মহানবী (সা.)-এর বিদায় হজ এবং গাদীরে খুমের ঘটনা
পোস্ট হয়েছে: অক্টোবর ২৮, ২০২১
সংকলন : মোহাম্মদ আশিফুর রহমান
ইসলামের সামষ্টিক ইবাদতসমূহের মধ্যে সবচেয়ে বড় ও আড়ম্বরপূর্ণ ইবাদত হলো হজ। প্রতি বছর সামর্থ্যবান মুসলমানরা যিলহজ মাসে তাঁদের এ ধর্মীয় দায়িত্ব পালনের জন্য পবিত্র মক্কা নগরীতে আগমন করেন। হজ এমন একটি সমাবেশ যেখানে মুসলিম উম্মাহ্র ঐক্য ও সাম্যের বাস্তব নমুনাই কেবল প্রকাশিত হয় তা নয়; বরং এর মাধ্যমে মুসলমানদের আন্তঃসম্পর্কও দৃঢ় হয়।
হযরত ইবরাহীম (আ.) পবিত্র কাবার ভিত্তি পুনঃনির্মাণ কাজ সম্পন্ন করে মহান আল্লাহ্র বান্দাদেরকে এ ঘর যিয়ারত করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। সেদিন থেকে এ অঞ্চল কাবা ও তাওয়াফের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। প্রতি বছর পৃথিবীর প্রত্যন্ত অঞ্চল এবং আরব উপদ্বীপের বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ এ ঘর যিয়ারত করার জন্য ছুটে আসে এবং যে আচার-অনুষ্ঠান হযরত ইবরাহীম (আ.) শিক্ষা দিয়েছিলেন, তা সম্পন্ন করে। কিন্তু কালক্রমে মহান নবিগণের নেতৃত্ব-ধারা থেকে হিজাযবাসী বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে কুরাইশদের স্বেচ্ছাচারিতা এবং সমগ্র আরব বিশ্বের চিন্তাজগতের ওপর প্রতিমাগুলোর আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হবার কারণে হজের আচার-অনুষ্ঠানও স্থান-কালের দৃষ্টিকোণ থেকে বিকৃত হয়ে যায় এবং সত্যিকার খোদায়ী রূপ হারিয়ে ফেলে।
এসব কারণেই মহানবী (সা.) হিজরতের দশম বর্ষে মহান আল্লাহ্র পক্ষ থেকে আদিষ্ট হন যে, তিনি নিজে ঐ বছর হজ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে মুসলিম উম্মাহ্কে ব্যবহারিকভাবে তাদের দায়িত্ব-কর্তব্যের সাথে পরিচিত করাবেন এবং উপরিউক্ত কারণসমূহের জন্য এ হজকে কেন্দ্র করে যেসব বিকৃতির উদ্ভব ঘটেছিল, সেগুলোর মূলোৎপাটন করবেন এবং জনগণকে আরাফাত ও মিনার সীমানা এবং ঐসব স্থান থেকে বের হবার সঠিক সময়ও শিখিয়ে দেবেন।
মহানবী (সা.) ইসলামি বর্ষপঞ্জির একাদশ মাস অর্থাৎ যিলকদ মাসে ঘোষণা করেন যে, তিনি ঐ বছর মহান আল্লাহ্র ঘর যিয়ারত করতে যাবেন। এ ঘোষণা মুসলমানদের এক বিরাট অংশের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার সৃষ্টি করে এবং এর ফলে হাজার হাজার মানুষ মদীনার চারপাশে তাঁবু স্থাপন করে মহানবীর হজযাত্রার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।
মহানবী (সা.) ২৬ যিলকদে আবু দুজানাকে মদীনায় নিজের স্থলবর্তী নিযুক্ত করে ৬০টি কুরবানির পশু সাথে নিয়ে পবিত্র মক্কার উদ্দেশে রওয়ানা হয়ে যান। তিনি যূল হুলাইফায় পৌঁছে দু’টি সেলাইবিহীন বস্ত্র পরে ‘মসজিদে শাজারাহ্’ থেকে ইহ্রাম করেন এবং ইহ্রাম করার সময় হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর আহ্বানে সাড়া দানস্বরূপ প্রসিদ্ধ দুআ- লাব্বাইক, আল্লাহুম্মা লাব্বাইক… পাঠ করেন। আর যখনই তিনি কোনো বহনকারী পশু (সওয়ারী) দেখতে পেয়েছেন বা উঁচু বা নিচু স্থানে উপনীত হয়েছেন, তখনই তিনি ‘লাব্বাইকা’ বলেছেন। যিলহজ মাসের ৪ তারিখে তিনি পবিত্র মক্কা নগরীতে প্রবেশ করেন এবং সরাসরি মসজিদুল হারামের পথ ধরে এগিয়ে যান। তিনি বনী শাইবার ফটক দিয়ে মসজিদুল হারামে প্রবেশ করেন। ঐ অবস্থায় তিনি মহান আল্লাহ্র প্রশংসা করছিলেন এবং হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর ওপর দরুদ পাঠ করছিলেন।
তাওয়াফের সময় তিনি হাজরে আসওয়াদের (কালো পাথর) নিকটে গিয়ে প্রথমে একে স্পর্শ করেন এবং এর উপর হাত বুলান এবং পবিত্র কাবা সাত বার তাওয়াফ করেন। এরপর তিনি মাকাম-ই ইবরাহীমের পশ্চাতে গিয়ে দু’ রাকাআত তাওয়াফের নামায আদায় করেন। তিনি নামায সমাপ্ত করে সাফা-মারওয়ার মাঝখানে সাঈ করেন। অতঃপর তিনি হাজীদের উদ্দেশে বলেন : ‘যারা নিজেদের সাথে কুরবানির পশু আনে নি, তারা ইহ্রাম ত্যাগ করবে এবং তাকসীর (অর্থাৎ চুল ছাটা বা নখ কাটা) করার মাধ্যমে তাদের জন্য ইহ্রামকালীন হারাম হয়ে যাওয়া বিষয়গুলো হালাল হয়ে যাবে। তবে আমি এবং যারা নিজেদের সাথে কুরবানির পশু এনেছে, তারা অবশ্যই ইহ্রামের অবস্থায় থাকবে ঐ সময় পর্যন্ত, যখন তাদের কুরবানির পশুগুলোকে তারা কুরবানি করবে।’
হজের আনুষ্ঠানিকতা শুরু
উমরার আমলসমূহ সমাপ্ত হয়। উমরা ও হজের আমলসমূহ শুরু হওয়ার অন্তর্বর্তীকালীন সময় কারো কাবায় (মসজিদুল হারাম ও মক্কা নগরীতে) অবস্থান করার ব্যাপারে মহানবী (সা.) সম্মত ছিলেন না। তাই তিনি মক্কার বাইরে তাঁর তাঁবু স্থাপন করার নির্দেশ দিলেন।
৮ যিলহজ বাইতুল্লাহ্ যিয়ারতকারিগণ পবিত্র মক্কা নগরী থেকে আরাফাতের ময়দানের দিকে যাত্রা শুরু করেন, যাতে তাঁরা ৯ যিলহজ দুপুর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করতে পারেন। মহানবী (সা.) ৮ যিলহজ মিনার পথে আরাফাতের ময়দানের দিকে যাত্রা করেন এবং ৯ যিলহজের সূর্যোদয় পর্যন্ত তিনি মিনায় অবস্থান করেন। এরপর তিনি নিজ উটের উপর সওয়ার হয়ে আরাফাতের পথে অগ্রসর হন এবং ‘নামিরাহ্’-এ অবতরণ করেন। উল্লেখ্য, এ স্থানেই মহানবী (সা.)-এর জন্য তাঁবু স্থাপন করা হয়েছিল। ঐ মহতী মহাসমাবেশে মহানবী (সা.) উটের পিঠে আসীন অবস্থায় তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ দান করেন। আর এ ঐতিহাসিক ভাষণই ‘বিদায় হজের ভাষণ’ নামে খ্যাতি লাভ করে।
বিদায় হজে মহানবী (সা.)-এর ঐতিহাসিক ভাষণ
মহানবী (সা.) আরাফাতের ময়দানে এক লক্ষ মানুষের সাথে যুহর ও আসরের নামায আদায় করেন। এরপর তিনি উটের পিঠে আরোহণ করে ঐ দিন তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন। অত্যন্ত বলিষ্ঠ ও উচ্চকণ্ঠের অধিকারী তাঁর সাহাবীরা তাঁর ভাষণ পুনরাবৃত্তি করে দূরবর্তী লোকদের কর্ণগোচর করেছিলেন।
মহানবী (সা.) তাঁর এ ভাষণে প্রথমেই নিজের পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়ার ইঙ্গিত দেন। এরপর তিনি মুসলমনাদেরকে বিভিন্ন বিষয়ে দিকনির্দেশনা দেন। প্রতিটি মুসলমানের ধন-সম্পদ ও জীবন সম্মানিত বলে ঘোষণা করেন। জাহেলিয়াতের যুগে যেসব রক্ত ঝরানো হয়েছে সেগুলোর প্রতিশোধ গ্রহণ থেকে বিরত থাকতে বলেন। আমানত তার প্রকৃত মালিকের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন। সুদকে হারাম করেন। অত্যাচার করা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেন। বারো মাসের মধ্যে যিলকদ, যিলহজ, মুহররম এবং রজব- এ চারটি মাসকে মহান আল্লাহ্ হারাম করেছেন বলে ঘোষণা করেন। স্ত্রীদের অধিকারের দিকে খেয়াল রাখতে বলেন। পথভ্রষ্টতা থেকে দূরে থাকার জন্য আল্লাহর কিতাব ও নিজ আহলে বাইতকে আঁকড়ে ধরার কথা বলেন।
১০ যিলহজ মহানবী মিনার উদ্দেশে রওয়ানা হলেন এবং কঙ্কর নিক্ষেপ, কুরবানি এবং তাকসীর ইত্যাদি সম্পন্ন করে হজের অন্যান্য আচার-অনুষ্ঠান ও কাজ আঞ্জাম দেয়ার জন্য পবিত্র মক্কা গমন করেন। আর এভাবে তিনি জনগণকে হজের আচার-অনুষ্ঠান এবং বিধানসমূহ শিক্ষা দেন।
হাদীসবিদগণের মধ্যে প্রসিদ্ধ অভিমত হচ্ছে এই যে, মহানবী (সা.) আরাফাতের দিবসে (৯ যিলহজ) তাঁর এ ভাষণ প্রদান করেছিলেন। তবে কতিপয় মুহাদ্দিস ও ঐতিহাসিক বিশ্বাস করেন, মহানবী (সা.) ১০ যিলহজ এ ভাষণ দিয়েছিলেন।
গাদীরে খুমের মহাঘটনা
হজের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হলো। মুসলমানরা মহানবীর কাছ থেকে হজের আমলসমূহ শিখে নেন। এ সময় মহানবী পবিত্র মদীনার উদ্দেশে পবিত্র মক্কা ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন। মদীনা অভিমুখে যাত্রার নির্দেশ দেওয়া হলো। কাফেলাসমূহ জুহ্ফার তিন মাইলের মধ্যে অবস্থিত ‘রাবুঘ’ নামক স্থানে পৌঁছলে ওহীর ফেরেশতা হযরত জিবরাইল আমীন (আ.) ‘গাদীরে খুম’ নামক স্থানে মহান আল্লাহর পক্ষ হতে একটি আয়াত নিয়ে অবতরণ করেন। আয়াতটি হলো :
ক্সক্স
আপনার প্রভুর পক্ষ থেকে আপনার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে, তা প্রচার করুন; আর যদি আপনি তা না করেন, তা হলে আপনি তাঁর রিসালাতই (যেন) প্রচার করেন নি এবং মহান আল্লাহ্ আপনাকে জনগণের অনিষ্টতা থেকে রক্ষা করবেন।… (সূরা মায়েদাহ্ : ৬৭)
মহানবী (সা.) যাত্রা বিরতির নির্দেশ দিলেন। যাঁরা কাফেলার সম্মুখভাগে ছিলেন তাঁদেরকে থামানো হলো এবং যাঁরা কাফেলার পেছনে ছিলেন তাঁরা এসে তাঁদের সাথে মিলিত হলেন। সেদিন দুপুর বেলা তীব্র গরম পড়েছিল। জনতা তাদের বহিরাবরণের একটি অংশ মাথার উপর এবং আরেকটি অংশ পায়ের নিচে রেখেছিল। মহানবী (সা.)-এর জন্য একটি শামিয়ানা তৈরি করা হলো। তিনি জামাআতে যুহরের নামায আদায় করলেন। এরপর জনতা তাঁর চারপাশে সমবেত হলে তিনি একটি উঁচু জায়গার উপর গিয়ে দাঁড়ালেন যা উটের হাওদা দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল। তিনি বলিষ্ঠ কণ্ঠে ভাষণ দিলেন।
গাদীরে খুমে মহানবী (সা.)-এর ভাষণ
মহানবী (সা.) প্রথমে মহান আল্লাহ্র একত্ববাদের সাক্ষ্য দেন, তাঁর প্রশংসা করেন এবং যাবতীয় মন্দ কাজ থেকে তাঁর কাছে আশ্রয় কামনা করেন। তিনি তাঁর উপর অর্পিত রিসালাতের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেছেন কিনা সে ব্যাপারে উপস্থিত জনতা হতে সাক্ষ্য গ্রহণ করেন।
এরপর মহানবী (সা.) সকলকে জিজ্ঞাসা করেন : ‘তোমরা কি সাক্ষ্য দেবে যে, বিশ্বজগতের মাবুদ এক-অদ্বিতীয় এবং মুহাম্মাদ আল্লাহ্র বান্দা এবং তাঁর রাসূল; পরকালে বেহেশত, দোযখ এবং চিরস্থায়ী জীবনের ব্যাপারে কোনো দ্বিধা ও সন্দেহ নেই?’ তখন সবাই বললেন : ‘এসব সত্য এবং আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি।’
অতঃপর তিনি বললেন : ‘হে লোকসকল! আমি দু’টি মূল্যবান জিনিস তোমাদের মাঝে রেখে যাচ্ছি। আমরা দেখব, তোমরা আমার রেখে যাওয়া এ দু’টি স্মৃতিচিহ্নের সাথে কেমন আচরণ কর?’ ঐ সময় একজন দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করেন : ‘এ দুটি মূল্যবান জিনিস কী?’ মহানবী বললেন : ‘একটি মহান আল্লাহ্র কিতাব (পবিত্র কুরআন), যার এক প্রান্ত মহান আল্লাহ্র হাতে এবং অপর প্রান্ত তোমাদের হাতে আছে এবং অপরটি আমার বংশধর (আহ্লে বাইত)। মহান আল্লাহ আমাকে জানিয়েছেন, এ দুই স্মৃতিচিহ্ন কখনো পরস্পর বিচ্ছিন্ন হবে না।’
এরপর তিনি সমবেত লোকদেরকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন : ‘হে লোকসকল! পবিত্র কুরআন ও আমার বংশধর থেকে অগ্রগামী হয়ো না এবং কার্যত এতদুভয়ের প্রতি অবহেলা প্রদর্শন করো না; এর অন্যথা করলে তোমরা ধ্বংস হয়ে যাবে।’
এ সময় মহানবী (সা.) আলী (আ.)-এর হাত উঁচু করে ধরেন এবং আলী (আ.)-কে উপস্থিত জনতার কাছে পরিচয় করিয়ে দেন। এরপর তিনি জিজ্ঞেস করেন : ‘মুমিনদের চেয়ে তাদের নিজেদের ওপর কে সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত?’ তখন সবাই জবাব দিলেন : ‘মহান আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসূলই ভালো জানেন।’ মহানবী তখন বললেন : ‘মহান আল্লাহ্ আমার মাওলা এবং আমি মুমিনদের মাওলা; আর আমি তাদের নিজেদের ওপর তাদের চেয়ে বেশি অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত এবং সবচেয়ে যোগ্যতাসম্পন্ন। সুতরাং হে লোকসকল! আমি যার মাওলা, এই আলীও তার মাওলা।’
এরপর তিনি মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন : ‘হে আল্লাহ! যে তাকে (হযরত আলীকে) সমর্থন করবে তাকে তুমিও সমর্থন কর; যে তার সাথে শত্রুতা করবে, তার সাথে তুমিও শত্রুতা কর; যে তাকে ভালোবাসবে, তাকে তুমিও ভালোবাস; যে তাকে ঘৃণা করবে, তাকে তুমিও ঘৃণা কর; যে তাকে সাহায্য করবে, তাকে তুমিও সাহায্য কর এবং যে তাকে সাহায্য থেকে বিরত থাকবে, তাকে তুমিও সাহায্য থেকে বিরত থাক এবং সে যেদিকে ঘোরে, সত্যকেও তার সাথে সেদিকে ঘুরিয়ে দাও।’
মহানবীর ভাষণের পর গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ হযরত আলীর সাথে মুসাফাহা করে তাঁকে অভিনন্দন জানান। সবার আগে হযরত আবু বকর ও হযরত উমর হযরত আলীকে অভিনন্দন জ্ঞাপন করেন এবং শুভেচ্ছা জানান।
সাহাবী কবি হাস্সান ইবনে সাবিত মহানবী (সা.)-এর কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে তৎক্ষণাৎ একটি কবিতা রচনা করেন এবং তা তাঁর সামনে আবৃত্তি করেন। এই কবিতার দু’টি পঙ্ক্তি নিচে তুলে ধরা হলো :
فقال له: قم يا علىّ، فإنّنِى رضيتك من بعدى إماما وهاديا
فمن كنت مولاه فهذا وليّه فكونوا له أَتـبـاع صدق موالـيا
‘অতঃপর তিনি তাঁকে বললেন : হে আলী! উঠে দাঁড়াও।
কারণ, আমি তোমাকে আমার পরে ইমাম (নেতা) ও পথপ্রদর্শক মনোনীত করেছি।
অতএব, আমি যার মাওলা (অভিভাবক ও কর্তৃপক্ষ), সেও তার ওয়ালী।
তাই তোমরা সবাই তার সত্যিকার সমর্থক ও অনুসারী হয়ে যাও।’
গাদীরে খুমের ঘটনার চিরস্থায়িত্ব
গাদীরে খুমের ঐতিহাসিক ঘটনা সর্বকাল ও সর্বযুগে এক জীবন্ত ইতিহাস রূপে বিদ্যমান। মুসলিম লেখক ও গ্রন্থ রচয়িতাগণ তাঁদের প্রণীত গ্রন্থসমূহে এ ব্যাপারে আলোচনা করেছেন এবং একে ইমাম আলী (আ.)-এর অন্যতম ফযীলত ও শ্রেষ্ঠত্ব বলে গণ্য করেছেন। গাদীরে খুমের ঘটনা মুহাদ্দিস, মুফাস্সির, কালামশাস্ত্রবিদ, দার্শনিক, ঐতিহাসিক ও জীবনচরিত রচয়িতাগণের মতো বিভিন্ন শ্রেণির মনীষীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে এবং তাঁরা এ ব্যাপারে অতিশয় গুরুত্ব প্রদান করেছেন- যা অন্য কোনো ঘটনার ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যায় না।
এ ঐতিহাসিক ঘটনার গুরুত্ব তুলে ধরার ক্ষেত্রে এতটুকু উল্লেখ করাই যথেষ্ট যে, মহানবী (সা.)-এর ১১০ জন সাহাবী এই ঘটনা বর্ণনা করেছেন। হিজরি দ্বিতীয় শতকে তাবেয়িগণের যুগেও ৮৯ জন তাবেয়ী এ হাদীস বর্ণনা করেছেন। পরবর্তী শতকসমূহেও হাদীসে গাদীরের বর্ণনাকারিগণের সংখ্যা অনেক। তাঁদের মধ্য থেকে ৩৬০ জন তাঁদের নিজ নিজ গ্রন্থে এ হাদীসটি সংকলন করেছেন এবং অনেকেই এ প্রসঙ্গে বর্ণিত অনেক হাদীসের বিশুদ্ধতা ও সঠিক (সহীহ) হবার বিষয়টি স্বীকার করেছেন।
হিজরি তৃতীয় শতকে ৯২ জন আলেম, চতুর্থ শতকে ৪৩ জন, পঞ্চম শতকে ২৪ জন, ষষ্ঠ শতকে ২০ জন, সপ্তম শতকে ২১ জন, অষ্টম শতকে ১৮ জন, নবম শতকে ১৬ জন, দশম শতকে ১৪ জন, একাদশ শতকে ১২ জন, দ্বাদশ শতকে ১৩ জন, ত্রয়োদশ শতকে ১২ জন এবং চতুর্দশ শতকে ২০ জন আলেম এ হাদীস বর্ণনা করেছেন।
আলেমগণের কেউ কেউ কেবল এ হাদীস বর্ণনা করেই ক্ষান্ত হন নি; বরং এ হাদীসের সনদ এবং এর অন্তর্নিহিত অর্থ নিয়ে স্বতন্ত্র গ্রন্থও রচনা করেছেন।
প্রখ্যাত মুসলিম ঐতিহাসিক তাবারী ‘আল ওয়ালায়াহ্ ফী তুরুকি হাদীসিল গাদীর’ নামে একখানা গ্রন্থ রচনা করেছেন এবং এ হাদীস মহানবী (সা.) থেকে ৭২টি সূত্রে বর্ণনা করেছেন। ইবনে উকদাহ্ কুফী ‘বেলায়াত’ নামক সন্দর্ভে এ হাদীস ১০৫ জন রাবী থেকে বর্ণনা করেছেন। আবু বকর মুহাম্মাদ ইবনে উমর বাগদাদী এ হাদীস ২৫টি সূত্রে বর্ণনা করেছেন।
হাদীসশাস্ত্রবিদগণের মধ্য থেকে আহমাদ ইবনে হাম্বাল এ হাদীস ৪০টি সূত্রে, ইবনে হাজার আসকালানী ২৫টি সূত্রে, জাযারী শাফেঈ ২৫টি সূত্রে, আবূ সাঈদ সুজিস্তানী ১২০টি সূত্রে, আমীর মুহাম্মদ ইয়েমেনী ৪০টি সূত্রে, নাসাঈ ২৫০টি সূত্রে, আবুল আলা হামাদানী ১০০টি সূত্রে এবং আবুল ইরফান হিব্বান ৩০টি সূত্রে বর্ণনা করেছেন।
যেসব ব্যক্তি এ মহান ঐতিহাসিক ঘটনার বৈশিষ্ট্যসমূহ সংক্রান্ত বই-পুস্তক রচনা করেছেন তাঁদের সংখ্যা ২৬। আল্লামা আয়াতুল্লাহ্ আমীনী এ ঐতিহাসিক ঘটনা সম্পর্কে ‘আল গাদীর’ নামে একটি মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেছেন।