মার্কিন দূতাবাস দখলের ঘটনার মধ্যদিয়ে আমেরিকার প্রকৃত চেহারা উন্মোচিত হয়েছে: আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী
পোস্ট হয়েছে: নভেম্বর ৪, ২০২৫
  
		  	ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী বলেছেন, তেহরানে মার্কিন দূতাবাস দখলের ঘটনা মার্কিন সরকারের প্রকৃত চেহারা ও পরিচিতি সবার সামনে স্পষ্ট করে দিয়েছে।

তিনি বলেন, আমেরিকানরা মাঝে মধ্যেই ইরানের সঙ্গে সহযোগিতার ইচ্ছা প্রকাশের করছে। কিন্তু ইরানের সঙ্গে সহযোগিতা করার একই সময়ে অভিশপ্ত ইহুদিবাদী ইসরায়েলকে সহায়তা করা- এ দুটি বিষয় কখনও একসঙ্গে চলতে পারে না।
বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী দিবসকে সামনে রেখে আজ (সোমবার) সকালে ইরানের হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে তিনি এ কথা বলেন। এ সময় দখলদার ইসরায়েলের সঙ্গে ইরানের ১২ দিনের যুদ্ধে শাহাদাৎবরণকারীদের পরিবারের সদস্যরাও উপস্থিত ছিলেন।

আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী আরও বলেন, গোটা বিশ্বের জনমত যেখানে ইহুদিবাদী ইসরায়েলকে কলঙ্কিত ও দোষী হিসেবে সাব্যস্ত করেছে, সেখানে ঐ অভিশপ্ত দখলদারদের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের অব্যাহত সমর্থন, সহায়তা ও পৃষ্ঠপোষকতা ইরানের সঙ্গে সহযোগিতার মার্কিন দাবিকে অর্থহীন ও অগ্রহণযোগ্য করে তুলেছে।
তিনি বলেন, “যদি আমেরিকা ইহুদিবাদী ইসরায়েলকে পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া থেকে পুরোপুরি সরে আসে, সামরিক ঘাঁটিগুলো এই অঞ্চল থেকে সরিয়ে নেয় এবং এই অঞ্চলের বিষয়ে হস্তক্ষেপ বন্ধ করে, তাহলে বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে, তবে এটি এখনকার বা অদূর ভবিষ্যতেরও বিষয় নয়।”

তিনি তার বক্তব্যে যুক্তরাষ্ট্রের ইরান-বিরোধী শত্রুতার ইতিহাস এবং ১৯৭৯ সালের ৪ নভেম্বরে (ফার্সি ১৩ আবান ১৩৫৮) মার্কিন গুপ্তচরবৃত্তির ঘাঁটি দখলের ঘটনাকে বিশ্লেষণ করে বলেন, আমেরিকান দূতাবাস দখলের ঘটনাটি দু’টি দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়- একটি ঐতিহাসিক এবং অন্যটি পরিচয়গত।”
ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী বলেন, ১৯৭৯ সালের ৪ নভেম্বরে তরুণ শিক্ষার্থীরা যে সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছে তাতে দিনটি ইরানি জাতির জন্য গৌরব ও বিজয়ের দিন হয়ে উঠেছে। ইরানের ইতিহাসে যেমন বিজয়ের দিন আছে, তেমনি দুর্বলতা ও পতনের দিনও আছে-উভয়ই জাতীয় স্মৃতিতে সংরক্ষিত থাকা উচিত।”
পরিচয়গত দিকটি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, “মার্কিন দূতাবাস দখলের ঘটনাটি একদিকে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের প্রকৃত চরিত্র, অন্যদিকে ইসলামী বিপ্লবের প্রকৃত পরিচয় ও মর্মকে স্পষ্ট করে দিয়েছে।”

তিনি আত্মম্ভরিতা শব্দটির কুরআনিক শিকড়ের দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, “কখনও কখনও কোনো কোনো রাষ্ট্র যেমন অতীতে ব্রিটেন বা বর্তমানে আমেরিকা-নিজেকে এতটাই বড় ভাবতে শুরু করে যে, অন্য জাতির গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থে হস্তক্ষেপ করে তাদের ভাগ্য নির্ধারণের অধিকার দাবি করে ফেলে, কোনো দেশ দুর্বল হলে বা জনগণ সচেতন না থাকলে তারা সেখানে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করে বসে, তাদের তেল ও সম্পদ লুট করে নেয়। এই শ্রেষ্ঠত্ববাদের বিরুদ্ধেই আমরা অবস্থান নিয়েছি এবং এর বিরুদ্ধেই আমরা স্লোগান দিয়ে থাকি।”
সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী ব্রিটেন ও তার মিত্রদের ষড়যন্ত্রের প্রসঙ্গ টেনে স্মরণ করিয়ে দেন, কীভাবে তারা প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মোসাদ্দেকের সরকারকে উৎখাতের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল। তিনি বলেন, মোসাদ্দেকের সরলতা ও অসাবধানতা ছিল, তিনি ব্রিটেনের হাত থেকে রক্ষা পেতে আমেরিকার সাহায্য চেয়েছিলেন। কিন্তু আমেরিকানরা মোসাদ্দেকের প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ হাসি দেখালেও, পর্দার আড়ালে ব্রিটিশদের সঙ্গে মিলে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটায়, জাতীয় সরকারকে উচ্ছেদ করে এবং পতালক শাহ (রাজা)-কে আবার ইরানে ফিরিয়ে আনে।

আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী বলেন, ইসলামী বিপ্লবের সঙ্গে আমেরিকার প্রথম সরাসরি সংঘাত শুরু হয় আমেরিকার সিনেটের এক বৈরী প্রস্তাবের মাধ্যমে। এরপর তিনি আরও বলেন, যখন মোহাম্মদ রেজা শাহকে যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় দেওয়া হয়, তখন তা ইরানিদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ সৃষ্টি করে। জনগণ অনুভব করে যে, আমেরিকানরা আবারও ফার্সি ২৮ মোরদাদের (১৯৫৩ সালের) সামরিক অভ্যুত্থানের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে চায় এবং শাহকে পুনরায় ইরানে ফিরিয়ে আনার পথ প্রস্তুত করছে। ফলে জনগণ রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করে, যার একটি অংশে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণেই আমেরিকান দূতাবাস দখলের ঘটনা ঘটে।
তিনি বলেন, দূতাবাসে শিক্ষার্থীদের দুই-তিন দিন অবস্থানের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল ইরানি জনগণের ক্ষোভ বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরা। কিন্তু তারা দূতাবাসে এমন নথি পায় যা থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, ঘটনাটি তাদের ধারণার চেয়েও গভীরে প্রোথিত এবং যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস ছিল ইসলামী বিপ্লব ধ্বংসের ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনার কেন্দ্র।
সর্বোচ্চ নেতা ইমাম খামেনেয়ী বলেন, সাধারণত দূতাবাসের কাজ তথ্য সংগ্রহে সীমাবদ্ধ থাকে, কিন্তু আমেরিকান দূতাবাসে ‘ষড়যন্ত্র কক্ষ’ স্থাপন করা হয়েছিল, যেখানে পতিত শাহ সরকারের অবশিষ্ট অংশ, সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য ও অন্যদের একত্রিত করে বিপ্লববিরোধী কার্যক্রম সংগঠনের পরিকল্পনা হচ্ছিল। শিক্ষার্থীরা এটি বুঝে যাওয়ার পরই দূতাবাস দখল বজায় রাখার সিদ্ধান্ত নেয়।

তিনি বলেন, দূতাবাস দখলের ঘটনা থেকেই ইরান ও আমেরিকার মধ্যে সমস্যার সূচনা হয়েছে বলে যারা ব্যাখ্যা করেন তাদের বক্তব্য সঠিক নয়। প্রকৃতপক্ষে সমস্যা শুরু হয়েছিল ১৯৫৩ সালের (ফার্সি ২৮ মোরদাদ) সামরিক অভ্যুত্থানের সময়, ১৯৭৯ সালের ৪ নভেম্বর নয়। তবে দূতাবাস দখল ঘটনার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা এক বিশাল ষড়যন্ত্র উন্মোচন করতে সক্ষম হয় এবং সংগৃহীত নথির মাধ্যমে ইসলামী বিপ্লবের বিরুদ্ধে বিপদের প্রকৃত চেহারা প্রকাশ পায়।
আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী বলেন, আমেরিকার শত্রুতা ও নানা ধরনের ষড়যন্ত্রের মূল কারণ হলো- ইসলামী বিপ্লবের মাধ্যমে ইরানের সম্পদ ও প্রভাবের ওপর থেকে আমেরিকার নিয়ন্ত্রণ হারানো। তিনি আরও বলেন, তারা এত সহজে ইরানের ওপর আধিপত্য ছেড়ে দিতে প্রস্তুত ছিল না, তাই বিপ্লবের শুরু থেকেই শুধু ইসলামী প্রজাতন্ত্র নয়, বরং গোটা ইরান জাতির বিরুদ্ধেই উস্কানি ও ষড়যন্ত্র শুরু করে।

তিনি আরও বলেন, ইসলামী বিপ্লবের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ধারাবাহিক শত্রুতা ও বিদ্বেষই ইমাম খোমেনী (রহ.)’র সেই বাণীর যথার্থতা প্রমাণ করে। তিনি বলেছেন, যত পারো আমেরিকার বিরুদ্ধে ক্ষোভ ঝাড়ো।
এই প্রসঙ্গে আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী আরও বলেন, আমেরিকার শত্রুতা শুধু কথায় সীমাবদ্ধ ছিল না। তারা যতভাবে পেরেছে, তা বাস্তবায়ন করেছে — নিষেধাজ্ঞা, ষড়যন্ত্র, ইসলামী প্রজাতন্ত্রের শত্রুদের সহায়তা, সাদ্দাম হোসেনকে উসকানি ও সহায়তা দিয়ে ইরানের ওপর আক্রমণ চালানো, ৩০০ যাত্রীসহ ইরানি যাত্রীবাহী বিমান ভূপাতিত করা, প্রচারযুদ্ধ এবং সরাসরি সামরিক হামলা- এর সবই করেছে। কারণ, আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী প্রকৃতি ইসলামী বিপ্লবের স্বাধীনচেতা স্বভাবের সঙ্গে কখনও সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তাই যুক্তরাষ্ট্র ও ইসলামী প্রজাতন্ত্রের মধ্যে বিরোধ কৌশলগত বা সাময়িক নয়, বরং মৌলিক ও স্বভাবগত।
তিনি তাদেরও সমালোচনা করেন যারা মনে করেন “আমরা যদি ‘আমেরিকা নিপাত যাক’ স্লোগান না দিতাম, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র আমাদের প্রতি এত বৈরিতা দেখাত না।” আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী বলেন, এ ধরনের বক্তব্য ইতিহাস বিকৃত করার নামান্তর। আমেরিকা ইরানের বিরুদ্ধে যে শত্রুতা দেখায়, তার কারণ কোনো স্লোগান নয়; বরং আমেরিকার মূল সমস্যা ইসলামী প্রজাতন্ত্রের সঙ্গে মৌলিক দ্বন্দ্ব ও স্বার্থের সংঘাত।
তিনি আরও বলেন, কেউ কেউ প্রশ্ন করে- আমরা আমেরিকার কাছে আত্মসমর্পণ করি নি, কিন্তু আমরা কি আর কখনোই তাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখব না? আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী বলেন, আমেরিকার দাম্ভিক প্রকৃতি ও চরিত্র আত্মসমর্পণ ছাড়া কিছুই মেনে নেয় না। এই প্রত্যাশা যুক্তরাষ্ট্রের সব প্রেসিডেন্টের মধ্যেই ছিল, যদিও তারা তা প্রকাশ্যে বলত না। কিন্তু বর্তমান প্রেসিডেন্ট তা মুখে বলে দিয়েছে এবং এর মধ্য দিয়েই আমেরিকার আসল চরিত্র প্রকাশ পেয়েছে।

তিনি আরও বলেন- এত ক্ষমতাশালী, সম্পদশালী, জ্ঞান ও চেতনায় সমৃদ্ধ, সচেতন ও উদ্যমী তরুণসমৃদ্ধ ইরানি জাতির কাছ থেকে আত্মসমর্পণের প্রত্যাশা একেবারেই অর্থহীন। দূরবর্তী ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কিছু বলা না গেলেও, বর্তমান পরিস্থিতিতে সবার জানা উচিৎ- আমাদের বহু সমস্যার সমাধান নিহিত আছে শক্তিশালী হওয়ার মধ্যেই।
ইসলামী বিপ্লবের নেতা হজরত ফাতিমা (সা.) ও হজরত জয়নব (সা.)-এর নাম স্মরণ করে তরুণদের উদ্দেশে বলেন, এই দুই উজ্জ্বল আদর্শের বাস্তব অনুসারী হও এবং তোমাদের চারপাশের মানুষদেরও তাদের জীবনযাপন পদ্ধতি থেকে শিক্ষা নিতে উৎসাহিত করো।#
পার্সটুডে