বৃহস্পতিবার, ১৯শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৪ঠা আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

শোকাবহ আশুরা ও আজকের প্রেক্ষাপটে আমাদের করণীয়

পোস্ট হয়েছে: জানুয়ারি ১৫, ২০১৮ 

সম্পাদকীয়
শোকাবহ আশুরা ও আজকের প্রেক্ষাপটে আমাদের করণীয়
দশই মহররম শোকাবহ আশুরা; হিজরি ৬১ সালের এ দিনে সাইয়্যেদুশ্ শুহাদা বেহেশতে যুবকদের নেতা হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) কারবালায় তাঁর স্বজন ও সহচরগণসহ ইয়াযীদী বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে শাহাদাত বরণ করেন। এ ঘটনা মানব জাতির ইতিহাসের করুণতম ঘটনাÑ প্রেক্ষাপটসহ যে ঘটনা ইতিহাসের বিতর্কাতীত বিষয়াবলির অন্যতম।
আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.)-এর শাহাদাতের পরে হযরত ইমাম হাসান (আ.) খেলাফতের দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হন। কিন্তু মুসলিম উম্মাহ্কে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ও সম্ভাব্য রোমান হামলা থেকে রক্ষার লক্ষ্যে তিনি তাঁর বৈধ খেলাফতকে মুআবিয়ার হাতে ছেড়ে দেন। মুআবিয়া হযরত ইমাম হাসান (আ.)-এর সাথে কৃত সন্ধির শর্ত ভঙ্গ করে মৃত্যুকালে হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-এর হাতে খেলাফতের দায়িত্ব হস্তান্তরের পরিবর্তে স্বীয় চরিত্রহীন পাপাচারী পুত্র ইয়াযীদকে খেলাফতে অধিষ্ঠিত করে গেলে ইয়াযীদ ইমাম হুসাইনের কাছ থেকে শক্তিপ্রয়োগে বাই‘আত্ আদায়ের জন্য মদীনার প্রশাসককে নির্দেশ দেয়। কিন্তু হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-এর ন্যায় ব্যক্তি ইসলামের সমস্ত সীমারেখা অমান্যকারী ইয়াযীদের আনুগত্য করলে যে কারো জন্য তা ইসলামি মূল্যবোধ বিসর্জনের সপক্ষে দলিল হিসেবে গণ্য হতো। এ কারণে তিনি ইয়াযীদের অনুকূলে বাই‘আত্ করা থেকে বিরত থাকেন এবং রক্তপাত এড়াবার লক্ষ্যে রাতের বেলা মদীনা ত্যাগ করে মক্কায় চলে যান।
মক্কায় তিনি লোকদের মধ্যে মুসলমানদের হুকূমাতের অবস্থা সম্বন্ধে সচেতনতা সৃষ্টির কাজে আত্মনিয়োগ করেন। কিন্তু ইয়াযীদ সেখানে তাঁকে হজের ভীড়ে হত্যার জন্য গুপ্তঘাতক পাঠালে হযরত ইমাম (আ.) পবিত্র স্থানে রক্তপাত এড়াবার লক্ষ্যে মক্কা ত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন এবং কূফার জনগণের দাও‘আতে সাড়া দিয়ে সেখানে পৌঁছার উদ্দেশ্যে কারবালায় উপনীত হন। সেখানে ইয়াযীদী বাহিনী দ্বারা অবরুদ্ধ হয়ে তিনি মদীনায় ফিরে যাবেন বা মুসলমানদের রাজ্যের সীমান্তের ওপারে হিজরত করবেন বলে প্রস্তাব দেনÑ যা আবারো প্রমাণ করে যে, তিনি ক্ষমতালোভী ছিলেন না এবং রক্তপাত এড়াবার জন্য শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা করেছিলেন। তা সত্ত্বেও ইয়াযীদের নির্দেশে তার বাহিনী ইমামের ওপরে ইয়াযীদের অনুকূলে বাই‘আত্ করার জন্য কঠোরভাবে চাপ সৃষ্টি করে। কিন্তু ইমাম হুসাইন কোনো অবস্থায়ই ফাসেক্ব ইয়াযীদের অনুকূলে বাই‘আত্ করাকে জায়েয গণ্য করেন নি বিধায় তাদের এ চাপের কাছে নতি স্বীকার করতে অস্বীকৃতি জানান। এমতাবস্থায় ইয়াযীদী বাহিনী তাঁকে তাঁর সকল পুরুষ স্বজন ও সহচরসহ, এমনকি দুগ্ধপোষ্য শিশুকেও নির্মমভাবে হত্যা করে; কেবল আল্লাহ্ তা‘আলার বিশেষ ইচ্ছায় হযরত ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.) ঐ সময় মরণাপন্ন অসুস্থ থাকায় এ হত্যাকা- থেকে রেহাই পান।
হযরত ইমাম হুসাইনের আত্মত্যাগের এ ঘটনা মুসলমানদের জন্য বাতিলকে সহ্য করার সীমারেখাকে সুস্পষ্ট করে দেয়। এভাবে কারবালার ঘটনা যুগ যুগান্তর ধরে প্রকৃত ইসলামের অনুসারীদের জন্য প্রেরণার উৎসে পরিণত হয়।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক যে, কারবালার ঘটনা সম্পর্কে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলে আসা মতৈক্যের বরখেলাফে ইদানীং কিছুসংখ্যক লোক একদিকে কারবালার ঘটনার গুরুত্ব হ্রাস করার লক্ষ্যে অতীতের অনেক ইতিবাচক ঘটনা আশুরার দিনে ঘটেছিল বলে দাবি করছেÑযার সপক্ষে কোনো অকাট্য দলীল নেইÑএবং এর ভিত্তিতে আশুরার এ শোকের দিনকে এমনকি আনন্দের দিন বলে অভিহিত করার মতো জঘন্য মানসিকতার প্রদর্শন করতেও দ্বিধা করছে না। অন্যদিকে তারা কারবালার ঘটনাকে ইসলামের সাথে সম্পর্কহীন রাজনৈতিক সংঘাত ও ইমাম হুসাইনকে বৈধ (?!) খেলাফতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহকারী ক্ষমতাপ্রয়াসী হিসেবে চিত্রিত করার এবং নরপিশাচ ইয়াযীদকে নির্দোষ প্রমাণের ঘৃণ্য অপচেষ্টা চালাচ্ছে। তারা দাবি করছে যে, ইয়াযীদের অনুমতি ছাড়াই কারবালার ঘটনা ঘটানো হয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, তারা এ-ও প্রচার করছে যে, শিয়ারাই ইমাম হুসাইনকে হত্যা করেছিল। আমরা এ ব্যাপারে কোনো দীর্ঘ আলোচনা ও মন্তব্য না করে কেবল মুক্তবিবেক মানুষদের কাছে প্রশ্ন করব : যদি তা-ই হয়ে থাকে তাহলে যারা এ জন্য দায়ী ইয়াযীদ তাদেরকে শাস্তি দেয় নি কেন; বরং কেন তাদেরকে পুরস্কৃত করেছিল এবং ইমামের পরিবারের সদস্যদেরকে কারারুদ্ধ করে ছিল?
এটা আজ অনস্বীকার্য যে, ইরানের ইসলামি বিপ্লবের বিজয়ের মধ্য দিয়ে ইসলামের বিজয় ও ইসলামি ঐক্য অভিমুখে মুসলিম উম্মাহ্র নবযাত্রা শুরু হয়েছে। তাই ইসলামকে ছিন্নভিন্ন ও নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যে ইসলামের দুশমনদের পক্ষ থেকে বিলিয়ন-বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে বহুমুখী হামলা শুরু হয়েছে এবং আশুরাসহ ইসলামের বিতর্কাতীত বিষয়গুলোকে বিতর্কিত করার অপচেষ্টা এ ষড়যন্ত্রমূলক হামলার প্রধান কর্মসূচি। এমতাবস্থায় সমগ্র মুসলিম উম্মাহ্র জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে ইসলামের দুশমনদের এ ষড়যন্ত্র ও হামলাকে জ্ঞানের অস্ত্র দ্বারা শক্তভাবে মোকাবিলা করা অপরিহার্য।
আমরা আশুরা উপলক্ষে সমগ্র মুসলিম উম্মাহ্র প্রতি, বিশেষ করে নিউজ লেটারের পাঠক-পাঠিকাদের প্রতি গভীর শোক ও সমবেদনা জানাচ্ছি।