মঙ্গলবার, ১৪ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ২৯শে আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

English

পাণ্ডুলিপি গবেষণা ও পাঠোদ্ধারে ফারসি বিভাগ

পোস্ট হয়েছে: অক্টোবর ১৪, ২০২৫ 

news-image

আমরা সবাই কমবেশি জানি যে ফারসি ভাষা প্রায় সাড়ে ছয়শত বছর (৬৩৩বছর) ভারতীয় উপমহাদেশের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে সর্বত্র প্রচলিত ছিল। ১২০৪ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৮৩৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এই দীর্ঘ সময় ফারসি রাষ্ট্রভাষা থাকার কারণে রাষ্ট্রের সকল দাপ্তরিক কাজকর্মে,দলিল-দস্তাবেজ লেখায় ও ঐ সময়ের বইপুস্তকও ফারসি ভাষায় লেখা হয়। ফলে আমাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ইতিহাস,ঐতিহ্য, সাহিত্য ও সংস্কৃতির নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি ফারসি ভাষায় লিপিবদ্ধ রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময় ফারসি ও উর্দু বিভাগ এক সাথে ছিল। পরবর্তীকালে ২০০৬ সালে ফারসি ও উর্দু বিভাগ আলাদা হয়ে যায়। আমার ধারণা ফারসি বিভাগ চালুর অন্যতম কারণ হচ্ছে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পাণ্ডুলিপির গুরুত্ব। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে থাকা হাতে লেখা পাণ্ডুলিপিগুলো তালপাতা,পশুর চামড়া ও কাগজের উপর লেখা। যদিও পাণ্ডুলিপি পাঠোদ্ধার খুবই দুরূহ ও ধৈর্যের কাজ তবুও সব সময়ে কিছু শিক্ষক ও গবেষক থাকেন যাদের কাছে প্রাচীন এই অমূল্য সম্পদগুলো নিয়ে কাজ করার বিষয়টা কৌতূহলের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। ১৯৯০ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি বিভাগের তিনজন ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক ফারসি পাণ্ডুলিপি বিষয়ে ইরান থেকে তাদের পিএইচডি ডিগ্রি সম্পন্ন করেছেন। ১৯৯৮ সালে ড. মো. শামীম খান বাংলাদেশের উর্দু-ফারসি কবি মাওলানা উবায়দুল্লাহ উবায়দি সুহরাওয়ার্দির ফারসি ভাষায় রচিত ‘দাস্তানে এবরাতে বার’ শীর্ষক পাণ্ডুলিপি সম্পাদনা ও টীকাভাষ্য সংযোজন সংক্রান্ত গবেষণার জন্য তেহরান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ২০০২ সালে ড. কে.এম সাইফুল ইসলাম খান তেহরান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘তাসহিহ ভা ভিরায়েশে দিওয়ানে আব্দুল করিম খাকী : শায়েরে বাঙ্গালা জাবান দার বাংলাদেশ’ এই শিরোনামে তার পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। পাণ্ডুলিপিটি বই আকারে এখনো প্রকাশিত হয়নি। তারপর ২০০৯ সালে মাশহাদের ফেরদৌসী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ড. মুহসিন উদ্দিন মিয়া ‘দিওয়ানে সিরাজ উদ্দিন ফরিদপুরী ভা পিরামুনে অন’ বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। পরবর্তীকালে যেটি ২০১৩ সালে ঢাকাস্থ ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র থেকে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। সর্বশেষ ২০১৯ সালে ড. মুমিত আল রশিদ ইরানের তারবিয়্যাত মোদাররেস (শিক্ষক প্রশিক্ষণ) বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘গুলদাস্তে গুলশান মানি গ্রন্থের ব্যাখা,বিশ্লেষণ ও শুদ্ধিকরণ’ বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। এটি এখনো গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের সাবেক ভিজিটিং প্রফেসর ড. মুহাম্মদ কাজেম কাহদূয়ি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের পাণ্ডুলিপি শাখা নিয়ে একটি গবেষণা প্রবন্ধ রচনা করেন যা ১৯৯৯ সালে ‘নামে পার্সি’ নামক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী মো: কামাল হোসেন খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে যেসব ফারসি পাণ্ডুলিপি রয়েছে সেসব পাণ্ডুলিপির উপর গবেষণা করে ২০১০ সালে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত ফারসি পাণ্ডুলিপির তথ্যানুসন্ধান’ শিরোনামে এম.ফিল ডিগ্রি অর্জন করেন।
ড. মুহসিন উদ্দিন মিয়া ২০১১ সালের ৩ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার কর্তৃক আয়োজিত সেমিনারে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংরক্ষিত ফারসি পাণ্ডুলিপি অনুসন্ধান’ শিরোনামে প্রবন্ধ পাঠ করেন।যা ২০১২ সাল প্রকাশিত হয়।
ড. মো. আবুল কালাম সরকারের ‘মোয়াররাফিয়ে নোসখেহায়ে খাততিয়ে কাসায়েদে উরফি শিরাজী দার কেতাবখানেয়ে মারকাযিয়ে দানেশগাহে দাকায়ে বাংলাদেশ ‘ শীর্ষক প্রবন্ধ ২০১৫ সালে ভারতের লখনৌ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি বিভাগ কর্তৃক আয়োজিত ‘যেন্দেগী ভা আসারে উরফী শিরাজী’ আন্তর্জাতিক সেমিনারের সুভেনিরে প্রকাশিত হয়। এরপর তিনি ২০১৮ সালের ২৪ থেকে ২৫ ফেব্রুয়ারি লাইফগেট হিউম্যান সোসাইটি লখনৌ, ইন্ডিয়া কর্তৃক আয়োজিত  ‘আমিরখসরু এ মাল্টিফেসেটেড ইন্ডিয়ান পার্সোনালিটি’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক সেমিনারে  ‘মোয়াররাফিয়ে নোসখেহায়ে খাততিয়ে ফারসিয়ে আমিরখসরু দার কিতাবখানেয়ে দানেশগাহে দাকা দার বাংলাদেশ ‘ বিষয়ে আরেকটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মো. আবুল হাসেম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত ফারসি পাণ্ডুলিপি নিয়ে ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি পাণ্ডুলিপির পরিচয়’ শীর্ষক গ্রন্থ রচনা করেন। ভূমিকা ও উপসংহারসহ সাতটি অধ্যায়ে বিন্যস্ত বইটি ‘বলাকা’ প্রকাশন থেকে ২০১৫ সালে প্রকাশিত হয়েছে।
সবচেয়ে আশার বিষয় হচ্ছে সম্প্রতি ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ও গবেষক ড. মো. আবুল কালাম সরকার ইরানের ইয়াযদ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের সাবেক ভিজিটিং প্রফেসর ড. মুহাম্মদ কাজেম কাহদূয়ি এর সহযোগিতায় চারটি পান্ডুলিপির সংশোধন ও পাঠোদ্ধার করেন। তাঁরা প্রথমে ‘দিওয়ানে উবায়দি’ নামে মাওলানা উবায়দুল্লাহ উবায়দি সুহরাওয়ার্দির পাণ্ডুলিপিটির পাঠোদ্ধার করেন, যেটি ২০২০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার থেকে প্রকাশিত হয়। এটি  স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ফারসি ভাষার কোনো পাণ্ডুলিপির গ্রন্থাকারে প্রথম প্রকাশ। এটি একটি ফারসি কাব্যগ্রন্থ। এরপর আবুল বারাকাত মুনির লাহোরির ‘মাসনাভি দার সিফাতে বাঙ্গালে’ পাণ্ডুলিপিটির পাঠোদ্ধার ও সম্পাদনা করেন- যা ২০২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার থেকে প্রকাশিত হয়। লেখক আবুল বারাকাত মুনির লাহোরি গ্রন্থটিতে বাংলাদেশের অপরূপ নৈসর্গিক সৌন্দর্যের চিত্র কাব্যের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন।
সৈয়দ মাহমুদ আযাদ রচিত ‘দিওয়ানে আযাদ’ শীর্ষক গ্রন্থটি একটি মূল্যবান সম্পদ। ঢাকায় জন্মগ্রহণ করা সৈয়দ মাহমুদ আযাদ কর্তৃক লেখা ফারসি কবিতার সমাবেশ রয়েছে গ্রন্থটিতে। ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের উদ্যোগে ফারসি ভাষায় রচিত কোনো পাণ্ডুলিপি গ্রন্থাকারে প্রকাশের এটি তৃতীয় উদ্যোগ।
‘তারিখে জাহাঙ্গির নগর ওরফে ঢাকা’ সৈয়দ আলি আল হোসাইনি আল কাযভিনি কর্তৃক বইটি রচিত। তিনি নওয়াব ইন্তেযাম-উদ-দৌলা নাসিরুল মুলক্ সৈয়দ আলি খানবাহাদুর নুসরত জঙ্গ নামে পরিচিত। পাণ্ডুলিপিটিতে ঢাকার প্রাচীন অজানা ইতিহাস ও ঐতিহ্য লিপিবদ্ধ রয়েছে। পাণ্ডুলিপিটিরও পাঠোদ্ধার, ভূমিকা, টীকাভাষ্য ও সম্পাদনা করেন ড. মো.আবুল কালাম সরকার। একাজে সহযোগিতা করেছেন ড. মুহাম্মদ কাজেম কাহদূয়ি। পাণ্ডুলিপিটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার থেকে প্রকাশিত হয়েছে।
এছাড়াও ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগগুলোতেও পাণ্ডুলিপি পঠন ও পাঠোদ্ধার বিষয়ক কোর্স পড়ানো হয়ে থাকে।
পরিশেষে, এই আশাবাদ ব্যক্ত করছি যে ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ আগামীতে আরও বেশি পাণ্ডুলিপি গবেষণা ও পাঠোদ্ধারের মাধ্যমে নতুন জ্ঞান সৃষ্টি ও ইতিহাস-ঐতিহ্য উদ্ঘাটনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে।

সুজন পারভেজ
শিক্ষার্থী,ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।