বৃহস্পতিবার, ১৯শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৪ঠা আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)- জগৎসমূহের জন্য রহমত

পোস্ট হয়েছে: মার্চ ১৭, ২০২০ 

 

মো. আশিফুর রহমান

মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) সর্বশেষ নবী ও রাসূল। তাঁর পরে আর কোনো নবী বা রাসূল আসবেন না। মহান আল্লাহ সর্বশেষ নবীকে প্রেরণ করেছেন সমগ্র সৃষ্টির জন্য রহমত হিসেবে।মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করেন :
আমি তো আপনাকে জগৎসমূহের জন্য রহমত হিসেবে বৈ প্রেরণ করি নি।
মহানবী (সা.) এমন এক সময়ে আরব জাতির মধ্যে আগমন করেছিলেন যখন আরবরা জাহেলিয়াতের অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল।জীবনের ন্যূনতম নিরাপত্তা ছিল না। খুব ছোটখাটো বিষয়ে মানুষ সংঘর্ষে লিপ্ত হতো। গোত্রে গোত্রে বিবাদ লেগেই থাকত। মানুষের অধিকার হরণ, রাহাজানি ও হত্যাকা- নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার ছিল। ইয়াতীমদেরকে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হতো। নারীদেরকে মানুষ বলে গণ্য করা হতো না। কন্যাসন্তানদের জীবন্ত কবর দেয়া হতো।
শুধু আরব নয়; সমগ্র পৃথিবী অন্যায়-অত্যাচারে পূর্ণ ছিল। ধন-সম্পদ ও শক্তিমত্তার অধিকারীরা দুর্বলদের ওপর প্রতিনিয়ত অত্যাচার-নিপীড়ন চালাত। মানুষ মূর্তিপূজা, প্রকৃতিপূজা, অগ্নিপূজা ইত্যাদিতে লিপ্ত ছিল।
পৃথিবীতে এমন অবস্থা বিরাজমান থাকাকালে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর প্রিয় বান্দা মহানবী (সা.)-কে মানুষের জন্য রহমত হিসেবে প্রেরণ করেছিলেন।যখন তিনি জন্মগ্রহণ করেন সেই সময় যেসব প্রাকৃতিক নিদর্শন প্রকাশিত হয়েছিল তাতেই তাঁর রহমত হিসেবে আগমনের চিহ্ন ফুটে ওঠে। মূর্তিপূজা, কুসংস্কার, কূপম-ূকতা, অশ্লীলতা, মন্দ কাজ, ব্যভিচারকে উৎপাটন করা এবং এর বিপরীতে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করাÑ নারীর অধিকার, শিশুর অধিকার, গরীবের অধিকার, ইয়াতিমের অধিকার, দাসদের অধিকার, বন্দির অধিকার এভাবে সমস্ত মানুষের অধিকারের পয়গাম নিয়ে মহানবী (সা.) আবির্ভূত হয়েছিলেন।মানুষকে সকল প্রকার বন্দিত্বের নিগঢ় থেকে মুক্ত করতে এসেছিলেন। অপমানের হাত থেকে উদ্ধার করে সম্মান সহকারে বাঁচার পথ বাতলে দেয়ার জন্য এসেছিলেন।
মহানবী (সা.) জীবনের শুরু থেকেই সকলের কল্যাণকামী ছিলেন। সহমর্মিতা, সম আচরণ তাঁর অস্থিমজ্জায় মিশে ছিল। বালক বয়সে তাঁর ধাত্রীমাতা নিজ সন্তানদেরকে কাজে পাঠিয়ে মহানবীকে ঘরে বসিয়ে রাখলে তিনি তাঁর অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে বলেন যে, তিনিও তাঁর দুধভাইদের সাথে কাজে যাবেন। যুবক বয়সে তিনি হিলফুল ফুযূল নামে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনে যোগ দিয়ে মানুষের জন্য কল্যাণমূলক কাজে অংশগ্রহণ করেন।
মহানবী (সা.) মুসলিম, অমুসলিম, ছোট-বড়, নারী-পুরুষ, ধনী-গরীব সকলের জন্য রহমত হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তিনি কিয়ামত পর্যন্ত যত মানুষের আগমন ঘটবে সকলের জন্য রহমত। তিনি কেবল মানব জাতির জন্য রহমত নন; বরং তিনি পশু-পাখি, উদ্ভিদ এবং দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান সকল জগতের জন্য রহমত। নিচে মহানবী (সা.) যে রহমত হিসেবে এসেছিলেন তার ব্যাপ্তি সম্পর্কে সংক্ষেপে কিছু বর্ণনা করা হলো :
মানব জাতির প্রতি রহমত
মহানবী (সা.) ছিলেন কোমল হৃদয়ের অধিকারী। তিনি সকলের সাথে কোমল ও দয়ার্দ্র্য আচরণ করতেন। মহানবীর এই বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেন :
‘(হে রাসূল!) আল্লাহর পক্ষ থেকে এ এক অনুগ্রহ যে, তুমি তাদের প্রতি দয়ার্দ্রচিত্ত হয়েছ। যদি তুমি রুক্ষ মেজাজ ও কঠিন হৃদয়সম্পন্ন হতে তবে অবশ্যই তারা তোমার চারপাশ থেকে ছত্রভঙ্গ হয়ে যেত…।’Ñ সূরা আলে ইমরান : ১৫৯
মহানবী (সা.) অপরকে দয়ার ব্যাপারে এরশাদ করেন : ‘যে মানুষের প্রতি দয়া করে না, আল্লাহও তার প্রতি দয়া করেন না।’Ñ মুসলিম : ২৩১৯
মহানবী (সা.) অন্যত্র বলেন : ‘আল্লাহ তা‘আলা দয়ালুদের ওপর দয়া ও অনুগ্রহ করেন। তোমরা জমিনবাসীকে দয়া কর, তাহলে যিনি আসমানে আছেন তিনি তোমাদের ওপর দয়া করবেন। দয়া রহমান হতে উদগত। যে লোক দয়ার স¤পর্ক বজায় রাখে আল্লাহ তা‘আলাও তার সাথে নিজ স¤পর্ক বজায় রাখেন। আর যে লোক দয়ার স¤পর্ক ছিন্ন করে, আল্লাহ তা‘আলাও তার সাথে দয়ার স¤পর্ক ছিন্ন করেন।’Ñতিরমিজি : ১৯২৪
মুমিনদের প্রতি রহমত
মহানবী (সা.) দীর্ঘ ২৩ বছর মানুষকে মহান আল্লাহর পথে আহ্বান করেন। এ সময়ে মানুষ তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে তাওহীদের পতাকাতলে সমবেত হয়। কিন্তু এ পথ মসৃণ ছিল না। তাঁদেরকে এ পথে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। তাঁরা আল্লাহ তা‘আলার জন্য পার্থিব বিষয়াদিকে বিসর্জন দেন। মহান আল্লাহর পথে তাঁরা নিজেদেরকে উৎসর্গ করেন। মহানবী (সা.)-এর কাছে তাঁদের দুঃখ-কষ্ট ছিল অসহনীয়। তাই তিনি তাঁদের কারণে ব্যথিত হতেন। আল্লাহ তা‘আলা নিজ গুণবাচক নাম ‘রাউফ’ (দয়ার্দ্র) ও ‘রাহীম’ (পরম দয়ালু) ব্যবহার করেমহানবী (সা.)-এর এমন অবস্থার প্রশংসা করেছেন।মুমিনদের প্রতি তাঁর ভালোবাসাকে আল্লাহ্ তা‘আলা এভাবে ব্যক্ত করেছেন :
‘(হে লোকসকল!) তোমাদের মধ্য থেকেই তোমাদের নিকট এক রাসূল এসেছে, (তোমাদের প্রতি তার অনুকম্পার পরিচয় এই যে,) তোমাদের দুর্ভোগ তার পক্ষে দুর্বিষহ। সে তোমাদের (পথ প্রদর্শনের) অভিলাষী, বিশ্বাসীদের প্রতি দয়ার্দ্র ও পরম দয়ালু।’Ñ সূরা তওবা : ১২৮
কাফিরদের প্রতিও পরম সহানুভূতিশীল
শুধু মুমিন নয়, কাফিরদের প্রতিও তিনি সহানুভূতিশীল ও অত্যন্ত দয়ালু ছিলেন।প্রকৃতপক্ষে, মানুষের জন্য সবচেয়ে আগে প্রয়োজন নিজ ¯্রষ্টা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা। ¯্রষ্টা সম্পর্কিত জ্ঞান মানুষকে সকল পরাধীনতার বন্ধন থেকে মুক্ত করে। যখন মানুষ এক-অদ্বিতীয় আল্লাহকে প্রভু হিসেবে আনুগত্য স্বীকার না করবে তখন সে অনেক প্রভুকে মেনে নিতে বাধ্য হবে। কিন্তু জাহেল আরবরা এটি স্বীকার করতে চাইত না। অন্যদিকে মহানবী (সা.) আল্লাহ্র সেরা সৃষ্টি মানুষকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন। মহানবী (সা.) দীর্ঘদিন মানুষকে আল্লাহর পথে আহ্বান করেছেন। কিন্তু মানুষের অসচেতনতা ও গোঁড়ামি তাঁকে ব্যথিত করত। তিনি স্পষ্ট দেখতে পেতেন যে, আল্লাহ্্র শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষ জাহান্নামের আগুনে দগ্ধ হবে। ‘রাহমাতুল্লিল আলামীন’ হয়ে তিনি তা সহ্য করতে পারতেন না।তাই তিনি মানুষকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচানোর জন্য অস্থির হয়ে উঠতেন। মহান আল্লাহ্ তাঁর এ অবস্থাকে বর্ণনা করেছেন এভাবে :
‘আর সম্ভবত তুমিতোমার জীবনকে তাদের পেছনে শোকে-দুঃখে ধ্বংস করে দেবেন যদি তারা এ কথায় ঈমান না আনে।’Ñ সূরা কাহাফ : ৬
একইভাবে সূরা ফাতিরের ৮ নং আয়াতে আল্লাহ্্ বলছেন : فَلَا تَذْهَبْ نَفْسَكَ عَلَيهِمْ حَسَراتٍ ‘তাদের পেছনে যেন আক্ষেপ ও দুঃখে তোমার জীবন নিঃশেষ না হয়।’
এখানে আরেকটি বিষয় লক্ষ্যণীয় যে, মহানবী (সা.) কাফির-মুশরিকদের জন্য কখনই মহান আল্লাহর কাছে বদদোয়া করেন নি। এটিও তাঁর রহমাতুল্লিল আলামীন হওয়ার অন্যতম উদাহরণ। তিনি বলেছিলেন : ‘আমি অভিশাপকারীরূপে প্রেরিত হই নি; আমি কেবল করুণারূপে প্রেরিত হয়েছি।’ (মুসলিম : ৪৭০৭, মিশকাত : ৫৮১২)
ক্ষমা ও উদারতা : মহানবী (সা.) মক্কার ১০ বছরের নবুওয়াতি জীবনে কাফির-মুশরিকদের দ্বারা ভীষণভাবে নিপীড়নের শিকার হন। তারা তাঁকে পাগল, জাদুকর প্রভৃতি নামে আহ্বান করে মানসিকভাবে নির্যাতন করে এবং শারীরিকভাবেও নির্যাতন করে। একই সাথে অন্যান্য মুসলমানকেও তারা শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করে। আর এ নির্যাতন থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য মুসলমানরা প্রথমে আবিসিনিয়া ও পরে মদিনায় হিজরত করে। মহানবী (সা.) নিজেও মদিনায় হিজরত করতে বাধ্য হন। এরপর প্রায় ৮ বছর ধরে তারা মুসলমানদের সাথে সশস্ত্র যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এসব যুদ্ধে অনেক মুসলমান শাহাদাত বরণ করেন। কিন্তু অষ্টম হিজরিতে মক্কা বিজয়ের পর মহানবী (সা.) কাফির-মুশরিকদের থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ না করে তাদের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। এমনকি মহানবী (সা.) তাঁর চাচা হামযার হত্যাকারী ওয়াহশী ও হযরত হামযার কলিজা ভক্ষণকারিণী হিন্দাকেও ক্ষমা করে দিয়েছিলেন।
সমবেদনা ও সহানুভূতি :সহানুভূতি প্রকাশ, হিত কামনা ও উপকার করার ক্ষেত্রে মুসলমান-অমুসলমানে কোনো পার্থক্য নেই। যাদের সাথে মুসলমানদের যুদ্ধাবস্থা বিরাজমান এমন অমুসলিম ব্যতীত সবার প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করা যায়। অমুসলমানদের উপকার করার কোনো বাধা তো নেইই; বরং ইসলামি রাষ্ট্রে বসবাসরত অমুসলিম জনগণ এক্ষেত্রে মুসলমান নাগরিকের সমান হকদার। মহানবী (সা.) ও সাহাবায়ে কেরাম নিজেদের জীবনে এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্তসমূহ রেখে গিয়েছেন। জনৈক ইহুদি বালক মহানবীর নিকট আসা-যাওয়া করতো। একদিন তিনি ছেলেটিকে দেখতে না পেয়ে তার খোঁজ নিলেন। জানা গেল, ছেলেটি অসুস্থ। তিনি তৎক্ষণাত তার বাড়িতে গিয়ে তার সেবা-শুশ্রƒষা করতে লাগলেন। এক পর্যায়ে তিনি তাকে ইসলামের দাওয়াত দিলে ছেলেটি তার পিতামাতার সম্মতিক্রমে মুসলমান হয়ে যায়। কোরআন মজিদে মুসলমানদের প্রতি এরূপই নির্দেশ রয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘যারা ধর্মের ব্যাপারে তোমাদের সাথে যুদ্ধরত নয় এবং মাতৃভূমি থেকে তোমাদেরকে বহিষ্কার করেনি তাদের সাথে দয়া ও ন্যায়বিচারের ব্যবহার করতে আল্লাহ তোমাদের নিষেধ করেন না।’Ñসূরা মুমতাহিনা : ৮
বয়োজ্যেষ্ঠ ও ছোটদের প্রতি রহমত
সমাজের বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিদের যেমন সম্মান দেয়া প্রয়োজন তেমনি ছোটদেরও ¯েœহ ও ভালোবাসা প্রাপ্য। এ বিষয়টি মহানবী (সা.) নিজ জীবনে দেখিয়েছেন এবং মুসলমানদেরকে এ বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করেছেন। ‘খুতবায়ে শা’বানীয়া’ নামে প্রসিদ্ধ বক্তব্যে মহানবী (সা.) যখন বিভিন্ন দায়িত্ব সম্পর্কে সাহাবীদেরকে দিকনির্দেশনা দিচ্ছিলেন সেখানে তিনি উপদেশ দেন : ‘তোমরা বয়োজ্যেষ্ঠদের সম্মান কর এবং ছোটদের প্রতি দয়াশীল হও।’Ñউয়ুনু আখবারির রিযা, ১ম খ-, পৃ. ২৯৫
মহানবী (সা.) অন্যত্র বলেন : ‘যে শিশুদের প্রতি ¯েœহ করে না এবং বড়দের সম্মান করে না সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়।’Ñ আল মুহাজ্জাতুল বাইদা, ৩য় খ-, পৃ. ৩৬৫
একটি বর্ণনামোতাবেক মহানবী (সা.) আরও বলেছেন :‘তোমরা শিশুদেরকে ভালোবাসো ও তাদের প্রতি দয়াশীল হও।’Ñ বিহারুল আনওয়ার, ৯৩তম খ-, পৃ. ১০৪
মহানবী (সা.) শিশুদের প্রতি এতই মেহেরবান ছিলেন যে, বলা হয়ে থাকে, তায়েফ সফরে যেসব শিশু তাঁর দিকে পাথর ছুঁড়ে মেরেছিল তিনি তাদের প্রতি কোনো প্রতিক্রিয়া দেখান নি; বরং হযরত আলী (আ.) তাদেরকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলেন।’Ñ তাফসীরে কুম্মী, ১ম খ-, পৃ. ১১৫
নারীদের প্রতি রহমত
মহানবী (সা.)-এর জন্মের সময় নারীদেরকে কেবল ভোগ্যপণ্য বলে মনে করা হতো। তাদের কোনো মর্যাদা ছিল না। মহানবী (সা.) নারীদের জন্য রহমত হিসেবে আবির্ভূত হন। তিনি নারীদেরকে যথাযোগ্য আসনে অধিষ্ঠিত করেন। পরিবারে একজন মা, বোন, স্ত্রী ও কন্যা হিসেবে নারী অধিকারের প্রবক্তা ছিলেন মহানবী (সা.)। শুধু কথা নয়, কাজের মাধ্যমে নিজের জীবনে তিনি নারীদের মর্যাদাকে পরিস্ফুট করেন। হযরত খাদীজাকে স্ত্রী হিসেবে যে সম্মান তিনি দিয়েছিলেন তা ছিল তৎকালীন সমাজের সম্পূর্ণ বিপরীত। বিধবা নারীদেরকে তিনি স্বমর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেন। কয়েকজন বিধবার অসহায়ত্ব দূর করার জন্য তিনি নিজে তাঁদেরকে বিবাহ করেন।
কন্যাসন্তানকে জীবন্ত কবর দেয়া ও তাদেরকে তুচ্ছ গণ্য করার জাহেলী সমাজে তিনি হযরত ফাতেমা যাহরা (সা.আ.)-এর প্রতি কন্যা হিসেবে যে আচরণ করেছিলেন তাতে তিনি যে নারী জাতির মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য এসেছিলেন তা স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। পবিত্র কোরআনের বাণী অনুযায়ী নারী-পুরুষের মর্যাদার কারণ যে তাকওয়া তা মানব সমাজে প্রচারের মাধ্যমে তিনি নারী জাতিকে ঘৃণিত ও অপমানিত অবস্থা থেকে রক্ষা করেন।
ইয়াতিম ওগরীব-মিসকিনদের প্রতি রহমত
জাহেলী যুগে ইয়াতিমদের প্রতি ¯েœহ-মমতা প্রদর্শন করা হতো না, তাদেরকে নিগৃহীত করা হতো, ন্যায্য পাওনা থেকে তাদেরকে বঞ্চিত করা হতো, তাদের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করা হতো। মহানবী (সা.) ইয়াতিমদের জন্য রহমতস্বরূপ আগমন করলেন। মহানবী (সা.) নিজেই ইয়াতিম ছিলেন। তিনি ইয়াতিমের কষ্ট বুঝতেন। আর তাই তিনি ইয়াতিমদের সাথে সদাচরণের ও তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়ার এবং তাদের প্রতি দায়িত্ব পালনের জন্য উপদেশ দিয়েছেন। মহানবী (সা.) বলেন : ‘আমি এবং অনাথের দায়িত্বগ্রহণকারী জান্নাতে এই দুই অঙ্গুলির কাছাকাছি থাকব।’ এ কথা বলে তিনি তর্জনী এবং মধ্যমা অঙ্গুলির মাঝে একটু ফাঁক করলেন।- বুখারী
নবী করীম (সা.) বলেন : ‘মুসলমানদের সর্বাপেক্ষা উত্তম গৃহ হলো সে গৃহ, যে গৃহে কোনো ইয়াতিম বসবাস করে আর সে গৃহবাসীরা তার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করে; এবং সবচেয়ে মন্দ গৃহ সে গৃহ, যে গৃহে কোনো ইয়াতিম থাকে অথচ সে গৃহবাসীরা তার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করে না।’Ñ ইবনে মাজাহ
নবী করীম (সা.) আরো বলেন :‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যেইয়াতিম অনাথদের মাথায় ¯েœহের হাত বোলাবে, ইয়াতিমের স্পর্শকৃত প্রত্যেকটি চুলের বিনিময়ে আল্লাহ ঐ ¯েœহকারীকে অসংখ্য নেকী দান করবেন।’ তিরমিযী
ইয়াতিমদের ধন-সম্পদ যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ করার ওপর মহানবী (সা.) গুরুত্ব আরোপ করেছেন। পবিত্র কোরআনের আয়াতে ঘোষিত হয়েছে : ‘…আর স¤পদ ব্যয় করবে তাঁরই মুহব্বতে আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতিম-মিসকীন, মুসাফির-ভিক্ষুক ও মুক্তিকামী ক্রীতদাসদের জন্য…’Ñ সূরা বাকারা : ১৭৬
মহান আল্লাহ অসহায় ইয়াতিমদের হক আদায় না করা এবং মিসকিনদের খাবার না দেয়া লোকদেরকে স¤পর্কে সূরা মাউনে বলেছেন, ‘তুমি কি এমন লোককে দেখেছ, যে দ্বীনকে অস্বীকার করে ? সে তো ওই ব্যক্তি যে ইয়াতিমের প্রতি রুঢ় আচরণ করে তাড়িয়ে দেয় আর মিসকিনদের খাবার প্রদানে মানুষকে নিরুৎসাহিত করে।’Ñ সূরা মাউন: ১-৩
মহানবী (সা.) গরীব-মিসকিনদের সাথে উত্তম ব্যবহার করতেন। তাদেরকে সাহায্য-সহযোগিতা করতেন এবং অন্য সকলকে তাদের সাহায্য করার জন্য উপদেশ দিতেন। সূরা বনি ইসরাইলের ২৬ নং আয়াতে বলা হয়েছে : ‘আর নিজের নিকটবর্তীদের হক আদায় করে দাও এবং গরীব-মিসকিন, প্রতিবেশী ও প্রবাসী মুসাফিরদেরও তাদের হক দিয়ে দাও…’
অন্য একটি আয়াতে বলা হয়েছে : ‘সুতরাং নিকটাত্মীয়দেরকে তাদের হক দিয়ে দাও এবং (তেমনিভাবে) দিয়ে দাও গরীব-মিসকীন, অভাবগ্রস্ত ও প্রতিবেশীদের হক…’Ñ সূরা রূম : ৩৮
পবিত্র কোরআনের বাণী অনুযায়ী গরীব-মিসকিনদেরকে সাহায্য ও সহযোগিতার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করতেন।তাদের জন্য দান-সাদাকার নসিহত করতেন।
আবূ সাঈদ খুদরী হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা মিসকিনদের ভালোবাস।’ কেননা আমি রাসূল (সা.)-কে তাঁর দুআয় বলতে শুনেছি, ‘হে আল্লাহ! তুমি আমাকে মিসকিন রূপে জীবিত রাখ, মিসকিন রূপে মৃত্যুদান কর এবং মিসকিনদের দলভুক্ত করে হাশরের ময়দানে উত্থিত কর।’Ñ ইবনু মাজাহ, হাদিস ৪১২৬
ঋণগ্রস্তের প্রতি দয়া
বুরায়দা (রা.) হতে বর্ণিত; তিনি বলেন, আমি রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি: যে ব্যক্তিকোনো অভাবী ঋণীকে অবকাশ দিবে তার বিনিময়ে প্রতিদিন সাদকার সাওয়াব পাবে। বুরায়দা বলেন, আমি রাসূল হতে আরো শুনলাম যে, যে ব্যক্তি কোনো অভাবী ঋণীকে অবকাশ দিবে সে প্রতিদিন দ্বিগুণ সাওয়াব পাবে। অতঃপর বুরায়দা বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি এমন কথা বলেছেন, যে ব্যক্তি কোনো অভাবী ঋণীকে অবকাশ দিবে তাকে প্রতিদিন দ্বিগুণ সাওয়াব দেওয়া হবে? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন : ঋণ পরিশোধের আগ পর্যন্ত প্রতিদিন সাদকার সাওয়াব পাবে, আর মাফ করে দেওয়া হয়, তাহলে প্রতিদিন দ্বিগুণ সাওয়াব পাবে।’Ñ মুসনাদে আহমাদ : ২২৫৩৭
দাসদের প্রতি রহমত
জাহেলী যুগে দাসদেরকে পশুর মতো গণ্য করা হতো। শুধু আরবে নয়, সারা পৃথিবীতে দাসদেরকে নীচু শ্রেণির মানুষ মনে করা হতো। তাদেরকে দিয়ে অমানুষিক ও সাধ্যাতীত পরিশ্রম করানো হতো। কাজের ত্রুটি ঘটলে নির্মমভাবে প্রহার করা হতো ও কঠিন শাস্তি দেয়া হতো। তাদেরকে পর্যাপ্ত খাবার দেয়া হতো না। কোনো বিষয়েই তারা স্বাধীন ছিল না, মালিকের কথামতো সবকিছু করতে হতো।তাদেরকে বিয়ের অধিকার দেয়া হতো না। যদিও বা তাদেরকে বিয়ে করার অনুমতি দিত, কিন্তু সন্তানের মালিকানা মালিকের হাতে চলে যেত।
এমন অবস্থায় মহানবী (সা.) দাসদের প্রতি সদয় আচরণ করার নির্দেশ দিলেন।ইসলামের শান্তির বাণীতে আকৃষ্ট হয়ে বেলাল, খাব্বাবসহ অনেক দাস ইসলাম গ্রহণ করেন। মহানবী (সা.) নিজে অনেক দাসকে ক্রয় করে মুক্ত করে দেন এবং সাহাবীদেরকে দাসমুক্তির ব্যাপারে উৎসাহিত করেন। তিনি বলেন : ‘যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমকে দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করবে, তাকে তার প্রতিটি অঙ্গের বিনিময়ে প্রতিটি অঙ্গকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা জাহান্নাম থেকে মুক্তি দান করবেন।’ [৫]
পবিত্র কোরআনেও সৎকর্মের উল্লেখের সময় মুক্তিকামী ক্রীতদাসের জন্য ব্যয়ের কথা উল্লেখ করেছেনÑ‘…আর স¤পদ ব্যয় করবে তাঁরই মুহব্বতে আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতিম-মিসকীন, মুসাফির-ভিক্ষুক ও মুক্তিকামী ক্রীতদাসদের জন্য…’ (সূরা বাকারা : ১৭৬)।এমনকি ইসলামি শরীয়তে বিশেষ কিছু বিষয়ের কাফ্ফারারক্ষেত্রে দাসমুক্তিকে অন্যতম বিধান হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। যেমন : ইচ্ছাকৃত শপথ ভঙ্গের কাফ্ফারা।
মহানবী (সা.) বিদায় হজের ভাষণে দাসদের সম্পর্কে বলেন :‘তোমাদের দাস ও অধীনদের বিষয়ে আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় কর। তোমরা তোমাদের দাস-দাসীদের সাথে ভালো ব্যবহার কর। তাদের সাথে খারাপ ব্যবহার কর না। তাদের ওপর নির্যাতন করবে না। তোমরা যা খাবে তাদেরকে তা খেতে দেবে। তোমরা যা পরবে তাদেরকে সেভাবে পরতে দেবে। মনে রেখ, তারাও মানুষ, তোমরাও মানুষ। এরাও একই আল্লাহর সৃষ্টি।’
বন্দিদের প্রতি রহমত
প্রাচীনকালে যুদ্ধবন্দিদেরকে অমানুষিক নির্যাতন করা হতো। একই কক্ষে অনেককে বন্দি করে রাখা হতো। তাদেরকে ঠিকমতো খাবার দেয়া হতো না। অনেককে গরম পানিতে সিদ্ধ করে, ক্রুশ বিদ্ধ করে, শরীরের মাংস কেটে ইত্যাদি নৃশংস পন্থায় হত্যা করা হতো। এমন অবস্থায় মহানবী (সা.) বন্দিদের জন্যও রহমতস্বরূপ এসেছিলেন। বদর যুদ্ধে প্রথম মুসলমানদের হাতে কাফের-মুশরিকরা বন্দি হয়। মহানবী (সা.) বন্দিদেরকে হত্যা না করে মুক্তিপণ নিয়ে এবং বন্দিদের মধ্যে যারা পড়ালেখা জানত তাদের জন্য মুক্তির মাধ্যম হিসেবে মুসলমানদেরকে শিক্ষা দেয়াকে ঘোষণা করেন। এতে মহানবীর বন্দিদের প্রতি মমত্ববোধ প্রকাশিত হয়।
বন্দিদেরকে শারীরিক অত্যাচার না করা, তাদেরকে খাবার দেয়া, তাদের সাথে ভালো আচরণ করা হলো ইসলামের বিধান।রাসূলুল্লাহ(সা.) বলেছেন :‘যে মুসলিম তার বন্দির সাথে খারাপ ব্যবহার করবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।’ মুসনাদে আহমদ : ৩২
জাতিভেদ ও বর্ণভেদ প্রথা বাতিল
বিদায় হজের ভাষণে মহানবী (সা.) বলেন : আরবের ওপর অনারবের এবং অনারবের ওপর আরবের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই, সাদার ওপর কালোর আর কালোর ওপর সাদার কোনো মর্যাদা নেই। তাকওয়াই শুধু পার্থক্য নির্ণয় করবে।
এভাবে মহানবী (সা.) মানব জাতির জন্য রহমত হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন।
পশুপাখিরজন্য রহমত
মানব জাতির প্রতি রহমত হিসেবে আগমনের কিছু বিষয় উল্লেখের পর এখন সৃষ্টিজগতের অন্যান্য সৃষ্টির প্রতি মহানবীর করুণা সম্পর্কে কিছুটা আলোকপাত করা হলো।
হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) পশু-পাখির জন্যও রহমতস্বরূপ এসেছেন। তৎকালীন সময়ে যখন মানুষের প্রতি মানুষের মমত্ববোধ ছিল না তখন পশপাখিদের প্রতি তাদের আচরণ কেমন ছিল তা কিছুটা হলেও ধারণা করা যায়। মহানবী (সা.)-এর আগমনের মাধ্যমে পশুপাখিরাও মানুষের কাছ থেকে যথাযথ আচরণ পেতে শুরু করে। মহানবী (সা.) প্রাণীদের যতœ নেয়া, খাদ্য ও পানি দেয়া, চিকিৎসা করা, এদের অপরিহার্য প্রয়োজনসমূহ পূরণ করা, প্রাণিদের ওপর যুলুম-নির্যাতন না করার বিষয়বিভিন্ন হাদিসের মাধ্যমে বারবার তুলে ধরেছেন। এজন্যই আমরা ইসলামি শরীআতের আহকামে প্রাণিদের সাথে মানুষের আচরণ সম্পর্কে প্রচুর বিধিবিধান লক্ষ করে থাকি।
হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) জন্তু-জানোয়ারের সাথে আচরণের ক্ষেত্রে আল্লাহ্ তা‘য়ালাকে ভয় করার জন্য নসিহত করেছেন। মহানবী (সা.) বলেন : ‘উত্তমভাবে (এগুলোকে কষ্ট না দিয়ে) ওদের পিঠে সওয়ার হও (এবং উত্তমভাবে তাদের কাছ থেকে সেবা গ্রহণ করো) আর উত্তমভাবে ওদের গোশত ভক্ষণ করো।’Ñ জামেউস সাগীর, ১ম খ-, পৃ. ২৪
পশুর ওপরে বেশি বোঝা চাপানো, মাঝখানে বিশ্রাম ব্যতীত বোঝাসহ দীর্ঘ পথ অতিক্রম করা এবং একটি পশুর ওপরে তিনজন সওয়ার হওয়া থেকে নিষেধ করা হয়েছে এবং পশুকে তার সাধ্যের অতীত পথ অতিক্রম করতে বাধ্য না করতে বলা হয়েছে।Ñজাওয়াহেরুল্ কালাম, ৩১তম খ-, পৃ. ৩৯৭
ঘোড়ার কপালের পশম কামিয়ে ফেলতে নিষেধ করা হয়েছে, ওগুলোর ঘাড়ের লোমও কামিয়ে ফেলতেও নিষেধ করা হয়েছে যেহেতু তা শীতের সময় ওগুলোর ঘাড় গরম রাখে। আর তার লেজের পশম খাটো করতে নিষেধ করা হয়েছে। কারণ, এটা হচ্ছে ওদের পোকামাকড় তাড়াবার হাতিয়ার।Ñ মাকারেমুল আখলাক, পৃ. ২৬৪
ইসলামি শরীয়তে পশুকে শারীরিকভাবে কষ্ট দেয়া অপছন্দনীয় হওয়া ছাড়াও কথায় পশুকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা, গালি দেয়া,মন্দ বলা ও অভিশাপ দেয়া অপছন্দনীয় কাজ।ইসলাম-পূর্ব যুগে যখন ঘোড়া ছিল যুদ্ধের জন্য অত্যন্ত প্রভাবশালী একটি উপকরণ এবং ঘোড়া যুদ্ধে প্রাধান্যের কারণ হিসেবে পরিগণিত হতো তখন লোকদের মধ্যে একটি বহুলপ্রচলিত নিয়ম ছিল রণাঙ্গণে দ্বন্দ্বযুদ্ধের সময় প্রত্যেক যোদ্ধাই তার সম্ভাব্য পরাজয় ও মৃত্যুর পর তার ঘোড়া যাতে শত্রুর হাতে না পড়ে সে লক্ষ্যে অথবা বীরত্বের নিদর্শনস্বরূপ স্বীয় ঘোড়ার পাগুলো কেটে দিত। ইসলাম এ কাজ করতে নিষেধ করেছে। একইভাবেপ্রাণিদের চেহারার ওপর আঘাত করতেও নিষেধ করা হয়েছে।Ñ আল-কাফী, ৬ষ্ঠ খ-, পৃ. ৫৩৮
এমনকি পশুপাখিকে জবেহ করার সময়ও পশুর সাথে ভালো আচরণ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।Ñ বিহারুল আনওয়ার,৬২তম খ-, মুসনাদে আহমাদ ইবনে হাম্বাল, ৪র্থ খ-, পৃ. ১২৩
প্রাণীর দুধ পুরোপুরি দোহন করতে নিষেধ করা হয়েছে যাতে তার বাচ্চার কষ্ট না হয়। বিনা কারণে গর্ভবতী পশু হত্যা ও বিনা কারণে পশুহত্যাকে নিষেধ করা হয়েছে।Ñ দায়ায়েমুল ইসলাম, ২য় খ-, পৃ. ১৭৭
প্রাচীনকাল থেকে মানুষের অন্যতম বিনোদন হচ্ছে পশু-পাখিদের মধ্যে লড়াই লাগিয়ে দেয়া। যেমন : মোরগের লড়াই, দুম্বার লড়াই, কুকুরের লড়াই, ষাঁড়ের লড়াই ইত্যাদি। বর্তমানেও বিশ্বের কোনো কোনো অঞ্চলে এগুলোর প্রচলন রয়েছে। এমনকি টিভি-চ্যানেলসমূহ এসব প্রতিযোগিতা প্রচার করে বা কখনো কখনো নিজেরাই এ সবের আয়োজন করে। ইসলামে প্রাণিদের সাথে এ ধরনের আচরণ করতে নিষেধ করা হয়েছে।
হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) ঘোড়া, দুম্বা ও মোরগসহ যে কোনো প্রাণীকে বন্ধ্যা করতে নিষেধ করেছেন।Ñ বিহারুল আনওয়ার, ৬২তম খ-, পৃ. ১০
গাছপালার প্রতি রহমত
রাসূলুল্লাহ্(সা.) যখন সৈন্যদেরকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করেন তখন তাদের উদ্দেশে এরশাদ করতেন : ‘একান্ত অনন্যোপায় না হলে কোনো বৃক্ষ কর্তন করবে না।’Ñ আল মাহাসিন, পৃ. ৩৫৫
ইসলামে বৃক্ষের রক্ষণাবেক্ষণ ও বৃক্ষের গোড়ায় পানি দেয়ার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং গাছ কাটতে নিষেধ করা হয়েছে। হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)এরশাদ করেন :‘যে কেউ তাল্হ্ ও সিদ্র্ বৃক্ষের (যেগুলোর গোড়ায় পানি না দিলে বেঁচে থাকে না) পানি দেবে সে যেন তৃষ্ণার্ত মু‘মিনের পিপাসা নিবৃত্ত করল।’Ñ তাফসীরে আয়াশী, ২য় খ-, পৃ. ৮৭
হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) ফলের গাছের নিচে প্রস্রাব করতে সকলকে নিষেধ করেছেন।Ñ আল-ফাকীহ, ৪র্থ খ-, পৃ. ৪
প্রকৃতির প্রতি রহমত
হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) এরশাদ করেন :‘তোমরা তোমাদের যিন্দেগীর পরিবেশকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখ এবং তোমরা ইহুদিদের মতো হয়ো না।’Ñ আল কাফী, ৬ষ্ঠ খ-, পৃ. ৫৩১
হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) এরশাদ করেন :‘তোমরা বায়ুপ্রবাহকে গালি দিয়ো না। কারণ, তা সুসংবাদদাতা, সতর্ককারী ও পরাগায়ণকারী। অতএব, তোমরা আল্লাহ্র কাছে তার কল্যাণসমূহ প্রার্থনা করো এবং তার ক্ষতিসমূহ থেকে তাঁর কাছে আশ্রয় গ্রহণ করো।’Ñ তাফসীরে আয়াশী, ২য় খ-, পৃ. ২৩৯
হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) উহুদ পাহাড় সম্বন্ধে এরশাদ করেন :‘এই উহুদ হচ্ছে এমন একটি পাহাড় যা আমাদেরকে ভালোবাসে এবং আমরাও এটাকে ভালোবাসি।’Ñ বিহারুল আনওয়ার, ২১তম খ-, পৃ. ২৪৮
হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর এ উক্তি কেবল বিশেষভাবে উহুদ পাহাড় সম্পর্কে নয়, বরং তাঁর এ কথার মানে হচ্ছে এই যে, সমস্ত পাহাড়-পর্বতই আমাদেরকে ভালোবাসেÑ আমাদের বন্ধু এবং আমাদের উচিত সকল পাহাড়-পর্বতের বন্ধু হওয়া তথা এগুলোকে ভালোবাসা। এখানে উহুদ পাহাড়ের কথা কেবল উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
তিনি ব্যবহার করা হয় এমন সুপেয় পানির বা সুপেয় পানির নালা ও নদীর কিনারে পায়খানা-প্রস্রাব করতে নিষেধ করেছেন।Ñ কিতাবুল খিসাল, পৃ. ৯৭
আবার তিনি যে কূপের পানি ব্যবহার করা হয় তাতে থুথু বা কুলি ফেলতে নিষেধ করেছেন।Ñ আল ফাকীহ্, ৪র্থ খ-, পৃ. ১০
উপসংহার
প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তা‘আলা মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-কে সৃষ্টিজগতের সকলের জন্য দয়া ও করুণার প্রতীক রূপে প্রেরণ করেছেন। মহানবীর ওপর নাযিলকৃত মহাগ্রন্থ আল কোরআন ও মহানবীর জীবনীতে এই দয়া ও করুণার পরিচয় স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। মহানবী (সা.) নিজে যেমন দয়া ও করুণার মূর্ত প্রতীক ছিলেন তেমনি তিনি সকল মানুষকে তাঁর মতো হওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছেন। তিনি যেমন দয়া ও করুণার মাহাত্ম্য বর্ণনা করেছেন তেমনি কঠোরতা আরোপের কুফল বর্ণনা করেছেন। কোথাও উপদেশ দিয়েছেন আবার কোথাও নির্দেশ জারি করছেন। তাই প্রতিটি মুমিন-মুসলমানের জন্য একান্ত প্রয়োজন হলো মহানবী (সা.)-এর দেখানো পথে নিজেদেরকে গড়ে তোলা যাতে বিশ^জগৎ একটি দয়ামায়াপূর্ণ ও শান্তির আবাসস্থলে পরিণত হতে পারে।