শুক্রবার, ১৭ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ১লা কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

English

ঢাকাস্থ ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে বইয়ের মোড়ক উন্মোচন

পোস্ট হয়েছে: সেপ্টেম্বর ২৫, ২০২৫ 

news-image

বিশিষ্ট কবি, সাহিত্যিক, লেখক, গবেষক ও শিক্ষাবিদদের উপস্থিতিতে আজ বৃহস্পতিবার ঢাকাস্থ ইরান দূতাবাসের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র মিলনায়তনে ‘আল কুরআনে ইসলামী চিন্তাধারার সামগ্রিক রূপরেখা’ এবং ‘আমি বেঁচে আছি’ শীর্ষক দুটি বইয়ের মোড়ক উন্মাচন করা হয়েছে। ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হযরত আয়াতুল্লাহ আল উযমা সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ীর একটি ধারাবাহিক বক্তব্যের সংকলন ‘আল কুরআনে ইসলামী চিন্তাধারার সামগ্রিক রূপরেখা’ এবং মাসুমেহ আবাদের বন্দি জীবনের স্মৃতিকথা ‘আমি বেঁচে আছি’ শীর্ষক  বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ইরানের রিলিজিয়ন্স অ্যান্ড ডেনোমিনেশন ইউনিভার্সিটির ফেকাল্টি মেম্বার প্রফেসর ড. সাইয়্যেদ মাহদী মুসাভী এবং ফরিদগঞ্জ মজিদিয়া কামিল মাদ্রাসার সাবেক প্রিন্সিপাল মাওলানা ড. এ কে এম মাহবুবুর রহমান। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন ‘আল কুরআনে ইসলামী চিন্তাধারার সামগ্রিক রূপরেখা’ শীর্ষক বইয়ের অনুবাদক ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী এবং ‘আমি বেঁচে আছি’ বইয়ের অনুবাদক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের শিক্ষক তানজিনা বিনতে নূর। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ঢাকাস্থ ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের কালচারাল কাউন্সলের সাইয়্যদে রেযা মীরমোহাম্মাদী।

অনুষ্ঠানে ইরানের রিলিজিয়ন্স অ্যান্ড ডেনোমিনেশন ইউনিভার্সিটির ফেকাল্টি মেম্বার প্রফেসর ড. সাইয়্যেদ মাহদী মুসাভী বলেন, আজ যে দুটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হচ্ছে তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বই। বই দুটির একটির নাম ‘আমি বেঁচে আছি’। এটি অনুবাদ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের শিক্ষক তানজিনা বিনতে নূর। এটি একজন ইরানি নারীর বন্দী জীবনের স্মৃতি কথা নিয়ে। ইরানের বহুল প্রচলিত এই বইটি অনুবাদক খুবই সুন্দর ও সাবলীল ভাষায় অনুবাদ করেছেন। দ্বিতীয় যে বইটি ডক্টর ইসা শাহিদী অনুবাদ করেছেন সেটি ‘আল কুরআনে ইসলামে চিন্তা ধারার সামগ্রিক রূপরেখা’। তিনি এর আগেও ইরানের সর্বোচ্চ নেতার  কয়েকটি বই অনুবাদ করেছেন। তিনি ইরানের ইসলামী বিপ্লবের রুপকার ইমাম খোমেইনী (র.) এর গ্রন্থ  দিওয়ানে ইমামও অনুবাদ করেছেন। তার অনুবাদগ্রন্থ সমূহের মধ্যে মৌলানা রুমির  মসনবী শরীফও রয়েছে।  তিনি অত্যন্ত দক্ষ ও অভিজ্ঞ একজন অনুবাদক। বই দুটি অনুবাদের ক্ষেত্রে এই দুজন উপযুক্ত লোককে নির্বাচিত করায় আমি ঢাকাস্থ ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের কালচারাল কাউন্সলের সাইয়্যদে রেযা মীরমোহাম্মাদীকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

আমি  ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদীর একটি বক্তব্যের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলতে চাই বাংলাদেশ ইমাম খোমেইনী (র.) এর  রাজনৈতিক জীবন নিয়ে যত চর্চা হয়েছে তার দর্শন ও আধ্যাত্মিক দিকগুলো নিয়ে তত চর্চা হয়নি। আমি বর্তমান রাহবারের ব্যাপারেও বলতে চাই যে তার যে জ্ঞান ও প্রজ্ঞা, বিশেষ করে তার কোরআনিক জ্ঞান, দর্শন ও সাহিত্যসহ জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় তার পান্ডিত্য তা নিয়ে তেমনটি চর্চা হয় না যেমনটি তার রাজনৈতিক দিক নিয়ে আলোচনা হয় । চর্চা হয় । আমি অত্যন্ত আনন্দিত যে সম্প্রতি বাংলাদেশে ইরানের বর্তমান সর্বোচ্চ নেতার বিভিন্ন বিষয়ে চিন্তাধারা তুলে ধরার একটা ততপরতা  শুরু হয়েছে। বিভিন্ন বিষয়ে ইরানের সর্বোচ্চ নেতার  বক্তব্য সংকলন করে ফার্সিতে যেসব বই প্রকাশিত হয়েছে তার বেশ কয়েকটি এরই মধ্যে বাংলাদেশে বাংলা ভাষায় অনুবাদ করে প্রকাশ করা হয়েছে। এটা একটি শুভ লক্ষণ বলে আমি মনে করি। এরমধ্য দিয়ে  বাংলাদেশে উনার পান্ডিত্যের বিভিন্ন দিক নিয়ে চর্চা শুরু হয়েছে। এই বইগুলো নিয়ে যদি কোনো পাঠ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয় তাহলে এই বইগুলো থেকে জ্ঞান চর্চার আরো বেশি সুযোগ তৈরি হবে। আরেকটা বিষয় বলতে চাই যখন কোন বিপ্লব সংঘটিত হয় তা কেবল পুরুষদের দ্বারাই সংঘটিত হয় না । সেখানে নারীদেরও ভূমিকা থাকে। আমি বেঁচে আছি বইটি থেকে এটা প্রমাণিত হয়েছে এবং সবাই অনুধাবন করতে পারবে যে নারীরাও ইরানের ইসলামী বিপ্লবে এবং শত্রুর চাপিয়ে দেয়া  যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

অনুষ্ঠানে ঢাকাস্থ ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের কালচারাল কাউন্সলের সাইয়্যদে রেযা মীরমোহাম্মাদী বলেন, আমি বেঁচে আছি বইয়ের প্রেক্ষাপট ছিল সেই সময়ের যখন ইরানের উপরে ইরাকের বাথ পার্টির সরকার ৮ বছরের যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিল। সেই যুদ্ধের বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহ এমন গুরুত্বপূর্ণ যেগুলো রেকর্ড হয়ে থাকা উচিত ছিল। সেগুলো সংরণক্ষণ ও পরবর্তী প্রজন্মের কাছে ছড়িয়ে দেওয়ার একটি মাধ্যম হলো স্মৃতিকথা লেখা। ১৯৮০ সালের ঘটনাবলী নিয়ে লেখিকা মাত্র ১৭ বছর বয়সে এই বইটি লিখেছিলেন। তিনি রেড ক্রিসেন্টের নার্স হিসেবে যুদ্ধক্ষেত্রে ছিলেন। অনুবাদ করার জন্য বইটি নির্বাচন করার কারণ হলো, ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা ইমাম খামেনি নিজেই এই বইটি পড়ার জন্য ও বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করার জন্য তাগিদ দিয়েছেন। বইটির অনুবাদক হিসেবে তানজিনা বিনতে নূরকে নির্বাচিত করার কারণ ছিল,  এই বইটি লেখক একজন নারী,  আর নারীদের নিজস্ব আবেগ যেন তাদের ভাষাতেই বেশি ফুটে ওঠে। স্মৃতিকথায় যুদ্ধবন্দি হিসেবে ইরাকের কারাগারে লেখিকার দিনলিপি বর্ণিত হয়েছে। লেখিকা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে আটক হওয়ার আগ পর্যন্ত যেসব জায়গায় গিয়েছেন সবখানে নিজের ভাইকে নিজের অস্তিত্ব জানান দেওয়ার জন্য একটা চিরকুট লিখে রাখতেন । চিরকুটে লেখা থাকত ‘আমি বেঁচে আছি’। এবং ইরাকের সেনাদের হাতে বন্দী হওয়ার পর এই চিরকুটই তার বন্দি জীবনের অকথিত নির্যাতনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

অনুষ্ঠানে ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী বলেন,  আমার জন্য সৌভাগ্যের বিষয় হলো যে ইমাম খোমেনীর কিছু মৌলিক গ্রন্থ ও কাজ অনুবাদ করার সুযোগ হয়েছিল। ইরানে রেডিও তেহরানে কর্মরত থাকাকালে ইমাম খোমেনির বক্তব্যের অনুবাদ আমি করতাম। আমি খুব আগ্রহের সাথে ইমামের বক্তৃতাগুলো অনুবাদ করতাম। কিন্তু একইসাথে দুর্ভাগ্য ও আফসোসের বিষয় হচ্ছে এই কাজগুলো সংরক্ষণ করি নি। এগুলো সংরক্ষণ করলে  বেশ কয়েকটি বই হয়ে যেত। আমি প্রত্যেকটি অনুবাদে মন প্রাণ ঢেলে দিয়ে চেষ্টা করি যেন অনুবাদ হিসেবে নয়, নতুন লেখা হিসেবে পরিচিতি পায়।

এই বইটিও ইরানের বর্তমান রাহবার ১৯৭৪ সালের দিকে রমযান মাসে মাশহাদের এক মসজিদে যেসব বক্তৃতা দিয়েছিলেন সেগুলোর সংকলিত অনুবাদ। সে যুগে তিনি তার বক্তব্যগুলো নোট কপি করে শ্রোতাদের মধ্যে বিলি করাতেন ও ক্যাসেট আকারে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলেন। এগুলো রাজনৈতিক আলাপ ছিল না, বরং ঈমান নিয়ে বয়ান দিয়েছেন। এই বইটি পড়লে বুঝতে পারবেন যে রাসুল (স) এর প্রতি আমাদের যে ভালোবাসা, শ্রদ্ধা তা ইরানের নেতৃবৃন্দ ও সাধারণ মানুষের মনে আরো প্রগাঢ় রুপে রয়েছে৷ ঈমানের সংজ্ঞা কি, মানুষের প্রতি ঈমানের দাবি কী সেগুলা এখানে উঠে এসেছে। এছাড়াও ইসলামের অন্যান্য বিধিবিধান সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। প্রত্যেকটি কথা তিনি কোরান শরীফের আয়াতের আলোকে বলেছেন, ফলে তার কাছে কোরআনের ব্যাখ্যা কেমন তা জানা যায়। তখনকার শাহ শাসনের কঠোর বেড়াজালের মধ্যেও দূরদূরান্ত থেকে ছাত্ররা তার বক্তব্য শুনতে আসতেন ।

অনুষ্ঠানে মাওলানা ড. এ.কে. এম মাহবুবুর রহমান  ‘’ইসলামি চিন্তাধারার সামগ্রিক রুপরেখা” বইয়ের পর্যালোচনায় বলেন,  ইসলামে নেতৃত্বের জন্য তিনটি বৈশিষ্ট্যের দরকার হয় একটি হল আলেমদের থেকে সরাসরি কুরআন সুন্নাহর জ্ঞানে পারদর্শী হওয়া, দ্বিতীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থায় ইসলাম সম্পর্কে আলেমকে জানতে হবে,  তৃতীয় হল,  আধ্যাত্মিক জ্ঞান থাকতে হবে।  এই তিনটি বৈশিষ্ট্য যে সকল নেতার মধ্যে ছিল তারাই ইসলামকে পরিপূর্ণভাবে ধরে রেখেছেন।

ইরানের রাহবার ইমাম খামেনীর এই বইয়ে ইসলামের ব্যবহার দৈনন্দিন, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, আন্তর্জাতিক সর্ব ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ তফসিরের সাথে তুলে ধরা হয়েছে।  তিনি এতে ইমানের প্রায়োগিক দিক তুলে ধরেছেন।

ইমাম খামেনি সমাজ, রাজনীতি ও অর্থনীতির প্রতি মুমিনদের উদাসীনতাকে অপছন্দ করেছেন। শুধু ধর্ম ও জিকির ভিত্তিক জীবনযাপনকে পরিহার করতে বলেছেন৷ কেননা আল্লাহ রাসুল (স) সমাজের প্রশাসক ও কাজীও ছিলেন৷ রাসুল (স) এর জীবনার্দশকে অনুসরণ করতে বলেছেন৷ এমনকি ইমাম খামেনি মাগফেরাতের জন্য ব্যক্তি, পারিবারিক ও সামাজিক জীবন শুধরাতে বলেছেন৷ সামর্থ অনুযায়ী সর্বদা দান করতে বলেছেন৷

ইমানদার ভাইএর ভুলে তার সমালোচনা না করে শুধরানো চেষ্টা করতে বলেছেন৷ গানিমাতের সম্পদ বিষয়ে ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন,  খনিজ সম্পদ, জঙ্গল, প্রান্তিক ভূমিও এর অন্তর্ভুক্ত। আলোচক বলেন, শুধু ধার্মিক বা আধ্যাত্মিক জীবন নয় বরং রাজনৈতিক, পারিবারিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনে সর্ব ক্ষেত্রে যদি বেলায়েতের চিন্তাধারা বাস্তবায়ন করা যায় তবেই ইসলাম জীবনে পরিপূর্ণতা ও সফলতা পাবে।

আলোচক তার বক্তব্যে এই বইটি আলেমদের ও শিক্ষিত লোকদের শিক্ষার মূল্যবান খোরাক বলে বর্ণনা করেন। বইটিতে  ইঙ্গিত বা ইশারায় যা লেখা বা বয়ান করা হয়েছে সে বিষয়ে ফুটনোট দেওয়ার পরামর্শ দেন।

অনুষ্ঠানে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের শিক্ষক তানজিনা বিনতে নূর তার বক্তব্যে অনূদিত গ্রন্থ আমি বেঁচে আছি-এর প্রেক্ষাপট ও মূল লেখিকার পরিচয় তুলে ধরেন। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা যে গ্রন্থটি বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদের গুরুত্ব বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন, সেই বইটি বাংলাভাষী পাঠকদের হাতে পৌঁছে দেওয়ার সুযোগ করে দেওয়ায় তিনি ঢাকাস্থ ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।

তিনি বলেন, ‘ফারসি থেকে বাংলায় অনূদিত আমার চতুর্থ গ্রন্থ আমি বেঁচে আছি-এর প্রকাশনা উৎসব আমার জীবনের এক স্মরণীয় মুহূর্ত। ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় ইরাকের বাথ পার্টির হাতে যুদ্ধবন্দী হিসেবে কাটানো চার বছরের অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখিত মাসুমে আবাদের এই আত্মকথন কেবল যুদ্ধবন্দিত্বের স্মৃতি নয়, বরং সাহস, ত্যাগ ও মানবিক শক্তির এক অনন্য দলিল। এই বই অনুবাদ করা আমার কাছে শুধু একটি কাজ ছিল না; বরং এটি ছিল এক আবেগঘন যাত্রা—যেখানে আমি তার অটল স্থিতি, বেদনা ও সংগ্রামের কণ্ঠকে বাংলাভাষী পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার সেতু হতে পেরেছি। আমি বিশ্বাস করি, এই কাহিনি আমাদের পাঠকদের মাঝেও অনুপ্রেরণা জাগাবে।