ঢাকায় ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত
পোস্ট হয়েছে: জুন ৩, ২০২৫

ইরানের ইসলামি বিপ্লবের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর ৩৬ তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আজ বিকেলে রাজধানীর জাতীয় জাদুঘরের কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ঢাকাস্থ ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের উদ্যোগে ‘ইমাম খোমেইনী (রহ.): ইসলামি দেশগুলো ও মুসলমানদের স্বাধীনতা ও মুক্তির রক্ষক’ শীর্ষক এই আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. এ বি এম ওবাইদুল ইসলাম। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকাস্থ ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত মানসুর চাভূশি।
অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মহাখালী দারুল উলুম হোসাইনিয়া কামিল মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল ড. মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম আল মারুফ ও খুলনার ইসলামী শিক্ষা কেন্দ্রের প্রিন্সিপাল হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলেমিন সাইয়্যেদ ইব্রাহিম খলিল রাজাভী। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ঢাকাস্থ ইরান দূতাবাসের কালচারাল কাউন্সেলর সাইয়্যেদ রেযা মীরমোহাম্মাদী।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. এ বি এম ওবাইদুল ইসলাম বলেন, আজ এমন এক মহান ব্যক্তিত্বকে স্মরণ করতে এখানে উপস্থিত হয়েছি যিনি বিশ্বের সমসাময়িক ইতিহাসে অসামান্য ভূমিকা পালন করেছেন এবং ইরানে ইসলামি বিপ্লব প্রতিষ্ঠা করে ইতিহাস সৃষ্টিকারীতে পরিণত হয়েছেন। এই মহান ব্যক্তিত্ব ও অনন্য রাজনৈতিক নেতা হলেন ইমাম খোমেইনী (রহ.)। শুধু ইরান নয়, বিশ্বের নানা প্রান্তের মুসলমান আর স্বাধীনতায় বিশ্বাসী মানুষ আজ গভীর শ্রদ্ধায় তাঁকে স্মরণ করছে।
তিনি শুধু একটা সময় নয়, গোটা যুগের চিন্তাধারা পাল্টে দেন। তিনি ছিলেন আধ্যাত্মিক নেতা ,সাহসী বিপ্লবী ও মানবতার জন্য নিবেদিত পথপ্রদর্শক।
তাঁর চিন্তা, তাঁর কাজ, আর তাঁর জীবন আমাদের শেখায় বিশ্বাস আর সাহস থাকলে একা একজন মানুষও গোটা সমাজের চেহারা পাল্টে দিতে পারে।
ইমাম খোমেইনী (রহ.)- এর উত্থান ছিল অন্য সবার থেকে আলাদা। তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা ছিলেন না; বরং তিনি আল্লাহর উপর ভরসা আর মানুষের ভালবাসার জন্য আত্মত্যাগ এর ধারণা নিয়ে এগিয়ে ছিলেন। তার বিশ্বাস ছিল যদি জনগণ সৎ উদ্দেশ্যে এক হয়, আর আল্লাহর সাহায্যে ভরসা রাখে তাহলে বড় বড় শক্তিকেও হারানো যায়। আর সেটাই তিনি করে দেখিয়েছেন। তাঁর নেতৃত্বে ইরান থেকে আড়াই হাজার বছরের রাজতন্ত্র চলে যায়, আসে ইসলামি প্রজাতন্ত্র। সে সময় বিশ্ববাসী দেখেছে, ধর্ম, ন্যায়ের লড়াই আর নেতৃত্ব একসাথে কিভাবে ইতিহাস গড়ে। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ইসলামি বিপ্লব দুনিয়ার মুসলমানের কাছে, মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সমগ্র মানবতার কাছে এক নুতন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। ঐতিহাসিক এই বিপ্লবের সাড়ে ৪ দশকের সাফল্য আজ বিশ্বের সকল মুসলিম ও স্বাধীনতাকামী জাতির জন্য একটি রোল মডেল। নানা ষড়যন্ত্র ও কঠিন অবরোধের মধ্যেও বিশ্বের অনেক দেশের চেয়ে দ্রুত গতিতে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে দেশটি। শিক্ষা, বিজ্ঞান, উদ্ভাবন, প্রযুক্তিগত উন্নয়নসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এখন নেতৃস্থানীয় দেশের তালিকায় রয়েছে ইরান।
ইসলামি বিশ্বে ইরান আজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দেশ। দেশটি কোনো অপশক্তির কাছে মাথানত করে না। তবে বিশ্বের মজলুম মানুষের পক্ষে দেশটির সহযোগিতার হাত সব সময় প্রসারিত। বিশেষ করে ফিলিস্তিনের মজলুম মানুষের পক্ষে ইরান যেভাবে সর্বশক্তি দিয়ে সহযোগিতা করে যাচ্ছে এমন নজির বিশ্বে আর দ্বিতীয়টি নেই। সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান সব সময় বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখায় বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো ইরানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের জাল বিছিয়ে রেখেছে। কিন্তু ইসলামের শত্রুদের সকল ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে দেশটি যেভাবে উন্নয়ন ও অগ্রগতির দিকে এগিয়ে চলেছে তা বিশ্বের জাতিগুলোর জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।
সভায় ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের রাষ্ট্রদূত মনসুর চাভুশি বলেন, ইমাম খোমইনী (রহ.) এমন একজন নেতা ছিলেন যিনি শুধু ইরানে নয় পুরো মুসলিম বিশ্বের রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও সংস্কৃতি অঙ্গনে গভীর প্রভাব বিস্তারকার করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি নিজেকে কেবল ব্যক্তিগত ধর্মচর্চার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি। তিনি ইসলামকে সামাজিক ন্যায়বিচার এবং রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়ের ভিত্তি হিসেবে তুলে ধরেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, ইসলামের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো যদি সঠিকভাবে অনুসরণ করা হয় তাহলে একটি জাতিকে নিপীড়ন ও আধিপত্যকামীদের হাত থেকে মুক্তি দেয়া সম্ভব। রাষ্ট্রদূত বলেন, ইমাম খোমেইনী ইসলামকে জীবনের মূল ভিত্তি হিসেবে, সমাজদর্শনের হাতিয়ার হিসেবে চর্চা করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন দৈনন্দিন জীবন থেকে শুরু করে সমাজ, রাষ্ট্র, সকল পর্যায়ে ইসলামকে কিভাবে সুষ্ঠুভাবে ব্যবহার করা যায়।
ইমাম খোমেইনী (রহ.) তাঁর সারাজীবন ইসলামের মূল শিক্ষাগুলোকে নিজের জীবন ও কর্ম দিয়ে মানুষের সামনে তুলে ধরেছেন।মুসলমানদের তিনি এমন জায়গায় নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন যেখানে তারা নিজেদের ভাগ্য নিজেরাই গঠন করতে পারে। ইরানের ইসলামি বিপ্লব তার এই চিন্তাধারার বাস্তব প্রতিফলন। তিনি বিশ্ববাসীকে দেখিয়েছেন যে, বিশ্বাস ও একতা থাকলে তাহলে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শক্তির বিরুদ্ধেও অত্যন্ত বলিষ্ঠ ও সুদৃঢ়ভাবে দাঁড়ানো যায়।
রাষ্ট্রদূত বলেন, ইমাম খোমেইনী (রহ)-এর মৃত্যুর সাড়ে চার দশক পেরিয়ে গেলেও তাঁর বাণী, তাঁর জীবন আমাদের জন্য অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় হয়ে আছে।
তিনি বলেন, আজকের বিশ্বের যে সামাজিক অস্থিরতা, যুদ্ধাবস্থা, ও পরস্পরের প্রতি যে অবিশ্বাস বিরাজ করছে তা থেকে মুক্তি পেতে হলে আমাদেরকে ইমাম খোমেইনীর চিন্তাবোধ থেকে নিজেদেরকে শক্তিশালী করতে হবে এবেং তার দেখানো পথ ও আদর্শকে অনুসরণ করতে হবে। বর্তমানে ইরানসহ বিশ্বের অনেক দেশে তরুণরা স্বাধীন, তাদের চিন্তাভাবনা, চরিত্র, দায়িত্বের দিক থেকে অতীতের চেয়ে এগিয়ে আছে। শুধু প্রয়োজন সঠিক দিকনির্দেশনায় তাদের পরিচালিত করা। ইমাম খোমেইনীর চিন্তাধারা ও নীতিগুলো ভালোভাবে উপলদ্ধি করা তরুণদের জন্য পথ প্রদর্শনীয় হতে পারে। আজকের এই দিনে তাঁর স্মৃতিকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি।
অনুষ্ঠানে ঢাকাস্থ ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের কালচারাল কাউন্সেলর সাইয়্যেদ রেজা মীরমোহাম্মদী বলেন, বিপ্লবের মহান নেতা এবং ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের রূপকার ইমাম খোমেইনী (রহ.) ছিলেন বর্তমান যুগে বিশুদ্ধ ইসলামের পুনরুজ্জীবিতকারী। তাঁর নেতৃত্বে সংঘটিত ইরানের ইসলামি বিপ্লবকে একটি মহান ঐতিহাসিক ঘটনা বলা হয় যা বিশ্বব্যাপী সমীকরণ পাল্টে দেয় এবং পুঁজিবাদ এবং সমাজতন্ত্রের বাইরে তৃতীয় একটি ডিসকোর্স তৈরি করে।
সাইয়্যেদ রেজা মীরমোহাম্মদী বলেন, বিদেশীদের উপর ইরানে তৎকালীন সরকারের নির্ভরশীলতা ও দেশটিতে প্রকৃত স্বাধীনতা না থাকার কারণেই মূলত ইমাম খোমেইনী (র.) ইসলামি বিপ্লবের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে, ইরানসহ সকল মসলিম দেশ ও জাতির প্রকৃত স্বাধীনতা থাকা উচিত এবং বিদেশী শক্তির উপর নির্ভরশীলতা থেকে মুক্ত থাকা উচিত।
তিনি মনে করতেন প্রকৃত স্বাধীনতা না থাকা ও বিদেশী শক্তির উপর নির্ভরশীলতা ইরানসহ অন্য মুসলিম দেশগুলোর উন্নয়ন ও অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করছে। এই শোচনীয় পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে হলে ইসলামি দেশগুলোর স্বাধীনতা থাকা প্রয়োজন।
তিনি বিশ্বাস করতেন যে, স্বাধীনতা এবং মুক্তি জাতিগুলোর মৌলিক অধিকারগুলির মধ্যে একটি এবং তাদের নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনে অবশ্যই তা অর্জন করতে হবে।
কালচারাল কাউন্সেলর আশা প্রকাশ করেন যে, ইরানের মতো সকল ইসলামি দেশ এবং মুসলিম জাতি পূর্ণ স্বাধীনতা ও মুক্তি অর্জন করবে এবং তাদের ঐক্য ও সংহতির মাধ্যমে গাজা ও ফিলিস্তিন সমস্যাসহ ইসলামি বিশ্বের সকল সমস্যা সমাধান করবে।
অনুষ্ঠানে খুলনার ইসলামী শিক্ষাকেন্দ্রের প্রিন্সিপাল, হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন সাইয়্যেদ ইব্রাহীম খলিল রাজাভী বলেন, বলা হতো ইসলাম ধর্ম শুধু মসজিদেই বন্দি হয়ে থাকবে। ইসলামকে রাষ্ট্র গঠনে বা রাজনৈতিক ভূমিকায় রাখার কোনো অবকাশ নেই। রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলামকে প্রতিষ্ঠা করা থেকে দূরে রাখতেই এমনটি বলা হতো। কিন্তু ইমাম খোমেইনী (রহ. )এই ধারণাতে পরিবর্তন এনেছিলেন। তিনি একটা সফল বিপ্লব ঘটানোর মাধ্যমে সারা বিশ্বের মুসলমানকে আশান্বিত করেছেন। সেই বিপ্লবের পর থেকে ইসলামের শত্রুরা ইরানের বিরুদ্ধে আরো বেশি সোচ্চার হয়। তারা এই বিপ্লবকে ‘শিয়া বিপ্লব’ বলে বিশ্বে প্রচার করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ইসলামের শত্রুদের সেই চেষ্টা সফল হয়নি। ইমাম খোমেইনীর হাত ছিল সবসময় মজলুমদের জন প্রসারিত। তিনি ছিলেন বিশ্বের মুক্তিকামী নুষের নেতা। বিপ্লবের পরপরেই ইমাম খোমেইনী ফিলিস্তিনের মজলুমদের পাশে অবস্থান নিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘যেখানেই মজলুম রয়েছে সেখানেই আমাদের অবস্থান।’
ইব্রাহীম খলিল রাজাভী বলেন, বিশ্বে যখন মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ-বিভাজন চরম আকার ধারণ করেছিল এবং মুসলমানদের একত্রিত হওয়াটাই কঠিন বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল তখনই ইমাম খোমেইনী ঐক্যের ডাক দিয়েছিলেন। হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর জন্মবার্ষিকীর তারিখ নিয়ে মুসলমানদের মধ্যে মতভেদ ছিল। এ সমস্যা সমাধানে ইমাম খোমেইনী ১২-১৭ রবিয়াল আউয়াল ‘ঐক্য সপ্তাহ’ পালনের ডাক দিয়েছিলেন। সেই চেতনার প্রতিফলন আজ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ফ্রন্টে দেখা যায়।
মহাখালী দারুল উলুম হোসেইনিয়া কামিল মাদরাসার প্রিন্সিপাল ড. মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম আল মারুফ বলেন, ইমাম খোমেইনী (রহ.) মুসলিম বিশ্বের জন্য কী রেখে গেছেন তা ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানকে কাছে থেকে না দেখলে বুঝা সম্ভব নয়। ইসলামি বিপ্লব প্রতিষ্ঠা করে তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন কোরআনের বাহক আলেমরাও দেশের নেতৃত্ব দিতে পারে। তিনি পশ্চিমাদের ভুল ভেঙে দিয়েছিলেন।
ড. নজরুল ইসলাম বলেন, “আল্লাহর উপর বিশ্বাস ও ভরসা ছিল বলেই হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে আল্লাহ বদর এবং ওহুদের প্রতিকূল যুদ্ধের মধ্যেও বিজয় করেছিলেন। ঠিক তেমনি আল্লাহর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস এবং ইমান ছিল বলেই আল্লাহ তা’আলা হযরত ইমাম খোমইনীকেও বিজয়ী করেছেন। তাঁর এই বিজয় পুরো বিশ্ব দেখেছে। তিনি ইসলামের পতাকাতলে সকলকে একত্রিত করতে চেয়েছেন৷
মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম আল মারুফ আরো বলেন, ইরানে ইমাম খোমেইনীর ইসলামি বিপ্লবের চেতনা আজও ইরানের তরুণদের উদ্দীপনায় রয়েছে৷ ইরানের তরুণরা সেই আর্দশকে ধারণ করে চলে বলে তারা পশ্চিমাদের চ্যালেঞ্জ করতে পারে। আমাদেরও উচিত তাঁর সেই জীবনাদর্শ অনুকরণ করে চলা৷