ঢাকায় ইব্রাহিম রায়িসির শাহাদাত বার্ষিকী উপলক্ষ্যে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত
পোস্ট হয়েছে: মে ২০, ২০২৫

ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সাবেক প্রেসিডেন্ট আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ ইব্রাহিম রায়িসি ও তাঁর সফরসঙ্গীদের ১ম শাহাদাত বার্ষিকী উপলক্ষ্যে আজ রাজধানীর ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র মিলনায়তনে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ঢাকাস্থ ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের উদ্যোগে এই আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। ‘ইরানের সাবেক প্রেসিডেন্ট শহিদ ইব্রাহিম রায়িসির গভার্নেন্স মডেল’ শীর্ষক এই আলোচনা সভায় বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের ডিন প্রফেসর ড. মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান খান ও দৈনিক দেশ রূপান্তরের সম্পাদক ও জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি কামাল উদ্দিন সবুজ। অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন রাজধানীর গুলশান কেন্দ্রীয় মসজিদের ইমাম মৌলানা ফাহিমুর রহমান। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ঢাকাস্থ ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের কালচারাল কাউন্সেলর সাইয়্যেদ রেযা মীরমোহাম্মাদী।
আলোচনা সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের ডিন প্রফেসর ড. মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান খান বলেন, ইরানের শাহবিরোধী বিপ্লবে শহিদ ইব্রাহিম রায়িসি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। বিপ্লব পরবর্তী ইসলামি প্রজাতন্ত্রে তিনি সরকারি চাকরিতে বিচার প্রশাসনের সাথে যুক্ত হয়েছিলেন এবং তার মেধা, যোগ্যতা ও মননের মধ্য দিয়ে সেখানের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে আসীন হয়েছিলেন। তিনি ইরানের অ্যাটর্নি জেনারেল ছিলেন। প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এই পদগুলোতে থাকা অবস্থায় তিনি ইরানের বিচার বিভাগ এবং আইন ব্যবস্থাপনায় কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার সাধনের মাধ্যমে ইরানের জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। ২০১৭ সালে প্রেসিডেন্ট ইলেকশনে তিনি হাসান রুহানির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। সেই নির্বাচনে তিনি জয় লাভ করেননি বটে, কিন্তু ইরানের মানুষের ব্যাপকভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। যার ধারাবাহিকতায় ২০২১ সালের নির্বাচনে বিপুলভাবে জনসমর্থিত হয়ে ইরানের ৮ম প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি দায়িত্বভার গ্রহণ করেছিলেন।
ড. ছিদ্দিকুর রহমান বলেন, এমন একটা সময় ইব্রাহিম রায়িসি ইরানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেছিলেন, যখন ইরান নানামুখী সংকটে নিমজ্জিত ছিল। অর্থনৈতিক সংকট ছিল অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। তখন ইরানের জনগণের দুভোর্গের অন্যতম কারণ ছিল পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা ইরানের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে একের পর এক অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপের মধ্য দিয়ে ইরানকে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করার অপচেষ্টা চালিয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরে।
অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় তাঁর সুচিন্তিত ও প্রাজ্ঞ্য নীতিতে সফল হয়েছিলেন। তিনি তরুণদেরকে তাঁর দেশের অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলার প্রথম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। বেকারত্ব অপসারণে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। পলিটিক্যাল এলিট ও সামাজিক এলিটদের স্বার্থের চেয়ে সাধারণ মানুষের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে নীতি গ্রহণ করেছিলেন। কোনো ব্যক্তি তুষ্টি নয়, জনতুষ্টির লক্ষ্যকে সামনে রেখে তিনি ইরানের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর চেষ্টা করেছেন।
এছাড়া তিনি আমলাতন্ত্রের জটিলতা, দুর্নীতি দূরীভুত করে শক্তিশালী অর্থনৈতিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। অল্প সময়ের মধ্যে এসব উদ্যোগের সুফল নাগরিকরা পেতে শুরু করেছিলেন।
অর্থনৈতিক কূটনীতির উপর তিনি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। তিনি তাঁর বিদেশ নীতিতে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সাধন করেছিলেন। চীনের সাথে ইরানের সম্পর্কের উন্নয়ন, ব্রিকসের সদস্যপদ প্রাপ্তি এগুলোর অন্যতম।
অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান খান বলেন, রায়িসি ইরানের ইসলামি বিপ্লবকে পরিপূর্ণভাবে ধারণ করতেন। এই বিপ্লবের চেতনার সাথে সামঞ্জস্য রেখে তিনি রাষ্ট্রীয়, বেসামরিক প্রশাসন এবং অন্যান্য যে বৈদেশিক নীতি আছে সেগুলোকে ঢেলে সাজানোর একটি পরিকল্পনা তিনি গ্রহণ করেছিলেন। সেখানেও তিনি ইরানের মূল যে রাষ্ট্রীয় নীতি তার সাথে সামঞ্জস্য রেখে মধ্যপ্রাচ্যের সংকট নিরসনে চেষ্টা চালিয়েছেন। সিরিয়াতে ইরানিয়ান কনস্যুলেটে ইসরায়েলি হামলার পাল্টা জবাব দিয়েছিলেন তিনি। ইসরায়েলের অভ্যন্তরে সঠিক নিশানায় হামলা করে সমুচিত জবাব দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন একজন আদর্শ ও জনপ্রিয় একজন প্রেসিডেন্ট। তাঁকে বলা হতো ‘জনতার প্রেসিডেন্ট’।
আলোচনা সভায় ঢাকাস্থ ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের কালচারাল কাউন্সেলর সাইয়্যেদ রেযা মীরমোহাম্মদী বলেন, ইরানের সাবেক প্রেসিডেন্ট আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ ইব্রাহিম রায়িসি ছিলেন একজন বড় মাপের আলেম, চিন্তাবিদ ও রাজনীতিবিদ। জীবনের পথ চলার ক্ষেত্রে পবিত্র কুরআনে যেসব দিকনির্দেশনা রয়েছে ইব্রাহিম রায়িসির জীবনাচরণ ও কর্মে তা প্রতিফলিত হয়েছে। পবিত্র কুরআনের নির্দেশনা অনুযায়ী একজন ব্যক্তি কিভাবে পথ চলবে, একজন শাসক কিভাবে দায়িত্ব পালন করবে সেই নির্দেশনা যেন তিনি হুবহু অনুসরণ করেছেন। পবিত্র কুরআনে কাফেরদের ব্যাপারে কঠোর হওয়ার এবং ইসলামের অনুসারীদের ব্যাপারে নমনীয় হওয়ার যে নির্দেশনা রয়েছে তিনি তা যথাযথভাবে অনুসরণ করতেন। তিনি বিশ্বের সকল মুসলমানের জন্য ছিলেন অত্যন্ত উদার ও নমনীয়। তিনি সবসময় মানুষের জন্য কাজ করেছেন। মানুষের সেবায় তাঁর জীবন অতিবাহিত করেছেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত নিষ্ঠাবান ও ন্যায়পরায়ণ রাষ্ট্রনায়ক। তিনি যখনি যে দায়িত্ব পালন করেছেন লক্ষ্য ছিল মহান আল্লাহ যেন তাঁর কাজের প্রতি সন্তুষ্ট থাকেন। তিনি আল্লাহর সন্তুষ্টির মধ্য দিয়ে মানুষের সেবা করার চেষ্টা করতেন। তিনি দেশের ভিতরে ও বাইরে যে দায়িত্ব পালন করেছেন তা ছিল মহান আল্লাহর নির্দেশিত পথেই। ইসলামের শত্রুদেরকে তিনি শত্রু হিসেবে এবং ইসলামের বন্ধুদেরকে তিনি বন্ধু হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে তিনি জনগণের স্বার্থকে প্রাধান্য দিতেন। জনগণের সেবাই ছিল তাঁর প্রধান লক্ষ্য। আমিরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.) তাঁর গভর্নর মালেক আশতারের কাছে লেখা চিঠিতে লিখেছিলেন, তুমি যে কাজই করবে লক্ষ্য যেন হয় জনসেবা। জনগণের স্বার্থই যেন সেখানে প্রাধান্য পায়। কোনো দল, গোষ্ঠী বা ব্যক্তি বিশেষ করে ক্ষমতাশালী ও বিত্তশালীরা যেন সেখানে প্রাধান্য না পায় । জনগণের জন্য কাজ করাই যেন তোমার প্রধান লক্ষ্য থাকে। ইব্রাহিম রায়িসি হযরত আলীর ঐ চিঠিটির নির্দেশনা যেন অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন। তিনি তাঁর দিন রাতের কাজকর্মে জনসেবা ও জনগণের সন্তুষ্টিকে প্রাধান্য দিতেন।
ইব্রাহিম রায়িসির ব্যক্তিত্বের একটি বড় বৈশিষ্ট্য ছিল সততা ও ন্যায়পরায়ণতা। তিনি অন্তরে যেটা ধারণ করতেন মুখে তাই বলতেন এবং কর্মের মাধ্যমে তা বাস্তবায়ন করতেন। একজন সরকারপ্রধান যখন এমন সততার সাথে দায়িত্ব পালন করেন তখন আল্লাহ তাআলা তাঁর উপর সন্তুষ্ট হন এবং জনগণও তাঁর উপর সন্তুষ্ট হয়। ড. রায়িসি ছিলেন অত্যন্ত পরিশ্রমী একজন মানুষ। ক্লান্তি কী তা তাঁর মধ্যে দেখা যেত না। তাঁর কোনো ছুটির দিন ছিল না। তিনি সর্বদা কাজের মধ্যেই নিমজ্জিত থাকতেন। আর এসব গুণই তাঁকে একজন সফল রাষ্ট্রনায়কে পরিণত করেছিল।
আলোচনা সভায় দৈনিক দেশ রূপান্তর এর সম্পাদক ও জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি কামাল উদ্দিন সবুজ বলেন, ইরান থেকে বাংলাদেশ ভৌগোলিকভাবে অনেক দূরে হলেও সম্পর্কের দিক থেকে দেশ দুটি খুবই নিকটে। দেশ দুটির মধ্যে দীর্ঘদিনের সুসম্পর্ক রয়েছে। ইরান একটি প্রাচীন সভ্যতার দেশ। ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে দেশটি অত্যন্ত সমৃদ্ধ। ইরানের বিখ্যাত কবি ও সাহিত্যিক হাফিজ, রুমি, শেখ সাদি, ওমর খৈয়াম এদেশে খুবই জনপ্রিয়। আমি নিজেও ইরানি কবি-সাহিত্যিকদের ভক্ত। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামও ইরানি কবি হাফিজের সাহিত্য দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।
তিনি বলেন, ইরানিরা সাহসী জাতি। তারা কখনই পরাজিত হয়নি। যখন এই দেশটির প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রায়িসির হেলিকপ্টার নিখোঁজ হওয়ার খবর আসে তখন শুধু ইরান নয় বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের সকলেই সেই হেলিকপ্টারের খবর জানার জন্য উদগ্রীব ছিল। আমার বারবার সন্দেহ হচ্ছিল এটা কোনো ষড়যন্ত্র কিনা? কারণ, আমরা সকলেই জানি ইব্রাহিম রায়িসি ফিলিস্তিনে ইহুদিবাদী আগ্রাসানের বিরুদ্ধে কতটা বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দিয়েছেন৷ ইরান কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে তাঁর মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হওয়ার পর আমরা সকলেই গভীরভাবে শোকাহত ছিলাম। আমি জান্নাতে শহিদ ইব্রাহিম রায়িসি ও তাঁর সঙ্গীদের উচ্চ মর্যাদা কামনা করছি।
কামাল উদ্দিন সবুজ বলেন, ফিলিস্তিনে ইহুদিবাদী ইসরাইলের বর্বর আগ্রাসনের বিরুদ্ধে একমাত্র ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান জোরালো প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে এবং ফিলিস্তিনকে সর্বাত্মকভাবে সহায়তা করে আসছে। আর অন্য মুসলিম দেশগুলো নীরব ভূমিকা পালন করছে। এই দেশগুলো যদি শহিদ ইব্রাহিম রায়িসির নীতি অনুসরণ করে ঐক্যবদ্ধ হতো তাহলে ইহুদিবাদী ইসরাইল মুসলমানদের পুণ্যভূমি ফিলিস্তিনে এমন বর্বরোচিত হামলা করার সাহস পেত না। তিনি ফিলিস্তিন সংকট নিরসনে ওআইসি ও আরবলীগের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।
আলোচনা সভায় গুলশান সেন্ট্রাল মসজিদের ইমাম মাওলানা ফাহিমুর রহমান বলেন, ইরানের সাবেক প্রেসিডেন্ট শহিদ ইব্রাহিম রাইসি মুসলিম উম্মাহের জন্য যা করে গেছেন, তা দু এক কথার মাধ্যমে প্রকাশ করা সম্ভব নয় ৷ আমার স্পষ্ট মনে আছে, তাঁর শাহাদাতের খবরের পর বাংলাদেশে বিভিন্ন মসজিদে দোয়ার আয়োজন হয়েছে। আমরাও রাজধানীর গুলশান সেন্ট্রাল মসজিদে বিশেষ দোয়ার আয়োজন করেছি। এটা শুধু বাংলাদেশ নয় সারা বিশ্বের মুসলিম জাতির জন্য শোকাবহ সময় ছিল। ইব্রাহিম রায়িসির জানাযার নামাযে লক্ষ লক্ষ মানুষের উপস্থিতিই প্রমাণ করে তাঁর প্রতি মানুষ কতটা সন্তুষ্ট ছিল৷
ফাহিমুর রহমান বলেন, ইরানের সরকার ও জনগণের ফিলিস্তিনের নিপীড়িত মানুষের জন্য ভালোবাসা ও আবেগ অনেক বেশি৷ নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি বলেন, ‘ইরানের এক কিরাত প্রতিযোগিতায় আমি উপস্থিত ছিলাম, সেখানে দেখলাম ইরানের প্রত্যেক কারী তাঁদের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ শেষে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী মানুষের প্রতি সহানুভূতি ও ভালোবাসা প্রদর্শন করছিলেন।’
ইব্রাহিম রায়িসিও ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার জন্য সর্বদা সোচ্চার ছিলেন। মাওলানা ফাহিমুর রহমান তাঁর শিক্ষকের উপদেশের কথা স্মরণ করে বলেন, ‘নেতৃত্ব দানের পূর্বে তুমি জ্ঞানী ও যোগ্য হও।’ তিনি ইব্রাহিম রায়িসিকে সেই নেতৃত্বের জন্য তেমনই আর্দশ নেতা মনে করেন৷ তিনি বলেন, কুরআনের নির্দেশ অনুযায়ী যোগ্য নেতার গুণাবলি যেমন: সৎ পথে থাকা, ন্যায় বিচারে অবিচল থাকা, এসব প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রায়িসির মধ্যে আমরা দেখতে পাই।