ক্যানেল: পৃথিবীর বুকে ইরানি স্থাপত্যকর্মের এক অনন্য নিদর্শন
পোস্ট হয়েছে: সেপ্টেম্বর ২, ২০২৫

ইরানের ক্যানেলগুলো (কানাত বা কারিজ) এখানকার স্থাপত্যকর্মের সবচেয়ে উজ্জ্বল অর্জনগুলির মধ্যে একটি। ইরানের প্রাচীন সভ্যতার মধ্যেই রয়েছে এর শেকড়। ভূগর্ভস্থ পানি এই ক্যানেলগুলোর মাধ্যমে সরবরাহের ব্যবস্থা করা হতো। বিশেষ প্রক্রিয়ায় উচুঁস্থান থেকে পানি অন্যান্য শুকনো অঞ্চলে সরবরাহ করা হতো।
ক্যানেলগুলি কেবল প্রাকৃতিক সম্পদ পরিচালনায় ইরানি দক্ষতার প্রতীক নয় বরং সভ্যতা নির্মাণ, কৃষি উন্নয়ন এবং পরিবেশগত ভারসাম্যের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
ইরানে ক্যানেলগুলোর (কানাতগুলির) ঐতিহাসিক উৎপত্তি
ইরানে ক্যানেলগুলোর দীর্ঘ প্রায় ২৫০০ বছরেরও বেশি পুরনো।
ঐতিহাসিক তথ্য প্রমাণে দেখা যায় যে, প্রথম ক্যানেল তৈরি করা হয়েছিল আচেমেনিড যুগে। তারপর দ্রুত গোটা ইরানে ছড়িয়ে পড়ে। ভূতত্ত্ব, ভূমি ঢাল এবং ভূগর্ভস্থ পানি সম্পদ সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞানের মাধ্যমে, ইরানিরা ক্যানেলগুলোর জটিল সমন্বয় করতে সক্ষম হয়েছিল। যার কিছু কিছু এখনও সক্রিয় রয়েছে। খ্রিস্টপূর্ব ১ম সহস্রাব্দের গোড়ার দিকে ইরানের শুষ্ক পাহাড়ি অঞ্চলে পানি সরবরাহের নালা নির্মাণের প্রযুক্তি ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলে যেসব অঞ্চলের কৃষকরা যখন দীর্ঘ শুষ্ক মৌসুমে পানির অভাবে পড়ে এবং চাষ করতে ব্যর্থ হয় তখন এই পানির নালাগুলো ব্যবহারের মাধ্যমে তারা চাষাবাদ করত। আর এই পানি নালা প্রক্রিয়াটি ধীরে ধীরে বিশ্বের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে। এখন চীন থেকে মরক্কো এমনকি আমেরিকাতেও অনেক পানির নালা রয়েছে।
খোরাসান রাজাভির গোনাবাদের ক্যানেলটি বিশ্বের গভীরতম ক্যানেল
এর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উদাহরণগুলির মধ্যে একটি হল উত্তর-পূর্ব ইরানের খোরাসান রাজাভি প্রদেশে অবস্থিত কাসবেহ গোনাবাদ পানিনালী। বিশ্বের প্রাচীনতম এবং গভীরতম পানিনালাগুলির মধ্যে একটি হিসাবে পরিচিত। এর গভীরতা ৩৫০ মিটারেরও বেশি।
দক্ষিণ ইরানের ইয়াজদের জারচ ক্যানেলকে ইরানের দীর্ঘতম পানিনালী হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এর দৈর্ঘ্য ৭০ কিলোমিটারেরও বেশি। ২০১৬ সালে, জাতিসংঘের শিক্ষা, বৈজ্ঞানিক ও সাংস্কৃতিক সংস্থা (ইউনেস্কো) ১১টি ইরানি পানিনালীকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে নিবন্ধিত করে। ইরানের এই প্রাচীন প্রযুক্তির গুরুত্ব বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে।
মধ্য ইরানের ইয়াজদের জারচ পানিনালী
ইউনেস্কো-নিবন্ধিত ক্যানেলগুলোর মধ্যে রয়েছে গোনাবাদ কাসবেহ, বালাদেহ ফেরদৌস, জারচ হাসান আবাদ, মির্জা নাসরাল্লাহ মেহরিজ ওয়াটার মিল, জোপার কেরমান, আকবরবাদ এবং কাসেম আবাদ, বারভাত বামে, আরদেস্তানের মোন, ইসফাহানের ভাজওয়ান এবং মাজদাবাদ এবং আরাকের ইব্রাহিম আবাদ, খোরাসান রাজাভি, দক্ষিণ খোরাসান, ইয়াজদ, কেরমান, মারকাজি এবং ইসফাহান এই ছয়টি প্রদেশে।
গোনাবাদ কাসবেহের ক্যানেল, ইরান এবং বিশ্বের গভীরতম ক্যানেল
গোনাবাদ কাসবেহের ক্যানেলটি ইরান এবং বিশ্বের গভীরতম ক্যানেল। এটি খোরাসান রাজাভি প্রদেশে অবস্থিত। এই ক্যানেলটি আড়াই হাজার বছরেরও বেশি পুরানো। আছামেনিড আমলে নির্মিত হয়েছিল এবং এর কূপের গভীরতা ৩৫০ মিটারেরও বেশি। এই ক্যানেলের দৈর্ঘ্য প্রায় ৩৩ কিলোমিটার এবং এখনও আশেপাশের এলাকায় পানি সরবরাহ করে। ২০১৬ সালে কাসবেহের ক্যানেলটি ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে নিবন্ধিত হয়।
ক্যানেলের ব্যবহার
প্রাচীন কালে ইরানে খাবার পানি সরবরাহ, কৃষিজমি সেচ, এমনকি ঘরবাড়ি ও সরকারি ভবন ঠান্ডা করার জন্য ক্যানেল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। ইয়াজদ (দক্ষিণ ইরান), কেরমান (দক্ষিণ-পূর্ব ইরান) এবং কাশান (মধ্য ইরান) এর মতো শহরগুলিতে নগর স্থাপত্য গৃহস্থালীর কাজে, স্নানঘর, জলাধার এবং বাগানের জন্য ক্যানেলর পানি ব্যবহারের জন্য নকশা করা হয়েছিল যাতে এই টেকসই এবং কম খরচের ব্যবস্থা শুষ্ক ও মরুভূমি অঞ্চলে বসবাস সম্ভব করে তুলতে পারে এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারে। ক্যানেল কেবল একটি স্থাপত্য প্রযুক্তি নয়, বরং ইরানের সাংস্কৃতিক পরিচয়েরও অংশ।
পার্সটুডে/