শুক্রবার, ১৫ই আগস্ট, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ৩১শে শ্রাবণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

English

জ্ঞানের আলোর দিশারী হযরত আলী (আ.)

পোস্ট হয়েছে: এপ্রিল ২৪, ২০১৬ 

news-image

ভেতরের অলংকার সুন্দরতরো বাইরের চেয়ে

জ্ঞানের সৌন্দর্য সে তো কখনোই থাকে না লুকিয়ে

পুরুষের সৌন্দর্য হলো তার ব্যক্তিত্ব আর ভদ্রতায়

মানুষের সৌন্দর্যের রহস্য সততা আর সত্যবাদিতায়

উপরোক্ত ক’টি লাইন ইমাম আলী (আঃ) এর কবিতা।

পৃথিবীতে যত মহান মনীষীর জন্ম হয়েছে তাঁদের অন্যতম হলেন ইমাম আলী (আ.)। তাঁর এই মহত্ত্ব, বিশালত্ব এবং ধী-শক্তি প্রমাণ করে যে, ইসলাম প্রজন্মের পর প্রজন্মকে যথার্থ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে সক্ষম। কবিতায় সৌন্দর্যের কথা বলা হয়েছে। অভ্যন্তরীণ এই সৌন্দর্য ছিল তাঁর মধ্যে অফুরন্ত। ছিল চারিত্রিক সৌন্দর্য, ছিল আচার-আচরণ, নীতি-নৈতিকতা এবং সর্বোপরি আধ্যাত্মিক সৌন্দর্য। তাঁর জ্ঞান ও ব্যক্তিত্বের সৌন্দর্য সমাজে সবসময় আলো বিকিরণ করেছে এবং এখনো বিশ্বব্যাপী করে যাচ্ছে। ভবিষ্যতেও যে তা অব্যাহত থাকবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

এই পৃথিবীতে বহু শক্তির আবির্ভাব ঘটেছে। সমাজে তাদের প্রভাবও পড়েছে। কিন্তু সেইসব শক্তি ইতিবাচক কোনো আদর্শ হিসেবে উপস্থাপিত হয় নি। আবার এমন অনেক ব্যক্তিত্বেরও জন্ম হয়েছে,যাঁদের নাম ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। কারণ, তাঁরা মানবতার স্বার্থে নিজেদের জ্ঞান ও গুণকে কাজে লাগিয়ে সমাজে যে আলো বিলিয়ে গেছেন সেই আলো আজো অম্লান রয়েছে। মানুষ সেই আলো থেকে আজো অজ্ঞতার আঁধার দূর করছে। তেমনি জ্ঞান ও প্রজ্ঞার আলো বিকিরণকারী অসামান্য একজন ব্যক্তিত্ব ছিলেন হযরত আলী (আ.)।

তিনিই সত্য, স্বয়ং সত্য যাঁর নিত্য সহগামী

পৃথিবীর পবিত্রতম গৃহে জন্ম নিয়ে যিনি অনন্য

যাঁর জ্ঞানের দরোজা পেরিয়ে যেতে হয় নগরে

রাসূলের জ্ঞান-ধ্যানের পবিত্র আলোয় ধন্য

যে নগর জাহেলি পৃথিবীকে দিয়েছে আলোর দিশা

শ্বাশ্বত যে আলোয় কেটে গেছে কালের অমানিশা।

খাওয়ারেযমি লিখেছেন, নবী করিম ( সা ) বলেছেন, আমার পরে আমার উম্মতের মধ্যে সবচেয়ে বড় জ্ঞানী হল আলী ইবনে আবি তালিব। জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ আনসারীও বর্ণনা করেন, একদিন নবীজী উচ্চৈঃস্বরে বললেন, আমি হলাম জ্ঞান ও বিজ্ঞানের শহর আর আলী হল সেই শহরের দরজা। তাই যে-ই জ্ঞান অর্জন করতে ইচ্ছুক সে যেন এই শহরের দরজার কাছে যায়।

হযরত আলী ( আ. ) যে জ্ঞানী ছিলেন তাঁর ‘নাহজুল বালাগা’-ই তার প্রমাণ। ব্যক্তিগত এবং সামাজিক জীবনের বিচিত্র সমস্যার নৈয়ায়িক সমাধান যারা চায়, সেইসব ন্যায়-নীতিবান মানুষের জন্য ‘নাহজুল বালাগাহ’ একটি চমৎকার গাইড লাইন।

বিশিষ্ট মুসলিম মনীষী ও দার্শনিক মরহুম আল্লামা মুহাম্মাদ তাকি জাফরি আলী (আ.)-এর ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্যগুলোর প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, দয়া এবং ভালোবাসা মানুষের উন্নত স্বাভাবিক গুণ। সকল মানুষের মাঝেই এইসব গুণ লক্ষ্য করা যায়। তবে সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে দেখা যায় ছোটোখাটো ভুলের জন্যও ঐ ভালোবাসা শত্র”তায় পরিণত হয়। কিন্তু যেসব মানুষ উন্নত নৈতিক গুণাবলি অর্জন করেছেন তাঁদের ক্ষেত্রে এই ভালোবাসা ব্যক্তিগত প্রবণতা বা ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করে না। তাঁরা সত্যের মানদণ্ডের ভিত্তিতে ভারসাম্য রক্ষা করে চলেন। কেননা, তাঁদের দৃষ্টিতে সৃষ্টিগতভাবেই মানুষ ভালোবাসার পাত্র। এই বৈশিষ্ট্যটা ইমাম আলী ইবনে আবি তালেব (আ.)-এর সমগ্র জীবনব্যাপী লক্ষ্য করা যায়। সিফফিনের যুদ্ধে শত্র”রা আলী ( আ.)-এর সেনাদের জন্য পানি সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছিল যাতে তাঁর সেনারা তৃষ্ণায় মারা যায়।

কিন্তু কিছুক্ষণ পর আলী (আ.)-এর সেনারা বীর বিক্রমে যুদ্ধ করে শত্র”পক্ষকে পিছু হটতে বাধ্য করে। ফলে ফোরাতের পানির নিয়ন্ত্রণ আলী (আ.)-এর সেনাদের হাতে এসে যায়। ইমামের সঙ্গীরা তখন শত্র”দের মতোই পানি সরবরাহ তাদের জন্য বন্ধ করে দিতে চাইলো। কিন্তু আলী (আ.) একাজ থেকে তাঁর সেনাদের বিরত রাখলেন এবং বললেন, ‘আমি কখনোই এভাবে বিজয় লাভ করতে চাই না। কেননা, এই বিজয়ের মধ্যে মুসলমানিত্বের কোনো চিহ্ন নেই।’

একইভাবে যখন নামায পড়া অবস্থায় ইমাম আলী (আ.)-এর মাথা মুবারকে ইবনে মুলযিম তলোয়ার দিয়ে আঘাত হেনেছিল তখনও ইমাম সবকিছুর আগে তাঁর সন্তান ইমাম হাসান (আ.)-কে বলেছিলেন তাঁর হত্যাকারীর ওপর যেন যুলুম নির্যাতন করা না হয়। এটা হলো সেই চারিত্রিক সৌন্দর্য, সেই ভালোবাসা যা মহান মনীষিগণকে উন্নত এবং পূর্ণতাপ্রাপ্তির মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করে। হযরত আলী (আ.) ছিলেন সেই পূর্ণতাপ্রাপ্ত মহান মনীষীদের অন্যতম। প্রশ্ন জাগতেই পারে, কী করে তিনি এইসব অসামান্য গুণ অর্জন করেছেন? উত্তরটা খুবই সোজা। কেননা, তিনি পরশ পাথরের সংস্পর্শে বেড়ে উঠেছেন। আল্লাহর শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর ঘরে বড় হয়েছেন যেখান থেকে ইসলামের দাওয়াত শুরু হয়েছিল। সারাটি জীবন তিনি নবীজীর সাহচর্যে ছিলেন। তাঁর সাহচর্য পেয়েই আধ্যাত্মিকতার পূর্ণতায় পৌঁছেছেন তিনি।

বর্তমান বিশ্বে ‘জোর যার মুল্লুক তার’- এরকম অবস্থা বিরাজমান। যিনি শাসক তিনি যেন আইন-কানুনের ঊর্ধ্বে। তাঁর ব্যাপারে যেন কোনো আইন নেই, বিচার নেই। কে করবে তার বিচার? অথচ আলী (আ.) সুযোগ থাকা সত্ত্বেও কোনোদিন খেলাফতের শক্তি বা ক্ষমতাকে ব্যক্তিস্বার্থে ব্যবহার করেন নি। একটি ঘটনার উল্লেখ করে আজকের আলোচনার পরিসমাপ্তি টানব। হযরত আলী (আ.) তাঁর খেলাফতকালে একদিন তাঁর বর্মটা হারিয়ে ফেলেছিলেন। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তা পেলেন না। কিছু সময় পেরিয়ে গেল। একদিন একটি গলিতে কুফার এক খ্রিস্টান লোকের হাতে দেখলেন তার ঐ হারানো বর্মটি। লোকটি নিকটবর্তী হতেই তিনি চিনতে পারলেন তাঁর বর্মটি। আলী (আ.) লোকটিকে তাঁর বর্মটি ফিরিয়ে দিতে বললেন। কিন্তু খ্রিস্টান লোকটি অস্বীকার করে বললো যে, সেটা তারই বর্ম। ফয়সালার জন্য দু’জনেই গেলেন শহরের কাজীর কাছে।

কাজী আলী (আ.)-কে খলিফা হিসেবে কোনোরকম গুরুত্ব না দিয়ে একজন সাধারণ বাদীর মতোই দেখলেন। বাদী-বিবাদী উভয়কেই নিজ নিজ স্থানে বসতে বললেন এবং ঘটনা কী জানতে চাইলেন। আলী (আ.) বললেন, ‘ওর হাতের ঐ বর্মটা আমার। আমি না বিক্রি করেছি, না তাকে দান করেছি। তাকে ফেরত দিতে বললে সে ফেরত দিল না।’ পক্ষান্তরে খ্রিস্টান লোকটিও বলল যে, বর্মটা তার। বিচারক এবার ইসলামি আইন অনুযায়ী আলী (আ.)-কে দুইজন সাক্ষী আনতে বললেন। আলী (আ.) বললেন-‘মিকদাদ এবং আমার ছেলে হাসান সাক্ষ্য দেবে যে, ঐ বর্মটা আমার।’ কাজী বললেন, ‘মিকদাদের সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য, কিন্তু হাসানের নয়। কারণ, হাসান আপনার সন্তান। ফলে আপনি ঐ বর্মের মালিকানা দাবি করতে পারেন না, বর্মটা তাই খ্রিস্টান লোকটির।’

আলী (আ.) বিচারকের রায় শোনার পর কোনোরকম অভিযোগ না করে উঠে চলে গেলেন। খ্রিস্টান লোকটি জানত যে, আলী (আ.) তাঁর শাসন-ক্ষমতা ব্যবহার করে নিজের অধিকার আদায় করে নিতে পারতেন, কিন্তু তিনি আদালতের শরণাপন্ন হলেন। এ বিষয়টি খ্রিস্টান লোকটিকে ভীষণভাবে বিস্মিত করে। সে আলী (আ.) এর পূত-পবিত্রতা এবং সততা দেখে অবিশ্বাস্যরকমভাবে উঠে দাঁড়ালো এবং আলী (আ.) এর পেছনে ছুটলো। নিজেকে আলীর পায়ে সঁপে দিল। আলী (আ.) তাকে ওঠালেন এবং শান্ত হতে বললেন। খ্রিস্টান লোকটি সলজ্জভাবে আলী (আ.) কে তাঁর বর্মটি ফেরত দিল এবং সেখানেই ইসলাম গ্রহণ করল।

সূত্র: আইআরআইবি