হজ-বাণীতে রাহবার হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী
পোস্ট হয়েছে: জানুয়ারি ১৫, ২০১৮
ফিলিস্তিনের মুক্তির লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ করা সমগ্র মুসলিম উম্মাহ্র অপরিহার্য কর্তব্য
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হযরত আয়াতুল্লাহিল উযমা সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী এবারের পবিত্র হজে সমবেত হাজিদের উদ্দেশে প্রদত্ত বাণীতে বলেন, ফিলিস্তিনের মুক্তির লক্ষ্যে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা সমগ্র মুসলিম উম্মাহ্র অপরিহার্য কর্তব্য। এছাড়া তিনি তাঁর বাণীতে মুসলিম দেশগুলোতে চলমান যুদ্ধগুলো দ্রুত বন্ধের জন্য আহ্বান জানান।
রাহ্বার তাঁর বাণীর শুরুতে মহান আল্লাহ্ তা‘আলার প্রশংসা করেন এবং রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (সা.), তাঁর নি®পাপ আহ্লে বাইত (আ.) ও তাঁর পছন্দনীয় সাহাবীদের ওপর সালাম ও দরুদ পেশ করেন।
এরপর ইরানের ইসলামি বিপ্লবের রাহ্বার বলেন, মহান আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি এ কারণে যে, তিনি অতীতের বছরগুলোর মত এ বছরও বিশ্বের বিপুল সংখ্যক মুমিন মুসলমানকে হজ পালনের সৌভাগ্য দান করেছেন এবং তাঁদেরকে মহাকল্যাণময় ও স্বচ্ছ-সুপেয় রহমতের ঝর্নাধারা থেকে উপকৃত হবার এবং এ মূল্যবান পবিত্র সময়ের দিন-রাতে আল্লাহর মহিমান্বিত ঘরের চারপাশে ইবাদত, বিনম্র-বিহ্বলতা, যিক্র ও নৈকট্য অর্জনের সাধনায় মশগুল হবার ও এভাবে হৃদয়গুলোকে বদলে ফেলার, আর প্রাণগুলোকে পবিত্র ও সুসজ্জিত-সুশোভিত করার সুযোগ দিয়েছেন।
হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী বলেন, হজ রহস্যে ভরপুর এমন এক ইবাদত ও এমন এক পবিত্র স্থানে অবস্থানের সুযোগÑ যা ঐশী বরকতে পরিপূর্ণ ও মহান আল্লাহর নানা নিদর্শনের বহিঃপ্রকাশ। হজ আল্লাহর প্রতি ঈমান পোষণকারী বান্দাদেরকে, বিশেষত বিনম্র ও চিন্তাশীল-জ্ঞানী ব্যক্তিদের আধ্যাত্মিক মর্যাদা এনে দিতে পারে এবং তাঁদেরকে আলোকিত হৃদয়ের অধিকারী ও উচ্চতর ব্যক্তিতে পরিণত করতে পারে। হজ এ ধরনের ব্যক্তিদেরকে অন্তর্দৃষ্টি ও সাহসিকতার মত নানা গুণে গুণান্বিত করতে পারে এবং তাঁদেরকে কাজের উদ্যম ও আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সংগ্রাম করার গুণ প্রদান করতে পারে।
ইসলামি বিপ্লবের রাহ্বার বলেন, হজের রাজনৈতিক, আধ্যাত্মিক এবং ব্যক্তিগত ও সামাজিক দিকগুলো নজিরবিহীন, অত্যন্ত উচ্চমানের ও দৃশ্যমান। আজ মুসলিম সমাজের জন্য হজের এই আধ্যাত্মিক ও সামাজিক-রাজনৈতিক উভয় দিকই খুবই জরুরি। তিনি বলেন, আজ একদিকে বস্তুবাদের সম্মোহনী শক্তি নানা ধরনের উন্নত উপকরণের মাধ্যমে মানুষকে বিভ্রান্ত করছে ও তাদেরকে ধ্বংস করছে, অন্যদিকে আধিপত্যকামী শক্তিগুলোর নীতি ও কর্মসূচি মুসলমানদের মধ্যে ফেতনা ও বিভেদের আগুন ছড়িয়ে দিচ্ছে। তারা মুসলিম দেশগুলোকে নিরাপত্তাহীনতা ও মতবিরোধের জাহান্নামে পরিণত করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে।
হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী বলেন, হজ মুসলিম উম্মাহকে এই দুই বিরাট ব্যাধি থেকে নিরাময় করতে পারে। মনগুলোকে পবিত্রতায় উজ্জীবিত করে তোলার এবং তাকওয়া ও আধ্যাত্মিকতার আলোয় আলোকিত করে তোলার সুযোগ সৃষ্টি হয় এই হজের মাধ্যমে। একইভাবে হজে মুসলিম বিশ্বের তিক্ত ঘটনাবলির ওপর দৃষ্টিপাত করারও পরিবেশ তৈরি হয় এবং এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য দৃঢ়সংকল্পে আবদ্ধ হওয়ার চেতনায় উজ্জীবিত হবার পাশাপাশি বাস্তবে কাজে লাগানোরও ¯পৃহা সৃষ্টি হয়।
ইসলামি বিপ্লবের রাহ্বার বলেন, মুসলিম বিশ্ব আজ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। এই নিরাপত্তাহীনতা একদিকে নৈতিক, অপরদিকে আধ্যাত্মিক। রাজনৈতিক নিরাপত্তাহীনতাও মুসলিম বিশ্বকে গ্রাস করে আছে। এইসব নিরাপত্তাহীনতার অন্যতম কারণ হলো আমাদের উদাসীনতা এবং শত্রুদের নির্দয় আক্রমণ। তিনি বলেন, আমরা দুর্নীতিবাজ শত্রুদের আক্রমণ মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে আমাদের দ্বীনি দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করি নি এবং বিচারবুদ্ধিগুলোকেও সঠিকভাবে কাজে লাগাই নি। আমরা কাফেরদের বিরুদ্ধে আপোষহীন হবার নীতিও ভুলে গিয়েছি, তেমনি নিজেদের মধ্যে পর¯পরে দয়াপরবশ হবার শিক্ষাও ভুলে গিয়েছি। এর পরিণতিতে শত্রুরা মুসলিম বিশ্বের মূল ভূখ-ের কেন্দ্রস্থলে ফেতনা-ফাসাদ সৃষ্টি করে চলেছে।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতা বলেন, আমরা ফিলিস্তিনীদের মুক্তির ব্যাপারে আমাদের অবশ্য করণীয় দায়িত্ব পালনে উদাসীন রয়েছি। বর্তমানে সিরিয়ায়, ইরাকে, ইয়েমেনে, লিবিয়ায় ও বাহরাইনে গৃহযুদ্ধ চলছে, আবার পাকিস্তানে ও আফগানিস্তানে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে মোকাবেলা করতে হচ্ছে। এ ব্যাপারে মুসলিম দেশগুলোর নেতৃবৃন্দ এবং মুসলিম বিশ্বের সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের ব্যাপক দায়দায়িত্ব রয়েছে। তিনি বলেন, এ দায়িত্বগুলোর মধ্যে রয়েছে ঐক্য প্রতিষ্ঠা, ধর্মীয় ও গোত্রীয় সামগ্রিক নির্যাতন পরিহার, সব মুসলিম দেশ ও জাতিকে তাদের শত্রুদের শত্রুতার ধরন ও কৌশলগুলোর ব্যাপারে এবং যায়নবাদ ও বলদর্পী শক্তিগুলোর বিশ্বাসঘাতকতার ব্যাপারে সচেতন করা। সর্বোপরি নরম যুদ্ধের ও সশস্ত্র যুদ্ধের ময়দানে শত্রুদের মোকাবেলা করার জন্য যথাযথ উপকরণে ও অস্ত্রেশস্ত্রে সুসজ্জিত হওয়া এবং দ্রুততার সঙ্গে মুসলিম দেশগুলোতে চলমান বিপর্যয়কর ঘটনাগুলো বন্ধ করা অপরিহার্য। এসব তিক্ত ঘটনার মধ্যে ইয়েমেন পরিস্থিতি আজ গোটা বিশ্বের দুঃখ-কষ্ট ও প্রতিবাদের উৎস হয়ে আছে। এছাড়া মিয়ানমার ও অন্যান্য স্থানের মযলুমদের মতো নির্যাতিত মুসলিম সংখ্যালঘুদের প্রতি দৃঢ় সমর্থন ঘোষণা করা অপরিহার্য।
রাহ্বার বলেন, মুসলিম উম্মাহ্র সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ফিলিস্তিনিদের সমর্থন দেয়া। এটি হবে এমন এক জাতির প্রতি নিঃশর্ত সমর্থন ও সহযোগিতা, যে জাতি তাদের দখল হয়ে যাওয়া মাতৃভূমির জন্য প্রায় ৭০ বছর ধরে সংগ্রাম করছে।
তিনি বলেন, এর সবই আমাদের ওপর অর্পিত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। বিশ্বের জাতিগুলোর উচিত তাদের সরকারগুলোর কাছে এসব দাবি তুলে ধরা এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বদের উচিত দৃঢ় মনোবল ও অকৃত্রিম ইচ্ছার আলোকে এসব দাবি বাস্তবায়নে চেষ্টা করা। এসব কাজের অর্থ হচ্ছে নিশ্চিতভাবে ঐশী ধর্মকে সাহায্য করা। নিঃসন্দেহে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী এসব কাজে সাহায্য করবেন।
হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী বলেন, এগুলো হজের শিক্ষার অংশ এবং আমি আশা করি আমরা এসব শিক্ষা গ্রহণ করে সে অনুযায়ী কাজ করব। পরিশেষে, আমি দোয়া করি আপনাদের হজ কবুল হোক। আমি মিনা ও মসজিদুল হারামের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। আমি দোয়া করছি, মহানুভব ও দয়ালু আল্লাহ তা‘আলা যেন তাঁদেরকে উচ্চ মর্যাদা দান করেন।