রবিবার, ২৮শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১৫ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

কারবালার শাশ্বত বিপ্লব (পর্ব-১)

পোস্ট হয়েছে: আগস্ট ১২, ২০২১ 

news-image
শোকাবহ মহররম উপলক্ষে কারবালার শাশ্বত বিপ্লব ধারাবাহিক প্রবন্ধের প্রথম পর্ব থেকে সবাইকে জানাচ্ছি সংগ্রামী সালাম ও গভীর শোক আর সমবেদনা।
আবারও ফিরে এসেছে গভীর শোকাবহ মাস পবিত্র মহররম। এই মাস ইসলামের চিরস্মরণীয় ও ঐতিহাসিক পুনর্জাগরণের মাস এবং এই মাস সবাইকে স্মরণ করিয়ে দেয় ইসলামের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ ও কুরবানির বিশ্ববিশ্রুত ইতিহাস। যা কিছু পবিত্র উদ্দেশ্য নিয়ে তথা আন্তরিক চিত্তে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করা হয় তা চিরস্থায়িত্ব লাভ করে। কারবালার মহাবিপ্লবও হচ্ছে এমনই একটি ঐতিহাসিক ও বিশ্ব-নন্দিত মহাবিপ্লব। এ বিপ্লব অন্যায়, জুলুম, শোষণ এবং অধর্ম ও খোদাদ্রোহিতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের অনন্ত উদ্দীপনার উৎস। কারবালার ঘটনার একদিকে রয়েছে ব্যাপক পাশবিকতা আর নৃশংসতার তাণ্ডব  যার নেতৃত্বে ও কর্মপ্রবাহে ছিল খোদাদ্রোহী,  জালিম ও পবিত্র ইসলাম ধর্মকে বিকৃতকারী উমাইয়া গোত্রবাদী মুয়াবিয়া ও ইয়াজিদি গোষ্ঠীর নিকৃষ্টতম ভূমিকা; আর অন্যদিকে ছিল মহানবী (সা)-এর দ্বিতীয় তথা কনিষ্ঠ দৌহিত্র হযরত ইমাম হুসাইনের নেতৃত্বাধীন একদল ইসলাম-প্রেমিক মানুষের অতুলনীয় বীরত্ব ও ত্যাগের অনন্য-সুন্দর ও কিংবদন্তীতুল্য কাব্যময় কীর্তি তথা ইসলামী জাগরণের উৎকৃষ্টতম ভূমিকা। তাই বিশ্ব-ইতিহাসে ও মানব মনের সবচেয়ে গভীরে স্থান পেয়েছে চিরস্মরণীয় এই মহাবিপ্লব।
নিঃসন্দেহে কারবালার মর্ম বিদারী ঘটনা হলো মানব ইতিহাসের দীর্ঘ পরিক্রমায় ঘটে যাওয়া অজস্র ঘটনাবলির মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও শিক্ষণীয়। এটা এমন এক বিস্ময়কর ঘটনা, যার সামনে বিশ্বের মহান চিন্তাবিদরা থমকে দাঁড়াতে বাধ্য হয়েছেন, পরম বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে স্তুতি-বন্দনায় মুখিরত হয়েছেন এই নজিরবিহীন আত্মত্যাগের। কারণ, কারবালার কালজয়ী বিপ্লবের মহানায়করা ‘অপমান আমাদের সয় না”- এই স্লোগান ধ্বনিত করে ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য সংখ্যায় হাতে গোনা জনাকয়েক হওয়া সত্ত্বেও খোদায়ী প্রেম ও শৌর্যে পূর্ণ টগবগে অন্তর নিয়ে জিহাদ ও শাহাদাতের ময়দানে আবির্ভূত হন এবং প্রতারণা ও প্রবঞ্চনার অন্ধকার জগতকে পেছনে ফেলে ঊর্ধ্বজগতে মহান আল্লাহর সনে পাড়ি জমান। তারা নিজ কথা ও কাজ দিয়ে জগতবাসীকে জানিয়ে দিয়ে যান যে, ‘‘যে মৃত্যু সত্যের পথে হয়,তা মধূর চেয়েও সুধাময়।’’
বিশ্বের অধিকাংশ মুসলমানের জীবনপটে যেমন, তেমনি তাদের পবিত্র বিশ্বাসের পাদমূলেও আশুরার সঞ্জীবনী ধারা প্রবাহমান। কারবালার আন্দোলন সুদীর্ঘ চৌদ্দশ’ বছর ধরে-সুগভীর বারিধারা দিয়ে তৃষ্ণা মিটিয়ে আসছে প্রাণগুলোর। আজও মূল্যবোধ,আবেগ,অনুভূতি,বিচক্ষণতা ও অভিপ্রায়ের অযুত-অজস্র সুক্ষ্ণ ও স্থূল বলয় বিদ্যমান যা এই আশুরার অক্ষকে ঘিরে আবর্তনশীল।
প্রেমের বৃত্ত অঙ্কনের কাটা-কম্পাস স্বরূপ হলো মহররম মাসের সেই কারবালা ও সেই আশুরা।
সেই কারবালাই পরবর্তীকালে জন্ম দিয়েছে তাওয়াবিন আন্দোলন ও মহামতি মুখতারের বিপ্লব, জন্ম দিয়েছে নফসে জাকিয়া ও ইমাম জায়েদের আন্দোলন। আর এইসব আন্দোলনের পরিণতিতেই ভেসে গেছে জালিম উমাইয়াদের রাজতন্ত্র এবং জোরদার হয় বিশ্বনবীর পবিত্র আহলে বাইতভুক্ত ইমামদের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক নানা আন্দোলন। যুগে যুগে দেশে দেশে নানা ইসলামী জাগরণ ও জুলুম বিরোধী গণ-বিদ্রোহ, যেমন সারবেদারান আন্দোলন এবং এমনকি সাম্প্রতিক যুগে সংঘটিত ইরানের ইসলামী বিপ্লবও কারবালার সেই মহাবিপ্লবের কাছে ঋণী। আজকের যুগেও শহীদ নাব্বাব সাফাভী, শহীদ চামরান, শহীদ ইমাদ মুগনিয়া ও  সাম্প্রতিক সময়ের শহীদ কাসেম সুলায়মানি ও আবু মাহদি আল মুহান্দিসরা সেই আশুরা এবং শাহাদাতের অনুপম সংস্কৃতিরই সুফল।
মহররম মাস বিশ্ব ইতিহাসের  গুরুত্বপূর্ণ বহু ঘটনার মাস হলেও কারবালার মহাবিপ্লব ও এ বিপ্লবের মহানায়ক শহীদ-সম্রাট হজরত ইমাম হুসাইন (আ) এবং তাঁর উৎসর্গকৃত-প্রাণ সঙ্গীদের শাহাদতের ঘটনাই এ মাসের সবচেয়ে বড় ঘটনা হিসেবে স্বীকৃত ও সর্বোচ্চ মহিমায় চিরসমুজ্জ্বল। ইসলামের সবচেয়ে মর্মান্তিক ও সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত হিসেবে এক অমর মহাআদর্শ জড়িয়ে আছে এই পবিত্র মাসের সঙ্গে। খোদাপ্রেম, আত্মত্যাগ, ন্যায়কামীতা ও জুলুমের বিরুদ্ধে সংগ্রামের মতো নানা মহতী চেতনার সর্বোচ্চ প্রকাশ মহররমকে করেছে প্রকৃত খোদায়ী ধর্ম এবং সভ্যতার সবচেয়ে গৌরবময় পতাকা তুলে ধরার মাস।
মহররম ও কারবালার মহাবিপ্লবকে বুঝতে হলে সব কিছুর আগে ভালোভাবে জানতে হবে প্রকৃত মুহাম্মাদি ইসলামের মূল কাণ্ডারিদের প্রকৃত মর্যাদা এবং বিশেষভাবে হযরত ইমাম হুসাইন (আ)-এর প্রকৃত পরিচয় ও মর্যাদার স্বরূপ। একইসঙ্গে বুঝতে হবে প্রকৃত মুহাম্মাদি ইসলামের বিপরীত পথে চলা পশু-শক্তির মূল কুচক্রী ও তাদের কারসাজিগুলোকেও।
কারবালার মহাবিপ্লব বিশ্বের সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা হিসেবে অবিস্মরণীয়। এই মহাট্র্যাজেডির পরিবেশ ও পটভূমি লুকিয়ে ছিল আরব গোত্রগুলোর প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও দ্বন্দ্বের মধ্যে। মহানবী (সা) নিজে ছিলেন কুরাইশদের মধ্যে সবচেয়ে সম্মানিত গোত্র তথা হাশেমি গোত্রের। হযরত ইব্রাহিম (আ)-এর বংশধারা হতে আসা এ গোত্রের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা কাবা ঘরের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারী ছিলেন।  মহানবী (সা)-এর দাদা আবদুল মোত্তালেব ও পরবর্তীতে আবুতালিব একই কারণে বিশেষ সম্মানের অধিকারী ছিলেন। পরবর্তীকালে মহানবী (সা) মহান আল্লাহর সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসুল (সা) হিসেবে আরব বিশ্বে সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারী হয়েছিলেন। আর মহানবীর পবিত্র আহলে বাইতের সদস্য হযরত আলী (আ) এবং হযরত ফাতিমা জাহরার (সালামুল্লাহি আলাইহা) সন্তান হযরত ইমাম হাসান ও হুসাইনও সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারী হওয়ায় গোত্রবাদী ঈর্ষায় আক্রান্ত হয়েছিল অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি। তাই হাশেমি বংশের মোকাবেলায় কুরাইশ বংশের অন্য গোত্রগুলোর মধ্যে এক ধরনের ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার সম্পর্ক জোরালো হয়ে উঠেছিল। আর এ অবস্থা থেকে সর্বোচ্চ রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে সক্ষম হয়েছিল উমাইয়া বংশ।  পার্সটুডে