সোমবার, ৯ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২৪শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

‘বাংলাদেশে ফারসি শিক্ষায় করোনা মহামারির প্রভাব’

পোস্ট হয়েছে: জানুয়ারি ৯, ২০২১ 

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বাহাউদ্দিন-

[গত ১৫-১৬ ডিসেম্বর ২০২০ ইরানের তেহরানে অনুষ্ঠিত ‘বিশ্বে ফারসি ভাষার শিক্ষা ও প্রসার : করোনা মহামারির প্রভাব’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বাহাউদ্দিন আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে যে বক্তব্য তুলে ধরেন নিউজলেটারের পাঠকবর্গের জন্য তা বাংলায় অনুবাদ করে নি¤েœ উপস্থাপিত হলো।]
বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর এদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। আজ আমাদের সেই বিজয় দিবস; এ উপলক্ষে আমি আপনাদের সকলকে আমার দেশের পক্ষ থেকে অভিনন্দন জানাই।
আপনারা জেনে খুশি হবেন, বাংলাদেশ ফারসি শিক্ষার জন্য এক উর্বর ভূমি। বাংলা ভাষা বহু ফারসি শব্দ ধারণ করে শক্তিশালী ও গতিশীল হয়েছে। অনুরূপভাবে এতদঞ্চলের কবি-সাহিত্যিকদের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্য ফারসি সাহিত্যের অনেক উপাদান গ্রহণ করে সমৃদ্ধ ও উপকৃত হয়েছে। প্রায় দশ থেকে বার হাজার ফারসি শব্দ বাংলা ভাষার সাথে ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে। একইভাবে বাঙালি কবিদের উপর ফারসি কবিদের অবিশ্বাস্য প্রভাব রয়েছে। তাই আমরা বলি, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের রয়েছে ব্যাপক অবদান। এতদ্ব্যতীত বাংলা ও ফারসির পার¯পরিক ঘনিষ্ঠ মেলবন্ধন বঙ্গীয় অঞ্চলে হাজার বছর ধরে অব্যাহত রয়েছে।
বাংলাদেশে মোটাদাগে দুই ধরনের শিক্ষা-ব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে। একটি সাধারণ শিক্ষা-ব্যবস্থা আর অন্যটি ধর্মীয় শিক্ষা-ব্যবস্থা। ফারসি ভাষা ও সাহিত্য এতদুভয় পদ্ধতির শিক্ষা-ব্যবস্থাতেই পড়ানো হয়ে থাকে। অর্থাৎ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, যেমন দ্বীনি মাদ্রাসাসমূহ এবং দ্বিতীয়ত, দেশের সরকারি শিক্ষা-ব্যবস্থায়; যেমন, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ। আমরা বলতে পারি, উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশে ফারসির রয়েছে এক অনবদ্য ঐতিহ্য; যা আমাদের জন্য খুবই গৌরবের। সেটি হলো, দেশের সর্বপ্রাচীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফারসি ভাষা ও সাহিত্য অধ্যয়ন ও চর্চা; বর্তমানে এ বিশ্ববিদ্যালয় তার শতবর্ষ উদ্যাপন করছে। ১৯২১ সালের ১ জুলাই যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার ঐতিহাসিক যাত্রা শুরু করে তখন থেকেই ফারসি বিভাগ ছিল; যাতে অনার্স ও মাস্টার্স পর্যায়ে ফারসি পড়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়। পরবর্তীকালে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তানের এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ও উর্দু বিভাগে উর্দুর প্রাধান্য চলে আসে। কিন্তু বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হলে আবারো ফারসির পুরনো ঐতিহ্য ফিরে আসতে থাকে এবং ১৯৭৯ সালে ইরানের ইসলামি বিপ্লব বিজয়ের পর থেকে ইরানের ঢাকাস্থ দূতাবাস ও কালচারাল সেন্টারের সর্বাত্মক সহযোগিতায় সর্বতোভাবে ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা, শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে এক নবজোয়ার বইতে থাকে। উল্লেখ্য যে, ১৯৩৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়; যা ফারসি ভাষার মাতৃপ্রতিম দেশ ইরানের সর্বপ্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়। সেদিক বিবেচনায় বলতে পারি, এটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ যে, উচ্চশিক্ষায় ফারসির যাত্রা ইরানের আগেই আমাদের এই বাংলায় শুরু হয়েছিল!
বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর পর্যায়ে শিক্ষা ও গবেষণার জন্য ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় তিনটি হলো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। এ বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে বিএ, এমএ, এমফিল ও পিএইচডি পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা অর্জনের ব্যবস্থা রয়েছে। দেশের তিনটি সরকারি আলিয়া মাদ্রাসা, যথাক্রমে মাদ্রাসা-ই আলিয়া, ঢাকা, সিলেট সরকারি আলিয়া মাদ্রাসা ও বগুড়া সরকারি মুস্তাফাবিয়া আলিয়া মাদ্রাসার সিলেবাসে ফারসি ভাষা ও সাহিত্য রয়েছে এবং বেসরকারি কওমি মাদ্রাসায়ও ফারসি অধ্যয়নের সুযোগ রয়েছে। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটেও ফারসি ভাষা কোর্স চালু আছে। এসব শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে হাজার হাজার শিক্ষার্থী ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে পড়াশোনায় নিয়োজিত রয়েছে। কিন্তু করোনা মহামারির কবলে পড়ে সমগ্র দেশের গোটা শিক্ষাব্যবস্থাই এক ভয়াবহ অনিশ্চয়তার মধ্যে পতিত হয়েছে।
আপনাদের সদয় অবগতির জন্য জানাই, গত ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। ১৭ মার্চ ২০২০ হতে দেশের সমস্ত শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান সরকারিভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হয়; আজ পর্যন্ত সেগুলো খোলার পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি। প্রাথমিক পর্যায়ে কিছুদিন আমরা করোনা পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছি। এসময় প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সকল ক্লাস ও পরীক্ষা কার্যক্রম বন্ধ থাকে। পরবর্তীতে মে এবং জুন মাস হতে আমরা অনলাইন ক্লাস কার্যক্রম শুরু করি আর এভাবেই করোনা মহামারিতে দেশের ফারসি পরিবারও যথারীতি তাদের শিক্ষা কার্যক্রমে নিজেদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে। দেশব্যাপী চলমান মহামারিতে ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক, শিক্ষার্থীরা তাদের অ্যাকাডেমিক জীবন সচল রাখতে আন্তরিকভাবে সচেষ্ট থাকেন। এক্ষেত্রে আমাদের ছাত্র-শিক্ষকদের সামনে অনেক সমস্যা এসে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। আমরা সেগুলোর সমাধানে সাধ্যমতো আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখি।
বাংলাদেশে ফারসি শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে গত মার্চ থেকে ডিসেম্বরের প্রথম দশক পর্যন্ত শুধু জুম ও অনলাইনে নানা মাধ্যমে ক্লাসসমূহ চালু ছিল। কিন্তু সমস্ত পরীক্ষা কার্যক্রম বন্ধ ছিল। গত এক সপ্তাহে দেশের প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্তৃপক্ষ পরিকল্পিত উপায়ে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে স্থগিত পরীক্ষাগুলো অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এক্ষেত্রেও নানা প্রতিবন্ধকতা ও চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এর মধ্যে প্রথমেই ভাববার বিষয় হলো, দেশের নানা প্রান্ত হতে শিক্ষার্থীরা
বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিতে এসে কোথায় অবস্থান করবে এবং দ্বিতীয়ত, করোনা মহামারির এই দুঃসময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলসমূহ খোলা ঠিক হবে কি-না। এসব বিষয় খুব ভেবে-চিন্তে সিদ্ধান্ত নেয়া অতি জরুরি। কেননা, আমাদের দেশে করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের হার এখনো কমছে না, বরং শীতের প্রকোপে তা আরো বেড়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে পরীক্ষা নেয়াও জরুরি, কেননা, শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা ও রেজাল্ট শেষে তাদের পেশাগত কর্মজীবনে প্রবেশ করবে। এসব অত্যাবশ্যকীয় বিষয়ে সময়োচিত সমাধানকল্পেই এখন আমরা সাবধানে কাজ করে যাচ্ছি।
একটি বিষয় আপনাদের সদয় অবগতির জন্য উল্লেখ করতে চাই যে, হঠাৎ করে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে আমাদের অনেক শিক্ষার্থীই আর্থিকভাবে সমস্যায় পড়ে যায়। আমরা শুরুতেই বিপদাপন্ন শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছি এবং তাদেরকে সাধ্যমতো আর্থিক সহায়তা প্রদান করেছি।
অতঃপর অনলাইন ক্লাসে অংশগ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করেছি। আমাদের দেশের শিক্ষা মন্ত্রণালয়, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন ও বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ অভাবী ও দরিদ্র শিক্ষার্থীদের সহায়তায় এগিয়ে এসেছে এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এতে করে শিক্ষার্থীদের পরিবারের উপর আর্থিক চাপ অনেকটাই কমে যায় এবং এরকম প্রতিকূল পরিবেশেও তারা শিক্ষা কার্যক্রমে নিজেদের সংযুক্ত রাখতে সক্ষম হয়; যদিও আমরা আমাদের শিক্ষার্থীদের চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় শিক্ষা-সামগ্রী সরবরাহ করতে পারিনি, কেননা, আমাদেরও নানা সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান ফারসি ভাষা ও সাহিত্য পরিবারের জন্য মাতৃপ্রতিম দেশ। একইভাবে জ্ঞানচর্চা, মেধার বিকাশ ও সংস্কৃতির লালনের ক্ষেত্রেও ইরান আমাদের সুযোগ্য অভিভাবক ও পৃষ্ঠপোষক। আমাদের দেশে যে কোনো কারণে ফারসি ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির শিক্ষা বিপদাপন্ন হলে ইরান আমাদের পাশে থাকবে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা। অতীতে সবসময়ই আমরা ইরানের কাছ থেকে গবেষণা ও শিক্ষা-বিষয়ক সহযোগিতা পেয়েছি, এজন্য আমরা গভীর কৃতজ্ঞ। বর্তমানে
করোনা মহামারিতে আমাদের ফারসি শিক্ষার্থীরা অনেকটাই বিপদগ্রস্ত, এক্ষেত্রেও ইরানি জাতি আমাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়াবে; এটা আমাদের বিশ্বাস। আমাদের দেশে ইরানি কালচারাল সেন্টার ও দূতাবাস রয়েছে এবং যোগ্য ও পদস্থ ব্যক্তিবর্গ সেখানে তাঁদের পেশাগত দায়িত্ব অত্যন্ত দক্ষতার সাথে পালন করে যাচ্ছেন। তাঁদের প্রতিও আমাদের দৃঢ় আস্থা রয়েছে, বিপদসঙ্কুল এ পরিস্থিতিতে মহান ইরানি জাতির পক্ষ থেকে তাঁরা বরাবরের মতোই আমাদের প্রিয় শিক্ষার্থীদের পাশে
থাকবেন।
সমগ্র বিশ্ব করোনা ভাইরাস থেকে মুক্ত হোক। বিশ্বমানবতা পরিত্রাণ লাভ করুক। মর্যাদাপূর্ণ এ আন্তর্জাতিক সেমিনারে আমাকে দাওয়াত দেয়ায় সম্মানিত আয়োজকদের প্রতি জানাই অজস্র ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা। বাংলাদেশ ও ইরানের বন্ধুত্ব ও স¤পর্ক দীর্ঘস্থায়ী হোক। সবাইকে ধন্যবাদ। খোদা হাফেজ!