শিশু-কিশোরদের প্রতি মহানবী (সা.)-এর আচরণ
পোস্ট হয়েছে: মার্চ ১৭, ২০২০
মুহাম্মাদ আলী চানারানী
শিশুর যেমন খাবার ও পানির প্রয়োজন রয়েছে তেমনি তার যতœ ও আদরেরও প্রয়োজন রয়েছে এবং তার সাথে ¯েœহ ও ভালোবাসাপূর্ণ আচরণ করা উচিতÑ যা শিশুর মনের জন্য সর্বোত্তম খাবারস্বরূপ। যেসব শিশু শৈশবকাল থেকেই তাদের পিতা-মাতার নিকট হতে পর্যাপ্ত পরিমাণে ভালোবাসা পেয়েছে তারা সাধারণত হাসি-খুশি স্বভাবের হয়ে থাকে। আমাদের ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের অনেক বক্তব্যে শিশুদের প্রতি ¯েœহ ও ভালোবাসার দিকটি আলোচিত হয়েছে এবং বিভিন্নভাবে তাদেরকে ¯েœহের উপদেশও দেওয়া হয়েছে। এখানে তার মধ্য থেকে কয়েকটি উল্লেখ করা হলো :
‘খুতবায়ে শা’বানীয়া’ নামে প্রসিদ্ধ বক্তব্যে মহানবী (সা.) যখন বিভিন্ন দায়িত্ব সম্পর্কে সাহাবীদেরকে দিকনির্দেশনা দিচ্ছিলেন সেখানে তিনি উপদেশ দেন : ‘তোমরা বয়োজ্যেষ্ঠদের সম্মান কর এবং ছোটদের প্রতি দয়াশীল হও।’ উয়ুনু আখবারির রিযা, ১ম খ-, পৃ. ২৯৫
মহানবী (সা.) অন্যত্র বলেন : ‘যে শিশুদের প্রতি ¯েœহ করে না এবং বড়দের সম্মান করে না সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়।’ আল মুহাজ্জাতুল বাইদা, ৩য় খ-, পৃ. ৩৬৫
শিশুদের প্রতি মহানবী (সা.)-এর ভালোবাসা
হযরত আলী (আ.) বলেন : ‘যখন আমি শিশু ছিলাম তখন মহানবী (সা.) আমাকে তাঁর কোলে বসাতেন, বুকে জড়িয়ে ধরতেন এবং কখনও কখনও তাঁর বিছানায় ঘুম পাড়িয়ে দিতেন। তিনি পরম মমতায় তাঁর মুখম-ল আমার মুখের ওপর রাখতেন এবং তাঁর শরীরের সুঘ্রাণ নেওয়াতেন।’ নাহজুল বালাগা
যখন মহানবী (সা.) আনসার সাহাবীদের শিশুদেরকে দেখতেন তখন তাদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন, তাদেরকে সালাম দিতেন এবং তাদের জন্য দোয়া করতেন। আনাস ইবনে মালিক বলেন : ‘আমি মহানবী (সা.) ছাড়া আর কাউকে নিজ পরিবারের প্রতি এত বেশি দয়াশীল দেখি নি। সীরাতুন নাবাবীয়্যাহ, ইবনে কাসীর, ৪র্থ খ-, পৃ. ৬১২
প্রতিদিন তিনি তাঁর সন্তান-সন্ততি ও নাতি-নাতনিদের মাথায় চুম্বন করতেন। বিহারুল আনওয়ার, ১০৪তম খ-, পৃ. ৯৯
ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইনের প্রতি মহানবী (সা.)-এর ভালোবাসা
ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইনের প্রতি মহানবীর গভীর ও ভীষণ ভালোবাসা ছিল। আনাস ইবনে মালিক বর্ণনা করেন : ‘মহানবী (সা.)-কে জিজ্ঞেস করা হলো : ‘আপনার পরিবারের মধ্য থেকে কোন্ ব্যক্তিকে আপনি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন।’ মহানবী জবাব দেন : ‘আমি হাসান ও হুসাইনকে অন্যদের চেয়ে বেশি ভালোবাসি।’ ইহকাকুল হক, ১০ম খ-, পৃ. ৫৯৫
ইমাম হাসান (আ.) বলেন : “মহানবী (সা.) আমাকে বলেন : ‘হে আমার সন্তান! তুমি আমার শরীরের অংশসদৃশ; তাদের ভালো হোক যারা তোমাকে এবং তোমার সন্তানদেরকে ভালোবাসবে এবং তাদের জন্য আফসোস যারা তোমাকে হত্যা করবে।’” ইহকাকুল হাক এর পরিশিষ্ট, ১১তম খ-, পৃ. ৩১১-৩১৪
ইমাম হুসাইনের প্রতি মহানবীর ভালোবাসা এত বেশি ছিল যে, তিনি তাঁর ক্রন্দন সহ্য করতে পারতেন না।
ইয়াযীদ বিন আবি যিয়াদ বলেন : ‘মহানবী (সা.) হযরত আয়েশার ঘর থেকে বের হয়ে হযরত ফাতিমার ঘর অতিক্রম করছিলেন। তিনি হুসাইনের ক্রন্দনধ্বনি শুনলেন এবং ফাতিমাকে বললেন : ‘তুমি কি জান না, হুসাইনের ক্রন্দন আমাকে ব্যথিত করে?’ ইহকাকুল হাক এর পরিশিষ্ট, ১১তম খ-, পৃ. ৩১১-৩১৪
শিশুদেরকে সহ্য করা
হযরত আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিবের স্ত্রী উম্মে ফযল বলেন : “যখন ইমাম হুসাইন একজন দুগ্ধপোষ্য শিশু তখন একদিন মহানবী (সা.) তাকে আমার কাছ থেকে নিয়ে কোলে নেন এবং তাকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। ইমাম হুসাইন তাঁর কোলে প্র¯্রাব করে দিলে আমি তাকে মহানবীর কোল থেকে দ্রুত নিয়ে নিলাম আর সে ক্রন্দন করা শুরু করল। মহানবী আমাকে বললেন : ‘তাড়াহুড়া করো না। আমার কাপড় তো পানি দিয়ে পরিষ্কার করা যাবে, কিন্তু আমার সন্তান হুসাইনের মন থেকে এই ব্যথার স্মৃতি কী করে দূর হবে?’”
শহীদদের শিশুদের সাথে মহানবীর আচরণ
বাশীর বিন আকরিয়া বিন যাহনী বলেন : “উহুদের যুদ্ধের দিন আমি মহানবীকে জিজ্ঞেস করলাম, আমার পিতা কীভাবে শহীদ হয়েছেন?’ মহানবী (সা.) বললেন : ‘সে আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হয়েছে। তার ওপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক!’ তখন আমি কেঁদে ফেললাম। মহানবী (সা.) আমাকে জড়িয়ে ধরলেন, আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন এবং আমাকে তাঁর ঘোড়ার ওপর বসিয়ে বললেন : ‘তুমি কি আমাকে তোমার পিতার মতো হওয়া পছন্দ করো না?’ মাজমাউল জাওয়ায়েদ, ৮ম খ-, পৃ. ১৬১
ইবনে হিশাম লিখেছেন : আবুদল্লাহ ইবনে জাফরের স্ত্রী আসমা বিনতে উমাইস বলেন : “যেদিন মুতার যুদ্ধে জাফর শহীদ হন, সেদিন মহানবী (সা.) আমাদের বাড়িতে আসেন। আমি সবেমাত্র ঘরের কাজগুলো শেষ করে ছেলেমেয়েদেরকে পরিপাটি করছিলাম। মহানবী (সা.) আমাকে বললেন : ‘জাফরের সন্তানদেরকে আমার কাছে নিয়ে আস।’ আমি সন্তানদেরকে তাঁর কাছে নিয়ে আসলাম। তিনি তাদেরকে বুকে টেনে নিলেন এবং আদর করতে থাকলেন, তখন তাঁর চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরছিল।”
“আমি জিজ্ঞেস করলাম : ‘হে নবী! আপনি কাঁদছেন কেন? জাফর ও তাঁর সঙ্গী-সাথিদের কোনো খবর এসেছে কি?’ তখন মহানবী বললেন : ‘তারা আজকে শহীদ হয়েছে।’” সিরাতে ইবনে হিশাম, ২য় খ-, পৃ. ২৫২
অন্য শিশুরাও মহানবীর এমন দয়া ও পিতৃসুলভ ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত ছিল না। বর্ণিত হয়েছে যে, মহানবী (সা.) শিশুদেরকে জড়িয়ে ধরতেন এবং কাউকে কাউকে তাঁর ঘাড়ে ও পিঠে উঠাতেন। তিনি তাঁর সাথিদের বলতেন, শিশুদেরকে জড়িয়ে ধর এবং তাদেরকে তোমাদের কাঁধে নাও। শিশুরা তাঁর এমন আচরণকে খুবই পছন্দ করত, এতে তারা অপরিসীম আনন্দ পেত এবং কখনই এরকম মধুর মুহূর্তগুলোকে ভুলে যেত না। পরবর্তী কালে কেউ কেউ গর্ব করে বলতেন : ‘মহানবী (সা.) আমাকে তাঁর পিঠে নিয়েছেন।’ আবার কেউ বলতেন : ‘মহানবী (সা.) তাঁর সাহাবীকে নির্দেশ দিয়েছিলেন তোমাকে পিঠে নেয়ার জন্য।’ আল মাহাজ্জাতুল বাইদা, ৩য় খ-, পৃ. ৩৬৬
মহানবী (সা.) নিজেও শিশুদের চুমু দিতেন।
মহানবী (সা.) বলেন : ‘যে কেউ তার সন্তানকে চুমু দেয় সে একটি সৎকর্ম সম্পাদন করে এবং যে কেউ তার সন্তানকে খুশি করে আল্লাহ পুনরুত্থান দিবসে তাকে খুশি করবেন।’ মাকারিমুল আখলাক, পৃ. ১১৩
হযরত আয়েশা বলেন : “এক ব্যক্তি মহানবী (সা.)-এর নিকট আসলেন এবং বললেন : ‘আপনি কি শিশুদেরকে চুম্বন করেন? আমি কখনও তা করি নি।’ মহানবী (সা.) জবাব দিলেন : ‘যখন আল্লাহ তোমার হৃদয় থেকে তাঁর মায়া-মমতা উঠিয়ে নিয়েছেন তখন আমি কী করতে পারি?” সহীহ বুখারী, ৮ম খ-, পৃ. ৯
ইবনে আব্বাস বলেন : ‘আমি মহানবী (সা.)-এর সাথে ছিলাম। তাঁর পুত্রসন্তান ইবরাহীম তাঁর বাম ঊরু এবং ইমাম হুসাইন ডান ঊরুর ওপর ছিলেন। মহানবী (সা.) কোনো সময় ইবরাহীমকে আবার কোনো সময় হুসাইনকে চুম্বন করছিলেন।’ মানাকিবে ইবনে শাহর আ’শুব, ৩য় খ-, পৃ. ২৩৪
শিশুদের ক্ষেত্রে ন্যায়পরায়ণতা
হযরত আবু সাঈদ খুদরী বলেন : ‘একদিন মহানবী (সা.) তাঁর কন্যার বাড়িতে গেলেন। আলী (আ.) বিছানায় ঘুমাচ্ছিলেন এবং তাঁর সন্তানদ্বয় হাসান এবং হুসাইন তাঁর পাশে ছিল। তারা পানি চাইল। মহানবী (সা.) তাদের জন্য পানি আনলেন। হুসাইন প্রথমে সামনে এলো। মহানবী (সা.) বললেন : “হাসান প্রথমে পানি চেয়েছিল।’ হযরত ফাতিমা (আ.) জিজ্ঞেস করলেন : ‘আপনি কি হাসানকে বেশি ভালোবাসেন?’ মহানবী (সা.) জবাব দিলেন : ‘দুজনই আমার নিকট সমান। [কিন্তু ন্যায়পরায়ণতা এটাই দাবি করে যে, প্রত্যেকে পর্যায়ক্রমে পানি পান করবে।]’” মাজমাউল জাওয়ায়েদ, ৯ম খ-, পৃ. ১৭১
শিশুদের খেলাধুলা করার প্রবণতা
মহানবী (সা.) বলেন : ‘এমন ব্যক্তি যার সাথে একটি সন্তান আছে তার সাথে শিশুর মতো আচরণ করো।’ কানযুল উম্মাল, বক্তব্য ৪৫৪১৩
মহানবী (সা.) আরো বলেন : ‘সেই পিতার ওপর আল্লাহর কৃপা বর্ষিত হোক যে উত্তম নিয়্যতে তার সন্তানকে সাহায্য করে, তার সাথে সদাচরণ করে, তার বন্ধু এবং তাকে ভালোভাবে শিক্ষিত করে।’ মুসতাদরাকুল ওয়াসায়েল, ২য় খ-, পৃ. ৬২৬
শিশুদের সাথে মহানবী (সা.)-এর খেলা করা
মহানবী (সা.) ইমাম হাসান ও হুসাইনের সাথে খেলা করেছেন।
ইয়ালা বিন মুররা বলেন : “মহানবী (সা.) দুপুরের খাওয়ার জন্য নিমন্ত্রিত হয়েছিলেন। আমরা তাঁর সাথে ছিলাম, হঠাৎ আমরা হাসানকে গলিপথে খেলতে দেখলাম। মহানবী (সা.) তাকে দেখলেন এবং তাকে ধরার জন্য দুই হাত প্রসারিত করে দৌড়ে গেলেন। হাসান তার থেকে পালানোর জন্য এদিক-ওদিক দৌড়াতে লাগল যা মহানবীর হাসির উদ্রেক করল। মহানবী (সা.) হাসানকে ধরে ফেললেন। তিনি তার একটি হাত তার চিবুকের নিচে এবং অন্য হাত তার মাথার ওপর রাখলেন। তিনি তাঁর মুখ শিশুটির কাছে নিলেন এবং তাকে এই বলে চুম্বন করলেন : ‘হাসান আমার একটি অংশ এবং আমি তার অংশ। যারা তাকে ভালোবাসে আল্লাহ তাদেরকে ভালোবাসবেন।’ বিহারুল আনওয়ার, ৪৩তম খ-, প.ৃ ৩০৬
অনেক বর্ণনায় এসেছে যে, এটি ইমাম হুসাইনের সাথে সম্পর্কিত একটি ঘটনা (অর্থাৎ ইমাম হাসানের সাথে সম্পর্কিত নয়)। সহীহ তিরমিযী, ৫ম খ-, পৃ. ৬১৫
একটি বর্ণনায় এসেছে যে, মহানবী (সা.) আব্বাসের সন্তানদেরকে ডাকতেন। তারা ছোট ছিল এবং খেলাধুলা করতে ভালোবাসত। তিনি তাদেরকে বলতেন : ‘যে আমার কাছে সবচেয়ে দ্রুত আসতে পারবে সে পুরস্কৃত হবে।’
শিশুদের খাওয়ানো
সালমান ফারসি বলেন : “আমি মহানবীর গৃহে প্রবেশ করলাম। হাসান ও হুসাইন তাঁর সাথে খাবার খাচ্ছিল। মহানবী (সা.) কিছু খাবার হাসানের মুখে দিচ্ছিলেন এবং কিছু খাবার হুসাইনের মুখে দিচ্ছিলেন। যখন তাঁরা খাওয়া শেষ করলেন তখন মহানবী হাসানকে তাঁর কাঁধে নিলেন এবং হুসাইনকে তাঁর কোলে বসালেন। এরপর তিনি আমার দিকে মুখ করলেন এবং বললেন : ‘হে সালমান! তুমি কি তাদেরকে পছন্দ কর?’ আমি বললাম : ‘হে নবী! কীভাবে আমি তাদেরকে পছন্দ করব না যখন আমি আপনার নিকট তাদের অবস্থান ও মর্যাদা প্রত্যক্ষ করি।’” বিহারুল আনওয়ার, ৩৬তম খ-, পৃ. ৩০৪
শিশুদেরকে সালাম দেয়া
মহানবী (সা.)-এর আরেকটি অভ্যাস ছিল শিশুদেরকে সালাম দেয়া।
হযরত আনাস ইবনে মালিক বলেন : ‘মহানবী (সা.) কয়েকটি শিশুর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তাদেরকে সালাম দিলেন এবং তাদেরকে খাবার দিলেন।’ সুনানে ইবনে মাজাহ, ২য় খ-, পৃ. ২২২০
ইমাম বাকির (আ.) বলেন : “মহানবী (সা.) বলেছেন : ‘মৃত্যু পর্যন্ত আমি পাঁচটি জিনিস পরিত্যাগ করব না। এগুলোর অন্যতম হলো শিশুদেরকে সালাম দেয়া।’ উয়ুনু আখবারির রিযা (আ.), পৃ. ২৩৫
আরেকটি বর্ণনায় এসেছে যে, মহানবী (সা.) ছোট-বড় সকলকে সালাম দিতেন। মুসতাদরাকুল ওয়াসায়েল, ২য় খ-, পৃ. ৬৯ তিনিই প্রথমে অন্যদেরকে সালাম দিতেন, এমনকি শিশুদেরকেও। রাহমাতে আলামীন, পৃ. ৬৬৩
তিনি যাকেই দেখতেন, তাকেই প্রথমে সালাম করতেন এবং মুসাফাহা করতেন।’ মাকারিমুল আখলাক, ১ম খ-, পৃ. ২৩
সংকলন ও অনুবাদ : সরকার ওয়াসি আহমেদ