বৃহস্পতিবার, ১৯শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৪ঠা আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

মাইকেল মধুসূদনের আত্মবিলাপ

পোস্ট হয়েছে: জুন ১৫, ২০২১ 

মাইকেল মধুসূদনের আত্মবিলাপ
সৌম্য সালেক

সামাজিক-রাষ্ট্রিক জীবনে যেমন ক্রান্তিকাল আসে তেমনি ভাষা-সাহিত্যের ক্ষেত্রেও ক্রান্তিকাল রয়েছে। বাংলা সাহিত্যে এমন এক পর্যায়ে মাইকেল মধুসূদনের আবির্ভাব ঘটে যখন বাংলা সাহিত্যের ক্রান্তিকাল। মধ্যযুগীয় সাহিত্যধারা থেকে বের হবার চেষ্টা চলেছে তখন। যাঁরা মধ্যযুগীয় বিষয়বস্তু, বাক্য ও ছন্দপ্রবণতা থেকে বের হবার চেষ্টায় ছিলেন তাঁদের একজন ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত (১৮১২-১৮৫৯)। আধুনিক কবিতা বা সাহিত্য বিষয়সীমা বর্জিত, সেখানে মানুষ এমনকি পরিপার্শ্বের প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় বিষয়বস্তুও সাহিত্যের অনুষঙ্গ বলে বিবেচিত হয়ে থাকে। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত আধুনিকতায় উত্তরণে কাজ করেছেন, তার ‘পাঁঠা’, ‘আনারস’, ‘তাপসে মাছ’ কবিতায় এবং কিছু বিদ্রƒপাত্মক লেখায় সে স্বাক্ষাৎ পাওয়া যায়। স্বদেশ ও সমাজের প্রতি তাঁর অনুরাগ ছিল। কিন্তু তাঁর ভাষা, ছন্দ-অলংকার ছিল মধ্যযুগীয়- যার ফলে আধুনিকতার উত্তরণে তখনও পথ বাকি ছিল। মধ্যযুগের সাহিত্যের বিষয় ছিল প্রধানত ধর্মকাহিনী, ঐতিহাসিক বিজয়গাথা, পুরাণ, রাজা-বাদশার আখ্যান এবং স্তুতি-বন্দনা কেন্দ্রিক। মাইকেল মধুসূদন দত্ত সেই সাহিত্য ব্যক্তিত্ব যিনি বিষয়, ভাষা ও প্রকরণগতভাবে বাংলা সাহিত্য বিশেষত বাংলা কবিতাকে আধুনিকতার সাথে পরিচয় ঘটান। মধুসূদনকে বাংলা সাহিত্যের প্রথম বিদ্রোহী বলা হয়, তাঁর এই বিদ্রোহ ছিল যেমন ভাষাবিদ্রোহ, তেমনি সাহিত্যের আঙ্গিক ও বিষয়-নিরীক্ষার দিক থেকেও।
মধুসূদনের ভাষা-বিদ্রোহ এবং অগ্রগামী সৃজন প্রক্রিয়ার বিষয়টিকে চমৎকার ব্যাখ্যা করেছেন লেখক গবেষক আহমদ রফিক, তাঁর ‘নজরুলের বিদ্রোহ : বিদ্রোহের স্বরূপ-অন্বেষ’ শীর্ষক রচনা থেকে কিছু অংশ তুলে ধরছি। ‘বিষয়গত ও প্রকরণগত উভয় দিকেই মধুসূদন তার বিদ্রোহী ভূমিকাটির সমাপন ঘটিয়েছেন এমন এক আবেগে, যার পেছন ছিল প্রচলিত মূল্যবোধ থেকে আধুনিকতায় উত্তরণের সৎসাহস। এই বলিষ্ঠ মননশীলতাই মধুসূদনের কাব্যচেতনায় লক্ষ্যণীয় বৈশিষ্ট্য যা প্রতীকী বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে বাংলা সাহিত্যের জন্য নতুন এক দিকদর্শন প্রতিষ্ঠা করেছিল।’
আমরা মধুসূদনের কবিতায় বিচিত্র বিষয়ের স্বাক্ষাৎ পাই, যা আধুনিক সাহিত্যের প্রবণতা বলে বিবেচিত। ‘ময়ুর ও গৌরি’; ‘অশ্ব ও কুরঙ্গ’; ‘সূর্য্য ও মৈনাক গিরি’; ‘মেঘ ও চাতক’; ‘সিংহ ও মশক’; ‘পীড়িত সিংহ’ ও অন্যান্য পশু এবং রসলা ও স্বর্ণ-লতিকা কবিতাগুলো যেমন মধুসূনের বিষয় নির্বাচনের সর্বমুখীতাকে প্রকাশ করে তেমনি এসবে প্রকাশিত ভাবনা-প্রবাহ, ভাষা ও আঙ্গিকগত নিরীক্ষা একজন আধুনিক শব্দ-শিল্পী হিসেবে তাঁকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে।
মধুসুদন দত্ত বাংলা সনেট ও অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তক, বাংলা ভাষার প্রথম সার্থক নাটক (শর্মিষ্ঠা-১৮৫৯) ও প্রথম সার্থক প্রহসন রচিয়তা এবং বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ মহাকাব্য ‘মেঘনাদবধ’ কাব্য রচনার মাধ্যমে একজন সার্বিক ও সম্পন্ন সাহিত্যকার- শিল্পকার হিসেবে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন। কবিতা ও নাটকের আঙ্গিকগত এসব উৎকর্ষের অন্তরালে ছিল তাঁর উৎসুক-অভিসন্ধিৎসা এবং বিষয়ের নিরীক্ষা, যা সেসময়ে বাংলা সাহিত্যের জন্য ছিল অভিনব ব্যাপার। মধুসূদনের সেই অগ্রবর্তী ভাবনা ও নিরীক্ষার ধারাবাহিক চর্চার ফল আজকের বাংলা কবিতা। মধুসূদন হোমেরিক স্টাইলে লেখার প্রবর্তন করেন- ‘মেঘনাদবধ’ কাব্যে। তিনি হোমারের ‘ইলিয়াড’কে জগতের শ্রেষ্ঠ মহাকাব্য বলে মনে করতেন। ‘হেকটর বধ’ কাব্যে তিনি ইলিয়াড এর কাহিনী বিবৃত করতে আরম্ভ করেও শেষে করতে পারেন নি। অসমাপ্ত আকারে যা ১৮৭১ সালে গ্রন্থাকারে বের হয়, সেখানে উপহারপত্রে ভূদেব মুখোপাধ্যায়কে তিনি লেখেন, ‘আমাদিগের রামায়ন, মহাভারত রামচন্দ্রের পঞ্চপা-বের জীবন-চরিত্র মাত্র… কিন্তু ঈলিয়াসের নিকট এসকল কাব্য কোথায়?’
মধুসূদন ইংরেজ কবি লর্ড বায়রনের জীবন ও কর্ম দ্বারা ব্যাপকভাবে অনুপ্রাণিত ছিলেন। তাঁর কবিতায় আমরা বায়রনের বেশ কিছু উদ্ধৃতির প্রয়োগ লক্ষ্য করি। ‘বঙ্গভূমির প্রতি’ কবিতায় রয়েছে বায়রনের বিখ্যাত উক্তি, ‘গু ঘধঃরাব খধহফ, মড়ড়ফ ঘরমযঃ’- এর ব্যবহার। একটি অবাক বিষয় হলো বায়রন মারা যান ১৮২৪ সালে এবং সে বছরের ২৫ জানুয়ারি মধুসূদনের জন্ম হয়। মধুসূদনের বিপুল প্রতিভার আরেক পরিচায়ক তাঁর ভাষা দক্ষতা। বাংলা ছাড়া তিনি আরও বারোটি ভাষা জানতেন। ইংরেজি ভাষার বিশ্বব্যাপী প্রভাব এবং সে ভাষার কবি-সাহিত্যিকদের শ্রেষ্ঠত্ব লক্ষ্য করে তিনি ইংরেজিতে সাহিত্য চর্চা আরম্ভ করেন। মাদ্রাজ থেকে প্রকাশিত তাঁর প্রথম কাব্য ছিল ইংরেজিতে লেখা- ‘ঞযব ঈধঢ়ঃরাব খধফু-১৮৪৯’ । নিজ ভাষার প্রতি তাঁর এ বিরাগ-অনুরাগের কারণ মূলত বিভিন্ন ভাষা সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান এবং সে ভাষার বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে অবহিতি। কিন্তু তিনি পরবর্তীকালে বুঝতে সক্ষম হন যে, মাতৃভাষাই শেষ্ঠ এবং মূল্যবান। তিনি ফিরে আসেন। তাঁর এই প্রত্যাবর্তন ছিল বাংলা সাহিত্যের বাঁক বদলের অন্যতম ঘটনা। মধুসূদনের কবিতায় আমরা শুনতে পাই ভাষাবন্দনার অনুপম উক্তি, ‘মাতৃভাষা রূপখানি পূর্ণ মণিজালে।’ তিনি নিজেকে ‘বাঙ্গাল’ পরিচয় দিতে পছন্দ করতেন। ঢাকায় প্রদত্ত তাঁর একটি বক্তৃতার কিছু অংশ এখানে প্রকাশ করছি :
‘আমার সম্বন্দের আপনাদের আর যে কোন ভ্রমই হইক আমি সাহেব হইয়াছি এ ভ্রমটি হওয়া ভারি অন্যায়। আমার সাহেব হইবার পথ বিধাতা রোধ করিয়া রাখিয়াছেন। আমি আমার বসিবার ও শয়ন করিবার ঘরে এক একখানি আর্শি রাখিয়া দিয়াছি এবং আমার মনে সাহেব হইবার ইচ্ছা… বলবৎ হয় অমনি আর্শিতে মুখ দেখি। আরো, আমি সুদ্ধ বাঙালি নহি, আমি বাঙ্গাল, আমার বাটি যশোহর।’
মধুসুদনের কাব্যভাষা ঋজু, সংহত এবং আভিজাত্যপূর্ণ। পরবর্তী সময়ে বাংলা কবিতায় গীতি-কবিতার ব্যাপক চর্চা পরিলক্ষিত হয়, মধুসূদনীয় ভাষাভঙ্গিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও কাব্যচর্চা করেন নি। রবীন্দ্রনাথ বিহারীলাল ও অন্য গীতিকবিদের ভঙ্গিকেই নিজের কাব্যচর্চার জন্য বেছে নিয়েছিলেন। গীতি-কবিতার অন্তর্মুখী নতবাক্ কাব্যভাষার বাইরে পরবর্তী সময়ে আমরা কাজী নজরুল ইসলাম, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ও মোহিতলাল মজুমদারের কিছু কবিতায় মধুসূদনীয় ছন্দ, শব্দ ও বাক্রীতির স্বাক্ষাৎ পাই। উল্লেখ্য, ‘মেঘনাদবধ’ কাব্যের অনুপ্রেরণায় অনেক কবি মহাকাব্য রচনায় ব্রতী হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে রঙ্গলাল বন্দোপাধ্যায়, নবীনচন্দ্র সেন, হেমচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়, কায়কোবাদ, সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী, গোলাম মোস্তফা এবং ফররুখ আহমাদের নাম বিশেষভাবে স্মরণযোগ্য। মধুসূদনের কাব্যভাষার শক্তি, স্বাতন্ত্র্য এবং অভিনবত্ব সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের একটি মন্তব্য এখানে তুলে ধরছি : ‘আপন শক্তির পরে শ্রদ্ধা ছিল বলেই বাংলাভাষার পরে কবি শ্রদ্ধা প্রকাশ করলেন। বাংলা ভাষাকে নির্ভীকভাবে এমন আধুনিকতার দীক্ষা দিলেন, যা তার পূর্বানুবৃত্তি থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। বঙ্গবাণীকে গম্ভীর স্বরনির্ঘোষে মন্ত্রিত করে তোলার জন্য সংস্কৃত ভা-ার থেকে মধুসূদন নিঃসঙ্কোচে যেসব শব্দ আহরণ করতে লাগলেন সেও নতুন, বাংলা পয়ারের সনাতন সমবিভক্ত আল ভেঙ্গে দিয়ে তার ওপরে অমিত্রাক্ষরের যে-বন্যা বইয়ে দিলেন সে-ও নতুন। আর মহাকাব্য, খ–কাব্য রচনার যে রীতি অবলম্বন করলেন, তাও বাংলা ভাষায় নতুন।’
(দুই)
কিশোরকাল থেকেই মধুসূদন ছিলেন দৃঢ়চেতা ও আত্মবিশ্বাসী। তাঁর সর্বগ্রাসী প্রতিভা সর্বজনবিদিত। মধুসূদনের ব্যক্তিত্ব গঠনে হিন্দু কলেজের শিক্ষাপর্ব এবং এ কলেজের বহিষ্কৃত শিক্ষক ডিরোজিও’র চিন্তা-ভাবনার প্রভাব অত্যন্ত গভীর। বড় কবি হবার জন্য তাঁর যে বাসনা তা কিংবদন্তিতুল্য, বিশেষত ভারতবর্ষে কেউ কবি হবার জন্যে এতটা উচ্চাকাক্সক্ষা দেখান নি এবং এতদূর ত্যাগ স্বীকারও কেউ করেনি। বিশ্বখ্যাত কবি হবার জন্য ইংল্যান্ড যাবার আকাক্সক্ষায় তিনি যে কতটা প্রবল ছিলেন, তা প্রকাশ পেয়েছে বন্ধু গৌরদাশকে লেখা চিঠিতে, তখন তিনি হিন্দু কলেজের ছাত্র।
‘সূর্য উঠতে ভুলে যেতে পারে, কিন্তু আমি- আমি ইংল্যান্ডে যাওয়ার কথা ভুলব না, ভুলতে পারব না। আর একবার ইংল্যান্ডে যেতে পারলে শ্রেষ্ঠ কবি আমি হবই।’ এতটাই প্রবল ছিল কবিতার প্রতি তাঁর অনুরাগ। তিনি আইন পড়ার উদ্দেশ্যে ইংল্যান্ড গিয়েছিলেনও, সেটা ১৮৬২ সাল। সেখানে গিয়ে তিনি সহসা বুঝতে সক্ষম হন যে, ইউরোপীয় সমাজ কোন বহিরাগতকে সাদরে গ্রহণের জন্য বসে নেই। তাঁর জীবন ছিল বাধাহীন, অমিতব্যয়ী, উশৃঙ্খল ও দ্বন্দ্বমুখর যার ফলে মাত্র ৪৯ বছরের জীবনের মধ্যে দেখা যায় ভাঙ্গা-গড়া, উত্থান-পতনের অনেক ঘটনা। আসলে অধিকাংশ শিল্পী-কবির জীবনই এমন বিশৃঙ্খলা ও দ্বন্দ্বে ভরা। এ বিষয়ে কার্ল গুস্তাভ ইয়ুং এর বহুশ্রুত মন্তব্যটি স্মরণ করছি : ‘শিল্পীর জীবন দ্বন্দ্বপূর্ণ না হয়ে পারে না, কারণ, দুটি বিপরীতমুখী শক্তি তাঁর ভিতর সংঘাতে লিপ্ত, একদিকে আনন্দ, তৃপ্তি ও সুরক্ষার জন্য সাধারণ মানবীয় বাসনা; অপরদিকে সৃষ্টির জন্য অদম্য আকাক্সক্ষা, যার বাস্তবায়নের জন্য মানবীয় বাসনাগুলোকে অগ্রাহ্য করা আবশ্যক।’ মধুসূদনের জীবনে দ্বী-মুখী সংকটের এই খেলা আমৃত্যু চলেছে, সে গল্প আমাদের অজানা নয়।
মাইকেল মধুসূদন তাঁর সাহিত্যকর্মে পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যধারার শিল্পরীতির সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন। চতুর্দশপদী কবিতাবলির মধ্যে তাঁর আধুনিক সাহিত্যভাবনার প্রকাশ ঘটেছে সবচেয়ে নিবিড়ভাবে। বিষয় বৈচিত্র্যের পাশাপাশি তাঁর মানস-ভ্রমণের নানা অনুভব ও অভিব্যক্তির প্রকাশ কবিতাগুলোর অন্তর্নিহিত সুর, যা সহজেই চোখে পড়ে। সনেটের বাইরে মধুসূদন বিভিন্ন বিষয়ে আরও বেশ কিছু কবিতা রচনা করেছেন যা সেসময় গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় নি, পরবর্তীকালে মধুসূদন রচনাবলিতে ‘নানা কবিতা’ শিরোনামে পত্রস্থ হয়েছে।
মধুসূদন রচিত গীতিকবিতাগুলোর মধ্যে সর্বাগ্রে উল্লেখযোগ্য কবিতার নাম, ‘আত্ম-বিলাপ’। এটিকে আধুনিক বাংলা কবিতার সূচনা-স্মারক বিবেচনা করলে অত্যুক্তি হবে না। আধুনিক জীবন বোধের সাথে ছন্দে- প্রকরণে- বিশ্লেষণে, শব্দপ্রয়োগে, উপমা-উৎপ্রেক্ষার যথার্থ ব্যবহারে আত্ম-বিলাপ আধুনিক বাংলা কবিতার এক অনন্য পাঠ। জীবনব্যাপী অপচয় ও আকাশ-কুসুম কল্পনার পিছে ধেয়ে চলার অভিঘাত এবং অনুতাপ এই কবিতার মর্মভাষ হলেও যুগযন্ত্রণায় দগ্ধ নাগরিক মানুষের বিষণœতাও এই কবিতার বিভিন্ন স্তবকে প্রতিভাত। কবির ‘বঙ্গভাষা’, ‘বঙ্গভূমির প্রতি’- এসব কবিতার মর্মার্থের সাথে এ কবিতার ভাবের মিল থাকলেও এখানে ভাষা বা দেশাত্মবোধের চেয়ে মুখ্য হয়েছে ব্যক্তির অন্তরগত অভিঘাত, যা ব্যক্তি হয়ে সমষ্টির একান্ত মানসকে স্পর্শ করেছে।
‘প্রেমের নিগড় গড়ি পরিলি চরণে সাধে কি ফল লাভিলি?
জ্বলন্ত-পাবক-শিখা লোভে তুই কাল-ফাঁদে
উড়িয়া পড়িলি?
পতঙ্গ যে রঙ্গে ধায়, ধাইলি, অবোধ হায়!
না দেখিলি, না শুনিলি- এবে রে পরাণ কাঁদে!
সাত স্তবকের কবিতায় আশার ছলনা, প্রমত্ত মনের তৃষ্ণা, স্বপ্নের কুহক, প্রেমের ফাঁদ, অর্থ-অন্বেষণ, যশোলাভের বাসনা এবং শতমুক্তাধিক আয়ুর অপচয়- এসব শব্দভাষ্যে কবি অনিশ্চিত-অচিহ্নিত জীবনের হাহাকার এবং আধুনিক অবিমৃষ্য জীবনের সারাৎসারকে তুলে এনেছেন অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায়। সুচিন্তা ও সুপরিকল্পনা ব্যতিরেকে কেবল ধোঁয়াসার মতো স্বপ্নের পথে ছুটে যে প্রাপ্তির পাল্লা শূন্য থেকে যায় এবং মাঝখানে মূল্যবান সময় নষ্ট হয়, এই চৈতন্য-‘আত্ম-বিলাপ’ কবিতায় অনুপম পরিভাষা পেয়েছে। কবিতাটির শেষ স্তবক এমন :
‘মুকতা ফলের লোভে ডুবে রে অতল জলে
যতনে ধীবর,
শতমুক্তাধিক আয়ু কালসিন্ধু জলতলে
ফেলিস্ পামর!
ফিরি দিবে হারাধন, কে তোরে, অবোধ মন
হায় রে, ভুলিবি কত আশার কুহক-ছলে!’
নানা ঘাত-প্রতিঘাতে, ভাঙ্গনে-বিভ্রমে পর্যুদস্ত হলেও মাইকেল মধুসূদন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশে যা করেছেন, তা অতুলনীয় এবং ঐশ্বর্যম-িত। অত্যধিক বাসনার ফলে একসময় তাঁর কাছে অন্য ভাষার সাহিত্য মহান বলে গণ্য হলেও তিনি সাহিত্যজীবনের প্রায় সর্বাংশ-জুড়ে বাংলা সাহিত্য নিয়েই খেটেছেন এবং সুকোমল বাংলা ভাষাকে অনুভব করেছেন হৃদয় দিয়ে এবং তা প্রকাশ পেয়েছে তাঁর বিভিন্ন লেখার ছত্রে ছত্রে। এখানে বাংলাভাষার প্রতি তাঁর অনুরাগের কিঞ্চিৎ কথকতা তুলে ধরছি: ‘যদি আমি মেঘ রূপে এ চন্দ্রিমার বিভারাশি স্থানে স্থানে ও সময়ে সময়ে অজ্ঞাত তিমিরে গ্রাস করি, তবুও আমার মার্জনার্থে এই একমাত্র কারণ রহিল, যে সুকোমল মাতৃভাষার প্রতি আমার এতদূর অনুরাগ যে তাহাকে এ অলঙ্কারখানি না দিয়া থাকিতে পারি না।’
বাংলা সাহিত্যের নবজাগরণের অন্যতম প্রতিভূ মাইকেল মধুসূদন দত্তের স্বর্ণছোঁয়ায় আধুনিকতার পথে অগ্রবর্তী হয়েছে বাংলা কবিতা তথা বাংলা সাহিত্য। এটি সম্ভব হয়েছিল প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যসাহিত্য সম্পর্কে তাঁর নিবিড় পরিচয়ের সুবাদে। সাহিত্যের বিষয়বস্তু, ভাষা ও প্রকরণ কেমন হওয়া উচিত তা যথার্থরূপে তিনি অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছিলেন যার ফলে পাল্টে গিয়েছিল বাংলা সাহিত্যের দৃশ্যপট। সাহিত্যের আঙ্গিক ও বিষয় নিয়ে পরবর্তীকালে বিভিন্ন কবি-লেখকের বিভিন্ন নিরীক্ষা সত্ত্বেও মধুসূদনের হাতে বাংলা সাহিত্যের যে বাঁকবদল ঘটেছে, বোধ করি অন্য কারও দ্বারা সাহিত্যের এতটা পরিবর্তন সূচিত হয় নি। বাংলা সাহিত্যের ধারাবাহিকতায় তিনি যেমন অনিবার্য তেমনি বাংলা সাহিত্য অনুধাবনেও তাঁর কাব্য ও নাটক অবশ্য পাঠ্য। ভাষার আবর্তন-বিবর্তন প্রক্রিয়া অনুধাবনে একজন কবির জন্য যেমন মধুসূদন পাঠ জরুরি, তেমনি তাঁর সৃজন-কৌশল, জীবন ও সাহিত্য-কীর্তির নতুন নতুন তথ্য ও বিবৃতি উদ্ভাবনের মাঝে আজও সাহিত্যমোদীদের কাক্সিক্ষত রসদ রয়েছে।
মধুসূদনের জন্মের দুইশত বছর পূর্তি হতে আর বেশিদিন বাকি নেই। চর্চা-পরিচর্যার মাধ্যমে এই মহান কবির সৃজন প্রতিভা ও সম্পন্নতার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হলেই তাঁর প্রতি আমাদের ভালোবাসা প্রকাশ পাবে। আর এই চর্চা প্রয়োজন আমাদের নিজের জন্য, প্রয়োজন সমাজ ও সাহিত্যের প্রগতির জন্য।
কবি মধুসূদন রচিত একটি ইংরেজি কবিতার প্রথম স্তবক উপস্থাপনপূর্বক রচনা শেষ করছি।
ঞযরং যবধৎঃ, ফবধৎ সধরফ ! ঃযধঃ ঃযড়ংব ংবিবঃ বুবং
ঐধাব ঈড়হয়ঁবৎবফ ষড়হম ধমড়,
ঝধু, ঐড়ি পধহ রহ ৎবনবষষরড়হ ৎরংব
অমধরহংঃ রঃ’ং ংড়াবৎবরমহ হড়?ি