সমসাময়িক চিন্তাবিদদের বিশ্লেষণে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর বিপ্লবের প্রেক্ষাপট
পোস্ট হয়েছে: অক্টোবর ১৯, ২০২০
আব্দুল কুদ্দুস বাদশা –
মানব ইতিহাস সুখময় ও বিষাদময় উভয় প্রকার ঘটনায় পরিপূর্ণ। এসব ঘটনায় মহানায়কদের আত্মত্যাগী ও বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য মানুষ যেমন তাঁদেরকে যুগ যুগ ধরে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। একইভাবে যারা কাপুরুষের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে মানবতার পিঠে খঞ্জর হেনেছে, তারা মানুষের ঘৃণার পাত্রে পরিণত হয়েছে। কিন্তু ৬১ হিজরিতে মরু কারবালায় নবী-দৌহিত্র ইমাম হোসাইন (আ.)-এর উপর সংঘটিত ইয়াযিদ বাহিনীর চরম নৃশংসতার সামনে থমকে দাঁড়ায় মানব ইতিহাস। অন্য সব ঘটনাই যেন চাপা পড়ে যায়। একদিকে সত্য ও ন্যায়ের প্রতি আপোষহীনতার পরাকাষ্ঠা, অপরদিকে অন্যায় ও অসত্যের চরম কুৎসিত চেহারা।
কারবালার ঘটনা ছিল হকপন্থী ও বাতিলপন্থীদের সংঘাত। ইমাম হোসাইন (আ.) এ কথা বলেন নি যে, আমি ইয়াযিদের কাছে বাইয়াত করব না। বরং তিনি বলেন, مثلی لا یبایع مثله ‘আমার মতো কেউ তার মতো কারো কাছে বাইয়াত করতে পারে না।’ এখানে ব্যক্তি নয়, হক ও বাতিলের প্রশ্ন। হক বাতিলের কাছে শির নত করে না।
ইতিহাসের বিবরণ থেকে দৃশ্যমান হয় যে, সেদিন ইয়াযিদী হুকুমতের বিপরীতে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর জন্য দুইটি পথই খোলা ছিল, হয় বাইয়াত, না হয় বিদ্রোহ। বিদ্রোহের ফলাফল ছিল শাহাদাত অথবা নিজে হুকুমত প্রতিষ্ঠা করা। পক্ষান্তরে বাইয়াতের ফলাফল ছিল অপমান ও ধ্বংস। ইমাম বেছে নিলেন বিদ্রোহের পথ আর ঘোষণা করলেন ‘সৎকাজে আদেশ আর অসৎ কাজে নিষেধ’ই উদ্দেশ্য। তিনি বার বার উমাইয়া শাসনচক্রের দ্বারা দ্বীন পদদলিত হওয়া এবং বেদআত ছড়িয়ে পড়ার ব্যাপারে সাবধান করে দেন। পাশাপাশি তিনি ইয়াযিদের খোদাদ্রোহী জুলুমশাহীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার আহ্বান জানান। ইমাম হোসাইন (আ.)-এর বিদ্রোহের ফলাফল ছিল ইসলামের পুনরুজ্জীবন, দ্বীনবিদ্বেষী উমাইয়া শাসনের বিলুপ্তি এবং একত্ববাদী মুমিনের মাথা উঁচু করে বাঁচার সংস্কৃতির গোড়াপত্তন। মুসলিম অভিধানে যার মূল্যায়নে বলা হয়েছে : ان الاسلام محمدی الحدوث، حسینی البقاء ইসলামের ভিত্তিপ্রস্তর মুহম্মদী পরিচয়ে, আর এর চিরস্থায়িত্ব হোসাইনী পরিচয়ে।
প্রখ্যাত জার্মান গবেষক ও ঐতিহাসিক গ. গড়ৎরিহ বলেন, ‘হোসাইন তাঁর প্রাণপ্রিয় স্বজনদেরকে উৎসর্গ করার মাধ্যমে দুনিয়াকে আত্মত্যাগের শিক্ষা দিয়েছেন এবং ইসলাম ও মুসলমানদের নাম ইতিহাসে লিপিবদ্ধ এবং বিশ্বে গৌরবান্বিত করেছেন। যদি এরূপ ঘটনা সংঘটিত না হতো, নিশ্চিত বলা যায় যে, ইসলাম বর্তমানের এই অবস্থায় থাকত না। সম্ভাবনা ছিল ইসলাম ও মুসলমানদের নাম সম্পূর্ণরূপে মুছে যাওয়ার।’
ইমাম হোসাইন (আ.) একটি অসম যুদ্ধে শাহাদাতবরণ করেন। আর তাঁর স্বজন পরিজনকে বন্দি করা হয়। তবে উস্তাদ শহীদ মুর্তাজা মোতাহহারী’র ভাষায় ইমাম তাঁর অভীষ্ট অর্জন করেছেন। অথচ ইমাম যদি ইয়াযিদের হাতে বাইয়াত করতেন, তা হলে শুধু যে তাঁর অভীষ্ট ও লক্ষ্য অর্জিত হতো না, তা নয়, উপরন্তু তাঁর বাইয়াতের অসংখ্য নেতিবাচক প্রভাব পড়ত গোটা ইসলাম ও মুসলিম জাহানের উপর। এরূপ কয়েকটি প্রধানতম নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো :
প্রথমত : উমাইয়াদের দ্বীনবিরোধী অবৈধ হুকুমতের বৈধতা
উমাইয়ারা তাদের হুকুমতকে উত্তরাধিকার সম্পদে পরিণত করার চেষ্টায় লিপ্ত ছিল। আবু সুফিয়ান এক খাস বৈঠকে স্বীয় গ্রোত্রের লোকদের উদ্দেশ্যে বলেন, یا بنی امیّة! تلقّفوها تلقف الکرة.. ‘হে উমাইয়া বংশ! ইসলামের খেলাফতকে নিয়ে [ফুট]বলের ন্যায় খেলতে থাক এবং একজনের পা থেকে আরেক জনের পায়ে ঠেলে দাও।’
মুয়াবিয়াও শতচেষ্টা করেছেন রাজশক্তি, রাজকোষ ও মিথ্যাচারের জোরে উমাইয়া শাসনকে টিকিয়ে রাখতে। এই উদ্দেশ্যে তিনি ইয়াযিদের যুবরাজ পদের প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেন। অতঃপর ইয়াযিদের অনুকূলে বাইয়াত আদায়ের মাধ্যমে লক্ষ্যে পৌঁছবার চেষ্টা করেন। সন্দেহের অবকাশ নেই যে, এক্ষেত্রে ইয়াযিদের হুকুমত যোগ্যতা, খোদায়ী বৈধতা কিংবা জনগণের গ্রহণযোগ্যতাÑ এগুলোর কোনো একটির ভিত্তিতে গঠিত হয়নি। কারণ, শীর্ষ ইসলামী নেতৃত্বের কোনো গুণই তার মধ্যে ছিল না। জনগণ বিশেষ করে সুশীল সমাজ ইয়াযিদকে চিনত একজন ফাসেক হিসাবে, যার মধ্যে খেলাফত পরিচালনার কোনোই যোগ্যতা নেই। এমনকি মুয়াবিয়ার অনুচররাও এ বিষয়ে জ্ঞাত ছিল এবং তারা মুয়াবিয়ার এ প্রস্তাবে আপত্তি জানিয়েছিল।
মুয়াবিয়া যখন মদীনার গভর্নর যিয়াদের কাছে চিঠি লিখে ইয়াযিদের অনুকূলে বাইয়াত আদায়ের ফরমান পাঠান, এর উত্তরে গভর্নর লিখেন : যদি জনগণকে তার জন্য বাইয়াত করতে বলি তাহলে তারা আমাদেরকে কী বলবে? হোসাইন ইবনে আলী (আ.) ও আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস… এর ন্যায় ব্যক্তিরা এখনও তাদের মাঝে রয়েছেন। স্বয়ং ইমাম হোসাইন (আ.) এক পত্র মারফত ইয়াযিদের নেতৃত্বের প্রসঙ্গ উত্থাপন করায় মুয়াবিয়াকে তীব্র ভর্ৎসনা করেন এবং তাকে মদ্যপ ও ফাসেক বলে উল্লেখ করেন।
মুয়াবিয়া তাঁর জীবদ্দশায় ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কাছ থেকে বাইয়াত আদায় করতে সক্ষম হননি। কিন্তু তিনি ইয়াযিদকে আবদুল্লাহ্ ইবনে যুবাইর ও ইমাম হোসাইন (আ.)-এর ন্যায় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের থেকে বাইয়াত আদায়ের কথা বলে যান। অবশ্য তিনি ইমাম হোসাইনের সাথে সহিংস আচরণ না করার জন্য উপদেশ দেন। কারণ, ইমাম হোসাইন বিশেষ সামাজিক মর্যাদার অধিকারী ছিলেন। ইমাম হোসাইনের বাইয়াত তাদের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কারণ, এর মাধ্যমে তাদের দুইটি ফায়দা হাসিল হতো- (১) অন্যদের বাইয়াতের ক্ষেত্র প্রস্তুত হওয়া এবং (২) উমাইয়া হুকুমত রাজতন্ত্রে পরিণত হওয়ার বন্দোবস্ত পাকা হওয়া।
মুয়াবিয়ার মৃত্যু হলে ইয়াযিদ মদীনার গভর্নর ওয়ালিদ ইবনে উত্বাকে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর বাইয়াত আদায়ের ফরমান পাঠায়। ইমামকে এ ফরমানের কথা জানানো হলে তিনি ওয়ালিদকে বলেন, ‘আমরা হলাম নবীর আহলে বাইত, রেসালাতের খনি, ফেরেশতাদের গমনাগমনের ঠিকানা। আর ইয়াযিদ একজন ফাসেক লোক, মদপায়ী, নিরপরাধ মানুষদের হত্যাকারী। সে এমন লোক যে প্রকাশ্যে পাপাচারে ও ব্যভিচারে লিপ্ত হয়। অতএব, আমার মত কেউ তার মত কারও সাথে বাইয়াত করতে পারে না।’
এ প্রসঙ্গে উস্তাদ শহীদ মুর্তজা মোতাহ্হারী বলেন, ‘অন্যান্য ফ্যাসাদ ছাড়াও এই লোকটির [ইয়াযিদের] বাইয়াতের মধ্যে আরও দুইটি ফ্যাসাদ নিহিত ছিল যা মুয়াবিয়ার ক্ষেত্রে ছিল না। প্রথমত. ইয়াযিদের সাথে বাইয়াত ইমাম হোসাইন (আ.)-এর পক্ষ থেকে [উমাইয়াদের] রাজতান্ত্রিক খেলাফতকে স্বীকৃতির কারণ হতো। অর্থাৎ এটা কোনো ব্যক্তি বিশেষের খেলাফতের বিষয় ছিল না। বরং খেলাফতকে রাজতন্ত্রে পরিণত করার ব্যাপার ছিল। আর দ্বিতীয়ত খোদ্ ইয়াযিদকে নিয়ে সমস্যা ছিল…।’
কিন্তু ইমাম হোসাইন (আ.) বাইয়াত না করায় উমাইয়া হুকুমতের ধ্বংসের কারণ হলো। উমাইয়া শাসনামলের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় তাদের নাতিদীর্ঘ শাসনামল অগণিত সমস্যা ও সংকটের সম্মুখীন হয় এবং টিকতে পারে নি। প্রখ্যাত মিশরীয় জার্নালিস্ট ও সাহিত্য সমালোচক আব্বাস মাহমুদ আক্কাদ লিখেন, ‘উমাইয়া হুকুমতের এক দিনের [কারবালা ট্রাজেডি] অর্জন হলো এটা যে, ঐরূপ সুবিশাল ও সুবিস্তৃত সা¤্রাজ্য হয়েও একজন মানুষের স্বাভাবিক আয়ুষ্কালের সমানও টিকলো না, তাদের থাবা থেকে বের হয়ে গেল। আজকে যখন উভয় পক্ষের আয়ুষ্কালকে দাড়িপাল্লায় রাখি এবং প্রত্যেকের জয় পরাজয় পরিমাপ করি, তখন কারবালার দিনের বিজয়ীকে (ইয়াযিদ) পরাজিতের চেয়ে বেশি পরাজিত দেখতে পাই এবং বিজয়কে সম্পূর্ণরূপে তার প্রতিদ্বন্দ্বী (ইমাম হোসাইন) এর সাথে দেখতে পাই।’
দ্বিতীয়ত : দ্বীনের উপরে আঘাত
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, উমাইয়ারা ছিল দ্বীন-বিদ্বেষী। দ্বীনকে জীবন থেকে বাদ দিয়েই তারা জীবনের সন্ধান করত। একদিন আবু সুফিয়ান উমাইয়াদের উদ্দেশে বলে, ‘হে আমার স্বজনরা! জেনে রাখ, বেহেশতও নেই, দোযখও নেই। বরং আসল কথা হল হুকুমত। এ হুকুমতকে কুক্ষিগত করতে হবে…।’ একরাতে মুগীরা আসলেন মুয়াবিয়ার কাছে। ঠিক তখনই আযানের ধ্বনি ভেসে আসলো। মুয়াবিয়া আযানের মধ্যে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর রেসালাতের প্রতি সাক্ষ্য শোনা মাত্রই প্রচ- ক্ষিপ্ত হয়ে বলে উঠলেন, ‘দ্যাখো, মুহাম্মদ কী করেছে, নিজের নামকে খোদার নামের পাশে স্থাপন করেছে।’ তিনি দ্বীন ও দ্বীনি মূল্যবোধ সম্পর্কে এতটাই অবজ্ঞাশীল ছিলেন যে, জুমা’র নামাযকে বুধবারে অনুষ্ঠিত করান। ওয়ালিদ ইবনে আবদুল মালেক যখন খেলাফত পেলেন, কুরআনকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘[হে কোরআন!] তুমি যখন আল্লাহর কাছে যাবে, বলবে ওয়ালিদ আমাকে তীরবর্ষণ করেছে।’ আর ইয়াযিদ তো বলতো, لعبت هاشم بالملک فلا خبر جاء و لا وحی نزل ‘বনি হাশিম রাজত্ব নিয়ে খেলেছে, আসলে কোনো খবরই আসেনি, আর কোনো ওহিও নাযিল হয়নি।’
ইমাম (আ.) স্বীয় বক্তব্যের অনেক জায়গায় উমাইয়াদের দ্বীনবিরোধী চরিত্রের বিবরণ দিয়েছেন এবং তৎকালীন সমাজের অবস্থা তুলে ধরেছেন। কারবালার পথে ফারাযদাকের সাথে ইমামের সাক্ষাৎ ঘটে। এ সাক্ষাতে তিনি সুস্পষ্টভাবে শামের শাসকবর্গের দ্বীনের বরখেলাফ কর্মকা- প্রসঙ্গে বলেন, ‘একদল রয়েছে যারা শয়তানের আনুগত্যকে গ্রহণ করেছে এবং দয়াময় আল্লাহর আনুগত্যকে বর্জন করেছে। তারা জমিনে ফ্যাসাদকে প্রকাশ্য রূপ দিয়েছে আর খোদায়ী সীমাকে লঙ্ঘন করেছে…।’
একটি চিঠিতে ইমাম বসরার অধিবাসীদের উদ্দেশে লিখেন, ‘আমি তোমাদেরকে আল্লাহর কিতাব ও রাসূল (সা.)-এর সুন্নাতের দিকে আহ্বান জানাই। কেননা, এ দলটি [উমাইয়ারা] রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নাতকে ধ্বংস করে দিয়েছে এবং খোদার দ্বীনের মধ্যে বেদআতকে জিন্দা করেছে।’
তৃতীয়ত : জনগণের পথভ্রষ্টতা
আহলে বাইতের অনুসারী হিসাবে আমরা বিশ্বাস পোষণ করি যে, মাসুম ইমামগণের কথা ও কাজ আমাদের জন্য হুজ্জাত তথা আদর্শস্বরূপ। অর্থাৎ তাঁরা মানুষের জীবনের কর্মপন্থা নির্ধারণ করে দেন। একারণে তাঁদেরকে এমনভাবে চলতে হবে যাতে জনগণের হেদায়াতের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। যদি ইমাম হোসাইন (আ.) ইয়াযিদের হাতে বাইয়াত করতেন, তাহলে জনগণের পথভ্রষ্টতার ক্ষেত্র তৈরি হতো। কারণ, বাইয়াতসূত্রে তখন ইমামকে ইয়াযিদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হতো। ফলে তাদের মধ্যে এ চিন্তার উদ্রেক হতো যে, জালিম হুকুমতের সাথে বাইয়াত করা এবং তাকে সমর্থন করা যায়। তাদের বাইয়াত চাওয়ার একটা উদ্দেশ্যও ছিল এটা যে, ইমাম হোসাইন (আ.) বাইয়াত করে ফেললে অন্য মুসলমানদের বাইয়াত করার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়ে যাবে। একারণে ইমাম তদীয় ভ্রাতা মুহাম্মদ ইবনে হানাফিয়্যাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘হে ভাই! আল্লাহর শপথ! যদি দুনিয়ার কোনো প্রান্তে আমার কোনো আশ্রয় ও নিরাপদ স্থান না থাকে তবুও কিছুতেই আমি ইয়াযিদের হাতে বাইয়াত করব না।’
ইমামের বাইয়াত না করার ফলে এ দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিষ্ঠিত হলো যে, ইয়াযিদের হুকুমত অবৈধ। কুফার জনগণও ইমাম বাইয়াত না করার পর ইয়াযিদের হুকুমতের প্রতি তাদের বিরোধিতা ঘোষণা করে এবং ইমামকে কুফায় আমন্ত্রণ জানায়। তাছাড়া ইমামের বাইয়াত না করার কারণে চিন্তার বিকাশ এবং পরবর্তীকালের গণজাগরণসমূহের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত চিন্তাবিদ আয়াতুল্লাহ মেসবাহ্ ইয়াযদী লিখেন, ‘সাইয়্যেদুশ শুহাদা ইমাম হোসাইন (আ.)-এর বিদ্রোহের ফলশ্রুতিতে জনগণ অনুধাবন করতে পারল যে, ইয়াযিদ রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রকৃত খলিফা নয়। আর এটা ছিল উম্মাহর প্রতি ইমাম হোসাইনের সর্বপ্রথম খেদমত যা তিনি তাঁর বিদ্রোহের মাধ্যমে আঞ্জাম দিয়েছেন।’ তাওয়াবীনদের বিদ্রোহ, মদীনার গণবিদ্রোহ, মুখতার ছাকাফী’র বিদ্রোহ ইত্যাদি বিদ্রোহসমূহ ইমাম হোসাইনের বাইয়াত না করা থেকে অনুপ্রেরণা গ্রহণ করে সংঘটিত হয়েছে। এরই ধারায় সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে ইরানের মহান ইসলামি বিপ্লব।
চতুর্থত : অন্যায় ও অত্যাচারের প্রশ্রয়
এটা সকলের কাছে স্পষ্ট ছিল যে, ইয়াযিদ উম্মাহর নেতৃত্ব প্রদানের যোগ্যতা রাখত না। কারণ, সে খেলাফতের পূর্বে যেমন তদ্রƒপ খেলাফতের পরেও সীমাহীন গোনাহ ও পাপের মধ্যে ডুবে ছিল। তাছাড়া তার সবচেয়ে বড় ব্যাধি ছিল প্রকাশ্যে পাপকর্ম করা। উস্তাদ মোতাহ্হারী বলেন, ‘খোদ ইয়াযিদের অস্তিত্বই [উম্মাহর জন্য] সবচেয়ে বড় মুসিবতের কারণ ছিল। কারণ, সে না শাসন পরিচালনায় দক্ষ ছিল। আর না ন্যায়পরায়ণতা ও তাকওয়ার অধিকারী ছিল। সে শুধু যে পাপাচার ও ব্যভিচারেই লিপ্ত ছিল, তা নয়, বরং এসব পাপাচার করত প্রকাশ্যে। অন্যান্য উমাইয়া খলিফাও পাপাচারে লিপ্ত হতো, তবে ইয়াযিদের মতো এরূপ প্রকাশ্যে করত না।’ কারবালার নির্মম হত্যাকা-ের পরেও সে থেমে থাকেনি। এ ঘটনার খবর যখন মদীনায় পৌঁছে তখন আবদুল্লাহ ইবনে হানযালার নেতৃত্বে মদীনার কয়েকজন লোক ইয়াযিদের ব্যাপারে অনুসন্ধান করতে শামে যান। সেখানে তাঁরা ইয়াযিদের কার্যকলাপ দেখে বললেন, ‘আমরা এমন এক লোককে দেখে এলাম যার দ্বীন নেই, মদ পান করে, ঢাক বাজায় আর কুকুর নিয়ে খেলে।’ ইবনে জওযী আবদুল্লাহ ইবনে হানযালার উদ্ধৃতি দিয়ে বর্ণনা করেন যে তিনি বলেন, ‘আমরা এমন অবস্থায় ইয়াযিদের দরবার থেকে বের হয়ে এসেছি যখন ভয় হচ্ছিল যে [তার অতিশয় পাপাচারের কারণে] আসমান থেকে আমাদের উপর পাথর বর্ষিত হয় কিনা। সে এমন এক নরাধম যে তার মা ও বোনের সাথেও ব্যভিচারে লিপ্ত হয়। সে মদ পান করে এবং নামায তরক করে।’
ইয়াযিদ কারবালা হত্যাকা-ের পর মদীনায় আক্রমণ চালায় এবং নির্বিচারে গণহত্যা, ধর্ষণ ও লুণ্ঠন পরিচালনা করে, যা ইতিহাসে ‘ওয়াকিআতু হাররা’ নামে পরিচিত। মক্কার মসজিদুল হারামও ইয়াযিদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি। আহলে সুন্নাতের প্রখ্যাত প-িত সয়ুতী হাসান বসরী থেকে বর্ণনা করেন যে তিনি বলেন, ‘আল্লাহর শপথ! ঐ ঘটনায় কেউই রক্ষা পায়নি এবং এক হাজার কন্যাকে ধর্ষণ করা হয়।’ কা’বা ঘরে অগ্নিসংযোগ করা হয়। ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন যে, ইয়াযিদ বাহিনীর সেনাপতি হাসিন ইবনে নামির যখন লস্কর নিয়ে মক্কায় প্রবেশ করে, সবদিক থেকে ঘিরে ফেলে। আর আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর মসজিদুল হারামে আশ্রয় নিয়েছেন এই কারণ দেখিয়ে তারা খানা কা’বায় আক্রমণ চালায় এবং মিনজানিকের মাধ্যমে আল্লাহর পবিত্র হেরেম শরীফে অগ্নি নিক্ষেপ করে এমনভাবে যে, কা’বার পর্দায় এবং ছাদে আগুন ধরে যায়।’
ইয়াযিদের হাতে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর বাইয়াত হওয়া শুধু যে এক জালেমশাহীকে সাহায্য করা হতো, তাই না, এক ধরনের অন্যায় ও অত্যাচারকে প্রশ্রয় দেওয়া হতো। অথচ পবিত্র আহলে বাইতের পুণ্যময় সংস্কৃতিতে অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়ার কোনো অর্থ হয় না। একারণেই ইমাম হোসাইন (আ.) ইয়াযিদকে খোদাদ্রোহী শাসক আখ্যা দিয়ে ফরিয়াদ তোলেন : ما الامام الاّ العامل بالکتاب و القائم بالقسط ‘আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী আমলকারী ও ন্যায় প্রতিষ্ঠাকারী না হলে সে নেতা নয়।’
পরিশেষে বলা যায়, কারবালার ইতিহাসকে মুছে ফেলার জন্য ইসলামের ভেতরে ও বাইরে শত্রুদের ঘাম ঝরানো চেষ্টা সত্ত্বেও কোনো ক্ষতিই তারা সাধন করতে পারেনি। কারণ, এ ঘটনাকে চির অম্লান করে রাখতে স্বয়ং আল্লাহর অনুগ্রহ ছাড়াও এমন কিছু উপাদান এর সাথে মিশে রয়েছে যা সকল প্রতিকূলতার মধ্যেও একে অক্ষয় রাখবে চিরকাল। হক পথে অবিচলতা, মানবের প্রকৃতি ও সহজাত প্রবৃত্তিগত ভিত্তি আর ইসলামের নিখাঁদ আধ্যাত্মিক অনুপ্রেরণাÑ এগুলোই হল সেই উপাদান। তাই সমকালীন প্রখ্যাত চিন্তাবিদ ও মুফাস্সির আয়াতুল্লাহ জাওয়াদী আমুলী’র মতে , ইমাম হোসাইন (আ.) ইসলামের জন্য সর্বস্ব উজাড় করে দিয়েছেন। একারণে তাঁর আন্দোলনও ইসলামের ন্যায় দুটি চিরায়ত বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হয়েছে। যথা (১) সামগ্রিকতা এবং (২) চিরস্থায়িত্ব। অর্থাৎ একটি হচ্ছে সর্বজনীনতা, জাতি ধর্ম নির্বিশেষে বিশ্বের সকল ন্যায়কামী ও স্বাধীনচেতা মানুষ এ বিপ্লবকে তাদের অনুপ্রেরণার বাতিঘর বলে জানবে। আর অপরটি হচ্ছে চিরন্তনতা, অনাদিকালের কোনো আস্তরণই একে চাপা দিতে পারবে না। তাই তো যিয়ারতের মধ্যে আমরা বলি ঃ ما بقی اللیل و النهار [হে ইমাম! আমাদের সালাম হোক আপনার প্রতি] যতদিন অবশিষ্ট থাকবে রাত্রি ও দিবস।
. ইবনে আছির, আল-কামেল খ. ৪, পৃ. ১১২; মুজামুল বুলদান, খ. ২, পৃ. ২৪৯; আল-ইমামা ওয়া আল-সিয়াসাহ, খ. ১, পৃ. ২৩৮।
. তারিখুল খুলাফা, পৃ. ২৩৩।
. উদ্ধৃত, সাঈদ দাউদী, আশুরা, পৃ. ২২৫।
. তারিখে তাবারী, খ. ৪, পৃ. ২৬২।
. ২৩ অক্টোবর ২০১৫ তারিখে প্রদত্ত উস্তাদের লেকচার থেকে উদ্ধৃত।