের সামাজিক অভ্যুত্থান, আধাসামন্ত কাচার রাজবংশের ক্রমাবলুপ্তি এবং পরবর্তীকালে পাহলভী রাজবংশের উত্থান, প্রভৃতি ঘটনাবলি ফারসি সাহিত্যের আধুনিকতার স্রোতধারাকে এতটাই বেগবান করে তুলে যে, মাশরুতিয়াত যুগের রক্ষণশীল কবিতায় যে বিবর্তন ও ক্রমবিকাশের ধারা সূচিত হয়েছিল তা আর কোনোমতেই রোধ করা যায় না বরং এই বিবর্তনধারা এমন একজন কবির প্রতীক্ষায় ছিল, যে চূড়ান্তভাবে ফারসি কবিতাকে পাল্টে দিতে পারে। ফারসি কবিতার প্রাচীন অবয়ব, বহুকাল ধরে যে রীতি ও সীমাবদ্ধ ফর্মে আটকে ছিল তা আর সমকালীন সামাজিক সমস্যাবলির পূর্ণপ্রকাশ করতে সমর্থ হতে পারে না। ইতিহাসের এই সন্ধিক্ষণে ফারসি কাব্যসাহিত্যে যে বিষয়টি বাঞ্ছিত ছিল তা হচ্ছে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, নতুন শব্দাবলি এবং আধুনিক জীবনানুভূতি। ঠিক এই সময়েই আধুনিক ফারসি সাহিত্যাঙ্গনে নিমা ইউশিজের আবির্ভাব ঘটে। যিনি ফারসি কাব্যের বিষয়বস্তু ও কবি-কল্পনার আধুনিকায়নের পাশাপাশি ফারসি কবিতার সনাতনী ধারার ছন্দ এবং পঙ্্ক্তির সমতা সম্পূর্ণ রূপে ভেঙ্গে কবিতার ছন্দ, তাল ও পঙ্্ক্তিতে সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিক নির্মাণ করেন। ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে ইরানে ইসলামি বিপ্লব বিজয়ের আগ পর্যন্ত যে ধারা তাঁর পরবর্তী তরুণ ও প্রতিভাবান কবিরা সাদরে গ্রহণ করেন এবং তাঁদের কাব্যকর্মে এই ধারার অবলম্বন করেন। যার ফলে এ ধারার কবিতাকে ‘নিমায়ী ধারার কবিতা’ এবং এই যুগকে ‘নিমায়ী যুগ’ বলে আখ্যায়িত করা হয়। নিমায়ী যুগের যেসব প্রতিভাবান কবি ফারসি সাহিত্যের চিরায়ত ধারায় কার্বচর্চা করে স্বীয় প্রতিভাগুণে আধুনিক ফারসি কাব্যভা-ারকে সমৃদ্ধ করার পাশাপাশি সাধারণ মানুষের কাছে ব্যাপক সমাদৃত হয়েছেন ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসাইন শাহরিয়ার তাঁদের অন্যতম।
ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসাইন শাহরিয়ার ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে ইরানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর তাবরিজে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মির্জা আগা খোশক্নাবি পেশায় ছিলেন আইনজীবী। তাঁর বাল্যকাল ছিল ইরানের মাশরুতিয়াত বা সংবিধান আন্দোলনের উত্তাল সময়। এ কারণে তাঁর শৈশবের দিনগুলো নানা অর্থকষ্টে কাটাতে হয়। ওস্তাদ শাহরিয়ার তাঁর শৈশব ও কৈশোর জীবন তাবরিজ শহরেই অতিবাহিত করেন এবং সেখানেই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। এরপর তেহরান গমন করেন এবং তেহরানে এসে মালেকুশ শোয়ারা বাহার, কারখি ইয়াজদি, আমিরি ফিরোজ কুহি, আরেফ কাজভিনি, মিরজাদে এশকি, ইরাজ মির্জা প্রমুখ বিখ্যাত কবিদের সাথে তাঁর পরিচয় ঘটে। তেহরানে অবস্থানের প্রথম বছরগুলোতেই সেই সময়ের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও প্রসিদ্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ‘দারুল ফুনুন’-এ উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। এরপর মেডিক্যালে ভর্তি হন। এসময় সুরাইয়া নাম্মী এক তরুণীর সাথে তাঁর প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সুরাইয়া ছিলেন সেনাবাহিনীর এক কর্নেলের মেয়ে। অসাধারণ রূপবতী ছিলেন তিনি। সে কারণে শাহরিয়ার তাঁকে ‘পরি’ বলে ডাকতেন। পরিকে তিনি প্রচুর কবিতা লিখেছেন। তাঁদের দুজনের মধ্যে মধুর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। সুরাইয়ার বাবা-মাও তাঁদের এই সম্পর্কের কথা জানতেন। সুরাইয়াকে নিয়ে শাহরিয়ারের জীবনে বহু স্মৃতিও রয়েছে। যার কিছু কিছু শাহরিয়ার তাঁর স্মৃতিকথায় উল্লেখও করেছেন। প্রায় প্রতিটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে তাঁর অনেক কবিতাও রয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁদের এই প্রণয় আর পরিণতিতে পৌঁছেনি। শেষের দিকে সুরাইয়া কেমন যেন বদলে যান। কবিকে এড়িয়ে চলতে থাকেন। শাহরিয়ারও তাঁর কবি-সম্পদ অভিমানের কারণে নিজ থেকে আর সুরাইয়ার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেন নি। বাকি জীবন এই প্রেমের স্মৃতি শাহরিয়ারকে তাড়িয়ে নিয়ে গেছে এবং এই স্মৃতি নিয়ে তিনি বহু কবিতাও রচনা করেছেন।
একদিকে অর্থনৈতিক টানাপোড়েন অপরদিকে সুরাইয়ার সাথে প্রণয়ের ইতি হওয়ার কারণে মেডিক্যালে পড়াশোনা শেষ করা তাঁর পক্ষে আর সম্ভব হয়নি। ফলে পড়াশোনা ত্যাগ করে সরকারি চাকরি গ্রহণ করেন এবং বেশ কয়েকটি চাকরি বদল করে শেষ পর্যন্ত কৃষি ব্যাংকের চাকরিতে স্থিত হন। যদিও তিনি এই চাকরিও পছন্দ করতেন না তবুও অবসর পর্যন্ত এই চাকরিতেই বহাল ছিলেন। এই সময় থেকেই তিনি পূর্ণোদ্যমে কাব্যচর্চায় আত্মনিয়োগ করেন।
১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে শাহরিয়ার ইরানের বিখ্যাত চিত্রশিল্পী কামালুল মুলকের সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে খোরাসানে ছুটে যান এবং এ উপলক্ষে ‘জিয়ারাতে কামালুল মুলক’ শিরোনামে একটি কবিতা রচনা করেন। ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে ৮৪ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন এবং তাবরিজের সারখাব কবরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়।
শাহরিয়ার তাঁর জীবনের বেশিরভাগ সময়ই কবিতা এবং সাহিত্যচর্চায় কাটিয়েছেন। মাত্র চার বছর বয়সে গৃহ পরিচারিকা রোকেয়া খানমের উদ্দেশ্যে আজারবায়জানীয় তুর্কি ভাষায় মুখে মুখে নি¤েœাক্ত শ্লোকটি রচনা করেন :
روقیه باجی باشمین تاجی
آتی آت ایته منه ویرکته
[রোকেয়া বুবু, তুমি আমার মাথার তাজ
গোশতগুলো কুকুরকে দিয়ে আমায় দাও সেদ্ধ ভাত]
মাত্র নয় বছর বয়সে একবার তাঁর মা তাঁর ওপর রাগ করলে তিনি মাকে খুশি করার জন্য ফারসি ভাষায় প্রথম কবিতা রচনা করেন। ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে মালেকুশ শোয়ারা বাহার, সাইদ নাফিসি এবং পাজমান বাখতিয়ারের ভূমিকাসমেত শাহরিয়ারের প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। কাব্যচর্চার শুরুর দিকে শাহরিয়ার তাঁর কাব্যনাম ব্যবহার করতেন ‘বেহজাত’। কিন্তু পরবর্তীকালে কাব্যনাম ব্যবহারের জন্য তিনি হাফিজের গজলের শরণাপন্ন হন এবং হফিজের দিওয়ান থেকে ‘ফাল গ্রহণ’ বা ভাগ্য গণনার মাধ্যমে ‘শাহরিয়ার’ কাব্যনাম ব্যবহার করেন।
শাহরিয়ার ফেরদৌসি, সাদি, রুমি এবং হাফিজের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। বিশেষ করে হাফিজের কবিতা ও চিন্তাধারার প্রতি তিনি ছিলেন গভীর অনুরাগী। এই অনুরাগের ফলেই তিনি হাফিজকে উদ্দেশ্য করে ‘ভেদা বা হাফেজ’ এবং ‘হাফেজে জাবেদান’ শিরোনামে পৃথক দুটি গজল রচনা করে তাঁর সেই অনুরাগ-অনুভূতি প্রকাশ করেছেন। গজল কবিতার মাধ্যমেই তিনি তাঁর বেশিরভাগ অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন। এগুলো তাঁর যৌবনকাল এবং বেড়ে ওঠার সময়কালের অনুভূতিসমূহের এমন বাক্সময় প্রকাশ, যেগুলোকে ফারসি ভাষার শ্রেষ্ঠ তিন গজলকার রুমি, সাদি এবং হাফিজের গজল-প্রভাবিত বলে মনে হয়। উদাহারণ হিসেবে তাঁর ‘حالا چرا’ (এখন কেন) গজলটির উদ্ধৃত করা যায়। যেটি শুরু হয়েছে এভাবেÑ
آمدی، جانم به قربانت ولی حالا چرا
بی وفا حالا که من افتاده¬ام از پا چرا

نوشدارويی و بعد از مرگ سهراب آمدی
سنگدل اين زودتر می¬خواستی، حالا چرا

عمر ما را مهلت امروز و فردای تو نيست
من که يک امروز مهمان توام، فردا چرا

نازنينا ما به¬ناز تو جوانی داده¬ايم
ديگر اکنون با جوانان ناز کن با ما چرا

وه که با اين عمرهای کوته بی¬اعتبار
اين¬همه غافل شده از چون منی شيدا چرا

شور فرهادم بپرسش سر به¬زير افکنده بود
ای لب شيرين جواب تلخ سربالا چرا

ای¬ شب ¬هجران ¬که ¬يکدم در تو چشم من نخفت
اينقدر با بخت خواب آلود من، لالا چرا

آسمان چون جمع مشتاقان پريشان می کند
در شگفتم من نمی¬پاشد ز هم دنيا چرا

در خزان هجر گل ای بلبل طبع حزين
خامشی شرط وفاداری بود، غوغا چرا

شهريارا بی حبيب خود نمی¬کردی سفر
اين سفر راه قيامت می¬روی، تنها چرا

[এসেছ, জান আমার তোমার জন্য উৎসর্গিত তবে এখন কেন
অবিশ্বস্ত এখন তো আমি নিরুপায় হয়ে গেছি তবে কেন

সেই প্রতিষেধক যে সোহরাবের মৃত্যুর পরে এলে
পাষাণ-হৃদয় এমন দ্রুততর চাচ্ছিলে, এখন কেন

আমার জীবন তো তোমার আজ এবং আগামীর অবকাশ নয়
আমি তো তোমার আজকের অতিথি, আগামীকাল কেন

আদরণীয়া আমার তোমার অনুরাগে যৌবন দিয়েছি
এখন অন্য তরুণদের সাথে কর ছলাকলা আমার সাথে কেন

হায় এই ছোট্ট জীবনের সাথে এতটা আস্থাহীন
উদাসীন হলে আমার মতো প্রেমে মত্তর বিষয়ে

ফরহাদের আবেগ আমি প্রশ্নে মাথা নুয়ানো ছিলো
হে মিষ্টি ঠোঁট তিক্ত জবাবে শির উঁচু কেন

হে বিরহের রাত যাতে এক মুহূর্ত তোমাতে আমার চোখ ঘুমায়নি
এতটা আমার নিদ্রালু ভাগ্যের সাথে, বিদায় বিদায় কেন

আকাশ যেন সকল আগ্রহীকে অস্থির করে তুলছে
বিস্মিত আমি জগৎ আমার জনহীন হয় না কেন

ফুলের বিচ্ছেদের শরতে হে ব্যথিত প্রকৃতির বুলবুল
নিশ্চুপতা ছিল বিশ্বস্ততার শর্ত, শোরগোল কেন

হে শাহরিয়ার নিজ বন্ধুহীন করনি ভ্রমণ
এই কেয়ামতের ভ্রমণে যাচ্ছ, একাকী কেন]

শাহরিয়ারের কবিতায় ধর্মীয় চিন্তার প্রকাশ লক্ষ করা যায়। বিশেষ করে ইসলামি বিপ্লবের আন্দোলনের দিনগুলোতে এবং তার পরবর্তী সময়ে ধর্মীয় ও চারিত্রিক বিষয়াবলি নিয়ে কাব্যচর্চা করেন তিনি। ইসলামি ঐতিহ্য, ইরানের ইসলামি বিপ্লব এবং এই বিপ্লবে নেতৃত্বদানকারীদের প্রশংসায়ও কবিতা রচনা করেছেন তিনি। তাঁর ধর্মীয় চিন্তাধারা প্রভাবিত কবিতাসমূহে তিনি হযরত আলী (রা.)-এর প্রতি তাঁর অনুরাগ ও প্রেমাসক্তি প্রকাশ করেছেন। তিনি সর্বদা মহান আল্লাহর পবিত্র কালাম কুরআন ও রাসূল (সা.)-এর হাদীস ও ওলী-বুজুর্গদের বাণীর প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। তাঁর কবিতায় নবী-পরিবার তথা আহলে বাইতের প্রতি তাঁর বিশেষ অনুরাগ ছিল। কারবালার বিয়োগান্তক ঘটনার স্মৃতি তাঁর ‘داغ حسين’ (হোসাইনের শোকচিহ্ন) কবিতায় এভাবেই বিবৃত হয়েছেÑ
محرم آمد و نو کرد درد و داغ حسين
گريست ابر خزان هم به باغ و راغ حسين
هزار و سيصد و اندی گذشت سال و هنوز
چو لاله بر دل خونین شيعه داغ حسین
به هر چمن که بتازد سموم باد خزان
زمانه یاد کند از خزان باغ حسین
هنوز ساقی عطشان کربلا گویی
کنار علقمه افتاده با ایاغ حسین
اگر چراغ حسینی به خیمه شد خاموش
منور است مساجد به چلچراغ حسین
[মোর্হারম এসেছে আর হোসাইনের শোককে করেছে নবায়ন
শরতের মেঘও হোসাইনের বাগান আর সবুজ প্রান্তরে করেছে ক্রন্দন
তেরশ বছরেরও অধিক পার হলো তবুও এখনো
শিয়াদের রক্তাক্ত হৃদয়ে হোসাইনের শোকচিহ্ন টিউলিপ ফুলের মতন
যে তৃণভূমিতেই শরত-বায়ুর বিষ বয়ে যায়
হোসাইনের বাগানের শরতকালের কথাই স্মরণ করে যায়
এখন কারবালার তৃষ্ণার্ত সাকী যেন মনে হয়
‘আলকামা’র পাশে পড়ে আছে হোসাইনের পানপাত্রসহ
যদিও তাঁবুতে হোসাইন-প্রদীপ নিভে গেছে
তবুও মসজিদগুলো আলোকিত হোসাইনের চল্লিশ প্রদীপে]
শাহরিয়ার চিরায়ত ধারার ফারসি কবিতা, যথা : কাসিদা, মাসনাভি, গজল, কেতআ, রুবাই ইত্যাকার সব ধারায়ই কবিতা রচনা করেছেন। এছাড়া নিমায়ী ধারার কবিতায়ও নিরীক্ষা চালিয়েছেন তিনি এবং ‘এই ভায়ে মাদারাম’, ‘দো মুরগে বেহেশতি’, ‘মুমিয়ায়ী’, ‘পায়াম বে আনশাতিন’ প্রভৃতির ন্যায় উল্লেখযোগ্য কেতআ রচনা করেছেন। নিমায়ী ধারার তাঁর এই কবিতায় শিল্পের নাগপাশে বন্দি অসহায় মানুষদের প্রতি তাঁর সমবেদনা ও সহমর্মিতা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। এসবের পাশাপাশি শাহরিয়ার তাঁর নিজের মাতৃভাষা অর্থাৎ আজারবাইজানীয় তুর্কী ভাষায় এমন কিছু মনোমুগ্ধকর কবিতা রচনা করেছেন, যেগুলো ফারসি-ভাষী পাঠকদের কাছেও সমাদৃত হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে তাঁর ‘সালাম বে হায়দার বাবা’র কথা উল্লেখ করা যায়; যেটি আযারবাইজানীয় তুর্কী ভাষার শ্রেষ্ঠকর্ম হিসেবে বিবেচিত এবং ফারসি ভাষাতেও এর অনুবাদ হয়েছে। এই কবিতায় তিনি গ্রাম এবং গ্রামের মানুষের প্রতি তাঁর যে প্রেমাসক্তি এবং তাদের মৌলিকত্ব ও সৌন্দর্যের কথা ব্যক্ত করেছেন। এই কাহিনি-কাব্যে কবির আবেগ-অনুভূতি, জীবন-প্রাণ এমনভাবে একাকার হয়ে গেছে, মনে হবে যেন কবির সমস্ত জীবনের অনুভূতি-কল্পনা তিনি তাঁর এই কবিতায় ঢেলে দিয়েছেন। এ কারণেই শাহরিয়ারকে ‘হায়দার বাবার কবি’ এবং ‘গ্রামের সম্মানের কবি’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। তাঁর এই কাহিনি-কাব্য প্রথমবার ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে তাবরিজ থেকে প্রকাশিত হয় এবং প্রথমে আযারবাইজানীয়দের মধ্যে এবং পরবর্তীতে সমস্ত ইরানে এর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। হায়দার বাবা মূলত শাহরিয়ার জন্ম-গ্রামের একটি পাহাড়ের নাম, যাকে সম্বোধন করে কবি তাঁর গ্রামীণ জীবন, গ্রামীণ প্রকৃতি, গ্রামের মানুষের জীবনাচার এবং গ্রামীণ ইতিহাস-ঐতিহ্য এক এক করে বর্ণনা করেছেন। যার শুরু হয়েছে এভাবেÑ ‘হায়দার বাবা, যখন ঝড়-ঝঞ্ঝা শুরু হয় আর বন্যা ও বৃষ্টির পানি পাহাড় ও উপত্যকা হয়ে গড়িয়ে পড়ে, সুন্দরী বালিকারা দলে দলে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে তা দেখতে থাকে, তোমার শক্তিমত্তা আর বিশালতার প্রতি সালাম এবং অভিভাদন, তখন আমাকেও স্মরণ করো।’
শাহরিয়ারের সমস্ত কাব্যকর্মকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা যায়। ক. আজারবাইজানীয় তুর্কি ভাষায় রচিত কবিতা এবং খ. ফারসি ভাষায় রচিত কাবিতা। আজারবাইজানীয় তুর্কি ভাষায় রচিত বিখ্যাত কাহিনিকাব্য ‘হায়দার বাবায়ে সালাম’ দুই খ-ে প্রকাশিত হয়। যা পরবর্তীতে ফারসি ভাষায়ও অনূদিত হয়ে প্রকাশিত হয়। অপর দিকে ফারসি ভাষায় তিনি ৫৪৭টি গজল, ১০০টি কাসিদা, ২৫টি মাসনাভি, ১৫০টি ক্বেতআ, ১২৩টি খ- কবিতা এবং ইসলামি বিপ্লব নিয়ে রচিত ৩৯ টি কবিতা। ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে তাঁর দিওয়ান (কাব্যসংকলন)-এর প্রথম খ- প্রকাশিত হয়। দ্বিতীয় ও তৃতীয় খ- প্রকাশিত হয় ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে এবং চতুর্থ ও পঞ্চম খ- প্রকাশিত হয় ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে। পরবর্তীকালে তেহরানের এন্তেশারাতে নেগাহ ‘দিওয়ানে শাহরিয়ার’ শিরোনামে দুই খ-ে শাহরিয়ারের কাব্যসমগ্র প্রকাশ করে। যা এ পর্যন্ত একাধিকবার পুনঃপ্রকাশিত হয়েছে।
ফারসি সাহিত্যের চিরায়ত কবি ফেরদৌসি, সাদি, রুমি এবং হাফিজের প্রতি শাহরিয়ারের বিশেষ অনুরাগ ছিল। বিশেষ করে হাফিজের কবিতা এবং তাঁর কাব্যদর্শনের তিনি খুবই প্রশংসা করতেন। মূলত হাফিজের প্রতিই তাঁর টান ছিল সবচেয়ে অধিক। যা তিনি তাঁর ‘বেদা বে হাফেজ, এবং ‘হাফেজে জাবেদান’ শিরোনামের পৃথক দুটি গজলে ভাবনার নিবিড়তায় প্রকাশ করেছেন। শাহরিয়ার তাঁর কাব্যানুভূতির বেশিরভাগই প্রকাশ করেছেন ‘গজল’ কাব্যের মাধ্যমে। তাঁর এসব গজল তাঁর যৌবন ও পূর্ণ বয়সের স্মৃতির স্মরণ। ভাষা ও কাব্যানুভূতির দিক থেকে এসব গজল এতটাই সমৃদ্ধ এবং শিল্পমান উত্তীর্ণ যে, এতে প্রতীয়মান হয় ফারসি কাব্যের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ তিন গজল রচয়িতা রুমি, সাদি এবং হাফিজের গজলের সব কাব্যকলাই শাহরিয়ার রপ্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
শাহরিয়ার ছিলেন অসাধারণ কাব্যপ্রতিভার অধিকারী। তাঁর সমগ্র কাব্যে মনস্তাত্ত্বিকতা, সংবেদশীলতা ও কবি-কল্পনা এতটাই প্রবল যে, নিমায়ী যুগে বসবাস করে ও নিমায়ী কাব্য-বলয়ের বাইরে ফারসি সাহিত্যের সনাতনী ধারায় কাব্য রচনা করেও স্বীয় প্রতিভা এবং কাব্যগুণেই শাহরিয়ার অনন্য হয়ে উঠেছেন এবং আধুনিক ফারসি কাব্যে আপন আসন পাকাপোক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন। তাই বলে তিনি যে নিমায়ী ধারায় কোনো কবিতা রচনা করেন নি, এমনটা নয়। তবে তাঁর নিমায়ী ধারায় রচিত কবিতাগুলোওযেসব কবিতা তিনি নিমার জন্য এবং তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে রচনা করেছেনযেমন বিশ্লেষণধর্মী তেমনি কাব্যদৃষ্টি, কবি-কল্পনা এবংচিত্রকল্পের দিক থেকেও সনাতনী ধারার পরিবর্তন প্রকাশের নির্দেশকের ভূমিকা পালন করেছে। ‘زندان زندگی’ (জীবনের কারাগার) তাঁর এধারারই একটি কবিতা। এর কয়েকটি পঙ্্ক্তির উদ্ধৃতির মাধ্যমে আমরা আমাদের আলোচনার সমাপ্তি টানছিÑ

تا هستم ای رفیق ندانی که کیستم
روزی سراغ وقت من آیی که نیستم
در آستان مرگ که زندان زندگیست
تهمت به خویشتن نتوان زد که زیستم
پیداست از گلاب سرشکم که من چو گل
یک روز خنده کردم و عمری گریستم
[যতক্ষণ আছি হে বন্ধু জানবে না যে আমি কে
একদিন আমার সময়ের খোঁজে আসবে যখন আমি নেই
মৃত্যুর চৌকাঠে যেটি জীবনের কারাগার
স্বজনদের অভিযোগ করা যায় না যে বেঁচে আছি
আমার অশ্রু-গোলাপে বোঝা যায় আমিও ফুলের মতো
একদিন হেসেছি আর এক জীবন কাঁদলাম]
লেখক : অধ্যাপক, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ,
ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়

ইবনে সিনার বিস্ময়কর প্রতিভা

 

ড. মো. কামাল উদ্দিন
মানবসভ্যতার সূচনালগ্ন থেকে পারস্য জ্ঞান-বিজ্ঞান, সভ্যতা-সংস্কৃতি, শিল্প-সাহিত্যে গৌরবময় মর্যাদায় আসীন। পারস্য সা¤্রাজ্য বিশে^র অন্যতম প্রাচীন সা¤্রাজ্য। পারস্য তথা ইরানের রয়েছে প্রায় তিন হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্য। ইতিহাসের কালজয়ী পারস্য প্রতিভা ইবনে সিনা, আল-গায্যালি, কবি ফেরদৌসি, ওমর খৈয়াম, শেখ সাদি, রুমি, হাফিজ ও জামি। জ্ঞান-বিজ্ঞানের এক প্রোজ্জ্বল নক্ষত্র ইবনে সিনা। চিকিৎসাশাস্ত্র, দর্শন, ধর্মতত্ত্ব, গণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞানে তিনি স্মরণীয় প্রতিভা। একই সাথে তিনি ইরান, তুরস্ক, আফগানিস্তান ও রাশিয়ার প-িতদের কাছে জাতীয় জ্ঞানবীর হিসেবে আখ্যায়িত। চিকিৎসাশাস্ত্রে তাঁর সাফল্য ঈর্ষণীয়। চিকিৎসাশাস্ত্রের বিশ^কোষ আল-কানুন ফিত-তিব উনিশ শতক অবধি প্রাচ্য ও প্রাশ্চাত্যের বিভিন্ন বিশ^বিদ্যালয় ও চিকিৎসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত ছিল। প্রায় সাতশ বছরকালব্যাপী তাঁর গ্রন্থাবলি অক্সফোর্ড, কেমব্রিজসহ ইউরোপের বিখ্যাত বিশ^বিদ্যালয়গুলোতে গুরুত্বসহকারে পঠিত হয়। চিকিৎসাশাস্ত্রের এই মহান দিকপাল ইউরোপে ‘আভিসিনা’ নামে পরিচিত। অধিবিদ্যা, যুক্তিবিজ্ঞান, নৈতিকতা, পদার্থবিজ্ঞান ও ধর্মতত্ত্বেও রয়েছে তাঁর অবিস্মরণীয় সাফল্য।
ইবনে সিনার জন্ম ৯৮০ সালে বর্তমান উজবেকিস্তানের বিখ্যাত শহর বোখারার নিকটবর্তী খার্মাতায়েন জেলার আফসানা গ্রামে। পুরো নাম হিসেবে ইরানিরা তাঁকে আবু আলী হোসাইন বিন আবদুল্লাহ বিন হাসান বিন আলী বিন সিনা আর আরবরা তাঁকে আবু আলী হোসাইন ইবনে আবদুল্লাহ আল-হাসান ইবনে আলী ইবনে সিনা হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তবে তিনি আবু আলী সিনা, ইবনে সিনা, পুরসিনা, আভিসিনা, শাইখুর রাঈস নামেও সমধিক পরিচিত। পিতার নাম আবদুল্লাহ ও মায়ের নাম সিতারা। শৈশবেই তাঁর অসাধারণ প্রতিভার স্বাক্ষর দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। মাত্র ১০ বছর বয়সে তিনি কুরআন মজিদের ৩০ পারা মুখস্থ করেন। বিখ্যাত দার্শনিক আবু আবদুল্লাহ আল-নাতেলির কাছে দর্শন ও ন্যায়শাস্ত্র শিক্ষালাভ করেন। ধর্মতত্ত্ব, ফিকাহশাস্ত্র ও তাফসিরবিদ্যায় পা-িত্য অর্জন করেন ইসমাইল সুফির কাছ থেকে। গণিতশাস্ত্রের দীক্ষা পান মাহমুদ মাস্সাহের কাছে। মাতৃভাষা ফারসি হলেও সমকালীন অন্যান্য প-িতের মতো তিনিও আরবি ভাষায় অমূল্য রত্মভা-ার রচনায় ব্রতী হন।
ইবনে সিনা মাত্র উনিশ বছর বয়সে বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, অর্থনীতি, রাজনীতি, গণিতশাস্ত্র, জ্যামিতি, ন্যায়শাস্ত্র, চিকিৎসাশাস্ত্র, কাব্য, সাহিত্য প্রভৃতি বিষয়ে অর্জন করেন গভীর পা-িত্য। ২১ বছর বয়সে আল-মাজমুয়া নামক বিশ^কোষ রচনা করেন। তিনি ছিলেন প্রখর মেধার অধিকারী। এমনকি শিক্ষাগুরু আল-নাতেলি অনুধাবন করেন তাঁকে শিক্ষা দেওয়ার মতো সামর্থ্য তাঁর নেই। ইবনে সিনা স্বীয় অত্মজীবনীতে উল্লেখ করেন : যে কোনো জটিল সমস্যার সমাধান ওস্তাদ যেরূপ করতে পারতেন আমি তার চেয়ে ভালোভাবে করতে পারতাম। এমনকি আল-নাতেলির কাছে মানতেক বা তর্কশাস্ত্রের মূলমন্ত্র অধ্যয়নের পর দেখতে পেলাম আমার আর শেখার মতো কিছু বাকি নেই। তখন গ্রন্থগুলো পুনরায় পড়তে শুরু করলাম। সববিষয়ে পারদর্শী হয়ে উঠলাম। এমনকি জ্যামিতিক জটিল সমস্যাবলি সমাধান করে শিক্ষকের কাছে যাওয়ার পর তিনি সবগুলোকেই সঠিক বলে প্রতীয়মান করলেন। আমার পা-িত্য অবলোকনের পর তিনি পিতাকে নতুন শিক্ষকের সন্ধানে জ্ঞানার্জনের পরামর্শ দেন। তারপর আমি ধর্মতত্ত্ব ও প্রকৃতিবিজ্ঞানবিষয়ক অধ্যয়নে মনোনিবেশ করি।
ইবনে সিনা অতি অল্পসময়ে অ্যারিস্টটলের দর্শন সম্পূর্ণরূপে আত্মস্থ করতে সক্ষম হন। নতুন কোনো গ্রন্থের সন্ধান না পেয়ে পুরনো বইগুলো আবার পড়তে শুরু করলেন। চতুর্দিকে যশ-খ্যাতি ছড়িয়ে পড়লে বিভিন্ন দেশ থেকে তাঁর কাছে শিক্ষার্থীরা জ্ঞানার্জনে ছুটে আসতে লাগলো। এ পর্বে তিনি চিকিৎসাবিদ্যাসম্পৃক্ত অধ্যয়নে মনোনিবেশ করেন। চিকিৎসাবিজ্ঞান সংক্রান্ত গ্রন্থাবলি সংগ্রহ করে গবেষণায় আত্মনিয়োগ করেন। তিনি স্বীয় জীবনীতে উল্লেখ করেন যে, গভীর রজনীতে গবেষণায় যখন কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারতেন না তখন নামাজ পড়ে আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করে ঘুমিয়ে পড়তেন। কখনো বা মসজিদে গিয়ে আল্লাহর সাহায্য কামনা করতেন। আর নিদ্রার মাঝেই অমীমাংসিত বিষয়গুলোর সন্ধান পেয়ে যেতেন। ঘুম থেকে উঠে তিনি সমুদয় সমস্যার সমাধান করে ফেলতেন।
বোখারার শাসক নুহ বিন মনসুর দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পড়লে দেশি-বিদেশি সব চিকিৎসক মিলেও তাঁকে সুস্থ করতে তুলতে পারেন নি। ততদিনে ইবনে সিনার খ্যাতিও শাসক পর্যন্ত পৌঁছে যায়, তিনি শাসককে সম্পূর্ণরূপে সারিয়ে তোলেন। বাদশাহ তাঁকে আরোগ্য লাভের স্বীকৃতিস্বরূপ বিপুল পরিমাণ পুরস্কার ঘোষণা দেন। জ্ঞানপিপাসু ইবনে সিনা বিপুল সম্পদ ও উচ্চপদ লাভের সুযোগ উপেক্ষা করে শাহী গ্রন্থাগারে প্রবেশ করে পড়াশুনার অনুমতি প্রার্থনা করেন। এ প্রার্থনা মঞ্জুর হলে তাঁর জন্য শাহী গ্রন্থাগারে অধ্যয়নের দ্বার উন্মোচিত হয়ে যায়। জ্ঞান-বিজ্ঞানের এ বিশাল ভা-ার দেখে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়েন। এ জ্ঞানভা-ার ছিল তাঁর কল্পনাতীত। প্রাচীন থেকে শুরু করে সব লেখকের অমূল্য গ্রন্থে ভরপুর ছিল এই গ্রন্থাগার। গ্রন্থ ও লেখকের নামসহ তালিকা প্রস্তুত করে তিনি অধ্যয়নে মনোনিবেশ করেন। জ্ঞানার্জনের নেশায় তিনি এতটাই মগ্ন ছিলেন যে, প্রায়ই নাওয়া-খাওয়ার কথা ভুলে যেতেন। সাধনা ও অধ্যবসায়ের ফলে মাত্র অল্প কয়েকদিনের ব্যবধানেই ইবনে সিনা গ্রন্থাগারের সব কিতাব মুখস্থ করে ফেলেন। জ্ঞান-বিজ্ঞানের সব শাখায়ই তিনি পারঙ্গম হয়ে উঠেন।
ইবনে সিনা খাওয়ারিজমে রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণ করেন ১০০৪ সালে। এ সময় খাওয়ারিজমের বাদশাহ ছিলেন মামুন বিন মাহমুদ। সেখানে প-িত আল-বিরুনির সাথে সাক্ষাৎ হয়। স্বাধীনচেতা ইবনে সিনা ১০০৪ থেকে ১০১০ সাল পর্যন্ত খাওয়ারিজমে শান্তিপূর্ণভাবে কাটিয়ে দেন। ইবনে সিনার সুখ্যাতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়লে গজনির সুলতান মাহমুদ তাঁকে পেতে চাইলেন। সুলতান বিখ্যাত জ্ঞানী ব্যক্তিদের দেশ-বিদেশ থেকে ডেকে এনে শাহী দরবারের গৌরব বৃদ্ধি করতেন এবং তাঁদেরকে মণি-মুক্তা উপহার দিতেন। সুলতান তাঁর প্রধানশিল্পী আবু নসরকে ইবনে সিনার চল্লিশটি প্রতিকৃতি তৈরির নির্দেশ দেন। আসল ইবনে সিনাকে খুঁজে বের করার জন্য দেশে-বিদেশে সুলতান মাহমুদ প্রতিকৃতিসহ লোক পাঠিয়ে দেন। খাওয়ারিজমের বাদশাহ মামুন বিন মাহমুদকে পত্র মারফত তাঁর দরবারের জ্ঞানী ব্যক্তিদের সুলতান মাহমুদের দরবারে পাঠিয়ে দেওয়ার ইঙ্গিত করেন। আসলে অন্যান্য জ্ঞানী ব্যক্তির সঙ্গে ইবনে সিনাকে পাওয়াই ছিল তাঁর মূল উদ্দেশ্য।
ইবনে সিনার বহুদেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতার ঝুলি ছিল সমৃদ্ধ। আল-বিরুনি ভারতবর্ষের প্রতি অনুরাগী হলেও ইবনে সিনার মনোযোগ ছিল ভারতবর্ষের উল্টো দিকে। তাঁর মূল উৎসাহ ছিল পশ্চিমের দিকে। ইবনে সিনার চিকিৎসাবিষয়ক বইগুলো প্রাচ্যের সীমানা ছাড়িয়ে পাশ্চাত্য জগতে স্থায়ী আসন তৈরি করে নেয়। খাওয়ারিজম শহর থেকে বিদায় নিয়ে তিনি রাজধানী শহর গুরুগঞ্জে উপস্থিত হন। এ শহরে জীবনের বেশ কিছু সময় অতিবাহিত করেন। এখানে অবস্থানকালে চিকিৎসাবিদ্যাবিষয়ক অমর গ্রন্থ আল-কানুন ফিত তিব রচনা করেন। এরপর তিনি যান পূর্ব পারস্যের খোরাসান শহরে। সুলতান মাহমুদ ইবনে সিনাকে আবার দরবারে নিয়ে যাওয়ার জন্য দিকে দিকে দূত প্রেরণ করেন। এবার নিজ দরবার নয়, সুলতান মাহমুদের ইচ্ছা ছিল তাঁর জামাতা খাওয়ারিজম অধিপতির দরবারকে জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিদের দ্বারা সুশোভিত করা। ইবনে সিনাকে তিনি চেয়েছিলেন সভাসদ হিসেবে। কিন্তু কিছু বিষয়ে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছিল সুলতান মাহমুদের সাথে ইবনে সিনার।
ইবনে সিনা ছিলেন স্বাধীনচেতা। তিনি জর্জন নামক স্থানে পালিয়ে যান। সুলতান মাহমুদ এ খবর জানতে পেরে জর্জনের অধিপতিকে ফরমান পাঠান যেন ইবনে সিনাকে হস্তান্তর করা হয়। এমন পরিস্থিতি তৈরি হলে ইবনে সিনা এবার জর্জন থেকেও পালিয়ে গিয়ে আবার নিরুদ্দেশ যাত্রা করেন। তিনি ইরানের খোরাসান হয়ে যাওয়ার পথে তুসে সমসাময়িক কবি আবুল কাসেম ফেরদৌসির বিখ্যাত তুস নগরী পরিদর্শন করেন। এ যাত্রায় তিনি রেই শহর হয়ে হামেদানে এসে উপনীত হন। হামেদান নগরী ছিল জ্ঞান-বিজ্ঞান ও ঐশ^র্যের এক কেন্দ্রস্থল। স¤্রাট শামসুদ্দৌলা তাঁকে সম্মানের আসনে রাখেন, আর তিনিও গবেষণার উপযুক্ত পরিবেশ পেয়ে যান। চিকিৎসাসেবার পাশাপাশি তিনি অধিবিদ্যা, ধর্মতত্ত্ব এবং দর্শনের মৌলিক বিষয়ে গবেষণায় মনোনিবেশ করেন। এখানেই রচিত হয় বিখ্যাত গ্রন্থ কিতাব আল-শিফা।
ভ্রমণ পরিক্রমায় ১০৩৪ থেকে ১০৩৭ সাল পর্যন্ত ইবনে সিনার অতিবাহিত হয় ইসফাহানে। শাসক আলাউদ্দৌলা তাঁকে সম্মান ও মর্যাদার আসনে সমাসীন করেন। হামেদানের সাথে ইসফাহানের যুদ্ধ সংঘটিত হলে শাসকের অনুরোধ রক্ষায় তিনিও সফরসঙ্গী হিসেবে হামেদানে পৌঁছেন। যুদ্ধশিবিরেই ইবনে সিনা অসুস্থ হয়ে ১০৩৭ সালে মৃত্যুবরণ করেন। হামাদানেই তাঁকে সমাহিত করা হয়। ইরানের খ্যাতিমান আধুনিক কবি আরেফ কাজভিনির সমাধিও হামাদানে।
বহুমমুখী প্রতিভাধর ইবনে সিনার পদার্থবিজ্ঞান, ধর্মতত্ত্ব, জ্যামিতি, গণিত, চিকিৎসাবিজ্ঞান, সাহিত্য প্রভৃতি বিষয়ে ১১১টি গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া যায়। তন্মধ্যে কানুন ফিত্ তিব (চিকিৎসাবিজ্ঞান), কিতাব আল-শিফা ( আরোগ্যতত্ত্ব) এবং কিতাব আল-ইশারাৎ (বিবিধ অনুশীলনী) সর্বাপেক্ষা প্রসিদ্ধ। কানুন ফিত-তিব সর্বপ্রথম ১০২৫ সালে আরবি ভাষায় প্রকাশ পায়। এটি আঠারো খ-ে সমাপ্ত। ল্যাটিন, ইংরেজি ও হিব্রু ভাষায় তা অনূদিত হয়। কানুনে প্রায় শতাধিক জটিল রোগের কারণ, লক্ষণ, পথ্যাদির বিস্তারিত ব্যাখ্যা রয়েছে। ইবনে সিনা ফার্মাকোলজি ও ক্লিনিক্যাল প্র্যাকটিসের উন্নয়ন করেন। তবে তাঁর মূল কর্মক্ষেত্র ছিল চিকিৎসাশাস্ত্র। তিনি হলিস্টিক মেডিসিনের প্রণেতা। একই সাথে শারীরিক, মানসিক এবং আত্মিক যোগসূত্রকে বিবেচনায় রেখে চিকিৎসা দেওয়া হয়। তিনি মানুষের চোখের সঠিক এনাটমি বর্ণনা করেন। সুদীর্ঘকাল আগেই তিনি বলে যান যক্ষ্মা একটি ছোঁয়াচে রোগ। যা পরবর্তীকালে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় সঠিক বলে প্রমাণিত হয়। সত্যিই ইবনে সিনা আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের জনক।
ইবনে সিনার কিতাব আল-শিফা (আরোগ্যতত্ত্ব) একটি বিশ^কোষ। এটিও আঠারো খ-ে সমাপ্ত। এতে রয়েছে পদার্থবিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান, এরিস্টটলীয় দর্শনসহ নানাবিধ বিষয়ের সমাহার। দ্বাদশ শতকে এটি ল্যাটিন ভাষায় অনূদিত হয় ও ইউরোপে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে। মধ্যযুগের ইউরোপীয় বিজ্ঞানী-দার্শনিকদের নিকট এটি সমাদৃত হয়। গ্রন্থটির পদার্থবিজ্ঞান অধ্যায়ে ইবনে সিনা প্রমাণ করেন যে, বিশে^র মৌলিক বস্তুসমূহ প্রকৃতি যেভাবে বিভিন্ন শ্রেণিতে বিন্যস্ত করেছে তা পরিবর্তন করা মানুষের সাধ্যাতীত। কিতাব আল-ইশারাত তাঁর পরিণত বয়সের রচনা। দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধের সংকলন। মানব সমাজের বহু চিরন্তন সমস্যার আলোকপাত রয়েছে এতে। সৃষ্টিরহস্য উন্মোচিত করার অব্যক্ত প্রয়াস। পঞ্চম অধ্যায়ে সুফিতত্ত্বের গূঢ় রহস্য, পরমাত্মার সাথে মানবাত্মার মিলনাকাক্সক্ষার আকুতি ব্যক্ত হয়। আধ্যাত্মিক সাধনার পথে যেসব স্তরপরিক্রমা অতিক্রম করতে হয় তা যেন ফুটে ওঠে ধাপে ধাপে।
ইবনে সিনার বিখ্যাত গ্রন্থাবলি হলো কিতাবুল মাজমু, কিতাবুল হাসিল ওয়াল মাহসুল, কিতাবুল র্বির ওয়াল ইসম, কিতাবুল আরসাদিল কুল্লিয়্যাহ, কিতাবুল ইনসাফ, কিতাবুন্নাজাহ, কিতাবুল হিদায়াহ, কিতাবুল মুখতাসারিল আওসাত, কিতাবুল আলাঈ, কিতাবু লিসানিল আরাব ফিল-লুগাহ, কিতাবুল আদভিয়াহ আল-ক্বালবিয়াহ, কিতাবুল মুজিয, কিতাবু বাযিল হিকমাহ আল-মাশরাফিয়্যাহ, কিতাবুল মাআদ প্রভৃতি।
ইবনে সিনার অমর গ্রন্থাবলি আরবিতে রচিত হলেও ফারসি ভাষায়ও তাঁর অবদান স্বীকৃত। অধিকাংশ গবেষকের মতে, তাঁর ফারসি গ্রন্থের সংখ্যা ২০টি। বহুমুখী প্রতিভাধর ইবনে সিনার কাব্যজগতেও রয়েছে সফল পদচারণা। ফারসি ও আরবি দুভাষাতেই তাঁর কাব্যচর্চার নিদর্শন বিদ্যমান। ফারসি পঙ্্ক্তির সংখ্যা ৭২টি হিসেবে বিভিন্ন গ্রন্থে আলোকপাত করা হয়েছে। তাঁর ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপাত্মক ফারসি কবিতায় পাঠকহৃদয় আলোড়িত হয়। বৈশি^ক জীবনের অসারতা, মানুষের অপারগতা-অক্ষমতা কাব্যদর্শনের প্রধান উপজীব্য। কাব্যজুড়ে রয়েছে জীবন ও সৃষ্টিজগের রহস্য উদ্ঘাটনের তীব্র বাসনা। জীবন-রহস্য উন্মোচনের প্রবল আকুতি দৃশ্যমান হয়ে ওঠে শ্লোকের বাঁকে বাঁকে। একজন শক্তিমান কবির বহুমাত্রিক বৈশিষ্ট্যও চিত্রিত হয় ইবনে সিনার কবিতায়।
روزکی چند در جهان بودم
بر سر خاک باد پیمودم
ساعتی لطف و لحظه ای در قهر
جان پاکیزه را بیالودم
باخرد را به طبع، کردم هجو
بی خرد را به طمع بستودم
آتشی برافروختم از دل
و آب دیده ازو بیالودم
با هواهای حرص شیطانی
ساعتی شادمان بنغودم
آخر العمر چون سرآمد کار
رفتم تخم کشته بدرودم
گوهرم باز شد به گوهر خویش
من از این خستگی بیالودم
کس نداند که من کجا رفتم
خود ندانم که من کجا بودم
دل گرچه درین بادیه بشتافت
یک موی ندانست ولی موی شکافت
اندر دل هزار خورشید بتافت
آخر به کمال ذره ای راه نیافت

এ ধরণীতে ছিলাম কিছুকাল
অহংকারে ভ্রমণ করেছি মাটির ওপর।
কখনো দয়ায় আবার কখনো ক্রোধে
পবিত্র হৃদয় আঙিনাকে করেছি কলুষিত।
জ্ঞানীকে ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপে করেছি জর্জরিত
লালসায় ডুবে মুর্খের করেছি প্রশংসাবাণী।
অন্তরকে দ্বগ্ধ করেছি বহ্নিশিখায়
চোখের জলকে করেছি অপমান।
শয়তানি লোভ-লালসায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে
আনন্দ-উচ্ছাসে বাজিয়েছি গানের সুর।
জীবনসায়াহ্নে চূড়ান্ত পরিণতির কালে
ফসলের বীজ বপনে করলাম মনোনিবেশ।
অর্জিত মণি-মুক্তা এসে যুক্ত হলো আমার ভা-ারে
আলস্য-অবহেলায় যাপিত জীবন বয়ে আনলো অপমানের ঝুড়ি।
জানে না কেউ কীইবা আমার পরিণতি
নিজেও জানি না কোথায় ছিলাম আমি।
যদিও হৃদয় এই পথে-প্রান্তরে ছুটে চলেছে তীব্রবেগে
একটি পশমও জানেনি কিছুই যদিও চির ধরেছে চুলে।
হৃদয় আঙিনায় সহ¯্র সূর্য বিকিরণ করেছে আলো
অথচ জীবন মোর এক বিন্দুও পায়নি পথের দিশা।

ইবনে সিনা প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের এক প্রোজ্জ্বল নক্ষত্র। যাঁর আলোকচ্ছটায় বিশ^বাসী প্রায় নয় শতকব্যাপী আলোকিত হয়ে আসছে। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের জনক ইবনে সিনার জন্মদিন শাহরিভার মাসের ১ তারিখ ইরানে চিকিৎসা দিবস হিসেবে পালিত হয়। ইরান, তুরস্ক, ফ্রান্স, আফগানিস্তান, বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ইবনে সিনার নামে চিকিৎসাবিজ্ঞানবিষয়ক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। ইউনেস্কো প্রতি দুবছর অন্তর ইবনে সিনা পুরস্কার দিয়ে থাকে। চিকিৎসাশাস্ত্র, পদার্থবিজ্ঞান, ধর্মতত্ত্ব, জ্যামিতি, গণিত, সাহিত্যসহ জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রায় সব শাখায় রয়েছে তাঁর সফল বিচরণ। বিশেষত তাঁর মেডিকেল বিশ^কোষ আল-কানুন ফিত-তিব উনিশ শতক অবধি মুসলিম বিশ^ ও ইউরোপে সিলেবাসভুক্তভাবে পঠিত হয়। ইউনানি চিকিৎসায় তা অদ্যাবধি যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করে আসছে। বহুমুখী প্রতিভাধর ইবনে সিনা যুগ যুগ ধরে মানবহৃদয়ে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন স্বীয় কর্মের মাধ্যমে।

প্রফেসর, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ
রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়।

চিকিৎসা বিজ্ঞানের পথিকৃৎ আলরাজি

ড. তারিক জিয়াউর রহমান সিরাজী : পারস্যে ‘অনুবাদ আন্দোলন’ শুরু হওয়ার পর আব্বাসি যুগের গোড়ার দিকে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ গ্রিক, সুরইয়ানি (প্রাচীন সিরীয়), পাহলাভি, সংস্কৃত ও অন্যান্য ভাষা থেকে আরবি ভাষায় রূপান্তরিত হয়ে তা ফারসি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এর ফলে গ্রিক দর্শনের নিদর্শনগুলো মুসলমানদের মধ্যে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। ইসলামি বিশ্বে এ সকল রচনা অনুবাদের পেছনে বিভিন্ন উদ্দেশ্য নিহিত ছিল। তবে এ সবের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল বিভিন্ন শাখার জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিক্ষা-দীক্ষার সাথে ইসলামি জ্ঞান-বিজ্ঞান ও নীতিশাস্ত্রের সমন্বয় সাধন করা। মূলত গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটলের কর্মগুলোর অনুবাদের মাধ্যমে ইসলামি চিন্তাদর্শনের ক্ষেত্রে এক নতুন অধ্যায়ের উন্মেষ ঘটে। এ ধারার কর্মতৎপরতা দার্শনিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও ধর্মশাস্ত্রীয় বিষয়গুলো ছাড়াও জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখায় গবেষকদের আগুয়ান হতেও ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিল। এরই ধারাবাহিকতায় পারস্যের বিজ্ঞানমনস্ক মুসলিম দার্শনিক ও পণ্ডিতগণ বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় বুৎপত্তি অর্জন করেন; বিশেষ করে চিকিৎসাবিজ্ঞানে তাঁরা এক অভূতপূর্ব সাফল্যের স্বাক্ষর রেখে যান।
উল্লেখ্য যে, মুসলমানগণ গ্রিকদের সংস্পর্শে আসার সাথে সাথেই চিকিৎসাশাস্ত্রে তাঁদের জ্ঞানানুশীলনের সূচনা ঘটে। তাঁদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় গ্রিক পণ্ডিতদের চিকিৎসাশাস্ত্রীয় ও আয়ুর্বেদিক গ্রন্থগুলো আরবি ভাষায় অনুবাদ করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় প্রাচীন গ্রিক চিকিৎসাবিদ গ্যালেন (এধষবহ, ১২৯-২১৬খ্রি.) যাঁকে ফারসি, আরবি ও উর্দু ভাষায় জালিনুস বলা হয়; তাঁর রচিত চিকিৎসাবিজ্ঞান সম্পর্কিত প্রাচীন পাণ্ডুলিপিগুলো পারস্য ও আরব সমাজে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে। মূলত তাঁর চিকিৎসাশাস্ত্রীয় বিদ্যার উপর নির্ভর করেই মুসলমান চিকিৎসগণ চিকিৎসাশাস্ত্রে তাঁদের জ্ঞানানুশীলন শুরু করেন। গ্যালেনের রচনাসমগ্র সর্বপ্রথম আরবিতে অনুবাদ করেন বিখ্যাত সিরীয় অনুবাদক ও চিকিৎসাবিজ্ঞানী হুনায়েন ইবনে ইসহাক আল ইবাদি (৮০৯-৮৭৩ খ্রি.) যিনি তৎকালীন চিকিৎসাশাস্ত্রে অসামান্য খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।

এসব মুসলিম দার্শনিক ও চিকিৎসাবিজ্ঞানী অধুনাকালের চিকিৎসাবিজ্ঞানের পথিকৃত হিসাবে অম্লান হয়ে আছেন। বিশ্ববিশ্রুত চিকিৎসা বিজ্ঞানী আবু বকর মুহাম্মাদ বিন জাকারিয়া আলরাজি (৮৫৪-৯২৫/৯৩২ খ্রি.) হলেন তাঁদের অন্যতম-যিনি ইউরোপে রাজেশ (জযধুবং) নামে পরিচিত।
মুসলিম চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের মধ্যে আলরাজি ছিলেন একজন শ্রেষ্ঠ চিকিৎসাবিজ্ঞানী। তিনি কেবল চিকিৎসাবিজ্ঞানীই ছিলেন না; বরং তিনি ছিলেন একাধারে দার্শনিক, গণিতবিদ ও রসায়নবিদ। আলরাজি ইরানের প্রসিদ্ধ রেই শহরে জন্মগ্রহণ করেন। ছোট বেলা থেকেই গানের প্রতি আলরাজির প্রবল ঝোঁক ছিল। আর এ কাণেই তাঁর শৈশবের একাংশ কাটে গান চর্চায়। এরপর তিনি বিদ্যান্বষণে আগ্রহী হয়ে উঠেন। ঘুরে ঘুরে বিদ্যার্জনের বড় কৌতুহল ছিল আলরাজির। হঠাৎ একদিন তিনি রেই শহরের একটি হাসপাতাল পরিদর্শন করেন। সেখানে ব্যাধিগ্রস্ত অসংখ্য লোক দেখে তাঁর হৃদয় ভেঙ্গে পড়ে। এরপর থেকেই তিনি চিকিৎসাবিজ্ঞানের উপর অধিক পড়াশুনার সিদ্ধান্ত নেন।

তাঁর এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু তাঁর এ বিদ্যান্বেষণে আগ্রহ দেখে তাঁকে বাগদাদে যাওয়ার জন্য পরামর্শ দেন। আলরাজি বন্ধুর এ পরামর্শ অকপটে মেনে নেন এবং প্রায় বিশ বছর বয়সে তিনি জ্ঞানার্জনের উদ্দেশ্যে বাগদাদ গমন করেন। সেখানে তিনি বিশিষ্ট চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও শিক্ষকদের নিকট চিকিৎসাশাস্ত্রে বিশেষ জ্ঞান অর্জন করেন। এ অভিজ্ঞ শিক্ষদের সংস্পর্শে তিনি বহুদিন কাজ করেন এবং অল্প সময়েই মেধা ও মননের উৎকর্ষ সাধন করে চিকিৎসক হিসাবে সুপরিচিত হন। এরপর তিনি পুনরায় রেই শহরে ফিরে আসেন এবং চিকিৎসক হিসাবে কাজ শুরু করেন।
আলরাজির উপলব্ধিজ্ঞান ও পর্যবেক্ষণশক্তি ছিল অত্যন্ত প্রখর ও সূক্ষ্ম। একটি বর্ণনা থেকে তা সহসা বুঝা যায়। আলরাজি নিজ শহরে ফিরে আসার কয়েক বছর পর পুনরায় যখন বাগদাদে ফিরে যান তখন বাগদাদে একটি হাসপাতাল স্থাপনের জন্য সেখানকার অধিবাসীরা জল্পনা কল্পনায় মত্ত ছিল। হাসপাতালটি কোথায় স্থাপন করা যায় সে ব্যাপারেও তারা ছিল চিন্তিত। আলরাজি বুদ্ধিমত্তার সাথে সে সমস্যার সমাধান দেন। তিনি কতগুলো কাঁচা গোশতের টুকরো নিয়ে বাগদাদের বিভিন্ন স্থানে ঝুলিয়ে দিলেন এবং তা কয়েকদিন ঝুলন্ত অবস্থায় রেখে দিলেন। একটি স্থান ছাড়া সব জায়গায় গোশতের টুকরোগুলো অতি তাড়াতাড়ি পচে গিয়েছিল। যে স্থানটিতে দীর্ঘ সময় ধরে গোশতের টুকরো ভালো ছিল আলরাজি সেখানে হাসপাতাল স্থাপনের পরামর্শ দিলেন। হাসপাতাল স্থাপিত হওয়ার পর তাঁকেই সে হাসপাতালের প্রধান হিসাবে নিয়োগ করা হলো।
তাঁর গবেষণাকর্মের মধ্যে সর্বাগ্রে চিকিৎসাবিজ্ঞানের শ্রেষ্ঠগ্রন্থ আল হাভি (ঈড়হঃরহবহং) এবং এরপর রসায়নশাস্ত্রের র্সেরুল আসরার (ঝবপৎবঃ ড়ভ ঝবপৎবঃং বা রহস্যাবলির রহস্য) শীর্ষক গ্রন্থের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। তাঁর শেষোক্ত গ্রন্থটি তদানীন্তন সময়ে প্রকৃতিবিজ্ঞানের ওপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিল।
আলরাজির শ্রেষ্ঠ ও গুরুত্বপূণ অবদান হলো আল হাভি। এ গ্রন্থে তিনি প্রায় প্রতিটি রোগ সম্পর্কে ব্যাপক আলোচনা করেছেন। এতে আরো রয়েছে গ্রিক, সিরীয়, আরব্য, পারস্য ও ভারতীয় চিকিৎসা পদ্ধতির বিস্তারিত আলোচনা। এরপর গ্রন্থটিতে তাঁর নিজের অভিজ্ঞতা ও মতামত তুলে ধরেন। এ গ্রন্থটি প্রায় ২০টি পুস্তিকার সমন্বয়ে প্রণীত। এর নবম পুস্তিকাটি খ্রিস্টীয় ষোলো শতক পর্যন্ত ইউরোপের প্রায় প্রতিটি বিশ^বিদ্যালয়ের চিকিৎসাবিজ্ঞান বিভাগের পাঠ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত ছিল।
এ গ্রন্থটিতে তিনি মেডিসিন সম্বন্ধীয় অনেক খুঁটিনাটি বিষয়ও তুলে ধরেন। এটি রচনা করতে তাঁর সময় লেগেছিল প্রায় ১৪ থেকে ১৫ বছর। দিনরাত পরিশ্রম করে তিনি তাঁর সাধনা চালিয়ে গেলেন। এক পর্যায়ে তিনি গভীর রাত পর্যন্ত লিখতে শুরু করেন। এমনি করে ধীরে ধীরে তিনি অন্ধ হয়ে গেলেন। কিন্তু মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত আলরাজি কখনো ক্ষান্ত হননি। তিনি লেখার কাজ চালিয়ে গেলেন অন্যভাবে। তিনি বলতেন আর তাঁর ছাত্ররা তা লিখে রাখত। যখন তিনি মারা গেলেন তখন তাঁর ছাত্ররাই এ আল হাভির কাজ সমাপ্ত করেছিল। এসব বই ছাড়াও তিনি বহু গ্রন্থ রচনা করে গেছেন- যা চিকিৎসাবিজ্ঞানে আজও অনুসৃত হচ্ছে।
আলরাজি সবসময় বলতেন : ‘মানুষের অসুস্থতার অন্যতম কারণ হলো তারা অসুস্থ অবস্থায় বেশি অস্থিরতায় ভোগে।’ তিনি চিকিৎসকদের এই বলে অনুরোধ করতেন; যাতে তাঁরা রোগীদের সাথে ভালো ব্যবহার করেন। তাহলে রোগীদের অস্থিরতা এবং বিষণ্নতা কেটে যাবে। তিনি রোগীদের ভয়ভীতি, অস্থিরতা ও বিষণ্নতা দূর করার জন্য সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন।
একদা খোরাসানের শাসক মানসুর ইবনে ইসহাক অসুস্থ হয়েছিলন। তিনি এতটা অসুস্থ ছিলেন যে, দাঁড়াতে পারতেন না এবং হাঁটতেও পারতেন না। আলরাজি তাঁর চিকিৎসার ভার হাতে নিলেন। তিনি তাঁকে বললেন : ‘এখন গরম পানি দিয়ে গোসল করবেন।’ আশপাশ থেকে মানুসর ইবনে ইসহাকের কর্মচারীদের তিনি সরিয়ে দিলেন। এরপর আলরাজি হাতে একটি ছুরি নিয়ে মানসুরের দিকে এগিয়ে গেলেন। মানসুর এ অবস্থা দেখে ভীত হলেন এবং লাফ দিয়ে গোসল খানার বাইরে চলে এলেন। তিনি যখন দৌড়ে চলে যাচ্ছিলেন তখন আলরাজি তাঁকে বললেন : ‘এখন আপনি দাঁড়াতেও পারেন এবং হাঁটতেও পারেন। আপনি এখন সুস্থ, কিন্তু দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিলেন।’
তাঁর চিকিৎসাবিজ্ঞান সংক্রান্ত গ্রন্থগুলোর অন্যতম গ্রন্থ হলো কিতাব আল মানসুরি। এ গ্রন্থটি তিনি খোরাসানের শাসক মানসুর ইবনে ইসহাক সামানিকে উৎসর্গ করেছিলেন। এ গ্রন্থটিতে শরীরে যে নানা ধরনের ইনফেকশন হয় তার প্রতিকার নিয়ে তিনি বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। এ গ্রন্থটি বিশ্বের বহ ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এ গ্রন্থটি ইউরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হতো।
প্রথম দিকে তিনি আল-কেমি (মধ্যযুগীয় রাসায়নশাস্ত্র), গণিতশাস্ত্র ও দর্শনশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। বিশেষ করে আল-কেমি তথা রসায়নের উপর অধিক বুৎপত্তি লাভ করেন। তিনি রসায়নশাস্ত্রের উপর র্সেরুল আসরার (রহস্যাবলির রহস্য) শীর্ষক একটি গ্রন্থ রচনা করেন যাকে ঞযব নড়ড়শ ড়ভ ংবপৎবঃং বা গোপন তথ্যনির্ভর পুস্তক বলা হয়ে থাকে। তৎকালীন সময় এ গ্রন্থটি বেশ পরিচিতি লাভ করেছিল। আমরা অনেকেই জানি না যে, এ গ্রন্থ দিয়েই আজকের রসায়নবিজ্ঞানের সূচনা হয়েছিল।
শল্য চিকিৎসার প্রাণপুরুষ আলরাজিই প্রথম চিকিৎসক যিনি হাম ও গুটি বসন্তকে আলাদা রোগ হিসাবে চি‎িহ্নত করেছিলেন। তাঁর রচিত আল জুদারি ওয়াল হাসবাহ নামক গ্রন্থে তিনি হাম ও গুটি বসন্ত সম্পর্কে বিজ্ঞানসম্মত ব্যাপক আলোচনা করেছেন। সে সময়ে গুটি বসন্ত মহামারি আকারে গ্রামের পর গ্রাম মানুষের মাঝে আতঙ্ক ছড়াতো। আলরাজি ছিলেন গ্রিক দর্শনের প্রতি বিশেষভাবে অনুরাগী। তিনি গ্রিক ভাষায় রচিত বিভিন্ন গ্রন্থ অনুবাদ করে ও নিজের গবেষণালব্ধ জ্ঞান প্রয়োগ করে গুটি বসন্ত প্রতিরোধের কার্যকরি উপায় ব্যাখ্যা করেন। তিনি তাঁর সারাজীবনের প্রাপ্ত জ্ঞান ও গবেষণা একত্র করে এ গ্রন্থটি লিখেন। যেখানে তিনি বলেন : ‘কিছুদিন আগেও বুখারার হাজার হাজার মানুষ চিকিৎসার অভাবে মারা গেছে। তাই সাধারণ লোকদের চিকিৎসার জন্য বিশেষ ভূমিকা রাখা প্রয়োজন।’ এ গ্রন্থটি ল্যাটিন ও ইউরোপের প্রায় সকল ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ১৪৯৮ থেকে ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত গ্রন্থটির ইংরেজি সংস্করণ প্রায় চল্লিশবার প্রকাশিত হয়েছে।
এছাড়া মানুষের কিডনি ও গলব্লাডারে কেনো পাথর হয় এ সম্পর্কে তিনি একটি মৌলিক ও গবেষণালব্ধ পুস্তিকা রচনা করেন। লাশ কাটা সম্পর্কেও তাঁর রচিত পুস্তিকা রয়েছে।
দীর্ঘদিন বাইরে জীবনযাপন করার পর বৃদ্ধ বয়সে আলরাজি পুনরায় রেই শহরে ফিরে এলেন। যদিও তিনি অন্ধ ছিলেন কিন্তু তাঁর দুঃখ-কষ্টকে লাঘব করার জন্য তাঁর বন্ধু-বান্ধব ও ছাত্ররা সদা প্রস্তুত ছিল।
আল রাজি রসায়নবিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান, চিকিৎসাবিজ্ঞান ও অন্যান্য বিষয়ে প্রায় ২০০টির অধিক গ্রন্থ লিখেছেন। চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রায় প্রতিটি রোগ সম্পর্কেই তিনি গবেষণালব্ধ পুস্তিকা লিখে গেছেন। এছাড়া তিনি সালফিউরিক এসিড আবিষ্কার করেন। তিনি ইথানল উৎপাদন ও পরিশোধন এবং চিকিৎসায় এর ব্যবহার পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন।
আলরাজি উচ্চমার্গের একজন দার্শনিকও ছিলেন। নানা মতবিরোধের কারণে তাঁর দার্শনিক রচনাবলি ব্যাপক প্রসারতা লাভ করেনি। আলরাজির দার্শনিক গুরুত্ব স্পষ্টত ইসমাইলি সম্প্রদায়ের চিন্তাধারার সাথে যুক্তিতর্কের মাধ্যমেই প্রকাশ পেয়েছে। এ দলের বড় মাপের পণ্ডিত তথা মোহাম্মাদ র্সাখে নিশাপুরি ও হামিদ কেরমানির সাথে তাঁর দার্শনিক ও পাণ্ডিত্যপূর্ণ মতবিরোধ ছিল। যদিও তাঁদের বেশিরভাগ মতবিরোধ ও বিতর্ক ছিল রসায়নশাস্ত্রীয় বিষয়ের ওপর। আলরাজি আধ্যাত্মিক ও রহস্যপূর্ণ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রকৃতির দৃশ্যমান বিষয়গুলোর পরিচিতি তুলে ধরার বিপক্ষে ছিলেন। কিন্তু দার্শনিকগণ সময়, প্রকৃতি, আত্মা ও নবুওয়াতের ক্ষেত্রে রাজির চিন্তাদর্শনের বিরোধিতা করেছেন। তিনি নবুওয়াত সংক্রান্ত আলোচনায় দার্শনিকদের কাছ থেকে সাহায্যও প্রার্থনা করেছিলেন। নবুওয়াত সম্পর্কিত রচনার কারণে তাঁকে নিন্দা আর সমালোচনার মুখোমুখিও হতে হয়েছিল। যদিও পরবর্তীকালে নবুওয়াত সম্পর্কিত তাঁর কোনো রচনারই অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। তাছাড়া অনেকেই এ বিষয়টিকে দর্শন বহির্ভূত বিষয় বলে মনে করেছেন। মোটকথা, তাঁর ধর্মীয় ও মরমি মতবাদগুলো প্লেটো ও ইরানে প্রাচীন ধর্মীয় মতবাদকে ধারণ করে আছে।
বিশাল জ্ঞানের অধিকারী আলরাজি ছিলেন অত্যন্ত দয়ালু। তিনি গরিবদের বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা ও ঔষধ বিতরণ করতেন। তিনি যেমনি ছিলেন বিদ্বান তেমনি ছিলেন পরহিতৈষী ও প্রশস্ত হৃদয়ের অধিকারী। তিনি বহু দেশ ভ্রমণ করেন। বাগদাদ নগরীতে তাঁর একটি পরীক্ষারগার ছিল। তাঁর নামে ইরানে রাজি ইন্সটিটিউট ও ইরানের কেরমানশাহ শহরে রাজি বিশ্ববিদ্যালয় অবস্থিত। ইরানে প্রতি বছর ২৭ আগস্ট আলরাজিকে স্মরণ করে রাজি দিবস পালন করা হয়।
পরিশেষে বলা যায় যে, চিকিৎসাবিজ্ঞানে আলরাজির অবদান অবিস্মরণীয়। তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদানসমূহের কারণে তাঁকে আরব্য মেডিসিনের পিতা বলা হয়। তিনি আজও চিকিৎসাবিজ্ঞানে অমর হয়ে আছেন এবং থাকবেন। তাঁকে ব্যতীত চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাস রচনা সম্ভব নয়।

তথ্যসূত্র
১. আবদুল মওদুদ (১৯৮০ খ্রি.), মুসলিম মনীষা, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ঢাকা।
২. আহমাদ তামীমদারী (২০০৭ খ্রি.), ফার্সী সাহিত্যের ইতিহাস (বাংলা ভাষায় অনূদিত), আলহুদা আন্তর্জাতিক প্রকাশনা সংস্থা, ইরান।
৩. মো. ফজলুর রহমান মুনশী (১৯৯৭ খ্রি.), বিশ্বের মুসলিম মনীষীদের কথা, বার্ড পাবলিকেশন্স, ঢাকা।
৪. সৈয়দ হোসেন নসর (২০০৫ খ্রি.), তিনজন মুসলিম মনীষী, (অনুবাদ: মহীউদ্দীন), দিব্যপ্রকাশ, ঢাকা।
৫. নিউজ লেটার, ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, ঢাকার মুখপাত্র।
৬. Edward G. Browne (1969), A literary History of Persia, (Vol.-I), Cambridge University press, London
৭. https://en.wikipedia.org/wiki/Muhammad_ibn_Zakariya_al-Razi

অধ্যাপক, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়