বিলুপ্তির পথে সুন্দরী হাঁস
পোস্ট হয়েছে: ডিসেম্বর ৩, ২০২৫
সুন্দরবনের কচিখালীর কাছে ছিটা কটকা খালে পুরুষ সুন্দরী হাঁসছবি : লেখক
সুন্দরবনের প্রধান আকর্ষণ মহাবিপন্ন বেঙ্গল টাইগার। কিন্তু বর্তমানে এর থেকেও বিলুপ্তপ্রায় হয়ে পড়েছে আরেকটি প্রাণী (পাখি)। কয়েক বছর আগেও বিশ্বব্যাপী মহাবিপন্ন পাখিটির সংখ্যা ছিল ৬০০ থেকে ১ হাজার ৭০০। কিন্তু বর্তমানে ১০৮ থেকে ৩০৪টিতে এসে ঠেকেছে, যার ৮০ থেকে ১৬০টিই আমাদের সুন্দরবনের বাসিন্দা। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, এই পাখি যদি সুন্দরবন থেকে হারিয়ে যায়, তাহলে পৃথিবী থেকেই হারিয়ে যাবে। কারণ, বাংলাদেশ ছাড়াও আরও যে দুটি দেশে ওরা নিশ্চিতভাবে বেঁচে আছে, তার মধ্যে কম্বোডিয়ায় ১২ থেকে ৬০টি ও মিয়ানমারে ১২ থেকে ৪০টি পাখি রয়েছে। যদিও ইদানীং সহজে চোখে পড়ছে না।
২৯ বছর ধরে সুন্দরবনে ঘুরলেও গোলবনের রহস্যময় মহাবিপন্ন পাখিটিকে খুঁজছি ২০১৪ সাল থেকে। কিন্তু ২০১৮ সালের ২৭ জানুয়ারির আগে ওকে খুঁজে পাইনি। সেদিন বাঘের বৈঠকখানাখ্যাত কচিখালী থেকে সকাল ১০টায় ‘বাঘের বাড়ি’খ্যাত কটকা রওনা হলাম। অভিজ্ঞ সারেং সগির ও মাঝি গাউসের পরামর্শে বড় কটকা খাল দিয়ে না গিয়ে ছিটা কটকা নামের ছোট খাল দিয়ে এগোতে থাকলাম। এই খালেই কয়েক বছর ধরে ওকে দেখা যাচ্ছে।
তখন ভাটা চলছিল। ক্যামেরা হাতে আমরা সাতজন টান টান দাঁড়িয়ে। খালের দুই পাশে গোলগাছের সারি, দৃষ্টি সবার গোলবনের পলিময় কাদার দিকে। কিন্তু ভারী ক্যামেরা তাক করে কতক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায়? পরিশ্রান্ত সবাই কিছুক্ষণের জন্য ক্যামেরা নামালেন। তবে আমার দৃষ্টি গোলবনের কাদা থেকে সরল না। কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্যামেরার ভিউ ফাইন্ডারে হাঁসের মতো কিন্তু অদ্ভুত এক পাখির চেহারা ভেসে উঠল। মন্ত্রমুগ্ধের মতো একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম। আর আমার আঙুল অজান্তেই শাটারে ক্লিক করে গেল। হঠাৎ বলে উঠলাম হাঁসপাখি! হাঁসপাখি!! পাখিটি দ্রুত গোলবনের কাদাময় পাড় থেকে পানিতে নেমে গেল। আমি এবং আরেকজন ছাড়া কেউ ওর ছবি তুলতে পারল না।
খানিক পর আরও দুটির দেখা পেলাম। পরদিন ভোরে কটকার কাছে সুন্দরী (হোমরা) খালে আরও চারটিকে দেখলাম। একযাত্রায় সাতটি হাঁসপাখির দেখা পাওয়া মহাভাগ্যের ব্যাপার। কিন্তু এরপর যতবার সুন্দরবনে গেছি, পলিমাটিতে পায়ের ছাপ দেখলেও পাখি দেখিনি। তিন বছর ধরে পায়ের ছাপও দেখছি না।
বাঘের থেকেও গুরুত্বপূর্ণ সুন্দরবনের এই হাঁসপাখি কে? এ দেশের এক অতিবিরল ও মহাবিপন্ন পাখি সুন্দরী, গেইলো বা বাইলা হাঁস। জেলে-বাওয়ালি-মৌয়ালদের কাছে এ নামেই পরিচিত। তবে নামে হাঁসপাখি হলেও আদতে হাঁসের ধারেকাছের পাখিও নয় এটি; বরং জলমুরগি, অর্থাৎ ডাহুক-কোড়াদের নিকটাত্মীয়। ইংরেজি নাম মাস্কড/এশিয়ান ফিনফুট। গোত্র Helornithidae, বৈজ্ঞানিক নাম Heliopais personata। অতিলাজুক পাখিটিকে একসময় বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, মিয়ানমার, লাওস, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও ইন্দোনেশিয়ায় দেখা গেলেও বর্তমানে শুধু বাংলাদেশ, কম্বোডিয়া ও মিয়ানমারে দেখা যায়।
সুন্দরবনের খালপাড়ে জেলেদের পাতা চরপাটা জালছবি : ফরিদী নুমান
যদিও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই পাখি কমে যাওয়ার মূল কারণ আবাস এলাকা ধ্বংস, সুন্দরবনের নদী-খালে জলযান চলাচল বৃদ্ধি, মাছ ধরায় বিষের ব্যবহার, জলবায়ু পরিবর্তন ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ডিম-ছানা চুরি, শিকার ইত্যাদি। কিন্তু কঠিন বাস্তবতা ও অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায়, সুন্দরবনের আপাত–অসহায়, গরিব ও নিরীহ জেলেদের চরপাটা জালের অত্যাচারই প্রধানত দায়ী।
পাখিটি ভাটার সময় অল্প পানিতে সাঁতার কেটে বা কাদায় হেঁটে চিংড়ি, ছোট মাছ, কাঁকড়া, শামুক, কীটপতঙ্গ ইত্যাদি খায়। এ সময় জেলেরা ব্যস্ত থাকেন চরপাটা জাল পাততে। এরপর জোয়ারে জালে যে মাছ আটকায়, পরের ভাটাতে জেলেরা সে মাছ তুলে নেন। পরের ভাটাতেও হাঁসপাখি খালের পাড়ে নামতে পারে না, ফলে খাবার খেতে পারে না। অনেক সময় বোকা পাখিগুলো জালে আটকা পড়ে জেলেদের পেটে যায়। এভাবে দিনের পর দিন জেলেদের অত্যাচারে শেষ পর্যন্ত পাখিটি আবাস এলাকা ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যায়। সেখানেও একই অবস্থার পুনরাবৃত্তি ঘটে। এভাবে জামতলী, হাড়বাড়িয়া ও ছিটা কটকা খাল থেকে ওরা হারিয়ে গেছে।
বর্তমানে সুন্দরবনে বাঘ রক্ষার জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ হলেও সুন্দরী হাঁস রক্ষায় বন বিভাগের কোনো বরাদ্দ আছে কি না তা জানা নেই। তবে দ্রুত জোরালো পদক্ষেপ না নিলে গোলাপি শিরের মতো এরাও দ্রুতই পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাবে। এদের বিলুপ্তি ঠেকাতে প্রয়োজন সুন্দরী হাঁসের সম্ভাব্য আবাস এলাকায় জেলেদের চরপাটা জাল পাতা বন্ধ ও নিয়মিত তদারকি করা।
- আ ন ম আমিনুর রহমান, পাখি ও বন্য প্রাণী প্রজনন ও চিকিৎসাবিশেষজ্ঞ, গাজীপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়