বৃহস্পতিবার, ১৯শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৪ঠা আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘জালাল উদ্দিন রুমির দর্শনে বিশ্বজগৎ ও মানবসৃষ্টি রহস্য’ শীর্ষক সেমিনার অনুষ্ঠিত

পোস্ট হয়েছে: নভেম্বর ২২, ২০১৮ 

ইরানের বিখ্যাত সুফিকবি মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি স্মরণে দিবস পালন উপলক্ষে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের উদ্যোগে ‘জালাল উদ্দিন রুমির দর্শনে বিশ্বজগৎ ও মানবসৃষ্টি রহস্য’ শীর্ষক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য প্রফেসর ড. চৌধুরী মো. জাকারিয়া, বিশেষ অতিথি হিসেবে রাবি কলা অনুষদের ডীন প্রফেসর ড. মো. ফজলুল হক ও ঢাকাস্থ ইরানি সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের কালচারাল কাউন্সেলর জনাব সাইয়্যেদ মূসা হোসেইনী উপস্থিত ছিলেন। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের ভিজিটিং প্রফেসর ড. কাজেম কাহদুয়ি, রাবি ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের ভিজিটিং প্রফেসর ড. রেজা সামিযাদে, রাবি ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের প্রফেসর ড. মো. শফিউল্লাহ। সেমিনারে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের প্রফেসর মো. নূরুল হুদা। বিভাগীয় সভাপতি প্রফেসর ড. মো. আতাউল্যাহর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সেমিনারে সঞ্চালক ও ভাষান্তরের দায়িত্ব পালন করেন প্রফেসর ড. মো. কামাল উদ্দিন।
ড. মো. ইমতিয়াজ আহমেদের পবিত্র কুরআন মজিদ থেকে তেলাওয়াতের মাধ্যমে সেমিনার শুরু হয়। অতিথিবৃন্দের স্বাগত জানিয়ে স্বরচিত ফারসি গান পরিবেশন করেন বিভাগের পিএইচডি গবেষক মো. মহররম হোসাইন ও তার দল। বিভাগের পক্ষ থেকে অতিথিবৃন্দকে ক্রেস্ট প্রদান করা হয়, বিশেষ করে বিদায়ী কালচারাল কাউন্সেলর জনাব সাইয়্যেদ মূসা হোসেইনীকে ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের পক্ষ থেকে বিদায়ী স্মারক ক্রেস্ট উপহার দেওয়া হয়। উক্ত সেমিনারে বিভিন্ন বিভাগের অর্ধ শতাধিক শিক্ষক ও দুই শতাধিক ফারসি শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিলেন।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রফেসর ড. চৌধুরী মো. জাকারিয়া বলেন, সুফিদর্শনের মাধ্যমে ইরান ও বাংলাদেশের মধ্যে এক প্রাচীন ও ঐতিহাসিক সম্পর্ক বিদ্যমান রয়েছে। তিনি আরও বলেন, আমি যখন ঢাকায় টওঞঝ-এর প্রোভিসির দায়িত্বে কর্মরত ছিলাম তখন আল্লামা রুমি সোসাইটির সাথে সবসময় সম্পৃক্ত ছিলাম। বাংলা ভাষায় ফারসি প্রভাব সম্পর্কে বলেন, বাংলা ভাষায় প্রায় আট হাজার ফারসি শব্দ ব্যবহৃত হচ্ছে। নামাজ, রোজা, পর্চা, জায়নামাজ প্রভৃতি ফারসি শব্দ বাংলার ন্যায় আমাদের কাছে পরিচিত। অগণিত ফারসি গ্রন্থ বাংলা ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ‘গুলিস্তান’, ‘বুস্তান’, ‘শাহনামা’, ‘দিওয়ানে হাফিজ’, ‘রুবাইয়াতে ওমর খৈয়্যাম’ অন্যতম। ইরানিদের আতিথেয়তা বিশ্বজুড়ে খুবই সমাদৃত। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে আগত ইরানি ভিজিটিং প্রফেসর ড. রেজা সামিজাদেকে স্বাগত জানাচ্ছি। তাঁর আগমনে ফারসি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ও অনেক বেশি উপকৃত হবে।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে রাবি কলা অনুষদের ডীন প্রফেসর ড. মো. ফজলুল হক বলেন, মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি বিশ্বসাহিত্যের এক অমূল্য রতœ। ‘মসনবিয়ে রুমি’ ও ‘দিওয়ানে শামস তাবরিযি’ তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ। রুমি ¯্রষ্টা ও সৃষ্টিজগৎ সম্পর্কে দার্শনিক তত্ত্ব উত্থাপন করেন। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশ ও ইরানের মধ্যে রয়েছে এক সুদৃঢ় ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক। ঢাকাস্থ ইরান কালচারাল সেন্টারের কাউন্সেলর জনাব সাইয়্যেদ মূসা হোসেইনী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের উন্নয়নে বিশেষ সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন। এ বিভাগের শিক্ষকগণও একাডেমিক কার্যক্রমে খুবই সক্রিয়। ফলে মাত্র দু’বছরের ব্যবধানে বিভাগ শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক অনেক উন্নয়নমূলক কার্যক্রম সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়েছে। এ বিভাগ উত্তরোত্তর আরো উন্নতি লাভ করবে বলে প্রত্যাশা করছি। তিনি কালচারাল কাউন্সেলরের নিকট ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের এম এ শ্রেণিতে উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদেরকে শিক্ষাবৃত্তির প্রদানের মাধ্যমে ইরানে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টির অনুরোধ জানান।
ইরান কালচারাল সেন্টারের কাউন্সেলর জনাব সাইয়্যেদ মূসা হোসেইনী তাঁর বক্তব্যে উল্লেখ করেন, আমি এবার তৃতীয় বারের মতো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে আগমন করলাম। যখনই আমি এ বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছি তখনই এখান থেকে এনার্জি লাভ করেছি। প্রথমবার যখন আসি তখন ফারসি বিষয় ভাষা বিভাগের অধীনে ছিল। তৎকালীন মাননীয় উপাচার্য প্রফেসর ড. মো. মিজানউদ্দিনের সাথে সাক্ষাৎ করেছি, তিনি ফারসিকে স্বতন্ত্র বিভাগ করার বিষয়ে ইতিবাচক সাড়া প্রদান করেন। কয়েক মাস পর দ্বিতীয়বার যখন এ বিভাগে এলাম তখন ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ স্বতন্ত্র বিভাগের মর্যাদা লাভ করেছে। মাননীয় উপাচার্য মহোদয়ের উপস্থিতিতে ইরানিয়ান স্টাডিজ রুম উদ্বোধনের পাশাপাশি ফারসি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের নিয়ে ইরানি শিক্ষক দ্বারা ফারসি ভাষা ও সাহিত্য প্রমোশন কোর্স সম্পন্ন করা হয়। এবার তৃতীয়বারের মতো এ বিভাগে যখন এসেছি তখন বিভাগ অনেক উন্নতি লাভ করেছে। ইরানের একজন খ্যাতিমান ফারসি প-িত প্রফেসর ড. রেজা সামিজাদে বিভাগে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে যোগদান করেছেন। আশা করি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের ভিজিটিং প্রফেসর ড. কাজেম কাহদুয়ি এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং প্রফেসর ড. রেজা সামিযাদের কাছ থেকে বিভাগীয় শিক্ষক ও শিক্ষার্থীবৃন্দ তাঁদের পঠন-পাঠন ও গবেষণামূলক কাজে অনেক বেশি উপকৃত হবেন। শুরু থেকেই এই বিভাগের শিক্ষক ও ছাত্র-ছাত্রীবৃন্দ খুবই সক্রিয় ভূমিকা পালন করে আসছেন। বিভাগের একাডেমিক ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। এ বছর ইরানের তেহরানে শেখ সাদি ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ফারসি শিক্ষক প্রশিক্ষণ কোর্সের আয়োজন করা হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে সর্বমোট চার জন শিক্ষক এ কোর্সে অংশগ্রহণ করেন, তন্মধ্যে তিন জন শিক্ষক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অংশগ্রহণ করেন আর এক জন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এটাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি শিক্ষকগণের সক্রিয়তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আশা করি আগামী দিনেও তাঁদের এ তৎপরতা অব্যাহত থাকবে। আগামী বছরের শুরুতে ঢাকাতে ডেফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সাযেমানে ফারাহাঙ্গ ওয়া এরতেবাতাতে ইসলামি, মাশহাদ ফেরদৌসি ইউনিভার্সিটির উদ্যোগে একটি আন্তর্জাতিক সেমিনার অনুষ্ঠিত হবে। এতে গবেষণামূলক প্রবন্ধ রচনার মাধ্যমে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত শিক্ষকগণ অংশগ্রহণ করতে পারবেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের ভিজিটিং প্রফেসর ড. কাজেম কাহদুয়ি তাঁর বক্তব্যে বলেন, আমি ২২ বছর পর দ্বিতীয়বার বাংলাদেশে আগমন করলাম। বিদেশি হিসেবে যাঁরা বাংলাদেশে আসেন তাঁরা দু’বার কান্না করেন। প্রথমবার যখন আসেন তখন জানেন না যে, তাঁরা কোথায় আসছেন? দ্বিতীয়বার যখন তাঁরা নিজ দেশে ফিরে যান তখন বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসা, আন্তরিকতা ও আতিথেয়তায় অশ্রুসিক্ত হয়ে বিদায় নিতে হয়। তিনি তাঁর বক্তব্যে রুমির ‘মসনবি’র কাহিনীর আলোকে মানুষের জীবনকে শিশুর জীবনের সাথে তুলনা করেন। তিনি ‘মসনবি’ থেকে সুলতান মাহমুদ ও চোরের কাহিনী উপস্থাপনের মাধ্যমে শিক্ষণীয় বিষয় তুলে ধরেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের ভিজিটিং প্রফেসর ড. রেজা সামিযাদে বলেন, রুমির জীবনকে তিনভাগে ভাগ করা যায়। তাঁর জীবনের শেষাংশ ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যার সূচনা হয়েছিল চল্লিশ বছর বয়সের পর শামস তাবরিযির সাথে সাক্ষাতের মধ্য দিয়ে। এতে তাঁর জীবনের আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়। তিনি আরও বলেন, ফরিদ উদ্দিন আত্তার রুমিকে তাঁর ‘আসরার’ নামে কাব্যগ্রন্থটি উপহার দিয়েছিলেন। রুমির ‘মসনবি’ পৃথিবীর প্রায় ত্রিশটির অধিক ভাষায় অনূদিত হয়েছে। রুমি ফারসি সাহিত্যাকাশের এক মহান নক্ষত্র হিসেবে বিশ্ববাসীর কাছে স্মরণীয় হয়ে আছেন।
প্রফেসর ড. মো. শফিল্লাহ বলেন, মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমির ‘মসনবি’ বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ের সাথে গেঁথে আছে। বাংলাদেশের যেখানেই ওয়াজ-মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়, প্রায় সর্বত্রই তাঁর ‘মসনবি’ থেকে আলোচনা করা হয়।
সেমিনারে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকগণের মধ্যে যাঁরা আন্তর্জাতিক সেমিনারে অংশগ্রহণ উপলক্ষে ইরান সফর করে এসেছেন তাঁরা বর্তমান ইরানের উন্নয়ন ও অগ্রগতি সম্পর্কে তাঁদের অভিমত তুলে ধরেন। এতে অংশগ্রহণ করেন ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের প্রফেসর ও কলা অনুষদের সাবেক ডীন প্রফেসর ড. এফ এম এ এইচ তাকী, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে প্রফেসর ড. মুহিবউল্যাহ সিদ্দিকী ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ড. আব্দুর রহমান সিদ্দিকী।
সভাপতির বক্তব্যে বিভাগীয় সভাপতি প্রফেসর ড. মো. আতাউল্যাহ অনুষ্ঠানে আগত মাননীয় প্রধান অতিথি, বিশেষ অতিথিবৃন্দ, সম্মানিত আলোচকবৃন্দ, প্রবন্ধকার, বিভিন্ন বিভাগের বিজ্ঞ শিক্ষকম-লী, সুধীম-লী ও উপস্থিত ছাত্র-ছাত্রীদেরকে আন্তরিক ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। ছুটির পর পুনরায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় খোলার মাত্র তৃতীয় দিনে বিভাগের পক্ষ থেকে আয়োজিত এ সেমিনারকে সাফল্যম-িত করায় তিনি উপস্থিত সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
পরিশেষে ইরানের আন্তর্জাতিক কুরআন মজিদ প্রদর্শনীমূলক সেমিনারে অংশগ্রহণকারী রাবি আরবি বিভাগের প্রফেসর ড. মতিউর রহমানের মুনাজাতের মাধ্যমে সেমিনারের পরিসমাপ্তি ঘটে।
উপ-উপাচার্য মহোদয়ের সাথে সাক্ষাৎ
ইরান কালচারাল কাউন্সেলর জনাব সাইয়্যেদ মূসা হোসেইনি ইরানি প্রতিনিধি দল এবং ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের শিক্ষকদের নিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য প্রফেসর ড. আনন্দ কুমার সাহার সাথে সাক্ষাৎ করেন। তাঁরা উভয় দেশের ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ককে আরো জোরদার করার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন। এক্ষেত্রে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং প্রফেসর ড. রেজা সামিযাদে যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করবেন। তাঁরা মনে করেন ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ যেভাবে গতিশীলতার সাথে অ্যাকাডেমিক ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে আগামী দিনে তা আরো উত্তরোত্তর সাফল্যের দিকে নিয়ে যাবে।
ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ পরিদর্শন
জনাব সাইয়্যেদ মূসা হোসেইনী ও প্রফেসর ড. কাজেম কাহদুয়ি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ পরিদর্শন করেন। এসময় শিক্ষার্থীরা কালচারাল কাউন্সেলরের উদ্দেশে বিদায়ী বক্তব্য প্রদান করেন। বিভাগীয় সকল শিক্ষক ও ছাত্র-ছাত্রী বিভাগের উন্নয়নে ও স্বতন্ত্র বিভাগের মর্যাদা লাভের ক্ষেত্রে তাঁর সার্বিক সহযোগিতার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। ড. কাহদুয়ি তাঁর বক্তব্যে বলেন, ফারসি আমরা শুধু রুটি রুজির জন্য অধ্যয়ন করি না। কারণ, রিযিকের ফয়সালা আল্লাহর পক্ষ থেকে আসে। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহপ্রেমে পাগলপারা মানুষ সবাই একই দলভুক্ত। আমরা সবাই একই স্থানে দাঁড়িয়ে নিজেদের ও জাতির উন্নয়নে এগিয়ে যাব।

ঢাবির ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের উদ্যোগে ইরানি কালচারাল কাউন্সেলরকে বিদায় সংবর্ধনা

ঢাকাস্থ ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের কালচারাল কাউন্সেলর সাইয়্যেদ মূসা হোসেইনীর বাংলাদেশে দায়িত্ব পালন শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের উদ্যোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের হাফিজ প্রাঙ্গনে গত ১৩ আগষ্ট এক বিদায় সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের উপস্থিতিতে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. আবুল কালাম সরকার। সূচনা বক্তব্য প্রদান করেন বিভাগের প্রবীন শিক্ষক ড. কুলসুম আবুল বাশার। অনুষ্ঠানে জনাব মূসা হোসেইনীকে বিভাগের পক্ষ থেকে স্মারক ক্রেস্ট প্রদান করেন ড. আবুল কালাম সরকার। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর ড.এ কে এম সাইফুল ইসলাম খান, প্রফেসর ড. তারেক সিরাজী, প্রফেসর ড. আব্দুস সবুর খান ও সহকারী অধ্যাপক মুমিত আল রশিদ। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক জনাব আহসানুল হাদী।
প্রফেসর ড. কুলসুম আবুল বাশার তাঁর বক্তৃতায় বলেন, সাইয়্যেদ মূসা হোসেইনী বাংলাদেশে দায়িত্ব পালনকালে তাঁর কার্যক্রম ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না; বরং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের উন্নয়নে বড় ভূমিকা রেখেছেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইরানি ভিজিটিং প্রফেসরদের আগমন ও অবদানের প্রশংসা করেন।
অনুষ্ঠানে প্রফেসর কে এম সাইফুল ইসলাম খান কয়েকটি কবিতার উদ্ধৃতি থেকে বলেন, ‘গাঞ্জ’ একটি ফারসি শব্দ এবং আমরা ফারসি সাহিত্যের চর্চার মধ্য দিয়ে জ্ঞান, সংস্কৃতি ও আধ্যাত্মিকতার গাঞ্জে মিলিত হয়েছি। এই উপমহাদেশের বিজ্ঞজনেরা একসময় ফারসির রতœভা-ারে বিচরণ করেছেনÑ বর্তমানে এই সাহিত্যচর্চার মধ্য দিয়ে আমরা আবারও সমৃদ্ধ হব।
অনুষ্ঠানে প্রফেসর ড. আব্দুস সবুর খান বলেন, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ ও ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের স¤পর্ক একই পরিবারের মত। তিনি জনাব মূসা হোসেইনীর সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফারসি বিভাগে ইরানের সহায়তায় ভাষা শিক্ষা ল্যাব প্রতিষ্ঠা, বিভাগের ১ জন শিক্ষক ও ২ জন ছাত্রের উচ্চশিক্ষার্থে ইরানে অবস্থান, ইরানে বিভিন্ন সেমিনারে শিক্ষকদের ব্যাপক অংশগ্রহণ, ফারসি বিভাগকে সাথে নিয়ে ভিন্ন মাত্রায় নওরোয উৎসব উদ্যাপনসহ বিভিন্ন কার্যক্রমের কথা তুলে ধরেন।
প্রফেসর ড. তারেক সিরাজী তাঁর বক্তৃতায় বলেন, জনাব মূসা হোসেইনীর কর্মসূচিগুলোর একটি স্থায়ী প্রভাব রয়েছে ও ছাত্র-শিক্ষকরা তা থেকে উপকৃত হবে।
সহকারী অধ্যাপক মুমিত আল রশিদ তাঁর বক্তৃতায় নতুন প্রজন্মকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈচিত্র্যময় অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে ফারসিচর্চাকে ব্যাপকতর করতে ও তাদের কর্মকা-কে বিভাগ ও দেশের গ-ি পেরিয়ে সর্বত্র সম্প্রসারিত করার আহ্বান জানান।
প্রফেসর ড. আবুল কালাম সরকার তাঁর বক্তৃতায় ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের উন্নয়নে আবদান রাখার জন্য সাইয়্যেদ মূসা হোসেইনীকে ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের ছাত্র-শিক্ষকরা সাম্প্রতিক দিনগুলোতে তাদের সাফল্যের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে বিশেষভাবে পুরস্কৃত হচ্ছে।

বাংলাদেশ সরকার ও ইরানভক্ত মানুষের সহযোগিতার কথা স্মরণীয় হয়ে থাকবে : মূসা হোসেইনী
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের বিদায়ী কালচারাল কাউন্সেলর সাইয়্যেদ মূসা হোসেইনী বলেছেন, তাঁর দায়িত্বকালীন সময়ে বাংলাদেশ সরকার ও সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রনণালয় ও প্রতিষ্ঠানসমূহ এবং বাংলাদেশের ইরানভক্ত জনগণ যে সহযোগিতা করেছেন তা স্মরণীয় হয়ে থাকবে। পূর্ণ মেয়াদে দায়িত্ব পালন শেষে ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি একথা বলেন।
গত ৮ সেপ্টেম্বর ঢাকাস্থ ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র মিলনায়তনে ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের কালচারাল কাউন্সেলর সাইয়্যেদ মূসা হোসেইনীর বিদায় ও নবনিযুক্ত ভারপ্রাপ্ত কালচারাল কাউন্সেলর সাইয়্যেদ মাহদী হোসেইনীর বরণ উপলক্ষে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল প্রফেসর ড. মুহাম্মদ সিরাজউদ্দিন। অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে ইরানি ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে দ্বিতীয় মেয়াদে নিযুক্ত ড. কাজেম কাহদুয়ীকেও সংবর্ধনা দেয়া হয়।
অনুষ্ঠানে স্মৃতিচারণমূলক বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ের সাবেক প্রক্টর ও ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক ড. কে এম সাইফুল ইসলাম খান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক ড. আবদুস সবুর খান, ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের কর্মকর্তা ড. জহির উদ্দিন মাহমুদ, বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ হুজ্জাতুল ইসলাম মোহম্মদ আশরাফ উদ্দিন খান, আল কুদস কমিটি বাংলাদেশ-এর সেক্রেটারি জেনারেল মোস্তফা তারেকুল হাসান এবং ইতিহাসবিদ আশরাফুল ইসলাম।
অনুষ্ঠানে বিদায়ী কালচারাল কাউন্সেলর সাইয়্যেদ মূসা হোসেইনী আরো বলেন, বাংলাদেশকে আমি কখনো বিদেশ ভাবি নি। আর ইরানপ্রেমিক এদেশের মানুষকে পর ভাবি নি। নিজের ভাই-বোনই মনে হয়েছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাজ করেছি এবং কাজ করার পূর্ণ পরিবেশ এখানে বিদ্যমান ছিল। সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের কাজ যেহেতু কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, সাংবাদিক, গবেষক, অধ্যাপক, বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে এমনকি কিছু কিছু বিষয় ছিল ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের সাথে, কাজেই সবার মতামত বা পরামর্শ নিয়ে, সবাইকে সাথে নিয়ে পার¯পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে কাজ করেছি এবং সবার সহযোগিতা পেয়েছি। বিভিন্ন সাহিত্য-সাংস্কৃতিক সংগঠন, নাট্যসংগঠন, ফিল্ম প্রডিউসার, প্রকাশকের সাথে একাত্ম হয়ে কাজ করতে হয়েছে। তাই বাংলাদেশে দায়িত্ব শেষ করে নিজ দেশে যাওয়ার সময়ও আমার মনে হচ্ছে আমি নিজেই দেশ ছেড়ে যাচ্ছি।
আমি এমন একটি দেশের ও এমন একটি বিপ্লবের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছি যে দেশের জনগণ রক্ত ও জীবন দিয়ে সেই বিপ্লবের বিজয় ছিনিয়ে এনেছে। এই বিপ্লবের সুশোভিত সুফল ও এর সৌরভকে পৃথিবীময় বিশ্ববাসীর কাছে ছড়িয়ে দেয়ার যে জাতীয় দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে এর অংশ হিসেবেই আমি বাংলাদেশে দায়িত্ব পালন করেছি।
সভাপতির বক্তব্যে ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল প্রফেসর ড. সিরাজুদ্দিন বলেন, ইরানের সাথে বাংলাদেশের স¤পর্ক হাজার বছরের। আর ফারসি ভাষা একটি আধ্যাত্মিক ও প্রেমের ভাষা হিসেবে পরিচিত। এদেশে ফারসি রাজভাষা ছিল দীর্ঘদিন। ইংরেজরা এদেশ দখল করার পরও বহুদিন এদেশে তথা এ উপমহাদেশে ইংরেজরা ফারসি ভাষাতেই শাসনকার্য চলিয়েছে এবং ফারসি ভাষা শেখার জন্য ও ফারসি ভাষাতে রাজকার্য চালানোর জন্য ফারসি জানা আলেমগণের সহযোগিতা নিয়েছে। পরে তারা ধীরে ধীরে ইংরেজি চালু করেছে।
আমরা ইসলাম পেয়েছি ইরানের ভেতর দিয়ে। ফারসি ভাষাভাষী সুফি ও অলি-দরবেশদের মাধ্যমে। ইরানের সাথে এই যে আমাদের ঐতিহাসিক ও ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ঐক্য সে ঐক্য যুগে যুগে জোরদার হয়েছে সাইয়্যেদ মূসা হোসেইনীদের মতো অভিজ্ঞতাস¤পন্ন ও নিবেদিতপ্রাণ কর্মকতাদের কারণে। আশা করি ভারপ্রাপ্ত নবাগত তরুণ কাউন্সেলরও জনাব মূসা হোসেইনীর মতোই দক্ষ ও প্রাণবন্ত হবেন এবং অভিজ্ঞতার স্বাক্ষর রাখবেন।
দ্বিতীয়বারের মতো বাংলাদেশে আগত ইরানের ভিজিটিং প্রফেসর ড. কাজেম কাহদুয়ী বলেন, বাংলাদেশ আমার প্রিয় দেশ। এর সবুজ শ্যামল বিস্তৃত ভূখ- আমার প্রিয় জায়গা। সেকারণে আমি চিনে না গিয়ে, হাঙ্গেরীতে না গিয়ে বাংলাদেশেই আবার ফিরে এসেছি। তিনি বলেন, আমি যখন প্রথম মেয়াদে আসি তখন ফারসি বিভাগের ছাত্র সংখ্যা ছিল চারজনের মতো। আর ছাত্রী তো ছিলই না। সেখান থেকে আজ ফারসি শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়ে ঢাকা, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮০০ ছাড়িয়ে গেছে। এদেশের মানুষের রয়েছে ইরান ও ফারসি ভাষার প্রতি এক গভীর মমতা।
নবনিযুক্ত ভারপ্রাপ্ত কালচারাল কাউন্সেলর জনাব সাইয়্যেদ মাহদী হোসেইনী তাঁর দায়িত্বকালে সকলের সহযোগিতা কামনা করেন।
অধ্যাপক ড. কে এম সাইফুল ইসলাম খান মাওলানা জালালউদ্দীন রুমী (র.)-এর মসনবী থেকে বেশ কিছু লাইন সুর করে পাঠ করেন ও বলেন, মাওলানা রুমীর প্রেম ও মানবিক আওয়াজ ইরানের মাটিতে সীমাবদ্ধ না থেকে তা ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বময়। এই আওয়াজকে আজ বুলন্দ করতে হবে। দল, মত, জাতি, ধর্ম, মাজহাব, তরীকা নির্বিশেষে ঐক্য, প্রেম ও সংহতির সুবাস ছড়িয়ে দিতে হবে সবখানে। বিভেদ-বিদ্বেষের ভয়ংকর আগুন নেভাতে রুমীর আধ্যাত্মিকতার ঝর্নাধারা বইয়ে দিতে হবে এবং এপথেই ফিরে আসতে হবে। ইরানের ইসলামি বিপ্লবের পর সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের প্রসারে ফারসি চর্চার ব্যাপকতার ফলেই এ উপলব্ধি আমাদের হয়েছে।
অধ্যাপক ড. আবদুস সবুর খান সাইয়্যেদ মূসা হোসেইনীর অভিজ্ঞতা, দায়িত্ব সচেতনতা, বুদ্ধিদীপ্ততার কথা উল্লেখ করে বলেন যে, তিনি ছিলেন একজন ধীর-স্থির চিন্তার মানুষ। ঠা-া মাথায় নীরবে কাজ করতেন। কালচারাল সেন্টারের সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের অনেক যৌথ কার্যক্রম রয়েছে। তিনি সবক্ষেত্রে আন্তরিক সহযোগিতা করেছেন।
ড. জহির উদ্দিন মাহমুদ বলেন, সাইয়্যেদ মূসা হোসেইনী ইরানের ইসলামি বিপ্লবের একজন প্রত্যক্ষ সাক্ষী। তিনি বিপ্লবের সমাবেশ-মিছিলে অংশগ্রহণ করেছেন। রাজপথে তিনি ছিলেন। ইমাম খোমেইনী (র.) প্যারিস থেকে এসে বেহেশত যাহরায় যে ঐতিহাসিক বিপ্লবী ভাষণ দেন সেটিও তিনি কাছে থেকে শুনেছেন ও দেখেছেন। তিনি ইরানের পররাষ্ট্র ও সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর চাকুরি জীবনের শেষ সময়টা তিনি বাংলাদেশে কাটিয়ে গেলেন। তাঁকে কাজ করতে হতো ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক সংগঠন, সংস্থা ও ব্যক্তিবর্গের সাথে। ইসলামিক ফাউন্ডেশন, জাতীয় জাদুঘর, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, বাংলা একাডেমী, নজরুল ইনস্টিটিউট সহ বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেল, নাট্য গ্রুপ বা ফিল্ম প্রডিউসারের সাথেও। তাঁর সময়ে এসব ক্ষেত্রে যথার্থ সমন্বয় সাধিত হয়েছে।
জনাব আশরাফ উদ্দিন খান বলেন, সাইয়্যেদ মূসা হোসেইনী একজন জ্ঞানী মানুষ এবং সফল কালচারাল কাউন্সেলর। তিনি বাংলাদেশের মানুষের মনস্তাত্ত্বিক অবস্থাটা বুঝতেন। শুধু তাই নয়, তিনি উপমহাদেশের মানুষের মনস্তত্ত্বও বোঝেন। তিনি উর্দু সহ বেশ কয়েকটি ভাষা জানেন। তিনি পাকিস্তানেও দায়িত্ব পালন করেছেন। এ অভিজ্ঞতা তাঁকে তাঁর দায়িত্ব পালনের পথকে প্রশস্ত করে দিয়েছে।
তিনি আরো বলেন, ইসলামি বিপ্লবের পর থেকেই ইরান ক্রমাগতভাবে বিশ্বের কায়েমী স্বার্থবাদী পরাশক্তির শত্রুতার সম্মুখীন হয়েছে। পশ্চিমা মিডিয়ার অপপ্রচার ও অর্থনৈতিক অবরোধের ভেতরও ইরান বিশ্ব-মুসলিম ও মানবতার স্বার্থে কাজ করে গেছে ও বর্তমানেও করে চলেছে। ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের কাজও থেমে থাকে নি। ইনশাআল্লাহ সামনেও তা থেমে থাকবে না।
আল কুদস কমিটি বাংলাদেশের সেক্রেটারি জেনারেল ও মাল্টিলিংক প্রিন্টার্সের স্বত্বাধিকারী জনাব মোস্তফা তারেকুল হাসান বলেন, মূলত ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র থেকে প্রকাশিত নিউজলেটার ও বই পত্র ছাপা সংক্রান্ত বিষয়ে মূসা হোসেইনী সাহেবের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করেছি। তাঁর সাথে কাজ করে স্বাচ্ছন্দবোধ করেছি, স্বাধীনতা অনুভব করেছি। তিনি নির্দেশ নয়, পরামর্শ দিতেন। নিউজলেটারের ব্যাপারে আমার পূর্ব অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে বর্তমানের সাথে স্বাধীনভাবে সমন্বয় করে নিতে বলতেন। তিনি বলতেন, বাংলাদেশ ও ইরানের কালচার ও ধর্মানুভূতির সাথে সমন্বয় করে আপনি স্বাধীনভাবে এর প্রচ্ছদ ও গেটআপ, মেকআপ ঠিক করে নিন। স্মিত হাসি ছাড়া তিনি কখনো কথা বলতেন না। আমি তাঁর সর্বাঙ্গীন শুভ কামনা করি।
ইতিহাসবিদ আশরাফুল ইসলাম বলেন, বিশ্বে ইসলামি বিপ্লব একমাত্র ইরানই সফলভাবে স¤পন্ন করেছে এবং সকল প্রতিকূলতার ভেতর দিয়েও তারা তা ধরে রেখেছে। মুসলিম দেশসমূহের মধ্যে একমাত্র ইরান-ই যে কোন দেশে তাদের কূটনৈতিক কর্মে সাংস্কৃতিক বিনিময়ের ক্ষেত্রে বিশেষ দায়িত্ব পালন করে। এবং সে দেশের মাটির সাথে গভীর স¤পর্ক আবিষ্কার করে সমন্বয়ের চেষ্টা করে।
সংস্কৃতির ভাব-হৃদয়ের আদান প্রদান করে। ইরানের সাথে রয়েছে বাংলাদেশের হাজার হাজার বছরের সম্বন্ধ। ফারসি ভাষা ও সংস্কৃতির প্রভাব প্রাচীনকাল থেকেই এখানেসুগভীর। সুফিজম বিকশিত হয়েছে ফারসি ভাষায়। ইরান কালচারাল সেন্টার কর্তৃক ইতিহাসবিদ জনাব আশরাফুল ইসলামের সাতানব্বই বছর বয়স্কা ফারসি ও উর্দু নাগরী ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারা মা মোসাম্মৎ জামিলা খাতুনকে সম্বর্ধনা দেয়ার কথা স্মরণ করে তাঁকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানান।

শেখ সাদী ও নজরুল বিষয়ক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত

‘নজরুলের কবিতা মানব হৃদয়ের গভীরে প্রবেশ করেছে’Ñ ড. কাজেম কাহদুয়ী
গত ২৮ সেপ্টেম্বর ঢাকাস্থ ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র মিলনায়তনে ‘নজরুল ফররুখ গবেষণা ফাউন্ডেশন’ ও ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের যৌথ উদ্যোগে ইরানের কবি শেখ সাদী ও বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা ও সাহিত্যকর্মের ওপর এক জ্ঞানগর্ভ আলোচনা অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। নজরুল ফররুখ গবেষণা ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি লেখক গবেষক এমদাদুল হক চৌধুরীর সভাপতিত্বে ও সংস্কৃতিসেবী জাহিদুর রহমানের উপস্থাপনায় উক্ত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে ড. কাজেম কাহদুয়ী একথা বলেন। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইরানি ভিজিটিং প্রফেসর ও নজরুল-গবেষক ড. কাজেম কাহদুয়ী, বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কালচারাল কাউন্সেলর সাইয়্যেদ মাহদী হোসেইনী ফায়েক, প্রবীণ সাংবাদিক ও বিশিষ্ট কবি জনাব এরশাদ মজুমদার, নজরুল-গবেষক ও নজরুল ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক কবি আবদুল হাই শিকদার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এবং লালকুঠি দরবার শরীফের পীর জনাব আহসানুল হাদী। আলোচনায় অংশ নেন নয়া সৈনিক পত্রিকার সম্পাদক ড. মুহাম্মদ একরামুল ইসলাম, কবি ও আবৃত্তিকার আহমদ বাসীর, কবি শাহ সিদ্দিক, জনাব মাহবুব মুকুল প্রমুখ। শেখ সাদীকে নিবেদিত কবিতা পাঠ করেন কবি আমিন আল আসাদ ও কবি রহমান মাজিদ।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে ড. কাজেম কাহদুয়ী বলেন, ফেরদৌসী, রুমী, সাদী, হাফিজ ইরানের সবচেয়ে আলোচিত ও গুরুত্বপূর্ণ কবি। ইরানের এই চার কবি বাংলাদেশের জনগণের কাছেও প্রিয় ও পরিচিত। বিশেষ করে শেখ সাদী ও রুমী মিশে আছেন বাংলাদেশের ধর্মীয় আবহের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমানে দ্বিতীয় মেয়াদে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে দায়িত্ব পালনে এসেছি। আজ থেকে ২৫ বছর আগে যখন প্রথমবার বাংলাদেশে আসি তখন ঈদের নামাজ পড়তে গিয়ে দেখলাম ইমাম সাহেব মুনাজাতে দরূদ, দোয়ার সাথে শেখ সাদী (র)-এর বিখ্যাত চার লাইন নাত পাঠ করছেনÑ ‘বালাগাল উলা বি কামালিহি/ কাশাফাত দুজা বি জামালিহি/ হাসুনাত জামিও খিসালিহি/ সাল্লু আলাইহি ওয়া আলিহি’Ñ এটা শুনে আমার খুব প্রশান্তি অনুভব হয়েছে। শেখ সাদী (র) মানবাত্মাকে আল্লাহর রঙ্গে রঙ্গিন করার ও রাসূলপ্রেমের পরম প্রশান্তির পথে ধাবিত হতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। আর বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা প্রবেশ করেছে মানব হৃদয়ের গভীরে। সাদি ও হাফিজ-এর হৃদয়ের ধ্বনিই আমরা বাংলাদেশের নজরুলের কবিতায় পাই। হাফিজের ‘দিওয়ান’ নজরুল অনুবাদ করেছেন। নজরুল হাফিজ-প্রেমিক ছিলেন বলেই তিনি তাঁর ছেলের নাম রেখেছিলেন বুলবুল। এই বুলবুল যখন জন্মগ্রহণ করে তখন নজরুল ‘দিওয়ানে হাফিজ’ অনুবাদের কাজও শুরু করেন একই দিনে। সবচেয়ে বেদনা ও মর্মপীড়ার বিষয় এটা যে, যেদিন এই ‘দিওয়ান’ অনুবাদ শেষ হলো সেই দিন নজরুলের পুত্রসন্তান বুলবুলও অসুস্থতায় ইন্তেকাল করলো।
নজরুল ‘ধুমকেতু’ পত্রিকা সম্পাদনা করেন। নজরুল প্রচুর ফারসি শব্দ তাঁর কবিতায় ব্যবহার করেছেন। তখনকার অনেক কবি-লেখক-সমালোচক নজরুলের এই সব ফারসি শব্দ বাংলায় ব্যবহারের সমালোচনা করেন, বিশেষ করে নজরুল ফারসি ‘খুন’ শব্দটি প্রয়োগ করলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আপত্তি করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ফারসি আমার প্রাণের শব্দ, সেগুলো আমার কবিতায় আমি অবশ্যই ব্যবহার করব। সর্বোপরি শেখ সাদী ছিলেন একজন মানবতাবাদী কবি।
নজরুল-গবেষক শেকড়সন্ধানী কবি আবদুল হাই শিকদার বলেন, শেখ সাদীর জ্ঞানের গভীরতা পাশ্চাত্য প-িত ও বিজ্ঞানী পিথাগোরাস এবং টেনিশন থেকেও অনেক ঊর্ধ্বে। শেখ সাদী মানবতাকে সমৃদ্ধ করতে চেয়েছেন আধ্যাত্মিক চেতনা দিয়ে। হাফিজ ও শেখ সাদীর মধ্যে পার্থক্য হলো হাফিজ মানবাত্মার রোদনকে পৌঁছে দিতে চেয়েছেন পরমলোকে। আর সাদী পরমলোক থেকে আলো এনে মানব জীবনকে সার্থক করতে চেয়েছেন। শেখ সাদী (র) মহানবী (সা.)-এর হাদীসের সেই পরম বাণী ‘সকল বিশ্বাসী মানবম-লী এক দেহের মতো, এর যে কোন অংশে আঘাত লাগলে সমস্ত দেহে এর বেদনা অনুভূত হয়’ অনুযায়ী যে কবিতার লাইন রচনা করেন তা জাতিসংঘের সদর দরজায় লিপিবদ্ধ আছে। শেখ সাদী সহ ইরানি কবিদের রচনার পরিচয় পেতে মোহাম্মদ বরকতুল্লাহর ‘পারস্য প্রতিভা’ ও মুহাম্মদ মনসুর উদ্দিনের ‘ইরানের কবি’ পড়তে হবে। শেখ সাদীর কবিতা বাংলায় প্রথম অনুবাদ করেন কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার ও সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত। শেখ সাদী যেদিন এই ধরাধামে জন্মগ্রহণ করেন সেই দিন দুনিয়া থেকে বিদায় নেন বিখ্যাত অলি আবদুল কাদের জিলানী (র)। এ যেন এক সূর্যের অস্ত গিয়ে একই ভাবাদর্শের আরেক সূর্যের উদয়। শেখ সাদী (র) অত্যাচারের প্রতিবাদে অনেক কবিতা লিখেছেন। তিনি জালিম শাসকদের সম্পর্কে লিখেছেন। তিনি জালিম শাসকদের অত্যাচার প্রত্যক্ষ করেছিলেন। যখন ডাকাত হালাকু-মঙ্গোলরা বাগদাদ নগরী দখল করে লক্ষ লক্ষ লোককে হত্যা করেছিল। তিনি এই হত্যাকা- দেখে প্রচ-ভাবে বেদনাহত হন এবং বাগদাদ ছেড়ে মক্কায় চলে আসেন।
শেখ সাদী অনেক দেশ ভ্রমণ করেছেন। ইবনে বতুতার পর শেখ সাদীর মতো ভ্রমণ আর কেউ করেন নি।
কবি আবদুল হাই শিকদার হাফিজ ও শেষ সাদীর ওপর ডকুমেন্টারি ফিল্ম নির্মাণের জন্য ২০০৬ সালে ইরান সফরের স্মৃতি উল্লেখ করে প্রসঙ্গিকভাবে বলেন, ইরান একটি সুন্দর দেশ ও ইরানি জাতি একটি সংস্কৃতিবান ও সুশীল জাতি। ইরানের সাহিত্য অত্যন্ত শক্তিশালী ও শাণিত। ইরানের সাহিত্যের মতো ইরানি জাতির সা¤্রাজ্যবাদবিরোধী চেতনাও শাণিত। এ জাতি ঐক্যবদ্ধ জাতি। ইরান অস্তিত্বহীন হলে মুসলমানদের আর কিছুই থাকবে না। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুলের সাহিত্যেও আমরা পাই ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যবাদবিরোধী চেতনা। আমরা ইরানি জাতিকে সমর্থন করি। ইরানের সা¤্রজ্যবাদবিরোধী চেতনাকে সালাম জানাই। আমরাও ইহুদি যায়নবাদের প্রতি ধিক্কার জানাই।
প্রবীণ সাংবাদিক এরশাদ মজুমদার বলেন, সাদীর সাহিত্য আমাদেরকে খাঁটি মানুষ ও মুসলমান হতে বলে সেই সাথে মানবতাবাদী মানুষ হতে বলে। কথা প্রসঙ্গে তিনি ধর্মদ্রোহিতা এবং ধর্মীয় গোঁড়ামি ও চিন্তার সীমাবদ্ধতা উভয়ের সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, একদল লোক না বুঝেই যেমন ধর্মের বিরোধিতা করে আবার একদল চিন্তাবিদ না বুঝেই ইকবাল, নজরুল, ইবনে সীনা, ওমর খৈয়ামকে কাফের বলেছিল। রোকেয়াকে ফাসেক বলেছিল। ইসলামের বড় বড় সাধককে তাঁদের কথার মর্মার্থ না বুঝতে পেরে তাদের প্রতি মারমুখী হয়েছিল। যেমন মনসুর হাল্লাজের কথা ধরা যায়।
শেখ সাদী যেমন ছিলেন কবি তেমন ছিলেন ওলি। শেখ সাদীর তাসাউফযুক্ত সাহিত্য মানুষকে আল্লাহর রঙ্গে রঙ্গিন করতে চায় ও ইনসানে কামেল হিসেবে গড়ে তুলতে চায়। কিন্তু আজকে মানুষের কথা ও কাজের কোন মিল নেই। সৃষ্টির সেরা মানুষ আজ তাদের স্বভাব-চরিত্রে পশুত্বকে হার মানিয়েছে। মানুষের ভেতর ঢুকে পড়েছে মুনাফেকী ও স্ববিরোধিতা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের সহকারী অধ্যাপক অনুষ্ঠানের বক্তাদের বক্তব্যকে বাংলা থেকে ফারসি ভাষায় এবং ইরানি বক্তাদের ফারসি বক্তব্যকে বাংলায় ভাষান্তর করেন। এছাড়া তিনি তাঁর বক্তব্যে বলেন, কবিদের কবিতায় অফুরন্ত এক জীবনী শক্তি লুক্কায়িত থাকে যা যুগ যুগ ধরে আলো বর্ষণ করে। সেই আলোকে গ্রহণ করে মানব সমাজকে পশু সমাজের থেকে পৃথক করা হয়। শেখ সাদীর কবিতা মরিচাযুক্ত ধরা আত্মাকে মরিচামুক্ত করতে সহায়তা করে।
নয়া সৈনিক পত্রিকার সম্পাদক একরামুল ইসলাম বলেন, ধর্মের প্রকৃত রূপ কখনো উগ্রবাদ, জঙ্গীবাদকে সমর্থন করে না। শেখ সাদী তাঁর রচনায় ধর্মের প্রকৃত রূপ তুলে ধরেছেন। ইসলামের জিহাদ আর উগ্রবাদ, জঙ্গীবাদ এক জিনিস নয়। ধর্মের নামে জঙ্গীবাদ, বোমা মেরে অতর্কিতে মানুষ মারা ইহুদি-যায়নবাদীদের ফিলিস্তিনি হত্যা, বর্মী নাসাকা বাহিনী কর্তৃক রোহিঙ্গা হত্যা একই অপরাধ। ইসলামের বিজয় হচ্ছে নৈতিক বিজয়। সেটা শেখ সাদীর মতো আল্লাহর খাঁটি বান্দা ও রাসূলপ্রেমিকদের দ্বারাই হয়েছে।
আবৃত্তি শিল্পী আহমদ বাসির বলেন, হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রয়েছে ইরানের। আর পৃথিবীর মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র ইরানই সারা বিশ্বে তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রসার ঘটাতে সর্বদা তৎপর। ইরান ইসলামি বিপ্লব করেছে। হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সাথে ইরানের ইসলামি বিপ্লবের চেতনা মিলে মিশে যে আত্মবিশ্বাস ইরানি জাতির মধ্যে তৈরি হয়েছে সেই আত্মবিশ্বাসই তাদের সকল প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে বিজয়ী করেছে। সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সব সময়ই ইরান সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে।
আমাদের জাতীয় কবি নজরুলের সাথে শেখ সাদীর বড় মিল উভয়ই রাসূল (সা.)-এর শানে নাত লিখেছেন। শেখ সাদী ও রুমির কবিতার ভেতর যে অফুরন্ত শক্তি রয়েছে সেটা আত্মোন্নয়নে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখে।
কবি শাহ সিদ্দিক বলেন, শেখ সাদী ও নজরুল উভয়েই মানবতার জয়গান গেয়েছেন। নজরুল মানুষকে অনেক ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন। তিনি তাঁর মানুষ কবিতায় মানবের জয়গান গেয়েছেন। বিদ্রোহী কবিতায় কবি বলেছেন, মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি/চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি/ ভুলোক দূলোক গোলাক ভেদিয়া/ খোদার আসন আরশ ছেদিয়া উঠিয়াছি চির বিস্ময়…’ এই কবিতায় তিনি মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর মেরাজের ঘটনার কথাই বলেছেন। রাসূল (সা.)-এর মেরাজে গমন মানে মানবতার প্রতিনিধির মেরাজে গমন। এতো মানবতারই সম্মান। তিনি একই কবিতায় বলেছেন, ‘আমি জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি’Ñ এ লাইনে তিনি নমরুদের অগ্নিকু- থেকে মুসলমান জাতির পিতা ইবরাহীম (আ.)-এর পূর্ণাঙ্গ ফিরে আসার চিত্র এঁকেছেন। নমরুদের আগুনের স্থলে ফুল হয়ে গেল। আর পুষ্পের সাথে ইবরাহীম (আ.)-ও পুষ্পের মতো হাসি হেসেছেন। সেটাই তিনি বুঝিয়েছেন। এখানেও তিনি মানবতাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন।
জনাব মাহবুব মুকুল তাঁর আলোচনায় বলেন, শেখ সাদীকে যতটা জানার দরকার ছিল আমাদের দেশে তা মোটেই চর্চা হয় নি। আমরা শুধু সাধারণভাবে শেখ সাদীর পোশাকের গল্পটি ছাড়া আর কিছুই তাঁর সম্পর্কে জানি না। আর তাঁর সেই বিখ্যাত নাত ‘বলাগাল উলা বি…’। কিন্তু ‘গুলিস্তা’, ‘বোস্তা’ ছাড়াও তাঁর অপরাপর সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে আমাদের জানা প্রয়োজন। প্রয়োজন জাতীয় বা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সেমিনার বা আলোচনা সভা।

◊ আমিন আল আসাদ

দুরন্ত টিভির বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের প্রতিনিধির অংশগ্রহণ
তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ও সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নুরসহ দেশী-বিদেশী বিশিষ্ট ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে ৭ই অক্টোবর রবিবার পালিত হলো দেশের একমাত্র শিশুতোষ টেলিভিশন চ্যানেল দুরন্ত’র প্রথম বর্ষপূর্তি। টেলিভিশন কর্তৃপক্ষকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাতে অনুষ্ঠানে হাজির হন ঢাকাস্থ ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের প্রতিনিধি ড. কাজেম কাহদূয়ী। এরপর টেলিভিশনের কর্ণধার ও দেশের বর্তমান পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের সাথে সাক্ষাৎ করেন তিনি। এসময় প্রতিমন্ত্রী তার টেলিভিশনে ইরানের শিশুতোষ বিষয়ক অনুষ্ঠানমালা প্রচারে আগ্রহ প্রকাশ করলে ড. কাহদূয়ী এ ব্যাপারে সহযোগিতার আশ্বাস দেন। পরে তিনি বর্ষপূর্তির অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে শিশু-কিশোরদের জন্য টেলিভিশনের অনুষ্ঠানমালার গুরুত্ব তুলে ধরেন। ড. কাহদূয়ী ইরানের ইসলামি বিপ্লবের নেতা ইমাম খোমেইনী (র.)-এর টেলিভিশনের গুরুত্ব স¤পর্কে এক বক্তব্যের উদ্ধৃত করে বলেন, টেলিভিশন হলো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো।
টেলিভিশনের শিক্ষণীয় ও গঠনমূলক অনুষ্ঠানমালা শিশু কিশোরদের সঠিকভাবে বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। যেমনটি ইমাম খোমেইনী (র.) বলেছেন, আমরা যদি শিশুদের সঠিকভাবে প্রতিপালন করতে পারি তাহলে নতুন প্রজন্ম কম সমস্যার সম্মুখীন হবে। ড. কাহদূয়ী একইভাবে একটি হাদিস উদ্ধৃত করে বলেন, সকল শিশুই একটি পবিত্র ফেতরাত (স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য) নিয়ে দুনিয়ায় আসে এবং বাবা মা তাদের নিজ নিজ ধর্মের দিকে ধাবিত করে। অর্থাৎ দীর্ঘ অতীতকাল থেকে পরিবার শিশুর প্রাথমিক শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হলেও বর্তমান দুনিয়ার গণমাধ্যম শিশুর প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। কারণ, বর্তমান যুগের গণমাধ্যম শিশুদের বিনোদনের অন্যতম প্রধান মাধ্যম হওয়ায় তারা এর ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। আজ শিশু তার মায়ের কোলে আসার পর থেকেই বলতে গেলে শিশুর সুস্থ বিনোদন ও প্রতিপালনের ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের বিশেষ করে ভিডিও মাধ্যমের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। আমি শুনেছি যে দুরন্ত টেলিভিশন তাদের আকর্ষণীয় অনুষ্ঠানমালার জন্য এই অল্প সময়ের মধ্যেই বেশ জনপ্রিয়তা অজর্ন করতে সক্ষম হয়েছে। আজকের শিশুদের আগামী দিনের সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ার লক্ষ্যে ও বাংলাদেশকে আগামী দিনে আরো সুন্দর সমাজ উপহার দিতে দুরন্ত টেলিভিশন আরো সুন্দর ও আকর্ষণীয় অনুষ্ঠান উপহার দিবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে কয়েকজন খুদে অভিনয়শিল্পী তাদের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে। যাদের বয়স ৬ থেকে ১২ বছরের মধ্যে। প্রত্যেকেই দুরন্ত টিভির বিভিন্ন ধারাবাহিকে অভিনয় করেছে। অনুভূতি বলতে গিয়ে একজন বলল, ‘আমি স্কুলে গেলে সবাই জানতে চায়, কবে আমার নাটক প্রচার হবে?’ আরেকজন বলল, ‘কোথাও বেড়াতে গেলে অনেকে আমার সঙ্গে ছবি তোলে।’ আরেকজন মাইক্রোফোন হাতে নিয়েই বলল, ‘আমাকে এখন আর কেউ আসল নামে ডাকে না, ডাকে বান্টি নামে।’
উল্লেখ্য বাংলাদেশের একমাত্র শিশুদের টেলিভিশন চ্যানেলটির বর্ষপূর্তির আনন্দ সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে ৭ অক্টোবর বিকেল ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত এক আনন্দ আড্ডার আয়োজন করে টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে শুরু হয় নতুন কিছু ধারাবাহিক। চ্যানেল কর্তৃপক্ষ জানায়, বৈচিত্র্যপূর্ণ অনুষ্ঠান আয়োজন করতে দুরন্ত টেলিভিশন সব সময় চেষ্টা করে থাকে। আগামীতেও সে ধারা অব্যাহত থাকবে।

ইরান ভ্রমণ স্মৃতিচারণমূলক আলোচনা ও কবিতা পাঠ অনুষ্ঠিত

গত ১৮ আগস্ট ২০১৮ ঢাকাস্থ মিরপুর লালকুঠি দরবার শরীফ মিলনায়তনে লালকুঠি সাহিত্য পরিষদের উদ্যোগে লালকুঠি দরবার শরীফের পীর সাহেব ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এবং লালকুঠি সাহিত্য পরিষদ সভাপতি শাহ সূফি হযরত মাওলানা অধ্যাপক আহসানুল হাদীর মাসব্যাপী ইরান সফর এবং ইতিপূর্বে আরো যাঁরা ইরান সফল করেছেন তাঁদের স্মৃতিচারণমূলক বিষয় নিয়ে ‘কবিতার দেশে বিপ্লবের দেশে পারস্যের পথে প্রান্তরে’ শীর্ষক আলোচনা সভা ও লালকুঠি সাহিত্য পরিষদ-এর নিয়মিত সাহিত্য সভা অনুষ্ঠিত হয়।
এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের শেকড় সন্ধানী কবি নজরুল গবেষক সাংবাদিক কবি আবদুল হাই শিকদার। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ইতিহাসবিদ আশরাফুল ইসলাম ও চিনাইর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের বাংলার অধ্যাপক কবি মুহিবুর রহিম। আলোচনায় অংশ নেন নজরুল-ফররুখ গবেষণা ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি লেখক গবেষক এমদাদুল হক চৌধুরী, ক্বারী আলমগীর হোসেন মোল্লা, রেডিও তেহরানের সাবেক সংবাদ পাঠক, মর্সিয়া লেখক ও ছড়াকার কবি শাহ নওয়াজ তাবীব। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন কবি আমিন আল আসাদ। পবিত্র কালামে পাক থেকে তেলাওয়াতের মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু হয়। পবিত্র কালামে পাক থেকে তেলাওয়াত করেন শিল্পী ক্বারী হাবিবুর রহমান। নাতে রাসূল (সা.) পেশ করেন লালকুঠি দরবারের বয়োজ্যেষ্ঠ কবি মুক্তিযোদ্ধা হাজী রফিক মিয়া। কবিতা পাঠে অংশ নেন মুহিবুর রহিম, তাজ ইসলাম, ক্বারী ওবায়দুল্লাহ, আমিন আল আসাদ, শাহ নওয়াজ তাবিব, রহমান মাজিদ, নাসিমা আক্তার নিঝুম, আলমগীর হোসেন জোয়ারদার, হুমায়ূন কবির, জয়নাল আবেদীন প্রমুখ।
অনুষ্ঠানের সভাপতি ও প্রধান আলোচক জনাব আহসানুল হাদী তাঁর সাম্প্রতিক ইরান সফরের স্মৃতিচারণ করে বলেন, বর্তমান সফরটি ছিল একটি অ্যাকাডেমিক সফর যার আয়োজক ছিল ‘বুনিয়াদে সাদী’ নামে একটি সংস্থা যার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে ফারসি ভাষা ও সাহিত্যকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সম্প্রসারণের জন্য কাজ করা এবং বিশ্বময় ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের প্রতিনিত্বশীল যোগ্যতাস¤পন্ন লোক তৈরি করা। এই সংস্থাটি ইরানের শিক্ষা ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের আওতাধীন। তারা একটি শিক্ষক প্রশিক্ষণ কোর্সের আয়োজন করে। আমার সঙ্গে রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের ফারসি বিভাগের আরো দু’জন শিক্ষক উপস্থিত ছিলেন। ঢাকাস্থ ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের সহায়তায় আমি সেই সফরে অংশগ্রহণ করি। ১৪টি দেশের শিক্ষকবৃন্দ সেখানে অংশগ্রহণ করেন। শুধু মুসলিম দেশ নয়, অমুসলিম দেশের প্রতিনিধিত্বও ছিল সেখানে। আমি সেখানে বিভিন্ন সেমিনারে বক্তব্য রাখি এবং টেলিভিশনের অনুষ্ঠানেও অংশগ্রহণ করি।
জনাব হাদী ইরানের ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক নগরী কোম সফরেরও স্মৃতি বর্ণনা করেন। বর্ণনা দেন বোস্তাম নগরীতে অবস্থিত হয়রত বায়েজিদ বোস্তামীর মাযার যিয়ারতের। ইতিপূর্বে আরো তিনবার তিনি ইরান সফর করেছেন। ২০০৮ সালে ইরানের ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা ইমাম খোমেইনী (র.)-এর ১৮তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বাংলাদেশ থেকে কবি মোহন রায়হান, কবি আহমদ কায়সার, কবি রোকন জহুর, কবি আমিন আল আসাদ, কবি মোস্তাফিজ মামুন সহ ইরান সফরের কথা উল্লেখ করে বলেন, সেই সফরে আমরা ইরানের আরেক আধ্যাত্মিক শহর মাশহাদ গমন করি, যেটি খোরাসান প্রদেশে অবস্থিত। সেখানে নবীবংশের ৮ম ইমাম রেযা (আ.)-এর মাযার যিয়ারত করি। এই প্রদেশের তূস নগরীতে রয়েছে মহাকবি ফেরদৌসির মাযার।
জনাব আহসানুল হাদী বলেন, শিক্ষা-সংস্কৃতি এবং ধর্মীয়-আধ্যাত্মিক জ্ঞান বিস্তারে ইরানের ইসলামি সরকারের ভূমিকা খুবই প্রশংসনীয়। তিনি বলেন, ইরান যে আসলেই একটি আধ্যাত্মিক চেতনায় পরিপূর্ণ দেশ, আপনি ইরানে গিয়ে স্বচক্ষে অবলোকন করলে সেটির প্রমাণ পাবেন। তাবে সে চোখ আপনার থাকতে হবে। সেদেশের আলেমরা শুধু মসজিদের সাধারণ মোল্লাই নন। তাঁরা আসলেই পূর্ণ যোগ্যতাসম্পন্ন লোক। আমি যতবার ইরানে গিয়েছি ততবারই আমার অন্তর সমৃদ্ধ হয়েছে।
ইরানের ইসলামি বিপ্লব না হলে তাদের জাতীয় চেতনা ও ধর্মীয় অধ্যাত্মবোধকে বিশ্বময় সম্প্রসারণ করা কিছুতেই সম্ভব হতো না। কিন্তু কিছু জনগণকে লক্ষ্যভ্রষ্ট ও ধৈর্য্যচ্যুত করার জন্য বাহির থেকে সা¤্রাজ্যবাদের অনুচররা অপচেষ্টা করে যাচ্ছে। অবরোধের পর অবরোধের ফলে জাগতিকভাবে ইরান একটু সমস্যায় পড়েছে এতে কোন সন্দেহ নেই। সেকারণে বদর, ওহুদ, খন্দক ও কারবালার চেতনায় জনগণকে ধৈর্য ধরতে হবে ও সেই শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে মনোবল বৃদ্ধি করতে হবে। ভোগবাদী আরব দেশগুলোর মতো তেলসম্পদ বিক্রি আর ভোগবিলাসে জীবন পার করে দেয়ার নাম জীবন নয়। এই তেল সম্পদ ফুড়িয়ে যাবে। কিন্তু জ্ঞানের শক্তি টিকে থাকবে। টিকে থাকবে ঈমানের শক্তি। এই জ্ঞানশক্তির বিকাশ ঘটিয়ে ইরানি জাতি আজ পারমাণবিক শক্তিসম্পন্ন জাতি হয়েছে। স্যাটেলাইট বা কৃত্রিম উপগ্রহ ইরান অনেক আগেই এবং অনেকবার উড়িয়েছে। নিজের উদ্যোগে এবং নিজেরই প্রযুক্তির সহায়তায়। ইরানে এখনো দরিদ্র মানুষ নেই এমন নয়, তবে তা শাহের আমল থেকে বেশি নয়। ইরান শিক্ষা-দীক্ষায় ও বিজ্ঞানচর্চায় অনেক দূর এগিয়ে গেছে।
কবি আবদুল হাই শিকদার বলেন, ২০০৪ সালের সেপ্টেম্বরে পারস্যের কবিদের গুলবাগিচায় ‘ইরান বাংলাদেশ যৌথ উদ্যোগে আন্তর্জাতিক নজরুল সম্মেলনে আমি অংশগ্রহণ করি এবং সিরাজ ও ইসফাহান ভ্রমণ করি। কবি হাফিজের ওপর একটি ডকুমেন্টারি ফিল্ম তৈরি করি। আমার সঙ্গে ছিলেন শিল্পী ও ডকুমেন্টারি প্রডিউসার ফরিদী নূমান। বিটিভিতে আমার পরিচালিত ‘কথামালা’ অনুষ্ঠানে ইরান ভ্রমণের ওপর তিনটি প্রতিবেদন প্রদর্শন করি। সেই ভ্রমণে ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র আমাদেরকে বিশেষভাবে সহযোগিতা করে। বিশেষ করে তৎকালীন কালচারাল কাউন্সেলর জনাব আলী আভারসাজীর সহযোগিতার কথা স্মরণ করতেই হবে। ইরান নিজের সংস্কৃতির বিকাশ ও বিস্তারে এবং অন্যের সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে ও আত্মস্থ করতে কতটা আন্তরিক তা উক্ত সম্মেলন থেকেই বোঝা যায়। নজরুলকে ভালো করে আত্মস্থ করেছেন বলেই ইরানের সাংস্কৃতিক মন্ত্রী বলতে বাধ্য হয়েছেন, ‘নজরুল আমাদেরই সম্পদ। প্রচ- ঝড়ো হাওয়া নজরুলকে আমাদের মাঝখান থেকে বাংলাদেশের কাদামটিতে ফেলে দিয়েছে।’
ইরান তার জাতীয় মেধা ও ব্যক্তিত্বগুলোকে সঠিকভাবে দুনিয়ার বুকে পেশ করতে পেরেছে এবং তাদের সংস্কৃতির সঠিক প্রতিনিধিত্ব তাঁরা করছে বলেই জাতিসংঘের সদর দরজায় শেখ সাদী ও রুমীর কবিতা উৎকীর্ণ থাকে। শেখ সাদীর কবিতার একটি বাক্য সেখনে লেখা রয়েছে যে, ‘গোটা মানব সমাজ একটি দেহের মতো/এর যে কোন স্থান আঘাতপ্রাপ্ত হয় সমস্ত দেহে তা অনুভূত হয়’। জার্মান কবি গ্যাটে ইরানের কবি হাফিজের ভূয়সী প্রশংসা করে বলেছেন, ‘যে হাফিজ পড়ে নি তার জীবনই বৃথা’। হাফিজ এবং ফেরদৌসি দুইজনের পার্থক্য বোঝাতে কবি শিকদার বলেন, ফেরদৌসি ছিলেন বোহেমিয়ান। তিনি দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন। আর হাফিজ ছিলেন ঘরমুখী কবি। তিনি তাঁর প্রিয় নদী রুকনাবাদের তীর ছেড়ে কোথাও যান নি। ইরানি জাতি তাদের সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বদেরকে যেভাবে ফোকাস করেছে ও করছে আমরা আমাদের রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, ফররুখকে সেভাবে বিশ^ময় ফোকাস করতে পারি নি।
প্রসঙ্গক্রমে কবি শিকদার বলেন, শিয়া-সুন্নি বিভেদ ভুলে যেতে হবে এবং ইরান-তুরান এক হয়ে কাজ করতে হবে। আমাকে ইরানে শিয়া-সুন্নি বিষয়ে প্রশ্ন করলে আমি বলেছিলাম, আমি মুসলমান। আমি শিয়া-সুন্নি ঐক্যের বিষয়ে ইমাম খোমেইনী (র.)-এর সেই বাণী উল্লেখ করে বলেছিলাম, ‘যারা শিয়া ও সুন্নিদের মাঝে বিরোধ তৈরি করে তারা শিয়াও নয়, সুন্নিও নয়, তারা স¤্রাজ্যবাদীদের দালাল।’ আমি বলেছিলাম, যে কোন মূল্যে এ বিভেদ দূর করতে হবে। আহলে বাইতকে শিয়া-সুন্নি উভয়েই মহব্বত করে। কেবল কারবালার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ গ্রুপটি ছাড়া। শিয়া-সুন্নি উভয় মাযহাবের মানুষ মিলেই মোঘলরা ভারতবর্ষ শাসন করেছে। শিয়া-সুন্নিদের মধ্যে আগে বৈবাহিক ও সামাজিক সম্পর্কও ছিল। সে সম্পর্ক আবার গড়ে তুলতে হবে। তিনি বলেন, শিয়া-সুন্নি ঐক্য ভঙ্গের জন্য সা¤্রাজ্যবাদীরা নানা কূটকৌশল হাতে নিয়েছে। তারা পাকিস্তানে শিয়া মসজিদে বোমা হামলা করে পাকিস্তান ও ইরানের সম্পর্কে ফাটল ধরাতে চায়। আবার তুরস্কের সঙ্গে ইরানের বিরোধ তৈরি করার জন্য রাজনৈতিক চাল চালতে থাকে।
তিনি বলেন, ফারসি ভাষা বাংলার সাথে এমনভাবে মিশে গেছে যে, একে আর পৃথক করার সুযোগ নেই। ফারসি শিক্ষার গুরুত্ব উল্লেখ করে তিনি ঢাকাস্থ ইরানের কালচারাল সেন্টারের প্রতি গণমুখী ফারসি অ্যাকাডেমী চালু করার আহ্বান জানান এবং লালকুঠি দরবারে একটি ফারর্সি চর্চা কেন্দ্র গড়ে তোলা যায় কিনা সে ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করা ব্যাপারে দরবারের পীর সাহেবের কাছে আবেদন রাখেন। তিনি বলেন, নবাব সিরাজউদ্দৌলার ওপর ডকুমেন্টারি করতে ভারতে গিয়ে মুর্শিদাবাদে বিশাল লাইব্রেরি দেখতে পাই যার অধিকাংশ বই ফারসি ভাষায় রচিত। ফারসি ভাষা না জানার কারণে এর ভেতরে প্রবেশ করতে পারি নি, বইগুলো হাত দিয়ে স্পর্শ করেছি মাত্র।
ইতিহাসবিদ জনাব আশরাফুল ইসলাম বলেন, আমাদের ইতিহাস, ধর্মীয় আচার-আচরণের সাথে আমাদের জীবন ও সংস্কৃতির সাথে ইরান ও ফারসি ভাষা মিশে গেছে অকৃত্রিমভাবে। আমাদের রক্তে, অস্থি-মজ্জায় তা একাকার হয়ে মিশে গেছে। কারবালা ট্রাজেডির শোকাবহতা এবং নবী-পরিবারের প্রতি ভক্তি আমাদের চেতনার অবিনাশী অংশ। এখানে শিয়া-সুন্নির কোন বিষয় নেই। কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রামে বিশাল একটি কারবালার মাঠ আছে। আমাদের দেশের মুহররম মিছিলে শিয়া-সুন্নি নির্বিশেষে অংশগ্রহণ করে। কারবালার ইতিহাস চর্চায় ও কারবালার পুঁথি পাঠে অংশগ্রহণ করে গ্রামে কাঁদে না এমন লোক নেই। আমাদের গ্রামে দশদিনব্যাপী মুহররমের জারি গান হয়। মর্সিয়া পাঠ হয়। হয় ওয়াজ-নসিহতও।
তিনি একটি গ্রাম্যছড়ার দুইটি লাইন আবৃত্তি করে ফারসি ও বাংলার সম্পর্ক বোঝান এভাবে যে, ‘যগাই মাধাই দুইজনে/ মসনবী পড়ে নলবনে’। যগাই মাধাই দুইজন বাঙালি হিন্দু, অথচ তারা নলবনে বসে ‘মসনবী’ পড়ছে। ইরানি সংস্কৃতির কতটা শক্তিশালী প্রভাব থাকলে বাঙালি হিন্দুও মুসলমানী সাহিত্য ‘মসনবী’ পাঠে মনোযোগী হয় তা এই ছড়ায় বোঝা যায়। তিনি বলেন, এটাই আমাদের বাংলাদেশ।
তিনি ফারসি ভাষা ও সংস্কৃতি বিকাশে ও বাংলার সাথে পারস্যের সাংস্কৃতিক আত্মীয়তা জোরদার করতে ইরান দূতাবাস ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রকে আরো গণমুখী হওয়ার আহ্ববান জানান। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বুদ্বিবৃত্তিক পরিম-লে এটি সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।
বিশেষ অতিথি অধ্যাপক কবি মুহিবুর রহিম স্মৃতিচারণ করে বলেন, ইরানের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র থেকে প্রকাশিত ‘নিউজলেটার’-এ একসময় নিয়মিত লিখতাম। রেডিও তেহরানের শুরুর দিকে যখন মরহুম ফরিদ উদ্দিন খান পরিচালক ছিলেন তখন আমার অনেক কথিকা তেহরান বেতারে প্রচারিত হয়েছে। আমাদের সময় রেডিওর খবরের ওপর নির্ভরশীল ছিল গ্রামবাংলার মানুষ। আমি রেডিও তেহরানের নিয়মিত শ্রোতা ছিলাম। ঢাকায় অবস্থানকালে বাংলাদেশে ইরানের ধর্মীয় প্রতিনিধি আয়াতুল্লাহ শাহরুখী খুররমাবাদী (র.)-এর সাথে প্রেসক্লাব ভিআইপি লাউন্সে আমাদের একটি বৈঠক হয়। তাঁর সাথে আমাদের নানা বিষয়ে মতবিনিময় হয়। রেডিও তেহরানের বাংলাদেশী বন্ধুরা একটি সাহিত্য ম্যাগাজিন বের করতেন ‘দীগ্দর্শন’ নামেÑ সেখানে আমার কবিতা ছাপা হয়েছে ‘ইমাম খোমেনী (র)’ নামে। ইরানের সাথে আমাদের বাংলাদেশের বন্ধুত্ব অতীতেও ছিল, ভবিষ্যতেও থাকবে। ইরানের ইসলামি বিপ্লবকে বাংলাদেশের মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই সমর্থন করেছে। মাযহাবী বিভেদ নয়, বিশ্ব-মুসলমান এক হয়েই কাজ করতে হবে। সা¤্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্রকে রুখতে হবে। ‘ইসলামের আদর্শিক বিপ্লব ও নৈতিক সাংস্কৃতিক বিপ্লব ছাড়া মানবজাতির মুক্তি নেই’Ñ মাওলানা আবদুর রহীম (র.) এ কথাটি অনেক আগেই জাতিকে শুনিয়েছিলেন। তিনি বলেন, আমেরিকার মানুষও যদি মুক্তি চায় তাহলে ইসলামি নৈতিকতার কাছেই তাদেরকে আত্মসমর্পণ করতে হবে।
জনাব এমদাদুল হক চৌধুরী বলেন, নজরুল ও ফররুখ আহমদের কবিতায় অনেক ফারসি শব্দ প্রয়োগ করা হয়েছে। ইরানের সাথে আমাদের শেকড়ের সম্পর্ক আছে, সেটি অস্বীকার করার উপায় নেই। মুসলমান দেশগুলো মিলেমিশে শক্তিশালী উম্মাহ গঠন করতে হবে। কুরবানি তথা ত্যাগের শিক্ষায় মুসলমানদের উদ্দীপ্ত হতে হবে এবং পরস্পর ছাড় দিয়ে ঐক্যবদ্ধ হতে বলে তিনি মত ব্যক্ত করেন।
ক্বারী আলমগীর হোসেন মোল্লা তাঁর ইরান ভ্রমণের স্মৃতিচারণ করে বলেন, ১৯৯৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ‘শুরায়ে এহইয়ায়ে যাবা’ন ও আদাবিয়া’তে ফারসি’ সংস্থার দাওয়াতে আমরা ইরান যাই। বর্তমানে এই সংস্থার নাম ‘বুনিয়াদে সাদী’Ñ যা অনুষ্ঠানের সভাপতি জনাব আহসানুল হাদী উল্লেখ করেছেন। আমাদের সাথে ছিলেন ড. আবদুস সবুর খান, ড. তারিক সিরাজী ও ড. মুহাম্মদ শাহজালাল প্রমুখ। আমি ইরানের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে বহুদিন যাবৎ চাকুরি করছি। এখানে চাকুরি করার আগে এবং ইরান গিয়ে স্বচক্ষে দেখে আসার পূর্বে ইরানের শিয়া মাযহাবের মানুষ সম্পর্কে অনেক ভুল ধারণা ছিল। একটি সমাজে নানা রকমের মানুষ থাকে। কোন সাধারণ মানুষের কোন কাজ বা কথার দ্বারা যেমন আসল ঘটনা না জেনে মূল্যায়ন করা সম্ভব নয় তেমনি স্বচক্ষে দেখার আগে ও বোঝার আগে সকল ধারণা মনে বদ্ধমূল করা ঠিক নয়। আমরা জেনেছিলাম, শিয়ারা হযরত আলীকে নবী মানে ও তাঁকে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর থেকে বড় করে দেখে। তারা অন্য কোরআন মানে। অথচ আমি এগুলোর কোন বিষয়েরই সত্যতা পাই নি। বরং আমরা দেখলাম, সালমান রুশদী যখন মহানবী (সা.) ও তাঁর পরিবার-পরিজনকে নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক বই ‘স্যাটানিক ভার্সেস’ লিখলো তখন ইমাম খোমেইনীই সালমান রুশদীর বিরুদ্ধে ফতোয়া দিয়ে বিশ্বময় আন্দোলন ছড়িয়ে দিয়েছিলেন।
তিনি বলেন, ইরানের মানুষদের থেকে পেয়েছি মায়া-মমতা, আথিতেয়তা। বাসে উঠলেই এমনভাবে ‘সালামুন আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ’ বলে সালাম দেয়, মনে হয় যেন অনেক দিনের চেনা, কিন্তু জীবনে কোনদিনই দেখা হয় নি। মাশহাদে ইমাম রেযা (আ.)-এর মাযার যিয়ারত করেছি। ইবনে সীনার মাযারে গিয়েছি। অনেক আনন্দময় ছিল সেই ভ্রমণ।
জনাব শাহ নওয়াজ তাবিব বলেন, তেহরান রেডিওতে থাকাকালীন ইরানের পথে প্রান্তরে অনেক ঘুরেছি। অনেক স্মৃতি ইরানকে নিয়ে। তাদের আচার-ব্যবহার বদান্যতায় পরিপূর্ণ। কথায় কথায় ‘সালামুন আলাকুম, হালে সোমা’ খুবে’Ñ সালাম, কেমন আছেন। উত্তরে বলবে, ‘খোদা’ রা’ শোক্র’Ñ আল্লাহকে ধন্যবাদ। ‘খুবাম’ অর্থাৎ ভাল আছি। ‘শোমা’ চেতুরে’Ñ তুমি কেমন আছ। কথায় কথায় ‘মুতাশাক্কেরাম’, ‘খেইলী মামনুন’ ইত্যাদি তো আছেই। যার অর্থ ধন্যবাদ। কোন কিছুর সহযোগিত চাইলে আপনি যদি তাকে সহযোগিতা করেন তবে সেই সহযোগিতা নিতে নিতে বলবে, ‘দাস্তে শোমা’ দারদ না কোনে’Ñ তোমার হাতে ব্যথা না হোক! সবজি, ফল ইত্যাদি কিনতে গেলেও কথায় কথায় তারা দোয়া করবে। এই ফল ও সবজি তোমার দেহের উপকার করুক! রোগ মুক্তি দান করুক! শক্তি বৃদ্ধি করুক! ইত্যাদি। কারো সাথে ঝগড়া লাগলে তৃতীয় জন এসে সাথে সাথে দরূদ পড়ে বলবে, ‘আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মুহাম্মাদ ওয়া আলে মুহাম্মাদ। অর্থাৎ ‘রাসূল (সা.)-এর প্রতি এবং তাঁর বংশধরদের প্রতি সালাম। সঙ্গে সঙ্গে ঝগড়া শেষ। ইরানে দেখলাম রাসূল (সা.) ও তাঁর পরিবারের প্রতি অগাধ ভক্তি। কেউ একজন দরূদ পড়লেই সমস্বরে পুরো মজলিশ দরূদ পড়বে। যারা বলে ইরানের শিয়ারা রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে নবী মানে না তাদের কাছে প্রশ্ন হলো তাহলে এত দরূদ কারা পড়ে? আর তারা রাসূলের আহালে বাইতের শানে দরূদ পড়ে আর কান্নাকাটি করে। একটি কথা রয়েছে যে, মুমিনের চোখের জলে জাহান্নামের আগুন নেভে। পাপ দূরীভূত হয় তওবা আর ক্রন্দনের মাঝে। ইরানিদের চোখে যেন পানি এসেই থাকে। যে কোন দোয়া-দরূদ পড়েই তারা আল্লাহর কাছে নাজাত চেয়ে সমস্বরে কাঁদতে থাকে।
জনাব তাবিব ইরানে থাকাকালীন আযাদী স্কোয়ার, ময়দানে ইনকিলাব, বেহেশতে যাহরা, তালেঘানী এভিনিউ, ময়দানে আরজেনটাইন ইত্যাদি স্থানে নিয়মিত যাতায়াতের স্মৃতিচারণ করেন।
কবি আমিন আল আসাদ তাঁর প্রবন্ধে বলেন, আমার রচিত ‘ইমাম খোমেনী (র.) ও ইসলামী বিপ্লব’ শীর্ষক বইয়ের নিমিত্তে ২০০৮ সালে ইরান সফরে যাই। লালকুঠি দরবার শরীফের পীর সাহেব জনাব আহসানুল হাদী, কবি মোহন রায়হান, কবি রোকন জহুর, কবি মুস্তাফিজ মামুন, কবি আহমেদ কায়সার, মাওলানা সাবির রেজা, গবেষক রাশেদুজ্জামান সহ দশ বারোজন। প্রিয় নেতা ইমাম খোমেইনীর ১৮তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে তাঁর মাযার যিয়ারতের সৌভাগ্য হয়। মাশহাদ গিয়েছি এবং ঘুরেছি তেহরানের পথে প্রান্তরে। ময়দানে ইনকিলাব, ময়দানে ফেরদৌসি, বেহশতে যাহরাসহ বেশ কয়েক স্থানে। ইমাম খোমেইনী (র)-এর বাড়িটি দেখেছি। মাশহাদে গিয়েছি ইমাম রেযা (আ.)-এর মাযার যিয়ারতে।
ইরানের ইসলামি বিপ্লব সারা দুুনিয়াকে ঝাঁকুনি দিয়ে জাগিয়ে দেয়া এক আলোকের বিস্ফোরণÑ যা মুসলমানসহ নির্যাতিত জাতিসমূহের ঘুম ভাঙাতে সহায়ক হয়েছিল। এই বিপ্লবের বিরুদ্ধে অঙ্কুরেই একে শেষ করে দেয়ার ষড়যন্ত্র হয়েছে, এখনো সেই ষড়যন্ত্র চলছে। দল-মত-মাযহাব-তরিকা নির্বিশেষে মুসলমানদেরকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
আমিন আল আসাদ

সারা দেশে আশুরা পালিত
গত ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৮ সারাদেশে ভাবগম্ভীর পরিবেশে ও যথাযোগ্য মর্যাদায় পবিত্র আশুরা পালিত হয়েছে। পবিত্র আশুরা উপলক্ষে বাণী প্রদান করেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ তাঁর বাণীতে উল্লেখ করেন, পবিত্র আশুরা সমগ্র মুসলিম উম্মাহর জন্য এক তাৎপর্যময় ও শোকের দিন। কারবালার শোকাবহ ঘটনা আমাদেরকে অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে উদ্বুদ্ধ করে, সত্য ও সুন্দরের পথে চলার প্রেরণা যোগায়। তিনি আরো বলেন, সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে হিজরি ৬১ সনের ১০ মুহররম হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র হযরত ইমাম হোসাইন (রা.) তাঁর পরিবারের সম্মানিত সদস্য ও ঘনিষ্ঠ সহচরবৃন্দ বিশ^াসঘাতক ইয়াযীদের সৈন্যদের হাতে কারবালায় শহীদ হন। ইসলামের সুমহান আদর্শ ও ত্যাগের মহিমাকে সমুন্নত রাখার জন্য তাঁদের এই আত্মত্যাগ ইতিহাসে সমুজ্জ্বল হয়ে আছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর বাণীতে বলেন, এ দিনটি বিশে^র মুসলমানদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র। হিজরি ৬১ সনের ১০ মুহররম মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রিয় দৌহিত্র হযরত ইমাম হোসাইন (রা.) ও তাঁর পরিবারবর্গ কারবালা প্রান্তরে শাহাদাতবরণ করেন। সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় তাঁদের এ আত্মত্যাগ মুসলিম উম্মাহর জন্য এক উজ্জ্বল ও অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। প্রধানমন্ত্রী আমাদের জাতীয় জীবনে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় আশুরার মহান শিক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে সবার প্রতি আহ্বান জানান।
ইসলামি ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মাওলানা আবদুল লতিফ নেজামী বলেন, কারবালার জিহাদ এক শিক্ষণীয় ও অনুসরণীয় ঘটনা। এর একদিকে রয়েছে শোকাবহ অশ্রুসজল কাহিনী, অপরদিকে মহান আত্মত্যাগের অনুপ্রেরণা এবং সেই সাথে ন্যায়, সত্য ও সততা প্রতিষ্ঠার দৃঢ় প্রত্যয়। হযরত হোসাইনের অতুলনীয় শাহাদাত কোন পরাজয়ের প্রতিফলন নয়; বরং মুসলিম উম্মাহর জন্য পরম বিজয়ের সংকেত। তিনি আশুরার দিনে ঢাকা মহানগর আয়োজিত এক আলোচনা সভায় বক্তৃতাকালে এসব কথা বলেন।
বিশ^ সুন্নী আন্দোলনের উদ্যোগে আশুরার দিন সকালে শোভাযাত্রা ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে সভাপতির বক্তব্যে বিশ^ সুন্নী আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম হায়াত্ বলেন, বদর, ওহুদ ও কারবালার ঘটনার শিক্ষা, চেতনা এক ও অভিন্ন।

চট্টগ্রাম মহানগরীর আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ, জমিয়তুল ফালাহ মসজিদ, বায়তুশ শরফ মসজিদ, লালদীঘি মসজিদসহ বিভিন্ন স্থানে ওয়াজ ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়।
আনজুমান-এ-রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনায় শোহাদায়ে কারবালা মাহফিলে বক্তাগণ বলেন, সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় ইমাম হোসাইন (রা.)-এর আদর্শ অনুসরণের কোন বিকল্প নেই। অনুষ্ঠানে প্রধান বক্তা ছিলেন জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া কামিল মাদরাসার শায়খুল হাদীস মুফতি মুহাম্মদ ওবাইদুল হক নঈমী।
কাগতিয়া দরবার শরীফের পীর আল্লামা অধ্যক্ষ ছৈয়্যদ মুহাম্মদ মুনির উল্লাহ আহমদী গত ২০ সেপ্টেম্বর ‘পবিত্র আশুরার তাৎপর্য’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বলেন, কারবালার ঘটনা সর্বকালের সবচেয়ে মর্মান্তিক। এদিন কারবালা প্রান্তরে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় নবীজির প্রিয় দৌহিত্র ইমাম হোসাইন (রা.) পরিবারবর্গসহ নিজের জীবন উৎসর্গ করেন, যা মুসলমানদের ইসলামের সত্য, সুন্দর ও ন্যায়ের পথে চলতে আজীবন প্রেরণা যোগাবে।
বিভিন্ন মসজিদ, মাদরাসা, সংগঠন ও খানকা আহলে বাইতে রাসূল (সা.) স্মরণে আলোচনা ও শোকসভার আয়োজন করে। আলোচনা সভায় বক্তাগণ আশুরার ত্যাগের শিক্ষা রাষ্ট্র, সমাজ ও ব্যক্তি জীবনে অনুসরণ করার আহ্বান জানান।
পবিত্র আশুরা উপলক্ষে ২০ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে কোরআনখানি ও ওয়াজ মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়।
দেশের বিভিন্ন স্থানে শোক র‌্যালি ও মিছিল বের করা হয়। রেডিও ও টিভি চ্যানেলগুলোতে মুহররম উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়। সংবাদপত্রগুলো বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে।

ঢাকাস্থ নাখালপাড়া ইমাম বাড়িতে শোকানুষ্ঠান
পবিত্র আশুরা উপলক্ষে নাখালপাড়াস্থ ইমামবাড়িতে ১-১৩ মুহররম ১৩ দিনব্যাপী আলোচনা ও শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়। পবিত্র কোরআনের আলোকে প্রকৃত ঈমানদারের পরিচয়, মহানবী (সা.) ও তাঁর আহলে বাইতের প্রতি ভালোবাসা ও তাঁদেরকে আনুগত্য করার বিষয়ে ধারাবাহিক বক্তব্য উপস্থাপন করেন হুজ্জাতুল ইসলাম আব্দুল কুদ্দুস বাদশা। তিনি বলেন, শুধু মৌখিক স্বীকারোক্তির মাধ্যমে ঈমানদারকে চেনা যায় না। প্রকৃত ঈমানদারের পরিচয় তার কর্মের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। আর সত্যিকার ঈমানদারদের বৈশিষ্ট্য পবিত্র কোরআনের আয়াতে স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) ও তাঁর আহলে বাইতের প্রতি ভালোবাসা ও আনুগত্যকে মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে ফরয বলে ঘোষণা দিয়েছেন। তাই এ বিষয়ে সকল মুসলমানের উচিত আল্লাহর তা‘আলার নির্দেশের প্রতি মনোযোগী হওয়া। মহান আল্লাহর নির্দেশের প্রতি মনোযোগিতার অভাব ও উদাসীনতার কারণেই মুসলিম জাতির ইতিহাসের একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়ে এসে ইমাম হোসাইনকে পরিবার-পরিজন ও বন্ধু-বান্ধবসহ হত্যা করা হয়। আর ইমাম হোসাইন (আ.) অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করে নিজের জীবন উৎসর্গের মাধ্যমে ইসলামকে পুনরুজ্জীবিত করেন।

খুলনায় আশুরা পালিত
খুলনায় পবিত্র মুহররম উপলক্ষে আঞ্জুমান-এ-পাঞ্জাতানী ট্রাষ্ট আয়োজিত ১০ দিনব্যাপী শোক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। ১ হতে ১০ মুহররম পর্যন্ত আলোচনা করেন ইসলামী শিক্ষা কেন্দ্রের অধ্যক্ষ হুজ্জাতুল ইসলাম সৈয়দ ইব্রাহিম খলিল রাজাভী। সমাপনী দিনে হযরত ইমাম হোসাইন (আ.)-এর পবিত্র শাহাদাত স্মরণে আশুরার শোক মিছিল নগরীর আলতাপোল লেনস্থ আঞ্জুমান-এ-পাঞ্জাতানী ট্রাষ্ট ইমাম বাড়ি হতে সকাল ৯.৩০ মিনিটে বের হয়।
শোক মিছিলপূর্ব বক্তৃতায় হুজ্জাতুল ইসলাম সৈয়দ ইব্রাহীম খলীল রাজাভী আশুরার শোক সমাবেশে সূরা আলে ইমরানের ৬১নং আয়াত উদ্ধৃত করে বলেন, ধর্ম সম্পর্কে নাজরানের খ্রিস্টানরা রাসূলে করিম (সা.)-এর সাথে বিতর্কে লিপ্ত হলে নবী (সা.) অনেক যুক্তিতর্কের পরও তাদেরকে বোঝাতে যখন সক্ষম হলেন না তখন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন রাসূল (সা.)-কে তাদের সাথে মোবাহিলার নির্দেশ দিলেন এবং মোবাহিলার জন্য তাঁর দুই দৌহিত্র হাসান ও হোসাইন (আ.), কন্যা ফাতিমা (সা. আ.) ও জামাই ও চাচাত ভাই হযরত আলী (আ.)-কে সঙ্গে নিয়ে মোবাহিলার ময়দানের দিকে অগ্রসর হলেন। তাঁদেরকে আসতে দেখে খ্রিস্টান পাদ্রিরা খ্রিস্টানদেরকে মোবাহিলা থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিল এবং জিজিরা কর প্রদানে সম্মত হলো।
এ ঘটনা প্রমাণ করে যে, নবী (সা.) ও আহলে বাইতের এ চার সদস্যের বিপক্ষে যারাই অবস্থান নেবে তারাই মিথ্যাবাদী প্রতিপন্ন হবে।
তিনি বলেন, আশুরার শিক্ষাই হলো যালিমদের বিরুদ্ধে ও মযলুমদের পক্ষে অবস্থান নেয়া।
আলোচনা শেষে একটি শোক ও মাতম মিছিল নগরীর প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে পুনরায় ইমামবাড়িতে গিয়ে শেষ হয়।

বেনাপোলে আশুরার শোক মজলিশ ও মিছিল
১০ মুহররম ইমাম হোসাইন (আ.)-এর পবিত্র শাহাদাত উপলক্ষে ইমাম মাহদী (আঃ) ফাউন্ডেশন, শার্শা যশোর এর আয়োজনে বাংলাদেশের বৃহত্তর স্থল বন্দর বেনাপোলে এক বিশাল শোক মজলিশ ও মিছিলের আয়োজন করা হয়। শোক মজলিশে বক্তব্য রাখেন শার্শা উপজেলার প্রাক্তন শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক জনাব মোঃ আনোয়ারুল ইসলাম, মাষ্টার আয়ুব হোসেন। অনুষ্ঠানে প্রধান বক্তা হিসেবে বক্তব্য রাখেন বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ মোঃ ইকবাল হোসেন (শান্তি)। শোক মজলিশে কাসিদা পাঠ করেন জনাব মোহাম্মাদ আলী।
১ মুহররম থেকে ১০ মুহররম পর্যন্ত ঝিকরগাছা উপজেলার বিভিন্ন স্থানে শোক মজলিশ অনুষ্ঠিত হয়। শোক মজলিশ শেষে শোক মিছিল বের বেনাপোল বাজার, নোম্যান্স ল্যান্ড প্রদিক্ষণ করে পুনরায় বেনাপোল বলফিল্ডে ফিরে আসে। অনুষ্ঠানের সার্বিক সহযোগিতায় ছিল আলী আকবর (আঃ) যুব সংঘ, শার্শা, যশোর।