বৃহস্পতিবার, ১৯শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৪ঠা আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

‘শাবে ইয়ালদা’ ইরানের শীতকালীন জনপ্রিয় উৎসব

পোস্ট হয়েছে: মার্চ ১৬, ২০২২ 

সাইদুল ইসলাম

‘শাবে ইয়ালদা’ ইরানের শীতকালীন একটি জনপ্রিয় উৎসব। যা প্রাচীন কাল থেকেই ব্যাপক জাঁকজমকপূর্ণভাবে পালিত হয়ে আসছে। এ উৎসবকে কেন্দ্র করে দেশটির বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। ইরানের ইনস্টিটিউট ফর ইন্টেলেকচুয়াল ডেভেলপমেন্ট অব চিলড্রেন অ্যান্ড ইয়াং অ্যাডাল্ট্্স (আইআইডিসিওয়াইএ-কানুন) ‘শাবে ইয়ালদা’ উপলক্ষ্যে কুড়ি বছরেরও বেশি সময় ধরে আন্তর্জাতিক গল্প বলার উৎসবের আয়োজন করে আসছে। করোনা পরিস্থিতির কারণে এ বছর অনলাইনে অনুষ্ঠিত হয় আন্তর্জাতিক গল্প বলার ২৩তম উৎসব। এবারের উৎসবে সারা বিশ্ব থেকে ২০জনের অধিক গল্পকার এবং বিপুল সংখ্যক ইরানি কথক অংশগ্রহণ করেন। গল্প বলার পারফরম্যান্সগুলো কানুন-এর ওয়েবসাইট, ইন্সটাগ্রাম এবং ইরানের ভিডিও শেয়ারিং পরিষেবা অ্যাপারাতে অনলাইনে সম্প্রচার করা হয়। শাবে ইয়ালদার রাতে অনুষ্ঠিত হয় উৎসবের চূড়ান্ত পর্ব।
কানুন এর উপ-পরিচালক মাহমুদ মোরাভভেজ উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বলেন, ‘গল্প বলার ঐতিহ্য মানুষের অস্তিত্বের শুরুর ইতিহাসের সাথে জড়িত এবং ইতিহাসের বিভিন্ন সময়কালে মানুষের মধ্যে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের একটি প্রধান মাধ্যম ছিল এটি।’ ‘শাবে ইয়ালদা’ এখন আন্তর্জাতিক পরিম-লে বহুল পরিচত এক উৎসবের নাম। শীঘ্রই জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থার (ইউনেসকো) অধরা ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান পেতে যাচ্ছে এটি। তেহরান টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, সিল্ক রোডের পাশাপাশি সম্প্রতি অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় নিবন্ধিত হয়েছে ইরানের ঐতিহ্যবাহী উৎসব ‘শাবে ইয়ালদা’। যা ভবিষ্যতে ইউনেস্কোর তালিকাভুক্ত হওয়ার পথ উল্লেখযোগ্যভাবে প্রশস্ত করে।
দক্ষিণ কোরিয়ায় ইউনেস্কো (আইসিএইচসিএপি) এর পৃষ্ঠপোষকতায় ও ইন্টারন্যাশনাল ইনফরমেশন অ্যান্ড নেটওয়াার্কিং সেন্টার আয়োজিত এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের অন্তর্মুখী সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি অনলাইন আন্তর্জাতিক সম্মেলন এবং ১০ ডিসেম্বর সমরকন্দে ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর সেন্ট্রাল এশিয়ান স্টাডিজে (আইআইসিএএস) উৎসবটি নিবন্ধন লাভ করে।
ইয়ালদা শব্দের অর্থ সূচনা বা জন্ম। শীত মওসুমে নিরক্ষ রেখা থেকে সূর্যের দূরতম অবস্থানকালে উত্তর গোলার্ধের দীর্ঘতম রাতে উদ্যাপিত হয় শাবে ইয়ালদা। ইরানি ক্যালেন্ডার অনুসারে প্রতি বছর ডিসেম্বরের ২০ বা ২১ তারিখ রাতে উদ্যাপিত হয় এই উৎসব। এটি ইরানি পরিবার ও বন্ধুদের একত্র হয়ে মূল্যবান সময় কাটানোর একটি সোনালি রাত। এদিন সবাই মিলে ধুমধাম করে বছরের দীর্ঘতম রাত উদ্যাপন করেন। ‘শাবে ইয়ালদা’ ঘিরে ইরানে রয়েছে বেশ কিছু ঐতিহ্য। শীতের দীর্ঘতম এই রাতে পরিবারগুলো একত্রিত হয়ে কবিতা এবং উৎসবে মেতে ওঠে। সঙ্গে ঐতিহ্যবাহী তরতাজা ফলমূলের সমাহার তো রয়েছেই। করুণাময় এই রাতে ইরানিদের কাছে শীতকালীন শীতলতা যেন পরাজিত হয়। ভালোবাসার উষ্ণতা পুরো পরিবারকে আলিঙ্গন করে। আত্মাগুলো একে অপরের আরও বেশি ঘনিষ্ঠ হয়ে ভালোবাসা বিনিময়ে মেতে ওঠে।
ইরান ছাড়াও আফগানিস্তান, তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান এবং কিছু ককেশীয় অঞ্চলের দেশ, যেমন- আজারবাইজান এবং আর্মেনিয়ায় বছরের একই সময় এই শাবে ইয়ালদা উদ্যাপিত হয়। এসব অঞ্চলের মানুষ যেসব কারণে শাবে ইয়ালদা উদ্যাপন করে থাকেন তার মধ্যে শীতের আগমন এবং অন্ধকারের উপর আলোর বিজয় অন্যতম। তারা মনে করেন অন্ধকার মন্দের প্রতীক। আর শাবে ইয়ালদার পরে প্রথম সকাল অন্ধকার ও অশুভ শক্তির উপর সূর্য এবং আলোর বিজয়ের সূচনা। অর্থাৎ এ রাতেই আলোর কাছে আঁধার পরাজিত হয় এবং এ রাত থেকেই মানবজাতির জন্য সুদিনের পালা বইতে শুরু করে।
কোনো কোনো ইরানি কবি-সাহিত্যিকের মতে, রাত হলো অশুভ বা মন্দের প্রতীক এবং দিন হলো ঔজ্জ্বল্য, শুভ্রতা, স্বচ্ছলতা, নির্মলতা ও পবিত্রতার প্রতীক। শাবে ইয়ালদা নিয়ে মহাকবি শেখ সাদি লিখেছেন,
ব্যথাতুর অন্তরে প্রশান্তির হাওয়া নাহি বয়
ইয়ালদার রজনী না পোহালে হয় না ভোরের উদয়।
কবি শেখ সাদি অপর এক কবিতায় বলেছেন,
তোমার রূপ দেখা প্রতিটি সকাল যেন শুভ নববর্ষ
তোমার বিচ্ছেদের প্রতিটি রাত যেন অতি দীর্ঘ
কবি শেখ ফরিদ উদ্দীন আত্তার বলেন,
নেই যদি জানা শেষ কোথায় আমার এ ব্যথাবেদনার
নেই কোনো উৎসব তবে কাল শাবে ইয়ালদার
কবি আল্লামা ইকবাল বলেছেন,
প্রাণচক্ষুকে যেমন অন্ধ করে দেয় তারই সুরমায়
আলোকিত দিনকে রাত পরিণত করে ইয়ালদায়
আল বিরুনী তাঁর ‘আল-বাকিয়াহ’ গ্রন্থে ইয়ালদাকে ‘মিলাদে আকবর’ বা ‘শ্রেষ্ঠতম জন্মদিন’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। যার উদ্দেশ্য সূর্যের জন্মদিন হিসেবে অধিক পরিচিত।
২১ ডিসেম্বরের এই রাতে বিদেশে বসবাসরত ইরানিদের জন্য রয়েছে চমৎকার কিছু সুযোগ। তাঁরা এদিন বিভিন্ন জাতি ও সংস্কৃতির মানুষদের কাছে নিজেদের অসাধারণ এই ঐতিহ্য তুলে ধরতে পারেন। প্রথা ও রীতিনীতি ভাগাভাগি করার মাধ্যমে দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্ক গড়ে তোলার সুযোগ পান। যা আন্তঃসংযুক্তির এই বিশ্বে পারস্পরিক উত্তম বোঝাপড়ার পথ প্রশস্ত করে। শাবে ইয়ালদার পূর্ব মুহূর্তে ইরানের ব্যস্ততম রাস্তায় উঁকি দিলে দেখা যায় মুদি ও কনফেকশনারি দোকানগুলো যেন মহাউৎসবে মেতে উঠেছে। সব শ্রেণি-পেশার মানুষ প্রয়োজনীয় খাবার-দাবার কিনে আনন্দ উপভোগের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
ইয়ালদা রাতে সাধারণত পুষ্পশোভিত বাটিতে করে তরতাজা ফলমূল ও রঙিন আজিল (শুকনো ফল, বীজ ও বাদামের সংমিশ্রণ) পরিবেশন করা হয়। ইরানিদের কাছে গ্রীষ্মকালে ফলমূল হলো প্রাচুর্যের স্মারক। এই রাতের ঐতিহ্যবাহী টাটকা ফল হচ্ছে তরমুজ ও ডালিম। এ দু’টি ফলকে অনুগ্রহের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিশ্বাস করা হয়, শীতের আগমনের আগে তরমুজ খেলে অসুস্থতার বিরুদ্ধে শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে।
রাতে উষ্ণ খাবার শেষে অনেকে কবিতা, গল্প ও বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে অসাধারণ মুহূর্ত কাটান। মধ্যরাত পর্যন্ত চলতে থাকে এই উৎসব।
লোকজন নিজেদের ভাগ্যগণনাও এই রাতেই করে থাকেন। মহাকবি হাফিজ শিরাজির কাব্য সংকলনের প্রতিটি গজলের রয়েছে আলাদা আলাদা তাৎপর্য। তাঁর কাব্য সংকলনটি সামনে রেখে পরিবারের বয়স্ক ব্যক্তি শুরু করেন ভাগ্যগণনা। যার ভাগ্যগণনা করা হবে তিনি পবিত্র হয়ে চোখ বন্ধ করে ৩ বার সূরা ইখলাস পড়ে মনে মনে কিছু একটা চাইবেন। অতঃপর বয়স্ক ব্যক্তি কাব্য সংকলনটি তাঁর সামনে খুলে ধরে বলবেন, ‘ডান পৃষ্ঠা নাকি বাম পৃষ্ঠা?’ চোখ বন্ধ রেখেই লোকটি কোনো এক পৃষ্ঠায় নিজের ডান হাতটি রাখবেন এবং বয়স্ক ব্যক্তি ওই পৃষ্ঠার কবিতা ও তার তাৎপর্য ব্যাখ্যা করবেন। এভাবেই দীর্ঘ এই রাতটি গল্পগুজবে পার করে দেন ইরানের জনগণ। তবে ইরানের কোনো কোনো অংশে মহাকবি ফেরদৌসির ‘শাহনামা’ থেকে সুরে সুরে আবৃত্তি করা হয়। কোথাও কোথাও সারা রাত কবিতার লড়াই অনুষ্ঠিত হয়।