বৃহস্পতিবার, ১৪ই আগস্ট, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ৩০শে শ্রাবণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

English

ইরানি গার্ডেন, যেন পৃথিবীতে স্বর্গের কাল্পনিক প্রতীক (ভিডিও)

পোস্ট হয়েছে: এপ্রিল ২৫, ২০১৯ 

news-image

নিপুণ হাতে গড়ে তোলা সাজানো গোছানো বাগান। যার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং কলা ও স্থাপত্যের নান্দনিক গুণাবলি সমবেত হয়ে ফুটিয়ে তুলেছে অপরূপ দৃশ্য। ইরানি এই গার্ডেনগুলো প্রায় ছয় হাজার বছরের পুরনো। প্রত্যক্ষ করলেই মনে হয়, এ যেন পৃথিবীতে স্বর্গের প্রতীকী উপস্থাপনা।

জানা যায়, প্রাচীনকালে ইরানিরা পবিত্র কর্ম হিসেবে গাছপালা রোপন করতো। অতঃপর ধীরে ধীরে তারা তাদের এই দক্ষতাকে কৃষি ও স্থাপত্যের কাজে ঢেলে দিলো। তখন চরম জলবায়ু পরিস্থিতিতে কীভাবে বেঁচে থাকার অধিকতর কার্যকর উপায় বের করা যায় তা নিয়ে অবিরাম প্রচেষ্টা চলছিল। এরই অংশ হিসেবে বাগানগুলোকে সুসজ্জিত করে নির্মাণ করার কাজ শুরু হয়।

ইরানি বাগানগুলোর জটিল জ্যামিতিক নকশায় চারটি মূল উপাদান পাওয়া যায়। আধ্যাত্মিক ও অবসর বিনোদোনের জন্য সুরক্ষিত জায়গা তৈরিতে বাগানের চারপাশে নির্মাণ করা হয় উঁচু প্রাচীর। এসব বাগানের মধ্যখানের সবচেয়ে উঁচু জায়গায় প্রাসাদ স্থাপন করা হয়। সাথে থাকে একটি পানির পুল। যা টাইলস ও ঝরনা দিয়ে সুসজ্জিত করা হয়। সবুজ গাছপালা আচ্ছাদিত পুরো বাগান এলাকায় সেঁচকাজের জন্য একটি অথবা একাধিক পানির ড্রেন রয়েছে।

ইরানি এসব গার্ডেনে যে প্রাসাদ রয়েছে, তার অভ্যন্তরে রয়েছে ভেতরের অঙ্গন। এই অঙ্গনটিকে ঘিরেও গড়ে তোলা হয় বাগান। স্থাপত্য উপাদান দিয়ে বাগান ও প্রাসাদ- এই দুই স্থানের মধ্যে দারুণ সংযোগ গড়ে তোলা হয়। ইরানের বাগানগুলো মূলত চ্যানেলের পানি নির্গমন ও পানি সরবারাহের ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গের মুখে তৈরি করা হয়। স্রোত ও পুলের মাধ্যমে এই পানি প্রবাহিত করা হয় বাগানে।

এসব পুল ও জলপ্রবাহ ঘিরে রয়েছে সিডার, পাইন ও প্লেইনের মতো লম্বা লম্বা গাছের সারি। যা এমন ঘন ছায়া তৈরি করেছে যা পানিকে বাষ্পে পরিণত হওয়া থেকে প্রতিরোধ করে এবং আঙ্গিনা রাখে রাখে ঠাণ্ডা । অন্যদিকে, পরিবেশে প্রশান্তিদায়ক ঘ্রাণ ছড়িয়ে দিতে সুশোভিত ফুল গাছ লাগানো আছে।

পুলগুলোর অবস্থান থাকে সাধারণত প্রাসাদের সামনে। যা বিশাল আয়না হিসেবে কাজ করে। পুলের পানিতে ভেসে ওঠে সুবিশাল অট্টালিকার পুরো প্রতিচ্ছবি।

হাখামানসী সাম্রাজ্যের (খ্রিস্ট পূর্ব ৫৫০ থেকে ৩৩০ সাল) সময় এই পৃথিবীতে স্বর্গ নির্মাণের ধারণা ইরানি সংস্কৃতির একটি প্রধান অংশ হয়ে ওঠে। পাশাপাশি এই সংস্কৃতি অন্যদের মাঝেও ছড়িয়ে দেওয়া হয়। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে ইরানের দক্ষিণাঞ্চলীয় ফারস প্রদেশে পাসারগাদ রাজপ্রাসাদে একটি বাগান তৈরির নির্দেশ দেন সাইরাস দ্য গ্রেট। যে বাগানের সাথে ছিল অসাধারণ প্যাভিলিয়ন, অর্কিড, পুল ও সোপান। এগুলো সুসামঞ্জস্যভাবে চার-খণ্ড পদ্ধতিতে স্থাপন করা হয়। পারস্য বাগানের স্টাইলের জন্য এটাকে প্রথম সরকারি দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

সাসানীয় সাম্রাজ্যের ( ২২৪ থেকে ৬৫১ খ্রিস্টাব্দ) সময় পানির ঝরনার আলংকারিক ও কার্যকরী ব্যবহার শুরু হয়। পুকুরগুলো জরাস্ত্রিয়ানিজিমের (অগ্নি পূজা) প্রভাবে বাগানের অধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে ওঠে। কেননা, এই ধর্মীয় বিশ্বাসে পানির যে গুরুত্বপূর্ণ মূল্য রয়েছে তার জন্য শ্রদ্ধা জানানো হয়।

ইসলাম আগমনের পর তা বাগানের জ্যামিতিক নকশা ও নান্দনিক ভঙ্গি তাৎপর্য আরও বাড়িয়ে তোলে। স্পেনের আন্দালুসিয়া থেকে ভারত এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চলে এসব বাগানের নকশার বড় ধরনের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। ভারতের মুঘল সাম্রাজ্যের (১৫২৬ থেকে ১৮৫৭ সাল) সময় নির্মিত হুমায়ুনের সমাধি ও তাজমহল তৈরি করা হয় পারস্যের অনুকরণে। বিশ্বে সর্ববৃহৎ যেসব পারস্য গার্ডেন রয়েছে তার অন্যতম এ দুটি।

সাফাভী রাজবংশের (১৫০১ থেকে ১৭৩৬ সাল) সময় ইরানি বাগানগুলোর নকশা চরম সমৃদ্ধতা লাভ করে। পারস্য গার্ডেনের স্টাইলের ভিত্তিতে প্রথম ও দ্বিতীয় রাজধানী শহর কাজভিন ও ইসফাহানের নগর পরিকল্পনার নকশা প্রণয়ন করা হয়।

বর্তমানে জাতিসংঘের শিক্ষা বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী পারস্য গার্ডেন রয়েছে ১২টি। এরমধ্যে নয়টি ইরানে, দুটি ভারতে আর একটি রয়েছে পাকিস্তানে।

ইরানি স্থাপত্য ও নগর নকশা প্রণয়নে পারস্য গার্ডেনের প্রভাবতো রয়েছেই। পাশাপাশি পারস্য গালিচার শৈল্পিক নকশায় এসব গার্ডেনের সর্বাপেক্ষা তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।

এসব পারস্য গালিচা, গার্ডেন যে স্বর্গের প্রতীক। যা স্থান ও কালের বিধিনিষেধ ছাড়িয়ে গেছে। এমন এক পৃথিবীর প্রতিচ্ছবি তৈরি করেছে যেখানে শরীর ও আত্মা লাভ করতে পারে প্রশান্তি। সূত্র: প্রেসটিভি।