জ্ঞানসাধক কবি ও সাংবাদিক অধ্যাপক সিরাজুল হক
পোস্ট হয়েছে: জুলাই ২৩, ২০২৫

বাংলাদেশের বিশিষ্ট সাংবাদিক,কবি,সাহিত্যিক, লেখক,গবেষক ও অনুবাদক অধ্যাপক সিরাজুল হক ১৯৪৭ সালে বরিশাল জেলার ‘আবদা বিশর’ গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বর্তমানে ভোলা জেলার রাসুলপুর গ্রামে তাঁর পৈত্রিক নিবাস। ঐতিহ্যবাহী পরিবারে জন্মগ্রহণ করা সিরাজুল হক মাত্র দুই বছর বয়সে মাতৃহারা হন এবং অষ্টম শ্রেণিতে থাকাকালীন তাঁর বাবাকে হারান। তাঁর বাবা নূর বক্স হাওলাদার ছিলেন সমাজসেবক এবং দাদা ব্রিটিশ আমলের পোস্ট মাস্টার। অল্প বয়সেই পিতামাতাহীন হয়ে বেড়ে ওঠেন নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে, কিন্তু শিক্ষাজীবনে বরাবরই ছিলেন মেধার শীর্ষে। তিনি স্বাধীনতার পূর্বে ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে বিএ অনার্স ও ১৯৭০ সালে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন এবং এস এম হলের(স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম) ছাত্র ছিলেন। সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে অবস্থানকালেই লেখালেখি, সাহিত্যচর্চা ও সাংবাদিকতা শুরু করেন। তাঁর শিক্ষক ছিলেন শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরী, ড. মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, ড. আবদুল হাই, ড. নীলিমা ইব্রাহিমসহ অনেকে। তিনি বাংলা, ইংরেজি, আরবি, ফারসি, উর্দু, হিন্দি প্রভৃতি ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন। এছাড়া ছাত্র থাকাকালীন তুর্কি ভাষায়ও শিখেছিলেন।
সাংবাদিক সিরাজুল হকের কর্মজীবন শুরু হয় শিক্ষকতা পেশা দিয়ে। বরিশালের কামারখালি কলেজে বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও পরে অধ্যক্ষ ছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক বাহিনীর হাতে আটক হয়ে নির্যাতিত হন। তাঁর ডায়েরিতে বঙ্গবন্ধুসহ রাজনৈতিক নেতাদের নাম ও নম্বর পাওয়ায় সন্দেহের তীর তাঁর দিকে ছোড়া হয়, তবে অলৌকিকভাবে তিনি প্রাণে বেঁচে যান।
শিক্ষকতার জীবনের এক পর্যায়ে তিনি গভীরভাবে সাংবাদিকতা, গবেষণা ও লেখালেখির জীবনে প্রবেশ করেন ।
১৯৬৫ সালে সাপ্তাহিক ‘Young Pakistan’ পত্রিকার মাধ্যমে তাঁর বর্ণাঢ্য সাংবাদিকতা জীবনের সূচনা হয়। কর্মজীবনে তিনি দৈনিক আজাদ ও দৈনিক জনপদসহ বিভিন্ন স্বনামধন্য পত্রিকায় গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। জনপদ-এ বিভিন্ন দায়িত্বে বহাল ছিলেন। ১৯৮৩ সালের ডিসেম্বরে দৈনিক জনপদের বার্তা ও নির্বাহী সম্পাদকের পদ অলংকৃত করেন পরবর্তীকালে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হন। এ দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিয়ে কিছুদিন ব্যবসায় আত্মনিয়োগ করেন।
এছাড়াও জনাব সিরাজুল হক দ্য ডন, অধুনালুপ্ত মাসিক তাহজীব ও সাপ্তাহিক ইংরেজি ‘Walfajar’-এর সম্পাদক ছিলেন।
১৯৭৯ সালে ইরানের ইসলামী বিপ্লব সংগঠিত হওয়ার পর ১৯৮৭ সালের ১৬ জানুয়ারি তেহরানে ‘Islamic Propagation Organization’ এ বাংলা বিভাগের প্রধান হিসাবে যোগদান করেন। এছাড়া তিনি কিছুদিনের জন্য তেহরান টাইমস ও ইরান রেডিও তেহরানের সাথে (খণ্ডকালীন হিসেবে) জড়িত ছিলেন।
১৯৯০ সালের ৩০ জুলাই চাকুরি ছেড়ে দিয়ে দেশে চলে আসেন। ১৯৯০ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ২০ বছর তিনি ঢাকাস্থ ইরানি সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের মুখপত্র নিউজ লেটার-এর সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি আনজুমানে ফারসি বাংলাদেশের সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন। এছাড়াও তিনি ১৯৬৭ সালে গঠিত অনন্য সাহিত্য সংস্কৃতি সংসদ ও ১৯৯৪ সালে প্রতিষ্ঠিত আল্লামা ইকবাল রিসার্চ একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন।
বিভিন্ন সময়ে তিনি বিভিন্ন দেশ সফর করেন। এছাড়া তিনি দেশে বিদেশে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সেমিনারে অংশগ্রহণ করে গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। ইরানে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সেমিনারে ফারসি ভাষা প্রচারে বিশেষ অবদানের জন্য তাকে স্বর্ণমুদ্রা ও সনদ প্রদান করা হয়।
অধ্যাপক হক সাংবাদিকতা ও শিক্ষাক্ষেত্রে অসংখ্য তরুণকে উৎসাহিত করেছেন। কর্মজীবনে সৌদি আরব, ইরান, ইরাক, আরব আমিরাত, ভারত, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, গ্রিস, লিবিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, রোমসহ বিশ্বের বহু দেশে ভ্রমণ করেন এবং প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সফরসঙ্গীও ছিলেন। বিভিন্ন সময়ে তিনি বিভিন্ন দেশ সফর করেন।
সিরাজুল হক ছিলেন জাতীয় প্রেসক্লাবের আজীবন সদস্য, নিউইয়র্ক বাংলাদেশ প্রেসক্লাবের সক্রিয় সদস্য এবং বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের নির্বাচিত কোষাধ্যক্ষ।
সাংবাদিকতার পাশাপাশি তিনি সাহিত্যচর্চাও করেন।
কবিতা,শিশু-সাহিত্য , উপন্যাস, গবেষণা, প্রবন্ধ ও অনুবাদ গ্রন্থ সব মিলিয়ে তাঁর বইয়ের সংখ্যা ৩০ এর অধিক । তাঁর মৌলিক রচনা ‘মুক্তির পথ’ প্রকাশিত হয় ১৯৭২ সালে। ‘বহতা নদীর মতো’ ( তাঁর প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ)।
*মৌলিক রচনাবলি :
মুক্তির পথ (১৯৭২), হরেক রকম মজা, হাজার কাঠি(দুটি ছড়াগ্রন্থ), রাত পোহালো, ছুটির দিনে, ময়নার চিড়িয়াখানা (শিশুতোষ), বেদনার তিমিরে (গল্প গ্রন্থ), আন্ডিল গাঁওয়ের ইতিকথা (শিশুতোষ), ডেফোডিলের মতো, এসো বৃষ্টি ঝড়ের বেগে, হেজাযের পথে প্রান্তরে, মহানবীর মহাজীবন (প্রকাশের পথে)।
*অনূদিত গ্রন্থাবলি :
নিজের ঘরে অপরিচিত (১৯৬৬), সমাজতন্ত্র ও ইসলাম (১৯৬৬), তামাদ্দুনে আরব (১৯৭০), শহীদ হাসানুল বান্নার রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) (১৯৭৭), খতমে নবুয়্যত (১৯৮৫), যুদ্ধ ও সন্ধি ১৯৮৭), হিজরত ও জিহাদ (১৯৮৮), মহানবীর সংক্ষিপ্ত জীবন চরিত (১৯৯১), ইসলামী আদর্শ: একটি বৈজ্ঞানিক পর্যালোচনা (১৯৯১), আজকের মানুষ ও সামাজিক সংকট (১৯৯৩), সত্যের আহ্বান (১৯৯৩), ঝর্ণার প্রহরী (১৯৯৩), তাহেরার নামে পত্র (অনুবাদ গ্রন্থ)।
তিনি কয়েকটি আরবি পুস্তকেরও বঙ্গানুবাদ করেন। ফারসি-বাংলা অভিধান যৌথ সম্পাদনা করেন।
তাঁর প্রবন্ধ সংকলন দিন যায় কথা থাকে (যন্ত্রস্থ), সফরনামা (যন্ত্রস্থ), প্রবন্ধসংগ্রহ (যন্ত্রস্থ)।
এছাড়া বাংলায় অনূদিত সহীহ আল-বুখারি, পারলৌকিক জীবন এবং ইসলামের দৃষ্টিতে কাদিয়ানী ও বাহাই মতবাদসহ কতিপয় গ্রন্থের সম্পাদনা করেন।
তাঁর বড় ছেলে অধ্যাপক ড. তারিক জিয়াউর রহমান সিরাজী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ও সিনিয়র শিক্ষক। ড.তারিক জিয়াউর রহমান সিরাজীর ছাত্র সুজন পারভেজের লেখা সিরাজুল হক স্মরণে রচিত কবিতা:
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী
অধ্যাপক সিরাজুল হক জ্ঞানপূজারী।
লেখা পড়াই যার নেশা
যাকে দেখলে দূর হয় নিরাশা।
নির্যাতিত আর নিপীড়িত মানুষের ব্যথা
যার কবিতার মূল কথা
ন্যায় নীতি ও অন্যায়ের প্রতিবাদে
শক্তিশালী বজ্রকন্ঠ হয়ে বাজে।
ইসলামের সৌন্দর্য ও শান্তির বাণী
যার কথা ও কবিতার কাহিনী
বহুভাষাবিদ ও জ্ঞান সাধক হয়ে
কাজ করেছেন নিভৃত অন্তরালে
তাঁর বহতা নদী,ডেফোডিল ও বৃষ্টি ঝড়ের আকাশে
সাতটি ছড়ার সিতারা জ্বলছে আলো হয়ে।।
মানবিক চেতনাসম্পন্ন এক সংস্কৃতিমনা ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক সিরাজুল হক ২৬ জুন ২০২৫ বৃহস্পতিবার নিউইয়র্ক সময় সকাল ১১:১৫ মিনিটে (বাংলাদেশ সময় রাত ৯:১৫) নিউইয়র্কের কুইন্স সিটির কুইন্স হাসপাতালে কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়ে পরলোকগমন করেন। ২৯ জুন রবিবার সকালে আমেরিকা থেকে মরহুমের মরদেহ ঢাকায় আনা হয় পরে ঐ দিনই বাদ আছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে জানাযার নামায অনুষ্ঠিত হওয়ার পর আজিমপুর কবরস্থানে তাঁর সহধর্মিণীর পাশে তাকে দাফন করা হয়।
সুজন পারভেজ
শিক্ষার্থী, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।