বৃহস্পতিবার, ১৯শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৪ঠা আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

সম্পাদকীয়

পোস্ট হয়েছে: অক্টোবর ২৮, ২০২১ 

নূরের জন্মোৎসব
يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ إِنَّا أَرْسَلْنَاكَ شَاهِدًا وَمُبَشِّرًا وَنَذِيرًا ﴿٤٥﴾ وَدَاعِيًا إِلَى اللهِ بِإِذْنِهِ وَسِرَاجًا مُّنِيرًا ﴿٤٦﴾
‘হে নবী! অবশ্যই আমি আপনাকে (লোকদের জন্য) সাক্ষী, সুসংবাদদাতা, সতর্ককারী ও আল্লাহ্র অনুমতিক্রমে তাঁর দিকে আহ্বানকারী হিসেবে এবং জ্যোতির্ময় প্রদীপরূপে প্রেরণ করেছি।’ (সূরা আল-আহযাব : ৪৫-৪৬)
এতে সন্দেহের কোনোই অবকাশ নেই যে, কোনো মানুষের পক্ষেই হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর সমুন্নত ব্যক্তিত্বের সকল দিক বর্ণনা করা সম্ভব নয়। কারণ, এ মহান রাসূলের ব্যক্তিত্বের দিকসমূহ বুঝার জন্য মানুষের সক্ষমতা খুবই সীমিত। তাই আমরা আল্লাহ্ রাব্বুল্ ‘আলামীনের নির্বাচিত এ শ্রেষ্ঠতম নবী ও রাসূল সম্পর্কে ইতিহাস থেকে যা জানতে পেরেছি তা কেবলই এ মহান ব্যক্তিত্বের অভ্যন্তরীণ ও প্রকৃত সত্তার একটি ছায়া মাত্র। তবে আমাদের জন্য তাঁর এ পরিচয়টুকুই যথেষ্ট। কারণ, প্রথমত, এ থেকেই আমরা তাঁকে আমাদের জন্য পরিপূর্ণ অনুসরণীয় আদর্শ হিসেবে পাচ্ছি। দ্বিতীয়ত, এর ফলে আমরা রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে কেন্দ্র করে ইসলামি ঐক্যে উপনীত হতে সক্ষম। সুতরাং আমাদের মুসলমানদের জন্য রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ব্যক্তিত্বের বিভিন্ন দিক এবং তাঁর জীবন, সীরাত, চরিত্র ও আচরণ এবং সমুন্নত শিক্ষাসমূহের সাথে গভীরভাবে পরিচিত হওয়া অপরিহার্য।
বস্তুত ইসলামের সবচেয়ে বড় প্রচার এটাই যে, আমরা বিশ^বাসীর সামনে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রকৃত পরিচয় তুলে ধরব, আর এটাই প্রকৃত রাসূলপ্রেমের দাবি। কারণ, তাহলে মানুষের মন রাসূলুল্লাহ্র প্রতি আকৃষ্ট হতে বাধ্য। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই যে, সাম্প্রতিক কালে ইসলামি জাহানে এমন কতক ইফরাতী (উগ্রপন্থী) ফিরকা ও ধারা আত্মপ্রকাশ করেছে যারা আল্লাহর দ্বীন ইসলাম ও রাহ্মাতুল্লিল ‘আলামীন রাসূলুল্লাহ (সা.) সম্পর্কে ভুল পরিচয় তুলে ধরছে এবং ইসলামকে সন্ত্রাসবাদের সমার্থকে পর্যবসিত করেছে; বস্তুত এটাই আজ ইসলাম ও রাসূলুল্লাহর মযলূম হওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ মূলগতভাবেই ইসলাম ও রাসূলুল্লাহর সমুন্নত শিক্ষা ও চারিত্রিক বিধানে ইফরাত (উগ্রপন্থা) ও সন্ত্রাসের, যেমন : আত্মঘাতী হামলা, নিরপরাধ মানুষ হত্যা, শিরñেদ ইত্যাদির ন্যায় নিষ্ঠুরতার কোনো স্থান নেই।
আজকের দিনে মানব প্রজাতি মুক্তি ও সফলতার তীরে উপনীত হওয়ার জন্য ইসলামি সচেতনতা এবং রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ব্যক্তিসত্তার বিভিন্ন দিক, তাঁর চারিত্রিক শিক্ষা, রাষ্ট্রপরিচালনা পদ্ধতি, রাষ্ট্রীয় নীতিমালা, জনকল্যাণ, ইবাদত-বন্দেগি, জিহাদ ও বিশেষ শিক্ষার সাথে পরিচিত হওয়ার জন্য অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি মুখাপেক্ষী। কারণ, বর্তমানে দু’টি পক্ষ থেকে রাসূলুল্লাহ্র প্রতি হামলা চালানো হচ্ছে :
প্রথমত, মাযহাবী উগ্রপন্থার অনুসরণকারীরা – যারা দ্বীন ইসলাম সম্পর্কে অসম্পূর্ণ ও ভ্রান্ত তাৎপর্য গ্রহণ করেছে। দ্বিতীয়ত, বৈশি^ক দাম্ভিক বৃহৎ শক্তিবর্গ – যারা ইসলামি সচেতনতা ও জাগরণ এবং মুসলমানদের ঐক্যকে ভয় পাচ্ছে।
ইসলামি ঐক্য
বস্তুত ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ব হচ্ছে সুন্দরতম পরিভাষাসমূহের অন্যতম। পূর্ববর্তী সমস্ত নবী-রাসূলের (আ.) আদর্শের ধারাবাহিকতায় হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) মানবসমাজকে ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের শিক্ষা উপহার দিয়েছেন। আর এটা অনস্বীকার্য যে, মুসলমানদের জন্য ঐক্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। কারণ, ইসলামের দুশমনরা তাদের বিখ্যাত সর্বজনজ্ঞাত ‘ভাগ কর ও শাসন কর’ ঔপনিবেশিক নীতির ভিত্তিতে সব সময়ই মুসলমানদের মধ্যে অনৈক্য ও বিভক্তি সৃষ্টি করে তা থেকে সুবিধা হাসিল করে আসছে।
বিগত এক শতাব্দী কাল যাবৎ সারা বিশে^র ওলামায়ে ইসলাম ও ইসলামি চিন্তাবিদগণ ইসলামি ঐক্যের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে আসছেন। এটা অনস্বীকার্য যে, মুসলমানদের বিভিন্ন মাযহাব ও ফিরকার মধ্যে আকায়েদের কতক শাখা-প্রশাখা ও কতক ফিকহী বিষয়ে মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও তারা আকায়েদের অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক বিষয়গুলোতে এবং অনেক বেশি ফিকহী বিষয়ে অভিন্নতার অধিকারী। তাই তাঁরা ইসলামের বিপজ্জনক দুশমনদের মোকাবিলায় পরস্পরের প্রতি ভ্রাতৃত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়ে ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপ গ্রহণের চেষ্টা করে আসছেন। আল্লাহ্ তা‘আলা কোরআন মজীদে মুসলমানদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন : وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلا تَفَرَّقُوا – ‘তোমরা দৃঢ়তার সাথে আল্লাহ্র রশি আঁকড়ে ধর এবং বিভক্ত হয়ো না।’ সুতরাং অনস্বীকার্য যে, ইসলামের ঘোরতর দুশমনদের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দেয়ার চাবিকাঠি মুসলমানদের ঐক্য ও দূরদর্শিতার মধ্যে নিহিত। এ বিষয়টি সামনে রেখেই, যেহেতু ১২ ও ১৭ই রবিউল আউয়াল যথাক্রমে সুন্নি ও শিয়া মতে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জন্মদিন সেহেতু ইরানের ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা হযরত ইমাম খোমেইনী (র.) বিপ্লবের বিজয়ের পর পরই যথার্থভাবেই ঈদে মীলাদুন্নবী (সা.) উপলক্ষ্যে ১২ থেকে ১৭ই রবিউল আউয়ালকে ‘ইসলামি ঐক্য সপ্তাহ’ হিসেবে ঘোষণা করেন এবং তখন থেকেই প্রতি বছর বিশে^র মুসলমানরা এ সপ্তাহটি উদ্যাপন করে ইসলামের অন্তর্দৃষ্টির আলোকে নিজেদের মধ্যকার অনৈক্য ও বিভক্তিকে পাশে সরিয়ে রেখে ইসলামের দুশমনদের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দেয়ার চেষ্টা চালিয়ে আসছে।
সবশেষে এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে চাই যে, ইসলামি জাহানের ঐক্যের আহ্বায়নকারী হিসেবে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান মাজ্মা‘এ জাহানীয়ে তাক্বরীবে মাযাহেবে ইসলামি (ইসলামি মাযহাবসমূহের ঘনিষ্ঠতা সৃষ্টিকারী বৈশি^ক সংস্থা)-এর মাধ্যমে প্রতি বছর তেহরানে আন্তর্জাতিক ইসলামি ঐক্য সম্মেলনের আয়োজন করে আসছে – যা সারা বিশে^ ইসলামি মাযহাবসমূহের ওলামা ও চিন্তাবিদগণের বৃহত্তম সমাবেশ।
আমরা হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর মহান জন্মদিন কেন্দ্রিক ঈদে মীলাদুন্নবী ও ইসলামি ঐক্য সপ্তাহ উপলক্ষ্যে এবং একই সাথে আহ্লে বাইতের ধারাবাহিকতার ষষ্ঠ ইমাম হযরত জা‘ফর সাদেক (আ.)-এর জন্মদিন উপলক্ষ্যে বিশে^র মুসলমানদের প্রতি ও বিশেষভাবে নিউজলেটারের পাঠক-পাঠিকাদের প্রতি মোবারকবাদ জানাচ্ছি। আমাদের প্রত্যাশা এই যে, এ মহান সপ্তাহে ইসলামি জাহানের ঐক্য অতীতের চেয়েও অধিকতর সুদৃঢ় হবে এবং আমরা সকলেই যথাযথভাবে আমাদের দ্বীনী দায়িত্ব পালনে সক্ষম হব, ইন শাআল্লাহ।
মোহাম্মাদ রেযা নাফার
বাংলাদেশে নিয়োজিত ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের রাষ্ট্রদূত
সাইয়্যেদ হাসান সেহাত
বাংলাদেশে নিয়োজিত ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের কালচারাল কাউন্সেলর