মহানবী হয়রত মুহাম্মদ (সা.)-এর কন্যা হযরত ফাতিমা (সা.আ.)-এর জন্মদিন ও নারী দিবস উপলক্ষ্যে আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ ভবনের মুজাফফর আহমেদ চৌধুরী মিলনায়তনে এক আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ঢাকাস্থ ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র এবং যাহরা এসোসিয়েশনের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত ‘হযরত ফাতিমা জাহরা (সা.আ.) বিশ্বের নারীদের আদর্শ’ শীর্ষক আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকাস্থ ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের কালচারাল কাউন্সেলর সাইয়্যেদ রেজা মীরমোহাম্মদী। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ড. নুসরাত ফাতেমা এবং চক্ষু বিশেষজ্ঞ ও সার্জন এবং লায়ন্স চক্ষু ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের সহকারি রেজিস্ট্রার ড. ইসরাত জাহান ইপা। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন যাহরা এসোসিয়েশনের চেয়ারপারসন মিসেস সেলিনা পারভীন।
অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, একজন পরিপূর্ণ মানুষের যতগুলো ভালো দিক ও গুণাবলী থাকা প্রয়োজন তার সবগুলোর অধিকারী ছিলেন ‘হযরত ফাতিমা জাহরা (সা.আ.)। তিনি ছিলেন সমগ্র বিশ্বের নারী জাতির আদর্শ, বেহেশতের নারীদের নেত্রী, পবিত্র কোরআন এবং অসংখ্য হাদীস কর্তৃক ঘোষিত নিষ্পাপ নারী। ‘হযরত ফাতিমা জাহরা (সা.আ.) সম্পর্কে মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) বলেন, হযরত ফাতিমাকে কষ্ট দিলে আল্লাহ অসন্তুস্ট হয় আর হযরত ফাতেমাকে ভালোবাসলে আল্লাহ সন্তুষ্ট হয়।
আমরা যদি ‘হযরত ফাতিমার জীবনীর দিকে লক্ষ করি তাহলে দেখতে পাব যে, তাঁর জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে রয়েছে আমাদের জন্য পরম শিক্ষা এবং সেটি সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ইহলৌকিক, পারলৌকিক, আধ্যাত্মিক, ধৈর্য সংযম ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে।
বক্তারা আরো বলেন, ‘হযরত ফাতেমা (সা.‘আ.) হচ্ছেন গোটা ইতিহাসে এবং অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ কাল নির্বিশেষে সব সময়ের জন্য নারীকুলের অনুসরণীয় আদর্শ। বস্তুত মানুষের ঐশী ও পবিত্র দিকটি তাঁর মধ্যে পরিপূর্ণরূপে প্রকাশিত হয়েছে। ‘তিনি ছিলেন বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্বের অধিকারী একজন মানুষ, ইসলামের পথে একজন সাহসী সংগ্রামী, একজন জ্ঞানী মহিলা- যিনি একই সময় একদিকে যেমন একজন গৃহিণীর ভূমিকা পালন করেন অন্যদিকে ছিলেন একজন মমতাময়ী স্ত্রী ও মাতা এবং পূর্ণতার অধিকারিণী।ইরানের ইসলামী বিপ্লবের রুপকার ইমাম খোমেইনী (রহ্.)‘হযরত ফাতেমা (সা.‘আ.)এর জন্মদিনকে নারী দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছেন যাতে বিশ্বের নারীরা হযরত ফাতেমা (সা.‘আ.) সম্পর্কে আরো বেশি বেশি জানতে পারে এবং তাঁকে তাদের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করতে পারে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে আজ ‘ মুসলিম উম্মাহ গঠন: নয়া ইসলামি সভ্যতা বিনির্মাণের পূর্বশর্ত ‘ শীর্ষক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে। ঢাকাস্থ ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের যৌথ উদ্যোগে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিলসোফি স্টুডেন্ট ইউনিয়নের সহযোগিতায় আয়োজিত সেমিনারে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকাস্থ ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের কালচারাল কাউন্সেলর সাইয়্যেদ রেজা মীরমোহাম্মদী। সেমিনারে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মো. মুনির হোসেন তালুকদার এবং ইতিহাস বিভাগের প্রফেসর ড. মোহাম্মদ গোলাম রব্বানি। সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন দর্শন বিভাগের সহকারি অধ্যাপক ও ফিলোসফি স্টুডেন্ট ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত চেয়াম্যান মোহাম্মদ উল্লাহ। অনুষ্ঠানে বক্তরা বলেন, আজকে যে বিষয়ে সেমিনারটির আয়োজন করা হয়েছে তা মুসলমানদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। তারা বলেন, যারা ইসলামকে অনুসরণ করে তারাই মুসলিম উম্মাহ।অর্থাৎ যারা লক্ষ্য অর্জনের জন্য একই পথ অনুসরণ করে।আর যারা লক্ষ্য অর্জনের জন্য একই পথ অনুসরণ করবে তারা অবশ্যই ঐক্যবদ্ধ জাতিতে পরিনত হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আজ বিশ্বে মুসলমানদের মধ্যে অনৈক্য বিরাজ করছে।বিভেদ-বিভাজন আজ মুসলমানদের প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।মুসলমানরা যদি ঐক্যবদ্ধ হতে পারে, সহিত্যকারে ইসলামী উম্মাহ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে তাহলেই কেবল নয়া ইসলামী সভ্যতা বিনির্মাণ সম্ভব।যেখানে থাকবেনা কোন সংঘাত, হানাহানি।যে সভ্যতায় কেবলই বিরাজ করবে শান্তি ও সমৃদ্ধি।
রেইনবো ফিল্ম সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা এবং ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের পরিচালক আহমেদ মুজতবা জামালের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন ঢাকাস্থ ইরান দূতাবাসের কালচারাল কাউন্সেলর সাইয়্যেদ রেজা মীর মোহাম্মদী। রোববার রাজধানীর সাইন্স ল্যাবরেটরি রোডে অবস্থিত রেইনবো ফিল্ম সোসাইটির কার্যালয়ে এই সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠিত হয়। সাক্ষাতে ঢাকাস্থ ইরানি কালচারাল কাউন্সেলর সাইয়্যেদ রেজা মীর মোহাম্মদী বলেন, ইরান ও বাংলাদেশ দুটি ভ্রাতৃ ও বন্ধুপ্রতিম দেশ এবং দেশদুটির সংস্কৃতির অনেক ক্ষেত্রেই অভিন্নতা রয়েছে।আমরা চাই দুদেশের মধ্যকার সাংস্কৃতিক সম্পর্ককে আরো উচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যেতে। তিনি ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবকে এদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্র উৎসব উল্লেখ করে বলেন, বাংলাদেশে ইরানি চলচ্চিত্র যে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে তার পেছনে ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। এ সময় রেইনবো ফিল্ম সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা এবং ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের পরিচালক আহমেদ মুজতবা জামাল বলেন, ইরানে ইসলামী বিপ্রব সংঘটিত হওয়ার পর আমরা মনে করেছিলাম দেশটির চলচ্চিত্র শিল্প হয়তো দুর্বল হয়ে পড়বে। কিন্তু জার্মানীতে অনুষ্ঠিত একটি চলচ্চিত্র উৎসবে ইরানি সিনেমা দেখে দেশটির চলচ্চিত্র শিল্প সম্পর্কে আমার ধারনা পাল্টে যায়।এরপর থোকে ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে আমরা নিয়মিতভাবে ইরানি চলচ্চিত্র প্রদর্শন করেছি এবং এ পর্যন্ত অনেক ইরানি ছবি এই উৎসবে পুরস্কার পেয়েছে। তিনি বলেন, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান এখন বিশ্বমানের চলচ্চিত্র নির্মাণ করছে এবং অস্কার থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত অসংখ্য আন্তর্জাতিক পুরস্কার ঘরে তুলেছে মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশটি।আমরা চাই চলচ্চিত্র শিল্পের ক্ষেত্রে দেশটির অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে।
মুজতাহিদ ফারুকী –
বাংলাদেশে মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসব মাত্র দুটি। ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা। এর বাইরে এমন আর কোনও উৎসব নেই যেখানে মত পথ, রাজনীতি, শিক্ষা, নির্বিশেষে সব শ্রেণির বা ঘরানার মুসলমান এক হয়ে আনন্দ উদ্যাপন করতে পারেন। শবে বরাতের মতো ধর্মীয় সামাজিক উৎসব এখন আর সেভাবে পালিত হয় না। অতি ধর্মীয় শুদ্ধতার দিকে বেশি মনোযোগ দিতে গিয়ে আমরা এই দিবস পালন নিরুৎসাহিত করেছি। কিন্তু আমরা খেয়াল করিনি, এই উৎসব পালনের দিনে মহল্লার প্রতিটি ঘরে রুটি-হালুয়া বা রুটি-গোশত বিতরণের মধ্যে যে সামাজিক বন্ধন, সম্প্রীতির পরিবেশ সৃষ্টি হতো, গরীবের জন্য যে দান-ধ্যানের সুযোগটা ছিল তার সবই বন্ধ হয়ে গেছে। আবার সারা রাত ইবাদত করা ও ফজরের নামাজের পর আখেরি মোনাজাত, সিরনি বিতরণ এই সংস্কৃতিগুলো আমরা হারিয়ে ফেলতে বসেছি। সবচেয়ে বড় যে জিনিসটি হারিয়েছে সেটি হলো, মুসলমান সমাজের একটি সর্বজনীন উৎসবের আমেজ। এই আমেজটি দুই ঈদের ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের ভেতর ঠিক যেন পাওয়া যায় না।
উৎসবের আমেজের লোভেই মুসলিম ছেলেমেয়েরা অন্য ধর্মের উৎসবে যোগ দিতে যায়। এজন্যই প্রয়োজন শবে বরাতের মতো উৎসবের প্রয়োজন ছিল। এটি বন্ধ হওয়ায় কী ক্ষতি হয়েছে, যারা বুঝতে অক্ষম তাদের সঙ্গে তর্কে যাব না। তবে এটুকু বলা দরকার মনে করি যে, ধর্মকে অবলম্বন করে যে কোনও উৎসব আয়োজন করা হয় পরিচ্ছন্ন বিনোদন ও সাংস্কৃতিক ক্ষুধা মেটানোর জন্য। এটাকে আক্ষরিক অর্থে ইবাদত হিসেবে গণ্য করার আবশ্যকতাও নেই। পরিচ্ছন্ন বিনোদন ও সংস্কৃতির উপস্থিতি না থাকলে সমাজে নানা রকম সমস্যার সৃষ্টি হয়। সে প্রসঙ্গে যাবার আগে দেখি, উৎসবের সামাজিক গুরুত্ব কী?
উৎসব হলো যে কোনও জাতির বা জনগোষ্ঠীর গৌরবময় ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও প্রচলিত রীতিপ্রথার সামষ্টিক উদ্যাপনের একটি সরব উপায়। পরস্পরের চিন্তা-চেতনাকে একটি বিশেষ আনন্দের উৎসের সঙ্গে একাত্ম করে তোলার মাধ্যমে প্রিয় মানুষদের সঙ্গে আনন্দ ভাগ করে নেওয়ার মুহূর্ত নিয়ে আসে উৎসব। এক অর্থে যে কোনও সমাজের সব উৎসবই হলো কোনও না কোনওভাবে সাংস্কৃতিক উৎসবই। উৎসবের অর্থনৈতিক গুরুত্বও বিপুল।
উৎসব সামাজিক সংহতি সুদৃঢ় করে, সমাজে প্রতিটি ব্যক্তির নিজের একটি অবস্থান আছে এই বোধ নিশ্চিত করে। বিনোদনের পাশাপাশি এটি জনগণের সামষ্টিক আচরণের একটি সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য স্থান চিহ্নিত করে দেয়। প্রতিটি উৎসবের সময় সমাজের সবার মধ্যে একটি ইতিবাচক মনোভাবের সৃষ্টি হয়। বৈরিতা ভুলে পরস্পরকে আলিঙ্গনের আবহ তৈরি হয়। এতে সম্প্রীতির বন্ধন গড়ে ওঠে, শুভেচ্ছা বিনিময়ের ও সাংস্কৃতিক সমন্বয়ের একটি চমৎকার পরিবেশ সৃষ্টি হয়। উৎসব মানুষের ইতিহাস, ঐতিহ্য, তার উৎস বা শিকড়ের সঙ্গে যুক্ত থাকার এবং সেটি ধরে রাখার বিপুল অনুপ্রেরণা যোগায়। দৈনন্দিন জীবনের সব রকম চাপ ও একঘেয়েমি থেকে মুক্ত করে, মানুষকে কিছু সময়ের জন্য স্বস্তিকর এক নির্মল আনন্দে মেতে থাকার সুযোগ করে দেয় যা তার কর্মজীবনে ইতিবাচক ফল দেয়। আমরা যখন পরিবার, বন্ধু বা সমাজের সদস্য হিসাবে একত্রিত হই, আনন্দময় সময় কাটাই তখন আমাদের মধ্যে ঐক্যবোধের জন্ম হয়। আর এই ঐক্য বা সংহতি হলো জীবনের, বলা যায়, সমাজের বা রাষ্ট্রের যে কোন সঙ্কট মোকাবেলা করার ও তা কাটিয়ে ওঠার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার।
মুসলমানদের ঈদ, খ্রিস্টানদের ক্রিসমাস ও নিউ ইয়ার, ইরানিদের নওরোজ ও শবে ইয়ালদা, হিন্দুদের দুর্গা পূজা বা দিওয়ালী, নবরাত্রি ইত্যাদি ধর্মীয় উৎসবই হোক আর লৌকিক ঐতিহ্যনির্ভর উৎসব অনুষ্ঠানই হোক এর সবগুলোই কিন্তু সংশ্লিষ্ট সমাজের সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছে। কারণ, একটি দেশের বা সমাজের সব মানুষ যে কর্মকাণ্ড বছরের পর বছর ধরে অনুশীলন করে সেটাই তার সংস্কৃতি। যেভাবে সংস্কৃতির অংশ হয়ে যায় পোশাক, ধর্মীয় আচার-আচরণ, কৃষি বা বাণিজ্যের মত পেশা, ভাষা এবং ভাষাভিত্তিক কর্মকাণ্ড ইত্যাদি। যেমন, প্রতি ভোরে নামাজ পড়ে পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত, ঈদে কুরবানি করা, রোজা রাখা, রাতের শেষভাগে ঘুম থেকে উঠে সেহরি ও সূর্যাস্তের সময় ইফতার খাওয়া এগুলো ধর্মীয় নির্দেশে করা হলেও হাজার বছরের অনুশীলনে মুসলমানের সামাজিক সংস্কৃতিতে রূপান্তরিত হয়েছে।
খ্রিস্টানদের ক্রিসমাস ধর্মীয় উৎসব। কিন্তু এই দিনে পরস্পরকে উপহার দেওয়া, শুভেচ্ছা জানানো, টার্কি দিয়ে ডিনারের আয়োজন এগুলো সামাজিক জীবনের অনুষঙ্গ হয়ে গেছে। ফলে এসব এখন সংস্কৃতির অংশ, যা একইসঙ্গে ধর্মীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব বহন করে।
খ্রিস্টানদের পয়গম্বর যিশুর জন্মদিন ২৫ ডিসেম্বর কিনা তা নিয়ে তাদেরই বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে ভিন্নমত আছে। কিন্তু ভিন্নমত পোষণকারীরা এই নিয়ে কোনও যুদ্ধ-ফাসাদে লিপ্ত হয়নি। নিজের ভিন্নমত নিজের কাছে রেখে বৃহত্তর খ্রিস্টান জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিলেমিশে উৎসব পালন করছে। একারণেই ক্রিসমাস বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। ভিন্ন ধর্মের মানুষেরাও এই দিনে বন্ধুদের সঙ্গে কার্ড বিনিময় করেন, শুভেচ্ছা জানান, সামাজিক মাধ্যমে অভিনন্দন জানান। পার্টিতে যোগ দেন।
ইরানের নওরোজ উৎসবের কথা আমরা সবাই জানি। উৎসবটি দেশটিতে ইসলামি বিপ্লবের পরও সেটি নিষিদ্ধ করা হয়নি। তারা এখনও অবাধে নওরোজ উৎসব পালন করছে। নববর্ষের প্রারম্ভে তারা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে যাতে বছরটি তাদের জীবনে সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্য বয়ে আনে। তারা এই প্রার্থনায় বলে থাকে : ‘হে অন্তর ও দৃষ্টির পরিবর্তনকারী এবং দিন ও রাতের পরিচালনাকারী এবং অবস্থার পরিবর্তনকারী (মহান আল্লাহ)! আমাদের অবস্থাকে সর্বোত্তম অবস্থায় রূপান্তরিত করুন।’ নওরোজে যে দস্তরখানা পাতা হয় সেখানেও তারা কোরআন মজীদকে স্থাপন করেছেন ধর্মীয় আবহে দিবসটি পালন করার মানসে। প্রাচীন এ উৎসবকে তারা এভাবে ইসলামের আবরণে মুড়িয়ে দিয়েছে। তারা পালন করছে ‘শবে ইয়ালদা’র মতো নিছকই লোকজ বিশ্বাসভিত্তিক প্রাচীন উৎসবও। এই উৎসবগুলোকে তারা ইসলামের রংয়ে রঙ্গিন করেছে। উৎসবগুলো ইরান ও আশেপাশের বেশ কয়েকটি দেশে এখনও বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার সঙ্গে পালিত হচ্ছে।
বাংলা নববর্ষও হতে পারে একটি পরিচ্ছন্ন সাংস্কৃতিক উৎসব। যেমন- নৌকা বাইচের আয়োজন, পিঠা উৎসব, হালখাতা, সিরনি বিতরণ ইত্যাদি নানা আনুষ্ঠানিকতায় পালিত হতে পারে বর্ষবরণের আয়োজন।
উৎসবে একটি সমাজের সব মানুষের মেলামেশা ও সৌহার্দ্য বিনিময়ের সুযোগ ঘটে। ইসলামে দুটি ঈদ উৎসবের বাইরে এমন আর একটিও সুযোগ নেই যেখানে সারা দেশের মানুষ একসঙ্গে নির্মল আনন্দময় আনুষ্ঠানিকতায় অংশ নিতে পারে। আমরা সচেতন যে, ইসলাম মানুষকে আল্লাহর স্মরণ ভুলে গিয়ে কোনওরকম কর্মকান্ডেই বুঁদ হয়ে থাকার অনুমতি দেয়নি। এমনকি বৈষয়িকতা ভুলে কেবল খোদার অন্বেষণে বৈরাগ্য গ্রহণের সুযোগও ইসলামে নেই। বরং ইহলৌকিক ও পারলৌকিক জীবনের মধ্যে একটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান গ্রহণের তাগিদ দেয় ইসলাম। সুতরাং ইসলাম অনুসরণ করা মানে আনন্দ উল্লাসহীন একটি নিরানন্দ জীবন কাটানো হতে পারে না। কিন্তু বাংলাদেশে এটিই যেন নির্ধারিত।
আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই, সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মোকাবেলা করা যেতে পারে কেবলই সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড দিয়ে। আর সেই হতিয়ারটি হতে হবে প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে উন্নততর। আমরা মুসলমানরা অন্যের সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের শিকার হয়ে কম্পমান হবার পরিবর্তে নিজেরা একটু আগ্রাসী সংস্কৃতির চর্চা করতে পারি কিনা তা ভেবে দেখতে হবে। আগ্রাসী সংস্কৃতি বলতে বোঝাতে চাই এমন এক সংস্কৃতি যা মুসলিম তরুণদের পাশাপাশি অন্যদেরও আকৃষ্ট করতে সক্ষম হবে এবং আমরা সেই ‘অন্যদেরকে’ আমাদের সংস্কৃতির ভেতরে আমন্ত্রণ জানাব।
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জন্মদিনে যে ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) পালন করা হয়ে থাকে। এই দিবসকে ঘিরে একটি আনন্দ উৎসবের, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের জোয়ার সৃষ্টি করা সম্ভব। এ দিনে রাসূলের জীবন নিয়ে আলোচনা, দোয়া- মোনাজাত, খাবার বিতরণ করা যেতে পারে। করা যেতে পারে মানুষে মানুষে শুভেচ্ছা বিনিময়, কাব্যপাঠ, কাওয়ালি ও গজলের আসর বসানো, বিশ্বের সব মানুষের মঙ্গল কামনার একটি উপলক্ষ সৃষ্টি করা। কারণ, রাসূল (সা.) তো শুধু মুসলমানের সম্পদ নন। তাঁকে বলা হয়, রাহমাতুল্লিল আলামিন।
এতক্ষণ যা কিছু বলার চেষ্টা করেছি তার লক্ষ্য একটিই। আমাদের বক্তব্য স্পষ্ট। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে ধর্মীয় চেতনা সামাজিকভাবে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রয়োজন আছে। কাওয়ালি ইসলামি সংস্কৃতির ঐতিহ্য এমনটা সর্বাংশে ঠিক নয়। তবে এটি যে মুসলিম সংস্কৃতির অঙ্গ তাতে সন্দেহ নেই। বেদাত বা ইসলামি চেতনার সঙ্গে ঠিক যায় না, এ কথা বলে যদি সব উৎসব আনন্দ জনজীবন থেকে হটিয়ে দিই তাহলে ক্ষতিটা কোথায় আশা করি স্পষ্ট করতে পেরেছি।
আমাদের বিশ্বাস, ‘কুন ফা ইয়া কুন’ অথবা ‘তাজদারে হারাম’ এর মতো সহিহ ইসলামি ভাবাদর্শের বাহক যেসব কাওয়ালি বিশ্বজুড়ে মানুষের মধ্যে সাড়া জাগিয়েছে সেগুলো গেয়ে বা শুনে যে তরুণ আবিষ্ট হয়ে থাকবে, সে আর যাই হোক কখনও বিপথগামী হবে না। এই হাতিয়ারটিকে শাণিত করে তা কাজে লাগাতে হবে। আর সেটি যদি করা হয় ঈদে মিলাদুন্নবী সা. বা শবে বরাতের মতো কোনও ধর্মীয় উৎসবের অনুষঙ্গে তাহলে সেটিই হবে মোক্ষম।
যাঁরা চিন্তাশীল, যাঁরা মুসলমানদের বর্তমান করুণ অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় নিয়ে ভাবনাচিন্তা করেন এই লেখা তাঁদের উদ্দেশে। বিতর্ক সৃষ্টির কোনও ইচ্ছা বা উদ্দেশ্য কোনওটাই নেই।
সম্পাদকীয়
ইরানের ইসলামি বিপ্লবের প্রতি বিশ্বের মুসলমানদের দৃষ্টিভঙ্গি
অনেক রাজনৈতিক ও সামাজিক বিশ্লেষকের স্বীকারোক্তি অনুসারে ইরানে ইসলামি বিপ্লব সংঘটিত হওয়া বিংশ শতকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও সামাজিক ঘটনা হিসাবে আখ্যা লাভ করেছে।
এই বিপ্লবের গুরুত্ব পর্যালোচনার জন্য আমরা ইরানের ইসলামি বিপ্লবকে বিশ্বের বড় বড় বিপ্লব, যেমন : ফরাসি বিপ্লব, রুশ কিংবা চীনের বিপ্লবের সাথেও তুলনা করে দেখতে পারি। আবার এই বিপ্লবের অর্জনসমূহের দিক থেকেও পর্যালোচনা করা যেতে পারে।
উভয় পদ্ধতিতে আমরা এই ফলাফলে উপনীত হব যে, তিনটি বৈশিষ্ট্য এই বিপ্লবকে বিশ্বের অন্য সব বিপ্লব থেকে স্বতন্ত্র মর্যাদা দান করেছে। তা হলো ‘ইসলামি হওয়া’, ‘জনতার বিপ্লব হওয়া’ এবং ‘সাংস্কৃতিক দিকের প্রাবল্য’। যে বিপ্লব বিপুল জনগণের অংশগ্রহণে বিজয় লাভ করেছে এবং একই সাথে ‘অভ্যন্তরীণ সাম্রাজ্যবাদ’ এবং ‘বাইরের সা¤্রাজ্যবাদ’কে টার্গেটে পরিণত করেছে।
ইরানের ইসলামি বিপ্লব বিশ্ববাসীর কাছে প্রমাণ করেছে যে, ইসলামের নামে এবং দ্বীনে ইসলামের মাধ্যমেও সবচেয়ে একনায়কতান্ত্রিক ও খোদাদ্রোহী নেতাদের বিরুদ্ধেও রুখে দাঁড়ানো এবং তাদেরকে ক্ষমতার মসনদ থেকে টেনে নামানো যায়। আর তদস্থলে জনগণের পছন্দের সরকারকে স্থলাভিষিক্ত করা যায়। আর ঠিক এই কারণেই তাত্ত্বিকরা বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার পিছনের কারণ ও পূর্ব শর্তাবলি নিয়ে যেসব তত্ত্ব প্রদান করেছিলেন, সেসব তত্ত্বের বিপরীতে ইরানের ইসলামি বিপ্লব তাদের বিপ্লবতত্ত্বের বই-কিতাবে বিশ্লেষণের নতুন এক পৃষ্ঠা যোগ করে দেয়।
এই বিপ্লব তার স্লোগানসমূহ, যেমন : ‘স্বাধীনতা, মুক্তি, ইসলামি প্রজাতন্ত্র’ কিংবা ‘প্রাচ্য নয়, পাশ্চাত্য নয়, ইসলামি প্রজাতন্ত্র’ এই স্লোগান সহকারেই বিশ্বমঞ্চে পরিচিতি লাভ করেছে। আর বৈশ্বিক অঙ্গনে বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বের সামনে খোদায়ী মূল্যবোধসমৃদ্ধ জনমানুষের জাগরণভিত্তিক বিপ্লবের একটি মডেল উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে।
ইরানি জাতির বিপ্লব ছিল ‘ঈমান এবং ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক মূল্যবোধভিত্তিক’ একটি বিপ্লব। আর এটাই এই বিপ্লবকে ফরাসি কিংবা রুশ বিপ্লব থেকে পৃথককারী একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হিসাবে গণ্য হয়।
অবশ্য এই আন্দোলন ইরানের সমকালীন ইতিহাসের দীর্ঘ স্বাধীনতাকামী আন্দোলনসমূহ, যেমন : পড়হংঃরঃঁঃরড়হধষ মুভমেন্ট, তেলসম্পদ জাতীয়করণ আন্দোলন এবং বিভিন্ন ন্যায়কামী সংগ্রামের ধারায় এসে চূড়ান্ত সাফল্য লাভ করে। অতঃপর একটি নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ইসলামি প্রজাতন্ত্রের কাঠামোর মধ্যে ইসলামি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করার মাধ্যমে বিশ্বায়নের প্রক্রিয়ায় বিশেষ করে মুসলমি জাহানের রাজনৈতিক হাওয়া বদলের প্রেক্ষিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছে।
অপরদিকে ‘ধর্মীয় নেতৃত্বের উপাদান’টি ছিল ইসলামি বিপ্লবের আরেকটি বিশেষ দিক। এই বিপ্লব সূচিত হয় একজন মুসলমান ফকিহ ও দ্বীনি আলেমের নেতৃত্বে। ইরানি জাতির ইতিহাসের পাতা উল্টাতে থাকলে দেখা যেত কেবল রাজা-বাদশাহরাই ইরানে শাসন করত। আপনি যদি হাফিয, সাদি, ফেরদৌসিসহ ইরানের নামজাদা কবিদের কবিতা পাঠ করেন তাহলে ইরানে বাদশা ও সুলতানদের কী ভূমিকা ছিল তা বুঝতে পারবেন।
ইরানের ইসলামি বিপ্লব প্রথমবারের মতো ইরানের শাসনব্যবস্থা ও জাতির ভাগ্যের নিয়ন্ত্রণকে রাজা-বাদশাহদের হাত থেকে ছিনিয়ে নেয় এবং দ্বীনি আলেমদের হাতে সোপর্দ করে। আর এরূপ ঘটনা ইসলামি জাহানে তো বটেই, গোটা বিশ্বেও একটি নজিরবিহীন ঘটনা ছিল। অবশ্য বিশ্বের মুসলমানদের কাছে এই বিপ্লব যেমন দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে, তদ্রƒপ এই বিপ্লব নিয়ে পর্যালোচনা এবং বিশ্লেষণও কম হয়নি।
বিশ্বের মুসলমানদের প্রতি ইরানের ইসলামি বিপ্লবের বার্তা ছিল ঐক্যের বার্তা। যে ঐক্য মুসলমানদেরকে বিচ্ছিন্নতা ও বিভেদ থেকে দূরে রাখতে পারে। ইরানের ইসলামি বিপ্লবের বার্তা ছিল এটা যে, ইসলাম একটি শক্তিশালী এবং ঐক্য প্রতিষ্ঠাকারী দ্বীন হিসেবে শান্তি সংহতির পথে চলার এবং মানবের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক চাহিদাগুলো পূরণ করার সক্ষমতা রাখে।
ইসলামি বিপ্লবের বার্তাই ছিল এটা যে ইসলাম মানবের জন্য জীবনসঞ্চারী হতে পারে। ইসলাম বিশ্বের সকল মানুষের সৌভাগ্য, সুখ, শান্তি ও নিরাপত্তা বিধান করতে পারে। এই বিপ্লব ‘আমরা পারব’ এই সংস্কৃতিকে বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে দিতে পেরেছে। আর ইরান এবং ইরানি জাতির মাধ্যমে এমন এক ব্যান্ড তৈরি করেছে যে, হ্যা, যদি কোনো জাতি ইচ্ছা করে তাহলে কয়েক শতক ধরে শাসন করে আসা এক বাদশাহিকেও উৎখাত করে তাদের কাক্সিক্ষত ও পছন্দসই শাসনব্যবস্থাকে ক্ষমতায় আনতে পারে এবং সকল খাতে তাদের সেই পছন্দসই হুকুমতকে সমর্থন যোগাতে পারে। হোক সেটা নির্বাচন, হোক যুদ্ধ, হোক নিষেধাজ্ঞা কিংবা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চাপ যাই হোক না কেন। তারা তাদের ইসলামি বিপ্লবের প্রতিরক্ষায় নিজেদের জীবন দিতেও প্রস্তুত। এই বিপ্লব ইরানি জাতির সেই অমিত শক্তিকে বিশ্বের সামনে দেখিয়ে দিয়েছে।
ইরানের মুসলিম জাতি মসজিদগুলোকে সামাজিক যোগাযোগের একটি মাধ্যম হিসাবে কাজে লাগাতে পেরেছে। যে সামাজিক যোগাযোগ আজকে সোশ্যাল মিডিয়া জগতে খুবই পরিচিত। আমরা এবং আপনারা প্রতিদিন এসব সোশ্যাল মিডিয়া হরহামেশাই ব্যবহার করছি। যেমন ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ইত্যাদি। কিন্তু ইরানি জাতি আজ থেকে ৪২ বছর আগেই বিভিন্ন শহরে ও গ্রামে অবস্থিত মসজিদগুলোকেই এরকম সোশ্যাল মিডিয়া এবং সামাজিক যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করেছিল। আর এভাবেই তারা বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বৃহৎ বিপ্লবকে সফল করে তোলে।
আমি ইরানের ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা এবং ইসলামি প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর রূহের প্রতি সালাম ও শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। ইরানের ইসলামি বিপ্লব তাঁরই নামে এবং তাঁরই স্মরণ সহকারে বিশ্বে পরিচিতি লাভ করেছে।
ড. সাইয়্যেদ হাসান সেহাত
কালচালার কাউন্সেলর
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান দূতাবাস
ঢাকা, ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ইং
সিরাজুল ইসলাম
সমসাময়িক বিশ্বে ইরানের ইসলামি বিপ্লব এবং বিপ্লব-পরবর্তীকালে কুদস ফোর্স গঠন- এ দুটি বিষয়ের যে ভূমিকা, যে প্রভাব তা নিয়ে বহু আলোচনা ও ব্যাপক গবেষণা করার প্রয়োজন রয়েছে। ইরানের ইসলামি বিপ্লব ও কুদস ফোর্স একেবার অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এ নিয়ে মানুষকে জানানোর এখনও অনেক কিছু বাকি রয়েছে।
১৯৭৯ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ইরানে ইসলামি বিপ্লব সফল হওয়ার পর ইহুদিবাদী ইসরাইলকে ইরান মুসলমানদের জন্য প্রধান শত্রু ঘোষণা করে। এই শত্রুর দখলে যেমন চলে গেছে নিরপরাধ ফিলিস্তিনিদের ঘর-বাড়ি ও ভূখণ্ড, তেমনি এই অপশক্তি মুসলমানদের প্রথম ক্বিবলা মসজিদুল আকসা দখল করে রেখেছে। সবচেয়ে দুঃখজনক হচ্ছে, এই বর্বর শক্তি মসজিদুল আকসা দখল করে রাখলেও, লাখ লাখ ফিলিস্তিনিকে উদ্বাস্তু করলেও তার পক্ষে অবস্থান নেওয়া আরব দেশের সংখ্যা একেবারে কম নয়। খোদ ইরানের শাসক রেজা শাহের সঙ্গেও ইসরাইলের ছিল বিরাট দহরম-মহরম। ফলে বিপ্লব-পরবর্তী ইরানের ইসলমি নেতৃত্বকে বেছে নিতে হয় বিরাট এক কঠিন পথ, পবিত্র আল-কুদস উদ্ধারের সংগ্রামময় পথ।
ইরানের ইসলামি বিপ্লবকে যারা মেনে নিতে পারেনি তারা নানামুখী ষড়যন্ত্র শুরু করে বিপ্লব নস্যাৎ করার জন্য। এর অংশ হিসেবে ১৯৮০ সালের ২২ সেপ্টেম্বর ইরানের ওপর ইরাকের সাদ্দাম সরকার সামরিক আগ্রাসন শুরু করে। সেই যুদ্ধের সময় ইরান কুদস ফোর্সকে একটি বিশেষ গোয়েন্দা ইউনিট হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। ১৯৮৮ সালে আট বছরের যুদ্ধ শেষে কুদস ফোর্সকে ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসি’র স্বতন্ত্র শাখা হিসেবে পুনর্গঠন করা হয়। এই বাহিনীর মূল কাজ হয়ে ওঠে শত্রুর কবল থেকে ‘মুসলিম ভূখণ্ড’ বিশেষ করে ইসরাইলের কবল থেকে পবিত্র জেরুজালেম আল-কুদস শহর উদ্ধার। এজন্য মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ইসলামি শক্তিকে বিশেষ করে লেবানন ও ফিলিস্তিনে প্রতিষ্ঠিত হিজবুল্লাহ, হামাস ও ইসলামি জিহাদ আন্দোলনকে সমর্থন ও সহযোগিতা করা শুরু করে ইরান। কুদস ফোর্স গঠনের সময় এর কমান্ডার নিযুক্ত করা হয় আইআরজিসি’র সেনা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহমাদ ওয়াহিদিকে। কুদস ফোর্সের প্রধান হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেন ১৯৮৮ সাল থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত। ১৯৯৮ সালে এই বাহিনীর দায়িত্ব পান মেজর জেনারেল কাসেম সোলাইমানি। সেই থেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি এই বাহিনীর নেতৃত্ব দেন। দায়িত্ব পালনকালে অনেক বড় ও কঠিন সামরিক অভিযানে নেতৃত্ব দিতে হয়েছে তাঁকে। বলা যায়, তাঁর ভূমিকার কারণে আজকের মধ্যপ্রাচ্যের এই চেহারা আমরা দেখছি, তিনি ব্যর্থ হলে হয়ত ভিন্ন চেহারা দেখতে হতো। বিশেষ করে ইরাক ও সিরিয়ায় বিদেশী মদদে তৎপর উগ্র তাকফিরি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে জেনারেল কাসেম সোলাইমানি যে অনন্য ভূমিকা রেখেছেন তা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। তবে তাঁকে শেষ পর্যন্ত জীবন দিতে হয়েছে, জীবন দিয়েই তিনি অমরত্ব লাভ করেছেন। শাহাদাতের অমীয় সুধা পানের যে তীব্র আকাক্সক্ষা তিনি পোষণ করতেন তা হয়ত পূরণ হয়েছে কিন্তু তাঁকে হত্যার জন্য ভয়াবহ কলঙ্কের অধিকারী হয়েছে মার্কিন সরকার।
এই বিপ্লবী ও কুশলী সমরনায়কের শাহাদাতের পর তাঁকে নিয়ে মানুষের মধ্যে যে ভালোবাসা, যে আকুলতা দেখা গেছে তা ইতিহাসে বিরল। তবুও অনেকে প্রশ্ন তোলেন কেন ইরাক ও সিরিয়ার ঘটনাবলিতে ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনী জড়িয়ে পড়ল?
আমরা সবাই জানি যে, সিরিয়া ঐতিহাসিকভাবে ইরানের মিত্র দেশ। ১৯৭৯ সালে যখন ইরানে ইসলামি বিপ্লব সফল হয় তখন মধ্যপ্রাচ্যের একমাত্র দেশ সিরিয়া ইরানের পাশে দাঁড়িয়েছিল। ইরানের ইসলামি বিপ্লবকে সমর্থন করেছে তৎকালীন হাফেজ আল-আসাদের সরকার। যদিও সিরিয়া ইসলামি শাসনের অধীনের কোনো দেশ ছিল না, কিন্তু ইরানে ইসলামি বিপ্লব সফল হওয়ার পরে যে প্রেক্ষাপট তৈরি হয় এবং মধ্যপ্রাচ্যের নানান সমীকরণ নিয়ে যখন বহুমুখী হিসাব-নিকাশ চলছে তখন একেবারে নিঃশর্তে ইরানের প্রতি সমর্থন জানায় দেশটি। একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট জানা ও বোঝার জন্য এই কথাটি স্মরণে রাখা দরকার। ইরাক ও সিরিয়ায় ইরানের আইআরজিসির জড়িয়ে পড়ার এটি একটি প্রেক্ষিত।
ইরানের সঙ্গে সিরিয়ার আলাদা রকমের ঘনিষ্ঠতা অনেক আগে থেকেই ছিল। যখন ইরানে ইসলামি বিপ্লব সফল হলো এবং ইসলামি সরকার প্রতিষ্ঠিত হলো তার পরপরই এই সরকারকে উৎখাত করার জন্য, বিপ্লবকে নস্যাৎ করার জন্য আঞ্চলিক বহুসংখ্যক রাজতান্ত্রিক দেশ, ইহুদিবাদী ইসরাইল, আমেরিকা, ব্রিটেন ও তাদের পশ্চিমা মিত্ররা অনেক বেশি তৎপর হয়ে উঠল। কিন্তু নানা চেষ্টা-প্রচেষ্টার পরও যখন ইরানের ইসলামি সরকারকে উৎখাত করা গেল না তখন ইরাকের স্বৈরশাসক সাদ্দামের সামরিক বাহিনীকে লেলিয়ে দিয়ে সদ্য বিপ্লব সফল হওয়া দেশের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া হলো, যা আট বছর ধরে চলে। এতে দুই দেশের লাখ লাখ মুসলিম নরনারী নিহত হলেন। এই বিশাল হত্যাকাণ্ড, এই যে এত বড় সম্পদের হানি, ধ্বংসযজ্ঞ তার প্রধান দায় আমেরিকা, ইসরাইল ও তার দোসরদের। এক্ষেত্রে তারা স্বৈরাচারী ও উচ্চাভিলাসী সাদ্দামকে ব্যবহার করে।
ভয়াবহ সামরিক আগ্রাসনের মাধ্যমে যখন ইরানের ইসলামি বিপ্লব ও বিপ্লবী সরকারকে অকার্যকর করে দেওয়ার প্রচেষ্টা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে তখন সিরিয়ার সরকার ইরানের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। ইরানের সঙ্গে সিরিয়ার সরাসরি সীমান্ত না থাকার পরেও সিরিয়া তার সাধ্যমতো সহযোগিতা করার চেষ্টা করেছে। এমনকি, ইরাকের অভ্যন্তরে বিমান হামলা চালানোর জন্য সিরিয়া তার আকাশসীমা ব্যবহারের সুযোগ দিয়েছিল। এই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটটা বুঝতে পারলে সিরিয়ার গত এক দশকের সংঘাতে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের জড়িয়ে পড়ার গুরুত্বপূর্ণ একটি কারণ বোঝা যায়। অর্থাৎ ইরানের বিপদের দিনে সিরিয়া যেভাবে সাহায্য করেছে, সিরিয়ার বিপদের দিনেও ইরান সেভাবে সাহায্য করেছে। ইরান অবশ্যই নিজে থেকে গায়ের জোরে সিরিয়ায় যায় নি, বরং বাশার আল-আসাদ সরকারের আমন্ত্রণে গিয়েছে; যেমনটি এসেছে রাশিয়া।
ইরানের ভেতরে ইরাকের সাদ্দাম সরকারকে দিয়ে আগ্রাসন চালিয়ে শত্রুরা যেসব লক্ষ্য অর্জন করতে চেয়েছিল তা হলো না। অর্থাৎ ইরানের ইসলামি বিপ্লব ও ইসলামি সরকারকে নস্যাৎ করা বা ধ্বংস করা সম্ভব হয় নি। বরং এই যুদ্ধের ভেতর দিয়ে ইরানের অর্জিত অভিজ্ঞতাগুলোকে সামরিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে গঠনমূলক কাজে ব্যবহার করা হলো। যুদ্ধে ইরান সবচেয়ে বড় যে তিক্ত অভিজ্ঞতা অর্জন করলো সেটি হচ্ছে যে, তার পাশে তেমন কেউ নেই, যা করার তা নিজেকেই করতে হবে। ফলে ইরান নিজেকে সবদিক দিয়ে উন্নত ও শক্তিশালী করার চেষ্টায় নিয়োজিত হলো। পাশাপাশি যে সাদ্দামকে দিয়ে ইরানকে ধ্বংস করার চেষ্টা করা হয়েছে, একসময় সেই সাদ্দামকে আমেরিকা ও তার মিত্ররা উৎখাত করে দিল, হত্যা করল। ইতিহাসের কী নির্মম পরিহাস!
যাইহোক, সাদ্দাম-পরবর্তী ইরাক আর সাদ্দাম-পূর্ববর্তী ইরাক এক কথা নয়। আকাশ-পাতাল ব্যবধান বলা যায়। সাদ্দামকে উৎখাত করার মধ্য দিয়ে ইরাকে লুকিয়ে থাকা ইসলামি বিপ্লবের প্রভাব অনেকটা প্রকাশ হয়ে পড়ে। ইরাকে সাদ্দাম নিহত হওয়ার পর প্রেক্ষাপট বদলে যায়। বিপ্লবের প্রভাবের ফলে নতুন একটি ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা স্পষ্ট হয়ে উঠে যা আমেরিকা, ব্রিটেন, ইসরাইল ও তাদের অনেক আরব মিত্রের জন্য ভীতির কারণ হয়ে দেখা দেয়। সাদ্দামকে উৎখাত করা আমেরিকার জন্য এক রকমের জরুরি হয়ে পড়েছিল আবার তাকে উৎখাত করার ফলে নতুন ও কঠিন বাস্তবতার মুখে পড়ে তারা। নতুন ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় মধ্যপ্রাচ্যে ইরান হয়ে ওঠে অনেক বেশি প্রভাবশালী দেশ, ইরানই হয়ে পড়ে এই বলয়ের নেতা।
ইরানে ইসলামি বিপ্লব সফল হওয়ার পর যেসব কারণে আমেরিকা ও তার দোসরদের মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল তার অন্যতম প্রধান হচ্ছে, তেল ও অন্যান্য মূল্যবান খনিজ সম্পদের ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারানোর ভয়। তারা মনে করেছিল ইরান যেভাবে পাশ্চাত্যকে ‘না’ বলে দিয়েছে, ইরানের বিপ্লব টিকে গেলে তার প্রভাব আরো দেশের ওপর পড়বে। মধ্যপ্রাচ্যের আরো দেশের ওপর ইরানি বিপ্লব প্রভাব ফেললে সেসব দেশও তেল ও খনিজ সম্পদের ওপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে ফেলবে। এতে পুরো মধ্যপ্রাচ্যে এক সময় আমেরিকা ও তার পশ্চিমা মিত্রদের কর্তৃত্ব খর্ব হবে। এসব ভেবে নতুন নীলনকশা প্রণয়ন করে আমেরিকা ও ইসরাইল যার নাম দেওয়া হয় ‘নিউ মিডলইস্ট প্ল্যান’ বা ‘নতুন মধ্যপ্রাচ্য পরিকল্পনা’। এ পরিকল্পনার আওতায় ভূমধ্যসাগর থেকে চীনের পাদদেশ পর্যন্ত নতুন মধ্যপ্রাচ্য গঠনের নীলনকশা হাতে নেয় আমেরিকা ও ইসরাইল। নতুন মধ্যপ্রাচ্য গঠিত হলে তার কর্তৃত্ব থাকবে আমেরিকা ও ইসরাইলের হাতে। এ পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয় প্রধানত প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধের সময়কালে এবং জর্জ ডাব্লিউ বুশের আমলে তা প্রকাশ্যে বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়। এ নিয়ে কাজ করেছেন বুশ ও তার সহযোগী ডিক চেনি, রোনাল্ড রামসফিল্ড, কন্ডোলিৎজা রাইস, ম্যাককেইন প্রমুখ নব্য-রক্ষণশীলরা।
এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে তারা বহুমূখী কর্মসূচি হাতে নিয়েছিলেন। এসব কর্মসূচি হলো- রাষ্ট্রশক্তি হিসেবে সিরিয়া ও ইরানকে ধ্বংস করে ফেলা; হামাস, হিজবুল্লাহ, ইসলামি জিহাদ ও হুথি আন্দোলনের মতো মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিরোধকামী সংগঠনগুলোকে নির্মূল করা এবং পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ইসলামের নামে কথিত ইসলামপন্থি কতকগুলো গ্রুপ তৈরি করে এসব দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা।
সিরিয়া এমন একটি দেশ যার ভৌগোলিক অবস্থান ইসরাইলের একেবারে দোরগোড়ায়। এছাড়া, ইসরাইল ইস্যুতে অনেক দেশ আপোষ করলেও সিরিয়া নন-ইসলামিক দেশ হয়েও কোনো আপোষ করে নি। এক সময় জর্দান, মিশর ও সিরিয়া ঐক্যবদ্ধভাবে ইসরাইলের বিরুদ্ধে লড়াই করলেও মিশর ও জর্দান ইসরাইলের সঙ্গে শান্তি চুক্তি করে নির্ঝঞ্ঝাট আছে কিন্তু সিরিয়া সে পথে পা বাড়ায় নি বরং ইরানের সঙ্গে মিলে সিরিয়া এখনও নিজের ও ফিলিস্তিনের দখল হয়ে যাওয়া ভূখ- উদ্ধারের স্বপ্ন দেখে। সে ক্ষেত্রে সিরিয়া হচ্ছে ইসরাইলবিরোধী প্রতিরোধের প্রথম ফ্রন্ট। লেবানন ও ফিলিস্তিনের প্রতিরোধকামী সংগঠনগুলোকে ইরান এবং সিরিয়াই সহযোগিতা দিয়ে আজকের এই শক্তিশালী অবস্থান এনেছে। এছাড়া, সিরিয়া কার্যত ইসরাইলের সঙ্গে যুদ্ধাবস্থার মধ্যে রয়েছে। ফলে ষড়যন্ত্রকারীরা নিউ মিডলইস্ট প্ল্যান বাস্তবায়ন করার জন্য ২০১১ সালের ‘আরব বসন্ত’কে ঘুরিয়ে সিরিয়ায় নিয়ে আবদ্ধ করল এবং গোলযোগ সৃষ্টির জন্য অর্থ ও প্রশিক্ষণ দিয়ে কিছু লোককে রাস্তায় নামিয়ে দিল। এর ফাঁকে পূর্ব পরিকল্পনা মতো বাশার আসাদ সরকারকে স্বৈরশক্তি হিসেবে দেখিয়ে সিরিয়ায় ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলে উগ্র তাকফিরি সন্ত্রাসীদের লেলিয়ে দেওয়া হলো। শুরু হলো সিরিয়া সংকট। একইভাবে ইরাকেও পাঠানো হলো এই উগ্র গোষ্ঠীকে এবং তারা ইরাকের মসুল শহর দখল করে নিয়ে সেখানে রীতিমতো খেলাফত কায়েম করল। ইরাক ও সিরিয়া পাশাপাশি দুটি দেশ এবং দুটি দেশের সঙ্গেই ইরানের সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। এই তিন দেশের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ভৌগোলিক রূপ হচ্ছে একেবারে ভূমধ্যসাগরের তীর থেকে শুরু করে পাকিস্তান ও আফগান সীমান্ত পর্যন্ত বিশাল এলাকা। নিউ মিডলইস্ট প্ল্যান বাস্তবায়ন করতে গেলে এই তিন দেশকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারলে বাকি কাজ সহজ হয়ে যায়।
পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আমেরিকা ও ইসরাইল মাঠে নামে, সঙ্গে থাকল পশ্চিমা ও আরব মিত্ররা। ইরানও তার মিত্ররা এই পরিকল্পনা বুঝতে পেরে পাল্টা মাঠে নামে। শুরু হয় দু পক্ষের লড়াই। সেই লড়াইয়ের অংশ হিসেবে জেনারেল কাসেম সোলাইমানি তথা ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী ইরাক ও সিরিয়ায় কাজ করেছে। যেখানে সামরিক পরামর্শ দেওয়া প্রয়োজন সেখানে তাই দিয়েছে, যেখানে ময়দানে সামরিক তৎপরতা চালানো প্রয়োজন সেখান তাই করেছে। অর্থাৎ আমেরিকা, ইসরাইল ও তাদের মিত্রদের নিউ মিডলইস্ট প্ল্যান বাস্তবায়নের বিরুদ্ধে মাঠে ময়দানে লড়াই করেছেন জেনারেল সোলাইমানি। যেখানে নিউ মিডলইস্ট প্ল্যান বাস্তবায়ন করতে মরিয়া একপক্ষ সেখানে সেই পরিকল্পনা প্রতিদিন নস্যাৎ করে দিচ্ছেন জেনারেল সোলাইমানি ও তার সহযোগীরা। তিনি দেশ থেকে দেশান্তরে, এ ময়দান থেকে সে ময়দানে ছুটে বেড়িয়েছেন। শুধু তাই নয়, মধ্যপ্রাচ্যে যেসব প্রতিরোধকামী সংগঠন গড়ে উঠেছে তাতে রয়েছে ইরানের সরাসরি সাহায্য সহযোগিতা। অর্থ, অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়ে বিশাল একদল প্রতিরোধ যোদ্ধা তৈরি হয়েছে। সে কাজেও জেনারেল সোলাইমানির অনন্য ভূমিকা রয়েছে। ফলে আমেরিকা ও ইসরাইলের প্রধান ও একমাত্র টার্গেটে পরিণত হন জেনারেল কাসেম সোলাইমানি। তারা জেনারেলকে সরিয়ে দেওয়া আশু কর্তব্য মনে করেছে এবং সেই বর্বর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছে।
ইরাক ও সিরিয়ায় তৎপর সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর মূলোৎপাটন সম্ভব হলে মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি ভিন্ন হবেÑ একথা ভেবে আমেরিকা, ইহুদিবাদী ইসরাইল ও তাদের পশ্চিমা এবং আঞ্চলিক মিত্ররা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। রাজনৈতিক সমাধান কিংবা কূটনীতির পথ কোনোটাতেই তারা নিরাপদ বোধ করে নি। তারা বেছে নেয় সন্ত্রাসের পথ। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে, সমস্ত আন্তর্জাতিক আইন-কানুন উপেক্ষা করে মার্কিন সরকার ও তাদের সন্ত্রাসী বাহিনী নির্জন ভোরে বাগদাদের রাজপথ রক্তে রঞ্জিত করে। শাহাদাতবরণ করেন ইরানের শীর্ষস্থানীয় সেনা কর্মকর্তা জেনারেল কাসেম সোলাইমানি। শাহাদাতের সাক্ষী হয়ে বাগদাদের রাজপথে পড়ে থাকে হাতের আংটিটি।
জেনারেল কাসেম সোলাইমানিকে হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে নিজের ভূমিকা বিতর্কিত করেছে আমেরিকা। সিরিয়া ইস্যুসহ বিভিন্ন ঘটনায় আমেরিকা দাবি করে আসছে তারা উগ্রবাদ এবং সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। যদিও সিরিয়ায় তৎপর উগ্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠী দায়েশের প্রতিষ্ঠা, প্রশিক্ষণ, অস্ত্র এবং অর্থ যোগানের সবকিছুর সাথেই আমেরিকার সম্পৃক্ততা ছিল তারপরও তারা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের দাবি করে আসছিল। অন্যদিকে মাঠে-ময়দানে জেনারেল কাসেম সোলাইমানি উগ্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। ইরানের কোনো শত্রুদেশও বলতে পারবে না যে, জেনারেল কাসেম সোলাইমানি সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেন নি। এরকম একটি পেক্ষাপটে জেনারেল সোলাইমানিকে হত্যা করে আমেরিকা প্রকৃতপক্ষে সন্ত্রাসবাদবিরোধী লড়াইয়ের বিপরীতে অবস্থান নিয়েছে। অর্থাৎ আমেরিকার এই ভূমিকা সন্ত্রাসীদের পক্ষে গেছে এবং সেক্ষেত্রে বলাই যায় যে, আমেরিকা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে নি বরং সন্ত্রাসীদের পক্ষে লড়াই করছে। জেনারেল কাসেম সোলাইমানিকে হত্যার ক্ষেত্রে এটি ছিল আমেরিকার সবচেয়ে বড় কূটনৈতিক ভুল।
জেনারেল সোলাইমানি হত্যার কারণে ইরান আমেরিকার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে সামরিকভাবে প্রতিশোধ নেওয়ার সুযোগ পেয়েছে, তেমনি আমেরিকার সামরিক ও প্রযুক্তিগত দুর্বলতাও ইরানের কাছে পরিষ্কার হয়েছে। সেক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্যে ইরান তার প্রভাব প্রতিপত্তি আরো বেশি বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে ইরানকে বাদ দিয়ে কেউ এখন কোনো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে পারবে না। ইরানের সামরিক ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতার পাশাপাশি তার কূটনৈতিক সৌন্দর্য পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের বেশকিছু দেশকে আকৃষ্ট করবে যা আমেরিকা ও তার মিত্রদের জন্য কূটনৈতিকভাবে বড় ধরনের বিপর্যয় হিসেবে দেখা হবে। জীবন দিয়ে জেনারেল কাসেম সোলাইমানি যে সত্য রচনা করে গেছেন তার আর ক্ষয় নেই, তিনি শাহাদাতের মধ্য দিয়ে অমরত্ব লাভ করেছেন।
লেখক : সাংবদিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লষক
সাইদুল ইসলাম
গত ১১ ফেব্রুয়ারি ইরানসহ বিশে^র বিভিন্ন দেশে পালিত হলো ইসলামি বিপ্লবের ৪৩তম বিজয় বার্ষিকী। এ উপলক্ষে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান দশদিনব্যাপী কর্মসূচি পালন করে। ঐতিহাসিক এই বিপ্লবের ৪ দশকের সাফল্য আজ বিশ্বের সকল মুসলিম ও স্বাধীনতাকামী জাতির জন্য একটি রোল মডেল। বহু বিশ্লেষকের মতে এ বিপ্লব বিগত এক হাজার বছরের সেরা আদর্শিক বিপ্লব, যা ইরানি জাতির জন্য ফিরিয়ে আনে প্রকৃত স্বাধীনতা, সম্মান ও উন্নয়নের বিরতিহীন অগ্রযাত্রার সেই গৌরবের ধারা। এ বিপ্লবের ফলে দিশেহারা হয়ে পড়া মার্কিন পরাশক্তি ও তার মিত্রদের দশকের পর দশক ধরে চলমান নানা ষড়যন্ত্র ও কঠিন অবরোধের মধ্যেও বিশ্বের অনেক দেশের চেয়ে দ্রুত গতিতে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে দেশটি। আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইরান বিস্ময়কর অগ্রগতি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিভিন্ন উন্নয়ন সূচকে শক্তিশালী অবস্থান বলে দিচ্ছে দেশটি কতটা অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলেছে। শিক্ষা, বিজ্ঞান, উদ্ভাবন, প্রযুক্তিগত উন্নয়নসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এখন নেতৃস্থানীয় দেশের তালিকায় রয়েছে ইরান।
আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে বর্তমানে ইরানের অবস্থান বিশ্বে দ্বিতীয়। ন্যানো প্রযুক্তিতে দেশটির অবস্থান বিশ্বে তৃতীয়। সামরিক শক্তির দিক থেকে ইরানের অবস্থান বিশ্বে ষষ্ঠ, সাবমেরিন বা ডুবো জাহাজ শিল্পে ষষ্ঠ, অ্যারোস্পেস, সামরিক ও বেসামরিক বিমান শিল্প, কৃত্রিম উপগ্রহ ও মহাকাশ সংক্রান্ত প্রযুক্তিতে অষ্টম, চিকিৎসা খাতে দশম, কৃষিতে দশম, খেলাধুলায় ১৩তম এবং শিল্প খাতে ইরানের অবস্থান বিশ্বে ১৯তম।
ইরানের ইসলামি বিপ্লব ও বিপ্লবী ইরানি জাতি অর্থনৈতিক খাতসহ কোনো কোনো খাতে বাইরের শত্রুর নজিরবিহীন বাধা আর নিষেধাজ্ঞার কারণে বেশ অসুবিধা ও হয়রানির শিকার হলেও এসব কিছুই ইসলামি ইরানের দুর্বার অগ্রযাত্রাকে থামাতে পারেনি মোটেও। বরং এসব বাধা ও নিষেধাজ্ঞা ইরানের জন্য শাপে বরে পরিণত হচ্ছে এবং যেসব খাতেই বাধা আসছে ইসলামি ইরান সেসব খাতেই হয়ে উঠছে স্বয়ংসম্পূর্ণ।
উল্লেখ্য, পাশ্চাত্যের ব্যাংকিং নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরানের তেল রপ্তানির আয় কিছুটা বাধাগ্রস্ত হলেও বা রপ্তানি আয়ের অর্থের প্রবাহ দেশে আসতে দেরি হলেও ইরান পণ্যের বিনিময়ে পণ্য প্রদান ব্যবস্থা বা বার্টার সিস্টেমসহ নানা ধরনের বিকল্প পদ্ধতি ব্যবহার করে এই সমস্যা সমাধান করছে। এ ছাড়াও পেট্রোকেমিক্যাল পণ্যসহ তেল-বহির্ভূত নানা পণ্যের রপ্তানি বাড়িয়ে দিয়ে ইসলামি ইরান তার অর্থনীতিকে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের নির্ভরতা থেকে অনেকাংশেই বের করে আনতে সক্ষম হয়েছে। আগামী অল্প কিছুকালের মধ্যেই ইরানের অর্থনীতির সিংহভাগই জ্বালানি তেল বিক্রির নির্ভরতা থেকে মুক্ত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এভাবে পাশ্চাত্যের নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরানের অর্থনীতি হয়ে উঠছে বহুমুখী, বিচিত্রময় ও স্বনির্ভর।
ইসলামি বিপ্লবের ৪৩তম বিজয় বার্ষিকীকে সামনে রেখে দেশটিতে এবার অসংখ্য উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন করা হয়। ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি গত ৬ ফেব্রুয়ারি এক ভিডিও কনফারেন্সে সারা দেশে ১৭ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগসহ ৪৮টি বড় শিল্প প্রকল্প শুরু করার নির্দেশ দেন। প্রকল্পগুলো দেশের বিভিন্ন প্রদেশের ২৭টি শহরে বাস্তবায়িত হতে চলেছে। এছাড়াও দেশব্যাপী ৪৬৮টি শিল্প ও খনি প্রকল্প, ৪৮৪টি পরিবহন প্রকল্প, ২ হাজার ৯৫০টি শিক্ষামূলক প্রকল্প এবং অসংখ্য বন্দর উন্নয়ন, সামুদ্রিক এবং পরিবহন প্রকল্পের উদ্বোধন করা হয়।
আন্তর্জাতিক রাজনীতি, কূটনীতি, সমরনীতি, অর্থনীতি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং অন্য অনেক খাতে বিপ্লবী ইরানের বিস্ময়কর সাফল্যের অন্যতম প্রধান কারণ হলো এই বিপ্লবের সর্বোচ্চ নেতার সময়োপযোগী, বিপ্লবী ও ইসলামসম্মত দিক-নির্দেশনা এবং জনগণ ও রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে এই মহান নেতার প্রতি একনিষ্ঠ আনুগত্য।
সম্প্রতি ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান সফলভাবে মহাকাশে আরো একটি গবেষণাধর্মী স্যাটেলাইট পাঠিয়েছে। ইরানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আহমাদ হোসেইনি জানান নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি স্যাটেলাইট বহনকারী সী-মোর্গ নামের রকেটে করে তিনটি গবেষণাধর্মী ডিভাইস মহাকাশে পাঠানো হয়েছে। আহমাদ হোসেইনি বলেন, মহাকাশ গবেষণার এই মিশনে প্রথমবারের মতো একসঙ্গে তিনটি ডিভাইস পাঠানো হয়েছে। এসব ডিভাইস মহাকাশের কক্ষপথে ৪৭০ কিলোমিটার উচ্চতায় অবস্থান করবে এবং রকেটের গতি ছিল প্রতি সেকেন্ডে ৭.৩৫০ কিলোমিটার। ইরানের এ কর্মকর্তা জানান, ‘রকেট উৎক্ষেপণের সময় মহাকাশ কেন্দ্রের সবকিছুই নিখুঁতভাবে কাজ করেছে এবং পরিকল্পনা মতো স্যাটেলাইট বহনকারী রকেট উৎক্ষেপণ করা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে চূড়ান্তভাবে মহাকাশ গবেষণা পরিকল্পনার লক্ষ্য অর্জিত হলো।’ এ নিয়ে ইরান এ পর্যন্ত মহাকাশে ৮টি উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করেছে। দেশটির দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র এবং ত্রুজ ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলো এখন লক্ষ্যবস্তুতে নিখুঁতভাবে আঘাত হানতে সক্ষম। বিজ্ঞান-গবেষণায় ইসলামি ইরান এখন বিশ্বের শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকটি দেশের অন্যতম। এই নিবন্ধে ইসলামি বিপ্লবের পর গত ৪৩ বছরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইরানের সার্বিক উন্নয়নের একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরা হলো :
শিল্প, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে উন্নয়ন
একটি দেশ তথা জাতির উন্নয়নের প্রধান চালিকাশক্তি হচ্ছে জ্ঞান-বিজ্ঞান। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে যে জাতি যত বেশি এগিয়ে সে জাতি তত উন্নত। বলা হয়ে থাকে, জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ কোনো জাতি যেকোনো সময় যে কোনো কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে সক্ষম। আর এ বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব দিয়েই ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতার নির্দেশে দেশটির বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদরা চরম আত্মত্যাগ ও সাধনার মাধ্যমে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অভাবনীয় সাফল্যের স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। বিজ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রে ইরানের বিজ্ঞানীদের অগ্রগতি সমগ্র বিশ্বের বিজ্ঞানীদের গড় অগ্রগতির চেয়ে ১১ গুণ দ্রুততর (ঋধংঃবংঃ)। সব দেশের বৈজ্ঞানিক অবস্থান বিশ্লেষণ নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান সায়েন্স-মেট্রিক্স এ তথ্য জানিয়ে বলেছে, বৈশ্বিক পরিম-লে ইরানের বাস্তবিক এই উন্নতি বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে দেশটিকে দ্রুতবর্ধনশীল দেশ হিসেবে পরিণত করেছে। বিশ্বের সকল দেশের বৈজ্ঞানিক অবস্থানের তুলনামূলক বিভিন্ন পরিসংখ্যানে ইরানের অগ্রগতি সু¯পষ্টভাবে উঠে এসেছে।
এক কথায় বলতে গেলে ইসলামি বিপ্লবের গত ৪৩ বছরে ইরান বায়োপ্রযুক্তি, ন্যানোপ্রযুক্তি, ওষুধ শিল্পসহ বিজ্ঞানের প্রায় সব ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব উন্নতি সাধন করেছে। দেশটি এখন মধ্যপ্রাচ্যে সবচেয়ে বেশি গাড়ি নির্মাণকারী দেশ। পরিবহন খাতে বিরাট উন্নতি ঘটিয়েছে। এছাড়া, মধ্যপ্রাচ্যের ভেতরে ইরান হচ্ছে নির্মাণ, গৃহস্থালিতে ব্যবহার্য জিনিসপত্র, খাদ্য ও কৃষিপণ্য উৎপাদন, অস্ত্র ও তথ্যপ্রযুক্তি, বিদ্যুৎ এবং পেট্রোকেমিক্যাল উৎপাদনে সবচেয়ে অগ্রগামী দেশ। ২০০৯ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ‘সাফির’ নামে একটি রকেট উৎক্ষেপণের মাধ্যমে ইরান সর্বপ্রথম কক্ষপথে তার কৃত্রিম উপগ্রহ স্থাপনে সাফল্য অর্জন করে। নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি স্যাটেলাইট ও দেশে নির্মিত লাঞ্চারের মাধ্যমে রকেট উৎক্ষেপণে বিশ্বে যে সাতটি দেশ সক্ষম ইরান এখন তার একটি। এছাড়া, ইউরেনিয়াম হেক্সাফ্লুরাইড উৎপাদন ও পুরো ‘পরমাণু জ্বালানি চক্র’ নিয়ন্ত্রণে সক্ষম এলিট ক্লাবের সদস্য দেশ ইরান।
মহাকাশ প্রযুক্তির জ্ঞানের দিক দিয়ে ইরান বিশ্বের শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে রয়েছে এবং মহাকাশবিজ্ঞানের দিক থেকে রয়েছে ১১তম স্থানে। অন্যদিকে, মহাকাশবিজ্ঞানে অঞ্চলে শীর্ষস্থানে রয়েছে দেশটি। মহাশূন্যে নিজস্ব প্রযুক্তিতে নির্মিত স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণে সক্ষম দেশের মধ্যে ইরানের অবস্থান নবম এবং মহাকাশযানে প্রাণী পাঠানোর ক্ষেত্রে ইরানের অবস্থান ষষ্ঠ। স্টেমসেল গবেষণার ক্ষেত্রে ইরান প্রথম সারির ১০টি দেশের মাঝে অবস্থান করছে। স্টেমসেল রিপ্লেস করার ক্ষেত্রে বিশ্বে ইরানের অবস্থান দ্বিতীয়। আর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় বিশ্বে শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে ১৩তম স্থানে রয়েছে ইরান। ২০২১ সালে বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তিতে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলা বিজ্ঞানীদের তালিকায় শীর্ষ দুই শতাংশের মধ্যে স্থান করে নিয়েছেন আট ইরানি বিজ্ঞানী। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং বৈশ্বিক সূচকে এই চিত্র উঠে এসেছে। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বের লক্ষাধিক বিশিষ্ট বিজ্ঞানীর তথ্য উপস্থাপনার জন্য একটি ডাটাবেজ তৈরি করেছে। এতে বিজ্ঞানের ২২টি ক্ষেত্র ও ১৭৬টি উপশাখায় কাজ করা বিজ্ঞানীদের তথ্য তুলে ধরা হয়।
বৈজ্ঞানিক বিকাশের ক্ষেত্রে ইরান বিশ্বে চতুর্থ স্থান অর্জন করেছে। চলতি বছর অর্থাৎ ২০২২ সালে বিশ্বব্যাপী বৈজ্ঞানিক উৎপাদনে ইরানের অবস্থান ১৫তম। বিজ্ঞান উৎপাদনের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ ওয়েব সায়েন্সের আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার সূচকে ৩৮২ স্কোর নিয়ে ইরান বিশ্বে ১৫তম স্থানে রয়েছে। যা নিবন্ধিত ইরানি নিবন্ধগুলোর গুণমান নির্দেশ করে। নিউরোসায়েন্স এবং কগনিটিভ নিউরোলজির ক্ষেত্রে অঞ্চলে প্রথম স্থানে রয়েছে ইরান। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর পরিচালিত অধ্যয়ন এবং মূল্যায়নের ভিত্তিতে ইরান এই অঞ্চলে নিউরোসায়েন্স এবং জ্ঞানীয় নিউরোলজিতে প্রথম স্থানে রয়েছে। এছাড়া ইরান বর্তমানে নিউরোসায়েন্সের ক্ষেত্রে বিশ্বে ১৯তম, আচরণগত নিউরোসায়েন্সে ১৩তম, সেলুলার ও আণবিক ক্ষেত্রে ১৭তম এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও স্নায়ুবিজ্ঞানে ১২তম স্থানে রয়েছে।
ন্যানো প্রযুক্তিতে ইরান বিশে^ তৃতীয়
কারিগরি ও প্রযুক্তিক্ষেত্রে এখন ন্যানোপ্রযুক্তি একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রায় সকল বিভাগেই এই ন্যানো প্রযুক্তি এখন গুরুত্বপূর্ণ স্থান করে নিয়েছে। এই প্রযুক্তিতে বিশ্বে ইরানের অবস্থান তৃতীয়। মেডিসিন, ইঞ্জিনিয়ারিং, ফার্মাসিউটিক্যালস, পশু চিকিৎসা, পরিবেশবিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান, মলিকিউল, এমনকি মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়েও এই প্রযুক্তির ব্যবহার লক্ষণীয়। চলতি ইরানি বছরের প্রথম ছয় মাসে (২১ মার্চ থেকে ২১ সেপ্টেম্বর) ইরানে মোট ৭৮৩টি ন্যানো পণ্য ও সরঞ্জাম তৈরি হয়েছে এবং এসব পণ্য ন্যানোস্কেল সার্টিফিকেটও লাভ করেছে। এর আগে গত বছর দেশটিতে মোট ৭৫০টি ন্যানো পণ্য ও সরঞ্জাম তৈরি হয়। ৭৮৩টি পণ্যের মধ্যে ৫৬৬টি ন্যানো পণ্য সংশ্লিষ্ট ও ২১৭টি ন্যানো সরঞ্জাম সংশ্লিষ্ট।
অন্যদিকে, চলতি ইরানি বছরের (যা ২১ মার্চ শেষ হবে) শেষ নাগাদ ন্যানো প্রযুক্তি পণ্য থেকে ইরানের রাজস্ব আয় প্রায় ৭২৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পর্যন্ত পৌঁছবে বলে আশা করা হচ্ছে। ন্যানোটেকনোলজি ইনোভেশন কাউন্সিলের সেক্রেটারি সাইদ সরকার এই প্রত্যাশা করে বলেন, গত ২০ বছরে ২৫টি শিল্প খাত থেকে ৮৫০টি ন্যানো পণ্য বাজারে প্রবেশ করেছে।
গবেষণাগারের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম, শিল্প সরঞ্জাম, টেক্সটাইল সরঞ্জাম, লন্ড্রি বা ডিজারজেন্ট পণ্য সামগ্রী, কৃষি ও ভবন নির্মাণ সরঞ্জাম ইত্যাদি ন্যানো প্রযুক্তিজাত পণ্যের অন্তর্ভুক্ত। টেক্সটাইল শিল্প পণ্যের ক্ষেত্রে হাসপাতালে ব্যবহৃত বেডশিটের কথা বলা যেতে পারে। ন্যানো প্রযুক্তির ব্যবহার করে নির্মিত এইসব বেডশিট অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল মানে কোনোরকম ব্যাকটেরিয়া এসব চাদরে আক্রমণ করতে পারবে না। শিশুদের জামা-কাপড়ও এই ন্যানো প্রযুক্তির মাধ্যমে তৈরি করা হয়। স্যাটেলাইট-রশ্মি, মাইক্রোওয়েভ রশ্মি প্রতিরোধক কাপড়ও ন্যানো প্রযুক্তির মাধ্যমে তৈরি করা হয়। বায়ুম-লীয় ঠা-া প্লাজমা শিল্প মেশিনের কথা না বললেই নয়। এই শিল্পে এখন তাঁত শিল্পসহ খাবার, চিকিৎসা, প্যাকেজিং এবং স্টেরিলাইজ করা হয়। এমনকি পরিবেশবিজ্ঞানেও এই প্রযুক্তির ব্যবহার ব্যাপকভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
শিক্ষা খাতে ইরানের উন্নয়ন
ইসলামি বিপ্লবের গত ৪৩ বছরে ইরানে শিক্ষা খাতে ব্যাপক অগ্রগতি হয়েছে। বর্তমানে দেশটির শতকরা ৯৭ ভাগ মানুষ শিক্ষিত। ইসলামি শিক্ষা-দর্শনের ভিত্তিতে দেশের প্রয়োজনের প্রতি দৃষ্টি রেখে এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে অগ্রগতির সাথে তাল মিলিয়ে শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো হয়েছে। বিশেষ করে উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে দেশটির অগ্রগতি চোখে পড়ার মতো। বর্তমানে ইরানের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে ১৫৪টি, পাবলিক মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে ৫৮টি, বেসরকারি ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় ৫৬৭টি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে ৩৫৪টি। টাইমস হায়ার এডুকেশন ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র্যাঙ্কিং ২০২২ এ বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে স্থান পেয়েছে ইরানের ৫৯টি বিশ্ববিদ্যালয়। ১৩টি সূচকের ভিত্তিতে চারটি ক্ষেত্রে পারফরমেন্সের ভিত্তিতে এই র্যাঙ্কিং প্রকাশ করা হয়। ক্ষেত্রগুলো হলো পাঠদান, গবেষণা, জ্ঞান হস্তান্তর ও আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি। ২০১২ থেকে ২০১৪ সালে এই তালিকায় ইরান থেকে মাত্র একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থান পেয়েছিল। এদিকে, বিশ্বের ৩০ হাজার শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে স্থান পেয়েছে ইরানের ৬৯৪টি প্রতিষ্ঠান। ওয়েবমেট্রিক্স র্যাঙ্কিং অব ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি ২০২২-এ এই চিত্র দেখা গেছে। আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওয়েবমেট্রিক্স র্যাঙ্কিং একটি যৌগিক সূচকের উপর ভিত্তি করে প্রকাশ করা হয়। ওয়েবমেট্রিক্স র্যাঙ্কিং ২০০৪ সালে চালু করা হয় এবং প্রতি বছর জানুয়ারি এবং জুলাই মাসে র্যাঙ্কিং আপডেট করা হয়। ২০২১ সালে এটি বিশ্বব্যাপী ৩১ হাজারের অধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ওয়েব সূচক প্রকাশ করে।
চিকিৎসা ক্ষেত্রে ইরানের উন্নয়ন
ইসলামি বিপ্লবের গত ৪৩ বছরে চিকিৎসাখাতে ইরানের উন্নয়ন যেকারো দৃষ্টি আকর্ষণ করতে বাধ্য। বিপ্লবের আগে যে দেশটির অনেক শহরে ইরানি ডাক্তার খুঁজে পাওয়া দুরূহ ব্যাপার ছিল সে ইরানের নাম এখন চিকিৎসাবিজ্ঞানে বিশ্বের শীর্ষ দেশগুলোর তালিকায়। বর্তমানে চিকিৎসাবিজ্ঞানে ইরানের অবস্থান বিশে^ দশম। দেশটি বর্তমানে অভ্যন্তরীণ চাহিদার ৯৮ শতাংশ ওষুধ নিজেই তৈরি করে এবং চাহিদার শতকরা ১০০ ভাগ ওষুধ উৎপাদনের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে দেশটি। বর্তমানে বিশ্বের ৫৪টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে ইরানি কোম্পানিগুলোর তৈরি মেডিকেল সরঞ্জাম। বৈশ্বিকভাবে ৫ লাখ মেডিকেল সরঞ্জাম আইটেমের মধ্যে ৫৬ শতাংশ ইরানি ভার্সন আন্তর্জাতিক বাজারে পাওয়া যায়। ইরানের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক দপ্তরের তথ্যমতে, দেশব্যাপী স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতে মোট ২২৭টি বিজ্ঞানভিত্তিক কোম্পানি মেডিকেল সরঞ্জাম সরবরাহ করে। সম্প্রতি রাশিয়া, জার্মানি এবং ইকুয়েডরে ‘ব্রেন সার্জারি নেভিগেশন সিস্টেম’ রপ্তানি শুরু করছে ইরান। মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচারের এসব জটিল উপকরণ বর্তমানে ইরানের ৮০টি হাসপাতালে ব্যবহৃত হচ্ছে। উপকরণগুলো কৌশলগত পণ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মস্তিষ্কের বিভিন্ন ধরনের জটিল অস্ত্রোপচারে এধরনের উপকরণ ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এধরনের ডিভাইস সার্জনকে অস্ত্রোপচারের সময় প্রয়োজনীয় সঠিক দিক-নির্দেশনা দিতে সক্ষম। টিউমার, সাইনাস ও মাথার খুলি, এমনকি স্পাইনাল কর্ড বা মেরুদ- অপারেশনে এসব ডিভাইস খুবই উপযোগী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের পরিচালক আহমেদ আল-মানদারি বলেছেন, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য ইরান হচ্ছে রোল মডেল। মানদারি বলেন, বিগত চার দশক ধরে ইরানের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নেটওয়ার্ক জনগণের সময়মতো সাশ্রয়ী মূল্যে, গ্রহণযোগ্য ও প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য পরিষেবা নিশ্চিতের লক্ষে কাজ করছে। তিনি বলেন, এসব নতুন স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের আওতা বাড়াতে সাহায্য করবে এবং শতভাগ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
ইরানের চিকিৎসাবিজ্ঞানের ৬৫টি বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে স্থান পেয়েছে। ওয়েবমেট্রিক্স র্যাঙ্কিং অব ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি জানুয়ারি ২০২২-এ এই চিত্র দেখা গেছে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন মতে, ইরান ২০১৯ সালে হাসপাতালের সংখ্যা ও মানের দিক দিয়ে বিশ্বে ২১তম স্থান অর্জন করে। সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণের দিক দিয়ে ইরান বিশ্বে দ্বিতীয় দেশের স্বীকৃত লাভ করে।
এদিকে, ইরানের চিকিৎসা খাতে ব্যবহৃত জৈব পণ্য উৎপাদন এবং রপ্তানি সংস্থার পরিচালক জানিয়েছেন, ইরান কেবল বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ওষুধ রপ্তানি করছে তা-ই নয়, একই সাথে দেশটি জৈব ওষুধ প্রস্তুত সংক্রান্ত প্রযুক্তি এবং অভিজ্ঞতাও রপ্তানি করছে। এ জাতীয় প্রযুক্তি রপ্তানির মধ্য দিয়ে ইরানের জৈব ওষুধ উৎপাদনের উচ্চ সক্ষমতাই ফুটে উঠেছে। বর্তমানে ইরান এ জাতীয় ওষুধ নির্মাণের প্রযুক্তি তুরস্ক, মালয়েশিয়া, ইরাক, আর্মেনিয়া, কাযাখস্তান এবং রাশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করছে। এ ছাড়াও ইরানি বিজ্ঞানীরা শক্তিশালী মৌলিক কোষ তৈরি করতে সক্ষম হওয়ায় ইরান এ ক্ষেত্রে বিশ্বের সেরা ৫টি দেশের মধ্যে স্থান করে নিয়েছে। বিশ্বের খ্যাতনামা বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী মৌলিক কোষ নির্মাণে ইরানের সাফল্যের কথা স্বীকার করেছে। ফলে ইরান এক্ষেত্রে বিশ্ব অঙ্গনে জার্মানি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও চীনের পরই নিজের বিজয় পতাকা উড্ডীন করতে সক্ষম হয়।
ক্যান্সার চিকিৎসায়ও ইরানি বিজ্ঞানীরা উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছেন। তেহরানের কে এন তূসি প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা ন্যানো প্রযুক্তি ব্যবহার করে এমন একটি যৌগ আবিষ্কার করেছেন যার সাহায্যে মানবদেহে ক্যান্সার চিহ্নিত করা যাবে। এধরনের যৌগ উৎপাদন করা যাবে বেশ সস্তায় এবং এতে অপেক্ষাকৃত কম খরচে ক্যান্সার রোগীর চিকিৎসা স¤পন্ন করা যাবে। হৃদযন্ত্র প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রেও ইরানি চিকিৎসকদের সাফল্য চোখে পড়ার মতো। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে ইরান হৃদযন্ত্র প্রতিস্থাপন ও হৃদরোগ চিকিৎসায় শীর্ষে অবস্থান করছে।
এদিকে, বিশ^ব্যাপী মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে ও আক্রান্তদের চিকিৎসায় উল্লেখ্যযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে ইরান। এরই মধ্যে ইরান করোনাভাইরাসের বেশ কয়েকটি টিকাও তৈরি করেছে। বর্তমানে দেশটি করোনার টিকা প্রস্তুতকারী বিশ্বের ছয়টি দেশের মধ্যে নিজেদের স্থান করে নিয়েছে। দেশটি এখন নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও করোনার টিকা রপ্তানির প্রস্তুতি নিচ্ছে।
মেডিক্যাল ট্যুরিজম
মেডিক্যাল ট্যুরিজম শিল্পে ইরান এখন উন্নয়নশীল দেশগুলোর কাতারে রয়েছে। এখন সারা বছর জুড়েই বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বহু মানুষ চিকিৎসার জন্য ইরানে আসছেন। বেশিরভাগ রোগী হলেন ব্রিটেন, সুইডেনসহ পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলোর। ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য নীতিতে চিকিৎসা ব্যয় কমানোর ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এ কারণে ইরানে যেকোনো অপারেশনের ব্যয় তুরস্ক, ব্রিটেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক চতুর্থাংশের মতো। তবে চিকিৎসার গুণগত অবস্থা বিশ্বমানের। সেজন্যই বিদেশী রোগীরা ইরানের চিকিৎসার মানের ব্যাপারে সন্তুষ্ট। ইরানের উন্নত চিকিৎসাসেবা বিশ্বের চিকিৎসকগণকেও আকৃষ্ট করছে। দেশটিতে ওপেন হার্ট সার্জারিসহ বহু জটিল ও মারাত্মক রোগের চিকিৎসা এখন উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে করা হচ্ছে।
রপ্তানি খাত
একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি হলো রপ্তানি খাত। এই খাতে যে দেশ যত বেশি শক্তিশালী সেই দেশ অর্থনৈতিকভাবে তত বেশি সমৃদ্ধ। আর এক্ষেত্রে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান উদীয়মান অর্থনীতির সম্ভাবনাময় দেশ হিসেবে পরিকল্পিতভাবে এগিয়ে যাচ্ছে সমৃদ্ধির ইতিবাচক গতিধারায়। তেলের ওপর নির্ভরতাই ছিল এক সময় দেশটির অর্থনীতির প্রধান চালিকা শক্তি। কিন্তু সেই তেলনির্ভর অর্থনীতি থেকে ক্রমশ বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে দেশটি। ইসলামি বিপ্লবের পর বিগত ৪৩ বছরে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তিগুলোও পাল্টে যাচ্ছে। ক্রমশ শিল্প, কৃষি ও সেবা খাতের বিকাশ ঘটছে। এর ফলে দেশটির অর্থনীতির মৌলিক কাঠামো অনেকটাই বদলে যাচ্ছে। ইরানের ওপর চাপিয়ে দেওয়া নিষ্ঠুর অবরোধ সত্ত্বেও চলতি ফারসি বছরের প্রথম নয় মাসে দেশটিতে বৈদেশিক বাণিজ্য ৭২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে। ইরানের শুল্ক প্রশাসনের (আইআরআইসিএ) প্রধান আলিরেজা মোগাদাসি এ তথ্য জানিয়েছেন। মোগাদাসি জানান, ফারসি ১৪০০ সালের প্রথম ৯ মাসে ইরান এবং অন্যান্য দেশের মধ্যে ৭২ বিলিয়ন ডলার মূল্যের ১২ কোটি ২৫ লাখ টন পণ্য বিনিময় হয়েছে। যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ওজনের দিক দিয়ে ১১ শতাংশ এবং মূল্যের দিক দিয়ে ৩৮ শতাংশ বেশি। মোগাাদাসি আরও বলেন, বাণিজ্য সম্পর্ক একই গতিতে চলতে থাকলে বছরের শেষ নাগাদ দেশের মোট বাণিজ্য ৯৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে।
বছরের প্রথম নয় মাসে ওই মোট বাণিজ্যের মধ্যে ৩ কোটি ৫১ লাখ বিলিয়ন ডলার মূল্যের ৯ কোটি ২৩ হাজার টন পণ্য ছিল রপ্তানি সংশ্লিষ্ট। যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ওজনের দিক দিয়ে ৮ শতাংশ এবং মূল্যের দিক দিয়ে ৪০ শতাংশ বেশি। এদিকে, ইরানের শুল্ক প্রশাসনের (আইআরআইসিএ) উপপ্রধান ফোরুদ আসগারি জানিয়েছেন, চলতি ফারসি বছরের শেষ নাগাদ ইরানের তেল-বহির্ভূত রপ্তানির পরিমাণ ৪৬ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছবে বলে আশা করা হচ্ছে। জনাব আসগারি বলেন, ষষ্ঠ ইরানি ক্যালেন্ডার মাস (যা ২২ সেপ্টেম্বর শেষ হয়েছে) শাহরিভার থেকে তেল-বহির্ভূত পণ্য রপ্তানি ত্বরান্বিত হয়েছে। তাই আশা করা হচ্ছে চলতি বছরের শেষে এই পরিমাণ ৪৬ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছবে।
চলতি ফারসি বছরে দেশটির প্রথম নয় মাসে খনিজ রপ্তানি বেড়েছে ৯০ শতাংশ। এই সময়ে দেশটি ৯ দশমিক ৪৮৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানি করতে সক্ষম হয়েছে। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় এই রপ্তানি ৯০ দশমিক ৮ শতাংশ বেড়েছে। অপর একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২১ মার্চ থেকে ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশটি থেকে ২৮০ দশমিক ৬৩০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের ইস্পাত ও ইস্পাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে। খনি ও খনিজ খাতের সর্বোচ্চ ৫৫ দশমিক ৬ শতাংশ রপ্তানি অংশ ছিল ইস্পাত ও ইস্পাত পণ্যের। ইরানে তেল-বহির্ভূত পণ্য রপ্তানির তালিকায় শীর্ষে রয়েছে প্লাস্টিক ও প্লাস্টিকের জিনিসপত্র, জৈব রাসায়নিক পণ্যসামগ্রী, আকরিকসহ ধাতব দ্রব্যসমূহ, ফলমূল ও বাদাম। এছাড়া দেশটির রপ্তানিযোগ্য পণ্যের মধ্যে আয়রন ও স্টিল, কপার, সার, লবণ, সালফার, পাথর ও সিমেন্ট, পেট্রোকেমিক্যাল, কৃষিপণ্য, খাদ্যপণ্য, খনিজ ও ওষধি পণ্য উল্লেখযোগ্য।
কৃষি উন্নয়ন
ইসলামি বিপ্লবের গত ৪৩ বছরে কৃষি খাতে ইরানের অগ্রগতির চিত্র রীতিমত বিস্ময়কর। কৃষি পণ্যের বৈচিত্র্যের দিক দিয়ে ইরান বিশে^ তৃতীয় অবস্থান দখল করতে সক্ষম হয়েছে। আর ইরানের তুলনামূলক রপ্তানি সম্ভাবনাময় খাতগুলোর তালিকায় শীর্ষে উঠে এসেছে দেশটির কৃষি খাত। ইরানের বাণিজ্য উন্নয়ন সংস্থা (টিপিও) প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে এই চিত্র পাওয়া গেছে। বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা বা ফাওর তথ্য মতে, ইরান হচ্ছে বিশ্বের প্রধান পাঁচটি দেশের মধ্যে একটি যে দেশটি কমলা, মাল্টা ও লেবুজাতীয় ফল উৎপাদনে সেরা অবস্থানে রয়েছে। এছাড়া শশা, ক্ষীরা, খেজুর, বেগুন, ডুমুর, পেস্তা, নাশপাতি, আখরোট ও তরমুজ উৎপাদনে বিশ্বের সেরা পাঁচ দেশের মধ্যে রয়েছে ইরান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাপিয়ে দেওয়া কঠিন অবরোধের মধ্যেও চলতি ফারসি বছরের প্রথম চার মাসে (২১ মার্চ থেকে ২২ জুলাই) মূল্যের দিক দিয়ে ইরানের কৃষি পণ্যের রপ্তানি বেড়েছে ৯ শতাংশ। আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় এই রপ্তানি বেড়েছে। ইরানের শুল্ক প্রশাসনের (আইআরআইসিএ) উপপ্রধান মেহরদাদ জামাল অরুনাকি এই তথ্য জানান। আইআরআইসিএ এর কারিগরিবিষয়ক উপপ্রধান বলেন, চার মাসে ১ দশমিক ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের ২৫ লাখ টন কৃষি পণ্য রপ্তানি হয়েছে। উল্লিখিত সময়ে রপ্তানি হওয়া প্রধান প্রধান খাদ্যদ্রব্য এবং কৃষি পণ্য ছিল টমেটো, পেস্তা, তরমুজ, টমেটো পেস্ট, পনির, আপেল, আলু, খেজুর ও বিভিন্ন মিষ্টি। রপ্তানি গন্তব্যের শীর্ষে ছিল ইরাক, চীন, আফগানিস্তান ও সংযুক্ত আরব আমিরাত।
সামরিক শক্তি
ইরান সারা বিশ্বে এখন যেসব কারণে বিশেষ আলোচিত তার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে এর সামরিক শক্তি। এ ক্ষেত্রে ইরানের অবস্থান বিশ্বে ষষ্ঠ। সামরিক শক্তি নিয়ে পূর্ণাঙ্গ আলোচনায় না গিয়েও বলা যায়, ইরানের রয়েছে প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ সক্রিয় সেনা সদস্য। এছাড়া আছে সাড়ে তিন লাখ রিজার্ভ সেনা। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী বাসিজ, যার সদস্য সংখ্যা দশ লাখের বেশি। এতে পুরুষের পাশাপাশি নারী সদস্যও রয়েছে। সব মিলিয়ে ইরান যেকোনো সময় দশ লাখের বেশি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেনা মোবিলাইজ করতে পারে এবং এ সুবিধা বিশ্বের হাতেগোনা কয়েকটি দেশের রয়েছে। ইরানের হাতে রয়েছে নিজস্ব সামরিক শিল্প-কারখানা যেখানে ট্যাংক, আর্মার্ড পারসোনেল ক্যারিয়ার, গাইডেড মিসাইল, সাবমেরিন, সামরিক নৌযান, গাইডেড মিসাইল ডেস্ট্রয়ার, রাডার সিস্টেম, হেলিকপ্টার এবং জঙ্গিবিমান তৈরি করা হয়। এছাড়া ইরানের কারখানায় তৈরি করা হচ্ছে হুত, কাউসার, জেলযাল, ফতেহ-১১০, শাহাব-৩ ও সিজ্জিল ক্ষেপণাস্ত্র এবং নানা ধরনের ড্রোন।
পর্যটন শিল্প
আনন্দ, ভালোলাগা আর রূপময় স্বপ্নিল পৃথিবীর অজানা কোনো সৌন্দর্যের হাতছানিতে ক্ষণিকের জন্য হারিয়ে যেতে মন ছুটে চলে পাহাড়, নদী, সাগর ও অরণ্যে। কখনও মন চায় কোনো শিল্পকর্মের সুনিপুণ কারুকার্যে মন রাঙাতে। আর সে মনের খোরাক জোগাতেই দূর থেকে দূরে ছুটে চলা। সে চলার পথের গন্তব্য যদি হয় ইতিহাস, ঐত্যিহ্যে সমৃদ্ধ কোনো দেশ তাহলে যে একজন ভ্রমণপিপাসুর মনের ষোলকলা পূর্ণ হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ঠিক এমনই এক দেশের নাম হলো ইরান। বলা হয়ে থাকে, পৃথিবীর অর্ধেক সৌন্দর্যের দেশ এটি। যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী মিডিয়া সিএনএন এর সিনিয়র প্রডিউসার ব্যারি নিল্ড ইরানের পর্যটন স¤পর্কে তাঁর প্রতিবেদনের শিরোনাম করেছেন, ‘থার্টি ফোর ইনক্রেডিবল বিউটিফুল রিজন্স টু ভিজিট ইরান’। অর্থাৎ ইরান সফরের ৩৪টি অবিশ্বাস্য সুন্দর কারণ। ইরানের ৩৪টি আকর্ষণীয় নিদর্শনের বর্ণনা দিয়ে এই প্রতিবেদনটি লেখা হয়। এমন একটি দেশে ইসলামি বিপ্লবের গত ৪৩ বছরে সরকারের নানামুখী পদক্ষেপ দেশটিকে বিশ্বপর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রে পরিণত করেছে। বর্তমানে ইরান বিশ্বের সেরা ১০ পর্যটন গন্তব্যের অন্যতম।
জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় রয়েছে ইরানের ২৬টি নিদর্শন। এই তালিকা ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে। গত ২৭ জুলাই ইরানের উরামানাত সাংস্কৃতিক ভূদৃশ্যকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানসমূহের তালিকায় যুক্ত করেছে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা ইউনেস্কো। ১ লাখ ৬ হাজার হেক্টর ভূখ-ের উরামানাতে কয়েকশ’ গ্রাম রয়েছে। এর চারপাশ ঘিরে রয়েছে আরও ৩ লাখ ৩ হাজার হেক্টরের দৃষ্টিনন্দন এলাকা। একই মাসে এক হাজার চারশ কিলোমিটার দীর্ঘ ট্রান্স-ইরানিয়ান রেলপথকেও বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে ইউনেস্কো। রেলপথটি ইরানের ব্যাপক উন্নয়নের ক্ষেত্রে একটি টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে। এসব উন্নয়নের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক উন্নয়ন। প্রাকৃতিক পরিবেশের দিক থেকে বলতে গেলে দেশটিতে যেমন রয়েছে পাহাড় আর সাগর, তেমনি রয়েছে বিশাল মরুভূমি, কোথাও নদ-নদী, আবার কোথাও সুবিস্তৃত সমতল ভূমি। ভূমি-বৈচিত্র্যের মতো এখানকার আবহাওয়াতেও রয়েছে বেশ বৈচিত্র্য। সারা ইরানে বসন্ত, গ্রীষ্ম, শরৎ ও শীতÑ এই চারটি ঋতু রয়েছে। রাজধানী তেহরানসহ বিশাল এলাকাজুড়ে যখন প্রচ- শীত কিংবা তুষারাবৃত তখন দক্ষিণে (পারস্য উপসাগর সংলগ্ন) দিব্যি বসন্তের হাওয়া। পাহাড়, সাগর, নদ-নদী আর জঙ্গলাকীর্ণ বৈচিত্র্যময় ভূমি এবং আবহাওয়ার কারণে ইরানে পর্যটকের ভিড়ও লেগে থাকে সারা বছর।
গ্রামীণ উন্নয়ন
আট কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত ইরানের ৭৪ শতাংশ মানুষ শহরে এবং ২৬ শতাংশ মানুষ গ্রামে বাস করে। তবে শহরের মতো গ্রামের মানুষও সকল মৌলিক নাগরিক সুবিধা ভোগ করছে। স্বল্প আয়ের জনগণ কম খরচে ও ঋণসুবিধা পেয়ে বাড়ির মালিক হচ্ছে। ইসলামি বিপ্লবের পর পরই প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ, পানি, স্কুল-কলেজ ও হাসপাতাল-ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা করে তাৎক্ষণিক নাগরিক সুবিধা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। এখন ইরানের গ্রামের মানুষও স্বাস্থ্যবিমার আওতায় চলে এসেছে।
সামাজিক নিরাপত্তা
যে কোনো দেশের শান্তি ও সমৃদ্ধির বিষয়টি অনেকাংশই নির্ভর করে সেই দেশের সামাজিক নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলার ওপর। ইরানে ইসলামি বিপ্লবের পর দেশটির সামাজিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। তাই তো সারা বিশ্বের নজর আজ শান্ত ও স্থিতিশীল ইরানের দিকে, দেশটির সামাজিক নিরাপত্তার দিকে। যেখানে ইউরোপ ও আমেরিকার মতো উন্নত দেশের মানুষ সারাক্ষণ নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে, আত্মরক্ষার জন্য বাধ্য হয় অস্ত্র বহন করতে, বর্ণবৈষম্য, সামাজিক বৈষম্য, সংখ্যালঘুদের অধিকার হরণ, খুন, ধর্ষণ, সন্ত্রাস, চরম নৈতিক অবক্ষয়, গভীর পারিবারিক সংকট, তালাক প্রভৃতি যেখানে নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার সেখানে ইরানে বিরাজ করছে উল্টো চিত্র। এখানে নেই কোনো মারামারি, নেই চুরি-ছিনতাই, গোলাগুলি-অস্ত্রবাজি। প্রতিদিনের পত্রিকায় কিংবা টেলিভিশনের খবরে খুন-হত্যাকা-ের খবর ‘মাস্ট আইটেম’ হিসেবে থাকে নাÑ যা অনেক উন্নত দেশেও কল্পনা করা যায় না। এখানে মানুষ অনেক বেশি নিরাপদে পথ চলে। সেই নিরাপত্তা দিনে-রাতে একই রকম। রাতের আঁধার নামার সঙ্গে সঙ্গে এখানে ভয় নেমে আসে না। নিশ্চিন্তে পথ চলা যায় একাকী। ভাবতেও হয় নাÑ ‘কেউ জানতে চাইবে কাছে কী আছে!’ বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে এই নিরাপত্তা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার ক্ষেত্রেই সমান। একজন নারী কিংবা তরুণী যদি একাকী রাতের বেলায় পথে হেঁটে যায় তাকেও আলাদা করে ভাবতে হয় না নিরাপত্তার কথা। পথ চলতে গেলে ডাকাত-ছিনতাইকারীর সামনে পড়ার ভয় নেই। রাস্তায় নেই কোনো উটকো মাস্তানি। কেউ পথ আগলে দাঁড়াবে না, কেউ অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করবে না বা শিস দেবে না। এ এক অন্যরকম সমাজ; সামাজিক নিরাপত্তাই যার বড় বৈশিষ্ট্য। সার্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি আসলে ইরানকে নিয়ে গেছে অন্যরকম উচ্চতায়।
চলচ্চিত্র শিল্পের উন্নয়ন
চলচ্চিত্র একটি সৃজনশীল গণমাধ্যম। এর সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক উপাদান। যে দেশে তা নির্মিত হয় সে দেশেরই জাতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতিনিধিত্ব করে চলচ্চিত্রটি। শিল্পকলার প্রভাবশালী মাধ্যম, শক্তিশালী বিনোদন মাধ্যম এবং শিক্ষার অন্যতম সেরা উপকরণ হিসেবেও খ্যাতি রয়েছে চলচ্চিত্রের। গণযোগাযোগ বা সাধারণ মানুষের কাছাকাছি খুব সহজে পৌঁছার ক্ষেত্রেও চলচ্চিত্রের ভূমিকা অপরিসীম। আবার সৃষ্টিশীল মানুষ ও আলোকিত সমাজ উপহার দেওয়ার ক্ষেত্রেও এর রয়েছে জাদুকরি প্রভাব। আর এক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই ইতিহাস, ঐতিহ্য ও শিল্প-সাহিত্যে সমৃদ্ধ দেশ ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান। দেশটির চলচ্চিত্র এখন বিশ্বমানের। অসংখ্য আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ইরানি সিনেমার হৃদয়¯পর্শী ও প্রভাবশালী উপস্থিতি বিশ্বে ইরানি সংস্কৃতি ও শিল্পের স্বচ্ছ ভাবমূর্তি তুলে ধরেছে। ১৯০০ সালে শুরু হয় ইরানি চলচ্চিত্রের পথচলা। বর্তমানে দেশটিতে প্রতি বছর প্রায় ২০০টি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। শক্তিশালী চিত্রনাট্য, অসাধারণ ও অভূতপূর্ব অভিনয়, কলাকুশলির মনকাড়া আবেদন ছাড়াও বিশ্বমানের কারিগরি কৌশলের কারণে বিশ্বের সর্বত্র আজ ইরানি সিনেমা ব্যাপকভাবে দর্শক সমাদৃত হচ্ছে। সেই সাথে পুরস্কৃত হচ্ছে শীর্ষ আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবগুলোতে।
আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র অঙ্গনে সবচেয়ে আলোচিত ও সম্মানজনক পুরস্কার অস্কার থেকে শুরু করে অনেক গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক পুরস্কার ঘরে তুলে নিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের এ দেশটি। অস্কারের ৮৯তম আসরে সেরা বিদেশী ভাষার চলচ্চিত্র হিসেবে পুরস্কার জিতে নেয় ইরানি ছবি ‘দ্য সেল্্সম্যান’। এ নিয়ে দ্বিতীয়বার অস্কার জিতলেন ছবিটির পরিচালক আসগর ফারহাদি। এর আগে ‘অ্যা সেপারেশন’ তাঁকে এনে দেয় এই সম্মাননা।
পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন এবং প্রভাবশালী চলচ্চিত্র উৎসব কান চলচ্চিত্র এই উৎসবের ৭০তম আসরে সিনেফন্ডেশন পুরস্কার জিতেছে ইরানি স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি ‘অ্যানিমল’। ৭১তম কান চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনও হয়েছে ইরানি চলচ্চিত্র দিয়ে এবং এই উৎসবের শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকারের পুরস্কারও জিতে নিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশটি।
ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবের ৭৪তম আসরে দুই অ্যাওয়ার্ড জয় করে ইরানি চলচ্চিত্র ‘নো ডেট, নো সিগনেচার’। ছবিটির জন্য সেরা পরিচালকের অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন এর পরিচালক চলচ্চিত্রকার ভাহিদ জলিলভান্দ এবং সেরা অভিনেতার অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন নাভিদ মোহাম্মাদজাদেহ।
চলতি বছর ২০তম ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবেও তিনটি পুরস্কার পেয়েছে ইরান। সেরা তথ্যচিত্রের পুরস্কার পেয়েছে ইরানি তথ্যচিত্র হলি ব্রেড। আর ইরানি অভিনেত্রী সুসান পারভার পেয়েছেন উৎসবের সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার। ওমেন ফিল্ম সেকশনে সেরা সিনেমা হয়েছে ইরানের ‘লেডি অব দ্য সিটি’। এক কথায় বলতে গেলে প্রাচ্য থেকে পাশ্চাত্যে সর্বত্র ইরানি চলচ্চিত্রের জয়জয়কার।
আর্থ-সামাজিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইরানি নারীদের সাফল্য
নারীর উন্নয়নে বিশ্বের যে দেশগুলো এগিয়ে রয়েছে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান তাদের অন্যতম। জ্ঞান-বিজ্ঞান, রাজনীতি, অর্থনীতি, খেলাধুলাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইরানের নারীদের সাফল্য চোখে পড়ার মতো। ফারসি ১৩৯৫ সালের হিসাব অনুযায়ী ৮ কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত ইরানে সাক্ষরতার হার ৯৭ শতাংশ। এর মধ্যে ৪৬ শতাংশ নারী। দেশটিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারী মানুষের সংখ্যা ১১ মিলিয়ন। যার ৫০ শতাংশই নারী। বিশ্বে সর্বোচ্চ সংখ্যক নারী বিজ্ঞানীর তালিকার শীর্ষে রয়েছে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে পশ্চিমা বিশ্বের প্রতিপক্ষদের বহুদূর ছাড়িয়ে গেছেন দেশটির নারীরা। এক হিসাব মতে, বিজ্ঞানে ডিপ্লোমা স¤পন্ন করেন ইরানের অর্ধেকেরও বেশি নারী। ইরানের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল এবং গণিত (সংক্ষেপে এসটিইএম) বিষয়ে ¯œাতক স¤পন্ন করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশই নারী। যা বিশ্বের যে কোনো দেশের তুলনায় শতাংশে অনেক বেশি। লেখিকা সাদিয়া জাহিদি তাঁর নতুন বই ‘ফিফটি মিলিয়ন রাইজিং’-এ এসব তথ্য তুলে ধরেন। কর্মক্ষেত্রে ইরানি নারীদের সাফল্য চোখে পড়ার মতো। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, প্রশাসন, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও চিকিৎসা কেন্দ্র থেকে শুরু করে প্রায় সব ধরনের কর্মক্ষেত্রে ইরানি নারীদের রয়েছে সরব উপস্থিতি।
দেশটিতে প্রায় ৬০ শতাংশ নারী কার্যনির্বাহী ও প্রশাসনিক কর্মী হিসেবে সক্রিয় রয়েছেন। ইরান ট্যালেন্ট ডটকমের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, প্রায় ৫০ শতাংশ ইরানি নারী শিল্প ক্ষেত্রে কাজ করছেন। দেশজুড়ে ২৮টি ভিন্ন ভিন্ন চাকরি ক্ষেত্রের ১ লাখ কর্মচারীর ওপর জরিপ পরিচালনা করে এই তথ্য দেওয়া হয়।
বিদ্যুৎ উৎপাদনে ইরানের সাফল্য
যেকোনো দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও জনগণের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে বিদ্যুৎ অপরিহার্য। শিল্প, কলকারখানা, কৃষিকাজ, মানব স¤পদ উন্নয়ন, আধুনিক জীবনযাত্রা, চিকিৎসা, যোগাযোগ, ক¤িপউটার প্রযুক্তির ব্যবহার থেকে শুরু করে উন্নয়নের প্রায় সকল ক্ষেত্রেই প্রয়োজন বিদ্যুৎ। বাস্তবতার নিরিখে এ সকল উপলব্ধি থেকে বিদ্যুৎ খাতের কাক্সিক্ষত উন্নয়ন ও পরিচালনা দক্ষতা বৃদ্ধি ও উন্নত গ্রাহক সেবা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান এরই মধ্যে ব্যাপক সফলতা অর্জন করেছে। দেশটি বর্তমানে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ খাতে কেবল পুরোপুরি স্বয়ংস¤পূর্ণতা অর্জন করেছে তাই নয়, একই সাথে দেশটিতে উৎপাদিত বিদ্যুৎ এখন অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। বর্তমানে ইরানের উৎপাদিত বিদ্যুতের পরিমাণ ৮৪ হাজার মেগাওয়াট অতিক্রম করেছে। ২০১৫ সালে দেশটিতে যেখানে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৭৫ হাজার মেগাওয়াট সেখানে ২০২১ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৮৬ হাজার ২১৫ মেগাওয়াটে। এর মধ্য দিয়ে ইরান বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিক থেকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে এক নম্বর স্থানে রয়েছে।
এছাড়া আরও অনেক ক্ষেত্রেই ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান সাফল্যের স্বাক্ষর রেখে চলেছে যা এই সীমিত পরিসরে তুলে ধরা প্রায় অসম্ভব। তবে যে কথা না বললেই নয় তা হচ্ছে, শত বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও ইসলামি বিপ্লবের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম খোমেইনী (র.)-এর সুযোগ্য উত্তরসূরি ও ইসলামি বিপ্লবের বর্তমান নেতা হযরত আয়াতুল্লাহ আল উজমা খামেনেয়ীর নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ ইরানি জাতি কোনো অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করে উন্নয়নের ধারায় যেভাবে অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলেছে তাতে দেশটি একদিন বিশ্বের নেতৃত্বের আসনে অবস্থান করবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
১৩ রজব আমিরুল মুমিনীন (আ.)-এর জন্মদিবস উপলক্ষে বিশেষ নিবন্ধ
ড. এম আব্দুল কুদ্দুস বাদশা
ঐতিহাসিকরা লিখেছেন ৩০ আমুল ফিল তথা হস্তিসনের ১৩ রজব পবিত্র মক্কায় এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে, মানব জাতির ইতিহাসে যার কোনো নজির খুঁজে পাওয়া যাবে না। পরবর্তীকালেও যার কোনো পুনরাবৃত্তি ঘটেনি। সেদিন হযরত আলী (কা.) খানা কা’বার মধ্যে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন হযরত আবু তালিব ইবনে আবদুল মুত্তালিব ইবনে হাশিম ইবনে আবদে মানাফ। যিনি সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর চাচা। আর মাতা ছিলেন ফাতিমা বিনতে আসাদ বিন হাশিম। সুতরাং হযরত আলী পিতৃ ও মাতৃ উভয় দিক থেকে হাশিমী বংশীয় ছিলেন। তাঁর প্রধান লকবগুলো ছিল ‘আসাদুল্লাহ’, ‘মুরতাযা’ ও ‘আমিরুল মুমিনীন’ আর প্রধান কুনিয়াত ছিল ‘আবুল হাসান’ ও ‘আবু তুরাব’।
হযরত আলীর কা’বা ঘরের মধ্যে জন্মগ্রহণের ঘটনাটি ছিল তাঁর জন্য এক বিশেষ ফযিলত। শিয়া-সুন্নি নির্বিশেষে ‘ইলমুল আনসাব’ শাস্ত্রের প-িতবৃন্দ তাঁদের গ্রন্থাবলিতে এ ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন। মুহাম্মাদ মালেকি বলেন : ‘তিনি ৩০ আমুলফিলের ১৩ রজব রোজ শুক্রবার পবিত্র মক্কা শরীফে বায়তুল্লাহ’র মধ্যে জন্মগ্রহণ করেন… তাঁর আগে কেউই বায়তুল হারামের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেনি। এটি এমন একটি বিশেষ ফযিলত যা মহান আল্লাহ তাঁকে দান করেছেন তাঁর উচ্চতর মর্যাদাকে সমুন্নত করতে এবং তাঁর কারামাত তথা সম্মানকে প্রকাশ করতে।’
হাকেম নিশাবুরি বলেন : হযরত আলী খানা কা’বার মধ্যে জন্মগ্রহণের খবরটি তাওয়াতুর সূত্রে আমাদের কাছে পৌঁছেছে। অদ্যাবধি আর কেউ এই বিরল মর্যাদা লাভ করেনি।
আমিরুল মুমিনীন হযরত আলী (কা.) এরূপ অসংখ্য বিরল ফযিলতের অধিকারী ছিলেন। কবি আবুল আইনা’র ভাষায় বলতে হয় : ‘আমি যদি আপনার ফাযায়েল বর্ণনা করতে চাই তাহলে ব্যাপারটা এমন হবে যেন সূর্যের আলোয় ঝলমলে দুপুরে আমি দিনের পরিচয় বর্ণনা করতে চাই, যা কারও সামনে অপ্রকাশিত নয়।’
হযরত আলীর এই অশেষ ফযিলতের মধ্যে তাঁর জ্ঞান-গরিমার মহিমা ছিল সর্বজনস্বীকৃত। স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সা.) আলীর শৈশবকাল থেকে মা যেমন বুকের দুধ পান করিয়ে তিলে তিলে আপন শিশুকে বড় করে, ঠিক সেভাবেই আলীকে জ্ঞানের আহার দিয়ে লালন পালন করেন। ‘নাহজুল বালাগা’র ১৯২ নং খুতবায় বর্ণিত হয়েছে যে হযরত আলী স্বয়ং এভাবেই তাঁর সেই সৌভাগ্যধন্য শৈশবের স্মৃতিচারণ করেছেন : ‘রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাকে আমার শৈশবের প্রারম্ভ থেকেই নিজের কোলে পিঠে করে লালন পালন করেছেন এবং প্রত্যেকদিনই তিনি জ্ঞান ও চরিত্রের একটি করে দরজা আমার সামনে খুলে দিতেন আর আমাকে তা মেনে চলতে নির্দেশ দিতেন।’
হযরত আলী ইবনে আবি তালিব (কা.) ছিলেন রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিজের হাতে গড়া পূর্ণ ইসলামের এবং পূর্ণ ঈমানের মূর্তমান প্রতীক। অনেকে তাঁকে হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর আল-কুরআনের পরে দ্বিতীয় চিরন্তন মু’জিজা হিসাবেও আখ্যায়িত করেন। বরং কারও কারও ভাষায় তিনি ছিলেন জীবন্ত কুরআন। কুরআনের সাথে হযরত আলীর এই অঙ্গাঙ্গি সম্পর্ক স্পষ্ট হয়ে ওঠে ‘নাহজুল বালাগা’য় বর্ণিত তাঁর ১৫৮ নং খুতবার ভাষ্য থেকে। তিনি বলেন :
ذلک القرآن فاسْتنطقوه ولنْ ینطق ولکن أُخبرکم عنه ألا إنّ فیه علم ما یأتی والحدیث عن الماضی و دواء دائکم ونظم ما بینکم.
: ‘এই হলো কোরআন। তোমরা কোরআনকে কথা বলাও। কখনও সে কথা বলবে না। কিন্তু আমি হলাম কোরআনের মুখপাত্র। এর মধ্যের সববিষয়ে আমি তোমাদেরকে অবগত করব। জেনে রেখো! এই কোরআনের মধ্যে ভবিষ্যতের জ্ঞান রয়েছে, রয়েছে অতীতের কথাও। তোমাদের সমস্ত বেদনার উপশম আর সুষ্ঠ জীবন ব্যবস্থা বিধৃত রয়েছে এর মধ্যে।’
একইভাবে ‘নাহজুল বালাগা’র ১৭৫ নং খুতবায় তিনি বলেন :
واللّه لو شئتُ أن أُخبر کلّ رجلٍ منکم بمخْرجه وموْلجه وجمیع شأنه لفعلتُ! ولکن أخاف أن تکفروا فىّ برسول الله (صلی الله علیه و آله و سلم) ألا وإنّى مُفْضیه إلی الخاصّة ممّن یؤمّن ذلک منه.
: ‘আল্লাহ্র শপথ! যদি চাইতাম তোমাদের সকলের জীবনের সূচনা ও পরিণতি আর তোমাদের প্রবেশ বাহির সম্পর্কে খবর জানাতে, আমি তা পারতাম! কিন্তু ভয় হয় পাছে তোমরা আমাকে নিয়ে কুফরিতে লিপ্ত হও কিনা এই কথা বলে যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) যা বলেননি, আলী তা বলছে। জেনে রেখো, আমি বিশেষ কিছু আস্থাভাজন ব্যক্তির কাছে এই জগতের কিছু কিছু রহস্য জ্ঞান প্রকাশ করি।’
হযরত আলী (কা.) এভাবে সরাসরি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর শিষ্যত্ব লাভে ধন্য হন। এই জ্ঞানের পরিমাত্রা সম্পর্কে ইশারা করে তিনি বলেন : ‘রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাকে জ্ঞানের এক হাজারটি দরজা শিক্ষা দিয়েছেন, যেগুলোর প্রত্যেকটি থেকে আবার এক হাজারটি করে জ্ঞানের দরজা খুলে যায়।’ নাহজুল বালাগায় বর্ণিত ৩ নং খুতবায় হযরত আলী বলেন : ‘[আমার জ্ঞানের পাহাড় এতই উঁচু যে] আমার থেকে শুধু জ্ঞানের ঢল নামে এবং কোনো পাখিই আমার চুঁড়ায় পৌঁছতে পারে না।’
তিনি জনগণকে উদ্দেশ করে উদাত্ত ঘোষণা দিতেন : ‘তোমরা আমাকে হারানোর আগে আমার কাছ থেকে প্রশ্ন করে জেনে নাও। আমি জমিনের পথঘাটের চাইতে আসমানের পথঘাটের খবর বেশি রাখি।’ (নাহজুল বালাগা : খুতবা ১৮৯)
স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজ হাতে-গড়া এই শিষ্যের ব্যাপারে উম্মতকে জানিয়ে দিয়েছেন : ‘আমি সমস্ত জ্ঞানের নগরী, আর আলী তার দরজা। কাজেই যে নগরে প্রবেশ করতে চায় সে যেন এর দরজা দিয়েই প্রবেশ করে।’ মহিউদ্দিন আল-আরাবী তাঁর ‘রিসালাতুল কুদ্্স’ এর মধ্যে হযরত আলী (কা.)-এর পরিচয় দিয়েছেন এভাবে : ‘এই হচ্ছে আলী ইবনে আবি তালিব, সেই ব্যক্তি যিনি হচ্ছেন নববী জ্ঞান-নগরীর দরজা এবং ঐ নগরীর রহস্যকথার মালিক ও ইমাম।’ ( রিসালাতুল কুদ্স : ৩৭; আল-ফুতুহাত আল-মাক্কিয়্যা: ৮/১০৭)
আল্লামা সিবত ইবনে জাওযি হযরত আলী (কা.)-এর জ্ঞানের বিষয়ে লিখেছেন : “…তাঁকে আল-বাত্বীন নামে আখ্যায়িত করা হতো। কেননা, তিনি ছিলেন জ্ঞানের গভীরতায় পরিপূর্ণ। আর তিনি (আ.) বলতেন : ‘যদি আমার জন্য একটি ক্লাসের ব্যবস্থা করা হতো তাহলে একটি উটের পিঠে যতটা বহন করা যায় ততটা পরিমাণ কেবল ‘বিসমিল্লাহ’র তাফসিরে বক্তব্য রাখতাম।’ আর তাঁকে ‘আল-আনযা’ বলে আখ্যায়িত করা হতো। কারণ, তিনি ছিলেন র্শ্কি থেকে বিমুক্ত।” (তাযকিরাতুল খাওয়াস : ১৬)
বিখ্যাত খ্রিস্টান প্রাচ্যবিদ নিভিসিয়ান যেন হযরত আলী (কা.)-এর আফসোসকে লক্ষ্য করেই বলেন : ‘যদি আলী ইবনে আবি তালিব, এই শক্তিমান ও বাগ্মী বর্তমান যুগেও কুফার মিম্বারে বসতেন তাহলে আপনারা দেখতে পেতেন মসজিদে কুফা ঐ বিশাল বিস্তৃতির পরও পাশ্চাত্য ও গোটা বিশ্ব থেকে কিভাবে বিজ্ঞানী ও প-িতরা আলীর উত্তাল জ্ঞানের দরিয়ায় অবগাহন করার জন্য ভিড় জমাতেন। (উদ্ধৃত: আবদুল ফাত্তাহ আবদুল মাকসুদ রচিত আল ইমাম আলী ইবনে আবি তালিব (আ.) : ১/১৫)
আল্লামা মুহাম্মাদ তালহা আল-শাফেয়ী হযরত আলীর ফযিলত সম্পর্কে অবগত হওয়ার জন্য আরব কবির পথনির্দেশনা অনুসরণ করার আহ্বান জানিয়েছেন। কবি বলেন : عن المرء لا تسأل وسل عن قرینه * فکل قرین بالمقارن یقتدی : যদি কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে জানতে চাও তাহলে তার সঙ্গীকেই প্রশ্ন কর। তাকে প্রশ্ন করো না। কারণ, প্রত্যেক সহচর তার সঙ্গীর কর্ম ও আচরণের অনুকরণ করে থাকে। অতঃপর তিনি হযরত আলীর সঙ্গী ও সহবৎ সম্পর্কে বলেন: ‘দিগন্তে দিগন্তে যে নবুওয়াতের জ্যোতি ছড়িয়ে পড়েছিল, মহান আল্লাহ তা থেকে তাঁর [আলীর] মধ্যে বিকিরণ ঘটান এবং তাঁকে এক পূতপবিত্র প্রাণ দান করেন। আর তাঁর আপন সত্তায় যে নির্মলতা ও নিষ্কলুতা বিদ্যমান ছিল একারণে আল্লাহ তাঁর মধ্যে সমস্ত মানবিক ও নৈতিক সদগুণ ধারণ করার যোগ্যতা প্রদান করেন। এরূপ এক শুদ্ধাচারী মানবসত্তার অধিকারী হওয়ার সুবাদে তিনি সকল পঙ্কিলতা, কুফ্রি, অশুদ্ধতা ও অসূচিতা থেকে পবিত্র থাকেন। র্শ্ক,ি পাপাচারিতা, মিথ্যা, নিফাক কোনো কিছুই তাঁর সে বিশুদ্ধতায় আঁচড় কাটতে পারেনি। আর একারণেই তিনি ছিলেন পুরুষদের মধ্যে সর্বপ্রথম ব্যক্তি যিনি নিঃসঙ্কোচে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি ঈমান আনেন এবং মূর্তি ও প্রতিমাগুলো গুড়িয়ে দিয়ে মসজিদুল হারামকে বাতিল সব খোদা এবং র্শ্কি ও গোমরাহির চিহ্নসমূহ অপসারণে অনুপ্রাণিত হন। আর এ কারণেই তাঁকে আনযা‘ [অর্থাৎ র্শ্কি থেকে বিমুক্ত] আখ্যায়িত করা হয়…।’
এ প্রসঙ্গে লেবাননের বিখ্যাত খ্রিস্টান লেখক ও কবি এবড়ৎমব ঔড়ৎফধপ এর একটি মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন : ‘আমার মতে ইবনে আবি তালিব ছিলেন প্রথম আরব পুরুষ, যিনি রুহে কুল্লি তথা সামগ্রিক আত্মার সাথে সহচর ও সহবতে ছিলেন। আলী তাঁর আযামতের কারণেই শহীদ হন।’ (দ্য ভয়েস অব হিউম্যান জাস্টিস : ৪৬৭)
আল্লামা মুহাম্মাদ তালহা আল-শাফেয়ী আরও বলেন : …রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সাথে তাঁর সার্বক্ষণিক সাহচর্যের কারণে আল্লাহ অবিরত তাঁর জ্ঞানের পরিধি বাড়িয়ে দিতেন। এই জ্ঞানের প্রাচুর্য এতটাই বৃদ্ধি লাভ করে যে তিরমিযী শরীফের সহিহ হাদিসের ভাষ্য মোতাবিক স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সা.) হযরত আলীর ব্যাপারে ঘোষণা করেন : ‘আমি সমস্ত জ্ঞানের নগরী আর আলী তার দরজা।’ এই অসামান্য জ্ঞান দ্বারা তিনি বাদি-বিবাদির জটিল সব বিচারের ন্যায্য মীমাংসা করে দিতেন আর কঠিনতম মাসলাসমূহের সঠিক ফয়সালা বলে দিতেন। জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখায় তাঁর কোনো না কোনো অবদান চোখে পড়বে… আর যেহেতু আল্লাহ তাঁকে বিভিন্ন প্রকার জ্ঞান ও হিকমত দান করেছিলেন, একারণে সকলের কাছে সেটা প্রকাশ হয়ে যায় এবং তাকে ‘বাত্বিন’ নামে আখ্যায়িত করে। বাত্বিন বলা হয় তাকে যার পেট মোটা থাকে। কিন্তু হযরত আলীর ভিতরে নানা প্রকার জ্ঞান-বিজ্ঞান ও হিকমতের অপূর্ব সমাহার ঘটেছিল একারণে তাঁকেও ‘বাত্বিন’ আখ্যা দেওয়া হতো। জড় খাদ্যদ্রব্যে নয়, অজড় জ্ঞান-বিজ্ঞান আর হিকমতেই তাঁর পেট পরিপূর্ণ। (মাতালিব আস-সাউল : ৭০-৭৬)
সুতরাং মুসলিম অমুসলিম নির্বিশেষে সকল ব্যক্তির কাছে দিনের আলোর মতো সুস্পষ্ট যে আমিরুল মুমিনীন হযরত আলী ইবনে আবি তালিব (কা.) অফুরান ও বৈচিত্র্যময় জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন, যা নির্ঝরিণী ঝরনাধারার মতো শুধু প্রবহমাণ ছিল নিরন্তর। ব্যিখাত মুসলিম গণিতজ্ঞ ও দার্শনিক খাজা নাসিরুদ্দিন তুসি বলেন: ‘[জ্ঞানের দিক থেকে] তিনি ছিলেন এমন এক সদা প্রবহমাণ ঝরনাধারা, সকল প-িত তাঁদের জ্ঞানসূত্রকে তাঁর সাথেই যুক্ত করত।’ (তাজরিদ আল-ই’তিকাদ) তিনি সেই বিশাল জ্ঞানভা-ার থেকে কিছু প্রজ্ঞা জ্ঞান মানুষদের প্রাত্যহিক জীবনের সাথে সংশ্লিষ্ট থাকায় এবং উপকারী হওয়ায় এবং তাদের বোধগম্যতার সাধ্যের মধ্যে থাকায় প্রকাশ করেছিলেন। আর কিছু গোপন রেখে যান, যাতে সত্যান্বেষী যোগ্যতাসম্পন্ন লোকেরা সেগুলো খুঁজে পায়।
‘নাহজুল বালাগা’র ২২১ নং খুতবাটি শুরু হয় এই বাক্যটি দিয়ে : یَا لَهُ مَرَاماً مَا أَبْعَدَهُ، وَ زَوْراً مَا أَغْفَلَهُ، وَ خَطَراً مَا أَفْظَعَهُ : ‘হায়! গন্তব্য কতই না দূর! অথচ পথিকরা কতই না বে-খবর! আর কাজ কতই না দুষ্কর!’ আর খুতবার শেষাংশে বলেন : وَ إِنَّ لِلْمَوْتِ لَغَمَرَاتٍ هِيَ أَفْظَعُ مِنْ أَنْ تُسْتَغْرَقَ بِصِفَةٍ أَوْ تَعْتَدِلَ عَلَى عُقُولِ أَهْلِ الدُّنْيَا. :নিশ্চয় মৃত্যুতে রয়েছে অনেক বিষম যন্ত্রণা, যা বলে বুঝাবার নয় কিংবা দুনিয়াবাসীর আক্ল দ্বারা তা পরিমাপযোগ্য নয়।’
আসলে প-িত ও বিজ্ঞানীরা মৃত্যুর স্বরূপ ব্যাখ্যা করার সক্ষমতা রাখেন না। হযরত আলী (কা.) আলোচ্য খুতবার মধ্যে একটি বাক্যে মৃত ব্যক্তিদের সম্পর্কে বলেন: لَا يَتَعَارَفُونَ لِلَيْلٍ صَبَاحاً وَ لَا لِنَهَارٍ مَسَاءً أَيُّ الْجَدِيدَيْنِ ظَعَنُوا فِيهِ كَانَ عَلَيْهِمْ سَرْمَداً : ‘.. এরা এক জায়গায় সমবেত হয়েছে বটে কিন্তু নিঃসঙ্গ। একে অপরের বন্ধু বটে কিন্তু পরস্পর থেকে দূরে। এরা রাতের জন্য কোনো ভোর চেনে না, তদ্রƒপ দিনের জন্যও চেনে না কোনো সন্ধ্যা। এরা দিনের বেলায় মৃত্যুর সফরে গিয়ে থাকুক আর রাতের বেলায়ই গিয়ে থাকুক এ সফরই তাদের চিরন্তন যাত্রা।’
এই বাক্যটি ‘নাহজুল বালাগা’র মধ্যে সবচেয়ে ব্রিলিয়ান্ট (প্রজ্ঞাদীপ্ত) বাক্য হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে এবং যাঁরা ‘নাহজুল বালাগা’র শরাহ তথা ব্যাখ্যা করে থাকেন তাঁরা এই ব্যাক্যটির ব্যাখ্যা করার অনেক প্রয়াস চালিয়েছেন। কিন্তু হযরত আলী (আ.)-এর কথার মর্মার্থ উদ্ধার করা কঠিন। ইবনে আবিল হাদিদ মু’তাযেলি এই বাক্যটির ব্যাখ্যায় বলেন: এই খুতবাটি অদ্ভুত গভীরতাসম্পন্ন এবং বিশুদ্ধ, আলঙ্কারিক ও উন্নত শব্দামালায় গাঁথা। কেউ যদি ‘নাহজুল বালাগা’র এই চ্যাপ্টারটি পর্যালোচনা করে তাহলে অনুধাবন করবে যে এই যে মুয়াবিয়া বলেছেন ‘কুরাইশের জন্য যিনি ফাসাহাত তথা ভাষার বিশুদ্ধতার ভিত্তি স্থাপন করেছেন তিনি আলী ব্যতীত আর কেউ নন’Ñ তিনি ঠিকই বলেছেন। যদি আরবের সমস্ত বিশুদ্ধভাষী প-িত এক জায়গায় সমবেত হন আর এই খুতবাটি তাঁদের সামনে পাঠ করা হয় তাহলে সকলের উচিত হবে এই খুতবার সামনে সিজদা করা! ঠিক যেমনটা কবিগণ আদি ইবনে রুকা’র সামনে সিজদা করেছিলেন। যখন কেউ কেউ একাজের জন্য আপত্তি তুলেছিল তখন তাঁরা বলেছিলেন : ‘আমরা কবিতার মধ্যে সিজদার জায়গা কোথায় তা জানি। যেমনভাবে তোমরা কোরআনের মধ্যে সিজদার জায়গাগুলো কোথায় তা জানো।’ (লোকমান : ৩৩)
অর্থাৎ ইবনে আবিল হাদিদ দাবি করেন, কোরআনের কতক সূরার মধ্যে এমন কিছু আয়াত রয়েছে যেগুলো পাঠ করলে সিজদায় যেতে হয়, আলী ইবনে আবি তালিবের খুতবাগুলোর মধ্যেও এমন কিছু কথা রয়েছে যেগুলোর বলিষ্ঠতা, বিশুদ্ধতা, আলঙ্কারিত্ব ও অর্থের নিগুঢ়তার কারণে ভাষার ফাসাহাত সমঝদারদের সেগুলোর সামনে সিজদা করা উচিত!
এই বিষয়টি যখন আল্লামা তাবাতাবাঈ (রহ.) এর কাছে উত্থাপন করা হয় যে ইবনে আবিল হাদিদ কীভাবে এত বড় একটা দাবি করতে পারলেন, তখন উস্তাদ আল্লামা বলেন: ইবনে আবিল হাদিদ অবান্তর কিছুই বলেননি। কারণ, সিজদা হচ্ছে আল্ল্হার কালামের জন্য। সেই একই সারমর্ম হযরত আলী (আ.)-এর খুতবার আদলে নিঃসৃত হয়েছে। সিজদা প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর কালামের জন্যই, তাঁর সৃষ্টির কালামের জন্য নয়।
ইবনে আবিল হাদিদ অতঃপর বলেন : ‘সেই মহান সত্তার কসম করে বলছি যার নামে গোটা উম্মত কসম করে থাকে, আমি এই খুতবাটি বিগত পঞ্চাশ বছরে এক হাজারেরও বেশি বার পাঠ করেছি এবং প্রত্যেকবার যখন পাঠ করতাম আমার কাছে নতুন মনে হতো। নতুন কোনো কথা এবং নতুন কোনো উপদেশ আমার কলবের মধ্যে জেগে উঠত।’ (নাহজুল বালাগা, খুতবা ২৩০)
ইসলামের মহান মনীষি ও দার্শনিক ইবনে সিনা মি’রাজ এর উপরে একটি গবেষণাপত্র রচনা করেন যা ‘রিসালাতুল মি’রাজিয়্যা’ নামে পরিচিত। সেখানে তিনি রাসূলূল্লাহ (সা.)-এর একটি হাদিস বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেন : সাহাবিদের মধ্যে হযরত আলী (আ.)-এর স্থান ছিল ইন্দ্রিয়সমূহের মাঝে আক্্লের ন্যায় کَالْمعقول بِیْن المحْسوس । রাসূলুল্লাহ (সা.) হযরত আলী (আ.)-কে বলেন : یا على إذا تَقرّب الناس إلی الله بأنواعِ البِرّ، تقرّب إلیه أنت بِالعقل، تَسبقهم : ‘হে আলী! লোকেরা যখন নানা পুণ্যকর্মের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অন্বেষণ করে তুমি তখন আক্লের মাধ্যমে তাঁর নৈকট্য অন্বেষণ করো। তাহলে তুমি তাদের আগে পৌঁছে যাবে।’
ইবনে সিনা’র এই বক্তব্যের ব্যাখ্যাকাররা বলেছেন : সাহাবিদের মাঝে আলী (আ.) ছিলেন আক্ল, আর অন্যরা ইন্দ্রিয়সম। ইন্দ্রিয়সমূহ আকলের মুখাপেক্ষী, আর আক্্ল সেগুলোর পরিচালক ও নির্দেশক। আলী হলেন সাহাবিদের মধ্যে সেই পথনির্দেশক আর সাহাবিগণ তাঁর প্রতি মুখাপেক্ষী। (দ্র. হাশিয়া-ই শিফা)
গ্রন্থসূত্র:
১. নাহজুল বালাগা, সাইয়্যেদ রাজি সংকলিত এবং ইবনে আবিল হাদিদ মু’তাযেলি কর্তৃক শরাহকৃত।
২. আল-ফুতুহাতুল মাক্কিয়্য, রিসালাতুল কুদ্স, মহিউদ্দিন ইবনে আরাবি।
৩. তাযকিরাতুল খাওয়াস, সিবত ইবনে জওযি।
৪. আল-ইমাম আলী ইবনে আবি তালিব (আ.), আবদুল ফাত্তাহ আবদুল মাকসুদ।
৫. ঞযব ঠড়রপব ড়ভ ঐঁসধহ ঔঁংঃরপব নু এবড়ৎমব ঔড়ৎফধপ
৬. মাতালিব আল-সাউল, মুহাম্মদ ইবনে তালহা আল-শাফেয়ী।
৭. তাজরিদ আল-ই‘তিকাদ, খাজা নাসিরুদ্দিন তুসি।
৮. আল শিফা (হাশিয়া), ইবনে সিনা।