বৃহস্পতিবার, ১৯শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৪ঠা আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

সম্পাদকীয় – ইরানের ইসলামি বিপ্লবের প্রতি বিশ্বের মুসলমানদের দৃষ্টিভঙ্গি

পোস্ট হয়েছে: মার্চ ১৬, ২০২২ 

সম্পাদকীয়

ইরানের ইসলামি বিপ্লবের প্রতি বিশ্বের মুসলমানদের দৃষ্টিভঙ্গি

অনেক রাজনৈতিক ও সামাজিক বিশ্লেষকের স্বীকারোক্তি অনুসারে ইরানে ইসলামি বিপ্লব সংঘটিত হওয়া বিংশ শতকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও সামাজিক ঘটনা হিসাবে আখ্যা লাভ করেছে।
এই বিপ্লবের গুরুত্ব পর্যালোচনার জন্য আমরা ইরানের ইসলামি বিপ্লবকে বিশ্বের বড় বড় বিপ্লব, যেমন : ফরাসি বিপ্লব, রুশ কিংবা চীনের বিপ্লবের সাথেও তুলনা করে দেখতে পারি। আবার এই বিপ্লবের অর্জনসমূহের দিক থেকেও পর্যালোচনা করা যেতে পারে।
উভয় পদ্ধতিতে আমরা এই ফলাফলে উপনীত হব যে, তিনটি বৈশিষ্ট্য এই বিপ্লবকে বিশ্বের অন্য সব বিপ্লব থেকে স্বতন্ত্র মর্যাদা দান করেছে। তা হলো ‘ইসলামি হওয়া’, ‘জনতার বিপ্লব হওয়া’ এবং ‘সাংস্কৃতিক দিকের প্রাবল্য’। যে বিপ্লব বিপুল জনগণের অংশগ্রহণে বিজয় লাভ করেছে এবং একই সাথে ‘অভ্যন্তরীণ সাম্রাজ্যবাদ’ এবং ‘বাইরের সা¤্রাজ্যবাদ’কে টার্গেটে পরিণত করেছে।
ইরানের ইসলামি বিপ্লব বিশ্ববাসীর কাছে প্রমাণ করেছে যে, ইসলামের নামে এবং দ্বীনে ইসলামের মাধ্যমেও সবচেয়ে একনায়কতান্ত্রিক ও খোদাদ্রোহী নেতাদের বিরুদ্ধেও রুখে দাঁড়ানো এবং তাদেরকে ক্ষমতার মসনদ থেকে টেনে নামানো যায়। আর তদস্থলে জনগণের পছন্দের সরকারকে স্থলাভিষিক্ত করা যায়। আর ঠিক এই কারণেই তাত্ত্বিকরা বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার পিছনের কারণ ও পূর্ব শর্তাবলি নিয়ে যেসব তত্ত্ব প্রদান করেছিলেন, সেসব তত্ত্বের বিপরীতে ইরানের ইসলামি বিপ্লব তাদের বিপ্লবতত্ত্বের বই-কিতাবে বিশ্লেষণের নতুন এক পৃষ্ঠা যোগ করে দেয়।
এই বিপ্লব তার স্লোগানসমূহ, যেমন : ‘স্বাধীনতা, মুক্তি, ইসলামি প্রজাতন্ত্র’ কিংবা ‘প্রাচ্য নয়, পাশ্চাত্য নয়, ইসলামি প্রজাতন্ত্র’ এই স্লোগান সহকারেই বিশ্বমঞ্চে পরিচিতি লাভ করেছে। আর বৈশ্বিক অঙ্গনে বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বের সামনে খোদায়ী মূল্যবোধসমৃদ্ধ জনমানুষের জাগরণভিত্তিক বিপ্লবের একটি মডেল উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে।
ইরানি জাতির বিপ্লব ছিল ‘ঈমান এবং ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক মূল্যবোধভিত্তিক’ একটি বিপ্লব। আর এটাই এই বিপ্লবকে ফরাসি কিংবা রুশ বিপ্লব থেকে পৃথককারী একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হিসাবে গণ্য হয়।
অবশ্য এই আন্দোলন ইরানের সমকালীন ইতিহাসের দীর্ঘ স্বাধীনতাকামী আন্দোলনসমূহ, যেমন : পড়হংঃরঃঁঃরড়হধষ মুভমেন্ট, তেলসম্পদ জাতীয়করণ আন্দোলন এবং বিভিন্ন ন্যায়কামী সংগ্রামের ধারায় এসে চূড়ান্ত সাফল্য লাভ করে। অতঃপর একটি নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ইসলামি প্রজাতন্ত্রের কাঠামোর মধ্যে ইসলামি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করার মাধ্যমে বিশ্বায়নের প্রক্রিয়ায় বিশেষ করে মুসলমি জাহানের রাজনৈতিক হাওয়া বদলের প্রেক্ষিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছে।
অপরদিকে ‘ধর্মীয় নেতৃত্বের উপাদান’টি ছিল ইসলামি বিপ্লবের আরেকটি বিশেষ দিক। এই বিপ্লব সূচিত হয় একজন মুসলমান ফকিহ ও দ্বীনি আলেমের নেতৃত্বে। ইরানি জাতির ইতিহাসের পাতা উল্টাতে থাকলে দেখা যেত কেবল রাজা-বাদশাহরাই ইরানে শাসন করত। আপনি যদি হাফিয, সাদি, ফেরদৌসিসহ ইরানের নামজাদা কবিদের কবিতা পাঠ করেন তাহলে ইরানে বাদশা ও সুলতানদের কী ভূমিকা ছিল তা বুঝতে পারবেন।
ইরানের ইসলামি বিপ্লব প্রথমবারের মতো ইরানের শাসনব্যবস্থা ও জাতির ভাগ্যের নিয়ন্ত্রণকে রাজা-বাদশাহদের হাত থেকে ছিনিয়ে নেয় এবং দ্বীনি আলেমদের হাতে সোপর্দ করে। আর এরূপ ঘটনা ইসলামি জাহানে তো বটেই, গোটা বিশ্বেও একটি নজিরবিহীন ঘটনা ছিল। অবশ্য বিশ্বের মুসলমানদের কাছে এই বিপ্লব যেমন দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে, তদ্রƒপ এই বিপ্লব নিয়ে পর্যালোচনা এবং বিশ্লেষণও কম হয়নি।
বিশ্বের মুসলমানদের প্রতি ইরানের ইসলামি বিপ্লবের বার্তা ছিল ঐক্যের বার্তা। যে ঐক্য মুসলমানদেরকে বিচ্ছিন্নতা ও বিভেদ থেকে দূরে রাখতে পারে। ইরানের ইসলামি বিপ্লবের বার্তা ছিল এটা যে, ইসলাম একটি শক্তিশালী এবং ঐক্য প্রতিষ্ঠাকারী দ্বীন হিসেবে শান্তি সংহতির পথে চলার এবং মানবের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক চাহিদাগুলো পূরণ করার সক্ষমতা রাখে।
ইসলামি বিপ্লবের বার্তাই ছিল এটা যে ইসলাম মানবের জন্য জীবনসঞ্চারী হতে পারে। ইসলাম বিশ্বের সকল মানুষের সৌভাগ্য, সুখ, শান্তি ও নিরাপত্তা বিধান করতে পারে। এই বিপ্লব ‘আমরা পারব’ এই সংস্কৃতিকে বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে দিতে পেরেছে। আর ইরান এবং ইরানি জাতির মাধ্যমে এমন এক ব্যান্ড তৈরি করেছে যে, হ্যা, যদি কোনো জাতি ইচ্ছা করে তাহলে কয়েক শতক ধরে শাসন করে আসা এক বাদশাহিকেও উৎখাত করে তাদের কাক্সিক্ষত ও পছন্দসই শাসনব্যবস্থাকে ক্ষমতায় আনতে পারে এবং সকল খাতে তাদের সেই পছন্দসই হুকুমতকে সমর্থন যোগাতে পারে। হোক সেটা নির্বাচন, হোক যুদ্ধ, হোক নিষেধাজ্ঞা কিংবা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চাপ যাই হোক না কেন। তারা তাদের ইসলামি বিপ্লবের প্রতিরক্ষায় নিজেদের জীবন দিতেও প্রস্তুত। এই বিপ্লব ইরানি জাতির সেই অমিত শক্তিকে বিশ্বের সামনে দেখিয়ে দিয়েছে।
ইরানের মুসলিম জাতি মসজিদগুলোকে সামাজিক যোগাযোগের একটি মাধ্যম হিসাবে কাজে লাগাতে পেরেছে। যে সামাজিক যোগাযোগ আজকে সোশ্যাল মিডিয়া জগতে খুবই পরিচিত। আমরা এবং আপনারা প্রতিদিন এসব সোশ্যাল মিডিয়া হরহামেশাই ব্যবহার করছি। যেমন ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ইত্যাদি। কিন্তু ইরানি জাতি আজ থেকে ৪২ বছর আগেই বিভিন্ন শহরে ও গ্রামে অবস্থিত মসজিদগুলোকেই এরকম সোশ্যাল মিডিয়া এবং সামাজিক যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করেছিল। আর এভাবেই তারা বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বৃহৎ বিপ্লবকে সফল করে তোলে।
আমি ইরানের ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা এবং ইসলামি প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর রূহের প্রতি সালাম ও শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। ইরানের ইসলামি বিপ্লব তাঁরই নামে এবং তাঁরই স্মরণ সহকারে বিশ্বে পরিচিতি লাভ করেছে।

ড. সাইয়্যেদ হাসান সেহাত
কালচালার কাউন্সেলর
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান দূতাবাস
ঢাকা, ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ইং