সোমবার, ৯ই জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ২৬শে জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

English

ফার্সি ১৫ খোরদাদের মহাকাব্যিক গণঅভ্যুত্থান এবং ইরানী জনগণের ইসলামী বিপ্লবের বিজয়

পোস্ট হয়েছে: জুন ৯, ২০২৫ 

news-image

পাহলভি শাসনের বিরুদ্ধে ইরানী জনগণের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের মূলে ছিল বিদেশীদের উপর নির্ভরশীল ওই তাবেদারি সরকারের নিপীড়ন আর দুর্নীতি। ইরানী জনগণ ঈমান, ঐক্য এবং দৃঢ় ইচ্ছাশক্তির উপর নির্ভর করে, পাহলভি শাসন ব্যবস্থাকে উৎখাত করে।

১৩৪২ থেকে ১৩৫৭ হিজরী সময়কাল ইরানী জনগণের সংগ্রামের ইতিহাসে একটি উজ্জ্বল অধ্যায়, যা ইমাম খোমেনী (রহ.)-এর বিজ্ঞ নেতৃত্ব এবং জনগণের ত্যাগ ও নিষ্ঠার ফলস্বরূপ ফার্সি ১৩৫৭ সালের ২২ বাহমান ইসলামী বিপ্লবের গৌরবময় বিজয় অর্জন সম্ভব হয়। আজকের এ সংক্রান্ত আলোচনায় পাহলভি শাসনের বিরুদ্ধে ইরানী জনগণের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের নানা দিক তুলে ধরার চেষ্টা করবো।

জনপ্রিয় বিদ্রোহের পটভূমি

পশ্চিমা শক্তির উপর, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল পাহলভি শাসনব্যবস্থা ১৯৬৩ সালে “শ্বেত বিপ্লব” এর মতো কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে জনগণকে প্রতারিত করার এবং তাদের আধিপত্য সুসংহত করার চেষ্টা করেছিল। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য যে ভূমি সংস্কারের কথা বলা হয়েছিল, তা আসলে কৃষিকাজের ধ্বংস এবং গ্রামীণ জনগণের শহরে ব্যাপক অভিবাসনের দিকে পরিচালিত করেছিল। এটা এমন সময়ের কথা যখন পাহলভি রাজদরবার দুর্নীতি ও বিলাসিতায় নিমজ্জিত ছিল এবং ১৯৭৪ সালে ২০০০ কোটি ডলারে পৌঁছানো বিশাল তেল রাজস্ব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে অস্ত্র কেনা এবং রাজতন্ত্রের ২,৫০০ তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উদযাপনের মতো প্রদর্শনীমূলক প্রকল্পে ব্যয় করা হয়েছিল। ঠিক একই সময়ে, সিআইএ-এর সহায়তায় প্রতিষ্ঠিত ভয়ঙ্কর সাভাক বাহিনী মুক্তিকামী ইরানি জনগণকে গ্রেপ্তার, নির্যাতন এবং নির্বাসন দিচ্ছিল। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের (১৯৭৬) একটি প্রতিবেদন অনুসারে, বিপ্লবের উত্তাল দিনগুলোতে ইরানে রাজনৈতিক কারণে ৫০,০০০ এরও বেশি মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল এবং শত শত মানুষকে কারাগারে হত্যা করা হয়েছিল। এই নৃশংসতা পাহলভি সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য ইরানি জনগণের সংকল্পকে আরও শক্তিশালী করেছিল।

ফার্সি ১৩৪২ সালের ১৫ খোরদাদের বিদ্রোহ ছিল বিপ্লবের স্ফুলিঙ্গ

এই মহান আন্দোলনের সূচনা বিন্দু ছিল (ফার্সি ১৩৪২ সালের ১৫ খোরদাদ) অর্থাৎ, ১৯৬৩ সালের ৫ জুনের বিদ্রোহ। ইসলামী বিপ্লবের মহান নেতা ইমাম খোমেনী (রহ.) ১৯৬৩ সালের ৩ জুন কোমের ফয়জিয়াহ মাদ্রাসায় এক ঐতিহাসিক ভাষণে সাহসিকতার সাথে পাহলভি সরকারের বিশ্বাসঘাতকতা উন্মোচন করেন এবং ইসরাইলি শাসনের উপর নির্ভরশীলতা এই সরকারের দুর্নীতি এবং জনগণের উপর দমন-পীড়নের সমালোচনা করেন। ইমাম খোমেনির ওই ভাষণের ব্যাপক প্রভাবে ভীত হয়ে পাহলভি সরকার, ১৫ খোরদাদ অর্থাৎ ৫ জুন ইমামকে গ্রেপ্তার করে। সরকারের এই পদক্ষেপে পুরো জাতি ক্ষোভে ফুঁসে উঠে এবং তেহরান, কোম, শিরাজ এবং ভারামিনে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়। পাহলভি সরকারের বাহিনী জনগণের উপর নির্মম দমন পীড়ন চালায় এবং ঐতিহাসিক দলিল অনুসারে ১,০০০ জনেরও বেশি মানুষ শহীদ হন। ৫ জুনের বিদ্রোহ, যাকে ইমাম খোমেনী (রহ.) “ইসলামী আন্দোলনের সূচনা” বলে অভিহিত করেছিলেন, বিপ্লবের ভিত্তিকে আরও শক্তিশালী করে।

ফার্সি ১৩৪২ (১৯৬৩ )সালের পরের বছরগুলোতে, ইসলামী আন্দোলনের প্রসার

ফার্সি ১৩৪২ (১৯৬৩ )সালের পরের বছরগুলোতে, ইমাম খোমেনী (রহ.)-এর নেতৃত্বে ইসলামী আন্দোলন প্রসারিত হয়। ধর্মীয় ও বিপ্লবী গোষ্ঠীগুলি লিফলেট বিতরণ, ইমামের বক্তৃতা রেকর্ডিং এবং গোপন সভা করে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করে। পাহলভি সরকার ফার্সি ১৩৪৩ সালে তুরস্ক এবং তারপর ইরাকের নাজাফে ইমামকে নির্বাসনে পাঠিয়ে এই আন্দোলন দমন করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু নাজাফ থেকে পাঠানো তাঁর বার্তা লক্ষ লক্ষ ইরানির হৃদয়কে আলোড়িত করেছিল। সাইয়্যেদ হামিদ রুহানির “দ্য মুভমেন্ট অফ ইমাম খোমেনী” বইটি লিখেছেন যে এই সময়কালে, বিপ্লবী আলেম সমাজ এবং জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল এবং “স্বাধীনতা, ইসলামি বিপ্লব, ইসলামী প্রজাতন্ত্র” স্লোগানে সমগ্র ইরান প্রকম্পিত হয়ে উঠেছিল।

ফার্সি ১৩৫০ এর দশক জাতির মহাকাব্যের উত্থান

১৩৫০-এর দশকে, পাহলভি সরকারের প্রতি ইরানি জনগণের অসন্তোষ চরমে পৌঁছেছিল। জনগণের কল্যাণের পরিবর্তে, বিশাল তেল রাজস্ব রাজ দরবারের বিনোদন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে অস্ত্র কেনার জন্য ব্যয় করা হয়েছিল। বিশ্বব্যাংকের নথি অনুসারে (১৯৭৬ সালে), ইরানি জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ দারিদ্র্যসীমার নীচে ছিল, অন্যদিকে রাজতন্ত্রের ২,৫০০ বছর পূর্তি উদযাপনের ব্যয় ধরা হয়েছিল ১০ কোটি ডলারেরও বেশি (মার্কিন কংগ্রেসনাল ডকুমেন্টস, ১৯৭৬)। এই বৈষম্য জনসাধারণের ক্ষোভকে আরও বাড়িয়ে তোলে। ১৯৭৮ সালের ৭ জানুয়ারী পাহলভি সরকার এতেলাত পত্রিকায় ইমাম খোমেনী (রহ.)-এর বিরুদ্ধে একটি অবমাননাকর নিবন্ধ প্রকাশ করলে জনগণের ক্ষোভের আগুন বহুগুণে জ্বলে ওঠে। এরপর ৯ জানুয়ারী কোমের জনগণ রাস্তায় নেমে আসে এবং সরকার ২০ জনেরও বেশি মানুষকে হত্যা করে। এ ছাড়া তাবরিজ, ইয়াজদ এবং ইসফাহান শহরগুলোতে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে।

১৯৭৯ সাল; ইসলামী বিপ্লবের বিজয়

১৯৭৯ ছিল ইরানি জনগণের ঐক্য ও ঈমানের গৌরবময় বছর। ১০ আগস্ট আবাদানের রেক্স সিনেমা হলে অগ্নিকাণ্ড, যেখানে পরবর্তী নথিগুলোতে সাভাকের ভূমিকা থাকার বিষযটি নিশ্চিত হওয়া গেছে। এ ঘটনা ৪০০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছিল যার ফলে সরকারের প্রতি ঘৃণা আরও গভীর হয়। এরপর ফার্সি ১৭ শাহরিভার তেহরানের জলেহ স্কোয়ারে “ব্ল্যাক ফ্রাইডে” ঘটনা ঘটে এবং পাহলভি সরকারের বাহিনীর হাতে শত শত নিরীহ মানুষ শহীদ হন। এরপর তেল, শিক্ষা এবং প্রশাসন বিভাগে দেশব্যাপী ধর্মঘট সরকারকে পঙ্গু করে দেয়। তেল উৎপাদন প্রতিদিন ৬০ লক্ষ ব্যারেল থেকে কমে ১ লক্ষ ব্যারেলেরও কম হয় (OPEC রিপোর্ট, ১৯৭৮)। “স্বাধীনতা, বিপ্লব, ইসলামী প্রজাতন্ত্র” স্লোগান দিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের বিক্ষোভ পাহলভি শাসনের ভিত্তি কাঁপিয়ে দেয়। ১৯৭৯ সালের ১৬ জানুয়ারী মোহাম্মদ রেজা শাহের পলায়ন এবং ১৯৭৯ সালের ১ ফেব্রুয়ারী ইমাম খোমেনী (রহ.)-এর প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে শাহের সরকার বিরোধী ইসলামি বিপ্লবের উত্তর দিনগুলোর অবসান ঘটে এবং চূড়ান্তভাবে ইসলামি বিপ্লব সংঘটিত হয়। অবশেষে, ফার্সি ১৩৫৭ সালের ২২ বাহমান অর্থাৎ ইংরেজি ১৯৭৯ সালের ১১ ফেব্রুয়ারী ইমামের নেতৃত্বে এবং জাতির ত্যাগের মাধ্যমে ইসলামী বিপ্লব বিজয় অর্জন করে এবং ইরানে সাম্রাজ্যবাদী শাসনের পতন ঘটে।

পার্সটুডে/