বৃহস্পতিবার, ১৪ই আগস্ট, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ৩০শে শ্রাবণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

English

ইমাম জাফর সাদিক (আ.): ইসলামের অনন্য কাণ্ডারি

পোস্ট হয়েছে: জুন ২৯, ২০১৯ 

news-image

ইমাম জা’ফর আস সাদিক (আ.)ছিলেন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)’র পবিত্র আহলে বাইতের অন্যতম সদস্য। সততার কারণে তিনি “সাদিক” বা সত্যবাদী নামে খ্যাত।

তিরাশী হিজরির ১৭ রবিউল আউয়াল পবিত্র মদীনায় জন্ম নিয়েছিলেন ইমাম জাফর সাদিক। তাঁর পিতা ইমাম মুহাম্মাদ বাকেরও ছিলেন মহানবীর আহলে বাইতের সদস্য এবং নিষ্পাপ ইমাম।  আর মা ছিলেন উম্মে ফারওয়াহ ফাতিমা। পিতার শাহাদতের পর ৩১ বছর বয়সে ইমাম জাফর সাদিক মুসলিম জাহানের ইমাম হন। তিনি ১১৪ হিজরি থেকে ১৪৮ হিজরি এই দায়িত্ব পালন করেন।

ইমাম সাদিকের শিক্ষক ছিলেন দাদা ইমাম জাইনুল আবেদীন-আ. এবং পিতা ইমাম মুহাম্মাদ বাকির (আ.)।

ইমাম জাফর সাদিক (আ.) যে মহাসাগরের মত অগাধ জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন তা ছিল নবুওতী জ্ঞানেরই উত্তরাধিকার। তাই ইমাম জাফর সাদিক (আ.) বলতেন, “আমার বক্তব্য আমার বাবা ইমাম বাকের (আ.)’র বক্তব্য, তাঁর বক্তব্য আমার দাদা ইমাম জাইনুল আবিদীন (আ.)’র বক্তব্য, আমার দাদার কথা আমীরুল মুমিনিন হযরত আলীরই কথা (আ.) এবং তাঁর বক্তব্য হচ্ছে রাসূল (সা.)’রই বক্তব্য, আর রাসূলে খোদা (সা.)’র বক্তব্য হচ্ছে মহান আল্লাহরই বক্তব্য।”

ইমাম জাফর সাদিক (আ.) বলেছিলেন, ”আমাদের তথা রাসূল (সা.)’র আহলে বাইতের কাছে রয়েছে ভবিষ্যতের জ্ঞান, অতীতের জ্ঞান ও অন্তরে সঞ্চারিত খোদায়ি জ্ঞান তথা ইলহাম। আমরা শুনতে পাই ফেরেশতাদের বাণী, আমাদের কাছে রয়েছে রাসূল (সা.)’র অস্ত্রসমূহ এবং আহলে বাইতের সদস্য ইমাম মাহদী (আ.)’র কাছে না পৌঁছা পর্যন্ত সেগুলো আমাদের হাতছাড়া হবে না। আমাদের কাছে রয়েছে হযরত মূসার তৌরাত, হযরত ঈসার ইঞ্জিল, হযরত দাউদের যাবুর এবং মহান আল্লাহর পাঠানো অন্যান্য আসমানি কেতাব।”

ইমাম জাফর সাদিক (আ.) আরো বলেছেন, “আমাদের কাছে রয়েছে হযরত ফাতিমার সহিফা যাতে রয়েছে সমস্ত ভবিষ্যৎ ঘটনার বিবরণ এবং এমনকি পৃথিবীর শেষ ঘণ্টা পর্যন্ত সমস্ত শাসকের নামও তাতে লেখা আছে। আমাদের কাছে রয়েছে ‘আল জামী’ নামের দলীল, সত্তুর গজ দীর্ঘ ঐ দলীলে লেখা রয়েছে রাসূলুল্লাহ (সা.)’র বাণী এবং ঐসব বাণী আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.) নিজ হাতে লিখেছিলেন। আল্লাহর শপথ! এতে রয়েছে মানুষের জন্যে কিয়ামত পর্যন্ত প্রয়োজনীয় সবকিছু।”

অনন্য চরিত্র ও নৈতিকতার অধিকারী ইমাম সাদিক (আ.) ছিলেন অত্যন্ত দূরদর্শী, বিচক্ষণ ও মহাজ্ঞানী। তাঁর পিতার শাহাদতের পর মুসলিম জাহানে তিনিই ছিলেন জ্ঞানের সবচেয়ে বড় উৎস। ইমাম জাফর সাদিক (আ.)’র কাছ থেকে চার হাজার রাবী হাদিস সংগ্রহ করেছিলেন। ইমাম তাঁর ছাত্রদেরকে ফিকাহ, হাদিস ও তাফসীর ছাড়াও গণিত ও রসায়ন শাস্ত্রের মতো বিভিন্ন বিজ্ঞানও শেখাতেন।

বিখ্যাত ফকিহ মুহাম্মাদ বিন মুসলিম ও যুরারেহ, কালাম শাস্ত্রবিদ ও দার্শনিক হিশাম, আধ্যাত্মিক শাস্ত্রের বিশিষ্ট পণ্ডিত মুফায্যাল ও সাফাওয়ান এবং গণিত ও রসায়ন শাস্ত্রের জগত-বিখ্যাত পণ্ডিত জাবির ইবনে হাইয়ানের মতো ব্যক্তিত্বরা গড়ে উঠেছিলেন ইমাম জাফর সাদিক (আ.) ‘র জ্ঞানের স্পর্শে। এছাড়াও বায়েজীদ বোস্তামী, হাসান বসরী, ইমাম আবু হানিফা, ইমাম মালেক ও ইয়াহইয়া ইবনে সাঈদের মতো বিশ্ববিশ্রুত মনীষীরা ইমাম জাফর সাদিক (আ.)’র কাছ থেকে জ্ঞান লাভ করে নিজেদের ধন্য করেছেন।

আহলে সুন্নাতের মালিকি মাজহাবের প্রতিষ্ঠাতা মালিক ইবনে আনাস বলেছেন. ” জ্ঞান, ইবাদত ও তাকওয়ার ক্ষেত্রে জাফর ইবনে মুহাম্মাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ কোনো ব্যক্তিকে কোনো চোখই দেখেনি, কোনো কানই শোনেনি এবং কোনো মানুষ কল্পনাও করেনি।” মালিক ইমামের কাছ থেকে হাদিসও বর্ণনা করেছেন।

আহলে সুন্নাতের হানাফি মাজহাবের প্রতিষ্ঠাতা আবু হানিফা বলেছেন, “আমি জাফর ইবনে মুহাম্মাদ থেকে বড় কোন জ্ঞানী বা ফকিহকে দেখিনি। সবচেয়ে জ্ঞানী হল সেই ব্যক্তি যে মানুষের মধ্যে মতপার্থক্যের বিষয়গুলো সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি জ্ঞান রাখেন। আর জাফর ইবনে মুহাম্মাদ হলেন সেই জ্ঞানের অধিকারী।” অতীত যুগে আরবি ভাষায় ফিক্‌হ বা ফিকাহ বলতে সব ধরনের জ্ঞানকে বোঝানো হত।

ইমাম আবু হানিফা ইমাম জা’ফর আস সাদিক (আ.)’র কাছে দুই বছর শিক্ষা অর্জন করায় নিজেকে গর্বিত মনে করতেন। তিনি এই দুই বছরকে ফিকাহ শাস্ত্রের ওপর তার জ্ঞান অর্জনের মূল চালিকাশক্তি বলে মনে করতেন। এ প্রসঙ্গে আবু হানিফা বলেছেন, যদি জাফর ইবনে মুহাম্মাদের সান্নিধ্যের তথা ক্লাসের ঐ দু’বছর না থাকত তবে আবু হানিফা ধ্বংস হয়ে যেত। আবু হানিফা বলতেন, সেই দুই বছরে আমি যা শিখেছি সারা জীবনেও আমি ততটা শিখতে পারিনি। 

সাইয়্যেদ মির আলী হিন্দি ইমাম জাফর সাদিক (আ) সম্পর্কে (তারিখুল আরাব বইয়ের ১৭৯ পৃষ্ঠা) বলেছেন, ‘তিনি দিগন্ত প্রসারী চিন্তাশক্তি ও দূর-দৃষ্টির অধিকারী ছিলেন। তিনি তাঁর যুগে প্রচলিত জ্ঞানসমূহের সকল শাখায় পূর্ণ জ্ঞান রাখতেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি প্রথম ব্যক্তি হিসেবে প্রসিদ্ধ অর্থে ইসলামে দর্শন শিক্ষার গোড়া পত্তন করেন। যারা ইসলামে ফিকাহ শাস্ত্রের বিভিন্ন মাজহাবের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে আবির্ভূত হয়েছেন কেবল তারাই তাঁর কাছে শিক্ষা গ্রহণ করেননি বরং দর্শন শিক্ষার্থী ও দার্শনিকরাও ইসলামী বিশ্বের দূর দূরান্ত থেকে তাঁর ক্লাসে উপস্থিত হতেন।’

ইসলামের সার্বিক উন্নয়নের জন্য ও এ ধর্মকে সাংস্কৃতিক বা চিন্তাগত হামলাসহ সার্বিক ক্ষতিকর দিক থেকে সুরক্ষার জন্য যা যা করার দরকার তার সবই তিনি করেছিলেন।  ৩৪ বছর ধরে মুসলিম জাহানের নেতৃত্ব দেয়ার পর ১৪৮ হিজরির ২৫ শাওয়াল শাহাদত বরণ করেন ইমাম জাফর সাদিক (আ)। আব্বাসিয় শাসক মানসুর দাওয়ানিকি বিষ প্রয়োগ করে এই মহান ইমামকে শহীদ করে।

নবী-রাসূলদেরকে অশেষ দুঃখ-দুর্দশার শিকার হতে হয়েছে ইসলামের বাণী প্রচারের দায়ে। আর তাঁদের উত্তরসূরি এই মহান ইমামসহ অন্য ইমামরাও অনেকাংশে একই অবস্থার শিকার হয়েছেন। ইসলামী ভূখণ্ডগুলোতে ইমাম জা’ফর সাদিক (আ.)’র ইমামতের প্রভাব ও সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ায় ভীত-সন্ত্রস্ত আব্বাসিয় জালিম শাসক মানসুর দাওয়ানিকি বলেছিল:

 “জাফর ইবনে মুহাম্মাদ যদিও তরবারি দিয়ে সংগ্রাম করছেন না, কিন্তু তার পদক্ষেপগুলো আমার কাছে একটি অভ্যুত্থানের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ এবং কঠিন বলে মনে হয়।”

দাওয়ানিকির নির্দেশে ইমাম জা’ফর সাদিক (আ.)কে শহীদ করা হলেও  শাহাদাতের পর ইমামের নুরানি ব্যক্তিত্বের ঔজ্জ্বল্য বহুগুণ বেড়ে যায়।

৬৫ বছর বয়স্ক ইমামের লাশ দাফন করার সময় ইমাম প্রেমিক আবু হুরাইরা আজালি নিজেকে বলছিলেন:

‘তুমি কি জান কোন মহামানবের লাশ নিয়ে যাচ্ছ মাটি দিতে? তাঁর আগে ও পরে যদি ইমাম না থাকত তাহলে অবশ্যই বলতাম, কাল কিয়ামত পর্যন্ত এ পৃথিবী এমন মহামানব তৈরিতে অপারগ।’

ইমামের সামনে বিশ্বনবী (সা.)’র নাম উচ্চারিত হলে তাঁর চেহারার রং পাল্টে যেত। হজের ইহরাম বাধার পর ইমাম আল্লাহর ভয়ে এতটা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়তেন যে লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক শীর্ষক তালবিয়া উচ্চারণকে ঔদ্ধত্য বলে মনে করতেন।

ইমাম জাফর সাদিক (আ.) থেকে অসংখ্য কারামাত বা অলৌকিক ঘটনা দেখা গেছে এবং প্রসিদ্ধ অনেক মুকাশাফা (অন্তরে আধ্যাত্মিকভাবে প্রতিফলিত অদৃশ্য জগতের সত্য ঘটনাগুলো) বর্ণিত হয়েছে। এরূপ একটি ঘটনা হল একবার এক ব্যক্তি খলিফা মনসূরের কাছে তাঁর সম্পর্কে মিথ্যা রটনা করল (যে ইমাম সাদিক মনসূরের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন)। অতঃপর মানসুর যখন হজ্বে আসল যে ব্যক্তি অপবাদ দিয়েছিল তাকে ডেকে পাঠাল এবং জাফর সাদিকের সামনে তাকে বলল, তুমি যা বলেছিলে তা সত্য প্রমাণের জন্য আল্লাহর নামে কসম করতে রাজি আছ? সে বলল, হ্যাঁ।  ইমাম জাফর সাদিক মনসুরকে বললেন, ঠিক আছে, সে যা দাবি করছে সে অনুযায়ী তাকে কসম করতে বল। মানসুর তাকে বলল, তাঁর সামনে কসম কর। জাফর সাদিক ঐ ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে বললেন এভাবে কসম কর, ‘আল্লাহর শক্তি ও ক্ষমতা থেকে আমি বিচ্ছিন্ন হই এবং আমার শক্তি ও ক্ষমতার আশ্রয় চাই। সত্যিই জাফর এমন বলেছেন ও এমন করেছেন।’ ঐ ব্যক্তি প্রথমে এরূপে কসম করতে রাজী হল না। পরে তা করলো। তার কসম খাওয়া সমাপ্ত হওয়া মাত্রই ঐ লোকটি মনসূরের সামনে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল। অন্য একটি ঘটনা এরূপ বর্ণিত হয়েছে যে, এক জালেম ব্যক্তি তাঁর দাসকে হত্যা করে। ইমাম ভোর রাত্রিতে নামাজ পড়ে তার প্রতি অভিশাপ বর্ষণ করেন। তিনি এরূপ করার কিছুক্ষণের মধ্যেই ঐ জালেম ব্যক্তির মৃত্যুও কারণে তার ঘর থেকে কান্নার ধ্বনি শোনা গেল।

বর্ণিত হয়েছে, যখন তাঁর কাছে এ সংবাদ পৌঁছল যে, হাকাম ইবনে আব্বাস কালবি ইমামের চাচা যাইদ (ইবনে আলী) সম্পর্কে এ কবিতাটি (ব্যঙ্গ করে) পাঠ করেছে :আপনাদের কারণেই আমরা যাইদকে খেজুর গাছে ঝুলিয়ে হত্যা করেছি। আমরা কখনও দেখিনি কোন সৎপথপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে খেজুর গাছের কাণ্ডে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়। তখন ইমাম তাকে অভিশাপ দিয়ে বললেন, হে আল্লাহ আপনার কুকুরগুলো থেকে একটি কুকুরকে তার ওপর প্রবল করে দিন। কিছুদিন অতিবাহিত না হতেই একটি সিংহ তাকে ছিন্ন ভিন্ন করে (খায়)।

তাঁর অন্যতম কারামত তাশরী ইবনে ওয়াহাব বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, লাইস ইবনে সাদকে বলতে শুনেছি, আমি ১১৩ হিজরিতে হজ্বে গিয়েছিলাম। যখন আসরের নামাজ শেষ করে আবু কুবাইস পাহাড়ে উঠলাম সেখানে এ ব্যক্তিকে বসে দোয়া করতে দেখলাম। তিনি ‘ইয়া রাব’ ‘ইয়া রাব’ বললেন ততক্ষণ পর্যন্ত যতক্ষণ তাঁর নিশ্বাসের টান ছিল। এরপর ‘ইয়া হাইয়ু’ বলা শুরু করলেন যতক্ষণ তার দম থাকে। এরপর বললেন, হে আল্লাহ আমি আঙ্গুর খেতে চাই। আমাকে আঙ্গুর দিন। আমার গায়ের চাদরও ছিঁড়ে গেছে, আমাকে বস্ত্র দান করুন। তখনও তাঁর দোয়া শেষ হয়নি দেখলাম তাঁর সামনে এক ঝুড়ি আঙ্গুর উপস্থিত দেখলাম…

সাফওয়ান বিন ইয়াহিয়া বলেন: জাফার বিন মুহাম্মাদ বিন আশআস বলেছেন, একবার মানসুর ইমামকে পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিল এ উদ্দেশ্যে যেন তাঁর ওপর এই অজুহাতে কঠোরতা আরোপ করা যায়। এ লক্ষ্যে ইবনে মুহাজিরকে ডেকে বলল: এ অর্থ নিয়ে মদীনায় যাও। আব্দুল্লাহ ইবনে হাসান, জাফর ইবনে মুহাম্মাদ ও তাদের পরিবারবর্গের কাছে গিয়ে বলল, আমি খোরাসান থেকে মদীনায় এসেছি। এখানে আমি অপরিচিত। আর আমি আপনাদের এক অনুসারী। খোরাসানের লোকেরা এ অর্থ আপনাদের জন্য পাঠিয়েছেন। এরপর তাদের প্রত্যেককে আমি যেভাবে নির্ধারণ করেছি সেভাবে অর্থ দান কর। কিন্তু দেয়ার সময় শর্ত করবে যে, যেহেতু আমি অন্যদের প্রেরিত সেহেতু অনুরোধ হল যে পরিমাণ অর্থ আপনি গ্রহণ করলেন তা একটি কাগজে লিখে দিন। ইবনে মুহাজির মদীনায় গিয়ে তার দায়িত্ব সম্পন্ন করে ফিরে আসলে মানসুর তাকে জিজ্ঞেস করল: তুমি কি করে এসেছো তার বর্ণনা দাও। ইবনে মুহাজির বলল, তাদের কাছে গিয়েছি এবং তাদের নির্ধারিত অর্থ দিয়ে লিখিত রসিদ নিয়ে এসেছি। কিন্তু জাফর ইবনে মুহাম্মাদ তা গ্রহণ করেননি। যখন আমি তাঁর কাছে যাই তখন তিনি মসজিদুন্নবীতে নামাজ পড়ছিলেন। আমি তাঁর পেছনে গিয়ে বসলাম। মনে মনে ভাবলাম, যখন তিনি নামাজ শেষ করবেন তখন আমার কথা তাকে বলব। তিনি নামাজ শেষ করা মাত্রই আমার দিকে ঘুরে বললেন: হে লোক, আল্লাহকে ভয় কর এবং মুহাম্মাদ (সা.)-এর আহলে বাইতের সাথে প্রতারণার চেষ্টা কর না। আর তোমার বন্ধুকেও (মানসুর) যেয়ে বল, সেও যেন আল্লাহকে ভয় করে এবং মুহাম্মাদ (সা.)-এর আহলে বাইতের সাথে যেন প্রতারণার চেষ্টা না করে। তাদের (বনি আব্বাস) সাথে বনি উমাইয়ার কোন পার্থক্য নেই। তারা উভয়েই অভাবী। আমি (হতচকিত হলেও স্বাভাবিক ভঙ্গিতে) বললাম, ‘আল্লাহ আপনার মঙ্গল করুন। আমি আপনার উদ্দেশ্য বুঝতে পারি নি।’ তিনি বললেন, আমার আরো কাছে আস। আমি তার কাছে গেলে তিনি আমার ও তোমার মধ্যে যা কথোপকথন হয়েছিল তা হুবহু বর্ণনা করলেন যেন তিনি আমাদের সঙ্গে তৃতীয় ব্যক্তি হিসাবে ছিলেন। মানসুর (একথা শুনে) বলল ইবনে মুহাজির, নিঃসন্দেহে আল্লাহর রাসূলের আহলে বাইতের মধ্যে একজন অবশ্যই মুহাদ্দিস (যার সঙ্গে ফেরেশতারা কথা বলেন) রয়েছে যার কাছে ইলহাম (গায়েবীভাবে খবর) হয়। নিশ্চয়ই বর্তমানে জাফর ইবনে মুহাম্মাদ আমাদের মধ্যকার সেই ব্যক্তি।

জাফার বিন মুহাম্মাদ বিন আশআস বলেন, এই ঘটনার প্রভাবেই আমরা  নবীর (দরুদ) আহলে বাইতের অনুসারী হয়েছি। (বিহারুল আনোয়ার, খণ্ড-৪৭, পৃ-১২৯ এবং মানাকিব, খণ্ড-৪, পৃ-২২৫)

মানসুর ১৪৭ হিজরিতে হজ্বের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে মদীনায় পৌঁছায়। সে রাবি নামক এক ব্যক্তিকে ইমামের কাছে পাঠিয়ে তাঁকে তার সামনে হাজির করার নির্দেশ দিল। মানসুর তাকে বলল, আল্লাহ আমাকে হত্যা করুন যদি তাঁকে হত্যা না করি। রাবি প্রথমে মানসুরের নির্দেশকে না শোনার ভান করল যাতে হয়তো মানসুর তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে অথবা বিষয়টি একেবারে ভুলে যায়। কিন্তু মানসুর তার নির্দেশের পুনরাবৃত্তি করে বলে, তাঁকে কষ্ট দিয়ে অপমানজনক অবস্থায় আমার সামনে উপস্থিত কর। যখন ইমাম তার কাছে গেলেন সে তাঁর সঙ্গে অত্যন্ত রূঢ় আচরণ করে এবং অশোভনীয় ভঙ্গিতে বলে যে, ইরাকের লোকেরা তোমাকে নিজেদের ইমাম মনে করে এবং তোমার কাছে তাদের সম্পদের জাকাত পাঠায়। আর তাই পূর্ণশক্তি নিয়ে আমার বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছো এবং সংঘাত সৃষ্টি করছো। আল্লাহ আমাকে হত্যা করুন যদি আমি তোমাকে হত্যা না করি। ইমাম সাদিক (আ.) বললেন : হে আমির (শাসক)! আল্লাহ সুলাইমান (আ.) কে নিয়ামত দিয়েছিলেন। আর তিনি তার শোকর আদায় করেছিলেন। তিনি আইয়ুব (আ.)কে বিপদাপদ দিয়ে পরীক্ষা করেছিলেন। আর তিনি তাতে ধৈর্য ধধারণ করেছিলেন। হযরত ইউসুফ (আ.) এর প্রতি জুলুম করা হয়েছিল। আর তিনি তাঁর ওপর অবিচারকারীদের ক্ষমা করেছিলেন। মানসুর তখন বলল, “আমার কাছে আস। তুমি নিরপরাধ প্রমাণিত হয়েছো। তাই তোমাকে নিরাপত্তা দিচ্ছি। তুমি আমার জন্য কোন সমস্যা নও।

এক আত্মীয় তার আত্মীয়দের থেকে যা নিয়েছে আল্লাহ তার থেকে অনেক বেশী তোমাকে দান করুন।” এরপর সে ইমামের হাত ধরে টেনে নিয়ে নিজের পাশে বসাল এবং বলল, উপহারের বক্সটি আমার কাছে নিয়ে এস। সুগন্ধি আতরের পাত্র আনা হলে মানসুর নিজের হাতে ইমামকে তা মাখিয়ে দিল ও বলল, আল্লাহর আশ্রয় ও সংরক্ষণে থাক। অতঃপর রাবিকে বলল, হে রাবি! আবা আব্দিল্লাহর উপহার ও জোব্বা তার ঘরে পৌঁছে দিয়ে এস। রাবি ইমামের কাছ জিনিসগুলো পৌঁছে দিয়ে বলল, আমি আপনার কাছে প্রথমবার আসার পূর্বে যা দেখেছিলাম আপনি তা দেখেননি। আর তারপর যা দেখলাম তা আপনি জানেন। হে আবা আব্দিল্লাহ, আপনি মানসূরের কাছে গিয়ে কি বলেছিলেন। ইমাম বললেন, “(মনে মনে এ দোয়া করেছিলাম) হে আল্লাহ, আপনি আমাকে আপনার সেই চোখ দিয়ে হেফাজত করুন যা কখনও নিদ্রা যায় না এবং আপনার অপরাজেয় দুর্গে আমাকে আশ্রয় দিন। আমার ওপর আপনার অসীম ক্ষমতা দিয়ে আমাকে ক্ষমা করুন। কারণ আপনিই আমার সেই আশার স্থল যা আমাকে ধ্বংস থেকে রক্ষা করবে। হে আল্লাহ! আপনি ঐ ব্যক্তি হতে মহান ও শ্রেষ্ঠ যাকে আমি আমার জন্য অনিষ্টকারী বলে ভয় করি। হে আমার প্রতিপালক! তার রক্তপাতের ইচ্ছাকে আপনার মাধ্যমে প্রতিরোধ করছি এবং তার কাঙ্ক্ষিত মন্দ থেকে আপনার আশ্রয় চাইছি।” 

ইমাম জা’ফর আস সাদিক (আ.)’র কয়েকটি অমূল্য বাণী শুনিয়ে শেষ করব আজকের আলোচনা: যারা নামাজকে কম গুরুত্ব দেবে আমাদের তথা বিশ্বনবী (সা.)’র আহলে বাইতের শাফায়াত তাদের ভাগ্যে জুটবে না। তিনটি বিষয়ের পরিচয় পাওয়া যায় এ তিন ক্ষেত্রে: রাগের মুহূর্তে ধৈর্যের পরিচয়, যুদ্ধের সময় বীরত্বের ও অভাবের সময় ভাইয়ের পরিচয়।

ইমাম জা’ফর আস সাদিক (আ.)’ বলেছেন, কোনো বান্দাই পরিপূর্ণভাবে প্রকৃত ঈমানে পৌঁছাতে পারবে না যতক্ষণ না তাদের মধ্যে এই তিনটি বৈশিষ্ট্য অর্জিত হবে: পুরোপুরি ধর্মকে বুঝতে পারা, সঠিক পদ্ধতিতে জীবন যাপন করা এবং দুঃখ-কষ্টে ধৈর্য ধারণ করা।

কোনো এক ব্যক্তি ইমাম জাফর সাদিক (আ)’র কাছে এসে তাঁর উপদেশ প্রার্থনা করলে তিনি বলেন, মহান আল্লাহ যদি তোমার রুজি-রিজিকের দায়িত্ব নিয়ে থাকেন তাহলে (এক্ষেত্রে) তোমার এতো বেশি (তথা মাত্রাতিরিক্ত) চেষ্টা-প্রচেষ্টার দরকার কি? মহান আল্লাহ যখন রুজি-রিজিক বণ্টন করেই রেখেছেন তাহলে এক্ষেত্রে এত বেশি ব্যাকুল হওয়ার দরকার কি? মহান আল্লাহ যখন দানের প্রতিদান দেয়ার ব্যবস্থা রেখেছেন তখন দান করতে এতো কার্পণ্য কিসের? পরিণতি ও শাস্তি যদি আল্লাহর পক্ষ থেকেই হয়ে থাকে তাহলে কেনো পাপ করবো? মৃত্যু যদি সত্য (অনিবার্য) হয়ে থাকে তাহলে কেনো নিষিদ্ধ বা হারাম বিনোদনে লিপ্ত হব? (কঠিন) পুলসিরাত পার হওয়ার নিয়ম যদি সত্য হয়ে থাকে তাহলে কেনো ওজ্‌ব বা আত্ম-তৃপ্তি ও আত্ম-প্রসাদে মগ্ন হব? বিপদ-আপদ ও নানা ধরনের নির্ধারিত অবস্থা যদি মহান আল্লাহর লিখে রাখা ভাগ্য বা তাকদিরের বিধান হয়ে থাকে তাহলে এসব নিয়ে এতো দুঃখ করার কি আছে?   পার্সটুডে।