বরকতময় মাসসমূহ ও মহানবীর পরিবার
পোস্ট হয়েছে: জুলাই ২৫, ২০১৯
মো. আশিফুর রহমান –
রজব, শাবান ও রমযান- এ তিনটি মাস এমন বরকতময় ও ফযিলতের মাস যে সম্পর্কে হাদিসে অনেক বর্ণনা এসেছে। হাদিসে রজব মাসকে ‘আল্লাহর মাস’, শাবান মাসকে ‘মহানবীর মাস’ ও রমযান মাসকে ‘উম্মতের মাস’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ তিনটি মাস মহানবী (সা.)-এর আহলে বাইতের সাথেও সম্পৃক্ত, কেননা, এ মাসগুলোতে মহানবীর পরিবারের বেশ কিছু সংখ্যক সদস্য জন্মগ্রহণ করেন। সেসব মহান ব্যক্তির মধ্য হতে কয়েকজন সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা উপস্থাপন করা হলো।
ইমাম হাসান (আ.)
ইমাম হাসান (আ.) তৃতীয় হিজরির ১৫ রমজানে পবিত্র নগরী মদিনাতে জন্মগ্রহণ করেন। ইমাম আলী (আ.) ও হযরত ফাতিমা যাহরা (সা. আ.)-এর প্রথম সন্তান। ইমাম হাসান (আ.)-এর উপনাম হচ্ছে ‘আবু মুহাম্মাদ’। ইমাম হাসান (আ.)-এর উপাধিগুলো হলো ত্যাইয়েব, ত্বাকী, সিবত, জাকী, সাইয়্যেদ, ওলী ও মুজতাবা।
ইমাম হাসান (আ.) দেখতে হুবহু মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর মতো ছিলেন এবং তাঁর সুন্দর ও অপরূপ চেহারা দেখে জনগণের হৃদয় শান্ত হতো এবং তাঁরা সকলেই মহানবীর কথা স্মরণ করতেন।আনাস বিন মালেক বলেন :‘হাসান ইবনে আলী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর সবচেয়ে বেশি সদৃশ ছিলেন।’- কাশফুল গুম্মাহ ফি মা’রেফাতিল আইম্মাহ, ১ম খ-, পৃ. ৫২২
খুব ছোটবেলা থেকে হাসান ইবনে আলী (আ.) মহানবী (সা.)-এর মজলিশে অংশগ্রহণ করতেন এবং ওহীর বিষয়বস্তুসমূহ মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করতেন এবং সেগুলো মুখস্থ করতেন। পরে তাঁর মায়ের নিকট এসে সেগুলো বর্ণনা করতেন। যখন হযরত আলী (আ.) ঘরে ফিরতেন, তখন দেখতেন যে, মসজিদে মহানবী (সা.) যে বিষয়গুলো বলেছেন সে সম্পর্কে হযরত ফাতিমা (সা. আ.) অবগত রয়েছেন এবং সকল খুঁটিনাটি বিষয় জানতেন; আলী (আ.) তাঁর নিকট জিজ্ঞাসা করতেন : ‘এগুলো তুমি কীভাবে জেনেছ?’ ফাতিমা (সা. আ.) উত্তরে বলতেন : ‘আপনার সন্তান হাসানের মাধ্যমে আমি অবগত হয়েছি।’
পবিত্র কুরআনের সাথে ইমাম হাসানের অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ছিল। বিশেষ করে সূরা কাহ্ফের প্রতি তাঁর অন্যরকম আকর্ষণ ছিল। যাহাবী হতে বর্ণিত হয়েছে, ইমাম হাসান (আ.) ঘুমানোর জন্য যখনই বিছানায় যেতেন, তখনই সূরা কাহ্ফতিলাওয়াত করতেন।- ইহকাকুল হাক্ক, ১১ নং খ-, (মালহাক্কাত) পৃ. ১১৪, সিরা আয়লামুল নাবলায় গ্রন্থ হতে।
হযরত ইমাম হাসান ইবনে আলী (আ.) একনিষ্ঠভাবে আল্লাহ তাআলার ইবাদত করতেন।
ইমাম হাসান যখনই আজানের ধ্বনি শুনতেন, তখনই তাঁর চেহারা পরিবর্তন হয়ে যেত এবং তাঁর রং হলুদ বর্ণ হয়ে যেত। এ বিশেষ পরিবর্তনের বিষয়ে তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন : ‘নিঃসন্দেহে মহান আল্লাহ তাঁর বার্তা বাহককে আমার নিকট প্রেরণ করেন এবং আমাকে তাঁর বিশেষ সেবার (নামাযের) জন্য আহ্বান জানান। আমি জানি না, মহান আল্লাহ এ সেবাকে (নামায) গ্রহণ করবেন, কি করবেন না। তাহলে কেন আমার চেহারার রং পরিবর্তন হবে না?’- সারহে রিসালাতুল হুকুক, ইমাম যাইনুল আবেদীন (আ.), কাবাঞ্চি রচিত, ২য় খ-, পৃ. ৮৪
ওযূ করার সময়ও ইমাম হাসানের চেহারার রং পরিবর্তন হয়ে যেত। এ বিষয়ে তিনি বলতেন : ‘‘আরশের মালিক আল্লাহর নিকট যে ব্যক্তি প্রবেশের সিদ্ধান্ত নেয়, তার চেহারার রং পরিবর্তন হওয়াই উত্তম।’- ইদ্দাতুদ দায়ী, ইবনে ফাহাদ হিল্লী, পৃ. ১৩৯
ইমাম হাসানের ইবাদতসমূহের অন্যতম হচ্ছে আল্লাহর ঘর যিয়ারত ও হজ পালন। রেওয়ায়েত অনুযায়ী ইমাম হাসান পঁচিশ বার পায়ে হেঁটে আল্লাহর ঘর (ক্বাবা শরিফ) যিয়ারত করেছেন।
ইমাম হাসান (আ.) ছিলেন অত্যধিক দানশীল, তিনি অভাবীদেরকে কখনই খালি হাতে ফিরিয়ে দিতেন না। কোন ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি তাঁর শরণাপন্ন হলে তিনি সেই ঋণ শোধ করে দিতেন, তিনি অসুস্থদেরকে দেখতে যেতেন, উত্তম কাজের প্রতিদান হিসেবে দাস মুক্ত করে দিতেন। তাঁর বিরোধীদের প্রতিও তিনি দয়া প্রদর্শন করতেন। তাদের অত্যাচারের মোকাবেলায় ধৈর্য ধারণ করতেন ও তাদের জন্য মহান আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতেন। তিনি সৎকর্মশীলদের কর্মের প্রশংসা করতেন।
ইমাম হাসান (আ.) একজন সাহসী ও বীর যোদ্ধা ছিলেন। ইমাম আলী (আ.)-এর খেলাফতকালে জঙ্গে জামালে তাঁর সাহসিকতা ও বীরত্বের কারণেই যুদ্ধ দ্রুত শেষ হয়ে যায়; তিনি জঙ্গে সিফফিন ও জঙ্গে নাহরাওয়ানেও সাহসিকতা ও বীরত্ব প্রদর্শন করেন।
নিজ খেলাফতকালে ইমাম হাসান (আ.) নানা সমস্যার মোকাবিলা করেন। আমীরে মুয়াবিয়া তাঁর খেলাফত মেনে নিতে অস্বীকার করে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হলে ইমাম হাসানও যুদ্ধের জন্য বের হন। কিন্তু নিজ সেনাপতি ও সৈন্যদের বিশ^াসঘাতকতা ও মুয়াবিয়ার চক্রান্তের ফলে তিনি তার সাথে সন্ধি করেন। সন্ধি চুক্তি করার মাধ্যমে ইমাম হাসান (আ.) সামাজিক ও রাজনৈতিক সফলতা অর্জন করেছেন। এ সন্ধির মাধ্যমে তিনি মুসলমানদেরকে নিশ্চিহ্ন হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করেন। অপরদিকে মুয়াবিয়ার প্রকৃত রূপ সকলের নিকট স্পষ্ট হয়ে যায়।
ইমাম হাসান (আ.)-এর মাযার মদিনার জান্নাতুল বাকীতে অবস্থিত।
ইমাম হোসাইন (আ.)
ইমাম হোসাইন (আ.) ৪র্থ হিজরির ৩ শাবান পবিত্র মদিনায় জন্মগ্রহণ করেন। মহানবী (সা.)-এর মুখম-লের সাথে ইমাম হাসানের মুখম-ল এবং তাঁর দৈহিক গঠনের সাথে ইমাম হোসাইনের দৈহিক গঠনের সাদৃশ্য ছিল। এজন্য হযরত আলী বলেছেন :‘কেউ যদি মহানবীকে দেখে খুশি হতে চায় তাহলে তার উচিত হাসান ও হোসাইনকে দেখা। কারণ, মহানবীর সাথে এ দু’জনেরই সবচেয়ে বেশি দৈহিক ও আকৃতিগত সাদৃশ্য রয়েছে।’
ইমাম হোসাইনের উপনাম ছিল আবু আবদিল্লাহ। মহানবী তাঁকে ‘বেহেশতের যুবকদের নেতা’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন।
ইমাম হোসাইন (আ.) বাল্যকালেই ইসলামি কর্মকা-ে আত্মনিয়োগ এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি তাঁর পিতা ইমাম আলী ইবনে আবি তালিব (আ.)-এর সাথে তিনটি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।যখন তাঁর ভাই ইমাম হাসান (আ.) ইমাম হন তখন তিনি সর্বাবস্থায় তাঁকে মান্য করেন ও তাঁর অনুসরণ করেন। ইমাম হাসানের শাহাদাতের পর তাঁর ভূমিকা একটি নতুন পর্যায়ে উপনীত হয়।
ইমাম হাসান কর্তৃক মুয়াবিয়ার সাথে কৃত সন্ধির শর্ত মোতাবেক ইমাম হোসাইন (আ.) মুয়াবিয়ার শাসনামলে তার বিরোধিতা করেন নি। কিন্তু মৃত্যুর পূর্বেই মুয়াবিয়া তার ফাসেক পুত্র ইয়াযীদকে খলিফা হিসেবে ঘোষণা ও তার পক্ষে বাইআত দাবি করলে ইমাম হোসাইন তা অস্বীকার করেন। ইয়াযীদ খলিফা হওয়ার পর প্রকাশ্যে ইসলামবিরোধী কর্মকা- অব্যাহত রাখলে এবং ইমাম হোসাইন (আ.)-এর আনুগত্য দাবি করলে ইমাম হোসাইন (আ.) তাঁর আন্দোলন শুরু করেন। আন্দোলনের এক পর্যায়ে কুফাবাসীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে তিনি কুফার দিকে যাত্রা করেন। পথিমধ্যে ইয়াযীদের বাহিনী কর্তৃক বাধাপ্রাপ্ত হয়ে কারবালায় উপনীত হন। অবশেষে ইসলামকে পুনরুজ্জীবিত করতে ৬১ হিজরির ১০ মুহররম কারবালায় একটি অসম যুদ্ধে অবতীর্ণ হন এবংপরিবার-পরিজন ও বন্ধু-বান্ধবসহ তিনি নিজেকে উৎসর্গ করেন।
ইমাম হোসাইন (আ.) ছিলেন সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার অবিসংবাদিত নেতা। তিনি ছিলেন মহানুভবতার প্রতীক- অন্যের দুঃখ-কষ্ট লাঘবে নিবেদিতপ্রাণ। যিনি মানুষের সাথে কোমল আচরণ করতেন, আত্মীয়দের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতেন, দুর্বলদেরকে সহায়তা করতেন, ঋণগ্রস্তদের ঋণ মওকুফ করে দিতেন। যিনি ছিলেন অভাবীদের প্রতি দয়ালু ও ইয়াতীমদের প্রতি সচেতন। সর্বোপরি ইমাম হোসাইন (আ.) ছিলেন ধৈর্য, অবিচলতা, সাহসিকতা ও বীরত্বের অতুলনীয় দৃষ্টান্ত।
হযরত যায়নাব বিনতে আলী (আ.)
হযরত যায়নাব (আ.) ৫ম (মতান্তরে ৬ষ্ঠ) হিজরির ৫ শাবান পবিত্র মদিনা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন হযরত আলী (আ.) ও হযরত ফাতিমা (আ.)-এর তৃতীয় সন্তান। মহানবী (সা.) তাঁর নাম রাখলেন ‘যায়নাব’ যার অর্থ হলো ‘পিতার সৌন্দর্য’। হযরত যায়নাব (আ.)-এর প্রসিদ্ধ উপাধিগুলো আলেমাহ গায়রু মুয়াল্লিমাহ, ফাদ্বিলাহ, কামিলাহ ইত্যাদি।
হযরত যায়নাবের শৈশবকাল মহানবী (সা.), হযরত আলী, হযরত ফাতেমা ও তাঁর দুই ভাইয়ের সান্নিধ্যে অতিবাহিত হয়। মাত্র ছয় বছর বয়সে হযরত যায়নাব তাঁর নানা ও পরম মমতাময়ী মাতাকে হারান। এরপর হযরত আলী তাঁকে সযতেœ প্রতিপালন করেন। হযরত যায়নাব (আ.) রাসূলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর আহলে বাইতের সদস্যদের সরাসরি তত্ত্বাবধানে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। পুণ্যময় জীবন যাপন, ইবাদতে নিষ্ঠা, সাহসী ও নির্ভীকচিত্ত হওয়া, অত্যাচারের মোকাবেলা, ধৈর্যধারণ ইত্যাদি শিক্ষা লাভ করেন নিজ পরিবার হতে। খুব অল্প বয়সেই হযরত যায়নাব (আ.) বিভিন্ন বিষয়ে পা-িত্য অর্জন করেন।
হযরত যায়নাব (আ.) মদীনায় তাঁর গৃহে নিয়মিত ধর্মীয় ক্লাস চালু করেন। যখন তিনি তাঁর পিতার সাথে কুফায় চলে যান তখন সেখানেও তিনি একইভাবে ধর্মীয় ক্লাস চালু করেন।
হযরত যায়নাব ছিলেন একজন দানশীলা নারী। হযরত যায়নাবের কাছে যখনই কেউ কোন কিছু চেয়েছে সে খালি হাতে ফেরে নি। এমনই ছিল হযরত যায়নাবের দানশীলতা।
হযরত যায়নাব ছিলেন ইবাদতে একনিষ্ঠ। তিনি ইবাদতের এই একাগ্রতা শিক্ষা লাভ করেছিলেন তাঁর মা হযরত ফাতিমাতুয যাহরা (আ.)-এর কাছ থেকে। ধৈর্যশীলতা তাঁর রক্তে মিশে ছিল। নানা মহানবী (সা.), মা হযরত ফাতিমা যাহরা, পিতা ইমাম আলী, বড় ভাই ইমাম হাসানের মৃত্যু তিনি কাছে থেকে দেখেছেন। আর তিনি ছিলেন সেই মহীয়সী নারী যিনি তাঁর শহীদ ভাইদের, সন্তানদের ও পরিবারের অন্য সদস্যদের শরীর কারবালার ময়দানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকতে দেখেও বলেন, ‘আমি সৌন্দর্য ছাড়া আর কিছুই দেখি না।’
হযরতযায়নাব একজন সুবক্তা ছিলেন; একই সাথে তিনি প্রভূত মানসিক শক্তির অধিকারী ও সাহসী ছিলেন। তিনি অত্যাচারীদের ভয়ে কখনই ভীত হন নি। কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনার পর কুফায় উবাযদুল্লাহ ইবনে যিয়াদের দরবারে ও শামে ইয়াযীদের প্রাসাদে হযরত যায়নাব অতুলনীয় সাহসিকতা প্রদর্শন করেন।
হযরত যায়নাব (আ.) মহানবীর আহলে বাইতকে মানুষের সামনে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। তিনি মুসলমানদের সামনে বনু উমাইয়্যার মুখোশ উন্মোচন করে দিয়েছিলেন। তিনিই সকলের সামনে তুলে ধরেন যে, কারবালার ঘটনা কোন ক্ষমতা দখলের লড়াই ছিল না। এটি ছিল ইসলামের প্রতিরক্ষার সংগ্রাম, মানুষের স্বাধীনতা ও মর্যাদার নীতিকে সমুন্নত করার জন্য একটি বীরত্বগাথা, সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের নমুনা।
হযরত যায়নাব ৬২ হিজরিতে ৫৭ বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন। তাঁর মাযার বর্তমান সিরিয়ায় যায়নাবিয়াতে অবস্থিত।
ইমাম আলী ইবনুল হুসাইন যায়নুল আবেদীন (আ.)
ইমাম আলী ইবনুল হুসাইন (আ.) ৩৮ হিজরির ৫ শাবান পবিত্র মদিনায় জন্মগ্রহণ করেন। হযরত আলী (আ.)এই নবজাতকের নাম রাখেন ‘আলী’। ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.)-এর কুনিয়াত বা ডাক নাম হলো আবু মুহাম্মাদ।
ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.) শৈশবের প্রথম কয়েক বছর অতিবাহিত করেন পিতামহ আলী ইবনে আবু তালিবের ¯েœহক্রোড়ে এবং পরবর্তীকালে চাচা ইমাম হাসান ও পিতা ইমাম হুসাইনের কাছে লালিত-পালিত হন। তাঁদের কাছ থেকেই তিনি লাভ করেন ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা।
কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনার সময় ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.) সেখানে উপস্থিত ছিলেন। অসুস্থতার কারণে তিনি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারেননি। সেই কারণে নিহতহওয়া থেকে রেহাই পান।কারবালার ঘটনার পর ইয়াযীদের বর্বর বাহিনীর হাতে ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.) বন্দি হন। নারীদের সাথে তাঁকেও বন্দি করে দামেশকে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে ইয়াযীদের রাজপ্রাসাদে হযরত যায়নাব (আ.) ও হযরত যায়নুল আবেদীন (আ.)-এর ভাষণের প্রতিক্রিয়ায় জনমত বিগড়ে যাবার ভয়ে ইয়াযীদ তাঁদেরকে মদিনায় পাঠিয়ে দিতে বাধ্য হয়।
মদিনায় ফিরেও ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.) চরম নির্যাতনের মধ্যে দিন অতিবাহিত করেন। তাঁর চলাফেরার ওপর আরোপ করা হয় কঠোর নিয়ন্ত্রণ এবং কোন ব্যক্তির সাথে তাঁর সাক্ষাৎ স¤পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়। ইমাম যায়নুল আবেদীনকে তাঁদের অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি জবাব দিয়েছিলেন : ‘আমাদের অবস্থা ফিরআউন বংশীয়দের মাঝে বনু ইসরাইলের ন্যায়- তারা তাদের শিশুদেরকে হত্যা করত এবং তাদের নারীদেরকে ছেড়ে দিত।’
মুসলিম লেখকগণ প্রতিভা, জ্ঞান এবং ধার্মিকতার জন্য ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.)-এর ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।
ইবনে হাজার আসকালানী তাঁর ‘সাওয়ায়েকে মুহরিকাহ’ গ্রন্থে বলেন : ‘যায়নুল আবেদীন হলেন এমন ব্যক্তি যিনি তাঁর পিতার জ্ঞান, দুনিয়াবিমুখতা ও ইবাদত উত্তরাধিকার হিসাবে পেয়েছিলেন।’
ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.) তাঁর পিতার শাহাদাতের পর প্রায় ৩৪ বছর পর্যন্ত জীবিত ছিলেন এবং সমগ্র জীবনকাল নিবেদিতচিত্তে আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগি ও শহীদ পিতার স্মরণের মধ্যে অতিবাহিত করেন। তিনি অধিক পরিমাণ সময় নামায পড়তেন ও সেজদারত থাকতেন বিধায় ‘সাজ্জাদ’ হিসাবে পরিচিতি লাভ করেন।
ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.)-এর দানশীলতা ছিল অসাধারণ। তিনি রাতের বেলা ঘুরে ঘুরে গরীর-দুঃখীদের খোঁজ-খবর নিতেন এবং নিজের পিঠে করে আটার বস্তা ও অন্যান্য খাদ্যসামগ্রী নিয়ে তাদেরকে সাহায্য করতেন। তিনি নিজের শত্রুদেরও প্রয়োজনের মুহূর্তে সাহায্য করতে দ্বিধাবোধ করতেন না; শত্রুদের সদুপদেশ দানে কখনো বিরত হতেন না।
ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.)-এর ওপর অধিক কঠোরতা আরোপ করা হলে তিনি বনু উমাইয়্যার বিরুদ্ধে আন্দোলনের বিকল্প পন্থা বেছে নিয়েছিলেন। আর সেটা হলো আল্লাহর কাছে নিবেদন পেশ করার জন্য মোনাজাত করা। ‘আস-সাহীফা আল-কামিলাহ’ বা ‘আস-সাহীফা আস-সাজ্জাদীয়া’ বলে খ্যাত তাঁর মোনাজাতের এসব মূল্যবান সংগ্রহ ‘আলে মুহাম্মাদের যাবুর’ বলেও পরিচিত। ‘আস-সহীফা আস-সাজ্জাদীয়া’ গ্রন্থে ৫৭টি দোয়া রয়েছে। এসব দোয়ার মধ্যে রয়েছে মহান আল্লাহর প্রশংসা, মহানবী (সা.) ও তাঁর পরিবারবর্গের ওপর দরুদ, ফেরেশতাদের প্রতি দরুদ, নবিগণের অনুসারীদের জন্য আল্লাহর অনুগ্রহ চাওয়া, আল্লাহ তাআলার কাছে আশ্রয় চাওয়া, অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা, শত্রুদের শত্রুতাকে প্রতিহত করার দোয়া ইত্যাদি। এসব মোনাজাতের মাধ্যমে ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.) মুসলমান ও বিশ্ববাসীর জন্য প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন।
ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.)-এর অন্যতম প্রসিদ্ধ গ্রন্থের নাম হলো ‘রিসালাতুল হুকুক’ (অধিকার পত্র)। এটি অধিকার সংক্রান্ত একটি গ্রন্থ। এই গ্রন্থে মহান আল্লাহর অধিকার, নিজের প্রতি অধিকার, নিজের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের অধিকার, আত্মীয়-স্বজনের অধিকার, প্রতিবেশীর প্রতি অধিকার এভাবে ৫০টি অধিকারের প্রসঙ্গ বর্ণিত হয়েছে।
হযরত আব্বাস ইবনে আলী (আ.)
ইমাম আলী (আ.)-এর পুত্র ও ‘বনি হাশিমের চাঁদ’ নামে পরিচিত হযরত আব্বাস ইবনে আলী ২৬ হিজরির ৪ শাবান পবিত্র মদিনায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মায়ের নাম ছিল ফাতিমা বিনতে হিযাম, যিনি ‘উম্মুল বানীন’ নামে ইতিহাসে প্রসিদ্ধ। উম্মুল বানীন পবিত্র আহলে বাইতের জন্য উৎসর্গকৃত প্রাণ ছিলেন, অন্যদিকে আহলে বাইতও এই মহিয়সী নারীকে অত্যন্ত উচ্চতর মর্যাদার অধিকারী বলে মনে করতেন।
ইমাম আলী (আ.)তাঁর নাম রাখেন আব্বাস। এর অর্থ সাহসী ও বীর। হযরত আব্বাস ‘আবুল ফযল’ নামে প্রসিদ্ধ ছিলেন। তিনি ‘আব্বাস আলমদার’ বা আব্বাস পতাকাবাহী নামেও প্রসিদ্ধ। কেননা, তিনি কারবালার ময়দানে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর সেনাদলের পতাকা বহন করেছিলেন। তিনি ছিলেন ইমাম হোসাইনের একনিষ্ঠ অনুসারীদের অন্যতম।
ইমাম আলী (আ.) তাঁর এ পুত্র সম্পর্কে বলেন : ‘আমার সন্তান আব্বাস শিশু থাকা অবস্থায়ই জ্ঞান রপ্ত করত। কবুতরের ছানা যেভাবে মায়ের কাছ থেকে পানি ও খাদ্য নেয়, তেমনি আব্বাসও আমার কাছ থেকে জ্ঞান রপ্ত করত।’
স্বয়ং হযরত আলী (আ.) নিজের শাহাদাতের সময় প্রিয় পুত্র আব্বাসকে কাছে ডেকে এনে তাঁকে নিজের বুকের মধ্যে টেনে নেন এবং তাঁর মর্যাদা প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘শিগগিরই কিয়ামত বা পুনরুত্থানের দিনে আমার চোখ তোমার মাধ্যমে উজ্জ্বল হবে।’
হযরত আব্বাস যেমন সুদর্শন ছিলেন তেমনি ছিলেন সাহসিকতা, বীরত্ব, শক্তিমত্তা ও যোদ্ধা হিসেবে ক্ষিপ্রতার অধিকারী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ইবনে মানযার তাঁর ‘আল-আয়ানে বর্ণনা করেন যে, আব্বাস ছিলেন সিংহ যাকে অন্যান্য সিংহ ভয় পায়- যা যোদ্ধা হিসেবে তাঁর পরিচিতি তুলে ধরে।
আব্বাস তাঁর পিতার সাথে সিফফিন যুদ্ধে প্রথম যোদ্ধা হিসেবে যোগদান করেন। তিনি এই যুদ্ধে তাঁর পিতার পোশাক পরিধান করে যুদ্ধের ময়দানে অবতীর্ণ হন। তিনি এই যুদ্ধে অনেক শত্রুসেনাকে হত্যা করেন। মুয়াবিয়ার সৈন্যরা তাঁকেই হযরত আলী মনে করে ভুলে নিপতিত হয়। পরে যখন ইমাম আলী স্বয়ং যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হন তখন মুয়াবিয়ার সৈন্যরা অপর সৈন্য সম্পর্কে আশ্চর্যান্বিত হয়ে যায়। ইমাম আলী তাঁর পরিচয় শত্রুসেনাদের সামনে তুলে ধরে বলেন : ‘ সে হলো আব্বাস, বনি হাশিমের চাঁদ।’
কারবালায় হযরত আব্বাস ইমাম হোসাইনের প্রতি আনুগত্যের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেন। ইয়াযীদ খলিফা হয়ে ইমাম হোসাইনের আনুগত্য দাবি করে। ইমাম হোসাইন একজন পাপিষ্ঠের আনুগত্য করতে অস্বীকার করেন। ইমাম হোসাইন মদিনা থেকে মক্কা, মক্কা থেকে কুফা যাবার পথে ইয়াযীদের সেনাবাহিনী কর্তৃক বাধাপ্রাপ্ত হয়ে কারবালায় উপনীত হন। সেখানে তাঁকে তাঁর সঙ্গী-সাথিসহ অবরোধ করা হয়। অবশেষে ১০ মুহররম ইমাম হোসাইন এক অসম যুদ্ধে অবতীর্ণ হন।
ইমাম হোসাইন (আ.)-এর সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাপতি ও পতাকাবাহক হওয়া সত্ত্বেও ইমাম হোসাইন (আ.) হযরত আব্বাসকে তাঁর পরিবারের তৃষ্ণার্ত শিশুদের জন্য পানি আনার দায়িত্ব দেন। ফোরাতের কূল ইয়াযীদের সেনাবাহিনী অবরোধ করে রেখেছিল এবং তারা ইমাম হোসাইনের লোকদেরকে পানি আনতে বাধা দিচ্ছিল। হযরত আব্বাস একমাত্র ব্যক্তি যাঁকে ইমাম হোসাইন যুদ্ধে প্রেরণ করেন নি; বরং তাঁকে পানি আনতে পাঠিয়েছিলেন।
হযরত আব্বাস একাকী বীরত্বের সাথে ইয়াযীদের বাহিনীকে সরিয়ে দিয়ে ফোরাতের পানিতে নেমে যান এবং এক মশক পানি ভর্তি করেন। যখন তিনি ফোরাতে নেমে মশকে পানি ভর্তি করছিলেন, তখনও তিনি ইমাম হোসাইনের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। যদিও তিনি নিজেও খুব তৃষ্ণার্ত ছিলেন, কিন্তু তারপরও ইমাম হোসাইন ও তাঁর পরিবারের শিশুদের তৃষ্ণার্ত অবস্থা স্মরণ করে তিনি পানি পান করেন নি। ইতিহাসে বর্ণিত হয়েছে যে, কীভাবে তিনি ফোরাত অধিকার করেছিলেন, তারপরও পানি পান করেন নি। আব্বাসের সাথে ছিল একটি বর্শা এবং পানিভর্তি একটি মশক। অপরদিকে তাঁকে পতাকা বহনের দায়িত্বও দেয়া হয়েছিল। পানিভর্তি মশক নিয়ে তাঁবুতে ফেরার পথে তাঁকে পিছন থেকে আঘাত করা হয়। তাঁর একটি হাত কেটে পড়ে যায়। পরে পিছন থেকে আরেকটি আঘাতে তাঁর অপর হাত কেটে ফেলা হয়। আব্বাস তাঁর দাঁতে চেপে মশক আনতে থাকেন। ইয়াযীদের সেনারা হযরত আব্বাসের চেহারা ও মশকে তীর নিক্ষেপ করতে থাকে। মশক ফেটে পানি পড়ে যায়। একটি তীর এসে আব্বাসের চোখে বিঁধে। একজন সেনা আব্বাসের মাথায় আঘাত করে। আব্বাস মাটিতে পড়ে যান। এরপর তীর ও বর্শা নিক্ষেপ করে হযরত আব্বাসকে শহীদ করা হয়। হযরত আব্বাসের মাযার কারবালায় ফোরাতের তীরে অবস্থিত।
হযরত আব্বাসের পাঁচ জন ছেলে ও দুই জন মেয়ে ছিল।
এই মহামানবের জন্মদিন ইসলামি ইরানে ‘রুযই জানবজান’ বা যুদ্ধাহতদের দিবস হিসেবে পালিত হয়।
হযরত আলী আকবর (আ.)
আলী আকবর (আ.) ৩৩ হিজরির ১১ শাবান পবিত্র মদিনায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মায়ের নাম ছিল লায়লা বিনতে আবি মুররা।আলী আকবরইমাম হোসাইন (আ.)-এর জ্যেষ্ঠ সন্তান ছিলেন। অবশ্য কেউ কেউ বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বয়সে আলী ইবনু হোসাইন যায়নুল আবেদীন (আ.) অপেক্ষা ছোট ছিলেন।
বর্ণিত হয়েছে যে, চেহারা ও ব্যক্তিত্বের দিক থেকে মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর হযরত আলী আকবরেরসাদৃশ্য ছিল। আলী আকবর কারবালার ময়দানে সাহসিকতা ও আত্মত্যাগের মহান নজির স্থাপন করেন এবং ইয়াযীদের বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করে শাহাদাত বরণ করেন। ইতিহাসবিদদের মতে, আশুরার দিনে তিনি ছিলেন রাসূলের বংশধারা বনু হাশিমের প্রথম শহীদ। তাঁকে কারবালায় তাঁর পিতার কবরের পাশে সমাহিত করা হয়।
যাঁরা ইমাম হোসাইন (আ.)-এর মহান পিতা ইমাম আলী (আ.)-এর নাম পৃথিবীর বুক থেকে মুছে দিতে চেয়েছিল তাদের বিপরীত পদক্ষেপ হিসেবে ইমাম হোসাইন (আ.) তাঁর এ সন্তানের নাম রেখেছিলেন আলী। শুধু তাই নয়, ইমাম হোসাইন (আ.) তাঁর প্রত্যেক সন্তানের নাম রেখেছিলেন ‘আলী’। হযরত আলী আকবরের উপনাম ছিল ‘আবুল হাসান’।- আবুল ফারাজ ইসফাহানি, মাকতালুত তালিবিয়্যীন, পৃ. ৮৬।
হযরত আলী আকবরের চেহারা ছিল সম্ভ্রান্ত এবং তা চাঁদের মতো উজ্জ্বল ছিল। তিনি সৌন্দর্য ও পরিচ্ছন্নতার কারণে সম্মানিত ছিলেন। তাঁর শরীরের রং ছিল গোলাপি-সাদা। তার চোখ ছিল কালো এবং দীর্ঘ ভ্রুবিশিষ্ট। তিনি বিস্তৃত কাঁধবিশিষ্ট মধ্যম গড়নের শরীরের অধিকারী ছিলেন।উচ্চতায়ও তিনি মধ্যম ধরনের ছিলেন।-মাহাল্লাতী, ফারসান আল হাইযা, পৃ. ৪০৯-৪১০
তিনি এমনভাবে হাঁটতেন যেন মনে হতো তিনি কোন উঁচু জায়গা থেকে নেমে আসছেন। যখন কারো দিকে ফিরতেন তখন পুরো শরীরকে ফেরাতেন। তিনি অধিকাংশ সময় নিচের দিকে দৃষ্টিপাত করে থাকতেন। তাঁর দেহ থেকে মেশকের গন্ধ পাওয়া যেত।
ইমাম হোসাইন তাঁকে লোকদের মধ্যে সৃষ্টি ও আচরণগত বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে মহানবী (সা.)-এর সাথে সবচেয়ে সাদৃশ্যপূর্ণ বলে উল্লেখ করেছেন।- খারেজমী, মাকতালুল হুসাইন, ২য় খ-, পৃ. ৩৪
ইমাম হোসাইন (আ.) বলতেন : ‘হে আল্লাহ! যখন আমরা তোমার নবীকে দেখতে পছন্দ করতাম তখন আমরা তার (আলী আকবার) দিকে তাকাতাম।’- ইবনে তাউস, আল লুহূফ, পৃ. ১৩৯; খারেজমী, মাকতালুল হুসাইন, ২য় খ-, পৃ. ৩৫
হযরত আলী আকবর (আ.) সত্যপথের নির্ভীক সৈনিক ছিলেন। পাপিষ্ঠ ইয়াযীদ ক্ষমতা হাতে পেয়েই ইমাম হোসাইন (আ.)-এর নিকট থেকে আনুগত্য দাবি করে। ইমাম হোসাইন তাঁর মহান সংগ্রাম শুরু করেন। তিনি মক্কার উদ্দেশে মদিনা থেকে বের হয়ে পড়েন। হযরত আলী আকবর তাঁর পিতার সাথে যাত্রা শুরু করেন।
ইমাম হোসাইন তাঁর যাত্রাপথে একটি স্থানে যাত্রাবিরতি করেন। সেখানে একটি স্বপ্ন দেখে তাঁর ঘুম ভেঙে যায় এবং তিনি ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন’ পড়েন। আলী আকবার তাঁকে এর কারণ জানতে চাইতে তিনি বলেন, তিনি একটি স্বপ্ন দেখেছেন যে, এই কাফেলা এগিয়ে যাচ্ছে আর মৃত্যু এ কাফেলাকে অনুসরণ করছে। তখন আলী আকবর ইমাম হোসাইনকে প্রশ্ন করেন : ‘আমরা কি সত্যপথে নই?’ ইমাম হোসাইন ইতিবাচক জবাব দিলে তিনি বলেন : ‘ হে পিতা! যখন আমরা সত্যপথে রয়েছি, তখন আমরা মৃত্যুকে ভয় পাই না।’- মুফিদ আল ইরশাদ, ২য় খ-, পৃ. ৮২। ইমাম হোসাইন আলী আকবরের জন্য দোয়া করেন : ‘আল্লাহ যেন তোমাকে সর্বোচ্চ পুরস্কার প্রদান করেন যা একজন সন্তান তার পিতার নিকট থেকে পেতে পারে।’- আবু মিখনাফ, ওয়াকাত আল তাফ, পৃ. ২৭৬; তাবারী, তারিখুল উমাম ওয়াল মুলূক, ৩য় খ-, পৃ. ৩০৯
আশুরার দিনে আলী আকবর যুদ্ধে অবতীর্ণ হলে শত্রুপক্ষের একজন তাঁকে উদ্দেশ্য করে বলে : ‘হে আলী! তুমি তো আমীরুল মুমিনীন (ইয়াযীদ)-এর আত্মীয়, আর আমরা একে মূল্যায়ন করতে চাই, তুমি চাইলে আমরা তোমাকে নিরাপত্তা দেব।’ আলী আকবার প্রত্যুত্তরে বলেন : ‘মহানবী (সা.)-এর সাথে আত্মীয়তার সম্পর্কই মূল্যায়িত হওয়ার জন্য অধিক গুরুত্বপূর্ণ।’
আলী আকবার আশুরার দিনে বনু হাশিমের প্রথম ব্যক্তি হিসেবে শাহাদাত বরণ করেন- যা যিয়ারাতে শুহাদা’য় উল্লেখ করা হয়েছে : ‘আপনার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক, সর্বোত্তম বংশধারার মধ্য থেকে যিনি প্রথম নিহত হয়েছেন।’
হযরত আলী আকবারের জন্মদিনটিকে ইরানে ‘যুবদিবস’ হিসেবে পালন করা হয়।
ইমাম মাহদী (আ.)
ইমাম মাহদী (আ.)-এর আবির্ভাব সম্বন্ধে শিয়া-সুন্নী নির্বিশেষে সকলেই একমত। এ সংক্রান্ত হাদীস ও বর্ণনাগুলো তাওয়াতুরের (অকাট্য) পর্যায়ে পৌঁছেছে। আল ইমামুল মাহদী গ্রন্থের লেখক আলী মুহাম্মদ আলী দাখিল ৫০ জন সাহাবী ও ৫০ জন তাবেয়ীর নাম উল্লেখ করেছেন যাঁরা ইমাম মাহদী স¤পর্কে হাদীস লিপিবদ্ধ করেছেন। এ সংক্রান্ত ৬০০০ হাদীসের কথা তিনি বলেছেন।
ইমাম মাহদী (আ.)-এর জন্মগ্রহণের বিষয়ে মতভেদ লক্ষ্য করা যায়। আহলে সুন্নাত ওয়ালা জামায়াতের অধিকাংশ আলেমের মতে ইমাম মাহদী (আ.) কিয়ামতের আগে জন্মগ্রহণ করবেন। অন্যদিকে আহলে বাইতের মাযহাবের অনুসারী আলেমগণের মতে, ইমাম মাহদী ২৫৫ হিজরীর ১৫ শাবান শুক্রবার ফজরের ওয়াক্তের আগে ইরাকের সার্মারা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন।ইমাম মাহদী (আ.)-এর পিতা হলেন আহলে বাইতের একাদশ ইমাম হাসান আল আসকারী (আ.)। তাঁর মায়ের নাম নারজীস।
ইমাম মাহদী (আ.)-এর কুনিয়াত আবুল কাসেম। তাঁর অনেক উপাধি আছে। যেমন-কায়েম,মুনতাযার, সাহেবুজ্জামান, বাকিয়াতুল্লাহ্, হুজ্জাতুল্লাহ্ ইত্যাদি।
পবিত্র কোরআনের অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে :‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে আল্লাহ্ তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন যে, তিনি তাদেরকে পৃথিবীতে প্রতিনিধিত্ব দান করবেন, যেমন তিনি প্রতিনিধিত্ব দান করেছিলেন তাদের পূর্ববর্তিগণকে এবং তিনি অবশ্যই তাদের জন্য সুদৃঢ় করবেন তাদের দীনকে যা তিনি তাদের জন্য মনোনীত করেছেন এবং ভয়-ভীতির পরিবর্তে তাদেরকে অবশ্যই নিরাপত্তা দান করবেন। তারা আমার ইবাদত করবে, আমার কোন শরীক করবে না, অতঃপর যারা অকৃতজ্ঞ হবে তারা তো সত্যত্যাগী।’- সূরা নূর : ৫৫
আর হাদীসে এসেছে যে, এ প্রতিশ্রুতির পরিপূর্ণ দৃষ্টান্ত বাস্তবরূপ লাভ করবে ইমাম মাহদী (আ.)-এর আবির্ভাবের পর।
রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেছেন : ‘যদি পৃথিবীর আয়ুষ্কাল একদিনের বেশি অবশিষ্ট না থাকে, তবু মহান আল্লাহ্ ঐ দিনকে এমন সুদীর্ঘ করবেন, যাতে আমার আহলে বাইতের মধ্য থেকে আমার নামের অনুরূপ নামধারী কোন ব্যক্তি হুকুমত করতে পারে।’- তিরমিযী ২য় খ-, পৃ.৪৬, আবু দাউদ,মুসনাদ
কিয়ামতের আগে পৃথিবী যখন অন্যায়, অত্যাচার ও অবিচারে পূর্ণ হয়ে যাবে তখন এক মহান ব্যক্তি মানবের মাঝে আবির্ভূত হবেন। তিনি সকল অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করবেন। তিনি সকল অপশক্তিকে পরাজিত করে পৃথিবীতে একটি তাওহীদবাদী ন্যায়পরায়ণ শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করবেন। এই সংক্রান্ত বিশ্বাসই মাহদাভীয়াত।
যেহেতু এসকল কর্ম সম্পাদনকারী মহান ব্যক্তির উপাধি ‘মাহদী’, সেহেতু এই সংক্রান্ত বিশ্বাস ‘মাহদাভীয়াত’ নামে অভিহিত হয়েছে।
মুসলিম উম্মাহ্ ঐকমত্য পোষণ করে যে, মহানবী (সা.)-এর বংশধারার সর্বশেষ ইমাম হচ্ছেন ইমাম মুহাম্মদ আল মাহ্দী (আ.), যিনি শেষ যামানায় আবির্ভূত হয়ে বিশ্বব্যাপী ইসলামি হুকুমত এবং ন্যায়বিচার কায়েম করবেন এবং পৃথিবীর বুক থেকে অন্যায়-অত্যাচার ও শোষণের পরিসমাপ্তি ঘটাবেন।
মাহদাভীয়াতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো ইমাম মাহদীর জন্য প্রতীক্ষা। প্রতীক্ষা অর্থ অবশ্যম্ভাবী কোন ঘটনার জন্য অপেক্ষা। এই রকম প্রতীক্ষা মানুষের কাঁধে দায়িত্ব অর্পণ করে।যখন একজন নিশ্চিত হয় যে, তার সামনে এমন একটি ভবিষ্যৎ রয়েছে, তখন সে এর জন্য প্রস্তুত হবে। যেমনটি পবিত্র কোরআন বলছে : ‘আমি উপদেশের (তাওরাতের) পর যাবুরে লিখে দিয়েছি যে, আমার সৎকর্মপরায়ণ বান্দারাই অবশেষে পৃথিবীর উত্তরাধিকারী হবে।’- সূরা আম্বিয়া : ১০৫
আল্লাহর সৎকর্মশীল বান্দাগণ এই আয়াতের মর্মার্থ বুঝতে পারে। তারা এ আয়াতকে বুকে ধারণ করে প্রস্তুতি নেয়। প্রতীক্ষা মানেই নিজেদেরকে প্রস্তুত করা। যারা প্রতীক্ষা করছে তাদেরকে ইমাম মাহদী (আ.)-এর আগমনকালে যেসব বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে সেগুলোর নিকটবর্তী হতে হবে। সত্যপন্থী, সাহসী, ইবাদতগুজার, আত্মিক পরিশুদ্ধতা- যা যা প্রয়োজন প্রতীক্ষারতদেরকে তা অর্জন করতে হবে। আমাদেরকে প্রতিনিয়ত অধিকতর অগ্রগতি অর্জন করতে হবে এবং আধ্যাত্মিক চরিত্র অর্জন করতে হবে।
১৫ শাবানকে ইরানে ‘অসহায় ও নির্যাতিত-নিপীড়িতদের দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়।